০৫. অম্বা-শিখণ্ডিনী

০৫. অম্বা-শিখণ্ডিনী

০১.

মহারাজ শান্তনুর পুত্র বিচিত্রবীর্ষ যখন রাজা হয়েছেন, তখন তার বয়স খুব কম। কুরু ভরতবংশের রাজবাড়িতে যে ভয়ংকর ‘অ্যাকসিডেন্ট’ ঘটে গেল, তার ফলেই বিচিত্রবীর্য রাজা হলেন।

সত্যি কথা বলতে কি, শান্তনুর প্রথম পুত্র গাঙ্গেয় ভীষ্মই শান্তনুর অধিকৃত কৌরব-ভূখণ্ড অতি যত্নে রক্ষা করে চলেছিলেন। কিন্তু শান্তনুর প্রিয়া পত্নী সত্যবতীর বিবাহের সময়ে ভীষ্ম যেহেতু রাজা না হওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন, তাই শান্তনুর মৃত্যুর পর সত্যবতীর গর্ভজাত তার প্রথম পুত্র চিত্রাঙ্গদ রাজা হলেন। চিত্রাঙ্গদ ভীষ্মের কথা যে খুব মেনে চলতেন, তা নয়। স্বভাবের দিক থেকেও তিনি ছিলেন কঞ্চিৎ অহংকারী। এই অহংকার এবং স্বাধিকার প্রমত্ততার জন্য একদিন তাঁকে বেঘোরে প্রাণ দিতে হল।

চিত্রাঙ্গদ মারা গেলে রাজা হলেন কুমার বিচিত্রবীর্য। চিত্রাঙ্গদের উদাহরণে কুরুবংশের রাজবধূ সত্যবতী বুঝেছিলেন যে, রাজ্য-শাসনের বিচিত্র ক্ষেত্রে ভীষ্মের পরামর্শ ছাড়া যেমন চলা উচিত হবে না, তেমনই সাংসারিক ক্ষেত্রেও ভীষ্মের কর্তৃত্ব মেনে চলা ঠিক হবে। ভীষ্ম সত্যবতীকে কখনও অতিক্রম করেননি এবং সত্যবতীও পুত্রের হিতের জন্য ভীষ্মের ওপরেই নির্ভর করাটা যুক্তিযুক্ত মনে করতেন। ফলে কুমার বিচিত্রবীর্য যখন রাজা হলেন, তখন হস্তিনাপুরের শাসন এবং কৌরব সংসারের ভালমন্দ সবটাই দেখছিলেন গাঙ্গেয় ভীষ্ম হতে চিত্রাঙ্গদে ভীষ্মে বালে ভ্রাতরি কৌরব। পালয়ামাস তদ্ৰাজ্যং সত্যবত্যা মতে স্থিতঃ ॥

কুমার বিচিত্রবীর্য যখন যৌবনে পদার্পণ করলেন, ভীষ্ম তখন ছোট ভাইটির বিবাহের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। মহারাজ শান্তনু বেঁচে নেই, অতএব এই পিতৃহীন ভাইটির সুরক্ষার ভার নিয়ে ভীষ্ম তার গায়ে রাজনৈতিক জটিলতার আঁচটিও লাগতে দেননি; কিন্তু সেই ছোট ভাইটি এখন সম্পূর্ণ যুবক; অন্য দিকে কুরুবংশের সন্তান-সন্ততি আর কেউ নেই। এই অবস্থায় ছোট ভাইটির বিয়ে দিয়ে তাঁকে সংসারী করলে কুরুবংশের বৃদ্ধি ঘটবে– এই শুভৈষণায় ভীষ্ম ঠিক করলেন, বিচিত্রবীর্যের বিয়ে দিতে হবে– ভীষ্মে বিচিত্রবীর্যস্য বিবাহায়াকরোল্মতিম।

জননী সত্যবতীর সঙ্গে তার আলোচনা হয়ে গেল। তিনি ভীষ্মের গৌরবে সঙ্গে সঙ্গেই তার সঙ্গে সহমত হলেন। এইবার মেয়ে দেখার পালা। সে কালের দিনে কোনও রাজার ঘরে সুন্দরী এবং গুণবতী কন্যা থাকলে তাদের মধ্যে কেই বা বিবাহযোগ্যা অথবা কার বিয়ের কথা হচ্ছে– এ সব খবর ‘চরৈবতি’-স্বভাব মুনি ঋষিদের কাছে পাওয়া যেত, অথবা সেইসব খবর দিতেন ব্রাহ্মণেরা যারা ভিনরাজ্যে যজন-যাজন করতে যেতেন। হয়তো তাদেরই কারও কাছে ভীষ্ম কিছু খবর পেলেন। আরও একটি জব্বর খবর পেলেন। সেটি একটি স্বয়ম্বর-সভার খবর। স্বয়ম্বরের খবর রাজারাই জানাতেন। কন্যার পিতা বিভিন্ন রাজ্যের রাজাদের কাছে আমন্ত্রণ পত্র পাঠাতেন স্বয়ম্বরের দিনক্ষণ ঠিক করে।

হস্তিনাপুরের কৌরব রাজ্যেও সেই আমন্ত্রণপত্র এসে পৌঁছল। কাশী রাজ্যের রাজা খবর পাঠাচ্ছেন–তার তিনটি কন্যা স্বয়ম্বর-সভায় দাঁড়িয়ে তাদের মনোমতো বর পছন্দ করবেন। কন্যা তিনটি অসাধারণ সুন্দরী কন্যা স্তিস্রোইন্সরোপমাঃ। ভীষ্ম যেহেতু হস্তিনাপুরের প্রশাসনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন এবং হস্তিনাপুরের যুবক রাজা বিচিত্রবীর্যের ওপরেই যেহেতু তার প্রাধান্য সর্বজনস্বীকৃত, কাজেই কাশীরাজের স্বয়ম্বর-সভার নিমন্ত্রণপত্র তার কাছেই এসে পৌঁছল। ভীষ্ম ঠিক করলেন, কুমার বিচিত্রবীর্যকে তিনি কোনও ঝামেলায় জড়াবেন না। স্বয়ংবর-সভা অনেক সময়েই ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়, কুরুবংশের এই একমাত্র সন্তান-বীজ বিচিত্রবীর্যের গায়ে কোনও যুদ্ধের আঁচ লাগুক– এটা বোধহয় তিনি পছন্দ করলেন না। ছোট ভাইটির ওপর তার অপত্যস্নেহ এমনই যে, তিনি ঠিক করলেন– নিজেই ওই স্বয়ম্বর-সভায় উপস্থিত হয়ে ভাইয়ের জন্য তিন কন্যাকে নিয়ে আসবেন হস্তিনাপুরে।

জননী সত্যবতীর সঙ্গেও তিনি তার কার্যক্রম নিয়ে কথা বললেন। মহামতি ভীষ্মের গুরুত্ব এবং কুরু বংশের সবেধন-নীলমণির কথা ভেবে সত্যবতীও ভীষ্মের প্রয়াস সমর্থন করলেন। সত্যবতীর অনুমতি নিয়ে ভীষ্ম একা একটিমাত্র রথে চড়ে রওনা দিলেন বারাণসী নগরীর দিকে জগামানুমতে মাতুঃ পুরীং বারাণসীং প্রতি।

যারা ভারতবর্ষের পুরাতন ইতিহাস নিয়ে চিন্তা করেন, তাঁরা সাক্ষ্য দিয়ে বলবেন– সে কালের ষোড়শ মহাজনপদের মধ্যে কাশী ছিল অন্যতম সম্পন্ন রাষ্ট্র। বৌদ্ধ জাতক থেকে। জানা যায় যে, শুধু রাজকীয় মাহাত্মেই নয়, আয়তনেও তখনকার কাশী ছিল মিথিলা, এমনকী ইন্দ্রপ্রস্থের চেয়েও বড়। আমরা যখনকার কথা বলছি, তখন যুধিষ্ঠিরের ইন্দ্রপ্রস্থ তৈরি হয়নি; ফলত প্রমাণের জন্য আমরা যদি শতপথ ব্রাহ্মণের মতো প্রাচীন গ্রন্থের ওপর নির্ভর করি তবে দেখব, ধৃতরাষ্ট্র বলে কাশীর এক পূর্বতন রাজা অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছেন। অশ্বমেধ যজ্ঞ মানে সারা পৃথিবী-জয়ের পরিকল্পনা। কিন্তু কাশীরাজ ধৃতরাষ্ট্র এই বিরাট যজ্ঞের পরিকল্পনা করেও পরাজিত হলেন শতানীক সাত্রাজিতের কাছে। এই পরাজয়ে কাশীর রাজাদের আত্মাভিমান ভীষণভাবে আহত হয়েছিল। শতপথ ব্রাহ্মণ যখন লেখা হচ্ছে, তখনও কাশীওয়ালাদের প্রতিজ্ঞা শুনতে পাচ্ছি। তারা নাকি অপমান সহ্য করতে না পেরে তাদের যজ্ঞাগ্নি নিবিয়ে দিয়েছিলেন, যতদিন না তাদের রাজকীয় মর্যাদা পুনরুদ্ধার হয়।

শতপথ ব্রাহ্মণ থেকে ভাল করে টের না পেলেও বৌদ্ধ জাতকে কিন্তু কাশী রাজ্যের জয় জয়কার। আশেপাশের সব রাজ্য কাশীর রাজাকে সব সময় ভয় করে চলেন। কেননা বার বার তারা কাশীর রাজার কাছে পরাজিত হয়েছেন। মহাভারতে কাশীর রাজা প্রতর্দন, যাদব বীতহব্য (বীতিহোত্র) এবং হৈহয়দের যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছেন, সে প্রমাণ আছে। আশ্চর্য ব্যাপার হল- জাতকে যে সব নামকরা কাশীরাজের নাম পাওয়া যায়, তাদের কয়েক জন ব্রাহ্মণ্য পুরাণেও সমান আদলে উল্লিখিত। বিম্বকসেন, উদকসেন এবং ভল্লাট– এইরকম কয়েক জন রাজা মৎস্য-বায়ু পুরাণের মতো প্রাচীন পুরাণে যেমন জায়গা পেয়েছেন, তেমনই জায়গা পেয়েছেন বৌদ্ধ জাতকে।

আর আছেন কাশীর রাজা ব্রহ্মদত্ত। প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস জানেন, অথচ ব্রহ্মদত্তের নাম জানবেন না– এ হতেই পারে না। তিনি এক মিথিক্যাল ফিগার। মহাবঃ বলেছেন–

ভূতপুব্বং ভিক্ষবে বারাণসিয়ং ব্রহ্মদত্তো নাম কাশীরাজা
অহোসি অঢ়চে মহদ্ধনো মহাভোগো মহলো
মহাবাহনো মহাবিজিতো পরিপুগ্ন-কোস-কোঠঠা গারো।

কাশীরাজ ব্রহ্মদত্তের কত যে উপাখ্যান আছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। বস্তুত কাশীর রাজাদের সম্মান এবং কাশীরাজ্যের সমৃদ্ধি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, কাশীর পার্শ্ববর্তী সমস্ত রাজ্যই কাশীর অধিকার কামনা করত সব সময়, তবে সে কামনা পূর্ণ হত না, কারণ কাশী রাজ্যের যোদ্ধারা ছিলেন যুদ্ধে অদম্য। ঐতিহাসিক লিখেছেন Beনাres in this respect resembled ancient Babylon and mediaeval Rome, being the coveted prize of its more warlike but less civilised neighbours. GJ GPU রাষ্ট্রের রাজকন্যাকে ঘরের বউ করে নিয়ে আসার মধ্যে যে মর্যাদা আছে, সেটা হস্তিনাপুরের অধিকর্তা মহামতি ভীষ্ম বুঝেছিলেন। যোদ্ধা হিসেবে তার নিজের মর্যাদা তখন কম নয়, অতএব একাকী একরথে তিনি রওনা দিলেন কাশীর দিকে রথেনৈকেন শত্রুজিৎ। উদ্দেশ্য– কাশীরাজের তিন সুন্দরী কন্যাকে ছোটভাই বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া।

ভীষ্ম যখন কাশী-রাজ্যে গিয়ে উপস্থিত হলেন, তখন দেখলেন– রাজারা সব আগেই এসে গেছেন। স্বয়ম্বর-সভা আরম্ভ হচ্ছে প্রায়। রাজারা সব নিজ নিজ আসনে উপবিষ্ট। এমনকী পতিংবরা তিন কন্যাও বরমাল্য হাতে করে দাঁড়িয়ে আছেন প্রতীক্ষায়। ভীষ্ম রাজাদের একবার দেখে নিলেন। দেখে নিলেন কাশীরাজের তিন সুন্দরী কন্যাকেও দদর্শ কন্যা স্তাশ্চৈব ভীষ্মঃ শান্তনুনন্দনঃ। মনে মনে ভাবলেন বুঝি– বেশ মানাবে, ভাই বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে এই তিন কন্যার জোড় বেশ মানাবে। ভীষ্ম আশ্বস্ত হয়ে বসলেন কন্যাপ্রার্থী রাজাদের জন্য নির্দিষ্ট একটি আসনে।

স্বয়ম্বর সভায় রাজাদের নাম ডাকা শুরু হল। ইনি শ্রাবন্তীর রাজা, ইনি বৈশালীর। ইনি কেকয় দেশের রাজা, ইনি শাপুরের… ইত্যাদি। রাজারা উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছেন। কেউ শেষবারের মতো মাথার মুকুটটি ঠিক করে নিচ্ছেন, কেউ গলার হারমধ্যস্থিত বৈদূর্য মণিটি সোজা করে স্থাপন করছেন, কেউ বা সোদ্বেগ মুখের আকার নিহন করে সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করছেন তাড়াতাড়ি। এক এক করে রাজাদের নাম পড়া হচ্ছে, আর কন্যারা সেই কীর্তিত রাজার মুখের দিকে তাকিয়ে পরখ করার চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে যৌবনবতী কন্যাদের নজর গিয়ে পড়ল মহামতি ভীষ্মের ওপর।

পলিত কেশ, বলিরেখায় কণ্বঞ্চিৎ দীর্ণ মুখ-মণ্ডল। ভীষ্ম বসেছিলেন নিরুত্তাপে, নিরুদ্বেগে। তার একমাত্র ভাবনা, এই বিশাল রাজ-সমাজের বাহু-দণ্ড এড়িয়ে তাকে হরণ করে নিয়ে যেতে হবে এই তিন কন্যাকে।

কিন্তু হঠাৎ এ কী কাণ্ড ঘটল? তিন কন্যা ভীষ্মের দিকে এক বার তাকিয়েই যেন ভির্মি খেলেন। ভাবলেন বুঝি– এই বসন্তের ফুলবনে এক বৃদ্ধ হস্তীর প্রবেশ ঘটল কী করে? সত্যি কথা বলতে কি, ভীষ্মকে যখন তারা দেখলেন, তখন যে তিনি খুব বুড়ো হয়ে গেছেন, তা তো নয়। তবে অন্যান্য রাজাদের তুলনায় তার কেশে পাক ধরেছে বেশি, কিছু বলিরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ভালে, কপোলে। যৌবনবান রাজাদের মধ্যে বিপ্রতীপ একাকিত্ব নিয়ে বসে থাকা এক বৃদ্ধপ্রায় নিশ্চেষ্ট ব্যক্তিকে দেখে কাশীরাজের মেয়েরা যেন ভীষণ ভয় পেলেন। কন্যাকামী রাজাদের অধোগতি এবং মানসিক বিকার দেখে তারা স্বয়ম্বর সভা ছেড়ে পালিয়ে গেলেন অপক্ৰামন্ত তাঃ সর্বা বৃদ্ধ ইত্যেব চিন্তয়া।

ভীষ্মের দিকে কাশীরাজ-কন্যাদের কৌতূহলী দৃষ্টি এবং তাদের পালিয়ে যাওয়া দেখে সমবেত রাজারাজড়ারা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। তারা এতক্ষণ উত্তেজনার আগুন পোয়াচ্ছিলেন। কার গলায় মালা এসে পড়ে– এই সরস-কুতুহলে এতক্ষণ তারা মুগ্ধ মূক হয়ে বসেছিলেন। কিন্তু মেয়েরা চলে যেতে তাদের মনে হল যেন লব্ধপ্রায় আকাঙ্ক্ষিত বস্তুটিই হাতছাড়া হয়ে গেছে এবং অঘটনের জন্য তারা ভীষ্মকেই সম্পূর্ণ দায়ী মনে করলেন।

উত্তেজনায় মুখর হয়ে সমবেত রাজারা এ বার গালাগালি দিতে লাগলেন ভীষ্মকে। তাদের মুখ ছুটল সমস্ত ভদ্রতা এবং মর্যাদা অতিক্রম করে। কেউ বললেন– ব্যাটার ভণ্ডামি দেখ। লোকে নাকি একে ধর্মপরায়ণ এক মহাত্মা মানুষ বলে জানে। ব্যাটা বুড়ো হয়েছে, মাথার সবগুলো চুল পাকা, আর কপালটা তো কুঁকড়ে কাকের পা হয়ে গেছে– বৃদ্ধো পরমধর্মাত্মা বলি-পলিত-ধারণঃ। অথচ এই বুড়ো-হাবড়া কী রকম বেহায়া দেখ, এই বয়সে আবার বিয়ে করার শখ চেগিয়েছে– কিংকারণ ইহায়াতো নির্লজ্জো ভরতভঃ।

অন্য এক জন বললেন– ব্যাটা না জোর গলায় প্রতিজ্ঞা করেছিল জীবনে বিয়ে করব, অমুক করব না, তমুক করব না, ব্রহ্মচারী হয়ে থাকব। তো এ সব কোথাকার ন্যাকামি? লোকে এখন কী বলবে, আর ওই বা লোকের সামনে কী বলবে– মিথ্যাপ্রতিজ্ঞা লোকে কিং বদিষ্যতি ভারত। এখন লোক হাসিয়ে বিয়ে করতে এসেছে, ব্যাটা নাকি বেম্মচারী! ভণ্ড কোথাকার বৃথৈব প্রথিতো ডুবি।

রাজাদের একাংশ এইভাবে ভীষ্মকে গালাগালি দিতে লাগলেন, অন্যাংশ হো হো করে হাসতে লাগলেন- ইত্যেবং প্রব্রুবন্তস্তে হসন্তি স্ম নৃপাধমাঃ। প্রসিদ্ধ ভরতবংশের জাতক হয়ে, ধনুর্বেদে পরশুরামের শিষ্য হয়ে এই অপমান ভীষ্মের পক্ষে হজম করা সহজ নয়। তার ক্রোধ চরমে উঠল– ক্ষত্রিয়াণাং বচঃ শ্রুত্বা ভীষ্মক্রোধ ভারত।

অবশ্য এইরকম একটা গণ্ডগোল, ঝুট-ঝামেলার ব্যাপার তিনি বোধহয় চেয়েওছিলেন। মনে রাখতে হবে, ভীষ্ম ভাইয়ের জন্য কন্যাবরণ করতে এসেছেন, সেখানে এমনটি নিশ্চয়ই তিনি চাননি যে, কন্যারা তাঁকেই মালা দিয়ে বরণ করুক। তিনি আগেই বুঝে এসেছিলেন যে, এই বাবদে যুদ্ধ তথা অশান্তি কিছু হবেই এবং তার সুযোগই তিনি নেবেন। কন্যাদের রাজসভার অন্তরালে চলে যাওয়া এবং রাজাদের গালাগালি– কোনওটাই তিনি গ্রাহ্য করলেন না। স্বয়ম্বর সভার সিংহাসন ছেড়ে তিনি সাহংকারে হেঁটে গেলেন সভার অন্তরালে, যেখানে তিন কন্যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছিল। তিনজনের হাত ধরে বাইরে অপেক্ষমাণ নিজের রথে আগে তাদের উঠিয়ে নিলেন ভীষ্ম। অবস্থা দেখে অন্যান্য রাজারাও স্বয়ম্বর-সভা ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। তারা হতচকিত, বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ।

যুদ্ধের প্রথম নিয়ম হল যাতে যুদ্ধ না বাধে। সেইজন্য ভীষ্ম প্রথমে একটু শাস্ত্র-জ্ঞান। দিলেন উপস্থিত রাজাদের। বললেন, উপযুক্ত গুণবান পাত্রকে ঘরে ডেকে এনে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার রীতির কথা পণ্ডিতরা অনেক বারই বলেছেন। তবে বিয়ের রীতি তো এক রকম নয়। কেউ মেয়েকে গয়নাগাটি দিয়ে বরকে টাকাপয়সার যৌতুক দিয়েও বিয়ে দেন, একেবারে না পারলে দুটি গোরু দান করেও বিয়ে দেন– প্রযচ্ছন্ত্যপরে কন্যাং মিথুনেন গবামপি। আবার বরপক্ষেও এমন মানুষ আছেন, যাঁরা বিয়ের জন্য কন্যাপণ দেন আবার কেউ বা জোর করে বিয়ে করেন মেয়েকে। পাত্র-পাত্রী নিজেরা পছন্দ করেও বিয়ে করে কত সময়। কিন্তু আমাদের মধ্যে যারা রাজারাজড়া আছেন, তারা স্বয়ম্বরে এসে বিবাহ সম্পন্ন করাটাই বেশি পছন্দ করেন– স্বয়ম্বরং তু রাজন্যাঃ প্রশংসন্তুপন্তি চ। আবার এই স্বয়ম্বর-সভাতেই যদি জোর করে মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার মতো ঘটনা কিছু ঘটে, তবে বীর ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সেটাই বোধহয় বেশি ভাল।

ভীষ্ম শাস্ত্রজ্ঞান বিতরণ করার পর আরও কিছু ভাল ভাল কথা বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি তার ধারে-কাছে গেলেন না। অর্থাৎ যুদ্ধ প্রশমন করা নয়, তিনি যুদ্ধ বাধাতেই চাইছেন। নিজের শক্তি এবং ক্ষাত্রতেজের ওপর তার অসীম বিশ্বাস ছিল। অতএব সমবেত ক্রুদ্ধ রাজাদের শুনিয়ে শুনিয়ে তিনি সোজা বলে বসলেন, তা এই যে ভাই রাজারা সব! এই তো আমি তোমাদের সামনেই এই মেয়ে তিনটিকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছি তা ইমাঃ পৃথিবীপালা জিহীর্ষামি বলাদিতঃ। তোমাদের ক্ষমতা থাকে তো যুদ্ধ করা হয় জিতবে, নয় হারবে– বিজয়ায়েতরায় বা। আমার দিক থেকে শুধু এইটুকুই জানাই, আমি যুদ্ধ করব বলে ঠিক করেই এসেছি। অতএব আমি প্রস্তুত। স্থিতোহহংপৃথিবীপালা যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়।

ভীষ্ম উত্তরের জন্য প্রতীক্ষা করলেন না। তিন কন্যাকে সাবহেলে রথে চাপিয়ে তিনি রথ চালিয়ে দিলেন অসামান্য দ্রুততায়। এক বার শুধু পিছন দিকে তাকিয়ে বললেন– বিদায়– আমন্ত্র স তা প্রায়াচ্ছীঘ্রং কন্যাঃ প্রগৃহ্য তাঃ।

ভীষ্মের কথা শুনে সমবেত রাজারা রাগে অপমানে দাঁতে দাঁত ঘষতে লাগলেন, এক হাত দিয়ে আরেক হাতে চড়-চাপড় মারতে আরম্ভ করলেন– যেন সে সব আঘাত ভীষ্মের ওপরেই গিয়ে পড়ছে। যুদ্ধামোদী রাজারা তখন কন্যালাভের আশায় এবং বিশেষত ভীষ্মকে শাস্তি দেবার জন্য স্বয়ম্বরসভার উপযুক্ত গয়নাগাঁটি ছেড়ে যুদ্ধের উপযুক্ত বর্ম পরার জন্য ব্যস্ত হলেন। ভূষণ-অলংকার তাড়াতাড়ি ছুঁড়ে ফেলেই লোহার বর্ম পরে নিতে হবে। সে এক তুমুল কাণ্ড বেধে গেল– সম্রমো সুমহানভৃৎ।

বর্ম-কবচ পরে ঢাল-তরোয়াল উঁচিয়ে রাজারা ঘোড়ায় চড়ে ভীষ্মের পশ্চাদ্ধাবন করলেন– প্রমথ কৌরব্যমনুসরুদায়ুধাঃ। যুদ্ধ আরম্ভ হল। ভীষ্ম একদিকে একা, অন্যপক্ষে কন্যালিন্দু রাজারা। ভীষণ যুদ্ধ। শর-তোমর-পরশুর বৃষ্টি। মহাভারতের কবি এই যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছেন, আমরা তার মধ্যে যাচ্ছি না। শুধু এটুকু বলেই ক্ষান্ত হব যে, এতগুলি রাজার বিরুদ্ধে ভীষ্মের আত্মরক্ষার নৈপুণ্য এবং একযোগে পরপক্ষচ্ছেদনের ক্ষমতা দেখে তাঁর শত্রুরাও তাঁকে প্রশংসা করেছিলেন– রক্ষণঞ্চাত্মনঃ সংখ্যে শত্রবোহপ্যভ্যপূজয়।

সমবেত রাজারা ভীষ্মের কাছে হেরে গেলেন। ভীষ্ম শান্তমনে তিন কন্যাকে রথে চাপিয়ে হস্তিনাপুরের দিকে রথ চালিয়ে দিলেন। তিন কন্যা এতক্ষণ ভীষ্মের রথেরই পুচ্ছভাগে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা আগে ভেবেছিল যে, সমবেত স্বয়ম্বরকামী রাজাদের কাছে এই বৃদ্ধপ্রায় মানুষটি ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবেন। কিন্তু তা হল না। এঁদের মধ্যে মধ্যমা এবং কনিষ্ঠা কন্যাটির কোনও ভাববিকার ছিল না। এই বৃদ্ধপ্রায় লোকটির সঙ্গে যেতে হচ্ছে এবং হয়তো তাকে বিয়েও করতে হবে– এই ভাবনায় তারা কিছু অস্বস্থ বিমনা হয়েই ছিল। কিন্তু এই তিন কন্যার মধ্যে জ্যেষ্ঠাটি ভীষ্মের বল-বিক্রম দেখে একটু অবাকই হয়েছিল বোধহয়। মুখে তার কোনও বাকঘূর্তি হয়নি, মহাভারতের কবিও এ বাবদে স্বকণ্ঠে কিছু বলেননি। কিন্তু বিধাতার কপাল-লিখন যেমন শুধু ফললেই তবে বোঝা যায়, সেই ললাট-লিখনের মতো সুপ্ত নিগূঢ় কিছু লিখনের আঁচড় হয়তো পড়ে গেল এই জ্যেষ্ঠা কন্যাটির অবচেতন হৃদয়ে। না, এ বাবদে এখনই কোনও মন্তব্য করা যাবে না, কারণ আমরা এখনও কোনও কিছুই জানি না, এমনকী হৃদয়ের অস্পষ্ট লিখনের কথাও জানি না।

.

০২.

এখনকার রাজস্থানে আলোয়ার বলে যে জায়গাটা আছে, প্রাচীনকালে তার নাম এবং ভৌগোলিক পরিচিতি অন্য রকম ছিল। আমাদের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার রিপোর্ট খুঁটিয়ে দেখলে জানা যাবে, প্রাচীনকালে শাপুর বলে যে জায়গাটি ছিল, সেটাই এখনকার আলোয়ার অঞ্চল। শাল্বপুরে শাল্ব রাজারা শান্থায়ন গোষ্ঠীর মানুষেরা থাকতেন বলেই পণ্ডিতজনের বিশ্বাস। শাল্বপুর কী করে আলোয়ারে পরিণত হল, তা নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিক পরম্পরাটা পরিষ্কারভাবেই দেখানো যায়। পণ্ডিতেরা বলেন ‘শাম্বপুর’ কথাটা লোকমুখে সহজীকৃত হয়ে “শালওয়ার হয়ে যায়। তারপর ‘শালওয়ার’ পরিণত হয় ‘হালওয়ারে।

তালব্য ‘শ’ কী করে ‘হ’-এ পরিণত হয়, তা বুঝতে হলে আমার মাস্টারমশাইয়ের ব্যঙ্গোক্তিটি মনে রাখতে হয়। তিনি বলেছিলেন– দেখো বাপু! পূর্ববঙ্গনিবাসী ব্যক্তির কাছে কখনও আশীর্বাদ ভিক্ষা কোরো না। কেননা তারা ‘শতায়ু হও’ বলতে গিয়ে বলবেন ‘হতায়ু হও’– ‘শতায়ুরিতি বক্তব্যে হতায়ুরিতি কথ্যতে। মাস্টারমশাই এবং আমি দুজনেই পূর্ববঙ্গের মানুষ বলেই আমরা খুব সহজে বুঝতে পারি ‘শালওয়ার’ কী করে ‘হালওয়ার’ হয়। আর ‘হালওয়ার’ থেকে ‘আলওয়ার’ শব্দটা শুধু উচ্চারণের দৃঢ়তা এবং কোমলতা থেকেই নিষ্পন্ন হবে।

যাই হোক ‘আলওয়ার জায়গাটার পূর্বরূপ শাল্বপুর যখন বিশিষ্ট নগর হিসেবে পরিচিত ছিল, তখন তার একটা স্বাতন্ত্রও ছিল। পরবর্তী কালে শাল্বদেশ মৎস্যদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বলে মনে হয়। কিন্তু আমরা যখনকার কথা বলছি, তখন শান্দপুর ছিল মৎস্যদেশের পাশেই। মহাভারতে বারংবার শাল্বদের নাম উচ্চারিত হয়েছে মৎস্যদেশের সঙ্গে, যুগ্মভাবে আবার কখনও বা আলাদা করে ‘শা মৎস্যাস্তথা’, অথবা ‘শ্বাল্বমৎস্যাস্তথা। কোনও কোনও পণ্ডিত অবশ্য বলেন- শাম্বরা থাকতেন আরাবল্লী পাহাড়ের পশ্চিমে কোনও জায়গায়, আবার কেউ বা বলেন– শাল্বদের বসতি ছিল যমুনা-তীরবর্তী অঞ্চলে। আবার কেউ বা বলেন– শাপুর ছিল গুজরাটের উত্তর-পূর্ব কোনও স্থান। শাল্বদেশের রাজাকে কখনও কখনও সৌভপতি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাতে বোঝায় সৌভ ছিল শারে প্রতিশব্দ মাত্র।

আমরা যে রাজার কথা বলছি, তিনি তখনকার দিনের প্রবল পরাক্রান্ত রাজা। নিজের দেশের নামে তাকে শাল্ব-রাজা বলেই ডাকা হয়েছে অর্থাৎ তিনি এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে তাকে দেশের নামে ডাকতেও বাধা হয়নি কারও। এই শাল্বপতি কোনও সময়ে কাশীরাজ্যে এসেছিলেন। হয়তো এই আগমনের পিছনে সৌভপতির উদ্দেশ্য ছিল নিছক ভ্রমণ অথবা রাজনৈতিক কারণ। কাশীরাজ্যের মতো বিখ্যাত রাষ্ট্রকে মিত্ৰগোষ্ঠীর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করাটাও কাশীরাজ্যে শাল্বরাজার আগমনের হেতু বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

লক্ষণীয় ব্যাপার হল, এই রাষ্ট্রনৈতিক বন্ধু-ভাবনার প্রক্রিয়া চলার সময়েই কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল সৌভপতি শারে। হয়তো এই পরিচয় গাঢ় থেকে গাঢ়তর হল কাশীরাজ্যের দিগন্তলীন তমাল-বিপিনে, হয়তো বা গঙ্গার তীরভূমির স্নিগ্ধ ছায়াময় বেতসী-তরুর তলায় কোনও কুঞ্জবনে অথবা হয়তো রাজার উদ্যান-বাটিকায় যেখানে কাশীরাজের সঙ্গে একান্তে কথা বলবার সময় ক্রীড়াচ্ছলে অথবা স্বেচ্ছাকৃতভাবে অম্বার যাতায়াতে। মহাভারতের কবি শাল্বরাজের সঙ্গে অম্বার প্রথম মিলনের কথা ঘটা করে উচ্চারণ করেননি। তবে তাঁর উদার শ্লোকরাশি থেকে বোঝা যায়– অম্বা শাল্বরাজের রূপে গুণে বশীভূত হয়ে পড়েছিলেন।

অম্বার মনের কথা শাল্বরাজের জানতে দেরি হয়নি। তিনি কাশীরাজের কাছে অম্বাকে বিবাহ করার প্রস্তাব দেন। কাশীরাজ সৌভপতির হৃদয় এবং মর্যাদা বুঝে তাকে তৎক্ষণাৎ কন্যা সম্প্রদান করলেন না বটে, কিন্তু প্রত্যাখ্যান করলেন না। আসলে তার মনোবাসনা কিছু অন্য রকম ছিল। সেকালের দিনের এক বিখ্যাত দেশের মর্যাদাময় রাজপুরুষ হওয়ার দরুন কাশীরাজ এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে নিজের জ্যেষ্ঠা কন্যাকে শাল্বরাজের হাতে তুলে দিতে চাননি। তা ছাড়া আরও দুটি কন্যা রয়েছে। তারাও বিবাহযোগ্যা। কাশীরাজ ভাবলেন, একটি স্বয়ম্বর-সভা ডেকে যদি বিভিন্ন রাজ্যের রাজা-রাজড়া এবং রাজপুত্রদের নিমন্ত্রণ জানানো যায়, তা হলে বিবাহের আড়ম্বরও সম্ভব হবে এবং কাশীরাজের মর্যাদারও উপযুক্ত হবে সেটা। শান্দুরাজার বা তার জ্যেষ্ঠা কন্যার মনোবাসনাও তাতে অপূর্ণ থাকবে না। স্বয়ম্বর-সভার মধ্যেই অম্বা তার পরম ঈপ্সিত শাল্বরাজের গলায় মালা দেবেন, কারও সেখানে কিছু বলার থাকবে না। কাশীরাজের অন্য কন্যারাও এই স্বয়ম্বরে তাদের নিজের সুযোগ পাবেন।

আমরা জানি, সেকালের দিনের স্বয়ম্বর-সভা অনেক সময় এইভাবে প্রহসনে পরিণত হত। পিতামাতারা পূর্বেই একটি বিবাহ-সম্বন্ধ ঠিক করে রাখতেন এবং স্বয়ম্বর-কালে কন্যা অনেক সময়েই সেই পিতামাতার ইচ্ছাপূরণ করতেন।

এখানেও সেই ঘটনা ঘটতে চলেছে। কিন্তু সবকিছুই গণ্ডগোল হয়ে গেল ভীষ্মের আগমনে। কুমার বিচিত্রবীর্য, যাঁর বিবাহের কারণে ভীষ্ম এখানে এসেছেন সেই বিচিত্রবীর্য নিজে এলে হয়তো এত ঘটনা এখানে ঘটত না। হয়তো অম্বাকে বাদ দিয়েই অন্য দুটি রমণীর পাণিপ্রার্থী হতেন তিনি। যাই হোক, বাস্তবে যা ঘটল তা হল, ভীষ্ম তিন কন্যাকে বিনা বাক্যব্যয়ে রথে তুললেন এবং প্রাথমিক যুদ্ধে সমবেত রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি জিতেও গেলেন। অন্যান্য রাজারা যখন যুদ্ধ করছিলেন, তখন তাদের মধ্যে শাল্বরাজাও ছিলেন। নিজের মনের গূঢ় অভিসন্ধি গোপন করে তিনি যেমন স্বয়ম্বর-সভায় অন্য রাজাদের সঙ্গে মিশে একক বসেছিলেন, যুদ্ধের সময়েও তেমনই অন্য রাজাদের সঙ্গে একত্র যুদ্ধ করছিলেন তিনি।

কিন্তু ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধে সমবেত রাজারা যখন যুদ্ধ ছেড়ে ভীষ্মেরই প্রশংসা করতে লাগলেন। তখন শাল্বরাজের পক্ষে আর নিজেকে গোপন রাখা সম্ভব হল না। তিনি আত্মপ্রকাশ করতে বাধ্য হলেন। তিনি একাকী পশ্চাদ্ধাবন করলেন ভীষ্মের– অভ্যগচ্ছদ অমেয়াত্মা ভীষ্মং শান্তনবং রণে। হঠাৎ শাল্বরাজ একা কেন ভীষ্মের পিছু নিলেন, তার কারণ হিসেবে একটা অসাধারণ উপমা ব্যবহার করেছেন মহাভারতের কবি এবং এই উপমাটি পশু-সম্বন্ধীয়। কবি বলেছেন– একটি সাধারণ হস্তী যখন একটি কামোন্মত্তা হস্তিনীর পিছন পিছন যেতে থাকে কামনাপূর্তির আশায় তখন সেই স্ত্রীকামী হস্তীকে যেমন যূথপতি হস্তী এসে দাঁত দিয়ে আঘাত করে পিছন দিক থেকে, ঠিক তেমনই শাল্বরাজও ভীষ্মের পশ্চাদ্ধাবন করলেন– বারণং জঘনে ভিন্দন দণ্ডাভ্যামপরো যথা। বাসিতামনুসপো যুথপো বলিনাং বরঃ।

শাল্বরাজার একটাই ভুল হয়েছিল তিনি ভীষ্মকেই কন্যাপ্রার্থী ভেবেছিলেন এবং সেইজন্যই নিদারুণ ক্রোধে ভীষ্মকে আক্রমণ করলেন এবং আক্রমণের সময় অসংখ্য বাক্যবাণে তাকে আগেই আকুলিত করে তুললেন। বেশিক্ষণ সহ্য হল না। নিধুম অগ্নির মতো ক্রোধা বিধুমোহগিরিব জ্বলন- ক্রোধের সর্বব্যাপ্ত শিখা ছড়িয়ে দিয়ে পলিতপ্রায় ভ্র দুটি কুঞ্চিত করে ভীষ্ম তার রথ ঘোরালেন শাল্বরাজের দিকে। একবার যুদ্ধজয়ী ভীষ্মকে পুনরায় যুদ্ধভূমিতে ফিরতে দেখে সমবেত রাজারা যুদ্ধ দেখার জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন প্রেক্ষকাঃ সমবর্তন্ত ভীষ্ম-শাল্ব-সমাগমে।

ছুটন্ত রথ এক দিক থেকে আরেক দিকে ঘুরিয়ে আনতে সময় লাগে। সেই রথকে যুদ্ধের উপযোগী সমতল ক্ষেত্রে স্থাপন করতে আরও একটু সময় লাগে সারথির। কিন্তু শাল্ব এই সময়টুকু দেননি, রথ ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাণবর্ষণ শুরু করেছেন। পূর্বজয়ী ভীষ্মকে এইভাবে হঠাৎ কাবু হয়ে পড়তে দেখে পার্শ্ববর্তী প্রেক্ষক রাজারা সব হাততালি দিয়ে উঠলেন, শাল্বরাজাকেও যথোচিত প্রশংসা করতে আরম্ভ করলেন। এতে ভীষ্মের রাগ আরও বেড়ে গেল। তিনি একবার শুধু মুখে বললেন– দাঁড়া ব্যাটা। দেখাচ্ছি মজা- তিষ্ঠ তিষ্ঠেত্যভাষত।

ভীষ্ম সারথিকে বললেন– ঠিক যেখানে শাল্বরাজ দাঁড়িয়ে আছেন, সেইখানে আমার রথটি স্থাপন করো। বন্দুকের যেমন ‘রেঞ্জ’ থাকে তেমনই বাণেরও একটা ‘রেঞ্জ’ আছে। হয়তো সেই সুবিধার জন্যই কাছে যাওয়া। মহাভারতের কবি আবারও একটি বন্য উপমা দিলেন। বললেন, একটি সন্তপ্তা গাভীর সঙ্গে মিলিত হবার জন্য দুটি বৃষ যেমন গর্জন করতে থাকে, তেমনই শাল্ব এবং ভীষ্ম যুদ্ধোন্মাদী হয়ে গর্জন করতে লাগলেন পতিম্বরা কন্যা তিনটিকে মাঝখানে রেখে– তৌ বৃষাবিব নর্দন্তেী বলিনৌ বাসিতান্তরে। আমরা জানি, ভীষ্ম কন্যাকামী নন, অতএব তাঁকে এই মুহূর্তে বৃষ বলা যায় না, কিন্তু রমণীকে হরণ করার নিরিখে শাল্বরাজের কাছে তিনি বৃষ ছাড়া আর কী?

যাই হোক ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ হল। ভীষ্ম একদিকে শারে বাণ প্রতিহত করতে লাগলেন, অন্য দিকে একে একে তার অশ্বগুলি, তার সারথি এবং শেষ পর্যন্ত রথটিও খণ্ড খণ্ড করে ফেললেন। শাম্বরাজ সহায়-সাধনহীন অবস্থায় ভীষ্মের বাণাঘাতে শুধু জীবন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন বিস্তীর্ণ যুদ্ধভূমিতে। ভীষ্ম তাকে মারলেন না, বিবাহের সভায় এসে অনর্থক এই হত্যা তার স্বভাবের মধ্যে আসে না। কামুক পুরুষের কাম-বাসনা বাণের আঘাতে তৃপ্ত করে দিতেই তার কৌতুক হল যেন। শাম্বকে তিনি জীবন্ত অবস্থায় ছেড়ে দিলেন– জিহ্বা বিসর্জয়ামাস জীবন্তং নৃপসত্তমঃ।

প্রার্থিতা রমণীর সামনে পরাজয়ের এই অপমান শাল্বরাজের ক্ষত্রিয়-হৃদয়ে কতটা আঘাত করেছিল, তা পরে বোঝা যাবে। আপাতত তিনি লজ্জায় অপমানে মাথা নিচু করে নিজের রাজ্য শাপুরে প্রবেশ করলেন এবং নিস্তব্ধভাবে রাজ্য চালাতে লাগলেন। অন্য দিকে ভীষ্ম তার শত্রুবিজয় অব্যাহত রেখে যুদ্ধজয়ের কেতন উড়িয়ে রওনা দিলেন হস্তিনাপুরের দিকে। আপন রথস্থ তিন কন্যার জ্যেষ্ঠাটি এই যুদ্ধজয়ের পর তার কপোল-লম্বিত চঞ্চল কুন্তলগুচ্ছ সরিয়ে একবারের তরেও এই পলিতপ্রায় বৃদ্ধ যুবকটির দিকে লোচন আয়ত করেছিলেন কি না, ভীষ্ম তা খেয়াল করলেন না। তিনি এটাও খেয়াল করলেন না যে, শাল্বরাজা পরাজিত হবার ফলে তিন কন্যার একজনের মুখে কোনও দুঃখের ছায়া ঘনিয়ে এল কি না।

সমস্ত রাজাকে হারিয়ে দিয়ে কাশীরাজের তিন কন্যাকে হরণ করে আনার মধ্যেই ভীষ্মের সার্থকতা। সেই সার্থকতার গর্ব নিয়েই তিনি রথ হাঁকিয়ে দিলেন হস্তিনাপুরের দিকে। রাস্তায় কত নদী-পাহাড় পড়ল। কত বন, কত বিচিত্র বৃক্ষের শোভা দেখতে দেখতে ভীষ্ম বাড়ি ফিরলেন। পুত্রবধূর শুচিতায় ভগিনীর সহজতায় অথবা কন্যার বাৎসল্য পদে পদে বিজ্ঞাপন করে তিন কন্যাকে হস্তিনাপুরে নিয়ে এলেন ভীষ্ম–মুষা ইব স ধর্মাত্মা ভগিনীরিব চানুজাঃ। যথা দুহিতরশ্চৈব পরিগৃহ্য যৌ কুরূন। এত কষ্ট করে, রাজাদের কাছে এত অপমান সহ্য করেও ভীষ্ম এই কন্যাহরণের মতো কাজটি করতে গেলেন কেন? না, এতে তার ছোটভাই বিচিত্রবীর্য খুশি হবেন– ভ্রাতুঃ প্রিয়চিকীর্ষয়া।

কন্যা তিনটিকে নিয়ে ভীষ্ম তাদের প্রথমে গচ্ছিত করলেন জননী সত্যবতীর কাছে এবং তার সঙ্গেই প্রথম আলোচনা করলেন, কবে কীভাবে কত আড়ম্বরে বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে হৃতকন্যাদের বিবাহ দেওয়া যায়– সত্যবত্যা সহ মিথঃ কৃত্বা নিশ্চয়মাত্মবান্।

জননী সত্যবতী এই বিবাহ-আয়োজনের ভার সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিলেন ভীষ্মের ওপর। ভীষ্ম এবার ঋত্বিক এবং বৈনিক ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। বিবাহের দিন-ক্ষণ, শুভ মুহূর্ত, লগ্ন এবং মঙ্গল-উৎসবের আড়ম্বর সবকিছু নিয়েই ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আলোচনা চলছে ভীষ্মের। যে সভায় ভীষ্ম বসে আছেন, সেখানে ব্রাহ্মণদের সংখ্যাই বেশি, হয়তো মন্ত্রী অমাত্য দু-একজন আছেন, আর আছেন ভীষ্ম।

এই আলোচনা-সভা চলার সময় অতি অদ্ভুত এক ব্যাঘাত ঘটল, যা ইতিপূর্বে হস্তিনাপুরে কখনও ঘটেনি। সভা চলছে, এই অবস্থাতেই কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যাটি সেখানে উপস্থিত হলেন। তার মনে স্ত্রীজনোচিত কোনও সংকোচ নেই। নেই কন্যাজনোচিত লজ্জা। ভীষ্মকে তিনি কিছু বলতে চান। ভীষ্ম তার দিকে উন্মুখ এবং অবহিত হতেই কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা স্বীয়াধরে ভুবনভোলানো হাসি ছড়িয়ে বললেন– মহাশয়! ধর্ম কী বস্তু আপনি জানেন, কারণ আপনি ধর্মজ্ঞ। আমি আপনাকে কিছু নিবেদন করতে চাই। সেটা জেনে যা আপনার ধর্ম বলে মনে হয়, তাই আপনি করবেন– এত বিজ্ঞায় ধর্মজ্ঞ ধর্মতত্ত্বং সমাচর।

কথার আগেই ভীষ্মকে ধর্মজ্ঞের সম্বোধনে সম্বোধন করে ধর্মানুসারে কাজ করার অনুরোধ জানানোর মধ্যে অম্বার কিছু উদ্দেশ্য আছে এবং ধর্মানুসারে বিচার করলে তিনি যে তার অনুকূলেই রায় পাবেন– এটাও তাঁর বিশ্বাস আছে। যাই হোক, অম্বা বললেন, এই যে স্বয়ম্বর হয়ে গেল, তার আগে, অনেক আগেই আমি মনে মনে সৌভপতি শাল্বরাজকে স্বামী হিসেবে বরণ করেছিলাম–ময়া সৌভপতিঃ পূর্বং মনসা হি বৃতঃ পতিঃ। আর শাল্বরাজও আমাকে তাঁর পত্নীর স্থান দেবেন বলে স্বয়ম্বরের পূর্বেই আমাকে বেছে নিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আমার পিতারও জানা ছিল। কাশীরাজ আমাদের এই মনের মিলন বৈবাহিক সম্বন্ধে পরিণত করতে চেয়েছিলেন– তেন চাস্মি বৃতা পূর্বমেষ কামশ্চ মে পিতুঃ।

নিজেদের পূর্বরাগের কথা জানিয়ে কাশীরাজনন্দিনী এবার তার আসল ইচ্ছেটা জানালেন ভীষ্মের প্রতি তিরস্কারের অঙ্গুলি-সংকেত করে। বললেন– এই স্বয়ম্বর সভাতে আমি শাল্বরাজের গলাতেই আমার বরণমালা পরিয়ে দিতাম- ময়া বরয়িতব্যোহভূৎ শান্তস্মিন স্বয়ম্বরে।

অম্বা আর একটি কথাও বলেননি। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁর পূর্বপরিকল্পিত কার্য পদ্ধতির মধ্যে অনর্থ ডেকে এনেছেন ভীষ্ম। স্বয়ম্বর-সভা থেকে তিন কন্যাকে হরণ করে নিয়ে এসে তিনি এক প্রেমিকযুগলের আশা-আকাঙ্ক্ষায় জল ঢেলে দিয়েছেন।

অম্বা একা ভীষ্মের সামনেই তার গোপন প্রণয় ব্যক্ত করেননি। সভায় মন্ত্রী ব্রাহ্মণরা বসে ছিলেন। কাজেই একান্তে হলে ভীষ্ম সে প্রার্থনা উড়িয়ে দিতে পারতেন। আমরা জানি তিনি এই প্রার্থনা উড়িয়ে দিতেন না– তবু একান্তে হলে তিনি যদিও বা অন্যরকম কিছু করতেও পারতেন, কিন্তু এই সমবেত ন্যায়বিৎ ব্রাহ্মণদের সামনে তা করা সম্ভব নয়। অম্বার কথা শুনে ভীষ্ম যতটা বিব্রত হলেন, তার থেকে বেশি চিন্তাকুল হলেন। এই মেয়েকে নিয়ে এখন কী করা যায়, কোন কাজ অপহৃতা কাশীরাজনন্দিনীর উপযুক্ত হবে– চিন্তামভিগম বীরো যুক্তাং তস্যৈব কর্মণঃ।

কাশীরাজনন্দিনী নিজের যুক্তি দিয়ে আরও একটা কথা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ভীষ্মকে। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সমস্ত রাজাকে হারিয়ে বীরের দর্পে ভীষ্ম তার শরীরটা হস্তিনাপুরে নিয়ে আসতে পেরেছেন বটে, কিন্তু তার মন-প্রাণ রয়ে গেছে শাল্বপুরে ব্যথিত শাল্বরাজার কাছে। অম্বা বলেছিলেন, জোর করে আপনি আমাকে এখানে এনেছেন বটে, কিন্তু আপনি তো আর জোর করে আপনার ভাইকে ভালবাসাতে পারবেন না। আপনি প্রসিদ্ধ কুরুবংশের জাতক হয়ে কী করে এক অন্যপূর্বা নারীকে নিজের ঘরে রাখবেন– বাসয়েথা গৃহে ভীষ্ম কৌরবঃ সন্ বিশেষতঃ। ভীষ্ম জানেন– রাজকীয় মর্যাদা বা ক্ষাত্রধর্মের তেজ দেখিয়ে একটি রমণীকে হরণ করা যায় বটে কিন্তু তার মন পাওয়া যায় না, কিংবা তার মনের পূর্বাস্বাদিত লালিত কেন্দ্রগুলিকেও নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায় না। ভীষ্ম এটা জানেন।

কিন্তু রমণীর মন! সে কি সত্যিই বোঝেন ভীষ্ম। কোনও রমণীর সঙ্গে তার পূর্বরাগ হয়নি। কাউকে তিনি ভালবাসেননি এমনকী কাউকে ভালবাসবেন না, কাউকে বিবাহ করবেন না বলে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন। এই অবস্থায় অম্বার বক্তব্য তাঁর পক্ষে বোঝা মুশকিলই বটে। কিন্তু অবিবাহিত পুরুষ অথবা যে পুরুষ কখনও স্ত্রী-হৃদয়ের ভাবনা একটুও ভাবেনি, সে স্ত্রীলোকের ব্যাপারে উচ্চকিত থাকে বেশি। পিতার বিবাহের সময় ভীষ্ম পূর্বাপর কোনও বিবেচনা না করে প্রায় সমবয়সি এক রমণীকে জননীতে পরিণত করেছিলেন।

কাজেই অম্বা যখন বলেছিলেন– আমার জন্য শাশ্বরাজ এখনও নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছেন– স মাং প্রতীক্ষতে ব্যক্তম আপনি আপনার বুদ্ধি দিয়ে বিচার করুন, আপনার মন দিয়ে বিচার করুন– এতদবুদ্ধ্যা বিনিশ্চিত মনসা ভরতভ– তখন কিন্তু এই উচ্চকিত বৃদ্ধ আর দেরি করেননি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে জননী সত্যবতীর কাছে সমস্ত ঘটনা নিবেদন করেছেন। রাজকীয় মর্যাদার ব্যাপারও এখানে আছে। তিন কন্যাকে হরণ করে আনা হল, আর বিবাহের সময় পাওয়া গেল দুই কন্যা। তা তো হতে পারে না। অতএব মন্ত্রী, পুরোহিত, ঋত্বিক সবাইকে জানিয়ে ভীষ্ম কাশীরাজনন্দিনীকে অনুমতি দিলেন শাল্বরাজের কাছে ফিরে যাবার জন্য– সমনুজ্ঞাসিতং কন্যামম্বং জ্যেষ্ঠাং নরাধিপ।

ভীষ্মের বিষয়বুদ্ধি কিছু কম নেই। এক কন্যা রমণী হস্তিনাপুর থেকে শাল্বপুরে যাবেন, তার স্ত্রীজনোচিত সমস্যা আছে, পথের ভয় আছে এবং তার মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারও আছে। অতএব অম্বা যেদিন শাল্বপুরের পথে পা বাড়ালেন, সেদিন তার সঙ্গে দেওয়া হল একটি ধাত্রী রমণীকে আর দেওয়া হল কতকগুলি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে। তাঁরা সমস্ত পথ ধরে অম্বার সুরক্ষার ব্যবস্থা করবেন–বৃদ্ধৈৰ্বিজাতিভিগুপ্তা ধাত্রা চানুগতা তদা। অম্বা হস্তিনাপুর ছেড়ে চলে গেলেন শাল্বপুরের দিকে। কত পথ, কত নদ-নদী পেরিয়ে মনে মনে শাল্বরাজের কথা ভাবতে ভাবতে অম্বা পথ চলতে থাকলেন। ভাবলেন, কতই না আশ্চর্য হবেন শাল্বরাজ। যে কাশীরাজ কন্যাকে বিবাহের জন্য হরণ করা হয়েছিল সেই প্রিয়তমা সমস্ত বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে নিজে এসে উপস্থিত হয়েছেন তার কাছে– শাল্বরাজ কত খুশি হবেন তাকে দেখে। রাজ্য জয় করাও তো কিছুই নয় এই অদ্ভুত ঘটনার কাছে।

অম্বা শাল্বকে বললেন, আমি সব কিছু ছেড়ে, সমস্ত বাধা অতিক্রম করে তোমার কাছে ফিরে এসেছি, তুমি আমাকে গ্রহণ করো– আগতাহং মহাবাহো স্বামুদ্দিশ্য মহামতে। একই পংক্তিতে ‘মহাবাহু’ এবং ‘মহামতি’– এই সম্বোধন দুটি খেয়াল করার মতো। ক’দিন আগেই ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধে শাল্বরাজ প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। অম্বা বোঝাতে চাইলেন, তাতে কী! যুদ্ধে ওরকম হয়ই। তুমি আমার কাছে মহাবাহু সেই বীরপুরুষটিই আছ। আর ‘মহামতি’! যে রমণীকে বিবাহের জন্য হরণ করা হয়েছিল, তাকে সেই ঘর থেকে ফিরে আসতে হয়েছে প্রেমের তাড়নায়। প্রিয়তম নায়ক যদি ভুল বোঝেন, তাই শাল্বরাজের সুস্থিরা বুদ্ধির কাছে নিবেদন আছে এই দীনা রমণীর। তাই এমন সম্বোধন মহামতি।

কিন্তু এই বিপন্ন মুহূর্তেও অম্বার মধুর সম্বোধনে শাল্বরাজের হৃদয় বিগলিত হল না। তিনি সামান্য ব্যঙ্গের হাসি ফুটিয়ে অম্বাকে বললেন, কেন! তোমার জায়গার অভাব কোথায়? তুমি সেই ভীষ্মের কাছে ফিরে যাও। অন্য একজন বিয়ের সাধ করে তোমাকে টেনে নিয়ে গেল, আর সেই মেয়েকে আমি ভার্যার মর্যাদা দেব, তা কী করে হয়? তুমি ভীষ্মের কাছে ফিরে যাও- গচ্ছ ভদ্রে পুনস্তত্র সকাশং ভীষ্মকস্য বৈ।

শাল্বরাজ মনে করেছিলেন, ভীষ্মই তার প্রিয়তমা রমণীকে বিয়ে করার ইচ্ছেয় তাকে হরণ করেছেন। অম্বা শাল্বর ভুল ভেঙে দেবার চেষ্টা করলেন। বললেন, আমার বয়স বেশি নয়, রাজা! সবকিছু আমি বুঝি না, কিন্তু আমি তো তোমার কাছে আত্মনিবেদন করেছি, আমি তোমার ভক্ত। লোকে কি একান্ত বশম্বদ জনকে পরিত্যাগ করে? তা ছাড়া ভীষ্মের কথা বলছ? আমি কিন্তু তার অনুমতি নিয়েই এখানে এসেছি। আরও একটা কথা। তিনি কিন্তু নিজে বিয়ে করার জন্য আমাদের হরণ করেননি। ভাই বিচিত্রবীর্যের জন্য তিনি এই কাজ করেছেন এবং আমার আর দুই বোনের সঙ্গে তার বিয়েও হয়ে গেছে। আমি শুধু ভীষ্মকে আমার অভিসন্ধি জানিয়ে এখানে আসার অনুমতি লাভ করেছি– অনুজ্ঞাতা চ তেনৈব ততোহং ভূশমাগতা।

অম্বা যেভাবে ভীষ্মের কথা বলেছেন, তাতে এই মুহূর্তে ভীষ্মের প্রতি তার যথেষ্ট শ্রদ্ধা ফুটে উঠেছে। কিন্তু শাল্বরাজ তার বুদ্ধিতেই অম্বার বিচার করেছেন। তিনি বলেছেন, ভীষ্ম যখন সমস্ত রাজাকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে তোমাকে রথে তুললেন তখন তো বেশ খুশি-খুশিই দেখাচ্ছিল তোমাকে- ত্বং হি ভীষ্মেণ নির্জিতা নীতা প্রীতিমতী তদা। অন্য লোক যাকে এইভাবে নিয়ে গেছে, সেই অন্য লোকের হাত ধরা রমণীকে আমার মতো রাজারা বিয়ে করে না– কণ্বমষ্মদৃবিধো রাজা পরপূর্বাং প্রবেশয়েৎ।

অম্বা বললেন, খুশি-খুশি। আমাকে তুমি খুশি-খুশি দেখেছ? আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে গেলেন ভীষ্ম, আর আমাকে তুমি খুশি-খুশি দেখলে নাস্মি প্রীতিমতী নীতা ভীষ্মেণামিত্রকর্ষণ। আমাকে নিয়ে যাবার সময় কতই না কাঁদছিলাম আমি। কিন্তু তাতে কী? ভীষ্ম সমস্ত রাজাকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে আমাকে নিয়ে গেছেন– বলান্নীতাস্মি রুদতী বিদ্রাব্য পৃথিবীপতি। আমার কীই বা করার ছিল?

আসলে শাল্বরাজের রাগ কোথায় আমরা জানি। প্রিয়তমার সামনে তিনি ভীষ্মের হাতে মার খেয়েছেন। রথ, অশ্ব, সারথি খুইয়ে তাকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। সে অপমান তিনি ভোলেননি বলেই বারবার তিনি বলেছেন, যিনি এত যুদ্ধ করে রাজাদের হারিয়ে দিয়েছিলেন– পরামৃষ্য মহাযুদ্ধে নির্জিত্য পৃথিবীপতিন– তুমি তার কাছেই যাও। তার অভিমান হল– যুদ্ধে হেরে যাবার মুহূর্তে তিনি তাঁর প্রিয়তমার মুখে খুশি-খুশি ভাব দেখেছেন।

অম্বা এ কথা অস্বীকার করেছেন বটে, তবে এমনও হতে পারে যে, সেই মুহূর্তে নিজের প্রীত ভাব সম্বন্ধে তিনি সচেতন ছিলেন না। প্রৌঢ়-বৃদ্ধ ভীষ্ম যখন সমস্ত রাজকুলকে যুদ্ধে হারিয়ে দিলেন একা এবং তারপরেও যুবক বীর শাল্বরাজকেও যখন তিনি নাকানিচোবানি খাইয়ে দিলেন, হয়তো সেই মুহূর্তে অম্বার অযান্ত্রিক মনের মধ্যে বিস্ময়ের আলো লেগেছিল। হয়তো সেই মুহূর্তে ভীষ্মের শক্তির প্রতি এক বিস্মিত নারী-হৃদয় শ্রদ্ধা জানিয়েছিল সমর্থনের হাসি হেসে। সেই স্মিতহাস্যের মধ্যে যতটুকু আবেগ প্রকাশিত হয়েছিল, তা আকস্মিক এবং অকিঞ্চিৎকর হলেও সেই ক্ষণটুকু তো মিথ্যে নয়।

আমরা অনুমানে জানি এই আকস্মিক খুশিভাবের সম্বন্ধে অম্বা সচেতন ছিলেন না। কিন্তু শাল্বরাজ তো সচেতন ছিলেন। তা ছাড়া শাল্বরাজের এমন যুক্তি থাকতেই পারে যে, যখন অম্বাকে রথে ওঠানো হল, যখন তিনি পথ চলতে লাগলেন ভীষ্মের সঙ্গে একই রথে, তখন তিনি কেন শাল্বরাজের প্রতি তার অনুরাগের কথা ব্যক্ত করলেন না? এমনকী রাজাদের যখন যুদ্ধে হারিয়ে দেওয়া হল, এমনকী শাম্বরাজও যখন হেরে গেলেন, তখনও তিনি কেন চেঁচিয়ে উঠলেন না আকাশ বাতাস আকুল করে? কেন এক সমর্পিতপ্রাণা প্রেমিকা ভীষ্মের সামনে আনত হয়ে বলে উঠল না– ধূলি-লুণ্ঠিত এই যুদ্ধ-ধ্বস্ত যুবকই আমার প্রাণেশ্বর।

বললে, আমরা জানি, অম্বা যদি সত্যিই মুখ ফুটে একথা একবারের তরেও বলতেন, যেমনটি এখন তিনি বলে এসেছেন, তা হলে ভীষ্ম অবশ্যই তাকে ছেড়ে দিতেন। কিন্তু তা হয়নি। অম্বা কিছুই বলেননি। কিন্তু শাল্বরাজের দিক থেকে বস্তুটা কীরকম হয়। তিনি অম্বাকে সোজাসুজি প্রত্যাখ্যান করলেন। অম্বা ভাবলেন, শাম্বরাজকে যদি ভাল করে সব কিছু বোঝানো যায়, তবে তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন। অম্বা বললেন, আমি ভীষ্মের কাছে বিদায় নিয়েই এসেছি। তিনি তোমার কাছে আসার জন্য অনুমতি দিয়েছেন আমাকে। তা ছাড়া তুমি যে বার বার আমাকে তার কাছে ফিরে যেতে বলছ, তিনি তো আমাকে চান না– ন স ভীষ্মে মহাবাহুর্মামিচ্ছতি বিশাম্পতে।

অম্বা এবার সকরুণ সুরে বললেন, আমি তো তোমাকে ছাড়া আর কাউকে মনে মনেও ভাবিনি। আমি কখনও কারও নই, আমি তোমার–ন চান্যপূর্বা রাজেন্দ্র হামহং সমুপস্থিতা। মনে রেখো, আমি একজন কুমারী কন্যা। আমি স্বয়ং তোমার কাছে উপস্থিত হয়েছি, তোমার প্রসন্নতা ভিক্ষা করেছি– তৃৎপ্ৰসাদাভিকাঙিক্ষনীম্। অম্বা এইভাবে আত্মসমর্পণ করলেও শাল্বরাজের হৃদয় একটুও বিগলিত হল না। সাপ যেমন তার পুরনো খোলস ছেড়ে ফেলে, তেমন করেই শাল্ব ত্যাগ করলেন অম্বাকে– অত্যজ ভরতশ্রেষ্ঠ জীর্ণাং ত্বচমিবোরগঃ। অম্বা অনেক কাঁদলেন, অনেক অনুনয় করলেন, অনেক কথা বললেন। শেষে বোধহয় তার একটু রাগই হল। বললেন, তুমি আজকে আমায় ছেড়ে দিচ্ছ বলে এটা ভেব না যে, আমার কোনও গতি হবে না। পৃথিবীতে ভদ্রলোক এখনও কিছু আছেন, যাঁদের কাছে আমি আশ্রয় পাব– তত্র মে গতয়ঃ সন্তু সন্তঃ সত্যং যথা ধ্রুবম্। অম্বার কথা শুনে শাল্ব তাঁকে অবহেলে শেষ কথা শুনিয়ে দিলেও অম্বাকে প্রত্যাখ্যান করার মূল কারণটিও তিনি লুকোলেন না। বললেন ঠিক আছে, ঠিক আছে তুমি যাও। তবে মনে রেখো– আমি যে আজকে তোমাকে প্রত্যাখ্যান করলাম, সে শুধু ভীষ্মের ভয়ে। ভীষ্ম তোমাকে তুলে নিয়ে গেছেন, সেই তোমাকে আমি যদি গ্রহণ করি, তবে তার ক্রোধকেই আমন্ত্রণ জানানো হবে– বিভেমি ভীষ্মৎ সুশ্রেণি ত্বঞ্চ ভীষ্ম-পরিগ্রহঃ।

.

০৩.

শাল্বরাজের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অম্বা বেরিয়ে পড়লেন বটে, কিন্তু তার শেষ কথাটি শুনে অম্বার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল ভীষ্মের ওপর। শাল্ব-নগরের বাইরে রাস্তায় বেরিয়ে তিনি নিজের করুণ অবস্থা সম্বন্ধে ভাবনা শুরু করলেন। তিনি এটা পরিষ্কার বুঝলেন, হস্তিনাপুরে ফিরে যাবার কোনও মানে নেই। তার অন্য দুই বোনের বিয়ে এতদিনে হয়ে গেছে, অথবা হবে। কিন্তু সকলের সামনে তিনি যেভাবে শাল্বরাজের প্রতি প্রেম নিবেদন করেছেন, তাতে হস্তিনাপুরে আবার ফিরে যাবার কোনও মুখ নেই তাঁর– ন চ শক্যং পুনর্গন্তুং ময়া বারণসাহ্বায়ম্।

অনেকে ভাবেন– অম্বা শাল্বরাজার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আবার ভীষ্মের কাছে যান এবং ভীষ্ম তখন তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রত্যাখ্যানের পর তার ভীষ্মের ওপর রাগ হয়। কিন্তু কথাটা ঠিক নয়। অম্বা রাস্তায় বেরিয়েই সিদ্ধান্ত নেন, ভীষ্মের কাছেও ফিরে যাবেন না, নিজের বাড়িতেও ফিরে যাবেন না। সমস্ত ঘটনার জন্য, এমনকী স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করার জন্য নিজের পিতার ওপরেও তার রাগ হয়। নিজেকেও তিনি কম ধিক্কার দেননি। ভীষ্মের সঙ্গে শাল্বের যুদ্ধ বাধার সঙ্গে সঙ্গেই কেন তিনি এক ছুটে শাল্বরাজার কাছে পালিয়ে আসেননি। এইসব পশ্চাত্তাপ নিরন্তর তাঁকে দগ্ধ করতে লাগল– প্রবৃত্তে দারুণে যুদ্ধে শান্বার্থং নাগতা পুরা। কিন্তু সব কিছুর ওপরেও তার মনে হল– ভীষ্ম যদি রাজসভা থেকে জোর করে তাকে তুলে নিয়ে না যেতেন, তা হলে কখনই এই দুর্ভাগ্য তাঁর হয় না। অতএব তাঁর জীবনের সমস্ত কষ্টের মূল হলেন সেই ভীষ্ম– অনয়স্যা তু মুখং ভীষ্মঃ শান্তনবো মম। অতএব যেভাবে হোক ভীষ্মের ওপরে শোধ নিতে হবে– সা ভীষ্মে প্রতিকর্তব্যঃ… দুঃখহেতু স মে মতঃ।

শোধ তো নিতে হবে, কিন্তু কেমন করে? অম্বা জানেন, ভীষ্মকে যুদ্ধে জেতা প্রায় অসম্ভব। এমন কোনও যোদ্ধা নেই যে প্রবল পরাক্রমী ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিশ্চিত পরাজয়ের গ্লানি উপভোগ করতে চাইবে। অতএব তপস্যা বা ব্রাহ্মণ ঋষি-মুনির সাহায্যে ভীষ্মকে পর্যুদস্ত করা যায় কি না সেই ভাবনায় তিনি শাপুরের বাইরে এসেই নিজের গন্তব্যস্থল নিশ্চিত করে ফেললেন।

শাল্বপুরের সীমা শেষ হতেই একটি আশ্রম আছে। ত্যাগব্রতী মুনি-ঋষিরা সেখানে বাস করেন। এই আশ্রমের প্রধান পুরুষ হলেন মহর্ষি শৈখাবত্য। তখন সন্ধ্যা নামছে। অম্বা আস্তে আস্তে মহর্ষি শৈখাবত্যর আশ্রমে প্রবেশ করলেন ধীরপদে। অসাধারণ এক সুন্দরী যুবতী হঠাৎ তপোবনের আঙিনায় এসে উপস্থিত হল দেখে তপস্বী মুনি-ঋষিরা ভারী অবাক হলেন। তারা একে একে ঘিরে ধরলেন অম্বাকে। জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ গো। তুমি কাদের মেয়ে, তুমি থাকো কোথায়, এই আশ্রমে এলে কেন? অম্বা সাশ্রুকণ্ঠে সব জানালেন– স্বয়ম্বর-সভা থেকে শাল্বরাজের শেষ প্রত্যাখ্যান পর্যন্ত। দুঃখের কাহিনি শোনাতে শোনাতেই রাত ভোর হয়ে গেল– ততস্ত্রামবসদ্ৰাত্রিং তাপসৈঃ পরিবারিতা।

অম্বার মুখে তার দুঃখের কাহিনি শুনে তপোবৃদ্ধ মহর্ষি শৈখাবত্য বললেন, তোমার এই বিপন্ন অবস্থায় আমরা তপস্বীরা কীই বা করতে পারি, মা এবং গতে তু কিং ভদ্রে শক্যং কতুং তপস্বিভিঃ? আমরা এই আশ্রমে যজ্ঞ-হোম-তপস্যা নিয়ে থাকি। সেখানে তোমার কী সুবিধে করে দিতে পারি আমরা? অম্বা তখনও কাঁদছেন, তখনও তার নিঃশ্বাস দীর্ঘায়িত। মনে তার যাই থাকুক, মুখে বললেন– না না, আমাকে নিয়ে বিব্রত হবেন না আপনারা। আমিও সন্ন্যাসিনী হয়ে এই আশ্রমে বসেই তপস্যা করব। পূর্বজন্মে যত পাপ করেছি, তপস্যা করে তার মূল্য চোকানোর চেষ্টা করব। আপনারা সব মুনি-ঋষি, দেবতার মতো আপনাদের স্বভাব। আমাকে আপনারা বিরত করবেন না। আমি আর আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফিরে যেতে চাই না– নোৎসহে তং পুনর্গন্তুং স্বজনং প্রতি তাপসাঃ।

মহর্ষি শৈখাবত্যের পর অন্য তপস্বীরাও অম্বাকে অনেক বোঝালেন। কেউ বললেন, এঁকে পিতার আশ্রয়েই ফেরত পাঠানো উচিত। কেউ বললেন, শাল্বরাজার কাছেই বা আরেকবার গেলে কেমন হয়? অনেক তর্ক-যুক্তির অবতারণা এবং তার নিরসন করে শেষ পর্যন্ত তপস্বীরা বোঝালেন– পিতার ওখানেই তোমার ফিরে যাওয়া উচিত, কারণ পিতার মতো আশ্রয় মেয়েদের আর কিছু হতে পারে না– ন চ তেহন্যা গতির্নাযা ভবেদ্ভদ্রে পিতা যথা। সবকিছুর ওপরে তপস্বীরা অবশ্য অম্বার অলোকসামান্য রূপ দেখে তাঁকে আশ্রমে রাখতে একটু দ্বিধান্বিতও হয়েছেন। বার বার বলেছেন– তোমার এই রূপ, এই বয়স, এই অরক্ষিত আশ্রমে অনেক ভয়ও আছে তোমার– ভদ্রে দোষা হি বিদ্যন্তে বহবো বরবৰ্ণিনি। তার মধ্যে এই আশ্রমে রাজারা রাজপুত্রের মাঝে মাঝেই আসেন। তারা তোমাকে দেখলেই প্রার্থনা জানাবেন বিবাহের জন্য। সে এক ভীষণ সমস্যা হবে।

অম্বা কোনও যুক্তি কোনও বাধা মানলেন না। বললেন, আমি আপনাদের সুরক্ষাতেই এই তপোবনে তপস্যা করব– তপস্তপ্তম অভীপ্সামি তাপসৈঃ পরিরক্ষিতা। মুনিরা আর কী করেন, তারা আশ্রয় দিলেন অম্বাকে। ভালই চলছিল অম্বার। গাছের ফুল কুড়িয়ে, গাছে জল দিয়ে, তপস্বীদের পুজোপহার সাজিয়ে ভালই চলছিল অম্বার। এরই মধ্যে মহর্ষি শৈখাবত্যের আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন রাজর্ষি হোত্ৰবাহন। তিনি রাজাও বটে, ঋষিও বটে। এঁর সঙ্গে অম্বার একটা আত্মীয়তার সম্বন্ধও আছে। রাজর্ষি হোত্ৰবাহন অম্বার মায়ের বাবা অর্থাৎ তিনি কাশীরাজের শ্বশুর এবং তিনি অম্বার মাতামহ।

অম্বা আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা নিবেদন করলেন রাজর্ষি হোত্ৰবাহনের কাছে। অম্বার ওপর তার মায়া হল এবং যাঁদের কাছ থেকে অম্বা কষ্ট পেয়েছেন, তাদের ওপর তার খুব রাগ হল। নাতনিকে নিজের কোলে বসিয়ে তিনি অভয় দিলেন, একটা বিহিত নিশ্চয় করব আমি। তোর মনে যে দুঃখ আছে, সে দুঃখ আমি দূর করব।

রাজর্ষি হোত্ৰবাহন অম্বাকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, তুই জামদগ্ন্য পরশুরামের কাছে যা, মা। তিনি তোর সব দুঃখ দূর করে দেবেন। অম্বা বললেন, কোথায় থাকেন তিনি, আর কেনই বা তিনি আমার কথা শুনে আমার কথায় কাজ করবেন। হোত্ৰবাহন বললেন, পরশুরাম আমার পরম বন্ধু। তিনি থাকেন মহেন্দ্র পর্বতে। যেমন তার তপস্যার তেজ, তেমনই তার ক্ষমতা অস্ত্রশক্তি। তুই সেখানে গিয়ে তার পায়ে ধরে নিজের কথা বলবি এবং আমার নাম করবি। আমার কথা শুনলে, তিনি নিশ্চয় তোর ইচ্ছা পূরণ করবেন। তিনি যে আমার সখা– ময়ি সংকীর্তিতে রামঃ সর্বং তত্তে করিষ্যতি।

অম্বার ভাগ্য তখন ভালই চলছিল। অম্বার সঙ্গে যখন তাঁর মাতামহ হোত্ৰবাহনের কথোপকথন চলছে, সেই সময়েই সেখানে উপস্থিত হলেন মহাত্মা পরশুরামের একান্ত অনুচর, অকৃতব্রণ। ঋষিরা সকলে আসন ছেড়ে উঠে অভিবাদন জানালেন অকৃতব্রণকে। পারস্পরিক কুশল জিজ্ঞাসা শেষ হলে রাজর্ষি হোত্ৰবাহন পরশুরামের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন ইত্যাদি। অকৃতব্রণ বললেন, মহাত্মা পরশুরাম সব সময় আপনার কথা বলেন– ভবন্তমেব সততং রামঃ কীর্তয়তি প্রভো। বার বার কথাপ্রসঙ্গে তিনি আপনার বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করেন। বস্তুত আপনাকে দেখার জন্য কালই তিনি এখানে এসে উপস্থিত হবেন।

সেকালের দিনে এমন হত। মুনি-ঋষিরা এক জায়গায় বসে থাকতেন না। বিভিন্ন তীর্থে তীর্থে তারা ‘চরৈবেতি’র নেশায় ঘুরে বেড়াতেন, বিভিন্ন রাজার রাজকীয় ক্রিয়াকর্মে উপস্থিত থাকতেন। উপস্থিত থাকতেন বিভিন্ন জায়গায় আয়োজিত যজ্ঞভূমিতে। এইভাবে ভ্রমণ করার ফলে একের সঙ্গে অন্যের দেখা হয়ে যেত, একের কাছে অন্যের খবরও পাওয়া যেত এইভাবে। রাজর্ষি হোত্ৰবাহন যে শৈখাবত্যের আশ্রমে এসেছেন– এ খবর পরশুরামের কাছে আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। এখন তিনি যাতে সেখান থেকে চলে না যান সেইজন্যই অগ্রদূত হিসেবে অকৃতব্রণের আগমন।

যাই হোক, কথার মাঝখানে অকৃতব্রণ অম্বাকে দেখে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। হোত্ৰবাহন বললেন, এটি আমার নাতনি দৌহিত্রীয়ং মম বিভো কাশীরাজসুতা প্রিয়া। হোত্ৰবাহন অকৃতব্রণের কাছে অম্বার জীবনকাহিনি বলে তার দুঃখের কথা জানালেন। সঙ্গে এটাও জানাতে ভুললেন না যে, তাঁর নাতনিটি ভীষ্মকেই তার সমস্ত কষ্টের মূল বলে মনে করছে অস্য দুঃখস্য চোৎপত্তিং ভীষ্মমেবেহ মনতে। অম্বা হোত্ৰবাহনের এই কথার পরম্পরায় তাকে সোচ্চারে সমর্থন করলেন না বটে, কিন্তু ভাবে ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন– তিনি ভীষ্মের শাস্তি চান। মুখে শুধু বললেন, আমার বাড়িতে ফেরার কোনও উপায় নেই। আমি মহাত্মা পরশুরামের কাছে গিয়ে সব জানাব। তিনি যা করতে বলবেন, তাই করব– তন্মে কাৰ্যতমং কাৰ্যমিতি মে ভগবন্মতিঃ।

পরশুরামের অনুচর অকৃতব্রণ তার গুরু আসবার আগেই অম্বার ব্যাপারে তাদের ইতিকর্তব্য বুঝে নিতে চাইলেন। কারণ রাজর্ষি হোত্ৰবাহনের নাতনি যখন, তখন কিছু একটা করতেই হবে। পরশুরামও তা করবেন। কিন্তু অম্বা ঠিক কী চান, সেটা আগে বুঝে নেওয়া দরকার। অকৃতব্রণ বললেন, দেখ বৎসে। যদি সৌভপতি শাম্বের ব্যাপারে এখনও তোমার দুর্বলতা থাকে, যদি তুমি মনে কর তোমার হয়ে তাকে বুঝিয়ে বলা দরকার, তবে মহাত্মা পরশুরাম তাই করবেন– নিযোক্ষ্যতি মহাত্মা স রামস্তদ্ধিতকাম্যয়া। আবার তুমি যদি মনে কর– ভীষ্মকে যুদ্ধে হারিয়ে তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া দরকার, তবে পরশুরাম তাই করবেন।

ঠিক এই মুহূর্তে, অর্থাৎ যখন অম্বা বুঝলেন ভীষ্মকে শাস্তি দেওয়া যাবে, ঠিক এই মুহূর্তে ভীষ্মের প্রতি যেন তার সামান্য করুণা দেখা দিল। এটাকে ঠিক দুর্বলতা বলা যাবে কি না জানি না, কিন্তু অম্বা সত্য কথা বলতে বাধ্য হলেন। অম্বা বললেন, ভীষ্ম আমাকে স্বয়ম্বর সভা থেকে হরণ করেছিলেন বটে, তবে আমি যে শাল্বরাজকে মনে মনে ভালবাসি তা তিনি জানতেন না– নাভিজানতি মে ভীষ্মে ব্ৰহ্মন্ শাগতং মনঃ। আমি আপনাকে সবই জানালাম। শান্ধের কথাও আপনাকে বলেছি। ভীষ্মের কথাও আপনাকে বলেছি। বলেছি আমার দুঃখের কথাও। এখন সব জেনে, সব বুঝে কী করা উচিত, তা আপনিই বলুন– বিধানং তত্র ভগব কর্তুমহসি যুক্তিতঃ।

অকৃতব্রণ অনেক চিন্তা করে বললেন, সবই বুঝলাম। কিন্তু একটা কথা বার বারই মনে হচ্ছে যদি তোমাকে ভীষ্ম হরণ না করতেন, তা হলে শাল্বরাজ আজকে তোমাকে মাথায় করে রাখতেন। কিন্তু যেহেতু তিনি তোমায় রাজসভা থেকে হরণ করেছিলেন, তাই তো আজ তোমার সম্বন্ধে শাল্বরাজের মনে এত সংশয়, এত অভিমান। ভীষ্মের পৌরুষ, অহংকার এবং তোমার হরণ-প্রক্রিয়া– এই সবকিছুর নিরিখে আমার তো মনে হয় ভীষ্মের ওপরেই তোমার প্রতিশোধ-স্পৃহা জন্মানো উচিত– তস্মাৎ প্রতিক্রিয়া যুক্তা ভীষ্মে কারয়িতুং তব।

যে অম্বা একটু আগে ভীষ্মের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার ব্যাপারে সংশয়াপন্ন ছিলেন, অকৃতব্রণের যুক্তিতর্কে তার সিদ্ধান্ত পালটে গেল এবং দৃঢ়ও হল। অম্বা বললেন আমার মনেও এমনই ছিল। কেবলই আমার মনে হয় আমি ভীষ্মকে যুদ্ধ করে মেরে ফেলি– ঘাতয়েয়ং যদি রণে ভীষ্মমিতেব নিত্যদা।

অকৃতব্রণ এবং অম্বা ভীষ্মের ব্যাপারে মনঃস্থির করতে সারা দিন লাগিয়ে দিলেন। তার মধ্যে বিকেলের দিকেই পরশুরাম জামদগ্ন্য উপস্থিত হলেন শৈখাত্যের আশ্রমে। রাজর্ষি হোত্ৰবাহনের সঙ্গে তার কুশল এবং ভাব বিনিময় হল। দু’জনেই সুস্থিত হয়ে বসলে হোত্ৰবাহন নাতনির দুঃখের কথা সব সবিস্তারে জানালেন। অনুনয় করে বললেন, ওর কাছে সব শুনে তুমি বলে দাও কী করা উচিত। অম্বা প্রথমেই পরশুরামের কাছে অনেক কাদলেন– রুদোদ সা শোকবতী বাষ্প-ব্যাকুল-লোচনা। পরশুরামের হৃদয় বিগলিত হল। বললেন, তুমি যেমন আমার বন্ধুর নাতনি, তেমনই আমারও তাই। বল তোমার কী দুঃখ, আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। তুমি যা বল তাই করব– করিষ্যে বচনং তব।

অম্বা আনুপূর্বিক সব ঘটনা পরশুরামের কাছে নিবেদন করলেন। পরশুরাম বললেন, তুমি চিন্তা কোরো না। আমি ভীষ্মের কাছে দূত পাঠাব। তিনি নিশ্চয় আমার কথা শুনবেন। আর যদি না শোনেন, তবে তো যুদ্ধের পথ খোলাই রইল। আমি তার সব ধ্বংস করে দেব। পরশুরাম বিকল্প ব্যবস্থাও দিলেন। বললেন, আর যদি মনে কর, শাল্বরাজকে রাজি করাতে হবে, তবে আমি তাও করতে পারি যোজয়াম্যত্র কর্মণি।

অম্বা বললেন, ভীষ্ম যখন আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, তখন শাল্বরাজের কাছে তো আমি নিজেই গিয়েছিলাম। তাকে অকথা কুকথাও অনেক বলেছি অবোচং দুর্বচং বচঃ। কিন্তু তিনি আমার চরিত্র নিয়েই আশঙ্কিত। এ অবস্থায় আমি মনে করি, ভীষ্মই আমার সমস্ত বিপদের মূল। আপনি তাকে শেষ করে দিন জন্মের মতো,তার জন্যই আমার যত কষ্ট–ভীষ্মং জহি মহাবাহো যৎকৃতে দুঃখমীদৃশম্।

পরশুরাম এবার একটু গাঁইগুই করে বললেন, আমার তো অস্ত্র ধারণ করাই বারণ। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, ব্রাহ্মণদের নির্দেশ অথবা তাদের অভীষ্ট কোনও কারণ ছাড়া আমি অস্ত্র ধারণ করব না। আর তা ছাড়া তুমি এত ভাবছ কেন? ভীষ্মই হোন আর শাল্বই হোন, তারা দুজনেই আমার কথা শুনবেন। কথাতেই কাজ হয়ে যাবে, যুদ্ধের দরকার কী? অম্বা বললেন, আমি ও সব জানি না। আপনি প্রতিজ্ঞা করেছেন– আপনি আমার কথা শুনবেন, অতএব আপনি যুদ্ধে তাঁকে বধ করুন প্রতিশ্রুতং যদপি তৎ সত্যং কতুমহসি।

পরশুরাম রাজি হচ্ছেন না দেখে স্বয়ং অকৃতব্রণ অম্বার সাহায্যে এগিয়ে এলেন। বললেন, রাজকুমারী আপনার শরণাগতা। আপনি তাকে যা কথা দিয়েছেন, তা পালন করা আপনার ধর্ম। তা ছাড়া ব্রাহ্মণদের কারণে ক্ষত্রিয়-নিধনের প্রতিশ্রুতিও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। ভীষ্ম ক্ষত্রিয়, তাকে বধ করে আপনি এই বালিকার কাছে আপনার সত্য রক্ষা করুন– তেন যুধ্যস্ব সংগ্রামে সমেত্য কুরুনন্দন।

পণ্ডিতেরা বলেন– পরশুরামের সঙ্গে ক্ষত্রিয়দের যে কয়েক বার যুদ্ধ হয়েছে, তার মূলে আছে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের পারস্পরিক গুরুত্ব নির্ণয়ের ইতিহাস। আমরা সেই ইতিহাসে যাচ্ছি না, তবে আপাতত বলতে পারি আজকের এই ইতিহাস এক রমণীর তৈরি। আজকের দিনের প্রগতিবাদীরা, যারা সেকালের দিনে নারী-স্বাধীনতার বিষয়ে বারংবার সন্দেহ প্রকাশ করেন, তাদের জানাই– অম্বা হলেন সেই রমণী যিনি স্বয়ং ভীষ্মের কাছে, নিজের প্রণয়-অভিলাষ ব্যক্ত করে সসম্মানে হস্তিনাপুর থেকে শাপুর যেতে পেরেছিলেন এবং সেখানে তার প্রণয় ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি প্রতিশোধ-স্পৃহায় এমন এক জন পুরুষকে কাজে লাগাচ্ছেন, যিনি তার পূর্বকৃত প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে বসেছেন এক রমণীর কাছে। ভীষ্মের ওপরে এই রমণীর অস্পষ্ট দুর্বলতা নিয়ে যারা কাব্য করতে ভালবাসেন, তাদের হতোদ্যম না করেও বলতে পারি– অম্বা জ্বলেপুড়ে মরছেন নিজের অভিমানে; তার প্রণয় ব্যর্থ হওয়ায় তিনি এমন এক জনকে প্রতিশোধের পাত্র হিসেবে নির্ণয় করেছেন, যিনি তার রসজ্ঞ নন একটুও। এই প্রতিশোধ-স্পৃহা জন্মেছে শুধুই তার নারীত্বের ব্যর্থতায়, এবং সে ব্যর্থতার জন্য ভীষ্ম দায়ী নন।

যাই হোক, পরশুরাম অম্বার কথায় রাজি হলেন ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। অম্বাকে নিয়েই তিনি চললেন হস্তিনাপুরে। সেখানে তখন মহা আনন্দ চলছে। ভাই বিচিত্রবীর্যের বিয়ে হয়ে গেছে। রাজ্যপাটে কোনও সমস্যা নেই। ভীষ্মের ছত্রচ্ছায়া এবং বিচিত্রবীর্যের শাসনে সবকিছুই চলছে অতি চমৎকার। এরই মধ্যে পরশুরাম নীলাকাশে বজ্রের মতো উপস্থিত হলেন হস্তিনাপুরে। ভীষ্ম তার রাজবাড়ির পুরোহিত-মন্ত্রিবর্গ নিয়ে দেখা করলেন পরশুরামের সঙ্গে ঋত্বিগভি-দেকল্পৈশ্চ তথৈব চ পুরোহিতৈঃ। পরশুরাম ভীষ্মকে বললেন, এ কী ব্যবহার তোমার? এই মেয়েটিকে এক বার ধরে নিয়ে গেছ, একবার ছেড়ে দিয়েছ– অকামেন ত্বয়া নীতা পুনশ্চৈব বিসর্জিতা। তোমার তো বিয়ে করার ইচ্ছেও ছিল না। এখন দেখ তো এর কী অবস্থা। আচার ধর্ম সবই এর নাশ হয়ে গেছে। শাল্বরাজ এর। চরিত্রে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এবং শুধু তুমি একে তুলে এনেছিলে বলেই তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন এই রমণীকে। সে যাই হোক, মেয়েটার করুণ অবস্থা তো দেখছ, এখন আমার কথা শুনে তুমি একে গ্রহণ কর– তস্মাদিমাং মন্নিয়োগাৎ প্রতিগৃহ্নীস্ব ভারত।

মনে রাখা দরকার, পরশুরাম কিন্তু ভীষ্মের অস্ত্রগুরু। তিনি অতি অল্প বয়সে পরশুরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতে গিয়েছিলেন এবং কৃতবিদ্য হয়ে ফিরেও এসেছিলেন। পরশুরামের অমন কথা শুনে ভীষ্ম একটু হতচকিত হলেও নিজের যুক্তি সাজাতে ভুল করলেন না। বললেন, আমি তো এখন আর এই রমণীকে ভাইয়ের হাতে তুলে দিতে পারি না। ইনি যে মুহূর্তে বলেছেন– আমি শাল্বরাজের প্রণয়িণী, সেই মুহূর্তেই আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি। এখন তো আর এঁকে আমি ফিরিয়ে নিতে পারি না। আমারও ধর্ম আছে। ভয় পেয়ে, রাগ করে, লোভে কিংবা কামনায়, আমি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম ত্যাগ করতে পারি না।

পরশুরাম হঠাৎই খুব রেগে গেলেন। আসলে এটাই ছিল তার স্ট্র্যাটেজি ভাল কথায় কাজ না হলেই রাগ দেখাতেন। পরশুরাম বললেন, তুমি যদি কথা না শোন, তা হলে কিন্তু যুদ্ধে তোমাকে হত্যা করব আমি। ভীষ্ম অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন, গুরুর পায়ে মাথা ঠুকলেন, অনেক অনুনয় বিনয় করলেন। পরশুরাম ভাবলেন, ভীষ্ম ভয় পেয়েছেন। অতএব তিনি তার পূর্বের অনুরোধ পুনরাবৃত্তি করে বললেন, আমার ভাল লাগবে জেনেই তুমি মেয়েটাকে ফিরিয়ে নাও, নিজের কুলরক্ষা কর গৃহণেমাং মহাবাহো রক্ষস্ব কুলমাত্মনঃ।

সত্যি কথা বলতে কি, পরশুরাম যে ধারায় কথা বলছেন, ভীষ্ম ইচ্ছে করেই সে ধারাটি বুঝতে চাইছিলেন না। বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে এই রমণীর আর বিয়ের প্রশ্ন ওঠে না। শাম্বের সঙ্গেও তার প্রণয় ব্যর্থ হয়ে গেছে। এখন পরশুরাম বোঝাতে চাইছেন– সব জায়গা থেকেই যখন রমণীর মাথায় ব্যর্থতা নেমে এসেছে এবং এই ব্যর্থতা এবং কুলনাশের জন্য ভীষ্মই দায়ী, তখন ভীষ্মকেই তার দায় নিতে হবে। পরশুরাম স্পষ্টাস্পষ্টি বিবাহের কথা বলছেন না, কিন্তু বার বার বলছেন– এঁকে তুমি গ্রহণ কর, কুলরক্ষা কর। এ রকমটি না হলে তোমার কিন্তু ভাল হবে না।

কুল রক্ষার মানেই তো বিয়ে করা। ভীষ্ম কি তা বোঝেন না? খুব বোঝেন, কিন্তু তিনি এই কথার ধারে কাছে গেলেন না। ভীষ্ম এ বার একটু শক্ত হলেন। বললেন, এমনটি হতে পারে না। আপনি শুধু শুধু এই বিষয়ে পরিশ্রম করবেন না। যে রমণী– একজনকে ভালবাসি বলে আমার ঘর ছেড়ে চলে গেল, সে রমণীকে সব জেনেশুনে কে তার নিজের ঘরে স্থান দেবে– বাসয়েৎ কো গৃহে জান স্ত্রীণাং দোষো মহাত্যয়ঃ। আপনি যদি তবু আমার কথা না শোনেন তবে আমাকে যুদ্ধই করতে হবে। কারণ আপনি আমার গুরু হওয়া সত্ত্বেও গুরুর মতো ব্যবহার করছেন না আমার সঙ্গে। অতএব আমি যুদ্ধই করব গুরুবৃত্তিং ন জানীষে তস্মাৎ যোৎস্যামি বৈ ত্বয়া।

সেকালের দিনে যুদ্ধ বাধবার বা বাধাবার একটা অনুক্রম ছিল। যুদ্ধ লাগবার আগে পরস্পর পরস্পরকে গালাগালি দিয়ে গা গরম করে নিতেন। ভীষ্ম এবং পরশুরামও সেই প্রক্রিয়া আরম্ভ করলেন। আমরা সেই সম্পূর্ণ আক্ষেপ-প্রতিক্ষেপের মধ্যে যাব না। তবে যেটুকু না বললে নয়, তা হল, আপনি কুরুক্ষেত্রের মুক্তভূমিতে আসুন। সেখানেই আমাদের যুদ্ধ হবে। ওই কুরুক্ষেত্রেই আমি পিতার শ্রাদ্ধ করে শুচিতা লাভ করেছিলাম, অতএব ওখানেই আপনাকে হত্যা করে পুনরায় শৌচলাভ করব আমি। মনে রাখবেন, এতদিন ধরে আপনি যে বড় ক্ষত্রিয়হন্তা বলে নাম কিনেছেন, তার কারণ আপনি ক্ষত্রিয় কাকে বলে। দেখেননি এবং ভীষ্মও তখন জন্মায়নি–ন তদা জাতবান ভীষ্মঃ ক্ষত্রিয়ো বাপি মদ্বিধঃ।

পরশুরাম উলটে বললেন, এটা তুমি ভালই বলেছ, যুদ্ধটা কুরুক্ষেত্রেই হোক। তার কারণ পাশ দিয়েই তো গঙ্গা বয়ে যাচ্ছেন, তিনি তোমার মা। আমি যখন শত-সহস্র শরক্ষেপে তোমাকে হত্যা করব, তখন অন্তত স্নেহময়ী জননী জাহ্নবী তোমাকে শেষ দেখাটা দেখতে পারবেন। অবশ্য যখন তিনি তোমায় দেখবেন, তখন তোমার দেহটি শেয়াল-শকুনে খাচ্ছে। তার কিছু দুঃখ হবে, কী আর করা যাবে– জাহ্নবী পশ্যতাং ভীষ্ম গৃধ্রু-কঙ্ক-বলাশন।

ভীষ্ম আর পরশুরামে বাগযুদ্ধ কিছুক্ষণ চলার পর দু’জনেই আসল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। সে এক ভীষণ যুদ্ধ, তেমন যুদ্ধ কোনও দিন কেউ দেখেনি। মহাভারতের পাঁচ ছয় অধ্যায় জুড়ে এই মহদযুদ্ধের বর্ণনা রয়েছে, এবং তাতেও এই দুই মহান যোদ্ধার যুদ্ধ অমীমাংসিত থেকে গেছে। পরশুরাম এবং ভীষ্ম যখন উভয়েই যুদ্ধে উন্মত্ত হয়ে উঠছেন, তখন দেবতা, ঋষি এবং শুভার্থী মানুষেরা একযোগে এসে মিনতি করলেন যুদ্ধ থামাবার জন্য। অনেক চেষ্টার পর যুদ্ধ থামল এবং পরশুরাম সকলের সামনে ভীষ্মের গৌরবের কথা বলতে লাগলেন। ভীষ্মও সবার সামনে গুরু পরশুরামের চরণবন্দনা করলেন ততোহহং রামমাসাদ্য ববলে তৃশবিক্ষতঃ।

পরশুরাম ভীষ্মকে বললেন– আমি পৃথিবীতে ঢের তের বীর দেখেছি। কিন্তু তোমার মতো এমন বীর আর দ্বিতীয় নেই ত্বৎসমমা নাস্তি লোকেহস্মিন ক্ষত্রিয়ঃ পৃথিবীচরঃ। পরশুরাম অম্বার কাছেও নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে বললেন, আমি আমার চেষ্টা কিছু কম করিনি, দুনিয়ার লোক দেখেছে– প্রত্যক্ষ মেতল্লোকানাম– আমি আমার প্রাণপণ চেষ্টা করেছি, কিন্তু ভীষ্মকে আমি যুদ্ধে হারাতে পারিনি। জানিস মা। আমার এইটুকুই ক্ষমতা, এইটুকুই আমার শক্তি। তুই এখন যেখানে ইচ্ছে যেতে পারিস, মা। আমি আর কী-ই বা করতে পারি। তবে আমার ধারণা, তুই ভীষ্মের কাছেই বরং আশ্রয় যাচনা করতে পারিস, এ ছাড়া আর তো কোনও উপায়ও আমি দেখছি না– ভীষ্মদেব প্রপদ্যস্ব ন তেহন্যা বিদ্যতে গতিঃ।

পরশুরাম সলজ্জে চুপ করলেন এবং অম্বা তার লজ্জা ভাঙিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি যা বললেন তা অত্যন্ত সত্যি। ভীষ্মকে যুদ্ধে বধ করার মতো শক্তি এই জগতে নেই। আপনি আমার জন্য যথেষ্ট করেছেন। ভীষ্ম যথেষ্ট শক্তিমান, যথেষ্ট ক্ষমতাশালী, এটা আমি বুঝেছি, কিন্তু তাই বলে আমার পক্ষে ভীষ্মের কাছে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়–ন চাহমেনং যাস্যামি পুনর্ভীষ্মং কথঞ্চন। বরং আমি সেইখানে যাব, যেখানে গেলে ভীষ্মকে আমি যুদ্ধে হত্যা করতে পারব।

অম্বাকে পরশুরাম অনেক বার এই কথাটা বলেছেন, তুমি ভীষ্মের কাছে ফিরে যাও। কথাটার মানে কী? অম্বা ভাবলেন– ভীষ্ম তো তাকে বিয়ে করবেন না, ভাই বিচিত্রবীর্যের সঙ্গেও তার বিয়ে দেবেন না। তাঁর নিজের দিক থেকেই ভীষ্মের ওপর যে কোনও দুর্বলতা। আছে, তাও তো নয়। যে দুর্বলতাটুকুও তার আছে, সেটা ভীষ্মের যুদ্ধ ক্ষমতার প্রতি। কিন্তু এই দুর্বলতা আপাতদৃষ্টে কোনও মধুর রসে পরিণতি লাভ করে না, কারণ ভীষ্মের কথা মনে হলেই তার বোধ হয়– ওই লোকটা তার জীবনের সর্বনাশ করে দিয়েছেন। তার কেবলই রাগ হয়, কেবলই প্রতিহিংসা বৃত্তি জেগে ওঠে। কিন্তু ভীষ্মের ওপরেই তার এই ক্রোধ কেন? এই বৃদ্ধপ্রায় ব্যক্তিটির জন্য এতটুকুও যদি তার সরসতা না থেকে থাকে, তা হলে বিপ্রতীপভাবে এতটা সবিকারী হয়ে ওঠা যায় কি?

ওদিকে ভীষ্মের দিক থেকে ব্যাপারটা দেখি। তিনি ক্রমশই অবাক হচ্ছেন। এমন একটি রমণী তিনি ভূমণ্ডলে দেখেননি। তাকে রাজসভা থেকে তুলে আনলেন, রাস্তায় এত শত যুদ্ধ হল, রমণী কিছুই বলল না। বিবাহের মুহূর্তে নিজের অন্যাভিলাষিতা ব্যক্ত করে সগর্বে চলে গেল। তারপর প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর থেকেই এই রমণী দিন রাত যেন তাকে শত্রুভাবে ভজনা করে যাচ্ছে। ভীষ্মের কাছে যাচনা করা নয়, সামান্য একটু বললেই তিনি এই রমণীর সারা জীবনের পরমাশ্রয় রচনা করে দিতে পারতেন। হয়তো বিবাহ করতেন না তিনি, কিন্তু হস্তিনাপুরের রাজসুখ থেকে তাকে বঞ্চিত করতেন না নিশ্চয়ই। কিন্তু না, এ রমণী তার কাছে কোনও ভিক্ষা চায় না। আজকে পরশুরামের মতো গুরুকে দিয়েও যখন তার ভীষ্ম-হত্যাব্রত সম্পূর্ণ হল না, তখনও তিনি অসীম ক্রোধে প্রতিজ্ঞা করে গেলেন– আমি বরং সেইখানে যাব, যেখানে গেলে ভীষ্মকে আমি যুদ্ধভূমিতে শুইয়ে দিতে পারি– সমরে পাতয়িষ্যামি স্বয়মেব ভৃগুহ।

.

০৪.

মনে রাখতে হবে, আমরা এখন অম্বার এই যে কাহিনি শুনছি তা পূর্বস্মৃতি হিসেবে শুনছি মহাভারতের উদ্যোগপর্বে, ভীষ্মের মুখে। ফলত অম্বার জীবনের বিচিত্র গতির সঙ্গে সঙ্গে ভীষ্মের প্রতিক্রিয়াও আমরা শুনতে পাব। অম্বা ভীষ্মকে বধ করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে বনে চলে গেলেন তপস্যা করতে তাপস্যে ধৃতসংকল্পা সা মে চিন্তয়তী বধম। ভীষ্ম বাড়িতে এসে জননী সত্যবতীকে সমস্ত ঘটনা নিবেদন করেই ক্ষান্ত হলেন না, তার ভীষণ চিন্তা রয়ে গেল অম্বার জন্য। এটা যে তার অবচেতনের কোনও সরসতা, তা আমাদের মনে হয় না; তবে যে মানুষকে পৃথিবীর কোনও শক্তি যুদ্ধে হারাতে পারে না, সেই মানুষটিকে বধ করার জন্য একজন রমণী তপসা আরম্ভ করলেন, এতে ভীষ্মের বিস্ময়ের অন্ত রইল না। ঘনিষ্ঠজনের কাছে তিনি বলেও ফেললেন, পৃথিবীতে এমন কোনও ক্ষত্রিয় বীর নেই, যে আমার সঙ্গে যুদ্ধে এঁটে উঠতে পারে। কিন্তু ব্রহ্মবিৎ অথবা তপস্যারত ব্যক্তির যে অলৌকিক শক্তি জন্মায়, তার সঙ্গে এঁটে ওঠে কার সাধ্য ঋতে ব্রহ্মবিদস্তাভ তপসা সংশিতব্রতাৎ।

ভীষ্ম ভয় পাননি নিশ্চয়ই। কিন্তু যখন এই অলোকসুন্দরী রমণী বনে চলে গেলেন, তখন তিনি বেশ কিছু দক্ষ গুপ্তচর নিয়োগ করলেন রমণীর উপর কড়া নজর রাখবার জন্য পুরুষাংশ্চাদিশং প্রাজ্ঞা কন্যাবৃত্তান্তকর্মণি। ভীষ্মের মতো মহাবীর এক রমণীর গতিপ্রকৃতির ওপর সদাসর্বদা জাগ্রত চর-চক্ষু নিক্ষেপ করে রেখেছেন– এটা কি শুধুই ভয়ে? ব্ৰহ্মতেজী বা তপস্বী জাতীয় মানুষেরা তা ভাবতেও বা পারেন, কিন্তু রসশাস্ত্রকারেরা, যারা জীবনের রস এবং রসাভাস নিয়ে ভাবনা করেন তারাও কি এই একই কথা বলবেন? অম্বার এই তপশ্চর্যার উদ্দেশ্য এবং তার চেষ্টার কথা ভীষ্ম নারদ এবং ব্যাসের কাছে নিবেদন করেছিলেন। তারা ভীষ্মের মন কী বুঝেছিলেন জানি না, তারা বলেছিলেন– কী আর করা যাবে? অম্বাকে নিয়ে তুমি দুঃখ কোরো না ভীষ্ম। দৈবকে কখনও পুরুষকার দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যায় না, অতএব তাঁকে নিয়ে আর দুঃখ কোরো না– ন বিষাদক্বয়া কাৰ্য্যো ভীষ্ম কাশীসুতাং প্রতি৷ এই দুঃখ কি শুধুই তিনি অম্বার হাতে মারা যেতে পারেন, এই ভয়ে? রসশাস্ত্রকারেরা কী বলবেন? যাই হোক, গুপ্তচরদের মুখে ভীষ্ম যে খবর পেয়েছেন, তা তিনি নিজেই জানিয়েছেন। জানিয়েছেন তার দুঃখকষ্ট এবং সংকল্পের কথা।

অম্বা কঠোর তপস্যা করছিলেন। যমুনার তীরে একটি আশ্রম বানিয়ে তিনি ভীষ্মবধের প্রতিজ্ঞায় তপস্যামগ্ন হলেন। খাওয়া নেই দাওয়া নেই, স্নান নেই, কাপড় বদলানো নেই, তিনি তপস্যা করে যাচ্ছেন– নিরাহারা কৃশা রুক্ষা জটিলা মলপঙ্কিনী। অম্বার আত্মীয়স্বজনরা যথাসাধ্য তাঁকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন, অম্বা শোনেননি। কঠোর তপস্যার শেষে তিনি তীর্থে তীর্থে ঘুরেও বেড়ালেন অনেক। তীর্থবাসী তপস্বীরাও তার এই কষ্টের জীবন দেখে মায়া করেছেন। তারা বলেছেন, ত্যাগ করো তোমার এই কষ্টব্রত। লোকালয়ে ফিরে যাও। অম্বা বলেছেন, আমি পরজন্মে স্বর্গ বা বৈকুণ্ঠে যাওয়ার জন্য এই তপস্যা করছি না– ন লোকাৰ্থং তপোধনাঃ। ভীষ্মকে যুদ্ধে হত্যা করে তবেই আমার শান্তি। তার জন্যই এই কষ্টের মধ্যে আমি নিক্ষিপ্ত হয়েছি। মেয়ে হয়ে জন্মেও আমি কোনও স্বামীসুখ পেলাম না। আমার অবস্থা হয়েছে একটি ক্লীবের মতো নৈব স্ত্রী ন পুমানিহ। জেনে রাখবেন– আমি ভীষ্মকে না মেরে ছাড়ব না। স্ত্রীলোকের হাব-ভাব স্বভাব আর আমার ভাল লাগে না, আমি পুরুষ হতে চাই– স্ত্রীভাবে পরিনির্বিগ্না পুংস্তুর্থে কৃতনিশ্চয়।

মহাভারতের বিশাল বিচিত্র কাহিনির অন্তরে অম্বা যেভাবে একদিন শিখণ্ডী হয়ে যাবেন, তার মধ্যে তার তপস্যা, মহাদেবের কাছ থেকে বরলাভ এবং যক্ষ স্কুণাকর্ণের উপাখ্যান এসে এক অদ্ভুত জটিলতা এবং অলৌকিকতা তৈরি করবে। কিন্তু অম্বা থেকে শিখণ্ডীতে রূপান্তরের মধ্যে যে কথ্যগুলি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বলে আমাদের মনে হয়, তা হল–উপরিউক্ত দুঃখের কথাগুলি, যা অম্বা তপস্বীদের জানিয়েছেন। অম্বা বলেছেন, আমি যেন স্ত্রীও নই পুরুষও নই– নৈব স্ত্রী ন পুমানিহ ভীষ্মের কারণে অম্বার এই দুঃখখাচ্ছাসই আমাদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এক তথ্য।

মনে রাখতে হবে, অম্বা কিন্তু এখনও শিখণ্ডীতে পরিণত হননি। অম্বা শুধু নিজের করুণ অবস্থা বর্ণনা করেছেন মাত্র। তিনি বলেছেন, ভীষ্মই আমাকে সমস্ত বঞ্চনা করেছেন, তাঁর জন্যই আজকে আমি সমস্ত স্বামীসুখ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। ভীষ্ম একদিন তাকে রাজসভা থেকে হরণ করে এনেছিলেন বলেই তার জীবনে এক বিরাট বিড়ম্বনা নেমে এসেছে, তিনি যেন আর স্ত্রীও নন, পুরুষও নন। স্ত্রী নন এই কারণে যে, স্বামীর ঘর, গার্হস্থ্যজীবন তার কপালে জুটল না। আবার পুরুষও নন এই কারণে যে, একজন পুরুষ যেমন তার বলে, শক্তিতে, স্বাধিকারে নিজের প্রাপ্য বস্তু অধিকার করে এবং অধিকার করতে না পারলে ধ্বংস করে, অম্বা তা করতে পারছেন না বলেই তিনি যেন পুরুষও নন। অম্বার নপুংসকত্ব এইখানেই নৈব স্ত্রী ন পুমানিহ।

স্বামী-সংসার যে রাজকুমারীর কাছে অপ্রাপ্য রয়ে গেল, রাজার ঘরে জন্মেছেন বলেই সেই রাজকুমারী জানেন যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের অধিকারটুকু পেলেই তার আর দুঃখ থাকবে না। অন্তত পুরুষ হলে আজকে এত লোক তাকে করুণা করত না অন্তত। অম্বা ধারণা করেছেন, শুধুমাত্র পুরুষ মানুষ হওয়ার সুবিধে পেয়েই ভীষ্ম তাকে চরম অপমান করেছেন এবং এইজন্যই নারী-জন্মে তাঁর ঘেন্না ধরে গেছে। এখন তিনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটি সার্থক পুরুষ হতে চান স্ত্রীভাবে পরিনির্বিন্না পুংস্ত্বার্থে কৃতনিশ্চয়।

মহাভারতের বর্ণনায় এরপর যা দেখব, তা হল, অম্বা ভগবান মহাদেবের কাছ থেকে। বরলাভ করছেন। মহাদেব তাকে পুরুষ হওয়ার বর দিয়েছেন, কিন্তু কীভাবে কোন জন্মে, কেমন করে এই পুরুষত্ব তার জীবনে নেমে আসবে, সে কথা এখানে খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। অন্য দিকে, ঠিক এখন থেকেই লক্ষ রাখতে হবে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের দিকে। কারণ তিনিও ওই একই মহাদেবের কাছে পুত্রলাভের বর পেয়েছেন। দ্রুপদকে যিনি অপমান করে তার রাজ্য কেড়ে নিয়েছিলেন, সেই দ্রোণাচার্যকে অস্ত্রগুরু হিসেবে রাজ্যে আশ্রয় দিয়েছিলেন প্রধানত ভীষ্ম। কৌরব-পাণ্ডবদের শিক্ষাশেষে দ্রোণাচার্য তার প্রিয় শিষ্য অর্জুনের মাধ্যমে দ্রুপদকে জয় করেন এবং তার রাজ্য কেড়ে নেন। অতএব দ্রোণাচার্যের সঙ্গে তার আশ্রয়দাতা ভীষ্মও দ্রুপদের পরম শত্রুতে পরিণত হয়েছেন। অতএব ভীষ্মের ওপর প্রতিশোধ-স্পৃহায় দ্রুপদ মহাদেবের কাছে বর চেয়েছিলেন– ভগবান পুত্ৰমিচ্ছামি ভীষ্মং প্রতিচিকীর্ষয়া।

আমরা জানি, অম্বার পুরুষত্বের পরিণতির উৎস হল মহাদেবের এই দুটি বর। কিন্তু বরলাভের অলৌকিকতার মধ্যে না গেলে অম্বা থেকে শিখণ্ডীর পরিণতি কিন্তু যথেষ্ট লোকগ্রাহ্যভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় এবং সে ব্যাখ্যা বেরিয়ে আসবে ওই বরদানের তথ্য থেকেই। লক্ষ করে দেখুন, মহাদেব দ্রুপদকে বর দিয়েছিলেন– তোমার প্রথমে একটি কন্যা হবে এবং সে-ই ভবিষ্যতে পুরুষত্ব লাভ করবে– কন্যা ভূত্ব পুমান্ ভাবী– অর্থাৎ এক্কেবারে আক্ষরিক অর্থে এই শ্লোকের মানে হল– মেয়ে হয়েই সে পুরুষ হবে।

এবারে দেখুন, দ্রুপদপত্নী যখন সন্তান লাভ করলেন, তখন তিনি পরম রূপবতী এক কন্যাই লাভ করেছেন– কন্যাং পরমরূপাঞ্চ প্রাজায়ত নরাধিপ। কিন্তু কী আশ্চর্য, এতদিন সন্তানহীন অবস্থায় থেকেও আজ যে রমণী সুন্দরী একটি কন্যা লাভ করলেন, তিনি কিন্তু তাঁকে কন্যা বলে প্রচার করলেন না। মহাভারতের কবি লিখেছেন– দ্রুপদের বুদ্ধিমতী মহিষীটি তার প্রথমজন্মা কন্যাটিকে পুত্র বলে সর্বত্র প্রচার করলেন– দ্রুপদস্য মনস্বিনী। খ্যাপয়ামাস… পুত্রো হেষ মমেতি বৈ। অন্যদিকে দ্রুপদও তার কন্যাটির স্বরূপ-লক্ষণ চেপে গিয়ে সেকালের সামাজিক বিধান অনুসারে একটি পুত্রের উপযুক্ত স্মার্ত প্রক্রিয়াগুলি যথাযথভাবে সম্পন্ন করলেন।

ঠিক এইখানেই আমাদের একটি বিশেষ ধারণার কথা বলে নিতে হবে। আপনাদের খেয়াল আছে কি- মহর্ষি শৈখাবত্যের আশ্রমে হঠাৎ যে আপনারা রাজর্ষি হোত্ৰবাহনকে আসতে দেখলেন, তিনি সৃঞ্জয় বংশের অধস্তন পুরুষ। রাজর্ষি হোত্ৰবাহন কাশীরাজের শ্বশুর এবং অম্বা তার মেয়ের ঘরের নাতনি। তিনিই প্রথম অম্বাকে তার দুঃখ দূর করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। অন্য দিকে নিজের প্রভাবেই তিনি তৎকালীন দিনের ক্ষত্রিয়হন্তা বীর পরশুরামের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দেন অম্বার। হয়তো তাতে কিছু হয়নি। কিন্তু রাজর্ষি হোত্ৰবাহন অম্বাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে মনে হয় না। যখন অম্বার সঙ্গে হোত্ৰবাহনের প্রথম দেখা হয়, তখন তিনি অম্বাকে আশ্রয় দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন-ময়ি বর্তস্ব পুত্রিকে।

এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল– বেদে, ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিতে এবং মহাভারতের সর্বত্র মহারাজ সৃঞ্জয় পাঞ্চালদের পূর্বপুরুষ বলে পরিচিত। শুধু তাই নয়, সৃঞ্জয় মহারাজ এমনই এক বিখ্যাত পুরুষ ছিলেন যে পাঞ্চাল শব্দের পরিবর্তেও সৃঞ্জয় শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে মহাভারতে। দ্রুপদ-পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকেও সৃঞ্জয়দের অন্যতম বলেই গণ্য করা হয়েছে। মহাভারতে যেখানে সৃঞ্জয় শব্দটি পাঞ্চালদের পরিবর্ত শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি, সেখানেও সৃঞ্জয়দের নাম উচ্চারিত হয়েছে পাঞ্চালদের সঙ্গে পাঞ্চালাঃ সৃঞ্জয়ৈঃ সহ। বস্তুত মহারাজ সৃঞ্জয়ের নামেই গোটা পাঞ্চাল-রাজবংশ কখনও কখনও নামাঙ্কিত হয়েছে। রাজর্ষি হোত্ৰবাহন সৃঞ্জয় বংশের লোক বলেই, অপিচ সৃঞ্জয়রা পাঞ্চালদের সঙ্গে একাত্মক বলেই আমাদের ধারণা হয়– রাজর্ষি সৃঞ্জয় হোত্ৰবাহন শেষ পর্যন্ত অম্বাকে সমর্পণ করেন পাঞ্চাল দ্রুপদের হাতে। শুধু অপুত্রক বলেই নয়, ভীষ্মের ওপর প্রতিশোধস্পৃহাটা যেহেতু অম্বা এবং দ্রুপদের সাধারণ ধর্ম, তাই অম্বাকে দ্রুপদের ঘরেই নিয়ে আসা হয়।

অম্বার পুরুষত্বলাভের তপশ্চর্যায় আমরা অবিশ্বাস করি না। কিন্তু এই তপস্যা ধর্মবাসনায় প্রণোদিত কি না, সে বিষয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। মহাভারতের কবি যে কবিতা-কল্পনা লতা’ লতিয়ে দিয়েছেন অম্বার জীবন উপাখ্যানের সঙ্গে, তাতে স্পষ্টতই আমাদের ধারণা প্রমাণ করা কঠিন হবে। কিন্তু এও তো ঠিক অম্বা নিজমুখেই বলেছেন, আমি ভবিষ্যতের কোনও পারলৌকিক আশায় এই তপস্যা করছি না, করছি ভীষ্মবধের প্রতিজ্ঞায়। আমরা বিশেষভাবে মনে করি, অম্বা অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করছিলেন। একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে এই বিদ্যাশিক্ষার যন্ত্রণা প্রায় দুঃসহ বলেই শেষ পর্যন্ত সবার কাছে তাকে বারণ শুনতে হয়েছে। হয়তো এই বিদ্যাশিক্ষার যন্ত্রণায় এবং বনে বনে তীর্থে তীর্থে ঘুরে ঘুরে তার শরীরের রমণীয়তাও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল এবং হয়তো সেইজন্যই অস্ত্রচর্চার প্রশিক্ষণের মধ্যেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়েছিল– আমি স্ত্রীও নই পুরুষও নই।

অন্য দিকে আরও একটা কথা এখানে বিচার করতে হবে। সেটা হল, মহাদেবের বরের প্রতি যদি দ্রুপদরাজার এতই শ্রদ্ধা থাকে তা হলে তার সদ্যপ্রাপ্ত কন্যাটি নিয়ে এত ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় কেন? দ্রুপদ-মহিষীরই বা অত বুদ্ধিমত্তা ফলিয়ে কন্যাটিকে পুত্র বলে প্রচার করার কী দরকার ছিল, কারণ তিনিও তো জানতেন মহাদেবের বরে প্রথমে তার কন্যাই হবে। মহাভারতের কবি যতই কবিত্ব করুন, তিনি সময়মতো আমাদের হাতে তথ্য দিয়ে দেন, যাতে আমরা সত্য সিদ্ধান্ত রচনা করতে পারি। তিনি শব্দের চাতুর্যে অঙ্গুলিসংকেত করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, মহাদেবের বর থাকা সত্ত্বেও দ্রুপদের রাজবাড়িতে এই চাপাচাপি– রক্ষণঞ্চৈব মন্ত্রস্য– স্বাভাবিক নয় যেন। পাঞ্চাল নগরের প্রত্যেকটি লোকের কাছে দ্রুপদ তার কন্যার স্বরূপ লুকিয়ে রেখে প্রচার করলেন যে, তার পুত্রই হয়েছে– ছাদয়ামাস তাং কন্যাং পুমানিতি চ সোহব্রবীৎ। অন্য দিকে ভীষ্মের কথাটাও ধরুন; তিনি প্রতিনিয়ত গুপ্তচরের মাধ্যমে অম্বার খোঁজখবর রাখছিলেন নিজেরই প্রয়োজনে, নিজেরই তাড়নায়। সেই তিনি যখন জীবনের শেষ কল্পের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে অম্বার কাহিনি বিবৃত করছেন, তখন তিনি যেন কেমন হতভম্ব হয়ে বলছেন, আমি কিন্তু গুপ্তচরের সংবাদ, নারদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং অম্বার তপস্যার নিরিখে এই কথাই জানতাম যে, দ্রুপদের বাড়ির মেয়েটি একটি সম্পূর্ণ মেয়েই বটে– অহমেকন্তু চারেণ বচনান্নারদস্য চ। জ্ঞাতবান…।

অম্বার জীবন-পরিণতিতে আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, মহারাজ দ্রুপদ তার মেয়েটির লোকশিক্ষা এবং শিল্পশিক্ষার ব্যবস্থা করে শেষমেষ তাকে ধনুর্বিদ্যা শিখবার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দ্রোণাচার্যের কাছে। অম্বা, দ্রুপদের সম্প্রচারে যার নাম এখন শিখণ্ডী, তিনি দ্রোণাচার্যের কাছেই অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছেন–ইম্বস্ত্রে চৈব রাজেন্দ্র দ্রোণশিষ্যো বভূব হ। সেকালের দিনে এমনটিই হত। পিতার সঙ্গে শত্রুতা আছে বলে তার পুত্রকে বিদ্যাশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করব, এমন রীতি গুরুদের ধর্মে সইত না।

মনে রাখা দরকার, মহাভারতের উপাখ্যানে এখনও কিন্তু সেই আলৌকিকতা আসেনি, যাতে বলা যাবে, অম্বা কন্যাত্ব থেকে পুরুষত্ব লাভ করেছেন। দ্রুপদ-দম্পতি এখনও তাদের মেয়েটিকে ছেলে বলে চালাতে পারছেন এবং দ্রোণাচার্যও নিজের অজ্ঞাতসারে একটি ছেলে-সাজা মেয়েকে অস্ত্রশিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন।

একটি মেয়েকে ছেলে সাজিয়ে প্রচার এবং ব্যবহার করার চরম বিড়ম্বনা নেমে এল তখনই, যখন দ্রুপদ শিখণ্ডীর বিবাহ দিতে চাইলেন। পাঞ্চাল দেশের রাজা বলে কথা, দ্রুপদের পাত্রী পেতে অসুবিধে হল না। দশার্ণ দেশের রাজা হিরণ্যবর্মা তার মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হলেন শিখণ্ডীর সঙ্গে। কিন্তু বিয়ে যখন হয়ে গেল, তখন দশার্ণ-রাজার মেয়ে শিখণ্ডীকে স্ত্রীচিহ্নধারিণী শিখণ্ডিনী বলেই চিনলেন– হিরণ্যবর্মণঃ কন্যা জ্ঞাত্ব তাঃ তং শিখণ্ডিনীম। মহাভারতের কবিও এখানে শিখণ্ডীকে শিখণ্ডিনী বলেছেন। দেখুন, এখনও এই যুবক-বয়স, থুড়ি যুবতী-বয়স পর্যন্তও কিন্তু শিখণ্ডী মেয়েই আছেন। অবশ্য বয়সটা যুবতীর শেষ সীমাতেই ধরে নেওয়া ভাল, কারণ আমাদের মতে তিনি অম্বা। এই যে দশার্ণ রাজকন্যার সঙ্গে শিখণ্ডীর তথাকথিত বিবাহ হল, এই বিবাহের পর্ব থেকেই অম্বা-শিখণ্ডীর জীবনে যত গোলমাল শুরু হল, মহাভারতের কবিও তার উপাখ্যান জমাতে আরম্ভ করলেন এই সময় থেকেই।

দশার্ণরাজ হিরণ্যবর্মা দ্রুপদের বিরুদ্ধে তঞ্চকতার অভিযোগ এনে তার রাজ্য জয় করবেন বলে ঠিক করলেন। বিপন্ন দ্রুপদ এই আক্রান্ত হওয়ার মুখে কারও ওপরেই রাগ করতে না পেরে নিজের স্ত্রীর ওপরেই খানিকটা হম্বিতম্বি করলেন– এই তো, আগেই বলেছিলাম, এমন লুকোছাপা কোরো না, এখন হল? ইত্যাদি। দ্রুপদ এবং দ্রপদপত্নীর এই বিড়ম্বনা দেখে শিখণ্ডিনী নিজেই তার বাবামায়ের মুখরক্ষার ভার নিলেন। তিনি গৃহত্যাগ করে চলে গেলেন বনে। বলতে বাধা নেই, তথাকথিত শিখণ্ডিনীর এই ব্যবহারও তার অন্তরশায়িনী অম্বার চরিত্রের সঙ্গে মেলে।

মহাভারতের কাহিনিতে যা দেখি, তাতে এক নিবিড় বনের মধ্যে যক্ষ স্থূণাকর্ণের সঙ্গে শিখণ্ডিনীর দেখা হয়। চিন্তায় দুঃখে শুষ্ক শরীর, ক্ষতহৃদয়া শিখণ্ডিনীকে দেখে যক্ষ স্থণাকর্ণের মায়া হল। স্থূণাকর্ণের কিছু দৈবী ক্ষমতা আছে। সে বলল, আমি তোমাকে কিছুকালের জন্য আমার পুংচিহ্ন দান করব এবং তোমার স্ত্রীচিহ্ন ধারণ করব আমি। কিছুকাল এইভাবে চলুক। তারপর সময় হলে তুমি এবং আমি আবার লিঙ্গ-বিনিময় করে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাব। অতএব কিছুকালের জন্য তুমি আমার পুংচিহ্ন ধার পেতে পার– কিঞ্চিৎ কালান্তরং দাস্যে পুংলিঙ্গং স্বমিদং তব।

বেদ থেকে আরম্ভ করে মহাভারতের কাল পর্যন্ত আমরা কোনও লিঙ্গ-প্রতিস্থাপনের ঘটনা জানি না। শুধুমাত্র শিখণ্ডিনী-স্কুণাকর্ণের উদাহরণে লিঙ্গ-প্রতিস্থাপনের পরিণত শল্যবিদ্যার পদ্ধতি সেকালের দিনের নিরিখে স্বীকার করে নেওয়া কঠিন। এ ছাড়াও অম্বা এবং দ্রুপদের প্রতি মহাদেবের বর, শিখণ্ডিনীর স্বীকৃত কন্যাত্ব, দশার্ণ রাজার মেয়ের সঙ্গে শিখণ্ডিনীর বিবাহ এবং শেষ পর্যন্ত স্কুণাকর্ণের সঙ্গে লিঙ্গ বিনিময়ের ঘটনা– এইসব কিছুর মধ্যেই যে অলৌকিকতাটুকু আছে, সেটা বাদ দিয়েও কিন্তু শিখণ্ডীর জীবন ব্যাখ্যা করতে আমাদের অসুবিধে হয় না এবং সে ব্যাখ্যায় মহাভারতের কবিতথ্যই আমাদের সহায় হয়েছে।

বস্তুত অম্বা যে মহাদেবের বরলাভের পূর্বেই বলেছিলেন, আমি যেন কেমন হয়ে গেছি। আমি যেন স্ত্রীও নই পুরুষও নই– এই ভাবটুকুর মধ্যেই শিখণ্ডীর নপুংসকত্ব লুকিয়ে আছে। আসলে অম্বার পুরুষত্ব-লাভের পর্যবসান পুংলিঙ্গ-লাভে নয়, পুরুষের যোগ্য বিদ্যালাভে, পুরুষের যোগ্য ক্ষমতালাভে। অম্বা যে এতকাল তপস্যা করেছেন, সে তপস্যাও পুরুষসুলভ অস্ত্রশিক্ষা ছাড়া আর কিছুই নয়।

আগে বলেছি, সৃঞ্জয় রাজর্ষি হোত্ৰবাহন অম্বাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, তোর কোনও চিন্তা নেই, মা! আমি তোর সমস্ত দুঃখ দূর করব, তুই মা, আমার কাছেই থাকবি– দুঃখং ছিলাম্যহং তে বৈ ময়ি বর্তস্ব পুত্রিকে। হোত্ৰবাহন অম্বাকে নিজের হাতে না রেখে স্বগোত্রীয় আত্মীয় অপুত্রক দ্রুপদের হাতেই তুলে দিয়েছিলেন। কারণ এঁদের দু’জনেরই সাধারণ শত্রু হলেন ভীষ্ম। অম্বাকে রীতিমতো বয়স্থ অবস্থায় পেয়েছিলেন বলে এবং আপন তপস্যার গুণে অম্বা অস্ত্রবিদ্যা লাভ করেছিলেন বলেই দ্রুপদ তাকে পুরুষ বলে প্রচার করার সুযোগ পেয়েছিলেন।

মহাভারত জানিয়েছে– তপস্যার সিদ্ধিতে অম্বা যখন মহাদেবের কাছে বরলাভ করলেন, তখন তিনি অগ্নিতে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। এর পরেই তিনি দ্রুপদের মেয়ে হয়ে জন্মান। আমাদের দৃষ্টিতে এই আত্মাহুতি অম্বার স্ত্রী-স্বভাবের অন্ত সূচনা করে। তিনি নিজেই বলেছেন, স্ত্রীভাবে তার ঘেন্না ধরে গেছে, তিনি পুরুষত্ব চান। এই আত্মাহুতির রূপক তার জীবনে স্ত্রী-স্বভাবের সমাধিমাত্র। এর পরেই–’পুরুষের বিদ্যা করেছিনু শিক্ষা। মহাদেবের কাছ থেকে বরলাভ করার পর, অথবা বলা উচিত পুরুষের বিদ্যাশিক্ষার পর থেকেই অম্বা পুরুষসুলভ আচরণ শুরু করেন এবং সেই হোত্ৰবাহনের চেষ্টায় অপুত্রক দ্রুপদের ঘরে পুরুষের মতোই মানুষ হতে থাকেন। ভীষ্মও তার বিশ্বস্ত গুপ্তচরদের কাছে খবর পেয়েছেন যে, শিখণ্ডী আসলে একটি রমণী। ধৃষ্ট্যদুন্ন তথা কৌরব-পাণ্ডবদের সঙ্গে শিখণ্ডী যখন দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেন, তখনও তিনি স্ত্রী, অন্তত ভীষ্ম তাই বলেছেন– শিখণ্ডিনং মহারাজ পুত্রং স্ত্রীপূর্বিনং তথা।

পরবর্তী সময়ে দেখব, শিখণ্ডী এতটাই অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছেন যে মহামতি ভীষ্মের মতো যোদ্ধাও তাকে ‘রথমুখ্য অর্থাৎ মহাবীর যোদ্ধাদের অন্যতম বলে স্বীকার করেছেন। কিন্তু যত বড় যোদ্ধাই তিনি হোন না কেন শিখণ্ডী যে আদতে স্ত্রীলোক অথবা তিনি অম্বাই, সে কথাও ভীষ্মের অজানা ছিল না। দ্রুপদ তার কন্যাটিকে যেভাবে মানুষ করেছিলেন, তার মধ্যে রীতিমতো এক কুটিল বুদ্ধি কাজ করেছে। তার কন্যাটি যেহেতু ভীষ্মবধের প্রতিজ্ঞা নিয়েই অস্ত্রবিদ্যা আয়ত্ত করেছেন, এবং যেহেতু সে রমণী তার আপন স্ত্রীত্বকেই ঘৃণা করছেন, সেই রমণীকে তিনি পুরুষ-প্রচারে মানুষ করেছেন এই কারণেই যে, অস্ত্রশিক্ষায় শিক্ষিত শিখণ্ডী পুরুষের যে সুবিধাটুকু ভোগ করছে করুক, উপরন্তু ভীষ্মবধের সময় স্ত্রীত্বের সুবিধেটুকু সে যেমন পাবে, তেমনই দ্রুপদও।

স্ত্রীলোক হওয়া সত্ত্বেও শিখণ্ডী যে পুরুষ সেজে থাকতেন, সে কথা ভীষ্মের মন্তব্য থেকেই আরও পরিষ্কার হয়ে যায়। উদ্যোগ পর্বে অম্বা-শিখণ্ডীর জীবন-পরিণতির কথা বলতে বলতে ভীষ্ম বলেছেন, এই হল আমার চিরকালের নীতি– আমি কোনওদিন তার ওপরে অস্ত্র নিক্ষেপ করি না যে একজন স্ত্রী। কোনও পুরুষ যে আগে স্ত্রী ছিল, তার ওপরেও আমি অস্ত্ৰক্ষেপ করি না। যে পুরুষকে একজন স্ত্রীর নামে ডাকা হয়, তাকেও আমি কোনও বাণাঘাত করি না। আর যে পুরুষের মতো সাজে অথচ স্বরূপত যে স্ত্রীলোক, তার গায়েও। আমি শরনিক্ষেপ করি না– স্ক্রিয়াং স্ত্রীপূর্বকে চৈব স্ত্রীনামি স্ত্রীস্বরূপিণী।

ভীষ্মের এই চতুর্বিকল্পক স্ত্রীত্বের সব কটিই কিন্তু অম্বা-শিখণ্ডীর দিকে অঙ্গুলিসংকেত করে। ভীষ্ম জানেন, অম্বা আদতে কাশীরাজের কন্যা–জ্যেষ্ঠা কাশীপতেঃ কন্যা। যিনি দ্রুপদের ঘরে শিখণ্ডী নামে পরিচিত হয়েছেন, তিনি পূর্বে এক রমণী ছিলেন– দ্রুপদস্য কুলে জাতা শিখণ্ডী ভরতভ। এই পংক্তিতে শিখণ্ডী পুরুষ হলেও তার জন্মের ব্যাপারে স্ত্রীলিঙ্গ ব্যবহার করা হয়েছে– কুলে জাতা। এই গেল দ্বিতীয় বিকল্প। তৃতীয় বিকল্প কোনও স্ত্রী নাম। শিখণ্ডীর আসল নাম অম্বা কিন্তু দ্রুপদের ঘরে আসার পরে তার নাম পালটে গেলেও তাকে শিখণ্ডিনীও বলা হয়েছে অনেক বার। চতুর্থ বিকল্প হল– স্ত্রীস্বরূপিণী। অর্থাৎ যে স্বরূপত স্ত্রী কিন্তু পুরুষের মতো সাজে বা পুরুষের মতো ব্যবহার করে। ভীষ্ম দ্রুপদের ঘরে জন্মানো ছেলেটিকে স্ত্রী বলেই জানতেন, এখন তিনি হয়তো পুরুষের ব্যবহারে অস্ত্রধারণ করেন কিন্তু স্বরূপত তাকে অম্বা বলেই জানেন ভীষ্ম।

শিখণ্ডী যদি পুরুষের বিদ্যা শিখে পুরুষের মতো ব্যবহার না করতেন, তা হলে ভীষ্ম তার চতুর্বিধ বিকল্পের দুটি মাত্র বলতেন– স্ত্রী এবং নপুংসকই তার অস্ত্র-স্তম্ভনের কারণ ঘটাত শুধু। কিন্তু শিখণ্ডীই যেহেতু পূর্বের অম্বা ভীষ্মকে তাই আরও দুটি বিকল্প জুড়তে হয়েছে– স্ত্রীনাম এবং স্ত্রীস্বরূপ। অন্য সময়ে দেখব, ভীষ্ম অনেক সময়েই শিখণ্ডীকে নপুংসক বলে উল্লেখ না করে শুধু স্ত্রীলোক বলেই উল্লেখ করেছেন। শিখণ্ডীর নপুংসকত্ব তাই লিঙ্গকেন্দ্রিক নয়, এই নপুংসকত্ব হল স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও পুরুষ-স্বভাবের মিশ্রচারিতায়। ভীষ্ম এই মিশ্রচারিতাকেই ঘৃণা করেন।

অর্জুন যে দিন অম্বা-শিখণ্ডীকে রথের পুরোভাগে রেখে পিছন থেকে বাণ বর্ষণ করেছিলেন ভীষ্মের ওপর, সে দিন শিখণ্ডীর অস্ত্রবিদ্যার পরিচয় আমরা কিছু পাইনি, সে বিদ্যার প্রয়োজনও সে দিন হয়নি। ভীষ্ম তাকে দেখেই ধনুঃশর নামিয়ে রেখেছিলেন। সামনে মূর্তিমতী সেই পুরুষবিধা রমণী, যাকে একদিন হাত ধরে রথে চড়িয়েছিলেন, যাঁকে হরণ করে নিয়ে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছিলেন একরথে– কাশী থেকে হস্তিনাপুর। পথে কত নদ-নদী পাহাড় পড়েছে, পড়েছে কত বন-অরণ্যানী। তখন এক বারের তরেও যাঁর দিকে তাকাবার অবসর পাননি ভীষ্ম, যার জন্য রাজসভা থেকে আরম্ভ করে পথ চলাকালীন যুদ্ধ করতে করতে ফিরেছিলেন তিনি, আজ এই অন্তিম বয়সে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়েই পরম বীর তার সমস্ত অস্ত্রভার মুক্ত করলেন। সে দিন যাঁকে জোর করে ধরে নিয়ে এসেছিলেন, আজ তারই জীবনের সমস্ত কষ্টের জন্য তিনি যেন প্রায়শ্চিত্ত করলেন কোনও বাধা না দিয়ে, কোনও জোর না খাঁটিয়ে। অম্বা-শিখণ্ডিনীর দিকে একবার তাকিয়ে সেই যে তিনি নির্বিরোধে নিশ্চেষ্ট হয়ে রইলেন রথের উপর, সেই তার পূর্বকৃত্য হতে পারত। কেননা, সে দিন অম্বাকে প্রীতিমতী হয়ে ভীষ্মের সঙ্গে যেতে দেখেছিলেন শাম্বরাজ। সে দিন সেই প্রীতি-প্রণয়ে মন দিতে পারেননি বলেই আজ যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে ভীষ্মকে শেষ শুভদৃষ্টি দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হল অম্বার কাছে, শিখণ্ডীর কাছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *