০৯. হিড়িম্বা

০৯. হিড়িম্বা

০১.

এই মহান বিশ্বায়নের যুগে বাঙালির বিয়ে নিয়ে যে কত সমস্যা হচ্ছে, তার কতটুকু খবর আপনারা রাখেন!হা, এটা মানি যে, ভারতবর্ষে বিয়ে এমনই সংবেদনশীল ব্যাপার, যেখানে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সংশ্লেষণ, সংবেদনশীলতা এবং আবেশের চেয়েও বাবা-মামা আত্মীয়স্বজনের আপন হৃদয়-মথিত শাস্ত্রজ্ঞান যে কত মধুর হৃদয় বিমর্দিত করেছে, তা ভাবলে আমার কষ্ট হয়। এই যে সেদিন এক ভদ্রলোক তার মেয়ের জ্যোতিষীক ‘দেবগণ নিয়ে এমন গর্বিত হয়ে বসে থাকলেন যে, “রাক্ষস’গণের এক প্রেমিক-রাক্ষস যুদ্ধে ক্ষান্তি দিয়ে মেয়েটির ব্যাপারে অজস্র প্রেম নিবেদন করে বাড়ি ফিরে গেল। আমি যত বোঝানোর চেষ্টা করলাম- বিয়ের ব্যাপারে এটা এত কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়– তোমার মেয়ে দেবগণ বলে এমন কিছু দেবপ্রতিমা নয় যে, সর্বদা সে দেবতার আচরণ করে বেড়াচ্ছে। তার হাতে লক্ষ্মীর ঝাপিও নেই, সরস্বতীর বীণাটিও নেই, বরং প্রেমের ক্ষেত্রে তার যে অভয়মুদ্রাটি ছিল, সেটাও এখন গুটিয়ে যাচ্ছে বাবা-মায়ের অল্পশিক্ষিত জ্যোতিষচর্চায়। বলি, এটা কোনও কারণ হল বিয়ে ভাঙার? তোমার নিন্দিত রাক্ষসগণের চেয়ে রাক্ষস তো তথাকথিতভাবে আরও খারাপ, সেই স্বয়ং রাক্ষসের সঙ্গে বিয়ে হলেও প্রেম-ভালবাসার ক্ষেত্রে কোনও ক্ষতি হয় না।

আমার চিৎকার-চ্যাঁচামেচি শুনে পরিধানে তীব্রবাস সেই সুন্দরী মেয়েটি ভিতর-ঘর থেকে বেরিয়ে এল। দেখলুম সে একটা গেঞ্জি পরে আছে, যা আমার পাঁচ বছরের নাতনির গায়েই লম্বায় খাটো হবে। যা হোক, সেটাকে কোনও মতে টেনে-টুনে আমার সামনে অর্ধোদর অবস্থায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল– আমিও তো তাই বলি কাকু, এই সব দেবগণ, রাক্ষসগণ এ-সব কী ‘হুইমজিক্যাল’ জিনিস বলো তো? কোনও মানে আছে এ-সবের? আমি বললাম– মানে হয়তো একটা আছে কিন্তু সেই মানেটা তোর বাবা যেমন বুঝছে, এমন নয়। তোর বাবা যেমন বুঝছে, তাতে মনে হচ্ছে যেন ওই ছেলেটা, ওই ফটিক না কনক কী বললি– যেন সে একটা রাক্ষস আর তুই হলি দেবতা। আমার তো বরং উলটোটাই মনে হল। কথাটা বলতেই তো অনুলেখা সোফার কুশন নিয়ে হেঁই মারি কী সেই মারি করে আমার ওপর চড়াও হল। আমি কোনও মতে সেই আলতো এবং আবদারি আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচালুম, তারপর ‘জ্যোতিষ-বচনার্থ’ দেবগণ রাক্ষসগণের তাৎপর্য বোঝালুম, তাতে মেঘ কেটে গেল অনেকটাই, অবশেষে তাদের বিয়েও সুসম্পন্ন হয়েছে। সুখী দম্পতি এখন তারা মাঝে মাঝে নিজেদের সুখহীনতা নিয়ে যত ঝগড়া করে, তার চেয়ে সুখ নিয়ে ঝগড়া করে বেশি। তাতে ‘জ্যোতিষবচনার্থ’ আমি আবার বলেছি- এই দেবাসুরের শাশ্বতিক দ্বন্দ্ব দেবগণ আর রাক্ষসগণের তাৎপর্য বহন করে এবং সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে পৃথিবীর তাবৎ দম্পতিকুলের সকলেই একজন রাক্ষস আর একজন দেবতা।

ঘটনা ঘটেছে আরও একটা। আমেরিকার ওয়াশিংটন অঞ্চলের এক অস্থায়ী ভারতীয় বাপ আমাকে টেলিফোনে হা-হুঁতাশ করে জানালেন যে, তার ছেলে একটি নিগ্রোজাতীয় রমণীকে অতিশয় ভালবেসে বিয়ে করতে চাইছে, এখন কী কর্তব্য। ঘটনাচক্রে আমি ভদ্রলোককে জানতাম। এই কলকাতাতেই একটি মেয়ের সঙ্গে পূর্বে তার পুত্রের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। খুব সুন্দরী না হলেও মেয়েটি যথেষ্ট ভাল ছিল, কিন্তু বর্ণাশ্রমের মৌখিকতা এবং ঐকান্তিক বংশমর্যাদার কারণে তিনি সে বিয়েতে ঘোরতর অমত করেছিলেন বলেই সেই বিয়েটা হতে পারেনি। তাতে তার ছেলে অতিক্রুদ্ধ হয়ে পড়াশুনোয় মন দিল এবং তারপর আমেরিকা চলে গেল। ভালই চলছিল তার পাঠান্তের চাকরি, এরই মধ্যে বছর চারেক যেতে-না-যেতেই পূর্বকথিত নিগ্রো-সুন্দরী তার হৃদয় অধিকার করল। বাবা-মা সমস্ত কর্ম এবং আলস্য ত্যাগ করে ছেলের ওপর ওই নিগ্রো-হৃদয়ের আক্রমণ রোধ করার জন্য দৌড়ে উড়ে গেলেন আমেরিকায়।

বলা বাহুল্য, তাদের অপছন্দ হল এবং ক্রমিক হৃদয়-চাপ প্রশমনের জন্য আমাকে টেলিফোন করলেন ছেলের অনুপস্থিতিতে। বললেন এমনভাবে যেন ‘খোকা আমার কিচ্ছু বোঝে না মা’, শুধু মেয়েটারই দোষ। তাকে নাকি রাক্ষসীর মতো দেখতে, হাসলে পরে দাঁতের মাড়ি বেরিয়ে পড়ে এবং সে ব্যাঙ এবং গোরু প্রেমানন্দে খায়। অনেক বর্ণনা এবং তার আগ্রাসী ভালবাসার বিচিত্র উদাহরণ শোনার পর আমি ছেলের বাবাকে বললুম– আপনার আর কিছুই করণীয় নেই, আপনি ফিরে আসুন কলকাতায় এবং মাহেন্দ্রক্ষণ দেখে একটি প্রগতিশীল পুরোহিত নিযুক্ত করুন। তারপর উলুধ্বনি এবং শঙ্খনাদ সহযোগে ইতরজনকে মিষ্টান্ন বিতরণ করে ছেলের বিয়ে দিন।

ছেলের বাপ ভদ্রলোক এবার আমার ওপরেই রেগে গেলেন এবং বললেন আপনাকে আমি কী এইজন্য ফোন করেছিলাম? আমি বললাম– তা হলে কীসের জন্য ফোন করেছিলেন, আপনার দ্বিতীয় বারের অন্যায় প্রলাপে মদত দেব বলে? আপনি তো জানেন– প্রেমের ব্যাপারে আমি ভীষণ রকমের উদার। কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে’– এই ঋষিবাক্যে যদি বিশ্বাস থাকে এবং তা থাকতেই হবে, নইলে গত্যন্তর নেই– তা হলে আপনার মতে ওই রাক্ষসীর মতো মেয়েটির সঙ্গে ছেলেটির বিয়ে দিন, সে রাক্ষসীর মতো আপনার ছেলেকে ভালবাসবে। ছেলের বাবা আমার পরিহাসে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে আরম্ভ করলে আমি বুঝলাম– ভদ্রলোককে কিঞ্চিৎ শাস্ত্রীয় সান্ত্বনার প্রলেপ দেবার দরকার। কেননা আগের বারেও তিনি সস্ত্রীক যেভাবে ছেলের বিয়ে ভেঙে দিয়েছিলেন, সেখানেও তিনি খানিকটা ব্রাহ্মণ-শূদ্র ইত্যাদি বর্ণ-বাধার সংস্কারে চালিত হয়েছিলেন, আর এখন তো একে বিদেশিনী তাতে নিগ্রো, ফলে ভারতীয় বর্ণবিধির সমস্ত সাম্মানিক বিকল্পগুলিই একেবারে ঘেঁটে গেছে। অতএব এমন একজন বিভ্রান্ত শঙ্কাকুল মানুষকে শান্ত করার জন্য দ্বিতীয় দফায় দূরভাষণ আরম্ভ করলাম খানিক পরে।

ভদ্রলোককে বললাম দেখুন, ভারতবর্ষ একশো কোটির দেশ। এখানে যদি শুধুই বামুনে-বামুনে আর ক্ষত্রিয়ে-ক্ষত্রিয়ে বিয়ে হত, তা হলে অন্য বর্গের সুন্দরীরা সব এতকাল উপোস করে আছেন নাকি! বিশেষত যে-দেশের নীতিশাস্ত্রকারেরা শ্লোক বেঁধে বলেছে। ‘স্ত্রীরং দুঙ্কুলাদপি’– ভাল মেয়ে হলে যত খারাপ বর্ণই হোক, তাকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে এসো, সেখানে কি আপনি মনে করেন যে, বামুন-কায়েত-ক্ষত্রিয়রা সব উপোস করে বসে থাকেন বর্ণ-মিশ্রণ, বর্ণ-সংকর তো হতই, এতটা হত বলেই তো খোদ ভগবদ্গীতার মধ্যে প্রথমাধ্যায়েই বর্ণ-সংকরের ভয় দেখানো হয়েছে। সমাজে বারবার ব্যাপারটা ঘটত বলেই ভগবদ্গীতাও আপনার মতোই বলেছে– মেয়েগুলো সব ভারী দুষ্টু, আর মেয়েরা দুষ্টু হলেই সমাজে বর্ণ-সংকর তৈরি হয়– স্ত্রী দুষ্টাসু বাষ্ণেয় জায়তে বর্ণসংকরঃ।

ওই একই কথা হল– গীতা বলেছে দুষ্টু, আর আপনি বলেছেন রাক্ষসী। রাক্ষসী মেয়েটা আপনার ছেলেকে গ্রাস করেছে। তা আমি বলি- ভগবদ্গীতার সেই সামাজিক ছেলেগুলো কি সব ধোয়া তুলসীপাতা যে, রাক্ষসীরা সব এসে তুলসীপাতা চিবোচ্ছে, নাকি আপনার ছেলেটি ওই ‘ফুরিতোত্তরাধরা’ নিগ্রো রমণীটির প্রতি কোনও আগ্রাসনী মত্ততায় ধেয়ে যায়নি। জেনে রাখুন মশাই, ভারতবর্ষের সভ্যতায় মহামানবের সমুদ্রমন্থন ঘটেছে। স্বয়ং মনু মহারাজ যিনি সবর্ণ-বিবাহের বিধিবিধান দেবার ব্যাপারে আমাদের পিতামহ সমান, তিনি পর্যন্ত বুঝেছিলেন যে, যত ধর্ম-কর্ম, যাগ-যজ্ঞ-অগ্নিহোত্র করুক, নিম্নবর্ণের তেমন সুন্দরী গুণবতী মেয়ে দেখলে দেবতারাই নিজেদের কন্ট্রোল করতে পারেন না, তো বামুন-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য। মনু ওইজন্য বলে রেখেছেন– যদি এমন অত্যাসক্তি তৈরি হয়, তা হলে ধর্মরক্ষা করার জন্য প্রথম বিবাহটি সবর্ণেই করো, অর্থাৎ একটা ধর্মবিবাহ আগে সংঘটিত হোক বামুনে-বামুনে, ক্ষত্রিয়ে-ক্ষত্রিয়ে অথবা বৈশ্য-বৈশ্যে। তারপর যদি নিজেকে সংযত করতে না পারো তবে নিজাপেক্ষা নিম্নবর্ণে বিবাহ করতে পারো, তবে সেটা হবে কামজ বিবাহ, অর্থাৎ কিনা বুঝে নিতে হবে সেই বিবাহের মধ্যে কাম আছে, শিথিল ভাষায় ‘সেনসুয়ালিটি আছে, ‘সেক্সুয়ালিটি আছে। মনু মহারাজ মার্কা মেরে দিয়েছেন একেবারে।

আমেরিকার ভদ্রলোক এবার আমতা-আমতা করে বললেন– তা হলেই দেখুন– এটা একেবারেই কামজ বিবাহ, আর ওই রাক্ষুসে মেয়েটাই এর জন্য দায়ী। বার বার এক কথা শুনে আমার এবার ভারী রাগ হল। আমি বললাম- দেখুন, এইরকম একটা নাম দেবারও শাস্ত্রীয় কারণ আছে এবং সেটা শাস্ত্রীয় পরিশীলন দিয়েই বুঝতে হয়। নইলে নিচু জাতের মেয়ে পছন্দ করাটাই শুধু কামজ ভাবনা, আর আপনারা কি সব ‘প্লেটনিক’ চালিয়েছেন এতকাল? তা ছাড়া মনু-মহারাজের কড়া শাসনের মধ্যেও তার বাস্তব বুদ্ধিটা খেয়াল করুন। হ্যাঁ, নৈতিকভাবে তিনি অসবর্ণ বিবাহ পছন্দ করেন না, কিন্তু তিনি এটাও বুঝেছিলেন যে, ব্রাহ্মণই হোক আর ক্ষত্রিয়ই হোক, তিনি কোনওভাবেই তাদের কামনার গতি রুদ্ধ করে দিতে পারবেন না। অতএব নৈতিকতার জায়গায় সবর্ণে ধর্মবিবাহের নির্দেশ দিয়ে অসবর্ণ বিবাহগুলিকে কামজ বলে চিহ্নিত করেছেন।

ভদ্রলোককে এবার বোঝালাম যে, মনুর সময়ে এমনকী তার বহু কাল পরেও এই বিংশ শতাব্দীর গোড়ায়ও সমাজে বহুবিবাহ চলত। অতএব ধর্ম এবং কাম দুটোই যথাযথ লাভ করেছেন বহুগামী পুরুষেরা। কিন্তু এখন সরকারি আইনে ধর্ম-কাম যখন একের মধ্যেই লাভ করতে হবে, তাই আর নিজে মনু-মহারাজ হয়ে ওঠার অপচেষ্টা করবেন না। ছেলে যা করছে খুশি মনে মেনে নিন। আর আমার শেষ কথাটা শুনুন– আপনি এত রাক্ষসী রাক্ষসী করছেন, মহাভারতের যুগে মধ্যম পাণ্ডব ভীম তো খোদ এক রাক্ষসীকেই বিয়ে করেছিলেন, সেখানে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির পর্যন্ত সেই বিয়েতে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন, সেখানে আপনি কোথাকার কোন ধর্মরাজ এসেছেন যে, এই নিগ্রোসুন্দরীকে ছেলের জীবন থেকে মুছে দিতে চাইছেন? মনে রাখবেন– ভারতবর্ষ নীতি-নিয়ম অনেক করেছে, কিন্তু তাই বলে হৃদয় ভাঙার মন্ত্র শেখায়নি কখনও। আমাদের দেশে রাক্ষসীরাও বৈবাহিক প্রক্রিয়ায় অপাঙক্তেয় নয়– তুমিও এস, তুমি এস, তুমিও এস এবং তুমি৷ আপনি আমার কাছে হিড়িম্বার ভালবাসার কথা শুনুন, আপনার তথাকথিত রাক্ষসী বউমার সঙ্গে মিলবে ভাল।

.

০২.

জানেন তো আপনারা সবাই মানালি বলে একটা স্বর্গসুন্দর জায়গা আছে। সেখানে উচ্চচুড় পাহাড়ের মধ্যে শত শত পাহাড়ি গাছের মাঝখানে আছে হিড়িম্বার মন্দির। প্রথমে তো অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এখানে এই হিমাচল প্রদেশের প্রত্যন্ত ভূমিতে হিড়িম্বার অধিষ্ঠান হল কী করে? পরে সেখানকার ফলক দেখে বুঝলাম আমাদের শক্তিরূপিণী পরমা দেবীর সঙ্গে হিড়িম্বা এখানে এক হয়ে গেছেন এবং দেবী নাকি তত্রস্থ রাজ্যভ্রষ্ট রাজাকে হিড়িম্বার বেশে দেখা দিয়ে তাকে স্বপ্নদেশ দেন। পণ্ডিতজনেরা বলছেন– এই রাজা নাকি বাহাদুরসিং এবং তিনিই নাকি ১৫৫৩ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা যুদ্ধ জয় করে রাজ্য ফিরে পান। সেই রাজাই প্রতিষ্ঠা করেন হিড়িম্বার মন্দির এবং এখনও সেখানে দেবী হিড়িম্বার নিত্যপূজা অব্যাহত। ভারী ভাল লাগল, এই নির্জন অরণ্য পরিবেশে হিড়িম্বার মন্দির দেখে। মন্দিরের বিগ্রহের কোনও ছিরিছাঁদ নেই। চারদিকে পাথরের দেয়াল আর তারই মাঝখানে যেন গুহাহিত হিড়িম্বা। বেশ মানায়।

আমার কাছে অবশ্য হিড়িম্বার তাৎপর্য অন্যখানে এবং সেই তাৎপর্যেও তাকে দেবী বলে সম্বোধন করতেই আমার ভাল লাগে। মহাভারতে পাণ্ডবরা তখন জতুগৃহের আগুন থেকে মুক্তি পেয়ে সুড়ঙ্গ-পথে গঙ্গার ধারে এসে উঠেছিলেন। সেখানে মহামতি বিদুরের বিশ্বস্ত লোক একখানি নৌকা নিয়ে এসেছিল এবং তাতে করেই গঙ্গা পেরিয়ে রাত্রির নক্ষত্র-নির্দেশে দক্ষিণ দিকে চলতে আরম্ভ করলেন– ততো নাবং পরিত্যজ্য প্রযযুদক্ষিণাং দিশম। জতুগৃহের অবস্থান বারণাবতে, এখনকার দিল্লি থেকে সে-জায়গা খুব দূরে ছিল না এবং পাণ্ডবরা যদি গঙ্গা পেরিয়ে দক্ষিণ দিকে গিয়ে থাকেন, তবে সেটা কুলুমানালির পাহাড়ি জায়গা নয় বটে, কিন্তু সে জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দৰ্য্য কিছু কম নয়। কারণ পাণ্ডবরা এখানে বিশাল অরণ্যভূমি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত পঞ্চালে পৌঁছেছিলেন, যেটা এখনকার বেরিলি-বদায়ুনের কাছাকাছি। এই গভীর অরণ্যভূমির মধ্যেই হিড়িম্বার সঙ্গে দেখা হয়েছিল মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেনের।

জতুগৃহে আসন্ন মৃত্যুর দুর্ভাবনাকে জীবনে রূপান্তরিত করার জন্য পাণ্ডবদের মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়েছিল অনেক, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রাত্র-জাগরণ, আবার সেই রাত্রের আঁধারে পথ চলা। সব কিছু মিলে জননী কুন্তী আর চার পাণ্ডব ভাই ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় এবং ক্লান্তিতে একেবারে শুয়ে পড়লেন বটগাছের তলায়। কিন্তু এত সব ঝামেলার মধ্যেও যাঁর কোনও ‘টেনশন’ নেই, রক্তচাপ নেই তিনি হলেন মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেন। জতুগৃহের শেষ আগুনটা তিনিই লাগিয়েছেন এবং এই অগম্য পথে তিনি বেশ খানিকটা বয়ে এনেছেন জননীকে এবং ভাইদেরও। জলের আশায়, ক্লান্তিতে সবাই যখন বট গাছের তলায় শুয়ে পড়লেন, তখন ভীম বললেন– খানিকটা দূরে জলচারী সারস-বকদের ডাক শুনতে পাচ্ছি, তোমরা অপেক্ষা কর, আমি জল নিয়ে আসছি। ভীম জল নিয়ে এলেন এবং এসে সবাইকে নিদ্রিত অবস্থায় দেখে বিড় বিড় করে দুর্যোধনকে বেশ খানিকটা গালাগালি দিলেন। তাতে ক্ষুব্ধ মনও যেমন তার শান্ত হল খানিকটা, তেমনই শাপদসংকুল অরণ্যের মধ্যে নিজে জাগ্রত থেকে সকলকে পাহারা দেওয়ার কাজটাও তার কাছে অনেক সহজ হয়ে গেল।

ঠিক এইরকম এক অবস্থাতেই পঞ্চপাণ্ডব এবং তাদের জননীকে দেখতে পায় নরমাংসভোজী রাক্ষস হিড়িম্ব। অনেক দিন পরে এতগুলি মানুষকে স্বয়মাগত ভোজ্য হিসেবে লাভ করে অতি প্রীত হয়ে সে ভগিনী হিড়িম্বাকে বলেছিল– মানুষের গন্ধে আমার জিভে জল আসছে, জিভটা যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে মুখ থেকে জিঘ্ৰতঃ প্রজ্ঞতা স্নেহাজ্জিহ্বা পৰ্যেতি মে মুখাৎ। তুই বাপু যা, মানুষগুলোকে মেরে নিয়ে আয়, আমরা দুই ভাইবোনে মিলে বহুকাল নরমাংস খাইনি।

মহাভারত রামায়ণে রাক্ষস-রাক্ষসীদের বর্ণনা যত ভয়ংকরই হোক, রামায়ণে রাবণ কুম্ভকর্ণ-বিভীষণকেও যেমন আমি কোনওমতেই অসভ্য বর্বর এবং মনুষ্যেতর কোনও ‘স্পিসিস’ ভাবি না, তেমনই মহাভারতের হিড়িম্ব, হিড়িম্বা বা বক রাক্ষসের মধ্যে রাক্ষসত্ব কিছুই নেই, যা আছে তা অনেকটাই তাদের অতিমানুষিক ক্ষুধা, লোভ এবং চেহারার বর্ণনা দিয়ে একটা রাক্ষসোচিত ভাব প্রকাশ করা। বস্তুত মহাভারতীয় রাক্ষসদের আমরা মূল সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, কখনও বা আর্যেতর গোষ্ঠীভুক্ত এবং প্রধানত শারীরিক শক্তিতে অতিশক্তিমান গুন্ডা-বদমাশ বলে মনে করি। খেয়াল করে দেখবেন, হিড়িম্ব ভগিনীকে আধুনিক একটি ‘মাস্তান’-এর মতোই বলেছে–ওরা যেহেতু আমারই এলাকায় শুয়ে আছে। অতএব তোর কোনও ভয় নেই। তুই ওদের মেরে নিয়ে আয়– অস্ম বিষয়সুপ্তেভ্যো নৈতেভ্যো ভয়মস্তি তো হিড়িম্ব এবং হিড়িম্বা নাম দুটির মধ্যে ভাষাগত ভাবে যে সব বর্ণ ব্যবহৃত হয়েছে, তাতে অবশ্য তাদের আর্যেতর গোষ্ঠীর মানুষ বলতে খুব একটা অসুবিধে হয় না এবং হয়তো সেইজন্যই মহাকাব্যের পরিসরে তারা রাক্ষস-রাক্ষসী বলে চিহ্নিত হয়েছেন।

সে যাই হোক, হিড়িম্ব রাক্ষসের নির্দেশ পেয়ে তার ভগিনী হিড়িম্বা প্রায় লাফিয়ে লাফিয়েই সুখসুপ্ত পাণ্ডবদের কাছে এল। কিন্তু বলিষ্ঠ দেহ বিশালকায় ভীমসেনকে দেখে হিড়িম্বার বড় ভাল লাগল। তার মনে হল– এই উজ্জ্বলকান্তি সিংহসদৃশ পুরুষটিই তার স্বামী হবার উপযুক্ত– ভর্তা যুক্তো ভবেন্মম। কী অনাবিল, ছলনাহীন এই সিদ্ধান্ত। বিদগ্ধা আর্য রমণীর সুরুচিসম্পন্ন হাব-ভাব হিড়িম্বা জানে না। নাগরিকার বৃত্তিতে নিষেধের মাধ্যমে ‘হা’-বলা কিংবা কোনও কথা না বলে শুধু ভঙ্গিতে অনেক কথা বলার আদত সে শেখেনি, শেখেনি নাগরিক বিলাস। তার যা মনে হয় তাই বলে এবং তা বলতে তার এতটুকু দ্বিধা লজ্জা নেই।

মধ্যম পাণ্ডবকে যে মুহূর্তে সে দেখেছে, সেই মুহূর্তেই তার হৃদয়ে আবেগ উত্তাল হয়ে উঠেছে। সে মনে মনে ভাবল– আমার ভাই এঁদের মারতে বলেছে, কিন্তু আমি কিছুতেই তা করব না। কেননা ভাইয়ের ভালবাসার চেয়ে স্বামীর ভালবাসা অনেক বেশি উপভোগ্য এবং সে ভালবাসার পরিমাণও অনেক বেশি পতিস্নেহোহতি বলবান্ তথা না ভ্রাতৃসৌহৃহদম। এদের যদি মেরে ফেলি তবে আমার ভাই আর আমার সাময়িক রসনা-তৃপ্তি হবে। কিন্তু এই পুরুষটিকে না মেরে বরঞ্চ যদি তাকে স্বামী হিসেবে বরণ করি, তবে কত কতকাল এঁর সঙ্গে আমি সুখে আমোদে কাল কাটাব– অহত্বা তু মোদিষ্যে শাশ্বতীঃ সমাঃ।

এইখানে দুটো কথা আছে– একটা পুরনো কথা, যেটা বললে আধুনিক মহিলারা প্রতিক্রিয় হবেন। আর দ্বিতীয়টা আধুনিক কথা, যেটা শুনলে পুরাতনেরা দুঃখিত হবেন এবং আধুনিক মহিলারা মেনেও না মানার ভান করবেন অথবা শেষ পর্যন্ত দুঃখিতই হবেন। একজন শাস্ত্রীয় রমণীর মুখেই এ-কথা বেরিয়েছিল যে, অবিবাহিত অবস্থায় পিতা-মাতা এবং ভাই-দাদারা একটি মেয়েকে যত আদর দিতে পারে অথবা যত অর্থ-বিত্ত-ঐশ্বর্য দিতে পারে, সেই আদর অথবা সেই ধনৈশ্বর্যদানের একটা সীমা আছে; কিন্তু একজন বিবাহিত স্বামী যে আদর অথবা যে অর্থধন স্ত্রীকে দিতে পারেন, তার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। আজকের দিনের প্রগতিবাদিনীরা এই আত্যন্তিক স্বামী-গৌরবে বিরক্ত হতে পারেন এবং এটাও সত্যি যে, ভারতবর্ষের সহস্র বিবাহ-জীবনে স্ত্রীরা স্বামীদের কাছ থেকে যত অর্থ-বিত্ত লাভ করেছেন সেটা সীমাহীন নয় অনেক সময়েই, হয়তো বা তার অর্থনৈতিক কারণও থাকতে পারে যথেষ্ট। এমনকী অর্থ-বিত্ত লাভ করলেও তার উপরে স্ত্রীলোকের সঠিক স্বাতন্ত্র ছিল কিনা, সেটাও ভাববার মতো বিষয়। তা ছাড়া আদরের ব্যাপারটাও যথেষ্ট সংশয়িত ছিল- এত লোকাপেক্ষা, পিতৃতন্ত্রের অনন্ত দায়বদ্ধতা, সব কিছু মিলিয়ে স্ত্রীর প্রতি আদর-যত্নও অনেক সময় স্বামীদের কাছে আচরণহীন যান্ত্রিকতায় পরিণত হত। অর্থাৎ কিনা আমরা স্বীকার করতে চাই যে, পূর্বোক্ত শাস্ত্রীয় ভাবনার একটা অন্ধকার দিকও আছে, যেখানে পশুপালনের মতো প্রতিপালনের দিকটাই বড় হয়ে ওঠে, অনাবিল উদার আদর অথবা নিঃস্বার্থ সীমাহীন অর্থধারাও এখানে পদে পদে খণ্ডিত।

এই সত্য মেনে নিয়েও বলি– আমি চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেও এমন বহু মেয়েকে নিজেকে চোখে দেখেছি, তারা বাপের বাড়ির পিতৃতন্ত্রে ভাই-দাদাদের আদর-যত্ন পরখ করতে-করতে এমন কথা বার বার বলতেন– বিয়ে হলে আর এই অবস্থা থাকবে না। আমি শুধু বিয়ের অপেক্ষায় আছি। এই আশা এবং এই প্রতীক্ষাটুকু সব সময় সর্বাংশে যে সত্য হয়েছে, তা নয়, অথবা যতটা স্বপ্ন ছিল ততটা হয়তো সত্য হয়নি, কিন্তু সেই বিয়ের দিনে যে বৈবাহিক আড়ম্বর তৈরি হয়– শাড়ি-গয়না উপহার সব মিলিয়ে একটা অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য অবশ্যই তৈরি হয় যা চলতেও থাকে বেশ কিছু দিন। আর স্বামী যদি ভালমানুষ হন, তার আদর এবং ভালবাসা যদি দিন-দিনান্তরে বাড়তেই থাকে তবে অর্থ-বিত্তের আয় ব্যয়ে স্ত্রীর স্বাধীনতা এসেই যায়। লক্ষণীয়, অতি প্রাচীন কালে মনু-মহাভারতের কালেও অর্থের আয়-ব্যয় সংক্রান্ত হিসেব রাখার ব্যাপার অনেক সময়েই স্ত্রীর ওপরে বর্তাত এবং সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত সাংসারিক আয়-ব্যয় স্ত্রীরাই সামলাচ্ছেন, এটা হরবকত দেখি। ফলত ব্যতিক্রম থাকা সত্ত্বেও নিজের হাতে স্বামীর সংসার সামলানোর মধ্যে যে অযান্ত্রিক স্বাধীনতা তৈরি হয়, তাতেও স্ত্রীরা অনেক সময়েই সুখী থাকেন। বিশেষত তার সঙ্গে স্বামীর আদর ভালবাসা যুক্ত থাকলে এ-কথা মনেই হতে পারে যে, স্বামী যতটা দেন এবং যতটা ‘স্পেস’ ছেড়ে দেন, বাপ-ভাইরা তা দেয় না। হিড়িম্বা সেটাই স্পষ্ট করে বলেছে– স্বামীর ভালবাসা অনেক ভাল, অন্তত ভাইয়ের ভালবাসার চেয়ে অনেক ভাল পতিস্নেহোহতি বলবান্ তথা ন ভ্রাতৃসৌহৃদম। হিড়িম্বা এতদিন শুধু হিড়িম্ব ভাইয়ের খিদমতগারি করেছে, রাক্ষস ভাইয়ের যথেচ্ছ অন্যায় অসভ্যতায় তাকে মদত দিতে হয়েছে। সে এই করুণ অনাদৃত জীবন থেকে এখন বেরিয়ে এসে বৈবাহিক জীবন লাভ করতে চায়।

এবার দ্বিতীয় ভাবনাটা বলি। এটাই তো সার্বিকভাবে দৃষ্ট এবং শ্রুত যে, সুন্দরী মেয়ে দেখলে যুবক পুরুষেরা খানিক উত্তাল হয়ে ওঠে। বিশেষত রমণীর স্তন-জঘন বিস্তারে পুরুষের কামার্ততার দৃষ্টান্তই হাজার হাজার। কিন্তু সাধারণ স্বীকৃতি এইরকমই যে, মেয়েরা এইরকম নয়। সুন্দর মোহন পুরুষ দেখলেই তারা হামলে পড়ে না এবং অনুরাগ দেখায় না প্রকট করে। আর যদি বা কোনও পুরুষের জন্য কোনও মেয়ে তার পছন্দটা প্রকট করে তোলে, তা হলে সমাজ সেটা ভাল চোখে দেখে না এবং এই ধরনের মেয়েদের খারাপ মেয়ে বলে চিহ্নিত করতে কোনও দ্বিধা করে না। কিন্তু পণ্ডিতজনেরা জানাচ্ছেন যে, সুন্দরী মেয়ে দেখলে পরে পুরুষের জৈব আকর্ষণ যেমন স্বাভাবিক, তেমনই বলিষ্ঠ সুন্দর পুরুষ দেখলে মেয়েদের আকর্ষণটাও সেইরকমই স্বাভাবিক, এমনকী সেই আকর্ষণ প্রকট করে তোলাটাও ভীষণ রকমের অস্বাভাবিক ভাবার কোনও কারণ নেই।

পরম নান্দনিক সরসতায় এই কথাটা অবিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে বটে, কিন্তু বৌদ্ধিক চেতনায় তথা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এই সত্যই উন্মোচিত হয়েছে যে, তেমন সুপুরুষের জন্য রমণীর লালসাও প্রায় একইরকম। ডানিয়েল বার্গনার নামে এক ভদ্রলোক নিউইয়র্ক টাইমস-এর একটি সংখ্যায় মেরিডিথ শিভারস-এর একটা ইন্টারভিউ-এর বিবরণ দিয়েছেন। মেরিডিথ ওনটারিও তে কুইন ইউনিভার্সিটির প্রোফেসর এবং তিনি রমণীর মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় অগ্রণী মহিলা বলে চিহ্নিত। ছত্রিশ বছর বয়সি এই মহিলা টরোন্টো ইউনিভার্সিটির মনস্তত্ত্বের গবেষণাগারে বেশ কিছু মহিলা এবং পুরুষকে চেয়ারে বসিয়ে তাদের অনুভূতিপ্রবণ যৌনাঙ্গের সঙ্গে আধুনিককালের অনভূতিগ্রাহক বিদ্যুচ্চালিত যন্ত্রের সংযোগ স্থাপন করে রেখেছিলেন। অতঃপর একটি বিশিষ্ট প্রজাতির শিম্পাঞ্জি-যুগলের নগ্ন মিলন দৃশ্য দেখিয়ে পুরুষ এবং রমণীদের যৌন প্রতিক্রিয়া যান্ত্রিকভাবে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। এছাড়াও দৃশ্যগতভাবে আরও রোমাঞ্চকর কিছু ছিল।

মেরিডিথ বৈদ্যুতিন যন্ত্রানুষঙ্গে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, উদ্দীপনের ক্ষেত্রে সময় বুঝে, মানুষ দেখে, মেয়েদের যৌন প্রতিক্রিয়াও একইরকম। মেরিডিথের পরীক্ষা প্রক্রিয়াগুলি বিশদভাবে বোঝানো যেত হয়তো, কিন্তু তাতে অতি-আধুনিকা হলেও তাদের অস্বস্তি বাড়বে। হয়তো এটাও মানব যে, সুপুরুষ দর্শনে উদ্দীপনা-উত্তেজনা হলেও তার বাঁচিক প্রকাশ হয়তো অনেকটাই অনেকের ক্ষেত্রে অপ্রকাশ্য থাকে, আর মুখ-চোখের হাব-ভাবের পরিবর্তন ছাড়া দৈহিক বিকার বাইরে পরিস্ফুট হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই, অথচ পুরুষেরা এখানে প্রায় নাচার মেরিডিথ লিখেছেন।

ঘটনা হল, মধ্যম পাণ্ডবের পৌরুষদৃপ্ত চেহারা, যা সম্পূর্ণ মহাভারত জুড়ে বারবার ঘোষিত– সোনার মতো গায়ের রং, বিশাল লম্বা চেহারা, দীর্ঘ বাহু, পেটানো কাধ এবং তার মধ্যে দাড়ি-গোঁফ খুব কম বলে তাকে আরও মসৃণ চিকন লাগে। ভীমের চেহারা দেখে হিড়িম্বা রাক্ষসী একেবারে পাগল হয়ে গেল। নিজের কাছে নিজেই সে বলেই ফেলল– সিংহের মতো দৃপ্ত চেহারা, লম্বা, কঠিন পৌরুষেয় অথচ এমন গায়ের রং যেন দ্যুতি বেরোচ্ছে শরীর থেকে– অয়ং শ্যামো মহাবাহুঃ সিংহস্কন্ধো মহাদ্যুতিঃ। এই মানুষটাকেই আমি আমার জীবনসঙ্গী স্বামী হিসেবে চাই। মেরিডিথ শিভারস্ এবং আরও যারা female sexuality-র কথা সোচ্চারে বলেন, তাঁদের কথা সত্য বলেই হিড়িম্বার দিক থেকে এমন অগ্রণী ভূমিকা রাক্ষসী ভীমকে মনে মনে চাইল আপন কামনা-পূর্তির জন্য– রাক্ষসী কাময়ামাস রূপেণাপ্রতিমং ভুবি এবং এই চাওয়াটা এতটাই তীব্র যে, তার জন্য হিড়িম্বা তার এতকালের ভাই হিড়িম্ব রাক্ষসকেও ত্যাগ করতে রাজি। এমন একটা পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হলে সেটা তার ভাই হিড়িম্বের সাহচর্য থেকে অনেক ভাল বলেই তার ধারণা। এক সাহেব গবেষক অবশ্য এ-বিষয়েও একটা মন্তব্য করেছেন এবং সেটা হিড়িম্বার সম্বন্ধে বেশ খাটে। সাহেব লিখেছেন–Females could benefit from both paterনাl care and good genes offered by long-term male partners; however, because males displaying in dicators of genetic quality are attractive, they are in demand as sex partners, and they shift their efforts towards mating at the expense of providing paterনাl care.

হিড়িম্বার বাপ নেই, সে ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে থাকে। এতকাল পরে এমন একটা সুপুরুষ দেখে তার যৌন সাহচর্যও সে যেমন কামনা করছে, তেমনই তাকে সারা জীবনের সঙ্গী করে নেবার মধ্যে তার একটা বুদ্ধিও কাজ করছে এবং সেখানে ভাইয়ের যান্ত্রিক তত্ত্বাবধানের থেকে ভীমের মতো এক শালপ্রাংশু পুরুষের আসঙ্গ এবং দাম্পত্য তার কাছে শ্রেয় মনে হচ্ছে– পতিস্নেহহহতি বলবান্ তথা ন ভ্রাতৃসৌহৃদম্।

আসঙ্গ-লিপ্সা এবং প্রেমের দাম্পত্যে তার যুক্তি এতটাই সরল এবং সোজা যে, হিড়িম্বার বক্তব্য হল– ভাইয়ের সঙ্গে আমার ভাব-ভালবাসার তৃপ্তি তো এইটুকুনি– মুহূর্তমেব তৃপ্তিশ্চ ভবে ভ্রাতুর্মমৈব চ বরঞ্চ ভাইয়ের কথায় এদের না মেরে বাঁচিয়ে রাখলে আমার তৃপ্তি হবে ষোলো আনা– কত বছর আমি এই লোকটার সঙ্গে দিন কাটাব, উঃ ভাবতেই কী ভাল লাগে– মোদিষ্যে শাশ্বতীঃ সমা। সত্যি বলতে কী আবারও বলছি– এইরকম মেয়ে আমি অনেক দেখেছি, আত্মীয়-স্বজন এবং বান্ধবী, স্নেহাস্পদদের মধ্যেও অনেকানেক দেখেছি, যারা বিয়ের নামেই খুব খুশি হয়ে ওঠেন। এর একটা অন্তর্নিহিত কারণও আছে। আজকাল বড় ঘরের একছেলে অথবা একমেয়ের সংসারে ছেলেমেয়েরা যেমন সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে অথবা যতটা অনিয়ন্ত্রণে থাকে, সাধারণ ঘরে তা থাকে না। আর আমাদের অল্প বয়সে যা দেখেছি, তাতে নিম্ন-মধ্য-উচ্চ সমস্ত বিত্তভোগীদের মধ্যেই কন্যা অবস্থায় মেয়েদের ওপর যথেষ্ট এবং কখনও কখনও যথেচ্ছ নিয়ন্ত্রণ খাটানো হত। এমনিতে মেয়েকে সুপাত্রে দেবার কল্পনায় এবং পরিকল্পনায় মেয়েদের গতিবিধির ওপর তো নিয়ন্ত্রণ থাকতই এবং সেটা মেয়ে বলে তার শারীরিক সুরক্ষার মানেই ছিল যে যে পথে পুরুষের দৃষ্টি এবং সদালাপ বন্ধ করা যায় তার ব্যবস্থা করা। আর অন্যদিকে স্বামীর ঘরে গিয়ে কী করতে হবে না হবে, তার কোনও স্থিরতা নেই বলে বাড়িতে মেয়েকে কাজ শেখানোর অছিলায় তাকে দিয়ে প্রায় দাসী-বৃত্তি করানোটা বাপ-ভাইয়েরও রেওয়াজ হয়ে যেত বা এখনও যায়।

আমি শত শত জায়গায় দেখেছি– এমন একটা বদ্ধ অবস্থা থেকে প্রাথমিক মুক্তির জন্য অনেক মেয়েই বিয়ের কথায় প্রচণ্ড সুখী হয়ে ওঠে– শাড়ি, গয়না এবং একায়নী মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠাটাও সাময়িকভাবে অধিকাংশ মেয়েদের একটা সুখখাচ্ছাস তৈরি করে। স্বামীর ঘরে গিয়েও একইরকম দাসীবৃত্তি জোটে কিনা, সেখানেও একইরকম নিয়ন্ত্রণ কিনা– এই তর্ক অনেক ক্ষেত্রে সযৌক্তিক হলেও, আবার অনেক ক্ষেত্রে নয়ও। স্বামীর ঘরে পুত্রকন্যা নিয়ে সংসার করতে করতে অনেকের যে সাংসারিক ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়, সেটাও অনেক বিবাহিত রমণীই পছন্দ করেন। এমনকী স্বামীর রোজগার নিজের হাতে সংসারে ব্যয় করতে করতেও অনেকে এক ধরনের সাংসারিক তৃপ্তি অনুভব করেন এবং কখনও এই শাড়িটা, ওই গয়নাটা অথবা একটি বাড়ি যখন তৈরি হয়– তখন অনেক বাপের বাড়িতে ঈর্ষার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতেও দেখেছি মেয়েদের। বিশেষত একটু বিত্তবান বাড়ির বউ হয়ে গেলে বাপ-ভাইরা তখন সামান্য হলেও যে সাসূয় দৃষ্টিতে ঘরের মেয়েটিকে দেখতে থাকেন, সেটা ভেবে মাঝে মাঝে আমার মায়া হয়।

আজকের প্রগতিশীল নারীবাদী দৃষ্টিতে স্বামীর ঘরে তথাকথিত দাসীবৃত্তি সত্ত্বেও পূর্বাবস্থা থেকে অর্থনৈতিক উন্নতি এবং কখনও সামাজিক উন্নতিকেও কীভাবে দেখা হবে, সেই তর্কের মধ্যে না গিয়েও বলতে পারি– বাপের বাড়ির বাপ-ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি লাভ করে স্বামীর বাড়িতে নিজের ঘর পাওয়াটাকে প্রাচীনেরা অনেকেই একটা বড় পাওয়া বলে চিহ্নিত করেছেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণটা পাওয়া যাবে রামায়ণের নায়িকা সীতার কথায়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, সীতার মুখে সেকালের নারীধর্মে পুরুষতান্ত্রিকতাকে মেনে নেওয়া এবং সেটাকেই বড় করে দেখাটা একটা ট্রেইট’ বটে, কিন্তু তবুও সীতা একটা কথা বলেছিলেন, যেখানে বাপ-ভাই ব্যাপারটার ওপরে একটা হেয় তৈরি হয় এবং আংশিকভাবে হলেও সেটা পুরুষতান্ত্রিকতারও বিরুদ্ধে যায়। কিন্তু আমি বলব– তার চেয়েও বেশি বোধহয় আমার পূর্বকথিত প্রস্তাবনা– স্বামীর বাড়িতে বাপ-ভাইয়ের চরম নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঁচার আভাস।

সীতা বলেছিলেন বাপ যা দেয় তার একটা সীমা আছে, ভাই যা দেয় তারও একটা সীমা আছে, এমনকী নিজের পেটের ছেলে যা দেয় তারও একটা সীমা আছে, কিন্তু স্বামীর ঘরে স্বামী যে সুখ দেয়, তার মধ্যে কোনও সীমা নেই, অমিত নির্বাধ সেই সুখ অতএব স্বামীকে কে না পছন্দ করবে– অমিতস্য হি দাতারং ভর্তারং কা ন পূজয়েৎ। আমি ঠিক এই দৃষ্টিকোণ থেকে হিড়িম্বার কথা ভাবি। হিড়িম্বা বলেছে- ভাইয়ের সঙ্গে আমার ভাব ভালবাসার তৃপ্তি অতি সামান্য, কিন্তু স্বামীর সঙ্গে জীবন কাটানোর তৃপ্তি আমার চিরন্তনী মোদিষ্যে শাশ্বতীঃ সমাঃ। হিড়িম্বার কথা এবং যুক্তির মধ্যে রামায়ণী সীতার তন্ত্রযুক্তি যেমন আছে, তেমনই বাড়তি যেটা আছে এবং যেটা জীবনেও সীতা মুখে বলতে পারবেন না, সেটা হল আসঙ্গলিপ্সা, ভীমের মতো পুরুষের আসঙ্গলিপ্সা।

মনে মনে আসঙ্গলিপ্সায় ঝুঁকে পড়া এক রমণীর সময় লাগে না নিজে অগ্রণী হতে। মহাভারতের কবি লিখেছেন– ভীমের কাছে যাবার সংকল্প তৈরি হতেই হিড়িম্বা এক সুন্দরী রমণীর রূপ ধারণ করল এবং অলৌকিক রাক্ষসী মায়ায় সে খুব সেজেগুজে মোহিনী হয়ে উঠল। রাক্ষসী মায়াতে অসুন্দর সুন্দর হতে পারে কিনা, এই অলৌকিকে বিশ্বাস না করেও বলা যায় পুরুষের চোখে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য সাজগোজ করে সুন্দরী হয়ে ওঠাটা কোনও অ-পূর্ব ঘটনা নয় এবং আমরা বলব– রাক্ষসী মায়ার কাজটা এইখানেই। বিশেষত এখনকার কালে তো এটা সৌন্দর্যের তত্ত্বভাবনার মধ্যে পড়ে– অসুন্দর বলে কোনও তিরস্কার-চিন্তার মধ্যেই আমরা এখন নেই। আমরা বলি– কোনও কিছুই আর অসুন্দর নয়– এটা নির্ভর করে কেমন করে কোন অঙ্গে কোন বিভঙ্গে তুমি শরীরকে ‘প্রেজেন্ট করছ। অসুন্দর বা ঈষৎ সুন্দরকে সুন্দর করে সমক্ষে আনাটাই তো রাক্ষসী মায়া এবং আসঙ্গলিপ্সায় এই মায়া আরও মোহিনী হয়ে ওঠে।

মহাভারতের কবি লিখেছেন– ভীমের কাছে যাবার আগে হিড়িম্বা এক সুন্দরী রমণীর রূপ ধারণ করেছিল এবং অলৌকিক ক্ষমতায় খুব সেজেগুজে, গয়না পরে, আবার সমস্ত শরীরে-মুখে একটা লজ্জা লজ্জা ভাব ঘনিয়ে এনে সে ভীমের কাছে উপস্থিত হয়েছিল। এ-বিষয়ে আমাদের পূর্বলিখিত ধারণা ছাড়াও এখানে একটি মহাকাবিক্য অভিসন্ধি আছে। বলে আমরা মনে করি। বস্তুত আর্যেতর জনগোষ্ঠীভুক্ত একটি রাক্ষসী রমণীর মধ্যে তৎকালীন দিনে অনেক সময়েই এক ধরনের অমার্জিত, অভদ্র, সদাচারহীন স্বতন্ত্রতার আরোপ করা হত। এতকাল একান্তে এই বনের মধ্যে ভাইয়ের খিদমতগারি করতে করতে আভরণহীন, মলমলিন থাকাটাই তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভীমকে দেখার পর সে যখন তার সঙ্গ পাবার জন্য আকুল হল, সে তখন তার অমার্জিত, মলিন রূপ ত্যাগ করে এক আর‍্যা রমণীর বেশভূষায়-অলংকরণে প্রকট করে তুলল নিজেকে। এমনকী সজ্জিত অঙ্গসৌষ্ঠবের মধ্যে একটু নাগরোচিত সলজ্জভাবও সে ফুটিয়ে তুলল মুখে-চোখে, হাবে ভাবে– লজ্জমানেব ললনা দিব্যাভরণভূষিতা। মহাভারতের কবি যাকে রাক্ষসীর মানুষী রূপ বলেছেন, সেটা হয়তো আভরণে, বেশভূষায় এবং আচরণে তার পরিবর্তিত, মার্জিত রূপ।

ভীমের চেহারা দেখে স্বকপোলকল্পনায় প্রেম থেকে একেবারে বিয়ে পর্যন্ত ভেবে নেবার মধ্যে যে রাক্ষসী যুক্তি আছে, তা অত্যন্ত সরল বলেই ঈপ্সিত পুরুষ ভীমের সঙ্গে কথা বলতে হিড়িম্বার কোনও লজ্জা-দ্বিধা হল না। সে নানারকম শারীর বিলোভন সৃষ্টি করতে করতে ভীমের কাছে গেল- উপতস্থে মহাবাহুং ভীমসেনং শনৈঃ শনৈঃ। এবারে ঈষৎ হেসে হিড়িম্বা ভীমকে জিজ্ঞাসা করল– কোথা থেকে এই দেশে এসেছ গো তুমি? তোমার পরিচয়ই বা কী? তুমি কে? সব দেবতার মতো চেহারা, এই পুরুষগুলিই বা কারা। আর এই যে সোনার বন্ন স্ত্রীলোকটি, ইনিই বা কে? এই বনের মধ্যে মাটিতে শুয়ে আছেন সব, যেন মনে করছেন নিজের ঘরেই ঘুমোচ্ছেন। তোমরা কি জানো না– এই বনে ভয়ংকর হিড়িম্ব রাক্ষস বাস করে– বসতি হ্যত্র পাপাত্মা হিড়িম্বো নাম রাক্ষসঃ।

রাক্ষসের সম্বন্ধে জানান দেবার মধ্যে খুব যে একটা ভীতিপ্রদর্শনের ব্যাপার ছিল, তা বোঝা যাচ্ছিল। অপিচ অপরিচিত যুবক পুরুষের সঙ্গে কথা বলে তাকে অনুকূল করার ভাবনাও ছিল হিড়িম্বার মাথায়! সেই কারণেই ভয়ংকরের সংবাদ দিয়েও সেটা যেন ‘আমিই ঠিক করে দিতে পারি সব’– সেই ভূমিকায় নেমে এসে রাক্ষস-ভাই হিড়িম্বের সমস্ত পরিকল্পনা ভীমের কাছে ফঁস করে দিল হিড়িম্বা। হিড়িম্বা বলল– আবার ভাই খুব খারাপ মন নিয়ে একটা কাজ করতে এখানে পাঠিয়েছে আমাকে। সে তোমাদের মেরে তোমাদের মাংস খেতে চায়। কিন্তু না, এটা আমি হতে দেব না। তোমার এই দেবতাপানা চেহারা দেখে আমি আমার ভবিষ্যতের স্বামী হিসেবে আর কাউকে ভাবতে পারছি না। সত্যি বলছি, পারছি না– নান্যং ভর্তারমিচ্ছামি সত্যমেদ ব্রবীমি তে।

আমার গৃহকর্ত্রী এক সময় সখেদে আমাকে বলেছিলেন– যে মেয়ে নিজের মুখে সোজা ভাষায় পুরুষের কাছে প্রেম নিবেদন করে, সাহিত্যের বিদগ্ধ জগতে তো বটেই, বাস্তব জগতেও ভাব-ভালবাসার যে প্রকরণ, তাতে মেয়েদের নাকি কোনও মূল্য থাকে না। যে মেয়ে নিজের মুখে কখনও কোনও নির্দিষ্ট পুরুষের প্রতি আপন আসক্তি জ্ঞাপন করে, সে আপনি বিকোয়, তার স্বপ্রকটিত সহজলভ্যতা পুরুষকে বেশি আকর্ষণ করতে পারে না, বেশি দিন তো নয়ই। সাহিত্যের বিদগ্ধ বৃত্তিতে অথবা নাগরিকতার পরিশীলিত বৃত্তিতে কথাটা অসত্য নয় হয়তো, বিশেষত যাঁদের মানসলোকে যারে যায় না দেখা, যায় যে দেখে– ভালবাসে আড়াল থেকে এমন জাতীয় স্নিগ্ধ রাবীন্দ্রিকতার অহরহ অনুশীলন চলছে, তাদের হয়তো আমার এই জাগতিক বোধটুকু বোঝানো যাবে না, কিন্তু এটাও মানতে হবে যে, পুরুষের পৌরুষেয়তা ভেঙে দেবার পক্ষে এটাও একটা উপচার বটে। বিশেষত ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর রোম্যান্টিক সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে ‘ককেটিশ ফিমেল’-এর আবেদন যদি বা নাকচ হয়ে যায়ও, প্রাচীন সাহিত্য বা জীবনে অথবা আধুনিক জীবন ও সাহিত্যে মেয়েদের সেই নমনীয়, কমনীয়, শান্তশীল বিদগ্ধতাই দৃঢ়ভাবে আচরণীয় কিনা, সেটা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে।

এখনকার দিনে ভিক্টোরিয়ান যুগে Flirt’s Tragedy নিয়ে বই লেখা হচ্ছে, মানুষের ‘শরীর নিয়ে নতুন দার্শনিক ভাবনা আরম্ভ হয়েছে, তার মধ্যে স্ত্রীলোকের সম্ভোগেচ্ছা লুকিয়ে রাখারও খুব একটা দায় থাকছে না। এই অত্যাধুনিক ভাবনায় আল্লুত হবার আগেই কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে যে, মহাভারতের কালে অথবা রামায়ণের কালে কিন্তু অনেক মহিলাই নিজের ভোগেচ্ছার কথা নিজেই বলতে পারতেন। তার জন্য কোনও ‘পোস্ট মডার্নিজমে’রও দরকার হয়নি, অথবা প্রয়োজন হয়নি কোনও উত্তর-ঔপনিবেশিকতার আবেশ। সহজ কথাটা তখন সহজেই বলা যেত এবং এই সহজ ভাবের একটা অন্য মূল্য আছে। কথোপকণ্বনে বক্রোক্তির চমৎকার এখানে থাকে না হয়তো, অথবা থাকে না ধ্বনি-ব্যঞ্জনার মধুর তাৎপর্য, কিন্তু প্রেম ভালবাসার ক্ষেত্রে শারীরিক ভাবনারাশি মূল্যহীন নয় যেহেতু, সেখানে কোনও শরীরী আবেদনই বা এত নিন্দিত হবে কেন। হ্যাঁ, এটা ঠিকই, হিড়িম্বার সপ্রেম বক্তব্যগুলিকে আমরা কোনও উজ্জ্বল উন্নত রসের পর্যায়ভুক্ত করতে পারি না, কিন্তু আত্মনিবেদন যদি সেই রসের অন্যতম উপাদান হয়, তা হলে সেখানেও তো শারীরিক বাসনার ইচ্ছাময় শব্দগুলি অনুচ্চারিত থাকে না। গোপিকাকুল যখন কৃষ্ণকে বলেন– তোমার অধরামৃতপূরকে সিঞ্চন করো আমাদের অধর সিঞ্চাঙ্গ ন হৃদধরামৃতপূরকেণ– তখন কিন্তু আমরা নিজাঙ্গদানে কৃষ্ণসেবার কথা বলি। অতএব হিড়িম্বার আত্মনিবেদনের কথাও আমাদের বুঝতে হবে। হিড়িম্বা ভীমকে বলেছে তোমাকে দেখে আমার শরীর-মন কামনায় মুগ্ধ হয়ে গেছে। আমি তোমাকে এত করে চাইছি বলেই আমাকে তোমায় চাইতে হবে– কামোপহত-চিত্তাঙ্গীং ভজমানাং ভজস্ব মাম।

‘আমি তোমাকে চাই অতএব আমাকেও তুমি চাইবে’- এমন রাক্ষুসে যুক্তি ভীম তার সমস্ত ক্ষত্রিয়জীবনে শোনেননি বটে, তবে এই সরল যুক্তি একমাত্র ভীমের পক্ষেই বোঝা সম্ভব, অন্যের পক্ষে নয়। প্রেম-বিবাহের এই ইচ্ছাপূরণের জন্য হিড়িম্বা অনেক কিছু করতে রাজি। ভীম যদি তাকে স্বীকার করেন তবে সে উপযুক্ত প্রতিদানও দিতে চায়। সেই স্বীকৃতির অপেক্ষায় হিড়িম্বার সপ্রেম প্রতিদান বাক্যও বড় সহজ।

হিড়িম্বা সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করে বলে সেই নরখাদক রাক্ষস ভাইয়ের আক্রোশ থেকে আমিই তোমাকে বাঁচাব, তারপর চলে যাব পাহাড়-ঘেরা কোনও নির্জন স্থানে। রাক্ষসের মায়া প্রয়োগ করে ঘুরে বেড়াব আকাশে আকাশে। দেখো, আমার সঙ্গে এমন করে ঘুরে বেড়াতে তোমার খুব ভাল লাগবে– অতুলামাগুহি প্রীতিং তত্র তত্র ময়া সহ। ভীমও বড় সহজ মানুষ। পরবর্তীকালে দ্রৌপদীর প্রেমবৈদগ্ধ্যে বার বার যাকে আপ্লুত এবং ব্যবহৃত হতে দেখব, সেই ভীম আসলে হিড়িম্বার প্রেমেরই যোগ্য ছিলেন পুরোপুরি। ভীম কিন্তু এই মুহূর্তে এক বিরাট কাজে ব্যস্ত। তিনি মা-ভাইদের পাহারা দিচ্ছেন, অতএব কোনও রমণীর কামজ আকর্ষণে সাড়া দেওয়াটা এখন তাঁর পক্ষে মোটেই বীরোচিত নয়। তা ছাড়া ভরতবংশীয় মধ্যম পাণ্ডব এক রাক্ষসের ভয়ে তার রাক্ষসী ভগিনীর আশ্রয় পোষণে বিপন্মুক্ত হবেন– এটা তার বীরত্ববোধে আঘাত করে। ভীম বললেন– আহা! বেশ বললে বাপু রাক্ষসী! রাক্ষসের খাবার থালায় নিদ্রিত মা-ভাইদের পরিবেশন করে আমি এক কামার্ত পুরুষের মতো তোমার সঙ্গে যাই আর কি– দত্ত্বা রাক্ষসভোজনম।… কামার্ত ইব মদ্বিধঃ।

হিড়িম্বা বলল– তা হলে যেমনটি তোমার ভাল লাগে, আমি তাই করব। তুমি এঁদের সবাইকে জাগাও। আমি এঁদের সকলকেই বাঁচাব। হিড়িম্বা বুঝেছে–কথাটা স্বার্থপরের মতো হয়ে গেছে। যাঁকে সে স্বামী হিসেবে পেতে চাইছে তার মা-ভাইদেরও যে ভালবাসতে হবে, এটা সে এখন বুঝেছে। কিন্তু এই নিবেদিতপ্রাণা রমণীর কাছে ভীমও বা তার বীরদর্প সংকুচিত রাখবেন কেন? তিনি বললেন- তোমার সেই বদমাশ ভাইয়ের ভয়ে আমি আমার মা-ভাইদের জাগাতে পারব না। তা ছাড়া ওই রাক্ষস আমার শক্তি সহ্য করতে পারবে না। এই সগর্ব আস্ফালনের সঙ্গে ভীম কিন্তু হিড়িম্বাকে রাক্ষসী জেনেও একবার ‘ভদ্রে একবার ‘তন্বঙ্গী’ বলে সম্বোধন করেছেন। অর্থাৎ ভীম তাকে পুরোপুরি অস্বীকার করছেন না। কিন্তু এক রমণী তাকে বাঁচাতে চেয়েছে বলেই তিনি আপন বীরমানিতায় হিড়িম্বার প্রতি একটু তাচ্ছিল্য দেখিয়েই যেন বললেন– তুমি যাও বা এখানেই থাক, কিন্তু ভাল হয় যদি তোমার নরখাদক ভাইটিকেই এখানে পাঠিয়ে দাও– তং বা প্ৰেষয় তথঙ্গি ভ্রাতরং পুরুষাদকম্।

হিড়িম্বা ভীমের এই উদ্ধত আচরণ গায়ে মাখল না। সে দেখল– তার দেরি হচ্ছে দেখে তার ভাই হিড়িম্ব ধেয়ে আসছে। এতকাল এই রাক্ষসের হিংস্রতা সে দেখেছে। সে ভয় পেয়ে বলল– ওই আসছে আমার ভাই। তোমায় যা বলি একবারটি শোনো। আমি রাক্ষসী, রাক্ষসের বল আমার শরীরে। তুমি আমার এই পিঠের ওপর চড়ে বসো, তোমাকে আমি উড়িয়ে নিয়ে যাব। তোমার ভাই এবং মাকেও আমি একইভাবে নিয়ে যেতে পারি। এসো পিঠে চড়ে বসো– আরুহেমাং মম শ্রেণিং নেষ্যামি ত্বাং বিহায়সা। হিড়িম্বা অবশ্য বর্তমান অনুবাদকের মতো ভদ্রভাবে ‘আমার পিঠে চড়ে বসো বলেনি। বলেছিল– তুমি আমার এই নিতম্বদেশে আরোহণ করো। রাক্ষস কি অত ভদ্রভাষায় কথা বলে? সে পৃষ্ঠদেশ বোঝাতে আপন নিতম্বের উল্লেখ করে। কিন্তু মধ্যম পাণ্ডব হিড়িম্বার আর্তিতে রসিক হয়ে উঠেছেন আপাতত। আর্যেতরা রমণীর কথার মাত্রা আর্য ভাষায় ফিরিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ওহে বিপুলনিতম্বে (সংস্কৃতে এমন সম্বোধন– পৃথুশ্রোণি, বিপুলশ্রোণি ইত্যাদি খুব চলে)! তোমার ভয় নেই কোনও। আমি থাকতে তোমার ভাই আমাদের কিছুই করতে পারবে না। তোমার সামনেই তাকে আমি কেমন মেরে ফেলি, দেখো–অহমেনং হনিষ্যামি প্রেক্ষন্ত্যাস্তে সুমধ্যমে।

ভীম এটা বুঝেছেন যে, হিড়িম্বা তার ভাইয়ের জীবনের মূল্যেও তাঁকে চায়। হিড়িম্বার মার্জিতা মানুষী চেহারাটাও তার ভালই লাগছে বটে, নইলে বিপুলশ্রোণী, সুমধ্যমা এই সব সম্বোধন আসছে কোথা থেকে? কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি যেমন সরলা এই হিড়িম্বা রাক্ষসী, তেমনই সরল এই মধ্যম পাণ্ডব। তিনি যে হিড়িম্ব রাক্ষসের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিমান এবং তাকে মেরে ফেলতে যে তার কোনও অসুবিধে হবে না, সেটা বোঝানোর জন্য ভীম এবার তার হাতের ‘মাসল’ দেখাতে আরম্ভ করলেন হিড়িম্বাকে, দেখাতে লাগলেন পায়ের গুলি, বুকের ছাতি, এমনকী উরু সন্ধিও। শেষে বললেন– আমাকে মানুষ বলে খুব খাটো করে দেখোনা সুন্দরী মাবমংস্থাঃ পৃথুশ্রোণি মত্বা মামিহ মামুষম। হিড়িম্বা বলল– তুমি মানুষ নও, তুমি আমার দেবতা। তোমাকে একটুও ছোট করে দেখছি না আমি– নাবমন্যে নরব্যাঘ্র স্বামহং দেবরূপিন। তবে কিনা, মানুষের ঈশ্বর বড় মানুষ আমার! রাক্ষসের হিংস্রতা আমি দেখেছি, তাই ভয় পাই।

হিড়িম্ব রাক্ষস এবার এসেই গেল। তার আর দেরি সইছে না। কিন্তু সে এসে যা দেখল, তাতে তার চক্ষু স্থির হয়ে গেল। সে দেখল– তার রাক্ষসী বোন মানুষের মতো সেজেছে। সে চুলের খোঁপায় জড়িয়ে দিয়েছে বনফুলের মালা, মুখখানিকেও ঘষে-মেজে বেশ চাঁদপানা করে তুলেছে। ভুরু, নাক, চোখ, এমনকী সমস্ত রুক্ষ চুলের গোছাটিও সে বিচিত্র ঢঙে সজ্জিত করে তুলেছে। হিড়িম্ব দেখল– হিড়িম্বার গায়ের চামড়া কোন মন্ত্রবলে কোমল হয়ে উঠেছে এবং হাত পায়ের নখ পর্যন্ত সুচারু ভাবে মসৃণ করে তুলেছে সে– সুনাসাক্ষি কেশান্তাং সুকুমার নখত্বক। এর ওপর আছে অলঙ্কারের শোভা এবং হিড়িম্ব দেখল যে, তার বোনটি এমন একখানি সুসূক্ষ্ম বাস পরিধান করেছে, যাতে রমণীয় প্রত্যঙ্গ-সৌন্দর্য্য প্রকট হয়ে ওঠে– সুসূক্ষ্মাম্বরধারিণীম। হিড়িম্ব এবার তাকে সন্দেহ করতে আরম্ভ করল, সে ভাবল, হিড়িম্বা নিশ্চয়ই পুরুষের মন ভোলানোর জন্যই এমন মোহন সাজে সেজেছে– পুংষ্কামাং শঙ্কমানশ্চ চুক্রোধ পুরুষাদকঃ। হিড়িম্ব ক্রোধে ফেটে পড়ল এবং পাণ্ডবদের আগে মেরে তারপর সে তার ভগিনীকে শিক্ষা দেবে বলে ঠিক করল।

হিড়িম্ব রাক্ষসের হম্বিতম্বি শুনে ভীমও এবার যথেষ্ট ক্রুদ্ধ হলেন এবং হিড়িম্বার আত্মনিবেদনের স্বীকৃতি স্বরূপই তিনি বললেন– যারা ঘুমচ্ছে, তাদের ছেড়ে তুই আমাকে ধর। আর তুই তোর বোনকে কী করবি? আমার সামনে আমি কোনও স্ত্রীহত্যা হতে দেব না। তা ছাড়া ও দোষটাই বা কী করেছে? আমাকে এই বালিকা যেভাবে কামনা করেছে, তাতে বোঝা যায় ও নিজের বশে ছিল না। তুই ওকে এখানে আসতে বলেছিলি, ও এসেছে। এখানে আমার চেহারা দেখে ও মজেছে, তাতে তোর কাছে ওর কী অপরাধ ঘটল? অপরাধ যে করেছে সে হল ওর অন্তরশায়ী মূর্তিহীন অনঙ্গ, তার জন্য তুই একে দায়ী কচ্ছিস কেন– অননে কৃতে দোষে নেমাং গর্হিতুমহসি? তবে একে আমার সামনে আমি কিছুতেই তোর হাতে মরে যেতে দেব না। আয় তুই আমার সঙ্গে যুদ্ধ কর। ভীমের কথা থেকে বোঝা যায়– আগে তিনি যতই এই রমণীকে ‘যাও বা থাকো’– এমন ঔদাসীন্য দেখিয়েছেন, সেই ঔদাসীন্য এখন তার নেই। এমনকী তার আসঙ্গলিঙ্গায় এখন তিনি নিজেও খানিকটা আকুল বোধ করছেন। অন্তত এই রমণীর আসঙ্গলিপ্সা তার কাছে অস্বাভাবিক বা অযৌক্তিক মনে হচ্ছে না। অর্থাৎ ভীম এখন অনেকটাই অনুকূল হিড়িম্বার ব্যাপারে। অন্তত কিছুতেই তিনি তার হিতৈষিণী প্রিয়ৈষিণীকে মরতে দিতে চান না।

হিড়িম্বের সঙ্গে ভীমের ভয়ংকর যুদ্ধ আরম্ভ হল এবং এই যুদ্ধের পরিণতি আমরা জানি। কিন্তু যুদ্ধ চলাকালীন পরস্পরের সমাহ্বান-শব্দে পাণ্ডব-ভাইরা যখন কুন্তীর সঙ্গে জেগে উঠে সুন্দরী হিড়িম্বাকে দেখলেন, তখন হিড়িম্বার প্রতিক্রিয়াটুকু লক্ষ করার মতো। কুন্তী হিড়িম্বার রূপ দেখে আশ্চর্য হয়েছিলেন– কে গো তুমি? কার মেয়ে? এই বনের মধ্যে কী করতে এসেছ? তুমি কি বনদেবী না অপ্সরা? হিড়িম্বা সরল মনে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে বলল– এই বিশাল ঘন-নীল যে বন দেখছেন, এখানে হিড়িম্ব রাক্ষসের বাস। আমি তার ভগিনী হিড়িম্বা। আপনাদের সবাইকে মেরে নিয়ে যাবার জন্য আমার ভাই আমাকে এখানে পাঠিয়েছিল। কিন্তু আপনার বলিষ্ঠ সুদর্শন পুত্রটিকে দেখে আমি তাকে আমার স্বামী হিসেবে বরণ করেছি– তত বৃতো ময়া ভর্তা তব পুত্রো মহাবলঃ। এখান থেকে আপনার ছেলেকে আমি সরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। এদিকে আমার দেরি দেখে আমার ভাই হিড়িম্ব এখানে এসে গেছে। আপনাদের ঘুমে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, সেইজন্য আমার স্বামী অর্থাৎ আপনার পুত্র তাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে অন্যত্র ভীষণ যুদ্ধ করছে– স তেন মম কান্তেন তবু পুত্রেণ ধীমতা।

এখানে কান্ত কথাটা লক্ষ করার মতো। কান্ত শব্দটায় যতখানি স্বামী বোঝায়, তার থেকেও বেশি বোঝায় কামিত, কাঙিক্ষত ব্যক্তিকে। হিড়িম্বা নিজের অধিকার-বচনটুকু মোটেই ছাড়ছে না। ভীমের সম্বন্ধে কুন্তীকে– তোমার ছেলে বলার আগেই সে আমার স্বামী বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করছে। বনবাসিনী রাক্ষসীর মুখে–রাক্ষস, যুদ্ধ এবং সবার ওপরে ভীমের সঙ্গে তার স্বামী সম্বন্ধের কথা শুনে কেমন যেন হতচকিত হয়ে গেলেন। কুন্তী। কিন্তু সবার আগে রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধে ভীমের কী হল, সেটা দেখা দরকার বলে সকলেই আগে হুড়মুড়িয়ে যুদ্ধস্থলে এসে উপস্থিত হলেন এবং আমরা জানি– এই যুদ্ধে হিড়িম্বকে বধ করে ভীম শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হন। যুদ্ধজয়ের পর ভীম যখন সকলের প্রশংসা উপভোগ করছেন সেইসময় হিড়িম্বাও কিন্তু দাঁড়িয়েছিল একান্তে। অর্জুন বন ছেড়ে নগরের পথে যাবার দিক নির্দেশ করলেন এবং সকলে চলতে লাগলেন নির্দিষ্ট পথে। আশ্চর্য হিড়িম্বার সম্বন্ধে কেউ আর কোনও কথাও বলল না। না ভীম, না অন্য পাণ্ডবদের কেউ, না জননী কুন্তী। সেই গভীর নির্জন পথ বেয়ে পাণ্ডবরা যখন চলতে আরম্ভ করলেন, তখন হতভ্রাতৃকা হিড়িম্বা, একটু আগেই যে নাকি ভীমকে স্বামিত্বে বরণ করার গৌরব করছিল, তার দিকে কেউ চেয়েও দেখল না। না ভীম, না অন্য পাণ্ডবরা, না জননী কুন্তী। হিড়িম্বা একেবারে নিজের ইচ্ছায়, আপনাতে আপনি বিকশি পাণ্ডব-ভাই এবং জননী কুন্তীর পিছন পিছন চলতে লাগলেন, একটু দূরত্ব বজায় রেখে।

হিড়িম্বাকে এইভাবে চলতে দেখে হঠাৎই ভীম বললেন– রাক্ষসীরা মোহিনী মায়া বিস্তার করে নানা শত্রুতা করে, অতএব হিড়িম্বের মতো তোরও মরাই উচিত। এই বলে তার দিকে একটু এগোতেই যুধিষ্ঠির তাকে স্ত্রী-হত্যায় বাধা দিলেন। মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে যদিও কিছু বলেননি, তবু আমার মনে হয়, ভীমের এই হঠাৎ বলা কথাটার মধ্যে একটা যুক্তি আছে। আচ্ছা, হিড়িম্ববধের পর ভীমের মতো ব্যক্তির পক্ষে কি মা-ভাইদের কাছে প্রকট করে বলা সম্ভব ছিল যে, এই যে মেয়েটি দেখছ, ও রাক্ষসী হলে কী হবে, ও খুব ভাল, ওকে আমি বিয়ে করতে চাই। কোনও ভাবেই কি এই অযৌক্তিক যুক্তি পরম্পরা, অন্য পাণ্ডবদের মনে ভীমের ঐকান্তিক বিবাহেচ্ছা ছাড়া আর কিছু প্রকাশ করত? নাকি তারা এই বিবাহ সহজে মেনে নিতেন?

আমার ধারণা, এখানে ভীম একটু নাটক করলেন। যখন কেউ পেছন পেছন চলতে থাকা হিড়িম্বার দিকে নজর দিল না, সবাই যখন তার ধীর অনুবর্তন সম্পূর্ণ জেনেও তাকে উপেক্ষা করল, তখন এই অতি-নাটকীয়তা ছাড়া কীই বা উপায় ছিল ভীমের। একটু আগেই যিনি তাঁর নিজের সামনে স্ত্রীহত্যা করতে দেবেন না বলে হিড়িম্বকে শাসাচ্ছিলেন, একটু আগে যে রমণীর সামনে তিনি হাতের পেশি আর উরুদেশের পরিঘবৎ কাঠিন্য প্রচার করছিলেন, সেই রমণীকে আপন বক্তব্য বলতে দেওয়ার জন্য উপেক্ষমাণ মা-ভাইদের সামনে এই অতিনাটকীয়তা ছাড়া আর কীই বা প্রকাশ করতে পারতেন ভীম।

ঠিক তাই। ভীম একটু একটু এগোতেই এবং যুধিষ্ঠির তাকে বাধা দিতেই হিড়িম্বা জননী কুন্তীর কাছে পরিষ্কার বলে ফেলার সুযোগ পেল। সে কুন্তীকে বলল– একটি মেয়ে যদি কোনও পুরুষকে কামনা করে, ভালবাসে, তবে সেই অন্তর্গতা কামনার কী দুঃখ তা আপনি জানেন– আর্যে জানাসি যদদুঃখংমিহ স্ত্রীণামনঙ্গজম। যেন মেয়ে হিসেবে কুন্তীই একমাত্র হিড়িম্বার মন বুঝবেন। হিড়িম্বা বলল– আমি এতক্ষণ অনেক দুঃখ সয়েছি, কিন্তু এখন আমার ভাই মারা গেছে এবং আমি আমার স্বজন, স্বধর্ম– সব ছেড়ে আপনার এই ছেলেটিকে আমার স্বামী হিসেবে চেয়েছি। এখন যদি আপনি এবং আপনার এই ছেলে আমায় প্রত্যাখ্যান করেন, তবে আমি আর বাঁচব না– প্রত্যাখ্যাতা ন জীবামি সত্যমেদ ব্রবীমি তে। হিড়িম্বা কোনও কিছু লুকোয়নি কারও কাছে। এমনকী তার এই ভালবাসার মধ্যে যে দৈহিক কামজ বাসনার সম্পূর্ণ মুক্তি আছে, সেটা প্রকট করে তুলতেও তার লজ্জা নেই।

হিড়িম্বা এতখানিই ভীমকে ভালবেসে ফেলেছে, যে তার জন্য নিজেকে হেয় করতে তার বাধেনি। পঞ্চপুত্রের জননী হিসেবে কুন্তী ভাবী পুত্রবধূর কোন কথায় খুশি হতে পারেন, সরলা হিড়িম্বা তা সরল ভাবেই জানে। হিড়িম্বা বলল– আমি আপনার ছেলেকে দেখে মুগ্ধ হয়েছি। সেই মুগ্ধা, অনুগতাকে আপনিই পারেন আপনার ছেলের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে সংযোজয় সুতেন তে।

এতক্ষণ ধরে এত যে কথা চলছে কই ভীম তো এ-সবের প্রতিবাদ করলেন না। একবারও তো বললেন না–না মা! বিশ্বাস কোরো না এসব কথায়। ও রাক্ষসী, ও মায়া জানে কই বললেন না তো এসব কথা। তাতেই বুঝি, ভীমের পূর্ব ব্যবহার নাটকীয়তা মাত্র। হিড়িম্বা ভীমের কাছে যেমন আত্মনিবেদন করেছিলেন, ঠিক তেমনই সরলভাবে জননী কুন্তীর কাছে আত্মনিবেদন করে বললেন আপনি আমার ওপরে বিশ্বাস রাখুন। আমি আপনার ছেলেকে আমার অভীষ্ট জায়গায় নিয়ে যাব, আবার তাকে ফিরিয়ে দিয়ে যাব। আপনারা যেই আমার কথা ভাববেন, অমনই আমি এসে দুর্গম স্থানেও আপনাদের বহন করে নিয়ে যাব। যদি তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে হয়, তবে আমি আমার পিঠে করে আপনাদের বয়ে নিয়ে যাব– পৃষ্ঠেন বো বহিষ্যামি শীঘ্রং গতিমভীপ্সতঃ। আপনি শুধু আপনার পুত্রের সঙ্গে আমার মিলন ঘটিয়ে দিন।

হিড়িম্বার যা ক্ষমতা, যা সে পারে, নিজের গুণ হিসেবে তাই সে নিবেদন করেছে। একেবারে শেষে এসেছে ধর্মের কথায়। রাক্ষসী হলে কী হবে, তারও স্বানুভূত ধর্মবোধ আছে। সে বলেছে– বিপদের সময় যে পরের ধর্ম রক্ষা করে, সেই তো শ্রেষ্ঠ ধর্মজ্ঞ, আর ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হওয়াটাই ধার্মিকের বিপদ, অতএব যে যে উপায়ে ধর্ম সাধিত হয়, সেই উপায়গুলি নিন্দনীয় নয় কখনও। হিড়িম্বা বলতে চায়– ভীমকে সে রাক্ষসোচিত স্বধর্ম ত্যাগ করে পতিত্বে বরণ করেছে, এখন যদি সে প্রত্যাখ্যাত হয়, তবে স্ত্রীলোকের পালনীয় ধর্ম থেকে সে চ্যুত হবে। আমরা জানি, আজকে এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভবমণ্ডিত ধর্মগুলির কোনও মূল্য নেই। স্বধর্ম, স্ত্রীধর্ম– এগুলির পালনীয়তাও আজকে তাৎপর্য হারিয়েছে। কিন্তু সেদিনকার দৃষ্টিতে দেখলে এক রমণী অভিমত পুরুষকে কামনা করার পরেও, স্বামিত্বে বরণ করার পরেও, তাকে পাচ্ছে না, এটা তার কাছে ধর্মচ্যুতি বলেই গণ্য হয়েছে।

যে উদ্দেশ্যে অথবা যার উদ্দেশ্যে হিড়িম্বা এ-কথা বলেছে তা অবশ্য সিদ্ধ হল। ধর্মচ্যুতির প্রশ্নে ধর্মজ্ঞ যুধিষ্ঠির এবার জবাব দিয়েছেন। তিনি হিড়িম্বার কথা সম্পূর্ণ স্বীকার করে নিয়ে বলেছেন– তুমি যা বলেছ, তা মেনে নিচ্ছি। তবে হ্যাঁ, ভীমকে যদি তুমি নিয়েই যাও, তবে তোমাকেও একটা কথা দিতে হবে। আমাদের সকাল বেলার স্নান-আহ্নিক, বেশ-ভূষার পর ভীমকে তুমি নিয়ে যাবে, কিন্তু সূর্য ডোববার আগেই তুমি ভীমের সঙ্গে বিহার-ভ্রমণ শেষ করবে। দিনের বেলায় তুমি যেখানে ইচ্ছে যাও, কিন্তু রাতের বেলায় তুমি তাকে ফিরিয়ে দেবে আমাদের কাছে।

কথাটা যুধিষ্ঠির বললেন হিড়িম্বাকে, কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে উত্তরটা দিলেন ভীমসেন। তার মানে হিড়িম্বার সঙ্গে তার মিলনে আদৌ কোনও অনিচ্ছে ছিল না। তিনি ভাইদের দিকটাও রেখে এবং হিড়িম্বার দিকটাও ভেবে হিড়িম্বাকে বললেন– শোনো রাক্ষসী! (আদরের ডাক বলে কথা!) তোমার সঙ্গে আমি কতক্ষণ থাকব শোনো আমার সঙ্গে সঙ্গত হওয়ার পর যতদিন না তোমার পুত্র জন্মগ্রহণ করে, ততদিন পূর্বনির্দিষ্ট সময় মতো আমি তোমার সঙ্গে বিহার করব। কিন্তু পুত্র জন্মের পর আর নয় তাবৎকালং গমিষ্যামি ত্বয়া সহ সুমধ্যমে। সেকালের সমাজের দৃষ্টিতে মধ্যম পাণ্ডবের এই উক্তি খুব অসঙ্গত নয়। কেননা, স্ত্রী-পুরুষের মিলন-মৈথুন যদি বা বিবাহের অন্যতম অঙ্গ হয়ে থাকে, তবু পুত্রলাভই ছিল বিবাহের শেষ মর্ম। ভীম জানেন– পুত্রলাভের মধ্য দিয়েই হিড়িম্বার রাক্ষসী কামনা উপশান্ত হবে এবং সত্যি, হিড়িম্বা সাগ্রহে ভীমের কথা মেনে নিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে হিড়িম্বা পাণ্ডব-ভাইদের মধ্যে প্রথমা পুত্রবধূর পদবিতে প্রতিষ্ঠিত হলেন।

মহাভারতের কবি এরপরে লিখেছেন– যুধিষ্ঠির এবং ভীমের সমস্ত নির্দেশ মেনে নিয়ে হিড়িম্বা ভীমকে নিয়ে ওপরের দিকে চলে গেলেন–ভীমসেনমুপাদায় সোেমাচক্ৰমে ততঃ। আমার জিজ্ঞাসা হয়– এই ওপরের দিকের জায়গাটাই এখনকার কুলু-মানালি নয়তো? নইলে হিমাচল প্রদেশের সেই প্রত্যন্ত ভূমিতে হিড়িম্বার অধিষ্ঠান ঘটল কী করে? সেখানে যদি কোনও ভাবে তার উপস্থিতি অনুভূত না হত, তা হলে তত্রস্থ শক্তিরূপিণী দেবীর সঙ্গেই বা কী করে তিনি একাত্মতা লাভ করলেন! মহাভারতের কবি ভীম হিড়িম্বার বিহার স্থানগুলির যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার মধ্যে নদী, বন, সাগর-সৈকতও যেমন আছে, তেমনই আছে হিমালয়ের বনভূমিঘেরা কুঞ্জদেশ, গুহা এবং পার্বত্য সানুদেশ– হিমবগিরিকুঞ্জে গুহাসু বিবিধাসু চ।… দেবারণ্যে পুণ্যে তথা পর্বতসানুষু। এই যে দেবারণ্য, এই যে হিমালয়ের গিরিকর এবং পার্বত্যসানুর কথা শুনছি, এগুলি শোনার পরে যদি মানালির উচ্চচূড় দেবভূমিতে হিড়িম্বার মন্দির দেখি, তখন একবারের তরেও অন্তত মনে হবে– হিড়িম্বা বুঝি মধ্যম পাণ্ডবের সঙ্গে এখানে বিহার করতে এসেছিলেন কোনও সময়।

ভীমের সঙ্গে হিড়িম্বার যে মিলন হল, তার মধ্যে না ছিল প্রথাসিদ্ধ বৈবাহিক আচার, না ছিল মন্ত্রোচ্চারণ, না ছিল আত্মীয়পরিজনের স্বীকারগুঞ্জন। আধুনিক মতে একেবারে ‘পারফেক্ট লিভ টুগেদার’। অথচ এই রাক্ষসী সুন্দরীই কিন্তু পাণ্ডবদের প্রথমা কুলবধূ এবং তার মতো মহাকাব্যে উপেক্ষিতাই বা আর ক’জন আছেন। যুধিষ্ঠির-ভীমের শর্ত তিনি এতটাই মেনেছিলেন যে, সত্যি পুত্রজন্মের পর আর তাকে আমরা দেখতে পাই না। পরবর্তী কালে হিড়িম্বা বারবার আমাদের স্মরণে এসেছেন তার পুত্র ঘটোৎকচের প্রসঙ্গে। কিন্তু হিড়িম্বাকে আমরা আর একবারও মহাভারতের কোনও পর্যায়ে দেখিনি।

তবে হ্যাঁ, যেটুকু সময় তিনি ভীমের সঙ্গে ছিলেন, সেই সময়টুকু ভীমকে তিনি যে কত জায়গায় নিয়ে গেছেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। হিড়িম্বার কথা যেভাবে আরম্ভ হয়েছিল, তাতে দৈহিক কামনা, বিশেষত মেয়েদের যৌনতার ভাষা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ঠিক এই নিরিখে দেখতে গেলে ভীমের সঙ্গে যখন তার মিলন সম্পূর্ণ হল, তখন কিন্তু যৌনতার সর্ববিধ আচরণই তার মিলন-পর্যায়গুলিতে অপেক্ষিত ছিল, অথচ সেইসব চুম্বন আলিঙ্গন অথবা প্রত্যঙ্গ সংবাহনের একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি মহাকবি। তিনি শুধু সুন্দর সুন্দর রমণীয় ভূমি-নদী-পাহাড়ের উল্লেখ করেছেন, যে-সব জায়গায় গেলে দৈহিক সঙ্গসুখ মানসিক অন্তরঙ্গতায় উত্তীর্ণ হয়। আবার এই মিলনের মধ্যে ভীম এবং হিড়িম্বার পারস্পরিক তথা দেহজ আসক্তিটুকু মহাকবির অসাধারণ বাক্য-ব্যঞ্জনায় ধরা পড়ে, যদিও হিড়িম্বাই সেখানে শারীরিক সুখচেতনার কত্রী হয়ে ওঠেন। মহাকবি লিখেছেন– ভীমকে সুখ দেবার জন্য হিড়িম্বা রূপসী মানবীর রূপ ধারণ করে অলংকার-বিভূষণে সজ্জিত হয়ে থাকত এবং হাবে-ভাবে-বিলাসিতায় তার মনোহরণ করত– বিভ্ৰতী পরমং রূপং রময়ামাস পাণ্ডবম।

হিড়িম্বার সঙ্গে ভীমের এই মিলন-মধুরতার ফল ফলল। তাদের একটি ছেলে হল। লক্ষণীয়, হিড়িম্বাই মধ্যম পাণ্ডবকে লালসা-তৃপ্তির জন্য প্রধানত চেয়েছিলেন বলে যৌনতার ক্ষেত্রে তার রমণীয় কর্তৃত্ব যেমন তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে, তেমনই পুত্রজন্মের ক্ষেত্রেও মহাভারতের কবি কিন্তু তাকেই কর্তৃপদে বসিয়ে বলেছেন– ভীমসেনের কাছ থেকে হিড়িম্বা রাক্ষসী এক বিশাল শক্তিমান পুত্রের জন্ম দিল– প্রজজ্ঞে রাক্ষসী পুত্রং ভীমসেনান্মহাবলম। হয়তো বা মহাভারতের কবি আজকের ভাবনায় নিষ্ণাত ছিলেন না– ‘উইমেন সেক্সয়ালিটি, পুত্রলাভের ব্যপারে স্ত্রীজনের কর্তৃত্ব– এইসব কথা হয়তো তিনি জানতেন না। কিন্তু পৃথিবীতে অকল্পিতভাবেই এমন মৌল উদাহরণ কিছু থেকেই যায় এবং মহাকবির চোখ এড়ায় না বলেই অনন্ত স্ত্রী-হৃদয়বৃত্তির মধ্যেও হিড়িম্বার কর্তৃত্বভিমানিনী বৃত্তিটি তিনি ভুলে যাননি। শব্দ-প্রয়োগের ক্ষেত্রেও মহাকবির স্বাতন্ত্র এখানে লক্ষ করার মতো– রময়ামাস পাণ্ডবম– তিনি মধ্যম পাণ্ডব ভীমকে সুখিত-রমিত করছেন, তিনি ভীমের মাধ্যমে পুত্র লাভ করেছেন প্রজজ্ঞে রাক্ষসী পুত্রং– কর্তৃপদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে হিড়িম্বার এই প্রাধান্য নিশ্চয়ই এক আধুনিক সমাপতন– আপনি না মানলেও একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছেন না এই শব্দপ্রমাণ।

যাই হোক, পুত্রজন্মের পর হিড়িম্বার হৃদয় আনন্দে পূর্ণ হয়ে উঠল। মহাকবি তার মহাকাব্যিক অভিসন্ধিতে লিখেছেন বটে যে, রাক্ষসীরা সদ্যই গর্ভ ধারণ করে এবং সদ্যই গর্ভমুক্ত হয়ে পুত্রকন্যা প্রসব করে, এমনকী তাদের পুত্রকন্যারা বড়ও হয়ে যায় সদ্য-সদ্য। এসব কথা মহাভারতে দেবতাদের প্রসঙ্গেও আছে, ঋষিদের প্রসঙ্গেও আছে, এমনকী স্বয়ং মহাভারতের কবির নিজের সম্বন্ধেও আছে। এমনটা সম্ভব কিনা, সেই তর্কে না গিয়েও বলতে পারি– ভীমের সঙ্গে বিহার আহার শয্যায় কম দিন কাটেনি হিড়িম্বার। অতএব এরই মধ্যে গর্ভধারণ এবং এই এখন গর্ভমুক্তির সময়টুকু লৌকিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু হিড়িম্বার পুত্রটির সদ্য বড় হয়ে যাওয়াটা লৌকিক বিচারে টেকে না বলেই মহাকাব্যিক উদারতার প্রশ্ন এখানে থেকেই যায়। পুত্রজন্মের সঙ্গে সঙ্গে হিড়িম্বার স্বামী-সহবাসের কাল। শেষ হয়ে যায়, অথচ সেই পুত্রের সঙ্গে পিতা, পিতৃব্য এবং জননী কুন্তীর দেখা হবে না, সম্ভাষণ হবে না, ভবিষ্যতে কর্ণের একাগ্নী বাণের আধার এই হিড়িম্বার পুত্র পিতৃব্য অর্জুনের প্রাণ বাঁচিয়ে দেবেন, অথচ তার সঙ্গে কোনও সম্ভাষণই হবে না, তার সঙ্গে দেখাই হবে না, এমনটা মহাকাব্যিক পরিমণ্ডলে সম্ভব নয়। ফলে হিড়িম্বার পুত্র বালক হওয়া সত্ত্বেও যৌবন লাভ করল– বালোহপি যৌবনং প্রাপ্তঃ- এবং মহাকাব্যের অভিসন্ধি পূর্ণ হল।

পরম ঈপ্সিত স্বামীর কাছ থেকে পুত্র লাভ করে হিড়িম্বার মন গর্বে ভরে গেল। ছেলের চেহারার মধ্যে রাক্ষসের চেহারা যতটুকুই আসুক, ভীমের চেহারাও সে কম পায়নি। তবে তার মাথাটা খানিক ঘটের মতো হয়েছে এবং মাথার চুলগুলো খোঁচা খোঁচা। পুত্রলাভের পরেই হিড়িম্বা স্মরণ করলেন– যুধিষ্ঠির-কুন্তীর কাছে তিনি কথা দিয়েছেন, সে কথা তাকে রাখতে হবে, ভীমকে এবার আপন মায়াজাল থেকে মুক্ত করে দিতে হবে সম্পূর্ণভাবে। কেননা, ভীমের সঙ্গে সহবাসের দিন তার শেষ হয়ে গেছে– সংবাসসময়য়া জীর্ণ ইত্যাভাষ্য ততস্তু তান– শেষ বিদায়ের জন্য হিড়িম্বা আবেগে ফুরিতধরা হলেন না। বরঞ্চ অত্যন্ত সপ্রতিভভাবে ছেলে ঘটোৎকচের হাত ধরে উপস্থিত হলেন জননী কুন্তীর সামনে।

হিড়িম্বা বিদায় চাইলেন কুন্তীর কাছে এবং ঘটোৎকচ কুন্তীর চরণবন্দনা করলেন। ঠিক এইখানে কুন্তীর বক্তব্য আজকের দিনের উপরি-প্রগতিশীল এবং অন্তরে সংস্কারাচ্ছন্ন পুরুষ রমণীকে লজ্জা দিতে পারে। কুন্তী ঘটোৎকচকে বললেন– বাছা! তুমি কুরুবংশে জন্মেছ, ভীমের মতোই তুমি আমার কাছে সমান স্নেহের ত্বং কুরুণাং কুলে জাতঃ সাক্ষাৎ ভীম সমো হ্যসি। এই প্রসঙ্গে আমি শুধু আজকের ধনী-মানী জনক-জননীদের একটা সামান্য বার্তা দিতে চাই। বলতে চাই, শিক্ষা-দীক্ষা, ধন-মানের সঙ্গেই প্রগতিশীলতার অবশ্যম্ভাবী যোগ থাকে না। প্রগতির বোধ এমনই এক মুক্ত-সংস্কৃত ব্যক্তিমানসে প্রতিফলিত হয়, যেখানে জীবনবোধের মধ্যে অনহংকৃত এক মমতা আছে অন্যের জন্য, অন্যের জীবনের জন্য। কুন্তী ঘটোৎকচকে কুরুবংশের ছেলে বলে ভাবেন মানে হিড়িম্বা রাক্ষসীকেও তিনি পাণ্ডবদের প্রথমা কুলবধূ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ঘটোৎকচকে তিনি শুধু ভীমের ছেলে বলে একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্মের মধ্যে আবদ্ধ করেননি, কুন্তী ঘটোৎকচকে আশীর্বাদ করে বলেছেন– তুমি পাঁচ পাণ্ডবভাইয়েরই জ্যেষ্ঠ পুত্র জ্যেষ্ঠ পুত্রোহসি পঞ্চানাং এটা যে হিড়িম্বার জন্যও কত বড় এক সর্বাঙ্গীণ স্বীকৃতি, সেটা আমি ভারতবর্ষের বিচিত্র-মহান জনজাতিকীর্ণ সমাজের সমন্বয়ের বুদ্ধিতে বোঝাতে চাই।

হিড়িম্বা রাক্ষসী হলেও ভীমের প্রতি ভালবাসায় এবং আনুগত্যে নিজের কথা রেখেছেন এবং আপন গর্ভজাত মানব-রাক্ষস ছেলেটিকেও তিনি তাঁর পিতা-পিতৃব্যের দায়িত্বে রেখে যাননি, হিড়িম্বা ছেলেকে নিজের সঙ্গে নিয়ে গেছেন নিজের দায়িত্বে। পুত্র ঘটোৎকচের হাত ধরে পাঞ্চাল দেশের কাছাকাছি পুরাতন ভ্ৰাতৃভূমি ছেড়ে চলে গেছেন আরও উত্তর দিকে, হয়তো বা সেই উচ্চচূড় পর্বত-সানু মানালিতে। হিড়িম্বা আর ফিরে আসেননি কখনও, গুরুকার্য করার প্রয়োজনে পাণ্ডবরা ঘটোৎকচকে স্মরণ করেছেন এবং তিনিও প্রাণ দিয়েছেন পাণ্ডবদের কারণেই, কিন্তু কোনও প্রসঙ্গে কোনও অবস্থায় আমরা হিড়িম্বাকে আর দেখি না। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে আমরা অর্জুন-ভার‍্যা উলূপী-চিত্রাঙ্গদাকে যথেষ্ট আপ্যায়িত হতে দেখেছি, কিন্তু হিড়িম্বাকে আর দেখিনি। রাক্ষসী হিড়িম্বা তার শিবের মতো স্বামীর কাছে যে কথা দিয়েছিলেন সে কথা তিনি রক্ষা করেছিলেন রাক্ষসীর ভালবাসায়। কামনা ভালবাসায় পরিণত না হলে এমন করে কথা রাখা যায় না, স্বামীর স্বার্থে এমন। করে পুত্র বিসর্জনও দেওয়া যায় না। হয়তো সেইজন্যই হিড়িম্বা দেবী হয়ে গেছেন, উলূপী চিত্রাঙ্গদারা তা হননি।

হিড়িম্বাকে মহাভারতের কবি যে কেন আর কোনও মহাকাব্যিক ঘটনা-প্রবাহের মধ্যে এনে ফেললেন না, তার কতগুলি সামাজিক কারণ থাকতে পারে এবং সেই কারণগুলি তৎকালীন সমাজের অনন্ত উদারতার মধ্যেও যথেষ্ট যুক্তিসহ হয়ে উঠতে পারে। প্রথমত, হিড়িম্বা-ভীমের প্রণয়-বিবাহের মধ্যে আনুষ্ঠানিকতার সামাজিক নিয়ম ছিল না, ফলে ইন্দ্রপ্রস্থ বা হস্তিনার রাজকীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে হিড়িম্বা ক্ষণিকের জন্যও এসে পড়লে, তার কী প্রতিক্রিয়া হতে পারত, আমরা বলতে পারি না। দ্বিতীয়ত, হিড়িম্বা রাক্ষসী। আর্যায়ণের প্রথম পর্যায়ে আমরা রামায়ণ-মহাকাব্যে যত রাক্ষস দেখেছি, মহাভারতে আমরা সেই সংখ্যায় বা পরিমাণে তত রাক্ষস দেখি না। দৃশ্যতই আর্যায়ণের পরবর্তী পর্যায়ে অবশিষ্ট রাক্ষসী ভাবনার মধ্যে আর্যভাব অনেকটা সম্প্রসারিত হয়ে থাকলেও জাতিগতভাবে তথাকথিত রাক্ষস-রাক্ষসীর প্রতি সামাজিক ব্রাহ্মণ্যের অনভিনন্দন বা ঘৃণা তখনও শেষ হয়ে যায়নি। ফলে অন্যান্য পাণ্ডববধূদের মতো হিড়িম্বা রাজধানীতে এলে কী তার সামাজিক বা লৌকিক প্রতিক্রিয়া হত এবং সেই প্রতিক্রিয়া মহাভারতের অন্যান্য উদার-মধুর চরিত্র গুলির কোনও নীচতা বা অনুদারতা প্রকাশ করে ফেলত কিনা, মহাভারতের কবি সে-ব্যাপারে অতি সতর্ক ছিলেন হয়তো। অতএব তিনি এ-সাহস দেখাননি।

কিন্তু ‘মিথ’ এমনই এক বস্তু যেখানে সামাজিক সত্যগুলি কালপর্যায়ে সামগ্রিক নির্জন থেকে উঠে আসে এবং তা মৌলভাবে অগ্রন্থিত থাকলেও পরবর্তী কবির হাতে তা সত্য হয়ে ওঠে, তাতে আমরা বুঝতে পারি– এমনটা হইলেও হইতে পারিত। বাঙালির কবি কাশীরাম দাস লোভ সম্বরণ করতে পারেননি। যুধিষ্ঠির মহারাজের রাজসূয় যজ্ঞে অর্জুনের স্ত্রী উলূপী-চিত্রাঙ্গদারা রাজকীয়ভাবে আমন্ত্রিত হয়েই এসেছিলেন মনে হয়। সেই আমন্ত্রিত বধূদের পাশে রেখে কাশীরাম দাস হিড়িম্বাকে টেনে এনেছেন কবিজনোচিত অপূর্বনির্মাণ নিপুণতায় এবং বুঝিয়ে দিয়েছেন– এমনটা হইলেও হইতে পারিত। কাশীরাম এই সত্য উদঘাটনের ভূমিকাটাও করেছেন রাক্ষসী সরলতায়।

হিড়িম্বার ছেলে ঘটোৎকচ তখন হিড়িম্বক বনে রাজত্ব করে। প্রয়াত মাতুল হিড়িম্বের বনটাকেই সে রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করার স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে। সে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের কথা শুনে মায়ের সঙ্গে ইন্দ্রপ্রস্থে যাবার আয়োজন করল। বহুতর রাক্ষস অনুগামী এবং জননী হিড়িম্বাকে নিয়ে সে রাজকীয় ঠাটে হাতির পিঠ থেকে নামল ইন্দ্রপ্রস্থের দ্বারে। দ্বারপালেরা যদিও তার রাজকীয় ঠাটবাটে মুগ্ধ হয়েছিল, তবু প্রবেশপথে তারা বাধা দিল। কিন্তু ভীমের ছেলে হিড়িম্বার গর্ভজাত– এই পরিচয়মাত্রেই তাদের প্রবেশ করানো হল এবং সহদেব নিজে তাদের আগমনবার্তা দিলেন মহারাজ যুধিষ্ঠিরের কাছে। যুধিষ্ঠির ঘটোৎকচকে রাজসভায় নিয়ে এসে সহদেবকে বললেন– ‘মাতারে পাঠাও তার যথায় পার্ষতী।

এটাই হবার কথা, পার্ষতী কৃষ্ণা দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডবের স্ত্রী, তিনি পট্টমহিষী, রাজসূয় যজ্ঞ যাঁরা আয়োজন করছেন, তাদের প্রধানা মহিষী। রাজকুলের অন্যান্য মহিলাদের ‘হোস্ট’ করার ভার দ্রৌপদীর ওপরেই। হিড়িম্বাকে সেখানে নিয়ে আসা হল এবং তিনি আসছেন। আমরা মূল মহাভারতে দেখেছি– ভীমকে পছন্দ হতে হিড়িম্বা মায়ারূপ ধরে সুন্দরী হয়েছিলেন, কিন্তু আমরা টিপ্পনী দিয়ে বলেছিলাম– হিড়িম্বা যথেষ্ট সুন্দরীই ছিলেন, তবে হিড়িম্ব-ভাইয়ের ঘরে অনাদরে থাকতে-থাকতে আর তার ফাই-ফরমাস খাটতে খাটতে খানিক রূপভ্রষ্টা ছিলেন। কিন্তু ভীমকে দেখার পর থেকেই তিনি রূপচর্চার মন দিয়েছিলেন। কাশীরাম এ বাবদে অনেক সাহসী। তিনি কোনও মায়ারূপের কথা বলেননি। এমনিতেই হিড়িম্বারে দেখি চমকিত অন্তঃপুরী। আমরা যদিও বা রাক্ষসী ভেবে হিড়িম্বাকে কিঞ্চিৎ শ্যামা সুশোভনা ভেবেছিলাম, কাশীরামের দৃষ্টিতে তিনি বিনা মেঘে স্থির যেন তড়িৎ-তরঙ্গ।

বসনে-ভূষণে-আভরণে হিড়িম্বা এখানে এতটাই রূপবতী যে, দ্রৌপদীর অন্তঃপুরচারিণীরা তথা সমাগতা রমণীরা তর্কানুমানে বলছে–

কেহ বলে, হবে বুঝি মদন-মোহিনী।
কেহ বলে, হবে বুঝি নগেন্দ্ৰনন্দিনী!
কেহ বলে, মেঘে ছাড়ি হইয়া মানিনী।
 ভূমিতলে আসি দেখা দিল সৌদামিনী!

যাই হোক, কাশীরামের দৃষ্টিতে এই অপরূপা হিড়িম্বা প্রথমেই বিধি নিয়মমতে কুন্তীকে গিয়ে প্রণাম করতেই তিনি তাকে আশীর্বাদ করে বসতে বললেন। বস্তুত এই মহিলাকুলের মধ্যে একমাত্র কুন্তীই তাকে চেনেন, অন্যেরা তাঁকে চেনেন না, তবে জানেন নিশ্চয়। একই কথা হিড়িম্বার ক্ষেত্রেও সত্য, তিনিও সব খবর রাখেন এবং বোঝেনও সব। কুন্তী তাকে সসম্ভাষণে বসতে বললে–

যথায় দ্রৌপদী-ভদ্রা রত্ন সিংহাসনে।
হিড়িম্বা বসিল গিয়া তার মধ্যস্থানে।

হিড়িম্বাই যেহেতু ইন্দ্রপ্রস্থের রাজধানীতে প্রথম এসেছেন এবং তিনি কাউকে চেনেনও না অতএব তার কোনও দায় ছিল না দ্রৌপদী কিংবা সুভদ্রাকে সম্ভাষণ করার। কিন্তু প্রধান দায় যাঁর ছিল, সেই দ্রৌপদী হিড়িম্বাকে নিজের পাশে বসতে দেখেই ভীষণ রেগে গেলেন এবং হিড়িম্বাও অতিরিক্ত আত্মসম্মানবোধে দ্রৌপদীর সঙ্গে কোনও কুশল বিনিময়ও করলেন না, কথাও বললেন না কোনও কাণ্ড দেখে পঞ্চস্বামী-গর্বিতা দ্রৌপদী আর থাকতে পারলেন না। তিনি হিড়িম্বাকে গালাগালি দিতে আরম্ভ করলেন সেই ভাষায় ঠিক যেভাবে মধ্যযুগীয় বর্ণাশ্রমগর্বিণী মহিলারা নীচ-জাতীয়া, হীন-জাতীয় রমণীর এতটুকু সাহংকার উপস্থিতি বা ঘোষণা শুনলে উচ্চকণ্ঠে নির্লজ্জভাবে বলতেন। দ্রৌপদী বললেন– স্বভাব কোনও দিন যায় না রে, স্বভাব কখনও যায় না–

কী আহার, কী বিহার, কোথায় বসতি।
কীরূপ আচার তোর, না জানি প্রকৃতি ॥

তথাকথিত হীনজাতীয় রমণীর প্রতি এই সাধারণ ব্রাহ্মণ্য আক্ষেপ, আমার নিজের কানেই বহুবার শুনেছি ছোটবেলায়। আচার-বিচার নেই, কোথায় থাকিস তার ঠিক নেই– ইত্যাদি সাধারণ তিরস্কারের সঙ্গে দ্রৌপদী হিড়িম্বাকে দুটি ভয়ংকর দোষ দিলেন। প্রথমটা হল– দ্রৌপদী জানেন যে, হিড়িম্বা ভীমের প্রতি নিজে আকৃষ্ট হয়ে নিজে তার ভালবাসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং সেটা তার ভাই হিড়িম্ব-রাক্ষসের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এবং তার মৃত্যুর মূল্যে। দ্রৌপদী এটাকে কামাতুর স্বভাবের পরিচয় বলে মনে করেন বলে হিড়িম্বাকে বললেন–

ভাতৃবৈরী জনে কেহ না দেখে নয়নে।
কামাতুরা হয়ে তুই ভজিলি সে-জনে ॥

দ্বিতীয়ত, দ্রৌপদী এটাও শুনেছেন যে, হিড়িম্বা ভীমকে নিয়ে প্রচুর এদিক-ওদিক ঘুরেছেন এবং পুত্রলাভের পরেও তার এই ঘুরে বেড়ানো স্বভাব যায়নি বলেই তার ঘৃণা আছে। হিড়িম্বার প্রতি। এমন একজন রাক্ষসী এসে রাজসভার মধ্যে তারই পাশে বসে থাকবে, এ-কথা ভাবতেই দ্রৌপদীর ক্রুদ্ধ চিৎকার ভেসে আসে–

সতত ভ্ৰমিস তুই যথা লয় মন।
 একে কুপ্রকৃতি তায় নাহিক বারণ ॥
 অন্বেষিয়া ভ্ৰমিস ভ্রমরী যেন মধু।
 সভামধ্যে বসিলি হইয়া কুলবধূ ॥

তিরস্কার যথেচ্ছ হলে সজ্জিত যুক্তির মধ্যেও যে কুযুক্তি এসে যায়, এটা তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। নইলে পাণ্ডবদের কুলবধূ হয়ে দ্রৌপদী কিংবা সুভদ্রা যদি সভায় বসে থাকতে পারেন, তবে হিড়িম্বাই বা সেখানে বসতে পারবেন না কেন! আসলে দ্রৌপদীর রাগ, হিড়িম্বা হীনজাতীয় বলে এবং হীনজাতীয় বলেই হয়তো তাঁর রাক্ষসীর অভিধা জুটেছে। সবার শেষে দ্রৌপদী একেবারে স্পষ্ট নির্দেশে বললেন–

মর্যাদা থাকিতে কেন না যাস উঠিয়া।
আপন সদৃশ স্থানে বস তুমি গিয়া ॥

হিড়িম্বা এই অসহ্য অপমান মেনে নিলেন না এবং এখানে সযত্নে জানানো উচিত যে, রাক্ষসী হিড়িম্বার প্রতি কাশীরাম দাসের অনন্ত মায়া ছিল। ফলে মূল মহাভারতে এসব ঘটনার লেশমাত্র না থাকলেও মহাভারতেরই তথ্যসূত্র দিয়ে হিড়িম্বার মুখে উকিলের যুক্তি জুগিয়ে দিয়েছেন কাশীরাম। হিড়িম্বা দ্রৌপদীকে বলেছেন– তুমি অকারণে অহংকার প্রকট করে যা নয় তা বলার চেষ্টা কোরো না। তুমি নিজের ছিদ্রগুলো আগে দ্যাখো, আগে আয়নায় তোমার নিজের মুখটা দ্যাখো, তারপর আমাকে বলল। আমি না হয় আমার ভাইয়ের শত্রু ভীমকে ভালবেসেছি। তোর ক্ষেত্রে কী হয়েছে সেটা দেখ। তোর বাপ দ্রুপদকে তে অর্জুন যুদ্ধে হারিয়ে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল দ্রোণাচার্যের কাছে। অথচ এত বড় অপমানটা যে করল, তার হাতেই মেয়েকে তুলে দিল তোর বাপ। সেখানে লজ্জা করে না তোর। আর আমি ভীমকে ভালবেসেছি আগে, তারপর আমার ভাই মরেছে যুদ্ধ করে, বীরধর্মে মরেছে সে। কিন্তু তোর বাপ তো নিজের অপমান জেনে বুঝে তোকে তুলে দিয়েছে শত্রুর হাতে, আর তুই নিজেও সেটা মেনে নিয়েছিস

শত্রুরে যে ভজে তার বলি ক্লীবজন্ম।
সংসারে বিখ্যাত তোর জনকের কর্ম ॥

মুখের মতো এইরকম একটা জবাবের পরে হিড়িম্বা এবার নিজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করলেন জ্যেষ্ঠার মর্যাদায়। কারণ, দ্রৌপদী মর্যাদার কথা তুলেছেন, অতএব তারও একটা উপযুক্ত জবাব দেওয়া দরকার। হয়তো বা হিড়িম্বা জানতেনও যে, ভীমের ব্যাপারে দ্রৌপদীর কিছু ‘পজেসিভনেস’-ও আছে, কিন্তু সে-সব তো অনেক পরের কথা। হিড়িম্বা বললেন– ওহে শোন! তুই যে আমাকে বেশ একটা সতীন ভেবে কথা বলছিস, ওরকমটা চলবে না। বরঞ্চ তুইই আমার সতীন। তোর বিয়ের অনেক আগে ভীমের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেছে, এমনকী আমার ছেলে পর্যন্ত হয়ে গেছে তোর বিয়ের আগে

আমার সপত্নী তুমি আমি না তোমার।
 তোর বিবাহের আগে বিবাহ আমার।

এইটুকুতে দ্রৌপদীর আক্ষিপ্ত তিরস্কারের সমুচিত উত্তর হয়ে গেলেও হিড়িম্বা তাকে এত সহজে ছেড়ে দিলেন না। ইন্দ্রপ্রস্থের রাজবাড়িতে হিড়িম্বার বধূ-স্থানের মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দ্রৌপদী। তার পাঁচ-পাঁচটা স্বামী থাকতে পারে, এমনকী তার স্বামীদের অন্য বিবাহিত স্ত্রীরা অন্য দাবি নাও জানাতে পারে, কিন্তু তাদের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললে হিড়িম্বা ছাড়বেন না। তিনি বললেন আমার শাশুড়ি কুন্তী-মায়ের পাঁচ ছেলে বটে, কিন্তু বধূর সংখ্যায় তোমাকে নিয়ে আমরা সবাই ন’জন। তো আর আট জনের কোন অধিকার এবং দায় নিয়ে তুমি মাথা ঘামাও? তুমি একা পাটরানি সমস্ত ভোগটা করে যাচ্ছ, আর আমাকে দেখেই তোমার গায়ে জ্বালা ধরেছে। তুমি আমাকে বলছ নাকি আমি স্বতন্ত্র বুদ্ধিতে চলি, এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াই। কিন্তু আমি আমার ছেলের রাজ্যে, ছেলের অধিকারে খাই-পরি, সেখানে স্বতন্ত্রতা, স্বেচ্ছাচারিতা কোথায়? বরঞ্চ স্বতন্ত্র বললে একমাত্র তোকেই বলতে হয়। পাণ্ডবকুলের সমস্ত ঐশ্বর্য তুই একা স্বতন্তরী খাচ্ছিস, আমরা আট বউ সেই ঐশ্বর্যের অর্ধেকও তো চোখে দেখি না, তা হলে কি-হেতু নিন্দিস মোরে বলি স্বতন্তরা।

হিড়িম্বা নিজের ছেলের দিকে নির্দেশ করে দ্রৌপদীকে বললেন– দ্যাখ, আমাদের ছেলের দিকে একবার তাকিয়ে দ্যাখ, সমস্ত রাক্ষসদের জয় করে সে রাজকর নিয়ে এসেছে। মহারাজের রাজসূয় যজ্ঞে মোর পুত্রে শোভিতেছে পাণ্ডবের সভা। হিড়িম্বা যে-সব কথা শুনিয়েছেন, সেই সব কথার সোজাসুজি প্রত্যুত্তর দ্রৌপদীর যুক্তিতে আসেনি। কিন্তু যুক্তিতে হেরে গেলে সযৌক্তিক ব্যক্তিও যেমন এলেমেলো কথা বলে গালি দেয়, দ্রৌপদীও ঠিক সেইভাবেই হিড়িম্বাকে শুনিয়ে বললেন– এত ছেলে ছেলে করিস না। কর্ণ বলে একজন আছে জানিস তো, তার ভয়ংকর একাগ্নী বাণে তোর ছেলের মাথাটা কাটা যাবে। পুত্রের ওপর অভিশাপ শুনে হিড়িম্বাও ছেড়ে কথা বললেন না। বললেন– তবে রে! আমার ছেলেকে তুই এত বড় অভিশাপ দিলি, তা হলে জেনে রাখু– ছেলেদের জন্য তোরও অনেক কষ্ট আছে কপালে। আমার ছেলে তবু যুদ্ধ করে মরে স্বর্গে যাবে, তোর ছেলেরা বিনা যুদ্ধে বেঘোরে মারা যাবে–

যুদ্ধ করি মোর পুত্র যাবে স্বর্গবাস।
 বিনা যুদ্ধে তোর পঞ্চ পুত্র হৈবে নাশ ॥

হিড়িম্বা এতই রেগে গেছেন যে, এবার ইন্দ্রপ্রস্থের সভা ছেড়ে বেরিয়ে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। এই সময়ে দুই বউয়ের কোন্দলে প্রবেশ করলেন কুন্তী এবং দু’জনকেই শান্ত করে যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞ-সহায়তা করলেন। কাশীরামের এই কাণ্ডটা মূল মহাভারতে নেই, আর কর্ণের কাছে ইন্দ্রদত্ত একাগ্নী বাণ এসেই পৌঁছয়নি তখনও। কিন্তু নির্মাণ-নিপুণ কবি কাশীরাম যেহেতু হিড়িম্বার পুত্র ঘটোৎকচের মৃত্যুকারণ জানেন এবং দ্রৌপদীর ছেলেদেরও মৃত্যুর পরিস্থিতি জানেন, অতএব সেই দুটি ঘটনা হান্তক ভূমিকায় কাজে লাগিয়ে এমন একটি নতুন গল্প সৃষ্টি করেছেন, যা চিরকালীন ভারতবর্ষীয় সমাজের অন্যায় আভিজাত্য বোধকেও যেমন আঘাত করে, তেমনই রাক্ষসী হিড়িম্বার প্রতি কাশীরামের কবিজনোচিত বেদনাবোধও এখানে লক্ষ করার মতো বিষয়। হিড়িম্বা কোনও দিন রাজধানীর প্রকাশ্য প্রবাহের মধ্যে ফিরে এলেন না, কিন্তু ফিরে আসলে কী কী জটিল আবর্ত তৈরি হতে পারত, তার একটা কল্পিত ঝলক তৈরি করে দিয়েছেন কাশীরাম।

কাশীরাম দাস যেভাবে হিড়িম্বাকে রাজসূয় যজ্ঞের পটভূমিতে নিয়ে এসেছিলেন, তাতে একটা সামাজিক ব্যবস্থার উন্মোচন ঘটল বটে, কিন্তু এখানে পঞ্চস্বামীগর্বিতা দ্রৌপদীর সঙ্গে সাংসারিক বিবাদ ছাড়া আর কিছু দেখানোর সুযোগ হল না। এই বিরাট রাজসূয়ের অন্তরালে একবারের তরেও তার যেন দেখা হল না মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেনের সঙ্গে।

মহাকাব্য মহাভারত পড়ে আমার কিন্তু সেই দুঃখটা থেকেই গিয়েছিল, দুঃখ ছিল এই যে, সেই যে ছেলের হাত ধরে রাক্ষসী চলে গেল উত্তরে, আরও উত্তরে, তার সঙ্গে আর একবারও দেখা হল না মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেনের। তবে আরও পড়তে পড়তে বুঝলাম– আমি একাই শুধু সেই সংবেদনশীল বুদ্ধিমান নই, যে এই নান্দনিক অভাবটুকু অনুভব করেছে, এই অভাবটুকু অনুভব করেছেন কবিকুলের আদিতম নাট্যকার মহামতি ভাস, যিনি খ্রিস্টীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতাব্দীতেই মহাকাব্যের এই আংশিক ট্র্যাজিডি মেনে নিতে পারেননি এবং হিড়িম্বার সঙ্গে ভীমের মিলন ঘটিয়ে দিয়েছেন নির্মল হাস্যরসের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে পরশুরাম রাজশেখর বসু বাংলায় ভাসের নাটকটিকে নিয়ে অসামান্য একটি গল্প লিখেছেন। আমরা সেটি পড়ে নেবার পরামর্শ দিয়েই এই প্রবন্ধ শেষ করতে পারতাম, কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে মহাকাব্যের হিড়িম্বা-ভীমের প্রণয়-সত্যের ট্র্যাজিডিটুকু ভাস যেভাবে মিলনে উত্তীর্ণ করেছেন, তাতে অন্য এক সত্যের উদঘাটন হয়ে গেছে।

ভাসের এই নাটকের নাম ‘মধ্যমব্যায়োগ’ এবং খ্রিস্টীয় শতাব্দীর আদিকালে এটি একটি একাঙ্ক নাটক, কোনও সংস্কৃত নাট্যকার সেইকালে লেখেননি। নাটকটা আরম্ভই হচ্ছে অদ্ভুত এক ‘আয়রনি’ দিয়ে। মহাভারতের মধ্যম পাণ্ডব ভীমের প্রতি প্রণয়াবেশে যে হিড়িম্বা তার ভাই হিড়িম্ব রাক্ষসের হাত থেকে ভীম এবং অন্যান্য পাণ্ডব-ভাইদের বাঁচাতে চেয়েছিলেন, সেই হিড়িম্ব ছিল নরমাংসলোলুপ এক হিংস্র প্রকৃতির আর্যেতর মানুষ। একবার দেখার পরে ভীমকে তার ভাল লেগে গিয়েছিল বলেই হিড়িম্বা এখানে হিড়িম্ব-ভাইয়ের নরখাদকতার বৃত্তি প্রকট করে তুলেছেন বেশি করে এবং তার স্বচিহ্নিত প্রণয়ী ভীম এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ মা ভাইকে বাঁচিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ঘরের কথা ফাঁস করে দিয়ে। ধরেই নেওয়া যায় যে, আর্যগোষ্ঠীর ক্ষত্রিয় প্রতিভূ ভীমের সঙ্গে হিড়িম্বার সহবাস পরিচয়ের পর তার রাক্ষসী-বৃত্তি কিছু কমবে। বিশেষত নরমাংসলোলুপতার যে জঘন্য অভ্যাস রাক্ষস-রাক্ষসীদের ওপর চিরকাল চাপানো হয়েছে, সেই অভ্যাস আর্যজনের সহবাসে স্তিমিত হবে। কিন্তু ভাসের নাটকে দেখছি অদ্ভুত এক ‘আয়রনি’ দিয়েই নাটকের সূত্রপাত ঘটেছে।

ঘটনার স্থান এবং সময় নির্ধারণ করা হয়েছে পাণ্ডবদের অরণ্যবাসের সময়ে। তার মানে অনেক কাল কেটে গেছে সেই দ্রৌপদীর সঙ্গে পাঁচ পাণ্ডব-ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে, যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রস্থে রাজা হয়ে কিছু কাল কাটিয়েছেন, শকুনির সঙ্গে পাশাখেলা হয়েছে। এবং পাণ্ডবরা বনবাসে গেছেন, এমনকী বনবাসেরও কয়েক বছর কেটে গেছে। এইরকম একটা সময়ের প্রক্ষেপে ভাস নাটক আরম্ভ করছেন। দেখা যাচ্ছে প্রথম ‘সিনে’ই কুমার ঘটোৎকচ তার বিশাল ভীতিকর শরীর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং এক ব্রাহ্মণ স্ত্রী-পুত্রসহ তাকে দেখে ভীষণ ভয় পাচ্ছেন। প্রথম প্রথম ব্রাহ্মণ একটু ভয় পেলেও খানিকটা বোধহয় নিশ্চিন্তও ছিলেন যে, রাক্ষসরা আর যাই হোক ব্রাহ্মণ-পরিবারের কাউকে প্রাণে মারবে না। তার তিন ছেলে ঘটোৎকচের চেহারার রাক্ষসোচিত বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে আলোচনা বিচার করছিলেন– লোকটার চুল লাল, চোখ পিঙ্গলবর্ণ, উঁচু দাঁত, গায়ের রং কালো, কিন্তু দৃপ্ত, সাহসী এবং উগ্র চেহারা, কিন্তু এই রাক্ষসের গলায় একটা পৈতে আছে। ব্রাহ্মণ পিতা এবং তার তিন ছেলে ভয় পাচ্ছিলেন বটে, কিন্তু সংসারে ঘষ্টে-যাওয়া গিন্নি যেমন অতি ঘনিষ্ঠজনের বৃত্তির উৎকর্ষও বোঝেন না এবং অন্যের ভয়-ত্রাসও কিছু বোঝেন না, সেইরকমভাবেই ব্রাহ্মণী বললেন– কে রে এই লোকটা? তখন থেকে জ্বালিয়ে মারছে।

ততক্ষণে ঘটোৎকচ সামনে এসে গেছেন এবং এই পরিবারের এক-দু’জনের জীবন চলে গেলে যেন খুব কিছু ক্ষতি হয়ে যাবে না, এইরকম একটা ভাব দেখিয়ে ঘটোৎকচ বললেন– ওহে বামুন, পঁড়াও, দাঁড়াও। আমায় ভয়ে তোমার স্থিরতা-ধীরতা নষ্ট হয়ে গেছে, তা জানি। পুত্ৰ-পরিবারকে আমার হাত থেকে বাঁচাবে, সেই শক্তিও তোমার নেই। তবে হ্যাঁ, গরুড়ের পাখার বাতাস লেগে তোমার মতো আর্তজনেরও রাগ চেতিয়ে ওঠে জানি, কিন্তু কিছু তো করার নেই, যেয়ো না, যেয়ো না এখান থেকে।

রাক্ষসদের সম্বন্ধে আমাদের যেমন ধারণা– তারা এসেই মেরে-ধরে খেয়ে ফেলবে– ঘটোৎকচ কিন্তু সেরকম ব্যবহার করছেন না, তিনি একটু রেখে-ঢেকে কথা বলছেন, একেবারে হামলে পড়ছেন না। তার কথাবার্তা শুনে ব্রাহ্মণও বলছেন– ভয় পেয়ো না, ব্রাহ্মণী! ভয় পেয়ো না ছেলেরা! এর কথা শুনে মনে হচ্ছে লোকটার কিছু বোধশক্তি আছে, একটু চিন্তা করে কথা বলছে যেন সবিমৰ্শা হি অস্য বাণী। ব্রাহ্মণের কথার খেই ধরে ঘটোৎকচও বলল– আরে কী ঝামেলা! এত কী কথা বলছ– আমি জানি, এই পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণেরা পূজ্যতম বটে। কিন্তু কী করি! আমি তো নাচার। আমার মা একটা আদেশ করেছেন আমাকে, তাই সমস্ত দ্বিধা ত্যাগ করে এই অকাজটা আমাকে করতে হবে– অকার্যমেত ময়াদ্য কাৰ্যং/ মাতুর্নিয়োগাদপনীয় শঙ্কাম।

খুব নাটকীয়ভাবেই ভাস তাঁর দর্শিতব্য ঘটনা এবং ভাবনার মধ্যে একটা ‘আয়রনি’ তৈরি করছেন। এই যে ব্রাহ্মণ পরিবার– এঁরা একটা বড় নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরছেন। তবে কিনা সেকালের দিনের ব্রাহ্মণের ঘরের নেমন্তন্ন, তাই উৎসবটাও ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের ঘটনা। ব্রাহ্মণ কেশবদাস তার স্ত্রী এবং তিন ছেলেকে নিয়ে ভারতের উত্তর-দেশে উদ্যামক গ্রামে মামার ছেলের উপনয়ন উৎসবে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার সময় বনের পথে সামান্য বিশ্রাম নেবার সময় এই বিপত্তি। লক্ষণীয়, কেশবদাস উত্তরদেশ থেকে ফিরছিলেন এবং মহাভারতের বিবরণে এটাই আছে যে, হিড়িম্বা তার ছেলে ঘটোৎকচকে নিয়ে আরও উত্তরের দিকে চলে গিয়েছিলেন।

‘আয়রনি’র জায়গাটা হল এই যে, হিড়িম্বা একটি ব্রত উপবাস করেছিলেন। অতএব পরের দিন পারণ-পর্বের জন্য তিনি ছেলেকে বলেছেন একটি মানুষ ধরে আনতে। সেই নরমাংস খেয়ে তিনি উপবাস ভঙ্গ করবেন। মনে করিয়ে দিতে চাই– এইরকম অন্য একটা দিন, যেদিন তার রাক্ষস-ভাই হিড়িম্বও আপন নরমাংসলোলুপতায় এই হিড়িম্বাকেই পাঠিয়েছিল পাণ্ডব ভাইদের ধরে আনার জন্য। সেদিন হিড়িম্বা কাউকেই ধরতে পারেননি, উলটে মধ্যম পাণ্ডবের আসঙ্গলিপ্সায় তিনি আপন ভাইয়ের নরমাংস-লিপ্সায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ সেই হিড়িম্বাই কিন্তু নরমাংসের জন্য ছেলেকে পাঠিয়েছেন বনস্থলীতে। হয়তো নিছক নরমাংস লোলুপতার জন্যই নয়, এর পেছনে হিড়িম্বার ব্রতোপবাসের ধর্মীয় কারণ কিছু আছে। কিন্তু সেখানে নিয়মভঙ্গের জন্য নরমাংস লাগবে কেন? বস্তুত হিড়িম্বা। নিজেই এই নরমাংসের জন্য ছেলেকে আদেশ দেওয়ায় তার ভাইয়ের বৃত্তি আজ পুনরাবৃত্ত হল এবং ভাস বোধহয় বোঝাতে চাইছেন যে, বৈবাহিক সংসর্গ-সহবাসের মাধ্যমে অনেক কিছু পরিশীলিত হলেও পূর্বেকার বৃত্তি, রুচি এবং স্বভাব আমূল পরিবর্তিত হয়ে যায় না। হিড়িম্বা তাই ভীমের ঔরসজাত পুত্রটিকেই একটি মানুষ ধরে আনার জন্য আদেশ দেন।

ঘটোৎকচ অবশ্য মায়ের আদেশের আভাসটুকু দিয়েছে। ব্রাহ্মণী আর খুব ভরসা রাখতে পারছেন না ঘটোৎকচের কথায়। এখনও তিনি পরিষ্কার করে বলেননি যে, ঠিক কী তিনি চান, তবে সেটা যেহেতু অন্যায় অকাজ বলে তিনি নিজেই চিহ্নিত করেছেন, অতএব বিপদ একটা আছে বলেই মনে করছেন সংসারের ভারবাহক এই পিতা। তিনি বলেও ফেললেন– ব্রাহ্মণী! ওখান থেকে ফেরার সময় জলক্লিন্ন মুনি আমাদের বলেইছিলেন যে, এই বনে রাক্ষসের ভয় আছে, তুমি সাবধানে যেয়ে। এখন দেখছি, সেই বিপদই হল। ব্রাহ্মণী অসহায়ভাবে বললেন– এমন বিপদ দেখেও তুমি এমন চুপচাপ আছ কী করে? বরঞ্চ আমরা সবাই মিলে একটু চেঁচামেচি করে দেখি-না, কেউ যদি বিপদ-ত্রাণের জন্য এগিয়ে আসে। মায়ের কথা শুনে ব্রাহ্মণের বড় ছেলে বলল- কার আশায় এখানে চাঁচাব মা। দেখছ তো এই অরণ্যের মধ্যে কোথাও কোনও জনমানব নেই। থাকার মধ্যে আছে শুধু পশু আর পাখি। তবে হ্যাঁ, এই শান্ত নির্জন বনস্থলীতে মনস্বী জন এবং মুনি-ঋষিরা থাকতে পছন্দ করবেন বটে।

প্রথম পুত্রের কথা শুনে ব্রাহ্মণের মাথায় বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো একটা ভাবনা খেলে গেল। তিনি বললেন– ব্রাহ্মণী ভয় পেয়ো না। মনস্ব জন, মুনি-ঋষিরা এরকম জায়গায় থাকতে পছন্দ করবেন শুনে আমার ভয়টা কেমন কেটে যাচ্ছে। আমার ধারণা, পাণ্ডব ভাইরা এখন বনবাসে আছেন এবং তারা কাছাকাছি কোথাও আছেন বলেই আমার মনে হচ্ছে। আর যদি তারা কেউ থাকেন তা হলে এইরকম ভয়ানক দেখতে লোককে তারাই শায়েস্তা করতে পারেন। কেননা, তারা যুদ্ধ ভালবাসেন, শরণাগতকে রক্ষা করেন, দরিদ্র মানুষের প্রতি তাদের দয়া-মায়া আছে এবং সবাই জানে তারা কেমন বীর। যে আমাদের এইভাবে ভয় দেখাচ্ছে, তাকে ঠান্ডা করতে ওঁরাই হলেন উপযুক্ত লোক– দণ্ডং যথাহমিহ ধারয়িতুং সমর্থাঃ।

লক্ষণীয়, ব্রাহ্মণের পরিবারের মধ্যে এত যে ভয়-ত্রাস চলছে, সে-সব দেখেশুনেও ঘটোৎকচ কিন্তু ভয়ংকর কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না, কিংবা হাউ-মাউ-খাউ করেও তেড়ে আসছেন না। অন্তত নাট্যকার ভাস তাকে এই মুহূর্তে খানিকটা উদাসীন হিসেবে দেখিয়ে রাখছেন এইজন্যই যে, রাক্ষস হলেও তিনি ভীমের পুত্র, মায়ের উপবাসভঙ্গের জন্য খাবার হিসেবে মানুষ ধরে নিয়ে যেতে চাইলেও তার ভদ্রাভদ্র, সমীচীন জ্ঞান আছে। অতএব এখনও তিনি কোনও আক্রমণের ভাব দেখাননি। বরঞ্চ যথোচিত আলোচনার সুযোগ দিচ্ছেন।

ব্রাহ্মণ-পিতার ক্ষীণ আশায় কিন্তু একেবারে ঘোলা জল ঢেলে দিলেন সেই তার প্রথম পুত্রই। সে বলল তুমি যে পাণ্ডবদের জন্য সকলের জীবনের আশা করছ, আমার কাছে যা খবর, তাতে এইটুকু বলতে পারি যে, পাণ্ডবরা এখানে নেই। তারা সব মহর্ষি ধৌম্যের আশ্রমে গেছেন শতকুম্ভ নামে এক যজ্ঞ করার জন্য। কথাটা আমি শুনেছি এক ব্রাহ্মণের মুখে যিনি ওই যজ্ঞস্থল থেকে ফিরেছেন। ব্রাহ্মণ পিতা বললেন– তা হলে তো সবই শেষ হয়ে গেল, আর কোনও আশা নেই বাঁচার। ছেলে বলল– না বাবা, সবাই কিন্তু সেই যজ্ঞে যাননি। বনের মধ্যে তাদের আশ্রমটি সুরক্ষিত রাখার জন্য মধ্যম পাণ্ডব ভীম এখানে রয়ে গেছেন। ব্রাহ্মণ লাফিয়ে উঠে বললেন– আরে শুধু ভীম যদি এখানে থেকে থাকেন, তা হলে বলতে হবে সব পাণ্ডবরাই এখানে আছেন। আসলে ভীমের শক্তি এবং অস্ত্ৰক্ষমতার কথা এতটাই লোকবিশ্রুত ছিল যে, তার মতো একজন থাকলে আর কাউকেই প্রয়োজন হয় না। তবে ব্রাহ্মণের ছেলে পিতার উৎফুল্লতায় খুব একটা উৎফুল্ল হল না। কারণ সে জানে যে, এই সময়টাতে তিনি ব্যায়াম এবং শরীরচর্চার জন্য অন্যত্র একটু দূরে থাকেন।

ব্রাহ্মণ পিতা যখন এই আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বে ভুগছেন এবং ভাবছেন যে, কিছু করার থাকলেও এই মুহূর্তে তা করা যাচ্ছে না, তখন নিরাশার শেষ জায়গায় এসে ব্রাহ্মণ বললেন– সব আশাই যখন ব্যর্থ হয়ে গেছে, তখন অন্তত অনুনয়-বিনয় করে দেখি একবার। যুবমানস জানে, এতে লাভ হবে না, ব্রাহ্মণের প্রথম ছেলে তাই বলল– কোনও লাভ হবে না, বাবা! পরিশ্রমই সার। ব্রাহ্মণ বললেন- দ্যাখো বাছা! কোনও আশাই যেখানে নেই, সেখানে অনুনয়-প্রার্থনাই একমাত্র উপায়। দেখি না কী হয়! ব্রাহ্মণ এবার ঘটোৎকচের দিকে তাকিয়ে বললেন– এই যে মশাই! আমাদের কি মুক্তি হয় না কোনও ভাবে? ঘটোৎকচ কোনও ক্রোধ প্রকাশ না করে ঠান্ডা মাথায় বললেন– মুক্তি হতে পারে একটা শর্তে। দেখুন, এটা আমার মায়ের ব্যাপার। তিনি আমাকে আদেশ দিয়ে বলেছেন– বাছা! আমার উপবাস ভঙ্গ করার জন্য এই অরণ্য থেকে একটি মানুষ ধরে নিয়ে এসো। সেই কাজ করতে গিয়ে দেখছি তোমরা এখানে রয়েছ। তাই তোমাদেরই ধরেছি। এখন তোমার বাঁচার শর্ত হল, তুমি তোমার একটি ছেলে আমাকে দাও। বদলে তুমি তোমার সতী-সাধ্বী স্ত্রীকে, দুটি ছেলেকে এবং নিজেকে বাঁচাতে পারো। অতএব ভালমন্দ গুণাগুণ বিচার করে তোমার একটি ছেলেকে আমার হাতে দাও বলাবলং পরিজ্ঞায় পুত্রমেকং বিসর্জয়।

এই বিপন্ন অবস্থাতেও ঘটোৎকচের কথা শুনে ব্রাহ্মণ বেশ রেগে গেলেন। বললেন– ব্যাটা রাক্ষস! বদমাশ কোথাকার! আমি কি বামুন নই, নাকি খারাপ বামুন? আমি এতদিন শাস্ত্র পড়েছি, শাস্ত্রের মর্ম জানি। সেই আমি কিনা একটি সচ্চরিত্র গুণবান ছেলেকে তোর হাতে তুলে দেব! বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের কথায় এতটুকুও রাগ করলেন না ঘটোৎকচ, কিন্তু নিজের জায়গা থেকে এতটুকু সরলেনও না। ঘটোৎকচ বললেন– কে বলেছে আপনি খারাপ বামুন, আপনি খুব ভাল বামুন। কিন্তু তবু বলছি– আপনার একটা ছেলেকে আমি চেয়েছি, যদি তা না দেন, তা হলে আপনি সপরিবারে ধ্বংস হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন। ব্রাহ্মণ আবারও রেগে গেলেন। বললেন ঠিক আছে, তা হলে শোনো আমার প্রতিজ্ঞা। শোন, আমার এই শরীরের যা কাজ, তা হয়ে গেছে, বার্ধক্যও গ্রাস করেছে আমার শরীর। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য শাস্ত্রীয় আচারে মার্জিত এবং সংস্কৃত এই শরীর আমি আহুতি দেব তোর জন্য। তুই চল, আমাকে নিয়ে চল।

বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের এই হঠাৎ প্রতিক্রিয়ায় সমস্ত পরিবারটার মধ্যেই একটা আলোড়ন হল। পরিবারের একজনকে বাঁচানোর জন্য আত্মাহুতির ধূম পড়ে গেল। প্রথমেই উচ্চকিত হলেন ব্রাহ্মণী। তিনি বললেন– প্রভু এমন কাজও করবেন না আপনি। পতিব্রতা পত্নীর কাছে স্বামীই তো একমাত্র ধর্ম। আমিও তো আমার এই শরীর-ধারণের পুরস্কার লাভ করেছি, অতএব এই শরীর দিয়ে আমি এই বংশ, পুত্রদের এবং আপনাকে রক্ষা করতে চাই। বাহ্মণীর কথায় ঘটোৎকচ এবার সসম্ভ্রমে জানাল– দেখুন, আমার মায়ের আবার স্ত্রীলোক পছন্দ নয়, অর্থাৎ উপবাস-ভঙ্গের ক্ষেত্রেও শুধু মানুষ হলে তার চলে না, এখানে তার স্ত্রী-পুরুষের বিচার আছে, পুরুষ-মাংসই তার পছন্দ, স্ত্রীলোকের মাংস নয়।

স্ত্রী হিসেবে হিড়িম্বা পুরুষের মাংসই পছন্দ করেন–এখানেও কোনও সামাজিক-দার্শনিক যৌনতার আলোচনা চলে কিনা, সেটা ভাববার বিষয়। কিন্তু আপাতত সে আলোচনায় আমরা যাব না। দেখুন, বাপ-মায়ের এমন একটা আত্মবলিদানের প্রক্রিয়ায় যুবক ছেলেদের মধ্যে এবার আত্মবিসর্জনের নতুন ভাবনা আরম্ভ হল। স্ত্রীলোকে ঘটোৎকচ-জননীর অরুচি দেখে ব্রাহ্মণ পিতা তাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই ঘটোৎকচের সঙ্গে যেতে চাইছিলেন, কিন্তু ঘটোৎকচ তাকেও দূরে হটিয়ে দিলেন, কেননা চর্মসার, মেদহীন এক বৃদ্ধের মাংসও হিড়িম্বার পছন্দ হবে না, সেটা ঘটোৎকচ জানেন। ফলে পড়ে রইলেন তিন ছেলে। তিন জনের মধ্যে প্রথম অনেক বেশি দায়িত্বশীল। সে পিতা-মাতা-ভাইদের বাঁচানোর জন্য আগে যেতে চাইল। গুরুজনদের বাঁচানোর তাগিদে দ্বিতীয় জন্যও একই কথা বলল। তৃতীয় জনও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা। সকলেই পরিবারের স্বার্থে আগে যেতে চায় আত্মবিসর্জনের জন্য।

তিনজনের বক্তব্য শোনার পর প্রথম পুত্র বলল– শাস্ত্রীয় কারণেই আমার দায়িত্ব অনেক বেশি। পিতা বিপদগ্রস্ত হলে জ্যেষ্ঠ পুত্রই তাকে উদ্ধার করে। অতএব আমাকেই যেতে হবে। ঠিক এই অবস্থায় প্রথম পারিবারিক টানাপোড়েন দেখা দিল। পিতা বললেন– এই জ্যেষ্ঠ পুত্র আমার সবচেয়ে প্রিয়, তাকে আমি ছেড়ে দিতে পারব না! ব্রাহ্মণী বললেন– তোমার কাছে যেমন বড় ছেলে, আমার কাছে তেমনই ছোট ছেলে। তাকেও আমি ছাড়তে পারব না। এবার দুই ভাইয়ের মধ্যম দ্বিতীয় পুত্রটি বাবা-মায়ের এই ভাগাভাগি দেখে একটু যেন মর্মাহত হয়েই ঘটোৎকচকে বলল– পিতা-মাতাই যাকে চান না, তার প্রতি কে প্রসন্ন হবে? ঘটোৎকচ বললেন– আমি তোমার প্রতি প্রীত-প্রসন্ন হয়েছি। তুমি তাড়াতাড়ি চলো আমার সঙ্গে। দ্বিতীয় পুত্রটির মনে প্রথমে একটু অভিমান এসেছিল বটে, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সে নিজেকে সামলে নিল এবং নিজের ভৌতিক দেহের পরিবর্তে সে যে পরিবারের সকলকে বাঁচাতে পারছে– এই গর্বে সে নিজের অভিমানের জায়গাটা পালটে নিল। তার এই আত্মত্যাগের গৌরব দেখে স্বয়ং ঘটোৎকচ পর্যন্ত তার দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

এখানে বলা প্রয়োজন যে, নাট্যকার ভাস যেভাবে এই তিন পুত্রের উদাহরণ তৈরি করেছেন, যেভাবে প্রথম পুত্রটির প্রতি পিতার এবং কনিষ্ঠ পুত্রটির ওপর মায়ের স্নেহের বাহুল্য দেখিয়েছেন, তার সূত্র আসছে বৈদিক কালের শুনঃশেপের উদাহরণ থেকে। ভাস যেহেতু উত্তর-বৈদিককালের নাট্যকার, অতএব তার নাটকে যাগ-যজ্ঞ, পৌরোহিত্য, ব্রাহ্মণ্য এবং অন্যান্য বৈদিক ক্রিয়া-কলাপের প্রাধান্য যেমন আছে, তেমনই কিছু কিছু ‘কনভেনশনাল’ কাহিনিও তাঁর নাটকে সূত্রাকারে ঢুকে গেছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থে দেখা যাবে– হতদরিদ্র এক ব্রাহ্মণ অজীগর্ত অর্থের লোভে তিন পুত্রের মধ্যে একজনকে প্রায় বিক্রি করে দিচ্ছে। সেখানেও স্নেহ-প্রিয়ত্বের কারণে প্রথম পুত্রকে পিতা ছাড়ছেন না, মা। ছাড়ছেন না কনিষ্ঠকে, অবশেষে মধ্যম শুনঃশেপকে দু’জনেই ছেড়ে দিচ্ছেন। ভাস সেই বৈদিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন নাটকীয় বৃত্তিতে। ব্রাহ্মণের মধ্যম পুত্রটি ঘটোৎকচের সঙ্গে যাচ্ছে।

ঘটোৎকচ কোনও তাড়া করছেন না। কেননা আসন্ন বিদায়-দৃশ্যে করুণা-বিগলিত পিতার আশীর্বাদ, জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠের অভিবাদন-আলিঙ্গন– কোনওটাকেই তিনি ক্রুর রাক্ষসোচিত দৃষ্টিতে দেখছেন না। এর পরেই নাটকের গতি পরিবর্তিত হচ্ছে উত্তেজনার দিকে। ব্রাহ্মণের দ্বিতীয় পুত্রটি ঘটোৎকচের সঙ্গে চলে যাবার কালে নিকটবর্তী জলাশয়ে একবার জল খেয়ে আসতে চাইল। সামনে তার মৃত্যু কীভাবে আসছে, সে বুঝতে পারছে, অতএব ভয় তাকে গ্রাস করছে, সে জল খেতে চাইছে। ঘটোৎকচ অবশ্য তার পালিয়ে যাবার আশঙ্কা করছেন না, কিন্তু একটু নিস্তরঙ্গ ভাব দেখিয়ে বললেন আমার মায়ের আবার খাবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, যাহোক তাড়াতাড়ি করো। দ্বিতীয় পুত্র চোখের আড়াল হতেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বিলাপ করতে লাগলেন পুত্রের জন্য। তার বিলাপিনী ভাষায় যুক্ত হয়েছে পুত্রস্নেহের আকুলতা, পুত্রের জন্য গৌরব। কিন্তু জল খেয়ে আসতে ব্রাহ্মণ-যুবার দেরি হচ্ছে জীবন যাবার মুহূর্তে কে আর অত সময়ের শৃঙ্খল মেনে চলে!

এদিকে ঘটোৎকচ একটু অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন। একা একাই তিনি সোচ্চারে বলে উঠছেন– ব্রাহ্মণের এই ছেলেটি বড্ড দেরি করে ফেলছে। মায়ের খাবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। কী যে করি? এবার তিনি ব্রাহ্মণ-পিতাকেই বলে বসলেন– তোমার ছেলেটাকে একবার ডাকো তো। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ রেগে বললেন– ব্যাটা! তুই রাক্ষসেরও অধম। রাক্ষসরাও এইভাবে কথা বলে না। তুই কিনা বাপকে বলছিস ছেলেকে মরণের মুখে যাবার জন্য ডাক দিতে। ঘটোৎকচ বললেন– আহা চটছ কেন? ক্ষমা দাও বাপু। আমি রাক্ষস মানুষ, আমার কথাবার্তার ধরনটাই ওইরকম। তা বেশ তো তোমার ছেলের নামটা একটু বলো, আমিই ডেকে নিচ্ছি। ব্রাহ্মণ আবারও রেগে বললেন– এ-কথাটাও আমি শুনতে পাচ্ছি না। ঘটোৎকচ বললেন–ঠিক আছে, ঠিক আছে বলতে হবে না তোমাকে। তিনি এবার ব্রাহ্মণের পুত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন– এই যে, বলো তো, তোমার ভাইটার নাম কী? ব্রাহ্মণের প্রথম পুত্র বলল– বেচারা মধ্যম, ওকে আমরা মধ্যম অর্থাৎ মেজ বলেই ডাকি। ঘটোৎকচ বললেন– বাঃ, নামটা বেশ মানিয়েছে তো। তাই আমি ওই নামেই ডাকছি– ওহে মধ্যম, ওরে মেজ! তাড়াতাড়ি এসো, তাড়াতাড়ি এসো এবার।

এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই নাটকের দৃশ্য পরিবর্তন ঘটে গেল এবং নাটকীয়তাও অন্য মোড় নিল। এবারের দৃশ্যে আমরা মধ্যম পাণ্ডব মহাবলী ভীমসেনকে দেখতে পাচ্ছি। তিনি হঠাৎ এই ‘মধ্যম’ সম্বোধনের বিলম্বিত ডাক শুনে বিচলিত হয়ে নিজে নিজেই বললেন– এ কার কণ্ঠস্বর। এই বনে শত শত পাখি ডাকছে, ঘনসন্নিবিষ্ট বৃক্ষে পরিপূর্ণ এই বন কারও পক্ষে অতিক্রম করাও অত সোজা নয়। এখানে উঁচু গলায় এমন করে কে ডাকছে? গলাটাও অনেকটা অর্জুনের মতো লাগছে, আমার মনে কেমন এক উৎকণ্ঠা হচ্ছে।

একটু দূরে ঘটোৎকচকেও আমরা উৎকণ্ঠিত দেখতে পাচ্ছি। ব্রাহ্মণের পুত্রটি এখনও ফেরেনি। তিনি আবারও জোরে জোরে ডাকতে আরম্ভ করলেন– ওহে মধ্যম! তাড়াতাড়ি এসো। আমার মায়ের খাবার বেলা পেরিয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করো, ওহে মধ্যম! তাড়াতাড়ি করো। কথাগুলো আবার ভীমের কানে গেল। বারবার এরকম ডাক শুনে তিনি বেশ বিরক্ত হয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন- কে রে এটা? এই বনের মধ্যে আমার ব্যায়াম করার দমটাই নষ্ট করে দিচ্ছে। বারবার আমাকে ‘মধ্যম’ বলে ডাকছে, এটা কে?

এরপর আরও খানিক এগিয়ে আসতেই ঘটোৎকচকে দেখতে পেলেন ভীম। ছেলে এখন এত বড় হয়ে গেছে যে ভীম তাকে প্রথম দেখায় চিনতেই পারলেন না, কিন্তু ঘটোৎকচের বলিষ্ঠ চেহারাটা তার বেশ পছন্দ হল। নিজের মনে মনেই তিনি বললেন– সিংহের মতো এর মুখ, সিংহের মতো দত, সুরার মতো উজ্জ্বল দুটি চোখ, পিঙ্গল ভুরু, বাজপাখির মতো নাক, দীর্ঘ বাহু, অথচ গলার স্বর বেশ স্নিগ্ধ এবং গভীর। একে দেখে বোঝা যাচ্ছে এই বলিষ্ঠ ছেলেটি কোনও বিখ্যাত বীরের ঔরসে রাক্ষসীর গর্ভে জন্মেছে–সুব্যক্তং রাক্ষসীজো বিপুলবলযুতে লোকবীরস্য পুত্রঃ।

পণ্ডিতজনেরাও স্বীকার করবেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে এবং অতি গভীর অসবর্ণ অথবা জাতি-কুল-হীন বিপরীত স্ত্রী-পুরুষের মিলনজাত সন্তানদের মধ্যেও দেখেছি যে, চেহারার একটা ছাপ পড়ে। ঘটোৎকচের চেহারায় যেমন ক্ষত্রিয়-বীরের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, তেমনই তার হনু, চোখ, ভুরু এবং চুলের মধ্যে বিজাতীয় ছাপ পড়েছে। হ্যাঁ, তাতে করে এটা বোঝা যায় যে, এই সন্তান সাংস্কারিক জাতি-বর্ণ-সম্ভুত নয়, কিন্তু ভীম যে তাকে একেবারে লোকবীর ক্ষত্রিয়ের ঔরসে রাক্ষসীর গর্ভজাত ভেবে নিচ্ছেন, এটা নাট্যকার ভাসের ভাবনা। ঘটোৎকচের প্রতি ভীমের অযথা স্নেহ পূর্বাহ্নেই সূচিত করে দেওয়াটা হয়তো ভাসের উদ্দেশ্য এখানে।

ঘটোৎকচ তখনও দেখেননি ভীমকে, তিনি আরও জোরে চেঁচিয়ে ‘মধ্যম’ ‘মধ্যম’ বলে ডাকতে আরম্ভ করলেন। ভীম তার দৃষ্টিপথে এসে গেছেন ততক্ষণ। তিনি ঘটোৎকচের দিকে তাকিয়ে বললেন– আরে চাঁচাচ্ছিস কেন, এই তো আমি এসে গেছি। ঘটোৎকচ দেখল– এটা ব্রাহ্মণের সেই দ্বিতীয় ছেলেটি নয়। কিন্তু ভীমের চেহারাটা দেখে তারও বেশ ভাল লাগল এবং সম্ভ্রমও জাগল। ভীমের চেহারা দেখে ভগবান বিষ্ণু বলে মনে হচ্ছে তার, একই সঙ্গে যে পরমাত্মীয়ও মনে হচ্ছে। পরম আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও পরস্পর পরস্পরকে চিনতে পারছেন না, অথচ একের প্রতি অপরের স্নেহ এবং অন্যতরের প্রতি অপরের শ্রদ্ধা, এমনকী পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি মারামারি– এগুলি এক ধরনের নাটকীয় কৌতূহল তৈরি করে এবং ভাস সেটাকে সযত্নে লালিত করেছেন– কেননা পাঠক তাঁদের পিতা-পুত্র হিসেবে জানে। যাই হোক– ঘটোৎকচ ব্রাহ্মণের পুত্রের বদলে তাকেই মেনে নিয়ে বলল- ওহে মধ্যম! তোমাকেই আমি ডাকছি। ভীম সঙ্গে সঙ্গে বললেন– হ্যাঁ, আমিও তো সেইজন্যই এসেছি।

ঘটোৎকচ মধ্যম বলে ডাকছিলেন একজনকে, এলেন আরেকজন। সেজন্য যেন একটু কৌতূহলী হয়েই বললেন- তুমিও কি মধ্যম? আসলে তিন ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়কে মধ্যম বা মেজো বলে ডাকাটা যেমন বেশ মজা লেগেছে তার, তেমনই মধ্যম পুত্রটির ওপরে পিতামাতার যে আপেক্ষিক স্নেহহীনতা– যা অধিকাংশ সংসারে সেদিনও এক বৈশিষ্ট্য ছিল– সেই স্নেহহীনতার নিরিখে ভীমও সেইরকম জনক-জননীর অবহেলার পাত্র নাকি– সেটা যাচাই করার জন্যই যেন ঘটোৎকচের এই প্রশ্ন তুমিও কি মধ্যম। ভীম এবার হেঁয়ালি করে নিজের ক্ষমতা প্রকাশ করার সুযোগ পেলেন। বললেন– যাঁদের বধ করা সম্ভব নয়, তাঁদেরও আমি মধ্যম। যাঁরা পৃথিবীতে বলদর্পিত শক্তিমান, তাঁদেরও আমি মধ্যম, পৃথিবীতে অন্যান্য রাজারাজড়াদের ঝগড়াঝাটিতে আমি মধ্যম, অর্থাৎ নির্বিকার, আবার ভাইদের মধ্যেও আমি মধ্যম। আরও শোনো, পঞ্চভূতের মধ্যেও আমি মধ্যম (ভীম যেহেতু বায়ুর পুত্র), রাজকুলেও আমি মধ্যম, পৃথিবীতে সকলেই আমাকে মধ্যম বলে ডাকে, ভয়ের ব্যাপারেও আমি মধ্যম, অর্থাৎ নির্বিকার, আর মধ্যম আমি সমস্ত কাজে (কেননা তাকে দাদা যুধিষ্ঠিরের কথা শুনতে হয়)।

ভীমসেনের মুখে এত প্রত্যয়ের সঙ্গে, এত দর্পের সঙ্গে বারবার এই মধ্যম কথাটা শুনে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের মনে আশা জাগল। ভীমকে দেখে ভীমের কথা শুনে তাকে যমরাজের দর্পের মতো তার বিপদ-মুক্তির জন্য মধ্যম পাণ্ডব উপস্থিত হয়েছেন বলে মনে হল তার। ইতিমধ্যে সেই ব্রাহ্মণের দ্বিতীয় পুত্র যে জলপান করার জন্য জলাশয়ে গিয়েছিল, সে নিজের পরলোক চিন্তায় যথাসম্ভব বৈদিক বিধিতে নিজের পারলৌকিক শ্রাদ্ধ করে এল জলাঞ্জলি দিয়ে এবং সে ঘটোৎকচের সামনে ঠিক সেই সময়ে উপস্থিত হল, যখন নিরুপায় বিপন্ন ব্রাহ্মণ ভীমের কাছে জানালেন আমাদের বাঁচান আপনি, এই ব্রাহ্মণকুলকে সপরিবারে বাঁচান।

বিপদের সময় ব্রাহ্মণ-কুলকে বাঁচানো চিরকালীন ক্ষত্রিয়ধর্ম। এরকম কত করেছেন ভীম। অতএব দ্বিধাহীনভাবে বললেন– কোনও ভয় নেই আপনার। আমি মধ্যম, আপনি বলুন আপনার কীসের ভয়? ব্রাহ্মণ বললেন– আগে মহারাজ যুধিষ্ঠির যেখানে রাজত্ব করতেন সেই কুরুজাঙ্গল-ভূমিতে আমি ঘূপগ্রামে থাকি। আমার নাম কেশবদাস, মাঠরগোত্রের বামুন। উত্তর দিকে উদ্যামক গ্রামে আমার মামার ছেলের উপনয়নে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফেরার পথে এই বিপত্তি। এই রাক্ষসটা আমাদের সবাইকে মারার তাল করেছে। ভীম বললেন– ও, এই ব্যাপার! আপনাদের যাবার পথে ঝামেলা করছে। আচ্ছা আমি দেখছি।

ভীম প্রথমে একটু বুঝিয়ে বললেন। বললেন– বামুন মানুষ; ওঁকে শান্তিতে ফিরতে দাও। ছেড়ে দাও এঁদের। ঘটোৎকচ গোঁ ধরে থাকলেন। তিনি মোটেই ছাড়বেন না। ভীম একটু অবাকই হলেন, তাঁর সামনে এমন অবাধ্যতা করা সইছে না তার। অথচ ঘটোৎকচ যে। খুব খারাপ ব্যবহার করছেন তাও নয়। শুধু তার এক কথা– ছাড়ব না। ভীম ভাবলেন– এটা কার ছেলে রে। এই রাক্ষস-কিশোরের মধ্যে তিনি তার ভাইদের ভাব দেখতে পাচ্ছেন, কৈশোর্যের কারণে একটু স্নেহও হচ্ছে– কুমার অভিমন্যুর কথা তার বার বার মনে হচ্ছে। সন্দেহ এবং কৌতূহল আরও জোরদার হল, যখন ঘটোৎকচ বললেন– আমার বাপ এসে বললেও আমি এদের ছাড়ব না। কেননা এদের একটাকে আমি ধরেছি মায়ের আদেশে–ন মুচ্যতে তথা হেষ গৃহীততা মাতুরাজ্ঞয়া।

ভীম মনে মনে ভাবলেন– ছেলেটার একটা মূল্যবোধ আছে বটে। একটু রাক্ষসোচিত আচরণ করছে, কিন্তু মায়ের আদেশ পালন করার চেষ্টা করছে যে ছেলে, তাকে কী দোষ দেওয়া যায়? কেননা মায়ের চেয়ে বড় দেবতা আর কে আছেন এই পৃথিবীতে? তবে ভীম আর কৌতূহল এড়াতে পারলেন না। বললেন– একটা কথা জিজ্ঞাসা করি তোমাকে। ঘটোৎকচ বললেন যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। আমার সময় চলে যাচ্ছে। ভীম জিজ্ঞাসা করলেন– তোমার মায়ের নাম কী? ঘটোৎকচ নিঃসংকোচে বললেন– মা হিড়িম্বা রাক্ষসী। আকাশ যেমন পূর্ণচন্দ্রকে স্বামী হিসেবে পেয়েছে, তেমনই ভাগ্যবতী মা আমার পাণ্ডব-কুলের প্রদীপ মহাত্মা ভীমকে স্বামী হিসেবে পেয়েছেন।

ভীম এই কথা শুনে বড় গর্ববোধ করলেন। মনে মনে বললেন– তা হলে এটি হিড়িম্বার ছেলে। তাই এর চেহারা, সাহস এবং শক্তি অনেকটাই এর বাবা-কাকাদের মতোই রূপং সত্ত্বং বলঞ্চৈব পিতৃভিঃ সদৃশং বহু। কিন্তু প্রজাদের ব্যাপারে এর মনটা নরম নয় কেন, সেটাই আশ্চর্য! এই একটা শ্লোক লিখে ভাস বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, বৈবাহিক ব্যাপারে মহাভারতের উদারতা তারও মজ্জাগত, নইলে ঘটোৎকচের সাহস এবং শক্তির সঙ্গে রূপের কথাটা এভাবে বলতেন না ভাস৷ কেননা ভীমের পুত্র হওয়া সত্ত্বেও তার রূপের মধ্যে আর্যেতর রাক্ষসাভাস ছিল। ভাস সেটাকে সম্পূর্ণ মেনে নিয়েই বাবা-কাকাদের সঙ্গে তার তুল্যতা প্রকাশ করেছেন ভীমের মতো পিতার মুখ দিয়ে, দ্বিতীয়ত, ব্রাহ্মণ যুধিষ্ঠিরের পূর্ববসতি কুরুজাঙ্গলের মানুষ, সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে পাণ্ডবদের প্রজা। সেই প্রজার ওপরে ঘটোৎকচের মায়া নেই কেন– এই অনাত্মীয়তাটুকু ভীমকে একটু কষ্ট দিচ্ছে। তিনি ভাবছেন তার ছেলে হিসেবে জ্যাঠা যুধিষ্ঠিরের রাজ্যের প্রজাকে সে এইভাবে ধরবে কেন?

ভীম আরও একবার ব্রাহ্মণদের ছেলেটাকে ছেড়ে দিতে বললেন। ঘটোৎকচ রাজি না হলে ভীম ব্রাহ্মণকে বললেন– আপনি ছেলে নিয়ে বাড়ি যান; আমি ক্ষত্রিয়ের বংশে জন্মেছি, ব্রাহ্মণের শরীরের সঙ্গে আমার শরীর বিনিময় করব। ভীম ঘটোৎকচের সঙ্গে চললেন বটে, কিন্তু এতদিন পরে ছেলেকে দেখছেন, তার শক্তি-তেজ তাঁর মতোই কিনা একটু বুঝে নেবার চেষ্টা করলেন। বললেন– দ্যাখো হে ছোকরা! এত দম্ভ, এত সাহস যারা দেখায়, তাদের আমি অত তোয়াক্কা করি না। তোমার ক্ষমতা থাকে তো জোর করে আমাকে নিয়ে যাও। এর উত্তরে ঘটোৎকচ বললেন– আমি কে জানো। ভীম বললেন– জানি, আমার ছেলে বলে জানি। ঘটোৎকচ বললেন– কেমন কথা এটা? আমি আবার তোমার ছেলে হলাম কী করে? ভীম বললেন– আরে চটছ কেন ছোকরা? আমরা ক্ষত্রিয়রা প্রজামাত্রেই পুত্র সম্বোধন করি। ঘটোৎকচ বললেন– তাই নাকি? ভিতু লোকের অস্ত্র ধরেছ তুমি। ভীম বললেন– দ্যাখো হে ছোকরা! ভয় কাকে বলে আমি জানি না। ওটা তোমার কাছে আমি শিখতে চাই। তুমি শিখিয়ে দাও ওটা। ঘটোৎকচ বললেন– ঠিক আছে। আমি শিখিয়ে দিচ্ছি, তুমি অস্ত্রধারণ করো। ভীম সগর্বে উত্তর দিলেন– ধারণ করা হয়ে গেছে। এই যে সোনার থামের মতো দুটো হাত দেখছ আমার, এ-দুটোই আমার অস্ত্র।

ঘটোৎকচ এবার একটু থমকে গিয়ে বললেন– এসব কথা শুধু আমার বাবা ভীমসেনকে মানায়। ভীম আনন্দে গর্বসহকারে বললেন– এই ভীম আবার কে, সে কি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, কৃষ্ণ, কার্তিক, ইন্দ্র- কার মতো সে। ঘটোৎকচ বললেন– এঁদের সবার মতো। এর উত্তরে ভীম সে-কথা নস্যাৎ করে দিয়ে বললেন–মিথ্যে কথা– অমনই ঘটোৎকচের সঙ্গে মারামারি লেগে গেল ভীমের। গাছ, পাথর, মল্লযুদ্ধ, মায়াযুদ্ধ অনেকরকম যুদ্ধ হল ভীমের সঙ্গে, ঘটোৎকচ পুরোপুরি তাকে কাবু করতে না পেরে শেষে বাচ্চা ছেলের মতো বললেন তুমি কিন্তু আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছ যে, এই ব্রাহ্মণ-পুত্রের বদলে তুমি যাবে আমার সঙ্গে। ভীম বললেন– সে কথা আমার বেশ মনে আছে, বেশ তো চলো। অতি অদ্ভুত ব্যাপার দেখে ব্রাহ্মণও তার পুত্র-পরিবার নিয়ে ভীম এবং ঘটোৎকচের পিছন পিছন চলতে লাগলেন।

ঘটোৎকচ ভীমকে নিয়ে মায়ের কাছে এল। দুয়োরের বাইরে ভীমকে দাঁড় করিয়ে রেখে ঘটোৎকচ বলল- দাঁড়াও, তোমার উপস্থিতি মায়ের কাছে জানাই আমি। ঘটোৎকচ এবার মায়ের কাছে সব জানিয়ে বললেন– মা! তোমার উৎকৃষ্ট ভোজনের জন্য বহু দিনের আকাঙিক্ষত একটি মানুষ এনেছি– চিরাভিলষিততা ভবতা আহারার্থ আনীতো মানুষ। ‘চিরাভিলষিতো’ এই শব্দটার মধ্যে নাট্যকার ভাস যেমন স্বামী ভীমের জন্য রাক্ষসী হিড়িম্বার চিরকালীন এক আকাঙ্ক্ষার হৃদয় পুষ্ট করেছেন, তেমনই ‘আহার’ শব্দটা ব্যবহার করেও ভীম যে তার শারীরিক-বৃত্তির প্রশান্তি সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। সেই কবে ভীমকে ছেড়ে এসেছেন হিড়িম্বা, এতদিন উপবাসে থাকার পর একবার তো চিরাভিলষিত এই আহারের প্রয়োজন আছে হিড়িম্বার। অতএব ভীম হিড়িম্বার দৈনন্দিন মাংস-ভাতের আহার নন, বহুকালের অভীষ্ট আহার।

হিড়িম্বা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন– কীরকম মানুষ এনেছ, বাছা! ঘটোৎকচ বললেন– চেহারাতে এ একটা মানুষ বটে, তবে শক্তি-ক্ষমতায় নয়। হিড়িম্বা নানা প্রশ্ন করেছেন এরপর– ব্রাহ্মণ নাকি, বৃদ্ধ নাকি, শিশু নাকি তার মানে আর্য স্বামীর সহবাস-পরিচয়ে এই ধরনের মানুষ ধরে আনলে তাঁর এখন চলত না। হিড়িম্বা এবার বললেন– তা হলে তো দেখতে হয়। বাইরে এসে এবার ভীমকে দেখতে পেলেন হিড়িম্বা। বিস্ময়ে, আনন্দে এবং অপ্রত্যাশিত ভাবে ভীমকে দেখতে পেয়ে হিড়িম্বার রমণী-হৃদয় ভালবাসায় পরিপূর্ণ। উপবাস-ভঙ্গের জন্য পারণ বা পূরণ হিসেবে এমন মধুর ভোজ্য বস্তু তিনি আশা করেননি। বাঁধভাঙা আনন্দে ছেলেকে বললেন হিড়িম্বা– এ তুই কাকে ধরে এনেছিস, পাগল! ইনি তো আমার দেবতা রে! ইনি আমারও দেবতা, তোরও দেবতা।

তখনও ভীম হিড়িম্বার দিকে তাকাননি। দুয়ার-বাহিরে ইতস্তত পায়চারী করছেন। ঘটোৎকচ বাইরে দাঁড়ানো ওই মানুষটির ওপর অন্তরে শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠলেও হঠাৎ করে মা তাকে দেবতা সম্বোধন করায় একটু অবাকই হল। মায়ের কাছে তার প্রশ্ন; হঠাৎ দেবতা বলে ভাবব কেন লোকটাকে? এবার সমস্ত কৌতূহলের নিরসন করে হিড়িম্বা ভীমের কাছে এসে বললেন– আর্যপুত্র তুমি! জয় হোক তোমার স্বামীকে আর্যপুত্র বলে সম্বোধন করাটা সেকালের সম্বোধন-রীতি, ঠিক যেমনটি ষাট-সত্তর বছর আগে ছিল একটু অন্যভাবে এই বাংলার মাটিতেও। হিড়িম্বাকে এতদিন পরে দেখে ভীম অপার আনন্দ পেলেন। পাণ্ডবকুলের প্রথমা বধূকে দেবী সম্বোধন করে ভীম বললেন– রাজ্য হারিয়ে কত কাল আমরা এই গহন বনে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কত কষ্ট পাচ্ছি এই বনের মধ্যে। আজ তুমি অনন্ত করুণায় আমাদের সমস্ত দুঃখ ঘুচিয়ে দিলে।

বস্তুত ভীম বুঝিয়ে দিলেন– এতকাল পরে হিড়িম্বার দেখা পেয়ে তিনি কতটা অভিভূত, কতটা মুগ্ধ। কিন্তু এখন বোধহয় তিনি বুঝতে পারছেন যে, ভীমের সঙ্গে এইভাবে দেখা হওয়ার ভবিতব্যে বুঝি হিড়িম্বার পূর্বপরিকল্পনা ছিল, যে পরিকল্পনার কথা তিনি ছেলে ঘটোৎকচকেও বলেননি। এটা বুঝে নেওয়া ভাল যে, প্রথম-দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দের নাট্যকার হিসেবে ভাস তার নায়ক ভীম এবং নায়িকা হিড়িম্বার মুখে এমন ভাষা ব্যবহার করবেন না, যা তার সময়কালীন পরিশীলনের বিরোধী। ভীমকে দেখার পর ঈঙ্গিত মিলনের আনন্দে হিড়িম্বার পক্ষেও যেমন ‘আই লাভ ইউ’ বলে জড়িয়ে ধরা সম্ভব ছিল না, তেমনই ভীমের পক্ষেও সেটা সমান বিরোধী। ফলত প্রথম দেখায় হিড়িম্বার সবিস্ময় মুখে ‘আর্যপুত্র’ সম্বোধন যতটা মানানসই, তার বুঝি বেশি মানানসই ভীমের মুখে তার দেবী সম্বোধন কা পুনরিয়ম। অয়ে দেবী হিড়িম্বা– এই সম্বোধন মহাভারতের সেই অঙ্গীকার বজায় রেখেছে, কেননা কুন্তী তাকে সপুত্ৰা হবার পরেই প্রথমা কুলবধূর সম্মান দিয়েছিলেন।

নাটকের শেষ ব্যঞ্জনাটা না বোঝালে অধর্ম হবে। নাটকের ভাষা তো সংক্ষিপ্ত হয় কিন্তু ব্যঞ্জনা হয় পাহাড়-প্রমাণ। অনেক কষ্টের মধ্যে হিড়িম্বার দেখা পাওয়ায় তাদের বনবাস দুঃখ মোচন হয়ে গেছে বলে ভীম নিজেই জানিয়েছেন হিড়িম্বাকে। কিন্তু কীভাবে এই অসম্ভব সম্ভব হল, সেটা ভীম সকৌতূহলে একবার জিজ্ঞাসা করলেন হিড়িম্বাকে। নাট্যকার হিড়িম্বার মুখেও কোনও বেশি কথা বসাননি, কিন্তু হিড়িম্বার হবে এবং ভাবে বসিয়েছেন রমণীর মধুরতা, বিবাহিতা বধূর চটুলতা। হিড়িম্বা ভীমের গা ঘেঁষে এসে কানে-কানে জানিয়েছেন– আর্যপুত্র! এইভাবে। ভীম সানন্দ মুগ্ধতায় বলেছেন– জাতিতেই তুমি শুধু রাক্ষী রয়ে গেলে, কিন্তু আচরণে নয়– জাত্যা রাক্ষসী ন সমুদাচারেণ। ভীম-হিড়িম্বার এই সস্নেহ এবং মুগ্ধ সংলাপের মধ্যেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, হিড়িম্বা জেনেছিলেন যে, এই বনে পাণ্ডবরা আছেন এবং আজ সম্পূর্ণ আশ্রমের মধ্যে পাণ্ডব-ভাইরা এবং স্বয়ং দ্রৌপদী কেউ যখন বাড়িতে নেই, অথচ ভীম একা, তখনই হিড়িম্বা নিভৃতে ভীমের সঙ্গে একবার চোখের দেখা সম্পূর্ণ করার জন্য ছেলেকে দিয়ে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ঘটিয়েছেন। তিনি জানতেন– ব্রাহ্মণের এই বিপদে ভীম কিছুতেই দূরে থাকবেন না। তিনি আসবেনই তাকে বিপদমুক্ত করতে। এই অভীষ্টতা ছিল বলেই ভীমকে ধরে আনার পর হিড়িম্বা নিশ্চিন্ত হবার জন্য প্রশ্ন করেছিলেন– যাকে ধরে এনেছ, সে ব্রাহ্মণ নাকি, শিশু নাকি? তারপর যখন পরিকল্পনার সুষ্ঠু সমাধান ঘটেছে, তখনও নিশ্চিন্তে তার আর্যপুত্রের সামনে এসেছেন এবং এই মুহূর্তে ছেলেকে তিনি বলছেন পাগল ছেলে, পেন্নাম কর বাবাকে, নাটকের শেষে ভীম তার স্ত্রী হিড়িম্বাকে নিয়ে, ঘটোৎকচকে নিয়ে তাদের আশ্রমের প্রবেশপথ পর্যন্ত অনুগমন করেছেন, তারপর দ্রৌপদীহীন, পাণ্ডবান্তরহীন সেই আশ্রমের মধ্যে ভীম শেষ পর্যন্ত প্রবেশ করে কতিপয় দিন স্থায়ী হয়েছিলেন কিনা, সে খবর নাট্যকার দেননি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *