১. ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র

যে পারে সে অমনি পারে, কিন্তু সবাই পারে না। বৃহৎ ব্যক্তিত্ব এবং সেই ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য এমনই এক বস্তু যে, তিনি একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় ধারার মধ্যে থেকেও নিজের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করতে পারেন। না, আমি মহামতি চৈতন্যের কথা বলছিই না। চৈতন্যের আবির্ভাব ঘটেছে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি। তাঁর জন্মের অন্তত দেড়শো-দুশো বছর আগে থেকে এমনই একটা স্বতন্ত্র আন্দোলন তৈরি হয়েছিল—যেখানে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকেও এক-একজন ব্যক্তি তাঁর বৈধ সম্প্রদায়ের আবরণ ভঙ্গ করে আপন চিদাকাশটুকু উপহার দিয়েছেন সাধারণ মানুষকে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়।

আমি তখন সদ্য এম এ পাশ করে নবদ্বীপের বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াতে ঢুকেছি। কিছুদিনের মধ্যে কলেজে একটি বিদ্বৎসভা আয়োজন করার ভার পড়ল আমার ওপর। প্রস্তাবিত হল—তৎকালীন দিনের সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্যকে কলেজে নিয়ে আসতে হবে বক্তৃতা দেওয়ার জন্যে। বিষ্ণুবাবু প্রথিতযশা মানুষ, অলংকার এবং ব্যাকরণ শাস্ত্রে ধুরন্ধর পণ্ডিত। আমি যেহেতু দীর্ঘদিন বিষ্ণুবাবুর ছাত্র ছিলাম এবং কলেজেও যেহেতু সদ্য-অধ্যাপক, অতএব তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা থেকে আরম্ভ করে তাঁর বক্তৃতার বিষয়বস্তু ঠিক করা এবং নির্দিষ্ট দিনে তাঁকে কলকাতা থেকে নবদ্বীপ কলেজে নিয়ে আসার সমস্ত দায়িত্ব আমার ওপর চেপে গেল। কাজটার মধ্যে আমার নিরানন্দ ছিল না, কেননা বিষ্ণুবাবুর সঙ্গে যে এক ঘণ্টা বসবে, সে যদি সাময়িকভাবে সহনশীল হয় এবং তাঁর প্রাথমিক ধাতানিটুকু মেনে নিতে পারে, তাহলে ওই এক ঘণ্টার মধ্যেই সে অনেক কিছু নতুন শিখবে।

মনে আছে, তখন গরমের দিন। আমি এবং বিষ্ণুবাবু পাশাপাশি সালার-প্যাসেঞ্জারে বসে নবদ্বীপ রওনা হয়েছি। বিষ্ণুবাবু পড়া ছাড়া বসে থাকতে পারতেন না। তিনি কী একটা পড়ছেন এবং আমার সঙ্গে অবান্তর কথা বলার জন্য এতটুকু ভ্রুকুটিও নষ্ট করছেন না। আমি তখন চৈতন্যদেবের পূর্ববর্তী ভক্তি-আন্দোলনের ধারা নিয়ে গবেষণা-টবেষণা করার চেষ্টা করছি। ভাবলুম—একটু জিজ্ঞাসা করি এবং একই সঙ্গে তাঁর তিরস্কার হজম করার জন্য প্রস্তুত হলাম। তাঁর গ্রন্থের ওপর চেতন নিবিষ্টতা ভেদ করে জিজ্ঞাসা করলাম—স্যর! আমি তো চৈতন্যদেব, তথা তাঁর পূর্ববর্তী ভক্তি-আন্দোলনের ধারা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছি অনেকদিন, কিন্তু চৈতন্য যেমন সরস ভক্তির কথা বলেন, যার মধ্যে অনুরাগের সম্বন্ধটাই বেশি, তেমনটা কি তাঁর পূর্বেও কিছু ছিল? আরও পরিষ্কার করে বলি—যেমন ধরুন, রূপ গোস্বামী যেমন তাঁর ভক্তিরসামৃতসিন্ধু বা উজ্জ্বল নীলমণি গ্রন্থে ভক্তিকে রস হিসেবে গ্রহণ করে তার গভীর বিচার করেছেন, তেমনটি কি প্রাচীন আলংকারিকরাও ভেবেছিলেন একটুও? প্রশ্নটা করে আমি চুপ করে রইলাম।

প্রথমত, বিষ্ণুবাবু তাকালেনই না, ভ্রূক্ষেপও করলেন না। পূর্বতন অভিজ্ঞতায় বুঝলাম—এবার আমায় সইতে হবে, তাঁর প্রাথমিক ক্ষণভগ্ন শব্দতেজ সইতে হবে এবার। কেননা তিনি চুপ করে আছেন মানেই তিনি সব শুনছেন এবং ভিতরে ভিতরে তাঁর উত্তর তৈরি হয়ে গেছে এবং সেই সঙ্গে ছাত্রের মূর্খতা প্রমাণের অধিক্ষেপটুকুও। প্রথমে ঠান্ডা মাথায় কথঞ্চিৎ অপাঙ্গ-কুঞ্চিৎ চক্ষে আমার দিকে তাকিয়ে বিষ্ণুবাবু বললেন—মন্মট ভট্টের কাব্যপ্রকাশ পড়েছ? আমি বললুম—হ্যাঁ স্যর! সে তো এম এ ক্লাসেই ছিল, আর আপনিই তো পড়িয়েছিলেন। শেষ কথাটায় তিনি হঠাৎই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন এবং আমি জানি, কারণ না থাকলেও এই ক্রোধ হওয়ারই ছিল। বললেন—পড়েছ তো মোটে দুটি উল্লাস। ব্যস! কাব্যপ্রকাশ পড়া হয়ে গেল। আমি তো-তো করছি দেখে আরও রেগে গিয়ে ঈষৎ সানুনাসিক স্বরে বললেন—তা হ্যাঁ, হে কলেজে পড়াচ্ছ। তোমার ঘটেও ইউনিভার্সিটির সিলেবাস, ছাত্রের ঘটেও ইউনিভার্সিটির সিলেবাস, তা কেমন পড়ানো হবে? কাব্যপ্রকাশ-এ দশটা উল্লাস (অধ্যায়) আছে, এখনও পর্যন্ত উলটেপালটে দেখার সময় পাওনি, আবার বুদ্ধি ফলিয়ে প্রশ্ন করছ?

আমি জানতুম—এই প্রাথমিক কটূক্তি-প্রবাহের পর তিনি প্রসন্ন হবেন, কিন্তু প্রশ্নের মীমাংসা করবেন সেই কটূক্তির আভাস বজায় রেখেই। বিষ্ণুবাবু বললেন—কাব্যপ্রকাশ-এর দশম উল্লাসে জনৈক শিবভক্তের খেদোক্তি আছে। ভগবান শিব তাঁকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তি পেয়ে ভগবান শিবের সঙ্গে একাত্মতা লাভের আশঙ্কায় সে কষ্ট পাচ্ছে। অদ্বৈতবাদী ‘সোহম’ অর্থাৎ ‘আমিই সেই ব্রহ্ম’—এই উপাসনার মাধ্যমে ব্রহ্মসাযুজ্য লাভ করেন, জীবাত্মা-পরমাত্মা একাকার হয়ে যায়। দ্বৈতবাদী এমন মুক্তি পছন্দ করে না। সে ভগবানের সেবাসুখ পেতে চায়। কিন্তু সমস্ত ধর্ম সম্প্রদায়ের মুক্তি-মোক্ষ নিয়ে এত হই-চই, বিশেষত শঙ্করাচার্য আসার পর থেকে মুক্তির প্রাধান্যবাদ এমন চরমে উঠেছিল যে ভক্তি-ভালোবাসায় ভগবানকে লাভ করার ব্যাপারটা একেবারে গৌণ স্থানে গিয়ে পৌঁছল।

নবদ্বীপগামী সালার-প্যাসেঞ্জার তখন নৈহাটি-ব্যান্ডেল হয়ে বাঁশবেড়িয়া ত্রিবেণী অতিক্রম করছে। তখনকার কালে নবদ্বীপের ট্রেনে দারুণ মিষ্টি পাওয়া যেত। একজন চেনা মিষ্টিওয়ালা আমাকে নিয়মিত মিষ্টি খাওয়ায়। আজকে আমাকে এক প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত দেখেও সে তার প্রাত্যহিক অভ্যাস ত্যাগ করল না এবং বারংবার শব্দনাদেও আমাকে অব্যাকুল দেখে সে আমার কাঁধে হাত দিয়ে বণিকোচিত দন্তবিকাশ করে বলল—মিষ্টি খাবেন না, স্যার! কাঁচাগোল্লা, রসকদম! আমি এতদ্বারা প্ররোচিত হয়ে বিষ্ণুবাবু এবং মিষ্টিওয়ালা—উভয়কেই তৃপ্ত করার জন্য বিষ্ণুবাবুকে বললাম—মিষ্টি খাবেন, স্যার? গভীর তাত্ত্বিক আলোচনা এইভাবে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় বিষ্ণুবাবু পূর্বের চেয়েও অধিক সানুনাসিকতায় আমাকে বললেন—তুমি খাও! হ্যাঁ তুমি খাও। কাব্যপ্রকাশ-এর দুই উল্লাস পড়ে তুমি এখন মিষ্টিওয়ালাদের ‘স্যার’ হয়েছ, তুমি খাও। আমি সঙ্গে সঙ্গে—এমনভাবে যেন মিষ্টিওয়ালাদের কোনোদিন দেখিইনি এইভাবে বললাম—এই যাও, যাও, দেখছ স্যরের সঙ্গে একটু কথা বলছি। হ্যাঁ স্যার। আপনি বলছিলেন—দ্বৈতবাদীরা নির্বাণ-মুক্তি পছন্দ করেন না।

বিষ্ণুবাবু প্রীতাপ্রীত-চক্ষে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—পড়াশুনো কর হে! এই তো সময় সবকিছু পড়ে নেওয়ার। সপ্তদ্বীপা বসুমতী, তার রহস্য জানতে গেলে পড়তে হবে। তোমাকে দ্বৈতবাদীর কথা বলছিলুম অলংকার গ্রন্থের উদাহরণ থেকে। এই যে মিষ্টিওয়ালা মিষ্টি নিয়ে এসেছিল, কেন এসেছিল? তুমি মিষ্টির রসাস্বাদন করবে বলে। তা এখন ভাবো—তুমি যদি নিজেই মিষ্টি হয়ে যাও, তবে মিষ্টির স্বাদ বুঝবে কী করে! দ্বৈতবাদী আর অদ্বৈতবাদীর এই তফাত। অদ্বৈতবাদী ব্রহ্মসাযুজ্যের মাধ্যমে নিজেই ব্রহ্মভূত হয়ে যায়, আর দ্বৈতবাদী পরব্রহ্মের রসকল্প আস্বাদন করতে চায়। কথাটা রামপ্রসাদ খুব সহজে বলেছিলেন—মাগো! নির্বাণে কী আছে ফল/জলেতে মিশায় জল/চিনি হওয়া ভালো নয় মন চিনি খেতে ভালোবাসি। এবার বাড়ি গিয়ে কাব্যপ্রকাশ-এর দশম উল্লাস খুলে দেখো; সব কিছুই মুখে মুখে হয় না। একটু পড়, কষ্ট কর, সপ্তদ্বীপা সেতিহাসা বসুমতী।

বুঝলাম—বিষ্ণুবাবুকে দিয়ে আর কথা বলানো যাবে না। নবদ্বীপের বিদ্বৎসভা সেরে বাড়ি ফিরলাম পরের দিন। ঘাঁটতে আরম্ভ করলাম কাব্যপ্রকাশ-এর দশম উল্লাস। পেয়ে গেলাম বিষ্ণুবাবুর উচ্চারিত উদাহরণ শ্লোক। বিষ্ণুবাবু বলেছিলেন—প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে মন্মটাচার্য ভক্তিকে নয়-নয়টা রসের মধ্যে স্থান দেননি, কিন্তু এই শ্লোক দেখলে বোঝা যায় ঈশ্বরের জন্য দ্বৈতবাদীর ভক্তি-ভালোবাসা কাকে বলে! শ্লোক পড়ে মন জুড়িয়ে গেল। শ্লোকের অন্তর্নিহিত ভাবে বোঝা যাচ্ছে—এক শিবভক্তের প্রতি করুণা করে ভগবান শিব তাঁকে সর্বজনকাম্য মোক্ষ-বর দিয়ে দিয়েছেন। সে শিবভক্ত ছিল, এবার সাযুজ্য মুক্তি লাভ করে শিবত্ব লাভ করেছে। এ-অবস্থা তার ভালো লাগছে না, শ্লোকের মধ্যে তার আর্তি ভেসে আসছে।

শিবভক্ত বলছে—বেশ তো ছিলাম এই শিবমন্দিরে পুজো-আচ্চা নিয়ে। গলায় একটা রুদ্রাক্ষের মালা পড়তাম, শিবনাম জপ করতাম রুদ্রাক্ষের গুটিকায়। আজ থেকে আর মালাও পরতে হবে না, জপও করতে হবে না। আমার নাকি মুক্তি হয়েছে। আর এই আমার শিবমন্দিরের শ্বেতশুভ্র সোপানগুলি, যাতে পায়ে পায়ে পৌঁছে যাওয়া যায় গিরিজা-গৌরীর প্রাণপ্রিয় শিবমূর্তির কাছে, এই সোপানগুলি আমি প্রতিদিন ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে রাখতাম, শিবভক্তেরা সেই পরিমার্জিত সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতেন শিবমূর্তির সামনে। হায়! আজ থেকে আমায় আর কিছুই করতে হবে না—হা সোপান-পরম্পরাং গিরিসুতা- কান্তালয়ালংকৃতিম—আমার সেবা-আরাধনায় তুষ্ট হয়ে বিভু শিব আমাকে তাঁর সেবা-সুখ থেকে বঞ্চিত করেছেন। মোক্ষ বলে এক মহামোহ আছে কত-শত মানুষের, তাতে এই জগতের সত্তা বোধটাই লুপ্ত হয়ে যায়—কিছু শিব আমাকে সেই মোহের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়েছেন। হায় ভগবান! আমি কি এই চেয়েছিলাম!

শ্লোক পড়ার পরে আমার ভিতরে এক অসাধারণ অনুভূতির সৃষ্টি হল। আমি তো আশৈশব এই পরিবেশের মধ্যেই বড় হয়েছি—যেখানে অন্যান্য বহুতর ধর্মসম্প্রদায়ের কাম্য মোক্ষ, মুক্তি, নির্বাণ একেবারে তুচ্ছ হয়ে গেছে। আরও আশ্চর্য হলাম এই কারণে যে, মহামতি চৈতন্য নন, তাঁর অনেক পূর্বকাল থেকেই তাঁর পরম রসায়ন ভক্তিবাদের জমি তৈরি হচ্ছিল তাহলে। গবেষণায় তো এ-কথা ভালোভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদে ভারতবর্ষের সমস্ত দার্শনিক এবং ধর্মীয় তত্ত্ব একেবারে আমূল আলোড়িত হয়ে গিয়েছিল। ভারতবর্ষের মাটিতে তখন গিরি, পুরী, ভারতী, স্বামী, সরস্বতীরা একচ্ছত্র দার্শনিক অধিকার ভোগ করছেন। এমনকী শঙ্করমতের বিরুদ্ধে রামানুজ-নিম্বার্ক-মধ্বাচার্যেরা যে দ্বৈতবাদী মত প্রচার করলেন, তাঁরা বিষ্ণু-নারায়ণের মতো ভাবধারী ভগবানের প্রতিষ্ঠা জাগিয়ে তুললেন বটে, কিন্তু মুক্তির ভাবনাটা তাঁদের মন থেকে গেল না। ভগবৎ-সাধনের পরম উপায় হিসেবে ভক্তিকেও তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু ভক্তিকে তাঁরা ব্যবহার করেছেন মুক্তিলাভের উপায় হিসেবে, ভক্তি তাঁদের কাছে সেবাবৃত্তির ভাবনায় রসায়িত হয়ে উঠল না কোনোদিন।

বিষ্ণুবাবুর মুখে উচ্চারিত কাব্যপ্রকাশ-এর শ্লোক আস্বাদন করে আমার গবেষণায় নতুন দিগন্ত খুলে গেল। বুঝলাম—চৈতন্যদেবের পুণ্যজন্মের অনেক আগে থেকেই তাঁর ভক্তিরসবাদ কিছু কিছু মানুষের অন্তর্গত হয়েছে। প্রথমেই বলেছিলাম—যে পারে সে অমনি পারে, সবাই পারে না। অদ্বৈতবাদী শংকরাচার্যের ভাবনা-ভাবিত দশনামী সম্প্রদায়ের তখন এমন দোর্দণ্ডপ্রতাপ যে, সন্ন্যাসী হতে গেলে গিরি পুরী ভারতী না হলে, তাঁদের সন্ন্যাসী বলেই কেউ মানত না। কিন্তু শঙ্করমতের সন্ন্যাসী হয়েও—কেননা গুরুর উপাধি পুরী-ভারতী বহিরঙ্গে ধারণ করেও অন্তচিন্তিত সিদ্ধ দেহের মধ্যে জ্যোতিঃস্বরূপ ব্রহ্মের পরিবর্তে জ্যোতিষ্মান ঈশ্বরের মনুষ্যকল্প লালন করে যাওয়ার জন্য গুরুর চেয়েও বৃহত্তর বিভূতিময় এক মহাসত্ত্বের প্রয়োজন হয়, গুরুর মর্যাদা রেখেও নিজমত প্রকাশের জন্য অধিকতর এক স্বাতন্ত্র্যও লাগে। চৈতন্য জন্মের পূর্বে একশো/দুশো বছরের মধ্যে এইরকম দু-চারজন বিভূতিময় সত্ত্বের প্রকাশ ঘটেছিল। তাঁদের একজনের কথা না বললে চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবন-সাধনাটাই বোঝা যাবে না। শুধু তাই নয়, এই মানুষটার জন্য তৎকালীন ভারতের অন্যতর অংশের সংস্কৃতি এই বাংলার হৃদয়ের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল—যার ফলশ্রুতি স্বয়ং চৈতন্যদেব।

কেউ বলতে পারে না, তিনি কোন দেশের লোক। গবেষণা তাঁকে বাঙালি করে তুলতে পারেনি, আবার তাঁকে দক্ষিণ-ভারতীয়ও করে তুলতে পারেনি, আবার তিনি যে মুম্বই অঞ্চলের মানুষ তাও বলা যায় না। তবে শেষ জায়গাটা থেকেই আমাদের অন্বেষণ আরম্ভ করতে হবে। মুম্বই প্রদেশে ভীমা নদীর তীরে শোলাপুর জায়গাটা এখনও বেশ পরিচিত। সেন্ট্রাল রেলওয়েতে বোম্বে-পুণা-কুরদ-ওয়াদিরাইচুর লাইন থেকে ব্রাঞ্চ লাইনে পড়বে পানঢারপুর (পান্ডারপুর) স্টেশন। এখানেই বিটঠলনাথজির মন্দিরে। বিটঠলনাথজির মন্দির বিগ্রহের ডাকনাম বিঠোবা। এই মন্দিরে একবার আমরা লক্ষ্মীপতি পুরী নামে এক অদ্বৈতবাদী সন্ন্যাসীকে দেখতে পেয়েছি। তবে এই মন্দিরেই যে তিনি সেদিন ছিলেন, তা নয়। সন্ন্যাসী মানুষ, তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ান। এমন হতেই পারে, তিনি তখন দক্ষিণ ভারতের কোনো মন্দিরে ভগবান কৃষ্ণের অন্য কোনো মূর্তি দেখে আপ্লুত বোধ করেছিলেন। সন্ন্যাসী শঙ্করাচার্যের প্রবর্তিত দশনামী সম্প্রদায়ের মানুষ, কিন্তু কৃষ্ণের লীলামাধুরী তাঁর সোহং-ব্রহ্মবাদকে দূরে সরিয়ে দিয়ে তাঁকে রসিক ভক্ত করে তুলেছে।

এমনটা অসম্ভব নয়। ভগবান কৃষ্ণের মধ্যেই সেই মাধুর্য সৌন্দর্য চমৎকারিতা আছে, যাতে শুষ্ক-রুক্ষ্ম মুনির হৃদয়ও আর্দ্র-সিক্ত হয়ে ওঠে। ভাগবতপুরাণ একবার বলেছিল যে, আত্মারাম মুনি যাঁরা, যাঁরা এই জীবনেই নিজের মধ্যে পরব্রহ্মজ্যোতিকে একত্তর করে ফেলেছেন, সেই তাঁরা পর্যন্ত ব্রহ্মাত্মকতাবাদ দিয়ে নিজে কৃষ্ণের ভক্তিকৌতুকে মোহিত হয়ে পড়েন— কুর্বন্ত্যহৈতুকীং ভক্তিম ইত্থংভূতগুণো হরিঃ। লক্ষ্মীপতি পুরী গোঁসাইও সেইরকম। শঙ্করমতে দীক্ষালাভ করেও তিনি বিভিন্ন কৃষ্ণ-মন্দিরে ঘুরে বেড়ান, কৃষ্ণের লীলারসে তিনি মগ্ন। এই লক্ষ্মীপতির সঙ্গেই দেখা হয়ে গেল এক বৃদ্ধপ্রায় মানুষের। মনে মনে তাঁর সন্ন্যাস হয়ে গেছে বহুকাল, কিন্তু এখনও গুরুর কাছে দীক্ষা হয়নি। হয়তো বা মনের মতো গুরুও খুঁজে পাননি, যিনি তাঁকে পরম আনন্দের পথে নিয়ে যাবেন। দশনামী গুরকুদেব সোহংবাদ তাঁর মনের সঙ্গে লড়ে না, অথচ তাঁরা ছাড়া ত্যাগ-বৈরাগ্যপ্রধান গুরুও তেমন নেই। কাজেই এই বৃদ্ধপ্রায় ব্যক্তিটির সন্ন্যাস-দীক্ষা হয়নি এখনও। লক্ষ্মীপতি পুরীর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর সেদিন তাঁর জীবনটাই পালটে গেল।

লক্ষ্মীপতি পুরী শঙ্কর প্রবর্তিত সম্প্রদায়ের অন্যতম আচার্য হলেও ভগবান কৃষ্ণের রূপ-গুণ-লীলা তাকে উদবেল করে তোলে। কিন্তু অদ্বৈতবাদের বীজ তাঁর মনে প্রোথিত থাকায় এখনও তিনি কৃষ্ণকে তাঁর আপন স্বরূপে আবিষ্কার করতে পারেন না। বৃদ্ধপ্রায় মানুষটি লক্ষ্মীপতির ভাব দেখে ভাবেন—এই যথেষ্ট। এঁর কাছেই তিনি দীক্ষা নেবেন। বাকি যেটুকু থাকবে সেটুকু শিষ্যের কাজ। গুরুরা দীক্ষা দেন, শিক্ষা দেন, আরও অনেক কিছু করেন, কিন্তু সুশিষ্যের প্রতি দত্ত বিদ্যা শিষ্যের অন্তর্গত বৈদগ্ধ্যে আরও অধিক স্ফূর্তি লাভ করতে পারে। বৃদ্ধপ্রায় মানুষটি লক্ষ্মীপতি পুরীর কাছে দীক্ষা নিলেন, তাঁর নতুন নাম হল মাধবেন্দ্র পুরী। শঙ্কর-সন্ন্যাসের উপাধি ওই ‘পুরী’ নামটুকুই অবশিষ্ট রইল, মাধবেন্দ্রের শরীর-মন জুড়ে রইল কৃষ্ণলীলার মাধুর্য। সংশয়-জড়িত ভাবে পুরী ভাবলেন—আমি কি অন্যায় করছি, ভুল করছি। গুরুর কাছে যেমন দীক্ষা নিলাম, তাতে কি আমারই দোষ হচ্ছে না? পুরীর মনে পড়ে গীতার শ্লোক, কৃষ্ণের নিজের মুখের কথা—সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ—বর্ণধর্ম, আশ্রমধর্ম সব ত্যাগ করে তুমি আমার শরণাপন্ন হও, আমি তোমার সব পাপ ধুয়ে দেব।

অন্তর্হৃদয়ে মাধবেন্দ্র উপলব্ধি করেন—কৃষ্ণ তো গুরুরও গুরু, পার্থসারথিরূপে তিনিও তো গুরুর ভূমিকাতেই আছেন, অতএব আর সংশয় নেই। বেদের চরৈবেতি মন্ত্রে পথ চলতে চলতে মাধবেন্দ্র পুরীর মুখে সেই শ্লোক উচ্চারিত হল, যার মর্মকথা আমি সেই শিবভক্তের মুখে শুনেছিলাম অনেককাল আগে মন্মটাচার্যের কাব্যপ্রকাশ গ্রন্থে। বিষ্ণুবাবু স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন—সেই শিবভক্ত দুঃখ পাচ্ছিল—তাঁর জপের রুদ্রাক্ষমালা, ভস্মতিলককে বিদায় দিতে হচ্ছে বলে। মাধবেন্দ্রের এই শ্লোক একই সুরে উচ্চারিত, বাচনভঙ্গিও প্রায় এক, কিন্তু শ্লোকের মর্মে আছে আত্মনিবেদন, শরণাগতি। চৈতন্যপার্ষদ রূপ সংগ্রহ করেছেন, কিন্তু এই শ্লোক আছে লীলাশুক বিল্বমঙ্গলের কৃষ্ণকর্ণামৃত গ্রন্থে। হয়তো কৃষ্ণের জন্য বিল্বমঙ্গলের সেই আত্মনিবেদন মাধবেন্দ্র পুরী আত্মসাৎ করেছিলেন বলেই রূপ গোস্বামী মাধবেন্দ্রের নামে এই শ্লোক মহিমান্বিত করেছেন।

শ্লোকের শরণাগতিতে মাধবেন্দ্র ক্ষমা চেয়ে বলেছেন—এতকাল যে ব্রাহ্মণসুলভ আচরণে সকাল-সন্ধ্যায় গায়ত্রী উচ্চারণ করে সন্ধ্যাবন্দনা করতুম, আজ থেকে বিদায় দিলুম তাকে! ব্রাহ্মণত্বের জাগরণে তিন-তিনবার স্নান করে যে শরীর পবিত্র করতুম, আজ থেকে তারও আর দরকার নেই। সন্ধ্যাবন্দনা সুখে থাকুন, স্নান-পবিত্রতাকেও নমস্কার—সন্ধ্যাবন্দন ভদ্রমস্তু ভবতে ভো স্নান তুভ্যং নমঃ। মাধবেন্দ্র সমস্ত বৈদিক দেবতা আর পূর্বপ্রেত পিতৃগণকে আহ্বান জানিয়ে বললেন—কর্মযজ্ঞে যাঁদের বার বার আহ্বান করেছি, আমার সেই বৈদিক দেবতারা! প্রতিদিন যাঁদের উদ্দেশে অঞ্জলি তর্পণ করেছি আমার পিতামহ-পিতাঠাকুরেরা! আর আমি কিছুই করতে পারব না, এতদিন যা দিয়েছি, তাতেই তুষ্ট থাকো তোমরা, আর আমি কিছুই করতে পারব না। আর পারব না বলে যদি কিছু পাপ ঘটে থাকে তবে সে পাপও ধুয়ে ফেলেছি যাদবোত্তংশ কৃষ্ণের কথা বার বার স্মরণ করে। তাছাড়া একবার যখন তাঁর পায়ে আত্মনিবেদন করেছি, তখন এটাই সার বুঝেছি যে, আমার আর কিছুরই প্রয়োজন নেই—তদলং মন্যে কিমন্যেন মে।

এটা ঠিক যে, সন্ন্যাসীর জীবনে এমনিতেই ত্রিসন্ধ্যা স্নান অথবা তিন সন্ধ্যায় আহ্নিককৃত্যের শৃঙ্খল থাকে না, থাকে না পিতামাতার প্রতি শ্রাদ্ধতর্পণের ইতিকর্তব্য। মাধবেন্দ্র পুরীর এই শ্লোকোক্তি থেকে এই ভাব মনে আসতে পারে যেন এতকাল এই প্রায়-বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বর্ণাশ্রমধর্মের শুষ্করুক্ষ আচার তাঁকে পীড়া দিচ্ছিল। আসলে কিন্তু তা নয়। এই শ্লোক উচ্চারণ করে মাধবেন্দ্র বোঝাতে চাইছেন—তিনি কৃষ্ণের একান্ত শরণাগত, তাই তাঁর বর্ণধর্ম আশ্রমধর্মের বালাই নেই; আরও যেটা তিনি বোঝাতে চাইছেন, সেটা হল— যে সম্প্রদায়ে তিনি সন্ন্যাস-দীক্ষা নিলেন সেই সম্প্রদায়ের আনুক্রমিক আচার অথবা সেই সম্প্রদায়ের তত্ত্বগত আদর্শও তাঁর একান্ত সাধন নয়, বর্ণাশ্রমধর্ম-ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সাম্প্রদায়িক ধর্মেরও অতিক্রম ঘটিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন—কৃষ্ণ ছাড়া আমার আর কাউকে চাই না, কোনো কিছুরই দরকার নেই আমার—তদলং মন্যে কিমন্যেন মে।

দেখুন, শুধু ‘শরণাগতি’ শব্দটার মধ্যেও এক ধরনের শুষ্কতা আছে, মাধবেন্দ্র পুরী কৃষ্ণের লীলা-মাধুর্যে আপ্লুত—সেই আপ্লুতি তাঁকে একদিকে যেমন ব্রহ্মসাযুজ্যের সো’হংবাদী আদর্শ থেকে সরিয়ে এনেছে, তেমনই তা শুধু এক শরণাগত ভক্তের আত্মনিবেদনের ঐকান্তিকতাটুকুকেও রসায়িত করে তুলেছে। চৈতন্যচরিতামৃত-এর কবি মাধবেন্দ্র পুরীর সম্বন্ধে লিখেছেন—মাধবেন্দ্র পুরীর কথা অকথ্যকথন। মেঘ দেখিলেই তিঁহ হয় অচেতন। আকাশে কালো মেঘ দেখলেই কৃষ্ণের কালো রূপের কথা তাঁর মনে পড়ে। তিনি পাগলের মতো এখানে ওখানে ছুটে বেড়ান—যদি কোথাও কৃষ্ণের দেখা মেলে। মনে মনে ভাবেন—কোথায় সেই অলকা-তিলকা মাখা মুখখানি, কোনো কদমগাছের তলায় কদমফুলের মালা পরে কোথাও হয়তো দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, কোথায় তাঁর দেখা পাব—কদা দ্রক্ষ্যামি নন্দসা বালকং নীপমালকম…লসত্তিলক-ভালকম।

পণ্ডিতেরা বলেছেন—শঙ্করাচার্যের বিরুদ্ধে যে দার্শনিকেরা তর্কযুক্তি সহকারে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন তাঁরা মূলত বৈষ্ণব। রামানুজ, নিম্বার্ক, বিষ্ণুস্বামী বা মধ্বাচার্য—এঁরাই শঙ্কর-পরবর্তী যুগের চার সম্প্রদায়-প্রবর্তক বৈষ্ণবাচার্য। কিন্তু মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের ভাবধারা এঁদের সঙ্গে মেলে না। চৈতন্য মহাপ্রভুর সরসা ভক্তির মূলে আছেন এই মাধবেন্দ্র পুরী—যাঁকে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের বেদগ্রন্থ বলেছে—তিনি চৈতন্য-প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের আদি সূত্রধার—ভক্তি-কল্পতরুর তিঁহো প্রথম অঙ্কুর। চার বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সাধ্য-সাধনের সম্পর্কহীন এই রসময়ী ভক্তি মাধবেন্দ্র পুরীই বা কোথা থেকে পেলেন? পণ্ডিতেরা বলেছেন—দক্ষিণ ভারতের আলবর-সাধকেরা এই ভাবের ভাবুক। তাঁদের রসময়ী ভক্তির পরম্পরার সঙ্গে ভাগবত পুরাণ এবং লীলাশুক বিল্বমঙ্গলের কৃষ্ণকর্ণামৃত-এর মধুর ভক্তিরস মাধবেন্দ্র পুরী বয়ে এনেছিলেন দাক্ষিণাত্য থেকে। মাধবেন্দ্র পুরীর পর্যটন সূত্রগুলিও এখানে দেখার মতো। সুদূর দাক্ষিণাত্যে দীক্ষা নিয়ে তিনি কৃষ্ণপ্রেমে পাগল হয়ে আস্তানা নিলেন লীলাভূমি বৃন্দাবনে। আর এখানেই তো সেই অদ্ভুত অলৌকিক কাণ্ড ঘটে গেল—যা সাধারণভাবে বললে আজকের মানুষ বিশ্বাসই করবে না।

মাধবেন্দ্র পুরী অযাচকবৃত্তি সন্ন্যাসী। জীবনধারণের জন্য সামান্য খাদ্যটুকুও তিনি কারও কাছে চাইবেন না। কেউ কিছু দিয়ে গেল তো ঠিক আছে, তিনি নিজে কারও কাছে যাচনা করেন না, বরং উপবাসী থাকেন। একদিন এইরকমই উপোস করে আছেন। বৃন্দাবনবাসীরা কৃষ্ণের গোবর্ধনলীলা স্মরণ করে অনেকেই গোবর্ধন পরিক্রমা করে। মাধবেন্দ্রও সেদিন পরিক্রমা সেরে বসে আছেন গোবিন্দকুণ্ডের তীরে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, মৃদু স্বরে কৃষ্ণনাম করছেন। সারাদিন খাওয়া হয়নি, খাওয়ার জন্য কোনো তাড়নাও নেই। হঠাৎই এক গোপবালক এক ভাঁড় দুধ নিয়ে এসে মাধবেন্দ্র পুরীর সামনে দাঁড়াল। ভাঁড়-ভর্তি দুধ তাঁর হাতে দিয়ে বলল—আমি পরে এসে ভাঁড় নিয়ে যাব। তুমি দুধ খেয়ে ভাঁড় রেখে দিও। আমি এই গ্রামেই থাকি, অযাচকদের আহার জোগাই আমি। তুমি খাও, আমি এই এলাম বলে।

পুরী গোঁসাই দুধ খেয়ে ভাণ্ড ধুয়ে বসে আছেন। মুখে কৃষ্ণনাম চলছে, কিন্তু রাত অন্ধকার হয়ে গেল সে বালক আর আসে না। শেষ রাতে যখন নিদ্রার আবেশে তিনি প্রায়াচ্ছন্ন, তখন ঘুমঘোরে মনোহর সেই বালক এল। পুরী গোঁসাই স্বপ্ন দেখছেন—বালক তাঁর হাত ধরে এক কুঞ্জে নিয়ে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে বলল—আমি গোবর্ধনের অধিপতি গোপাল। ম্লেচ্ছ আক্রমণের ভয়ে আমার সেবকেরা আমাকে কুঞ্জে রেখে চলে গেছে। রোদ-বৃষ্টি-শীতে আমার বড় কষ্ট। এতদিন তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। তুমি আমাকে কুঞ্জ থেকে বাইরে এনে আমার সেবা প্রতিষ্ঠা করো।

‘ম্লেচ্ছ আক্রমণ’। হ্যাঁ, ভারতবর্ষে তখন ইতস্তত মুসলমান রাজাদের আধিপত্য কায়েম হয়েছে। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন যে, মাধবেন্দ্র পুরী ১৪২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই ধরাধামে বর্তমান ছিলেন। তিনি যদি একটু বেশি বয়সেও দীক্ষা নিয়ে থাকেন, তবে তাঁর পরিপূর্ণ ভক্তি আন্দোলনের সময় ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল খুব খারাপ। ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর লঙ ভারত আক্রমণ করেন, তখন থেকে দিল্লিতে কোনো একছত্রী মুসলমান রাজা ছিলেন না। ১৪৫০ থেকে ১৪৭৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বহলোল লোদী দিল্লি অধিকার করেন বটে, কিন্তু তাঁর আশেপাশে সমস্ত রাজ্যে তখন মুসলমান শাসনের ডামাডোল চলছে। এ-রাজ্যের সঙ্গে ও-রাজ্যের বিবাদ বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে—যদিও সেসব সংঘর্ষও ছিল ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা মুসলমান শাসকদের মধ্যেই নতুন করে ক্ষমতা লাভ করার সংঘর্ষ। ফলে অত্রস্থ মানুষের মনে অন্যধর্মী শাসকের ভয় রীতিমতো চেপে বসেছিল। ভারতীয় মানুষের বিশ্বাস এবং আস্থার জায়গা যে দেবমন্দিরগুলি, সেগুলি সহজেই আক্রান্ত হত মুসলমান উৎপীড়কদের হাতে এবং এখানে রাজা যতখানি উদ্যোগী হতেন, তার চেয়ে বেশি উৎসাহী হতেন পারিষদবর্গ, কেননা বিশ্বাস নষ্ট করার মধ্যে যে ক্রুরতা কাজ করে—সে ক্রুরতা রাজার চেয়ে তার পারিষদবর্গের বেশি থাকে।

মাধবেন্দ্র পুরীর মনে কিন্তু এই ম্লেচ্ছভয় নেই। দিল্লিতে ফিরোজ শাহ আছেন, নাকি বহলোল লোদী আছেন—এসব তাঁর ভাবনার মধ্যে আসে না। ভোররাতের স্বপ্নে গোপাল-বালকের স্বপ্ন দেখে তিনি শুধু রাত্রির আঁধার কাটার অপেক্ষায় ছিলেন। সকাল হতেই পুরী গোঁসাই গোবর্ধনবাসী মানুষদের সঙ্গে নিয়ে বনের মধ্যে গেলেন—যেখানে তাঁর স্বপ্নে দেখা ঠাকুর আছেন। খানিকক্ষণ খনন চলার পরেই মাটির অন্তরাল দেখে বেরিয়ে এল গোপাল বিগ্রহ। পুরী গোঁসাই সেই বিগ্রহ বুকে করে এনে তাঁর সেবা প্রতিষ্ঠা করলেন গোবর্ধনের ওপরেই। দিনে দিনে সেবার সমারোহ বেড়ে উঠল এবং এখনও সেই গোপালের সেবা-স্মরণের চিহ্ন রয়ে গেছে মাধবেন্দ্র-প্রবর্তিত অন্নকূট মহোৎসবের মধ্যে।

আমি চৈতন্য মহাপ্রভুর কথা বলতে গিয়ে মাধবেন্দ্র পুরীর কথা যে এত বলছি তার কারণ চৈতন্য-প্রবর্তিত ভক্তি সাধনার ধান ভানতে হলে এই শিবের গীত নিতান্তই জরুরি। আমি ভেবে অবাক হই—এক প্রায়-নতুন ভক্তি আন্দোলনের ধারা প্রবর্তনের জন্য মাধবেন্দ্র পুরী যে ভৌগোলিক পথ নির্বাচন করেছিলেন, মহাপ্রভু চৈতন্যও অনেককাল পরে সেই পথ ধরেই তাঁর ভক্তি-আন্দোলনের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। অবশ্য সে কথা বলতে গেলেও আবার শিবের গীত গাইতে হবে অর্থাৎ সেখানেও হৃদয়হারী কাহিনি আছে। আপনারা বলতে পারেন—এসব কথা, কাহিনি, উপাখ্যান শোনাচ্ছ কেন? বেশ তো একেবারে আবেগহীন ভাবে নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকের মতো চৈতন্যের ঐতিহাসিক পটভূমি বিচার করে তাঁর সারস্বত জীবনের কথা বলতে পারতে। আমি বলব—ইতিহাস বিচারের ভাবনা-চিন্তা কিন্তু পালটেছে। ঐতিহাসিকেরা আজকাল লোকপ্রচলিত, অথচ প্রায়-সত্য ঘটনাগুলিকে ইতিহাস-অর্থনীতি-সমাজনীতির আলোয় নতুন করে ভাবছেন। নইলে ভাওয়াল সন্ন্যাসীর কাহিনি নিয়ে পার্থ চ্যাটার্জীর ‘প্রিন্সলি ইমপস্টার’ অথবা গৌতম ভদ্রের জাল প্রতাপচাঁদ নতুন করে ভাবাত না। তাছাড়া মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের ভক্তি-আন্দোলনের মধ্যে এক ভয়ংকর প্রাণময় আবেগ আছে আর সেই সব আবেগ-অনুভূতি ছড়িয়ে আছে শত শত মহাজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে, শত শত কাহিনির মধ্যে। অতএব কাহিনি না বললে ইতিহাসে যাওয়া সম্ভবই নয়।

মাধবেন্দ্র পুরী মহাসমারোহে তাঁর ‘লসত্তিলক-ভালক’ গোপালকের সেবা চালাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে আবারও তাঁর স্বপ্নে এলেন সেই মনোহর সুন্দর মূর্তি—গোপবেশ বেণুকর, নবকিশোর নটবর। তিনি বললেন—তুমি আমার অনেক সেবা করেছ, গোঁসাই! তবু আমার শরীরের জ্বালা জুড়লো না। এতদিন তো রোদ বৃষ্টিতে কষ্ট পেয়েছি, শরীরের জ্বালা তাই বড় বেশি। তুমি এক কাজ করো। মলয় পর্বতের চন্দন বড় শীতল, তুমি সেই চন্দন নিয়ে এসে আমার বিগ্রহ-শরীরে লেপন কর, তাতে আমার জ্বালা যাবে। পুরী বললেন—কোথায় পাব আমি মলয়-চন্দন? তাছাড়া প্রতিদিন গোপালের নিত্যসেবা ছেড়ে আমি যাবই বা কোথায়? স্বপ্নে দেখা বালক বলল—মলয়জ আন যাই নীলাচল হৈতে। অর্থাৎ নীলাচল জগন্নাথে গেলেই তোমার চন্দনের জোগাড় হয়ে যাবে। কিন্তু স্বপ্নাদেশে আরও বলা হল—অন্যকে দিয়ে সেই চন্দন আনালে চলবে না। তোমাকে নিজে যেতে হবে—অন্য হৈতে নহে তুমি চলহ ত্বরিতে।

জানি, বেশ ভালো জানি যে, যুক্তিবাদী মানুষ বলবে—এসব হল গেঁজেলের কথা। আরে ভগবান হলেন সর্বশক্তিমান। তাঁর যদি ইচ্ছা হয়, তবে তো মুহূর্তের মধ্যে শত বৃক্ষের চন্দন-প্রলেপ তাঁর অঙ্গ জুড়িয়ে দিতে পারে। আমরা বলি—অত দূরে চিন্তা কেন? সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের শরীরে তাপ সৃষ্টি হওয়ার প্রসঙ্গই তো আসে না—এমন ভাবলেই তো হয়। আর যদি বা তাপ সৃষ্টি হয়, তবে আবার চন্দনের প্রয়োজন কী, ইচ্ছামাত্রেই তো তিনি শীতোষ্ণ-বাষ্পায়িত হতে পারেন। কিন্তু ঈশ্বরের এই সর্বশক্তিমত্তায় বিশ্বাস করেও তাঁর এই মনুষ্যসুলভ রসায়ন—এটাই ভাগবত-দর্শনের বৈশিষ্ট্য। তাঁর অখিল পারিষদকুল এবং ভক্তকুলের কাছে ঈশ্বরের এই সাপেক্ষ ব্যবহার তাঁকে অশব্দ-অস্পর্শ-অরূপের অনির্বচনীয়তা থেকে নিতান্ত প্রাণময় করে তোলে—তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে তুমি তাই এসেছ নীচে/আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে। এইরকম একটা দর্শনেই মাধবেন্দ্র পুরীর মতো রসিক ভক্তের কাছে অমন স্বপ্নের আবদার ভেসে আসে—অন্য হৈতে নহে তুমি চলহ ত্বরিতে।

আসলে এ তো নিছক স্বপ্নাদেশ নয়, এই চন্দন-ভ্রমণের মাধ্যমেই মাধবেন্দ্র পুরীর প্রেমময় ভক্তির পরম অভ্যুদয় ঘটবে বাংলার বুকে এবং তা যুক্ত হবে ওড়িশা-বৃন্দাবনের বৃত্তে পুনরাবর্তনের মহিমায়। মাধবেন্দ্র পুরী সোজাসুজি নীলাচলে গেলেন না। গোপালের স্বপ্নাদেশে তিনি চন্দন আনতে রওনা দিলেন বটে, কিন্তু পথের সুবিধার জন্যই হোক, কিংবা অন্য কোনো টানে তিনি বৃন্দাবন থেকে পায়ে হেঁটে পৌঁছালেন এই বাংলাদেশে। পণ্ডিতেরা অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন—বৃন্দাবন থেকে পুরী যাওয়া যেত অনেক সহজে, প্রায় বৃদ্ধ পুরীর পক্ষে সেটাই সহজ ছিল, কিন্তু তবু যে তিনি পথ চলতে চলতে চলে এলেন এই শ্যাম বঙ্গদেশে, তার কিছু কারণ থাকবে নিশ্চয়। প্রথম হতে পারে, তিনি বাঙালি ছিলেন। সন্ন্যাসীর পরিব্রাজকতা তাঁকে এখানে-সেখানে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ালেও এই শ্যামল-সুন্দর বাংলাদেশ তাঁকে নিজের অন্তর্গত আকর্ষণে টেনে নিয়ে এসেছে। দ্বিতীয়ত হতে পারে—বঙ্গভূমিতে মাধবেন্দ্রের পূর্ব-পরিচিত কিছু মানুষজন ছিলেন—যাঁরা তাঁর পরিব্রাজনের সময় থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন। এতদিনে যখন সময় হল, তখন প্রথম সুযোগেই মাধবেন্দ্র তাঁর অনুরাগময়ী ভক্তির প্রেমস্পর্শ লাগিয়ে দিলেন বঙ্গভূমির গায়ে।

পণ্ডিতেরা বলেন—মাধবেন্দ্র পুরী বাঙালি ছিলেন কিনা সেটা প্রমাণ করবার মতো তথ্যও যেমন আমাদের হাতে নেই, তেমনই সেটা অপ্রমাণ করার মতো তথ্যও আমাদের হাতে নেই। অর্থাৎ তিনি অবাঙালি হতেও পারেন, আবার নাও পারেন। অবশ্য তাতে কিছুই আসে যায় না। কেননা যদি দ্বিতীয়টাও হয়, অর্থাৎ এখানে তাঁর পূর্বপরিচিত কিছু ব্যক্তি ছিলেন, যাঁদের আকর্ষণ তিনি এড়াতে পারেননি, তাতেও যা ফল হওয়ার, তাই-ই হয়েছে। বস্তুত পূর্বপরিচিত ব্যক্তি না থাকলে বঙ্গভূমিতে তাঁর ভক্তি-দর্শনের ভাবধারা এত সহজে প্রোথিত হত না। আর এই পূর্বপরিচয় খুব অসম্ভবও নয়। গৌড়বঙ্গে নবদ্বীপ তখন অন্যতম বিদ্যাকেন্দ্র। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে পণ্ডিত-সজ্জনের নবদ্বীপে আসাটা তখন মোটেই অসম্ভব ছিল না। সেই কারণে মাধবেন্দ্র যদি অন্য প্রদেশের মানুষও হয়ে থাকেন, তবুও পূর্বে এই বাংলায় তাঁর আনাগোনা হয়ে থাকতে পারে এবং পূর্বপরিচিত মানুষজনও কিছু থেকে থাকতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, নিজভাবের ভাবুক যেখানে থাকে সেখানে একটা বিশেষ আকর্ষণ থাকে। বঙ্গভূমি গীতিগোবিন্দ-এর দেশ, এখানে কৃষ্ণলীলার চর্চা চলছে বহুকাল ধরে। বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসের গীত তখন বঙ্গভূমিকে প্লাবিত করেছে—এইরকম একটা আবহ যেখানে পূর্বেই তৈরি ছিল, সেখানে মাধবেন্দ্র পুরীর ভাবের ভাবুক অনেকেই থাকার কথা এবং ছিলও।

কথাটা এইজন্য বলছি যে, চৈতন্যচরিতামৃত-এ দেখছি—মাধবেন্দ্র পুরী তাঁর গোপাল-বিগ্রহের আদেশ মাথায় নিয়ে চন্দনের জন্য নীলাচল-জগন্নাথে যাবার পথে আগে গৌড়দেশে এলেন এবং সেখানে তাঁর ঠিকানা পাওয়া যাচ্ছে শান্তিপুরে। অদ্বৈত আচার্যের নিবাস-স্থান। পুরী গোঁসাই অদ্বৈতের ঘরে কেন এসেছিলেন, চৈতন্যচরিতামৃত-এর কবি তা বলেননি। শুধু বলেছিলেন—পুরীর প্রেম দেখি আচার্য আনন্দ অন্তরে। তাঁর ঠাঁই মন্ত্র নিল যতন করিয়া। চলিলা দক্ষিণে পুরী তাঁরে দীক্ষা দিয়া।

অদ্বৈত আচার্য চৈতন্য মহাপ্রভুর অনেক আগে জন্মেছিলেন, প্রায় সঠিক বলতে গেলে সেটা ১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দ হবে, তার মানে মহাপ্রভুর চেয়ে তিনি অন্তত পঞ্চাশ/বাহান্ন বছরের বড়ো। পণ্ডিতেরা এমন কথা অনেকেই বলেন যে, মৈথিল কবি বিদ্যাপতির সঙ্গে অদ্বৈত আচার্যের সাক্ষাৎকার ঘটেছিল। শ্রীহট্টের আদিনিবাস লাউরগ্রাম ছেড়ে অদ্বৈত প্রথমে আসেন শান্তিপুরে। অদ্বৈত আচার্যের বিষয়ে লেখা যেসব আকর গ্রন্থ পাওয়া যায় সেগুলি থেকে প্রমাণ হবে যে, পূর্বে তাঁর নাম ছিল কমলাক্ষ ভট্টাচার্য এবং শান্তাচার্য নামে এক ব্যক্তির কাছে তিনি নাকি বেদাদি শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন বলে তাঁর আচার্য উপাধি আসে। আমাদের ধারণা অবশ্য অন্যরকম। ধরে নিতে পারি— শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে তাঁর আচার্য উপাধি জুটতে পারে বটে, কিন্তু গৃহী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রথম নামটি বদলে গেল কী করে? আমরা জানি যে, এসব সমস্যা সমাধানের কোনো উপযুক্ত প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। তবু বলি, আমাদের ধারণা—বঙ্গদেশে তখন ন্যায়শাস্ত্র চর্চার সঙ্গে বেদান্তের চর্চাও খুব বেশি হত, শঙ্কর-বেদান্তে অদ্বৈতবাদের প্রভাবও কিছু কম ছিল না। মনে হয় সেই অদ্বৈত-বেদান্তের পণ্ডিতজনোচিত কৌতুকেই কমলাক্ষ ভট্টাচার্যের বৈদান্তিক সংস্কার ঘটেছিল প্রথমে, ফলে তাঁর প্রথম নাম পালটে ‘অদ্বৈত’ হয়ে যায়, আর সন্ন্যাস যাঁরা নিতেন না, তাঁরা আচার্য নামে পরিচিত হতেন বলেই তাঁর পুরো নাম অদ্বৈত আচার্য।

কিন্তু সমসাময়িক এই অদ্বৈত বৈদান্তিক সংস্কার তাঁকে শান্তি দেয়নি। কৃষ্ণভক্তি, কৃষ্ণপ্রেম তাঁকে অন্য পথে প্রাণিত করে। আমাদের বিশ্বাস—মাধবেন্দ্র পুরীর সঙ্গে কমলাক্ষ ভট্টাচার্যের পূর্বপরিচয় ছিল এবং মাধবেন্দ্র হয়তো আগেও কয়েকবার এ দেশে এসেছেন। এমনও হতে পারে যে, এ-পরিচয় হয়েছিল সেই নবহট্টে, বা নৈহাটিতে থাকতেই। কেননা দেখুন, মাধবেন্দ্রের আর এক শিষ্য ঈশ্বরপুরী, যিনি ভবিষ্যতে মহাপ্রভু চৈতন্যকে মন্ত্রদীক্ষা দেবেন, তিনি ছিলেন কুমারহট্টের লোক। কুমারহট্ট এবং নবহট্ট পাশাপাশি জায়গা—এখন যেটা হালিশহর এবং নৈহাটি। আমাদের বিশেষ ধারণা—মাধবেন্দ্র পুরী হালিশহর-নৈহাটি অঞ্চলে এসেছিলেন। ঈশ্বরপুরী এবং অদ্বৈত আচার্যকে তিনি আগে থেকেই চিনতেন। কৃষ্ণভিত্তিক এবং কৃষ্ণপ্রেমের মাধুর্য তখন থেকেই এঁদের অন্তর্গত হয়েছিল। কিন্তু দীক্ষার প্রসঙ্গ আসেনি, কেননা তখনও পর্যন্ত মাধবেন্দ্র পুরীরই দীক্ষা হয়নি হয়তো।

মনে রাখা দরকার—গুরু যেমন শিষ্য চিনে পরীক্ষা করে নেন, তেমনই আগ্রহী শিষ্যও মনের মতো উপযুক্ত গুরু খুঁজে বেড়ান। কোন ভাবে ঈশ্বরের সাধনা হবে, কোন রূপে ঈশ্বরকে ভক্তের ভালো লাগে, ঈশ্বরের কোন গুণ ভক্তকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে, এগুলি একজন রসিক-ভাবুক ভক্তের মনে অনেক আগে থেকেই ক্রিয়া করতে থাকে। গুরুর জন্য, আপন অন্তর্গত ভাবসিদ্ধির জন্য ভক্তের অন্বেষণ তাই চলতেই থাকে বহুদিন ধরে। গুরু শিষ্যকে দেখলেন অথবা শিষ্য গুরুকে দেখলেন, আর অমনি দীক্ষা হয়ে গেল—এমন কৃপা-করুণার উদাহরণ অবশ্যই আছে, কিন্তু বহুতর ক্ষেত্রেই মন্ত্রদীক্ষার পূর্বে এক ধরনের একাত্মতার অন্বেষণ চলে। আমাদের তাই ধারণা অদ্বৈত আচার্য এবং ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে মাধবেন্দ্রের পরিচয় ছিল পূর্ব থেকেই। ঈশ্বরপুরীর দীক্ষা অদ্বৈত প্রভুর আগে হয়েছে না পরে হয়েছে, সে তর্কের প্রয়োজন নেই। কিন্তু কমলাক্ষ ভট্টাচার্য যখন শান্তিপুরে-আসা মাধবেন্দ্র পুরীর ভাব দেখলেন, যখন দেখলেন এক বৃদ্ধপ্রায় সন্ন্যাসী সেই সুদূর বৃন্দাবন থেকে ওড়িশায় যাচ্ছেন প্রিয় বিগ্রহের চন্দন-সেবার জন্য, তখনই কমলাক্ষ বুঝেছিলেন—এই প্রেম তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। মাধবেন্দ্র পুরীর কাছে দীক্ষা নিতে তাঁর এতটুকু সময়ও লাগল না, এতটুকু দ্বিধাও হল না—পুরীর প্রেম দেখি আচার্য আনন্দ অন্তরে। তাঁর ঠাঁই মন্ত্র নিল যতন করিয়া। আমাদের ধারণা—দীক্ষা দানের সময় পুরী গোঁসাইয়ের দশনামী সম্প্রদায়ের নামাচরণটুকু বোধহয় রয়েই গেল এবং সেই সঙ্গে গৃহী অবস্থার জন্য কমলাক্ষ ভট্টাচার্য অদ্বৈত আচার্য নামে পরিচিত হলেন। বৃন্দাবনের ব্রজপ্রেম, দাক্ষিণাত্যে আলওয়াড়দের প্রেমভক্তি-পরম্পরা গৌড়বঙ্গে প্রোথিত হয়ে গেল অদ্বৈত আচার্যের ঘরে।

মাধবেন্দ্র পুরী অদ্বৈত আচার্যকে দীক্ষা দিয়ে কবেই নীলাচলে চলে গেছেন। মাঝপথে রেমুণায় গোপীনাথ বিগ্রহ দর্শন করেছেন, গোপালের জন্য চন্দন-কর্পূর জোগাড় করেছেন এবং হয়তো শেষপর্যন্ত আর তাঁর বৃন্দাবনে ফেরা হয়নি। সেসব ঘটনার বিস্তারে যাব না, শুধু এইটুকু বলা প্রয়োজন যে—বৃন্দাবন, গৌড়বঙ্গ এবং নীলাচল-পুরীর মধ্যে যে ত্রিভুজ-সংযোগ ভবিষ্যতে সুদৃঢ় হয়ে উঠবে চৈতন্য মহাপ্রভুর সময়ে, সেই প্রেমের পথ কিন্তু পূর্বোৎকীর্ণ হয়ে রইল মাধবেন্দ্র পুরীর প্রেমযাত্রায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *