৪. গ্রেট ট্র্যাডিশন

বিদেশি পণ্ডিতেরা বিভিন্ন লোক-সমাজের ধর্ম-চেতনা লক্ষ্য করে দুটি অসাধারণ শব্দের সৃষ্টি করেছেন—Great Tradition আর Little Tradition, শব্দ দুটি আমাদের সমাজেও সুপ্রযুক্ত। গ্রেট ট্র্যাডিশন হল ধর্মভাবনার মূল ধারণা যা বেদ-বেদান্ত থেকে আমাদের ধর্ম-যুক্তির মধ্যে প্রবহমান। যেমন নবদ্বীপের অভিজাত পণ্ডিতকুল বেদবেদান্তের মৌলিক ধারা বজায় রেখে অদ্বৈতবেদান্ত অথবা বড়জোর বিষ্ণু-নারায়ণের ঐশ্বর্য মূর্তির সেবায় আবিষ্ট ছিলেন। অন্য দিকে আছে সাধারণ মানুষ—যাঁরা অভিজাত-কুলের শাব্দিক আড়ম্বরে গ্রেট ট্র্যাডিশন-কে স্বভাবতই ভয় পায় এবং নিজেদের মতো করেই একটা লোক-ধর্মের সংস্কার গড়ে তোলে। চরিতকার বৃন্দাবন দাস দেখিয়েছেন যে, সাধারণ মানুষ বেদ-বেদান্ত বোঝে না। তারা মঙ্গলচণ্ডীর গীত গায়, বিষহরি মনসার পূজা করে। আর উলটো দিকে ভট্টাচার্য-চক্রবর্তী-মিশ্র-আচার্যদের অভিজাতকুল শাস্ত্র পড়ান বটে কিন্তু শাস্ত্রের মর্ম বোঝেন না—ব্রাহ্মণের শুষ্ক আচার তাঁদের পৃথক করে রেখেছে সাধারণ মানুষের স্বকল্পিত সংস্কৃতি থেকে।

ব্রাহ্মণ্য এবং লোকসংস্কৃতির পরস্পর বিপরীত ঐতিহ্যের মধ্যে আছে ‘মঝঝিমঃ পন্থাঃ’ অর্থাৎ মধ্যপন্থী ধারা। সেই ধারাটি অস্পষ্টরূপে নেমে আসছিল বৈষ্ণব-ধারণার পথে জয়দেব-বিদ্যাপতি-মাধবেন্দ্রপুরীর সরসা ভক্তির পথবাহিত হয়ে। এই ধারণার মূল প্রোথিত হয়েছিল নবদ্বীপে অদ্বৈত আচার্যের ঘরে। মাধবেন্দ্রপুরী তাঁকে শিখিয়ে গেছেন ভগবানের মধুর স্বরূপের কথা, যে মধুরতার পথ ধরে মানুষের সঙ্গেও পরম ঈশ্বরের প্রিয়ত্বের সম্বন্ধ ঘটতে পারে, শিখিয়ে গেছেন কৃষ্ণের নাম-গুণের মহিমা, যে নামে তিনি নেমে আসেন এই মর্ত্যের ধূলিকণার মধ্যে।

নবদ্বীপের ওই উদ্যত ব্রাহ্মণ এবং মনসা-চণ্ডীর লোকাবহের মধ্যেও অদ্বৈত আচার্য একটি নিজস্ব গোষ্ঠী তৈরি করতে পেরেছিলেন। পূর্বেই জানিয়েছি যে, তিনি মাধবেন্দ্রপুরীর কাছে দীক্ষা লাভ করে নবদ্বীপে অবস্থান করেছিলেন এবং তাঁর বাড়িতে সন্ধ্যাবেলায় নিয়মিত বৈষ্ণবসভা বসত—যেখানে চৈতন্যের অগ্রজ বিশ্বরূপ কৃষ্ণভক্তিমূলক শাস্ত্রের আলোচনা করতেন এবং কুমার বিশ্বম্ভরের সেখানে যাতায়াত ছিল। অদ্বৈত আচার্যের অসম্ভব নজর ছিল এই দীপ্ত অহংকারী বালকের ওপর। তখনও পর্যন্ত বিশ্বম্ভর অদ্বৈত আচার্যের পথে আসেননি—তিনি মাঝে মাঝে তাঁর বাড়িতে যান বটে, কিন্তু সেখানে ভক্তি-শাস্ত্রের ব্যাখ্যা শুনিয়ে অগ্রজের স্থানও প্রতিপূরণ করেন না অথবা অদ্বৈত সভায় সহপাঠী মুকুন্দ দত্তের মধুর কৃষ্ণলীলা গান শুনেও অভিভূত হন না। আগে এই মানুষগুলি তাঁর সঙ্গে বাগযুদ্ধ করতেন কখনও কখনও, কিন্তু তাও কেউ করে না, সবাই তাঁকে এড়িয়ে চলেন। দেখা হলেই পাণ্ডিত্য যাচাই করে ফাঁকি জিজ্ঞাসা—এসব আর তাঁদের ভালো লাগে না। আর চৈতন্যও তাঁদের কৃষ্ণভক্তিরসের সঙ্গী নন তখনও, তিনি দেখা হলেই ফাঁকি জিজ্ঞাসা করেন—ফাঁকি বিনু প্রভু কৃষকথা না জিজ্ঞাসে।

নিজের জন সকলেই তাঁকে এড়িয়ে চলছেন, অন্যদিকে ভট্টাচার্য, চক্রবর্তীদের দলেও তিনি নেই—হয়তো এইরকম একটা পরিস্থিতি বিশ্বম্ভর পণ্ডিতের মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটাচ্ছিল। তিনিও বুঝতে পারছিলেন—কেউ কেউ তাঁকে এড়িয়ে চলছে। অদ্বৈত আচার্যের ঘরে যাঁরা কৃষ্ণচর্চা করেন, তাঁদের কেউ কেউ বিশ্বম্ভর পণ্ডিতকে বলেও ফেলল—এই বিদ্যার রসে আর কতদিন ভুলে থাকবে তুমি? কৃষ্ণের মাধুর্যই কিছু বুঝলে না, বুঝলে না তাঁর রূপ-গুণের মাধুর্য। সহপাঠী মুকুন্দ তাঁকে এড়িয়ে এসে অদ্বৈত আচার্যের ঘরে প্রবেশ করেন, আরম্ভ হয় কীর্তন এবং ভাগবতী কথা। এই রকমই এক দিনে অদ্বৈতের আবাসে উপস্থিত হলেন মহামতি ঈশ্বরপুরী।

সম্ভবত গুরু মাধবেন্দ্রপুরীর প্রয়াণ ঘটেছে তখন এবং পূর্বাশ্রমে তিনি যেহেতু হালিশহরের মানুষ এবং বাঙালি, অতএব গুরুর মহাপ্রয়াণের পর তিনি গুরুভাই অদ্বৈত আচার্যের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন নবদ্বীপে। অদ্বৈত তখনও প্রত্যক্ষ চেনেন না তাঁকে, কিন্তু মাধবেন্দ্রপুরী এই গৃহস্থ শিষ্যের ঠিকানা দিয়ে থাকবেন তাঁকে। স্নিগ্ধ মানুষ বটে, কিন্তু ঈশ্বরপুরী ভক্ত বৈষ্ণবের বেশে অদ্বৈতের ঘরে আসেননি। হয়তো বা গিরি-পুরী-ভারতী ইত্যাদি শঙ্কর-সন্ন্যাসীর বেশই তাঁর রয়ে গেছে। অদ্বৈত আচার্য বার বার তাঁর দিকে তাকাচ্ছেন, পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে অদ্বৈতকে তিনি বলছেন—আপনার চরণ-দর্শনের জন্যই এসেছি। এরই মধ্যে গায়ক মুকুন্দ দত্ত কৃষ্ণ-সম্বন্ধী গীত আরম্ভ করতেই ঈশ্বরপুরী বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে পড়লেন মাটিতে। সকলে বুঝতে পারলেন—যে বেশেই থাকুন ঈশ্বরপুরী পরম কৃষ্ণভক্ত এবং তিনি মাধবেন্দ্রপুরীর শিষ্য।

নবদ্বীপের পথে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একদিন নিমাই পণ্ডিতের সঙ্গে ঈশ্বরপুরীর দেখা হল। আসলে গৃহস্থ অবস্থাতেই হোক অথবা সন্ন্যাস আশ্রমে, চৈতন্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তাঁর চেহারা। চরিতকার থেকে আরম্ভ করে অন্য সমস্ত উপাদান থেকে এটা প্রমাণ হবে যে, তাঁর গায়ের রং ভীষণ রকমের ফর্সা এবং আকারে যথেষ্ট লম্বা। দশজনের মধ্যে হেঁটে গেলে তিনিই প্রথমে চোখে পড়বেন এবং তাঁকে দেখলে পরে তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতি সমীহ হয়, ভয় হয়—তথাপি সাধ্বস করে দেখি সর্বজনে। ঈশ্বরপুরী তাঁর চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকেন অবাক বিস্ময়ে। জিজ্ঞাসা করেন—’কি পুঁথি পঢ়াও, পঢ়, কোন স্থানে ঘর’। পড়ুয়া শিষ্যেরা এ-কথার উত্তর দিয়ে বলল—ইনি নিমাই পণ্ডিত। ঈশ্বরপুরী নিমাই পণ্ডিতের কথা শুনেছেন। বললেন—ও তুমিই সেই নিমাই পণ্ডিত। বেশ বেশ, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

সন্ন্যাসী দেখে ঈশ্বরপুরীকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাঁর যথোচিত মধ্যাহ্নআহারের ব্যবস্থা করলেন নিমাই পণ্ডিত। খাওয়া-দাওয়া সেরে মন্দিরের দাওয়ায় বসে কৃষ্ণকথা বলতে আরম্ভ করলেন ঈশ্বরপুরী। কিন্তু নিমাই পণ্ডিত খুব একটা রা কাড়লেন না। ঈশ্বরপুরী প্রথমে অদ্বৈত আচার্যের অতিথি হয়েছিলেন, কিন্তু কিছুদিন পর তিনি অদ্বৈতের আবাস ছেড়ে গোপীনাথ আচার্যের বাড়িতে গিয়ে রইলেন। গোপীনাথ আচার্য হলেন তৎকালীন বঙ্গদেশের অদ্বিতীয় নৈয়ায়িক বিখ্যাত সার্বভৌম ভট্টাচার্যের ভগিনীপতি। তাঁর বাড়িতে অবস্থান-কালে অনেকেই আসতেন ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে দেখা করতে এবং এই প্রথম বিশ্বম্ভর-নিমাই-এর মধ্যে একটি মানুষের সন্ধান পাচ্ছি, যেখানে নিমাই পণ্ডিত তাঁর নিজের সমস্ত আত্মসচেতনতা নিরস্ত করে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আসতেন ঈশ্বরপুরীকে প্রণাম করার জন্য। এই দাম্ভিক অধ্যাপককে ঈশ্বরপুরীও কেন জানি না বেশ পছন্দ করেন এবং দাম্ভিক মানুষের সঙ্গে যেভাবে ব্যবহার করতে হয় ঠিক সেইভাবেই নিমাই পণ্ডিতের পাণ্ডিত্যে ঈষৎ কণ্ডূয়ণ করে ঈশ্বরপুরী একদিন বললেন—আমি ‘কৃষ্ণলীলামৃত’ নামে একটি গ্রন্থ লিখেছি, এই গ্রন্থের মধ্যে যদি ব্যাকরণেরও কোনো দোষ থাকে, তবে আমায় শুদ্ধ করে দিলে আমার পরম সন্তাোষ ঘটবে।

এই প্রথম নিমাই পণ্ডিতের মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি, হয়তো বেশ কিছুদিন ঈশ্বরপুরীর সঙ্গ করার ফলেই তাঁর মধ্যে এই নৈমিত্তিক পরিবর্তন এসেছে। কেননা, ঈশ্বরপুরী গোপীনাথ আচার্যের ঘরে বেশ কয়েক মাস ছিলেন এবং নিমাই পণ্ডিত প্রতিদিন অধ্যয়ন-অধ্যাপনার শেষে সন্ধ্যাবেলায় তাঁর কাছে গেছেন। পরিবর্তনের স্বরূপটাও কিছু অদ্ভুত। এই কিছুদিন আগেও তাঁর মুখের বোলচাল ছিল আমাদেরই মতো সাধারণ; নিজের ওপর অখণ্ড বিশ্বাসে তিনি বলতেন—ভালো করে ব্যাকরণের সন্ধি পর্যন্ত যে করতে পারে না, সেও নিজেকে এখন ভট্টাচার্য বলে জাহির করতে চায়—

প্রভু কহে সন্ধি কার্য্য জ্ঞান নাহি যার।
কলিযুগে ভট্টাচার্য পদবী তাহার।।

এই মানুষই ঈশ্বরপুরীর গ্রন্থ-সংশোধনের প্রসঙ্গে বলছেন—আপনি প্রেমীভক্ত বলে কথা, আপনি যা লিখবেন, তাতেই কৃষ্ণের প্রীতি ঘটবে। পণ্ডিত ব্যক্তি বিষ্ণু-নমস্কার করার সময় নির্ভুল সংস্কৃতে বলে—’শ্রীবিষ্ণবে নমঃ’ আর মূর্খ ভুল সংস্কৃতে বলে—’বিষ্ণায় নমঃ’—তাতে ফল দুরকম হয় না, ভাবগ্রাহী জনার্দন ভক্তের ভাবটুকুই গ্রহণ করেন, সংস্কৃত ব্যাকরণের ভুল নিয়ে তিনি মাথা ঘামান না। অতএব আপনি যে কৃষ্ণপ্রেমের কথা লিখেছেন সেখানে ভুল ধরে কার এমন সাহস? ঈশ্বরপুরী নিমাই পণ্ডিতের কথায় খুশি হয়েছেন মনে-মনে, কিন্তু তাঁর কৃষ্ণলীলামৃত গ্রন্থখানি সংশোধন করাবার ছলে, তাঁকে দিয়ে একবার পড়িয়ে নেওয়ার ইচ্ছায় আবারও অনুরোধ করেছেন। কৃষ্ণলীলামৃত গ্রন্থের বিচার চলল কয়েকদিন, এর মধ্যে একদিন শুধু সংস্কৃত ধাতুপ্রয়োগের সামান্য একটা দোষ উচ্চারণ করেছিলেন নিমাই পণ্ডিত, কিন্তু ঈশ্বরপুরী সে দোষ সংশোধন না করে নিজের পক্ষে ব্যাখ্যা করলেন এবং কী আশ্চর্য, অহংকারী পণ্ডিত মেনে নিলেন তাঁর তর্ক-যুক্তি।

বিশ্লেষণী বুদ্ধি প্রকট করে চৈতন্য-চরিত-গবেষকরা বলেন যে, এই সময়ে নিমাই পণ্ডিতের বায়ু-রোগ দেখা দেয় এবং এটাই তাঁর জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’। এই সময়ে তিনি খানিকটা বাতুল পাগলের মতো ব্যবহার করেছেন এবং নিজেকে ভগবত্তার স্বরূপে প্রকট করেছেন—যার চরম অভিব্যক্তি ঘটেছে শ্রীবাসের বাড়িতে ভগবান দেব-সিংহাসনে অধিরূঢ় হবার পর। আমাদের মতে—এত বড় বিরাট পুরুষের জীবন-চর্যার আকস্মিক যে পরিবর্তন এসেছিল, তা বহিরঙ্গে খুব অস্বাভাবিক ছিল বলেই ভীষণ রকমের অলৌকিক বলে মনে হয়। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে, তাঁর জীবন-চর্যার ধারার মধ্যেই এই আকস্মিকতা বা অস্বাভাবিকতার বীজ ছিল। অলোকসামান্য পুরুষের এক-একটা পদক্ষেপ অনেক সময়ই খুব আকস্মিক এবং বিপরীত বলে মনে হয়, কিন্তু এঁদের শক্তি-বিভূতি এতটাই যা ভীষণভাবে অপচয় লাভ করার মুখেও আকস্মিকভাবে বিরাট এক অভ্যুদয় ঘটিয়ে দেন। নইলে দেখুন, শৈশবের সময় নিমাই-বিশ্বম্ভর চরম দুষ্টুমিতে জীবন কাটিয়েছেন, সেকালের দিনে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হওয়ার বুদ্ধি মাথায় নিয়েও তিনি শিশুশাস্ত্র ব্যাকরণ পড়ে বসে রইলেন, অধ্যাপনার জীবনেও একটি ভালো গ্রন্থ রচনা করলেন না, যা সেকালের নবদ্বীপবাসী পণ্ডিতমাত্রেই করেছেন, তারপর হঠাৎ এল সেই আকস্মিক পরিবর্তন—সেদিন আর তিনি ঘরে থাকতে পারেননি। কৃষ্ণভক্তি-সরল রাজ্যে প্রবেশ করার পথে যেটা প্রথম বাধা—আভিজাত্য, কৌলীন্য, ব্রাহ্মণ্য, আত্মমানিতা—সব ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন একদিন অকালে, অসময়ে।

সেদিন দ্বিপ্রহরের খাওয়া-দাওয়া সারা হয়ে গিয়েছিল, সাধারণত আবার সেই সন্ধ্যাবেলায় অধ্যাপনার কালে নিমাই পণ্ডিত পড়াতে যান মুকুন্দ-সঞ্জয়ের চণ্ডীমণ্ডপে। কিন্তু সেদিন দিবা ভোজনের পরে নিমাই পণ্ডিতের চোখে ঘুম এল না। তিনি অসময়ে পুঁথি-হাতে বেরিয়ে পড়লেন, কিন্তু পড়াতে গেলেন না। প্রথমে গিয়ে উঠলেন এক তাঁতির বাড়ি। তাঁতি তাঁত বোনে, তার বাড়িতে প্রচুর ধুতি-শাড়ি-কাপড়। ব্রাহ্মণ মানুষ, তায় ওই চেহারা—তাঁতি অনেক সম্মান করে নিমাই পণ্ডিতকে ঘরে বসাল। নিমাই পণ্ডিত ভালো একটা কাপড় চাইলেন তাঁতির কাছে। কাপড় এনে দিতেই দামের কথা উঠল, কিন্তু পণ্ডিত বললেন—আমার কাছে এক পয়সাও নেই। তাঁতি বলল—ঠিক আছে—তুমি দশ-পনেরো দিন পরেই না হয় দাম দিও। নিমাই পণ্ডিত বস্ত্র গ্রহণ করে উপস্থিত হলেন এক গয়লার ঘরে। তারপর গন্ধবণিকের ঘর, মালাকারের ঘর, বারুজীবী-তাম্বুলীর ঘর, শঙ্খবণিকের ঘর এবং সর্বশেষে শ্রীধরের বাড়ি—যিনি বাজারে এসে থোড়-কলা-মুলো-মোচা বেচে জীবন চালান।

চরিতকার বৃন্দাবন দাস কৃষ্ণলীলার সারস্যে নিমাই পণ্ডিতের এই নগর-ভ্রমণের বর্ণনা করেছেন। ভাবটা এমন, যেন কংসবধের আগে কৃষ্ণ যেমন মথুরা-পুরীতে রজক, মালাকার, গন্ধকার—এঁদের কাছ থেকে জিনিস নিয়ে সেজেছিলেন, গৌরাঙ্গ নিমাই সেই আবেশেই যেন সাধারণ মানুষের কাছে থেকে দান নিচ্ছেন—পূর্বে যেন মধুপুরী করিলা ভ্রমণ। সেই লীলা করে এবে শ্রীশচীনন্দন।। আমাদের বক্তব্য, ভক্ত-চরিতকার যে-ভাবেই ঘটনাগুলি প্রকট করুন, আমরা এই ঘটনাটাকে একটু অন্যভাবে দেখি। না হয় ধরেই নিলাম—তাঁতি কিংবা মালাকার, গন্ধবণিক বা শঙ্খবণিক কারও বাড়ি তিনি যাননি, কিন্তু নগর-অভিযানের শেষে একটি ঐতিহাসিক চরিত্র আছেন। তিনি খোলা-বেচা শ্রীধর। এই নামেই তিনি সমস্ত বৈষ্ণব-মহলে বিখ্যাত। এই দরিদ্র বাজারে-বসা মানুষটির সঙ্গে নিমাই পণ্ডিত অনর্থক ঝগড়া করতেন এবং মূল্য না দিয়ে জোর তাঁর বিক্রেয় দ্রব্যের ওপর ভাগ বসাতেন। এ-ঘটনা আপাতত দেখলে খুব ক্রুর মনে হতে পারে, কিন্তু খোলা-বেচা শ্রীধর আর নিমাই পণ্ডিতের অন্তরঙ্গতা এতটাই যে, আমাদের সেই ঐতিহাসিক উচ্চারণ করতে হচ্ছে যে, তীব্র অভিজাত ব্রাহ্মণ্য যা নবদ্বীপের অভিজাত শ্রেণিকে আকণ্ঠ অহংকারে ভরিয়ে রেখেছিল, নিমাই পণ্ডিত সেই ব্রাহ্মণ্যের কুণ্ডলী থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁর আনাগোনা চলছে সাধারণ মানুষের বাড়িতে বাড়িতে, বিশেষত দরিদ্রের ঘরে। নিম্নবর্গের মানুষগুলির সঙ্গে তাঁর দহরম-মহরম বাড়ছে।

আমরা জানি, চরিতকারদের বয়ান থেকেই জানি যে, পিতৃ-পিতামহক্রমে নিমাই-পণ্ডিতের ঘরে দারিদ্র্য ছিল। অধ্যাপনা করে পণ্ডিত তেমন অর্থ ঘরে আনতে পারেননি কোনোদিন, যাতে খুব তাড়াতাড়ি দারিদ্র্য-মোচন ঘটে। হয়তো অর্থলাভের উদ্দেশ্যেই তিনি বঙ্গদেশে শ্রীহট্টে গিয়েছিলেন, অর্থলাভও কিছু ঘটেছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু তাঁর অধ্যয়ন-অধ্যাপনার জীবন ছাড়াও এখানে যেটা বাড়তি পাচ্ছি, সেটা হল—নতুন একটা সর্বাশ্লেষী ধর্মের কথা তিনি সুস্পষ্টভাবে বলতে আরম্ভ করেছেন। তপন মিশ্র নামে যে ব্রাহ্মণটি তাঁর কাছে সাধ্য-সাধনের তত্ত্ব জানতে এসেছিল, তাঁকে তিনি শুধু ‘হরেকৃষ্ণ’—নামকীর্তন করতে বলছেন। এরই সঙ্গে আছে প্রাসঙ্গিক উপদেশ—

অতএব গৃহে তুমি কৃষ্ণ ভজ গিয়া।
কুটিনাটি পরিহরি একান্ত হইয়া।।

এখানে এই ‘কুটিনাটি’ কথাটা খুব বড়ো একটা শব্দ। আমাদের প্রত্যেকের কাছে আচার-বিচার, শুদ্ধি-সংস্কারের একটা পরম্পরালব্ধ শাস্ত্রীয় সংজ্ঞা যেমন আছে, তেমনই তার নিজস্ব উপলব্ধিজাত সংজ্ঞাও আছে। যে-কোনো ধর্মপালনের ক্ষেত্রে সেই আচার-বিচারগুলি নিশ্চেতনেও ক্রিয়া করতে থাকে এবং তারই বশবর্তী হয়ে আমরা হাত-মুখ ধুয়ে, স্নান-শুদ্ধি করে পুজো করি, সাধন করি। ভেবে দেখুন, তখন নবদ্বীপে বেদাচারের অবশেষে নব্যস্মৃতির উদয় হয়েছে, সমাজের অভিজাতশ্রেণি তাতে আবিষ্টপ্রায়। সেই স্মৃতিশাস্ত্রের বিপরীত ভূমিতে দাঁড়িয়ে এমন একটা প্রচার যে, তুমি সব বিচার-আচার-শুদ্ধিমার্গের ‘কুটিনাটি’ ত্যাগ করে শুধু কৃষ্ণভজন করো এবং খেতে-শুতে যখন ইচ্ছে হরিনাম করো—এই প্রচার একদিকে যেমন তপন মিশ্রের মতো সামাজিক ব্রাহ্মণকে তাঁর ব্রাহ্মণ্যের মঞ্চ থেকে নামিয়ে আনছে, তেমনই অন্যদিকে সাধারণ নিম্নবর্গীয় দরিদ্র মানুষকে একেশ্বরবাদিতার স্বপ্ন দেখাচ্ছে—পথটাও বড়ো সহজ—শুধু হরিনাম করো—রাত্রে দিনে নাম লয় খাইতে শুইতে। তাহার মহিমা বেদে নাহি পারে দিতে।।

অনেকে এমন ভাবেন, এমনকী অনেক বড় বিদ্বান মানুষকে আমি সভা-সমিতিতে বড় গলায় বলতেও শুনেছি যে, চৈতন্যদেব একজন সমাজ-সংস্কারক, তিনি এই করেছেন, তিনি সেই করেছেন ইত্যাদি। এমনকী অনেক সভায় এই বিরাট পুরুষের গায়ে সাম্যবাদের ফুরফুরে হাওয়াও লাগিয়ে দেওয়া হয়—তিনিই প্রথম মিছিল করে মুসলমান কাজিকে অনুকূল নিয়ে আসেন, তিনিই জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে একত্রে নিয়ে আসেন ইত্যাদি। এইসব বৃহদুক্তির একটা কথাও মিথ্যেও নয়, কিন্তু তার প্রক্রিয়াটা কিন্তু এই নয় যে, তিনি তৎকালীন জাতি-বর্ণ-দীর্ণ সমাজটাকে নিপুণভাবে দেখেশুনে বেশ সচেতনভাবে একটা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এইভাবে তিনি সমাজ-সংস্কার করবেন। আমরা যারা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের পরম্পরা খুব কাছ থেকে দেখেছি, চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণবদের অন্তর্লোক যাঁদের জানা আছে এবং জানা আছে চৈতন্য-ধর্মের অগণিত রসশাস্ত্র তথা দার্শনিক গ্রন্থগুলি, তাঁরা কিন্তু চৈতন্যদেবের এই সমাজ-সংস্কারকের ভূমিকা একেবারেই অন্য চোখে দেখবেন।

প্রসিদ্ধ রামদাস বাবাজিমশায় হরিদাস-নির্যাতনের প্রসঙ্গে এক কলি গান গাইতেন— দেখতে আসলে দেখা দেওয়া অনুষঙ্গে হয়ে যায়, চৈতন্যদেবের সমাজ-সংস্কারের ঘটনাটাও তেমনই এক অনুষঙ্গ। তিনি সচেতনভাবে সেটা করেননি কিন্তু অনুষঙ্গে হয়ে গেছে—তাঁর উদার ধর্মমতের অনুষঙ্গ-মাধ্যমেই সেটা হয়ে গেছে। কেমন করে যে এটা হয়, তার প্রক্রিয়াটা যে-কোনো অবতার-প্রমাণ পুরুষের পক্ষেই প্রযোজ্য। এই যে পূর্বকালের কথা শুনে থাকি—মথুরায় কংস ধ্বংস লঙ্কায় রাবণ—অর্থাৎ রামচন্দ্র বা কৃষ্ণের বিরাট ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রেও সেটা এমনিভাবেই খাটে। অবতারবাদের গূঢ় তত্ত্বও যদি খুব গভীরভাবে আলোচনা করা যায়, তাহলে দেখবেন—একটা রাবণ-বধ, বা একটা কংস-বধ—এগুলো ইশ্বরাবতারের কোনো মৌলিক উদ্দেশ্যই নয়, অন্তত মনুষ্য-অবতারের উদ্দেশ্য তো নয়-ই। অবতার-প্রসঙ্গে গীতার সেই শাশ্বত বাণী বারবার উচ্চারিত হয়ে বটে—পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম—কিন্তু সেটা একটা জাগতিক প্রয়োজন হলেও মনুষ্য অবভাবের সেটা মৌলিক উদ্দেশ্য নয়। রামচন্দ্র লঙ্কায় রাবণ-বধ করলেন, পৃথিবীতে অশুভশক্তির বিনাশ ঘটল, মানুষ শাস্তি পেল—এটা রামচন্দ্রের মহিমা কিছু বাড়ায় না। কিন্তু তাঁর মতো বিরাট পুরুষ যখন পিতৃসত্য রক্ষার জন্য বনে যান, অথবা ভাই লক্ষ্মণের জন্য, বন্ধু সুগ্রীবের জন্য, এমনকী পরিণীতা পত্নীকে উদ্ধারের জন্য যে মানবিক অন্তরঙ্গতার পরিচয় দেন—সেই স্বার্থহীন লোকশিক্ষাই তথা সেই অন্তরঙ্গতাই কিন্তু রাম-অবতারের স্থায়ীভাব অথবা আধুনিক ভাষায় leitmotif।

ব্যাপারটা একটুও আড়ম্বর না করে খুব নিপুণভাবে ধরেছিলেন চৈতন্যচরিতামৃত-এর লেখক কৃষ্ণদাস কবিরাজ। তিনি বলেছিলেন—আনুষঙ্গ কর্ম এই অসুর-মারণ। অর্থাৎ অসুর-দৈত্য মেরে ফেলাটা মনুষ্য অবতারের গৌণ কর্মমাত্র। এই যে কৃষ্ণের কথা ওঠে, তো তাঁর জীবনে যত ঘটনা ঘটছে, সেখানে ওই কংস বধ কি শিশুপালবধ এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়, বরঞ্চ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই সব ঘটনা—যেখানে তিনি অধিগুণসম্পন্ন ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও রাধার প্রেমে পাগল, অতিবুদ্ধিমান অস্ত্রবীর হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর সখার রথের সারথি। আর শত শত মানুষের সঙ্গে কৃষ্ণের মানবিক সম্পর্কগুলি এমন একটা স্তরে পৌঁছেছে যে, তাঁর নরলীলা মনুষ্য-স্বরূপই ভগবত্তার অভিব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে—কৃষ্ণের যতেক খেলা/সর্বোত্তম নরলীলা/নরবপু তাঁহার স্বরূপ।

এই নিরিখে চৈতন্য মহাপ্রভুর ভাবনা-বিচারও আমাদের কাছে অন্যরকম। তিনি প্রধানত এক উদার ধর্মের প্রবক্তা—যে ধর্ম তাঁর অনুভবসিদ্ধ এবং যে ধর্ম তিনি নিজে সৃষ্টি করেছেন। এই সৃষ্টিকর্মটা তাঁর মতো বিরাট বিশাল ব্যক্তিত্বের পক্ষেই সম্ভব, কিন্তু কোনোমতেই এ-কথা বলা ঠিক হবে না যে, সাধারণ মানুষের কষ্ট-যন্ত্রণার দিকে তাকিয়ে, তাঁদের কথা ভেবে-ভেবেই এই নূতন উদার ধর্ম তিনি সৃষ্টি করেছেন। যদি তাই হত, তাহলে ভাবুক-রসিক সাধকের চেয়ে তাঁকে রাজনীতিক বলা বেশি ভালো হত। তাঁর আটচল্লিশ বছরের জীবনে চব্বিশ বছরের গৃহস্থাশ্রম বাদ দিলে আর চব্বিশটা বছর যেভাবে কেটেছে—তাতে তাঁর ব্যক্তি জীবনের ভক্তিরসায়নটুকুই বড়ো হয়ে ওঠে—তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে কৃষ্ণভক্তির প্রচার চালানো তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু ভক্তি এবং ভগবত্তাকে শাস্ত্রীয়ভাবে বোধ করার প্রক্রিয়াটা তিনি এতটাই লৌকিক উপায়ে সহজ করে বুঝেছিলেন, যাতে সমাজ-সংস্কারের কাজটা অনুষঙ্গে আপনিই হয়ে গেছে। এর জন্য তাঁকে বাড়তি কোনো চেষ্টা করতে হয়নি। তাঁর ধর্মবোধ অত্যন্ত সহজ বলে সাধারণ মানুষ আপনিই তাঁর বশবর্তী হয়েছে।

ভারতবর্ষে নতুন কোনো ধর্ম অথবা নতুন কোনো দর্শন প্রস্তাবিত করার সবচেয়ে বড়ো বাধা ছিল পূর্ববর্তী ধর্ম এবং পূর্ববর্তী দর্শন—কেননা সর্বত্র প্রমাণ দিতে হবে শাস্ত্র থেকেই। চৈতন্য তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধিতে পূর্বের শাস্ত্র-দর্শন অতিক্রম করেছেন, অথচ শাস্ত্র-পরম্পরার বাইরে তিনি পা রাখেননি। সবচেয়ে বড়ো কথা, পরম ঈশ্বর, যিনি এতদিন সকলের দুরাগত অন্তরীক্ষলোকের অধিবাসী ছিলেন, যাঁকে সবিতৃমণ্ডলের মধ্যবর্তী কোনো অঞ্চলে জ্যোতির স্বরূপে ধ্যান করতে হত, সেই ঈশ্বরকে তিনি মথুরা বৃন্দাবন থেকে বিশ্বস্ত ঐতিহাসিকতায় তুলে এনে মানুষের মনের সঙ্গে তাঁর প্রিয়ত্বের সম্বন্ধ ঘটিয়ে দিলেন। অন্যদিকে যে ঈশ্বরকে পাওবার জন্য জ্ঞান, যোগ এবং সহস্র আচার গড়ে উঠেছিল, তা এক লহমায় ভেঙে পড়ল চৈতন্যের উদার সিংহনাদে—কলিযুগের একমাত্র সাধন—হরিনাম, হরিনাম, এবং হরিনাম। এমন একটা সহজ সাধন-কল্পের জন্যই যে শত-সহস্র জাতি-বর্ণ-দীর্ণ সাধারণ মানুষ চৈতন্যের পিছনে এক-আকার হয়ে দাঁড়াবে—এটাই ছিল দেশ এবং সময়ের পরিণতি। সেকালের পদে-পদাবলিতে এই বিরাট অভ্যুদয় নিবন্ধ হয়েছে—ধাওল নদীয়ার লোক গৌরাঙ্গ বলিয়া।

গঙ্গার সমৃদ্ধ অঞ্চল ছেড়ে পদ্মাবতীর দেশের মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটার মধ্যে বিশাল কোনো তাৎপর্য নেই, কিন্তু নিমাই পণ্ডিতের অধ্যাপন-সৌজন্যের অন্তরালে যে মানুষগুলির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হচ্ছে, তাঁরা কিন্তু তৎকালীন নবদ্বীপের অভিজাত সংস্কৃতির তুলনায় অনেকটাই হীন। একথা ইতিহাসের প্রমাণেই মানি যে, শ্রীহট্ট-হরিকেল অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কম ছিল না, কিন্তু পঞ্চদশ/ষোড়শ শতকে গৌড়বঙ্গের তুলনায় সে ঐতিহ্য অবশ্যই ম্লান। আর একটা কথা—মানুষ নিজের মধ্যে যে পরিবর্তন অনুভব করে বা যে পরিবর্তন সে ঘটাতে চায়, তা স্বদেশের চিরপরিচিত ভূমিতে ঘটাতে গেলে নিজেরও কিছু অস্বস্তি লাগে, অন্যেরাও তা নিয়ে বড়ো বেশি কথা বলে। লক্ষণীয়, চৈতন্য কিন্তু তখন জীবনের সেই অবস্থায় উপনীত নন, যখন লোকলজ্জা অথবা নিজের লাজ-ভয়, মান-অপমান, সব বিসর্জন দিয়ে নিজেকে প্রকট করে তুলছেন, কিন্তু আশ্চর্য হল—জীবনের শেষ পর্যায়ে উপস্থিত হয়ে তিনি সাধারণের উদ্দেশে যে সাধন-মন্ত্র উপদেশ করবেন, সেই হরিনাম-মহামন্ত্র কিন্তু তিনি প্রথমে উচ্চারণ করছেন পূর্ববঙ্গের অপরিচিত ভূমিতে। অর্থাৎ তিনি তাঁর বোধসিদ্ধ বক্তব্য বলতে আরম্ভ করেছেন নিজের বাহ্য কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়েই এবং তা নিজের দেশে নয়, অন্য দেশে।

অন্তত এইসব ক্ষেত্রে চৈতন্য মহাপ্রভু বেশ লৌকিকভাবেই প্রমাণসহ হয়ে ওঠেন। এ-বঙ্গে এবং ও-বঙ্গে বহুতর সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটছে। এমনকী তাঁর মধ্যে থেকে একান্ত লৌকিক এবং সাধারণী বৃত্তিগুলিও তখন পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়নি। বাঙাল দেশ থেকে ঘুরে আসার পর বাঙাল ভাষা নকল করে আপন ইষ্টজনের মধ্যে তিনি মজা কুড়োচ্ছেন—এ দৃশ্য তাঁকে আমাদের মতোই মনুষ্যোচিত করে তোলে। বাঙাল ভাষা নকল করে কথা বলার ব্যাপারটা এত দূর পৌঁছেছিল, যা মোটেই শিষ্টজনোচিত নয়। বিশেষত শ্রীহট্টের মানুষ দেখলে নিমাই পণ্ডিত আর স্থির থাকতে পারতেন না। মনে রাখতে হবে—ইতোমধ্যে তাঁর প্রথমা স্ত্রী লক্ষ্মীপ্রিয়া সর্পাঘাতে মারা গেছেন কিন্তু এই মৃত্যুতে জননী শচীদেবীকে যতখানি বিব্রত দেখেছি, নিমাই পণ্ডিতকে তত নয় এবং এই দুর্ঘটনার পরও শ্রীহট্টীয় মানুষদের সঙ্গে তাঁর রসিকতার বহর কমছে না। চৈতন্যের পূর্বপুরুষেরা অনেকেই শ্রীহট্টীয়, অথচ নবদ্বীপ-শান্তিপুরের পরিশীলিত ভাষার বংশধর তাঁর পিতা-পিতামহের দেশজ ব্যক্তিদের ভাষা নকল করছেন এবং যখন করছেন, তিনি তখন অধ্যাপক। শ্রীহট্টীয়রা দেখলে তিনি এত সময় ধরেই এই ভাষা-বিকার উপস্থাপনা করতেন যাতে আক্রান্ত ব্যক্তি ক্রোধ না করে থাকতে পারত না। অবস্থা এমন দাঁড়াত যে, বাঙাল শ্রীহট্টীয়রা তাঁর পিছনে হাতের কাছে যা পান, তাই নিয়েই দৌড়োতেন এবং একজন অধ্যাপক পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও নিমাই পণ্ডিতও দৌড়ে পালাতেন। তারা প্রভুর নাগাল না পেয়ে গালাগালি দিতেন দূর থেকে এবং আমার পরম বিশ্বাস, সে গালাগালিটাও নিশ্চয়ই বাঙাল ভাষাতেই দিতেন তাঁরা।

এই ভাষা-নকলের ঘটনায় উত্যক্ত হয়ে শ্রীহট্টীয়রা কোনো সময় নিমাই পণ্ডিতকে রাজকীয় শিকদারের কাছেও ধরে নিয়ে গেছে এবং নিমাই পণ্ডিতের বন্ধু-বান্ধবদের শিকদারের বাড়িতে গিয়ে মিটমাট করতে হয়েছে। আমরা এই ঘটনাটা উল্লেখ করতাম না, কিন্তু এই কারণেই তা করেছি যে, নিমাই পণ্ডিতের স্বভাবের মধ্যেই এই অদ্ভুত একটা গোঁয়ার্তুমি আছে যাতে যেটা তিনি ধরেন, সেটা আর তিনি ছাড়তে পারেন না। এই যে ভয়ংকর মনুষ্যোচিত ভাব—এই ভাবটাই যখন ভবিষ্যতে ধর্ম-দার্শনিকতায় পরিবর্তিত হবে, তখনও এই সুবিধাটা থাকবেই যে, অতি-সাধারণ মানুষও তাঁকে নিতান্ত মনুষ্যোচিতভাবেই স্পর্শ করতে পারবে, বুঝতে পারবে তাঁর উদার পারমার্থিকতা।

পূর্ববঙ্গ থেকে আসার পরে নিমাই পণ্ডিতের ঘরে অর্থের সংকট খানিকটা মিটেছিল— তাই বলে সেটা এতটা নয়, যেটা তাঁকে ধনীর পর্যায়ে নিয়ে যায়। কেননা তাঁর দ্বিতীয় বিবাহের সময় লক্ষ্মীমতী বিষ্ণুপ্রিয়া যখন তাঁর ঘরে এলেন, তখন নিমাই পণ্ডিতের বন্ধু বুদ্ধিমন্ত খান সে বিবাহের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করেছেন। বুদ্ধিমন্ত খান অবশ্যই নবদ্বীপে জমিদার-শ্রেণির মানুষ ছিলেন এবং মুসলমান শাসকবর্গের সঙ্গেও তাঁর ওঠাবসা ভালোই ছিল, নইলে গুণরাজ খান, যশোরাজ খানের মতো খান-উপাধিটা তাঁর জুটত না। যাই হোক, বন্ধু নিমাই পণ্ডিতের বিয়েটাও তিনি এমনভাবেই দিয়েছিলেন, যাতে দরিদ্র ব্রাহ্মণের দিন-যাপনের গ্লানি এতটুকু প্রকট না হয়ে ওঠে। তিনি বলেছিলেন—

শুন সর্ব ভাই।
বামনিঞা মত এ বিবাহে কিছু নাই।।
এ বিবাহ পণ্ডিতেরে করাইব হেন।
রাজকুমারের মত লোকে দেখে যেন।।

বেশ ধুমধাম করে নিমাই পণ্ডিতের দ্বিতীয় বিবাহ হল বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে। কিন্তু তার থেকেও বড়ো কথা যেটা এখানে বুঝতে হবে, সেটা হল—তাঁর অনুগামী তৈরি হয়েছে অনেক। তাঁর সখা-বন্ধুরা তাঁকে শিকদারের আইনি হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসছে, কোনো বন্ধু তাঁর বিশাল চণ্ডীমণ্ডপ তাঁর অধ্যাপনার জন্য ছেড়ে দিয়েছে এবং ধনী বন্ধু তাঁর বিবাহের ব্যয়ভার বহন করছে—এই সমস্ত ঘটনা থেকে তাঁর প্রিয়ত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আরও এক বৃহৎ গোষ্ঠী, যাঁরা অদ্বৈত আচার্যের ঘরে কীর্তনানন্দে রয়েছেন, তাঁরা শুধু এই বৃহৎ নেতা-নায়কের অপেক্ষা করছেন, কবে তিনি অধ্যাপনার বিদ্যারঙ্গ ছেড়ে নতুন রূপে ধরা দেন।

নিমাই পণ্ডিতের জীবনে আমূল পরিবর্তন যে সময়ে এল এবং যে ভাবে এল—তার কোনো লৌকিক ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। কোনো ঐতিহাসিকতা বা সামাজিক সূত্র ধরে এই বিরাট অভ্যুদয়ের ব্যাখ্যা করা যাবে না এবং অন্তত আমি সেই ব্যাখ্যা দিতে পারবও না। শুধু এইটুকু বলতে পারি—ধর্মের জগতে এমন হয়, তাতে যাঁরা বিশ্বাস করতে পারেন, তাঁরা বেঁচে গেলেন, যাঁরা পারেন না, তাঁরা যুক্তি দিয়ে বিচার করতে থাকুন। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ওই বিশ্বাসের পথ ধরেই তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে আজকের সমাজ-সচেতন ঐতিহাসিকের যুক্তি-তর্কগুলি নিবেশ করছি মাত্র। নইলে চৈতন্য-জীবন নিয়ে এই যুক্তিবাদী নির্মাণ আমার পছন্দ নয়। পছন্দ না হওয়ার সবচেয়ে বড়ো কারণ হল—আমি ছোটোবেলা থেকে শত শত চৈতন্যপন্থী ভক্ত দেখেছি, দেখেছি প্রেমীভক্ত, যাঁদের সঙ্গ করলে তাঁদের চৈতন্য-প্রেমের জাল ছেড়ে বেরিয়ে আসাই কঠিন। চৈতন্যপন্থীদের মধ্যেই এমন মানুষ আমি দেখেছি, যাঁরা ধন-মান-ঐশ্বর্য এক মুহূর্তে মলবৎ পরিত্যাগ করে চলে গেছেন, সেখানে স্বয়ং চৈতন্যের এই হঠাৎ পরিবর্তন আমার কাছে এতটুকু অস্বাভাবিক নয়।

আগে ভাবতাম—এসব এক ধরনের সংকীর্ণতা। তখন মনের মধ্যে বুঝি উপলব্ধ বিদ্যার সামান্য অহংকার ছিল, হয়তো বা গবেষণা-কর্মের নানান নব-নবোন্মেষিণী গরিমায় আমার হৃদয়ের চারিদিকে ঘনিয়ে উঠেছিল আত্মমানিতার আবরণ। তখন ভাবতাম—এসব নিছকই সংকীর্ণতা, নিজের ঘরের জিনিসটাকে বড়ো করে দেখানো। কৃষ্ণদাস কবিরাজ রাধার প্রণয়-মহিমা নির্ণয় করতে গিয়ে যখন এমন কথা বললেন—বুঝিবে রসিক ভক্ত না বুঝিবে মূঢ়—তখন এটাই ভেবেছিলাম যে, তামাম জগতের মানুষকে বেরসিক বলে কবিরাজ এক ধরনের আত্মতৃপ্তি লাভ করছেন, আর একই সঙ্গে সমুদয় কৃষ্ণভক্তদের একটা ‘কোটারি’ তৈরি করার চেষ্টা করছেন তিনি। এরপর এক সময় মহামতি রূপ গোস্বামীর ভক্তিরসামৃতসিন্ধু পড়তে আরম্ভ করলুম। বিভাব, সাত্ত্বিক ভাব, ব্যভিচারী ভাব ইত্যাদির চমৎকার ব্যাখ্যাবৃত্তি অনুভব করে অবশেষে স্থায়ী ভাব শেষ করেই একটা ধাক্কা খেলুম। গোস্বামীজি লিখলেন—অনেকেই আছেন যাঁরা জ্ঞান- বৈরাগ্যের সাধন করেন বটে, কিন্তু ভক্তির ব্যাপারে উদাসীন, অর্থাৎ শুকনো-শুকনো জ্ঞানের তাত্ত্বিকতায় যাঁদের হৃদয় কঠিন হয়ে উঠেছে, তাঁদের জন্য আমার এই গ্রন্থ নয় বাপু। এমনকী তাঁদের জন্যও এই গ্রন্থ নয়, যাঁরা দিনরাত হেতুবাদিতায় তর্কের ঝড় তুলে ঈশ্বরের প্রতিষ্ঠা করছেন মাত্র, অথবা তাঁদের জন্যও নয় যাঁরা কর্মকাণ্ডের যজ্ঞ-দান-হোমক্রিয়ায় নিতান্ত ব্যতিব্যস্ত।

কেমন যেন ধাক্কা খেলুম এসব কথা শুনে। রূপ বলছেন—গৃহস্থ যেমন চোরের ভয়ে মহামূল্য বস্তু লুকিয়ে রাখে, ভক্তিরসিক ব্যক্তি যেন সেইভাবেই তার আস্বাদ্য ভক্তি লুকিয়ে রাখবেন কর্মবাদী, হেতুবাদী, জ্ঞানবাদী মানুষের কাছ থেকে, কেননা যিনি রসিক ভক্ত নন, তিনি ভক্তির সরসতা অনুভবই করতে পারবেন না—সর্বথৈব দুরহো’য়ম অভক্তৈর্ভগবদ-রসঃ। এসব কথা পড়ে সন্দেহ হত, নিজে ভালো করে বুঝতে পারতাম না এই সংকোচ, এই সংকীর্ণতার তাৎপর্য, কেননা আমি নিজে সেই পরম আস্বাদনের ভোক্তা পুরুষ, অতএব আমার মাথায় এটা ঢুকতই না যে, অন্যের কাছেই বা এ সরসতা গ্রহণীয় হবে না কেন। ক্রমে বড়ো বড়ো গবেষকের বই পড়লাম, স্বদেশি-বিদেশি অনেক গবেষকের সঙ্গে কথাও হল। ওঁরা বেশ গালভরা একটা শব্দ শুনিয়ে বললেন— cult; cultic feature এটা। প্রত্যেক পুরাতন cult-এর ক্ষেত্রে—none but the initiates has access into it—এই ব্যাপার আছে।

তাঁদের কথা বোধগম্য না হওয়ার কিছু নেই। দীক্ষিত ব্যক্তি ছাড়া বিশেষ cult-এর ব্রত-নিয়ম-আচার পালন করা যায় না বা cult-এর গভীরে প্রবেশ করা যায় না, সেটা বুঝতে কি অসুবিধা আছে? কিন্তু চৈতন্যপন্থা তো তেমন নয়, অনেক অদীক্ষিত অবৈষ্ণবও তো এই রসের রসিক, তবে এমন লুকোছাপা ভাব কেন, কেন এমন সতর্কতা। ভাবতে ভাবতে আমার বয়স বেড়েছে, তথাকথিত সংকীর্ণতাকে তদীয় অনুভব দিয়ে বুঝতে শিখেছি। ঘরের মধ্যে আপন আনন্দ লুকিয়ে রাখার তত্ত্বটা আবিষ্কার করলাম ভগবদগীতার মধ্যে। সেখানে অর্জুনকে শতেক দার্শনিক তত্ত্ব উপদেশ করার পর চরম শ্লোকে ভগবান বললেন সমস্ত ধর্মত্যাগ করে তুমি আমার শরণ নাও, আমি তোমাকে সমস্ত অনর্থ পাপ থেকে বাঁচাব। এই চরম উপদেশ দেওবার পরই কৃষ্ণ বললেন—দেখো বাপু অর্জুন। আমি যা এতক্ষণ ধরে বলেছি, তা যেন এমন লোককে বোলো না যার মন, বুদ্ধি এবং ইন্দ্রিয়ের সংযম ঐকতানে পর্যবসিত হয়নি—ইদন্তে নাতপস্কায়। ধরা যাক, ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধি সংযত হয়েছে কিন্তু যা বলেছি এতক্ষণ, তার প্রতি যার শ্রদ্ধা নেই, ভক্তি নেই, আত্মনিবেদন নেই, এমন লোককেও তুমি আমার এসব কথা বোলো না। আবার এমনও হতে পারে যে, তিনি সংযতেন্দ্রিয় ব্যক্তি, শ্রদ্ধাবান ভক্তও বটে, কিন্তু শুনতে চান না এসব কথা—আমি বলি তেমন লোকের কাছেও তুমি বোলো না। কেননা জ্ঞান, বৈরাগ্য, ইন্দ্রিয়সংযম ইত্যাদির মাধ্যমে যে মানুষ গম্ভীর পরিশীলন লাভ করেছেন, তিনি ঈশ্বর পুরুষের এই নিতান্ত মানুষ রূপটিকে তো স্বীকারই করবেন না, উপরন্তু সমস্ত ধর্ম-কর্ম ত্যাগ করে তাঁর ঐকান্তিক শরণাগতির কথাটাকে খুব ছেঁদো বলে ভাববেন, ভাগবত্তার স্বরূপের প্রতি তাঁদের অশ্রদ্ধা থাকবে। অতএব তেমন লোকের এসব কথা পছন্দ হবে না বলেই তুমি তাঁদের কাছেও আমার এই মনের কথাগুলি বোলো না—না চাশুশ্রূষবে বাচ্যং ন চ মাং যো’ভ্যসূয়তি।

সত্যি কথা বলতে কী, চৈতন্য-জীবন আমার কাছে এক অন্তরঙ্গ কথা, তাঁর সেই বিরাট অভ্যুদয় ব্যাখ্যার জন্য আমি কিন্তু সেই পাঠকদের ‘অ্যাড্রেস’ করছি, যাঁরা তাঁর জীবনের এই আকস্মিক পরিবর্তনকে ঈশ্বর-প্রেরিত অথবা দৈব-সংঘটিত বলেই ভাববেন, অনন্ত সেখানে বেশি যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করবেন না। নিমাই পণ্ডিত গয়ায় গিয়ে পিতৃশ্রাদ্ধ করলেন, দর্শন করলেন বিষ্ণু-পাদপদ্ম। তাঁর শরীর-মন উদ্ভাসিত হয়ে উঠল— এই সেই চরণ—যা একদিন অপার করুণা-রসে দৈত্যরাজ বলির মস্তকে অর্পিত হয়েছিল, এই সেই চরণ, যা প্রতি পূজার সংকল্পে উচ্চারিত হয়—তদ বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরযঃ দিবীব চক্ষুরাততম। এই সেই চরণ, যার দিকে নিশ্চল চোখে চেয়ে থাকেন দেবতারা—নিমাই পণ্ডিতের সমস্ত বিদ্যার অহংকার চোখের জলে ধুয়ে গেল, তাঁর মনের মধ্যে জেগে উঠল বিরাট পুরুষের সেই ব্যাপ্তি—যা অন্তরের মধ্যে অতীত-অনাগতকে একাকার করে দেয়, জাতি-বর্ণ, ঐশ্বর্য-কৌলীন্যকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। বিষ্ণুপাদপদ্ম দর্শন করে নিমাই পণ্ডিত কেমন যেন হয়ে গেলেন—

অশ্রুধারা বহে দুই শ্রীপদ্ম-নয়নে।
লোমহর্ষ কম্প হৈল চরণদর্শনে।।

গয়াধামে কত না মানুষ বিষ্ণুপাদপদ্ম দর্শন করেন, কয়জনের এমন হয়? অতএব নিমাই পণ্ডিতের ক্ষেত্রে যা ঘটল, সেটা বিষ্ণুপাদপদ্মের মহিমা, নাকি সেটা তাঁর নিজের মহিমা! একটা কিছু উপলক্ষ্য লাগে বিরাট অভ্যুদয়ের জন্য—সেই রাজপুত্র, যিনি কপিলাবস্তুর পথভ্রমণে বার্ধক্য-জরা-মৃত্যুর চিরন্তন দৃশ্য দেখে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছিলেন, এও তেমনই এক উপলক্ষ্য—বৈদিক বিষ্ণুর বিরাট ব্যাপ্ত পদ-সংক্রমণ নিমাই পণ্ডিতের অন্তরাত্মা জাগিয়ে তুলল ব্যাপ্তির সংকেতে—জাভং রসময়ং জগৎ—

সর্বজগতের ভাগ্যে প্রভু গৌরচন্দ্র।
প্রেমভক্তি প্রকাশের করিলা আরম্ভ।।

চরিতকার যাই বলুন—ঈশ্বরপুরী সেই সময়েই দৈবযোগে উপস্থিত হলেন গয়ায়, আমার তা বিশ্বাস হয় না। এই মানুষটির জন্য তিনি বহুকালের অপেক্ষায় ছিলেন। নবদ্বীপে একবার অদ্বৈত আচার্যের ঘরে, একবার গোপীনাথ আচার্যের ঘরে থেকে ঈশ্বরপুরী এই মানুষটির সান্নিধ্যে এসেছেন, নিজকৃত গ্রন্থ সংশোধন করার নাম করে তিনি বারবার তাঁর কাছে আসবার চেষ্টা করেছেন। তখন পারেননি, এখন সে পথ সুগম হয়ে গেল। আসল কথা কী জানেন—শিষ্য যেমন কখনও উপযুক্ত গুরুলাভের জন্য গুরুর পিছনে ঘোরে, তেমনই এমন গুরুও আছেন, যিনি উপযুক্ত শিষ্যের জন্য তেমন শিষ্যের পিছন পিছন ঘোরেন। ঈশ্বরপুরী তেমন গুরু নন, যিনি অর্থলোভে, মানলোভে নিমাই পণ্ডিতের পিছনে ধাওয়া করছেন, তাঁর কাজ—মাধবেন্দ্রপুরীর প্রেমময়ী ভক্তির বীজটি সঠিক জায়গায় রোপণ করা, যে-বীজ মহীরুহ হয়ে উঠবে। নিমাই পণ্ডিতকে দেখে ঈশ্বরপুরী বুঝেছিলেন—মাধবেন্দ্রপুরী প্রবর্তিত প্রেমভক্তির সবচেয়ে বড়ো আধার হতে পারেন এই মানুষটি। তদবধি তাঁর কৃপাচক্ষু পড়ে আছে পণ্ডিতের ওপর। তিনি এখানে সেখানে ঘুরছেন এবং গয়ায় এসে নিমাই পণ্ডিতকে বলেও ফেলেছেন—যদবধি তোমা দেখিয়াছি নদীয়ায়। তদবধি চিত্তে আর কিছু নাই ভায়।।

যিনি এর পরের দিনই নিমাই পণ্ডিতের গুরু হবেন, তিনি কত সন্তর্পণে এগোচ্ছেন তাঁর দিকে। গয়াধামে কোনো বিশাল প্রভুত্বের পদসঞ্চারে তিনি নিমাই পণ্ডিতের ঘরে ‘অয়মহং ভোঃ’ বলে উপস্থিত হননি। গয়ায় বিভিন্ন তীর্থ এবং বিষ্ণুপাদপদ্ম দর্শন করে এসে নিমাই পণ্ডিত দিনান্তের আহার রন্ধন করেছেন, সেই বেলা তাঁর দ্বারে এসে উপস্থিত হলেন ঈশ্বরপুরী। নিমাই পণ্ডিত বললেন—আজ যা রেঁধেছি, তুমি খাও সব। পুরী বললেন—তবে তুমি কী খাবে? পণ্ডিত বললেন—আবার রান্না করতে কতক্ষণ?

পুরী বোলে কি কার্যে করিবে আর পাক?
যে অন্ন আছয়ে তাহি কর দুই ভাগ।।

নিমাই পণ্ডিত মানলেন না। তিনি বুঝেছিলেন—এই অর্ধপ্রৌঢ় মানুষটি তাঁকে খুব চাইছেন। অতএব সেই গৌরব নিয়েই বললেন—তুমি যদি আমাকে চাও, তো আমার রান্না সবটাই তোমায় খেতে হবে। ঈশ্বরপুরী ভাবী শিষ্যের প্রথম দাস্যকর্ম অঙ্গীকার করলেন। ভাবী গুরু আর ভাবী শিষ্যের নিভৃতে কথা হল অনেক। পরের দিনই ঈশ্বরপুরীর কাছে মন্ত্রদীক্ষা চাইলেন নিমাই পণ্ডিত। পুরী বললেন—মন্ত্র কী, তোমার জন্য প্রাণ দিতে পারি। পুরী গোঁসাই কৃষ্ণের দশাক্ষর মন্ত্র উচ্চারণ করলেন নিমাই পণ্ডিতের কানে। নিমাই পণ্ডিত ঈশ্বরপুরীকে প্রদক্ষিণ করে শিষ্যবৎ আত্মনিবেদন করলেন গুরুর চরণে। এ কেমন গুরু, আর এ কেমন শিষ্য! দীক্ষামন্ত্রের আদান-প্রদান শিষ্য এবং গুরু দুজনেই পরম উল্লাসে অস্থির হয়ে পড়লেন। শিষ্যের অবস্থা হল ততোধিক। দশ অক্ষরের ক্ষুদ্র একটি দীক্ষামন্ত্র আণবিক আবেগ-স্ফুরণ ঘটিয়ে দিল নিমাই পণ্ডিতের মনে—তিনি হা কৃষ্ণ, কোথা কৃষ্ণ বলে পাগল হয়ে উঠলেন, সমস্ত শরীর ভরে উঠল কৃষ্ণপ্রেমের আবেশে—

যে প্রভু আছিলা অতি পরম গম্ভীর।
সে প্রভু হইলা প্রেমে পরম অস্থির।।

আমার সহৃদয় পাঠককুল। আমি আপনাদের মনে কোনো বিশ্বাসের মন্ত্র জাগাতে পারব না, যাতে এই আকস্মিক প্রেম-বিকার ব্যাখ্যা করা যায়। লোকে তো একে বিকারই বলে, বুদ্ধিমান তার্কিক জনে এমনও বলেছে যে, এ হল এক ধরনের ‘হিস্টিরিয়া’। আগেই বলেছি—তাদের বোঝানোর দায় নেই আমার। কিন্তু আমি যে নিজেও এমন দেখেছি, শুনেছি, অনুভবও করেছি। যারা আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে রামদাস বাবাজি মশায়ের মুখে ‘হরিদাস নির্যান’ শুনেছেন, তাঁরা কীর্তনের আসরে বসেই কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন। বলতে পারেন, এও তো বিকার। দীক্ষামন্ত্র লাভের পর হঠাৎ এই আকস্মিক পরিবর্তন কী করে হল, তার কোনো লৌকিক যুক্তি নেই আমার কাছে। কিন্তু উপযুক্ত গুরুর কাছে উপযুক্ত শিষ্য যখন প্রথম শিক্ষা পেতে আরম্ভ করে, তখন এমনতর পাগলামি আমি লৌকিক জগতেও দেখেছি, সেখানে কৃষ্ণপ্রেমী গুরুর কাছে চৈতন্যের মতো শিষ্য যখন দীক্ষামন্ত্র লাভ করেন, তখন যে কী অনাস্বাদিতপূর্ব চমৎকার ঘটতে পারে, তা শুধু অনুভববেদ্য, প্রত্যক্ষ প্রমাণসিদ্ধ নয়। পরের দিন শেষ রাত্রেই নিমাই পণ্ডিত ঘর ছেড়ে মথুরা বৃন্দাবনের উদ্দেশে রওনা দিলেন—কী করব, কোথায় যাব, কোথায় গেলে কৃষ্ণ পাব—এমন একটা আকুতি তাড়িয়ে নিয়ে চলল তাঁকে। কিন্তু মাঝপথে সে তাড়না স্তব্ধও হল। চরিতকার বলেছেন ‘দৈববাণী’। দৈববাণী বলেছিল—এখন মথুরা যাওয়ার কাল নয়, এখন তুমি নবদ্বীপে ফিরে যাও।

আমাদের ধারণা—দৈববাণীর চেয়েও এখানে অন্তরের তাড়না ছিল বেশি। নবদ্বীপে কতগুলি মানুষ তাঁর অপেক্ষায় বসে আছেন—শান্তিপুরের প্রৌঢ়-বৃদ্ধ অদ্বৈত আচার্য, গদাধর, শ্রীবাস, মুকুন্দ আরও কত শত মানুষ পূর্বে থেকেই তাঁর ভাব গ্রহণ করে বসে আছেন, তাঁদের মধ্যে আপন কল্যাণী শক্তি সঞ্চার করার কাজটুকু তাঁর বাকি রয়ে গেছে। বিশেষত মাধবেন্দ্রপুরীর প্রেমভক্তির উত্তরাধিকার, যা ঈশ্বরপুরীর মাধ্যমে তাঁর মধ্যে সমাহিত হল, সেই প্রেমভক্তির প্রথম রহস্যটুকু আপন দেশের মানুষকে জানিয়ে দেওয়ার কাজটুকু তিনি করে যাবেন।

গয়া থেকে নিমাই পণ্ডিত ফিরে এলেন নবদ্বীপে—একেবারেই পরিবর্তিত হয়েছে তাঁর স্বভাব এবং বক্তব্য। সেই বেপরোয়া অধ্যাপকের ঔদ্ধত্য এতটুকু অবশিষ্ট নেই তাঁর মধ্যে, সর্বক্ষণ কৃষ্ণের নাম করে যাচ্ছেন এবং অন্তরের মধ্যে কৃষ্ণপ্রেম রসায়িত হচ্ছে ক্ষণেক্ষণে। অধ্যাপনার মণ্ডপে ছাত্ররা আসছে, কিন্তু কলাপ ব্যাকরণের বৃত্তি-পঞ্জী-টীকা ভুলে তিনি কৃষ্ণকথা বলছেন ছাত্রদের। সময় এল, যখন ছাত্ররাও ব্যাকরণ ছেড়ে ভক্তির ব্যাখ্যান বুঝতে শুরু করল। আবহ খানিকটা তৈরি ছিল বটে, কিন্তু পুরোটা মোটেই নয়। চরিতকার বৃন্দাবন দাস যেভাবে এই সময়টার বর্ণনা করেছেন, তা যে ঠিকঠাক আমি বোঝাতে পারব না, তা নয়, কিন্তু চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণবের ঘরে-দোরে যাঁদের যাতায়াত নেই, তাঁদের কাছে সন্ন্যাস-পূর্ব নিমাইপণ্ডিতকেও বোঝা সম্ভব হবে না, তেমনই নদীয়া-বিনোদিয়া মহাপ্রভুর সঙ্গে তাঁর ভক্তগোষ্ঠীর ঐকান্তিক ব্যবহারগুলি বোঝা কঠিন হবে।

এ-কথা অবশ্যই এখানে জানাতে হবে যে, গয়া থেকে ফেরার পর, নবদ্বীপে যে বৈষ্ণব-সমাজ এতদিন ধরে একটু একটু করে পুষ্ট হচ্ছিল, তারা শুধু এক নতুন ব্যক্তিত্বই সঙ্গী হিসেবে লাভ করেনি, তারা এক বিরাট পুরুষের নেতৃত্ব লাভ করেছিল। অদ্বৈত আচার্যের মতো প্রৌঢ় বৃদ্ধ ব্যক্তি নিজেকে এই নবীন যুবার দাস হিসেবে ঘোষণা করলেন। বীরভূমের জাতক নিত্যানন্দ অন্য জায়গা থেকে এসেছিলেন নবদ্বীপে। নিত্যানন্দ এমনই এক বিচিত্র মানুষ যিনি প্রথম জীবন থেকে তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করে নিজের ধর্মমত দৃঢ় করেছেন এবং তাঁকে বিচার করতে গেলে আবারও সেই আশ্চর্য তথ্যটি দিতে হবে যে, তিনি এবং মাধবেন্দ্রপুরী হয়তো একই গুরুর শিষ্য—মাধবেন্দ্র বৃদ্ধ এবং নিত্যানন্দ যুবক, হয়তো বৃদ্ধত্বের কারণে মাধবেন্দ্রপুরীকে গুরুর সম্মানে দেখতেন নিত্যানন্দ এবং এই দুইজনের সাক্ষাৎকার যখন হয়েছিল, তখনও কিন্তু নিমাই পণ্ডিত তাঁর ভক্তিভাবের মধুর রাজ্যে প্রবেশই করেননি। মাধবেন্দ্রপুরীর প্রেমময়ী ভক্তি নিত্যানন্দের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল এবং সেই ভক্তি আত্মসাৎ করে তিনি এমন সময়েই নবদ্বীপে এসেছিলেন যখন নিমাই পণ্ডিত নবদ্বীপের সামগ্রিক বাতাবরণ পালটে দিতে বসেছেন প্রায়।

সেদিন মুকুন্দ-সঞ্জয়ের বিরাট চণ্ডীমণ্ডপে নিমাই পণ্ডিতের ব্যাকরণ-শিষ্যেরা শেষ সিদ্ধান্ত চাইল। পণ্ডিত বললেন—আমার দ্বারা এ অধ্যাপনার কর্ম আর সম্ভব হবে না। নবদ্বীপে নামী-দামি অনেক অধ্যাপক আছেন, তোমাদের যার যেখানে ইচ্ছে পড়তে যাও। নিমাই পণ্ডিত পুঁথি বন্ধ করে বেঁধে ফেললেন দড়ি দিয়ে। শিষ্যরা বলল—এতদিন আপনার কাছে পড়ার পর আর কোথাও আমাদের পক্ষে আর পড়াশুনো করা সম্ভব নয়। তারাও সব পুঁথি বন্ধ করে দিল—পুস্তকে দিলেন সব শিষ্যগণ ডোর। এই ঘটনাটা খুব বড়ো নয়, কিন্তু একই সঙ্গে আমি নিমাই পণ্ডিতের জনপ্রিয়তাটুকু বোঝাতে চাইছি। শিষ্যদের প্রতি পণ্ডিত আচার্যের শেষ উপদেশ হল—

পঢ়িলাঙ শুনিলাঙ এত কাল ধরি।
কৃষ্ণের কীর্তন কর পরিপূর্ণ করি।।

বিদ্যায়তনের সেই প্রকোষ্ঠেই কৃষ্ণের সংকীর্তন আরম্ভ হয়ে গেল, সেইখানেই অন্য মানুষজন জমায়েত হতে আরম্ভ করল—কীর্তনের রোল উঠল পাঠাগার থেকেই। সবার কাছে যেটা সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল সেটা হল এই যে, এমন উদ্ধত অহংকারী অধ্যাপক কোন মায়ামন্ত্রবলে এমন দীন-হীন নরম হয়ে উঠল? নাকি কৃষ্ণভক্তি বস্তুটাই এইরকম যা মানুষকে এমন মধুর কোমল করে তোলে।

হেন উদ্ধতের যদি হেন ভক্তি হয়।
না বুঝি কৃষ্ণের ইচ্ছা এ বা কিবা হয়।।

নবদ্বীপে শ্রীবাস বা শ্রীনিবাস পণ্ডিতেরা চার ভাই। চার ভাই-ই বৈষ্ণব। নবদ্বীপে শ্রীবাসের বাড়িতে কীর্তনানন্দ আরম্ভ হয়েছিল অনেক আগে থেকেই, সেখানে আনাগোনা করতেন তাবৎ বৈষ্ণব সজ্জনেরা—গদাধর, মুকুন্দ, মুরারি, অদ্বৈত আচার্য সকলেই। কৃষ্ণপ্রেমের অনুভবে নিমাই পণ্ডিতকে যখন বাইরে থেকে বিকারগ্রস্তের মতো দেখাচ্ছিল, তখন এই শ্রীবাস পণ্ডিতই প্রথম তাঁর অভ্যুদয় প্রচার করেন। বাড়িতে শচীমাতা প্রথমে ভয় পেয়েছিলেন তাঁর ছেলের সাত্ত্বিক ভাবকে বায়ুর প্রকোপ ভেবে, পরে শ্রীবাসের বক্তব্য শুনে আরও গভীরতর ভয় তাঁর মনের মধ্যে বাসা বাঁধল। ভাবলেন—জ্যেষ্ঠ বিশ্বরূপের মতো নিমাইও একদিন সন্ন্যাসী না হয়ে যায়—বাহিরায় পুত্র পাছে এই মনে ভয়।

শ্রীবাসের গৃহে নামকীর্তনের যে বিরাট উল্লাস-যজ্ঞ আরম্ভ হয়েছিল, চরিতকারেরা সেখানে নিমাই-পণ্ডিতের নানান অলৌকিক বিভূতিও লিপিবদ্ধ করেছেন, আমরা তার মধ্যে যাচ্ছি না, কেননা সেগুলি ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা। বাস্তবে এই একটা সময় যখন নবদ্বীপ এবং তার সমীপবর্তী অন্যান্য স্থান থেকে বহু বহু পরিচ্ছন্ন মানুষ নিমাই পণ্ডিতকে তাঁদের ধর্মীয় ভাবনার পথপ্রদর্শক বলে মেনে নিল। নবদ্বীপের পণ্ডিত সমাজ তখনও তাঁর ব্যাপারে উদাসীন রইল, কিন্তু মধ্যবিত্ত মানুষ এবং সাধারণ ভদ্র দরিদ্র মানুষ নতুন প্রাণ খুঁজে পেল নবোন্মেষিত এই ধর্মের মধ্যে।

প্রাথমিক একটা ‘রি-অ্যাকশন’ অবশ্যই হয়েছিল এবং তা হয়েছিল সাধারণের মধ্যেও এবং পণ্ডিতের মধ্যেও। মানুষ তো কত রকম আছে—ভিন্নরুচি, ভিন্নভাব এবং তার মধ্যে আছে ভিন্নধর্মী শাসকের ভয়—যেন নতুন কোনো হিন্দুয়ানি আরম্ভ হল। চরিতকারের সমাজের এই অংশের প্রতিক্রিয়াটুকু সযত্নে লক্ষ্য করেছেন, কিন্তু তা বর্ণনা করেছেন অতি সংক্ষেপে এবং বেশ সকৌতুকে। অত্যন্ত বিষয়ী মানুষ যাঁরা—সমাজের কোনো উজ্জীবনী প্রক্রিয়া যাদের মনে ছায়া ফেলে না, স্ত্রী-পুত্র-খাদ্য এবং স্ব-সুখবাসনা ছাড়া আর কিছুই যারা ভাবে না, তারা বিচার-ভাবনাহীন বৈষয়িকতায় বলতে আরম্ভ করলেন—এই লোকগুলোর হঠাৎ হল কী? রাত্রিদিন হরিনাম করে ডাক ছাড়ছে, আমাদের ঘুমের বারোটা বেজে গেছে। বিশেষ করে রাতের বেলায় এত চেঁচিয়ে লাভ কী? মনে-মনে ভগবানকে ডাকলে পুণ্য কি কম হয়?—

কেহ বোলে—এ-গুলায় হইল কি বাই।
কেহ বোলে—রাত্রে নিদ্রা যাইতে না পাই।।
মনে মনে ডাকিলে কি পুণ্য নাহি হয়?
রাত্রি করি ডাকিলে কি পুণ্য জনময়?

ঘটনা হল—শ্রীবাসের বাড়িতে যে কীর্তনারম্ভ হয়েছিল, তা রাত্রিতেই হচ্ছিল। দিনের বেলায় অর্থ-চিন্তায় ব্যাপৃত মানুষের বৈষয়িক বিঘ্ন না ঘটে, এটা যেমন একটা কারণ হতে পারে, তেমনই অন্য কারণ হতে পারে ভিন্নধর্মী এবং ভিন্নদেশি প্রশাসকের ভয়—যাতে প্রাথমিক এই সংকীর্তনরঙ্গ অঙ্কুরেই বিনষ্ট না হয়। পুণ্য-পাপ এই শব্দদুটির উচ্চারণে বোঝা যায় যে, এরা বঙ্গের স্মৃতিশাস্ত্রতাড়িত মানুষ, বিভিন্ন বৈদিক ক্রিয়ার অপভ্রষ্ট আচার—এই করলে পুণ্য, আর এই করলে পাপ—এই রকম একটা সাধারণ যোগ-বিয়োগের অঙ্ক মেনে এরা চলে। ঈশ্বর সম্বন্ধে এদের ধারণাটা অবশ্য বড়োই গম্ভীর এবং দূরবর্তী—অন্তরীক্ষলোকে আসীন হয়ে তিনি যে পরম গম্ভীরতায় প্রত্যেকটি মানুষের পাপ-পুণ্যের নিক্তি কষে যাচ্ছেন এমন একটা ধারণাবশে তারা মন্তব্য করে—কীর্তনের এই উচ্চগ্রাম চেঁচামেচিতে প্রলয়পয়োধিজলে অনন্ত-শয়ান বিষ্ণুর ঘুম ভেঙে যাবে এবং তাতে অন্য বিপাক সৃষ্টি হবে—

কেহ বোলে গোসাই রুষিব ঘন ডাকে।
এগুলোর সর্বনাশ হইব এই পাকে।।

এ-বাবদে সমাজের মাথা ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের ভাব ছিল অন্যরকম। এতকাল তাঁরা উপনিষদের ব্রহ্ম নিয়ে মাথা ঘামিয়ে এসেছেন। নিরাকার নির্বিশেষ পরব্রহ্মের উপাসনায় তাঁদের সাধন হল জ্ঞানযোগ। পণ্ডিত বলেই তাঁরা যুক্তি-তর্ক দিয়ে সেই জ্ঞানের সাধন বুঝতে পারেন। সাধারণ ক্রিয়াচারে পুণ্য-পাপের ভাবনা তাঁদের ভাবিত করে না। শম-দমের সাধন সম্বল করে সংসার মুক্তির জন্য তাঁরা পরম গম্ভীর জ্ঞানকেই একমাত্র উপায় বলে উপদেশ দিয়ে থাকেন। এ-হেন বড়ো মানুষেরা ভগবানকে অত খাস্তা-খাস্তা সহজ জিনিস ভাবেন না। হরি-কৃষ্ণ বলে ডাক ছাড়লেই তিনি এসে দেখা দেবেন—ভগবানকে এত সহজ করে ফেললে এতদিন ধরে যে যাগ-যজ্ঞ-ধ্যান-জ্ঞানের চেষ্টা করলেন পণ্ডিতেরা, সে-সব কি তাহলে অর্থহীন? তা ছাড়া এতদিনের উপদিষ্ট জ্ঞান-সাধনের শিষ্ট মার্গ ত্যাগ করে হরি-কৃষ্ণ বলে ডাক ছাড়লেই তার দেখা মিলবে—এমন ভাবনার কোনো মূল্য নেই পণ্ডিতদের কাছে—

কেহ বোলে জ্ঞান যোগ এড়িয়া বিচার
পরম উদ্ধত হেন সভার ব্যাভার।।
কেহ বোলে কিসের কীর্তন কেবা জানে।
এত পাক করে এই শ্রীবাস বামনে।

শ্রীবাস পণ্ডিতের ওপরেই তখনকার সংরক্ষণশীল পণ্ডিত সমাজের আরও বেশি রাগ, কেননা ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত হয়েও তিনি এই হরিনাম-সংকীর্তনের আশ্রয়-প্রশ্রয় অঙ্গীকার করেছেন। নবদ্বীপের পণ্ডিত-সমাজের প্রতিক্রিয়া নিয়ে বৃন্দাবন দাস যে শ্লোক বেঁধেছিলেন, তার একটা অসাধারণ সূত্রও মেলে সমসাময়িক একটি সংস্কৃত শ্লোকে। আগেই বলে নেওয়া ভালো যে, নবদ্বীপে বিদ্যাবত্তার যে সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল, সেখানে নব্যন্যায়ের পণ্ডিতেরাও কিন্তু অনেকেই মনে-মনে বেদান্তবাদী জ্ঞানযোগের পক্ষপাতী ছিলেন এবং তাঁরা যে স্মৃতিশাস্ত্রীয় কর্মকাণ্ডে খানিকটা উদাসীন ছিলেন তার জোরদার প্রমাণ মেলে তৎকালীন স্মৃতিশাস্ত্রেই। স্মার্ত রঘুনন্দনের গুরু শ্রীনাথ আচার্য-চূড়ামণি নিজকৃত একটি স্মার্ত গ্রন্থে লিখেছেন—আমাদের আচার-বিচার, হোম-যজ্ঞসমৃদ্ধ স্মৃতিশাস্ত্রের দিকে দার্শনিক পণ্ডিতেরা কেমন যেন হাতির মতো নির্বিকার চোখে একবার তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নেন। শ্রীনাথ এখানে বোধহয় নির্দিষ্টভাবে বৈদান্তিকদের কথাই বলছেন। তারপরেই ইঙ্গিত করছেন নৈয়ায়িকদের প্রতি। বলছেন—আর এক দার্শনিকদের দল আছে, যারা শুধু পদার্থ-বিচার করে যাচ্ছে দিন-রাত। অতএব শিষ্যদের হিতের জন্য আমাকে গ্রন্থ লিখতে হচ্ছে।

এতে এই কথাটাই আরও ভালোভাবে প্রমাণ হয় যে, পণ্ডিত নন, বৈদান্তিক নন, নৈয়ায়িক নন—এমন একটা সাধারণ ব্রাহ্মণ-সমাজের মধ্যেই স্মৃতিশাস্ত্রের আচার-বিচার এবং বৈদিক হোম-যজ্ঞের ক্ষীয়মাণ অবশেষটুকু ধরে রাখার একটা প্রবণতা ছিল। আর ছিলেন ব্রাহ্মণেতর বৈশ্য শূদ্র মানুষেরা, স্মার্ত প্রক্রিয়াগুলি যাঁদের কাছে ব্রাহ্মণ্য আচরণের হোম তৈরি করত। এঁরা ব্রাহ্মণ নন, কোনো মন্ত্রবলে এঁরা ব্রাহ্মণ হতেও পারবেন না, কিন্তু এঁদের হয়ে হোমযজ্ঞ করে, এঁদের, ব্রত-উপবাস- পূজানবিধি শিখিয়ে বাহ্মণ যে উচ্চতর ব্রাহ্মণ্যের স্পর্শ দিতেন এঁদের, তার একটা নিজস্ব মোহ ছিল। আবার নিজেরা কিছু করতে পারছেন না বলে একটা হীনম্মন্যতাও তাদের ছিল। অতএব নিমাই পণ্ডিত যখন সমস্ত হীনবর্গের কাছে হরিসংকীর্তনের উদার আহ্বান পৌঁছে দিলেন, সেদিনও কিন্তু সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি হল স্মৃতিশাস্ত্রী সংরক্ষক প্রভুদের। আমরা যে সমসাময়িক শ্লোকের কথা বলেছিলাম, সেই শ্লোকের মধ্যে স্মার্ত শাস্ত্রকারের এই যন্ত্রণা ধরা পড়েছে। সেখানে নব্যন্যায় এবং চৈতন্য-মহাপ্রভুর কীর্তন সমারোহ জোয়ারের চেহারা নিয়েছে।

শ্লোকটির নির্গলিতার্থ থেকে মনে হয়—চৈতন্য মহাপ্রভু তখন সন্ন্যাস নিয়ে নবদ্বীপ ছেড়ে চলে গেছেন এবং তাঁর প্রবর্তিত কাজটুকু সম্পূর্ণ করছেন নিত্যানন্দ প্রভু। নিত্যানন্দের ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারণ, তিনি খুব বিনয় নিয়েও চলতেন না। সংকীর্তন প্রচারের ক্ষেত্রে তাঁর ক্ষমতাও ছিল অপরিসীম। দীন-হীন সাধারণকে জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে প্রেমভক্তি দান করে নিজ গ্রন্থির মধ্যে নিয়ে আসার কাজটা চৈতন্যের অনুপস্থিতিতে তাঁর ওপরেই বর্তেছিল, এবং তিনি সে কাজটা করেছিলেন সাধারণ নিয়ম-কানুন তথা স্মার্ত আচার-বিচারের ঊর্ধ্বে উঠে। ফলত তাঁর ওপরে স্মার্তদের ক্ষোভ ছিল চৈতন্যের চেয়েও বেশি। ঠিক এই কারণেই বর্তমান শ্লোকে চৈতন্যের বদলে নিত্যানন্দকেই আসল অপরাধী বলে নির্ণয় করা হয়েছে। শ্লোক বলছে—কলিযুগের কী বিপুল পরাক্রম দেখ ভাই—বুদ্ধিজীবী দার্শনিক পণ্ডিতেরা এখন আর হোম-যজ্ঞ করেন না। তাঁরা শ্রুতি-স্মৃতিসম্মত কর্মানুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে অগ্নিতে আহুতি দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে সবই আহুতি দিচ্ছেন তার্কিক শিরোমণি রঘুনাথের তর্কযজ্ঞের আগুনে। আরেক দিকে দেখো—কোথা থেকে এক কৃষ্ণনাম-সংকীর্তনের আওয়াজ উঠেছে, অবধূত নিত্যানন্দ নিজের স্বেচ্ছাচারিতায় সমস্ত বৈদিক অনুষ্ঠানের বিলুপ্তি ঘটিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন এক আন্দোলন তৈরি করেছেন। অতএব সাবধান ভাই, সব সাবধান, নিজের মনকে এসব ভুল পথে যেতে দিও না বাপু। কলির পরাক্রম বড়ো বেড়ে গেছে—বলী কলিপরাক্রমী বিরম বিভ্রমেভ্যো মনঃ।

নিমাই পণ্ডিতের সংকীর্তন-যজ্ঞ শ্রীবাসের বাড়িতে আরম্ভ হয়েছিল রাতের বেলায়। ক্রমে তা দিনের বেলাতেও ছড়িয়ে পড়ল সর্ব-সাধারণের মধ্যে। দলে দলে মানুষ যোগ দিতে লাগল এই নতুন ধর্মের প্রেরণায়। আচার্য-বৃদ্ধ অদ্বৈত ভাবাবিষ্ট গৌরাঙ্গের কাছে বর চেয়েছিলেন—মূর্খ- নীচ-দরিদ্রের অনুগ্রহ করো। নিমাই পণ্ডিত কথা রেখেছিলেন। নদীয়ার নগরে-নগরে কীর্তন আরম্ভ হয়েছিল। অদ্বৈত বলেছিলেন—যদি ভক্তিই বিলোতে হয়—

যদি ভক্তি বিলাইবা।
স্ত্রী-শূদ্র আদি যত মূর্খেরে সে দিবা।।

বৃদ্ধ আচার্যের এই সকরুণ যাচনা থেকে বোঝা যায় যে, সমাজের এমন একটা অংশকে এই ধর্মের অংশীদার করা হচ্ছে, যারা এতদিন ঐতিহ্যগত ব্রাহ্মণ্যের বঞ্চনা-যন্ত্রণা সহ্য করেছে। এতে আরও বোঝা যায় যে, বেদ নয়, উপনিষদ নয়, সাংখ্য বেদান্ত কিংবা ন্যায়-বৈশেষিকও নয়, চৈতন্য এমন একটি পরম্পরাগত শাস্ত্রকে অবলম্বন করেছেন আপন ধর্মমূল হিসেবে—যাকে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা অস্বীকারও করতে পারছেন না, আবার ভালো করে গিলতেও পারছেন না। এই শাস্ত্র হল পুরাণ এবং পুরাণের আরম্ভ-বক্তব্যই এ-রকম যে, স্ত্রী-শূদ্র এবং ক্রিয়াকাণ্ডহীন ব্রাহ্মণদের জন্যই পুরাণ লেখা হচ্ছে, কেননা বেদে-ব্রাহ্মণ্যে তাঁদের অধিকার নেই—স্ত্রী-শূদ্র দ্বিজবন্ধুনাং ত্রয়ী ন শ্রুতিগোচরাঃ। অধিকার যাদের থাকে না, তারাও অধিকারী হতে চায়। এটাই সাধারণ ধর্ম। বৃন্দাবন দাস ভান-ভণিতার ধার ধারেন না বলেই এমন করে বলতে পেরেছেন যে, চৈতন্য এমন একটা ধর্ম প্রবর্তন করলেন যা দেখে স্ত্রী-শূদ্র চণ্ডালেও নেচে ওঠে আর ভট্টাচার্য-চক্রবর্তীদের তাতে জ্বালা ধরে গায়ে—

চণ্ডালাদি নাচয়ে প্রভুর গুণগ্রামে।
ভট্ট-মিশ্র-চক্রবর্তী সব নিন্দা জানে।।

যারা চিরকাল উচ্চবর্ণের অনুগমন করে এসেছে, তারা চৈতন্য-ধর্মের মাহাত্ম্যে সামাজিক সম্মান এবং অধিকার লাভ করায় তৎকালীন সমাজের মধ্যে একদিকে যেমন একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেল, তেমনই অন্যদিকে নিমাই পণ্ডিত পরিচিত হয়ে উঠলেন পরিত্রাতা হিসেবে। মানুষের শক্তি তাঁর পশ্চাৎবর্তী হল দিনে-দিনে। এই শক্তি যে কতটা, তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ মিলবে কতগুলি নির্দিষ্টে ঘটনায়। এখানে বিশদ করে বলবার উপায় নেই তাই সূত্রাকারে এ-কথা জানিয়ে রাখছি যে, নিমাই পণ্ডিত যে ভক্তিধর্মের প্রচার আরম্ভ করলেন, তার নেতৃত্বে ছিলেন কিন্তু সমাজের তথাকথিত উচ্চশ্রেণির লোকেরাই। বিত্তে ঐশ্বর্যে তাঁরা খুব বড়ো ছিলেন না, কিন্তু মধ্যবিত্তের ঘর থেকে উঠে আসা ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ—যাঁরা এদিক-ওদিকে ভিনদেশে পড়ে ছিলেন, তাঁরা চৈতন্যের অনুগামী হওয়ায় তাঁর ধর্ম-আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করেছে। দ্বিতীয়ত, জগাই-মাধাইয়ের মতো দুষ্কৃতী, মদ্যপ—যারা নবদ্বীপে দুষ্কর্ম করার জন্য মুসলমান প্রশাসকের কোটাল বলে নিজেদের পরিচয় দিত, তাঁরা তাঁদের দুষ্কর্ম বন্ধ করে, মদ্যপান ছেড়ে শ্রীবাস-অঙ্গনে কীর্তন আরম্ভ করল।

সাধারণ মানুষ এইসব অদ্ভুত কাণ্ড দেখছে, লক্ষ্য করছে। এ-কথা ভাবার কোনো কারণ নেই, কোনো অলৌকিক মন্ত্রবলে জগাই-মাধাইয়ের মতো ভয়ংকর দুষ্কৃতী সাধু হয়ে গেল। এটা চৈতন্য-নিত্যানন্দের সেই অসামান্য ব্যক্তিত্ব, যাতে এতটুকু হিংসা না করেও এমন দুষ্কৃতীকে তাঁরা আপন করুণার মহিমায় কৃষ্ণভক্তির উদার ভূমিতে পৌঁছে দিয়েছেন। নিমাই-পণ্ডিতের আদেশে নিত্যানন্দ এবং হরিদাস ঠাকুর প্রতিদিন পাড়ায় পাড়ায় সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে কৃষ্ণনামের মহিমা কীর্তন করতেন। এমন কর্মে হরিদাস ঠাকুরের নিযুক্তি নিমাই পণ্ডিতের বাস্তব-বোধ আরও প্রকট করে তোলে। হরিদাস মুসলমান যখন ছিলেন, তিনি চৈতন্য মহাপ্রভুর অলৌকিক ভাবাবেশের বহু আগে থেকেই বৈষ্ণব। যবন হওয়া সত্ত্বেও হরিনাম কৃষ্ণনাম করার হিন্দুয়ানির জন্য মুসলমান প্রশাসকের হাতে তাঁকে মার খেতে হয়েছে বাজারে বাজারে। অদ্বৈত আচার্য এবং শ্রীবাস পণ্ডিতের ঘরে তিনি আগেই এসে জুটেছিলেন। নিমাই পণ্ডিত এখন তাঁকে নিযুক্ত করেছেন নাম-ধর্মের প্রচারে। অন্য ধর্মের মানুষ আমার ধর্মের ধ্বনিকে পরম সম্মানে আদর করছে—এই ঘটনা সাধারণ মানুষকে আত্মস্ফীত করে তোলে। ফলত নিত্যানন্দের সঙ্গে হরিদাস ঠাকুরের হরিনাম-প্রচারের যুক্তিটা অনেক বেশি লোকগ্রাহ্যই শুধু হয়ে ওঠেনি, তা একই সঙ্গে নিমাই পণ্ডিতের নেতৃত্বের বোধ জাগ্রত করে।

নদীয়ার সাধারণ মানুষকে ভক্তিধর্মে উজ্জীবিত করার প্রয়াসের মধ্যেই মদ্যপ জগাই-মাধাইয়ের সঙ্গে নিত্যানন্দ এবং হরিদাসের দেখা হয়। জগাই-মাধাইয়ের ভক্তিধর্ম গ্রহণের মধ্যে এক বিচিত্র রঙ্গ আছে। আসলে এমন আমার জীবনেই দেখেছি যে, সাধু-মহাপুরুষরা অনেক সময় বিপরীত স্থানে নিজের ধর্ম প্রচার করে থাকেন। এমনও দেখেছি যে, তাঁরা অভিপ্রেত মানুষটিকে নিজ ধর্মে শামিল করার জন্য তাঁর পিতা-মাতা, আত্মীয়-বন্ধুর তিরস্কার, গালি-গালাজ খাচ্ছেন। কিন্তু এমন অবস্থাতেও তাঁরা অবিচলিত থেকে অভিপ্রেত বিপরীতমুখী মানুষকেও নিজ ধর্মে দীক্ষিত করেছেন এবং পরবর্তীকালে সেই তিরস্কারী পিতা-মাতা, আত্মীয়-বন্ধুকেও আমি সেই ধর্ম গ্রহণ করতে দেখেছি।

জগাই-মাধাই ব্রাহ্মণের ঘরের ছেলে, তাদের পিতা-মাতাও যথেষ্ট ভালো, কিন্তু কুসঙ্গে পড়ে এদের মদ খাওয়া অভ্যাস হয়েছিল, মদের সঙ্গে মাংস এবং হয়তো গোমাংসও। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি করে তারা নিজেদের মদ খাওয়ার পয়সা তোলে। নিত্যানন্দ এবং হরিদাস গৌরাঙ্গ প্রভুর নির্দেশে সেদিনও বেরিয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর ভক্তিধর্মের বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য এবং সেদিন অদূরেই দেখা হয়ে গেল দুই মদ্যপের সঙ্গে। লোকের কাছে পরিচয় জিজ্ঞাসা করে নিত্যানন্দ জানলেন তাঁদের বংশপরিচয়। পিতা-মাতা, ভাই, বন্ধু এদের ত্যাগ করেছেন এবং ‘হেন পাপ নাহি না করে দুইজন।’ নিত্যানন্দ পাপী উদ্ধারের মানসে তাঁদের কাছে এগোতে চাইলে পাড়ার লোকজন তাঁকে বারণ করল—এরা মানুষকে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করে না। আর জেনে রেখো—তোমরা সন্ন্যাসী বলে কোনো রেহাই পাবে না, কীসের সন্ন্যাসী-জ্ঞান এই-দুইর ঠাঁই। নিত্যানন্দ হরিদাসকে বললেন—আমরা প্রভুর আজ্ঞা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি কৃষ্ণনাম প্রচার করার জন্য। আমাদের ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। অতএব চৈতন্য-প্রভুর আদেশ পৌঁছে দিয়ে নিত্যানন্দ দুই মদ্যপের সামনে গিয়ে বললেন—বলো কৃষ্ণ, ভজ কৃষ্ণ, লহ কৃষ্ণনাম।

কথা বলবার সঙ্গে-সঙ্গে নিত্যানন্দ হরিদাসের অদ্ভুত অবস্থা হল। জগাই-মাধাই ছুটল দুই সন্ন্যাসীকে তাড়া করে। ভয়ে দুজনেই ছুটলেন ঊর্ধ্বমুখে। সাধারণে বলল—আগেই নিষেধ করেছিলাম, আরা যারা চৈতন্যধর্মকে পাগলামি ভাবছিল, তারা বলল—দুই ভণ্ডের উচিত শাস্তি হয়েছে। হরিদাস-নিত্যানন্দ ছুটছেন, তাঁদের পিছনে পিছনে ছুটছে জগাই-মাধাই—তাদের শরীর স্থূল এবং কিছু মদের ঘোর রয়েছে বলেই তারা দুই সন্ন্যাসী ঠাকুরকে ধরতে পারছে না। কিন্তু ছুটতে-ছুটতে দুই সন্ন্যাসীর মধ্যে যে অন্তরঙ্গ কোন্দল শুরু হল—পরম বৈষ্ণবদের ঘরে আমি অনুরূপ গল্প নিজের কানে শুনেছি। নিত্যানন্দ হরিদাসকে বললেন—এমন কৃষ্ণনাম শুনিয়েছি দুই মাতালকে যাতে এরা ভয়ংকর বৈষ্ণব হয়ে উঠেছে, আজকে যদি প্রাণে বাঁচি, তবেই বাঁচলাম, নইলে তো শেষ। হরিদাস যখন বললেন—তোমার বুদ্ধিতেই আজকে আমার এই দশা, এমন চঞ্চল লোকের সঙ্গে মানুষ বেরয় কখনও। কী আর বলব—তুমি মাতালকে ধরে হরিনাম শোনাচ্ছ। আমি জেনেশুনে এমন চঞ্চল লোকের সঙ্গে এসেছি বলেই না আমার এই দশা—জানিঞাও আসি আমি চঞ্চল সহিতে।

অসাধারণ জবাব দিলেন নিত্যানন্দ, হয়তো এ-সব কারণেই বৈষ্ণবেরা তাঁকে ‘রঙ্গিলা ঠাকুর’ বলে ডাকে। নিত্যানন্দ বললেন—তুমি আমাকে কী চঞ্চল বলছ, তোমার প্রভু চৈতন্যের কথা বলো না একবার। তিনি তো সবচেয়ে বড়ো চঞ্চল মানুষ। আর তাঁর স্বভাবটাই বা কী। বামুন মানুষ, কোথায় একটু ভেবে-চিন্তে কথা বলবে। তা তো নয়—ভাবটা এমন, যেন রাজা এসেছেন কোথা থেকে, আমরা শুধু রাজার আদেশ পালন করে যাচ্ছি। তিনি বলেছেন, অতএব ঘরে ঘরে গিয়ে হরিনাম শোনাচ্ছি সবাইকে—লোকে তো আমাদের চোর আর ভণ্ড ছাড়া কিছু বলে না। তাঁর আদেশ মেনে লোকের গালি খাচ্ছি, আর আদেশ না মানলে, তাঁর গালি খাব। তাঁর আদেশে তুমিও তো মাতালের সামনে ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ বললে, আর এখন তুমি আমাকেই দুষছ কেন শুধু—

আপন প্রভুর দোষ না জানহ তুমি।
দুইজনে বলিলাঙ দোষভাগী আমি।।

নিত্যানন্দ প্রভুর মুখে চৈতন্য-মহাপ্রভুর প্রকৃত বৈশিষ্ট্যটি এখানে ফুটে উঠেছে। এখনও তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেননি, আমরা চৈতন্য বলে মাঝে-মাঝে তাঁকে ডাকছি বটে, কিন্তু এখনও তাঁর নাম চৈতন্য নয়। কিন্তু যেদিন থেকে কৃষ্ণপ্রেমের মাহাত্ম্যে তিনি বিহ্বল হয়েছেন, সেই আকুল বিহ্বলতাও কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব বিনাশ করেনি। তাঁকে কেউ অতিক্রম করতে পারে না। নিত্যানন্দের মুখে বৃন্দাবন দাসের ভাষাটা এইরকম—ব্রাহ্মণ হইয়া যেন রাজ-আজ্ঞা করে। নিত্যানন্দের রসিকতার মধ্যেও এই কথাটার একটা তাৎপর্য আছে। সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বে নিমাই পণ্ডিতকে আমরা যেভাবে পরিবর্তিত হতে দেখলাম—এই পরিবর্তনের মধ্যেও একটা তথ্য খুব সুস্পষ্টভাবে ধরা যায় যে, তিনি আপামর জনসাধারণের কাছে একটা সহজ বার্তা পৌঁছে দিতে চান এবং সে বার্তা হল—সমস্ত বাহ্য আড়ম্বর ত্যাগ করে কৃষ্ণের নাম কর। সাধারণের পক্ষে সেটাই সবচেয়ে বড়ো উপায়।

মদ্যপ জগাই-মাধাই নিত্যানন্দ এবং হরিদাস ঠাকুরকে ধাওয়া করে বহু দূর এসেছিল এবং এক সময় মদের ঘোরে আপন কর্তব্যে ক্ষান্তিও দিয়েছিল। সন্ন্যাসী-প্রায় নিমাই পণ্ডিতের কাছে নিত্যানন্দ আর্জি পেশ করেছিলেন—এই দুই মদ্যপকে কৃষ্ণনামে মাতাল করতে হবে। প্রভুর খানিকটা ক্রোধাবেশ হয়েছিল প্রাথমিকভাবে, কিন্তু তিনি অহিংসভাবে হরিনামের উচ্চারণেই মানুষকে নিজের পথে আনতে চেয়েছেন। তাঁর ইচ্ছার ফলশ্রুতি ঘটল দু-একদিনের মধ্যেই। গঙ্গার যে ঘাটে স্নান করতে যান মহাপ্রভু, সেই ঘাটের কাছে এসেই দুই মদ্যপ সাময়িক একটা আস্তানা নিয়েছিল। তারা এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়, নিজের শক্তিতে নানা অপকর্ম করে, আস্তে আস্তে সেই ঘাটে লোকজন কমতে লাগল। সন্ধে গড়িয়ে একটু রাত হলেই আর কেউ গঙ্গার ঘাটে যাওয়ার সাহস পায় না, যদি বা যায় দশ-পনেরো জন একসঙ্গে জড়ো হয়ে তবে যায়। আবার এমনই মজা, রাতের বেলায় তারা শ্রীবাসের বাড়ির কাছেই এসে জোটে—রাত্রিতে সেখানে কীর্তন হয়, মৃদঙ্গ-মন্দিরার তালে তালে তারা নাচতে থাকে মদের ঘোরে তাল মিলিয়ে। গান যত ভালো লাগে, তালে তারা তত বেশি নাচে, তত বেশি মদ খায়। মহাপ্রভুকে দেখলে আবার মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করে—তোমার বাড়িতে যে মঙ্গলচণ্ডীর গান হয়, তা তো তুমিই শেষ করেছ। বেশ লাগে তোমাদের গান। একবার গায়েনদের দেখতে ইচ্ছে হয়, তোমাদের এই মঙ্গলচণ্ডীর উৎসবে যেসব জিনিসপত্র লাগবে, আমরা এনে দেব। তুমি আমাদের জানাতে দ্বিধা কোরো না।

তখনকার সময়ে মঙ্গলচণ্ডীর গান, মনসার লোক-গান ছাড়া গানই ছিল না। রাত্রে শ্রীবাসের বাড়িতে হরিনাম-সংকীর্তনের বিচিত্র ধ্বনি, বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসের পদ, যা মাতালদেরও নাচিয়ে দিত, সেটা নৃত্যগীতের ক্ষেত্রে নতুন সংযোজন এবং সেটাও চৈতন্য-ধর্মের নতুন প্রবর্তনা। নিমাই পণ্ডিত এদের দেখলে পরে একটু একটু এড়িয়ে-এড়িয়ে চলেন, অন্য লোকেরা কাছাকাছিও থাকে না। সেইদিন একটু রাত হয়ে গিয়েছিল ফিরতে। নিত্যানন্দ তাঁর কীর্তনের দল-বল নিয়ে ফিরছেন একটু রাতে—গ্রামে-নগরে কীর্তন সেরে আসতে তাঁর দেরি হয়ে গেছে। রাতের আধা-অন্ধকারে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল জগাই-মাধাই দুই মদ্যপের। তারা জিজ্ঞাসা করল, ‘কে রে তুই?’ নিত্যানন্দ বললেন—আমি ‘অবধূত’। অবধূত কথাটার একটা গভীর গম্ভীর অর্থ আছে, এবং তা নিয়ে একটা বিচারও আছে। আমরা তার মধ্যে যাচ্ছি না। শুধু এইটুকু বলি—অবধূত এমন দরের সন্ন্যাসী, যিনি সন্ন্যাসীর নিয়ম-আচারও তেমন করে মানেন না। তিনি এতটাই উচ্চস্তরের মানুষ যে, এই মানা না-মানায় তাঁর সাধন-সিদ্ধিরও কোনো ক্ষতি হয় না। অথচ নিয়ম-আচার না মানার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁকে নিয়ে নানা সংশয়েরও সৃষ্টি হয়। এই না মানার পরিণামটা নিত্যানন্দ প্রভুর ক্ষেত্রে এতটাই যে নিত্যানন্দ প্রভু একটু বেশি বয়সে দু-দুটি বিবাহও করেছিলেন। যাক এসব কথা, অবধূত-সন্ন্যাসীর সম্ভাব হল—তিনি দেশে-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ান, দুই মদ্যপের একজন মাধাই সেই অর্থটা ধরে ভাবল—বাইরের লোক আবার এই নবদ্বীপে কেন! মাতালের ক্রোধে সে মাটির একটা ভাঙা পাত্র ছুঁড়ে মারল নিত্যানন্দের মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে ঝরে পড়ল রক্ত।

নিত্যানন্দ মহাপ্রভু গোবিন্দ-নাম স্মরণ করতে লাগলেন। কিন্তু একবারও মাধাইকে তিরস্কার করলেন না, কিংবা আত্মরক্ষার চেষ্টাও করলেন না। মাধাই আরও একবার আঘাত করবার জন্য ভাঙা মৃৎপাত্র তুলতে গেলে জগাই তাকে বারণ করল এবং ‘অবধূত’ শব্দের সাধারণ অর্থ করে বলল—বিদেশি ‘দেশান্তরী’ মানুষকে শুধু শুধু মেরে কী হবে? নিত্যানন্দ প্রভুর এমন রক্তাক্ত লাঞ্ছনার কথা প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে নিবেদিত হল গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর কাছে। তিনি অন্যান্য ভক্তদের নিয়ে তৎক্ষণাৎ পৌঁছলেন নিত্যানন্দের কাছে। নিত্যানন্দের মুখে এতটুকু কাতরতার চিহ্ন নেই, ভয়ংকর-বৃত্তি দুই মদ্যপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি হাসছেন। নিত্যানন্দের মাথার রক্ত দেখে প্রভুর আপাত একটা ক্রোধাবেশ হল বটে, কিন্তু নিত্যানন্দ যুক্তি দিলেন—মাধাই মদ্যপানজনিত মত্ততায় এমন কাজ করেছে, এটি তার ইচ্ছাকৃত নয়। বিশেষত জগাই তার ভাইকে বাধা দিয়েছে, এমতাবস্থায় এদের কারও ওপরেই রাগ করা যায় না।

জগাই এবং মাধাই—হয়তো বা কোনো কালে এদের ভালো দুটো নাম ছিল, হয়তো নাম ছিল জগন্নাথ এবং মাধব। দুঃসঙ্গে পড়ে এরা মাতাল এবং অসভ্যের চূড়ান্ত হয়ে উঠেছিল। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু এদের দুই জনকেই কৃপা করেছিলেন এবং দুই জনেই তাদের অসদবৃত্তি ছেড়ে পরম ভক্ত হয়ে উঠেছিল। চরিতকারেরা এই অসদুদ্ধার-কাহিনিতে নানান ভগবত্তার আবেশ দেখিয়েছেন বিশ্বম্ভর নিমাইয়ের মধ্যে এবং সেটা তাঁদের কথা, কিন্তু গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মাহাত্ম্য এইখানেই যে, পাপী-তাপী বা অসৎ বলেই তাকে ফেলে দেওয়া যাবে না, দূরে সরিয়ে রাখা যাবে না। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু এমন ব্যক্তিকেও নিজের সমাজে টেনে এনেছেন আপন আন্তরিকতায়, ভালোবাসায়। সঙ্গে-সঙ্গে জগাই-মাধাই গৌরাঙ্গ-নিত্যানন্দের কৃপায় কৃষ্ণপ্রেমে মূর্ছিত হল কি না হল—সেটা বিশ্বাসী ভক্তের ভক্তিরাগরক্ত চক্ষুর মহোৎসব, কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ যেটা বুঝি, সেটা হল—এই ঘটনা প্রমাণ করে মহাপ্রভুর কৃষ্ণপ্রেমের জগতে কেউ অচ্ছুৎ নয়, কেউ অবহেলার পাত্র নয়—সমাজবহির্ভূত অসভ্য মানুষও এখানে নিজের স্থান খুঁজে পায়।

সন্ন্যাসের পূর্ব সময়ের মধ্যেই মহাপ্রভুর এই ভক্তি-আন্দোলন সমস্ত রাঢ়ভূমি এবং বঙ্গভূমিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ব্যক্তিত্বশালী মানুষ গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর এই উদার ধর্ম গ্রহণ করায় জায়গাগুলি ভক্তি-আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। চরিতকারেরা অদ্ভুত একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন এই প্রসঙ্গে। বলেছেন—গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু নিজে তাঁর পার্ষদদের নিয়ে নবদ্বীপে জন্মালেন বটে, কিন্তু তাঁর অনেক প্রিয় ভক্তই দূরে অন্যত্র জন্মেছেন। যে সব দেশে গঙ্গা নেই, হরিনামের ধ্বনিও কোনোদিন শোনা যায়নি যেখানে, সেইসব ‘শোচ্য দেশে শোচ্য কুলে’ মহাপ্রভুর ‘আপন সমান’ ভক্তেরা জন্মেছিলেন। তার মানে শুধু গৌরাঙ্গ বিশ্বম্ভর নন, অন্যান্য জায়গাতেও এই উদার ভক্তি আন্দোলনের আধার তৈরি হয়েই ছিল। তাঁরা তাঁদের মতো করে এই ভক্তির পথ দেখাচ্ছিলেন সাধারণ মানুষকে। তাঁরা সকলেই যে উচ্চবর্ণজাত ব্রাহ্মণ কিংবা অভিজাত পুরুষ, তাও নয়। কিন্তু গৌরাঙ্গ-মহাপ্রভুর ব্যক্তিত্ব প্রকাশের সঙ্গে-সঙ্গেই ওইসব দঊরস্থিত ভক্তেরা তাঁদের সামনে নেতৃত্ব দেওবার মানুষটিকে পেয়ে গেলেন। চরিতকারের অবতারবাদী দৃষ্টিতে ব্যাপারটা এই রকম—

শোচ্য দেশে শোচ্য কুলে আপন সমান।
জন্মাইয়া বৈষ্ণব সভারে করে ত্রাণ।।
নানা স্থানে অবতীর্ণ হইলা ভক্তগণ।
নবদ্বীপে আসি সভার হইল মিলন।।
নবদ্বীপে হইব প্রভুর অবতার।
অতএব নবদ্বীপে মিলন সভার।।

সামাজিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিতে এতাবৎ গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর জীবন যদি লক্ষ্য করা যায়, তাহলে বলব সন্ন্যাস-পূর্বকালে তাঁর জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল—মুসলমান কাজির রাজনৈতিক প্রতিরোধের সামনে তাঁর সর্বাশ্লেষী ধর্মের উত্তরণ। একথা মানতেই হবে যে, প্রতিরোধ, বিরোধ, অপবাদ আরও একভাবে এসেছিল এবং তা এসেছিল প্রথমত সংরক্ষণশীল হিন্দু সমাজের মধ্যে থেকেই। মানুষ তো এমন চিরন্তনভাবেই আছেন যাঁরা নূতন অথচ উদার ধর্ম সহ্য করতে পারেন না বা পারেননি। তাঁরা নিমাই পণ্ডিত এবং তাঁর পার্ষদগণের মুখে হরিনামের ধ্বনি শুনেই নানা কথা বলেছেন, এবং তৈলবাজ লোকও তাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন, যাঁরা ভেবেছিলেন যে ঘটনাটা মুসলমান শাসকের গোচরে আনা দরকার।

প্রথম দিকে তারা গুজব রটাত। কেননা ভিনদেশি শাসক সম্বন্ধে যে সংশয় ছিল, সেই সংশয় থেকেই গুজব রটিয়ে বলত—এই ব্যাটা শ্রীবাসের জন্যই দেশটা উচ্ছন্নে যাবে। শ্রীবাসের বাড়িতেই যেহেতু রাত্রিভর কীর্তনানন্দ চলত, অতএব দুই-একজন আরও একটু বাড়িয়ে বলল—এই তো সেদিন রাজদরবারে গিয়েছিলাম, সেখানে দেওয়ান-ঘরে শুনলাম—এইসব কীর্তনের খবর তাদের কানে পৌঁছেছে। রাজার নৌকা আসছে শ্রীবাসকে ধরে নিয়ে যাওবার জন্য। আর এক উৎসাহী বলল—আমি আগেই বলেছিলাম—এই বিপদটা হবে। আরে ওই শ্রীবাস ব্যাটার আর কি! যাবে একদিকে পালিয়ে, কিন্তু আমাদের সর্বনাশ করে দিয়ে যাবে। তখন অনেক করে বলেছিলাম—ওই শ্রীবাসের ঘরদোর ভেঙে গঙ্গায় ফেলে দাও, তখন শোনোনি কথা, ভেবেছিলে ঠাট্টা করছি, এখন বোঝো মজা। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হল—নিতান্তই যদি মুসলমান শাসকের পেয়াদা আসে দোষীজনকে ধরতে, তাহলে শ্রীবাসকে আমরাই ধরে তার হাতে দিয়ে দেব—

কেহ বোলে আমরা সভের কোন দায়।
শ্রীবাসে বান্ধিয়া দিব যেবা আসি চায়।।

কথাটা বেশ চাউর হয়ে গেল যে, রাজার নৌকা আসছে শ্রীবাসকে ধরতে। অন্য ভক্তজনেরা খুব একটা ভয় পেলেন না—হয়তো এই কারণেই যে, তাঁদের বাড়িগুলো সংকীর্তনের কেন্দ্র হয়ে ওঠেনি শ্রীবাসের বাড়ির মতো। কিন্তু সরল-হৃদয় শ্রীবাস নবদ্বীপের রটনা বিশ্বাস করলেন একটু-একটু। মনে মনে তাঁর ভয়ও হল। ভাইরা, স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়স্বজন এবং বৈষ্ণবদের সঙ্গতে শ্রীবাসের বাড়ি এখন যেভাবে চলছে, তাতে শাসকের পেয়াদা এলে তাঁর বিপদ বাড়বে। তিনি একটু ভয়ই পেলেন—কেননা শাসক ভিন্নধর্মী মুসলমান, একবার তাঁর ওপর অবিশ্বাস জন্মালে তাঁর ওপরে কোনো মায়া থাকবে না—যবনের রাজ্য দেখি মনে হইল ভয়।

শ্রীবাস পণ্ডিতের বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য চরিতকার বৃন্দাবন দাস এখানে বিশ্বম্ভর মহাপ্রভুর অবতার-সত্তা প্রকাশ করেছেন। সেটা একান্ত বিশ্বাসের ব্যাপার। কিন্তু সেই বিভূতিতে বিশ্বাস না করলেও প্রভুর বক্তব্য বলে চরিতকার যা নিবেদন করেছেন, তা থেকে আর কিছু না হোক, তাঁর ক্রিয়া-কর্ম পদ্ধতি তথা তাঁর কার্যকরী ব্যক্তিত্বটুকু ঠিক বোঝা যায়। সংকীর্তন-রঙ্গের হোতা হিসেবে তিনি নিজের বিশ্বাসকে শ্রীবাসের দায় বলে এড়িয়ে যাননি। তিনি বলেছিলেন—শাসকের নৌকো যদি শ্রীবাসকে ধরতে আসে তবে—মুঞি গিয়া সর্ব আগে নৌকায় চঢ়িমু। আপন ধর্ম-সাধন-পদ্ধতির ওপর গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর এতটাই বিশ্বাস যে, তিনি মনে করেন—পৃথিবীর অতি ক্রুর-নৃশংস মানুষও তাঁর ভক্তিবাদী রসায়নে মোহিত হবে। শ্রীবাসকে তিনি বলেছেন—আমাকে যদি রাজা একবার দেখেন, তাহলে তিনি নৃপাসনে বসেই থাকতে পারবেন না। তাঁকে আমি আমার কৃষ্ণনামের মহামন্ত্রে বিহ্বল করে তুলব। তারপর মুসলমান প্রশাসকের উদ্দেশে তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বললেন—তোমার মোল্লা-কাজি সবাইকে ডেকে আনো এখানে, ডেকে আনো তোমার হাতি-ঘোড়া, পশু-পক্ষী যত আছে। এবার মোল্লা-কাজিদের আদেশ দাও—তারা নিজেদের শাস্ত্র উচ্চারণ করে কাঁদাক সবাইকে—

শুন শুন অয়ে রাজা সত্য মিথ্যা জান।
যতেক মোল্লা কাজী সব তোর আন।।
হস্তী ঘোড়া পশুপক্ষী যত তোর আছে।
সকল আনহ রাজা আপনার কাছে।।
এবে হেন আজ্ঞা কর সকল কাজীরে।
আপনার শাস্ত্র বলি কান্দাউ সভারে।।

গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু বুঝেছিলেন যে, তাঁর ভক্তিধর্ম শুধুমাত্র উপদেশ-সার নীতিকথা নয়। ধর্মপালনের মধ্যে যে শাস্ত্রীয় বাধ্যতা থাকে, সেই বাধ্যতার মধ্যে যে শুষ্কতা থাকে, চৈতন্য-প্রবর্তিত ভক্তিধর্মে সেই বাধ্যতা, শুষ্কতা নেই। হরিনামের বিধি-মন্ত্র ভক্তিকে কীভাবে রসে পরিণত করে তা এখানে দেখানোর উপায় নেই, কেননা সেই রসশাস্ত্রসম্মত বিচার এত অল্প পরিসরে বোঝানো কঠিন। কিন্তু ভক্তি এবং শরণাগতির ফলে ভক্তের মধ্যে যে রসায়ন ঘটে, সেটা এমনই এক অবধারিত সহজ পরিণতি, যেটা মহাপ্রভুর মতো আভ্যুদায়িক ব্যক্তিত্বের পক্ষে প্রকট করাটা কোনো কঠিন কাজ নয়। মহাপ্রভু শ্রীবাসকে বলেছিলেন—

রাজার যতেক গণ রাজার সহিতে।
সভা কান্দাইমু কৃষ্ণ বলি ভাল মতে।।

শ্রীবাস মহাপ্রভুর কথায় আশ্বস্ত বোধ করেছিলেন এবং স্থানীয় মানুষজনও যেসব হুমকি দিয়েছিল, তেমন কোনো রাজভয় নেমে আসেনি মহাপ্রভুর কীর্তন-সম্প্রচারে। বেশ কিছু দিন এমনই চলেছিল এবং নবদ্বীপে ভক্তিধর্মের প্রতিষ্ঠা ঘটে গিয়েছিল অত্যল্পকালের মধ্যেই। কীর্তনের প্রচার যত বাড়তে লাগল, ততই অবশ্য সংশয় সৃষ্টি হচ্ছিল অবিশ্বাসীর মনে। বিশেষত শ্রীবাসের রুদ্ধদ্বার গৃহে সারা রাত ধরে যে কীর্তন চলত, তাতে সন্দেহ পোষণ করার জন্য মুসলমান কাজির প্রয়োজন ছিল না, কোটালের শক্তিপ্রয়োগের আগে হিন্দুদের কোটনামি এবং নালিশি স্বভাব সেখানে অনেক বেশি সক্রিয় ছিল। শ্রীবাসের বাড়িতে মহাপ্রভু যে কীর্তনানন্দে মেতেছিলেন, অবিশ্বাসী পড়শিদের মুখে তার ব্যাখ্যা ছিল এইরকম—কেউ বলত আরে এগুলো সব খায়, মাছ-মাংস-গোমাংস সব খায়, দেখতে পেলে যদি ওই ভণ্ডামি ধরে ফেলি, তাই দরজা খোলে না কখনও। অন্যজন বলে—এক্কেবারে সত্যি কথা বলেছ, এসব না খেলে গায়ে এত শক্তি আসে কোত্থেকে, অষ্টপ্রহর নাম করতে শক্তি লাগে ভায়া। আরও কুৎসিত মন্তব্যও বাদ গেল না। কেউ বলল—’আরে ভাই মদিরা আনিয়া। সভে রাত্রি করি খায় লোক লুকাইয়া।’

নিমাই পণ্ডিতদের সম্বন্ধে এসব লোকের ধারণা খারাপ ছিল না, কিন্তু এখন খারাপ হয়েছে। তাদের ধারণা—সঙ্গদোষে পণ্ডিতের আজ এই অবস্থা। তার বাপটাও নেই যে তাকে শিক্ষা দিয়ে আগলে রাখবে, তার মধ্যে আছে বায়ু রোগের প্রকোপ, যার জন্য সব গেছে, নইলে দেখ, আগে এত চর্চা করত, এখন বইয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। পুঁথিতে হাতও ছোঁয়ায় না, আরে এক মাস ব্যাকরণ না পড়লে লোকে সব ভুলে যায়, সেখানে এত দিন হয়ে গেল শুধু কীর্তন করে বেড়াচ্ছে। আর নিম্নমানের মানুষেরা যুক্তি দিল—আমরা দরজা বন্ধ করে কীর্তন করার রহস্যটা বুঝে গেছি। আসলে এরা হল সব নিম্নশ্রেণির তন্ত্রসাধক। রাতের বেলায় মেয়েছেলে নিয়ে আসে, তার সঙ্গে— ‘ভক্ষ্য ভোজ্য গন্ধ মাল্য বিবিধ বসন। খাইয়া তা সভা সঙ্গে বিবিধ রমণ। ভিন্ন লোক দেখিলে, না হয় তার সঙ্গ। এতেক দুয়ার দিয়া করে নানা রঙ্গ।’ মহাপ্রভুর এই রুদ্ধদ্বার কীর্তনানন্দের অন্য রহস্য নিশ্চয়ই আছে, তবে সে রহস্যও সাধারণ মানুষকে বোঝানো কঠিন। আসলে সিদ্ধ মহাপুরুষদের বিচিত্র স্বভাব থাকে, তাদের সাধনসিদ্ধ সাত্ত্বিক ভাব-বিকারগুলি অশ্রু, কম্প, পুলকাদি সাধারণের চোখে বিকারগ্রস্তের মতোই লাগে। মহাপ্রভু নিজের এই বিকারগুলি জনসমক্ষে প্রকট হোক চাননি, প্রকট করতে চাননি তাঁর বিভূতিময়ী সত্তা। অতএব রুদ্ধদ্বার কীর্তনের জন্য ব্যাখ্যা হল নানারকম এবং সেই ভয় দেখানো আবার শুরু হল—আমরা রাজদরবারে নালিশ জানাব। তারপর দেওয়ানের লোক এসে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাবে—

কেহ বোলে কালি হউ যাইব দেয়ানে।
কঁকালি বান্ধিয়া সব নিজ জনে জনে।।

এতসব হুমকি, মনের মধ্যে নানারকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব সত্ত্বেও মানুষ যে রাজদরবারে মহাপ্রভুর সংকীর্তন-বিলাস নিয়ে কোনো স্পষ্ট নালিশ জানিয়েছিল, তা মনে হয় না। তবে শ্রীবাসের ঘরে যে সংকীর্তন চলছিল দিনের পর দিন, তাতে সকলের একটা সংশয় ছিল যে, এই কারণে একদিন যবন শাসকের কোপে পড়বে নবদ্বীপ—অন্যথা যবনে গ্রাস করিবে কবল।

যবন শাসকের কোপ হওয়ার অনুকূল ঘটনা যেটা ঘটল, সেটা যুক্তিতর্কের মধ্যে আসে না খুব, তবু সেটা ঘটল। মহাপ্রভুর সংকীর্তন-ভাবনা ততদিনে শ্রীবাসের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ যেমন শ্রীবাসের বাড়ির রহস্য-কীর্তন নিয়ে অনর্থক অপবাদ তৈরি করেছে, তেমনই অনেক মানুষের দুঃখও ছিল যে, তাঁরা মহাপ্রভুর কীর্তনানন্দের নাগাল পাচ্ছেন না। অনেকেই তখন দিনের বেলায় মহাপ্রভুর সঙ্গে দেখা করতে আরম্ভ করল। তাঁর এমনই ব্যক্তিত্ব, এমনই দিব্য আবেশ যে তাঁকে দেখলেই মাথা নুয়ে আসে সহজে। প্রভু তাদের আদেশ করেন—কৃষ্ণভক্তি, কৃষ্ণগুণগান ছাড়া তোমাদের উপদেশ দেওয়ার মতো কিছু নেই আমার। তোমরা দশে-পাঁচে মিলে নিজের ঘরে বসে কলিকালের মহামন্ত্র কৃষ্ণনাম জপ কর। এই নাম করতে-করতেই তোমাদের সিদ্ধি হবে।

প্রভুর এই কথা অসামান্য ফলেছিল। হরিনাম সংকীর্তন শ্রীবাসের অঙ্গন ছেড়ে নবদ্বীপের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল। সন্ধ্যা হলেই ঘরে ঘরে কীর্তন আরম্ভ হয়ে যায়। মৃদঙ্গ, মন্দিরা, শঙ্খ যা নৈমিত্তিক দুর্গোৎসবের বাদ্য ছিল, তার নিত্য ব্যবহার আরম্ভ হল নগরে নগরে গ্রামে গ্রামে। মাঝেমধ্যেই প্রভুর সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়, তিনি কখনও বিনয়ে নম্র হয়ে, কখনও বা তাদের আলিঙ্গন করে বলেন—’অহর্নিশ ভাই সব বোলহ কৃষ্ণেরে’— দিন রাত হরিগুণ গান কর, কৃষ্ণের নাম কর। এত সহজে এই বিধানের মধ্যে যেহেতু স্মার্ত আচারের গোঁড়ামি নেই, বৈদান্তিক জ্ঞানের তাত্ত্বিকতা নেই, অতএব সাধারণ সর্বস্তরের মানুষ এমনভাবেই চৈতন্যের ধর্মে শামিল হল, যেটা বহির্মুখ সামাজিক জনের কাছে অনভীষ্ট পরিহাসের বিষয় হয়ে উঠল। একটু উদাহরণ দিয়ে বলি—

একদিন প্রভুর প্রিয় ভক্ত শ্রীধর যাচ্ছেন রাস্তা দিয়ে। শ্রীধরের কোনো সামাজিক কৌলীন্য নেই, অর্থ-প্রতিপত্তি নেই, তিনি নবদ্বীপের বাজারে থোড়া-মোচা-কলা বেচে সংসার প্রতিপালন করেন। তিনি মহাপ্রভুর অসীম কৃপালাভ করেছেন, কাজেই সামাজিক কৌলীন্যহীন মানুষ হলেও ভক্ত-বৈষ্ণবেরা তাঁকে অন্য চোখে দেখেন। একদিন তিনি রাস্তা দিয়ে আসছেন উচ্চৈচঃস্বরে হরিনাম করতে-করতে। তাঁর এই ভাব-বিহ্বল হরিনাম শুনে রাস্তায় বেশ কিছু লোক জুটে গেল, তারা কীর্তন করতে করতে নাচতে লাগল শ্রীধরের সঙ্গে। নাগরিক মানুষের এমন পরিবর্তন দেখে শ্রীধর মহাপ্রভুর কৃপা স্মরণ করে ভাববিহ্বলতায় মাটিতে গড়াগড়ি দিতে থাকলেন। বহির্মুখ অবিশ্বাসী জনেরা এ-দৃশ্য দেখল এবং পরিহাস করে বলতে আরম্ভ করল—কী দিন এল! খোলা-বেচা মিনসেও ‘ভাব’ দেখাচ্ছে। ব্যাটার পেটে ভাত নেই, খেতে পায় না, সেও আজকে বৈষ্ণব হয়ে ভাব দেখাচ্ছে—হের ভাই সব!

খোলা বেচা মুনিসাও হইল বৈষ্ণব।।
পরিধান-বস্ত্র নাহি পেটে নাহি ভাত।
লোকেদের জানায় ভাব হইল আমাত।।

এই সামান্য ঘটনা উল্লেখ করে আমি দুটি কথা বোঝাতে চাইছি। প্রথমত, নবদ্বীপের রাস্তায়-রাস্তায় এখন কীর্তন আরম্ভ হয়েছে এবং নগরের অন্যান্য সাধারণ মানুষ এখন সহজেই চৈতন্য-প্রবর্তিত কীর্তন-গানে শামিল হন। অন্যদিকে এই ধর্মের প্রতি তথাকথিত সামাজিক সুসভ্য জনের কদর্থনা আছে। চরিতকার এঁদের চিহ্নিত করেছেন ‘হিন্দু কাজি’ বলে—যারা নাকি হিন্দু সমাজের মধ্যে থেকেও আপন সামাজিক উচ্চতা-বোধে চৈতন্যের কদর্থনা করে যাচ্ছেন— হিন্দু-কাজি সব আরও মারে কদর্থিয়া—বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড় এই নিয়মে রাজ-দরবারে যারা তৈল-নিষেক করে যাচ্ছিলেন তারা মুসলমান কাজির চেয়েও বেশি ভাবনা প্রকট করেছিলেন। ঘটনাটা এইভাবে ঘটল—

একদিন নবদ্বীপের সাধারণ মানুষেরা অনেকে একত্র হয়ে রাস্তা দিয়ে কীর্তন করতে-করতে চলেছিল এবং দৈবাৎ নগর-শাসক মুসলমান কাজির কানে মৃদঙ্গ-মন্দিরা-শঙ্খের শব্দ ভেসে এল। নবদ্বীপের নিমাই পণ্ডিতের কথা মাঝে মাঝে তাঁর কানে আসছিল বটে, তবে তাতে প্রশাসনের কোনো বিরুদ্ধতা ছিল না দেখে তিনি এতদিন চুপচাপ ছিলেন। কিন্তু এবার তিনি প্রত্যক্ষ দেখলেন—বহু লোক একত্রে সমবেত হচ্ছে নগরের মধ্যে, তারা প্রশাসনের কোনো বিরোধিতা করছে না বটে, তবে নগরের যত্রতত্র এমন মনুষ্য-সমবায় কোন দিন কোন চেহারা নেবে, সেটা ভিন্নধর্মী প্রশাসকের মনে একটা সংশয় তৈরি করে রাখবে অবশ্যই। কাজি কীর্তনমত্ত জন-সমূহের ওপর চড়াও হলেন লোকজন নিয়ে। মাঝে-মাঝে ক্রোধ-হুংকার ছাড়তে আরম্ভ করলেন— আজি কি বা করে তোর নিমাঞি আচার্য।

কাজির ভয়ে সাধারণ মানুষজন অনেকেই পালিয়ে গেল। কীর্তনরত বৈষ্ণবদের খোল-মৃদঙ্গ অনেকগুলি ভেঙে দিলেন কাজি এবং বেশ কিছু লোককে তিনি মারধরও করলেন—

যাহারে পাইল কাজি মারিল তাহারে।
ভাঙিল মৃদঙ্গ অনাচার কৈল দ্বারে।।

আসলে মুসলমান কাজির পক্ষে এটা বোঝা সম্ভব ছিল না যে, এটা কোনো ‘হিন্দু আপরাইজিং’ নয়। বিশেষত এতদিন তিনি শাসন-কার্যে নিযুক্ত আছেন এবং নবদ্বীপকে এতদিন যেভাবে তিনি চিনেছেন তাতে বিদ্যাচর্চা, ধর্মচর্চা সবটাই ঘরের মধ্যে ব্যক্তিগত স্তরে সংঘটিত হতে দেখেছেন। নগরের রাস্তায় এমন হরিনাম-সংকীর্তন, সাধারণ মানুষের মধ্যে চৈতন্য-ধর্ম নিয়ে এমন মাতোয়ারা ভাব—এটা তিনি কখনও দেখেননি, আর দেখেননি বলেই তাঁর মনে একটা দুর্ভাবনা সৃষ্টি হল যে, ভবিষ্যতে এই মনুষ্য-সমবায় শাসকের বিরুদ্ধে সংগঠিত না হয়। তাঁর মনে হল—সাধারণ মানুষ হিন্দুয়ানিতে মেতেছে এবং এমন হিন্দুয়ানি চলতে থাকলে তিনি জাতমারা করে ছাড়বেন হিন্দুদের। তাঁর সুস্পষ্ট হুংকার শোনা গেল নবদ্বীপের রাস্তায়—

কাজি বোলে হিন্দুয়ানি হইল নদীয়া।
করিমু ইহার শান্তি নাগালি পাইয়া।।
ক্ষমা করি যাঙ আজি দৈবে হৈল রাতি।
আর দিন লাগি পাইলে লৈব জাতি।।

কাজি প্রাণে মারবেন না, জাতি মারবেন— এই সামাজিক-মৃত্যুর ভয় নবদ্বীপবাসীকে আক্রান্ত, আচ্ছন্ন করে রাখল বেশ কয়েকদিন। বেশ কয়েকদিন কাজি তার দলবল নিয়ে নগরে-নগরে ঘুরলেন কিন্তু কোথায় কীর্তন, কোথায় মৃদঙ্গ-মন্দির-শঙ্খ! চৈতন্য-ভক্তের কীর্তন-রঙ্গ বন্ধ হয়ে রইল কয়েকদিন। শাসকের তল্পিবাহক ‘হিন্দু-কাজি’রা বলতে লাগল—বেশ হয়েছে। হরিনাম মনে-মনে করলে হচ্ছে না, এত হুড়াহুড়ি করে এত নাচন-কোঁদন করে হরিনাম করার কথা কোন শাস্ত্রে বলে! এদের কি জাত খোয়াবার ভয়টাও নেই—লঙ্ঘিবে বেদের বাক্য এই শাস্তি হয়। জাতি করিয়াও এ-গুলোর নাহি ভয়। তাঁরা চৈতন্য-নিত্যানন্দের উদ্দেশ্যেও কটূক্তি করতেও ছাড়ল না। বলল—এবার নিমাই পণ্ডিত বুঝবে—কাজির বাড়িটা কেমন লাগে। আর ওই যে নিত্যানন্দ—সময়-অসময় নেই নগরে-নগরে কীর্তন করে বেড়াচ্ছে, এবার সে বুঝবে ঠ্যালা—দেখো আর কোনো দিন বাহিরায় রঙ্গ।

মহাপ্রভু গৌরাঙ্গের কাছে আবেদন-নিবেদন-সংবাদ এল—নগরে নগরে কীর্তন বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিদিন লোকজন নিয়ে কাজি নজর রাখছে কীর্তনীয়া বৈষ্ণবদের ওপর। সব শুনে মহাপ্রভুর কিঞ্চিৎ ক্রোধাবেশ হল বটে, তবে রাগ করে তিনি যেটা করতে চাইলেন, সেটাকে একটা সামগ্রিক বিপ্লব বলা চলে। সাধারণ মানুষকে একত্রিত করে সেই সংহত শক্তির মাধ্যমেই যে শাসক-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চরম প্রতিবাদ হানা যেতে পারে, সেটা প্রথমে করে দেখালেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য। তবে তাঁর এই প্রতিবাদের মধ্যে হানাহানি ছিল না, ছিল না সর্বনাশা আক্রমণ—যা সংঘশক্তিকে বর্বরোচিত করে তোলে।

চৈতন্য আদেশ দিলেন নিত্যানন্দ প্রভুকে—কেননা নগর কীর্তনের তিনিই প্রধান সূত্রধার। চৈতন্য বললেন—তুমি এই নবদ্বীপ-মণ্ডলের সবার ঘরে, সমস্ত বৈষ্ণবের কাছে গিয়ে বলবে যে, আমি নগর-সংকীর্তন করতে-করতে কাজির বাড়িতে যাব— সর্ব নবদ্বীপে আজি করিমু কীর্তন। ক্রোধাবেশে এমন কথাও তিনি বললেন যে, আজ আমি পুড়িয়ে দেব কাজির ঘর-বাড়ি, দেখি কে কোথায় শাসক আছে আমাকে বাধা দেয়। আমার আদেশে আজ তুমি সবাইকে জানাবে—আজকে যারা কৃষ্ণের শক্তি দেখতে চায়, তারা যেন প্রত্যেকে এক-একটি বড় প্রদীপ জ্বালিয়ে নিয়ে আমার এখানে আসে। সকলেই দ্বিপ্রহরের খাওয়া-দাওয়া সারবে তাড়াতাড়ি এবং বিকেল হওয়ার আগেই উপস্থিত হবে আমার কাছে—বিকালে আসিবে ঝাট করিয়া ভোজনে।

মহাপ্রভুর এই বার্তা মুহূর্তের মধ্যে রটে গেল সর্ব নবদ্বীপে। অনেকে দ্বিপ্রহরের ভোজন বাদ দিয়ে দিল, বিশালাকার প্রদীপ বানিয়ে নবদ্বীপের নগরিয়া জন একে একে উপস্থিত হতে আরম্ভ করল মহাপ্রভুর আঙিনায়—নিমাঞি পণ্ডিত আজি নগরে নগরে। নাচিবেন ধ্বনি হৈল প্রতি ঘরে ঘরে। মহাপ্রভু বলেছিলেন—’মহাদীপ’ নিয়ে আসবে প্রত্যেক মানুষ। এ কিন্তু মাটির প্রদীপ নয়, এ হল মশাল। মহাপ্রভুর নির্দেশ পাওয়া মাত্র ঘরে ঘরে মশাল বাঁধা শুরু হয়ে গেল— বাপও মশাল বাঁধছে ছেলেও মশাল বাঁধছে। কেউ বড়ো বড়ো করে মশাল বাঁধছে, কেউ বা একটার জায়গায় দশটা বাঁধছে এবং সেই মশালের তৈলপুর ফুরিয়ে গেলে যাতে পুনরায় তেলে চুবিয়ে জ্বালানো যায়, তার জন্য বড়ো বড়ো ভাণ্ডও নেওয়া হল—

তা বড় তা বড় করি সভেই বান্ধেন।
বড় বড় ভাণ্ডে তৈল করিয়া লয়েন।।

দ্বিপ্রহরের পর থেকে মহাপ্রভুর বাড়িতেও সাজ-সাজ সব পড়ে গেল। নগর-সংকীর্তনের সময় যাঁরা কীর্তন করতে-করতে যাবেন, তাঁদের কে আগে যাবেন, কে পিছনে, কে মাঝখানে কিংবা কার সঙ্গে কে-কে থাকবেন এসব সম্বন্ধে একটা দলবিভাগের ভাবনা প্রকাশ করলেন মহাপ্রভু নিজে। আসলে যাঁরা এসব দেখেননি, কোনো সম্প্রদায়ের ভিতর থেকে যাঁরা এগুলো বোঝেননি তাঁদের পক্ষে এই বিভাগ বোঝা খুব কঠিন। আমি ছোটোবেলা থেকে যেহেতু বহু শুদ্ধ বৈষ্ণবের আখড়া দেখেছি, বহু কীর্তন শুনেছি, সেই সুবাদে বলতে পারি— এ এক বিচিত্র অনুভব। এমন দেখেছি— এক-একজন মধুর কীর্তনীয়া তাঁর সমুচিত দোহারফির অভাবে, সঙ্গতের অভাবে, সহকারীর অভাবে তেমন করে গাইতে পারেন না। এমন দেখেছি— যিনি রাতের গভীরে অসাধারণ কীর্তন করেন, তিনি সন্ধ্যারতি-কীর্তনের সময়ে একেবারেই স্তিমিত। এমন দেখেছি—যিনি একজনের সঙ্গে মৃদঙ্গের বোল ছোটাতে পারেন, আরেকজনের গায়েনের সঙ্গে তিনি অতি সাধারণ। জেনে রাখুন—এই সব কিন্তু শ্রাদ্ধ-বাড়িতে অথবা অর্ডারি অষ্টপ্রহরে ভাড়াটে কীর্তন গানের কথা বলছি না— এসব আমার মান্য বৈষ্ণব-স্থানে দেখা-শোনা অনুভবসিদ্ধ কথা। আসলে মানুষের ব্যক্তিগত সুরজ্ঞান, তালজ্ঞান, চরিত্র, ভাব-অনুরাগ এবং সংস্কার বিশেষত বৈষ্ণবীয় সংস্কার—এগুলি সব একত্র হয়ে তাঁর সহকারী, অনুকারী তৈরি করে ফেলে। দিনের পর দিন কীর্তন, অসচেতন প্রয়াস পরীক্ষা এবং ভুল, রাতের পর রাত তেমন সঙ্গীর সঙ্গ— এই সমস্ত কিছুই সম্মিলিত কীর্তনের অভিপ্রেত সম্প্রদায় সৃষ্টি করে ফেলে।

মহাপ্রভু বললেন—কাজির কাছে যাওয়ার জন্য বিরাট কীর্তনের দল বেরবে, তাতে ‘আগে নৃত্য করিবেন আচার্য গোঁসাই’ এবং তার পিছনে একটি কীর্তনের সম্প্রদায় থাকবে। অর্থাৎ অদ্বৈত আচার্য যাবেন সবার সামনে—চৈতন্য গোষ্ঠীর তিনিই বৃদ্ধতম ব্যক্তি, তিনি চৈতন্য ধর্মের চৈতন্য-পূর্ব প্রকাশ, অতএব তিনি সবার আগে যাবেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের এমন কীর্তন-রঙ্গের অগ্রভাগে এমন বৃদ্ধ আচার্যকে কত দেখেছি—তাঁরা যে সব সময় খুব ভালো কীর্তন গান করেন অথবা উদ্বাহু নৃত্য করেন, তাও নয়। কিন্তু তাঁর সম্মান, তাঁর মর্যাদা এবং গুরুত্ব তাঁকে অগ্রবর্তী করে। আজকে মহাপ্রভুর এই নগর-সংকীর্তনে মাঝখানে এক বিরাট দল নিয়ে থাকবেন ঠাকুর হরিদাস। এরও কারণ আছে। ঠাকুর হরিদাস নিজে মুসলমান গোষ্ঠীর মানুষ, তাঁকে নিয়ে আগে অনেক তর্ক-বিতর্ক, অত্যাচার, নিপীড়ন হয়ে গেছে। আপন ধর্ম ছেড়ে হরিনাম মুখে আনার জন্য শাসকের ক্রোধাগ্নি আত্মসাৎ করতে হয়েছে তাঁকে। পর পর বাইশটি বাজারে নিয়ে গিয়ে সবার সামনে তাঁকে বেত্রাঘাত করেছে প্রশাসনিক রাজপুরুষ। তবু তাঁকে নিজের অভীষ্ট থেকে ভ্রষ্ট করা যায়নি।

মহাপ্রভু হরিদাসকে মাঝখানে রেখে একদিকে কাজিকে ইঙ্গিতে বোঝাবেন যে, ধর্মপালনের অধিকার, ধর্ম-পরিবর্তনের অধিকার মানুষের একান্ত নিজস্ব এবং ধর্মের অন্তর্গত সার ঈশ্বরানুভূতির আনন্দ শাসকের নিপীড়ন অতিক্রম করেও বেঁচে থাকে এবং থাকবে। হরিদাসকে মাঝখানে রেখে নবদ্বীপের সংরক্ষণশীল স্মার্ত সমাজের মুখেও সম্মার্জনীর আঘাত ঠুকে দিলেন মহাপ্রভু। বুঝিয়ে দিলেন—এতদিন এই ছিল যে, হিন্দু জন-জাতির মানুষ খুঁটিনাটি নানা কারণে সমাজচ্যুত হত এবং একবার সমাজচ্যুত হলে হিন্দুধর্মে তার আর প্রবেশ-পথ থাকে না। চৈতন্য-ধর্মে এমন হবে না, সূর্য-চন্দ্রের আলোক-বিকিরণ যেমন শূদ্র-চণ্ডালের জাতি-তত্ত্ব বুঝে বিকীর্ণ হয় না, তেমনই চৈতন্যধর্মও এই বাহ্য জাতিসংস্কার নিয়ে বিব্রত নয়, এখানে সবার স্থান আছে—তাঁদের সাধারণ-সামান্য ধর্ম হল হরিনাম-সংকীর্তন। আচার-বিচারের বালাই নেই, জাতি-বর্ণের বালাই নেই, উত্তম-অধমের ভেদ বিবেক নেই, এমনকী অন্য ধর্মীরও প্রবেশ আছে এখানে। হিন্দু-সংরক্ষণশীলতায় তিনি যেমন বিচার্য হোন-চৈতন্য বুঝিয়ে দিলেন— তাঁর কাছে যবন হরিদাস শুধু হরিনামে সিদ্ধ বলেই আজকের সংকীর্তন-যজ্ঞের মধ্যমণি। তাঁর আদেশ—

মধ্যে নৃত্য করি যাইবেন হরিদাস।
এক সম্প্রদায় গাইবেন তান পাশ।।

অর্থাৎ যবন হরিদাস মাঝখানে থাকবেন, আর তাঁর পিছনে অনুগামী হয়ে কীর্তন করবেন হিন্দু-কীর্তনীয়ার বিরাট এক দল। সবার পিছনে শ্রীবাস পণ্ডিত— যাঁর বাড়িতে মহাপ্রভুর প্রথম আত্মপ্রকাশ, যাঁকে এতকাল লোকে রাজনৈতিক শাসকের ভয় দেখিয়েছে এবং যিনি অনেক উপরোধ সহ্য করেও চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণবমণ্ডলীকে নিজের ঘরে ‘আঁতুড়’ তোলার মতো করে আশ্রয় দিয়েছেন। তাঁকে আজকের নগরকীর্তনের পুচ্ছভাগে দাঁড় করিয়ে দিয়ে মহাপ্রভু বুঝিয়ে দিলেন—শ্রীবাস পণ্ডিত চৈতন্য-সংগঠনের শেষ দুর্গরক্ষক। হয়তো এই কারণেই চরিতকার এই নগর-কীর্তনের সংস্থানকে মহাপ্রভুর অঙ্গ উপাঙ্গ পরিষদ-বর্গকে ভাগবত পুরাণের ভাষা আত্মসাৎ করে অস্ত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন—সাঙ্গোপাঙ্গ অস্ত্র পরিষদে প্রভু নাচে—সাঙ্গোপাঙ্গো’স্ত্রপার্ষদঃ।

মধ্যাহ্ন চলে গিয়ে অপরাহ্নের বেলা এল। দলে দলে লোক মশাল-দীপ জ্বালিয়ে উপস্থিত হল শ্রীবাসের বাড়ির সামনে। মাঝে মাঝে হরিধ্বনি উঠেছে আকাশে, অনন্ত দীপালোকে ভগবান কৃষ্ণ যেন জ্যোতিরূপে আত্মপ্রকাশ করলেন নদীয়ায়। প্রভুর নগর-সংকীর্তন উপলক্ষে নবদ্বীপের গৃহস্থ-বাড়িতেও নতুন সমারোহ তৈরি হয়েছিল। ঘরে-ঘরে জ্বালা হয়েছিল প্রদীপ, ঘরের দোরে পূর্ণঘট, আমের পল্লব। সন্ধ্যার অন্ধকার আসার আগেই মহাপ্রভুর নগর-সংকীর্তনের দল বেরিয়ে পড়ল গঙ্গার তীর ধরে। আরম্ভ হল হরিনাম। বেজে উঠল খোল-মৃদঙ্গ করতাল। কীর্তন যাওয়ার পাথে বহুতর লোক— যাঁরা আগে আসেননি—তাঁরাও বাড়ি ছেড়ে যোগ দিচ্ছেন কীর্তনের সমারোহে। এ এক অদ্ভুত সমারোহ, যেখানে পণ্ডিতের পাণ্ডিত্য নেই, মানীও তার মান বিসর্জন দিয়ে হরিধ্বনিতে গলা মেলাচ্ছেন। এমনকী যে চোর বেবাক ঘর খালি দেখে চুরি করবে ভেবেছিল— ‘সেই চোর পাসরিল আপন বেভার’— সেও ‘হরি’ বলে যোগ দিল এই মহা-সমারোহে।

বহুজনের সমারোহ ঘটলে এমনই হয়, ব্যক্তির ব্যক্তিগত ধর্ম, সমাজ ব্যবহার, সংস্কার গাম্ভীর্য সব ধুলোয় গড়াগড়ি যায়। পূর্বের ভাবনা-মতো আচার্য অদ্বৈত, হরিদাস ঠাকুর এবং শ্রীবাস তাঁদের গীত-নৃত্যের সম্প্রদায় নিয়ে চলেছেন। মহাপ্রভু স্বতন্ত্র, তিনি সকলের পিছনে কীর্তনানন্দে চলেছেন নিত্যানন্দ প্রভুর সঙ্গে। মহাপ্রভুর ভক্ত যত, কত বা নাম বলব তাঁদের— গদাধর, বক্রেশ্বর, মুরারি, শ্রীধর—কত, কত নাম করব—’কেহ গায়, কেহ বায়, কেহ মাঝে নাচে।’ নগর-কীর্তনে কীর্তনীয়ার দল যত এগিয়ে যাচ্ছিল, তাতে কীর্তনানন্দ এতটাই প্রধান যে, মোটেই এটা বোঝা যাচ্ছিল না— মহাপ্রভু সাঙ্গোপাঙ্গের অস্ত্র নিয়ে বিধর্মী কাজিকে শায়েস্তা করতে যাচ্ছেন।

কীর্তন-সমারোহ চলল গঙ্গার তীর ধরে। চরিতকার এই কীর্তন ভ্রমণের ভৌগোলিক উত্তরণ দেখিয়েছেন গঙ্গার ঘাটের ‘ল্যান্ডমার্ক’-গুলি উল্লেখ করে। গঙ্গার যে ঘাটে মহাপ্রভু স্নান করতেন সেই ঘাটের ওপর দিয়ে কীর্তন মিছিল গেল মাধাইয়ের ঘাটে। জগাই-মাধাই দুই ভাই, তার একজন হলেন মাধাই। মহাপ্রভু-নিত্যানন্দের কৃপা লাভ করার পর দুই পাষণ্ডী ভাইয়ের হৃদয় পরিবর্তন ঘটেছিল। সাধন-ভজন-পরায়ণতার কথা ছেড়েই দিলাম। সেই থেকে দুই ভাইয়ের অন্যতম মাধাই বিশেষ একটি গঙ্গা-ঘাট পরিষ্কার রাখত, কোদাল দিয়ে মাটি কেটে সেই ঘাটটিকে সে স্নানপুণ্যার্থী মানুষের গমনযোগ্য করে তুলত। সেই থেকে সেই ঘাটটির নামই হয়ে গেল ‘মাধাইয়ের ঘাট’। নগর সংকীর্তন মাধাই-এর ঘাট হয়ে এসে পড়ল বারকোনা ঘাটে— এ ঘাটের আধুনিক নাম বারগোরা বা বারগোলা ঘাট। সেখান থেকে নগরিয়া ঘাট হয়ে কীর্তনের দল উপস্থিত হল গঙ্গানগর। এখনও পর্যন্ত এই সব স্থান-নাম অপরিবর্তিত আছে। গঙ্গানগর থেকে মহাপ্রভু চলে এলেন সিমুলিয়া—নবদ্বীপ থেকে উত্তরে সেটা মোটামুটি এক ক্রোশ। কাজির বাড়ি আর তেমন দূরে নয়। এখন কাজির বাড়ি গঙ্গার ওপারে মায়াপুরে। কিন্তু তখন গঙ্গা যেমন বইত, তাতে ওই জায়গা নবদ্বীপের পারেই ছিল।

সাধারণ মানুষ, যারা কীর্তনের মহাসমারোহে শামিল হয়েছিল, তারা, এমনকী সামান্য ভক্তেরাও এই একত্রিত শক্তিতে বলীয়ান হয়ে মুহুর্মুহু কাজিকে মেরে ফেলার ডাক ছাড়ছিলেন। বার-বার চেঁচাচ্ছিলেন—’ধর ধর কোথা কাজি ভাণ্ডিয়া পলায়’। এই পরাক্রম হুংকার যতই সত্য হোক এসব একেবারেই সাধারণ মানুষের একত্র সমাবেশের শক্তিজাত হুংকার, এ বড়োই একদেশিক, বড়োই পরোক্ষ। মহাপ্রভু যে-ভাবে, যে-রসে এই সংকীর্তন-সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন তাতে এটুকু তিনি সহজেই বুঝে গিয়েছিলেন যে, এই বহুল জন-সমাবেশই কাজিকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট, এর জন্য তাঁকে হুংকার পরাক্রম দেখাতে হবে না। চরিতকার বৃন্দাবন দাস কিন্তু সরল সোজা মানুষ, তিনি এই বিচিত্র জন-সমাবেশে মহাপ্রভুর মুখ দিয়েও এমন কথা বার করেছেন, যা তাঁর ভাবোল্লাসী চরিত্রের সঙ্গে ঠিক মানায় না। বৃন্দাবন দাস নগর-সংকীর্তনে যাওয়ার সময়েও মহাপ্রভুর বাহ্যজ্ঞানহীন পরম ভক্তিভাব বর্ণনা করছেন, অন্যদিকে সেই তিনিই কাজির ঘরে এসে তাঁর ঘর-বাড়ি-বাগান তছনছ করার আদেশ দিচ্ছেন, অথবা তাঁর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন—এমনটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।

বৃন্দাবন দাসের বয়ান অনুযায়ী, প্রথমত এমন বৃহৎ জনসমাবেশের খবর শুনে মুসলমান কাজি তাঁর আপন পদাধিকার-স্মৃতিতে প্রচুর তর্জন-গর্জন করেছিলেন। অনুচরকে বলেছিলেন—জেনে এসো এত গীত-বাদ্যের ধ্বনি কীসের জন্য, এটা কি বিয়ের বরযাত্রী যাচ্ছে, নাকি ভূতের কীর্তন? কারই বা এত সাহস যে, আমার কথা অতিক্রম করে এত ‘হিন্দুয়ানি’ দেখাচ্ছে? কাজির অনুচর সংকীর্তন-সমারোহ দেখে ভয় পেয়েছিল, এমনকী সে নিজের মাথার পাগড়ি ফেলে দিয়ে হিন্দু সাজারও চেষ্টা করেছিল সাময়িকভাবে। সব দেখে এসে সে কাজিকে পালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছিল। মশাল-জ্বালা সেই বিরাট কীর্তন-সমারোহের বর্ণনা দিয়ে কাজির অনুচর বলেছিল—লোকজন এমন অনুগতভাবে নিমাই পণ্ডিতের পিছন পিছন আসছে, এতই তাদের সমারোহ-ভাব যে, রাজা আসলেও লোকে এমন করে না। সব চেয়ে বড়ো কথা—আমরা যেসব নগরবাসীকে হিন্দুয়ানি-কীর্তনের দায়ে মারধোর করেছিলাম, তাঁরা এখন ‘কাজি মার’ ‘কাজি মার’ বলে ধেয়ে আসছে, আর এখানে যে হিন্দুর ভূতটি আছে, সে হল সেই নিমাই পণ্ডিত, এগুলো সব তারই কাজ—সেই সে হিন্দুর ভূত এ তাহার কার্য।

তবু এমন হুঁশিয়ারির মধ্যেও অনুচরের বর্ণনায় মহাপ্রভুর-যে মুখচ্ছবি আছে, সেখানেও কীর্তনের মধ্যে তিনি একবার ভাবোল্লাসে কেঁদে ভাসাচ্ছেন, কখনও বা আছাড় খাচ্ছেন মাটিতে। আমরা নগর-সংকীর্তন চলাকালীন সময়েও প্রভুকে কেমন বিবিক্ত দেখছি। যেখানে নবদ্বীপের নগরিয়া সব হরিধ্বনি আর কৃষ্ণনাম করছেন, সেখানে মহাপ্রভু আপন বিবিক্ত মনে ধ্রুপদী সঙ্গীতের সুর ধরেছেন কৃষ্ণ স্মরণ সরসতায়—

তুয়া চরণে মন লাগহুঁ রে!
সারঙ্গধর! তুয়া চরণে মন লাগহুঁ রে।।

বৃন্দাবন দাস বলেছেন— ‘চৈতন্যচন্দ্রের এই আদি সংকীর্তন।’ যিনি এই ধ্রুপদী কীর্তন গাইছেন আপন রসে, তিনিই কৃষ্ণস্মরণে মাটিতে আছাড় খাবেন, অথবা তাঁর চোখ দিয়ে বইবে বিরহীর বিধুর নয়নধারা—এমনকী কাজির অনুচরও তাতে অবাক হয়ে এসে বলবে—’বামনা আছাড় যত খায়’ ‘বামনা এতেক কান্দে কেনে’। কিন্তু সেই মানুষটাই হঠাৎ ভাব পরিবর্তন করে বলবেন—কাজি-বেটা কোথায় গেল? তার মাথা কেটে ফেলব। কাজির বাড়ি ভাঙ, বাড়িতে আগুন দাও— এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এসব কথা মহাপ্রভুর মুখ দিয়ে বেরনোর কথা নয়। এমন কঠিন নির্দেশ তাঁর এখনকার পরিবর্তিত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সযৌক্তিক হয়ে ওঠে না। বৃন্দাবন দাসের বর্ণনায় কাজি প্রথমে অনেক তর্জন-গর্জন করে বলেছিলেন— আমাকে অতিক্রম করে হিন্দুয়ানি করলে তার জাতি মারব আমি—

এবা নহে মোর লঙ্ঘি হিন্দুয়ানি করে।
তবে জাতি নিমু আমি সভার নগরে।।

যখন বঙ্গদেশে মুসলমান অধিকার চলছে এবং মুসলমান কাজির হাতেও যথেষ্ট অধিকার আছে, সেখানে এমন তর্জন-গর্জন অসত্য নাও হতে পারে। ইতস্তত বলাৎকৃত ধর্মান্তর করার কাজও সে যুগে অসত্য ছিল না, কিন্তু বঙ্গদেশের মুসলমান শাসনের ভাবটা তখন এমন তালেই চলছিল যে, কাজি মুখে যতই তর্জন-গর্জন করুন, তিনি আপন ধর্মবোধে বেহুঁশ হয়েছিলেন এমনটাও হওয়ার সম্ভাবনা কম। আবার পিছনে জন-সমারোহ আছে বলেই মহাপ্রভুর মতো ব্যক্তিত্ব হঠাৎই প্রতিহিংসা’রায়ণ হয়ে উঠে কাজির ঘর-দোর ভেঙে ফেলতে বলবেন অথবা তাঁর বাড়ি পুড়িয়ে দিতে বলবেন—এমনটাও হওয়ার কথা নয়। অন্তত সেটা বিপরীত মনে হয়, প্রভুর স্বভাবের বিপরীত। বৃন্দাবন দাসের কাজি প্রথমে অনেক তর্জনগর্জন করে প্রাণভয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়েছিলেন সানুচরে, সপরিবারে—

শুনিয়া কম্পিত কাজি গণ সহে ধায়।
সর্পভয়ে যেন ভেক ইন্দুর পলায়।।

কিন্তু বঙ্গের শাসনাধিকার যেমন ছিল, তাতে প্রশাসকের দায়িত্ব সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে কাজি ভয়ে অন্যত্র পালিয়ে যাবেন, এমনটা বোধহয় ইচ্ছাপূরণের কাহিনি হয়ে যাবে। বরঞ্চ এ বাবদে চৈতন্যচরিতামৃত-কার কৃষ্ণনাস কবিরাজের শ্রুত বিবরণ অনেক বেশি বিশ্বাস্য এবং গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। একটা বিশাল জনসমারোহের সার্বিক এবং সর্বকালিক চরিত্রই এমন হয়, যেখানে বিভিন্ন এবং বিচিত্র স্বভাবের মানুষ থাকেন। এমন সমারোহে যিনি নেতৃত্ব দেন, তাঁর উদ্দেশ্য এবং তদ্ভাব-ভাবিত জনের অধিকাংশের উদ্দেশ্য একরকম হলেও সমস্ত সাধারণ মানুষের ওপর নেতার কর্তৃত্ব এবং নিয়ম সম্পূর্ণ কাজ করে না। অন্তত একাংশে তো কাজ করেই না, কেননা তাদের সমারোহে যোগ দেওয়াটাই অনেকটা হুজুগে যোগ দেওয়ার মতো। প্রথম প্রতিরুদ্ধ হয়ে নেতা ব্যক্তি যে প্রথম হুংকারটি ছাড়েন, সাধারণ অনর্থকারী হুজুগে মানুষ ভাবেন—সেই হুংকারটাই বোধহয় সব। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নেতা যে সামগ্রিক রাষ্ট্র এবং সমাজের পরিস্থিতি অনুসারেই সিদ্ধান্ত নেন—সেটা অনর্থকারী সাধারণকে কে বোঝাবে!

এখানেও তো মহাপ্রভু তাঁর সংকীর্তনে কাজি সাহেবের প্রতিরোধ দেখে প্রথমে হুংকার ছেড়েছিলেন—দেখি কোন কাজি আজি করে নিবারণ।। আজি সংহারিব আমি সকল যবন। কিন্তু বাস্তবে এটা উদ্দেশ্য বাধিত হওয়ার প্রথম হুংকার, এই হুংকারের মধ্যে সত্য নেই। প্রতিরোধ হিসেবে মহাপ্রভু যেটা করেছেন সেটা ওই বৃহৎ জনসমাবেশ— যেটা গৌণভাবে আয়োজিত হলেও বিরুদ্ধ পক্ষের কাছে সেটা ত্রাসজনক প্রতিবাদ। কিন্তু মুখ্যত আজই মহাপ্রভু শ্রীবাস অঙ্গনের গোপন ভজন-কুটির থেকে নেমে এলেন সবার সামনে। বলেছিলেন— নগরে নগরে আজি করিব কীর্তন। দেখি কোন কাজি আসি করে নিবারণ। যে মহাপ্রভু এতদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন, তিনি আজ এই বৃহৎ জনসমাবেশে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, নবদ্বীপবাসীর কাছে এ ছিল চরম সার্থকতার দিন। কাজেই ভক্ত বৈষ্ণবদের সঙ্গে অন্যান্য অনেক মানুষই জুটে গিয়েছিলেন সেদিনের কীর্তন রঙ্গে। বৃন্দাবন দাস লিখেছেন সে কথা। বলেছেন—যে যে জায়গায় মহাপ্রভু তাঁর কীর্তন সমাবেশ নিয়ে উপস্থিত হচ্ছিলেন, সেখানে সেখানেই ‘গৃহবৃত্ত পরিহরি শুনি লোকে ধায়’। বিশেষত এই বিশাল নগর সংকীর্তনের মধ্যেও মহাপ্রভুর ভক্তিভাব স্ফূর্ত সাত্ত্বিকভাবগুলি এমনই প্রকট ছিল যে—

সে কম্প সে ঘর্ম সে বা পুলক দেখিতে।
পাষণ্ডীর চিত্তবৃত্তি করয়ে নাচিতে।।

কাজেই এই কীর্তন সমাবেশের মধ্যে এমন মানুষও যথেষ্টই ছিলেন, যারা মহাপ্রভুর সেই প্রথম প্রতিরোধ-হুংকারটুকুই শেষ মনে রেখেছে। মহাপ্রভুর সংকীর্তন-সমাবেশ যখন কাজির বাড়ির সামনে এসে পৌঁছাল, তখন এই আবেগপ্রবণ হুজুগে মানুষগুলির স্বরূপ প্রকট হয়ে পড়ল এবং এই অবস্থায় এক বিশাল সমাবেশ-পুষ্ট মানুষের কী মনস্তত্ত্ব হতে পারে তা সবচেয়ে ভালো ধরেছেন চৈতন্যচরিতামৃত-এর কবি। তিনি বলেছেন— ‘কাজি কিংবা যবন ধ্বংস করব’ বলে প্রভু যে প্রথম প্রতিরোধ-শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন, সেটাই বুঝি বৃহৎ নেতৃত্বের প্রশ্রয়—যেমনটি অহরহ দেখবেন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে— নেতারা কেমন কঠিন শব্দ উচ্চারণ করে সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তোলেন। মহাপ্রভু কোনো রাজনৈতিক নেতা নন, কিন্তু বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে তখন তাঁর প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর কথা লোকে মানছে এবং তাঁর মতো এক মান্য ব্যক্তিত্ব যখন অন্যধর্মী শাসক ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ঘোষণা করে বিশাল জন-সমাবেশ সহ তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হচ্ছেন, তখন এতদিনের শাসন-ত্রস্ত মানুষ একটা নতুন বল পেয়ে যায়। তখন শান্ত সভ্যতার বদলে অনর্থ অ-ব্যাপার ঘটতে থাকে। যার ফলে কাজির ফল-ফুলের বাগানও কিছু নষ্ট হয়েছে এবং সাধারণ অনর্থপ্রিয় মানুষ সাময়িক জনসমাবেশের বলে বেশ তর্জনগর্জনও করতে আরম্ভ করল। চরিতামৃতকার তাদের মনস্তত্ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন—

তর্জন গর্জন করি করে কোলাহল।
গৌরচন্দ্র বলে লোক প্রশ্রয় পাগল।।

অসাধারণ এই শব্দের প্রয়োগ—প্রশ্রয় পাগল—অর্থাৎ সামান্য প্রশ্রয় পেলে যারা পাগলের মতো আচরণ করে। যেহেতু একবার চৈতন্য বলেছিলেন—ধ্বংস করব কাজিকে, সেই প্রশ্রয়টুকু শাসকের শাসন-পীড়িত হৃদয়ে এমনভাবেই ক্রিয়া করেছে, যাতে একটা প্রতিশোধের ভাব চলে এসেছে। তারা উচ্ছৃঙ্খল ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর শক্তি এবং ব্যক্তিত্বকে মাথায় রেখেও বলা যায়, তিনিও সাময়িকভাবে এই সমস্ত মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। কেননা যে-কোনো উল্লাসের প্রাথমিক প্রকাশের সময়ে যেমনটি হয় হয়তো সেটাকেই সাধারণ মানুষ প্রশ্রয় বলে ধরে নিয়েছে।

চৈতন্য চরিতামৃত-কার কবিরাজ এমনই এক পরিশীলিত ব্যক্তিত্ব যে, তিনি যখন পূর্বতন জীবনীকার বৃন্দাবন দাসকে অতিক্রম করেন, তখন এমনভাবেই করেন, যাতে তাঁর এতটুকু মর্যাদাহানি না হয়। রাজনৈতিক নিপীড়ন হেতু সাধারণ মানুষের মধ্যে যে বিক্ষোভটুকু বৃন্দাবন দাসের জবানিতে প্রকাশ পেয়েছে অথবা যা হয়তো নিতান্তই বৃন্দাবন দাসের একান্ত কল্পিত ভাবনা—সেটাকে কৃষ্ণদাস কবিরাজ মানতে না চাইলে ছোটো করে লিখেছেন—’বিস্তারিত বর্ণিলা ইহা বৃন্দাবন দাস’। কিন্তু এর পরেই কবিরাজ নিজে যেমন শুনেছেন, তেমনটি বর্ণনা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে—এই জায়গায় তিনি পূর্বের জীবনীকারের সঙ্গে একমত নন।

এখানেও তাই ঘটেছে। এটাই পরম বাস্তব যে, মহাপ্রভুর মতো ব্যক্তিত্ব বিরুদ্ধধর্মী শাসকের ঘর-বাড়ি ভেঙে পুড়িয়ে দেওয়ার আদেশ দেবেন—এমনটা হতেই পারে না এবং শাসক সম্প্রদায়ের নিজস্ব প্রতিনিধিও সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবেন, তাও হতে পারে না। সবচেয়ে বড়ো কথা, তখনকার সুলতানি শাসনে হুসেন শাহর আমলে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক এমন ক্রুর পর্যায়ে অবশিষ্ট হয়নি, যাতে কোনো পক্ষই ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেন। হ্যাঁ, ভিন্নধর্মী শাসকের প্রতিনিধি যাঁরা, তাঁদের নিজস্ব চরিত্র অনুসারে শাসনের দিক থেকে কোথাও কোনো অতিরেক বা বাড়াবাড়ি হয়ে থাকতেই পারে, কিন্তু সেই বাড়াবাড়ির প্রতিরোধটাও তেমন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবে—এটা মহাপ্রভু চৈতন্যের বিশাল মানসিকতার সঙ্গে খাপ খায় না। চৈতন্যচরিতামৃত-র ভাষায়—’উদ্ধত লোক ভাঙে কাজির পুষ্প বন’। কিন্তু এইটুকুই, তারপরেই মহাপ্রভু কাজির বাড়ির দুয়ারে এসে বসেছেন এবং ভব্য সভ্য সুজন মানুষকে দিয়ে কাজিকে ডেকে পাঠিয়েছেন—ভদ্র লোক পাঠাইয়া কাজি বোলাইলা। কাজি মোটেই ভেক বা ইঁদুরের মতো ভয়ে পালিয়ে যাননি।

কাজি মহাপ্রভুর ব্যক্তিত্ব অনুধাবন করেই আপন দোষ বুঝেছেন। চৈতন্যের ভক্তি-আন্দোলন যে কোনো রাজনৈতিক উত্থান নয়, অথবা তাঁর কীর্তন-প্রচার যে ভিন্নধর্মী শাসক-সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হিন্দুয়ানির জাগরণ নয়—এটা কাজি বুঝেছিলেন বলেই চৈতন্যের কাছে এসেছেন মাথা নীচু করে। কাজি সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে মহাপ্রভু তাঁকে যথোচিত সম্মান দিয়ে বসিয়েছেন এবং কথা আরম্ভ করেছেন। প্রতিশোধের সমস্ত ভাবনা ছেড়ে, সপরিহাসে, লঘু ভাষায়। প্রভু বলেছেন—আমি তোমার বাড়িতে এসেছি সকলকে নিয়ে, আমি তোমার অভ্যাগত, সেখানে আমাকে দেখে তুমি ঘরে গিয়ে লুকোলে—এ কোথাকার ধর্ম? আমার ধর্ম, তোমার ধর্ম— কোনোটাতেই তো এমন বলে না। অতিথি বলে কথা। কাজি বললেন— কারণ, তাঁর কাছে এই রকমই খবর ছিল, তাই সেই খেয়ালেই কাজি বললেন—তুমি তো ক্রুদ্ধ হয়ে এমন জনসমাবেশ ঘটিয়ে আমার বাড়ি এলে, তাই তোমার ক্রোধটুকু যাতে আগে শান্ত হয়, সেইজন্যেই ঘরে দুয়োর দিয়ে বসেছিলাম। এখন তুমি শান্ত হয়েছ, ভব্য-সুজনকে পাঠিয়েছ আমায় ডাকতে। তাই আমিও এসেছি তোমার কাছে। আমার একথা ভেবে ভালো লাগছে যে তোমার মতো এক অতিথি আজ আমার ঘরে এসেছে।

মুসলমান কাজি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রতিনিধি হলেও এবং শাসকের বাহুবল, অস্ত্রবল তাঁর হাতের মধ্যে থাকলেও এমন বৃহৎ জনসমাবেশ দেখে কাজি মনে-মনে অবশ্যই একটু ভয় পেয়েছেন। মহাপ্রভু যে নগর-সংকীর্তন নিয়ে এসেছেন, সেটাকে হরিনামের ‘স্লোগান’ বলতে আমার আপত্তি আছে, তবে এটা তিনি অবশ্যই বুঝেছিলেন যে, নিরস্ত্র, শাসিত মানুষকে যদি প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হয়, তবে সকলের একত্র হওয়াটা খুব জরুরি এবং একটা বৃহৎ সমাবেশ যদি পায়ে পায়ে বিরুদ্ধ শাসকের বাড়ির সামনে অত্যন্ত ভব্য হয়েও দাঁড়ায়, তবুও তার মনে-মনে ভয় হতে বাধ্য। আমরা কাজিকে এখন তথাকথিত ‘হিন্দুর ভূত’ মহাপ্রভুর সঙ্গে কেমন একটা ভাব জমাতে দেখছি এবং চৈতন্যচরিতামৃত-কারের এই বয়ান খুব স্বাভাবিক মনে হয়।

কাজি বললেন—বাছা! তোমার যিনি দাদু, তোমার মায়ের পিতাঠাকুর—নীলাম্বর চক্রবর্তী, তিনি গ্রাম সম্বন্ধে আমার চাচা হন। আর একথা মনে রেখো—রক্তের সম্বন্ধে যত চাচা-কাকা আছে, তার থেকে গাঁয়ে যাকে চাচা বলে মেনেছি, সে সম্বন্ধটা অনেক বড়ো। আর সেদিক থেকে দেখতে গেলে তুমি হলে আমার ভাগনে। তা বাছা! ভাগনে যদি তেমন রেগে যায়, তখন মামারা সেটা মেনেই নেয়, সহ্য করে। আবার অন্যদিকে মামাও যদি একটা ভুল করে ফেলে, তখন ভাগনেও সেটা তেমন করে ধরে না, সেটা ভুলে যেতে হয়—

ভাগিনার ক্রোধ মামা অবশ্য সহয়।
মাতুলের অপরাধ ভাগিনা না লয়।।

গ্রাম-সম্বন্ধে সরসতা উল্লেখ করে কাজি চৈতন্যের সঙ্গে যেভাবে মামা-ভাগনের সম্পর্ক পাতিয়ে নিলেন, তাতে একদিকে যেমন এটা প্রমাণ হল যে, এই বৃহৎ জনসমাবেশের মুখে কাজি চৈতন্যের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে চাইছেন, অন্যদিকে এটাও কিন্তু পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, মহাপ্রভুর সময়ে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কও একটা বোঝাবুঝির জায়গাতেই অবস্থিত ছিল। অন্তত সেটা বিপদসীমার ওপরে চলে যায়নি। যদিও চাপা উত্তেজনা একটা অবশ্যই ছিল এবং কখন কী ঘটবে, সেটা সংশয়াতীত ছিল না কোনো মতেই। কাজি এবং চৈতন্য একসঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছেন—দূরে দাঁড়ানো নদীয়ার নগরিয়া, কীর্তনীয়ারা সেসব বুঝতে পারছিল না বটে, কিন্তু ভরসা পাচ্ছিল যথেষ্ট।

চৈতন্যের সঙ্গে কাজির কথোপথনে চৈতন্যচরিতামৃত-কার যেভাবে উপস্থাপনা করেছেন, সেটা যদি তাঁর কল্পিত উচ্চারণও হয়, তবু বলতে হবে যে, শাসক মুসলমান সম্প্রদায়ের সমস্ত আচরণের মধ্যে যে বিষয়টি তৎকালীন হিন্দু সমাজকে সবচেয়ে বেশি আহত করত, সেটা বোধহয় গোমাংস-ভক্ষণ। এ বিষয়ে যে যুক্তি এখনও দেওয়া হয় এবং গো-মাংসভোজী হিন্দুরাও যে যুক্তি উল্লেখ করে থাকেন, সেটা সেই পুরাতন যুক্তি— বৈদিক যুগে গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ ছিল না এবং শ্রৌতযজ্ঞে শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ গোবধে অংশগ্রহণ করতেন। চৈতন্য মহাপ্রভুর মুখে গোমাংস ভক্ষণের জন্য যে ক্ষোভটুকু প্রকাশ পেয়েছে, তার বিরুদ্ধে কাজি সেই শ্রৌতযজ্ঞে গোবধের যুক্তিই উল্লেখ করেছেন। চৈতন্য অবশ্যই একথা মানেননি। ইতিহাসের অনুক্রমে হিন্দুদের মধ্যে গোবধ যে অতি-প্রাচীন কালেই এক সময় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল— তার কারণ লৌকিকভাবে দেখতে গেলে গোরুর মাংসের চেয়ে গোরুর দুধের সম্বন্ধে অধিক প্রয়োজনীয়তা-বোধ এবং হয়তো এই প্রয়োজন-বোধ থেকেই গোহত্যা নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হতে থাকে উপনিষদ-পুরাণ, ধর্মশাস্ত্র এবং মহাভারত-রামায়ণের মধ্যে।

চৈতন্য চরিতামৃত-র কবিও একটি পুরাণ-বাক্যই উদ্ধার করেছেন মহাপ্রভুর যুক্তির সপক্ষে, যদিও মহাপ্রভু সেটা কাজির সম্মুখে ব্যবহার করেছিলেন কিনা, তা জানা নেই। তবে ব্যবহার না করলেও শাসক মুসলমানদের এই গোবধের ভাবনাটি সম্বন্ধে তৎকালীন গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের দৃষ্টিকোণ কীরকম ছিল, তা প্রমাণ হয়ে যায় মহাপ্রভুর মুখে এই পুরাণ-বাক্য বসিয়ে দেওয়ায়। অন্যদিকে গোহত্যাকারীর চরম পাপ-স্পর্শ সম্বন্ধে মহাপ্রভুর সতর্কবাণীর প্রতিযুক্তিতে কাজি যে বলেছেন—আমার পরম্পরা-গত শাস্ত্র তোমার শাস্ত্রের থেকে আধুনিক এবং জাতি-বৃত্তির অনুরোধে এই শাস্ত্র আমাকে মানতে হয়—এটাও পরকীয় শাস্ত্র সম্বন্ধে তৎকালীন মুসলমান শাসকের সহিষ্ণুতা-বোধের পরিচয় দেয়। চরিতামৃত-কার বুঝিয়ে দিয়েছেন—এই নিয়ে তর্ক চলে না, যার যার শাস্ত্র, তার তার কাছে চরম প্রমাণ-বহ—

কল্পিত আমার শাস্ত্র আমি সব জানি।
জাতি-অনুরোধে তবু সেই শাস্ত্র মানি।।

কাজির সঙ্গে মহাপ্রভুর কথা-প্রসঙ্গ আমরা একটু-বেশিই আলোচনা করছি, এবং তা এই কারণে করছি যে, এই কথোপকথন থেকে তৎকালীন সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ খানিকটা প্রকট হয়ে ওঠে। কাজি যখন ঘনিষ্ঠ হয়েই কথা বলতে আরম্ভ করলেন মহাপ্রভুর সঙ্গে, তখন ততোধিক ঘনিষ্ঠতায় তিনি কাজিকে ‘মামা’-সম্বোধন করে বললেন—এবার একটা সত্যি কথা বল দেখি, মামা! সেদিন তুমি আমাদের কীর্তন-রঙ্গে বাধা দিয়ে আমাদের মৃদঙ্গ ভেঙে দিয়ে এলে, কিন্তু তার পরেও তো নগর-সংকীর্তন অনেক হয়েছে, অনেক চলছেও নবদ্বীপে, কই তুমি তো আর বাধা দাওনি—

তুমি কাজি হিন্দু ধর্ম বাধে অধিকারী।
এবে যে না কর মানা বুঝিতে না পারি।।

এই প্রশ্নের উত্তরে কাজি প্রথমে কিছু অলৌকিক বৃত্তান্তের কথা বলেছেন, কিন্তু তার পরেই আসল কথাটি বেরিয়ে এসেছে। কাজি বলেছেন—তাঁর স্বপ্নে নাকি নৃসিংহদেব এসে তাঁকে মারধর করেছেন এবং কাজি পেয়াদা পাঠিয়ে কীর্তন নিষেধ করতে গেলে সেই পেয়াদার সুরক্ষিত দাড়িটি পুড়ে গেছে। কাজি এবার ভয় পেয়ে পেয়াদাদের আদেশ দিয়েছেন—কীর্তনের বিঘ্ন না ঘটাতে। এই কাহিনি বুঝতে আমাদের অসুবিধে হয় না। কিন্তু কাহিনির ব্যবচ্ছেদ ঘটালে উলটো টানে এটাও বোঝা যায় যে, কীর্তনের মৃদঙ্গ ভাঙার পিছনেও যেমন কাজির কাছে পূর্ব প্ররোচনা ছিল, তেমনই পুনরায় বাধা-সৃষ্টি না করার ক্ষেত্রেও তাঁর রাজনৈতিক শুভ-কৌশলের বুদ্ধি ছিল। কাজির নিজের মুখেই সেকথা বেরিয়েছে যদিও একটু অন্যভাবে, তবু লৌকিক দিক থেকে বিচার করলে সেকথা সত্য বলেও মনে হয়।

কাজি বলেছিলেন—নগরে নগরে যখন কীর্তন-প্রচার বেড়ে চলছিল উত্তরোত্তর, তখন স্বজাতীয় মুসলমান-জনেরা অনেকেই এসে আমাকে সচেতন করে দিয়ে বলেছেন— নবদ্বীপে কিন্তু হিন্দুধর্মের বাড়াবাড়ি চলছে, বড়ো বেশি কীর্তনের ধুম দেখছি আজকাল—

নগরে হিন্দুর ধর্ম বাঢ়িল অপার।
হরি হরি ধ্বনি বই নাহি শুনি আর।।

এটা অবশ্যই ঠিক যে, ধর্মপালন বলতে এতদিন নবদ্বীপে যা চলেছে, তার দুটি নির্দিষ্ট ভাগ ছিল। পণ্ডিত-অভিজাতরা বেদ-বেদান্ত, ধ্যান-জপ, সন্ধ্যা-আহ্নিক-গঙ্গাস্নানের সঙ্গে স্মার্ত ক্রিয়াকলাপগুলি চালিয়ে যেতেন, আর সাধারণ মানুষ যারা বৈদান্তিক ভাবনা বুঝতেন না, তাঁরা মঙ্গলচণ্ডী, বিষহরি-মনসার গীত গাইতেন। কিন্তু ধর্মপালনের এই বিষয়গুলি, বিশেষত আচরণ-প্রক্রিয়ার জায়গাটা এতই ব্যক্তিগত, অতএব পরম্পরা বিচ্ছিন্ন ছিল যে, ধর্ম নিয়ে সার্বিকভাবে একত্র হওয়াটা কখনোই ঘটেনি। এখন সেটা ঘটছে। নবদ্বীপের নগরিয়ারা মহাপ্রভুর সঙ্গে দেখা করতে যায়, তাদের হাতে কোনো মহার্ঘ্য উপায়ন লাগে না—কেহো বা নূতন দ্রব্য, কারো হাতে কলা। কেহো ঘৃত, কেহো দধি, কেহো দিব্য মালা। মহাপ্রভু এঁদের সবার কাছে আশ্বাস দিয়েছেন যে, ধর্ম বলতে বিরাট কিছু পালনীয় আচার নেই, শুধু হরিনাম কর এবং তার প্রক্রিয়াটা কী—দশ পাঁচে মিলি নিজ দুয়ারে বসিয়া। কীর্তন করহ সবে হাতে তালি দিয়া।।

এই যে অনাড়ম্বর আরম্ভ—এর মধ্যে আর কিছু না থাক একটা অদ্ভুত উৎসাহ ছিল। অতএব মহাপ্রভু যখন নিজে তাঁর কীর্তনধ্বনি নিয়ে পথের মাঝে এসে দাঁড়ালেন— ‘ঘরে ঘরে নগরে নগরে প্রতি দ্বারে’—সেদিন ওই দশ-পাঁচ আর দশ-পাঁচের এক-একটা পরিবার মিলে-মিশে এক বিরাট কীর্তন সমারোহ তৈরি করে ফেলল এবং সেই সমারোহ দেখেই কাজির লোক কাজির কাছে নালিশ করেছে যে, ‘নগরে হিন্দুর ধর্ম বাঢ়িল অপার’। শুধু এই নয়, কাজি নিজেই তাঁর একান্ত কথোপকথনের মধ্যে মহাপ্রভুকে জানিয়েছেন যে, অনুগত সহচরেরা শুধু এটাকে হিন্দুধর্মের বাড়াবাড়ি বলেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা এই ঘটনার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াটাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বলেছে—এই যে হিন্দুরা এত হরি-হরি বলে কোলাহল সৃষ্টি করেছে, এটাকে কোনো বিরুদ্ধবাদী রাজনৈতিক উত্থান বলবেন কিনা ভেবে দেখুন। অন্তত যেটা ঘটেছে, সেটা অন্য কোনো আকার গ্রহণ করলে কাজির সমস্যা আছে। তারা ভয় দেখিয়ে কাজিকে সাবধান করেছে—

হরি-হরি বলি হিন্দু করে কোলাহল।
পাৎসা শুনিলে তোমার করিবেক ফল।।

নিজের স্বধর্মী, সগন্ধ মানুষেরা ছাড়াও আর আছেন সেই সব মানুষেরা—যাঁরা চিরকাল থাকেন—যাঁরা যেকোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনেই পরবর্তী শাসকের অনুগত চাটুকারে পরিণত হন—কাজি একান্তে জানিয়েছেন মহাপ্রভুকে যে, তাঁরাও এসে নালিশ করে গেছেন তাঁর কাছে। কাজি এসব কথা বড়ো গলায় বলতে চাননি। মহাপ্রভুকে তিনি বলেছিলেন—তুমি একটু সরে এসো, আমি সব বলছি, কেন সেদিন নবদ্বীপের রাস্তায় গিয়ে আমার লোকজন তোমাদের কীর্তনের মৃদঙ্গ ভেঙে দিয়ে এসেছে, আমি বলছি তোমাকে, তুমি একটু সরে এসো একান্তে—নিভৃত হও যদি তবে করি নিবেদন। মহাপ্রভু সেদিন প্রকৃষ্ট জননেতার মতোই সমস্ত স্পষ্টতা জনসমক্ষে বজায় রেখে বলেছিলেন—স্ফুট করি কহ তুম না করিহ ভয়। প্রভু বলে—এ-লোক আমার অন্তরঙ্গ হয়।

কাজি বলেছিলেন—হিন্দুদের মধ্যেও অনেকে এসে তাঁকে সব জানিয়ে তোমার নাম ধরে বলেছে—ওই যে ওই নিমাই পণ্ডিত, সেই আজ হিন্দুর ধর্ম নষ্ট করে দিয়েছে। এই যে একটা কীর্তন চালাচ্ছে দিন-রাত, এটাকে তো কোনোদিন হিন্দুদের কোনো আচরণ-প্রক্রিয়া বলে শুনিনি। হ্যাঁ, নৃত্য-গীত-বাদ্য এসব মাঝে মাঝে শুনি বটে, তবে সেটা ওই মঙ্গলচণ্ডী কিংবা মনসা জাগানোর জন্য শুনেছি। কিন্তু এ কী হল—নাচছে, চেঁচাচ্ছে, বাজনা বাজাচ্ছে—’মৃদঙ্গ-করতাল শব্দে কর্ণে লাগে তালি।’

এই হিন্দুরা নিমাই পণ্ডিতের হঠাৎ পরিবর্তনটাও ভালোভাবে নেননি। বলে গেছেন— পণ্ডিত আগে লোকটা ভালোই ছিল, কিন্তু ‘গয়া হৈতে আসিয়া চালায় বিপরীত’। এই বিপরীত ভাব তারাই বা কাজিকে কী বোঝাবেন! তিনি যে অখিল-রসামৃত-মূর্তি কৃষ্ণের ভাবনা-সুখে একবার হাসেন, একবার কাঁদেন, একবার মাটিতে গড়াগড়ি যান—এ-ভাব যারা বোঝেনি, তারা কী বোঝাবে কাজিকে! তারা শুধু এইটুকু কাজিকে বোঝাতে পেরেছে যে, নিমাই পণ্ডিত হিন্দুর ধর্ম নষ্ট করে দিয়েছে। কতকগুলো উলটোপালটা লোক তার দলে এসে জুটেছে, যত সব নীচ-মূর্খ ভাটের দল দিন-রাত কৃষ্ণ-নাম করছে, এর ফল হবে সর্বনাশ—

কৃষ্ণের কীর্তন করে নীচ রাড়বাড়।
এই পাপে নবদ্বীপ হইবে উজার।।

শাসক কাজির কাছে তাঁরা বলে গেছেন যাতে তিনি নিমাই পণ্ডিতকে ডেকে এনে যথোচিত শাসন করে দেন—নিমাই বোলাইয়া তারে করহ তর্জন, এবং এই শাসনকাণ্ডে হিন্দু সমাজপতিরা কাজির পিছনে থাকবেন।

কাজি কাজির বুদ্ধিমতো প্রথমেই নেতাকে ডেকে পাঠাননি। তিনি প্রথমে ভাব বুঝতে চেয়েছেন কীর্তনে বাধা সৃষ্টি করে, মৃদঙ্গ-খোল ভেঙে দিয়ে। কিন্তু আজ যখন বিরাট কীর্তন-সমারোহ নিয়ে নিমাই পণ্ডিত নিজেই এসেছেন তাঁর দ্বারে, কাজি তখন এটা স্পষ্ট বুঝে গেছেন—এটা কোনো রাজনৈতিক হিন্দু-জাগরণ নয়, প্রধানত ধর্মীয় ভাবনাই এখানে প্রধান কারণ এবং রাজনীতির সঙ্গে এর কোনো স্পষ্ট যোগাযোগ নেই। তিনি পালিয়েও যাননি, বরঞ্চ নিমাই পণ্ডিতের সঙ্গে দু’দণ্ড বসে তাঁর সরসা ভক্তির ভাবটুকু বুঝে নিয়েছেন। তাঁকে সম্পূর্ণ আশ্বাস দিয়ে বলেছেন—হরিনাম সংকীর্তনে আর এতটুকু বাধা আসবে না প্রশাসনের তরফ থেকে। মহাপ্রভু উঠে এসেছেন তাঁর অন্তরঙ্গ কীর্তনের মহা-সমারোহে এবং সেখানে তাঁর আনন্দ-উৎসাহ এমনই ছিল যে, স্বয়ং কাজিও চলে এসেছিলেন তাঁর পিছন পিছন—সঙ্গে চলি আইসে কাজি উল্লসিত মন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *