১৪. সত্যভামা

১৪. সত্যভামা

সেবারে দক্ষিণ-এশিয়ার সুবর্ণভূমিতে যেতে হয়েছিল একটি বিদ্বৎসভায় বক্তৃতা দেবার নেমন্তন্নে। বক্তাদের মধ্যে সেখানে দেশ-বিদেশের অনেক বিশিষ্ট নাম ছিল এবং তাদের মধ্যেও অনবদ্যা হওয়ার জন্য তখন তিনি বহুশ্রুত এবং ‘ফেমিনিজম’ ছাড়াও আরও বেশ কিছু ব্যাপারে তিনি জড়িয়ে আছেন বলেই সেই বিদ্বৎসভায় তিনি যেমন অন্যতম এক বক্তা হয়ে এসেছিলেন, তেমনি আরও একটা বড় কারণে তাকে সেই বিদ্বৎসভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং সেটা ছিল সভার অন্যতম আকর্ষণ-বিন্দু বিদ্বৎসভার শেষে তার নৃত্য-পরিবেশন করার কথা ছিল। আমি আগে মল্লিকাকে পিটার ব্রুকে দেখেছি, কিন্তু এমন প্রাত্যহিকতার মধ্যে কখনও দেখিনি। একই হোটেলে তিন-চারদিন আছি, এখানে-ওখানে, খাবার টেবিলে, ‘চত্বরেষু সভাসু চ’ তার সঙ্গেই দেখা হচ্ছে এবং কেন জানি না, প্রথম দিনের একটা সন্ধ্যাকালীন আড্ডার পর তার সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল।

খুব কাছ থেকে কখনও ভূষিত, কখনও অভূষিত একেবারে দৈনন্দিনভাবে তাঁকে দেখছিলাম, বিচিত্র বিষয়ে কথা বলছিলাম, রামায়ণের রাম থেকে মহাভারতের দ্রৌপদী নিয়েও কথা হচ্ছিল, কিন্তু সভার শেষে তার নৃত্য-পরিবেশনের বিষয়টি তখনও আমাদের কাছে অঘোষিত ছিল। তখন সুবর্ণভূমিতে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, বিদ্বৎসভার বক্তা-শ্রোতা ছাড়াও শহরের আরও বেশ কিছু গণ্যমান্য মানুষ উপস্থিত হয়েছেন মল্লিকার নাচ দেখার জন্য। আমি দর্শকাসনে বসেছিলাম। একজন মহিলা এসে আমাকে জানালেন, মল্লিকা ডাকছেন আপনাকে। তার সঙ্গে যেতে মেক-আপ রুমের বাইরে এসে দাঁড়ালেন মল্লিকা, তাঁর নৃত্যসজ্জা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ চেহারায় মাদক-সুন্দর লাগছিল তাকে অথচ তিনি প্রথাগতভাবে সেই অর্থে ভয়ংকর সুন্দরী নন, কিন্তু চেহারার মধ্যে ওই চঁছা-ছোলা ভাব, ভয়ংকর রকমের ব্যক্তিত্ব এবং only the nose and eyes একজন বলেছিল সেইরকম– সব মিলিয়ে এটাই বোঝা যাচ্ছিল যে সৌন্দৰ্য্য মানে দৈহিক সৌন্দৰ্য্য ছাড়াও আরও বেশি কিছু। মল্লিকা আমাকে দেখে বললেন, I am Satyabham.

সামান্য কথার পরেই আমি দর্শকাসনে ফিরে এসেছি। কিন্তু কী বলব, আমার সহৃদয় পাঠককুল! সেই ধ্বনি পবনে বহিল। কথাটা বারবার ধ্রুবপদের মতো ফিরে এসেছে মল্লিকার নৃত্যপরিবেশনের মধ্যে। তিনি পৌরাণিক পারিজাত-হরণের বিষয়টি বেছে নিয়েছিলেন নাচের জন্য সেই যে সেই অদ্ভুত বিষয়টা– নারদমুনি সুরলোক থেকে নেমে এসে স্বর্গের নন্দনকাননে ফোঁটা একটি পারিজাত ফুল দিয়েছেন কৃষ্ণের হাতে, কৃষ্ণ সেটা সপ্রণয়ে পট্টমহিষী রুক্মিণীর হাতে দিয়েছেন এবং নারদ নিজেই গিয়ে সেই খবর দিয়েছেন কৃষ্ণের অন্যতরা মহিষী সত্যভামাকে। সত্যভামার রাগ হয়েছে, কৃষ্ণ তার মান ভাঙাচ্ছেন। এই মান ভাঙানোর পালার মধ্যে কৃষ্ণ-সত্যভামার সংলাপ আছে, গান আছে সংস্কৃতের শ্লোক ভাষায়। মল্লিকা সেগুলি ইংরেজি অনুবাদ করে দিয়েছেন এবং তা টেপ-রেকর্ডারে যথোপযুক্তভাবে বাজছিল, আর মল্লিকা ‘লিপ মেলাচ্ছিলেন চিরাচরিত অভ্যস্ততায়। সংস্কৃত শ্লোক ছাড়াও ভোজপুরী-হিন্দিতে ক্ল্যাসিক্যাল গানের কথকতা ভেসে আসছিল সত্যভামার জবানিতে। কৃষ্ণ এটা-সেটা বলে নানা ওজর-অজুহাত দিয়ে সত্যভামার মান ভাঙানোর চেষ্টা করছেন এবং কৃষ্ণের কথারম্ভেই সত্যভামা চলে যাচ্ছেন স্টেজের পিছন দিকে এবং তার কথা শেষ হতেই নৃত্যের তালে তালে সত্যভামা স্টেজের সামনের দিকে এগিয়ে আসছেন এবং কৃষ্ণের ওজর-অজুহাত যুক্তি দিয়ে কাটার আগেই দু’ হাত কোমরে দিয়ে দৃঢ় ব্যক্তিত্বে, শাণিত অপাঙ্গ-সম্পাতে কৃষ্ণের দিকে তাকাচ্ছেন এবং বলছেন– আমি সত্যভামা–I am Satyabhama.

সেই পূর্ণালোকিত রঙ্গমঞ্চের মধ্যে বারংবার কৃষ্ণের নির্দিষ্ট বক্তব্য শোনার পরই পুনঃ পুনঃ আবৃত্ত সেই রমণীয় ব্যক্তিত্বের ঝনৎকার–lam Satyabhama–মল্লিকা তার পদন্যাস আর সাপাঙ্গ-মুখভঙ্গিতে সত্যভামাকে যেন স্বরূপে প্রকট করে তুলেছিলেন– সমস্ত কিছু ছাপিয়ে, আলো গান-সাজ সব ছাপিয়ে শুধু সেই অন্তহীন শব্দ– I am Satyabhama এখনও আমার কানে বাজে। পরবর্তীকালে অনেক তাৎক্ষণিক কথা পারস্পরিক প্রতিজ্ঞা থাকলেও মল্লিকার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি, সুবর্ণদ্বীপের দৈনন্দিন কথালাপও অনেক ভুলে গেছি, কিন্তু সেই সন্ধ্যার পারিজাত-হরণ বৃত্তান্তে প্রথমাবধি শেষ শব্দের মধ্যে ওই একটি পঙক্তি যেভাবে, যে ক্ষণে scripting করেছিলেন মল্লিকা, যে ঠাটে তিনি দাঁড়িয়ে স্থির বলছিলেন সে-কথাটা, সেটাই এতদিন ধরে বুঝেছি, সেটাই সত্যভামা-চরিত্রের ওপর আলোকপাতের রক্তবিন্দু–lam Satyabhama- যেন সবকিছু ছাপিয়ে খেয়াল করতে হবে তাকেই, কেননা তিনি রুক্মিণী নন যে, কৃষ্ণ যা বোঝাবেন তাই তিনি মেনে নেবেন, কেননা তিনি জাম্ববতীও নন যে, কৃষ্ণের অন্তঃপুরমহিষীদের মধ্যে গণ্যা হয়েছেন বলেই তিনি ধন্যা হবেন। তার মতো রমণীর সঙ্গে কথা বলতে হলে কৃষ্ণের মতো নায়ক-পুরুষকেও সতর্ক হয়ে কথা বলতে হবে, কেননা তিনি সত্যভামা–I am Satyabharma- সত্যভামার অঙ্গে প্রত্যঙ্গে, কথায়, মনে রমণীর সেই সর্বাশ্লেষী অহংকার জড়িয়ে আছে– তিনি সত্যভামা।

সত্যভামার জীবন বহুবর্ণময় এবং ঘটনাবহুল, হয়তো বা এতসব ঘটনাই তার ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছে। যেখানে তিনি জন্মেছেন, সেখানকার রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবেশ, তার নিজের পারিবারিক জীবন এবং যে সময়ে কমলকলির মতো তার শরীর-মন একসঙ্গে ফুটে উঠছে, সেই সময়ে অতি অল্পবয়সি যুবা থেকে প্রৌঢ় পুরুষের সপ্রণয় তথা নিতান্ত বৈষয়িক দৃষ্টিপাত তাকে অন্যতর এক তির্যক রমণীয়তায় প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং হয়তো খুব বিপ্রতীপ ঘটনার মধ্য দিয়েই এই রমণীয়তা সম্পন্ন হয়েছে। প্রথমে বোধহয় রাজনৈতিক–প্রশাসনিক অবস্থানটাই বুঝে নেওয়া দরকার, কেননা তাতে সত্যভামার সামাজিক অবস্থানটুকুও পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমরা আগেও বলেছি যে, কৃষ্ণ যেখানে জন্মেছিলেন অথবা যেখানে তার বাপ-পিতামহ, জ্ঞাতিগুষ্টি সকলে যে রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে বড় হয়েছেন সেখানে রাজার শাসন চলত না। ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যে কাশী-কাঞ্চী অবন্তীতে যখন রাজতান্ত্রিক শাসন চলছে, তখন মথুরা-শূরসেন অঞ্চলে এক ধরনের ‘অলিগার্কিক্যাল’ শাসন চলত, যেটাকে স্বয়ং কৌটিল্য বলেছেন ‘সঙ্ঘ শাসন, ইংরেজিতে সহজে বললে corporation. কৌটিল্য যাঁর নামের সঙ্গে ‘সঙঘ’ শব্দটি জুড়ে আমাদের তৎকালীন ইতিহাসের সূত্র ধরিয়ে দিয়েছেন তিনি হলেন কৃষ্ণের বৃদ্ধ প্রপিতামহ বৃষ্ণি। বৃষ্টির বংশধারাতেই কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল।

আমরা সেকথায় পরে আসছি, প্রথমে বোধহয় এটাই জানানো দরকার যে, মথুরা শূরসেন অঞ্চলে এবং পরবর্তীকালে দ্বারকায় যদু-বৃষ্ণিদের শাখা-প্রশাখা, জ্ঞাতিগুষ্টির নামে অনেগুলি সঙঘ ছিল এবং সেইসব সঙ্ঘমুখ্যরাই একত্রে মথুরা-দ্বারকার শাসন চালাতেন প্রায় গণতান্ত্রিকভাবেই। সত্যভামার প্রসঙ্গে যাবার আগেই আমাদের এই জ্ঞাতি-গুষ্টি সঙ্ঘমুখ্যদের পরিচয় খানিক দিয়ে নিতে হচ্ছে– কারণ, সত্যভামার মতো এক রমণীয় সত্যকে ঐতিহাসিকতায় প্রতিষ্ঠা করতে গেলে এই পারিবারিক পরিচয় নিতান্তই জরুরি। মহারাজ যযাতির প্রথম পুত্র যদুর ছেলে হল ক্রোষ্ট্র বা ক্ৰোষ্টা। ক্রোষ্ট্র দুটি বিবাহ করেছিলেন। তাদের নাম গান্ধারী এবং মাদ্ৰী; প্রথমা গান্ধার রাজ্যের মেয়ে, সেইজন্যই এই নাম, দ্বিতীয়া মদ্রভূমির, তাই মাদ্রী। গান্ধারীর একমাত্র পুত্রের নাম সুমিত্র, কেউ কেউ তাকে অনমিত্র বলেও ডেকেছেন, যদিও নামের অর্থ তাতে বদলায় না। আমাদের প্রস্তাবিত সত্যভামা এই বংশেই জন্মেছেন, তার পিতার নাম সত্রাজিৎ এবং তার জ্যাঠা সত্রাজিতের বড় ভাই প্রসেন। সত্যভামার বৈবাহিক প্রসঙ্গে তার বাপ-জ্যাঠা দু’জনকেই আমাদের বিশেষ প্রয়োজন হবে– কেননা দু’জনেই সেই কালের দিনে আজকের দিনের মতো জঘন্য কারণে খুন হয়েছিলেন। প্রসেন এবং সত্রাজিৎ বৃষ্ণির প্রথমা স্ত্রীর গর্ভধারায় অধস্তন পুরুষ হলেও বিখ্যাত বৃষ্ণির নামেই তারা পরিচিত ছিলেন।

আবার ক্রোস্টুর দ্বিতীয় স্ত্রী বহুপুত্রবতী ছিলেন। তার প্রথম পুত্রের ধারায় এই বংশে জন্ম নিয়েছেন অক্রূর। তার পিতামহ বৃষ্ণিও যথেষ্ট বিখ্যাত ছিলেন বলে অক্রূর বৃষ্ণি সঙ্ঘের প্রধান বলেও বহুল পরিচিত ছিলেন। কৃষ্ণ-বলরাম জন্মেছেন মাদ্রীর দ্বিতীয় পুত্রের ধারায়, তাদের পিতামহ বসুদেব-পিতা আর্যক শূর। শূর এতটাই বিখ্যাত ছিলেন যে তার নামে মথুরা অঞ্চলটাই শূরসেন নামে চিহ্নিত ছিল, স্বয়ং মেগাস্থিনিস মথুরা-জায়গাটাকে ‘শূরসেনাই’ বলে ডেকেছেন বলে পিতামহ শূর এক মুহূর্তেই ঐতিহাসিকতায় উপস্থিত হন আমাদের কাছে। মাদ্রীর তৃতীয় পুত্রের বংশধারায় জন্মেছেন সাত্যকি। তাঁর পিতামহ শিনির নামে বিখ্যাত হয়েছে শিনি সঙ্ঘ অথবা শৈনেয়-গণ। পরবর্তী সময়ে বৃষ্ণি, শিনি, শূর– এইসব পিতামহের নাম যতই শোনা যাক না কেন, এঁদের সবার অতি বৃদ্ধ প্রপিতামহ হলেন যদুপুত্ৰ ক্ৰোষ্ট্র। তার মানে সাত পুরুষ এর মধ্যে চলে গেল কিনা জানি না, কিন্তু জ্ঞাতি গুষ্টির লতায়-পাতায় এক অর্থে সত্যভামা, অক্রূর, কৃষ্ণ-বলরাম, সাত্যকি এরা সবাই ভাইবেরাদর। এই নামগুলির সঙ্গে আরও একটি-দুটি নাম আমাদের বলতে হবে, তারা হলেন কৃতবর্মা এবং শতধন্বা। কৃতবর্মাকে আপনারা চেনেন, তিনি কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে কৃষ্ণ এবং পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন এবং পাণ্ডবদের ক্ষতিও করেছিলেন যথেষ্ট। এই কৃতবর্মা এবং তার ছোট ভাই শতধন্ব– এঁরা হলেন সেই অক্রূরের পিতামহ বৃষ্ণিরও বড় ভাই অন্ধক বংশের জাতক। এই দুই ভাইয়ের পিতা হলেন হৃদিক, ফলে শতধন্বা-কৃতবর্মা হলেন হার্দিক।

আমাদের মূল প্রসঙ্গ সত্যভামার সম্বন্ধে কোনও বিশ্লেষণ করার আগেই যে এতগুলি বংশ-নাম এবং এক-একটা পরিচিত নামের বাপ-পিতামহদের নাম নিয়ে যথাসম্ভব বিরক্তিকর একটা পরিচয় দিলাম, তার কারণ দুটি অথবা তিনটি। এক হল– এই এতগুলি নাম কিন্তু মোহময়ী সত্যভামার জীবনের সঙ্গে কোনও-না-কোনওভাবে জড়িত। দ্বিতীয়ত অক্রূর যদি বা এঁদের সকলের মধ্যে প্রৌঢ়-প্রৌঢ়তর হয়ে থাকেন, তবে এঁদের সকলের কনিষ্ঠ এবং এই কেবলই কৈশোর পেরিয়ে এসেছেন, তিনি হলেন শতধন্বা। এঁরা সকলেই কিন্তু এক অর্থে ভাই অথবা বেশ কাছের আত্মীয়। সোজা কথায় যদুপুত্র ক্রোষ্ট্র থেকে পঞ্চম পুরুষেই কিন্তু অর-সত্যভামা-কৃষ্ণ-সাত্যকি-কৃতবর্মারা সব সগোত্রীয় ভাই বোন। তার মানে অরের সঙ্গে সত্যভামার যা সম্পর্ক, কৃষ্ণের সঙ্গেও কিন্তু তাই। তা হলে সত্যভামার স্পাহনীয়তা কোন জায়গায় পৌঁছেছিল যে, পূর্বোক্ত নামগুলির মধ্যে একটি-দুটি ছাড়া আর সকলেই তার নাটকীয় জীবনে নামভূমিকায় আছেন। তৃতীয় কথাটা পুনরুক্তি, অর্থাৎ কিনা বৃষ্ণিবীর অক্রূর, শৈনেয় সাত্যকি, কৃষ্ণ-বলরাম অথবা সুমিত্রের ধারায় সৌমিত্র সত্রাজিৎ এঁরা সকলেই এক-একজন সঙঘমুখ্য। এক মথুরা-দ্বারকায় কোনও রাজনৈতিক-সামাজিক সিদ্ধান্ত করার সময়ে এঁদের সকলকে নিয়ে ‘মিটিং হত এবং সিদ্ধান্ত হত বহুলাংশের মতাধিক্যে অর্থাৎ এঁরা কেউ একে অপরের চেয়ে রাজনৈতিকভাবে ন্যূন নন।

সত্যভামার জীবনের কোনও কথা যদি মহাভারত থেকে উল্লেখ করে তাকে প্রমাণ করতে হয়, তবে আমার এবং সাধারণ পাঠকের মহা-সমস্যা তৈরি হবে। মহাভারতে সত্যভামার কথা উঠলেই অল্পত ব্যক্তিরা বনপর্বে সত্যভামা-দ্রৌপদীর কথোপকণ্বনের উল্লেখ করেন এবং সেখানে স্বামীর মন পাওয়ার ব্যাপারে দ্রৌপদীর বক্তব্য শুনেই তৎকালীন স্ত্রী-সমাজের অবস্থান নির্ণয় করতে বসেন। সদম্ভে জানিয়ে রাখি– এঁরা মহাভারত কিছু বোঝেন না। কেননা মহাভারত বুঝতে গেলে শুধু মহাভারত পড়লে চলে না, কেননা ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক পরম্পরা বুঝতে গেলে বেদ-পুরাণ সবকিছু মিলিয়ে না পড়লে হবে না এবং সেগুলি পড়ার পরেও মহাভারতীয় চরিত্রগুলির স্বকীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মাথায় রেখেই সেই চরিত্রের মুখের কথা বিচার করতে হবে। এর চেয়েও বড় কথা হল– মহাভারত যেহেতু মুখ্যত কুরু-পাণ্ডবদের জীবন-কাহিনি নিয়েই বেশি ব্যস্ত, তাই কৃষ্ণের জীবন, বিশেষত তার অন্যতমা স্ত্রী সত্যভামার জীবন এখানে সবিস্তারে আসারই কথা নয়। কিন্তু সূত্রগুলি সব আছে এবং তা আছে বহু জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পুরাণগুলিতে কথিত কাহিনির উপাদানে সেইসব মহাভারতীয় সূত্র আমাদের পূরণ করে নিতে হবে।

সত্যভামার জীবনে প্রায় কৃষ্ণের মতোই যে জিনিসটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, সেটা একটা জড় জাগতিক বস্তুমাত্র এবং সেটায় তার নিজের কোনও মাথ্যব্যথা নেই কিন্তু সেটা নিয়ে সত্যভামার সকল পার্শ্বচরিত্ররাই মাথা ঘামাতে বাধ্য হয়েছেন বলেই তাকেও সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়েছে। এই জড়-জাগতিক বস্তুটি হল একটি হিরে-পান্নাজাতীয় মণি; যার নাম স্যমন্তক। সত্যভামার জীবন নিয়ে কথা বলতে গেলে এই মণির কথা আসবেই, অতএব সে কাহিনি সংক্ষিপ্ত আকারে শুনে নিতে হবে।

বেশির ভাগ পুরাণ অনুযায়ী সত্যভামার পিতা সত্রাজিৎ ছিলেন সূর্যের উপাসক। কিন্তু ভারতবর্ষের মাটিতে উপাস্য এবং উপাসক অনেক সময়েই প্রিয়ত্বের সম্বন্ধে ধরা পড়েছেন এবং হরিবংশ জানিয়েছে ভগবান সূর্য নাকি তার অত্যন্ত প্রিয় সখা ছিলেন– সখা প্রাণসমোহভবৎ। একদিন পশ্চিম সমুদ্রতীরে সত্রাজিৎ তার সূর্যোপাসনা শেষ করেছেন, হঠাৎই সমস্ত দিমণ্ডল উদ্ভাসিত করে তার সামনে উপস্থিত হলেন সূর্যদেব এবং তিনি সত্রাজিৎকে বর দিতে চাইলেন। সত্রাজিৎ তাঁর কাছে কিছু চাইতে পারলেন না, শুধু সূর্যের প্রীতি-প্রতীক নিজের কাছে রাখার জন্য তিনি তার গলার মালাখানি চেয়ে বসলেন। বন্ধু উপাসকের জন্য এর চাইতে বড় সম্মান আর কীই বা হতে পারে। সূর্য তার গলার মালাখানি খুলে পরিয়ে দিলেন সত্রাজিতের গলায়। অনেক মণি-রত্নখচিত এই মাল্যখানির মধ্যমণি ছিল স্যমন্তক এবং সেই মণির ক্ষমতা একেবারে অলৌকিক। এই মণি নাকি আটবার সুবর্ণ প্রসব করত প্রতিদিন এবং যে রাজ্যে এই মণিরত্ন থাকবে সেখানে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, রোগ-ব্যাধি কিছুই থাকবে না মণির প্রভাবে।

সত্রাজিৎ যখন এই মণিরত্ন গলায় নিয়ে দ্বারকায় প্রবেশ করলেন তখন এতটাই তিনি উদ্ভাসিত যে, তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন সূর্যই বুঝি আকাশ থেকে নেমে এসেছেন ভুয়ে– সূর্যোহয়ং গচ্ছতীতি হ। অসম্ভব দামি জিনিস সঙ্গে নিয়ে ঘুরলে ঈর্ষা অসূয়াগ্রস্ত মানুষের হতাশাটুকু যতই উপভোগ্য হোক আক্রোশী লোভী মানুষের হাত থেকে রেহাই নেই কোনও এই সত্যটা সত্রাজিৎ বুঝে গিয়েছিলেন পথ চলার কালেই হাজারও চক্ষুর প্রতিক্রিয়া দেখে। শুধু তাই নয়, মনে মনে আরও কতগুলি মুখ তার বুদ্ধিবৃত্তিকে আলোড়িত করল। দ্বারকার বিভিন্ন সঙ্ঘপ্রধানেরা তাঁর জ্ঞাতিগুষ্টির লোক হলেও তারা কেউ কম প্রভাবশালী নন এবং তারা বুদ্ধিও কেউ কিছু কম রাখেন না। অতএব ওই মহার্ঘ মণি-রত্নটিকে সত্রাজিৎ নিজের কাছে রাখা ঠিক মনে করলেন না। হরিবংশ ঠাকুর জানিয়েছেন যে, সত্রাজিৎ মণিটি নিয়ে ভালবেসে নিজের দাদা প্রসেনের হাতে দিলেন- দদৌ ভ্রাত্রে নরপতিঃ প্রেম্না সত্রাজি উত্তমম্। কিন্তু দাদাভাইয়ের ওপর যত ভালবাসাই থাকুক সত্রাজিতের, আসলে কিন্তু সেই বাস্তব ভয়, অতিমূল্যবান বস্তু নিজের ঘরে রেখে নিজের বিপদ ডেকে আনার ভয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় ভয় ছিল এই যে, মথুরা-দ্বারকার অন্যতম প্রভাবশালী নেতা কৃষ্ণ যদি এই মণিটি কোনওভাবে চেয়ে বসেন। রিষ্ণুপুরাণ জানিয়েছে– সত্রাজিতের আশঙ্কা সঠিক ছিল এবং এখানে বিষ্ণুপুরাণের বক্তব্য আমাদের বিশ্বাস করতে হবে এই কারণে যে, পৌরাণিক কণ্বক ঠাকুর কৃষ্ণের প্রতি শত শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও এখানে তার চরিত্রের ওপর অন্যদের কলঙ্ক আরোপণ মেনে নিচ্ছেন। দ্বিতীয় হল বিষ্ণুপুরাণের ভাষা। পণ্ডিতেরা স্বীকার করেছেন যে এক-একটি বিশেষ পুরাণের কোনও কোনও জায়গায় প্রাচীন গদ্যভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। ঐতিহাসিকতার দিক থেকে এই গদ্যভাষার মূল্য অপরিসীম এবং বিষ্ণুপুরাণ জানিয়েছে, পাছে কৃষ্ণ এই মণিটি তার কাছে চেয়ে বসেন, সেই আশঙ্কাতেই সত্রাজিৎ দাদা প্রসেনজিতের কাছে সেটি রেখে দিলেন।

বিষ্ণুপুরাণ আগেই ইঙ্গিত দিয়েছে, হরিবংশও পরে জানিয়েছে যে, এই স্যমন্তক মণির ব্যাপারে কৃষ্ণ সস্পৃহ ছিলেন, সোজা কথায় মণিটির ওপরে তার লোভ ছিল। তবে কিনা এটাও খুব মেনে নেওয়া মুশকিল, বিশেষত তার সমগ্র জীবনের শতেক ঘটনা এবং তাঁর চরিত্রের নিরিখে এটা ভাবা খুব মুশকিল যে, তার মতো উদার অবতারপ্রমাণ মানুষ একটি মণির জন্য লোভ প্রকাশ করবেন। প্রাচীন বিষ্ণুপুরাণ অবশ্য এ-বাবদে কৃষ্ণকে বাঁচিয়ে দেবার চেষ্টা করে বলেছে যে, মথুরা-দ্বারকার কুলসঙ্ঘগুলির প্রধানতম যিনি, সেই রাজা-উপাধিধারী উগ্রসেনের জন্যই কৃষ্ণ নাকি মণিটি উদ্ধার করার চেষ্টা করেছিলেন সত্রাজিতের কাছ থেকে অচ্যুতোহপি ততুমুগ্রসেনস্য ভূপতের্যোগ্যমিতি লিঙ্গাঞ্চক্রে।

সত্রাজিতের কাছে কৃষ্ণের দিক থেকে এই মণি-যাচনার কথা মিথ্যে নাও হতে পারে। কেননা স্যমন্তক মণির মধ্যে সামগ্রিকভাবে একটা রাষ্ট্রীয় কল্যাণ-সাধনের গুণ ছিল। প্রবাদ ছিল, এই মণি যাঁর সংগ্রহে থাকত, সেই ঘরে এটি প্রতিদিন আট বার সুবর্ণ প্রসব করত এবং মণির প্রভাবে সেই রাষ্ট্রে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় কিছু ঘটত না। এমন সার্বিক কল্যাণগুণ যেটির মধ্যে আছে, সেটি অবশ্যই রাষ্ট্রকল্যাণের সাধক হিসেবে রাজার কাছেই থাকা উচিত। আর এখানে কৃষ্ণের দিক থেকে মণি-যাচনারও কারণ আছে। কংসের অত্যাচার এবং তার একনায়ক অপশাসন থেকে মথুরাকে মুক্ত করার ব্যাপারে কৃষ্ণেরই অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। মগধরাজ জরাসন্ধের প্রত্যক্ষ মদতে তার জামাই কংস মথুরায় যদু-বৃষ্ণিদের সঙঘশাসনের মূলোচ্ছেদ করে দিয়ে ভোজসঙ্ঘের মুখ্য পুরুষ নিজের পিতা উগ্রসেনকে বন্দি করেছিলেন এবং মথুরায় নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঠিক এই অবস্থায় মথুরার অন্তত আঠেরোটা কুল সঙ্ঘের প্রধান পুরুষেরা মথুরার বাইরে

অন্যত্র বৃন্দাবনে থাকা কৃষ্ণের হস্তক্ষেপ যাচনা করেন পূর্বের সঙ্ঘশাসন সুস্থিত করতে একথা মহাভারতেই বলা আছে– জ্ঞাতিত্রাণমভীপ্সদ্ভিঃ অস্মাৎসম্ভাবনা কৃতা। এই অবস্থায় কৃষ্ণ জ্ঞাতিদের ডাকে সাড়া দেন এবং কংসকে মেরে ফেলেন– এই সংবাদও মহাভারতে আছে। কংস মারা যাবার পর তার পিতাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে মথুরার সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন, যদিও এই সঙঘশাসনে রাজা হিসেবে একজনকে প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারটা অনেকটা গণতান্ত্রিক শাসনে একটি দলনেতা নির্বাচনের মতো ঘটনা। কৌটিল্য তাঁর স্বকৃত অর্থশাস্ত্রে সঙ্ঘশাসনের প্রধান পুরুষকে রাজা নামের উপাধিধারী ব্যক্তি হিসেবে অথবা রাজশব্দোপজীবী নামে নির্দেশ করেছেন। বস্তুত জ্ঞাতিগুষ্টির অনেকগুলি কুলের সঙ্ঘমুখ্যকে রাজনৈতিকভাবে পরিচালনা করার জন্যই কৃষ্ণ কংসপিতা উগ্রসেনকে মথুরার শাসনে নিযুক্ত করেছিলেন।

কংসের মৃত্যুর পর তার শ্বশুর জরাসন্ধ বারবার মথুরা আক্রমণ করতে থাকলে অতিষ্ঠ হয়ে কৃষ্ণ দ্বারকায় যদু-বৃষ্ণিদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন এবং এখানে সঙঘগুলির প্রধান হিসেবে রাজার উপাধিমাত্র নিয়ে শাসন পরিচালনা করতে থাকলেন সেই কংসপিতা উগ্রসেন। কৃষ্ণ যেহেতু কংসের অপসারণ থেকে আরম্ভ করে দ্বারকায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত সমস্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটার মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন, তাই নিজে রাজা হয়ে না বসলেও তার প্রভাব ছিল সবচাইতে বেশি। হয়তো এই ভূমিকা থেকে রাষ্ট্রের উন্নতি এবং কল্যাণের চিন্তাতেই রাজা-উপাধিধারী উগ্রসেনের হাত শক্ত করার জন্য তিনি চেয়েছিলেন যাতে মণিটি উগ্রসেনের কাছেই থাকে, কেননা তাতেই মণির গুণে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মঙ্গল এবং প্রাকৃতিক মঙ্গল সাধিত হওয়ার কথা। হরিবংশ পরিষ্কার জানিয়েছে যে, কৃষ্ণ সব লজ্জা ত্যাগ করে প্রসেনজিতের কাছে রাখা সেই স্যমন্তক মণিটি চেয়েই বসেছিলেন, কিন্তু প্রসেন তাকে সত্রাজিতের গচ্ছিত-রাখা সেই মহার্ঘ রত্নটি দিতে অস্বীকার করেন– লিপ্সাং চক্রে প্রসেনা মণিরত্নে স্যমন্তকে গোবিন্দো ন চ তল্লোভাৎ…। কাজেই সত্রাজিতের অনুমান ঠিক ছিল– রাষ্ট্রের ভালর জন্যই তোক আর নিজের জন্যই হোক কৃষ্ণ মণিটি চাইতে পারেন এবং চাইলে পরে তাকে মণিটি না দিয়ে থাকা খুব কঠিন। সেই কারণেই সত্রাজিৎ আগেভাগে মণিটি হাতবদল করে প্রসেনের হাতে দিয়ে রেখেছিলেন, যাতে সত্রাজিতের কাছে চাইলে তিনি বলবেন, সেটা তো আমি দাদা প্রসেনকে দিয়েছি, আপনাকে আর দিই কী করে, আবার প্রসেনের কাছে চাইলে তিনি বলবেন– ওটি তো আমার নয়, ছোট ভাইয়ের গচ্ছিত রাখা ধন আপনাকে দিই কী করে!

আবার কৃষ্ণের দিক থেকেও দেখুন, মণিটি যাঁর কাছেই থাক, রাজপ্রয়োজনে, দেশের প্রয়োজনে এবং নিজের শক্তি-প্রভাবে মণিটি তিনি জোর করেই নিতে পারতেন প্রসেন কিংবা সত্রাজিতের কাছ থেকে, কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন– মণিটি নিলে যদু-বৃষ্ণি-সঙেঘর এক কুলীন সঙ্ঘমুখ্যের সঙ্গে তার একটা অযথা বিরোধ তৈরি হবে, এই বিরোধে জ্ঞাতিগুষ্টি আত্মীয়-স্বজনদের বিভাগ-পক্ষপাত তৈরি হবে এবং সেটা সঙ্ঘাসনের পক্ষে মোটেই ভাল না। অতএব আবারও রাষ্ট্রীয় কল্যাণে কারণেই এবং অবশ্যই জ্ঞাতিবিরোধের আশঙ্কায় স্যমন্তক মণির অধিকার নিয়ে তিনি কোনও প্রভাব-প্রতিপত্তিও খাটালেন না, জোরও খাটালেন না। জোর খাটালে তিনি পেতেন, কিন্তু কৃষ্ণ সে জোর খাটালেন না–বিষ্ণুপুরাণ আর হরিবংশ ঠিক তাই লিখেছে– শক্তোহপি ন জহার সঃ।

স্যমন্তক মণি নিয়ে যতটুকু সামান্য ঘটনা এ যাবৎ যা ঘটেছে, তাতে এটুকু পরিষ্কার যে, এই মণিরত্ন নিয়ে একটা ঐতিহাসিক গণ্ডগোল তৈরি হয়েছিল যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আগে এবং অবশ্যই জরাসন্ধ-বধের আগে, কিন্তু রুক্মিণীর সঙ্গে কৃষ্ণের বিবাহের পরে। আর একই সঙ্গে সাত্ৰাজিতী সত্যভামার কথা জানিয়ে রাখা ভাল যে, এখনও তিনি আড়ালেই আছেন, তবে এটা তো বোঝা যাচ্ছে দ্বারকার এতগুলি কুলসঙেঘর অন্যতম মুখ্য পুরুষ সত্রাজিৎ এবং প্রসেনের বাড়িতে কৃষ্ণের যাতায়াত ছিল এবং এঁরা সব কাছাকাছি থাকেন বলেই কৃষ্ণকে বারবার দেখে থাকাটা সত্যভামার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। বাপ জ্যাঠার সঙ্গে কৃষ্ণের আপাতত একটা মন-কষাকষি তৈরি হলেও কংসের মৃত্যুর পর এবং দ্বারকায় রাজধানী প্রতিষ্ঠার পর কৃষ্ণ তখন এতটাই ‘হিরো’ যে, সত্যভামার মতো সুন্দরী যুবতীর পক্ষে তাকে উপেক্ষা করাটা খুব মুশকিল ছিল। সে যাই হোক, সত্যভামার সঙ্গে কৃষ্ণের মানসিক সংশ্লেষের কোনও খবর আমরা এখনও পাইনি বটে, কিন্তু আত্মীয়তা নিবন্ধন উভয়ে উভয়কে চিনতেন অথবা একের বাড়িতে অপরের যাতায়াত ছিল, এটা মানতে কোনও অসুবিধে নেই।

তবে আরও একটা ব্যাপার, সেটা বলে নেওয়া ভাল। যদিও কথাটা পরে আসবে, কিন্তু এই জ্ঞাতিগুষ্টির পলিটিক্স এত আরম্ভ হয়ে যাবে যে, এমন সংবেদনশীল ব্যাপারটা তখন যেন কেমন তথ্য নিবেদনের মতো শোনাবে। ঘটনা হল– এবং এমন ঘটনা আজও হয়, কিন্তু কিছু করার থাকে না, সেই ঘটনা হল যে, কৃষ্ণের সঙ্গে সত্যভামার বিয়ের পরে আমরা জানতে পারলাম– কৃষ্ণের সঙ্গে বিয়ের অনেক আগে থেকেই নাকি সত্যভামার হৃদয় চাইতেন আরও তিনটি লোক এবং তাদের মধ্যে অন্তত দু’জন দ্বারকার কুল সঙেঘর মান্যগণ্য পুরুষ। তাদের একজন হলেন অর এবং দ্বিতীয় জন কৃতবর্মা। এঁদের সঙ্গে তৃতীয়ও একজন আছেন– তাকে বলা উচিত বালক কিশোর উত্তীয় তার নাম– তিনি হলেন কৃতবর্মার ছোট ভাই শতধন্বা, লোকে সংক্ষেপে বলত শতধনু। বিষ্ণুপুরাণ জানিয়েছে, কৃষ্ণের বিয়ের আগে থেকেই অনূর, কৃতবর্মা এবং শতধন্ব– এই তিনজনেই সুন্দরী সত্যভামাকে কামনা করতেন মনে মনে তাঞ্চার-কৃতবর্ম-শতধন্ব-প্রমুখাঃ পূর্বং বরয়ামাসুঃ। বিষ্ণুপুরাণ তথ্যটুকু নিবেদন করেই সাংবাদিকতার দায় থেকে মুক্ত হলেন বটে, কিন্তু কৃষ্ণের সঙ্গে বিয়ে হবার আগে এই তিনজন কে কীভাবে সত্যভামার দিকে অভিমুখী হয়েছিলেন অথবা সত্যভামাই বা কীভাবে কতটা তাদের দিকে অভিমুখী, সে খবর পুরাণকার দিলেন না, শুধু জানালেন, কৃষ্ণের অনেক আগে থেকেই এঁরা চেয়েছিলেন সত্যভামাকে।

সত্যি বলতে কী, এই তিন পৃথক ব্যক্তিত্বের মধ্যে তুলনা করাও মুশকিল, তবে এটা তো ঠিকই যে, এঁদের মধ্যে খানিক বেশি বয়সের হলেন অর। কৃতবর্মা প্রায় কৃষ্ণের সমবয়সি হবেন এবং শতধম্বা কৃষ্ণের থেকে একটু ছোট হবেন বলেই মনে হয়। বিষ্ণুপুরাণে ব্যবহৃত ক্রিয়াপদটি, এঁরা ‘চাইতেন’ বা ‘চেয়েছিলেন সত্যভামাকে, এই ক্রিয়া থেকেই অনুমানযোগ্য হয়ে পড়ে সত্রাজিতের বাড়িতে তাঁদের গতায়াত, সত্যভামার সঙ্গে তাঁদের কথালাপের চেষ্টা এবং সত্যভামার স্পৃহনীয়তা। এদের মধ্যে শতধন্বার জন্য আমার মায়া লাগে। দাদা কৃতবর্মা যে রমণীকে পছন্দ করেন ভাই শতধম্বারও তাকেই ভাল লাগে, এইরকম একটা অদ্ভুত পরিস্থিতিতে কৃতবর্মার ব্যক্তিত্বের কাছে শতধন্বা ম্লান ছিলেন নিশ্চয়। তবে কিনা কৃতবর্মা বীর মানুষ, তার মধ্যে যদু-বৃষ্ণি সঙ্ঘে তার প্রশাসনিক দায়িত্বও অনেক বেশি ছিল, সর্বোপরি তার চরিত্রটাও যেমনটি মহাভারতে টের পেয়েছি, তাতে খুব বেশি বিগলিত হয়ে সত্যভামার দিকে ঝুঁকে পড়াটা খুব স্বাভাবিক ছিল না। তবে ওই আর কী, তিনি মুগ্ধ ছিলেন বটে সত্যভামার ব্যাপারে, কিন্তু বহির্ভাবে তার যতটুকু ব্যক্ত হয়ে থাকবে, তাতে ছোট ভাই শতধন্বার পক্ষে সত্যভামার প্রতি নিজের ভাব প্রকট করে তোলাটা অসম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে অল্প বয়স বলেই হয়তো বেশ মুখচোরা স্বভাবের ছিলেন তিনি, নইলে একবারের তরেও তার কোনও অভিব্যক্তি শোনা যায় না কেন? বাকি রইলেন অক্রূর। অক্রূরই বোধহয় একমাত্র মানুষ, যাঁকে প্রায় চিহ্নিত করে বলা যায় যে, সত্যভামার হৃদয় পেতে তিনি সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন, অবশ্য রাজকন্যার সঙ্গে রাজ্যটাও, কেননা সত্যভামার ওপরে তার যত আকাঙ্ক্ষা ছিল, তার চেয়ে বেশি আকাঙ্ক্ষিত ছিল তার কাছে স্যমন্তক মণি।

হরিবংশ পুরাণ সত্যভামার প্রতি দুর্বলতার প্রসঙ্গে কৃতবর্মা এবং শতধন্বার নাম সেভাবে করেনি, কিন্তু অরের ব্যাপারে বলেছে– অক্রূর সদা-সর্বদা সুন্দরী সত্যভামাকে চাইতেন, কামনা করতেন– সদা হি প্ৰাৰ্থয়ামাস সত্যভামামনিন্দিতাম৷ আমরা জানি– অর্জুরের বয়স কিছু বেশি এবং কৃষ্ণের চাইতেও তিনি বেশ খানিকটা বড়। তবে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় অক্রূর অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ। কূটনীতি এবং রাজ্যব্যবহারে তিনি এতটাই বুদ্ধিমান যে, মৃত অত্যাচারী কংস রাজার শাসনেও তিনি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন কংসের প্রতি কৃষ্ণকে বৃন্দাবন থেকে মথুরায় নিয়ে এসে মল্লযুদ্ধে তাকে মেরে ফেলার কল্পনাটা কংসের হলেও মথুরায় কৃষ্ণকে নিয়ে আসার জন্য অক্রকেই পাঠিয়েছিলেন কংস। সেই কংসের সময় থেকে অক্রূর রাজনীতিতে জড়িয়ে আছেন এবং কংস মারা যাবার পর মথুরা দ্বারকায় নতুন নায়ক হিসেবে যদু বৃষ্ণি-অন্ধকদের ‘করপোরেশনে’ কৃষ্ণের প্রতিষ্ঠা যখন তুঙ্গবিন্দুতে পৌঁছেছে, সেখানেও কিন্তু অক্রূরের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা কিছু লঘু নয়। নানা কারণে কৃষ্ণকে তিনি মেনে নিতে বাধ্য হন, কিন্তু অনেক সময়েই তিনি কৃষ্ণের বিরোধী ভূমিকায় অবস্থান করেন। হয়তো বা কংসের মৃত্যুর পর তার কিছু প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু তখন রাজার ভূমিকায় কংসপিতা আহুক উগ্রসেনকে ফিরিয়ে আনায় অক্রূর একযোগে কৃষ্ণ এবং আহুক-উগ্রসেনেরও বিরোধী স্থানে অবস্থিত। আর এই বিরোধের জায়গাতেই হার্দিক কৃতবর্মা তার মদতদাতা– লক্ষ করে দেখবেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও কৃতবর্মা কৃষ্ণের বিরুদ্ধে দুর্যোধনের মদতদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। সঙ্ঘশাসনের সামগ্রিকতায় এই বিরোধ যে সবসময় প্রকটভাবে ধরা পড়ে তা নয়, কিন্তু পাওয়ার রিলেশনশিপ’ এমনই একটা ব্যাপার যে, ওপর ওপর সব বোঝা না গেলেও এই বিরোধিত্য চোরাবালির মতো কাজ করে এবং করেছেও।

হরিবংশ যখন অনিন্দ্যসুন্দরী সত্যভামার ব্যাপারে অরের হৃদয়-দৌর্বল্য ব্যক্ত করল, ঠিক তখনই একই সঙ্গে স্যমন্তক মণির ব্যাপারেও অক্রূরের লোভের কথাটুকুও জানিয়ে দিয়েছে- অরোহন্তরমন্বিচ্ছন মণিঞ্চৈব স্যমন্তকম্। অর্থাৎ অক্রূর সত্যভামাকেও চান, আবার স্যমন্তক মণিটিও চান। হয়তো এমনও হতে পারে সত্যভামাকে পেলে সত্রাজিতের ঘরের সম্পত্তি স্যমন্তকও তাঁর হাতে এসে যাবে এই পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বিষ্ণুপুরাণ যেহেতু বলেছে- কৃষ্ণের সঙ্গে সত্যভামার বিয়ের অনেক আগে থেকেই অক্রূর-কৃতবর্মা শতধন্বারা সত্যভামার হৃদয়াভিলাষী ছিলেন, অতএব এটাকেই আমরা প্রথম প্রমাণ হিসেবে নিলাম যে, সত্যভামাই অক্রূরের প্রথম লক্ষ্য ছিলেন, স্যমন্তক মণির অভিলাষ যুক্ত হয়েছে পরে। কিন্তু মূল কাহিনি আমরা যেভাবে আরম্ভ করেছিলাম, তাতে এখনও পর্যন্ত সত্যভামা সেভাবে অভিব্যক্ত নন, কিন্তু স্যমন্তক মণির সঙ্গে ভবিষ্যতে সত্যভামা এবং কৃষ্ণও যেহেতু জড়িয়ে যাবেন, তাই যদু-বৃষ্ণি-অন্ধকদের প্রায়-আত্মীয় জ্ঞাতিগুষ্ঠির মধ্যেই সত্যভামার বিষয়ে কাম্যতা কতটুকু, তাকে নিয়ে কত পুরুষের লোলভাব কতটুকু, সেটা জানিয়ে রাখলাম।

আমাদের মূল কাহিনিস্রোতে এসে জানাই– কৃষ্ণ চাইতে পারেন, এই ভেবে সত্রাজিৎ তো মণিটি রেখে দিলেন দাদা প্রসেনের কাছে ঠিক যেমন বিষ্ণুপুরাণ জানিয়েছে– সত্রাজিতেহপ্যচ্যুতে মামেতদ যাচিষ্যতি ইতি অবগতরত্নলোভঃ স্বভ্রাত্রে প্রসেনায় তদ রত্নং দত্তবান কৃষ্ণ এই মণি চেয়েছিলেন বলেই সত্রাজিৎ মণিটি প্রসেনের কাছ থেকে আরও সরালেন না। কিন্তু মণিটির বস্তুগুণ এবং মহার্ঘতা এমনই যে, তা না যায় ঘরে রাখা, না যায় সরিয়ে রাখা আবার কাছে থাকলে তা পরতেও ইচ্ছে করে। তা প্রসেন একদিন মণিটি গলায় পরে মৃগয়া করতে গেলেন বনে। পৌরাণিকেরা তাই লিখেছেন বটে, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস– মহার্ঘ মণিরত্ন কোথাও কোনও গোপন স্থানে রেখে আসবার জন্যই তিনি মৃগয়ার ছলে সেই উদ্দিষ্ট স্থানে রওনা হলেন। কিন্তু তার কপাল ভাল ছিল না, পথিমধ্যে একটি ভয়ংকর সিংহ তাকে মেরে ফেলল। তার অশ্বটিও মারা পড়ল সিংহের হাতে। সিংহ যখন প্রসেন এবং তার অশ্বটিকে মেরে সেই ভাস্বর স্যমন্তক মণি নিয়ে যাবার উপক্রম করেছে, তখন ভল্লুকরাজ জাম্ববান তাকে দেখতে পেলেন। জাম্ববান এবার সিংহটিকে মেরে সেই মণিরত্ন নিয়ে আপন গুহায় প্রবেশ করলেন। জাম্ববানের ছেলের নাম সুকুমার। মণি দেখে সে উচ্ছ্বসিত হলে জাম্ববান তার হাতেই স্যমন্তক মণি দিয়ে দিলেন।

এই কাহিনির মধ্যে প্রথমেই আমাদের পাঠককুলের অবিশ্বাস আসা দরকার। কেননা সিংহ তার প্রবৃত্তি এবং স্বভাববশত ঘোড়াও মারতে পারে প্রসেনকেও মারতে পারে, কিন্তু একটি সিংহ কোন আর্থিক প্রয়োজনবশত স্যমন্তক মণি নিয়ে যাচ্ছিল এবং কোন আর্থিক প্রয়োজনেই বা এক ভল্লুকরাজ সিংহকে মারছে এবং তার ছেলের আবার একটি মনুষ্য নাম–পরিষ্কার বোঝা যায় যে, এখানে নৃতাত্ত্বিক কোনও সূত্র আছে এবং সে-কথায় আমরা পরে আসছি। আগে জানানো দরকার যে, প্রসেন মৃগয়া থেকে ফিরে আসছেন না দেখে দ্বারকায় যদু-বৃষ্ণি সঙেঘর সাধারণ্যে নানা জল্পনা-কল্পনা আরম্ভ করল। লোকেরা কানাকানি করে বলতে লাগল যে, প্রসেন মরেননি, তাকে মারা হয়েছে। ওই মণিটার ওপরে তো কৃষ্ণের চোখ পড়েছিল, কিন্তু মণিটা তিনি পাননি, অতএব এই কাজটা কৃষ্ণেরই– নূন মেত অস্য কর্ম– আমরা এটা বিশ্বাস করতে পারছি না যে, প্রসেন মৃগয়া করতে গিয়ে অনর্থক প্রাণ হারাতে পারেন। অন্য কেউও তাকে মারেনি, এটা কৃষ্ণেরই কাজ– সমস্ত যদুকুলের মধ্যে এইসব কথা চলতে লাগল চুপিসাড়ে– নান্যেন প্রসেনো হন্যতে ইত্যখিল এব যদুলোকঃ পরম্পরং কণাকর্ণি অকণ্বয়ৎ।

কথাটা কৃষ্ণেরও কানে গেল একসময়। এমন একটা অপবাদ তিনি প্রায় সইতেই পারলেন না। কৃষ্ণের জীবৎকালেই অনেক অপবাদ তার নামে উঠেছে, কিন্তু খুন করে চুরির অপবাদ তার বিরুদ্ধে ওঠেনি। স্বভাবতই এই অপবাদ স্থালনের জন্য তিনি উচ্চকণ্ঠে সবার মধ্যে ঘোষণা করলেন যে, ঘটনাস্থল থেকে মণিটি তিনি উদ্ধার করে আনবেনই। যে অন্যায় তিনি করেননি– অনকারী তস্য কর্মণঃ–অথচ তার দায় এসে পড়ল তার ওপর, অতএব তারই দায় আসে মণিটি উদ্ধার করে নিয়ে আসার। তিনি সকলের সামনে প্রকাশ্যে জানালেন– খোয়া যাওয়া মণিরত্ন ঠিক উদ্ধার করে নিয়ে আসব আমি– আহরিষ্যে মণিমিতি প্রতিজ্ঞায় বনং যযৌ। কৃষ্ণ বেশ কয়েকজন বিশ্বস্ত লোককে সঙ্গে নিলেন, বিশেষত যারা বনের পথ চেনে, যারা রাজপুরুষদের সঙ্গে মৃগয়ায় যায় এবং মৃগপদচিহ্ন চিনে সেই পথ ধরে এগোতে পারে। এইসব আপ্ত-পুরুষদের সঙ্গে নিয়ে প্রসেনের চলা পথ বেয়ে কৃষ্ণ এগোতে থাকলেন প্রসেনস্য পদং গৃহ্য পুরষৈরাপ্তকারিভিঃ।

ঘোড়ার পিঠে চড়ে যে তীব্রবেগে অরণ্যের অন্তরে প্রবেশ করেছে তাকে খুঁজে বার করা অত সহজ নয়। পথ চলতে-চলতে কৃষ্ণ পরিশ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এবারে তাঁর সামনে ঋক্ষবান পর্বত এবং বিন্ধ্য পর্বত। এই দুই পর্বতের সম্ভাব্য স্থানগুলি দেখলেই আপাতত সমস্যা মেটে। নতুন উদ্যমে আবারও খুঁজতে খুঁজতে এবার হঠাৎই চোখে পড়ল সেই মৃত ঘোড়াটি, যাতে মৃগয়ার জন্য সওয়ার হয়েছিলেন প্রসেন। আর প্রসেনকেও বেশি খুঁজতে হল না। অদূরেই তার নিথর মরদেহটি পাওয়া গেল– সাশ্বং হতং প্রসেনং বৈ… স দদর্শ মহামনাঃ। সবই পাওয়া গেল, কিন্তু যে প্রতিজ্ঞায় কলঙ্কমোচনের জন্য কৃষ্ণ প্রসেনকে খুঁজতে এলেন, কৃষ্ণ দেখলেন– সেই মণি নেই প্রসেনের কাছে নাবিন্দচ্চৈচ্ছিতং মণিম্। হতাশ কৃষ্ণ খানিকটা বিমূঢ় অবস্থায় ইতস্তত পদচারণা করতে করতে একটি সিংহকে মৃত অবস্থায় দেখতে পেলেন। সিংহের গায়ে নখদন্তের চিহ্ন, যুদ্ধকালে নখোৎপাটিত গাত্রলোমের নমুনা পরীক্ষা করে নিপুণ কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন যে, একটি ভল্লুকজাতীয় প্রাণী, অথবা একটি ভল্লুকই সিংহটিকে মেরেছে। কৃষ্ণ সেই ভল্লুকের পদচিহ্নও দেখতে পেলেন। আপুরুষদের দিয়ে সেই পদচিহ্নগুলি পরীক্ষা করে কৃষ্ণ আরও নিশ্চিত হলেন যে, ভল্লুকটিই ওই সিংহকে মেরে একটি নির্দিষ্ট দিকে চলে গেছে ঋক্ষেণ নিহতো দৃষ্টঃ পাদৈ ঋক্ষশ্চ সূচিতঃ।

পাঠক! আবার সেই সিংহের কথা, সেই ভালুকের কথা। ভল্লুক পশুরাজ সিংহকে মারছে, ভালুক মণি নিয়ে পালাল কিনা সেই সন্দেহও হচ্ছে, অতএব নৃতাত্ত্বিক কায়দায় কথাটা পরিষ্কার করে নেওয়াই ভাল। লক্ষ করে দেখুন, সিংহ সশস্ত্র প্রসেনকে মেরে মণি নিয়ে পালাচ্ছে, সে তো গলায় পরে বনস্থলীতে ঘুরে বেড়াবার জন্য নয় নিশ্চয়ই, সেটাকে সে মূল্যবান রত্ন বলে বুঝেছে; আবার সিংহকে মারছে এক ভালুক এবং সেও মণি নিয়েই পালিয়েছে। আসলে যে অঞ্চলে প্রসেন মৃগয়ায় গিয়েছিলেন, সেটা ঋক্ষবান পর্বত, আরও একটু এগিয়ে বিন্ধ্য। আর্যায়নের প্রথম পর্যায় অথবা দ্বিতীয় পর্যায়ে এইসব অঞ্চলে যে সব মানুষ থাকতেন, তারা অনেকেই আর্যবৃত্তের বাইরে উপজাতীয় মানুষ। তারা কেউ বা সিংহের ‘টোটেম’ ব্যবহার করতেন, কেউ বা ভল্লুকের অথবা কেউ সাপের। নইলে জাম্ববান নামটাই খেয়াল করে দেখুন। রামায়ণে রামচন্দ্রের সহায়ক জাম্ববানকে মনে আছে তো? যাঁরা এই অঞ্চলে ভল্লুকের টোটেম ব্যবহার করতেন তাদের মোড়ল ছিলেন জাম্ববান। তিনি রামায়ণে এতই বিখ্যাত হয়ে গেছেন যে, পরবর্তী সময়ে ভল্লুকের টোটেম ব্যবহার করা সমস্ত উপজাতীয় মানুষের মোড়লকেই জাম্ববান নামে ডাকা হয়েছে। তা নইলে রামচন্দ্রের আমলের জাম্ববান কৃষ্ণের কালে টিকে থাকতেন না। এখানে যে মানুষটি প্রসেনের গলায় ভাস্বর মণিটি দেখে লোভী হয়ে উঠেছিল, সে সিংহের ‘টোটেম’ ব্যবহারকারী কোনও মানুষ। কিন্তু ঋক্ষবান পর্বতে সিংহের টোটেমওয়ালা বেশি শক্তি দেখাতে পারেনি, কারণ ‘ঋক্ষ’ মানেই ভালুক, আর তাদের নামেই যেহেতু পর্বত, অতএব অনুমান করি– এখানে ভল্লুকের ‘টোটেম’ ব্যবহারকারী মানুষেরা বেশি থাকতেন। জাম্ববান নামটা এই উপজাতির ‘লিডারে’র গৌরব সূচনা করে। কেননা, রামায়ণের আমল থেকেই জাম্ববান ভল্লুকাধিপতি বলে বিখ্যাত। এখানে এই উপজাতীয় মানুষের সংখ্যাও বেশি এবং তাদের নেতা জাম্ববানের শারীরিক শক্তিও বেশি। এই কারণেই এক ভল্লুকের পক্ষে সিংহকে মারা সম্ভব হয়েছে। জাম্ববান সিংহকে মেরে মণিটি নিয়ে তার ছেলে সুকুমারকে দিলেন খেলা করার জন্য।

যাই হোক, কৃষ্ণ তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গকে নিয়ে ভল্লুকের পদচিহ্ন অনুসরণ করতে করতে কিছুদূর এসে দেখলেন– সেই পদচিহ্ন একটি গুহার মুখে এসেই মিলিয়ে গেছে। কৃষ্ণ বুঝলেন, গুহায় প্রবেশ করতে হবে। তিনি সহাগত যদু-বৃষ্ণি সঙ্ঘের লোকদের এবং আপ্ত পুরুষদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে নিজে সেই গুহার মধ্যে প্রবেশ করলেন। গুহার প্রায়ান্ধকার পথ দিয়ে সাবধানে এগোতে এগোতে অর্ধেক পথেই কৃষ্ণের কানে একটি নারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল। রমণী সান্ত্বনা দেবার মতো করে একটি বাচ্চা ছেলেকে যেন বুঝিয়ে বলছেন– সিংহ প্রসেনকে মেরেছে, আবার জাম্ববান সেই সিংহকে মেরে এই মণি নিয়ে এসেছে। সুকুমার। তুমি কেঁদো না। এই মণি এখন তোমারই– সুকুমারক মা রোদীস্তব হেষ স্যমন্তক।

এখানে গবেষণার দৃষ্টিতে যেটা খেয়াল করার মতো বিষয়, সেটা হল– হরিবংশ, ব্রহ্মপুরাণ এবং বিষ্ণুপুরাণ– এই তিনটি পুরাণেই রমণীর মুখে ওই সান্ত্বনা-বাক্যটি অনুষ্টুপ ছন্দে লেখা, এমনকী বিষ্ণুপুরাণে স্যমন্তক মণির হরণাহরণের সমস্ত কাহিনিটাই যেখানে গদ্যে লেখা, সেখানেও কিন্তু অনুষ্টুপ ছন্দে লেখা এই শ্লোকটি প্রায় অবিকৃত। গবেষক পণ্ডিতেরা জানিয়েছেন– মহাভারত-পুরাণগুলির মধ্যে প্রাচীন গাথা হিসেবে চিহ্নিত কতগুলি শ্লোকের উল্লেখ থাকে, পৌরাণিকদের কৌশলী কথকতায় প্রাচীন কাহিনি, কথা মাঝে মাঝে অন্য রূপ ধারণ করলেও গাথা-শ্লোকগুলিকে তারা প্রায় সময়েই অবিকৃত রেখেই কথকতা করেন। আসলে পুরাণের মধ্যে এই গাথা-অংশগুলি অপেক্ষাকৃতভাবে প্রাচীন এবং যেগুলি লোক-পরম্পরায় লোক-মুখে উচ্চারিত হতে হতে বহুশ্রুত বিখ্যাত হয়ে ওঠে। তিন-তিনটি পুরাণে এই শ্লোকটি একই চেহারায় রয়েছে এবং বিষ্ণুপুরাণের গদ্যে লেখা অংশগুলিকে পণ্ডিতেরা যেহেতু এমনিতেই প্রাচীনতর লিখিত সংস্করণ মনে করেন, সেই গদ্যে-লেখা স্যমন্তক মণির বিবরণের মধ্যেও যেহেতু এই শ্লোক অবিকৃত রয়েছে, তাতে আমরা ধারণা করি শ্লোকটি পৌরাণিকদের কাছে মৌখিক পরম্পরায় বাহিত এবং মণির এই বিবরণের একটা ঐতিহাসিকতা আছে– অর্থাৎ এটা কল্পকাহিনি নয়, এমনটা ঘটেছিল কৃষ্ণের জীবনে।

যাই হোক, গুহাপথের অর্ধমাত্র অতিক্রান্ত হওয়ার পরেই নারীকণ্ঠে স্যমন্তক মণির বিষয়ে স্পষ্ট কথা শুনে কৃষ্ণ আর কালবিলম্ব করলেন না। তিনি গুহার ভিতরে প্রবেশ করলেন। কৃষ্ণ যত বড় প্রভাবশালী মানুষই হোন না কেন, উপজাতীয় গুহায় অপরিচিত লোক দেখে জাম্ববান তাকে ছেড়ে দিলেন না। দুইজনের যুদ্ধ আরম্ভ হল গুহার মধ্যেই। এই যুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্র কতটুকু ব্যবহার হয়েছে, সে কথা কোনও পুরাণ জানায়নি। কিন্তু গুহার মধ্যে কৃষ্ণের সঙ্গে কী হচ্ছে না হচ্ছে, সে খবর বাইরে অপেক্ষারত যদু-বৃষ্ণিদের আপ্ত পুরুষেরা নিলেন না। তারা সাত-আট দিন অপেক্ষা করলেন কৃষ্ণের জন্য সপ্তাষ্টদিনানি স্থঃ–তারপর সকলেই একযোগে ফিরে গেলেন দ্বারকায়। এই ফিরে যাওয়া দলের মধ্যে কৃষ্ণের দাদা বলরামও ছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। তারা ফিরে যাবার পরেও যেহেতু কৃষ্ণ দু চার দিনের মধ্যে ফিরলেন না, অতএব তারা ভাবলেন এবং ঘোষণা করে দিলেন যে, কৃষ্ণ মারা গেছেন। তারা মৃত কৃষ্ণের উদ্দেশে রীতিমতো একটা শ্ৰাদ্ধশান্তিও করে ফেললেন– তদন্ধবাশ্চ তৎকালোচিত অখিলমুপরত- ক্রিয়াকলাপং চঃ।

ওদিকে জাম্ববানের সঙ্গে কৃষ্ণের যুদ্ধ চলল পুরো একুশ দিন। শেষের দিকে জাম্ববান আর পেরে উঠছিলেন না কৃষ্ণের সঙ্গে। তার বয়সটাও কৃষ্ণের চেয়ে অনেক বেশি এবং উপর্যুপরি খাওয়া-দাওয়ার অভাবে জাম্ববানের শক্তিক্ষয় হয়ে গিয়েছিল। অতএব যুদ্ধে। তিনি হেরে গেলেন কৃষ্ণের কাছে। হেরে যাবার পর জাম্ববান কৃষ্ণের কাছে নতি স্বীকার করলেন নিজের কন্যা জাম্ববতাঁকে কৃষ্ণের কাছে দিয়ে। দুই পক্ষের শান্তিসন্ধির জন্য এই কন্যা-সম্প্রদানই যথেষ্ট ছিল, অতএব কোনও কোনও পুরাণ এই অংশে কৃষ্ণকে অলৌকিকতার কক্ষে নিয়ে গিয়ে তাকে যে বিষ্ণু-নারায়ণের অংশ বলে জাম্ববানের কাছে প্রতিপন্ন করেছেন, সেটা বিশ্বাসী ধার্মিক-জনের কাছে বড় হয়ে উঠুক, আমরা কিন্তু ইতিহাসের যৌক্তিকতাতেই বিশ্বাস করি যে, এখানে তথাকথিত অনার্য-ভাবনায় চিহ্নিত জাম্ববানের মেয়ে জাম্ববতীর সঙ্গে কৃষ্ণের বিবাহটাই যুদ্ধশান্তির পথ তৈরি করেছিল। বিশেষত তৎকালীন দিনে মহান আর্য পুরুষেরা অনেকেই অনাৰ্যা রমণীকুলের পাণিগ্রহণ করে আমোদিত বোধ করেছেন, সেখানে কৃষ্ণের মতো ললিত পুরুষের কাছে জাম্ববতীর আবেদন কিছু কম হবার কথা নয়। কৃষ্ণ জাম্ববতীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন এবং ফিরে এলেন দ্বারকায়। সঙ্গে সেই স্যমন্তক মণি, সন্ধি হবার পরেই যে মণি জাম্ববান দিয়ে দিয়েছিলেন কৃষ্ণের হাতে।

অনেক গাম্ভীর্য নিয়ে যাঁর মৃত্যু-সংবাদ ঘোষিত হয়েছিল, যার শ্রাদ্ধ পর্যন্ত করে ফেলেছিলেন আত্মীয়-স্বজনেরা, সেই কৃষ্ণ এক অনার্ষা সুন্দরীর হাত ধরে রাজধানীতে ফিরলেন মহাসমারোহে এবং তার সঙ্গে সেই বহুপ্রতীক্ষিত স্যমন্তক মণি। কৃষ্ণ আর কাল বিলম্ব না করে সাত্ত্বত-বৃষ্ণি-অন্ধকদের জরুরি সভা ডাকতে বললেন উগ্রসেনকে। সভায় সঙঘমুখ্যেরা সকলে উপস্থিত হলে সবার সামনে কৃষ্ণ মণিটি দিলেন সত্রাজিতের হাতে, কেননা তিনিই স্যমন্তক মণির মূল অধিকারী, তিনিই মণি পেয়েছিলেন সূর্যদেবের হাত থেকে– দদৌ সত্রাজিতে তং বৈ সর্বসাত্বতসংসদি৷ কৃষ্ণ যেভাবে সবার সামনে সত্রাজিতের হাতে মণি তুলে দিয়ে নিজের কলঙ্ক মোচন করলেন, যেভাবে মণি ফিরিয়ে আনার সাক্ষী হিসেবে স্বয়ং জাম্ববতী অন্তঃপুরে বসে রইলেন মণির অন্তর্বর্তী অধিকারীর মতো, তাতে সত্রাজিৎ মণি পেয়েও স্বস্তিবোধ করলেন না। কেননা তিনি মনে মনে জানেন যে, ওই স্যমন্তক মণির জন্যই তিনি কৃষ্ণকে লোভী সাজিয়েছেন। দেশের রাজার জন্য অথবা বহুজনহিতের জন্য কৃষ্ণ মণিটি একবারমাত্র যাচনা করেছিলেন বলে মণিহরণের অপবাদ তিনিই দিয়েছিলেন প্রথম এবং তারপর দাদা প্রসেনের খুনি বলে তাকে প্রচার করার কৌশলও তিনিই গ্রহণ করেছিলেন। ফলে এখন সগর্বে এবং সাড়ম্বরে মণি ফিরিয়ে দেবার ফলে সত্রাজিৎ চরম লজ্জায় পড়লেন।

কৃষ্ণ কিন্তু একবারও সঙঘমুখ্যদের সভায় হম্বিতম্বি করে নিজের নামে অন্যদের কলঙ্ক রোপনের কথা বলেননি, তিনি নিশূপে সবিনয়ে মণি ফিরিয়ে দিয়েছেন মৌন-মূক অহংকারে। ফলত সত্রাজিতের লজ্জা-সংকোচ যেমন বাড়ল, তেমনই মনে মনে একটু ভয়ও হল। কৃষ্ণের মতো প্রভাবশালী নেতার ওপর না বুঝে কলঙ্করোপন করাটা যে মোটেই বুদ্ধির কাজ হয়নি, সেটা ভেবেই কৃষ্ণকে খুশি করার জন্য এবং তার সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করার জন্য সত্রাজিৎ তার তিন মেয়ের সবচেয়ে সুন্দরীটিকে কৃষ্ণের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন, এই সুন্দরীই সত্যভামা সত্যভামোত্তমা স্ত্রীণাং… ভার্যাং কৃষ্ণায় তাং দদৌ! এই বিবাহ এতটাই আকস্মিক এবং ঘটনা-পরম্পরা-বাহিত ছিল যে সত্যভামা নিজেও বুঝি এই বৈবাহিক ব্যাপারে প্রস্তুত ছিলেন না এবং হয়তো প্রস্তুত ছিলেন না স্বয়ং কৃষ্ণও। কিন্তু বিবাহ হয়ে গেল অনুকূল লগ্ন-সঞ্চারে।

বিবাহের অনুক্রম মানতে গেলে কৃষ্ণের প্রথমা স্ত্রী রুক্মিণীর পরেই কিন্তু দ্বিতীয় স্থানে আসেন জাম্ববতী এবং তার অব্যবহিত কিছুদিনের মধ্যেই কৃষ্ণের জীবনে এলেন সত্যভামা। সত্যভামার জীবন নিয়ে যে বিচিত্র নাটক কৃষ্ণের জীবনে শুরু হল, তার কথায় পরে আসছি, আপাতত যেটা জানানো দরকার, সেটা হল, কৃষ্ণের জীবনে রুক্মিণী যেমন সত্য, জাম্ববতী তেমনই সত্য, এবং তেমনই সত্য আমাদের সত্যভামা। বারবার তাদের ঐতিহাসিকতার কথা বলতে হচ্ছে এই কারণে যে, পণ্ডিত-সজ্জনদের মধ্যে এমনও কেউ কেউ আছেন যাঁরা কৃষ্ণের ঐতিহাসিকতায় বিশ্বাস করলেও কৃষ্ণের বিবাহিতা পত্নীদের ঐতিহাসিকতায় বিশ্বাস করেন না। কেউ কেউ আবার পট্টমহিষী রুক্মিণীকে যদি বা কোনও মতে নেন, তো জাম্ববতী এবং সত্যভামাকে একেবারেই আমল দিতে চান না। স্বয়ং মহামতি বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণচরিত্রের অতুলনীয় যৌক্তিকতার মধ্যেও সম্ভবত ঔপনিবেশিক যন্ত্রণায় ভুগেই এমন কথা লিখেছেন যে, রুক্মিণী ছাড়া কৃষ্ণের আর কোনও স্ত্রী ছিলেন না।

মহামতি বঙ্কিম জাম্ববানকে স্রেফ ভল্লুক বলে উড়িয়ে দিয়েছেন এবং কোনও ভল্লুকের মেয়ের সঙ্গে কৃষ্ণের বিয়ে হতে পারে এটা তাঁর মতে অসম্ভব। অন্যদিকে সত্যভামার সঙ্গে সম্পূর্ণ স্যমন্তক মণির বিবরণটাই তার কাছে পৌরাণিকদের উপন্যাস। সাহেবদের প্রক্ষিপ্তবাদের ছোঁয়াচ তার গায়েও এমনভাবে লেগেছিল যে, ‘বিক্সিক্যাল মর্যালিটি’তে বাঁধা আদর্শ এক কৃষ্ণের প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি তার চিরাভীষ্ট জাতীয়তাবোধেও সম্পূর্ণতা আনতে পারেননি। খুব সংক্ষেপে হলেও একটা কথা বোঝা দরকার যে, কৃষ্ণের আমলে বহুবিবাহ কোনও সমাজ-অচল অন্যায় প্রথা বলে গণিত ছিল না। অতএব রুক্মিণী ছাড়া আর কোনও রমণী তার প্রেমবৃত্তের মধ্যে অথবা নিতান্ত বৈবাহিক বৃত্তের মধ্যে এসে পড়বেন না, এমন ভাবাটা ধীরললিত কৃষ্ণের জন্য একটু বেশি বৈরাগ্যসূচক হয়ে পড়ে। জাম্ববতীর কথা মহাভারতে-পুরাণে খুব বেশি চর্চিত না হলেও এটা মানতে হবে যে, যেখানে যেখানেই স্যমন্তক মণির কাহিনি আলোচিত হয়েছে, সেখানে সেখানেই জাম্ববতী কৃষ্ণের কাছে প্রদত্ত তার পিতার যুদ্ধোত্তর উপহার হিসেবেই চিহ্নিত। তা ছাড়া বহুতর রমণীর বল্লভ ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও এই অনার্য উপজাতীয় রমণীর আবেদন কৃষ্ণের কাছে কিছু কম ছিল না। লোকমুখে এতটাই তিনি চর্চিত যে কোন কালের সেই পঞ্চম শতাব্দীর গুপ্তযুগীয় ‘তুশম প্রস্তরলিপি’তে বলা হচ্ছে যে, কৃষ্ণ জাম্ববতীর মুখপদ্মে লীন এমন এক মধুকর, যিনি জাম্ববতীর সরসতায় রাধার মুখখানিও ভুলতে বসেছেন।

জাম্ববতীর প্রতি কৃষ্ণ এতটা আসক্ত ছিলেন, এটা যদি আমাদের অনুমানযোগ্য কোনও সত্যের খাতিরে নাও মেনে নিই এবং এমনটা যদি মেনেও নিই যে, কৃষ্ণের বৈবাহিক জীবনে জাম্ববতী মাঝে মাঝে আকস্মিক ভালবাসা যোগ করেছেন, তার বেশি কিছু নয়, তা হলে তার পরেও কিন্তু বলব যে, সত্যভামা এবং স্যমন্তক মণি কৃষ্ণের জীবনে ঐতিহাসিকভাবে সত্য– এতটাই সত্য যে, ব্যাপারটা এইভাবেও বলা যায়– স্যমন্তক মণির ঘটনা যদি সত্য হয়, তবে সত্যভামাও ঐতিহাসিকতায় প্রতিষ্ঠিত হন, আবার কৃষ্ণের সঙ্গে সত্যভামার বিবাহ যদি সত্য হয়, তবে স্যমন্তক মণিও সত্য। এ-কথা বলার পিছনে কতগুলি পুরাতাত্ত্বিক সূত্র আছে। প্রথমত বেশিরভাগ পুরাণে স্যমন্তক মণির কাহিনিটি আশ্চর্যজনকভাবে কৃষ্ণ কাহিনির মূলস্থান থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে, অর্থাৎ যেখানে কৃষ্ণজীবনের নানা কথা উল্লিখিত হচ্ছে, সেখানে সত্যভামার সঙ্গে তার বিবাহ এবং স্যমন্তকের কাহিনি বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে অনেক আগে, বা পরে এমন জায়গায়, যেখানে যদু-বৃষ্ণি-অন্ধকদের বংশ পরম্পরা বর্ণনা করা হচ্ছে। আর রাজ-রাজড়া, মুনি-ঋষিদের বংশ-পরম্পরা বর্ণনাতেই যেহেতু পৌরাণিকদের ইতিহাস-স্মৃতি প্রধানত কীর্তিত–সর্গশ্চ প্রতিসর্গশ্চ বংশশা মন্বন্তরাণি চ– তাই এই অংশে বর্ণিত স্যমন্তক, জাম্ববতী এবং সত্যভামার কথা ঐতিহাসিকভাবে বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই কাহিনি অংশের প্রাচীনতা এবং ঐতিহাসিকতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বিষ্ণুপুরাণ। এই পুরাণ সর্বৈব শ্লোক-ছন্দে লেখা হয়েছে, কিন্তু পুরাতন রাজাদের বংশাবলির বর্ণনায় যেখানে প্রাচীন গদ্যভাষা ব্যবহৃত, পণ্ডিতরা মনে করেন বহুতর শ্লোকবদ্ধ ছন্দের মধ্যে যেখানে এই গদ্যের ব্যবহার, সেই অংশ অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি প্রাচীন। অতএব সেই গদ্যাংশে বর্ণিত বংশাবলি– বর্ণনার মধ্যে স্যমন্তক-জাম্ববতী-সত্যভামার কথা অবশ্যই বেশি প্রাচীন এবং সেটা এক্ষেত্রে ঐতিহাসিকতার একটা প্রমাণ বটেই।

সামান্য সাধারণ দু-তিনটি সাহেবি যুক্তি দিয়ে স্যমন্তক মণি এবং সত্যভামাকে পৌরাণিকদের উপন্যাস-গালগল্পের কোঠায় ফেলে দিলেও মহামতি বঙ্কিমের কৃষ্ণচারিত্রিক ভাবনাগুলি সবসময় ভারতবর্ষীয় সাহিত্যের উপাদান এবং অন্তঃপ্রমাণের দ্বারা সমর্থিত হয় না, বিশেষত স্যমন্তক মণির ব্যাপারে বঙ্কিমের ধারণা গবেষণার যুক্তিকে একেবারেই নিষ্প্রভ লাগে। মহামতি বঙ্কিম খেয়ালই করেননি যে, স্যমন্তক মণির জলঘোলা ঘটনাটা পুরাণকারদের কল্পনাপ্রসূত কোনও কল্পকাহিনি নয়, এই ঘটনা ঘটেছিল এবং তা জনসমাজে এতটাই প্রচলিত ছিল যে প্রাচীনতর অভিধানকার বা কোষকার-বৈয়াকরণের ধাতুরূপের উদাহরণ দেবার সময়ে পর্যন্ত সকলেই-জানে’ ভেবে এই স্যমন্তক মণির ঐতিহাসিক উদাহরণ দিয়েছেন, কিন্তু সে-কথা জানানোর জন্য আগে আমাদের মূল কাহিনিতে ফিরে যেতে হবে।

মনে আছে নিশ্চয়ই যে, সত্রাজিৎ পূর্বে কৃষ্ণের অপবাদ দিয়ে এখন একটু ভয় পেয়েই যেন সত্যভামার সঙ্গে কৃষ্ণের বিয়ে দিলেন। হঠাৎ এই বিবাহের আগে পর্যন্ত কৃষ্ণও বোধহয় তেমন করে তলিয়ে দেখেননি যে, তার অন্তঃপুর-প্রবিষ্টা এই নববধূটি অন্য আরও কত রাজপুরুষের কামনার আধার ছিল। হ্যাঁ, একথা মানতে পারি যে, বিবাহের আগে জ্ঞাতিগত আত্মীয়তার সূত্রেই কৃষ্ণ সত্যভামাকে চিনতেন এবং সত্যভামাও হয়তো ভালই চিনতেই যদু-বৃষ্ণিকুলের শিরোমণির মতো উজ্জ্বল এই নেতাকে। হয়তো সামান্য বাক্যালাপও ছিল কৃষ্ণের সঙ্গে সত্যভামার। কিন্তু স্যমন্তক মণির মতো একটা sensitive ব্যাপার এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকায় কৃষ্ণ বা সত্যভামা কোনও পক্ষই তাদের অন্তর উন্মোচন করেননি। তাই বলে কৃষ্ণের মতো কূটনৈতিক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সত্যভামার প্রতি প্রৌঢ়তম অক্রূরের সস্নেহ কামদৃষ্টিপাতের কথা জানতেন না অথবা সত্যভামাকে নিয়ে কৃতবর্মা-শতধন্বার মানসবিলাসের কথা জানতেন না, এটা হতে পারে না। অতএব সত্যভামার সঙ্গে কৃষ্ণের বিবাহটা যখন আকস্মিকভাবে হয়েই গেল, তখন কৃষ্ণ বেশ একটু আত্মতৃপ্ত হয়ে মৌনমূক অহংকারে কালাতিপাত করছিলেন।

কিন্তু একের প্রেম-সৌভাগ্য পূর্বতন লুব্ধকের মনে হিংসার জন্ম দেয়। কৃষ্ণের সঙ্গে সত্যভামার এই বিবাহবন্ধন ভাল মনে মেনে নিলেন না অক্রূর, কেননা সত্যভামাকে লাভ করার ব্যাপারে তারই অভিলাষ ছিল সর্বাধিক। কীভাবে, কোন বিভঙ্গে, কেমন মধুরতায় সত্যভামার জন্য তার প্রৌঢ় রোমাঞ্চ প্রকাশ করতেন অক্রূর, তার কোনও বিবরণ-প্রমাণ নেই বটে, কিন্তু তিনিই যে সত্যভামার হৃদয় কামনা করতেন, সেটা তথ্য হিসেবে বিষ্ণুপুরাণ জানিয়েছে এবং হরিবংশ আরও এক কাঠি এগিয়ে গিয়ে বলেছে– অক্রূর সদাসর্বদা চাইতেন, সুন্দরী সত্যভামা তার হোন। অন্যদিকে সত্যভামার প্রতি কৃতবর্মা এবং শতধন্বার আকর্ষণের কথা অক্রূর জানতেন, কিন্তু তাদের তিনি কখনওই খুব বড় শত্রু হিসেবে ভাবেননি। কেননা কৃতবর্মা খানিক রুক্ষ-শুষ্ক মানুষ, তাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়াটা প্রবীণ এই রাজনীতিকের পক্ষে অসম্ভব কিছু ছিল না। বরঞ্চ সামান্য একটু আশঙ্কা সর্বকনিষ্ঠ শতধন্বাকে নিয়েই ছিল, কেননা যৌবনসন্ধিতে অনুরাগ যত স্বপ্নমায়া তৈরি করে তাতে হৃদয়-ভঙ্গের বেদনা তীব্রতর হয়। এই তিনজন স্বাভিলাষ মানুষ সত্যভামা পর্যন্ত তাদের হৃদয়-শব্দ পৌঁছোতে পেরেছিলেন কিনা, আমরা তো জানি না। তবে মনে হয়, সত্রাজিতের কাছে অক্রূর বারবারই সত্যভামার বিষয়ে দরবার করেছেন এবং তাকে জানিয়েছেন তার সাভিলাষ হৃদয়ের কথাও। হয়তো সেই কারণে সত্রাজিৎও এত তড়িঘড়ি করে সত্যভামার বিবাহ সম্পন্ন করেছেন কৃষ্ণের সঙ্গে। তাতে যদু-বৃষ্ণিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নায়কের সঙ্গেও সুসম্পর্ক তৈরি হল, অন্যদিকে তিনজন পাণিপ্রার্থীর অসমান যাচনাও সকারণ ব্যাখ্যায় উপেক্ষা করা গেল।

বিবাহের ব্যাপারে অরই যে সবচেয়ে বড় দাবিদার ছিলেন, সেটা বোঝা যায়, কৃষ্ণের সঙ্গে সত্যভামার বিবাহ-ঘটনার অব্যবহিত পরেই প্রথম প্রতিক্রিয় হলেন অক্রূর। কিন্তু কৃষ্ণের মতো প্রভাবশালী পুরুষের সঙ্গে তিনি নিজে কোনও সরাসরি বিবাদে জড়াতে চাইলেন না, কিন্তু মেয়ের বাবা হিসেবে সত্রাজিৎকে কীভাবে উচিত শিক্ষা দেওয়া যয়, সেটার ব্যবস্থা করার জন্য তিনি বেছে নিলেন সেই দুই ভাইকে যারা সত্যভামার হৃদয় কামনা করেছিলেন যুগপৎ। তবে সত্যভামার সঙ্গে স্যমন্তক মণির অধিকারটাই অক্রূরের কাছে বেশি কাম্য ছিল কিনা, সেটাও এই মুহূর্ত বিচার্য হয়ে উঠবে। কেননা, স্যমন্তক মণি প্রতিদিন আট বার সুবর্ণ প্রসব করত কিনা, অথবা তা অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি রোধ করত কিনা, সে তর্কে না গিয়েও বলতে পারি, মণিটি পরম ভাস্বর ছিল এবং এটির মহার্ঘতা এবং বিক্রয়মূল্যই এটিকে চরম যাচনীয় করে তুলেছে।

কৃতবর্মা এবং শতধন্বা– এই দুই আপন ভাই অন্ধক-বৃষ্ণিদের মতোই যদুবংশের আর এক ধারা ভজমানের বংশে জন্মেছেন। অর্জুরের সঙ্গে তাদের যেমন নিকট সম্পর্ক, কৃষ্ণের সঙ্গেও ঠিক তেমনই এক জ্ঞাতিসম্পর্ক, এমনকী সুন্দরী সত্যভামার সঙ্গেও তাই। এই সম্পর্কে সমতার মধ্যে কৃষ্ণ কেন হঠাৎ অসমভাবে বেশি সুবিধা পেয়ে যাবেন, সেই বিচারের জন্য অক্রূর প্রথমেই চলে এলেন কৃতবর্মা এবং শতধন্বার কাছে। দুই ভাইয়ের কাছে এসে কথাটা উপস্থাপন করলেও অক্রূর প্রধানভাবে ব্যবহার করতে চাইলেন সর্বকনিষ্ঠ শতধন্বকে, কেননা শতধন্বা স্যমন্তক মণি নিয়ে এতটুকুও মাথা ঘামান না, তার কৈশোরগন্ধী যুবহৃদয় আজ সত্যভামার জন্য খান খান হয়ে আছে। অক্রূর কৃতবর্মার বাড়িতে এসে কৃতবর্মাকে আগে সমস্ত পরিকল্পনাটা বোঝালেন, তারপর দুজনে একযোগে শতধন্বকে বললেন, এই সত্রাজিৎ লোকটাই হল আসল বদমাশ– অয়ম্ অতিদুরাত্মা সত্ৰাজিতঃ। শতধনু! তুমি জানো যে, আমরা, আমি এবং কৃতবর্মা তো বটেই, এমনকী কতবার তুমিও আমরা তিনজনেই সত্যভামার জন্য কতবার যাচনা করেছি সত্রাজিতের কাছে। কিন্তু আমাদের দু’জনকে সত্রাজিৎ তো ধর্তব্যের মধ্যেই আনল না, এমনকী তুমি যে তুমি শতধন্ব, তুমি যুবক পুরুষ, তোমাকেও এতটুকু গণ্য করল না সে। আমাদের সবাইকে অবহেলা করে নিজের মেয়ে সত্যভামাকে দিয়ে দিল কৃষ্ণের হাতে যোহস্মাভির্ভবতা চাভ্যর্থিতোহপি আত্মজাম অস্মন্ ভবন্তং চ অবিগণয। কৃষ্ণায় দত্তবান।

সত্রাজিতের বিরুদ্ধে শতধন্বার দুর্বলতা এবং যোগ্যতাটুকু ভালভাবে উসকে দিয়ে অক্রূর বললেন, এমনভাবে যে লোকটা আমাদের অপমান করল, সে পাপিষ্ঠের বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই, ওকে মরতে হবে– তদল অনেন জীবতা। একটা মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করে অর আরও গূঢ়তর কৌশলে অন্যতর এক জাগতিক লাভের কথা শোনালেন শতধন্বকে। বললেন, দেখো, মেয়েটাকে তো তোমাকে দিলই না সত্রাজিৎ, কিন্তু স্যমন্তক মণিটা এখনও ওর কাছে আছে। আমি বলব, অন্তত একটা লাভ তো হবে, তুমি ওই সত্রাজিৎ-ব্যাটাকে মেরে মণিটা অন্তত নিজের হাতে আনো। সেটায় অসুবিধে কী– ঘাতয়িত্বেনং তন্মহারত্নং ত্বয়া কিং ন গৃহ্যতে মণিটা অন্তত তুমিই সান্ত্বনা হিসেবে পাও, সেটা আমরা চাই। আর এই কাজ করতে গেলে কোনও বাধা যদি আসে তোমার, তো আমরা তোমার পিছনে আছি– বয়মপি অভ্যুপপল্স্যামঃ।

অক্রূর বিলক্ষণ জানতেন যে বাধা আসবেই, বিশেষত সত্রাজিতের ঘরের সঙ্গে কৃষ্ণের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হবার পর সত্রাজিতের মৃত্যু এবং স্যমন্তক মণির অপহরণ দেখার পর কৃষ্ণ নিশূপে নিদ্রা যাবেন, এমনটা যে হবে না, এটা অক্রূর বিলক্ষণ জানতেন। কিন্তু অর এটাও বুঝেছিলেন যে, সদ্য-সদ্য সত্যভামাকে হারিয়ে এই বালক-কিশোর শতধন্বার হৃদয় এখন ক্ষোভে বিদীর্ণ হয়ে আছে। আর ক্ষত্রিয় বীরেরা প্রেমে ব্যর্থ হলে বেশি রোম্যান্টিক হবার চেয়ে কন্যাপিতাকে শাস্তি দেবার পথ বেছে নেবেন, এটা অক্রূর বুঝেছিলেন বলেই শতধন্বকে দিয়ে সত্রাজিৎকে খুন করার পরিকল্পনা তিনিই করলেন সুকৌশলে, কিন্তু সত্রাজিৎকে হত্যা করে শতধন্বা মণি নিয়ে আসলে তারপর কী হবে, সেখানে শুধু সাহায্য-বার্তার কথা জ্ঞাপন করেই ক্ষান্ত হলেন না অক্রূর। তিনি বললেন, যদি অচ্যুত কৃষ্ণ এ-ব্যাপারে তোমার প্রতি কোনও শত্রুতা আচরণ করে, তবে আমি এবং কৃতবর্মা তোমাকে সবরকম সাহায্য করব- যদি অচ্যুতস্তবাপি বৈরানুবন্ধং করিষ্যতি, বয়মপি অ্যুপপৎস্যামঃ। শতধন্বা যেহেতু অর এবং কৃতবর্মার চেয়েও সত্যভামার প্রতি নান্দনিকভাবে বেশি অনুরক্ত ছিলেন এবং এঁদের চাইতে তার বয়সটাও যেহেতু নান্দনিকতাতেই আক্রান্ত ছিল, অতএব তিনি সরলভাবে অরের চক্রান্ত মেনে নিলেন নিজের মতো বুদ্ধিতে। তিনি অরকে বললেন, আপনি যা বলছেন আমি তাই করব–এবমুক্তঃ তথেতি অসাবপ্যাহ।

একটা খুন করতে গেলে যেমন সুযোগের অপেক্ষা করতে হয়, তেমনই সময়েরও অপেক্ষা করতে হয়। সময় এবং সুযোগ দুটোই এসে গেল। কৃষ্ণ তখন সত্যভামার সঙ্গে কিছুকাল দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেছেন। ইতিমধ্যে বার্তাবহ দূতেরা এসে খবর দিল যে, দুর্যোধনের চক্রান্তে জতুগৃহের আগুনে পাণ্ডবরা মায়ের সঙ্গে সকলেই পুড়ে গেছেন। এই সংবাদ পেয়ে কৃষ্ণ অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে সরেজমিনে সব দেখার জন্য সাত্যকিকে নিয়ে দ্রুতগামী অশ্বে বারণাবতে রওনা দিলেন। অক্রূর যেমনটা চাইছিলেন, তার অভিমত সুযোগ এসে গেল এবং এই সুযোগে আমাদের ধারণাটা বলি। আমাদের ধারণা- শতধন্বকে দিয়ে অক্রূর যে সত্রাজিৎকে খুন করার পরিকল্পনাটুকু করলেন, সেটা কৃষ্ণ বারণাবতে প্রস্থান করার পরেই বোধহয় করেছেন। কারণ হরিবংশের বয়ানে দেখছি– সত্রাজিৎকে হত্যার পরিকল্পনা এবং তাকে হত্যা করার পরেই অক্রূর শতধন্বাকে একবার বললেন, কৃষ্ণ যদি শ্বশুরবধের জন্য ক্রুদ্ধ হয়ে তোমাকে মারার জন্য তোমার পশ্চাদ্ধাবন করেন, তবে তোমার পাশে থেকে আমরাও তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করব। কেননা, সম্পূর্ণ দ্বারকাপুরী এখন আমার বশে, আমার অধীনে আছে– মমাদ্য দ্বারকা সর্বা বশে তিস্তত্যসংশয়। আসলে কৃষ্ণের অনুপস্থিতিতে এই প্রবীণ রাজনীতিকের ক্ষমতা এবং প্রভাব অনেক বেড়েছে দ্বারকায়। অক্র এখন অনেক আত্মবিশ্বাসী এবং যে কোনও প্রতিহিংসায় তিনি সফল হবেন বলে মনে করছেন এই সময়, কেননা এই সময়ে কৃষ্ণ নেই দ্বারকায়।

কৃষ্ণের কাছে যখন খবর এল যে, পাণ্ডবরা জতুগৃহে দগ্ধ হয়েছেন, তখনই অন্য সূত্রে তিনি খবর পেয়ে গেছেন যে, তারা বেঁচেও গেছেন জতুগৃহের আগুন থেকে। তবুও পাণ্ডবরা মরেছেন ভেবেই দুর্যোধন যাতে এখন বেশ কিছুদিন পাণ্ডবদের জীবননাশের চেষ্টায় বিরত থাকেন, সেইজন্যই কতগুলো লোকদেখানো কাজ করার জন্য প্রথম খবরটায় গুরুত্ব দিয়েই বারণাবতের পথে ছুটলেন কৃষ্ণ, তার সঙ্গে অতিবিশ্বস্ত সাত্যকি। এদিকে কৃষ্ণ নেই দেখেই অক্রূর আর কালবিলম্ব না করে শতধন্বকে উত্তেজিত করলেন সত্রাজিৎকে বধ করার জন্য। রাতের অন্ধকারে সমস্ত দ্বারকা নগরী যখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে একদিন শতধন্বা সত্রাজিতের ভবনে প্রবেশ করে সুপ্ত অবস্থাতেই সত্রাজিৎকে হত্যা করলেন এবং স্যমন্তক মণিটি নিয়ে ফিরে এলেন বিনা বাধায়। হরিবংশে দেখছি– শতধন্বা সত্রাজিৎকে মেরে তখন-তখনই মণিটি এনে অক্রূরের হাতে জমা করে দিলেন সেই রাত্রেই রাত্রে তং মণিমাদায় ততোহরায় দত্তবান্। অর মণিরত্ন হাতে নিয়ে শতধন্বকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে, তার কাছে যে স্যমন্তক মণি আছে, এ-কথা তিনি কাউকে বলবেন না– সময়ং কারয়াঞ্চক্রে নাবেদ্যোহয়ং ত্বয়েZত এবং শর্তটা এইখানেই যে, কাউকে না জানালেই তবে তিনি কৃষ্ণের বিরুদ্ধে গিয়ে শতধন্বাকে সাহায্য করবেন।

এতে বোঝা যাচ্ছে– স্যমন্তক মণির ওপর অক্রূরের লোভটাই ছিল সবচেয়ে বেশি, এমনকী এটাও হতে পারে যে, ভবিষ্যতে মণিটি হস্তগত করার জন্যই তিনি সত্যভামার প্রতি মনে-মনে আসক্ত হয়েছিলেন, যাতে বিয়ের পরে উপহার হিসেবেই তিনি মণিটি লাভ করতে পারেন। বিষ্ণুপুরাণে অবশ্য ঘটনা একটু অন্যরকম। শতধন্বা সত্রাজিৎকে বধ করে স্যমন্তক মণি নিজের কাছেই রেখেছেন, কেননা অক্রূর সেই নির্দেশই দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সত্যভামাকে না হয় তুমি পেলে না, কিন্তু তার বদলে সত্রাজিৎকে মেরে মণিটি তুমি নেবে না কেন? শতধন্বা সেইমতোই সত্রাজিৎকে হত্যা করে মণি রেখেছেন নিজের কাছে, আপাতত নিজের কাছে মণি রাখার মধ্যে তিনি কোনও ভয় দেখেননি।

সত্রাজিতের আকস্মিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল। কৃষ্ণের পূর্বনিযুক্ত গুপ্তচরেরা এই খবরটুকু কৃষ্ণের অনুপস্থিতিতে সত্যভামাকেই জানিয়ে গেল যে, তার পিতা সত্রাজিৎ খুন হয়েছেন শতধন্বার হাতে এবং তার গৃহে রক্ষিত মণিরত্ন স্যমন্তকও তিনি নিয়ে গেছেন। এই খবর পাবার পর যা তৎকালীন দিনের কোনও যুবতী রমণী পারতেন না, সেই কাজটি সত্যভামা করে দেখালেন। পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে তার দুঃখ এবং ক্রোধ একসঙ্গে জাগ্রত হল। তিনি দ্রুতগামী অশ্ব যোজনা করলেন রথে এবং একা পৌঁছলেন বারণাবতে, যেখানে কৃষ্ণ আছেন– প্রযযৌ রথমারুহ্য নগরং বারণাবত। সত্রাজিতের মৃত্যুর খবর দেবার সময় সত্যভামা অবশ্য স্যমন্তক মণির চেয়েও তার নিজের ব্যাপারে শতধন্বার অভিলাষের কথা বেশি প্রকট করে বললেন– পিতা আমাকে তোমার হাতে বিয়ের জন্য তুলে দিয়েছিলেন বলেই সেটা সহ্য করতে না পেরে ক্রুদ্ধ শতধন্বা আজ আমার পিতাকে হত্যা করেছে– ভগবতেহহং প্রতিপাদিতেতি অক্ষান্তিম শতধন্বনা অস্মৃৎপিতা ব্যাপাদিতঃ– এমনকী পিতার ঘরে রক্ষিত সেই স্যমন্তক মণিরত্নও শতধন্বাই অপহরণ করেছে– তচ্চ স্যমন্তকমণিরত্নমপহৃতম।

সমস্ত ঘটনা জানানোর পর সত্যভামা নিজের সমস্ত ক্ষোভ শতধন্বার প্রতি প্রকট করে কৃষ্ণকে বললেন, এই শতধম্বা আমাকে এইভাবে অপমান করল, তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার জন্য আমার বাবাকে খুন করল এবং মহার্ঘ মণিটিও বাড়ি থেকে নিয়ে গেল, এই সমস্ত ঘটনা তুমি বিচার করো, তারপর যা উপযুক্ত মনে হয় করো– তদিয়মস্যাবহাসনা। তদালোচ্য যত্র যুক্তং তং ক্রিয়তা। কৃষ্ণ সব শুনলেন, ক্রোধস্ফুরিতাধরা সত্যভামার সামনে ক্রোধে তার চোখ কুটি কুটিল হয়ে উঠল বটে, কিন্তু কৃষ্ণ আপাদমস্তক প্রখর রাজনীতিবিদ। আপাতত সত্যভামার মতো বহুজনকাঙিক্ষতা বিদগ্ধা রমণীর সামনে তিনি যতখানিই আবেগ প্রকট করে তুলুন, দ্বারকার সঙঘ-রাজনীতির বিভিন্ন টানাপোড়েনের কথা তাকে মনে রাখতেই হয়। ফলত শ্বশুর সত্রাজিতের এই আক্রান্ত মৃত্যুতে তিনি মনে মনে একটু খুশিই হলেন, কেননা এককালে এই স্যমন্তক মণির জন্য তাকেও কম অপমান সহ্য করতে হয়নি। দেশের-দশের জন্য মণি চেয়ে তিনি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন সত্রাজিতের কাছে এবং তাকে চোর অপবাদ দিয়ে রটনা করার মূলেও এই সত্রাজিই ছিলেন। ফলে মনে মনে একটু যেন অপমান-শান্তি ঘটল কৃষ্ণের। কিন্তু বাইরে সত্যভামার সামনে তিনি ক্রোধে রক্তচক্ষু হয়ে জানালেন, তোমার এই অপমান আসলে আমারই অপমান। ওরা তোমাকে নয়, আমাকেই অপমান করতে চেয়েছে। আমি কথা দিচ্ছি, আমি সেই পাপিষ্ঠের করা এই অপমান কিছুতেই সহ্য করব না– সত্যে, মমৈষাবহাসনা। নাহমেতাং তস্য দুরাত্মনঃ সহিষ্যে– এটা মনে রেখো সত্য যে, একটা গাছে পুরোপুরি না উঠে সেই গাছের মগডালে থাকা পাখিগুলোকে মারা যায় না। ওরা গাছে না উঠেই পাখির বাসায় হাত দিল। এর ফল ওরা বুঝবে, তুমি এই ব্যাপারটা নিয়ে আর কষ্ট পেয়ো না, সত্যান হি অনুল্লঙ্ঘ্য বরপাদপং তৎকৃত-নীরাশ্রয়িণো বিহঙ্গা বধ্যন্তে। তদলম অত্যর্থমমুনা অস্মৃৎপুরতঃ শোকপ্রেরিত-বাক্য পরিকরেণ।

কৃষ্ণ আর দেরি করলেন না, বারণাবতে পাণ্ডবদের ভস্মীভূত হবার ঘটনা তিনি পূর্বেও বিশ্বাস করেননি, সব দেখে-শুনে এখন তো আরও বিশ্বাস করলেন না। কিন্তু দুর্যোধন যাতে পাণ্ডবদের ব্যাপারে এখনই আবার সক্রিয় না হন, অতএব তাকে ঠকাবার জন্যই পাণ্ডবদের একটা লোকদেখানো শ্রাদ্ধ করলেন। তারপর সাত্যকির ওপর জতুগৃহে দগ্ধ মানুষদের অস্থি সংগ্রহ করার ভার দিয়ে তিনি সত্যভামার সঙ্গে ফিরে এলেন দ্বারকায়। সত্রাজিতের খুনের ব্যাপারে শতধন্বার নামটাই সরাসরি জড়িয়ে গেল বটে, হয়তো কৃষ্ণ জানতেনও যে, তার স্ত্রী সত্যভামার জন্য এই সদ্যোযুবকের বিশেষ আপ্লতি ছিল, কিন্তু খুনের পর স্যমন্তক মণি অপহৃত হওয়ায় তিনি বুঝতে পারছিলেন, এর পিছনে আরও গভীর রহস্য আছে। কিন্তু আপাতত তাকে শতধন্বাকে ধরেই এগোতে হবে এবং সত্যভামার প্রাথমিক ক্রোধ প্রশমনের জন্য তার পিতৃহন্তাকে যে আগে শাস্তি দেওয়া দরকার সেটা তিনি বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এইরকম একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবার জন্যও পিছনে কিছু সমর্থন দরকার। সেইজন্যে প্রথমেই তিনি দাদা বলরামকে নির্জনে ডেকে বললেন, দেখুন, মৃগয়ারত প্রসেনকে মেরেছিল সিংহ, সত্রাজিৎকে খুন করেছে শতধন্বা, অতএব উপযুক্ত অধিকারী না থাকাতে এই স্যমন্তক মণি এখন আমাদের দু’জনেরই প্রাপ্য হওয়া উচিত– তদুভয় বিনাশাৎ তন্মণিরত্নমাবাভ্যাং সামান্যং ভবিষ্যতি।

এখানে মণির অধিকারী হিসেবে বলরামকেও জড়িয়ে নেওয়াটা কৃষ্ণেরই বুদ্ধি এবং সেটা প্রধানত বলরামের মতো নিরপেক্ষ জনকে পাশে রাখার জন্য। কৃষ্ণ তাকে বললেন, অতএব আর দেরি না করে রথে উঠুন, শতধন্বকে আগে ধরতে হবে। কৃষ্ণ-বলরামের এই তোড়জোড়ের খবর শতধন্বার কানে এসে পৌঁছল। তিনি প্রথমেই বড় ভাই কৃতবর্মার কাছে গেলেন সাহায্যের প্রত্যাশায়। কেননা পূর্বে অক্রূর যখন সত্রাজিৎকে খুন করার সাহস জুগিয়েছিলেন তাকে, তখন দাদা কৃতবর্মাও সাহায্যের কথা বলেছিলেন। কাজেই নিকটজনের কাছে আগে গেলেন শতধম্বা। কিন্তু এই মুহূর্তে কৃতবর্মা তাকে সাফ জানিয়ে দিলেন, কৃষ্ণ এবং বলরামের বিরুদ্ধে যাবার কোনও সামর্থ্য তার নেই। অর্থাৎ আগে যা বলেছি, বলেছি। এখন বলছি, পারব না। অগত্যা অক্রূরের কাছে গেলেন শতধন্বা। অক্রূর কৃষ্ণ-বলরামের ওপর আরও অনেক অলংকার চড়িয়ে বললেন, তিন ভুবনের সফল শক্তিমান পুরুষ যাঁদের ভয়ের চোখে দেখে, আমি তাদের সঙ্গে কী যুদ্ধ করব, তুমি অন্য কারও কাছে সাহায্য চাও– তদন্যতঃ শরণমভিলষ্যতাম।

বিপদের প্রান্তভাগে দাঁড়িয়ে শতধন্বা সব বুঝে গেলেন এবং এটাও বুঝে গেলেন যে, সত্রাজিৎকে খুন করার জন্য যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি ওই স্যমন্তক মণির কারণে তিনি আজ মরতে বসেছেন। তিনি ভাবলেন, অন্তত মণিটা যদি তাঁর সঙ্গে না থাকে, তবে হয়তো বেঁচেও যেতে পারেন তিনি। অরের ওপর তার যা রাগ হচ্ছিল, এবং যে আশা নিয়ে তিনি অর্জুরের কাছে গিয়েছিলেন, তাতে সমস্ত জগৎটাকেই শতধন্বা তখন অক্রময় দেখছিলেন– শতধন্বা ততোহরম্ অবৈক্ষং সর্বতো দিশম্। বিশেষত অক্রূর আগে যেভাবে তাকে সত্ৰাজিৎ-হত্যা এবং মণিহরণে প্ররোচিত করেছিলেন, তাতে এখন এইভাবে অক্রূর পাল্টি খেয়ে যাওয়ায় শতধন্বা পরিষ্কার বুঝলেন, তার নিজের মতো সত্যভামার জন্য নয়, মণির জন্যই আসলে ব্যগ্র ছিলেন অক্রূর। না হলে এখন কৃষ্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা তিনি নাই করুন, কিন্তু তাঁর যা রাজনৈতিক ক্ষমতা, তাতে তিনি সামনে এগিয়ে এলে কৃষ্ণকে অন্যভাবে ভাবতে হত। হরিবংশ তো তাই পরিষ্কারই জানিয়েছে যে, অরের সেই শক্তিসামর্থ্য ছিল কৃষ্ণের বিরুদ্ধাচরণ করার, কিন্তু শঠতাবশতই তিনি শতধম্বার পাশে এসে দাঁড়ালেন না– শক্তোহপি শাঠ্যাদ হার্দিক্যম অরো নাভ্যপদ্যত।

শতধন্বার হাতেও আর সময় নেই এদিকে। ভবিষ্যয়ের কারণ স্যমন্তক মণিটি তখন অক্রূরের কাছেই দিয়ে যাবার মানসে তিনি বললেন, আপনি যদি নিতান্তই আমাকে সাহায্য করতে অসমর্থ হন, তা হলে অন্তত এই মণিরত্ন স্যমন্তক রাখুন আপনার কাছে, এটা নিলে আমি বাঁচতেও বা পারি–তদয়মস্মৃন্মণিঃ সংগৃহ্য রক্ষ্যতাম। অক্রূর বললেন, মণিটি আমি রাখতে পারি। কিন্তু তোমায় কথা দিতে হবে যে, তুমি মৃত্যুর মুখে এসে পঁাড়ালেও মণিটি কার কাছে আছে তুমি বলবে না। শতধন্বা স্বীকার করে নিলেন এই শর্ত। কারণ, তার প্রধান আকর্ষণের কেন্দ্র ছিলেন সত্যভামা, স্যমন্তক মণি নয়। এই মণি তিনি অপহরণ করেছিলেন অক্রূরের কথাতেই এবং সমস্ত সহায়তার হাত তুলে নিয়ে অক্রূর কিন্তু মণিটি নিজের হেফাজতে এনে ফেললেন। শতধন্বার কাছ থেকে মণি গ্রহণ করলেন অর– অরস্তন্মণিরত্মং জগ্রাহ। পাঠকের কাছে অনুরোধ, তারা যেন বিষ্ণুপুরাণের এই ছোট্ট পঙক্তিটি– অক্রূর সেই মণি গ্রহণ করলেন– অরস্তন্মণিরত্নং জগ্রাহ– এই পঙক্তিটি যেন মনে রাখেন।

শতধন্বা অক্রূরের কাছে স্যমন্তক মণি রেখে একটি মাদী ঘোড়ায় চেপে বসলেন। এই ঘোটকীর সুনাম ছিল, এটি নাকি এক লপ্তে চারশো ক্রোশ বা একশো যোজন দৌড়তে পারে, অশ্বিনীর নাম হৃদয় বিখ্যাতা হৃদয়া নাম শতযোজন-গামিনী। শতধন্বা ঘোড়ায় চড়ে ছুটলেন, এদিকে কৃষ্ণ-বলরাম চারঘোড়ার রথে সওয়ার হয়ে ছুটলেন তার পিছনে। দুর্ভাগ্যবশতই তোক অথবা ঘোটকী বলেই হোক অনেকটা পথ অতিক্রম করে হৃদয়া নামের সেই অশ্বিনী ক্লান্ত হয়ে পড়ল এবং মিথিলার কাছাকাছি একটা জায়গায় এসে সে মারা গেল। শতধন্বা উপায়ান্তর না দেখে পায়ে হেঁটেই বনের পথ ধরে পালাতে লাগলেন শতধনুরপি তাং পরিত্যজ্য পদাতিরেবাদ্রবৎ। কৃষ্ণ-বলরাম রথে যখন এসে পৌঁছলেন, তখন দেখলেন একটি ঘোটকী মরে পড়ে আছে। অশ্বার মৃত শরীর দেখে রথের ঘোড়াগুলি কেমন যেন একটা আচরণ করতে আরম্ভ করল। কৃষ্ণ বাস্তব পরিস্থিতি বুঝে দাদা বলরামকে বললেন, এই মৃত অশ্বের শরীর অতিক্রম করে এই চার ঘোড়ার রথ চালিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা কোরো না তুমি– নৈতে অশ্ব ভবতেমং ভূমিভাগ উল্লঙ্ঘ্য নেয়াঃ। তার চেয়ে তুমি এখানে অপেক্ষা করো যতক্ষণ আমি ফিরে না আসি। আমি পায়ে হেঁটেই শতধন্বকে ধরতে পারব, কেননা সেও পায়ে হেঁটেই যাচ্ছে এবং বেশিক্ষণ সে এখান থেকে যায়নি। তুমি এখানেই থাকো আমি আসছি।

বলরাম দাঁড়িয়ে রইলেন কৃষ্ণের কথামতো। আর কৃষ্ণ খুব জোরে হেঁটে মাত্র দুই ক্রোশ পথ যেতেই দেখতে পেলেন শতধন্বকে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, স্যমন্তক শতধন্বার কাছেই রয়েছে এবং সেইজন্যই সে এত পালাচ্ছে। এই বিশ্বাসের জন্যই কৃষ্ণ কোনও ঝুঁকি নিলেন না, সম্মুখীন দ্বন্দ্বে কোনও সময় নষ্ট করলেন না, এমনকী দূর থেকে একবারও একটু সাবধানবাণীও উচ্চারণ করলেন না যে, মণিটি তুমি দিয়ে দাও, আমি এখনও বলছি, তুমি এইভাবে বাঁচতে পারবে না। কৃষ্ণ দূর থেকেই তার চিরাভ্যস্ত চক্র নিক্ষেপ করে শতধম্বার মাথা কেটে ফেললেন। সত্যভামা বলেছিলেন– পিতৃহত্যার শোধ নিতে হবে, তিনি বিনা বাক্যে শতধন্বকে মেরে সেই প্রতিশোধ নিলেন বটে, কিন্তু এবারে তার নিজের কৌতূহল এবং প্রয়োজনে কৃষ্ণ বেশ সময় নিয়েই আতিপাতি করে শতধন্বার জামাকাপড় হাটকে খুঁজলেন, এমনকী তাঁর শরীরের অন্তর্বর্তী স্থানগুলিও খুঁজে দেখলেন ভাল করে। কিন্তু স্যমন্তক মণি তিনি খুঁজে পেলেন না। কৃষ্ণ হতাশ হয়ে ফিরে এলেন বলরামের কাছে। বললেন, আমাদের ভুলই হয়ে গেল দাদা! আমরা বৃথাই শতধন্বকে মেরে বসলাম। কিন্তু যেটার জন্য চেষ্টা, সেই স্যমন্তক মণি কিন্তু আমি শতধন্বার কাছে খুঁজে পেলাম না– বৃথৈবাশ্মভির্ঘাতিতঃ শতধনুঃ, ন প্রাপ্ত অখিলজগৎসারভূতং তন্মণিরত্নম।

কৃষ্ণের কথায় এবং ঘটনার আকস্মিকতায় বলরাম যতখানি বিস্মিত হলেন, তার চেয়েও বেশি রেগে গেলেন। কৃষ্ণ যেভাবে তাকে বুঝিয়েছিলেন তাতে বলরাম সরলভাবেই বুঝেছিলেন যে, মণিটি শতধম্বার কাছেই আছে। কিন্তু সেই অনুমান যখন মিলল না, তখন বলরাম আর অন্য নতুন কোনওভাবে ভাবতে পারলেন না। বরঞ্চ কৃষ্ণকেই তিনি আর যেন বিশ্বাস করছিলেন না একেবারে। এতটাই অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন বলরাম যে, সেই মুহূর্তেই যেন কৃষ্ণের জামাকাপড় খুঁজে দেখার মতো মানসিকতা হচ্ছিল তার। নেহাৎ সেটা পারছেন না বলেই বলরাম বললেন- ধিক্ তোমাকে কৃষ্ণ! শত ধিক্ তোমাকে। তুমি যে এইরকম অর্থলিষ্ণু তা আমি জীবনেও ভাবিনি। আজকে শুধু ভাই বলে তোমাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম– ধিক্ ত্বাং যম্ অর্থলিম্পূঃ। এতচ্চ তে ভ্রাতৃত্বান্মর্ষয়ে। আমাদের ধারণা, সেই যে কৃষ্ণ এসে দাদা বলরামকে বলেছিলেন, সত্রাজিতের মৃত্যুর পর স্যমন্তক মণি এখন আমাদের দু’জনের হবে, সেই তখন থেকে বুঝি এই মণিরত্নের ওপর দাদা বলরামেরও একটা লালসা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তা নইলে মণি শতধন্বার কাছ থেকে না পেলেও এতটা তো তার রেগে ওঠার কথা নয়। ভাবা যায় কী, কৃষ্ণকে তিনি বলছেন- তোমার সামনে এই খোলা রাস্তা রয়েছে, কৃষ্ণ! তুমি এবার যেখানে ইচ্ছে যেতে পারো তদয়ং পন্থাঃ, স্বেচ্ছয়া গম্যতা– আমার দ্বারকাতেও প্রয়োজন নেই, তোমাকেও প্রয়োজন নেই, কোনও আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকেও দরকার নেই আমার–ন মে দ্বারকয়া, ন ত্বয়া, ন বন্ধুভিঃ কার্য– তুমি চলে যাও যেখানে ইচ্ছে।

প্রত্যাশিতভাবেই কৃষ্ণ অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন দাদা বলরামকে। অনেক শপথ করে বললেন, আমি কি এমন কাজ করতে পারি কখনও যে, মণিটি নিজের কাছে রেখে তোমাকে বলব আমার কাছে নেই। আমি সত্যি বলছি দাদা, শতধন্বাকে বৃথাই মারলাম, শতধন্বার কাছে মণি ছিল না, আমার কাছেও নেই। বলরাম এবার যেন আরও ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, কেন তুমি বারবার আমার কাছে এমন উলটো-পালটা শপথ করছ বলল তো–অলম এভির্মমাগ্রতোহলীক শপথৈঃ। কৃষ্ণ শুধু বোঝানোরই চেষ্টা করছেন এবং সে আগ্রহে কমতি হচ্ছে না দেখে বলরাম নিজেই এবার সেই জায়গা থেকে হাঁটা দিলেন মিথিলাপুরীর দিকে। উপায়ান্তর না দেখে কৃষ্ণ একাই ফিরে গেলেন দ্বারকায়। সত্যভামাকে হয়তো বা তিনি বোঝাতে পেরেছিলেন সবকিছু, হয়তো বা পিতৃহন্তা শতধন্বকে বধ করে আসায় সত্যভামার প্রাথমিক ক্ষোভটুকু শান্ত হয়েছিল, কিন্তু স্যমন্তক মণিরত্ন কোথায় গেল, সেটা নিয়ে যথেষ্ট ধন্দে ছিলেন কৃষ্ণের মতো মানুষও। সত্যভামা অবশ্য এ-ব্যাপারে কৃষ্ণকে কোনও প্রশ্ন করেননি কোনওদিন। অথচ পিতা সত্রাজিতের মৃত্যুর পর নীতিগতভাবে মণিটি তার কাছেই আসার কথা উত্তরাধিকারের নিয়মে। কিন্তু স্যমন্তক মণির অধিকার নিয়ে সত্যভামাকে আমরা কোনওদিন একটি কথাও বলতে শুনিনি এবং এইখানেই তার বিদগ্ধতা।

দ্বারকায় স্যমন্তক মণির কথা আস্তে আস্তে চাপা পড়ে গেল, কৃষ্ণও তাঁর মহিষীদের নিয়ে সুখে কাল কাটাচ্ছেন। কিন্তু দুশ্চিন্তা রয়েই গেল। দাদা বলরাম সেই যে রেগে মিথিলাপুরীতে গিয়ে বসে রইলেন, তিন বছর হয়ে গেল, এখনও তিনি ফিরছেন না। ওদিকে কৃষ্ণ দেখতে পাচ্ছেন অক্রূরের বড় বাড়-বাড়ন্ত হয়েছে, কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণাভাবে তাকে সোজাসুজি কিছু বলাও যাচ্ছে না। তা ছাড়া বাড়বাড়ন্ত অনেক হলেও স্যমন্তক-প্রসূত সোনা-দানা-অর্থ দিয়ে অক্রূর কিন্তু বাইরে খুব একটা খরচাপাতি করতে পারছেন না। কিন্তু তবুও স্যমন্তক মণি যে তার কাছেই আছে সে-কথা বুঝতে পারছেন না কৃষ্ণ এবং অক্রূরও খুব একটা মেলামেশা করছেন না কারও সঙ্গে। তিনি বুঝতে দিচ্ছেন না কিছু। শতধন্বার জন্যও কৃষ্ণের চিন্তা হয়, এতই আকস্মিকভাবে, কোনও বাক্যালাপ না করেই তাকে মেরেছেন যে, এখন সন্দেহ করতে ভয় হয়, যদিও কৃষ্ণ এটা বুঝে গেছেন যাঁরাই এককালে তার স্ত্রী সত্যভামার প্রণয়-অনুগ্রহ চেয়েছিলেন, তারাই আসলে স্যমন্তক মণির ব্যাপারে সন্দেহভাজন। তাঁদের মধ্যে একজন মারা গেছেন। শতধন্বার দাদা কৃতবর্মার নামও সত্যভামার প্রণয়ীগোষ্ঠীতে জড়িয়ে গেলেও সত্যভামার প্রণয় এবং স্যমন্তক মণি দুই ব্যাপারেই তেমন কোনও তীব্রতা ছিল না তার। তবে দ্বারকার সঙ্ঘ-রাজনীতিতে কৃষ্ণের প্রভাব প্রতিপত্তি তাঁকে অক্ষমের ঈর্ষায় ভোগাত মাঝে মাঝে।

আর অক্রূর এখন যেন হঠাৎ সাধু হয়েছেন। তিনি একটার পর একটা যজ্ঞ করে যাচ্ছেন। ব্রাহ্মণ-সন্তানদের দান করছেন এবং বাহ্য ভোগবিলাসে বিরত থাকছেন। আসলে তাঁর বুদ্ধিটা কেউ ধরতেই পারছেন না। তিনি যে সত্যভামাকে বিবাহ করতে না পেরে হঠাৎ সাধু হয়েছেন– একথা অন্য কেউ বিশ্বাস করলেও কৃষ্ণ তা করছেন না। কেননা কৃষ্ণ তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা জানেন। কিন্তু যজ্ঞকর্মে রত ব্যক্তিকে ধরা খুব কঠিন। আসলে যা হয়, সরকারি বেসরকারি যে কোনও জায়গায় যাঁরা ঘুষ খেয়ে উপরিজীবিকা নির্বাহ করেন, তারা কেউই প্রায় বাইরের ভোগ-বিলাসটুকু তেমন করে দেখাতে পারেন না। তারা সাধু সেজে থাকেন না ঠিকই, কিন্তু মাইনেকড়ি দিয়ে যতটুকু হয়, তার চেয়ে সামান্য একটু ওপরে নিজেদের ভোগ-বিলাসসামগ্রীর মান বেঁধে রাখেন, যাতে খুব একটা সন্দেহ তৈরি না হয়। অরও সেটা পারছেন না, স্যমন্তক মণির অলৌকিক প্রভাব-জাত অষ্টবার সুবর্ণ দৈনিক লাভ করেও বাইরে তিনি তার ভোগবিলাসের মাত্রা প্রকট করে তুলতে পারছেন না। তিনি যজ্ঞ করছেন, একটার পর একটা যজ্ঞ করছেন। যজ্ঞ করতে গেলেও বিস্তর অর্থের প্রয়োজন হত সেকালের দিনে, কিন্তু সেই অর্থ অন্তত অর জোগাতে পারেন, এটা ভাবা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু অক্রূর যজ্ঞ করে যাচ্ছেন সম্পূর্ণ অন্য কারণে এবং সেটা করছেন আপন দোষমনস্কতায়।

স্যমন্তক মণি ঘরে থাকায় সদাসর্বদা তার মনে হয় যে, কৃষ্ণের চোখে ঠিক তিনি ধরা পড়তে পারেন এবং এই ভয়ও তার আছে যে, ধরা যদি পড়েন তবে কৃষ্ণ যদি শতধন্বার মতোই আকস্মিকভাবে তাকে হত্যা করেন। বিষ্ণুপুরাণ জানিয়েছে, এই ভয়েই অক্রূর একটার পর একটা যজ্ঞ করছিলেন, কেননা তখনকার কালে এটা বিধিবদ্ধ মান্য নিয়ম ছিল। যে, যজ্ঞে দীক্ষিত ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্য পুরুষকে কেউ হত্যা করত না। করলে ব্রহ্মহত্যার মহাপাতক হত বলে সকলেই মনে করতেন। সেই কারণে একটার পর একটা যজ্ঞদীক্ষা নিয়ে অক্রূর প্রায় ষাট বাষট্টি বছর কাটিয়ে দিলেন– দীক্ষাকবচং প্রবিষ্ট এব দ্বিষষ্টিবর্ষাণি– অর্থাৎ নিরন্তর এই যজ্ঞদীক্ষা অরের ক্ষেত্রে একটা ‘শিড়’ হিসেবে কাজ করছিল।

এতক্ষণ ধরে সত্যভামা এবং স্যমন্তক মণি নিয়ে যত কথা বলছিলাম, তা প্রাচীন কালের এক অপরিশীলিত গোয়েন্দা কাহিনির মতো শোনালেও আসল আসামী এখনও ধরা পড়েনি। তবু আমরা এত বড় কাহিনিটা আপনাদের শোনালাম এইজন্য যে, এই কাহিনির মধ্যে সত্যতা আছে। সত্যভামার সঙ্গে স্যমন্তককে জড়িয়ে এই ঘটনা যে ঘটেছিল তার একটা বড় প্রমাণ আগেই দিয়েছি এবং তা হল– সত্যভামা এবং স্যমন্তকের কথা বেশিরভাগ পুরাণ এবং হরিবংশে মূল কৃষ্ণজীবনের অন্যান্য কাহিনির সঙ্গে অসংপৃক্ত লেখা হয়েছে এবং কখনও তা গদ্যে– যেটা প্রাচীনতার প্রমাণ। দ্বিতীয় প্রমাণটা আরও বড় এবং মহামতি বঙ্কিমচন্দ্র এবং তদনুসারী যুক্তিবাদীদের চোখে গবেষকজনের পরিশ্রম-প্রসূত এসব তথ্য ধরা পড়েনি বলেই কৃষ্ণ-জীবনের চরম-সংবেদনশীল সত্যভামা-স্যমন্তকের কাহিনিটি তাদের কাছে উপন্যাস হয়ে গেছে। অবশ্য জীবনের সত্য অনেক সময়েই গল্প-উপন্যাসের চেয়েও বেশি রোমাঞ্চকর হয়। সেই কারণেই সত্যভামার সঙ্গে কৃষ্ণের বিবাহ-ঘটনাকে বঙ্কিমের মতো যুক্তিবাদী ঔপন্যাসিকও স্বভাব-ভাবনায় উপন্যাস না বলে পারেন না। যা হোক দ্বিতীয় প্রমাণটা দিই।

গবেষণার এই সূত্রটি যিনি এখানে দিয়েছেন তার নাম না করলে অন্যায় হবে। সেকালের দিনের বিখ্যাত গবেষণা-পত্রিকা Indian Culture-এ ১৯৩৯ সালের এপ্রিল সংখ্যায় শ্রীযোগেন্দ্রনাথ বসু একটি অমূল্য গবেষণা-প্রবন্ধ লেখেন। তার লেখাটির নাম Sources of the two Krisনা Legends.’ এই নিবন্ধে পূর্বোক্ত গবেষক দেখিয়েছেন যে, পুরাণগুলি লেখা হবার বহু আগে থেকেই স্যমন্তক-সত্যভামা অথবা স্যমন্তক-অক্রূরের কাহিনি ঐতিহাসিকতার কারণেই লোকমুখে প্রচলিত ছিল। তার প্রমাণ আছে খ্রিস্টপূর্বকালে যাস্কের লেখায়। যাস্ক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর বিখ্যাত বৈয়াকরণ পাণিনির চেয়েও অনেক আগের মানুষ। তিনি একাধারে কোষকার এবং বৈয়াকরণ দুইই বটে। প্রধানত বৈদিক শব্দগুলির অর্থ এবং ধাতুপ্রকৃতি নিয়েই তার গ্রন্থ নিরুক্ত রচিত হয়েছে এবং বেদ পড়তে হলে শিক্ষা-কল্প ইত্যাদি যে ছয়টি বেদাঙ্গ জানতে হয়, তার সবশেষ হল ধাতু-প্রত্যয় জাত শব্দের বুৎপত্তি জানা। এই ব্যাপারটাকে সেকালের ভাষায় নিরুক্ত বলে। কিন্তু যাস্কের লেখা আস্ত গ্রন্থ-নামটাই এখানে বেদাঙ্গের মধ্যে ঢুকে গেছে। তাতে বোঝা যায় যাস্কের মান্যতা কতটা।

যাই হোক, সেই যাস্ক যিনি পুরাণ এবং পাণিনিরও বহু পূর্বকালের মানুষ, তিনি ‘দণ্ড শব্দটির অর্থ বোঝানোর জন্য প্রথমে একটি বাক্য গঠন করে উদাহরণ দিলেন ‘দণ্ড্যঃ পুরুষঃ’। আমাদের ব্যাকরণের বুদ্ধিতে এই বাক্যের মানে হওয়া উচিত–দণ্ডযোগ্য কোনও মানুষ যাকে অপরাধের জন্য দণ্ড দিতে হবে। যাস্ক মানেন যে, দণ্ড দেওয়া বা শাস্তি দেওয়া অর্থে ‘দণ্ড’ ধাতুর প্রয়োগ তার আমলে চালু হলেও তার নিজের কালের আগের কোষকার উপমন্যু এবং তার সম্প্রদায়ের গুরুরা দণ্ড ধাতুর অর্থ করেছেন দমন করা। এবং হয়তো বা উপমন্যুদের মতো কোষকার-বৈয়াকরণদেরও আগে আরও একটা অর্থ ছিল এই দণ্ড ধাতুর। যাস্ক লিখেছেন- দণ্ড শব্দটা দ ধাতু থেকে আসার একটা ইতিহাস আছে, অর্থাৎ দণ্ড ধাতুটাই অন্য ধাতু থেকে নিষ্পন্ন একটা ধাতু। নিরুক্তের মধ্যে যাস্ক দণ্ড শব্দ নিষ্পন্ন করার সময় পূর্বের ধাতুরূপটুকু বলেছেন বটে কিন্তু সেই ধাতুর সঙ্গে কোন প্রত্যয় যুক্ত করে দণ্ড শব্দ বা ধাতু নিষ্পন্ন হল সেটা লেখেননি। যাস্ক বলেছেন, দণ্ড শব্দ ধারণাৰ্থক দ ধাতু থেকে এসেছে দণ্ডো দদতে ধারয়তিকর্মণঃ। অর্থাৎ ধারণ করা অর্থে দ ধাতুর ব্যবহার আগে প্রচলিত ছিল এবং সেই দ-এর শেষে ‘অনি’ প্রত্যয় করে দণ্ড নামে একটা শব্দ তৈরি হল এবং সেটা ক্রিয়াপদ হিসেবেও সেটা ব্যবহৃতও হতে থাকল।

স্পষ্টতই বোঝা উচিত, দণ্ড শব্দ বা দণ্ড ধাতু নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আমাদের প্রমাণের জায়গাটা হল দ ধাতুর ব্যবহার ‘দদতে’ মানে ধারণ করছে ধারয়তি। যাস্ক এখানে বেদ থেকে উদাহরণ দিতে পারতেন, কেননা বেদে ধারণ করা অর্থে দুদতে ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু তাতে আমরা ভাবতাম, এটা বিশেষভাবে বেদের মন্ত্রেই ব্যবহার করা হয়, সংস্কৃতের কথ্য বা লেখ্য ভাষায় এটা চলে না। ঠিক সেইজন্যই যাস্ক এমন একটা ঘটনার উদাহরণ দিলেন যা মৌখিক পরম্পরায় লোকে তখনও বলছে। বলছে। যে এই রকমটা ঘটেছিল। যাস্ক লিখলেন অক্রূর নামে একজন মণি ধারণ করেছেন– এইরকমটা লোকে এখনও বলে– অঙ্কুরো দদতে মণিম্ ইতি অভিভাষন্তে।

যাস্কের সময় নির্ধারিতভাবে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম অথবা ষষ্ঠ শতাব্দ। সেই সময়ে জনসাধারণের মুখে এই কথা চলছে যে, অক্রূর মণিটা ধারণ করেছেন অর্থাৎ অরই মণিটা নিয়েছেন এবং ধারণ করেছেন। যাস্ক লিখিত নিরুক্তের প্রাচীন টীকাকার দুর্গসিংহ মণি বলতে অবশ্যই স্যমন্তক মণির কথা লিখেছেন এবং অক্রূর যে সেই স্যমন্তক মণিই ধারণ করেছিলেন সেটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন। কিন্তু সে-কথা পরে। আমরা শুধু বলব, যাস্ক লিখিত ‘দদতে’ ক্রিয়াপদটি যে ধারণ করা অর্থে ব্যবহার হত ‘লৌকিক ভাষায় সেটা পুরাণকারদের সময়ে উঠে গেছে এবং তারা ‘দদতে’ পদটাকে ‘আদান’ বা গ্রহণ করা অর্থে ব্যবহার করে লিখেছেন ‘জগ্রাহ’–অর্থাৎ গ্রহণ করলেন, ঠিক যেমনটি বিষ্ণুপুরাণে অক্রূরের সম্বন্ধে বলা হয়েছে- অক্রূর স্তন্মণিরত্নং জগ্রাহ– অক্রূর সেই মণিরত্ন গ্রহণ করলেন। এখানে ধারণের জায়গায় গ্রহণ করা ছাড়া অর্থের আর কোনও পার্থক্য নেই। ওদিকে হরিবংশ যখন এই একই প্রসঙ্গের বর্ণনা দিয়েছে, তখনও কিন্তু একবার লিখেছে ‘আদায়’। মানে, গ্রহণ করে (করিয়া), যা কিনা দ ধাতুর শব্দস্মৃতিই শুধু বহন করে। তা ছাড়া হরিবংশ সোজাসুজি ধারণ অর্থে ‘ধারয়ামাস’ শব্দটাও প্রয়োগ করেছে, অর্থাৎ হরিবংশ ‘দদতে’ ক্রিয়াটির ধারণার্থক ভাবনাটা মাথায় রেখেছে।

যাস্ক লিখেছেন, ধারণ করা অর্থে দ ধাতুর উদাহরণ হিসেবে লোকে যে বাক্যটা উচ্চারণ করে, তা হল, অক্রূর মণি ধারণ করেছেন– অরো দদতে মণিম্ ইতি অভিভাষন্তে। ‘অভিভাষন্তে’ মানে লোকে বলে। আমাদের বক্তব্য এতেই বোঝা যায়। স্যমন্তক মণির সম্পূর্ণ কাহিনিটাই কৃষ্ণের জীবনে এতটাই এক ঐতিহাসিক সত্য ছিল যে, সেটা আমাদের প্রাচীন মৌখিক পরম্পরা বা oral tradition-এর মধ্যে এসে গেছে এবং আমরা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি পৌরাণিক কণ্বক ঠাকুরেরা সেই লোক-পরম্পরার মৌখিকতা থেকে মণি কাহিনির উপাদান সংগ্রহ করেছেন।

গবেষক যোগেন্দ্রনাথ বসু সিদ্ধান্তে এসে বলেছেন যে, যাঙ্কের উদ্ধৃত পর্ভূক্তিটি– অঙ্কুরো দদতে মণিম, এটি কোনও বহু পুরাতন কোনও প্রচলিত শ্লোকের একাংশ। এই পুরাতন শ্লোকগুলিকে বলা হয় গাথা। বস্তুত পুরাণগুলি তো বটেই এমনকী মহাভারতও এই ধরনের অতি পুরাতন গাথাগুলি নিজেদের লেখ্য অংশের মধ্যে প্রায় অবিকৃতভাবে ব্যবহার করে থাকে। যাস্ক ব্যবহৃত পর্ভূক্তিটি শুনলেও মনে হয় যে এটি ছন্দোবদ্ধ কোনও প্রাচীন গাথার একাংশ। গবেষক যোগেন্দ্রনাথ মনে করেন স্যমন্তক মণির কাহিনি যেহেতু বৃষ্ণিবংশীয় সত্রাজিতের প্রসঙ্গেই সর্বদা উচ্চারিত, তাই এই গাথাংশটি might have formed a part of family ballad or the gatha of the Vrisnis which used to be sang on cer emonial occasions. গবেষকের এই প্রমাণে আমরাও বোঝাতে চাইছি, স্যমন্তক মণি নিয়ে অন্ধক-বৃষ্ণি-ভজমান ইত্যাদি গোষ্ঠীর যে গণ্ডগোল তৈরি হয়েছিল এবং তাতে শেষ পর্যন্ত সত্রাজিতের মণি কীভাবে শেষ পর্যন্ত অক্রূর ধারণ করলেন, সেই কাহিনিটাই একেবারে সংক্ষিপ্তসার হিসেবে যাস্কের কালেও পূর্বপ্রচলিত ওই গাথার মধ্যে ধরা পড়েছে। আর যাস্ক এখানে ভীষণই বিশ্বাসযোগ্য, কেননা তিনি পৌরাণিক নন, তিনি স্যমন্তক মণির কাহিনি বা সত্যভামার বিবাহ-সংবাদও লিখতে বসেননি। নিতান্ত অপ্রসঙ্গে, দণ্ড শব্দের নিরুক্তি বিচার করার সময় অন্য এক ক্রিয়াপদের উদাহরণ দিতে গিয়ে এক ঐতিহাসিক সত্য তিনি উদঘাটন করে ফেলেছেন।

কাহিনির প্রস্তাবে আমরা পূর্বে যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম– অর্থাৎ শতধন্বকে মেরে কৃষ্ণ মণি পেলেন না, অথচ মণি স্বচক্ষে না দেখে নিজের দাদা বলরাম কৃষ্ণকেই সন্দেহ করতে আরম্ভ করলেন, এমনকী তিনি রাগ করে চলেও গেলেন মিথিলায়– এই অবস্থায় কৃষ্ণ ম্লান মুখে ফিরলেন দ্বারকায়, আর অক্রূর একটার পর একটা যজ্ঞ করে যেতে লাগলেন ষাট বাষট্টি বছর ধরে। এই ঘটনাগুলি কৃষ্ণের জীবনে একটা বিরাট অশান্তি তৈরি করেছিল। ঘরে সত্যভামার কাছে তিনি নিশ্চয়ই অস্বস্তিতে ছিলেন, সত্রাজিতের মৃত্যুর পর সেই মণি উত্তরাধিকার সূত্রে সত্যভামারই পাবার কথা। অথচ ঢাকঢোল পিটিয়ে শতধন্বাকে বধ করেও কৃষ্ণ মণি এনে দিতে পারলেন না সত্যভামার কাছে। ওদিকে দাদা বলরাম, যিনি কোনও দাবিদারই ছিলেন না মণির, তিনিও কৃষ্ণের কথায় প্রভাবিত হয়ে শতধম্বার হত্যার সহায় হলেন অথচ মণিটি চোখে দেখলেন না। আর ওদিকে যিনি মণি নিয়ে বসে রইলেন, তিনিও মণির বৈভব প্রকট করতে না পেরে মৃত্যুভয়ে যজ্ঞ করতে লেগেছেন। কৃষ্ণের মতো ধুরন্ধর মানুষও মাথা খাঁটিয়ে বুঝতে পারছেন না যে, মণি কোথায় গেল?

এত অশান্তির মধ্যে বছর তিনেক পরে একটু সুবিধে হল কৃষ্ণের। সমগ্র যাদবকুল একসময় বুঝল যে, মণিহরণের সঙ্গে অন্তত কৃষ্ণের কোনও যোগ নেই আর তাতেই বৃষ্ণিদের প্রবর মন্ত্রী উদ্ধব, দ্বারকা-মথুরার রাজোপাধিধারী উগ্রসেন, এঁরা সবাই বিদেহ মিথিলায় গিয়ে বলরামকে অনেক বোঝালেন, অনেক যুক্তি দিয়ে তার বিশ্বাস উৎপাদন করলেন এবং অনেক শপথ করে তাকে ফিরিয়ে আনলেন দ্বারকায়। এদিকে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। দ্বারকায় ভোজবংশীয় প্রধানেরা অক্রূরের সমর্থক ছিলেন। তারা করলেন কী, কৃষ্ণের সমর্থক সাতবংশীয়দের জ্ঞাতিগুষ্টির এক প্রধান এবং তিনি মহারাজ সাত্ত্বতের প্রপৌত্র, তার নাম শত্রুঘ্ন– এই শত্রুঘ্নকে মেরে ফেললেন অর-পক্ষের ভোজেরা। আগেই বলেছি, দ্বারকায় চলত সঙ্ঘপ্রধানদের শাসন, এখানে লতায়-পাতায় অনেক জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যেই চোরাগোপ্তা বিবাদ চলত। আর সাত্ত্বতবংশীয়দের ওপর কৃষ্ণের প্রীতি একটু বেশিই ছিল– ভাগবতে তাকে বলা হয়েছে- সাত্ত্বতকুলের প্রধান ভগবান সাত্ত্বতাং পতিঃ। সেই সাত্ত্বতকুলের একজন যখন অর-পক্ষের ভোজদের হাতে খুন হলেন, তখন অক্রূর একটু ভয় পেলেন– চোরের মন বলে কথা। তিনি ভোজকুলের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে পালিয়ে গেলেন অন্যত্র– দ্বারকামপহায় অপক্ৰান্তঃ।

এর আগে আমরা স্যমন্তক মণির প্রসঙ্গে জানিয়েছিলাম যে, এই মণি যেখানে থাকত, সেই রাজ্যে অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি-দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ হত না। কিন্তু অক্রূর যেই পালিয়ে চলে গেলেন, তার পরদিন থেকেই দ্বারকায় অনাবৃষ্টি, মড়ক, পশুভয়– এইসব নানান ঝামেলা আরম্ভ হয়ে গেল। দ্বারকায় কৃষ্ণ-বলরাম-উগ্রসেন এবং অন্যান্য কুল সঙেঘর প্রধানদের নিয়ে মিটিং আরম্ভ হল। সঙঘরাষ্ট্রে এমনটাই হয়। সেখানে অন্ধক বংশের এক বৃদ্ধ অক্রূরের পিতার অনেক সুখ্যাতি করে বললেন, অর্জুরের পিতা যেখানে থাকতেন, সেরাজ্যে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ হত না। অক্রূর যেখানে থাকবেন সেখানেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় না। অতএব অরকে রাজ্যে ডেকে আনা হোক, তার কোনও অন্যায় এবং অপরাধ উচ্চারণ করবার প্রয়োজন নেই। তিনি আসলে যদি দেশের এতটা উপকার হয়, তবে তাকে নিয়ে আসাটাই বেশি প্রয়োজন অলমত্রাতিগুণবতি অপরাধান্বেষণেন

এই কথোপকথন থেকেই স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, এই অন্ধক বৃদ্ধ অক্রূরের হয়ে কথা বলছেন, কিন্তু তার কথায় হঠাৎই অক্রূরের পিতার মধ্যে স্যমন্তক মণির গুণগুলি আরোপিত হওয়ায় একদিকে যেমন সভায় অনুচ্চারিত অক্রূরের ঘরে-থাকা স্যমন্তক মণির ইঙ্গিতই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তেমনই অজুরের কোনও দোষ না দেখে তাকে রাজ্যে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবে অর্জুরের কাছে স্যমন্তক মণি থেকে যাওয়ার ইঙ্গিতটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যাই হোক, দেশের এবং দশের প্রয়োজনে উগ্রসেন, বলরাম, কৃষ্ণ এবং অন্যান্য যাদবরা অক্রূরের সমস্ত অন্যায়-অপরাধ সহ্য করে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিলেন এবং অক্রূর ফিরেও আসলেন দ্বারকায়। তিনি ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে দ্বারকায় সবরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনাবৃষ্টি, মড়ক, দুর্ভিক্ষ সব বন্ধ হয়ে গেল। কৃষ্ণ বুঝে গেলেন, যদু-সভায় ‘মিটিং-এ অক্রূরের পিতার যে গুণগান করা হয়েছিল, সেটা একেবারেই হেঁদো কথা– স্বল্পম এত কারণং যদয়ং গান্দিন্যাং শফল্কেন অঙ্কুরো জনিতঃ– আসল কথা, এটা স্যমন্তক মণির প্রভাব। কারণ সকলেই জানে যে, স্যমন্তক মণি যে রাজ্যে থাকে সেখানে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় না। এসব যখন হঠাৎই অক্রূর ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে গেল, তা হলে এটা নিশ্চিত যে, সেই মহার্ঘ মণি অক্রূরের কাছেই আছে– তন্মুনম অস্য সকাশে স মহামণিঃ স্যমন্তকাখ্যস্তিষ্ঠতি।

কৃষ্ণ একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেলেন। বস্তুত মণির সঙ্গে জড়িত অনাবৃষ্টি-দুর্ভিক্ষ-মড়কের কাহিনি যদি বিশ্বাস নাও করি এবং এগুলিকে যদি লৌকিক পরিশীলনে তেমন গুরুত্ব নাও দিই, তবুও যদুসভায় অন্ধক-বৃদ্ধের যে প্রস্তাব ছিল– অক্রূরের কোনও দোষ দেখার প্রয়োজন নেই, তাকে রাজ্যে ফিরিয়ে আনা হোক– এই প্রস্তাবেই কৃষ্ণের কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। তিনি সুচতুর বুদ্ধিমান লোক, লোকোত্তর চতুরতা থাকার ফলেই অন্যের চতুরতা ধরে ফেলতে তার সময় লাগে না। তবুও যে এতদিন সময় লেগে গেল, তার কারণ সঙ্ঘ শাসনের রাজনৈতিক তাৎপর্য। অক্রূর অন্ধক-বৃষ্ণিদের সঙঘশাসনে অন্যতম প্রভাবশালী প্রবীণ নেতা। তাকে যখন-তখন চোরের অপবাদ দিয়ে রাজ্যের মধ্যে রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি করা যায় না। বিশেষত শতধম্বার মতো নগণ্য জনের সঙ্গেও যে অন্যায় হয়ে গেছে, তার জন্য অনুতপ্ত ছিলেন কৃষ্ণ। তিনি আর একটা হত্যা করে রাজনৈতিক সমস্যা বাড়াতে চাননি। কিন্তু এখন তিনি বুঝে গেছেন তার নিজের স্ত্রী সত্যভামার প্রতি অর্জুরের যে এত আকর্ষণের কথা তিনি শুনেছেন, তা সত্যভামার জন্য মোটেই নয়, তা প্রধানত স্যমন্তক মণির জন্য। বরঞ্চ সত্যভামার প্রতি প্রেমে যে সত্যিই কাতর ছিল, সে বেচারা শতধন্বা তাঁর হাতে অহেতুক মারা পড়েছে। কৃষ্ণ এখন বুঝে গেছেন যে, অক্রূর কেন একটার পর একটা যজ্ঞ করছিলেন নিজের প্রতি আক্রমণ রোধ করার জন্য, কেন তার পক্ষের একটি মানুষ অক্রূরের দলের হাতে মারা পড়তেই অক্রূর অন্য রাজ্যে পালিয়ে যান। কই তিনি তো শতধন্বাকে মারার পরেও পালাননি। কৃষ্ণ বুঝেছেন, সবকিছু অক্রূর করেছেন ওই স্যমন্তক মণি নিজের অধিকারে রাখার জন্য। নইলে তিনি বাইরে নিজের বৈভব-ঐশ্বর্য প্রকট করতে পারছেন না, অথচ যজ্ঞের পর যজ্ঞ করে সাধু সেজে বসেছিলেন সকলের চোখে, সব ওই স্যমন্তক মণির জন্য অয়মপি যজ্ঞদনন্তর অন্যৎ ক্ৰত্বন্তরং, তস্মাদ যজ্ঞান্তরং যজতীতি। অল্পোপাদাঞ্চাস্য। অসংশয়ম্ অত্রাসৌ বরমণিস্তিষ্ঠতীতি।

অক্রূর ফিরে এলেন দ্বারকায়। এবার কৃষ্ণ ভাবলেন কীভাবে তার নিজের অপবাদটুকু দূর করা যায়। শ্বশুরহন্তা শতধন্বাকে মেরে তিনি সত্যভামার উদ্যত ক্রোধ কিছু শান্ত করতে পেরেছেন বটে, কিন্তু পিতা সত্রাজিতের স্যমন্তক মণির উত্তরাধিকার তিনি সত্যভামাকে ফিরিয়ে দিতে পারেননি। অন্যদিকে দাদা বলরাম চোখের সামনে দেখলেন– শতধন্ব মরল কৃষ্ণের হাতে অথচ তার কাছ থেকে মণি ফিরে পেলেন না কৃষ্ণ। তিনি কৃষ্ণকে অবিশ্বাস করেছেন। কৃষ্ণ তাই ঠিক করলেন অক্রূর লোকটাকে সবার সামনে ‘এক্সপোজ’ করতে হবে– মণি ফিরে পান আর না পান। এতসব ভেবেই একদিন তিনি দ্বারকার সমস্ত কুলপ্রধান যাদব-বৃষ্ণি-অন্ধকদের আমন্ত্রণ জানালেন নিজের বাড়িতে সকল যাদব-সমাজম আত্মগেহে এবাচীকরৎ। সভায় উপস্থিত সকলের সঙ্গে নানা কথা বলে কৃষ্ণ অরের সঙ্গে খানিক হাস্য-পরিহাস করে পরিবেশটাকে প্রথমে লঘু করে দিলেন। তারপর সময় বুঝে হঠাৎই কৃষ্ণ অরকে বললেন, দেখুন আমরা সকলেই জানি যে, ত্রিজগতের সার সেই স্যমন্তক মণিটি শতধন্বা আপনার কাছেই রেখে গেছে– শতধন্বনা অখিল-জগৎ সারভূতং স্যমন্তকরত্নং ভবতঃ সকাশে সমর্পিতম। না-না, আপনার কোনও দুশ্চিন্তা নেই। ওই মণিতে দেশের-দশের উপকার হয়, ওটা আপনার কাছে আছে এবং তা আপনার কাছেই থাকুক ততেদ রাষ্ট্রোপকারকং ভবতঃ সকাশে তিষ্ঠতীতি তিতু আমাদের কোনও সমস্যা নেই, মণিরত্নের উপকারফল আমরা সবাই ভোগ করছি। আপনি শুধু একটা উপকার করুন আমার। আমার প্রিয় দাদা বলরাম এইরকম একটা সন্দেহ করেন যে, মণিটা আমার কাছে আছে। তার ভাবটা এই যে, আমি শতধন্বাকে মেরে মণিটা আমার ঘরেই লুকিয়ে রেখেছি। আমার তাই একান্ত অনুরোধ যে, আপনি মণিটি একবার সবাইকে দেখান এবং তারপর না হয় আপনার কাছেই রেখে দিন– এষ বলভদ্রোহম্মান আশঙ্কিতবান তদন্মুৎপ্রীতয়ে দর্শয়।

অক্রূর মহা সমস্যায় পড়লেন। ভাবলেন, মণির ব্যাপারে যদি অন্যরকম বলি, তা হলে একবার যদি শরীর-অন্বেষণের দিকে যায়, তবে এক পরত দেহাবরণের তলাতেই তো মণি পেয়ে যাবে– তৎ কেবলাম্বর-তিরোধান অন্বিষ্যন্তো রত্নমেতে দ্রক্ষ্যন্তীতি। কিন্তু সেই মিথ্যে তার সম্মানের পক্ষে তখন বড় বেশি কঠিন হয়ে উঠবে। এতসব চিন্তা করেই শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণের প্রত্যক্ষে সকলের সামনেই বললেন– আমার সেই স্যমন্তক মণি, শতধনু আমাকে দিয়ে গিয়েছিল– মমৈতৎ স্যমন্তকমণিরত্নং শতধনুষা সমর্পিত। এবারে কৃষ্ণকে উদ্দেশ করে অর বললেন, শতধন্বা মারা যাবার পর আপনি মণিটি ‘আজ চাইবেন কাল চাইবেন’ এইরকম ভেবে মণিটি আর দেওয়া হয়নি, সেটা আমি অনেক কষ্টেই এতকাল ধারণ করে বসেছিলাম– অতিকৃচ্ছেনৈতাবন্তং কালমধারয়। অনেক কষ্টেই এইজন্য যে, এই মণির জন্য আমি কোনওরকম ভোগবিলাস এতদিন করতে পারিনি। এই মণি আমার কাছে থাকার জন্য যে ঐশ্বর্য-সুখ আমি ভোগ করতে পারতাম, তার একাংশও আমি ভোগ করতে পারিনি। অথচ মণিটি ধারণ করলে আপনি যদি কিছু ভাবেন, যদি ভাবেন এটা রাষ্ট্রের উপকারে লাগত, অথচ সেটা প্রকটভাবে বলাও যাচ্ছে না, বোঝানোও যাচ্ছে না– এত সব ভেবে আমি কিছু আর বলিনি। এখন এই স্যমন্তক মণি আপনি গ্রহণ করুন, এটা নিয়ে নিজের কাছেই রাখুন বা যাকে ইচ্ছে দিন, কিন্তু এটা এবার আপনি নিন– তদিদং স্যমন্তকরত্নং গৃহ্যতাম, ইচ্ছয়া বা যস্যাভিমতং তস্য সমর্পতাম।

এই কথোপকথন থেকে বোঝা যায় যে, শতধন্বার মৃত্যুর পরে অরের কাছেই যে স্যমন্তক মণি ছিল, সেটা কৃষ্ণ কোনও না কোনওভাবে আন্দাজ করেছিলেন, কিন্তু সঙ্ঘশাসনের রাজনৈতিক শিষ্টাচার মেনেই অক্রূরের মতো প্রবীন নেতাকে মানসিক আঘাত দেননি তিনি। কিন্তু এতে তার ব্যক্তিগত জীবনে অনেক যন্ত্রণা তৈরি হয়েছে। স্ত্রী সত্যভামার কাছে জবাবদিহির দায় ছাড়াও অতি নিকট বলরামের কাছে তিনি চোর বলে প্রতিপন্ন। ফলে আজ যখন সমস্ত মান-অপমানের ঊর্ধ্বে উঠে অক্রূর তার অধর বস্ত্রের অন্তরাল থেকে মণিটি বার করে এনে সমগ্র যাদব-সমাজের চক্ষুর সামনে রাখলেন তখন সমস্ত সভা যেরকম মণিপ্রভায় কান্তিমতী হয়ে উঠল, তেমনই উজ্জ্বল হয়ে উঠল কতগুলি মুখ। অক্রূর মণিটি সবার সামনে রেখে বললেন, এই সেই স্যমন্তক মণি, যা শতধন্বা আমাকে দিয়েছিল। এবার তিনি গ্রহণ করুন এই মণি, যাঁর সঠিক অধিকার আছে এই মণির ওপর– যস্যায়ং স এনং গৃহ্নাতু ইতি।

মণির ওপর সত্যভামারই তো অধিকার আসে সবার আগে এবং সবার ওপরে। কিন্তু সমগ্র এই কাহিনি জুড়ে আমরা কোথাও এই স্যমন্তক মণির ওপর তার উদগ্র আগ্রহ দেখিনি। মুখে কোনওদিন বলেননি যে, মণিটি আমার বাবার ছিল, অতএব মণি ধারণ করার কথা আমারই। অথচ অগ্রজ বলরামকে একবার গৌরবে দ্বিবচন প্রয়োগ করে কৃষ্ণ বলেছিলেন, আমার শ্বশুর মারা যাবার পর এ-মণি এখন আমাদের দুজনের, তাতেই বলরাম মণির ওপর এতটাই অধিকার বোধ করেছিলেন যে, তিনি কৃষ্ণকেই সন্দেহ করে বসেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে কৃষ্ণ এই মণির ব্যাপারে এতটুকুও আগ্রহী ছিলেন বলে আমরা মনে করি না এবং তার ক্রিয়াকর্মও বহুল সুদূরপ্রসারী ভাবনার সঙ্গে যুক্ত, ফলে মণি-সংগ্রহের জন্য তার সমস্ত চেষ্টাই ব্যক্তিগত প্রয়োজনে চালিত ছিল না। কিন্তু আজ যখন মণিটি সবার সামনে রেখে অধিকারী-নির্ণয়ের প্রশ্ন উঠল, তখন প্রথম উজ্জ্বল হয়ে উঠল বলরামের মুখ। তিনি পূর্বকথা স্মরণ করে ভাবলেন, কৃষ্ণের সঙ্গে আমারও সহভোগ্য এই মণির সম্পদ। অতএব মণির ব্যাপারে তিনি আগ্রহী বোধ করতে লাগলেন। কিন্তু এখন এই প্রান্তভূমিতে এসে যখন মণির অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, তখন কিন্তু সত্যভামাও ভাবলেন, এই স্যমন্তক আমার বাপের জিনিস, আমার পিতৃধন, অতএব এটা আমারই হওয়া উচিত। অতএব সত্যভামা চাইলেন মণিটি তার হাতেই দেওয়া হোক মমৈবেদং পিতৃধনমিতি অতীব চ সত্যভামাপি স্পৃহয়ঞ্চকার।

বিষ্ণুপুরাণ প্রাচীন গদ্যে লিখেছে, দাদা বলরাম এবং স্ত্রী সত্যভামা– এই দুয়ের মণি বাসনার দ্বৈরথে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণের অবস্থাটা দাঁড়াল দুটি চাকার মধ্যে পিষে যাবার মতো– কৃষ্ণোহপি আত্মানং চক্রান্তরাবস্থিত ইব মেনে। কিন্তু সরল দাদা বলরামের সঙ্গে এবং প্রিয়তমা পত্নী সত্যভামার সঙ্গেও অন্তঃকলহ থেকে বাঁচার জন্য সুচতুর কৃষ্ণ সভার মাঝখানে দাঁড়িয়ে স্যমন্তক মণির অধিকারী নির্ণয় করে নিলেন প্রথমে এবং তাতেই বুঝিয়ে দিলেন যে, হ্যাঁ, তোমাদের মনের ইচ্ছা আমি বুঝেছি। তিনি অরকেই বললেন, দেখুন আমাদের এই যদুসমাজের সামনে এই মণিটি দেখানোর প্রয়োজন ছিল এই কারণেই যে, এতে আমার নামে অপবাদটুকু ঘুচে গেল এবং সকলে জানল যে, অন্তত আমি কোনও দিন এই মণি নিজের কাছে রাখিনি৷ এই মণির আসল অধিকারীর কথা বলতে গেলে বলা উচিত যে, আমাদের ঘরে এই মণি এলে আমার এবং বলরামের সমান অধিকার থাকবে মণির ওপর এতচ্চ মম বলভদ্রস্য চ সামান্যম। আর প্রকৃত উত্তরাধিকারীর কথা বললে মণি পাবার যোগ্য হলেন একমাত্র সত্যভামা। কেননা, এটা তার পিতৃধন, এখানে আর কারও অধিকার আসে না– পিতৃধনঞ্চৈতৎ সত্যভামায়া নান্যস্য।

কথাগুলি বলেই কৃষ্ণ তার এতদিনের অভিজ্ঞতার স্মৃতিতে ক্ষণিক অবগাহন করলেন। তিনি বুঝেছেন যে, এই মণির মহার্ঘতা এবং মণিজন্য ঐশ্বর্য যে মত্ততা তৈরি করতে পারে, তাতে নিজেদের ঘরের মধ্যেই অন্তঃকলহ সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা আছে। সেই বিপদ এড়ানোর জন্যই কৃষ্ণ বললেন, দেখুন এই মণি ধারণের জন্য যে শুচিতা এবং ব্রহ্মচর্যের প্রয়োজন হয়, তা আমার নেই। আমি এতগুলি বিবাহ করেছি, তাতে শুচিতা আর ব্রহ্মচর্যের কথা আর কী করে বড়াই করে বলি, আমার ষোলো হাজার বউ– অহেমস্য ষোড়শ-স্ত্রী সহস্র-পরিগ্রহাদ অসমর্থো ধারণে। একই কারণে আমার স্ত্রী সত্যভামাই বা এই মণি ধারণ করবেন কোন ব্রহ্মচারিতার মাহাত্মে কণ্বঞ্চৈতৎ সত্যভামা স্বীকরোতু। আর আমি দাদা বলরামের কথাই বা কী বলব? তিনি কি আর এই বয়সে এসে এতকালের অভ্যস্ত মদ্যপানের অভ্যাস ত্যাগ করবেন– বলভদ্রেণাপি মদিরাপানাদ্যশেযোপভোগ-পরিত্যাগঃ কথং কাৰ্যঃ? মণিধারণের ব্যাপারে উত্তরাধিকার বিকল্পের নিরসন করেই কৃষ্ণ অক্রূরকে বললেন, আমাদের তিনজনের তরফেই আমি আপনাকে জানাচ্ছি, আপনার কাছেই থাকুক এই স্যমন্তক মণি, তাতেই সমগ্র রাষ্ট্রের উপকার। এই মণিধারণে আপনিই সমর্থতম। কৃষ্ণের কথা শুনে অক্রূর আবারও গ্রহণ করলেন স্যমন্তক মণি, এতদিন লোকভয়ে বাইরে যা প্রকট করতে পারতেন না, এবার নির্দ্বিধায় সেই মণিরত্ন ধারণ করলেন অক্রূর– তথেত্যুত্ত্বা জগ্রাহ তন্মহামণিরত্ন৷ বিষ্ণুপুরাণের ক্রিয়াপদ জগ্রাহ– গ্রহণ করলেন– স্মৃতিতে থাকল যাঙ্কের লেখা লোকপ্রবাদ, অরই মণি ধারণ করলেন অঙ্কুরো দদতে মণিম্।

অক্রূরকে মণি দিয়ে দেবার ফলে মণির প্রকৃত উত্তরাধিকারী সত্যভামা কোনও ক্ষোভ করেছিলেন কিনা, সেটা বিষ্ণুপুরাণ-হরিবংশ কেউই বলেনি। কিন্তু এতাবৎ কাহিনিটা প্রমাণ করে যে, নেতিবাচকভাবে হলেও এই স্যমন্তক মণির সঙ্গে সত্যভামার জীবন বহুলাংশে জড়িত এবং কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর বিবাহ-সঙঘটনার মূলেও এই স্যমন্তক মণি। কিন্তু বৈবাহিক জীবনে কৃষ্ণের মধুর সঙ্গ তাঁকে এতটাই মুগ্ধ রেখেছিল যে, পিতার সম্পত্তি নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো স্থূলতা তিনি কখনও দেখাননি। কিন্তু সেটা অন্য কথা। স্যমন্তক মণির কাহিনি-চমৎকারে সত্যভামার মতো ‘সেনসেশনাল’ মহিলার জীবন-চমকারিতাই ঢাকা পড়ে গেছে। বিশেষত পুরাণগুলি মূলত তথা ঐতিহ্যগতভাবে সংরক্ষণশীল বলেই সেই যে একবার মাত্র সত্যভামার কথা বলতে গিয়ে বলেছিল, তাকে অক্রূর-কৃতবর্মা-শতধন্বার মতো গুরুত্বপূর্ণ যাদবজনেরাও ভীষণভাবে কামনা করতেন, কিন্তু তারপরে আর সত্যভামার ‘সেনসেশন’ নিয়ে আর কথা বলেনি। বলেনি তার কারণ, কৃষ্ণের সঙ্গে তার বিবাহ হয়ে গেছে এবং বিবাহোত্তর জীবনে কৃষ্ণের প্রিয়তমা স্ত্রীর ওপরে অন্যের আকর্ষণ ছিল– এ-কথায় বেশি কথা হয়ে গেলে লোকসমাজে কৃষ্ণের মর্যাদা নষ্ট হত। কিন্তু আমরা বলব, স্যমন্তক মণি তো বটেই, তার সঙ্গে সত্যভামাও যে বেশ খানিকটা সংকটের ঝড় তুলে দিয়েছিলেন কৃষ্ণের জীবনে, তার একটা বড় প্রমাণ আছে মহাভারতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মহাভারত কিন্তু কৃষ্ণের পূর্বজীবন বা বিবাহিত জীবন সম্বন্ধে ব্যয়িত কোনও মহাকাব্য নয়। পাণ্ডব-কৌরবের মুখ্য ইতিহাসের মধ্যে এখানে কৃষ্ণের জীবন-কথা মাঝে মাঝে এসে যায়। ঠিক যেমন রুক্মিণীর স্বয়ংবর-পর্ব সেইভাবে কোনও প্রচলিত বিস্তারে আলোচিত না হলেও মাঝে মাঝে যেমন তার সূত্র পাই মহাভারতেও, তেমনই সত্যভামা এবং স্যমন্তক সম্বন্ধে বিস্তারিত কোনও বিবরণ মহাভারতে না থাকলেও এই দুটি নিয়ে যে গৃহবিবাদ শুরু হয়েছিল এবং দীর্ঘ ষাট বছর ধরে কৃষ্ণকে তার ফল পোয়াতে হয়েছিল, তারও একটা সুত্র পাই। মহাভারতে। আমরা বিষ্ণুপুরাণ এবং হরিবংশে দেখেছি, শতধন্বার কাছ থেকে মণি পাবার সময় থেকে মণিটি শেষ পর্যন্ত অক্রূরের হাতে দেওয়া পর্যন্ত ষাট বছর সময় চলে গেছে। শেষে কৃষ্ণ অরকে বলেছিলেন, আজকে প্রায় ষাট বছর হয়ে গেল, আমি এই মণির জন্য ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম। আগেকার সেই রাগের তীব্রতা হয়তো এখন আর নেই, কিন্তু তবু সেই রাগ আমার মনের মধ্যে এখনও ধিকি ধিকি জ্বলছে– স সংরূঢ়োহসকৃৎপ্রাপ্তস্ততঃ কালাত্যয়ে মহান।

মহাভারতে প্রসঙ্গটা একেবারেই অন্য। শান্তিপর্বে শরশয়ান ভীষ্ম গণরাজ্য অথবা সঙঘশাসনের শক্তি বোঝানোর জন্য কৃষ্ণ এবং নারদের একটি সংলাপ উদ্ধার করেছেন। সেখানে প্রসঙ্গটা এই যে, সঙ্ঘশাসনের একতা টিকিয়ে রাখার জন্য কৃষ্ণকে কতটা সইতে হয়েছে। কথার ভাবেই বোঝা যায় প্রায় বৃদ্ধ অবস্থায় কৃষ্ণ নারদের কাছে আপন জীবনের দুঃখ কষ্টের কথা বলছেন এবং সে-কথায় এই ভাবই ফুটে ওঠে যে, আত্মীয়-স্বজনের জন্য কতটা ‘স্যাক্রিফাইস’ তাকে করতে হয়েছে। ঠিক এই বক্তব্যের মধ্যেই সত্যভামা এবং স্যমন্তকের জন্য যে ভয়ংকর ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছিল, তার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ছায়াটুকু পরিষ্কার ধরা পড়ে। কৃষ্ণ নারদকে বলেছেন, এই যে দেখছ আমার সব জ্ঞাতিগুষ্টি, এরা আমাকে খুব ক্ষমতাশালী বলে মনে করে, এমনকী মুখে এমন ভাব করে যেন আমি এদের ভগবান, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই জ্ঞাতিগুষ্টির চাকরের মতো থাকতে হয় আমাকে দাস্যম্ ঐশ্বর্যবাদেন জ্ঞাতীনাং তু করোম্যহম্। ধন-সম্পত্তির যে উপায়-আদায় আমি নিজে করি, তার অর্ধেক ভোগ করি আমি, আর বাকি অর্ধেক যায় জ্ঞাতিগুষ্টির ভোগে, কিন্তু আমার লাভটা এই যে, তবুও তাদের বাঁকাচোরা কথা সব আমাকে সহ্য করতে হয়– অর্ধং ভোক্তাস্মি ভোগানাং বাদুরুক্তানি চ ক্ষমে।

জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যে এই ধরনের সম্পর্ক খুব নতুন নয়, এখানে বৃহৎ মহৎ ব্যক্তি-মানুষের সহ্যশক্তির উদাহরণও আছে। কিন্তু কৃষ্ণ এবার একান্তভাবে নিজের নিকট জন, প্রায় পারিবারিক কথা শুনিয়ে বলছেন, এই যে আমার দাদা বলরাম, নিজের শক্তি এবং ক্ষমতায় নিজেই তিনি এত মত্ত যে, কাউকে তিনি গ্রাহ্যের মধ্যেও আনেন না, আর আমার ছোট ভাই গদ, তাকে দেখতে সুন্দর সবাই জানে, কিন্তু সেই সৌন্দর্য্যে সে নিজেই পাগল হয়ে আছে– বলং সংকর্ষণে নিত্যং সৌকুমার্যং পুনৰ্গদে। তবে ছোট ভাইয়ের দোষ দিই কেন শুধু, আমার নিজের ছেলের দোষও এখানে একইরকম, এই যে আমার প্রদ্যুম্ন, সেও আপন রূপে আপনি মত্ত। এসব দেখে আর ভাল লাগে না আমার, আমি বড় অসহায় বোধ করি– রূপেণ মত্তঃ প্রদ্যুম্নঃ সোহসহায়োহস্মি নারদ। আসলে দাদা বলরামের যে অসীম শক্তিমত্তা অথবা প্রদ্যুম্ন তিনিও বিশাল অস্ত্রবিদ পুরুষ, কিন্তু এঁদের শক্তি বা যুক্তিনিষ্ঠ মতামত কখনওই কৃষ্ণের কাজে আসে না। যদি আসত, তবে বলরাম শতধম্বার মৃত্যুর পরেও কৃষ্ণকে বিশ্বাস করতেন, অথবা সব কিছু জানার পরেও কৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামার একান্ত উত্তরাধিকারে প্রাপ্য স্যমন্তক মণির ওপর ওইরকম অদ্ভুত আকর্ষণ প্রকট করে তুলতেন না বলরাম।

কৃষ্ণ এবার তার জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যার কথা বলছেন নারদকে এবং এখানে প্রচ্ছন্নভাবে স্যমন্তক মণি এবং সত্যভামার অন্তরীণ ছায়াটুকু আছেই। কৃষ্ণ বলেছেন, বৃষ্ণি-অন্ধক গোষ্ঠীর মধ্যে অনেকেই অনেক বড় মানুষ। কিন্তু তাদের মধ্যে আবার আহুক এবং অক্রূরকে নিয়ে আমার সমস্যার অন্ত নেই। (এখানে আহুক বলতে আহুকের ছেলে উগ্রসেনকে বোঝাচ্ছে। মহাভারত-পুরাণে অনেক সময়েই পিতা-পিতামহের নাম ব্যবহার করা হয়েছে অধস্তন পুরুষকে বোঝানোর জন্য। কৃষ্ণ কংসহত্যা করে উগ্রসেনকে রাজার সিংহাসনে বসিয়েছিলেন বলে হয়তো প্রবীণ নেতা অক্রূরের মনে কিছু ক্ষোভ ছিল এবং তদবধি আহুক উগ্রসেন এবং অক্রূরের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছে।) কৃষ্ণ বলেছেন– সঙ্ঘ-শাসনে যে জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যে আহুক উগ্রসেন আর অরের মতো দুটি আত্মীয়-বন্ধু থাকবেন, তার থেকে জ্বালা বোধহয় আর কিছুতে নেই– স্যাতাং যস্যাহুঁকারে কিছু দুঃখতরং ততঃ। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে আমি যদি সমাধান-সূত্র দিই, তা হলে আহুক উগ্রসেন বলবে, কৃষ্ণ অরের পক্ষ নিয়েছে আর অক্রূর বলবে, আমি আহুকের পক্ষ নিয়েছি। আমার এমন সমস্যা যে, একই সমাধানে দু’জনেই আমাকে বারণ করতে থাকে, অথচ সঠিক হলেও আমি একজনের সঙ্গেও সহমত হতে পারি না- দ্বাভ্যাং নিবারিতো নিত্যং বৃণোম্যেকতরং ন চ। অথচ সমস্যা এমনই অর্থাৎ বৃষ্ণি-অন্ধকদের কাছে এদের দুজনেরই গুরুত্ব এতটা যে, এরা না থাকলেও চলবে না– যস্য চাপি ন তো স্যাতাং কিন্তু দুঃখতরং ততঃ।

আসলে স্যমন্তক মণি নিয়েও কৃষ্ণ এদের দুজনের ঝগড়াতে ভুগেছেন এবং মাঝখানে সত্যভামা এবং সত্যভামার বাবা থাকায় এই ঝগড়াটা তার জীবনের ব্যক্তিগত স্তরে এসে পৌঁছেছিল। কৃষ্ণ দেশের রাজা আহুক উগ্রসেনের জন্যই রাষ্ট্রোপকারসাধক মণিটি চেয়েছিলেন, কিন্তু ঘটনাক্রমে সে মণি এল না, মাঝখান দিয়ে সত্যভামার সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল। তাতে সমস্যা দ্বিগুণতর হল। কৃষ্ণ শতধন্বাকে মারতে পেরেছেন, সে নেহাৎই সত্যভামার গুণগ্রাহী এবং সত্রাজিতের হন্তা বলেই। কিন্তু তিনি অর্জুরের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেননি যেহেতু তাতে সঙ্ঘ-শাসনের রাজনীতি জড়িত ছিল। অবশেষে তিনি শুধু অপবাদমুক্ত হতে পেরেছেন এবং সেটা স্যমন্তক মণি অরের কাছে রেখে দিয়ে এবং সত্যভামাকে না দিয়ে।

আমরা শুধু বলব, এই বিশাল রাজনীতি, খুন, সন্দেহ এবং এক বিরাট অশান্তির মধ্য দিয়েই কিন্তু সত্যভামাকে লাভ করেছেন কৃষ্ণ এবং হয়তো বা এতসব জটিলতা এবং অনভিমত পুরুষের প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়েই সত্যভামার বৈদগ্ধ্যের উপাদান তৈরি হয়েছে। বলেই কৃষ্ণের দিক থেকেও তাকে পাবার মধ্যে যেন এক অলভ্যতা এবং বামতা ছিল, যাতে সত্যভামা প্রিয়তরা হয়ে উঠেছেন কৃষ্ণের কাছে। যে রমণী পিতৃহন্তাকে শায়েস্তা করার জন্য একাকিনী রথে চড়ে দ্বারকা থেকে বারণাবতে চলে গিয়েছিলেন কৃষ্ণের কাছে, তিনি যে অবগুণ্ঠিতা সাধারণী রমণীটি নন, তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। আর কৃষ্ণ বুঝি সত্যভামাকে ছাড়া এক দণ্ড তিষ্ঠোতে পারেন না, নইলে কোথায় সেই প্রাগজ্যোতিষপুরে নরকাসুরকে যুদ্ধ করে মারতে যেতে হবে, কৃষ্ণ তার গরুড়-বাহনের পক্ষপুটে সত্যভামাকেও নিয়ে গেছেন প্রাগজ্যোতিষপুরে, মানে, আমেদাবাদ থেকে অসমে। এ-খবর আমাদের দিয়েছে ‘নরকাসুর-বিজয়-ব্যায়োগ’ নামে একটা নাটক গ্রন্থ। ধর্মসূরি নামে এক জৈনধর্মীর লেখা এই নাটকে সত্যভামা অত্যন্ত আধুনিকভাবে প্রগম্ভ। যুদ্ধস্থানে স্ত্রীলোকের যাওয়াটা যেখানে পরম্পরাগত কারণেই নিষিদ্ধ, সেখানে সত্যভামা বায়না করে কৃষ্ণের সঙ্গে যাচ্ছেন। বায়না মেনে পরে অবশ্য কৃষ্ণকে আমরা বিরক্ত দেখছি না, বরঞ্চ আগে নিষেধ করে অপরাধ করেছেন, তার জন্য গরুড়-বাহনের পক্ষপুটে তাকে কোলে বসিয়ে যুদ্ধযাত্রা করেছেন কৃষ্ণ অঙ্কে নিধায় দয়িতামিহ সত্যভামাম। জৈন ধর্মসূরি সত্যভামাকে এইভাবে চিত্রিত করেছেন পুরাণ-মহাভারতে সত্যভামার প্রতি কৃষ্ণের অনুরাগ-পদ্ধতি দেখেই। সত্যভামার আবদার, সে তো মানতেই হবে। কৃষ্ণ রুক্মিণীকে বলেছিলেন, পরিহাস করব না? সেই যে গৃহস্থের একমাত্র রমণীয় সুখ! কিন্তু সত্যভামার সঙ্গে পরিহাসের আগেই তিনি মানিনী হন। অতিরিক্ত আত্ম-সচেতনতা থাকলেও যদি সত্যভামা কাউকে ভালবেসে থাকেন, তবে সে কৃষ্ণ। কিন্তু এমন একটা ভালবাসার জন্য কৃষ্ণকে সবসময় এত সচেতন থাকতে হয়েছে যে, সে সুখ একমাত্র কৃষ্ণের মতো ভগবানই বোধহয় সহ্য করতে পারেন। গৃহস্থেরা এমন কী করলে লোকে তাকে বউ-চাটা পুরুষ বলে, সত্যভামার জন্য কৃষ্ণকেও তাই শুনতে হয়েছে। স্বর্গের দেবরাজ তাকে বলেছেন– বউয়ের আঁচল ধরা কৃষ্ণকে আমি কেমন করে ক্ষমা করব– অহো তং মর্ষয়িষ্যামি কিমর্থং স্ত্রীজিতং হরি? তবু সত্যভামার জন্য এই অপবাদ কৃষ্ণের কাছে সুখের মতো এক ব্যথা।

সেদিন দ্বারকার কাছেই রৈবতক পর্বতে এক উৎসবের আয়োজন চলছিল। মহারানি রুক্মিণী দেবী ব্রত-উপবাস সাঙ্গ করেছেন, সেই উপলক্ষেই এই উৎসব। ব্রাহ্মণরা এসেছেন, দান-ধ্যান হবে, মণ্ডা-মিঠাই খাওয়া হবে- সবাই খুব খুশি। কৃষ্ণ নিজের হাতে ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা বিলোলেন, জ্ঞাতিগুষ্টির সবাইকে কিছু না কিছু দিয়ে তুষ্ট করলেন। স্বামীর মঙ্গলের জন্য উপবাস-ক্লিষ্টা রুক্মিণীর পাশে বসে কৃষ্ণ তাকে অনেক আদর জানালেন, অনেক প্রশংসা করলেন। ঠিক এই সময়ে নারদ মুনি এসে উপস্থিত হলেন কোথা থেকে। কৃষ্ণের কাছ থেকে পাদ্য-অর্ঘ্য পাওয়ার পরেই তিনি স্বর্গ থেকে আনা একগুচ্ছ মন্দারমঞ্জরী উপহার দিলেন কৃষ্ণকে। কৃষ্ণ পাশে-বসা রুক্মিণীর হাতে সেই পারিজাত ফুলের উপহার তুলে দিতেই তিনি কৃষ্ণেরই ইঙ্গিতে দদৌ কৃষ্ণেঙ্গিতানুগা– সেই পারিজাত গুঁজে দিলেন চুলের খোঁপায়। এক মুহূর্তে রুক্মিণীকে দ্বিগুণতর সুন্দরী মনে হল– শুশুভে দেবপুষ্পেণ দ্বিগুণং ভৈষ্মকী তদা।

পারিজাত ফুল বড় মহার্ঘ্য। তার গন্ধেরও শেষ নেই, গুণেরও শেষ নেই। এমন একটা ফুল কৃষ্ণ রুক্মিণীর হাতে তুলে দিলেন বলে নারদ তাকে খুব মাথায় তুলে দিলেন। নারদ বললেন, আজ আমি বুঝলাম কৃষ্ণের এতগুলি মহিষীর মধ্যে তুমিই তার সবচেয়ে ভালবাসার জন। আজ তুমি তোমার সতীনদের অভিমানের গোড়ায় জল ঢেলে দিয়েছ– অবমানাবসেকেন ত্বয়া সিক্তাদ্য ভামিনি। আজ তোমার সমস্ত সতীনেরা সব অপমানে মাথা নিচু করে থাকবে, কেননা কৃষ্ণ তোমাকেই এই বিরল পুষ্পের উপহার দিয়েছেন। আর ওই যে সুন্দরী, সত্রাজিতের মেয়ে, সত্যভামা, যিনি কৃষ্ণের ভালবাসার অধিকারে নিজেকে সবার চেয়ে বেশি সৌভাগ্যবতী বলে গুমোর করেন, আজকে তিনি বুঝবেন কার ভাগ্যি বেশি– অদ্য সাত্রাজিতী দেবী জ্ঞাস্যতে বরবর্ণিনী। জাম্ববতী, গান্ধারী– এইসব মহিষীরা জীবনে আর কোনওদিন মুখ তুলে দাঁড়াতে পারবে না। আজকে আমি বুঝলাম, কৃষ্ণের দ্বিতীয় আত্মাই হলে তুমি–আত্মা দ্বিতীয়ঃ কৃষ্ণস্য ভেজে ত্বমিতি ভামিনি।

রুক্মিণী তো নারদের কথায় আহ্লাদে ডগমগ হলেন; তিনি খেয়াল করলেন না যে,সত্যভামার গুপ্তচরী দাসীরা হেথায় হোথায় দাঁড়িয়ে নারদের রুক্মিণী-স্তুতি শুনে ফেলল। তারা সব গিয়ে সত্যভামাকে অনুপুঙ্খ ‘রিপোর্ট’ দিল। কৃষ্ণের অন্য মহিষীরাও এসব শুনেছেন, তবে রুক্মিণী সবার বড়, মহারানি বলে কথা, তার ওপরে প্রদ্যুম্নের মতো একটি ছেলের মা বলেও তিনি একটু বাড়তি সম্মান পান– অহেঁতি পুত্রমতেতি জ্যেষ্ঠেতি চ সমাগতাঃ- তারা আর ব্যাপারটা গায়ে মাখেননি। কিন্তু সত্যভামা, তার রূপ আছে, যৌবন আছে এবং এখনও পর্যন্ত কোনও ছেলে নেই বলে নিজের রূপ-যৌবনের ওপরে বোধহয় একটু বেশিই ভরসা করেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, কৃষ্ণ তাকে সদা-সর্বদা মাথায় তুলে রাখেন–রূপযৌবন-সম্পন্না স্বসৌভাগ্যেন গর্বিতা– এমন উৎকর্ষ নিয়ে তিনি জ্যেষ্ঠা বলে রুক্মিণীকে বাড়তি সম্মান দেবেন কেন? বিশেষত রুক্মিণীর ওপর তার রাগ কীসের, তার চিন্তা কৃষ্ণকে নিয়ে, সে কেন রুক্মিণীকে পাত্তা দেবে? পারিজাতের সংবাদ শোনামাত্র কুমকুম-লাল শাড়িখানি খুলে ফেলে– সমুৎস্যজন্তী বসনাং সকুমকুম সত্যভামা একটা সাদা কাপড় পরলেন। তারপর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে রৈবতকের অন্তঃপুরের কোনায় এক নির্জন ঘরে গিয়ে বসে রইলেন। রাগ হলে সত্যভামা আবার মাথায় একটা সাদা ফেট্টি বাঁধেন এবং কপালের চারপাশে লাগিয়ে দেন রক্তচন্দনের ছোপ, এটাই তার রাগ জানান দেবার চেহারা বদ্ধা ললাটে হিমচন্দ্ৰশুক্লং/দুকূলপট্টং প্রিয়রোষচিহ্ন। দাসীরা দু-একবার চেষ্টা করল তাকে বাইরে নিয়ে যেতে, কিন্তু তিনি কিচ্ছুটি না বলে চুপ করে রইলেন, দীর্ঘ দীর্ঘতর নিঃশ্বাস তাকে আন্দোলিত করছিল, হাতের কমল-কলি তিনি চটকে চটকে গুঁড়ো করে ফেললেন– বিচুর্ণয়ামাস কুশেশয়ং সা/নিঃশ্বস্য নিঃশ্বস্য নখৈতভ্রঃ।

খবর চলে গেল। কৃষ্ণ নারদের সামনে রুক্মিণীর পাশে বসে আছেন, এই অবস্থাতেও দাসদাসীরা তাকে খবর দিল কানে কানে। তারা বুঝেছিল, সত্যভামার এই কঠিন-করুণ অবস্থা বেশিক্ষণ চললে কৃষ্ণের যন্ত্রণা যত বাড়বে, তাদের যন্ত্রণা হবে ততোধিক। নারদ রুক্মিণীর সঙ্গে কথা বলছেন, ‘অ্যাটেন্ড’ করছেন, এই সুযোগ নিয়ে কৃষ্ণ একটা অজুহাত দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন সেখান থেকে জগাম ত্বরিতশ্চৈব… ব্যপদেশেন ভারত। এই ব্যবহারে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, এটাও ভাবার কোনও কারণ নেই যে, ভবিষ্যতে যিনি মহাভারত-সূত্ৰধার হবেন, তিনি কিনা অজুহাত-অছিলা খুঁজে স্ত্রীর মান ভাঙানোর জন্য দৌড়চ্ছেন– জগাম ত্বরিতশ্চৈব। আর কৃষ্ণ তো এমনটাই চেয়েছিলেন। নিতান্তই অনুগত এবং স্বানুকূল এক গৃহিণীকে আলিঙ্গন করে তিনি গার্হস্থ্য কাটাচ্ছেন এই গড়ড়ল জীবন তো তিনি চাননি এবং তা যদি চাইতেন, তা হলে প্রথমা রুক্মিণীই তো তার কাছে সবচেয়ে কাম্য এবং মধুরা হতেন– খুব স্পষ্টভাবেই তিনি তা নন। এই পারিজাত কাহিনি আরম্ভ হওয়ার মুখেই হরিবংশ ঠাকুর মন্তব্য করেছেন, পত্নীলাভ করে বিবাহিত জীবন যাপন করার সময় কৃষ্ণের চরিত্র যে কী বিচিত্র হয়েছিল, শ্রবণ করুন, মহারাজ! এবং সত্যি বলতে কী, সে চরিত্র তাকেই খুব মানায়– নিবোধ চরিতং চিত্রং তস্যৈব সদৃশং বিভো। বস্তুত তখনকার বৈবাহিক জীবন এবং এখনকার বৈবাহিক জীবনে অনেক তফাত আছে। তখনকার পুরুষ বহু বিবাহ করত, এখন আইনগতভাবেই তা নিষিদ্ধ। আর মেয়েরা চিরকালই একটি পুরুষকে বিবাহ করে সুখী থাকবে এটাই সমাজসিদ্ধ এবং নীতিসিদ্ধ নিয়মে পরিণত। গবেষক পণ্ডিতেরা মানবমনের গহন নিয়ে গবেষণা করে এমনই সিদ্ধান্ত করেছেন যে, বিবাহপ্রথার মাধ্যমে একক স্বামী অথবা একক স্ত্রীর প্রেম-ভালবাসায় আবদ্ধ থাকাটা আমাদের মানবিক স্বভাব প্রসূত কোনও বৃত্তি নয়, ওটা সাংস্কৃতিক তথা সামাজিকভাবে আমাদের ওপর চাপানো আছে– long-term exclusivity with a sexual emotioনাl com panion is not an inনাte human need, but a culturally induced one.

গবেষকের এই মন্তব্য কিন্তু বৈবাহিক জীবনের পত্নীনিষ্ঠতা বা পতিনিষ্ঠতা ভেঙে দেবার জন্য নয়। তার বক্তব্য, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষের মনের মধ্যেই যেহেতু প্রেম ভালবাসার বিষয়ে এক বৈচিত্র্যবাদী, এক varaietist বাসা বেঁধে আছে, তাই সেখানে আমাদের দ্বৈত জীবনের মধ্যেও অন্তত সেই বৈচিত্র্য নিবেশ করা প্রয়োজন, নইলে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক এক দুর্বহ ভারে পরিণত হয়, আর সম্পর্ক জিনিসটা একদিনেই ভেঙে পড়ে না, দৈনন্দিন অনাচরণে তা বিলয় প্রাপ্ত হয়- it does not break, it melts. যদি এই ভাবনার নিরিখে কৃষ্ণের আচার লক্ষ করি, তা হলে তো বলতে হবে, তার জীবনে আর variety-র অভাব কী, এতগুলি স্ত্রীই তো তার স্বাদ বদলের জন্য ছিলেন। আমরা শুধু বলব, একাধিক স্ত্রী থাকলেও তারা যদি সেই মহান পাতিব্রত্যের চিরানুকূল বৃত্তের মধ্যেই ব্যাকরণগত বৈবাহিক প্রক্রিয়ায় আবদ্ধ থাকেন, তা হলে যৌনতার বিষয় কিছু উপশান্ত হতে পারে বটে, কিন্তু ভাবজগতের চাহিদাটুকু সেখানে রয়েই যায়। বিশেষত কৃষ্ণের মতো রসিক পুরুষ তো আর শুধু স্ত্রীর ওপরে পজেশন’ নিয়ে শান্ত থাকতে পারেন না। তার কাছে ভাবজগৎটাই প্রধান এবং হয়তো এই কারণেই হরিবংশ ঠাকুরের মতো পুরাণ-গম্ভীর মানুষও কৃষ্ণের বৈবাহিক জীবন নিয়ে এই মন্তব্য করেছেন– বিবাহিত জীবনে তার বিচিত্র চরিতের কথা শুনুন।

আজ নারদের সামনে পারিজাত-পুষ্পের বিপৰ্যাস যে ঘটনা ঘটাল, তাতে সত্যভামাকে নিয়ে বিলক্ষণ চিন্তিত হলেন কৃষ্ণ। হরিবংশ মন্তব্য করেছে, সাত্রাজিতী সত্যভামাকে কৃষ্ণ প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসেন এবং হয়তো বা সত্যভামা এই ভালবাসাটা বোঝেন। বলেই কৃষ্ণের এতটুকু অন্যাবেশেই তিনি বড় অভিমানিনী হন, আবার তিনি যে এতটুকুতেই অভিমানিনী হন, সেটাও কৃষ্ণ বোঝেন– অভিমানবতীম্ ইষ্টাং প্রাণৈরপি গরীয়সী। সত্যভামাকে কৃষ্ণ এত ভালবাসেনই বা কেন, তার অভিমানিতায় কৃষ্ণ এত দুশ্চিন্তিতই বা কেন? আমরা জানি এর প্রথম কারণ সেই দুর্লভ্যতা। অক্রূর, কৃতবর্মা, শতধন্বা এতগুলি প্রসিদ্ধ পুরুষের লোমভূতা রমণীটি শেষ পর্যন্ত তার কণ্ঠলগ্না হয়েছেন, এটা যেমন কৃষ্ণের কাছে সৌভাগ্যের প্রতাঁকে ধরা দিয়েছিল, তেমনই বিবাহিত হবার পরেও সত্যভামা বোধহয় নিজের চারদিকে সেই রহস্য চিরকাল ঘনিয়ে রাখতে পেরেছিলেন, যাতে কোনওদিনই তিনি কৃষ্ণের কাছে বড় সুলভ সহজ অভ্যাসে পরিণত হননি। এটা অবশ্যই একটা আর্ট’ এবং এখন যদি কেউ বলেন যে, মান-অভিমান, কপট ক্রোধ এগুলিই যদি খুব বেশি আসে জীবনে, তা হলেই বৈবাহিক দাম্পত্যের একটা সফল রূপ দেখতে পাওয়া যাবে, তাদের বলি, এটা কোনও উপায়ই নয়। মান-অভিমানের বামতা কখনও হয়তো দাম্পত্য রস সৃষ্টি করে বটে, কিন্তু মান-অভিমানের আতিশয্য একসময়ে বিরক্তি এবং অবসাদেরও জন্ম দিতে পারে।

আসলে শুধু এই মান-অভিমানই নয়, আরও কিছু আছে, যেখানে রমণীর স্বকীয় ব্যক্তিত্বের আবরণ-সংবরণ এবং অবশ্যই উন্মোচনেও sizzling হয়ে ওঠে দাম্পত্য– সেটাই আর্ট। মহাভারতের মধ্যে সত্যভামা দ্রৌপদীর কাছে এক সময় জানতে চেয়েছিলেন, কী করে তুমি তোমার অশেষ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পাঁচ-পাঁচটা স্বামীকে সামলাও– কেন বৃত্তেন দ্রৌপদী পাণ্ডবান্ অধিতিষ্ঠসি? কোনও ব্রত-উপবাস, কোনও মন্ত্রতন্ত্র নাকি ওষুধ করেছ তুমি স্বামীদের, তারা তো দেখি সবসময় তোমার বশ হয়েই আছেন, সবসময় তাকিয়ে আছেন তোমার মুখের দিকেই, কখন কী বলল তুমি মুখপ্রেক্ষাশ্চ তে সর্বে। সত্যভামা একটু অনুযোগ করেই বলেছিলেন, তুমি একটু রহস্যটা বলো দিদি! যাতে করে আমি আমার স্বামী কৃষ্ণকেও খানিক নিজের বশে রাখতে পারি যেন কৃষ্ণে ভবেন্নিত্যং মম কৃষ্ণো বশানুগঃ।

এর উত্তরে দ্রৌপদী যা বলেছিলেন, সে কথায় আমি পরে আসব। কিন্তু এটা বলতে পারি– দ্রৌপদীকে জিজ্ঞাসা করার কোনও প্রয়োজন ছিল না সত্যভামার। কারণ প্রথমত দ্রৌপদীর স্বামীরা কেউ কৃষ্ণ নন; দ্বিতীয়ত পাঁচ পাঁচটা স্বামী থাকায় তাদের পর্যায়-সম্ভোগ দ্রৌপদীকে যতখানি স্বাভাবিক কারণে varietist করে তুলতে পারে, সত্যভামার সে সুযোগ নেই। কিন্তু বৈচিত্র্যের সুযোগ থাকলেও persoনাlity-র যে মন্ত্রে তিনি স্বামীদের অভিভূত করতে পেরেছিলেন, সত্যভামার মধ্যে সেটা আরও বেশি ছিল বলেই কৃষ্ণের মতো ললিত স্বামীকেও তিনি স্ববশে আনতে পেরেছিলেন নিজেকে বারবার recreate করে।

আপাতত অবশ্য এই পারিজাত-পুষ্পের ঘটনায় সত্যভামা যেভাবে ঈর্ষাতুর অভিমানে বসে আছেন ক্রোধগৃহে, সেটাকে কৃষ্ণ কীভাবে সামাল দেন, সেটা দেখে নেওয়া দরকার। একান্ত পার্শ্বচরদের কাছে সত্যভামার রাগের খবর পেয়ে বিচিত্র অছিলায় কৃষ্ণ সত্যভামার ঘরের দিকে ছুটলেন বটে কিন্তু ছুটে যাওয়াটা ওই ঘর পর্যন্তই, সত্যভামার গোঁসা-ঘরে ঢুকতে হল খুব সমঝে, ধীরে ধীরে, ভয়ে ভয়ে ভীতভীতঃ স শনকৈর্বিবেশ মধুসূদন।

মাঝে মাঝে সত্যভামার এরকম হয়। তিনি খুব সুন্দরী, খুব অভিমানিনী। কৃষ্ণ জানেন– সত্যভামা এইরকমই। দূর থেকেই তিনি দেখতে পেলেন, সত্যভামা একবার উপুড় হয়ে বিছানায় শুচ্ছেন, কখনও পদ্মের পাপড়ি ছিঁড়ে উঁচু থেকে চোখের ওপর ফেলছেন, দাসীর হাতে চন্দন-বাটা ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন, কখনও মাথা দোলাচ্ছেন, কখনও হাসছেন, আর এখন ঠিক এই মুহূর্তে যখন তিনি বালিশে মুখ গুঁজে উশখুশ করে কাঁদতে আরম্ভ করলেন, তখনই সময় বুঝে ঘরে ঢুকলেন কৃষ্ণ– অবগুণ্ঠ্য যদা বক্ত উপধানে ন্যবেশয়ৎ। কৃষ্ণ সম্পূর্ণ ব্যাপারটাকে লঘু করার জন্য হাসছিলেন। ভাবটা এই ওরে পাগলি মেয়ে, এরকম করে নাকি? কথা বলবার সময় কৃষ্ণের গা দিয়ে পারিজাতের তীব্র গন্ধ বেরুছিল।

আর যায় কোথা! এতক্ষণ উলটে ফিরে বসেছিলেন সত্যভামা। এবার সামনে ফিরে মুখের ওপর কমল-কলির মতো হাত দুটি চাপা দিয়ে বললেন, ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে শোভসীত্যব্রবীহরি বলার সঙ্গে সঙ্গে চোখের জল গড়িয়ে পড়ল মাটিতে, যেন কমলকলি থেকে গড়িয়ে পড়ল তুষার-জলের বিন্দু! কৃষ্ণ না এই চেয়েছিলেন, ভালবাসার বৈদভী রীতি! কৃষ্ণ সত্যভামার চোখের জল নিজের হাতে ধরে বললেন, এ কী, তুমি এমন করে কাঁদছ কেন? এ কী চেহারা হয়েছে তোমার? মুখখানা এত ফ্যাকাসে, যেন সকালবেলার চাঁদ, ভর দুপুরে পদ্মফুল! তার ওপরে আবার এই সাদা শাড়ি, কেন তোমার সেই কুঙ্কুম লাল শাড়িটা কোথায় গেল, অথবা সেই সোনার বরণ শাড়িটা? কৃষ্ণ একটু ঠাট্টা-ইয়ারকিও করলেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। সুন্দরী সত্যভামা একটা কথাও বললেন না। হরিবংশ জানিয়েছে, সত্যভামা এমনিতেই খুব কম কথা বলেন, কিন্তু কম কথা বললেও অথবা না বললেও তার মুখের স্মিতহাসিটি কিন্তু থেকেই যায়– স্মেরেণুবহুভাষিণা এবং সেটা কিন্তু বিদগ্ধা ব্যক্তিত্বময়ী রমণীর লক্ষণ বটে। কিন্তু সমস্যা এই যে, বৈদগ্ধ্যের এই পরমেপ্সিত লক্ষণ যখন স্বামী হিসেবে নিজের ওপরেই ঘুরে আসে, তখন তাকে সামাল দেবার জন্য বিদগ্ধ পুরুষকেও অন্য রাস্তা দেখতে হয়।

কৃষ্ণ এবার অন্য রাস্তা ধরলেন, যাতে আস্তে আস্তে সেই কথাটায় আসা যায়, যার জন্য সত্যভামা এত অভিমান করে বসে আছেন। কৃষ্ণ বললেন, কী এমন অন্যায়টা করলাম আমি,–কিমকামহং দেবি– যাতে তুমি এত কষ্ট দিচ্ছ আমায়? আমি মনে এবং মুখে কোনওদিন কি তোমায় অতিক্রম করেছি– ন ত্বামতিচরাম্যহম্? কৃষ্ণ এবার আসল কথায় এলেন। বললেন, হতে পারে সমাজের নিয়মে আমার অনেকগুলি স্ত্রী! আমি কর্তব্যের খাতিরে সবার প্রতি সমান ব্যবহারও করি। কিন্তু তুমি! তোমার ব্যাপারে যে আমার বিশেষ পক্ষপাত আছে, আদর-ভালবাসাও যে অনেক বেশি, সেটা তো নিশ্চিত। আমার অন্য কোনও স্ত্রীই এই প্রশ্রয় ভোগ করে না– স্নেহ বহুমানশ্চ ত্বামৃতেহন্যাসু নাস্তি মে। জেনে রেখো, আমি মরে গেলেও তোমার ওপর এই বিশেষ ভালবাসা আমার যাবে না– নৈব ত্বং মদনোজহ্যান্থতেহপি ময়ি মামকঃ। এখানে এই সংস্কৃত শ্লোকাংশে ‘মদন’ কথাটার ব্যবহার বড় সাংঘাতিক। মদন’ শব্দটা তো আজকাল খুব কুৎসার্থে ব্যবহৃত এবং প্রায়শই জুগুপ্সায় স্পষ্টভাবে উচ্চারিতই হয় না। বিশেষত বাংলা কথ্য ভাষায় ‘মদন’ শব্দটির এমন একটা ‘সেম্যান্টিক’ অপকর্ষ ঘটেছে যে, উচ্চারণ মাত্রেই এই শব্দের একটা বোকা-বোকা যৌন তাৎপর্য ফুটে ওঠে। হ্যাঁ, এটা অবশ্যই মানতে হবে যে, মদন শব্দের ধাতু-প্রত্যয়গত অর্থের মধ্যেই একটা স্থল শরীর আভাস আছে যেন, তার ওপরে কুমারসম্ভবকাব্যে পার্বতীর শরীরে মদনদেবের শারীরিক অধ্যাস ‘মদন’ শব্দটার মধ্যেই এমন একটা শরীর-শরীর গন্ধ নিবেশ করেছে যে, আধুনিক কালে শব্দটার মূল তাৎপর্যই নষ্ট হয়ে গেছে। হ্যাঁ, যে ধাতু থেকে শব্দটা এসেছে, সেই মদ ধাতুর অর্থ অবশ্যই মত্ত করে তোলা এবং স্ত্রী-শরীরই তার প্রথাগত এবং পরম্পরাগত মাধ্যম, যাতে পুরুষ শারীরিকভাবে মত্ত হয়। কিন্তু সবার ওপরে এটাও তো ঠিক যে মত্ত অথবা প্রমত্ত হয়ে ওঠা– যেটা পুরুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং প্রমত্ত করে তোলা যেটা অধিকাংশ স্ত্রীলোকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সেটা প্রধানত একটা মানসিক প্রক্রিয়া এবং প্রেম-ভালবাসা সেখানে এক অন্তরঙ্গ ফল। এখানে শারীরিক যৌনতার কোনও প্রসঙ্গ নেই, এমন ভাবাটা বাড়াবাড়ি কথা হয়ে যাবে, কিন্তু মানসিক আবেশের একটা গভীর অংশও যে এখানে আবিষ্ট আছে এবং তা যে প্রেম-ভালবাসাই বটে, তা প্রমাণ হয়ে যায় যখন রূপ গোস্বামীর মতো মহামতি রসশাস্ত্রকার ‘মদন’ শব্দ থেকেই ‘মদিনাখ্য মহাভাবে’র সংজ্ঞা তৈরি করেন। সেই ‘মাদন’ নামের মহাভাবের বসতি আবার কৃষ্ণপ্ৰেষ্ঠা রাধারানির মধ্যেই, যাঁর কৃষ্ণেকনিষ্ঠ প্রেম নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। ঠিক এই ভাবনায় বিচার করলে কৃষ্ণ যখন বলেন, আমি মরে গেলেও তোমার ওপরে আমার এই মদন-ভাব অথবা এই মত্ততা কোনওদিন নিরস্ত হবে না, তখনই বোঝা যায়, কৃষ্ণের মহিষীকূলে অন্য সমস্ত স্ত্রী তো বটেই, এমনকী পাটরানি রুক্মিণীর নিয়মমাফিক মর্যাদার চেয়েও সত্যভামার মর্যাদা আলাদা।

এখানে খানিক অপ্রাসঙ্গিক হলেও রূপ গোস্বামীর কথায় ফিরে আসতে হবে আমাকে, কেননা সত্যভামার প্রেম-ভালবাসার কথায় তার সাক্ষীটাও খুব জরুরি। রূপ গোস্বামী একটা নাটক লিখবেন বলে ঠিক করছিলেন, যার মধ্যে কৃষ্ণের বৃন্দাবন-লীলা এবং দ্বারকার মহিষীদের নিয়ে সেখানকার পুরলীলা একাধারে বর্ণিত হবে। এমনিতে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে কৃষ্ণের বৃন্দাবন-লীলাই চরম সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, দ্বারকাস্থিত কৃষ্ণের মহিষীরা বৃন্দাবনের রাধা-চন্দ্রাবলীর কাছে একেবারেই গৌণ-মানে থাকেন। রূপ গোস্বামী এই ব্যাপারে খানিক রসশাস্ত্রীয় তথা দার্শনিক সমাধান করতে গিয়ে বৃন্দাবন-দ্বারকার পটভূমি মিশিয়ে একটি নাটক লেখার পরিকল্পনা করেন। বৃন্দাবনে থাকার সময়েই তিনি নাটকের আরম্ভ করে দিয়েছিলেন, কিন্তু হঠাৎই ছোট ভাই অনুপমের শরীর-খারাপের খবর শুনেই বোধহয় রূপ-সনাতন দুই ভাই বাংলায় এলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। ছোট ভাই অবশ্য তারা আসার পরেই মারা গেলেন এবং আর কিছু করণীয় না থাকায় রূপ একাকী রওনা হলেন পুরীতে, চৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গে দেখা করার জন্য। নাটক লেখার পরিকল্পনা এবং ভাবনা কিন্তু মনের মধ্যে রয়েই গেছে রূপের এবং পথ চলতে চলতে বিশ্রামের স্থানগুলিতে কিছু কিছু ‘নোট’ও করে রাখছিলেন তিনি। এর মধ্যে পুরী যাবার পথে যখন উড়িষ্যার সীমানায় ঢুকে পড়েছেন রূপ, তখন একদিন তাকে রাত্রিবাস করতে হল উড়িষ্যার সত্যভামাপুর নামে একটি গ্রামে। এমনিতেই নাটকের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে সত্যভামার বিভিন্ন ভূমিকা আছে। সেসব নিয়ে বিশেষ চিন্তিত ছিলেন রূপ। তার মধ্যে। ব্ৰজপুরের রাধারানির পাশাপাশি দ্বারকার সত্যভামাকে নিয়ে আসাটা বৈষ্ণব জগতের তাত্ত্বিক দার্শনিকেরা কীভাবে গ্রহণ করবেন সে বিষয়েও তার দুশ্চিন্তা ছিল। রাত্রিতে যখন সত্যভামার নামাঙ্কিত ভূমিকাতেই তিনি নিদ্রাতুর হলেন, তখন স্থানমাহাত্মের কারণেই তাকে যেন স্বপ্নে দেখা দিলেন সত্যভামা। তিনি বললেন, একটা নয়, দুটো নাটক লিখতে হবে তোমাকে। অন্তত যে নাটকে আমি থাকব, সেটা তুমি আলাদা করে দাও। আমাদের ধারণা, রূপ গোস্বামীর অন্তরস্থিত সত্যভামা বোধহয় ভয়ে ভয়েই ছিলেন যে, রাধাপ্রেমের শ্রেষ্ঠত্ব-ভাবনায় ভাবিত গৌড়ীয় রসশাস্ত্রের লেখায় সত্যভামা উপযুক্ত স্থান পাবেন কিনা!

সত্যভামার আজ্ঞায় রূপ গোস্বামী দুটি পৃথক নাটক রচনা করলেন এবং দ্বিতীয় নাটক ললিতমাধবে সত্যভামাকে রূপ নিয়ে এলেন অসাধারণ নাটকীয় প্রক্রিয়ায়। এই নাটকের প্রথমাংশে বৃন্দাবনের রাধা-চন্দ্রাবলীসহ ললিতা-বিশাখা ইত্যাদি অষ্ট সখীকে নানান প্রেম ভূমিকায় দেখতে দেখতে হঠাৎই এঁদের ক্রীড়ার স্থান পরিবর্তন হয়ে যায় অলৌকিকভাবে এবং এঁরা সবাই “রিসারেক্ট’ বা ‘রি-ইনকারনেট’ করেন দ্বারকার অষ্টমহিষী হিসেবে। এখানে এই ভূমিকা পরিবর্তনে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হল, বৃন্দাবনে কৃষ্ণের শ্রেষ্ঠতমা রাধা যখন দ্বারকা-লীলায় প্রকাশিত হলেন, তখন দ্বারকার সবচেয়ে মর্যাদাময়ী পট্টমহিষী রুক্মিণীর মধ্যেই তার প্রকাশ সম্ভাব্য ছিল। কিন্তু রূপ এই শাস্ত্রীয় ব্যাকরণ পালটে দিয়ে বৃন্দাবনের দক্ষিণা নায়িকা চন্দ্রাবলীর প্রবেশ ঘটালেন রুক্মিণীর মধ্যে, আর রাধাকে প্রকাশ করলেন সত্যভামার ভূমিকায়। সমগ্র বৈষ্ণব রসতত্ত্বে রূপ গোস্বামী অন্যদের চেয়ে একেবারে বিলক্ষণ এবং অত্যন্ত নিষ্ণাত বলেই তিনি মর্যাদার ব্যাকরণ অতিক্রম করে রস-ভাবের সূক্ষ্ম অনুভূতিতে সত্যভামাকে রাধার বামতা-বৈদগ্ধ্যের মহিমায় বুঝতে পেরেছিলেন। একদিকে ভক্তিরসামৃতসিন্ধুর মতো রসশাস্ত্রীয় গ্রন্থে তিনি যে বিশ্বাসে কৃষ্ণমহিষী মধ্যে সত্যভামাকে শ্রেষ্ঠতমা হিসেবে নির্ধারণ করেছেন– সত্যভামোত্তমা স্ত্রীণাং সৌভাগ্যে চাধিকাভবৎ তেমনই অন্যদিকে সত্যভামাকে রাধার সমকক্ষায় বসিয়ে তাকে বৈবাহিক জীবনের চিহ্নিত জড়তাগুলি থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং এখানেই তার শ্রেষ্ঠত্ব।

আজকে কৃষ্ণের মতো বিশাল এক ব্যক্তিত্বকে কিন্তু সব কাজ ফেলে ছুটে আসতে হয়েছে সত্যভামার ক্রোধগৃহে এবং যিনি শত শত রাজরাজড়াদের কথার যুক্তিতে ধন্য করেন, তার কথা, যুক্তি এমনকী অনুনয়ও কোনও কাজে আসছে না সত্যভামার কাছে। এটাকে নেহাতই এক সাধারণ দাম্পত্য জীবনের চিরন্তনী খুনশুটি বলে ধরে নিয়েও যদি এমন বলি যে, এরকম তো হয়েই থাকে, একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে– দাম্পত্যকলহে চৈব ইত্যাদি– তাহলেও বলব এই ব্যাপারটার সঙ্গে সত্যভামার সেই বিশাল বৈদগ্ধ্যের মিশ্রণ আছে, ব্যাপারটা অত সোজা নয়। কৃষ্ণ বললেন, চাঁদের জ্যোৎস্না সূর্যের তাপ আর আগুনের দীপ্তি যেমন স্বাভাবিক তেমনই তোমার ওপর আমার ভালবাসা। ভাবটা এই, কোথায় কাকে একটা পারিজাত ফুল দিলাম, তাতেই তুমি এতসব ভেবে বসে আছ– কান্তিশ্চ শাশ্বতী চন্দ্রে তথা ত্বয়ি স্নেহ মম।

সত্যভামা এবার চোখ মুছলেন। এবার বুঝি মানিনীর কথা বলার অবসর হল। সত্যভামা বললেন, আমারও এই ধারণা ছিল যে, তুমি শুধু আমারই– মদীয় স্মৃমিতি–কিন্তু আজ বুঝলাম, আমার ওপর তোমার ভালবাসার মধ্যে কোনও বিশেষ নেই, সবার সঙ্গে আমি সমান। যতদিন আমি বেঁচে থাকব, ততদিন তোমাকেই আমি দ্বিতীয় আত্মা বলেই ভেবে এসেছি। কিন্তু আজ তোমাকে আমি চিনে নিয়েছি– এ-ব্যাপারে বেশি কথা বলে কোনও লাভ নেই– কিমত্র বহুনোক্তেন হৃদয়ং বেঘ্নি তেহচ্যুত।

যে-কোনও অন্যায়জাত অভিমান-ঘটনার পর স্বামীরা চিরকালই চেষ্টা করেন নানা কথায় স্ত্রীদের ভোলাতে। আর কৃষ্ণ যতখানি নায়ক বটে, তার চেয়ে বাগ্মী অনেক বেশি। কথা এবং যুক্তি দিয়ে তিনি সমস্ত বিপক্ষতা ভুলিয়ে দিতে পারেন, এটা তার প্রমাণিত ক্ষমতা। আর বাগ্মীপুরুষের ক্ষমতাটাকে স্ত্রীরা সব সময়ই ভয় পান। তারা ভাবেন, সেই বাগ্মিতা তাদের ওপরে প্রয়োগ করা হচ্ছে। সত্যভামা বললেন, সব তোমার কথার ঢঙ বাঙমাত্ৰমেব পশ্যামি– আমার ওপর ভালবাসাটাও তোমার লোকদেখানো, কিন্তু অন্যত্র এটা বড় স্বাভাবিক–তবান্যত্র ন কৃত্রিমঃ। সত্যভামা রুক্মিণীর ইঙ্গিত দিলেন ‘অন্যত্র’ শব্দটা উচ্চারণ করে। তিনি বললেন, যা দেখলাম আজ, তা তো আর পালটাবে না, কিংবা যা শুনলাম, তাই কি পালটাবে কোনওদিন অথবা ভালবাসার প্রকাশ কীভাবে হয় তাও তো আজ প্রত্যক্ষ দেখলাম। ইঙ্গিত– রুক্মিণীকে কৃষ্ণের পারিজাত উপহার– শ্রুতং চাপ্যথ যম্ভাব্যং দৃষ্টস্নেহফলোদয়ঃ। সত্যভামা এবার কৃষ্ণের রঙিন উত্তরীয়ের লম্বিত অংশটুকু তুলে নিয়ে মুখ ঢাকলেন অশ্রু সংবরণ করার জন্য গ্রহায় পীতং হরিবাসসঃ শুভা/ পটান্তমাধায় মুখে শুচিস্মিতা। সত্যভামা এবার একটু শিথিল হলেন বোধহয়। কারণ তিনি কথা বলছেন, প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন। কৃষ্ণ বুঝতে পারছিলেন যে, সত্যভামার রাগের মূল জায়গাটা ধরতে হবে। এমনিতে নিজের সম্বন্ধে তিনি ভীষণই নিশ্চিত। রুক্মিণী-জাম্ববতী এঁদের সঙ্গে তিনি তো অনেক কালই আছেন, কিন্তু তাদের তিনি অসম্মানও করেননি কখনও, আবার আপন প্রেমের প্রত্যয়ে এতটাই তিনি প্রতিষ্ঠিত যে, তাদের ধর্তব্যের মধ্যেও গণ্য করেন না। তা হলে রাগের কারণটা নিহিত আছে তার অবমাননে, সেটা কেমন করে, কোথায়, কোন মুহূর্তে ঘটল, কৃষ্ণ জানতে চান সেটা।

কৃষ্ণ সুযোগ বুঝে বললেন, আমার প্রাণের শপথ– শাপিতাসি মম প্রাণৈঃ- যদি আমার মরা মুখ দেখতে না চাও, তা হলে তোমার লেগেছে কোথায়– সেটা তোমার এই চিরভক্তকে বলতে দোষ আছে কোনও? সত্যভামা বললেন, তোমার ভালবাসার সৌভাগ্যে আমি যে সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবতী, এ গর্ব আমার তুমিই প্রতিষ্ঠা করেছিলে। আমি সকলের মধ্যে মাথা উঁচু করে চলতাম। ভাবতাম, তোমার স্ত্রীদের মধ্যে আমিই তোমার কাছে সবচেয়ে স্পৃহনীয়। কিন্তু এই সৌভাগ্য তো তুমিই প্রতিষ্ঠা করেছিলে– ত্বয়ৈব স্থাপিতং পূর্বং সৌভাগ্যং মম মানদ। কিন্তু আজ আমি সবার উপহাসের পাত্র। সবাই আমাকে যা-তা বলছে। নারদ তোমাকে হাজার মণিরত্নের চেয়েও মূল্যবান স্বর্গের পারিজাত ফুল দিয়েছিলেন, আর তুমিও নাহয় সৌজন্যবোধে তোমার অতিপ্রিয় পট্টমহিষী রুক্মিণীকে সেটা দিয়ে নিজের প্রেম এবং প্রশংসা প্রকাশ করেছ। তাতে কিছু মনে করার নেই। কিন্তু তোমার সামনেই নারদ তোমার প্রিয়তমা মহারানির স্তুতি-প্রশংসা আরম্ভ করলেন এবং তুমি প্রেমানন্দে পরম পুলকে সেই ভূয়সী প্রশংসা শুনতে আরম্ভ করলে, এটাতেও আমার কিছু বলার নেই তমশ্রেীষীশু হৃষ্টং প্রিয়ায়াঃ সস্তবং কিল। কিন্তু আমার শুধু জিজ্ঞাসা হয়, নারদের সেই স্তুতি-নতি-প্রশংসার মধ্যে এই অভাগিনীর নাম উচ্চারিত হল কেন– দুৰ্ভগগাহয়ং জনস্তত্ৰ কিমর্থ অনুশব্দিতঃ? সারা জীবনে বিচিত্র বহু রমণীর অভিজ্ঞতার নিরিখে কৃষ্ণ এটা জানেন যে, স্ত্রীলোক কখনও তুলনা পছন্দ করে না। অন্য বাড়ির অন্য ঘরের স্ত্রীলোকের সঙ্গে তুলনাই যেখানে স্বাভাবিক নিয়মে এত অপছন্দ, সেখানে সপত্নীর সঙ্গে তুলনায় কী হতে পারে?

সত্যভামা বললেন, হতেই পারে, হতেই পারে রুক্মিণীর ওপর নারদের অনেক শ্রদ্ধাভক্তি আছে, তিনি রুক্মিণীর প্রশংসা করছেন নিজের অভিলাষে– কামং কামোহস্তু তস্যৈব– কিন্তু আমার রাগের বিষয় হল, তুমি তো সেই প্রশংসা বসে বসে শুনছিলে এবং তোমার সামনেই সে এই কথা বলে গেল যে, আজকে সাত্রাজিতী সত্যভামার খোতা মুখ ভোঁতা হয়ে গেল। তুমি রুক্মিণীর সামনেই বসে বসে শুনেছ এ-কথা– সান্নিধ্যং তব তত্র তৎ। রুক্মিণী ভাল, রুক্মিণী ভাল থাকুন, আমার দুর্ভাগা নামটা সেখানে আসে কেন– দুর্ভগগাহয়ং জনস্তত্ৰ কিমর্থম অনুশব্দিতঃ। আর তুমি তো জানোই, লোকে বলে, সংসারে মানের জন্যই মান নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। এমন মানহীন জীবন নিয়ে আমি আর বাঁচতে চাই না– তদেবং সতি নেচ্ছামি জীবিতুং মানবর্জিতা। সত্যভামার ক্রোধের জায়গাটা ভীষণ রকমের সূক্ষ্ম। মানের চাইতেও সেটা বোধহয় ঈর্ষা কিনা কে জানে? কিন্তু সত্যভামা রুক্মিণীকে ঈর্ষা করেন না, ঈর্ষার যোগ্যই মনে করেন না তাকে। কিন্তু আজ কোনওভাবে কৃষ্ণের সামনে তার নাম প্রতিতুলনায় উচ্চারিত হওয়ায় এবং কৃষ্ণ সেখানে নিরুত্তর বসে থাকায় রাগটা তার কৃষ্ণের ওপরই হচ্ছে। প্রেমের ক্ষেত্রে তিনি আর সুরক্ষিত বোধ করছেন না। কৃষ্ণকে বলেছেন সে-কথা– যার কাছে আমি সবরকমের সুরক্ষা পেতাম, আজ তাকে দেখে আমার ভয় করছে, সে আর আমাকে রক্ষা করে না। কত অবহেলায় আমার নাম উচ্চারিত হয়, অথচ তার ভাবান্তর হয় না- সর্বতো রক্ষতে যো মাং স মাং নাদ্যাভিরক্ষতি। হায়! এমন অবহেলায় কোথায় যাব আমি! সত্যভামা বলেই চললেন, বলেই চললেন। একসময় ফুরিতাধরে চরম অভিমানের কথাটা জানিয়ে কৃষ্ণকে বললেন, তুমি, এই তুমিই একসময় বলেছিলে– সাত্ৰাজিতী! প্রিয়া আমার! তোমার চেয়ে ভালবাসার জন আর কেউ নেই আমার পৃথিবীতে– সাত্রাজিতি প্রিয়া নান্যা ত্বত্তো মেহস্তীতি বিদ্ধি মাম– সেই প্রতিজ্ঞা আজ কোথায় গেল, কৃষ্ণ? সেই মানুষটাই আর তেমন নেই, কাজেই কে আর স্মরণ করে সে কথা– যদবোচঃ ক তদ্যতম্ অথবা কঃ স্মরিষ্যতি?

সত্যভামা ভীষণরকমের অপমান বোধ করছেন। নারদ রুক্মিণীর প্রশংসা করেছেন, এতে কোনও ক্ষতি ছিল না তার মতে। এমনকী সেটা কৃষ্ণ শুনছেনও সম্মতিসূচক মৌনতায়, এতেও তার কিছু মনে করার ছিল না। কিন্তু যে মুহূর্তে তার নাম উল্লিখিত হল অবহেলায়, সাবমানে এবং কৃষ্ণ সেটা শুনলেনও, হয়তো নিছকই নৈর্ব্যক্তিক নিরুপায়তায়, কিন্তু সেটা সত্যভামার কাছে ভীষণই অপমানের হয়ে উঠেছে। সকলের কাছে আজ তিনি এমন ছোট হয়ে গেছেন বলেই সত্যভামা কৃষ্ণকে জানিয়েছেন– সবার চাইতে আমি তোমার কাছে বেশি, এসব তো অনেক দূরের কথা, যেখানে তুমি আমাকে অন্য লোকের সমান বলেই মনে করো না, সেখানে কোথায় আমি, আর কোথায় আমার প্রেম– যৎ সমানাং জনৈর্দেবো মাং ন পশ্যতি নিত্যদা। সত্যভামা মনে করছেন যে রীতিমতো প্রবঞ্চনাই করা হয়েছে তাঁর সঙ্গে এবং সেটা কৃষ্ণই করেছেন। ফলে এখন কৃষ্ণ তার বাক্যের মধুরতায় যতই পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করুন, সত্যভামার কাছে তিনি এখন বামাত্রমধুরঃ শঠঃ।’ এই শঠতা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে কী করে? বলা যাচ্ছে, কেননা সত্যভামা মনে করেন– বলা যায়– যেহেতু নারদ যখন রুক্মিণীর প্রশংসা করছিলেন এবং সত্যভামাকে হেয় করছিলেন, তখন কৃষ্ণের গলা দিয়ে স্বর বেরোয়নি, উচ্চারিত হয়নি কোনও প্রতিবাদের বর্ণ, কোনও অসন্তোষ প্রকাশিত হয়নি তাঁর চোখের ভাষায়, অথবা হাত-পায়ের নাড়াচাড়ায় অথবা কোনও ইশারায় স্বরবর্ণেঙ্গিতাকারৈনিগূঢ়া দেব যত্নতঃ।

আমরা জানি বোধহয় যে, প্রণয়িনীর এমনতর অভিমানের মুখে নিজেকে সযৌক্তিক প্রমাণ করার কোনও উপায় থাকে না পুরুষের। অতএব একেবারেই সব পৌরুষ বিসর্জন দিয়ে কৃষ্ণ বললেন, এমন করে আর বোলো না তুমি। আর তোমাকে বেশি কথা না বলেও জানাই, আমি তোমারই–কিমত্র বহুনোক্তেন ত্বদীয়মবগচ্ছ মাম। এরপর নিজেকে প্রমাণিত করার শেষ চেষ্টা হিসেবে কৃষ্ণ এবার একটা মিথ্যে কথা বললেন সত্যভামাকে। বললেন, নারদমুনি আমাকে পারিজাত-পুষ্প উপহার দিলে রুক্মিণী সেটা আমার কাছে চেয়েছিলেন, আর আমিও স্বামী-সুলভ উদারতায় সেটা তার হাতে দিয়েছি– দাক্ষিণ্যাদ অনুরোধাচ্চ দত্তবান্নাত্ৰ সংশয়ঃ- আর সেটা যদি একটা মস্ত অপরাধ হয়ে থাকে, তবে সেই একটা অপরাধ তুমি ক্ষমা করো। তুমি খুশি হও এবার। আমরা জানি, কৃষ্ণ একটু মিথ্যে কথা বলেছেন এবং এই মিথ্যের মাহাত্ম্য আমরা বুঝি দাম্পত্য-কলহে নিজেকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যে বলায় দোষ নেই– স্বয়ং মহাভারত এ ব্যাপারে বিধান দিয়েছেন স্ত্রীষু রাজন ন বিবাহকালে। কিন্তু সেই ‘জাস্টিফিকেশনেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। সত্যভামার মান ভাঙানোর জন্য আরও অভিনব কিছু করতে হবে। কৃষ্ণ বললেন, পারিজাত ফুল যখন তোমার এতই পছন্দ, তা হলে পারিজাতের গোটা গাছটাই আমি স্বর্গের নন্দনকানন থেকে উপড়ে এনে তোমার ঘরের দুয়ারে পুঁতে দেব আমি– গৃহে তে স্থাপয়িষ্যামি যাবৎ কালং তুমিচ্ছসি? সত্যভামা বললেন, হ্যাঁ, তাই যদি তুমি করতে পারো, তবেই আমার জ্বালা কমে, আর তাতেই তোমার সমস্ত মহিষীদের মধ্যে আমি যে সবার ওপরে আছি, সেটা বুঝব– সীমন্তিনীনাং সর্বাসাম অধিকা স্যামসোজ।

অতঃপর স্বর্গ থেকে পারিজাত-পুষ্প উপড়ে আনার যে প্রক্রিয়া শুরু হল, সেটা আর এক অধ্যায় এবং এই প্রক্রিয়ার পূর্ব ঘটনায় হরিবংশ এবং বিষ্ণুপুরাণের বক্তব্যে কিছু তফাত আছে। বিষ্ণুপুরাণে দেখা যাচ্ছে, কৃষ্ণ প্রাগজ্যোতিষপুরে নরকাসুরকে বধ করতে গেছেন এবং তার সঙ্গে একই গরুড়াসনে যুদ্ধক্ষেত্রে চলে গেছেন সত্যভামা। যুদ্ধ-শেষে নরকাসুর যে শত-সহস্র দেব-গন্ধর্ব-মানুষী কন্যাদের হরণ করে এনে মণি পর্বতে লুকিয়ে রেখেছিল, সেই মণিপর্বতটাকেই গরুড়ের পিঠে চাপিয়ে নিলেন কৃষ্ণ দ্বারকায় নিয়ে যাবার জন্য। আর নিলেন দেবমাতা অদিতির কুণ্ডল, যেটা নরকাসুর দেবতাদের যুদ্ধে হারিয়ে দেবমাতা অদিতির কান থেকে ছিঁড়ে নিয়ে এসেছিলেন। কৃষ্ণ ঠিক করলেন দ্বারকা যাবার পথে দেবমাতা অদিতিকে ওই কুণ্ডল ফেরত দিয়ে তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে দ্বারকায় ফিরবেন। সেই ভাবনায় স্বর্গে গিয়ে কুণ্ডল ফেরত দেবার পরেই বিপদটা ঘটল।

বিদায় নেবার জন্য কৃষ্ণের পরে সত্যভামাও অদিতিকে প্রণাম করে আশীর্বাদ চাইলেন দেবমাতার কাছে। অদিতি আশীর্বাদ করে বললেন, আমার অনুগ্রহে তোমার শরীরে বুড়ো বয়সের কোনও ছাপ পড়বে না কোনওদিন, চেহারায় আসবে না কোনও বিরূপতা– জরা বৈরূপ্যমেব চ– আর চিরটাকাল তোমার যৌবন থাকবে সুস্থির ভবিষ্যত্যনবদ্যাঙ্গি সুস্থিরং নবযৌবনম্। এর থেকে বড় আশীর্বাদ এক বিবাহিত রমণীর কাছে আর কীই বা হতে পারে। এমনিতেই সত্যভামা কৃষ্ণের অন্য মহিষীদের তুলনায় কিছু অধিক যৌবনবতী ছিলেন বলে মনে করি, কিন্তু এই শারীরিক আশীর্বাদের চেয়েও সত্যভামার ব্যক্তিত্বই যে তাকে সবার চাইতে বিলক্ষণ করেছে, সেটা এক্ষুনি টের পাওয়া যাবে পারিজাত-হরণের বিষ্ণুপুরাণীয় বর্ণনায়।

দেবমাতা অদিতির পর দেবরাজ ইন্দ্র এবং ইন্দ্রাণী শচীর সঙ্গে দেখা করে যাওয়াটা সৌজন্য বলেই কৃষ্ণ এবং সত্যভামা তাদের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন, এই সময় দেবরাজ স্বয়ং ইন্দ্রাণীর সঙ্গে নিজেরাই এসে উপস্থিত হলেন দেবমাতা অদিতির ঘরে। অদিতির অনুজ্ঞায় ইন্দ্র কৃষ্ণকে যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করলেন বটে, কিন্তু প্রোটোকল অনুযায়ী ইন্দ্রাণী যখন কৃষ্ণপ্রিয় সত্যভামাকে যথোচিত সমাদর করতে যাবেন, তখন সত্যভামার রূপ দেখেই হোক অথবা তার ব্যক্তিত্ব দেখেই হোক, তখন ইন্দ্রাণী শচী একটা কাণ্ড করে বসলেন। বস্তুত এক ব্যক্তিত্বময়ী রমণীর প্রতি অন্য ব্যক্তিত্বময়ীর ঈর্ষাই হয়তো এই কাণ্ডটা বাধাল, ইন্দ্রাণী শচী কৃষ্ণুপ্রিয়া সত্যভামাকে দেখিয়ে দেখিয়ে সদ্যছিন্ন পারিজাত-মঞ্জরী তার নিজের খোঁপায় গুঁজে দিলেন, কিন্তু সমুচিত সদাচার প্রদর্শন করে সত্যভামাকে সেই ফুল এগিয়ে দিলেন না। ভাবলেন, মর্ত্যভূমির এই সাধারণ মেয়ে এই পুষ্পের মর্যাদা কতটুকু বুঝবে– ন দদৌ মানুষীং মা স্বয়ং পুস্পৈরলংকৃতা।

সত্যভামা সব দেখলেন, আপাতত সহ্যও করে নিলেন এই অসৌজন্য, তারপর অমরাবতী স্বর্গভূমি দেখতে বেরোলেন দু’জনে– কৃষ্ণ আর সত্যভামা। ঘুরতে ঘুরতে নন্দনকাননে এসে উপস্থিত হতেই সুগন্ধে তাদের শরীর-মন ভরে গেল। পারিজাতের গাছ। এবং ফুল, দুটোই দেখতে যেমন ভাল, তেমনই গন্ধে একেবারে ভরপুর। পারিজাত পুষ্পের সম্ভার দেখে সত্যভামা এবার কৃষ্ণকে বললেন, এই গাছটা তুমি স্বর্গ থেকে নিয়ে গিয়ে দ্বারকার মাটিতে পুঁতে দাও না কেন– কম্যান্ন দ্বারকামেষ নীয়তে দেবপাদপঃ? সত্যভামার প্রথম কথায় খুব একটা আমল দিলেন না কৃষ্ণ। তা ছাড়া দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে এসে তার সঙ্গে অনর্থক একটা ঝুট-ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চাইলেন না কৃষ্ণ। তবে শচী ইন্দ্রাণী সত্যভামার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছেন সেটা কৃষ্ণ দেখেছেন এবং মনেও রেখেছেন। কিন্তু কৃষ্ণ খুব একটা সাড়া দিচ্ছেন না দেখে সত্যভামা এবার তার একান্ত আপন সেই অভিমান-পন্থা নিলেন। তিনি বললেন, তোমার সেই মুখের কথাটা যদি সত্যি হয়, তুমি না বারবার বলো এই কথা যে, ‘সত্যা! তুমি আমার কাছে সবার চাইতে প্রিয়– যদি তে তদ বচঃ সত্যং সত্যাত্যর্থং প্রিয়েতি মে’– তা হলে আমার এই কথাটা তোমার শুনতে হবে। এই পারিজাত বৃক্ষ তুমি নিয়ে যাবে দ্বারকায়। সেখানে আমার গৃহ-সংলগ্ন উদ্যানটিতে এই গাছ আমি পুঁতে দেব– মদগেহ-নিদ্ভুটাৰ্থায় তদয়ং নীয়তাং তরু।

হরিবংশের জবান থেকে এখানে একটু আলাদাই হল বটে। এই গ্রন্থে মহিষী-প্রথমা রুক্মিণীর প্রতি ঈর্ষায় সত্যভামা চরম অভিমানিনী হলে কৃষ্ণ নিজেই বলেছিলেন যে সত্যভামার প্রীতির জন্য তিনি পুরো পারিজাত বৃক্ষটাই উপড়ে নিয়ে আসবেন দ্বারকায়। কিন্তু বিষ্ণুপুরাণে সত্যভামা নিজেই বায়না ধরেছেন পারিজাত বৃক্ষ দ্বারকায় নিয়ে যাবার জন্য, যদিও এখানেও তার ক্রোধ উদ্দীপিত করেছেন অন্যতরা এক রমণী, তিনি স্বর্গীয়া। পারিজাত পুষ্প নিয়ে ইন্দ্রাণী শচীর অহংকার চূর্ণ করার মানসের সঙ্গে সত্যভামা কিন্তু সপত্নীদের ওপর, বিশেষত প্রধানা রুক্মিণীর ওপর নিজের মর্যাদা-প্রতিষ্ঠার কাজটাও সেরে নিচ্ছেন একই সঙ্গে। তিনি কৃষ্ণের মুখের কথা উদ্ধার করে তাঁকে জানালেন, কৃষ্ণ! একথা একবার মাত্র তুমি বলোনি, যাতে আমি ভেবে নিতে পারি যে, কোনও মুহূর্তের আতিশয্যে তুমি আমাকে বেশি ভালবেসে ফেলেছ। বহুবার তুমি আমাকে বলেছ, রুক্মিণী, জাম্ববতী কেউ আমার তেমন ভালবাসার মানুষ নন, যতটা তুমিন মে জাম্ববতী তাদৃগ অভীষ্টা ন চ রুক্মিণী। জানি না, এসব কথা কথার ঝেকেই তুমি আমাকে বলেছিলে কিনা, নাকি এসব কথা আমাকে প্রলুব্ধ করার জন্য স্তোকবাক্য হিসেবে বলেছিলে, অথবা আমি যা ভাবছি তা নয়, তুমি সত্যিই যদি আমাকে ভালবেসে এইসব কথা বলে থাকো– সত্যং তদ যদি গোবিন্দ নোপচারকৃতং তব– তা হলে আমি যেমনটি চেয়েছি, এই পারিজাত বৃক্ষ আমারই ঘরের দাওয়ায় পুঁতে দিতে হবে। এবার ফুল ফুটবে দ্বারকায়, ফুল ফুটবে আমারই উঠোনে, আর সেই ফুল খোঁপায় গুঁজে আমি রুক্মিণী, জাম্ববতী সবার সামনে, সবার মধ্যে ঘুরে বেড়াব– সপত্নীনাম অহং মধ্যে শোভেয়মিতি কাময়ে।

কৃষ্ণ আর বেশি কথা বাড়াননি। সত্যভামাকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে তিনি গোটা পারিজাত বৃক্ষটাকেই তুলে নিলেন গরুড়ের পিঠে আরোপয়ামাস হরিঃ পারিজাতং গুরুত্মতি– কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না, কারও অনুমতি নিলেন না– না ইন্দ্রের, না ইন্দ্রাণীর। কৃষ্ণের এই আকস্মিক সাহসী আচরণে বিহ্বল নন্দনকাননের বনরক্ষীরা কৃষ্ণকে বারবার এই বলে সাবধান করে দিল যে, এই গাছ ইন্দ্রপ্রিয়া শচীদেবীর গাছ, দেবতারা অমৃতমন্থন করার সময় শচীর কেশভূষণের জন্য এই দেববৃক্ষ তুলে এনেছিলেন– শচীবিভূষণার্থায় দেবৈরমৃতমন্থনে। এটাকে নিয়ে আপনি খুব সহজে যেতে পারবেন না এখান থেকে। কৃষ্ণ যদি ভাবেন, ইন্দ্র হলেও হত, একটি স্ত্রীলোকের ঈপ্সিত বৃক্ষ একটু জোর করে তুলে নিয়ে গেলে কী আর হবে, এমন একটা পূর্বপক্ষ ভেবে নিয়েই রক্ষীরা কৃষ্ণকে বলল, দেখুন! দেবরাজ ইন্দ্র সদাসর্বদা শচীর মুখ চেয়ে আছেন, তাঁর নিজের অধিকারের গাছটা আপনি তুলে নিয়ে গিয়েও কুশলে থাকবেন, এটা হবে না, মহাশয়– দেবরাজ-মুখপ্রেক্ষী যস্যাস্তস্যাঃ পরিগ্রহ।

বনরক্ষীরা কৃষ্ণকে উদ্দেশ করে কথা বললেন বটে, কিন্তু কথার উত্তর দিলেন সত্যভামা। এইরকম দাম্পত্য প্রেমে, দাম্পত্য জীবনে অনেক সময়েই হয়, বিশেষত যেসব ক্ষেত্রে স্ত্রীরা সূর্যতেজে তপ্ত বালুকারাশির সাধর্মে স্বামীর মর্যাদা, ঐশ্বর্য এবং ব্যক্তিত্বের প্রতিফলিত গৌরব নিজের মধ্যে অনুভব করেন, তারা কখনও কখনও স্বামীর চেয়েও অধিক প্রখর হন। প্রতিপক্ষের উষ্ণ মন্তব্য এঁরা স্বামী পর্যন্ত যাবার আগেই, স্বামী নরম হয়ে যেতে পারেন, তিনি ঝামেলা এড়িয়ে যেতে পারেন অথবা তিনি অধিক মর্যাদাবোধে উদাসীন নিরুত্তর থেকে যেতে পারেন- এসব আগাম ভেবে নিয়েই তারা স্বামীর আগেই উত্তর দেন। সত্যভামা অবশ্য এই ধরনের প্রখরা না হলেও কৃষ্ণের প্রেম-প্রশ্রয় তিনি সমধিক ভোগ করেন। বিশেষত এখানে বনরক্ষীরা পারিজাত-পুষ্পকে ইন্দ্রাণী শচীর ‘পরিগ্রহ’ বা অধিকারী বলায় সত্যভামা ঈর্ষা এবং অসূয়ায় অধিক দগ্ধ হয়েছেন। তার ওপরে শচীর পছন্দ এই পারিজাত রক্ষার জন্য ইন্দ্র তার স্ত্রীর মুখের দিকেই তাকিয়ে আছেন– একথা শুনে তার নিজের স্বামী এ-বিষয়ে কতটা উদ্যোগী হতে পারেন সত্যভামার জন্য, সেটাও বুঝিয়ে দিলেন সত্যভামা। সত্যভামা রেগে গেছেন– সত্যভামাতিকোপিনী।

তবে সত্যভামার কথায় মনস্বিতার যুক্তি দেখা গেল আগে। তিনি বনরক্ষীদের বললেন, পারিজাত পুষ্পের অধিকার নিয়ে যদি কথা বলিস, তা হলে এই শচীই বা কে আর এই ইন্দ্ৰই বা কে কা শচী পারিজাতস্য কো বা শক্ৰঃ সুরাধিপঃ? সমুদ্র মন্থন করে অনেক কিছুই উঠেছিল যা পৃথিবীর সর্বজনাভোগ্য সম্পদ। যেমন সুরা উঠেছে সমুদ্র থেকে, উঠেছে। চাঁদ, উঠেছেন লক্ষ্মী– এগুলি তো সর্বসাধারণের সম্পত্তি, পারিজাত পুষ্পও তাই সকলের প্রাপ্য হওয়া উচিত– সামান্যঃ সর্বলোকস্য পারিজাতস্তথা দ্রুমঃ। এই যুক্তির পর যদি শক্তিপ্রদর্শনের প্রশ্ন আসে সেখানে সত্যভামার উত্তর আরও কঠিন, আরও গর্বোদ্ধত। তিনি বললেন, দেখো রক্ষীরা! তোমরা তোমাদের মালকিনকে খবর দাও। ইন্দ্রাণী শচী যদি তার স্বামীর বাহুবলে স্ফীত হয়ে এই বৃক্ষহরণ রোধ করতে চান, তবে তোমরা সেইভাবেই তাকে বলো। বলো যে, আমি, আমি কৃষ্ণপ্রিয় সত্যভামা, আমি আমার স্বামীর শক্তিতে এই বৃক্ষ নিয়ে যাচ্ছি, তোমার ক্ষমার প্রয়োজন নেই এখানে– সত্যভামা বদত্যেত অতিগর্বোদ্ধতাক্ষর। তুমি যদি তোমার স্বামীর প্রিয় হও এবং তোমার স্বামী যদি তোমার কথা মেনেই চলেন, তা হলে জানাও শচীকে যে, আমার স্বামী এই দেববৃক্ষ হরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন, তোমাদের ক্ষমতা থাকে তো আটকাও– মদভর্তুৰ্হরতো বৃক্ষং তৎ কারয় নিবারণ। তোমাদের দেবতাদের সামনে আমি মানুষী হয়ে এই বৃক্ষকে হরণ করাচ্ছি, এটাই আমার ক্ষমতা মানুষী হারয়ামি তে।

পারিজাত-হরণের এই প্রসঙ্গে সত্যভামার এই গর্বোক্তির মধ্যে একটা পৌরাণিক অভিসন্ধিও আছে, সেটা জানি! মানে, কৃষ্ণাবতারের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য বৈদিক পরম্পরায় আগত ইন্দ্র-অগ্নি-বায়ু ইত্যাদি দেবতার ওপর কৃষ্ণের মর্যাদাধিক্য দেখানোটা একান্ত জরুরি হয়ে পড়ে। বিশেষত কৃষ্ণের মনুষ্য-স্বরূপটা যে সমস্ত দেবস্বরূপের চেয়েও অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, সেটা বোঝানোর জন্য সত্যভামার এই গর্বোক্তিগুলিকেই মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে বটে, তবে সত্যভামার চরিত্র এবং তার স্বামীগৌরবের মধ্যেও যে এই মাধ্যম হয়ে ওঠার বীজ নিহিত ছিল, সেটা বোঝানোও পুরাণকারদের একটা অভিসন্ধি বটে। সত্যভামা বনরক্ষীদের যেভাবে বলেছিলেন, তারা সেইভাবেই শচীর কাছে সত্যভামার গর্বভাবনা জানাল। ইন্দ্রাণী শচীর প্রোৎসাহনে ইন্দ্রও পারিজাত-বৃক্ষ রক্ষার জন্য বিশাল দেবসৈন্য সঙ্গে বজ্রহস্তে তৈরি হলেন।

ঈর্ষাঅসূয়ায় প্রসূত এই যুদ্ধ লাগল। বেদের বৃত্র-শম্বর-ঘাতক দেবরাজ মানুষ কৃষ্ণের সঙ্গে ভয়ংকর যুদ্ধ করলেন বটে, কিন্তু শেষ রক্ষা করতে না পেরে বজ্র নিক্ষেপ করবেন বলেই মন্ত্র পড়ে কৃষ্ণের উদ্দেশে ছেড়ে দিলেন বজ্র। কৃষ্ণ নির্দ্বিধায় সেই বজ্র হাত দিয়েই ধরে ফেললেন, কিন্তু নিজের চক্ৰায়ুধ ব্যবহার করলেন না তাই বলে। ইন্দ্র সভয়ে পালাতে লাগলেন, কিন্তু এইবার শুরু হল সত্যভামার বাক্যবাণ। সত্যভামা বললেন, আপনি না শচীর স্বামী, আপনাকে কি মানায় এইভাবে পলায়ন করা? বরঞ্চ দাঁড়ান, এই তো আপনার ইন্দ্রাণী শচী আপনার কাছে চলে আসবেন এক্ষুনি। তার মাথায় গোঁজা থাকবে পারিজাত ফুলের গুচ্ছ– পারিজাত-সুগাভোগা বামুপস্থাপস্যতে শচী। আর এটাও তো খুব ঠিক কথা যে, এক সময় যিনি পারিজাতের মালায় শোভাশালিনী হয়ে সপ্রণয়ে এসে দাঁড়াতেন আপনার সামনে, এখন যদি তাকে সেই আগের মতো না দেখে অন্যরকম দেখেন, তা হলে এই স্বর্গভূমি আর কোন সুখ বয়ে আনবে আপনার কাছে অপশ্যতো যথাপূর্বং প্রণয়াদাগং শচীম?

অস্ত্রহীন দেবরাজের প্রতি এতক্ষণ যে তির্যক প্রকারে তিরস্কার বর্ষণ করলেন সত্যভামা, তার মধ্যে বারবার ভেসে এসেছে ইন্দ্রাণীর সেই গর্বিত মুখচ্ছবি, যেখানে তিনি সত্যভামাকে দেখিয়ে দেখিয়ে পারিজাত পুষ্প নিজের মাথায় খুঁজেছিলেন এবং সত্যভামাকে সেটা দেননি। সত্যভামা শুধু সেই ঘটনাটা মনে করিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি পারিজাতের বৃক্ষ নিয়ে যান দেবরাজ, এতে কোনও প্রয়োজন নেই আমাদের। কিন্তু ঘটনাটা কী জানেন তো? শচী তার স্বামীর গর্বে স্ফীত হয়ে বড় অপমান করেছিল আমাকে, আমি আপনার ঘরে অতিথি হয়ে এসেছিলাম, সেখানে এই সামান্য সৌজন্যটুকু অপেক্ষিত ছিল। সেটা তিনি দেখাননি– ন দর্শ গৃহে যাতামুপচারেণ মাং শচী। আর ঠিক সেই কারণেই আমি স্ত্রীলোক বলেই হোক, অথবা রাজনীতির গভীরতা আমি অত বুঝি না বলেই হোক, আমি শুধু আমার স্বামীর গৌরব এবং ক্ষমতাটুকু সমঝে দিলাম মাত্র স্ত্রীত্বা অগুরুচিত্তাহং স্বভর্তৃশ্লাঘনাপরা– নইলে পরের ঘরের এই পারিজাত ফুল নিয়ে গিয়ে আমি কী করব? এই সম্পূর্ণ ঘটনায় ইন্দ্রাণী শচীর শুধু বোঝা উচিত ছিল যে, নিজের রূপ আর স্বামীর গর্বে গর্বিত হওয়ার স্বভাবটা শুধু তার বিলক্ষণ কোনও প্রাপ্তি নয়, সেটা সমস্ত রমণীরই স্বভাব এবং ভাবনা– রূপেণ গর্বিতা সা তু ভর্তা স্ত্রী কা ন গর্বিত। সত্যভামা পারিজাত-বৃক্ষ ফিরিয়ে দিয়ে কৃষ্ণের সঙ্গে চলে এলেন দ্বারকায়।

বিষ্ণুপুরাণে সত্যভামা শেষ দিকে রীতিমতো ভাল, শচীর অহংকার চূর্ণ করা-মাত্রেই তার শান্তি হয়েছে। কিন্তু হরিবংশ পুরাণে মানিনী সত্যভামার শুধু একটা কথা রাখার জন্য স্বর্গরাজ্যে দেবরাজের সঙ্গে কৃষ্ণের বিশাল যুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। স্বামী-সোহাগী সত্যভামা স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন। কৃষ্ণ তাঁকে ফেলে রেখে যেতে পারেননি। যুদ্ধের সময় কৃষ্ণের গর্বে ইন্দ্র এবং ইন্দ্রাণীকেও দু-চার কথা শোনাতে ছাড়েননি সত্যভামা। পারিজাতের অধিকার নিয়ে দীর্ঘকাল ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছিল। ইন্দ্রাণী আর সত্যভামার উতোর-চাপানে যুদ্ধটা ব্যক্তিগত ক্রোধে পর্যবসিত হয়েছিল। যুদ্ধ অবশ্যই কৃষ্ণের অনুকূলে শেষ হয় এবং স্বর্গের দেবরাজ হয়েও ইন্দ্র যখন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন, তখন কিন্তু কৃষ্ণ স্বীকার করেছেন যে, আমি শুধু বউয়ের কথা শুনেই তোমার নন্দন-বন থেকে উপড়ে নিয়ে গিয়েছি এই পারিজাতের গাছ গৃহীতোহয়ং ময়া শক্র সত্যাবচনকারণা।

তা যাক, বউয়ের কথা সবাই শোনে, কৃষ্ণও শুনেছেন। মুশকিল হল, কৃষ্ণ কতটা শোনেন, সেটা ভাষ্য দিয়ে বোঝাবার মতো জায়গা এটা নয়। তবু এই সামান্য পরিসরে যতটুকু আমি বোঝাতে চেয়েছি, তা হল, কৃষ্ণের অন্তঃপুরে যত রমণীই থাক, তার সংখ্যাতত্ত্ব আমার কাছে গৌণ। আমি শুধু বুঝি কৃষ্ণ প্রেমের রহস্য জানতেন। দাম্পত্য জীবনে যে খাড়া-বড়ি থোড়ের একঘেঁয়েমি আসে, অন্তত সেই কালেও সেটা তিনি বুঝেছিলেন বলেই একটি গৃহবধূ স্ত্রীর মধ্যেও তিনি প্রেমিকার সন্ধান চেয়েছিলেন। দিন-রাত স্বামীসেবার ব্রত নিয়ে থাকা দাম্পত্যের ছ্যাকড়া-গাড়ি টানার কথা সেদিনেও তিনি ভাবতে পারতেন না। কুজ নজ ঘর্মাক্ত গৃহস্থ-জীবনের মধ্যে অন্তত একটু নতুনত্ব আসুক– এই সমান অনুভূতিটুকু ছিল বলেই বোধহয় তিনি চাইতেন যে, প্রেমিকার মতো তার প্রিয়তমা পত্নীটিরও ঠোঁট ফুলে উঠুক অভিমানে, অপাঙ্গ অরুণিত হোক বক্রতায়, বাক্য শাণিত হোক বিদগ্ধতায়। কারণ, সত্যিই তো গৃহস্থ জীবনের গড্ডলিকায় প্রণয়িণী বধূর এই অন্যতর আচরণটুকুই তো একমাত্র নতুনত্ব, একমাত্র লাভ–অয়ং হি পরমো লাভো গৃহেষু গৃহমেধিনা। আর ঠিক এইজন্যই, এই ঘামে ভেজা প্যাঁচপ্যাঁচে জীবনটার মধ্যে এই সামান্য দখিনা বাতাসটুকু আমদানি করার জন্যই সত্যভামার গালি-শোনা গৃহস্থ কৃষ্ণকে আমরা পছন্দ করি।

খুব সহজ সরলভাবে সত্যভামাকে যেটুকু চেনা গেল, তাতে মনে হবে যেন কৃষ্ণ তার তিরস্কার-বক্রোক্তি শোনার ভয়েই তাকে ভালবাসতেন, যেন ভয়েই তাকে মাথায় তুলে রাখতেন। কিন্তু বাস্তবে যদি গভীরভাবে সত্যভামার চরিত্র অনুধাবন করেন, তা হলে দেখবেন কৃষ্ণের মতো বিশালবুদ্ধি তথা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের স্ত্রী হতে গেলে যে সমধর্মিতার প্রয়োজন হয়, সেটাই সত্যভামার ছিল এবং অন্যদের তা ছিল না।

মহাভারতে দ্রৌপদীর কাছে স্বামী বশ করার মন্ত্র শিখতে চেয়েছিলেন সত্যভামা। দ্রৌপদী উত্তর দিয়েছেন এই প্রশ্নের, তবে এই উত্তরের মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক এবং বাস্তবসম্মত যেটা, সেটা হল– মন্ত্র-তন্ত্র, ব্রত-হোম কিংবা বশীকরণের ওষুধ খাইয়ে কখনও স্বামীদের বশ করা যায় না–ন জাতু বশগো ভর্তা স্ত্রিয়াঃ স্যান্মন্ত্রকর্মণা। বরঞ্চ বশীকরণের ওষুধ বলে মেয়েরা যেসব ওষুধ স্বামীদের ওপর প্রয়োগ করে, তাতে স্বামীদের সত্যি-সত্যিই শারীরিক রোগ তৈরি হয় ওষুধের পার্শ্বক্রিয়া থেকে। দ্রৌপদী বলেছেন– এগুলো কোনও ভদ্রঘরের মেয়েদের কাজ নয়, আমি কখনওই এসব কাজ করি না– অসদাচরিতে মার্গে কথং স্যানুকীর্তনম। দ্রৌপদী এসব কাজ করেন না– এটা ঠিক আছে, কিন্তু যেসব কাজ করার ফলে স্বামীরা তার বশে আছেন বলে তিনি বলেছেন, সেগুলিও তিনি এতটুকু করেন বলে আমাদের মনে হয় না। প্রথমত দ্রৌপদীর এই উপদেশাবলি মহাভারতের পাঠ-শুদ্ধিবাদীরা গ্রন্থ থেকেই বর্জন করে দিয়েছেন, কিন্তু সেটা আমাদের কাছে কোনও বড় ব্যাপার নয়। কেননা এমন উপদেশ-পরামর্শ তিনি দিতেই পারেন। বিশেষত এইরকম একটা বিষয়ে যদি উপদেশ-পরামর্শই দিতে হয়, তা হলে সেটা সাধারণের পালনীয় হওয়া উচিত বলেই তার মধ্যে সর্বগ্রাহ্য একটা ‘ডাইডাটিভনেস’ থাকে। নইলে স্বামীকে হাতে রাখার উপদেশ হিসেবে তিনি যেসব কথা বলেছেন, সেগুলি যদি তার জীবনে এতটুকু পালিত হয়ে থাকে, সেগুলি তার চরিত্র অনুযায়ী একেবারেই গৌণ ব্যাপার এবং সেটা সত্যভামার সম্বন্ধেও একান্তভাবে সত্য। নইলে দেখুন, স্বামীরা স্নান না করলে দ্রৌপদী স্নান করেন না, স্বামীরা না খেলে দ্রৌপদী খান না অথবা স্বামীরা বাইরে থেকে এলে তিনি তাদের পা ধোয়ার জল এগিয়ে দেন অথবা তিনি বাসন মাজেন, রান্না করেন, শাশুড়ির মতে চলেন, গৃহকর্ম করেন, সকলের আগে সকালে ঘুম থেকে ওঠেন এবং সবার পরে তিনি শুতে যান– এই যে এতসব গৃহকর্মনিপুণা এক গৃহিণীর কর্ম– এগুলিই শুধু দ্রৌপদীর মতো এক মনস্বিনী রমণীর স্বামী বশ করার কৌশল– এটা আমরা মানতে পারলাম না।

আসল সত্যটা আপনাদের জানিয়ে বলি, উপরিউক্ত উপদেশাবলি একেবারে স্মৃতিশাস্ত্রোচিত পতিব্রতার ধর্ম কোনও কোনও সময়ে দ্রৌপদী পালন করে থাকতেও পারেন, কিন্তু সম্পূর্ণ মহাভারতের মধ্যে দ্রৌপদীর এই কর্মগুলির প্রতিফলন দরকার ছিল। অর্থাৎ আমরা বলতে চাই, সমগ্র মহাভারতের মধ্যে দ্রৌপদীর চরিত্রটা যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তাতে কোনও জায়গায় আমরা দ্রৌপদীকে বাসন মাজতেও দেখিনি, অথবা স্বামী বাড়ি ফিরলে পা-ধোয়ার জল দিতেও দেখিনি। তাকে মহাভারতের অসংখ্য বিচিত্রতার মধ্যে আপ্রবন্ধ স্থির যেভাবে দেখেছি, সেটি হল তার অসম্ভব ব্যক্তিত্ব– যে ব্যক্তিত্বে দূতসভায় বস্ত্রহরণের সময় তার চোখে চোখ পড়লেই পাণ্ডবরা ভয় পেতে থাকেন– স পাণ্ডবান্ কোপপরীতদেহান। সন্দীপয়ামাস কটাক্ষপাতৈঃ যে ব্যক্তিত্বে তর্কধ্বস্ত যুধিষ্ঠিরকে সারা বনবাস এবং অজ্ঞাতবাসের সময় জুড়ে দ্রৌপদীর জন্য দোষী বোধ করতে হয়, যে ব্যক্তিত্বে সমস্ত স্বামীদের সামনে কৃষ্ণের মতো পুরুষকে সখা সম্বোধন করে দোষারোপ করা যায়, অথবা যে ব্যক্তিত্বে লম্পট কীচকের সম্বন্ধে রাজসভায় একাকিনী গিয়ে অভিযোগ করা যায়, এই ব্যক্তিত্ব কিন্তু কোনওভাবেই ভোরে স্বামীদের আগে ওঠা, বাসন মাজা বা দরজার বাইরে গিয়ে না দাঁড়ানোর স্মার্ত সতীপনার ব্যক্তিত্ব নয়। বরঞ্চ আমি ব্যক্তিত্ব বলতে যে মানসিক দৃঢ়তা এবং মনস্বিতার কথা বলছি যাতে স্ত্রীলোকের মুখের ওপর, শরীরের ওপর ঝুলে থাকা যে প্রতীয়মান গম্ভীরতা তৈরি হয়, তাতে পুরুষের উৎকণ্ঠা আরও বাড়ে, যেমনটি দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে হয়েছে এবং একইভাবে তা সত্যভামার ক্ষেত্রেও হয়েছে পাণ্ডবরা দ্রৌপদীকে লাভ করে যেমন সুস্থির থাকেননি, তেমনই কৃষ্ণও সত্যভামাকে লাভ করে সুস্থির থাকেননি।

প্রসঙ্গত বলি, সত্যভামা বা দ্রৌপদীর মধ্যে যে মনস্বিতা এবং যে ব্যক্তিত্ব আমরা দেখেছি, সেটা কৃষ্ণ অথবা পাণ্ডবদের মতো বিরাট এবং মনস্বী স্বামীদের সঙ্গে দাম্পত্যের মর্মভাগিতা তৈরি করেছিল। হয়তো এইভাবে একটা শেয়ারড কনজুগালিটি তৈরি হয় যেখানে একের অনুপস্থিতিতে অন্যে নিজেকে একইভাবে প্রয়োগ করতে পারেন, অথবা বিপক্ষতার মাধ্যমেও নিজের যুক্তি অন্যতরকে দিয়ে গ্রহণ করাতে পারেন। সত্যভামা কৃষ্ণকে বলেছিলেন, আমার সম্মান নষ্ট হয়ে গেলে আমার আর বেঁচে থেকে লাভ নেই–তদেবং সতি নেচ্ছামি জীবিতুং মানবর্জিতা। অর্থাৎ সমস্ত অবস্থায় নিজেদের মর্যাদা নিয়ে ভাবিত থাকাটা এই ব্যক্তিত্বের অঙ্গ হিসেবে কাজ করে। ফলত এই ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশের জায়গাগুলো খুব সঙ্গত কারণেই ভীষণ রকমের সপ্রতিভ, এমনকী কখনও কখনও তা খানিক প্রগম্ভও বটে। একান্ত আনুগত্যে স্বামী সেবার চেয়েও আপাতদৃষ্টিতে স্বামীর কর্মপদ্ধতির মধ্যে স্ত্রীর অংশভাগিতা এখানে বেশি। সত্যভামাকে দেখুন, পিতার মৃত্যুর পর তিনি একা একটি রথে চড়ে দ্বারকা থেকে বারণাবতে পাণ্ডবদের জতুগৃহ পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন পিতৃহত্যার শোধ তোলার জন্য। এটা কি তৎকালীন দিনের আর কোনও মহিলার পক্ষে সম্ভব ছিল– সম্ভাব্য তালিকায় একমাত্র দ্রৌপদী ছাড়া। সত্যভামার স্বামী-সোহাগের ব্যাপারটাও ছিল অন্যান্য পতিব্রতা গৃহবধূজনের পক্ষে বিপজ্জনক। পারিজাত-পুষ্পের সেই ঘটনায় সত্যভামা নিজমুখে কৃষ্ণকে জানিয়েছিলেন, মহাসাগরে জলক্রীড়া করার সময় আমি তোমার কোলে উঠে স্নান করি– জলক্রীড়াং বাঙ্কস্থা দেব কৃত্বা মহোদধৌ–কিন্তু এখন যা হল, তাতে আর ওই সমুদ্রের দিকে আর তাকাতে পারব না আমি।

আমি এটা বলছি না যে, কৃষ্ণের নিবিড় হস্তাবলম্বনে কৃষ্ণের সঙ্গে সমুদ্রস্নান করা, একা একরথে বারণাবতে চলে যাওয়া, অথবা যুদ্ধভূমিতেও স্বামীর সঙ্গে থাকাটাই একমাত্র ‘স্মার্টনেস’ যাতে বেশ চমক লাগে; কিন্তু এই ‘স্মার্টনেস’-এর চেয়েও জরুরি বোধহয় সেই মনস্বিতা এবং ব্যক্তিত্ব, যাতে স্বামী হিসেবে কৃষ্ণ সত্যভামাকে তার জটিল জীবনের অংশভাগী ভাবতে পেরেছেন, মনস্বী পুরুষের ভাবনার সংগ্রাহিতা যৌবনবতী স্ত্রীর যৌনতার চেয়েও অধিক কোনও আস্বাদন দেয় যা অনির্বচনীয় কোনও যৌনতার প্রতীক হয়ে ওঠে।

এই প্রসঙ্গে মহাভারতের একটি ঘটনা না বললেই নয়। মহাভারতে তখন যুদ্ধের উদ্যোগপর্ব চলছে। ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে পাণ্ডবদের কাছে পাঠিয়েছেন যুদ্ধের বিষয়ে তাদের প্রস্তুতি এবং মানসিকতা বুঝে আসার জন্য। সঞ্জয় ফিরে এসেছেন, ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে তার দফায় দফায় আলোচনা চলছে, ধৃতরাষ্ট্র ভয় পাচ্ছেন, বারবার মহাবীর অর্জুনের বক্তব্য শুনতে চাইছেন, সুচতুর কৃষ্ণের কথা শুনতে চাইছেন। এই অবস্থায় সঞ্জয় অনেকবার অর্জুনের বক্তব্য এবং কৃষ্ণের বক্তব্য শুনিয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রকে। কিন্তু ভয়বিহ্বল ব্যক্তি, বিশেষত নিজেই যে নিজের দোষ জানে, সে আবারও অবস্থার বিপাক পরিমাপ করতে চায়। ধৃতরাষ্ট্র আবারও জিজ্ঞাসা করলেন সঞ্জয়কে, কী বললেন কৃষ্ণ, কী বললেন অর্জুন, আর-একবার বলো তো? সঞ্জয় আগে যা বলেছিলেন, তা সভামধ্যে উপস্থিত সকলের সামনে উচ্চারিত অর্জুন অথবা কৃষ্ণের কথা। সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের হিতাকাঙ্ক্ষী, তিনি উভয়পক্ষেরই রক্তক্ষয় চান না। সঞ্জয় ঠিক করলেন, এবার তিনি কৃষ্ণ এবং অর্জুনের একান্তে উচ্চারিত ব্যক্তিগত কথা শোনাবেন ধৃতরাষ্ট্রকে।

সঞ্জয় বললেন, আমি যেমনটা কৃষ্ণকে এবং অর্জুনকে দেখেছি এবং তারা যা স্বমুখে বলেছেন, সেটা শুনুন আপনি। আমি সেদিন নিজের সমস্ত দুরন্ত ভাবনাগুলি সংযত রেখে, অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে হাতজোড় করে ওঁদের অন্তঃপুরে ঢুকছিলাম। একান্তে ব্যক্তিগত সেই প্রকোষ্ঠ, যেখানে অন্তঃপুরের মেয়েরা থাকেন সেখানে কৃষ্ণার্জুন দু’জনেই ছিলেন। সেটা একান্ত ব্যক্তিগত স্থান বলেই আমি খুব সংকোচের সঙ্গে মাথা নিচু করে, নিজের পায়ের আঙুল দেখতে দেখতে প্রবেশ করছিলাম। আরও সংকোচ হচ্ছিল এই কারণে যে, এই অন্তঃপুরে শুধু কৃষ্ণ এবং অর্জুনই থাকবেন না, থাকবেন কৃষ্ণপ্রিয় সত্যভামাও এবং থাকবেন দ্রৌপদী– আমি জানতাম সে-কথা– যত্র কৃষ্ণৌ চ কৃষ্ণা চ সত্যভামা চ ভাবিনী। আমার সংকোচ হচ্ছিল, কারণ এই অন্তঃপুরে নকুল-সহদেবও আসেন না, এমনকী অভিমন্যুও ছেলের আবদার দেখিয়ে আসেন না এখানে নৈবাভিমন্যুর্ন যমৌ তং দেশমভিযান্তি বৈ। কিন্তু আমার প্রয়োজন এতটাই যে আমি প্রবেশ করলাম সেই অন্তঃপুরে।

সঞ্জয় সাধারণত খুব মূল প্রসঙ্গে কথা বলেন, কিন্তু বলার আগেই অন্তঃপুরের যে ভণিতা করছেন, তাতে দুটো জিনিস বেরিয়ে আসে। প্রথমত অজ্ঞাতবাসের পর পাণ্ডবরা যেখান থেকে হস্তিনাপুরের সঙ্গে রাজনৈতিক কথালাপ চালাচ্ছিলেন, সেটা বিরাট রাজার তৈরি করে দেওয়া একটি উপনগরী। এখানে আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য কৃষ্ণ, বলরাম, সাত্যকি এঁরা সবাই এসেছেন দ্বারকা থেকে। আমাদের বক্তব্য এখানে সত্যভামাই বোধহয় একমাত্র স্ত্রীলোক, যিনি কৃষ্ণের সঙ্গে এসেছেন দ্বারকা থেকে। তার মানে, তিনি কৃষ্ণের মহিষীকুলের সেই মানুষটি, যিনি কূট এবং কুটিল একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যেও কৃষ্ণের মানসিক সঙ্গী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সারাদিন কৃষ্ণ তথা পাণ্ডবদের সঙ্গে হস্তিনাপুর থেকে ধৃতরাষ্ট্রের দূত হিসেবে আসা সঞ্জয়ের কথাবার্তা চলেছে দফায় দফায়। এখন সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসছে। দ্রৌপদী আজকের এই আলোচনায় নিজে অংশগ্রহণ করেননি বলেই অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়েই বসেছিলেন সত্যভামার সঙ্গে। সভাশেষে কৃষ্ণ এবং অর্জুন দু’জনেই দ্রৌপদীর অন্তঃপুরে ফিরে এসেছেন এবং সেখানেই সত্যভামাও আছেন।

সঞ্জয় দেখেছেন অনেক এবং জানেনও অনেক। তিনি বুঝেছেন যে, এইসময় সারাদিনের রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞের পর কৃষ্ণ প্রবেশ করেছেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অর্জুনের অন্তঃপুরে, যেখানে দ্রৌপদীর সঙ্গে সত্যভামাও আছেন। সঞ্জয় দেখেছেন অর্জুন এবং কৃষ্ণ সারাদিনের রাজনৈতিক অবসাদ মোচনের জন্য স্নান-টান করে ফ্রেশ হয়ে বসেছেন, পরিষ্কার জামাকাপড় পরেছেন এবং খানিক প্রসাধনও করেছেন স্ত্রীদের সামনে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য। শ্রান্তি অপনোদনের জন্য মদ্যপানের ব্যবস্থা হয়েছে এবং কৃষ্ণ-অর্জুন দু’জনেই মদ্যপান করছেন এখন- উভৌ মধ্বাসবাক্ষীবৌ উভৌ চন্দনষিতৌ। এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, সত্যভামা এবং দ্ৰৌপদী এই ‘মধ্বসবে’র রস থেকে বঞ্চিত ছিলেন। কেননা সঞ্জয় যখন অনেক সংকোচ শেষ করে এই অন্তঃপুরে প্রবেশ করেছেন, তখন এতটাই কাল অতিবাহিত যে, কৃষ্ণ-অর্জুন এবং দ্ৰৌপদী-সত্যভামা যথেষ্ট ‘রিলাকল্ড’ মেজাজে বসে আছেন এবং এই ‘রিলাকসেশনে’র নমুনা এমনই যে, তা এখনকার দিনের অনেক আধুনিকতাকেও হার মানাবে। সঞ্জয় বলেছেন, আমি দেখলাম, অর্ধশায়িত অবস্থায় মদ্যপান করতে করতে কৃষ্ণ তার দুটি পা-ই তুলে দিয়েছেন অর্জুনের কোলে, আর অর্জুনের একটা পা দ্রৌপদীর কোলে এবং অন্য পাটি সত্যভামার কোলে অর্জুনস্য চ কৃষ্ণায়াং সত্যায়াঞ্চ মহাত্মনঃ।

আমরা আর বর্ণনা বাড়াতে চাই না, কেননা সঞ্জয় যেমন রাজনীতির কথা বলতে গিয়ে এই অপ্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন, আমরাও তেমনই সত্যভামার প্রস্তাবে-প্রসঙ্গে অবস্থান করছি বলেই এই অপ্রসঙ্গটাকেই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক মনে করি। আমরা বলতে চাই, সেইকালের দিনে, যখন সতীত্ব, সাধ্বীত্বের সম্পূর্ণ মাত্রাটিই পর-পুরুষ-স্পর্শ-বিরহের মধ্যে নিহিত এবং প্রোথিত ছিল, এমনকী নিজের স্বামীর ক্ষেত্রেও গৃহমেধিনী বধূরা অবগুণ্ঠন মোচন করে স্বামীর সঙ্গে সদাসর্বদা ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এমনটা যেখানে সমাজের চোখে ভীষণই নিন্দিত ছিল, সেখানে কৃষ্ণ যেখানে যাচ্ছেন, সেখানেই প্রায় সময় সত্যভামা তার সফরসঙ্গিনী– এটা অনভ্যস্ত চোখে বেশ কটু-কষায় লাগে। কিন্তু আমরা বলব, সত্যভামার ভালবাসা এতটাই আধুনিকভাবে প্রত্যয়ী ছিল যে, স্বামী হিসেবে কৃষ্ণ অনেকটাই তার আপন সখার মতো। বিশেষত এই যে, অর্জুন সত্যভামার কোলের ওপরে পা তুলে বসে আছেন, এটাকে এখনকার জঘন্যতায় ‘ওয়াইফ-সোয়াপিং’ বলে ভুল না করেও বলতে পারি সত্যভামার ওপর কৃষ্ণের ভালবাসা এবং বিশ্বাসও এতটাই যে, অতিঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে যখন তিনি মদ্যপানে বিনোদিত বোধ করছেন, তখন প্রিয়া পত্নীর ঊরুর ওপরে স্থাপিত বন্ধুর চরণ দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হচ্ছেন না এবং সত্যভামাও এখানে পরপুরুষের চরণস্পর্শে ছুঁৎকার কিংবা শীৎকার কোনওটাতেই মুহ্যমান হচ্ছেন না। কৃষ্ণের বন্ধু বলেই অর্জুনও তার সঙ্গে সমবন্ধুত্বে একটা পা তার কোলে তুলে দিতেই পারেন– এই সহজ ব্যাপারটা সহজে গ্রহণ করতে পারেন বলেই তিনি কৃষ্ণের সর্বশ্রেষ্ঠা প্রণয়িনী সত্যভামা।

অনেকে বলতে পারেন, তুমি একটা উদাহরণ দিয়ে সত্যভামাকে এমন মাথায় তুলে ছাড়লে– এটা নেহাৎ বাড়াবাড়ি বটে। আমি শুধু বলব, একটি রমণী-চরিত্রের ‘ফোক্যাল পয়েন্ট বুঝতে গেলে অনন্ত উদাহরণের দরকার হয় না। আর মহাভারত-পুরাণ তো এমন নয় যে, আমার প্রমাণিতব্য ভাবনা বুঝে অনেকানেক প্রমাণ রেখে যাবে যাতে করে সত্যভামাকে আমি ঈপ্সিতভাবে প্রমাণ করতে পারি। আসলে সত্যভামাকে বুঝতে গেলে তাঁর সপত্নী-রোষ-রুষিত অভিমানগুলি দিয়ে বোঝা যাবে না, তাকে বোঝার উপায় তার আপন কালাতিক্রমী সেই ব্যবহারগুলি দিয়ে, যেখানে তাঁর সপ্রতিভ এবং বিদগ্ধতা অন্য রমণীকুলের সমস্ত অভ্যস্ত মাত্রাকে অতিক্রম করে। এখানে দেখার বিষয় এইটাই যে, সারাজীবন ধরে কৃষ্ণের মতো এক বিশালবুদ্ধি মানুষ যে কর্মশীলতায় জীবন বাহিত করছেন, সত্যভামা কৃষ্ণের সেই জীবনের সহধর্মচারিণী– যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রাজনীতি–কৃষ্ণ যেখানেই গেছেন, সেইখানেই সত্যভামা আছেন তার হৃদয়-বোদ্ধা সখীর মতো। দাম্পত্য জীবনে যে রমণী এমন বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন, তাকে প্রমাণের জন্য একটা-দুটো ‘ট্রেইট’ই যথেষ্ট এবং ওই একটা-দুটো উদাহরণের প্ররোচনাতেই রূপ গোস্বামীর নাটকে বৃন্দাবনের রাধা সত্যভামা হয়ে ওঠেন বিবর্তনে, এই প্ররোচনাতেই রসশাস্ত্রে লিখিত হয় অন্য সমস্ত মহিষীদের থেকে সত্যভামা আলাদা– সত্যভামোত্তমা স্ত্রীণাং সৌভাগ্যে চাধিকাভবৎ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *