১০. দ্রৌপদী

১০. দ্রৌপদী

০১.

ইংরেজি এই শব্দটার কোনও বাংলা অনুবাদ করা যায় না, অথচ এই ঘটনাটাকে ‘ইনট্ৰিগিং’ না বলে অন্য কোনও শব্দে প্রকাশ করা হলে ঘটনার মেজাজটাকেই অস্বীকার করা হয়। ১৯৭০ সালে যখন নিউ ইয়র্কের রাস্তায় সে-দেশের নারীকুল চরমপন্থী তীব্রতায় ‘ফ্রিডম ট্র্যাশ ক্যান’-গুলিতে তাঁদের অন্তর্বাস, সাজার জিনিস, সাবান, চোখের কৃত্রিম নিমেষগুলিও ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পুরুষদের যৌনতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেন, সেদিন সেই আন্দোলনের ঢেউ কিন্তু ভারতবর্ষেরও এখানে-ওখানে আছড়ে পড়েছিল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের দেওয়া একটা পোস্টার’ পড়েছিল– আজ কি নারী সীতা নেহি দ্রৌপদী হ্যায়। এই কথাটাই আমার কাছে খুব ‘ইট্রিগিং’। পোস্টার সাঁটানোর আগে দিল্লিবাসিনী স্ত্রীস্বাধীনতা-কামিনীরা কি একবারও ভেবে দেখেছিলেন, তারা কী লিখেছেন। অথবা যথেষ্টই ভেবেছিলেন– অন্তত দ্রৌপদী-চরিত্রের একটা দিক তাদের কাছে উদ্ভাসিত, যা সভায় সভায় আজকের প্রগতিবাদিনীদের আমি বোঝাতে পারি না। দিল্লিবাসিনীরা নিশ্চয়ই সেই দিকটা নিয়ে বলতে চাননি, যা আমিও বলতে চাই না। অর্থাৎ কিনা সীতা রামচন্দ্রের প্রতি একনিষ্ঠা এক সাধ্বীবধূ, তিনি রাম ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের কথা মনে মনেও ভাবতে পারেন না, পাঁচ-পাঁচটা স্বামীর সাহচর্য তো দূরের কথা– যথাহং রাঘবাদন্যং মনসাপি ন চিন্তয়ে। না, প্রগতিবাদিনীরা নিশ্চয়ই এরকম ভাবেননি যে, আমরা সীতার মতো এক স্বামীতে সন্তুষ্ট নই, আমরা দ্রৌপদীর মতো পাঁচটা স্বামী চাই। তাদের ভাবনার মধ্যে নিশ্চয়ই দ্রৌপদীর স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, প্রায় সময়েই তার নির্ভীক আচরণ এবং প্রয়োজনে স্বামীদের বিরুদ্ধে কথা বলার যে নিদারুণ অভ্যাস– এগুলোই কাজ করেছে। তবে হ্যাঁ, এ-কথাও প্রগতিবাদিনীরা ভেবে থাকতে পারেন যে, সীতার মতো এক স্বামীর ভবিতব্যতার মধ্যেই বা থাকব কেন, স্বামী যদি অভিপ্রেত না হন, তার চরিত্রে এবং ব্যবহারে যদি স্ত্রীর প্রতি সম্মানবোধ কাজ না করে, তা হলে নতুন আলোয় নতুন সিন্ধুপারেই বা গমনাগমন করব না কেন! অন্তত দ্রৌপদীকে তো সেদিক থেকে মেনে নেওয়াই যায়।

আমরা এই অহেতুক অথচ সামান্য সংবাদটুকু এইজন্য নিবেদন করলাম যে, আজকের দিনের অনেক সভাসমিতিতে দ্রৌপদীকেও ভয়ংকরভাবে পুরুষশাসনের শিকার হিসেবে চিহ্নিত হতে দেখি। স্বামীসহ অন্য পুরুষদের কারণেই তার জীবনে করুণ পরিণতি নেমে এসেছিল– এই সিদ্ধান্তটা দ্রৌপদীর জীবনে পঞ্চস্বামীর ভবিতব্যতা এবং কৌরবসভায় তাঁর প্রতি চরম অভব্য আচরণের নিরিখেই বলা যায়, এমনটা প্রায়ই আমি শুনে থাকি। আমি তাই উপরি-উক্ত সংবাদের মাধ্যমে এ-কথাটা জানালাম যে, দ্রৌপদীর ওপর এহেন পৌরুষেয় অত্যাচারের পরেও দিল্লির প্রগতিবাদিনীরা দ্রৌপদী হবার বাসনা প্রকট করলেন কেন? তা হলে কি দ্রৌপদীর মধ্যে এমন কিছু আছে, যা অনুকরণযোগ্য কাম্য হয়ে উঠতে পারে প্রগতিশীলতার পরিসরেও, অথবা পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে একটি লোকপরম্পরা-প্রাপ্ত কাহিনি নিবেদন করি।

ঘটনাস্থল দুর্যোধনের সাতমহলা বাড়ির অন্দরমহল। এখানে দুর্যোধনের স্ত্রী ভানুমতী আছেন। কোনও কারণে আজ সেখানে পঞ্চস্বামিগর্বিতা দ্রৌপদীর আগমন ঘটেছে। ভানুমতী তাকে নেমন্তন্ন করেছিলেন, নাকি দ্রৌপদী সেখানে নিজেই এসেছিলেন, সে খবর আমরা রাখি না। কিন্তু ভানুমতী যেহেতু দুর্যোধনের স্ত্রী এবং দ্রৌপদী যেহেতু পাঁচ ভাইয়ের এক বউ, তাই তাদের কথাবার্তা সোজা খাতে বইছিল না। বিশেষত এই দুই রমণীর স্বামীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সহজ ছিল না, তাই এঁদের কথাবার্তার মধ্যেও কুটিল ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বিনা কারণেই এসে পড়ছিল। দুর্যোধনের গরবে গরবিনী ভানুমতী শেষ পর্যন্ত চিবিয়ে চিবিয়ে বলেই ফেললেন কথাটা। বললেন– তোমার তো আবার একটা নয়, দুটো নয়, পাঁচ-পাঁচটা স্বামী। এ বিদ্রূপ দ্রৌপদীর গা-সওয়া। কৃষ্ণের পরম-প্রিয়া পত্নী সত্যভামাও মহাভারতের বনপর্বে একই প্রশ্ন করেছিলেন। তবে তার বলার ভঙ্গি ছিল ভাল আর জিজ্ঞাসার সঙ্গে ছিল বিনয়। সত্যভামা বলেছিলেন– পাঁচ-পাঁচটা পাণ্ডব স্বামীকে তুমি কেমন তুষ্ট কর দিদি? ব্রত, স্নান, মন্ত্র, নাকি ওষুধ করেছ দিদি! বল না, কী করলে আমার ওই একটা স্বামীই কৃষ্ণ আমার বশে থাকে! কী বুদ্ধিতেই বা তুমি পাঁচ স্বামীকে সামাল দাও– কেন বৃত্তেন দ্রৌপদী পাণ্ডবান অধিতিষ্ঠসি?

হ্যাঁ, সত্যভামার প্রশ্নে আবদার ছিল, জিজ্ঞাসার মধ্যে মিনতি ছিল, দ্রৌপদীও তাই স্বামী হাতে রাখার কেতা-কানুন সত্যভামাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন একেবারে বুড়ি মাসিমার মতো। কিন্তু এই ভানুমতীর বলার ঢঙ তো আলাদা, ভানুমতীর কথার মধ্যে যেন মেয়েমানুষের লাম্পট্যের ইঙ্গিত আছে। দ্রৌপদী ছাড়বেন কেন? বিশেষত তিনি বিদগ্ধা মহিলা, সংসার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দগ্ধাও বটে। সীতা-সাবিত্রীর আদর্শ দ্রৌপদীর চলে না, মুখ বুঝে সহ্য করার লোকও তিনি নন। সঙ্গে সঙ্গে দ্রৌপদী জবাব দিলেন আমার শ্বশুরকুলে স্বামীর সংখ্যা চিরকালই একটু বেশি ভানুমতী পতিবৃদ্ধিঃ কুলে মম।

সরলা ভানুমতী প্রথমে বুঝতেই পারেননি কোপটা কোথায় গিয়ে পড়ল। তারপর যখন দ্রৌপদীর কথাটা বেশ ভেবে দেখলেন, তখন বুঝলেন তাঁর নিজের শ্বশুর, দিদিশাশুড়ি সবাই জড়িয়ে গেছেন দ্রৌপদীর কথার পাকে। দ্রৌপদীর শাশুড়ি হলেন কুন্তী। পাণ্ডু ছাড়াও আরও পাঁচজন তাঁর অপত্যকারক স্বামী ছিলেন। না হয় ধরেই নিলাম কর্ণ-পিতা সূর্যের কথা দ্রৌপদী জানতেন না। আবার কুন্তীর দুই শাশুড়ি হলেন অম্বিকা আর অম্বালিকা। বিচিত্রবীর্য ছাড়াও এঁদের পুত্রদাতা স্বামী স্বয়ং মহর্ষি ব্যাসদেব। এই সুবাদে ভানুমতীর শ্বশুর ধৃতরাষ্ট্র অথবা তার শাশুড়ি মা অম্বিকাও তো ফেঁসে গেলেন। আবার অম্বিকা-অম্বালিকার শাশুড়ি যে সত্যবতী, তাঁর শান্তনু ছাড়াও তো আরেক স্বামী ছিলেন পরাশর মুনি। এবার দ্রৌপদীর কথার গুরুত্ব বুঝে আর কথা বাড়াননি দুর্যোধন সোহাগী ভানুমতী।

জনান্তিকে বলে রাখি, ভানুমতী-দ্রৌপদীর এই সংলাপের কথা মহাভারতে নেই। এমনকী দুর্যোধনের স্ত্রীর নাম ভানুমতী কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে। পণ্ডিতেরা বলেন– বেণীসংহার নাটকের লেখক ভট্টনারায়ণই দুর্যোধন-বধূর নামকরণ করেন ভানুমতী। বস্তুত দুর্যোধনের স্ত্রীর নাম ভানুমতী না মাধবী, তাতে কিছু আসে যায় না। এমনকী ওপরের যে সংলাপটি পণ্ডিত অনন্তকাল ঠাকুর আমাকে বলেছিলেন, সেটিও তাঁর মতে লোকপরম্পরায় প্রচলিত শ্লোকের একাংশ। খুব প্রামাণিক না হলেও এই শ্লোকটিকে আমরা অসীম গুরুত্ব দিই, এবং তা দিই এই কারণে যে, দ্রৌপদীর চরিত্র বুঝতে এমন শ্লোক বুঝি আর দ্বিতীয় নেই।

যাঁরা আর্থ-সামাজিক কুতুহলে সেকালের তাবৎ নারীকুলের প্রতি অন্যায় আর অবিচারের জিগির তোলেন, দ্রৌপদীর চরিত্র তাদের কিছু হতাশ করবে। স্বামীদের ভুল বা ভালমানুষির জন্য দ্রৌপদীর জীবনে দুঃখ-কষ্ট এবং উপদ্রব– কোনওটাই কম হয়নি। তবু কিন্তু কোনও সতীলক্ষ্মীর বিপন্নতা দ্রৌপদীর ছিল না। সতীলক্ষ্মীর মতো স্বামীদের সব কথা তিনি মুখ বুজে সহ্যও করেননি। বরঞ্চ আধুনিক অনেক গোবেচারা স্বামীদের মতোই দ্রৌপদীর পঞ্চ স্বামীকে মাঝে মাঝেই তার মুখঝামটা খেয়ে গোবেচারা হয়ে যেতে হয়েছে। এবং জনান্তিকে আবারও বলি– দ্রৌপদীর পাঁচ-পাঁচটি স্বামীই দ্রৌপদীকে রীতিমতো ভয় পেয়ে চলতেন। ভয় পেতেন অন্যেরাও। তবে সে-কথা পরে।

দ্রৌপদী কালো মেয়ে। কালো বলেই তাঁর নাম কৃষ্ণা কৃষ্ণেত্যেবাব্রুবন কৃষ্ণাং কৃষ্ণাভূৎ সা হি বৰ্ণতঃ। মহাভারতীয় রঙ্গভূমিতে যে ক’টি কালো মানুষ মহাভারত মাতিয়ে রেখেছেন তার মধ্যে তিনজনই পুরুষ, আর দু’জন স্ত্রীলোক। এই নতুন কথাটা প্রথম শুনি শ্রদ্ধেয়া গৌরী ধর্মপালের কাছে। প্রথম কালো মহামতি ব্যাসদেব, দ্বিতীয় কালো কৃষ্ণ ঠাকুর, তৃতীয় হলেন অর্জুন। আর মেয়েদের মধ্যে ব্যাস-জননী ধীবরকন্যা সত্যবতী নিকষ কালো। তার নামও ছিল কালী। কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রাকেও কালী বলে ডাকা হত, কিন্তু তার গায়ের রং কালো ছিল না। কাজেই গায়ের রং এবং নামেও মহাভারতের দ্বিতীয়া যে কালো স্ত্রীলোকটি তার নাম দ্রৌপদী। তবে গায়ের রং কালো হলে কী হবে, সেকালে দ্রৌপদীর মতো সুন্দরী সারা ভারতবর্ষ খুঁজলেও মিলত না। অবশ্য দ্রৌপদীর রূপ যে শুধুমাত্র শরীরকেন্দ্রিক ছিল না, তার রূপ যে দেহের সীমা অতিক্রম করেছিল, সে-কথা বোঝা যাবে স্বয়ং ব্যাসের বর্ণনায়। মহাভারতকার দ্রৌপদীর শারীরিক রূপ বর্ণনায় বেশি শব্দ খরচ করেননি। সুকেশী সুস্তনী শ্যামা পীনশ্রোণীপরোধরা’– দ্রৌপদীর এই বর্ণনা মহাকাব্যের সুন্দরীদের তুলনায় অল্পমাত্র। লক্ষণীয় বিষয় হল- নায়িকার রূপ বর্ণনার ক্ষেত্রে মহাকাব্যকারেরা যেখানে অনুপম শব্দরাশির বন্যা বইয়ে দেন, সেখানে দ্রৌপদীর রূপবর্ণনায় মহাভারতকার যেন একেবারে আধুনিক মানসিকতায় গ্ল্যামারের দিকে মন দিয়েছেন। দ্রৌপদী যে মোটেই বেঁটে ছিলেন না, আবার ঢ্যাঙা লম্বাও ছিলেন না নাতিহ্রস্বা ন মহতী সেকেলে কবির কাছে। এই বর্ণনা, এই বাস্তব দৃষ্টিটুকু অভাবনীয়। তাও একবার নয়, দু’বার এই কথা ব্যাসকে লিখতে হয়েছে, যদিও অন্যত্র হলে নারীদেহের প্রত্যঙ্গ বর্ণনার ঝড় উঠে যেত তাঁরই হাতে। ব্যাস জানতেন দ্রৌপদীর রূপ তাঁর কুঞ্চিত কেশরাশি কিংবা স্তন-জঘনে নয়, তার রূপ সেই দৃপ্ত ভঙ্গিতে বিভ্রাজমানা বপুষা– সেই বিদগ্ধতায়, যার সঙ্গে তুলনা চলে শুধু সমুজ্জ্বল বৈদুর্যমণির–বৈদুর্যমণিসন্নিভা। যেখানেই তিনি থাকেন, সেখানেই আলো ঠিকরে পড়ে, প্রতি কথায়, প্রতি কাজে। আর তার মধ্যে আছে এক দূরত্ব, যে দূরত্ব তাঁর জন্ম লগ্নেই বিধিপ্রদত্ত, কেননা যজ্ঞীয় বেদীর আগুন থেকে তার জন্ম। তার মানে এই নয় যে, একটি যজ্ঞবেদী থেকে কৃষ্ণার জন্ম হয়েছিল। এমনটি হতেই পারে না। তার কারণ দ্রুপদ রাজার আয়োজিত দ্রোণ-হন্তার জন্মযজ্ঞে পুরোহিত যখন আগুনে ঘি দিচ্ছিলেন তখনই তিনি টের পেয়েছিলেন যে ওই যজ্ঞের আগুন থেকে শুধুমাত্র একটি কুমার জন্মাবে না, উপরন্তু একটি কুমারীও জন্মাবে। দ্রুপদ রাজার স্ত্রীকে তিনি বলেছিলেন– রাজ্ঞি পৃষতি মিথুনং ত্বমুপস্থিত তুমি পুত্র এবং কন্যা দুই-ই পাবে রানি। পুরোহিত যাজ যজ্ঞে আহুতি দেওয়া মাত্রই সেই আগুন থেকে জন্মালেন কুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন– উত্তস্থৌ পাবকাৎ তস্মাৎ। এর পরে ধৃষ্টদ্যুম্নের একটু বর্ণনা দিয়েই ব্যাস বললেন- কুমারী চাপি পাঞ্চালী বেদীমধ্যাৎ সমুন্থিতা– সেই বেদী থেকেই কুমারী পাঞ্চালীও উদ্ভূত হলেন। ঠিক এখানে আগুন কথাটা সোজাসুজি নেই বটে তবে যজ্ঞীয় বেদীর মধ্যে আগুন ছাড়া আর কী থাকে? বিশেষ পূর্বাহ্নে যে আগুন থেকে কুমার জন্মেছেন। ব্যাস অবশ্য পরে পরিষ্কার লিখেছেন যে দ্রুপদের পুত্রেষ্টি যজ্ঞে পুত্র এবং কন্যার মিথুন জন্মাল– তথা তন্মিথুনং যজ্ঞে দ্রুপদস্য মহামখে।

কাজেই যজ্ঞের বেদীমাত্র নয়, বেদীর আগুন থেকেই তাঁর জন্ম। বস্তুত আগুন তো কৃষ্ণার গায়ের রঙে আসবে না, আগুন যে দ্রৌপদীর চরিত্রে। যাঁরা দ্রৌপদীর নিত্যসঙ্গী– পাঁচভাই তারা এই আগুনে সোনার মতো পুড়ে পুড়ে শুদ্ধ হয়েছেন। আর যাঁরা দূরের, তারা যতবারই এই যাজ্ঞসেনীর আগুনে হাত দিয়েছেন, ততবারই তাদের হাত পুড়েছে, কপাল পুড়েছে, গোটা বংশ ছারখার হয়ে গেছে। দ্রৌপদীর আবির্ভাব লগ্নেই তাই দৈববাণী শোনা গেছে- ক্ষত্রিয় কুলের ধ্বংসের জন্যই তার জন্ম, তিনি কৌরবদের ভয়ের নিশান– অস্যা হেতোঃ কৌরবাণাং মহদুৎপদ্যতে ভয়ম। কি অসামান্যতায়, কী রূপে, কী গুণে– দ্রৌপদীর সঙ্গে আমি তার বৃদ্ধা দিদিশাশুড়ি সত্যবতীর খুব মিল খুঁজে পাই। শুধু গায়ের রং ভাগ করে নিয়ে এঁরা যে একজন কালী আর অন্যজন কৃষ্ণা হয়েছেন তাই নয়, এঁদের দু’জনের মধ্যেই ছিল সেই বিরল ব্যক্তিত্ব, যাতে সত্যবতীর হাতে গড়ে উঠেছিল ওই বিরাট কুরুকুল, আর দ্রৌপদীর ক্ষোভে সেই কুরুকুল ধ্বংস হয়ে গেল। সৃষ্টি আর ধ্বংসের মধ্যে তফাৎ এইটুকুই যে, মহারাজ শান্তনু, পিতামহ ভীষ্ম– এঁরা সত্যবতীর ব্যক্তিত্ব মেনে নিয়েছেন, আর পাণ্ডবেরা দুর্ভাগ্যবশে এবং কৌরবেরা সাহঙ্কারে দ্রৌপদীর ব্যক্তিত্বকে অপমান করেছেন। ফল একপক্ষে বিড়ম্বনা, অন্যপক্ষে ধ্বংস।

ভাবতে একটু অবাক লাগে এইখানে যে, মহাকাব্যের চরমতমা নায়িকার জন্ম হল, অথচ সেই নায়িকা দ্রৌপদীর কোনও ছেলেবেলা নেই, জনক-জননীর বাৎসল্য-ভারাক্রান্ত কোনও শৈশব নেই, ছোট্ট ছোট্ট সঙ্গীদের সঙ্গে কন্দুক-ক্রীড়ারও কোনও ঘটনা মহাভারতের বিরাট পরিসরে এতটুকুও বর্ণিত নয়। জন্ম থেকেই তিনি স্পষ্ট এক কুমারীত্ব বহন করছেন– কুমারী চাপি পাঞ্চালী– যা যৌবনসন্ধির ইষ্ট ভাবটুকুর ইঙ্গিত দিয়ে চলেছে। মহাকাব্য হিসেবে মহাভারত যেখানে কত অবান্তর খুঁটিনাটির কথা বলে, সেখানে নিতান্তই বর্ণনীয়া প্রধানতমা রমণীটির ক্ষেত্রে মহাকাব্যের কবি যে তার শৈশব-পৌগণ্ড ছাড়িয়ে একেবারে সোজাসুজি যৌবনে উপনীত হলেন, সেখানে একটা ব্যঞ্জনা আছে বলে অবশ্যই মনে হয়। অগ্নিবেদীর মধ্য থেকে যজ্ঞ-সিদ্ধির মতো যে কুমারী জন্মালেন, মহাভারতের কবি তার রূপ বর্ণনায় চঁদ-তারার উপমা জোগাড় করে আনেননি, বরঞ্চ খুব গদ্যজাতীয় ভাষায় সোজাসুজি বলেছেন তিনি বেশ সুশ্রী, তার শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি দর্শনীয়– সুভগা দর্শনীয়াঙ্গী– আজকের দিনে এই শব্দটা ‘এক্সকুইজিট ফিগার’ বলে অনুবাদ করা যেতেই পারেন তার চোখ দুটি কৃষ্ণবর্ণ এবং সুদীর্ঘ পাপড়ির মতো, তার ওপরে মনোহর; গায়ের রংও কালো এবং কেশকলাপ কুঞ্চিত, নখগুলি তাম্রাভ এবং উন্নত, আর স্তনযুগল সুগঠিত পীন– দেখলে মনে হয়, কোনও স্বর্গসুন্দরী মানুষের রূপ ধরে নেমে এসেছেন ডুয়ে।

এই যে বর্ণনা, এটা অবশ্যই কোনও যৌবনোদ্ধতা রমণীর রূপ, যাঁকে জন্মলগ্নেই শৈশব-পোগণ্ডহীন এক আবির্ভাব বলে মনে হচ্ছে। লোকে তো বলবেই যে, অলৌকিক যজ্ঞকথায় যদি বিশ্বাস না করো, তা হলে কি দ্রুপদের সেই যাজ্ঞিক পুরোহিতই কোথাও থেকে ধৃষ্টদ্যুম্ন আর দ্রৌপদী এই দুই ভাইবোনকে নিয়ে এসেছিলেন দ্রুপদের হিংসা মেটানোর জন্য। নইলে, আবির্ভাবেই এই যৌবনোদ্ধতা রমণীর রূপ দেখে জননীর বাৎসল্য প্রকাশেও সংশয় আসে। দ্রুপদের মহিষীকে যাজ্ঞিক যাজ-ঋষির কাছে এসে বলতে হয়– এই মেয়ে যেন আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে আর মা বলে না জানে ন বৈ মদন্যাং জননীং জানীয়ামিমাবিতি। আর কেনই বা তাকে দেখলেই মনে হয় যে, তিনি ভবিষ্যতে তার বিরুদ্ধ ক্ষত্রিয় রাজাদের জীবনান্ত ডেকে আনবেন, তিনি রমণীকুলের শ্রেষ্ঠা বটে– সর্বঘোষিরা কৃষ্ণা নিনীষুঃ ক্ষত্রিয়ান ক্ষয়ম্।

তার মানে, মহাভারতের কবি প্রথম কল্পেই দ্রৌপদীকে এমনভাবেই মহাকাব্যের পরিসরে প্রবেশ করাচ্ছেন যাতে তার সৌন্দর্যের সঙ্গে তার তেজ এবং ব্যক্তিত্ব যেন পাঠকের মনে অন্যতর এক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। আরও লক্ষণীয় যে, আবির্ভাব লগ্নেই প্রায় দ্রৌপদীকে স্বয়ংবরের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। তার আগে দ্রৌপদীর সঙ্গে তার পিতা-মাতা, ভাই-বন্ধু অথবা অন্য কারও সঙ্গে কারও কোনও ‘ইনটার-অ্যাকশন’ নেই। দ্রুপদের ঘরের বাইরে দ্রৌপদীর প্রথম খবর পাচ্ছি বক রাক্ষস নিহত হবার পর সেই ব্রাহ্মণের বাড়িতেই যেখানে পাণ্ডবরা বসবাস করছিলেন এবং যেখানে অপর এক ব্রাহ্মণ আশ্রয়প্রার্থী হয়ে এসেছেন। তিনি গল্প করতে-করতে দ্রৌপদীর স্বয়ংবর প্রস্তুতির খবর শুনিয়েছেন পাণ্ডবদের। এবং এটাই দ্রৌপদী-বিষয়ে প্রথম সংবাদ-সরবরাহ হচ্ছে মহাভারতে।

দ্রৌপদীর যেদিন বিয়ে অথবা স্বয়ম্বর, তার আগে পাণ্ডবেরা বারণাবতে জতুগৃহের আগুন হজম করে প্রচ্ছন্নভাবে এধার-ওধার ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ-বন সে-বন দেখে, আর কিছুই করার না পেয়ে পাণ্ডবজননী কুন্তী পর্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। ভিক্ষা-টিক্ষাও ভাল মিলছে না। এরই মধ্যে ব্যাস এসে দ্রৌপদীর জন্মকথা শুনিয়ে গেলেন পাণ্ডবদের। যাবার আগে এও বলে গেলেন, যে সেই রমণীই পাণ্ডবদের বউ হবে। কুন্তী এবং পাণ্ডবদের কাছে এটা দ্রৌপদীর বিষয়ে দ্বিতীয় বারের খবর। কিন্তু কৌরব-জ্ঞাতির প্রতারণা আর বন-বনান্তরে ঘুরে বেড়াবার যন্ত্রণায় পাণ্ডবদের মনে তখন স্ত্রীচিন্তা ঠাই পায় না। সমস্ত জগৎকে খরতাপে আক্রমণ না করে সূর্য যেমন সন্ধ্যা-বধূকে ভজনা করে না, তেমনি জগতের কাছে আপন শৌর্য প্রকাশ না করে পাণ্ডবেরাই বা রমণীর চিন্তা করবেন কী করে? তবে একাধারে শৌর্য বীর্য দেখানোর সুযোগ এবং স্ত্রীরত্ন লাভ– দুইয়েরই মওকা এল দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে, যদিও পাণ্ডবেরা এ-কথা সচেতনভাবে বোঝেননি। তারা পাঞ্চাল রাজ্যের উদ্দেশে রওনা দিলেন ভাল ভিক্ষে পাবার আশায়। কারণ তারা শুনেছিলেন পাঞ্চাল রাজ্যে ভাল ভিক্ষে পাওয়া যায়- সুভিক্ষাশ্চৈব পাঞ্চালাঃ “য়ন্তে। তা ছাড়া বনে বনে এতকাল বাস করে নগরে ভ্রমণ করার জন্য পাণ্ডবদের নাগরিক-বৃত্তিও কিছুটা উত্তেজিত হয়েছিল বুঝি। কেননা পাঁচ ছেলের মা কুন্তী পর্যন্ত ভেবেছিলেন– নগরে গেলে দারুণ মজা হবে– অপূর্বদর্শনং বীর রমণীয়ং ভবিষ্যতি। পাণ্ডবেরা তাই চললেন। রাস্তায় ব্যাসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল বটে, তবে ব্যাসের কথা, দ্রৌপদীর কথা বুঝি বা তাদের ভাল করে মনেও ছিল না।

পাঞ্চাল রাজ্যে পোঁছে ইস্তক দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরের খবর পাণ্ডবদের কানে আসছিল। মনে মনে তাকে বিয়ে করার মানসিক প্রস্তুতি পাণ্ডবদের কারও ছিল না, কিন্তু তারা যে স্বয়ম্বরের জাঁকজমক দেখতে যাবেন, এটা অবশ্য মনে মনে ছিল। পাণ্ডবেরা পাঞ্চাল রাজ্যে পৌঁছবেন কি, রাস্তাতেই তারা দেখতে পেলেন দলে দলে ব্রাহ্মণ-সজ্জনেরা চলেছেন দ্রুপদের রাজসভায়। পাণ্ডবেরা তখনও বাড়ি-ঘর বাসস্থান ঠিক করেননি কিছু। তখনও প্রচ্ছন্নচারী ব্রাহ্মণের বেশ। যুধিষ্ঠির কিছু শুধোবার আগেই ব্রাহ্মণেরা স্বজাতীয় ভ্রমে পাণ্ডবদের জিজ্ঞাসা করলেন আপনারা আসছেন কোত্থেকে, যাবেনই বা কোথায়? পুরো পরিচয় পাবার আগেই ব্রাহ্মণেরা বললেন- চল সব দ্রুপদের রাজবাড়িতে, বিরাট উৎসব, দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর। আমরা সবাই তো সেখানেই যাচ্ছি। নিষ্কিঞ্চন ব্রাহ্মণেরা দ্রৌপদীর চেহারার একটা লোভনীয় বর্ণনাও দিতে চাইলেন। তারা বললেন– দারুণ দেখতে নাকি দ্রৌপদীকে। দর্শনীয়া’, ‘অনবদ্যাঙ্গী’, পদ্মের পাপড়ির মতো চোখ। এক ক্রোশ দূর থেকেও নাকি তার গায়ের মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যায় (পাঠক! যোজনগন্ধা পদ্মগন্ধী সত্যবতীর সঙ্গে এখানেও দ্রৌপদীর মিল)। ব্রাহ্মণ বলে কথা, তাদের মুখে প্রত্যঙ্গ বর্ণনা কেমন শোনায়; তাই বুঝি অতি সংক্ষেপেও কোনও আড়ম্বরের মধ্যে না গিয়ে, অথচ সব কিছুই বুঝিয়ে দিয়ে ব্রাহ্মণেরা বললেন– দ্রৌপদী তনুমধ্যমা– অর্থাৎ যাঁর কোমরটা বেশ স্লিম। অনবদ্য তার চেহারা, তার ওপরে ‘সুকুমারী মনস্বিনী।

না, ব্রাহ্মণেরা দ্রৌপদীকে পেতে চান না। তাঁরা ধূমধাম দেখবেন, রঙ্গ দেখবেন। উপরি পাওনা রাজার দান– টাকাপয়সা, গোরু, ভোক্ষ্যং ভোজ্যঞ্চ সর্বশঃ। ব্রাহ্মণেরা বললেন– তোমরাও চল আমাদের সঙ্গে, মজা দেখে, দান নিয়ে ফিরে আসবে এবং কৌতূহলং কৃত্বা দৃষ্টা চ প্রতিগৃহ্য চ। চাই কি, তোমাদের পাঁচ ভাইয়ের এক ভাইকে কৃষ্ণা বরণও করতে পারে, কারণ তোমরা সবাই তো দেখতে বেশ সুন্দর। যুধিষ্ঠির বললেন নিশ্চয়, নিশ্চয়, এই আমরা এলুম বলে।

এক কুমোরের ঘরে পাণ্ডবদের থাকার ব্যবস্থা হল। ভিক্ষা করে আর ব্রাহ্মণের বেশ ধরে পাণ্ডবেরা তাদের ছদ্ম ব্রাহ্মণ্য বজায় রাখছিলেন। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে রাজা-রাজড়ারা এবং ব্রাহ্মণেরা অনেক আগে থেকেই উপস্থিত হচ্ছিলেন। পাণ্ডবেরাও নিজেদের ব্যবস্থা করে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে উপস্থিত হলেন। সভা একেবারে গমগম করছে। দ্রুপদ মৎস্যচক্ষুর পণ সমবেত সবাইকে জানালেন এবং প্রায় ‘অলিপিয়ান’ কায়দায় স্বয়ম্বর ঘোষণা করলেন– স্বয়ম্বরম অঘোষয়ৎ। ঈশান কোণে বসলে নাকি কোনও কাজে পরাজয় হয় না, তাই রাজারা বসলেন সেদিকটায়, মঞ্চের ওপর সারি সারি। উত্তর দিকটায় সাধারণ লোকেরা। আর ঋষি ব্রাহ্মণেরাও বসলেন তাদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায়।

বিবাহেচ্ছু রাজারা সব বসে আছেন এমনভাবে, যেন মনে হচ্ছে– এ বলে তুই আমায় দেখ, ও বলে তুই আমায় দেখ– স্পর্ধমানা স্তদান্যোন্যং নিষেদুঃ সর্বপার্থিবাঃ। ক্ষত্রিয় জনতার মধ্যে তখন সাগরতরঙ্গের মতো অবিরাম কোলাহল। প্রত্যেকেই তখন ভাবছেন– কখন সেই দীপ্তিমতী সুন্দরী উদয় হবেন রাজসভায়, কখন কনে দেখব? এরই মধ্যে বাজনা বাদ্যি আরম্ভ হয়ে গেল। সালঙ্কারা দ্রৌপদী রাঙা কাপড় পরে সভায় উদয় হলেন। হাতে সোনার রঙের বরণমালা। কার গলায় মালা দেব, কে সেই বীরপুরুষ– এই চিন্তায় কিছুটা বা বিবশা– আপ্লুতাঙ্গী সুবসনা সর্বাভরণভূষিতা। ব্রাহ্মণেরা আগুনে আহুতি দিয়ে স্বস্তিবচন করলেন, এক লহমায় বাদ্যবাদন থেমে গেল– কুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন কথা বলছেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন– এই ধনুক, ওই মীনচক্ষু লক্ষ্যস্থল, আর এই যে বাণগুলি। আপনাদের কাজ ছিদ্রপথে ওই মৎস্যচক্ষু ভেদ করা। যিনিই এই কষ্টকর কাজটি করতে পারবেন তারই গলায় মালা দেবেন আমার ভগিনী–দ্রৌপদী। কালিদাসের পার্বতাঁকে সকামে দেখে শিবের তিনটি চোখ যেমন যুগপৎ তার অধরোষ্ঠে পড়েছিল, এখানে সমবেত রাজমণ্ডলীর আতুর চোখগুলিও তেমনি একসঙ্গে দ্রৌপদীর ওপরে গিয়ে পড়ল। প্রত্যেকেই এই ভাবনায় মশগুল যে, দ্রৌপদীকে আমিই জিতব–সঙ্কল্পজেনাভিপরিপ্লতাঙ্গাঃ–এবং লক্ষ্যভেদ করার আগেই প্রত্যেকে ভাবতে লাগলেন- দ্রৌপদী আমারই কৃষ্ণা মমত্যেব! আশ্চর্য! যে রাজারা অন্য সময় এক জোট, প্রাণের বন্ধু, তারাও এখন অহংমম ভাবনায় সব আসন ছেড়ে উঠে পড়েছেন, একে অন্যকে গালাগালি দিচ্ছেন, যদিও তাদের চোখ, মন এবং রসভাব– সবই এক দ্রৌপদীর দিকে– কন্দর্পবাণাভিনিপীড়িতাঙ্গা… কৃষ্ণাগতৈর্নেক্রমনঃস্বভাবৈঃ… দ্বেষং প্রচঃ সুহৃদোহপি তত্র।

সেকালের স্বয়ংবর সভার চরিত্রই বোধহয় এটা। ক্ষত্রিয় রাজাদের বহু বিবাহের অসুবিধে ছিল না, অতএব সুন্দরী রাজকন্যাদের স্বয়ংবর-সংবাদ প্রচারিত হলেই তারা অনেকেই স্ত্রীর লাভের ভাগ্য-পরীক্ষায় নেমে পড়তেন। স্বয়ংবর-সভায় অতি-বড় বন্ধুও কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে সাজগোজ থেকে আরম্ভ করে রাজনৈতিক এবং সামরিক উচ্চতা-খ্যাপন বিবাহ সভাতেও প্রকট হয়ে উঠত। আর সবচেয়ে কৌতুককর ছিল সেই মুহূর্তটি, যখন রাজকন্যা প্রথম সভায় এসে উপস্থিত হতেন বরমাল্য-হাতে, মহাভারতে কবি এর একটা “ক্রুড’ বর্ণনা দিয়েছেন, যা পরবর্তীকালের মহাকবিরা গ্রহণ করেছেন আলংকারিক পরিশীলনে। এখানে যেমন দেখছি– রাজারা দ্রৌপদীকে দেখে কোমল কামুকতায় অস্থির হয়ে উঠছেন– কন্দর্পবাণাভিপরিপ্লঙ্গা এবং সেই কারণেই বন্ধুস্থানীয় রাজারাও একে অন্যের প্রতি দ্বেষ প্রকাশ করছেন। কালিদাসের রঘুবংশে এই চিত্রটাই অসম্ভব পরিশীলিত ভাবে আছে এবং তেমনটা হওয়াই খুব স্বাভাবিক। কালিদাসে ইন্দুমতীর স্বয়ংবরে যেইমাত্র তিনি সভাগৃহে প্রবেশ করেছেন, সঙ্গে-সঙ্গেই রাজাদের মধ্যে নানান প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে এবং সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল– বসন-অলংকার-প্রসাধন শেষবারের মতো ঠিক করে নেওয়া। কালিদাস শব্দটি এখানে ব্যবহার করেছেন– শৃঙ্গারচেষ্টা বিবিধা বভূবুঃ। শৃঙ্গার শব্দের অর্থ সাজগোজ করাও যেমন হয়, তেমনই কামুক জনের অপরিশীলিত ইঙ্গিতও হয়। কিন্তু একটি শব্দেই কালিদাস মহাকাব্যিক ‘ক্রুডনেস’ এবং প্রসাধনী প্রক্রিয়া–দুটিই বুঝিয়ে দিয়েছেন। মহাভারতে দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে এই অপরিশীলন দ্রৌপদীর ব্যক্তিত্ব এবং শারীরিক আবেদন বিপ্রতীপভাবে প্রতীয়মান।

কুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন রাজাদের নাম ঘোষণা আরম্ভ করে দিয়েছেন আগেই উদ্দেশ্য দ্রৌপদীকে কিঞ্চিৎ পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন– ইনি দুর্যোধন, ইনি কর্ণ, ইনি জরাসন্ধ, ইনি কৃষ্ণ, ইনি শিশুপাল– আরও কত শত নাম, যার মধ্যে বাংলা দেশের রাজা পর্যন্ত আছেন। বস্তুত বিদর্ভ রাজনন্দিনী রুক্মিণীর পরে আর এমন কোনও স্বয়ম্বরসভা বসেনি, যার সঙ্গে তুলনা চলে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরের। সেই সময়ে এই কৃষ্ণা দ্রৌপদীর রূপ গুণের কথা ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। আমাদের ধারণা– ওই যে বলা হয়েছে। দ্রৌপদীর গায়ের মিষ্টি গন্ধ এক ক্রোশ দূর থেকে পাওয়া যেত– একথার আসল তাৎপর্য হল- দূরে দূরান্তরে এই কালো মেয়েটির রূপ-গুণের কথা লোকে জানত। আজ তাই এতগুলি রাজ-ভ্রমর এই কৃষ্ণা পদ্মিনীর মধুলোভে দ্রুপদের রাজসভায় গুনগুন করছে। খেয়াল করতে হবে একই বিবাহ-সভায় বরাত পরীক্ষা করতে মামা-ভাগ্নে– শল্য এবং পাণ্ডবেরা উভয়েই এসেছেন। বাপ-বেটা বিরাট এবং তার ছেলে, জরাসন্ধ এবং তার ছেলে– দুয়েই এসেছেন– যার কপালে দ্রৌপদী জোটে তারই লাভ।

আরম্ভ হল ধনুক তোলা। কলিঙ্গ, বঙ্গ, পুণ্ড্র সব গেল। জরাসন্ধ, শিশুপাল, শল্য– সব গেল। দুর্যোধন, অশ্বত্থামা– সব গেল। মহাভারতকার কেবলই এই মহারাজাদের নাম একটি একটি করে বলেন, আর বলেন–না, ইনিও হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছেন– জানুভ্যাম অগমন্মহীম। এত রাজার মাঝখানে মাত্র একটি দৃঢ় সংকল্পিত মুখ ধনুকখানি তুলে তাতে বাণ লাগিয়ে লক্ষ্যভেদ করে ফেলেছিল আর কী! যাকে দেখে পাণ্ডবেরা পর্যন্ত ধরে নিয়েছিলেন– এই বুঝি লক্ষ্য-বিদ্ধ হল। তিনি কর্ণ, যাঁকে সমবেত সমস্ত রাজমণ্ডলীর সামনে দ্রৌপদী প্রত্যাখ্যান করে বললেন– সুতপুত্রের গলায় মালা দেব না আমি– নাহং বরয়ামি সূত। ইতিহাসকে যাঁরা নীচে থেকে দেখেন– History from below তাদের, এই ঘটনাটা মনঃপূত হবে না। হবেই বা কেন– সমাজের পর্যায়ভুক্তিতে কর্ণ সুতপুত্র, কিন্তু স্বয়ম্বর সভায় তার কী? কুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন তো প্রতিজ্ঞাই করেছিলেন– যিনিই লক্ষ্যভেদ করবেন, তিনিই পাবেন আমার ভগিনীকে, মিথ্যে বলছি না বাপু– তস্যাদ্য ভার‍্যা ভগিনী মমেয়ং কৃষ্ণা ভবিত্রী ন মৃষা বদামি। সমাজের উচ্চবর্ণে না জন্মানোর যন্ত্রণা কর্ণকে সাভিমানে সইতে হল শুধু সূর্যের দিকে একবার তাকিয়ে। কিন্তু মশাই! নারী স্বাধীনতা। সে ব্যাপারে কী বলবেন? সমাজের বিচারে স্ত্রীলোকের অবস্থা তো অতি করুণ ছিল বলে শুনি। কিন্তু বাপভায়ের প্রতিজ্ঞায় তুড়ি মেরে উন্মুক্ত সভার মধ্যে দ্রৌপদী যে নিজের পছন্দ অপছন্দ পরিষ্কার জানালেন, তাতে কি এটাই প্রমাণ হয় না যে, সেকালের নারী সমাজের ওপর অত্যাচারের ইতিহাস একেবারে নিরঙ্কুশ বা সর্বাঙ্গীণ হতে পারে না। অত্যাচার ছিল, এবং এখনও আছে। কিন্তু তারই মধ্যে কোথাও বা ছিল মুক্তির বাতাস, কোথাও বা স্ব-অধীনতাও।

দ্রৌপদীর এই প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে কৃষ্ণপ্রেয়সী রুক্মিণীর এক ধরনের মিল আছে। রুক্মিণীর বাবা ভীষ্মক এবং ভাই রুক্মী সেকালের প্রবল পরাক্রান্ত রাজা শিশুপালের সঙ্গে রুক্মিণীর বিয়ে প্রায় পাকাই করে ফেলেছিলেন। রুক্মিণী তার শোধ নিয়েছেন একেবারে পালিয়ে গিয়ে, নিজের পছন্দে বিয়ে করে। দ্রৌপদীও বাপ-ভায়ের প্রতিজ্ঞার মর্যাদা রাখেননি এবং আপন স্বাধীনতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর, দ্রুপদ-ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতিজ্ঞা এবং কর্ণকে প্রত্যাখ্যান– এ-সব কিছুর মধ্যেই একটা রহস্য আছে, যে রহস্য আগে বোঝা প্রয়োজন। একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে যে, সেকালের স্বয়ম্বর সভায় বীর-বরণের ক্ষেত্রে কন্যার ইচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেলেও সব জায়গায় কন্যার ইচ্ছেই শেষ কথা ছিল না। রাজনীতির চাল ছিল। ছিল সামাজিক মান মর্যাদার প্রশ্নও। যেমন ধরুন রুক্মিণীর স্বয়ম্বরের আগেই যে তার বাপ-ভাই শিশুপালকে রুক্মিণীর বর হিসেবে পছন্দ করেছিলেন– এর থেকেই প্রমাণিত হয় যে, স্বয়ম্বর সভা অনেক সময় প্রহসনে পরিণত হত। অবশ্য রুক্মিণীর বাপ-ভাই যে শিশুপালকে মনস্থ করেছিলেন তার পিছনে রাজনৈতিক কারণ ছিল। কারণ ছিল– শিশুপালের পৃষ্ঠপোষক দুর্ধর্ষ জরাসন্ধকে সন্তুষ্ট রাখার। এ-প্রসঙ্গ অন্যত্র আলোচনা করেছি। এখানে শুধু এইটুকুই প্রয়োজন যে, রাজনৈতিক কারণে পিতা এবং ভ্রাতা অনেক সময়েই তাদের মতামত চাপিয়ে দিতেন স্বয়ম্বরা বধূটির ওপর। সৌভাগ্যের কথা, দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে তার বাপ ভাইয়ের সঙ্গে তার মতামতের মিল ছিল এবং সেই কারণেই এবং এটা অবশ্যই রাজনৈতিক কারণ– দ্রৌপদীর কর্ণ-প্রত্যাখ্যান আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত মনে হয় না।

একটা জিনিস খেয়াল করুন। মহাভারতকার দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরের পূর্বাহ্নেই জানিয়েছেন যে, দ্রুপদ রাজার ভারী ইচ্ছে ছিল যাতে পাণ্ডব অর্জুনের সঙ্গেই তার মেয়ের বিয়ে হয়– যজ্ঞসেনস্য কামস্তু পাণ্ডবায় কিরীটিনে। কৃষ্ণাং দদ্যামিতি…। ব্যাস লিখেছেন, দ্রুপদ সবসময় মনে মনে এই ইচ্ছা পোষণ করেও বাইরে এ-কথা কখনও প্রকাশ করেননি। কিন্তু আমরা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় একথা জানি যে, অন্য কোথাও প্রকাশ না করলেও পিতার মনোগত ইচ্ছা বউ-ছেলে-মেয়ে ঠিকই জানতে পারে। আমাদের দৃঢ় ধারণা– দ্রৌপদী পিতার ইচ্ছে জানতেন। সৌভাগ্যবশত পিতার ইচ্ছের সঙ্গে দ্রৌপদীর ইচ্ছের মিল ছিল, এবং তার কারণও আছে। আমরা যে ঠিক কথা বলছি তার আরও দুটো কারণ আছে। প্রথমত বারণাবতের জতুগৃহে পাণ্ডবদের মৃত্যুর কথা যথেষ্ট চাউর হয়ে গেলেও দ্রুপদ সে-কথা বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না। বিশ্বাস করতেন না বলেই ব্যাস লিখেছেন যে, পাণ্ডব অর্জুনকে তিনি খুঁজছিলেন–সোন্বেষমাণঃ কৌন্তেয়ং– এবং প্রধানত তার কথা মনে রেখেই তিনি স্বয়ম্বরের জন্য সেইরকম অসামান্য একখানি ধনুক তৈরি করিয়েছিলেন। তৈরি করিয়েছিলেন সেইরকম কৃত্রিম যন্ত্র যা কেউ ভেদ করতে না পারে। দ্রুপদ জানতেন– তার মেয়ের স্বয়ম্বরে অংশ গ্রহণ করাটা মর্যাদার ব্যাপার এবং তার বিশ্বাস ছিল অর্জুন যদি কোথাও থাকেন, তা হলে এই বিরাট স্বয়ম্বর উৎসবে তিনি আসবেনই। দ্বিতীয়ত, খেয়াল করুন ধৃষ্টদ্যুম্নের কথা। পিতার ইচ্ছে তিনি নিশ্চয় জানতেন এবং অর্জুনের সমকক্ষ বীর যে একমাত্র কর্ণ– তাও তিনি জানতেন। ঠিক এই কারণেই তাঁর ভগিনী সম্প্রদানের প্রতিজ্ঞার মধ্যে একটু প্যাঁচ ছিল। ধৃষ্টদ্যুম্ন বলেছিলেন– মিথ্যে বলছি না বাপু, আমার ভগিনী তারই ভার‍্যা হবেন, যিনি এই লক্ষ্যভেদের মতো মহৎ কর্মটি করবেন। তবে তিনি কেমনটি হবেন? যিনি নাকি– কুলেন রূপেন বলেন যুক্তঃ– অর্থাৎ সেই মানুষটি, যার বংশ-মর্যাদা, রূপ এবং বীরত্ব- সবই আছে। কাজেই যিনিই লক্ষ্যভেদ করবেন তিনিই আমার বোনের স্বামী হবেন– কুমার ধৃষ্টদ্যুম্নের এই প্রতিজ্ঞার মধ্যেও একটু কথার ফাঁক ছিল, এবং দ্রৌপদী যে সুতপুত্রকে মর্যাদার প্রশ্নে প্রত্যাখ্যান করলেন, তাতে আমরা তাই খুব একটা আশ্চর্য বোধ করি না। বিশেষত মহারাজ দ্রুপদ অর্জুনকে খুঁজছিলেন– এই নিরিখে, অপিচ ধৃষ্টদ্যুম্ন লক্ষ্যভেদের ক্ষমতার সঙ্গে লক্ষ্যভেত্তা পুরুষের কুলমর্যাদা এবং রূপও চাইছেন এই নিরিখে আমরা তো ধারণা করি যে দ্রৌপদী কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য পূর্বাহ্নেই প্রস্তুত ছিলেন। এমনকী তাকে শেখানোও হয়ে থাকতে পারে যে কূটনৈতিক কারণে কর্ণকে স্বয়ম্বর-সভায় নেমন্তন্ন করতে হয়েছে বটে, কিন্তু দ্রৌপদীকে এ ব্যাপারটা সভাতেই সামলাতে হবে। দ্রৌপদী সামলে দিয়েছেন, এবং অর্জুন ছাড়া একমাত্র বীর যিনি এই লক্ষ্যভেদ করতে পারতেন, তিনি অসম্মানে বঞ্চিত হলেন।

যাক, বড় বড় বীরেরা যখন হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লেন, তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন তখন ব্রাহ্মণদের মধ্যে বসে হাতে সুড়সুড়ি দিচ্ছেন। তিনি আর থাকতে পারলেন না। বসে থাকা সমস্ত ব্রাহ্মণদের মধ্যে থেকে রমণীর বরমাল্যের আশায় হঠাৎ করে উঠে আসতে অর্জুনের সংকোচ হচ্ছিল নিশ্চয়ই। কাজেই তাদের কারও বা অস্বস্তি এবং কারও বা বিরক্তি জন্মিয়েই উঠে পড়লেন অর্জুন। ব্রাহ্মণদের মধ্যে এর এক অদ্ভুত মিশ্রক্রিয়া হল। কিছু উদ্যমী ব্রাহ্মণ একেবারে হই হই করে উঠলেন, তারা তাদের পরনের অজিন খুলে রুমালের মতো উড়িয়ে বিধুম্বন্তোহজিনানি চ– অর্জুনকে ‘চিয়ার আপ’ করতে থাকলেন। কিন্তু মধ্যপন্থী ব্রাহ্মণেরা, যারা একটু বে-ভরসা গোছের, তারা বলতে থাকলেন– কর্ণ শল্য রসাতলে গেল, আর এই দুবলা বামুন প্রাণতো দুর্বলীয়সা বেটা বলে কিনা ধনুক তুলব। সমস্ত রাজমণ্ডলের সামনে আজ বামুনদের মাথা হেঁট করে দেবে এই বিটলে ছেলেটা অবস্যা ভবিষ্যন্তি ব্রাহ্মণঃ সর্বরাজ। চিন্তিত ব্রাহ্মণেরা বললেন– ভাল চাও তো চেপে বসে পড় এখানে। অর্জুনে থামলেন না দেখে, তারা অন্যদের বললেন- প্রেমানন্দেই হোক, অহংকার বশেই হোক কিংবা চপলতা বশে ছেলেটা যে ধনুক বাঁকাতে যাচ্ছে ওকে বারণ করুন, যেন না যায়– বার্যতাং সাধু মা গমৎ।

এই যে কথাগুলি বললেন–এঁরা হলেন ব্রাহ্মণদের মধ্যে বে-ভরসাদলের, মহাভারতকার যাঁদের বলেছেন– বিমনসঃ। কিন্তু অর্জুন উঠতে যাঁরা বেশ খুশি হলেন– মুদান্বিতাঃ– তারা উদ্যমী হয়ে বললেন মাথাও হেঁট হবে না, মানও খোয়াবে না। ছেলেটার চেহারা দেখেছ; হাতের গোছা আর কাঁধের গুলিগুলো দেখেছ? তার ওপরে ছেলেটার উৎসাহ দেখলে বোঝা যায় যে, এর সম্ভাবনা আছে। ক্ষ্যামতা না থাকলে কি আর এমনি এমনি উঠে গেল– ন হি অশক্তঃ স্বয়ং ব্রজেৎ। রোগা হলেও এই ব্রাহ্মণদের খুব মনের জোর আছে। এঁদের ধারণা বামুনের অসাধ্য কিছু নেই, হোক না বামুন ফলাহারী, উপোসী, ব্রতধারী। জল খায় আর হাওয়া খায় বলে– অভক্ষা বায়ুভক্ষাশ্চ– তারা কি সব মরে গেছে নাকি, বামুন নিজের তেজেই বামুন।

ব্রাহ্মণবেশী অর্জুনের ঘাড়ে চেপে রোগা বামুনেরা যতক্ষণ মুখ এবং হস্তব্যায়াম করছিলেন, ততক্ষণে অর্জুন ধনুকের কাছে পৌঁছে গেছেন এবং দ্রুপদের যন্ত্র-লক্ষ্যও ভেদ করে দিয়েছেন। আর যায় কোথা, ক্ষত্রিয়দের লজ্জা দিয়ে ব্রাহ্মণেরা তাদের উতলা উত্তরীয়গুলি আকাশে বিজয়ধ্বজের মতো উড়িয়ে দিলেন। দেবতাদের মুগ্ধ পুষ্পবৃষ্টির মধ্যে সুকুমারী দ্রৌপদী মধুর এক সমর্থনের হাসি হেসে উৎস্ময়ন্তী– ব্রাহ্মণবেশীর গলায় সাদা ফুলের বরমাল্যখানি দুলিয়ে দিলেন। তখনও তিনি জানেন না– ইনিই তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন গাণ্ডীবধন্বা। আমাদের ধারণা, বিবাহলগ্নে এই যে তিনি ব্রাহ্মণবোধে জীবনসঙ্গী বেছে নিলেন, এইখানেই তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। সারাজীবনই তার কেটেছে বনবাসিনী ব্রাহ্মণ-বধূর মতো। রাজোচিত সুখভোগ তার কপালে জোটেনি, যাও জুটেছে তাও কণ্টকহীন নয়। বনবাস আর অজ্ঞাতবাসে তার যৌবন শুধু ব্রাহ্মণের আদর্শধূলিতে ধূসর। সাময়িকভাবে ভিক্ষাব্রতী ব্রাহ্মণবেশীরা কুটিরে ফিরে গিয়ে তার বধূ-পরিচয় করিয়েছে। ভিক্ষার পরিচয়ে। মহাভারতকার এই পরিচয় লগ্নটি লক্ষ করে বলেছেন- পাণ্ডবেরা যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীকে ভিক্ষা বলে পরিচয় দিলেন– ভিক্ষেতি অথাবেদয়তাম। পাণ্ডবেরা সারা জীবন এই ভিক্ষার ঝুলি বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছেন, আর যিনি স্বয়ং ভিক্ষা তার সঙ্গে অন্য পাঁচজন ব্যবহারও করেছেন ভিক্ষার মতো।

অথচ দ্রৌপদীর বিবাহলগ্নে ঘটনাগুলি এইরকম ছিল না। এই অসামান্য রমণীর বরমাল্য ভিক্ষার জন্য দূর দূরান্ত থেকে এসেছিলেন সেকালের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত রাজারা। ঠিক সেই অর্থে পাণ্ডবরা তখনও প্রতিষ্ঠিত নন, কারণ তারা তখনও হস্তিনাপুরের সামান্য দাবিদার মাত্র, রাজা নন। তবে যদি সম্ভাবনার কথা ধরা যায়, তা হলে অবশ্যই বলতে হবে যে, ভীমার্জুনের শক্তিমত্তার কথা তখন সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে গিয়েছিল এবং এই সম্ভাবনাকে মূলধন করেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দ্রুপদরাজার রাজনৈতিক বুদ্ধি পরিচালিত হয়েছিল। মনে রাখা দরকার যাঁর সঙ্গেই দ্রুপদ-কন্যা দ্রৌপদীর মেলবন্ধন ঘটবে তার সঙ্গে পাঞ্চাল রাজ্যেরও সুসম্পর্ক হবে– এ তো জানা কথা। রাজনৈতিক অবস্থানে দ্রুপদের অবস্থা তখন ভাল নয়। তার অর্ধেক রাজ্য পাণ্ডব-কৌরবের গুরুদক্ষিণার সময়েই দ্রোণের করত। দ্রোণ কৌরবসভায় গুরুমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত এবং স্বয়ং পিতামহ ভীষ্ম তাকে উষ্ণ সম্মানে কুরুকুলের হিতাকাঙ্ক্ষীর আসনে বসিয়ে দিয়েছেন। সেজন্য ভীষ্মের ওপরেও দ্রুপদের ক্ষোভ থাকতে পারে। অন্যদিকে পাণ্ডবেরা যে জ্ঞাতিদের দ্বারা লাঞ্ছিত হচ্ছেন এবং বারণাবতে তাদের পুড়িয়ে মারার চেষ্টাও হয়েছিল– এ খবর দ্রুপদ রাখতেন। বস্তুত যে বালকবীর অর্জুন তাকে বেঁধে দ্রোণাচার্যের কাছে পঁড় করিয়েছিল, তার ওপরে দ্রুপদের রাগ ছিল না, রাগ ছিল দ্রোণের ওপরেই। কাজেই দ্রুপদ যে মনে মনে দ্রৌপদীকে অর্জুনের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেও কিন্তু আরেক প্রতিশোধস্পৃহা যে স্পৃহায় পূর্বে ধৃষ্টদ্যুম্নের জন্ম হয়েছে। খেয়াল করে দেখুন কুরুকুলের বর্ম-আঁটা দুই প্রধান পুরুষ মহারথ দ্রোণ এবং ভীষ্ম– এই দু’জনেরই হন্তা কিন্তু দ্রুপদের ঘরেই জন্মেছে একজন ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং অন্যজন শিখণ্ডী। একজন যদি দ্রোণবধের নিমিত্তমাত্র হয়ে থাকেন, তো ভীষ্মবধের নিমিত্তও শিখণ্ডী। দু’জনকেই নিমিত্ত বলেছি এই কারণে যে, অর্জুন না থাকলে এই দু’জনেরই বলবীর্য এমনকী শিখণ্ডীর ক্লীবত্বও বিফলে যেত। কাজেই দ্রোণাচার্যের আদেশ মাত্রে যে ছেলেটির হাতে দ্রুপদ বাঁধা পড়েছিলেন তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হলে যে রাজনৈতিক দিক দিয়ে দ্রুপদের সুবিধা ছিল, একথা সবাই বোঝে।

আমাদের ধারণা, পাণ্ডবেরা যে বারণাবতে জতুগৃহদাহ থেকে কোনওক্রমে বেঁচে গেছেন, এ-কথা দ্রুপদ কোনওভাবে শুনেছিলেন, না হলে ধনুক বানাবার আগে তিনি অর্জুনকে খুঁজবেন কেন– সোহন্বেষয়ানঃ কৌন্তেয়ম। দ্বিতীয়ত, দ্রৌপদীর বিয়ের পর ধৃষ্টদ্যুম্ন পাণ্ডবদের কুমোরশালা থেকে লুকিয়ে সব জেনে এসে দ্রুপদকে বললেন- এঁরা নিশ্চয়ই ক্ষত্রিয়, শুধু তাই নয়, এঁরাই পাণ্ডব। ধৃষ্টদ্যুম্ন এবার বললেন- পাণ্ডবেরা জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচে ফিরেছেন– এইরকম একটা কথা শুনে ঘরে বসে থাকবেন না। আর সত্যিই তো তাই। সেই কবে ব্যাসদেব জানিয়ে যাচ্ছেন দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর হবে, আর পাণ্ডবদের মনে নববধূর নিত্য আসা-যাওয়া ঘটছিল। সেই কবে ধৌম্য পুরোহিতকে তারা বরণ করে নিলেন আর সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডবদের মনে হল এবার ধৌম্যকে সঙ্গে নিয়ে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর দেখতে যাব– মেনিরে সহিতা গন্তুং পাঞ্চাল্যাস্তং স্বয়ম্বরম। এ যেন বরপক্ষের পুরোহিত ঠিক হয়েছে, আর পাণ্ডবেরা চললেন বধূ বরণ করতে।

দ্রুপদের মনে যেমন ধারণা ছিল যে, দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সম্ভাবনা ঘটলে পাণ্ডবেরা আর কিছুতেই আত্মগোপন করে থাকতে পারবেন না, ঠিক এই ধারণাটা ছিল আরেকজন মানুষেরও তিনি কৃষ্ণ। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর তার কাছে রাজনৈতিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সে-কথা আমি অন্যত্র বিস্তারিত লিখেছি। এখানে শুধু এইটুকুই বলব যে, কংসকে হত্যা করার পর কৃষ্ণ এবং তার যাদব-সেনার উপর জরাসন্ধের আক্রোশ অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল, কারণ কংস ছিল জরাসন্ধের জামাই এবং জরাসন্ধ ছিলেন তার কালের অবিসংবাদিত নেতা। হরিবংশে দেখা যাবে, জরাসন্ধের সৈন্যবাহিনীর পুচ্ছভাগে দুর্যোধন ইত্যাদি কৌরবরাও সামিল হয়েছেন–কৃষ্ণের বিরুদ্ধে কোনও সমবেত আক্রমণে জরাসন্ধকে সাহায্য করার জন্য– দুর্যোধনাদয়শ্চৈব ধার্তরাষ্ট্রা মহাবলাঃ। অন্যদিকে উদীয়মান নেতা কৃষ্ণ একটু একটু করে জরাসন্ধের দিকে এগোচ্ছিলেন। কারণ, জরাসন্ধের বিনাশ না হলে যাদব বৃষ্ণিকুলের কোনও স্বস্তি ছিল না। কৃষ্ণ কৌরব-পাণ্ডবের জ্ঞাতিভেদের কথা জানতেন, বিশেষত পাণ্ডবদের সঙ্গে তার পারিবারিক সম্বন্ধসূত্র থাকায় তিনি চাইছিলেন হস্তিনাপুরে পাণ্ডবেরাও একটা শক্তি হয়ে দাঁড়ান। হরিবংশে দেখা যাচ্ছে বারণাবতে পাণ্ডবদের পুড়ে মরার কথা শুনে কৃষ্ণ ছুটে এসেছিলেন সেখানে। যে কোনও কারণেই হোক, তাঁকে হঠাৎ করে দ্বারকায় ফিরে যেতে হল পাণ্ডবদের শ্রাদ্ধ-তর্পণ করেই, যেন ওইটাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, শ্রাদ্ধকল্পের পরেও তিনি সাত্যকিকে বলে গেলেন পাণ্ডবদের অস্থি সঞ্চয় করতে কুল্যার্থে চাপি পাণ্ডুনাং ন্যযোজয়ত সাত্যকিম। স্পষ্টতই বোঝা যায় যে কৃষ্ণ যে ধরনের মানুষ তাতে যাচাই না করে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেবার লোক তিনি নন। তা ছাড়া পাণ্ডবদের মৃত্যুর কথা তিনি বিশ্বাস করেননি। সাত্যকিকে অস্থি সঞ্চয় করতে বলা মানেই হল– হয় তুমি মৃত পাণ্ডবদের অস্থি সঞ্চয় করে দেখাও, নয়তো জীবিত পাণ্ডবদের পাত্তা লাগাও। মহামতি বিদুর পাণ্ডবদের লাক্ষাগৃহ-মুক্তির খবর শত চেষ্টাতেও চেপে রাখতে পারেননি। কানাঘুষা চলছিলই, এবং মহারাজ দ্রুপদ, কুমার। ধৃষ্টদ্যুম্ন যেমন কানাঘুষাতেই সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে পাণ্ডবেরা বেঁচে আছেন, সাত্যকিও নিশ্চয়ই এই কানাঘুষার খবর কৃষ্ণকে জানিয়ে থাকবেন। কৃষ্ণও তাই দ্রুপদের মতোই ধারণা করেছেন যে, দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরের মতো ঘটনা ঘটলে পাণ্ডবেরা কিছুতেই আত্মগোপন করে থাকবেন না, তাদের দেখা যাবেই। কৃষ্ণের অনুমান পুরোটাই ঠিক। পাণ্ডবেরা এসেছিলেন। বিবাহসভা এবং ধনুর্বেধের হই-হট্টগোলের মধ্যেই ছাইচাপা আগুনের মতো ছদ্মবেশী পাণ্ডবদের কৃষ্ণ ঠিকই চিনেছিলেন ভস্মাবৃতাঙ্গানিব হব্যবাহান। চেনাটা তাঁর প্রয়োজনও ছিল। কারণ, পাঞ্চালের সঙ্গে পাণ্ডবদের মেলবন্ধন ঘটলে উভয়েই শক্তিশালী হবেন, এবং তার প্রধান শত্রু জরাসন্ধের বিরুদ্ধে সে-জোট কাজে আসবে।

পাণ্ডবেরা কিন্তু কৃষ্ণ-বলরাম কাউকেই চিনতে পারেননি। কারণ এই নয় যে, ভিড়-ভাট্টা কোলাহল। যখন প্রথম দ্রৌপদী স্বয়ম্বর সভায় এলেন, সবাই তখন একযোগে, একদৃষ্টিতে কৃষ্ণার দিকে তাকিয়েছিল কিন্তু কৃষ্ণ সেই অবস্থাতেই পাণ্ডবদের চিনে ফেলেছিলেন, দাদা বলরামকে চিনিয়েও দিয়েছিলেন। অথচ পাণ্ডবেরা স্বরূপে থাকা কৃষ্ণকেও চিনতে পারেননি। দ্রৌপদীর ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন বিভিন্ন রাজ-নাম কীর্তনের সময় কৃষ্ণ বলরামের কথা বলেওছিলেন। কিন্তু কে দেখে তাদের? কে দেখে রাজাদের? সবাই যেমন তখন দ্রৌপদীকেই দেখছিল, ঠোঁট কামড়াচ্ছিল, পাণ্ডবেরাও তখন প্রায় সেই কাজেই মত্ত ছিলেন। ব্যাসদেবকে তাই লিখতে হয়েছে– দ্রৌপদীকে দেখে পাণ্ডবেরা সবাই একেবারে কামমোহিত হয়ে পড়েছিলেন– তাং দ্রৌপদীং প্রেক্ষ্য তদা স্ম সর্বে। কন্দর্পবাণাভিহতা বভূবুঃ। এই ফুলশরের আঘাতে মূৰ্ছিত অবস্থা চলেছে একেবারে পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত।

পাঁচ ভাই রীতিমতো যুদ্ধ জয় করে দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে সেই যখন কুমোরশালায় পোঁছলেন, সেখানে কি তাদের এমন শব্দহীন নিরুচ্চার প্রত্যাগমন ঘটেছে, যাতে কাক পক্ষী এবং কুন্তী কেউ কিচ্ছু টের পেলেন না। অথচ সেই দিন তো জাগতিক প্রকৃতির মধ্যেই এক ধরনের চাপল্যহীন তুষ্ণীম্ভাব বিরাজ করছিল। ঘন মেঘে মেদুর অম্বর, বৃষ্টি পড়ছে যখন-তখন, দুর্দিনের বিরক্তিতে মানুষজন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে ততঃ সুপ্তজনপ্ৰায়ে দুর্দিনে মেঘসংপ্লতে। দুর্দিনের কবলে যখন অপরাহ্নে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, তখন কুমোরশালার ভাড়া ঘরে বসে কুন্তী নানা দুশ্চিন্তা করছিলেন– দুর্যোধন বা দুর্যোধনের লোকেরা কি চিনে ফেলল তার ছেলেদের, নাকি মায়াবী রাক্ষসেরা কিছু করল? সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা– ভগবৎ-প্রতিম ব্যাসের কথা কি তা হলে সব মিথ্যে হয়ে গেল বিপরীতং মতং জাতং ব্যাসস্যাপি মহাত্মনঃ।

আমরা এটা জানি যে, ব্যাস কিন্তু দ্রৌপদীর কথা পূর্বাহ্নেই কুন্তী এবং পাণ্ডবদের জানিয়েছিলেন এবং এটাও বলেছিলেন যে, পাঁচজনের স্ত্রী হবেন দ্রৌপদী। এই অবস্থায় একবারও কুন্তীর মনে দ্রৌপদীর কথা উদয় হয়নি, এটা কি খুব যুক্তিসঙ্গত হবে! অতএব যে মুহূর্তে অর্জুন-ভীম স্বয়ংবর-লক্কা দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের দরজা থেকেই ঘোষণা করলেন মা! ভিক্ষা এনেছি সেই মুহূর্তেই কুটীরের অন্তরাল থেকে কুন্তী বললেন– সবাই মিলে ভিক্ষা ভাগ করে নাও– এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার মধ্যে কুন্তী নবাগতা দ্রৌপদীকেই এই ঘোষণা শোনাতে চেয়েছেন। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, কুন্তী অন্য কোনও প্রতিক্রিয়াশীল শাশুড়ির মতো নন। পুত্রবধূ দ্রৌপদীর সঙ্গে কুন্তীর সম্পর্ক চিরকালই খুব ভাল ছিল এবং পুত্রবধূর সম্পর্কে তার শ্রদ্ধাও কিছু কম দেখিনি। কিন্তু বিবাহ-পূর্ব মুহূর্তেও ভাবী পুত্রবধূর চাইতেও ছেলের জন্য জননীর ভাবনা বেশি থাকে এবং পুত্রদের প্রতি কুন্তীর স্নেহ সমান এবং মাদ্রীপুত্র সহদেবের জন্য একটু বেশিই। ঠিক এইরকম একটা মানসিক অবস্থানে কুন্তী কিচ্ছু না বুঝে পাঁচ ভাইকে ভিক্ষা ভাগ করে নিতে বলেছেন, এটা আমার কাছে তর্কসহ মনে হয় না। বিশেষত যিনি একটু আগেই ভাবছিলেন যে, ভগবান ব্যাসের কথা কি তা হলে বিপরীত হয়ে গেল– তিনিই তো দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর অবশ্যম্ভাবিতা জানিয়ে পাণ্ডবদের পঞ্চাল-নগরে বাস করার নির্দেশ দিয়েছিলেন– পঞ্চাল-নগরে তস্মান্নিবসধ্বং মহাবলাঃ যাতে সেই মেয়েটিকে লাভ করতে পারেন পাণ্ডবরা।

এত সব কি ভুলে গিয়েছিলেন কুন্তী! হতেই পারে না। আমরা যদি ব্যাসকথিত দ্রৌপদীর পূর্বজন্ম-কথাটাকে একটা অলৌকিক কাহিনি হিসেবেও ধরি, যদি এমনও বলি যে, ভবিষ্যতে পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিয়ে হয়েছিল বলেই এক রমণীর বহুভর্তৃতার মধ্যে বহুগামিতার দোষ কাটানোর জন্য মহাভারতের কবি পূর্বাহ্নেই দ্রৌপদীর পূর্বজন্ম কথা উচ্চারণ করে রেখে দ্রৌপদীর সঙ্গে পাণ্ডবদের বিয়ের একটা মহাকাব্যিক যৌক্তিকতা তৈরি করে রেখেছিলেন, তা হলে কুন্তীকে আমরা সমস্ত প্রক্রিয়াটির অনুঘটিকা হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। তিনিই তার ছেলেদের কাছে পঞ্চাল-রাজ্যে যাবার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং পঞ্চালে আসা ইস্তক দ্রৌপদী-স্বয়ম্বরের সংবাদ বার বার তার শ্রুতিতে আসাই স্বাভাবিক। ঠিক এই অবস্থায় সমস্ত পাণ্ডবেরা সকলে অপরাহ্নের মেঘদুর্দিন প্রায়ান্ধকারে অন্যান্য ব্রাহ্মণদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে বাড়ি ফিরছেন– ব্রাহ্মণৈঃ প্রাবিশও জিষ্ণুর্ভার্গববে তৎ– এবং কুটিরদ্বারেই ভীম-অর্জুনের সাগ্রহ ঘোষণা– মা! ভিক্ষা এনেছি– আর পরিবেষ্টা ব্রাহ্মণেরা সেখানে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন নাকি, তারা তো সেই স্বয়ম্বর-শেষ থেকেই চেঁচাচ্ছিলেন যে, এই স্বয়ম্বর-সভাটা ব্রাহ্মণদের প্রাধান্যেই শেষ হল, ব্রাহ্মণরাই পাঞ্চালীকে পেয়েছে– বৃত্তো ব্রহ্মোত্তরো রঙ্গঃ পাঞ্চালী ব্রাহ্মণৈবৃতা- ঠিক এই অবস্থায় কুন্তী একেবারে নিস্তরঙ্গ মধ্যযুগীয় ঠাকুরমার মতো যা করছিলেন, গভীর নিস্তব্ধতায় তাই করতে-করতেই পান চিবোতে লাগলেন এবং ততোধিক নিস্তরঙ্গতায় ছেলেদের বললেন– ভিক্ষা ভাগ করে নাও– এত বড় বোকার ভুল কুন্তীর মতো বিদগ্ধা রমণী করতে পারেন না। বরঞ্চ বলব– এই ইচ্ছাকৃত সব বুঝেও না বুঝে বলার মধ্যেই তার প্রকৃত ইচ্ছাশক্তি কাজ করছিল। তিনি চাইছিলেন– তার পাঁচ ছেলেই লাভ করুক সুন্দরীশ্রেষ্ঠা দ্রৌপদীকে।

তবে এত সব অন্তর্নিহিত মনের কথা পরিষ্কার করে বলতে চাননি মহাভারতের কবি। অতএব কাহিনির উপরি-অংশে রসিকতার ভাগই বেশি রইল। মা যে কুটিরের অন্তরাল থেকে বললেন– ভিক্ষাবস্তু ভাগ করে নাও বাছারা, এবং তার পরেই আগুনপানা দ্রৌপদীকে দেখে নববধূর হাত ধরে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে বলেছেন– এখন আমি কী করব? যাতে আমার কথাটাও মিথ্যে না হয়, অথচ ধর্মও সুস্থির থাকে এবং পঞ্চালনন্দিনীর কোনও অধর্ম না হয়, সেইরকম কিছু করো। মায়ের কথা শুনে যুধিষ্ঠির প্রথমেই যে সমাধান দিয়ে দিতে পারতেন, তা কিন্তু দেননি। যে নায়ক অসামান্য দক্ষতায় লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীকে জিতেছেন, যুধিষ্ঠির প্রথমে সেই অর্জুনকে ‘অফার’ দিয়ে সবচেয়ে যথার্থ কথাটা বললেন। বললেন– অর্জুন! তুমিই যাজ্ঞসেনী পাঞ্চালীকে লক্ষ্যবেধ করে জিতেছ এবং তোমার পাশেই রাজপুত্রীকে সবচেয়ে বেশি মানাবে ত্বয়া জিতা ফাল্গুন যাজ্ঞসেনী। ত্বয়ৈব শোভিষ্যতি রাজপুত্রী। অতএব কোনও দ্বিধা নেই, তুমিই অগ্নিসাক্ষী করে তাকে বিধি অনুসারে গ্রহণ করো।

অন্য কোনও পাণ্ডব হলে কী হত বলতে পারব না, কিন্তু অর্জুন এই সময়ে যে ব্যবহার করলেন, তা একমাত্র মহাকাব্যিক বীরকেই মানায়। অসামান্য এক বীরোচিত সৌজন্যবোধ সবসময়েই তাঁর মধ্যে কাজ করে, অতএব সেই বীরোচিত ভদ্রতাতেই অর্জুন নিমেষে যুধিষ্ঠিরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললেন– না, মহারাজ! না। তুমি এইভাবে আমাকে অধর্মের পথে ঠেলে দিয়ো না। এ-রকম ব্যবহার তো অশিষ্টজনের মধ্যে দেখা যায়। দুই বড় ভাইয়ের বিয়ে হল না, তার আগেই আমি বিয়ে করে বসব, এটা হয় নাকি? সবার আগে তো তোমার বিয়ে হোক, তারপর ভীমসেন, তারপর তো আমি- ভবান নিবেশ্যঃ প্রথমং ততোহয়ং/ ভীমো মহাবাহুরচিন্ত্যকর্মা। অহং ততঃ…। আর এ-ব্যাপারে তুমি সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা কোরো না। আমরা সবাই এবং এই নবলব্ধা কন্যা– সবাই আমরা তোমার কথা শুনেই চলব।

এ-দেশে এটা অবশ্য একটা চিরকালীন আচারের মধ্যেই পড়ে। কন্যা বয়স্থা হলে সবার আগে তার বিবাহের ব্যবস্থা করতে হত এবং তার পরেই বড় ভাই। এই সমুদাচার এবং সদাচার এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে এক সময়ে স্মৃতিশাস্ত্রকারেরা সমাজ-বিধান দিয়ে। বলতে আরম্ভ করলেন যে, বড় ভাইয়ের বিয়ের আগেই যদি ছোটভাই বিয়ে করে বসে, তবে তার সংজ্ঞা হবে ‘পরিবেত্তা এবং পরিবেত্তা’-র চিহ্ন বহন করাটা সমাজের চোখে খুব সহনীয় ছিল না। অর্জুন তাই প্রথমত এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং অন্যদিকে পাণ্ডব-ভাইদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে ‘সেনসিটিভ’ বলেই মায়ের মন এবং যুধিষ্ঠিরের মনোগত ইচ্ছার কথা তিনি আগেই বুঝেছেন। এ-ব্যাপারে যিনি অপরা, তার মতামত নেওয়াটা আধুনিক দৃষ্টিতে জরুরি ছিল, কিন্তু অর্জুন সবাইকে হারিয়ে যে বীররমণীকে জিতে এনেছেন, তিনি যে অর্জুনের কথা শুনবেন– এ-কথাও অর্জুনের বোঝা হয়ে গেছে। বোঝা হয়ে গেছে তিনি অর্জুনকে অতিক্রম করবেন না।

অদ্যতনেরা বলেন– ও-সব ভাবের কথা বলবেন না। অর্জুন কিছুই বোঝেননি। শুধু এইটুকু তিনি বুঝেছেন তার বলবান পৌরুষেয় অহংকারে যে, তিনি লক্ষ্যভেদ করে যাঁকে স্বয়ংবরে জিতে নিয়ে এসেছেন, এবং অন্যান্য রাজা-রাজড়াদের যুদ্ধে পরাজিত করে যার অধিকার পেয়েছেন, তার ওপরে অর্জুন নিজের অধিকার-কর্তৃত্বেই এ-কথা বলেছেন। বলেছেন– এই কন্যাটিও তোমার কথা শুনবে। আমরা বলব– মহাকাব্যিক সমাজ এবং তার পরিমণ্ডলে এই ঘটনা এত জটিল ছিল না। বিশেষত দ্রৌপদীকে নিয়ে যে অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে মায়ের কথা, ভাইদের একতা– সব কিছু মিলিয়ে এই পরিস্থিতিতে অর্জুন বলেছিলেন– আমরা সব ভাইয়েরা এবং এই কন্যা সকলেই তোমার কথা মেনে নেব, তুমি তোমার সিদ্ধান্ত বল বৃকোদরোহহঞ্চ যমৌ চ রাজন/ইয়ঞ্চ কন্যা ভবতো নিযোজ্যাঃ।

অর্জুনের এই বীরোচিত ভদ্রতার অব্যবহিত পরমুহূর্তে অন্যান্য পাণ্ডব-ভাইদের প্রতিক্রিয়া ছিল দেখার মতো। যেই তারা বুঝলেন– অর্জুনের কথার মধ্যে ভাইদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং স্নেহ আছে- ভক্তিস্নেহসমন্বিতম– এবং যখন বুঝলেন যে, অর্জুন স্বয়ংবরে দ্রৌপদীকে এককভাবে জিতে নেবার স্বাধিকার ত্যাগ করে সে-অধিকার ভাইদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চান, সেই মুহূর্তেই সমস্ত পাণ্ডব-ভাইরা দ্রৌপদীর ওপর নিজেদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন– দৃষ্টিং নিবেশয়ামাসুঃ পাঞ্চাল্যাং পাণ্ডুনন্দনাঃ পুরুষের এই দৃষ্টি কেমন হয়, বিশেষত যে মুহূর্তে এই মানসিক প্রশ্রয় থাকে যে, এই রমণী আমারই হতে পারে, তখন এই দৃষ্টি কেমন হয়, এই দৃষ্টির প্রকৃতি কী এবং রমণী-শরীরের কোথায় কোথায় এই দৃষ্টি পড়ে, তা মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি বোঝে এবং অবশ্যই বোঝে ‘অন্তঃশাক্তঃ বহিঃ শৈবঃ সেইসব পুরুষেরা, যারা নিজেদের সঙ্গে প্রতারণা করে না। মহাকবি কালিদাস তার কুমারসম্ভব কাব্যে ব্যঞ্জনার সংক্ষিপ্তিতে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন একবার মনের অজান্তেও পুষ্পশরের মৃদু আঘাতেই পরম যোগী ভগবান শংকরের জ্ঞানাগ্নিদীপ্ত তৃতীয় নয়ন সহ তার সবগুলি চক্ষুই যুবতী উমার বিম্বফলসদৃশ অধরৌষ্ঠের ওপর নিপতিত হয়েছিল– উমামুখে বিম্বফলাধরৌষ্ঠে। ব্যাপারয়ামাস বিলোচনানি।

মহাকাব্যের কবিও তো কম ব্যঞ্জনা-মুখর নন। এমনকী কালিদাসের মতো তিনি রমণী শরীরের কোনও প্রতীকি অঙ্গসংস্থানও বেছে নেননি পরম কবিত্বময়তায়। কারণ তিনি জানেন– এ হল সেই মুহূর্ত, যখন পুরুষ রমণীর সমস্ত প্রত্যঙ্গসংস্থানে যৌনতার দৃষ্টি সংক্রমণ ঘটায়। অতএব মহাভারতের কবি সমস্ত সাদৃষ্টিক বুদ্ধিতে অত্যন্ত সরলভাবে জানিয়েছেন– সব পাণ্ডব ভাইয়েরাই তখন কৃষ্ণা-পাঞ্চালীর ওপর দৃষ্টিপাত করলেন। আর ঠিক এইখানে স্ত্রী-হৃদয়ের প্রতিক্রিয়ায় পাঞ্চালী কৃষ্ণাও কিছু শরম-বিজড়িতা অবগুণ্ঠনবতী নন- তিনিও তাঁদের দেখছিলেন, তাদের মোহ দেখছিলেন, তারা কীভাবে তাকে দেখছিলেন, তাও দেখছিলেন নিশ্চয়ই– দৃষ্টা তে তত্র পশ্যন্তীং সর্বে কৃষ্ণাং যশস্বিনীম্। অর্থাৎ তিনিও পরিমাপ করছিলেন পঞ্চপাণ্ডব ভাইদের। যে-সব প্রগতিবাদিনীরা আমাকে এক বিদ্বৎসভায় বোঝাতে চেয়েছিলেন– এ এক বিষম অন্যায় হয়ে গিয়েছিল– যুধিষ্ঠির অন্যায়ভাবে পাঁচ-পাঁচটা পুরুষের আপদ চাপিয়ে দিয়েছিলেন নবাগতা স্বয়ংবর বধূটির ওপর তাদের প্রতি পরম করুণায় জানাই– মহাভারতের পরমা এবং চরমা নায়িকাকে ওই একবিংশ শতাব্দীর পরিশীলনে একাকিনীর ধারণ ক্ষমতায় বিচার করবেন না। বিশেষত যে রমণী স্বয়ংবর-সভার নিয়ম অতিক্রম করে সমাগত রাজা-রাজড়াদের সামনে কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করতে পেরে থাকেন, সেই রমণীর যদি পঞ্চস্বামীর ব্যাপারে অনভিপ্রায় থাকত, তা হলে এই মুহূর্তে তিনি প্রতিবাদ করতেন। এবং প্রতিবাদ করলে স্বয়ংবরের ধর্মবোধে যুধিষ্ঠির তা মেনেও নিতেন। কেননা কী হওয়া উচিত, তা তিনি অর্জুনকে প্রথম ‘অফার’ দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছেন।

অতএব আমরা বলব– কৃষ্ণা পাঞ্চালী এই পরিস্থিতিটা এনজয় করছিলেন এবং আদিম ভাবেই ‘এনজয় করছিলেন। পাঁচ-পাঁচটা বীর পুরুষ তার দিকে ইতস্তত দৃষ্টিপাত করছেন এই অবস্থায় প্রতিক্রিয়া তাদেরও পরিষ্কার চোখে দেখে নেওয়াটা যেমন তার সাহসের মধ্যে পড়ে, তেমনই তার প্রতিকামিতার আমাদের মধ্যেও পড়ে। মহাকাব্য মহাভারতের প্রধানতমা নায়িকার এই সাহসও আছে এবং তেমনই প্রতিকামিতাও আছে। যদি এখানে একান্তভাবেই পশ্যমান প্রেক্ষমাণা পাঞ্চালীর নিগূঢ় সম্মতি না থাকত, তা হলে সমস্ত পাণ্ডবরা তাকে একই সঙ্গে আপন আপন হৃদয়ে ধারণ করতে পারতেন না কবি লিখেছেন- দ্রৌপদীকে দেখে তারা একে অপরের মুখ চাওয়াচায়ি করেছেন এবং সকলেই তাকে হৃদয়ের মধ্যে গ্রহণ করেছেন– সম্প্রেক্ষ্যান্যোন্যমাসীনা হৃদয়ৈস্তাম্ অধারয়ন।

আমাদের এখানে প্রথম জিজ্ঞাসা হয়– অর্জুন যখন যুধিষ্ঠিরের প্রথম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে পাঞ্চালী কৃষ্ণাকে স্বাধিকার থেকে মুক্ত করে দিলেন, তারপর সকল পাণ্ডবরাই যে পাঞ্চালীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন– পাঞ্চাল্যাং পাণ্ডুনন্দনাঃ- এই দৃষ্টিপাতের মধ্যে কি অর্জুনও আছেন, আছেন কি যুধিষ্ঠিরও, যিনি নিজে প্রায় বিচারকের আসনে বসে আছেন পরিস্থিতি বিচার করে ঘোষণা করার জন্য। আমরা মনে করি অবশ্যই আছেন, তা নইলে অমন একটা সাধারণ বহুবচন প্রয়োগ করতেন না মহাভারতের কবি- পাঞ্চাল্যাং পাণ্ডুনন্দনাঃ। আর আমি আগে যা বলেছিলাম– পুরুষের এই প্রথম সাগ্রহ দৃষ্টিপাতে দ্রৌপদী নিজেই যথেষ্ট পুলকিত হয়েছেন বলে আমরা মনে করি। দেখুন, মহাকাব্যিক সমাজে পুরুষের বহু-বিবাহ প্রথা চালু ছিল, কিন্তু স্ত্রীলোকের বহু-স্বামিকতার চলন ছিল না এবং তা না থাকার সমাজগত কারণ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সন্তানের পরিচয়-স্পষ্টতা নিয়ে। কার ঔরসে কার জন্ম হচ্ছে এখানে এমনই এক পৌরুষেয় অধিকারের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল, যার ফলে স্ত্রীলোকের এক স্বামিত্বের ভাবনাটা বাস্তব কারণেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পণ্ডিতরা এ-কথা বার বার স্বীকার করেন যে, বৈবাহিক প্রথার মাধ্যমে স্ত্রীলোকের যৌনতাকে নিজের অধিকারে রাখাটাই এখানে পুরুষ মানুষের ‘মোটিভেশন’ হিসেবে কাজ করেছে এবং স্ত্রীলোকের এক-পুরুষগামিতার ঘটনাটাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এমনভাবে ‘আইডিয়ালাইজ’ করে ফেলা হয়েছে যে, বহুস্বামিকতা এবং বহুপুরুষগামিতাকে মেয়েরাই আত্মিকভাবে প্রত্যাখ্যান করে এবং সেটা শুধু ভারতবর্ষের সতীভাবিত দেশে নয়, সব সমাজেই প্রায় তাই।

স্ত্রীলোকের পক্ষে এক-স্বামিকতার যে আইডিয়ালাইজেশন’, এটাকেই আমাদের দেশে আমরা সংস্কার বলি, আর ওদের দেশের বিশেষ ভাষায় এটা ‘culturally induced social conditioning’ বলেন। পণ্ডিতেরা দেখিয়েছেন– নারীপ্রগতিবাদিনীরা যেদিন থেকে তাদের শরীর এবং মনের ওপর স্বাধীনতা ঘোষণা করতে আরম্ভ করেছেন, সেদিন থেকেই সমাজ বহির্ভূত বহুগামিতার মধ্যে না গিয়ে ‘Serial monogamy’ ব্যাপারটা তাঁরা বেশি পছন্দ করছেন। অসীম ব্যক্তিত্বময়ী দ্রৌপদীর ক্ষেত্রেও এই ঘটনা ঘটেছে কিনা, তা আমরা খুব পুস্তকানুসারী উপায়ে বলতে পারি না। কিন্তু লক্ষ করে দেখুন, দ্রৌপদী কিন্তু পঞ্চ পাণ্ডব ভাইয়ের প্রকট কামদৃষ্টিকে প্রত্যাখ্যান করছেন না, ঘৃণার চোখেও দেখছেন না, বরঞ্চ উদার চোখে দাঁড়িয়ে দেখছেন– তারা কী দেখছেন। ব্যাস সাফাই গেয়েছেন পরে, কিন্তু পাঁচ ভাইয়ের অবস্থা বর্ণনা করেছেন– ঈষৎ অনিবার্য কামনার ভাষায়। তিনি বলেছেন– কী আর করা যাবে বলো, পাঞ্চালী কৃষ্ণার চেহারাটাই এমন যে তাকে দেখলে কামনার উদ্রেক হবেই, সমস্ত পুরুষের কাছেই তিনি সহনীয়– কাম্যং হি রূপং পাঞ্চাল্যা বিধাত্রা বিহিতং স্বয়ম্ তিনি অন্যা রমণীদের মতো নন, সকলের চাইতে আলাদা এবং সকলেরই মনোহরণ, ফলে পাঁচ পাণ্ডব ভাই যখন দ্রৌপদীর দিকে ভাল করে তাকালেন এবং যখন বুঝলেন– এই মনোহরণ রমণী তারও হতে পারে, তখন তাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়-দমনের শক্তি যেন শিথিল হয়ে গেল, তাদের হৃদয়ে জেগে উঠল প্রবল কামনা সম্প্রমথ্যেন্দ্রিয়গ্রামং প্রাদুরাসন্মনোভবঃ।

আমি মহাভারতের কবির কাছে কৃতজ্ঞ এই কারণে যে, তিনি কোনও দ্বিচারিতা করেননি। তেমন তেমন জায়গায় রমণী-শরীরের বহিরঙ্গও যে ভদ্রলোক-ছোটলোক একাকার করে দেয়, মহাকবি সেটা লুকিয়ে রাখেননি। আমি জানি, ভদ্রা সুবুদ্ধিমতী বিষয়াভিজ্ঞা বিদুষীরা এই বৈয়াসিকী ভাষায় বিব্রত হবেন এবং আরও একবার বলবেন– এই হল সেই জায়গা, যেখানে পুরুষমানুষই তার পৌরুষেয় ভাষায় স্ত্রীলোককে ‘কমোডিটি বানিয়ে ফেলছে, সমস্ত মহাভারত জুড়ে দ্রৌপদীর এই ‘কমোডিটাইজেশন’ অথবা কমোডিফিকেশন’ চলেছে। আমি শুধু এইখানে আপনাদের দোহাই চাইব, বলব- সমস্ত ব্যাপারটাকে এত জটিল করে তুলবেন না এখনই। বরঞ্চ এটাকে যদি অতিসাধারণ দেহতত্ত্ব, তথা রমণী-শরীর দর্শনে পুরুষের যৌন জাগরণের তাত্ত্বিকতা দিয়ে বিচার করেন, তবে মহাভারতের কাল তথা দ্রৌপদীকে বোঝা অনেক সহজ হবে। আর মনে রাখবেন, পাঁচ ভাই পাণ্ডবের এই প্রতিক্রিয়াটা তিনি কিন্তু দেখছেন এবং বাধা দিচ্ছেন না। আমি বলব– এনজয় করছেন। এবং অবশেষে সব দেখেশুনে যুধিষ্ঠির যখন এই সিদ্ধান্ত দিলেন আমাদের সকলেরই স্ত্রী হবেন দ্রৌপদী– সর্বেষাং দ্রৌপদী ভার‍্যা ভবিষ্যতি হি নঃ শুভা– তখনও দ্রৌপদী কিন্তু প্রতিবাদ করেননি। এবং আমি বলব– তিনি ‘এনজয় করছিলেন। এই মুহূর্তটা বেশ করুণও বটে। পাঁচ-পাঁচজন যুদ্ধবীরের চোখ তখন কৃষ্ণা পাঞ্চালীর দিকে। প্রত্যেকে একবার দ্রৌপদীর দিকে তাকান, আরেকবার ভাইদের দিকে। সবার হৃদয়ে তখন সুন্দরী কৃষ্ণা, পঞ্চবীর পাণ্ডবেরা তাকে হৃদয়ে ধারণ করেছেন– হৃদয়ৈস্তামধারয়। মনে মনে বোধহয় এঁদের একটু ভয়ও ছিল। যে রমণী উন্মুক্ত রাজসভায় সুতপুত্ৰ কর্ণকে অত্যন্ত কটুভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তিনি যদি এখন বলে বসেন– আমাকে যিনি জিতে এনেছেন, আমি তাকেই চাই, তা হলে কী হবে! পাণ্ডবদের ভাগ্য ভাল, দ্রৌপদী সে-কথা বলেননি। বরঞ্চ পাঁচ ভাইয়ের টেরা চোখের চাউনিতে এবং অর্জুনের বদান্যতায় দ্রৌপদী তখন ক্ষণিক বিব্রত। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন– অর্জুনের উপরোধে এখন যদি জ্যেষ্ঠটির, মানে, ওই ধর্মমার্কা যুধিষ্ঠিরের গলায় মালা দিতে হয়, তার চেয়ে একদমে পাঁচজনকে সামলানো অনেক ভাল– অন্তত তার মধ্যে তো অৰ্জুন থাকবেন। সেই অর্জুন, যিনি তার যুবতী হৃদয়ের প্রথম অতিথি, সেই অর্জুন যিনি সবার মধ্যে সবলে জিতে এনেছেন তাকে।

যুধিষ্ঠির এতক্ষণ ভাইদের মুগ্ধ চোখগুলি আর মদনাহত চেহারা লক্ষ করে যাচ্ছিলেন। এইবার তার মহর্ষি দ্বৈপায়নের কথা মনে পড়ল। ঋষি না বলেছিলেন– তোমাদের পাঁচজনের স্ত্রী হবেন দ্রৌপদী, এইটাই বিধাতার বিধান নির্দিষ্ট ভবতাং পত্নী কৃষ্ণা পার্ষত্যনিন্দিতা। কিন্তু কেন এমনটি বলেছিলেন ঋষি সেকথা পৌরাণিকের দিক থেকে একরকম, যুধিষ্ঠিরের দিক থেকে অন্যরকম। পৌরাণিক দার্শনিকেরা পোড়ো বাড়ির দরজা আর খ্যাপা হাওয়াকে এমনভাবে মেলান যে, পাঠকের মনে হবে খ্যাপা হাওয়ার জন্যেই বুঝি বা বাড়িটার অমন পড় পড় অবস্থা। এর অভিশাপ, তার তপস্যা, অমুকের পূর্ব জন্মের সামান্য ঘটনা– সব পুরাণকারেরা মিলিয়ে দেন, এবং কপাল ভাল থাকলে দার্শনিকের সায়-সম্মতিও জুটে যায় তাতে। দ্রৌপদীর বেলাতেও তা জুটেছে। কেমন করে জুটেছে, তার আগে ব্যাসের অনুভবে দ্রৌপদীর পূর্বজন্মের গল্পটা শোনাই, তারপর দর্শন।

ব্যাস দ্রৌপদীর বিয়ের অনেক আগে পাণ্ডবদের বলেছিলেন যে, পূর্বজন্মে দ্রৌপদী ছিলেন এক ঋষির কন্যা। পরমা রূপবতী; এমনকী এই ঋষিকন্যা সোজা হয়ে দাঁড়ালে তার কোমরের মাঝখানটা যে কোথায় সেঁটে থাকে তা বোঝাই যায় না– বিলগ্নমধ্যা সুশ্রোণী সুব্ধঃ সর্বগুণান্বিতা। এ হেন সুন্দরী মেয়েরও দুর্ভাগ্য হল স্বকৃত কর্মদোষে, যাতে তার বিয়েই হল না, জুটল না মনোমত বর। সে তখন তপস্যা আরম্ভ করল ভগবান শংকরের। তুষ্ট ভগবান বর দিতে চাইলে কন্যা সর্বগুণে গুণী এক পতি চাইলেন। পাছে ভোলেভালা শিব কন্যার আকাঙ্ক্ষা না বোঝেন, তাই সে বারবার ইচ্ছেটি পরিষ্কার করে জানাল। কিন্তু ঈশ্বর, বিশেষত বরদ ঈশ্বরের কাছে বৃথা কথা চলে না। যা বক্তব্য যা ঈপ্সিত তা একেবারেই স্পষ্ট করে তাকে জানাতে হয়। অতএব শিব বললেন– তুমি যেহেতু পাঁচবার স্বামী চেয়ে বর মেগেছ, তাই তোমার বরও হবে পাঁচটা। পূর্বজন্মের ঋষিকন্যা এতদিন বিয়ে না করে থাকার ক্ষোভেই যেন বিনা বাক্যব্যয়ে, বিনা আপত্তিতে পঞ্চস্বামী-সম্ভোগের কথা মেনে নিয়ে বললেন- এবম্ ইচ্ছামি– তাই হোক প্রভু, তোমার দয়ায় তাই হোক– এবমিচ্ছাম্যহং দেব ত্বৎপ্রসাদাৎ পতিং প্রভো।

এই যে দ্রৌপদীর পূর্বজন্মে পাঁচবার বর চেয়ে পাঁচ স্বামী লাভ করার ঘটনা ঘটল, তাতে এক মহা সমস্যা হয়েছে দার্শনিকদের। অবশ্য তাদের আসল সমস্যাটা আরও গভীরতর। তারা বললেন যজ্ঞাদির বিনিয়োগে এমন কথা তো পাওয়া যায় যে, ‘সমিধ যজন করছে, ‘তনপাত্ যজন করছে’– সমিধ যজতি, তনূনপাত্ যজতি। এক্ষেত্রে যজতি’ অর্থাৎ যজন করার ব্যাপারটা কি আলাদা আলাদা পাঁচবার বোঝাবে, নাকি একবার? মীমাংসক দার্শনিকেরা কিন্তু বেদের বিনিয়োগমন্ত্রগুলিতে বেশির ভাগ সময়েই আক্ষরিক অর্থে ধরেন এবং সেই নিরিখেই তারা বললেন– যজন করার ব্যাপারটা যখন পাঁচবার উচ্চারণ করা হয়েছে, তখন ওই যজ্ঞের ভাবনা কিংবা যজ্ঞীয় কর্মে ভেদ একটা স্বীকার করতেই হবে। অর্থাৎ একের মধ্যেও একটা বিভিন্নতা আছে। এই প্রসঙ্গে তারা পঞ্চেন্দ্রোপাখ্যান’ বলে একটি পুরাকাহিনি স্মরণ করেছেন। কাহিনিটি আর কিছুই নয়, সেই তপস্যা করতে করতে বুড়ো হয়ে যাওয়া দ্রৌপদীর কাহিনি। দার্শনিকদের মতে এখানে দেবতা একটাই, এবং তিনি হলেন প্রধান দেবতা ইন্দ্র।

বেদের কাহিনিতে ত্বষ্টার ছেলেকে বধ করার সময় ইন্দ্রের তেজ ধর্মের মধ্যে প্রবেশ করেছিল, বল প্রবেশ করেছিল বায়ুতে আর তার রূপ প্রবেশ করেছিল দুই অশ্বিনীকুমারের মধ্যে। অর্ধেকটা অবশ্য ইন্দ্রের নিজের মধ্যেই ছিল। অতএব একই ইন্দ্রের ধর্মাংশ কুন্তীর গর্ভে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের জন্ম দিলেন। বল স্বরূপ বায়ু-অংশ মহাবলী ভীমের জন্ম দিলেন। অশ্বিনীকুমার-দ্বয় মাদ্রীর গর্ভে জন্ম দিলেন নকুল আর সহদেবকে। এঁরা দুজনেই ইন্দ্রের রূপ-স্বরূপ অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের সন্তান বলে অত্যন্ত রূপবান বলে পরিচিত। ইন্দ্র স্বয়ং তার আপন অপ্রতিম অর্ধ দিয়ে কুন্তীর গর্ভে অর্জুনের জন্ম দিলেন। তা হলে এই পাঁচজনই ইন্দ্রের অবয়ব এবং ইন্দ্র থেকেই জন্মলাভ করায় এক এবং অদ্বিতীয় ইন্দ্রই এঁদের মূল জন্মদাতা– পঞ্চাপীন্দ্রাবয়ব-প্রকৃতিত্বা ইন্দ্রা এবেতি পঞ্চেন্দ্রোপাখ্যানে।

দার্শনিকের এই উদার দৃষ্টিতে অবশ্য দ্রৌপদীর ওপর অসতীত্বের সেই চিরন্তন আরোপ অনেকটাই কমে যায়। এমনকী অর্জুনের লক্ষ্যভেদও অনেক বেশি সযৌক্তিক হয়ে ওঠে এই সুবাদে, কারণ ইন্দ্রের অর্ধাংশই রয়েছে অর্জুনের মধ্যে। কিন্তু দ্রৌপদীর ওপর অসতীত্বের আরোপ যতই কমুক, পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ভাগ হয়ে ইন্দ্র যদি একাও জন্মে থাকেন, তবু বাস্তবে তার ওই পঞ্চ-অবয়ব-বিশিষ্ট পঞ্চপাণ্ডব ভ্রাতারা কিন্তু কেউই নিজের নিজের অধিকার ছাড়েননি। কাজেই দ্রৌপদীকে বিয়ে করার জন্য যুধিষ্ঠিরের প্রস্তাব অর্জুন যেই প্রত্যাখ্যান করলেন, যেই অর্জুন বললেন অগ্রজদের অনুক্রম নষ্ট করে এখনই তার বিয়ে করা সাজে না; সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু পাঁচ ভাই পাণ্ডবেরা প্রত্যেকে অনিমিখে দেখছিলেন দ্রৌপদীকে– দৃষ্টিং নিবেশয়ামাসুঃ পাঞ্চাল্যাং পাণ্ডুনন্দনাঃ। প্রত্যেকেই একবার চকিতে তাকিয়ে থাকা দ্রৌপদীকে দেখেন, আরেকবার অন্যভাইদের দেখেন। হ্যাঁ, দ্বৈপায়ন ঋষির বিধান– পাঁচ জনেরই স্ত্রী হবেন দ্রৌপদী– এই অনুজ্ঞা যুধিষ্ঠিরের মনে পড়ল বটে, কিন্তু ভাইদের ভাবগতিক এবং তাদের মুখের চেহারায় তাৎক্ষণিক পরিবর্তনই যুধিষ্ঠিরের কাছে বড় হয়ে দেখা দিল তেষাম আকারবজ্ঞঃ কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ। ব্যাসের বচনের থেকেও তাঁর বেশি মনে হল– যদি শেষে সুন্দরী কৃষ্ণার কারণে ভাইতে ভাইতে বিবাদ লাগে! যুধিষ্ঠির ভাইদের মুখগুলি দেখে বুঝলেন– ভাইদের একজনও যদি কৃষ্ণার সঙ্গসুখ থেকে বঞ্চিত হন, তা হলে তাদের মনে জন্মাবে সেই অন্তর্দাহ, যা তাদের পাঁচ ভায়ের একজোট ভেঙে দেবে। অতএব ভাই-ভাই ঝগড়া হওয়ার চেয়ে মিথথা ভেদভয়ানূপঃ যুধিষ্ঠির মায়ের প্রস্তাবই মেনে নিলেন। ঠিক হল পাঁচজনেরই ঘরণী হবেন দ্রৌপদী। অবশ্য প্রথম বাধাটা এল মহারাজ দ্রুপদের দিক থেকেই।

কথাটা খুব অল্পের ওপর একটা অন্তর্মানসিক সিদ্ধান্তের মধ্যে সেরে ফেলা হল বটে, কিন্তু এটা ভীষণ এবং ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ যে দ্রৌপদীর মতো এক বিদগ্ধা সুন্দরী রমণী যদি শুধুমাত্র অর্জুনের স্ত্রী হতেন, তা হলে অন্যান্য পাণ্ডব-ভাইদের মনে এক ধরনের ঈর্ষা-অসূয়ার জন্ম হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ছিল। পাঁচ পাণ্ডব-ভাই তাকে পেয়েছেন, এই ঘটনায় কৌরবদের অনেকের মধ্যেই এই দীর্ঘনিশ্বাস শোনা গেছে যে, ওরাই শুধু দ্রৌপদীকে পেল– তৈর্লব্ধা দ্রৌপদী ভার‍্যা দ্রুপদশ্চ সুতৈঃ সহ। অতএব এটাও বেশ অনুমানযোগ্য যে, একতাবদ্ধ পাঁচ পাণ্ডবভাই, যাঁরা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের শাসনে জীবন অতিবাহিত করছেন, তাদের একতাবদ্ধ রাখার জন্য দ্রৌপদীর বিবাহ-বিষয়ক সিদ্ধান্তটি একদিকে যেমন সকলের স্ত্রৈণ ভাবনার তৃপ্তি ঘটাল, তেমনই রাজনীতির দিক থেকেও তাদের একতা সুনিশ্চিত করল। পাণ্ডবদের মধ্যে বিবাহ-বিষয়ক সিদ্ধান্ত হয়ে যাবার পর কৃষ্ণ-বলরাম প্রচ্ছন্নভাবে এসে পৌঁছোলেন কুম্ভকার গৃহে। কৃষ্ণ-বলরাম অনেক শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে যাবার পর রাতের খাওয়া-শোয়া নিয়ে কিছু চিন্তা করতে হল। যুধিষ্ঠিরকে বাদ দিয়ে চার ভাই ভিক্ষায় বেরোলেন এবং ফিরে এসে সম্পূর্ণ ভিক্ষালব্ধ বস্তু যুধিষ্ঠিরের কাছে জমা করলেন।

মহাভারতের কবি খুব প্রতীকীভাবে মাত্র এক রাতের সাংসারিক সন্নিবেশ দেখাচ্ছেন। ভিক্ষালব্ধ বস্তু রান্না করলেন কুন্তী, কিন্তু তা পরিবেশন করতে দিলেন দ্রৌপদীকে এবং এখানে শাশুড়ি সুলভ যে অনুজ্ঞাটি ছিল, সেটাও একটা প্রতীকী অনুশাসন– অর্থাৎ, এই সংসারে খাবার-দাবার যা জুটবে, তার অর্ধেক খাবেন ভীম, বাকি অর্ধেক চার ভাই, কুন্তী এবং দ্ৰৌপদী। শোবার সময়ে একটা ঘরের মধ্যে সাত জন। সহদেব সারা ঘরে কুশ বিছিয়ে দিলেন, তার ওপরে মৃগচর্ম পাতা হল এক এক করে। পাঁচ ভাই পাণ্ডব দক্ষিণ দিকে মাথা করে শুলেন, গুরুজনের মর্যাদায় কুন্তী শুলেন পাণ্ডবদের মাথার দিকটায়, আর তাদের পায়ের দিকে শুলেন দ্রৌপদী। এখানে মহাভারতের কবি একটা চুটকি মন্তব্য করেছিলেন দ্রৌপদী যেন শোয়ার সময় পাণ্ডবদের পা রাখার বালিশ হয়ে রইলেন– অশেত ভূমৌ সহ পাণ্ডুপুত্রৈঃ। পাদোপধানীব কৃতা কুশেযু।

এই কথায় আমার বিষয়জ্ঞ বন্ধু-বান্ধবীরা বলেছিল- দেখলি তো! দ্রৌপদীও পায়ের বালিশ হয়ে গেলেন, পুরুষ-সমাজ তাদের কোনও অহংকার ছাড়েনি, দ্রৌপদীর মতো এমন বিশাল ব্যক্তিত্বময়ী রমণীকেও পায়ের তলায় পিষতে আরম্ভ করেছে, যেন foot-cushion–আসলে, এর আগে আমি, অন্য জায়গায় যা হয় হোক, মহাভারতের দ্রৌপদীর কিন্তু সে অবস্থা নয়, তিনি কিন্তু উদগ্র পৌরুষেয়তার প্রতিবাদ কিছু করতে পেরেছেন– এর আগে এই জাতীয় কথা কিছু বলে থাকায় দ্রৌপদী পাঁচ ভাইয়ের পা-রাখার বালিশে পরিণত হলেন– এ-কথাটা যেন আমার আকাঙ্ক্ষিত প্রতিপাদ্যকে খণ্ডিত করে দেয়। বন্ধু-বান্ধবীরা তাই ছাড়ল না, আমাকে এক হাত নিল বটে। আমি বললাম দেখ ভাই! পরের লাইনটা দেখ। মহাভারতের কবি লিখেছেন– এতে দ্রৌপদী কিছু মনে করেননি, পাঁচ পাণ্ডবদের ওপর কোনও অবজ্ঞার ভাবও নেমে আসেনি তার দিক থেকে ন চাপি দুঃখং মনসাপি তস্যা/ ন চাবমেনে কুরুপাণ্ডবাংস্তান।

পণ্ডিতানী বান্ধবীরা বলেছিলেন– এই যে মনে করলেন না– এতে তো আরও বোঝা যায় যে, মনে করার যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু আপন মহাশয়তার জন্য দ্রৌপদী এ-ব্যাপারকে ধরেননি বা মনে করেননি। এই যুক্তিজালের মধ্যে আমার অন্যতর এক ইতিহাসের পণ্ডিত তিনি সেই সময়ে ঈষৎ রঙিন অবস্থায় ছিলেন তিনি বললেন– নতুন বিয়ে করে এনে মানুষটাকে পায়ের তলায় আড়াআড়ি শোয়ানো হয়েছিল। পাঁচ পাণ্ডবরা পা দিয়ে রাতের বেলায় উলটো-পালটা করেছে এই মানুষটার সঙ্গে। কিন্তু শুধু ‘কাশ্মীরি তুরঙ্গমী’র মতো পেটা চেহারা বলে ভদ্রমহিলা সয়ে গেছেন এবং নতুন এসেছেন বলেও খানিকটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আমি বললাম দেখ ভাই! ইতিহাসে পণ্ডিত হলেই মহাকাব্যের শব্দশক্তি বোঝা যায় না। খুব সাধারণ কল্পনাতেও একখানা ঘরে যদি এই সাতজনকে রাত্রে শুতে হয় তা হলে কুন্তীও পাঁচ পাণ্ডবদের মাথার ওপরে আড়াআড়িই শুয়েছিলেন। এরপর দ্রৌপদীকে শোয়ালে কোথায় শোয়াতেন তারা। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও গুরুজনদের দিকে পা রেখে শোয়া যেত না। অতএব তাঁকে তো মাথার দিকে রাখতেই হবে। তা হলে দ্রৌপদীকে কোথায় স্থান দেবেন তারা। পাশে শোয়ানোর উপায় নেই, তার কারণ এখন পাণ্ডবদের সঙ্গে তার বিধিসম্মত বিবাহই হয়নি। আর তা ছাড়া কোন পাণ্ডব ভাইয়ের পাশে শোবেন তিনি! অতএব পায়ের কাছে আড়াআড়ি। তাই এখানে সেই কুশশয্যায় দ্রৌপদী পাণ্ডবদের পা-রাখার বালিশের মতো শুয়ে রইলেন– পাদোপধানীব কৃতা কুশেষু। তবে এটা একটা আলংকারিক সমাধান– ভাড়া বাড়ির একটা ঘর, সেখানে মা এবং এখনও বিয়ে হয়নি এমন ভাবী বউকে নিয়ে শোয়া, ফলত পায়ের দিকে শোয়া দ্রৌপদীকে পা-রাখার ‘কুশন’-এর তুলনা করে একদিকে কবি যেমন পাণ্ডবদের অসহায় বিকল্পহীনতার ইঙ্গিত দিয়েছেন, অন্যদিকে দ্রৌপদী যে এতে কিছু মনে করলেন না, ভাবী স্বামীদের অবজ্ঞা করলেন না, তাতে দ্রৌপদীর মতো দর্পশালিনী বিদগ্ধা রমণীও যে পাণ্ডবদের মনে মনে পছন্দ করে ফেলেছেন, এবং তাদের তিনি শ্রদ্ধাও করতে পারছেন, সেটা প্রমাণ হয়।

আর সেদিন তার শরীরের স্পর্শ করার কোনও নীতিধার্মিক উপায় ছিল না যে, মাঝে মাঝে পায়ের আঙুল দিয়ে ভাবী বধূর সঙ্গে উলটো-পালটা করবেন। আর মহাভারত মহাকাব্যের বীর নায়কেরা কেউ শেয়ালদা স্টেশনের আঙুল-চালানো পাবলিক নন যে, রাতের অন্ধকারে রমণী-শরীরে টিপ দিয়ে দেখবেন– মন্দ নয় তো! বরঞ্চ সমস্যা হয়েছে মহাভারতের বঙ্গানুবাদে মহামতি হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর সাংস্কারিক মানসে। সিদ্ধান্তবাগীশ বাংলা করেছেন– “দ্রৌপদী সেইভাবে শয়ন করিলে, পাণ্ডবরা যেন তাহাকে পা-বালিশ করিলেন; তাহাতেও দ্রৌপদীর শরীরে বা মনে কোনও দুঃখ হইল না এবং তিনি পাণ্ডবগণকে কোনও অবজ্ঞা করিলেন না।” আমার পূর্বোক্ত রঙিন ঐতিহাসিক বন্ধু এই বাংলাটা পড়েই গুলিয়ে ফেলেছেন, আর সিদ্ধান্তবাগীশকেও আমি কোনও দোষ দিই না। তিনি মহাপণ্ডিত মানুষ বটে, কিন্তু সংস্কৃতভাষাসেবী পণ্ডিতজনের কাছে পূর্বাগত টীকা-টিপ্পনীর একটা পরম্পরাও মানসলোকে কাজ করে সাংস্কারিকভাবে। লক্ষণীয়, মূলশ্লোকে “পাদোপধানীব”– ‘পা রাখার বালিশের মতো’ শব্দটা শোনা মাত্রই নীলকণ্ঠের মতো প্রাচীন এবং প্রামাণ্য টীকাকারও মন্তব্য করে বসলেন– এরকম হওয়ায় সমস্ত পাণ্ডবদের পাদস্পর্শ লাভ করতে করতে পাদোপধানীব, সর্বেষাং পাদস্পর্শং লভমানা–দ্রৌপদী কুশশয্যায় রাত কাটালেন। অতএব সিদ্ধান্তবাগীশ আর কী করেন। তিনি লিখলেন– ‘পাণ্ডবেরা যেন তাহাকে পা-বালিশ করিলেন। তাহাতেও দ্রৌপদীর শরীরে ও মনে কোনও দুঃখ হইল না। আমরা শুধু বলব– নীলকণ্ঠ এবং সিদ্ধান্তবাগীশ দু’জনেরই বোঝার ভুল হয়েছে। মূল মহাকাব্যিক শ্লোকে এমন কোনও শব্দ নেই যাতে ‘শরীরে’র কথাটা কোনও ভাবে আমদানী করা যায়। আর ‘পা-বালিশ’ আর ‘পা-রাখার বালিশ’-এরও তফাৎ আছে। আরও তফাৎ আছে– পা রাখার বালিশের মতো কথাটায়। শুধু পঞ্চ বীর স্বামীর পায়ের দিকে দ্রৌপদীর শোয়াটাই এখানে প্রধান উল্লেখ্য ব্যাপার ছিল এবং এই আলংকারিক প্রতাঁকে তার পঞ্চস্বামীর অধীনতা স্বীকার করার ব্যাপারটাও ইঙ্গিতে চলে আসে। কিন্তু বাস্তবে এই পায়ের দিকে শোয়াটা যে দ্রৌপদীর মতো ভয়ংকর ব্যক্তিত্বও মেনে নিলেন, স্বামীদের প্রতি কোনও বিদ্বেষ, কোনও অবজ্ঞা না করে–মহাভারতের কবি এই ইঙ্গিতটুকু দিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছেন, তার বেশি কোনও শারীরক ভাষ্য এ-শ্লোকের মধ্যে নেই– যেমনটা টীকাকার নীলকণ্ঠ পুলকিত হয়ে বলতে চাইছেন, অথবা সিদ্ধান্তবাগীশ বঙ্গানুবাদে আরও সশব্দে বললেন– তাহার শরীরে বা মনে কোনও দুঃখ হইল না যেন দ্রৌপদীর শরীরের ওপর পাঁচ পাণ্ডবের দশখানা পা উলটো-পালটা করেছে এবং তিনি তাতে কষ্ট পাননি।

নীলকণ্ঠ এবং সিদ্ধান্তবাগীশের কাছে মহাভারতের ঠিক পরবর্তী প্রাসঙ্গিক শ্লোকটা এই যে, পাণ্ডবরা শোয়ামাত্র সৈন্য-সামন্ত, অস্ত্র, রথ, হস্তী, তরবারি, বাণ– এই সব ক্ষত্রিয় বস্তু নিয়ে কথা বলতে আরম্ভ করলেন– অস্ত্রাণি দিব্যানি রথাংশ্চ নাগান। খগান শরাংশ্যাপি পরশ্বধাংশ্চ। এইসব বিচিত্র শাক্ত কথার মধ্যে ক্ষত্রিয় বীরেরা দ্রৌপদীকে পায়ের আঙুল দিয়ে খোঁচাচ্ছেন– এমন কোনও ঘটনা মহাকাব্যিক অভিসন্ধির সঙ্গে মানায় না। লক্ষণীয়, এর পরেই কুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন পিতা দ্রুপদের দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে সেই কুম্ভকার-গৃহে পৌঁছোলেন এবং বাইরে থেকে সেই সব অস্ত্র সম্বন্ধীয় কথাবার্তাই শুনতে পেলেন এবং এদিক-ওদিক থেকে দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেলেন পাণ্ডবরা কীভাবে শুয়ে আছেন, দ্রৌপদীই বা কীভাবে শুয়ে আছেন! ধৃষ্টদ্যুম্ন পাণ্ডবদের সমস্ত বৃত্তান্ত, তাদের কথোপকথন এবং দ্রৌপদীর অবস্থান সবটাই পিতা দ্রুপদকে জানাবেন বলে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।

দ্রুপদ সত্যিই বড় উদ্বিগ্ন ছিলেন। তার সবচেয়ে বড় ভয়– কোন ঘরে পড়লেন দ্রৌপদী। ধৃষ্টদ্যুম্ন যেভাবে স্বয়ংবরের শর্ত ঘোষণা করেছিলেন, তাতে যে কেউ মৎস্যচক্ষু ভেদ করতে পারলেই দ্রৌপদীকে পেতে পারতেন। দ্রুপদ অবশ্য খুব ভেবে-চিন্তে মৎস্য-চক্ষুর যন্ত্রনির্মাণ করেছিলেন। তার দৃঢ় বিশ্বাসও ছিল যে, একমাত্র অর্জুন ছাড়া নীচের দিকে জলচ্ছায়ায় তাকিয়ে ওপর দিকে রাখা মৎস্য-চক্ষু ভেদ করাটা আর কারও কর্ম নয়। তবু তার মনে উদ্বেগটা বড় হয়ে উঠেছে- যেহেতু পাণ্ডবরা স্বরূপে, স্ববেশে ছিলেন না। অতএব ধৃষ্টদ্যুম্ন ফিরে আসতেই, তার অন্তিম জিজ্ঞাসা ছিল দ্রৌপদী কোনও হীন জায়গায় পড়েনি তো? কোনও বৈশ্য-শূদ্র বা অপর কোনও হীন জাতিতে দ্রৌপদীর সংক্রমণ ঘটলে, সেটা তার মতো ক্ষত্রিয়ের মাথায় বৈশ্য-শূদ্রদের বাঁ পায়ের লাথি বলে ভাবছিলেন তিনি– কৃচিন্ন বামো মম মূৰ্ধি পাদঃ কৃষ্ণাভিমর্ষেণ কৃতোদ্য পুত্র? দ্রুপদের দুশ্চিন্তাটা তখনকার সমাজ দৃষ্টিতে বোঝাটা খুব অসম্ভব নয়। মহাভারতের বর্ণ-সংকর বিবাহ অনেক হয়েছে, কিন্তু এটাও বোঝা ভাল যে, জাতি-বর্ণ নিয়ে উচ্চতার সচেতন-বোধও সেই সমসাময়িক সমাজের অঙ্গ। বিশেষত ক্ষত্রিয়রা রাষ্ট্রশাসনে যুক্ত ছিলেন বলেই অর্থ এবং সম্মানের অধিকারিতায় খানিক অভিমানগ্রস্ত ছিলেন বই কী। এই দ্রুপদ ভাবছেন– যে রাজা আমাকেই রাজকর দিচ্ছে, অথবা কোনও করদ বৈশ্য তেমন কোনও লোক অথবা কোনও শূদ্র অথবা কোনও বৈশ্য আমার মেয়েটাকে জিতে নিয়ে গেল না তো কচিন্ন শূদ্রেণ ন হীনজেন। বৈশ্যেন বা করদেনোপপন্না?

আসলে এই দুশ্চিন্তাটা বেশ বোঝা যায়– শূদ্র, বৈশ্য বা অপর কোনও তথাকথিত হীন জাতির সঙ্গে বিবাহ ব্যাপারটা একটা অর্থনৈতিক পার্থক্য সূচনা করে এবং সেটা এতই বড় এক পার্থক্য যা জীবন, জীবনযাত্রার মান, খাদ্যাভ্যাস এবং দৈনন্দিন চলন-বলনটাকেও এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, জাতি-বর্ণের ছুঁৎমার্গহীন ব্যক্তিকেও আমি এ-বিষয়ে বেশ বিচলিত হতে দেখেছি বহুবার। সেখানে দ্রৌপদীর মতো বিদগ্ধা এক রমণী কার ঘরে গিয়ে উঠছেন, এটা পিতা হিসেবে দ্রুপদের দুশ্চিন্তার বিষয়ই বটে। আর দ্রুপদ যেহেতু অর্জুনের কথা ভেবে-ভেবেই মৎস্য-চক্ষুর যন্ত্রখানি তৈরি করেছিলেন, তাতে তার দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে; তার মধ্যে স্বয়ংবরের মাঝখানে কর্ণ এসে এমন ভেলকি দেখিয়ে গেলেন, তাতে ওই ব্রাহ্মণবেশী মানুষটার পরিচয় নিয়ে আরও ধন্দ তৈরি হয়েছে। ব্রাহ্মণ হলে জাতিগত উচ্চতায় একটা তুষ্টি থাকে বটে, কিন্তু জামাতা ক্ষত্রিয় হলেই তবে দ্রুপদ বেশি খুশি হন এবং তিনি অর্জুন হলেই সবচেয়ে বেশি খুশি। ধৃষ্টদ্যুম্নকে তিনি বলেই ফেললেন– আমি অর্জুনের সঙ্গে আমার মেয়েটার সংযোগ ঘটাতে পেরেছি কি? নাকি এ-ব্যাপারে আমাকে অনুতাপ করতে হবে– কচিন্ন তপ্যে পরমপ্রতীতঃ। সংযুজ্য পার্থেন নরর্ষভেণ?

ধৃষ্টদ্যুম্ন যে খুব ভাল করে খবর নিতে পেরেছেন তা নয়, তবে তিনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অনুসরণ করেছিলেন ভগিনীর। তবুও দূরত্ব কিছু ছিল এবং সময়ও তিনি বেশিই নিয়েছিলেন, নইলে তার মধ্যেই কৃষ্ণ-বলরাম এক ফাঁকে দেখা করে চলে গেলেন কী করে? ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়নি। যাই হোক, বাইরে থেকে দেখে এবং বাড়ির ভিতর উঁকিঝুঁকি দিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন যেটা জানালেন, তার মধ্যে দ্রুপদের জামাতৃ-ভাবনা অনুমান-মাত্রেই পাণ্ডব-নির্ভর হয়ে উঠল বটে, কিন্তু পুরোপুরি সংশয় নিরসন হল না। ধৃষ্টদ্যুম্ন এসে বলেছিলেন- মৃগচর্মধারী যে যুবকটির চোখগুলো বেশ টানা-টানা– যে সেই মৎস্যচক্ষু ভেদ করে বামুনদের প্রশংসা কুড়োল খুব, তা সেই যুবক ছেলেটিকে তো একা একা যুদ্ধও করতে হল স্বয়ংবরে হেরে-যাওয়া হতাশ রাজাদের সঙ্গে, কিন্তু আমার বোনটিকে দেখলাম সে তার স্বয়ংবর জয়ী যুবক ছেলেটির পরিধান-চর্মবাসের প্রান্তটুকু ঠিক ধরে আছে এবং পদে পদে অনুসরণ করছে তাকেই কৃষ্ণা প্রগৃহ্যানিমন্বয়াত্তং/ নাগং যথা নাগবধূঃ প্রহৃষ্টা। ধৃষ্টদ্যুম্ন কিন্তু মহাকাব্যের উপযোগী একটা অসাধারণ উপমা দিয়েছেন এখানে। প্রসিদ্ধি অনুযায়ী হস্তিনীর জন্য পুরুষ হাতিদের মধ্যে অনেক সময়েই মারামারি লাগে, কিন্তু এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যে হাতিটি জেতে, হস্তিনী কিন্তু ঠিক তার পিছন পিছন যায়। দ্রৌপদীও ঠিক তার লক্ষভেত্তা পুরুষের অজিন-প্রান্তটি ধরে রেখেছিলেন এত যুদ্ধের পরেও। ধৃষ্টদ্যুম্ন জানালেন আরও একজন যুবক বীরও কিন্তু একটু আদিম কৌশলে যুদ্ধ করেছিলেন, তিনিও কিন্তু ওই প্রথমোক্ত যুবকেরই সহকারী ছিলেন এবং এই দুই যুবকের সঙ্গেই দ্রৌপদী গিয়ে পৌঁছেছিল এক কুম্ভকারের বাড়িতে। বাড়িওয়ালার নাম ভার্গব।

ধৃষ্টদ্যুম্ন কিন্তু যা দেখেছেন, তারই আনুপূর্বিক বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি বলেছেন– ওই কুম্ভকার-গৃহে ঘরের মধ্যে এক আগুনপানা চেহারার মহিলাকে বসে থাকতে দেখেছি আমি এবং তাকে ঘিরে আরও তিনটে ছেলে– ওই যুদ্ধজয়ী বীরের মতোই তাঁদেরও চেহারা। তারপর ওই বিজয়ী যুবক-দুটি, যাঁদের সঙ্গে দ্রৌপদী গেছেন তারা ওই মহিলাকে নমস্কার করে দ্রৌপদীকেও বললেন নমস্কার করতে। আমার মনে হল– ওই মহিলাই এই পাঁচ ছেলের মা। স্বয়ংবর সভার সব ঘটনা জানিয়ে একজনকে বাড়িতে রেখে আর চার জন ভিক্ষা করতে গেল। তারপর ভিক্ষা করে ফিরে এলে ওই বয়স্ক মহিলা রান্না করলেন, কিন্তু পরিবেশন করল দ্রৌপদী। সে সবাইকে খাইয়ে পরে নিজে খেল। রাত্রে শোয়ার ব্যবস্থা হল। কুশ-শয্যার ওপর মৃগচর্ম বিছিয়ে। কৃষ্ণা শুয়ে রইল ওই মহাবীরদের পায়ের দিকে– সুপ্তাস্তু তে পার্থিব সর্ব এব/ কৃষ্ণা চ তেষাং চরণোপধানী। সব দেখেশুনে ধৃষ্টদ্যুম্ন এবার নিজের মত ব্যক্ত করছেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন- ওই পাঁচটা যুবক ছেলে ঘুমোবার আগে যে-সব গল্প করছিল, তার সবটাই যুদ্ধ-বিষয়ক, অর্থাৎ কিনা এঁদের কথাগুলো বামুন-পণ্ডিত বা বৈশ্য শূদ্রের মতো কথা নয়– ন বৈশ্যশূদ্রৌপয়িকীঃ কথাস্তা। ন চ দ্বিজানাং কণ্বয়ন্তি বীরাঃ। আমার মনে হচ্ছে আমাদের আশা পূর্ণ হবে, পিতা! আর এটাও কিন্তু আমরা শুনেছি যে, পাণ্ডবরা জতুগৃহের অগ্নিদাহ থেকে বেঁচে গেছেন। বিশেষত লক্ষ্যভেদ যেভাবে হল এবং যেভাবে তারা রাত্রে শুয়ে শুয়েও যুদ্ধের কথা বলছেন, তাতে নিশ্চয় মনে হচ্ছে এঁরা পাঁচ ভাই পাণ্ডব, কোনও কারণে এঁরা ছদ্মবেশে আছেন।

ধৃষ্টদ্যুম্ন যেভাবে তার দৃষ্ট বিবরণ দিলেন, তাতে এ-কথাটা বারবার মনে হয় যে, জননী কুন্তীর মুখে সেই ভিক্ষা ভাগ করে নেবার নির্দেশটা অনেকটাই যেন অতিরিক্ত কথা বলে মনে হয়। কেননা ধৃষ্টদ্যুম্নের বিবরণে এই নির্দেশের কথা নেই এবং সেটাই স্বাভাবিক, কেননা বিবাহযোগ্যা রমণীটি ঘরে আসামাত্রই তার ভাগাভাগি সম্পূর্ণ হয়ে গেল, এটা মহাকাব্যিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে মানায় না। বিশেষত পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গেই দ্রৌপদীর বৈবাহিক সম্বন্ধের কথাটাও বিবাহ-প্রক্রিয়ার প্রথম পর্বে এসেছে বলে মনে করি। লক্ষ করে দেখুন, এখনও দ্রুপদের কাছে পাণ্ডবদের আকার-নিশ্চয় ঘটেনি, শুধু প্রকার-নিশ্চয় ঘটেছে। অতএব নিশ্চিত হবার জন্যই দ্রুপদ আপন পুরোহিতকে পাঠালেন পাণ্ডবদের নিশ্চিত পরিচয় জানার জন্য। পুরোহিত পাণ্ডবদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করেই বিবাহ-প্রসঙ্গে এসে বললেন লক্ষ্যভেত্তা যুবকটিকে দেখে দ্রুপদ-রাজা বড় আনন্দ পেয়েছেন বটে, কিন্তু তার বড় ইচ্ছে ছিল তার মেয়েটি পাণ্ডু-রাজার পুত্রবধূ হোন। তার মনে সবসময়েই ভাবনা এবং অভিলাষ ছিল যে, আমার এই মেয়েটিকে যেন স্কুল-দীর্ঘবাহু অর্জুন ক্ষত্রিয়-ধর্ম অনুযায়ী বিয়ে করে নিয়ে যান যদর্জুনো বৈ পৃথুদীর্ঘবাহুধর্মেণ বিলেত সুতাং মমৈতাম।

যুধিষ্ঠির পুরোহিতকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে নিজের বক্তব্য নিবেদন করে বললেন দ্রুপদ-রাজা ক্ষত্রিয়ের রীতি মেনে স্বয়ংবরের যে পণ রেখেছিলেন, আমাদের বীর যোদ্ধা সেই পণ মেনেই দ্রৌপদীকে জিতেছে। আসলে যুধিষ্ঠিরের মধ্যে সামান্য একটু সংশয় কাজ করছে। দ্রুপদ রাজা বারবার ক্ষত্রিয়, ক্ষত্রিয় বিধি– এসব শব্দ উচ্চারণ করছেন, অথচ পাণ্ডবরা সবাই এখন ব্রাহ্মণ-বেশে আছেন, তার মধ্যে তাদের আর্থিক অবস্থাও ভাল নয়, স্বয়ংবর-লক্ষ্যও ভেদ করা হয়েছে, অতএব একটু প্রতিবাদের সুরেই বললেন যুধিষ্ঠির। তিনি বললেন স্বয়ংবর ঘোষণার সময় দ্রুপদ রাজা তো জাতি, কুল, শীল, বংশ কোনওটাই নির্দিষ্ট করে বলেননি। তিনি বলেছিলেন– ধনুকে গুণ চাপাও, লক্ষ্যভেদ করো, নিয়ে যাও আমার মেয়েকে ন তত্র বর্ণেষু কৃতা বিবক্ষা/ ন চাপি শীলে ন কুলে ন গোত্রে– ফলে, আমাদের মধ্যে সেই বীর, যেভাবে দ্রুপদ বলেছেন, সেইভাবেই দ্রৌপদীকে জয় করেছে, সেখানে তার তো দুঃখ করার কিছু নেই। আর দ্রুপদ রাজার যে অভিলাষ সেটা তো পূর্ণ হবেই, এই রাজকন্যা সব দিক থেকে লক্ষ্যভেত্তা পুরুষটিরও প্রাপ্য, এটাই আমি মনে করি। তা ছাড়া ওই ধনুকে ছিলা পরিয়ে মৎস্যচক্ষুর লক্ষ্য ভেদ করাটা সাধারণ কোনও লোকের কাজ ছিল না; যার বুদ্ধি নেই, অস্ত্ৰক্ষমতা নেই, বংশগৌরব নেই, এমন লোকের পক্ষে কি ওই লক্ষ্য ভেদ করা সম্ভব ন চাকৃতাণে ন হীনজেন/ লক্ষ্যং তথা পাতয়িতুং ন শক্যম।

অর্থাৎ কিনা যুধিষ্ঠির এখনও নিজেদের পরিচয় পুরোপুরি ভাঙলেন না এবং আরও একটা কথাও পরিষ্কার যে, এখনও পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে এমন ঠিক হয়নি যে, তারা সবাই মিলে দ্রৌপদীকে বিবাহ করবেন, তা নইলে এমন কথা এখানে কথার মধ্যে আসত না যে, লক্ষ্যভেত্তা পুরুষ যিনি জিতেছেন এই রাজকন্যাকে, এই রাজকন্যা তারই প্রাপ্য এটাই আমি মনে করি– সপ্রাপ্যরূপাং হি নরেন্দ্রকন্যা/ মিমামহং ব্রাহ্মণ সাধু মন্যে। পুরোহিতের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের কথা চলছে। এর মধ্যেই রাজার বাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ এসে গেল। দ্রুপদের দূত বলল– এই বিয়ের জন্য বরপক্ষ-কন্যাপক্ষীয় সকলের একটা খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করেছেন দ্রুপদ-রাজা– জন্যার্থমন্নং দুপদেন রাজ্ঞা! বিবাহ হেতোরুপসংস্কৃতঞ্চ। মহাভারতের মধ্যে এই প্রথম আমরা একটা বিয়ের খাওয়া দেখছি, যেখান বর-বউ দুই পক্ষের আত্মীয়স্বজন নিয়ে খাওয়া-দাওয়াটা হবে। সংস্কৃত শব্দটাও খেয়াল করুন- জনার্থ- ‘জন্য’ মানে বর এবং বউয়ের জ্ঞাতি-বন্ধু-আত্মীয়-স্বজন, এমনকী এর মধ্যে ভৃত্য, চাকর-বাকরেরাও আছে। দ্রৌপদীর বিয়ে ছাড়া এইরকম একটা আন্তরিক নেমতন্ন, যা এখনও চলে, এরকমটা আগে দেখিনি। পাণ্ডবদের সকলের জন্য স্বর্ণপদ্মখচিত রথও এসেছে। পাণ্ডবরা পুরোহিত-ঠাকুরকে আগে পাঠিয়ে দিয়ে সকালের কাজ-কর্ম সেরে দ্রুপদের পাঠানো রথে উঠলেন। কুন্তী আর দ্রৌপদী চললেন একটা রথে কুন্তী চ কৃষ্ণা চ সহৈক্যানে।

দ্রুপদ রাজা জামাইয়ের বৃত্তি পরীক্ষার জন্য চতুর্বর্ণের ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্র কিছু সাজিয়ে রেখেছিলেন- পাণ্ডবরা কোনটা তুলে নেন সেটা দেখার জন্য। ফল-মালা, ঢাল-তরোয়াল, বর্ম-বাহন এবং কৃষিকাজের গোরু, দড়ি, কৃষিবীজ। পাণ্ডবরা অবশ্যই ক্ষত্রিয়োচিত জিনিসপত্র তুলে নিয়ে নিজেরাই উৎকৃষ্ট উচ্চাসনে গিয়ে বসলেন। কুন্তী দ্রৌপদীকে নিয়ে প্রবেশ করলেন অন্তঃপুরে। খাওয়া-দাওয়াও প্রচুর হল। এবার দ্রুপদ যুধিষ্ঠিরের কাছে প্রশ্ন রাখলেন সবিশেষ পরিচয় জানার জন্য। যুধিষ্ঠির এবার আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা জানালেন- সেই বারণাবতে জতুগৃহবাস থেকে কৌরব দুর্যোধনের বঞ্চনার কাহিনি এবং শেষ পর্যন্ত পঞ্চালে আসার বিবরণ। দ্রুপদ আনন্দে আত্মহারা হয়ে পাণ্ডবদের সমস্ত রাজনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য দেবার প্রতিজ্ঞা করে পাণ্ডবদের সকলের থাকার ব্যবস্থা করলেন এক অট্টালিকায় যেখানে কুন্তী, দ্রৌপদী এবং পঞ্চপাণ্ডব একত্র থাকার অধিকার পেলেন দ্রুপদের নির্দেশে তত্র তে ন্যবসন রাজন যজ্ঞসেনেন পূজিতাঃ। এই জায়গাটা আমার খুব আধুনিক লাগে– দ্রৌপদীর সঙ্গে এখনও বিয়ে হয়নি পাণ্ডবদের। অথচ এই অবস্থায় দ্রুপদ এক পৃথক প্রাসাদের মধ্যে কুন্তী, দ্রৌপদী এবং পাঁচ ভাই পাণ্ডবের থাকার ব্যবস্থা করছেন। দ্রৌপদীর সঙ্গে সম্পূর্ণ পাণ্ডব-পরিবারের একত্র সহবাস-পরিচয় ভাবী বধূকে যে অনেকখানি ‘ফ্যামিলিয়ারাইজ’ করে তুলবে, এটা সেইকালে দ্রুপদের মতো এক প্রাচীন পুরুষও বুঝেছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, এই একত্রবাস এক দিনের ছিল না, অন্তত কিছু দিনের, এবং আমাদের বিশেষ ধারণা সব ভাইরা মিলে দ্রৌপদীকে বিবাহ করার সিদ্ধান্তটা এই সময়েই নিশ্চিত হয়েছে। জননী কুন্তী হয়তো পূর্বে এই কথাটা যুধিষ্ঠিরকে বলে থাকবেন, কিন্তু এই সময়ে স্বয়ং দ্রুপদ এবং পাণ্ডবরা সকলেই ‘প্রত্যাশ্বস্ত’–পরস্পর পরস্পরের ব্যাপারে আশ্বস্ত, তখনই হয়তো দ্রৌপদীকে ভাল করে চিনে নিয়েই যুধিষ্ঠির এই নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, তারা সকলে মিলেই দ্রৌপদীকে বিয়ে করবেন। এরপর সেই দিন এল, যেদিন একটা শুভ লগ্ন দেখে দ্রুপদ যুধিষ্ঠিরকে বললেন- আজ বিবাহের প্রশস্ত দিন, সুতরাং আজই মহাবাহু অর্জুন যথাবিধানে কৃষ্ণার পাণিগ্রহণ করুন– গৃহ্নাতু বিধিবৎ পাণিম্ অদ্যায়ং কুরুনন্দনঃ।

যুধিষ্ঠির এবার নিজকৃত পূর্বসিদ্ধান্তের পথ পরিষ্কার করার জন্যই একটু অন্য ধরনের কথা-বার্তা বলতে আরম্ভ করলেন। যুধিষ্ঠির বললেন– বিয়ের কথা যদি বলেন, তবে আমারও তো একটা বিয়ের সম্বন্ধ করতে হয়, আমি তো সবার বড় মমাপি দারসম্বন্ধঃ কার্যস্তাবদ বিশাম্পতে। দ্রুপদ থতমত খেয়ে, তা তো বটেই, তা তো বটেই– এমনি একটা ভাবে যুধিষ্ঠিরের ইঙ্গিত বুঝে বললেন তা হলে আপনিই কৃষ্ণার পাণিগ্রহণ করুন, কিংবা আপনাদের মধ্যে অন্য কেউ…। যুধিষ্ঠির বললেন– কৃষ্ণা আমাদের সবারই ঘরণী হবেন। বিশেষত অর্জুন এই মহারত্ন জয় করেছে, আমরা ঠিক করেছি আমরা সবাই এই রত্নের অংশীদার হব– এষ নঃ সময়ো রাজন রত্নস্য সহ ভোজনম্। দ্রুপদ আকাশ থেকে পড়লেন। আরক্ত মুখে বললেন– এক পুরুষের অনেক বউ থাকে শুনেছি, কিন্তু এক বউয়ের অনেক স্বামী– অসম্ভব। এ তোমার কেমন বুদ্ধি বাপু? ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রুপদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বললেন– এরকমটি হলে ছোট ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে বড় ভাই যবীয়সঃ কথং ভ্রাতুঃ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা… উঃ আমি আর ভাবতে পারছি না। ঠিক এই সময়ে রাজভবনে উপস্থিত হলেন ব্যাস। তিনি পুরা-কাহিনি শোনালেন। পাণ্ডবদের অলৌকিক জন্মবৃত্তান্ত প্রকট করলেন। জানালেন দ্রৌপদীর পূর্ব-জন্মকথাও। দ্রৌপদী নাকি পূর্বজন্মে ছিলেন এক ঋষির কন্যা–রূপবতী, পতিপ্রার্থিনী। তিনি তপস্যায় শিবকে তুষ্ট করে পাঁচবার একই কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ঠাকুর আমাকে মনের মতো বর দিন। যেহেতু পাঁচবার, অতএব শিব বললেন তোমার পাঁচটা স্বামী হবে। ব্যাস বললেন– শিবের সেই কথা আজ ফলতে চলেছে। ভগবান শংকর, মহামতি ব্যাস– এঁদের ওপরে আর কথা চলে না। শুভলগ্নে পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে পাঁচ-সাতে পঁয়ত্রিশ পাকে বাঁধা পড়লেন অনিন্দ্যসুন্দরী দ্রৌপদী।

কুমারিল ভট্ট, যিনি ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম খ্রিস্টাব্দের ধুরন্ধর মীমাংসক পণ্ডিত বলে পরিচিত, তিনি তার তন্ত্রবার্তিকে কতগুলি প্রশ্ন তুলেছেন। ক্ষেত্র বিশেষে মহাত্মা পুরুষদের আপন আত্মতুষ্টিও ধর্মবিষয়ে কোনও প্রমাণ হতে পারে কি না, এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। সেই প্রসঙ্গে অনেকের সঙ্গে পাণ্ডবদের পাঁচ ভাইয়ের বউ দ্রৌপদীর কথা উঠেছে। পাঁচ ভাইকে পর্যায়ক্রমে সেবা করলে, দ্রৌপদী যে স্বৈরিণী বলে পরিচিত হতে পারেন এ প্রশ্ন তো দ্রৌপদীর বাপ-ভাইও তুলেছিলেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বারবার সেখানে বলেছেন– আমরা পাঁচজনে বিয়ে করব, এইটাই ধর্ম– এষ ধর্মো ধ্রুবো রাজ। ব্যাসের সামনেও যুধিষ্ঠির রীতিমতো আস্থা নিয়ে বলছেন– আমার কথা মিথ্যে হতে পারে না। তাই এখানে অধর্ম থাকতেই পারে না– বৰ্ততে হি মনো মেহত্ৰ নৈযোহধর্ম কথঞ্চন। বোধ করি ধর্মময় যুধিষ্ঠিরের এই আত্মতুষ্টির প্রমাণ দেবার জন্যই কুমারিল তন্ত্রবার্তিকে দ্রৌপদীর কথা তুলেছেন। কিন্তু ঠিক এই কথাটা তোলার সময় আত্মতুষ্টির প্রসঙ্গ গেছে হারিয়ে। কুমারিল সরাসরি প্রশ্ন তুলে বলেছেন- পঞ্চ পাণ্ডবের এক বউ কথাটা বিরুদ্ধ লাগতে পারে, কিন্তু স্বয়ং দ্বৈপায়ন তো সেকথা পরিষ্কার বুঝিয়েই দিয়েছেন। অর্থাৎ কিনা কুমারিল যুধিষ্ঠিরের আত্মতুষ্টির প্রামাণিকতা বাদ দিয়ে দ্রৌপদীর জন্মের দৈববাদকেই প্রাধান্য দিলেন বেশি। তার মতে যেখানে স্বয়ং দ্বৈপায়ন বেদিমধ্যাৎ সমুখিতা’ দ্রৌপদীর মাহাত্ম্য খ্যাপন করেছেন, তিনি তো আর সাধারণ মানবী নন যে স্বৈরিণীর প্রসঙ্গ আসবে। তিনি স্বয়ং লক্ষ্মীরূপিণী এবং লক্ষ্মী যদি অনেকের দ্বারা ভুক্তা হন, তা হলে দোষও হয় না– সা চ শ্ৰীঃ শ্রীশ্চ ভূয়োভির্ভুজ্যমানা ন দূষ্যতি।

আমরা আজকের দিনে দুষ্টুমি করে ভট্ট কুমারিলকে বলতে পারতাম– মহাশয়! তা হলে লক্ষ্মীস্বরূপিণী সীতা রাবণের দ্বারা দু’-একবার ভুক্তা হলে কী ক্ষতি হত, কিংবা লক্ষ্মী রুক্মিণী শিশুপালের অঙ্কশায়িনী হলেই বা কী ক্ষতি হত? তার ওপরে লক্ষ্মীর ভাগ স্বয়ং বিষ্ণুর। পাণ্ডবেরা কেউ তো তার তেজে জন্মাননি? যা হোক, আপাত এইসব বিটকেল প্রশ্ন আমরা ভট্ট কুমারিলকে করতে চাই না, কারণ তিনি আমাদের দারুণ একটি খবর দিয়েছেন। কুমারিল মহাভারতের প্রমাণে জানিয়েছেন যে, সুমধ্যমা দ্রৌপদী প্রত্যেক পতিসঙ্গমের পরই আবার কুমারী হয়ে যেতেন- মহানুভবা কিল সা সুমধ্যমা বভূব কন্যৈব গতে গতেহহনি। পাঠক! আবার আপনি দ্রৌপদীর বৃদ্ধা দিদিশাশুড়ি সত্যবতীর সঙ্গে দ্রৌপদীর মিল খুঁজে পেলেন। এমনকী মিল পেলেন তার শাশুড়ি কুন্তীর সঙ্গেও। মহর্ষি পরাশরের সঙ্গে সঙ্গম হওয়ার পর সত্যবতী আবার তার কুমারীত্ব লাভ করেছিলেন এবং তা পরাশরের বরে। দ্রৌপদীর কাহিনি কিন্তু আরও সাংঘাতিক, তিনি প্রতি সঙ্গমের পরেই কুমারীত্ব ফিরে পেতেন। আগে যে শ্লোকটি উদ্ধার করেছি সেটি কিন্তু ভট্ট কুমারিলের লেখা। তন্ত্রবার্তিকের এই শ্লোকের সূত্র ধরেই মূল মহাভারতীয় শ্লোকটি তন্ত্রবার্তিকের টীকাকার সোমেশ্বর ভট্ট তার ন্যায়সুধায় উদ্ধার করেছেন। এই শ্লোকটি আছে সেইখানেই, যেখানে পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে দ্রৌপদীর বৈদিক রীতিতে প্রথামাফিক বিয়ে হল।

ভগবান শংকর বলেছেন– তুমি পাঁচবার যেহেতু একই কথা বলেছ, অতএব তোমার স্বামী হবে পাঁচটি। কিন্তু যিনি পরজন্মে পঞ্চপতির মনোহারিণী হবেন, তাঁর বিদগ্ধতা, তার বাস্তব-বোধই কী কম হবে! পূর্বজন্মের ঋষিকন্যা দ্রৌপদী বললেন– হোক আমার পাঁচটা বর, তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু হলে এই বরও দিতে হবে যে, প্রত্যেক স্বামী-সহবাসের পরই কুমারীত্ব লাভ করব আমি– কৌমারমেব তৎ সর্বং সঙ্গমে সঙ্গমে ভবেৎ। বারংবার এই কুমারীত্বলাভের মধ্যেই দ্রৌপদীর দৈবসত্তার সন্ধান পেয়েছেন দার্শনিক কুমারিল। তার ধারণা, প্রধানত দ্রৌপদীর এই অমনুষ্যসুলভ কুমারীত্বের ভরসাতেই কৃষ্ণ কর্ণকে প্রলোভন দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেই যখন উদ্যোগপর্বে কৃষ্ণের দূতীয়ালি বিফল হল, তখন কৃষ্ণ ভাবলেন অন্তত কুরুপক্ষপাতী কর্ণকে যদি পাণ্ডবপক্ষে টেনে নেওয়া যায়, তা হলেও খানিকটা সাফল্য আসে তার অনুকূলে। কৃষ্ণ কর্ণকে আসল জন্মরহস্য শোনালেন, এবং জ্যেষ্ঠভ্রাতা হিসেবে তার রাজসিংহাসন প্রাপ্তির যোগ্যতাও ঘোষণা করলেন। কিন্তু টোপ হিসেবে কৃষ্ণ যাকে ব্যবহার করলেন, তিনি কিন্তু দ্রৌপদী। কৃষ্ণ বললেন– যুধিষ্ঠির তোমার মাথায় সাদা চামর দোলাবেন, ভীম ছাতা ধরে বসে থাকবেন, আর অনিন্দিতা দ্রৌপদী! ছ’বারের বার যথাকালে দ্রৌপদী উপনীত হবেন তোমার শয্যায়– ষষ্ঠে ত্বাং চ তথা কালে দ্রৌপদ্যুপগমিষ্যতি।

ভট্ট কুমারিল বলেছেন– মানুষের মধ্যে এই ধরনের কুমারীত্ব লাভ মোটেই সম্ভব নয় এবং দ্ৰৌপদীর এই কুমারীত্বের প্রামাণিকতা আছে বলেই কৃষ্ণ কর্ণকে প্রলোভিত করতে চেয়েছেন– অতিব বাসুদেবেন কর্ণ উক্তঃ… ইতরথা হি কথং প্রমাণভূতঃ সন এবং বদে। বস্তুত দ্রৌপদীর এই প্রাত্যহিক কুমারীত্ব নিয়ে ভট্ট মহোদয়দের যতই মাথাব্যথা থাকুক না কেন, আমাদের তেমন মাথাব্যথা নেই, এমনকী খোদ পঞ্চপাণ্ডবেরও কোনও মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয় না। অথচ ভট্ট-শৰ্মাদের দ্রৌপদীর সতীত্ব বিষয়ে চর্চাটা কিন্তু সামাজিক বিদ্বদজনের ভীষণ রকমের বিব্রত বোধ করার জায়গা থেকেই এসেছে এবং বিব্রত বোধ করেন বলেই এত দার্শনিক সমাধান প্রয়োজন হয় এই বিষয়ে। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের (১৮৮৭-১৯৫৪) মতো বিষণ্ণ কবি, যার অনেক কবিতা আমাদের স্কুল-পাঠ্যেও পড়তে হয়েছে, সেই তিনি স্বয়ং ব্যাস থেকে অন্যান্য পণ্ডিতদের এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখেই কাব্যিক মন্তব্য করেছিলেন–

পাঁজি-পুঁথি লয়ে খুঁজে মুনিগণ
 সতীর পঞ্চপতির হেতু,
কল্পনা গাঁথি জন্ম হইতে
জন্মান্তরে বাঁধিল সেতু।

ব্যাস-কথিত সেই পূর্ব-তপস্বিনীর শিব-তপস্যা এবং পঞ্চস্বামী-লাভের ব্যাপারে শিবের বরদানের ঘটনাটা যে দ্রৌপদীর সতীত্ব-বিপর্যয় সমাধান করার জন্যই পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং দ্রৌপদীর মহাকাব্যিক ব্যক্তিত্বের নিরিখে তিনি নিজে একাই যে তার পঞ্চস্বামীর দায়িত্ব নিতে পারেন, সেটা বোঝানোর জন্য যতীন্দ্রনাথ খুব লৌকিক যুক্তি দিয়ে বলেছেন–

যে সব কাহিনী জানি বা না জানি,
তেজস্বিনী গো, তোমারে চিনি,
আপন যোগ্য পুরুষ সৃজিতে
 জন্ম জন্ম তপস্বিনী।
দেবতারা মিলে গড়িতে পারেনি
তোমার প্রাপ্য তপের নিধি
 তাই গো সাধ্বি, পঞ্চ প্রদীপে।
তোমার আরতি করিল বিধি।

এই কবিতার মধ্যে সাধ্বী’ শব্দটাকে সম্বোধনে বসিয়ে নিয়ে পঞ্চস্বামীর ভোগ-ব্যবহারের যৌনতাকে একেবারে ফুকার দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন যতীন্দ্রনাথ। আমরা তাই দ্রৌপদীর সতীত্ব নিয়ে মাথা ঘামাই না, যেমনটি তার স্বামীরাও ঘামাননি। আরও একটা ঘটনা এখানে ভাবার মতো। এত যে পাঁচ স্বামীর কথা হচ্ছে, এখানে দ্রৌপদীর কোনও বক্তব্য নেই। তিনি নিজের সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন, কিন্তু পঞ্চস্বামীর ব্যাপারে তার অনিচ্ছা ব্যক্ত করেননি কোথাও। প্রগতিবাদীরা বলতে পারেন– তাকে ‘কেয়ার’-ই করা হয়নি, তার মত নেবার কোনও প্রয়োজনই বোধ করা হয়নি। কিন্তু আমরা বলব- দ্রৌপদীর যা চরিত্র আমরা সারা মহাভারত জুড়ে দেখেছি, তাতে জিজ্ঞাসা না করা হলেও অপছন্দের ব্যাপার হলে তিনি বলেই দিতেন। আমাদের ধারণা দ্রৌপদী বেশ এনজয়’ই করছিলেন ঘটনার গতি-প্রকৃতি। আর পাণ্ডবরা তো দ্রৌপদীর অসামান্য রূপে মুগ্ধ ছিলেন, সম্পূর্ণ বশীভূত ছিলেন তার গুণে এবং অবশ্যই বিদগ্ধতায় গর্বিত। সেই মুগ্ধতা এবং বশীভবন যে কতখানি, তা সাধারণ মানুষের চোখেও পড়ার কথা এবং সেটা বাইরে থেকে আসা নারদমুনিরও চোখে পড়েছিল। আসছি সে-কথায়।

.

০২.

দ্রৌপদীর সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডবের বিবাহ হবার পর বেশ কিছুদিন তারা দ্রুপদের পঞ্চাল-রাজ্যেই ছিলেন। জীবনটা তখন ঘোড়ায় জিন দিয়ে চলত না, আর মহাকাব্যিক সময়টাও মহাকাব্যিক তালে চলে বলে পাণ্ডবরাও কোনও তাড়া বোধ করেননি তক্ষুনি হস্তিনাপুরে ফিরে যাবার। ফলত বিয়ের পর বেশ কিছুদিন বাপের বাড়িতেই থাকার ফলে দ্রৌপদীও হয়তো খানিকটা নিজেকে স্বাধীনভাবে মেলে ধরতে পেরেছেন স্বামীদের কাছে। মহাভারতের কবি অবশ্য এই সময়ে স্বামীদের সঙ্গে দ্রৌপদীকে নিয়ে একটি শব্দও খরচা করেননি, বরঞ্চ শাশুড়ি কুন্তীর কাছে প্রতিদিন পট্টবস্ত্র পরিধান করে নববধুর নম্রতায় প্রণাম করতে যাচ্ছেন দ্রৌপদী, আর কুন্তী তাকে পঞ্চপুত্রের উপযুক্তা স্ত্রী হিসেবে অরুন্ধতী, দময়ন্তী, লক্ষ্মীর সঙ্গে দ্রৌপদীর তুলনা করছেন এই দৃশ্য চোখে পড়ছে আমাদের। আমরা যেন বুঝতে পারছি– কুন্তী অনেক বেশি নিশ্চিন্ত এখন। সেই কোন কালে পাণ্ডুর মৃত্যুর পর শতশৃঙ্গ পর্বত থেকে নেমে এসে হস্তিনাপুরে আপন পুত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিয়েছিলেন কুন্তী, যে কারণে ছেলেদের সঙ্গে রাজনৈতিক দুর্ভোগও ভুগেছেন এ-পর্যন্ত, সেই কুন্তীকে এবার যেন একটু আত্ম-সংবরণ করতে দেখছি। নিজের দায়িত্ব তিনি যেন এখন পঞ্চমীগর্বিতা দ্রৌপদীর স্কন্ধে ন্যস্ত করে মুক্ত হচ্ছেন। অনন্ত তাঁর আশীর্বাদের মধ্যে প্রধানতম তার আশীর্বাদ বুঝি এই যে, কুরুজাঙ্গল দেশে যেসব রাজ্য ও নগর আছে, সেখানে তুমি ধর্মানুরক্ত চিত্তে নিজের রাজাকে অভিষিক্ত করো– অনু ত্বম অভিষিচ্যস্ব নৃপতিং ধর্মবৎসলা। মহাভারতের টীকাকারেরা সামাজিক দুর্ভাবনা-বশতই এখানে ক্রিয়াপদে অনুজ্ঞা-বচনটা একেবারেই ইচ্ছাকৃতভাবে খেয়াল করলেন না এবং বললেন– ‘অভিষিচ্যস্ব’ মানে অভিষেক লাভ করো– অভিষেকং প্রাঙ্গুহি। কিন্তু এখানে ক্রিয়াপদে অনুজ্ঞায় এই শব্দের প্রকৃত অর্থ কুরুজাঙ্গল দেশে রাজাকে তুমি অভিষিক্ত করো এবার। দ্রৌপদীর বিদগ্ধতা এবং ব্যক্তিত্বের দৃষ্টিতে কুন্তীর দায়িত্ব-সংক্রমণ মধ্যযুগীয়েরা মেনে নিতে পারেননি বলেই মূল মহাভারতীয় শ্লোকের বিকার তৈরি হয়েছে টীকায়, অনুবাদে।

বস্তুত কুন্তীর এই কথা থেকে দ্রৌপদীর বিবাহ সম্বন্ধে আরও একটা তাৎপর্যও ফুটে ওঠে। এই বিয়ে যেন ঠিক সাধারণ বিবাহ-কৌতুক নয়। প্রথমত যুধিষ্ঠির এবং কুন্তী যে সিদ্ধান্ত নিলেন পাঁচ ভাইই বিয়ে করবেন দ্রৌপদীকে, সেখানেই একটা রাজনৈতিক দিক আছে। পৈতৃক রাজ্যে এখনও পাণ্ডবদের প্রতিষ্ঠা হয়নি, এর মধ্যে যদি শুধু অর্জুনের সঙ্গে বিয়ের ফলে ভাইতে ভাইতে ঈর্ষাতুর দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তা হলে পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ভিন্নতার সেই সুযোগ নেবে দুর্যোধন। বুদ্ধিমান যুধিষ্ঠির সেটা অনেক আগে বুঝেছিলেন বলেই যাতে ভাইদের মধ্যে দ্রৌপদীকে নিয়ে কোনও বিভেদ না হয়, তার জন্য সব ভাইরা মিলে দ্রৌপদীকে বিবাহ করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু এ তো গেল পরিবারের ভিতরকার রাজনীতি। এর বাইরেও দ্রৌপদীর সঙ্গে পাণ্ডবদের বিবাহের একটা রাজনৈতিক তাৎপর্য তৈরি হল। পাণ্ডবরা হস্তিনাপুর রাজ্যে থাকার সময় যে সামান্য রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পেয়েছিলেন, সেখানে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার আগেই তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে বারণাবতের জতুগৃহে পুড়ে মরতে পাঠানো হল মায়ের সঙ্গে। বিদুরের বুদ্ধিতে তারা মরলেন না এবং অবেশেষে পঞ্চাল দেশে দ্রৌপদীর সঙ্গে তাদের বিয়েও হল।

বিয়ের সময় থেকে দ্রৌপদীকে লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডবরা কিন্তু দ্রুপদের কাছ থেকে এই পরমাশ্বাসও লাভ করতে থাকলেন যে, হস্তিনাপুরে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য দ্রুপদ তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করবেন। আমরা এই সাহায্যের অর্থ বুঝতে পারি; এই মুহূর্তে এটা কোনও সামরিক সাহায্য নয়, বৈবাহিকতার মাধ্যমে পাণ্ডবরা মিত্রলাভ করেছেন, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘স্ট্রং অ্যালাই’, সেই ‘অ্যালাই’ কিন্তু হস্তিনাপুরের রাজনৈতিক মহলে একটা থ্রেট হিসেবে কাজ করছে। একই সঙ্গে পাণ্ডবদের উপরি পাওনা হল কৃষ্ণ। এই বিবাহ উপলক্ষ্যে কৃষ্ণ পাণ্ডবদের অন্যান্য বিশিষ্ট উপহারের সঙ্গে যা পাঠিয়েছেন সেগুলি কিন্তু সামরিক উপহার শিক্ষিত হস্তী, সুশিক্ষিত মদ্রদেশীয় অশ্ব, রথ, কোটি কোটি স্বর্ণমুদ্রা এবং রাশিকৃত মৌলিক স্বর্ণ– বীথীকৃত মমেয়াত্মা প্রাহিণোন্মধুসূদনঃ। এই যে বিশাল রাজনৈতিক এবং সামরিক আয়োজন– এর কেন্দ্রস্থলে কিন্তু দ্রৌপদী। অতএব দ্রৌপদীকে কিন্তু আর সাধারণ এক রাজবধু হিসেবে বিচার করা যাবে না। এখন থেকেই তাকে নিয়ে প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে উঠতে থাকবে। প্রতিপক্ষ রাজনীতির ধারা যে খাতে বইতে থাকবে, সেখানে দ্রৌপদীও বারবার বিচার্য এবং চিন্তনীয় হয়ে উঠবেন।

পাণ্ডবদের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ-পর্ব সমাপ্ত হতেই গুপ্তচরেরা হস্তিনাপুরে এসে দুর্যোধনকে সব কথা জানাল এবং দুর্যোধন তাতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বোধ করতে লাগলেন এবং তার ভাইরাও, কর্ণ-শকুনিও- অথ দুর্যোধনো রাজা বিমনা ভ্রাতৃভিঃ সহ। গুপ্তচরের খবর বিদুরের কাছেও গেল, কিন্তু তিনি যখন অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে খবরটা জানাতে গেলেন তখন বুঝলেন যে, আসল খবরটা ধৃতরাষ্ট্র তখনও জানেন না। বিদুরের খুশি দেখে তিনি ভেবে বসলেন– দ্রুপদনন্দিনী তাঁর পুত্র দুর্যোধনকেই পতিত্বে বরণ করেছে– মন্যতে স বৃতং পুত্রং জ্যেষ্ঠং দ্রুপদকন্যয়া– এমনকী তিনি বধূমুখ দর্শনানুভবের জন্য দুর্যোধনকে বহুতর অলংকার-নির্মাণের আদেশ দিয়ে বসলেন। বিদুর এবার ধৃতরাষ্ট্রকে প্রকৃত সত্য জানালেন এবং এক মুহূর্তের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্র কিন্তু দ্রৌপদীর চাইতেও দ্রৌপদীর সঙ্গে পাণ্ডবদের মিলিত হওয়ার রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে মাথা ঘামালেন বেশি। তিনি বলেও ফেললেন– এমন ঐশ্বর্য-সম্পত্তিহীন অবস্থায় দ্রুপদ রাজাকে পাণ্ডবরা যেভাবে মিত্র হিসেবে লাভ করলেন, তার রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে– কো হি দ্রুপদমাসাদ্য মিত্রং ক্ষত্তঃ সবান্ধবম্।

দুর্যোধন-দুঃশাসন এবং কর্ণ-শকুনিরা ধৃতরাষ্ট্রের সামনেই নানান পরিকল্পনা আরম্ভ করলেন। দ্রুপদ এবং পাণ্ডবদের মধ্যে গুপ্তচর পাঠিয়ে ভেদ সৃষ্টি করার পরিকল্পনার মধ্যে অন্যতম একটা পরিকল্পনা ছিল এইরকম যে, দ্রৌপদীকে পাণ্ডবদের ওপর বিরক্ত করে তোলা হোক। তাতে যুক্তি থাকুক এইরকম– এতগুলো স্বামী নিয়ে তুমি ঘর করবে কী করে? আর পাণ্ডবদেরও প্রত্যেককে বলা হোক– তোমরা পাঁচটা পুরুষ আর ওই একটা বউ, তোমরা পরস্পরের উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করছ। এতে কাজ হবে, তারপর দ্রৌপদীকে আমরাই পাব– টীকাকারের ভাষায়– ততশ্চ তাং ল্যামহে ইতি শেষঃ। অথবা এমনও করা যেতে পারে যে, অন্যতরা সুন্দরী রমণীদের দিয়ে পাঁচভাই পাণ্ডবকেই প্রলুব্ধ করা হোক এবং তাতেই কৃষ্ণা দ্রৌপদীকে স্বামীদের থেকে পৃথক করে ফেলা যাবে– একৈকস্তত্র কৌন্তেয়স্ততঃ কৃষ্ণা বিরজ্যতাম। দুর্যোধন-দুঃশাসন-কর্ণ-শকুনির মধ্যে এই যে এত সব যুক্তি-তর্ক-পরিকল্পনা চলছিল, সেইসব অনেক কূটনৈতিক যুক্তির মধ্যে একটা বড় প্রসঙ্গ হল- দ্রৌপদীকে পাণ্ডবদের ভালবাসার মোহজাল থেকে মুক্ত করে আনা এবং অবশেষে নিজেরা দ্রৌপদীর অধিকার লাভ করা। মহাবীর কর্ণ অবশ্য এই পরিকল্পনায় জল দিয়ে দুর্যোধনকে বলেছিলেন- পাণ্ডবদের কোনও ভাইকে তুমি আর একের বিরুদ্ধে অন্যকে প্ররোচিত করতে পারবে না। কেননা একটামাত্র বউতে যেখানে পাঁচজনেই আসক্ত, তাদের তুমি পৃথক করবে কী করে? ওদের একতা-বন্ধনের চাবিকাঠিটাই তো ওই একতমা দ্রৌপদী একস্যাং যে রতাঃ পত্নাং ন ভিদ্যন্তে পরস্পরম্। আর তোমরা যে ভাবছ– অন্য লোক দিয়ে দ্রৌপদীকে পাণ্ডবদের ওপর বিরক্ত করে তুলবে, সেটা অসম্ভব। কেননা দ্রৌপদী পাণ্ডবদের খুব খারাপ অবস্থা জেনেও তাদের সানন্দে বরণ করে নিয়েছে, আর এখন তো দ্রুপদ এবং কৃষ্ণের সহায়তায় তাদের অবস্থা সমৃদ্ধ হয়েছে, এখন দ্রৌপদী তার স্বামীদের থেকে সরে আসবে কেন? অতএব এটা অসম্ভব–ন চাপি কৃষ্ণা শক্যেত তেভ্যো ভেদয়িতুং পরৈঃ।

এরপর কৃষ্ণা দ্রৌপদী সম্বন্ধে কর্ণ একটা সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন, যা আজকের দিনের প্রগতিশীল যৌক্তিকতায় অবশ্যই বিচার্য হওয়া উচিত এবং আমার সহৃদয় পাঠককুল এবং ততোধিক সহৃদয়া পাঠিকা রমণীরা যেন এই আলোচনাকে যুক্তিবাদিতার দৃষ্টিতেই ক্ষমা করেন। পাণ্ডব-ভাইদের ওপর বিরক্তি তৈরি করে দ্রৌপদীকে যে ভাঙিয়ে আনা যাবে না, সে-বিষয়ে কারণটা কর্ণের মতে দ্রৌপদী নিজেই! কর্ণ বলেছেন– দ্যাখো, মেয়েদের যদি একের চেয়ে বেশি অনেকগুলি স্বামী থাকে, তবে সেই বহুভর্তৃকতা মেয়েদের কাছে যথেষ্টই কাম্য অর্থাৎ পছন্দের ঈপ্সিতশ্চ গুণঃ স্ত্রীণামেকস্যা বহুভর্তৃতা। সেখানে দ্রৌপদী এটাই পেয়েছে, পাঁচ-পাঁচটি উপভোক্তা বা উপভোগক্ষম পুরুষকে যদি কেউ শাস্ত্রসম্মতভাবে স্বামী হিসেবেই পায়, তা হলে দ্রৌপদীর মতো একজন রমণী তাদের ছেড়ে থাকবে কেন? অতএব দ্রৌপদীকে স্বামীদের থেকে ভাঙিয়ে নিয়ে আসাটা প্রায় অসম্ভব তঞ্চ প্রাপ্তবতী কৃষ্ণা ন সা ভেদয়িতুং ক্ষমা।

কর্ণের কথাটা যদি তার অভিমান-শ্লেষ থেকে বিশ্লিষ্ট করে একটু তটস্থ হয়ে বিচার করা যায়, তবে আজকের দিনের গবেষণায় এই মন্তব্যের কিছু সত্যতাও খুঁজে পাওয়া যাবে। পণ্ডিতজনেরা এ-বিষয়ে দুটি অসাধারণ শব্দ খুঁজে বার করেছেন– একটি হল exclusivists অর্থাৎ পুরুষ পরিহারিণী গোত্রের, অন্যটি varietists অর্থাৎ পুরুষ-বৈচিত্র্যবাদিনী। এঁরা বলছেন– এমনকী মহামতি কিসের মতও তাই যে, স্ত্রী-পুরুষ-নির্বিশেষে মানুষ মাত্রেই বৈচিত্র্য পছন্দ করে, একই জীবনসঙ্গীর সঙ্গে সাবেগে যৌবনজীবন কাটিয়ে যাওয়াটা কোনও রমণীর অন্তর্গত প্রয়োজনের জায়গা নয়, এটা সংস্কৃতিগতভাবে তার ওপর চাপানো একটা সামাজিক শৃঙ্খলা। এমন একটা দায়বদ্ধতা যদি হাজার হাজার বছর ধরে রমণীর মনের মধ্যে অন্তর্জাত কোনও সংস্কার তৈরি না করত, তা হলে মেয়েরাও পুরুষের ব্যাপারে বৈচিত্র্যবাদী হত, যেমনটি পুরুষেরা মেয়েদের ব্যাপারে হয়। স্বয়ং কিসের মতও তাই। তিনি অনেক পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন। যে, মেয়েদের মধ্যে বহুপুরুষগামিতার চিত্রটা যে আপাত দৃষ্টিতে দুর্বল মনে হয়, তার কারণটা কখনওই অন্তঃস্থিত কোনও বৃত্তি নয়, হাজার হাজার বছর ধরে তাকে সামাজিকতার সংস্কারে এইভাবে আবদ্ধ করা হয়েছে বলেই বহুপুরুষগামিতার ক্ষেত্রে মেয়েরা তেমন উন্মুখীন হয়ে উঠতে পারে না সহজে।

আমরা এই নিরিখে দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী লাভের ঘটনাটাকে একটা সমাজ স্বীকৃত সুব্যবস্থা বলেই ধরে নেব। তার মধ্যে দ্রৌপদীর শারীরিক আকর্ষণ সম্বন্ধে যত কথা মহাভারতে আছে, তাতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে oestradiol level-টা তার মধ্যে উচ্চতর জায়গায় ছিল কিনা বলতে পারব না– কেননা তাতেই নাকি মেয়েদের যৌন আকর্ষণ বেশি হয় কিন্তু তিনি পঞ্চস্বামী-গ্রহণের উপযুক্ত আধার ছিলেন, সে-কথা বারেবারেই প্রমাণিত হবে। বিশেষত হৃদয়গত আবেগ-মধুরতায় কোনও স্বামীকে কী এবং কতটা দিতে হবে, সেটা দ্রৌপদীর মতো বিদগ্ধা রমণীকে বুঝিয়ে দেবার প্রয়োজন ছিল না। ব্যাপারটা কবির দৃষ্টিতে অদ্ভুত নিপুণতায় দেখিয়েছিলেন কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। উল্লেখ্য, এক কবি যতীন্দ্রনাথ বাগচীর অনুরোধে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত দ্রৌপদী সম্বন্ধে লিখেছেন–

বিবাহ-আসনে বামাক্ষুষ্ঠ
দিলে তুমি রাজা যুধিষ্ঠিরে,
তর্জনী তুলি’ দিলে বৃকোদরে,
মধ্যমা দিলে পার্থবীরে;
 ঈষৎ নামায়ে দিলে অনামিকা,
ধরিল নকুল হৃষ্টমনে,
 কনিষ্ঠা তব পরশ করিয়া
সহদেব স্বীয় ভাগ্য গণে!

কবির লেখনীতে আপ্তবাক্যের মতো যে শব্দ উচ্চারিত হয়, তার মধ্যে যে কত গভীর সত্য থাকে, তা বোধহয় তিনি নিজেও অনুধাবন করতে পারেন না। অঙ্গুষ্ঠ বা বুড়ো আঙুল বস্তুটা বৃহত্ত্ব-মহত্ত্বের প্রতীক বটে, তবে বুড়ো আঙুলের মধ্যে একটা সুমহান অনর্থকতাও আছে, যেখানে যুধিষ্ঠির খুব গুরুত্বপূর্ণ ঔপাধিক হওয়া সত্ত্বেও দ্রৌপদীর জীবন এবং হৃদয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণভাবেই অকিঞ্চিৎকর। আবার দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমসেনই বোধহয় দ্রৌপদীর একমাত্র স্বামী যাঁর মাধ্যমে তিনি আপন অনভীষ্ট নিন্দিত শত্রুদের দমন করতে পেরেছেন, সেখানে তার তর্জনী ধারণ করাটা যথেষ্টই ব্যঞ্জনাময়। আবার অর্জুনরূপী মধ্যমাটা দেখুন। মধ্য শব্দটার মানেই একটু উদাসীন, নিরপেক্ষ ভাবের মানুষ; দ্রৌপদীর জীবনে অর্জুনের ভূমিকার মধ্যে কখনওই খুব আঁকড়ে ধরা নেই, অথচ মধ্যমাঙ্গুলির মতো সবচেয়ে বড়ই তো অর্জুন, দ্রৌপদী তাকেই তো জীবনের একমাত্র মাধ্যম করতে চেয়েছিলেন। এত সরল একটা পদ্যে তিন কুন্তীপুত্র থেকে মাদ্রীপুত্রদের পৃথক করলেন যতীন্দ্রমোহন, আমি ভেবে অবাক হই। নকুল-সহদেবের কথা যেই এল, অমনি ‘ঈষৎ নামায়ে দিলে অনামিকা’– অর্থাৎ দ্রৌপদীর মতো বিদগ্ধা রমণীকে ধরবারই ক্ষমতা নেই নকুল-সহদেবের, যদি না তিনি আঙুল ধরার ইঙ্গিতটুকু দেন। তার মধ্যে সহদেবের চেয়েও নকুল দ্রৌপদীর কাছে আরও অনামিক, সেই জন্য তার জন্য অনামিকা। আর সহদেব দ্রৌপদীকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে সত্যিই কতটা ধন্যম্মন্য ছিলেন সময়ে তার পরিচয় দেব।

প্রথমত উল্লেখ্য, ঠিক বিয়ের পর হস্তিনাপুরে প্রবেশ করার আগেই দ্রৌপদীর জন্য রাজ্য রাজনীতিতে একটা তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। দুর্যোধনের উলটো-পালটা ভাবনার মধ্যে জল ঢেলে দিয়ে কর্ণ বোঝালেন– ওইসব ছলনায় কোনও কাজ হবে না, একে ভাঙানো, তাকে সরানো, এসব করে কোনও ফল হবে না। বরঞ্চ যতক্ষণে দ্রুপদ রাজা যুদ্ধের উদ্যম শুরু না করেন, যতক্ষণে না কৃষ্ণ তার যাদব-বাহিনী নিয়ে যোগ দেন পাঞ্চাল দ্রুপদের সঙ্গে, তার মধ্যেই পাণ্ডবদের ওপর আক্রমণ করা হোক– রাজ্যার্থং পাণ্ডবেয়ানাং পাঞ্চাল্য-সদনং প্রতি। কিন্তু কর্ণের কথামতো কাজ করা সম্ভব ছিল না, হস্তিনাপুরের অন্তর্গহের রাজনীতি যেখানে ভীষ্ম-দ্রোণ, কৃপ-বিদুরেরা পাণ্ডবদের প্রতি জতুগৃহ-গমনের আদেশটুকুর তাৎপর্য বুঝে গিয়েছেন, তাদের কারণেই ধৃতরাষ্ট্রকে দ্রৌপদীসহ পাণ্ডবদের রাজ্যাধিকার মেনে নিতে হল এবং তিনি ইন্দ্রপ্রস্থে পাণ্ডবদের পৃথক রাজ্যস্থাপনের অনুমতি দিলেন। সেখানে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-বিবাদ যাই থাকুক, গ্রামের লোকেরা বলবেই যে, দ্রৌপদীর মতো বউটার জন্যই পাণ্ডবদের ভাগ্য খুলে গেল।

হস্তিনাপুরের প্রভাবমুক্ত হয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে রাজধানী-স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় নারদমুনি এসে পৌঁছোলেন সেখানে। প্রসঙ্গ দ্রৌপদী। পাঁচ ভাই একটি স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন, সেক্ষেত্রে সহবাসের আচারেও তো খানিকটা শৃঙ্খলা থাকতে হবে, কিন্তু সেটা তো আর পাঁচ ভাই ‘মিটিং করে ঠিক করতে পারেন না অথবা সোচ্চারে আলোচনাও করতে পারেন না যে, কীভাবে এক ভাইয়ের ভোগ-সাধনের পর কোন ক্রমে দ্রৌপদীর অধিকার পাবেন। সেই কারণেই মহাকাব্যিক অভিসন্ধিতে নারদ উপস্থিত হলেন ইন্দ্রপ্রস্থে। দ্রৌপদীকে দেখার পরেই তিনি প্রসঙ্গ তুলে বললেন– দ্যাখো বাছারা। তোমাদের পাঁচজনের একটা বউ, প্রত্যেকেরই ধর্মপত্নী দ্রৌপদী কৃষ্ণা– পাঞ্চালী ভবতামেকা ধর্মপত্নী যশস্বিনী। এখন তার অধিকার নিয়ে তোমাদের মধ্যে সুন্দ-উপসুন্দের লড়াই না লেগে যায়। সুন্দ-উপসুন্দ– দুই ভাইয়ের একটাই রাজ্য, একই গৃহে একই শয্যায় দুই ভাই একই স্ত্রী নিয়ে থাকত– এক রাজ্যাবেকহাবেকশয্যাসনাশনৌ- পরে দুটোতেই লড়াই করে মরল।

যুধিষ্ঠির দুই অসুরের কাহিনি শুনতে চাইলে নারদ তিলোত্তমার কাহিনি শোনালেন। অনিন্দ্যসুন্দরী তিলোত্তমার জন্যই দুই ভাই শেষ পর্যন্ত নিজেরা মারামারি করে মরলেন– এই কাহিনি সবিস্তারে শুনিয়ে নারদ দ্রৌপদীর কথা উপস্থাপন করলেন। বললেন– দ্রৌপদীর জন্য শেষ পর্যন্ত তোমাদের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়াঝাটি না লেগে যায়– যথা বো না ভেদঃ স্যাৎ সর্বেষাং দ্রৌপদীকৃতে। নারদ দ্রৌপদীর প্রসঙ্গে তিলোত্তমার কথা বলায় একদিকে যেমন দ্রৌপদীর চরম শারীরিক আকর্ষণ সূচিত হল, তেমনই অন্যদিকে প্রত্যেক ভাইই যাতে এই অসামান্যা রমণীর ওপর আপন অধিকার খুঁজে পান, সেই সূচনাও হল। পাণ্ডবরা সকলে মিলে নারদের সামনে প্রতিজ্ঞা করলেন– আমাদের এক-একজনের ঘরে দ্রৌপদী থাকবেন এক-এক বছর ধরে একৈকস্য গৃহে কৃষ্ণা বসেদ বর্ষমকল্মষা। সময়টা এক বছর থাকার ফলে পুত্র সম্ভাবনায় পিতৃত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রটাও স্পষ্ট হয়ে উঠবে যেমন, তেমনই যুধিষ্ঠিরাদির পর্যায়ে নকুল-সহদেব পর্যন্ত প্রত্যেকেই এক এক বছরের ছোট বলে ক্রমিক ভোগপর্যায়ও নিশ্চিত হয়ে গেল এবং তারা নিজেরাই ঠিক করলেন যে, এই একবছর নিশ্চিন্ত সহবাস-মধুরতার মধ্যে অন্য কেউ যদি উপস্থিত হন, তা হলে তাকে ব্রহ্মচারী হয়ে। বারো বছর বনে বাস করতে হবে।

একথা ঠিক যে, পঞ্চস্বামীর সুবাদে দ্রৌপদী একমাত্র যুধিষ্ঠির ছাড়া আর সব ভাইয়ের বউদিদি হয়েছেন; আর সহদেবের সঙ্গে মিলন কালে সব ভাইয়েরই তিনি ভাদ্দর বউ। কিন্তু মাঝখানে তিন স্বামী তিন সম্বন্ধেই আছেন দ্রৌপদীর সঙ্গে কখনও স্বামী, কখনও ভাশুর আবার কখনও বা দেওর। কথাটা মহাভারতের কতগুলি সংস্করণ ধরেছে, কতগুলি ধরেনি। কিন্তু যে সংস্করণে এই বার্তাবহ শ্লোকটা আছে, সেটা ভীষণই চমকদার। সেকালে ভাশুরকে ‘ভ্রাতৃশ্বশুর’ বলত, বস্তুত এই শব্দটা থেকেই ভাশুর শব্দটা এসেছে। পরবর্তীকালের স্মৃতিশাস্ত্রীয় দায়ভাগ অংশে ভ্রাতৃশ্বশুর শব্দটা ভাশুর অর্থে ব্যবহৃত হলেও মহাভারতের এই সংস্করণ ভ্রাতৃশ্বশুরের পরিবর্তে ‘পতিশ্বশুর’ শব্দটা ব্যবহার করে বলেছে– ভীম অর্জুন ইত্যাদির সঙ্গে দ্রৌপদীর স্বামী-সম্বন্ধ ধরলে জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরই একমাত্র সঠিক অর্থে পতিশ্বশুর বা ভাশুর হতে পারেন দ্রৌপদীর। আবার ওপরের চার ভাইয়ের সম্বন্ধ ধরলে একমাত্র সহদেবকেই সঠিক অর্থে দ্রৌপদীর দেবরও বলা যায়– পতিশ্বশুরতা জ্যেষ্ঠে পতিদেবরতানুজে– আর তিনজন কালে কালে স্বামী, ভাশুর, দেওর সবই– ত্ৰিতয়ং ত্রিতয়ং ত্রিষু।

ত্রিমাত্রিক সম্পর্ক নিয়ে তাঁর মনে কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল না। ব্যাস লিখেছেন– স্নিগ্ধ বনস্থলীর মধ্যে যেমন অনেকগুলি হাতি একসঙ্গে থাকে তেমনি পঞ্চস্বামীকে পেয়ে দ্রৌপদী গজদর্পিতা বনস্থলীর মতো অন্যের অধরা হয়েছিলেন। পাণ্ডবরাও তাঁর মধ্যে পেয়েছিলেন বনস্থলীর ছায়া। ব্যাস উপমাটি দিয়েছেন ভারী সুন্দর নাগৈরিব সরস্বতী। সরস্বতী’ মানে নীলকণ্ঠ লিখেছেন ‘বহু সরোবরযুক্ত বনস্থলী।

দ্রৌপদী যে এক-এক সময়ে এক-এক বীরস্বামীর স্নান সরোবরে পরিণত হতেন এবং অন্য স্বামীকে দিতেন বনস্থলীর ছায়া– তাতে সন্দেহ কি! ব্যাস তাই লিখেছেন– বভূব কৃষ্ণা সর্বেষাং পার্থানাং বশবর্তিনী– একসঙ্গে তিনি সবারই বশবর্তিনী ছিলেন এবং সেইজন্যই সাধারণভাবে বনস্থলীর উপমা। পাঁচ স্বামীর মধ্যে সবার সঙ্গেই দ্রৌপদীর ব্যবহার একরকম ছিল না। কাউকে একটু বেশি ভালবাসতেন, কাউকে বেশি বিশ্বাস করতেন, কাউকে বা যেন মানিয়ে চলেছেন, আবার কাউকে বাৎসল্যও করেছেন।

বাৎসল্যের কথাটা হয়তো বিশ্বাস হচ্ছে না, কিন্তু আমাদের ধারণা এই যে নকুল-সহদেব, এই দুই ভ্রাতার প্রতি দ্রৌপদীর বাৎসল্য রসই বেশি, যতখানি না শৃঙ্গার। সারা মহাভারতে যুধিষ্ঠির, ভীম আর অর্জুনের মাহাত্ম এত বেশি যে, এই তিন ভ্রাতার চাপে নকুল সহদেবের কথা সংকুচিত হয়েছে। বাস্তব ক্ষেত্রে গাছের-ওপর উঠে জলের খোঁজ করা, একে ডাকা, তাকে বলা– এইসব খুচরো কাজের বেলায় নকুল-সহদেবের ডাক পড়ত। দ্রৌপদীর বিয়ের অব্যবহিত পূর্বেও জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচে ফেরবার সময়ে নকুল-সহদেব ভীমের কোলে উঠেছেন। এ হেন নকুল-সহদেবের সঙ্গে তিনটি নাম করা বীর স্বামীর রসজ্ঞা দ্রৌপদী কী ব্যবহার করবেন। বিশেষত কনিষ্ঠ সহদেবের সঙ্গে?

.

০৩.

অপরূপা দ্রৌপদীকে যিনি প্রথম প্রেম নিবেদন করার সুযোগ পেলেন তিনি হলেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। এটি দ্রৌপদীর দুর্ভাগ্য না যুধিষ্ঠিরের সৌভাগ্য– সে আলোচনায় না গিয়েও বলতে পারি, যুধিষ্ঠির, মানে যিনি মহা যুদ্ধকালেও স্থির থাকতে পারেন, তিনি আর কত উতলা হয়ে রমণীর কাছে প্রেম নিবেদন করতে পারেন। বরঞ্চ যিনি তাকে লক্ষ্যভেদ করে জিতেছিলেন, যাঁর গলায় তিনি প্রথম বরমাল্য পরিয়ে দিয়েছিলেন, তার সময়-সুযোগ আসার আগেই তাকে হারাতে হল। আমি বলি, যে ঘরে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর সঙ্গে বসে আছেন, সে ঘরে অস্ত্র রাখা কেন। তুমি ক্ষত্রিয় মানুষ, ক্ষত থেকে ত্রাণ করাই তোমার ধর্ম, আর সেই ধর্ম রক্ষার জন্য যখন তখন অস্ত্রের প্রয়োজন হতেই পারে। যেমন দরকার হলও। গরিব ব্রাহ্মণের গোরু চুরি গেছে, অর্জুনকে এখন তীর-ধনুক নিয়ে চোর তাড়া করতে হবে। এখন উপায়? অস্ত্রাগারে যুধিষ্ঠির এবং দ্ৰৌপদী। এতকাল আমাদের এই ধারণাই ছিল যে, অস্ত্রাগারে এই নবদম্পতির আস্তানা ছিল। কিন্তু তা মোটেই নয়। মানুষটি তো যুধিষ্ঠির, তিনি দ্রৌপদীকে একান্তে পাওয়ার জন্য খাণ্ডবপ্রস্থে আর এক খণ্ড জমিও খুঁজে পাননি। বাগান, বনস্থলীর কথা ছেড়েই দিলাম। তিনি সেঁদিয়েছেন গিয়ে নির্জন অস্ত্রাগারে। অর্জুনের সে কী দোটানা অবস্থা। তিনি ভাবছেন– দাদা যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর সঙ্গে আছেন অস্ত্রাগারে, আর একদিকে ব্রাহ্মণ রক্ষা বিধানের দায়ে পাণ্ডবদের সাহায্য চাইছেন। পরিত্রাতার ভূমিকাই অর্জুনের কাছে বড় হল। তিনি অস্ত্রাগারে ঢুকলেন, ব্রাহ্মণের সম্পত্তি উদ্ধার করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই বনবাসের অনুমতি চাইলেন অগ্রজের কাছে।

অর্জুনের দিক থেকে এটা খুব বীরোচিত ব্যবহার হল বটে, কিন্তু ঘটনায় যুধিষ্ঠির অত্যন্ত বিব্রত বোধ করলেন। বারবার তিনি বললেন– আমার ঘরে ঢুকে তুমি কোনও অন্যায় কাজ করোনি, আমার অপ্রিয় কাজ তুমি করোনি কিছু। অতএব আমার মনে যদি কোনও অসন্তোষ না থাকে, তবে এমনি এমনি তুমি নিজেকে দোষী ভাবছ কেন। তা ছাড়া এমন যদি হত যে, ছোটভাই তার বউ নিয়ে নিভৃতে বসে আছে, বড় ভাই তার ঘরে ঢুকল, তবু সেটাকে একটা দোষ বলতে পারি, কিন্তু ছোট ভাই বড় দাদার ঘরে ঢুকেছে, তাতে কোনও অন্যায়ই হয় না– গুলোরনুপ্রবেশে হি নোপঘাতে যবীয়সঃ–অতএব অর্জুন! তুমি নিবৃত্ত হও, আমার কথা রাখো, আমাকে কোনও অবজ্ঞা তুমি করোনি। অর্জুন যুধিষ্ঠিরের কাতর উক্তি শুনেও খুব বিগলিত হলেন না। শান্ত কণ্ঠে বললেন– চালাকি করে কোনও ধর্ম আচরণ করা যায় না, একথা তোমার মুখেই বারবার শুনেছি। অতএব আমিও প্রতিজ্ঞাত সত্য থেকে সরে আসতে পারি না, আমাকে যেতেই হবে, তুমি অনুমতি দাও।

মহাভারতে দাম্পত্য-বিপর্যয়ের এই জায়গাটা অদ্ভুত। একটা তুচ্ছ ঘটনা ঘটাতে হবে বলেই ব্রাহ্মণের গোরু হারাল, কিন্তু গোরু খুঁজে আনার জন্য মহাভারতের সবচেয়ে বড় যুদ্ধবীর অর্জুনকেই প্রয়োজন হচ্ছে। এই তুচ্ছতার প্রয়োজন থেকে বুঝতে পারি ঘটনাটা অনেক গভীর এবং পরোক্ষে সেটা দ্রৌপদীর অধিকার লাভের জায়গা। যুধিষ্ঠির যেভাবে বিব্রত হয়ে অর্জুনকে অনুরোধ করেছেন থেকে যাবার জন্য, তাতে কেমন যেন মনে হয়– তিনি নিজেকে দোষী বোধ করছেন দ্রৌপদীর অনায়াস ভোগ্যতায়। অন্যদিকে যুধিষ্ঠিরের অনুরোধ সত্ত্বেও অর্জুনও যে এত কঠিন এবং নির্মম, সেটাও যেন বিপ্রতীপভাবে এক অপ্রাপ্তির শীতল প্রতিক্রিয়া। আমার শুধু মনে হয় এই সময়ে দ্রৌপদীর মনের মধ্যে কী হচ্ছিল? মহাভারতের কবি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি এ বাবদে দুই স্বামীর কথোপকণ্বনে তিনি আপাতদৃষ্টে অদৃশ্যা হয়ে আছেন। হয়তো বা এই সময়ে মনে পড়ে সেই বিবাহসভার কথা, যেখানে দ্রুপদের কাছে, ব্যাসের কাছে যুধিষ্ঠির বার বার মাতৃবাক্য পালনের কথা বলেছেন। শেষে কিন্তু নিজের অবচেতন মনের কথাও তিনি চেপে রাখতে পারেননি। বলেছেন– পাঁচভাই তাকে বিয়ে করুক– এ যেমন জননী কুন্তী বলছেন, এ তেমনি আমারও মনের কথা এবং চৈব বদত্যম্বা মম চৈতন্মনোগতম।

এ আমারই ইচ্ছে মনোগতম– এই ইচ্ছেটুকুর মধ্যে ব্যক্তিত্ব আছে ঠিকই। কিন্তু সেই মুহূর্তে, যখন নাকি লজ্জানা বধূটির পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব ছিল না, যেখানে তাঁর লক্ষ্যভেত্তা পুরুষসিংহ অর্জুন দাদাদের জন্য নিজের হক ছেড়ে দিয়েছেন, সেই কালেও দ্রৌপদী কি তার জ্যেষ্ঠ স্বামীকে ক্ষমা করতে পেরেছেন। আমার তো মনে হয় যুধিষ্ঠিরকে সেই থেকে তিনি মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। মহাভারতকার স্পষ্ট করে এই ব্যাপারে স্বকণ্ঠে কিছু ঘোষণা করেননি, তবে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দ্রৌপদীর ব্যবহার লক্ষ করার মতো। তার ওপরে পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে থাকা অর্জুনকে যদিও বা কোনও পর্যায়ে লাভ করা যেত, তাকেও তিনি পরম লগ্নে হারিয়ে বসলেন সেই যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে অস্ত্রাগারে রসালাপ করে। দ্রৌপদী নিজেকেই বা কী করে ক্ষমা করবেন। যুধিষ্ঠিরের কথা তো ছেড়ে দিলাম, যদিও এর ফল ভুগতে হয়েছে যুধিষ্ঠিরকেই, অন্য সময়ে, অন্যভাবে।

অর্জুন ব্রহ্মচারীর ব্রত নিয়ে বারো বছরের জন্য ঘর থেকে বেরোলেন বটে, কিন্তু এই ‘হিরোয়িক আইসোলেশন’-এর মধ্যে দ্রৌপদীর প্রতি তাঁর আকর্ষণটাই যে অন্য ধারায় বিপ্রতীপভাবে বয়ে চলল, সে-কথা স্বীকার করাই ভাল। ব্যাপারটা একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। অর্জুনের দিক থেকে একটা পরিকল্পিত ব্যবহার সৃষ্টি করে নিলেই তার নির্লিপ্ততা এবং দ্ৰৌপদী আকর্ষণের তাৎপর্য পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমন ধরুন, আমি সেদিনটার কথা ধরছি না, যেদিন লক্ষ্যভেদের পর খুশির হাসিতে উছলে-পড়া দ্রৌপদী বরমাল্যখানি অর্জুনের গলায় দুলিয়ে দিয়েছিলেন। ধরছি না এই জন্যে যে, নববধূর সদ্য ফোঁটা একাধার হৃদয়কল্পনার মধ্যে ঠাসাঠাসি করে বসিয়ে দেওয়া হল আরও চারজনকে। বেশ এ-পর্যন্তও না হয় বোঝা গেল, কিন্তু দ্রৌপদীর সঙ্গে প্রথম সহবাসের অধিকার তো অর্জুনকে দেওয়া যেত। না, যুধিষ্ঠিরও এ সুযোগ ছাড়েননি, যদিচ ছাড়লেও আমি নিশ্চিত জানি অর্জুন এ সুযোগ নিতেন না। তারপরেই তো সেই ব্রাহ্মণের গোরু-হারানোর ঘটনা। আচ্ছা, সামান্য একটা গোরুচোর ধরার জন্য, আর গোরু খোঁজার জন্যও কি অর্জুনকে যেতে হবে? ভীম, নকুল, সহদেব– এঁরা কী করছিলেন? যিনি দূর থেকে কতবার দ্রৌপদীর গলা শুনতে পেয়ে বিপদ উদ্ধার করেছেন, সেই তিনি ভীম ব্রাহ্মণের গোরু-হারানো গলা শুনতে পেলেন না? নাকি, কেউই ওই অস্ত্রাগারে ঢুকে দ্রৌপদীর সহবাস খোয়াতে চাননি। তা যাক, হয় অর্জুনই গোরু-চোর ধরতে গেলেন এবং নারদের নিয়মে তার বনবাস হল। কিন্তু যুধিষ্ঠির তো ছোট ভাইকে ছাড় দিয়ে বাড়িতেই থাকতে বলেছিলেন, তিনিই তো পাকামি করে থাকলেন না।

ঠিক এইখানটাতেই কথা। ধরে নিই যুধিষ্ঠিরের পীড়াপীড়িতে অর্জুন থেকেই গেলেন। ফলটা কী হত? প্রথমেই এটা পরিষ্কার হয়ে যেত যে, অর্জুন কোনও মূল্যেই সহবাস সুখ ত্যাগ করতে চান না। দ্বিতীয়ত, ভীম কিংবা নকুল-সহদেব হলেও বুঝি ঘরেই থেকে যেতে পারতেন, কিন্তু এটা যেহেতু সেই অর্জুন, যিনি দ্রৌপদীর বরমাল্য জিতেছিলেন, তাই তিনিই প্রথম নিয়ম ভাঙলে অন্য স্বামীদের মনে, বিশেষত যুধিষ্ঠিরের মনে তো এক ধরনের মিশ্রক্রিয়া হতই। ভীম, নকুল-সহদেবের মনে হত অর্জুনই যেহেতু লক্ষ্যভেদী এবং দ্রৌপদীর আসল নায়ক, তাই যুধিষ্ঠির তাকে অত করে থাকতে বলছেন। আর যুধিষ্ঠির মনে মনে ভাবতেন– অর্জুন থেকে গেল, বীর ক্ষত্রিয় হওয়া সত্ত্বেও অন্তত দ্রৌপদীর ওপরে নিজের হক এবং প্রাপ্য পাওনা ছেড়ে দিতে চায় না অর্জুন। কাজেই যুধিষ্ঠির যখন বলেছিলেন–তুমি ছোটভাই, বড়দের ঘরে ঢুকেছ, কী হয়েছে–এটা যুধিষ্ঠিরের ভালমানুষি, না পরীক্ষা, সেটা বুঝতে হবে। অন্তত অর্জুন এটাকে পরীক্ষা হিসেবেই নিয়েছিলেন। তাই যে কথা যুধিষ্ঠিরই সাধারণত বলেন, অর্জুন সেই ধর্মেরই দোহাই দিয়ে বললেন– ধর্মের ব্যাপারে চালাকি চলে না, একথা আপনার কাছেই শুনেছি। অতএব সত্যধর্ম থেকে বিচলিত হতে চাই না, দাদা! অর্জুন ধীর নির্লিপ্ততায় বনবাসী হলেন।

না, দ্রৌপদী কাঁদেননি, হৃদয়ের গভীরে পাক খাওয়া আসন্ন বিরহের বেদনা হৃদয়ের মধ্যেই বিলীন হয়ে গেছে। তা ছাড়া সেটা কোনও সময়ও ছিল না কদবার। তিনি জ্যেষ্ঠ স্বামীর সঙ্গসুখ ভোগ করছেন, এই সময়ে তৃতীয় পাণ্ডবের জন্য কাঁদবার মানে হবে একটাই। পক্ষপাত। তিনি শারীরিক সঙ্গ পাবার আগেই অর্জুনকে ভালবেসেছেন। অন্তত নববধূর প্রথম মিলন মুহূর্তেও এই কথাটা তিনি কান্নায় প্রকাশ করতে চাননি। কিন্তু অর্জুন তো চলে গেলেন এবং দ্ৰৌপদীকে না পাবার নৈরাশ্যেই কিছুটা বা বাউল স্বভাব হয়ে গেল তার। নৈরাশ্যের জবাবে উলূপী, চিত্রাঙ্গদা– একটার পর একটা বিয়েই করে ফেললেন। তারপর বুঝি দ্রৌপদীকে হারানোর দুঃখ কিছুটা বা ঘুচল প্রথমবারের মতো সুভদ্রাকে দেখে। রৈবতক পর্বতের বনভোজন মহোৎসবে সুভদ্রাকে দেখেই তার মনে হল– কৃষ্ণ-বলরামের বোনকে দেখে কেই বা না মোহিত হবে– কমিবৈষা ন মোহয়েৎ। তিনি সুভদ্রার মধ্যে দ্রৌপদীর রূপ এবং বৈদগ্ধ্য, দুয়েরই ছায়া পেলেন, মনে ভাবলেন– এই মহিলা যদি আমার বউ হত– যদি স্যান্ মম বার্ফেয়ী মহিষীয়ম। শেষে কৃষ্ণের মধ্যস্থতায় সুভদ্রা-হরণ করে, অনেক যুদ্ধের প্রস্তুতি শেষে বীরের মতো অৰ্জুন পেলেন সুভদ্রাকে।

পেলেন তো, কিন্তু এক বছরের একটু বেশি সময় দ্বারকায় থেকে সুভদ্রার উষ্ণ-সঙ্গ ভোগ করতে করতেই যে বনবাসের বারো বচ্ছর কেটে গেল। এবার তো ঘরে ফেরার পালা, খাণ্ডবপ্রস্থে দ্রৌপদীর ঘরে। উলূপী, চিত্রাঙ্গদাকে না হয় দ্রৌপদী নিজের সমমর্যাদায় দেখতেন না, কিন্তু সুভদ্রাকে নিয়ে দ্রৌপদীর মুখোমুখি হওয়া! অর্জুন যে জানেন দ্রৌপদী তাকে ভালবাসেন। মাটিতে পড়ে গেলেও স্খলিতপাদ মনুষ্যের অবলম্বন তো সেই ভূমিই, কাজেই যার কাছে অর্জুন অপরাধী, অর্জুন তাকেই আশ্রয় করলেন। খাণ্ডবপ্রস্থে এসে রাজা ব্রাহ্মণের অভিবাদন সেরেই তিনি ঢুকলেন দ্রৌপদীর ঘরে– দ্রৌপদীম অভিজগ্নিবান। আগেই খবর হয়ে গেছে। বারো বচ্ছর পরে অভিমানে বিধুর দ্রৌপদী প্রথম স্বামি-সম্ভাষণ করলেন কঠিন বক্রোক্তিতে। বললেন– তুমি আবার এখানে কেন? যাও সেইখানে, যেখানে আছে সেই সাত্বত-বৃষ্ণি-কুলের সোহাগী মেয়ে– তত্রৈব গচ্ছ কৌন্তেয় যত্র সা সাত্বতাত্মজা। দ্রৌপদী সুভদ্রার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করলেন না, তার বংশের নামে কথা চালালেন। অর্জুনকে খোঁটা দিয়ে বললেন- তোমার আর দোষ কী? ভারী জিনিস কঠিন বাঁধনে বেঁধে রাখলেও সময়কালে সে বাঁধন খানিকটা আলগা হয়েই যায়– সুবদ্ধস্যাপি ভারস্য পূর্ববন্ধঃ শ্লথায়তে।

ব্যাস লিখেছেন– প্রথমটা দ্রৌপদী যেভাবে বলছিলেন, তাতে তার প্রণয়কোপের ভাগটাই ছিল বেশি– প্রণয়াৎ কুরুনন্দনম। কিন্তু দ্রৌপদী যে বাঁধনের কথা বললেন, সে বাঁধন তো তার অন্য স্বামীদের। যুধিষ্ঠির, ভীম– এঁদের বাঁধন যত বেড়েছে, অর্জুনের বাঁধন তত আলগা হয়েছে– পরে তার প্রমাণও দেব। কিন্তু এই মুহূর্তে, বারো বছর পরে যে দ্রৌপদী প্রথমে প্রণয়রসে রাগ দেখিয়ে কথা আরম্ভ করেছিলেন সে রাগ তাঁর কোথায় গেল! তিনি তো পরমুহূর্তেই কেঁদে ফেললেন ঝরঝর করে। ব্যাস শব্দটা লিখছেন– বিপন্তীং, যার মানে বিলাপ করাও হয়, আবার কালীপ্রসন্ন সিংহ মশায়ের মতে নানাবিধ পরিহাস করিতে থাকিলে’– তাও হয়। সিংহীমশায় ভেবেছেন, আগে যখন প্রণয় কোপের কথা আছে, তা হলে এ শব্দটা পরিহাসই বোঝাবে। কিন্তু সাতবাহন হাল থেকে সমস্ত রসবেত্তা বোদ্ধারা বলেছেন– বিদগ্ধা মহিলারা রাগ দেখায় কেঁদে, আমি তাই এখানে ‘বিলপন্তীং’ বলতে কাঁদতে থাকা দ্রৌপদীকেই বুঝি। বিশেষ করে অর্জুন যেহেতু দ্রৌপদীকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, বহুভাবে দ্রৌপদীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন, তাতে বুঝি মানিনী দ্রৌপদী কাঁদছিলেন।

দ্রৌপদী কিন্তু ধরা পড়ে গেলেন। ধর্মপুত্র থেকে আরম্ভ করে প্রত্যেক পাণ্ডবেরই দ্রৌপদী ছাড়া অন্য স্ত্রী আছেন। তাদের কারও জন্যে দ্রৌপদীর কোনও দুঃখ কোথাও ধরা পড়েনি। কারণ তাদের কাউকে দ্রৌপদী আপনার সমকক্ষ মনে করেননি। কিন্তু অর্জুন তার নির্লিপ্ততার বাহানায় দ্রৌপদীর মতো সপ্রতিভ ব্যক্তিত্বের দিক থেকে পেছন ফিরতে গিয়ে তার সমকক্ষ আরেক ব্যক্তিত্বকে বিবাহ করে এনেছেন। এ অপমান দ্রৌপদী সইবেন কী করে? যার জন্য বারো বছর ধরে হৃদয়ের মধ্যে গোপন আসন সাজিয়ে বসে আছেন, তিনি একেবারে বিয়ে করে ফিরেছেন। দ্রৌপদী লজ্জায় অপমানে কেঁদে ফেললেন। প্রথমবারের মতো তিনি ধরা পড়ে গেলেন তিনি অর্জুনকে বেশি ভালবাসেন।

সমকক্ষ ব্যক্তিত্বকে দিয়ে সমকক্ষের মোকাবিলা করা মুশকিল, বিশেষত আগুনপানা দ্রৌপদীকে। অর্জুন প্রথমেই সুভদ্রাকে দ্রৌপদীর ঘরে এনে তোলার সাহস পাননি। এখন দ্রৌপদীর ভাব বুঝে, ক্ষমা চেয়ে ফিরে গেলেন সুভদ্রার ঘরে। নববধূর নতুন অনুরাগের মতো লাল কৌশেয় বাসখানি তাড়াতাড়ি খুলে ফেলতে বললেন সুভদ্রাকে, খুলে ফেলতে বললেন ভূষণ-অলংকার। সুভদ্রাকে সাজিয়ে দিলেন দীন-হীন গোয়ালিনীর বেশে কৃত্বা গোপালিকাবপুঃ। এবারে তাকে দ্রৌপদীর ঘরে পাঠিয়ে দিলেন একা। অনুক্রম অনুসারে সুভদ্রা কুন্তীকে প্রণাম করেই দ্রৌপদীর ঘরে এলেন। তাঁকেও প্রণাম করে সুভদ্রা বললেন– আজ থেকে আমি তোমার দাসী হলাম দিদি- প্ৰেষ্যাহম ইতি চাব্রবীৎ। ‘দাসী! দ্রৌপদীর অভিমান বুঝি কিঞ্চিৎ তৃপ্ত হল। সুভদ্রার কুল মান সব বুঝেও তার আপাত ব্যবহারে, দীন বেশে খুশি হলেন দ্রৌপদী। ভবিষ্যতের ধারণাহীন নতমুখী একা একা বালিকাকে দেখে দ্রৌপদীর বুঝি মায়া হল। উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন সুভদ্রাকে, আশীর্বাদ করলেন তোমার স্বামী নিঃসপত্ন হোন– নিঃসপত্নোহস্তুতে পতিঃ। সপত্ন– মানে শত্রু, কাজেই নিঃসপত্ন হোন মানে স্বামী নিঃশত্রুক হন– এই তো বীরাঙ্গনার আশীর্বাদ। কিন্তু পাঠক! শব্দের মধ্যেও ব্যঞ্জনা আছে। স্ত্রীলিঙ্গে ‘সপত্নী’ মানে যদি সতীন হয় তা হলে পুংলিঙ্গে সপত্ন মানেও একটা পুরুষ-সতীনের ব্যাপার থেকেই যায়, বিশেষত দ্রৌপদীর যিনি আসল স্বামী অর্জুন, তার সপত্ন পুরুষের জ্বালাতেই বারো বছর পরে অর্জুনকে দেখতে পেলেন তিনি। কাজেই দ্রৌপদীর এই আশীর্বাদের অর্থ এই যে, আমার মতো যেন তোমার অবস্থা না হয় তোমার স্বামী নিঃসপত্ন হোন।

ভাব দেখে মনে হল বুঝি দ্রৌপদী অর্জুনকে দিয়েই দিলেন সুভদ্রাকে। কিন্তু মন থেকে কি দেওয়া যায়? দেওয়া কি অতই সহজ? বরঞ্চ অর্জুনের প্রতি অক্ষমায় এবং সুভদ্রার প্রতি অতি ক্ষমায় দ্রৌপদীই যেন ধরা পড়ে গেলেন। সুভদ্রার স্বামীকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে নিজেরই মনের মধ্যে সতীন-কাঁটা বিঁধে রইল। অর্জুনের নির্লিপ্ততা দিনে দিনে বাড়িয়ে তুলল দ্রৌপদীর অক্ষমা। ইতিমধ্যে দ্রৌপদী ভীমকে অবলম্বন করতে আরম্ভ করেছেন– ভালবাসার জন্যে যতখানি, অর্জুনের ঈর্ষা জাগানোর জন্যে তার চেয়ে বেশি।

দ্রৌপদীর মতো বিদগ্ধা রমণীর মন বলে কথা– আমরা কীটের খোঁজে কেউটে সাপের গর্তে হাত ঢুকিয়ে ফেলেছি। এবার বরং একটু সাংসারিক কথায় আসি। দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর ঔরসে পাঁচটি পুত্র লাভ করলেন– যুধিষ্ঠিরের ছেলে প্রতিবিন্ধ্য, ভীমের ছেলে সুতসোম, অর্জুনের ছেলে শ্রুতকর্মা, নকুলের শতানীক এবং সহদেবের ছেলে শ্রুতসেন। এই ছেলেরা প্রত্যেকে প্রতিবিন্ধ্য থেকে পর পর এক-এক বছরের ছোট একবর্ষান্তরাস্কৃেতে– কিন্তু মনে রাখতে হবে এঁদের সবার চাইতে বড় কিন্তু অর্জুনের ঔরসে সুভদ্রার ছেলে অভিমন্যু। মহাভারতের কবি এমন একটা সময়ে দ্রৌপদীর পুত্রজন্মের কথা বললেন যার মধ্যে একটা তাচ্ছিল্য আছে যেন। আসলে, সৌভদ্র অভিমন্যুর জন্মকথা হচ্ছিল সবিস্তারে, সেখানে হঠাৎ করে দ্রৌপদীও তাঁর পঞ্চস্বামীর ঔরসে পাঁচটি পুত্র লাভ করলেন– পাঞ্চাল্যপি তু পঞ্চভ্যঃ পতিভ্য শুভলক্ষণা– এখানে সুভদ্রার পর দ্রৌপদীও’–‘পাঞ্চাল্যপি’– কথাটা বলে ফেলেই মহাকবি সেই এক যান্ত্রিকতার আভাস তৈরি করে দিলেন, যেখানে তার গর্ভজাত পুত্রেরা স্বয়ং দ্রৌপদীর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারল না। এই প্রক্রিয়ায় দ্রৌপদীর নিজস্ব বিদগ্ধতার জায়গাটা, অথবা বলা উচিত, তার ‘বৈদূর্যমণিসন্নিভ’ দীপ্যমান যৌবনের মাহাত্মটাই যেন বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তা নইলে তার গর্ভের পাঁচ-পাঁচটা ছেলে এমন অকিঞ্চিৎকরভাবে উল্লেখ্য হবেন কেন! বস্তুত এই প্রক্রিয়ায় সুভদ্রার চেয়ে সুভদ্রার ছেলে অভিমন্যু যেমন মহাভারতে পাঠকের দৃষ্টিসীমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন, তেমনই দ্রৌপদীর পুত্রেরাও দ্রৌপদীকে ‘প্রেক্রিয়েশন’ বা ‘রিপ্রোডাকশন’-এর ধর্মীয় যান্ত্রিকতাটুকু দিয়েই পাঠকের দৃষ্টির বাইরে চলে যান, উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠেন দ্রৌপদীই– যিনি আর্জুনি অভিমন্যুকে নিজপুত্রদের চেয়েও অনেক সমাদরে দেখেন।

অবশ্য এই জায়গাটায় অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদীর ভালবাসাটাই আমার কাছে বড় হয়ে ওঠে। হয়তো অর্জুনের প্রিয় পুত্র বলেই দ্রৌপদীও সুভদ্রার এই ছেলেটিকে নিজের ছেলের থেকে কম স্নেহ করতেন না। সুভদ্রা নিজেও তার বড় জা দ্রৌপদীকে কোনও দিনও কোনও ব্যবহারেই অতিক্রম করেননি। এই অনতিক্রমণই হয়তো ওজস্বিনী দ্রৌপদীকে সুভদ্রার ওপর সপত্নীর ঈর্ষা অতিক্রমের যুক্তি জুগিয়েছে। সেই যে বিবাহলগ্নেই সুভদ্রা এসে দ্রৌপদীকে বলেছিলেন- আমি তোমার দাসী, দিদি!– সে-ভাব তার শেষ পর্যন্ত ছিল। শল্য পর্বে দুর্যোধনের মতো শত্রুপক্ষ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে, তারা শত-চেষ্টাতেও সুভদ্রা এবং দ্রৌপদীর মধ্যে বিরোধ ঘটাতে সক্ষম হননি। তিনি বলেছেন– কৃষ্ণের বোন সুভদ্রা সমস্ত মান, অহঙ্কার ত্যাগ করে এখনও পর্যন্ত দ্রৌপদীর মতে চলেন। শুধু তাই নয়, তার সেবা শুশ্রূষা করেন দাসীর মতো–

নিক্ষিপ্য মানং দর্পঞ্চ বাসুদেব-সহোদরা।
কৃষ্ণায়াঃ প্ৰেষ্যবদ্ ভূত্বা শুশ্রুষাং কুরুতে সদা ৷

.

০৪.

যুধিষ্ঠির পৃথক রাজ্যে রাজা হয়েছেন, পট্টমহিষী হিসেবে দ্রৌপদীও রানি হয়েছেন বটে, তবে দ্রৌপদীর দিক থেকে যুধিষ্ঠিরের এই পার্শ্ব-পরিগ্রহ রাজকীয় প্রাতিষ্ঠানিকতার বেশি কিছু নয়। কিন্তু তার জন্য তার ব্যক্তিগত জীবনের চলা-ফেরা ব্যক্তিজীবনের সম্পর্কের দ্বারগুলিও রুদ্ধ হয়ে যায় না। খাণ্ডবপ্রস্থ তখনও ইন্দ্রপ্রস্থ হয়নি, অর্জুন ফিরে এসেছেন, সুভদ্রারও অনেক দিন কেটে গেছে, যদিও ভগিনীর বিবাহের সুবাদে কৃষ্ণ এখনও এই খাণ্ডবপ্রস্থেই বাস করছেন। এরই মধ্যে একদিন বেশ গরম পড়েছে, বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে রাজধানীর দুর্গ-দেয়ালের পরিসর। অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন– বড্ড গরম চলছে কৃষ্ণ! চলো যাই যমুনার দিকে উষ্ণানি কৃষ্ণ বর্তন্তে গচ্ছাব যমুনাং প্রতি। কৃষ্ণ বললেন– আমার মনের কথা বলেছ ভাই! আমারও মনে হচ্ছিল বন্ধু-বান্ধব নিয়ে জলের দিকে যাই একবার। আর দেরি হল না, ধর্মরাজের অনুমতি নিয়ে কৃষ্ণার্জুন চললেন যমুনার দিকে। অর্জুনের সঙ্গে চললেন দ্রৌপদী এবং তার নবপরিণীতা স্ত্রী সুভদ্রা। আর চলল রাজ্যের যত সব নাচিয়ে গাইয়ে মেয়েরা স্ত্রিয়শ্চ বিপুলশ্রোণ্যশ্চারুপীনপয়োধরা। তারা নিজেদের ক্রীড়া-মত্ততায় যমুনার তটভূমি আলোড়িত করে তুলল এবং সেটা খানিকটা উদ্দীপনও বটে দ্রৌপদী, অর্জুন বা সুভদ্রার সঙ্গে। বিবাহের পর এই প্রথম অর্জুনের সঙ্গে দ্রৌপদীর একান্তে আসা। মহাকাব্যের কবি সংখ্যাতাত্ত্বিকের মতো হিসেব দেননি বটে, তবে প্রথম বৎসরে যুধিষ্ঠিরের অনাপ্লুত সঙ্গ-রঙ্গে দ্রৌপদীর সহবাসের হিসেব যদি ধরি, তবে বারো বছর বনবাসের পর এই ত্রয়োদশতম বর্ষে দ্রৌপদী বোধহয় অন্য ভাইদের পরকীয়া ছিলেন না। অথবা থাকলেও তিনি এসেছেন ধর্মরাজের অনুমতি নিয়ে। তা ছাড়া সঙ্গে সুভদ্রাও তো এসেছেন। তবু খানিক একান্ত। দ্রৌপদী বড় খুশি হয়েছিলেন সেদিন। সুভদ্রার সঙ্গে একত্রে মদ্য পান করেছেন ক্ষত্রিয়াণীর মতো, নাচিয়ে-গাইয়ে মেয়েদের দিকে বসন-ভূষণের উপহার ছুঁড়ে দিয়েছেন বিহ্বলতায়– প্রাচ্ছতাং মহাহণি স্ত্রীণাং তে স্ম মদোৎকটে। দ্রৌপদী কি এত সুখ পেয়েছেন এর আগে, এই মুক্তি, অর্জুনের সঙ্গে এই প্রায় একান্ত মুক্তি।

মহাবীর অর্জুনের সময় ব্যস্ত হয়ে উঠল এই উৎসবমুখর যমুনা তীরেও। খাণ্ডববন দহনের পরিকল্পনা তৈরি হয়ে গেল এইখানেই এবং অতঃপর খাণ্ডব-দহন এবং ময়দানবের পরিকল্পনায় খাণ্ডবপ্রস্থ ইন্দ্রপ্রস্থ হয়ে উঠল। ইন্দ্রপ্রস্থের বহুবিত্তপ্রকাশিনী রাজসভায় নারদমুনি এসে যুধিষ্ঠিরকে রাজসূয় যজ্ঞ করতে বললেন, এতে তার রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বাড়বে। যুধিষ্ঠির রাজি হলেন এবং প্রধানত কৃষ্ণের বুদ্ধি এবং ভাইদের বাহুবলে এক বিস্তীর্ণ রাজমণ্ডল তার বশীভূত হল। রাজসূয় যজ্ঞের অর্ঘ্যদানের সময় মারা পড়লেন শিশুপাল। যজ্ঞান্তে সকলেই একে একে চলে গেলেন, কিন্তু ইন্দ্রপ্রস্থের সভাসৌকর্য দেখার নাম করে দুর্যোধন এবং শকুনি রয়ে গেলেন পাণ্ডবদের রাজধানীতে। ইন্দ্রপ্রস্থের অতুল শোভা দেখতে দেখতে দুর্যোধনের ঈর্ষা-অসূয়া কতটা উদ্দীপিত হল, সে খবর আমরা জানি। কিন্তু তার অনন্ত ঈর্ষা-কারণ বস্তুর মধ্যে আমরা দ্রৌপদীর ক্ষুদ্র স্থানটিকে ভুলছি না। রাজসভা দেখতে দেখতে যেখানে স্থল-জলের বিভ্রমে বারবার পড়ে যাচ্ছেন দুর্যোধন, সেখানে ভীম নাকি দুর্যোধনের দুর্গতি দেখে বেজায় হেসেছিলেন এবং তার পার্শ্বচর ব্যক্তিরাও হেসেছিল। কিন্তু এখানে একমাত্র ভীমের কথাই আছে, অন্যান্য পাণ্ডবদের কিংবা দ্রৌপদীর হাসাহাসির কোনও ঘটনাই নেই। কিন্তু ব্যাপারটা কেমন অসাধারণভাবে বেড়ে উঠছে দেখুন এবং তার মধ্যে দ্রৌপদী কীভাবে সংক্রমিত হচ্ছেন, সেটাও দেখুন। দুর্যোধন ঈর্ষা-অসূয়ায় মুহ্যমান, সেই মুহূর্তে শকুনি যখন অদ্ভুত কৌশলে অত্যন্ত নঞর্থকভাবে দুর্যোধনকে উদ্দীপিত করছেন, তখন প্রথমেই আসছে দ্রৌপদীর কথা।

শকুনি বললেন–যুধিষ্ঠিরের ওপরে তুমি রাগ কোরো না, ভাগনে! ওদের কপালে ওরা সুখভোগ করছে। তুমি আর কী করবে। তা ছাড়া চেষ্টা তো কম করোনি, সবই তো বিফলে গেছে। ওই যে দ্রৌপদী! তা সেই দ্রৌপদীকে তো ওরাই বউ হিসেবে পেল, সঙ্গে দ্রুপদ রাজা এবং তার ছেলেপিলেদের সহায়তাও জুটে গেল ওদের তৈর্লব্ধা দ্রৌপদী ভার‍্যা দ্রুপদশ্চ সুতৈঃ সহ। শকুনির মুখে পাণ্ডবদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি এবং অতুল সম্পত্তি লাভের প্রসঙ্গটা অপ্রসঙ্গ নয়, কিন্তু ক্ষতে লবণ-ক্ষেপণের মতো দ্রৌপদীর কথাটা ঠিক বেরিয়ে এল শকুনির মুখে। এই অপ্রাসঙ্গিক উদ্দীপনের ফল কী হল– দুর্যোধন যখন পিতা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে তার ঈর্ষা-অনুশোচনার বিবরণ শোনাচ্ছেন, তখন অনেক জ্বালার কথায় কথা বাড়িয়ে দ্রৌপদীর বিরুদ্ধেও ক্রোধ প্রকাশ করলেন দুর্যোধন। বললেন– একবার ভুল করে জলে পড়ে গিয়ে আবার যখন একটা পদ্মদীঘির মতো বস্তু দেখে পরনের কাপড় তুলে ধরেছি, তখন ভীম আমার অবস্থা দেখে হা হা করে হাসল। কিন্তু তারপর যখন স্থল ভেবে জলেই পড়ে গেলাম, তখন দেখলাম–কৃষ্ণ আর অর্জুনও আমাকে দেখে মিষ্টি মিষ্টি হাসছে এবং হাসছিল ওই দ্রৌপদী, অন্যান্য মেয়েদের নিয়ে দ্রৌপদীও হাসছিল– দ্রৌপদী চ সহ স্ত্রীভিথয়ন্তী মনো মম– এতে আমার ভীষণ আঘাত লেগেছে মনে। আমার এই অপমানের প্রতিশোধ নেব আমি।

দেখুন, ঘটনা যা ঘটে, তা থেকে যদি অন্য কারও ওপর নির্ভর নিজের ফায়দা তুলতে হয়, তা হলে বাড়িয়ে বলাটাই দস্তুর। প্রতিশোধ নিতে হলে ধৃতরাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া দুর্যোধনের চলবে না, অতএব অনুশোচনা এবং কষ্ট জানানোর সময়ে অন্য অনেক কথার মধ্যে দ্রৌপদীও কিন্তু একটা ভীষণ রকমের ‘আইটেম’ হয়ে উঠলেন। শকুনি আগেই বলেছিলেন– যুদ্ধ টুদ্ধ করে কিছু হবে না, বরঞ্চ কৌশলমার্গে অদক্ষ যুধিষ্ঠিরকে পাশাখেলায় পর্যুদস্ত করে আমি সমস্ত ধন-সম্পত্তি এবং পাণ্ডবদেরও আমি তোমার অধিকারে নিয়ে আসব। শকুনি দ্রৌপদীর কথা উহ্য রাখলেন এবং দুর্যোধন সমস্ত ঈর্ষা-অসূয়া-অভিমান একত্রিত করে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে পাশাখেলার অনুমতি বার করে নিলেন। বিদুরের মতো ব্যক্তিত্ব বারণ করলেও ধৃতরাষ্ট্র ছেলের স্বার্থে বললেন– বন্ধুর মতো পাশাখেলা হবে, কোনও চিন্তা নেই।

ধৃতরাষ্ট্রের কথায় খানিকটা বিশ্বাস করেই বিদুর ইন্দ্রপ্রস্থে এসেছিলেন পাশাখেলার নেমন্তন্ন করতে। কিন্তু নিতান্ত ব্যক্তিগত জায়গা থেকে তিনি পাশাখেলার কুফলগুলি যথেষ্টই বর্ণনা করায় যুধিষ্ঠিরের কিছু বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু বোঝেননি যে, তার পিছনে ছিল ওই খেলাটার প্রতি তার অত্যাসক্তি। যুধিষ্ঠির তো কোনওভাবেই জুয়াড়ি নন, জুয়াড়িদের সঙ্গে তিনি মেশেনওনি কোনওকালে, কিন্তু জুয়াড়িদের এই খেলাটার ওপর তার বড় মোহ ছিল। তিনি পাঁচ ভাই এবং দ্ৰৌপদীকে নিয়ে হস্তিনাপুরে এলেন সাড়ম্বরে। সকলকে যথাযোগ্য প্রণাম-অভিবাদন জানিয়ে যখন যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডবেরা অতিথিভবনে প্রবেশ করছেন, তখন দ্রৌপদীকে দেখে, তার ঋদ্ধি দেখে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রবধূরা কেউ খুশি হলেন না– যাজ্ঞসেনাঃ পরামৃদ্ধিং দৃষ্টা প্রজ্বলিতামিব। এখানে ঋদ্ধি’ শব্দটার অর্থ বেশভূষা এবং প্রচুর অলংকার বলে যাঁরা ব্যাখ্যা করেছেন বা অনুবাদ করেছেন, তাঁদের উদ্দেশে সবিনয়ে জানাই– ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রবধূদের বেশালংকার কিছু কম থাকার কথা নয়, কিন্তু দ্রৌপদীর চলনে-বলনে-চেহারায় যে ব্যক্তিত্ব ছিল, সেটাকে ঔদ্ধত্য বলে ভুল করাটা স্বাভাবিক বলেই মহাভারতের কবি দ্রৌপদীর ঋদ্ধিকে একটা বিশেষণ দিয়েছেন ‘প্রজ্বলিতামিব’–জ্বলছে যেন। প্রজ্বলিত আগুনপানা এক ধরনের বাড়বাড়ন্ত ঋদ্ধিং প্রজ্বলিতামিব। অন্তত দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে এই ঋদ্ধি বেশ-ভূষা-অলংকার হতে পারে না। কিছু বিদগ্ধা রমণী এমন থাকেনই, যাঁদের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলা যায় না, তাদের জিজ্ঞাসাই করা যায় না। স্বামী-পুত্ত্বর নিয়ে ভাল আছ তো গা। এ-হেন রমণীদের দেখলে ও-হেন রমণীরা পিছনে বলেন ‘দেমাক’– ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রবধূরা সেই কারণেই এক্কেবারে খুশি হলেন না– নাতিপ্ৰমনসোহভবন।

যুধিষ্ঠির পাশা খেলতে বসলেন শকুনির সঙ্গে এবং এই খেলার বিস্তারিত বিবরণে আমরা যেতে চাই না। শকুনি এক্কেবারে পাকা জুয়াড়ি এবং পাকা পাশাড়ে। খেলার দক্ষতার সঙ্গে খেলার অন্যায় কর্মগুলিও তার ভাল রপ্ত আছে। ফলে যুধিষ্ঠির যখন একটা একটা পণ ধরছেন, তখন খেলার সমাপ্তি ঘটতে সময় লাগছে না। শকুনি বলে বলে দান দিচ্ছেন এবং শেষে একবার সোচ্ছাসে বলছেন– এই নে, এটাও জিতলাম– জিতমিত্যেব। যুধিষ্ঠিরের পণ বাড়তে লাগল– ছোট থেকে বড়, মহার্ঘ থেকে মহার্ঘতর। আগ্রহ বাড়তে থাকল ধৃতরাষ্ট্রের দিক থেকে। তিনি বড় খুশি হয়ে উঠছেন শকুনির আপন জয়ঘোষণায়। যুধিষ্ঠিরের দুরাগ্রহ এবং মত্ততা বেড়েই চলেছে। এই অবস্থায় মহামতি বিদুর তীক্ষ্ণ ভাষায় এই পাশাখেলার আয়োজনের প্রতিবাদ করলেন। আয়োজক হিসেবে ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধন যেমন তার তিরস্কার থেকে মুক্তি পেলেন না, তেমনটি শকুনিও। কিন্তু পাশাখেলার আসর তখন এমন জমে উঠেছে যে, বিদুরকে যথেষ্ট অপমানজনক ভাষায় থামিয়ে দিলেন। দুর্যোধন যা তা বললেন বিদুরকে এবং ধৃতরাষ্ট্রের সামনেই। অথচ যুধিষ্ঠিরের মত্ততা তখন এমনই যে, তিনি এইসব বাদানুবাদের মধ্যে গেলেন না এবং বিদুর-দুর্যোধনের বাক্য-সংঘাত শেষ হতেই তিনি আবারও খেলা আরম্ভ করলেন।

সেকালের নিয়মে পণ রাখার আগে পণ্য বস্তুর গুণ বর্ণনা করার একটা রীতি ছিল। যুধিষ্ঠিরও সেটা করছিলেন। এই করতে করতে ধনসম্পত্তি রাজ্যপাট সব গেল যুধিষ্ঠিরের। এবার তিনি একে একে ভাইদের পণ রাখতে আরম্ভ করলেন এবং ওই একইভাবে তাদের গুণ-বিশেষ বর্ণনা করে। সহদেব থেকে ভীমসেন পর্যন্ত হেরে যাবার পর যুধিষ্ঠির নিজেকেই এবার বাজি রেখে বসলেন, শকুনি একই শঠতায় যুধিষ্ঠিরকে জিতে নিলেন এক লহমায়। সর্বহারা যুধিষ্ঠির যখন আর কিছু ভেবে পাচ্ছেন না, ঠিক তক্ষুনি শকুনি তাকে সুকৌশলে বললেন– এ তুমি কেমন একটা ভুল করলে, রাজা! তুমি কিনা নিজেকেই হেরে বসলে? আত্মপরাজয়ের মতো পাপ আর আছে নাকি? তা ছাড়া তোমার নিজের ঘরে অমন ভাল জিনিসটা তুমি এখনও পণই রাখোনি– গ্লহ একঃ অপরাজিতঃ। শকুনি মনে করিয়ে দিলেন– ঘরে আছেন তোমার প্রিয়া পত্নী কৃষ্ণা পাঞ্চালী। তুমি তাকে পণ রেখে নিজেকে অন্তত জিতে নাও পণস্ব কৃষ্ণাং পাঞ্চালীং তয়াত্মানং পুনর্জয়– এইভাবে মুক্ত করো নিজেকে।

যুধিষ্ঠিরের তখন মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নিয়তি-চালিত মানুষের মতো তিনি দ্রৌপদীর রূপ বর্ণনা আরম্ভ করলেন। বিয়ের আগে থেকে এখন পর্যন্ত দ্রৌপদীকে কেউ এভাবে শরীর-বিশ্লেষণ করে বর্ণনা করেনি– বলা উচিত– করা যায়নি, তাঁর ব্যক্তিত্বের নিরিখেই এমনটা করা যায় না। অথচ যুধিষ্ঠির ভূতাবিষ্টের মতো উন্মুক্ত রাজসভার মধ্যে সকলের সামনে দ্রৌপদীর রূপ বর্ণনা করতে আরম্ভ করলেন– নাতিহ্রস্বা ন মহতী– তিনি বেঁটেখাটো কোনও লোক নন, আবার ঢ্যাঙা লম্বাও নন, ভীষণ রকমের কিছু কালোও নন, আবার তেমন রাঙা-রাঙা গায়ের রংও নয় তার, ঘন কুঞ্চিত কেশরাশি, শরৎকালের পদ্মবাসিনী লক্ষ্মীর মতো তার চেহারা। গায়ে তেমন লোম নেই, পরিপাটি ক্ষীণকটি– যে রকম এক রমণী লাভ করলে যে কোনও পুরুষ তার ধর্ম-অর্থ-কাম সব সিদ্ধ করতে পারবে সেইরকম রমণী এই পাঞ্চালী কৃষ্ণা, আমিও তাঁকেই এবার পণ রাখছি- তয়ৈবংবিধয়া রাজন্ পাঞ্চাল্যাহং সমুধ্যয়া।

যুধিষ্ঠিরের মুখে আপন স্ত্রীর এই বর্ণনা অবধারিতভাবে একধরনের পণ্যতা তৈরি করে, যা এখনকার দিনের প্রগতি-তাত্ত্বিকেরা খুব কড়া করেই ধরবেন, যদিও মহাকাব্যের সামগ্রিকতায় আমরা এখানে নারীকে পণ্য করে তোলা হয়েছে এবং যুধিষ্ঠির এই পৌরুষের জন্য দায়ী এক প্রতিভূ পুরুষ– এই তাত্ত্বিকতার ওপর আমরা জোর দিই না। কেননা পাশাখেলার নেশায় যুধিষ্ঠির এখানে তার পুরুষভাইদের এমনকী নিজেকেও পণ্য করেছেন এবং সেই পণ্যতার ক্ষেত্রেও প্রত্যেকটি ভাইয়ের বিশেষ বিশেষ গুণবর্ণনা আছে। বরঞ্চ মহাকাব্যের পরম্পরা বিচারে এখানে পাশাখেলার মতো এক কামজ ব্যসনের নেশায় মানুষ যে প্রিয়তমা স্ত্রীকেও পণ্য করে তোলে– ঋগবেদের অক্ষসূক্তের সেই দুর্ভাগা পুরুষটিই যে এখানে যুধিষ্ঠিরের আকারে আছেন, সেই বৈদিক পরম্পরাই এখানে পণ্যতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। বিশেষত যুধিষ্ঠিরের মতো সদাশয় মানুষও যে অক্ষক্রীড়ার নেশায় এমন হিতাহিতজ্ঞানশূন্য মোহচালিত হয়ে পড়েন, যাতে নিজের ভাই এবং স্ত্রীকেও পণ্য করে ফেলতে দ্বিধা করছেন না, মহাশয়তার এই পতনই কিন্তু এখানে মহাকাব্যের ভিত তৈরি করেছে। এই যে মহবিভ্রম এবং মহতের বিভ্রম– এটাই মহাকাব্যের সৃষ্টি-নিদান হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলেই মহাভারতে যুধিষ্ঠিরের এই বিভ্রম বোঝানোর জন্য রামায়ণে সীতার কথায় রামচন্দ্রের সোনার হরিণের পিছনে ধাওয়া করার বিভ্রমটাকে উদাহরণ হিসেবে টানা হয়। যুধিষ্ঠিরকে বোঝানো হয়– মহারাজ! দুঃখ করবেন না, মহাশয় মানুষেরও ঈদৃশ পরিণতি ঘটে– প্রায়ঃ সমাসন্ন-বিপত্তিকালে ধিয়োহপি পুংসাং মলিনীভবন্তি।

আমরা তাই দ্রৌপদীকে পণ্য করে তোলার ব্যাপারটা যত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, তার চেয়ে অনেক বেশি চমৎকার মনে করি তার লড়াই করার তেজস্বিতা। যে-মুহূর্তে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে পণ রাখলেন, সেই মুহূর্তে সভাস্থলে ধিক্কারধ্বনি শোনা গেল তার উদ্দেশে, কুরুসভার বৃদ্ধরা এবং সভ্যেরা ধিক ধিক করতে লাগলেন, সমস্ত সভায় আলোড়ন তৈরি হয়ে গেল ওই একটি পণ্যতার বাক্যে। ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপা ঘামতে লাগলেন, বিদুর দু’হাতে নিজের মাথার চুল ধরে মাথা টিপে চোখ নিচু করে রইলেন। বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র স্নেহান্ধতায় পাগলপ্রায় বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন– জিতেছে কি? শকুনি জিতেছে এই দানটা? কর্ণ-দুঃশাসন-রা উত্তাল হাসছেন পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের বোকামি দেখে, ভদ্রলোকদের চোখের জল গড়িয়ে পড়ল লজ্জায় এরই মধ্যে শকুনি ঘোষণা করলেন– এই আমি জিতলাম তোমার দান–জিতমিত্যেব।

এই সমস্ত আলোড়ন, বিক্ষেপ, আক্ষেপের মূল কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু দ্রৌপদী, পাণ্ডবদের কুলবধূ– তাঁকে পাশার দানে, পণ্যতায় কলুষিত করেছেন যুধিষ্ঠির। এবং শুধু তাকেই জিতে নেবার অপেক্ষা ছিল এতক্ষণ। ধন-সম্পত্তি নয়, রাজ্যপাট নয়, অন্যান্য শক্তিধর পাণ্ডব ভাইদের দাসে পরিণত করে নিয়েও পাশাখেলার পরিণতি আসেনি। ভূতাবিষ্ট যুধিষ্ঠিরের মনে ছিল না দ্রৌপদীর কথা, তাকে মনে করিয়ে দিতে হয়েছে মানেই দ্রৌপদী সেই চরম পণ যাঁকে না হলে কৌরবপক্ষের প্রাপ্তি সম্পূর্ণ হয় না। কৌরবদের দিক থেকে দ্রৌপদীর অপ্রাপ্যতার অনুমান কতখানি, তা বোঝা যায় তাদের পরবর্তী মুহূর্তের প্রতিক্রিয়ায়। যে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিটি পাশাখেলার প্রক্রিয়ায় বাধা দিয়েছিলেন, সেই বিদুর যখন স্থাণুর মতো মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, দুর্যোধন সেই বিদুরকে দাসীপুত্র বলে সম্বোধন করে বললেন- এই যে ক্ষত্তা বিদুর! এদিকে এসো এবার, নিয়ে এসো এখানে পাণ্ডবদের সোহাগী বউটাকে এহি ক্ষদ্ভদ্ৰৌপদীমানয়স্ব। প্রিয়াং ভার্যাং সম্মতাং পাণ্ডবানাম। সে এখানে এসে আমাদের ঘরদোর ঝাড় দিক, তারপর অন্তঃপুরে আমাদের দাসীদের সঙ্গেই তার থাকার ব্যবস্থা হবে।

মহাভারতীয় প্রাচীনকালে ‘দাসী’-শব্দটার মধ্যে কিন্তু অনেক ইঙ্গিত আছে। দুর্যোধন যতই ওপর ওপর বলুন যে, ঘরদোর সাফসুতরো করার জন্য দ্রৌপদীকে নিয়ে এসো। এখানে, তবুও এটা একেবারেই বহিরঙ্গ আহ্বান। সেকালে দাসীত্বের মধ্যে এক ধরনের পুরুষভোগ্যতার ইঙ্গিত ছিল, দাসী অনেক ক্ষেত্রেই ভোগ্যা, এমনকী পাটরানির পরিবর্ত হিসেবেও সাময়িকভাবে দাসীরা ব্যবহৃত হয়েছেন, এমন উদাহরণ মহাভারতেই অনেক আছে। অতএব দুর্যোধন যে শুধুমাত্র ঘরদোর পরিষ্কার করার জন্য দ্রৌপদীকে ডাকছেন না, সেটা অন্যেরা যেমন দ্রৌপদীকে পণ রাখার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝেছিলেন, তেমনই মহামতি বিদুর সেটা আরও বেশি বুঝতে পারছেন দ্রৌপদী পণজিত হবার পর। আর ঠিক এতটা বুঝেছেন বলেই বিদুর দ্রৌপদীকে আপ্রাণ মুক্ত করার জন্য চেঁচিয়ে বললেন– এটা হতেই পারে না, দুর্যোধন! এটা হতেই পারে না। কৃষ্ণা পাঞ্চালী কখনও এইভাবে দাসী হতে পারেন না– ন হি দাসীত্বমাপন্না কৃষ্ণা ভবিতুমর্হতি। বিদুর এবার সেই আইনের প্রশ্ন তুলে দিলেন, যাতে বিদুর বুঝিয়ে দিতে পারেন যে, দুর্যোধনের কোনও নৈতিক অধিকারই নেই দ্রৌপদীকে সভাস্থলে আনার। তিনি বললেন– যুধিষ্ঠির আগে নিজেকেই পণে হেরে বসেছেন, এই অবস্থায় দ্রৌপদীর স্বামিত্বের অধিকারই তার থাকে না, অতএব তিনি দ্রৌপদীকে পণই রাখতে পারেন না– অনীশেন হি রাজ্ঞৈষা পণে ন্যস্তেতি মে মতিঃ। কিন্তু তবু যদি আইনের ধারে না গিয়ে তুমি দ্রৌপদীকে নিয়ে টানা-হাচড়া করো, তা হলে তোমাকে সেই ছাগলের গল্পটা বলতে হয়। সেই যে এক মাছ-ধরা জেলে মাছ ধরার বঁড়শিতে খানিক ভাতের গুলি দিয়ে টোপ লাগিয়ে রেখেছিল। জেলের অনুপস্থিতিতে হঠাৎই এক ছাগল এসে সেই টোপশুদ্ধ বঁড়শিটা গিলে নিল। ওদিকে সুতোর টান পড়তেই বঁড়শি মুখ থেকে বার করতে গিয়ে পিছনের দুই পা দিয়ে লাফাতে লাফাতে নিজের মুখটাই ঢুকতে লাগল মাটিতে। ফলে তার গলা কেটে রক্ত পড়তে লাগল। মনে রেখো দুর্যোধন! এই দ্রৌপদী কিন্তু তোমাদের গলার কাঁটা বঁড়শি, যার সুতোটা কিন্তু পাণ্ডবদের হাতে, তুমি কিন্তু মরবে দুর্যোধন! ওই ছাগলের মতো– টীকাকার নীলকণ্ঠ লিখেছেন এবং বঁড়শিস্থানীয়াং দ্রৌপদীং স্পৃশন ছাগ ই ত্বমপি নংক্ষ্যতীতি ভাবঃ।

বিদুর আইনি প্রশ্ন তুলে কড়া ভাষায় দুর্যোধনের সমালোচনা করতেই দুর্যোধন এড়িয়ে গেলেন তাকে। ঘটনা কিংবা কথাবার্তা অন্যদিকে ঘুরে যাবার আগেই বিদুরের প্রশ্ন এড়িয়ে দুর্যোধন সারথি জাতের একটি লোককে তার নাম প্রতিকামী তাকে বললেন দ্রৌপদীকে অন্তঃপুর থেকে ধরে আনতে। দুর্যোধন বললেন– এই বিদুর-ব্যাটা পাণ্ডবদের ভয়ে উলটো-পালটা বকছে। তুমি যাও, নিয়ে এসো দ্রৌপদীকে, তোমার কোনও ভয় নেই।

প্রাতিকামী চলল দুর্যোধনের আদেশ পালন করতে। সিংহের গুহায় ঢোকা কুকুরের মতো প্রাতিকামী পাণ্ডবদের প্রিয়া মহিষীকে বলল– যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় মত্ত, মহারাজ দুর্যোধন তোমায় জিতে নিয়েছেন, দ্রৌপদী! তুমি চল এখন ধৃতরাষ্ট্রের ঘরের কাজে নিযুক্ত হবে।- নয়ামি ত্বাং কর্মণে যাজ্ঞসেনি। দ্রৌপদীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। “এ তুমি কী বলছ প্রাতিকামী?”–দ্রৌপদী বললেন। সীতা-সাবিত্রীর আদর্শ তাঁর চলে না, অতএব তাঁর বক্তব্যে কোনও স্বামী-সোহাগ নেই। সোজা বললেন– রাজার ঘরের কোনও ভদ্র ছেলে বউকে পণ রেখে পাশা খেলে? পাশা খেলায় মজে গিয়ে রাজার যুক্তি বুদ্ধি সব গেছে, নইলে পণ রাখার মতো জিনিস আর কি কিছু ছিল না? প্রতিকামী বলল—থাকবে না কেন? ধন সম্পত্তি তার আগেই গেছে। তারপর ভাইদের বাজি রেখেছিলেন, তারপর নিজেকে, অবশেষে তোমাকে। দ্রৌপদী বললেন– ওরে সারথির পো, তুই আগে গিয়ে জুয়াড়িকে জিজ্ঞাসা কর যে, সে আগে নিজেকে বাজি রেখে হেরেছে, না, আগে আমাকে বাজি রেখে হেরেছে?

এই বিপন্ন মুহূর্তে এর থেকে ভাল জবাব আর কিছু হতে পারে না। দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের অধিকারের প্রশ্ন তুলেছেন। কোন অধিকারে, কার অধীশ্বর ভেবে ধর্মরাজ দ্রৌপদীকে বাজি ধরেছেন– কস্যেশো নঃ পরাজৈষীরিতি জ্বামাহ দ্রৌপদী। প্রাতিকামী যুধিষ্ঠিরকেই দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দিতে বলেছেন সবার সামনে। অর্থাৎ ভারতবর্ষের চিরন্তনী স্ত্রীবৃত্তি নিয়ে তিনি মাথা ঘামাচ্ছেন না। স্বামী অন্যায় করলেও তার বিরুদ্ধতা করে কথা বলা যাবে না– অন্তত এটা হচ্ছে না দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে। প্রাতিকামীর মাধ্যমেও দ্রৌপদী কিন্তু এখনও দুর্যোধনের সঙ্গে কথা বলছেন না। বিদুরের কথা তিনি শোনেননি, কিন্তু তিনি বিদুরের মতোই এই মুহূর্তে আত্মরক্ষার জন্য যুধিষ্ঠিরের স্বামিত্বের অধিকার খারিজ করে দিয়ে তার কাছেই প্রশ্ন তুলছেন–তুমি আগে নিজেকে বাজি রেখে হেরেছ, নাকি তোমার হারার পরে আমাকে বাজি রেখেছ কিছু পূর্বং পরাজৈষীরাত্মানম্ অথবা নু মাম। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর এই প্রশ্ন শুনে প্রাণহীন অচৈতন্য পুরুষের মতো বসেছিলেন, প্রতিকামী সূতকে ভাল-মন্দ, ঠিক-বেঠিক একটা কথারও উত্তর দিতে পারেননি– বচনং সাধ্বসাধু বা। কিন্তু নিজের প্রয়োজনে দুর্যোধনই প্রাতিকামীকে বললেন– তা এত সব বড় বড় প্রশ্নের উত্তর দ্রৌপদী এই সভায় এসেই করুক না, যদি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গেই তার এত কথা থাকে, তো সে-সব কথা এখানেই হোক, অন্যেরাও শুনুক তাদের কথা–ইহৈব সর্বে শৃথন্তু তস্যাশ্চৈতস্য যদ্বচঃ।

প্রাতিকামীও দুর্যোধনের অন্যায় বুঝে এবং তদুপরি তার অন্যায় আদেশ শুনে মোটেই খুশি হল না। সে ব্যথিতচিত্তে আবারও দ্রৌপদীর কাছে গেল এবং বলল– রাজনন্দিনী! ওরা আপনাকে সভায় গিয়ে যা বলার বলতে বলছে। ওদের সর্বনাশের সময় এসে গেছে, নইলে এমন করে বড় মানুষের সম্মান নষ্ট করে মনে প্রাপ্তঃ সংক্ষয়ঃ কৌরবাণাম। প্রাতিকামীর মুখে সভা-নিয়ন্ত্রকের আদেশ শুনেও মনস্বিনী দ্রৌপদী প্রাতিকামীর সমব্যথার সুযোগ নিয়ে অসম্ভব সুন্দর একটা উত্তর দিলেন। দ্রৌপদী বললেন– বিধাতার বিধান কে খণ্ডাবে বলো- এবং নূনং ব্যদধাৎ সংবিধাতা! তিনি নিশ্চয়ই এইরকম করেছেন যে, পণ্ডিত এবং মূর্খ দুই ধরনের মানুষই ধর্ম এবং অধর্মকে কোনও না কোনও সময় স্পর্শ করে। ভাবটা এই– যুধিষ্ঠির এবং দুর্যোধন দু’জনেই এখন অধর্মকে স্পর্শ করে আছেন। কিন্তু ধর্মাধর্মের দ্বৈরথে পণ্ডিতরা তো ধর্মকেই বড় বলে মানেন। এখন সেই ধর্মটা যেন কৌরবদের ছেড়ে না যায়। তুমি তাই আবারও গিয়ে রাজসভার সভ্যদের আমার আগের প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করো। তাঁরা যা বলবেন, তাই আমি করব।

প্রাতিকামী আবারও রাজসভায় গিয়ে দ্রৌপদীর কথা বলল, কিন্তু কাজ কিছু হল না, রাজসভার বিচক্ষণ এবং বৃদ্ধ সভ্যেরাও দুর্যোধনের অন্যায় অভীষ্ট মাথায় রেখেই কথা না বলে মাথা নিচু করে রইলেন– অধোমুখাস্তে ন চ কিঞ্চিদূচু। নিবন্ধং তং ধার্তরাষ্ট্রস্য বুদ্ধা। আসলে দুষ্ট রাজনীতির পরিণতিতে একেশ্বরতার একমুখীন প্রবৃত্তি এই ধরনের বিপত্তি তৈরি করে। দুর্যোধন কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের সোপান বেয়ে এই রাজনীতির মাথায় উঠেছেন, সেখানে ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপ-বিদুরেরাও অপ্রত্যক্ষে জড়িত, কিন্তু আজ তিনি দুষ্টতার এমন আবর্ত তৈরি করেছেন শুধু নিজেদের লোক নিয়ে যারা যখন-তখন সম্মানিতের মুখের ওপরেও অপমান-শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। বাধা পেলেই তারা অপমান করতে ছাড়ে না বলেই সেখানে দুষ্ট রাজনীতির প্রতিক্রিয়া এইরকমই হয় যে, সকলের বাক্য স্তব্ধ থাকে, তারা অধোবদনে শুধু দেখতে বাধ্য হন। এখানেও তাই হয়েছে। যেহেতু দুর্যোধনের ইচ্ছে, অতএব কুরুকুলের সভাসদরা নিজেদের মান বাঁচাতে অধোমুখে বসে থাকাটাই বেশি সুবিধের মনে করলেন।

ওদিকে যুধিষ্ঠিরের তো মাথাটাই কাজ করছে না। তিনি এটা বুঝে গেছেন যে, দুর্যোধন পাণ্ডব-কুলবধূ দ্রৌপদীকে রাজসভায় এনেই ছাড়বে এবং এখানে আইনি প্যাঁচ দেখিয়ে কোনও লাভ হবে না। তাই সকলের অলক্ষ্যে একজন বিশ্বস্ত দূতের মাধ্যমে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বলে পাঠালেন তিনি যেন সভায় আসেন যে অবস্থায় তিনি আছেন, যে কাপড় পরে আছেন, সেই কাপড় পরেই, একবস্ত্রা, অন্য আচ্ছাদনহীন। পরনের কাপড়টি নাভিদেশ থেকে একটু নীচে বেঁধে তিনি যেন শ্বশুর ধৃতরাষ্ট্রের সামনে আসেন কাঁদতে কাঁদতে– একবস্ত্রা ত্বধোনীবী রোদমানা রজস্বলা। যাঁর তখন এমনিতেই ক্রোধে ক্রন্দন করতে ইচ্ছা হচ্ছে, সেই দ্রৌপদীকে কান্নার অভিনয় করতে উপদেশ দিচ্ছেন ধর্মপুত্র। যে সংযম তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ছিল, সেই সংযম তো তিনি আগেই হারিয়েছেন, এখন তিনি ভীত-বিহ্বল হয়ে দ্রৌপদীর অসহায়তাকে ব্যবহার করতে বলছেন শ্বশুর-প্রতিম ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। এখনও তিনি সরলভাবে ভাবছেন অন্তত ধৃতরাষ্ট্র এই অন্যায়ের প্রতিকার করবেন।

কিন্তু অসহায়তাকে ব্যবহার করা, বিশেষত নারীর অসহায়তা, অথবা নারীত্ব ব্যবহার করে স্বকার্য উদ্ধার করা– তাও আবার অন্ধ শ্বশুরের সামনে, যেখানে কথা বলার প্রয়োজন হবে সবচেয়ে বেশি, দ্রৌপদী সেখানে পুত্রবধূর মতো ন্যুজ হয়ে ওঠার পাঠ কোনও দিন শেখেননি। যুধিষ্ঠিরের সেই দূত কী ধরনের যৌধিষ্ঠিরী বার্তা দ্রৌপদীকে দিতে পারল জানি না, কিন্তু দুর্যোধনও পুনরায় একই কথা প্রাতিকামীকে বললেন- তুমি এখানে তাকে নিয়ে এসো, প্রতিকামী! তার সামনেই কৌরবেরা জবাব দেবে– ইহৈবৈমানয় প্রতিকামিন। প্রত্যক্ষমস্যাঃ কুরবো ক্ৰবন্তু। প্রাতিকামী লোকটা দুর্যোধনের আজ্ঞাদাস হলেও সে কিন্তু দ্রৌপদীর ক্রোধ অনুমান করেও একটু ভীত হচ্ছিল– ভীতশ্চ কোপাদ দ্রুপদাত্মজায়াঃ বিশেষত দুর্যোধনের ইচ্ছেটা তাঁর মনঃপূত ছিল না বলেই, সে যেন একটু ঠ্যাটা লোকের মতোই সভাসদদের দিকে তাকিয়ে বলল– তা হলে কৃষ্ণা পাঞ্চালীকে আমি কী বলব– সভ্যানুবাচ কৃষ্ণাং কিমহং ব্রবীমি?

মুহূর্তের মধ্যে দুর্যোধন বুঝে ফেললেন– এই লোকটিকে দিয়ে হবে না, আরও নির্মম এবং আরও স্থূল কোনও মানুষ লাগবে যে রমণীর রমণীয়তা, অথবা মনস্বিনীর বিদগ্ধতা বোঝে না। তিনি দুঃশাসনকে আদেশ দিলেন–তুমি নিজে গিয়ে, ধরে নিয়ে এসো যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীকে স্বয়ং প্রগৃহ্যানয় যাজ্ঞসেনীম। দুর্যোধনের আদেশে দুঃশাসন গেলেন এবার দ্রৌপদীকে ধরে আনতে। তার চোখ লাল, নিজের ওপরে তার কোনও শাসন নেই– সেই দুঃশাসন গিয়ে খলনায়কের মতো দ্রৌপদীকে বললেন– এস গো, এস এস! তোমায় আমরা জিতে নিয়েছি! লজ্জা কীসের সুন্দরী! একবার দুর্যোধনের দিকে তাকাও- এহ্যেহি পাঞ্চালি জিতাসি কৃষ্ণে। দুর্যোধনং পশ্য বিমুক্তলজ্জা। এবার পাণ্ডবদের ছেড়ে কৌরবদের আত্মদান কর– কুরূ ভজস্বায়ত-পদ্মনেত্রে। দ্রৌপদী রাজবালা, এসব শোনা তাঁর অভ্যাস নেই। বিবর্ণা, হাতে মুখ ঢেকে কেবল পিছু হঠছেন, পিছু হঠতে হঠতে তিনি সেইখানে এসে উপস্থিত হলেন, যেখানে বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রীরা ছিলেন– যতঃ স্ত্রিয়স্তা বৃদ্ধস্য রাজ্ঞঃ কুরুপুঙ্গবস্য। টীকাকার কেউ কেউ এই মহাভারতীয় বচন শুনেই বলে উঠেছেন যে, দ্রৌপদী যখন ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রীদের ঘরে এসেছেন সেখানে গান্ধারী ছাড়া ধৃতরাষ্ট্রের অন্য স্ত্রীরা ছিলেন, গান্ধারী সেখানে ছিলেন না। আমরা বলব– গান্ধারীও সেখানে থাকতে পারেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই ছেলেদের কুকর্মের গতি তিনি রোধ করতে পারেননি, বা রোধ করা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। তা ছাড়া এত বড় একটা ঘটনা ঘটছে, অথচ তিনি সম্পূর্ণ অনবহিত, এটাও কি সম্ভব! মোট কথা, কুরুস্ত্রীদের মধ্যেও তার আশ্রয় মিলল না। দুঃশাসন এবার তার চুলে হাত দিল। যে চুল একদিন রাজসুয়ের যজ্ঞজলে অভিষিক্ত হয়েছিল, যে চুলের মধ্যে রাজেন্দ্রাণী হবার জল্পনা মেশানো ছিল, দুঃশাসন সেই চুলে হাত দিল। পাঁচ স্বামীর সাহচর্যে নাথবতী হয়েও অনাথের মতো কাঁদতে কাঁদতে দ্রৌপদী বললেন– ছোটলোক, অনার্য! রজস্বলা অবস্থায় এক কাপড়ে বসে আছি আমি৷ এ অবস্থায় আমাকে তুমি সভার মধ্যে নিয়ে যেতে পার না। মুখে খল হাসি হেসে দুঃশাসন বলল- তুমি রজস্বলাই হও আর এক কাপেড়েই থাক অথবা গায়ের কাপড় গায়ে নাই থাকুক- রজস্বলা বা ভব যাজ্ঞসেনি একাম্বরা বাপথবা বিবস্ত্রা– সভায় তোমাকে যেতেই হবে। তুমি আমাদের কেনা বাঁদী, আমরা যেমন খুশি ব্যবহার করব। আর তুমিও আমাদের নিশ্চিন্ত সুখে যেমন খুশি কামনা করতে পার– দূতে জিতা চাসি কৃতাসি দাসী। সা কাময়াম্মাংশ্চ যথোপজোষ। দুঃশাসনের টানাটানিতে দ্রৌপদীর কৃষ্ণকুঞ্চিত কেশরাশি খসে এলিয়ে পড়েছিল, পরিধানের বসন অর্ধ-বিগলিত প্রায়। দ্রৌপদী তবুও চেঁচিয়ে বললেন- যেসভায় বড় বড় সম্মানিত মানুষ বসে আছেন; বসে আছেন আমার গুরুজনেরা, সেখানে এইভাবে আমি দড়াব কী করে তেষামগ্রে নোৎসহে স্থাতুমেবম্।

এমন ঘোর এই বিমাননার মধ্যেও দ্রৌপদী কিন্তু এখনও তার স্বামীদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ভরসা হারিয়ে ফেলেননি। এমনকী যে যুধিষ্ঠির– যাঁকে সকলেই এই মুহূর্তে ঘৃণ্য অন্যায়ী মনে করছে, তার সম্বন্ধে এখনও তার বহুমান আছে, তবে এমনও হতে পারে যে, যুধিষ্ঠির যেহেতু নিজে পণজিত হয়ে তবে তাকে বাজি রেখেছিলেন– এই ঘটনাটা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তার মুখে এখনও প্রশংসা ভেসে আসছে যুধিষ্ঠিরের জন্য। দ্রৌপদী বললেন– অসভ্য কোথাকার! অনার্যবৃত্ত! তুই এইভাবে আমাকে প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় সভায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করিস না। মনে রাখিস, দেবতারাও যদি তোর সহায় হয়, তবুও আমার রাজপুতুর স্বামীরা তোদের ছেড়ে দেবে না। আর ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের কথা বলি, ধর্মের দিকে তার সতত দৃষ্টি আছে। ধর্মের গতি সূক্ষ্ম বলেই তাকে সহজে বোঝা মুশকিল। আমি এখনও মনে করি যে, আমার সেই ধার্মিক স্বামীর গুণগুলি না দেখে, তার সামান্য দোষের কথাটা খুব বড় করে প্রকট করে তোলাটা ঠিক হবে না– বাঁচাপি ভর্তুঃ পরমাণুমাত্র/ ইচ্ছামি দোষং ন গুণান। বিসৃজ্য।

এ-কথা শুনে অনেক পণ্ডিতজনের মনে হয়েছে যে, যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্রৌপদীর সরসতা অন্য পাণ্ডব স্বামীদের চাইতে বেশি। কিন্তু আমাদের মনে হয়– দ্রৌপদী এত সোজা সরল কথা বলছেন না এখানে। পরবর্তী সময়ে এটা তার যুক্তি হবে যে, যুধিষ্ঠির সত্যিই তো নিজের ইচ্ছেয় পাশা খেলতে আসেননি এবং তার সঙ্গে খেলায় ছলনার আশ্রয়ও নেওয়া হয়েছে, সেখানে যুধিষ্ঠিরের মতো সরলবুদ্ধি মানুষকে দোষ দিলে চলবে কেন? বস্তুত এখানে তার মুখে যুধিষ্ঠিরের প্রশংসা অনেকটা নিজেকে বাঁচানোর জন্যই। দুঃশাসন ততক্ষণে কৃষ্ণা পাঞ্চালীর চুল ধরে তাঁকে সভায় এনে ফেলেছেন। এই বিকট অভদ্রতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের প্রশংসা করে তাকে যেন আরও লজ্জায় ফেলে দিলেন। অন্যদিকে দুঃশাসনের অসভ্যতা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি রাজসভার সভ্য এবং বৃদ্ধজনদের উদ্দেশ করে বললেন আমাকে রজস্বলা অবস্থায় এমন বিপরীত বেশে টেনে আনা হল, অথচ কেউ এখানে একবার এই লোকটার সম্বন্ধে নিন্দা পর্যন্ত করছে না, তা হলে কি এটাই ধরে নেব যে, দুঃশাসন যা করছে, তাতে আপনাদের মত আছে, মশায়রা–ন চাপি কশ্চিৎ কুরুতে কুৎসাং/ ধ্রুবং ত্বদীয়ো মতমভূপেতঃ। আর আমি এই বিখ্যাত ভরতবংশীয় ক্ষত্রিয় পুরুষদের কোন অধঃপতন দেখছি! এই যে পিতামহ ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, মহামতি বিদুর, আর আমাদের রাজা ধৃতরাষ্ট্র এঁদের শরীরে তো প্রাণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। থাকলে, এমন অধর্মের কাজটা তারা বসে বসে দেখছেন কী করে রাস্তথা হীনমধর্মমুগ্ৰং, ন লক্ষয়ন্তে কুরুবীরমুখ্যাঃ।

একটা কথা কিন্তু এখানে এই অর্ধপ্রসঙ্গেও জানিয়ে রাখা দরকার। নারীর ওপর পৌরুষেয় অত্যাচার কোনও নতুন কথা নয়, চিরকাল তা চলেছে আজও তা চলছে। কিন্তু ইতিহাসের মধ্যযুগে তো বটেই, এমনকী আজ থেকে একশো বছর আগেও যেভাবে অত্যাচারটা মুখ বুজে সহ্য করতে হত, আমরা বলব– তার চেয়ে অবস্থাটা অনেক বেশি ভাল ছিল মহাকাব্যের যুগে। দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে জঘন্য অন্যায় করেছেন যুধিষ্ঠির, তার স্বামী। অন্যায় করেছেন ঈর্ষাকাতর শত্ৰুজন– করবেনই, ঈর্ষাকাতর বলেই করেছেন, অপ্রাপ্য সুন্দরী রমণীকে পাবার জন্য করেছেন, শত্রুর স্ত্রী হবার কারণে করেছেন। কিন্তু একটাই এখানে বোঝার কথা– দ্রৌপদী মুখ বুজে সহ্য করছেন না। দুঃশাসনকে যেমন তীব্র ভাষায় তিনি ভর্ৎসনা করেছেন, তেমনই রাজসভায় সমাবিষ্ট মান্যগণ্য এবং বৃদ্ধ কুলপুরুষদেরও তো তিনি ছেড়ে কথা বলছেন না। আর তার স্বামীরা, ভাগ্যতাড়িত হয়ে এখন যাঁরা কিছুই করতে পারছেন না বা বলতেও পারছেন না, তাদের প্রতি তাঁর সক্রোধ সাভিমান রক্ত দৃষ্টিপাতই যথেষ্ট ছিল। দৃষ্টির অগ্নিপাতে তিনি অন্তরে ক্ষুব্ধ স্বামীদের পুড়িয়ে দিচ্ছিলেন যেন সা পাণ্ডবান্ কোপপরীতদেহান। সন্দীপয়ামাস কটাক্ষপাতৈঃ। কিন্তু এই দৃষ্টিপাতে অন্তরে ক্ষুব্ধ। হয়ে উঠলেও কিছু করার উপায় ছিল না বলে–মহাকাব্যের কবি মন্তব্য করেছেন- ধন সম্পত্তি, রাজ্যপাট, মণি-রত্ন হারিয়ে পাণ্ডবরা যত দুঃখ পেয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি দুঃখ পেলেন সেই বিপন্ন সময়ে দ্রৌপদীর লজ্জাকুল, ক্রোধ-বক্র দৃষ্টি দেখে– যথা এপাকোপ সমীরিতেন। কৃষ্ণাকটাক্ষেণ বভূব দুঃখ।

দুঃশাসনের যন্ত্রণায় দ্রৌপদী কাতর হয়ে তাকাচ্ছিলেন স্বামীদের দিকে। এই অবস্থায় দ্রৌপদীকে ধাক্কা মেরে চিৎকৃত হাসির মধ্যে দুঃশাসন বললেন দাসী, আমাদের দাসী– আধূয় বেগেন বিসংজ্ঞকল্পাম।উবাচ দাসীতি হসন্ সশব্দ। কথাটার মধ্যে যে নিকৃষ্ট ইঙ্গিত আছে– যা আমরা আগে বলেছিলাম, তা যেন সমর্থিত হল সম-সময়েই শকুনি আর কর্ণের হাসিতে। বস্তুত দুর্যোধন, কর্ণ আর শকুনি বেশ মজা পাচ্ছিলেন দ্রৌপদীকে দেখে দুঃশাসন যেভাবে তাকে দগ্ধে দগ্ধে অত্যাচার করছিলেন, যেভাবে তার নারীত্বের অবমাননা করছিলেন, এগুলি তাদের মর্ষকাম তৃপ্ত করছিল। আমাকে যারা কর্ণ-চরিত্রের মহত্ত্ব এবং মাহাত্ম সম্বন্ধে বারবার স্মরণ করিয়ে দেন, তাঁদের আমি এই জায়গাগুলো একটু স্মরণ করিয়ে দিই। দ্রৌপদীর দুর্গতি তৈরি করে দুঃশাসনের মতো নিরেট যেভাবে হাসছেন, কর্ণও ঠিক সেইভাবেই হাসছেন দ্রৌপদীকে দেখে বা তার প্রতি দাসী-শব্দের উচ্চারণ শুনে– কর্ণস্তু তবাক্যমতীব-হৃষ্টঃ। সম্পূজয়ামাস হসন সশব্দম। হয়তো বা এটা তার পূর্বকালের সেই স্বয়ংবর প্রতিক্রিয়া দ্রৌপদী তাকে সূতপুত্র বলে স্বামিত্বে বরণ করেননি।

দ্রৌপদীর চড়া বক্তব্য শুনেও রাজসভার সকলে নিশুপ হয়ে আছেন– এটা একেবারেই বেমানান হচ্ছে বুঝেই কুরুবৃদ্ধ পিতামহ একটু কথা বলবার চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু দুর্যোধন-দুঃশাসনদের ‘অ্যাটিটুড’ দেখে– এটাও হয়, ওটাও হয়– গোছের একটা উত্তর দিয়ে বললেন- যে জিনিসটার ওপর স্বত্ব নেই, অধিকার নেই, সেটা দিয়ে পণ রাখা যায় না। অন্যদিকে এটাও আবার ঠিক যে, স্ত্রীর ওপর স্বামীর একটা স্বত্ব আছে– অতএব এই দুই দিক বিবেচনা করে আমার খুব বিভ্রান্ত লাগছে। এখানে আইন বা বিচারের সূক্ষ্মতা এতটাই যে যথার্থ উত্তর দেওয়াটা খুব কঠিন। ভীষ্ম কিন্তু ঘটনার গতি-প্রকৃতিটা সঠিক বুঝিয়েই দিয়েছেন, কিন্তু তিনি মনে করেন– কথাটা যুধিষ্ঠিরেরই বলা উচিত। তাঁরই তো বলা উচিত যে, নিজেকে পণ রেখে হেরে যাবার পর দ্রৌপদীর ওপর তার স্বত্ব-স্বামিত্ব থাকে না কিছু এবং তিনি বাজি না ধরলেও শকুনি যে মতলব করে তাকে দিয়ে দ্রৌপদীর বাজিটা ধরিয়েছেন- এ-ব্যাপারে তো যুধিষ্ঠিরকেই মুখ খুলতে হবে। ফলে দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা তো সত্যিই কঠিন। অর্থাৎ কিনা যুধিষ্ঠির যদি শকুনির শঠতার কথাটা নিজমুখে না বলেন, তা হলে কী উত্তরই বা দেওয়া যায়–ন ধর্মসৌক্ষ্মাৎ সুভগে বিবেক্তৃং। শক্লোমি তে প্রশ্নমিদং যথাবৎ।

এটা তো চিরকালীন একটা প্রশ্ন যে, স্ত্রীর ওপর স্বামীর স্বত্ব আছে কিনা। এখনকার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য-ভাবনার নিরিখে স্ত্রীলোকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বেড়েছে, বিবাহিত স্বামীর ঘরে থাকলেও তার পৃথক ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি– তার অর্থ, তার শরীর, তার যৌনকর্তৃত্ব– সব কিছুই আইনিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার দিকে এগোচ্ছে। তবে মহাভারতের কালে এমনটা ছিল না– এই কথা বলে মহাভারতীয় সমাজকে অপমান করার চেয়ে যদি ঊনবিংশ/বিংশ শতাব্দীর অর্ধকাল পর্যন্ত সাহেব-সুবোদের প্রগতিশীল আইনের দিকে দেখি তবে সে আইনেও মহাভারতীয় যুগের চাইতে উন্নতি কিছু দেখতে পাইনি। সেখানে আমি তো দ্রৌপদীর প্রশ্নটাকেই সাংঘাতিক প্রগতিশীল মনে করি। তিনি অন্তত এটা বলেছেন যে, পরাজিত, পণজিত অবস্থায় যুধিষ্ঠিরের স্বত্ব আছে কিনা দ্রৌপদীর ওপর। ভীষ্ম উত্তর দিয়ে আরও বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন স্বত্ব না থাকলে সেটাকে বাজি রাখা যায় না। কিন্তু স্ত্রীর ওপরে স্বামীর স্বত্ব আছে, সেই নিরিখে যুধিষ্ঠিরের কিছু অধিকার আছে।

কিন্তু লক্ষণীয়, যুধিষ্ঠিরকে অনেক খোঁচানো সত্ত্বেও যুধিষ্ঠির কোনও কথারই উত্তর দেননি। তাতে মনে হতে পারে নিজে পরাজিত হবার পর দ্রৌপদীর ওপর তার স্বত্ব নেই, অথচ বাজি ধরে চরম লজ্জায় পড়ে চুপ করে আছেন, অর্থাৎ কিনা দ্রৌপদী যে প্রশ্ন তুলেছেন, সেটা তিনি অন্যায় বলে মনে করছেন না। অথবা যেভাবে ঘটনা ঘটেছে-শকুনি তাকে দিয়ে প্রায় জোর করেই দ্রৌপদীকে বাজি ধরিয়েছেন– সে-কথাও এই সমুদ্যত তর্কমুখর দুর্যোধন-কর্ণদের মুখের ওপর আর বলে লাভ নেই, কারণ তারা নিজেরাই সকলে এখন দাসে পরিণত। কিন্তু সর্বশেষে মনে হয় তিনি এখন অনুতাপে এতটাই জর্জরিত এবং বিভ্রান্ত যে, ভাগ্যের ওপর সব কিছু ছেড়ে দিয়েছেন নাচার হয়ে, যার জন্য একেবারে অপ্রসঙ্গে গিয়ে অন্তত দ্রৌপদীকে বাঁচানোর জন্য তাকে নাটক করে কাঁদতে বলছেন শ্বশুর ধৃতরাষ্ট্রের সামনে।

দ্রৌপদী কিন্তু যুধিষ্ঠিরের ইচ্ছামতো চলেননি এবং ভীষ্মের কথার উত্তর দিয়ে তিনি বলেছেন– রাজা যুধিষ্ঠির তো নিজে এই পাশা খেলতে আসেননি। কতগুলো ঠগ, অসভ্য, কপট লোক তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। যুধিষ্ঠির পাশা খেলতে ভালবাসেন, এই পর্যন্ত। কিন্তু পাশাখেলা নিয়ে তিনি মাথা ঘামাননি কোনও দিন এবং এখানে পাশাখেলায় তার ইচ্ছে তৈরি করা হয়েছে, তা হলে কী করে বলি তিনি নিজের ইচ্ছেতে পাশা খেলতে এসেছেন? আর এই সরল-স্বভাব রাজা যুধিষ্ঠির বিপক্ষের শঠতা কিছু বুঝতে পারেননি, আর যখন বুঝেছেন ততক্ষণে তাকে পাশার পণে জয় করা হয়ে গেছে সদ্ভূয় সর্বৈশ্চ জিতোহপি স্মাৎ পশ্চাদয়ং কৈতবমভূপেতঃ। তা ছাড়া যুধিষ্ঠিরের কথা থাক, কুরুবংশীয়রা এই সভায় যাঁরা আছেন, তাদের যেমন নিজেদের ছেলেদের ওপর কর্তৃত্ব আছে, তেমনই পুত্রবধূদের ব্যাপারেও তাদের কর্তৃত্ব আছে, তারা আমার কথা পর্যালোচনা করে আমার প্রশ্নটার উত্তর দিন আমি কি পাশার পণে জিত হয়েছি– তিষ্ঠন্তি চেমে কুরবঃ সভায়াম। ঈশাঃ সুতানাঞ্চ তথা সুষাণাম্।

দ্রৌপদীর এই কথাটার মধ্যে একটা ঈঙ্গিত আছে। দ্রৌপদী বলেছেন- আপনাদের ছেলেদের ব্যাপারে যেমন আপনাদের কর্তৃত্ব আছে তেমনই কর্তৃত্ব আছে পুত্রবধূদের ব্যাপারেও। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যেটা হয় ছেলের ব্যাপারে মা-বাবা এবং গৃহগত গুরুজনেরা যতটা প্রশ্রয়-পরায়ণ হন, পুত্রবধূদের ব্যাপারে সেটা হন না। এখানে দুর্যোধন দুঃশাসনেরা যা করছেন, যে অসভ্যতা করছেন, সেখানে এতটুকুও প্রতিবাদ না করে প্রশ্রয় দেবার মধ্যেই যদি গুরুজনের কর্তৃত্ব নিহিত থাকে, তা হলে পুত্রবধূরা তাদের অত্যাচারের বলি হলে, সেখানেও গুরুজনের কর্তৃত্ব নির্বিশেষ হয়ে ওঠে। বাস্তবে তা উঠেছেও। গুরুজনেরা বসে বসে দ্রৌপদীর অপমান দেখছেন এবং দ্ৰৌপদী সঠিক প্রশ্ন করেও উত্তর পাচ্ছেন না। তিনি প্রশ্ন করছেন, অসহায়ভাবে কাঁদছেন এবং ততোধিক অসহায়ভাবে স্বামীদের দিকে দৃষ্টিপাত করছেন অবেক্ষমাণাম অসকৃৎ পতীংস্তান অথচ দুঃশাসন সকলকে অগ্রাহ্য করে তাকে গালাগালি দিয়ে যাচ্ছেন, কাপড় ধরে টানছেন এবং সেই টানাটানিতে দ্রৌপদীর উত্তমাঙ্গের উত্তরীয় বসনখানি খসে খসে পড়ছে– তাং কৃষ্যমাণাঞ্চ রজস্বলাঞ্চ/স্তোত্তরীয়া অতদমাণাম– যিনি অপমানের যোগ্য নন কখনও, তাঁকে অপমান করা হচ্ছে, অথচ সম্মানিত লোকেরা রাজসভায় বসে বসে সেই অপমান দেখছেন।

যুধিষ্ঠির দাসখত লিখে বসে থাকলেও ভীমসেনকে আর থামানো গেল না। দুঃশাসনের অসভ্যতা ক্রমে ক্রমে যে স্তরে পৌঁছেচ্ছিল, তাতে ভীমসেন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তিনি তিরস্কারের কথা সোচ্চারে বলতে আরম্ভ করলেন বটে, কিন্তু তিনি প্রথমে দুঃসাশনকে কিছুটি বললেন না। বললেন বড় দাদা যুধিষ্ঠিরকে, কেননা আজকে দ্রৌপদী এবং তাদের নিজেদের যত দুর্দশা তৈরি হয়েছে, তার মূল কারণ অবশ্যই যুধিষ্ঠির পাশাখেলায় তার দক্ষতা নেই, অথচ পাশা খেলতে ভালবাসেন। এই অবস্থায় গোঁ চেপে যাবার ফলে যুধিষ্ঠির নিজের ভাইদের তো বটেই এমনকী পঞ্চপাণ্ডবের স্ত্রী দ্রৌপদীকেও পণ রেখে বসলেন। দ্রৌপদী তো যুধিষ্ঠির ছাড়াও আর চার পাণ্ডবের স্ত্রী, তো অন্যের স্ত্রীকেই বা যুধিষ্ঠির পণ রাখেন কী করে? কথাটা আকারে-ইঙ্গিতে এবং সুকঠিন তিরস্কারে বলেই ফেললেন মধ্যম পাণ্ডব ভীম।

ভীম বললেন– জুয়াড়ি পাশাড়েদের ঘরে বেশ্যা থাকে বলে জানি। কিন্তু পাশার বাজি ধরার সময় তারা আপন মমতাবশে বেশ্যাদেরও বাজি রাখে না– বেশ্যাদের ওপরেও মায়া থাকে জুড়াড়ির মতো অধম লোকের ন তাভিরুত দীব্যন্তি দয়া চৈবাস্তি স্বপি৷ অথচ তোমার ধর্মোপনীতা স্ত্রীই শুধু নয়, দ্রৌপদী পাণ্ডবদের কুলবধূ, তাঁকেও বাজি রাখতে তোমার দ্বিধা হল না। তুমি অর্থ-সম্পদ সব হেরেছ, অস্ত্র-শস্ত্র-রথ-বাহন সব গেছে, এমনকী আমাদের রাজ্য, আমরা ভাইদের সব এবং তুমি নিজেকেও হেরে বসে আছ; হ্যাঁ, এর মধ্যে শত্রুদের ছলনাও আছে অনেক, কিন্তু তবু আমি এতে রেগে যাইনি, তখনও আমি মনে রেখেছি, তুমি আমাদের সকলের অধিকারী, প্রভু ন চ মে তত্র কোপোহভূৎ সর্বস্যেশো হি নো ভবান। কিন্তু এটা কী সাংঘাতিক অন্যায় করলে তুমি তুমি কুলস্ত্রী দ্রৌপদীকে পণ ধরলে শেষ পর্যন্ত। এটা এক অধম জুয়াড়ির থেকেও অধম কাজ যে, দ্রৌপদীর মতো এক রমণীও পণ্য হয়ে উঠলেন তোমার হাতে–ইমং ত্বতিক্রমং মন্যে দ্রৌপদী যত্র পণ্যতে।

ভীমের ভাষা খুব পরিষ্কার, তিরস্কারের অভিমুখও একমুখীন। ভীম বোঝাতে চাইলেন– যদি বাজি রাখার মতো কোনও সম্পত্তিও ভাবো দ্রৌপদীকে, তা হলেও বোঝা দরকার যে তুমি একা তার মালিক নও, যুধিষ্ঠির! ভীম বললেন– এই বেচারা তোমাকে একা বিয়ে করেনি, সমস্ত পাণ্ডবদের বীর স্বামী হিসেবে সে লাভ করেছে–এষা হনহতী বালা পাণ্ডবান্ প্রাপ্য কৌরবৈঃ- তো এতগুলো বীর স্বামী লাভ করার পরেও ক্ষুদ্র-নীচ কৌরবরা তাকে অপমান করার সুযোগ পায় কী করে? এই অপমান তাকে সইতে হচ্ছে শুধু তোমার জন্য ত্বকৃতে ক্লিশ্যতে ক্ষুদ্রৈশংসৈরকৃতাত্মভিঃ। সেইজন্যই ভীম বললেন– সেইজন্যই আর কারও ওপরে রাগ হচ্ছে না, রাগ হচ্ছে শুধু তোমার ওপরেই। আমি তোমাকে ছাড়ব না। যে হাতে জুয়ো খেলে তুমি দ্রৌপদীকে পাশার পণে বাজি রেখেছ, সেই হাত দুটোই আমি পুড়িয়ে দেব। কথাটা বলেই ভীমসেন কনিষ্ঠ সহদেবকে বললেন- সহদেব আগুন নিয়ে এসো তো, আজ এই যুধিষ্ঠিরের হাত দুটোই পুড়িয়ে দেব– বাহু তে সম্প্ৰধক্ষ্যামি সহদেব অগ্নিমানয়।

শত্রুপক্ষের লোকেদের সামনে ভীমের এই ভয়ংকর প্রয়াস তথা নিজেদের ঘরের কোন্দল বাইরে প্রকট না করার জন্য অর্জুন কোনও ক্রমে ভীমকে থামালেন বটে, কিন্তু এই বিপন্ন মুহূর্তেই বুঝি দ্রৌপদীর পাঁচ স্বামীকে চিনে নেবার সময়। লক্ষণীয়, যুধিষ্ঠির তাকে বাজি ধরে থাকলেও যতখানি রাগ তার ওপরে করা উচিত ছিল, তা কিন্তু দ্রৌপদী করেননি। এর একটা কারণ, তার ওপরে বেশি রাগ করলে তার হেরে যাওয়াটাও অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, যুধিষ্ঠিরকে এতদিনে যতটুকু চিনেছেন দ্রৌপদী, তাতে তার শৌর্য-বীর্য কোনওটা নিয়েই তার গর্ববোধ করার কিছু নেই। উপরন্তু যুধিষ্ঠিরের পরম প্রিয় যে ধর্মবোধ, সেটা নিয়েও তিনি বেশি মাথা ঘামান না। আর আজ তো সেই ধর্মস্থানও চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গেল। তার জ্যেষ্ঠ স্বামী ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির তাকে পাশার পণে আবদ্ধ করেছেন। এই সময়ে একবারও কি তার মনে হবে না সেই বিবাহকালের জটিলতা। যে সময়ে এক লজ্জানা স্বংয়বরবধূকে একবার মাত্র তার বিজেতা পুরুষের কাছে নিবেদন করেই যুধিষ্ঠির তার প্রত্যাখ্যান সানন্দে মেনে নিলেন এবং সকলে মিলে তাকালেন দ্রৌপদীর দিকে– দৃষ্টিং নিবেশয়ামাসুঃ পাঞ্চাল্যাং পাণ্ডুনন্দনাঃ– সেই পাণ্ডু-নন্দনদের মধ্যে যুধিষ্ঠিরও তো একজন। আপন বীরত্ব বা অক্ষমতায় কোনওভাবেই কি তার পক্ষে এই বীর্যশুল্কা রাজনন্দিনীকে পাওয়া সম্ভব ছিল? অথচ কত সহজেই না যুধিষ্ঠির শুধুমাত্র মাতৃ-আদেশ পালন করার সুবাদে পাঁচজনের গড্ডালিকায় দ্রৌপদীকে লাভ করলেন। এত সহজে পেলেন বলেই কি একদিনের পাশাখেলার মত্ততায় তিনি হেরে বসলেন দ্রৌপদীকে। এমন উদাসীন এক স্বামীকে দোষারোপ করেও তিনি তার গুরুত্ব বাড়াতে চান না। তিনি তাকে চিনে গেছেন।

কিন্তু নারীত্বের এই প্রলয়-মুহূর্তে সমস্ত প্রতিকূলতা মাথায় নিয়েও যে বৃকোদর স্বামীটি তার জ্যৈষ্ঠভ্রাতার অপকর্মের শাস্তি দিতে চাইছেন, তাকেও চিনতে পারছেন বা চিনে নিচ্ছেন দ্রৌপদী। এমনকী চিনে নিচ্ছেন তাকেও, যিনি অর্জুন, যিনি এক মুহূর্তে এই কুরুসভার সমস্ত বীরদের সঙ্গে এককভাবে যুদ্ধ করতে পারেন, সেই তিনি ভীমকে শান্ত করছেন যাতে শত্রুদের সামনে তাঁর সর্বজ্যেষ্ঠ ভ্রাতার এমন দুর্গতি না হয়। হয়তো এটাই শেষ পর্যন্ত হত, অর্জুন যদি ভীমের সমুদ্যত ক্রোধ শান্ত নাও করতেন, তবে হয়তো দ্রৌপদী নিজেই এ-কাজ করতেন। কেননা প্রায় কামী-স্বভাব শত্রুপক্ষের সামনেও তিনি সেদিন একথা বলছিলেন যে, আমি আমার পরম ধার্মিক স্বামীর গুণগুলি পরিহার করে তার অণুমাত্র দোষও আমি বাক্য দিয়ে উচ্চারণ করতে চাই না– বাঁচাপি ভর্তুঃ পরমাণুমাত্রম। ইচ্ছামি দোষং ন গুণা বিসৃজ্য! অতএব সহদেবকে আগুন নিয়ে আসার আদেশ দিলেও দ্রৌপদী তাঁর ‘নাতিকৃতপ্রযত্ন’ পাশাড়ে স্বামীটির দগ্ধহস্ত দেখে শত্রুকুলের আমোদিনী হয়ে উঠতেন না।

ভীমের উদ্যত ক্রোধ অর্জুন কিছুটা সামাল দিলেন বটে, কিন্তু সভাস্থলে দ্রৌপদীর অসহায়তা চরমে উঠল। দুঃশাসন তাকে ধরে টানাটানি করছেন, কৌরবরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছেন এবং উপস্থিত প্রধান বৃদ্ধরা এক্কেবারে চুপ। এই অবস্থায় বরফ ভেঙে কথা বলতে আরম্ভ করলেন বিকর্ণ, দুর্যোধনের ছোট ভাই। এটা হয়তো আশ্চর্যই ছিল, কেননা সমবেত কুরুবৃদ্ধ এবং আচার্যরা যেখানে এক্কেবারে চুপ করে আছেন, সেখানে দুর্যোধনের ঘরের লোক, তাঁর ছোট ভাই কথা বলছেন, এটা একেবারেই বিপরীত কথা। কিন্তু বিকর্ণের দিক থেকে এটা তার সমুজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব এবং নীতিবোধের প্রেরণাই বটে এবং এটা তিনি বুঝেছিলেন যে, বিদুর পূর্বাহ্নেই একবার দুর্যোধন-কর্ণের কথায় অপমানিত হয়েছেন, ভীষ্মদ্রোণ বুঝতে পারছেন– কথা বললেই তাঁরা অপমানিত হবেন– অতএব একেবারে যুবক সম্প্রদায়ের নীতি-নৈতিকতায় বিকর্ণ কথা বলতে আরম্ভ করলেন। দ্রৌপদীকে ধরে দুঃশাসনের টানাটানি তাঁর কাছে অসহ্য লাগছে। এমন ব্যক্তিত্বময়ী এক রমণীর এই চরম অসহায়তা তিনি মেনে নিতে পারলেন না বলেই কথা বলতে আরম্ভ করলেন তিনি কৃষ্যমানাঞ্চ পাঞ্চালীং বিকর্ণ ইদমব্রবীৎ।

আসলে বিকর্ণ যা বললেন, সেখানে দ্রৌপদীর বুদ্ধি এবং মনস্বিতাই বড় হয়ে ওঠে। অমন বিপন্ন মুহূর্তে ধর্মরাজ স্বামীর যুক্তি উড়িয়ে দিয়ে তিনি যা বলতে পেরেছিলেন, তার মধ্যে সারবত্তা ছিল বলেই বিকর্ণ তাঁকে সমর্থন না করে পারছেন না। মহাভারতের শব্দপ্রমাণে যা পাওয়া যায়, তাতে এ-কথা বলা যাবে না যে, চিরকাল অন্তরালে থেকে মুখ ফুটে কিছু না বললেও দ্রৌপদীর মতো ব্যক্তিত্বময়ী রমণীর প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধামিশ্রিত দুর্বলতা ছিল না আর কারও। কিন্তু শব্দপ্রমাণ এ-ব্যাপারে না থাকলেও অশব্দে এমন কোনও সম্রমানুরাগ তো থাকতেই পারে, তা নইলে দুর্যোধনের মতো ভীষণ কঠিন এক জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে, কর্ণের মতো সাহংকার এক কঠিন ব্যক্তিত্বের মুখোমুখি দ্রৌপদীকে তিনি সমর্থন করলেন কী করে। শুধুমাত্র মনস্বিনী এক নারীর যৌক্তিকতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিকর্ণ কথা বলছেন, এটার চেয়েও দ্রৌপদীর মতো এক সুন্দরী মনস্বিনীর দুর্বিপাক এবং অসহায়তা সহ্য করতে না পেরেই তিনি কথা বলছেন, এটাই বেশি যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। বিকর্ণের যুক্তি যথেষ্ট সংক্ষিপ্ত হলেও যথেষ্ট শাণিত। বিকর্ণ বললেন– দ্রৌপদী একটা প্রশ্ন করেছিলেন, আপনারা সেটার উত্তর দিন চাই না দিন, আমি কিন্তু সত্যটা বলবই। দ্রৌপদীর প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর দেওয়া আপনাদের উচিত ছিল; দেননি, সেটা অন্যায় হল। ভীষ্ম-ধৃতরাষ্ট্রের মতো বিরাট মানুষও কিছু বললেন না, বিদুরও বসে আছেন চুপ করে, দ্রোণ-কৃপের মুখেও কোনও উত্তর নেই। উপস্থিত রাজা-রাজড়াও তো কিছু বলতে পারেন, তারাও বলুন কিছু।

বিকর্ণের এত উত্তেজনা সত্ত্বেও কেউ কোনও কথা বললেন না। এতে বিকর্ণের আরও রাগ হল। রাগে দুই হাত ঘষতে ঘষতে বিকর্ণ বললেন– মৃগয়া, মদ্যপান, পাশাখেলা আর স্ত্রীসংসর্গ, এই চারটে রাজাদের কামজ ব্যসন। এগুলিতে আসক্ত হলে মানুষের নীতি ধর্মের সমস্ত চেতনা লুপ্ত হয়ে যায়। আর এই হতচেতন অবস্থায় মানুষ যে কাজটা করে বা যে কথাটা বলে, সেই কাজগুলিকে অকৃত বা করা হয়নি বলেই ধরে নেন বুদ্ধিমান, ধীমান ব্যক্তিরা। এখানে যে ঘটনা ঘটেছে তাতে মহামতি যুধিষ্ঠিরকে ধূর্ত পাশাড়েরাই খেলায় প্রবৃত্ত করেছে। অবশ্য পাশাখেলায় তার নিজেরও যথেষ্ট আসক্তি আছে। ফলে ঘটনাটা ঘটেই গেছে। কিন্তু তিনি পণটা ধরেছেন পাশাখেলায় প্রমত্ত অবস্থায় সমাহুতেন কিতবৈরাস্থিতো দ্রৌপদীপণঃ। বিকর্ণ বোঝাচ্ছেন- দূতাসক্ত যুধিষ্ঠির পাশাখেলার ঘোরে যেভাবে যে-অবস্থায় দ্রৌপদীকে পণ রেখেছেন, সেটাকে সত্য বলে না ধরাই ভাল, কেননা মদ কিংবা জুয়ায় মজে-থাকা মানুষের সব কাজটা সত্য নয়, সব কথাও তেমনই সত্য বলে। কেউ ধরে না– তথা যুক্তেন ন কৃতাং ক্রিয়াং লোকো ন মন্যতে।

বিকর্ণ এবার সেই প্রশ্ন তুললেন যা ভীম বলেছিলেন এবং দ্ৰৌপদী বলেছিলেন সূত্রাকারে। বিকর্ণ বললেন– দ্রৌপদী একা যুধিষ্ঠিরের স্ত্রী নন, তার ওপরে স্বত্ব-স্বামিত্ব আছে আর চার পাণ্ডবের সাধারণী চ সর্বেষাং পাণ্ডবানাম অনিন্দিতা। অন্য চার ভাইয়ের স্ত্রীকে তিনি একার ইচ্ছেতে পণ রাখতে পারেন না। সবচেয়ে বড় কথা, যিনি নিজেই নিজেকে আগে পণ রেখে বাজি হেরে বসে আছেন, তিনি অন্যকে পণ রাখবেন কোন এক্তিয়ারে? কিন্তু এই কাজটি তাকে করিয়েছেন শকুনি। তিনিই যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে পণ ধরানোর কালে দ্রৌপদীর কথা উল্লেখ করেছেন ইয়ঞ্চ কীর্তিতা কৃষ্ণা সৌবলেন পণার্থিনা। এই সমস্ত কথা বিচার করে দেখলে বোঝা যাবে যে, দ্রৌপদীকে পণ ধরে বাজি জিতে যাওয়াটা আইন অনুসারে মোটেই সিদ্ধ নয়।

বিকর্ণের যুক্তি-প্রতিযুক্তিতে রাজসভায় একটা আলোড়ন উঠে গেল বটে। অনেকেই বিকর্ণের প্রশংসা করতে লাগল এবং শকুনিকে নিন্দা করারও যুক্তি খুঁজে পেল। নিজেদের বেগতিক দেখে দুর্যোধনের বন্ধু কর্ণ এবার সভার হাল ধরলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন– এতক্ষণ তাদের নিজেদের অনুকূলে যে উত্তাপ তৈরি হয়েছে, তাকে ঝিমিয়ে পড়তে দিলে চলবে না। দ্রৌপদীর ব্যাপারে তার নিজের যে আক্রোশ ছিল, তা মেটাবার উপযুক্ততম সময়ও এটাই। কর্ণ বললেন– কেউ কোনও কথা বলছে না তুমি কেন এত কথা কও। এই দ্রৌপদী তো নিজেই তার প্রশ্নের জবাব চেয়েছে কতবার, এত বড় বড় লোক সব, কেউ তো একটা কথাও বলছে না, সেখানে তোমার মতো একটা বাচ্চা ছেলে– ছোট মুখে বড় বড় বড় কথা বলছ যদ্বীষি সভামধ্যে বালঃ স্থবিরভাষিতম্। কর্ণ কৌশল করে বললেন–তুমি দুর্যোধনের ছোট ভাই অথচ তুমি এত বোকা কেন বুঝি না। যুধিষ্ঠির সর্বস্ব বাজি রেখে পাশা খেলেছেন, দ্রৌপদী তো সেই সর্বস্বের মধ্যেই পড়ে, নাকি! তা ছাড়া যুধিষ্ঠির স্পষ্ট উচ্চারণে দ্রৌপদীর নাম করে বাজি ধরেছে, অন্য পাণ্ডবরাও সেখানে কোনও প্রতিরোধ শব্দ উচ্চারণ করেনি, তা হলে বলছ কেন বিকর্ণ যে, দ্রৌপদীকে আমরা জিতিনি।

কর্ণের পরবর্তী বক্তব্যটা ভয়ংকর এবং সেটা তিনি আগেও বলেছেন অন্যভাবে। তবে সেবারে প্রসঙ্গ ছিল দ্রৌপদী-স্বয়ংবরের পর পাঁচ স্বামীর সঙ্গে তার সম্বন্ধ ভাঙানো যায় কীভাবে, সেই ব্যাপারে। কর্ণ বলেছিলেন– ভাঙানো যাবে না দ্রৌপদীকে, কেননা একটি স্ত্রীলোকের কাছে বহু পুরুষের যৌনতা এমনিই যথেষ্ট আকাঙিক্ষত, আর সেটা যখন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বিধিসম্মতভাবেই হয়ে গেছে, সেখানে দ্রৌপদীকে ভাঙিয়ে আনা অসম্ভব। কথাটা আজও প্রায় একইভাবে বলেছেন কর্ণ, কিন্তু সেটা আরও বেশি জঘন্য এবং প্রশ্ন ওঠে এই কথাগুলি কর্ণের মুখ দিয়েই শুধু কেন বেরোয়। এবারে প্রসঙ্গটা– দ্রৌপদী রজস্বলা, এক বস্ত্রে আছেন বলে সভায় আসতে চাইছিলেন না। সেখানে দুঃশাসন আগেই তাকে শাসিয়ে বলেছিলেন, তুই এক কাপড়েই থাক, আর বিবস্ত্রাই হ, সভায় তোকে যেতেই হবে। দুঃশাসনের এই কথাকে বিকর্ণের প্রতিপ্রশ্নে সপ্রমাণ করে তুলছেন তিনি। কর্ণ বলেছেন– বৈদিক বিধি-নিয়ম অনুসারে মেয়েদের একটাই স্বামী থাকার কথা, সেখানে দ্রৌপদী যখন এতগুলি পুরুষের বশে আছে, সেটা তো বেশ্যার শামিল– ইয়ন্ত্রনেকবশগা বন্ধকীতি বিনিশ্চিতা। তা, একটা বেশ্যাকে কাপড় পরিয়েই আনি আর বিবস্ত্র অবস্থাতেই সভায় নিয়ে আসি, তাতে কোথায় কী আশ্চর্যের ব্যাপার হল– একাম্বরধরত্বং বাপথবাপি বিবস্ত্র!

দ্রৌপদীর সম্বন্ধে কথা বলতে গেলেই তার ব্যক্তিগত জীবনে বহুস্বামিকতার যৌনতা নিয়ে কথা-কটুক্তিটা কর্ণই সবচেয়ে বেশি করেছেন এবং এটা কেন করেছেন, কেন এই বিকার, সেটা একটা প্রশ্ন। এ-প্রশ্নের উত্তর সেই স্বয়ংবর সভায় লুকিয়ে আছে, যেখানে দ্রৌপদী কর্ণকে সূতপুত্র বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে শুধু সেই প্রত্যাখ্যানের প্রতিশোধ পূর্ণ করার জন্যই কর্ণ এই কথাগুলি বলেছিলেন, তা আমরা মনে করি না। আমাদের মনে হয়–দ্রৌপদীকে স্বয়ংবরে দেখার পর থেকেই তার ওপরে কর্ণের কিছু আকর্ষণ তৈরি। হয় এবং অভীপ্সিতা রমণীর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হলে, সেই রমণীর অপর-পুরুষভোগ্যতার কথায় স্বকীয় যৌনতার প্রতিফলনও ঘটে প্রতিপূরণও ঘটে। কর্ণের মুখেই তাই দ্রৌপদীর বিষয়ে এত বহুভোগ্যতার বাক্যরমণ তৈরি হয়, যা দুর্যোধন কিংবা দুঃশাসনের মুখে তেমন আসে না। নইলে দেখুন, যৌনতার এই বিপ্রতীপ পরিপুষ্টি ঘটছে বলেই দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ করার আদেশটাও কর্ণের মুখ থেকেই আসছে। দুর্যোধন, দুঃশাসন কেউ নন, কর্ণই দুঃশাসনকে আদেশ দিচ্ছেন– তুমি পাণ্ডবদের এবং দ্রৌপদীর কাপড়গুলো সব খুলে আনো–পাণ্ডবানাঞ্চ বাসাংসি দ্রৌপদ্যাশ্চ সমাহর।

পাণ্ডবদের সঙ্গে দ্রৌপদীরও বস্ত্র হরণ করো– এই আদেশের মধ্যে একটা সমান সম্বন্ধ তৈরি করা হলেও পাণ্ডবদের বস্ত্র বলতে তাদের সম্মান-মাহাত্মসূচক উত্তরীয় বস্ত্রই সংজ্ঞিত হয়, কিন্তু একবস্ত্রা দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে এই বার্থ কতটা ইঙ্গিত বহন করে? কর্ণের মানসিক সংস্কারের মধ্যে এই যে বিকার, সেটা অন্য কোথাও প্রকাশ পায়নি, অথচ তা শুধু দ্রৌপদীর প্রতি বাহিত বলেই আমাদের সন্দেহ হয় যে, কর্ণের কোনও প্রত্যাশা বাধিত হয়েছিল দ্রৌপদীর ব্যাপারে এবং সেখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এই প্রতিহিংসাময় আক্রোশ। কর্ণের আদেশ-মাত্রেই পাঁচ ভাই পাণ্ডব তাদের উত্তরীয় বসন উন্মুক্ত করে দিলেন এবং বসে পড়লেন নিজের জায়গায়। আর এদিকে দ্রৌপদী, যিনি হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন যুক্তি-প্রতিযুক্তির ভদ্রতা নিয়ে, তার দিকে এবার এগিয়ে গেলেন বশংবদ দুঃশাসন। তিনি জোর করে দ্রৌপদীর কাপড় ধরে টানাটানি আরম্ভ করে দিলেন ততো দুঃশাসনো রাজন দ্রৌপদ্যা বসনং বলাৎ।

দ্রৌপদীর এই বস্ত্রাকর্ষণের ব্যাপার নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বেশ একটু মতানৈক্য আছে এবং এই মতানৈক্য তৈরি হয়েছে মহাভারতের পাণ্ডুলিপিগুলির মধ্যে পাঠান্তর থাকায়। যেটা অনেকটাই বহুজন-সম্মত এবং প্রায় পরম্পরাগতভাবে যে পাঠ অনেক জায়গাতেই মেনে নেওয়া হয়েছে, সেটা হল– দুঃশাসন যেই অসভ্যের মতো দ্রৌপদীর কাপড় ধরে টানাটানি আরম্ভ করলেন, তখন দ্রৌপদী আর কোনও উপায় খুঁজে পেলেন না, তিনি আপন। বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য প্রার্থনা জানালেন ভগবান কৃষ্ণের কাছে। ভক্তিভরে উচ্চারণ করলেন দ্বারকাবাসী গোবিন্দের নাম এবং ঘনিয়ে-আসা বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য এবং অবশ্যই সমূহ লজ্জা-নিবারণের জন্য দ্রৌপদী কৃষ্ণ ভগবানের শরণ গ্রহণ করলেন। কিন্তু তখনও তিনি লজ্জায় মুখ লুকিয়ে কাঁদছিলেন, অনেক কাঁদছিলেন– প্রারুদ দুঃখিতা রাজ মুখমাচ্ছাদ্য ভামিনী। মহাভারতের এই পাঠান্তরে কৃষ্ণ দ্রৌপদীর আর্তিতে সাড়া দিয়েছেন এবং প্রায় অলৌকিকভাবে একের পর এক রঙিন বসন যুক্ত হতে লাগল। দ্রৌপদীর বস্ত্রকোটিতে তদ্রপম্ অপর বস্ত্র প্রাদুরাসীদনেকশঃ।

মহাভারতের এই পাঠান্তরে অবশ্যই ভক্তি, ভগবান এবং শরণাগতির জয়কার, এমনকী বিভিন্ন প্রদেশের লৌকিক গান, পালা, ভজনকীর্তন ইত্যাদির মধ্যেও বস্ত্রহরণের কালে দ্রৌপদীর এই লজ্জানিবারণের প্রার্থনা এবং কৃষ্ণের অলৌকিক বস্ত্রদানের কাহিনি পরম্পরাগত-ভাবে স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু মহাভারতের অত্যন্ত প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপিগুলিতে, বিশেষত কাশ্মীরি এবং নেপালি পাণ্ডুলিপিতে দ্রৌপদীর এই আর্ত কণ্ঠস্বর শোনা যায়নি। উত্তর ভারত এবং দক্ষিণ ভারতের পাণ্ডুলিপিতেও শ্লোকের হেরফের আছে– সেটা মেহেনড়লের মতো পণ্ডিত খুব স্পষ্ট করে জানিয়েছেন। এতসব কাণ্ড দেখে পুণে থেকে বেরোনো মহাভারতের বিশুদ্ধ সংস্করণ গোটা ব্যাপারটাকেই বাদ দিয়ে দ্রৌপদীর আর্তি-প্রার্থনা ফুট-নোটে রেখে দিয়েছে, কিন্তু আশ্চর্য কোনও বুদ্ধিতে এমন একটা দুটো শ্লোক এখানে মেনে নেওয়া হয়েছে যেটার অর্থ হল- দুঃশাসন দ্রৌপদীর উত্তমাঙ্গের বসন-প্রান্ত ধরে টানাটানি করতেই নূতন নূতন বস্ত্র সেখানে যুক্ত হতে থাকল পরের পর। পুণার পরিশুদ্ধ সংস্করণে সভাপর্বের সম্পাদক-মশাই অধ্যাপক এগারটন এই রহস্যের কারণ সমর্থক কোনও শ্লোক এখানে উদ্ধার করেননি এবং একটি পরম উদার মন্তব্য করে বলেছেন– no mention of Krishনা or any other superhuman agency… It is apparently implied (though not stated) that cosmic justice automatically, or “magically” if you like, prevented the chaste and noble Draupadi from being stripped in public.

দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের বিপর্যয় থেকে রক্ষার সহায় হিসেবে কৃষ্ণকে এই স্থানে নিয়ে আসতে বড়ই কষ্ট হয়েছে পরিশুদ্ধিবাদী পণ্ডিত সজ্জনের, তাতে ধর্মনিরপেক্ষ এক ভাবমূর্তি আমাদের মহাকাব্যকে বেশ একটা বিশ্বায়নী মর্যাদা দেয় এবং তার ওপরে cosmic justice নামক শব্দটাও যেন বেশ একটা মোহঘন আবরণ তৈরি করে। কিন্তু শত চেষ্টাতেও দ্রৌপদীর এই বিপন্ন মুহূর্তে কাপড় আমদানির ব্যাপারটা কোনওভাবেই প্রত্যাখ্যান করা যায়নি। হয়তো এই কারণেই আধুনিক পণ্ডিতদের মধ্যে বিখ্যাত হিলটেবাইটেল সাহেব কৃষ্ণের উপস্থিতির কথা এখনও প্রমাণ করবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পরিশুদ্ধিবাদীদের বিপক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি হল- দ্রৌপদীর উত্তমাঙ্গের বসন বা ‘আপার গারমেন্টের কোনও প্রশ্ন আসে না, কেননা তা হলে প্রথম থেকেই ‘রজস্বলা একবা’ কথাটা মিথ্যে হয়ে যায়। তবে এমন যদি হয় যে, পরিধান-বস্ত্রটি শাড়ির মতো ছিল, তা হলে খানিক সমাধান আসে বটে। কিন্তু বস্ত্ৰসরবরাহের প্রশ্নটা তবু থেকেই যায়।

আমি নিজে বৈষ্ণব-ঘরের মানুষ, যে কোনও ক্ষেত্রে কৃষ্ণফুর্তি ঘটলেই আমার তৃপ্তি হয় বড় এবং সেটা ভক্তির কারণে নয়, কৃষ্ণের মতো ওইরকম সর্বকূট-সমাধানকারী মানুষের আরও একটি বিচিত্র পদক্ষেপের জন্যই আমার মহামহিম লাগে তাঁকে। ফলে হিটেবাইটেল যে যুক্তিই দিন আমার ভাল লাগছে। তবে কিনা মহাকাব্যিক নিরপেক্ষতা নিয়ে একথা বলাই চলে যে, ‘কসমিক জাস্টিস’ তো আসলে আমাদের ধর্ম এবং আমাদের প্রদীপ ভট্টাচার্য এ-বাবদে ভালই বলেছেন যে, বিদুরের জন্মই হয়েছিল ধর্মের প্রতিরূপে এবং কৌরবসভায় দ্রৌপদীর অপমানের বিরুদ্ধে তিনিই ছিলেন প্রথম তীব্র প্রতিবাদী। তাঁকে তখন থামিয়ে দেওয়া হলেও তারই ব্যবস্থাপনায় এবং তারই তীব্রতায় দ্রৌপদী লজ্জা থেকে বেঁচেছিলেন। তবে এ-বিষয়ে স্পষ্ট করে তথ্য-প্রমাণ কিছু দেওয়া যায় না। প্রমাণ যতটুকু পাই মহাভারতের অন্তর্ভাবনায়, সেটা সেই পুরাতন শ্লোক, যেখানে বলা আছে–মহান ধর্ম বস্ত্ররূপ ধারণ করে নানাবিধ বস্ত্র দিয়ে দ্রৌপদীকে আবৃত করলেন ততস্তু ধর্মোহন্তরিতো মহাত্মা/ সমাবৃণোদ বিবিধবপূগৈঃ।

এখানে বস্ত্রান্তরিত ধর্মের কথা শুনেই পণ্ডিতজনেরা ধর্মরূপী বিদুরের কথা টেনে এনেছেন, যাঁর কথা কৃষ্ণও পরবর্তী সময়ে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বলেছেন যে, সেখানে একমাত্র বিদুরই সেই সময়ে ধর্মার্থ-সংযুক্ত কথাগুলি বলেছিলেন- একঃ ক্ষা ধর্মমর্থং ক্ৰবাণঃ–আর তা বলেছিলেন বলেই বিদুর ছাড়া আর কাউকে ত্রাতা বলে মনে হয়নি দ্রৌপদীর ন্যানং ক্ষর্নাথমবাপ কিঞ্চিৎ। এমন বিপন্ন সময়ে বিদুরকে না-হয় ত্রাতা বলে ভাবলেন দ্রৌপদী, কিন্তু কীভাবে তিনি এই বিপদ থেকে ত্রাণ করলেন– তার কিন্তু কোনও ইঙ্গিত দেয়নি মহাভারত। বরঞ্চ তার থেকে বিকল্পটা অনেক বেশি যুক্তিপূর্ণ, যদি বলি– দ্রৌপদীর বস্ত্রাকর্ষণের মতো অসভ্য ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সভায় উপস্থিত সমবেত রাজাদের নিন্দামন্দের চিৎকার উঠল এবং রাজারা তাদের উত্তরীয় বসন একটার পর একটা ছুঁড়ে দিতে লাগলেন দ্রৌপদীর দিকে ততত হলাহলাশব্দস্তত্রাসীদ ঘোরনিস্বনঃ। এটাই হয়তো এডগারটন সাহেবের cosmic justice বা magic অথবা এটাই সেই বস্ত্রান্তরিত ধর্ম যে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন বিদুর।

মহাভারত রাজাদের মুখে ওই নিন্দামন্দের ধিক্কারটুকু আগে উল্লেখ করেনি, ধর্ম বস্ত্ররূপ ধারণ করে দ্রৌপদীর লজ্জানিবারণ করার পর সেই অদ্ভুত ব্যাপার দেখার পর নাকি সমবেত রাজাদের টনক নড়েছে এবং তখন তারা দুঃশাসনের নিন্দা এবং দ্রৌপদীর প্রশংসাসূচক চিৎকার আরম্ভ করেছেন- শশংসুদ্রৌপদীং তত্র কুৎসন্তো ধৃতরাষ্ট্রজন্। আমরা শুধু বলব– সেটাই সবচেয়ে পার্থিব যুক্তি হবে যে, রাজারা এবং সভায় উপস্থিত মনস্বী দর্শকেরা নিজেদের উত্তরীয় বসনগুলি আগে ছুঁড়ে দিয়েছেন দ্রৌপদীর উদ্দেশে তার লজ্জা নিবারণের জন্য এবং পরে নিন্দামন্দের ঝড় তুলেছেন দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এমন একান্ত লৌকিক ভাবেই এই ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায় এবং সেটাই উচিত। কৃষ্ণের করুণায় বসন-প্রেরণের কথাও তাতে ব্যাখ্যাত হয়, ব্যাখ্যাত হয় বস্ত্রান্তরিত ধর্মের যুক্তিও।

দুঃশাসনের এই কাপড়-টানাটানির সম্মুখীন ফল যেটা ফলল, সেটা হল– মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেন যুধিষ্ঠিরের সমস্ত নির্বাক সত্য উপেক্ষা করে উঠে দাঁড়ালেন। ক্রুদ্ধমুখে দুই হাত ঘষতে-ঘষতে বললেন শুনুন, শুনুন, ক্ষত্রিয় রাজারা সব! এমন কথা আগে কেউ বলেনি, আর বলবেও না পরে। আমি যদি যুদ্ধের সময়ে ভরতবংশের কুলাঙ্গার এই দুর্বুদ্ধি দুঃশাসনের বুক চিরে রক্ত না খাই, তবে আমি আমার বাপ-ঠাকুরদার ছেলে নয়– পিতামহানাং সর্বেষাং নাহং গতিমবাপ্পয়া। ভীমের কথায় রাজসভায় উপস্থিত সকলেই দুঃশাসনকে গালি দিতে লাগল এবং সভায় এত বেশি পরিমাণ কাপড় এসে জমা হল। যে, দুঃশাসন ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন– যদা তু বাসসাং রাশিঃ সভামধ্যে সমাচিতঃ। দুঃশাসনের সঙ্গে সঙ্গে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রও গালি খেলেন বিস্তর। এই অবস্থায় বিদুর আর চুপ করে থাকলেন না। তিনি সময় বুঝে রাজসভার সমুচিত ইতিকর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিলেন সকলকে। তিনি চাইছিলেন দ্রৌপদী প্রথমে যে প্রশ্ন করেছিলেন, তার সযৌক্তিক উত্তর যেমন বিকর্ণ দিয়েছেন, তেমনই সভার নিয়ম মেনে সকলে ঠান্ডা মাথায় তার উত্তর দিন– ভবন্তোহপি হিতং প্রশ্নং বিব্রুবন্তু যথামতি।

বিদুর সাংসদীয় রীতিতে সংকটের সমাধান চাইছেন। অর্থাৎ এই অসভ্যতা নয়, সভায় সভ্যদের ‘ডেলিবারেশনস’ চলুক, সেখানে আগে মীমাংসা হোক– দ্রৌপদীর প্রশ্নের, তারপর মীমাংসা হোক– দ্রৌপদী কৌরবদের দাসী না অদাসী। বিদুরের কথা শুনে সমবেত রাজারা কিছু বললেন না বটে, কিন্তু সভার উত্তেজনা বুঝে কর্ণ দুঃশাসনকে আদেশ দিলেন দ্রৌপদীকে ঘরে নিয়ে যাবার জন্য কর্ণো দুঃশাসনং প্রাহ কৃষ্ণাং দাসীং গৃহান নয়। অর্থাৎ কর্ণ বোঝাতে চাইলেন– ঠিক আছে, আলোচনাই হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু পণজিতা দাসীর ওপর অধিকার তাদের ষোলো আনা, এবং সেইজন্যই পণ্যের মতো ব্যবহারও তার সঙ্গে মানায়। কর্ণের কথা শুনে দুঃশাসন তাকে অন্দরমহলে নিয়ে যাবার জন্য আবারও বস্ত্রাঞ্চলে টান দিলেন– দুঃশাসনঃ সভামধ্যে বিচকর্ষ তপস্বিনীম।

‘তপস্বিনীম’– মানে, বেচারা দ্রৌপদী, তাকে রক্ষা করার কেউ নেই। এই অবস্থায় দ্রৌপদীর মতো বিদগ্ধা রমণী নিজেকেই নিজে রক্ষা করার দায়িত্ব নিচ্ছেন। কোনও দৈহিক শক্তি দিয়ে নিজেকে রক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু বিদগ্ধা রমণীর মুখে শব্দমন্ত্র থাকে, সেখানে শাক্ত তন্ত্রাভ্যাসে প্রথমেই দুঃশাসনকে একটা ধমক কষালেন দ্রৌপদী। বললেন– নরাধম! বুদ্ধি-প্রজ্ঞা তোমার অবশিষ্ট নেই কিছু, আক্ষরিক অর্থেই তুমি দুঃশাসন! কিন্তু এই রাজসভায় এসে আমার তো কিছু কৃত্য ছিল। সে কৃত্য আগেই করা উচিত ছিল আমার। কিন্তু করা হয়নি বলেই তা করতে হবে এখন পুরস্তাৎ করণীয়ং মে ন কৃতং কার্যমুত্তর। আর এটাও তো সত্যিই, এই অসভ্য যেভাবে আমার কাপড় ধরে টানছিল, তাতে কোন ভদ্র আচরণই বা আমার পক্ষে করা সম্ভব ছিল? ওর অসভ্যতায় আমি বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম বিহ্বলাস্মি কৃতানেন কৰ্ষতা বলিনা বলাৎ। অদ্ভুত বাক্য-কৌশলে দ্রৌপদী বিদুর-কথিত সভা-সংসদের মর্যাদায় চলে এলেন। বললেন– সভায় উপস্থিত সকলকে আগে আমার অভিবাদন জানানো দরকার। এটা যদি আমি না করি, তা হলে অন্যায় হবে আমার অপরাধোহয়ং যদিদং ন কৃতং ময়া। কথা বলতে বলতেই দুঃখে, ক্রোধে, অপমানে দ্রৌপদীর চোখে জল চলে এল। মহাভারতের বক্তা বৈশম্পায়ন জানিয়েছেন যে অপমানের তিনি যোগ্য নন, সেই অপমান তাঁকে করা হয়েছে উন্মুক্ত রাজসভার মধ্যে সভায়াম অতথোচিতা- এতে উলটো দিকে একটা দোষ-চেতনা তৈরি হয় বলেই দ্রৌপদী সভার মর্যাদা সূচনা করেই বললেন– একমাত্র সেই স্বয়ংবর সভার শাস্ত্রবিহিত দূরত্বে থেকেই অন্যান্য রাজারা আমাকে একবার মাত্র সামনাসামনি দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, সেই একবার ছাড়া কেউ কখনও আমাকে দেখেননি, অথচ সেই আমাকে আজ সভায় টেনে আনা হল– সাহমদ্য সভাং গতা। দ্রৌপদী দুঃশাসনকে একেবারে কুলদূষকের জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন এবং পরের বাক্যে কৌরব-সভার সদস্যদের প্রতি ইঙ্গিত করে তাদের কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিলেন আমাকে সূর্য এবং বাইরের হাওয়াও কোনও দিন চোখে। দেখেনি, আজ তাকে কৌরব কুলপুরুষদের সঙ্গে সবাই দেখছে–সাহমদ্য সভামধ্যে দৃষ্টাম্মি কুরুভিঃ সমম্।

দ্রৌপদী জানেন– সত্যবদ্ধ যুধিষ্ঠিরের হাত-পা বাঁধা। কিন্তু তাই বলে তার স্বামিত্বের জায়গায় দাঁড়িয়ে তারা একেবারে মুখে কুলুপ এঁটে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন, এটা সাধারণ অবস্থায় হয় না বলেই দ্রৌপদী বলছেন বারবার এখন মনে হচ্ছে– সত্যিই সময়-কাল পালটে গেছে– মন্যে কালস্য পর্যয়– নইলে পাণ্ডবরা তাদের কুলবধূর এই অপমান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন এবং কৌরব-কুলভূষণেরা এই অন্যায় সহ্য করছেন– সময় পালটেছে নিশ্চয়ই, রাজার ধর্মই বা কোথায়– কৌরবরা বলতে পারবেন না যে, তাদের পূর্বপুরুষদের কেউ তাদের ঘরের বউকে কোনও দিন সভায় এনে তুলেছেন? দ্রৌপদী আবারও সেই কথাটা বলেছেন- ক্লিশ্যমানাম অনহতীম যে কষ্ট, যে অসম্মান, যে অপমান, যার পাবার কথা নয়, সেই কষ্ট, সেই অসম্মান অথবা সেই অপমান সে সমাজ থেকে পাচ্ছে মানেই সেখানে একটা রাজনৈতিক অপলাপ এবং বৈষম্য আছে। সমাজের যোগ্য মানুষকে যথাযথ মর্যাদা না দিয়ে অমর্যাদার মানুষ, অযোগ্য মানুষকে মর্যাদার স্থানে নিবেশ করাটা রাজনীতির বিষম-সিদ্ধির প্রশ্ন তুলে দেয়। দ্রৌপদী বলেছেন– আমি পাণ্ডবদের বিবাহিত ভাৰ্যা, আমি দ্রুপদ রাজার মেয়ে এবং আমি বাসুদেব কৃষ্ণের সখী– সেই আমি আজ এক সভার মধ্যে এসেছি কী ভাবে বাসুদেবস্য চ সখী পার্থিবানাং সভামিয়াম।

বিয়ের পর স্বামীর বাড়ির সুখ্যাতি এবং বাপের বাড়ির মর্যাদার প্রশ্নটা সব কালের সব মেয়েদেরই কথ্য বিষয়। কিন্তু সেই কালের দিনে এক বিরাট প্রথিত পুরুষকে আপন সখা বলে উচ্চারণ করে দ্রৌপদী নিজেকে এমন এক স্পষ্ট এবং নির্মল সম্পর্ক-সেতুর ওপরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, যা একান্তভাবেই মহাকাব্যিক রমণীর কোনও পৃথক প্রকোষ্ঠ নয়, বরং তা একান্তভাবেই দ্রৌপদীর। তিনিই পারেন রাজসভায় দাঁড়িয়ে বলতে– যে, আপনারা তাড়াতাড়ি এই নোটঙ্কি বন্ধ করুন– আমি দ্রুপদের মেয়ে, পাণ্ডব-পঞ্চকের বউ এবং বাসুদেব কৃষ্ণের সখী– সেই আমি এখানে পাশার চালে পণজিতা হয়ে আপনাদের দাসী হয়েছি, না এখনও অদাসী তাড়াতাড়ি বলে দিন দয়া করে আমি সেই অনুসারে আমার তর্ক-প্রত্যুত্তর জানাব, এবং সেই অনুসারে কাজ করব– তথা প্রত্যুক্তমিচ্ছামি তৎ করিষ্যামি কৌরবাঃ।

এই সভায় উত্তর দেবার লোক নেই। অতএব আগেও যেমন ভীষ্ম কথা বলেছিলেন, এবারও তাঁকেই বলতে হচ্ছে। দ্রৌপদীর প্রথম বারের প্রশ্নে এবং প্রত্যুত্তরে ভীষ্ম খানিক হতপ্রভ হয়েছিলেন, কিন্তু এবারে উত্তর দেবার সময় ভীষ্ম এটা খুব আধুনিক দৃষ্টিতেই লক্ষ করেছেন যে, রাজনৈতিক শক্তি যদি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়, তবে স্বেচ্ছাচারিতার অবসর তৈরি হয়ে যায় নিজে থেকেই। ভীষ্ম বলেছেন–আমি তো আগেই বলেছি, কল্যাণী! জগতে অতিবিজ্ঞ লোকেরাও ধর্ম এবং নীতি-নৈতিকতার নিয়ম-কানুন, তার সূক্ষ্মতা বোঝেন না। বরঞ্চ এটাই ঠিক যে, জগতে যারা রাজনৈতিকভাবে প্রবল হয়ে ওঠে, তারা যেটাকে নীতি নিয়ম বা ধর্ম বলে চিহ্নিত করে, সেটাই নীতি, সেটাই নিয়ম এবং লোকেও সেটাকেই ধর্ম বলতে থাকে– বলবাংশ্চ যথা ধর্মং লোকে পশ্যতি পূরুষঃ। ধর্ম-বিচারের শেষ জায়গায় এসে দুর্বল লোক যা বলে, এমনকী সে যদি সত্যিই ন্যায়ের কথাও বলে, তবুও সে প্রবল রাজনৈতিকতার চাপে প্রতিহত হয়ে যায়– স ধর্মো ধর্মবেলায়াং ভবত্যভিহতঃ পরঃ।

এ এক অতিবাস্তব অভিজ্ঞতার কথা এবং এমনই চিরকালীন এই কথা, যা আমরা আজকের গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্রেও টের পাই। গণতন্ত্রে অধিকাংশের ভোটে নির্বাচিত সরকার এবং তদুচিত সরকারি দলের মধ্যেও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু এমনভাবে ন্যস্ত হয় যে, সাধারণ দলকর্মীও ভেক থেকে পশুরাজ হয়ে ওঠেন। আমি একটি বৃহৎ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে পড়াবার সময় শিক্ষাব্রতীদের পর্যন্ত এমন দেখেছি যে, সরকারি দলের অন্ধ সমর্থকের সামনে একই দলভুক্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলা যায়নি এবং পাড়াতে দেখেছি একটি লোকাল কমিটির সাধারণ মেম্বারের এমন দোর্দণ্ড প্রতাপ যে সার্থক সমালোচনাতেও তার কোপে পড়াটা রাজতান্ত্রিক শোষণের চেয়েও খারাপ বলে মনে হয়েছে। জীবনানন্দের ধারণা-মতো আমরা সকলেই তখন সকলকে আড় চোখে দেখেছি, অথচ সুস্পষ্ট ফল ছিল এই যা ভীষ্ম বলেছেন– রাজনৈতিক প্রতাপবিশিষ্ট ব্যক্তি যেটাকে ন্যায়, নীতি, ধর্ম বলে মনে করবেন, সেটাই ধর্ম, সেটাই নীতি। কৌরবদের কী অবস্থা এখন! দুর্যোধন, কর্ণ, দুঃশাসন, শকুনি– এঁরা এমন বেপরোয়া কথা বলছেন, বেপরোয়া কাজ করছেন, যেখানে ভীষ্ম, বিদুর, দ্রোণ, কৃপ– কারও তোয়াক্কাই নেই। বিদুর এবং বিকর্ণকে রীতিমতো বেইজ্জত করা হয়েছে এবং ভীষ্মকেও খুব রেখে-ঢেকে, টেনে-টুনে চিন্তা করে উত্তর দিতে হচ্ছে। এখানে পরোক্ষেও তারা পাণ্ডবদের সমর্থন করতে পারছেন না, কিংবা তাদের সদগুণের কথা বলতে পারছেন না। সবচেয়ে বড় কথা, দ্রৌপদীর মতো এক বিদগ্ধা রমণীকে যেভাবে রাজসভায় এনে অসভ্যতা করছেন দুর্যোধন-কর্ণ-দুঃশাসনেরা, যেখানে তার কিংবা তার স্বামীদের দোষ থাকলেও এমনটা করা উচিত হয় না দ্রৌপদীর সঙ্গে যেটা দ্রৌপদী বলেছেন তার প্রাপ্য কিংবা যোগ্য নয় মোটেই মেয়ের সমান পুত্রবধূকে এমন নির্লজ্জ অপমান– ঠিক এই জিনিসটার সমালোচনাও যে করা যাচ্ছে না– ভীষ্ম এটাকেই বলছেন– বলবান লোকে যেটা করছে, সেটাই এখন ধর্ম বলতে হবে এবং দুর্বল লোকের কথা সেখানে প্রতিহত হবে এটাই স্বাভাবিক, আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না, দ্রৌপদী! তবে কুরুবংশ যে এই আচরণে ধ্বংসের মুখ দেখবে, সেটুকু আমি বলতে পারি– নূনমন্তঃ কুলস্যাস্য ভবিতা ন চিরাদিব।

নীতিধর্মের গ্লানি যেখানে তুঙ্গে ওঠে, অন্যায়ী লোককে যেখানে বলাও যায় না যে, তুমি অন্যায় করেছ, সেখানে ভীষ্ম যেটা বলছেন– এটাই যথেষ্ট সমালোচনা। কেননা দ্রৌপদী বা তার স্বামীদের সহায়ক কথা বললে দ্রৌপদীর ওপর অত্যাচার আরও বাড়ত হয়তো। সেই কারণেই ভীষ্ম দ্রৌপদী-প্রশ্নের সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে শুধু বললেন– তুমি যাঁদের কুলবধূ, তারা রাজ্যস্থিতি বজায় রাখার জন্য যেভাবে কামনা এবং ক্রোধ দুটোই সংবরণ করে আছেন, সেই তাদের ঘরের বউ হিসেবে তোমার যে চরিত্রের প্রকাশ ঘটেছে, এটাই তোমার উপযুক্ত উপপন্নঞ্চ পাঞ্চালি তবেদং বৃত্তমীদৃশম। তুমি এমন অবস্থাতেও ন্যায় কী, ধর্ম কী, এটা যে জানতে চাইছ, সেটাই তো চরম কথা। তুমি দেখো না, দ্রৌপদী! দেখো না– দ্রোণ-কৃপ-বিদুরের মতো ধর্মজ্ঞ ব্যক্তিদের শরীরে প্রাণ নেই বলে মনে হচ্ছে, তারা এই অন্যায় দেখে শূন্য-শরীরে বসে আছেন। পরিশেষে ভীষ্ম বললেন– আমার কিছু বলার নেই, দ্রৌপদী! বরঞ্চ তোমার এই প্রশ্নের সবচেয়ে বড় সদুত্তর দিতে পারেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির স্বয়ং। তুমি পাশার চালে জিত হয়েছ, নাকি জিত হওনি, সেটা তিনিই বলুন–অজিতাং বা জিং বাপি– যুধিষ্ঠিরস্তু প্রশ্নেহস্মিন প্রমাণমিতি মে মতিঃ।

আমরা মনে করি, ভীষ্ম শেষ পর্যন্ত সমালোচনাই করেছেন দুর্যোধন-কর্ণ-দুঃশাসনের। কিন্তু শকুনির মদতে বা কৌশলে পড়ে যুধিষ্ঠির পণ তো একটা ধরেইছিলেন, অতএব নিজের হারার পর পণ রাখার ব্যাপারে স্ত্রীর ওপরে তার স্বামিত্বের বিলোপ ঘটে–এ-কথাটা ভীষ্ম পরিষ্কার করে বলে দিলে তো আর এক বিপদ ঘটবে, দ্রৌপদী তো তাতে স্বামীদের অধিকারহীন এক মুক্তা রমণীতে পরিণত হবেন, সেখানে বলবানের আগ্রহ এবং নিগ্রহ আরও বাড়বে। হয়তো বা দ্রৌপদী এই মুক্তি চেয়েই প্রশ্ন করেছিলেন, কিন্তু মুক্তা এবং স্বাধীনা এক রমণীকে শুধু বাক্যজালে রক্ষা করার উপায় কুরুবৃদ্ধদের জানা ছিল না। কেননা দেখুন, ভীষ্মের এই ইতিবাচক সমালোচনার পরেও কিন্তু রাজসভার আর কেউ একটি কথাও বললেন না। সমবেত রাজা-রাজড়ারা, কেউ একটি কথাও না; বললেন না দুর্যোধন-কর্ণদের ভয়ে– নোচুর্বচঃ সাধু অথবাপ্যসাধু। মহীক্ষিততা ধার্তরাষ্ট্রস্য ভীতাঃ। যদি বলতেন, তা হলে হয়তো বা দ্রৌপদীর ওপর অত্যাচার আরও বাড়ত, নয়তো বাড়তি অপমান জুটত তাদের কপালে। আর অধম পুরুষের চাটুকারিতার অভ্যাসও তো কম থাকে না। তারা দুর্যোধনের কথার প্রতিবাদ করবেন কী!

সময় এবং সুযোগ বুঝে ভীষ্মের কথাটারই সবচেয়ে উপযোগ ঘটালেন দুর্যোধন। তিনি বললেন- প্রশ্নটা শুধু যুধিষ্ঠিরের ওপরেই থাকে কেন দ্রৌপদী, প্রশ্নটা ভীম-অর্জুন, নকুল, সহদেব সবার ওপরেই থাক, তারাই সব বলুন না। তারা তোমার জন্য যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যা প্রমাণ করে একবার বলুন না যে, তিনি তোমার স্বামী নন। এ-কথাটা একবার বলুন না তারা গলা ছেড়ে অনীশ্বরং বিব্রুবন্তু আমধ্যে। যুধিষ্ঠিরং তব পাঞ্চালি হেতোঃ– অথবা যুধিষ্ঠির নিজেই বলুন না যে, তিনি তোমার স্বামী নন, অথবা স্বামী। আর এ-ব্যাপারে সভায় উপস্থিত রাজা-রাজড়ারা কী বলবে? সভার সভ্য রাজারা দুর্যোধনের প্রশংসা করতে লাগল, স্তাবকদের মতো উত্তরীয় কাপড় উড়িয়ে দুর্যোধনকে সমর্থনও করতে লাগল, যদিও কিছু রাজাদের গলায় ভেসে এল আর্তনাদের সুর, হাহাকার। কিন্তু দুর্যোধনের কথায় সবাই এবার তাকিয়ে রইল যুধিষ্ঠিরের দিকে, অন্য চার পাণ্ডবদের দিকেও তাঁরা কে কী বলেন দ্রৌপদীর প্রশ্ন-মীমাংসায়।

সত্যি বলতে কী, দ্রৌপদী যে প্রশ্নটা করছেন এবং তা মীমাংসা করার জন্য দুর্যোধন কর্ণরাও যে-প্রশ্ন যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডবদের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন, আজকের দিনের ভাষায় এটা ‘পজেশন’-এর প্রশ্ন, যা থেকে পণ্যতার প্রশ্নও আসে এবং যুধিষ্ঠির ঠিক তাই করেছেন যাকে সরাসরি পণ্যতাই বলা যায়। কিন্তু আমরা বলব– ‘পজেসিভনেস’ অথবা পজেশন’, আর পণ্যতা কিন্তু এক নয়। যে কোনও ভালবাসার মধ্যেই পজেসিভনেস’ থাকে ‘আমার’ বোধ থাকে, প্রেমের ক্ষেত্রে এবং দাম্পত্যের ক্ষেত্রে এই পজেসিভনেস’ থাকারই কথা, নইলে ভিড় বাসে যে-লোকটি আমার প্রেমিকার বা আমার স্ত্রীর নিতম্ব স্পর্শ করে উত্যক্ত করছে, তখন কি প্রেমিক পুরুষ অথবা স্বামী নির্বিকার দাঁড়িয়ে ভাববেন– ইনি তো আমার নন, আমি তো এঁর অধিকারী নই। আসলে ভালবাসা, স্নেহ, প্রেম এই সব মানসিক প্রক্রিয়ায় আমার-বোধ বা মম-কার আসবে, মমতা মানেই তো আমার পজেশনের বোধ। কিন্তু পণ্যতা ব্যাপারটা কিছু পৃথক বটে। দাম্পত্য জীবনে মম-কারের বোধে যদি পুরুষের আত্মবোধ বা অহংকার তৈরি হয়, সে যদি এমন ভাবতে থাকে যে, আমাকে ছাড়া আমার স্ত্রীর আর কোনও গতি নেই, তখন এই পুরুষের স্বার্থের তাড়নায় মম-কার পণ্যতায় পরিণত হয়। এখানে যুধিষ্ঠিরের ক্ষণিক ভুলে অন্য নেশায় দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে পণ্যই তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের ভাইরা থেকে আরম্ভ করে স্বয়ং দ্রৌপদীও বোঝেন– যুধিষ্ঠির এমন মানুষ নন। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের এই ক্ষণিক অসচেতনার মাশুল দ্রৌপদীকে যেভাবে চুকোতে হচ্ছে এবং শত্রুপক্ষ এতটাই তার সুযোগ নিচ্ছে যে, দ্রৌপদী তার আইনি প্রশ্নে যুধিষ্ঠিরের স্বামিত্ব বা পজেশন থেকেই মুক্ত হতে চাইছেন ক্ষণিকের জন্য।

আর এই মুহূর্তে যুধিষ্ঠিরের অধিকারে থাকাটা ভীষণ যন্ত্রণার জায়গা তৈরি করে দিচ্ছে। বলেই সকল স্তাবকতা স্তব্ধ করে দিয়ে ভীম তার বীরত্বের সূচক বাহু-দুটি দেখিয়ে বললেন আমাদের পুণ্য, আমাদের তপস্যা এমনকী আমাদের প্রাণেরও অধিকার আমাদের জ্যেষ্ঠ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের অধিকারে। তিনি যদি নিজেকে পণজিত বলে মনে করেন তবে আমরাও তার সঙ্গে জিত হয়েছি বলেই বুঝতে হবে। আজকে যুধিষ্ঠিরের গুরু-গৌরবেই আমি আটকে আছি, আর অর্জুনও আমাকে বারণ করেছে, যদি এমনটা না হত– আজকে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির আমাকে ছেড়ে দিন একবার তার অধিকার থেকে, আমি শুধু আমার এই দুটো হাত দিয়েই পিষে মেরে ফেলতাম ধৃতরাষ্ট্রের সবগুলো ছেলেকে। এই হাত-দুটোর মাঝে পড়লে দেবরাজ ইন্দ্র এলেও পার পাবে না- নৈতয়োরন্তরং প্রাপ্য মুচ্যেতাপি শতক্রতুঃ! ভীম আপন নিরুদ্ধ ক্রোধে নিজের চন্দনরুষিত হাত-দুটিই শুধু দেখাতে লাগলেন, কিন্তু সত্যবদ্ধ যুধিষ্ঠিরকে তিনি অতিক্রম করতে পারলেন না, ভীষ্ম-দ্রোণ-বিদুরেরাও তাকে শান্ত হতে বললেন।

দ্রৌপদীর আইনি প্রশ্নের কেউ উত্তর দিতে পারলেন না, যুধিষ্ঠির তো নির্বাক হয়েই রইলেন। আশ্চর্যজনকভাবে হঠাৎ পালটা আইন দেখিয়ে জঘন্যভাবে দ্রৌপদীকে উদ্দেশ্য। করে কথা বলতে আরম্ভ করলেন কর্ণ। কর্ণ বললেন– ক্রীতদাস, পুত্র এবং স্ত্রী– এই তিন জনেরই আপন-লব্ধ ধনের ওপর কোনও অধিকার নেই। আর এখানে আরও সমস্যা হল ক্রীতদাসের নিজের স্ত্রীর ওপরেও কোনও স্বত্ব থাকে না, নিজের সম্পত্তির ওপরেও কোনও অধিকার থাকে না। অতএব, এই যে রাজনন্দিনী দ্রৌপদী! তুমি অন্তঃপুরে গিয়ে রাজার পরিবারের সেবা করো। এখন এই ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরাই তোমার মালিক, তোমার পাণ্ডব স্বামীরা নন। আর সবচেয়ে বড় কথা, তুমি এই ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের মধ্যেই কাউকে স্বামী হিসেবে বেছে নাও, এই ক্ষুদ্র, উদ্যমহীন পাণ্ডবদের দিয়ে তোমার কী হবে। তবে হ্যাঁ, এটাও মনে রেখো– ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের মধ্যেই যদি কাউকে বাছ, তা হলে স্বামী হিসেবে তার যৌনতৃপ্তি ঘটানোটাও দাসীদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে– এটা তোমার মনে রাখা উচিত অবাচ্যা বৈ পতিষু কামবৃত্তির্নিত্যং দাস্যে বিদিতং তত্তবাস্তু।

কর্ণের কথা শুনে ভীমের গা যেন জ্বলে উঠল। যুধিষ্ঠিরের সত্যপাশে বদ্ধ হয়ে তিনি না পারছেন এই লোকগুলিকে পিষে মারতে, আবার শক্তি-সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও না পারছেন অবস্থার প্রতিকার করতে। অতএব ক্রোধনিশ্বাসের সঙ্গে আরক্ত নয়নে ভীম যুধিষ্ঠিরকেই বললেন- আমি কর্ণের ওপরে রেগে যাইনি, দাসধর্মের কথা কর্ণ যা বলছে, তা সত্য বটে। আমি শুধু বলব– তুমি যদি দ্রৌপদীকে নিয়ে খেলাটা না করতে তা হলে আর এই কথাগুলো বলতে পারত না আমাদের শত্রুরা কিং বিদ্বিষো বৈ মামেবং ব্যাহরেয়ুঃ। নাদেবীং যদ্যনয়া নরেন্দ্র। ভীমের এই সাভিমান ক্রোধ-ব্যক্তি শুনে দুর্যোধন ভাবলেন– আরে! এই তো সুযোগ! এদের নিজেদের মধ্যেই ঝগড়া লেগে গেছে, যা আগেও একবার যুধিষ্ঠিরকে পুড়িয়ে মারার উপক্রম করেছিল। দুর্যোধন আবারও একবার বললেন– বলুন, রাজা যুধিষ্ঠির! আপনি বলুন। ভীম-অর্জুন, নকুল-সহদেব আপনার সব ভাইই তো আপনাকেই মেনে চলে। অতএব আপনি বলুন- দ্রৌপদীকে আমরা জিতেছি, না তিনি পণজিতা নন। এই সামান্য কথাটা শেষ করেই দুর্যোধন আর অপেক্ষা করলেন না। লজ্জা সম্ভ্রমের সমস্ত বর্ণমালা অতিক্রম করে তিনি তার বাম ঊরুদেশের ওপর বস্ত্র অপসারিত করলেন এবং হাসতে হাসতে দ্রৌপদীর দিকে তেরছা করে তাকাতে থাকলেন– হসন ঐক্ষত পাঞ্চালী… অপোহ্য বসনং স্বকম্।

দুর্যোধনের এই ব্যবহারের সাধারণ সরল ব্যাখ্যাও যেমন হয়, তেমনই গভীর এবং সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা হতে পারে তাঁর মনস্তত্ত্বের। আমরা সাধারণভাবে বলতেই পারি– এ তো পুরুষমানুষের সেই লম্পট স্বভাব যে নাকি এক বিবাহিতা মহিলার প্রতি এমন যৌনতার ইঙ্গিতে নিজের যৌনলিপ্সা প্রকট করে। পণ্ডিত মনস্তত্ত্ববিদরা তখনই বলবেন– দুর্যোধনের মধ্যে সেই স্ত্রীবিষয়িনী দুর্বলতাও আছে আর এমনই সেই দুর্বলতা, যেখানে তিনি স্পষ্ট জানেন এই রমণী কোনও দিন তার বশীভূত হয়ে তাঁর অঙ্কারূঢ়া হবেন না। এই অপ্রাপ্যতা এক ধরনের হীনমন্যতা তৈরি করে বলেই তিনি একবার বন্ধু কর্ণের দিকে চক্ষু-কুঞ্চন করেই দ্রৌপদীকে পায়ের কাপড় সরিয়ে বাম ঊরু দেখাচ্ছেন এবং খ্যাক-খ্যাক করে হাসছেন–অভস্মৃয়িত্বা রাধেয়ং… সব্যমূরুম্ অদৰ্শয়ৎ। ইংরেজি তর্জমায় পুরুষরা এইরকম ‘লিউড় জেসচার’ করলে মেয়েরা দেখে না, তা নয়; দেখতে বাধ্য হয়, তাদের চোখ পড়ে, অসঙ্গতি এবং অভাবনীয়তার চকিত কারণে চোখ পড়েই যায়। এবং কী আশ্চর্য সিদ্ধান্তবাগীশ দ্রৌপদীর এই চকিত বিস্ময় বা অপস্ময় অনুবাদই করলেন না। মহাভারত বলেছে- দ্রৌপদী দেখছেন এতেও লজ্জা হল না দুর্যোধনের, তিনি তার বাম উরু দেখাতে লাগলেন তাকে– দ্রৌপদ্যাঃ প্রেক্ষমানায়াঃ সব্যমূরম্ অদৰ্শয়ৎ।

এখানে দ্রৌপদীর বিশেষণ হিসেবে যে শব্দ প্রয়োগ হয়েছে এবং বিশেষ্য পদে দ্রৌপদীর ক্ষেত্রেও যে বিভক্তিটি প্রয়োগ করা হয়েছে, সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মে তাকে বলে “অনাদরে ষষ্ঠী। তার মানে হল– দ্রৌপদী যে তেমন অবস্থায় দুর্যোধনের দিকে পরম অনিচ্ছায় তাকিয়ে ফেললেন একবার এই অনভিপ্রায়কে কোনও পাত্তা না দিয়ে তাকে এতটুকুও ‘কেয়ার’ না করেই দুর্যোধন তার বাম উরু দেখাতে লাগলেন। এটা দেখে ভীম আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি তাঁর ক্রোধরক্ত চক্ষু দুটি বিস্ফারণ করে রাজসভায় সমাগত রাজাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন- দুর্যোধন! শুনে রাখো তুমি। আমি যদি মহাযুদ্ধে তোমার এই বাম উরুটি গদাঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ না করি, তা হলে আমার বাপ-ঠাকুরদার বংশে জন্মাইনি আমি– যদ্যেতমূরুং গদয়া ন ভিন্দ্যাং তে মহাহবে। ভীম আর একটাও কথা বললেন না, শুধু ক্রোধে আগুন হয়ে রইলেন, যা দৃশ্যতই বড় ভয়ংকর ছিল।

হয়তো ভীমের এই আস্ফালনের খুব প্রয়োজন ছিল। যুধিষ্ঠির যে সত্যপাশে আবদ্ধ ছিলেন– পণজিত হবার পরে অথবা শকুনির ফাঁদে পড়ে দ্রৌপদীকে হেরে বসেও তিনি যে অসহায়ের মতো আত্মদূষণে মগ্ন হয়ে বসে ছিলেন এমন সত্য যে ধর্ম নয়, সেটাই বুঝি একান্ত করে বুঝিয়ে দিতে চাইছেন মহাভারতের কবি। এই শঙ্কা, অর্থাৎ ধর্মের কাজ করছি। বলে যা ভাবছি, সেটাই হচ্ছে কি না– সত্যধর্মের এমন একটা সংশয়ী অবস্থান, যেখানে সত্য বা ধর্ম সত্যিই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কি না বোঝা যায় না– এই শঙ্কাটা স্বয়ং ব্যাসই তুলে ধরেছেন মহাভারতের মোক্ষধর্মপর্বে। ব্যাস বলছেন– এমনটা হয় কখনও, এমন অবিচক্ষণ মানুষও আছেন এই পৃথিবীতে যিনি ধর্মভাবে ধর্মের কামনা করেই অধর্মের কাজ করে ফেলছেন– অধর্মং ধর্মকামো হি করোতি হ্যবিচক্ষণঃ। আবার এমনও হয় যে, অধর্মের কাজ করছি ভেবে একজন আসলে ধর্মের কাজই করল– অধর্মকামশ্চ করোতি ধর্ম। ব্যাস বলছেন– এই দুই ধরনের লোকেরই কোথাও-না-কোথাও এক ধরনের দুর্বলতা আছে– এরা ঠিক কী করছে তা নিজেরাই তেমন বোঝে না উভেহবলঃ কর্মণী ন প্রজান। এখানে ঠিক এটাই ঘটেছে– যুধিষ্ঠির যে এখন কোনও কথা না বলে চুপটি করে বসে ভাবছেন যে, তিনি সত্যপাশে আবদ্ধ আর তার কিছু করার নেই, এটা বস্তুত ধর্মকামুক ব্যক্তির অধর্ম করে ফেলা। তিনি যুক্তি দিয়ে একবারও বলছেন না যে, তিনি নিজেকে হেরে যাবার পর পর দ্রৌপদীকে বাজি রাখতে পারেন না, নীতিগতভাবেই তিনি তখন দ্রৌপদীর স্বামী নন। আবার দেখুন, আমরা যখন ভাবছি যে, যুধিষ্ঠির এবং অন্যান্যরা সবাই যখন চুপ করে আছেন, অথচ ভীম আস্ফালনে একবার দুঃশাসনের রক্তপান করবেন বলছেন, আর একবার দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করবেন বলছেন– এগুলি সব যুধিষ্ঠিরের সত্য ধর্ম থেকে বেরিয়ে এসে কথা বলা– তা কিন্তু নয়। তিনি ধর্মের কাজ না করতে চেয়েও কিন্তু ধর্মের কাজটাই করছেন। হয়তো ভীম সেটা নিজেও বোঝেননি। কিন্তু এটাই যে ঠিক আচরণ ছিল কুলবধূকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেবার, সেটা বোঝা যায় আকস্মিক বিদুরের ভাষণে।

বিদুর আর থাকতে পারলেন না। বললেন- ভীষণ ভীষণ ভয়ের ব্যাপারে হয়ে গেল এবং সে-ভয় ভীমের কাছ থেকেই উপস্থিত হবে– সেটা বুঝে নাও ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা সব পরং ভয়ং পশ্যত ভীমসেনা। তবুধ্যধ্বং ধৃতরাষ্ট্রস্য পুত্রাঃ। পাশাখেলার সব নিয়ম তোমরা লঙঘন করেছ। কী অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, আজ একটি স্ত্রীকে রাজসভায় এনে তোমরা বিবাদ আরম্ভ করেছ। এতটুকু মঙ্গলও আর অবশিষ্ট থাকবে না। বিদুর এই ভীতি প্রদর্শন করেই ক্ষান্ত হননি। দুর্যোধন বারবার সেই আইনি প্রশ্ন তুলছেন বলে তিনি পরিষ্কার জানালেন যে, যুধিষ্ঠির নিজেকে আগে বাজি রেখে হেরেছেন বলেই দ্রৌপদীকে পণ ধরার অধিকার এবং তার স্বামিত্ব দুটোই তিনি হারিয়ে বসেছেন। অতএব শুধু শকুনির কৌশলে পড়ে বিভ্রান্ত হয়ে দুর্যোধনেরা যেন নিজেদের বিপদ ডেকে না আনে– এই কথাটা বেশ কড়া করে বুঝিয়ে দিতেই এটা বোঝা গেল যে, সভার হাওয়া অন্য দিকে ঘুরছে এবং সেটা সম্ভব হয়েছে মধ্যম পাণ্ডব ভীমের সন্ত্রাস-সৃষ্টির ভাষায়। হয়তো এর ফলেই শেষ মুহূর্তে যুধিষ্ঠিরের ভাবশিষ্য অর্জুন বলে ফেললেন– রাজা যুধিষ্ঠির আগে আমাদের সকলেরই অধিকারী প্রভু ছিলেন, কিন্তু নিজেকে হেরে তিনি এখন কোন বস্তুর অধিকারী থাকতে পারেন? ঈশস্বয়ং কস্য পরাজিতাত্মা? অর্থাৎ অর্জুন বোঝাতে চাইলেন যে, পাশার পণ্যে দ্রৌপদীকে জিতে যাওয়াটা নেহাই শকুনির কৌশল।

এর পরেই ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় সেই চিরন্তন তথা ‘মিথিক্যাল’ অমঙ্গলের চিহ্নগুলি প্রকট হয়ে উঠল– উচ্চৈস্বরে ডেকে উঠল শেয়াল, গর্দভ, শকুন এবং সেই শব্দ শুনতে পেলেন তারাই, যাঁরা দ্রৌপদীর এই লাঞ্ছনা কিছুতেই সইতে পারছেন না। ধৃতরাষ্ট্রও পুত্রদের মতোই এই লাঞ্ছনায় মৌনভাবে শামিল ছিলেন বলেই অবশেষে বিদুর এবং গান্ধারী একান্তভাবে ধৃতরাষ্ট্রকে ভবিষ্যতের দুর্ভাবনা বোঝালেন। আমরা মনে করি- হোমগৃহে শৃগালের ডাক, রাসভ-শকুনের চিৎকার ইত্যাদি অতিজাগতিক শব্দের চেয়েও যুধিষ্ঠিরের প্রতিজ্ঞাত সত্যের বাইরে এসে ভীমের যে ভয়ংকর আস্ফালন– এটাকেই অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বলেছিলেন বিদুর এবং গান্ধারী। তার ফল হয় সঙ্গে সঙ্গে। ধৃতরাষ্ট্র সকলের সামনে দুর্যোধনকে গালমন্দ করে বললেন- অসভ্য ছেলে কোথাকার! তুই শেষ হয়ে গেছিস– হতোহসি দুর্যোধন মন্দবুদ্ধে। তা নইলে এই কুরুকুলের রাজসভার মধ্যে পাণ্ডবদের ধর্মপত্নী দ্রৌপদীর সঙ্গে কথা চালাচালি করছিস– স্ত্রিয়ং সমাভাষসি দুর্বিনীত। বিশেষত দ্রৌপদীং ধর্মপত্নীম। এক মুহূর্তে সমস্ত সুর পালটে দিয়ে ধৃতরাষ্ট্র দ্রৌপদীকে বর দিতে চাইলেন। প্রশংসা করে বললেন- তুমি আমার পুত্রবধূদের মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট, তুমি ধর্ম জানো, তুমি সতী বটে, তুমি বর চাও আমার কাছে, যা ইচ্ছে চাও- বরং বৃণী পাঞ্চালি!

বর চাইতে গিয়ে এই বুঝি প্রথম তার জ্যেষ্ঠ স্বামীর মুখে কষাঘাত করলেন দ্রৌপদী। যে যুধিষ্ঠির তাকে পাশায় পণ রেখে আজকে সকলের সামনে তার চরম অপমানের রাস্তা খুলে দিয়েছেন, দ্রৌপদী প্রথম তাকে দাসত্ব থেকে থেকে মুক্তি দেবার বর চাইলেন। তখনও যুধিষ্ঠিরের সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য– তিনি ধর্ম অনুসারেই চলেন সদা সর্বদা, তিনি বড় সুন্দর মানুষ সর্বধর্মানুগঃ শ্রীমান– তাঁকে আগে মুক্তি দিন দাসত্ব থেকে। এমন যেন না হয় যে, এই যুধিষ্ঠিরের ঔরসে আমার গর্ভে জাত আমার পুত্র প্রতিবিন্ধ্যকে অন্য ছেলেরা ডেকে বলবে– আরে! এই যে আমার চাকরের পো, আয় এদিকে– এমনটা যেন না হয়। ধৃতরাষ্ট্র মুক্তি দিলেন যুধিষ্ঠিরকে এবং তারপর দ্বিতীয় বর দিতে চাইলে দ্রৌপদী তার অন্য চার স্বামী ভীম-অর্জুন এবং নকুল-সহদেবকেও মুক্ত করলেন দাসত্ব থেকে। ধৃতরাষ্ট্র বিমুগ্ধ স্বরে দ্রৌপদীকে বললেন আমার ঘরে যত ছেলের বউরা আছে, তাদের সবার চাইতে তুমি ভাল, সব চাইতে ধর্ম-চারী বধূ হলে তুমি- ত্বং হি সর্ববধূনাং মে শ্রেয়সী ধর্মচারিণী।

ধৃতরাষ্ট্র দ্রৌপদীর যত গুণ বলছেন, এতক্ষণ বুঝি তার এসব খেয়াল ছিল না। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি তার এই হঠাৎ মন পরিবর্তনের পিছনে ভীমের গদাঘাত-কল্পনা এবং বিদুর-গান্ধারীর সানুবন্ধ নিবেদন যতখানি আছে, তার চাইতে বেশি আছে এতক্ষণ ধরে দ্রৌপদীর এই অনমনীয় আচরণ এবং তারই ফলে শেষ পর্যন্ত সভার গতি ঘুরে যাওয়া। পরবর্তীকালে একসময় ধৃতরাষ্ট্র তার ছেলেদের সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন– যজ্ঞসেন দ্রুপদের ওই মেয়ে দ্রৌপদী কিন্তু শুধুই তেজ– তেজ ছাড়া কিছু নেই ওর মধ্যে যজ্ঞসেনস্য দুহিতা তেজ এব হি কেবলম্৷ আমরা বলব–তেজ দেখার এই আরম্ভ, যেদিন দ্রৌপদীকে চরম অপমান করার পর ধৃতরাষ্ট্র স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বর দান করা আরম্ভ করেছেন। দ্বিতীয় বরে ধনুক-বাণ-গদা সহ চার স্বামীকে মুক্ত করে নিয়েছেন দ্রৌপদী। ধৃতরাষ্ট্র এখন মুগ্ধতার ভাণে তৃতীয় বর দিতে চাইছেন। বলছেন– এ অতি সামান্যই হয়েছে, নন্দিনী! তুমি তৃতীয় বর চাও– তৃতীয়ং বরয়াম্মুত্তো নাসি দ্বাভ্যাং সুসৎকৃতা। দ্রৌপদী বীরোচিত বিদগ্ধতায় ধৃতরাষ্ট্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললেন– লোভ জিনিসটা ধর্মনাশ করে, মহারাজ। আমার আর নেবার ক্ষমতা নেই। আমি তো বামুন নই, মহারাজ। তাদের মানায় বর চাওয়া। ‘প্রতিগ্রহ’ ছাড়া তাদের জীবিকা নেই, তারা একশোটা বর চাইতে পারেন। কিন্তু ক্ষত্রিয়রা এত বর চাইবে কেন? আমার স্বামীরা জুয়োখেলার মতো একটা পাপ কাজ করে দাসত্বে বাঁধা পড়েছিলেন, তারা মুক্তি পেয়েছেন এই যথেষ্ট। এর পরে তাদের নিজের ভাল কীসে হবে, তা তারা নিজেরাই বুঝে নেবেন– বেৎস্যন্তি চৈব ভদ্ৰাণি রাজন্ পুণ্যেন কর্মণা।

দ্রৌপদী যা বলেছেন এবং যেভাবে বলেছেন, তাতে তার মনস্বিতার সঙ্গে ওজস্বিতাও যেমন ধরা পড়ে, তেমনই বড় অকথিতভাবে ধরা পড়ে স্বামীদের ওপর দ্রৌপদীর ভরসা। এত কিছুর পরেও তার ভরসা আছে স্বামীদের ওপর– এই শান্ত বরদ মুহূর্তে নিশ্চয়ই তিনি বোঝেন যে, হঠাৎ এক বিপাক তৈরি হয়ে গিয়েছিল এবং সে বিপাক সত্যিই তার জ্যেষ্ঠ স্বামী তৈরি করেননি, ছলে-বলে-কৌশলে তা তৈরি করেছে ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরাই। বিশেষত এই সম্পূর্ণ দূত-প্রক্রিয়ার মধ্যে মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেনকে দ্রৌপদী যেভাবে প্রতিক্রিয় দেখেছেন সমস্ত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও, তাতে এই মানুষটির আপাত-কঠিন বহিরঙ্গের মধ্যে তার আদেশ-লুব্ধ এক একান্ত প্রেমিককে আবিষ্কার করেছেন দ্রৌপদী। আর বিপন্ন স্বামীদের জন্য নিজের অবাধ্যতায় এতক্ষণ স্থির থেকেও পরিশেষে যেভাবে তিনি সাধ্য বস্তুটুকু বিনা চেষ্টায় ছিনিয়ে নিয়েছেন, তাতে সবচেয়ে বড় শংসাপত্র দিয়েছেন তার চরম শত্রু– কর্ণ। যিনি এতক্ষণ তাকে কৌরব-ঘরের দাসী বানাতে চাইছিলেন, যিনি এক বিদগ্ধা রমণীর বসন-মোচনের জন্য উপরোধ তৈরি করে যৌন-চেতন স্বাভিমান পুষ্ট করছিলেন, সেই তিনি এবার বললেন– অনেক সুন্দরী-সুন্দরী স্ত্রীদের কথা শুনেছি বাপু! কিন্তু তাদের কেউ যে এমন একটা কাজ করতে পারে, এমন দেখিওনি শুনিওনি সামেতাদৃশং কর্ম ন কস্যাশ্চন শুশ্রম।

আসলে অতিসুন্দরী রমণীকুলের মধ্যে অনেক সময়েই এক ধরনের লোকপুষ্ট সৌন্দর্য্যের আত্মপ্রসাদ থাকে। তাতে পৃথিবীতে আর কিছু তাদের কর্তব্য, করণীয় আছে বলে তারা ভাবেন না, সেখানে বিপন্ন স্বামীকে বিপন্মুক্ত করে বার করে আনার ব্যাপারটা তো তাদের সৌন্দৰ্য-সাধনায় কষাঘাত বলে গণ্য হবে। কিন্তু দ্রৌপদীর অসামান্য সৌন্দৰ্য্য তার শরীর অতিক্রম করে বুদ্ধিতে এসে পৌঁছেছে। কম ক্ষণ তিনি রাজসভায় দাঁড়িয়ে ছিলেন না, একটার পর একটা মানসিক ধর্ষণের প্রক্রিয়া চলছে শত লোকের সামনে। অথচ দ্রৌপদী তার নিজের লড়াইতে সম্পূর্ণ স্থির এবং সেইকালের এক অসামান্যা সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র শারীরিকতার সূত্রেই তাঁকে ‘অ্যাড্রেস’ করা যাচ্ছে না– এই অবস্থায় কর্ণের মতো বিপ্রতীপ-প্রণয়ী শত্রুকে আশ্চর্য হয়ে বলতেই হয়- পাণ্ডবরা তো সাগরে ডুবে যাচ্ছিল– অবলম্বনহীন। আশ্রয়হীন অপবাদের সমুদ্রে যখন তারা হাবুডুবু খাচ্ছে, সেই সময়ে কোথা থেকে নৌকো নিয়ে এল এই মেয়ে– পাঞ্চালী বাঁচিয়ে নিয়ে গেল সমস্ত পাণ্ডব ভাইদের পাঞ্চালী পাণ্ডুপুত্ৰাণাং নৌরেষা পারগাভবৎ।

কর্ণের এই মোহসুন্দর সাশ্চর্য ভাব কেটে যেতে সময় লাগেনি। পাণ্ডবদের সব কিছু ফেরত দিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে যাবার অনুমতি দিতেই যে-সময়ে তারা ইন্দ্রপ্রস্থের পথ ধরেছেন, সেই মুহূর্তেই আবার দুর্মন্ত্রণার ঘটা চলল ধৃতরাষ্ট্রের ঘরে। দুর্যোধন পিতাকে বুঝিয়ে ছাড়লেন– আবারও পাশা খেলতে হবে। নইলে বিপদ ঘটবে নিজেদের। খানিক অনিচ্ছাসত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্র আবারও লোক পাঠালেন পাণ্ডবদের ফিরিয়ে আনতে। আবারও পাশাখেলা হল– সবাই জানেন। আবারও যুধিষ্ঠির হারলেন– সবাই জানেন। বারো বছর বনবাস, আর এক বছর অজ্ঞাতবাসের জন্য প্রস্তুত হলেন পাণ্ডবরা; দ্রৌপদী-সহ। যাবার পথটাও খুব যে মসৃণ ছিল, তা নয়। যেভাবে ইন্দ্রপ্রস্থ যাবার পথ থেকেই সবাইকে ধরে আনা হল এবং যেভাবে ধৃতরাষ্ট্র আপন বৃদ্ধ-সম্বন্ধের গৌরব ব্যবহার করে যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে পাশা খেলালেন, তাতে কেউ যে কোনও কথা বললেন না, এমনকী দ্রৌপদীও নয়, তাতে বোঝা যায়, এই বনবাস নিয়তির মতো নেমে এসেছিল। কিন্তু বনে যাবার পথে যাদের পুনরায় অপমান-বাক্য শুনতে হল, তারাই শুধু প্রতিবাদী ছিলেন এবং প্রতিবাদী ছিলেন বলেই কুমার দুঃশাসনের টার্গেট ছিলেন দ্রৌপদী এবং ভীম।

পাণ্ডবরা মৃগচর্ম পরিধান করে দ্রৌপদীকে নিয়ে বনে যাবার আগে সমস্ত বৃদ্ধজন এবং ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বিদায়-ভাষণ জানাবার আগেই দুঃশাসনের মুখ খুলে গেল। পাশার চালে হেরেছেন বলেই ধর্ম-নিয়মে তারা প্রত্যুত্তর দেবেন না ধরে নিয়েই দুঃশাসন দ্রৌপদীকেই সঠিকভাবে ‘টার্গেট করলেন। বললেন– দ্রুপদ রাজা কাজটা ভাল করেননি মোটেই। কতগুলি নপুংসক স্বামীর হাতে দ্রৌপদীকে ছেড়ে দিয়েছেন। আর দ্রৌপদী তোমায় বলি শোনো-যে-সব স্বামীরা তোমার ভাল ভাল জামা-কাপড় পরত, সব তো গেছে, তারা সর্বস্বহীন নিরাশ্রয়। এদের দেখে তোমার কতটা পছন্দ হবে, দ্রৌপদী–কা ত্বং প্রীতিং লক্ষ্ম্যসে যাজ্ঞসেনি– তার চেয়ে এই ভাল নয় কী, তুমি একটা স্বামী বেছে নাও– পতিং বৃণীম্বেহ যমন্যমিচ্ছসি। এই যে একটা ভয়ংকর সময় এসে উপস্থিত তোমার স্বামীদের, আমরা চাই না এই সর্বনাশটা তোমাকেও স্পর্শ করুক। এখানে কৌরবদের মধ্যে মহাবীর এবং টাকা পয়সাওলা লোক অনেক আছে, তুমি একজনকে স্বামী হিসেবে বেছে নাও, ভাল থাকবে, সত্যিই ভাল থাকবে– এষাং বৃণীষ্কৈকতমং পতিত্বে/ ন ত্বাং নয়েৎ কালবিপর্যয়োহয়।

এটাকেই আধুনিক যৌনবৈজ্ঞানিক ভাষায় ‘টারগেটিং অথবা ‘অবজেটিফিকেশন’ বলে। অর্থাৎ যেহেতু দ্রৌপদীর স্বামী একান্ত বিধিসম্মতভাবেই পাঁচটি, কিন্তু পাঁচটি বলেই তাকে যে কোনও সময় যে কোনও অজুহাতে আরও অন্য যে কোনও লোকের শয্যাশঙ্গিনী হতে বলা যায় যেন। তবে এর সোজাসুজি উত্তর দ্রৌপদীর মতো মনস্বিনী রমণীর মুখে মানায় না বলেই, আবার দৃপ্ত পদচারণায় ভীমসেন উলটে ফিরে এসেছেন। দুঃশাসনকে চরম শাসিয়ে তাকে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন আবারও। কিন্তু ভীম যেহেতু তখনই কিছু করতে পারছেন না, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যুধিষ্ঠির-জ্যেষ্ঠের কথা রাখার জন্য তখনই যেহেতু গদাঘাতে দুঃশাসন-দুর্যোধনদের শেষ করতে পারছেন না, তাই তাঁর অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ভীমকেও কথা শোনাতে ছাড়লেন না দুঃশাসন। যেহেতু তিনি, একমাত্র তিনিই যেহেতু প্রতিহিংসায় প্রতিজ্ঞা-গ্রহণ করছেন দ্রৌপদীর হয়ে, অতএব তাকে দুঃশাসনের মুখে ‘গোরু’ সম্বোধন শুনতে হল এবং দুর্যোধন হাসিতে ফেটে পড়ে ভীমের প্রতিবাদী হেঁটে চলার অনুকরণ করে দেখাতে লাগলেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, ভীম কিছুই করতে পারছেন না, শুধু একের পর এক ধ্বংসের প্রতিজ্ঞা নিয়ে যাচ্ছেন।

এইগুলি দ্রৌপদীর স্ত্রীহৃদয়ে কাজ করেছে, কাজ করেছে স্বামীর সঙ্গে ব্যবহারেও। নকুল, সহদেব, অর্জুন, যুধিষ্ঠির সবাই চুপ, শুধু ভীম একের পর এক প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা নিয়ে যাচ্ছেন। দূতসভার মাঝখানে অসহায় দ্রৌপদী এবার বোধহয় বুঝতে পারলেন যাকে তিনি ভালবাসেন, সে বুঝি তাকে ভালবাসে না। কই গাণ্ডীবধন্বার মুখ দিয়ে একটি আওয়াজও তো বেরল না, কিছুই করতে নাই পারুন, অন্তত প্রতিবাদ। স্বামী আত্মসার, নাকি সে আপন স্ত্রীর গৌরবে মহিমান্বিত, তার রক্ষা বিধানে তৎপর, তা বোঝবার এই তো সময়। দ্রৌপদী স্বামীদের চিনে নিলেন। এরপর তিনি যতবারই বিপদে পড়েছেন, তিনি ভীমের কাছেই তা জানিয়েছেন, মহাভারতের উদাত্ত নায়ক অর্জুনকে নয়। উদ্ধত ব্যক্তিত্ব দ্রৌপদীর ভাল লাগে, ধীরোদাত্ত নায়কত্ব নয়। এই দূতসভায় অকর্মণ্য অক্ষম অর্জুনকে তিনি যেমন চিনলেন তেমনি চিনলেন যুধিষ্ঠিরকে ক্রোধহীন, আপন স্ত্রী-রক্ষায় অপারগ, প্রতিবাদহীন– শুধু ধর্মসার। পতিধর্মের জন্য যদি স্ত্রীধর্ম ত্যাগ করতে হয় তা হলে স্ত্রীলোকের কী রইল, বিশেষত যে নারী নিজেই অত ব্যক্তিত্বহীন নন। আগুন থেকে তার জন্ম, আগুন তাঁর স্বভাবে রয়েছে। সেই আগুনে যিনি চিরকাল সর্বনাশের হাওয়া লাগিয়েছেন, তিনি বায়ুপুত্র ভীম, অন্য কেউ নন। দ্বিতীয়বার পাশা খেলায় হেরে পাণ্ডবদের যখন বনে যাওয়া ঠিক হল, তখন দুঃশাসন দ্রৌপদীকে বলেছিল– তুমি আবার বনে যাচ্ছ কেন, সুন্দরী! চাল ছাড়া যেমন ধানের খোসা, পশুর চামড়া পরা খেলনা যেমনটি, পাণ্ডবরাও ঠিক তেমনি এদের সেবা করে তুমি কী করবে?

কেউ এসব কথার প্রতিবাদ করেননি। সুকুমারী কৃষ্ণারও আর দুঃশাসনের সঙ্গে কথা বলার প্রবৃত্তি ছিল না। সিংহ যেমন শেয়ালের দিকে ধেয়ে আসে, তেমনি ভীম এবার ধেয়ে এলেন দুঃশাসনের দিকে। আবার সেই প্রতিজ্ঞা– বুক চিরে রক্ত খাব। একেবারে শেষে বুঝি সবাই এবার খেপে উঠলেন, অর্জুন, নকুল, সহদেব– সবাই। সবাই এবার ভীমের সঙ্গে গলা মিলিয়ে প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা নিলেন। কিন্তু প্রথমে ভীম। কৃষ্ণা আবার তাকে চিনলেন।

একটা কথা এখানে বলে রাখাই ভাল। রামায়ণের সীতা এবং মহাভারতের দ্রৌপদী– এই দু’জনেরই একমাত্র মিল হল যে তারা অযযানিসম্ভবা– অর্থাৎ কিনা তাদের জন্মে অলৌকিকতার গন্ধ আছে। কিন্তু এই দুই মহাকাব্যের নায়িকা-চরিত্র এত বিপরীত যে ভয়। হয়– একের পরিস্থিতিতে আরেকজন পড়লে কী করতেন। কল্পনা করতে মজা পাই– যদি দণ্ডকবনে লক্ষ্মণের গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে এসে দ্রৌপদী ভিক্ষা দিতেন রাবণকে, তবে হয়। তাপসবেশী রাবণের দাড়ি-গাছি উপড়ে দিতেন দ্রৌপদী; আর সীতা যদি শ্লথবাসা হতেন উন্মুক্ত রাজসভায় তবে তিনি তক্ষুনি ধরণী দ্বিধা হবার মন্ত্র পড়ে চিরতরে ঢুকে পড়তেন পাতালে; মহাভারত কাব্যখানাই অর্ধসমাপ্ত রয়ে যেত৷ যদি বলেন রাজসভায় দ্রৌপদীই বা এমন কী করেছেন যে, আমরা তার গুণপনায় মুগ্ধ হচ্ছি। আমি বলব অনেক কিছু করেছেন, যা সর্বংসহা সীতার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সীতাকে যদি রামচন্দ্র বলতেন যে তুমি সভায় এসে শ্বশুরের সামনে কান্নাকাটি কর তা হলে তাই করতেন। তার পক্ষে কি রামচন্দ্রকে ‘জুয়াড়ি’ সম্বোধন করে এই প্রশ্নটা করা সম্ভব হত যে, পাশাখেলায় আগে নিজেকে বাজি রেখে হেরেছেন, না আগে তাঁকে বাজি রেখেছেন কিং নু পূর্বং পরাজৈষীরাত্মানাম্ অথবা নু মাম?

এ তো রীতিমতো ‘ল-পয়েন্ট। সভাসদদের কারও পক্ষে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রাতিকামী, যে দ্রৌপদীকে নিতে এসেছিল, সেও বুঝতে পেরেছিল প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন দুর্যোধনও, যার জন্যে প্রাতিকামী দ্বিতীয়বার বলেছেন– তা হলে আমি রাজকুমারী কৃষ্ণাকে কী বলব– উবাচ কৃষ্ণাং কিমহং ব্রবীমি? দুর্যোধন বলেছেন প্রাতিকামী ভীমকে ভয় পাচ্ছে। তা মোটেই নয়। সে দ্রৌপদীকেই ভয় পাচ্ছিল– স্ত্রীলোকের কাছে এমন সাংঘাতিক আইনের প্রশ্ন শুনেই সে দ্রৌপদীর ওজন বুঝেছে– ভীতশ্চ কোপা দ্রুপাত্মজায়াঃ। দ্রৌপদীর মুখে আইনের প্রশ্ন শুনে সভাসদ কুরুবৃদ্ধেরা যে চুপ করে গেলেন তার কারণ একটাই। বাপের বাড়িতে দ্রৌপদী কিছু কিছু শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তার বাবা দ্রুপদ বাড়িতে পণ্ডিত রেখে ছেলে ধৃষ্টদ্যুম্নের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। দ্রৌপদী যে। তার কাছ থেকে এবং ভাইয়ের কাছ থেকেও বিদ্যা শিখে নিতেন সে-কথা দ্রৌপদী নিজেই কবুল করেছেন মহাভারতের বনপর্বে। আর আইনের ব্যাপারে দ্রৌপদীর আগ্রহ ছিল বিশেষ রকম। তখনকার দিনে আইনের বই বলতে বৃহস্পতিসংহিতা, শুক্ৰসংহিতা– এই সবই ছিল। ঘরে রাখা সেই পণ্ডিতের কাছে বৃহস্পতি-নীতির পাঠ নিতেন প্রধানত দ্রুপদ রাজা। কিন্তু আইনের ব্যাপারে দ্রৌপদীর এত আগ্রহ ছিল যে ওই পাঠ-গ্রহণের সময় তিনি কোনও কাজের অছিলায় চলে আসতেন সেইখানে, যেখানে গুরুজি বৃহস্পতি পড়াচ্ছেন। দ্রৌপদীর আগ্রহ দেখে গুরুজিও তাকে সস্নেহে বৃহস্পতি-নীতির উপদেশ দিতেন এবং বাবার আদরের দুলালী সঙ্গে সঙ্গে বাবার কোলে বসে যেতেবৃহস্পতির লেখা আইন বোঝবার জন্য স মাং রাজন কর্মবতীম আগতামাহ সান্ত্বয়। শুশ্রুষমাণাম আসীনাং পিতুরঙ্কে যুধিষ্ঠির।

বনে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন পাণ্ডব ভাইরা। সকলের কাছে অনুমতি নিয়ে পাণ্ডবরা বেরোবার উপক্রম করলে দ্রৌপদী কুন্তীর কাছে বিদায় নিতে এলেন। মহাভারতে দ্রৌপদীর সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডবের বিবাহের পর থেকেই শাশুড়ি হিসেবে কুন্তীকে আমরা অনেকটাই সমাপ্ত-কৃত্যা জননীর ভূমিকায় দেখেছি। হয়তো অতি উপযুক্ত পুত্রবধূর হাতে পুত্রদের হৃদয়-ভার ন্যস্ত করে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন বলেই খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। তার মধ্যে ইন্দ্রপ্রস্থে পুত্রদের রাজ্যপ্রাপ্তিতে এই নিশ্চিন্ততা আরও বেড়েছিল হয়তো। কিন্তু বিপদ যেভাবে নেমে আসল, তাতে ভীষণ রকমের কষ্ট পেলেও কুন্তী কিন্তু ধৈর্য হারাননি। পুত্রদের তিনি বিদায় দিয়েছেন এবং রামায়ণে রামের বনবাসে জননী কৌশল্যার মতো বিলাপ করতেও দেখিনি। কিন্তু এই বিদায়-বেলায় দ্রৌপদীকে দেখে কুন্তী যেন আর সইতে পারলেন না। অতিকষ্টে দ্রৌপদীর ওপর তার অনন্ত আস্থার কথা জানিয়ে কুন্তী বললেন– তুমি কষ্ট পেয়ো না, বাছা বৎসে শোকো ন তে কাৰ্যঃ প্রাপ্যেদং বসনং মহৎ। স্বামীদের বিষয়ে তোমার কর্তব্য কী, সেটা তোমায় বলে দিতে হবে না আমি জানি। এই কৌরবসভায় যা তোমার সঙ্গে হয়েছে, তাতে এটাই বলতে হবে– কৌরবরা অনেক ভাগ্যবান, এখনও যে তোমার চোখের তীব্র চাউনিতেই তারা ধ্বংস হয়ে যায়নি, তুমি দগ্ধ করোনি বলেই তারা দগ্ধ হয়নি, এটাই তাদের ভাগ্য– সভাগ্যাঃ কুরবশ্চেমে যে ন দগ্ধাস্ত্ৰয়ানঘে।

পাঁচ স্বামীর সঙ্গে কীভাবে এই কষ্টকর দিন কাটাতে হবে কুন্তী একবারও সে-পথে যাননি। কিন্তু একজন শুধু একজনের জন্য কুন্তী দ্রৌপদীকে যা বলেছেন, তাতে পঞ্চস্বামীর সঙ্গে দ্রৌপদীর ব্যবহারের একটা অদ্ভুত চিত্র ফুটে ওঠে। কুন্তী যুধিষ্ঠির-ভীম কারও কথা বলেননি, কিন্তু সপত্নী মাদ্রীর কনিষ্ঠ ছেলেটিকে তিনি যেহেতু বড় ভালবাসতেন, তাই তার কথাটা না বলে পারলেন না। কুন্তী বললেন– এই বনবাসকালে আমার কনিষ্ঠ পুত্র সহদেবকে তুমি সবসময় একটু দেখে রেখো– সহদেবশ্চ মে পুত্রঃ সদাবেক্ষ্যো বনে বসন– দেখো কোনও বিপদে পড়ে আমার এই ছেলেটি যেন অবসাদগ্রস্ত না হয়। কুন্তী বলেছিলেন– তোমার মধ্যে যেমন পাতিব্ৰত্যের গুণ আছে, তেমনই আমার কথা তুমি যথেষ্ট ভাবো বলেই মদনুধ্যানবৃংহিতা- আমার মতো মায়ের গুণও তোমার মধ্যে আছে। তুমি দেখো, মা-মরা ছেলে আমার সহদেব, সে যেন আমাকে ছেড়ে মা-হারানোর দুঃখ না পায়– যথেদং ব্যসনং প্রাপ্য নায়ং সীদেমহামতিঃ। বস্তুত জননী কুন্তী নিজের ছেলেদের চেয়েও সহদেবকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন বলেই তার ‘অনুধ্যানে দ্রৌপদীর মধ্যেও শৃঙ্গারের চেয়েও সহদেবের প্রতি বাৎসল্যের আধিক্য ছিল হয়তো।

খুব যে এটা অস্বাভাবিক কথা হয়ে গেল, তা নয়। তবে কিনা সম্পূর্ণ শৃঙ্গারাধার এক স্বামীর প্রতি কোনও স্ত্রী বাৎসল্য দেখাতে পারছেন কিনা অবশ্যই নির্ভর করে স্বামী বা স্ত্রীর নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর। অর্থাৎ কিনা স্বামীর চরিত্রের মধ্যেও যদি বাৎসল্য লাভের একটা পরমাকাঙ্ক্ষা থাকে এবং স্ত্রীর মধ্যেও তা দেবার ক্ষমতা থাকে, তবে শৃঙ্গার রসের গৌণতায়, শৃঙ্গার বাৎসল্যে পরিণত হয়। তবে কিনা এটা সর্বাঙ্গীণ সত্য যে, মেয়েরাই যেহেতু মা হন, সন্তানের জন্ম দেন, তাকে লালন করেন, তাই স্নায়বিক কারণেই হোক, অথবা রসতাত্ত্বিক দিক থেকে অখিল-বাৎসল্যের বীজভূমি বলেই তোক একটি মেয়ের মধ্যে শৃঙ্গার-ভাবনার অন্তরালেও এক সজীব বাৎসল্য থাকে যা অনেক সময়েই শৃঙ্গার-রসকে পুষ্ট করে প্রত্যক্ষে পরোক্ষে।

ঠিক এইরকম একটা তাত্ত্বিকতায় এক রমণীর হৃদয়-সরসতা বিচার করলে দ্রৌপদীর সুবিধে ছিল অনেক বেশি। প্রত্যেক রমণী-হৃদয়েই যে বহুতর ভাব-সরসতা নিহিত থাকে, তা একক-স্বামীর আধারেই প্রথমত মিটিয়ে নিতে হয়, পরিশেষে পুত্র-পরিজনের আধারে তা পৃথক আলম্বনও খুঁজে পায়। কিন্তু দ্রৌপদীর স্বামীর সংখ্যা যেহেতু পাঁচ, তাই শান্ত-দাস্য সখ্য-বাৎসল্য-মধুরকে তিনি পঞ্চোপাসনায় পৃথকভাবেই বিতরণ করতে পেরেছেন। কথাটা এমন ছক কষা পণ্ডিতি গবেষণার মতো করে কোন স্বামীর প্রতি কোন রস কতটা, এই পরিমাপ-সূক্ষ্মতায় গ্রহণ করবেন না, বরঞ্চ এ-ক্ষেত্রে সহদেবের কথাটাই যদি বিশেষভাবে দেখি, তা হলে দেখব– সহদেবের প্রতি কুন্তীর বৎসলতা দ্রৌপদীর মধ্যেও যে সংক্রান্ত হয়েছিল, তার প্রমাণ আছে মহাভারতের বনপর্বে, বিরাট পর্বে এবং অন্যত্রও।

বিরাটের রাজবাড়িতে কীচকের তাড়নায় অতিষ্ঠ হয়ে দ্রৌপদী যখন ভীমের কাছে। নালিশ জানাতে এসেছিলেন, তখনও এই সহদেবের জন্য মায়ায় তাঁর বাক্য অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি, সহদেবের জন্য দ্রৌপদীর মমতা প্রায় কুন্তীর মতোই। বাস্তবে সহদেবের স্বামিত্বের নিরিখে অতিরিক্ত মায়া দেখানো যেহেতু খারাপ দেখায়, দ্রৌপদী তাই সহদেবের ওপর তার অসীম মমত্ব প্রকাশ করেন কুন্তীর জবানিতেই। বিরাটপর্বে ভীমের কাছে তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন– আমার মনে শান্তি নেই একটুও। সহদেবের কথা ভেবে ভেবে রাতে আমার ঘুমই আসে না, তায় শান্তি– ন নিদ্রাম অভিগচ্ছামি ভীমসেন কুততা রতি। দ্রৌপদী বললেন– বনে আসবার আগে জননী কুন্তী আমার হাত ধরে বলেছিলেন দ্রৌপদী। রাত-বিরেতে আমার সহদেবকে একটু দেখে রেখো, তুমি নিজ হাতে ওকে খাইয়ে দিয়ে স্বয়ং পাঞ্চালি ভোজয়েঃ।

এসব কথা থেকে বোঝা যায়, সহদেব হয়তো ঘুমের ঘোরে গায়ের চাদর ফেলে দিতেন, হয়তো তিনি নিজহাতে জুত করে খেতে পারতেন না, অতএব জননী কুন্তীর সমস্ত মাতৃস্নেহ দ্রৌপদীর বধূহৃদয়ে এক মিশ্ররূপ নিয়েছিল। যার জন্য মুখে তিনি সহদেবকে ‘বীর’ ‘শূর’– এইসব জব্বর জব্বর বিশেষণে ভূষিত করলেও মনে মনে ভাবতেন– আহা ওই কচি স্বামীটার কী হবে– দূয়ামি ভরতশ্রেষ্ঠ দৃষ্টা তে ভ্রাতরং প্রিয়ম। দ্বৈতবনে এসে দ্রৌপদী যখন নির্বিকার যুধিষ্ঠিরকে বেশ পাঁচ-কথা শুনিয়ে দিলেন, তখন ভীম আর অর্জুনের কথা উল্লেখ করে দ্রৌপদী বলেছিলেন– এঁরা এইরকম মহাবীর, তবুও এঁদের বনে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু নকুল-সহদেব, বিশেষত সহদেবের কথা যখন উঠল, তখন দ্রৌপদী বললেন– সহদেবকে বনের মধ্যে দেখেও তোমার মায়া লাগছে না, তুমি নিজেকে ক্ষমা করছ কী করে? নকুল সহদেব, যারা নাকি জীবনে কষ্টের মুখ দেখেনি, তাদের দুঃখ দেখেও কি তোমার রাগ হচ্ছে না?

ভীম-অর্জুনের বেলায় বীরতা, আর নকুল-সহদেবের বেলায় তাদের দুঃখই দ্রৌপদীর কাছে বড় হয়ে উঠেছে। ভাবে বুঝি, যমজ এই ভাই-দুটির ওপর দ্রৌপদীর রসাপ্লতি যতখানি ছিল, তার চেয়ে মায়া এবং বাৎসল্যই ছিল বেশি। অন্যদিকে সহদেব কিন্তু দ্রৌপদীকে আপন গিন্নি ভেবে বড়ই গর্বিত বোধ করতেন। ছোট বলে সহদেবের অনেক ছেলেমানুষি ছিল, নিজেকে ছেলেমানুষের মতো একটু প্রাজ্ঞও ভাবতেন তিনি– আত্মনঃ সদৃশং প্রাজ্ঞং নৈযোহমন্যত করুন। ঠিক এই কারণেই বুঝি কুরুসভায় পাঞ্চালীর যে অপমান হয়েছিল, তার প্রতিশোধের ভার তিনি একা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। উদ্যোগপর্বে কৃষ্ণ যখন পাণ্ডবদের হয়ে কুরুসভায় দূতীয়ালি করতে যাচ্ছিলেন, তখন সমস্ত পাণ্ডবেরা, এমনকী ভীম পর্যন্ত বারবার শান্তির কথা বলেছিলেন। এই লোকক্ষয়কর যুদ্ধ যাতে না হয় তার জন্য সমস্ত পাণ্ডবেরা ছিলেন উদগ্রীব। কিন্তু যখন সহদেবকে বলতে বলা হল, তখন তিনি আচমকা বলে উঠলেন– যুধিষ্ঠির যা বলেছেন তাই সনাতন ধর্ম বটে, কিন্তু কৃষ্ণ! তুমি সেই চেষ্টাই করবে যাতে যুদ্ধ বাধে। এমনকী যদি কৌরব নায়কেরাও পাণ্ডবদের সঙ্গে শান্তি স্থাপনে আগ্রহী হন, তবু কিন্তু যুদ্ধ বাধানোর চেষ্টা করবে। কুরুসভায় পাঞ্চালীকে যে অপমান আমি সইতে দেখেছি, দুর্যোধনকে না মেরে তার শোধ তোলা অসম্ভব। কৃষ্ণ! যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন এঁরা ধার্মিক মানুষ, তাই তারা যুদ্ধশান্তির কথা বলছেন, কিন্তু আমি ধর্মের বাঁধ ভেঙে দিয়ে একাই যুদ্ধ করতে চাই– ধর্ম উৎসৃজ্য তেনাহং যোঙ্কুমিচ্ছামি সংযুগে।

যে কনিষ্ঠ ছেলেটি দ্রৌপদীর অপমানে উত্তেজিত, ধর্মের বাঁধ ভেঙে যুদ্ধে একাই প্রাণ দিতে চায়, তার প্রেমরহস্য যতই একতরফা হোক না কেন, দ্রৌপদী তাকে বাৎসল্যে বন্দি করেছিলেন, যে বাৎসল্যকে সে প্রেম বলে ভুল করেছিল। অন্যথায় দ্রৌপদীর প্রেম বড় সহজলভ্য নয়। যে বিশালবপু বৃষস্কন্ধ মানুষটি দ্রৌপদীর জন্য কত শতবার প্রতিজ্ঞা করেছেন, সেই মধ্যম পাণ্ডব ভীমও যে দ্রৌপদীর প্রেমের স্বাদ সম্পূর্ণ পেয়েছেন তা আমরা মনে করি না। অথচ দ্রৌপদী ভীমের কাছে মাঝে মাঝে এমনভাবে আত্মনিবেদন করেছেন যে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে যেন ভীমের মধ্যে তিনি মনের মানুষ খুঁজে পেয়েছেন। আসলে এই মধ্যম পাণ্ডব নিজেই দ্রৌপদীকে এত ভালবাসতেন যে দ্রৌপদীকে মাঝে মাঝেই তার কাছে আত্মনিবেদন করতে হয়েছে। এত বড় বিশাল মাপের মানুষকে তো আর সহদেবের মতো বাৎসল্যরসে সিঞ্চিত করা যায় না। তবে এই যে আত্মনিবেদন, এ কিন্তু প্রেমের আত্মনিবেদন নয়, এ শুধু বিশ্বাস। চিরমুগ্ধ মধ্যম পাণ্ডবকে তিনি মাঝে মাঝেই কাজে লাগিয়েছেন, এমন কাজ যা অন্যের দ্বারা হবে না। আর দ্রৌপদীর লাবণ্যে, বৈদগ্ধ্যে আত্মহারা ভীম বারবার সেই দুরূহ কর্মগুলি করেছেন প্রিয়ার মন পাবেন বলে।

আপন স্বয়ম্বর লগ্নে দ্রৌপদী নিশ্চয়ই লক্ষ করেছিলেন যে, লক্ষ্যভেত্তা পুরুষটির সঙ্গে আরও একজন শক্তিধর পুরুষ সমস্ত রাজমণ্ডলকে একেবারে নাজেহাল করে তুলেছে। সেই মানুষটি অন্যের মতোই তাকে দেখে মুগ্ধহৃদয়ে বরণ করেছিল। অথচ দ্রৌপদী পাঁচভাগ হয়ে গেলেন। কিন্তু এই মুগ্ধতার কথা মনে রেখেই বিদগ্ধা দ্রৌপদী তার এই পরম বিশ্বস্ত পতিটিকে এমন কোনও কর্মভার দিতেন, যাতে ভীম ভাবতেন– দ্রৌপদীর পক্ষপাত বুঝি তার ওপরেই। এর মধ্যে অর্জুন নামক উদাত্ত পুরুষটির মধ্যে যে ঈর্ষা জাগানোর ব্যাপার আছে, তা ভীম বুঝতেন না। তার ওপরে অর্জুন যখন তপস্যা ইত্যাদি নানা কারণে বাইরে গেছেন, তখন দ্রৌপদী এমন ভাব করতেন যেন ভীমই তার মালঞ্চের একমাত্র মালাকর।

মনে করুন সেই দিনটির কথা। অর্জুন গেছেন দেবলোকে, অস্ত্র সন্ধানে। বহুদিন হয়ে গেল তিনি ফেরেন না। লোমশ মুনির কথায় অন্য পাণ্ডবেরা গন্ধমাদন পর্বতে এলেন যদি অর্জুনের সঙ্গে দেখা হয়। পাহাড়ের চড়াই-উতরাই ভাঙতে গিয়ে পথশ্রান্তা দ্রুপদ রাজার দুলালী কৃষ্ণা হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। তবু টাল রাখতে পারলেন না, একেবারে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। তাকে প্রথমে দেখতে পেলেন নকুল। কোনওমতে তাকে ধরে ফেলেই নকুল অন্য ভাইদের ডাকতে লাগলেন। দৌড়ে এলেন যুধিষ্ঠির, ভীম, সহদেব। নিজের কোলে দ্রৌপদীর মাথা রেখে ধর্মরাজ খানিকক্ষণ বিলাপ করলেন– সাত-পুরু বিছানায় যার শুয়ে থাকার কথা, আমার জন্যে তার কী অবস্থা–ইত্যাদি ইত্যাদি। বারবার পাণ্ডবেরা ঠান্ডা হাতে তাকে স্পর্শ করে, মুখে জলের ছিটে দিয়ে হাওয়া করে– জলমিশ্রেণ বায়ুনা– দ্রৌপদীর জ্ঞান ফিরিয়ে আনলেন। কিন্তু জ্ঞান ফিরলেই দেখা গেল ধর্মরাজ তার কোলে-মাথা-রাখা দ্রৌপদীকে অনেকভাবে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন– অর্থাৎ কিনা, এখন কেমন লাগছে, একটু ভাল বোধ করছ কি– পর্যাশ্বাসয়দ অপ্যেনা। অন্যদিকে নকুল-সহদেব সেই তখন থেকে দ্রৌপদীর রক্ততল পা-দুখানি টিপেই চলেছেন– তস্যা যমৌ রক্ততলৌ পাদৌ পূজিতলক্ষণৌ… সংববাহতুঃ। হ্যাঁ, অসুখে পড়লে স্ত্রীর পা টিপলে। দোষ কী, কিন্তু আমাদের ধারণা, অসুখে না পড়লে, মানে সুখের দিনেও নকুল-সহদেবের ওই একই গতি ছিল। এদিকে মাথা আর পা-দুখানি তিন পাণ্ডবের মধ্যে ভাগ হয়ে যাওয়ায় ভীমের পক্ষে যেহেতু আর কোনও অঙ্গসংবাহন সম্ভব ছিল না, অতএব হতচকিত হয়ে তিনি দাঁড়িয়েই ছিলেন। ধর্মরাজ মুখ তুলে বললেন– এই বন্ধুর গিরিপথ দ্রৌপদীর পক্ষে আর অতিক্রম করা সম্ভব নয়, ভীম! ভীম বললেন, এ ব্যাপারে আপনি কোনও চিন্তাই করবেন না, সব ভার আমার। আমি বরং আমার পুরনো ছেলে ঘটোৎকচকে স্মরণ করছি। সে হাওয়ার গতিতে সবাইকেই নিয়ে যেতে পারবে। ব্যবস্থা হল, পাণ্ডবেরা অর্জুনকে রাস্তায় ধরে ফেলার আশায় নিসর্গরাজ্য গন্ধমাদনে প্রবেশ করলেন।

হিমালয়ের বিচিত্র মনোরম পরিবেশে পাণ্ডবেরা এবং দ্রৌপদী বিমলানন্দে দিন কাটাচ্ছেন। এমনই এক দিনে না-জানা দিঘির এক সহস্রদল পদ্ম হাওয়ায় উড়ে এসে দ্রৌপদীর পায়ের কাছে মাটিতে পড়ল। সূর্যের কিরণ-মাখা সে পদ্মের যেমন রং, তেমনই তার গন্ধ। দ্রৌপদী বায়না ধরলেন, ভীমের কাছে বায়না ধরলেন– দেখেছ কী সুন্দর পদ্ম, যেমন রং, তেমনই গন্ধ। আমাকে যদি তুমি ভালবেসে থাক– যদি তেহহং প্রিয়া পার্থ– তা হলে এই পদ্ম আরও অনেক, অনেক আমায় এনে দিতে হবে ভীম! আমি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সেই পদ্ম উপহার দেব– ইদঞ্চ ধর্মরাজায় প্রদাস্যামি পরন্তপ। বুঝুন অবস্থা, মেজস্বামী ভীমসেন কোথায় মাঠ-ঘাট খুঁজে দিব্যগন্ধ পদ্ম নিয়ে আসবেন, আর সেই পদ্মগুলি যাবে জ্যেষ্ঠ স্বামী যুধিষ্ঠিরের ভোগে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার সময় দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের কোলে শুতে পেরেছিলেন বলেই নাকি– অঙ্কমানীয় ধর্মাত্মা– জানি না, দ্রৌপদী দূতসভার অপমান ভুলে ধর্মরাজকে সৌগন্ধিক উপহার দিতে চাইলেন এবং সে উপহারের ব্যবস্থা করবেন ভীম। শুধু তাই নয় দ্রৌপদীর ইচ্ছে- দু’-পাঁচটা পদ্মফুলের গাছ যদি গোড়াশুদ্ধ উপড়ে আনা যায় তবে সেগুলি কাম্যক বনে পুঁতেও দেওয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য, কাম্যক বন পাণ্ডবদের বনবাস লগ্নে প্রথম অরণ্য, প্রথম প্রথম বনবাসে দ্রৌপদীর বুঝি সে অরণ্য ভারী। ভাল লেগেছিল। ভীমের কাছে বায়না ধরে দ্রৌপদী ছুটলেন ধর্মরাজের কাছে। যে একগাছি পদ্ম হাওয়ায় উড়ে এসেছিল, সেটিও তিনি নিবেদন করতে চান ধর্মরাজের হৃদয়ে। এদিকে ভীম প্রিয়ার ইচ্ছে পূরণ করার জন্যে প্রিয়ায়াঃ প্রিয়কামঃ চলে গেলেন সেই সহস্রদল পদ্ম জোগাড় করার জন্য।

সে কি সোজা কথা। গিরি-দরী, নদ-নদী পেরিয়ে, হাজারো বনস্থলী তছনছ করে, শেষে পূর্বজন্মের দাদা হনুমানের উপদেশ নিয়ে ভীমসেন গন্ধমাদনের বিশেষ বিশেষ জায়গায় সূর্যবরণ পদ্ম খুঁজে চললেন। তাঁর সদা সজাগ চোখ দুটি ছিল শুধু পর্বতসানুদেশে ফোঁটা ফুলের রাশির ওপর, আর পাথেয় ছিল দ্রৌপদীর বাক্য। দ্রৌপদী যে বলেছেন– যদি তুমি আমাকে একটুও ভালবাস, ভীম, আমাকে পদ্ম এনে দিতেই হবে। ভীম আরও তাড়াতাড়ি চললেন- দ্রৌপদীবাক্যপাথেয়ো ভীমঃ শীঘ্রতরং যযৌ। শেষে এক হরিণ-চরা বনের ধারে, হাঁস আর চখাচখীর শব্দ-মুখর নদীর মধ্যে ভীম দেখলেন সেই পদ্ম– হাজার, হাজার, যেন পদ্মের মালা সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে নদীর মধ্যে। পদ্মগুলি দেখার পরেই মহাবলী ভীমের যে প্রথম প্রতিক্রিয়া হল, সেটি ভারী সুন্দর করে লিখেছেন ব্যাসদেব। ভীমের প্রতিক্রিয়ায় তার একান্ত প্রেমের সঙ্গে করুণা মাখিয়ে দিয়েছেন চরিত্রচিত্রী ব্যাসদেব। পদ্মগুলি দেখেই ভীম যেন সব পেয়েছির দেশে পৌঁছে গেলেন– তদ দৃষ্টা লব্ধকামঃ সঃ। পুষ্পদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে ভীমের মন যেন প্রিয়া দ্রৌপদীর সান্নিধ্য লাভ করল, যে দ্রৌপদী রাজার দুলালী হয়েও বনবাসের কষ্টে মলিন– বনবাসপরিক্লিষ্টাং জগাম মনসা প্রিয়াম। তারই কষ্টার্জিত ফুল দিয়ে কৃষ্ণা ধর্মরাজের প্রিয় সাধন করবেন, এই কুটিলতা ভীমের মনে ছিল না। কৃষ্ণা মুখ ফুটে ফুল চেয়েছেন– এইটেই তাঁর কাছে বড় কথা ছিল। যার জন্য ফুল পাওয়া মাত্র তিনি লব্ধকাম, দ্রৌপদীর উষ্ণ সান্নিধ্য লাভ করেছেন মনে মনে। ভীম নিজে সরল মানুষ, তার ভালবাসাও সরল। বিশেষত পদ্ম পাওয়া মাত্রেই তার মনে যে কৃষ্ণার মলিন মুখখানি ভেসে উঠেছে তাতে বোঝা যায় নিজে সঙ্গে থাকলেও দ্রৌপদীর বনবাস তিনি কোনওদিন সহ্য করতে পারেননি।

ভীম যে দ্রৌপদীর জন্য পদ্মবনে গেছেন সে-কথা যুধিষ্ঠির জানতেন না। কাজেই ভীমকে বহুক্ষণ না দেখে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে দ্রৌপদীকেই ভীমের কথা জিজ্ঞেস করলেন। তখন কিন্তু এই বিদগ্ধা মহিলা– তোমায় সাজাব যতনে কুসুম-রতনে–ইত্যাদি প্রেমালাপ যুধিষ্ঠিরকে উপহার দেননি। তিনি বললেন- ওই যে অপূর্ব পদ্মফুল, সেইগুলিই অনেকগাছি আমি ভীমকে আনতে বলেছি। আমার প্রিয় সাধনের জন্য প্রিয়ার্থং মম পাণ্ডবঃ- তিনি বোধহয় গেছেন আরও উত্তরে। ঠিক কথাটাই দ্রৌপদী মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন। ভীমকে তিনি কত ভালবাসতেন, সে বিসংবাদে কাজ নেই, তবে তার ভাল লাগবে বলে, শুধুমাত্র তাঁর ভাল লাগবে বলে কত দুঃসাহস যে ভীম দেখিয়েছেন তা বলবার নয়। আর ঠিক এইসব জায়গায় মহারাজ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিপ্রতীপ আচরণও লক্ষ করার মতো। ভীমের সঙ্গে দ্রৌপদীর সম্পর্ক যাই থাকুক, তার সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের সম্পর্কটিও খেয়াল করে যেতে হবে।

সত্যি কথা বলতে কী, যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে দ্রৌপদী ঠিক কী পেলেন, তা বোঝবার আগেই তাঁর বনবাস-পর্ব শুরু হয়ে গেছে। যদি শব্দমন্ত্রে পঞ্চম লাগিয়ে দিই এবং মহাভারতে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা দ্রৌপদীর প্রণয়সূচক বচনাংশ তুলে ধরে প্রমাণ করতে চাই যে, যুধিষ্ঠিরই দ্রৌপদীর আসল প্রাণনাথ, তা হলে আমার মতে সেটা বড় আধ্যাত্মিক বাড়াবাড়ি হবে। প্রথমত এমন অমলিন ব্যক্তিত্ব এবং সতত জাজ্বল্যমান আত্মসচেতনতা নিয়ে এককভাবে কাউকে ভালবাসাই দ্রৌপদীর পক্ষে অসম্ভব ছিল বলে আমরা মনে করি। সেখানে যুধিষ্ঠির কখনও তার ব্যক্তিত্বের জায়গাটায় ভীষণ রকমের অনুকূল হয়ে ওঠেননি। এই বৈবাহিক সময়ে পঞ্চস্বামীর একক বন্ধু বলেই ইন্দ্রপ্রস্থে রাজা যুধিষ্ঠিরের পাশে প্রথাসিদ্ধ রানি হওয়ার সুবাদ ছাড়া এমন কোনও ঘটনাই ঘটেনি, যা তাকে যুধিষ্ঠিরের প্রতি কোমল করে তোলে। সুরসৌগন্ধিক পুষ্প যুধিষ্ঠিরকে দেবার মধ্যেও ক্ষণিক যুধিষ্ঠিরের প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে ওঠাটা দ্রৌপদীর বিকীর্ণ শৃঙ্গার-সরস হৃদয়ের একটি বর্ণাভাসমাত্র। সেটা ভীষণ প্রকটও হয়ে ওঠে, যখন যুধিষ্ঠির ভীমকে না দেখে দ্রৌপদীকে প্রশ্ন করেন– পাঞ্চালী! কোথায় গেছে ভীম? কী করতে গেছে সে কচ্চিৎ ক ভীমঃ পাঞ্চালি কিঞ্চিৎ কৃত্যং চিকীর্ষতী! এবং দ্ৰৌপদী নির্মোহ উত্তর দেন– আমার ভাল লাগবে বলে, সে ফুল আনতে গেছে। ঠিক এইখানে যুধিষ্ঠিরের প্রতি ক্ষণিক সরসতা প্রকট করার চেয়েও ভীম তার কতটা বশংবদ– এটা প্রকট করে তোলাটা দ্রৌপদীর অনেক বড় দায় ছিল। তিনি এমন করেই ভালবাসতে ভালবাসেন।

বনযাত্রার কালে কুন্তীর কাছ থেকে বিদায় নেবার পর দ্রৌপদী তার চরম প্রতিশোধ স্পৃহা লুকিয়ে রাখেননি। তখনও তিনি রজস্বলা, একখানি বস্ত্রে দেহ আবৃত করে হস্তিনাপুর থেকে বেরোচ্ছেন, কিন্তু চুলগুলি পুরো ভোলা এবং চোখে জল। বিদুর এই চেহারার মধ্যে অন্য অর্থ খুঁজে পেয়েছেন। তার মতে দ্রৌপদী নাকি বোঝাতে চাইছেন যারা আজ আমার এই অবস্থা করেছে, তাদের বউরাও আজ থেকে চোদ্দো বছর পরে স্বামী-পুত্র-স্বজন হারিয়ে বিধবা-অবস্থায় এইরকমই মুক্তকেশে গঙ্গায় তর্পণ করে বাড়ি ফিরবে। বস্তুত কুরুবাড়ির নিরীহ বউদের প্রতি দ্রৌপদীর কোনও বিরূপতা ছিল বলে আমরা মনে করি না। বরঞ্চ এই ভাবনার মর্ম যতখানি কৌরবদের মৃত্যু-কামনার তাৎপর্য বহন করে, ততখানি তাদের বউদের বিধবা দেখার তৃপ্তিতে নয়। একইভাবে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে তার বাদ-প্রতিবাদের অংশগুলিকেও যাঁরা প্রণয়াত্মক দাম্পত্য হিসেবে দেখতে চান, অথবা কখনও তাকে মেনে নেওয়াটাকে যদি যুধিষ্ঠিরের প্রতি বশংবদতা হিসেবে দেখতে চান, তা হলে এটাই আগেভাগে জানাব যে, মহাকাব্য মহাভারত প্রেম-ভালবাসার ব্যাপারে কোনও জটিল মোহস্পন্দন তৈরি করে না। প্রণয়, মোহ, মান এবং ক্রোধের মতো বৃত্তিগুলি এখানে ‘সারফেস’ থেকেই ধরা পড়ে। দ্রৌপদীকে নিয়ে পাণ্ডবরা বনে এলেন এবং বনপথ পাণ্ডবদের কাছে নতুন বস্তু নয়, জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচে তাদের বনে বনে ঘুরতে হয়েছে। বিবাহের পূর্বকাল পর্যন্ত, কিন্তু দ্রৌপদীর কাছে বনের পথ নতুন বটে। রামায়ণের সীতার মতো স্বামীর প্রিয়তায় তিনি বনকে স্বামী-সংসর্গে স্বর্গ বলে মেনে নিতে পারেননি।

বনে বাস করতে গেলে যেসব উপদ্রব ঘটে, তার প্রথম প্রতীকী উপস্থাপন ঘটেছে কির্মীর রাক্ষসকে দিয়ে। মহাভারতের কবি প্রথমেই বুঝিয়ে দিলেন– এই ধরনের অদ্ভুত সন্ত্রাসের সঙ্গে দ্রৌপদী একেবারে অভ্যস্ত নন। এমনকী এমনটা কল্পনাও করতে পারেন না বলে ভয়ে তিনি চোখ বুজে ফেললেন– অদৃষ্টপূর্বসন্ত্রাসা ন্যমীলয়ত লোচনে। পাঁচ পাণ্ডব ভাইদের মধ্যে ভয়-বিত্ৰস্তা দ্রৌপদী তখনও দুঃশাসনের হাত-লাগানো চুলগুলি খোলা রয়েছে তার ব্যাস মহাকবি উপমা দিলেন পাঁচটা পাহাড়ের মধ্যে স্খলিতা নদীর মতো আকুল– পাঁচ ভাইই এস্তা দ্রৌপদীকে একত্রে স্পর্শ করে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন এতটাই মনোযোগ দিয়ে যেন চক্ষু রূপের সন্ধান পেয়েছে, নাসিকা গন্ধের, মধুর শব্দ শুনেছে কান, জিহ্বা আস্বাদন করছে রস আর ত্বক স্পর্শ করছে আকাঙিক্ষত শরীর পাঁচ স্বামী পাঁচ ইন্দ্রিয়ের মতো যেন আপন আপন বিষয় খুঁজে পেল– ইন্দ্রিয়াণি প্রসস্তানি বিষয়েষু যথা রতিম।

দ্রৌপদীর জন্য পাঁচ ভাইয়ের এই ত্রস্ত মনোযোগর মধ্যেই কিন্তু রাক্ষসের অন্বেষণ ঘোষণা ভেসে আসে– কির্মীর নাকি শুধু ভীমকে খুঁজছে। ভীম স্বভাবসিদ্ধভাবেই বেরিয়ে এলেন রাক্ষসকে শিক্ষা দেবার জন্য। রাক্ষস মারা পড়ল এবং পাণ্ডবরা কাম্যক বন ছেড়ে দ্বৈতবনে এসে একটি কুটীর নির্মাণ করলেন দ্রৌপদীকে নিয়ে বসবাস করার জন্য। দ্বৈতবন প্রবেশের পর সবচেয়ে বড় ঘটনা বোধহয় এটাই যে, এইখানে প্রথমে দেখা করলেন কৃষ্ণ। তিনি দ্বারকা থেকে আসার সময় দ্রুপদ রাজার ছেলে, মানে, দ্রৌপদীর বাপের বাড়ির লোকদেরও সঙ্গে নিয়ে এলেন দ্বৈতবনে। সেদিন আনন্দে ভরে উঠেছিল পাণ্ডবদের আরণ্য কুটীর। কৃষ্ণ সেখানে এসে প্রথম অভিবাদনেই বলেছিলেন– সময় এসেছে এবার। এবার যুদ্ধভূমি দুর্যোধন-কর্ণ-দুঃশাসন-শকুনির রক্ত পান করতে চাইছে– দুঃশাসন-চতুর্থানাং ভূমিঃ পাস্যতি শোণিতম। লক্ষণীয়, এমন চড়া সুরে কথালাপের সুর বেঁধে দিলেও অর্জুন কিন্তু শান্ত কথায় শান্ত করেছিলেন। চুপ করে ছিলেন অন্য পাণ্ডব ভাইরাও। কিন্তু দ্রৌপদী ছাড়েননি।

তা ছাড়া এই বুঝি তার শ্রেষ্ঠ সুযোগ ছিল, আর এমনটা বোধ হয় স্বাভাবিক বটে। আসলে স্বামীর ঘরে শ্বশুরবাড়িতে বসে মেয়ে যদি তার প্রতিবাদের কথা, তার ওপরে অত্যাচারের কথা স্পষ্টভাবে বলতেও পারে, তবু সেখানে তার আহত হৃদয়ের অভিমানটুকু তেমনভাবে ফুরিত হয় না, যতটা হয় বাপের বাড়ির লোকের সামনে এবং অবশ্যই সমান-হৃদয় বন্ধুর সামনে। দ্রৌপদী আজ কৃষ্ণের সঙ্গে কথা বলতে আসছেন– বাপের বাড়ির লোকে পরিবৃত হয়ে– ধৃষ্টদ্যুম্ন-মুখৈধীরৈভ্রাতৃভিঃ পরিবারিতা। দ্রৌপদী আজ তার পরম সখা, সমান-হৃদয় বন্ধু কৃষ্ণের সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন তার সমান-হৃদয় কেন? এইজন্য যে, ভাল করে খেয়াল করবেন– আজকে দুর্যোধন-দুঃশাসন-কর্ণ সম্বন্ধে কৃষ্ণের যা মত, দ্রৌপদীর মতও তাই। কৃষ্ণ প্রথমে এসে পাণ্ডবদের সামনে দুরন্ত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন যারা শঠতা করে ছলনা করে অনিষ্ট করে তাদের সবার আগে মেরে ফেলা উচিত, এটাই সনাতন ধর্ম– নিকৃত্যোপচরন বধ্যঃ এষ ধর্মঃ সনাতনঃ। তার মানে, সত্য পালন করে এই বনবাসে আসার ব্যাপারটাকে কৃষ্ণ খুব বড়মানুষি হিসেবে দেখছেন না– ঠিক যেমন একটু পরেই কৃষ্ণ চলে যাবার পর যুধিষ্ঠিরকে দ্রৌপদী বলবেন– কৌরবদের ওপর ক্ষমা দেখানোর সময়ই নয় এটা, আমাদের চিরকালের অপকারী দুর্যোধনদের ওপর এখনই ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত।

এই সমান বোধ যেমন কৃষ্ণকে দ্রৌপদীর কাছে এনে দিয়েছে তেমনই আর এক কারণ হল– কৃষ্ণের ওপরে দ্রৌপদীর ভরসা। তিনি তাকে এতটাই বিশ্বাস করেন। একটু আগেই অর্জুন কৃষ্ণকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়ে প্রায় তাকে ভগবত্তার প্রকোষ্ঠে ঠেলে দিয়েছেন। দ্রৌপদীও কথা আরম্ভ করেছেন সেই ভগবত্তার সম্বোধনেই, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে নিজের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন– তুমি এত বড় ঈশ্বর হওয়া সত্ত্বেও আমার কী হল? আমি নাকি পাঁচ পাণ্ডবের স্ত্রী, মহামহিম কৃষ্ণের সখী নাকি আমি? আর ধৃষ্টদ্যুম্নের মতো যোদ্ধার বোন হওয়া সত্ত্বেও আমাকে দুষ্কৃতীরা রাজসভায় টেনে আনল কী করে– সভাং কৃষ্যেত মাদৃশী? কৃষ্ণের কাছে নিজের তৎকালীন বিপন্ন অবস্থাটা বলার সময় আমি তখন রজস্বলা অবস্থায় এক কাপড়ে বসে ছিলাম– এ-কথা জানাতে মহাকাব্যের নায়িকার কোনও সংকোচ হয় না। এটা মহাকাব্যিক শব্দের উত্তরণ বটে– এই অতি-আধুনিক কালেও অতি প্রগল্ভা রমণীরাও ভাই-বন্ধুর সামনে আমি তখন রজস্বলা অবস্থায় ছিলাম এ কথা সোচ্চারে বলতে সংকোচ বোধ করবেন। কিন্তু মহাকাব্যিক কালে ঋতুকালের অব্যবহিত সময়ে ভার্যাগমনের রীতি ছিল বলেই হয়তো অখিল পতিকুলের প্রাতিরাত্রিক জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে দিতে রজস্বলা হবার শব্দ উচ্চারণে দ্বিধা ছিল না রমণীকুলের। আর দ্রৌপদী তো বিপন্নতার চরমে পৌঁছেছিলেন শত্রুদের হাতে, অতএব তার মুখে কোনও শব্দই বেমানান নয়।

কৃষ্ণের কাছে দ্রৌপদী বলছেন– আমি তখন লজ্জায় কঁপছি, শরীর খারাপ ছিল বলে কোনও মতে এক কাপড়ে রয়েছি তখন, কিন্তু সেই অবস্থায় আমাকে রাজসভায় নিয়ে এল দুঃশাসন। রাজসভার সমস্ত লোক আমাকে দেখে হা হা করে হাসছে আর তোমরা সব বেঁচে থাকতেও আমাকে ওরা সব বেশ্যার মতো ভোগ করতে চাইল– দাসীভাবেন মাং ভোকুম্ ঈষুস্তে মধুসূদন। আর কাদের সামনে ব্যাপারটা ঘটছে? ওই পিতামহ ভীষ্ম, ওই ধৃতরাষ্ট্র যাঁদের ঘরের বউ আমি, তারা আমার শ্বশুর সব, তাদের সামনে তাদেরই ঘরের ছেলেরা আমাকে ভোগ করতে চাইছে, অথচ কেউ কিছু বলছে না। দ্রৌপদী এবার স্বামীদের প্রসঙ্গে আসছেন। বললেন– আমি কাউকে দূষছি না, আমার শ্বশুর, দাদা-শশুর কাউকে না– হয়তো বা পুত্রস্নেহে তারা অতি প্রশ্রয়ীও হতে পারেন কিন্তু আমার স্বামীরা কি করছিলেন? বিধিসম্মতভাবে বিবাহিতা তাদের যশস্বিনী ধর্মপত্নীকে লোকে অবাধে উত্যক্ত করে মারছে, আর তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটা অবাধে দেখছেন– যৎ ক্লিশ্যমানাং প্রেক্ষন্তে ধর্মপত্নীং যশস্বিনীম।

বলা বাহুল্য, এই বাক্যে যুধিষ্ঠিরের সত্যবদ্ধতারও নিন্দা করছেন দ্রৌপদী, বলতে চাইছেন বিবাহিতা স্ত্রীর এ-হেন বিপন্নতার কালেও যুধিষ্ঠিরের ওই নির্বাক সত্যসন্ধান কোন ধর্ম তৈরি করে? কিন্তু লক্ষণীয়, যুধিষ্ঠিরের নামও উচ্চারণ করলেন না দ্রৌপদী এবং আমরা নিশ্চিত যে, এটা জ্যেষ্ঠ স্বামীর প্রতি সামান্য মর্যাদাবশতও নয়, কারণ সেটা হলে– অমন জঘন্য মুহূর্তেও যাঁরা তাঁর জ্যেষ্ঠ স্বামীকে অতিক্রম করে তার মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে আসেননি, তাদের প্রতি এই ধিক্কার-বাক্য ভেসে আসত না দ্রৌপদীর মুখ থেকে। দ্রৌপদী বলেছেন– ধিক্ এই অর্জুনের গাণ্ডীবকে, ধিক্কার রইল পাণ্ডব মধ্যম ভীমসেনের বাহুবলের প্রতি ক্ষুদ্র-নীচ লোকেরা আমাকে নির্বাধে অপমান-উৎপীড়ন করে যাচ্ছিল, আর এঁরা সেটা নিশূপে সহ্য করছিলেন– যৌ মা বিপ্রকৃতং ক্ষুদ্রৈর্মর্ষয়েতাং জনার্দন।

দ্রৌপদী কিন্তু জানেন যে, ভীম প্রতিবাদ করেছিলেন, তিনি যুধিষ্ঠিরের পাশাখেলার হাতখানিও পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, এমনকী অপেক্ষা করছিলেন একটা চরম আদেশ নেমে আসার, কিন্তু তা আসেনি। যুধিষ্ঠির তো বলেই নি, কিন্তু যিনি বলেছিলেন, তাঁকে থামিয়ে দিয়েছেন অর্জুন। কিন্তু এই সূত্রে শুধু অর্জুনকে তিরস্কার করাটা একটা একক আক্রমণ হয়ে যাবে বলেই ভীমকে জড়িয়ে নিয়ে দ্রৌপদী ধিক্কার দিয়েছেন আসলে যুধিষ্ঠিরকে এবং একই সঙ্গে এই দুই মহাশক্তিধর স্বামীদেরও, কেননা তারাও যুধিষ্ঠিরকে অতিক্রম করেননি অথবা করতে পারেননি। করতে পারেননি ভীম, আর করেননি অর্জুন। যিনি প্রতিবাদ করতে চেয়েও পারেননি, তাঁর প্রতি দ্রৌপদীর মমতা আছে স্পষ্টতই আসছি সে-কথায়। তার চেয়েও বড় এক বিপন্ন সমস্যার কথা বলছেন দ্রৌপদী। বলছেন– এটা তো চিরকালের ধর্ম, কৃষ্ণ! ভদ্রলোকের তো এটাই আচার যে, একজন দৈহিক শক্তিহীন অল্পবল স্বামীও তাঁর বউটাকে সমস্ত অন্যায়-অপমান-বিপন্নতা থেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে– যদৃভাৰ্যাং পরিরক্ষন্তি ভর্তারোহল্পবলা অপি।

দ্রৌপদীর কথায় আমার মনে পড়ে গেল এক আমোদিনী বিদ্বৎসভার কথা। সেখানে সেমিনারে এক পুরুষ বক্তা বলছিলেন– ‘উইমেন-এমপাওয়ারমেন্ট ব্যাপারটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই এটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ যে, একজন বিবাহিতা মহিলাও কীভাবে জীবন নির্বাহ করবেন, সেখানে তার নিজের স্বাধীনতা থাকা উচিত, কিন্তু আর এক গভীর বিপন্নতা নাকি তাঁকে কুরে কুরে খায়। তিনি বলছিলেন– হ্যাঁ, এটা তো হওয়াই উচিত যে, মেয়েরা নিজের মতো করে বাঁচবে, নিজের মতো করেই জীবন কাটাবে, এমনকী বিয়ে হলেও এই স্বাধীনতা তাদের থাকা উচিত, তাদের শ্বশুরবাড়ির জীবন, চাকরি, সন্তান পালন– সব জায়গাতেই স্বাধীনতা থাকা উচিত মেয়েদের, তবে হ্যাঁ, তাদের শরীর-সুরক্ষার ব্যাপারেও তাঁদের স্বাধীন ভাবনা থাকা দরকার। রাস্তা-ঘাটে লোক-জন উত্যক্ত করবে, ট্রামে-বাসে কদর্য লোকেরা অস্বস্তি তৈরি করবে, তখনও তাদের নিজের ব্যবস্থা নিজেদেরই নিতে হবে। তখন যেন বাপ-ভাই-স্বামীদের ডাক না পড়ে!

সভায় বসে আমি বুঝলাম– বড় অভিমান হয়েছে বেচারার। তার মধ্যে ওই সভায় প্রচুর মহিলা বক্তারা মেয়েদের জীবন, যৌবন, আর্থিক স্বাধীনতা, সব কিছু নিয়েই পুরুষদের এমন বাড়াবাড়ি রকমের আক্রমণ করেছেন, তা যেন পূর্বোক্ত ভদ্রলোক-বক্তার নিজেরই আঁতে ঘা দিয়ে দিয়েছিল। তার ভাবটা ছিল এইরকম– যেন, এই তো এবার থেকে যখন যৌবনবতী স্ত্রীকে নিয়ে রাস্তায় যাবেন, তখন যদি কেউ স্ত্রীকে ঠোনা মেরে তুলে নিয়ে যেতে চায়, তখন সেই দুষ্কৃতাঁকে আর বাধা দেবার প্রশ্ন আসবে না। বউ নিজের জীবন-যৌবন নিজেই সামলাবে, এখানেও তিনি স্বাধীন, তাঁর সুরক্ষার জন্য যেন স্বামীর ডাক না পড়ে।

সভার প্রশ্নোত্তরপর্বে অভিমানী বক্তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, ‘উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট’ ব্যাপারটা যতখানি ‘বায়োলজিক্যালি-রিলেটেড’ ভাবনা, তার চেয়েও অনেক বেশি ‘সোশ্যালি অ্যান্ড সোশিয়োলজিক্যালি রিলেটেড’ ভাবনা। আপনি বউয়ের জীবন-ধারণের ব্যাপারে, তার স্বমত-প্রকাশের ব্যাপারে, তার চাকরির ব্যাপারে স্বাধীনতা স্বীকার করে নিচ্ছেন মানে এই নয় যে, অন্য একজন আপনার বউকে ‘মলেস্ট’ করে যাবে, আর আপনি শক্তিমান হওয়া সত্ত্বেও তার প্রতিবাদ করবেন না, বাধা দেবেন না এবং নিশ্চল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাববেন– যেমন স্বাধীনতা চাইছ, এবার বোঝো, নিজের সুরক্ষার ব্যাপারেও আমার অপেক্ষা থাকা উচিত য় তোমার। সত্যি বলতে কী, এই প্রতিকূল প্রতিশোধের ইচ্ছা নিয়ে কখনও ‘জেন-ইকুয়ালিটি’র সহায় হওয়া যায় না। আমরা বলব অন্যের অসভ্যতা থেকে স্ত্রীকে অথবা অন্য স্ত্রীলোককেও সুরক্ষা দেওয়াটা যে কোনও পুরুষের ন্যূনতম ইতিকর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তার সঙ্গে স্ত্রীলোকের স্বাধীন চিন্তার সঙ্গে তার শারীরিক দুর্বলতার জায়গাতে আঘাত করাটা কোনও পৌরুষেয় অহংকার তৃপ্ত করে না। অতি অল্পবল মানুষও তাঁর স্ত্রীকে শুধুমাত্র মমত্ববোধেই বলবত্তরের অন্যায় থেকে রক্ষা করে, এটা ‘ইনস্টিংটিভলি’-ই হওয়ার কথা এবং দ্রৌপদী সেটাই বলছেন যে, দুর্বল লোকেরাও নিজের স্ত্রীকে অপমান-আক্রমণ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে– যদ ভার্যাং পরিরক্ষন্তি ভর্তাররাইল্পবলা অপি। তা ছাড়া দ্রৌপদীর যুক্তি আছে আরও। তিনি বলছেন– যে স্বামী তার স্ত্রীর সুরক্ষা দিতে পারেন, তারই সন্তান সুরক্ষিত হয়। তা হলে এ কীরকম ভর্তা আমার! শুনি নাকি ভর্তাই নিজে ভার্যার উদরে সন্তান হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তো, এ কীরকম ভর্তা আমার! যিনি নিজের স্ত্রীকে সুরক্ষা দিতে পারেন না, তিনি আবার আমার উদরে সন্তান হয়ে জন্মাবেন কোন সুবাদে ভর্তা চ ভার্যয় রক্ষ্যঃ কথং জায়ান্ মমোদরে।

কৃষ্ণের কাছে নিজের স্বামীদের সম্বন্ধে প্রতিবাদ জানানোর সময়ে দ্রৌপদীর শেষ যুক্তিটা ছিল আরও ভয়ংকর। স্ত্রী হিসেবে নয়, আত্মীয় হিসেবে নয়, দ্রৌপদী এক সাধারণ নাগরিক হিসেবে বলেছেন– এঁরা নাকি সব শরণাগত-পালক, শরণাগত মানুষকে নাকি এঁরা পরিত্যাগ করেন না, অথচ আমি তো এঁদের কাছে শরণাগত হয়ে নিজের সুরক্ষা ভিক্ষা করেছিলাম, কই তবু তো আমাকে রক্ষা করেননি এই পাণ্ডবরা– তে মাং শরণমাপন্নাং নান্থপদ্যন্ত পাণ্ডবাঃ!

এটা কিন্তু মানতেই হবে যে, দ্রৌপদী যথেষ্টই ভাল যুক্তি সাজাতে পারেন, সে যুক্তি গভীর এবং অকাট্যও বটে। তার চেয়েও বড় কথা, পাণ্ডবরা হয়তো দ্রৌপদীকে উপযুক্ত সুরক্ষা দিতে পারেননি, কিন্তু সেই কৌরবসভায় সামান্য পাশাখেলার এক কূট অভিসন্ধিতে সম্পূর্ণ রাজ্যটাই নিয়ে নিল ওরা, সবাইকে এক লহমায় দাসে পরিণত করল, আমি রজস্বলা অবস্থায় এক কাপড়ে, আমাকে চুলের মুঠি ধরে নিয়ে আসল রাজসভায়, অথচ আমার পাঁচ পাঁচটা ছেলে, এদের ঔরসে জন্মেছে– তারাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল এই ঘটনা– আচ্ছা, তুমি বলো তো কৃষ্ণ! অর্জুনের গাণ্ডীব আছে, ভীমের এত শক্তি আছে, তবু কেন এই দুর্বল ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের জন্য আমার ছেলেরা কেন এই লাঞ্ছনা সহ্য করল কিমর্থং ধার্তরাষ্ট্ৰাণাং সহন্তে দুর্বলীয়সাম– ধিক অর্জুনের গাণ্ডীবকে, ধিক অর্জুন, ধিক্কার আমার ভীমের পুরুষকারে।

সকলকে জড়িয়ে-মড়িয়ে সকল স্বামীদের প্রতি অনন্ত ধিক্কার বর্ষণ করলেও দ্রৌপদীর কিন্তু ভীমসেনের প্রতি এই আস্থা তৈরি হয়েছে যে, এই সেই একমাত্র লোক যিনি আপন মমত্বের তাড়নাতেই তার মর্যাদা রক্ষায় সদা অভিমুখ। ফলে এত ধিক্কারের মধ্যেও যখন তিনি দুর্যোধনদের আশৈশব অত্যাচারের কথাগুলি বলতে আরম্ভ করলেন, তখন ভীমের প্রসঙ্গটাই সর্বাধিক টেনে আনলেন দ্রৌপদী। আর এটাও ঠিক যে, ভীমই যেহেতু কৌরব অত্যাচারের নিশানা হয়েছেন বারবার, তাতে যেমন অত্যাচারের হিসেব দিতেও সুবিধে হচ্ছে তার, তেমনই ভীমের প্রতিই যেহেতু তার পৃথক এক বিশ্বাস তৈরি হয়েছে, ফলত তার প্রতি অত্যাচার উচ্চারণের মধ্যে স্বামী হিসেবে ভীমের প্রতি নিজের পক্ষপাত এবং প্রিয়তা মিশিয়ে দিতেও তার অসুবিধে হচ্ছে না। দ্রৌপদী বারণাবতের প্রসঙ্গ তুললেন, যেখানে মায়ের সঙ্গে পাণ্ডবদের রাজ্য থেকে বহিষ্কার করেছিলেন দুর্যোধন। তারপর ভীমের খাবারে বিষ মেশানোর কথা, তাকে গঙ্গায় অজ্ঞান অবস্থায় ভাসিয়ে দেবার কথা, বারণাবতের জতুগৃহে ভীম কীভাবে আগুন দিয়ে, মা-ভাইদের কীভাবে কোলে করে নিয়ে গিয়েছিলেন বনপথে, সেই সম্পূর্ণ কাহিনিটাও অশ্রুতপূর্বের মতো কৃষ্ণের কাছে বললেন দ্রৌপদী এবং তা সর্বক্ষণই ভীমের বীরত্ব খ্যাপন করে।

ভীমের এই পূর্বজীবন দ্রৌপদী দেখেননি, কিন্তু শুনেছেন, হয়তো বা এই মহাকাব্যিক ত্রাতার ভূমিকায় নেমে-আসা স্বামীটির কথা শুনতে তাঁর ভাল লেগেছে। বিশেষত দ্রৌপদী যখন হিড়িম্ববধ পর্বে ভীমের গরিমা উল্লেখ করছেন, সেখানে তার অগ্রজা সপত্নী হিড়িম্বাকে নিয়েও তার গর্বের অন্ত নেই। ভীমের প্রতি হিড়িম্বার শরীরী আকর্ষণ নিয়ে তার এতটুকু মাথাব্যথা নেই, বরঞ্চ হিড়িম্বা রাক্ষসী যে কত বড় মনের মানুষ, সে-কথা বলার সময়ে দ্রৌপদীর অন্তর আকুলিত হয়েছিল এই ভেবে যে, সেই ভীমপ্রিয়া রাক্ষসী তার পাঁচ স্বামীকেই নরখাদক ভাইয়ের হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছিল। হিড়িম্বাকে একাধারে মনস্বিনী এবং অসামান্যা সুন্দরী বলতেও দ্রৌপদীর ঈর্ষা হয়নি এতটুকুও। দ্রৌপদীর পূর্ব বিবরণে বক রাক্ষসের কথাও এসেছে এবং সেখানেও ভীমের জয়কার। কিন্তু আনুপূর্বিক বিবরণের শেষে যখন আপন স্বয়ংবরের কথা উঠল, তখন সবার শেষে অর্জুনের অসম্ভব বীরত্বের ভাষ্যটুকুই সবচেয়ে বড় হয়ে উঠল। দ্রৌপদী বলেছেন– তুমি যেমন ভীষ্মক রাজার মেয়ে রুক্সিণীকে জয় করে এনেছিলে, ঠিক সেইভাবেই অর্জুন আমাকে জিতে নিলেন স্বয়ংবরে। কত যুদ্ধ হল সেখানে, কত রাজা-মহারাজা ফিরে গেলেন আহত হয়ে! কিন্তু অন্যেরা কেউ যা পারত না, অর্জুন সেটাই করে দেখাল এবং সুযুদ্ধে পার্থেন জিতাহং মধুসূদন।

অর্জুনের ব্যাপারে গভীর আপ্লতি দেখালেন দ্রৌপদী এবং একবারের তরেও যেহেতু উল্লেখ করলেন না যে, তারপর পাঁচ পাণ্ডবের সঙ্গেই তার বিয়ে হল, অতএব দ্রৌপদীর অভিমানও এখানে ভীষণ রকমের বিপ্রতীপভাবে অনুমানযোগ্য হয়ে ওঠে। হয়তো এটাই তিনি বলতে চেয়েছিলেন যে, স্বয়ংবরে যিনি যুদ্ধ করে তাকে জিতে আনলেন, তিনি কোন নৈতিকতায় বাঁধা পড়ে এমন নৈর্ব্যক্তিক মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে থাকলেন কৌরবসভায়? আর এখন! চরম হতাশায় দ্রৌপদী বলছেন– জননী কুন্তীকে ছেড়ে এসে বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমাকে নিকৃষ্ট লোকেরা চরম অপমান করছে দেখেও কেমন করে আমার শক্তিমান স্বামীরা উপেক্ষা করছে নির্বীর্য মানুষের মতো নিহীনৈঃ পরিক্ৰিশ্যন্তীং সমুপেক্ষন্তি মাং কথম?

দ্রৌপদীর ক্ষোভ শেষ পর্যন্ত চরম অভিমানে পরিণত হল কৃষ্ণের সামনে। সেই যে সেই স্বয়ংবর-পর্বের পর কৃষ্ণের সঙ্গে দ্রৌপদীর দেখা হয়েছিল, অর্জুনের পরম সখা বলেই হয়তো কৃষ্ণের সঙ্গেও তার গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। স্ত্রী-পুরুষের গভীর বন্ধুত্বের মধ্যে বস্তুবাদী পণ্ডিতেরা অনেক সময়েই যৌনতার লুপ্ত-সরস্বতী দেখতে পান অন্তরিত চেতনায়, তবে সংস্কৃত নীতিশাস্ত্রে প্রীতিলক্ষণের মধ্যে যেহেতু গোপন কথা জানানো এবং জেনে নেওয়াটা গুহ্যমাখ্যাতি পৃচ্ছতি– অন্যতম এক বৈশিষ্ট্য এবং বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে সম প্রাণতাই বন্ধু হবার সবচেয়ে বড় লক্ষণ– সমপ্রাণঃ সখা মতঃ–তাই দ্রৌপদী এবং কৃষ্ণের সম্পর্কের মধ্যে সমান-হৃদয়তা অথবা সমপ্রাণতার বিষয়টাই বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সমস্ত যৌনতার বিশ্রান্তি ঘটে যায় এমন এক বিশ্বাসে, যেখানে দ্রৌপদী মনে করেন অন্য কেউ বুঝুক না বুঝুক, কৃষ্ণ ঠিক বোঝেন আমাকে।

এতক্ষণ নিজের যন্ত্রণাগুলি সবিস্তারে বলার শেষ পর্যায়ে যখন অবিচারের জায়গাটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন চোখে জল আসে অবিরল ধারায়। দ্রৌপদী কান্নায় ভেঙে পড়লেন। মহাভারতের বিদগ্ধ কবি মন্তব্য করলেন দ্রৌপদীর কথা বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসছিল। মৃদুভাষিণী দ্রৌপদী তাঁর পদ্মকোষতুল্য কোমল হস্তদুটি দিয়ে মুখমণ্ডল আবৃত করে রোদন। করতে লাগলেন। উদগত অশ্রুরাশি তার উন্নত পীবর বর্তুল স্তনের ওপর ঝড়ে পড়তে লাগল স্তনাবাপতিতৌ পীনৌ সুজাতৌ শুভলক্ষণৌ। দ্রৌপদী বলতে লাগলেন– আমি তো কোনও খারাপ বংশে জন্মাইনি, বউ হয়ে এসেছি মহাত্মা পাণ্ডুর ঘরে, আর এই মহাবীর পাণ্ডবদের ঘরণী আমি, তবু কেন আমি কোনও সুরক্ষা পাইনি, শত্রুরা আমার চুল ধরে টেনে আনল আর পাঁচ পাণ্ডব কিনা সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন– পঞ্চানাং পাণ্ডুপুত্ৰাণাং প্রেক্ষতাং মধুসূদন।

ঠিক এইখানেই দ্রৌপদীর দুঃখ-ক্ষোভ-অভিমান অশ্রুরাশির আকারে ঝরে পড়ছিল তার পীনোন্নত স্তনমণ্ডলে। জানি না, অশ্রুপাতের আধার হিসেবে মহাকবি কেন এই রমণীয় প্রত্যঙ্গটুকুই বেছে নিলেন! তা হলে কি স্ত্রী-পুরুষের বন্ধুত্বের মধ্যেও অতি-পরোক্ষ অনুভূতিতে যৌনতার আভাস দিতে হয় এমনই প্রসঙ্গহীন রমণীয়তায়। ঠিক এখনই দু’হাতে মুখ ঢেকে দ্রৌপদী কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলবেন– বুঝেছি, আমার কেউ নেই, কৃষ্ণ! আমার স্বামীরা নেই, ছেলেরা নেই, বাপ-ভাই-আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই, এমনকী তুমিও নেই, কৃষ্ণ নৈব ত্বং মধুসূদন। এ-কথা যদি আজকের দিনেও কোনও রমণী তার ‘সতী’ স্বামীর সামনে প্রকৃত বন্ধুর উদ্দেশে বলত, তা হলে তাঁদের সমস্ত দাম্পত্য কলহের বিষয় হয়ে উঠত এই বন্ধুত্বই– সতীদের মতে এই বন্ধুত্ব সম্পূর্ণটাই সন্দেহ-সংশয়ের তন্তু দিয়ে গড়া। দ্রৌপদীর পক্ষে আমাদের যুক্তি হল– এমন সম্পর্ক দ্রৌপদীর মতো বিদগ্ধা রমণীর পক্ষে সর্বথাই সম্ভব। যিনি পাঁচ-পাঁচটা স্বামীর সঙ্গে ঘর করেন এবং বিচিত্র সম্পর্ক সেতুতে যাঁদের বেঁধে রেখেছেন, তিনি একজন পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে নির্বিকার অথচ সবিকারী সম্পর্ক রাখতে পারবেন না, এটা হতে পারে না। বিশেষত তিনি যা কিছু বলছেন, তার পাঁচ স্বামীর সামনেই বলছেন। এই এই পাঁচ স্বামীও তাদের এই বন্ধুত্বের কথা সবিশেষ জানেন– কৃষ্ণা দ্রৌপদী এবং কৃষ্ণকে তারা সেইভাবেই সমীহ করেন।

দ্রৌপদীর সাশ্রু বক্তব্য শেষ হওয়ামাত্রই কৃষ্ণ তার স্বামীদের সম্মান এতটুকু ব্যাহত না করে বলেছেন- দ্রৌপদী! যাদের ওপরে তোমার এত রাগ তৈরি হয়েছে, তারা অর্জুনের শরাঘাতে প্রত্যেকে রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দেবো তোমার পাণ্ডব-স্বামীদের মাধ্যমেই যা করার আমি করব, তুমি কেঁদো না– যৎসমর্থং পাণ্ডবানাং তৎ করিষ্যামি মা শুচঃ। লক্ষণীয় নিশ্চয়, কৃষ্ণের এই অসম্ভব মাত্ৰাজ্ঞান। অন্য কোনও অপরিণতবুদ্ধি বন্ধু হলে তিনি দ্রৌপদীর পাঁচ স্বামীর মুণ্ডপাত করে দ্রৌপদীর মতো আগুনপানা রূপসীর জন্য সমস্ত দায় নিজেই গ্রহণ করতেন। আর কৃষ্ণের মতো বিশালবুদ্ধি মানুষ তো তা করতেই পারতেন। কিন্তু কৃষ্ণ দ্রৌপদীর কাছে তার স্বামীদের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে শেষে তার আপন প্রতিজ্ঞা বাক্য উচ্চারণ করেছেন– আজ যদি আকাশ থেকে স্বর্গ পড়ে খসে, ভেঙে পড়ে হিমালয় অথবা খণ্ড খণ্ড হয় এই পৃথিবী, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, দ্রৌপদী! তুমি আবারও রাজরানি হবে- সত্যং তে প্রতিজানামি রাজ্ঞাং রাজ্ঞী ভবিষ্যসি।

কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞাশেষে দ্রৌপদীর প্রতিক্রিয়া ছিল এমনই, যেখানে রসশাস্ত্রের চরম অভিব্যক্তি ঘটে যায়। কৃষ্ণের কথা শেষ হলে দ্রৌপদী আর একটি কথাও বলেননি। তিনি শুধু একবার তার বীরমানী গাণ্ডীবধন্বা মধ্যম স্বামীর দিকে বক্র তির্যক দৃষ্টিপাত করেছিলেন– সাচীকৃতমবৈক্ষৎ সা পাঞ্চালী মধ্যমং পতিম। আর এই বক্র দৃষ্টিপাতের প্রতিক্রিয়া ছিল এই যে, অর্জুন দাঁড়িয়ে উঠলেন এবং দ্রৌপদীকে প্রসন্ন করে বললেন তোমার ক্ৰোধতাম্র নয়নে শুভ আসুক নেমে৷ তুমি আর কেঁদো না, কৃষ্ণ যা বলল, ঠিক তেমনটাই হবে, অন্যথা হবে না- মা রোদীঃ শুভতাম্ৰাক্ষি যথাহ মধুসূদনঃ। অর্জুনের পর দ্রৌপদীর ভাই ধৃষ্টদ্যুম্নও প্রতিজ্ঞা করলেন পাণ্ডবদের সামনে রেখেই। দ্রৌপদী বুঝলেন, এই বনবাস-কালের দীর্ঘসূত্রিতায় তিনি অন্তত রাজোচিত ‘উত্থান-শক্তিকে চেতিয়ে রাখতে পেরেছেন।

রাজনৈতিক দৃষ্টিতে ‘উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং ‘উত্থান’-শক্তি এমনই এক ভাববাচক পদার্থ, যা চর্চিত না হলে মরচে ধরে যায়। বারো বচ্ছরের বনবাস-কাল জুড়ে পূর্বের সঞ্চিত ক্রোধ ধরে রাখা এবং তদনুসারে উদ্দীপিত থাকা অত সোজা নয়। কৃষ্ণ-ধৃষ্টদ্যুম্নরা দ্বৈতবন ছেড়ে চলে যাবার সময় দ্রৌপদীর পরিচারিকা-দাসী-ধাত্রীরা কৃষ্ণের সঙ্গে দ্বারকায় চলে গেল। যত অলংকার, মহার্ঘ্য যত কিছু সে-সবও দ্রৌপদী দ্বারকায় পাঠিয়ে দিলেন ধাত্রী-পরিচারিকাদের হাতে। দ্রৌপদী এবার অনেকটাই বনবাসের যোগ্য করে নিলেন নিজেকে।

বনবাসের কাল চলছিলও ভালই। ব্রাহ্মণেরা যুধিষ্ঠিরকে নানা উপদেশ দিচ্ছেন, দ্রৌপদী সূর্যমার্কা থালার দৌলতে ঝালে-ঝোলে-অম্বলে সবাইকে খাওয়াচ্ছেন, চার ভাই বনে বনে ঘোরেন, আর যুধিষ্ঠির ধর্মকথা শোনেন। এই গড্ডলিকার জীবন দ্রৌপদীর যেন আর সহ্য হচ্ছিল না। বীর ক্ষত্রিয় পুরুষেরা নিষ্কর্মার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে আর যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণ-সম্মেলন করে যাচ্ছেন। ওদিকে শত্রুর বৃদ্ধি ঘটছে। দুর্যোধন ভালই রাজ্য চালাচ্ছেন, সে খবরও দ্রৌপদীর কাছে আছে। এই অবস্থায়, যুধিষ্ঠির যদি দুঃখ দুঃখ মুখ করে দ্রৌপদীকে স্তোক দিতেন কিংবা কোমর বাঁধতেন পরবর্তী প্রতিশোধের জন্য– তাও বুঝি কিছু সান্ত্বনা থাকত। কিন্তু তিনি নির্বিকার, অনুৎসাহী ব্রাহ্মণোচিত ধর্মচর্চায় আবদ্ধ। এক দিন ফেটে পড়লেন দ্রৌপদী।

যুধিষ্ঠিরের ওপর তার রাগ জমা ছিল বহুদিনের। যে যাই বলুক, দ্রৌপদী জানতেন– তার এ দুরবস্থা যুধিষ্ঠিরের জন্যই। সকলের সম্মানিত ধর্মরাজ স্বামীকে তিনি বারবার শ্রদ্ধা করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু একই সঙ্গে পাশা খেলায় যুধিষ্ঠিরের অত্যাসক্তি তাকে তার জ্যেষ্ঠ-স্বামীর ওপর সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল হতে বাধা দিয়েছে। যে দূতাসক্তি একদিন তাকে পণ্য করে তুলেছিল, যে দূতাসক্তি একদিন তাকে রাজসভায় বিবস্ত্র করার সুযোগ এনে দিয়েছিল শত্রুপক্ষের কাছে, তিনি যতই ধর্ম-উপদেশ করুন না কেন, ঘা-খাওয়া রমণীর কাছে তা ধর্মধ্বজিতা বলে মনে হয়। সত্যিই যে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে এই ধারাতেই ভাবতেন তার প্রমাণ পাব সেই বিরাট পর্বে, কীচক যেখানে দ্রৌপদীর পেছন পেছন ঘুর ঘুর করছেন। অপমানিতা দ্রৌপদী তার চিরদিনের বিশ্বাসী ভীমের কাছে সেদিন বলেছিলেন– তোমার বড়ভাই যুধিষ্ঠিরকে তুমি নিন্দা করতে পার, যার পাশা খেলার শখ মেটানোর জন্য আমাকে এই অনন্ত দুঃখ সইতে হচ্ছে। পৃথিবীতে এক জুয়াড়ি ছাড়া এমন আর কে আছে যে রাজ্য হারিয়ে, নিজেকে হারিয়ে, শেষে বনবাসের জন্য আবার পাশা খেলে– প্রবজ্যায়ৈব দীব্যেত বিনা দুর্দত-দেবিনম।

দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে ক্ষমা করতে পারেননি, কোনওদিনও পারেননি। বনবাসে কিছুদিন কাটার পরেই তিনি রাগে ফেটে পড়লেন যুধিষ্ঠিরের কাছে। না, এ ঝগড়াটা নেহাত সাধারণ স্তরের ছিল না। বিবাহ এবং ছেলেপিলে হবার পর কর্তা-গিন্নির যে গার্হস্থ্য কলহ এ তাও নয়। ঝগড়ার পূর্বাহ্নেই ব্যাসকে দ্রৌপদীর সম্বন্ধে বলতে হয়েছে প্রিয়া চ দর্শনীয়া চ পণ্ডিতা চ পতিব্রতা, অর্থাৎ কিনা বারবার এই ‘চ’ শব্দ দিয়ে ব্যাসকে দ্রৌপদীর প্রশংসায় ‘ক্যাটিগোরিক্যাল’ হতে হয়েছে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশেষণে এক কুলবধূ রমণীকে ‘পণ্ডিত’ বলে সম্বোধন করায় বুঝতে পারি দ্রৌপদীর কথাগুলি যে ঠিক তার পেছনে ব্যাসেরও সমর্থন আছে।

দ্রৌপদী বললেন– তোমাকে এমনকী আমাকে যে তোমার সঙ্গে গাছের ছালের কোপনী পরিয়ে বনে পার করেছে দুর্যোধন, তাতে তার মনে অনুতাপ তো হয়ইনি, বরঞ্চ সে রয়েছে আনন্দে মোদতে পাপপুরুষঃ। তা ছাড়া তোমার অবস্থা দেখে আমার করুণা হচ্ছে মহারাজ….

পাঠক! দ্রৌপদীর এই করুণার নমুনাগুলি আমি মহাভারতকারের ভাষায় উপস্থাপন করতে চাই না। মহাভারতের ঠিক এই জায়গাটি অবলম্বন করে মহাকবি ভারবি তার কিরাতাৰ্জুনীয় মহাকাব্যে দ্রৌপদীর জবানি তৈরি করেছেন। এক মহাকবি আরেক মহাকবিকে যেমন বুঝেছেন তারই মূৰ্ছনা ভারবির দ্রৌপদীর রসনায়। দ্রৌপদী বললেন- তোমার অবস্থা দেখে আমার করুণা হচ্ছে মহারাজ! সময় ছিল যখন বন্দিরা বিচিত্র রাগিণীতে বন্দনা গান গেয়ে তোমার ঘুম ভাঙাত, এখনও গানে গানেই তোমার ঘুম ভাঙে মহারাজ, তবে সে বন্য শেয়ালের অমঙ্গল গানে। সময় ছিল, যখন দ্বিজোচ্ছিষ্ট অন্নে প্রতিদিনের ভোজন আরম্ভ করতে তুমি, এখনও তাই কর তুমি, তবে এ দ্বিজ ব্রাহ্মণ নয়, এ দ্বিজ দু’বার জন্মানো অণ্ডজ পাখি, যাদের ঠুকরে খাওয়া ফলের প্রসাদ পাও তুমি। সময় ছিল, যখন প্রণতমস্তক রাজা রাজড়াদের মুকুটমণিতে রক্তলাল হয়ে উঠত তোমার পা দুখানি, হ্যাঁ, এখনও তোমার পা দু’খানি রক্তলাল, তবে তা একেবারেই রক্তেই– ব্রাহ্মণদের তুলে নেওয়া আধেক-ছাঁটা ধারালো কুশাঙ্কুরে বিদ্ধ হয় তোমার চরণ আর আক্ষরিক অর্থেই সেগুলি রক্তে রাঙা হয়ে ওঠে।

বস্তুত দ্বৈপায়ন ব্যাসের মহাভারতে দ্রৌপদীর অধিকারের সীমানা দেখে ভারবির দ্রৌপদী আরও বেশির মুখর হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদে। তিনি বললেন– মহারাজ! এ জগতে তুমি ছাড়া আর কে আছে যে তার মনোরমা কুলবধূর মতো রাজলক্ষ্মীকে অন্যের দ্বারা অপহরণ করায়, কারণ আমাকেও যেমন তুমি পাশা খেলে অন্যের হাতে তুলে দিয়েছিলে, তেমনি রাজলক্ষ্মীকেও তুমি পাশা খেলেই অন্যের হাতে তুলে দিয়েছ,- পরৈস্তুদন্যঃ ক ইবাপহারেন মনোরমা আত্মবধূমিব শিয়ম। তোমার পূর্বতন রাজপুরুষেরা ইন্দ্রের মতো যে-রাজ্য শাসন করে গেছেন, সেই রাজ্য তারা তুলে দিয়েছিলেন তোমার হাতে। আর তুমি! হাতির গুঁড়ে মালা পরিয়ে দিলে সে যেমন যথেচ্ছভাবে সে মালা একদিকে ছুঁড়ে দেয়, তেমনি তুমিও রাজলক্ষ্মীর বরমাল্যখানি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছ, যা লুফে নিয়েছে কৌরবেরা। তা ছাড়া তোমার জোয়ান জোয়ান ভাইগুলিকে দেখে তোমার মায়া হয় না মহারাজ? এই যে ভীম, যে এককালে রক্তচন্দন গায়ে মেখে সগর্বে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াত পরিভ্রম-লোহিতচন্দনাৰ্চিতঃ সে এখনও চন্দনের মতো লাল রং গায়ে মেখেই ঘুরে বেড়ায় তবে তা গিরি-গুহার গৈরিক ধুলোর লাল–পদাতিরন্ত গিরিরেণুরুষিতঃ। তারপর, এই যে দেখছ অর্জুন, যে এককালে উত্তর দিক জয় করে থরে থরে ধনরত্ন এনে দিয়েছিল। তোমার রাজসূয় যজ্ঞের ভাণ্ডার পূর্ণ করতে, সেই বীরপুত্র এখন গাছের বাকল খুঁজে বেড়ায় কোনটা পরিধানের উপযুক্ত, কোনটা নয়, এই বাছাই করার বীরকর্মে সে এখন নিযুক্ত।

রাজসভায় সুখলালিত পাণ্ডবদের বনবাসমলিন অবস্থাটি প্রতিতুলনায় বড় করুণ করে ধরবার চেষ্টা করেছেন ভারবি। দ্রৌপদীর জবানিতে তার বক্তব্য হয়ে উঠেছে বক্রোক্তির সংকেতে অলংকৃত। মহাভারতকার অলংকারের ধার ধারেন না, সহজ কথা তিনি এত সহজেই বলেন যে, দ্রৌপদীর বক্তব্য যেন আরও ক্ষুরধার হয়ে ওঠে। মহাভারতের দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের কাছে রাগে ফেটে পড়েন তোমার শরীরে কি রাগ বলে কোনও জিনিস নেই মহারাজ! তোমার জোয়ান জোয়ান ভাইয়েরা সব ঘুরে-বুলে বেড়াচ্ছে। যাদের খাওয়াবার জন্য পাঁচকেরা শতেক ব্যঞ্জনে রান্না করে দিত, তাদের এখন বন্য খাবার ছাড়া গতি নেই। এই ভীমকে দেখে তোমার রাগ হয় না মহারাজ! যার পথ চলার সুখের জন্য দুয়ারে গোটা কতক রথ, হাতি, ঘোড়া প্রস্তুত থাকত, যে একাই সমস্ত কৌরবদের ধ্বংস সাধনে সমর্থ, তাকে দুঃখিত অন্তরে বনের বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে দেখে তোমার রাগ হয় না মহারাজ! যে অর্জুনের তুলনা শুধু অর্জুনই, অস্ত্রসন্ধানে যে যমের মতো সমস্ত রাজার মস্তক নত করে ছেড়েছিল, সেই বাঘের মতো মানুষটাকে দেখে তোমার রাগ যে কেন বেড়ে যায় না– তাই ভেবে আমার মুচ্ছো যেতে ইচ্ছে করে ন চ তে বর্ধতে মস্তেন মুহ্যামি ভারত। তারপর আছে নকুল, অমন সুন্দর চেহারা, অমন বীরত্ব দর্শনীয়ঞ্চ শূরঞ্চ, আছে সহদেব, কোনওদিন কোনও দুঃখ সইতে হয়নি বেচারাকে– আহা তাদের দেখেও কি তোমার রাগ বেড়ে যায় না মহারাজ! একেবারে শেষে আমার নিজের কথাও বলি, বড়মানুষের ঘরে আমার জন্ম, মহারাজ পাণ্ডুর পুত্রবধূ, মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী আর পাঁচ-পাঁচটা বীর স্বামীর ঘরণী আমি– এমন আমাকে বনে বনে ঘুরতে দেখে তুমি সেই লোকগুলোকে ক্ষমা কর কী করে? বেশ বুঝি রাগ বলে কোনও জিনিসই তোমার শরীরে নেই, ভাইদের এবং বউকে দেখে মনে কোনও পীড়াও হয় না তোমার। জান তো লোকে বলে যাদের গায়ে ক্ষত্রিয়ের রক্ত আছে তারা কখনও ক্রোধহীন হয় না– ন নির্মঃ ক্ষত্রিয়োহস্তি লোকে নির্বচনং স্মৃতম্। ভারবি কবি মহাভারতের এই কথাটাকে আরও একটু টেনে নিয়ে দ্রৌপদীর মুখে বলেছেন– ক্ষমার দ্বারা শান্তি চায় মুনিরা, রাজার নয়। আর তোমার যদি হৃদয়ে অত ক্ষমা থাকে, তবে মাথায় জটা ঝুলিয়ে হোমকুণ্ডু সাজিয়ে মুনিদের মতো মন্ত্র পড় গিয়ে জটাধরঃ সন্ জুহুধীহ পাবকম্।

পূর্ণ এক অধ্যায়ে দ্রৌপদীর মুখে যে ধ্রুবপদ বেঁধে দিয়েছেন মহাভারতকার তা হল– তবু তোমার মাথায় রাগ চড়ে না যুধিষ্ঠির কম্মান মর্ন বর্ধতে। যুধিষ্ঠিরের কিছুই হয়নি, কোনও বিক্রিয়া নয়, প্রতিক্রিয়াও নয়। দ্রৌপদী সর্বসহ প্রহ্লাদের উক্তি পর্যন্ত উদ্ধার করে যুধিষ্ঠিরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, দৈত্যকুলের প্রহ্লাদের মতেও মাঝে মাঝে ক্রোধের প্রয়োজন আছে, অন্তত রাজনীতিতে, শত্রু-ব্যবহারে। কিন্তু যুধিষ্ঠির তবু সেই মিনমিন করে সেই অক্রোধ, ক্ষমা, আর শান্তির বাণী পুনরুক্তি করতে থাকলেন। এবার রাগের বদলে দ্রৌপদীর ঘেন্না ধরে গেল যেন। যে ধর্ম মানুষকে এমন করে ডোবায়, সেই ধর্মের প্রবক্তার ওপরেই তার ঘেন্না ধরে গেল যেন। লজ্জায় ঘৃণায় ক্ষুব্ধা হল তার রসনা৷ বললেন- ঠাকুর তোমার পায়ে নমো নমঃ, যে ঠাকুর তোমায় এমন করে গড়েছে– নমো ধাত্রে বিধাত্রে চ যৌ মোহং চতুস্তব। শুনেছি ধর্মের রক্ষাকারী রাজাকে ধর্মই রক্ষা করে, নিজেও সে রক্ষিত হয়, কিন্তু সেই ধর্ম তোমাকে রক্ষা করছে বলে তো মনে হচ্ছে না। আমি জানি এই যে ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, এমনকী আমি– এদের সবাইকে তুমি ধর্মরক্ষার জন্য ত্যাগ করতে পার। ছায়ার মতো তোমার বুদ্ধি সবসময় ধর্মেরই অনুগামিনী। জানি, এই সসাগরা পৃথিবী লাভ করে ছোট বড় কাউকে তুমি অবমাননা করোনি, কিংবা বলদর্পে তোমার শিংও গজায়নি দুটো– ন তে শৃঙ্গ অবর্ধত। কিন্তু যে তুমি, রাজসূয়, পুণ্ডরীক যজ্ঞ করে এত দানধ্যান করলে, সেই তোমার ধর্মরাজের পাশা খেলার মতো বিপরীত বুদ্ধিটা কী করে হল শুনি? সব তো খুইয়েছিলে, রাজ্য, ধন, অস্ত্র, ভাই এমনকী পরিণীতা স্ত্রীকেও। তুমি তো সরলতা, মৃদুতা, বদান্যতা, লজ্জাশীলতা, সত্যবাদিতা এত সব ধর্মগুণের পরাকাষ্ঠা, সেই তোমার মতো লোকের জুয়ো খেলার মতো উলটো বুদ্ধি হল কী করে– কণ্বম অক্ষব্যসনজা বুদ্ধিরাপতিতা তব।

দ্রৌপদী আরও অনেক কথা বলেছেন, দর্শনশাস্ত্রও বাদ যায়নি। বেশ বোঝা যায় শান্তরসের নায়ক যুধিষ্ঠিরের ধর্মকথা তার কাছে সময়কালে ধর্মধ্বজিতাই মনে হয়েছে। যুধিষ্ঠির ‘পণ্ডিতা’ দ্রৌপদীর যুক্তি-তর্ক মেনে তার বচন বিন্যাসভঙ্গির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন– বলগু চিত্রপদং শ্লং যাজ্ঞসেনি ত্বয়া বচঃ। কিন্তু এই প্রথম বাক্যটি বলেই যুধিষ্ঠির হৃদয়ে কোনও জটিলতা বোধ করলেন বোধহয়। দ্বিতীয় বাক্যেই তিনি বললেন, যত ভালই বলে থাক, কিন্তু যা বলেছ, নাস্তিকের মতো বলেছ। তর্কাহত ধর্মিষ্ঠ মানুষের শেষ অস্ত্র তর্কজয়ী মানুষকে নাস্তিক বলা। যুধিষ্ঠির কি পণ্ডিতা ঘরণীর সারকথা বুঝতে পেরেই তাকে নাস্তিক প্রতিপন্ন করলেন। অনেক কথা যুধিষ্ঠির বললেন, তাতে ব্রাহ্মণ সজ্জন, মুনি-ঋষিদের ধর্ম প্রমাণসিদ্ধ হল, কিন্তু রাজধর্ম, যা নিয়ে মহাভারতেরই অন্যত্রও বিশদ আলোচনা আছে এবং যে আলোচনা দ্রৌপদীর সপক্ষে যাবে, কই যুধিষ্ঠির তো তার ধারও মাড়ালেন না। তিনি স্ত্রীকে নাস্তিক বললেন এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দ্রৌপদীও ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু এই ক্ষমা চাওয়া তার হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত নয়। বস্তুত দৈবাধীন হয়ে বসে থাকা এবং সময়ের অপেক্ষা করা– যুধিষ্ঠিরের এই অলস নীতিতে দ্রৌপদীর আস্থা ছিল না। তাই ক্ষমা চেয়েও দ্রৌপদী বললেন– হঠকারিতা করে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া যেমন বোকামি, তেমনি দৈবের দোহাই দিয়ে অনির্দিষ্ট কাল অপেক্ষা করাও এক ধরনের বোকামি। দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে ইঙ্গিত করেই ব্যঙ্গ করলেন যে নাকি দৈব মাথায় নিয়ে নিশ্চেষ্টভাবে সুখে নিদ্রা যায়, তার বুদ্ধি বলে কিছু নেই। জলের মধ্যে সদ্য নির্মিত কাদার ঘটখানি রাখলে সে যেমন আপনিই গলে গলে জলের মধ্যে মিশে যায়, দৈবাধীন পুরুষের অবস্থাও তেমনই– অবসীদেৎ স দুর্বুদ্ধিঃ আমো ঘট ইবাম্ভসি।

দ্রৌপদী, বীরস্বামিগর্বিতা দ্রৌপদী, পুরুষকারে বিশ্বাস করেন। যুধিষ্ঠিরকে তিনি বলতে চান– তুমি আমার জ্যেষ্ঠ স্বামী হলে কী হয়, তুমি যে হলে চাষারও অধম যুধিষ্ঠির। দেখ না, ক্ষেতের চাষিরাও লাঙল দিয়ে মাটি ফেড়ে বীজ বপন করে– পৃথিবীং লাঙ্গলেনেহ ভিত্ত্বা বীজং বপন্তু্যত– তারপর কৃষক চুপটি করে বসে থাকে দৈবাধীন বৃষ্টিপাতের অপেক্ষায়। কৃষক ভাবে, যতটুকু আমার পুরুষকারে কুলোয় লাঙল দিয়ে মাটি ফাড়া– সেটুকু আমি করেছি, তারপরেও যদি বৃষ্টিপাতের দৈব সাহায্য না পাই তা হলে আমার দিক থেকে অন্তত ত্রুটি নেই কোনও যদন্যঃ পুরুষঃ কুর্যাৎ কৃতং তৎ সকলং ময়া। তেমনি ধীর ব্যক্তিরা তাঁর পৌরুষের কর্তব্যটি আগে সম্পন্ন করেন, তারপরেও যদি দৈব তার সহায়তায় হাত বাড়িয়ে না দেয়, তখন তিনি আত্মতুষ্ট থাকেন এই ভেবে যে তার তো কোনও দোষ নেই। দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের এই উত্তাপহীন অলস-দশা সহ্য করতে পারেন না। যুধিষ্ঠিরকে তিনি মুখের ওপর শুনিয়ে দিয়েছেন যে, শুয়ে পড়ে থাকা অলস ব্যক্তিকে অলক্ষ্মীতে ধরে– অলক্ষ্মীরাবিশত্যেনং শয়ানমলসং নরম। কিছু তো কর, কিছু করলে তবে তো তুমি বলবে আমি চেষ্টা করেছি, হয়নি–কৃতে কর্মণি রাজেন্দ্র তথামৃণ্যমবান্ধুতে।

যুধিষ্ঠির কিছু করেননি, অন্তত সেই সময়ে কিছু করেননি। ঘরের বউ পণ্ডিতদের মতো বৃহস্পতির রাজনীতি উপদেশ দেবে, এ বোধহয় তার সহ্য হল না। কিন্তু তিনি যে দ্রৌপদীকে আরেক দফা নাস্তিক-টাস্তিক বলে বসিয়ে দেবেন সে উপায়ও রইল না, কারণ মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেন ততক্ষণে বেশ একটু রাগত স্বরেই এগিয়ে এলেন দ্রৌপদীর পক্ষে ক্রুদ্ধো রাজান অব্রবীৎ। নরমে গরমে অনেক কিছুই বলে গেলেন ভীম, তার সমস্ত বক্তব্য দ্রৌপদীর ভাষণের পাদটীকা মাত্র। সত্যি বলতে কি, ভীম দ্রৌপদীকে এতটাই ভালবাসেন যে, কখনও, কোনও সময়ে তার কথার যৌক্তিকতা নিয়ে বিচার করেননি বেশি। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে যতখানি বুঝি ভালবাসেন তার থেকেও বুঝি ভয় পান; আর ভয় পান বলেই তার ভালবাসার মধ্যে শুকনো কর্তব্যের দায় যেন বেশি করে ধরা পড়ে। পাঠক! খেয়াল করবেন, অজ্ঞাতবাসের আগে সব পাণ্ডবেরা যখন ভাবছেন কীভাবে, কোন কর্ম করে বিরাট রাজার রাজ্যে নিজেদের লুকিয়ে রাখবেন, তখন যুধিষ্ঠির বলছেন– এই আমাদের প্রাণের চেয়েও ভালবাসার পাত্রী দ্রৌপদী। মায়ের মতো এঁকে প্রতিপালন করা উচিত এবং বড়বোনের মতো ইনি আমাদের পূজনীয়াও বটে– মাতেব পরিপাল্যা চ পূজ্যা জ্যেষ্ঠেব চ স্বসা। অজ্ঞাতবাসের সময় অন্য মেয়েদের মতো দ্রৌপদী কি কিছু কাজকর্ম করতে পারবেন– ন হি কিঞ্চিৎ বিজানাতি কর্ম কর্তৃং যথা স্ত্রিয়ঃ।

কিন্তু দ্রৌপদীর কাছে যুধিষ্ঠিরের এই কথাগুলি বাণী দেওয়ার মতো মনে হয়। মূলত, যুধিষ্ঠিরের কারণেই তাকে সমাজ বহির্ভূত ভাবে পঞ্চস্বামী বরণ করতে হয়েছে। একথা একভাবে তার মুখ দিয়ে প্রকাশও হয়েছে এবং তা প্রকাশ হয়েছে মহাভারতের যুদ্ধ-মেটা শান্তিপর্বে যখন তার জীবনেরও শেষ পর্ব উপস্থিত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর ভাই, বন্ধু, জ্ঞাতিরা সব মারা যাওয়ায় যুধিষ্ঠিরের বৈরাগ্য উপস্থিত হয়েছে। যুধিষ্ঠিরের এই বৈরাগ্যই তো দ্রৌপদীর দু’চক্ষের বিষ। অথচ এই বৈরাগ্যই দ্রৌপদীকে সারা জীবন তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ব্যাপারটা মহাভারতকার ব্যাসের নজর এড়ায়নি। দ্রৌপদী যে যুধিষ্ঠিরকে খুব ভাল চোখে দেখতে পারেন না, সে-কথা ব্যাসও রেখে ঢেকে পিতামহের মতো লঘু প্রশ্রয়ে প্রকাশ করেছেন। বলেছেন– দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের ব্যাপারে চিরকালই একটু অভিমানবতী– অভিমানবতী নিত্যং বিশেষণে যুধিষ্ঠিরে।

কিন্তু অভিমানের কথাগুলি কেমন? দ্রৌপদী বললেন, অনেক কথাই বললেন, ‘ক্লীব’ টিব ইত্যাদি গালাগালিও বাদ গেল না। রাজনীতি, দণ্ডনীতির মধ্যে দ্রৌপদীর অভিমানও মিশে গেল। বললেন– আজকে আমার এতগুলো স্বামী কেন কিং পুনঃ পুরুষব্যাঘ্র পতয়ো মে নরর্ষাভাঃ। আমার তো মনে হয় তোমাদের মধ্যে যে কেউ একজন আমার স্বামী হলেই আমার যথেষ্ট সুখ হত। একোপি হি সখায়ৈং মম স্যাদিতি মে মতিঃ। (দ্রৌপদী শুধু অর্জুনকে ব্যঞ্জনা করেননি তো?) কিন্তু কপালের ফের, শরীরে যেমন পাঁচটা ইন্দ্রিয় থাকে তেমনি তোমরা পাঁচজনই আমার স্বামী। দ্রৌপদী ভুলে যাননি যে মূলত যুধিষ্ঠিরের পাশা-পণ্যের চাপেই কৌরবসভায় তার চরম অপমান এবং পাশার দৌরাত্ম্যেই আবার অজ্ঞাতবাস। যুধিষ্ঠির নিজেও এ-কথা সবিনয়ে স্বীকার করেছেন। কিন্তু স্বীকার করলেই কী? এই ব্যবহারগুলির মধ্যে দ্রৌপদী ‘মা’ কিংবা ‘বড়বোনে’র সম্মান পাননি। পরবর্তীকালে দেখেছি, এতকাল বনবাস-যুদ্ধ এবং সত্যি সত্যি যুদ্ধের পর যখন আবার যুধিষ্ঠিরের বৈরাগ্য এসেছে, তখন দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন– ‘তুমি উন্মাদ’ এবং তোমার পাগলামির জন্যেই তোমার চার ভাইও আজ পাগল হতে বসেছে– তবোন্মদান্মহারাজ সোন্মদাঃ সর্বপাণ্ডবাঃ। দ্রৌপদী বললেন– জননী কুন্তী বলেছিলেন, সমস্ত শত্রুশাতন করে যুধিষ্ঠির তোমায় সুখে রাখবে। ছাই–ত ব্যর্থং সংপ্রপশ্যামি। তুমি উন্মাদ, ডাক্তার ডাকিয়ে চিকিৎসা করাও। ধূপ, কাজল আর নস্যির ব্যবস্থা নিয়ে কবিরাজ আসুন– ভেষজৈঃ স চিকিৎস্যঃ স্যাৎ… ধূপৈরঞ্জনযোগৈশ্চ নস্যকর্মভিরেব চ।

সত্যিই যুধিষ্ঠিরের ব্যবহারে এই দ্বিমাত্রিকতা আছে। যিনি আজকে দ্রৌপদীকে মায়ের মতো, বড়বোনের মতো প্রতিপাল্যা মনে করেন, তিনিই পূর্বে তাকে পাশা খেলায় পণ রাখেন কী করে? ভীমের তো এইটেই খারাপ লেগেছে। তার মতে পাশাখেলায় ধন-সম্পত্তি হেরে যাই, রাজ্য হারাই–দুঃখ নেই। কিন্তু এটাই যুধিষ্ঠিরের বাড়াবাড়ি যে, তিনি দ্রৌপদীকে পণ রেখেছেন– ইমং ত্বতিক্রমং মন্যে দ্রৌপদী যত্র পণ্যতে। বস্তুত যুধিষ্ঠির ছাড়া ভীম, অর্জুন কারও ব্যবহারেই দ্রৌপদী বৈষম্য খুঁজে পাননি। বিশেষত দ্রৌপদীর সম্বন্ধে ভীমের গৌরববোধ এতই বেশি যে, তিনি বিশ্বাসই করতে পারেন না যে অজ্ঞাতবাসে দ্রৌপদীকে লুকিয়ে রাখা যাবে। যুধিষ্ঠির অজ্ঞাতবাসের সাজ নিয়ে চিন্তা করেছেন অজ্ঞাতবাসের আগে। কিন্তু ভীম তো সেই প্রথম বনবাসে দ্বৈতবনে বসেই ভাবছেন দীপ্তিমতী দ্রৌপদীকে লুকিয়ে রাখবেন কী করে? অজ্ঞাতবাসের আবরণে ফুলটি না হয় লুকোনোই রইল, কিন্তু পাণ্ডবঘরণীর উদীৰ্ণ গন্ধ লুকোবেন কী করে? সেই বনপর্বেই ভীম বলছেন– এই যে ‘পুণ্যকীর্তি রাজপুত্রী দ্রৌপদী’, ইনি এতই বিখ্যাত যে লোকের মধ্যে অপরিচিতার মতো থাকবেন কী করে বিশ্রুতা কণ্বম্ অজ্ঞাতা কৃষ্ণা পার্থ চরিষ্যতি।

গর্বে বুঝি কৃষ্ণার বুক ফুলে উঠেছিল সেদিন। বুঝেছিলেন এই মানুষটিই তাঁর একমাত্র নির্ভর। কৌরবসভায় প্রিয়া মহিষীর অপমানে বারংবার যে মানুষটি সভাস্তম্ভের দৈর্ঘ্য মেপে মেপে দেখছিলেন, সেই মানুষটিই তার একান্ত নির্ভর। তার এই আস্থার প্রমাণ দিয়েছেন ভীম, দ্রৌপদীর মুখের এককথায় হিমালয় থেকে পদ্মফুল কুড়িয়ে এনে। বস্তুত দ্রৌপদীর ব্যাপারে ভীমের এই যে গৌরববোধ তা একেবারে মিথ্যে ছিল না। ধরে নিতে পারি যজ্ঞবেদী থেকে উঠবার সময়েই যে কুমারীতাতুঙ্গনখী সুশ্চারুপীনপয়োধরা, তিনি বিবাহসময়ে নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ যৌবনবতী, পুষ্পবতী। বিবাহের পর বনবাসের সময় পর্যন্ত দ্রৌপদীর অনেক বছর কেটেছে। এতদিনে পঞ্চবীর স্বামীকে পাঁচ-পাঁচটি বীর সন্তানও উপহার দিয়েছেন তিনি প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানীক এবং শ্রুতসেন– এই পঞ্চপুত্রের জননী দ্রৌপদী। বনবাসপর্বে কৃচ্ছুতায় মালিন্যে বারো বছর কেটেছে, তবুও দ্রৌপদীর দেহজ আকর্ষণ বোধহয় একটুও কমেনি। ভীমের ভালবাসার ভয় তাই মিথ্যে নয়– বিশ্রুতা কণ্বম অজ্ঞাতা কৃষ্ণা পার্থ চরিষ্যতি। বিশেষত অন্য মানুষের কাছে দ্রৌপদীর আকর্ষণ এতই বেশি যে, ভীমের দায়িত্ব বারবার বেড়ে গেছে এবং বারবার তিনিই দ্রৌপদীর আস্থাভাজন হয়ে উঠেছেন, অর্জুন নন, যুধিষ্ঠির তো ননই।

স্মরণ করুন সেই দিনটির কথা। পাণ্ডবেরা সবাই দ্রৌপদীকে ঘরে একা রেখে চারদিকে বেরিয়ে পড়েছেন মৃগয়ায়, নিজেদেরও খেতে হবে, ব্রাহ্মণদেরও খাওয়াতে হবে। কিন্তু এই সময়ে সিন্ধু-সৌবীর দেশের রাজা জয়দ্রথ মনে মনে বিয়ের ভাবনা নিয়ে উপস্থিত হলেন শাল্বরাজার নগরীতে। জয়দ্রথের বিয়ে হয়ে গেছে, প্রতিথযশা ধৃতরাষ্ট্রের তিনি জামাই, দুঃশলাকে বিয়ে করে স্বয়ং দুর্যোধনকে তিনি সম্বন্ধী বানিয়েছেন। কিন্তু জয়দ্রথের আবার বিয়ে করার ইচ্ছে হয়েছে, তাই আবার বরের সাজে বেরিয়ে পড়েছেন, তবে ছাতনাতলাটি ঠিক কোথায় এখনও ঠিক জানেন না। শাল্গুনগরী থেকে আরও রাজা-রাজড়াদের বরযাত্রী নিয়ে তিনি কাম্যক বনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন। পাণ্ডবরাও তখন কাম্যক বনে এবং একলা ঘরে দ্রৌপদী। নির্জন বন। নতুন মেঘে বিদ্যুতের ছটা লাগলে যে শোভা হয়, দ্রৌপদীর আগুন-রূপের বিজলি লেগে বনস্থলীরও সেই দশা। তিনি কুটিরের দ্বারেই বসেছিলেন এবং চোখে পড়ে গেলেন জয়দ্রথের। শুধু জয়দ্রথ কেন, উপস্থিত সকলেই দ্রৌপদীকে না দেখে পারছিলেন না। ইনি অপ্সরা না দেবকন্যা– এইসব গতানুগতিক তর্কে অন্যেরা যখন ব্যস্ত, তখন কিন্তু জয়দ্রথের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে– দ্রষ্টা তাং দুষ্টমানসঃ অব্রবীৎ কামমোহিতঃ। বন্ধুকে ডেকে জয়দ্রথ দ্রৌপদীর সমস্ত খবর নিতে বললেন। মহাভারতকারের মতে ব্যাপারটা ছিল– ঠিক শেয়াল যদি বাঘের সুন্দরী বউয়ের খবরাখবর জানার চেষ্টা করে– সেইরকম ক্রোষ্টা ব্যাঘ্রবধূমিব।

আহা! জয়দ্রথের দিক থেকেও ব্যাপারটা একটু চিন্তা করুন পাঠক! নির্জন অরণ্যে একাকিনী সুন্দরী, যাঁর প্রতি অঙ্গসংস্থানে এখনও খুঁত নেই– ‘অনবদ্যাঙ্গী’– তাঁর দিকে যুবক পুরুষেরা তাকাবে না, বিশেষত যে যুবক বিবাহার্থী! আমি বেশ জানি, জয়দ্রথ জ্ঞাতি-সম্বন্ধে পাণ্ডবদের পূর্বপরিচিত হলেও পাণ্ডব ঘরণীকে তিনি চিনতেন না। নির্জন অরণ্যে একচারিণী সুন্দরীকে দেখে বিবাহার্থী যুবকের মনে এই ইচ্ছে হতেই পারে যে, এই সুন্দরীকেই বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে যাই– এতামেব অহমাদায় গমিষ্যামি স্বমালয়ম। তবে সন্দেহ এই– এমন চেহারা, ভুরু, দাঁত, চোখ কোনও কিছুতেই খুঁত নেই, উত্তমাঙ্গ অধমাঙ্গ অনালোচ্য, শুধু বলি তনুমধ্যমা– ইনি আমাকে পছন্দ করবেন তো? জয়দ্রথ বন্ধুকে খোঁজ করতে পাঠালেন।

আমি বলি, দ্রৌপদীরও দোষ ছিল। না হয় তিনি পঞ্চম্বামিগর্বিতা রাজপুত্রী। কিন্তু সুন্দরী অরণ্যভূমির মধ্যে বিশেষত যেখানে তার পাঁচ স্বামীই বাইরে গেছেন সেখানে এই খ্যাপা হাওয়ায় ব্যাধূয়মানা পবনেন সু– কুটির দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়োজন কী? দ্রৌপদীর আরও দোষ- এমন আগুনপানা রূপ যখন– দেদীপ্যমানাগ্নিশিখেব নক্তং সেখানে দুয়ার থেকে নেমে এসে (দ্রৌপদী বিলক্ষণ জানতেন– রাজপুরুষেরা তাকে দেখছিলেন– সর্বে দৃশ্যস্তাম্ অনিন্দিতা জয়দ্রথ তাকে দেখে বন্ধুর কাছে গুনগুন করছিলেন এবং বন্ধু কোটিকাস্য তার দিকে আসছে দেখেও)– দুয়ার থেকে নেমে এসে চিরকালের প্রেমের প্রতীক কদমগাছের একখানি অবাধ্য ডাল নুইয়ে ধরেছিলেন কেন– কদম্বস্য বিনাম্য শাখা একাশ্রয়ে তিষ্ঠসি শোভমানা। দ্রৌপদী কি বুঝতে পারছিলেন না, এই শাখা নোয়ানোর আয়াসে, আন্দোলিত শরীরে, খ্যাপা হাওয়ায় তাকে আরও মোহিনী, আরও সুন্দরী লাগছিল।

দ্রৌপদী গাছের ডাল ছাড়লেন। যখন নাকি জয়দ্রথের বন্ধু তার সহগামী সমস্ত রাজপুরুষের একে একে পরিচয় দিয়েছেন, তখন দ্রৌপদী কদম্বের ডাল মুক্ত করলেন। যখন জয়দ্রথের পরিচয় দিয়ে বন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন– তুমি কার বউ, কার মেয়ে– তখন দ্রৌপদী গাছের ডাল ছাড়লেন। সেই তখনই দ্রৌপদী মন্দ ভাবনায় উত্তমাঙ্গের ক্ষৌম বনবাসখানি আরও একটু টেনে নিলেন– অবেক্ষ্য মন্দং প্রবিমুচ্য শাখাং সংগৃহ্নতী কৌশিক উত্তরীয়ম। সংরক্ষণশীলেরা বলবেনই– দ্রৌপদীর দোষ ছিল। কিন্তু মহাশয়! দ্রৌপদীর ব্যবহারে লুকানো আছে চিরকালের বিবাহিতা রমণীর মনস্তত্ত্ব। বিবাহিতা বলে কি নিজের যৌবন অন্য পুরুষের চোখের আলোয় একটুও পরীক্ষা করবে না রমণী! একটুও পরখ করবে না, এই বেলাতেও তার আকর্ষণ আছে কিনা? দ্রৌপদী এতক্ষণ কদমগাছের শাখা টানাটানি করে এই পরীক্ষাই চালিয়েছেন। কিন্তু পরীক্ষায় সফল হওয়া মাত্রেই ঈষৎ-স্ত্রস্ত উত্তরীয় টেনে নিয়েছেন। নিশ্চয় বিপদ বুঝে– অবেক্ষ্য মন্দম্।

আমরা কি দ্রৌপদীর মনস্তত্ত্ব-চিন্তায় প্রসঙ্গ হারিয়ে ফেলেছি? আমরা দ্রৌপদীর প্রতি ভীমের স্বামি-ব্যবহার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু দ্রৌপদী যেমন স্বামী থাকতেও নিজের অস্তিত্ব, নিজের আকর্ষণ যাচাই করে নিলেন, আমরাও তেমনি একটু অন্য প্রসঙ্গ থেকে ঘুরে এলাম। বলা বাহুল্য, দ্রৌপদী বিদগ্ধা রমণী, ঠারেঠোরে আপন মাধুর্যের পরীক্ষা শেষ হতেই বিদগ্ধা বিবাহিতের পতিগৌরব ফিরে আসে। দ্রৌপদীরও তাই হয়েছে, অতএব আমরাও প্রসঙ্গে উপস্থিত। জয়দ্রথের বন্ধু দ্রৌপদীর মুখে পঞ্চপাণ্ডবের বৃত্তান্ত শুনে এসে জয়দ্রথকে জানাল। জানাল সে পাণ্ডবদের প্রিয়া পত্নী।

মধুলম্পট যে ভ্রমর একবার মল্লিকা ফুলে বসেছে, তার আর অন্য ফুল ভাল লাগে না, এ-কথা রসিক আলংকারিকেরা বলেছেন। জয়দ্রথের অবস্থাও এখন তাই। সে বললে– বিবাহিতা রমণীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতমা এই মহিলাকে দেখে আর ফেরার পথ নেই– সিমন্তিনীনাং মুখ্যয়াং বিনিবৃত্তঃ কথং ভবান। বস্তুত দুর্যোধনের বোন দুঃশলা, যে তার পূর্ব-পরিণীতা বধূও বটে, সেই দুঃশলাকেও বুঝি দ্রৌপদীর তুলনায় বানরী বলে মনে হচ্ছিল জয়দ্রথের কাছে– যথা শাখামৃগস্ত্রিয়ঃ। জয়দ্রথ মনের বেগ আর সহ্য করতে না পেরে সোজা উপস্থিত হল দ্রৌপদীর কাছে। বলল– সব ভাল তো, তুমি, তোমার স্বামীরা?

ঠাকুরজামাই বাড়ি এলেন। দ্রৌপদী বললেন– ভাল আছি গো ঠাকুরজামাই, সবাই ভাল আছি। যুধিষ্ঠির, তার ভাইয়েরা এবং আমি– সবাই ভাল। এই নাও পা ধোবার জল, এইখানটায় বোস। আজকে তোমায় পাঁচশো হরিণের মাংস দিয়ে প্রাতরাশ খাওয়াব, ঠাকুরজামাই– মৃগান পঞ্চশতঞ্চৈব প্রাতরাশান্ দদানি তে। জয়দ্রথ বললে তোমার প্রাতরাশ মাথায় থাকুক– কুশলং প্রাতরাশস্য– এখন আমার রথে ওঠ। রাজ্যহীন বনচারী পাণ্ডবদের উপাসনা করার যোগ্য নও তুমি। তুমি হবে আমার বউ ভার‍্যা মে ভব সুশ্রোণি। দ্রৌপদীর বুক কেঁপে উঠল। কুটি-কুটিল কটাক্ষে একটু সরে গিয়ে দ্রৌপদী বললেন– লজ্জা করে না তোমার, কী সব বলছ? বিপদ বুঝে বিদগ্ধা রমণী অপেক্ষা করতে লাগলেন স্বামীদের, আর মুখে নানা মিষ্টি কথা বলে রীতিমতো ভুলিয়ে দিলেন জয়দ্রথকে বিলোভয়ামাস পরং বাকৈর্বাক্যানি যুঞ্জতী। পাঁচ-পাঁচটা জোয়ান মরদকে যিনি হেলায় ভুলিয়ে রেখেছেন, তাঁর পক্ষে কিছু সময়ের জন্য জয়দ্রথকে ভোলানো অসম্ভব নয়। কিন্তু সে যে দুষ্ট মানুষ, কামার্ত। দ্রৌপদীকে আবার রেগে উঠতে হল। ইন্দ্ৰকল্প স্বামীদের কুৎসা তিনি আর সইতে পারছিলেন না। স্বামীদের বল-বীর্য সম্বন্ধে তিনি কিছু বলাও প্রয়োজন বোধ করলেন।

স্বামীদের প্রসঙ্গে দ্রৌপদীর ভাব-ভাবনার কথায় এই অংশটুকুই আমার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু দুষ্টজনের কাছে স্বামি-গৌরব করতে হলে সব স্বামীরই গৌরব করতে হয়। সেই সাধারণীকরণের সভ্যতার মধ্যে থেকে স্ত্রী-হৃদয়ের নির্ভরতা বের করে আনা কঠিন। এখানে যুধিষ্ঠিরকেও সংগ্রামী ভূমিকায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে দ্রৌপদী জয়দ্রথকে বললেন– তুমি ভাবছ যুধিষ্ঠিরকে জয় করে আমায় নিয়ে যাবে। এটা কেমন জান– কেউ যদি হাতে একটা ছড়ি নিয়ে ভাবে, “আমি হিমালয়ের পাহাড়ি হাতি মেরে ফেলব’, সেইরকম। তা ছাড়া রেগে যাওয়া ভীমকে কি তুমি দেখেছ? দেখনি। পালিয়ে যেতে যেতে যখন দেখবে, তখন মনে হবে ‘ঘুমিয়ে থাকা মহাবল সিংহের দাড়ি ধরে টেনেছি, এখন উপায়– সিংহস্য পক্ষ্মানি মুখাৰ্লনাসি’।

দ্রৌপদী অর্জুনের বেলাতেও সিংহের উপমা দিলেন। নকুল-সহদেবেরও কম প্রশংসা করলেন না। কিন্তু জয়দ্রথ ছাড়বেন কেন, তিনি পাণ্ডবদের নিন্দা করেই চললেন এবং প্রচুর ছুঁয়ো-না, ছুঁয়ো-না-র মধ্যেও দ্রৌপদীর আঁচল ধরে টান দিলেন। টানের চোটে দ্রৌপদী জয়দ্রথের কাছে এলেন বটে, কিন্তু তিনি তো সীতা-সাবিত্রী নন কিংবা অত ‘স্পর্শকাতর’ও নন, কাজেই নিজের আঁচলের উলটো টানে জয়দ্রথকে তিনি ফেলে দিলেন মাটিতে সমবাক্ষিপৎ সা৷ পাঞ্চালী-মেয়ের ঠেলা জয়দ্রথ সামলাতে পারল না, কিন্তু পড়ে গিয়েও সে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে উঠে এল। আঁচল ধরে সে যখন টানতেই থাকল, তখন দ্রৌপদী ধৌম্য পুরোহিতকে জানিয়ে উঠে পড়লেন জয়দ্রথের রথে। আমি নিশ্চয় জানি, অনুরূপ পরিস্থিতিতে দণ্ডক-গতা সীতার সঙ্গে দ্রৌপদীর তফাত হল- নিজের অনিচ্ছায় পুরুষের স্পর্শমাত্রেই তিনি কাতর হন না– তার পরীক্ষা দুঃশাসনের টানাটানিতেই হয়ে গেছে। দ্রৌপদী যদি ব্যাসের না হয়ে বাল্মীকির হতেন, তা হলে হয় তাঁকে এখন ‘সুইসাইড করতে হত নয়তো মায়া-দ্রৌপদী হয়ে জয়দ্রথের সঙ্গে যেতে হত। দ্বিতীয়ত, দুঃশাসনের অভিজ্ঞতায় তিনি স্বেচ্ছায় রথে উঠেছেন– সাকৃষ্যামাণা রথম্ আরুরোহ। তৃতীয়ত, দ্রৌপদীর সুবিধে ছিল, তাঁর ‘রাম’ একটি নয়, পাঁচটি; তার অবিচল ধারণা ছিল– পাঁচটি যখন পাঁচ দিকে মৃগয়া করতে গেছে, তখন তার চিৎকারে একটা-না-একটা স্বামীকে বনপথেই পাওয়া যাবে। দ্রৌপদী স্বেচ্ছায় রথে উঠলেন।

সত্যিই পাণ্ডবেরা এসে গেলেন। ঘরে ফিরে ঘটনা শুনেই তারা জয়দ্রথের পিছু নিলেন। একসময়ে জয়দ্রথ তাঁদের দেখতে পেলেন এবং ভয়ে তার প্রাণ উড়ে গেল। আমি আগেই বলেছি, জয়দ্রথ পাণ্ডব এবং দ্ৰৌপদী কাউকেই ভাল চিনতেন না। তিনি দ্রৌপদীকে স্বামী পরিচয় দিতে বললেন এবং ঠিক এইখানটায় শত সাধারণীকরণের মধ্যেও দ্রৌপদী কোন স্বামীকে কেমনটি দেখেন তার একটা দ্বিধাহীন বর্ণনা আছে। প্রত্যেক স্বামী সম্বন্ধে দ্রৌপদীর গৌরবের মধ্যেও কোথাও যেন তার পক্ষপাতের বিশেষ আছে। ঠিক এই বিশ্লেষণটায় পৌঁছনোর জন্যই আমাকে জয়দ্রথের পথটুকু অতিক্রম করতে হল।

ভীত ত্রস্ত জয়দ্রথ বললেন– ওই এলেন বুঝি তোমার স্বামীরা। একটু বুঝিয়ে বলবে সুন্দরী, কার কেমন ক্ষমতা? দ্রৌপদী বললেন, তোমার আয়ু শেষ হয়ে এসেছে এখন আর ওসব বলেই বা কী হবে? তবে কিনা মৃত্যু পথের পথিক যে, তার শেষ ইচ্ছে পূরণ করা ধর্ম, তাই বলছি। ওই যে দেখছ– চোখ দুটো টানা টানা, ফরসা চেহারার মানুষটি– ইনি কুরুবংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষ যুধিষ্ঠির, লোকে যাঁকে ধর্মপুত্র বলে ডাকে। শত্রুও যদি শরণাগত হয়, তবে তাকেও ইনি প্রাণদান করেন।

লক্ষণীয়, যুধিষ্ঠিরের বল, বীর্য, যুদ্ধক্ষমতা– এইসব বীরসুলভ গুণের দিকে দ্রৌপদীর আর কোনও নজর নেই, তাঁর দৃষ্টিতে যুধিষ্ঠির শরণাগত শত্রুরও পালক অর্থাৎ নিজের কিংবা আপনজনের ক্ষতি স্বীকার করেও তিনি শত্রুকে বাঁচান। দ্রৌপদী এবার ভীমের প্রসঙ্গে এলেন, বললেন– ওই যে দেখছ শাল খুঁটির মতো লম্বা চেহারা, বড় বড় হাত; ভ্রুকুটি কুটিল চোখ আর দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে যাচ্ছে ইনিই আমার স্বামী ভীম। লোকে ওকে ভীম বলে কেন জান– ওর কোনও কাজই সাধারণ মানুষের মতো নয়। তৃতীয় ব্যক্তির চোখ থেকে সরে এসে একান্ত আপন এবং নিবিড় দৃষ্টিতে ভীমকে যেমন লাগে, দ্রৌপদী এবার তাই বলছেন– অন্যায় করে এই মানুষটির কাছে বাঁচবার আশা কম। তা ছাড়া শত্রুতার একটি শব্দও ইনি ভোলেন না– নায়ং বৈরং বিস্মরতে কদাচিৎ এবং শত্রুর প্রাণ না নেওয়া পর্যন্ত তার মনে শান্তি থাকে না।

দ্রৌপদী যা বলেছেন, তার প্রমাণও তিনি পেয়েছেন। কৌরবদের পাশাখেলার আসরে একমাত্র ভীমই চুপ করে থাকতে পারেননি। বারংবার তার ভীষণ প্রতিজ্ঞায় সভাগৃহ কেঁপে উঠেছিল, এবং ভবিষ্যতে দ্রৌপদীর এই ধারণা প্রমাণিত করেছে যে, ভীম কখনও শত্রুতা ভোলেন না। অথচ দেখুন, যে অর্জুনের সঙ্গে দ্রৌপদীর মালাবদল হয়েছিল এবং যাঁর মতো বীর সমকালে প্রায় কেউ ছিল না, তার অনেক গুণের পরিচয় দিয়ে দ্রৌপদী বললেন– ইনি যুধিষ্ঠিরের শুধু ভাইই নয়, শিষ্যও বটে– ভ্রাতা চ শিষ্যশ্চ যুধিষ্ঠিরস্য। ছোটভাই বড়ভাইয়ের কথায় ওঠেন বসেন, অন্য মানুষের কাছে এর থেকে বেশি পারিবারিক গৌরব আর কী আছে। কিন্তু দ্রৌপদীর ব্যক্তিজীবনেও তার এই বিশ্লেষণের গুরুত্ব আছে। সেই যেদিন কুন্তী-যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে ভিক্ষা ভেবে ভাগ করে নিলেন, সেদিনও এই মানুষটি কিছু বলেননি। তারপর দিন গেছে, রাত গেছে, কৌরবসভায় সেই চরম অপমানের দিন এসেছে, অর্জুন কিছুই বলেননি, কেননা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সত্যবদ্ধ এবং তিনি যদি কোনও উচ্চবাচ্য না করেন অর্জুনও করবেন না, কারণ ইনি “ভ্রাতা চ শিষ্যশ্চ যুধিষ্ঠিরস্য। এই ব্যবহার বোধহয় দ্রৌপদীর ভাল লাগেনি, এমনকী ভীম যখন যুধিষ্ঠিরের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে রুখে ওঠেন, তখন তাকেও শান্ত করে দেন এই অর্জুন। দ্রৌপদীর চোখে তিনি তাই যুধিষ্ঠিরের ভাই এবং ভাবশিষ্য।

জয়দ্রথের সেনাবাহিনী এবং পঞ্চপাণ্ডবের যুদ্ধ বাধল। প্রথমেই যাকে নির্ভীক ভাবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেল– তিনি ভীম। অবশ্য স্ত্রীরক্ষার জন্য এখানে যুধিষ্ঠির থেকে সহদেব সবাই যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু যে মুহূর্তে জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে ছেড়ে বনের মধ্যে পালালেন এবং যে মুহূর্তে ভীম তা জানতে পারলেন, সেই মুহূর্তেই ধর্মরাজকে তিনি বললেন সবাইকে নিয়ে আপনি কুটিরে ফিরে যান এবং দ্ৰৌপদীকে দেখা-শোনা করুন। জয়দ্রথকে আমি দেখছি, তার আজকে বেঁচে ফেরা কঠিন। যুধিষ্ঠির জানেন তার অনুপস্থিতিতে জয়দ্রথ যদি ভীমের হাতে পড়ে, তা হলে দলাপাকানো মাংসপিণ্ড ছাড়া জয়দ্রথকে আর চেনা যাবে না। যুধিষ্ঠির অনুনয় করে বললেন– ভগিনী দুঃশলা বিধবা হবে, জননী গান্ধারীর একমাত্র কন্যা বিধবা হবে। এই দুঃশলা আর গান্ধারীর কথা মনে রেখে অন্তত তাকে প্রাণে মেরো না– দুঃশলামভিসংঘৃত্য গান্ধারীঞ্চ যশস্বিনীম।

দ্রৌপদী প্রথমেই ব্যাকুল হয়ে ডেকে উঠলেন ভীমকে ভীমম উবাচ ব্যাকুলেন্দ্রিয়া। তারপর দেখলেন অর্জুনের মতো সম্মানিত পুরুষও সেখানে দাঁড়িয়ে। তখন দু’জনকেই যেন উদ্দেশ করে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কথার প্রতিবাদ জানালেন দ্রৌপদী। তিনি বললেন– যদি আমার ভাল লাগার কথা বল, তা হলে মানুষের অধম সেই জয়দ্রথকে কিন্তু মারাই উচিত– কত্তং চেৎ প্রিয়ং মহ্যং বধ্যঃ স পুরুষাধমঃ। জনান্তিকে বলি– ‘আমার ভাল লাগবে’ এই কথাটা কিন্তু অবশ্যই ভীমের উদ্দেশে, কারণ তিনিই এ-ব্যাপারে একমাত্র উদ্যোগী ছিলেন এবং দ্ৰৌপদীর ভাল লাগার মূল্যও তিনিই সবচেয়ে বেশি দেন। সেইজন্যেই বুঝি ভীমকে তিনি প্রথমে বলতে আরম্ভ করেছিলেন। দ্রৌপদী বললেন– যে পরের বউ চুরি করে এবং যে রাজ্য চুরি করে সেই অপরাধী বারবার যাচনা করলেও তাকে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।

আমার ধারণা, এই রাজ্য চুরির কথাটা যে হঠাৎ দ্রৌপদীর মুখে এল, তা এমনি এমনি নয়। ব্যাস এই মুহূর্তে দ্রৌপদীর বিশেষণ দিয়েছেন ‘কুপিতা, হ্রীমতী, প্রাজ্ঞা’। প্রাজ্ঞা দ্রৌপদী এ-কথাটা অর্জুনের উদ্দেশে আকাশে উড়িয়ে দিয়েছেন। ভাবটা এই– যারা রাজ্য চুরি করেছে তাদের তো ছেড়েই দিয়েছ, এখন বউ-চুরির ব্যাপারে কী কর দেখি– পুরুষ মানুষেরা তো এই দুটি বস্তুকেই জমি বলে ভাবে। ভীম-অর্জুন ঝড়ের বেগে গিয়ে জয়দ্রথকে ধরে ফেললেন এক ক্রোশের মাথায়। তিনি তখন বনের পথে পালাচ্ছেন। অর্জুন নায়কের মতো বললেন– এই ক্ষমতায় পরের বউ চুরি করতে আস? পালিয়ে যেয়ো না, ফিরে এসো বলছি। কিন্তু জয়দ্রথ কি আর সেখানে থাকে! এবারে ভীম হঠাৎ করে ছুট লাগালেন জয়দ্রথের পেছনে দাঁড়া ব্যাটা, যাচ্ছিস কোথায় তিষ্ঠতিষ্ঠ। সঙ্গে সঙ্গে ধর্মরাজের শিষ্য বিবেকরূপী অর্জুন চেঁচিয়ে বললেন– প্রাণে মেরো না ভাই– মা ব্যধীরিতি।

ভীম প্রথমেই জয়দ্রথের চুলের মুঠি ধরে তার মুখটা একটু বনের মাটিতে ঘষে নিলেন। তারপর দু’-চার ঘা চড়ালেন মাথায়। তারপরের ব্যাপারটা অনেকটা হিন্দি সিনেমার মতো। খলনায়ক মাটিতে পড়ে গেছে, আর নায়ক বলছে ‘উঠ উঠু’, তারপর আবার মার। তেমনি জয়দ্রথ যেই একটু সামাল দিয়ে মাটি থেকে উঠতে চায়– পুনঃ সঞ্জীবমানস্য তস্যোৎপতিতুমিচ্ছতঃ–অমনি ভীমের লাথি। এবার থামালেন অর্জুন। কিন্তু ভীম কি থামতে চান। তিনি অর্জুনের তুণ থেকে একখানি আধা-চাঁদের মতো বাণ দিয়ে জয়দ্রথের মাথাটা পাঁচ জায়গায় চেঁছে নিলেন, তারপর তাকে নিয়ে এলেন সেই বনের কুটিরে, যেখানে দ্রৌপদী আছেন, যুধিষ্ঠির আছেন। যুধিষ্ঠির জয়দ্রথের অবস্থা দেখে বললেন– এবার ছেড়ে দাও ভাই– মুচ্যতামিতি চাব্রবীৎ

দ্রৌপদী জয়দ্রথকে অর্জুনের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন– ভ্রাতা চ শিষ্যশ্চ যুধিষ্ঠিরস্য–ইনি যুধিষ্ঠিরের শিষ্য অর্জুন। জয়দ্রথের ঝুঁটি-ধরা মানুষটি যদি সেই অর্জুন হতেন, তা হলে যুধিষ্ঠিরের কথা মুখ দিয়ে বেরনো মাত্রেই তিনি মুক্ত হতেন। কিন্তু ইনি তো অৰ্জুন নন, ভীম। কাজেই যুধিষ্ঠিরের কথায় কাজ হল না। কৌরবের রাজসভায় দূতক্রীড়ায়, এবং দুঃশাসনের হাতে দ্রৌপদীর যে অপমান হয়েছিল, তার সমমমী যুধিষ্ঠিরও নন, অর্জুনও নন। তার ওপরেও জয়দ্রথকে ধরতে যাবার আগে দ্রৌপদী যে ভীমকেই প্রথম ডেকে উচ্চ স্বরে বলেছিলেন– যদি আমার ভাল লাগার কথা বল কৰ্তব্যং চেৎ প্রিয়ং মহং বধ্যঃ স পুরুষাধমঃ– তা হলে জয়দ্রথকে শেষ করে দেবে। সবার মধ্যে দ্রৌপদীর এই আকুল আবেদন ভীম ভুলে যাবেন কী করে? হন না তিনি ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির। ভীম সোজা বললেন- আপনার কথায় ছাড়ব না, আপনি দ্রৌপদীকে বলুন- রাজানং চাবী ভীমো দ্রৌপদ্যাঃ কথ্যতামিতি। যুধিষ্ঠিরের কথা মিথ্যে হয়ে যায়। তার কাতর অবস্থা দেখে দ্রৌপদীর বুঝি মায়া হল। জয়দ্রথের ওপরে যতখানি, তার চেয়েও বেশি বোধহয় যুধিষ্ঠিরের ওপর। হাজার হোক জ্যেষ্ঠ স্বামী বটে, যুধিষ্ঠিরের মুখ চেয়েই অভিপ্রেক্ষ্য যুধিষ্ঠিরম– দ্রৌপদী বললেন– যাক এর মাথাটা তো কামিয়ে নিয়েছ, এবার এটা পাণ্ডবদের দাস হয়ে গেছে, একে এবার ছেড়েই দাও। ছাড়া পেল দুর্যোধনের ভগ্নীপতি জয়দ্রথ। দ্রৌপদী আবার চিনলেন ভীম, অর্জুন এবং যুধিষ্ঠিরকেও।

.

০৫.

বারো বছর বনের পথে চলে-ফিরে পুরো এক বছর অজ্ঞাতবাসের সময় হয়ে গেল। ভীম তো সেই কবেই যুধিষ্ঠিরকে শাসিয়ে রেখেছেন– অজ্ঞাতবাসে দ্রৌপদীর এই আগুনপানা রূপ আপনি লুকিয়ে রাখবেন কী করে বিশ্রুতা কণ্বম অজ্ঞাতা কৃষ্ণা পার্থ চরিষ্যতি। কিন্তু বনের ফল আর মধু-খাওয়া গতানুগতিক মুখে অজ্ঞাতবাসের নতুন সব পাণ্ডবদের মুখেই বোধ হয় তেঁতুলের চাটনির কাজ করল, দ্রৌপদীর তো বিশেষত। যুধিষ্ঠির, ভীম– সবাই একে একে ‘আমি এই সাজব’, ‘আমি সেই সাজব’– এমনি করে নতুন ঘরের কল্পলোক তৈরি করলেন। এখানে দ্রৌপদীও পেছিয়ে থাকবেন কেন! যুধিষ্ঠির অবশ্য বিরাট রাজার সঙ্গে আবার নতুন করে পাশার ছক পাতার গন্ধে দ্রৌপদীর বনবাসের কষ্টটা ভুলেই গেছিলেন। তিনি বেশ কর্তাঠাকুরের মতো বললেন– আমরা সবাই তো এটা-ওটা করব ঠিক করলাম, কিন্তু দ্রৌপদী তো অন্য বউদের মতো কাজকর্ম তেমন কিছু জানে না– ন হি কিঞ্চি বিজানাতি কর্ম কর্তৃং যথা স্ত্রিয়ঃ। ছোটবেলা থেকে যখন যেখানে গেছেন, দ্রৌপদী তো গয়না, কাপড়, এসেন্স আর বেণীতে ফুল গোঁজা ছাড়া আর কিছু জানেন না– মাল্যগন্ধা অলংকারাণ বস্ত্রাণি বিবিধানি চ৷ এন্যেবাভিজানাতি যতো যাতা হি ভাবিনী। বিরাট রাজার ঘরে ইনি কি কিছু করতে পারবেন?

কী-ই বা বলার আছে! জ্যেষ্ঠ স্বামী, বড় মুখ করে বলছেন। দ্রৌপদী আর কী-ই বা বলেন? হ্যাঁ বনবাসের কৃচ্ছতার মধ্যেও প্রথম দিকটায় দ্রৌপদীর দাস-দাসী প্রচুর ছিল, পরে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল দ্বারকায়, কিন্তু তাই বলে দিন রাত শাড়ি-গয়নার চিন্তা করার মতো অবিদগ্ধা নন দ্রৌপদী। হয়তো তার মনে পড়ল– বিয়ের নববধূকে পাণ্ডবেরা কুমোরশালায় পরের বাড়িতে এনে তুলেছিলেন। হয়তো মনে পড়ল– সুখের মুখ দেখেছিলাম দু’দিন বই তো নয়– সেই খাণ্ডবপ্রস্থে রাজসূয় যজ্ঞের পরে। তারপরেই তো আবার পাশার আসর বসল আর কপালে জুটল বারো বছরের বনবাস, এক বছরের অজ্ঞাতবাস। তবু দ্রৌপদী এসব কথায় কথা বাড়ালেন না। বরঞ্চ অজ্ঞাতবাসের নতুন সাজের কথায় যেন বেশ মজাই পেয়েছেন, এমনি মেজাজে বললেন– লোকে তো ঘরে শিল্পকর্মের জন্য দাসী রাখে, যদিও ভদ্রঘরের মেয়ে-বউরা সে কাজ করেন না– একথা সবাই জানে ইতি লোকস্য নিশ্চয়ঃ। আমি বিরাটরাজার রানির বাড়িতে সৈরীর কাজ করব, তার চুল বাঁধব, তাকে সাজিয়ে দেব।

দ্রৌপদী ‘সৈরী’ কথাটার একটা বিশ্লেষণ করেছিলেন তার বক্তব্যের প্রথম লাইনে। সৈরন্ধ্রীকে লোকে দাসীকর্মের জন্য রাখে এবং যে রাখে সে তাকে পালন করে। টীকাকার নীলকণ্ঠ দেখিয়েছেন– সৈরন্ধ্রী পরের ঘরে থাকে, কিন্তু সে স্বাধীনও বটে। সে দাসী হলেও খানিকটা অরক্ষিতা অর্থাৎ কিনা স্ত্রী-পুত্রের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে গৃহকর্তার যে দায়িত্ব থাকে, দাসীর ব্যাপারে তা থাকে না। আবার এই দাসীর চাকরিটা যেহেতু দাসীর নিজের হাতেই, তাই সে খানিকটা স্বাধীনও বটে অর্থাৎ তার অরক্ষণের ভাগ দিয়ে যদি কোনও বিপদ আসে, তা হলে সে চাকরি ছেড়েও দিতে পারে। কিন্তু মজা হল কাজের লোক যদি অতি সুন্দরী হয়, তবে তাকে নিয়ে গৃহকর্তীর বিপদ আছে, বিশেষত সেকালের পুরুষ মানুষের কাছে মা আর বোন ছাড়া আর সবাই বুঝি গম্য ছিলেন। যা হোক সবাই যখন নানা বেশে নানান ছাঁদে বিরাট রাজ্যে ঢুকে নিজের নিজের কাজ বাগিয়ে নিলেন তখন দ্রৌপদীও কাজের লোকের মতো একটি ময়লা কাপড় পরে নিলেন। কিন্তু ময়লা কাপড় পড়লে কি হয়, তিনি যেহেতু বড় ঘরে চুল বাঁধার কাজ করবেন, তাই নিজের চুলেই যত পারেন বেশ খানিকটা কায়দা করে নিলেন। শুধু এপাশের চুল ওপাশে নিয়ে ক্ষান্ত হলেন না, কালো চুলে চিকন-মৃদু, দীর্ঘ-হ্রস্ব গ্রন্থি তুলে বড় বাহারি সাজে সাজলেন দ্রৌপদী। ‘অ্যাডভারটাইজমেন্ট।

ময়লা কাপড়ের মধ্যে থেকে যে আগুনপানা রূপ চোখে পড়ছিল, আর কথাবার্তায় ধরা পড়ে যাচ্ছিল এমনি বিদগ্ধতা যে, বিরাট নগরের স্ত্রী-পুরুষ কেউই বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, পেটের দায়ে দ্রৌপদী খেটে খেতে এসেছেন– ন শ্রদ্ধধত তাং দাসীম অন্নেহেলোরুপস্থিতাম। বিরাটরাজার রানি সুদেষ্ণা পঞ্জাব-ঘেঁষা কাশ্মীর অঞ্চলের মেয়ে। ছাদের আলসে থেকে অমন আলো-ছড়ানো রূপ দেখে তিনি দ্রৌপদীকে ডেকে আনলেন। বললেন, “কে গো তুমি মেয়ে, কী চাও?” “কাজ চাই, যে কাজে লাগাবে, তার বাড়িতেই থাকব”–দ্রৌপদী বললেন। সুদেষ্ণা বললেন– এই কি কাজের লোকের চেহারা নৈবংরূপা ভবন্ত্যেব যথা বদসি ভাবিনি? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি নিজেই মালকিন। নইলে এমন চেহারা, হাত, পা, নাভি, নাক, চোখ– সবই সুন্দর– সুকেশী সুস্তনী শ্যামা পীনশ্রোণিপয়োধরা। কথা বলার ঢঙও তো একেবারে হাঁসের মতো হংসগদগদভাষিণী। এক কথায় তুমি হলে দারুণ ‘স্মার্ট’, যেন কাশ্মীরি ঘোড়া– কাশ্মীরীব তুরঙ্গমী আর লক্ষ্মীর মতো রূপ তোমার।

সুদেষ্ণা দ্রৌপদীর তুলনায় উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, সবাইকেই স্মরণ করলেন। দ্রৌপদী সলজ্জে বললেন– ওসব কিছুই নয়, নাস্মি দেবী ন গন্ধর্বী। আমি সৈরী, খোঁপা বাঁধার কাজটি জানি ভাল, কুমকুম-চন্দনের অঙ্গরাগ তৈরি করি আর পা-মল্লিকার বিচিত্র মালা গাঁথতে পারি। ঘুরে ঘুরে বেড়াই, যেখানে যেখানে ভাল খাওয়া-পরা পাই- বাসাংসি যাবচ্চ লভে লভমানা সুভোজন- সেখানে সেখানেই আমি থাকি। সুদেষ্ণা বললেন তোমাকে মাথায় করে রাখতে পারি– মূর্ধি ত্বাং বাসয়েয়ং, কিন্তু ভয় হয়, স্বয়ং রাজা যদি তোমার রূপ দেখে তোমার প্রেমে পড়ে যান। দেখ না, রাজকুলের মেয়েরাই তোমাকে কেমন ড্যাব ড্যাব করে দেখছে, সেখানে পুরুষমানুষের বিশ্বাস আছে– পুমাংসং কং ন মোহয়ে তারা তো মোহিত হবেই। এখন যদি বিরাট রাজা তোমার রূপ দেখে আমাকে ছেড়ে তোমাকে ধরেন– বিহায় মাং বরারোহে গচ্ছে সর্বেণ চেতসা! না, না, বাপু, তুমি এস, যেই তোমাকে দেখবে, তারই মাথা পাগল হবে, প্রেমে নয়, কামেই। তোমার মতো মেয়েমানুষকে ঘরে ঠাই দেওয়া আর গাছের চুড়োয় উঠে আত্মহত্যা করা সমান।

দ্রৌপদী বললেন– কি বিরাট রাজা, কি আর কেউ, অন্য কোনও পুরুষ আমার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারবে না। আমার পাঁচটি গন্ধর্ব স্বামী আছে, তাঁরা আড়াল থেকে অদৃশ্যভাবেই আমাকে রক্ষা করেন। শুধু একটা শর্ত আমাকে উচ্ছিষ্ট খেতে দেবেন না অথবা কাউকে পা ধুইয়ে দিতে বলবেন না। এতেই আমার স্বামীরা সন্তুষ্ট। আমার রূপ দেখে কোনও পুরুষ যদি আমার পেছনে ছোঁক ছোঁক করে যো হি মাং পুরুষো গৃধ্যে তাকে পরপারে যেতে হবে সেই রাত্রেই। অতএব আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমাকে সতীধর্ম থেকে টলানো অত সস্তা নয়, আমার অদৃশ্য স্বামীরা আছেন না! দ্রৌপদীর বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে বিরাটরানি সুদেষ্ণা দ্রৌপদীকে প্রধান পরিচারিকার স্থান দিলেন।

পঞ্চ গন্ধর্ব স্বামীর মধ্যে প্রধানত যার ভরসায় দ্রৌপদী এত কথা বললেন, সেই মধ্যম পাণ্ডব ভীম কিন্তু বিরাটের পাকশালায় রাঁধার কাজে ব্যস্ত। ভাল খাইয়ে বলে ভীমের নাম ছিল, কাজেই রন্ধনশালায় ভীমের দিন খারাপ কাটছিল না। মাঝে মাঝে রাজার সামনে কুস্তির লড়াইতেও অংশ নিচ্ছিলেন তিনি। দ্রৌপদীরই একটু কষ্ট হচ্ছিল বুঝি, একমাত্র যুধিষ্ঠির ছাড়া আর সবারই পরিশ্রমের কাজ, সবাই রাজাকে কাজ দেখিয়ে তোষানোর চেষ্টা করছেন। দেওরপানা নরম স্বামী নকুল-সহদেবের গোরু-ঘোড়ার তদারকি দ্রৌপদীর স্ত্রীহৃদয়ে মমতা জাগাচ্ছিল। আবার ধরুন ভারতের ‘চিফ অব দ্য আর্মি-স্টাফ’-কে যদি রবীন্দ্রভারতীর কলা বিভাগে কুচিপুরি শেখাতে হয়, তা হলে তার বউয়ের যে মর্মপীড়া হয়, বৃহন্নলাবেশী অর্জুনকে দেখে দ্রৌপদীর সেই পীড়াই হচ্ছিল– নাতিপ্রীতিমতী রাজ।

যাই হোক সুখে দুঃখে দশ মাস কেটে গেল। দ্রৌপদী সুদেষ্ণার চুল বেঁধে, মালা গেঁথে ভালই দিন গুজরান করছিলেন। অজ্ঞাতবাসের পাট প্রায় চুকে এসেছে, এমনি এক দিনে সুদেষ্ণার ভাই কীচক এলেন বোনের খবর নিতে। তখনকার দিনে শালাবাবুদের খাতির ছিল এখনকার দিনের মতোই। বিশেষত সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যে রাজার শালার একটি বিশেষ সুনাম আছে। আলংকারিকেরা দেখিয়েছেন, রাজার শালা মানেই সে অকালকুষ্মাণ্ড, কিন্তু শুধু রাজার শালা বলেই শাসন-বিভাগে তার ভাল কাজ জোটে এবং সেই জোরে সে নানা কুকর্ম করে বেড়ায়। এই নিয়মে বিরাটের শালাও কিছু ব্যতিক্রম নন। বোনের পাশে সুন্দরী দ্রৌপদীকে দেখেই তিনি বেশ তপ্ত হয়ে উঠলেন। সুদেষ্ণাকে বললেন– কে বটে এই মেয়েটা, আগে তো দেখিনি! এ যে একেবারে ফেনানো মদের মতো, আমাকে মাতাল করে তুলছে। কীচক বলল- তুমি একে দিয়ে দাসী-কর্ম করাচ্ছ, এই কি এর কাজ? এ হবে আমার ঘরের শোভা, আমার যা আছে তা সব দেব একে। কীচক আর অপেক্ষা করল না, অধৈর্য হয়ে সোজা দ্রৌপদীকেই সে কাম নিবেদন করল। কীচক প্রেম নিবেদন জানে না, তাই তার কথাই শুরু হল দ্রৌপদীর প্রত্যঙ্গ-প্রশংসায়। তার মধ্যেও আবার স্তন-জঘনের প্রশংসাই বেশি, এই জায়গাগুলোতে হার অলংকার না থাকায় রাজার শালা সেগুলো গড়িয়ে দেবার দায়িত্ব অনুভব করে। বারবার সে তার উন্মত্ত কামতপ্ত ভাব সোজাসুজি জানাতে থাকে। পাঁচ ছেলের মা এবং অন্তত আঠারো বছর বিবাহিত জীবন-কাটানো দ্রৌপদী কীচকের কাছে। কাঁচা বয়েসের তিলোত্তমা ইদঞ্চ রূপং প্রথমঞ্চ তে বয়ঃ। হয়তো শরীরের বাঁধন দ্রৌপদীর তেমনি ছিল এবং সেই কারণেই কীচক দ্রৌপদীর কাছে প্রতিজ্ঞা করে বসল আমার পুরনো সব বউগুলোকে আমি ঘর থেকে বিদায় করে দেব, নয়তো তারা তোমরা দাসী হবে– ত্যজামি দারান মম যে পুরাতনাঃ/ ভবন্তু দাস্যস্তব চারুহাসিনি। এমনকী আমাকেও তুমি যা বলবে তাই করব, আমিও তোমার দাস।

জয়দ্রথের অভিজ্ঞতায় দ্রৌপদী আর কথা বাড়ালেন না। নিজের প্রতি ঘৃণা জাগানোর জন্য দ্রৌপদী কীচককে বললেন- খুব খারাপ ঘরে আমার জন্ম, তা ছাড়া আমি অন্যের বউ। তোমার এই দুর্বুদ্ধি ত্যাগ কর। এসব সাধুভাষায় কি আর কামুককে ভোলানো যায়! নানা অকথা-কুকথায় দ্রৌপদীর কান ভরিয়ে কীচক বললেন– আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে দারুণ বোকামি করবে তুমি, পরে তোমায় কাঁদতে হবে– পশ্চাত্তাপং গমিষ্যসি। তারপর, ক্ষমতা পেলে জামাইবাবুর করুণায় চাকরি-পাওয়া শালাবাবুদের যে অবস্থা হয় আর কি! কীচক বললেন– জান, আমি এ সমস্ত রাজ্যের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। বিরাটরাজার কথা একটুও না ভেবে কীচক জানালেন যে, সেই সবার আশ্রয়দাতা– প্রভুর্বাসয়িতা চাস্মি– তার সমান বীরও কেউ নেই। দ্রৌপদী এবার তার অদৃশ্য পঞ্চস্বামীর কথা শুনিয়ে কীচককে একটু ভয় দেখাতে চাইলেন, নিজেও খানিকটা রেগে গিয়ে বললেন তোমার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। মায়ের কোলে শুয়ে বাচ্চা ছেলে যেমন উঁদ ধরতে চায়, তোমার অবস্থাও সেইরকমই কীচক– কিং মাতুরঙ্কে শয়িতো যথা শিশুশ্চন্দ্ৰং জিঘৃক্ষন্নিব মনসে হি মাম।

কীচক গরবিনী বধূকে আর ঘাঁটালেন না, কিন্তু বোনটিকে সকাতরে বলে এলেন– যেমন করে পার তোমার পরিচারিকার মন আমার দিকে ভজিয়ে দাও যেনোপায়েন সৈরন্ধী ভজেন্মাং গজগামিনী। অতি প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে বোনেদের যে অবস্থা হয়, বিরাটরানি কীচককে বললেন– একটা ভাল পরব দেখে তুমি অনেক কিসিমের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কর, মদের ব্যবস্থাও রাখবে। সেই দিন, আমি তোমার ঘর থেকে সুরা নিয়ে আসবার ছলে সৈরন্ধ্রীকে পাঠিয়ে দেব। নির্জন ঘরে, বিনা বাধায় বিজনে নিরবগ্রহে তাকে বোঝাবার চেষ্টা কোরো, তবে যদি তোমার দিকে মন ফেরে– স্বামানা রমে যদি। সুদেষ্ণার ‘প্ল্যান’ মতো একদিন মাংস-ব্যঞ্জন অনেক রান্না হল, ব্যবস্থা হল উত্তম সুরার। কীচক খবর পাঠালেন সুদেষ্ণাকে, আর অমনি তিনি দ্রৌপদীকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, বড় সুরার তিয়াস লেগেছে সৈরী, তুমি একবার কীচকের ঘরে যাও, সেখান থেকে মদ নিয়ে এসো।

দ্রৌপদী সব বুঝলেন, সুদেষ্ণার উদ্দেশ্য এবং কীচকের উদ্দেশ্য– সব বুঝলেন। দ্রৌপদী বললেন– আমি যাব না রানি, তুমি বেশ ভালই জান তোমার ভাই লোকটা কীরকম বেহায়া– যথ স নিরপত্রপঃ। আমাকে দেখলেই সে উলটোপালটা বলবে, অশোভন ব্যবহার করবে। আমি যাব না রানি, তুমি অন্য কাউকে পাঠাও অন্যাং প্রেষয় ভদ্রং তে স হি মাম্ অবমংস্যতে। সুদেষ্ণা বললেন– আমি পাঠাচ্ছি জানলে সে তোমায় অপমান করতে পারে না। উত্তরের অপেক্ষা না করে সুদেষ্ণা পানপাত্রখানি দ্রৌপদীর হাতে ধরিয়ে দিলেন। দ্রৌপদী চললেন। এই প্রথমবার বুঝি পঞ্চস্বামিগর্বিতা পাণ্ডববধূ ভয় পেলেন। প্রশস্ত রাজপথে যেতে যেতে তার কান্না পেল। কী হবে কী হবে– সা শমানা রুদতী। পাঁচ-পাঁচটা জোয়ান স্বামী থাকতেও এই মুহূর্তে দ্রৌপদীর অবস্থা– যা হয় হবে দৈবং শরণমীয়ুষী। ভীতা এস্তা হরিণী কীচকের ঘরে উপস্থিত হল। আর অগাধ কামসাগরের পারে দাঁড়িয়ে কীচকের মনে হল– এই বুঝি তার তাপ-তরণের নৌকা– নাবং লন্ধেব পারগঃ। কীচক লাফ দিয়ে উঠলেন।

প্রথমে তো বৈষ্ণব পদাবলীর ভঙ্গিতে আজু রজনী হম ভাগে পোহায়নু– সুঝুষ্টা রজনী মম–ইত্যাদি আবাহন চলল কীচকের দিক থেকে। দ্বিতীয় দফায় চলল মণিরত্ন আর বেনারসির লোভ দেখানো। পরিশেষে বিছানাটা দেখিয়ে কীচক বললেন– এসব তোমার জন্য, এসো, বসে বসে একটু সুরাপান কর– পিবস্ব মধুমাধবীম। দ্রৌপদী বললেন– রানি সুরা পিপাসায় কাতর, তিনি সুরা চেয়েছেন। বলেছেন– সুরা নিয়ে এসো। আমার তাড়া আছে। কীচক এবার দ্রৌপদীর ডানহাতটি ধরলেন চেপে, তারপরেই আঁচলখানি! পাঠক জানেন, আঁচলে টান পড়লেই দ্রৌপদীর কিঞ্চিৎ ‘অ্যালার্জি হয়, দুঃশাসন, জয়দ্রথের কথা মনে পড়ে। তা দ্রৌপদী প্রথমে জয়দ্রথকে দেওয়া প্রথম ওষুধটি প্রয়োগ করলেন– ধাক্কা, জোর একখানা ধাক্কা। কীচক মাটিতে পড়ে গেলেন এবং সেই অবসরে দ্রৌপদী বিরাটের রাজসভায় উপস্থিত। কিন্তু কীচকই বা ছাড়বেন কেন, তিনি রাজার শালা, প্রশ্রয় পেয়ে মাথায় উঠেছেন, রাজা কিংবা রাজসভাকেই বা তাঁর ভয় কীসের? তিনিও উপস্থিত হলেন বিরাটের রাজসভায় এবং সবার সামনে দ্রৌপদীকে উলটো লাথি কষালেন।

রাজসভা থেকে রান্নাঘর আর কতদূর। রাজাকেও পান-ভোজন মাঝে মাঝেই জোগাতে হয়। কাজেই সেই ছলে ভীমও ততক্ষণে রাজসভায় উপস্থিত। দ্রৌপদীর অপমান দেখে ভীমের দাঁত কড়মড়ি আরম্ভ হল, ঘাম ঝরতে থাকল আর বারবার উঠব কি উঠব না– এই ভঙ্গিতে বসে থাকলেন। যুধিষ্ঠির দেখলেন মহা বিপদ, ভীম একটা মারামারি বাধিয়ে দিলে লোক জানাজানি হয়ে যাবে, তখন আবার বারো বছর বনে কাটাও। কোনও মতে তিনি ভীমকে আঙুলের খোঁচা মেরে মেরে বাইরে পাঠালেন। দ্রৌপদী আগুন চোখে বিরাটরাজাকে যেন দগ্ধ করে দিলেন। প্রথমে তো দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ করে তার অলক্ষ্য স্বামীদের খানিকটা অবোধ্য গালাগালি দিয়ে বিরাটকে বললেন– তুমি রাজা না দস্যু। নইলে তোমার সামনে নিরপরাধিনীর অপমান দেখেও চুপ করে বসে আছ দস্যুনামিব ধর্মস্তে ন হি সংসদি শোভতে। অথবা কী-ই বা বলব, যেমন এই কীচক, তেমনি এ-দেশের রাজা, আর তেমনি তোমার মোসাহেব সভাসদেরা (শেষ টিপ্পনীটির অন্তরে যুধিষ্ঠিরও আছেন)।

বিরাট কিছুই জানতেন না, কী ব্যাপার, কেন এই মারামারি, কিছুই জানতেন না। সভাসদেরা সব খবর নিলেন এবং তাঁরা কীচকের বিরুদ্ধে একটা নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করে দ্রৌপদীকে খুব প্রশংসা করলেন। যুধিষ্ঠিরের আর সহ্য হচ্ছিল না। সবার সামনে কুলবধূর হেনস্থা, সভাসদদের খবরাখবর নেওয়া, বিচার, প্রস্তাব এত সব কসরত যুধিষ্ঠিরের আর সহ্য হচ্ছিল না। রাগে যুধিষ্ঠির ঘামতে থাকলেন। এতটা সময় সভায় থেকে দ্রৌপদীও বুঝলেন তিনি কিঞ্চিৎ কঁচা কাজ করেছেন। যুধিষ্ঠির বললেন– তুমি সুদেষ্ণার ঘরে যাও সৈরন্ধ্রী। যে স্বামীদের কথা তুমি বললে, বোঝা যাচ্ছে, তাদের রাগ দেখাবার সময় এখনও আসেনি। তুমি সময় বোঝ না, সৈরঞ্জী, শুধু এই রাজসভায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাটুকে মেয়েদের মতো কাঁদছ। রাজসভায় তরল জলে মাছের মতো সভাসদেরা যে খেলা করে, এ কান্না তাদের স্পর্শ করে না, শুধু খেলার বিঘ্ন ঘটায় মাত্র– অকালজ্ঞাসি সৈরব্ধি শৈলুষীব বিরোদিষি। বিঘ্নং করোষি মৎস্যানাং দীব্যতাং রাজসংসদি। তুমি যাও, তোমার গন্ধর্ব স্বামীরা নিশ্চয়ই এই অপমানের বিহিত করবেন।

দ্রৌপদী সুদেষ্ণার কাছে ফিরে গেলেন। চুল খোলা, চোখ লাল, রাজরানি দ্রৌপদীর মুখে সব শুনে দ্রৌপদীকে কথা দিলেন যে, তিনি কীচকের বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন। দ্রৌপদী বললেন- তার আর দরকার হবে না, যাঁদের ব্যবস্থা নেবার কথা, তাঁরাই নেবেন। রাজসভায় দ্রৌপদীকে পদাঘাতে ভূলুণ্ঠিতা দেখেছেন ভীম, অন্য কেউ নন। এ-কথা দ্রৌপদীর মনে ছিল, অতএব সুদেষ্ণাকে উত্তর দিতে দেরি হয়নি দ্রৌপদীর।

অপমানে মানুষের যা হয়, মনে মনে শালা, রাজার শালাকে মেরেই ফেলতে চাইলেন দ্রৌপদী বধং কৃষ্ণা পরীন্সন্তী। মাথা ঠান্ডা করার জন্য শীতল জলে গা ধুলেন, উত্তমাঙ্গ এবং অধমাঙ্গের বসন দুটিতে কীচকের পায়ের ধুলো, মাটির ধুলো লেগেছে, সেগুলি ধুয়ে নিলেন। বাইরে রাত নেমে আসছে। সুদেষ্ণাকে এই একটু আগেই দ্রৌপদী বলেছেন– আজকের রাত্রিই তোমার ভাইয়ের কালরাত্রি না হয়– মন্যে চাদ্যৈব সুব্যক্তং পরলোকং গমিষ্যতি।

ধুর! গা ধুলে আর কাপড় ধুয়ে ফেললেই কি আর রাগ যায়? দ্রৌপদীর কিছুতেই আর স্বস্তি হচ্ছে না। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ওপর তার কোনও বিশ্বাস নেই। তিনি বলেছেন এখনও তোমার গন্ধর্ব স্বামীদের ক্রোধ করার সময় আসেনি। দ্রৌপদীর মনের ভাব– তোমার কোনওদিনই সময় আসবে না। এখন কী করি, কোথায় যাই, আমার ভবিষ্যতের পথটাই বা কী হওয়া উচিত কিং করোমি, ক গচ্ছামি, কথং কার্যং ভবেন্মম। রাতের আঁধার গভীরতর হয়ে আসছে। দ্রৌপদীর মনের মধ্যে বিদ্যুৎশিখার মতো ঝলক দিয়ে উঠল একটি নাম– ভীমসেন– ভীমং বৈ মনসাগমৎ। দ্রৌপদী জানেন ভীমের ব্যাপারে তার ভালবাসায় ফাঁকি আছে। কিন্তু তিনি এও জানেন যে, ভীমের ভালবাসায় কোনও ফাঁকি নেই। অন্তত দ্রৌপদী যা চান এবং যেমন করে চান তা একমাত্র সাধন করতে পারেন ভীম। যুধিষ্ঠিরের মনোভাব তিনি পূর্বাহ্নেই জানেন, আর অর্জুনকে বললে তিনি ধর্মরাজের সঙ্গে কোনও কথা না বলে দ্রৌপদীর কথায় কাজ করবেন বলে মনে হয় না। কাজেই একমাত্র ভরসা ভীম। তিনি নির্বিচারে কারও কোনও অপেক্ষা না রেখেই দ্রৌপদীর যা ভাল লাগে তাই করবেন– নান্যং কশ্চিদ্ ঋতে ভীমান্মমাদ্য মনসঃ প্রিয়ম্– অতএব সেই সময়ে ভীমই তার একমাত্র প্রিয় হয়ে উঠলেন (ব্যাসের এই পঙক্তিটির মধ্যে দ্রৌপদীর ভালবাসার ফকিটুকু ধরা পড়ে গেল)।

রাতের সুখশয়ন ছেড়ে স্তিমিতপ্রদীপ রজনীর আধছায়ায় অন্দরমহলের বাইরে চলে এলেন দ্রৌপদী। সূপকার-কুলপতি ভীমের আবাস হবে রন্ধনশালার কাছেই, যেখানে বল্লব নামের ছদ্মবেশে নিজেকে মধ্যম-পাণ্ডবের গৌরব থেকে আড়াল করে রেখেছেন তিনি। দ্রৌপদী এক লহমায় ভীমের ঘরের সামনে পৌঁছলেন। ভেজানো দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই দ্রৌপদী বিড়বিড় করে বললেন– আমার মর্মশত্ৰু কীচক বেঁচে আছে, তবু তুমি ঘুমোচ্ছ কী করে– কথং নিদ্রাং নিষেবসে। দ্রৌপদী দেখলেন, তার বিড়বিড়ানিতে ভীমের ঘুম ভাঙল না, বলবান সিংহ যেমন নির্ভয়ে নিদ্রা যায়, তেমনি ভীম ঘুমিয়েই আছেন। ব্যাস লিখেছেন দ্রৌপদীর অলোকসামান্য রূপে আর ভীমের প্রদীপ্ত তেজে সেই রন্ধনশালা যেন জ্বলে উঠল। আমি বলি, ভীমের আগুন-তেজে দ্রৌপদীর রূপের ঘি পড়ল। পাঁচ স্বামীর সহবাসিনী দ্রৌপদী দীর্ঘ দশ-এগারো মাস পরে মধ্যম-পাণ্ডবের সাহচর্য পেয়েছেন। মনে আছে অপমানের জ্বালা। ভীমকে কীভাবে কাবু করতে হবে তা তিনি জানেন।

দ্রৌপদী ভীমকে জাগালেন। কিন্তু যেভাবে জাগালেন তার মধ্যে মহাভারতকার দ্রৌপদীর প্রেমের ফাঁকিটুকু দেখিয়ে দিয়েছেন। কালীপ্রসন্ন সিংহমশায় বিপদ ভেবে এই ফাঁকির শ্লোকের অনুবাদ করেননি, কিন্তু এই শ্লোক না হলে দ্রৌপদীর প্রেম-বিশ্লেষণ অসমাপ্ত থেকে যাবে। দ্রৌপদীর প্রেমের ফাঁকিটুকু আরও পরিষ্কার করে দেখিয়েছেন টীকাকার নীলকণ্ঠ। অতএব তার সাহায্যও আমরা নেব। ব্যাস লিখেছেন–দ্রৌপদী প্রথমেই ভীমের কাছটিতে গা ঘেঁষে বসলেন, পাঞ্চালী দ্রৌপদী সর্বাংশে বরণীয় পতির কাছটিতে বসলেন– উপাতিষ্ঠত পাঞ্চালী। কেমন করে বসলেন? ব্যাস উপমা দিয়েছেন– পুষ্পবতী কামাতুরা রমণীর মতো। বাসিতেব কামাতুরা রমণীর মতো। প্রকৃতপক্ষে তিনি কামাতুরা নন, নীলকণ্ঠ আরও ভেঙে বললেন– বস্তুতঃ ন কামাতুরা কিন্তু দ্বেষাতুরা এব। অর্থাৎ কিনা অন্তর্দাহ, প্রতিশোধ ইত্যাদি কারণেই ভীমকে পটাবার জন্য কামাতুরা রমণীর মতো দ্রৌপদী ভীমের গা ঘেঁষে বসলেন। ঠিক যেমনটি বন্য বকস্ত্রী প্রকৃতই কামাতুরা হয়ে বকের গা ঘেঁষে বসে থাকে, ঠিক যেমনটি তিন বছর বয়সের বকনা গোরু গরম হয়ে ষাঁড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে ঠিক তেমনই এক কামাতুরার ভাব নিয়ে দ্রৌপদী ভীমের কাছটি ঘেঁষে বসলেন– সর্বক্ষেতেব মাহেয়ী বনে জাতা ত্রিহায়ণী। উপাতিষ্ঠত পাঞ্চালী বাসিতেব বরর্ষভম ॥

শ্লোকটিতে ‘বাসিতা’ মানে পুষ্পিণী কামাতুরা নারী। ইব’ শব্দটা উপমার্থক, যার মানে ‘মতো’– কামাতুরা রমণীর মতো। এই ‘মতো’ শব্দটা “সর্বশ্বেতা’ অর্থাৎ বকীর সঙ্গেও লাগবে আবার গোরুর সঙ্গেও লাগবে। কাক যেমন দু’দিকে চোখ ঘুরাতে পারে, সেই রকম ‘মতো’ শব্দটা একবার বকীর সঙ্গে লাগবে, আবার গোরুর সঙ্গেও লাগবে। নীলকণ্ঠ লিখেছেন আভিধানিক অর্থে শ্বেতা মানে রাজহংসী। কিন্তু সর্ব’ শব্দটা তো আর বোকার মতো ব্যবহার করেননি ব্যাস। কাজেই ‘সর্বশ্বেতা’ মানে কী। আর সে যেহেতু বনে জাত, তাই কামাতুর হতে তার সময় লাগে না। আবার ‘মাহেয়ী’ মানেও গোরু, ত্রিহায়ণী মানেও গোরু। ব্যাস। নিশ্চয়ই একই অর্থে দুটো শব্দ প্রয়োগ করেননি। ব্যাস বলতে চেয়েছেন তিন বচ্ছর বয়সের গোরু ত্রিহায়ণী। আমরা বলি– তাতে এমনকী হল? নীলকণ্ঠ উত্তর দিয়েছেন ওই ‘তিন বচ্ছরে’র বিশেষণটার মধ্যেই কামাতুরত্ব লুকিয়ে আছে, নইলে ওটি দ্রৌপদীর উপমা হবে কেন? নীলকণ্ঠ লিখেছেন– তিন বচ্ছর বয়েসের গোরু নাকি যৌবনবতী কামাতুরা হয়– ত্রিবর্ষা হি গৌঃ যৌবনারূঢ়া কামাতুরা চ ভবতি। তা আমাদের দ্রৌপদী যৌবনবতী গাভীর মতো, বন্য বীর মতো কামাতুরা ভাব দেখিয়ে ভীমের কাছে বসলেন।

এই শ্লোকে দ্রৌপদীর প্রেমের ফাঁকিটুকু সাধারণে যাতে সহজে না বোঝে, তাই ব্যাস পর পর কয়েকটি উপমা সাজিয়ে দিয়েছেন। গোমতী নদীর তীরে মহাপ্রাংশু শালগাছগুলিকে লতা যেমন জড়িয়ে ধরে তেমনি করে পাঞ্চালী ভীমকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলেন। মনের মধ্যে দ্বেষভাব নিয়ে আর বাইরে যেমন কামাতুর ভাবে তিনি ভীমের কাছে বসে ছিলেন, মনের মধ্যে সেই ভাব নিয়েই তিনি নিশ্চয়ই ভীমকে জড়িয়ে ধরলেন। প্রসুপ্ত মৃগরাজ সিংহকে সিংহবধূ যেমন জড়িয়ে ধরে, হাতিকে যেমন জড়িয়ে ধরে হাতির বউ, তেমনি দ্রৌপদী জড়িয়ে ধরলেন ভীমকে। দ্রৌপদীর প্রেমশীতল বক্ষে বাহুর ঘেরে জেগে উঠলেন ভীম– বাহুভ্যাং পরিরভ্যৈনং প্রাবোধয়দনিন্দিতা। গলার স্বরে বীণার গান্ধার তুলে দ্রৌপদী বললেন– ওঠো ওঠো, কেমন মরার মতো ঘুমোচ্ছ তুমি ভীম– উত্তিষ্ঠোতিষ্ঠ কিং শেষে ভীমসেন যথা মৃতঃ। এমন মরার মতো না হলে কি আর জীবন্ত কোনও লোকের বউকে অপমান করে অন্যে বেঁচে থাকে?

গা-ঘেঁষা, আলিঙ্গন, বাহুর ঘের– এত সবের পর বীণার গান্ধারে যে সপ্তমের আমদানি হল তাতে ভীমের দিক থেকে আর প্রত্যালিঙ্গন সম্ভব ছিল না। ভীম উঠে বসলেন এবং সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন– তোমার গায়ের রং যে একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে! কী ব্যাপারটা হয়েছে, খোলসা করে বল তো? খারাপ, ভাল, যাই ঘটুক, পরিষ্কার বল। তুমি তো জান কৃষ্ণা, সমস্ত ব্যাপারেই আমি তোমার বিশ্বাস রেখেছি, অনেক বিপদে আমি তোমাকে কতবার বাঁচিয়েছি- অহমেব হি তে কৃষ্ণে বিশ্বাস্যঃ সর্বকর্মসু। অহম আপৎসু চাপি ত্বাং মোয়ামি পুনঃ পুনঃ ॥

ভীমের মতো মানুষও বুঝে গেছেন দ্রৌপদী তাকে বিশ্বাস করেন। বিশেষ করে বিপদে পড়লে অন্য সবার থেকে ভীমই যে দ্রৌপদীর কাছে বেশি আদরণীয় হয়ে ওঠেন, সে কথা ভীমও বুঝে গেছেন। ঠিক সেই কারণেই ভীম বললেন- তোমার যা বলার বল এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে তুমি যা চাও অর্থাৎ যা হলে তোমার ভাল লাগবে, সেটা তাড়াতাড়ি বল– শীঘ্রমুক্কা যথাকামং যত্তে কার্যং ব্যবস্থিতম। সবাই জেগে উঠলে তোমায় আমায় চিনে ফেলতে পারে, কাজেই তার আগেই যা বলার বলে শুতে যাও।

আমি আগেই বলেছি যুধিষ্ঠিরের স্বামী ব্যবহারে দ্রৌপদী কোনওকালেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই বিরাটের রাজসভায় তিনি কথা দিলেও তার ওপরে তিনি নির্ভর করেননি। তিনি ভীমের কাছে এসেছেন তড়িঘড়ি অপমানের শোধ নিতে। দ্রৌপদী ভীমের মনস্তত্ত্ব জানতেন অথবা কোন বুদ্ধিমতী স্ত্রীই বা স্বামীর মনস্তত্ত্ব না জানেন? দ্রৌপদী এও জানতেন যে, যুধিষ্ঠিরের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার নীতি ভীম পছন্দ করেন না অথবা অপমানের সময়েও যুধিষ্ঠিরের স্থিরভাব ভীম দু’চক্ষে দেখতে পারেন না।

দ্রৌপদী তাই ভীমের কাছে প্রথমেই যুধিষ্ঠিরের ওপর ঝাল ঝেড়ে নিলেন। দ্রৌপদী বললেন– যার স্বামী যুধিষ্ঠির, তার জীবনে আর সুখ কী অশোচত্বং কুতস্তস্যা যস্যা ভর্তা যুধিষ্ঠিরঃ? আমার সব দুঃখ জেনেও, আবার তুমি ভালভালাই করে জিজ্ঞেস করছ–কী আমার হয়েছে? দ্রৌপদী পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে তুললেন, কারণ তিনি জানেন কোন কোন ঘটনায় ভীমের আক্রোশ জমা আছে। তিনি বললেন– একে তো সেই কৌরবসভার মধ্যে আমাকে টেনে আনা হয়েছিল, সে দুঃখ তো আমার রয়েইছে, এক দ্রৌপদী ছাড়া আর কোন রাজার ঝি এত অপমান সইবে? তার মধ্যে বনের মাঝে জয়দ্রথ এসে আমাকে আরেকবার নাকাল করে গেল, সেই অপমানও আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন মেয়ে সইবে– বোচুমুৎসহতে নু কা? এখন আবার… কেন, তুমি তো চোখের সামনেই দেখলে, এখন আবার ধূর্ত বিরাটরাজার শালা কীচক রাজার সামনেই আমায় লাথি কষাল– সে আঘাত সহ্য করার জন্যও তো আমিই বেঁচে আছি– কা নু জীবেত মাদৃশী। আমার আর বেঁচে থেকে লাভ কী? এই রাজার শালা রানির ঘরে আমার দাসীত্বের সুযোগ নিয়ে দিন-রাত– ‘আমার বউ হও, আমার বউ হও’– বলে ঘ্যানর ঘ্যানর করছে– নিত্যমেবাহ দুষ্টাত্মা ভার‍্যা মম ভবেতি বৈ।

কীচকের সম্বন্ধে এইটুকু বলেই দ্রৌপদী কিন্তু আবার যুধিষ্ঠিরের ওপর আক্রোশে ফেটে পড়লেন। বললেন, তোমার দাদাভাইকে ঝাড়তে পারছ না, যার জুয়া খেলার ফল ভোগ করছি আমি– ভ্রাতরং তে বিগহস্ব জ্যেষ্ঠং দুর্লতদেবিনম। যস্যাস্মি কর্মণা প্রাপ্ত দুঃখমেতদনন্তকম্। সত্যি করে বল তো, এক জুয়াড়ি ছাড়া আর কে আছে, যে নাকি রাজ্য সম্পত্তি সব ছেড়ে দিয়ে বনবাসের জন্য পাশা খেলে? দ্রৌপদী বললেন– খেলবি, খেল, ধন-রত্ন কি হাজার খানেক মোহর নিয়ে সম্বচ্ছর ধরে সকাল-সন্ধে পাশা খেললেও তো এত সম্পত্তি উজাড় হয়ে যেত না সায়ং প্রাতরদেবিষ্যদ অপি সংবৎসরান বহুন। কিন্তু বিবাদ আর উৎপাতের পাশা খেলে এখন মাথামোটার মতো চিৎপাত হয়ে পড়ে, চুপটি করে পুরনো কাজের হিসেব করছে–তৃষ্ণীম আস্তে যথা মূঢ় স্বানি কর্মাণি চিন্তয়ন। এই হল তোমার দাদা।

দ্রৌপদী দেখলেন, একটু বেশি হয়ে গেছে। ভীম যদি আবার ‘জুয়াড়ি’ মাথামোটা– এসব কথায় খেপে যান। তাই তিনি ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের পূর্ব সম্মানের এক লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে, “এখন তার কী অবস্থা হয়েছে, এও কি আমি সইতে পারি!”– এইভাবে একটা প্রলেপ লাগিয়ে দিলেন পূর্ব গঞ্জনার ওপর। দ্রৌপদী দেখাতে চাইলেন তিনি এই অনুক্রমেই কথা বলছিলেন, যার জন্য ভীমের সম্বন্ধেও তাকে বলতে হল– এই যে তুমি পাকঘরে রসুই করার কাজ নিয়ে বিরাট রাজার খিদমতগারি করছ, এও কি আমি সইতে পারি তদা সীদতি মে মনঃ। বিরাট রাজা বলল তোমার গায়ে শক্তি আছে, এই মত্ত হাতিগুলোর সঙ্গে লড়, আর তুমি হাতির সঙ্গে লড়াই করছ। হাতির সঙ্গে তোমার লড়াই দেখে এদিকে বিরাটরানি সুদেষ্ণা আর তার পরিজনেরা যে দাঁত বার করে হাসে, তাতে আমার কীরকম লাগে, তা তুমি জানি কি হসন্ত্যন্তঃপুরে নার্যো মম তৃদ্বিজতে মনঃ। জানো তো, তোমার ওই হাতির লড়াই দেখে একদিন আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল, আমি চক্কর খেয়ে পড়েই গেছিলাম। তাই না দেখে বিরাটরানি অন্য মেয়েদের সামনে পঁাত বার করে কি হাসিই না হাসছিল। আর তারা কী বলল, জান? বলল– রাঁধুনে ছেলেটিকে হাতির সঙ্গে যুদ্ধ করতে দেখে এই সুন্দরীর এমন সোহাগ উথলে উঠেছে, যেন ও ব্যাটা ওর কতকালের সোয়ামী স্নেহাৎ সংবাসজাদু ধর্মাদ… ইয়ং সমনুশোচতি। তা আমাদের সৈরস্ত্রীকেও দেখতে ভাল, রাঁধুনে ছোকরাটাও চমৎকার, মেয়েদের মনের কথাও কিছু বলা যায় না, তার ওপরে দুটিতেই এই রাজবাড়িতে কাজ নিয়েছে প্রায়ই একই সময়ে, সৈরস্ত্রীও তো দেখি মাঝে মাঝেই স্বামীর সঙ্গে মিলতে পারছে না বলে দুঃখ করে, কে জানে কী ব্যাপার! দ্রৌপদী বললেন– জান ভীম। সুদেষ্ণারা বারবার আমাকে এই সব কথা বলে, আবার তাতে যদি আমি রেগে যাই, তা হলে আবার তোমায় নিয়ে আমাকে ঠাট্টা করে– ক্রুধ্যন্তীং মাং চ সংক্ষ্যে সমশঙ্কত মাং ত্বয়ি। আমার আর এসব ভাল লাগছে না। আবার আর-একজনকে দেখ, ওইরকম ধনুর্ধর পুরুষ! সে কিনা খুকি-বিনুনি বেঁধে বেণীবিকৃতকেশান্তঃ–কানে দুল পরে, মেয়ে সেজে মেয়েদেরই মধ্যে নাচ শেখাচ্ছে, গান শেখাচ্ছে– কন্যানাং নওঁকো যুবা। সোহদ্য কন্যাপরিবৃতো গায়ন্নাস্তে ধনঞ্জয়ঃ। আর দুটির কথা তো ছেড়েই দিলাম– একজন লাল খেটো পরে সংরদ্ধং রক্তনেপথ্যং– রাখালি করে বেড়াচ্ছে, আর একজন বিরাট রাজাকে ঘোড়ার কেরামতি দেখাচ্ছে বিরাটম উপতিষ্ঠং দর্শয়ন্তঞ্চ বাজিনঃ।

বস্তুত দ্রৌপদীর এই বক্তব্যের মধ্যে বীরভ্রাতা ভীম আর অর্জুনের জন্যই তার মানসিক নিপীড়ন বেশি। আমি আগেই বলেছি নকুল এবং সহদেবের ব্যাপারে দ্রৌপদীর পত্নীপ্রেম যতটুকু ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল বাৎসল্য। এইখানে ভীমের কাছে যে তিনি দুঃখ করছেন, তাতেও সেই ভাবটি পরিষ্কার ফুটে উঠেছে।

ভীম আর অর্জুনের জন্যই দ্রৌপদীর মনে বীরপত্নীর মর্মপীড়া ছিল। স্ত্রীবেশী অর্জুনের ব্যবহার তার আর সহ্য হচ্ছিল না। আর ভীমের মতো মানুষ রাজবাড়ির মাইনে-করা কুস্তিগির আর হাতিদের সঙ্গে লড়ে মেয়েদের তামাশার খোরাক জোগাচ্ছেন, দ্রৌপদীর কাছে এর থেকে কষ্টকর আর কী হতে পারে! আবার এই ঘটনা নিয়ে রাজবাড়ির মেয়েদের সামনে তাঁর মমতা দেখানোর উপায়টুকু পর্যন্ত নেই। একে তো জানাজানি হবার ভয়, তার ওপরে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ক, যা নাকি দ্রৌপদী এবং ভীমের ক্ষেত্রে ঘটনাই, সেটাকেও অন্তত সবার সামনে উড়িয়ে দিতে হচ্ছে, সুদেষ্ণা আর অন্য মেয়েদের মশকরাও শুনতে হচ্ছে আমাদের সৈরস্ত্রীও রূপে-গুণে লক্ষ্মীমতী আর এই রাঁধুনে ছোকরাটাও চমৎকার দেখতে– কল্যাণরূপা সৈরী বল্লবশ্যাপি সুন্দরঃ। অর্জুন আর ভীমের জন্য মর্মপীড়া বাদ দিলে যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্রৌপদীর কিন্তু সেই একই ভাব। বিশেষত কৌরবের রাজসভায় যে পাশাখেলা হয়েছিল, তাতে হাজার নাকানি-চুবানি খেয়েও যুধিষ্ঠির যে বিরাটের রাজসভায় আবার পাশা খেলারই কাজ নিয়েছেন, এটা দ্রৌপদীর কাছে অন্য অর্থ বহন করে এনেছে। তার কাছে নকুল সহদেব ছোট্ট ‘নাজুক’, নরম মানুষ– গোরু চরানো ঘোড়া-দাবড়ানো এসব পরিশ্রমবহুল কাজ তাদের যেন সয় না। উলটোদিক থেকে ভীম আর অর্জুন হলেন বীর। বিশাল গদা আর গাণ্ডীব নিয়ে যাদের কারবার, তাদের পক্ষে রান্না করা আর গান শেখানো যেন নিতান্ত বীরত্বহানির ব্যাপার, অন্তত দ্রৌপদীর কাছে তাই। কিন্তু সেদিক থেকে দেখতে গেলে যুধিষ্ঠিরকে কোনও পরিশ্রমের কাজও করতে হচ্ছিল না, আবার তার সম্মান হানি হয়, এমন কিছুও তাকে করতে হচ্ছিল না। এতে তো দ্রৌপদীর বরং সুখী হবার কথা ছিল, কিন্তু তা তিনি হননি।

যুধিষ্ঠিরের হাত থেকে পাশার দান পড়ছে– এ তার দু’চক্ষের বিষ। ভীমের কাছে তিনি কথা আরম্ভ করেছিলেন যুধিষ্ঠিরকে ধিক্কার দিয়ে। বলেছিলেন– যুধিষ্ঠির যার স্বামী, তার আবার সুখ? এখন ভীমের কাছে সব স্বামীর প্রতি মমত্ব জানিয়ে কথা শেষ করলেন। যুধিষ্ঠিরকে দিয়েই। বললেন– এই যে শতেক দুঃখ আমার দেখছ, সেও যুধিষ্ঠিরের জন্যেই এবং দুঃখশতাবিষ্টা যুধিষ্ঠির-নিমিত্ততঃ। আজকে যে আমাকে চাকরানির মতো রাজবাড়িতে ফরমাস খাটতে হচ্ছে, রানি সুদেষ্ণার পায়খানা পেচ্ছাপের জল জোগান দিতে হচ্ছে, সেও ওই পাকা জুয়াড়িটার জন্য শৌচদাস্মি সুদেষ্ণায়া অক্ষধূৰ্ত্তস্য কারণাৎ। দ্রৌপদী এতক্ষণ অন্য স্বামীদের কষ্টভোগের কথা শুনিয়েছেন, এবারে নিজের দুর্ভোগের কাহিনি শোনাতে লাগলেন ভীমকে।

দ্রৌপদী বললেন– পঞ্চপাণ্ডবের মহিষী আর দ্রুপদ রাজার মেয়ে হয়েও এই অবস্থায় পড়ে আমি ছাড়া আর কে বেঁচে থাকতে পারে? এককালে ইন্দ্রের মতো স্বামীরা আমার মুখ চেয়ে বসে থাকত, এখন আমি এই অন্তঃপুরের ছোটলোক মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার সুখ কী ছিল– তা তুমি তো অন্তত বুঝবে ভীম। এককালে আমি হাঁটলে পরে আমার সামনে পেছনে শতখানেক বাঁদী যেত, এখন আমিই সেই কাজটা করি, আর হাঁটেন রানি সুদেষ্ণা সাহমদ্য সুদেষ্ণায়াঃ পুরঃ পশ্চাচ্চ গামিনী। আর একটা দুঃখ আমার মনের মধ্যে কাঁটার মতো বিধছে, ভীম। আমি আগে কোনও দিন কারও জন্যে চন্দনও ঘষিনি, আমার শাশুড়িমাতা ছাড়া আর কারও গা-হাত-পাও টিপে দিইনি, এখন সেই চন্দন পিষতে পিষতে আমার হাতে কড়া পড়ে গেল। দেখ, ভীম! দেখ এই আঙুলগুলো, এ কি আর সেইরকম নরম তুলতুলে আছে, যেমনটি তুমি আগে দেখেছ– পশ্য কৌন্তেয় পাণী মে নৈবং যৌ ভবতঃ পুরা।

পাঠক! লক্ষ করবেন, সুদেষ্ণার বাড়িতে এই পরিচারিকার কাজ দ্রৌপদী নিজেই সেধে নিয়েছিলেন, নইলে যুধিষ্ঠির ঠিকই সন্দেহ করেছিলেন যে, সুকুমারী কৃষ্ণার পক্ষে কোনও নীচ কাজ করা সম্ভব নয় হয়তো। কিন্তু রাজার শালা কীচকের জ্বালায় আজ পরিস্থিতি পালটে গেছে। আজ তিনি যুধিষ্ঠিরকেই দুষছেন যে, কেন তাকে চন্দন পিষতে হচ্ছে? দ্রৌপদী বলেছেন যে, আমি কোনওদিন শাশুড়ি কি স্বামীদের ভয় করে চলিনি– বিভেমি কুন্ত্যা যা নাহং যুস্মাকং বা কদাচন– সেই আমাকে কিনা এখন বিরাটরাজার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে হয়। চন্দন পেষা ভাল হল, না মন্দ হল– বর্ণকঃ সুকৃতো ন বা– মহারাজ কী বলবেন কিং নু বক্ষ্যতি সম্রাড় মাং– এ সব প্রশ্নে সব সময় এখন আমি বিচলিত। হায় হায়! কী পাপ করেছি, যার ফলে আমাকে এত দুঃখও সইতে হল।

দ্রৌপদীর চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকল, ভীমের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে কান্নার নিঃশ্বাসে মিশিয়ে দিলেন অশ্রুবারি। ভীম দ্রৌপদীর হাত দুখানি নিজের হাতে তুলে নিলেন, অসীম মমতায় সে দুটি হাত ক্ষণকাল রাখলেন নিজের মুখে, তারপর কেঁদে ফেললেন দ্রৌপদীর হাতের মধ্যেই মুখমানীয় দ্রৌপদ্যা রুরোদ পরবীরহা। নিঝুম রাত্রে যখন বৃষ্টির মতো অন্ধকারের কাজল ঝরে পড়ছিল তখন বিরাটের রন্ধনশালার মধ্যে একটি সম্পূর্ণ প্রেমের ছবি দেখতে পেলাম আমরা। বর্তমান লেখক কিন্তু ভীম আর দ্রৌপদীর এই আভিসারিক প্রেম সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ বাস্তববাদী। ভীম যে দ্রৌপদীর হাত দুখানি নিজের গালের ওপরে রাখলেন তার কারণ হয়তো এই সুবিশাল গদা চালাতে চালাতে ভীমের নিজের হাতেই কড়া পড়ে গেছে; সেই গদা-ঘোরানো কড়ার মধ্যে চন্দন-পেষা মেয়েলি কড়া ঠিক ঠাহর করা যায় না বলেই ভীম নিজের মসৃণ গালে (পাঠক! ভীমের দাড়ি গোঁফও খুব বেশি ছিল না) দ্রৌপদীর হাত রেখে তার দুর্ভোগ পরিমাপ করতে চেয়েছেন এবং যখন বুঝেছেন দ্রৌপদীর কথা সত্যি, সরলপ্রাণ ভীম তখন কেঁদে উঠেছেন সমব্যথায়। আমার কথা যে ঠিক, তার প্রমাণ দ্রৌপদীর হাত দুখানি মুখে মেজেই ভীম বলে উঠেছেন– ধিক আমার বাহুবল ধিক সেই গাণ্ডীবধম্বার গাণ্ডীবকে, যাঁরা থাকতেও তোমার হাতের রক্ত-লাল নরম তালুতে কড়া পড়েছে– যত্তে রক্তৌ পুরা ভূত্ব পাণী কৃতর্কিণাবিমৌ।

এতক্ষণ ভীমের সামনে দ্রৌপদী যে যুধিষ্ঠিরের নিন্দা করেছেন, তাতে অন্য সময়ে হলে ভীমের দিক থেকে যে প্রতিক্রিয়াটি হত, তা হয়তো দ্রৌপদীর অনুকূলেই যেত এবং অন্যত্র তা গেছেও। কিন্তু এই সময়ে অজ্ঞাতবাসের কারণেই হোক কিংবা যা তোক কোনও কারণে, ভীম কিন্তু দ্রৌপদীকে বুঝিয়ে বলতে চাইলেন যে বেচারা যুধিষ্ঠিরের ওপরে তিনি যেন রাগ না করেন। ভীম বললেন– যুধিষ্ঠির অজ্ঞাতবাসের শেষের দিন গুণছেন, নইলে তো একটি লাথিতে ওই বদমাস কীচকটার মাথা গুঁড়িয়ে ফেলতাম আমি– পোথয়ামি পদা শিরঃ। এই বিরাট রাজ্যেও লাগিয়ে দিতাম ধুন্ধুমার। নেহাৎ বড় ভাই যুধিষ্ঠির সব জানাজানি হবার ভয়ে চোখের ঠারে আমাকে সরে যেতে বললেন, তাই। কী জানি কেন, সরলপ্রাণ ভীমও বুঝেছেন যে যুধিষ্ঠির ঠিক কাজই করেছেন এবং এটা মাথায় ঢুকেছে বলেই তার মাথাও ঠান্ডা হয়েছে– স্থিত এবাস্মি ভামিনি। এই প্রথমবার বুঝি ভীম বললেন– মাথা ঠান্ডা কর, সুন্দরী! মাথা ঠান্ডা কর। তুমি যুধিষ্ঠিরের নামে যেভাবে বললে, এ যদি তিনি শোনেন, তিনি নির্ঘাত ‘সুইসাইড’ করবেন– শৃণুয়াদ যদি কল্যাণি নূনং জহ্যাৎ স জীবিত।

ভীমের কী সরল যুক্তি, হাজার হোক বড় ভাই, সুখে দুঃখে এতকাল একসঙ্গে আছেন। ভীম খুব চেষ্টা করলেন– যাতে যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্রৌপদী কিঞ্চিৎ সুদক্ষিণা হন। তিনি যুক্তি দিয়ে বললেন– তোমার এই নিন্দে-মন্দ শুনলে যুধিষ্ঠির নির্ঘাত ‘সুইসাইড’ করবেন। আর যুধিষ্ঠির ‘সুইসাইড করলে অর্জুন নকুল এবং সহদেবও ‘সুইসাইড়’ করবে। অপিচ এরা সবাই আত্মহত্যা করলে আমিই বা আর বেঁচে থেকে কী করব– নাহং শক্লোমি জীবিতুম। অকাট্য যুক্তি, অর্থাৎ কিনা যুধিষ্ঠিরের আত্মহত্যার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আত্মহত্যা করতে পারছেন না, কারণ বোধহয় দ্রৌপদীই, কিন্তু চার ভাই পর পর মারা গেলে তিনি একা দ্রৌপদীর একচ্ছত্র অধিকার নিতেও সাহসী নন– কারণ বোধহয় অনভ্যাস। দ্রৌপদীকে ভাগে পাওয়াই ভীমের অভ্যাস অথবা তার ভ্রাতৃপ্রীতিও ছোট করে দেখা উচিত নয়। যুধিষ্ঠিরকে আংশিক অবমাননা তিনি বহুবারই করেছেন কিন্তু পুরোটা কখনও নয়।

ভীমের কাছে দ্রৌপদীর ভাষণ শুনে একথা পরিষ্কার বোঝা যায়, মাঝে মাঝে দ্রৌপদীর অন্যায় মাথা গরম করার অভ্যাস ছিল, নইলে ভীমের মতো হঠাৎ-ক্রোধী মানুষও এই মুহূর্তে চ্যবনপত্নী সুকন্যা, সীতাদেবী, লোপামুদ্রা এবং সাবিত্রীর উদাহরণ তুলে দ্রৌপদীকে পতিপরায়ণতার উপদেশ দিয়েছেন।

পাঠক মহাশয়! আমরা বোধহয় আবার প্রসঙ্গ থেকে সরে এসেছি। আমাদের দোষও নেই খুব একটা দ্রৌপদী এতক্ষণ পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছিলেন, তার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ঘাঁটছিলাম। এখন তিনি ভীমের মনোভাব বুঝে যুধিষ্ঠির ইত্যাদির প্রসঙ্গ বাদ দিয়েছেন, আমরাও তাই সুযোগ বুঝে সেই রাজার শালা কীচকের প্রসঙ্গে এসেছি। দ্রৌপদী বললেন– আমার দুঃখ সমস্ত সহ্য-সীমার বাইরে চলে গেছে, নইলে যুধিষ্ঠিরকে গালমন্দ করে আর কী হবেন রাজানমুপালভে? পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটেই বা কী হবে– কিমুক্তেন ব্যতীতেন? দ্রৌপদী এবার সোজাসুজি কীচকের প্রসঙ্গে এলেন। তার ভাব, ভাবনা, তার পেছনে রাজবাড়ির মদত– এ-সব কিছুই ভীমকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন। দ্রৌপদীর বক্তব্য অনুযায়ী এক বাঘের মুখ থেকে বাঁচতে গিয়ে দ্রৌপদী আরেক বাঘের মুখে পড়েছেন। দ্রৌপদী সুদেষ্ণার পরিচারিকা। সুদেষ্ণার ধারণা– দ্রৌপদীকে দেখলে রাজা বিরাটকে ঠেকানো খুবই কঠিন হবে। দ্রৌপদীর রূপে তিনি এতই উদ্বিগ্ন যে, রাজা বিরাট অন্তঃপুরের দিকে এলেই সুদেষ্ণা এটা ওটা ফরমাস দিয়ে দ্রৌপদীকে এদিক-ওদিক পাঠিয়ে দেন। এই সুযোগটাই কীচক নিয়েছে। সুদেষ্ণার মনোভাব বুঝেই এবং ইতস্তত দ্রৌপদীকে চলাফেরা করতে দেখেই কীচক দ্রৌপদীকে প্রেম নিবেদন করা শুরু করে। তার পরের ঘটনা ভীমের জানা। গতদিন কীচক দ্রৌপদীকে সবার সামনে পদাঘাত করেছে। রাজা বিরাটের এতে কিছুই করবার নেই, কেননা সুদেষ্ণার কারণেই হোক কিংবা অন্য কোনও কারণে, রাজা তাকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তুলেছেন এবং দ্রৌপদীর পক্ষে তা কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে– কীচকো রাজবাল্লভ্যাচ্ছোককৃত্ মম ভারত।

শুধু এইটুকুই নয়, দ্রৌপদীর কাছে এইমাত্র যে সংবাদ পাওয়া গেল, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, কীচক শুধু সুন্দরী নারীর রতিলিষ্ণু নন, তিনি নৃশংসও বটে। গরিব প্রজাদের টাকা পয়সা আত্মসাৎ করা থেকে হত্যা- এসব কিছুতেই তাঁর হাত পাকা। দ্রৌপদীর আশঙ্কা হয় (পাঠক হিসেবে আমরাও বুঝি– এ আশঙ্কা অমূলক নয়) যে, বারবার রাস্তায় তিনি যেভাবে কামান্ধ কীচকের রতি-প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাতে এরপর তাঁর চোখের সামনে পড়লেই যথেষ্ট চড়-লাথি খেতে হবে দ্রৌপদীকে। পরে মহাভারতের গীতাপর্বে আমরা দেখেছি যে, কামীজনের কামনা প্রতিহত হলেই তা ক্রোধের আকার ধারণ করে। ‘কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে’ এই শ্লোকের ওপর টীকায় শংকরাচার্য তাই লিখেছেন– কাম এব প্রতিহতঃ ক্রোধরূপেণ পরিণমতে। দ্রৌপদী কীচকের ব্যাপারে এই সন্দেহই করছেন। তিনি এখন আপন সতীত্বের থেকেও বারবার মার খাবার কথা ভাবছেন এবং সেই মার খেতে খেতে তার জীবন থাকবে কিনা– এই স্কুল শারীরিক চিন্তাই আপাতত তার আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে– দর্শনে দর্শনে হন্যাদু যথা জহ্যাঞ্চ জীবিতম। দ্রৌপদী বললেন ভীম! এতে তোমাদের ধর্মও থাকবে না, শৌর্য-বীর্যও ব্যর্থ, কেননা যে স্বামী বউকেই রক্ষা করতে পারে না, তার আবার ধর্ম কীসের মহান ধর্মো ন শিষ্যতি। আবার তোমরা যে। লোক জানাজানি হবার ভয়ে অজ্ঞাতবাসের ব্রত নিয়েছ, সেই প্রতিজ্ঞা রাখতে গেলে তোমরা পাঁচভাই আর স্ত্রীর আশা কোরো না– সময়ং রক্ষমাণানাং ভার‍্যা ব ন ভবিষ্যতি।

কীচকের কামনার জ্বরে দগ্ধা দ্রৌপদী মহিলা হিসেবে আকুল প্রার্থনা জানালেন ভীমের কাছে, কারণ, অজ্ঞাতবাসের কড়াকড়ির মধ্যে এই কাজ ভীম ছাড়া আর কারও পক্ষেই উদ্ধার করা সম্ভব নয়। দ্রৌপদী বললেন– তুমি আমাকে একসময়ে জটাসুরের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলে, ভীম! (এ ঘটনা বনপর্বের। জটাসুর হরণ করে নিয়ে যাচ্ছিল যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব এবং দ্ৰৌপদীকে। ভীম তাকে মারেন।) তুমিই রক্ষা করেছিলে দুষ্ট জয়দ্রথের হাত থেকে, এখন এই লম্পট কীচকটাকেও উপযুক্ত শিক্ষা দাও। পাথরের ওপর মাটির কলসি ফাটালে যেমনটি হয়, তেমনি করে ওই কীচকের মাথাটাও ফাটাও দেখি– ভিন্ধি কুম্ভমিবাশ্মনি।

জনান্তিকে বলে রাখি দ্রৌপদীর সামনে ‘মাসল’ ফুলিয়ে বাহুর কসরত দেখাতে একটু পছন্দ করতেন ভীম। স্ত্রীলোক সামনে থাকলে কোন বীরপুরুষই বা এটি না-পছন্দ করে। আমরা বনপর্বে কীর্মির রাক্ষস বধের সময়ে দেখেছি সুন্দরী কৃষ্ণা ভীমের যুদ্ধ-কসরত দেখছিলেন বলে, শুধুমাত্র দেখছিলেন বলেই, ভীমের শক্তি যেন আরও ক’গুণ বেড়ে গেল– কৃষ্ণানয়ন দৃষ্টশ্চ ব্যবৰ্ধত বৃকোদরঃ। রুক্ষ শুষ্ক বামুন নীলকণ্ঠ এই শ্লোকের টীকায় বলেছেন কৌরবনিবাসে দ্রৌপদীর বস্ত্রাকর্ষণের কথা স্মরণ করেই, নাকি কৃষ্ণার চোখের চাহনিতে (নিশ্চয় করুণ চোখ বোঝাচ্ছেন নীলকণ্ঠ) অধিক কুপিত হয়েছেন ভীম। আরে এই শ্লোকের পূর্বার্ধে তো দুর্যোধনের অত্যাচারের কথাই আছে, কাজেই ‘কৃষ্ণানয়নদৃষ্ট’ এই সুন্দর শ্লোকাংশে আবার ওসব কথা কেন! নীলকণ্ঠ জানেন না, সুন্দরী স্ত্রীর তারিফ করা চোখের চাহনিতে যে কোনও প্রতিযোগিতার শক্তি বেড়ে যায়, যুদ্ধশক্তি তো বটেই। আমি বাপু এখানে ভূয়োদশী ব্যাসের কথার সোজা অর্থ বুঝি– কৃষ্ণানয়নদৃষ্টশ্চ ব্যবর্ধত বৃকোদরঃ। তার ওপরে করুণ চোখে তাকানোটা কৃষ্ণার স্বভাববিরুদ্ধ। হয় তিনি বিদগ্ধা নারীর কটাক্ষে তাকান, নয়তো বাহবা দেওয়ার চোখে। ভীমের শক্তি তাতেই চেতিয়ে দেয়। দ্রৌপদী জানেন– কীচকের কথা যতটুকু বলেছেন, তাতেই ভীম তেতে গেছেন, এখন শুধু ঠোঁট ফুলিয়ে একবার বললেন– কীচক জীবিত আছে– এই অবস্থায় যদি কালকের রাত্রিও কাটে তবে আমি ‘গ্লাসের মধ্যে বিষ গুলিয়ে খাব– বিষমালোড্য পাস্যামি– তবু কীচকের হাতে আমি ধরা দেব না। তার চেয়ে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে মরব, তাও ভাল।

আবার প্রেমের ‘সিন’। ভীম দ্রৌপদীর কথার মর্ম বুঝলেন। বুঝলেন কীচকের বিরুদ্ধে আশু ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সুন্দরী কৃষ্ণা তখনও ভীমের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদছেন। ভীম জড়িয়ে ধরলেন দুঃখের ঝড়ে আপতিতা অভিসারিকাকে। হাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে রাজনন্দিনী দ্রৌপদীকে আশ্বাস দিয়ে বললেন– তুমি যা চাও তাই হবে তথা। ভদ্রে করিষ্যামি যথা ত্বং ভীরু ভাষসে। তবে একটু নাটক করতে হবে তোমায়। বিরাটের নতুন নৃত্যশালাটি চেন তো? ওখানে দিনের বেলা মেয়েরা নাচে, কিন্তু রাত্রে কেউ সেখানে থাকে না। তুমি কীচককে জানাবে নৃত্যশালাতেই তোমার সঙ্গে মিলন হবে তার। দেখো কেউ যেন তোমাদের কথালাপ শুনতে না পায়। আজ সন্ধেবেলাতেই এই কাজ করতে হবে, তারপর সেখানেই আমি কীচককে তার মৃত বাপ-ঠাকুরদার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেব– তত্ৰাস্য দর্শয়িষ্যামি পূর্বপ্ৰেতান পিতামহান।

রাত্রি আর বাকি নেই। দুহু কোলে দুহু কাঁদে, যতক্ষণ থাকা যায় ততক্ষণ থেকে দ্রৌপদী ফিরলেন নিজের ঘরে। ভোর হতেই কীচককে আবার দেখা গেল দ্রৌপদীর কাছে কাছে ঘুর ঘুর করতে। তাঁর আর লজ্জা-ভয় নেই। তিনি বললেন– বিরাট রাজার সামনেই তো তোমাকে আমি লাথি মেরেছি। আরে! রাজা আমিই এবং সেনাপতি তো বটেই– অহমের হি মৎস্যানাং রাজা বৈ বাহিনীপতিঃ। আমাকে তুমি একটু সুখ দাও সুন্দরী, আমি তোমার গোলাম হয়ে যাব– দাসো ভীরু ভবামি তে। প্রতিদিন তোমায় দেব হাজার মোহরের তোড়া আর দাস-দাসী যা চাও! পরিবর্তে আমি চাই তোমার সঙ্গে মিলতে– অস্তু নো ভীরু সঙ্গমঃ।

দ্রৌপদী বিদগ্ধা নারী। নাটক করা তাঁর ভালই আসে। দ্রৌপদী বললেন– আমি আজ মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি– তোমার বাঁধনে ধরা দেব। কিন্তু একটা কথা, তোমার বন্ধু বান্ধব ভাইয়েরা সব কেউ যেন এ-কথাটা জানতে না পারে। তুমি জান তো, আমার সেই মুখপোড়া গন্ধর্ব স্বামীগুলো আছে, তারা জানতে পারলে আমায় আর আস্ত রাখবে না। কীচক বললেন– দূর বোকা, কেউ জানতে পারবে না, আমি একাই যাব–একো ভদ্রে গমিষ্যামি ‘মিট করার জায়গা ঠিক হয়ে গেল সেই নৃত্যশালা।

সেই সকালবেলার কথা। দুপুর বারোটা পর্যন্ত কীচকের মনে হল সে যেন ছ’মাস বসে আছে। দুপুর গড়িয়ে পড়তেই আরম্ভ হল তার সাজ। মনে কেবল দ্রৌপদীর রূপ-চিন্তা, আর সমাগমের প্রতীক্ষা। দ্রৌপদী আবার ভীমের কাছে জানিয়ে এসেছেন– সব ব্যবস্থা পাকা। রাত এসে গেল। সিংহ যেমন প্রচ্ছন্ন ভাবে শিকারের অপেক্ষা করে, ভীমও অন্ধকার নর্তনাগারে তেমনটি ঘাপটি মেরে রইলেন। রাত্রির আমেজে অনেক সাজগোজ করে কীচক উপস্থিত হলেন অন্ধকার নৃত্যশালায়। প্রথমে যেন কিছু ঠাহর করাই যায় না কোথায় সেই দ্রৌপদী। কীচকের মনে হল– সে যে বলেছিল, নৃত্যশালায় রীতিমতো শয্যা বিছানো আছে একটা। কোথায় শয্যা! আরে এই তো, এইখানেই শুয়ে আছে, কীচক অল্প একটু হাত ছোঁয়ালেন। দ্রৌপদী যে এতটা উন্মুখ হয়ে আছেন, তা যেন তাঁর কল্পনাতেও আসে না। কীচক বললেন- তোমায় কত টাকা পাঠিয়েছি, কত দাসী পাঠিয়েছি, তোমার সেবার জন্য। (এবার কাজের কথায়–) জান তো আমার অন্তঃপুরের মেয়েরা বলে আমার মতো সুন্দর পুরুষ নাকি তারা কোনওদিন দেখেনি।

উত্তর এল, তবে সে কণ্ঠস্বরে বজ্র লজ্জাহত, বড় কঠিন, শুষ্ক স্বাধীন সে উত্তর। উত্তর এল– বড় সৌভাগ্য আমার, তুমি এত সুন্দর। মেয়েদের ভাল লাগবার মতোই বটে। তবে এখন আমি তোমায় যে স্পর্শসুখ দেব, তুমি কামকলাকোবিদ হওয়া সত্ত্বেও এমন স্পর্শসুখ তুমি কোথাও পাওনি– ঈদৃশন্তু ত্বয়া স্পর্শঃ সৃষ্টপূর্বো ন কৰ্হিচিৎ। আর নিশ্চয়ই বলতে হবে না। কীচক আর ভীমের ধস্তাধস্তিতে নৃত্যশালা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। অবশেষে কীচককে মাংসপিণ্ডে পরিণত করে একটুখানি আগুন জ্বালিয়ে ভীম এবার ডাকলেন দ্রৌপদীকে। দ্রৌপদী এবং ভীম–দু’জনেরই ক্রোধ শান্ত হল। ভীম বললেন– তোমায় যারা অন্যায়ভাবে চাইবে, তাদের অবস্থা হবে ঠিক এই কীচকের মতো। দ্রৌপদীর প্রিয়কার্য করে ভীম রন্ধনশালায় ফিরে গেলেন। কিন্তু দ্রৌপদী গেলেন না। তাঁর সাহসটা দেখুন। এই নির্জন রাত্রে তিনি ঘুমন্ত সভাসদদের ডেকে ডেকে বললেন দেখুন আমার গন্ধর্ব-স্বামীরা লম্পট কীচককে তার লাম্পট্যের শাস্তিটি কেমন দিয়েছেন, দেখুন। সভাপালেরা এলেন, মশাল জ্বালিয়ে এলেন অন্যেরাও। কীচকের বন্ধুবান্ধব এবং তার ভাইয়েরাও। কীচকের ভাইয়েরা হল সব উপকীচক। তারা ভাবল এই দ্রৌপদীটাই যত নষ্টের গোড়া। তারা দ্রৌপদীকে বেঁধে নিয়ে চলল মরা কীচকের সঙ্গে তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে কীচকের আত্মার শান্তি ঘটাতে। দ্রৌপদী পঞ্চস্বামীর ছদ্মনামগুলি ধরে চেঁচাতে লাগলেন এবং আবার তার রক্ষায় এগিয়ে এলেন ভীম। গুপ্ত দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে শ্মশান চত্বরে ঢুকে দ্রৌপদীকে বন্ধন-মুক্ত করলেন ভীম এবং সেইসঙ্গে কীচকের একশো পাঁচটি ভাইকেও হত্যা করলেন।

খবরটা রটে গেল। প্রত্যক্ষদর্শীরা এসে রাজা বিরাটকে ভয় দেখাল। ভয়ের কারণ তিনটে– সৈরী অত্যন্ত রূপবতী, গন্ধর্ব বলে যার কথা শোনা যাচ্ছে সে প্রবল পরাক্রান্ত; তৃতীয়, কোনও পুরুষ যদি আবার দ্রৌপদীর পেছনে ছোঁক ছোঁক করে তা হলেই বিরাট রাজ্য উচ্ছন্নে যাবে। রাজাকে তারা বলল– মুক্ত হয়ে সৈরন্ধ্রী আবার আপনার ঘরে ফিরে আসছে– পুনরায়াতি তে গৃহম। মানে এটাও যেন একটা ভয়ের কথা। দ্রৌপদীকে রাস্তায় ফিরে আসতে দেখে বিরাটরাজ্যের পুরুষমানুষেরা পর্যন্ত পালিয়ে গিয়ে ঘরের দরজা দিল। শ্মশান-ফেরা দ্রৌপদী স্নান করে নতুন কাপড় পরে জনহীন পথ বেয়ে বিরাটের রন্ধনশালার দ্বারে এলেন ভীমকে কৃতজ্ঞতা জানাতে। একটু ইশারা করে আস্তে ভীমকে বললেন– নমো গন্ধর্বরাজায়, তুমি আমার রক্ষাকর্তা। ভীম বললেন– আমরা যার হুকুমের গোলাম, তার এইটুকু কথাতেই আমি অঋণী হলাম।

আমরা বলেছিলাম পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে ভীম একমাত্র মানুষ যিনি দ্রৌপদীকে ভালবাসতেন মনের গভীর থেকে। দ্রৌপদীর প্রত্যেকটি কথা যিনি বিনা দ্বিধায় নির্বিচারে পালন করতেন, তিনি ভীম। কৌরবসভায় দ্রৌপদীর অপমানে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন– দুঃশাসনের বুক চিরে রক্ত খাব। খেয়েছেন। দুর্যোধনকে বলেছিলেন– গদার বাড়িতে তোমার উরু দুটি ভাঙব। ভেঙেছেন। ক্ষত্রিয়ের নীতি উল্লঙঘন করার কলঙ্ক মাথায় নিয়েও দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করেছিলেন ভীম। কিন্তু যে দ্রৌপদীর জন্য ভীমের এত আত্মদান, সেই দ্রৌপদী! তার মনে মনে মাতাল হওয়ার জায়গা তো ভীম নয়। ভীমকে তিনি বললেন নমো গন্ধর্বরাজায়– আর এইটুকু চাটুতেই ভীম একেবারে বাধিত বোধ করেন দ্রৌপদীর কাছে। কিন্তু বিদগ্ধা রসবতীর এতে তৃপ্তি হবে কেন? তিনি কেবলই ধাওয়া করে বেড়ান সেই ব্যক্তিত্বের পেছনে, যাকে কেবলই মনে হয় এই বুঝি আধেক ধরা পড়েছেন। কিন্তু আর বাকি অর্ধেকের নাগাল পেয়েছি পেয়েছি করেও পাওয়া যায় না যেন। তার জন্য খোঁজ চলে, কিন্তু উত্তর মেলে কি?

দ্রৌপদী কিন্তু ভীমের কাছ থেকে মধুর বিদায় নিয়ে সুদেষ্ণার ঘরে ফিরে গেলেন না। মহাভারতের লেখক লক্ষ করেছেন যে, তিনি বিনা কারণে বিরাট রাজার নর্তনালয়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই যেখানে বিরাটের মেয়েরা নাচগান শেখে। আর নর্তনাগারের কাছে গেলে যে বৃহন্নলাবেশী অর্জুনকে দেখা যাবে, তাতে সন্দেহ কী? হ্যাঁ, তিনি স্বভাবতই রাজবাড়ির মেয়েদের কাছে নাচের বোল আউড়ে যাচ্ছিলেন। মেয়েরাও দেখল দ্রৌপদীকে। সেই মুহূর্তে দ্রৌপদী নিজেই যেহেতু জব্বর খবর, তাই নাচিয়ে মেয়েরা সব অর্জুনকে নিয়েই বেরিয়ে এসে দ্রৌপদীকে সম্ভাষণ জানাল– ভাগ্যিস আপনি কীচকদের হাত থেকে ছাড়া পেয়েছেন, ভাগ্যি মানি আপনি ফিরে সেছেন আবার দিষ্টা সৈরঞ্জী মুক্তাসি, দিষ্ট্যাসি পুনরাগতা। মেয়েদের দেখাদেখি অর্জুনও জিজ্ঞাসা করলেন– তুমি কেমন করে ছাড়া পেলে সৈরঞ্জী! কেমন করেই বা সেই দুষ্টু লোকগুলো শাস্তি পেল– আমরা আদ্যন্ত সব কিছু শুনতে চাই তোমার মুখে ইচ্ছামি বৈ তব শ্রোতুং সর্বমেত যথাযথ।

দ্রৌপদীকে এমনিতেই ক্লিষ্টা দেখাচ্ছিল, কিন্তু যিনি সারারাত্রির ধকল সহ্য করে, সকালবেলায় গা ধুয়ে, কাপড় কেচে গাত্রাণি বাসসী চৈব প্রক্ষাল্য সলিলেন সা– আবার ভীমের কাছে দরবার করতে যেতে পারেন, তিনি নিশ্চয়ই এত ক্লান্ত ছিলেন না যে, গল্প বলতে পারবেন না। কিন্তু কই, তিনি তো গল্পের ধারে কাছে গেলেন না, উলটে। দ্রৌপদী বৃহন্নলাবেশী অর্জুনকে বললেন- তুমি অন্তঃপুরের মেয়েদের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছ, সুখেই থাক, আবার সৈরন্ধ্রীর কী হল না হল, তা দিয়ে তোমার আজ কী দরকার কিছু তব সৈরন্ধ্যা কার্যমদ্য বৈ। রাজবাড়ির কিঙ্করী সৈরন্ধ্রী যে কষ্ট পাচ্ছে, সে কষ্ট তো আর তোমাকে পেতে হচ্ছে না এবং ঠিক সেইজন্যই মধুর হাসিটি হেসে দুখিনীকে এমনতর প্রশ্ন করতে পারছ– তেন মাং দুঃখিতামেবং পৃচ্ছসে প্রহসন্নিব– ‘হাসিয়ে সোহাগ করা শুধু অপমান?’

অন্তরের ব্যথায় দ্রৌপদী ভুলেই গেছিলেন অর্জুন এখন স্ত্রীবেশে বৃহন্নলা, আপন পূর্ব সংস্কারবশে তাই অর্জুনের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন পুংলিঙ্গবোধক ক্রিয়াপদ– প্রহসন্নিব। অর্জুন শুধরে দিয়ে বললেন- বৃহন্নলাও তোমার জন্যে যথোচিত দুঃখ পাচ্ছে, কল্যাণী! তাকে তুমি অন্তত পশু-পক্ষী ভেব না। এতকাল তুমি আমাদের মধ্যে আছ, আমিও তোমাদের মধ্যে একসঙ্গে আছি। সহবাসিনী একজনের কষ্ট মানে যে আমাদের সবারই কষ্ট। এবারে অর্জুন মোক্ষম কথাটি বললেন। বললেন– যে কেউ আরেকজনের মনের কথা ভাল করে বুঝতে পারে না– ন তু কেনচি অত্যন্তং কস্যচিদ হৃদয়ং ক্কচিৎ। বেদিতুং শক্যতে ভদ্রে যেন মাং নাবলুধ্যসে ৷

দ্রৌপদীকে অর্জুন কতটা ভালবাসতেন সেটার পরিমাণ বিচারে অর্জুনের এই কথাটা অত্যন্ত জরুরি। যে বিদগ্ধা সুন্দরীকে তিনি নিজেই লক্ষ্যভেদ করে আপন বীর্যশুল্কে বিবাহ করে এনেছিলেন, বিবাহের এত বচ্ছর পরেও তাকে বলতে হচ্ছে– তুমি আমার মনের কথাটা বুঝতে পারছ না– যেন মাং নাববুধ্যসে। অন্যদিকে দ্রৌপদী তার মনের কথাটাই বুঝতে চান, অথচ পারেন না। এমনকী আজকেও তিনি এক লহমার তরে অর্জুনের কাছে না এসে পারেননি, অন্তত এই বিপন্ন মুহূর্তে অর্জুন তার কথা কী ভাবছেন, কতটা ভাবছেন– এই জানা তার নিতান্ত প্রয়োজন। এসেই খোঁটা দিয়েছেন, অথচ অর্জুন কতটা নিরুপায় তা তিনি বোঝবার চেষ্টা করেননি।

বস্তুত দ্রৌপদীর ব্যাপারে অর্জুন যে শুধু এখনই নিরুপায় তা নয়। স্ত্রীবেশী বৃহন্নলা অজ্ঞাতবাসের ব্যবহারে– এখনই নিরুপায়, তা মোটেই নয়। এই উপায়হীনতার বন্ধন তার জীবনে সেইদিন থেকে তৈরি হয়েছে, যেদিন তাঁর মা কুমোরশালার মধ্যে থেকে দ্রৌপদীকে না দেখেই বলেছিলেন– পাঁচ ভাই ভাগ করে নাও। ব্যাপারটা আরও একটু বুঝিয়ে বলি। প্রথম কথা, অর্জুন হলেন মহাভারতের উদাত্ত নায়ক। যুদ্ধবীর হিসেবে তিনি যতখানি বড়, ঠিক ততখানি বড় সংযমী হিসেবে। সংযমী কথাটা আমি খুব প্রসারিত অর্থে ব্যবহার করছি। মহাভারতের কথায় অর্জুনের যতগুলি পদক্ষেপ আছে, প্রত্যেকটি সংযমের মাহাত্মে ভরা। যুদ্ধ কিংবা অন্যান্য জায়গাগুলো আপাতত বাদই দিলাম, কারণ সেখানে সমস্ত বড় কাজগুলিই তার নীরব এবং আস্ফোটহীন সহায়তায় ঘটেছে। শুধু দ্রৌপদীর ক্ষেত্রটাই ধরি, তা হলেও দেখব- প্রতি পদক্ষেপে তাকে নিজেকে বাঁধবার জন্যই কতবার রাশ টেনে ধরতে হয়েছে এবং এইভাবেই তিনি অন্য ভাইদের ভুল বুঝবার যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পেতে চেয়েছেন। অন্যদিকে সুন্দরী কৃষ্ণাকে দেখুন। পাঁচ ভাইকে আপন একক প্রেম ভাগ করে দেওয়ার বৈবাহিকভাবে তিনি দায়বদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে তা করতে গিয়ে কারও প্রতি বাৎসল্য, কাউকে রসমধুর স্তোকবাক্য, আবার কারও প্রতি শুধুই কর্তব্য করে গেছেন। কিন্তু অর্জুনের ব্যাপারটা বুঝি আলাদা। বিবাহ-লগ্নেই যে লক্ষ্যভেদী বীরপুরুষকে তিনি আশ্চর্য বিস্ময়ে হৃদয় নিবেদন করেছিলেন, সেই মানুষকে কি ভাগের প্রেম দিলে চলে? কারণে অকারণে, জ্ঞানে অজ্ঞানে দ্রৌপদীর দিক থেকে তাই কখনও বা সামান্য আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে, যে আকুলতা অতি স্বাভাবিক এবং তা এতই সূক্ষ্ম যে বোঝাই যায় না, এতই গভীর যে একমাত্র ভাগ-বসানো সতর্ক স্বামী ছাড়া অন্য কারও পক্ষে তা ধরাই মুশকিল।

বস্তুত আমাদের দেশের সামাজিক পরিস্থিতিতে একজনের পাঁচটা বউ থাকতে পারত, কিন্তু এক বউয়ের পাঁচটা স্বামী থাকতে পারত না। কিন্তু এক স্বামীর পাঁচটা কেন, যদি দুটি বউও থাকে তাদের একজন ঠিক বুঝতে পারে যে অন্যতরের প্রতি কতটা রস বিতরণ হচ্ছে, তেমনি এক বউয়ের যদি পাঁচটা স্বামী থাকে তা হলে অন্য স্বামীরাও ঠিক বুঝতে পারেন যে, নিকষে কার কতটা রসলাভ হল। এঁদের মধ্যে তাঁর পক্ষেই বরং খানিকটা নির্লিপ্ত থাকা সম্ভব, যাঁর ভাগ্যে সত্যিই সেই রস-বিনোদন ঘটছে এবং এই ঘটনাই ঘটেছে অর্জুনের ক্ষেত্রে। দ্রৌপদীর প্রেম নিশ্চিত জেনেই তিনি সে প্রেমে অধিকতর নির্লিপ্ত; কিন্তু সমস্ত বাস্তবতার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে, ঔচিত্যের গণ্ডী পেরিয়ে অর্জুনের জন্য দ্রৌপদীর যে আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে, সে আকুলতা সামান্য হলেও তা ঠিক ধরা পড়েছে অন্য স্বামীদের কাছে। হ্যাঁ, এ-কথা ঠিক, দ্রৌপদীর বিবাহ থেকে আরম্ভ করে মহাভারতের প্রায় শেষাংশ পর্যন্ত এ-তথ্য কেউ প্রকাশ করেননি, পঞ্চপাণ্ডবের কেউ না। মনের কথা বুঝি মনেই ছিল, হয়তো দ্রৌপদীর সামনে এ-কথা প্রকাশ করার ভয়ও ছিল। কিন্তু মহাপ্রস্থানপর্বে যে মুহূর্তে দ্রৌপদীর দেহান্ত হয়েছে সেই মুহূর্তে আমাদের ধারণামতো– বউ ভাল। মরলে আর চাকর ভাল পালালে– এই সুযুক্তি সহানুভূতি যুধিষ্ঠিরের ছিল না, সেই মুহূর্তে তিনি যেন ভাইদের প্রতিনিধি হয়ে বললেন- আমাদের সবার মধ্যে দ্রৌপদী সবচেয়ে ভালবাসত অর্জুনকে, তার ওপরেই ছিল দ্রৌপদীর গহন প্রেমের পক্ষপাত পক্ষপাতো মহানস্যা বিশেষণে ধনঞ্জয়ে। যুধিষ্ঠির একটুও ভণিতা না করে দ্বিধাহীনভাবে বললেন– এই পক্ষপাতেরই ফল আজ পাচ্ছে দ্রৌপদী তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে– তস্যৈতৎ ফলমদ্যৈষা ভুক্তে পুরুষসত্তম।

অর্জুনকে বেশি ভালবাসত এবং তার ফল পেয়েছে, মরেছে মৃত্যুর মুহূর্তে হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা যুধিষ্ঠিরের এই সত্যবচন তাকে যতই সত্যবাক ঋষির মতো করে তুলুক, মানুষের হৃয়লোকে এ যেন নৃশংসতা। তা ছাড়া এই পক্ষপাত কতটুকু? নববধূর কুসুম-কল্পনা বারবার দলিত করে ভাবে ভঙ্গিতে আর বক্রোক্তিতে এই পক্ষপাত কতটুকু দেখাতে পেরেছেন দ্রৌপদী? আবার তিনি, যদি বা নিজের অভিমান-মঞ্চ থেকে নেমে এসে যতটুকু পক্ষপাত দেখাতে পেরেছেন, অর্জুনের দিক থেকে তারও সাড়া মেলেনি। একেবারে বিরাটপর্বে এসে অর্জুনকে তাই বলতে হয়েছে– কেউ কারও মন বোঝে না, আমাকেও তুমি বোঝ না– যেন মাংস নাবলুধ্যসে।

কিন্তু নিজেকে না বোঝার মতো কারণ অর্জুন যদি নিজেও তৈরি করে না থাকেন, তবে পরিস্থিতি তো সত্যিই এমন তৈরি হয়েছিল, যা তাকে না বোঝার মতো। কৌরব-সভায় সেই চরম অপমানের দিনে দ্রৌপদীর তো মনে হয়েই থাকতে পারে যে, অর্জুন তাঁর প্রতি নিতান্তই নির্বিকার। অর্জুন যেন তাঁর হয়ে একটুও কথা বলছেন না। যেখানে ভীম দ্রৌপদীর অপমানে একের পর এক প্রতিজ্ঞা করে যাচ্ছেন, তার প্রতিতুলনায় গাণ্ডীবধন্থাকে তার নিতান্ত অপ্রতিভ মনে হল। ভীম রাগের চোটে জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের হাত পুড়িয়ে দিতে চাইছিলেন, অর্জুনই তাঁকে বারণ করেছেন। এসব ব্যবহার দ্রৌপদীর কাছে প্রীতিপ্রদ হয়নি। হয়তো সাধারণ সাংসারিকতায় অথবা নিতান্তই রমণীজনোচিত অভিমানে।

দ্রৌপদী বুঝতে পারেননি, যিনি মহাযুদ্ধের নায়ক হবেন, তাঁর মাথাটি ভীমের মতো হলে চলে না। অর্জুনের যুক্তি ছিল–যুধিষ্ঠির পাশা খেলতে আসেননি। ক্ষত্রিয় ধর্মের নিয়ম অনুসারে পাশা খেলায় আহূত হলে তাকে খেলতেই হবে। সেখানে যুধিষ্ঠিরের দোষ কী? অর্জুন ভীমকে বলেছেন–নিজেদের মধ্যে বাদ-বিসংবাদে শত্রুরই আখেরে লাভ হবে। সেই সুযোগ আপনি করে দেবেন না দাদা–ন সকামাঃ পরে কার্যাঃ। ভীম যুক্তি বুঝেছেন। তবু অর্জুনের এই স্থিরতা, ধৈর্য্যের চেয়ে ভীমের হঠাৎ-ক্রোধই দ্রৌপদীর কাছে বেশি ভাল লেগেছে। অর্জুনের ওপর অক্ষমা তাই বেড়েই যাচ্ছিল। কিন্তু মুখের এই ক্ষমাহীনতার সঙ্গে দ্রৌপদীর হৃদয়ের মিল নেই। সেখানে বারবার অর্জুনের প্রেমিকা হিসেবেই তিনি ধরা পড়ে যান। বনবাস-পর্বে পাণ্ডবেরা যখন দ্বৈতবন ছাড়ার মুখে, তখন ব্যাস এসে প্রতিস্মৃতি বিদ্যা দিয়ে গেলেন যুধিষ্ঠিরকে। যুধিষ্ঠির অর্জুনকে সেই বিদ্যা শিখিয়ে তপস্যায় যেতে বললেন, যে তপস্যায় তুষ্ট হবেন ইন্দ্র এবং মহাদেব। অর্জুন জ্যেষ্ঠের আদেশ নিয়ে চললেন। ব্রাহ্মণেরা আশীর্বাদ করলেন–ধ্রুবোহস্তু বিজয়স্তব। হতভাগিনী দ্রৌপদী আবার ধরা পড়ে গেলেন।

অর্জুনের আসন্ন প্রবাস বেদনায় দ্রৌপদীর মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। সব ভাইয়ের সামনেই তিনি অর্জুনের জন্য জমে থাকা ভালবাসা উজাড় করে দিলেন। বুঝি বিদগ্ধা রমণীর ভালবাসার এই রীতি। মুখে তার প্রতি প্রসন্ন নন, অথচ বাড়ি থেকে তিনি যে চলে যাবেন, তারও উপায় নেই–চলে যেতে চাইলেই অভিমানে ভরা একরাশ দুঃখ হাঁড়ি-মুখ থেকে গলগল করে বেরিয়ে পড়ে। দ্রৌপদী বললেন–মহাবাহু! তুমি জন্মানোর পরে আর‍্যা কুন্তী তোমার কাছে যা চেয়েছিলেন এবং যেমনটি তুমিও চাও, ঠিক তেমনটিই যেন তোমার হয়, অর্জুন! ঠিক এই শুভাকাঙ্ক্ষার পরেই দ্রৌপদীর গলা থেকে বেরিয়ে এল আক্ষেপের সুর–প্রার্থনা করি, কারও যেন আর ক্ষত্রিয়কুলে জন্ম না হয়–মাস্মাকং ক্ষত্রিয়কুলে জন্ম কশ্চিদবাথুয়াৎ। ভিক্ষা করে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন, সেই ব্রাহ্মণেরা আমাদের চেয়ে অনেক ভাল আছেন, তাঁদের আমি নমস্কার করি–ব্রাহ্মণেভ্যো নমো নিত্যং যেষাং ভৈক্ষ্যেণ জীবিকা।

ক্ষত্রিয় রমণীর মুখে এ কী কথা? না, আমরা বুঝি, আমরা দ্রৌপদীর দুঃখ বুঝি। সেই যে নববধূর আবেশ না ঘুচতেই ব্রাহ্মণের গোরু উদ্ধার করতে অর্জুনকে ছুটে যেতে হল, আর বনবাস জুটল কপালে, সে ক্ষত্রিয় বলেই তো; রাজসভায় পাশাখেলার আসরে অপমান হতে হল দ্রৌপদীকে, তাও–তো ক্ষত্রিয়নীতির বালাই নিয়ে। আবার এখন যে অর্জুনকে প্রবাসে তপস্যায় যেতে হচ্ছে, তাও তো ক্ষাত্রযুদ্ধে চরম জয়লাভের জন্য। এর থেকে বামুন হয়ে জন্মালে, দু’বেলা দু’মুঠো ভিক্ষার অন্ন মুখে দিয়ে, বামুন ঠাকুরের ত্রিসন্ধ্যা-তপস্যার ব্যবস্থা করে দিলেই তো ল্যাঠা চুকত। অন্তত তিনি তো কাছেই থাকতেন, কোনওদিন কর্মহীন অবকাশে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিন কাটাতে হত না দ্রৌপদীকে। কিন্তু দ্রৌপদীর মুশকিল হল–কৌরবসভায় যে অপমান তাকে সইতে হয়েছিল তার চরম প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অর্জুনকে ছেড়ে দিতেই হবে, আবার অন্যদিকে তাকে ছেড়ে থাকতে তার বনবাসের জীবন হয়ে উঠবে বিরহে বিধুর। চার স্বামী কাছে থাকতেও শুধু অর্জুন না থাকার মানে যে আলাদা। দ্রৌপদী বললেন–কুরুসভায় দুর্যোধন আমাকে বলেছিল ‘গোরু। আমি না হয় ‘গোরু’ই হলাম, কিন্তু সেই বাঁচিক অপমান আর দুঃখ থেকে, তুমি অর্জুন–আমার কাছে থাকবে না–এ দুঃখ আমার কাছে আরও অনেক বড়–তস্মাদ দুঃখাদ ইদং দুখং গরীয় ইতি মে মতিঃ। তুমি চলে গেলে তোমার ভাইয়েরা হয়তো তোমার বীরত্বের কথা কয়েই দিন কাটাবে; কিন্তু আমার কী থাকল–তুমি প্রবাসে কষ্ট করবে, সেই অবস্থায় কোনও সুখ, কোনও ভোগ এমনকী জীবনও আমার কাছে অসহ্য লাগবে। আমাদের সুখ, দুঃখ, জীবন, মরণ, রাজ্য, ঐশ্বর্য–সব, সব তোমাতেই নির্ভর। কাজেই তোমাকে বিদায় দিতেই হবে, হে বন্ধু বিদায়। নমো ধাত্রে বিধাত্রে চ–প্রার্থনা করি তোমার প্রবাসের দিন সুখের হোক, তুমি নীরোগ থাক-স্বস্তি গচ্ছ হ্যনাময়ম।

ব্যাস লিখেছেন–দ্রৌপদী অর্জুনকে এই ‘আশীর্বাদ করে থামলেন–এবমুত্বাশিষঃ কৃষ্ণা বিররাম যশস্বিনী। দ্রৌপদী কি তখন যুধিষ্ঠির কিংবা ভীমের বউ হয়ে ছিলেন যে, এই শব্দটি–আশীর্বাদ? হয়তো তাই, নয়তো নয়–ব্যাস স্বকণ্ঠে কিছু বলেননি। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখেছি অর্জুনের বনবাস, প্রবাস–সবকিছুই ঘটে, যখন তিনি অন্য পাণ্ডবের ঘরণী–হয়তো এখানেও তাই হবে, হয়তো দুঃখ তাই বেশি। কৃষ্ণার এত কথা, এত শুভাশংসার উত্তরে অর্জুন কিন্তু একটি কথাও বলেননি। যদি বলতেন, তাহলে ভাইদের সতীন-হৃদয়ে তার ছায়া পড়ত এবং মৃত্যুর পরও তাকে শুনতে হত–অর্জুন কৃষ্ণার প্রতি বেশি অনুরক্ত ছিল। কিন্তু অর্জুন না হয় ধীরোদাত্ত নায়ক পুরুষ, কিছু বললেন না, কিন্তু দ্রৌপদীর স্ত্রীহৃদয় কি বশে আনা যায়। একবার, যেমন এখন, তিনি অর্জুনের ওপর তার পক্ষপাত প্রকাশ করে ফেললেন, তেমনি অর্জুনের প্রবাস-পর্বে তিনি নিজেকে নিজেই একেবারেই ধরে রাখতে পারেননি।

অর্জুন যখন তপস্যার জন্য চলে গেলেন তখনও পাণ্ডবেরা কাম্যকবনে। তারা কিছুদিন ব্রাহ্মণদের মুখে নল-দময়ন্তীর কাহিনি শুনে দিন কাটালেন, কিন্তু অর্জুন ছাড়া কারও ভাল লাগছিল না, এমনকী মহাভারতের শ্রোতা যে তরুণ ছেলেটি–জন্মেজয়, অর্জুন যার সাক্ষাৎ প্রপিতামহ, সে পর্যন্ত বৈশম্পায়নকে বলল– অর্জুনকে বাদ দিয়ে আমার আর আর পিতামহেরা কী করছিলেন? সুভদ্রার গর্ভ-পরম্পরায় যার জন্ম সেই জন্মেজয়ও কি দ্রৌপদীর ধরা পড়ার আন্দাজ পেয়েছিলেন কোনও? মহর্ষি বৈশম্পায়ন একটু বললেন অন্য পাণ্ডবদের কথা। তারা সুতোছেঁড়া মণিমালার মতো ছন্নছাড়া আর ডানাকাটা পাখির মতো ছন্দোহীন হয়ে পড়েছেন। সবাই শোকার্ত, অহৃষ্টমনসঃ, কিন্তু পাঞ্চালী-দ্রৌপদীর অবস্থা যেন আরও খারাপ, অর্জুনকে স্মরণ করলেই জীবনের সবগুলো ফাগুন যেন একসঙ্গে তার বুকের মধ্যে হা হা করে–অর্জুনকে যে তাঁর ভাল করে পাওয়াই হয়নি। ব্যাস তাই লিখলেন–বিশেষতস্তু পাঞ্চালী স্মরন্তী মধ্যমং পতিম। পাঞ্চালী দুঃখ জানানোর লোক পেলেন না, বেছে বেছে যুধিষ্ঠিরকেই তিনি মনের ব্যথা বোঝাতে আরম্ভ করলেন। জ্যেষ্ঠ স্বামীর মানসিক জটিলতা সম্পূর্ণ হল–দ্রৌপদী অর্জুনেরই।

দ্রৌপদী বললেন–মাত্র দুটি হাতেই অর্জুন আমার সহস্রবাহু কার্তবীর্যাজুনের মতো শক্তিশালী। তাকে ছাড়া এই বনভূমি যে আমার কাছে শূন্য হয়ে গেছে, এই ফল-ফুল, নদী লতা সব শূন্য। সেই মেঘের মতো কালোপানা পেটা চেহারা, হাঁটলে মনে হবে হা হাঁটছে বটে, হাতি হাঁটছে। আর মনে পড়ছে তার নীল পদ্মের পাপড়ি হেন চোখ দুটি। সে ছাড়া এই কাম্যকবন আমার অন্ধকার। যার ধনুকের টঙ্কার শুনলে মনে হবে বাজ পড়ছে যেন–সেই পরবাসী অর্জুনের কথা ভেবে ভেবে একটু যে শান্তি পাচ্ছি না আমি–ন লভে শৰ্ম বৈ রাজন স্মরন্তী সব্যসাচিন।

অর্জুনের বীরত্ব, অর্জুনের চেহারা আর অর্জুন ছাড়া সুন্দরী অরণ্যভূমি–শূন্যামিব প্রপশ্যামি–দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের কাছে সম্পূর্ণ ধরা পড়ে গেলেন। কৃষ্ণার অর্জুন-বিলাপ শেষ হলে ভীম, নকুল এবং সহদেব তাঁরই সঙ্গে সুর মেলালেন বটে, কিন্তু সেই অধ্যায়ে ধর্মরাজের মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরল না। পরের অধ্যায়ে দেখতে পাচ্ছি কৃষ্ণা এবং ভাইদের সম্মিলিত হাহাকার শুনে যুধিষ্ঠিরও কিঞ্চিৎ বিমনা হলেন–ত্বা বাক্যানি বিমনা ধর্মরাজোইপ্যজায়ত। যুধিষ্ঠিরও অর্জুনের জন্যে বিলাপ করেছেন, তবে সে পরে, ভাইদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে নয়। আমি বিশ্বাস করি প্রধানত দ্রৌপদীর উদ্ভ্রান্ত অবস্থা দেখেই পরবর্তী সময়ে যুধিষ্ঠির এবং তার ভাইয়েরা অর্জুনকে কৈলাস পর্বতের দুর্গম পথে খুঁজতে বেরলেন। যুধিষ্ঠির পথ-পরিশ্রমের কারণে কৃষ্ণাকে রেখেই যেতে চেয়েছিলেন, সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন শুধু নকুলকে। কিন্তু ভীম দ্রৌপদীর মন বুঝেই জবাব দিলেন–সে হয় না, দ্রৌপদী সত্যিই ক্লান্ত। কিন্তু অর্জুনকে দেখতে না পেয়ে তিনি তো দুঃখও পাচ্ছেন বটে এবং প্রিয়দর্শন লালসা যেহেতু শ্রমক্লান্ত শরীরকেও টেনে নিয়ে চলে, তাই দ্রৌপদী অর্জুনকে দেখার ইচ্ছে সামলাতে পারবেন না, তিনি যাবেনই–ব্রজত্যেব হি কল্যাণী শ্বেতবাহদিদৃক্ষয়া।

সার্থক প্রেমিক ছাড়া প্রিয়ার মনের কথা এমন করে কে বুঝবে? ভীম দ্রৌপদীকে ভালবাসেন বলেই তার ভালবাসার পাত্রকে এমন করেই জুগিয়ে দিতে পারেন। ভীম বললেন–দুর্গম স্থানে আমি কাঁধে করে নিয়ে যাব দ্রৌপদীকে–অহং বহিস্যে পাঞ্চালীং যত্র যত্ৰ ন শক্ষ্যতি৷ এইবার এতক্ষণে দ্রৌপদীর মুখে হাসি ফুটল–প্রহসন্তী মনোরমা। যুধিষ্ঠিরকে সলজ্জে বললেন–আমার জন্য আপনি ব্যাকুল হবেন না, মহারাজ! আমি ঠিক পারব–গমিষ্যামি ন সন্তাপঃ কার্যো মাং প্রতি ভারত। ঠিক এই অর্জুনকে খুঁজবার পথেই দ্রৌপদীর সেই সুর-সৌগন্ধিকের বায়না। বায়না ভীমের কাছে। পাঠক! এটি উৎকট কিছু ভাববেন না। অর্জুনের প্রতি এতক্ষণ যে অতিরিক্ত পক্ষপাত দেখিয়েছেন পাঞ্চালী, তাতে যদি একান্ত অনুরক্ত ভীমের প্রতি অবিচার হয়, তাই তিনি নতুন কোনও কর্ম দিয়ে ধন্য করলেন অনুরাগীকে। কিন্তু লক্ষ করুন অর্জুনকে। পাঁচ বচ্ছর পরে অর্জুনের সঙ্গে দেখা হল পাণ্ডবদের এবং পাঞ্চালীর। অর্জুন চারভাইকে অভিবাদন জানালেন, অগ্রজদের প্রণাম করলেন, অনুজদের আশীর্বাদ। কিন্তু এতদিনের পথ-চাওয়া কৃষ্ণার সঙ্গে মিলিত হলেন যখন, অবিচারী ব্যাস সেই মুহূর্তটিকে তপ্ত আলিঙ্গনে ধরে রাখতে পারেননি। রাখবেন কী করে? অর্জুনই যে সেরকম নন। দ্রৌপদী নিশ্চয়ই কাঁদছিলেন, হয়তো অনেক আশা ছিল। কিন্তু অর্জুন কী করেন, তিনি আপন প্রণয়িনীকে কোনওমতে সান্ত্বনা দিলেন–সমেত্য কৃষ্ণাং পরিসাল্ক চৈনাম–এর বেশি কিছুই তাঁর পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। আর যদি করতেন তা হলে মৃত্যুর পরে যুধিষ্ঠিরের মুখে সেই বাণী শুনতে হত–দ্রৌপদীর প্রতি অর্জুনের বেশি পক্ষপাত ছিল।

আমরা বিরাট রাজার নৃত্যশালায় দ্রৌপদী আর অর্জুনের সংলাপ থেকেই অর্জুনের প্রসঙ্গে এসেছিলাম। অৰ্জুন বলেছিলেন–আমার মন তুমি বুঝলে না, ধনি। আমরা বলি, বুঝবার উপায় রাখলে কি? কৌরবসভায় দ্রৌপদীর অনুকূলে তুমি একটি কথাও বললে। বনের মধ্যে জয়দ্রথ এলেন, তোমার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভীম, বিরাটের ঘরে কীচকেরা জ্বালাল, রক্ষা করলেন ভীম, তুমি তখনও উত্তরাকে নাচ শিখিয়ে চলেছ। অর্জুন। তুমি বলবে–দ্রৌপদীর বিপদে তুমি এগিয়ে আসার আগেই ভীম এত বেশি প্রাগ্রসর যে, তারপরেও তোমার এগিয়ে আসাটা বেমানান হত। আমরা বলি, হলেই কি, প্রেম দেখানোর রাস্তা তো ওইটাই। আসলে বল, তুমি যুধিষ্ঠিরের কাছে ধরা পড়ে যেতে–তুমি নির্লিপ্ত বীর সাজতে চেয়েছ এবং তা পেরেওছ। তোমার বিরুদ্ধে যুধিষ্ঠিরের কোনও অভিযোগ নেই বটে, কিন্তু দ্রৌপদীর আছে, আমাদেরও আছে। দ্রৌপদীর মতো আমরাও তাই তোমাকে আশীর্বাদ করি–তুমি জন্মানোর সময় আর‍্যা কুন্তী যা চেয়েছিলেন এবং তুমিও যেমনটি চাও, তুমি যেন তাই পাও, অর্জুন–তৎ তেহস্তু সর্বং কৌন্তেয় যথা চ স্বয়মিচ্ছসি। তোমাকে আর আমার মন বুঝতে হবে না অর্জুন। দ্রৌপদীর ভালবাসার উত্তরে, তুমি যদি কোথাও ধরা পড়ে যেতে, সেই হত তোমার সত্য পুরস্কার। তা তুমি পারনি, কিন্তু ধরা-পড়া তুমি জান না তা তো নয়। কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রার কাছে তুমি বেশ বাঁধা। দ্রৌপদীর আগেই তার গর্ভে তোমার পুত্র হয়েছে এবং সেই পুত্রের শিক্ষা-দীক্ষা হয়েছে সযত্নে। দ্রৌপদীর গর্ভে তোমার পুত্র অবহেলিত, তার নামও শোনা যায় না। বিরাট রাজা যখন উত্তরার বিবাহ সম্বন্ধ করলেন তখন তাকে তোমার দ্রৌপদী-গর্ভজাত পুত্র শ্রুতকর্মার জন্য গ্রহণ করলেই পারতে, অভিমন্যুর জন্য কেন? পট্টমহিষী দ্রৌপদীর সমস্ত পুত্রগুলির মৃত্যুও হয়েছে এমনভাবে, যা একটু বীরোচিত নয়। সবই দ্রৌপদীর ভাগ্য। অথচ সুভদ্রার ধারায় অভিমন্যু মারা গেলেও তারই বংশ পরীক্ষিৎ, জন্মেজয় পাণ্ডবকুলের রাজ্যশাসন করেছেন। স্বামী এবং পুত্র–কোনওটাতেই চরম সুখ হয়নি দ্রৌপদীর। প্রায় সারা জীবনই রাজ্যহীন অথচ–শুধু পট্টমহিষীর উপাধিটা বয়ে বেড়ানো ছাড়া দ্রৌপদী আর কিছুই পাননি।

আসলে বিদগ্ধা এক রমণীর অধিকার স্বামীর পক্ষে অতি গৌরবের কথা। কিন্তু সে যদি অতি বিদগ্ধা হয় তাহলে স্বামী তাকে যতখানি ভালবাসেন তার চেয়ে বেশি ভয় পান। দ্রৌপদীকে অনেকেই ভয় পেতেন, স্বামীরাও। ব্যাতিরেক একমাত্র অর্জুন, কারণ তিনি নির্লিপ্ত। স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র পর্যন্ত তাঁর পুত্রদের সাবধান করে দিয়েছেন দ্রৌপদীর তেজস্বিতা সম্পর্কে। ঘোষযাত্রা পর্বে তিনি বলেছেন–দ্রৌপদী শুধু তেজেরই প্রতিমূর্তি–যজ্ঞসেনস্য দুহিতা তেজ এব তু কেবলম। রাজমাতা কুন্তী, যিনি নিজেও প্রায় কোনওদিন রাজ্যসুখ ভোগ করেননি, তিনি অসীম প্রশয়ে তার এই পুত্রবধূটিকে তেজস্বিনী দেখতেই ভালবাসতেন। অন্তত একজন স্ত্রীলোক হিসেবে পুত্রবধূর মর্যাদা সর্বক্ষণ তার অন্তরশায়িনী ছিল। বনবাসে যাবার সময় দ্রৌপদীকে তিনি বলেছেন–আমি নিশ্চিন্ত, কারণ পতিব্রতার ধর্ম তোমায় শেখাতে হবে না। সত্যি কুন্তী নিশ্চিন্ত ছিলেন, কিন্তু বনবাসের চোদ্দো বছরের মাথায় কৃষ্ণ যখন দূতীয়ালি করার জন্য কৌরবসভায় এসেছেন, তখন কৃষ্ণের দেখা পাওয়ামাত্র তিনি যেমন তার প্রিয় পুত্রদের জন্য বিলাপ করেছেন, তেমনি করেছেন পুত্রবধূ দ্রৌপদীর জন্য। কুন্তী বলেছেন–প্রিয় পুত্রদের থেকেও দ্রৌপদী আমার কাছে প্রিয়তরা–সবৈঃ পুত্রৈঃ প্রিয়তরা দ্রৌপদী মে জনার্দন। সে নিজের পুত্রস্নেহ জলাঞ্জলি দিয়ে স্বামীদের সঙ্গে কষ্ট করা বেশি ভাল মনে করেছে। কুন্তী তাঁর উপাধি দিয়েছেন–ঈশ্বরী সর্বকল্যাণী। স্ত্রীলোক হিসেবে কুন্তীর কাছে দ্রৌপদীর মর্যাদা যে কতখানি, সেটা বোঝা যায় কুন্তী যখন কৃষ্ণকে বলেন–যেদিন কৌরবসভায় আমি দ্রৌপদীর অপমান দেখেছি, সেদিন থেকে কি যুধিষ্ঠির, কি ভীম, কি অর্জুন, নকুল, সহদেব কাউকে আমি আর প্রিয় বলে ভাবতে পারি না। কুন্তী দ্রৌপদীর অপমানে এতখানি অপমানিত বোধ করেন যে, পাশাখেলায় যুধিষ্ঠিরের হার, রাজ্য হারানো এমনকী পুত্রদের নির্বাসন পর্যন্ত তাঁর সইতে পারে, কিন্তু রাজসভায় দ্রৌপদীকে খারাপ কথা বলা–এ তাঁর সয় না–ন দুঃখং রাজ্যহরণং ন চ দূতে পরাজয়ঃ।…যত্ন সা বৃহতী শ্যামা একবস্ত্রা সভাং গতা। অশৃণোৎ পরুষ বাচঃ কিংনু দুঃখতরং ততঃ।

কুন্তীর এই অভিমানী মর্যাদাবোধ দ্রৌপদীর অন্তরে সর্বক্ষণ অনুষ্যত ছিল। তিনি মুখে যতই বলুন না কেন–ক্ষত্রিয়কুলে যেন আর কারও জন্ম না হয়, দ্রৌপদী ছিলেন সেই মানের ক্ষত্রিয়রমণী যিনি কোনও কিছুর মূল্যেই মান খোয়তে রাজি নন। বাস্তব জীবনে তিনি যতখানি প্রেমিকা বা কুলবধূ, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষাত্র তেজে তেজস্বিনী। সে তেজ এমনই যে তা প্রায় তার পুরুষস্বামীদের সমান্তরাল। যেদিন থেকে তার অপমান হয়েছে সেদিন থেকে প্রতিশোধ-স্পৃহাই তাঁর ধ্যান এবং জ্ঞান। মহাভারতের শল্যপর্বে এসে দেখেছি–যখন একে একে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণের মতো প্রধান সেনাপতিরা মারা গেছেন, মারা গেছেন দুর্যোধনের ভাইয়েরা, কুলগুরু কৃপাচার্য তখন সন্ধি করবেন না। তার অনেক যুক্তির মধ্যে একটি হল দ্রৌপদী। এতদিনে দুর্যোধনের বোধ হয়েছে যে, রাজসভায় দ্রৌপদীর যে অপমান তাঁরা করেছিলেন, সে অপমানের শোধ না হওয়া পর্যন্ত পাণ্ডবেরা কেন, স্বয়ং দ্রৌপদীই ছাড়বেন না। দুর্যোধনের কাছেই আমরা শুনেছি যে, অপমানের পরের দিন থেকেই দ্রৌপদী নাকি প্রতিশোধ-স্পৃহায় আপন স্বামীদের জয়লাভের জন্য তপশ্চরণ করছেন এবং সেই তপস্যার অঙ্গ হিসেবে সেদিন থেকেই তিনি নাকি মাটিতে শোন। দ্রৌপদী মাটিতে শোবেন ততদিনই, যতদিন না মূলশ দুর্যোধনের অন্ত হচ্ছে–স্থণ্ডিলে নিত্যদা শেতে যাব বৈরস্য শাতন।

এই হচ্ছেন দ্রৌপদী। শুধু প্রাজ্ঞা’ ‘পাণ্ডিত্য কিংবা ‘মনস্বিনী’ নন, আগুনের মতো তেজস্বিনী। অজ্ঞাতবাসের শেষে যেখানে কৌরবদের সঙ্গে কথাবার্তার স্ট্র্যাটিজি’ ঠিক করা হচ্ছে, সেদিন পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যে একমাত্র সহদেব ছাড়া চারজনই, এমনকী ভীমও সন্ধির সুরে কথা বলেছিলেন। অন্তত ভীমের আচরণ দেখে দ্রৌপদী তো কিঞ্চিৎ হতাশই হয়ে পড়লেন–ভীমসেনঞ্চসংশান্তং দৃষ্টা পরমদুর্মনাঃ। সেদিন এই কনিষ্ঠ স্বামীকেই সহায় করে– সম্পূজ্য সহদেবঞ্চ–দ্রৌপদী কৃষ্ণের কাছে তার প্রতিশোধের বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন। দুঃশাসনের হাত-ছোঁয়ানো দ্রৌপদীর চুল–অসিতায়তমূর্ধজা–সর্বজনের অভিজ্ঞানের জন্য সেদিন খোলাই ছিল। দ্রৌপদী আজকে আবার রাজনীতির পাকা আলোচনায় সামিল। অনেক কথার মধ্যে দ্রৌপদী বললেন–যুধিষ্ঠির মাত্র পাঁচখানি গ্রাম চেয়ে দুর্যোধনের সঙ্গে সন্ধি চাচ্ছেন, তাও যেন লজ্জার সঙ্গে হ্রীমতঃ সন্ধিমিচ্ছতঃ। মনে রেখ কৃষ্ণ। দুর্যোধন যদি ঈপ্সিত রাজ্য না দেন, তাহলে যেন খবরদার সন্ধি করতে যেয়ো না, দুর্যোধন করতে চাইলেও না–সন্ধিমিচ্ছেন্ন কৰ্ত্তব্যস্তত্র গত্বা কথঞ্চন। তাদের ওপরে তোমার দয়া দেখানোর দরকার নেই। যেখানে মিষ্টি কথায় কাজ হয় না, সেখানে দণ্ড দিতে হয় এবং এই পাপিষ্ঠদের দরকার মহাদণ্ড–তম্মাত্তেষু মহাদণ্ডঃ ক্ষেপ্তব্যঃ ক্ষিপ্রমত্যুত।

পরপর খানিকটা ওজস্বিনী বক্তৃতা দিয়ে দ্রৌপদী এবার করুণরসের ছোঁয়া লাগালেন রমণীর অস্ত্র হিসেবে। বললেন, কৃষ্ণ! তোমাকে ভাল করেই বলছি, হয়তো বা পুনরুক্তিও হচ্ছে, কিন্তু সীমন্তিনী কুলবধূর দুর্দশা আমার মতো আর কার হয়েছে বলতে পার! যজ্ঞের আগুন থেকে আমার জন্ম, মহারাজ দ্রুপদের মেয়ে আমি। ধৃষ্টদ্যুম্নের বোন আর তোমার না আমি বন্ধু–তব কৃষ্ণ প্রিয়া সখী। আজকে মহারাজ পাণ্ডুর কুলবধূ হয়ে, পাঁচটা বীর স্বামী থাকতে এবং পাঁচটা ছেলে থাকতেও কৌরবসভায় আমাকে সেই অপমান সইতে হল? এই পাণ্ডবদের শরীরে যেন তখন রাগ বলে কিছু ছিল না, তাঁরা কোনও চেষ্টাও করেননি আমাকে বাঁচাবার। তারা শুধু স্থাণু সাক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার অপমান দেখছিলেন– নিরমর্ষেষু অচেষ্টেষু প্রেক্ষমাণেষু পাণ্ডুযু। ধিক্ এই অর্জুন আর ভীমকে যদি এঁরা থাকতেও দুর্যোধন আর এক মুহূর্তও বেঁচে থাকে–যত্র দুর্যোধনঃ কৃষ্ণ মুহুৰ্তমপি জীবতি।

লক্ষণীয়, দ্রৌপদী যেখানে নিজেকে করুণার যোগ্য বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, সেখানে তাঁর করুণ-রসাত্মক বাক্যগুলির মধ্যেও ওজস্বিতার ছোঁয়া লাগে। প্রত্যেক কথায়, প্রত্যেক শব্দে প্রতিহিংসার ফুলকি ছড়িয়ে দ্রৌপদী মাথা ঝাঁকিয়ে তাঁর বাম বাহুতে নিয়ে এলেন আপন কুঞ্চিত কেশদাম। বেণী করা থাকলেও সে চুলের কোঁকড়ানো ভাব, ঘনত্ব অথবা সুবাস–কোনওটাই চাপা দেওয়া যাচ্ছে না। সেই বিশাল বেণী-ভুজঙ্গিনীকে কৃষ্ণা তুলে নিলেন তার বাম হাতে–মহাভুজগর্বচ্চসম। কেশপক্ষং বরাাহা গৃহ্য বামেন পাণিনা। সেই কুটিল কেশদামের মধ্যে বিষধর সর্পের অভিসন্ধি আরোপ করে দ্রৌপদী আকুল, জলভরা চোখে আস্তে আস্তে কৃষ্ণের কাছে এলেন। প্রস্ফুটিত পদ্মের পাপড়ির মতো আয়ত চোখে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে পাণ্ডব-ঘরণী কৃষ্ণা বললেন–এই সেই চুল, কৃষ্ণ! যে চুলে হাত লাগিয়েছিল দুঃশাসন। তোমার সন্ধি করার ইচ্ছে প্রবল হলে তুমি শুধু এই আমার চুলের কথা মনে রেখ–স্মৰ্ত্তব্যঃ সর্বকার্যেষু পরেষাং সন্ধিমিচ্ছতা।

বক্তৃতায় এই অলংকার-পর্বের পর এবারে ‘আলটিমেটাম’। দ্রৌপদী বললেন ভীম আর অর্জুনকে তো দেখছি যুদ্ধের ব্যাপারে একেবারে যেন মিইয়ে গেছে, তারা যেন এখন সন্ধির জন্যই সজ্জিত। আমি বলছি–তারা যদি যুদ্ধ করতে না চান, তাহলে জানবে–যুদ্ধ। করবেন আমার বৃদ্ধ পিতা, যুদ্ধ করবেন আমার ভাইয়েরা–পিতা মে যোৎস্যতে বৃদ্ধঃ সহ পুত্রৈমহারথৈঃ। যুদ্ধ করার লোক আছে আরও। আমার পাঁচটি ছেলে তাদের মায়ের সম্মান রক্ষা করার জন্য ঝুঁপিয়ে পড়বে, আর তাদের নেতৃত্ব দেবে কুমার অভিমন্যু–অভিমন্যুৎ পুরস্কৃত্য যোৎস্যন্তে কুরুভিঃ সহ।

দ্রৌপদী যাঁদের নাম করলেন, তাঁদের ওপর তার অধিকার একান্ত। এমনকী অর্জুন যতই সুভদ্রা-সোহাগী হন না কেন, সুভদ্রার ছেলে অভিমন্যুর ক্ষমতা ছিল না তার বড়-মায়ের আদেশ অমান্য করার। কাজেই দ্রৌপদী স্বামীদের কাছে তার প্রেমের যথাযথ মূল্য না পেলেও তার ওজস্বিতার সম্মান, ব্যক্তিত্বের সম্মান সব সময় পেয়েছেন। নিজের ছেলেদের নেতৃত্বে কুমার অভিমন্যুকে স্থাপন করার মধ্যে ওই ওজস্বিতার সঙ্গে স্নেহধারা মিশেছে। হয়তো এই স্নেহধারা কৃষ্ণা পাঞ্চালীর অন্তরতম অর্জুনের প্রিয়তম পুত্র বলেই। তবু এই স্নেহ যে কতটা ছিল–তা স্বয়ং যুধিষ্ঠিরও ইয়ত্তা করতে পারেননি, যতখানি করেছেন সেই অর্জুন এবং তাও হয়তো বিদগ্ধা রমণীর অন্তর বিদগ্ধজনে বোঝে বলেই। প্রসঙ্গ থেকে সরে এসেও বলতে বাধ্য হচ্ছি–ওজস্বিতার মতো কঠিন গুণের প্রতিতুলনায় স্নেহ বড় বিরুদ্ধ বস্তু হলেও ব্যাঘ্রিনীর পুত্রের জন্য ব্যাঘিনীর মমতা মোটেই অকল্পনীয় নয়। অভিমন্যু যখন সপ্তরথীর চক্রান্তে প্রাণ দিলেন, তখন যুধিষ্ঠির প্রচুর বিলাপ করেছিলেন। সেই সখেদ বিলাপোক্তির মধ্যে যুধিষ্ঠির বারবার এই কথা বলেছেন যে, তিনি অর্জুনের সামনে মুখ দেখাবেন কী করে! কী করেই বা তিনি অভিমন্যু-জননী সুভদ্রার মুখের দিকে চাইবেন–সুভদ্রাং বা মহাভাগাং প্রিয়ং পুত্রমপশ্যতীম।

কিন্তু অর্জুনকে বলতে হয়নি। প্রিয় পুত্রটি যখন সামনে এসে দাঁড়াল না, যুদ্ধ শিবির থমথম করছে, তখনই অর্জুন বুঝেছিলেন–অভিমন্যু যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। কেমন করে সেই পুত্রের মৃত্যু ঘনিয়ে এল–সেটা সবিশেষ জিজ্ঞাসা করার প্রথম মুহূর্তেই অভিমন্যুর প্রিয়ত্বের সম্বন্ধগুলি স্মরণ করলেন অর্জুন। বললেন–কেমন করে মারা গেল সেই বালকটি, যে শুধু সুভদ্রাই নয়, দ্রৌপদী এবং কৃষ্ণের প্রিয় পুত্র সুভদ্রায়াঃ প্রিয়ং পুত্রং দ্রৌপদ্যাঃ কেশবস্য চ। এরপর আবার যখন অর্জুনের বিলাপোক্তির মধ্যে নিজের প্রতি ধিক্কার আসছে–প্রিয় পুত্রকে বাঁচাতে পারেননি বলে, তখনও সবার কথা বাদ দিয়ে শুধু দুটি শোকার্তা রমণীর মুখ তাঁকে পীড়ন করছে। কিন্তু শোক-ক্লিষ্ট অবস্থার মধ্যেও এই দুই রমণীর মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য অর্জুনের নজর এড়ায় না। অভিমন্যুর প্রতি ভালবাসার ক্ষেত্রে অর্জুন এই দুই নারীর নাম এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করেন, কিন্তু তবুও তার মধ্যে বলতে ভোলেন না–অভিমন্যুকে না দেখে সুভদ্রা আমায় কী বলবে? আর শোকার্তা দ্রৌপদীকে আমিই বা কী বলব?–সুভদ্রা বক্ষ্যতে কিং মাম অভিমন্যুম অপশ্যতা। দ্রৌপদী চৈব দুঃখার্তে তে চ বক্ষ্যামি কিং বহম।

‘একজন আমায় কী বলবে, অন্যজনকে আমি কী বলব? অর্থাৎ প্রিয় পুত্রের মৃত্যুতে এই দুই নারী একইভাবে শোক সন্তপ্ত হবেন সন্দেহ নেই, কিন্তু তাদের মধ্যে প্রথমা সুভদ্রার শোকের আচ্ছাদন এতটাই যে, তিনি প্রিয় পুত্রের মৃত্যুর জন্য বারবার অর্জুনের কাছে নিরাশ্রয়তার আর শূন্যতার হাহাকার শোনাবেন। তাই অর্জুন বলছেন–সুভদ্রা আমায় কী বলবে? কিন্তু ওই পুত্রহীনার শত শূন্যতার মধ্যেও অন্যতরা রমণী তাকে প্রশ্ন করবে– তোমার এই শিব-স্পর্ধী ধনুষ্মত্তা নিয়ে বাসববিজয়ী বীরত্ব নিয়ে তুমি কী করছিলে, অর্জুন? তাই অর্জুনকে ভাবতে হয়–আমি দ্রৌপদীকে কী-ই বা বলব–তে চ বক্ষ্যামি কিং ৰহম। দ্রৌপদী এইখানেই দ্রৌপদী। বস্তুত অর্জুন এই অসম্ভব মৃত্যু-সংবাদ বহন করে এই দুই নারীর মুখোমুখি হতে পারেননি। আমার বক্তব্য ছিল–অসামান্য প্রেম, বা অকৃত্রিম স্নেহধারার মধ্যেও দ্রৌপদীর ব্যক্তিত্ব এমনই যে, অন্যায় এবং ক্ষত্রিয়ের শিথিলতায় তিনি প্রশ্ন না করে থাকবেন না। সুভদ্রা বিলাপ করবেন, গালাগালিও দেবেন, কিন্তু দ্রৌপদী প্রতিশোধ চাইবেন, জীবনের বদলে জীবন–আমি সুখে নেই, তুমিও সুখে থাকবে না।

আমি আমার পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে যাই। দ্রৌপদী তাঁর স্বামীদের কাছে সার্থক প্রেমের মূল্য যতখানি পেয়েছেন, ব্যক্তিত্বের মূল্য পেয়েছেন তার চেয়ে বেশি। আর স্বামী ছাড়াও অন্য যারা আছেন, তাঁরাও দ্রৌপদীর সাভিমান ব্যক্তিত্বকে অতিক্রম করতে পারেননি। ফলে কৃষ্ণের মতো অসাধারণ পুরুষকেও দ্রৌপদীর স্বাধিকার-বক্তৃতা সমস্ত গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হয়েছে। সন্ধির আশ্রয় নিয়ে যে মহান দূত কৌরবসভায় যাচ্ছিলেন, তিনি পূর্বাহ্নেই দ্রৌপদীকে নিজের নামের মাহাত্মটুকু ধার দিয়ে কবুল করে বসলেন–আজ তুমি যেমন করে কাঁদছ, কৃষ্ণা। ঠিক এমনই কাঁদবে কৌরবপক্ষের কুলবধূরা। স্বামী, পুত্র, ভাই, বন্ধু– সব হারিয়ে কাঁদবে এবং তা কাঁদবে শুধু তুমি তাদের ওপর রাগ করেছ বলে–যেষাং ক্রুদ্ধাসি ভামিনি। কত অসাধারণ বুদ্ধির অধিকারী এই কৃষ্ণ। তার ধারণা–ভীম, অর্জুনের মতো মহাবীরদের সন্ধিকামুকতার পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যাই থাকুক, দ্রৌপদীর তাতে মন ভরবার কথা নয়, কারণ কুরুসভায় যে অপমান হয়েছিল তার বলি একমাত্র দ্রৌপদীই। পাছে ভীম, অর্জুনের মতো স্বামীকে তিনি ভুল বোঝেন, তাই কৃষ্ণ বললেন–আমি যা বললাম, তা আমি এই ভীম অর্জুন কি নকুল-সহদেবকে সঙ্গে নিয়েই করব, স্বয়ং ধর্মরাজও সেই নির্দেশ দেবেন। কৃষ্ণ বললেন–আমার অনুরোধ যদি কৌরবেরা না শোনে, তাহলে শেয়াল-কুকুরের খাদ্য হয়ে রণভূমিতে মরে পড়ে থাকতে হবে তাদের। আজকে যদি হিমালয় পাহাড়ও চলতে আরম্ভ করে, পৃথিবীও যদি ফেটে যায় শতধা, আকাশও যদি তার নক্ষত্রবাহিনী নিয়ে ভেঙে পড়ে ভঁয়ে, তবুও আমার কথা অন্যথা হবে না, কৃষ্ণা! তুমি আর কেঁদো না–কৃষ্ণে বাষ্পে নিগৃহ্যতাম্।

আবারও সেই সম্বোধন–কৃষ্ণা! নিজের নামের সমস্ত ব্যাপ্তি দ্রৌপদীর ডাক-নামে লিপ্ত করে কৃষ্ণের এই সম্বোধন কৃষ্ণা। যুধিষ্ঠির যা পারেননি, অর্জুন-ভীম যা পারেননি, কৃষ্ণ তাই পারলেন। কেন পারলেন–সে কথায় পরে আসছি।

আমি আগেই বলেছিদ্রৌপদী আগুনের মতো। কৌরবরা কৃষ্ণের প্রস্তাব মেনে নেননি। অতএব একদিন যে কুরুকুল ভীষ্ম, বিদুর এবং রাজমাতা সত্যবতীর বিচক্ষণতায় সংবর্ধিত হয়েছিল, সেই কুরুকুল দ্রৌপদীর ক্রোধের আগুনে আপনাকে আহুতি দিল। সংস্কৃতের নীতিশাস্ত্রে একটা লোকপ্রসিদ্ধ কথা চালু আছে। কথাটার মোদ্দা অর্থটা হল–সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি–এই চতুর্যুগের এক একটিতে একেকজন অসামান্যা নারী জন্মেছেন, যাঁদের কারণে প্রচুর লোকক্ষয়, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং অশান্তি হয়েছে। নীতিশাস্ত্রকার এই নারীর নাম দিয়েছেন ‘কৃত্যা’ ‘কৃত্যা’ শব্দটির অর্থের মধ্যে একটু হীনতা আছে, কারণ কৃত্যা মানে হল এক ধরণের অপদেবতা। কখনও বা যজ্ঞীয় অভিচার প্রক্রিয়ায় সেই অপদেবী নারীর উৎপত্তি হয় অপরের ধ্বংস সাধনের জন্য। এই শ্লোকটিতে অবশ্য কৃত্যা শব্দটি আরও একটু বিশদর্থে ব্যবহৃত। এখানে বলা হচ্ছে–সত্যযুগের কৃত্যা হলেন রেণুকা।

রেণুকা মহর্ষি জমদগ্নির স্ত্রী, পরশুরামের মা। ছেলে হয়েও পরশুরাম মাকে মেরেছিলেন, এইটাই তার সম্বন্ধে বিখ্যাত কথা। বাবার কাছে বর লাভ করে পরশুরাম অবশ্য মাকে পরে বাঁচিয়ে ছিলেন।

এক সময় ক্ষত্রিয়কুলের বিশাল পুরুষ কার্তবীর্য-অর্জুন পাত্রমিত্র নিয়ে জমদগ্নির আশ্রমে আসেন। জমদগ্নি তার কামধেনু সুশীলার সাহায্যে অতিথি-সংস্কার করেন বটে, কিন্তু ওই কামধেনুর ওপর কার্তবীর্যের লোভ হয়। মুনিও তাঁর হোমধেনু দেবেন না, রাজাও সেটা নেবেন। ফল হল এই যে, ব্রাহ্মণের সঙ্গে ক্ষত্রিয়কুলের যুদ্ধবিগ্রহ বেধে গেল। চলল আক্রমণ, পালটা আক্রমণ। জমদগ্নির দিক থেকে যুদ্ধ চালাতে লাগলেন পরশুরাম। তিনি কার্তবীর্যের হাজার হাত কেটে মেরে ফেললেন তাঁকে। ওদিকে পরশুরাম যখন বাড়ি নেই তখন কার্তবীর্যের ছেলে এসে জমদগ্নি মুনিকেই মেরে রেখে গেল। এই সময়ে জমদগ্নির স্ত্রী রেণুকা নাকি স্বামীর মৃত্যু যন্ত্রণায় একুশবার বুক চাপড়ে কেঁদেছিলেন। পুত্র পরশুরাম তখন বাধা দিয়ে মায়ের হাত ধরেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন একুশবার তিনি ক্ষত্রিয় নিধন করবেন। এই শুরু হল। পরশুরাম ক্ষত্রিয় মেরে রুধির হ্রদ তৈরি করে গেলেন। জমদগ্নির স্ত্রী রেণুকা এই একুশবার ক্ষত্রিয় নিধনের কারণ বলে সত্য যুগের কৃত্যা হলেন তিনি।

ত্রেতাযুগের কৃত্যা হলেন জনকনন্দিনী সীতা। সীতার কারণেই রামচন্দ্রের সাগর পার হয়ে লঙ্কায় যাওয়া এবং রাবণ বধ। কবির মতে দ্বাপরের কৃত্যা হলেন দ্রৌপদী। কারণ তাকে অপমান করার ফলেই কুরুকুল উৎসাদিত হয়েছিল। সবার শেষে কবির মজাদার মন্তব্য–কলিকালে ঘরে ঘরে এই কৃত্যাদেবীরা আছেন, যাঁরা ঘর ভাঙেন–দ্বাপরে দ্রৌপদী কৃত্যা কলৌ কৃত্যা গৃহে গৃহে।

শ্লোকটা আমি উদ্ধার করলাম বটে, তবে এই শ্লোকের ভাবার্থের সঙ্গে আমার মতের মিল হয় না। প্রথমত দেখুন, কলিযুগের ‘ঘর-পোড়ানি, পরভুলানি সামান্যা নারীগুলির সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে দ্রৌপদীর নাম উচ্চারণ করায় আমার আপত্তি আছে। দ্বিতীয়ত জনকনন্দিনী সীতা রাবণ-বধের যত বড় নিমিত্তই হন না কেন, তার সঙ্গেও দ্রৌপদীর কোনও তুলনা হয় না। আর ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের কুলক্ষয়ী যুদ্ধে রেণুকার একুশবার বুক চাপড়ানোটা এতই অকিঞ্চিৎকর যে, রেণুকাকে একটি গোটা যুগের ধ্বংস-প্রতীক বলে মেনে নিতে আমার যৌক্তিকতায় বাধে। আমার তো মনে হয় দ্বাপর-কলির সন্ধিলগ্নে এই যে বিরাট ভারত যুদ্ধ হয়েছিল, সেই যুদ্ধের নিমিত্ত হিসেবে দ্রৌপদী অত্যন্ত ব্যতিক্রমীভাবে উজ্জ্বল বলেই তাকে একটি যুগ-ধ্বংসের প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত করা অনেক বেশি সযৌক্তিক। অপিচ সেইটেই একমাত্র বেশি সযৌক্তিক বলে অন্যান্য যুগেও আরও এক একটি নারীকে শুধু খাড়া করে দেওয়া হল চতুর্যুগের শূন্যতা পূরণের জন্যই। নইলে দেখুন, সত্যযুগের রেণুকা বা কলিকালের ফাঁপা-চুলের রোম-দোলানো বিনোদিনীর কথা না হয় বাদই দিলাম, ত্রেতা যুগের সীতা লঙ্কার রাক্ষস ধ্বংসের যতখানি কারণ, রামচন্দ্র নিজেই তার চেয়ে অনেক বেশি কারণ। রাবণ-বধের অন্তে সীতা উদ্ধারের পর রামচন্দ্র নিজেই প্রায় সে কথা স্বীকার করে বলেছেন–সমুদ্র লঙ্ঘন করে এসে অশেষ রণপরিশ্রমে রাক্ষস রাবণকে আমি যে শাস্তি দিয়েছি–তা তোমার জন্য নয় সীতা। তা সবটাই প্রখ্যাত রঘুবংশের কলঙ্কমোচনের জন্য, নিজের মান রক্ষার জন্য–ময়েদং মানকাঙিক্ষণা। তবু অসামান্যা রূপবতী সীতাকে আমরা ত্রেতাযুগের কৃত্যা হিসেবে মেনে নিতে পারি, কারণ সীতাহরণ না হলে সেই বিরাট লঙ্কাকাণ্ড ঘটত না।

কিন্তু রাবণ সীতাকে হরণ করেছেন, তাতে সীতার দিক থেকে অক্ষম বিলাপোক্তি ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। তিনি অত্যন্ত পতিনির্ভর এবং সেই ভরসাই তার কাজে লেগেছে। কিন্তু অনুরূপ পরিস্থিতিতে দ্রৌপদী পড়লে কী হত, তা সভাপর্বে বস্ত্র হরণের সময়েই টের পাওয়া গেছে। পাঁচটি স্বামীর একজনেরও সেখানে সঙ্গত কারণেই কথা বলার উপায় ছিল না। কিন্তু দ্রৌপদী নিজেও নিষ্ক্রিয় ছিলেন না। বস্ত্রাকর্ষণের হতচকিত মুহূর্তগুলির মধ্যেও তিনি কৌরবসভায় ধুন্ধুমার লাগিয়ে দিয়েছিলেন এবং সভা শেষ হয়েছে তারই অনুকূলে। কাজেই সীতাহরণের বদলে দ্রৌপদী-হরণ হলে দ্রৌপদী যে নিষ্ক্রিয় থাকতেন না–তা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। অন্তত হনুমান পৌঁছনোর আগেই অশোকবনে যে ধুন্ধুমার লেগে যেত–তা বেশ অনুমান করা যায়।

তবু বলি, এই সব তাৎক্ষণিক প্রত্যাশা তো দ্রৌপদীর কাছে করাই যায়, কিন্তু এমনটাই দ্রৌপদী নয়। দ্রৌপদী আরও অনেক বড়। অন্তত সমস্ত, কুরুকুল-ধ্বংসের প্রতীক হিসেবে দ্রৌপদীকে চিহ্নিত করতে গেলে কুরুসভার মধ্যে তার সর্বাঙ্গীণ অপমানই একমাত্র কারণ–  এমন একটা কথাও বড়ই অকিঞ্চিৎকর শোনাবে। মনে রাখা দরকার, মহাভারতের কবি যাঁকে ‘মনস্বিনী’ অথবা ‘পণ্ডিতা’ শব্দের উপাধিতে ভূষিত করেছেন, তিনি শুধু নারীর অপমানে ক্লিষ্ট হন না। পঞ্চস্বামীকেও তিনি শুধুমাত্র তার একান্ত অপমানের দ্বারাই চালিত করেছেন–তাও আমি মনে করি না। মহাকাব্যের বিরাট পরিমণ্ডলে কুরুসভায় দ্রৌপদীর অপমান একটা খণ্ডচিত্র মাত্র। সেই অপমান থেকে উৎক্রমণ করার জন্য তার বীরস্বামীদের সহায়তার প্রয়োজন হয়নি, তিনি একাই ছিলেন তার জন্য যথেষ্ট।

কুরুসভায় আসবার আগে যুধিষ্ঠির তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘একবস্ত্রা অধোনীবী’ অবস্থায় শ্বশুর ধৃতরাষ্ট্রের সামনে এসে কেঁদে কেঁদে তিনি যেন তার করুণা উদ্রেক করেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির তাকে চেনেননি। কুরুসভায় এসে তিনি যে নিজের জ্যেষ্ঠ-স্বামীকেই আইনের ফাঁদে ফেলে আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন অথবা আপন মনস্বিতায় শ্বশুরকে সন্তুষ্ট করে সেই ফঁদে-পড়া জ্যেষ্ঠ-স্বামীকেই প্রথম মুক্ত করবেন কৌরবদের হাত থেকে–এসব কথা যুধিষ্ঠির ভাবতেই পারেন না। বিদগ্ধা রমণীর বিচিত্র হৃদয় বুঝতে পারেন না বলেই যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর কথায় কখনও থতমত খান, কখনও পুলকিত হন, কখনও সাতিশয় ক্রুদ্ধ হন, কখনও বা গালাগালিও দেন। কিন্তু এই যে ‘কনফিউশন’, এই দ্বিধাগ্রস্ততা–এর কারণও দ্রৌপদীর বৈদগ্ধ্যই। নারীত্বের সঙ্গে ব্যক্তিত্ব, পড়াশুনো এবং রাজনীতির জ্ঞান যদি একত্তর হয়ে যায়, তাহলে যে বিশালতা জন্মায়, সেই বিশালতা ধারণ করার ক্ষমতা যুধিষ্ঠিরের ছিল না। যাঁর ছিল, তিনি সে-পথে হাঁটেননি একান্ত ব্যক্তিগত কারণে–তিনি অর্জুন। আরও যাঁর ছিল–তিনি তাঁকে অবধারণ করেছেন বটে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি একটু ঘরের বাইরের লোক–তিনি কৃষ্ণ। তবু সে-কথা পরে।

দ্যূতক্রীড়ার উত্তর পর্বে যে দিন কৃষ্ণা পাঞ্চালী কুরুকুলের দাসপঙ্ক থেকে তার পঞ্চ স্বামীকে উদ্ধার করে আনলেন–সেদিন দুর্যোধন-কৰ্ণরা বাঁকা হাসি হেসে বলেছিলেন– যারা জলে ডুবে মরছিল, আঁকড়ে ধরবার মতো কিছু ছিল না, সেই নিমজ্জমান পাণ্ডবদের দ্রৌপদী যেন নৌকার মতো এসে পার করে নিয়ে গেলেন–পাঞ্চালী পাণ্ডুপুত্ৰাণাং নৌরেষা পারগাভবৎ। কথাটা সেই মুহূর্তে যতই বাঁকা শোনাক, কথাটার মধ্যে গভীর সত্য আছে, এবং সে-সত্য স্বয়ং যুধিষ্ঠিরই পরে স্বীকার করেছেন। কর্ণের ওই কথা শুনে ভীম তো সেই মুহূর্তে রেগেমেগে অস্থির হয়েছিলেন, কিন্তু ওই একই কথা পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ স্বীকার করে নিয়েছিলেন পরে। যখন বনপর্বে স্বয়ং দ্রৌপদী এবং ভীমের কাছে তিনি তার প্রশান্তি আর ক্ষমাগুণের জন্য গালাগালি খাচ্ছেন, তখন তিনি বলেছেন–তোমরা যে দু’জনে মিলে আমায় গালাগালি করছ, সেটা যত খারাপই শোনাক, তবু বেঠিক নয়। আমি যে অসম্ভব একটা অন্যায় করেছিলাম, তার কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে তোমাদের–মমানয়াদ্ধি বাসনং ব আগাৎ। আমার যথেষ্ট মনে পড়ে–যেদিন ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা কপট পাশায় জিতে আমাদের রাজ্য নিয়ে নিল, আমাদের মাথায় চাপিয়ে দিল দাস-দাসীর অপমান-পঙ্ক, সেদিন এই দ্রৌপদী–আমাদেরই এই দ্রৌপদীই, সবার প্রধান ভরসা হয়ে উঠেছিলেন– যত্ৰাভবচ্ছুরণং দ্রৌপদী নঃ।

এত নির্ভরতার সুরে পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের এই যে স্তুতিবাদ–আপনারা কি মনে করেন–এই স্তুতিবাদে দ্রৌপদী একটুও সম্মানিত বোধ করেছেন? আমি যতদূর এই মহাকাব্যের নায়িকাকে চিনেছি, তাতে আমার বোধ হয় না যে, কোনও অসাধারণ বিপৎকালে স্বামীদের তিনি রক্ষা করেছেন–এই গৌরববোধ তাকে মোটেই স্বস্তি দেয় না। বরঞ্চ বিপৎকালে স্বামীরা কেন তাকে রক্ষা করতে পারেননি, কেন স্বামীরা বেঁচে থাকতেও–জীবৎসু পাণ্ডুপুত্ৰেযু–তাঁকে অন্য পুরুষের হাতে চুলের মুঠি-ধরা সইতে হল– এই কৈফিয়ত তিনি বার বার চেয়েছেন। তিনি তো স্বামীদের শরণ বা আশ্রয় হতে চান না, কিন্তু স্বামীরা তার অপমান চোখে দেখছেন–এই অবস্থাতেও–পঞ্চানাং পাণ্ডুপুত্ৰাণাং প্রেক্ষতাং–কেন তার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে পারেননি–এই অনাস্থা বিদগ্ধা রমণীর বুকে পীড়ার সঞ্চার করে। কর্ণের বাঁকা কথা শুনে ভীম যে রেগে গিয়েছিলেন, বরং তাও তাঁর ভাল লাগে। তিনি তবু তাতে সনাথ বোধ করেন; এই বোধ আছে বলেই কৌরবসভায় পঞ্চস্বামীর দাসত্ব-মুক্তির পর ধৃতরাষ্ট্র যখন আবারও বর দিতে চাইলেন, তখন তিনি বলেছিলেন–আমি আর কোনও বর চাই না। আমার স্বামীরা পাপকর্ম করে ফেলেছিলেন, কিন্তু এখন তাঁরা বিপদ থেকে উত্তীর্ণ–পাপীয়াংস ইমে ভূত্বা সন্তীৰ্ণাঃ পতয়ো মম। এঁদের মঙ্গল এখন এঁরা নিজেরাই বুঝবেন।

এক্ষুনি যে শ্লোকটা বললাম–আমার স্বামীরা নীচকর্ম পাপকর্ম করে ফেলেছিলেন, এখন তারা বিপদ থেকে উত্তীর্ণ–এই শ্লোকে ‘পাপীয়াংসঃ’ শব্দের অর্থ টীকাকার নীলকণ্ঠ বলেছেন–কৌরবদের দাস্যে তারা নীচভাবে অবনমিত হয়েছিলেন। কিন্তু পাপীয়াংসঃ মানে কি দ্রৌপদী শুধু তাদের দাসত্বে কষ্ট পেয়েছিলেন? আমার তো মনে হয়–পাণ্ডবদের দাসত্ব-শৃঙ্খল থেকেও, তাঁর স্বামীরা যে উন্মুক্ত রাজসভার মধ্যে তাকে রক্ষা করতে পারলেন না, কুলবধূর লজ্জা নিবারণ করতে পারলেন না–এই অসহায়তার জন্যই তিনি বলেছেন আমার স্বামীরা নীচকর্ম করে ফেলেছিলেন। যেভাবেই হোক এখন তারা মুক্ত, কী করতে হবে–সেই মঙ্গল কর্ম তাঁদের আপন পুণ্যবলেই তারা সাধিত করবেন–বেৎস্যন্তি চৈব ভদ্ৰাণি রাজন পুণ্যেন কর্মণা।

কী সেই পুণ্য কর্ম, যার দ্বারা নিজেদের মঙ্গল সাধন করবেন তার স্বামীরা? এই পুণ্য নিশ্চয়ই যজ্ঞে আহুতি দেওয়া অথবা ব্রাহ্মণের যজ্ঞ-তপস্যা নয়, ক্ষত্রিয়ের কাছে এই পুণ্য হল তার শক্তি, যে শক্তির দ্বারা সে অন্যায়কে দমন করে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করে। দ্রৌপদী যে স্ত্রী-রক্ষায় অক্ষম স্বামীদের পাপী হয়ে পড়াটা দেখেছিলেন, তাতেও তিনি ততটা আহত হননি, যতটা হয়েছেন পরবর্তী সময়েও নিজের ক্ষমতায় তাঁরা প্রতিশোধ-বৃত্তি গ্রহণ না করায়। ‘পাপ’ বা ‘পাপী’ বলতে দ্রৌপদীর বোধে যে স্বামীদের অক্ষমতাই ছিল এবং ‘পুণ্য’ বলতে তার মনে যে ক্ষত্রিয়বন্ধুর প্রতিশোধ-স্পৃহাই ছিল তা আরও একভাবে বোঝা যায়।

দ্যূতক্রীড়ার দ্বিতীয় পর্বে যুধিষ্ঠির যখন পাশাখেলায় হেরে গেলেন, তখন অরণ্যবাসের শাস্তি নেমে এল সমস্ত পাণ্ডবভাই এবং দ্ৰৌপদীর ওপর। যুধিষ্ঠির এবং অন্য বীর ভাইয়েরাও জানতেন এই পাশাখেলার জন্ম হয়েছে কৌরবদের লোভ এবং অন্যায় থেকেই। কিন্তু পাণ্ডবভাইয়েরা কেউই দুর্যোধনের বাজি ধরার প্রতিবাদ করেননি, যুধিষ্ঠিরকেও অতিক্রম করেননি। পাঞ্চালী কৃষ্ণার পতির পুণ্যে সতীর প্রতিশোধ-স্পৃহা তৃপ্ত হয়নি কিছুই। এরই মধ্যে কৃষ্ণ এসে পৌঁছলেন কাম্যকবনে, পাণ্ডবদের কাছে। আগেও আমি একবার বলেছি–এই সময়ে কীভাবে দ্রৌপদী তার অভিমান প্রকাশ করেছিলেন কৃষ্ণের ওপর। কিন্তু এই মুহূর্তে যে কথাটি ভীষণ জরুরি, তা হল–’পাপ’ আর ‘পুণ্য’ বলতে দ্রৌপদী কী বুঝেছিলেন? দ্রৌপদী বলেছিলেন–ওঁদের দিক দেখে না হয় অন্যায়টা বুঝলাম। বুঝলাম যে, ভীষ্ম কিংবা ধৃতরাষ্ট্র তাদের ধর্মানুসারে বিবাহিতা কুলবধূর অপমানে প্রশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু আমি আমার স্বামীদের দোষই বেশি দিই, কেননা তারা ভারতবিখ্যাত বীর অথচ তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের ধর্মপত্নীর’ ধর্ষণা দেখেছেন–যৎ ক্লিশ্যমানাং প্রেক্ষন্তে ধর্মপত্নীং যশস্বিনীম্।

আপনাদের কি মনে হয় না–এখানে ‘ধর্মপত্নী” কথাটার ওপর একটা আলাদা জোর আছে। মনে রাখা দরকার–এর পরেই যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দ্রৌপদী এবং ভীমের ঝগড়া লাগবে; তখন ক্ষমা আর ধর্মের কথা কতবারই না বলেছেন যুধিষ্ঠির। দ্রৌপদী আগে ভাগেই তাই ধর্মের কথাই বলছেন। বললেন–চিরন্তন যে ধর্মপথ অথবা যে ধর্ম সজ্জন ব্যক্তিরা আচরণ করে এসেছেন এতকাল–সেই ধর্মে দৈহিক শক্তিহীন স্বামীরাও তাদের স্ত্রীদের সর্বতোভাবে রক্ষা করেন। সেখানে আমার কী হল? দ্রৌপদী এবার নিশ্চয়ই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের দিকে ইঙ্গিত করেছেন অর্থাৎ ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির থাকতেও আমার এই দশা হল কেন। দ্রৌপদী এবার ভীমের কথার জবাব দিচ্ছেন, যদিও সে-কথা ভোলেভালা ভীমও বোঝেননি। দ্রৌপদীর ‘অনারে’ পাণ্ডবদের দাসত্ব মুক্তির পর কর্ণ তির্যকভাবে পাণ্ডবদের যা বলেছিলেন তার অর্থ–অগতির গতি তোদের এই বউটি। আমি আগেই বলেছি কথাটা শুনে ভীম খুব ক্ষেপে গিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষ্যাপার কথাগুলির ভাষা যা ছিল, তাতে কর্ণ যথেষ্ট বিদ্ধ হলেও দ্রৌপদীর গায়ে তার আঁচ লাগে। ভীম সে-কথা না বুঝলেও, দ্রৌপদীর সে কষ্ট আছে বলেই আমি মনে করি।

ভীম রেগে অর্জুনকে উদ্দেশ করে কর্ণের কথার জবাব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন–হ্যায়! শেষে স্ত্রীই কিনা পাণ্ডবদের গতি হল–স্ত্রী গতিঃ পাণ্ডুপুত্ৰাণাম! শাস্ত্রে বলে যে, পুরুষ মানুষ যদি মারা যায়, যদি অপবিত্র হয়, জ্ঞাতিবন্ধু যদি তাকে ত্যাগ করে, তাহলে পুত্র, মঙ্গল কর্ম এবং বিদ্যা–এই তিন জ্যোতি তাকে সাহায্য করে। কিন্তু আজ আমাদের ধর্মপত্নীকে দুঃশাসন যেভাবে সবলে লঙ্ঘন করল, তাতে তার গর্ভের সন্তান কীভাবে আমাদের জ্যোতিঃস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে।

কথাগুলি যতই ধর্মগন্ধী হোক না কেন, কথাগুলি ভাল নয়। এই কথায় যে স্বয়ং দ্রৌপদী জড়িয়ে পড়েন–সেটা সেই মুহূর্তে কর্ণ-দুঃশাসনের বিগহণার আতিশয্যে ভীম বুঝতে পারেননি। কিন্তু যাঁকে সম্বোধন করে ভীম কথাগুলি বলেছিলেন, সেই অর্জুন কিন্তু বুঝেছিলেন যে, এই ধর্ম-প্রবচন বেশি দূর এগোতে দেওয়া উচিত নয়। তিনি বলেছিলেন– ফালতু লোকে কী বলল, না বলল–তাই নিয়ে কি ভদ্রলোক মাথা ঘামায়? ভীমের নিন্দাবাদ কর্ণ-দুঃশাসনের অসভ্যতা প্রকট করার জন্য যতটা, দ্রৌপদীর অসহায়তার জন্যও যে ততটাই–সেটা দ্রৌপদী বোঝেন, কিন্তু কথাটা তো ভাল নয়। তাই এ-বিষয়ে তার বক্তব্য কী হতে পারে-সেটা ভীমের নাম না করেও তিনি কৃষ্ণকে একভাবে বলেছেন। তিনি বলেছেন–দুর্বল লোকেরাও নিজের বউকে সব সময় বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করে–যদ ভার্যাং পরিরক্ষন্তি ভৰ্ত্তারোইল্পবলা অপি। স্ত্রীকে সর্বতোভাবে রক্ষা করার অর্থ হল আত্মজ সন্তানকে রক্ষা করা। স্ত্রী এবং সন্তানের সুরক্ষার মধ্য দিয়ে পুরুষ নিজেও রক্ষিত হয়, কেননা পুরুষ স্ত্রীর গর্ভে নিজেই জন্মায় বলে স্ত্রীকে লোকে ‘জায়া’ বলে।

এতটা শাস্ত্র-প্রসিদ্ধ কথা বলে এইবার ভীমকে এক হাত নিচ্ছেন দ্রৌপদী অর্থাৎ ভাবটা এই–তুমি না বলেছিলে–দুঃশাসন যেভাবে আমাদের ধর্মপত্নীকে লঙ্ঘন করল, তাতে তার গর্ভের সন্তান পিতার কাছে জ্যোতিঃস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে না। তাতে আমি বলি কি–স্ত্রীকেই যেখানে স্বামীর সুরক্ষায় উদযুক্ত হতে হয়, যে স্বামী স্ত্রী-রক্ষায় নিরুদ্যম হয়ে নিজেই যেখানে স্ত্রীর আশ্রয়ে মুক্ত হন, সে আমার পেটে ধর্মজ সন্তানের জন্ম দিয়ে নিজে জন্মাবে কীভাবে–ভর্তা চ ভায়া রক্ষ্যঃ কথং জায়ান মমোদরে? এতকাল শুনে এসেছি– শরণাগত জনকে পাণ্ডবরা কখনও ত্যাগ করেন না, আমি যে ধর্মপত্নীর অধিকারে তাদের শরণাগত হয়েই আছি, কই আমার প্রতি তো তাঁরা সেই শরণাগত-পরিত্রাণের অনুগ্রহ দেখাননি–তে মাং শরণমাপন্নাং নান্থপদ্যন্ত পাণ্ডবাঃ। এত যে শুনি–ধনুযুদ্ধে পাণ্ডবদের জয় করবেন, এমন শত্ৰু পৃথিবীতে নেই, কেন সেই পাণ্ডবরা দুর্বলতর কৌরবদের অপমান সহ্য করছেন–কিমর্থং ধার্তরাষ্ট্ৰাণাং সহন্তে দুর্বলীয়সাম।

হয়তো শেষ বাক্যটি তার অর্জুনের উদ্দেশে। কিন্তু অর্জুন-ভীমের উদ্দেশে যে কটুবাক্যই তিনি বলুন না কেন, দ্রৌপদীর মূল লক্ষ্য ছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ-স্বামী–ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, যার ধর্ম এবং ক্ষমার অনুবৃত্তিতে ভীমার্জুনের মত শক্তিধরকেও দমিত হয়ে থাকতে হয়েছে। আসল কথা, কেীরব সভায় আত্মশক্তিতে স্বামীদের দাসত্ব-বন্ধন মোচন করেও দ্রৌপদী কোনও সাধুবাদে আগ্রহী নন, স্বামীরা কেন আপন যুক্তিতে স্ত্রীর সম্মান বাঁচাতে পারেননি বা এখনও কেন তারা শত্রুর মাথায় পা দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারছেন না–এই প্রতিশোধ-ভাবনাতেই তিনি আকুল। কারণ স্বামীরা যদি স্বরাজ্যে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত হন, তা হলে আপনিই যে দ্রৌপদীর সম্মান ফিরে আসবে–সেটা দ্রৌপদী জানতেন। এই স্বরাজ্য এবং রাজ-সম্মানের মতো বিরাট একটা ব্যাপারের জন্য দ্রৌপদী নিজের অপমানকে শুধু নিমিত্তের মতো ব্যবহার করেছেন। বস্তুত পাণ্ডব-কৌরবদের জ্ঞাতিস্বার্থ এবং রাজনীতির মধ্যে তিনি এতটাই সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন যে, যখনই তিনি স্বামীদের, বিশেষত যুধিষ্ঠিরের দুর্বলতা লক্ষ করেছেন, তখনই সবার ওপরে যে যুক্তিটা তিনি অস্ত্রের মতো ব্যবহার করেছেন–সেটা সেই কৌরবসভায় অপমানের কথা।

তাই বলেছিলাম-দ্রৌপদী ঠিক সীতা বা রেণুকার মতো নন। তাঁর ধর্ষণ অপমান তিনি সব সময়ই মনে রেখেছেন বটে, কিন্তু সেইটাই সব নয়। তিনি চেয়েছেন, তার স্বামীরা স্বাধিকারে প্রতিষ্ঠিত হন, এবং এই প্রতিষ্ঠায় যত বিলম্ব ঘটছিল, ততই পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের ওপর তার ক্রোধ ঘনীভূত হচ্ছিল। কারণ, দ্রৌপদী জানেন–যুধিষ্ঠিরের একান্ত ধর্মবোধ এবং সহিষ্ণুতা ক্ষত্রিয়ের ধর্মের সঙ্গে মেলে না, ক্ষত্রিয় বধূর আশা-আকাঙ্ক্ষাও তাতে তৃপ্তিলাভ করে না। তৃপ্তিলাভ করে না বলেই তিনি নিজের অপমান সমস্ত রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। আমাদের এই সিদ্ধান্ত যে মিথ্যা নয় তারও একটা প্রমাণ আমরা হাজির করার চেষ্টা করছি।

কথাটা আমি আগেও একবার উল্লেখ করেছি, তবে তা অন্য প্রসঙ্গে, অন্যভাবে। উদ্যোগপর্বে কৃষ্ণ যখন পাণ্ডবদের দূত হয়ে কৌরবসভায় যাচ্ছেন, তখন তো যুধিষ্ঠির– ভীম–দু’জনেই সন্ধিকামী হয়ে উঠলেন। অর্জুন সন্ধির কথা বলেছেন, আবার বলেনওনি। সহদেব সন্ধির বিরুদ্ধে ছিলেন, এবং প্রধানত তার কথাকে প্রাধান্য দিয়েই দ্রৌপদী প্রথমে রাজনীতির কথা তুললেন। দ্রৌপদী যে রাজনীতি ভাল বুঝতেন অথবা এ বিষয়ে যে তার যথেষ্ট পড়াশুনো ছিল–সে কথা সেই কৌরবসভায় অপমানের পর থেকে একেবারে যুধিষ্ঠিরের রাজ্যলাভ পর্যন্ত শত শতবার প্রকাশিত হয়েছে। পাণ্ডব-কৌরবদের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি যেভাবে, যেপথে চলছিল–সেখানে যৌধিষ্ঠিরী নীতি তাঁর পছন্দ হয়নি। এই স্থিরবুদ্ধি মনস্বীর ‘ধীরে চল’ নীতি, অথবা শত্রুর বিরুদ্ধে নিজের উত্থান-শক্তি বিলম্বিত করাটা দ্রৌপদীর রাজনীতি-বোধে আঘাত করেছে। এর প্রমাণ দ্রৌপদী আর যুধিষ্ঠিরের বহুতর কথোপকণ্বনে বারংবার ফুটে উঠেছে। দুর্যোধনের বিরুদ্ধে সঠিক কী নীতি গ্রহণ করা উচিত ছিল বা এখনও উচিত–তা নিয়ে এই দুই জনের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য উদ্যোগ-পর্বের এই মুহূর্ত পর্যন্তও দূর হয়নি।

হ্যাঁ, স্বামী বলে দ্রৌপদী এইটুকু মেনে নিতে রাজি আছেন যে, ঠিক আছে, যুধিষ্ঠির তো ইন্দ্রপ্রস্থের পরিবর্তে পাঁচখানি গ্রাম ফিরে পাবার প্রস্তাব দিয়েছেন দুর্যোধনকে; সে অন্তত তাই দিক। কিন্তু গোটা রাজ্যের বদলে এই যে যুধিষ্ঠির কঠিন কিছু করতে পারেন না বলে লজ্জা-লজ্জা মুখ করে সন্ধির কথা বলছেন দ্রৌপদীর সাফ কথা–পঞ্চ গ্রামের শর্তে যদি দুর্যোধন রাজি না হন, তবে যেন কৃষ্ণ আগ বাড়িয়ে সন্ধির কথা না বলেন। অর্থাৎ দ্রৌপদীর মতে–তোমরাই অন্যায়ভাবে আমাদের রাজ্য কেড়ে নিয়েছ, অথচ এখন সন্ধির কথা তোমাদের দিক থেকেও উঠছে। কিন্তু সন্ধি যদি আদৌ করতে হয়, ‘অ্যাজ আ টোকেন অব গুড জেসচার’ তোমাকে নমনীয়তার প্রমাণ হিসেবে পাঁচটি গ্রাম আগে দিয়ে দিতে হবে, তারপর সন্ধির কথা। দ্রৌপদী কৃষ্ণকে সাবধান করে দিয়ে বলেছেন–যদি রাজ্য না দিয়ে দুর্যোধন সন্ধি করতে চায়, তবে তুমি যেন সেখানে গিয়ে সন্ধি করে এস না–অপ্রদানেন রাজ্যস্য যদি কৃষ্ণ সুযোধনঃ। সন্ধিমিচ্ছেন্ন কৰ্ত্তব্যস্তত্র গত্বা কথঞ্চন।

এইবার দ্রৌপদী রাজনীতির তত্ত্ব এবং প্রয়োগের কথায় আসছেন, যে-কথায় এতকাল মহামতি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে তাঁর বারবার মতবিরোধ ঘটেছে, এবং যে কথার মীমাংসা এখনও হয়নি। দ্রৌপদী বললেন-”ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা যদি ক্রুদ্ধ হয়েও আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে–কারণ, ক্রুদ্ধ হলে শক্তির বৃদ্ধি ঘটে–তবুও সেই শক্তি প্রতিরোধ করার ক্ষমতা পাণ্ডব এবং পাঞ্চালদের আছে। এতকালের অভিজ্ঞতায় কৃষ্ণকে সম্পূর্ণ সচেতন করে দিয়ে দ্রৌপদী বললেন–তুমি যেন এটা মনে কোরো না, কৃষ্ণ, যে, ভাল ভাল কথা আর নীতির উপদেশ দিয়ে তাদের কিছু করা যাবে; এমনকী তাদের কিছু ছেড়ে দিয়েও যে লাভ হবে, তাও আমার মনে হয় না– অর্থাৎ ওই ইন্দ্রপ্রস্থ বা রাজ্যের অর্ধাংশের দাবি না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু মাত্র পাঁচখানি গ্রাম নিয়ে সন্তুষ্ট থেকেও আর সব দাবি যদি আমরা ছেড়ে দিই, তাতেও যে কিছু করা যাবে– তা মনে হয় না– ন হি সা ন দানেন শক্যোর্থ স্তেষু কশ্চন। দ্রৌপদীর বক্তব্য তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করেও যদি কিছু না হয়, ত্যাগ স্বীকার বা অন্য কিছু করেও যদি কিছু না হয় তা হলে তাদের ওপর তোমার অত করুণা করার দরকার কী? সত্যি কথা বলতে কি, যদি নিজে বাঁচতে হয়, তা হলে তাদের শাস্তি দিয়েই বাঁচতে হবে– যোক্তব্য স্তেষু দণ্ডঃ স্যাজ্জীবিতং পরিরক্ষতা।

অতএব পাণ্ডবরা দ্রৌপদীর বাপের বাড়ির লোক পাঞ্চালদের সঙ্গে নিয়ে এই মুহূর্তে দুর্যোধনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ুক– এই ছিল দ্রৌপদীর সর্বশেষ সিদ্ধান্ত। এতে পাণ্ডবদের সামর্থ্যে তৃপ্ত হবে ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা। দ্রৌপদী বোধহয় এখন জ্যেষ্ঠ-পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে কিছু ইঙ্গিত করছেন। তিনি বললেন– ক্ষত্রিয় হোক অথবা অক্ষত্রিয়, সে যদি লোভী হয়, তা হলে উপযুক্ত অথবা নিজের ধর্মে স্থিত ক্ষত্রিয়ের কাজ হল সেই লোভীটিকে মেরে ঠান্ডা করা– ক্ষত্রিয়েণ হি হন্তব্যঃ ক্ষত্রিয়ো লোভমাস্থিতঃ। আসলে দ্রৌপদীর মতে- যাকে মারা উচিত নয়, তাকে মেরে ফেলাটা যেমন অন্যায়, তেমনই যে বধযোগ্য, তাকে বাঁচিয়ে রাখাটাও একইরকম অন্যায়।

রাজনীতির দিক দিয়ে নিজের সমস্ত নীতি-যুক্তি উপস্থিত করেও দ্রৌপদী এবার মোক্ষম সেই ঘটনায় এলেন, যেখানে অন্যের যুক্তি-তর্ক হার মানবে, যেখানে তিনি নিরঙ্কুশ– যেখানে শুধু এক যুক্তিতেই কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া যায়। সেই কুরুসভার অপমানের ঘটনা। দ্রৌপদী নিজেই তার বাপের বাড়ির আভিজাত্য, শ্বশুর-কুলের সম্মান, স্বামীদের শক্তি এবং ধর্মজ পুত্রদের অভিমান সব একত্রিত করে সেই সাংঘাতিক পুরাতন কথাটা তুললেন– শাঁখা-সিঁদুর-পরা আর কোনও অভাগিনী এই পৃথিবীতে আছে– কা নু সীমন্তিনী মাদৃ– যে তার স্বামীরা বেঁচে থাকতে, ভাইয়েরা বেঁচে থাকতে, এমনকী তুমিও বেঁচে থাকতে, সবার সামনে অন্যের হাতে চুলের মুঠি ধরার অপমান সহ্য করল। ক্রোধলেশহীন, প্রতিকারের চেষ্টাহীন স্বামীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে অপমান দেখলেন, আর আমাকে কেঁদে কেঁদে ডাকতে হল তোমাকে– পাহি মামিতি গোবিন্দ মনসা চিন্তিতোহসি মে। বাস, রাজনীতির প্রয়োগ-তত্ত্বের আগুনে এইমাত্র দ্রৌপদীর ঘূতগন্ধী অভিমান যুক্ত হল।

দ্রৌপদী পুনরায় সেই কথাগুলি উচ্চারণ করলেন, যা তিনি কৃষ্ণের সামনে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন বনবাস-আরম্ভে কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হবার পর। পাণ্ডব-মুখ্য মুখ্য স্বামীদের সন্ধিকামুকতায় উদ্বিগ্ন আজ আবারও সেই পরম শক্তিমান বন্ধুর আশ্রয় নিয়ে দ্রৌপদী বলেছেন– যে-অপমান দুর্যোধন-দুঃশাসন-কর্ণেরা আমাকে করেছে, তাতে আমার বীর স্বামীরা থাকতেও তারা যদি এক মুহূর্তও বেঁচে থাকে তো সেটাই আমার স্বামীদের পক্ষে চরম লাঞ্ছনার– যত্র দুর্যোধনঃ কৃষ্ণ মুহূর্তমপি জীবতি– কিন্তু তারা বেঁচে আছে, ভালভাবেই বেঁচে আছে। দ্রৌপদী দেখেছেন– অপমানের প্রতিশোধ নেবার কথা হাজার বার তার স্বামীরা উচ্চারণ করা সত্ত্বেও শুধুমাত্র রাজনীতির কারণে আজকে তাদের মধ্যে যে সন্ধি-কার্যের দায়বদ্ধতা তৈরি হয়েছে, সেটা তার কাছে ব্যক্তিগতভাবে এক কুলবধূ নারীর অপমান গৌণ করে দেয়। এখন কৃষ্ণও যদি তার স্বামীদের কথায় প্রভাবিত হয়ে পড়েন, তা হলে কার কাছে আর যাবেন তিনি। অতএব শেষ চেষ্টায় তার বিনয়টুকুও প্রথাসিদ্ধ কথার কথা হয়ে ওঠে। দ্রৌপদী ব্যঙ্গ করে বললেন– আমার ওপর তোমার যদি এতটুকুও অনুগ্রহ থাকে কৃষ্ণ, যদি এতটুকুও কৃপার যোগ্য মনে হয় আমাকে, তা হলে ধৃতরাষ্ট্রের কুলাঙ্গার ছেলেগুলির ওপর সম্পূর্ণ ক্রোধটাই উগরে দিতে হবে– ধার্তরাষ্ট্রে বৈ কোপঃ সর্বঃ কৃষ্ণ বিধীয়তাম।

এর পরের কাজটা কৃষ্ণের কাছে অভাবনীয় ছিল। যুদ্ধোদ্যোগের সভায় তখনও বসে আছেন অনেকেই। সেই সভায় একমাত্র কনিষ্ঠ স্বামী সহদেব– তিনি নিজেকে চিরকালই পণ্ডিত ভাবেন, এমনকী বীরও ভাবেন যথেষ্ট, কেননা সেই সভায় বৃহত্তর রাজনৈতিক সিদ্ধির জন্য প্রায় সকলেই সন্ধির কথা বললেও সহদেব কিন্তু একাই নিজের ক্ষমতায় ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণের মতো মহাবীরদের পর্যুদস্ত করে দ্রৌপদীর অপমানের প্রতিশোধ নেবেন বলেছিলেন। পঞ্চস্বামীর একক স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও দ্রৌপদীর ওপর সহদেবের এই ‘মম’-কারই হয়তো তার অহংকার পুষ্ট করেছিল, কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ-পূর্ব পরিস্থিতিতে জ্ঞাতিজনের রক্তপাত না ঘটানোর জন্য যে চেষ্টা অনেক দিন ধরেই চলছিল, সেখানে এটা ছিল শেষ জায়গা। কৃষ্ণ সর্বশেষ চেষ্টা করবেন শান্তির জন্য। ঠিক এই প্ৰমুখতার সামনে দাঁড়িয়ে দ্রৌপদী নিজের গভীরতম ক্ষোভোদগার করেও মনে করলেন– এও বুঝি যথেষ্ট নয়। ধিক্কার-বাচন শেষ করেই দ্রৌপদী এবার এগিয়ে এলেন কৃষ্ণের দিকে, তারপর বেণীর আকারে সমাহৃত কুটিল-সর্পিল কেশগুচ্ছ বাঁ হাতে নিয়ে কেশপক্ষং বারোহা গৃহ্য বামেন পাণিনা– কৃষ্ণকে বললেন কৃষ্ণা দ্রৌপদী। বললেন– এই সেই রাজসূয় যজ্ঞের পবিত্র জল-স্পৃষ্ট কেশরাশি যা দুঃশাসন আপন মুষ্টিতে ধরেছিল– তুমি যখন কৌরবদের সঙ্গে সন্ধির কথা ভাববে, তখনই যেন এই মুক্তবেণী কেশরাশির কথা মনে পড়ে– স্মর্তব্যঃ সততং কৃষ্ণ পরেষাং সন্ধিমিচ্ছতা। ‘

খুব স্পষ্ট বোঝা যায়, বনবাস-অজ্ঞাতবাসের শেষ পর্যায়ে এসেও তার বীর স্বামীরা যখন কৌরবদের সঙ্গে সন্ধির কথা ভাবছেন, তখন স্পষ্টতই তিনি তার স্বামীদের ওপর আর ভরসা রাখতে পারছেন না, এবং এই বেভরসা তথা ‘ফ্রাসট্রেশন’-এর জায়গা এমনই যে, এক মুহূর্তে তিনি স্বামীদের এক পৃথক অবস্থানে বসিয়ে রেখে কৃষ্ণের কাছে ঘোষণা করেন– যদি ভীম আর অর্জুনের মতো মানুষেরা এত সন্ধিকামী হয়ে ওঠেন, তা হলে দরকার নেই তাদের যুদ্ধ করার, আমার অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য আমার ভাইদের নিয়ে না হয় যুদ্ধ করবেন আমার বৃদ্ধ পিতা, আর আমার ছেলেদের নিয়ে যুদ্ধ করবে আমার অভিমন্যু পিতা মে যোৎস্যতে বৃদ্ধঃ সহপুর্মৈহারথৈঃ। অভিমন্যুং পুরস্কৃত্য যোৎস্যন্তে কুরুভিঃ সহ। এই মুহূর্তে দ্রৌপদী বোধহয় সবচেয়ে অবাক হয়েছেন তাঁর সুচিরভক্ত ভীমকে দেখে। কৃষ্ণ আগেই ভীমের কথা শুনে বলেছিলেন– এ তো কেমন সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন বিরাট পাহাড়ও যেন হালকা হয়ে গেল, আগুনের গরম যেন ঠান্ডা-শেতল বলে মনে হচ্ছে– গিরেরিব লঘুত্বং তৎ শীতত্বমিব পাবকে। দ্রৌপদী এই ব্যঙ্গোক্তিকে আরও তীক্ষ্ণ করে দিয়ে বলেছেন– আজ তেরোটা বচ্ছর পার হয়ে গেছে, আমি মনের মধ্যে আগুনের মতো এই ক্রোধ নিয়ে বসে আছি, কিন্তু আমার গা জ্বলে যাচ্ছে এই ভীমের কথা শুনে বিদীৰ্যতে মে হৃদয়ং ভীমবাশল্যপীড়িতম– এই তেরো বছরে ক’বার ইনি বলেছেন- দুঃশাসনের রক্তপান করব, দুর্যোধনের ঊরু ভেঙে দেব– আর আজ যখন যুদ্ধের সময়ে এই প্রতিজ্ঞাপূরণের সময় এল, তখন তিনি ধর্ম দেখাচ্ছেন– ধর্ম– দ্রৌপদীর ভাবটা এই, ভীমও আজ ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির হয়েছেন– যোহয়মদ্য মহাবাহুধর্মমেবানুপশ্যতি।

দ্রৌপদীর ক্ষোভ অন্তর দিয়ে বুঝেছেন কৃষ্ণ। প্রগাঢ় রাজনৈতিকতায় সভা চালিত হলেও কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন– সন্ধির কথাটা একেবারেই কথার কথা, ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা এই সন্ধির প্রস্তাব মানবে না, তাদের সময় ঘনিয়ে এসেছে– ধার্তরাষ্ট্রাঃ কালপক্কা ন চেৎ শৃথন্তি মে বচঃ। কৃষ্ণ আগের মতোই আজও আশ্বস্ত করেছেন কৃষ্ণা দ্রৌপদীকে। বলেছেন– আজকে তুমি যেমন কেঁদে ভাসাচ্ছ, দ্রৌপদী! এমনি করেই কাঁদবে একদিন কৌরবদের বউরাও। তবে জেনে রেখো, তোমার সম্মান আমি রাখব। যা যা করার আমি করব, এই ভীম-অর্জুন-সহদেবকে দিয়েই করাব, আর জ্যেষ্ঠ স্বামীটিও থাকবেন আমাদের মাথার ওপর– অহঞ্চ তৎ করিষ্যামি ভীমার্জুনমৈঃ সহ। এই যে কৃষ্ণ বলেছেন– আমি করব– অহঞ্চ তৎ করিষ্যামি– এখন থেকেই বুঝতে পারি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভার কৃষ্ণের হাতে চলে গেছে, যুধিষ্ঠির এখানে অলংকৃত একযান্ত্রিকতায় উচ্চাসনে বসে আছেন মাত্র। তাকে দ্রৌপদীও ভরসা করেন না কৃষ্ণও করেন না।

কৌরব-সভায় দ্রৌপদীর অসহায় ক্রন্দনের সময় সেই অলৌকিক বস্ত্ররাশি দুঃশাসনকে ক্লান্ত করেছিল কিনা, তা আমাদের প্রত্যয়ে আসে না হয়তো। কিন্তু কৃষ্ণের নামে যে কাজ হয়েছিল– তা আমি হলফ করে বলতে পারি। হরিনামের মাহাত্ম্য এই নামের মধ্যে নাও থাকতে পারে কিন্তু সে যুগের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে কৃষ্ণের কূটনীতির মাহাত্ম তখন এতই বহুশ্রুত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত যে, কৃষ্ণনামের মাত্রা তখন রাজনৈতিক কি দিয়ে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কৃষ্ণ পরে যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন– আমি যদি সেইসময় শুধু দ্বারকায় থাকতাম, তা হলে কৌরবরা না ডাকলেও আমি অনাহূত অবস্থাতেও পাশাখেলার আসরে পৌঁছতাম। প্রথমে ভীষ্ম-দ্রোণ এবং অন্যান্য বড় বড় মানুষদের সঙ্গে নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। পাশাখেলার দোষগুলি বোঝাতাম– আর যদি তাতেও কেউ আমার ভাল কথা না শুনত, তা হলে মেরে বোঝাতাম– পথ্য জিনিসটা কী– পথ্যঞ্চ ভরতশ্রেষ্ঠ নিগৃহ্নীয়াং বলেন তম্। হয়তো তাতে অন্য পাশাড়েরা সব ক্ষেপে গিয়ে ওদের পক্ষে জুটত। তাতে কী? ওদেরও মেরে ফেলতাম নির্দ্বিধায় তাংশ্চ হন্যাং দুরোদরান্।

আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি– কৃষ্ণের এই ক্ষমতা ছিল। তিনি যা বলেন, তা যে করতে পারেন– সেটা যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়ে শিশুপাল বধের সময়েই দেখা গেছে। কোনও বিরুদ্ধতা তাকে কিছুই করতে পারেনি। কৌরব-সভায় পাশাখেলার সময় ভাল কথা অনেকেই বলেছেন, বিদুর তো বিশেষ করে, কিন্তু ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর কারওই ওই মারার ক্ষমতাটা ছিল না। সমগ্র দূতসভায় একমাত্র দ্রৌপদী ছাড়া কৃষ্ণের নাম কেউ মুখে আনেননি– কৌরবরা তো নয়ই পাণ্ডবরাও নয়, ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরও নয়। আমার ধারণা যে মুহূর্তে এই শায়েস্তা করার লোকটির নাম দ্রৌপদীর মাধ্যমে সবারই স্মরণে এসেছে, সেই মুহূর্তে দুঃশাসন ক্লান্ত বোধ করেছেন, তাকে থামতেও হয়েছে। কিন্তু অপমান-মুক্তির মধ্যে দ্রৌপদী তার পঞ্চস্বামীকে ত্রাতার ভূমিকায় পাননি– সেই ধর্ষণ, অপমানের মুহূর্তেও পাননি, আজ এতকাল বনবাস পর্বের পর যুধিষ্ঠির, ভীম এবং আংশিকভাবে অর্জুনেরও সন্ধিকামুকতা দেখে তিনি এখনও আশ্বস্ত নন। তাই সেদিন সেই অকারণ লাঞ্ছনার মধ্যেও তিনি কৃষ্ণকে স্মরণ করেছিলেন, আজ এই যুদ্ধোদ্যোগের সময়েও তিনি কৃষ্ণেরই স্মরণ নিয়েছেন বোধহয় একমাত্র তিনিই পারেন ক্ষত্রিয়বধূর কাম্য জয়াশা পূরণ করতে।

বস্তুত এই প্রত্যাশাপূরণের ক্ষেত্রে ভীম এবং অর্জুনও দ্রৌপদীর অবিশ্বাসের মানুষ ছিলেন না, কিন্তু তার এই দুই স্বামীই যাঁর ইচ্ছা বা নীতি-যুক্তি অতিক্রম করতেন না– সেই জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের অমোঘ শাসন দ্রৌপদী কোনওদিনই পছন্দ করেননি, তাঁর নীতি-যুক্তিও সহ্য করতে পারেননি কোনওদিন। লেখক-সজ্জনের মধ্যে আছেন কেউ কেউ, যাঁরা যুধিষ্ঠিরের প্রতি সদয় পক্ষপাতে দ্রৌপদীকেও তার প্রতি সরসা করে তুলেছেন। স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু তাঁর অসাধারণ সংহত ভাষায় যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্রৌপদীর প্রায় একক নিষ্ঠা এবং আশ্রয়ের কথাটা প্রকাশ করেছেন। তবে সে মত আমার মতো সাধারণ মহাভারত পাঠকের মনে বড় অনর্থক রকমের জটিল বলে মনে হয়েছে। মহাকাব্যের নায়িকা হিসেবে তথা পঞ্চস্বামীর একতমা বধূ হিসেবে দ্রৌপদীর মনের গতি-প্রকৃতি যে অতিশয় জটিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই জটিলতার সুযোগে পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্রৌপদীর ‘নিকটতম’ সম্বন্ধ প্রমাণ করে দেওয়াটা আমাদের মতে কিছুটা সংহতিহীন মনে হয়।

আমি প্রথমে প্রয়াত বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্যগুলি উদ্ধার করে তার সার্বিক মতটা দেখানোর চেষ্টা করব, তারপর, আমাদের যৌক্তিকতা আমরা দেখাব। বুদ্ধদেববাবু লিখেছেন– (১, ২, ৩ সংখ্যাগুলি আমার দেওয়া)

(১) “কিন্তু আসলে যেন যুধিষ্ঠিরের সঙ্গেই নিকটতম তার সম্বন্ধ– ঘটনার পর ঘটনা অনুধাবন করতে করতে এমনি একটা ধারণা হয় আমাদের, যদিও অগ্নিসম্ভবা আগ্নেয়স্বভাব পাঞ্চালীর সঙ্গে মৃদু দূতাসক্ত যুদ্ধবিমুখ যুধিষ্ঠিরের বৈশাদৃশ্য অতিশয় স্পষ্ট।”

(২) “বক-যক্ষের প্রশ্নের উত্তরে তিনি তিনবার উল্লেখ করেছেন ভার্যার– তাঁর ভার্যার, তা বুঝে নিতে আমাদের দেরি হয় না। গৃহে মিত্র ভার্যা’, ‘দৈবকৃত সখা ভার্যা’, আর উপরন্তু ‘ধর্ম অর্থ কাম– এই এই তিন পরস্পর বিরোধীর সংযোগ ঘটে শুধু ধৰ্মচারিণী ভার্যার মধ্যে– এ সব কথা যুধিষ্ঠিরের মুখে ঠিক শাস্ত্রবচনের মতো শোনাচ্ছে না, এদের পিছনে দ্রৌপদীর সঞ্চার আমরা অনুভব করি…”।

(৩) “যুধিষ্ঠির সযত্নে লালন করেছিলেন এই সম্পর্কটিকে, এবং বহুভর্তৃকা দ্রৌপদী এর মূল্য বিষয়ে কতটা সচেতন ছিলেন তাও আমরা অনেকবার দেখেছি। স্মর্তব্য, তার পায়ের কাছে যে স্বর্ণপদ্মটি উড়ে এসে পড়েছিল, দ্রৌপদী সেটি যুধিষ্ঠিরকেই উপহার দিয়েছিলেন, আজ্ঞাবহ ভীমসেনকে নয় (বনঃ ১৪৬)। তার আছে ‘ইন্দ্রের মত পঞ্চস্বামী’–এই বাঁধা বুলিটি দ্রৌপদীর মুখে শুনতে পাওয়া যায়, কিন্তু দ্যুতসভায় অপমানিত হয়ে তিনি তীব্র স্বরে বলে উঠলেন (সভা: ৬৭): আমি পাণ্ডবদের সহধর্মিণী, আমি ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের ভার্যা।’ যেন বহুবচনের মধ্যে যুধিষ্ঠিরকে ধরানো গেল না, স্বতন্ত্রভাবে তার নাম বলতে হলো, যেন পাঁচের মধ্যে একের নাম করতে হলে যুধিষ্ঠিরকেই তার মনে পড়ে।”

(৪) “আমরা লক্ষ করি যে সভাপর্বের পরে কাহিনি যত এগিয়ে চলে ততই সত্য হয়ে ওঠে দ্রৌপদীর সেই আর্ত মুহূর্তের ঘোষণা; একান্ত ভাবে না হোক, উত্তরোত্তর আরও বেশি সংশ্লিষ্টভাবে, তিনি যুধিষ্ঠিরের ভার্যারূপে প্রতিভাত হতে থাকেন। দ্রৌপদীর অন্য দুই প্রধান স্বামীর উপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলো ফেলছেন ব্যাসদেব বলা বাহুল্য, নকুল সহদেব এ প্রসঙ্গে বিবেচ্য নন– দ্রৌপদীর বল্লভ রূপে কখনও অর্জুনকে আর কখনও বা ভীমকে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু তার নিত্যসঙ্গীরূপে যুধিষ্ঠিরই ছিলেন একমাত্র–হয়তো ঘটনাচক্রে, যেহেতু অর্জুন ছিলেন অনবরত ভ্রাম্যমাণ আর ভীমসেন প্রধানত এক মল্লবীর হিসেবে উপস্থিত, বা হয়তো অন্তঃস্থিত কোনও নিগূঢ় আকর্ষণ ছিল দু’জনের মধ্যে– কেননা বিপরীতেরও আকর্ষণ থাকে, এবং তা প্রবল হবারও বাধা নেই। যে কারণে কান্তিমান দুর্মদ যুবা আলকিবিয়াদেস-এর পক্ষে কুদর্শন বৃদ্ধ জ্ঞানী সক্রেটিস ছিলেন প্রয়োজন, হয়তো সেই কারণেই দ্রৌপদীর যুধিষ্ঠিরকে না হলে চলত না।”

(৫) “যাকে বলা যায় সত্যিকার দাম্পত্য সম্বন্ধ, তার দৃষ্টান্ত রূপে যুধিষ্ঠির-দ্রৌপদীকেই মনে পড়ে আমাদের ঠিক মধুর রসে আশ্রিত নয় হয়তো, বলা যায় না রতিপরিমলে অনুলিপ্ত, কিন্তু গভীর ও স্থির ও সশ্রদ্ধ প্রীতিপরায়ণ সেই সম্বন্ধ, এবং যা আরও জরুরি সমকক্ষতার উপর প্রতিষ্ঠিত।”।

বুদ্ধদেব বসু মহাশয়ের সমস্ত কথাগুলি এখানে উদ্ধার করতে পারলেই ভাল হত, কিন্তু তাতে গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধির ভয় আছে; তা ছাড়া যতটুকু আমরা এখানে তুলেছি, তাতেই তার সার্বিক মতটা বোঝা যায়। আমাদের নিবেদন প্রথম মন্তব্যে ‘আসলে’ যেন যুধিষ্ঠিরই তার স্বামী’–এখানে ‘আসল’ আর ‘যেন’ কথাটি যতই কাব্যগন্ধী গদ্যের সূচনা করুক, এই কথাগুলির মধ্যে কেমন এক অপ্রত্যয় আছে, বোঝা যায়, মহাভারতের সামগ্রিক প্রমাণে এই কথা সম্পূর্ণ প্রমাণ করা যাবে না ভেবেই মন্তব্যের মধ্যে এক পিচ্ছিল অনিশ্চয়তা রেখে দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু “যুধিষ্ঠিরের সঙ্গেই নিকটতম তার সম্বন্ধ এই কথার সঙ্গেই ‘যদিও যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দ্রৌপদীর ‘বৈশাদৃশ্য অতিশয় স্পষ্ট’– এই আপাত বিরোধিতারও অর্থ আমার কাছে স্পষ্ট নয়– এবং অস্পষ্টতা দিয়ে আর যাই হোক, পঞ্চস্বামীর একতমের সঙ্গে দ্রৌপদীর ‘নিকটতম সম্বন্ধ’ প্রমাণ করা কঠিন।

স্বামীদের সঙ্গে দ্রৌপদীর সম্বন্ধ পূর্বে আমি খানিকটা দেখানোর চেষ্টা করেছি এবং তা অবশ্যই মহাভারতের প্রমাণে। তাতে আমি কোথাও যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ‘নিকটতম সম্বন্ধ’ খুঁজে পাইনি। তার ওপরে বুদ্ধদেবের ৪ সংখ্যক মন্তব্যে ‘সভাপর্বের পর থেকে দ্রৌপদীকে ‘উত্তরোত্তর’ যুধিষ্ঠিরের সংশ্লিষ্ট অথবা ‘তিনি যুধিষ্ঠিরের ভার্যারূপে প্রতিভাত হতে থাকেন’– এই সিদ্ধান্তের মধ্যেও আমি কোনও বৈয়াসিক যুক্তি খুঁজে পাইনি। বরঞ্চ প্রায় উলটোটাই আমার কাছে সত্য বলে মনে হয়।

দ্রৌপদী যেদিন স্বয়ম্বরা বধূটির লজ্জারুণ চেলি পরে কুম্ভকার গৃহের ভাড়া-করা শ্বশুর বাড়িতে এলেন, সেদিন গৃহের অন্তরালে থাকা কুন্তীর বচন ছিল– যা এনেছ পাঁচ ভাই ভাগ করে খাও। তারপর দ্রৌপদীকে দেখে তিনি ভীষণ ভয়ে আর্তস্বরে যুধিষ্ঠিরকেই বলেছিলেন– তুমি সেই ব্যবস্থা কর যাতে আমার কথা মিথ্যে না হয়, কৃষ্ণা পাঞ্চালীকে যাতে কোনও অধর্ম না স্পর্শ করে অথবা তাতে তার যেন কোনও বিভ্রান্তিও না হয় অর্থাৎ তিনি যেন কোনও ভুল না বোঝেন–ন বিভ্রমেচ্চ।

যুধিষ্ঠির মাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন হয়তো ধর্মের সূক্ষ্ম গতিপথ– যা তিনি নিজেও তখন তত বোঝেননি এবং যা তিনি কন্যার পিতা দ্রুপদকেও বোঝাতে পারেননি– সূক্ষ্মো ধর্মো মহারাজ নাস্য বিদ্মো বয়ং গতিম– অথচ তিনি প্রায় আদেশের মতো বলেছিলেন– আমাদের সবারই মহিষী হবেন এই কল্যাণী দ্রৌপদী। মায়ের কথা মিথ্যে হয়নি, হয়তো বৃহত্তর স্বার্থে পঞ্চভ্রাতার সৌহার্দ্যকামনায় ধর্মও লঙ্ঘিত হয়নি, কিন্তু কৃষ্ণা পাঞ্চালীর কোনও বিভ্রান্তি হল কিনা, অর্থাৎ তিনি ভুল বুঝলেন কিনা– সে খোঁজ, যুধিষ্ঠির নেননি। দ্রুপদকেও তিনি ধর্মের গতি বোঝাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত মায়েরই আশ্রয় নিয়েছেন, এবং নিজেকেও তিনি যথোপযুক্ত প্রয়োগ করেছেন সর্বাংশে জ্যেষ্ঠের মতো। বলেছেন মা এইরকম বলেছেন, আমারও তাই মনে হয় এবঞ্চেব বদত্যম্বা মম চৈতনমনোগতম। দ্রৌপদী খুশি হয়েছিলেন কি না আমাদের জানা নেই। নিয়তির মতো পাঁচ স্বামী যখন তার মাথায় চেপে গেল, তখন এই বিদগ্ধা নায়িকা অসাধারণ দক্ষতায় পঞ্চপ্রদীপের তলায় ধৃতিদণ্ডটির মতো পঞ্চস্বামীরই বশবর্তিনী হয়েছেন– বভূব কৃষ্ণা সর্বেষাং পার্থানাং বশবৰ্ত্তিনী। কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে তিনি ক্ষমা করেছেন তো?

তবু এমন পাঁচ স্বামীকে নিয়ে ভরা সুখের মধ্যে অর্জুন এক সামান্য গোরুচোর ধরতে গিয়ে বনে চলে যেতে বাধ্য হলেন কিন্তু ফিরে এলেন– যাদবনন্দিনী সুভদ্রাকে নিয়ে। ফিরে আসার পর দ্রৌপদীকে আমরা খণ্ডিতা হতে দেখেছি। অর্জুনের ওপর বড় অভিমান করতেও দেখেছি। উল্লেখ্য, মহামতি যুধিষ্ঠির কিন্তু রীতিমতো স্বয়ম্বরে গিয়ে গোবাসন শৈব্যের মেয়ে দেবিকাকে বিয়ে করেছিলেন। এই বিয়েটা দ্রৌপদীর বিয়ের আগে না পরে সুসম্পন্ন হয়েছিল– সে-খবর মহাভারতের কবি দেননি, অকিঞ্চিৎকর বলেই দেননি, আর দ্রৌপদীর কাছেও এ-ঘটনা ছিল বড়ই অকিঞ্চিৎকর! যুধিষ্ঠিরের প্রতি তাঁর নৈকট্যবোধ তীব্র হলে এই দেবিকার কথা একবারও অন্তত দ্রৌপদীর মুখে শুনতাম, অথবা দেখতাম সামান্যতম ভ্রুকুটি। এই ভ্রুকুটি যেমন যুধিষ্ঠিরের অন্যতরা স্ত্রীর জন্যও কুঞ্চিত হয়নি, তেমনই হয়নি নকুল বা সহদেবের অন্যান্য বধূদের জন্যও। স্বামীর প্রতি একান্ত অধিকারবোধই এই ভ্রুকুটি-কুটিলতার জন্ম দেয় বলে রসশাস্ত্রে শুনেছি। অথবা যুধিষ্ঠির সেই রসভাব-সমন্বিত বিদগ্ধ ভ্রুকুটি-ভঙ্গের যোগ্য ছিলেন না– অন্তত দ্রৌপদীর কাছে। দ্রৌপদীর মুখে ভীম হিড়িম্বার সংবাদও সাড়ম্বরে শুনেছি, কিন্তু হিড়িম্বাকে নিয়ে দ্রৌপদীর ঈর্ষা তো ছিলই না, বরং একটু স্বাধিকার-বোধই ছিল যেন একান্ত অনুগত ভীমের বউ বলেই হয়তো।

তবুও কেউ বলতে পারেন অন্যান্য পাণ্ডব-বধূদের ব্যাপারে দ্রৌপদীর অন্তরঙ্গ ঔদাসীন্য এমন কিছু দরকারি কথা নয়, যাতে যুধিষ্ঠিরের প্রতি তাঁর নৈকট্য অপ্রমাণ হয়ে গেল। কথাটা যাই হোক, আমিও অত বড় করে কিছু বলছি না, কিন্তু অন্যের ক্ষেত্রে নিস্তরঙ্গতা আর অর্জুনের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া– এই বৈপরীত্যের মধ্যে যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্রৌপদীর সামান্য নৈকট্যের আভাস যতটা, অর্জুনের প্রতি দুর্বলতার ইঙ্গিত তার চেয়ে বেশি।

তবু থাক সে-কথা। অর্জুন-সুভদ্রার বিয়ের পরে দ্রৌপদীকে আমরা একবার অর্জুনের সঙ্গে বেড়াতে যেতে দেখেছি। নিজের ইচ্ছায় নয়। কিন্তু বারো বছর বাইরে বাইরে থেকে এক যৌবনোদ্ধত যুবক এতকাল পরে বাড়ি ফিরেছে– হতে পারে, তার সঙ্গে সুভদ্রার মতো সুন্দরী সঙ্গিনী আছে– তবু জীবনের প্রথম নারীটিকে স্ববীর্যে জয় করে আনার মধ্যে যে চিরন্তন অধিকারবোধ থাকে, হয়তো সেই অধিকার-বোধেই, অথবা অর্জুন বাড়ি ফিরেও হয়তো দেখেছিলেন– দ্রৌপদী তখনও দাদা কিংবা ভাইদের পরকীয়া, হয়তো সেই যন্ত্রণায় অর্জুন যেন দ্রৌপদীর সমস্ত অন্যতর বন্ধন ছিন্ন করে দিয়ে ক্ষণেকের তরে নিজের অধিকারে স্থাপন করেছেন একান্ত এক বিহার-ভূমিতে।

বিবাহের পর দ্রৌপদীর সঙ্গে অর্জুনের সেই প্রথম মধুচন্দ্রিমা। জানি– মহাভারতের কবি কথাটা এমন স্পষ্ট করে বলেননি। কিন্তু ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নিঃসংশয় অনুজ্ঞার জন্য অর্জুন বেশ একটু কৌশলই করেছিলেন কিনা কে জানে! অর্জুন কৃষ্ণকে বলেছিলেন– চল যাই যমুনার দিকটায় ঘুরে আসি বড় গরম এখানে– উষ্ণানি কৃষ্ণ বৰ্ত্তন্তে গচ্ছাবো যমুনাং প্রতি। কৃষ্ণ বললেন– আমিও মনে মনে এই কথাই ভাবছিলাম, অর্জুন! বেশ বন্ধু বান্ধব সঙ্গে নিয়ে যমুনার কাছে ফুর্তি করে আসলে দারুণ হত। কে না জানে– ধীর সমীরে যমুনাতীরে কৃষ্ণের উল্লাস বড় বেশি। কিন্তু অর্জুন! কৃষ্ণের ইচ্ছা থাকায় ধর্মরাজের অনুমতি মিলতে দেরি হয়নি। ফুর্তির জন্য বন্ধু-বান্ধব যত না গেছেন তাদের সঙ্গে, ফুর্তিবাজ অন্য মেয়েরা গেছে তার চেয়ে বেশি। তারা নাচবে, গাইবে, যা ইচ্ছে করবে বনে কাশ্চিজ্জলে কাশ্চিৎ– স্ত্রিয়শ্চ বিপুল-শ্রোণ্য-শ্চারুপীনপয়োধরাঃ। কৃষ্ণ আর অর্জুনের সঙ্গে এসেছেন সুভদ্রা আর দ্রৌপদী। খাওয়া দাওয়া আর নাচে-গানে ভরে উঠল এই চারজনের অন্তরঙ্গ আসর। নাচনেওয়ালি মেয়েদের রঙ্গ-তামাশায় ভারী মজা পেলেন দ্রৌপদী এবং সুভদ্রা। খুশির মেজাজে তাঁরা সেই মেয়েদের দিকে নিজের গায়ের গয়না ছুঁড়ে দিলেন, ছুঁড়ে দিলেন রঙিন ওড়না– দ্রৌপদী চ সুভদ্রা চ বাসাংস্যাভরণানি চ।

বাড়ির বাইরে আপন ঈপ্সিততমের সঙ্গে দ্রৌপদীকে আমরা কি এত খুশির মেজাজে, এত উচ্ছ্বসিত আর কখনও দেখেছি? হয়তো নৈকট্যের আরও সংজ্ঞা আছে কোনও, দিন দিন, প্রতিদিন দাম্পত্য অভ্যাস সেই বুঝি নৈকট্য। হবেও বা কৃষ্ণ-অর্জুনের এই যমুনা-বিহার থেকেই সূচিত হয়েছিল খাণ্ডব-দহনের প্রক্রিয়া। পাণ্ডবরা ধৃতরাষ্ট্রের অনুজ্ঞায় খাণ্ডবপ্রস্থে রাজ্য করতে এসেছেন। শস্যহীন, রুক্ষ জমি এই খাণ্ডবপ্রস্থ। অগ্নিদেবের ক্ষুধামান্দ্য ইত্যাদি কঠিন কথা থাক। কিন্তু সমস্ত খাণ্ডববন পুড়িয়ে যে বীর প্রায় একক ক্ষমতায় জায়গাটাকে সবার বাসযোগ্য করে তুললেন, যে শালীনতায় তিনি ময়দানবের মাধ্যমে ইন্দ্রপ্রস্থে রাজপ্রসাদ বানানোর ব্যবস্থা করলেন– সেই অর্জুনের সব ক্ষমতা, ত্যাগ- দ্রৌপদীর মনে ছিল। খাণ্ডব দহনের অসাধারণ প্রক্রিয়ায় দ্রৌপদী কতটা মুগ্ধ ছিলেন– তা টের পাওয়া যায় পরবর্তী সময়ে দ্রৌপদীর আক্ষেপে। সেই বিরাট-পর্বে দ্রৌপদী যখন কীচকের উদগ্র কামনায় বিব্রত হচ্ছেন, তখন ভীমের কাছে গিয়ে দ্রৌপদী অর্ধেক অনুশোচনা করেছেন শুধু অর্জুনকে নিয়ে। তাঁর কেবলই কষ্ট অর্জুনের এই দশা হল কী করে? সেই মানুষ, যে নাকি খাণ্ডব-দহন করে অগ্নিকে তৃপ্ত করেছিলেন– যোহতপয়দমেয়াত্মা খাণ্ডবে জাতবেদসম– সে বিরাট রাজার অন্তঃপুরে নাচনেওয়ালি সেজে থাকে কী করে? এই খাণ্ডব-দহনের প্রসঙ্গ দ্রৌপদীর মুখে আবার এসেছে, যখন তিনি কুমার উত্তরের কাছে বৃহন্নলার সারথি হবার যোগ্যতা-প্রমাণে ব্যস্ত হয়েছিলেন। কাজেই মহাভারতের আদিপর্বেও যুধিষ্ঠিরের স্বামিত্বে যত গৌরবান্বিত ছিলেন দ্রৌপদী, তার চেয়ে অনেক বেশি মুগ্ধ ছিলেন অর্জুনের বীরত্বে। কিন্তু দ্রৌপদীর কাছে অর্জুনের মাহাত্ম্য প্রমাণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়, আমার বক্তব্য– আদিপর্বে আমরা এমন কিছু দেখিনি যাতে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দ্রৌপদীর নৈকট্য প্রমাণ করা যায়।

তারপর বুদ্ধদেব যেমন লিখেছেন– “দ্যুতসভায় অবমানিত হয়ে দ্রৌপদী তীব্র স্বরে বলে উঠলেন– আমি পাণ্ডবদের সহধর্মিণী, আমি ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের ভার্যা!– যেন বহুবচনের মধ্যে যুধিষ্ঠিরকে ধরানো গেল না, স্বতন্ত্রভাবে এবং বিশেষভাবে তার নাম বলতে হ’লো…’– ঠিক এইভাবে কথাগুলি মহাভারতে নেই। দ্রৌপদী বলেছিলেন– আমি পাণ্ডবদের ভার্যা, ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী, এবং কৃষ্ণের বান্ধবী হওয়া সত্ত্বেও কেমন করে যে আমায় এই সভায় সমস্ত রাজাদের সামনে নিয়ে আসা হল– ভাবতে পারি না।

এই হল একটি শ্লোক এবং এই শ্লোকে ‘কথং হি ভার‍্যা পাণ্ডুনাম্’ আমি পাণ্ডবদের ভার্যা– এখানে যুধিষ্ঠিরকেও ধরানো গেছে একভাবে। পরের শ্লোকে যুধিষ্ঠিরের নাম আলাদাভাবে উচ্চারণ করেছেন দ্রৌপদী, কিন্তু তার তাৎপর্য বুদ্ধদেব যেমনটি বলেছেন, তেমনটি আমার মনে হয় না। এখানে আবারও শ্লোকটা যেখানে আছে, যে প্রসঙ্গে আছে– সেটা বলি। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বাজি রেখে হেরেছেন যদিও, তবু তিনি নিজেকে বাজি রেখে হেরেছেন আগে। এ অবস্থায় আইনের মারপ্যাঁচে দ্রৌপদীকে কোনও ভাবেই কৌরবদের দাসী বলা যায় কিনা– এটাই ছিল দ্রৌপদীর প্রশ্ন। এই প্রশ্নকূট নিয়ে আগেও আলোচনা হয়ে গেছে। মহামতি ভীষ্ম এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন এবং উত্তরের জন্য দেখিয়ে দিয়েছেন যুধিষ্ঠিরকেই। দুঃশাসনের অসভ্যতাও তখন শেষ হয়ে গেছে, কাপড় টেনে টেনে তিনি তখন ক্লান্ত। এরই মধ্যে কর্ণ বললেন– দুঃশাসন! ঝিটাকে এবার ঘরে নিয়ে যাও– কৃষ্ণাং দাসীং গৃহান্ নয়।

ঠিক এই মুহূর্তে কৃষ্ণা পাঞ্চালী আবার কথা আরম্ভ করলেন সমবেত সুধীজনের সামনে। আবার সেই শাশ্বত লোকাঁচার সাধারণ ধর্মবোধের কথা তুললেন দ্রৌপদী। সেই স্বয়ম্বর সভায় রাজাদের সামনে একবার আমি এসেছিলাম, আর আজও আমাকে আসতে হল। আমার গায়ে হাওয়ার পরশ লাগলেও যেখানে আমার স্বামীরা সইতে পারেন না, ভাবেন বুঝি, পর-পুরুষের ছোঁয়া লাগল সেই পাণ্ডবরাও আমার এই অপমান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সহ্য করলেন।

ঠিক এইখানেই দ্রৌপদী দুঃখ করে বলেছেন- পাণ্ডবের ভার্যা, ধৃষ্টদ্যুম্নের বোন এবং কৃষ্ণের বান্ধবী হয়েও আমাকে এই সভায় আসতে হল? এর পরেই যুধিষ্ঠিরের গৌরবে সেই আলাদা শ্লোকটি। দ্রৌপদী বললেন–দেখ হে, কৌরবরা! আমি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ভার্যা, আমাদের বিবাহ হয়েছে সবর্ণে, ক্ষত্রিয়ে ক্ষত্রিয়ে– তামিমাং ধর্মরাজস্য ভার্যাং সদৃশ-বর্ণজাম– এখন ভেবে দেখ তোমরা, আমাকে দাসী বলবে, না, অদাসী বলবে? যা বলবে– তাই করব– ব্রুত দাসীম অদাসীং বা তৎ করিষ্যামি কৌরবাঃ।

এখানে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ভার্যার গৌরবে যে কথাগুলি বলেছেন দ্রৌপদী, তার একটা পৃথক গুরুত্ব অবশ্যই আছে আমার বিবেচনায়, তবে তার প্রসঙ্গটা এখানে খেয়াল করার মতো। মনে রাখা দরকার- দ্রৌপদীকে কোনওভাবেই দাসী বলা যায় কিনা- এই ছিল প্রশ্ন। দ্রৌপদী ধৃতরাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি কৌরবকুলের পুত্রবধূ, ধৃতরাষ্ট্রের কন্যার মতো সুষাং দুহিতরঞ্চৈব। দ্রৌপদী মনে করিয়ে দিয়েছেন– কুরুকুলের চিরন্তন ধর্মবোধের কথা– যে ধর্মবোধ অতিক্রম করে তারা কোনওদিন কুলবধূদের অমর্যাদা করেননি, এবং যে ধর্মবোধ এখন বিলুপ্ত। এইবার তিনি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ভার্যার গৌরবের কথা বলছেন।

আবারও মনে রাখতে হবে– বিদগ্ধা দ্রৌপদী, পাণ্ডব-ভার‍্যা দ্রৌপদী, ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী দ্রৌপদী এই অভিজাত বংশ-সম্বন্ধগুলি কৌরব-কুলাঙ্গারদের মনে করিয়ে দিয়ে তবেই দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের প্রসঙ্গে আসছেন। আসছেন ইজন্য যে, এই কয়েক ঘণ্টা আগেও তিনি ছিলেন ইন্দ্রপ্রস্থের পাটরানি। রাজা যুধিষ্ঠিরের স্ত্রী। ক্ষত্রিয় যুধিষ্ঠির সমানবর্ণা ক্ষত্রিয়া কুমারীকে বিবাহ করে, তবেই না কুরুকুলের পুত্রবধূর সম্মানে তাকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। আর যে কুরুকুল চিরকাল শুধু ধর্মানুসারে কাজ করেছে, সেই কুরুকুলের জাতকেরা আজ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ধর্মানুসারে বিবাহিতা রানি দ্রৌপদীকে দাসী বানাতে চাইছে। দ্রৌপদীর শাণিত ইঙ্গিত– এতে আভিজাত্যও নেই, ধর্মও নেই।

ধর্ম শব্দটা এখানে ফুল, নৈবেদ্য কিংবা বেলপাতার পুজো বোঝাচ্ছে না, ধর্ম এখানে এক বিশাল নীতিবোধ, সামাজিক ঔচিত্য; এমনকী যা করা হয়ে গেছে, তা যদি ঠিক না হয়ে থাকে, তবে তার করণীয়তা সম্বন্ধে গভীর কোনও তর্কও হতে পারে। দ্রৌপদী সেই তর্কই করছিলেন, এবং এইসব ক্ষেত্রে যুধিষ্ঠির এতকাল ছিলেন প্রমাণ স্বরূপ। পাশা-ক্রীড়ার এই তাৎক্ষণিক মত্ততা ছাড়া যুধিষ্ঠির নৈতিক এবং উচিত কার্যে সবসময় ব্যক্তি স্বার্থ অতিক্রম করে সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেছেন। এমনকী এখনও তিনি পাশা খেলে নিজেকে এবং নিজের স্ত্রীকেও হেরেছেন– এই চরম মুহূর্তেও পাশা খেলার ন্যায় নীতি অনুসারে তার মাথার ওপর যে গভীর সংকট নেমে এসেছে– সে সংকট থেকে বাঁচবার জন্য অন্য কোনও সহজ পন্থা অবলম্বন করেননি, অথবা কোনও তর্ক করেননি। কারণ পাশাখেলার নির্ধারিত নিয়মনীতিও তার কাছে ধর্ম। যার জন্য দ্রৌপদী যখন বারবার কৌরবদের ওপরে চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন– বল তোমরা, আমি দাসী, না অদাসী, আমি ধর্মানুসারে জিত হয়েছি! না জিত হইনি- তোমরা যা বলবে আমি তাই করব।

লক্ষণীয় বিষয় হল, কৌরবরা এখানে আজ্ঞাকারীর ভূমিকায় থেকেও তাদের সিদ্ধান্ত তারা ঘোষণা করেননি। এই অবস্থাতেও তারা বলেছেন– ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের বুদ্ধি ধর্মেই স্থিত এবং পাশাখেলায় হেরে যাবার পর এখনও তোমার ওপর তার স্বামীর অধিকার আছে, কি নেই- তা এই ইন্দ্ৰকল্প যুধিষ্ঠিরের কাছেই জেনে নাও– ধর্মে হিতো ধর্মসুতো মহাত্মা স্বয়ঞ্চেদং কণ্বয়ত্বিকল্পঃ।

এই কথাটা দুর্যোধন বলেছেন। আপনারা কি মনে করেন না যে, এখানেও স্বতন্ত্রভাবে এবং বিশেষভাবেই’ যুধিষ্ঠিরের নাম করতে হয়েছে। অন্যদিকে এই সংকট কালেও দ্রৌপদী যে ধর্মকেই শেষ অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছেন, সেই বহুমাননা করেও ভীষ্ম কিন্তু আবারও সেই যুধিষ্ঠিরকেই ন্যায়-নীতি বিচারের শেষ প্রমাণ বলে মনে করেছেন– যুধিষ্ঠিরস্তু প্রশ্নেহস্মিন প্রণামমিতি মে মতিঃ।

যে কারণে ভীষ্ম, এবং এমনকী দুর্যোধনও বার বার ‘স্বতন্ত্রভাবে এবং বিশেষভাবে, আলাদা করে যুধিষ্ঠিরের নাম করেছেন। আমার বিবেচনায় দ্রৌপদীও ওই একই কারণে যুধিষ্ঠিরের নাম আলাদা এবং স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করেছেন। কারণটা ভীষ্ম একবার যুধিষ্ঠির সম্বন্ধে বলেছেন, আবার অন্যত্র দ্রৌপদী নিজেই যুধিষ্ঠিরের সম্বন্ধে সে-কথা বলেছেন। ভীষ্ম এই দ্রৌপদীকেই বলেছিলেন– দরকার হলে যুধিষ্ঠির সমস্ত পৃথিবীও ত্যাগ করতে পারেন, কিন্তু ধর্ম ত্যাগ করবেন না– ত্যজেৎ সর্বাং পৃথিবীং সমৃদ্ধাং, যুধিষ্ঠিরো ধর্মমতো ন জহ্যাং। আর বনপর্বে এসে দ্রৌপদী নিজেই তার স্বামীর সম্বন্ধে বলেছেন আমি যা বুঝি তাতে তুমি ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, এমনকী নিজেকেও অথবা আমাকেও ত্যাগ করতে পার, কিন্তু ধর্ম ত্যাগ করতে পার না– ত্যজেমিতি মে বুদ্ধি ন তু ধর্মং পরিত্যজেঃ।

ধর্মের জন্য যুধিষ্ঠির এতটাই নিরপেক্ষ। এই নিরপেক্ষতা এমন এক প্রাবাদিক পর্যায়ে উন্নীত যে, দ্রৌপদী প্রথম দুঃশাসনের কবলে পড়ে অতিসংকটে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সম্বন্ধে যে-শব্দ উচ্চারণ করেন– ধর্মে হিতো ধর্মসুতো মহাত্মা– দুর্যোধন তার শত্রুপক্ষ হয়েও তার তর্ক-সংকটে সেই একই প্রবাদ-কল্প ব্যবহার করেন– ধর্মে হিতো ধর্মসুতো মহাত্মা। কাজেই দ্রৌপদীর পক্ষে স্বতন্ত্রভাবে এবং বিশিষ্টভাবে যুধিষ্ঠিরের নাম উচ্চারণের মধ্যে যদি অন্য কোনও মাহাত্ম্য আরোপ করতে হয়, তবে দুর্যোধন বা ভীষ্মের দিক থেকে যুধিষ্ঠিরের নাম পৃথকভাবে উচ্চারণ করার জন্য আমরা তার কোন মাহাত্ম্য স্মরণ করব? বস্তুত ধর্ম, এবং এক অতি পৃথক তথা স্বতন্ত্র ধর্মবোধই যুধিষ্ঠিরকে তার ভাইদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে, যার ফলে দ্রৌপদী, দুর্যোধন একই কারণে যুধিষ্ঠিরের নাম উল্লেখ করেন। এর মধ্যে যদি বুদ্ধদেবের দৃষ্টি-মতো দ্রৌপদীর ‘উত্তরোত্তর আরও বেশি সংশ্লিষ্টভাবে’ যুধিষ্ঠিরের ভার্ষায় উত্তরণ দেখতে পাই, তা হলে দুর্যোধন বা ভীষ্মের জন্যও আমাদের আরও সংশ্লিষ্ট কোনও সম্বন্ধ খুঁজে বার করতে হবে।

যুধিষ্ঠিরের সম্বন্ধে পৃথক এবং বৃহৎ আলোচনার অবসর যখন আসবে, তখন আরও সূক্ষ্মভাবে এসব কথা ধরবার চেষ্টা করব, তবে শুধু বুদ্ধদেব বসুর মতো মহোদয় ব্যক্তির প্রতিপক্ষতার গৌরবে অল্প হলেও এ-কথা বলতে হবে যে, দ্রৌপদী কোনওভাবেই উত্তরোত্তর আরও সংশ্লিষ্টভাবে যুধিষ্ঠিরের ভার্যারূপে প্রতিভাত হন না। যুধিষ্ঠির স্বক্ষেত্রে এতই বেশি বড়, এতই বেশি মহান এবং সেই কারণেই সুদূর আকাশে-আঁকা ইন্দ্রধনুটির মতো এতই তার দূরত্ব যে, তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে কারও পক্ষে সংশ্লিষ্টতায় উত্তরণ ঘটানো বড় কঠিন বলেই আমি মনে করি।

দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের স্ত্রী তো বটেই, কিন্তু এই জ্যেষ্ঠ-স্বামীর সঙ্গে তার ব্যবহারে একধরনের ‘ডিকটমি’ আছে। একদিকে যুধিষ্ঠির যেখানে তার সুদূর ধর্মমঞ্চে বসে আছেন, সেখানে দুঃশাসন এসে তার চুলের মুঠি ধরলেও, তিনি বলে ওঠেন– আমি ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের কথার মধ্যে গুণগুলি বাদ দিয়ে অণুমাত্র দোষও দেখতে চাই না, কারণ ধর্মের গতি সূক্ষ্ম এবং নিপুণভাবে তা লক্ষ করতে হয়; তিনি যা বুঝেছেন, আমি হয়তো তা বুঝতে পারছি না– বাঁচাপি ভর্তুঃ পরমাণুমাত্রম্ ইচ্ছামি দোষং ন গুণান বিসৃজ্য। অন্য দিকে এই সুদূর সম্মানিত ব্যবহারের লেশমাত্রও ছিল না, যখন দুঃশাসনেরও আগে প্রাতিকামী এসে দ্রৌপদীকে প্রথম রাজসভায় যেতে বলেছিল। দ্রৌপদী সারথি-জাতের প্রতিকামীর সামনেই রাজা যুধিষ্ঠিরের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে তার দূতাসক্তির ঘৃণ্যতা প্রমাণ করে বলেছিলেন– যাও সভায় গিয়ে সেই জুয়াড়িকে জিজ্ঞাসা করে এসো যে, সে নিজেকে আগে বাজি রেখে হেরেছে, না আমাকে গচ্ছ ত্বং কিতবং গত্বা সভায়াং পৃচ্ছ সূতজ?

এই মুহূর্তে দ্রৌপদী আপন কুলবধূর সম্মান বাঁচানোর জন্য আইনের ফাঁকে যুধিষ্ঠিরের অধিকার সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন। অর্থাৎ যুধিষ্ঠির যদি আগে কোনওভাবে নিজেকে বাজি রেখে হেরে থাকেন, তবে এই মুহূর্তে তার স্বামীত্বের অধিকার না থাকায় দ্রৌপদী খুশি হতে পারেন। কাহিনি যত এগিয়ে চলেছে, যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্রৌপদীর অধৈর্য আরও বেড়ে চলেছে বলে আমাদের মনে হয়েছে। সামগ্রিকভাবে যুধিষ্ঠির তাতে খারাপ হলেন, না ভাল হলেন– সে তর্কে আমি আপাতত যাচ্ছি না। কারণ, যুধিষ্ঠির এক বিশাল এবং ব্যাপ্ত মহামের মতো। শুধুমাত্র দ্রৌপদীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে তিনি খারাপ, না ভাল– সে প্রশ্নটির শুধু আলোচনা হতে পারে।

যুধিষ্ঠিরের সূক্ষ্ম ধর্মবোধের মতো বুদ্ধদেবের সাহিত্য বোধও বুঝি অতিশয় সূক্ষ্ম, এতটাই সূক্ষ্ম যে, আমার মতো অনধিকারীর পক্ষে তা ধরাও বুঝি মুশকিল। তবে পূর্বাপর বিচারে আমার যা মনে হয়েছে, তাতে সভাপর্বের পর কাহিনি যতই এগিয়ে চলেছে যুধিষ্ঠির সম্পর্কে দ্রৌপদীর অসহিষ্ণুতা ততই বেড়েছে। ইন্দ্ৰকল্প পাঁচস্বামীর পিছন পিছন তিনি বনে গিয়েছেন বটে, কিন্তু মনের রাগ তিনি মনে লুকিয়ে রাখেননি। দুঃশাসনের হাতে ধরা চুল তিনি খুলে রেখে দিয়েছেন সমস্ত অপমানের প্রতাঁকের মতো। বনে যাবার কিছুদিনের মধ্যে যখন কৃষ্ণ পৌঁছালেন পাণ্ডবদের কাছে, তখন দ্রৌপদী কৃষ্ণের সামনে ধিক্কার দিয়েছেন স্বামীদের। হয়তো অত্যন্ত ক্ষোভে অথবা চরম উদাসীনতায় যুধিষ্ঠিরের নামও তিনি করেননি। ভাবটা এই– তিনি যা করে ফেলেছেন, ফেলেছেন; কিন্তু কী হল এই ভীম আর অর্জুনের, যাঁদের একজন নিজের বাহুবলে আস্থাবান আর অন্যজন ধনুষ্মত্তায়– ধিক্ বলং ভীমসেনস্য ধিক্ পার্থস্য গাণ্ডীবম? বুদ্ধদেবের অনুকরণে কি এখানে বলব যে, পাঁচজনের মধ্যে যেন এঁদের ধরানো গেল না, স্বতন্ত্র এবং বিশেষভাবে এঁদের নাম করতে হল। যেন দ্রৌপদী নিজের রক্ষার জন্য এই দুই পাণ্ডবের ওপর বেশি নির্ভর করেন, যুধিষ্ঠির কিংবা নকুল-সহদেবের ওপর তার যেন কোনও ভরসাই নেই।

কাহিনি আরও যখন এগিয়ে চলেছে, দ্রৌপদীকে আমরা তখন আরও উত্তপ্ত দেখেছি। দ্বৈতবনের এক অরুণিত সায়াহ্নে দ্রৌপদীকে দেখছি যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে বিব্রত, বিরক্ত। তিনি কথা আরম্ভ করেছিলেন দুর্যোধনের দোষ এবং শকুনির কপটতা নিয়েই, যাতে স্বামীদের ওপরে, বিশেষত যুধিষ্ঠিরের ওপরে তার আক্ষেপ না আসে। ইন্দ্রপ্রস্থে পঞ্চ-স্বামীর সুখোচ্ছাস এবং এই বনে তাদের কষ্টকর জীবনের প্রতিতুলনার উল্লেখেই কথা সমাপ্ত হতে পারত। কিন্তু রাজনীতির বিষয়ে দ্রৌপদীর ভাল রকম পড়াশুনো থাকায় তিনি সর্বংসহ প্রাদের উক্তি শুনিয়েছেন যুধিষ্ঠিরকে। শুনিয়েছেন প্রহ্লাদের মতো নরম মানুষও সময়কালে দণ্ডের প্রশংসা করেছেন, ক্ষমার নয়। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর কথা শোনেননি, কারণ তার সেই চিরন্তন ধর্মবোধ, সেই চিরন্তনী ক্ষমার মহত্ত্ব। দ্রৌপদী হাল ছেড়ে দিয়েছেন তার জ্যেষ্ঠ-স্বামী সম্পর্কে বলেছেন তুমি ধর্মের জন্য নিজেকে, নিজের সমস্ত ভাইদের, এমনকী আমাকেও ত্যাগ করতে পার– ভীমসেনাৰ্জুনৌ চেমৌ মাদ্রেয়ৌ চ ময়া সহ–কিন্তু ধর্ম ত্যাগ করতে পার না।

দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের এই বিশাল ভারবত্তা এবং মহত্বের দূরত্ব জানেন। কিন্তু সে তার সহ্যের বাইরে–

যত বড় হোক ইন্দ্রধনু সে।
সুদূর আকাশে আঁকা,
আমি ভালবাসি মোর ধরণীর
প্রজাপতিটির পাখা।

ধর্মে চিরস্থিত মহান যুধিষ্ঠিরের বিশালতা দূরে সরিয়ে দিয়ে দ্রৌপদী তার স্বামীর কাছাকাছি আসতে চেষ্টা করেছেন। ঝগড়া করে বলেছেন– এত সরল, এত মৃদু, এত বদান্য অথবা এত সত্যবাদী তুমি– অথচ সেই তোমার মতো এক মানুষের একটা জুয়াড়ির মতো জুয়ো খেলার দোষটি ঘটল কেন– কণ্বমক্ষ-ব্যসনজা বুদ্ধিরাপতিতা তব? সময় বুঝে পাঞ্চালী কৃষ্ণাও কত ধর্মের উপদেশ শুনিয়ে দিলেন যুধিষ্ঠিরকে। তবু যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর মনের কাছাকাছি আসেননি। স্ত্রীর সুমহান উপদেশের মধ্যে নাস্তিক্যের দোষারোপ করে তিনি শেষ আদেশ জারি করেছেন– বিধাতার বিধানকে ‘চ্যালেঞ্জ’ কোরো না, খোদার ওপর খোদকারি কোরো না– ঈশ্বরঞ্চাপি ভূতানাং ধাতারং মা চ বৈ ক্ষিপ। আরও শেখো আরও নত হওয়ার চেষ্টা করো, এমন বুদ্ধি ভাল নয় মোটেই– শিক্ষস্বৈনং নমস্বৈনং মা তে ভূদ বুদ্ধিরীদৃশী।

নিজের কথা একটুও শুনছেন না, এমন মানুষকে দ্রৌপদী গভীর চুম্বনে পবিত্র করে তোলেননি। তিনি অদৃষ্টবাদী নন, অতএব পুনরায় তিনি তাকে শত্রুর বিরুদ্ধে জেগে উঠতে বলেছেন। বলেছেন– রাজনীতির ফলের জন্য চেষ্টা প্রয়োজন, যত্ন প্রয়োজন। তোমার মতো যারা বিধাতা আর অদৃষ্ট নিয়ে শুয়ে থাকে, তাদের অলক্ষ্মীতে ধরে আর কিছু নয়– অলক্ষ্মীরাবিশত্যেনং শয়ানম অলসং নরম।

দুঃখের বিষয়–দ্রৌপদী এখনও আমার কাছে যথার্থ যুধিষ্ঠিরের ভার্যারূপে প্রতিভাত হচ্ছেন না। অপিচ কোনও ‘নিগূঢ় আকর্ষণ’ও তাকে যুধিষ্ঠিরের কাছাকাছি নিয়ে আসছে। বলে আমার মনে হয়নি। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দ্রৌপদীর এই রাজনৈতিক তর্কযুদ্ধের পর-পরই অর্জুন চলে গেলেন তপস্যায় পাশুপত অস্ত্রের সন্ধানে। দ্রৌপদীর মনের অবস্থা তখন কী হয়েছিল– তা পূর্বেই দেখিয়েছি। বছরের পর বছর অর্জুন-হীন জীবন আর দিনের পর দিন যুধিষ্ঠির মুনি-ঋষিদের কাছে পুরাণ-কাহিনি, অধ্যাত্ম-কথা শুনে যাচ্ছেন। এরই অবধারিত ফল- দ্রৌপদী অতিষ্ঠ হয়ে অর্জুনের জন্য একদিন কেঁদে উঠেছেন আমার কিছু ভাল লাগছে না, অর্জুনকে ছাড়া একটুও ভাল লাগছে না, অর্জুন ছাড়া আমার কাছে সব শূন্য শূন্যামিব প্রপশ্যামি তত্র তত্র মহীমিমাম্।

ঠিক এই ধরনের হাহাকার দ্রৌপদীর মুখে আর দ্বিতীয়বার শুনেছি কিনা সন্দেহ। এই বিলাপোক্তির সঙ্গে ভীম, নকুল এবং সহদেব– তিন ভাইই সুর মিলিয়েছেন, কিন্তু যুধিষ্ঠির নন। অবশ্য তিনি পরে একই কথা বলেছেন, কিন্তু ভাইদের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ সুর মেলাননি৷ আপন অধ্যাত্ম স্বাতন্ত্রে তখনও তিনি স্থিতধী। ভেবেছেন বুঝি– মেয়েরা ওরকম কাঁদেই বটে। কিন্তু কৃষ্ণা পাঞ্চালীর সঙ্গে ভাইয়েরা যোগ দেওয়ায় যুধিষ্ঠির কিছু চিন্তিত হলেন– ধনঞ্জয়োৎসুকানান্তু ভ্রাতৃণাং কৃষ্ণয়া সহ। সবার মন ভোলানোর জন্য নারদের পরামর্শে যুধিষ্ঠির সবাইকে নিয়ে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ালেন। ঘুরে ঘুরে দ্রৌপদী শ্রান্ত, ক্লান্ত। কিন্তু এরই মধ্যে খবর এসে গেছে অর্জুনের অস্ত্রপ্রাপ্তি সম্পূর্ণ, তিনি আসছেন। দ্রৌপদীকে আর রাখা যায়নি, হিমালয়ের কঠিন বন্ধুর পথে তার পা চলে না। তবু তাকে রাখা যায়নি। যুধিষ্ঠির বলেছেন– তুমি এখানেই দ্রৌপদীকে নিয়ে থাক ভীম। তোমার গায়ে জোর আছে, তুমি সহদেব, ধৌম্য– এঁদের নিয়ে এখানে থাক, নইলে এত কষ্ট করে কৃষ্ণা পাঞ্চালী যাবেন কী করে?

দিনের পর দিন নিত্যসঙ্গের ফলে দ্রৌপদীর মন যদি এইভাবে বুঝে থাকেন যুধিষ্ঠির, তা হলে কী করেই বা বলি- পাঁচের মধ্যে একের নাম করতে হলে ‘যুধিষ্ঠিরকেই তার মনে পড়ে। আর ভীমসেন, যাকে বুদ্ধদেব ভেবেছেন বড়ই স্কুল, দ্রৌপদীর ‘আজ্ঞাবহ’ অথবা ‘প্রধানত এক মল্লবীর’– তিনি কিন্তু দ্রৌপদীর মতো এক বিদগ্ধা রমণীর মন বোঝেন। এই স্থূল মল্লবীর জানেন– ‘অনবরত ভ্রাম্যমাণ’ যুবকটির ওপর এই রমণীর কী গভীর দুর্বলতা। যুধিষ্ঠিরের প্রস্তাব শেষ হতে না হতেই তিনি জানিয়েছেন– হ্যাঁ, পথশ্রম, কিংবা শারীরিক কষ্ট অবশ্যই হচ্ছে, তবে দ্রৌপদী যে যাবেনই, তিনি যে অর্জুনকে দেখতে পাবেন–ব্রজত্যেক হি কল্যাণী শ্বেতবাহ-দিদৃক্ষয়া। দ্রৌপদী গেছেন, হিমালয়ের কনকনে হাওয়ায় আর পথশ্রমে দ্রৌপদী একবার অজ্ঞানও হয়ে গিয়েছেন, কিন্তু তবু গেছেন। ভীমের ছেলে ঘটোৎকচের কাঁধে বসে চলতে চলতে শেষে বুঝি তার ভালই লাগছিল। অর্জুন আসবেন, কী ভাল যে লাগছে! এখন আর বন্ধুর পার্বত্য ভূমিতে হাঁটার কষ্ট নেই, শুধু সামান্য অপেক্ষার আনন্দ। হিমালয়ের পর্বত, বিজন অরণ্যানী– সে যেমন এখনও মধুর তেমনই সেদিনও ছিল অপূর্ব। বনভূমি ফল-ফুলের শোভায় উপচে পড়ছে, আর কৃষ্ণা পাঞ্চালীর মনে তখন শুধু অর্জুনের দিদৃক্ষা– কতদিন পর তার সঙ্গে দেখা হবে।

ঠিক এইরকম একটা মানসিক পরিমণ্ডলের মধ্যে মন যখন আপনিই উদার হয়ে যায়– ঠিক তখনই কোথা থেকে উড়ে এসে একটি মাত্র সুর-সৌগন্ধিক, সোনার বরণ পদ্ম দ্রৌপদী পায়ের কাছে এসে পড়েছিল। আনন্দের আতিশয্যে দ্রৌপদীর সেটি উপহার দিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরকে। বুদ্ধদেবের মনে হয়েছে– যুধিষ্ঠির আর দ্রৌপদীর জীবন-বন্ধনে এই উপহার বুঝি এক বিরাট ঘটনা, বিরাট প্রতীকী ঘটনা বহুভর্তৃকা দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকেই তার স্বামী হিসেবে মনে মনে এতদিন লালন করতেন বলেই যেন দ্রৌপদীর দিক থেকে এই স্বর্ণপদ্মের উপহার। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের এরকম মনে হয় না। হ্যাঁ, এমন তো হতেই পারে যে বিদগ্ধা রমণী পঞ্চস্বামী নিয়ে ঘর করেন এবং যার অন্তরের কেন্দ্রভূমিতে অর্জুনের মতো এক বিরাট স্বপ্ন আছে– তিনি তার জ্যেষ্ঠ-স্বামীটির সম্বন্ধে এমন তো ভাবতেই পারেন- আহা! এই মহান পুরুষটির হৃদয় তো আমি কোনও দিন ভাল করে লক্ষ করিনি, সারা জীবন ধর্ম ধর্ম করে গেল, শত্রুপক্ষের অন্যায় আচরণের জন্য কতই না গালাগালি দিয়েছি এঁকে! নিজের স্ত্রীর কাছেও কৃতই না লাঘব সহ্য করতে হয়েছে এই মহান ব্যক্তিটিকে! দ্রৌপদী ভাবতেই পারেন। উদগ্র নীতিবোধ, অতি-প্রকট সাধুতা– এ-সব আমার অপমানের নিরিখে আমার কাছে যতই কষ্টের হোক, যুধিষ্ঠির মানুষটা তো খারাপ নয়।

না, এ-সব কথা মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে উচ্চারণ করেননি। কিন্তু স্বর্ণপদ্মের উপহারে আর যাই হোক, যুধিষ্ঠিরের ভার্যাত্ব-প্রমাণের তাগিদ দ্রৌপদীর ছিল না। বরঞ্চ উদারতা ছিল। যে বীর স্বামীর সম্বন্ধে মনে মনে তার একান্ত অপ্রাপ্তির বেদনা ছিল, তার সঙ্গে দেখা হবে– এই আনন্দই তাকে সেদিন আকস্মিকভাবে যুধিষ্ঠিরের প্রতি উদার করে তুলেছিল। এই ঔদার্যের আরও একটা কারণ আছে। সেটা হচ্ছে অনায়ত্ততা। যুধিষ্ঠিরকে তিনি কোনওদিনই ভাল করে আয়ত্ত করতে পারেননি। হ্যাঁ, অর্জুনকেও পারেননি। এমনকী তথাকথিত ভাবনাটি যদি মেনেও নিই, অর্থাৎ একজন ‘নিত্যসঙ্গী’ অন্যজন ‘অনবরত ভ্রাম্যমাণ’। এক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণের ওপর দ্রৌপদীর হৃদয়ের যে দুর্বলতা ছিল, নিত্যসঙ্গীর ওপর তা ছিল না। কিন্তু দুর্বলতা না থাকলেও একজন বলিষ্ঠ পুরুষমানুষ– হোক না তার বলিষ্ঠতা নীতি অথবা ধর্মের দিক থেকেই শুধু প্রবল– তবু তিনি দ্রৌপদীর মতো একজন বিদগ্ধা রমণীর আয়ত্ত হবেন না– এটা কি দ্রৌপদীরই অভিপ্রেত ছিল?

স্বর্ণপদ্মের উপহার যুধিষ্ঠিরের ভাগ্যে জুটেছে দ্রৌপদীর ক্ষণিক-উচ্ছ্বাসের অঙ্গ হিসাবে, অথবা মাঝে মাঝে তিনি নিত্যসঙ্গী যুধিষ্ঠিরের মনের কাছে আসতে চেষ্টা করেছেন, তারই সুফল হিসেবে অথবা আমাকে যদি আরও স্বাধীনতা দেওয়া যায়, তবে বলব– অনেকদিন পর অর্জুনের দেখা পাবেন বলে সব কিছুই যখন তার কাছে উদার মাধুর্যে ধরা দিচ্ছে, সেই উদার-ক্ষণের উচ্ছ্বাসেই দ্রৌপদী স্বর্ণপদ্মের উপহার দিয়েছেন যুধিষ্ঠিরকে।

অন্যদিকে ব্যাপারটা যুধিষ্ঠিরের দিক থেকেও দেখুন। দ্রৌপদী বহু-ভর্তৃকা হলেও আসলে তিনি আমারই– এমন কোনও স্বাধিকার বোধ কি তার দিক থেকে ছিল? স্বর্ণপদ্মের উপহারে তিনি একটুও বিগলিত হননি। মহাভারতের কবি একটি শব্দও ব্যয় করেননি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে দ্রৌপদীর উপহার দেওয়ার ছবিটি তুলে রাখতে। শুধু একটা সংবাদের মতো আমাদের তিনি জানিয়েছেন দ্রৌপদী পদ্মফুল নিয়ে গেলেন ধর্মরাজের কাছে– জগাম পুষ্পমাদায় ধর্মরাজায় তত্তদা। ব্যাস, এরপর থেকেই কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন চলে গেছেন সেই ভীমসেনের বর্ণনায় যিনি দ্রৌপদীর ইচ্ছামাত্রে আরও স্বর্ণপদ্ম জোগাড় করতে চললেন অথবা দ্রৌপদীর ওপর ভালবাসায় তিনি কী করলেন, কতটা করলেন তার অনুপুঙক্ষ বিবরণে। যুধিষ্ঠির এবং স্বর্ণপদ্মের কথা আর একবারও ওঠেনি। উপহার পাওয়ার পর যুধিষ্ঠিরের সামান্য প্রতিক্রিয়াও স্থান পায়নি ব্যাসের লেখনীতে। ভীমের জন্য ব্যাসের এত সহানুভূতি কেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেল একটিমাত্র পক্তিতে। ভীমকে অনেকক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, যুধিষ্ঠির উতলা হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ভীম কোথায়, পাঞ্চালী! কোথায় সে, কী কাজে গেছে? কৃষ্ণা পাঞ্চালী বললেন– সেই যে সেই সোনার বরণ পদ্মখানি, মহারাজ! যৎ তৎ সৌগন্ধিকং রাজন- সেটা হাওয়ায় উড়ে এসে পড়েছিল বটে কিন্তু সেটা ভীমই আমাকে এনে দিয়েছিল– আমি বলেছি– আরও যদি এমন ফুল দেখ তো নিয়ে এস আমার জন্য।

এইটুকুই। দ্রৌপদীর উপহার পেয়ে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কোনও ভাব-বিকার আমরা দেখিনি। কিন্তু দ্রৌপদীর ইচ্ছা, শুধু একটা ইচ্ছার জন্য ভীমসেনকে কত মারামারি, কত গিরি-দরি-গুহা আমরা লঙ্ঘন করতে দেখলাম। যুধিষ্ঠির ভাইদের আর দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে ভীমকে খুঁজতে খুঁজতে যখন সেই পদ্ম-সরোবরের কাছে এসে পৌঁছলেন, তখন দেখলাম সরোবরের তীরে রক্ষী-প্রতিম যক্ষ-রাক্ষসদের মেরে গদা উঁচিয়ে রেগে অন্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ভীমসেন। যুধিষ্ঠির ভাইকে আলিঙ্গন করে মহাস্থবির ধর্মজ্ঞের মতো বললেন– এমন সাহস আর দ্বিতীয়বার কোরো না, যদি আমার মনের ইচ্ছা অনুসারে কাজ করতে চাও তত দ্বিতীয়বার এমন ব্যবহার কোরো না– পুনরেবং ন কৰ্ত্তব্যং মম চেদ ইচ্ছসি প্রিয়ম।

আর দ্রৌপদী ভীমকে কী বলেছিলেন? যদি আমি তোমার ভালবাসার মানুষ হই, ভীম– তা হলে এইরকম পদ্মফুল আরও আমাকে এনে দাও– যদি তেহং প্রিয়া পার্থ বহুনীমানুপাহর। মনে রাখবেন, ভীমের আনা পদ্মফুল দ্রৌপদী উপহার দিয়েছেন যুধিষ্ঠিরকে। তাতে বিন্দুমাত্র পুলকের প্রকাশ না ঘটিয়ে শুধুমাত্র দ্রৌপদীর প্রীতির জন্য সৌগন্ধিক পদ্মের অন্বেষায় ব্যস্ত ব্যক্তিটিকে যুধিষ্ঠির বলছেন– আমার পছন্দের কথা যদি ধর, তা হলে এমন কাজ যেন দ্বিতীয়বার কোরো না। এতে ভাইয়ের প্রতি যুধিষ্ঠিরের স্নেহ যতই প্রকট হয়ে উঠুক, দ্রৌপদীর উপহারের মর্যাদা এখানে কতটুকু প্রকাশ পেল? বিদগ্ধা প্রণয়িনীর ইচ্ছার মূল্যই বা কতটুকু থাকল?

আসলে এই উপহারের ব্যাপারটা বুদ্ধদেব অনর্থক বড় প্রতীকী করে তুলেছেন। কৃষ্ণা পাঞ্চালী আর যুধিষ্ঠিরের সম্পর্কে এত জটিলতা কিছু নেই। যুধিষ্ঠির তার আজন্মলালিত ধর্মীয় তথা ন্যায়নীতির সংস্কারেই হোক, অথবা পিতৃবিয়োগের পর জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে আপন জননী এবং ভাইদের একান্ত-নির্ভর হিসেবেই হোক অথবা শত্রুপক্ষের জটিল ব্যবহারে বার বার অভিজ্ঞ হয়ে ওঠার ফলেই হোক, জগৎ সংসারে তিনি যেন কেমন বুড়ো মানুষটির মতো হয়ে গিয়েছিলেন। দ্রৌপদীর সঙ্গে তার বয়সের যে বড় বেশি ফারাক ছিল, তা নয়; তবে স্ত্রীর ওপর তার ব্যবহারটি ছিল বয়স্ক স্বামীর মতো। ভাইদের তিনি যে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন, দ্রৌপদীকেও তিনি সেই স্নেহেই দেখতেন। দ্রৌপদী তাঁর কাছে নিতান্তই এক সংস্কারের মতো, ধর্মপত্নীর সংস্কারে বাঁধা, তার বেশি কিছু না। আর ঠিক এই কারণেই বক যক্ষের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির যখন বলেন- গৃহে মিত্র ভার্যা, দৈবকৃত সখা ভার্যা, আর উপরন্তু ‘ধর্ম অর্থ কাম– এই তিন পরস্পর বিরোধীর সংযোগ ঘটে শুধু ধৰ্মচারিণী ভার্যার মধ্যে’– এইসব কথার মধ্যে আমরা শুধু শাস্ত্রবচনের নীতিযুক্তিই অনুভব করি, দ্রৌপদীর সঞ্চার আমরা অনুভব করি না। মহাভারতে এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে দ্রৌপদীর প্রণয়-সঞ্চারে তিনি কোনও ধর্ম-যুক্তি লঙ্ঘন করেছেন অথবা তার মত পরিবর্তন করেছেন। বক-যক্ষের অতগুলি প্রশ্ন এবং যে প্রশ্নগুলির একটারও বেঠিক উত্তর তার স্নেহের ভাই এবং প্রিয়া পত্নীকে মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দিতে পারত, সেইখানে সেই বিশাল নীতিশাস্ত্রীয় প্রহেলিকা সমাধানের সময় যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর ব্যক্তিগত সঞ্চার অনুভব করবেন– এমন মানুষই তিনি নন। যক্ষের প্রশ্ন এবং যুধিষ্ঠিরের উত্তরগুলি যদি সেভাবে দেখতে হয়, তা হলে বলতে হবে যুধিষ্ঠির যক্ষের শত প্রশ্নের উত্তরে শতবার শত-পরিচিত মানুষের ব্যক্তিগত সঞ্চার অনুভব করে থাকবেন। বস্তুত আমাদের চির-পরিচিত সংসারের সাধারণ তুলাদণ্ড দিয়ে দ্রৌপদীর প্রতি যুধিষ্ঠিরের ব্যবহার পরিমাপ করা বড়ই কঠিন। ভারতবর্ষের ধর্ম এবং দর্শন বাদ দিয়ে শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকের দৃষ্টিতে যুধিষ্ঠিরের চরিত্র বিশ্লেষণ করা একান্ত অসম্ভব। কারণ তিনি বড় বেশি স্বতন্ত্র, বড় স্বতন্ত্র-স্বভাব, নির্বিগ্ন।

এত কথা বলেও আমি কিন্তু এটা বলছি না যে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে ভালবাসতেন না, অথবা দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে। বহুভর্তৃকা দ্রৌপদী তার পঞ্চস্বামীর সঙ্গে কখন, কী ব্যবহার করেছেন আমি সংক্ষেপে তার একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি– উদ্যোগপর্বে কৃষ্ণের দুতিয়ালির আগে পর্যন্তও দ্রৌপদী তার স্বামীদের কাছে নিজের অসহ্য অপমানের বিষয়ে সুবিচার পাবেন বলে মনে করেননি। কিন্তু যার কাছে সেই সুবিচার পাবেন বলে মনে করেছেন, অথবা যিনি এই বিদগ্ধা রমণীর স্বামী না হওয়া সত্ত্বেও তার মন বুঝেছেন, সেই ব্যক্তিটির সঙ্গে দ্রৌপদীর সম্পর্কটাও অদ্ভুত অদ্ভুত সুন্দর। আসছি সে কথায়, দ্রৌপদী তার প্রিয়তম অর্জুনের একান্ত ভালবাসা পাননি, ভীমসেন আজ্ঞাবহ– দ্রৌপদীর প্রেমে তিনি বিকিয়েই আছেন, যুধিষ্ঠির বৈচিত্র্যহীন নিত্য সাহচর্যের দৈনন্দিনতায় স্বামীত্বের অভ্যাসমাত্র, আর বলাই বাহুল্য, দ্রৌপদীর প্রেমের ক্ষেত্রে নকুল-সহদেব বড় বেশি বিবেচ্য নন। তাঁরা বৎসলা রমণীর স্নেহপাত্ৰ-মাত্র।

তা হলে দ্রৌপদী কী পেলেন? তিনি প্রিয়তম অর্জুনের প্রত্যক্ষ ভালবাসা পাননি, পঞ্চস্বামীর অসম রসবোধ তাকে ভাগ করে নিতে হয়েছে, তাদের সারাজীবনের কষ্টের ভাগের সঙ্গে। বদলে তিনি পেয়েছেন শুধু সম্মান, ক্ষাত্র-রমণীর সম্মান, বীরপত্নীর সম্মান, শত্রুকুলের সর্বনাশের সম্মান। এমনকী যখন তার প্রিয় পুত্রগুলিও মারা গেছে, তখনও তার কোনও বৈরাগ্য কিংবা নির্বেদ আসেনি; তখনও তিনি পুত্রহন্তা অশ্বত্থামার প্রাণ চেয়েছেন। পুত্রহত্যার প্রতিশোধ-স্পৃহায় তিনি সটান উপস্থিত হয়েছেন পাণ্ডব-শিবিরে যুধিষ্ঠিরের কাছে। হস্তিনাপুরের ভাবী মহারাজের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে দ্রৌপদী তার বাক্যশূল প্রয়োগ করলেন সমস্ত স্বামীদের হৃদয়েই প্রতিশোধ-স্পৃহায়।

তবে হ্যাঁ এখানেও, এই যুদ্ধপর্বের শেষ মুহূর্তেও একটা জিনিস লক্ষ করার মতো। ঝড়ে-পড়া কলাগাছের মতো দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের সামনে এসেইন্যপতৎ ভুবি– মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়লেন। তাঁর মুখটি শোকে কালিমাখা। অন্য কোনও কবি হলে দ্রৌপদীর মুখের উপমা দিতেন রাহুগ্রস্ত চাঁদের সঙ্গে। কিন্তু ব্যাস বললেন– তমোগ্রস্ত ইবাংশুমান অর্থাৎ তার মুখখানি অন্ধকারে ঢাকা সূর্যের মতো। সূর্য ছাড়া এই ভাস্বর মুখের তুলনা হয় না। দ্রৌপদী পড়েই গিয়েছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই ভীম একলাফে তাকে ধরে নিলেন বাহুর বন্ধনে বাহুভ্যাং পরিজগ্রাহ সমুৎপত্য বৃকোদরঃ। কণ্বঞ্চিৎ শান্ত হবার পর দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে বললেন– মহারাজ! সমস্ত ছেলেগুলোকে কালের গ্রাসে নিক্ষেপ করে বেশ তো রাজ্য-ভোগ করবেন মনে হচ্ছে। সমস্ত পৃথিবীর রাজা হয়ে আজকে সুভদ্রার ছেলেটাকে ভুলে গেলেন কী করে অবাপ্য পৃথিবীং কৃৎস্নাং সৌভদ্রং ন স্মরিষ্যসি! আপনি আজই। যদি ওই পাপিষ্ঠ অশ্বত্থামার জীবন না নিতে পারেন, তা হলে আমি উপোস করে মরব।

যুধিষ্ঠির স্বভাবতই মিন মিন করা আরম্ভ করলেন। দ্রৌপদী বললেন– ওকে প্রাণে মারা না। গেলেও ওর মাথার সহজাত মণিটি আমায় এনে দিতে হবে। দ্রৌপদী বুঝলেন– এরা কেউ এগোবে না, তিনি সোজা তার বশংবদ ভীমসেনকে ধরলেন এবং যথারীতি ভীম চললেনও। কাজটা সহজ ছিল না। কৃষ্ণ সঙ্গে সঙ্গে অর্জুনকে পাঠালেন, নিজেও গেলেন। অশ্বত্থামার সমস্ত সম্মানের প্রতীক, মণি আদায় হল এবং শুধুমাত্র নিজের জেদে সেই মণি যুধিষ্ঠিরের মাথায় ঝুলিয়ে শান্তি পেলেন কৃষ্ণা। তার এই জেদের সাক্ষী মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেন কিন্তু মণিটি দেবার সময় কতগুলি কথা বলেছিলেন এবং তার বাক্যশেষের ব্যঞ্জনাটি ছিল– তাও কি তুমি খুশি হওনি? আর কী চাই? ভীম বলেছিলেন এই নাও তোমার মণি– অয়ং ভদ্রে তব মণিঃ–পুত্রহন্তা অশ্বত্থামা পরাজিত। তোমার কি মনে পড়ে দ্রৌপদী! সেই যখন শান্তির দূত হয়ে কৃষ্ণ যাচ্ছিলেন কৌরবসভায় আর তুমি বলেছিলে– যুধিষ্ঠির আজ যেভাবে শান্তির কথা বলছেন, তাতে বুঝি আমার স্বামীরা বেঁচে নেই, আমার ছেলে নেই, ভাই নেই, এমনকী তুমিও নেই। দ্রৌপদী! তুমি সেদিন বড় কঠিন কথা বলেছিলে কৃষ্ণকে। মনে রেখ কৃষ্ণকে আমরা পুরুষোত্তম বলে মানি। সেই তাকে তুমি কী ভাষাতেই না অপবাদ দিয়েছিলে– উক্তবত্যসি তীব্রাণি বাক্যানি পুরুষোত্তমে। হতে পারে– সেসব কথা ক্ষত্রিয় ধর্মের অনুরূপ। কিন্তু আজ দেখ– দুর্যোধন মৃত, আমি কথা রেখেছি। দুঃশাসনের রুধির পান করেছি। আমি কথা রেখেছি। দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামার সমস্ত যশের নিদান এই মণিও তোমাকে এনে দিলাম।

ভীম এইখানে কথা শেষ করেছেন এবং আমার বিশ্বাস– এই বাক্যের অবশেষ দ্রৌপদীকে বলা যায় না। বলা গেলে শেষ কথা ছিল– আর কী চাও? এবার অন্তত যুদ্ধ বন্ধ হোক। ভীম বলেছেন- দ্রৌপদীর কথা নাকি ক্ষত্রিয় ধর্মের অনুরূপ, আমি বলি– আজীবন দ্রৌপদীর ব্যবহার প্রায় পুরুষ-ক্ষত্রিয়ের মতো। তিনি যতখানি রমণী তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষত্রিয়া কিংবা ক্ষত্রিয়াণী। তিনি যতখানি প্রেমিকা, তার চেয়ে পাঁচ স্বামীর জীবনে অনেক বড় ঝটিকা। পাণ্ডবেরা তাদের রাজ্যহরণে কিংবা ধন-রত্নহরণে তত দুঃখ পাননি, যতখানি পেয়েছেন অপমানিতা কৃষ্ণার বিদ্যুৎসঞ্চারী কটাক্ষে- হৃতেন রাজ্যে তথা ধনেন রত্নৈশ্চ মুখ্যৈ ন তথা বভূব। যথা ত্রপাকোপ-সমীরিতেন কৃষ্ণাকটাক্ষেণ বভূব দুঃখম ॥

দ্রৌপদীর কটাক্ষের কথা বারবার বলছি বটে, কিন্তু সারা জীবন ধরে স্ত্রীলোকের কটাক্ষ নিয়ে যত ভাল-মন্দ কথা-বার্তা শুনেছি, সে-কটাক্ষের তাৎপর্য সবটাই রসশাস্ত্রীয় ভাবনার মধ্যে নিহিত। সত্যি বলতে কী, সেই তাৎপর্যের একটা শাস্ত্রীয় সংকীর্ণতাও আছে। কবিরা যেমন রমণীর কটাক্ষ নিয়ে বাড়াবাড়ি করবেনই, হয়তো বা বলবেন এমন কথাও যে, পুরুষ মানুষেরা ততদিনই সৎপথে থাকবে, ইন্দ্রিয়-সংযমের ব্যাপারে ততদিনই তাদের চেতনা থাকবে এবং শিক্ষা-দীক্ষার বোধও থাকবে ততদিনই, যতদিন তাদের ওপর লীলাবতী মেয়েদের কটাক্ষ-দৃষ্টি না এসে পড়ে। দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে তার কটাক্ষ ব্যাপারটা কিন্তু এমন লাস্যময় মোহ-তাৎপর্যে ধরা পড়ে না, বরঞ্চ মুহূর্তে সেটা এক গভীর ব্যক্তিত্বের প্রতিরূপ হয়ে ওঠে। এই কটাক্ষের মধ্যে যে রসশাস্ত্রের কোনও মহিমা নেই তা নয়, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আছে ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ। কৃষ্ণা দ্রৌপদীর পাঁচ-পাঁচজন স্বামী এই মনোহর কঠিন কটাক্ষপাতে মাঝে মাঝেই ন্যুজ হয়ে স্বকর্তব্যে নিযুক্ত হয়েছেন, সেটা বলাই বাহুল্য কিন্তু এই কটাক্ষের গতিপথ আরও দূরে প্রসারিত, অর্থাৎ স্বামী নামক প্রতিষ্ঠান খণ্ডিত করে তা অনুক্ত প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে অন্য স্থানেও।

পরবর্তীকালে এক মহা-সুচতুর কবি দ্রৌপদীর নাম উচ্চারণ না করেও এক ব্যক্তিত্বময়ী রমণীর বিলাস লক্ষ করে সংশ্লেষে বলেছিল– তোমার বাঁকা চোখের চাউনিতে এমন অদ্ভুত এক সৌন্দৰ্য আছে, যা নাকি মহাভারতের জটিল কাহিনির মতোই বহুবর্ণ এবং বহুবিচিত্ৰগতি। ঠিক এই জায়গায় শব্দশ্লেষ করে কবি লিখেছেন– এই অপাঙ্গ-দৃষ্টির মধ্যে কৃষ্ণ আর অর্জুনের গুণ আছে- কৃষ্ণ শব্দের একটা অর্থ কালো, অর্জুন মানে সাদা, অর্থাৎ কখনও সে চোখে কৃষ্ণবর্ণের আধিক্য কখনও বা তা স্বচ্ছ-সাদা, ভাবলেশহীন ক্কচিৎ কৃষ্ণার্জুনগুণা। এখানে দ্বিতীয় অর্থ হল– গুণ মানে ধনুকের ছিলা। এ এমনই ভুরুর ধনুক যে ধনুকের ছিলার মধ্যে কখনও শার্গধর কৃষ্ণের ক্ষমতা দেখা যাচ্ছে, কখনও বা অর্জুনের ক্ষমতা দেখা যাচ্ছে, অর্থাৎ দ্রৌপদী কখনও কৃষ্ণপক্ষপাতী কখনও অর্জুনের দিকে হেলে আছেন। আবার এই ধনুকের ছিলা টেনে বাণ মারার সময় ছিলাটা কান পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া যায় অন্য অর্থে কর্ণ– দ্রৌপদীর মানস-হৃদয় নিয়ে টানাটানি করলে অন্তত তাঁর কটাক্ষ তো– কর্ণ পর্যন্তও পৌঁছে যেতে পারে– ক্কচিৎ কৃষ্ণার্জুনগুণা কচিং কর্ণান্তগামিনী।

দ্রৌপদীর একটা কটাক্ষ নিয়ে দ্ব্যর্থক শ্লেষবাক্যে মহাভারতের তিনটি প্রধান নায়কের নাম উঠে এল, এমন শ্লেষালংকার ভাগ্যি জীবনে ছাত্রদের কাছে ব্যাখ্যা করতে হয়নি। কিন্তু এটা মানতে হবে যে, অর্জুনকে যদি দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর একক প্রতীক হিসেবেও গ্রহণ করি, তা হলে তিনিও যে এ-হেন কটাক্ষে মাঝে মাঝেই ভঙ্গুর হতেন, তা আমরা বারংবার দেখিয়েছি, কিন্তু এই কটাক্ষ-সূত্রে কৃষ্ণের নামও জড়িয়ে গেল, জড়িয়ে গেলেন এমনকী কর্ণও ক্কচিৎ কর্ণান্তগামিনী– এটা বড়ই আশ্চর্য ব্যাপার। কৃষ্ণের নামটা জড়িয়ে গেলেও ব্যাখ্যা করতে অসুবিধে হয় না, কিন্তু কর্ণ এই কটাক্ষ-ভঙ্গীর আওতায় আসেন কী করে? এই প্রশ্নের সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করার আগে, আমাদের একটু মৌখকতার ঐতিহ্য ছুঁয়ে নিতে হবে। এই সেদিনও এক বিদ্বৎসভার আসরে ভাষণ-শেষে এক মহাভারত-কৌতূহলী মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন– আচ্ছা! আপনি তো মহাভারত নিয়ে অনেক ইয়ে টিয়ে করেন, তো আপনি কি বলতে পারেন যে, কর্ণের ওপর দ্রৌপদীর কোনও দুর্বলতা টতা ছিল কিনা? ভদ্রমহিলার শব্দক্ষেপেই বুঝতে পারা যায় যে, তার নিজেরই খুব বিশ্বাস নেই এব্যাপারে। আমি বললাম- দেখুন, মূল মহাভারত পড়ে কোনও ভাবেই কর্ণের প্রতি দ্রৌপদীর সামান্য দুর্বলতাও প্রমাণ করা যাবে না, বরঞ্চ উলটো দিকে দ্রৌপদীর নানান ব্যাপারে কর্ণের আক্রোশ, বারংবার অযথার্থভাবে তাকে ভুগিয়ে মারার ইচ্ছা এবং কোনও কোনও বক্রোক্তিতে কর্ণের মুখে দ্রৌপদীর প্রশংসাও– এগুলিকে এক ধরনের বিপ্রতীপ আকর্ষণের যুক্তি হিসেবে দেখা যেতেই পারে।

আসলে কর্ণের প্রতিও দ্রৌপদীর আকর্ষণ ছিল কিনা– এই জানার তাগিদ এবং তদনুসারে কিছু কাহিনি তৈরি করার প্রচেষ্টাটা এক ধরনের পৌরুষেয় তাগিদের মধ্যে পড়ে এবং এ-তাগিদ আরও বেশি হয় তাঁদেরই, যাঁরা শৈশবে মাতৃস্নেহ-বঞ্চিত কর্ণের গৌরব নিয়ে বেশি সচেতন। আর এটা তো সব সময়েই অনুমান-প্রমাণে যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে যে, দ্রৌপদীর নিজের চরিত্র, ব্যক্তিত্ব এবং জীবনযাত্রার প্রণালীর মধ্যেই এমন সব উত্তেজক উপাদান আছে যা সযৌক্তিক মানুষকেও ঈষৎ মুখর করে তুলতে পারে। কিন্তু গভীরভাবে ভেবে দেখবেন, দ্রৌপদী কিন্তু অসচেতন ভাবেও কোনওদিন তার পঞ্চস্বামীর সীমানা অতিক্রম করেননি, যদিও স্বামীর সংখ্যা পাঁচটা বলেই তার যৌনতার ক্ষেত্রটুকু যেহেতু প্রসারিত হয়ে পড়ে, অতএব তার ওপরে এই দুরাক্ষেপ বারংবার এসেছে এবং স্বয়ং কর্ণই এই মন্তব্য করেছেন যে, যার পাঁচ-পাঁচটা স্বামী আছে, তার আর একটা বেশি হয়ে ছ’টা হলে দোষ কী? কর্ণ হয়তো অসদভিপ্রায়ে দুরুক্তি করার জন্যই দুরুক্তি করে এ-কথা বলেছেন, কিন্তু দ্রৌপদীর জীবনে অন্য এক ষষ্ঠ স্বামীর সম্ভাবনার জায়গাটা যে একেবারে কোনও অবাস্তব আজগুবি কল্পনা নয়, সে-কথা তো দ্রৌপদীর পরম বন্ধু কৃষ্ণের মুখেও শোনা গেছে।

হতে পারে, সেটা কৃষ্ণের দিক থেকেই একটা ‘সিডাকশন’ তৈরি করার ব্যাপার ছিল কর্ণের জন্য আর কে না জানে দ্রৌপদীর শরীর,ব্যক্তিত্ব এবং মনস্বিতার মধ্যেই এই ‘সিডাকশন’ ছিল এবং তাঁর পাঁচ-পাঁচটা স্বামীও ছিলেন এই ‘সিডাকশন’ প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু দ্রৌপদীর দিক থেকে কোনওদিন এই ‘সিডাকশন’ ব্যবহার করার প্রশ্ন আসেনি, অনেক ক্ষোভ-আক্ষেপ থাকা সত্ত্বেও পাঁচ স্বামীর কনিষ্ঠটিরও স্বামিত্বের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ তিনি করেননি কখনও, সৌভাগ্যবশত তার স্বামীর সংখ্যাই পাঁচ এবং সিডাকশন’ যদি তার শরীরে নিসর্গতই থাকে তা হলে শীতকালের শীতল জলাশয়ে পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনার মতো– তা হলে জলাশয়ের দোষ দিয়ে লাভ কী! কৃষ্ণ কর্ণের কাছে দ্রৌপদীর নাম ব্যবহার করেছিলেন যুদ্ধকালীন সময়ে তাকে পাণ্ডবপক্ষে ফিরিয়ে আনার জন্য তাকে দোষ দিই না– কেননা পাণ্ডবপক্ষে কর্ণ ফিরে আসলে ‘ভীম ধরিবেন ছত্র, ধনঞ্জয় বীর সারথি হবেন রথে এসব কথা কৃষ্ণও তো কর্ণকে বলেছিলেন– এগুলোও তো ‘সিডাকশন’, নাকি পুরুষ বলেই শব্দটা প্রযোজ্য হবে না, এখানে কী মেয়েদেরই একক অধিকার? আর সত্যিই তো কৃষ্ণকে আমরা দোষ দিই কী করে, যুক্তিতর্ক মানলে কর্ণ যদি সত্যিই ফিরে আসতেন, তা হলে পাঁচ-স্বামীর সঙ্গে দ্রৌপদীর স্বামিত্বের অধিকার তো তাকে দিতেই হত। ঠিক সেই কারণেই একেবারে নারদের নিয়ম অনুসারেই কৃষ্ণ তাকে স্বাভাবিক প্রাপ্তির আভাসটুকু দিয়ে বলেছিলেন– রাজারা এবং রাজকন্যারা তোমার অভিষেকের তোড়জোড় করুন, দ্রৌপদীও তোমার কাছে নিয়মমতো আসবেন ষষ্ঠ পর্যায়ে, যেটাকে আসলে প্রথম পর্যায় ভাবাটাই ঠিক– ষষ্ঠে ত্বাঞ্চ তথা কালে দ্রৌপদ্যুপগমিষ্যতি।

হয়তো এই প্রতিপাদ্য বিষয়ের মধ্যে কৃষ্ণের বুদ্ধি, চতুরতা এমনকী দুষ্টুমিও থাকতে পারে একটু একটু– কেননা দ্রৌপদীর ব্যাপারে কর্ণের অপরোক্ষ অনুভূতি না থাকলেও পরোক্ষ কোনও দুর্বলতা- পুষ্পে কীটসম যেথা তৃষ্ণা জেগে রয় সে-কথা কৃষ্ণ জানতেনও হয়তো। সেই যেদিন স্বয়ংবর-সভায় কৃষ্ণা দ্রৌপদী ‘আমি সূতপুত্রকে বরণ করব না’ বলে ঘোষণা করলেন, সেদিন থেকেই তার প্রতি কর্ণের যে আক্রোশ-ক্রোধ জন্মেছিল, তার মধ্যে এক বিপ্রতীপ আকর্ষণও ছিল, তা নইলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ লাগার আগে পর্যন্ত কর্ণ দ্রৌপদীকে মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে দেননি। পাশাখেলার পর তাকে নগ্ন করার আদেশ কর্ণই দিয়েছেন দুঃশাসনকে, তাঁর পঞ্চস্বামীর সঙ্গে আর একজন কৌরবকে যোগ দিয়ে তাকে সম্পূর্ণ বেশ্যার চিহ্নে চিহ্নিত করাটাও কর্ণেরই কাজ ছিল। পাণ্ডবদের বনবাসের সময় দুর্যোধনকে বনে গিয়ে তার ঠাট-বাট দেখানোর প্ররোচনাটা কর্ণই দিয়েছেন এবং সমস্ত মেয়েদের তথা দুর্যোধনের স্ত্রীদের সালংকারা হয়ে দ্রৌপদীর সামনে ঘুরে বেড়ানোর যুক্তিটাও কর্ণই দিয়েছিলেন এইজন্য, যাতে দ্রৌপদী তার স্বামীদের নিয়ে হতাশ এবং বঞ্চিত বোধ করেন। দ্রৌপদীর ব্যাপারে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কর্ণের প্রতিশোধ-স্পৃহা-তাড়িত অযথা মন্তব্যগুলি নিয়ে বেশি কথা বলতে চাই না, কিন্তু এটা অবশ্যই ঠিক যে, এগুলি বিপ্রতীপভাবে দ্রৌপদীর প্রতি কর্ণের অকারণ আকর্ষণের তত্ত্বগত নিদান হয়ে ওঠে।

উলটো দিকে মূল মহাভারতের মধ্যে কর্ণের ব্যাপারে দ্রৌপদীকে কোথাও এতটুকুও বিগলিত দেখিনি এবং কর্ণের কারণে যখনই তিনি বিচলিত বোধ করেছেন, তখনই তার মৃত্যু কামনা করেছেন দ্রৌপদী। কিন্তু ভাগ্য এমনই এক বিষম বস্তু– যে, পঞ্চ-স্বামীর সুবাদই কিন্তু মূলত পাণ্ডব কর্ণের সম্বন্ধে একটা অনুকূল লৌকিক তর্ক তৈরি করে রেখেছে। বিশেষত দ্রৌপদী যেমনটি সারা জীবন চেয়েছেন– সব বাঁধন-নিয়ম ভেঙে তাঁর অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া হোক, এটা কর্ণ হলে অবশ্যই তাঁর অনুকূলে ঘটত। বিশ্বস্ত জন হিসেবে কর্ণ দুর্যোধনের ওপর যত আস্থা রেখেছেন, তাতে দ্রৌপদী হলে কী হত, কতটা দ্রৌপদীর ব্যাপারে অনুকূলে প্রতিক্রিয় হতেন তিনি- এইসব ‘হইলেও হইতে পারিত’ থেকেই কিন্তু এমন লৌকিক মুখরতা তৈরি হয়েছে যে, দ্রৌপদীরও হয়তো কিছু দুর্বলতা ছিল কর্ণের ওপর। আর আমরা তো বলব– কর্ণকে ফিরিয়ে আনার জন্য হলেও কর্ণের জন্য দ্রৌপদীর ‘সিডাকশন ব্যবহার করে কৃষ্ণ নিজেই এই অকারণ মুখরতা তৈরি করেছেন এবং যেহেতু দ্রৌপদীকে একটি কথাও জিজ্ঞাসা না করে তিনি এই বস্তু-সম্বন্ধের নিদর্শনা’ তৈরি করেছেন, তাতে পরবর্তীকালের লৌকিক কৃষ্টিতে দ্রৌপদীকেই খানিক দুর্বল করে তোলা হয়েছে কর্ণের প্রতি। এ-ব্যাপারে মধ্যযুগীয় মহাকবিদের মানসে কোনও প্রচ্ছন্ন পৌরুষেয়তা কাজ করেছে কিনা, খুব পরিষ্কার করে সে-কথা বলতে চাই না, কেননা প্রথমত কর্ণের মতো বঞ্চিত মহাবীরের জন্য দ্রৌপদীর এই হৃদয়-উপহার হয়তো প্রাপ্যই ছিল, আর দ্বিতীয়ত কাশীরাম দাস অসামান্য লৌকিক যুক্তিতে গল্পটা জমিয়ে দিয়েছেন চমৎকার। গল্পটা না বললে নয়।

কাশীরাম দাস এই কাহিনি সৃষ্টি করেছেন বনপর্বে। পাণ্ডবরা তখন কাম্যক বন ছেড়ে যাচ্ছেন অনেক কাল সেখানে থাকার পর। মনটা খারাপ, তবে কৃষ্ণ দ্বারকা থেকে আসায় সকলে খানিক উদ্দীপিত হলেন। কৃষ্ণ সহ পাণ্ডবরা দ্রৌপদীকে নিয়ে হাঁটছেন, যেতে যেতে এক সময় দ্রৌপদীর মনে হল– দীর্ঘ দিন বনবাসে পার হয়ে গেল, সুখে-দুঃখে কেটেছে অনেকদিন, কিন্তু এই বনবাসে যে কষ্ট করলাম স্বামীদের অনুগামী হয়ে, তাতে আমার এই তৃপ্তিবোধ করার যথেষ্ট কারণ আছে যে,

এ-তিন ভুবনে আমি সতী পতিব্রতা।
স্বামীর সহিত বনে দুঃখেতে দুঃখিতা ॥

দ্রৌপদী ভাবলেন– মুনি-ঋষিরাও আমার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন এবং হয়তো এই সতীত্বের জন্যই অখিল-ব্ৰহ্মাণ্ডপতি কৃষ্ণও আমার কথা মেনে চলেন। অন্তর্যামী কৃষ্ণ জানতে পারলেন কৃষ্ণা দ্রৌপদীর মনোগত অহংকারের কথা। তিনিও মনে মনে ঠিক করলেন দ্রৌপদীর দর্পচূর্ণ করবেন। এর পরেই তারা এসে পৌঁছোলেন এক তপোবনের মধ্যে। ভারী মনোরম পরিবেশ, পথশ্রমে ক্লান্ত সকলেই সেই তপোবনে সেদিনকার মতো আশ্রয় নিলেন। সেই তপোবনে একটি আমগাছ ছিল এবং অতি-অসময়েও সেই গাছের একটি উঁচু ডালে একটি মাত্র আম ধরে আছে। এমন অদ্ভুত ব্যাপার দেখে দ্রৌপদী অর্জুনের কাছে বায়না ধরলেন আমটি পেড়ে দেবার জন্য। অর্জুনও দ্রৌপদীর কাছে নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য আমটি পেড়ে দিলেন। পাকা সুদৃশ্য আমখানি দ্রৌপদী হাতে নিয়ে ঘুরছেন এবং সেটা কৃষ্ণের নজরে পড়ল। কৃষ্ণ একেবারে হায় হায় করে উঠলেন এবং অর্জুনকে বললেন–

কী কর্ম করিলে পার্থ কভু ভাল নয়।
দুরন্ত অনর্থ আজি ঘটিল নিশ্চয় ॥

কৃষ্ণের কথা শুনে অদ্ভুত আকস্মিকতায় কেউ কিছু বুঝতেই পারলেন না যে, কী অনর্থ ঘটল। একটি আম গাছ থেকে পেড়ে দেওয়ার ঘটনার সঙ্গে পূর্বকৃত কর্মদোষ থেকে আরম্ভ করে বুদ্ধিনাশ পর্যন্ত সবরকম অমঙ্গল-শঙ্কা কৃষ্ণের মুখে উচ্চারিত হল। যুধিষ্ঠির অত্যন্ত ভীত-ব্যর্থ হয়ে কৃষ্ণকে বার বার জিজ্ঞাসা করতে থাকলেন– একটা আম পেড়ে দ্রৌপদীর হাতে দিয়ে কী অন্যায়টা ঘটল? কৃষ্ণ বললেন- দেখো, এই তপোবনে সন্দীপন নামে এক কঠিন তপস্বী ঋষি থাকেন, দেবতা-দানব-মানব সকলেই তাকে ভয় করে চলে। তিনি যে-কথা বলবেন, সেটাই শেষ কথা। কৃষ্ণ এবার ঋষির দিনচর্যার হিসেব জানিয়ে বললেন– সন্দীপন মুনি বহুকাল এই তপোবনে আছেন এবং তার অভ্যাস হল– এক্কেবারে ভোরবেলায় তিনি অন্যত্র বেরিয়ে যান নির্জনে তপস্যা করার জন্য। তার এই তপোবনে এই যে আমগাছটা আছে, তারও একটা চরিত্র তৈরি হয়েছে মুনিরই তপস্যার ফলে। এই আমগাছে প্রতিদিন একটা করেই আম ধরে এবং মুনি তপস্যা করার জন্য প্রত্যূষে বেরিয়ে যাবার সময় এই আমটি কাঁচা, কিন্তু সমস্ত দিবস গেলে সেই আম ‘সন্ধ্যাকালে পাকে। সন্ধ্যাকালে মুনি আশ্রমে ফিরে আসেন এবং পাকা আমটি পেড়ে খান, সারাদিনের উপবাস-ক্লান্তি তাতেই দূর হয়ে যায়। উপাখ্যান শেষ করার পর কৃষ্ণের সভয় বার্তা

হেন আম্র দ্রৌপদীকে পাড়ি দিল পার্থ।
দোহার কর্মের দোষে হইল অনর্থ।

কৃষ্ণ ভয় পাচ্ছে– সন্ধ্যাবেলায় এসে উপবাসক্লিষ্ট মুনি যদি আমটি না পান, তবে অভিশাপ দিয়ে ভস্ম করে দেবেন সবাইকে। যুধিষ্ঠির কাতর হয়ে কৃষ্ণকে বললেন আমাদের সমস্ত বিপদে তুমিই আমাদের ত্রাণ করেছ চিরকাল, এই বিপদ থেকেও তুমিই বাঁচাবে আমাদের তোমার আশ্রিত মোরা ভাই পঞ্চজন। কৃষ্ণ এবার চিন্তিতভাবে বললেন– একটাই উপায় আছে। এই আমটি গাছের ডালে যে জায়গায় যেমনটি ছিল, সেইভাবে প্রতিস্থাপন করলে সবাই বাঁচবে। কিন্তু সেটা হবে কীভাবে, এটা তো আর আঠা দিয়ে জুড়ে দেওয়া নয়, আম যেমন ছিল, তেমনটাই থাকতে হবে। কৃষ্ণ বললেন– এর জন্য তোমাদের পাঁচ ভাই এবং দ্রৌপদীকে একেবারে সঠিক সত্য কথা বলতে হবে একটি ব্যাপারে। বলতে হবে কোন কথাটা তোমাদের একেক জনের মনে সব সময় জাগ্রত রয়েছে, যেটা তোমরা কিছুতেই ভুলে যাচ্ছ না কোন কথা কার মনে জাগে অনুক্ষণ! তবে একটাই শর্ত তোমাদের প্রত্যেক সতত দীপ্যমান এই মনের কথা জানানোর সময় কোনও মিথ্যা কথা বলবে না, কোনও ছলনা-চাতুরি-কপটতা করবে না।

যুধিষ্ঠিরকে দিয়েই মনোমধ্যে এই অনুক্ষণ চিন্ত্যমান বিষয়ের বিবরণ দেওয়া আরম্ভ হল। তিনি সব সময়েই ভাবেন– টাকাপয়সা, ধনসম্পত্তি ফিরে পেলে আবার আগের মতো যাগ-যজ্ঞ, ব্রাহ্মণভোজন করিয়ে দিন কাটাবেন। যুধিষ্ঠির তার বিবরণ শেষ করা মাত্রই সেই আমটি মাটি থেকে গাছের ডালের দিকে খানিক উর্ধ্বে উঠে শূন্যে ভাসতে লাগল। সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল এই কাণ্ড দেখে। এরপর ভীম তাঁর মনের কথা জানিয়ে বললেন– আমি সবসময় ভাবি কবে আমি দুঃশাসনের বুক চিরে রক্তপান করব, কবে দুর্যোধনের ঊরু ভাঙব গদাঘাতে। ভীমের কথায় আমটি আর খানিক ওপরে উঠল। তারপর অর্জুনের সত্যবাক্যে আম আরও খানিক উঠে গেল, নকুল-সহদেবের অকপট স্বীকারোক্তিতে আমটি চলে গেল গাছের ডালের অনেকটাই কাছে। এবারে দ্রৌপদী বললেই আমটি জুড়ে যাবার কথা। অতঃপর ধীরে ধীরে বলে যাজ্ঞসেনী।

বস্তুত পাশাখেলার আসরে পাণ্ডবরা যত অপমানিত হয়েছিলেন, তাতে অনুক্ষণ তাদের হৃদয়ে যে প্রতিশোধ-স্পৃহা ধিকিধিকি জ্বলছে, তারই সার্থক প্রকাশ ঘটেছে তাঁদের বক্তব্যে। দ্রৌপদী যখন বলতে উঠলেন– এবং এটাও তো ঠিক যে, প্রতিশোধ-স্পৃহা তার মনেও যথেষ্ট ছিল, অতএব তখন তিনিও প্রায় একই সুরে বললেন– আমি সবসময়েই এই চিন্তা করি যে, দুষ্ট লোকেরা আমাকে যত কষ্ট দিয়েছে, তারা সবাই মারা পড়বে ভীম-অর্জুনের হাতে। আর আমার ইচ্ছা হয়– আগে যেমন যাগ-যজ্ঞ করে আত্মীয়বন্ধুকে পালন করতাম, ঠিক সেইভাবে আবারও দিন কাটাই।

দ্রৌপদীর এই মহৎ উদারোক্তি শেষ হওয়ামাত্রই যে আমটি নাকি গাছের ডাল থেকে সামান্য একটু দূরে হাওয়ায় ভাসছিল, সেই আম আবারও মাটিতে পড়ে গেল ধপ করে। যুধিষ্ঠির প্রমাদ গণলেন– এ কী হল, এ কী হল বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। কৃষ্ণ বললেন–সব ঠিক ছিল কিন্তু করিল সকল নষ্ট দ্রুপদদুহিতা। সে কপট করে মনের কথাটি বাদ দিয়ে অন্য কথা বলেছে, যার ফলে এই দুর্গতি হল। কৃষ্ণ খুব ব্যগ্র হয়ে দ্রৌপদীকে বললেন– আরও একবার সুযোগ পাবে তুমি। মনের মধ্যে যা ঘটে অহরহ, সত্য করে বলো তুমি নিশ্চয় বৃক্ষেতে আম্র লাগিবে সর্বথা। কৃষ্ণের অনুগামিতায় যুধিষ্ঠিরও অনুনয় করলেন দ্রৌপদীকে কিন্তু দ্রৌপদী মৌন হয়ে রইলেন, একটি কথাও বললেন না। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে এল যে, দ্রৌপদীর প্রিয়তম স্বামী অর্জুন ভীষণভাবে রেগে গেলেন, এমনকী ধনুকে একটি বাণ জুড়ে বললেন–

শীঘ্ৰ কহ সত্য কথা।
 নচেৎ কাটিব তীক্ষ্ণ শরে তোর মাথা ॥

কাশীরাম দাসের মধ্যযুগীয় পৌরুষেয়তায় কাজ হল। দ্রৌপদী খানিক লজ্জা-লজ্জা মুখে বলতে আরম্ভ করলেন। বললেন– কী আর বলব, সখা। তুমি তো কৃষ্ণ অন্তর্যামী পুরুষ, সবার মনের কথা জানো৷ তবে মিথ্যে কথা বলব না, বললে পাপ হবে আমার। সেই যে রাজসূয় যজ্ঞের সময় মহাবীর কর্ণ এলেন কৌরবদের সঙ্গে। তাঁকে দেখা অবধি সবসময়েই আমার মনে হয়– আহা! ইনিও যদি কুন্তীর ছেলে হতেন, তা হলে পাঁচজনের সঙ্গে না হয় ছ’জন স্বামী হত আমার। এখনও এই কথাটাই আমার মনে হয়েছিল। দ্রৌপদী এই কথা বলামাত্র গাছের আম সটান গাছের ডালে গিয়ে লাগল।

কাশীরাম দাসে বৃন্তচ্যুত আম বৃন্তে গিয়ে লাগতেই যুধিষ্ঠির হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। কিন্তু দ্রৌপদীর এই সত্যবাক্যে ভীম অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে দ্রৌপদীকে যা-নয়-তাই বললেন। তাঁর রাগ হয়েছে এই কারণে যে, তিনি এত করেন দ্রৌপদীর জন্য, তবু এখনও এত আকাঙ্ক্ষা দ্রৌপদীর। রেগে গিয়ে বলেছেন–

এই কি তোমার রীতি কৃষ্ণা দুষ্টমতি।
 এক পতি সেবা করে সতী কুলবতী ॥
 বিশেষ তোমার এই পতি পঞ্চজন।
 তথাপি বাঞ্ছিস মনে সূতের নন্দন।

ভীম নাকি গদা নিয়ে মারতেই চাইছিলেন দ্রৌপদীকে। কৃষ্ণ কোনওমতে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বলেন দ্রৌপদীর মতো গুণবতী সতী দ্বিতীয় নেই ভুবনে। তবে যে এমন একটা মনের বাসনা তিনি জানালেন, তার কারণ আছে, সে কারণ আমি তোমাদের বলব যখন দেশে ফিরে আবার রাজা হয়ে বসবেন যুধিষ্ঠির।

আমরা জানি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জয়ী হয়ে যুধিষ্ঠির সিংহাসনে বসার পরে এই ঘটনার কথা আর কারও মনেই নেই। আর এও জানি– কাশীরাম দাস এই কাহিনির সৃষ্টি করেছেন নিতান্ত লোকজ উপাদান থেকে, এবং তা বস্তু-সম্বন্ধের সম্ভাবিত অভিসন্ধি থেকে অর্থাৎ এমনটি হইলেও হইতে পারিত। কর্ণ যেহেতু নিশ্চিতভাবেই কুন্তীর ছেলে ছিলেন এবং দ্রৌপদীর স্বামী-সংখ্যার আধিক্যটাও যেহেতু চোখে পড়ার মতো, তাই পাঁচের জায়গায় ছয় স্বামীর কল্পনাটা কখনওই খুব বাড়াবাড়ি হয় না এবং স্বয়ং কর্ণই নিজমুখে এই সম্ভাবনার কথা উচ্চারণ করেছিলেন বলেই গল্পের আম একবার গাছ থেকে পড়ে দ্রৌপদীর হৃদয় নিয়ে গাছের ডালে লেগেছে। মূল মহাভারতের মধ্যে দ্রৌপদীর প্রতি কর্ণের আক্রোশ উপলক্ষিত দুর্বলতা দেখেছি, কাশীরাম দাস সেই দুর্বলতার কাহিনির মধ্যে যেভাবে দ্রৌপদীর হৃদয় মন্ত্রণা মিশিয়ে দিয়েছেন, তাতে মৌলিক সত্যতা ব্যাহত হলেও সমান-হৃদয় পাঠক কিন্তু কাশীরামের তারিফ করে এখনও বলেন– এমনটা হইলেও হইতে পারিত।

তবে কিনা দ্রৌপদীর সঙ্গে কর্ণের সম্বন্ধ খোঁজার মধ্যে যেটা বড় হয়ে ওঠে, সেটাও কিন্তু একভাবে তাঁর স্বামী-সম্পর্কেরই প্রসারিত ক্ষেত্রমাত্র। এই ক্ষেত্রের বাইরেও আরও এক বিলাস-ক্ষেত্র আছে দ্রৌপদীর যা তৎকালীন কোনও রমণীর জীবনে প্রায় অভাবিত ছিল, অথবা ভাবিত হলেও অপবাদের চূড়ান্ত ভূমিতে নিক্ষিপ্ত হত। এটা হল এক প্রবাদ পুরুষের সঙ্গে দ্রৌপদীর বন্ধুত্বের জায়গা। সেই মহাভারতীয় বর্তমান কালে যৌনতার নাম গন্ধহীন এক স্বর্গীয় সম্পর্ক গড়ে তোলার পিছনে কৃষ্ণের প্রায়োগিক বাস্তব বুদ্ধি যত কাজ করেছে, দ্রৌপদীরও ঠিক ততখানি। কৃষ্ণার সঙ্গে কৃষ্ণের সম্পর্ক কী ছিল আমি কোনও আলোচনায় বিশেষ যাইনি, সে আলোচনার পরিসরও এটা নয়। তবে কৃষ্ণ যে কৃষ্ণার চিরকালের ‘অ্যাডমায়ারার সে-কথা বোধ করি মহাভারতের উদার পাঠককে বলে দিতে হবে না। পাঁচ-পাঁচটি স্বামী-কূপের বাইরেও দ্রৌপদীর আরও একটি নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা ছিল এবং সেযুগে যা প্রায় অভাবনীয়, কৃষ্ণ ছিলেন দ্রৌপদীর তাই– ‘বয়ফ্রেন্ড’। ইংরেজি কথাটা কৃষ্ণ-কৃষ্ণার সম্পর্ক-ব্যাখ্যায় বড় অগভীর, কিন্তু এর থেকে গভীর শব্দ প্রয়োগ করতে গেলে কৃষ্ণ কিংবা কৃষ্ণার ওপর যে ধরনের ভালবাসার দায় এসে পড়বে তাতেও স্বস্তি পাওয়া মুশকিল। তার থেকে বলি বন্ধু– কৃষ্ণস্য দয়িতা সখী। সংস্কৃতে ‘সখা’ শব্দটির মধ্যে সমপ্রাণতার মাহাত্ম্য মেশানো আছে, কিন্তু সে সমপ্রাণতা তো হয় পুরুষে পুরুষে, নয়তো মেয়েতে মেয়েতে। কিন্তু পুরুষ মানুষের মেয়ে বন্ধু– কৃষ্ণস্য দয়িতা সখী– তাও সেকালে ভাবা যায়!

নইলে পঞ্চস্বামীর অতিরিক্তে দ্রৌপদী বারবার অভিমান করে বলেছেন– এমনকী তুমিও এমন নিশ্বাস ফেলার জায়গা ক’জনের থাকে। কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে প্রথম দেখেছিলেন পাঞ্চালের স্বয়ম্বর-সভায়। না, না, আমি গজেন্দ্রকুমারের ‘পাঞ্চজন্য’ ফেঁদে বসছি না। সে ক্ষমতাও আমার নেই এবং মহাভারতের প্রমাণে আমার পক্ষে তা প্রমাণ করাও মুশকিল। তবে বলতে পারি– কৃষ্ণ কিংবা কৃষ্ণা কেউই তাদের পারস্পরিক ব্যবহারে সীমা অতিক্রম করেননি কোনওদিন। এমনকী আজকের দিনের স্বচ্ছ-দৃষ্টিতেও দুই যুবক যুবতাঁকে শুধুমাত্র বন্ধু ভাবা যায় না বলেই উপন্যাসের রাস্তা প্রশস্ত হয়। কিন্তু মহাভাতের প্রমাণে তারা কিন্তু শুধুই বন্ধু, প্রাণের বন্ধু এবং এইমাত্র, এর বেশি নয়। পাণ্ডবেরা বনবাসে আসার পর কৃষ্ণ যেদিন সদলবলে বনেই এসে উপস্থিত হলেন সেদিন দ্রৌপদী কৃষ্ণের সামনে তার কমলকলিকার মতো হাত-দুটি দিয়ে মুখ ঢেকে অনেক কেঁদেছিলেন। তার সমস্ত অপমানের কথা সবিস্তারে শুনিয়ে সেই একই কথা বলেছিলেন– আমার যেন স্বামী-পুত্র, ভাই-বন্ধু কেউ নেই– এমনকী তুমিও নেই– নৈব তুং মধুসূদন। আমি একটুও ভুলতে পারছি না, যাকে আমি সুতপুত্র বলে রাজসভায় লক্ষ্যভেদের যোগ্যতা দিইনি, সেই কর্ণও আমাকে দেখে খ্যাক খ্যাক করে হাসছিল– কর্ণো যৎ প্ৰাহসৎ তদা।

দ্রুপদের রাজসভায় যেদিন প্রথম কৃষ্ণা পাঞ্চালীকে দেখেছিলেন কৃষ্ণ, সেদিন তিনি ছিলেন পতিম্বরা বধূটি– আপ্লুতাঙ্গী সুবসনা সর্বাভরণভূষিতা। আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি, কৃষ্ণ সেই স্বয়ম্বর-সভায় নতুন একটি বিয়ে করার উদ্দেশ্য নিয়ে যাননি। কেননা সেই বারণাবতে জতুগৃহদাহের খবর শুনে সাত্যকিকে নিয়ে কৃষ্ণের অল্প অল্প গোয়েন্দাগিরির কথা আমি আগেই জানিয়েছি। স্বয়ম্বর-সভায় অর্জুনের লক্ষ্যভেদ হল। সমবেত রাজাদের আক্রমণ প্রতিহত করে দ্রৌপদীকে নিয়ে ভীম-অর্জুন ফিরলেন কুমোরপাড়ার বাড়িতে। আর তার পিছন পিছন এলেন কৃষ্ণ এবং বলরাম। সেদিন নববধূ কৃষ্ণাকে একটি সম্বোধনও করেননি কৃষ্ণ। কারণ যুধিষ্ঠির, ভীম ইত্যাদি পিসতুতো ভাইদের সঙ্গেও সেই তার প্রথম পরিচয়।

পরিচয়টা কিন্তু বাড়ল দ্রৌপদীর বিয়ের উপলক্ষেই। হস্তিনাপুরে পাণ্ডবরা ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত কৃষ্ণ পাঞ্চালেই ছিলেন। পদ স্বয়ং এবং হস্তিনাপুর থেকে নিমন্ত্রণ করতে আসা বিদুর দু’জনেই কৃষ্ণের প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। ফলত বিয়ের পর পর কৃষ্ণের সঙ্গে পাণ্ডবদের যোগাযোগ আরও বেড়ে গেল। পাণ্ডবরা রাজ্য পেলেন খাণ্ডবপ্রস্থে। ঘন ঘন যাতায়াত সমবয়সি অর্জুনের সঙ্গেও কৃষ্ণের যেমন বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে, হয়তো দ্রৌপদীর সঙ্গেও সেইভাবে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। অর্জুন বনবাস থেকে ফিরে আসার পর কৃষ্ণ-অর্জুন তথা সুভদ্রা-দ্রৌপদীকে আমরা যমুনা বিহারে একান্তে দেখেছি। কিন্তু আগেই বলেছি– সুভদ্রার সঙ্গে অর্জুনের বিয়েতে দ্রৌপদীর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল সাভিমান পরুষ-বাক্য। কৃষ্ণের ওপর দ্রৌপদী যে সেই মুহূর্তে খুশি হননি তা বোঝা যায় তার বাচনভঙ্গিতে। তিনি অর্জুনকে বলেছিলেন–তুমি সেই চুলোতেই যাও, যেখানে আছে সেই সাত্ত্বত-বৃষ্ণিকুলের পরমা মহিলাটি– সুভদ্রা।

কৃষ্ণ সাত্ত্বত-কুলেরই গৌরবময় পুরুষ। অর্জুন তার ভাই এবং বন্ধু। দ্রৌপদী অর্জুনের পরম-প্রণয়িনী জেনেও কৃষ্ণ তার দাদা বলরাম এবং অন্যান্য বৃষ্ণি-বীরদের আপত্তি সত্ত্বেও সুভদ্রাকে প্রায় স্বমতেই অর্জুনের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। সামান্যতম হলেও দ্রৌপদীর প্রিয়তম স্বামী অর্জুনের সম্বন্ধে কৃষ্ণের একটু ঈর্ষা ছিল কি না কে জানে? অর্জুন দ্রৌপদীকে নিয়ে সম্পূর্ণ সুখী হন এটা অন্তরের অন্তরে চাননি বলেই কি কৃষ্ণ সুভদ্রার ব্যাপারে অর্জুনকে এত সাহায্য করেছিলেন? কে জানে চতুর চূড়ামণির অন্তরে কী ছিল? মহাভারতের কবিকে ধন্যবাদ তিনি দ্বারকাবাসী সেই ধুরন্ধর পুরুষের নাম কৃষ্ণ, এবং দ্ৰৌপদীর নাম কৃষ্ণা রেখেই বুঝেছিলেন ব্যাকরণগতভাবে সম্পর্কটা অনেকদূর এগিয়ে গেছে। তিনি আর বাড়তে দেননি। তবে অর্জুনের সঙ্গে সুভদ্রার বিয়ে দেওয়ার মতো সামান্যতম ক্ষতি করেই বুঝি কৃষ্ণ অর্জুন এবং এমনকী দ্রৌপদীরও পরম বন্ধু হয়ে গেছেন। সুভদ্রাকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে কৃষ্ণ যেদিন দ্বারকায় ফিরে যাবার দিন ঠিক করলেন, সেদিন দ্রৌপদীকে রীতিমতো সান্ত্বনা দিয়ে তাঁকে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। যেদিন থেকে কৃষ্ণের সান্ত্বনায় দ্রৌপদী সুখ পেতে আরম্ভ করলেন, সেদিন থেকে বোঝা যায় তিনি মনে মনে অর্জুনকে একটু একটু করে হারিয়েছেন, আর নিজের অজান্তেই দ্বারকার ওই প্রবাদ-পুরুষটির কাছাকাছি চলে এসেছেন, বাঁধা পড়েছেন সম-প্রাণতার বন্ধনে বন্ধুত্বের বন্ধনে।

এই বন্ধুত্ব এতটাই যে, যুধিষ্ঠির, ভীম এমনকী অর্জুনও কৃষ্ণকে যতটুকু সম্মান করে কথা বলতেন, দ্রৌপদী তা বলতেন না। শাল্বরাজার সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাওয়ার জন্য কৃষ্ণ কুরুসভায় উপস্থিত থাকতে পারেননি, কিন্তু সেদিন সেই চরম অপমানের মধ্যে দ্রৌপদী স্বামীদের সুরক্ষায় বঞ্চিত হয়ে এই সমপ্রাণ বন্ধুর জন্যই ডাক ছেড়ে কেঁদেছিলেন– কৃষ্ণঞ্চ বিষ্ণুঞ্চ হরিং নরঞ্চ। ত্রাণায় বিক্ৰোশতি যাজ্ঞসেনী। তারপর যেদিন বনবাসে কৃষ্ণের সঙ্গে দ্রৌপদীর দেখা হল, যুধিষ্ঠির অর্জুনের কথা যেই থামল, অমনই দ্রৌপদী অভিমান-ভরে দেবল, নারদ আর পরশুরামের জবানিতে ‘ভগবান’ বলে গালাগালি দিলেন কৃষ্ণকে। বললেন– সবাই তোমাকে ঈশ্বর এবং সমস্ত প্রাণিজগতের একান্ত গতি বলে বর্ণনা করেন, কিন্তু এমন বিরাট, সনাতন পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও তার সখী হয়ে, পাণ্ডবদের বউ হয়ে, ধৃষ্টদ্যুম্নের বোন হয়ে আমাকে একবস্ত্রা রজস্বলা অবস্থায় কৌরব-সভায় দাঁড়াতে হল কেন? কেন আমার চুলের মুঠি গেল দুঃশাসনের হাতের মুঠোয়?

কৃষ্ণ কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি! দ্রৌপদী বলেছিলেন– জান কৃষ্ণ! ওরা আমাকে দাসীভাবে ভোগ করতে চেয়েছিল, অথচ তবু তোমরা সব বেঁচে ছিলে। অভিমানের শেষ কল্পে দ্রৌপদী নিজেকে এমন এক করুণ ভূমিকায় স্থাপন করেছেন, যেখানে তাঁর শেষ কথা– আসলে আমার কেউ নেই– স্বামীরা নেই, ছেলেরা নেই, আত্মীয়স্বজন নেই, বাপ নেই, এমনকী তুমিও আমার নও কৃষ্ণ নৈব ত্বং মধুসূদন। এই যে এত নেই নেই, তার মধ্যে বিদগ্ধা রমণীর মুখে– এমনকী তুমিও নেই– নৈব ত্বং– এই ‘তুমিও’ শব্দটা যেমন সবার থেকে আলাদা। যেন, তেমন দিনে ওঁরা অর্থাৎ আত্মীয়স্বজন, স্বামী-পুতুর বাপ-ভাইও আমায় না দেখতে পারে, কিন্তু তুমি চিরজনমের সখা হে! কৃষ্ণের মাত্রাটা সবার থেকে যেন আলাদা।

বনপর্বে, উদ্যোগপর্বে এমনকী যুদ্ধ শেষের দিন পর্যন্ত ওই একই কথাই বলেছেন দ্রৌপদী। কৃষ্ণ কেবলই সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন, কেননা যুদ্ধের রাজনীতিতে পরপক্ষকে শাস্তি দিতে সময় লাগে। কিন্তু পাঞ্চালী কৃষ্ণার করুণ-কালো জল-ভরা চোখের কথা কৃষ্ণ ভোলেননি। দর্শনের দৃষ্টিতে যত নির্লিপ্ত পুরুষই তিনি হন অথবা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নাই করুন কোনও সশস্ত্র যুদ্ধ, ভারত-যুদ্ধের সুতোটা যদি তার হাতেই ধরা থেকে থাকে– কেননা তিনি, মহাভারত সূত্রধারঃ– তা হলে কুরু-পাণ্ডবের পুতুলনাচে পাঞ্চালী কৃষ্ণাই ছিলেন তাঁর প্রধান নটী। জননী গান্ধারী ভারত-যুদ্ধের সমস্ত দায় কৃষ্ণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন, এবং সে দায় তিনি বহন করতেও দ্বিধা করেননি। বাহ্যত এই যুদ্ধের কারণের মধ্যে যত রাজনীতির কথা থাকুক, যতই থাক জ্ঞাতি-বঞ্চনা অথবা দুর্যোধনের অহংকার, কৃষ্ণ কিন্তু দ্রৌপদীর চুলের কথা ভোলেননি– সেই সর্পকুটিল, কুঞ্চিত কেশদাম– মহাভুজগর্বচ্চসম্।

উদ্যোগপর্বে মহামতি সঞ্জয় যখন বিরাটরাজ্যে পাণ্ডবদের কাছে ধৃতরাষ্ট্রের বক্তব্য শোনাতে উপস্থিত হয়েছিলেন, তখন কৃষ্ণও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। সবার কথার শেষে কৃষ্ণ যে-ভাষায় উত্তর দিয়েছিলেন সঞ্জয়কে, সেই ভাষাটা ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের পক্ষে নাকি ছিল ‘ত্রাসনী’ অর্থাৎ ‘লাস্ট ওয়ার্নিং’-এর মতো। ভাষার মধ্যে প্রাথমিক মৃদুতা ছিল বটে কিন্তু সেই মৃদুতার মধ্যে ছিল নিদারুণ পরিণতির সতর্কবাণী– ত্ৰাসনীং ধার্তরাষ্ট্ৰাণাং মৃদুপূর্বাং সুদারুনাম্।

কৃষ্ণের এই ভাষার সঙ্গে সঙ্গে তার কথা বলার পরিমণ্ডলটাও একটু বলতে হবে। মনে রাখা দরকার– এই পরিমণ্ডল বর্ণনায় আমার একটু ব্যক্তিগত প্রয়োজন আছে। যারা কৃষ্ণের ভগবত্তায় বিশ্বাসী, তারা যেন এই রাজোচিত পরিমণ্ডল বর্ণনায় আহত না হন। সঞ্জয় এসেছেন অর্জুনের সঙ্গে কথা বলতে। অর্জুন তখন অন্তঃপুরের শিথিল পরিবেশে বসে আছেন এবং কৃষ্ণও রয়েছেন সেখানেই। আর আছেন দ্রৌপদী এবং সত্যভামা। কিঞ্চিৎ মদ্যপান করার ফলে এই দুই মহাত্মার মন এবং বুদ্ধি– দুইই একটু টান টান হয়ে আছে। প্রগাঢ় বন্ধুত্ব এবং অন্তঃপুরের শৈথিল্যে কৃষ্ণ তার চেয়ার থেকেই দুই পা বাড়িয়ে দিয়েছেন অর্জুনের কোলে। আর অর্জুন তার এক পা রেখেছেন নিজের স্ত্রী দ্রৌপদীর কোলে এবং অন্যটি রেখেছেন কৃষ্ণের প্রিয়া পত্নী সত্যভামার কোলে– অর্জুনস্য চ কৃষ্ণায়াং সত্যায়াঞ্চ মহাত্মনঃ।

একথা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, কৃষ্ণ এবং অর্জুন মদের ঘোরে ব্যক্তিগত ব্যবহারের সীমা লঙ্ঘন করেছেন। বরঞ্চ এই মানুষগুলির মধ্যে বন্ধুত্ব এবং হৃদয়ের নৈকট্য এতই বেশি ছিল যে কৃষ্ণ-প্রিয়া সত্যভামার কোলে অর্জুনের পা রাখা দেখে যেমন আমরা আশ্চর্য হচ্ছি না, তেমনই আশ্চর্য হতাম না যদি দ্রৌপদীর কোলে কৃষ্ণের পা দুটি দেখতাম। তার ওপরে অন্তঃপুরের শিথিলতা তো আছেই। অর্জুন, কৃষ্ণ, দ্রৌপদী, সত্যভামার আন্তরিক ঘনিষ্ঠতা এতটাই ছিল যে, দ্বৈপায়ন ব্যাস মন্তব্য করেছেন– এঁরা ঘনিষ্ঠভাবে বসে থাকলে অভিমন্যু বা নকুল-সহদেবও সেখানে যেতেন না। ঠিক এইরকম একটা অন্তঃপুরের পরিবেশে সঞ্জয় তার দৌত্যকর্মের তাগিদে অর্জুনের কাছে আসতে বাধ্য হয়েছেন। সঞ্জয় তার বক্তব্য নিবেদন করলে অর্জুন নিজে কথা না বলে, কৃষ্ণকেই বলবার জন্য ইঙ্গিত করলেন।

কৃষ্ণ বললেন। কোনও বড় বড় রাজনৈতিক কথা নয়, কোনও বিশাল দর্শনের কথা নয়, এমনকী কোনও মহৎ ধর্মের কথাও নয়। কৃষ্ণ বললেন–যুধিষ্ঠিরের একটু তাড়া আছে সঞ্জয়! ভীষ্ম দ্রোণকে সাক্ষী রেখে তুমি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে বোলো–ভাল করে যজ্ঞ-টজ্ঞ করে নিন, ছেলে-পিলে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে যা আনন্দ করার, তাও করে নিন। সামনে বড় ভয় আসছে মহ বা ভয়ামাগতম। কেন জান, সঞ্জয়! কৃষ্ণ বলে চললেন–দ্রৌপদীর কাছে আমার ঋণ বেড়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। আর সেই কথাটা আমার মন থেকে এক পলের জন্যেও দূরে সরে যাচ্ছে না। আমি দূরে ছিলাম, আর সেই কুরুসভায় সমস্ত রাজন্যবর্গের চোখের সামনে অপমানিতা হতে হতে আমাকে কতই না কেঁদে কেঁদে ডেকেছিল দ্রৌপদী। এই কথাটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। দিন চলে গেছে অনেক, তাই দ্রৌপদীর কাছে ঋণও আমার বেড়েই চলেছে ঋণমেতৎ প্রবৃদ্ধং মে হৃদয়ান্নাপসৰ্পতি।

কৃষ্ণ আরও অনেক কথা বলেছিলেন, যার অর্থ একটাই– সামনে বড় ভয় আসছে তোমাদের মহদ বা ভয়মাগতম। যুদ্ধের উদ্যোগপর্ব চলছে, সেই মুহূর্তে কৃষ্ণের মুখে দ্রৌপদীর জন্য এই পরম আর্তি কৃষ্ণা পাঞ্চালীর হৃদয়ে অন্য এক বিশিষ্ট অনুভূতি তৈরি করেছিল নিশ্চয়ই। পঞ্চস্বামীকে নস্যাৎ করে দিয়েও ষষ্ঠ যে পুরুষটিকে তিনি আলাদা করে চিহ্নিত করেছিলেন– এমনকী তুমিও নও, কৃষ্ণ! সেই মানুষটি যখন তার সামনেই শত্রুপক্ষকে বলেন– আর দেরি নয়, আমাকে পাঞ্চালী কৃষ্ণার ঋণ চুকোতে হবে, সেদিন নিশ্চয়ই দ্রৌপদীর মনে হয়– পঞ্চস্বামীর বাইরেও আরও এক অন্যতম সম্বন্ধ আছে তার তার বন্ধু, চিরজনমের সখা হে।

এই সখার অধিকার এতটাই যে, যুধিষ্ঠির-ভীম অথবা অর্জুনও কৃষ্ণের সঙ্গে যে মর্যাদায় কথা বলেন, সেই মর্যাদা সমপ্রাণতার মাহাত্মে স্তব্ধ করে দিয়ে দ্রৌপদী কৃষ্ণকে সাভিমানে বলতে পারেন– আমি তোমাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিচ্ছি কৃষ্ণ। অন্তত চারটে কারণ। আছে যাতে তুমি নিয়ত আমাকে রক্ষা করতে বাধ্য–চতুর্ভিঃ কারণৈঃ কৃষ্ণ ত্বয়া রক্ষ্যাস্মি নিত্যশঃ। এক, ‘সম্বন্ধাৎ’ অর্থাৎ কিনা আমি তোমার আপন পিসির ছেলের বউ। দুই, ‘গৌরবাৎ’– আমাকে কি তুমি খুব কম ভাব, যজ্ঞের আগুন থেকে আমার জন্ম অতএব ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের যেমন গাৰ্হপত্য অগ্নি রক্ষা করেন, সেই গৌরবে আমারও রক্ষা হওয়া উচিত। তিন, ‘সখ্যাৎ’– সব চাইতে বড়, পাণ্ডববধূর সম্বন্ধ গৌরব ছাড়াও তোমার সঙ্গে আমার একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে তুমি আমার বন্ধু। দ্রৌপদী মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠকে চিনতেন না। চিনলে বলতেন– তুমি বোকার মতো সখ্যের অর্থ বানিয়েছ ভক্তিমতী। আমি কোনওদিনই কৃষ্ণের ভক্ত নই, আমি তার বন্ধু। দ্রৌপদী বলেছেন– আমি পাণ্ডবদের বউ বটে- ‘ভার‍্যা পার্থানাং’, কিন্তু আরও আছে অর্ধেক আকাশ– আমি যে তোমার বন্ধু– তব কৃষ্ণ সখী বিভো। চতুর্থ কারণ হিসেবে দ্রৌপদী কৃষ্ণকে বলেছেন সবার ওপরে তোমার ক্ষমতা আছে, সামর্থ্য আছে। তাই আমি তোমার ওপর নির্ভর করি– সম্বন্ধা গৌরবাৎ সখ্যাৎ প্রভুত্বেন চ কেশব। কৃষ্ণ এই কথাগুলি ভোলেননি। সম্বন্ধ, গৌরব, সখ্য এবং প্রভুত্ব– এই সবগুলিই তাকে দ্রৌপদীর কাছে উত্তরোত্তর ঋণীই করেছে, যে ঋণ চুকানোর জন্য দ্রৌপদীর সামনেই তিনি সে-কথা অঙ্গীকার করেছেন।

দ্রৌপদীর সঙ্গে কৃষ্ণের সম্পর্ক এই চার দেওয়ালের বাইরে যায়নি। যখনই মনে হয়েছে স্ত্রী হিসাবে তিনি সুবিচার পাচ্ছেন না, তখনই বন্ধুর কাছে তিনি সাভিমানে মুক্তশ্বাস হয়েছেন। আলগা করে দিয়েছেন তার নিজের মনের গুরুভার। পরিবর্তে কৃষ্ণের কাছে পেয়েছেন সেই আশ্বাস যা তিনি চান। সেই সমপ্রাণতা, যা তার স্বামীরাও তাকে দিতে পারেননি। দ্রৌপদীর মনের কথা দ্রৌপদীর মতো করেই যদি কেউ বুঝে থাকেন, তো সে কৃষ্ণ, তার স্বামীরা নন। দ্রৌপদীর সঙ্গে কৃষ্ণের সম্পর্ক এইটুকুই ভাই, ‘মনের কথা’, ‘তব কৃষ্ণ প্রিয়া সখী’।

এই রোদ দিগন্ত ভাসানো
স্পর্শ করে এসেছে তোমাকে।
এই পাওয়া মায়েরই মতো যেন
 ঘুমন্ত কপালে চুমু রাখে, চুপিসারে।
 আর এই বারান্দায় লাফানো চড়াই
বলে যে, আমি তো রোজ ভোরবেলা ওর কাছে যাই।
 ভোর না হতেই শিউলি-কনে বউ হাসে
ওই তো আমার কাছে ফুল নিতে আসে।
রসিকা কাশের বুড়ি
চোখ টেপে, জানি,
সারা রাত তুমিও যে কেনো… কোন্ অভিমানে…
 শিশির ঝিকোয় নিচু ঘাসের ওপরে।
ও কিন্তু আমারই সাথে অশ্রু ভাগ করে।
 জানি-তো, জানি-তো,
আমরা সকলে তো ওর
ভিনদেশি পাখিরা বলে
সুরের দোসর…
এত যে সম্পর্কসেতু
সুরে সুরে আজীবন পার
 বলো তো,
 এর পরও সত্যি কি উপায় আছে–
এই আর্যেতর বাসে।
পরস্পর অস্পৃষ্ট থাকার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *