০৪. সত্যবতী

০৪. সত্যবতী

০১.

সময়ের হিসেবে এখন থেকে প্রায় পাঁচ কিংবা ছয় হাজার বছর আগেকার কথা। বাহদ্রথ জরাসন্ধ তখন কেবলই মগধ রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। পূর্ব ভারতে কৌরব-বংশধারার শেষ বীজ তখন কেবলই উপ্ত হয়েছে মাত্র। হস্তিনাপুরের যুবরাজ শান্তনুর সঙ্গে নদীনায়িকা গঙ্গার চঞ্চল এবং অসফল মিলন কেবলই শেষ হয়েছে।

আনুমানিক ঠিক এই সময়ে আধুনিক মিরাটের পশ্চিম দিকে যেখানে যমুনা নদী বয়ে যাচ্ছে, সেই যমুনার তির ঘেঁষে একটি নৌকো দাঁড়িয়েছিল। নৌকোটি আকারে খুব বড় নয়, চার-পাঁচ আরোহী তাতে স্বচ্ছন্দে ভ্রমণ করতে পারে, আর আজ থেকে পাঁচ-ছ’হাজার বছর আগে আরোহীর সংখ্যা বেশি হবারও কথা নয়। নৌকোটি খুব বড় নয় বলেই হাওয়ায় সে নৌকো যাতে ভেসে চলে না যায়, তার জন্য একগাছি শুষ্ক-লতার রঞ্জু নৌকোর প্রান্তভাগে আটকানো লৌহ বলয়ের সঙ্গে বেঁধে রজ্জ্বর অন্য প্রান্ত তীরভূমিতে একটি খুঁটির সঙ্গে বাঁধা আছে।

নৌকোটি জলের ওপর ভাসছিল। নীল যমুনার কৃষ্ণবর্ণ জলতরঙ্গগুলি ছলাৎ ছলাৎ করে তিরভূমির ওপরে ঈষদুচ্চকিত শব্দে আছড়ে পড়ছিল। নৌকোর তলদেশেও সেই তরঙ্গমালার অভিঘাত টের পাওয়া যাচ্ছিল, যদিও তা শব্দে নয়, নৌকোর ঈষদীষৎ দুলুনিতে। নৌকোর হালের পিছনে, নৌকোর উপরি-প্রান্তভাগে এক উদ্ভিন্নযৌবনা রমণীকে আমরা বসে থাকতে দেখছি। যমুনার মতোই ঘননীল তার দৃষ্টিটুকু সুদূর অরণ্যবাহী পথের দিকে প্রসারিত। সে অপেক্ষা করছে বোঝা যায়, কারও জন্য সে নির্জন জলপ্রান্তে অপেক্ষা করছে, কিন্তু এ অপেক্ষা যে কোনও প্রাণপ্রিয় প্রণয়ীর মিলনাপেক্ষা নয়, সেটা তার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যায়। এ অপেক্ষা নিছকই এক অপেক্ষা, নিতান্তই প্রয়োজনে।

রমণী অতিশয় সুন্দরী। কিন্তু যে অর্থে সেই সেকালে এবং একালে রমণীর সৌন্দৰ্য্য বিচার করা হয়, সেই অর্থে কেউ তাকে সুন্দরী বলবেন না। কারণ এই রমণীর শরীরে গৌরবর্ণের আভাসমাত্রও নেই। রমণী ঘন কৃষ্ণবর্ণা, এবং লোকে তাকে আদর করে কালী বলে ডাকে। কিন্তু মানুষের সাধারণ সৌন্দৰ্য-ভাবনার মধ্যে থেকে যদি গৌরীয় দুর্বলতাটুকু হেঁটে ফেলা যায়, তবে এই কৃষ্ণবর্ণা রমণীর দিকে একবার চক্ষুমাত্র নিবেশ করলে মানুষের সমস্ত ইন্দ্রিয়বৃত্তি এমনই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে যে, সে স্বীকার করে বসবে– সৌন্দৰ্য-ভাবনায় গৌরবর্ণের পূর্বাবেশ একেবারেই মূল্যহীন।

এখনও সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসেনি। সবেমাত্র গোধূলির আলো ছড়িয়ে পড়েছে নীল যমুনা জলের ওপর, সবুজ বনভূমির ওপর, বনমধ্যবর্তী সর্পিল পথের ওপর এবং অবশ্যই পূর্বোক্ত রমণীর চিক্কণ-কৃষ্ণ শরীরের ওপর। আসন্ন সন্ধ্যারাগে উদ্ভাসিত দিগন্তের মধ্যে নৌকার প্রান্তদেশে নিষগ্না কৃষ্ণবর্ণা এই রমণী চিত্রার্পিত মূর্তির মতো একা বসেছিল। তার ঘন কৃষ্ণ কেশরাশি মাথার ওপরে চূড়া করে বাঁধা। আতা ওষ্ঠাধারে মুক্তাঝরানো হাসি। রমণীর উত্তমাঙ্গের বস্ত্র পৃষ্ঠলম্বী সূত্রগ্রন্থিতে দৃঢ়নিবদ্ধ এবং অধমাঙ্গের বস্তু কিছু খাটো। নৌকার ত্রিকোণ প্রান্তদেশে বসে রমণী তার পা দুটি নিবদ্ধ অবস্থায় নিম্নস্থিত কাষ্ঠস্তরের ওপর ছড়িয়ে রাখার ফলে তার কদলীস্তম্ভ-সদৃশ্য চরণ-দুটি ঊরু পর্যন্ত প্রায় অনাবৃত। এই অনাবরণ প্রকট লাবণ্য পৌরুষেয় দৃষ্টিতে পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার যান্ত্রিকতা বলে মনে হলেও এই রমণীর কাছে এটি স্বভাবসিদ্ধ এবং অতি সহজ।

কিন্তু ওই রমণীর পক্ষে এই অনাবরণ ব্যবহার যতই সহজ, সরল আর স্বাভাবিক হোক, সাধারণ মানুষ তা সহ্য করতে পারবে কেন! এমনকী কোনও জিতেন্দ্রিয় সিদ্ধ মহাপুরুষ হলেও নীলোর্মিচঞ্চল যমুনার জলে একটি নৌকোর ওপর অমন স্বভাবসুন্দর প্রত্যঙ্গমোহিনী রমণীমূর্তি দেখতে পেলে, তিনি স্থির থাকতে পারবেন না। অন্তত একবারের জন্যও তার মনে হবে– সমস্ত জীবনের ত্যাগ বৈরাগ্যের সাধন, অথবা সেই চিরাভ্যস্ত ইন্দ্রিয়নিরোধ তার উচিত হয়েছে তো? অন্তত একবারের তরেও মনে হবে– এই রমণীর অধিকার পেলে বেশ হত– অতীবরূপসম্পন্নাং সিদ্ধানামপি কাঙিক্ষতাম।

রমণী যে আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করছিল তার অবসান ঘটল আকস্মিকভাবে। জটাজুটধারী এক মুনিকে নদীতীরবর্তী সর্পিল পথ বেয়ে নৌকোর দিকেই আসতে দেখা গেল। সন্ধ্যা হয়ে আসবে এখনই, তাকে পরপারে পৌঁছোতে হবে। মহর্ষি বোধহয় তীর্থযাত্রায় বেরিয়েছেন। হয়তো যমুনা পার হয়ে মথুরা-শূরসেন অঞ্চলে কোন ও দেবক্ষেত্রে যাবেন, হয়তো বা যাবেন মৎস্য দেশের কোনও তীর্থে।

এই অঞ্চলে যমুনা কিঞ্চিৎ শীর্ণতোয়া। ফলে নদী-পারাপারের জন্য এইখানেই লোকে আসে। তাতে লোকেরও সময় লাগে কম, নৌবাহকেরও পরিশ্রম হয় কম। মহর্ষি অন্য সময়েও নদী পার হবার জন্য তার পরিচিত এই খেয়াঘাটে এসেছেন, কিন্তু সবসময়ে একটি পুরুষকেই দেখেছেন নৌকো পার করে দিতে। কিন্তু আজকের দিনে সব কিছুই কেমন অন্যরকম ঘটছে। খেয়াঘাটে আসতেও তার দেরি হয়ে গেছে, আর এদিকে সূর্যের শেষ অস্তরাগ যমুনার জলে লুটোপুটি খেয়ে সেই নৌকার প্রান্তদেশে বসা নিকষ-কৃষ্ণ রমণী শরীরের মধ্যে নতুন মায়া তৈরি করেছে। মুগ্ধ হলেন মুনিবর। উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে আরও এক চিক্কণ প্রকৃতি-শরীর তার নিরুদ্ধ প্রকৃতিকে বিক্ষুব্ধ করে তুলল। তিনি মনে মনে এই উদ্ভিন্নযৌবনা রমণীর আসঙ্গলিপ্সা করলেন– দৃষটুৈব চ তাং ধীমাংশ্চকমে চারুহাসিনীম।

তবে মনে মনে কামনায় পীড়িত হলেও সেই মানসিক বিকার সাময়িকভাবে দমিত করে রাখার অভ্যাস তার জানা ছিল। অতএব প্রাথমিক সম্মোহনের সেই উত্তাল ভাবটুকু প্রশমিত করে মুনিবর জিজ্ঞাসা করলেন– তা, হ্যাঁগো মেয়ে! এখানে যে চিরকাল নৌকো পারাপার করে, আমাদের সে-ই পরিচিত নাইয়াটি কোথায়- ক কর্ণধারো নৌর্যেন নীয়তে ক্রহি ভামিনি? রমণী বলল, তিনি আমার পিতা। আমার পিতার কোনও পুত্র সন্তান নেই, থাকলে সেই এই কর্ম করতে পারত। অথচ পিতার যা বয়স হয়েছে তাতে এখন নৌকো পারাপার করতে তার কষ্ট হয়। সেইজন্য এই নৌকো নিয়ে আমিই খেয়া পারাপার করি– নৌময়া বাহ্যতে দ্বিজ! মহর্ষি বললেন, সে তো খুব ভাল কথা। তা হলে আর দেরি নয়। এতক্ষণ অনেক আরোহীকে ওপারে নিয়ে গেছ তুমি। এখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, হয়তো আমিই তোমার নৌকোয় শেষ যাত্রী। নৌকো নিয়ে চল তাড়াতাড়ি অহং শেষো ভবিষ্যামি নীয়তামচিরণে বৈ। নীল যমুনার জলে নৌকো ছেড়ে দিল মধুরহাসিনী রমণী। নৌকোর ওপর তার দিনশেষের আরোহী জটাচীরধারী এক মুনিবর।

এই নৌকোর আরোহী যদি একজন সাধারণ মানুষ হতেন, তা হলে সেটা কোনও আখ্যায়িকা হত না। ঘটনা হল– দিনশেষের এই খেয়া-নৌকোয় যিনি পরপারে চলেছেন, তিনি মহামুনি পরাশর। কিন্তু এত বড় ঋষি হওয়া সত্ত্বেও এই খেয়া-পারাপারের নাইয়াটির প্রতি তিনি সংযতেন্দ্রিয় রুক্ষ-শুষ্ক মুনির মতো ব্যবহার করেননি। ব্যবহার করেছেন একেবারে সাধারণ মানুষের মতো, আর ঠিক সেই কারণেই ঘটনাটা আখ্যায়িকা হয়ে উঠেছে।

সূর্যবংশের বিখ্যাত পুরোহিত হলেন মহর্ষি বশিষ্ঠ। পরাশর এই বশিষ্ঠের নাতি। বিশ্বামিত্র মুনির সঙ্গে বশিষ্ঠের যে দীর্ঘদিন বিবাদ-বিসংবাদ চলেছিল, তাতে বশিষ্ঠের জ্যেষ্ঠপুত্র শক্ত্রি মারা গিয়েছিলেন। মারা গিয়েছিলেন মানে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। পুরাণ-ইতিহাসের বক্তব্য অনুযায়ী সূর্যবংশের রাজা কল্মষপাদের পুরোহিত-পদবী লাভের জন্য বিশ্বামিত্র এবং বশিষ্ঠ দু’জনেরই কিছু প্রতিযোগিতা হয়েছিল। এই অবস্থায় বশিষ্ঠের পুত্র শক্ত্রির সঙ্গেও কল্মষপাদের বিবাদ বেধে যায় ওই পূর্বোক্ত পদেরই অধিকার নিয়ে। রাজা শক্ত্রিকে চরম অপমান করেন। শক্ত্রিও ক্রুদ্ধ হয়ে কল্মষপাদকে অভিশাপ দেন।

আমাদের লৌকিক ইতিহাস অনুসারে এই হল ক্ষত্রিয় রাজার সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য বিবাদের ঘটনা যার সূত্রপাত হয়েছিল ভার্গব ব্রাহ্মণদের সঙ্গে ক্ষত্রিয় রাজাদের বিবাদকে কেন্দ্র করে। ঘটনা এতদূর যায় যে, রাজা কল্মষপাদ বিশ্বামিত্রের সহযোগিতায় বশিষ্ঠ-পুত্র শক্ত্রিকে মেরে ফেলেন। পরে অবশ্য শক্ত্রির পিতা বশিষ্ঠের সঙ্গে রাজা কল্মষপাদের সুসম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং রাজা নিজের ভুল বুঝতে পারেন কিন্তু ততদিনে দুর্ঘটনা যা ঘটার ঘটেই গেছে। উপযুক্ত পুত্রের মৃত্যুতে বশিষ্ঠ অন্তরে দগ্ধ হলেও যথাসম্ভব সংযতচিত্তে আপন যজ্ঞ। তপঃ-স্বাধ্যায় চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এমনই সময় একদিন সেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।

শক্ত্রি যখন মারা যান তখন তার ঔরসজাত পুত্র গর্ভস্থ ছিলেন। শক্ত্রির স্ত্রীর নাম অদৃশ্যন্তী। শক্ত্রির মৃত্যুতে তার পিতা বশিষ্ঠ উন্মত্তপ্রায় অবস্থায় নিজের ঘর ছেড়ে চলে যান। একসময় তিনি আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন যদিও তার এই চেষ্টা সফল হয় না। দুঃখ-প্রশমনের জন্য তিনি নানা দেশ নানা তীর্থে ঘুরে বেড়াতে থাকেন– স গত্বা বিৰিধান শৈলান্ দেশান বহুবিধাংস্তথা। অনেক নদী পাহাড়, অনেক অরণ্য, গ্রাম-শহর ঘুরে শ্রান্ত-ক্লান্ত সংযত বশিষ্ঠ ঘরে ফেরার পথ ধরলেন। একটু যেন আগ্রহও দেখা গেল তার মনে চির-পুরাতন সেই আশ্রমে ফিরে আসার জন্য।

অধিকাংশ পথ যখন অতিক্রান্ত, আশ্রম যখন আর খুব দূরে নয়, তখন বশিষ্ঠ বুঝতে পারলেন যে, একটি রমণী তার পিছন পিছন আসছে। বশিষ্ঠ দেখলেন– রমণী বিধবা এবং নিরাভরণা, তার মুখখানি করুণ লাবণ্যে ভরা। বশিষ্ঠ কোনও কথা বললেন না, যেমন চলছিলেন, চলতে লাগলেন। আনমনে চলতে চলতে হঠাৎই তার কানে ভেসে এল বেদ উচ্চারণের উদাত্ত-অনুদাত্ত-স্বরিতের ধ্বনি। মহর্ষি অবাক বিস্ময়ে পিছনে ফিরে তাকাতেই বিধবা রমণীর করুণ মুখখানি তার চোখে পড়ল। বশিষ্ঠ শুধোলেন, কে তুমি রমণী? কেনই বা তুমি আমার পিছন পিছন আসছ? বিধবা রমণী বললেন, পিতা! আমি আপনার পুত্রবধূ অদৃশ্যন্তী। বশিষ্ঠ বললেন, তা হলে কার মুখে ওই অপূর্ব বেদধ্বনি উচ্চারিত হতে শুনলাম। এই স্বর, এই ধ্বনি যে আমার খুব চেনা। আমার মৃত পুত্র শক্ত্রির মুখে এই বেদোচ্চারণ যে আমি বার বার শুনেছি– পুরা সাঙ্গস্য বেদস্য শক্ত্রেরিব ময়া শ্রুতঃ।

অদৃশ্যন্তী সলজ্জে বললেন, পিতা! আমার গর্ভে একটি পুত্র আছে। আপনার পুত্র শক্ত্রির ঔরসেই এই পুত্রের উৎপত্তি। এখন তার বারো বৎসর বয়স। সে গর্ভস্থ অবস্থাতেই বেদ উচ্চারণ করছে। গর্ভস্থ পুত্রের বারো বছর বয়স– মূল সংস্কৃত এবং তার সিদ্ধান্তবাগীশ কৃত অনুবাদ বিশ্বাস্য না অবিশ্বাস্য, তা অন্য কথা, কিন্তু আমাদের যা ধারণা, তা হল– বশিষ্ঠ পুত্রশোকে পাগল হয়ে বহুকাল আশ্রমের বাইরে ছিলেন। হয়তো তিনি যখন ফিরে এসেছেন, তখন শক্ত্রিপুত্রের বারো বছর বয়স হয়ে গেছে। পিতৃগৃহের পুরাতন আশ্রমে গর্ভগৃহে যিনি বড় হচ্ছিলেন বশিষ্ঠ তাঁকে চেনেনই না। মায়ের কাছে মায়ের অঞ্চলছায়ায় এবং মায়েরই অনুশাসনে এতকাল ধরে বড় হয়েছেন বলেই হয়তো এই গর্ভবাসের কল্পনা– যে কল্পনা পৌরাণিকদের লোকোত্তর ভাবনায় আক্ষরিক গর্ভবাসের রূপকে বিধৃত। মূল পুরাণের কথকতা থেকেও যেন আমাদের এই গবেষণাই প্রমাণ হয়। সেখানে বলা আছে– আমার গর্ভ থেকেই এই পুত্রের জন্ম। আপনার পুত্র শক্ত্রির ঔরসে জাত এই বালক। ছোটবেলা থেকে বেদাভ্যাস করতে করতে এই ছেলের এখন বারো বছর বয়স হল– সমা দ্বাদশ তস্যেহ বেদান অভ্যস্যতো মুনে।

অদৃশ্যম্ভীর মুখে এমন অভাবনীয় সংবাদ শুনে পরম আহ্লাদিত হলেন বশিষ্ঠ। শক্ত্রি বেঁচে নেই বটে, কিন্তু তার পুত্র তো আছে। সেই সূত্রে বশিষ্ঠের সন্তান-পরম্পরা তো অক্ষত অবিচ্ছিন্ন রইল– অস্তি সন্তানমিত্যুত্ত্বা–বশিষ্ঠ পুত্রবধূর সঙ্গে ঘরে ফিরে চললেন। বশিষ্ঠ ভাবলেন শক্ত্রির পুত্র, সে তো শক্ত্রিরই অন্য এক রূপ, অন্য এক জীবন– পরাসুঃ। পর মানে অন্য। অসু মানে প্রাণ, জীবন। অর্থাৎ অন্য (পর) এক প্রাণের (অসু) মধ্যে শক্ত্রি উজ্জীবিত আছেন বলেই শক্ত্রির পুত্রের নাম ‘পরাশর’। মূলে এই নামটি হয়তো ছিল পরাসুর (পরাসু + র)। আছে অর্থে ‘র’ প্রত্যয় হয়, যেমন– মধুর। তেমনই পরাসুর। তা থেকেই ডাকে ডাকে পরাসর এবং অবশেষে ‘পরাশর’।

পিতামহ বশিষ্ঠের সঙ্গে শিশু পরাশর যখন বেশ পরিচিত হয়ে উঠলেন, তখন চিরাচরিত সমাজব্যবস্থার অভ্যাসে পরাশর পিতামহ বশিষ্ঠকে বাবা-বাবা বলে ডাকতে আরম্ভ করলেন। স্নেহময় বশিষ্ঠও নাতির এই সম্বোধনে বাধা দিতেন না। ভাবতেন– আহা! পিতা নেই, অন্যদের দেখে কাউকে পিতা বলে ডাকতে কোন বালকের না ইচ্ছে করে! পুত্রের এই ব্যবহারে মাতা অদৃশ্যন্তী বড় অস্বস্তিতে পড়তেন, কিছুটা লজ্জিতও হতেন বুঝি। একদিন ওই একইরকম ভাবে পরাশর তার পিতামহ বশিষ্ঠকে বাবা-বাবা বলে ডাকছিলেন, এই অবস্থায় জননী অদৃশ্যন্তী পুত্রকে বললেন– বাছা! তুমি তোমার ঠাকুরদাদাকে বাবা-বাবা বলে ডাক কেন? এমন কোরো না, করতে হয় না- মা তাত। তাত তেতি ব্রহ্যেনং পিতর পিতুঃ। তোমার পিতা বেঁচে নেই। বনের ভিতর এক রাক্ষস তোমার পিতাকে ভক্ষণ করেছে।

একটি রাক্ষসই তাঁর পিতার মৃত্যুর কারণ জেনে পরাশর ক্রোধেঅধীর হয়ে উঠলেন। সবংশে রাক্ষসকুল নিধনের জন্য তিনি আরম্ভ করলেন রাক্ষসমেধ যজ্ঞ। দলে দলে রাক্ষস পরাশরের যজ্ঞের আগুনে দগ্ধ হতে লাগল। পুরাতন ভুয়োদশী ঋষিরা– অত্রি, পুলহ এমনকী রাক্ষসদের জন্ম-মূল পুলস্ত্য ঋষিও পরাশরের ক্রোধ শান্ত করার জন্য যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলেন। তারা সকলেই নিরীহ এবং নিরপরাধ রাক্ষসদের বধ না করার জন্য অনুরোধ করলেন পরাশরকে। ঋষিদের যুক্তি-তর্কের যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করে পরাশর তার উদ্দীপিত ক্রোধও সম্বরণ করলেন। তৎক্ষণাৎ যজ্ঞ বন্ধ করলেন পরাশর তদা সমাপয়ামাস সত্রং শক্তো মহামুনিঃ।

দীপ্যমান এই ক্রোধ-সম্বরণের এই ঘটনা থেকে বুঝতে পারি– পরাশর সাধারণ কোনও ব্যক্তিত্ব নন। শাস্ত্র বলে– কাম এবং ক্রোধের জন্ম হয়েছে একই উৎস থেকে। উভয়েই রজোগুণের আত্মজ– কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভবঃ। নিজের উদগত ক্রোধ যিনি প্রশমন করতে পারেন, রক্তস্ফীত ধমনীকে যিনি এক মুহূর্তে সাধারণ রক্তচাপে পরিণত করতে পারেন, সেই পরাশরকে আমরা যমুনার তীরে আগত দেখেছি। সেই পরাশরকে আমরা এক খেয়াতরীতে উঠতে দেখেছি, যেখানে পুরাতন নাইয়ার অনুপস্থিতিতে তিনি একটু আগেই পরিচিত হয়েছেন তার মেয়ের সঙ্গে। মুনি তার যৌবনোদ্ভেদ নিরীক্ষণ করে পুলকিত; তার কালো রূপের মধ্যে তিনি আলোর সন্ধান পেয়েছেন।

ইতিহাস-পুরাণের আরও যে-সব নর-নারীর চরিত্র আছে, তাতে এইরকম মদির পরিস্থিতিতে তাদের এতটুকুও সুস্থির দেখিনি। দর্শনমাত্রেই কামভাব সেইসব নর-নারীকে প্রায়ই মথিত করেছে। আলোচ্য মহামুনি পরাশরও যে ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে নৌকার ওপর সমাধিলগ্ন হয়েছেন তাও নয়। তবে তার পিছু পরিশীলিত ভাবনা আছে। আছে কবির মতো একটি হৃদয়। প্রথম সম্বোধনেই তিনি এই সন্ধ্যার রক্তিমা-মাখানো কৃষ্ণা রমণীর হাতে উপহার দিয়েছেন কবির হৃদয়, বলেছেন– আমি তোমার দিনশেষের খেয়ার শেষ যাত্রী হব, বাসবী! নিয়ে চল আমাকে– অহং শেষো ভবিষ্যামি নীয়তামচিরেণ বৈ। বাসবী! মুনির মুখে এই অশ্রুতপূর্ব সম্বোধন শুনে রমণীর জল-বাওয়া বৈঠাখানি চকিতের জন্য থেমে গেল কিনা, সে খবর আমরা পাইনি। কিন্তু আশ্চর্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আর তার আগ্রহটুকুও লুকিয়ে রাখল না। অর্থাৎ বাসবী’ নামের রহস্যটুকু সে জানে, কিন্তু অন্য কেউই যে রহস্য প্রায় জানে না, তা মুনি জানলেন কী করে? এবং সেই জানাটুকুও কী এমন কবির হৃদয়ের সঙ্গে মিশিয়ে এমন করেই বলতে হয়! রমণী তার দিনশেষের যাত্রীকে তুলে নিল নৌকোয়। নৌকো বাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণা রমণীর শারীরিক বিভঙ্গ দিনশেষের যাত্রী মহামুনি পরাশরের চোখ এড়িয়ে গেল না। চিত্তদুয়ার মুক্ত করে নির্নিমেষে তিনি তাকিয়ে রইলেন সোনার আঁচলখসা সন্ধ্যাসমা রমণীর দিকে।

কৃষ্ণা রমণী মহামুনি পরাশরের এই আকর্ষণ নারীজনোচিত সচেতনতায় বুঝে নিল এক লহমায়। মুনি তাকে বাসবী বলে সম্বোধন করেছেন। এই সম্বোধনের অর্থ সে জানে। কিন্তু মুনি কেন তাকে এই নামে ডাকলেন, সে-সম্বন্ধে তার মনে অদ্ভুত এক অনুসন্ধিৎসা রয়েই গেল। নিজেকে খানিকটা সপ্রতিভ দেখানোর জন্য বাসবী’ নামের রহস্যটি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে রমণী বলল– লোকে আমাকে মৎস্যগন্ধা বলে ডাকে, আমি অত্রস্থ ধীবরদের প্রধান দাশ রাজার কন্যা। বাস্তবে আমার পিতামাতার সংবাদ সর্বাংশে আমি জানি না এবং তার জন্য দুঃখও আমার কম নেই।

সত্যি কথা বলতে কি, বাসবী’ নামটি শোনা মাত্রেই রমণীর মনে যে রহস্য তৈরি হয়েছিল, তার বাচনভঙ্গির মধ্যেও কিন্তু তার নাম-রহস্য সম্বন্ধে একটা জিজ্ঞাসা জেগেই রইল। পরাশর উত্তর দিলেন সঙ্গে সঙ্গে এবং বোঝাতে চাইলেন যে, রমণীর বাসবী নামের রহস্যটি তিনি জানেন। অবশ্য নৌকার ওপর সন্ধ্যার এই অনুকূল লগ্নে রমণীকে তিনি তার নাম-রহস্য শোনাননি, কারণ তা শোনালে রমণীর লজ্জা বোধ হত।

.

০২.

পরাশর যা আভাসে বলেছেন এবং মহাভারতে যে আভাসটুকু সবিস্তারে ধরা আছে, তাতে এই রমণীকে ধীবর-রাজা দাশের ঔরসজাত কন্যা বলে মনে হয় না। তিনি দাশরাজার ঘরে পালিত হয়েছেন মাত্র। মহাভারতের উপাখ্যান অনুযায়ী চেদি দেশের রাজা চৈদ্য উপরিচর বসু তাঁর স্ত্রী গিরিকার সঙ্গে মিলিত হওয়ার আশায় অপেক্ষা করছিলেন। অন্যদিকে গিরিকাও ঋতুস্নান শেষ করে অপেক্ষা করছিলেন ওই একই প্রিয় মিলনের আকাঙ্ক্ষায়। ঠিক এই অবস্থায়, পিতৃপুরুষের আদেশে পিতৃযজ্ঞের কারণেই চেদিরাজকে মৃগবধের উদ্দেশে মৃগয়া করতে চলে যেতে হয় আকস্মিকভাবে। পৌরাণিক নিয়মে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে বন্য পশুপাখির মাংসে পিতৃপুরুষের তর্পণ সেকালে প্রথাগত ছিল। অতএব পিতৃপুরুষের ওই আদেশ অমান্য করতে না পেরেই উপরিচর বসু মৃগয়ায় গেলেন।

মৃগয়ায় রাজার মন বসল না মোটেই। অপেক্ষমাণা সুন্দরী গিরিকার কথা তাঁর বারবার মনে পড়ল। যান্ত্রিকভাবে রাজা মৃগয়া করছিলেন বটে, কিন্তু অযান্ত্রিক মনে নিরন্তর জেগে রইল সেই মধুর মুখখানি চকার মৃগয়াং কামী গিরিকামেব সংর। রতিলিন্দু রাজার মন সংযমের বাধ মানল না। তার তেজোবিন্দু উৎসারিত হল এবং রাজা তা ধারণ করলেন পত্রপুটে। তার পরের ঘটনা প্রায় সবারই জানা। অপেক্ষমাণ ঋতুস্নাতা স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হওয়া হল না, ঈপ্সিত পুত্রলাভও বিঘ্নিত হয়ে গেল তার ফলে। কিন্তু পুত্রজন্ম বিফল হোক– এটা যেহেতু রাজা চাইছিলেন না, অতএব পত্রপুটে ধরা সেই তেজোবিন্দু রাজা গিরিকার কাছে পাঠিয়ে দিলেন একটি বাজপাখির পায়ে বেঁধে। রাজার কপাল, গিরিকার কাছে সেই তেজোবিন্দু পৌঁছোল না, পথের মধ্যে আরেকটি বাজপাখির আক্রমণে সেই বিন্দু পতিত হল যমুনায়।

যমুনা নদীতে তখন শাপগ্ৰস্তা অপ্সরা অদ্রিকা মৎসী হয়ে বিচরণ করছিলেন। উপরিচর বসুর তেজ সেই মৎসী ভক্ষণ করে গর্ভবতী হল। এদিকে এক সময়ে ধীবরেরা জাল ফেলতে এল যমুনা নদীতে এবং দৈবের দোষে সেই গর্ভবতী মৎসী ধরা পড়ল ধীবরদের জালে। ধীবরেরা সেই মৎসীকে কাটতে গেলেই তার গর্ভ থেকে বেরিয়ে এল একটি স্ত্রী এবং একটি পুংশিশু। এই আশ্চর্য ঘটনা ধীবরেরা নিবেদন করল দেশের রাজা উপরিচর বসুর কাছে। সব দেখে শুনে উপরিচর বসু পুরুষ শিশুটিকে গ্রহণ করেন। মহাভারতের মতে চৈদ্য উপরিচরের এই শিশুপুত্রই ভবিষ্যতে ‘মৎস্য’ নামে এক ধার্মিক রাজা বলে পরিচিত হয়েছিলেন– স মৎস্যো নাম রাজাসীদ ধার্মিকঃ সত্যসঙ্গরঃ। শিশুকন্যাটিকে রাজা ধীবরদের হাতেই দিয়ে দেন এবং তা কন্যাসন্তান বলেই হয়তো। রাজা ধীবরদের বলে দেন যেন শিশুকন্যাটিকে তারাই মানুষ করে। মৎস্যঘাতীদের আশ্রয়ে থাকার ফলে এই মেয়েটি মৎস্যগন্ধা নামে পরিচিত হয়– সা কন্যা দুহিতা তস্যা মৎস্যা মৎস্যসগন্ধিনী। মৎস্যগন্ধার অপর নাম সত্যবতী এবং তার গায়ের রং কালো বলে তার ডাক নাম হয়ে গেল কালী।

এই উপাখ্যানের অলৌকিকত্ব এবং সরসতার খোলস থেকে প্রকৃত সত্য উদ্ধার করা খুব কঠিন, এমনকী প্রায় অসম্ভবই বটে। উপরিচর বসুর বংশ-পরম্পরার বিচার করলে দেখা যাবে যে, তিনি কোনও মতেই মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর পিতার সমবয়সি হতে পারেন না। সত্যবতী, ব্যাসদেব, শান্তনু এবং ভীষ্মের সঙ্গে উপরিচর বসুর সমসাময়িক ঐতিহাসিকভাবে বিচার করলেও সত্যবতী কখনও উপরিচরের পালিতা কন্যাও হতে পারেন না। কেননা উপরিচর বসু অনেক আগের কালের মানুষ। ভারতবর্ষে যখন আর্যায়ণ আরম্ভ হয়েছে, নতুন নতুন দেশ যখন আর্যগোষ্ঠীর হস্তগত হচ্ছে, সেই প্রথম কল্পে চেদি দেশের প্রতিষ্ঠার সময়ে আমরা উপরিচর বসুকে জড়িত দেখেছি। কালের প্রমাণে শান্তনু-ভীষ্ম অথবা সত্যবতী-ব্যাসের অনেক পূর্বেই উপরিচর বসুর সময় পেরিয়ে গেছে। সত্যবতীর কালের সঙ্গে চৈদ্য উপরিচরের কাল কোনওভাবেই মেলে না। অতএব কোনওভাবেই সত্যবতী তার কন্যা নন।

তা হলে মহাভারতের কবি যে উপাখ্যান রচনা করলেন তার সবটাই কি মিছে, নাকি অর্থহীন মৌখিকতা? আমরা বলি– এ আসলে পৌরাণিক কণ্বক-ঠাকুরদের কথকতা। ভবিষ্যতে যে রমণীর গর্ভে বিশালবুদ্ধি ব্যাস জন্মাবেন, সেই রমণীকে এক অবান্তর অশ্রুতকীর্তি রাজার নামের সঙ্গে জড়িত করে রাখাটা কণ্বকঠাকুরদের ভাল লাগেনি। কাজেই মহান উপরিচর বসুর উপাখ্যান এসে গেছে কথকতার মুখে। কিন্তু তাই বলে উপরিচরের সঙ্গে সত্যবতীর এক ফোঁটাও সম্পর্ক নেই, সেটাও ঠিক নয়। কথকতার ধূপের ধোঁয়া থেকে সেটা বার করাটাই ঐতিহাসিকের কাজ।

মনে রাখতে হবে, মহামুনি পরাশর সত্যবতীকে সম্বোধন করেছেন ‘বাসবী’ বলে। আরও মনে রাখতে হবে, আমরা ইতিপূর্বে মহাভারতের মধ্যেই দেখেছি– উপরিচর বসুর সবগুলি পুত্রকে একসঙ্গে ‘বাসব’ বলে ডাকা হত এবং তাদের প্রত্যেকের নামেই পৃথক পৃথক বংশধারা তৈরি হয়েছিল বাসবাঃ পঞ্চ রাজানঃ পৃথগবংশাশ্চ শাশ্বতাঃ। আমাদের অনুমান– মৎস্যগন্ধা সত্যবতী উপরিচর বসুর পুত্র কোনও বাসব রাজার বংশে জন্মেছেন। হয়তো সেই কারণেই পরাশর তাকে ডেকেছেন ‘বাসবী’ বলে।

আরও একটা অনুমানের কথা বলি। মহাভারতের নানান রাজবংশের ঐতিহাসিকতা বিচারে সবচেয়ে বড় সহায়ক গ্রন্থ হল পুরাণগুলি, যেগুলির মধ্যে বংশ, প্রতিবংশ, মন্বন্তরের ইতিহাস আছে। মহাভারত থেকে জানা যায়– উপরিচর বসুর পঞ্চম পুত্র ‘মাবেল্ল হয়তো মৎস্যদেশের রাজা ছিলেন কেননা মৎস্যদেশ উপরিচরের অধিকারভুক্ত ছিল এবং উপরিচরের পুত্রের নামও ছিল মৎস্য, তার নামেই হয়তো মৎস্য দেশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল– স মৎস্যো নাম রাজাসীদ ধার্মিকঃ সত্যসঙ্গরঃ। অন্যদিকে বায়ু পুরাণের মতো প্রাচীন পুরাণে দেখা যাচ্ছে– উপরিচর বসুর পুত্রসংখ্যা পাঁচ নয়। তার পুত্রসংখ্যা সাত এবং তার সপ্তম পুত্রের নামই মৎস্য। অথবা তার নাম মৎস্যকাল– মাথৈল্লশ্চ (মাবেল্লশ্চ) ললিখশ্চ মৎস্যকালশ্চ সপ্তমঃ। সংস্কৃত শব্দে যাঁকে ললিথ বলা হয়েছে, পণ্ডিতেরা তাকে রাজপুত্র লাঠোর বা রাঠোরদের পূর্বপুরুষ বলে মনে করেন। এখানে সবচেয়ে বড় কথা হল যে, তখনকার মৎস্যদেশ হল এখনকার রাজপুতানার অন্তর্গত জয়পুর-ভরতপুর-আলোয়ার অঞ্চল। অর্থাৎ ললিথ এবং মৎস্য– এঁরা দু’জনেই রাজপুতানা বা মৎস্যদেশের অধিবাসী ছিলেন এবং এঁদের মূল পরিচয়– এঁরা সব ‘বাসব’ রাজা।

মহাভারতের উপাখ্যানে সত্যবতীর জননীকে যেভাবে এক মৎসীর রূপ দেওয়া হয়েছে। এবং সত্যবতীর আপন ভ্রাতার নামেই যেহেতু মৎস্যদেশের প্রতিষ্ঠা, অপিচ এই মৎস্যও যেহেতু একজন ‘বাসব’ রাজা, তাই আমরা অনুমান করি সত্যবতী মৎস্যদেশীয় কোনও রমণী ছিলেন। অথবা তত্রস্থ মৎস্যরাজার সঙ্গে তার কোনও আত্মীয়তার সম্বন্ধ ছিল বলেই হয়তো সত্যবতীকে ‘মৎস্যা মৎস্যসগন্ধিনী’ বলা হয়েছে মহাভারতে। সংস্কৃতে ‘সগন্ধ’ শব্দের অর্থ আত্মীয় অথবা নিজের জাত। গান্ধার দেশের মেয়ে যদি গান্ধারী হতে পারেন, মদ্র দেশের মেয়ের নাম যদি মাদ্রী হয়, পঞ্চাল দেশের জাতিকা যদি পাঞ্চালী হন, তা হলে মৎস্য দেশের মেয়েই বা মৎসী বা মৎস্যগন্ধা হবেন না কেন? অবশ্য এমন হতেই পারে যে, সত্যবতীর জন্মের মধ্যে গৌরব ছিল না তত। আমরা উপরিচর বসুর পট্টমহিষী গিরিকার জন্মের মধ্যেও কোনও গৌরব দেখিনি। মহাভারতে যমুনা নদীর অন্তরচারিণী যে মৎসীকে আমরা উপরিচর বসুর তেজোবিন্দু ভক্ষণ করতে দেখেছি আমাদের ধারণা তিনি বসুরাজের অধিকৃত মৎস্যদেশের কোনও রমণী। হয়তো সেই মৎস্যদেশীয় কোনও রমণীর বংশধারাতেই সত্যবতীর জন্ম, যার জন্মদাতা স্বয়ং কোনও ‘বাসব’ বা বসুবংশীয় কোনও রাজা। রাজপুরুষের সঙ্গে অনামিকা মৎস্যদেশীয়ার মিলনের মধ্যে কোনও গৌরব ছিল না বলেই হয়তো, এবং তা সহসা ঘটেছিল বলেই হয়তো মৎসীকর্তৃক তেজোবিন্দু-ভক্ষণের ঘটনাটি রূপকাকারে বিবৃত হয়েছে।

এ-ব্যাপারে সন্দেহ করার কোনও কারণ নেই যে, সেই মৎস্যদেশীয় রমণীর কুলশীল আর্যজনের সম্মত ছিল না এবং এতেও কোনও সন্দেহ নেই যে, সত্যবতী মানুষ হয়েছেন ধীবরপল্লিতে। সঙ্গে কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, ধীবর শব্দটি মহাভারতে এসেইছে শুধু ‘মৎস্য’ শব্দের সূত্র ধরে। আমাদের ধারণায় মৎস্যগন্ধার জন্মদাতা বীজী পিতা আসলে মৎস্যদেশের রাজা এবং সত্যবতী মৎস্যরাজের পুত্রী বলেই হয়তো তার গায়ে আঁশটে গন্ধের কল্পনা। আবার এটাও ঠিক যে, সত্যবতীর মা আর্যজনবিগর্হিতা রমণী ছিলেন বলেই হয়তো সেই মৎস্যরাজ অন্তঃসত্ত্বা জননীকে ঘরে নিয়ে আসেননি। তিনি বিসর্জিত হয়েছিলেন। অতএব অন্যত্র হয়তো কোনও ধীবরপল্লিতে বিসর্জিতা হবার ফলেই ধীবরদের ঘরোয়া সংস্কার আরোপিত হয়েছিল সত্যবতীর ওপর। তার নামও সেই কারণেই মৎস্যগন্ধা।

পিতার অনুপস্থিতিতে সত্যবতী নৌকো বাইতে এসেছেন যমুনায়। তাঁর দিনশেষের যাত্রী পরাশর মোহময়ী নাইয়ার সমস্ত জীবনকাহিনি জানেন। জানেন তার অবমানিত জীবন-কথা এবং অবশ্যই তার জন্মকথাও, নইলে বাসবী’ বলে তাঁকে ডাকলেন কী করে? খেয়া পারাপারের তরুণী নাইয়া মহামুনি পরাশরের কথায় আপ্লুতা বোধ করেছেন। আপ্লুতা হয়েছেন তার মর্যাদাবোধে। মহামুনি হওয়া সত্ত্বেও পরাশর তাকে কোনও তাচ্ছিল্য করেননি এবং সুন্দরী রমণী বলে প্রথমেই ব্যাঘ্রঝম্পনের রীতিও অনুসরণ করেননি। রমণী তাঁর যষ্ঠেন্দ্রিয়ের বোধে এটা বুঝতে পেরেছেন যে, পরাশর তাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছেন, কিন্তু তার কথাবার্তা এবং সর্বোপরি তার মর্যাদাবোধে সত্যবতী তার কারুণ্যের স্পর্শ পেলেন অন্তরে। তিনি বললেন, আমি ধীবররাজার মেয়ে বলেই পরিচিত। আমার জন্মের ব্যাপারে আমার অনেক দুঃখশোক আছে। এর মধ্যেও আপনি আমাকে চিনলেন কী করে, আমার দুঃখই বা বুঝলেন কী করে জন্মশোকাভিতায়াঃ কথং জ্ঞাস্যসি কথ্যতাম? সত্যি কথাটা বলেই ফেলেছেন সত্যবতী। আমাদের বোঝা উচিত, সত্যবতী যদি উপরিচর বসুর মেয়েই হবেন অথবা কোনও ‘বাসব’ রাজার মেয়ে বলেই যদি তিনি স্বীকৃত হতেন, তা হলে তার জন্ম নিয়ে কোনও শোক থাকবার কথা নয়। নিজেকে তিনি ‘জন্মশোকাভিতপ্তা বলেই পরিষ্কার জানিয়েছেন। এই কষ্টের ফলেই ‘বাসব’ রাজার পিতৃত্ব ঘুচিয়ে ফেলে তিনি পরাশরকে জানান– আমি দাশ রাজার মেয়ে। লোকে আমাকে মৎস্যগন্ধা বলে ডাকে। বস্তুত তিনি মৎস্যরাজেরই মেয়ে কিন্তু মায়ের অগৌরবে মৎস্যরাজ তাঁকে ঘরে না রাখলেও তাঁর সঙ্গে সত্যবতীর জন্ম সম্বন্ধে আত্মীয়তা আছে বলেই লোকে তাকে মৎস্যগন্ধা বলে ডাকে।

মহামুনি পরাশর সব খবর রাখেন এবং জানেন- মৎস্যগন্ধা আসলে বসুবংশেরই মেয়ে, তাকে ডেকেছেনও ‘বাসবী’ বলে। কিন্তু সেই ‘বাসবী’ সাভিমানে জানিয়েছেন যে তিনি মানুষ হয়েছেন কোনও অপাংক্তেয় মানুষের কাছে যার নাম দাশ। তার পালনের গৌরবেই আপাতত সত্যবতী গর্বিতা, বাসবী হিসেবে সেই গর্ব তিনি বোধ করেন না।

পরাশর কোনও অসভ্যতা করেননি যৌবনবতী সত্যবতীর সঙ্গে, কোনও অসভ্য ভণিতার মধ্যেও যাননি, পৌরাণিক পুরুষেরা স্ত্রীলোক দেখলেই যেমনটি করতেন। মৎস্যগন্ধার অপার রূপরাশি বর্ণনা অথবা স্তন-জঘনের সকাম বর্ণনা করে অন্যান্য পুরাণ-পুরুষের মতো সত্যবতীকে তিনি বিব্রতও করেননি। কোনও ভণিতা না করে পরাশর বলেছেন– বাসবী! আমি একটি পুত্র চাই তোমার কাছে এবং সেইজন্যই তোমার সঙ্গে মিলন প্রার্থনা করি।

সেকালের দিনের নিরিখে পরাশরের এই প্রার্থনার একটা তাৎপর্য আছে। কামনা কীভাবে ধর্মে পরিণতি লাভ করে– এটা তারই উদাহরণ। সেকালের দিনে পিতৃঋণ শোধ করার জন্য পুত্র-কামনা করতেন প্রাচীনেরা। রমণীর সঙ্গে শারীরিক মিলনের মধ্যে যে বাধ-ভাঙা কামনার অভিসন্ধি আছে প্রাচীনেরা সেই কামনাকে শৃঙ্খলিত করবার চেষ্টা করতেন পুত্রার্থে মিলনের সকারণতায়। অর্থাৎ শারীরিক মিলন যেন বল্গাহীন অসংখ্যাত ইন্দ্রিয়-চর্বণে পরিণত না হয়, পুত্রলাভের আকাঙ্ক্ষায় মিলন ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তির ক্ষেত্র থেকে মানুষকে সরিয়ে আনে ধর্মের বৃহত্তর ক্ষেত্রে। পরাশর ঠিক তাই করেছেন। যিনি ভবিষ্যতে বিশালবুদ্ধি ব্যাসের পিতা হবেন, তিনি ইন্দ্রিয়পরবশ হয়ে কাজ করছেন না, তিনি পুত্রের প্রয়োজনে সেকালের ধর্মের আনুগত্যে একবার মিলন সম্পন্ন করতে চান যান্ত্রিকভাবে।

মুনিবর পরাশরের ইচ্ছা এবং আশয় ধরে ফেলতে সত্যবতীর অসুবিধে হয়নি, এমনকী তার ওই পুত্রলাভের যান্ত্রিকতার কথাটাও সত্যবতী মেনে নিতে খুব অসুবিধে বোধ করছেন না। কিন্তু নারীসুলভ সাধারণ লজ্জা তাকে কুণ্ঠিত করে তুলেছে। তিনি বললেন, দেখুন মুনিবর! পরপারে কিছু ঋষি-মুনিদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে–পশ্য ভগব পরপারে স্থিতান্ ঋষীণ। হয়তো এই ঋষি-মুনিরা আগেই খেয়া পার হয়ে যমুনার ওপারে গেছেন। হয়তো বা পরাশরের জন্যই তারা অপেক্ষা করছেন এবং তাকিয়েও আছেন ওই খেয়া নৌকার দিকে। সত্যবতী ভারী লজ্জাবোধ করলেন। বললেন মুনিরা সব তাকিয়ে আছেন। আমাদের দিকে। এই অবস্থায় কীভাবে আমাদের মিলন সম্ভব আবহোষ্টয়োরেভিঃ কথং নু স্যাৎ সমাগমঃ।

পরাশর তপস্বী, যোগী। তিনি বিভূতিমান মহাসত্ত্ব পুরুষ। নারী-পুরুষের শারীরিক মিলনের মধ্যে বাহ্যত যে আবরণ দরকার সেই আবরণ তিনি সৃষ্টি করলেন যোগবলে। চারিদিক ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হল। আমাদের ধারণা, গোধূলির শেষ লগ্নে অন্ধকারের যে ছায়া নামছিল প্ৰেমনত নয়নের দীর্ঘচ্ছায়াময় পল্লবের মতো সেই ছায়াই মুনিসৃষ্ট অলৌকিক ‘নীহারিকা’র রূপকে বর্ণিত হয়েছে। সন্ধ্যার প্রায়াচ্ছন্ন অন্ধকারের মধ্যে এবার সত্যবতী অনুভব করলেন যে, মুনি যা বলছেন, তা মৌখিকতা মাত্র নয়। মুনি শারীরিক মিলনে আগ্রহী এবং সে মিলন আসন্নপ্রায়। প্রখর বাস্তব সত্যবতীকে হঠাৎই পরিণত করে তুলল এক মুহূর্তে। আরও বড় কথা তিনি জানেন যে, সমাজের অসম্মত অবিধির মিলনে যে পুত্রের জন্ম হবে, তার দায়িত্ব যদিও বা পরাশরই গ্রহণ করেন। কারণ পরাশর পুত্রলাভের জন্যই মিলন কামনা করেছেন কিন্তু সেই মিলনের মধ্যে যে সামাজিক অসম্মতি আছে তার জন্য সমাজ তাকে কী মর্যাদা দেবে?

সত্যবতী ভয় পেলেন। নিজের জন্মের কারণেই যিনি কষ্ট পান, তিনি তো এই প্রস্তাবে ভয় পাবেনই। তার বাস্তবতার বোধও তাই অন্যের চেয়ে প্রখর। সত্যবতী বললেন, মুনিবর। আমি যে কুমারী। আপনার প্রস্তাবিত মিলন ঘটলে আমার পিতা কী বলবেন? আমার কুমারীত্ব দূষিত হলে আমি ঘরেই বা ফিরব কী করে, ঘরে থাকবই বা কী করে গৃহং গন্তুমৃষে চাহং ধীমন ন স্থাতুমুৎসহে।

তখনকার সমাজের যে রীতি ছিল, তাতে পরাশর জানতেন যে, তিনি যদি মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর কুমারীত্ব হরণ করেন এবং তার গর্ভজাত পুত্রের পিতৃত্ব অস্বীকার না করেন তা হলে সত্যবতীর কোনও অসুবিধে হবে না এবং সমাজেও তা খুব দূষণীয় বলে গণ্য হবে না। তবু তিনি সত্যবতীর ভয়টা বোঝেন, ‘জন্মশোকাভিতা’ এক রমণীর ভবিষ্যতের দায়ও তিনি বোঝেন, পরাশর অতএব সামান্য আশীর্বাদের ভঙ্গি মিশিয়েই বললেন, তুমি আমার প্রিয় কার্য সম্পাদন করো। তুমি আবারও তোমার অভীষ্ট কুমারীত্ব ফিরে পাবে। আমার সন্তোষ ঘটেছে অতএব যে বর চাও তাই পাবে। মৎস্যগন্ধা বললেন, আমার গায়ের মৎস্যগন্ধ দূর হোক, সুন্দর সৌগন্ধে প্রসন্ন হোক আমার শরীর।

আমরা পূর্বেও এই মৎস্যগন্ধের কথা বিশ্বাস করিনি, এখনও করি না। বস্তুত যে জন্মদাতা মৎস্যরাজ তার জন্ম দিয়েও তার পিতৃত্ব অস্বীকার করে তাকে বিসর্জন দিয়েছেন ধীবরপল্লিতে, পিতৃপরিচয়হীন সেই রমণী মৎস্যরাজের সন্ধতা অথবা আত্মীয়তা অস্বীকার করলেন প্রথম সুযোগে। পরাশরের আশীর্বাদে মৎস্যগন্ধার রমণীশরীরে পদ্মের সৌগন্ধ এসে তিনি যোজনগন্ধা’ বা ‘গন্ধবতী’তে পরিণত হলেন কিনা জানি না, তবে এই মুহূর্ত থেকেই যে তার নাম সত্যবতী হল, সে কথা আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

সত্যবতীর সঙ্গে পরাশরের অভীষ্ট মিলন সম্পূর্ণ হল এবং অলৌকিকভাবে তিনি সদ্যই গর্ভবতী হলেন এবং সদ্যোগৰ্ভ মোচন করলেন অলৌকিকভাবেই। মহভারতের কবি বেদব্যাস জন্মালেন। সদ্যোগৰ্ভ এবং সদ্যপ্রসবের কথাটা যে লৌকিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না, তা আমরা মনে করি না, কিন্তু মহাভারতের কবি যে অলৌকিক প্রতিভার অধিকারী তাতে তার জন্মের এই অলৌকিকতাটুকু আমরা জিইয়ে রাখতে চাই। বলতে চাই– জয় হোক মহামতি ব্যাসের– জয়তি পরাশরসূনুঃ সত্যবতীহৃদয়নন্দনো ব্যাসঃ।

ব্যাস জন্মালেন বটে, কিন্তু থাকলেন না সদ্যপ্রসবা মায়ের সঙ্গে। জন্মলগ্নেই তিনি শিশু নন, কৈশোরগন্ধী প্রায় যুবক। পিতা পরাশর তাকে নিয়ে যাচ্ছেন স্বাধ্যায়-অধ্যয়নের জন্য, তপস্যার জন্য। পরাশর যে শুধুমাত্র পুত্রলাভের ধর্মলাভ করার জন্যই কুমারী মৎস্যগন্ধার সাহচর্য প্রার্থনা করেছিলেন, তা এই ঘটনা থেকে আরও বেশি বোঝা যায়। কামচরিতার্থতার কারণ থাকলে পরাশর থেকে যেতেন যৌবনবতী সত্যবতীর সঙ্গে ঘর বাঁধনের মায়া পরবশ হয়ে। কিন্তু না, পুত্রলাভের সঙ্গে সঙ্গেই সেই সদ্যোজাত মহাপুরুষলক্ষণ পুত্রকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন পিতৃত্বের দায় সম্পূর্ণ পালন করে পিতৃঋণ শোধ করার জন্য।

অন্যদিকে ব্যাসকে দেখুন। সদ্যোগর্ভ থেকে যার জন্ম তার মাতৃদায় কতটুকু! গর্ভধারণের কষ্ট নেই, সন্তান-লালনের কষ্ট নেই, সত্যবতীও তাই পুত্রের কাছে বেশি কিছু আশা করেন না। তবু পিতার সঙ্গে একেবারে চলে যাবার আগে জননী সত্যবতীকে তিনি বলে গেলেন যে, তপস্যার জন্য তিনি চলে যাচ্ছেন বটে কিন্তু প্রয়োজনে স্মরণ করলেই তিনি চলে আসবেন মায়ের কাছে স্মৃতেহহং দর্শয়িষ্যামি কৃত্যেধিতি চ সোহব্রবীৎ।

সদ্যোজননীর মনে সদ্য-ত্যক্ত কৈশোরগন্ধী বালকের এই ভরসার কথাটুকু কতখানি ক্রিয়া করল জানি না, তবে কথাটা তার মনে দাগ কেটে রইল।

ত্যাগ এবং বৈরাগ্যের বিভূতিময় পরাশরের সংস্পর্শে এসে তথাকথিত কৈবর্তপল্লির রমণী মৎস্যগন্ধা গন্ধবতী সত্যবতীতে পরিণত হলেন। তিনি যেখানে উপস্থিত থাকতেন, সেখান থেকে দূর-দূরান্তে তার অঙ্গের সৌরভ ছড়িয়ে পড়ত, আমোদিত হত দিগদিগন্ত। এই জন্যই তাঁর নাম গন্ধবতী। তার নাম যোজনগন্ধা। আমরা অবশ্য এই পুষ্পমোদের অর্থ বিশদ কোনও অর্থেই বুঝি। নইলে লৌকিকভাবে এই পুষ্পমোদী গাত্রগন্ধের কোনও তাৎপর্যই হয় না। আমরা বুঝি– ধীবরপল্লীতে মানুষ হওয়া রমণী মহামুনি পরাশরের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার পূর্বতন পালকপিতার জাতি-সংস্কার কাটিয়ে উঠে বাহ্মণ্য সংস্কার লাভ করেছিলেন। তার সুনামের সৌগন্ধ, তার রূপের সৌগন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল বলেই সত্যবতী গন্ধবতী, সত্যবতী যোজনগন্ধা। পরাশরের সঙ্গে সংস্পর্শের পর সত্যবতী নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করলেন। নিজের সম্বন্ধে তার মর্যাদাবোধ নিজের কাছেই অনেক বেড়ে গেল।

এই ঘটনার পর অনেক কাল কেটে গেছে। সত্যবতী আরও রূপবতী আরও যৌবনবতী হয়েছেন। এই সময়ে আরও এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল তার জীবনে। হস্তিনাপুরের রাজা, প্রসিদ্ধ ভরত-কুরুবংশের জাতক মহারাজ শান্তনু মৃগয়ায় এসেছেন। যমুনার তীরবাহী পথ ধরে শান্তনু অনেক দূর চলে এসেছেন। মৃগয়াযোগ্য পশুপাখী সব সময়েই মৃগয়াকারী পুরুষের সামনে এসে উপস্থিত হয় না। এখানে ওখানে তাকে খুঁজতে হয়। মৃগ’ ধাতুর মানেই তো অন্বেষণ করা। শান্তনুও সেই অন্বেষণেই ছিলেন। কিন্তু অন্বেষণ করতে করতে যে মৃগমদের সৌরভ তাঁর নাসাপুট পূর্ণ করল, তা কোনও পশুপাখির নয়, সে সৌরভ বসন্তের হাওয়ায় ভেসে আসা যৌবনের সৌরভ। আসলে সুগন্ধ এবং সৌরভ এখানে রূপকমাত্র। এ রূপক প্রলোভনের; এ রূপক আকর্ষণের প্রতীক। গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে স্বর্গসুন্দরীর মতো এক রমণীকে দেখতে পেলেন মহারাজ শান্তনু। তিনি সত্যবতী। তিনি আবারও সেই যমুনার ওপর ডিঙিনৌকোয় বসেছিলেন সবিভঙ্গে। এমন অসাধারণ রূপের আবেদন নাসিকার কাছে অবশ্যই নয়, সে আবেদন দৃষ্টির কাছে। বেশ বুঝি, সত্যবতীর নাম শুধু গন্ধবতী অথবা যোজনগন্ধা বলেই এখানে নাসিকা এবং গন্ধের অবতারণা।

এমন একটি সুন্দরী রমণীকে এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বসে থাকতে দেখে শান্তনু একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন তাঁকে কে তুমি? কার মেয়ে? এই জনশূন্য স্থানে কীই বা বা তুমি করতে চাইছ– কস্য ত্বমসি কা বাহসি কিঞ্চ ভীরু চিকীর্ষসি? সত্যবতী নিজের পালক পিতার ঋণ অস্বীকার করলেন না। জানালেন– আমি দাশ রাজার কন্যা। তিনি না থাকলে আমাকে এই নৌকো পারাপার করতে হয়।

.

০৩.

যমুনার কালো জলে কৃষ্ণবর্ণা সত্যবতীর কথা শুনে এবং অবশ্যই তার সর্বাঙ্গে সৌন্দৰ্য লাবণ্য দেখে আবারও মুগ্ধ হলেন শান্তনু। গঙ্গাকে শান্তনু গৃহবধূ করে আনতে পারেননি, হয়তো সে উপায়ও তার ছিল না। তা ছাড়া গঙ্গার সঙ্গে সম্ভোগ-মিলনের মধ্যে যে কঠিন শর্ত ছিল, তাতে দেবব্রতর মতো একটি পুত্র লাভ করেই তাকে শান্ত থাকতে হয়েছে মাত্র, গঙ্গাকে রাজধানীতে নিয়ে যাবার মতো স্বাধিকার তিনি নিজেও বোধ করেননি, উপরন্তু গঙ্গার মধ্যে সুগৃহিণী সুলভ সত্তাও হয়তো ছিল না। কিন্তু সুচিরকাল স্ত্রী-সঙ্গহীন এক রাজা হিসেবে শান্তনুর দিন কেটেছে শুধু রাজকার্য নিয়ে আর অনাবিল পুত্রস্নেহে। বসন্তের উদাসী হাওয়ায় অথবা শরতের শেফালি-প্রভাতে অথবা বর্ষার ঘন-দেয়া বরিষণের মধ্যে রাজা শান্তনুর যে কত কিছু সংগোপনে বলার থাকে, অথচ বলা হয় না, কত কিছুই যে শোনার থাকে, অথচ শোনা হয় না। এই অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা এড়াতেই যমুনা-পুলিনে এসেছিলেন শান্তনু। আর সেই মুহূর্তে কী অদ্ভুত যোগাযোগ বিধাতার আদিসৃষ্টির মতো শান্তনু দাশেয়ী গন্ধবতাঁকে দেখতে পেলেন যমুনার তরঙ্গচঞ্চল জলের মধ্যে।

দেখামাত্রই তার প্রেমে পড়লেন শান্তনু। একে ঠিক প্রেম বলা উচিত কিনা সে বিষয়ে আমাদের আধুনিক সচেতনতা কাজ করে, কিন্তু গন্ধবতী দাশেয়ীর শরীরের মধ্যে আগুন ছিল, সেদিকে তাকালে দৃষ্টিরমণ আপনিই হয়ে যায়। অতএব তাকে দেখা মাত্রই কামনায় মোহিত হলেন শান্তনু। দেবরূপিণী কন্যার দিকে তাকিয়ে রাজা বললেন, তুমি শুধু আমারই থাকবে, কন্যা! এরকম আহ্বান হয়তো জীবনে বহুবার শুনেছেন সত্যবতী। অতএব নিজের মর্যাদা সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ণ রেখে তিনি বললেন, আমার সেই অধিকার নেই, যাতে আমি নিজেই নিজেকে তুলে দিতে পারি তোমার হাতে। তুমি আমার পিতার সঙ্গে কথা বলো। শান্তনু সঙ্গে সঙ্গে কৈবর্তপল্লিতে দাশরাজার কাছে উপস্থিত হলেন এবং নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমি হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনু। তোমার কন্যাকে আমি বিবাহ করতে চাই– স গত্বা পিতরং তস্যা বরয়ামাস তাং তদা।

কৈবর্তপল্লির দাশ রাজা যথেষ্ট বুদ্ধিমান মানুষ এবং তিনি নিজের স্বজাতীয়দের যথেষ্ট আস্থাভাজনও বটে। মৎস্যরাজের কন্যাকে তিনি অন্নপান দিয়ে মানুষই শুধু করেননি, এই মেয়েকে তিনি নিজের মেয়ের মতোই ভালবাসেন এবং তার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও তিনি ভয়ংকর সচেতন। এবং তিনি অবশ্যই সচেতন নিজের সম্বন্ধেও। একজন রাজার সঙ্গে তাঁর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল, আর তিনি ধন্য হয়ে যাবেন, এমন হীনমন্যতায় তিনি ভোগেন না। তার বিষয়বুদ্ধিও অন্য অনেকের থেকেই প্রখর। হস্তিনাপুরের রাজার এমন অভাবনীয় আগমন এবং তার চেয়েও অভাবনীয় প্রস্তাব শুনে তিনি এটা ভালই বুঝে গেছেন, হস্তিনাপুরের রাজা যখন তার মেয়ের অঞ্চল ধরে এত দূর কৈবর্তপল্লিতে এসে উপস্থিত হয়েছেন, তখন তার কাছ থেকে মেয়ের ভবিষ্যতের সমাদর সম্বন্ধে কথা আদায় করে নিতে হবে। কারণ রাজবংশের মেয়ে বলেই সত্যবতীকে তিনি যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়ে মানুষ করেছেন এবং সেই মেয়ে যে হস্তিনাপুরের শুদ্ধান্তবাসিনী হয়ে শুধু অন্যতম এক রাজভোগ্যা রমণী হয়ে থাকবেন– এটা কৈবর্তপল্লির মণ্ডলমশায় দাশরাজা মেনে নেবেন না। তিনি কথা চান। হস্তিনাপুরের রাজার কাছে।

দাশরাজা চিবুক শক্ত করে রাজাকে বললেন, মেয়ে যখন হয়েছে, তখন তাকে তো পাত্রস্থ করতেই হবে, মহারাজ! সে আর এমন বেশি কথা কী– জাতমাত্রৈব মে দেয়া বরায় বরবৰ্ণিনী। তবে কিনা এ বিষয়ে আমার একটু কথা আছে। অভিলাষ সামান্যই, তবু, মহারাজ, আমার কথাগুলো শুনতে হবে আপনাকে। অর্থাৎ আপনি যদি সত্যিই এই কন্যাকে আপনার ধর্মপত্নী হিসেবে গ্রহণ করতে চান, তবে আপনাকে একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে, মহারাজ! সেই প্রতিজ্ঞাটি করলে আমি আপনার হাতে মেয়েকে তুলে দেব। সত্যি কথা বলতে কী, আপনার মতো এমন উপযুক্ত সৎপাত্র আর কোথায় পাব, মহারাজ ন হি মে ত্বৎসমো কশ্চিদ্ বরো জাতু ভবিষ্যতি।

শান্তনু বুঝলেন যে, রূপমুগ্ধ হয়ে তিনি কৈবর্তপল্লির মণ্ডলমশায়ের কাছে এসে খুব ভাল কাজ করেননি। তিনি খানিকটা বেকায়দায় পড়ে গেছেন। হস্তিনাপুরের মতো একটি রাজ্যের শাসক হবার ফলে শান্তনুর কূটনীতির বোধ কিছু কম নয়। তিনি সহজেই বুঝে গেলেন যে, কুটিল কৈবৰ্তরাজের মনে এমন কোনও কথা আছে, যা সহজে পূরণ করার মতো নয়। তিনি বললেন, আগে তোমার অভিলাষটা শুনি, দাশরাজ! তবেই না সেটা পূরণ করার চেষ্টা করব। যদি সেটা মানার মতো হয়, তবেই তো মানব। একটা অসম্ভব বস্তুকে তো আর সম্ভব করে ফেলা যাবে না।

দাশরাজা নিজের অন্তর ব্যক্ত করে বললেন, আমার এই কন্যার গর্ভে যে পুত্রটি হবে, তাকেই আপনি দিয়ে যাবেন আপনার সিংহাসনের উত্তরাধিকার। আপনার জীবদ্দশাতেই সেই পুত্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে হবে, যাতে অন্য কোনও সমস্থানীয় ব্যক্তি ওই সিংহাসনের উত্তরাধিকার দাবি না করতে পারে– নান্যঃ কশ্চন পার্থিবঃ।

নীল যমুনার জলে যে রমণীর নীলকান্তি রূপ দেখে মোহিত হয়েছিলেন শান্তনু, সেই মোহন মুখ ছাপিয়ে শান্তনুর হৃদয়ের মধ্যে এক কৈশোরগন্ধী যুবকের বৎসল মুখ ভেসে উঠল। সে মুখ গঙ্গাপুত্র দেবব্রতের মুখ। হস্তিনাপুরে তাঁর পিতা শান্তনু ছাড়া আর কোনও আপনজন নেই তার। রাজ্যের প্রত্যেকটি প্রজার জন্য কুমার দেবব্রত আন্তরিকতা বোধ। করেন এবং এমন সর্বাতিশয়ী গুণের জন্যই তিনি বহু পূর্বেই যুবরাজ-পদে বৃত হয়েছেন। সেই নবযৌবনোৎসুক দেবব্রতকে যৌবরাজ্য থেকে সরিয়ে দিয়ে এই স্বার্থান্বেষী কৈবর্তমুখ্যের অন্যায় আবদার মেনে নিতে পারলেন না শান্তনু।

কৈবৰ্তরাজ হস্তিনাপুরের রাজাকে ভালভাবেই চিনতেন। শান্তনুর পূর্বপ্রণয়িনী গঙ্গা এবং তার পুত্র দেবব্রতর কথা তিনি জানতেন না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। অন্যদিকে দাশরাজ সবচেয়ে যেটা বেশি জানতেন, সেটা হল মহারাজ শান্তনুর কামুক-স্বভাবের কথা। দাশরাজা তার নিজের অভিজ্ঞতাবশে এটা বুঝেছেন যে, শান্তনু একবার যখন তার মেয়েকে দেখে মোহিত হয়েছেন, তখন তাকে দিয়ে কিছু অন্যায় সত্যও করিয়ে নেওয়া যেতে পারে। কুমার দেবব্রতর জন্য আপাতত শান্তনুর চক্ষুলজ্জা কাজ করল বটে, কিন্তু শান্তনু যে বঁড়শি-বিদ্ধ মৎস্যের মতো রাজধানীতে ফিরলেন, সে কথা দাশরাজও বুঝলেন এবং অবশ্যই বুঝলেন মহারাজ শান্তনু।

সত্যি কথা, যুবক পুত্র দেবব্রতর কারণে শান্তনু সাময়িকভাবে দাশরাজার আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন বটে, কিন্তু তার হদয় থেকে সত্যবতীর আবেদন এতটুকুও নষ্ট হল না। মনে মনে সত্যবতীর কথা ভাবতে ভাবতেই তিনি হস্তিনাপুরে ফিরে এলেন– স চিন্তয়ন্নেব তু তাং.. কামোপহতচেতনঃ। বিধাতার আদিসৃষ্টির জন্য সেই আদিকামনাটুকুও তার মন জুড়ে রইল। হস্তিনাপুরের রাজকার্য, প্রজাকল্যাণ, মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা কিছু আর শান্তনুর ভাল লাগে না। সারা দিন বসে বসে তিনি শুধু সত্যবতীর কথাই ভাবেন।

এইরকমই এক ধ্যানমগ্ন দিনে– শান্তনুং ধ্যানমাস্থিতম কুমার দেবব্রত এসে উপস্থিত হলেন পিতার কাছে। সামান্য অনুযোগের সুরেই বললেন– সর্বত্রই তো আপনার মঙ্গল দেখতে পাচ্ছি, পিতা। সামন্ত রাজারা সকলেই পরাভুত, কোথাও কোনও ত্রাস অথবা বিহ্বলতার কারণ ঘটেনি আমাদের। তা হলে আপনার মুখে এই ক্লিষ্টতার আভাস দেখি কেন? ধ্যানী-যোগীর মতো সদা-সর্বদা আপনাকে অন্য চিন্তায় ব্যাপৃত দেখতে পাচ্ছি। আপনি রাজকার্য দেখছেন না, আমার সঙ্গেও বাক্যালাপ করছেন না, এমনকী আস্তাবল থেকে ঘোড়া টেনে নিয়ে আপনি যে বাইরে বাইরে ছুটে বেড়াতে ভালবাসেন, তাও তো আপনি ছেড়ে দিয়েছেন। ছেড়ে দিয়েছেন পূর্বের সমস্ত অভ্যাস। আর শরীরটাও তো আপনার খুব খারাপ হয়ে গেছে একেবারে বিবর্ণ, কৃশ, পাণ্ডুর–ন চাষেন বিনির্যাসি বিবর্ণো হরিণঃ কৃশঃ।

শান্তনু এসব কথার কোনও উত্তর দিলেন না। দেবেনই বা কী করে? সত্যবতীর রূপে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন– একথা তো আর কুমার দেবব্রতকে বলা চলে না। এদিকে গাঙ্গেয় দেবব্রতও বড় ঋজু-সরল মানুষ। পিতার মানসিক পরিবর্তনের কথা তাকে জানতেই হবে। অতএব একটু অধৈর্য হয়েই বললেন– আপনার ব্যাধিটা কী, জানতে পারি আমি? যদি ব্যাধির নিদান জানা যায়, তবে তার প্রতিকারও সম্ভব– ব্যাধিমিচ্ছামি তে জ্ঞাতুং প্রতিকুৰ্যাং হি তত্র বৈ।

শান্তনু তার অন্তর ব্যথার কথা স্পষ্ট করে বলতেন পারলেন না। যুবক বয়স্ক পুত্র, যাঁর নিজেরই বিবাহের সময় আসন্ন তাকে এসব কথা বলা যায়ই বা কী করে? কিন্তু মনে যদি প্রৌঢ়বয়সেও কারও স্ত্রীসঙ্গলিপ্সা প্রবল হয়, সে স্পষ্ট করে না বললেও আড়েঠাড়ে বলে। শান্তনুও তাই করলেন। তিনি কুমার দেবব্রতর খুব প্রশংসা করলেন বটে, কিন্তু সেই প্রশংসাবাণী এবং অনাবিল পুত্রবাৎসল্য অতিক্রম করে আরও এক বিপন্নতা এমনভাবেই তার অন্তর থেকে বেরিয়ে এল, যাতে বেশ বোঝা যায় যে, তিনি যা বলছেন, তার অন্যতর অর্থ আছে। পুত্রের অনুযোগ, তিনি ধ্যানী-যোগীর মতো বসে আছেন– সেই অনুযোগ তিনি স্বীকার করে নিয়েই বললেন– তবে কী জানো, বাবা! আমাদের এই বিখ্যাত বিশাল বংশে তুমিই একমাত্র সন্তান। তার মধ্যে তোমার পুরুষকার এবং অস্ত্ৰক্ষমতা প্রদর্শনের তীব্রতা এমনই এক মাত্রা লাভ করেছে যে, মাঝে মাঝে আমার ভয় হয়। মানুষের জীবন বড়ই চঞ্চল, কখন কী হয় কিছুই বলা যায় না, তাই বলছিলাম তোমার জীবনে যদি কোনও বিপদ ঘটে, তবে এই পরম্পরাগত বিশাল বংশটাই লুপ্ত হয়ে যাবে। এক ছেলের বাবা হওয়াটা বড়ই কষ্টকর বটে। শান্তনু এবার অসাধারণ উপায়ে নিজের আত্মগত বাসনাটি প্রকট করলেন। বললেন, তুমি আমার একশো ছেলের বাড়া এক ছেলে। আমি আর সন্তান বৃদ্ধির জন্য অনর্থক বিয়ে-টিয়ে করে গোলমাল পাকাতে চাই না- ন চাপ্যহং বৃথা ভুয়ো দারান্ কর্তুমিহোৎসহে।

এ যেন অতিরিক্ত মদ্য-মাংসপ্রিয় এক অতিথি আমন্ত্রণকারী ব্যক্তিকে বলছে, না, না, ওসব ব্যবস্থা আর করবেন না। ওই শাক-শুক্তোই খুব ভাল। কিন্তু এই ভালমানুষির সঙ্গে শান্তনু যখন বলেন, পিতার কাছে একটি মাত্র পুত্রও যা, নিঃসন্তান হওয়াও তাই– তখনই তার আসল ইচ্ছেটা বোঝা যায়। দেবব্রতকে তিনি শতপুত্রর অধিক গৌরব দান করেও যখন মন্তব্য করেন, যজ্ঞের কথা বলো, আর বেদের কথাই বলল, এই সমস্ত কিছুই পুত্রপ্রাপ্তির সৌভাগ্য থেকে কম– তখন বোঝা যায় দেবব্রত ছাড়াও অন্য আরও কোনও পুত্রের মাহাত্ম্য তার কাছে বড় হয়ে উঠছে। দেবব্রতকে শান্তনু বলেছিলেন, তুমি সব সময় যুদ্ধবিগ্রহ করে বেড়াচ্ছ– তঞ্চ শূরঃ সদামর্ষী শস্ত্ৰনিত্যশ্চ ভারত– এই যুদ্ধবিগ্রহের ফলে তোমার যদি ভালমন্দ কোনও ঘটনা ঘটে যায়, তুমি যদি কোনওভাবে নিহত হও– নিধনং বিদ্যতে ক্কচিৎ– তা হলে এই বিশাল বংশের কী গতি হবে?

শান্তনুর কথা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়– দেবব্রত ছাড়াও তিনি অন্য পুত্রের আকাঙ্ক্ষা করছেন এবং পুত্রের কথা বলাটাই যেহেতু ধর্মসম্মত, যেহেতু শাস্ত্রে বলে– পুত্রের প্রয়োজনেই বিবাহ– অতএব বিবাহের মতো একটি গৌণ কর্ম তার অনীঙ্গিত নয় এবং যেন পুত্রোৎপত্তির মতো কোনও মুখ্য কর্মের সাধন হিসেবেই এই বিবাহের প্রয়োজন। পুত্র দেবব্রত সব বুঝলেন। মহাভারতের কবি মন্তব্য করেছেন– সব বুঝেই বুদ্ধিমান দেবব্রত পিতার কাছে বিদায় নিয়ে কুরুসভার এক বৃদ্ধ মন্ত্রীর কাছে এলেন- দেবব্রতো মহাবুদ্ধিঃ পথযাবনুচিন্তয়। দেবব্রত তাঁকে পিতার মনোদুঃখের কারণ জিজ্ঞাসা করলে সেই মন্ত্রী কোনও ঢাক গুড়গুড় না করে স্পষ্ট বললেন, দাশ রাজার কন্যা সত্যবতীর জন্য শান্তনুর মন খারাপ হয়েছে। তিনি তাকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন।

মন্ত্রীর কথা শুনে দেবব্রত সঙ্গে সঙ্গে কুরুসভার অভিজ্ঞ বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়দের নিয়ে উপস্থিত হলেন সেই কৈবর্তপল্লিতে। পিতার বিবাহের জন্য দেবব্রত সত্যবতীকে যাচনা করলেন দাশরাজার কাছে। দাশরাজা বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি আকস্মিকভাবে কোনও উলটো কথা বলে বসলেন না। কুমার দেবব্রতকে সাদর সম্ভাবষণে তুষ্ট করে আগে তাকে নিয়ে গিয়ে বসালেন নিজের সভায়। বললেন, কুমার! আপনি মহারাজ শান্তনুর পুত্র। যাঁরা অস্ত্রবিদ বলে বিখ্যাত, তাদের মধ্যে আপনি হলেন গিয়ে শ্রেষ্ঠ। পিতার উপযুক্ত অবলম্বন। আপনাকে আর কীই বা আমি বলব। সত্যি কথা বলতে কী– মহারাজ শান্তনুর মতো এক বিরাট পুরুষের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধের সুযোগ পেয়েও যদি সেটা গ্রহণ করা না যায়, তবে আমি কেন স্বর্গের দেবরাজ ইন্দ্ৰঠাকুরও অনুতপ্ত হবেন মনে মনে।

দাশরাজা লুব্ধ শান্তনুর সঙ্গে যেভাবে কথা বলেছিলেন, যেভাবে নিজের শর্তটি তাঁকে শুনিয়েই চুপ করে গিয়েছিলেন, এখানে কুমার দেবব্রতর সঙ্গে সেভাবে কথা বললেন না। দেবব্রত যুদ্ধবাজ মানুষ, সত্যে তার চিরপ্রতিষ্ঠা, অতএব দাশরাজা ধীরভাবে তার কথাগুলি সযৌক্তিক করে তুললেন। দাশরাজা বললেন, এ মেয়ে আমার নয়, কুমার! কন্যাটি রাজা উপরিচরের যে উপরিচর কৌলীন্যের গুণে আপনাদেরই সবার সমকক্ষ। তিনি কতবার আমাকে বলেছেন যে, এই মেয়ের উপযুক্ত স্বামী হতে পারেন একমাত্র মহারাজ শান্তনু তেন মে বহুশস্তাত পিতাতে পরিকীর্তিতঃ। অৰ্হঃ সত্যবতীং বোটুম…।

কোথায় মহারাজ উপরিচর, আর কোথায় শান্তনু। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে সময়ের একটা মস্ত ফারাক ঘটে যায়। তবে ওই যে বলেছিলাম– মৎস্যদেশে উপরিচর বসু যে পুত্রটিকে বসিয়ে দিয়েছিলেন, সেই পুত্রের পরম্পরায় জাত কোনও মৎস্যরাজের কন্যা হবেন সত্যবতী। দাশরাজা কৈবর্তপল্লিতে তাকে মানুষ করেছেন বটে, তবে বাসব রাজাদের কৌলীন্য তিনি ভুলে যাননি। আর কী অদ্ভুতভাবে সত্যবতীর উপাদেয়তা এবং দুর্লভতা উপস্থাপন করছেন তিনি।

দাশরাজা বললেন, এই তো সেদিন দেবর্ষি অসিত এসেছিলেন আমার থানে। অসিত, দেবল– এঁরা সব দেবর্ষি। তা দেবর্ষি অসিত বললেন– সত্যবতীকে তার চাই। আমি সোজা ‘না’ বলে দিলাম– অসিতো হ্যপি দেবর্ষিঃ প্রত্যাখ্যাতঃ পুরা ময়া। রাজকন্যে বলে কথা, তাকে কি আর শুষ্করুক্ষ মুনির হাতে তুলে দিতে পারি?

দাশরাজা এবার প্রকৃত প্রস্তাব করছেন। বললেন, তবে কিনা কুমার! আমি মেয়ের বাবা বলে কথা। আমার তো কিছু বলার থাকতেই পারে। আমি শুধু চাই আমার মেয়ের ঘরে যে নাতি জন্মাবে, তার কোনও বলবান শত্রু না থাকে। আমি তো জানি রাজকুমার– তোমার মতো এক মহাবীর যদি অসুর-গন্ধর্বদেরও শত্রু হয়ে দাঁড়ায় তবে সেই অসুর গন্ধর্বরাও রক্ষা পাবে না, তাদের কাউকে আর সুখে বেঁচে থাকতে হবে না– ন স জাতু সুখং জীব্যে ত্বয়ি ক্রুদ্ধে পরন্তপে। তা এখানে আমার এই মেয়ের গর্ভে তোমার পিতার যে পুত্রটি জন্মাবে এবং ভগবান না করুন, কখনও যদি তার সঙ্গে তোমার শত্রুতা হয়, তবে তার আর বাঁচার আশা থাকবে? শান্তনুর সঙ্গে আমার মেয়ের বৈবাহিক সম্বন্ধে আমি এইটুকুই মাত্র দোষ দেখতে পাচ্ছি। আমার আর কোনও অসুবিধেই নেই৷ সত্যবতীকে তার হাতে। তুলে দেওয়া বা না দেওয়া– এর মধ্যে এইটুকুই যা খটকা– এতাবান্অত্র দোষো হি… দানাদানে পরন্তপ।

.

০৪.

কুমার দেবব্রত কৈবর্ত রাজার আশয় স্পষ্ট অনুধাবন করলেন। সমস্ত ক্ষত্রিয়বৃদ্ধর সামনে তিনি সোদাত্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন– তুমি তোমার মনের সত্য গোপন করোনি, দাশরাজ! আমিও তাই সত্যের প্রতিজ্ঞা করছি। উপস্থিত ক্ষত্রিয়রা সবাই শুনে রাখুন– এমন প্রতিজ্ঞা আগে কেউ করেননি, পরেও কেউ করবেন না– নৈব জাতো ন চাজাত ঈদৃশং বক্তৃমুৎসহেৎ। দেবব্রত এবার দাশরাজের কথার সূত্র ধরে বললেন, তুমি যেমনটি বললে, আমি তাই করব। আমি কথা দিচ্ছি– এই সত্যবতীর গর্ভে যে পুত্র জন্মাবে, সেই আমাদের রাজা হবে– যোহস্যাং জনিষ্যতে পুত্রঃ স নো রাজা ভবিষ্যতি।

আগেই বলেছিলাম, কৈবৰ্তরাজ পাটোয়ারি বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। তিনি বুঝলেন– সত্যবতীর ছেলের রাজা হবার পথ নিষ্কণ্টক। কিন্তু রাজত্ব, রাজসুখ এমনই এক বস্তু যা পেলে বংশপরম্পরায় মানুষের ভোগ করতে ইচ্ছা করে। উল্কার মতো এসে যে সুখ ধূমকেতুর মতো চলে যায়, সে সুখ রাজতন্ত্রের রাজা বা গণতন্ত্রের নেতা– কেউ চান না। দাশরাজা তাই চিরস্থায়ী রাজসুখের স্বপ্ন দেখে দেবব্রতকে বললেন, আপনি যা বলেছেন, তা শুধু আপনারই উপযুক্ত। তবে কিনা আমি মেয়ের বাবা বলে কথা। মেয়ের বাবাদের স্বভাবই এমন আর সেই স্বভাবের বশেই আরও একটা কথা আমায় বলতে ইচ্ছে- কৌমারিকাণাং শীলেন বক্ষ্যাম্যহমরিন্দম।

কৈবৰ্তরাজ বলেন, আপনার প্রতিজ্ঞা যে কখনও মিথ্যা হবে না, সে কথা আমি বেশ জানি। আমি জানি, আপনার পিতার পরে আমার সত্যবতীর ছেলেই রাজা হবে। কিন্তু কুমার! আপনার যে পুত্র হবে তার সম্বন্ধে আমার সন্দেহটা তো থেকেই যাচ্ছে–তবাপত্যং ভবে যত্ত্ব তত্র নঃ সংশয়ে মহান। দেবব্রত দাশরাজার অভিপ্রায় বুঝে সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়দের শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, শুনুন মহাশয়েরা, আমার পিতার জন্য আমি প্রতিজ্ঞা করছি– আমি পূর্বেই রাজ্যের অধিকার ত্যাগ করেছি, আপনারা শুনেছেন। এখন আমি বলছি– আমি বিবাহও করব না এ জীবনে, আজ থেকে আমি ব্রহ্মচর্য পালন করব– অদ্য। প্রভৃতি মে দাশ ব্রহ্মচর্যং ভবিষ্যতি। চিরজীবন অপুত্রক অবস্থায় থাকলেও এই ব্রহ্মচর্যই আমাকে স্বর্গে নিয়ে যাবে।

সেকালের দিনে মানুষের বিশ্বাস ছিল– অপুত্রকের স্বর্গলাভ হয় না। কিন্তু ব্রহ্মচারীর জীবনে যে নিয়ম-ব্রত এবং তপস্যার সংযম আছে, সেই সংযমই তাকে স্বর্গের পথে নিয়ে যায়। দেবব্রতের প্রতিজ্ঞার পরে ব্রহ্মচর্যের সংযম তাই স্বেচ্ছাকৃত হলেও অকারণে নয়।

দেবব্রতর কঠিন প্রতিজ্ঞা শুনে অন্য কার মনে কী প্রতিক্রিয়া হল, মহাভারতের কবি সে খবর দেননি, কিন্তু দাশ রাজার হৃদয় আপন স্বার্থসিদ্ধিতে প্রোৎফুল্ল হয়ে উঠল। সানন্দে তিনি ঘোষণা করলেন, মেয়ে দেব না মানে? তোমার পিতার নির্বাচিত বধূকে এই এখুনি তোমার সঙ্গেই পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি।

পিতার মনোনীত হস্তিনাপুরের রাজবধূ সত্যবতীর সামনে এসে দাঁড়ালেন দেবব্রত। তাকে আপন জননীর সম্মান দিয়ে ভীষ্ম বললেন, এসো মা! রথে ওঠো। আমরা এবার নিজের ঘরে ফিরব– অধিরোহ রথং মাতঃ গচ্ছাবঃ স্বগৃহানিতি।

বয়সের দিক দিয়ে দেখতে গেলে দেবব্রত হয়তো সত্যবতীর সমবয়সি হবেন প্রায়। হয়তো বা সত্যবতী একটু বড়। দেবব্রত যখন শান্তনুর ঔরসে গঙ্গাগর্ভে জন্মেছেন, হয়তো তার সমসাময়িককালেই পরাশরের ঔরসে সত্যবতীর গর্ভে জন্মেছেন মহাভারতের কবি। কিন্তু বিবাহের বয়স যেহেতু রমণীর ক্ষেত্রে সবসময়েই কম হয় অপিচ পরাশর যেহেতু সত্যবতীর প্রথম যৌবনটুকুই লঙ্ঘন করেছিলেন, তাতে অনুমান করি–সত্যবতী দেবব্রতর চেয়ে খুব বেশি বড় হবেন না বয়সে।

যাই হোক, দেবব্রত যেদিন জননীর সম্বোধনে সত্যবতীকে নিজের রথে তুলে নিয়ে হস্তিনাপুরের পথে পা বাড়ালেন, সেদিন থেকেই এই অল্পবয়স্কা জননীর সঙ্গে তার ভাব হয়ে গিয়েছিল। হস্তিনাপুরের রাজসংকটে এই প্রায় সমবয়স্ক দুই মাতাপুত্রের পরম বন্ধুত্ব বার বার পরে আমাদের স্মরণ করতে হবে। কিন্তু তার আগে জানতে হবে- দেবব্রত অল্পবয়স্কা জননীকে রথে চাপিয়ে–রথমারোপ্য ভাবিনীম উপস্থিত হলেন হস্তিনাপুরের রাজধানীতে, পিতার প্রকোষ্ঠে। শান্তনুকে তিনি জানালেন কীভাবে দাশরাজাকে রাজি করাতে হয়েছে এই বৈবাহিক সম্পর্ক সুসম্পন্ন করার জন্য।

এই মুহূর্তে শান্তনুর মুখে পুত্র দেবব্রতর স্বার্থ-সম্বন্ধীয় কোনও দুশ্চিন্তার বলিরেখা আপতিত হয়নি। একবারও উচ্চারিত হয়নি– পুত্র! তোমাকে আমি যুবরাজ পদবীতে অভিষিক্ত করেছিলাম, এখনও তুমি তাই থাকলে। একবারও শান্তনু বলেননি- দেবব্রত! তোমার মতো পুত্র থাকতে, অন্য পুত্রে প্রয়োজন নেই আমার। পরম নৈঃশব্দ্যের মধ্যে দেবব্রতর যৌব-রাজ্যের সুখ সংক্রান্ত হল শান্তনুর ভাবী পুত্রের জন্য। যৌবনবতী সত্যবতীকে লাভ করে শান্তনুর হৃদয়ে যে রোমাঞ্চ তৈরি হয়েছিল, সেই আকস্মিক হৃদয়াফ্লাদ মহাভারতের কবি সলঙ্কে বর্ণনা করেননি, কারণ আপন জননী সত্যবতীর সম্পর্ক চেতনার মধ্যে রাখলে শান্তনুও মহাভারতের কবির পিতা। তার পক্ষে শান্তনুর হৃদয় ব্যাখ্যা করা সাজে না। যা সাজে তিনি তাই করেছেন। শান্তনুর মুখ দিয়ে পরমেপ্সিত স্ত্রী-লাভের কৃতজ্ঞতা বেরিয়ে এসেছে পুত্র দেবব্রতর জন্য। তিনি বর দিলেন– বৎস! তুমি যত কাল বেঁচে থাকতে চাও, ততকালই বেঁচে থাকবে। মৃত্যু তোমার ইচ্ছাধীন, ইচ্ছামৃত্যু হবে তুমিন তে মৃত্যু প্রভবিতা যাবজ্জীবিতুমিচ্ছসি।

আমরা শুধু ভাবি– শান্তনু যখন এক পুত্রের জীবন নিয়ে পূর্বে এত শঙ্কিত হচ্ছিলেন, তখনই এই মহান বরদান সম্পন্ন করলে পারতেন। কিন্তু তাতে মহাভারতের কবির পক্ষে লোক চরিত্রের বৈচিত্র্য দেখানো সম্ভব হত না। পুত্রকে সারা জীবন বাঁচিয়ে রাখা বা মৃত্যুকে তার ইচ্ছাধীন করে রাখার মধ্যে পিতার সব থেকে বেশি বাৎসল্য প্রকাশ পায়, জানি। হয়তো পুত্রকে এক বৃহৎ জীবন দান করে তার নিজকৃত বঞ্চনার প্রতিদান দিয়েছেন শান্তনু। কিন্তু মহাভারতের কবির দৃষ্টিতে এই ঘটনা বঞ্চনার অক্ষরে লিখিত হয়নি, হয়তো তার কাছে এ ঘটনা তত রূঢ়ও নয়। পরবর্তী সময়ে মহাভারতের বিশাল ঘটনা-সন্নিবেশের মধ্যে দেবব্রতকে যেভাবে উপস্থাপিত করা হবে, তাতে দেখা যাবে, পিতার বাৎসল্যে এই মহান পুরুষটি বঞ্চিত হলেও, অতিদীর্ঘ জীবনের অধিকারী হওয়ার সুবাদে তিনি এক বিশাল যুগের দ্রষ্টা বলে পরিগণিত হবেন।

হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে সত্যবতীর প্রবেশ নিয়ে যে নাটকের সৃষ্টি হয়েছিল, তার মধ্যে স্বয়ং সত্যবতীর ভূমিকা কতটুকু ছিল, তা নির্ধারণ করা খুবই শক্ত। যা দেখেছি, তাতে দাশরাজাই পিতা হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন এবং প্রিয় পালিতকন্যাটির ভবিষ্যৎ-সুরক্ষার জন্য হস্তিনাপুরে বিখ্যাত ভরতবংশের উত্তরাধিকারও তিনি নির্ণয় করে দিয়েছেন। আমাদের জিজ্ঞাসা হয়– এতে সত্যবতীর কোনও পরোক্ষ ভূমিকা ছিল কিনা? এটা ঘটনা যে, মহারাজা শান্তনু যেমন সত্যবতীর প্রেমে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, সত্যবতী তা হননি। যদি হতেন, তা হলে দাশরাজা শান্তনুকে যে শর্ত দিয়েছিলেন এবং সেই শর্ত শুনে শান্তনু যখন বিমূঢ় হয়ে রাজধানীতে নিবাত-নিস্পন্দ দীপশিখার মতো বসেছিলেন, তখন আমরা সত্যবতীকে এমন নির্বিকার দেখতাম না। শান্তনু তার কাছে একান্তে প্রেম নিবেদন করেছিলেন। সেই প্রেমের মধ্যে যদি এতটুকু পারস্পরিকতা থাকত, তা হলে দাশ রাজার শর্তে বিহ্বল শান্তনুর অবস্থা ভেবে একবারের তরেও সত্যবতী পিতা দাশরাজকে বলতেন– দেখুন, এতটা বোধহয় ঠিক হল না। কিন্তু না, কিছুই তিনি বলেননি পিতাকে। কুমার দেবব্রত বৈবাহিক ঘটনার মধ্যে অনুপ্রবেশ করে দাশরাজের বাড়িতে এসে সশব্দ অভিভাষণে দাশরাজার অপমানজনক শর্ত যখন মেনে নিলেন, তখনও সত্যবতীকে আমরা কোনও কথা বলতে শুনিনি।

এক হতে পারে অথবা হতেই পারে যে, পিতাকে অতিক্রম করা সত্যবতীর সাধ্য ছিল না এবং সে কথা প্রথমেই তিনি শান্তনুকেও জানিয়েছিলেন। আবার এও হতে পারে– দাশরাজা যে শর্ত আরোপ করেছিলেন, তাতে তার মৌন-সম্মতি ছিল। এমনকী প্রায় তারই সমবয়সি কুমার দেবব্রত যে তারই কারণে পিতার রাজ্যের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে ভবিষ্যতের সমস্ত সম্ভাবনা রুদ্ধ করে দিয়ে ভীষ্মপ্রতিজ্ঞ হলেন, তাতেও তাঁর রমণী হৃদয় এতটুকু বিগলিত হয়নি। অথবা এসব কিছু নয়, সত্যবতী ঘটনা-প্রবাহে গা ভাসিয়ে বসেছিলেন; পিতা তার ভবিষ্যতের আখের বুঝে নিয়ে যেভাবে তার বিবাহ দিয়েছেন তিনিও লক্ষ্মী মেয়ের মতো সব মেনে নিয়ে কুরুবাড়ির রাজমহিষী হয়ে বসেছেন।

উপরি উক্ত কল্পগুলির মধ্যে কোনটা সত্যবতীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, বিনা প্রমাণে তা বলা উচিত হবে না। কিন্তু একথা আমার বারবার মনে হয়– সত্যবতী অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মহিলা এবং তার ব্যক্তিত্বও হস্তিনাপুরের পট্টমহিষী হবার সর্বথা উপযুক্ত। বিবাহের পর অবশ্য খুব বেশি সময় অতিবাহিত হল না। দুটি সন্তানের জন্মের পর, অন্তত কনিষ্ঠটি বড় না হতেই শান্তনু মারা গেলেন। মহামতি ভীষ্ম সত্যবতীর নির্দেশ মস্তকে ধারণ করে জ্যেষ্ঠ পুত্র চিত্রাঙ্গদকে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে স্থাপন করলেন– স্থাপয়ামাস বৈ রাজ্যে সত্যবত্যা মতে স্থিতঃ।

এই একবারই বোধহয়; স্বামী শান্তনুর অবর্তমানে এই প্রথম এবং একবারই সত্যবতী ভীষ্মের ওপর কোনও নির্ভরতা না রেখে কাজ করেছিলেন। সত্যবতীর গর্ভজাত প্রথম পুত্র চিত্রাঙ্গদ ভীষ্মের ছত্রছায়ায় মানুষ হননি এবং হয়তো সত্যবতী তার প্রয়োজনও বোধ করেননি। কিন্তু রাজা হবার পর চিত্রাঙ্গদ প্রসিদ্ধ ভরতবংশের গৌরবমতো চলেননি। একবারের তরেও একথা তো শুনিইনি যে, কোথাও কোনওভাবে সত্যবতীর জ্যেষ্ঠপুত্র চিত্রাঙ্গদ ভীষ্মের প্রভাব মেনে চলেছেন। বরঞ্চ মহাভারত যা বলেছে, তাতে চিত্রাঙ্গদ অত্যন্ত বলদর্পী এবং অহংকারী রাজা ছিলেন। প্রতিবেশী রাজাদের তিনি আপন ভুজবলে পর্যদস্ত করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু অনুপযুক্ত রাজার অবিনয় তাঁকে এতটাই গ্রাস করেছিল যে, মানুষকে তিনি মানুষ বলে মনে করতেন না, নিজের সমান তো কাউকেই নয়– মনুষ্যং ন হি মেনে স কঞ্চিৎ সদৃশমাত্মনঃ। এর ফল হয়েছে খুব সরল। একদিন এক গন্ধর্ব-গুন্ডার হাতে তার প্রাণটাই চলে গেল।

চিত্রাঙ্গদের প্রেতকার্য সম্পন্ন হবার পর ভীষ্ম কিশোর বিচিত্রবীর্যকে সিংহাসনে বসালেন এবং এই অপ্রাপ্তযৌবন বালকটিও ভীষ্মের কথামতোই চলতে আরম্ভ করল- বিচিত্রবীর্যঃ স তদা ভীষ্মস্য বচনে স্থিতঃ। এই ঘটনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, কী তাড়াতাড়ি বিচক্ষণা সত্যবতী তার নিজের ভুল শুধরে নিয়েছেন। চিত্রাঙ্গদ রাজা হবার পর সত্যবতী একবারের তরেও তার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে এই উপদেশ দেননি যে দেখ বাছা! মহামতি ভীষ্ম এই কুরুরাষ্ট্রের সবচেয়ে অভিজ্ঞ পুরুষ, সমস্ত রাজনীতির গূঢ় তত্ত্বগুলি তার জানা। অতএব তুমি তাঁর পরামর্শ অনুসারে রাজ্য চালাও।

এই উপদেশ সত্যবতী দেননি, কারণ, হয়তো একবারের তরেও তার মনে হয়েছিল যে, ভীষ্মের পরামর্শ ছাড়াই তার জ্যেষ্ঠ পুত্রটি এমন সুন্দর রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন যে, প্রজারা ধন্য ধন্য করবে। কিন্তু এই ঘটনা ঘটেনি এবং চিত্রাঙ্গদের মৃত্যুর পর সত্যবতী অতি সত্বর তার ভুল শুধরে নিয়েছেন এবং কিশোর কুমার বিচিত্রবীর্যকে সোজাসুজি ভীষ্মের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে প্রাজ্ঞ ভীষ্মকে দেখুন। তিনি যেহেতু সত্যবতীর পিতার কাছে কুরুরাষ্ট্রের নায়কত্ব বিসর্জন দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, অতএব তিনিও কখনও নিজের মত খাটাননি এবং কুমার বিচিত্রবীর্যকেও স্বমতে চলতে বাধ্য করেননি। সত্যবতীর অপ্রাপ্তযৌবন পুত্রটিকে ভীষ্ম যে পরামর্শই দিয়ে থাকুন– তা রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, যাই হোক না কেন, তিনি কোনওদিন সত্যবতীকে ভুলেও অতিক্রম করেননি। অর্থাৎ রাষ্ট্রপরিচালনার সমস্ত ব্যাপারে ভীষ্ম যেসব পরামর্শ দিয়ে বিচিত্রবীর্যকে সাহায্য করতেন, তা তিনি রাজমহিষী এবং রাজমাতা সত্যবতীর মত নিয়েই করতেন। মহাভারতে বলা হয়েছে বিচিত্রবীর্যের হয়ে ভীষ্ম যে কুরুরাজ্য পালন করতেন, তা সত্যবতীর মত অনুসারেই করতেন– পালয়ামাস তরাজ্যং সত্যবত্যা মতে স্থিতঃ।

ভীষ্মের তত্ত্বাবধানে কুমার বিচিত্রবীর্যের রাজ্যশাসন চলতে লাগল এবং ভীষ্ম হাল ধরে ছিলেন বলেই তা ভালই চলতে লাগল। বিচিত্রবীর্য বড় হলেন এবং তার বিবাহযোগ্য বয়সও হল। ভীষ্ম যখন ভাবছেন যে, এবার বিচিত্রবীর্যের বিয়ে দেওয়া দরকার, তখনই কাশীরাজের তিন মেয়ে অম্বা, অম্বিকা এবং অম্বালিকার কথা তার কানে এল। স্বয়ম্বরসভায় কাশীরাজের তিন মেয়ের পাণিপ্রার্থী হিসেবে স্বয়ং বিচিত্রবীর্যকে তিনি পাঠানোর কথা একবারও ভাবলেন না। হয়তো কুরুবংশের রাজাদের পর পর মৃত্যু তার মনে যে ভীতি সৃষ্টি করেছিল, সেটাই এই সিদ্ধান্তের কারণ। স্বয়ম্বরসভা থেকে তিনটি মেয়েকে জোর করে তুলে আনতে গেলে অন্যান্য পাণিপ্রার্থী রাজাদের সঙ্গে যে যুদ্ধ হবে, সেই যুদ্ধের অবিশ্বাস্য পরিণতি নবীন যুবক বিচিত্রবীর্যের ওপরে চাপাতে চাননি ভীষ্ম। এব্যাপারে নিশ্চয়ই জননী সত্যবতীর সঙ্গে তার কথা হয়েছিল এবং পুত্রস্নেহে তিনিও ভীষ্মের এই পরিকল্পনা মেনে নিয়েছিলেন। কেননা, এটা খুব স্বাভাবিক ছিল না সেকালে যে, কনিষ্ঠ ভাইয়ের বিয়ের জন্য প্রায় পিতৃপ্রতিম এক প্রৌঢ় অথবা বৃদ্ধ কন্যার পাণিপ্রার্থী হয়ে যাচ্ছেন– এই ব্যাপারটা সত্যবতীও সমর্থন করেছেন পুত্রের প্রতি মায়ায়। অতএব সত্যবতীর মত নিয়ে ভীষ্ম একা একটিমাত্র যুদ্ধরথ সহায় করে কাশীরাজ্যে গেলেন তিন কন্যার সন্ধানে।

এত তোড়জোড় করে যে বিবাহের ব্যবস্থা করলেন ভীষ্ম, তার পরিণতি যে ভাল হয়নি, সে তো সকলেরই জানা। কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বার ব্যাপারটা তো ভীষ্মের জীবনে সব অর্থেই গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল, অন্যদিকে বিয়ের পর মাত্র সাত বৎসর বেঁচে থেকে অপুত্রক অবস্থাতেই লোকান্তরিত হয়েছেন তরুণ বিচিত্রবীর্য। ঠিক এই সময়টা থেকে সত্যবতীকে আমরা যে শুধু নতুনভাবেই চিনতে পারি, তাই নয়, সত্যবতী যে কত বড় বিচক্ষণা দীর্ঘদর্শিনী রাজমহিষী হতে পারেন, তা এই সময় থেকে বোঝা যায়। এখন তার স্বামী বেঁচে নেই, সম্পত্তির দায়ভা পাওয়া পুত্রেরাও বেঁচে নেই, শুধু তিনি নিজে বেঁচে আছেন। এখন তো তিনি স্বচ্ছন্দে ভাবতে পারতেন– আর কীসের দায় এই হস্তিনাপুরের রাজতন্ত্র নিয়ে। তার স্বামী-পুত্রের স্বার্থ নেই; চুলোয় যাক সব। ভীষ্ম আছেন হাল ধরবার মানুষ, অতএব যতদিন বেঁচে আছেন, রাজমহিষীর মর্যাদায় অন্ন-বস্ত্র-ঐশ্বর্য এবং আলস্যের চর্চাতেই তার জীবন কেটে যাবে।

কিন্তু এমনটি তিনি ভাবেননি। প্রসিদ্ধ ভরতবংশের রাজবধূ হয়ে এসে স্বামী হারাবার পর থেকেই তিনি দেবব্রত ভীষ্মকে বড় নিপুণভাবে লক্ষ করেছেন। লক্ষ করেছেন তার নিঃস্বার্থ রাজসেবী চরিত্র এবং হয়তো এই মানুষটির সঙ্গে মিশে-মিশেই, অথবা তার পরামর্শ শুনে চলতে-চলতেই তিনিও বুঝি একদিন হস্তিনাপুরের সিংহাসনের উত্তরাধিকার এবং প্রজাকল্যাণের সম্বন্ধে দায়িত্ব অনুভব করতে আরম্ভ করলেন। অন্যদিকে ভীষ্মের ব্যাপারে তার কিছু অন্তর্যন্ত্রণাও কাজ করেছে। তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, প্রধানত তার কারণেই তার স্বামীর এই প্রথমজন্মা পুত্রটি রাজ্যের অধিকার পাননি এবং তারই কারণে ভীষ্মকে একদিন বিবাহ না করে নিজের উত্তরাধিকার স্তব্ধ করে দিতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, ভীষ্মের মতো এইরকম বিরাট পুরুষের বংশ-সম্ভাবনা এবং রাজ্যের উত্তরাধিকার– দুইই স্তব্ধ করে দিয়ে স্বার্থপরের মতো আপন গর্ভে যাঁদের তিনি জন্ম দিলেন তারা কি জাতের মানুষ হলেন! প্রখ্যাত ভরত-কুরুদের উত্তরাধিকারী হয়ে তাদের একজন হলেন বলদর্পী, যিনি এক গন্ধর্বের সঙ্গে যুদ্ধোন্মত্ত হয়ে নিজের প্রাণ দিলেন বেঘোরে। আর অন্যজন বিচিত্রবীর্য! তিনি হলেন কামুক। অনিয়মিত কামসেবার কারণে তিনি রাজরোগে মৃত্যু বরণ করলেন শেষ পর্যন্ত।

.

০৫.

ঠিক এইসময় থেকেই সত্যবতী অত্যন্ত লজ্জিত বোধ করেছেন। বুঝেছেন– এত দিন যা করেছেন, ঠিক করেননি। যা করেছেন, তাতে ধর্ম নষ্ট হয়েছে, ভীষ্মের কাছে তাঁর মুখ দেখানোর উপায় নেই। অন্যদিকে কুরু-ভরতের বিখ্যাত বংশ এখন অবলুপ্তির পথে এবং তার আপন পিতৃবংশেও যেহেতু তিনি ছাড়া আর কেউ নেই, অতএব সে বংশেও দাশরাজার দুহিতৃ-পুত্র কেউ রইল না বংশে বাতি দেবার জন্য ধর্মঞ্চ পতিবংশঞ্চ মাতৃবংশঞ্চ ভাবিনী। এই আত্মগ্লানিই তাকে কিন্তু এসময় উদার বিস্তীর্ণ এক পৃথিবীতে অবতীর্ণ করে দিল। তিনি বুঝলেন যে, হস্তিনাপুরের রাজনীতিকে তিনিই আপন স্বার্থে ক্লিন্ন করে দিয়েছেন, অতএব এটা তারই দায়িত্ব যাতে কুরু-ভরতের বংশধারা হস্তিনাপুরে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শান্তনব ভীষ্মই হলেন একমাত্র ব্যক্তি, যাঁর কাছে তার দায় আছে।

সত্যবতী খুব সরলভাবেই প্রস্তাব দিলেন ভীষ্মকে, যদিও এত সরলভাবে তার ভাবা উচিত ছিল না, অন্তত সত্যবতীর মতো বুদ্ধিদৃপ্তা রমণীর পক্ষে তো আরও উচিত ছিল না। প্রস্তাবটা এতটাই সরল যে, অনেকের মনে হতে পারে যে, এরমধ্যে রীতিমতো একটা ভান আছে, কেননা সত্যবতী খুব ভালভাবে জানতেন যে, ভীষ্মের মতো কঠিনপ্রতিজ্ঞ ব্যক্তি তার প্রস্তাবে কখনও রাজি হবেন না। আর ঠিক সেইজন্যই এটাকে ভান বলে মনে হয়। আমি তবু এটাকে ভান বলে মনে করি না। কেননা এ ছাড়া সত্যবতীর কীই বা উপায় ছিল? তার আপন স্বার্থবুদ্ধি যতটুকুই থাকুক, তা বোধহয় তার জ্যেষ্ঠপুত্র চিত্রাঙ্গদ মারা যাবার পরেই চলে গেছে। বিচিত্রবীর্য রাজা হবার পর থেকেই তিনি ভীষ্মের ওপর পরম নির্ভরশীল হয়ে ছিলেন এবং কুত্রাপি তিনি ভীষ্মকে অতিক্রমও করেননি। তারপর যখন বিচিত্রবীর্যও মারা গেলেন, তখন তিনি বুঝেছেন যে, ভবিতব্য তথা কর্মফল এমনই এক অভাবিত কল্প, যা আপন ছন্দে চলে। বিবাহের পূর্বে শত শর্ত আরোপ করে স্বামীকে দিয়ে যা তিনি করাতে চেয়েছিলেন, আজ ভবিতব্য তা হতে দেয়নি। অতএব আপন নিক্ষিপ্ত থুৎকার নিজেই গলাধঃকরণ করে সত্যবতী নিজের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করছেন ভীষ্মের কাছে নতি স্বীকার করে।

সত্যবতী বললেন, স্বৰ্গত মহারাজ শান্তনুর পিণ্ড, যশ এবং বংশ আজ তোমারই ওপর নির্ভর করছে, ভীষ্ম ত্বয়ি পিণ্ডশ্চ কীর্তিশ্চ সন্তান প্রতিষ্ঠিত। সত্যবতী যা বলবেন, তার ভনিতা করছেন ভীষ্মের কাছে। বললেন, দেখ, পুণ্যকর্ম করলে স্বর্গলাভ যেমন নিশ্চিত, সত্য পরায়ণ হলে আয়ু যেমন নিশ্চিত তেমনই ধর্মও তোমার মধ্যে নিত্য প্রতিষ্ঠিত আছে– ত্বয়ি ধর্মস্তথা ধ্রুবঃ। ধর্ম, ধর্মের স্থিতি, কৌলিক আচার– সবই তুমি জান এবং বিপন্ন অবস্থায় তোমার জ্ঞান বৃহস্পতি এবং শুক্রাচার্যের মতো। তোমার ওপর আমার অত্যন্ত ভরসা আছে বলেই একটা বিশেষ কাজে তোমায় নিযুক্ত করব- তস্মাৎ সুভৃশমাশ্বস্য ত্বয়ি ধর্মভৃতাং বর। সত্যবতী এবার আসল কথাটা পেড়ে বললেন, দেখ, আমার ছেলে বিচিত্রবীর্য, সে তো তোমারই ভাই বটে; তা সে তো, বাবা অকালে চলে গেল। এখন তার যে দুই মহিষী, তাদের রূপ-যৌবন সব আছে, কিন্তু স্বামীটি তাদের চলে গেল। তাদের কোলে একটি ছেলেও হল না। তাই আমি বলছিলাম বাছা, তুমি এই দুই কুলবধূর গর্ভে পুত্রের জন্ম দিয়ে এই বিখ্যাত বংশধারা রক্ষা কর– তয়োরুৎপাদয়াপত্যং সন্তানায় কুলস্য নঃ। এই নিয়োগকর্মে যে অনুমতি প্রয়োজন হয়, সে অনুমতি আমি দিচ্ছি তোমাকে এ বাড়ির গুরুজন হিসেবে। আর এই প্রস্তাবে তুমি যদি একান্তই রাজি না হও, তা হলে তুমি নিজেই রাজ্যে অভিষিক্ত হও, ধর্মানুসারে বিবাহ কর এবং কোনও ভাবেই যেন পিতা-পিতামহদের কুল মজিয়ে দিয়ো না– দারাংশ্চ কুরু ধর্মেণ মা নিমজ্জীঃ পিতামহান।

সত্যবতী ভীষ্মের কাছে যে অন্যায় করেছিলেন, সে নিজের স্বার্থেই হোক অথবা পিতার চাপে, সেই অন্যায় তিনি স্বালন করার চেষ্টা করলেন যথাসাধ্য যথামতি। ভীষ্ম অবশ্যই তার কথা মানতে পারলেন না। তবে অবশ্যই তিনি সত্যবতীর দুশ্চিন্তাটুকু শিরোধার্য করে নিলেন। তাই বলে তার পূর্বের ক্ষার যতটুকু ছিল, সেটুকু থেকে তিনি মুক্তি দিলেন না সত্যবতীকে। মহাকাব্যের প্রৌঢ় নায়ক বলে কথা। তিনি বিপৎ-ত্রাণ করবেন নিশ্চয়ই, কিন্তু তাই বলে যিনি আত্মদোষে কুরুবংশের সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তিটিকে রাজ্যের উত্তরাধিকার তথা বংশকর্তার ভূমিকা থেকে বঞ্চিত করেছিলেন, তার প্রতি একটুও সত্য উচ্চারণ করে বিব্রত না করাটা মহাকাব্যের তরিকা নয়। ভীষ্ম বললেন- তুমি তো বেশ ভালই জান যে, কেন আমি সন্তান উৎপাদনে পুনরায় ব্রতী হতে পারি না। তোমার বিবাহের শর্ত নিয়েও যে সব ঘটনা ঘটেছিল, তাও তুমি ভালই জান জানাসি চ যথা বৃত্তং শুল্কহেতোস্তদন্তরে। কাজেই আমি আমার প্রতিজ্ঞা থেকে চ্যুত হতে পারি না, কোনও অবস্থাতেই নান ত্বহং সত্যমুৎসুষ্ঠুং ব্যবসেয়ং কথঞ্চন।

ভীষ্ম অবশ্য সত্যবতীর দুশ্চিন্তাটুকু ‘শেয়ার করছেন। সত্যবতী আত্মসমর্পণ করে বলেছিলেন- আমাদের এই বিপদ, এই কুরুকুল এখন উৎসন্ন হয়ে যেতে বসেছে। হ্যাঁ, আমি জানি, তোমার প্রতিজ্ঞার কথাও জানি এবং আমারই জন্য যে প্রতিজ্ঞা উচ্চারিত হয়েছিল, তাও জানি– জানামি চৈব সত্যং তন্মমাৰ্থে যচ্চ ভাষিতম। কিন্তু অন্তত আপদ্ধর্মের কথাও তো মনে রাখবে। অন্তত সেই দিকে তাকিয়ে আমাদের এই বিখ্যাত ভরতবংশের কুলতন্তুগুলি যাতে রক্ষা পায়, যাতে ধর্ম রক্ষা পায় এবং যাতে আমাদের আত্মীয়-স্বজন সকলে খুশি হয়, তুমি সেই ব্যবস্থা কর, ভীষ্ম– সুহৃদশ্চ প্রহৃষ্যেরংস্তথা কুরু পরন্তপ। মহামতি ভীষ্ম এই পারিবারিক বিপন্নতার মধ্যে অবশ্যই চুপ করে থাকলেন না। কিন্তু সত্যবতী যে ভীষ্মকে পুত্রোৎপাদনে নিযুক্ত করে আপদ্ধর্ম পালন করতে বলেছেন, তার উত্তরে ভীষ্ম বললেন- তুমি যেমন আমাকে ধর্মের কথা শোনালে, তেমনই আমিও তোমাকে ধর্মের কথাই শোনাচ্ছি, মহারানি! তুমিও ধর্মের দিকে তাকাও, এইভাবে আমাদের সবার সর্বনাশ কোরো নারাজ্ঞি ধর্মানবেক্ষস্ব মা নঃ সর্বান্ ব্যনীনশঃ। তবে হ্যাঁ, মহারাজ শান্তনুর সন্তান যাতে এই পৃথিবীতে অক্ষয় হয়ে থাকে, সে চিন্তা তোমার মতো আমিও করছি। নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বক্ষেত্রে যা হয়, তুমি তাই কর, তাই আমাদের সনাতন নিয়ম তত্তে ধর্মং প্রবক্ষ্যামি ক্ষাত্রং রাজ্ঞি সনাতন। তুমি আপদ্ধর্মকুশল প্রাজ্ঞ পুরোহিতদের সঙ্গে আলোচনা করে সমুচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর। আর এত কিছু যদি না করতে চাও, তবে একজন গুণবান ব্রাহ্মণকে আমন্ত্রণ করে বিচিত্রবীর্যের পত্নীদের গর্ভে পুত্রজন্মের ব্যবস্থা কর। তার জন্য যদি রাজকোষ থেকে অর্থদক্ষিণা দিতে হয় সেই গুণবান ব্রাহ্মণকে, তাতেও আপত্তির কিছু দেখি না– ব্রাহ্মণো গুণবান্ কশ্চিদ্ ধনেনোপনিমন্ত্ৰতাম।

ভীষ্মের কথা থেকে বোঝা যায় যে, সেকালের দিনের নিয়োগকর্মে গুণবান ব্যক্তিকে নিয়ে বংশধারা রক্ষা করার জন্য কখনও অর্থব্যয়ও করতে হত। আরও পরিষ্কার করে বলা যায় যে, সমাজশ্রেষ্ঠ সুশিক্ষিত ব্রাহ্মণ আপন অন্তর্গত তেজ অন্যত্র আধান করার জন্য অর্থমূল্য নিতেন কখনও, আবার কখনও নিতেনও না– এমন উদাহরণও ভূরি ভূরি আছে। হতে পারে– ব্রাহ্মণ মুনি-ঋষিদের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না, অতএব তারা আপন অমোঘ শক্তির ঋণমূল্য নিতেন। আবার এও হতে পারে– সত্যবতীর কথায় ভীষ্ম রীতিমতো বিপন্ন বোধ করছেন এবং এই পরম দায় থেকে বাঁচার জন্য এবং নিজেকে সত্যভ্রষ্টতা থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি যেন তেন প্রকারেণ অর্থের বিনিময়েও দায়মুক্ত হতে চাইছেন আপাতত।

পরম বুদ্ধিমতী সত্যবতী বুঝলেন যে, ভীষ্মকে জোর করে কোনও লাভ নেই। যিনি তার যৌবন-সন্ধিতে কঠিন প্রতিজ্ঞা করে ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে ব্রহ্মচারীর ব্রত গ্রহণ করেছেন, হেলায় রাজ্য বিসর্জন দিয়েছেন, তিনি এই বয়সে এসে যে আর ব্রতভঙ্গ করবেন না– সেটা খুব ভাল করেই জানেন সত্যবতী। আবার ভীষ্মের কথামত একজন গুণবান ব্রাহ্মণকে যে নিমন্ত্রণ করে আনবেন– এ ভাবনায় তিনি সায় দিতে পারলেন না, অথচ মানসিকভাবে এইখানেই তার সায় আছে যা তিনি হঠাৎই ব্যক্ত করতে পারলেন না। আসলে ভীষ্ম যে গুণবান ব্রাহ্মণের কথা বলছেন, তার চেয়েও গুণবত্তর ঋষিকল্প ব্রাহ্মণ তাঁর নিজেরই সম্বন্ধে জন্ম নিয়েছে। কিন্তু সে কথা তেমন হঠাৎ করে বলা যায় না। অথচ ভীষ্মকে আর সেকথা

বললেই নয়। কারণ মহারাজ শান্তনুর স্ত্রী-সম্বন্ধে তিনি এখন কুরুবংশের রাজমাতা বটে, কিন্তু শান্তনুর পুত্র-সম্বন্ধে তথা আপন ত্যাগ এবং ব্যক্তিত্বের মর্যাদায় ভীষ্ম এখনও এই কুরুবংশের অভিভাবক।

ভীষ্মকে বলবার সময় সত্যবতীর মতো অসাধারণ ব্যক্তিত্বময়ী রমণীও বেশ অপ্রতিভ বোধ করলেন। আসলে কথাটাই এমন যে, এই অপ্রতিভ ভাব কোনও অস্বাভাবিকও নয়। কথা বলতে গিয়ে সত্যবতী সবিশেষ লজ্জা পেলেন, কথার অন্তরে তার বাক্য স্থলিত হল মাঝে মাঝে ততঃ সত্যবতী ভীষ্মং বাঁচা সংসজ্জমানয়া। কিন্তু নিজের জীবনের গভীর গোপন কথাগুলি যেহেতু বলতেই হচ্ছে, অতএব একটা অপ্রতিভ হাসি তার মুখে লেগেই রইল। সত্যবতী বললেন, তোমার প্রতিজ্ঞার বিষয়ে যা তুমি বললে সব সত্য। তবে তোমার ওপরে আমার অগাধ বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাসেই এই বংশের কুলতন্তু রক্ষার জন্য তোমাকে একটা কথা এখন না বললেই নয়। কারণ তুমিই যেমন এই মহান কুলে ধর্মের স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছ, তেমনই তুমিই সত্যের স্বরূপ, সবচেয়ে বড় কথা, তুমিই এই বংশের প্রধান অবলম্বন– ত্বমেব নঃ কুলে ধর্মত্ত্বং সত্যং ত্বং পরা গতিঃ। তোমাকে সব কথা খুলে বলছি, তা শুনে তোমার যা মনে হয় তাই কর।

সত্যবতী নিজের কন্যা-জীবনের কাহিনি বলতে আরম্ভ করলেন সলজ্জে। বলতে আরম্ভ করলেন সেই আকুল সন্ধ্যার কথা, যখন দাশরাজার অনুপস্থিতিতে তরী বাইবার সময় আকস্মিক এসে পড়েছিলেন মহর্ষি পরাশর। কীভাবে আপন তেজপ্রভাবে মহর্ষি তাকে বশীভূত করেছিলেন এবং কীভাবে তপস্যার প্রভাবে নিজের চারিদিকে কুয়াশা ঘনিয়ে নিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গত হয়েছিলেন পরাশর সব খুলে বললেন সত্যবতী। মৎস্যগন্ধা থেকে তার পদ্মগন্ধায় রূপান্তরিত হওয়ার সামান্য ঘটনাটুকুও যেমন বাদ দিলেন না সত্যবতী, তেমনই শেষে জানালেন সেই বিরাট অভ্যুদয়ের কথা– দ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্মকথা। দ্বৈপায়ন ব্যাস যে তাঁরই কন্যাগর্ভের সন্তান, সে কথা বলতে বলতে গৌরবে সত্যবতীর বুক ভরে উঠল। তিনি বলতে আরম্ভ করলেন, আমার সেই কন্যাবস্থার পুত্রটি এখন বিখ্যাত ঋষি হয়েছে। চারটি বেদ বিভাগ করে আমার সেই দ্বীপজন্মা দ্বৈপায়ন এখন ব্যাস নামে খ্যাত হয়েছে– লোকে ব্যাসত্বমাপেদে… তপসা ভগবান ঋষিঃ। মহর্ষি পরাশরের তপস্যায় ব্যাস আমার সদ্যোগর্ভ থেকে মুক্ত হয়েই পিতার সঙ্গে তপস্যা করতে চলে গিয়েছিল– সদ্যোৎপন্নঃ স তু মহান্ সহ পিত্রা ততো গতঃ।

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের জন্ম-কথা জানিয়ে সত্যবতী এবার প্রকৃত প্রস্তাবে ফিরে এলেন। ভীষ্ম গুণবান এক ব্রাহ্মণকে নিয়োগ করার কথা বলেছিলেন পুত্রোৎপত্তির জন্য। সেই সূত্র ধরেই ব্যাসের নানান গুণপনার কথা বললেন সত্যবতী, তার পরেই বললেন– এই বংশের গুরুজন হিসেবে তুমি এবং আমি যদি সেই দ্বৈপায়ন ব্যাসকে এই বংশের পুত্রোৎপাদনে নিয়োগ করি, তা হলে অবশ্যই বিচিত্রবীর্যের পত্নীদের গর্ভে আমরা অভীষ্ট পুত্র লাভ করব– ভ্রাতুঃ ক্ষেত্রে কল্যাণমপত্যং জনয়িষ্যতি। ভীষ্ম যদি এমন প্রশ্ন করেন যে, তাকে ডাকলেই তিনি আসবেন কেন? যিনি জন্মমুহূর্তটি অতিবাহিত করেই তপস্যায় নিযুক্ত হয়েছিলেন, তাঁকে ডাকলেই তিনি রাজবংশের পুত্রোৎপাদনে স্বীকৃত হবেন কেন? এই প্রশ্নের আশঙ্কা করেই যেন সত্যবতী আগে থেকেই বলে উঠলেন– আমার সেই ছেলে তপস্যায় যাবার আগে আমায় বলে গিয়েছিল মা! কোনও কর্তব্য-কর্মে আমার প্রয়োজন হলে আমাকে নির্দ্বিধায় স্মরণ করো, আমি চলে আসব তোমার কাছে। এবারে তুমি বল, ভীষ্ম! তুমি যদি অনুমতি দাও তবে আমি সেই তপস্বী ঋষি পুত্রকে স্মরণ করতে পারি– তং স্মরিয্যে মহাবাহো যদি ভীষ্ম ত্বমিচ্ছমি– এবং তোমার অনুমতি পেলে সে এই পুত্রোৎপত্তি-কর্মে আপত্তি করবে বলে মনে হয় না।

প্রাথমিকভাবে ভীষ্ম একটু হতচকিতই হয়ে গেলেন। নিজের সত্যচ্যুত ভয়ে যিনি একটি গুণবান ব্রাহ্মণকে আমন্ত্রণ করার যুক্তি দেখিয়ে দায়মুক্ত হতে চেয়েছিলেন সেই তিনি এমন আকস্মিকভাবে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের নাম শুনবেন এবং তাও শুনবেন সত্যবতীর মুখেই একেবারে তার একান্ত পুত্রসম্বন্ধে– এটা ভীষ্ম ভাবতেই পারেননি। ব্যাসের নাম তখন বিখ্যাত হয়ে গেছে। বেদবিভাগকারী দ্বৈপায়ন ব্যাসের নাম শোনা মাত্রই ভীষ্মের মাথা নত হল শ্রদ্ধায়, হাত দুটি অঞ্জলিবদ্ধ হল বেদব্যাসের নাম-মাহাত্মে–মহর্ষেঃ কীর্তনে তস্য ভীষ্মঃ প্রাঞ্জলিরব্রবীৎ। তিনি সত্যবতীকে বললেন– যে কোনও কাজের আরম্ভেই সেই কর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ধর্ম-অর্থ-কামের ফলটুকু আগে বুঝে নেওয়া দরকার। তুমি ব্যাসের কথা উচ্চারণ করে এই বংশের হিত, মঙ্গল এবং ন্যায়ের কথাই বলেছ। তুমি যা বলেছ, তা আমার অত্যন্ত পছন্দেকথা, আমার অত্যন্ত অভিপ্রেত কথা– উক্তং ভবতা যচ্ছুয়স্তমহং রোচতে ভৃশম।

কোনও কোনও অবোধজনে এমন বলে থাকেন যে, বিধবা সত্যবতী আপন রমণীজনোচিত মোহিনী মায়ায় ভীষ্মকে বিপর্যস্ত করে অসাধারণ কৌশলে আপন কানীন পুত্রের ধারা ভরতবংশের কুলতন্তুর মধ্যে প্রতিস্থাপিত করেছেন। আমাদের বক্তব্য– এমন অশ্রদ্ধেয় সংবাদ অন্তত ব্যাসলিখিত মূল মহাভারতে নেই। এ হল এখনকার দিনের হেঁদো ঔপন্যাসিকের কল্পনাবিলাস। বস্তুত মহাকাব্যের পরিসরে এসব রমণীয় কৌশল চলে না। এখানে যা কিছু হয়, খুব সোজসুজি হয়। নিজের সন্তানদের ব্যাপারে সত্যবতীর মনে যদি প্রাথমিকভাবে কিছু স্বার্থ কাজ করেও থাকে, তবু বিচিত্রবীর্যের সময় থেকেই সে স্বার্থের ছিটেফোঁটাও কিছু ছিল না। তখন থেকেই ভীষ্ম সব কিছুই দেখাশোনা করেছেন, এমনকী তার বিয়েও দিয়েছেন তিনিই। আর বিচিত্রবীর্য মারা যাবার পর থেকে সত্যবতী সব ব্যাপারেই নির্ভর করেছেন ভীষ্মের ওপর। বিশেষত উপরি উক্ত নিয়োগ কর্মের ব্যাপারে সত্যবতী তো ভীষ্মকেই প্রথম অনুরোধ করেছিলেন। যদি বলেন– ওসব ঢঙের কথা, সত্যবতী জানতেন; ভীষ্ম রাজি হবে না। সেইজন্যই তিনি বেশি বেশি করে অনুরোধ করেছেন ভীষ্মকে।

আমরা আবারও বলব, এই ধরনের বিচ্ছিরি তঞ্চকতাও মহাকাব্যে চলে না। সত্যবতী কোনওদিন কোনও কিছু ভীষ্মকে লুকোননি, কোনওদিন কোনও ঢঙও করেননি ভীষ্মের সঙ্গে। নিয়োগ-কর্মের ক্ষেত্রেও নিজের কানীন পুত্রের কথা প্রস্তাব করার সময় সত্যবতী সর্বান্তঃকরণে ভীষ্মের ওপরেই নির্ভর করেছেন। আর একথা তো সত্যিই যে, হাজারো গুণবান ব্রাহ্মণের চেয়ে দ্বৈপায়ন বেদব্যাস অনেক বড় এক সহৃদয় ঋষি এবং যেহেতু তিনি সত্যবতীরই আত্মজ পুত্র, অতএব তাকে অনুমোদন দেওয়াটা তো ভীষ্মের পক্ষে অতি স্বাভাবিক। এমন অনুকূল সম্বন্ধের মধ্যে সত্যবতীর মায়া-বিস্তারের কোনও প্রয়োজন ছিল না এবং তার যুক্তিটাও ভীষ্মের কাছে পরম অভিপ্রেত ছিল। ভীষ্ম যখন সাগ্রহে সত্যবতীর প্রস্তাব স্বীকার করে নিলেন, সত্যবতী তখন নিশ্চিন্তে স্মরণ করলেন দ্বৈপায়ন বেদব্যাসকে– কৃষ্ণদ্বৈপায়নং কালী চিন্তয়ামাস বৈ মুনিম।

বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পর থেকে ভীষ্মের সঙ্গে সত্যবতীর যে কথোপকথন হল, এই পর্যন্ত সত্যবতীর হৃদয়টুকুও একটু বিচার করে দেখলে হয়। মহাকাব্যের বীর্য-শরীরের বিরাট পরিসরে এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হৃদয়-ভাঙা দুঃখগুলি আপাত দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না, আবার পড়েও। সত্যবতী যত ব্যক্তিত্বময়ীই হোন, যতই হোন তিনি শক্তিমতী রাজমাতা, আপন প্রেমে অধীর স্বামী হারানোর পর তিনি যখন পর্যায় ক্রমে দুটি পুত্রই হারালেন, তখন কি রাজরানি হৃদয়ও উদ্বেলিত হয়ে ওঠেনি! পুত্র হারানোর ব্যথা– সে তো বাঙালির মনেও যেমন, রাজমাতার হৃদয়েও তেমনই। কাজেই আমাদের ধারণা, রানিদের গর্ভে প্রখ্যাত ভরতবংশের পুত্রধারা বাহিত করার জন্য যতখানি, তার থেকে অনেক বেশি করে এই কথাটা বলব যে সত্যবতীর হৃদয় তখন পুত্ৰমুখ দেখার জন্য আকুল হয়ে ছিল। তার এই প্রথমজ পুত্রের কথা আর তো কেউ জানে না, শুধু তিনিই নিজে জানেন। কানীন পুত্রের কোনও সংবাদ না দিয়ে এত দিন তিনি শান্তনুর ঘর করেছেন, রাজবাড়িতে দুটি পুত্র তার জন্মেছিল। কিন্তু আজ যখন রাজবাড়ির স্বামী-পুত্র সব তিনি হারিয়েছেন, তখন তার মনে সেই হাহাকার সৃষ্টি হল, যা এক মৃতবৎসা জননীর মনে হয়। অথচ এখনও তার প্রথমজ পুত্রটি বেঁচে আছে– এই পুত্রের সঙ্গে যদি জননী-হৃদয়ের বাৎসল্য-যোগটুকু রাখতে হয়, তবে আর তার কথা পরিষ্কার করে

বললে উপায় ছিল না। ঠিক এই কারণেই ভীষ্ম যখন ভরতবংশের সন্তানসৃষ্টির জন্য বাইরে থেকে ব্রাহ্মণ আনার প্রস্তাব দিয়েছেন, ঠিক তখনই সত্যবতী তাঁর প্রথমজন্মা পুত্রটির সংবাদ দিয়েছেন আন্তরিকভাবে। এতে একদিকে যেমন ভরতবংশের ধারা রক্ষিত হওয়ার কথা তেমনই সত্যবতীর পুত্রহারা শূন্য হৃদয়টিও শান্ত হবার কথা।

মহাকাব্যের অলৌকিক শব্দের্য বজায় রেখেই মহাভারত বলেছে– জননী সত্যবতীর স্মরণ-অনুধ্যান যখন তপস্বী পুত্র ব্যাসের হৃদয়ে পৌঁছল, তখন তিনি শিষ্যদের বেদ পড়াচ্ছিলেন। ব্যাস নাকি জননীর স্মরণমাত্রেই তার অজ্ঞাতসারে এসে উপস্থিত হলেন সত্যবতীর সামনে– প্রাদুর্বভুবাবিদিতঃ ক্ষণেন কুরুনন্দন। আমাদের লৌকিক বুদ্ধি বলে যে, সত্যবতী হয়তো ব্যাসকে স্মরণ করে তাকে আনবার জন্য দূত পাঠিয়েছিলেন। বদরিকাশ্রমে এবং দূত যখন তার কাছে উপস্থিত হয়েছিল, তখন ব্যাস হয়তো বেদ শিক্ষা দিচ্ছিলেন শিষ্যদের। জননীর আহ্বান শোনামাত্র ব্যাস আর এক মুহূর্তও দেরি করেননি। তিনি কথা দিয়েছিলেন জননীকে যে, স্মরণমাত্রেই তিনি উপস্থিত হবেন মায়ের কাছে। অতএব কালবিলম্ব না করে তিনি যে অবস্থায় ছিলেন সেই অবস্থাতেই তিনি উপস্থিত হলেন সত্যবতীর কাছে। তার অজ্ঞাতসারে তাকে চমকিত করেই তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন সত্যবতীর হৃদয়ছেঁড়া প্রথমজ পুত্র দ্বৈপায়ন ব্যাস।

.

০৬.

পুত্র দ্বৈপায়নকে দেখে একেবারে আকুল হয়ে উঠলেন সত্যবতী। কোথায় আসন, কেমন আছিস, কতকাল দেখিনি’– ইত্যাদি নানা কুশল-প্রশ্ন সমাপনের সঙ্গে সত্যবতী প্রগাঢ় স্নেহালিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন পুত্রকে। সেই কতকাল আগে তার সেই প্রথমজ পুত্রটি যে তাকে প্রথম মা বলে ডেকেছিল– সেই পুত্রটিকে দেখে সত্যবতীর জননী-হৃদয় একেবারে আকুলি-বিকুলি করে উঠল। কবেই সে পুত্র তাকে ছেড়ে–বলা উচিত তাকে কন্যা-কলঙ্কের লজ্জা থেকে বাঁচিয়ে পিতার সঙ্গে চলে গিয়েছিল তপস্যা করতে। আজ সে মৃতবৎসা জননীর ক্রোড়ে ফিরে এসেছে। পুত্রের ত্বক-স্পর্শে সত্যবতীর এতাবৎ-স্তব্ধ স্তনদুগ্ধও যেন উদগলিত হল– পরিষজ্য চ বাহুভ্যাং প্রস্নবৈরভিষিচ্য চ। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল আনন্দে।

দ্বৈপায়ন ব্যাসকে এমন ছোট্ট শিশুটির মতো আদর-আপ্যায়ন করলেও তপস্যার শক্তিতে যিনি দুঃখ-সুখ, স্নেহ-মায়া সব জয় করেছেন, সেই ব্যাস কিন্তু জননীর শতধার স্নেহে একেবারে আপ্লুত হয়ে গেলেন না। প্রাজ্ঞ নিষ্কাম তপস্বীর মতো ব্যাস তার কমণ্ডলু থেকে সর্বতীর্থের পুণ্যসলিল ছিটিয়ে দিলেন স্নেহকাতরা জননীর মাথায়। তারপর প্রকৃত কার্যে ফিরে এলেন সঙ্গে সঙ্গে। বললেন, আপনি যা চাইছেন, আমি তাই করতে এসেছি। অতএব বলুন, কী প্রিয়কার্য করতে হবে আপনার শাধি মাং ধর্মতত্ত্বজ্ঞে করবাণি প্রিয়ং তব। সত্যবতী পুত্ৰমুখ দর্শনে যতই আপ্লুত হয়ে থাকুন, তিনিও কার্যাকার্য ভুলে যাননি। তিনি রাজবংশের প্রথা অনুসারে রাজপুরোহিতকে ডেকে পাঠালেন যথাবিধানে তপস্বী মুনিকে বরণ করে নেবার জন্য। রাজপুরোহিত প্রথা অনুসারে দ্বৈপায়ন ব্যাসকে অভ্যর্থনা জানানোর পর তিনিও বিধি অনুসারেই মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক অভ্যর্থনা গ্রহণ করলেন।

বেদব্যাস সুখাসনে উপবিষ্ট হলে সত্যবতী গভীর দৃষ্টিতে পুত্রের অন্তরের দিকে চেয়ে তাকে অসাধারণ একটি সম্বোধন করতে বললেন, কবি আমার! অর্থাৎ তুমি সবটাই বোঝ, যেমন একজন প্রকৃষ্ট কবি বোঝেন– ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান। সত্যবতী বললেন, দেখ বাছা! পুত্রেরা পিতা এবং মাতা– দু’জনেরই সহায় হয়ে জন্মায়। ফলত পিতা যেমন পুত্রের গুরুজন, তেমনই মাতাও পুত্রের কাছে একইরকম গুরুজন। সত্যবতী এবার ব্যাসের সঙ্গে হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির একটা আত্মীয়-সম্বন্ধ দেখানোর চেষ্টা করলেন এবং তা করলেন এইজন্যই যাতে ব্যাস এটা বোঝেন যে, এই রাজবাড়ির সংকটে তারও কিছু দায়িত্ব আছে।

সত্যবতী বললেন, মহর্ষি পরাশর, তোমার পিতা শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারেই আমার গর্ভে তোমাকে সৃষ্টি করেছিলেন। সেই দৃষ্টিতে দেখতে গেলে তুমি আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র– বিধানবিহিতঃ স ত্বং যথা মে প্রথমঃ সুতঃ। আবার আমার বৈবাহিক সূত্রে বিচিত্রবীর্য আমার কনিষ্ঠ পুত্র। এবারে একটা জিনিস বোঝ–একই পিতা বলে ভীষ্ম যেমন বিচিত্রবীর্যের ভাই, তেমনই একই মাতার সন্তান বলে তুমিও বিচিত্রবীর্যের ভাই– যথা বৈ পিতৃতো ভীষ্মস্তথা ত্বমপি মাতৃতঃ। এখন সমস্যা হয়েছে এই বংশের জ্যেষ্ঠ পুত্র ভীষ্ম বিবাহও করবেন না, পুত্রও উৎপাদন করবেন না। এ ব্যাপারে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ফলত এখানে এই হস্তিনাপুরের প্রজাদের দিকে তাকিয়ে আমি তোমার কাছে একটা প্রস্তাব করছি।

প্রস্তাব করার আগে সত্যবতী বোঝাতে চাইলেন যে, তিনি কোনও স্বার্থচিন্তায় কথা বলছেন না। তিনি যা বলছেন, তার পিছনে হস্তিনাপুরের রাজ্যের স্বার্থই প্রধান–অনুক্রোশাচ্চ ভূতানাং সর্বেষাং রক্ষণায় চ– তার সঙ্গে জুড়ে আছে মৃত বিচিত্রবীর্যের উত্তরাধিকারের মঙ্গল এবং সর্বোপরি আছে মহামতি ভীষ্মের সমর্থন। সত্যবতী এবার প্রকৃত প্রস্তাবে এসে বললেন, তোমার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের দুটি স্ত্রী আছে, দু’জনেই যথেষ্ট রূপবতী এবং যৌবনবতী, কিন্তু তাদের কোলে কোনও পুত্র নেই। তারা দুজনেই ধর্মানুসারে পুত্র কামনা করে। তাই বলছিলাম– বাছা! তুমি যদি তোমার এই দুই ভ্রাতৃবধূর গর্ভে পুত্র উৎপাদন কর তা হলে এই বংশের এবং এই রাজ্যের সমূহ মঙ্গল– তয়োরুৎপাদয়াপত্যং সমর্থো হাসি পুত্রক।

ব্যাস সত্যবতীর কথা ধৈর্য ধরে শুনলেন এবং তার ভূয়োদর্শিতার প্রশংসা করে বললেন, মা! তুমি তো ধর্মের সমস্ত তত্ত্বই জানো। ইহজন্মের পক্ষে যা মঙ্গল এবং পরজন্মের পক্ষেও যা মঙ্গল, তা সবই তুমি জান। কাজেই তোমার আদেশে ধর্মোদ্দেশে যেটুকু এই রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য করা দরকার, তা অবশ্যই করব আমি– তস্মাদহং ত্বন্নিয়োগান্ধর্মং উদ্দিশ্য কারণম্। আমি বিচিত্রবীর্যের বংশধারা রক্ষা করার জন্য দুই রানির গর্ভে নিশ্চয়ই পুত্র উৎপাদন করব। কিন্তু তার জন্য আমারও একটা কথা মানতে হবে। তোমার দুই মহারানি পুত্রবধূ এক বৎসর ধরে যথানিয়মে ব্রত পালন করে শুদ্ধ হোন, তবেই আমার সঙ্গে মিলন সম্ভব হবে। নইলে ব্রতাচরণহীন ত্যাগ-বৈরাগ্যহীন কোনও রমণীর সঙ্গে আমার দৈহিক সংশ্লেষ সম্ভব হতে পারে না–ন হি মামব্রতোপেতা উপেয়াৎ কাচিদঙ্গনা।

সত্যবতী প্রমাদ গণলেন- আরও এক বৎসর। এমনিতেই রাজাহীন অবস্থায় অনেক কাল পড়ে আছে হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসন। তবু ভীষ্ম কোনও মতে সামলাচ্ছেন রাজ্যভার। কিন্তু আর কত কাল! এই রাষ্ট্রের রাজমহিষী হিসেবে সত্যবতী সবিশেষ উপলব্ধি করেছেন যে, রাজা না হলে আর চলবে না। পুত্র ব্যাসকে তিনি বললেন, এক বছর অপেক্ষা করা যাবে না, বাছা! রানিরা যাতে এখনই গর্ভলাভ করতে পারেন, তুমি সেই ভাবনাই ভাব বাছা– সদ্যো যথা প্রপদ্যোতে দেব্যৌ গর্ভং তথা কুরু। তুমি তো জানো যে, এই অপরাজক রাজ্য রক্ষা করার ক্ষমতা আর আমাদের নেই। অতএব তুমি আর দেরি কোরো না। তুমি এসেছ যখন এইবারেই তুমি আমার সংকল্প সিদ্ধ করো। তুমি রানিদের গর্ভে পুত্ৰ উৎপাদন করো, ভীষ্ম সেই সন্তানদের বড় করে তুলবেন– তস্মাদ গর্ভং সমাধৎস্ব ভীষ্মঃ সংবর্ধয়িষ্যতি।

ব্যাস মায়ের কথায় রাজি হলেন বটে, কিন্তু পুরো রাজি হলেন না। বললেন, এমন অকালে ব্ৰতহীন অবস্থায় যদি আমাকে এখনই তোমাদের রানিদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করতে হয়, তবে আমার বিকৃত রূপ সহ্য করতে হবে রানিদের। বহুকাল তপশ্চরণ করে আমার শরীরে যে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে, সেই দুর্গন্ধ সহ্য করতে হবে তোমার রানিদের। আমার এই বিকৃত রূপ, এই বিকৃত বেশও তাদের সহ্য করতে হবে। আমি মনে করি, অন্তত এইটাই তাদের ব্রত হোক- বিরূপতাং মে সহতাং তয়োরেৎ পরং ব্রত। আসলে ব্যাস এই শর্তগুলি কেন দিচ্ছেন, আমরা তা জানি। নিয়োগ প্রথায় একটি স্ত্রী পুরুষের মিলনে কোনও পক্ষেরই যাতে শারীরিক, মানসিক কোনও আসক্তি না জন্মায়, যেন সন্তান লাভের মতো প্রয়োজনীয় কর্মটি একটি যান্ত্রিকতার মধ্য দিয়েই শেষ হয়– এই উদ্দেশ্যেই ব্যাসের ওই শর্ত, যুক্তি, ভাবনা।

ব্যাস রাজি হবার পর সত্যবতীর দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। বিচিত্রবীর্যের দুই বধূ পুত্রলাভের ব্যাপারে যথেষ্টই উন্মুখ ছিলেন, হস্তিনাপুরের রাজপরিবারের পক্ষ থেকে একটি নিয়োগের ঘটনাও যে ঘটবে– এটাও বুঝি তারা জানতেন। অর্থাৎ তাদের মানসিক প্রস্তুতি একটা ছিল। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এত তাড়াতাড়ি এটা ঘটবে এবং সেই নিয়োগের নায়ক হবেন একজন ঋষি, তাও কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের মতো এক ঋষি, এটা বুঝি তাদের ধারণার বাইরে ছিল। সত্যবতী অন্তঃপুরের একান্তে মিলিত হলেন বন্ধুদের সঙ্গে এবং সবিনয়ে নিজের ভাগ্যকে দোষ দিয়ে তাদের বললেন, দেখ, আমারই কপালে এই প্রখ্যাত ভরত বংশ উচ্ছিন্ন হয়ে যেতে বসেছে–ভরতানাং সমুচ্ছেদে ব্যক্তং মদ্ভাগ্যসংক্ষয়াৎ। এখন ধর্মের দিকে তাকিয়েই তোমাদের একটা কথা বলছি শোনো। সত্যবতী নিজের দুর্ভাগ্যের যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, তার মধ্যে তার দুই পুত্রের ইঙ্গিত যেমন ছিল, তেমনই তারই কারণে ভীষ্মও যে রাজা হতে পারেননি– এই স্বীকারোক্তিটুকুও ছিল। হয়তো সেই কারণেই দুই বন্ধুর কাছে নিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে যখন কথা বললেন সত্যবতী, তখন তিনি নিজের কথা না বলে ভীষ্মকেই প্রাধান্য দিয়ে বললেন, আমাকে এবং নিজের পিতৃকুলের সবাইকে দুঃখী দেখে মহামতি ভীষ্ম আমাকে নিয়োগপ্রথা অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখন এ-ব্যাপারে তোমরাই তো প্রধান সহায় আমাদের। নিজেদের গর্ভে দেবতুল্য পুত্র উৎপাদন করে এই ভরত বংশের ছিন্ন তন্তুর সন্ধিবন্ধন করতে তোমরাই পার নষ্টঞ্চ ভরতং বংশং পুনরেব সমুদ্ধর।

সত্যবতী প্রখর বুদ্ধিমতী। প্রথমেই তিনি বললেন না– কে বধূদের সাময়িক নায়ক হবেন। শুধু নিয়োগ-মিলনের জন্য বন্ধুদের সম্মতি বুঝেই তিনি ব্রাহ্মণ-ভোজন, দান-ধ্যান শুরু করে দিলেন। গুরু-ব্রাহ্মণ-অতিথিসেবা শেষ হলে সত্যবতী ঋতুস্নাতা পুত্রবধূ অম্বিকার ঘরে গিয়ে বললেন, তোমার একটি দেবর আছে। সে তোমার সঙ্গে মিলনের উদ্দেশে রজনীর দ্বিপ্রহরে তোমার ঘরে আসবে। তুমি তার জন্য প্রতীক্ষা করে থেকো– অপ্রমত্তা প্রতীক্ষ্যৈনং নিশীথে হ্যাঁগমিষ্যতি। সত্যবতী পুত্রলাভেচ্ছু বধূর কাছে একবারও বিকৃত-রূপ, বিকৃত-বেশ ঋষি ব্যাসের কথা বললেন না। সত্যবতীর এই অনুচ্চারণ আরও বোঝা যায় বধূ অম্বিকার ব্যবহার থেকে। তিনি যখন গভীর নিশীথে শাশুড়ি সত্যবতীর কথা শুনে দেবরের আগমন-প্রতীক্ষা করছেন, তখন তিনি যাঁদের কথা প্রত্যাশিতভাবে ভাবনা করছিলেন, তারা কিন্তু ভীষ্ম ইত্যাদি কুরুমুখ্যরা, যারা তার দেবর বলে চিহ্নিত সাংচিন্তয়ত্তদা ভীষ্মমন্যাংশ্চ কুরুপুত্রঙ্গবান।

ক্ষত্রিয় রাজকুলবধূর স্বপ্নেও ব্যাসের মতো ঋষির কোনও পদসঞ্চার ছিল না। বিশেষত তার বিকৃত রূপ, বিকৃত বেশ রাজরানির মনে এমনই এক রিপালশন তৈরি করেছিল যে ব্যাসের মিলন-মুহূর্তে তিনি ভয়ে, ঘৃণায় চক্ষু মুদে ফেলেছিলেন। এই নৈশমিলনের পর সত্যবতীর সোৎকণ্ঠ প্রশ্ন শুনে ব্যাস তাকে আশ্বস্ত করতে পারেননি। এক অঙ্গে বিকল এক অন্ধ পুত্রের জন্ম-সম্ভাবনার ভবিষ্যদ্বাণী করে ব্যাস সত্যবতীকে আরও ব্যর্থ করে তুলেছিলেন। কিন্তু এই বিপন্ন মুহূর্তেও সত্যবতী কত বিচক্ষণা, তাঁর রাজনৈতিক বুদ্ধিও কত প্রখর। অবশ্য যিনি যৌবনলগ্নে ভীষ্মের মতো বিরাট ব্যক্তিত্বের উত্তরাধিকার সম্ভাবনা স্তব্ধ করে দিয়ে শান্তনুর রাজমহিষী হয়েছিলেন এবং যিনি দুই পুত্রের মৃত্যুর পরেও হস্তিনাপুরের কল্যাণকামিতায় ভীষ্মের সঙ্গে যুগ্মভাবে রাজ্যশাসনের হাল ধরে বসেছিলেন, তাঁর এই বিচক্ষণতা স্বাভাবিক। প্রখ্যাত ভরতবংশের ধারায় একটি অন্ধপুত্র জন্মালে সে যে সমকালীন আইনপ্রণেতাদের অনুশাসনে রাজা হবার অধিকার পাবে না, মনুপ্রণীত এই রাজনৈতিক আইনের খবর সত্যবতী জানতেন। ফলে ব্যাসের কথা শোনামাত্রই তিনি আকুলভাবে বললেন, হে তপোধন পুত্র আমার! একজন অন্ধ কখনও কুরুবংশের রাজা হতে পারে না– নান্ধঃ কুরূণাং নৃপতিরনুরূপস্তপোধন। আমি চাই যে নাকি এই ভরত কুরুবংশের রক্ষা বিধান করবে, যে বাড়াতে পারে পিতৃবংশের উত্তরাধিকার, তুমি সেইরকম একটি পুত্র দাও আমার দ্বিতীয় পুত্রবধূর গর্ভে। ব্যাস মাতৃবাক্যে স্বীকৃত হলেন।

দ্বিতীয়া বধূ অম্বালিকা ব্যাসকে দেখে চক্ষু মুদলেন না বটে, কিন্তু তারও শরীরে কিঞ্চিৎ বিকার হল, যার ফলে পাণ্ডুবর্ণ পাণ্ডুর জন্মের সম্ভাবনা ঘটল। সত্যবতী তবুও যেন শান্তি পাচ্ছিলেন না। নিজের গর্ভস্থ দুই সন্তানের অপমৃত্যু-হেতু সত্যবতী এতটাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন যে, তিনি ব্যাসের কাছে তৃতীয় একটি পুত্রের জন্য আবারও আবদার করলেন। ব্যাস জননীর কথা ফেলেননি। তিনি রাজি হয়েছেন জননীর সেবাবৃত্তিতে প্রবৃত্ত হয়ে। কিন্তু জ্যেষ্ঠ কুলবধূ অম্বিকা ব্যাসের প্রতি ঘৃণায় নিজে উপগত না হয়ে দাসীকে পাঠিয়ে দিলেন ব্যাসের কাছে। ব্যাস তাঁর জননীর কাছে বড় রানির এই ছলনা না জানিয়ে পারেননি– প্রলম্ভমাত্মনশ্চৈব শূদ্রায়াং পুত্রজন্ম চা সত্যবতীও এই ছলনার নিরিখে ব্যাসের কাছে আর কোনও উপরোধ করেননি, অন্যদিকে বড় রানি অম্বিকার মানসিকতাও তিনি অস্বীকার করেননি। তিনি তাকে কোনও তিরস্কার করেননি, কেননা তিনি বুঝেছেন রাজকুলবধূ অম্বিকার পক্ষে ব্যাসকে সহ্য করা সত্যিই কঠিন ছিল।

ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুর– এই তিন কুমার জন্মালেন এবং কুরুরাষ্ট্র চলতে লাগল। নিজের গতিতে। তখনও এ রাষ্ট্রের হাল ধরে ছিলেন ভীষ্মই যদিও যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে ভীষ্ম সবসময় অনুমতি নিতেন জননী সত্যবতীর। তিন কুমারকে বিদ্বান অথবা অস্ত্রশিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে ভীষ্ম যা করার করেছেন, কেননা তিনি তা করতেনই এবং সত্যবতীও সে কথা জানতেন। কিন্তু কুমারদের জীবনেও যে সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, সেখানে যে ভীষ্ম সত্যবতীর অনুমতি নিতেন, তার কারণ এই নয় শুধু, তিনি রাজমাতা, অতএব তাঁকে সব জানানো দরকার। বরঞ্চ কারণ এই যে, সত্যবতীর বুদ্ধির ওপর ভীষ্মের অসম্ভব আস্থা ছিল। গান্ধারী এবং কুন্তীর সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডুর বিবাহের প্রসঙ্গ যখন এল, তখন মহামতি বিদুরের সঙ্গে ভীষ্ম আলোচনায় বসেছিলেন। সেই আলোচনায় ভীষ্ম মুক্তকণ্ঠে সত্যবতীর প্রশংসা করে বিদুরের কাছে বলেছিলেন– আমাদের এই বিখ্যাত কুরুবংশ একেবারে উচ্ছিন্ন হয়ে যেতে বসেছিল; সেই অবস্থায় আমি, সত্যবতী এবং কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস মিলে এই ভরতবংশের কুতন্তু পুনরায় স্থাপন করেছি– ময়া চ সত্যবত্যা চ কৃষ্ণেন চ মহাত্মনা।

বস্তুত সত্যবতীর বুদ্ধির ওপর এই যে বিশ্বাস এই বিশ্বাসই বলে দেয় সত্যবতীর বিচক্ষণতা কতখানি ছিল। তিনি সেই যুবতী অবস্থায় হস্তিনাপুরে প্রবেশ করেছিলেন মহারাজ শান্তনুর পাটরানি হয়ে। শান্তনুর নিজস্ব পৌরুষ কতটা ছিল, সেটা তার বিবাহের সময়ই বোঝা গেছে। আপন কামাভিলাষ পূরণের জন্য তিনি ভীষ্মকে যেভাবে বঞ্চিত করেছিলেন, ঠিক সেই বিপর্যস্ত পৌরুষের নিরিখে শান্তনুর এই যুবতী বধূটি যা ইচ্ছে তাই করতে পারতেন। হস্তিনাপুরের শাসন চলতে পারত অন্তঃপুরের পরিচালনায়। কিন্তু লক্ষণীয়, সত্যবর্তী কোনও অন্যায় আচরণ করেননি। কোমলপ্রাণ শান্তনুর চেয়ে তিনি বেশি নির্ভর করেছেন ভীষ্মের ওপর। এই নির্ভরতার সুফল পেয়েছে হস্তিনাপুরের রাজশাসন–হস্তিনাপুরের দুই রাজা মারা গেলেও যে শাসন বিঘ্নিত হয়নি। শেষে যখন পাণ্ডুর ওপর রাজ্যের ভার পড়ল এবং সত্যবতী বুঝলেন হস্তিনাপুর তার স্থায়ী রাজা পেয়ে গেছে, তখন থেকে সত্যবতীকে আমরা অনেক উদাসীন এবং নির্বিপ্ন দেখছি। রাজ্যশাসন বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তিনি আর মাথা ঘামান না এখন। এমনকী ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুদের জন্য যে বৈবাহিক সম্বন্ধ দেখা হল, সেখানেও ভীষ্মকেই আমরা প্রধান ভূমিকায় দেখছি। এখানে সত্যবতীর কোনও বক্তব্য শোনা যায় না। পাণ্ডু রাজা হবার পর রাজমাতা সত্যবতী এবং ভীষ্ম দু’জনকে দেখলেই মনে হয় যেন তারা হস্তিনাপুরের বৃত্তিভোগী রাজপুরুষ। পাণ্ডু রাজ্য জয় করে বহুতর ধনরত্ন নিয়ে এলে তিনি সত্যবতী, ভীষ্ম, এবং দুই রাজমাতা অম্বিকা এবং অম্বালিকাকে উপহার দিয়ে তুষ্ট করেন– ততঃ সত্যবতীং ভীষ্মং কৌশল্যাঞ্চ যস্বিনীম্।

বস্তুত সত্যবতী এখন আর রাজমাতা নন, তিনি এখন রাজপিতামহী। হস্তিনাপুরে অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের মনে রাজা না হওয়ার যে যন্ত্রণা ছিল, সে যন্ত্রণা জটিল আকার ধারণ করল ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডু উভয়েরই পুত্র জন্মাবার পর। ধৃতরাষ্ট্রের অন্তর্দ্বন্দ্বে সত্যবতীকে আমরা একটাও কথা বলতে দেখিনি, অথচ পূর্বে সমস্ত ব্যাপারেই তার নির্দিষ্ট অভিমত দেখতে পেয়েছি। সত্যবতী এখন অনেকটাই নির্বিগ্ন। কোনও ব্যাপারেই তিনি কোনও কথা বলেন না। এমনকী ধৃতরাষ্ট্রকে কার্যনির্বাহী রাজা হিসেবে হস্তিনাপুরে রেখে অত্যন্ত আকস্মিক ভাবে পাণ্ডু যে দুই স্ত্রীকে নিয়ে বনগমন করলেন এবং তারপর যে আর একেবারেই ফিরে আসলেন না– এ বিষয়ে হস্তিনাপুরের রাজমহল তোলপাড় হয়ে গেলেও আমরা একবারের তরেও সত্যবতীর কোনও কথা শুনিনি– না ক্ষোভের কথা, না হতাশার কথা, না বিরাগের কথাও।

শেষ পর্যন্ত পাণ্ডু তো মারা গেলেন। তার মৃতদেহও এসে পৌঁছল হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে। উপনীত ঋষিরা পাণ্ডুর মৃত্যু এবং তার পুত্রদের সম্বন্ধে যথাবক্তব্য বলে চলে গেলেন। সমস্ত নগরবাসী তখন শোকে আকুল। পাণ্ডু এবং মাদ্রীর মৃতদেহ যখন চিতার আগুনে দগ্ধ হয়ে গেল, তখন পাণ্ডুর প্রৌঢ়া জননীকেও আমরা পুত্রশোকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখলাম– হা হা পুত্রেতি কৌশল্যা পপাত সহসা ভুবি। কিন্তু ওই অসম্ভব বিপন্ন সময়েও আমরা সত্যবতীকে শ্মশানভূমিতে উপস্থিত দেখিনি। হয়তো পাণ্ডুর এই মৃত্যুতে সত্যবতী যথেষ্টই বিচলিত হয়েছিলেন এবং হস্তিনাপুরের রাজনীতি তিনি যতখানি বুঝতেন, তাতে এটা তিনি নিশ্চয়ই অনুভব করেছিলেন যে, হস্তিনাপুরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল থেকে আরও জটিলতর হবে।

সত্যবতীর যা চরিত্র, যেভাবে মহারাজ শান্তনুর সময় থেকে এখন পর্যন্ত তিনি হস্তিনাপুরের রাজনীতি দেখেছেন, তাতে ভয়ংকর জটিল সময়ে বিশেষত যখন পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুদ্ধিষ্ঠির এবং ধার্তরাষ্ট্র দুর্যোধনের রাজ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, তখনও কি বৃদ্ধা সত্যবতী চুপ করে থাকতে পারবেন– এ ব্যাপারে আমাদের যেন সন্দেহ আছে, তেমনই আরও একজন দূরদর্শী মনস্বী এই সন্দেহ করেছিলেন তিনি পা-ধৃতরাষ্ট্রের জনক কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। পাণ্ডু এবং মাদ্রীর শ্রাদ্ধক্রিয়া যখন শেষ হয়ে গেল, সত্যবতী যখন শোকে-দুঃখে মুহ্যমান হয়ে আছেন অন্তঃপুরে, তখন ব্যাস এসে উপস্থিত হলেন তার কাছে সম্মুঢ়াং দুঃখশোকার্তাং ব্যাসো মাতরমব্রবীৎ।

.

০৭.

ব্যাস তার জননীকে ঠিক চেনেন। তিনি বুঝেছেন যে, একসময় তার জননী হস্তিনাপুরের রাজবধূ হয়ে রাজৈশ্বর্যের পিছনে ছুটেছিলেন, এতদিনে হয়তো সেই বিষয়েষণায় নিবৃত্তি হয়েছে। ব্যাস জানেন নিশ্চয় যে তার জননীর মধ্যে এই বিষয়-ঐশ্বর্য ভোগের ইচ্ছা অন্তর্গত ছিল। নইলে যেদিন সেই মহর্ষি পরাশরের সঙ্গে তিনি সঙ্গত হয়েছিলেন, সেদিন সদ্যোগর্ভে ব্যাসের মতো অসাধারণ পুত্র লাভ করার পরেও কিন্তু তিনি একবারও বলেননি যে, দরকার নেই আমার ভোগ সুখে, দরকার নেই আমার সাধারণ সংসার সুখে; যে মহামুনি আমার বহির্মুখতা সত্ত্বেও আমাকে প্রায় আক্রান্ত করে আর্য সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, আমি তাঁরই সঙ্গে চলে যাই। অথবা বলেননি যে সন্তানের আমি জননী হয়েছি, সেই সন্তানের লালন বাৎসল্যে জীবন কাটাব। অর্থাৎ পরম ঋষির স্বচ্ছন্দ তেজঃসঞ্চারও তাকে বৈরাগ্যের পথে। প্রণোদিত করেনি। তিনি পরাশরের কাছে অক্ষত কুমারীত্ব চেয়েছেন, তা পেয়েছেন এবং ঋষির শুভকামনা তিনি ঐশ্বর্য ভোগৈষণায় রূপান্তরিত করেছেন।

কিন্তু সেসব ভোগলাভ করে কী পেলেন সত্যবতী! স্বামী শান্তনু গতায়ু, অকালে মৃত্যুবরণ করল দুই পুত্র। কোনও মতে হস্তিনাপুরের রাজবংশধারা প্রবাহিনী রইল তাঁর বৈরাগী তপস্বী পুত্রের করুণায়। এখন হস্তিনাপুরের রাজসংসারে এত যে জটিলতা বেড়েছে, ধৃতরাষ্ট্র এবং তাঁর পুত্র দুর্যোধন ক্রমেই যে দুর্বিনীত হয়ে উঠছেন। পাণ্ডু যে মারা গেলেন, তবু সত্যবতী এই সংসার চক্রের অন্দর মহলে বসে আছেন দুঃখ-শোকে মূৰ্ছিত হয়ে। তপস্বী পুত্রের কাছে তিনি হস্তিনাপুরের রাজপুত্র ভিক্ষা চেয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই পুত্রকে তিনি একবারও বলেন না যে– পুত্র আমার। আর ভাল লাগে না, এবারে আমি সংসারমুক্তি চাই।

যিনি বলছেন না, অথচ যার অন্তরে একদিন পরমর্ষি পরাশরের আর্যতেজ সঞ্চারিত হয়েছিল, তার তো সৌভাগ্য কিছু আছেই। শাস্ত্র বলেছে–সন্ত তপস্বজনেরা অনেক সময় কষ্টকর দুরুক্তি উচ্চারণ করেই সংসার বাসনা মুক্ত করেন– সন্ত এবাস্য ছিন্দন্তি মনোব্যাসঙ্গম্ উক্তিভিঃ। ব্যাস তাই করলেন এবার। পাণ্ডুর শ্রাদ্ধক্রিয়া শেষ হলে তিনি মায়ের কাছে গিয়ে আকস্মিকভাবে বললেন–মা! তোমার সুখের দিন শেষ হয়ে গেছে মা। দিন যত আসছে, সেসব ভয়ংকর দিন, মা! তুমি সহ্য করতে পারবে না– অতিক্রান্তসুখা কালাঃ পুর্যুপস্থিতদারুণাঃ। সামনের দিন যত এগিয়ে আসবে, তাতে পাপের ওপর পাপ নেমে আসবে এই পৃথিবীতে। তোমার পৃথিবী যৌবন হারিয়ে ফেলেছে মা, এবার তুমি আমার সঙ্গে চলো- শ্বঃ স্বঃ পাপিষ্ঠদিবসাঃ পৃথিবী গত যৌবনা।

‘পৃথিবী গতযৌবনা’– পৃথিবী তার যৌবন হারিয়েছে এই কথাটার একটা গভীর তাৎপর্য আছে। সত্যিই কি পৃথিবী যৌবন হারায়, নাকি আমরা হারাই। আমি আমার অল্প বয়সে খুব অবাক হয়ে ভাবতাম বুড়োরা খুব ক্লিশে হয়ে যাওয়া একটা কথা বলে। বার বার বলে– আর আমাদের কালে যা ছিল, যেমন ভাল মানুষ ছিল, তেমনই ভাল ছিল সময়। এখন সব নষ্ট হয়ে গেছে, একেবারে ঘোর কলি। আমার কালে আমি ভাবতুম– বুড়োরা এইরকম বলে বটে, কিন্তু আমি যখন বুড়ো হব, তখন কক্ষনও এইরকম কথা বলব না। আমি কালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলব। এখন যখন আমি বুড়ো হচ্ছি, কালের সঙ্গে যথেষ্ট তাল মিলিয়েও চলার চেষ্টা করছি, তবুও কোন অজান্তে মুখ দিয়ে এখন সেই কথা বরোয় আমাদের কালে যা ছিল…ইত্যাদি।

কথাটা এখন বুঝতে পারি– ব্যাসের এই অসাধারণ উচ্চারণ থেকে। আসলে পৃথিবী কখনওই যৌবন হারায় না। যারা এখন যুবক-যুবতী তাদের কাছে পৃথিবী এখন ঠিক যৌবনবতী। কিন্তু আমার যৌবন হারিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার পৃথিবীও যৌবন হারাতে থাকে। আমার জোশ-জৌলুশ-ভাস্বরতার অবক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার পৃথিবীর দীপ্তি কান্তিও ম্লান হতে থাকে ধীরে। সন্তানের সঙ্গে পিতামাতার বয়সের যে পার্থক্যটুকু থাকে– কালের এই মহান অন্তরটুকুই একজনের কাছে পৃথিবীর বিবর্ণতা, জড়তা বয়ে নিয়ে আসে, অথচ অন্যতরের কাছে উন্মুক্ত করে বক্ষোজ তারুণ্যের কথুলিকা। জড়, বিবর্ণ, অতিক্রান্তসুখ প্রৌঢ় বৃদ্ধ তখনও ভাবতে থাকে কাহার…

ব্যাসের মতো কালদর্শী কবি বৃদ্ধা জননীকে এইভাবেই তার নিজের বৃদ্ধত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন– তোমার পৃথিবীর যৌবন চলে গেছে মা! এখন দিনে দিনে ছলনা-কপটতা বাড়বে, যত দোষ আকুল করবে এই পৃথিবীকে। লুপ্ত হবে ধর্ম এবং যত সদাচার, একেবারে ঘোর সময় ঘনিয়ে আসবে অচিরেই লুপ্তধর্মক্রিয়াচারো ঘোরঃ কালো ভবিষ্যতি। আসলে এ হল সেই ক্লিশে কথা– যা মহাকাব্যের নায়ক এই ভাবে ভবিষ্যদ্বাণীর উচ্চারণ করেন। সেই ক্লিশে কথাটা– আর বাপু! আমাদের সময়ে যা ছিল! এখনকার মানুষগুলোকে দেখো– যত ঠগ-বদমাশ-জোচ্চোর, সব একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে মূল্যবোধ, নীতি, নিয়ম– ব্যাসের ভাষায় যেটা– বহু মায়াসমাকীর্ণো নানাদোষসমাকুলঃ। আসলে ঠগ বদমাশ-জোচ্চোর তখনও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু আমার যৌবনের সৌন্দর্য্যে আমারই সুন্দরী পৃথিবীকে যে চোখে আমি দেখতুম, মহাকাল সেই দৃষ্টিটাকেই হরণ করে বলে এখনকার পৃথিবীতে আমি ছলনা, বঞ্চনা আর দোষের সমাহার দেখতে পাই। বৃদ্ধ তার যৌবনের দেখা পৃথিবীর সঙ্গে পুত্র-পৌত্রের দেখা তরুণী পৃথিবীকে মেলাতে পারে না।

ব্যাস এবার প্রকৃত প্রস্তাবে ফিরে এসেছেন। কুরুরাজবংশে এক ভয়ংকর জটিলতা তিনি অনুমান করছেন। তিনি লক্ষ করেছেন যে, গান্ধারীর মতো ধৈর্যশালিনী রমণীও কুন্তীর ওপর ঈর্ষায় আপন গর্ভে আঘাত করে যুধিষ্ঠিরের আগে নিজ পুত্রের জন্ম দিতে চেয়েছেন। তিনি লক্ষ করেছেন– পাণ্ডু বনগমন করে বিশেষ কোনও অভিমানে আর বাড়ি ফেরেননি এবং অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মন থেকে রাষ্ট্রশাসনের লোভ কখনও অন্তরিত হয় না। বিশেষত এখন যে সময় এল– পাণ্ডু নেই, তার পুত্রেরা ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রিত হল, মহামতি ভীষ্ম কিছু অবগুণ্ঠিত- ব্যাস আর্যদৃষ্টিতে বুঝতে পারছেন– রাজবাড়িতে জটিলতা বাড়বে এবং ধৃতরাষ্ট্র পুত্রমোহবশে এমন কাজ করতে পারেন, যা সত্যবতী তার প্রাচীন মূল্যবোধে সহ্য করতে পারবেন না। ব্যাস তাই বেশ কঠিনভাবে বললেন– তোমারই সংবর্ধিত কুরুবংশের এই মানুষগুলির অন্যায় আচরণে এই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, মা। আমি এখনও বলছি– তুমি আমার সঙ্গে চলো, আমার তপোবনে থাকবে তুমি। সেখানে যোগধর্ম আচরণ করে জীবনের শেষ সময়টুকু কাটিয়ে দেবে গচ্ছ ত্বং যোগমাস্থায় যুক্তা বস তপোবনে। তুমি যত বেশি সময় এখানে থাকবে, ততই এই কুলের ক্ষয় দেখতে পাবে দিনে দিনে।

ব্যাস বলতে চাইলেন– ক্ষয় তো তুমি কম দেখোনি। স্বামী শান্তনু মারা গেছেন, তোমার গর্ভস্থ দুই পুত্র মারা গেছে, এখন পাণ্ডুও মারা গেলেন। তিনটে জেনারেশনের মৃত্যু দেখাই শুধু নয়, ব্যাস বলতে চাইলেন– অন্যায় তো তখন থেকেই আরম্ভ হয়েছে। কামাচারী শান্তনু নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবব্রত ভীষ্মকে রাজ্য দেননি, তোমার গর্ভস্থ দুই পুত্র ক্রোধ এবং কামবশেই অকালে মারা গেছে। আর অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র যেদিন থেকে পাণ্ডু রাজা হয়েছেন, সেদিন থেকেই ঈর্ষালু। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে– আপন যৌবনশক্তির তাড়নায় সত্যবতী তার পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া এই অন্যায়গুলিকে দেখতে পাননি। ব্যাস সর্বনিরপেক্ষ মহাকবি, তিনি সব দেখতে পান, কিন্তু কবিজনোচিত শৈলীর তন্ময়তায় এবং জননীর মর্যাদাবোধে শেষ কথাটা বলেন– তুমি আর এই কুরুবাড়িতে বসে বসে আপন কুলের ভয়ংকর এই ক্ষয় দেখতে যেয়ো না মা দ্রাক্ষীং কুলস্যাস্য ঘোরং সংক্ষয়মাত্মনঃ। তুমি চলো আমার সঙ্গে আমারই তপচ্ছায়ায় ব্যস করবে আমারই তপোবনে।

জননী সত্যবতী অতি বিচক্ষণা। তিনি ঋষিপুত্রের এই শব্দাঘাত উপেক্ষা করেননি। তিনি বুঝেছেন– যে পরমর্ষি তার প্রথম যৌবনোদ্ভেদে আর্য তেজ নিহিত করেছিলেন তার গর্ভে, সেই পরম অভ্যুদয় তিনি আপন মোহে হেলা করে এসেছেন। আজ সেই পুত্র তাকে তার পরমর্ষি স্বামীর বৈরাগ্য-সাধনপথে নিযুক্ত করতে এসেছে, এই তার সঠিক পথ। হঠাৎই তার মনে হল– দুই পুত্রবধূর কথা। তাঁরাই বা কী পেলেন! স্বামী অকালে কামাচারে গতায়ু হলেন, অবশেষে নিয়োগের মাধ্যমে তারা যে পুত্র লাভ করলেন, তাও এই ব্যাসের কাছ থেকেই। সেভাবে দেখতে গেলে ব্যাসই তো তাদের আসল স্বামী, তাদের গর্ভস্থ সন্তানের জনক। কী যে মনে হল সত্যবতীর! ব্যাস তাঁকে আকস্মিকভাবে বনগমনের প্রস্তাব দিয়েছেন, তিনিও ততোধিক আকস্মিকতায় সেই প্রস্তাব স্বীকার করেছেন– তথেতি সমনুজ্ঞায়। তারপরেই তেমনই আকস্মিকভাবে তিনি দুই পুত্রবধূর সামনে এসে, প্রধানত অম্বিকাকে উদ্দেশ করে বললেন– অম্বিকা! শুনছি নাকি তোমারই ছেলের ঘরের নাতি দুর্যোধনের অন্যায় কর্মে এই গোটা ভরতবংশটাই ধ্বংস হয়ে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে এই প্রজা, পরিজন, মন্ত্রী, অমাত্য সব– সানুবন্ধা বিনঙক্ষ্যন্তি পৌরাশ্চৈবতি নঃ তম।

অম্বিকা যথেষ্টই বুঝতে পেরেছেন যে, ব্যাসের কাছে কথা শুনেই সত্যবতীর এই প্রতিক্রিয়া। সম্ভবত ধৃতরাষ্ট্র যে প্রশ্রয় এবং যে পক্ষপাতে দুর্যোধনকে মানুষ করে তুলেছিলেন, তাতে অম্বিকাও নিশ্চয়ই খুশি ছিলেন না। সত্যবতী দুর্যোধনের সূত্রে ধৃতরাষ্ট্রের দিকেই তাঁর অভিযোগের অঙ্গুলিসংকেত করেছেন। অন্যদিকে পাণ্ডু মারা যাওয়ায় বিধবা অম্বালিকার জন্যও সত্যবতীর বড় মায়া হচ্ছিল। অম্বিকা ও অম্বালিকা– এই দুই রাজবধূই সত্যবতীর বিপরীত চরিত্র। সেই যে মহামতি ভীষ্ম এঁদের কাশীর রাজসভা থেকে তুলে এনে বিচিত্রবীর্যের বন্ধু হিসেবে হস্তিনাপুরে স্থাপন করেছিলেন, এই স্থাপনা ছাড়া আর কোনও ক্রিয়াকর্ম, ব্যক্তিগত ব্যবহার কিছুই জানা যায় না এঁদের সম্বন্ধে। কুরুবাড়ির রাজনীতিতেও এঁরা কখনও মাথা গলাননি সত্যবতীর মতো। সত্যবতী বুঝলেন তিনি আজ হস্তিনাপুর ছেড়ে চলে গেলে এই দুই রাজমাতা বড় একা, বড় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বেন, বিশেষত পাণ্ডুজননী অম্বালিকা, যাঁর রাজপদে অভিষিক্ত পুত্রটি মারা গেছে। সত্যবতী তাই অম্বিকাকে ভবিষ্যতের অন্যায় অনীতির কথা বলেই তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তারই ভগিনীর দুর্দশার কথা। বলেছেন– একবার তাকাও পুত্রশোকে ম্লান দীন এই অম্বালিকার দিকে। তুমি যদি চাও, তবে এমন হতে পারে যে, অম্বালিকাকে নিয়ে তুমিও আমার সঙ্গে চলো সেই শান্তির নিবাসে, তপোবনে, যেখানে পুত্র ব্যাস আমাকে নিয়ে যেতে চাইছেন– বনমাদায় ভদ্রং তে গচ্ছাম যদি মনসে।

অম্বিকা-অম্বালিকা সত্যবতীর দূরদৃষ্টির ওপর সম্পূর্ণ আস্থাশীল। তারা দ্বিরুক্তি না করে এক কাপড়ে বেরিয়ে এলেন সত্যবতীর সঙ্গে। ব্যাস যে তার জননীকে এবং একভাবে তার তেজোধারিণী দুই স্ত্রীকেও এইভাবে প্রবজ্যার পথে নিয়ে গেলেন, এ সম্বন্ধে তিনি কবি হিসেবে খুব অল্প কথাই লিখেছেন। যে ঘন ঘটমান কাহিনির মধ্যে দিয়ে, যে আড়ম্বরপূর্ণ তাৎপর্যের মধ্যে দিয়ে সত্যবতী অথবা অম্বা-অম্বালিকারও আগমন ঘটেছিল হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে, সেই ঘনঘটা, আড়ম্বর অনুপস্থিত রইল সত্যবতীর প্রব্রজ্যায়। রাজপুরীতে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের চোখ দিয়ে এক ফোঁটাও জল গড়িয়ে পড়ল না তার মা-ঠাকুমা চলে যাচ্ছেন বলে। কুরুবাড়ির অন্তঃপুরে একটুও কান্নার কলরোল উঠল না সত্যবতীর বনগমনের সিদ্ধান্তে। যে সত্যবতী এই রাজবাড়িতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সব জায়গায় ব্যাপ্ত হয়ে জুড়ে বসেছিলেন, তার বনগমনের সংবাদে এতটুকু বিপর্যয়, এতটুকু প্রতিক্রিয়া হল না তার পরিপার্শ্বের আবহমণ্ডলে।

আসলে মহাভারতের প্রকৃত সুর এই শান্ত রস। বিশেষত এ হল মহাভারতের কবির জীবনাবহের ক্ষেত্র, তারই মা, তারই নির্মোহ তেজ-ঋদ্ধা দুই রমণী। ব্যাস সব সময় বলেন সাংসারিক জগতের কর্মগুলি তো করেই যেতে হবে, কিন্তু এক সময়ে সব ত্যাগ করে মনে মনে মুক্তও হতে হবে। সত্যবতী এবং অম্বিকা-অম্বালিকাকে প্রব্রজ্যার পথে অনুগত করে ব্যাস তার জননীকে ঋষি পরাশরের সিদ্ধ জীবনের পথে নিয়ে এলেন– সংসার জীবনের চক্রান্ত থেকে তাঁকে নিয়ে এলেন শান্ত আশ্রম পদে। সঙ্গে নিয়ে এলেন দুই রিক্তা রমণীকে যাঁরা বিচিত্রবীর্যকে নামে মাত্র স্বামী হিসেবে পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর কাছ থেকে যাঁরা সন্তান লাভ করেছিলেন, ব্যাস তাদেরও নিয়ে এলেন বৈরাগ্যের নির্বিগ্ন জগতে একান্ত সহধর্মচারিণী করে।

সত্যবতী তার দুইপুত্রবধূকে সঙ্গে নিয়ে বিদায়বেলায় একবার মাত্রা দেখা করেছিলেন পুত্রপ্রতিম ভীষ্মের সঙ্গে– তথেZক্কা সাম্বিকয়া ভীষ্মমামন্ত্র সুব্রতা। তার অনুমতি লাভ করতে দেরি হয়নি। তারপর কোনও শোরগোল না করে সত্যবতী অম্বিকা-অম্বালিকাকে নিয়ে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে ব্যাস নির্দিষ্ট তপোবনে এসে পৌঁছেছেন– বনং যযৌ সত্যবতী মুযাভ্যাং সহ ভারত। এমন হতেই পারত যেন এই তো সত্যবতীর দ্বিতীয় সংসার। হতেই পারে এখানে ঋষি পরাশর ছিলেন তার প্রথম স্বামী; এখানে ব্যাস আছেন, যাঁকে একভাবে অম্বিকা-অম্বালিকার স্বামী বলে মনে করা যেতে পারে। অতএব সত্যবতী এক সংসার ছেড়ে যেন আর এক সংসারে যাত্রা করলেন– যেখানে তার স্বামী, পুত্র, পুত্রবধূ সব আছে; ভরা সংসার।

কিন্তু না, ঋষি ব্যাস সত্যবতীকে এক মোহ থেকে আর এক মোহের মধ্যে প্রবেশ করাননি। সত্যবতী এবং তার পুত্রবধূরা ব্যাসের বদরিকাশ্রমে এসে পুনরাবাস লাভ করেছিলেন, এমন কোনও সূচনা মহাভারতে নেই। সম্ভবত এমন কোনও বনস্থলীতে তাদের বসতি নির্দেশ করেছিলেন ব্যাস, যেখানে নিরুপায় হয়েই যোগাভ্যাসে মন দিতে হবে। তারা তাই করেছিলেন। বৈরাগ্য-কৃচ্ছসাধনে নিজেদের অন্তঃকরণ শুদ্ধ করে তপস্যার মাধ্যমে পরম ঈশ্বরের সঙ্গে তারা একাত্মতা সাধন করলেন গভীর মনঃসংযোগে। এইভাবেই একসময় তাদের মৃত্যুও হল– দেহং ত্যক্কা মহারাজ গতিমিষ্টাং যযুস্তদা। হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির কেন্দ্রস্থানে স্থিত সত্যবতী, মহারাজ শান্তনুর কামনার ধন সত্যবতী শেষ বয়সে সকলের অজান্তেই একদিন যেন হারিয়ে গেলেন এই চিরযৌবৃনা পৃথিবী থেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *