০৩. দেবযানী ও শর্মিষ্ঠা

০৩. দেবযানী ও শর্মিষ্ঠা

০১.

সময় যে পালটায়, পালটেছে, সেটা সবচেয়ে ভাল বুঝতে পারে আমাদের মতো সদ্য বুড়োরা। আমাদের এমন ক্ষমতা নেই যে, ডিকেন্সের দুই শহরের অসামান্য তুলনা করার কৌশল এখানে রপ্ত করব এবং সেই কৌশলে দুই কালের অসাধারণ একটা তুলনা টানব। বস্তুত ব্যাপারটা অত বৃহৎ কিছুও নয়। তবে কিনা বারবার মনে হয়, পুরুষ-রমণীর হৃদয় প্রকাশ করার প্রকারের মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য এসেছে এবং তাতে করে এমন ভাবারও কোনও কারণ নেই আমার যে, এখন যা হচ্ছে, যা বড় খারাপ, বড় বেলেল্লাপনা চলছে। সর্বত্র। এটা যদি খারাপ আর বেলেল্লাপনাই হত, তা হলে আমার পিতাঠাকুরের তুলনায় আমার যুবককালের সমস্ত ঘটনাপ্রবাহই বেলেল্লাপনা। তবে হ্যাঁ, এখন অনেক কিছুই দেখি, যা অনেক সময়ে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ঈর্ষাকাতর করে তোলে, যদিও বৃদ্ধত্বের শিংটুকুও ভাঙা চলে না, আর এখনকার ছেলেমেয়েরাও কেউ গোবৎস নয়; তারা সব বোঝে।

আমার খটকা লাগল সেইদিন এবং ঠিক সেইদিনই আমি বুঝলাম যে, আমার বৃদ্ধত্বের বয়ঃসন্ধি ঘটেছে, যেদিন কলেজ স্কোয়ারে পথ অতিক্রম করার সময় শুনলাম– একটি ছেলে সামান্য একটু অনুযোগের সুরে মেয়েটিকে বলছে– তুই কিন্তু এখনও আমাকে ‘আই লাভ ইউ’ বলিসনি। মেয়েটি ঈষল্লাস্যে মধুর হেসে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে, এই তো বলছি– আই লাভ ইউ। অত রাগ দেখাচ্ছিস কেন? সত্যি বলতে কী– সেই ধ্বনি পবনে বহিল। চলমান পথের মধ্যে দুই অজ্ঞাতপরিচয় তরুণ-তরুণীর এই কথোপকথন আমাকে দুটি বিষয় বুঝিয়ে দিল, অবশ্য এখানে একটি অন্যটির ফলশ্রুতি। প্রথমত, অনুমানযোগ্য কারণেই বুঝলাম এই দুই তরুণ-তরুণীর মধ্যে পরিচয় মেলামেশা হয়ে গেছে, কিন্তু যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতার মধ্যেও মেয়েটি ‘আই লাভ ইউ’ না বলায়, তরুণ ছেলেটি এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। দ্বিতীয় বিষয়টা একেবারেই অন্য। সেটা আমাদের সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে প্রায় ইংরেজি না-জানা একটি প্রজন্মের ভাষা-ব্যবহারের দিক। এই পোস্ট-কলোনিয়াল ভাবনারাশির অনন্ত প্রক্রিয়ায় আমাদের কালচারের মধ্যে ঔপনিবেশিকতা এমনভাবেই ঢুকে আছে যে, তার ফলশ্রুতি এই পঁড়াল, অর্থাৎ ইংরেজি ভাষায় ‘আই লাভ ইউ’ না বললে প্রেমশঙ্কা নিবৃত্ত হচ্ছে না।

আমার বক্তব্য হল– ছেলেমেয়েরা বহুকালই কলেজ স্কোয়ারে ঘুরেছে, প্রেম নিবেদনের ইতিহাসও বহুপথে শ্রুত, কীর্তিত এবং লিখিত হয়েছে, কিন্তু দুটি বস্তু এখন খুব চোখে পড়ে। প্রথমটা প্রাথমিক প্রেমসিদ্ধির চিহ্ন হিসেবে ‘আই লাভ ইউ’ নামক মহাবাক্যের প্রয়োগ। দ্বিতীয়টা, সামাজিক ঐতিহাসিকের মননের বিষয় এবং সেটা হল– মেয়েদের দিক থেকে আগ বাড়িয়ে প্রেম নিবেদনের প্রবণতা। দেখছি, মেয়েরাও আজকাল যথেষ্ট প্রেম নিবেদন করছে, ফ্লার্ট করছে ছেলেদের সঙ্গে এবং হাবে-ভাবে, লাস্যে-ভাষ্যে নিজেদের অগ্রগতির অবস্থানও বুঝিয়ে দিচ্ছে। আবারও বলি– এতে আমি খারাপ কিছু দেখছি না। বৃদ্ধরা পূর্বে একে কালের গতি বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেছেন বটে কিন্তু আমাদের কালেও আক্ষরিক অর্থে এটাকে কালের গতি বা পরিবর্তন হিসেবেই ধরে নেওয়া হত, অন্তত আমাদের বাপ-পিতামহরা তাই বলে স্বস্তি পেতেন। এর কারণ হিসেবে ফেমিনিজম, প্রগতিশীলতা, বিশ্বায়ন, এবং মেয়েদের মানসিক জড়তা-ভঙ্গ যাই থাক, এখানেই আমার বুকে কিছু সুখের মতো ব্যথা বাজে। এবং তা বাজুক, কেননা আমি বুড়ো হচ্ছি বলে তো আর দুনিয়ার অগ্রগতি রুখে থাকবে না। অপিচ সাজে-কাজে, কথায় এবং বার্তায় মেয়েরা আরও প্রগলভা থেকে প্রগলভতরা যদি হয়ে ওঠেন, তা হলে বুড়োদের নান্দনিক বোধ এবং নাতনি-স্নেহ আরও জাগ্রত হোক, এই প্রার্থনা করি।

কালের কথাটা তবু থেকেই যায়। আমি আধুনিক কালের যুবকদের প্রতি যেমন ঈর্ষাবোধ করি, তেমনই আমার পিতৃকুল এবং বয়স্ক দাদাদের জন্য দুঃখও পাই। তাদের কালে নাকি উচ্চশিক্ষায় যে সব মেয়েরা আসত, তারা মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে এসে ক্লাসে ঢুকতেন এবং ক্লাস করার পর তাদের সঙ্গেই বেরিয়ে যেতেন। পুরুষ সহপাঠীদের সঙ্গে কথাবার্তা প্রায় ছিলই না, মেলামেশা তো দূরের কথা। এ বাবদে আমাদের বয়সকাল অনেক ভাল ছিল। কথাবার্তা, হাসিঠাট্টাও পারস্পরিক চলত যথেষ্ট, কিন্তু প্রেমের ক্ষেত্রে রাবীন্দ্রিক প্রভাব যেন একটু বেশিই ছিল। অর্থাৎ কথা যত না ছিল, ভাব এবং ভাবালুতা ছিল তার চেয়ে বেশি। বিশেষত, এমন উদাহরণ খুব কমই ছিল, যেখানে মেয়েরা পুরুষের কাছে এগিয়ে এসেছে প্রেম নিবেদন করার জন্য। অন্যদিকে পুরুষের কাছে বিদগ্ধা তরুণীরা প্রায় সময়েই অবোধ্য থাকতে ভালবাসতেন। কথাবার্তা তথা ভাব-ভঙ্গির মধ্যে সাহিত্যের ধ্বনিতত্ত্ব বেশি মিশে থাকায় পুরুষের মনন-শক্তির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হত। কোনও কথা বললে মনে হত কেন বলল, না বললে মনে হত– কেনই বা বলল না– এই অসহনীয় স্বগত যুক্তিতর্কের মধ্যে ‘নিমেষে আঁচল ছুঁয়ে যায় যদি চলে। তবু সব কথা যাবে সে আমায় বলে’– এইসব বিচিত্র ভাব-সন্নিবেশ অনেক সময়েই আমাকে অতি বৈষ্ণব ভাবাপন্ন তৃণাদপি সুনীচ এবং তরুর মতো সহিষ্ণু করে তুলেছে। পাছে আমার ভাবমূর্তি ব্যাহত হয়, এই দুশ্চিন্তায় দুর্গত জীবন কাটাতে কাটাতেই আমি বুড়ো হয়ে গিয়েছি, তবু ভাবতে বাধ্য হই– কথাবার্তা আর ধ্বনি-ব্যঞ্জনার সঙ্গে নিজেকে প্রকাশ বা প্রকট করে তোলার একটা সুবিধেও আছে।

হতে পারে, এখানে ‘রোম্যান্টিসিজম’ একটা খুব বড় যুক্তি এবং মেয়েদের দিক থেকে প্রগলভ হয়ে ওঠা, নিজেকে কথায়-মনে প্রকট-প্রকাশ করে ফেলাটা ‘রোম্যান্টিসিজম’-এর চরম জায়গায় একটা বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, জীবন তো এরকম নয়। এখানে নিজের সঙ্গে নিজের ছায়াযুদ্ধ চলে প্রতিনিয়ত। এখানে আমাদের পৌরুষেয়তা, আমাদের সামাজিক আচার, আমাদের অহংকার এমনভাবেই মেয়েদের দেখতে, বলতে এবং শুনতে শিখিয়েছে যে, তাদের কায়, মন এবং বাক্য কোথাও কোনও আচরণভঙ্গ হলেই তাদের মেয়েত্ব নিয়ে বিচিত্র প্রশ্ন উঠে যায়। কিন্তু জীবন এবং জগৎ তো এটাই দাবি করে যে, এমন মেয়েও থাকবে এবং ছিল এবং আছে– যারা নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছে, প্রেম, ভালবাসা, এমনকী যৌনতার কথাও নিজের মুখে বলবে, বলত এবং বলে। যৌনতার কথা পর্যন্ত নাই গেলাম, কিন্তু একজন সুন্দরী রমণী তার হৃদয় উন্মোচিত করছে পুরুষের কাছে, প্রেম নিবেদন করছে নিজের ভাব-ব্যঞ্জনায়, অথবা নিজের মুখে– এটা অংশত সত্য হলেও সমাজের এই একান্ত বাস্তবটা বোঝানোর জন্য মহাভারতের আদিপর্বে একবার প্রবেশ করতেই হবে।

আদিপর্বের বিভিন্ন ঘটনাবলির মধ্যে আমরা যাব না। কিন্তু এখানে দেবযানীর কথাটা আমরা সাড়ম্বরে বলতে চাই। এই কারণে যে, তৎকালীন সমাজে তিনিই বোধহয় অন্যতমা রমণী যিনি ব্রাহ্মণকন্যা হওয়া সত্ত্বেও ভবিষ্যতে ক্ষত্রিয় রাজার কণ্ঠলগ্না হয়েছিলেন স্বেচ্ছায় স্ব-স্বাধীনতায়। আর দ্বিতীয় হল সেই দুর্লভ সামাজিক গুণ, যেখানে একটি মেয়ে নিজের মুখে তার পুরুষাভিলাষের কথা জানিয়েছে অভিমত পুরুষের জন্য। না, আমরা এটা মোটেই বলছি না যে, পুরুষই একমাত্র প্রেম, ভালবাসা, কামনার অভিলাষ জানায়। আমরা জানি, তা মেয়েরাও জানায়। তবে এই জানানো প্রায়শই শব্দমন্ত্রে হয় না, বেশির ভাগই তা রমণীর ভাবতন্ত্র, শব্দ সেখানে ফুটাস্ফুট ব্যক্ততায় ভাবকে তীব্রতর করে। তবে মহাভারতে দেবযানীর আখ্যানে সেই অসাধারণ বৈশিষ্ট্যটুকু আছে, যেখানে অতিসংরক্ষণশীল ব্রাহ্মণ্য কোনও বাধা হয়ে উঠতে পারেনি এবং দেবযানী তার নিজের জীবন নিজেই গঠন করছেন, নিজের পছন্দ যে পুরুষ তাকে নিজের পছন্দের কথা বলতেও তিনি দ্বিধা করছেন না, এমনকী নিজের মুখে নিজের আর্ত প্রেম জানাতেও তার কোনও দ্বিধা নেই।

সমাজ এবং জীবনের সাংস্কারিক পদ্ধতির মধ্যে থাকতে থাকতে আমরাও যেন এইরকমই ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছি যেন সুন্দরী মেয়েরা কখনওই নিজের মুখে পুরুষের কাছে প্রেম নিবেদন করে না অথবা জানায় না কোনও পুরুষের জন্য স্বাভিলাষ। আমাদের দেশে এটা তো একটা বৈশিষ্ট্যই বটে, কেননা মনু যাজ্ঞবল্ক্যর নিয়ম-নীতি মাথায় নিয়ে আমাদের পিতামাতারা বড় হয়েছেন, সেখানে বিবাহ-পূর্বকালে কোনও পুরুষের প্রতি অনুরাগই মেয়েদের পক্ষে বেশ অনভিপ্রেত ছিল, তার মধ্যে আবার নিজের মুখে প্রেম-যাচনা– মেয়েদের মুখে এটা যেন মানায়ই না। তবে সবিনয়ে জানাই, এটি এককভাবে ভারতবর্ষের কোনও বৈশিষ্ট্য নয়, ইংরেজ অথবা ইউরোপীয় সংস্কৃতিতেও হ্যাঁ, ওদের চুম্বনালিঙ্গনের প্রক্রিয়া যতই খোলামেলা বা উদার হোক, ইউরোপীয় সংস্কৃতিতেও আগ বাড়িয়ে মেয়েরা প্রেম নিবেদন করলে তাকে খানিক ‘ককেটিশ’ বলে চিহ্নিত করাটা সাধারণ রেওয়াজের মধ্যেই ছিল। এমনকী গবেষক পণ্ডিতেরা রেনোয়া-রাফায়েল-এর ছবির বিচার করার সময় পর্যন্ত মেয়েদের চোখের দিকে লক্ষ্য রেখে বলেছেন– স্বানুকূল করার জন্য ছেলেদের চোখ যদি মেয়েদের মুখের দিকে আবদ্ধ থাকে, তবে মেয়েদের চোখ কিন্তু এদিকে, ওদিকে অথবা দিগন্তে প্রসারিত, নেহাৎ চোখের মণির মতো শব্দ-শ্রবণে কানের কোনও লক্ষ্য চিত্রিত করা যায় না, তা নইলে মেয়েদের কানগুলিকেও অন্য কোনও দিগন্তে বিলীন হতে দেখা যেত চিত্রকরের হাতে। হয়তো বা অশেষ রমণীকুলের সামাজিক ভাবন্যাসের মধ্যেই এর রহস্য আছে এবং ডারউইনের মতো সামাজিক পিতা তো বলেই দিয়েছিলেন যে, 6168T1 TE Less eager than the male… she is coy, and may often be endeavour ing to escape from the male.’

এই যে রমণীকুলের ‘coyness’ লজ্জাবতী ভাব, রমণীর মন জয় করার জন্য পুরুষের যে সার্বক্ষণিক চেষ্টা এবং অপচেষ্টা এবং সেখানে ডারউইনের choice theory, অর্থাৎ রমণী বেছে নেবে তাকেই যার সেই দুরূহ সৌভাগ্য আছে, এখানে তার জায়গাটা অনেক শক্তপোক্ত বলে বলেন সামাজিকেরা। কিন্তু রমণীর লজ্জাবতী ভাবটাই সমস্ত নারীসমাজের সামান্য ধর্ম এবং সেটাই হওয়া উচিত– এই সিদ্ধান্ত সব পণ্ডিত-গবেষকেরা মানেন না। তাদের মতে ছলবলে বা চুলবুলে ‘ককেটিশ রমণীদেরও যথেষ্ট আবেদন আছে এবং সমাজে এবং সাহিত্যেও তারা সংখ্যায় কম নন। কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন– মেয়েদের ককেটিশ ভাবটা প্রায়ই স্বাভাবিক নয়, যদি বা কখনও এই স্বভাব দেখাও যায়, তা হলে বুঝতে হবে, সেই মেয়ের মধ্যে একটা ‘ইনসিকিওরিটি কাজ করছে এবং সেটা হয়তো তার ভবিষ্যৎ জীবনের একটা সুস্থিতির জন্যই।

আমরা বলব এই সমস্ত কল্পগুলি পটভূমিতে রেখেই মহাভারতের দেবযানীর চরিত্র ভাবনা করা উচিত। দেবযানীর প্রথম জীবনের সবচেয়ে বড় ভাগটি জুড়ে আছেন তার পিতা শুক্রাচার্য, সামাজিক জীবনে তিনি কিন্তু একটা চলমান ‘এস্টাব্লিশমেন্টে’র বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছেন। অর্থাৎ তিনি দেবতাদের তথাকথিত শুভশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অসুর-দৈত্য দানবের আচার্য হয়ে আছেন, তিনি ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ এবং বিরাট রাজনীতিজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও তিনি দৈত্য-দানবদের গুরু। তার মানে জীবনের প্রথম ভাগেই দেবযানী কিন্তু ‘মেইনস্ট্রিম’ ব্রাহ্মণ্য শক্তির বিরুদ্ধে একটা ‘কাউন্টার-হেজিমনি’র অঙ্গ হয়ে আছেন। এই মুহূর্তে দৈত্যদের সর্বময় রাজা বৃষপর্বার আচার্য-স্থানে আছেন শুক্রাচার্য। শুক্রাচার্য দানবদের রাজ্যেই বাস করেন এবং দেবযানীও তার কাছেই থাকেন। শুক্রাচার্যের স্ত্রী কিংবা দেবযানীর মায়ের নামটুকু আমরা পুরাণের বংশবর্ণনার অংশ থেকে জানতে পারি কিন্তু দেবযানীর নিত্য-নৈমিত্তিক-প্রাত্যহিক কোনও ঘটনার মধ্যে আমরা তার মায়ের সাহচর্য একবারও উল্লিখিত হতে দেখিনি। একটি পুরাণ স্পষ্টতই জানিয়েছে যে, মাতৃ-সাহচর্যহীনা দেবযানীর প্রতি পিতা শুক্রাচার্যের স্নেহ ছিল একেবারেই লাগামছাড়া।

এতগুলি কল্প-বিকল্পের মধ্যে দেবযানী মানুষ হচ্ছেন বলেই তার জীবনে প্রথম পুরুষের পদ-সঞ্চার রীতিমতো এক মনস্তত্বের বিষয় হয়ে ওঠে। দেবযানীর কাহিনি আরম্ভ হয়েছে এক দৈব অভিসন্ধি নিয়ে। ধন-সম্পত্তি আর ঐশ্বর্যের অধিকারকে কেন্দ্র করে দেবতা এবং অসুরদের সংঘাত চলছিল নিরন্তর– সুরাণামসুরাণাঞ্চ সমজায়ত বৈ মিথঃ। এই অবস্থায় দেবতারা বৃহস্পতিকে গুরু হিসেবে বরণ করে নিলেন, আর অসুর-দানবেরা গুরুকরণ করলেন শুক্রাচার্যকে। দেখা গেল, তখন যেসব সংঘর্ষ চলল, সে সব জায়গায় দেবতারা দৈত্য-দানবদের যখনই মেরে ফেলছেন, দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য তার সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করে সেইসব অসুর-দানবদের বাঁচিয়ে তুলছেন। কিন্তু এই বিদ্যা বৃহস্পতির জানা না থাকায় তিনি যুদ্ধহত দেবতাদের আর বাঁচাতে পারছেন না– ন হি বেদ স তাং বিদ্যাং যৎ কাব্যো বেত্তি বীর্যবান।

আসলে শুক্রাচার্যের মধ্যে নানান উদ্ভাবনী শক্তি ছিল এবং সেটা এতই বেশি চমৎকৃতি তৈরি করত যে তিনি একসময় ‘কবি’ নামে পরিচিত হন, এমনকী কাব্য নামেও। খোদ ভগবদ্গীতার বিভূতিযোগে ভগবান বলেছেন- কবিদের মধ্যে আমি উশনা শুক্রাচার্য– কবীনামুশনাঃ কবিঃ। এখানে পণ্ডিত টীকাকারেরা অবশ্য শাস্ত্রদ্রষ্টা ঋষিকেই কবি বলে চিহ্নিত করেছেন এবং আমরা মনে করি, রাজনীতির মতো কঠিন শাস্ত্র-দর্শনে শুক্রাচার্যের নব-নবোন্মেষশালিনী প্রজ্ঞা ছিল বলেই তিনি কবি বা কাব্য নামে চিহ্নিত হয়েছেন। ভৃগুপুত্র কবির ছেলে কাব্য উশনা– এই বংশলতা তার বুদ্ধি-প্রকর্ষে উড়ে গেছে। তিনি নিজেই কবি নামে চিহ্নিত।

সে যাই হোক, শুক্রাচার্য যা পারছেন, বৃহস্পতি তা পারছেন না বুঝেই দেবতারা শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতির ছেলে কচের শরণাপন্ন হলেন। তারা বললেন– আমরা তোমার সাহায্য চাই, ব্রাহ্মণ! অমিততেজস্বী শুক্রাচার্যের কাছে যে সঞ্জীবনী বিদ্যা আছে, সেই বিদ্যা তোমাকে আহরণ করে নিয়ে আসতে হবে আমাদের কাছে শুক্রে তামহর ক্ষিপ্রং ভাগভা নো ভবিষ্যসি। কীভাবে এই বিদ্যা শুক্রাচার্যের কাছ থেকে নিয়ে আসতে হবে– এবার তার উপায় কচকে বলতে আরম্ভ করলেন দেবতারা। তারা বললেন– শুক্রাচার্য এখন দানবরাজ বৃষপর্বার আচার্য হিসেবে তাঁরই রাজধানীতে তার কাছেই থাকেন। তিনি শুধু দানবদেরই রক্ষা করেন, দানব ছাড়া অন্য কাউকে তিনি রক্ষা করেন না। এই অবস্থায় তোমাকে গিয়ে শুক্রাচার্যকে তুষ্ট করতে হবে এবং তার মেয়েকেও তুষ্ট করতে হবে; আর সত্যি বলতে কী, এ কাজটা তুমিই শুধু পারো– মারাধয়িতুং শক্তো নান্যঃ কশ্চন বিদ্যতে।

এখানে কচের দিক থেকে তো প্রশ্ন উঠবেই যে, তোমরা শুক্রাচার্যকে তুষ্ট করতে বলছ, বিদ্যালাভের জন্য সেই সদগুরুর সেবা করব সেটা ঠিক আছে, কিন্তু তার মেয়েটাকেও তুষ্ট করতে হবে, এ কেমন কথা! দেবতারা কচকে বললেন– তুমি ‘পূর্ববয়াঃ অর্থাৎ তোমার বয়স কম, সেটা একটা সুবিধে, এই বয়সে বিদ্যা লাভ করার পরিশ্রম করে তুমি যেমন শুক্রাচার্যকে খুশি করার চেষ্টা করবে, তেমনই তার মেয়েটাকেও তুষ্ট করার চেষ্টা করবে। কেননা, তার আদরের মেয়ে দেবযানী তুষ্ট হলেই তুমি কাব্য উশনার কাছ থেকে নিশ্চিতভাবে বিদ্যা লাভ করতে পারবে– দেবযান্যাং হি তুষ্টায়াং বিদ্যাং তাং প্রান্সসি ধ্রুবম। এইরকম একটা প্রস্তাব কচের পক্ষে বোঝা অসম্ভব নয়। কিন্তু একটা যুবতী মেয়েকে তুষ্ট করে তার বাপের কাছে পৌঁছনো এবং তাঁর কাছ থেকে বিদ্যে আদায় করার প্রক্রিয়ার মধ্যে যে সব উপাদান আছে, তাতে কচের দিক থেকে অন্যত্র বাহিত হওয়ার সম্ভাবনা পুরোপুরি থেকে যায় বলেই দেবতারা যেন একটু সতর্ক হয়ে কচকে বলেছিলেন– তুমি দেবযানীকে তুষ্ট করবে তোমার চরিত্র দিয়ে। তোমার অনুকূলতা দিয়ে, তোমার মধুরতা দিয়ে, তোমার আচরণ দিয়ে এবং তোমার সংযম দিয়ে– শীলদাক্ষিণ্য-মাধুর্যেরাচারেণ দমেন চ।

তার মানে, প্রথম থেকেই এটা ঠিক হয়ে রইল যে, দেবযানীকে ভোলাতে হবে অনুকূল ব্যবহারে এবং পৌরুষের মধুরতায়, কিন্তু তাই বলে শেষ জায়গায় সংযমের বাঁধ ভাঙলে চলবে না। তার মানে, এটা তেমনই এক সুষ্ঠু পরিকল্পনা যেখানে ঠিক করেই নেওয়া হল যে, দেবযানীকে এক চরম বঞ্চনার শিকার হতেই হবে, এক যৌবনবান পুরুষ তাকে ভোলাবে, কিন্তু নিজে ভুলবে না।

দেবতাদের শুভেচ্ছা নিয়ে কচ উপস্থিত হলেন শুক্রাচার্যের আশ্রমে। সেখানে সবিনয় প্রণিপাতে কচ শুক্রাচার্যকে বললেন– আমি কচ– অঙ্গিরা ঋষির পৌত্র, বৃহস্পতির ছেলে। আমি আপনার শিষ্য হতে চাই। আমি কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করব এবং যতদিন শিক্ষা সম্পূর্ণ না হয়, ততদিন গুরুগৃহে থাকব–ব্রহ্মচর্যং চরিষ্যামি… শিষ্যং গৃহ্বীতু মাং ভবান। দানবগুরু শুক্রাচার্য সানন্দে কচকে শিষ্যত্বে বরণ করে নিলেন এবং স্বাগত জানালেন তার প্রচেষ্টাকে কচ সুস্বাগতং তেহস্তু প্রতিগৃহ্নামি তে বচঃ। বস্তুত শুক্রাচার্য খুশিই হয়েছেন, তার শত্রুপক্ষের শিক্ষক-আচার্যের জ্যেষ্ঠ পুত্রটি তার কাছে শিক্ষা নিতে এসেছে, এতে তার গর্বই হল। সেকালে অবশ্য এই ব্যবহারটা ছিল; শত্রু বলেই তার পুত্ৰ-আত্মীয়-পরিজনদের সঠিক শিক্ষা দেব না– এই সংকীর্ণতা গুরু-আচার্যদের ছিল না। আমরা পরবর্তী কালে দ্রোণাচার্যকে দেখব দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকে শিক্ষা দিচ্ছেন– ভবিষ্যতে এই ধৃষ্টদ্যুম্ন কিন্তু দ্রোণাচার্যের গলা কাটবেন। অতএব শিক্ষাদানের ব্যাপারে শুক্রাচার্যও সেই উদার দার্শনিকতায় বিশ্বাস করেন। শুক্রাচার্য কচকে বললেন– এখানে তুমি স্বাগত। আর আমি মনে করি– এতে তোমার পিতা বৃহস্পতিকেও আমার সম্মান জানানো হচ্ছে, তোমাকে প্রত্যাখ্যান করলে তাঁকে অসম্মান করা হবে, তাই তুমি আজ থেকে আমার শিষ্য হলে, তোমার পিতা সম্মানিত হন– অৰ্চয়িষ্যেহহমর্চং স্বাম অর্চিতোহস্তু বৃহস্পতিঃ।

শিষ্যত্ব গ্রহণের সময় কচ কিন্তু একবারও মুখ ফুটে বললেন না যে, তিনি সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখতে এসেছেন শুক্রাচার্যের কাছে। শুক্ৰ কচকে শিষ্যত্বে বরণ করতেই কচ ব্রহ্মচর্যের ব্রত গ্রহণ করলেন উশনা শুক্রাচার্যের উপযুক্ত শিষ্য হয়ে ওঠার জন্য, অন্যদিকে তিনি গুরুকন্যা দেবযানীর তুষ্টি বিধানের জন্যও নানাভাবে চেষ্টা করতে লাগলেন, এই খবর প্রাথমিকভাবে দিয়েছে মহাভারত– আরাধয়নুপাধ্যায়ং দেবযানীঞ্চ ভারত। এই তোষণের চেষ্টা বর্ণনা করতে গিয়ে মহাভারত কতগুলি তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করেছে। বলেছে– গুরু এবং গুরুকন্যা দু’জনকেই প্রীত করার চেষ্টা করছিলেন এই কচ– যিনি যৌবন নামক বস্তুটির নজরে এসেছেন, গোচর হয়েছেন কেবল যুবা যৌবনগোচরে এবং দেবযানীকে তিনি তোষণ করার ভাবনা করছেন কখনও তাকে গান শুনিয়ে, কখনও নাচ দেখিয়ে আবার কখনও সুরলোকের সিদ্ধ বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে গায় নৃত্যন বাদয়ংস্ট দেবযানীমতোষয়ৎ।

একজন যুবক পুরুষের দিক থেকে নয়, এমনকী এক যৌবনবতী রমণীর দিক থেকেও নয়, কিন্তু একজন তৃতীয় জনের দিক থেকে যদি দেখেন, তবে কচের এই প্রয়াস আপনার কাছে blatant লাগবে। আমার মনে আছে, আমি যখন বি. এ. ক্লাসে পড়ি, তখন একদিন একটা ক্লাস অফ হয়েছে এমন একটা ক্লাসরুমে চার-পাঁচজন মেয়ের সামনে দীপক সরকারকে টেবিল বাজিয়ে গান শোনাতে দেখেছিলাম। দীপক খুব ভালই গান করত এবং আমি জানতাম দীপক একটি বিশেষ মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতেও চাইত। সেদিনের ওই চার-পাঁচটি মেয়ের মধ্যে তার ঈপ্সিতা রমণীটিও ছিল। আমি হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়ে অপ্রস্তুত হয়ে বসে পড়লাম একটা বেঞ্চিতে এবং দীপকের গান শেষ হতেই সে অন্য মেয়েদের অনুরোধ করতে লাগল গান শোনানোর জন্য। সে শর্ত দিল তারা কেউ গাইলেই সে তার দ্বিতীয় গান শোনাবে। অন্যেরা তেমন গান জানত না, অন্তত দীপকের মতো জানত না। তারা অবশেষে সেই মেয়েটিকেই পীড়াপীড়ি করতে লাগল, যাকে দীপক ঈষৎ পছন্দ করে ফেলেছিল। অনেক না-না, আমি ও-রকম পারি না, অন্যদিন হবে ইত্যাদি বাহানার পরে সেও গাইল– আবার এসেছে আষাঢ়…।

এখানে দুটো জিনিস বলার আছে- দীপকের ব্যবহারিক প্রয়াসটা কিন্তু blatant ছিল না, সে তো একটি অপরিচিতা রমণীকে স্বানুকূল করতে চাইছিল প্রেমের জন্য। কচও সেই অনুকূলতা চাইছিলেন বটে, কিন্তু তা প্রেমের জন্য তো মোটেই নয়, নিছক তোষণের জন্য, তোষণ করে কার্যসিদ্ধির জন্য। এইজন্য এটাকে blunt বলছি, তা আরও বলছি এই কারণে যে, কচ সেটা জানেন। কচ জানেন– তিনি blatantly এটা করছেন কিন্তু দেবযানী সেটা জানেন না এবং একেবারেই সেটা বুঝতে পারছেন না। অসুর-দানবদের মধ্যে থাকতে থাকতে হঠাৎ এই সুরলোকের যুবক এসে উপস্থিত হল তার পিতার কাছে। পড়াশুনো ব্রত নিয়মের পাট চুকিয়েই সে দেবযানীর কাছে আসে, সে গান শোনায়, বাদ্যি বাজায় এবং নাচ দেখায়।

সামাজিক অভ্যস্ততার একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া সব সময়েই কাজ করে, সবার ভিতরেই করে। দিন-রাত অসুর-দানবের ক্রুর সংস্কৃতির মধ্যে যখন স্বর্গসমীরণের মতো কচ এসে দেবযানীর তোষণ করছেন নৃত্য-গীত-বাদ্যে, তখন এক যুবতী-হৃদয় সেগুলিকে নিছক তোষণ বলে বুঝতে পারে না। সে ভাবে, এত আয়োজন, পুরুষের এত প্রয়াস তো শুধু তারই হৃদয়-সংবাদের জন্য, সম্মতির জন্য। বারবার স্তুত-মুগ্ধ-যাচিত হতে হতে রমণীর হৃদয়েও এক অনুকূল প্রতিক্রিয়া আসে। আর কীই না করছেন কচ দেবযানীর মন পাবার জন্য কখনও ফুল্ল বকুল ফুল কুড়িয়ে আনা, কখনও বন্য ফল, আর দেবযানী যখন যা বলছেন, সেই আজ্ঞা পালনে সদা-তৎপর বৃহস্পতি-পুত্ৰ কচ– পুস্পৈঃ ফলৈঃ প্রেষনৈশ্চ তোেষয়ামাস ভারত। আরও দুটি শব্দ আছে মহাভারতের কবির। কচের সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন– যুবা যৌবন-গোচরে– অর্থাৎ এমন এক যুবা পুরুষ, যার ওপরে যৌবনের নজর পড়েছে কেবল। আর যে দেবযানীকে এই যৌবনগন্ধী তরুণ নানা উপচারে তুষ্ট করার চেষ্টা করছে, সেই মেয়েটিও সদ্য যৌবনে পা দিয়েছে– স শীলয় দেবযানীং কন্যাং সম্প্রতি-যৌবনাম।

সদ্য যৌবনে উপনীত কন্যা শব্দটার মধ্যেও একটা কামনার অভিসন্ধি আছে, তার হৃদয়টুকু কমলকলির মতো ফুটনোন্মুখ হয়েই আছে, ফলত কচের দিক থেকে দেবযানীর জন্য যে আনুকূল্যময় তোষণ, ভজন, রঞ্জন চলছিল, তা একসময়ে দেবযানীর মনকে ভাসিয়ে দিল সমান অনুভূতিতে। পিতার শিক্ষাকালে নিয়মব্রতে করে যে পরিশ্রম হত, যে পরিশ্রম হত দেবযানীর জন্য পুষ্প-ফলের অন্বেষণে, দেবযানী এখন যেন আর সেটা সইতে পারছেন না। আগে কচ দেবযানীর মন-ভোলানো গান গাইতেন, এখন দেবযানী কচকে বিনোদিত করার জন্য গান গাইতে থাকেন আর যেটা করেন তার মধ্যে রমণীর ললনাসুলভ বিভঙ্গ আছে, অর্থাৎ তিনি এবার কচের মন ভোলাতে চাইছেন। তা নইলে মহাভারতের কবি এমন সাংঘাতিক একটা ক্রিয়াপদ ঘটমান বর্তমানে প্রয়োগ করতেন না– গায়ন্তী চ ললন্তী চ রহঃ পৰ্য্যচরক্তদা। সংস্কৃতে ‘ল’ ক্রিয়ার অর্থ হল কামনা করা, ভীষণভাবে চাওয়া এবং কচের প্রতি এই কামনার প্রকাশ দেবযানীর দিক থেকে ঘটছে গোপনে, যেখানে অন্য লোক নেই– রহঃ পৰ্যচরক্তদা।

এত কথার সারমর্মে বুঝতে পারি- কচ দেবযানীর মন ভোলাতে চাইছেন শারীরিক পরিশ্রমে এবং নান্দনিক পরিচর্যায় কিন্তু তিনি নিজে ভুলছেন না। অথচ এতদিনে দেবযানীও পরিচর্যা পেতে পেতে কচের পরিচর্যার পরিশ্রম লাঘব করার চেষ্টা করছেন এবং নিজেও তাকে চাইতে আরম্ভ করেছেন মনে মনে, অর্থাৎ তিনি ভুলেছেন। মহাভারতের ঠিক এই জায়গায় গৌড়ীয় সংস্করণে একটি শ্লোক আছে, যা সব সংস্করণে নেই। এখানে দেখা যাচ্ছে– দেবযানীও তখন কচকে পাবার আশায়– ললন্তী নির্জন স্থানে তাকে গান শোনাচ্ছেন অথবা নৃত্যগীতের পরিচর্যা দিচ্ছেন, সেখানে মহাভারত মন্তব্য করছে– যে পুরুষ মেয়েদের কাছে ভাল গান গায়, পরিষ্কার বেশবাস করে, ভাল ভাল গিফট দেয়, সুন্দর কথা বলে এবং নিজেও যে বেশ ভাল দেখতে, তেমন পুরুষকে মেয়েরা নিশ্চয়ই চায়– গায়ন্তঞ্চৈব শুক্লঞ্চ দাতারং প্রিয়বাদিনম। নাৰ্যো নরং কাময়ন্তে। কচ খুব ঝকঝকে জামাকাপড় এবং অলংকার পরতেন কিনা, সে খবর মহাভারত দেয়নি, কিন্তু তিনি যে গান ভাল গাইতেন, ভাল কথা বলতে পারতেন এবং বিনা বাক্যে দেবযানীর অভীষ্ট পূরণ করার চেষ্টা করতেন, তার প্রমাণ তো আমরা পেয়েছি। বাড়ির কাজের লোক যেভাবে আজ্ঞা পালন করে, তেমনভাবে আজ্ঞা পালন করলে মহাভারত বলেছে ‘প্রেষনৈঃ’– কোন রমণী সেই পুরুষের ওপর খুশি না হয়ে পারে! অতএব দেবযানীও এবার চাইতে আরম্ভ করলেন কচকে গায়ন্তী চ ললন্তী চ।

মহাকাব্য জানিয়েছে এইভাবে নাকি পাঁচশো বছর কেটে গেল, যদিও মহাকাব্যের অতিশয়ী বর্ণনা বাদ দিয়ে এটুকু বলাই যায় যে, সময়টা অন্তত পাঁচ বছর হবেই। তবে এত বছরের এই ব্ৰহ্মচর্যের সাধন তার অনেকটাই অতিবাহিত হয়েছে দেবযানীর পরিচর্যায়, কেননা শুক্রাচার্যের নির্দিষ্ট মতে যদি এই ব্রহ্মচর্য পালিত হত, তা হলে কি আর একজন ব্রহ্মচারীর পক্ষে মিষ্টি মিষ্টি গান গেয়ে রমণীর মন ভোলানোর কাজটা সঠিক হত! কেননা গান গাওয়া, কিংবা সুদৃশ্য বেশ বাস ধারণ করা অথবা নির্জন স্থানে রমণীর সম্ভাষণ এ সব তো ব্রহ্মচর্যের শাস্ত্র একেবারেই ওলটপালট করে দেয়। তবে হ্যাঁ, দেবযানীর পরিচর্যা করে কচ যে সুফল পেয়েছিলেন, হয়তো শুক্রাচার্যের অকুণ্ঠ সেবায় সেই ফল পেতে আরও দেরি হত। তার প্রমাণ মিলবে শিগগিরই।

শুক্রাচার্য এবং দেবযানী কেউই কিন্তু এখনও পর্যন্ত বোঝেননি যে, শুক্রগৃহে কচের আসার আসল কারণটা কী? কিন্তু দানব-অসুরেরা কচের অভীষ্টটুকু বুঝে গেল খুব তাড়াতাড়ি। বিশেষত দেবযানীর সন্তোষণে কচের বাড়াবাড়িটাই বোধহয় এই অভিলাষটুকু আরও ধরিয়ে দিল। দেবতার গুরু বৃহস্পতির ওপর দানবদের হাজার ক্রোধ আছে এবং শুক্রাচার্যের সঞ্জীবনী বিদ্যাও যাতে সুরলোকে পাচার না হয়ে যায় এই ভাবনায় দানবেরা কচকে মেরে ফেলল– জয়ুবৃহম্পতেৰ্ঘেষাদ বিদ্যারক্ষাৰ্থমেব চ। শুক্রাচার্য কিংবা দেবযানীকে কচের গোপন ইচ্ছেটা জানাবার সাহস ছিল না দানবদের। অতএব একদিন যখন শুক্রাচার্যের হোমধেনুটিকে চরাতে নিয়ে গেছেন বনের কাছে, তখন দানবরা কচকে মেরে তার শরীর খণ্ড খণ্ড করে কেটে কুকুর দিয়ে খাইয়ে দিল।

এদিকে দিনান্তের সূর্য অস্ত গেল, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই আপন অভ্যস্তপদে শুক্রাচার্যের হোমধেনু এবং অন্যান্য গোরুগুলি ফিরে এল তাদের রক্ষক ছাড়াই– ততো গাবো নিবৃত্তাস্তা অগোপাঃ স্বং নিবেশন। গোরুগুলি সব ফিরে এল, অথচ কচ ফিরে এলেন না, এটা দেবযানীকে একেবারে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। পিতা শুক্রাচার্যের কাছে গিয়ে দেবযানী বললেন– পিতা! তোমার সায়ংকালীন হোম শেষ হয়ে গেল। সূর্যদেব অস্তাচলে চলে গেছেন, আমাদের গোরুগুলি সব ফিরে এসেছে রক্ষক ছাড়াই। পিতা! কোথাও কিন্তু কচকে দেখছি না অগোপাশ্চাগতা গাবঃ কচস্তাত ন দৃশ্যতে। এতকাল এই দানবপল্লিতে আছেন দেবযানী, দানবদেরও তিনি হাড়ে হাড়ে চেনেন। কিছু একটা ঘটেছে এইরকম সন্দেহ এবং অনুমানে দেবযানী শুক্রাচার্যকে বললেন- আমি নিশ্চিত, কচকে কোথাও কেউ মেরে ফেলেছে, অথবা সে নিজেই মরে পড়ে আছে কোথাও। নইলে সে এখনও ফিরে আসছে না কেন? আমার একটা সার-সত্য কথা শোনো বাবা। আমি কিন্তু কচকে ছাড়া বাঁচব না– তং বিনা ন চ জীবেয়মিতি সত্যং ব্রবীমি তে।

এই প্রথম এবং সেটা অসম্ভব প্রত্যয়ী ভাষায় স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হল দেবযানীর প্রেম। বৃহস্পতির পুত্র কচকে তিনি কামনা করেন জীবনের সঙ্গী হিসেবে পাবার জন্য এবং সে কথা স্পষ্টভাবে তিনি ব্যক্ত করছেন পিতার কাছে তাকে ছাড়া আমি বাঁচব না– তং বিনা ন চ জীবেয়ম্ ইতি সত্যং ব্রবীমি তে। আমরা এইসব কঠিন তর্কে এখন যাব না যে, এটা প্রেম নাকি মোহ, নাকি এইভাবে প্রেমের কথা সোচ্চারে জানানো যায় নাকি পিতার কাছে। আমরা শুধু এইটুকু বলব– মহাকাব্যের কালে তখনও প্রেম-ভালবাসার রবীন্দ্রীভবন বা রবীন্দ্রীকরণও ঘটেনি, প্রেমের ব্যাপারে নান্দনিক ব্যঞ্জনাও তখন সর্বত্র তত প্রকট নয়। ফলত পুরুষের মতো অনেক রমণীর মুখেও এই স্পষ্ট প্রেমোদগার খুব তাড়াতাড়ি শোনা যেত– যেমনটি দেবযানীর ক্ষেত্রে ঘটেছে।

পিতা শুক্রাচার্য তার আদরের মেয়েটিকে চেনেন, অতএব দেবযানীর স্পষ্টোক্তিমাত্রেই তিনি বলেছেন– একটুও চিন্তা করিসনে মা! এই আমি সঞ্জীবনী মন্ত্রে ডাকছি কচকে। সে এখনই চলে আসবে। শুক্রাচার্য তার সিদ্ধ সঞ্জীবন মন্ত্র উচ্চারণ করে কচকে ডাকলেন এবং কচ সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যার প্রভাবে পূর্বোক্ত কুকুরগুলির পেট চিরে একাকার শরীরে বেরিয়ে এলেন শুক্র এবং দেবযানীর সামনে। তার মুখবর্ণ সজীব, মন প্রফুল্ল এবং হয়তো বা মনে মনে ভাবছেন– এই সেই সঞ্জীবনী বিদ্যার স্পর্শ, যা তাকে আয়ত্ত করতে হবে।

কচ ফিরে আসার পর প্রথম প্রশ্ন করলেন দেবযানী, এবং অনুমান করি পিতা শুক্রাচার্য ততক্ষণে চলে গেছেন তার অভিমানিনী কন্যার প্রথম শব্দ-উচ্চারণের জন্য। দেবযানী সরল প্রশ্ন করলেন– তুমি কেন এত দেরি করে এলে? কী হয়েছিল তোমার– কস্মাচ্চিরায়িতোহসীতি। কচ এবার ভার্গবী দেবযানীকে আদ্যন্ত জানিয়ে বললেন–কল্যাণী! আমি প্রত্যেক দিনের মতো আজও গুরুর হোমের জন্য সমিধ, কুশ, তোমার জন্য ফুল, রাঁধার জন্য শুকনো কাঠ– এসব সংগ্রহ করে আসছিলাম। এতক্ষণে ঘোরাঘুরি করে একটু পরিশ্রান্ত লাগছিল, তাই একবারটি বসেছিলাম বটবৃক্ষের ছায়ায়। এমনকী আমার সঙ্গে যাওয়া গোরুগুলোও আমায় দেখে ইতস্তত এসে দাঁড়িয়ে ছিল সেই বটগাছের তলায়– গাবশ্চ সহিতাঃ সর্বা বৃক্ষচ্ছায়ামুপাশ্রিতাঃ। এবার হঠাৎই আমি দেখলাম– কতগুলি অসুর দানব আমার কাছে এসে জুটল কোথা থেকে। তারা আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে আমি বললাম আমি দেবগুরু বৃহস্পতির ছেলে, আমার নাম কচ বৃহস্পতি-সুতশ্চাহং কচ ইত্যভিশ্রুতঃ। তারপর কী জানি কী হল জানি না, আমার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে দানবরা। আমাকে ধরে মেরে, খণ্ড খণ্ড করে ভেঁচে খাইয়ে দিল কুকুরদের। তারপর তো এই গুরু আমায় আহ্বান করলেন তার সিদ্ধ সঞ্জীবনী মন্ত্র দিয়ে, আমি কোনও মতে জীবন পেয়ে ফিরে এসেছি তোমার কাছে– ত্বৎসমীপম্ ইহায়াতঃ কণ্বঞ্চিৎ প্রাপ্তজীবিতঃ।

কোনও রকমে জীবন ফিরে পেয়েছি, এই অনুভূতিটাই কচের কাছে বেশি মূল্যবান ছিল, নাকি বড় ছিল এই মনোহারী বিরহোত্তর সংযোজন– কোনওরকমে জীবন পেয়েই তোমার কাছে ফিরে এসেছি– ত্বৎসমীপমিহায়াতঃ কণ্বঞ্চিৎ প্রাপ্তজীবিতঃ– এই কূট তর্ক ওঠেনি মহাভারতের শব্দপংক্তিতে। এই দুই মানব-মানবীর জীবন আবারও চলতে লাগল সেই পরিচিত ছন্দে, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মধ্যেও সেই গান কিন্তু তখনও ছিল। আবারও একবার কচকে খুন করার চক্রান্ত হল। দেবযানী কচকে ফুল আনতে পাঠিয়ে ছিলেন বনে, দানবরা কচকে দেখে আবারও তাকে মারল। দেবযানী আবারও জানালেন পিতা শুক্রাচার্যকে, কচ আবারও বাঁচলেন শুক্রাচার্যের সঞ্জীবনী সাধনায়। কিন্তু তৃতীয় বার এই হত্যার মধ্যে কিছু বুদ্ধি-কৌশল মিশিয়ে দিল দানবরা। বার বার কচ বেঁচে ফিরে আসছেন– এটা দানবদের মোটই সহ্য হচ্ছিল না।

তৃতীয় বারে দানবরা কচকে মেরে তার শরীরটা পুড়িয়ে ফেলল। এবার সেই ভস্মীভূত শরীরের দগ্ধচূর্ণ শুক্রাচার্যের পানীয় সুরার সঙ্গে মিশিয়ে সেই সুরা তাঁকে পান করতে দিল। শুক্রাচার্য নির্দ্বিধায় সুরার সঙ্গে মিশ্রিত কচের দেহভস্ম পান করলেন অপিবৎ সুরয়া সার্ধং কচভস্ম ভৃগৃহঃ। সেকালের দিনে ব্রাহ্মণের পক্ষে সুরাপান একেবারে নিষিদ্ধ ছিল। সুরাপান করলে সেই পাতকী ব্রাহ্মণ সমাজের চোখে একেবারে হেয়, ঘৃণ্য হয়ে যেতেন। কিন্তু অসুর-দানবদের নিশ্চিন্ত কৌশল দেখে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, শুক্রাচার্যের সুরাপানের অভ্যাস ছিল। বিশেষত তিনি তেজস্বী মানুষ, নানান উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী এবং থাকেন অসুর-দানবের রজোগুণী পরিবেশে। তার এই সুরাপানের অভ্যাস হয়েছিল এবং তার ব্যক্তিত্ব এতটাই যে তার জবাবদিহির প্রয়োজন ছিল না কারও কাছে। দানবেরা শুক্রাচার্যের পানীয় সুরায় কচের শরীরভস্ম মিশিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে রইল যে, শুক্রাচার্য কচকে নিজেই শেষ মৃত্যুর পথ দেখাবেন।

শুক্রাচার্য সুরাপান করলেন দানবদের পরিকল্পনামতো এবং সেদিনও সূর্য অস্ত গেল, সন্ধ্যার ঘনায়মান রক্ত-কৃষ্ণ অবচ্ছায়ায় গোরুগুলি ফিরে এল গোচারণক্ষেত্র থেকে অথচ সেগুলির রক্ষক কচ সঙ্গে এলেন না– স সায়ন্তন-বেলায়াম অগোপা গাঃ সমাগতাঃ। কচের দেরি দেখে দেবযানীর মন আশঙ্কায় ভরে উঠল। তিনি আবারও পিতা শুক্রাচার্যের কাছে গিয়ে বললেন– পিতা! আমার কথা সব সময় শুনে চলে কচ। আজ আমি তাকে শুধু ফুল আনতে বলেছিলাম। কিন্তু তাতে তো এত দেরি হবার কথা নয়। আমার আবারও সন্দেহ হচ্ছে, হয় তাকে নিশ্চিত খুন করেছে, আর তা নইলে সে মারা গেছে। সে যা কিছুই হোক, পিতা! কচ যদি ফিরে না আসে, তা হলে আমি কিন্তু বাঁচব না– তং বিনা ন চ জীবেয়মিতি সত্যং ব্রবীমি তে।

শুক্রাচার্য ভাবলেন– আর বেশি কী হবে, অসুররা বোকার মতো আবারও কচকে মেরে ফেলেছে, আমি আবারও সঞ্জীবনী প্রয়োগ করব, কচ ফিরে আসবে আবার। শুক্রাচার্য সঞ্জীবনী মন্ত্রে আহ্বান করতে লাগলেন কচকে, কিন্তু অন্যান্য বারের মতো কচ কিন্তু ফিরে এলেন না। শুক্রাচার্য ভাবলেন কচ বোধহয় নিজে নিজেই কালপ্রাপ্ত হয়ে মারা গেছেন। তিনি দেবযানীকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললেন– বৃহস্পতির পুত্র কচ বোধহয় মারাই গেছে। আমি তো বার বার সঞ্জীবনী বিদ্যায় তার জীবন বাঁচিয়েছি, কিন্তু অসুরেরা তাকে মেরে ফেলছে, এ অবস্থায় আর কী করতে পারি বলো– বিদ্যয়া জীবিতোহপ্যেবং হন্যতে করবাম কিম।

পিতা শুক্রাচার্যের কথা শুনে দেবযানীর মন শোকে ভারাক্রান্ত হল, চোখ দিয়ে জল পড়ল ঝর ঝর করে। শুক্রাচার্য অসহায়ভাবে বললেন- দেবযানী তুমি এইভাবে শোক কোরো না, এমন করে কেঁদো না তুমি, তুমি অসুরগুরু শুক্রাচার্যের মেয়ে এবং এই দার্শনিক বোধ তোমার থাকাই উচিত যে, মরণ তো একদিন আসবেই মানুষের, অতএব কেঁদো না তুমি মৈবং শুচো মা রুদো দেবযানি/ ন দৃশী মমনুশোচতে। শুক্রাচার্য এবার দেবযানীকে একটু মর্যাদা দিয়ে বললেন- তা ছাড়া তোমার ক্ষমতা কি কম? স্বর্গের দেবতারা, মর্তের ব্রাহ্মণেরা, অসুরেরা তো বটেই, সবাই তোমাকে কত সম্মান করে। সেখানে তুমি এই একটা সাধারণ মানুষের জন্য এত কাদলে শোভা পায় না। আর তুমি তো এটাও বুঝতে পারছ যে, এই ব্রাহ্মণকে বাঁচিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে, যতবার তাকে বাঁচিয়ে তুলছি, তুমি দেখছ তো অসুররা তাকে মেরে ফেলছে। আমি আর কী করতে পারি– অশকোহসৌ রক্ষয়িতুং দ্বিজাতিঃ/ সঞ্জীবিতো বধ্যতে চৈব ভূয়ঃ।

পিতার কথায় এবং এই মানসিক বিপন্নতার সময়ে পিতার এই দার্শনিকতায় দেব্যানী বেশ বিরক্ত হলেন। কচ তার যৌবনস্নিগ্ধ হৃদয় এতটাই অধিকার করেছেন যে, তিনি শুধু তার সম্মান নিয়ে চিন্তিত নন, কচের আত্মসম্বন্ধে তিনি বুঝি এখন তার শ্বশুরকুলের সম্বন্ধেও ভাবতে আরম্ভ করেছেন। দেবযানী বললেন– ঋষিবৃদ্ধ অঙ্গিরা কচের পিতামহ এবং মহাতপস্বী বৃহস্পতি এই কচের পিতা। সে একজন ঋষির পৌত্র এবং একজন ঋষির পুত্র– এই রকম একটা মান্য মানুষের জন্য আমি শোক করব না, আমি কাঁদব না তার জন্য কথং ন শোয়েমহং ন রুদ্যাম। মুহূর্তের এই মর্যাদার জগৎ বিগলিত হয়ে মিশে গেল দেবযানীর ব্যক্তিগত অনুভূতির মধ্যে।

দেবযানী বললেন- কচ এখানে ব্রহ্মচারীর ব্রত ধারণ করে তপস্যা করেছে, সব সময় তাকে দেখে মনে হয়েছে যেন আমার সমস্ত ইচ্ছা পালনের জন্য সে পায়ের আঙুলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এমন কোনও কাজও বোধহয় নেই যা সে জানে না– যদোখিতঃ কর্মসু চৈব দক্ষঃ। আর আমার নিজের কথা বলি, একান্ত নিজের মনের কথা, পিতা আমার! কচ যে কী ভীষণ সুন্দর যতটা সুন্দর ততটাই বিদ্বান। কচকে আমি ভালবাসি, পিতা! কচ যদি ফিরে না আসে, তবে আমিও তার মৃত্যুপথের যাত্রী হব– কচস্য মার্গং প্রতিপৎস্যে ন মোক্ষ্যে। প্রিয়ো হি মে তাত কচোহভিরূপঃ।

সেকালের দিনে, সেই মহাকাব্যের কালেও একটি যুবতী রমণী তার পিতার সামনে তার ভালবাসার লোকের সম্বন্ধে বলছে– কচ যে ভীষণ সুন্দর পিতা! তাকে আমি ভালবাসি প্রিয়ো হি মে তাত কচোহভিরূপঃ- অভীষ্ট পুরুষের জন্য একটি রমণীর মুখে প্রিয়ত্বের এই স্পষ্টোক্তি আর বেশি শুনেছি বলে মনে হয় না। হ্যাঁ, মহাভারতে আরও দু-চারজন রমণীর মুখে কামনা, এমনকী ঈষদীষৎ যৌনতার কথাও শুনেছি, কিন্তু কামনার সঙ্গে প্রিয়ত্বের এই বিমিশ্রণ– কচ যে ভীষণ ভীষণ সুন্দর, পিতা! তাকে আমি ভালবাসি– প্রিয়ো হি মে তাত কচোহভিরূপঃ– দেবযানীর মুখে এই আত্মসমর্পণের কথা পিতা শুক্রাচার্যকে যেন এই মুহূর্তে আরও অসহায় করে তোলে।

ক্রোধের সঙ্গে ক্ষোভ মিশিয়ে শুক্রাচার্য বললেন– অসুর-দানবেরা নিশ্চয়ই আমার ওপর বিদ্বেষ পোষণ করে, নইলে এমনটা হবে কেন যে, তারা বারবার আমার এই নিরপরাধ শিষ্যটাকে মেরে ফেলছে। আমার প্রতি এই প্রতিকূল আচরণ ওদের ধ্বংস করে ছাড়বে আমি জানি। কিন্তু অসুর-দানবের ধ্বংসে দেবযানীর কিছু যায় আসে না, তিনি পিতাকে আবারও বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন কচকে বাঁচানোর জন্য। শুক্রাচার্য পুনরায় সঞ্জীবনী মন্ত্র প্রয়োগ করলেন এবং সেই বিদ্যার প্রভাবে কচের প্রথমে সংজ্ঞালাভ ঘটল, কিন্তু গুরুর উদরের মধ্যে আছেন বলেই বেশ ভয় পেলেন, কেননা গুরু তাকে আহ্বান করছেন বিদ্যা প্রয়োগ করে, এই অবস্থায় শুধুমাত্র সূক্ষ্ম চৈতন্যময় লিঙ্গদেহ থেকে শরীর ধারণ করলেই তো গুরু মারা পড়বেন, সেখানে উদরের বাইরে গেলে তো গুরুকে চিরতরের জন্য শেষ করে দেওয়া। অতএব কচ অতীব সংকোচে ধীরে ধীরে গুরুকে জানালেন– গুরুদেব! আপনি আমার কাছে ভগবানের মতো। আমি কচ, আপনার প্রসন্নতা ভিক্ষা করে বলছি লোকে যেভাবে পুত্রকে সমাদর করে আপনি আমাকে সেইভাবেই ভাবুন– যথা বহুমতঃ পুত্রস্তথা মন্যতু মাং ভবান।

ঠিক এই জায়গাটায় প্রসিদ্ধ টীকাকারেরা অনেকেই শব্দের মানে বলে সংস্কৃত শব্দের প্রতিশব্দ উচ্চারণ করে গেলেন, কিন্তু কচ কেন হঠাৎ আমাকে আপনার পুত্রের মতো ভাবুন–এই কথাটা বললেন, তার গূঢ়ার্থ কেউ বললেন না। আসলে পূর্বশ্লোকে বলা হয়েছে কচ শুক্রাচার্যের জঠরের মধ্যেই সংজ্ঞা লাভ করে গুরু শুক্রাচার্যের উদ্দেশে বললেন– বিদ্যাবলাল্লব্ধমতির্মহাত্মা/ শনৈর্বাক্যং জঠরে ব্যাজহার। এখানে দুটি অর্থ আছে। প্রথমত একটি শিশু যেহেতু মাতৃজঠরেই বৃদ্ধি লাভ করে, সেই জঠরেই সংজ্ঞা লাভ করে এবং সে পুত্র নামে চিহ্নিত হয়, কচ সেই অর্থে শুক্রাচার্যের উদর-জঠরে আছেন বলেই তিনি পুত্রের সংজ্ঞা লাভ করতে পারেন। এতদিন বিদ্যার জন্য সাধনা করার পর কচ সেই পুত্রের নৈকট্য আশা করছেন গুরুর কাছ থেকে। দ্বিতীয় অর্থটা আমাদের বিদ্যালাভের পরম্পরার কথা। উপনয়নকালে গায়ত্রী দীক্ষার সময় গুরু-আচার্য যে মন্ত্র দেন শিষ্যের কানে, সেই মুহূর্তেই গুরু তাঁকে আপন বিদ্যাগর্ভে স্থান দেন; বলা হয় অন্তত তিন রাত্রি গুরু তার শিষ্যকে গর্ভে ধারণ করেন। আমরা বিশ্বাস করি– কচের অভীষ্ট বিদ্যালাভের সময় এসেছে, অতএব যে ভাবেই হয়ে থাকুক গুরু শুক্রাচার্য কচকে আপন জঠরে ধারণ করে আছেন বিদ্যাদানের প্রাক্ মুহূর্তে।

আমরা প্রকৃত প্রস্তাবে ফিরে আসি। কচের কথা শুনে শুক্রাচার্য আশ্চর্য হয়ে বললেন– সবই বুঝলাম, কচ! বুঝলাম তুমি আমার জঠরে আছ, কিন্তু কোন পথে তুমি আমার জঠরে গিয়ে প্রবেশ করলে, কেমন করেই বা তুমি আমার উদরে বাস করছ– তমব্রবীৎ কেন পথেনোপনীত/ ত্বং চোদ্দরে তিষ্ঠসি ক্ৰহি বিপ্র বলো তুমি এই রহস্য, আমি আজই অসুরদের ধ্বংস করে দেবতাদের পক্ষে যাব। কচ বললেন– গুরুদেব! আপনার কৃপায় আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়নি, অতএব সব ঘটনাই আমি স্মরণ করতে পারছি– তব প্রসাদান্ন জহাতি মাং স্মৃতিঃ। স্মরামি সর্বং যচ্চ যথা চ বৃত্তম আর আমার এতদিনের তপস্যার ফলটুকুও নষ্ট হয়ে যায়নি, ফলে এই স্বল্পপরিসর জঠরের মধ্যে থাকার কষ্টও আমার অসহ্য হয়ে ওঠেনি। কচ এবার আনুপূর্বিক সব বললেন– কীভাবে অসুরেরা তাকে মেরে, পুড়িয়ে তার ভস্মচূর্ণ পানীয় সুরার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে–সব এক এক করে বললেন শুক্রাচার্যকে।

এমনটা ভাবতেই পারেন যে, আমরা দেবযানীর চরিত্র-ভাবনার প্রতিজ্ঞাত হয়েছি, আমরা কেন এই কচ-শুক্রাচার্য-সংবাদ বসে বসে শুনতে যাব। উত্তরে জানাই কচের জীবনের জন্য দেবযানীই কিন্তু শেষবারের মতো প্রার্থনা করেছিলেন পিতার কাছে এবং এখনও যে সংলাপ চলছে, তার সঙ্গেও দেবযানীর বর্তমান ভীষণভাবে জড়িত। কচের মুখে তার জঠরবাসের কাহিনি শুনে শুক্রাচার্য এবার ঘুরে তাকালেন দেবযানীর দিকে। বললেন– বলো দেবযানী! কীভাবে আমি তোমার প্রিয় কাৰ্যটুকু করতে পারি কিং তে প্রিয়ং করবাণ্যদ্য বৎসে। দ্যাখো, কচ বেঁচে ফিরতে পারে, কিন্তু তাতে আমি মারা যাব, কেননা আমার জঠর ভেদ করেই তাকে বেরোতে হবে, তা না হলে কচের দেখা পাবে না। তুমি– দৃশ্যেৎ কচো মগতো দেবযানি।

সত্যি বলতে কী, শুক্রাচার্যের মতো পিতার সন্ধান সেকালের শাস্ত্র-কাব্যে পাওয়া যাবে না। মাতৃহারা এই কন্যাটিকে হয়তো তিনি অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিয়েছেন, কিন্তু এমন করে একটি মেয়ের জন্যই বা ক’জন পিতা ভাবেন। তার মেয়ে একেবারে শত্রুপক্ষের আচার্য পুত্রকে ভালবেসে ফেলেছে, তাকে বাঁচানোর জন্য আজকে তিনি নিজের জীবনটাও বিসর্জন দিতে পারেন। দেবযানীকে বলেছেন– আমি মরলেই তবে কচ বাঁচবে, আর কোনও উপায় নেই বধেন মে জীবিতং স্যাৎ কচস্য। দেবযানী অসাধারণ উত্তর দিয়েছেন এই কথার, কেননা মরণের সমস্যা না হলেও অনেক গৃহস্থ-ঘরের মেয়েরই এই সমস্যা হয়, হয়তো বা সেটা ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’র সমস্যা, অথবা প্রিয়তম মাতাপিতার প্রিয়ত্বের সঙ্গে অভীষ্ট প্রিয়তম পুরুষের বৈকল্পিক প্রিয়ত্বের সমস্যা। এসব ক্ষেত্রে মেয়েরা যেটা বলে সেটা দেবযানীও বলেছেন, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে পিতামাতারা অনেক ক্ষেত্রেই যা করেন না, শুক্রাচার্য সেটা করেছেন।

দেবযানী বললেন– পিতা! তোমার মৃত্যু এবং কচের মৃত্যু– এই দুই মৃত্যুর যে কোনও একটিই আমার হৃদয়কে আগুনের মতো পুড়িয়ে মারবে– দ্বৌ মাং শোকাবগ্নিকল্পং দহেতাম। কেননা, আজকে কচ যদি মারা যায়, তবে আমার জীবনে সুখ-শান্তি বলে কিছু থাকবে না, আর তুমি যদি আজ মারা যাও, তা হলে আমি বাঁচব কী করে আর কচস্য নাশে মম মর্ম নাস্তি। তবোপঘাতে জীবিতুং নাস্মি শক্তা। শুক্রাচার্য দেবযানীর অন্তর অনুধাবন করলেন, কন্যার অন্তর বুঝে তিনি যে উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিলেন, এক কথায়, তা অনবদ্য। এটা যদি গল্প হিসেবেও নিই, তা হলেও এমন উপন্যাসোপম গল্প লেখা হয়েছে কিনা সন্দেহ। আর যদি এটা খানিক অলৌকিক সিদ্ধির নিরিখেও দেখি, তা হলে শুক্রাচার্যকে সেই কালের বুদ্ধিমত্তম আচার্য হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে, কেননা আগামী দিনের জীবন্ত বাস্তব বুঝে নিয়ে আগামী প্রজন্মের অনুকূলে যাওয়াই শুধু নয়, সম্পূর্ণ অনহংবাদিতায় এমনতর এক বুদ্ধির উদ্ভাবন তিনি করেছেন যাতে শিষ্যের জীবন তার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে এবং সেটা নিজের থেকেও অধিক।

আপন জঠরে লন্ধসংজ্ঞ কচের উদ্দেশে শুক্রাচার্য বললেন– ওহে বৃহস্পতির পুত্র কচ! তুমি তপস্যায় সম্পূর্ণ সিদ্ধিলাভ করেছ, যেহেতু দেবযানীকে তুমি সন্তুষ্ট করতে পেরেছ বলে দেবযানীও আজ তোমাকে সেইভাবেই পছন্দ করে ফেলেছে– সংসিদ্ধরূপোহসি বৃহম্পতেঃ সুত/ যত্ত্বাং ভক্তং ভজতে দেবযানী। আমার একান্ত-লব্ধ এই সঞ্জীবনী বিদ্যা তুমি লাভ করো, তুমি যদি নিতান্তই ইন্দ্ররূপী কচ না হয়ে শুধুই বৃহস্পতির পুত্র কচ হও, তা হলে গ্রহণ করো এই বিদ্যা। অবশ্য এত কথাই বা বলছি কেন, ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কারও পক্ষে আমার পেট থেকে বেরিয়ে আসাও সম্ভব নয়, তুমি গ্রহণ করো এই বিদ্যা বিদ্যামিমাং প্রাপ্নহি জীবনীং ত্বং ন চেদিন্দ্রঃ কচরূপী ত্বমদ্য।

এই শ্লোকটা একটু না আলোচনা করলে শুক্রাচার্যের মানসলোকও স্পষ্ট হয় না, স্পষ্ট হয় না দেবযানী এবং কচের ভাবনাও। আমরা যারা প্রথম থেকে ভাবছিলাম– শুক্রাচার্য বিপক্ষ দেবতাদের অভিসন্ধি এতটুকুও বুঝতে পারেননি, এবং তিনি তাদের ছলনায় অভিভূত, তারা ভুল ভাবছিলাম। ওই একটি মাত্র শব্দ– ওহে বৃহম্পতির ছেলে– এই সম্বোধনের মধ্যে যেমন শুক্রাচার্যের উদার হৃদয়ের আভাসটুকু স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তেমনই তুমি যদি ইন্দ্ররূপী কচ না হও– এই শব্দগুলিই স্পষ্ট বলে দেয় শুক্রাচার্য ইন্দ্রের ছলনাটুকু জানেন এবং ইন্দ্র নন বলেই, শুধু কচ হওয়ার জন্যই আজ তিনি বিদ্যা লাভ করতে পারছেন। কেননা কচের তপস্যা, সাধনা এতটাই যে, গুরুর সঙ্গে সঙ্গে গুরুর মেয়ে দেবযানীর মতো প্রায় অসন্তোয্যা রমণীকেও তিনি পরম নমনীয়তায় এতটাই বশ করে ফেলেছেন যে, সে তাকে চাইতে আরম্ভ করেছে। দ্বিতীয়ত, শিষ্যের পক্ষে ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠার এই তো সেই বিরলতম মুহূর্ত যেখানে গুরু তাকে অঙ্গীকার আত্মসাৎ করে নিজের সিদ্ধিগর্ভে স্থাপন করেন এবং আপন তেজ আধান করেন শিষ্যের মধ্যে। শুক্রাচার্য আজ সম্পূর্ণ অঙ্গীকৃত শিষ্যের মধ্যে বিদ্যার আধান করছেন। পরিস্থিতি যে রকম তৈরি হয়েছে, তাতে তার নিজের মৃত্যুর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। শুক্রাচার্য তাই আপন গর্ভস্থ কচের বেঁচে ওঠার মধ্যে গর্ভমুক্ত শিষ্যের পুত্রসম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা করে বলছেন– তোমাকে যেমন করে আমি বাঁচিয়ে তুলছি, এই দেহ থেকে বেরিয়ে গর্ভমুক্ত হওয়ার পর তুমিও তেমনই আমার পুত্র হয়ে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ো– পুত্রো ভূত্বা ভাবয় ভাবিতো মাম। অস্মদ্দেহাদুপনিম্য তাত। দেখো, যেন ধর্মের দিকে তোমার দৃষ্টি থাকে। মনে রেখো, তুমি কিন্তু আমারই প্রদত্ত বিদ্যার বলে বিদ্বান হবে, এই অবস্থায় তোমার যেন সেই ধর্মবতী ভাবনা থাকে যে, আমাকেও তুমি বাঁচিয়ে রাখবে।

এই মুহূর্তে শুক্রাচার্যের কথা শুনে মনে হবে যেন তিনি নিজের জীবন নিয়ে ভাবছেন। আমরা তা মনে করি না। বরঞ্চ প্রাচীন শিক্ষার এই গৌরব ছিল যে, বিদ্যাবংশ টিকিয়ে রাখতে হবে। আমাদের কী হয়, আমরা যাঁদের কাছ থেকে বিদ্যা লাভ করেছি, তাদের ভুলে যাই। গুরু কিন্তু শিষ্যের মধ্যে বেঁচে থাকতে চান, ঠিক যেমন মাতাপিতা পুত্রকন্যার মধ্যে। বিদ্যা লাভ করার পর অধীত বিদ্যা শ্রদ্ধাঞ্জলির মতো ফিরিয়ে দিতে হয় গুরুকেই। আজ শুক্রাচার্যের কাছে সেই সংকট এসেছে যে, তারই উদ্ভাবিত বিদ্যা তার বিপক্ষীয় শক্তির কাছে চলে যেতে বসেছে, সেই বিদ্যার মূলস্থান যাতে নষ্ট না হয়, শুক্রাচার্য সেটা সাবধান করছেন কচকে।

গুরু শুক্রাচার্যের কাছ থেকে সঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ করে কচ তার উদর ভেদ করে বাইরে বেরোলেন হিম-তুষারের আবরণহীন চাঁদের মতো সুন্দর হয়ে– ভিত্ত্বা কুক্ষিং নির্বিচক্রাম বিপ্রঃ/ শুক্লাত্যয়ে পৌৰ্ণমাস্যামিবেন্দুঃ। কচ সঞ্জীবিত হয়েই দেখলেন– তার গুরু শুক্রাচার্য মৃত পড়ে আছেন, অধ্যাত্ম জ্ঞান আর ব্রহ্মভাবনা যেন ছিন্নমূর্তি হয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে সেখানে। কচ সঙ্গে সঙ্গে সঞ্জীবনী বিদ্যায় অভিমন্দ্রিত করলেন গুরুর শরীর এবং শুক্রাচার্য পুনরায় পূর্বরূপে দাঁড়ালেন কচের সামনে। অভীষ্ট পুরুষ এবং পরম প্রিয় পিতা– দু’জনেই জীবিত হয়ে উঠলে দেবযানীর কী প্রতিক্রিয়া হল, এই মুহূর্তে মহাভারতের কবি তা লেখেননি। তার কাছে এখন অনেক বড় হয়ে উঠেছে– গুরু-শিষ্যের সেই বিদ্যা-পরম্পরা, যেখানে নিতান্ত শত্রুপক্ষের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কচের মুখ দিয়ে কী নির্মল শ্রদ্ধা ধ্বনিত হচ্ছে শুক্রাচার্যের জন্য। যাঁরা ভাবছিলেন, যেমনটা অসুররাও ভাবছিল হয়তো যে, কচ একবার গুরুর উদর ভেদ করে বেরিয়ে আর কেন গুরুকে বাঁচাবেন, তাঁরা দেখলেন– সঞ্জীবিত গুরু শুক্রাচার্যের সামনে দাঁড়িয়ে কচ বললেন– আপনার মতো মানুষ, যিনি আমার মতো বিদ্যাশূন্য ব্যক্তির কানে অমৃতের তুল্য বিদ্যার উচ্চারণ করেছেন– যঃ শ্রোত্রয়োরমৃতং সন্নিষিঞ্চে। বিদ্যাম অবিদ্যস্য যথা ত্বমাৰ্যঃ– সেই আপনাকে আমি আমার পিতা এবং মাতা বলে মনে করি। বিদ্যা দান করে আপনি যে উপকার করেছেন, আমি তার কোনও অপকার করতে পারি না। কারণ আমি জানি যে, গুরুর কাছে বিদ্যা শিখে তার আদর যে করে না, ইহলোকে-পরলোকে কোথাও তার ঠাই নেই।

শুক্রাচার্য পরম প্রীত হলেন কচের ভাবনায়। প্রথমত তার রাগ হল নিজেরই ওপর কেন তিনি সুরাপান করেছিলেন, যাতে জ্ঞানী মানুষেরও জ্ঞান নষ্ট হয়। শুক্ৰ প্ৰথমত ব্রাহ্মণের সুরাপান সর্বৈব নিষিদ্ধ করলেন, আর দানব-অসুরদের ডেকে বললেন- তোমরা ভীষণ রকমের বোকা। কচ এখন সঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ করেছেন, অতএব তিনি আমারই মতো প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। তোমরা তার কোনও ক্ষতি করার চেষ্টা কোরো না। কেননা তিনি এখনও কিছুদিন থাকবেন আমার কাছে। কচ পূর্বে গুরুর কাছে এসে বলেছিলেন– আমি হাজার বছরের ব্রত ধারণ করছি আপনার কাছে শিক্ষা লাভের জন্য। সেই মতো তিনি বিদ্যায় সিদ্ধিলাভ করা সত্ত্বেও আরও বেশ কিছুদিন থেকে গেলেন গুরুর আশ্রমে। গুরুর কাছে বিদ্যা এবং বিনয়- দুই শিক্ষাই সম্পূর্ণ হয়ে যাবার পর এবার গুরুর কাছ থেকে বিদায় নেবার পালা এল। শুক্রাচার্য কিন্তু সানন্দ মনে কচকে স্বর্গলোকে ফিরে যাবার অনুমতি দিলেন। কচ এবং তার মেয়ের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল, সেটা তাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার ভেবে নিয়েই একবারও কিন্তু সেই বিষয়ে কথা বললেন না। গুরু শুক্রাচার্যের অনুমতি লাভ করে কচ দেবলোকে ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন– অনুজ্ঞাতঃ কচঃ গন্তুমিয়েষ ত্রিদশালয়।

এই সম্পূর্ণ ঘটনা এবং তার প্রতিবেদনের মধ্যে এটা এতক্ষণ নিশ্চয়ই একটা লক্ষ করার মতো বিষয় ছিল যে, কচ কিন্তু অনেক নেচে-কুঁদে, গান গেয়েও দেবযানীর ব্যাপারে মানসিকভাবে খুব একটা ‘ইনভলবড’ হননি, কেননা তিনি ঠিক করেই নিয়েছেন যে, সঞ্জীবনী মন্ত্র লাভের জন্য তাকে এই নান্দনিক কাজগুলি করতে হবে। আরও খেয়াল করার মতো মুহূর্তটি হল– বিদ্যালাভের পর তার গুরুর সামনে তার হৃদয়ের উদার বিস্ফোরণ– আমার মতো বিদ্যাহীন শিষ্যের কানে আপনি অমৃতের মতো বিদ্যা সিঞ্চন করেছেন– যঃ শ্ৰোত্ৰয়োরমৃতং সন্নিষিঞ্চে। বিদ্যামবিদ্যস্য যথা ত্বমাৰ্যঃ। আপনি আমাকে নতুন জন্ম দিয়েছেন পিতামাতার মতো, আপনাকেই আমি আমার পিতা এবং মাতা মনে করি। একাধারে– তং মন্যেহহং পিতরং মাতরঞ্চ। বিদ্যা-দীক্ষার পর এই যে কচের ‘বিশদীভূত মনোমুকুর’, এখানে শুধু নবলব্ধ পরম জ্ঞানের ছায়া পড়ে, এখানে কোনও রমণীর মুখের ছায়া নেই।

ঠিক এইখানে দানবগুরু শুক্রাচার্যের ভাবটুকুও দেখার মতো। যে-তিনি দেবযানীর প্রতি কচের ভক্তিনম্রতা এবং প্রিয়তোষণে খুশি ছিলেন, বারবার দেবযানীর অনুরোধেই যে-তিনি কচের প্রাণ বাঁচিয়েছেন এবং শেষ বার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে বাঁচানোর সময় যে-শুক্রাচার্য কারণ দেখিয়েছেন এই বলে যে, কী আর করব, দেবযানীর ভক্ত তুমি এবং তোমাকে যেহেতু দেবযানীও ভজনা করে– যত্ত্বাং ভক্তং ভজতে দেবযানী– তাই তুমি লাভ করো এই সঞ্জীবনী বিদ্যা সেই তিনি শুক্রাচার্য আজ কিন্তু একবারও কচকে বিদায় অনুমতি দেবার সময় বললেন না দেবযানীর সঙ্গে দেখা করে যেতে, অথবা তার হৃদয় ঘটিত সূক্ষ্ম-মধুর ব্যাপারটুকুর ওপর সঠিক যত্ন নিতে। হয়তো বা এই দুই যুবক-যুবতীর প্রেম-ব্যবহারে তিনি নিশ্চিন্তও ছিলেন খানিকটা, ভেবেছিলেন হয়তো যে, এ-ব্যাপারে দেবযানী নিজেই যথেষ্ট, তাকে আর আগ বাড়িয়ে বাড়তি কিছু করতে হবে না। ফলত গুরুর কাছে বিদ্যা লাভ করে কচ যেরকম কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়েছিলেন, স্বয়ং শুক্রাচার্যও কিন্তু উপযুক্ত শিষ্যকে বিদ্যা দান করে পরম আহ্লাদিত হয়েছেন। দানবদের কাছে তিনি এমন কথাও বলেছিলেন গৌরবে যে, আজ কচ কিন্তু বিদ্যা লাভ করে আমার মতোই প্রভাবসম্পন্ন– সঞ্জীবনীং প্রাপ্য বিদ্যাং মহাত্মা। তুল্যপ্রভাবো ব্রাহ্মণো ব্রহ্মভূতঃ। হয়তো শিষ্যগৌরবে এতটা গৌরবান্বিত হয়েই তিনি যেন কচ-দেবযানীর স্বতঃসিদ্ধ ঘনিষ্ঠতায় আর পৃথক নির্দেশ দেওয়া সমীচীন মনে করেননি। মহাভারতে কচ এই সুবিধে এবং সুযোগ দুটোই পেয়ে রইলেন। তিনি গুরুর অনুমতি লাভ করে সুরলোকে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিলেন।

আমরা কিন্তু এখন সেই নান্দনিক মুহূর্তে উপনীত, যেখানে সুরগুরু বৃহস্পতির পুত্র কচের মানসে বাংলার কবিগুরুর হৃদয়স্পর্শ লেগেছে। কচ এসেছেন দেবযানীর কাছে বিদায় প্রার্থনা জানাতে– “দেহে আজ্ঞা, দেবযানী, দেবলোকে দাস। করিবে প্রয়াণ। আজি গুরুগৃহবাস। সমাপ্ত আমার।” মহাভারতে আমরা কচের এই শেষ সৌজন্যটুকু দেখতে পাই না। শুক্রাচার্যের কাছে শেষ বিদায় নিয়ে নিয়ে তিনি সুরলোকে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, অথচ একবারের তরেও এই আশ্রমের বীতকাল সহবাস-পরিচয়গুলি অথবা এতকাল যাকে নৃত্য-গীত-বাদ্যে পরিতুষ্ট করার চেষ্টা করেছেন, এবং যাঁর অনুরাগে তিনি বেঁচে আছেন, তার কথা বা অন্য কোনও কিছু তিনি মনে আনছেন না। বস্তুত মহাভারত কচকে সেই। পৌরুষেয়তা বা ‘মেল হায়ারারকি’র আকরিক স্তরে রেখেই কচের বিবরণ দিচ্ছে, যেখানে কচ দেবকার্য সিদ্ধ করতে এসেছেন। সেই প্রয়োজন মিটেছে, বিদ্যা লাভ হয়েছে এবং বিদ্যার গৌরবে তিনি ফিরে যাচ্ছেন। দেবযানীর কাছে তিনি একবারও আসেননি এবং এই আকরিক স্তরে মহাভারতে তিনি যেভাবে বর্ণিত, তাতে দেবযানী বলে যে তার জীবনে এতকাল কেউ ছিল, এটা তিনি মনেও আনতে চাননি অথবা মনে রাখতেই চাননি।

যে বিদ্যার গৌরব নিয়ে কচ মহাভারতে উপস্থিত, রবীন্দ্রনাথ সেটার উল্লেখ করছেন। গৌণতর স্নিগ্ধতায় এবং তাও সরাসরি দেবযানীর সামনে এবং তাঁকে খানিকটা মহিমান্বিত করেই যেন আশীর্বাদ করো মোরে। যে বিদ্যা শিখিনু তাহা চিরদিন ধরে অন্তরে জাজ্বল্য থাকে উজ্জ্বল রতন…। এখানে দেবযানী কাঙিক্ষত আশীর্বাদটুকু করলেন না বটে, কিন্তু বেশ একটু গুরুকন্যার ভঙ্গিমাতেই– তা বেশ, তা বেশ, মনোরথ পুরিয়াছে, পেয়েছ দুর্লভ বিদ্যা…” ইত্যাদি শুভেচ্ছার পরেই স্বপ্রসঙ্গে এসেছেন– আর-কিছু নাহি কি কামনা, ভেবে দেখো মনে মনে। কচ বলেছিলেন- আর কিছু নাহি।

বস্তুত মহাভারতে যা আছে, সেটাকে আকরিক স্তর থেকে নান্দনিক স্তরে নিয়ে যাবার জন্য কচকেই প্রথমে দেবযানীর কাছে নিয়ে আসার এই যে মুখবন্ধ, এটাই কচ-দেবযানী সংবাদের গহন পারস্পরিকতা তথা নান্দনিক বিদায়ের সুর বেঁধে দিয়েছে রবীন্দ্রনাথে। কিন্তু মহাভারত এ রকম নয়, মহাভারতে শত শত মানুষের মহাকাব্যিক চরিত্রোন্মেষ ঘটে কঠোর বাস্তবতায়। এক-একটা চরিত্রকে সে সমাজের জটিল মানসলোক থেকে তুলে আনে এবং দেখিয়ে দেয়, এমন মানুষ কিন্তু আছে দুনিয়ায় এবং সে এইভাবেই চলে; শুধু তাই নয়; এইরকম মানুষ একটা দেখছ মানে কিন্তু আরও হাজারটা এইরকম আছে। আর সত্যি বলতে কী, আমি আমার এই জীবনেই এ রকম বহু সহাধ্যায়ী এবং অন্য যুবক যুবতী দেখেছি যেখানে ছেলেটি একটি মেয়েকে ভুলিয়ে তার পিতার কাছে পৌঁছেছে, মাস্টারমশাই পিতার কাছে বিশেষ পাঠ নিয়েছে। মাস্টারমশাইয়ের মেয়ের সঙ্গে প্রেমের রঙ্গ করেছে এবং অবশেষে মেয়েটিকে মহাকালের হাতে ছেড়ে দিয়ে সে নিজের কেরিয়ার তুঙ্গে নিয়ে গেছে। একেবারে বিদ্যালাভের জায়গা না হলেও অন্য কিছু ক্ষেত্রে উলটোটাও দেখেছি। অর্থাৎ সেখানে মেয়েটি পৌঁছেছে ছেলে বন্ধুর বাবার কাছে এবং অভীষ্টসিদ্ধির পর পূর্বের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব অস্বীকার করে আর কিছু নাহি পর্যন্ত যেতেই দেয়নি। অতএব সমাজে এইরকম ঘটনা ঘটে, তবে সেই ঘটার মধ্যে প্রত্যেকটি ঘটনাই স্বতো বিশেষ এবং পাত্র-পাত্রীর মানস-ভেদে সেসব সত্য ঘটনা উপন্যাসোপম হয়ে ওঠে।

মহাভারত এই উপন্যাস তৈরি করে না, বরঞ্চ সে জীবনের আঞ্চলিক সত্যকে সামগ্রিক সত্যে রূপান্তরিত করে জানায়– কচ এলেনই না দেবযানীর কাছে, অতএব একটি যুবতী মেয়ে হয়েও সে মেয়ে যা সচরাচর করে না, করতে চায় না, তেমনটি করেই প্রথম এবং শেষ চেষ্টায় দেবযানী নিজেই উপস্থিত হলেন কচের কাছে। কথা বললেন তৎকালীন দিনের সামাজিকতা বজায় রেখেই। বললেন- তুমি মহর্ষি অঙ্গিরার পৌত্র! তোমার চরিত্র, বিদ্যা, তপস্যা এবং ইন্দ্রিয়সংযম–সবটাই তোমাকে অলংকৃত করেছে ভ্রাজসে বিদ্যয়া চৈব তপসা চ দমেন চ। শেষোক্ত শব্দটি ‘দম’ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সংযম– এই শব্দটা দেবযানীর মুখে ভীষণ রকমে ‘আয়রনিক্যাল লাগে। দেবযানী কি সামান্য হলেও একটু অসংযম চেয়েছিলেন কচের দিক থেকে, যে অসংযম অন্তত মানসিক হলেও একান্তভাবেই এবং অত্যন্ত রমণীয়ভাবেই ভীষণ প্রয়োজন রমণীর মন পাবার জন্য। আমরা বুঝতে পারি, কচ যা করেছেন সেই নৃত্য গীতবাদ্য অথবা ফুল কুড়িয়ে আনা– তার মধ্যে ছিল না তার অযান্ত্রিক মনটুকু, অথচ তিনি যা করেছেন, তা দেবযানীর ভুল বোঝার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। আর ঠিক সেইজন্যই দেবলোকে যিযাসু কচের কাছে গিয়ে দেবযানী প্রায় নির্লজ্জের মতো বলে ফেললেন– আমার পিতা শুক্রাচার্য তোমার পিতামহের শিষ্য, সেই পিতামহ আমার পিতার কাছে যেমন মাননীয়, তেমনই তোমার পিতা বৃহস্পতিও আমার কাছে তেমনই মাননীয়

এই মাননীয়তা এবং কুলাচারের পারিবারিক সমতা প্রতিষ্ঠা করেই দেবযানী বললেন– তুমি যখন আমার পিতার কাছে শিক্ষালাভ করার সময় ব্রত-নিয়ম-শৃঙ্খলা পালনে ব্যাপৃত পরিশ্রান্ত হয়ে পড়তে, তখন আমি অনেক ভক্তি নিয়ে তোমার সেবা, পরিচর্যা করেছি। আজকে তোমার বিদ্যালাভ সম্পূর্ণ হয়েছে, এখান থেকে তুমি চলে যাবার কথাও হয়তো ভাবছ, কিন্তু এতদিনে আমি কিন্তু তোমার প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠেছি, এমন অনুরক্ত জনের প্রতি তোমারও তো একইভাবে অনুরক্ত হওয়া উচিত– স সমাবৃতবিদ্যা মাং ভক্তাং ভজিতুমহসি। মহাভারতে এই যুক্তিটা বিভিন্ন অনুরাগের কাহিনির মধ্যে বারবার এসেছে, বিশেষত সেইসব জায়গায় যেখানে পুরুষ কিংবা নারী প্রথমে আন্তরিক প্রেমভাব প্রদর্শন করে তারপর প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টা করছে। আর এই যুক্তিটাও সাংঘাতিক– আমি যেহেতু তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি, অতএব তোমারও আমাকে ভালবাসা উচিত- ভক্তাং ভজিতুমহসি। বস্তুত তোমারও আমাকে ভালবাসা উচিত’ এই শব্দটা বেশ ঔচিত্যার্থে ব্যবহার করা এই কারণে যে, ওই প্রস্তাবিত ব্যক্তির ভালবাসাও আগে বেশ প্রকটই ছিল, কিন্তু এখন হঠাৎই সেটা স্তব্ধ হয়ে প্রায় অস্বীকারের জায়গায় পৌঁছোলে এই অকাট্য যুক্তিটা আসে মহাভারতে আমি ভালবেসেছি, অতএব তোমারও ভালবাসা উচিত আমাকে– ভক্তাং ভজিতুমহসি।

দেবযানীর কথার যুক্তি আছে এখানে। সত্যিই তো কচ যেভাবে দেবযানীর অনুরঞ্জন মনোরঞ্জন করেছেন, সেগুলি এক সম্পন্নযৌবনা রমণীর কাছে কোন বার্তা পৌঁছে দেয়? কী করেই বা দেবযানীর রমণীহৃদয় এটা বুঝবে যে, এত সব গান, নাচ, ফুল কুড়িয়ে আনা– এইসব কিছু তাঁকে যান্ত্রিকভাবে তোষণ করার জন্য, আর কিছু নেই তার মধ্যে? দেবযানী হয়তো এটাও বুঝেছেন যে, কচ যেভাবে বিনাবাক্যে বিদায় নেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাতে প্রেম-ভালবাসার আন্তর যুক্তি দিয়ে লাভ নেই, তার চেয়ে অন্তত নিজের অনুরাগ স্থির রাখার জন্য বৈবাহিক প্রস্তাব দেওয়াই ভাল। তিনি বললেন আমাদের যেমন সম্পর্ক তাতে আর দেরী না করে যথাবিধানে মন্ত্র উচ্চারণ করে আমাকে বিয়ে করো তুমি– গৃহাণ পাণিং বিধিবন্মম মন্ত্ৰপুরস্কৃতম্।

আমরা শুধু বলতে চাই– কতটা নাচার হলে, কতটা অসহায়তা থাকলে এক ‘সপ্রাপ্তযৌবনা’ রমণী নিজের মুখে বিয়ের প্রস্তাব দেয় পুরুষের কাছে। এবং কী আশ্চর্য, কচ সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছেন এই যুক্তিতে যে, দেবযানী তার গুরুপুত্রী, অতএব গুরু হিসেবে শুক্রাচার্য কচের কাছে যতখানি মান্য এবং পূজনীয়, দেবযানীও ঠিক ততখানিই মান্যা এবং পূজনীয়া। কচ বললেন– অতএব এইসব অন্যায় কথা তুমি আমাকে বোলো না– দেবযানী তথৈব ত্বং নৈবং মাং বক্তৃমহসি। যদি শাস্ত্রের কথা বলেন, যদি তৎকালীন আচার, নিয়ম এবং বিধির কথা বলেন, তা হলে কচের যুক্তি কিন্তু মিথ্যে নয়, ঠিক আছে। পুরাণ এবং ধর্মশাস্ত্র একাধিকবার বলেছে যে, গুরুপত্নী, গুরুপুত্র এবং গুরুকন্যারা গুরুবং মান্য এবং পূজনীয়। হ্যাঁ, এই ব্যাপারে কচ একেবারেই ঠিক আছেন, ধর্মশাস্ত্র এবং পুরাণগুলি এ-কথা বারবার জানিয়েছে যে, গুরুগৃহে ব্রত-নিয়ম পালন করে যে শিষ্য বিদ্যাভ্যাস করছেন, তিনি গুরুর বিবাহিত স্ত্রীর পর্যন্ত কাছাকাছি যাবেন না, সেখানে অবিবাহিতা গুরুকন্যা তো সাত মাইল দূরে থাকার কথা। শাস্ত্র বলেছে– গুরুর স্ত্রী যদি যুবতী হন, তবে তার পায়ে হাত দিয়ে পর্যন্ত প্রণাম করবে না, বরঞ্চ অভিবাদনের প্রয়োজনে তার পায়ের কাছে সন্নিহিত ভূমিতে হস্তস্পর্শ করে প্রণাম করতে পারো।

এতই যেখানে কড়ক্কড়ি সেখানে শাস্ত্রের বৃদ্ধাচার একটা মানা হল যে, গুরুর কন্যা দেবযানী গুরুর মতোই মান্যা, অতএব বিয়েটিয়ে চলবেনা। কিন্তু গুরুর আশ্রমে ব্রহ্মচর্য পালন করার সময় কচ কোন নিয়মটা মেনেছেন? ব্রহ্মচারীর একান্ত পরিহর্তব্য নৃত্য-গীত তিনি তো করেইছেন দেবযানীর সঙ্গে। আর মহাভারতের কণ্বকঠাকুর যে মোক্ষম খবরটি আমাদের দিয়েছে অর্থাৎ দেবযানী যখন বনভূমির কোনও নির্জন অন্তরালে নিজে গান শুনিয়েছেন। কচকে, তাকে মনে মনে কামনা করেছেন গায়ন্তী চ ললন্তী চ রহঃ পৰ্যচরথা– তখন কি কচ ‘ওঁ বিষ্ণু’ বলে কানে হাত দিয়ে থাকতেন, নাকি তিনি দেবযানীর মানসিক জল্পনা এতটুকুও বুঝতেন না। কই কচ তো নিজেকেও নিবারিত করেননি, একবারও বারণ করেননি দেবযানীকেও যে, এই পারস্পরিক প্রশ্রয় ভাল নয়, বন্ধ হোক এইসব সানুরাগ আচরণ? খুব স্বাভাবিকভাবেই কচের আচরণ আজ দেবযানীর কাছে অস্বাভাবিক লাগছে এবং যে মুহূর্তে কচ গুরুকন্যার পূজনীয়ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন, দেবযানী সেই মুহূর্তেই তাদের পারস্পরিক প্রশ্রয়ের স্মৃতি-তর্পণের কথাই শুনিয়েছেন, এবং মহাভারতে সেটা এতটাই সন্তর্পণে এবং মর্যাদায় করেছেন দেবযানী যে, কচের প্রতিক্রিয়াগুলি উচ্চারিতও হয়নি। দেবযানী শুধু নিজের কথা বলেছেন।

দেবযানী বলেছেন- অসুর-দানবেরা যখন বারবার তোমাকে মারবার চেষ্টা করছে, তখন এক-একবার তোমার অনুপস্থিতিতে আমি বুঝেছি যে, আমি ভালবেসে ফেলেছি তোমাকে তোমার মনে পড়ে না সেসব কথা– তদা প্রভৃতি যা প্রীতিস্তাং ত্বমদ্য স্মারস্ব মে। দেবযানী কিন্তু একবারও সবিনয়ে বললেন না যে, তার জন্যই কচ আজ বেঁচে আছেন, তার জন্যই আজ এই সঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ করা সম্ভব হয়েছে কচের পক্ষে। না, দেবযানী কচের কৃতজ্ঞতাবোধে কয়ন করছেন না, তিনি নিজের কথা বলছেন শুধু। বলেছেন তোমার জন্য আমার যে সৌহার্দ জন্মেছিল, এতদিনের পরিচয়ে আমার যে অনুরাগ সৃষ্টি হয়েছে তোমার জন্য, সেখানে কিন্তু আমি সম্পূর্ণ স্থির হয়ে আছি– সৌহার্দে চানুরাগে চ বেথ মে ভক্তিমুত্তমা। ঠিক এই অবস্থায় তুমি আমাকে এইভাবে ছেড়ে চলে যেতে পারো না; তা ছাড়া এমন নয় যে, আমি কোনও দোষও করেছি এর মধ্যে, তা হলে কোন যুক্তিতে তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে শুনি– ন মামহসি ধর্মজ্ঞ ত্যক্রুং ভক্তামনাগসম।

এই পরিচ্ছেদে ওই যে একবার এতকালের সৌহার্দ এবং অনুরাগ স্মরণ করতে বলেছেন দেবযানী, সেই সূত্র ধরেই রবীন্দ্রনাথ কী অসাধারণ এক বিদায়-স্মরণিকা তৈরি করেছেন। রবীন্দ্রনাথে দেবযানীর স্মরণ-প্রক্রিয়ার মধ্যে যে সুন্দরী অরণ্যভূমি’ অথবা ‘সেই বটতল, যেথা তুমি প্রতি দিবসেই গোধন চরাতে এসে পড়িতে ঘুমায়ে’, কিংবা সেই ‘হোমধেনু’ এইসব কিছু মহাভারতে কাহিনির বিবর্তনের মধ্যেই আছে, রবীন্দ্রনাথ সেগুলিকে পরে নিয়ে এসেছেন কচকে সুখস্মৃতি মনে করিয়ে দেবার জন্য। অবশ্য মহাভারতে কলস্বনা বেণুমতীর কথা নেই এবং বিদায় অভিশাপের পরবর্তী অংশ একান্তভাবেই রাবীন্দ্রিক সৃষ্টি। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, মহাভারতে যে সৌহার্দ এবং অনুরাগের কথা দেবযানী বলেছেন রবীন্দ্রনাথ সেটাকে এক কাব্যিক নান্দনিকতায় মোহময় করে তুলেছেন আরও। কিন্তু আকরিক স্তরে দেবযানীর এই সৌহার্দ এবং অনুরাগের কথা মহাভারতে কচের কাছে একেবারেই আমল পায় না। এখানে কচ প্রতিযুক্তিতে বলেন– যে কাজটা আমার করাই উচিত নয়, তুমি সেই কাজটা আমাকে দিয়ে করিয়ে নিতে চাইছ– অনিযোজ্যে নিযোক্তৃং মাং দেবযানি ন চাহসি।

কচের যুক্তি হল– শুক্রাচার্যের জঠরটিকে যদি দেবযানীরও জন্মজঠর হিসেবে কল্পনা করা যায়, তা হলে দেবযানীর জন্ম যেখান থেকে হয়েছে; কচেরও জন্ম হয়েছে সেখান থেকেই, কেননা কচও শুক্রাচার্যের উদরে বাস করেছেন। এই যুক্তিতে কচ বললেন–তুমি আমার ভগিনী হও, দেবযানী! তুমি আর কোনও সম্পর্কের কথা বোলো না– ভগিনী ধর্মতো মে ত্বং মৈবং বোচঃ সুমধ্যমে। আমি তোমাদের ঘরে অনেক সুখে থেকেছি, কোনও দিক থেকে কোনও অসুবিধে হয়নি আমার। কিন্তু এবার আমায় যেতে হবে, তুমি আমার যাত্রা-মঙ্গলের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করো– সুখমন্যুষিততা ভদ্রে… শিবম্ আশংস মে পথি।

যিনি নিজেকে প্রেমিকা বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছেন তার সঙ্গে তথাকথিত প্রেমিক যদি হঠাৎ তুঙ্গ মুহূর্তে বোন পাতিয়ে ফেলে, তা হলে প্রেমিকার মনের যে অবস্থা হয়, দেবযানীরও তাই হল। তা ছাড়া মহাভারতের কচও এমন সহৃদয় নন যে, কোমল সুরে অন্তত অপারগ ব্যক্তির মতো বলবেন যে, “আর যাহা আছে তাহা প্রকাশের নয়, সখী’ অথবা একবারের তরেও– ‘হা অভিমানিনী নারী সত্য শুনে কী হইবে সুখ’–এমন সব কথা সান্ত্বনার তরেও বলবেন না মহাভারতের কচ। ইনি শুধু কর্তব্য বোঝেন, স্বকার্যসাধনের কথা বোঝেন এবং বোঝেন অনাসক্ত নিষ্কাম কর্ম। এমনকী এই প্রায়-বিবাদের মুহূর্তেও। দেবযানীর সৌন্দর্য্যের বহুমানন অথবা তার প্রত্যঙ্গস্তুতির অভ্যাসটুকু এখনও মুছে যায়নি, নইলে যাকে ধর্মত ভগিনী বলে সান্ত্বনা দিচ্ছেন তাকে ‘প্রসীদ সুব্ধ’ বলে ডাকার দরকার কী, ‘সুমধ্যমা’ বলে তার মধ্যদেশের ক্ষীণতার অনুমানে অন্য কোনও পীনতার দিকে দৃষ্টি দেবারই বা দরকার কী, আর শেষ কালে শুক্রাচার্যের উদরবাসের প্রসঙ্গে ভগিনীত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে যেভাবে ‘বিশালাক্ষী, চাঁদ-চুয়ানো মুখ’ বলে কার্যোদ্ধারের চেষ্টা করছেন কচ, তাতে আমাদের বৃদ্ধ সিদ্ধান্তবাগীশ হরিদাস পর্যন্ত বলেছেন– এই দুটো সম্বোধন করে কচ অন্তত বুঝিয়ে দিলেন যে, দেবযানীর অতিশয়ী সৌন্দর্যের ব্যাপারে তার সন্দেহ নেই কোনও এবং তাকে একবার দেখলে পরে কোনও শরীরের দোষ কারও চোখে পড়ার কথা নয়– এতৎসম্বোধন-দ্বয়েন দেবযান্যা সৌন্দর্যাতিশয়-সূচনেন দৃষ্টদোষাভাবঃ সূচিতঃ।

তার মানে, সব দিক থেকে বৈবাহিক যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই না, বোন– এই তো মহাভারতীয় কচের মনোভাব। প্রসিদ্ধ সেই জার্মান দার্শনিক বলেছিলেন যে, হ্যাঁ বাপু! একজন নারী একজন পুরুষের বন্ধু তো হতেই পারে, তবে সেই বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য খানিক physical antipathy-র সাহায্য প্রয়োজন। মহাভারতের কচ তো সেটাও খুব ভালভাবে পেরেছেন বলে মনে হয় না। দেবযানীর সযৌক্তিক কথা তার কাছে এতটুকুও যৌক্তিক নয়, তিনি এখন বিদ্যা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচেন। দেবযানী সহ্য করতে পারলেন না এই অযৌক্তিক প্রত্যাখ্যান। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন– কচ! আমি মেয়ে হয়ে তোমার কাছে বৈবাহিক সম্বন্ধ যাচনা করেছি এবং সেটা ধর্মের জন্যও বটে, কামের জন্যও বটে। যেহেতু এই যাচনা প্রত্যাখ্যান করলে, অতএব এতদিন ধরে যে বিদ্যা তুমি শিখলে, তাতে তোমার সিদ্ধি আসবে না কোনওভাবেই– যদি মাং ধর্মকামর্থে প্রত্যাখ্যসসি যাচিতঃ- তুমি এই বিদ্যা প্রয়োগ করতে পারবে না ইচ্ছেমতো।

কচ সঙ্গে সঙ্গে বললেন– আমার অধীত বিদ্যা সফল না হলে কোনও ক্ষতি নেই আমার। আমি তা অন্যত্র ফলাব। আমি এই বিদ্যা যাদের শেখাব তারাই আমার বিদ্যার সুফল ফলাবে। তবে আমিও তোমায় বলছি, দেবযানী! তুমি আমার গুরুর মেয়ে বলেই তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছি, তা ছাড়া গুরু শুক্রাচার্যও এ-ব্যাপারে কোনও নির্দেশ দেননি আমাকে। আমি তো তোমাকে ধর্ম-কথা, চিরাচরিত নিয়মের কথা বললাম। কিন্তু ধর্ম নয়, কামনার বশেই তুমি আমাকে অভিশাপ দিলে; অতএব আমিও ছাড়ব না। আমিও তোমাকে জানিয়ে রাখলাম– তুমি যেভাবে চাইছ, সেইভাবে তোমার ইচ্ছে পূরণ হবে না- তস্মাদৃভবত্যা যঃ কামো ন তথা স ভবিষ্যতি। তুমি যেমনটি চেয়েছিলে যে, কোনও ঋষিপুত্র একদিন এসে তোমায় বরণ করে নিয়ে যাবে, আমি অভিশাপ দিচ্ছি তেমনটি হবে না। কোনও ঋষিপুত্র তোমার পাণিগ্রহণ করবে না– ঋষিপুত্রো ন তে কশ্চিজ্জাতু পাণিং গ্রহিষ্যতি।

দেবযানী কোনও দিন অন্তরের অন্তঃস্থলেও এমনটা ভেবেছিলেন বলে আমাদের মনে হয় না। কোনও ঋষিপুত্র তাকে দোলায় চড়িয়ে বিয়ে করে নিয়ে যাবেন এমন সারস্বতী আকাঙ্ক্ষা দেবযানীর মনে ছিল বলে আমাদের মনে হয় না। দেবযানী আসলে সত্যিই প্রেমে পড়েছিলেন এবং সেইজন্যই এই প্রত্যাখ্যানের কথাও তিনি পিতাকে বলেননি। তবে বললে কী হত– অন্তত দেবযানীর ব্যাপারে আমরা পিতা শুক্রাচার্যের যে চিরন্তনী মানসিকতা দেখেছি, তাতে দেবযানী একবার এই বৈবাহিক আগ্রহ জানালে কচের ফিরে যাবার উপায় থাকত না বলেই আমরা মনে করি। আর শুক্রাচার্য নিজে তার প্রিয় শিষ্যটিকে খুব ভাল চিনেছিলেন বলেই তার প্রতি দেবযানীর অনন্ত দুর্বলতা জেনেও কচের বিদ্যাগ্রাহিতার বিষয়েই তিনি মনোনিবেশ করেছেন, দেবযানীর ব্যাপারে তিনি কচকে কিছু বলতে চাননি। আর মহাভারতের কচ দেবযানীকে যেভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং যেভাবে তাকে অভিশাপ দিয়েছেন, তার প্রতিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথের প্রেম-দার্শনিকতা– তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও– এই দার্শনিকতায় কচের শেষ কথা– আমি বর দিনু দেবী, তুমি সুখী হবে। ভুলে যাবে সর্বগ্লানি বিপুল গৌরবে- এই পুরুষ-মানস একান্তভাবেই রবীন্দ্রনাথের মৌলিক সৃষ্টি। মহাভারত কিন্তু লোকচরিত্র শেখায়, মহাকাব্যিক দৃষ্টিতে সে সমাজের বাস্তব উদঘাটিত করে, আখ্যাত করে। শুধু বিদ্যা, শুধু ‘কেরিয়ার’, শুধু আত্মোন্নতির জন্য অনেক পুরুষ যে এইরকম প্রত্যাখ্যান করে এবং সেখানে যে বিদ্যা, ‘কেরিয়ার’ বা আত্মোন্নতিই রমণীর মনের চেয়েও অধিক সত্য হয়ে উঠতে পারে পুরুষের কাছে, এই জাগতিক সত্যটাই মহাকাব্য অনন্ত-ঘটনারাশির মধ্যে একটা উদাহরণ হিসেবে সপ্রমাণ হয়ে ওঠে। মহাকাব্য জানিয়ে রাখে যে, এমনটাও কিন্তু হয়– ঠিক যেমন লিখেছিলেন উইলিয়ম থ্যাকারে– Love is a mighty thing, dear Bob, but it is not the life of a man. There are a thousand other things for him to think of besides the red lips of Lucy, or the bright eyes of Eliza. There is business, there is friendship, there is society, there are taxes, there is ambition, and a manly desire to excercise the talents which are given to us by Heaven, and reap the prize of our desert.

রমণীর মন যে সহস্র বর্ষের সাধনার ধন, সেটা থ্যাকারে সাহেবের এই চরিত্রটি বোঝেন না, তেমনই বোঝেন না কচও দেবলোকে তার অনেক কাজ পড়ে আছে, অতএব মহাভারতের কচ দেবযানীকে অব্রাহ্মণের সঙ্গে বিয়ে হবার অভিশাপ দিয়ে ফিরে গেলেন দেবতাদের কাছে।

প্রথম প্রেমে যেভাবে প্রত্যাখ্যাতা হলেন দেবযানী, তাতে তার হৃদয়ের গভীরে একটা প্রতিক্রিয়া হবারই কথা। কচকে সত্যিই ভালবেসেছিলেন দেবযানী; তবে কচের সঙ্গে বিয়ে হলে তার পরবর্তী জীবন কেমন হত, সে কথা অনুমান করতে একটু ভয় বাসি মনে। এক তো হতে পারত– দেবাসুরের দ্বন্দ্ব মিটে যেত চিরকালের তরে, কিন্তু তাতে রাজনৈতিক নেতাদের মহা-সমস্যা হত– ইন্ডিয়া-পাকিস্তান মিলে গেলে যে সমস্যা, এটাও তাই। কিন্তু এই মজাক ছেড়ে দিলেও কচের ব্যক্তিগত জীবন দেবযানীকে নিয়ে কেমন হত, সেটা বোধহয় কচ বুঝেইছিলেন। কচ যখন গুরুগৃহে এসেছিলেন, তখন দেবযানীর ভাবটা যদি খেয়াল করে থাকেন, তবে দেখবেন, তিনি কিন্তু তেমন কোনও অস্থিরতার পরিচয় দেননি, যাতে ভাবা যায়– দেবলোক থেকে দেবগুরু বৃহস্পতির ছেলে পড়তে এসেছে তার বাবার কাছে এবং তিনি এক লহমায় গলে গিয়ে প্রেম নিবেদন করে বসলেন তার কাছে। বরঞ্চ তিনি বহুকাল অবিচল ছিলেন একান্ত ভাবেই গুরুপুত্রীর অভিমান-মঞ্চে বসে। কচ তাকে গান শোনাচ্ছেন, নাচ দেখাচ্ছেন, এবং তিনি বুঝতে পারছেন যে, তার মনোহরণের চেষ্টা চলছে; অবশেষে তিনি বিগলিত হচ্ছেন, অনুরূপ প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন এবং এক সময় কচের জন্য তিনি ‘কনসার্নড়।

কিন্তু কচের সঙ্গে যদি শেষ পর্যন্ত তার বিবাহ হত, তা হলে দিনের পর দিন পৌরুষেয় অভ্যস্ততায় সপ্রেম দিনগুলি কেটে গেলে দেবযানী কিন্তু অবশ্যই সেই গুরুপুত্রীর মর্যাদা প্রকোষ্ঠে ফিরে আসতেন, কেননা এই মর্যাদাই তাঁর অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। একটু খোলসা করে এই অনুমানের শক্তিটুকু জানাই। আমি খুব ছোটবেলা থেকে আমার পিতার ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে অনেক সাধু মহান্তের সংস্পর্শে এসেছি এবং সেই সূত্রে অনেক সন্ন্যাসী এবং গৃহস্থ গুরুও আমি দেখেছি। এই সূত্রে যে-ক’জন গৃহস্থ গুরুর সঙ্গ আমি পেয়েছি, তাঁদের অনেকেই নিজস্ব ক্ষেত্রে বড় সাধক। কিন্তু তাঁদের স্ত্রী-পুত্রদের মধ্যে প্রধানত স্ত্রী এবং কন্যারা অনেক সময় গুরুর চাইতেও বেশি গুরুগিরি করতেন। শিষ্যরা যেহেতু তাদের গুরুর মতোই শ্রদ্ধাভক্তি করত, তার সুযোগ তারা বেশ একটু গ্রহণ করতেন স্বপ্রয়োজনেই এবং ব্যাপারটা আধ্যাত্মিকতার চেয়েও নিতান্ত বৈষয়িক হয়ে উঠত অনেক সময়েই। এমন একটা ঘটনাও আমি কাছ থেকে দেখেছিলাম, যেখানে গুরুপুত্ৰী প্রেমে পড়লেন শিষ্যপুত্রের। শিষ্যপুত্রের বিদ্যা-বয়স এবং ভবিষ্যৎসম্ভাবনার উজ্জ্বলতা দেখে গুরুমা বিশেষ আগ্রহী হলেন এই বিবাহে। কিন্তু বাদ সাধলেন স্বয়ং শিষ্য, যার পুত্র ‘গায়ন্তী’ তথা ‘ললন্তী’ গুরুপুত্রীর প্রাগবৈবাহিক অভিব্যক্তিতে প্রায় বিগলিত হবার পথে এসে দাঁড়িয়েছেন। শিষ্য তথা পিতার যুক্তি ছিল– আমি গুরুর সঙ্গে তার প্রতিকামনায় তার পরিবারের সবার যত সেবা করেছি, তাতে ভবিষ্যতেও তার পরিবারের থেকে নানান অকারণ আদেশ আমার ওপর নেমে আসার সম্ভাবনা আছে, যা আমাকে গুরুবৎ মান্যতায় পালন করতে হবে, কিন্তু তাতে আমার পরিবারের ক্ষতি হবে। বিশেষত গুরুপুত্রীকেও আমি গুরুর মতোই মানি এবং তার সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ে হলেও তার আদেশ আমাকে যথাবৎ মান্য করতে হবে, সেটা ভবিষ্যতের পরিস্থিতিতে অসহনীয়ও হয়ে উঠতে পারে।

এই বিবাহ বন্ধ হয়েছিল এবং পিতারূপী শিষ্যটিকে তার জন্য অনেক ভর্ৎসনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল। সে যা হোক, আমি এই বাস্তব ঘটনা উল্লেখ করতাম না, যদি না দেবযানীর বিবাহিত ভবিষ্যতে এই ঘটনার অনুমানযোগ্য প্রতিরূপ না দেখতাম। কচ চলে যাবার পর দেবযানীর জীবনে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল এবং সেই শূন্যতার কারণে তার মনে যে কষ্ট তৈরি হয়েছিল তার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল দু’ভাবে। প্রথমত প্রতি পদেই তিনি গুরুকন্যার গুরুত্ব অধিকভাবে প্রকট করে তুলছিলেন, দ্বিতীয়ত দেবযানীর মনের মধ্যে এক ধরনের বিপন্নতা তৈরি হয়েছিল যাতে তার মনে হচ্ছিল তাকে পছন্দ করার অনেক লোক আছে এবং অবিলম্বেই তাদের একজনের সঙ্গে বিবাহিত হয়ে ওঠাটা খুব জরুরি। এটা অবশ্যই ঠিক যে, অসামান্যা সুন্দরী এবং বংশমর্যাদায় অত্যন্ত বড় হওয়া সত্ত্বেও যে রমণী এক অভাবিত কারণে প্রত্যাখ্যাত হন অভীষ্ট পুরুষের কাছেই, তবে তার মনে এইরকম একটা ‘ফ্রাষ্ট্রেশন আসতেই পারে এবং তাতে সাময়িকভাবে যার-তার ওপর ক্ৰোধী হয়ে ওঠাটাও যেমন স্বাভাবিক, তেমনই নিজের রূপ-গুণ যাচাই করে নেবার জন্য পুরুষানুসন্ধানের ব্যাপারটাও খুব স্বাভাবিক। দেবযানীর জীবনে সেই দ্বিতীয় পর্যায় এবার আরম্ভ হল।

.

০২.

পূর্ব-ঘটনা যাই ঘটে থাকুক, দানবরাজ বৃষপর্বার রাজ্যে শুক্রাচার্যের গুরুত্ব যেমন কমল না, তেমনই কমল না দেবযানীর গুরুত্ব। ‘আইডেনটিটি’-র এই জায়গাটা যথেষ্ট স্পষ্ট এবং উজ্জ্বল থাকায় দেবযানী যে অনেক দিন গালে হাত দিয়ে কচের জন্য শোক করলেন, তা নয়। খুব তাড়াতাড়িই তিনি নিজেকে সংবৃত করলেন নিজের মধ্যে, কিন্তু অন্তরের হতাশা তো শুধুমাত্র শোকাচ্ছন্নতার মাধ্যমেই প্রকাশ হয় না, অন্যজনের কাছে সেটা কখনও কখনও ক্রোধ, ঈর্ষা, অসূয়া অথবা অনভিনন্দনের মতো অদ্ভুত বিরুদ্ধ বৃত্তির মাধ্যমেও প্রকট হয়ে ওঠে, অনুভবী মানুষ মাত্রেই সেটা বুঝতে পারে। তবে খুব দার্শনিক মনস্তাত্ত্বিকতার মধ্যে না গিয়ে দেবযানীর অদ্যতন সময়টা বিচার করলে দেখা যাবে তিনি মাঝে মাঝেই ঝগড়া করে ফেলছেন। একগুঁয়েমি ব্যাপারটা তার স্বভাবের মধ্যেই ছিল, সেটা আমরা কচের আশ্রমে অবস্থানকালীন সময়েও দেখেছি, হয়তো সেই একগুঁয়েমি না থাকলে কচ বেঁচে ফিরতেন না ত্রিদশালয়ে, কিন্তু সেই একগুঁয়েমির প্রকাশটা প্রায়শই অভিমানের রূপ ধরত এবং সেটা প্রধানত শুক্রাচার্যের কাছেই। কিন্তু এখন দেবযানী ঝগড়া করে ফেলছেন।

পুরুষ আর পুরুষে যদি ঝগড়া হয়, তবে তা মন্দ লাগে না; তার তীব্রতা অনেক সময়েই দ্বন্দ্বযুদ্ধের সৃষ্টি করে। এবং তার পরিণতি সময়ে সময়ে ভয়ানক। পুরুষ আর রমণীর যে ঝগড়া, তা দাম্পত্য জীবনের অন্যতম অঙ্গ, ঝগড়ায় অংশগ্ৰাহী স্ত্রী-পুরুষের কাছে যে ঝগড়া, বিষবৎ ত্যাজ্য মনে হলেও, তা পাড়াপড়শির শ্রবণানন্দ বর্ধন করে। কিন্তু সব বাদ দিয়ে যদি মেয়েতে মেয়েতে ঝগড়ার কথায় আসি, তবে দেখবেন সেটা কোনও মতেই সহনীয় নয়। সে ঝগড়া শুনতেও ভাল লাগে না, রুচিকরও নয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার ফল সুদূরপ্রসারী। ঠিক এই রকমই একটা মারাত্মক ঝগড়া হয়েছিল অসুরগুরু শুক্রাচার্যের মেয়ে দেবযানীর সঙ্গে অসুরদের রাজা বৃষপর্বার মেয়ে শর্মিষ্ঠার।

মহাভারতে যে জায়গায় দেবযানী এবং শর্মিষ্ঠার ঝগড়ার কথা এসেছে, সেখানে দেবলোকের একটা অভিসন্ধি দেখা গেছে। অর্থাৎ বৃহস্পতির ছেলে কচ যখন মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা শিখে স্বর্গে এসে দেবতাদের সে বিদ্যা শেখালেন, তখন দেবতারা স্বর্গলোকের অধীশ্বর ইন্দ্রকে জানালেন যে, এবার সময় হয়েছে অসুররাজ বৃষপর্বার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার। ইন্দ্র অবশ্য সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে পরোক্ষভাবে অসুরদের শক্তি আরও খানিকটা ক্ষীণ করে দেবার জন্য নতুন এক চাল চাললেন। অসুররাজ্যে মায়াবৃত অবস্থায় ঘুরতে ঘুরতে ইন্দ্র দেখতে পেলেন– অসুরগুরু শুক্রাচার্যের মেয়ে দেবযানী এবং অসুররাজ বৃষপর্বার মেয়ে শর্মিষ্ঠা তাদের সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে নদীর জলে ক্রীড়া করতে নেমেছেন। স্নানরতা সমস্ত রমণীর পরনের কাপড়গুলি নির্দিষ্ট এক-একটা স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় জমা করা ছিল নদীর কিনারে আরণ্যক বৃক্ষের তলায় তলায়।

কথিত আছে, ইন্দ্র নাকি তার অলৌকিক ক্ষমতায় প্রচণ্ড দমকা হাওয়া সৃষ্টি করে মেয়েদের কাপড়গুলি সব এলোমেলো করে দিলেন। ফলে একজনের পরনের কাপড় পড়ে রইল অন্য জায়গায়। মেয়েদের স্নান এবং জলক্রীড়া শেষ হতেই তারা ত্বরিতগতিতে জল থেকে উঠে নিজের মনে করেই এক-একখানি কাপড় পরে নিল। অসুররাজ বৃষপর্বার মেয়ে শর্মিষ্ঠা রাজার ঘরের মেয়ে বলে কথা। রাজকন্যা বলেই খানিকটা অবাধে চলা তার অভ্যাস এবং অনেক ব্যাপারেই তার রাজকন্যা-সুলভ ঔদাসীন্যও আছে। তিনি যখন সলজ্জে জল থেকে উঠে লজ্জানিবারণী বস্ত্রখানি পরলেন, তখন একবারও খেয়াল করলেন না যে, দেবযানীর কাপড়টি ভুলক্রমে পরে বসে আছেন– ব্যতিমিশ্রমজানন্তী দুহিতা বৃষপর্বণঃ।

কিন্তু দেবযানী ব্রাহ্মণ শুক্রাচার্যের মেয়ে। বামুন ঘরের মেয়ে বলেই হোক, অথবা গুরুর মেয়ে বলেই তোক তার কিছু নিজস্বতা আছে এবং গুমোরও আছে, হয়তো বা কিছু শুচিবাইও আছে। শর্মিষ্ঠার গায়ে নিজের কাপড়খানি দেখেই দেবযানীর মাথায় যেন একেবারে খুন চেপে গেল। আসলে গুরুপুত্র এবং গুরুকন্যাদের মানসিকতা এমনটাই হয় অনেক সময়। তাঁরা দরকারে সমবয়সি শিষ্যপুত্র বা শিষ্যকন্যাদের সঙ্গে খেলা করেন, কিন্তু একটু ইতরবিশেষ হলেই তাদের সম্মানে লেগে যায় এবং তখনই অন্তরে জেগে ওঠে গুরুর শাসন। তদবস্থ শর্মিষ্ঠাকে দেখেই দেবযানী বললেন– হ্যাঁ-হে, অসুরের ঝি! এ তোর কেমনধারা ব্যবহার? তুই আমার শিষ্যা হয়ে আমারই কাপড় পরে বসে আছিস। তোর ভাল হবে না মোটে– কশ্মদ গৃহ্নাসি মে বস্ত্রং শিষ্যা ভূহা মমাসুরি?

অন্য সময়ে হলে অথবা একান্তে হলে শর্মিষ্ঠা হয়তো তবু খানিকটা মেনে নিতেন। দেবযানীর দাপট। কিন্তু এতগুলি সমবয়সি সখী-বান্ধবীর সামনে দেবযানী তাকে যখন শুধু অসুরঘরের মেয়ে বলেই অভদ্র আচরণের দায়ে গালি দিলেন শর্মিষ্ঠা তখন আর সইতে পারলেন না। একে রাজরক্ত, তাতে অন্যায়টাও তার ইচ্ছাকৃত নয়, গভীর তো নয়ই। বিশেষত অসুরঘরের আপকায়দা নিয়ে কুৎসিত ইঙ্গিত করায় দেবযানীকে অসুরঘরের মর্যাদা ভাল মতন বুঝিয়ে দেবার জন্য শর্মিষ্ঠা বললেন- দেখ, আমার বাবা বসে থাকুন, অথবা শুয়েই থাকুন, তোর বাবা স্তুতি পাঠক খোসামুদে মানুষের মতো নীচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার বাবার স্তুতি করেন– স্তৌতি বন্দীব চাভীক্ষং নীচৈঃ স্থিত্বা বিনীতবৎ।

শুধু এইটুকু বলেই ছেড়ে দিলেন না শর্মিষ্ঠা। সামান্য পরিধেয় বস্ত্রকে কেন্দ্র করে তাকে যে অপমান সইতে হয়েছে, সে অপমানটা দেবযানী তার একান্ত আপন শক্তি, ক্ষমতা বা গৌরবের জোরে করেননি, করেছেন পিতা শুক্রাচার্যের গৌরবে। পিতার ক্ষমতা তিনি ব্যবহার করেছেন নিজেকে জাহির করার জন্য। শর্মিষ্ঠা এই গৌরব সহ্য করতে পারেননি। অতএব দেবযানী এক কথা বললে তিনি চার কথা শুনিয়ে তার নিজের পিতার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করে বলেছেন– তুই হলি এমন একজন মানুষের মেয়ে যে স্তুতি করে, যে যাচনা করে এবং যে আমার বাবার দেওয়া দান গ্রহণ করে জীবিকা নির্বাহ করে– যাচত স্থং হি দুহিতা স্তুবতঃ প্রতিগৃহ্নতঃ। আর আমি কার মেয়ে জানিস? যাঁকে লোকে স্তব করে, যিনি কারও কাছে কিছু যাচনা করেন না এবং যিনি দান করেন। দেবযানী শর্মিষ্ঠাকে শাসিয়েছিলেন যে, তার কাপড় পরার ফল ভাল হবে না, তার উত্তরে শর্মিষ্ঠা বলেছিলেন– তোকে আমি গ্রাহ্যও করি না? তুই রাগ দেখিয়ে আমার যতই অপকার করার চেষ্টা করিস না কেন, তুই নিজে নিজেই কপাল কুটে বসে থাক অথবা তুই যতই মাটিতে আছাড় খেয়ে শোক করতে থাক, তুই আমার কিছুই করতে পারবি না। কারণ আমি রাজকন্যা এবং আমি সশস্ত্রা, তোকে আমি গণ্যই করি না। তুই যত ইচ্ছে রাগতে থাক– আদুম্বস্ব বিদুন্বস্ব দ্রুহ্য কুপ্যস্ব যাচকি।

সুযোগ পেয়ে শর্মিষ্ঠা ব্রাহ্মণ্য এবং রাজন্যের পারস্পরিক ভেদরেখাঁটিও একটু বুঝিয়ে দিলেন দেবযানীকে। বস্তুত সেকালের দিনে ব্রাহ্মণ্য এবং রাজন্যের পরস্পর নির্ভরতা যতটা ছিল, পরস্পর-নির্ভর বলেই এই দুয়ের একে অপরকে সাবজ্ঞে অতিক্রম করার প্রবৃত্তিটাও মাঝে-মাঝেই কাজ করত। শর্মিষ্ঠার কথায় স্পষ্ট এই ভাব ফুটে উঠছে যে, যাজ্ঞিক, পুরোহিত এবং আচার্যপ্রমাণ ঋষিদেরও অনেক সময়েই আর্থিক সাচ্ছন্দ তথা ব্যক্তি-গৌরব প্রকাশের জন্য রাজার ওপরেই নির্ভর করতে হত। আর রাজারা নির্ভর করতেন ব্রাহ্মণের বুদ্ধির ওপর, বিদ্যার ওপর, যাতে অনন্ত ভোগ-সুখ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার মধ্যেও তারা রাজত্ব চালিয়ে নিয়ে যেতেন। ফলত একটা অমূর্ত ভাবনায় যেভাবে বিদ্যা-বুদ্ধি এবং অর্থ-সম্পদের মধ্যে একটা চিরন্তন বিরোধ আছে, ঠিক সেই বিরোধ অন্তরবাহী হয়ে কাজ করে ব্রাহ্মণ্য এবং রাজন্যের বিরোধেও। আর এই বিরোধে অর্থ, সম্পদ এবং অর্থজনিত শক্তি বিদ্যাবলের মাহাত্ম্যকে অনেক সময়েই বিমানিত করে, ঠিক যেমন বাস্তব জীবনেও আমরা বিধ্বস্ত হয়ে অনেক সময়েই স্বীকার করি– বিদ্যা, বুদ্ধি যা বলো, আসলে টাকাই সব। সম্পন্ন পরিবারে, রাজা রাজড়ার পুত্র-কন্যার মধ্যে এই ভাব আরও বেশি প্রকটভাবে দেখা দেয় এবং এখানে আচার্য এবং ঋষি পিতার গৌরবে দেবযানীও যেহেতু সামান্য কারণে অনর্থক বেশি গুরুগিরি করে ফেলেছেন, অতএব শর্মিষ্ঠাও পিতার রাজশক্তির গৌরবে এমন কথা বলতে পারছেন দেবযানীকে যে, তুই দরিদ্র এবং তোর হাতে অস্ত্র নেই আর আমি রাজকন্যা এবং আমার হাতে অস্ত্রও আছে, অতএব তোর এত মেজাজ কীসের রে ভিখারি কোথাকার অনায়ুধা সায়ুধায়া রিক্তা ক্ষুভসি ভিক্ষুকি– আমার মধ্যে তুই এবার এমন একজনকে দেখতে পাবি যে উলটে মারতেও জানে।

এইরকম একটা উত্তাল ক্রোধের মুখে দেবযানী যথাসাধ্য যুক্তি দিয়ে নিজের প্রাধান্য বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন শর্মিষ্ঠাকে এবং হয়তো সেটাকে একটা উত্তম প্রয়াস বলে মেনে নেওয়াও যায়, কিন্তু একই সঙ্গে তিনি যখন শর্মিষ্ঠার গায়ে জড়ানো নিজের কাপড়খানি টানাটানি করে খুলেও নিতে চাইলেন, তখন তাকে যেন ব্রাহ্মণগুরু শুক্রাচার্যের মেয়ে বলে মনে হয় না। শর্মিষ্ঠাও এই ব্যবহার ভাল মনে নেননি এবং তিনি এতই ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে, দেবযানীকে একটি মজা কুয়োর মধ্যে ফেলে দিয়ে নির্দ্বিধায় বাড়ি ফিরে এলেন। এমনকী কাউকে বললেনও না যে, দেবযানীর কী অবস্থা হল। অসুর ঘরের মেয়ে বটে, হৃদয়টাও তার অনেক কঠিন। অতএব দেবযানীকে কুয়োয় ফেলে দিতেও তিনি সংকোচ বোধ করেননি, ফিরেও তাকাননি একবারও– অনবেক্ষ্য যযেী বেশ্ম– এবং যেন কুয়োর মধ্যে দেবযানী মরে পড়ে থাকলেই ভাল, এইরকম একটা কঠিন হৃদয়ের ভাবনা নিয়েই শর্মিষ্ঠা ঘরে ফিরে এসেছিলেন–হতেয়মিতি বিজ্ঞায় শর্মিষ্ঠা পাপনিশ্চয়া– একবার পিছন ফিরেও দেখলেন না তার দিকে এবং তাতে আরও বোঝা যায় যে, রাগটা তার অনেক দিনের। হয়তো বা এই রাগ জন্ম নিয়েছে বহুঁকালিক ব্যবহারে, শুক্রাচার্য দানবকুলের গুরু হওয়ার দরুন দেবযানীও দানবরাজার মহিলা-মহলে গুরুর মর্যাদায় এবং পৃথক মান্যতায় চলতেন বলেই হয়তো এত রাগ শর্মিষ্ঠার। ফলে দেবানীর দিকে তিনি একবার ফিরেও তাকালেন না– অনবেক্ষ্য যযৌ বেশ্ম ক্রোধবেগপরায়ণা।

শর্মিষ্ঠার ইচ্ছামতো দেবযানী অবশ্য মারা যাননি। জীবন তবু কেটে যায় গল্পকাহিনির সত্যের চেয়েও আরও বিচিত্র সত্য নিয়ে। বিপন্ন হলেও তাকে সাহায্য করার লোক আসে বাইরে থেকে পড়ে গেলে তাকে ধরে তুলবার মানুষ আসে আনমনে একাকী।

দেবযানী যেখানে মজা-কুয়োর মধ্যে পড়েছিলেন, সেখানে দৈবক্রমে এসে পৌঁছলেন পৌরব-বংশের রাজা নাহুষ যযাতি। মৃগয়ার পরিশ্রমে পিপাসার্ত হয়ে যাতি ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে ওই কুয়োর মধ্যে জল আছে ভেবে জল খেতে এসেছিলেন শ্রান্তযুগ্যঃ শ্রান্তহয়ো মৃগলিন্দুঃ পিপাসিতঃ।

হঠাৎ তিনি দেখলেন– কুয়োর মধ্যে আগুনপানা সুন্দরী এক রমণী ঈড়িয়ে আছেন– কন্যামগ্নিশিখামিব। দেবযানী কাঁদছিলেন কিনা, সে খবর দেননি মহাভারতের কবি, কারণ আগুন থেকে জলবিন্দু ক্ষরিত হয় না, অগ্নিশিখা-সমান দেবযানীও হয়তো কাঁদছিলেন না। কিন্তু কুয়োয় পড়ে যাবার পর থেকে কাল অনেকটাই অতিক্রান্ত হওয়ায় তাকে একটু চিন্তাকুল এবং উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল নিশ্চয়ই।

যযাতি তাঁকে দেখেই বুঝেছিলেন যে, দেবযানী বড় ঘরের মেয়ে। প্রথম দেখায় দেবযানীর রূপে তিনি এতটাই মুগ্ধ বোধ করেন যে, তার সাধারণ কুশল-জিজ্ঞাসার মধ্যেও কেমন শরীর শরীর গন্ধ চলে আসে। কুয়োর মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলেও দেবযানীর উদ্দেশে তিনি বলে ফেলেন– কেমন কঁচা সোনার মতো তোমার গায়ের রং, হাতের আঙুলে রক্ত ফেটে পড়ছে যেন, কানে সোনার দুলগুলিও তো একেবারে ঝকঝক করছে- কা ত্বং তানখী শ্যামা সুমৃষ্টমণিকুন্তলা। যযাতি বললেন– কে গো তুমি মেয়ে? এমন সুন্দর চেহারা তোমার, অথচ এমন বিপন্ন আতুর দেখাচ্ছে কেন তোমাকে? সবচেয়ে আশ্চর্য এই তৃণ-লতাচ্ছন্ন কুয়োর মধ্যেই বা তুমি এসে পড়লে কী করে? তুমি কার মেয়ে বলল তো– দুহিতা চৈব কস্য ত্বং বদ সত্যং সুমধ্যমে?

কূপের মধ্যে প্রতিকূল অবস্থাতে দাঁড়িয়ে থেকেও দেবযানী তার মর্যাদা সম্বন্ধে যেমন সচেতন, তেমনই সচেতন তার চেহারার জন্য। পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি সাহংকারে বললেন–যাঁর সঞ্জীবনী বিদ্যাবলে দৈত্যরা মরে গেলেও বেঁচে ওঠে আমি সেই শুক্রাচার্যের মেয়ে। তিনি নিশ্চয়ই এখনও জানেন না যে, আমি এই কুয়োর মধ্যে পড়ে রয়েছি। আর আপনি যে আমার রক্তিম অঙ্গুলিগুলির প্রশংসা করছিলেন– এই আমার সেই দখিন হাতখানি এষ মে দক্ষিণণা রাজন্ পাণিস্তানখাঙ্গুলিঃ। আপনি আমাকে এই হাত ধরেই কুয়ো থেকে তুলুন। আমি আশা করি আপনি শান্ত, বলবান, মনস্বী এবং সদ্বংশজাত, আর ঠিক সেইজন্যই আমার মতো মানুষকে এখান থেকে হাত ধরে তোলার উপযুক্ত লোকও আপনিই– সমুদ্ধর গৃহীত্বা মাং কুলীন স্বং, হি মে মতঃ।

পুরুষ মানুষের সামনে বিপন্ন অবস্থাতেও নিজের ‘ফেমিনিটি’ বজায় রাখা এবং দেবযানীর দম্ভটুকু আন্দাজ করতে পারলেন? যযাতির শঙ্কাকুল প্রশ্নে তিনি একবারও জানাননি যে স্ত্রীজনোচিত ঝগড়ার ফলে তার এই কূপগতি হয়েছে। উলটে বলেছেন– সঞ্জীবনী বিদ্যার জনক এখনও জানতে পারেননি বলেই এখনও তিনি কুয়োর মধ্যে পড়ে আছেন। নইলে এমনটি হত না। দ্বিতীয়ত যযাতি একবার মাত্র পুরুষোচিত উচ্ছ্বাসে তার রক্তিম অঙ্গুলিগুলির প্রশংসা করেছিলেন বলে, তিনি সেই রক্তিম অঙ্গুলিগুলির কথাই ঘোষণা করে সেই হাতটিই বাড়িয়ে দিয়েছিলেন যযাতির দিকে এষ মে দক্ষিণে রাজন্ পাণিস্তানখালিঃ। সবচেয়ে বড় কথা, বিপন্ন অবস্থায় তাকে কুয়ো থেকে তোলার জন্য তিনি রাজার কাছে কোনও কাকুতি-মিনতি করছেন না। বরঞ্চ তাকে হাত ধরে তোলার ব্যাপারে যে কৌলীন্য এবং আভিজাত্যের প্রয়োজন হয়, সেইটি রাজার আছে বলে তাকে কুয়ো থেকে তুলে রাজাই যেন ধন্য হবেন– এমন একটা ভাব করলেন দেবযানী।

যাই হোক, যযাতি বুঝলেন দেবযানী বামুন ঘরের মেয়ে। অতএব তার এগিয়ে-দেওয়া ডান হাতটি ধরে দেবযানীকে কুয়ো থেকে তুললেন যযাতি। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, এই উদ্ধার কার্যের পর এই ব্রাহ্মণকন্যার সঙ্গে আর একটি কথাও বলেননি যযাতি। সঙ্গে সঙ্গে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘরে ফিরে এসেছেন রাজা। এই যে চলে যাবার তাড়াহুড়ো, এ কি শুধুই বামুন-ঘরের মেয়ে বলে, নাকি দেবযানীর চরিত্রের মধ্যেই সেই দর্পোদ্রিক্ত বীজ ছিল, যাতে রাজা যযাতির মতো অভিজাত ব্যক্তিও রমণীর সাহচর্যমোহ ত্যাগ করে পালাতে চান, যেমন পালাতে চেয়েছিলেন ব্রাহ্মণ বৃহস্পতির পুত্র কচ এককালে।

যযাতি চলে যেতেই দেবযানী দেখলেন যে, তার গৃহদাসী ঘূর্ণিকা অনেকক্ষণ তাকে না দেখতে পেয়ে তার অন্বেষণে বেরিয়েছে। দেবযানী দাসীর কাছে শর্মিষ্ঠার ইতিবৃত্তান্ত সব জানিয়ে তাকে পিতা শুক্রাচার্যের কাছে পাঠালেন। দাসীকে বলে দিলেন– যতক্ষণ না পিতা এই ঘটনার বিহিত করছেন, ততক্ষণ তিনি অসুররাজ বৃষপর্বার রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করবেন না। ঘুর্ণিকা দেবযানীর কথামতো শুক্রাচার্যকে আদ্যন্ত ঘটনা সব জানালেন। বিশেষত জানালেন যে, অসুররাজপুত্রী শর্মিষ্ঠা দেবযানীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা করেছে।

এই অদ্ভুত মান-অপমানের চক্রান্তে দেবযানী মানসিকভাবে কতটা গ্রস্ত হতে পারেন, সেটা শুক্রাচার্য খুব ভালভাবে জানেন বলেই তিনি খুব তাড়াতাড়ি মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে বেরোলেন। কিন্তু মনে মনে শুক্রাচার্য এই ঘটনাটাও খুব ভাল জানেন যে, দেবযানীরও কোনও দোষ আছে। কেননা, দেবযানীর যা চরিত্র তাতে সে কিছুই করেনি, কিছুই বলেনি, অথচ একজন তাকে অযথা কুয়োর মধ্যে ফেলে দিয়ে গেল এমনটি হতে পারে না। তা ছাড়া শুক্রাচার্য বহু অভিজ্ঞ পুরুষ, দেবাসুরের রাজনীতি নিয়ে তার জীবন কাটে, কাজেই নির্মম সত্যটুকু তিনি অনুভব করতে পারেন সহজেই। তবু শৈশবে মাতৃহারা এই মেয়েটিকে তিনি অসম্ভব স্নেহ করেন, মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্রয়ও দেন। প্রধানত সেই স্নেহের বশেই দেবযানীর সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্র তিনি জড়িয়ে ধরলেন তাকে। কিন্তু একই সঙ্গে সত্য উচ্চারণ করতেও তার দ্বিধা হল না। খুব রয়েসয়ে শুক্রাচার্য বললেন– খুব দার্শনিক কায়দায় বললেন– দেখো মা! লোকে নিজের দোষ গুণ অনুসারেই দুঃখ এবং সুখ ভোগ করে। আমার মনে হয় এই ঘটনায় তোমার নিজেরও কোনও অন্যায় ছিল এবং হয়তো সেই অন্যায়েরই ফল ভোগ করছ তুমি মনে দুশ্চরিতং তেহস্তি যস্যেয়ং নিষ্কৃতিঃ কৃতা।

এ অবস্থায় যেমনটি হয়। নালিশ করার সময় যেমন অন্যায়কারী ব্যক্তি নিজের অন্যায় চেপে রেখে পরকৃত্য দোষের চূড়ান্ত কথাগুলি বলে এবং যার কাছে নালিশ করছি, তাকেই কীভাবে অপমান করা হয়েছে, সেই কথাগুলি বলে যেমন সালিশী-মানা ব্যক্তিকে পক্ষপাতী করার চেষ্টা করা হয়, ঠিক তেমন করেই দেবযানী শুক্রাচার্যকে বললেন আমার অন্যায়ই হোক, আর তার প্রায়শ্চিত্তই ভোগ করি, কিন্তু অসুর-মেয়ে শর্মিষ্ঠা কী বলেছে, একবার মন দিয়ে শোনো। শর্মিষ্ঠা বলেছে– তুমি নাকি দৈত্যদের স্তাবক– কথাটা কি ঠিক– সত্যং কিলৈতৎ সা প্রাহ দৈত্যনামসি গায়নঃ? শর্মিষ্ঠা চোখ লাল করে, সগর্বে সাহংকারে আমাকে বলেছে যে লোক সব সময় স্তব করে, প্রার্থনা করে এবং দান গ্রহণ করে– আমি নাকি তারই মেয়ে। আর লোকে যাঁর স্তব করে এবং যিনি দান করেন, কিন্তু দান গ্রহণ করেন না, শর্মিষ্ঠা নাকি তার মেয়ে। দেবযানী এবার শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করে বললেন– শোনো বাবা। আমি যদি সত্যি করে এক স্তাবক এবং প্রতিহজীবীর মেয়ে হই, তবে আমি যথাসাধ্য অনুনয়-বিনয় করে শর্মিষ্ঠাকে তুষ্ট করব, এ কথা আমি বলেই দিয়েছি– প্রসাদয়িয্যে শর্মিষ্ঠামিত্যুত্ত্বা তু সখী ময়া। দেবযানী এর পরেও ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন– শুধু এই জঘন্য কথাতেই শেষ হয়নি। এর পরেও আমাকে জোর করে ধরে কুয়োর মধ্যে ফেলে দিয়েছে শর্মিষ্ঠা।

শুক্রাচার্য দেবযানীকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করলেন। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন– মা! কখনই তুমি এক স্তাবক-যাচকের মেয়ে নও। বরঞ্চ সকলেই যার স্তুতি করে, তুমি তারই মেয়ে– অস্তোতুঃ হ্রয়মানস্য দুহিতা দেবযানসি। একথা তিন ভুবনের সবাই জানে। আমার অলৌকিক ঐশ্বর্য সঞ্জীবন মন্ত্রের ক্ষমতা দৈত্যরাজ বৃষপর্বাও জানেন, স্বর্গেশ্বর ইন্দ্রও জানেন এবং পৃথিবীপতি নাহুষ যযাতিও জানেন। তবে কী জান– নিজের ক্ষমতার কথা নিজের মুখে বলতে নেই। তাতে ভদ্রলোকের লজ্জা হয়– কণ্বনং স্বগুণানাঞ্চ কৃত্বা তপতি সজ্জন। কিন্তু তুমি তো আমার ক্ষমতার কথা ভালই জান, দেবযানী। তাই নিজের মুখে আর সে-সব কথা বলছি না– ততো বক্তৃমশক্তোহস্মি ত্বং মে জানাসি যদ্‌বলম। তা ছাড়া, যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন ওঠো, ঘরে যাবে চলো। যে তোমার সঙ্গে অসদাচরণ করেছে, তাকে ক্ষমা করে দাও। ক্ষমা করাটাই সাধু-সজ্জনের ধর্ম।

শুক্রাচার্য অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন দেবযানীকে। রাগ হলে সেই রাগ দমন করার সুফল কত, ক্রোধহীন ব্যক্তির মর্যাদা কত এবং ক্ষমা করলে কতটা ধর্ম হয়– এসব শাস্ত্রীয় কথা শাস্ত্রীয় অভিসন্ধিতেই দেবযানীকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন শুক্রাচার্য। পরিশেষে বললেন– বাচ্চারা এরকম ঝগড়া করেই থাকে, বুদ্ধি হয়নি বলেই এবং ঝগড়া করার ভালমন্দ বোঝে না বলেই বাচ্চারা এমন করে ঝগড়া করে। কিন্তু তাই বলে আমি বুড়ো মানুষ হয়ে এসব সাধারণ ঝগড়ার কথা মনে রাখব? তাই কি হয়? প্রাজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি কি কখনও বালক-বালিকার অনুকরণ করতে পারে– ন তৎ প্রাজ্ঞোহনুকুর্বীত ন বিদুস্তে বলাবলম্।

দেবযানী আরও কঠিন এবং শক্ত হলেন মুখে এবং মনে। বললেন– বাবা! ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্ব আমি জানি। ক্রোধ এবং ক্ষমার দোষ-গুণও আমার অজানা নয়। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে কাদের সঙ্গে থাকা যায় এবং কাদের সঙ্গে থাকা যায় না। যারা শিষ্য হয়ে শিষ্যের মতো ব্যবহার করে না, গুরু অথবা গুরুবৎ কিচ্ছু জানে না, অথচ মুখে বলবে আমি আপনার শিষ্য’– এমন মিশ্রবৃত্তি শিষ্যের সঙ্গে আমার অন্তত থাকতে ভাল লাগে না– তস্মাৎ সংকীর্ণবৃত্তে বাসো মম ন রোচতে।

দেবযানী আরও একটা অকাট্য যুক্তি দিয়ে ঘটনার গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করলেন। বললেন– যে মানুষ সহবাসী বা প্রতিবেশী জনের বৃত্তি, ব্যবসায় অথবা তার বংশ নিয়ে কটু মন্তব্য করে– পুমাংসো যে হি নিন্দন্তি বৃত্তেনাভিজনেন বা কোনও বুদ্ধিমান মানুষ, যে নিজের ভাল চায়, সে কখনও এই কটুকাটব্যের মধ্যে থাকবে না। এমন একটা শাস্ত্রীয় যুক্তি দেবযানীর মুখে শুনতে আশ্চর্য লাগে এই কারণে যে, তিনি নিজেই সেই সংকট প্রথম তৈরি করেন। সেই যখন স্নান করার সময় সকলের পরিধেয় বস্ত্র এলোমেলো হয়ে গেল, শর্মিষ্ঠা দেবযানীর কাপড় পরে ফেলেছিলেন ভ্রমবশত, তখন দেবযানীই কিন্তু শর্মিষ্ঠাকে অসুর ঘরের মেয়ে বলে প্রথম গালাগালিটা আরম্ভ করেছিলেন। নিজের বংশ নিয়ে এই অমর্যাদার কারণেই শর্মিষ্ঠার ক্রোধ উদ্ৰিক্ত হয়। যাই হোক, কাদের সঙ্গে থাকা যায় কাদের সঙ্গে যায় না এ বিষয়ে দেবযানী অনেক দৃষ্টান্ত দেবার পর পিতার ক্রোধাগ্নি উদ্দীপিত করার জন্য তারই উদ্দেশে বললেন– গরিব বলেই যারা লাভের আশায় বড়লোক শত্রুর মোসাহেবি করে, সেই সেবাবৃত্তির চেয়ে কষ্টকর আর কিছু আছে কিনা আমার জানা নেই। এমন নীচ মানুষের সংসর্গে পদে পদে যদি সম্মানী ব্যক্তিকে এইভাবে অপমানিত হতে হয়, তবে তার চেয়ে মরণও ঢের ভাল। দেবযানী শেষ দুঃখ জানিয়ে পিতাকে বললেন– ছুরি, কাটারি অথবা শরের আঘাতে যদি শরীরের কিছু অংশ কেটেও বেরিয়ে যায়, তবু সেখানে আবার মাংস গজায়, কিন্তু তীক্ষ্ণ এবং কটু কথায় মানুষের মনের মধ্যে যে ক্ষত তৈরি হয় সে ক্ষত কোনও দিন সারে না। বাক্যের ক্ষত রয়েই যায় বাঁচা দুরুক্তং বীভৎসং ন সংরোহতে বাক্ষতম্।

দেবযানীর এই কথাটা রীতিমতো রাজনীতির ইতিকর্তব্যের মধ্যে এসে পড়েছে। মহামান্য মনু মহারাজ তার সংহিতা গ্রন্থে কোন কোন দোষ থেকে রাজাদের বিরত থাকা উচিত সেই প্রসঙ্গে বলবার সময় ক্রোধজ ব্যসনের মধ্যে বাষ্পরুষ্য এবং দণ্ড-পারুষ্যের একটা তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন– রাজদণ্ড প্রয়োগ করে দণ্ডযোগ্য মানুষের হাত-পা, নাক-কান কেটে দিয়ে শাস্তি দেওয়াই যায়। কিন্তু তাতে সমস্যা এই যে, সেই ক্ষতির আর কোনও প্রতিবিধান করা যায় না। কাটা হাত-পা আর জোড়া দেওয়া যায় না। এই প্রসঙ্গে বাক্য পারুষ্যের কথা এসেছে। অর্থাৎ খারাপ কথা বলা, মনে আঘাত দিয়ে কথা বলার প্রসঙ্গ এসেছে। মনু বলেছেন– এটাও রাজা বা রাজনীতির পক্ষে একটা বড় দোয়। কেননা কুকথা এবং অপ্রিয় বাক্যের কুফল এমনই যে, হাজার চেষ্টা করলেও পরে আর সেই ক্ষত সেরে ওঠে না। মনুর টীকাকারেরা এইজায়গাটা যখন বিচার করছেন, তখন তারা মহাভারত থেকে দেবযানীর এই কথাটুকু উদ্ধার করেছেন। কুল্লুকভট্ট তার টীকায় লিখেছেন– অপ্রিয় বাক্যের ফল এতটাই মর্মে আঘাত করতে পারে যে, তার আর কোনও চিকিৎসা নেই। যেমনটি বলা হয়েছে– [মহাভারতে দেবযানীর উক্তিতে]–ন সংরোহতে বাকক্ষতম।

একটি মানুষ যার সঙ্গে অন্য জনের আত্মসম্বন্ধ আছে, যার প্রতি স্নেহ আছে, ব্যাকুল ভালবাসা আছে সে যদি সেই স্নিগ্ধ-ব্যাকুল মানুষটির কাছে যৎসামান্য যুক্তি এবং বেশির ভাগটাই অভিমান নিয়ে কিছু বোঝাতে থাকে, তবে এক সময় সে সেইভাবেই বুঝবে, যেমনটি তাকে বোঝানো হচ্ছে। শৈশবে মাতৃহারা দেবযানীর প্রতি শুক্রাচার্যের স্নেহ ছিল অন্তহীন। দেবযানীকে তিনি অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছেন এবং প্রথম প্রথম তাকে বলেছেন নিজের দোষ সম্বন্ধে সচেতন হতে। কিন্তু কন্যার অপার অভিমান এবং তার আপন স্নেহের মিশ্রক্রিয়া যখন চূড়ান্ত আকার ধারণ করল, তখন অসুরগুরুর লোকোত্তরা বুদ্ধিও আর কাজ করল না। মহাভারতের কবি টিপ্পনী করতে বাধ্য হয়েছেন যে, শুক্রাচার্য আর কোনও পূর্বাপর বিবেচনা না করেই সিংহাসনে সমাসীন অসুররাজ বৃষপর্বার সামনে গিয়ে উপস্থিত হলেন– বৃষপর্বণমাসীনম ইত্যুবাচ অবিচারয়ন। ব্যক্তিগতভাবে শুক্রাচার্য যে বৃষপর্বার ওপরে খুব ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তা নয়। অভিমান ক্ষুব্ধা দেবযানী যেহেতু শর্মিষ্ঠার শাস্তি চান এবং অসুরদের গুরুমর্যাদায় অবস্থিত শুক্রাচার্য যেহেতু এই ব্যাপারে সরাসরি শর্মিষ্ঠার সঙ্গে কথা বলতে পারেন না, অন্তত সেটা যেহেতু তাকে মানায় না, সেইজন্য তিনি সোজা বৃষপর্বার কাছে গিয়ে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। তার কথা থেকে এটা বোঝাও গেল যে, তার আসল রাগটা বৃষপর্বার ওপরে নয়, রাগটা প্রধানত শর্মিষ্ঠর ওপরেই, যার জন্য এই উটকো এক মেয়েলি ঝগড়ার মধ্যে তাকে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। শুক্রাচার্য একেবারে আকস্মিকভাবে বৃষপর্বাকে বললেন– তুমি গোরু দেখেছ, মহারাজ। গোরু গর্ভস্থ হয়েই কিন্তু সদ্য-সদ্যই প্রসব করে না। পাপও সেই রকম বারে বারে করতে করতে এক সময় পাপকর্মকারী মানুষের মূলোচ্ছেদ করে বসে। একটা জিনিস জেনো। আজকে যখন মুখরোচক গুরুপাক জিনিস খাচ্ছ, তখন মুখে ভাল লাগছে বটে, কিন্তু পেটে গিয়ে সে খাবার কুফল জন্মাবে। পাপও তেমনই। এখন না বুঝে পাপ করছ বটে, কিন্তু এর ফল গিয়ে বর্তাবে তোমার ছেলের ওপর, তোমার নাতির ওপর– ফলত্যেব ধ্রুবং পাপং গুরুভুমিবোদরে।

শুক্রাচার্য সোজাসুজি শর্মিষ্ঠার কথায় যেতে পারছেন না, তাই আগে অন্য কথা বলে বৃষপর্বার দোষ দেখিয়ে বললেন– আমারই ঘরে থাকা অবস্থায় তুমি ধার্মিক এবং গুরুনিষ্ঠ আমার শিষ্য ব্রাহ্মণ কচকে হত্যা করার ব্যবস্থা করেছিলে। আর এখন তোমার মেয়ে শর্মিষ্ঠা আমার ভালমানুষ মেয়েটাকে প্রথমে যা নয় তাই বলেছে। তারপর আবার তাকে প্রতারণা করে কুয়োর মধ্যে ফেলে দিয়েছে– বিপ্রকৃত্য চ সংরম্ভাৎ কূপে ক্ষিপ্তা মনস্বিনী।

শুক্রাচার্য বৃষপর্বাকে যাই কটু কথা বলুন, কিন্তু বলতে তার খারাপ লাগছে। এতকাল এই মানুষটার সুখে-দুঃখে আছেন, তাঁর ভাল-মন্দ চিন্তা করছেন, তাঁকে উপদেশ-পরামর্শ দিচ্ছেন এবং বৃষপর্বাও পরম মান্যতায় তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। তাই এই মানুষটাকে খারাপ কথা বলতে তার মনে লাগছে। তাই সঙ্গে সঙ্গে বললেন– দেবযানী আর তোমার রাজ্যে থাকবে না, আর সে যদি না থাকে, তবে তাকে ছেড়ে আমার পক্ষেও এখানে থাকা সম্ভব নয়। তাই আজ থেকে আমি সবান্ধবে তোমাকে ত্যাগ করলাম। একের ওপর রাগ অন্যের ওপর মেটাচ্ছেন বলে শুক্রাচার্য কণ্বঞ্চিৎ সান্ত্বনাও উচ্চারণ করলেন পরিশেষে। বললেন– আমার জন্য তুমি কষ্ট পেয়ো না, অথবা আমার ওপর রাগও কোরো না যেন। আসলে আমার উপায় নেই, দেবযানী না থাকলে আমি এখানে থাকতে পারি না। তার যেদিকে গতি হবে, আমারও গতি সেইদিকে, তার কাছে যা প্রিয় আমার কাছেও তাই প্রিয়– অস্যা গতির্গতির্মহ্যং প্রিয়মস্যাঃ প্রিয়ং মম।

যতটুকু কথা শুক্রাচার্য বলেছেন, তাতে এটা বোঝানো গেছে যে, তাকে নয়, তুষ্ট করতে হবে দেবযানীকে। অসুররাজ বৃষপর্ব পূর্বভূত ঘটনার বিন্দুবিসর্গ কিছুই জানতেন না। শুক্রাচার্যের আকস্মিক আক্ষেপে তিনি হতচকিত হয়ে বললেন– এ কী কথা বললেন, ব্রাহ্মণ। আমি যদি কচকে হত্যা করিয়ে থাকি অথবা আমি যদি শর্মিষ্ঠাকে দিয়ে দেবযানীকে কোনও কটু কথা বলিয়ে থাকি, তবে আমার যেন অসদগতি হয়। খুব সত্যি কথা, যে দুটি অভিযোগ শুক্রাচার্য করেছেন, তার কোনওটারই প্রকৃত দায় বৃষপর্বার নয়। কচকে যে বার বার মেরে ফেলার চেষ্টা হয়েছে, সে চেষ্টা করেছে অসুররা এবং তা তারা নিজেদের সিদ্ধান্তেই করেছে। এতে বৃষপর্বা সরাসরি দায়ী না হলেও, অসুরদের রাজা হিসেবে একটা নৈতিক দায় শুধু থেকে যায় এবং শুক্রাচার্য হয়তো নিরুপায় হয়ে তারই ইঙ্গিত করছেন। একইভাবে কন্যা শর্মিষ্ঠাকেও বৃষপর্বা শিখিয়ে দেননি যাতে সে দেব্যানীকে অপমান করে। কিন্তু সেখানেও তাকে পিতা হবার দায় বইতে হচ্ছে।

শুক্রাচার্যের আকস্মিক ক্রোধে বৃষপর্বা তাই হতভম্ব হয়ে বললেন– আপনি যদি এইভাবে এখনই চলে যান, গুরুদেব, তা হলে আমাদের সবাইকে তো সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে হবে! শুক্র বললেন– সে তোমরা যাই করো, সমুদ্রেই ডুবে মরো, আর অন্য দেশেই চলে যাও, আমি আমার মেয়েকে ছাড়া থাকতে পারব না। তবে হ্যাঁ আমি তোমার ভাল চাই সবসময়। তোমরা যদি নিতান্তই আমার উপস্থিতি চাও, তবে আমার মেয়ে দেবযানীকে তুষ্ট করো– প্রসাদ্যতাং দেবযানী জীবিতং যত্র মে স্থিতম। বৃষপর্বা একটু ইতস্তত করলেন, একটু যেন লজ্জা হল তাঁর। আপন কন্যার সমবয়সি একটি মেয়ের কাছে নিজের কোনও দোষ না থাকতেও ক্ষমা চাইতে হবে। এ কেমন বিড়ম্বনা। বৃষপর্ব ইনিয়ে বিনিয়ে বললেন– অসুরদের যত সম্পত্তি আছে– হাতি, ঘোড়া, রথ– সবই তো প্রভু আপনার। তা হলে…। শুক্রাচার্য বৃষপর্বার কথা কেড়ে নিয়ে বললেন– অসুরদের যত সম্পত্তি আছে, তার সবকিছুরই প্রভু যদি আমিই হই, তবে আমি বলছি– তোমরা দেবযানীকে সন্তুষ্ট করো– দেবযানী প্রসাদ্যতাম।

পুত্র-কন্যার জন্য পিতা-মাতাকে কখনও কখনও এইরকম অস্বস্তিকর পরিবেশে পড়তে হয়। শুক্রাচার্যের কথাগুলি শুনলেই বোঝা যায় যে, তিনি খুব যুক্তি-তর্কের মধ্যে যেতে চাইছেন না; কেননা যুক্তিতর্কের মধ্যে গেলে তাকে অসুররাজ বৃষপর্বার যুক্তি-তর্কও কিছু মেনে নিতে হত এবং তাতে এমন হতেই পারত যে, দেবযানীর সব কথা মেনে নেওয়া সম্ভব হত না, এমনকী যুক্তি-তর্ক খাঁটিয়ে দেবযানী-শর্মিষ্ঠার ঝামেলা মিটেও যেতে পারত অপরাধ স্বীকারের মাধ্যমে, ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু এসব মাধ্যম দেবযানী পছন্দ করছেন না, তিনি বিবাদ মেটাতে চাইছেন না, তিনি শর্মিষ্ঠাকে চরম শাস্তি দিতে চাইছেন এবং শুক্রাচার্য তার এই আদরিণী মেয়ের আবদার না মেনে পারছেন না, কেননা তিনি সেইভাবেই অনর্থক আদরে তাকে মানুষ করেছেন। কিন্তু বৃষপর্বার ওপরে অর্থ-মানের কারণেই যে স্নেহ-ভালবাসা শুক্রাচার্যের তৈরি হয়েছে, সেটা যাতে নষ্ট না হয় এবং যাতে ব্যাপারটা দেবযানী-শর্মিষ্ঠার স্তরেই আবদ্ধ থাকে, সেইজন্যই শুক্রাচার্য বারবার বলতে লাগলেন– আমাকে নয়, তুমি দেবযানীকে তুষ্ট-প্রসন্ন করো– দেবযানী প্রসাদ্যতাম।

বৃষপর্বা বুঝলেন আর কোনও উপায় নেই। অগত্যা বৃষপর্ব দেবযানীর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়াটাই শ্রেয় মনে করলেন। কেননা দেবযানী চলে গেলে তার কিছুই ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না বটে, কিন্তু শুক্রাচার্য তার রাজ্য ছেড়ে চলে গেলে সমূহ বিপদ। বৃষপর্বা যাতে খুব অস্বস্তিতে না পড়েন, সেজন্য শুক্রাচার্য আগেভাগেই এসে তাকে বুঝিয়ে বললেন– দেখো মা! বৃষপর্ব যথেষ্ট অনুতপ্ত এবং সে বার বার এ কথা বলেছে যে, তার ধন-সম্পত্তি, রাজ্য– এ সব কিছুরই মালিক আমি। দেবযানী পিতার কথায় একটুও আমল দিলেন না এবং অস্বস্তিটুকুও বুঝলেন না। তার শুধু মনে শর্মিষ্ঠার কথা। সে দেবযানীকে স্তাবক এবং যাচকের কন্যা বলেছে, দেবযানী পিতার অস্বস্তি, রাজার অসম্মান– এসব কিছু বোঝেন না। নিজের ‘ইগো ছাড়া তার অন্তরে আর কোনও দয়া, মায়া, স্নেহ-মমতা নেই। পিতাকে তিনি একই রকম রাগ দেখিয়ে বললেন আমি বিশ্বাস করি না তোমার কথা। তুমি যদি সত্যিই অসুররাজ বৃষপর্বার রাজ্য-সম্পত্তির মালিক হও, তবে সে নিজে এসে ওই কথা বলুক আমার সামনে নাভিজানামি তত্তেহহং রাজা তু বদ স্বয়ম্।

শুক্রাচার্য আর কথা বাড়ালেন না। বৃষপর্বা এর মধ্যে এসে পায়ে পড়লেন দেবযানীর পপাত ভুবি পাদয়োঃ। বৃষপর্বা বললেন দেবযানী! তুমি যা চাইবে, তা যদি একান্ত দুর্লভও হয়, যদি তা একান্ত অসাধ্যও হয় আমার, তবু আমি তোমাকে তা দেব। দেবযানী সময় বুঝে চরম আঘাত করলেন। বললেন– তা হলে তোমার মেয়ে শর্মিষ্ঠা তার এক হাজার সখীর সঙ্গে আমার দাসী হবে আজ থেকে। আর বিয়ের পর পিতা আমায় যে পাত্রে দান করবেন, সেই বাড়িতে শর্মিষ্ঠাও তার হাজার সখীর সঙ্গে আমার পিছন পিছন যাবে– অনু মাং তত্র গচ্ছেৎ সা যত্ৰ দাস্যতি মে পিতা।

শর্মিষ্ঠা রাজার ঘরের মেয়ে, কাজেই রাজমহলে তার পিতার সঙ্গে শুক্রাচার্যের যে কথা কাটাকাটি চলছে এবং শেষ পর্যন্ত বৃষপর্ব কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, এ খবর তাঁর কাছে আগেই চলে গেছে। সম্ভবত সেই জন্যই শর্মিষ্ঠাকে যে ছোটবেলা থেকে লালন করেছে, সেই ধাত্রীমাতা বৃষপর্বার কাছে কাছেই ছিল। সামনে তাকে দেখেই বৃষপর্ব আদেশ দিলেন– যাও ধাত্রী! শর্মিষ্ঠাকে গিয়ে বলো, দেবযানী যেমনটা চাইছে, সে যেন তাই এসে করে। ধাত্রী তাড়াতাড়ি করে শর্মিষ্ঠার কাছে গিয়ে বলল– ওঠো গো মেয়ে। এখন তোমার বাবা মা আত্মীয়স্বজনের প্রয়োজনে তোমায় কাজ করতে হবে। দেবযানী এমন করে তার পিতা শুক্রাচার্যকে বুঝিয়েছে যে, এখনই তিনি রাজ্য ছেড়ে চলে যাচ্ছেন প্রায়– ত্যজতি ব্রাহ্মণঃ শিষ্যান্ দেবযান্যা প্রচোদিতঃ। যা অবস্থা, তাতে দেবযানী এখন যা বলবে, তাই তোমাকে করতে হবে, মেয়ে!

শর্মিষ্ঠা রাজার ঘরের মেয়ে, রাজশাসন এবং রাজার ধর্ম জন্ম থেকে ক্রিয়া করে রাজবাড়ির পুত্র-কন্যাদের মধ্যে। নিজের আত্মসম্মানের চেয়ে রাজ্যের প্রয়োজনটাকে অনেক বড় করে দেখতে শেখাটা খুব সহজ নয়। শর্মিষ্ঠা সেটা শিখেছেন ভালভাবেই।

আজ যখন তিনি দেখলেন– তারই অপরাধে তার পিতা এবং তার আত্মীয় পরিজন অসুরেরা সকলে বিপন্ন হয়ে পড়েছেন, তখন তিনি নিজের সমস্ত গরিমা বিসর্জন দিয়ে ধাত্রীকে বললেন– দেবযানী যা চাইবে, আমি তাই করব– যং সা কাময়তে কামং করবণ্যহমদ্য তম। আমার দোষে দেবযানী এবং শুক্রাচার্য আমাদের রাজ্য ছেড়ে চলে যাবেন, এমনটি নিশ্চয়ই আমি করব না।

শর্মিষ্ঠা শেষবারের মতো রাজমর্যাদায় উঠে বসলেন শিবিকায়। সঙ্গে এক হাজার পরিচারিণী দাসী। শর্মিষ্ঠা দেব্যানীর সামনে পালকি থেকে নেমে পিতার ইচ্ছামতো দেবযানীকে বললেন– দেবযানী! এই এক হাজার দাসীর সঙ্গে আমিও তোমার পরিচারিকা দাসী হলাম– অহং দাসী-সহস্রেণ দাসী তে পরিচারিকা। তোমার পিতা যেখানে তোমাকে কন্যাদান করবেন, এই হাজার দাসীর সঙ্গে আমিও সেখানে তোমার পিছন পিছন যাব। দেবযানী এবার শর্মিষ্ঠার কথা উলটে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন- তুমি না বলেছিলে– আমি স্তাবক, যাচক এবং প্রতিগ্ৰহজীবীর মেয়ে, আর তুমি হলে সদাসংস্তুত দানী বাবার মেয়ে, তা হলে কোন লজ্জায় তুমি আমার দাসী হবে শুনি– স্মৃয়মানস্য দুহিতা কথং দাসী ভবিষ্যসি? শর্মিষ্ঠা এই ঝগড়ার কথার মধ্যেই গেলেন না। বললেন আমার বিপন্ন আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বন্ধু পিতা যাতে বিপন্মুক্ত হন, সেজন্য যে কোনও রকম কাজ আমি করতে রাজি যেন কেনচিদাৰ্তানাং জ্ঞাতীনাং সুখমাবহেৎ। আর ঠিক সেইজন্যই দাসীর মতোই অনুগমন করতে আমার কোনও বাধা নেই।

শর্মিষ্ঠার প্রতিবচন দেবযানী কতটা বুঝলেন জানি না, তবে শর্মিষ্ঠার এই কথাগুলির মধ্যেও যে রাজোচিত প্রত্যয় ছিল, সেকথা দেবযানীর পক্ষে সত্যিই বোঝা সম্ভব হয়নি। দেবযানী বুঝলেন না– যে প্রত্যয় নিয়ে শর্মিষ্ঠা তাঁকে অপমান করে কুয়োয় ফেলে দিয়েছিলেন, আজ সেই প্রত্যয়েই রাজকন্যার শিবিকা থেকে নেমে দেবযানীর দাসী হলেন শর্মিষ্ঠা। দেবযানী বসে থাকলেন পিতৃ-গৌরবের অভিমানমঞ্চে। তার নিজের কোনও ক্ষমতা নেই, অথচ যে পিতার ক্ষমতার ভিত্তিতে তার এত গৌরব এত আড়ম্বর, সেই পিতা যখন তাঁকে ক্রোধ এবং ক্ষমার তত্ত্ব বুঝিয়েছিলেন, তখনও তিনি বোঝেননি, আবার যখন পিতা এসে বৃষপর্বার কাতর আবেদনটুকু জানিয়েছিলেন, তখন পিতাকেই তিনি বলেছিলেন আমি তোমার কথায় বিশ্বাস করি না। অন্যদিকে শর্মিষ্ঠার ব্যক্তিত্ব দেখুন। তিনি পূর্বে দেবযানীকে অপমান করে ভয়ও পাননি, নিজেদের ঝগড়ার কথা পিতাকেও জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। কিন্তু রাজকন্যা বলে পিতার গৌরবে সেদিন দেবযানীর সঙ্গে ঝগড়া করলেও, আজ যখন তিনি দেবযানীর দাসী হলেন, তখন পিতার রাজোচিত গৌরব অতিক্রম করে আপন গৌরবে প্রতিষ্ঠিত হলেন, প্রতিষ্ঠিত হলেন নিজের প্রত্যয়ে।

দেবযানী শর্মিষ্ঠার এই একান্ত আপন গৌরব এবং তাঁর ব্যক্তিগত মর্যাদা কিছুই বুঝলেন না। পিতার ব্রাহ্মণ্য এবং গুরুগৌরবের ওপর ভরসা করে প্রথমে যেমন তিনি ঝগড়া আরম্ভ করেছিলেন, আজও সেই পিতৃগৌরবের মঞ্চে বসে শর্মিষ্ঠার দাসীত্ব-ভাবনাতেই তিনি পরম তুষ্ট বোধ করলেন। পিতাকে তিনি বললেন– এখন আমি সন্তুষ্ট হয়েছি পিতা, এবার আমি বৃষপর্বার রাজধানীতে প্রবেশ করতে পারি– প্রবিশ্যামি পুরং তাত তুষ্টাস্মি দ্বিজসত্তম।

পিতা অসুররাজ বৃষপর্বার স্বার্থে, পিতার রাজ্যের স্বার্থে এবং আত্মীয় পরিজন অসুরদের স্বার্থে রাজকন্যা শর্মিষ্ঠা দেবযানীর অনুবৃত্তি করতে আরম্ভ করলেন দাসীর মতো। অনুবৃত্তির নমুনা হিসেবে কালিদাস রঘুবংশে লিখেছিলেন– দাঁড়িয়ে পড়লে পঁড়ানো, চললে চলা, এমনকী তিনি জল খেলে জল খাওয়া– এই রকমভাবে অনুগমন করা যায় ছায়ার মতো। শর্মিষ্ঠাও প্রায় সেইভাবেই অনুগমন করছেন দেবযানীর। সেদিন কী খেয়াল হল, দেবানী আপন কৌতুকে সেই বনভূমিতে এসে উপস্থিত হলেন, যেখানে শর্মিষ্ঠা তাকে ফেলে দিয়েছিলেন কুয়োয় এবং যেখানে মহারাজ যযাতি তাঁর হাত ধরে উদ্ধার করেছিলেন কুয়ো থেকে। হয়তো দেবযানী বোঝাতে চেয়েছিলেন শর্মিষ্ঠাকে একবার বুঝে দ্যাখ, যে জায়গায় তুই আমাকে কুয়োয় ফেলে মারতে চেয়েছিলি, সেই বনভূমির মধ্যেই আজ তোকে আমার পিছন পিছন ঘুরতে হচ্ছে দাসীর মতো। অবশ্য এ ছাড়াও অন্য একটি কৌতুককর রোমাঞ্চও তাঁর মন জুড়ে থাকতে পারে। ভেবে থাকতে পারেন– যে মানুষটি তাকে একবার হাত ধরে কুয়ো থেকে তুলে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন, সেই মানুষটির সঙ্গে আবার যদি একবার দেখা হয়। এই বনভূমির মাঝখানে, উতল হাওয়ায়।

ঘটনাটা একেবারেই কাকতালীয় বলতে হবে। নইলে একই জায়গায় মহারাজ যযাতি আবারও এসে পৌঁছলেন কী করে? দেবযানী সেদিন প্রচুর সাজসজ্জা করেছিলেন। পুরাতন কষ্টস্পর্শী জায়গার স্মৃতি সুসময়ে বড়ই সুখ দেয়। দেবযানীও আজ চরম মানসিক সরসতার মধ্যে আছেন। এক হাজার দাসী নিয়ে শর্মিষ্ঠা তার পিছনে ঘুরঘুর করছে। কেউ খেলা করছে, কেউ বন্য ফল ছিঁড়ছে, কেউ খাচ্ছে, কেউ চিবোচ্ছে, আবার কেউ বা বন্য মধুপুষ্পের নিষ্যজাত মদিরা পান করছে– ক্রীড়ন্ত্যোভিরতাঃ সর্বাঃ পিবন্ত্যো মধুমাধবীম। দেবযানী এবং শর্মিষ্ঠাও এই বনভব ক্রীড়ারস থেকে সরিয়ে রাখেননি নিজেদের। দেবযানীর ‘মুড’ আজকে খুব ভাল। আজকে শর্মিষ্ঠার সাজগোজেও তার আপত্তি হয়নি এবং আজকে তার সঙ্গে একত্রে বসে একাসনে নয় কিন্তু বন্য পুষ্পসব পান করতেও তাঁর দ্বিধা হচ্ছে না যতক্ষণ অন্তরের শিরা-উপশিরা ভরি নাহি উঠে।

এমন সময়ে কী কাকতালীয় ঘটনা, মহারাজ যযাতি মৃগয়ার শ্রমে ক্লান্ত হয়ে জলপানের আশায় ঘুরতে ঘুরতে ঠিক সেইখানেই এসে উপস্থিত হলেন, যেখানে বসে আছেন শর্মিষ্ঠা এবং দেবযানী– তমেব দেশং সপ্রাপ্তো জলার্থী শ্রমকর্ষিতঃ। নির্জন বনভূমির মধ্যে হঠাৎ এই ব্যাকুল বিভ্রমে মেতে-ওঠা রমণীসমাজ দেখে মর্ত্যভূমির রাজা যযাতি একটু হতচকিত হয়ে গেলেন। তিনি দেখলেন একটি রত্নখচিত উৎকৃষ্ট আসনের ওপর দেবযানী বসে আছেন। আর তার থেকে একটু নিচু আসনে বসে আছে আরও একটি মেয়ে– সমস্ত মেয়ের মধ্যে তাকেই দেখতে সবচেয়ে ভাল রূপেনাপ্রতিমাং সাং স্ত্রীণাং মধ্যে বরাঙ্গনাম। সেও একটি সোনার আসনে বসে আছে বটে, কিন্তু তার আসন নিচুতে এবং সে উপরিস্থার পা টিপে দিচ্ছে, তবু মুখে তার ভুবন ভোলানো হাসিটুকু লেগেই আছে– দদর্শ পাদৌ বিয়াঃ সংবহন্তীমনিন্দিতাম।

আসলে শর্মিষ্ঠা মানুষটাই অমনই। যখন তিনি দেবযানীকে সকারণে অপমান করেছিলেন, তখনও তিনি কারও তোয়াক্কা না করেই নিজের অনুভব সিদ্ধিতে কাজ করেছেন। আজ যখন তাকে দাসীবৃত্তি করতে হচ্ছে এবং আজ যখন তিনি বুঝতে পারছেন যে, দেবযানী সচেতনভাবেই এই পুরাতন বনভূমিতে নিয়ে এসেছেন তার পুরাতন ক্ষতে ক্ষারক্ষেপণের জন্য, তখনও সেই অপমানকর অভিসন্ধিটুকুও শর্মিষ্ঠা গ্রহণ করেছেন একেবারে ‘স্পোর্টিং স্পিরিটে’। আজকে তিনি দেবযানীর পাও দাবাচ্ছেন আবার হাসছেনও নিষগ্নাং চারুহাসিনীম্।

এতক্ষণ যেসব সখী-দাসীরা হাসছিল, খেলছিল, নাচছিল আর বাদ্যি বাজাচ্ছিল, যযাতিকে দেখেই তারা সব থেমে গেল। লজ্জায় নামিয়ে নিল সব মুখ। এমন হঠাৎ নিস্তব্ধতার মধ্যে আগন্তুককে প্রশ্ন করতেই হয়। অতএব যযাতি প্রশ্ন করলেন– দু’ হাজার মেয়ে আপনাদের দুটি মেয়েকে ঘিরে রয়েছে। কে আপনারা? আপনাদের নাম কী, পরিচয় কী? এখানে কে উত্তর দেবেন, দেবযানী থাকতে। তিনি তার উচ্চাসনের মর্যাদা বুঝিয়ে দিয়ে বললেন– আমি দেবযানী। অসুরদের গুরু শুক্রাচার্য, আমি তার মেয়ে। আর এই যে দেখছেন আমার পা টিপে দিচ্ছে– ও অসুররাজ বৃষপর্বার মেয়ে আমার সখীও বটে দাসীও বটে। শর্মিষ্ঠার ব্যাপারে যতখানি তাচ্ছিল্য করা যায় ঠিক ততখানিই করলেন দেবযানী। যদি বা সখিত্ব এবং দাসিত্বের মধ্যে সখিত্বের অংশটুকু বেশি করে ধরেন আগন্তুক, তাই শর্মিষ্ঠার পরিচয় আরও একটু নামিয়ে দিয়ে বললেন– আমার সখীও বটে, দাসীও বটে, তবে যেখানে যেখানে আমি যাব, সেখানে সেখানেই ও আমার পিছন পিছন যাবে– ইয়ঞ্চ মে সখী দাসী যত্ৰাহং তত্র গামিনী।

আসলে দেবযানী বুঝতে পারছিলেন যে তার নিজের চেয়ে শর্মিষ্ঠা রাজার চোখে পড়েছে বেশি। তা ছাড়া, মহাভারতের কবি যদিও স্পষ্ট করে বলেননি বটে, কিন্তু আমাদের মনে হয়– যযাতিকে দেবযানী দেখেই চিনতে পেরেছিলেন। কেননা পুরুষ চিনতে দেবযানীর ভুল হয় না। দেবযানীর উত্তরে রাজা একটুও খুশি হলেন না। যে মেয়েটিকে তার পছন্দ, তাকে দাসী বলে অপমান করা হচ্ছে শুধু ব্রাহ্মণত্বের অভিমানে, দেবযানীর এই সাহংকার প্রত্যুক্তি মেনে নিতে পারলেন না যযাতি। তিনি বলে উঠলেন– এ আবার কেমন কথা। আমার তো ভারী আশ্চর্য লাগছে শুনে যে, অসুররাজ বৃষপর্বার এই পরমা সুন্দরী মেয়েটি কিনা তোমার দাসী। এ কেমন কথা হল– কথং নু তে সখী দাসী কন্যেয়ং বরবৰ্ণিনী।

যযাতি এবার শর্মিষ্ঠার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। বললেন– স্ত্রীলোকের এমন সুন্দর চেহারা এই পৃথিবীতে আমি দ্বিতীয়বার দেখিনি– নৈবংরূপা ময়া নারী দৃষ্টপূর্বা মহীতলে। ইনি দেবীও নন, গন্ধর্বীও নন, যক্ষীও নন, কিন্নরীও নন, অথচ মানুষের এমন সুন্দর চেহারা হয়! কেমন লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো টানা-টানা চোখ, এঁর ভাব-সাব-লক্ষণ দেখেও তো একবারও মনে হয় না যে, ইনি কারও দাসী হতে পারেন। অথচ তুমি বলছ–ইনি তোমার দাসী। হবেও বা। তবে এমন মানুষ দাসীত্ব করলে বুঝতে হবে হয় ভাগ্যের পরিহাস, নয়তো ইনি স্বেচ্ছায় তপস্যা করে তোমার দাসী হয়েছেন, নইলে এমন চেহারার মানুষ দাসী হয় নাকি অন্যথৈবানবদ্যাঙ্গী কথং দাসী ভবিষ্যতি?

দেবযানীর ধৈর্য লুপ্ত হচ্ছিল। প্রশংসা পাওয়া তার স্বভাব, প্রশংসা না করলে জোর করে, ঝগড়া করে, অভিশাপ দিয়েও প্রশংসা আদায় করা তার স্বভাব। মহারাজ যযাতি তাকে চরম আঘাত দিলেন আরও একটি কথা বলে। এক প্রগলভা আত্মসর্বস্ব রমণীর পাশে নতমুখে নিম্নাসনে বসে থাকা এক অনুপমা রমণীকে পাদসম্মাহন করতে দেখে রাজা যযাতি একেবারেই সহ্য করতে পারেননি। বিশেষত অসুররাজার মেয়ের মধ্যে তার নিজগৃহের রাজত্বগন্ধ আছে। আর সেইরকমই এক রাজবাড়ির মেয়ে কিনা দাসীবৃত্তি করতে বাধ্য হচ্ছে। শর্মিষ্ঠা সম্বন্ধে দেবযানীর সাহংকার উক্তিতে রাজা তাই একটুও সুখী হতে পারেননি এবং দেবযানীকে সরাসরি প্রত্যাঘাত করে বলে ফেললেন– দেখো। তুমি সুন্দরী বটে, কিন্তু এই মেয়েটির সৌন্দর্যের কাছে তোমার সৌন্দর্য কিছুই নয়– অস্যা রূপেণ তে রূপং ন কিঞ্চিৎ সদৃশং ভবেৎ। কিন্তু কী আর করা যাবে, সবই কপাল। নিশ্চয়ই এঁর পূর্বজন্মের পাপ ছিল, নইলে এমন দশা হবে কেন?

অন্য কোনও সময় এমন মুখের ওপর কথা শুনলে দেবযানী কী করতে পারতেন, আন্দাজ করা যায়। আবার পিতা শুক্রাচার্যকে ধরে গুরুতর অভিশাপ দেওয়াতেন নিশ্চয়। কিন্তু এখন সে সময় নয়। রাজা শর্মিষ্ঠাকে পছন্দ করলে কী হবে, দেব্যানী যে রাজাকেই পছন্দ করে ফেলেছেন। অতএব তাঁর যখন পছন্দ হয়েছে, যেভাবে হোক এই পুরুষমানুষটিকে আত্মসাৎ করবেনই। তাই রাজার মুখে নিজের সৌন্দৰ্য্য সম্বন্ধে অমন অপমানকর উক্তি শুনেও তিনি তা সম্পূর্ণ হজম করে নিলেন। শর্মিষ্ঠা কেমন করে তার দাসী হলেন, সেই বিশ্লেষণের মধ্যেও গেলেন না, কেননা তাতে তার নিজের দোষ রাজার কাছে প্রকট হয়ে উঠতে পারে। অতএব রাজার সমস্ত কৌতূহলে জল ঢেলে দিয়ে দেবযানী বললেন– সকলেই বিধির বিধান অনুসারে চলতে বাধ্য হন, রাজা। কাজেই এও বিধির বিধান, এ বিষয়ে বেশি কথা বলে আর লাভ আছে কিছু– মা বিচিত্রাঃ কথাঃ কৃথা। তার চেয়ে আপনার কথা বলুন– আপনার এই রাজবেশ, অথচ বৈদিক ভাষা, আচার-বিচারের সঙ্গেও বেশ পরিচয় আছে। মনে হচ্ছে। তা আপনার নাম কী, কোন দেশেরই রাজা আপনি?

যযাতি নিজের পরিচয় দিলেন। নামও বললেন। এরপর দেবযানী একবার রাজাকে তার আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করেছেন শুধু এবং রাজা যেন কেমন বুঝতে পারছিলেন এ মেয়ের গতিক ভাল না। তিনি আর কাল বিলম্ব না করে যাবার অনুমতি চাইলেন দেবযানীর কাছে। বললেন– অনেক তো হল, অনেক প্রশ্ন করলেন, এবার অনুমতি করুন– বহুধাপ্যনুযুক্তোহস্মি তদনুজ্ঞাতুমর্হসি। আর যাবেন কোথায় রাজা! দেবযানী সঙ্গে সঙ্গে বললেন– এই দু’হাজার দাসী এবং শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে আমরা সবাই আপনার অধীন হলাম, রাজা। আপনি আমার চিরকালের সখা হোন এবং আমার স্বামীও হোন– ত্বদীনাস্মি ভদ্রং তে সখা ভর্তা চ মে ভব।

স্বামীর সঙ্গে যে সখ্য সম্বন্ধ স্ত্রীলোকের মর্যাদার দৃষ্টিতে সে বড় উচ্চমার্গের কথা। কিন্তু দেবযানী যে এ কথা বলেছেন, তার মধ্যে অন্য ধরনের এক সচেতনতা আছে। এ যদি শুধুই এক মনোমুগ্ধকর প্রেমের বশে আত্মনিবেদন হত, তা হলে এই সখ্যসম্বন্ধের অন্য মাত্রা তৈরি হত, সে মাত্রায় যুক্ত হত কবির প্রেরণা চিরজনমের সখা হে– অথবা পরাণ-সখা বন্ধু হে আমার। কিন্তু আমরা দেবযানীকে চিনি। তিনি মুখে যতই রাজার অধীনতা স্বীকার করুন, সে আত্মনিবেদন একেবারেই মৌখিকতা, মৌখিক বিলাসিতা। আত্মনিবেদন করার সময়েও তিনি মনে রাখেন যে, গুরু শুক্রাচার্যের মেয়ে তিনি। ভর্তার সঙ্গে চিরসম্বন্ধের মধ্যেও বন্ধু যেমন বন্ধুর সঙ্গে সমানে সমানে মেশে দেবযানী সেই সমতাটুকু জিইয়ে রাখতে চাইলেন আপন গুরুগৌরবের সচেতনতায়।

রাজা যযাতি যেমন অবাক হলেন, তেমনই ফাঁপরে পড়লেন। একটি যৌবনবতী রমণী হঠাৎ প্রেম নিবেদন করলে, তার মুখের ওপর প্রত্যাখ্যান-শব্দও উচ্চারণ করা যায় না, আবার এ-কথাও তাকে বলা যায় না যে, দেখো বাপু। তোমার রূপ-গুণ, আচার-ব্যবহারও আমার পছন্দ হয়নি। অতএব ওসব বিয়ে-টিয়ে সম্ভব নয়। রাজা উলটো পথ ধরলেন। ব্রাহ্মণ গুরু শুক্রাচার্যের মেয়েকে পরম গৌরব দিয়ে বললেন– দেখো দেবযানী। তোমার ভাল হোক, কিন্তু আমি তোমায় বিয়ে করতে পারছি না- বিদ্ধ্যেশনসি ভদ্রং তে ন ত্বমহেহস্মি ভাবিনি। আমি ক্ষত্রিয় রাজা, আমার সঙ্গে ব্রাহ্মণ শুক্রাচার্য তার মেয়ের বিয়ে দিতে পারেন। বর্ণশ্রেষ্ঠ বলে চিহ্নিত ব্রাহ্মণ-কন্যার সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের বিয়ে পণ্ডিতরাও অনুমোদন করবেন না।

দেবযানী মহারাজ যযাতির কথা পড়তে দিলেন না। প্রথম যৌবনে তিনি বৃহস্পতি-পুত্র কচকে নিজের প্রেমজালে আবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন; পারেননি। আসলে দেবযানী প্রেমে পড়েননি, পিতার গৌরবে নিজের অহমিকার জালেই তিনি তাকে আবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন; পারেননি। তাই তিনি এবারে আর সুযোগ হারাতে চান না। কচ তাকে অভিশাপ দিয়ে রেখেছেন– কোনও ঋষি বা ঋষিপুত্রের সঙ্গে তার বিয়ে হবে না। যযাতি রাজা এবং রাজপুত্র। ব্রাহ্মণ না হোন, অন্তত ব্রাহ্মণের পরের বর্ণ তো বটে, এঁকে তিনি ছেড়ে দিতে পারেন না। এইরকম একটা নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি থেকেই দেবযানী যযাতির কথার উত্তর দিয়ে বললেন- তাতে কী আছে, মহারাজ! ব্রাহ্মণের সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের, ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে ব্রাহ্মণের সম্বন্ধ তো চিরকালের সংসৃষ্টং ব্ৰহ্মণা ক্ষত্রং ক্ষত্ৰেণ ব্ৰহ্ম সংহিত। আর আপনি আমার কাছে ঋষিও বটে ঋষিপুত্রও বটে।

মহারাজ যযাতির কোন পূর্বপুরুষ ঋষি ছিলেন, অথবা কোন সুবাদে তিনি ঋষি হতে পারেন, তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু প্রণয়-বাচনিক ব্যবহারে রাখালও তো রমণীর মৌখিক সরস্তায় রাজপুত্র হয়ে ওঠে অথবা পুরুষের কল্পভাষায় কত সাধারণীও তো স্বর্গসুন্দরী। অতএব সেই ভাষায় দেবযানী যখন যযাতিকে বলেন– প্রিয় আমার! তুমিই আমার কাছে ঋষি, তুমিই আমার ঋষিপুত্র, তুমি বিয়ে করে নিয়ে যাও আমাকে– ঋষিশ্চ ঋষিপুত্রশ্চ নাহুষাঙ্গ বহস্ব মাম– তখন এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, মহাভারতের টীকাকারদের ব্যাখ্যানুযায়ী এখানে ঋষি বলতে ঋষি-প্রতিম রাজর্ষি বুঝতে হবে, অথবা বহু পূর্বপুরুষের ঋষিত্ব প্রমাণ করে যযাতির ব্যাপারে দেবযানীর বচন প্রমাণ করতে হবে। আমরা মহাকাব্যের সমন্বয়িনী বুদ্ধিতে দেবযানীকে যতটুকু চিনেছি, তাতে তার এই প্রিয় সম্বোধনের মধ্যে তাঁর পূর্ব-প্রণয়ী বাৰ্হস্পত্য কচের প্রতি অধিক্ষেপ ছাড়া আর কিছু ছিল না। কচ বিরক্ত হয়ে দেবযানীকে অভিশাপ দিয়েছিলেন– কোনও ঋষিপুত্র তোমার স্বামী হবে না কোনও দিন– ঋষিপুত্রো ন তে কশ্চিজ্জাতু পাণিং গ্রহীষ্যতি। আজ যযাতিকে যখন দেবযানী প্রায় বৈবাহিক শৃঙ্খলের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছেন, অথচ যযাতি এখনও ব্রাহ্মণ-কন্যার সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের বৈবাহিক নিষেধের শাস্ত্রযুক্তি শোনাচ্ছেন, তখন প্রিয়-সম্বোধনে দেবযানীর সাফ কথা– ওসব আমি জানি না যাও, তুমিই আমার ঋষি, তুমিই আমার ঋষিপুত্র– কচের অভিশাপ যেন এই প্রিয় সম্বোধনে এক মুহূর্তে উড়িয়ে দিলেন দেবযানী।

ঋষি-ঋষিপুত্রের এই দ্বন্দ্বটা তবু ঘুচে যায়, কিন্তু ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের প্রতিলোম-বিবাহের শাস্ত্রীয় যুক্তিটা দেবযানী যেভাবে লঘু করে দিলেন, সেখানে সমাজের প্রখর বাস্তবতাই সবচেয়ে বড় যুক্তি হয়ে ওঠে। কেননা শাস্ত্রযুক্তি যতই প্রাতিনোম নিষেধ করুক, যতই বলুক বর্ণসংকরের ফলে শাস্ত্রীয় নরকের যন্ত্রণার কথা, কিন্তু পুরুষ-রমণীর প্রেম-ভালবাসার চিরন্তন জগৎ তো এমনই যেখানে বর্ণসংকরের যুক্তি খাটে না। ফলে অগস্ত্যের মতো ঋষির সঙ্গে রাজকুমারী লোপামুদ্রার যেমন বিয়ে হয়, বশিষ্ঠের সঙ্গে শূদ্রাণী অক্ষমালার যেমন আনুলোম্যে বিবাহ হয়, তেমনই প্রতিলোম বিবাহেরও অন্ত নেই ভারতবর্ষে, কিন্তু শাস্ত্রকারেরা এই বিষয়ের সামাজিক বিরুদ্ধতা স্মরণ করেই এই প্রণয়-বিবাহের কথা উদাহরণ হিসেবেও বলেন না, বলতে চান না। দেবযানী সেই বাস্তবতার যুক্তিতে প্রণয়-বিবাহের যুক্তিটুকুই শুধু বুঝিয়েছেন, তা আমরা মনে করি না। বস্তুত ব্রাহ্মণ্যের সঙ্গে ক্ষত্রিয়তার মাখামাখি এবং ক্ষত্রিয় ভাবনার সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যের মাখামাখি– শব্দগুলো দেখুন– সংসৃষ্টং ব্ৰহ্মণা ক্ষত্রং ক্ষত্রেণ ব্ৰহ্ম সংহিত– এই মাখামাখির মধ্যে সমাজের একটা সমসাময়িকতা আছে।

পণ্ডিতেরা জানিয়েছেন– বৈদিক কাল থেকে মহাভারতের কাল পর্যন্ত সময়ে ব্রাহ্মণ্য এবং ক্ষাত্রশক্তির পারস্পরিক নির্ভরতাতেই রাজনীতি, সমাজনীতি এমনকী অর্থনীতিও তৈরি হয়েছিল। ব্রাহ্মণেরা আইন তৈরি করতেন সেই আইন প্রয়োগ করতেন ক্ষত্রিয়েরা। এই পারস্পরিকতার মধ্যে নিজেদের স্বার্থরক্ষার ভাবনাও তারা যথেষ্ট করতেন বলেই সমাজের অধমাংশ এবং স্ত্রীলোকেরাও অনেক সময় পীড়িত হতেন বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। আবার ব্রাহ্মণ্য এবং ক্ষাত্র-শক্তির পারস্পরিক স্বার্থ-প্রতিপূরণের মধ্যে ঐহিক লাভ অনেক সময় বাস্তবসঙ্গত কারণেই বড় হয়ে উঠত বলে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মধ্যে সংঘাত সংঘর্ষও হত মাঝে মাঝে। পণ্ডিতেরা এই বিষয়ে বশিষ্ঠ এবং বিশ্বামিত্রের বিবাদের উদাহরণ দেন, উদাহরণ দেন নিমি রাজার এবং আরও অনেকের, যেখানে ব্রাহ্মণ্য এবং ক্ষাত্র শক্তি একে অপরের বিপক্ষে গেছে। কিন্তু ভারতবর্ষের বিশাল পরম্পরাবাহী বর্ণাশ্রমের ইতিহাসে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের বিরোধ দৃষ্টত যাই থাকুক এবং পণ্ডিতেরা গবেষকের আত্মপ্রমাণমুখর ভাবনায় যতই এই বিরোধ প্রমাণ করুন, ইতিহাসের সত্য এই যে, ভারতবর্ষে রাজনৈতিক শক্তি পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় দুই পক্ষেরই অবদান ছিল এবং এই দুই পক্ষই পরস্পরকে সবচেয়ে বেশি সমঝে চলত। ফলে ঝগড়া-বিবাদের জায়গা ছিল কমই এবং সামাজিক ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের বিবাহের শাস্ত্রীয় অনুমোদন না থাকলেও উচ্চবর্ণ হিসেবে এই দুয়ের পরম্পরাপেক্ষা এতটাই বেশি ছিল যে বিবাহের ব্যাপারে প্রতিলোম্যও খুব ভয়ংকরী বাধা হয়ে ওঠেনি কখনও। এই দিক থেকে দেবযানীর আশ্বাস বচন বা বিবাহের যুক্তি ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের পারস্পরিক শক্তিকেন্দ্রিক সহাবস্থান সবচেয়ে নিষ্ঠুর সত্য হিসেবে প্রকট করে তোলে। রাজনৈতিক এবং সামাজিক শক্তি-প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই দুই উচ্চবর্ণের পারস্পরিক সহায়তা বৈশ্য-শূদ্র এবং স্ত্রীলোকের সামাজিক, অর্থনৈতিক তথা পারিবারিক উৎপীড়ন তৈরি করত কিনা, তার বিস্তৃত আলোচনার পরিসর এটা নয়, কিন্তু ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের সামাজিক মাখামাখির কথাটা দেবযানী যেভাবে, যে ভাষায় বলেছেন ঠিক সেইভাবে সেই একই ভাষায় মহাভারতের অন্যত্রও উল্লিখিত হয়েছে। যুদ্ধপূর্ব সময়ে পরস্পরের রাজনৈতিক শক্তি এবং অবস্থান বুঝে নেবার জন্য। ইতঃপূর্বে অসুররাজ বৃষপর্ব এবং ব্রাহ্মণ শুক্রাচার্যের মধ্যে যে বিবাদ তৈরি হয়েছিল, তা যেভাবে মিটিয়ে ফেলা হল, সেটা থেকেই ব্রাহ্মণ্য এবং ক্ষাত্রশক্তির পারস্পরিক আনুকূল্যবিধানের চিত্রটা খুব পরিষ্কার হয়ে যায়। দেবযানী সেই পারস্পরিক আনুকূল্যের ভাবনাটা খুব সরলভাবে আপন বৈবাহিক যোজনায় প্রয়োগ করছেন এই মুহূর্তে।

যে বিবাহ যযাতি করতে চাইছেন না জীবন-যাপনের সুস্থিরতার জন্য, সেখানে দেবযানীর এই স্নিগ্ধ সমাধানে যযাতি খুব পুলকিত বোধ করলেন না। বরঞ্চ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের প্রতিবোম বিবাহের ফলে যে সামাজিক এবং পারিবারিক সংকট তৈরি হয়, তার একটা যথার্থ সামাজিক কারণ তিনি নির্ণয় করেছেন। যযাতি বলেছেন– হ্যাঁ, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মধ্যে একটা আন্তরিক সম্বন্ধ আছে বটে, তবে শাস্ত্রীয় যুক্তিতে সে-সম্বন্ধ তো সব বর্ণের মধ্যেই থাকার কথা, কেননা শ্রুতিবাক্য অনুসারেই তো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র– এই চতুবর্ণই সেই বিরাট সহস্ৰশীর্ষা পুরুষের মুখ, বাহু, উরু, চরণ থেকে সৃষ্ট হয়েছে– একদেহোবা বর্ণাশ্চত্বারোহপি বরাঙ্গনে– কিন্তু সমস্যাটা আসলে অন্য জায়গায়। সমস্যাটা শুচিতার বোধ নিয়ে, সমস্যাটা বর্ণভেদে প্রত্যেক বর্ণের আচার-বিচারের বোধ নিয়ে, সমস্যাটা প্রত্যেক বর্ণের পরম্পরা-বাহিত স্বধর্মবোধ নিয়ে এখানে প্রত্যেকটি বর্ণই একের থেকে অন্যে এমন বেশি মাত্রায় পৃথক এবং ব্রাহ্মণেরা সেখানে এমনই উচ্চস্থানে বিচরণ করেন যে, সমস্যাগুলি ভয়ংকর আকার নেয়– পৃথগৃধর্মাঃ পৃথক্‌শৌচাস্তেষ্কন্তু ব্রাহ্মণণা বরঃ।

যযাতি তার আপন বিবাহ-সংকটের মুহূর্তে যে সামাজিক সত্য উচ্চারণ করেছেন, তার চেয়ে বড় সত্য বোধহয় আর কিছু হতে পারে না। ভারতবর্ষের সমাজে আধুনিকতার সংক্রমণ এবং সেই সূত্রে বিবাহের সময় বর্ণধর্মের যত অতিক্রম ঘটেছে, তাতে প্রত্যেকটি অতিক্রমী বিবাহের মধ্যে কী ধরনের অশান্তি হত বা এখনও তা হয়, সেটা যারা জীবন দিয়ে বুঝেছেন, তারাই জানেন যে, ‘অজাতে’ ‘কুজাতে বিয়ে করার কী ফল হয়। এক্ষেত্রে পূর্বস্বীকৃত অনুলোম বিবাহ, যেখানে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যরা শাস্ত্রীয় বিধিতেই নিজের থেকে নিম্নবর্ণে বিবাহ করতে পারতেন, সেখানে এই ধরনের বিবাহে প্রেম-ভালবাসা-প্রণয়ই সব সময় কারণ হয়ে উঠত এবং এখনও তাই হয়। কিন্তু এই ধরনের প্রণয়জাত বিয়েতেও পিতা মাতারা তাদের ব্রাহ্মণ্যের মৌখিকতা ত্যাগ করতে পারেন না, যদিও বাস্তব জীবনে তারা সন্ধ্যা-বন্দনাদি সামান্য শৌচাচারও পালন করেন না। প্রাথমিক আপত্তি সত্ত্বেও যদি জোর করে যুবক-যুবতীর প্রণয় শেষ পর্যন্ত বিবাহে রূপান্তরিত হয় এবং মাতা-পিতা যদিবা পুত্র বাৎসল্যে মেনেও নেন ছেলেকে, তা হলেও কিছু দিন পর থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত উচ্চতার কথা ভেসে আসতে থাকে নিম্নবর্ণীয়া যুবতীর উদ্দেশে সে-কথা ছেলের মা-বাবাও বলে ফেলেন কখনও, কখনও বা আত্মীয়-স্বজনেরাও বলেন, কেননা তারা বলার জন্যই আছেন– কথায় বলে– বান্ধবাঃ কুলমিচ্ছন্তি।

সামান্য একটু অনুক্রম দিয়ে এইরকম একটা বিবাহ-ঘটনার বাস্তব চিত্র উদ্ধার করে জানাই যে, এক্ষেত্রে এক ব্রাহ্মণ বালক একটি শূদ্র মেয়ে বিয়ে করে এনেছিল এবং তাদের বউভাতের দিন আত্মীয়-স্বজনেরা এমন বিচিত্র কৌতূহলে সদলবলে উপস্থিত হলেন যেন চিড়িয়াখানায় শিম্পাঞ্জি দেখতে এসেছেন। কৌতূহল শান্ত হবার পর ‘টোটালি এমব্যারাসড’ ছেলের মা-বাবাকে তারা সান্ত্বনাও দিয়ে গেলেন– কী আর করবে বলো। ছেলের পছন্দ, তাকে তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। আত্মীয়-স্বজনেরা সকলে এসেছিলেন, সকলেই প্রচুর প্রীতিভোজ উদরসাৎ করলেন, তারপর প্রচুর ঢেকুর তুলতে তুলতে প্রচুর সমালোচনা করতে করতে ছেলের পিতামাতাকে প্রচুর দূষতে দূষতে নিজেদের ব্যাপারে পাক্কা অবস্থান নিয়ে বললেন–আমাদের ছেলেরা যদি এমন করে তবে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিতাম। অমুকদা আর অমুকদি একেবারে অন্ধ হয়ে গেছে।

এরপর আস্তে আস্তে সামাজিক পারিবারিক মেলামেশা চলতে থাকবে আর পদে পদে জাতিবর্ণগত দূষণ চলতে থাকবে। বউ যদি ভুলেও কোনও দিন বলে যে, বাপের বাড়িতে আমি কচুর লতি খেয়েছি, তা হলে শাশুড়ি বলবেন–আমাদের দেশে দেখতুম ওগুলো ছোটলোকেরা খেত। নিচু জাতের বউ যদি শিক্ষিতের বিজ্ঞানময়তায় কথা বলে, তা হলে অল্পবিদ্যার দুষণ তৈরি হবে অবধারিত। তার মধ্যে বউ যদি সুন্দরী হয় এবং তার যদি বিদ্যাবুদ্ধির সামান্যতম গুমরও থাকে, তবে শুনতে হবে– ছিল ভাগাড়ে, পড়েছে জোয়ারে, তাই সহ্য হচ্ছে না। এই যে পৃথক আচার, পৃথক আহার, পৃথক ভাবনা যা প্রত্যেক গৃহেই অন্যরকম, সেটাই দূষণের আধার হয়ে ওঠে তখনই, যখন জাতি-বর্ণের উচ্চাবচ বিপরিণাম ঘটে। অথচ সমান-বৰ্ণতা থাকলে ওই কচুর লতির কথাটাই আজকাল আই. টি. সি. সোনার বাংলার স্পেশাল থালিতে পড়লে উচ্ছ্বসিত হতে দেখেছি কত জনকে। যযাতি এই সমস্ত ব্যাপারগুলিকেই একত্রে ধরে ‘পৃথগধর্মাঃ পৃথক্‌শৌচাঃ’ বলে চিহ্নিত করেছেন।

বস্তুত যযাতির এই বাস্তববোধ আরও বেশি সপ্রমাণ হয়ে ওঠে প্রতিলোম বিবাহের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ একটি উচ্চবর্ণের রমণীর সঙ্গে যদি একটি নিম্নবর্ণের ছেলের বিয়ে হয়। এসব ক্ষেত্রে দেখেছি প্রথম দিকে অতি দজ্জাল শাশুড়িও একটু থতমত অবস্থায় থাকেন। আর দু-চার জন বউকে দেখেছি– দু-চার মাস যেতেই তারা বহুল শুদ্ধাচারের কথা বলেন– তোমাদের বাড়িতে এইরকম হয়, আমার ঠাকুমা থাকলে দেখতে। বামুন ঘরের বিধবা, কত শুদ্ধাচারে থাকেন তিনি। এখানেও আচার, ব্যবহার, আহার নিয়েও অধিক্ষেপ-বাক্য উচ্চারিত হয়। বস্তুত অনুলোমই বলুন আর প্রতিলোম বিবাহই বলুন, বর্ণসংকর মাত্রেই বিবাহের চেয়েও বিবাহোত্তর জীবনের সমস্যা অনেক বেশি এবং সে সমস্যা সবসময়েই ব্রাহ্মাণ্য আচার, ব্যবহার এবং জীবন-যাপনের সামাজিক উচ্চতার মাপকাঠিতেই বিচারিত। কথাটা খুব ভাল ধরেছিলেন সামাজিক-ঐতিহাসিক ম্যাক্স হুবার। The Brahmin and Castes নামক একটি রচনায় তিনি বলেছেন– ভারতবর্ষে জাতিবর্ণের বিভাগ মানেই বিভিন্ন সামাজিক অবস্থিতি এবং এই অবস্থানের নিম্নতা, মধ্যতা অথবা উচ্চতা ঠিক হয় ব্রাহ্মণদের তুলনায় অথবা ব্রাহ্মণরা যে ধর্মীয় সমুদাচার পালন করেন তার তুলনায় একটি বিশেষ বর্ণ কতটা দূরে বা কাছে আছেন সেটা থেকে। মহারাজ যযাতি বলেছিলেন– আমরা একের সঙ্গে অপরে মাখামাখি করি বটে, কিন্তু আমাদের চলমান জীবনের পদ্ধতি, আমাদের আচার-আচরণ এবং শুচিতার বোধ অন্যরকম, অথচ ব্রাহ্মণ সেখানে সবার ওপরে পৃথগৃধর্মাঃ পৃথকশৌচাস্তেষান্তু ব্রাহ্মণো বরঃ। আর এ-বাবদে ম্যাক্স হেবার লিখলেন– Caste, that is, the ritual rights and duties it gives and imposes and the position of the Brahmins, is the fundamental institution of Hinduism.

মহারাজ যযাতি যেভাবে পাকা সমাজ-ঐতিহাসিকদের মতো ক্ষত্রিয় বর্ণের আচার ব্যবহারের পৃথগৃভাব নির্ণয় করে দেবযানীর প্রণয়গ্রহ থেকে বেরোতে চাইলেন, দেবযানী নিজের আসন্ন প্রয়োজনেই তা হতে দিলেন না। তিনি একটি কুমারী মেয়ের গায়ে পুরুষ স্পর্শের প্রসঙ্গ তুলে বিবাহের অনিবার্যতা সপ্রমাণ করে তুললেন।

দেবযানী বললেন– ব্রাহ্মণের ধর্ম, ক্ষত্রিয়ের ধর্ম– এসব কথা থাক। হাতের ধর্মটুকু আপনি স্মরণ করুন, মহারাজা। আপনি যে আমায় হাতে ধরে কুয়ো থেকে তুলেছিলেন। তা এমন কোনও পুরুষমানুষ আছেন– আমায় দেখাতে পারবেন যে একটি মেয়ের পাণিগ্রহণ করে তাকে বিবাহের অধিকার প্রত্যাখ্যান করেছে? আপনি একবার আমার পাণিগ্রহণ করেছেন, আমি ভদ্রঘরের মেয়ে– সেই হাতে আমি আর কোনও পুরুষকে স্পর্শ করতেও পারব না– কথং নু মে মনস্বিন্যাঃ পাণিমন্যঃ পুমান স্পৃশেৎ।

যযাতি মহা-ফাঁপরে পড়লেন। ব্রাহ্মণ্য যে ভয়ংকর বস্তু এবং ব্রাহ্মণ্যকে যে তিনি যথেষ্টই ভয় পান– একথা বারবার জানিয়ে যযাতি বললেন– তোমার পিতা যদি তোমাকে আমার হাতে না দেন, তা হলে আমার পক্ষে সম্ভব হবে না তোমায় বিয়ে করা অহদত্তাঞ্চ চ পিত্রা ত্বাং ভদ্রে ন বিবহাম্যহম। যযাতি ভেবেছিলেন– দেবযানীর হয়তো স্বভাব আছে। পুরুষ দেখলে অভিভূত হওয়া। কিন্তু ব্রাহ্মণ পিতা শুক্রাচার্যের কাছে এই বিবাহের প্রস্তাব গেলেই তিনি সাহংকারে নস্যাৎ করে দেবেন দেবযানীকে এবং ব্রাহ্মণ থেকে হীনবর্ণ বলেই রাজার সঙ্গে দেবযানীর এই বিয়ে তিনি অনুমোদন করবেন না।

ভুল বুঝেছিলেন রাজা। দেবযানীর প্রতি তাঁর পিতার অন্ধ স্নেহের কথা তিনি জানতেন না। কতবার দেবযানীর জন্য তার আপন অলৌকিক ব্রাহ্মণ্য ব্যবহার করতে হয়েছে, তাও তিনি জানতেন না। রাজার কথা শুনেই দেবযানী সোল্লাসে বলে উঠলেন– ও এই কথা। তা হলে পিতাই আমাকে তুলে দেবেন আপনার হাতে। আর আমাকে আপনি ‘অদত্তা’ বলছেন কেন? আমি তো নিজেকে দিয়েই বসে আছি আপনার কাছে,কাজেই আপনি দত্তাকেই গ্রহণ করছেন, অদত্তাকে নয়। কথা বলেই দেবযানী পরিচারিকার দিকে তাকিয়ে বললেন- যা তো ঘূর্ণিকা, তুই আমার ব্রহ্মার সমান পিতাকে ডেকে নিয়ে আয় এখানে। একথাও তাকে বলবি যে, আপনার মেয়ে নাহুষ যযাতিকে নিজেই স্বামী হিসেবে পছন্দ করেছে স্বয়ম্বরে বৃতং শীঘ্রং নিবেদয় চ নাহুম্।

শুক্রাচার্যের কাছে সব খবর গেল। তিনি সব কাজ ছেড়ে তাড়াতাড়ি এসে উপস্থিত সেই বনভূমির মধ্যে। যযাতি যথোচিত মর্যাদায় তার পদবন্দনা করলে দেবযানী বললেন– এই যযাতিই আমাকে হাতে ধরে কুয়োর ভিতর থেকে তুলেছিলেন। আপনাকে প্রণাম– আপনি এঁর হাতেই আমাকে তুলে দিন। আমি আর অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে মানতে পারব না– নমস্তে দেহি মামস্মৈ লোকে নান্যং পতিং বৃণে। যযাতির সামনেই তাঁর মেয়ে যেসব যুক্তিতে নিজের প্রণয় বা আত্মসমর্পণ সযৌক্তিক করে তোলার চেষ্টা করছেন, তাতে একটু বিব্রতই বোধ করলেন শুক্রাচার্য। তিনি অসাধারণ সুন্দর একটি কথাও বললেন। বললেন– দেখো মা! ধর্ম, নিয়ম, আচার– এগুলো এক জিনিস, আর তোমার পছন্দ, প্রিয়ত্ব, প্রণয়– এগুলো আর এক জিনিস। আর ঠিক সেইজন্যই আমাকে না বলেই তুমি তোমার স্বামী ঠিক করেছ। এটা প্রণয়ের পরিসর, আমার কী বলার আছে। তা ছাড়া বৃহস্পতির ছেলে কচ যে অভিশাপ তোমাকে দিয়েছিল, তাতে কোনও ঋষি বা ঋষিপুত্রকে তুমি স্বামী হিসেবে পাবে না। অতএব যাঁকে তুমি স্বামী হিসেবে বরণ করেছ, আমার সম্পূর্ণ সম্মতিক্রমে তিনিই গ্রহণ করুন তোমাকে– গৃহাণেমাং ময়া দত্তাং মহিষীং নহুষাত্মজ।

চিন্তাটা যে এমন উলটো হয়ে যাবে, সেটা মোটেই ভাবেননি যযাতি। তিনি যে সুযোগ খুঁজছিলেন দেবযানীর হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য সে সুযোগ তিনি পেলেন না। শুক্রাচার্যকেও তিনি মিনমিন করে বললেন– এইভাবে বিবাহ হলে বর্ণসংকরের দোষ স্পর্শ করবে না তো আমাকে? এ ব্যাপারে আপনিই আমাকে সঠিক পরামর্শ দেবেন। শুক্রাচার্য নিজের দৈব তেজের ভরসা দিয়ে যযাতিকে বললেন– এই পাপ থেকে আমি তোমাকে মুক্ত করে দেব, মহারাজ– অস্মিন বিবাহে মা গ্লাসীরহং পাপং নুদামি তে তুমি বর্ণসংকরের ভয়ে বিষণ্ণ হয়ো না, মহারাজ! সুন্দরী দেবযানীকে বিয়ে করে তুমি অনন্ত আনন্দ লাভ করো।

এখানে তো সেই গভীর প্রশ্নটা সত্যিই উঠবে। মানুষ তো বলবেই–বাঃ, এ তো বেশ মজা, ব্রাহ্মণ শুক্রাচার্যের নিজের যেই প্রয়োজন হল, তখনই তিনি নিজেদেরই করা নিয়মের দফারফা করে দিলেন। তিনি নিজে বেশ বুঝেছেন যে, তার এই বদমেজাজি অহংকারী মেয়েটির বিয়ে দেওয়া খুব মুশকিল হবে, অতএব সে যখন নিজের বিয়ের ব্যবস্থা নিজেই কোনও মতে করে ফেলেছে, অতএব এই মুহূর্তে আর বর্ণসংকরের দোষটোশ নেই। আর যদি সে দোষ হয়ও, তা হলে আপন আর্য প্রভাবে তিনি তার জামাই রাজাকে সমস্ত অধর্ম থেকে মুক্ত করে দেবেন– অধর্মাত্ত্বাং বিমুঞ্চামি শৃণু ত্বং বরমীপ্সিতম। যুক্তিবাদীরা এখানে প্রশ্ন তুলবেনই যে, তা হলে বর্ণসংকরের ফলে নরকে গতি হবে– এমন কঠিন কথা যে প্রচার করা হয়েছে, সেগুলি কোনও আন্তরিক শাস্ত্রযুক্তি নয়, ব্রাহ্মণ্যের নিজস্ব প্রকোষ্ঠ এবং উচ্চতা বজায় রাখার জন্যই তা হলে এইসব প্রচার। তা না হলে এই প্রাতিষ্ঠানিক সত্য কোনও কাদামাটির পুতুল নাকি যে, অন্য জনের ভাব-ভালবাসায় চরম শাস্তি ঘোষণার জন্য এই নিয়ম ব্যবহার করা হবে, আর নিজেদের প্রয়োজন হলে বলব– আমার মেয়েটাকে বিয়ে করে তুমি আনন্দ রহো বেটা, তোমার সব দোষ আমি ঘুচিয়ে দেব– অহং পাপং নুদামি তে।

আমরা বলব– বর্ণসংকর তা হলে প্রথমত সেই শাস্ত্রীয় চেষ্টা, যাতে উচ্চবর্ণের শুক্র শোণিতের পরম্পরা দুষিত না হয়। যদি বা প্রণয় প্রেমের কাতরতায় বর্ণসংকর ঘটেও, তা উচ্চ-উচ্চতর বর্ণের অনুকূলে নিষ্পত্তি হবে, কেননা মনু-মহারাজ সামাজিক আইনের সেই পরিনিষ্পত্তি ঘটিয়েছেন যেখানে অনুলোম বিবাহ ঘটতে পারে এবং প্রত্যেকটি উচ্চতর বর্ণ স্ববর্ণের পরেই নিম্ন-নিম্নতর বর্ণের রমণীকে কামনা হলেই বিবাহ করতে পারেন, কিন্তু প্রতিলোম বিবাহ চলবে না, তাতে উচ্চতর বর্ণের মর্যাদা লঙ্ঘিত হবে, ব্রাহ্মণ্য লঙ্ঘিত হবে। কিন্তু এইসব কিছুর ওপরে এই মুহূর্তে প্রতিলোম বিবাহের ক্ষেত্রেও আপন সুবিধার্থে স্বয়ং শুক্রাচার্যের মুখে যে ব্রাহ্মণ্য স্বচ্ছন্দাচার দেখলাম, তার একটা ধর্মশাস্ত্রীয় তথা স্মার্ত তাৎপর্য আছে, কেননা স্মৃতিশাস্ত্রের বহুস্থলে আচার প্রমাণের জন্য মহাভারতীয় বচন উদ্ধৃত হয়েছে। লক্ষণীয়, প্রতিলোম বিবাহ স্মৃতিশাস্ত্র একেবারেই মানবে না বলে শুক্রাচার্যের এই মহাবাক্য ভুলেও কোথাও উচ্চারিত হয়নি, কিন্তু কথাপ্রসঙ্গেও যদি এই প্রসঙ্গ ওঠে সেই ভয়ে মহাভারতীয় টীকাকারদের অন্যতম এক আধুনিক টীকাকার এই মন্তব্য করেছেন যে, শুক্রাচার্য তাঁর শাস্ত্রবুদ্ধিতে এটাকে আর প্রতিলোম বিবাহ বলে মনে করেননি। তিনি নাকি ভেবেছেন যে, বাৰ্হস্পত্য কচ যে মুহূর্তে দেবযানীকে অভিশাপ দিয়ে বলেছেন– কোনও ঋষি বা ঋষিপুত্র তোমার স্বামী হবেন না– সেই মুহূর্তেই দেবযানী ব্রাহ্মণত্ব থেকে পতিত হয়ে ক্ষত্রিয়ের পর্যায়ভুক্ত হয়েছেন। রাজা যযাতি এই ঘটনা জানতেন না বলেই তার দিক থেকে যথোচিতভাবেই বর্ণসংকরের শঙ্কা করেছেন, আর শুক্রাচার্য সেটা জানেন বলেই অতি সহজে বলেছেন– এতে তোমার কোনও পাপ হবে না, আর পাপ হলেও সেটা থেকে আমি তোমাকে বাঁচাব। নিজের এবং দেবযানীর বর্ণস্থিতি সম্বন্ধে তার এই মনোভাব ছিল বলেই নাকি তিনি রাজার সামনেই দেবযানীকে বলেছিলেন– তুমি যখন নিজেই এই বিবাহ মনস্থ করেছ, তখন আমার আর কিছু বলার নেই। তা ছাড়া কচও যেহেতু তোমাকে অভিশাপ দিয়েছে, তখন অন্যরকম আর কিছু হবারও সম্ভাবনা নেই– কচশাপাত্ত্বয়া পূর্বং নান্যদৃভবিতুমহতি।

আমরা বেশ বুঝি– শুক্রাচার্যের মানস এইভাবে ভাবনা করাটাও এক ধরনের ব্রাহ্মণ্য সংযোজন। আসলে প্রেম-প্রণয়-ভালবাসার ক্ষেত্রটা মনুষ্যজীবনে এতটাই ব্যক্তিগত বৃত্তি এবং প্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে যে, বিধিনিষেধ আরোপ করে কখনওই শেষ রক্ষা করা যায় না। বিশেষত সেই সমাজেও বর্ণসংকর প্রচুর পরিমাণে ঘটত বলেই উচ্চ-নীচ বর্ণের বিবাহে বর্ণসংকর নিষেধ করা হয়েছে এত। আমরা বরঞ্চ বলব– প্রয়োজন যখন আসে, জীবনের যন্ত্রণামুখর পর্যায়গুলিতে যখন অনিবার্যতার ধর্ম পালন করতে হয়, তখন স্মৃতিশাস্ত্রের বিধিবিধান সব উপদেশের মৌখিকতায় পর্যবসিত হয়। আমাদের মনে হয়– শুক্রাচার্যের বক্তব্যও সেই মর্মেই। ক্ষুরধার বুদ্ধিমান এই মানুষটিকে সারা জীবন এমনই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছে যাতে ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও ব্রাহ্মণ্যের মূলধারা থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন। অসুর-দানবদের গুরু হয়ে তাকে সম্পূর্ণ আয়ুষ্কাল কাটিয়ে দিতে হয়েছে এবং সেটা অবশ্যই চির-আচরিত ব্রাহ্মণ্যের এক বিপরীত কোটিতে বসে। নইলে তিনিই বোধহয় একমাত্র ব্যক্তি যাঁর কথাবার্তা, সমাজ-ভাবনা, নীতিবোধ এবং ব্যক্তিজীবনের সংকটমোচনে তার প্রখর বাস্তবতা-বোধ তাকে অন্যরকম এক গৌরব দান করেছে এবং সে গৌরবও এতটাই যে মূলধারার ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র তার প্রতি চরম সম্মান জানাতে বাধ্য হয়। হয়তো জীবনের ক্ষেত্রে এতটা বৈপরীত্যের মধ্যে চলতে হয়েছে বলেই তিনি বোধহয় বোঝাতে পেরেছেন যে, ব্রাহ্মণ্যের অভিমান দিয়ে জীবন চালানো যায় না, প্রণয়-প্রেম-ভালবাসা যদি ব্রাহ্মণ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তা হলে সেখানে সামাজিক প্রতিকূলতা তৈরি হতে থাকে ব্রাহ্মণ্যের বিরুদ্ধেই। শুক্রাচার্য নিজের চোখে দেখলেন দেবযানী ব্রাহ্মণ্যের স্ফীতিবোধে প্রিয়সখী শর্মিষ্ঠাকে দাসীতে পরিণত করেছিলেন একদিন, কিন্তু আজ নিজের প্রয়োজনে, নিজের প্রণয়সিদ্ধির প্রয়োজনে সেই ব্রাহ্মণ্য তাকে জলাঞ্জলি দিতে হল। শুক্রাচার্য তাই জীবনবোধের সমাধান দিয়েছেন– ওসব পাপ-টাপ কিছুই হবে না বাপু! যদি হয় তো আমি বুঝে নেব– অহং পাপং নুদামি তে। মানে, এইসব বর্ণসংকর, নরক ইত্যাদি কথায় অনেক চক্র আছে, ও সব তোমার বোঝার দরকার নেই, ওসব আমি বুঝে নেবো। তুমি বিয়ে করে বাড়ি যাও।

শুক্রাচার্য বুঝতে পারছিলেন– দেবযানীকে বিয়ে দেওয়া তার পক্ষে মুশকিল হবে। মেয়ের যে রকম স্বভাব, যেরকম স্বাধীন চিন্তাধারা, সেখানে সুপাত্র পাবার বাস্তব অসুবিধে যে ঘটবেই, সেটা তিনি ভাল করেই অনুভব করছিলেন। অতএব এই মর্ত্য রাজা যযাতিকে যখন তাঁর মেয়ে নিজেই পছন্দ করেছে, সেখানে তাকে যথাসম্ভব অভয় দিয়ে বিবাহে প্রবৃত্ত করাটাই তিনি সঠিক মনে করলেন। শুক্রাচার্যের বাস্তব বুদ্ধি সাংঘাতিক। তিনি বুঝেছিলেন যে, রাজার সঙ্গে বিবাহের পরেও দেবযানী শর্মিষ্ঠাকে অবশ্যই নিয়ে যাবেন তার পৃষ্ঠলগ্না দাসীর মতো। কিন্তু শর্মিষ্ঠার রূপ যে একসময় রাজাকে অভিভূত করবে– এ ব্যাপারে অভিমানাচ্ছন্ন দেবযানী সচেতন না হলেও শুক্রাচার্য যথেষ্ট সচেতন। ঠিক সেইজন্য দেবযানীকে যযাতির হাতে তুলে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই শুক্রাচার্য বললেন– বৃষপর্বার এই কুমারী মেয়ে শর্মিষ্ঠাও তোমার সঙ্গে যাবে, মহারাজ। তাকে তুমি সসম্মানে পালন কোরো এবং কখনও যেন তাকে আপন সুখশয্যায় আহ্বান কোরো না- সম্পূজ্যা সততং রাজন্ ন চৈনাং শয়নে হুয়েঃ।

শুক্রাচার্যের কথা মান্য করে যযাতি অসুরগুরুকে সসম্মানে প্রদক্ষিণ করলেন এবং শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুসারে বিবাহ করলেন দেবযানীকে। শুক্রাচার্য প্রচুর যৌতুক দিলেন রাজাকে। রাজাও দেবযানীকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিলেন আপন রাজধানীর দিকে। দেবযানীর পিছন পিছন চললেন তার নিজের এক হাজার দাসী এবং তার পৃষ্ঠগামিনী হলেন শর্মিষ্ঠা আরও এক হাজার দাসী নিয়ে দ্বিসহস্রেণ কন্যানাং তথা শর্মিষ্ঠয়া সহ।

শর্মিষ্ঠাকে দাসিত্বে নিয়োগ করা থেকে আরম্ভ করে স্বামী হিসেবে একজনকে বিবাহ করা পর্যন্ত যা কিছুই ঘটেছে, তার মধ্যে দেবযানীর আত্মাভিমান ছাড়া আর কিছু নেই। পিতা শুক্রাচার্যের অলৌকিক তপঃপ্রভাব তিনি অপব্যবহার করেছেন আত্মাভিমান চরিতার্থ করার জন্যই। একটি রাজাকে তিনি বিবাহ করলেন, সেখানেও তার প্রেম-ভালবাসা ইত্যাদি সুকুমার অনুভব যতটুকু কাজ করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেছে খেয়াল, ইচ্ছে, আত্মতর্পণ। নিজের ইচ্ছে, নিজের ইগো তৃপ্ত হলেই যাঁরা খুশি হন, বন্ধু, স্বামী এবং পরিজন সকলেই এক সময় অত্যন্ত যান্ত্রিকভাবে তাঁদের প্রিয়সাধনের যন্ত্র হয়ে ওঠেন, উলটো দিক থেকে তাদের ভালবাসা পাওয়াটা এইসব রমণীদের ভাগ্যে জোটে না। তবে দেবযানীর মতো রমণীরা এটাকেই ভাগ্য বলে মনে করেন, স্বামী থেকে আরম্ভ করে সকলকেই তিনি নিয়ন্ত্রণ-শাসন করতে পারছেন, এই আত্মতর্পণের মধ্যেই তাঁদের ভালবাসা। কিন্তু এই আত্মতৃপ্তির গৌরব এবং সম্পূর্ণ আত্মসচেতনতা নিয়ে কখনও কাউকে সম্পূর্ণভাবে ভালবাসা যায় না।

.

০৩.

যেদিন নিজের কোনও দোষ ছাড়াই স্নানান্তে দেবযানীর পরিধেয় বস্ত্রখানি নিজের গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিলেন, সেদিন রাজকন্যার ভোলা স্বভাবে একবারও শর্মিষ্ঠা বুঝতে পারেননি যে সেই পরিধেয় বস্ত্রখণ্ড এমন বিপত্তি ঘটাবে তার সমস্ত জীবনে। যার সঙ্গে দেবযানী এতক্ষণ সখীর মতো খেলায় মত্ত ছিলেন, সেই দেবযানী যে হঠাৎ এমন করে সব সখিত্ব গৌণ করে গুরুঠাকুর হয়ে উঠবেন খেলার মাঝখানে, রাজার ঝিয়ারি শর্মিষ্ঠা তা বুঝবেন কেমন করে! ব্রাহ্মণ-গুরু শুক্রাচার্য অসুররাজ বৃষপূর্বার গুরু হয়ে এসেছেন, দেবাসুরদ্বন্দ্বে তিনি অসুরদের প্রভূত উপকার সাধন করেছেন– এ-কথা শর্মিষ্ঠা জানেন। কিন্তু পিতার প্রভুত্বের সুযোগ নিয়ে তার মেয়েটিও যে পরবর্তী প্রজন্মের অকারণ-প্রভু হয়ে উঠেছেন, এটা শর্মিষ্ঠা বুঝতেই পারেননি। রাজগুরু শুক্রাচার্য তাঁর সঞ্জীবনী বিদ্যার প্রভাবে রণক্ষেত্রে মৃতপ্রায় অসুরদের বাঁচিয়ে তোলেন– এ কৃতজ্ঞতায় অসুররাজ বৃষপর্ব শুক্রাচার্যের পালন-পোষণের ভার নিয়েছেন, শুক্রাচার্যের পরিবার-পরিজনও সেই সূত্রে লাভ করেন। গুরুজনোচিত মর্যাদা।

কিন্তু শর্মিষ্ঠা দেবযানীর সববয়সি খেলার সাথী। খেলতে খেলতে কি গুরুর মর্যাদা মনে রাখা যায়। তা ছাড়া তাঁর কাছে তাঁর পিতার গৌরবই বা কম কীসে? তিনি বৃত্তি দিয়ে, অন্নপান দিয়ে, মর্যাদা দিয়ে শুক্রাচার্যকে পালন করছেন– এ তো চোখে দেখা যায়। কিন্তু চোখে দেখা গেলেও রাজবৃত্তির চেয়ে বিদ্যার মূল্য বেশি এ-কথা বালিকার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি। ফলত দেবযানী গুরুগিরি ফলাতেই শর্মিষ্ঠাও তাঁর পিতার গৌরবের কথা বলেছেন। সেকালের দিনে বিদ্যা রাজবৃত্তির অনুসারী হত না, যেমনটি এখন। ফলে শর্মিষ্ঠাকেই মাথা নোয়াতে হল বৃহত্তর স্বার্থে পিতার স্বার্থে, অসুরদের স্বার্থে। কিন্তু বিদ্যার কাছে মাথা নোয়ানো এক জিনিস, আর পিতার বিদ্যার বলে বলীয়সী এক অপদেবীর খেয়াল এক জিনিস। অতএব দেবযানীর দাসী হতে হল তাকে। দেবযানী যখন বললেন–দেখ এবার। যাচক-স্তাবকের কন্যা বলে অপমান করেছিলি আমাকে দেখ কেমন লাগে! শর্মিষ্ঠা দ্বিতীয়বার এই ঝগড়ার মধ্যে যাননি। তিনি অম্লানবদনে রাজকন্যার মতোই বলেছিলেন– যাতে আমার পরিবার-পরিজন-জ্ঞাতিবর্গের উপকার হবে, তার স্বার্থে এই দাসীবৃত্তি করব আমি– যেন কেনচিদ্যৰ্তানাং জ্ঞাতীনাং সুখমাবহেৎ।

শর্মিষ্ঠা দেবযানীর দাসী হলেন বিনা দ্বিধায়। তার খাওয়া-নাওয়া, ওঠা-বসা সর্বত্র অনুগামিনী হলেন দাসীর মতো। এরই মধ্যে মহারাজ যযাতি যখন এসে তাকে উচ্চাসনে বসা দেবযানীর পা টিপতে দেখলেন, সেদিনও তিনি রাজকন্যার সত্তায় সচেতন হয়ে একবারও হাত সরিয়ে নেননি দেবযানীর পা থেকে। দেবযানী কোনও বিস্তারের মধ্যে না গিয়ে তার দিকে অঙ্গুলি সঙ্কেত করে তার দাসীত্বের পরিচয় দিলেন, তবু কোনও ভাবান্তর হল না শর্মিষ্ঠার। তিনি তবু হাসছিলেন– নিষগ্নাং চারুহাসিনীম্। কিন্তু রাজা যযাতি যখন দেবযানীর সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র কৌতূহল প্রকাশ না করে শর্মিষ্ঠার সম্বন্ধেই কৌতূহল দেখাতে আরম্ভ করলেন, তখন কেমন লেগেছিল যৌবনবতী শর্মিষ্ঠার? তিনি নিজের পরিচয় দিতে পারেননি। কেমন করে কত সামান্য ঘটনা থেকে এই দাসীবৃত্তি তার কপালে জুটল- সে ঘটনার বিন্দুবিসর্গও তিনি জানাতে পারেননি রাজাকে।

রাজা যযাতি দেবযানীকে মোটেই বিয়ে করতে চাননি, তিনি পেতে চেয়েছিলেন শর্মিষ্ঠাকেই। দেবযানীর সামনেই তিনি সোচ্চারে শর্মিষ্ঠার অনিন্দ্যসুন্দর রূপের প্রশংসা করে বলেছিলেন– এমন সুন্দরী কোনও রমণী আমি এই পৃথিবীতে দেখিনি কখনও নৈবংরূপা ময়া নারী দৃষ্টপূর্বা মহীতলে। শুধু তাই নয়, উচ্চাসনে বসে দেবযানী যখন শর্মিষ্ঠাকে দিয়ে পা টেপাচ্ছিলেন রাজাকে দেখিয়ে দেখিয়ে, তখন রাজা তার মুখের ওপর বলেছিলেন– তোমার সৌন্দর্যের চাইতে এই মেয়েটির সৌন্দর্য অনেক বেশি অস্যা রূপেণ তে রূপং ন কিঞ্চিৎ সদৃশং ভবেৎ।

দেবযানীর পদ-সম্মাহন করতে করতে এ সব কথা কেমন লেগেছিল শর্মিষ্ঠার? তার তো একটা কথা বলারও উপায় ছিল না। আগন্তুক রাজার মুখে নিজের রূপের প্রশংসা শুনে তাকে অধোমুখে থাকতে হয়ছে, থাকতে হয়েছে নির্বিকার। দেবযানীকে অতিক্রম করে জীবনের প্রথম রোমাঞ্চিত রাজপুরুষের প্রশংসার উত্তর দেওয়া দূরে থাক, উচ্চাভিমানিনী দেবযানীর সামনে তার হৃদয়ের মুগ্ধতাটুকুও দেখানোর উপায় ছিল না। অথচ সেই মানুষটিকে দেবযানীর পৃষ্ঠলগ্না হয়ে যেতে হবে দেবযানীর রোমাঞ্চ দেখার জন্য সাক্ষীর মতো, দ্রষ্টার মতো।

শুক্রাচার্য আবার তার সামনেই রাজাকে বলে দিলেন– এই বার্ষপর্বণী শর্মিষ্ঠাকে আপনি সম্মানের চোখে দেখবেন এবং কখনও তাকে আহ্বান করবেন না শয্যায়। শর্মিষ্ঠার কাছে। কেমন লেগেছিল এই আগাম সতর্ক সাবধানবাণী?

যযাতির বুঝতে কিছু বাকি ছিল না। কিন্তু এই সম্পূর্ণ বিবাহপর্বের মধ্যে এক অজানা ভয়, অযথা সম্মান এবং এক খণ্ডিত হৃদয় নিয়েই তিনি দেবযানীকে নিয়ে প্রবেশ করলেন রাজধানীর অন্তঃপুরে। শর্মিষ্ঠাকে কোথায় রাখা যায় সে-ব্যাপারে রাজা নিজে সিদ্ধান্ত নিলেন না। অন্তঃপুরের আশপাশে এখানে-ওখানে জায়গা দেখে একটি জায়গা ঠিক হল, যদিও ঘরবাড়ি সেখানে কিছুই ছিল না। দেবযানীর অনুমতি নিয়ে নতুন ঘর-বাড়ি তৈরি করে সেখানে শর্মিষ্ঠার থাকার ব্যবস্থা করলেন রাজা– দেবযান্যাশ্চানুমতে… গৃহং কৃত্বা ন্যবেশয়ৎ। এক হাজার নিজস্ব দাসী বাহিনীর সঙ্গে শর্মিষ্ঠার পৃথক আবাস, পৃথক অন্নপানের ব্যবস্থা হল– যদিও এই পৃথক অশন-আসন-বাসনের মধ্যে রাজার অন্তর্গত হৃদয়ের বিশেষ সমাদরের চিহ্নও কিছু ছিল যা হয়তো অতি সচেতনভাবে অচেতনের মতো সুব্যবস্থিত হয়েছিল বাসোভিরশ্নপানৈশ্চ সংবিভজ্য সুসৎকৃতাম্।

অতি-সুব্যক্তভাবে দেবযানীর দাসী বলে অন্তঃপুরচারিণীর উপযুক্ত একটি মহাল শর্মিষ্ঠার ভাগ্যে জোটেনি বটে, কিন্তু এমনিতে শর্মিষ্ঠার থাকবার জায়গাটা ভারী সুন্দর। শর্মিষ্ঠার বাড়ির আগেই আছে একটি অশোক ফুলের বন। সংস্কৃত সাহিত্যে অশোক ফুলের তাৎপর্য আছে প্রেমের প্রতীক হিসেবে। সেই অশোক ফুলের বনের প্রান্তেই শর্মিষ্ঠার বাড়ি। সচরাচর এ-দিকটায় রাজার পা পড়ে না। কিন্তু অন্তঃপুরের প্রাচীরের অন্তরাল ছেড়ে এই অশোক কুঞ্জের প্রান্তিক গৃহটিতে আসতে কার না মন চায়? বিশেষত অশোক ফুলের মতোই রাঙা-রাঙা একখানি মুখ সেখানে উদাসী চোখে চেয়ে আছে কার পদধ্বনির অপেক্ষায়।

দেবযানীর সাহচর্যে রাজাকে সুখী থাকতেই হবে, অন্তত সুখী দেখাতেই হবে। অতএব সেই সুখেই দেবযানী গর্ভবতী হলেন। শর্মিষ্ঠা বোধহয় দেবযানীর চেয়ে বয়সে একটু ছোট। দেবযানী গর্ভবতী হয়েছেন এবং নির্বিঘ্নে তাঁর পুত্র হয়েছে, এই সংবাদ শর্মিষ্ঠা জানেন। সময় এল, যখন শর্মিষ্ঠাও পুষ্পবতী হলেন। মনে মনে তার বড় কষ্ট হল। ভাবলেন– এই দাসীবৃত্তির জীবনে তার আর স্বামীর ঘর করা হল না। স্বামীই নেই, তায় স্বামীর ঘর। তার জীবন এবং যৌবন সম্পূর্ণ বৃথা হয়ে গেল ন চ মেহস্তি পতিবৃতঃ। ওদিকে দেবযানীর ছেলে হয়ে গেছে বলে শর্মিষ্ঠার মনে মনে একটা ঈর্ষাও এসেছে। বারবার তার মনে হচ্ছে– দেবযানীর দাসীবৃত্তি করেন বলে জীবনের সমস্ত ধর্মগুলিও বিসর্জন দিতে হবে নাকি! এটা-ওটা নানান চিন্তা করে শর্মিষ্ঠা কিছুতেই মনঃস্থির করতে পারলেন না। কী করবেন, কী উপায়ে তিনি ইচ্ছাপূরণ করবেন– অনেক ভেবেও তার কোনও কূল পেলেন না শর্মিষ্ঠা– কিং প্রাপ্তং কিং নু কর্তব্যং কিং বা কৃত্বা কৃতং ভবেৎ।

যযাতির সম্বন্ধে শর্মিষ্ঠার একটা ধারণা আছে। তিনি জানেন– রাজা তাকে সবিশেষ পছন্দ করেন। একবার তিনি ভাবলেন– দেবযানী যেমন নিজেই তাকে স্বামী হিসেবে বেছে নিয়েছে, সেখানে তিনিও তো একইভাবে যাতিকে স্বামী হিসেবে বরণ করতে পারেন যথা তয়া বৃতা ভর্তা অথৈবাহং বৃণোমি তম। শর্মিষ্ঠার এই ভাবনার পিছনে সেকালের দিনের সামাজিক কারণও একটা আছে। সেকালের দিনের রাজার ঘরে যিনি বা যাঁরা স্ত্রীর দাসী হয়ে আসতেন, তাঁরা অনেক সময়েই রাজার ভোগ্যা হতেন এবং সেই অর্থে স্বামীর। বিচিত্রবীর্যের দাসীর গর্ভে বিদুর জন্মালেও তাকে বৈচিত্রবীর্য বলতে যেমন অসুবিধে ছিল না, সেইরকম গান্ধারীর দাসীগর্ভজাত পুত্র যুযুৎসুও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র বলেই পরিচিত ছিলেন। কাজেই শর্মিষ্ঠার ভাবনাটা এখানে অমূলক নয়। তিনি তাকে স্বামীত্বে বরণ করতেই পারেন এবং সেক্ষেত্রে একটি সন্তান লাভের ইচ্ছাও তিনি জানাতে পারেন তাঁকে। শর্মিষ্ঠার ধারণা ছিল– পুত্রকামনায় রাজার সঙ্গে মিলিত হতে চাইলে তিনি সে মিলন না করতে পারবেন না কোনওভাবে– রাজ্ঞা পুত্রফলং দেয়মিতি মে নিশ্চিতা মতিঃ।

কিন্তু রাজাকে স্বামী হিসেবে চাইলেই তো আর হল না, তাঁকে পেতে হবে প্রত্যক্ষভাবে এবং তাও নির্জনে। কেননা তার এই ইচ্ছার কথা যদি কোনওভাবে দেবযানী জানতে পারেন, তবে তারও যেমন নিস্তার থাকবে না, তেমনই নিস্তার থাকবে না রাজারও। কাজেই বারবার তিনি তার প্রবল ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে ভাবতে লাগলেন- যদি কোনওভাবে, কোনও কারণে মহারাজ যযাতির সঙ্গে একবার তাঁর দেখা হত নিভৃতে– দেবযানীর শকুন-চক্ষুর আওতার বাইরে– অপীদানীং স ধর্মাত্মা ইয়ান্মে দর্শনং রহঃ।

কী আশ্চর্য! শর্মিষ্ঠার বিপুল ইচ্ছাশক্তির বশেই হোক অথবা ভগবানের ইচ্ছায়–মহারাজ যযাতি অশোক বনের প্রান্তপথে পা বাড়ালেন। মহাভারতের কবি মন্তব্য করেছেন ‘যদৃচ্ছয়া অর্থাৎ কোনও নির্দিষ্ট ইচ্ছা ছাড়া ঘুরতে ঘুরতে যযাতি এসে পৌঁছলেন সেই অশোক বনের প্রান্তসীমায়– যেখানে শর্মিষ্ঠাকে চকোরি-চক্ষুতে অপেক্ষা করতে দেখলেন তিনি। টীকাকার নীলকণ্ঠ আবার যদৃচ্ছয়া’ শব্দের অর্থ করেছেন– ঈশ্বরেচ্ছাবশত। কিন্তু আমরা যারা এই মর্ত্যভূমির মানুষ, তারা বেশ বুঝি– অকারণে অনিচ্ছায় ঘুরতে ঘুরতেও নয় আবার ভগবানের ইচ্ছেতেও নয়, রাজা স্বেচ্ছায় দেবযানীর রাহু-প্রেমের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ সচেতনভাবেই অশোকবনের নিভৃত পথে পা বাড়িয়েছিলেন, হয়তো তার চলাফেরার এই লোক দেখানো ভাবটুকু ছিল যে, তিনি চলেছেন পথভোলা পথিকের মতো। অশোকবনের শেষে, যেখানে আর একটু গেলেই শর্মিষ্ঠার গৃহপ্রাঙ্গণ শুরু হবে, রাজা দেখলেন, সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন শর্মিষ্ঠা একাকিনী, যেন অপেক্ষায় আকুল– অশোকবনিকাভ্যাসে শর্মিষ্ঠাং প্রাপ তিষ্ঠতীম।

স্বপ্নেও ভাবেননি শর্মিষ্ঠা–রাজার সঙ্গে অমন নির্জনে, প্রস্ফুটিত অশোকপুষ্পের লালিমা মাখানো প্রান্তরে তার দেখা হবে– এমন কথা স্বপ্নেও ভাবেননি শর্মিষ্ঠা। কিন্তু সময় তো বেশি নেই– কোথায় কীভাবে দেবযানীর সদাজাগ্রত চক্ষু তাকে তাড়া করে বেড়াবে, কে জানে। অতএব শর্মিষ্ঠা প্রথম সুযোগেই কথা আরম্ভ করলেন হেসে। বললেন– আপনার ঘরের সংরক্ষণশীল ঐতিহ্য এমনই যে পুরুষমানুষরা সহজেই মেয়েদের মুখ দেখতে পায় না– তব বা নাহুষ গৃহে কঃ স্ত্রিয়ং দ্রষ্ট্রমহতি। শর্মিষ্ঠা বোধহয় বলতে চাইলেন যে, এতদিন কোনও পুরুষমানুষ তার চরিত্র লঙঘন করেনি অতএব তার কুমারীত্বের মানটুকু এখনও অটুট। এতকাল এই অশোকবনের আড়ালে আছেন শর্মিষ্ঠা, কেউ তার খোঁজ করে না। শর্মিষ্ঠা তার অভিমানটুকু জানালেন– মহারাজ! আমার রূপ ছিল, আভিজাত্য ছিল এবং আমার চরিত্রের কথাও আপনি জানেন– রূপাভিজনশীলৈ হি ত্বং রাজন্ বেথ মাং সদা। কিন্তু এমন একটা অবস্থাতেও আমার কি এই অধিকার নেই, যাতে একবারও আপনার সঙ্গে মিলন হতে পারে আমার।

শর্মিষ্ঠা ‘মিলন’ কথাটা বলেননি। তিনি রাজার কাছে ঋতুরক্ষার আবেদন জানিয়েছিলেন। সেকালের দিনের নিয়মে স্ত্রীলোকের ঋতু বৃথা যাওয়াটা পাপ বলে গণ্য হত এবং ঋতুকালে পুরুষের কাছে মিলন প্রার্থনা করলে তা প্রত্যাখ্যান করাটাও অন্যায়ের মধ্যে গণ্য হত। শর্মিষ্ঠা সেই সামাজিক নিয়মেরই সুযোগ নিলেন বটে, কিন্তু আমাদের ধারণা– ঋতুরক্ষার কথাটা একেবারেই প্রথামাফিক কথা, শর্মিষ্ঠা রাজাকে চেয়েছিলেন নিজের ভালবাসার কারণেই। সবচেয়ে বড় কথা– শর্মিষ্ঠা তার নিজের প্রতি রাজার আন্তরিক আসক্তিটুকু জানতেন, আর ঠিক সেইজন্যই নিভৃত অশোককুঞ্জের ধারে আজ তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন।

শর্মিষ্ঠার কথা শুনে যযাতি মনে মনে অবশ্যই আপ্লুত বোধ করেছেন। কিন্তু দেবযানীর ভয়, শুক্রাচার্যের আক্রোশের ভয় সেই মুহূর্তেই তাকে এমনভাবে আক্রান্ত করল যে, তিনি সোজাসুজি এক কথায় শর্মিষ্ঠার প্রস্তাবে রাজি হতে পারলেন না। তিনি বললেন- শর্মিষ্ঠা। তোমার স্বভাবও আমি জানি, বংশ-পরিচয়ও জানি। তোমার চেহারার মধ্যে এমন এক বিন্দু স্থানও নেই, যেটাকে খারাপ বলা যেতে পারে, এমনই তোমার রূপ– রূপঞ্চ তে ন পশ্যামি সূচ্যগ্রমপি নিন্দিতম। কিন্তু দেবযানীকে বিয়ে করার সময় শুক্রাচার্য যেভাবে সাবধান করে দিয়েছিলেন আমাকে, তাতে কীভাবে তোমাকে একই শয্যায় আহ্বান করি। শর্মিষ্ঠা নিজের প্রয়োজনেই যযাতির ভয়-বিহ্বল সতর্কতা এক্কেবারে লঘু করে দিয়ে বললেন– ওসব কথা কি মনে রাখতে আছে, মহারাজ!নীতিশাস্ত্র কি বলে জানেন? নীতিশাস্ত্র বলে পরিহাসের সময়ে, মেয়েদের মন ভোলানোর সময়ে, বিয়ের সময়ে, প্রাণ যাবার সময়ে, আর সর্বস্ব চলে যাবার সময় মানুষ যদি মিথ্যে কথা বলে, তবে পাপ হয় না একটুওন নর্মযুক্তং বচনং হিনস্তি। ন স্ত্রী রাজন ন বিবাহকালে।

যযাতি এ-কথায় দ্রবীভূত হলেন না। বললেন- দেখো, আমি রাজা বলে কথা। সত্য এবং ধর্মাধর্মের ক্ষেত্রে সমস্ত প্রজারা রাজাকেই দৃষ্টান্ত হিসেবে মানে, তারা যেখানে রাজার কথাটাকেই প্রমাণ হিসেবে ধরে, সেখানে বিপন্ন অবস্থাতেও আমার মিথ্যাচরণ করা উচিত নয়। শর্মিষ্ঠা এবার শেষ যুক্তি উপন্যস্ত করলেন তৎকালীন সমাজের বৈধতা অনুসরণ করে। বললেন নিজের স্বামী এবং সখী-দাসীর স্বামী একই কথা হল, মহারাজ! এখানে একজনের সঙ্গে বিয়ে হওয়া মানে আর-একজনের সঙ্গেও বিয়ে হয়ে গেছে ধরে নিতে হবে। কাজেই যে মুহূর্তে দেবযানী আপনাকে স্বামীত্বে বরণ করেছে, সেই মুহূর্ত থেকে আপনিও আমার স্বামী হয়ে গেছেন– সমং বিবাহমিত্যাহুঃ সখ্যা মেহসি বৃতঃ পতিঃ।

শর্মিষ্ঠার কথায়, শর্মিষ্ঠার সপ্রয়াস অনুধাবনে এবং অবশ্যই তার রূপের আচ্ছন্নতায় রাজার মনও এবার আচ্ছন্ন হতে আরম্ভ করল। তিনি নিজের যুক্তিতে বললেন আমার স্বপক্ষে একটাই যুক্তি আছে। আমার একটা ব্রত হল– যাচক ব্যক্তি যে যা আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে তাই দেব। এদিকে তুমি আমার কাছে আমার মিলন যাচনা করছ– কী যে আমি করি– ত্বঞ্চ যাচসি মাং কামং ব্রুহি কিং করবানি তে? রাজার ভাবটা এই শারীরিক মিলন-কামনাও কি কোনওভাবে যাচনীয় পদার্থের মধ্যে পড়ে। যদি তা পড়ে, তবে এই যাচনা মানা যেতে পারে। তবে মজা হল– যে যাচনা করছে, রাজা তার কাছেই নিজযুক্তির অনুমোদন চাইছেন। শর্মিষ্ঠা সঙ্গে সঙ্গে বললেন– আমাকে অধর্ম থেকে রক্ষা করুন, মহারাজ। আপনার করুণায় আমি যদি পুত্রবতী হই, তবেই আমার ধর্ম রক্ষা হবে।

যযাতির মাধ্যম ছাড়া শর্মিষ্ঠার যেহেতু পুত্রলাভের আর কোনও উপায় ছিল না, অতএব শর্মিষ্ঠা তার অসহায়তা জ্ঞাপন করলেন একেবারে মনুর মত উদ্ধার করে। তিনি বললেন– দাস, স্ত্রী এবং পুত্র– এঁদের তো কোনও স্বাধীনতা নেই, মহারাজ! নিজের নিজের অর্জিত ধনেও এঁদের অধিকার নেই। আর আমার অবস্থা ভাবুন, মহারাজ! আমি দেবযানীর দাসী, আর সেই দেবযানী আবার আপনার অধীন। তা হলে দেবযানীর পরম্পরায় আমারও ইচ্ছাপূরণ করাটা আপনার কাজ– সা চাহঞ্চ ত্বয়া রাজন্ ভজনীয়াং ভজস্ব মাম।

নিজেকে ধরে রাখা আর সম্ভব হল না রাজার পক্ষে। তিনি শর্মিষ্ঠার সঙ্গে মিলিত হয়ে তার অভীষ্ট পুরণ করলেন এবং শর্মিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁর পৌর্বাহ্নিক দুর্বলতা থাকায় নিজেও পরম প্রীতি লাভ করলেন। যথাসময়ে শর্মিষ্ঠার পুত্র হল এবং সেই সুখবর দেবযানীর কানেও গেল যথাসময়ে। প্রথমে একটু খারাপই লাগল দেবযানীর। পরে একটু সামলে উঠে সোজা শর্মিষ্ঠার কাছে গিয়ে তাকে সোজাসুজি ‘চার্জ করে বললেন– এমনই তোর ইন্দ্রিয়ের তাড়না। এমন অধীর হয়ে এমন একটা পাপ করে বসলি। শর্মিষ্ঠা ঠান্ডা মাথায় বললেন– কিছুই পাপ করিনি। আমার গৃহে এক ঋষি এসেছিলেন অতিথির মতো, আমার ঋতুকাল উপস্থিত হওয়ায় আমি ধর্মসঙ্গতভাবেই তার কাছে মিলন প্রার্থনা করেছি এবং সেই কারণেই পুত্রলাভ করেছি আমি।

সেদিনকার কথা মনে আছে শর্মিষ্ঠার, যেদিন নাহুষ যযাতিকে ‘ঋষি এবং ‘ঋষিপুত্র’ বলে সম্বোধন করেছিলেন দেবযানী। আজ যযাতির ওপর সেই আরোপিত ঋষিত্বের উল্লেখ করেই সমস্ত মিথ্যাচার থেকে অব্যাহতি পেতে চাইলেন শর্মিষ্ঠা। দেবযানী খুব একটা বিশ্বাস করলেন না শর্মিষ্ঠার কথা। সামান্য সন্দেহের সুরেই বললেন– ঋষি-ব্রাহ্মণ বলে কথা। তা তার নাম কী? গোত্র কী? তার বংশ-পরিচয়ই বা কী? শর্মিষ্ঠা লঘু সুরে একেবারে উড়িয়ে দিলেন দেবযানীকে। বললেন– সে সব কী ছাই আমার মনে ছিল নাকি তখন? অমন একজন ঋষি, তপস্যার তেজে যেন দীপ্ত হয়ে উঠেছে তার সর্ব অঙ্গ। অমন দীপ্র তীব্র ব্যক্তিত্বের সামনে ওই সময় কারও শক্তি থাকে জাত-গোত্র শুধোবার– তং দৃষ্টা মম সংষ্ঠুং শক্তির্নাসীচ্ছুচিস্মিতে। শর্মিষ্ঠার হাবে-ভাবে কথায় বিশ্বাস উৎপাদিত হল দেবযানীর। বললেন- যদি এমনটাই হয়ে থাকে, তবে আমার আর রাগ করার কিছু নেই। বর্ণশ্রেষ্ঠ এক ব্রাহ্মণের কাছ থেকে যদি তোর পুত্রলাভ হয়ে থাকে, তা হলে ভালই হয়েছে।

দেবযানী চলে গেলেন শর্মিষ্ঠাকে বিশ্বাস করে। এর মধ্যে দেবযানীর আরও একটি পুত্র হল। প্রথম পুত্রের নাম যদু, দ্বিতীয় পুত্রের নাম তুর্বসু। ওদিকে অশোকবনের উতল হাওয়ায় যযাতির অভিসার-কৌতুকটুকুও বাদ পড়ল না। ভয় যদি একবার ভেঙে যায়, বিশেষত এই ধরনের সতত বাৰ্যমান চৌর্যমিলনের ক্ষেত্রে ভয় যদি একবার ভেঙে যায়, তবে এমন ভোগের আস্বাদ মধুরতর হয়। শর্মিষ্ঠা যযাতির ঔরসে তিনটি পুত্র লাভ করলেন– দ্রুহু, অনু এবং পুরু।

ভালই চলছিল যাতির সংসার– একদিকে অন্তঃপুর-চারিণী দেবযানী, অন্যদিকে অশোককুঞ্জের অন্তর্লীন মধুর অভিসার শর্মিষ্ঠার সঙ্গে। কিন্তু মনুষ্য জীবনে এত সুখ কি সয়? একদিন দেবযানী রাজার সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছেন এমনিই, অকারণে। ঘুরতে ঘুরতে কখন যে সেই অশোককুঞ্জের সীমানা এসে গেছে, রাজা তা বুঝলেও, বারণ করলে দেবযানী সচেতন হবেন, সেই ভয়েই হয়তো তিনি কিছু বলেননি। কিন্তু অঘটন যা ঘটার ঘটেই গেল। দেবযানী দেখলেন– কয়েকটি বালক অশোকবনের উন্মুক্ত প্রান্তরে খেলা করছে। ছেলেগুলি ভারী সুন্দর– যেমন ফুটফুটে তাদের চেহারা, তেমনই মনকাড়া স্বভাব একেবারে দেবশিশুর মতো। রাজগৃহের বাইরে এমন রাজপুত্রোপম চেহারা দেখে দেবযানী রাজাকেই জিজ্ঞাসা করলেন– এমন সুন্দর ছেলেগুলো কোন বাড়িতে জন্মেছে? দেখতেও তো অনেকটা তোমারই মতো? দেবযানী রাজার উত্তরের অপেক্ষা না করে ছেলেগুলিকেই। সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন– তোমাদের নাম কী বাছারা? তোমাদের বাবার নাম কী?

কপাল মন্দ মহারাজ যযাতির। রাজা এবং দেবযানী যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাদের অদূরেই ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন শর্মিষ্ঠা। দেবশিশুর মতো ছেলেগুলি দেবযানীর কথার উত্তরে মহারাজ যযাতি এবং শর্মিষ্ঠার দিকে অঙ্গুলি সঙ্কেত করে পর্যায়ক্রমে দেখিয়ে দিল ইনিই আমাদের পিতা, ইনি আমাদের মা। য্যাতির মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। ছেলেগুলি পিতা যযাতির নাম উল্লেখ করেই সাদরে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেল। কিন্তু দেবযানী সামনে আছেন বলে রাজা তার আপন পুত্রদেরও জড়িয়ে ধরে বুকে তুলে নিতে পারলেন না। অন্য সময়ে যযাতির আদরে অভ্যস্ত বালকেরা পিতার এই আবেগগন্ধহীন কাষ্ঠশুষ্ক ব্যবহার দেখে কাঁদতে কাঁদতে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা শর্মিষ্ঠার কাছে চলে গেল–রুদন্তস্তেহথ শর্মিষ্ঠামভুয়ুৰ্বালকাস্ততঃ।

অসুররাজার কন্যা শর্মিষ্ঠা দেবযানীর দাসীত্ব স্বীকার করলে কী হবে– রাজার উদাসীন ব্যবহারের কারণ তিনি অনুমান করতে পারেন। কিন্তু তিনিও রাজার ঘরের মেয়ে। তার ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধি কোনওভাবেই দেবযানীর চেয়ে কম নয়। নিজের গর্ভে গূঢ়েৎপন্ন শিশুদের কোনও পিতৃপরিচয় থাকবে না– এটা তিনি শেষ পর্যন্ত মেনে নেওয়ার লোক নন। এখন যখন দৈবক্রমে সেই পিতৃপরিচয় উদঘাটিত হয়েছে, তখন তিনি সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব নিয়েই প্রস্তুত হলেন দেবযানীর মৌখিক ঝটিকাবৃষ্টির জন্য। দেবযানী বললেন– তোর স্বভাবটা এখনও অসুরের মতোই রয়ে গেছে; আমারই বাড়িতে আমার দাসীর মতো থেকে আমার বিরুদ্ধে যেতে তোর ভয় করল না– তমেবাসুরধর্মং ত্বমাস্থিতা ন বিভেষি মে?

দেবযানী আবারও তাকে অসুরের ধর্ম নিয়ে গঞ্জনা দিলেন বলেই শর্মিষ্ঠা আসুরিকভাবেই চোয়াল শক্ত করে জবাব দিলেন– তোমাকে আমি একটুও ভয় পাই না। আমি তো অন্যায় কিছু করিনি। তুমি কি ভেবেছিলে– তোমার দাসী হয়েছি বলে সারা জীবন স্বামী পুত্রহীনভাবে জীবন কাটিয়ে দেব? আমার জীবনের ধর্ম, আমার নারীর স্বভাব কিছু থাকবে না? কাজেই এখানে অধর্মটা কী হল? আমি যাকে ঋষি বলেছিলাম, তিনি তো ঋষিই বটে। আর তা ছাড়া যেদিন থেকে তুমি রাজাকে পতিত্বে বরণ করেছ, সেদিন থেকে তোমার দাসীর ওপরও তার সম্পূর্ণ অধিকার এসেই যায়– এ তো জানা কথা। কাজেই তোমার স্বামী ন্যায়সঙ্গতভাবে আমারও স্বামী বটে– সখীভর্তা হি ধৰ্মেন ভর্তা ভবতি শোভনে– অতএব আমার ভুলটা কোথায়?

শর্মিষ্ঠার এই ব্যক্তিত্বময় যৌক্তিকতার জবাব দেবযানীর কাছে নেই। অতএব তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল মহারাজ যযাতির ওপর এবং রাগ হলে দেবযানীর সামনে একটাই রাস্তা খোলা থাকে সেটা তাঁর বাপের বাড়ি। দেবযানী বললেন আমার অপ্রিয় কাজ করেছ তুমি। আমি এক মুহূর্তও আর এখানে থাকব না। দেবযানী বাপের বড়ি চললেন–বিবর্ণ, মলিন মুখে ক্রোধ আর অশ্রুধারা নিয়ে শুক্রাচার্যের কাছে চললেন দেবযানী। আর তার পিছন পিছন চললেন মহারাজ যযাতি– উদ্বিগ্ন, চিন্তিত এবং ক্রোধোদ্দীপ্তা স্ত্রীর ক্রোধশান্তির চেষ্টা করতে করতে। দেবযানী ফিরলেন না– ন্যবৰ্ত্তত ন চৈব শ্ম ক্রোধসংরক্তলোচনা। পিতার কাছে উপস্থিত হয়ে দেবযানী ব্রাহ্মণ্যের উচ্চতা মনে রেখেই বললেন– অধর্ম এখন ধর্মের মাথায় চড়ে বসেছে, নীচের মানুষ চড়ে বসেছে ওপরের মানুষের মাথায়– অধর্মেন জিতে ধর্মঃ প্রবৃত্তমধরোত্তর।

আমি দেখেছি- এখনও যাঁদের অসবর্ণ বিয়ে হয় এমনকী ভালবেসেও যদি তা হয়, এবং তাতে স্ত্রী যদি হন বামুনঘরের এবং স্বামী তথাকথিত নিম্নবর্ণের, তা হলে কোথায় যেন কোনও দুর্গতি ভাগ্যচক্রের মধ্যে অন্তর্ভেদ সৃষ্টি করতে থাকে। কোনও সাধারণ অন্যায়, সাধারণ ঝগড়া অথবা সাধারণ দাম্পত্য কলহের মধ্যেই স্ত্রীর মুখ দিয়ে তখন বেরিয়ে পড়ে জাতিবর্ণের অকারণ কৌলীন্যের কথা, উচ্চ-নীচ ভেদাভিমানের কথা। অথচ মহারাজ যযাতি খুব বাস্তব দৃষ্টি নিয়ে দেবযানীকে বহু আগেই সেই যখন তিনি বিয়ের জন্য যযাতিকে পীড়াপীড়ি করছিলেন তখন কিন্তু তিনি বলেছিলেন– এমন বিয়ের জন্য জোর কোরো না। ক্ষত্রিয় আর ব্রাহ্মণের মধ্যে যতই আন্তরিক মিল থাকুক, কিন্তু এদের দুয়ের আচার-আচরণ আলাদা, শুচিতার বোধ আলাদা, ধর্মের বোধও আলাদা– পৃথগৃধর্মাঃ পৃথকশৌচাস্তেষাং তু ব্রাহ্মণো বরঃ।

আজকাল যত অসবর্ণ বিবাহ হয়, তাতে আপত্তির কিছু দেখতে পাই না আমি। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী কারও মধ্যে যদি উচ্চতর কৌলীন্যের বোধ অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করতে থাকে, তা হলেই সেখানে কথায়, কাজে, ব্যবহারের মধ্যে দাম্পত্য-সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে, জটিলতা তাতে আরও বাড়ে। দেবযানী পিতা শুক্রাচার্যের কাছে অধমোত্তমের বিপরীত আচরণের কথা উল্লেখ করেই শর্মিষ্ঠার গর্ভে মহারাজ যযাতির তিনটি পুত্রজন্মের কাহিনি বিবৃত করলেন এবং সবচেয়ে আশ্চর্য দেবযানী তার আপন গর্ভে পুত্রসংখ্যার হীনতা দেখিয়ে নিজেকে দুর্ভাগা এবং শর্মিষ্ঠার প্রতি যযাতির অধিকতর আকর্ষণ প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন। মেয়ের কথায় শুক্রাচার্য দ্বিতীয়বার কোনও চিন্তা করলেন না। মুহূর্তের মধ্যে তিনি দেবযানীর পৃষ্ঠাবনত যযাতির উদ্দেশে অভিশাপ উচ্চারণ করলেন– অচিরকাল মধ্যেই বৃদ্ধসুলভ জরায় আক্রান্ত হবে তুমি। অর্থাৎ শুক্রাচার্য এক অভিশাপের জোরে যযাতির ইন্দ্রিয়ের বৃত্তিটুকুই লোপ করে দিলেন।

যযাতির এই অকালবৃদ্ধত্ব এবং জরালাভের অবস্থাটুকু লৌকিকভাবে ব্যাখ্যা করা কঠিন, তবে খুব সম্ভব, ইন্দ্রিয়সুখ লাভের সমস্ত অধিকার তিনি হারিয়েছিলেন শুক্রাচার্যের চাপে এবং হয়তো তিনি হারিয়েছিলেন রাজত্বের অধিকারও। শুক্রাচার্যের অভিশাপ শুনে রাজা যযাতি এবার মোক্ষম অস্ত্রটি ব্যবহার করলেন শাপমুক্তির জন্য। তিনি বলেছিলেন– আপনার কন্যা দেবযানীর সঙ্গে মিলন-সুখ এখনও আমার অতৃপ্তই রয়ে গেছে অতৃপ্তো যৌবনস্যাহং দেবযান্যাং ভৃগুদ্বহ। অতএব এই অকাল বার্ধক্য থেকে মুক্তি দিন আমাকে। দেবযানীর প্রসঙ্গে শুক্রাচার্যের সম্বিৎ ফিরল। বিশেষত কোন অবস্থায় এবং অবস্থার চাপে মহারাজ যযাতি শর্মিষ্ঠার সংসর্গ করতে বাধ্য হয়েছেন সেই যুক্তিও তিনি অনুধাবন করলেন খানিকটা। সবচেয়ে বড় কথা, অভিশাপ দিয়েই শুক্রাচার্য বুঝেছেন যে, এতে তার মেয়ে দেবযানীরই ক্ষতি হচ্ছে বেশি। অতএব রাজার অনুনয় মেনে তিনি তাকে অন্যের দেহে জরা-সংক্রমণের অধিকার দিলেন। অর্থাৎ অন্য কেউ তার জরা গ্রহণ করলে যযাতি তার যৌবনও ফিরে পাবেন, রাজত্বও ফিরে পাবেন।

শুক্রাচার্যের এই সহৃদয়তার সুযোগ নিয়ে যযাতি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তার অনুমতি নিয়ে নিলেন। সেটা হল– জরা গ্রহণের জন্য তিনি পুত্রদেরই অনুরোধ করবেন এবং যে জরা গ্রহণে সম্মত হবে, তাকেই তিনি ভবিষ্যতে রাজ্যভার দিয়ে যাবেন। শুক্রাচার্য স্বীকার করে নিলেন এই অনুরোধ এবং বললেন– যে পুত্র তোমার জরা গ্রহণ করবে, সেই রাজা হবে হস্তিনাপুরে বয়ো দাস্যতি তে পুত্ৰো যঃ স রাজা ভবিষ্যতি।

এরপরে অনেক ঘটনা ঘটে গেল। পালা চলল অভিমান এবং দুরুক্তির। যযাতি তার প্রত্যেক পুত্রকে এক এক করে অনুরোধ জানালেন তার বার্ধক্য গ্রহণ করার জন্য এবং পরিবর্তে তার যৌবন ফিরিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু দেবযানীর গর্ভজাত কোনও পুত্ৰই তার জরা গ্রহণ করলেন না। নিজের যৌবনোচিত সম্ভোগ-সুখ তারা পিতার জন্য জলাঞ্জলি দিতে রাজি হলেন না। শর্মিষ্ঠার প্রথম দুই পুত্রও যযাতির অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন, কিন্তু কনিষ্ঠ পুরু প্রথম অনুরোধেই সানন্দে পিতার কথা মেনে নিলেন এবং তাঁর বয়স, বার্ধক্য, জরা সবটাই গ্রহণ করলেন নিজের শরীরে। যযাতি তার হৃত যৌবন ফিরে পেলেন।

মহাভারতের কবি এই মুহূর্তে একবারও শর্মিষ্ঠার কথা স্মরণ করেননি। যে দেবযানীকে যাতি বিধিসম্মতভাবে বিবাহ করে তার আজ্ঞানুবর্তী হয়েছিলেন প্রতি কর্মে, তাঁর পুত্ররা কেউ যখন পিতার দুঃখ বুঝলেন না, তাতে দেবযানীর কী প্রতিক্রিয়া হল, আমরা অনুমান করতে পারি। কিন্তু অসুর রাজকন্যা শর্মিষ্ঠা দেবযানীর দাসী হয়ে বাস করছিলেন রাজবাড়ির প্রত্যন্ত সীমায়, জীবন যাপন করছিলেন অত্যন্ত অবহেলিতভাবে, তাঁরই পুত্র যখন পিতার মনোরথ সম্পূর্ণ করল, সেদিন তার দাসীত্বের কষ্ট, প্রিয় মিলনের অপূর্ণতা এবং গূঢ়মিলনজাত পুত্রের অমর্যাদা– সব যেন ধুয়েমুছে গেল। মহাভারতের কবি শর্মিষ্ঠার সগর্ব হৃৎস্পন্দন একবারের তরেও উল্লেখ করেননি বটে, কিন্তু যেদিন তাঁরই কনিষ্ঠ পুরু পিতৃদত্ত সিংহাসনে রাজা হয়ে বসলেন, সেদিন দেবযানীর উচ্ছিষ্ট দাসীত্বপঙ্ক থেকে আপন মর্যাদায় উঠে এলেন শর্মিষ্ঠা। দাসী থেকে তিনি রাজমাতায় পরিণত হলেন।

কথা উঠেছিল, চেষ্টাও হয়েছিল। সমাজের প্রতিনিধি ব্রাহ্মণেরা প্রশ্ন তুলেছিলেন– কেন দেবযানীর গর্ভজাত জ্যেষ্ঠ পুত্র শুক্রাচার্যের দৌহিত্রকে বঞ্চিত করে শর্মিষ্ঠার গর্ভজাত কনিষ্ঠ পুরুকে রাজা করা হচ্ছে– জ্যেষ্ঠং যদুমতিক্রম্য রাজ্যং পুরোঃ প্রযচ্ছসি? রাজা যযাতি সেদিন শুক্রাচার্যের অনুমোদনটুকুই ব্যবহার করেছিলেন জনপদবাসী দেবযানীর ব্রাহ্মণ প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে। তারা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন– শুক্রাচার্যের অনুমোদনের পর আর কিছু বলার নেই তাদের বরদানেন শুক্ৰস্য ন শক্যং বক্তৃমুত্তর। যে দেবযানী সারা জীবন শুক্রাচার্যের শাসন জারি করে আপন স্বামীকে পর্যুদস্ত করে রেখেছিলেন, তাঁকে সেই শাসনই গলাধঃকরণ করতে হল– এমনই দেবযানীর কপাল। অন্যদিকে যৌবনের অভিসন্ধিতে পিতার জন্য আপন যৌবন ত্যাগ করে শর্মিষ্ঠার গর্ভজাত পুরু এমনই এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করলেন, যাতে শর্মিষ্ঠা শুধু পুত্রগর্বেই গর্বিত হলেন না, তিনি দাসীর পর্যায় থেকে উত্তরিত হলেন রাজমাতার পদবিতে। তাঁর পুত্রই প্রতিষ্ঠিত হলেন প্রতিষ্ঠানপুরের রাজ সিংহাসনে। চিরকাল অন্তরালে-থাকা শর্মিষ্ঠা দেব্যানীকে হারিয়ে দিলেন শেষ খেলায়– তারই পুত্রের বংশধারায় জন্মালেন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠতম প্রজানুরঞ্জক রাজা দুষ্মন্ত, ভরত, কুরু প্রমুখ। শর্মিষ্ঠা বেঁচে থাকলেন আপন মর্যাদায়, আপন শোণিতধারায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *