১৫. সুদেষ্ণা

১৫. সুদেষ্ণা

দেখুন, বড়লোকের ঘরে যেসব মেয়েরা থাকেন, তাদের আমি দূর থেকে খুবই শ্রদ্ধা। করি। একে তো সুখের ঘরে রূপের বাস– এমন মাখন-মাখন সব চেহারা, স্বল্পালম্বিত কেশগুচ্ছেও এমন এলোমেলো চুল, এমন উতলা আঁচল অথবা রূপের কথা থাক, যদি স্বভাবের কথাও বলি, তা হলে বলব– তাদের আপাত-বিনীত সম্ভ্রান্ত ভঙ্গির সঙ্গে মধুর হাসে বিধুর ভাষাও যেমন ভাল লাগে, তেমনই ভাল লাগে উদ্দাম উচ্ছল ভেঙে পড়া প্রগলভতাও কখনও। কিন্তু এত যে আমার ভাল লাগা, তার মুখে ছাই দিয়ে আমার এক বন্ধু বলেছিল– দেখ, ওরা দেখতে-শুনতে যতই ভাল হোক, বড়লোকের মেয়ে আর পয়সাওলা লোকের বউ, দেখবি, বুদ্ধিহীন হয়। যে কোনও উচ্ছলতায় ওরা তাড়াতাড়ি নাচে। অপরের কথায় তাড়াতাড়ি বাহিত হয়, আর নিজস্ব বিচারবুদ্ধি নেই বললেই চলে।

কথাটা শুনে আমার ভাল লাগেনি। প্রতিবাদ করে বলেছিলাম– এটা তোর ভারী একপেশে কথা। অন্তত, এটা কখনও সার্বিক লক্ষণ হতে পারে না। বরঞ্চ বড় ঘরের অর্থ, ঐশ্বর্য, সমৃদ্ধি সেসব বাড়ির বউঝিদের আরও বেশি সুরুচিসম্পন্না, আরও বেশি মর্যাদাময়ী করে তোলে। তা ছাড়া এইরকম একটা সাধারণীকরণ তো মধ্যবিত্ত মানুষের ঈর্ষা-অসূয়াই বেশি প্রকট করে তোলে। আমার বন্ধু সাময়িকভাবে চুপ করে গেলেও আমার কথা খুব মেনে নিল বলে মনে হল না। আর আমিও আমার তর্কে যুক্তিনিষ্ঠ ছিলাম বলেই মনে করি, কেননা দু’-চারটি রমণীর দৃষ্টান্ত দেখে এমন সাধারণীকরণ কখনও যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারে না। আরও দু-চারটি বুদ্ধিহীন সজ্জাসর্বস্ব আত্মারাম মহিলা যা বড় ঘরে আছে, তা তো অন্যান্য ঘরে শয়ে-শয়ে আছে। তবে হ্যাঁ, একটাই যুক্তি মানতে পারি এবং সেটা হল– বড়লোকের ঘর হলেই একটা প্রত্যাশা জন্মায় অমন মাখন-মাখন চেহারায় কুকলি-হাসির মধ্যে বুদ্ধি থাকবে না, বিদ্যা থাকবে না, এটা যেন ঠিক মানায় না। এটা যেন কেমন মেনে নিতে পারি না।

এই যে মানায় না এবং মেনে নিতে পারি না’– এইখানেই মহাভারতের সুদেষ্ণা ভীষণ সদর্থক হয়ে ওঠেন। সত্যিই তো, মহাভারতের অন্য যত স্ত্রী-চরিত্র– সত্যবতী, কুন্তী, গান্ধারী, দ্রৌপদী– এঁরাও তো বড় ঘরের মেয়ে, বড় ঘরের বউ তাদের ভাবনা এবং বুদ্ধিতে হীরকখণ্ডের দ্যুতি ঠিকরে পড়ে যেন। এমনকী মহাভারতের যেসব গৌণ রমণীরা আছেন– সুভদ্রা, উলূপী, চিত্রাঙ্গদা– তাঁদের তুলনাতেও সুদেষ্ণা কেমন সাধারণ। কিন্তু সাধারণ, অতি-সাধারণ বলেই মহাকাব্যিক নিরিখে তাকে মানায় না’ বা ‘মেনে নিতে পারি না বললেও সাধারণ গৃহস্থ-বধূর মধ্যে যেসব সাধারণী বৃত্তি থাকে– স্বামীকে সন্দেহ করা, বাপের বাড়ির লোক হলে সাত খুন মাপ, ন্যায়-অন্যায়ের কঠিন বিবেচনার ক্ষেত্রে উদাসীন বিভ্রান্তি– এগুলি আমাকে টানে। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে– মহাকাব্যের কবির সেই ক্রান্ত দৃষ্টিটুকুর কথা ভেবে। বুদ্ধি এবং যৌবনের মহাকাব্যিক মাত্রাগুলি মুখ্য মহিলা চরিত্রগুলির মধ্যে চিহ্নিত করেই তার কাজ ফুরিয়ে যায় না। একটা রাজবাড়ির মধ্যেই তিনি এমন চরিত্রের সন্ধান পান, যার মধ্যে বড়মানুষের ‘ইগো’ আছে ষোলো আনা, অথচ ভাবনায়, বুদ্ধিতে এবং আচারে তিনি বড় বেশি গ্রাম্য এবং সাধারণ।

অথচ সুদেষ্ণা খুব সাধারণ বাড়ির মেয়ে নন। তিনি কেকয় দেশের রাজার মেয়ে এবং দেশটা সেকালে আর্যসভ্যতা এবং সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল। পণ্ডিতদের মতে পঞ্চনদীর দুই নদী শতদ্রু-বিপাশা অথবা বিপাশা রাভীর মধ্যগত পাহাড়ি এলাকাটাই সেকালের কেকয় দেশ। এই কেকয় থেকে বিবাহ-পরিণয়ের সূত্রে তাঁর মৎস্যদেশে বিরাট রাজার বন্ধু হিসেবে আগমন। যদি দেশজ সংস্কৃতির কথা বলি, তবে মৎস্যদেশ, মানে এখানকার জয়পুর-ভরতপুর-আলোয়ার অঞ্চল সেকালে আর্য-ভাবনায় অধ্যুষিত ছিল। সরস্বতী-দৃষদ্বতীর মধ্যগত যে দেশটাকে ব্রহ্মর্ষিদেশ বলা হয়, তার অবস্থান প্রায় এইখানেই। তা ছাড়া আর্যদের পরিক্রমণ যে পথে ঘটেছিল, সেও তো পঞ্চনদীর দেশ থেকে সরস্বতী দৃষদবতীর মাঝখানে আর্যাবর্তে আসা। কাজেই কৈকেয়ী সুদেষ্ণার জন্ম এবং বিবাহ– দুই-ই আর্য-সংস্কৃতির প্রথম-প্রবাহিনী ধারায় সিক্ত। অথচ কৈকেয়ী সুদেষ্ণার চরিত্র মহাভারতীয় গান্ধারী, কুন্তী কিংবা সত্যবতীর মতো নৈতিকতা মেনে চলে না। অবশ্য এর কারণ শুধুমাত্র সুদেষ্ণাই নন। রাজা এবং বিশেষত পুরুষ হিসেবে সুদেষ্ণার স্বামী এতটাই উদাসীন প্রকৃতির যে, মৎস্য-রাজ্যের প্রশাসন এবং তিনি নিজেও অনেকটা স্ত্রী সুদেষ্ণার ইচ্ছার অধীন হয়ে গিয়েছিলেন। অধীন যদি বা নাও বলি, অন্তত তার অন্যায়গুলির প্রতিবাদও করেননি তিনি, আর রাজা হিসেবে তার সামনে সুদেষ্ণার সম্বন্ধে তো নয়ই, তাঁর সম্পর্কিত কারও সম্বন্ধে নালিশ করেও কোনও লাভ ছিল না।

চরিত্রের মূলস্থানে না গিয়ে আগেই একটা কথা বলে রাখা ভাল যে, মহাভারতের অন্যান্য বৃহৎ চরিত্রের মতো সুদেষ্ণা সারা মহাভারত জুড়ে অবস্থান করেন না। শুধুমাত্র বিরাট-পর্বের মধ্যে সুদেষ্ণাকে আমরা ছোট্ট একটি ফ্রেমের মধ্যে দেখতে পাব, সে চরিত্রের মধ্যে বিরাট বিস্তার নেই কোনও, মহাকাব্যের কোনও প্রশ্রয়ও তাকে মহত্তর কোনও স্তরে উন্নীত করে না। কিন্তু মানুষের অনন্ত জীবন-বৈচিত্র্যের মধ্যে সুদেষ্ণাও একতর জীবন, যেখানে রাজার ঘরের বড়লোক বউ কোনও প্রতিবিশিষ্ট চেহারায় ধরা পড়েন না। সুদেষ্ণা বুঝিয়ে দেন যে, অনেক সময়ে রাজার ঘরেও সাধারণ মনুষ্যবৃত্তি কাজ করে, কোনও বৃহৎ পরিশীলিত আভিজাত্য সেখানে অমূলক হয়ে ওঠে।

মহাভারতে খুব নাটকীয়ভাবে সুদেষ্ণার প্রবেশ ঘটেছে এবং এমন চেনা সুরে তিনি কথা বলেন, যাতে মনে হয় তার অন্যান্য সমস্ত পরিচয় যেন আমাদের আগে থেকে জানা। পাণ্ডবরা তখন বনবাস-পর্ব শেষ করে বিরাট রাজ্যে প্রবেশ করবেন বলে স্থির করেছেন। কে, কীভাবে, কোন ভূমিকায়, কোন বেশে বিরাট রাজ্যে অজ্ঞাতভাবে থাকবেন, তাও ঠিক হয়ে গেছে। হয়তো বিরাট রাজার ভোলেভালা চরিত্র সম্বন্ধে পাণ্ডবদের পূর্বজ্ঞান ছিল, কিন্তু দ্রৌপদী কৃষ্ণা প্রথমে যে-উচ্ছ্বাসে সুদেষ্ণার ঘরে সৈরিন্ধ্রীর বেশে কাজ করতে এসেছিলেন, তাতে সুদেষ্ণাকে প্রথমে যতখানি চেনা গেছে, পরে তিনি তাকে অন্যভাবে চিনেছেন বলেই মনে হয়। দ্রৌপদীকে নিয়ে বড় চিন্তায় ছিলেন যুধিষ্ঠির। রাজবাড়ির সুখে অভ্যস্ত বিলাসিনী দ্রৌপদী কীভাবে বিরাটগৃহে থাকবেন– এই দুশ্চিন্তায় জল ঢেলে দিয়ে দ্রৌপদী বলেছিলেন– সৈরিন্ধ্রীর কাজটা আমার বেশ পছন্দ হয়। লোকসমাজে এই ধারণা আছে। যে, এই কাজে কিছু স্বাধীনতাও আছে আবার পরাধীনতাও আছে। পরাধীনতা এইখানে যে, লোকের বাড়ি তাকে খাটতে হবে, তার খাওয়া-পরার ভারও সেই বাড়ির কর্তার। কিন্তু স্বাধীনতা এইখানে যে, তার সুরক্ষার ব্যাপারে নিয়োগকর্তার কোনও দায় নেই। অর্থাৎ সৈরিন্ধ্রী নিজের ইচ্ছেয় যেখানে-সেখানে, যখন-তখন চলাফেরা করতে পারে। প্রসাধন প্রস্তুত করা এবং সাজানো ব্যাপারটা যেহেতু তার স্বাধীন শিল্পরচনার এক্তিয়ার, অতএব এখনকার ‘বিউটিশিয়ানদের মতোই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনটা স্বাধীন, কিন্তু কাজের জায়গাটা তেমন স্বাধীন নয়, কেননা পরগৃহে কাজ করতে হয় বলেই এবং সে বাড়ির ভাত খেতে হয় বলেই সে বাড়ির নিয়ম-কানুন, মালিক-মালকিনির পরোয়ানা খানিকটা মেনে নিতে হয়। দ্রৌপদী তাতে খুব অস্বস্তি বোধ করেননি। তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন– তুমি চিন্তা কোরো না। আমি রাজভার‍্যা সুদেষ্ণার প্রসাধনী পরিচর্যা করেই এই এক বছর কাটিয়ে দেব এবং আমার মনে হয়, রাজবাড়ির মহিষী বলেই তিনি আমাকে সুরক্ষিত রাখার ভাবনাটাও যথাযথভাবে ভাববেন– যা রক্ষিষ্যতি মাং প্রাপ্তাং মা ভূত্তে দুঃখমীদৃশম।

বিরাট রাজ্যে যুধিষ্ঠির-ভীমের প্রবেশ সম্পন্ন হবার পর দ্রৌপদীর প্রবেশ। তিনি যখন তার কুঞ্চিতা কেশগুলিকে মাথার ডান দিকে তুলে বেঁধে, একখানি কালো কাপড় পরে রাজবাড়ির কাছাকাছি রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন, তখন আশেপাশের মেয়ে-পুরুষেরা তাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল– তুমি কে গো মেয়ে? কী করতে চাইছ? দ্রৌপদী উত্তর দিলেন– আমি সৈরিন্ধী। অন্য জায়গা থেকে এখানে এসেছি। কেউ যদি শুধুমাত্র আমার ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেয়, তা হলে তার বাড়িতে থেকেই তার কাজ করব আমি। হয়তো একজনকে নয়, আরও দু-চারজন জিজ্ঞাসুকে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে নিজের কথা বলতেই রাজবাড়ির অলিন্দে-বসা সুদেষ্ণার কানে সেটা গেল। রাস্তার লোকেরা একেবারেই তার কথা বিশ্বাস করেনি। কেননা কালো হলেও দ্রৌপদীর উচ্ছ্বসিত যৌবন, তার বিদগ্ধ রমণীয় ভঙ্গি এবং তার দৃপ্ত পদক্ষেপ এবং কথাবার্তা সব কিছুই এমন এক মর্যাদা বহন করছিল, যাতে তিনি শুধু অন্নপানের পরিবর্তে বাড়িতে দাসীর কাজ করবেন, এটা বিশ্বাস করা কঠিন হচ্ছিল।

ঠিক এইরকম একটা পরিস্থিতিতে আমরা প্রথম বিরাট-গৃহিণী সুদেষ্ণার সাক্ষাৎ পাই। রাজবাড়ির অলিন্দ থেকে তার দৃষ্টি পড়ে দ্রৌপদীর ওপর। এক কাপড়ে এসেছেন, সঙ্গে পোঁটলা-পুঁটলি কিছু নেই, এমনকী পুরুষ মানুষও একজন নেই সঙ্গে, সুদেষ্ণা লোক দিয়ে তাকে ডেকে পাঠালেন নিজের কাছে। পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে দ্রৌপদী সেই একই কথা বললেন– তিনি সৈরিন্ধ্রী, ভাত-কাপড় দিলে তিনি সুদেষ্ণার দাসী হয়ে থাকবেন। সুদেষ্ণার যে পরিচয়-ই ভবিষ্যতে আমাদের কাছে প্রকট হয়ে উঠুক, তাঁর লোক চিনতে ভুল হয়নি। তিনি বললেন, দেখো হে মেয়ে! দাস-দাসী আমি অনেক দেখেছি, তারা কেউ-ই তোমার মতো নয়। এমন আগুনপানা চেহারা নিয়ে কেউ দাসীবৃত্তি করে? অতএব যেমনটি তুমি বলছ, তা হতেই পারে না– নৈবংবিধা ভষত্যেবং যথা বদসি ভামিনি।

আসলে সুদেষ্ণার সমস্ত নজর তখন দ্রৌপদীর শরীরের দিকে। একেতেই সাধারণ রমণীকুলের মধ্যে এই স্বভাব থাকেই। সুন্দরী রমণী দেখলে নিজের সঙ্গে তুলনা করে দেখার একটা প্রবণতা থাকেই। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তুলনার পর অন্য সুন্দরীর প্রতি এক ধরনের ঈর্ষা-অসূয়া এমনকী অনীহাও কাজ করে। কিন্তু সুদেষ্ণা এদিকে খুব সরল। প্রথম দেখাতেই তিনি দ্রৌপদীর দাসীত্ব-বিলাস উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন– তোমার চেহারাটা তো অসম্ভব সুন্দর। রমণী-দেহের উচ্চাবচ সংস্থানের মধ্যে যে যে অঙ্গ গভীর-নিম্ন হওয়া দরকার, দ্রৌপদীর ঠিক তাই, আবার যে যে-স্থান উচ্চ-পীন হলে পরে রমণীর সৌন্দৰ্য্য বর্ধিত হয়, দ্রৌপদীর শরীর সংস্থানের উচ্চতা সেখানেই। সাধারণ সৌন্দৰ্য্য উচ্চারণে– ‘সুকেশী সুস্তনী শ্যামা পীনশ্রোণী-পয়োধরা’- দ্রৌপদীকে এইটুকু প্রশংসা করেই সুদেষ্ণা থামলেন না, দ্রৌপদীর শারীরিক সৌন্দর্য্য ছাড়াও তার মধ্যে যে ‘একস্ট্রা অর্ডিনারি গ্ল্যামার’ এবং অসম্ভব একটা এনার্জি কাজ করছে, এটা বোধহয় সুদেষ্ণা ছাড়া মহাভারতের আর কেউ এমনভাবে বলেননি। সুদেষ্ণা বলেছেন– তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কাশ্মীরি ঘোটকীর মতো টগবগ করছ যেন তেন তেনৈব সম্পন্না কাশ্মিরীব তুরঙ্গমী। যেমন তোমার রূপ, তেমনই তোমার সদা-প্রস্তুত মানসিক তেজ। এমন চেহারা কি দাসীদের জন্য তৈরি করেছেন ভগবান! তার চেয়ে তুমি সত্যি করে বল যে, তুমি দেবী না গন্ধবী, অপ্সরা না কিন্নরী, নাকি দেবকন্যা না দেবপত্নী–তাসাং ত্বং কতমা শুভে?

সবিনয়ে দ্রৌপদী বললেন আমি কোনও দেবী বা গান্ধর্বী নই। আমি সত্যিই সৈরিন্ধ্রী এবং অন্ন-পানের পরিবর্তে আমি সেবা করতে চাই। আমি দারুণ খোঁপা বাঁধতে জানি, জানি কত মিহি করে চন্দন বাটা যায়। তা ছাড়া মল্লিকা, চাপা এবং পদ্মের মালাগাছি তৈরি করি ভাল। আমার অভিজ্ঞতাও কম নয়। আমি একসময় কৃষ্ণভামিনী সত্যভামার সাজ সজ্জা করেছি, আর কুরুকুলের একতমা সুন্দরী পঞ্চপাণ্ডবের পত্নী দ্রৌপদীরও কাজ করেছি আমি। আমার বেশি চাহিদা নেই। ঠিক-ঠিক ভাত-কাপড় পেলেই আমি আনন্দে থাকি। আর জানেন তো, আমার কাজে খুশি হয়ে স্বয়ং দেবী দ্রৌপদী আমার নাম রেখেছিলেন মালিনী। আমি সেই মালিনী এসেছি আপনার কাছে, আপনার কাছে রেখে দিন আমাকে সাহমদ্যাগতা দেবি সুদেষ্ণা ত্বন্নিবেশনম্।

দ্রৌপদীর মতো অসাধারণ দৃপ্ত সুন্দরী তার কাছে কাজ চাইছেন, তাকে রাখতেও কোনও আপত্তি নেই তার। কিন্তু দ্রৌপদীর আগুনপানা রূপ তাকে স্বস্তি দিচ্ছে না। তবু সুদেষ্ণা বড় সরল, তিনি নিজের ঘরের কথা লুকিয়ে রাখতে পারেন না, চাপতে পারেন নিজের অন্তর্গত দ্বন্দ্ব। সুদেষ্ণা বললেন তোমাকে দেখে আমার মনে যদি কোনও সন্দেহ দানা না বাঁধত, তা হলে তোমায় আমি মাথায় করে রাখতাম। তোমাকে যদি ঘরে স্থান দিই, তা হলে আমার একটাই ভয়– রাজা বিরাট তোমাকে দেখে পাগল হয়ে যাবেন না তো? তোমাকে মন দিয়ে বসবেন না তো ন চেদিচ্ছতি রাজা ত্বাং গচ্ছেৎ সর্বেণ চেতসা?

সুদেষ্ণার কথারম্ভ থেকেই এ-কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, স্বামীর ব্যাপারে তিনি বেশ সন্দেহপ্রবণ। তার স্বামী বিরাট রাজার স্ত্রী-বিষয়ক দুর্বলতা ছিল–এমন ছিটেফোঁটা প্রমাণও আমরা মহাভারতের বিশাল সাম্রাজ্য জুড়ে পাইনি। মহাভারতের কবি কিছু লুকোন না, যদি বিরাট রাজার চরিত্র খারাপ হত, তা হলে মহাভারতের কোথাও না কোথাও তার ইঙ্গিত পেতাম। তা পাইনি বলেই বলছি– সুদেষ্ণা বোধহয় একটু সন্দেহপ্রবণ মহিলা। স্বামীকে সন্দেহ করার ব্যাপারে তার যুক্তি-তর্কও খুব শক্তপোক্ত নয়। তিনি দ্রৌপদীকে বললেন– রাজা তো পুরুষ মানুষ, তার তো হবেই এরকম। দেখো না, তোমাকে দেখা ইস্তক এই রাজবংশের মেয়েরা সব, যত আমার পরিচারিকা আছে, সব তোমার দিকেই চেয়ে আছে। সেখানে রাজা তো পুরুষ মানুষ, তোমাকে দেখলে কোন পুরুষ মানুষের মাথার ঠিক থাকবে– প্রসক্তাত্ত্বাং নিরীক্ষন্তে পুসাংসং কং ন মোহয়েঃ। তোমার এই চেহারা চোখে পড়লে রাজা বিরাট আমার মতো বিবাহিতা স্ত্রীকে ছেড়ে তোমাকে নিয়েই থাকবেন। সবচেয়ে বড় কথা, তুমি যদি সানুরাগে কোনও পুরুষ মানুষের দিকে তাকাও তা হলে সেই পুরুষ অবশ্যই কামনার বশবর্তী হবে– প্রসক্তমভিবীক্ষেথাঃ স কামবশগো ভবেৎ।

সুদেষ্ণা দ্রৌপদীকে তেমন করে চেনেন না এমনকী তিনি যে দ্রৌপদী, তাও তিনি জানেন না। কিন্তু একজন সুন্দরী পরিচারিকাকে বাড়িতে স্থান দেওয়ার ব্যাপারে তিনি যেভাবে কথা বলছেন, সেটা সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের কোনও গৃহিণীর চেয়েও বেশি। তিনি ধরেই নিচ্ছেন– এমন সুন্দরীকে ঘরে রাখলে কোনও পুরুষের চরিত্র ঠিক থাকবে না। তার শেষ কথাটা ছিল একেবারে প্রাণীবিজ্ঞানের জৈব উপমায় জড়িত। সুদেষ্ণা বলেছেন– তোমাকে ঘরে রাখা মানে কর্কটীর গর্ভ ধারণ করা। কর্কটী যেমন গর্ভধারণ করে নিজেরই মৃত্যু ডেকে আনে, তেমনই কাজটা হবে তোমাকে ঘরে রাখা যথা কর্কটকী গর্ভমাধত্তে মৃত্যুমাত্মনঃ। সাধারণ ভারতীয় ঐতিহ্যে এইরকম একটা ধারণা আছে যে, কর্কট-জাতীয় প্রাণী বা পতঙ্গ কর্কট কথাটির সোজা মানে কাঁকড়া কিন্তু এখানে কর্কট বলতে কাঁকড়াই বোঝাচ্ছে কিনা তা বলা যাচ্ছে না– তবে কিনা ধারণাটা এইরকম যে, কর্কটী অর্থাৎ স্ত্রী কর্কট নাকি গর্ভধারণ করলে সন্তান প্রসব করার সময় সাধারণত মারা যায়, অর্থাৎ এদের গর্ভস্থ প্রাণীটি অতিরিক্ত বড় হয়ে যায় বলে স্ত্রী-কর্কট মারা পড়ে।

প্রাণীবিদ্যাবিদ পণ্ডিতেরা এই ধারণা কতটা মানবেন সন্দেহ, এমনকী মহাভারতের টীকাকার মহামতি নীলকণ্ঠও ‘কর্কট’ শব্দটির অর্থে কোনও বিশেষ প্রাণীর কথা বলেননি, ভাষাগত অর্থে কাকড়ার উচ্চারণ তো এড়িয়েই গেছেন তিনি। কর্কট শব্দের অর্থ তিনি করেছেন– ষটপদবান জন্তুঃ অর্থাৎ ছয়-পা-ওয়ালা প্রাণী। আমাদের ধারণা- এটা ছয়-পা-ওয়ালা প্রাণী বা আট-পা-ওয়ালা এ-ব্যাপারটায় একটা বিভ্রান্তি নীলকণ্ঠের হতে পারে। যদি পরেরটা ধরি, তা হলে মহাভারতের শ্লোকার্থ পরিষ্কার হতে পারে। বিশিষ্ট প্রাণীবিদ্যাবিদ অধ্যাপক রাজীব ভক্ত আমাকে জানিয়েছিলেন যে, স্ত্রী মাকড়সা বা মৌমাছি, যারা অষ্টপদ পতঙ্গ, বিশেষত স্ত্রী-মাকড়সা, তারা ‘মেটিং’-এর পর পুরুষ মাকড়সাকে মেরে ফেলে এবং তারপর ‘সাক’ করে পুরুষ-মাকড়ের দেহের রসটা খেয়ে ফেলে। স্ত্রী-মাকড়সা এমনিতেই পুরুষ মাকড়সার থেকে আকারে বড় হয় এবং ‘মেটিং’-এর পর স্ত্রী-মাকড়ের শক্তিও বেড়ে যায় বহুগুণ। কাজেই বিরাটপত্নী সুদেষ্ণার আশঙ্কা আমরা এইভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি যে, অন্তঃপুরের গর্ভগৃহে যদি এই মালিনী দ্রৌপদীকে লুকিয়ে রাখা যায় তবু তার সৌন্দর্য্যের লোলুপতায় আকৃষ্ট হতে পারেন রাজ্যের রাজা, তাঁর স্বামী বিরাট। পুরুষ হিসেবে তিনি বাঁধা পড়বেন দ্রৌপদীর প্রেমে এবং সুদেষ্ণার স্বামীর মৃত্যু তো সেখানেই। অতএব দ্রৌপদীকে রাখা মানে সুদেষ্ণার পক্ষে নিজের স্বামী হারানো এবং অন্য অর্থে নিজেরই মৃত্যু ডেকে আনা– যথা কর্কটকী-গর্ভমাধত্তে মৃত্যুমাত্মনঃ।

দ্রৌপদী সুদেষ্ণার আশঙ্কায় প্রলেপ লাগিয়ে বললেন– আপনার স্বামী বিরাট কেন, কোনও পুরুষ মানুষই আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। আমার পাঁচ-পাঁচ জন গন্ধর্ব স্বামী আছেন। তারা সদা-সর্বদা রক্ষা করবেন। আর আমিও যে আপনার বাড়িতে কাজ করতে এসেছি, সে-একটা ব্রত পালনের নিয়ম ঠিক করার জন্য। আমি পরিচারিকা হয়ে থাকব বলেই আমাকে আপনারা উচ্ছিষ্ট দেবেন না, আর আমাকে দিয়ে পা ধোয়াবেন না আপনারা। আমার স্বামীরাও তাতে সন্তুষ্ট থাকবেন এবং আমিও। আর হঠাৎ যদি কোনও পুরুষ আমাকে পাবার জন্য লোলুপ হয়ে ওঠে, তবে সেই রাত্তিরেই তাকে নিজের দেহ ছেড়ে জন্মান্তরের দেহে প্রবেশ করতে হবে। দ্রৌপদী সুদেষ্ণাকে আরও আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে, তাকে অন্য দিকে প্রলোভিত করা কোনও পুরুষ মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়, সে চেষ্টা করলে তার প্রচ্ছন্নচারী গন্ধর্ব-স্বামীরা সেই পুরুষকে ছেড়ে দেবেন না।

সুদেষ্ণা সত্যিই বড় সরল এই দিকটায়। তিনি তার স্বামীর ব্যাপারেই শুধু নিশ্চিন্ত হতে চাইছিলেন, কিন্তু এটা সন্দেহ হল না যে, এই সুন্দরী মহিলার স্বামী সংখ্যা পাঁচটা কেন, তারা কেনই বা প্রচ্ছন্নচারী। দ্রৌপদীর যুক্তিতে সন্তুষ্ট হতেও তাঁর সময় লাগেনি এবং সন্তুষ্ট হওয়া মাত্রেই তিনি তাকে তার শর্ত মেনেই কাজে বহাল করেছেন। বলেছেন– যেমনভাবে তুমি এখানে থাকতে চাও তেমনভাবেই তুমি এখানে থাকবে এবং ত্বাং বাসয়িষ্যামি যথা ত্বং নন্দিনীচ্ছসি– কারও চরণও তোমাকে স্পর্শ করতে হবে না, কারও উচ্ছিষ্টও তোমাকে খেতে হবে না।

দ্রৌপদী কাজে বহাল হলেন এবং নিত্যদিন সুদেষ্ণার পরিচর্যায় আত্মনিয়োগ করলেন। এই পরিচর্যার কাজের মধ্যে সুদেষ্ণাকে সাজানো বা তার চুল বেঁধে নানান ধরনের কেশবিন্যাস করা অথবা কুমকুম-চন্দন-পঙ্কে তার দেহে অলকা-তিলকা রচনা করাই তার একমাত্র কাজ ছিল বলে মনে হয় না। আমাদের ধারণা, বাড়িতে সর্বসময়ের পরিচারিকা থাকলে যা হয়, সুদেষ্ণা ফাই-ফরমাস করতেন অবশ্যই, এমনকী তার স্নানের ব্যবস্থা থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য হীন কাজও কিছু কিছু করতে হত বলে মনে হয়। হয়তো বা দ্রৌপদীর পক্ষে সবচেয়ে কষ্টকর ছিল মধ্য মেধাবিণী রাজপত্নীর বিলাস-কুতুহলের কালে ততোধিক মধ্যম রসিকতাগুলি সহ্য করা। মহাভারতের কবি সবিস্তারে এইসব পরিচর্যা-কর্ম উল্লেখ করেননি, কিংবা সুদেষ্ণার ফাই-ফরমাসের নানান নমুনাও তিনি দেখাননি। কিন্তু কথাপ্রসঙ্গে যেসব ঘটনা এখানে ইঙ্গিতাকারে এসেছে তার মধ্যে থেকেই সূত্র সংগ্রহ করে বলা যায় যে, সুদেষ্ণা নৈতিক দিক থেকে খুব দৃঢ় মনের মানুষ ছিলেন না। নইলে নিজের স্বামীর ব্যাপারে দ্রৌপদীর রূপ নিয়ে তিনি যত আশঙ্কিত ছিলেন, সেই আশঙ্কা সময়মতো এতটুকুও মনে এল না, অথচ তখন সত্যিই তার কর্তৃত্ব এবং ব্যক্তিত্ব বড় বেশি প্রয়োজন ছিল স্বয়ং দ্রৌপদীর সুরক্ষার জন্যই।

আসলে সুদেষ্ণা যতই আদর করে রাখুন দ্রৌপদীকে, অন্তত সেই আদরে মৌখিকতার আবেশই বেশি ছিল বলে মনে হয়। কিন্তু সুদেষ্ণার অন্তর-গভীরে কৃষ্ণা দ্রৌপদীর আলোকসামান্য রূপ অসহনীয় ছিল ছিল বলেই আমাদের নিশ্চিত ধারণা। কেননা অসহনীয়তার মনস্তত্ত্ব কোনও কোনও রমণীর মনে এই বিপরীত প্রতিক্রিয়াই তৈরি করে যে, ওই রূপ কোনওভাবে দলিত, ধর্ষিত, কলুষিত হোক। সুদেষ্ণা নিজে যাঁকে আশ্রয় দিয়েছেন, তাঁকে প্রত্যক্ষত নিজে কিছু করা যায় না বলেই এই অবদমিত আকাঙ্ক্ষা তার মনে কাজ করে যাতে অপরূপা দ্রৌপদী তার দীপ্র সৌন্দৰ্য-সাম্রাজ্যের মধ্যে লাঞ্ছিত হন কোনওভাবে। সে সুযোগ সুদেষ্ণার এসে গেল।

সুদেষ্ণার বাড়িতে দ্রৌপদীর খুব সুখে থাকবার কথা নয়। সৈরিন্ধ্রীর কাজটার মধ্যে কেশচর্চা বা চন্দন-কুমকুমের প্রলেপ বানানোর কাজ যতটুকুই থাক, এই কাজটা রাজবধূর করার কথা ছিল না, বরঞ্চ রাজবধূ হিসেবে এই সেবা তার পাবার কথা। ফলত মনে মনে দ্রৌপদী সুখে ছিলেন না এতটুকুও। স্বামীরা বিরাটগৃহে হীন কার্য করছেন, নিজেও তাই করছেন, অতএব সুখ নেই তার মনে অবসৎ পরিচারাহা সুদুঃখং জনমেজয়। এই অবস্থায় দুঃখের ওপর মহাদুঃখ হিসেবে তার ভবিতব্যের মতো নেমে এলেন সুদেষ্ণার ভীই কীচক। সুদেষ্ণার চরিত্র-কথা বলতে গিয়ে কীচকের কথা এই জন্য বলতে হচ্ছে যে, সুদেষ্ণার সম্বন্ধেই তাঁর সম্বন্ধ, সুদেষ্ণা না থাকলে কীচকের অস্তিত্ব নেই কোনও। একই সঙ্গে এটাও মানতে হবে যে, সুদেষ্ণার ভাই বলেই তিনি কোনও সাধারণ লোক নন, সুদেষ্ণার সম্বন্ধ-বলেই তিনি বিরাট রাজ্যের প্রবল প্রতাপান্বিত সেনাপতি। সেই সেনাপতি কীচক তার ভগিনী সুদেষ্ণার ঘরে আসতে গিয়ে দ্রৌপদীকে দেখে ফেললেন। তিনি পরিচারিকার কর্মে রত ছিলেন, সেই অবস্থায় কীচকের আবির্ভাব ঘটল সুদেষ্ণার ঘরে– তথা চরন্তীং পাঞ্চালীং সুদেষ্ণায়াঃ নিবেশনে। যিনি বিশ্বস্তচিত্তে ঘরের পরিচারিকার কাজ করছেন, তার বেশ-বাস কিঞ্চিৎ অবিন্যস্ত থাকবে, অথবা কাজের সুবিধের জন্যই গ্রন্থিহীন বস্ত্রখানি অতিমাত্রায় সুগ্রন্থিত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তাতে দ্রৌপদীর দৈহিক রূপ-যৌবন, অঙ্গ-সংস্থান আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল হয়তো। আর কীচকও তেমন কোনও সংযমী পুরুষ নন এবং বিরাট রাজ্যের সেনাপতি বলেই আরও বুঝি অসংযত পৌরুষেতায় ভোগেন, ফলে দ্রৌপদীকে দেখামাত্রেই তিনি কামনায় তপ্ত হয়ে উঠলেন– কীচকঃ কাময়ামাস কাম-বাণ-প্রপীড়িতঃ। মহাভারতের কবি, মহাকাব্যের কবি দ্বৈপায়ন ব্যাস তখনকার রাজতন্ত্রের অন্যতর এক অন্ধকার রূপ দেখাচ্ছেন। দেখাচ্ছন– নিজের অক্ষমতায় যিনি সেনাপতি হননি, বৈবাহিক সম্বন্ধ লাঞ্ছিত করে যিনি স্ত্রৈণ জামাইবাবুর দুর্বলতায় রাজ্যের শাসনযন্ত্রে অধিষ্ঠিত হন, তিনি কোনও বিধি-নিয়ম, সামাজিক লজ্জার ধার ধারেন না। একজন মানুষ রাজ্যের সেনাপতি হওয়া সত্ত্বেও নিজের মর্যাদা ভুলে গিয়ে, এমনকী দিদি সুদেষ্ণার কাছে তিনি কী কাজে এসেছিলেন সে-কথাও ভুলে গিয়ে নির্লজ্জভাবে দিদি সুদেষ্ণাকেই প্রশ্ন করে বলছেন বিরাট রাজার বাড়িতে এই সুলক্ষণা রমণীটি আগে তো কোনওদিন দেখিনি। বহুকালের পুরাতন সুপক্কা সুরা যেমন গন্ধেই সুরারসিককে উন্মত্ত করে তোলে, এই সুন্দর ভঙ্গিশালিনী রমণীটিও কিন্তু নিজের রূপে আমাকে পাগল করে তুলেছে। এমন পাগল-করা রূপ, এমন মনোহরণ আবেশ– মেয়েটা কে? কোত্থেকে এসেছে, কারও স্ত্রী নাকি? এর সঙ্গে মিলন সঙ্গম ছাড়া আমাকে শান্ত করার আর কোনও ওষুধ নেই– চিত্তং বিনির্মথ্য করোতি মাং বশে/ ন চান্যদত্রৌষধমস্তি মে মত।

কীচক সুদেষ্ণাইকেই দ্রৌপদীর পরিচয় জিজ্ঞাসা করছিলেন, কিন্তু তার উত্তর শোনবার কোনও ধৈর্য ছিল না। অন্যদিকে এটাও আশ্চর্য যে, পরমাত্মীয়া দিদির সামনে নিজের কামবিকারের কথা উচ্চকণ্ঠে জানাতে তার লজ্জা করছে না এবং সুদেষ্ণাও ভাইয়ের এই কামতপ্ত শারীরিক ভাষ্য শুনে কানে আঙুল দিচ্ছেন না, অর্থাৎ কিনা এমনটা তার শোনা অভ্যাস আছে অথবা অভ্যাস না থাকলেও ভাইয়ের এই কথাগুলি শুনতে তিনি লজ্জিত বোধ করছেন না। কীচকের বুদ্ধি কম নয়। তার এটা বুঝতে দেরি হয়নি যে, এই রমণী পরিচারিকার কর্মে নিযুক্ত হয়েছে। অতএব সেই বোধেই তিনি সুদেষ্ণাকে বললেন তোমার এই সুন্দরী পরিচারিকাটি নতুন কাজে লেগেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে তোমাকে আমি স্পষ্ট জানাচ্ছি দিদি, এ-কাজটা ওকে মানাচ্ছে না। বরঞ্চ আমি বলি, আমার ঘরে তো জিনিস-পত্ৰ, ঐশ্বর্য-বিভবের অভাব নেই। ও বরঞ্চ আমার বাড়িতে গিয়ে সে-সব ভোগ করুক। আমার বাড়িটা তো আর কম বড় নয়, সেখানে দাস-দাসী, হাতি-ঘোড়া, খাদ্য পানীয়, বসন-ভূষণ, কিছুরই অভাব নেই। ও আমার বাড়িতে গিয়ে বাড়িটার শোভা ফিরিয়ে আনুক– মনোহরং কাঞ্চন-চিত্র-ভূষণং গৃহং মহচ্ছোভয়তামিয়ং মম।

এসব কথা সুদেষ্ণাকেই বললেন কীচক এবং সেটা দ্রৌপদীকে শুনিয়ে শুনিয়ে, যাতে সাধারণী স্ত্রীর মতো দ্রৌপদীও তার ঐশ্বর্য-সম্পত্তি এবং স্বর্ণালংকারের প্রতি আকৃষ্ট হন। লক্ষণীয়, এখনও পর্যন্ত সুদেষ্ণা কোনও উত্তর দেননি। হয়তো উত্তর দেবার মতো সুযোগও তিনি পাননি, কিন্তু কীচক-ভাইয়ের এই উন্মাদ-প্রলাপের মুখে তিনি তাকে থামিয়ে দেবারও চেষ্টা করেননি কোনও। এই অসম্ভব প্রশ্রয়টুকু কীচকের না বোঝার কথা নয়, ফলত সুদেষ্ণার সঙ্গে আর একটিও কথা না বলে তিনি সোজাসুজি দ্রৌপদীর কাছে উপস্থিত হলেন। সত্যি বলতে কী, সুদেষ্ণা এতটাই তৈরি মহিলা যে, কীচক-ভাই তাকে তার মনোভাব বুঝিয়ে দিয়েছেন, কথা বলার আর কোনও প্রয়োজনই নেই সুদেষ্ণার সঙ্গে। কীচক এবার সোজা দ্রৌপদীর কাছে গেছেন।

দ্রৌপদীর সঙ্গে কীচকের যে-সব কথা হয়েছে, আমি তার বিস্তারে যাব না, কেননা বিরাট-গৃহিণী সুদেষ্ণা সেখানে অনুপস্থিত। কিন্তু সামান্য আকারে সেই কথোপকথন একটু না  বললেও নয়, কেননা সেখান থেকেই সুদেষ্ণার ভূমিকাটুকু উঠে আসবে। সংক্ষিপ্ত হলেও বলা দরকার যে, কীচক দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ ভাষায় নিজের কাম-বিকার নিবেদন করল। প্রেম-ভালবাসার এতটুকুও গন্ধ নেই সেখানে, কীচক দ্রৌপদীর সামনে দ্রৌপদীরই স্তন-জঘনের উচ্চানুচ্চ বর্ণনা করে নিজের শারীরিক মোহ একেবারে উচ্চগ্রামে প্রকট করে তুলল। দ্রৌপদী প্রত্যাখ্যান করলেন কীচককে– সেনাপতির মর্যাদাসম্পন্ন একজন মানুষের গৃহপরিচারিকার প্রতি এই আকর্ষণ যে উপযুক্ত নয়– এই কথার সঙ্গে, তিনি যে একজন বিবাহিতা রমণী এবং তার বৈবাহিক গন্ধর্বও স্বামীরা এই খবর পেলে কীচকের মৃত্যু যে অবধারিত– এইসব বীরোচিত প্রত্যাখ্যান করার পর কীচক এবার ফিরে এলেন সুদেষ্ণার কাছে প্রত্যাখ্যাত রাজপুত্র সুদেষ্ণা কীচকোহব্রবীৎ। তিনি মনে মনে এটাই সার বুঝেছেন যে, এই রমণী যাঁর পরিচারিকা, সেই মালকিনকেই ধরতে হবে স্বকার্য সাধনের জন্য এবং সেই মালকিন তার নিজের দিদি, তিনি ভাইয়ের মন বুঝবেন নিঃসন্দেহে।

কীচক যে সুদেষ্ণার কাছে নিজের প্রয়োজনের কথা বলছেন, তার মধ্যে কোনও অনুনয়-বিনয় নেই। কোনও লজ্জাও নেই; শেষ মুহূর্তে একটা চরম কথা আছে বটে, কিন্তু সেটাও প্রশ্রয়শীলা রমণীকে ভয় দেখানোর কাজটাই বেশি করে। কীচক সুদেষ্ণাকে এসে বললেন– দ্যাখো দিদি, এই সৈরিন্ধ্রী যাতে আমার কাছে যায়, তুমি তার ব্যবস্থা কর। আমি তাকে চেয়েছি, এখন যে উপায়ে যে কৌশলে সে আমাকেই চায়, তুমি তার উপায় বার কর– যথা কৈকেয়ি সৈরিষ্ক্রী মামিয়াত তদবিধীয়তাম। নইলে কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে, এই বলে দিয়ে গেলাম। তুমি কৌশল বার কর, ওকে আমার চাই– তং সুদেষ্ণে পরীস্ব মাহং প্রাণান প্রহাসিষম।

সুদেষ্ণার প্রতি ভাই কীচকের এই যে আদেশোপম আবদার, এই আবদার থেকে সুদেষ্ণার জীবনের পূর্ব-ভাবনাগুলি পরিষ্কার হয়ে যায়। আমি অনেক পরিবারেই এমন বধূমাতাদের দেখেছি আগেও দেখেছি এখনও দেখছি যাঁরা শ্বশুরবাড়িতে আসার পর স্বামীর ক্ষমতা, ঐশ্বর্য এবং বিভবকে নিজের বাপের বাড়ির খাতে প্রবাহিনী করে তোলেন। আমি এতটা প্রগতি-ভাবনাহীন নই যে, জীবনের বাস্তব সত্যগুলি বুঝব না। এতটা হৃদয়হীনও নই যে, এই বাস্তব আমার বোঝার ক্ষমতা নেই আমাদের নবাগতা বধূমাতারাও আমাদের ছেলেদের মতোই এক-একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। এমনকী আপন পিতা মাতার প্রতি তাদের পুত্রতুল্য দায়িত্ব আছে, এটাও আমি সর্বৈব মানি। ফলত বধূমাতা নিজে রোজগার না করলেও স্বামীর উপার্জিত অর্থে আপন পিতা-মাতা এমনকী ভাই-বোনেদেরও ভরণ-পোষণ যথাসাধ্য করতে পারেন– এর মধ্যেও কোনও অন্যায় নেই, বরঞ্চ সেটাই স্বাভাবিক প্রয়োজন।

কিন্তু মুশকিল হয় অন্য জায়গায়। বধূ যখন শ্বশুর-শাশুড়ি অথবা স্বামীর ভাইবোনদের ভাবনাটা একেবারেই না ভেবে যদি বাপের বাড়ির স্বার্থের কথাই শুধু ভাবেন। এ-সব ক্ষেত্রে স্বামী-নামক মানুষটির দুর্বলতা, স্ত্রৈণতা এমনকী সরলতাও বেশ ভয়ংকরী হয়ে উঠতে পারে এবং স্ত্রী যদি অধিক ব্যক্তিত্বসম্পন্না সুন্দরী হন, তা হলে পুরুষের ওই দুর্বলতা, স্ত্রৈণতা এবং সরলতাই স্ত্রীর পিতৃগৃহ-প্রবাহিনী হয়ে ওঠে। আমরা সুদেষ্ণার চরিত্রটা এই নিরিখে খুব ভালভাবে বুঝতে পারি। সুদেষ্ণা কেকয়দেশের রাজনন্দিনী বটে, কিন্তু তার পিতা রাজা ছিলেন বলে মনে হয় না, হয়তো বা রাজন্যবর্গের অন্যতম ছিলেন তাঁর পিতা। হয়তো সে কারণেই সুদেষ্ণার ভাই কীচক রাজ্য পেয়ে রাজা হননি, তিনি চলে এসেছেন দিদির সঙ্গে জামাইবাবুর রাজ্যে। সেকালের দিনে এইরকম শ্যালক অনেক মিলবে এবং এই রাজশ্যালকেরা একটা ক্লাস’ হিসেবে পরিচিত, যাঁরা ভগিনী কিংবা দিদির সুবাদে জামাইবাবুর রাজ্যে শাসনযন্ত্রের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হতেন। জামাই-রাজা দুর্বলচিত্ত এবং স্ত্রৈণ, ফলত নির্গুণ রাজশ্যালকেরা উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যথেচ্ছাচার করতেন অনেকেই। কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটকে রাজশ্যালককে দেখুন, সে আইন-কানুন মানে না, যথেচ্ছভাবে সে সাধারণ মানুষকে বধ-বন্ধন-নিগ্রহ করতে পারে। আর মৃচ্ছকটিকের নাট্যকার যেভাবে রাজশ্যালক শকারের চরিত্র এঁকেছেন, তার মধ্যে আমি বিরাটগৃহিণী সুদেষ্ণার ভাইয়ের প্রতিচ্ছায়া দেখতে পাই। রাজা জামাইবাবুর অনুগ্রহে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়ে যথেচ্ছ নারীসম্ভোগ করে এবং নিজের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন শাসন-পদ অপব্যবহার করে সে নিজের স্বার্থ সাধন করে। সুদেষ্ণার ভাই বলেই কীচক এতটাই ক্ষমতাসম্পন্ন যে রাজা তাকে ঘাঁটাতে সাহস পান না এবং রাজক্ষমতার সঙ্গে পৌরুষের ভার যোগ হওয়ায় এখন তিনি অবলীলায় সুদেষ্ণাকে আদেশ করেন– তোমার পরিচারিকা ঝি-টি যাতে আমার সঙ্গে শয়ন করে, সে ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে যেনোপায়েন সৈরিন্ধ্রী ভজেন্মাং গজগামিনী।

কীচককে প্রত্যাখ্যান করার জন্য দ্রৌপদী যে যুক্তিগুলি দিয়েছিলেন, তা সুদেষ্ণাও জানতেন এবং সে যুক্তিগুলি এতটাই ব্যক্তিত্ব-নিষ্পন্ন ছিল যে, যথেচ্ছ-নারীগামী কীচকও অকামা দ্রৌপদীকে জোর করার সাহস পাননি। সেখানে রাজমহিষী হলেও সুদেষ্ণাই বা এত সাহসিনী হবেন কী করে? তিনি বিপদের গন্ধ পাচ্ছিলেন কিন্তু কীচককেও ফেলতে পারছিলেন না। দ্রৌপদী বলেছিলেন আমার গায়ের রং কালো, জাতিতেও নিকৃষ্ট, কাজ করি পরিচারিকার, যে কাজ লোকে নিন্দা করে– বিহীনবর্ণাং সৈরিন্ধ্রীং বীভৎসাং কেশকারিণীম। দ্রৌপদীর সঙ্গে সুদেষ্ণাও এটা বোঝেন যে, রাজ্যের সেনাপতি হয়ে তার ভাই তারই দাসীর দেহজ আকর্ষণে লালায়িত। এই মর্যাদাহীন আচরণে তিনি সম্মানিত বোধ করছেন না নিশ্চয়ই। বিশেষত যে মেয়ে বিবাহিত বলে গৌরব বোধ করছে এবং একাধিক স্বামীর আক্রমণের ভয় দেখাচ্ছে, সেখানে ইচ্ছে থাকলেও সুদেষ্ণা কিন্তু চিন্তিত বোধ করছেন। অথচ ভাই কীচকের উপরোধ তথা অন্যায়-আবদার তিনি উড়িয়েও দিতে পারছেন না। মহাকাব্যের কবি সুদেষ্ণার এই দোলাচল-চিত্তবৃত্তির কথা ঠিক ধরেছেন। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন যে, সুদেষ্ণা নিজের দিকটাও যথেষ্ট ভেবে দেখছেন।

কীচকের আদেশ-প্রতিম আবদার শুনে আপাতত সুদেষ্ণা দেখালেন, যেন তিনি বিগলিত হয়েই কৃপা করছেন কীচককে। কিন্তু পিছনে যেটা দেখতে পাচ্ছি, সেটা হল– সেই মুহূর্তেও তার মাথা ঠিক কাজ করছে– তিনি নিজের দিকটা যথেষ্ট খেয়াল রাখছেন, অর্থাৎ কিনা রাজমহিষী হিসেবে তিনি যাতে নিজের মর্যাদা খুইয়ে না বসেন এবং নিজের বিপদও যাতে না আসে। অন্যদিকে ভাই কীচক, যিনি কিনা শাসনযন্ত্রের জোরে প্রতাপশালী এবং তিনি স্নেহের ভাইটিও বটে, তার দিকটাও তিনি ভাবলেন। আর শেষে ভাবলেন দ্রৌপদীর উদ্বেগের কথাও। কীচককে যে সাহসে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন, সেই সাহসের উৎসভূমি এখনও তার প্রত্যক্ষ নয়, সেখান থেকে কী অনর্থ ঘটবে, তার জানা নেই। এই তিনটি ভাবনা সেই সংকট মুহূর্তেও সুদেষ্ণার মাথায় কাজ করছে স্বমর্থমনুসন্ধায় তথ্যার্থমনুচিন্ত্য চ। উদ্বেগষ্ণৈব কৃষ্ণায়াঃ…।

মুহূর্তের মধ্যেও এই অনুচিন্তনের ফল হল অবশ্যই। সুদেষ্ণা এমন সিদ্ধান্ত নিলেন না যাতে দ্রৌপদী ভাবেন– আশ্রিতা তথা নিযুক্তা দাসী বলেই তাকে জোর করে ভাইয়ের কামতৃপ্তি ঘটনোর জন্য তার ঘরে পাঠাচ্ছেন সুদেষ্ণা। অর্থাৎ সুদেষ্ণা এমন একটা উপায় বা কৌশল। বার করলেন যেখানে তার কোনও দায় থাকছে না। যা থাকছে, সেটা দ্রৌপদীর পরিচারিকা বৃত্তির পরিসর, সেখানে তার কিছু বলার থকছে না। সুদেষ্ণা কীচককে বললেন– ভাই! তুমি তোমার বাড়িতে একটা বড় উৎসবের আয়োজন কর আমাকেই খাওয়ানোর জন্য। এই উপলক্ষে বাড়িতেই প্রস্তুত কর উৎকৃষ্ট অন্ন-পানীয় এবং সুরা। আমি সেইদিন সুরা আনার জন্য আমার এই পরিচারিকা সৈরিন্ধ্রীকে তোমার কাছে পাঠাব- তত্রৈনাং প্রেষয়িষ্যামি সুরাহারীং তবান্তিকম্। এবারে তোমার জন্য ভাবনা, তাকে তুমি বাধাবন্ধবহীন নির্জন স্থানে নিয়ে যাও, তাকে কথায়-ব্যবহারে খুশি কর, অর্থাৎ এমনটা কর যাতে সে তোমার ব্যাপারে আগ্রহী এবং আকৃষ্ট বোধ করে– সান্তুয়েথা যথাকামং সাত্মানা রমে যথা। সুদেষ্ণার বুদ্ধি ধরা পড়ে এখানে তিনি এটা বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন যে, অনিচ্ছুক দ্রৌপদীকে কখনও শয়নাসনে নিগৃহীত করা যাবে না। অথচ কীচকের ভাবনাটা সেইরকমই। সেনাপতির পদ এবং নিজের শক্তি-পৌরুষেয়তায় মত্ত এমনই যে তিনি সেইরকমই ভাবছেন, সেটা বুঝেই সুদেষ্ণা বলেছিলেন- এমন কথা-ব্যবহার চালাও যাতে সে তোমার প্রতি অনুরক্ত হয়– সান্তুমানা রমেদ যথা।

সুদেষ্ণার পরামর্শ-কৌশলে উদ্দীপিত কীচক আর কাল বিলম্ব করলেন না। বাড়িতে গিয়েই তিনি প্রকৃষ্ট সুরা এবং অন্যান্য চর্ব্য-চোষ্যের ব্যবস্থা করে সুদেষ্ণাকে খবর দিলেন লোক দিয়ে। সুদেষ্ণা যে যাবেন না, সে তো আগে থেকেই ঠিক ছিল। অতএব পূর্বের পরিকল্পনা মতোই তিনি দ্রৌপদীকে বললেন– সৈরিন্ধ্রী! তুমি বরং একবারটি কীচকের বাড়িতে যাও। ওর ওখানে সুরা তৈরি করেছে অসম্ভব সুন্দর করে। ওই সুরা তুমি নিয়ে এস এখানে। আমার কিন্তু তেষ্টা পাচ্ছে ওই সুরাপানের জন্য। তুমি যাও, শিগগির কীচকের ঘরে যাও পানমানয় ক্যাণি পিপাসা মাং প্রবাধতে।

দ্রৌপদী এতকাল ধরে পাণ্ডব-কৌরবের জ্ঞাতি-বিরোধ দেখছেন, রাজনীতির চাল দেখছেন নানা কিসিমের, তিনি সুদেষ্ণার মনোভাব কিছু বুঝতে পারছেন না, এটা কোনও কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা, সুদেষ্ণার এখানেও তার দশ মাস থাকা হয়ে গেল। এতদিনে তিনি রানিকে যতটুকু চিনেছেন, তাতে মানুষটাকে খুব দয়াময়ী নিরীহ প্রকৃতির বলে মনে হয়নি তার। মনের মধ্যে হিংসা-ক্রুরতাও কিছু কম নেই। সুদেষ্ণার নৃশংসতাও খুব কম নয়। মহারাজ বিরাটের শখ ছিল, মাঝে-মাঝে তিনি মল্লদের সঙ্গে পশুর লড়াই করাতেন, কখনও-কখনও মল্লদের সঙ্গে শক্তিমত্তর মল্লের লড়াই, যেখানে দুর্বলতরের মৃত্যু দেখেও মজা লাগত তার। আশ্চর্য হল, এই লড়াই শুধু রাজসভার প্রাঙ্গণে আবদ্ধ ছিল না, রাজবাড়ির অন্তঃপুরেও তিনি মল্লযুদ্ধের আয়োজন করতেন, যেখানে অন্যতম মহিলা-দর্শক হতেন সুদেষ্ণা। বিরাটনগরে মধ্যম পাণ্ডব ভীমের আগমনের পর এই মল্লযুদ্ধের প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছিলেন তিনিই। কিন্তু ভীম মানেই তো অন্যপক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বীর মৃত্যু, যে প্রতিদ্বন্দ্বী যদি কোনও মানুষ নাও হয়, তবে ষাঁড়, হাতি এইসব পশু। কিন্তু অন্তঃপুরের মধ্যে এই নৃশংস লড়াই সুদেষ্ণা অবশ্যই দেখে খুশি হতেন– পুনরন্তঃপুরগতঃ স্ত্রীণাং মধ্যে বৃকোদরঃ।

এই যে নৃশংসতা দেখে খুশি হওয়া, এইনৃশংসতাই কাজ করেছে দ্রৌপদীর প্রতি আচরণে। সুদেষ্ণা জানতেন তিনি দ্রৌপদীর কী সর্বনাশ করতে যাচ্ছেন। কিন্তু পরিচারিকা সৈরিন্ধ্রীর রূপ, ব্যক্তিত্ব, অদৃশ্য স্বামী নিয়ে গর্ব এবং সর্বোপরি তার দীপ্র স্বভাব– সুদেষ্ণা এগুলো ভেঙে দিতে চেয়েছেন তার সতীত্ব লঙ্ঘিত করে। দ্রৌপদী কিন্তু সুদেষ্ণার কথা শুনেই বুঝেছেন, তিনি কী চাইছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন- আমি যাব না, কীচকের ঘরে আমি কিছুতেই যাব না–ন গচ্ছেয়ম্ অহং তস্য কীচকস্য নিবেশন–এবং আপনি জানেন যে, ও কতটা নির্লজ্জ। আমি আপনার মতো বড় মানুষের বাড়িতে থেকেও আমার স্বামীদের প্রতি ব্যভিচারিণী হব, এটা কি কোনও কথা হল। তা ছাড়া আপনার বাড়িতে কাজে লাগার সময়েই আপনার সঙ্গে আমার কথা হয়ে গিয়েছিল। কথা ছিল– আমি এ-সব কাজ করতে পারব না, বিশেষত অন্য কোনও পুরুষ আমাকে পেতে চাইলে কী হতে পারে, সে ব্যাপারেও আপনাকে আমি বলেছিলাম। দ্রৌপদী এবার প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন– আমি নিশ্চিত জানি যে, কীচকের ঘরে গেলে এই কামার্ত লোকটা আমার স্ত্রীভাবটুকু লঙঘন করবেই। আমি কিছুতেই যাব না ওই লোকটার ঘরে– সোহবমংস্যতি মাং দৃষ্টা ন যাস্যে তত্র শোভনে।

এসব কথা শুনে সুদেষ্ণার যে খুব ভাবান্তর হচ্ছিল, তা নয়। নিজে যেতে না চেয়ে দ্রৌপদী এবার বিকল্প প্রস্তাব দিয়ে বললেন আমার মতো আরও তো শতেক দাসী আছে আপনার, আপনি তাদের কাউকে পাঠান না ওই লোকটার কাছে, আমি গেলে ঠিক সে অপমান করবে আমাকে– স হি মাম্ অবমংস্যতি। ভাবটা এই অপমান সে করবেই, কেননা আমি তাকে প্রত্যাখ্যান করব। সুদেষ্ণা অনেক শুনেও রাজবাড়ির ঘরানায় খুব সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন। বললেন– তুমি আমার কাছ থেকে যাচ্ছ; আমার এখান থেকে সে বাড়িতে গেলে কীচক কখনও তোমাকে অপমান করবে না– নৈব ত্বাং জাতু হিংস্যাৎ স ইতঃ সম্পেষিতাং ময়া।

আমরা জানি এই কথাটার মধ্যে চরম মিথ্যাচার ছিল। সুদেষ্ণা নিজের ঘর বা তাঁর রাজমহিষীর প্রতিষ্ঠানের কথা যতই স্মরণ করিয়ে দিন, তার দুঃশাসিত ভাইয়ের কাছে রমণীর শরীর ছাড়া অন্য কোনও মর্যাদা নেই– সুদেষ্ণা সম্পূর্ণ জেনে এবং বুঝেই পূর্বপরিকল্পিতভাবে দ্রৌপদীকে এক চরম অসভ্যতা এবং অন্যায়ের মুখে ঠেলে দিয়েছেন, দ্রৌপদীকে, আশ্রিতা দ্রৌপদীকে। ঠিক এই মুহূর্তে এটাই ভাবতে ইচ্ছে করে যে, রাজমহিষীর উচ্চ মর্যাদা নয়, উদার-স্বভাব বিরাট রাজার স্ত্রীর মর্যাদাতেও নয়, আশ্রিতার প্রতি সুরক্ষা কল্পনা থেকেও নয়, তা হলে সমাজ-সাধনার কোনও প্রবৃত্তি থেকে সুদেষ্ণা নিজে মেয়ে হয়েও আরেকটি মেয়েকে এমন ধর্ষণার মুখে ছেড়ে দিলেন।

কারণ বোধহয় সেই ঈর্ষা, অসূয়া– যা আগেই বলেছি। আশ্রিতা হওয়া সত্ত্বেও একজন সৈরিন্ধ্রীর এত দীপ্র ভাব সুদেষ্ণা সইতে পারেন না। সেই যে প্রথম দিনে চাকরিতে বহাল হবার সময় দ্রৌপদী বলেছিলেন– আমি একাকী নিজের অধীনতায় চলতে ভালবাসি তত্র তত্র চরাম্যেকা লভমানা সুভোজনম্ অথবা, তিনি যে বলেছিলেন– এমন কোনও পুরুষ নেই এ জগতে, যে নাকি আমাকে প্রলোভন দেখিয়ে বিচলিত করতে পারেন চাপ্যহং চালয়িতুং শক্যা কেনচিদঙ্গনে। সত্যিই তো কীচক অনেক প্রলোভন দেখিয়েছিলেন, কিন্তু তাতে বিচলিত না হয়ে সুদেষ্ণা এমন দীপ্র স্বভাবের মহিলাকে বলাৎকারেই বশীভূতা দেখতে চান। অতএব নিশ্চিত ধর্ষণ জেনেও সুদেষ্ণা স্বর্ণময় সুরাপাত্র দ্রৌপদীর হাতে দিলেন কীচকের বাড়ি থেকে সুরা নিয়ে আসার জন্য– ইত্যস্যাঃ প্রদদৌ কাংস্যং সুপিধানং হিরন্ময়ম।

দ্রৌপদী কীচকের ঘরে প্রবেশ করলেন এস্তা হরিণীর মতো আর তাকে দেখামাত্রই কামুকের যত প্রলাপ সব বেরিয়ে এল কীচকের মুখ থেকে। দ্রৌপদী সুদেষ্ণার কথামতোই জানালেন– আমাকে রানি সুদেষ্ণা পাঠিয়েছেন আপনার ঘর থেকে সুরা আহরণ করে নিয়ে যাবার জন্য যা প্ৰৈষীদ্রাজপুত্রী মাং সুরাহারীং তবান্তিকম্। সুরার জন্য তিনি পিপাসার্তও বোধ করছেন যথেষ্ট, অতএব আমাকে যেতে হবে তাড়াতাড়ি। কীচক আর অপেক্ষা করেননি, তিনি দ্রৌপদীর হাত ধরে যেইমাত্র বস্ত্রাকর্ষণ করেছেন, সেই তো গণ্ডগোল লেগে গেল এবং যে গণ্ডগোল রাজসভা পর্যন্ত গড়াল, যেখানে বসেছিলেন রাজা বিরাট, কঙ্করূপী যুধিষ্ঠির এবং আশেপাশে বল্লব-রূপী ভীম। দ্রৌপদীর চরম অপমান হল রাজসভায়, কীচক দ্রৌপদীকে রাজসভায় বিরাটের সামনেই পদাঘাত করেছেন। অপমানিতা দ্রৌপদী বিরাট রাজার কাছে বিচার চেয়েছেন, রাজসভার সভ্যদের মতামত চেয়েছেন এবং ধিক্কার-তিরস্কারও করেছেন বিরাটকে। কিন্তু কোনও ফল হয়নি। রানি সুদেষ্ণার পরিপুষ্ট ভাইকে তিনি কিছুই করতে পারেননি এবং সে ভাইয়ের সেনাপতিত্বও অক্ষুণ্ণ রয়ে গেছে।

অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে, অজ্ঞাতবাসের কালে কথার মাত্রা অন্যদিকে গেলে বিপদ বাড়বে বুঝে যুধিষ্ঠির সামান্য ক্রোধ করেই বলেছেন– তুমি এখানে থেকো না সৈরিন্ধ্রী, তুমি সুদেষ্ণার ঘরে চলে যাও। দ্রৌপদী আরও খানিকক্ষণ ধিক্কার দিয়ে ফিরে এসেছেন সুদেষ্ণার ঘরে– ইত্যুঞ্জা দ্রবৎ কৃষ্ণা সুদেষ্ণায়া নিবেশন। তার চুল খুলে গেছে, ক্রোধে চক্ষু রক্তবর্ণ। অনেকক্ষণ কাঁদার পর এখন তার মুখমণ্ডল অনেকটা সদ্য মেঘভারমুক্ত সূর্যমণ্ডলের মতো বিবর্ণ ধূসর। সুদেষ্ণা তাকে দেখেই বুঝতে পারলেন– একটা বড় ঝড় বয়ে গেছে; অথচ খুব স্পষ্টভাবে কীচকের কথা না উল্লেখ করে সুদেষ্ণা বললেন– কে তোমাকে মারল এইভাবে, এই কাঁদছ কেন তুমি। কে সেই লোকটা যে তোমার অপ্রিয় আচরণ করে নিজের দুঃখ ডেকে আনল কস্যাদ্য ন সুখং ভদ্রে কেন তে বিপ্রিয়ং কৃতম?

দ্রৌপদী কোনও ভণিতা করলেন না। খুব সোজাসুজি বললেন– কেন আপনিই তো আমাকে সুরা আনতে পাঠালেন তার কাছ থেকে। সেই কীচকই আমাকে রাজসভায় মহারাজ বিরাটের সামনেই প্রহার করেছে সভায়াং পশ্যতো রাজ্ঞো যথৈব বিজনে বনে। এখানে ব্যাকরণ-শাস্ত্র-সম্মত বিভক্তি প্রয়োগের একটা সামান্য নৈপুণ্যে দ্রৌপদী সুদেষ্ণাকে যেন বুঝিয়ে দিলেন– তোমার এই জিজ্ঞাসাবাদের কোনও মূল্য নেই। তোমার স্বামীই এখানে কিছু করতে পারেননি, আর তুমি তো গৃহিণী স্ত্রীলোক। সংস্কৃতে অনাদর বোঝাতে, ‘কেয়ার’ না করা বোঝাতে ষষ্ঠী বিভক্তি হয়। এই যে দ্রৌপদী বললেন– একটা মানুষকে যদি অন্যের অলক্ষ্যে নির্জন স্থানে মারধোর করা যায়, তাতে অন্য কারও সোজাসুজি অপমান হয় না। কিন্তু একজন অধস্তন রাজপুরুষ যিনি রাজারই নিযুক্ত সেনাপতি, তিনি যদি রাজার সামনে, রাজসভার সভ্যদের সামনে, রাজসভার মধ্যে দাঁড়িয়েই একজন মহিলাকে প্রহার করেন, তা হলে রাজার সম্মান কী থাকে? এই বিভক্তি-প্রয়োগের মাধ্যমেই বোঝানো যায় যে, নিযুক্ত সেনাপতি অধস্তনের ওপর রাজার নিজেরই কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। দ্রৌপদী সুদেষ্ণাকে সেটাই বুঝিয়ে দিয়েছেন, অর্থাৎ তোমার স্বামীরই কোনও ক্ষমতা নেই তাকে শাসন করার, সেখানে তোমার এই কথার মানে কী!

সুদেষ্ণা দ্রৌপদীর কাছে বিবরণ শুনে বেশ বড় মুখ করে বললেন– কী, এত বড় ঘটনা। তুমি আমারই আদেশে, আমারই বাড়ি থেকে তার ঘরে সুরা আনতে গিয়েছিলে, এই পরিস্থিতিতেও কীচক যদি তোমায় অপমান করে থাকে, তা হলে তুমি বল, তুমি বললে আজই তার প্রাণদণ্ড করিয়ে দেব আমি– ঘাতয়ামি সুকেশান্তে কীচকং যদি মনসে।

আমরা জানি– সুদেষ্ণার এই কথা একেবারেই ফাঁকা আওয়াজ। তিনি নিজের অভিজ্ঞতাতেই জানেন– তাঁর ভাই কতটা দুর্বিনীত এবং তারই প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠে তাঁরই স্বামীর রাজ্যে সেনাপতিত্ব করছেন এবং এখন তাকেও তিনি মানে না তার স্বামীকেও মানেন না। অথচ সুদেষ্ণা মুখে বলছেন– তিনি কীচকের প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা করবেন। এটা ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া কী? এমনকী দ্রৌপদীও সেটা সহজেই বোঝেন এবং বোঝেন বলেই সুদেষ্ণার বিচার এবং তার মৌখিক প্রাণদণ্ড-বিধানের ওপর তার বড় কিছু আস্থা নেই। তিনি জানেন– সুদেষ্ণার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হবে না। অতএব বেশ মেজাজেই বললেন না, আপনাকে আর কিছুই করতে হবে না। যাদের কাছে সে অপরাধ করেছে, আমাকে অপমান করে আমার গন্ধর্ব স্বামীদের যে চটিয়েছে, তারাই এই অসভ্যতার মূল্য চোকাবেন এবং এখন দেখার বিষয় যে, আজকের রাতটা তার কাটে কিনা?

আশ্চর্যের বিষয়, সুদেষ্ণা এ-সব কথার কোনও প্রতিবাদ করেননি এবং এর পরে তার কোনও উচ্চবাচ্যও নেই। তিনি যেন বেশ নির্বিকার, যা হয় হবে গোছের ভাব। এই সম্পূর্ণ ঘটনা থেকে মনে হয়, তিনি যে খুব খারাপ লোক, তাও নয়। দ্রৌপদীকে ভাই কীচকের কামনার আগুনে নিক্ষেপ করার মধ্যে তাঁর ইচ্ছা ছিল কি ছিল না, এটা বিচার করা কঠিন, হয়তো বা তিনি নাচার ছিলেন, কীচককে নিয়ন্ত্রণ করার কোনও সাধ্যই ছিল না তার। কিন্তু এও তো ঠিক যে, তিনি দ্রৌপদীর অনুরোধ-উপরোধ প্রত্যাখ্যান করে সব জেনে শুনেও দ্রৌপদীকে নারীত্বের চরম অবমাননার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। আবার এখন তিনি বলছেন– কীচককে প্রাণদণ্ড দেবার ব্যবস্থা করবেন। এই দুটি আচরণ বিপরীত ভাবনা সমন্বিত। তাতে আরও মনে হয়, মানুষ হিসেবে হয়তো সুদেষ্ণা ঠিক এতটা খারাপ নন অথবা এতটা হিংস্রও নন। তবে হ্যাঁ, তার মধ্যে কতিপয়-স্ত্রীজনোচিত ব্যবহার আছে। ঈর্ষা, অসূয়া, অসহনীয়তা এগুলি হয়তো দ্রৌপদীর প্রতি তাঁকে খানিক তীক্ষ্ণ-তীব্র করে তুলেছে মাঝে মাঝে।

আমরা জানি, এর পরে দ্রৌপদীর প্ররোচনায় ভীম কীচককে বীভৎসভাবে হত্যা করেছেন, কিন্তু কীচক-বধের চেয়েও যে খবরটা এখানে বেশি জরুরি, সেটা হল সুদেষ্ণার সঙ্গে দ্রৌপদীর প্রাত্যহিক সম্পর্ক, যা খুব সুন্দরভাবে বেরিয়ে এসেছে দ্রৌপদীর সঙ্গে ভীমের বাক্যালাপে। দ্রৌপদী কীচকের কাছে অপমানিত হয়ে রাতের আঁধারে ভীমের কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে যুধিষ্ঠিরের প্রতি রীতিমতো ক্রোধ প্রকাশ করার পর অজ্ঞাতবাসের কারণে হীনকর্মে রত অন্যান্য পাণ্ডব-স্বামীদের জন্য তার দুঃখও প্রকটিত হল অনেক। এরপরেই ভীমের প্রসঙ্গে সুদেষ্ণার আচরণগুলি বলতে আরম্ভ করলেন দ্রৌপদী। তিনি বললেন– তোমার মতো বীর মানুষ যখন পাঁচক-কর্ম করে বিরাট রাজার মনোরঞ্জন কর, তখন আমার মনে দুঃখ হয় একরকম। কিন্তু বিরাট রাজা যখন অন্তঃপুরের প্রাঙ্গণে তোমাকে দিয়ে হাতির সঙ্গে যুদ্ধ করায়, তখন অন্তঃপুরের মেয়েগুলো সব হি হি করে হাসতে থাকে, কিন্তু আমার মন তোমার বিপদের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে– হসন্ত্যন্তঃপুরে নাৰ্যো মম তুদ্বিজতে মনঃ।

বলা বাহুল্য, দ্রৌপদী-কথিত এই মেয়েগুলোর মধ্যে সুদেষ্ণাও আছেন, বলা উচিত, সুদেষ্ণাই প্রধান। দ্রৌপদী ভীমকে বলেন– শুধুই কি হাতি! বাঘ-সিংহ-মহিষের মতো ভীষণ জন্তুর সঙ্গে তুমি যখন যুদ্ধ কর, তখন সুদেষ্ণা নিজের মজায় দেখে, আর আমার প্রাণ কাঁপতে থাকত আশঙ্কায় কৈকেয়্যাং প্রেক্ষামাণায়াং তদা মে কশ্মলো ভবেৎ। ঠিক এই কথা বলতে বলতেই সুদেষ্ণার মনোজগতের কথা স্পষ্টভাবে তুলে আনেন দ্রৌপদী। রূপ-যৌবনবতী রমণীদের সম্বন্ধে সুদেষ্ণার ধারণা খুব ভাল নয়। তাদের সবসময়েই তিনি সন্দেহের চোখে দেখেন এবং ভাবেন- পুরুষ মানুষ তাদের এতটুকু স্তাবকতা করলেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়বেন উষ্ণ বক্ষে বাহুর ঘেরে। দ্রৌপদী সুদেষ্ণার বাড়িতে সৈরিন্ধীর কাজে যোগ দেবার সময় তাঁর প্রথম সন্দেহ ছিল রাজা বিরাট এই মেয়েটিকে দেখলে ধৈর্য রাখতে পারবেন না এবং দ্ৰৌপদীকে কথা দিতে হয়েছে যে, তিনি কোনওভাবেই বিরাট কর্তৃক প্রলোভিত হবেন না। কীচকের ক্ষেত্রেও তার মনে হয়েছে- দ্রৌপদী যতই হম্বিতম্বি করুন, কীচকের তেজ এবং ব্যক্তিত্বের কাছে মাথা নোয়াবেন দ্রৌপদী এবং তার স্তুতি নতিতে বিগলিতও হবেন। কীচককে তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন– সান্ত্বয়িত্ব যথাকামং সামানা রমে যথা ভাল করে তোষামোদ করো নির্জনে যাতে করে সে অনুরক্ত এবং প্রবৃত্ত হয় তোমার দিকে। অর্থাৎ সুদেষ্ণার ধারণা– তোষামোদ করলেই মেয়েরা ভুলবে। হয়তো তিনি নিজেও সেইরকম।

দ্রৌপদী ভীমকে বলেছেন–বাঘ-সিংহের সঙ্গে তোমার লড়াই দেখে আমি যখন তোমার বিপদের আশঙ্কায় মুচ্ছো যাবার জোগাড়, সুদেষ্ণা তখন প্রাঙ্গণে উপবিষ্ট অন্য মেয়েদের দেখিয়ে দেখিয়ে আমায় বলেন– একই জায়গায় থাকে তো, ওই ওখানে রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত বল্লব নামে এই ছেলেটি, আর এই এখানে সৈরিন্ধ্রী। সব সময়েই একে অপরকে দেখছে। এইরকম কাছে কাছে থাকতে থাকতে একটা মায়াও তো জন্মায়। সৈরিন্ধ্রীর তাই হয়েছে, যার জন্য বল্লব-ঠাকুরকে যুদ্ধ করতে দেখলেই আমাদের সৈরিন্ধ্রীর মনে একটা কষ্ট হয়। একসঙ্গে কাছাকাছি থাকলে বুঝি এই মায়াটা হয়-ই– স্নেহাৎ সংবাসজান্মনে…ইমং সমনুশোচতি।

যুক্তির কথা হলে এটাও মানতে হবে যে, বল্লব ভীমের কাছাকাছি তো আরও অনেকে আছেন, সেই সব রমণীরা, যাঁরা সুদেষ্ণার পাশে বসে যুধ্যমান বল্লবকে দেখেন, কই তাদের সঙ্গে তো সুদেষ্ণা এই রসিকতা করেন না। সত্যি বলতে কী, তারা তো কেউ স্বামীর জীবনাশঙ্কায় চিন্তিত হয়ে মূৰ্ছিতপ্রায়ও হল না। কাজেই স্বামী-সম্বন্ধ না জেনে কোনও রমণী যদি অন্যতরার সঙ্গে কোনও সুন্দর পুরুষের কিঞ্চিৎ বা কণ্বঞ্চিৎ প্রিয়সম্বন্ধ রচনা-যোজনা করে, তাতে দোষের কিছু আছে বলে মনে হয় না। তা হলে দ্রৌপদীর লাগছে কেন? দ্রৌপদীর লাগছে এইজন্য যে, বল্লব ভীম তাঁর সত্যিই স্বামী বটে, অথচ সে-সম্বন্ধ তিনি প্রচ্ছন্ন রেখেছেন সবার কাছে। বিশেষত তিনি নিজেকে বিবাহিত বলে প্রচার করেন, অদৃশ্য স্বামীদের সম্বন্ধে তিনি নিজের সতীত্ব-প্রখ্যাপনও কম করেন না। এই অবস্থায় বল্লবকে দেখে তিনি যদি আচ্ছন্ন এবং করুণ হয়ে ওঠেন, তবে মুখরা সুদেষ্ণার কী এমন অপরাধ হল! তিনি বলতেই পারেন– সৈরিন্ধ্রীও বড় লক্ষ্মী মেয়ে আর এই যুধ্যমান বল্লবও বেশ সুন্দর পুরুষ– কল্যাণরূপা সৈরিন্ধ্রী বল্লবশ্যাপি সুন্দরঃ।

অন্যদিকে অদৃশ্যভাবে তার স্বামী আছেন বলা সত্ত্বেও একটি অন্য সুপুরুষ সম্বন্ধে প্রকাশ্যত দুর্বল দ্রৌপদীকে পরপুরুষের মোহাচ্ছন্ন বলে প্রমাণ করার মধ্যে একটা মর্যাদাহানির কলঙ্ক থাকে। এই কলঙ্কলেপনের চেষ্টাতেই দ্রৌপদীর আপত্তি। কিন্তু আপত্তি হলেও সুদেষ্ণার সেটা বোঝবার কথা নয়, কেননা বল্লবরূপী ভীমের জন্য তিনি তো উৎকণ্ঠা দেখাচ্ছেন প্রকাশ্যেই। অতএব একটি অপরিচিত পুরুষের জীবন-ভাবনায় আকুল হয়ে ওঠা অন্য এক অপরিচিতা রমণীকে সুদেষ্ণাও যেমন সঙ্গতভাবেই খোঁচা দিতে পারেন, তেমনই বাইরে যিনি সতীত্বের আবরণ খ্যাপন করছেন, অথচ তাকেই যদি এক তথাকথিত পরপুরুষের ভাবনায় আকুল বলে প্রমাণিত করা হয়, তবে তারও এক বিপন্নতা তৈরি হয়। তবে সেটা অনেকটাই এইরকম যে, নিজের হাতের খোঁচায় নিজের চোখে জল আসলে কেউ যদি কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করে তবে তার ওপরে রাগ করার মতো।

সুদেষ্ণার সমস্যা হল, এই রসিকতার সঙ্গে এক্ষেত্রে তাঁর রসিকতাও খুব অপ্রাসঙ্গিক বা অন্যায়ও নয়, কিন্তু রসিকতার সঙ্গে তিনি স্ত্রী-জাতির সাধারণ সত্তা এবং চরিত্রকেই কলঙ্কিত করে ফেলেন। দ্রৌপদীর সঙ্গে বল্লবের প্রণয় প্রমাণ করার জন্য তিনি বলে ওঠেন–মেয়েদের গোপনচারিণী ইচ্ছের কথা কিন্তু একেবারেই স্পষ্ট করে বলা যায় না। তার মধ্যে এই সৈরিঞ্জী আর বল্লব– দু’জনকেই দু’জনের সঙ্গে বেশ মানায়– স্ত্রীণাং চিত্তং তু দুজ্ঞেয়ং যুক্তরূপৌ চ মে মতৌ। এইসব রসিকতার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু পার্শ্ববর্তী রমণীকুলের মধ্যে গল্পটা তৈরি করে দেন। তিনি বলেন একটা ঘটনা কিন্তু খেয়াল কর। এই বল্লব আর এই সৈরিন্ধ্রী–এরা দুজনেই কিন্তু রাজবাড়িতে প্রায় একই সঙ্গে কাজে লেগেছে। তারা এতকাল ধরে একসঙ্গে পাশাপাশি আছে, এতদিন ধরে নিজেদের মধ্যে আড়েঠাড়ে কথাবার্তা হচ্ছে, হয়তো এর মধ্যে কিছু আছে, যার জন্য বাঘ-সিংহের সঙ্গে যুধ্যমান বল্লবের কিছু একটা হয়ে যাবে বলে কষ্ট পায় আমাদের সৈরিন্ধ্রী– সৈরিন্ধ্রী প্রিয়সংবাসান্নিত্যং করুণবাদিনী।

দ্রৌপদী যতই দোষ ধরুন, যতই তার সম্বন্ধে নালিশ করুন ভীমের কাছে, অন্তত এই রসিকতায় আমরা তাঁর বড় দোষ দেখি না কোনও হ্যাঁ, সুদেষ্ণা কিছু সন্দেহপ্রবণা রমণী বটে, তার নিজের মধ্যেও সেই অন্তশ্চিন্তিত অথবা অবদমিত পুরুষপ্রবৃত্তি ছিল কিনা কে জানে, হয়তো তিনি এমনই ভাবতেন যে, পৌরুষেয় শক্তিতে যে কোনও রমণী বশীভূত হতে পারে, কিন্তু দ্রৌপদী যে-কারণে নালিশ জানাচ্ছেন, সেটা খুব যুক্তিসহ নয়। এটা অবশ্যই ঠিক যে, সুদেষ্ণা দুর্বল প্রকৃতির মানুষ, কীচকের ক্ষেত্রে সেই দুর্বলতা চরমভাবে প্রকটিত। তিনি যেমন একভাবে কীচকের অসদুদ্দেশ্য জেনেও দ্রৌপদীকে প্ররোচিত করেছেন, তেমনই কীচক মারা গেলেও তাকে আমরা আহা-উঁহু কান্নাকাটি করতে দেখি না। বরঞ্চ তিনি এখন সৈরিন্ধ্রীকে ভয় পাচ্ছেন।

দ্রৌপদী যে সুদেষ্ণার সম্বন্ধে নালিশ জানাচ্ছেন ভীমের কাছে, সেটা অনেকটাই তাঁর ব্যক্তিগত জ্বালা। যিনি পূর্বে রাজবধূ ছিলেন, ইন্দ্রপ্রস্থের পট্টমহিষী, তিনি আজ সুদেষ্ণার মতো দুর্বল রমণীর স্নান আচমনের জল বহন করছেন– শৌচদাস্মি সুদেষ্ণায়াঃ– এটা দ্রৌপদীর ব্যক্তিগত কষ্ট। ইন্দ্রপ্রস্থের রাজবাড়িতে তিনি একবার আসন থেকে উঠে হাঁটতে আরম্ভ করলে তার সামনে পিছনে দাসীরা ছুটত তারই সুখযাত্রার জন্য, আর আজ বিরাট গৃহিণী সুদেষ্ণা রাজবাড়িতে হাঁটতে থাকলে দ্রৌপদীকেই তার সামনে অথবা পিছনে দৌড়তে হয়– সাহমদ্য সুদেষ্ণায়াঃ পুরঃ পশ্চাচ্চ গামিনী দ্রৌপদীর এ দুঃখও তার নিতান্ত ব্যক্তিগত কাজের শর্ত, এর জন্য তিনি সুদেষ্ণাকে দোষী করতে পারেন না কোনওভাবেই। সুদেষ্ণার একমাত্র বড় দোষ, তিনি কামুক কীচকের অভিসন্ধি জেনেও নিজের পরিচারিকা দাসীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তারই কাছে সমর্পণ করা। কিন্তু এর পিছনেও সুদেষ্ণার কিছু মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে এবং সেটা দ্রৌপদী একেবারে সঠিক ধরতে পেরেছেন।

দ্রৌপদী বলেছেন– কেকয়-রাজনন্দিনী সুদেষ্ণা সবসময় আমার রূপ নিয়ে আশঙ্কা করে, সবসময় সে ভাবে যে, এই বুঝি তার স্বামী বিরাট রাজা আমার রূপ দেখে-না মজে যায় এবং সুদেষ্ণাকে ছেড়ে আমার প্রতি না আকৃষ্ট হয়– নিত্যমুদবিজতে রাজা কথং নেয়া দিমিমা মিতি। এই উদ্বিগ্নতা এতটাই প্রকট ছিল যে, সে-কথা সুদেষ্ণা তার ভাই কীচককেও কোনও-না-কোনওভাবে জানিয়েছেন। দ্রৌপদী বলেছেন এটা জানার পর থেকেই আমার ওপর কীচকের আকর্ষণ আরও বেড়ে যায়, কীচক তারপর থেকেই আমাকে ভীষণভাবে চাইতে থাকে– তস্যা বিদিত্বা তদ্ভাবং… কীচকোহয়ং সুদুষ্টাত্মা সদা প্রার্থয়তে হি মাম। আমরা দ্রৌপদীর কথা থেকেই বুঝতে পারি– কেন সুদেষ্ণা দ্রৌপদীকে কীচকের কাম মুখের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিলেন ইচ্ছে করে। যেহেতু প্রথম থেকেই তার মনের মধ্যে কাজ করছে যে, রাজা এই রূপবতী রমণীর বশীভূত হবেন, অতএব সেই সন্দেহ-বাতিকেই তিনি তার বিশ্বস্তা দাসী সৈরিন্ধ্রীকে কীচকের ঘরে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। এই ভাবনায় যে, তাঁর স্বামীটি অন্তত ঠিক থাকবেন।

আমরা জানি এটা নিছক সন্দেহ। বিরাট রাজার কাছে সৈরিন্ধ্রী প্রতিদিনই যেতেন চন্দনপঙ্ক পৌঁছে দেবার জন্য। এমনকী দ্রৌপদীর পিষ্টপেষিত চন্দন-কুমকুম ছাড়া বিরাটের পছন্দও হত না, কিন্তু বিরাট কোনওদিন কোনও অভদ্র অশ্লীল ব্যবহার করেননি দ্রৌপদীর সঙ্গে। অথচ সুদেষ্ণা বোঝেননি যে, দ্রৌপদীকে আপন সন্দেহবশে বিপদের মুখে ঠেলে দেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কীচককেও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। কীচক এবং উপকীচকরা দ্রৌপদীর অদৃশ্য স্বামীদের হাতে নিহত হয়েছেন– এই প্রচার কানে যাবার পর বিরাট এসে সুদেষ্ণাকে বলেছেন– তুমি সৈরিন্ধ্রীকে এই নগর থেকে চলে যেতে বলবে। বলবে– মহারাজ বিরাট তোমার গন্ধর্ব স্বামীদের ব্যাপারে ভয় পাচ্ছেন, তুমি এই নগর ছেড়ে যেখানে ইচ্ছে চলে যাও। কীচকের মৃত্যুর পর সৈরিন্ধ্রী-দ্রৌপদী নগর ভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরলে সুদেষ্ণা স্বামীর কথামতো সৈরিন্ধ্রীকে বললেন- তুমি এই নগর ছেড়ে যেখানে মনে হয় চলে যাও– সৈরিন্ধ্রী গম্যতাং শীঘ্রং যত্র কাময়সে গতিম– আমার স্বামী তোমার গন্ধর্ব স্বামীদের কাছ থেকে পরাজয়ের ভয় পাচ্ছেন। তুমি চলে যাও।

শুধু এটুকু বললে বুঝতাম যে, সুদেষ্ণা স্বামীর কথা শুনছেন নির্বিচারে, কিন্তু এই কথার সঙ্গে তাঁর নিজের একটা যোজনা আছে। স্বামীর কথাটি শেষ করেই সুদেষ্ণা বললেন– দেখ, বয়সে তুমি তরুণী, এমন রূপ-যৌবন নিয়ে এখানে তোমার বাস না করাই ভাল তঞ্চাপি তরুণী সুভ্র রূপেণাপ্রতিমা ভুবি। এই কথার মধ্যে অবশ্যই সেই সন্দেহ আছে এবং এখন সন্দেহের সঙ্গে ভয়ও আছে। ভাই কীচক এই রূপের জন্য নিজেকে যেমন আত্মাহুতি দিল, শেষে তার স্বামীটিও না এই রূপে মত্ত হয়ে গন্ধর্ব-স্বামীদের হাতে মারা পড়েন।

দ্রৌপদী অবশ্য যাননি এবং সুদেষ্ণার কাছে মাত্র তেরো দিন সময় চেয়ে নিয়েছেন এবং অভয়ও দিয়েছেন তার স্বামীদের ব্যাপারে। বলেছেন– তেরো দিন পরেই তাঁর স্বামীরা এসে তাকে নিয়ে যাবেন এবং তার স্বামীরা বিরাট রাজার ভাল ছাড়া মন্দ করবেন না–তত মামুপনেয্যন্তি করিষ্যন্তি চ তে প্রিয়। সুদেষ্ণা কিন্তু সৈরিন্ধ্রীর কথা শুনেছেন। এটাও তার চরিত্রের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য যে, কোনও ঘটনা নিয়েই তিনি বেশি দূর ভাবেন না। তেমন হলে তো তিনি এখন দ্রৌপদীকে চাপাচাপি করতেন, ভ্রাতৃহন্ত্রী দাসীকে ঘরছাড়া করতে পারতেন সেই মুহূর্তেই। কিন্তু সৈরিন্ধ্রীর কথায় বিশ্বাস করেই হোক, অথবা তাকে কিংবা তার গন্ধর্ব স্বামীদের ভয় পেয়েই হোক সুদেষ্ণা দ্রৌপদীকে আর কোনও কথা বলেননি, রাজার প্রত্যাদেশও শোনাননি নিজের অস্বস্তি ঢাকার জন্য। মহাভারতের কবি সুদেষ্ণার জন্য বেশি জায়গা রাখতে পারেননি। পাণ্ডবদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে অজ্ঞাতবাসের জীবন এবং সেখানেও যে বাধা-বিঘ্ন সতত তাদের উদ্বিগ্ন করেছে, তারই পরিসরে সুদেষ্ণা এসে পড়েছেন খানিক জায়গা জুড়ে। কিন্তু এইটুকুর মধ্যেই এক আপাত সরলা রাজবধূর অন্তহৃদয়ের জটিলতা, সন্দেহ কতদূর যেতে পারে, সেইটুকু বলেই মহাভারতের কবি সুদেষ্ণা-পর্ব শেষ করে দিয়েছেন। সুদেষ্ণাকে এর পরে দেখতে পাব সেই বিবাহহাৎসবের মঞ্চভূমিতে, যেখানে অর্জুন-পুত্র অভিমন্যুর জন্য সুদেষ্ণা তার মেয়ে উত্তরাকে সাজিয়ে-গুজিয়ে বিবাহ-পীঠিকায় বসাচ্ছেন– সুদেষ্ণাঞ্চ পুরস্কৃত্য মৎস্যানাঞ্চত বরস্ত্রিয়ঃ। উত্তরা-অভিমন্যুর বিয়ে হয়ে গেলে মহাভারতে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। এই বিশাল-তুমুল যুদ্ধ-শব্দের মধ্যে সুদেষ্ণা হারিয়ে গেছেন কখন। মহাভারতের কবি আর তাকে স্মরণে আনেননি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *