১৩. রুক্মিণী

১৩. রুক্মিণী

বাস্তবের সঙ্গে যাঁদের সামান্য পরিচয় আছে অথবা এই জগৎ এবং জীবন সম্বন্ধে যাঁদের সার্বিক শ্রদ্ধা আছে, তারা এই তথ্য খুব ভালভাবে জানেন যে, প্রত্যেক পুরুষ বা রমণীর হৃদয়ে প্রেম আসে এবং সে প্রেম পৃথিবীর তাবৎ পুরুষ-রমণীর প্রেমের তুলনায় একেবারেই পৃথক এবং বিলক্ষণ। আর সত্যিই তো, প্রত্যেক পুরুষ এবং প্রত্যেক রমণীর হৃদয়ই তো এত বিলক্ষণভাবে পৃথক যে, সেখানে এক প্রেমের সঙ্গে আর এক প্রেমের তুলনা হয় না। তার মানে, প্রেমের ব্যাপারে একটা সামান্য লক্ষণ ঠিক করা একেবারেই সঠিক কাজ নয়, অথচ আমরা অহরহই তা করি। না করে উপায়ই বা কী! পৃথিবীর এই লক্ষ-কোটি মানুষের লক্ষ-কোটি কমল-কলি হৃদয়, তাদের জটিল-কুটিল প্রেমাবর্ত নির্ধারণ করা কি চাট্টিখানি কথা! তবু সেখানে সাহায্য করেন কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার এবং অবশ্যই এই পৃথিবীর আশ্চর্য-রসিক কণ্বক ঠাকুর যত। তারা এক অথবা একাধিক তিন-চারটি পুরুষ-নারীর হৃদয় উদঘাটন করেন, ঠিক যেমন সূর্য একে-একে উন্মোচন করেন কমল-কলির হৃদয়।

কবিরা যা পারেন, শাস্ত্রকারেরা তা পারেন না! যত প্রসিদ্ধ শাস্ত্রকার আছেন, রসশাস্ত্রকার, আলংকারিক, কাব্যতত্ত্ববেত্তা– তাঁরা তাবৎ নর-নারীকুলের হৃদয়-ভ্রমি বিচার করে নায়ক নায়িকার শ্রেণি নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন ভাব-লক্ষণ মিলিয়ে। নায়কের মধ্যে কেউ বা উদাত্তগুণ, কেউ ললিত, কেউ বা উদ্ধত। আবার যুবতী নায়িকাদের মধ্যে কেউ ধীরা, কেউ বা প্রগলভা– এইরকম আরও কত কিছু। রমণী-হৃদয় হাজারো মধুরতায় জটিল বলে নায়িকা-ভেদে রসশাস্ত্রকারদের উপশ্রেণি তৈরি করতে হয়েছে এবং তার মর্যাদা মৌল শ্রেণির চাইতে কিছু কম নয়। তবু এত যে সংজ্ঞা তৈরি হল, তাতে লক্ষণীয় এইটাই যে, হৃদয় দেওয়া-নেওয়ার কায়দা-কৌশল-তরিকার চেয়েও অনেক বড় নির্ধারক হল হৃদয়ের ভাব, ভাবনা এবং সরসতা। তবু মানুষের মধ্যে এত সম্পর্ক-সেতু তার সব কটিই কি সংজ্ঞা আর লক্ষণের মধ্যে আসে? মানুষের মধ্যেই আসে না, সেখানে আবার সেই অখিল রসামৃত-মূর্তি কৃষ্ণের জীবন-সঙ্গিনীদের হৃদয় ব্যাখ্যা করে কে?

আমার অদ্ভুত লাগে শব্দটা। ওঁরা ব্যবহার করেছেন অনেকেই, হয়তো অন্যভাবে করেছেন, কিন্তু নায়িকা-বিভাগের ক্ষেত্রে একেবারে সর্বোত্তমা নায়িকার লক্ষণ এবং সংজ্ঞা হিসেবে যে শব্দটাকে রীতিমতো কর্ষণ-বিশ্লেষণ করা যেত, সেটা হল– বিদগ্ধা। আলংকারিক এবং রসিক-সজ্জনেরা এই ‘বিদগ্ধা’ শব্দটির মধ্যে অনেক সম্ভাবনা দেখেছেন, কিন্তু শব্দটিকে নির্দিষ্ট ভাবে কোনও সংজ্ঞা বা লক্ষণের চেহারা দেননি। অথচ ওই যে এক মহাকবি লিখেছিলেন– তার খুব রাগ হলে সে চাঁচায় না, হম্বিতম্বি করে না, শুধু ভ্রুকুটি-কুটিল মুখখানি দেখলে বোঝা যায় যে, তার রাগ হয়েছে। অন্য সাধারণী যেমন চেঁচিয়ে ঝগড়া করে, এ তেমন নয়, ঝগড়া করার বদলে সে একেবারেই চুপ করে গিয়ে বিসংবাদ জানায়– কোপো যত্র কুটি-রচনা নিগ্রহো যত্র মৌন– এবং এটা যে কত বড় শাস্তি, তা একমাত্র ভুক্তভোগী প্রেমিকরাই সবচেয়ে ভাল জানেন। এই ধরনের রমণীয় যুবতীর খুশির জায়গাগুলিও খুব ব্যঞ্জনাময়। সামান্য স্মিতহাস্যের মধ্যেই তাদের অনুনয়ের উপাদান লুকোনো থাকে। আর যার দিকে একবার স্মিতহাসে দৃষ্টিপাত করেন সেই সহৃদয়ই বুঝতে পারে যে, সেই দৃষ্টিতে কমল-কলির সমস্ত প্রসন্নতা একত্র ফুটে ওঠে– দৃষ্টিপাতঃ প্রসাদঃ।

বস্তুত এমন যে প্রেম, কিংবা প্রেমের মধ্যে এই রুচি এবং এই বিদগ্ধতা, তাও যে আমরা কোনও দিন শুনিনি, বা জানি না, এমন নয়। হয়তো বা বৈদগ্ধ্যের মধ্যে আরও কিছু আছে, যেখানে এমন সুরুচিসম্পন্ন অভিমান কাজ করে অথবা কাজ করে ব্যঞ্জনাময় এমন অপূর্ব কথন-ভঙ্গি যাতে করে ‘হ্যাঁ’ বললে মনে হয় বুঝি ‘না’ আর ‘না’ বললে ‘া’ হতেও পারে বা– এ সবও এক উত্তমা বিদগ্ধা নায়িকার ভূষণ হয়ে উঠতে পারে। রসশাস্ত্রকারেরা পৃথক করে এমন বৈদগ্ধীর কথা বলেছেন বটে, কিন্তু একত্রে এক উত্তমা নায়িকার মধ্যে এত লক্ষণ তারা সন্নিবেশ করেননি। বিশেষত যেটা তারা বলেন না, সেটা হল– এই বৈদগ্ধী টিকিয়ে রাখার নিদান। বিবাহ-পূর্ব প্রেমে যে বিদগ্ধতা উত্তমা রমণীর একান্ত আকর্ষণ হয়ে ওঠে, বিবাহোত্তর জীবনে তা অনেক সময়েই পরিস্লান কূপোদকে পর্যবসিত হয়, মালার ফুল শুকিয়ে যায়, পড়ে থাকে ডোর, শুধু বন্ধনের সুতোগাছি। বিদগ্ধ পুরুষের কাছে এই পরিম্লান বন্ধনও কখনও কখনও যন্ত্রণার হয়ে ওঠে।

যদি কৃষ্ণের কথা এই প্রসঙ্গে টেনে আনি, তা হলে বলতেই হবে যে, তার মতো অসাধারণ নায়ক পুরুষ ক’জন আছেন? বিশেষত যে পুরুষের জন্য বিনোদিনী রাই কিশোরী বৃন্দাবনে উন্মাদিনী হয়েছিলেন, তার বিবাহিত জীবনে প্রথমা হিসেবে যিনি এসেছিলেন, সেই রুক্মিণীর বিবাহ-পূর্ব আবেদনের মধ্যে বৈদগ্ধ্যের আকর্ষণ কম ছিল না। অথচ বিবাহোত্তর জীবনে তার যে সতী-সাধ্বীর গড্ডলিকা-পরিণতি ঘটেছিল, তার জন্য রসিক-শেখর কৃষ্ণের জীবন কতটা স্মৃতি-মধুর ছিল, সেটা বলা খুব কঠিন। তবে কিনা রামচন্দ্রের মতো কৃষ্ণ তো কোনও ধীরোদাত্ত ধর্মগম্ভীর পুরুষ নন এবং একাধিক বিবাহও তাঁর সমাজে অচল ছিল না। বিশেষত শাস্ত্রকথিত যে সব নায়কভেদ আমাদের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে আছে, সে-সব দিয়ে আমাদের ‘অখিল-রসামৃত-মূর্তি’ কৃষ্ণকে নির্দিষ্ট একটা ছাঁদের মধ্যে ফেলা যায় না। তার মধ্যে উদাত্ত গুণের সঙ্গে ললিতগুণ, লালিত্যের সঙ্গে উদ্ধত্য এমন সূক্ষ্মতায় মিশেছে। যে, অন্য কোনও মহাকাব্যিক নায়কের মতো তার গায়ে ‘স্ট্যাম্প’ লাগিয়ে দিয়ে বলা যায় না যে, তিনি এইরকম– তিনি রামচন্দ্রের মতো, কী তিনি ভীমের মতো অথবা তিনি যুধিষ্ঠিরের মতো ধীরপ্রশান্ত।

বলা যায় না; কৃষ্ণের সম্বন্ধে এমন নির্দিষ্টভাবে কিছুতেই বলা যায় না। যাবেই বা কী করে। কী ছিল এই মানুষটার মধ্যে, কোন সেই মায়া-গুণ, যাতে হাজার ঘৃণা করেও সেই মানুষটাকে আঁকড়ে না ধরে থাকা যায় না। রূপ গোস্বামীর লেখা বিদগ্ধমাধব নাটকে রাধার সখীরা রাধার সামনেই তাঁর নষ্টচরিত্রের কথা সোচ্চারে বলে বোঝাচ্ছিল যে, এমন চঞ্চল, কঠিন এবং অসভ্য এই পুরুষটি রাধার ভালবাসার যোগ্য নয় এতটুকু। তার উত্তরে রাধা বলেছিলেন– অমন খারাপ করে বলিসনে ভাই। আমার শ্যামসুন্দর সেই পুরুষ, যদি হাজার বছর ধরেও সে কঠিন ব্যবহার করে আমার সঙ্গে, তবু জন্ম-জন্মান্তর ধরেও আমি তার দাসী না হয়ে থাকতে পারব না। সেইজন্যই বলছিলাম– ঠিক কী আছে এই মানুষটার মধ্যে সেটা যুক্তি তর্কের গবেষণা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করাটা খুব কঠিন। অতএব সেটা থেকে কৃষ্ণের বৈবাহিক জীবনে প্রধানা যে রমণীটি পট্টমহিষী হয়ে বসে ছিলেন, তিনিই তার স্বামীর জটিল মনটুকুও সম্পূর্ণ অধিকার করতে পেরেছিলেন কিনা, সেটা বোঝাই আমাদের রসশাস্ত্রীয় কর্তব্য হওয়া উচিত।

মথুরায় কংস-ধ্বংসের পর পরই কৃষ্ণ জড়িয়ে পড়লেন রাজনীতিতে। তখনকার ভারতবর্ষের রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় শক্তি ছিলেন মগধের রাজা জরাসন্ধ। সম্পর্কে তিনি কংসের শ্বশুর। জামাই কংস মারা যাওয়ার সঙ্গে জরাসন্ধ তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে কৃষ্ণের প্রতিপক্ষতা শুরু করলেন। আক্রমণের পর আক্রমণ চলল কৃষ্ণের মাতৃভূমি মথুরার ওপর। এই আক্রমণের জেরেই কৃষ্ণকে শেষ পর্যন্ত তার ভদ্রাসন সরিয়ে নিয়ে যেতে হয় দ্বারকায়। এর পর অসীম চতুরতা এবং নিপুণতার মাধ্যমেই কৃষ্ণের রাজনৈতিক উন্নতি ঘটতে থাকে। কৃষ্ণকে সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক পুরুষ হিসেবে ধরে নিয়েই তার এই রাজনৈতিক উত্তরণের কথা আমি অন্যত্র বলেছি। কিন্তু বর্তমান প্রবন্ধে তার অন্তঃপুরের সরসতার মধ্যেও আমি যে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ‘স্কেচ’টুকু এঁকে দিলাম, তার কারণ– কৃষ্ণের অন্তঃপুরচারিণী মহিষীদের মধ্যে যে প্রধানা– তাদের বিবাহের সঙ্গে রাজনীতির যোগ আছে।

মনে রাখতে হবে- মথুরা-দ্বারকায় যদুবংশীয়রা যেভাবে রাজত্ব চালাতেন, তাকে ইংরেজিতে বলা যায় কর্পোরেশন’। অর্থশাস্ত্রের লেখক কৌটিল্য পরিষ্কার জানিয়েছেন কৃষ্ণের আগে থেকেই তার বংশের লোকেরা কতগুলি সঙ্ঘের মাধ্যমে রাজত্ব চালাতেন। কৃষ্ণের পূর্বে যাঁরা যদুবংশে জন্মেছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বিখ্যাত পুরুষ। যেমন অন্ধক, কুকুর, বৃষ্ণি, ভোজ ইত্যাদি। এদের কর্পোরেশনের কোনওটির নাম অন্ধক সঙ্ঘ, কোনওটি বৃষ্ণি-সঙঘ আবার কোনওটি বা ভোজ-সঙ্ঘ। একবারে আধুনিক অর্থে না হলেও, এইসব সঙ্ঘগুলির কাজকর্ম ছিল যথেষ্ট গণতান্ত্রিক। কৃষ্ণের মামা ভোজবংশের কুলাঙ্গার হলেও ‘মিটিং’-এর প্রয়োজন হলে তিনি অন্যান্য সঙ্ঘমুখ্যদের ডাকতেন। কখনও কথা শুনতেন কখনও বা শুনতেন না। এ সব কথাও আমি অন্যত্র বলেছি।

আপনারা সবাই জানেন যে, কৃষ্ণ রাজা ছিলেন না বটে, তবে তিনি ছিলেন ‘কিংমেকার। কংস মারা যাওয়ার পর জরাসন্ধকে মোকাবিলা করার সময় অন্ধক-বৃষ্ণি এবং অন্যান্য সব সঙ্ঘের কর্তারাই কৃষ্ণের কথা মেনে চলতেন। কৃষ্ণের সময়ে মথুরা-দ্বারকায় যাঁরা সঙ্ঘ মুখ্য ছিলেন, তাদের অনেকেই ছিলেন কৃষ্ণের জ্ঞাতি-গুষ্টি। যুদ্ধ-বিদ্যায় এঁরা অসাধারণ পারদর্শী ছিলেন এবং দরকারে মথুরা-দ্বারকার সঙ্মুখ্যেরা বড় বড় যুদ্ধে সৈন্য ভাড়া দিতেন বলেও মনে করি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে এই ধরনের ‘মার্সেনারি’ সৈন্য দুই পক্ষেই গিয়েছিল। কৃষ্ণের সময়ে কৃতবর্মা, অক্রূর ইত্যাদি সঙঘমুখ্যেরা যত প্রতাপশালীই হোন না কেন কৃষ্ণের রাজনৈতিক বুদ্ধির কাছে তারা ছিলেন শিশু। ফলত কৃষ্ণকে তাদের মেনে চলতেই হত এবং সেটা এতটাই যে, মথুরা-দ্বারকায় কোনও একটি বিশেষ মেয়ের ওপরেও যদি তাদের ভালবাসার নজর লেগে থাকে, তবে সে যে তাঁদেরই পছন্দ করছে- এমন কোনও ‘গ্যারান্টি ছিল না। কারণ কৃষ্ণ এতটাই বড়, এতটাই মানী যে, তিনি না চাইলেও অন্যের ঈপ্সিততমা রমণীটি হয়তো কৃষ্ণের জন্যই মনে মনে অপেক্ষা করছে, এমনকী মেয়ের বাবাও হয়তো কৃষ্ণের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখবার জন্য তাকেই মেয়ে দিতে চায়। এইসব কঠিন ত্রিভূজী, চতুর্ভুজী প্রেমকাহিনির আগেই আমরা অবশ্য কৃষ্ণের বিবাহ-ক্রমে প্রথমা রমণীটির কথা সেরে নেব।

আগেই আমরা বলেছি যে, কৃষ্ণের সমসাময়িক কালে মগধের রাজা জরাসন্ধের মতো প্রবল-প্রতাপ নরপতি আর দ্বিতীয় ছিলেন না। প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ তার অঙ্গুলিহেলনে উঠত বসত। মহাভারতে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আরম্ভে কৃষ্ণ তাঁকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন- মহারাজ! এই বিশাল যজ্ঞের আগে জরাসন্ধের কথা মনে রাখবেন। সমস্ত ভারতবর্ষের একছত্র রাজা এবং প্রভু বলতে যা বোঝায়, জরাসন্ধ কিন্তু তাই– প্রভুর্যস্তু পরো রাজা যস্মিন্নেকবশে জগৎ। যাঁদের ওপর নির্ভর করে এই বিশাল আধিপত্য জরাসন্ধ অর্জন করেছিলেন, তাঁদের একজন হলেন চেদি দেশের রাজা শিশুপাল। তিনি জরাসন্ধের পুত্রের মতো প্রিয়, শিষ্য তো বটেই। জরাসন্ধের ভাব এবং ব্যবহার শিশুপালের এই প্রিয় ছিল যে কৃষ্ণ অবশ্য যুধিষ্ঠিরের কাছে তাকে জরাসন্ধের শিষ্য বলেই উল্লেখ করেছেন। সম্পর্কে শিশুপাল কিন্তু কৃষ্ণের আপন পিসতুতো ভাই। কিন্তু কৃষ্ণের প্রতিপক্ষ জরাসন্ধের সঙ্গে দিন-রাত ওঠাবসা করে তিনি কৃষ্ণের অন্যতম শত্রু হয়ে গিয়েছিলেন। সকলে সে কথা জানতও।

চেদি দেশটা হল বেনারস ছাড়িয়ে যদি আপনি ভারতবর্ষের মোটামুটি মাঝখানটায় পৌঁছন সেই জায়গাটায়। শিশুপালের বাবা দমঘোষ যখন চেদির রাজা, তখন তাঁর সঙ্গে নিজের বোনের বিয়ে দিয়ে কৃষ্ণপিতা বসুদেব কংস-জরাসন্ধের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চেয়েছিলেন মগধরাজ জরাসন্ধের পরাক্রম এবং চতুরতায় সে ‘স্ট্রাটিজি’ ব্যর্থ হয়। দমঘোষ জরাসন্ধের পক্ষেই চলে যান, আর তাঁর ছেলে শিশুপাল তো জরাসন্ধের পুত্ৰকল্প শিষ্য। সেই শিশুপাল বড় হয়েছে, জোয়ান হয়েছে, তার সঙ্গে একটা সুন্দরী মেয়ের বিয়ে না দিলে লোকে তো জরাসন্ধকেই দুয়ো দেবে। অতএব তার বিয়ে দেওয়াটা শিশুপালের বাবা নয়, জরাসন্ধেরই দায়িত্ব।

জরাসন্ধের যেমন ক্ষমতা এবং সমস্ত ভারবর্ষের রাজা-মহারাজাদের ওপর তার যা ‘কন্ট্রোল’, তাতে জরাসন্ধ যদি কোনও রাজাকে ডেকে বলেন যে তোমার মেয়েটি আমার শিশুপালের জন্য চাই, তা হলে তার না বলার সাধ্য নেই। কিন্তু এতই যদি ক্ষমতা হয়, তবে তিনি নিজে এই চেষ্টা করবেনই বা কেন। মেয়ের বাপ-ভাই আপনিই এসে জরাসন্ধের পায়ে ধরে বলবে– এই নিন, আপনি আপনার কার জন্য একটি সুপাত্রী খুঁজছিলেন না? এই নিন, সেই পাত্রী নিয়ে এসেছি। ঠিক এইরকম ভাবেই ব্যাপারটা ঘটত। কিন্তু কৃষ্ণ, বাদ সাধলেন কৃষ্ণ। রাজনৈতিক বুদ্ধি, সাহস আর ক্ষমতায় তিনি ততদিনে এমন জায়গায় পৌঁছে গেছেন। যে, সব হিসেব উলটোপালটা হয়ে গেল।

সেকালের দিনে বিদর্ভ দেশের বড় সুনাম ছিল। এই সুনাম শক্তি অথবা বলদর্পিতায় যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি সভ্যতায়, সংস্কৃতিতে। তখনকার দিনে যে বিস্তীর্ণ ভূমিকে। আমরা দাক্ষিণাত্য বলি, সেই জায়গার আরম্ভই বিদর্ভকে দিয়ে। বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে, নর্মদা নদী আর তাপ্তীর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে নদীঘেরা পাহাড়ি অঞ্চলটাই বোধহয় বিদর্ভ। চেদি রাজ্য থেকে এই বিদর্ভ যেমন খুব দূরে নয়, তেমনই মথুরা-দ্বারকা থেকেও এটা খুব দূরে নয়। সংস্কৃত ভাষা আর সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রীতিটাকেই যেহেতু বৈদভী রীতি বলে, তাই এখানকার মানুষ-জনের ভাবভঙ্গি, আচার-ব্যবহার এবং মুখের ভাষা সারা ভারতবর্ষের মধ্যেই বিখ্যাত ছিল। বিশেষত এই দেশের রাজার ঘরের মেয়েদের কথা-বার্তা, বিদগ্ধতা এমন উচ্চপর্যায়ের ছিল যে, বৈদভী রমণী বলতেই ভারতবর্ষীয় পুরুষদের মনে অন্য এক স্বপ্ন তৈরি হত।

জরাসন্ধ-কৃষ্ণ-শিশুপালের সময়ে এই বিদর্ভ দেশের রাজা ছিলেন ভীষ্মক। গবেষণার দৃষ্টি থেকে ভাল করে খুঁজলে প্রমাণ করা যায় যে, ভীষ্মকও মোটামুটি কৃষ্ণের জ্ঞাতি গুষ্টির মধ্যেই পড়েন, কারণ তারাও ভোজবংশীয়। এই ভীষ্মকের এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলের নাম রুক্ষ্মী, তিনি জরাসন্ধ-শিশুপালের গুণমুগ্ধ, আর মেয়ে হলেন রুক্মিণী। যেমন তার রূপ, তেমনই গুণ। রুক্মিণীর সমসাময়িক কালে তার মতো সুন্দরী আর দ্বিতীয় ছিল কি না সন্দেহ– অনন্যা প্রমদা লোকে রূপেণ যশসা শ্রিয়া। যেমন ফরসা তার গায়ের রঙ, তেমনই তার দেহের সৌষ্ঠব। চেহারাটা লম্বা এবং “স্লিম’–বৃহতী চারুসর্বাঙ্গী তন্বী। স্থূলতা যদি কোথাও থেকে থাকে তবে সে শুধু স্তনে, জঘনে, নিতম্বে– পীনোরুজঘনস্তনী। চুল কালো এবং কোঁকড়ানো। নখ লাল। তীক্ষ্ণ, সাদা, সমান এবং ঝকঝকে দাঁতের স্মিত হাসিতে রুক্মিণীকে মনে হয় স্বর্গের মায়াময়তা নেমে এসেছে ডুয়ে– মায়াং ভূমিগতামিব। যেন চাঁদের কিরণ জমাট বেঁধেছে রুক্মিণীর নারী-শরীরের আনাচে কানাচে।

সেকালের রাজা-রাজড়ারা এই বৈদভী সুন্দরীর খবর রাখবেন না, এমনটা হতেই পারে না। বিষ্ণুপুরাণ, ভাগবত পুরাণ কিংবা অন্যান্য পুরাণগুলিতে রুক্মিণীর বিয়ের ‘পলিটিকস’টা তেমনটি ঠিক ধরা নেই, যেমনটি আছে হরিবংশের বর্ণনায়। এখানে দেখছি- কৃষ্ণ তখন মথুরায়। জরাসন্ধের সঙ্গে তার আগেই বেশ কয়েকবার তার ঝামেলা হয়ে গেছে। হঠাৎ মথুরায় কৃষ্ণের গুপ্তচরেরা লোকপ্রাবৃত্তিকা নরাঃ কৃষ্ণকে এসে খবর দিল– শুনে এলাম, বিদর্ভের কুণ্ডিনপুরে অনেক রাজা-রাজড়ার সমাগম হচ্ছে। ভীষ্মকের ছেলে রুক্মী নাকি দেশ-বিদেশের অনেক রাজাদের কাছে নেমন্তন্নের চিঠি দিয়েছে। লোকেরা বলাবলি করছে–রুক্মীর বোন রুক্মিণীর স্বয়ংবর-সভার অনুষ্ঠান হবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই। রাজারা সব সেখানে যাচ্ছেন সৈন্যসামন্ত সঙ্গে নিয়ে।

চরেরা সংবাদের মধ্যে ব্যঞ্জনা মাখিয়ে কৃষ্ণকে বলল– যে সব রাজারা তাদের নিজেদের শক্তি সম্বন্ধে সচেতন এবং এই মুহূর্তে রুক্মিণীকে পাওয়ার জন্য যারা একে অন্যকে শত্রু ভেবে নিচ্ছেন তারা সবাই এখন সাভিলাষে চলেছেন কুণ্ডিনপুরে। শুধু আমরা, শুধু এই আমরা, যারা মথুরার এক টেরে পড়ে আছি, তারাই কি শুধু সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে এইখানেই পড়ে থাকব– নিরুৎসাহা ভবিষ্যামঃ কিমেকান্তচরা বয়ম? কথাগুলি কৃষ্ণের উদ্দেশেই। মৌখিক সংকেতটা তার দিকেই। কিন্তু এই কথাগুলি শোনার সঙ্গে সঙ্গে যে প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক, সেই প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে তার মনেও একটা গূঢ় মনঃকষ্টের সঞ্চার হল, বার্তাবহ। চরেরা যে প্রতিক্রিয়া দেখতে পেল না। এই স্বয়ংবরের আয়োজনের কথা শোনামাত্র তার মনে হল– কে যেন তার হৃদয়ে কাটা ফুটিয়ে দিল– হৃদি শল্যমিবার্পিতম্।

এই কাঁটা কীসের তা আমাদের বুঝতে দেরি হয় না। কৃষ্ণ রুক্মিণীর রূপের কথা শুনেছেন, গুণের কথাও বাদ যায়নি। হয়তো বা মনে ছিল– এই বৈদভী রমণী আমারই, একান্তই আমার। আসলে মথুরা-দ্বারকার এই বিদগ্ধ পুরুষ আর বিদর্ভনন্দিনী সেই স্বয়ংবরা রমণীটির মধ্যে নিঃসাড়ে এক অন্তর প্রক্রিয়া চলছিলই। কেউ তার খবর জানত না। শুধু বিষ্ণুপুরাণ আর ভাগবতপুরাণের ব্যাস তাদের কাহিনির সূত্রপাতেই পাঠকদের আশ্বস্ত করে সংক্ষেপে বলেছিলেন, কৃষ্ণ চাইতেন- রুক্মিণী আমার হোক, আর রুক্মিণীও চাইতেন কৃষ্ণ আমার হোক– রুক্মিণীং চকমে কৃষ্ণঃ সা চ তং চারুহাসিনী।

পারস্পরিক এই চাওয়া-চায়ির মধ্যে যেটা আসল সত্যি, তা হল- শুনে শুনে ভালবাসা আলংকারিকভাবে যাকে বলে শ্রবণানুরাগ। কংসকে মেরে, মগধের অধিরাজ জরাসন্ধের সঙ্গে টক্কর দিয়ে কৃষ্ণের মর্যাদা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিল, যাতে করে বিদর্ভনন্দিনী রুক্মিণী তার মধ্যে আপন মনের মানুষ খুঁজে পেয়েছিলেন। অন্যদিকে রুক্মিণীর অসামান্য রূপ আর সৌন্দর্যের কথা শুনে শুনে কৃষ্ণও তার মধ্যে লজ্জাব-পরা এক মহিষীর রূপ দেখতে পেলেন। ফলত এই না-বলা-বাণীর অন্তরাল থেকে হঠাৎই যেদিন শোনা গেল– রুক্মিণী স্বয়ংবরা হবেন, রাজারা সব ছুটে আসছেন কুণ্ডিনপুরে, সেদিন কৃষ্ণের মনে কে যেন কাটা ফুটিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি যাদব-সৈন্যদের যুদ্ধসজ্জা করতে বললেন– তিনি বিদর্ভে যাবেন। ‘

কৃষ্ণ বিদর্ভে এলেন এবং এসে দেখলেন– জরাসন্ধ ইত্যাদি বড় বড় রাজারা আগেই এসে গেছেন। অদ্ভুত ব্যাপার হল জরাসন্ধরা কিন্তু এই সময়ে কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধের ব্যাপারটা পছন্দ করছিলেন না। তার কারণ আছে। জরাসন্ধের সঙ্গে কৃষ্ণের অনেক যুদ্ধের মধ্যে একেবারে শেষেরটায় কৃষ্ণের জয় হয়েছিল। হয়তো এরই জেরে জরাসন্ধ আপাতত একটা লোকদেখানো স্তুতিবাদ করলেন কৃষ্ণের, কিন্তু অন্যদিকে তাকে সাজা দেওয়ার জন্য লাগালেন অন্য এক শক্তিশালী শক্তিকে। হরিবংশে যেমনটি দেখেছি তাতে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে একদিকে কৃষ্ণ এবং অন্যদিকে জরাসন্ধের মতো বিখ্যাত রাজার মাঝখানে পড়ে রুক্মিণীর পিতা ভীষ্মকের অবস্থা হয়েছিল অনেকটা দুই সিংহের মাঝখানে দাঁড়ানো হরিণের মতো। হয়তো এই কারণেই রুক্মিণীর স্বয়ংবরসভা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে হয়।

অবশ্য বেশিদিন এইভাবে স্বয়ংবরসভা চেপে রাখা গেল না। জরাসন্ধ কৃষ্ণের বিরুদ্ধে অন্যান্য নরপতিদের লাগিয়ে দেওয়ায় কৃষ্ণ যেমন অন্যত্র যুদ্ধ-বিগ্রহে ব্যস্ত রইলেন, তেমনই আরেক দিকের খবর হল– জরাসন্ধ এবং বিদর্ভনন্দিনী রুক্মিণী দু’জনেই নিজের নিজের মতো করে একটু সময় পেয়ে গেলেন। এই সময়ের সদব্যবহার জরাসন্ধ করলেন একভাবে, রুক্মিণী করলেন আরেকভাবে। অবশ্য কৃষ্ণ যে কিছুই সদ্ব্যবহার করলেন না, তা নয়। এই সময়ের মধ্যে তিনি দ্বারকায় নিজের বাড়ি-ঘর সব তৈরি করে ফেললেন। মথুরায় বারংবার জরাসন্ধের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ তিনি তার সাময়িক স্তুতিতে ভুলে যাবেন, এমন মানুষ তিনি নন। তিনি নিজেকে এবং নিজের পরিজনকে সুরক্ষিত করে তারপরে আবারও মন দিলেন বিদর্ভনন্দিনীর দিকে। তিনি এখনও কৃষ্ণের ঘরে আসেননি বটে, কিন্তু মনে তাঁর নিত্য আসা-যাওয়া।

সময় পেয়ে জরাসন্ধ ঠিক করলেন তার বশংবদ শিশুপালের বিয়ে দেবেন, সুন্দরী-শ্ৰেষ্ঠা রুক্মিণীর সঙ্গে। আমি আগেই বলেছি- তিনি চাইবেন কেন, তিনি ইচ্ছে করবেন। তিনি ইচ্ছে করেছেন, এখন সেই ইচ্ছে যাতে কোনওভাবেই বানচাল না হয়ে যায়, এবং যাতে শিশুপালের মনে কোনও কষ্ট না থাকে, তাই সমস্ত রাজাদের এক জায়গায় জড়ো করার কথা ভাবলেন জরাসন্ধ নৃপা উদযোজয়ামাস চেদিরাজপ্রিয়েন্সয়া। যে সব রাজাদের সঙ্গে কৃষ্ণের শত্রুতা আছে তাদের সবাইকে বেছে বেছে এক জায়গায় নিয়ে জরাসন্ধ শিশুপালের বরযাত্রী নিয়ে গেলেন বিদর্ভনগরে! জরাসন্ধের সবচেয়ে বড় সুবিধে ভীষ্মকের শক্তিমান পুত্র, রুক্মিণীর দাদা– স্বয়ং জরাসন্ধের পক্ষে। কংস মারা যাওয়ার পর রুক্মীর কৃষ্ণ-দ্বেষ আরও বেড়েছে। তিনি জানেন যে, তার বোন রুক্মিণী কৃষ্ণকে ভালবাসে, তিনি এও জানেন যে, কৃষ্ণও রুক্মিণীকে পেতে চান। কিন্তু মনে মনে তিনি ঠিকই করে রেখেছেন যে, কোনওভাবেই তিনি কৃষ্ণের হাতে নিজের বোনকে দেবেন না- তাং দদৌ ন চ কৃষ্ণায় দ্বেষাদ রুক্মী মহাবলঃ।

এরই মধ্যে জরাসন্ধ তার রাজসমাজ নিয়ে এসে গেলেন বিদর্ভে এবং বরকর্তা হিসেবে শিশুপালের জন্য মেয়ে চাইলেন ভীষ্মকের কাছ থেকে। ভীষ্মক উপায়ান্তর না দেখে রুক্মিণীকে বাগদান পর্যন্ত করে দিলেন শিশুপালের কাছে। অন্যদিকে রুক্মিণীর ভাই রুক্মী জরাসন্ধের খাতির-যত্নে নিজেকে সঁপে দিলেন আগে থেকেই। সময় আর বেশি নেই। রুক্মিণী বুঝলেন, তার ভালবাসা, তার প্রেম– কোনও কিছুরই মূল্য তিনি পাবেন না। পিতা ভয়ার্ত এবং ভাই জরাসন্ধের বশংবদ। কাজেই সময় আর নেই। পাকাপাকি এবং আনুষ্ঠানিক বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে। আগামী কাল বা পরশুই সেই বিয়ে।

এই অবস্থায় হরিবংশ এবং বিষ্ণুপুরাণ খুব সংক্ষিপ্তভাবে বলে দিয়েছেন মহামতি কৃষ্ণ বিয়ের আগের দিনই রুক্মিণীকে হরণ করে নিলেন– শ্বোভাবিনি বিবাহে তু তাং কন্যাং হৃতবান হরিঃ। এই সংক্ষিপ্তসার এমনিতে ঠিকই আছে, কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা অত সহজ ছিল না। অন্য এক অচেনা দেশে গিয়ে মেয়ে কখন কোথায় থাকবে জানা নেই– এই অবস্থায় কন্যাহরণ অত সহজ নয়। কিন্তু কৃষ্ণের পক্ষে ব্যাপারটা কেমন সহজ হয়ে গেল, সেটা অত্যন্ত রোমাঞ্চকরভাবে জানিয়েছে ভাগবতপুরাণ। শত সংক্ষিপ্ততার মধ্যেও এই পুরাণটি জানিয়েছেন কীভাবে রুক্মিণীকে রথে চাপিয়ে হরণ করে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেন কৃষ্ণ।

ভাগবতে দেখছি– যে মুহূর্তে রুক্মিণীর সহোদর রুক্মী ঠিক করলেন যে, বোনকে তিনি শিশুপালের হাতেই তুলে দেবেন, সেই দিনই রুক্মিণী বিদর্ভের এক বিশ্বস্ত ব্রাহ্মণকে ডেকে পাঠালেন। তার হাতে বিদর্ভের রাজনন্দিনীর মোহর আঁটা একটা চিঠি দিয়ে রুক্মিণী তাকে কৃষ্ণের কাছে পাঠিয়ে দিলেন দ্বারকায়। ব্রাহ্মণ-দূত খুব তাড়াতাড়ি খবর নিয়ে আসবেন রুক্মিণীর কাছে, জানাবেন কৃষ্ণের প্রতিক্রিয়া।

দ্বারকায় সোনার আসনে বসে ছিলেন কৃষ্ণ। ব্রাহ্মণকে দেখে আসন থেকে নেমে তার কুশল জিজ্ঞেস করতেই তিনি সমস্ত বিবরণ দিয়ে রুক্মিণীর পত্র দিলেন কৃষ্ণের হাতে। কৃষ্ণ একান্তে চিঠি খুললেন। রুক্মিণী লিখেছেন–

তিন ভুবনের সেরা সুন্দর আমার!

লোকের মুখে হৃদয়ের জ্বালা-জুড়োনো তোমার কথা অনেক, অনেকবার শুনেছি। তোমাকে একবার দেখলে পরে লোকের নাকি সব পাওয়ার অনুভূতি হয়। তোমার এত গুণ আর এত সৌন্দর্যের কথা বার বার শুনে আমার মনের সব লজ্জাই যেন ঘুচে গেল। নির্লজ্জ বেহায়ার মতো আমার মন কেমন যেন তোমারই স্বপ্ন দেখতে শুরু করল– ত্বয়ি অচ্যুতাবিশতি চিত্ত অপত্রপং মে।

বিয়ে হয়নি এমন একটা মেয়ে এইসব কথা বলছে দেখে তুমি যেন আবার আমাকে সত্যিই বেহায়া ভেবে বসো না। আমি বড় ঘরের মেয়ে; রূপ বল, বিদ্যা বল, ব্যক্তিত্ব বল, এমনকী টাকা-পয়সার কথাও বলতে পারো, কোনওটাই আমার কম নেই। এখন তুমিই বল, কোন মেয়ে তার রূপ, বয়স অথবা বিদ্যা এবং আভিজাত্যে সমান একটা স্বামী না চায়– বিদ্যাবয়োদ্রবিণধামভিরাত্মতুল্যম? এই নিরিখে আমার বিয়ের সময় তোমাকেই আমি পেতে চাই।

আমি মনে মনে তোমাকে আমার স্বামীর আসন দিয়েছি। এখন যা করবার তুমি করবে। এমনটি যেন আবার না হয় যাতে সিংহের খাবার শেয়ালে খেয়ে যায়। যা নিতান্তই তোমারই প্রাপ্য তাকে কি শিশুপালের মতো শেয়ালে নিয়ে যাবে তুলে?

মনে রেখো, সামনেই আমার বিয়ে। সময় বেশি নেই। এ দেশের নিয়ম আছে, বিয়ে করতে হলে মেয়ের বাবাকেই পণ দেয় বিবাহার্থী পুরুষ। তুমি এখানে এসে শিশুপাল জরাসন্ধের বাহিনীকে হারিয়ে দাও আর সেই শক্তিমত্তার পণ দিয়ে আমাকে এখান থেকে তুলে নিয়ে যাও রাক্ষসের মতো। যদি বলো, আমার আত্মীয়-স্বজনকে না মেরে কেমন করে এই অন্তঃপুরচারিণীকে নিয়ে যাবে, তা হলে তার উপায় বলি শোনো। আমাদের রাজবাড়ির নিয়ম আছে- বিয়ের আগের দিন নগরের বাইরে যে ভবানী-মন্দির আছে, সেইখানে পুজো দিতে যায় বিয়ের কনে। সঙ্গে দু-চারজন বান্ধবী ছাড়া আর কেউ থাকে না। অতএব সেইখান থেকেই… কী বলো? আর তুমি যদি না আসো, তা হলে তোমাকে অন্তত শত-জন্মে পাওয়ার আশায় শুকিয়ে শুকিয়ে মরতে হবে আমায়। শতজন্মেও তো পাব– জহ্যাম্যসূন ব্রতকৃশান্ শতজন্মভিঃ স্যাৎ।

চিঠির তলায় রুক্মিণীর নাম নেই। কে জানে, কেউ যদি রাস্তায় সরল ব্রাহ্মণকে প্রতারণা করে চিঠি কেড়ে নেয়। রুক্মিণীর চিঠি পড়া হয়ে গেলেই ব্রাহ্মণ তাই কৃষ্ণকে বললেন– এই হল সেই গোপন সংবাদ যা চিঠির মধ্যে লেখা আছে– ইত্যেতে গুহ্যসন্দেশ, এবং এটাই আমি বয়ে এনেছি এতদূর। সব বুঝে এখন আপনার যা করার করুন– বিমৃশ্য কর্তৃং যচ্চা ক্রিয়তাং তদনন্তর।

সেই কত হাজার বছর আগে দূরদেশিনী এক প্রেমিকার কাছ থেকে মন আধুনিক একটা প্রেমপত্র পেয়ে নায়ক-স্বভাব কৃষ্ণের মনে কী হয়েছিল, তা আমরা আন্দাজ করতে পারি। বার্তাবহ ব্রাহ্মণের হাত ধরে কৃষ্ণ বললেন– আমিও তার কথাই ভাবছি নিশিদিন। তার অবস্থা ভেবে রাত্রে আমার ঘুম হয় না। আমি জানি আমার ওপর রাগে রুক্মী আমার সঙ্গে তার মিলন রুদ্ধ করতে চায়। কিন্তু তা হবে না, বিবাহার্থী রাজাদের বিদলিত করে রুক্মিণীকে হরণ করে নিয়ে আসব আমি। খবর নিয়ে ব্রাহ্মণ চলল বিদর্ভে। আসলে কৃষ্ণই নিয়ে চললেন ব্রাহ্মণকে। দারুকের রথে চড়ে এক রাতের মধ্যে কৃষ্ণ চলে এলেন বিদর্ভে।

অন্তঃপুরে বসে কৃষ্ণপ্রিয়া রুক্মিণী তখন সময় গুণছেন। ব্রাহ্মণ তো এখনও এসে পৌঁছল না। বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে আগামীকাল। প্রণয়িনীর শত উৎকণ্ঠার মধ্যে বার্তাবহ ব্রাহ্মণ শেষ পর্যন্ত রুক্মিণীকে খবর দিলেন কৃষ্ণ এসে গেছেন। তিনি কী বলেছেন, তাও জানালেন রুক্মিণীকে। রুক্মিণী এবার নিশ্চিন্ত হয়ে নগরের বাইরে ভবানী মন্দিরে যাওয়ার উদ্যোগ করলেন। ভাগবত পুরাণ বা বিষ্ণুপুরাণে ঘটনার যা বিবরণ পাই তার থেকে এই মুহূর্তে অবশ্য হরিবংশ ঠাকুরের জবানই আমার কাছে সত্য এবং বেশি প্রাচীন বলে মনে হয়। হরিবংশে রুক্মিণী ইন্দ্রাণীর পুজো দিতে যাচ্ছেন, অম্বিকার নয়। কৃষ্ণের আমলে বৈদিক দেবতাদের অবক্ষয় শুরু হলেও ইন্দ্রপূজার চল ছিল। গোবর্ধন ধারণের মতো রূপকের মাধ্যমে ইন্দ্রপুজা বন্ধ হলেও সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে নববধূর কাছে ইন্দ্রাণী তখনও পুজো পেতেন। বিদর্ভে নগরের বাইরে তখনও যে মন্দির ছিল সেটা তখনও ইন্দ্রেরই নামাঙ্কিত। অর্থাৎ কৃষ্ণের নিজের দেশে তার ব্যক্তিত্বে ইন্দ্রপূজা বন্ধ হলেও বিদর্ভে সেই পূজা বন্ধ হয়নি। রুক্মিণী তাই সৌভাগ্যলক্ষ্মী ইন্দ্রাণীর পুজো দিতে যাবেন নগরের বাইরে– ইন্দ্রাণীমৰ্চয়িষ্যন্তী কৃতকৌতুকমালা।

কৃষ্ণ এই বিবাহবাসরে পৌঁছচ্ছেন পিসিমা তশ্রবার মনোরঞ্জনের অজুহাতে। কারণ তশ্রবার ছেলে শিশুপালই রুক্মিণীর বর হিসেবে জরাসন্ধের মনোনীত। কৃষ্ণ অবশ্য যুদ্ধের সমস্ত ভার দাদা বলরাম আর সাত্যকির ওপর ন্যস্ত করে নিজেকে মুক্ত রেখেছেন রুক্সিণী-হরণের জন্য। রাজনন্দিনী বাইরে ইন্দ্রাণী মন্দিরে চলেছেন সখীদের সঙ্গে নিয়ে। বিদর্ভের সেনাবাহিনী তাকে ‘গার্ড’ করে নিয়ে যাচ্ছিল। রুক্মিণীর কথামতো কৃষ্ণ একা সেখানে উপস্থিত। বলরাম আছেন কাছে কাছে। নগরপ্রান্তে অরণ্যের অন্তরালে যদুবংশের সৈন্যবাহিনী।

রুক্মিণী আসছেন। মাখন-রঙা বিয়ের বেনারসী পরে রুক্মিণী রূপিণী দেবী পাণ্ডুরক্ষৌমবাসিনী– যাত্রাপথে আগুনপানা রূপ ছড়িয়ে রুক্মিণী আসছেন। কৃষ্ণ তাকে এই প্রথম দেখছেন। দেখামাত্র তার কামনার অগ্নিশিখায় রূপের ঘি পড়ল– হবিষেবানলস্যাৰ্চিমনস্তস্যাং সমাদধৎ। ইন্দ্রাণীর মন্দির থেকে বেরনো মাত্র কৃষ্ণ রুক্মিণীকে কোলে তুলে নিয়ে চড়ালেন নিজের রথে। বায়ুবেগে রথ ছুটল দ্বারকার পথে। ওদিকে লড়াই লাগল বলরাম-সাত্যকির বাছাই করা সৈন্যদলের সঙ্গে জরাসন্ধ আর শিশুপালের বাহিনীর। রুক্মিণীর ভাই রুক্মী একা রথ নিয়ে ছুটলেন কৃষ্ণকে রাস্তায় ধরবার জন্য।

দুঃখের বিষয় জরাসন্ধ-শিশুপাল যেমন একদিকে বলরাম-সাত্যকির হাতে নাস্তানাবুদ হলেন, তেমনই অন্যদিকে রুক্মী কোনওরকমে তাও বুঝি নববধূ রুক্মিণীর করুণ যাচনায়– প্রাণ নিয়ে ফিরে এলেন কৃষ্ণের কাছ থেকে। ক্রোধে, অভিমানে তিনি কুণ্ডিনপুরে আর ঢুকলেন না। বিদর্ভের বাইরে নতুন এক রাজ্য তৈরি করে বাস করতে লাগলেন সেখানেই। দ্বারকায় যদুবংশীয়রা সবাই ফিরে এলে মহা সমারোহে কৃষ্ণের বিয়ে হল রুক্মিণীর সঙ্গে।

দেখুন, রুক্মিণী কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠা মহিষী। নববধূর প্রথম সঙ্গমে কৃষ্ণের মতো নায়ক পুরুষের যতখানি ভাল লাগার, তা নিশ্চয়ই লেগেছিল।

কারণ সব পুরাণ এবং হরিবংশের জবানে কৃষ্ণের অন্তঃপুরের এই প্রথমা রমণীটির সম্বন্ধে যথেষ্ট ভাল ভাল কথা শুনি। সীতার সঙ্গে রাম যে রকম, ইন্দ্রাণীর সঙ্গে ইন্দ্র যেরকম– এই সব রাজযোটকের উপমা কৃষ্ণ আর রুক্মিণীর সম্বন্ধেও এসেছে। কিন্তু এসব বড়ই ভাল ভাল কথা। রুক্মিণী বড় রূপবতী, বড় পতিব্রতা, বড় গুণোপে রূপশীলগুণান্বিতা। কৃষ্ণের ওপর তিনি এতই আস্থাশীল, এতই তিনি নম্র, কৃষ্ণের দাম্পত্যে তিনি এতই অভিভূত যে, কৃষ্ণকে তিনি দেবতার মতো মনে করেন। প্রত্যেকটি কথাই রুক্মিণীর কাছে বেদবাক্য।

কৃষ্ণের দিক থেকেও এটা বড় অবাক হওয়ার ছিল। তৎকালীন রাজনীতিতে যে রমণীটি হইহই ফেলে দিয়েছিল, যার জন্য বড় রাজনৈতিক কক্ষ তৈরি হয়ে গেল সম্পূর্ণ ভারতবর্ষে, সেই রুক্মিণী যে বশংবদ পত্নীটি হবেন– এটা কৃষ্ণ ভাবতেই পারেননি। ওইরকম একটি ‘সেনসেশনাল’ মহিলা, যার কারণে শিশুপাল মরার দিন পর্যন্ত সক্রোধ অভিমানে বলেছে– রুক্মিণী আমার ছিল, এই কৃষ্ণ তাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বিয়ে করেছে– মৎপূর্বাং রুক্মিণীং কৃষ্ণঃ–সেই রুক্মিণী যে এমন অনুক্ষণ স্বামীর মুখাপেক্ষী নিস্তরঙ্গ গৃহবধূটি হবেন, এ বুঝি কৃষ্ণ কল্পনাও করতে পারেনি।

পৌরাণিকেরা যে রুক্মিণীকে জ্যেষ্ঠা মহিষীর মর্যাদা দিয়েই কৃষ্ণের অন্য মহিষীদের বর্ণনা করেছেন, সেই কী এই নিস্তরঙ্গতার কারণে? কৃষ্ণের নাকি আরও সাতজন মহিষী ছিল। আমার তো ধারণা, এই সাতজনের মধ্যেও মাত্র একজন ছাড়া আর যে ছয়জন মহিষী ছিলেন তাঁরাও ছিলেন একই রকম ‘সাইফার অর্থাৎ কৃষ্ণের হৃদয়ে তরঙ্গ তুলবার ক্ষমতা এই ছয়জনেরও ছিল না। যাঁর সে ক্ষমতা ছিল, তার কথায় পরে আসছি।

পুরাণকারেরা কৃষ্ণের মহিষীদের যে লিস্টি দিয়েছেন, তাতে অবশ্য আটজন প্রধান মহিষী ছাড়াও কৃষ্ণের অন্তঃপুরে আরও ষোলো হাজার রমণীর কথা শোনা যায়। এখনকার আসাম অর্থাৎ তখনকার প্রাগজ্যোতিষপুরের অনার্য রাজা নরকাসুরকে মেরে এই ষোলো হাজার রমণীকে নাকি কৃষ্ণ নিয়ে এসেছিলেন দ্বারকায়। পুরাণকারেরা কৃষ্ণের অলৌকিক যোগসিদ্ধির প্রসঙ্গ তুলে দেখাতে চেয়েছেন যে, একই কৃষ্ণ নিজেকে ষোলো হাজার কৃষ্ণে রূপান্তরিত করে এই রমণীদের সঙ্গ দিতেন। আমার অবশ্য ঠিক এতটা বিশ্বাস হতে চায় না। নরকাসুর নাকি দেবতা, গন্ধর্ব, এবং মানুষের ঘরের বহু সংখ্যক কুমারী মেয়েদের হরণ করে এনে আটকে রেখেছিলেন মণিপর্বতের গুহায়। পুরাণকারেরা এই রমণীদের যথেষ্ট শুদ্ধশীলা এবং চরিত্রবতীও করে রেখেছিলেন বটে, তবে এঁরা– ষোলো হাজার না হয়ে আমার বিশ্বাসমতো যদি এঁরা ষোলোজন মাত্রও হন, তবু চরিত্রের দিক থেকে এঁরা যে বড় শুদ্ধশীলা ছিলেন, তা আমি মনে করি না। এঁদের কথাতেও আমি পরে আসছি।

রুক্মিণী ছাড়া কৃষ্ণের অন্তঃপুরে আর যে সাতজন প্রধানা মহিষী ছিলেন তাদের মধ্যেও দুইজনকে বাদ দিলে অন্যদের মর্যাদা ছিল নগণ্য। মুশকিল হল– বিভিন্ন পুরাণ এবং হরিবংশে কৃষ্ণের মহিষী সংখ্যা একেক জায়গায় একেক রকম। কোথাও আট, কোথাও বা দশ, কোথাও বা এগারোও বটে। এই পরস্পরবিরোধী সংখ্যা দেখে মহামতি বঙ্কিম মাথা গরম করে কৃষ্ণের অন্তঃপুর থেকে রুক্মিণী ছাড়া অন্য সমস্ত মহিষীদেরই বার করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার- পুরাণকারেরা বার বার বলেছেন- কৃষ্ণের প্রধানা মহিষী আটজন। কিন্তু এই আটজনের কথা বলা হয়েছে কখনও রুক্মিণীর বিয়ের পর, কখনও সত্যভামার বিয়ের পর, আবার কখনও বা জাম্ববতীর সঙ্গে কৃষ্ণের বিয়ের পর।

কথা হল– প্রধানা মহিষী আটজনই কিন্তু প্রধানতমাদের কথা এখানে বলা হয়নি। ফলত কখনও রুক্মিণীকে ধরে পুরাণের লিস্টিতে একবার নয়জন মহিষী, কখনও রুক্মিণী সত্যভামাকে ধরে মহিষীর সংখ্যা দশ আবার কখনও বা রুক্মিণী-সত্যভামা এবং জাম্ববতাঁকে ধরে এই সংখ্যা এগারো। যাই হোক বিভিন্ন পুরাণের নামে একটু ইতর বিশেষ ধরে নিয়ে অন্যান্য কৃষ্ণ-মহিষীদের নামগুলিও বলা যেতে পারে। এঁরা হলেন কালিন্দী, মিত্ৰবিন্দা, সত্যা, নাগ্নজিতী, রোহিণী বা ভদ্রা, লক্ষ্মণা এবং শৈব্যা গান্ধারী। পৌরাণিকেরা বলেন– কালিন্দী নাকি সূর্যের মেয়ে। কৃষ্ণ তখন কয়েক মাস ইন্দ্রপ্রস্থে ছিলেন। খাণ্ডব-দহন হয়ে গেছে। এই সময়ে কৃষ্ণের সঙ্গে বনে শিকার করতে করতে তৃষ্ণাতুর হয়ে অর্জুন যমুনায় জল খেতে নেমেছেন। হঠাৎ সামনে দেখলেন এক রূপসী মেয়ে। কৃষ্ণের ইঙ্গিতে অর্জুন তার নাম-ধাম জিজ্ঞাসা করলেন। জানা গেল– তিনি সূর্যদেবের মেয়ে; কৃষ্ণকে স্বামী পাওয়ার জন্য তিনি তপস্যার জোগাড় করছেন। তার নাম কালিন্দী। কৃষ্ণের দর্শন না পেলে তিনি জলের মধ্যেই বসে থাকবেন চিরকাল।

কৃষ্ণ তার কথা জানতেন অতএব তাঁকে রথে চড়িয়ে প্রথমে নিয়ে গেলেন যুধিষ্ঠিরের বাড়িতে। পরে দ্বারকায় নিয়ে গিয়ে বিয়ে করলেন তাকে। কালিন্দীর ব্যাপারে আমার যেটা সন্দেহ সেটা হল– যমুনা নদীকে কালিন্দী বলেই আমরা জানি, এবং সেই যমুনাও সূর্যকন্যা বলেই পুরাণে চিহ্নিত। যমুনা নদীর সঙ্গে পুরুষোত্তম কৃষ্ণের লীলা সম্বন্ধ যেহেতু অচ্ছেদ্য, অতএব পৌরাণিকের কথকতায় তিনি কৃষ্ণের স্ত্রী বলেই স্বীকৃত হয়েছেন।

মিত্ৰবিন্দা কৃষ্ণের আপন পিসি রাজাধিদেবীর মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই তিনি কৃষ্ণকে চেনেন এবং কৃষ্ণের ব্যাপারে তাঁর ‘হিরো ওয়ারশিপ’ ছিল। তাকে যদিও দুর্যোধনের বশংবদ অবন্তী দেশের দুই রাজা বিয়ে করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কৃষ্ণ এই পিসতুতো বোনটির মনের কথা জানতেন নিশ্চয়। স্বয়ংবরে স্বভগিনীং কৃষ্ণে সত্তা। তিনি তাকে হরণ করে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন। পিসতুতো-মাসতুতো অথবা মামাতো ভাই-বোনে বিয়ে হওয়ার ব্যাপারটা সেকালের সমাজে অস্বাভাবিক ছিল না। অর্জুনও তো মামাতো বোন সুভদ্রাকে বিয়ে করেছিলেন। অতএব কৃষ্ণের দিক থেকেও এটা অস্বাভাবিক নয়। কৃষ্ণের অন্তঃপুরে অবশ্য আরও একটি পিসতুতো বোন ছিলেন। তিনি তার আরেক পিসি শ্রুতকীর্তির মেয়ে। নাম ভদ্রা বা রোহিণী। ভদ্রা-রোহিণী কেকয় রাজার মেয়ে বলে তাকে কৈকেয়ী বলেও ডাকা হত। কন্যার পিতা বোধহয় এক্ষেত্রে কন্যা সম্প্রদান করতে রাজি হননি, কিন্তু ভদ্রার দাদারা, মানে, কৃষ্ণের পিসতুতো ভাইরা এই বিয়ের ব্যবস্থা করেন- কৈকেয়ীং ভ্রাতৃভিদত্তাং কৃষ্ণঃ সন্তর্দনাদিভিঃ।

কোশলের রাজা নগ্নজিতের মেয়ে ছিলেন সত্যা। বাবার নামে তাকে লোকে নাগ্নজিতী বলে ডাকত। এঁকে বিয়ে করার সময় কৃষ্ণকে একটু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। সাতটা ষাঁড় অথবা আমার ধারণা সাতটা ষণ্ডা মার্কা লোকের সঙ্গে যুদ্ধ করে যিনি বিজয়ী হবেন তিনিই নাগ্নজিতী সত্যাকে পাবেন– এইরকম একটা শর্ত ছিল এই বিয়েতে। কৃষ্ণ এই অসামান্য কার্যটি করে পাণিপ্রার্থী অন্যান্য রাজাদের জয় করে সত্যাকে বিয়ে করেন। লক্ষ্মণা মদ্র রাজার মেয়ে। গরুড় যেমন অমৃতের ভাণ্ড নিয়ে উড়ে গিয়েছিলেন তীব্র বেগে কৃষ্ণ তেমনই হরণ করে নিয়ে এসেছিলেন লক্ষ্মণাকে।

ভাগবত পুরাণে কৃষ্ণ মহিষীদের সম্পর্কে খানিকটা আঁচ পাওয়া গেলেও শৈব্যা গান্ধারীর সম্বন্ধে প্রায় কোনও কথাই পাওয়া যায় না। অন্যদিকে হরিবংশ ঠাকুর কালিন্দী, মিত্ৰবিন্দা– ইত্যাদি নাম অষ্টমহিষীর লিস্টিতে রাখলেও তাদের পরিচয় বা বিবাহের প্রক্রিয়ায় কোনও শ্লোক খরচ করেননি। লক্ষণীয় ব্যাপার হল- কৃষ্ণপ্রিয়া রুক্সিণী, সত্যভামা কিংবা জাম্ববতীর পরেই কৃষ্ণমহিষীদের মধ্যে অন্য যে নামটি হরিবংশে পৃথক এক বৈশিষ্ট্য নিয়ে উল্লিখিত হয়েছে, তিনি কিন্তু এই গান্ধারী। হরিবংশ যেহেতু ভাগবত পুরাণের থেকে অনেক প্রাচীন রচনা, তাই গান্ধারীকে আমরা আলাদা কিছু গুরুত্ব দেবই।

গান্ধারী শৈব্য রাজার মেয়ে এবং তিনি নাকি দেখতে ছিলেন স্বর্গের অপ্সরার মতো সুন্দরী শৈব্যস্য চ সুতাং তন্বীং রূপেণাঙ্গরসোপমাম। কৃষ্ণের বউতে বউতে ঝগড়া বাধানোর জন্য নারদ অন্য কোনও মহিষীর নাম না করলেও জাম্ববতীর সঙ্গে এক নিশ্বাসে গান্ধারীর নাম করেছেন। নারদ রুক্সিণীকে বলেছিলেন– আজ তোমায় দেখে জাম্ববতী আর গান্ধারীরা জীবনে আর সৌভাগ্যের আশা করবেন না। ভাবে বুঝি, এই গান্ধারীও খুব কম কিছু ছিলেন না। স্ত্রীলোকের মঙ্গল-ব্রত পালনের উৎসবে আমরা রুক্মিণী, সত্যভামা আর জাম্ববতীর সঙ্গে চতুর্থ যে কৃষ্ণ মহিষীকে স্বনামধন্যা দেখতে পাই তিনি এই শৈব্যা গান্ধারী– গান্ধাররাজপুত্রী চ যোগযুক্তা নরাধিপ। পুরাণগুলি এবং হরিবংশ ছাড়াও মহাভারতে আমরা গান্ধারীর সম্বন্ধে একটা ধূসর উল্লেখ পাই। রুক্মিণীর বিবাহের সময় কৃষ্ণের পরাক্রমবার্তা প্রকাশের পরেই মহাভারতের একটি শ্লোকে বলা হচ্ছে কৃষ্ণ গান্ধার রাজ্যের সকলকে খুব তাড়াতাড়ি পর্যুদস্ত করে নগ্নজিতের ছেলেদের সবাইকে পরাস্ত করেছিলেন যে গান্ধারাংস্তরসা সম্প্রমথ্য জিহ্বা পুত্রা নগ্নজিতঃ সমগ্রান্। পুরাণে-ইতিহাসে গান্ধার রাজ্য এবং শিবিদের রাজ্য প্রায় পাশাপাশি এবং এমনও হতে পারে সেই শৈব্য রাজাই গান্ধার শাসন করছিলেন তখন এবং গান্ধারের অধিকার পাবার পরেই হয়তো স্মারক হিসেবে নবজাত কন্যার নাম রেখেছিলেন গান্ধারী। গান্ধার রাজ্য এবং নগ্নজিতের ছেলেদের জয় করে কৃষ্ণ গান্ধারী এবং নগ্নজিতের কন্যা নাগ্নজিতাঁকে লাভ করলেন কিনা, সেই খবর মহাভারত সোজাসুজি না দিলেও এই দুই রমণী এই বৃহযুদ্ধের বৈবাহিক ফল বলেই আমরা মনে করি। পুরাণ বলেছে– গান্ধারীর বিয়ের সময় কৃষ্ণ নাকি অন্তত একশোটা রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। রাজাদের অনেককেই তিনি মেরে ফেলেছিলেন, অন্যদের দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়েছিলেন রথে– গান্ধারকন্যাবহনে নৃপাণাং রথে তথা যোজনমূৰ্জিতানাম। কাজেই এত কষ্ট করে যে রমণীকে কৃষ্ণ অন্তঃপুরে নিয়ে এসেছিলেন, তিনিও খুব হেলাফেলার কেউ নন।

তবু কৃষ্ণের অন্তঃপুরের শোভাসার এই সমস্ত রমণীদের আমরা না হয় হেঁটেই দিলাম। প্রমাণ-বাহুল্য অথবা ঐতিহাসিকতা– দুই দিক দিয়েই হয়তো এই রমণীদের আমরা প্রতিষ্ঠা করতে বিফল হব। কিন্তু কৃষ্ণের বুক খালি করে রুক্মিণী, সত্যভামা এবং জাম্ববতাঁকে অস্বীকার করার উপায় আমাদের নেই। উপায় নেই কারণ মহাভারতের মতো প্রাচীন গ্রন্থ আর কারও নাম না করে অন্তত এই তিনজনের নাম করেছে। উপায় নেই, কারণ এঁরা ইতিহাসের মতো সত্য এবং এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ইতিহাস বোধহয় রুক্মিণী, কেননা এমন কোনও শাস্ত্রীয় এবং মহাকাব্যিক উপাদান নেই, যেখানে ভীষ্মকাত্মজা রুক্মিণীর বিষয়ে সেই রাক্ষস বিবাহের কথা উল্লিখিত হয়নি এবং এমন কোনও শাস্ত্রীয় উপাদান নেই, যেখানে রুক্মিণী দ্বারকার পট্টমহিষী বলে স্বীকৃত নন। বিশেষত মহাভারতে রুক্মিণীর বিবাহের কারণে কৃষ্ণের শৌর্য-বিক্রমের ঘটনাটা একটা উদাহরণ হয়ে আছে। মহাভারতের উদ্যোগপর্বে অর্জুন যখন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের প্রতি নিজের শৌর্য-সংকেত পাঠাচ্ছেন, তখন তিনি কৃষ্ণের অপ্রতিরোধ্যতার কথা বলেছেন রুক্মিণী-হরণের উদাহরণ দিয়ে। অর্জুন বলেছেন তিনি একটিমাত্র রথ নিয়ে বিদর্ভে গিয়েছিলেন রুক্মিণীকে তুলে আনার জন্য, সেটা তো তিনি করেইছেন, কিন্তু সেটা সমস্ত ভোজদের যুদ্ধে পরাজিত করেই রূপে-গুণে বহুখ্যাত রুক্মিণীকে নিয়ে এসেছেন দ্বারকায় এবং তার গর্ভে প্রদ্যুম্নের মতো যশস্বী পুত্রের জন্ম দিয়েছেন– যো রুক্মিণীমেকরথেন ভোজান। উৎসাদ রাজ্ঞঃ সমরে সম্প্রসহ্য।

আমরা কৃষ্ণের মহিষীকুলের মধ্যে রুক্মিণীর বৈবাহিক গরিমা নিয়েও আর বেশি কথা বলতে চাই না এবং কৃষ্ণের পট্টমহিষী হিসেবে তার প্রকট সম্মান নিয়েও আর বিশদ কোনও আলোচনা করতে চাই না। কিন্তু একটা জিজ্ঞাসা তবু থেকেই যায়। সেটা হল– কতটা আত্মিক আকর্ষণ থাকলে অথবা কতটা সামাজিক বিকর্ষণ থাকলে একজন পুরুষ একটি রাক্ষস বিবাহ করার চেষ্টা করে। একটি মেয়েকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে বিবাহ করার মধ্যে যে অপ্রমেয় পৌরুষ আছে, সেটা সচরাচর তার নিজের ঘরের লোকেরাও পছন্দ করেন না ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বেন বলে, আর কন্যার বাড়ির লোকেরা সেটাকে নিজেদের শক্তির প্রতি চরম অপমান এবং সম্মানের প্রতি চরম অবজ্ঞা বলে মনে করেন। রুক্মিণীর বিবাহের ক্ষেত্রে ঘটনাটা রাজনৈতিক দিক থেকেও একেবারে বিরুদ্ধ জায়গায় চলে গিয়েছিল। আমরা আগেই জানিয়েছিলাম– কংসবধের পর মগধরাজ জরাসন্ধ রাজনৈতিকভাবে অধিক সক্রিয় ওঠেন কৃষ্ণের বিরুদ্ধে। বিদর্ভরাজ ভীষ্মক এবং তার পুত্র যেহেতু জরাসন্ধের অনুগামিতায় রুক্মিণীকে শিশুপালের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন, সেখানে কৃষ্ণ ভেবেছিলেন ভীষ্মক তার স্ববংশীয় ভোজ-বৃষ্ণি-অন্ধকদের কাছাকাছি ঘরের লোক এবং কৃষ্ণ যদি নিজে এই বিবাহ জোর করেও করেন, তা হলেও কন্যার পিতা হিসেবে কন্যাস্নেহেই একসময় তিনি কৃষ্ণের কাছাকাছি চলে আসবেন। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। মহাভারতের রাজসূয়-পর্বের আরম্ভেই কৃষ্ণ দুঃখ করে দাদা যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন– আমার শ্বশুরমশাই ভীষ্মকভোজ তো কম রাজা নন। ভৌগোলিক দৃষ্টিতে তার রাজ্যও যেমন অনেকটা ভূমি জুড়ে আছে, তেমনই নিজের পরাক্রমে তিনি ক্ৰথ- কৈশিক এবং পাণ্ড্য রাজাকেও জয় করেছেন। আমার শ্বশুরের ভাইটিও এক বিরাট যুদ্ধবীর। কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে আমার শ্বশুর একেবারে আমার উলটো দিকে ছিলেন। তিনি মাগধ জরাসন্ধের চিহ্নিত ভক্তের একজন– স ভক্তো মাগধং রাজা ভীষ্মকঃ পরবীরহা।

কৃষ্ণ যে ওই রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমাধানটা নিজের অনুকূলে করতে চেয়েছিলেন রুক্সিণী-হরণের মাধ্যমে এবং বিবাহের মাধ্যমে, সেটা তিনি যুধিষ্ঠিরকে জানিয়েছেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও তিনি জানাতে ভোলেননি যে, তাঁর এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। তিনি বলেছেন– আমি ভোজরাজ ভীষ্মকের মেয়েকে বিয়ে করে তার প্রিয় আচরণই করতে চেয়েছিলাম, তার জন্য অনেক বিনীত আচরণও করেছি– প্রিয়াণ্যাচরতঃ প্রৌঢ়ান সদা সম্বন্ধিনস্ততঃ–কিন্তু তাদের অনেক ভজনা করা সত্ত্বেও, অনেক আনুকূল্যময় প্রচেষ্টা দেখানোর পরেও, তারা মানে আমার শ্বশুরকুলের লোকেরা সকলেই মাগধ জরাসন্ধের মতে চলেন এবং আমাদের সবরকম অপ্রিয় কাজগুলিই করেন– ভজতো ন ভজত্যম্মান অপ্রিয়েষু ব্যবস্থিতঃ।

মহাভারতে কৃষ্ণের এই মন্তব্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, রুক্মিণীকে বিবাহ করে দ্বারকায় তাকে পট্টমহিষীর সম্মান দিয়েও কৃষ্ণ তার শ্বশুর এবং শ্যালকের মন জয় করতে পারেননি। কিন্তু আমাদের এই বাস্তব জগতে এই ধরনের বিবাহের একটা বিশেষ তাৎপর্য তৈরি হয়। অর্থাৎ মেয়ের বাড়ির সকল অভিভাবকতার বিরুদ্ধে গিয়ে একটি মেয়েকে যখন জোর করে কোনও পুরুষ বিয়ে করে, তো তখন তার পিছনে দুটি তিনটি কারণ কাজ করে এবং তা কৃষ্ণের ক্ষেত্রেও একইভাবে কাজ করেছে বলে আমরা মনে করি। প্রথমত এমন হতে পারে ছেলেটি এবং মেয়েটি দু’জনেই দু’জনকে পছন্দ করে এবং ভালবাসে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেয়ের বাড়ি থেকে ছেলেটিকে অযোগ্য কিংবা যে কোনও কারণে অসহনীয় ভাবলে ছেলেটি জোর করে মেয়েটিকে তুলে এনে বিয়ে করে অথবা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। কৃষ্ণ তাই করেছেন, তবে পালানোর পরিবর্তে শ্বশুর-কুলের বিরুদ্ধে তিনি ভয়ংকর পরাক্রম প্রকাশ করেছেন এবং তা ভীষণভাবেই রুক্মিণীর স্বমতে করেছেন। দ্বিতীয় কী কারণ থাকতে পারে এতখানি বিরুদ্ধতার মুখেও এমন বিয়ে করার কারণ হতে পারে, ভীষণ রকম পছন্দ এবং ভালবাসা, যা কৃষ্ণের ক্ষেত্রে একটা জরুরি মাৎসর্য তৈরি করেছে। পরবর্তীকালে জরাসন্ধের অনুগামী শিশুপালের মুখে যে মাৎসর্য প্রকাশ পেয়েছে, বারবার তিনি বলেছেন- রুক্মিণী আমার ছিল, আমার কাছে বাগদত্তা; তাকে কৃষ্ণ ছিনিয়ে নিয়েছে– এটা কৃষ্ণ মেনে নিতেই পারেননি, বিশেষত রুক্মিণী স্বয়ংই যেখানে কৃষ্ণের দিকে ঝুঁকে রয়েছেন, সেখানে তাকে অন্যে কেউ জীবনসঙ্গিনী করুক, এটা যেমন রুক্মিণী চাননি, তেমনই কৃষ্ণও চাননি। যে রুক্মিণী কৃষ্ণকে পত্র লিখে জানিয়েছিলেন যে, সিংহের ভাগ যেন শেয়ালে টেনে নিয়ে না যায় গোমায়ুবন-মৃগপতেলিমম্বুজাক্ষ সেখানে এক সুন্দরী গুণবতী রমণীর কথায় কৃষ্ণ কতটা ‘ইলেটেড’ ছিলেন যে, কন্যাপক্ষের সকল যূথবদ্ধ বিরুদ্ধতার মুখেও কৃষ্ণ তাকে হরণ করার ব্যাপারে আমোদিত বোধ করেছেন।

রুক্মিণীকে বিয়ে করে নিয়ে আসার পর রুক্মিণী দ্বারকাধীশ কৃষ্ণের পট্টমহিষী হলেন। যেমন তার রূপ, তেমনই তার গুণ, কৃষ্ণের প্রতি যেমন তার অনুকূল আচরণ, তেমনই আনুগত্যময়ী তার সেবাবৃত্তি। তিনি মনে মনে সদা-সর্বদা জানেন যে, তার স্বামী খুব বড় মানুষ, দুনিয়ার যত রাজনৈতিক তথা হাজারও সামাজিক সমস্যা আছে, সেগুলির সমাধানের ক্ষেত্রে দুনিয়ার লোক তার স্বামীকেই মুরুব্বি মানে। এমন অবস্থায় স্ত্রী হিসেবে তার অনেক দায়িত্ব এবং সে দায়িত্ব তাকে পালন করতে হবে স্বামীর ইচ্ছার অবিরোধে। বস্তুত এই যে আনুগত্যময়ী সেবার ভাবনা ভারতবর্ষের অখিল নারীকুলের আদর্শ হিসেবে চিহ্নিত, এই আদর্শের প্রতীক হলেন লক্ষ্মী। রুক্মিণীর মধ্যে এই আনুগত্য এবং অনুকূলতার মাহাত্ম্য পুরোপুরি ছিল বলেই তিনি শাস্ত্রীয় ভাবনায় নারায়ণরূপী কৃষ্ণের অথবা কৃষ্ণরূপী নারায়ণের বক্ষবিহারিণী লক্ষ্মী বলে কীর্তিত হয়েছেন।

লক্ষ্মীর পৌরাণিক চিত্রটাই এমন যে, একটা ছবি আঁকলে লক্ষ্মীকে নারায়ণের পাদসংবাহনে রত অবস্থাতেই দেখা যাবে। একইভাবে রুক্মিণীও কৃষ্ণের কাছে সদা নত। কৃষ্ণ যা বলবেন, তাই তিনি বিশ্বাস করবেন। তর্ক, প্রতিবাদ, দাম্পত্য কলহ– এ সবের ধারে কাছে তিনি যেতেন না। কৃষ্ণ তার স্বামী, এবং সেই স্বামী মাঝমাঝেই তার কাছে আসেন, তাকে পট্টমহিষীর মর্যাদা দেন– এতেই রুক্মিণী এত ডগমগ হয়ে থাকেন যে, স্বামীর কাছে প্রেমিকের ভালবাসা তিনি আশাই করেন না। স্বামী চাইলে রুক্মিণী সব করতে পারেন, অন্যের কাছে অভব্য অযৌক্তিক হলেও, পারেন।

এই ব্যাপারে একটা সঠিক উদাহরণ মহাভারত থেকেই দিতে চাই। না, সেটা এইরকম কোনও উদাহরণ নয় যেখানে অপমানে-অনাদরে কেউ কাঁদছেন, আর কৃষ্ণ সেই ভক্তহৃদয় শান্ত করার জন্য রুক্মিণীকেও অনাদর করে চলে এলেন তাঁর কাছে। এ-রকমটা দ্রৌপদীর অলৌকিক আহ্বান এবং কৃষ্ণের অলৌকিক আগমনেই সংঘটিত হয়েছিল পাণ্ডবদের বনবাসকালে, সেই যে সশিষ্য দুর্বাসা এসে অসময়ে খেতে চেয়েছিলেন দ্রৌপদীর কাছে। দ্রৌপদী সংকটমোচনের জন্য প্রপন্ন হয়ে স্মরণ করলেন বিপত্তারণ কৃষ্ণকে আর কৃষ্ণও অমনই পাশে-শুয়ে থাকা রুক্মিণীকেও কিচ্ছুটি না বলে একেবারে অলৌকিক গতিতে চলে এলেন দ্রৌপদীর সংকটমোচনের জন্য পাশ্বস্থাং শয়নে ত্যক্কা রুক্মিণীং কেশবঃ প্রভুঃ। আমরা এমন উদাহরণ দেব যা কৃষ্ণের নিজের জীবনেই ঘটছে, কিন্তু সেটাও গল্পকথা হিসেবেই আসছে মহাভারতে। কিন্তু এই কল্পকাহিনিকে প্রমাণ হিসেবে এইজন্য উল্লেখ করছি যে, এই গল্পগুলি রুক্মিণীর সতীত্ব, পাতিব্ৰত্য কিংবা একনিষ্ঠতা প্রমাণের জন্য নয়, বরঞ্চ আনুগত্য, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রমাণ করার জন্যই এই গল্পগুলি।

কৃষ্ণ দ্রৌপদীর সংকটমোচন করতে আসছেন, এটা তো হতেই পারে, কিন্তু পাশে শুয়ে থাকা রুক্মিণীকে একবারের তরেও তিনি জানিয়ে আসছেন না, পৌরাণিক রুক্মিণীর প্রতি এই অনাদর-তুচ্ছতা কিন্তু অপ্রাসঙ্গিকভাবে টেনে আনছেন এইজন্যই যে, রুক্মিণীকে বুঝতেই হবে– তাঁর স্বামী বৃহত্তর কার্য সাধনের জন্যই প্রয়োজনে চলে গেছেন এবং সময় খুব অল্প ছিল বলেই তাকে জানিয়ে যেতে পারেননি কৃষ্ণ, সেটা বুঝতে হবে এবং এটা সত্যি রুক্মিণী পরেও এ-বাবদে প্রশ্ন করবেন না। মহাভারত থেকেই আরও একটি উদাহরণ দেব, অবশ্য সেখানেও অদ্ভুতভাবে দুর্বাসা মুনিই আছেন, যাঁকে পৌরাণিকভাবে ব্যবহার করা হয় ধৈর্য-সহ্য পরীক্ষণের চরমতা বোঝানোর জন্য। প্রসঙ্গটা তৎকালীন সমাজের ব্রাহ্মণ্যশক্তির প্রতিষ্ঠার্থে কৃষ্ণের মানসিকতা বুঝে নেওয়া। অর্থাৎ কিনা, কৃষ্ণের কথা এবং জীবন দিয়ে প্রমাণ করা যে, ব্রাহ্মণের অবহেলা যেন কখনও না হয়। তারা বকুক, মারুক, অপমান করুক, তাদের কথা বিনা বাক্যে মেনে নিতে হবে। কৃষ্ণ নিজের মুখেই গল্প বলছেন রুক্সিণীর গর্ভজাত প্রদ্যুম্নের কাছে। আমরা আপাতত রুক্মিণীকে নিয়ে ব্যস্ত আছি বলেই ব্রাহ্মণ্যের মর্যাদা কতটা প্রতিষ্ঠা হল না হল, সেটা নিয়ে আমাদের এতটুকুও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু সেই ব্রাহ্মণ রুক্মিণীর প্রতি কী ব্যবহার করেছেন এবং কৃষ্ণের খাতিরে শুধু স্বামীর সহধর্মচারিণী হবার জন্য রুক্মিণী কতটা সয়েছেন, সেইজন্যই কৃষ্ণের কৃতজ্ঞতা-মুখর বক্তব্যটা আমাদের শুনতে হবে।

কৃষ্ণ জানাচ্ছেন– এক সময় দুর্বাসা মুনি দ্বারকায় এসে উপস্থিত হলেন। তার গায়ের রং বানরের লোমের মতো ধূসর তামাটে, পরনে কৌপীন, গালে লম্বা দাড়ি, রোগাটে গড়ন, আর ভীষণ লম্বা চেহারা, হাতে আবার বেলকাঠের বড় লাঠি। তিনি দ্বারকায় এসে হাটে মাঠে-সভায় বলে বেড়াতে লাগলেন– এমন কেউ আছে নাকি এই জায়গায় যে আমাকে একটু থাকতে দেবে ঘরে। আমি ঋষি দুর্বাসা, কে আমাকে আদর করে রাখবে– দুর্বাসসং বাসয়েৎ কো ব্রাহ্মণং সৎকৃতং গৃহে। দুর্বাসাকে ঘরে রাখলে যে সব সমস্যা হতে পারে, সে সব অবশ্য দুর্বাসা নিজে মুখেই বলে বেড়ালেন। বললেন– হ্যাঁ, আমাকে ঘরে রাখা খুব কঠিন কাজ অবশ্য। কেননা সামান্য একটু গোলমাল হলেই দুর্বাসা মুনির রাগ হয়ে যায় এবং যে আমাকে থাকতে দেবে, তাকে সব সময়ই খেয়াল রাখতে হবে আমার যাতে রাগ না হয়। তবে এ-সব শর্ত-নিয়মের কথা শুনে কেই বা আমাকে আশ্রয় দিতে রাজি হবে– পরিভাষাঞ্চ মে শ্রুত্ব কো নু দদ্যাৎ প্রতিশ্রয়।

কৃষ্ণ বলেছেন– আমি সব জেনে বুঝেই দুর্বাসাকে আমার ঘরে থাকতে দিলাম। সত্যিই তাকে রাখার এবং তার আতিথেয়তার অনেক সমস্যা ছিল। তিনি এক-একটা সময়ে ভীষণ বেশি পরিমাণ খেয়ে ফেলতেন আবার কখনও ভীষণ কম খেতেন। কখনও খাবার পর বাইরে গেলেন হাত ধুতে, কিন্তু তারপর আর ফিরেই আসলেন না– একদা সোহল্পকং ভুক্তেন চৈবেতি পুনর্থহান্৷ কৃষ্ণ দুর্বাসা মুনির খামখেয়ালি স্বভাবটার কথা জানাচ্ছেন বটে, কিন্তু তার জন্য তাঁর নিজের অসহনীয়তার কথা বলছেন না। এই খামখেয়ালিপনা কতটা যে, শোয়ার ঘরে ঢুকে তিনি বিছানার চাদর লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যাবেন, দেয়ালে টাঙানো ছবি ভেঙে দেবেন, কখনও কাঁদবেন, কখনও হাসবেন কিন্তু এইসব কিছুর পিছনে কোনও কারণ যে থাকবে তার কোনও মানে নেই- অকস্মাচ্চ প্রহসতি তথাকস্মাৎ প্ররোদিতি।

দুর্বাসার এইরকম ভয়ংকর সব আচরণের মধ্যে একটি বিশেষ দিনের ঘটনা জানাচ্ছেন কৃষ্ণ। সেদিন হঠাৎই তিনি বললেন- আমার খুব পায়েস খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। এখনই ব্যবস্থা করো। দুর্বাসার চরিত্র ভালরকম জানা ছিল বলে কৃষ্ণ সূপকারকে দিয়ে প্রায় সবরকম খাবারই রাঁধিয়ে রাখতেন। ফলে সুস্বাদু সুমধুর পরমান্ন তার সামনে সাজিয়ে দিতে কৃষ্ণের কোনও অসুবিধে হল না। দুর্বাসা পায়েস খেতে বসলেন, খানিকটা খেলেনও কিন্তু তারপরেই উঠে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণকে বললেন– বাকি পায়েসের খানিকটা খুব তাড়াতাড়ি আমার সারা গায়ে মাখিয়ে দাও তো– ক্ষিপ্রমঙ্গানি লিম্পস্ব পায়সেনেতি স স্ম হ। এই আদেশ পালন করাটা আপাতদৃষ্টিতে খুব সরল-সহজ মনে হতে পারে। কিন্তু অপরিচিত একটি লোক, তার ঢ্যাঙা লম্বা রোগা চেহারা, শুষ্ক-রুক্ষ শরীর এবং সর্বোপরি সেই পুরুষের গায়ে পায়েস মাখাতে কৃষ্ণের মতো শৌখিন মানুষের কেমন লেগেছিল, তা আজকের দিনের মানুষের কল্পনাতেও নেই। আমার মনে আছে, আমার খুব ছোটবেলায় গ্রামের বুড়োদের খুব সরষের তেল মাখা অভ্যেস ছিল এবং অনেক সময়েই তারা দু-চারজনে খোশ গল্প করতে করতে বাড়ির বালকদের নিয়োগ করতেন তেল মাখানোর জন্য। আমার মনে আছে– বাড়িতে আসা

ওইরকম এক খটখটে বুড়োর গায়ে তেল মাখাতে আমার খুব ঘেন্না করেছিল-সে বুড়োর আবার কথা বলার সময় দন্তহীন মুখ দিয়ে নাল পড়ত। কিন্তু কথা বলা তার চাই-ই, এই অবস্থায় ওই তেল-নালের মিশ্রিত সেই মর্দন যে আমার কেমন লেগেছিল, সেটা ভাবতে এখনও আমার ঘৃণা হয়। কৃষ্ণ বলেছেন– আমি কিন্তু কোনও বিচার করিনি, আমি বিনা বাক্যে তাঁরই উচ্ছিষ্ট পায়েস তার সারা গা, চুল, দাড়ি সব জায়গায় মাখিয়ে দিলাম– তেনোচ্ছিষ্টেন গাত্রাণি শিরশ্চৈবাভ্যমৃক্ষয়ম্।

এ পর্যন্তও ঠিক আছে। কৃষ্ণকে দুর্বাসা আদেশ করেছেন, তিনি তার গায়ে তারই ইচ্ছেমতো পায়েস মাখাচ্ছেন, তবু ঠিক আছে এই ঘটনা। কিন্তু তার পরের বার্তা আরও ভয়ঙ্কর এবং এখানে কৃষ্ণ তার আত্যন্তিক অসহায়তা জ্ঞাপন করছেন ছেলে প্রদ্যুম্নের কাছে। কৃষ্ণ বললেন– জানো প্রদ্যুম্ন! আমি তো তার গায়ে পায়েস মাখালাম আদেশমতো। কিন্তু হঠাৎই তার নজর পড়ল একান্তে দাঁড়িয়ে থাকা তোমার জননী শুভাননা সুন্দরী রুক্মিণীর দিকে– স দদর্শ তদাভ্যাসে মাতরং তে শুভাননাম। মুনি এবার পায়েসের বাটি হাতে এগিয়ে গেলেন রুক্মিণীর দিকে এবং মুনির ইচ্ছামতো রুক্মিণীও তার সর্বাঙ্গে পায়েস মাখিয়ে দিলেন বিনা দ্বিধায় এবং বিনা বাধায়। কৃষ্ণ অসহায় মুখে দাঁড়িয়ে আছেন, এবার মুনি নিজেও পায়েস মাখছেন এমনকী রুক্মিণীকেও মাখিয়ে দিচ্ছেন মহামজায়। দুর্বাসা মুনি পায়েস নিয়ে সর্বাঙ্গে পাগলামি করছেন, অবস্থার গতিকে হতচকিতা রুক্মিণী নিজের অসহায়তায় খানিক হেসে ঘটনাটাকে যথাসম্ভব লঘু করার চেষ্টা করছিলেন– তামপি স্ময়মানাং স পায়সেনাভ্যলেপয়ৎ।

এমন কাহিনিতে ফ্রয়েড সাহেব কোন অবচেতনের তত্ত্ব স্মরণ করতেন জানি না। জানি না, সাইমন দি বিভোয়া বা আঁদ্রে দোয়ারকিন-এর কী প্রতিক্রিয়া হত অনুরূপ ঘটনায়। কিন্তু আমরা যদি এই মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মধ্যে না গিয়েও শুধু সাধারণ তথ্যটুকু বিচার করি, তা হলেও বলব– রুক্মিণী এই অদ্ভুত আচরণ সহ্য করছেন শুধু স্বামীর অসহায়তার দিকে তাকিয়েই। দুর্বাসার মানসিক বিকার শুধু পায়সের অভ্যঙ্গ-লেপনেই শেষ হয়ে যায়নি। ওইরকম পায়েস লিপ্ত অবস্থায় দুর্বাসা রুক্মিণীকে একটি রথের সঙ্গে যুতে দিয়ে বললেন– রথ টানো–মুনিঃ পায়সদিগ্ধাঙ্গীং রথে তৃর্ণমযোজয়ৎ। রথে ঘোড়ার বদলে রুক্মিণী– তার গজগামিতার অভ্যাসে ঘোড়ার গতি আসে না, কিন্তু মুনি তাকে ছাড়লেন না, মুনি রুক্সিণীতেই ঘোড়সওয়ারি করতে করতে তাকে প্রকাশ্য রাজপথে নিয়ে গেলেন, ঘোড়ার প্রাপ্য চাবুকও তাকে খেতে হল মাঝে-মাঝে। যদু-বৃষ্ণি-সঙেঘর লোকেরা ব্রাহ্মণের উদ্দেশে যথেচ্ছ গালাগালি দিতে লাগল। কিন্তু কৃষ্ণ কিছু বললেন না, রুক্মিণীও কিছু বললেন না।

সব কিছু অম্লানবদনে সহ্য করার ফল অবশ্যই হল। দুর্বাসা ঋষি অনেক আশীর্বাদ করলেন কৃষ্ণ এবং রুক্মিণীর ধৈর্য-সহ্য দেখে, হয়তো এতে ব্রাহ্মণকুলের মর্যাদা এবং উচ্চতাও প্রতিষ্ঠা হল, কিন্তু সবকিছুর ওপরে এখানে রুক্মিণীর মানসিকতা আমাদের ভাবনালোকে তার সম্বন্ধে অন্য এক মর্যাদা তৈরি করে। মহাভারতে এই কাহিনি উল্লিখিত হয়েছে ব্রাহ্মণদের পূজ্যত্ব স্থাপনের জন্য, কিন্তু এই কাহিনি আমাদের কাছে অন্য এক তাৎপর্য বহন করে এবং সেটা স্বামীর প্রতি রুক্মিণীর মানসিকতা। বিনা প্রতিবাদে, বিনা কোনও প্রতিরোধে স্বামীর ব্যাপারে এই যে আনুকূল্যবোধ, এটাই একটা চরম আত্মত্যাগ বা চরম সতীত্ব বলে আমরা মহিমান্বিত করতে পারি, কিন্তু জিজ্ঞাসা হয়– এই সার্বিক আত্মনিবেদনে কৃষ্ণের মতো এক রসিক শেখর বিদগ্ধ-পুরুষ সম্পূর্ণ সুখী হতে পারেন কিনা। কিংবা অনুরূপ অবস্থায় পড়লে কৃষ্ণের অন্যতরা স্ত্রী সত্যভামা অথবা জাম্ববতী এতটা নিরীহ থাকতেন কিনা!

মহাভারতে উল্লিখিত ওই পায়েস মাখামাখি এবং মাখানোর ঘটনাটা সত্য নাও হতে পারে, হতে পারে এটা শুধুই এক কাহিনিমাত্র, এমনকী রুক্মিণীর এই অসম্ভব নমনীয় স্বানুকূল ব্যবহারে কৃষ্ণও পরম চমৎকৃত হয়ে বলতে পারেন যে, এমন বশংবদ সেবালক্ষ্মী আর দ্বিতীয় নেই দুনিয়ায় এবং হয়তো সেটাই এই কাহিনির ব্যঞ্জনা। কিন্তু তবুও এই সার্বক্ষণিক বশংবদতা, প্রস্তুতা এবং অনুকূলতা কৃষ্ণের মতো বিদগ্ধ পুরুষের মনোহরণ করে কিনা, সেটা ভাবার আছে। হয়তো এখানে প্রেম-ভালবাসা এবং কামনার ব্যাপারে চিরন্তন পুরুষের যৌন-মানসও ভীষণভাবে চিন্তনীয়। কেননা স্বভাবতই বহুঁকামী পুরুষ যদি বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তবে তার যৌনতার জায়গা সীমাবদ্ধ হয়ে যায় বলেই একটিমাত্র স্ত্রীর মধ্যেই সে যৌনতার বহুতর আস্বাদন লাভ করার চেষ্টা করে। কিন্তু খুব অনুভবযোগ্য প্রণিধানে একথা বুঝতে হবে যে, যৌনতা কিন্তু শুধুমাত্র স্ত্রী-পুরুষের মৈথুনের উপাদানেই একমাত্র গঠিত হয় না, বিষয়ত মৈথুনের ব্যাপারে পুরুষের কামনাই যেহেতু বহুশ্রুত এবং প্রথিত, অতএব তা প্রশমিত করার একমাত্র উপায় বারংবার ইচ্ছামাত্রিক যৌন মিলনও নয়। ঠিক এইখানেই পথ করে নেয় রমণীর কথা, রমণীর বামতা এবং মিলন-চেষ্টা-রহিত শারীরিক বিভঙ্গ। বস্তুত এগুলিও যৌনতারই অবচ্ছায়া বটে, কিন্তু পণ্ডিতরা এটাকে বলেছেন sizzle– এই ‘সিজল’টা নাকি প্রেম-ভালবাসায় জীবনটা চালনার ক্ষেত্রে একান্ত জরুরি।

আমরা বলেছিলাম– রুক্মিণী এত পতিব্রতা, এত বশম্বদ, প্রিয়তম স্বামীর গর্বে তিনি এতটাই মুগ্ধ যে, বিবাহোত্তর জীবনে তার মধ্যে এই মহতী তৃপ্তি যেন এক প্রকার স্থবিরতা সৃষ্টি করে। সসমে জানাই, এই স্থবিরতা কোনও অন্যায় নয়, বরঞ্চ সেটা চরমতম এক সাধুতা, কিন্তু চরম সাধুতার মধ্যে তো এক চরম স্থবিরতা আছেই, যা বৈবাহিক জীবনে স্বামীর দিক থেকে স্বাধিকারের অথবা স্ত্রীর ওপর স্বাধিকারের তৃপ্তি দেয় বটে, কিন্তু সেটাকে প্রেম বলাটা রসশাস্ত্রীয় মতে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। প্রাচীনকালেই এক মহাকবি লিখেছিলেন– একেবারেই নিজের অধীন এক অতি-অনুকূলা নিজের ঘরণীকে আলিঙ্গন করে যে শুয়ে থাকা, এটাকে কি প্রেম বলে? এটা এক ধরনের গৃহস্থ আশ্রমের ব্রতপালন বলা চলে, যা আমরা সকলেই কষ্টে-সৃষ্টে পালন করি–তৎ কিং প্রেম গৃহাশ্রমব্রতমিদং কষ্টং সমাচৰ্যতে। এই কবি অবশ্য সেই বিবাহ-পূর্ব রোমাঞ্চক জীবনে ফিরে যেতে চেয়েছেন, যেখানে চাঁদের জ্যোৎস্না-ধোয়া অভিসার আছে, সংকেত-স্থানের নিশানা দেবার জন্য দূতী আছে, আছে উতল হাওয়া, আর যমুনার জল।

কিন্তু আমাদের কৃষ্ণ এই পূর্বোক্ত প্রেমিক পুরুষের মতো বাস্তববোধহীন মানুষ নন, বরঞ্চ বাস্তবকে তিনি রোম্যান্টিক করে নিতে জানেন। রুক্মিণী নিতান্ত স্বানুকুলা গৃহবধূ বলে তিনি আবার বৃন্দাবনে বিনোদিনী রাইকিশোরীর কাছে ফিরে যাবেন, এমন অধার্মিক তো তিনি নন। বরঞ্চ বিবাহিত জীবনের বাস্তবে রুক্মিণী কী ছিলেন এবং তিনি কী হইয়াছেন, সেটা স্বয়ং রুক্মিণীকেই বুঝিয়ে দিতে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত হননি। তিনি আরও যেন কী চান এই প্রিয়তমা পট্টমহিষীটির মধ্যে যিনি এককালে অমন মধুর একটা প্রেমপত্র লিখে নিজেকে হরণ করতে বলেছিলেন, সেই রুক্মিণী আজ পাতিব্রত্যের বন্ধনে এমনই নম্র-কন্দ্র এবং আবর্জিত হয়ে রইলেন যে, এককালের নারীহরণ-করা রোমাঞ্চকর কৃষ্ণের বুকে সেটা কাটার মতো বেঁধে। এই নম্রতা, বশংবদতার ওপরে কৃষ্ণ আরও কী চান এই প্রথমা বধূটির কাছে, কৃষ্ণ তা লুকোননি। তবে সে খবর মহাভারতে নেই, তা আছে ভাগবত পুরাণে এবং সেটা মহাভারতের রুক্মিণী-ভাবনা প্রতিপূরণ করে।

সেদিন রুক্মিণীর ঘরেই ধবধবে পরিষ্কার বিছানায় বসে ছিলেন কৃষ্ণ। আজ রুক্মিণীও দারুণ সেজে কৃষ্ণকে হাওয়া করছিলেন চামর দুলিয়ে। কৃষ্ণ মনে মনে একটু লজ্জিতও হচ্ছিলেন বোধহয় সত্যি, তাকে কী ভালই না বাসে এই সরলা রুক্মিণী। কৃষ্ণ ছাড়া তার যেন আর দ্বিতীয় কোনও গতি নেই। এমন সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণের কাছে তার এত দীনতা নির্ভরতা কেন– তাং রূপিনীং শ্রিয়ম অনন্যগতিং নিরীক্ষ্য? কৃষ্ণের ইচ্ছার ওপর যাঁর এত নির্ভরতা, কৃষ্ণ ইচ্ছে করেই তাকে কাদাতে চাইলেন। কাদিতে কাদাতে কত সুখ!

কৃষ্ণ বললেন- হ্যাঁগো রুক্মিণী। রাজার ঘরের মেয়ে তুমি। কত শত গুণী, মানী এবং ধনী রাজারা তোমাকে পেতে চেয়েছিল আদর করে। তোমার বাপ-ভাইরাও চেয়েছিলেন তোমাকে ওইরকম বড় ঘরেই পাত্রস্থ করতে। কিন্তু তুমি কী করলে? ঘরের দুয়োরে-আসা তোমার প্রেম-ভিখারি শিশুপালের মতো একটা দুর্দম রাজাকে বাদ দিয়ে তুমি কিনা আমাকেই স্বামী হিসেবে বেছে নিলে? আর আমাকে তো এতদিন দেখছ! জরাসন্ধের মতো রাজাদের ভয়ে এই সমুদ্রগর্ভে দ্বারকায় লুকিয়ে আছি, সিংহাসনে বসে রাজা হওয়াও আর আমার হল না– প্রায়স্ত্যক্তপাসনান। কৃষ্ণ আরও দীনতা প্রকাশ করে রুক্মিণীকে বললেন– আমি জানতাম, সমানে সমানে বিয়ে হয়। রূপ বলো, ঐশ্বর্য বলো, বংশ বলো বন্ধুত্ব আর বিয়ে প্রায় হয় সমানে সমানে। আর তুমি বৈদভী– কথাটার মধ্যে বিদগ্ধা রমণীর ব্যঞ্জনা আছে– তুমি কিনা কিচ্ছুটি না ভেবে আমার মতো গুণ-মানহীন এমন একটা লোককে পছন্দ করে বসলে, যার নাম করে শুধু ভিখারিরা– বৃতা বয়ং গুণৈ হীনা ভিক্ষুভিঃ শ্লাঘিতা মুধা– এমনকী ভিখারিরাও যারা কৃষ্ণ নাম করে দিন-রাত গলা ফাটাচ্ছে, তাদেরও যে আমি কিছু দিতে পারি, তাও নয়।

কৃষ্ণ চেয়েছিলেন রুক্মিণীর বিকার হোক, প্রতিক্রিয়া হোক। ফুলে উঠুক মানিনীর অধরোষ্ঠ, কঠিন হোক যুগল, রক্তলাল হয়ে উঠুক বৈদভী রমণীর অপাঙ্গ দৃষ্টি! ভাগবতের অসামান্য টীকাকার বিশ্বনাথ চক্রবর্তী পর্যন্ত বুঝেছিলেন কৃষ্ণ কী চাইছেন রুক্মিণীর কাছে। তিনি লিখেছেন– স্বামীর কর্তব্যে গম্ভীরা, সদা প্রিয়ভাষিণী রুক্মিণীর মুখে রোষ-ভাষের মধুটুকু কেমন লাগে, সেটার জন্য কৃষ্ণ অমনিধারা কথা কইতে আরম্ভ করেছিলেন– অসম্ভাবিতমানায়াঃ পরমগম্ভীরায়াঃ প্রিয়ংবদায়াঃ রোযোক্তিমাধ্বীকং কণ্বমহং লভেয় ইতি।

কিন্তু হল না। রুক্মিণী মান করা জানেন না। বিকার একটা হল বটে, তবে সেটা মধ্যযুগীয় পতিব্রতা রমণীর গড্ডলিক-বিকার যা হয়ে থাকে, সেই বিকার হল মাথা নিচু করে পায়ের নখ দিয়ে প্রথমে তিনি মাটি খুঁড়তে লাগলেন, কাজল-মাখা চক্ষুর জলে স্তনভূষা কুমকুম রাগ ধুয়ে গেল, গলা দিয়ে আর স্বর বেরোল না- তস্থাবধোমুখ্যতিদুঃখরুদ্ধবাক্। এই গেল প্রথম প্রতিক্রিয়া। রুক্মিণী ভাবলেন স্বামীর বুঝি আর তাকে মনে ধরছে না। কৃষ্ণ বোধহয় ছেড়ে দেবেন তাকে। এ সব কথা ভাবামাত্র বালা সোনার চামর খুলে পড়ে গেল তার হাত থেকে। বুদ্ধি কোনও কাজ করল না। চোখে আঁধার দেখে আলুলায়িতকেশে তিনি মাটিতে পড়ে মুচ্ছো গেলেন।

কী চেয়েছিলেন কৃষ্ণ, আর কী হল? কৃষ্ণ পরম স্নেহে মাটিতে শোয়া নতনা বধূটিকে উঠিয়ে এলো চুল গুছিয়ে বেঁধে দিলেন, কোমল স্পর্শে চোখের জল দিলেন মুছিয়ে– কেশান সমুহ্য তদবক্তং প্রামৃজৎ পদ্মপাণিনা। মনে মনে আহতা একব্রতা মহিষীকে জড়িয়ে ধরে কৃষ্ণ রুক্মিণীকে বললেন– বৈদভী, বিদর্ভ রাজনন্দিনী।

বার বার আমি বলে যাচ্ছি ‘বৈদভী’ সম্বোধনটার মধ্যে নাকি ব্যঞ্জনা আছে। আগে তো বলেইছি– বিদর্ভ দেশের ‘কালচার’ সেকালে এমন ছিল যে, সেখানকার মেয়েদের বৈদগ্ধীর ঘরানা ছিল আলাদা। আর কীসের ব্যঞ্জনা? আছে একটা, সভয়ে বলি। মহাকাব্যের নল-দময়ন্তীর কথা নিয়ে মহাকবি শ্রীহর্ষ নৈষধচরিত লিখেছিলেন। দময়ন্তীর কথা তুললাম এই জন্যে যে, তিনিও রুক্মিণীর মতো বিদর্ভ দেশের মেয়ে। শুধু তাই নয়, যে কুণ্ডিনপুর রুক্মিণীর বাপের বাড়ি দময়ন্তীর বাপের বাড়িও সেইখানেই। কিন্তু দময়ন্তীর রূপের সঙ্গে বুদ্ধি এবং কথা বলার বৈদগ্ধী এত বেশি ছিল যে, নৈষধের লেখনিতে নল দময়ন্তীর সামনেই পঞ্চমুখ প্রশংসা করে বলেছিলেন- এ তুমি কেমন করে কথা বলছ? এ কী আমায় তুমি নিষেধ করছ, নাকি বিধান দিচ্ছ– আমি তো কিছু বুঝতেই পারছি না। অবশ্য কথার সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ, বক্রোক্তি, এ শুধু তোমাকেই মানায়। শুনেছি– আলংকারিকেরা যে ব্যঞ্জনার মাধুর্যের কথা অত করে বলেন, সেই ব্যঞ্জনার আকর হল গিয়ে তোমাদের মতো বিদগ্ধা রমণীদের বাক্যবিন্যাস– বিদগ্ধ-নারী-বচনং তদাকরঃ।

বৈদভী রুক্মিণীর কাছেও কৃষ্ণ এই বাক্যবিন্যাস, এই বিদগ্ধতা আশা করেছিলেন। রুক্মিণীর কাণ্ড দেখে কৃষ্ণ তাই বিব্রত হয়ে সম্বোধন করে বললেন– বৈদভী! অর্থাৎ–তুমি না বিদর্ভ দেশের মেয়ে!তুমি কি পরিহাসও বোঝো না? আমি শুধু আমার কথার পিঠে তোমার উলটো পরিহাস শুনতে চেয়েছিলাম, তাই অমন মজা করে কথাটা বলেছি– তদবচঃ শ্রোতুকামেন স্ফূল্যাচরিতম অঙ্গনে। আমি দময়ন্তীর উদাহরণে বলেছি– কৃষ্ণ রুক্মিণীর কাছে বিদর্ভের বৈদগ্ধী আশা করেছিলেন। কিন্তু রুক্মিণীর প্রতিক্রিয়া আনতা গৃহবধূটির মতো হওয়ায় তিনি ক্ষমা চেয়ে বলেছেন– আমি জানি, তুমি আমাকে ছাড়া আর কিছুই জানে না। কিন্তু নির্মম পরিহাসের উত্তরে আমি নির্মম কথাই শুনতে চেয়েছিলাম– তদবচঃ শ্রোতুকামেন। আমি দেখতে চেয়েছিলাম কেমন করে এই প্ৰেমনত মুখে ফুটে ওঠে মানিনীর সর্বস্ব ধন প্রণয়ের অভিমান, কেমন করে স্ফুরিত হয়ে ওঠে তোমার ঠোঁট, কেমনে নয়নপ্রান্ত হয় অরুণিত– কটাক্ষেপারুণাপাঙ্গং সুন্দর কুটীতটম৷ কৃষ্ণ এবার সাধারণ গৃহস্থের দিন-যাপন আর প্রাণ ধারণের একঘেঁয়েমির কথা তুলে শেষ কথাটা বললেন পাকা নাগরিকের মতো। বললেন– বোকা মেয়ে কোথাকার! প্রণয়িণী প্রিয়ার সঙ্গে পরিহাস-নর্মে দিন কাটাবে বলেই না লোকে বিয়ে করে, ঘর বাঁধে। এটুকু নইলে তার আর কী থাকে বলো। যন্নর্মৈ নীয়তে যামঃ প্রিয়য়া ভীরু ভামিনি।

বৈদভী রুক্মিণী হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন- কৃষ্ণ তা হলে তাকে ছাড়ার কথা ভাবছেন না, তিনি তা হলে এখনও তাকে ভালবাসেন। রুক্মিণী বুঝলেন না– নাগরিক পুরুষের কাছে এ কত বড় পীড়া যে, পরিহাস করে বলে দিতে হয়– এটা পরিহাস। কৃষ্ণ তারই আছেন– এই অস্তিত্বের গরিমাটুকুই তার কাছে এত বড় যে, কৃষ্ণ যেই বললেন– ভয় নেই ভীরু, তোমার সঙ্গে মজা করছিলাম– সঙ্গে সঙ্গে রুক্মিণী খুশি, যাক, তা হলে ভাবনার কিছু নেই– জ্ঞাত্ব তৎ পরিহাসোক্তিং পরিত্যাগভয়ং জহৌ। সঙ্গে সঙ্গে রুক্মিণীর মুখে হাসি ফুটল, সেই লজ্জা লজ্জা ভাব, সেই স্নিগ্ধ দৃষ্টি ফুটে উঠল তার চলনে-বলনে। শুধু তাই নয়, কৃষ্ণ পরিহাস করে যা যা বলেছিলেন, সেই সমস্ত কথার সগম্ভীর তাত্ত্বিক প্রত্যুত্তর দিয়ে রুক্মিণী বললেন– কোথায় তুমি আর কোথায় আমি! সৌন্দৰ্য্য বলো বুদ্ধি বললো, ঐশ্বর্য বলো সবতাতেই তুমি হলে আমার কাছে ভগবানের মতো। সেই তুমি কোথায়, আর বোকা লোকেরা পায়ে ধরে সেই সাধারণী রমণী আমি কোথায়– কাহং গুণ-প্রকৃতিরজ্ঞগৃহীতপাদা।

বস্তুত বিবাহ-পরবর্তী জীবনে রুক্মিণীর মধ্যে এই যে সার্বিক স্বামী-নির্ভরতা এবং স্বামী মনস্কতা দেখতে পাই– এটার একটা কারণ যেমন প্রাচীন ভারতবর্ষের শাস্ত্রভূমি থেকে উঠে আসতে পারে, তেমনই শাস্ত্রীয় আচার আচরণ পরম্পরাবাহিত হতে হতে সেটা সংস্কার এবং সাংস্কারিক বিশ্বাসও তৈরি করে ফেলতে পারে। রুক্মিণীর ক্ষেত্রে এটা তো আছেই, আবার এমনও হতে পারে যে, তার স্বভাবের মধ্যেই এই পরম নির্ভরতার বীজ ছিল, ফলে একবার প্রাণপাতী উদ্যোগ নিয়ে তিনি কোনও মতে সেই স্বামীর রথে উঠে পড়েছিলেন মাত্র। কিন্তু তারপর থেকে তিনি নিজেকে একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন কৃষ্ণের কাছে তাকে প্রকৃষ্টরূপে বহন করার জন্য। এই বহনের মধ্যে স্ত্রীর আত্মনিবেদন তার সমর্পণ, তার বশংবদতা এবং স্বামীর জন্য তার সার্বক্ষণিক তৎপরতা থাকতে পারে, কিন্তু এই ধরনের বহন এমনই এক সার্বিক বন্ধনের সৃষ্টি করে যে, তাতে স্বামীদেবতার মনের মধ্যে এক প্রকার হাঁসফাঁস অবস্থা তৈরি হয়। অনেক পুরুষ অবশ্য এই ব্যবহারে পরম পুলকিত থাকেন, কেননা এতে পুরুষের স্বাধিকার-বৃত্তি সম্পূর্ণ তৃপ্ত হয়, অন্তত একটি রমণীর মধ্যে তার স্বেচ্ছাধীন যৌনতাও তৃপ্ত হয়, এবং প্রতিষ্ঠিত হয় পারিবারিক সুখ। কিন্তু ঠিক এই ধরনের সুখে বিদগ্ধ পুরুষের সুখ সম্পন্ন হয় কিনা, এমনকী কোনও বিদগ্ধা রমণীও শুধু এই ধরনের সুখই বিতরণ করে আত্মতৃপ্তি লাভ করতে পারেন কিনা, সেটা যেমন এতকালের কাব্য-সাহিত্যের প্রমাণে বিচার্য হয়ে ওঠে, তেমনই সেটা প্রমাণ-যোগ্য হয়ে ওঠে জীবনে, মানুষের জীবনে।

আমরা গড্ডলিক মানুষের জীবনপ্রবাহ নিয়ে তো এখানে মাথা ঘামাচ্ছি না, এমনকী বহুঁকামিতার সুযোগ না থাকায় অনেক বুদ্ধিমান পণ্ডিতও স্ত্রীর কাছে একদিকে যেমন দাসীভাব আশা করেন, তেমনই রতিক্রীড়ার সময় তার মধ্যে বেশ্যাসুলভ আচরণও কামনা করেন, আর খাবার সময় হলে সেই নারী হয়ে উঠবেন জননীর মতো– কার্যে দাসী রতৌ বেশ্যা ভোজনে জননীসমা। কিন্তু কৃষ্ণ তো কোনও সাধারণ গড্ডলিক পুরুষ নন, তার মতো বিদগ্ধ ললিত পুরুষ ক’জন আছেন এই দুনিয়ায়? বস্তুত তিনি রুক্মিণীর কাছে দাসীবৎ আচরণও আশা করেন না, প্রচুর রতিভোগও কামনা করেন না, তাকে অনুগত রাখার জন্য কোনও বলপ্রয়োগও করেন না। তা হলে কী অসুবিধে হল? অসুবিধেটা আসলে সেই বৈবাহিক শাশ্বতিকতার মধ্যেই যেখানে পথ চলতে-চলতে পুরুষ রমণী দুই পক্ষেরই। কিছু সাংবিধানিক স্থবিরতা আসে, যেখানে প্রতিপদেই সহজলভ্যতা জীবনের সমস্ত নূতনত্বকেও প্রাত্যহিকতায় পরিণত করে। এরই মধ্যে যে রমণী অথবা যে পুরুষ নিজেকে তখনও ‘ইনটারেস্টিং’ তখনও মোহময় অথচ তখনও নাব্য করে রাখতে পারেন বাক্য এবং মনোময়তায়, তিনি থেকে যান। রুক্মিণী শুধু লক্ষ্মী হয়েই রইলেন কৃষ্ণের কাছে, নিবেদিতপ্রাণা চিরন্তনী।

হায় কৃষ্ণ! তোমার অন্তঃপুরের বৈদৰ্ভী-রীতিতে তোমার মন ভরল না। কিন্তু যে প্রণয়, মানিনীর যে অভিমান ঠোঁট ফোলা, অরুণ অপাঙ্গ– এত যা সব তুমি দেখতে চেয়েছিলে প্রিয়তমার মধ্যে, তা তুমি রুক্মিণীর মধ্যেও পাওনি, জাম্ববতীর মধ্যেও পাওনি, কিন্তু যার কাছে পেয়েছিলে, সে তো তোমার অতি পরিচিতা দ্বারকারই মেয়ে। সত্যভামা। তাঁকে দিয়ে তুমি পুণ্যক ব্ৰত করাতে পারোনি, দুর্বাসার পায়েস তার গায়ে মাখাতে পারেনি, মাননীয় অতিথির চাবুক তার পিঠে পড়েনি, উলটে তার মানের জ্বালায় দিন-রাত্রি তোমার পাগল পাগল লেগেছে, তবু এটা ঠিক যে, এমনতর এক বিষামৃত-মিলনের জন্যই বুঝি লোকে বিয়ে করে ঘর বাঁধে, এমনতর সুখের মতো ব্যথার জন্যই বুঝি ঘর-গেরস্তির আনন্দ, আর বেশি কীই বা আছে– অয়ং হি পরমো লাভো গৃহে গৃহমেধিনাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *