০১. উর্বশী

০১. উর্বশী

০১.

১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট। স্থান– বেঙ্গল থিয়েটার, ৯, বিডন স্ট্রিট, কলিকাতা। মাইকেল মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক মঞ্চস্থ হল। এই দিনটির বিশেষত্ব ছিল এই কারণে যে, স্ত্রী চরিত্র রূপায়ণে এই প্রথম বারাঙ্গনাদের মধ্যে থেকে অভিনেত্রী গ্রহণ করা হল। থিয়েটার কর্তৃপক্ষ চারজন বারাঙ্গনাকে অভিনয়ের কাজে লাগিয়েছিল, যাঁদের নাম শ্যামা, গোলাপ, এলোকেশী এবং জগত্তারিণী। গোলাপ যদিও পরবর্তীকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা, কিন্তু ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকে দেবযানীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এলোকেশী এবং দেবিকার ভূমিকায় জগত্তারিণী।

তৎকালীন বেঙ্গল থিয়েটারের পরিচালকগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন মহামতি বিদ্যাসাগর। তিনি এই ধরনের অভিনেত্রী গ্রহণের অত্যন্ত বিরোধী থাকায় বেঙ্গল থিয়েটারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করেন। অভিনয়ের সাবলীলতা এবং নীতিবোধের দ্বৈরথে বিদ্যাসাগরের মতো অতি আধুনিকতম মানুষটিও সেদিন নীতিবোধের কোঠায় পা রেখেছেন। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব প্রথম দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে আরম্ভ করে পাঁচশো বছর আগে পর্যন্ত অভিনয়ের স্বাভাবিকতার দিকেই মন দিয়েছি আমরা অর্থাৎ তখনও স্ত্রী চরিত্রের অভিনয়ে স্ত্রীরাই প্রাধান্য পেতেন এবং তারা যে অনেকেই অভিজাতবংশীয়া ছিলেন না, তার প্রমাণও ভূরিভূরি আছে।

পুরাতন নাচ-গানের কথা যখন তুললামই তখন নৃত্যাভিনয়ের প্রথম গুরু ভরত মুনির কথা না বলে পারা যাবে না। তা ছাড়া ভরতের নাট্যশাস্ত্র যেহেতু অনেকের মতেই খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীতে রচিত, তাই ইতিহাস-পুরাণের চেয়ে তার গুরুত্ব কিছু কম নয়। তা ছাড়া ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্রে যেভাবে অভিনেত্রীদের সৃষ্টি-কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, সেটা বুঝলে বঙ্গরঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রীদের পুরাতন পরম্পরাটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে।

একটা নাটকের মধ্যে যা যা থাকা দরকার, অর্থাৎ বাঁচিক চমৎকার, ভাবের ব্যঞ্জনা, আঙ্গিক কৌশল– এই সবকিছুর প্রয়োজন দেখিয়ে নাট্যশাস্ত্রের প্রথম পাঠ তৈরি করলেন ভরত মুনি। তারপর সুরগুরু ব্রহ্মাকে নাট্যশাস্ত্রের ‘রাফ ড্রাফট’ দেখানোর পর ব্রহ্মা তাকে বললেন, তুমি কাব্যনাটকের এতসব ভাবনা ভাবলে, আঙ্গিক, বাঁচিক এবং সাত্ত্বিক অভিনয়ের নানা নিয়মকানুনের কথাও তুমি বলেছ। তো এইসঙ্গে অভিনয়ের কৈশিকী বৃত্তিটাও তুমি বুঝিয়ে দাও– কৈশিকীমপি যোজয় এবং তার জন্য আর যা যা তোমার দরকার সেগুলোও বলো।

সমস্ত দেব-মনুষ্যের সম্পর্কে ঠাকুরদাদার মতো ব্রহ্মা তো দুটো কথা উপদেশ দিয়েই খালাস। কিন্তু নাটক নামানোর ঝামেলা যে কী, তা ভরত মুনির মতো একজন সফল পরিচালকের অজানা নেই। কৈশিকী বৃত্তি হল নৃত্যনাটকের সেই অংশ, যা বাঁচিক, আঙ্গিক বা সাত্ত্বিক অভিনয়ের সম্পূর্ণতা এনে দেয়। অভিনয়ের ভাব-ব্যঞ্জনা এবং সৌন্দর্য্য এই কৈশিকী বৃত্তির যোজনাতেই সম্পন্ন হয়। তুলনা দিয়ে বলতে গেলে এ হল চাঁদের জ্যোৎস্নার মতো, সুন্দরী রমণীর লাবণ্যের মতো। বাঁচিক সংলাপ, নিরলস অঙ্গ-সঞ্চালন এবং রস-ভাবের উপযুক্ত প্রকাশ-ক্ষমতা এগুলি নৃত্য কিংবা নাটকের যত বড় অঙ্গই হোক, তার সঙ্গে শিল্পীজনোচিত প্রয়োগলালিত্য এবং বৈচিত্র্যই কিন্তু নৃত্য কিংবা নাটকের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে। কৈশিকী বৃত্তির কাজ এটাই প্রাণ সঞ্চার করা। বিশেষত শৃঙ্গার রসের অভিনয়ে নায়ক-নায়িকার অভিনয় কৌশলে এই কৈশিকী বৃত্তির মিশ্রণই দ্রষ্টা-শ্রোতার হৃদয় আপ্লুত করে তোলে।

ভরত মুনি এতকাল তার নাটক চালিয়ে এসেছেন পুরুষ অভিনেতাদের দিয়েই। কিন্তু শৃঙ্গার-রসের নৃত্যনাটকে সুন্দরী স্ত্রীলোক ছাড়া যে কৈশিকী বৃত্তির প্রয়োগ সম্ভব নয়– এ তিনি ভালই জানতেন। ফলে ব্রহ্মার কথা শুনে তিনি একটু রেগেই গেলেন। তার বক্তব্য– আপনি তো বলেই খালাস-কৈশিকীটাও লাগাও। তা কৈশিকীর অভিনয়ের লোকজন দিন আমাকে। শুধু পুরুষমানুষ দিয়ে অভিনয়ের মধ্যে এই রসভাবসম্পন্ন শৃঙ্গার আমদানি করা সম্ভবই নয়, এর জন্য রমণী চাই, রমণী– অশ্যা পুরুষেঃ সা তু প্রযোক্তৃং স্ত্রীজনাদৃতে।

ব্রহ্মা আর দেরি করেননি। ভরত মুনির নাটকের তপস্যা সিদ্ধ করার জন্য ব্রহ্মা তার মন থেকে সৃষ্টি করলেন অপ্সরাদের। শৃঙ্গার রসের ভাব-ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে তুলে অপ্সরারা ভরত মুনির কৈশিকী বৃত্তির প্রয়োগ ঘটালেন নৃত্যে-নাটকে।

লক্ষণীয়, অপ্সরারা সৌন্দর্য এবং রমণীয়তার দিক থেকে প্রজাপতি ব্রহ্মার মানসসম্ভবা হলেও চারিত্রিক দিক দিয়ে তাদের ব্যবহার তৎকালীন সামাজিকতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস যদি বেশ্যাদের অভিনয়ে প্রথম সমৃদ্ধ হয়ে থাকে, তবে সংস্কৃতের নাট্যশালাও পুষ্ট হয়েছিল স্বৰ্গবেশ্যা অপ্সরাদের অভিনয়ে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে গুপ্তযুগের তথা ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ কোষকার অমর সিংহের লেখা ‘অমরকোষ খুলুন। দেখবেন অপ্সরাদের পরিচয় দিয়ে তিনি বলেছেন, মেয়েদের মধ্যে উর্বশী, মেনকা, রম্ভার মতো অপ্সরারা হলেন স্বর্গবেশ্যা– স্বর্বেশ্যা উর্বশীমুখাঃ।

অপ্সরাদের নাম করতে গিয়ে নবরত্নসভার এই মাননীয় সদস্যটি যে নামগুলি করেছেন, তারা হলেন উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, ঘৃতাচী, তিলোত্তমা, সুকেশী এবং মঞ্জুঘোষা ইত্যাদি। নাট্যশাস্ত্রে দেখবেন যাদের নায়িকা পেয়ে ভরত মুনি কৃতকৃতার্থ বোধ করলেন, তারাও কিন্তু এই সুকেশী, মঞ্জুকেশী, সুলোচনারা। ভরত মুনির সুবিধার্থে ব্রহ্মা একসঙ্গে অন্তত বাইশ তেইশজন অপ্সরাকে ভরত মুনির হাতে সঁপে দিয়েছেন।

কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হল, ভরত মুনি কিন্তু নাটকীয় ভাব-ব্যঞ্জনা বিস্তারের জন্য উর্বশী মেনকা-রস্তাদের মতো ভুবন-বিখ্যাত সুর-সুন্দরীদের পেলেন না। ভরত মুনি তাদের নাম জানতেন না, এমন নয়। তবে নাট্যসৃষ্টির মধ্যে লোকজীবনের উপাদানই যেহেতু বেশি এবং যেহেতু উর্বশী-মেনকা-রম্ভাদের মধ্যে স্বর্গলোকের অভিসন্ধি মেশানো আছে, তাই খানিকটা বাস্তব-চেতনার নির্দেশেই মঞ্জুঘোষাশী, সুকেশী, সুলোচনাদের মতো প্রায় অশ্রুত অপ্সরাদের নিয়োগ করা হল নাট্যকর্মে।

আমরা অপ্সরাদের উৎপত্তি-বিকাশ নিয়ে এখানে বেশি আলোচনা করব না। কিন্তু এটা মানতে হবে যে, প্রসিদ্ধ পুরু-ভরতবংশের যিনি আদি জননী, সেই উর্বশীকেও কিন্তু আমরা ভারতবর্ষের তাবৎ নাট্য-নাটকের আধারশক্তি অথবা বীজ হিসেবেই পাই। যে-সব পণ্ডিতেরা ভারতীয় নাটকের মূল অনুসন্ধান করেন, তারা সকলেই এই একটি ব্যাপারে একমত যে, ভারতীয় সংস্কৃত নাটকের বীজ আছে সুপ্রাচীন ঋগবেদের মধ্যেই। ঋগ্‌বেদের মন্ত্রগুচ্ছের অন্তরে প্রধান যে সূক্তগুলিতে (অনেকগুলি মন্ত্রের সংকলন) দেশি-বিদেশি গবেষকরা নাটকের মূল খুঁজে পেয়েছেন, সেগুলিকে বলা হয় সংবাদ-সূক্ত। সংবাদ মানে কথোপকথন। সংবাদ মানে একরূপতা, সাদৃশ্য, যেমন কবি আর সহৃদয় পাঠকের হৃদয় সংবাদ। কথোপকণ্বনের মধ্যে এই হৃদয়-সংবাদ নাও থাকতে পারে, কিন্তু সংবাদ শব্দের প্রধান অর্থ কথোপকথনই; যেমন ভীষ্ম-যুধিষ্ঠির সংবাদ, অর্জুন-কৃষ্ণ সংবাদ রাজন সংঘৃত্য সংঘৃত্য সংবাদমিমমদ্ভুত। ঋগবেদের মধ্যে প্রধান সংবাদ-সূক্ত দুটি হল– যম যমী-সংবাদ এবং পুরূরবা-উর্বশী-সংবাদ।

আমরা শুধু বলতে চাই– বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় যে নবরত্নের সমাহার ঘটেছিল, তার অন্যতম রত্ন, কোষকার অমর সিংহ যদি উর্বশীকে স্বৰ্গবেশ্যাদের প্রধান পরিচিত মুখ বলে থাকেন, স্বর্বেশ্যা উর্বশীমুখাঃ- তবে অন্যতর কালিদাস উর্বশীকে বিখ্যাত করে দিয়েছেন পুরু-ভরতবংশের আদি-জননী হিসেবেই। সবচেয়ে বড় কথা, সুরসুন্দরী অপ্সরাদের সতত অস্থির যে যৌনতার কথা মহাভারত-পুরাণে বিখ্যাত হয়ে আছে, যেখানে উর্বশীর মধ্যে আমরা সম্পূর্ণা এক প্রেমিকার হৃদয় দেখেছি সুপ্রাচীন ঋগবেদের মধ্যেই, দেখেছি সুরসুন্দরীর জননী হয়ে ওঠার পরিণতি। স্বয়ং কালিদাসও এই বৈদিক মন্ত্রণা ভুলতে পারেননি বলেই উর্বশীকে নামিয়ে এনেছেন একান্ত মানবিক সত্তার মধ্যে যেখানে পূর্বরাগ, প্রেম, শৃঙ্গার, বিরহ শেষ পর্যন্ত পাণ্ডব-কৌরব-বংশের আদি-প্রসূতিকে জননীর স্নেহ পরিণতির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করে।

.

০২.

আমাদের ইতিহাস-পুরাণে অপ্সরাদের সম্বন্ধে যা বলা আছে, তাতে প্রথম যেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, অপ্সরাদের মতো এমন সুন্দরী আর পৃথিবীতে নেই। আর এমন ভীষণ রকমের সুন্দরী হলে এমনিতেই আপন সৌন্দর্য-সচেতনতা এবং অনন্ত পুরুষের লোভদৃষ্টিতে নিজেকে প্রথাগত নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠা করাটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। এমনিতে একটা কথাই আছে যে, রাজার ঘরে অতিরিক্ত বেশি সময় থাকলে বামুনের চরিত্র নষ্ট হয়, আর অতিরিক্ত রূপ থাকলে নষ্ট হয় স্ত্রী–স্ত্রী বিনশ্যতি রূপেণ ব্রাহ্মণণা রাজসেবয়া। কিন্তু এই লোকমুখরতা যদি নাও মানি, তবুও বলতে হবে যে, স্বর্গসুন্দরী অপ্সরাদের পৌরাণিক উদ্ভবের মধ্যেই নষ্ট হওয়ার মন্ত্র লুকানো আছে, কিন্তু তার মধ্যে নিজে নষ্ট হওয়ার চেয়েও অন্য পুরুষকে নষ্ট করার মন্ত্রণা আরও বেশি। অবশেষে এর চেয়েও কুটিল যুক্তিতে আমার মনে হয়– পুরুষ মানুষ স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে নিজে নষ্ট হওয়ার জন্যই এমন একটা পৌরাণিকী ব্যবস্থা সামাজিকভাবে রেখে দিয়েছে যাতে শেষ জায়গায় এসে বলা যাবে– আমি শান্ত, দান্ত মুনি-ঋষি মানুষ। সমস্ত সংযম করপুটে রাখা আমলকীর মতো আমার হাতের মুঠোয়, কিন্তু কী করব–ওই অপ্সরা মেনকা, রম্ভা, ঘৃতাচী-পুঞ্জিকস্থলা ওদেরই ছলা-কলায় আমার এই দশা হল।

আসলে শুধুই সৌন্দৰ্য্য নয়, তার সঙ্গে বৈদগ্ধ্যও আছে। ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে একথা প্রমাণিতই হয়ে যাবে যে, সৌন্দর্যের সঙ্গে শাস্ত্রীয় কলা এবং বিদ্যা-বৈদগ্ধ্যের প্রধান আধার ছিলেন গণিকারাই। আর এ-প্রসঙ্গে আমরা বিস্তারিত তথ্য এই প্রবন্ধে জানা না। তবে এটা অবশ্যই বলব যে, অতিশয়ী সৌন্দর্যের সঙ্গে যদি বিদগ্ধতার অতিশয় যুক্ত হয়। তবে সেই রমণী চিরকালই বেশির ভাগ পুরুষের অনায়ত্তা ছিলেন বলেই গণিকার সম্বোধন লাভ করতেন। এক নিপুণ কবি বলেছিলেন, ওরে মেনকা-রম্ভাদের সঙ্গে কীভাবে সম্ভোগ উপভোগ করতে হয়, সে জানেন সুরপতি ইন্দ্র। তোদের মতো দাসী-চাকরানিদের পিছনে ঘোরা লোকেরা রম্ভা-মেনকাকে বুঝবে কী করে– জম্ভারিরেব জানাতি রম্ভাসংযোগবিভ্রমম। হয়তো এই শ্লোকের মধ্যে যৌনতার আভাসটুকুই বেশি, কিন্তু অপ্সরা মানেই যে যৌনতা নয়, সেটা জানিয়ে রাখাই ভাল। তবে অন্য সাধারণ গার্হস্থ্য রমণীকুলের সঙ্গে অপ্সরাদের পার্থক্য এইখানেই যে, যৌনতা এখানে, শরীর-বিলীন কোনও নিশ্চেষ্ট বৃত্তি হিসেবে থাকে না, এখানে ‘ফ্লন্ট’ করার একটা ব্যাপার আছে। আজকের দিনে অবশ্য ‘ফ্লন্ট’ করার ঘটনা অনেক বেশি সার্বত্রিক এবং তার কারণ হিসেবে সুব্যবস্থিত তর্কযুক্তিও হাজির করেন যুক্তিবাদীরা। সিডনির ‘মর্নিং হেরাল্ড’ কাগজে পল শিহান বলে একজন লিখলেন যে, অল্পবয়সি মেয়ে এবং অবশ্যই তরুণীরাও মাঝে মাঝে বড় অশালীন হয়ে ওঠে; যে-সব জামা কাপড় তারা পরে, তাতে পুরুষকে ‘প্রোভোক’ করার সমস্ত উপকরণই মজুদ থাকে, এরা অনেক সময়েই বিপজ্জনক যৌন মিলনকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলে এবং কোনও-না কোনও সময়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। শিহান মন্তব্য করেছেন, এমনটি যারা করেছে বা করে তারাই স্বাভাবিক, আমরাই অস্বাভাবিক। জামা-কাপড়ের বিভিন্ন যত নমুনা আছে– যাতে শরীর ফুটফুট ব্যঞ্জনায় যৌন মহিমায় প্রকট হয়ে ওঠে, সে-সবই নাকি সতেরো থেকে তেইশের মধ্যে অতিস্বাভাবিক, কেননা এই সময়ে তারা রমণীজনোচিত উর্বরতার তুঙ্গে থাকে। ফলত এই অবস্থায় যে-মেয়েরা নিজেদের বিজ্ঞাপিত করে অথবা ‘ফ্লন্ট’ করে, সেখানে তাদের অন্তর্গত যৌন তীব্রতাই কাজ করে এবং সেটা জুডো-খ্রিস্টান নৈতিকতা মেনে কাজ করে না, এবং সেটাই স্বাভাবিক।

আমরা এই দৃষ্টিকোণ থেকে তরুণী মেয়েদের কথা ভাবি না, বরঞ্চ এইভাবে যারা চলে তাদের আমরা মোটেই ভাল চোখে দেখি না এবং সকুৎসায় আরও এগিয়ে আমরা অন্যতর আখ্যা দিয়ে থাকি যে- আখ্যা সামাজিক বৃত্তের বাইরে। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, স্বর্গসুন্দরী উর্বশী কিন্তু এই বৃত্তের মধ্যেই আছেন, আছেন তার সমপ্রাণা মেনকা রম্ভা-তিলোত্তমারাও। মহাভারত-পুরাণে এই অপ্সরাদের যে-প্রয়োজনে ব্যবহৃত, ব্যবহৃত এবং ব্যবহৃত হতে দেখেছি, তা হল প্রধানত মুনি-ঋষি-তপস্বীদের ধ্যান ভঙ্গ করা। স্বর্গের অতিলৌকিক শক্তিমান দেবতারা মর্ত মানুষের তপস্যা-শক্তিকে ভয় পেতেন। তারা ভাবতেন তপস্যার কৃচ্ছসাধন করে তারা শেষ পর্যন্ত দেবেন্দ্রর ইন্দ্ৰত্ব কেড়ে নিয়ে স্বর্গের রাজা হয়ে বসবেন। দার্শনিক দৃষ্টিতে স্বর্গের ইন্দ্রপদ স্থায়ী কোনও নিত্যপদ নয়, অতএব কারও তপস্যা দেখলেই তারা ভয় পেতেন এবং পাঠিয়ে দিতেন স্বর্গসুন্দরী অপ্সরাদের কাউকে, যাঁরা শারীরিক বিভঙ্গে তপস্বীজনের মনে বিভ্রম ঘটাতেন। এতে মুনি-ঋষিদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটত, তাঁদের তপশ্চর‍্যা ব্যর্থ হয়ে যেত। আমাদের কবি দেবতাদের এই অন্যসমাধি-ভীরুতা বুঝে স্বয়ং উর্বশী সম্বন্ধেই লিখেছিলেন– মুনিগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল। তোমারি কটাক্ষপাতে ত্রিভুবন যৌবনচঞ্চল।

পল শিহান কিন্তু এতাদৃশী রমণীদের কথা বলেননি। তিনি সতেরো থেকে তেইশের সাধারণ মেয়েদের কথা বলেছেন অথবা বলেছেন অধিকবয়সা তরুণীদের কথা, শারীরিক উর্বরতা যাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় এবং সেই কারণে তারা শরীরের চটুলতা না করে পারে না। আর অপ্সরারা কী রকম? না, তারা দেবকার্য-সাধনের জন্য নিজেদের ‘এক্সপোজ’ করেন ‘ফ্লন্ট’ করেন। কিন্তু তাতে অপ্সরাদের কী হয়? ঋষি-মুনিদের ধ্যানভঙ্গ করে দেবতারা না হয় নিজের সিদ্ধি গুছিয়ে নিলেন। কিন্তু তাতে অপ্সরারা কী পাচ্ছেন? আপন সৌন্দর্য্যে অন্যান্য ঋষিদেও ধ্যানভঙ্গ করতে পারছেন, শুধু এই সাফল্যের গর্ব! আমরা বলব– বরং এটাই মেনে নেওয়া ভাল যে, রূপ-গুণের গৌরবে যে-সব সুন্দরী রমণীরা খানিক উর্বরতার আকর্ষকী তাড়না অনুভব করতেন, ‘ফ্লন্ট’ কিংবা ‘এক্সপোজ’ করার ব্যাপারে সামাজিক সতীত্বে যাঁরা তেমন বিশ্বাস করতেন না, তারাই আমাদের স্বর্গসুন্দরী অপ্সরা। প্রসঙ্গত পুরুষদের কথাটাও বলে নেওয়া ভাল। সামাজিক সৌজন্যে এবং পারিবারিক মহিমা প্রকটিত করার জন্য যত লক্ষ্মীমতী এবং মহা-মহিম মর্যাদাময়ী রমণীই পুরুষ-মানুষরা পছন্দ করুন না কেন, উপভোগ-শষ্যাতে সেই লক্ষ্মীমতীর কাছেই কিন্তু পুরুষেরা বেশ্যার ব্যবহার আশা করেন। তা নইলে এমন সংস্কৃত নীতিশ্লোক তৈরি হত না যে, এমন বউটি সত্যিই খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে খাওয়া-দাওয়া করাবে মায়ের মতো, বাড়ির কাজ করবে দাসীর মতো, আর রেতের বেলায় বিছানায় হয়ে উঠবে বেশ্যার মতো–কার্যে দাসী রতৌ বেশ্যা ভোজনে জননীসমা।

ভাবছেন, বড় অশ্লীল আর বাড়াবাড়ি কথা বলে ফেলছি আমি। পুরুষ-মানুষেরা আদপেই এমনটা এমন করে চান না, আর লক্ষ্মীমতী রমণীরাও আদপে এই আচরণ করতে পারেন না। আর যারা করেন তারা বেশ্যাই। বস্তুত ঠিক এইরকম একটা ভাবনা থেকেই স্বর্গসুন্দরী অপ্সরারা স্বৰ্গবেশ্যা বলে কথিত হয়েছেন অমরকোষে। অথচ এটাই সবচেয়ে বড় সত্য নবরত্নের রত্নতম অমর সিংহও বাস্তব বোঝেননি। যে-রমণীর অনন্ত সৌন্দর্যের মধ্যে খানিক বৈদগ্ধ্য আছে, প্রগলভতার সঙ্গে ‘ফ্লন্ট’ করারও ক্ষমতা আছে, তাকে মর্যাদাময়ী, কুলবধু বলেনি কেউ। সংস্কৃতের এক সাহসী কবি ‘বৈদগ্ধ্য-বিদগ্ধতা’র শব্দটিকে ধরে সশ্লেষে বলেছিলেন– প্রদীপের সলতে আগুনে দগ্ধ হলে যেমন কালো-মলিন হয়ে ওঠে, তেমনই কুলবধূও যদি বিদগ্ধা রমণী হন, তবে সে বিদগ্ধতা তার সামাজিক মলিনতা সৃষ্টি করে অর্থাৎ বিদগ্ধতায় তিনিও কালো হয়ে যান সলতের মতো। বহিরঙ্গে তার আগুন রূপটা কিন্তু ছিল, ঠিক যেমন থাকে দীপশলাকার। ঠিক এর পরেই কবির দ্বিতীয় পঙক্তির উচ্ছ্বাস– যেটা আসলে গণিকাদের দোষ বলে মনে হয়, সেটাই তাদের ভূষণ, ঠিক যেমন শশিকলার কলঙ্ক দোষা–অপি ভূষায়ৈ গণিকায়াঃ শশিকলায়াশ্চ। এবার বলুন, এই কথার সঙ্গে ডি. এইচ. লরেন্স-এর কথাটার কতটুকু ফারাক–what is pornography to one man is the laughter of genius to another.

মহাভারতের উদার-বিশদ প্রেক্ষিতে যদি অপ্সরা-সুন্দরীদের বিচার করা হয়, তা হলে দেখব এই স্বর্গসুন্দরীরাই, যারা প্রথাগত বৈবাহিক সীমানার নিতান্ত বাইরের মানুষ, তারাই কিন্তু মহাভারতের শতেক অভূদয়ের জননী। স্বৰ্গবেশ্যা বলে কথিত হলেও তাঁরাই কিন্তু বাৎসল্যের সন্ধান দিয়েছেন অনেক শুষ্করুক্ষ মুনি-ঋষিকে, অনেক সন্তানকামী রাজাকে, এমনকী স্বয়ং মহাভারতের কবি দ্বৈপায়ন ব্যাসকেও। হয়তো অপ্সরাদের এই জননীত্বও প্রথাসিদ্ধ তথা স্নেহস্নিগ্ধ জননীত্ব নয়, তবে এই নিরিখেই এটা সিদ্ধান্ত করা যায় যে, পুরুষ তার রতিমুক্তির জন্য নীতি-সম্মত বৈবাহিক স্ত্রীর মধ্যেও যেমন খানিক গণিকাভাব আকাঙ্ক্ষা করে, গণিকারাও তেমনই অন্যতর কারণে, অন্যতর উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও জননীর গৌরবটুকুও অনুভব করতে চান অনেক সময়েই, হয়তো বিনা কারণে, হয়তো বিনা কোনও অধিকার ভোগ করে। ডি. এইচ. লরেন্স লিখেছিলেন– If a woman hasn’t got a tiny streak of harlot in her, she’s a dry stick as a rule. And probably most harlots had somewhere a streak of womanly generosity… plenty of harlots gave themselves, when they felt like it, for nothing.

অপ্সরাদের সম্বন্ধে এই কথা সঠিক খাটে বলেই মহাভারতের এক জায়গায় যেখানে দৈনন্দিন কী করলে মানুষের ভাল হয়, এইরকম একটা প্রশ্ন করছেন যুধিষ্ঠির সেখানে দেবতা, ঋষি, রাজা, তীর্থ, নদীর বহুতর পুণ্য-নামের সঙ্গে অন্তত নয় জন অপ্সরাকে সকালে উঠেই স্মরণ করতে বলেছেন মহামতি ভীষ্ম। এখানে তাদের বিশেষণ দেবকন্যা এবং মহাভাগ্যবতী দেবকন্যা মহাভাগা দিব্যাশ্চারাং গণাঃ। এই যে প্রাতঃস্মরণীয়া নয় জন অপ্সরা, তাদের মধ্যে প্রথম নামটি হল উর্বশীর। উর্বশীই বোধহয় স্বর্গসুন্দরী অপ্সরাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ‘ডিগনিফায়েড’– যিনি বারংবার দেবকার্য-সাধনের জন্য মুনি ঋষিদের ধ্যান ভাঙানোর কাজে ব্যবহৃত হননি, অন্তত মেনকা, ঘৃতাচী, রম্ভার মতো তো হনইনি। উর্বশীর জন্ম কিংবা উৎপত্তিটাও একটু যেন অন্য রকম।

রামায়ণ-মহাভারত এবং পুরাণগুলিতে এটা সাধারণভাবেই দেখা যাবে যে, পৃথিবী এবং স্বর্গের যত উত্তমোত্তম বস্তু আছে, তা সবই প্রায় সমুদ্রমন্থনের ফল। পুরাণগুলিতে অবশ্য সৃষ্টিবিষয়িণী বর্ণনায় ব্রহ্মার মানসপুত্র কশ্যপের ঔরসে দক্ষকন্যা মুনির গর্ভে অপ্সরাদের জন্ম হয় বলে বলা হয়েছে- মুনির্মনীনাঞ্চ গণং গণমন্সরসাং তথা। কিন্তু পুরাণে যখন গণ অথবা একটা গোষ্ঠী হিসেবে অপ্সরাদের উৎপত্তি ঘোষণা করা হচ্ছে, তখন সেই বিশাল গণের মধ্যে উর্বশী-মেনকাদের নাম করা হয়নি প্রায়ই; যদি বা হয়েও থাকে তা হলে জাতি-নামে একবার অপ্সরাদের গণের কথা বলেই উর্বশী-মেনকাদের কথা পৃথক এবং বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মহাভারতে আবার পৃথক প্রসঙ্গেই শ্রেষ্ঠ অপ্সরাদের নাম করে বলা হল– উর্বশী, পূর্বচিত্তি, সহজন্যা, মেনকা, বিশ্বাচী আর ঘৃতাচী–এই ছয়জন হলেন অপ্সরাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং এই ছয়জনকে নিয়েই একটা গণ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু অপ্সরাদের এই শ্রেষ্ঠ গণের মধ্যে পৃথকভাবে ঘৃতাচী, বিশ্বাচীদের জন্মকথা কখনওই বলা হয় না, কিন্তু পুরাণে উর্বশীর জন্ম নিয়ে একটি পৃথক উপাখ্যানই আছে।

পুরাকালে ভগবান শ্রীহরির অংশসস্তৃত নর-নারায়ণ নামে দুই যুগলঋষি ছিলেন। তাঁরা বহুতর কৃচ্ছসাধন করে বহু বছর ধরে তপস্যা চালিয়ে যাওয়ায় স্বর্গের দেবতাদের মনেও ভয় দেখা দিল। দেবরাজ ইন্দ্র তো ভীষণই চিন্তিত হলেন যে, এবারে তার দেবরাজের স্বর্গ সিংহাসনটাই চলে যাবে। এত সব ভেবে ইন্দ্র বহুভাবে সেই যুগল-মুনির সমাধি ভঙ্গ করার চেষ্টা করলেন। শেষ পর্যন্ত কোনও উপায়ই কাজে লাগল না দেখে তিনি অপ্সরা-সুন্দরীদের ডেকে পাঠালেন নর-নারায়ণকে কামাতুর করে দেবার উদ্দেশে। এই মুহূর্তে একবারের তরে হলেও স্বর্গসুন্দরী অপ্সরাদেরও কিন্তু ‘বারাঙ্গনা’ বলেছেন পৌরাণিক–বারাঙ্গনাগণোহয়ং তে সহায়ার্থং ময়েরিতঃ। তারপরেই ইন্দ্র কিন্তু সোচ্ছ্বাসে তিলোত্তমা রম্ভার নাম করে বলেছেন– এঁরা একাই আমার এই গুরুতর কাজটা করে দিতে পারে– একা তিলোত্তমা রম্ভা কার্যং সাধয়িতুং ক্ষমা।

নর-নারায়ণ যুগল-ঋষির তপস্যার স্থানটি প্রাকৃতিকভাবেই ছিল অতি মনোরম গন্ধমাদন পর্বত। সেখানে ভালবাসার দেবতা তিলোত্তমা-রম্ভার মতো কাম-সৈন্য নিয়ে উপস্থিত হলেন। মুনি-যুগলের ধ্যান ভাঙাতে। অকালে বসন্তের ফুল ফুটল সেখানে, কোকিল-কুলের আলাপ শুরু হল বকুল গাছে– বভূবুঃ কোকিলালাপা বৃক্ষাগ্ৰেষু মনোহরাঃ। রম্ভা- তিলোত্তমা মনোহরণ শরীর-বিভঙ্গে নাচতে আরম্ভ করলেন দুই মুনির সামনে, সঙ্গে চলল তন্ত্রী-লয় সমন্বিত গান। অপ্সরাদের মধুর নৃত্য-গীত শুনে মুনিদের ধ্যান ভাঙল এবং সাময়িক বিস্ময়ে হতচকিত হয়ে একে অপরকে জিজ্ঞাসা করলেন– কী হয়েছে বলো তো? আজ কি হঠাৎ কালধর্মের বিপর্যয় ঘটে গেল– কালধর্ম-বিপৰ্য্যাসঃ কণ্বমদ্য দুরাসদঃ। এমন তো হবার কথা ছিল না। সমস্ত প্রাণীদের কেমন কামাতুর বলে মনে হচ্ছে। বসন্তলক্ষ্মীর এই আগমনও তো স্বাভাবিক নয়। সুরসুন্দরীরা এত সুন্দর সব গান করছে। আমার তো মনে হচ্ছে এর মধ্যে দেবরাজ ইন্দ্রের কোনও চক্রান্ত আছে, তিনি আমাদের ধ্যানভঙ্গ করার জন্যই এত সব আয়োজন করেছেন। এরই মধ্যে নৃত্যপরা অপ্সরা-সুন্দরীদের ওপর নজর পড়ল দুই ঋষির। দেখলেন এক-দু’জন নয়, রম্ভা-তিলোত্তমা, মেনকা-ঘৃতাচী থেকে আরম্ভ করে কাঞ্চনমালিনী-বিদ্যুন্মালারাও আছেন। রম্ভা-তিলোত্তমাদের যত মনোমোহিনী শক্তিই থাক, তারা কিন্তু মুনি-যুগলকে দেখে ভয়ও পাচ্ছেন একটু-একটু। কিন্তু দেবকার্য-সিদ্ধির জন্য তারা পুনরায় নৃত্য আরম্ভ করলেন মুনিদের সামনে। অপ্সরারা মুনিদের উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে যথোচিত সম্মান পুরঃসর নৃত্য আরম্ভ করলেও তাদের নৃত্যের বিষয় ছিল কামোদ্দীপক।

মুনিরা নিজেদের পরিশীলন অনুসারেই বুঝে গেলেন সব কিছু। বুঝে গেলেন– এখানে অপ্সরাদের দোষ নেই কিছু। তাদের মনোহরণ ভঙ্গি দেখে এতটুকুও অভিভূত না হয়ে নারায়ণ ঋষি তাদের বললেন, হ্যাঁগো! তোমরা তো সব এখানে স্বর্গ থেকে আমার অতিথি হয়ে এসেছ। তো বসো সব এখানে। আমি যথাসাধ্য আতিথ্য করব তোমাদের। অপ্সরাদের সঙ্গে এত ভাল করে কথা বললেও যুগল ঋষির অন্যতম নারায়ণের মনে একটু রাগ অভিমানও হল এবং সেটা হয়তো দেবরাজ ইন্দ্রের ওপরেই। তিনি মনে মনে ভাবলেন– বেশ তো তিলোত্তমা রম্ভাদের পাঠিয়েছেন দেবরাজ। কিন্তু এ আর এমন কী! সৌন্দর্য বস্তুটার কি অন্ত আছে কোনও! আমি এদের চেয়েও শতগুণ সুন্দরী অপ্সরা সৃষ্টি করতে পারি নতুন করে– বরাক্যঃ কা ইমাঃ সর্বাঃ সৃজাম্যদ্য নবাঃ কিল। কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঋষি নারায়ণ নিজের ঊরুতে চপেটাঘাত করলেন একবার। অমনই তার ঊরু থেকে সৃষ্টি হল এক সর্বাঙ্গসুন্দরী রমণীর। নারায়ণের ঊরু থেকে জন্মালেন বলেই তার নাম হল– উর্বশী নারায়ণোরুসস্তৃতা হু্যর্বশীতি ততঃ শুভা। উর্বশীর রূপ দেখে স্বর্গসুন্দরী অপ্সরাদের মনে চমৎকার তৈরি হল। তারা লজ্জায় নারায়ণ ঋষির কাছে মাথা নত করলেন। নারায়ণ ঋষি বললেন– তোমাদের ওপর আমার কোনও ক্ষোভ নেই। আমি আমার এই ঊরু সম্ভবা উর্বশীকে দেবরাজ ইন্দ্রের সন্তোষের জন্য উপহার হিসেবে পাঠাচ্ছি। এই পরমাসুন্দরী তোমাদের সঙ্গেই যাক দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে– উপায়নমিয়ং বালা গচ্ছত্বদ্য মনোহরা।

রম্ভা-তিলোত্তমারা এবার উর্বশীকে নিয়ে স্বর্গরাজ্যে ফিরলেন এবং ঋষিদের উপটৌকন উর্বশীকে নিবেদন করলেন ইন্দ্রের কাছে। ইন্দ্র অবাক হলেন যুগল-ঋষির তপস্যার শক্তি দেখে, যে শক্তিতে উর্বশীর মতো এমন সুন্দরী রমণীর সৃষ্টি হতে পেরেছে যেনোর্বশ্যাঃ স্বতপসা তাদৃগরূপাঃ প্রকল্পিতাঃ। আসলে নারায়ণ ঋষি তার তপোবল ক্ষয় করে সৃষ্টি করেছিলেন অসামান্যা উর্বশীর ঔরসোৎপাদয়ামাস নারীং সর্বাঙ্গসুন্দরীম– আর স্বর্গ থেকে যে-অপ্সরারা ভোলাতে এসেছিলেন ঋষিকে, তাঁদের পরিচর্যার জন্য তিনি আরও অনেক সমতুল্য অপ্সরাদের সৃষ্টি করেন। তারপর যখন উর্বশীকে স্বর্গে নিয়ে যাওয়া হল, তখন এঁরাও উর্বশীর অনুগামিনী হয়ে স্বর্গরাজ্যে চলে গেলেন। এই সম্পূর্ণ কাহিনি থেকে উপাখ্যানের আবরণটুকু ছেড়ে দিলে এইটুকু আমাদের মনে আসে যে, উর্বশী সমস্ত মনুষ্য কুলের তপস্যার ফল এবং তাঁর সৃষ্টির মধ্যে স্বর্গের অলৌকিকতার চেয়েও নর এবং নারায়ণের মানুষী ভাবনাটাই বড় হয়ে ওঠে। সবচেয়ে বড় কথা, সকলের সঙ্গে গদের ঢালে উর্বশীর সৃষ্টি হয়নি, তাঁর সৃষ্টি হয়েছে পৃথকভাবে এবং যে মহাকবি লিখেছিলেন– মুনিগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল। তোমার কটাক্ষপাতে ত্রিভুবন যৌবনচঞ্চল– তিনি কিন্তু এই নর-নারায়ণী কাহিনির নির্যাসটুকু বুঝেছিলেন। স্বর্গের অপ্সরা-লোকে উর্বশী কিন্তু অনেক পরে উড়ে এসে জুড়ে বসলেন। নৃত্যপরা স্বর্গসুন্দরীদের মধ্যে তিনি হয়ে উঠলেন প্রথমা। তাকে ছাড়া ইন্দ্র-সভায় নৃত্য-গীতের আসর আর মানায় না; অবশেষে তিনি উপস্থিত না থাকলে স্বর্গলোকে সুরকুলের আমোদ স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু উর্বশীর এই স্বর্গ-সম্বন্ধ এত গাঢ় হয়ে ওঠা সত্ত্বেও মর্ত্যলোকের সঙ্গে তার যেন কোথায় এক অদৃশ্য টান আছে। তাকে স্বর্গ থেকে মর্তে ফিরে আসতে হয় মাটির টানে।

উর্বশীর কথাটা যেভাবে এখানে বলে ফেলেছি, তাতে তার পূর্ব ইতিহাস কিছু জানানো দরকার। স্বর্গসুন্দরীদের প্রথমা উর্বশী যে নিজের নামে বহুকাল আগেই নৃত্যগীতের নিজস্ব একটা ঘরানা অথবা সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছিলেন, তা এই পূর্বের ইতিহাস থেকেই বোঝা যাবে।

বৃহদ-দেবতা বলে একখানা অতিপ্রাচীন বৈদিক গ্রন্থ আছে, শৌনক ঋষির লেখা। বেদের দেবতা এবং বিভিন্ন ঋকমন্ত্রের প্রয়োগ সম্বন্ধে আলোচনা থাকায় গ্রন্থটির খুব কদর আছে। বৈদিকদের মধ্যে। এই গ্রন্থের এক জায়গায় দেখা যাচ্ছে, মিত্রাবরুণ নামে এক যমজ দেবতা আদিত্য যজ্ঞ দেখতে এসেছেন। সেকালে এমনি যমজ বা যুগল দেবতা ছিলেন। আপনারা অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের নাম শুনে থাকবেন, মিত্রাবরুণও ওইরকম যুগল দেবতা। আবার ওই যুগলদেবতাই পুরাণে-ইতিহাসে মুনি বলে পরিচিত হয়েছেন। ব্যাকরণের ভাষায় এঁরা হলেন দেবর্ষি, যিনি দেবতা, তিনিই ঋষি। তা যাই হোক, দেবতা হন আর মুনিই হন, মিত্রাবরুণ এসেছেন স্বর্গের আদিত্য যজ্ঞে যোগ দিতে। এদিকে উর্বশী… আহা কে যে এই নামখানি দিয়েছিলেন, তার পায়ে নমস্কার– উর্বশী হলেন ইন্দ্রসভার সর্বসেরা নর্তকী। কিন্তু নর্তকী তো আরও অনেকে আছেন, উর্বশী যে সবার সেরা, তার কারণ অন্য। যেমন তার রূপ, তেমনই তার বিদগ্ধতা। উর্বশীর ক্ষমতা তিনি আপন দূরত্ব সম্পূর্ণ বজায় রেখে পুরুষমানুষের মনের উপর তার রূপলাবণ্য এবং বৈদগ্ধ্যের ছায়া ফেলতে পারেন।

এই আদিত্য যজ্ঞেও উর্বশী কিছু করেননি। নৃত্যের ভঙ্গিমায় সূক্ষ্ম বস্ত্রের স্কুটাস্ফুট ব্যঞ্জনায় কোনও দেহতত্ত্ব প্রকাশ করেননি। বাক-বৈদগ্ধ্যে যুগল-ঋষি মিত্রাবরুণ দেবের মনও মুগ্ধ করেননি। ইনি এসেছিলেন আদিত্য যজ্ঞের নেমন্তন্ন খেতে। আর মিত্রাবরুণ এসেছিলেন আদিত্য যজ্ঞের ক্রিয়াকলাপ দেখতে। কিন্তু মুশকিল হল– উর্বশীর চলনেই নাচন, বলনেই গান। যজ্ঞভূমিতে অপরূপা উর্বশীকে দেখে মিত্রাবরুণ আর ঝক মন্ত্রের উদাত্ত-অনুদাত্ত ধ্বনি শুনতে পেলেন না, শুনতে পেলেন না উদগাতার সামগীত, দেখতে পেলেন না অধ্বর্যর ঘৃতহোম। তাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় চক্ষুতে কেন্দ্রীভূত হল এবং সে চক্ষুর আহার্য ছিল একটিই- একা উর্বশী। ক্রমে ক্রমে মুগ্ধতা কামনায় রূপান্তরিত হল, মিত্রাবরুণের তেজ স্খলিত হল– তয়োস্তু পতিতং বীর্যম্।

উর্বশীর কোনও দোষ ছিল না। অবশ্য তার সবচেয়ে বড় দোষ– তিনি তিন ভুবনের সেরা সুন্দরী। মিত্রাবরুণ নিজেদের উন্মাদ কামনার কথা ভাবলেন না, শুধু শরীরের মধ্যে কেন এই অধঃপাত ঘটল, কেন জনসমক্ষে এমন লজ্জিত হলাম, এই দোষেই উর্বশীকে শাপ দিলেন– শাপ দিলেন স্বর্গে আর তোমার থাকা হবে না, সুন্দরী। তোমাকে যেতে হবে মর্ত্যলোকে, মর্ত্যজনের দুঃখ-কষ্ট, ভালবাসা বুঝতে। দেবর্ষিযুগলের অভিশাপ লাভ করে উর্বশীর যে খুব কষ্ট হল, তা আমরা মনে করি না। স্বর্গের নন্দনকানন, পারিজাত ফুলের সৌগন্ধ্য আর ইন্দ্রসভার বিলাস ছেড়ে যেতে হবে, এইটুকুই যা মনে দুঃখ, নইলে পৃথিবীও তার কাছে খুব খারাপ জায়গা নয়। কারণ মর্ত্যভূমির সর্বশ্রেষ্ঠ রাজার ঠিকানা জানা আছে উর্বশীর। তিনি পুরূরবা।

পুরূরবা রাজত্ব করতেন এখনকার ইলাহাবাদের কাছে প্রতিষ্ঠান’ বলে একটা জায়গায়। প্রসিদ্ধ পাণ্ডব-কৌরব বংশের তিনি বহুপূর্ব-পুরুষ। আমার এক আত্মীয়া, আধুনিকা, সুবেশা, সুগঠনা তরুণী। তিনি বাড়ির খাবার একদমই খেতে ভালবাসেন না। বেগুন এবং মুলোকে তিনি বর্বর-রুচির খাদ্য মনে করেন, লাউ উগা সহযোগে ডাল-ছড়ানো তরকারি তার কাছে শ্রাদ্ধকালের পিণ্ডের মতো, আর মাছ। ব্যাপারটা ঝোলে হলেই সেটা বাম-দক্ষিণাঙ্গুলির রমণীয় কম্পাক্ষেপণে ভীষণ ‘মেসি’। তবে এই তরুণী দোকানে দোকানে “ফিশ-ফ্রাই’ খেতে ভালবাসেন। ভালবাসেন ‘চাউ মিঙ’। আমি তাকে একদিন বললাম, তুমি দোকানে যে ‘ফ্রিশ-ফ্রাই’ খাও, সেই মাছগুলো দেখেছ কখনও? আত্মীয়া বলল, দেখার কী আছে? অমন যার স্বাদ, সে মাছও নিশ্চয়ই খুব ভাল হবে। আমি বললাম, নিশ্চয়ই। তবে কিনা, তুমি এত চার দিকে ঘোরাফেরা করো, কত ব্যাপারে ‘ফিল্ড ওয়র্ক’ করো, তিন কোয়াটার পেন্টু পরো, তোমাকে আমি ফিশ-ফ্রাইয়ের সুন্দর মাছগুলি দেখাব। কালই চলো, তবে সকাল সকাল উঠো।

পরের দিন সকালে উঠে তাকে গাড়ি করে একটা নাম করা বাজারে নিয়ে গেলাম। বাজারের খানিক আগেই গাড়ি রেখে হাঁটতে লাগলাম মাছের বাজারের উদ্দেশে, এ-তরুণী জীবনে বাজারেই যায়নি, মাছ দেখবে কোথায়! আর এমনই কপাল! যেতে যেতেই একটি রিকশা চোখে পড়ল– রিকশার পা-দানির ওপর গোটা আটেক ‘বমবে-ভেটকি, যা আমাদের দিশি ভেটকির ধারে কাছেও নয়–না আকারে, না প্রকারে। রিকশার পাদানিতে মাছগুলির লেজ একদিকে ঝুলছে, অপর দিকে মুড়োগুলি প্রায় রাস্তায় ঝুঁকে পড়েছে– এতটাই বড়। মাছগুলির রং পাশুটে, সবুজপ্রায়, মাঝে মাঝে হলদেটে ছোপ, দেহ ভাল রাখার জন্য প্রচুর নুন-হলুদ দেবার ফল আর কী! আমার সুশোভনা আত্মীয়াকে মাছগুলো দেখিয়ে বললাম, এই মাছগুলো চিনিস? সে ‘ওয়াঃ ওয়্যাঃ’ করে প্রায় বমি তুলে বলল, এগুলো কেউ খায়? আমি বললাম, খায় বইকী, তবে তোর মতো এমন ভদ্রলোকেরা খায় না। ধীরে চলমান রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এগুলো কি ভাই ‘বমবে ভেটকি’? সে নির্দয়ভাবে উত্তর দিল বমবে ভেটকি আবার কী? বলুন ‘বমবে ভোলা। আমি বললাম, এগুলো কী তা হলে ভোলা মাছ? সে বলল, মুখখানা কি ভেটকে আছে, বাবু? যে জিজ্ঞেস করছেন? সব ভোলা, সেটাকেই আপনারা বমবে ভেটকি দেখছেন, এখন পাঙাশ মাছেরও ফেরাই হচ্ছে, দোকানে খাবার সময় সব ‘পিউর’ ভেটকি।

সব কথা আমার ভাগনি শুনতে পায়নি, মাছের রূপ দেখে সে খানিকটা দূরেই দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম–চল এবার। কীভাবে ফিশ-ফ্রাইয়ের ‘ফিলে তৈরি হচ্ছে, দেখবি চল। মাছ কাটার জায়গায় পৌঁছোতেই সে উলটে চলতে আরম্ভ করল। দুর্গন্ধের কথা ছেড়েই দিলাম। এক ঝলক সে যা দেখেছে, সবই সেই রিকশায় দেখা মাছ এবং তার ‘ফিলে’ তৈরি করে সেই মাছের লিঙ্গদেহটি ফেলে রাখা রয়েছে টাল দিয়ে। তরুণী নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বেরিয়ে গেল, আমার সঙ্গে ফিরল না এবং আমি কতগুলি পরিচ্ছন্ন ‘ফিলে’ নিয়ে বাড়ি ফিরে বোনকে বললুম– মেয়েটা খাবে। একটু ফ্রাই করার ব্যবস্থা কর। আমার ভাগনি রেগে কেঁদে অগ্ন্যুৎপাতী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি জীবনে আর ফিশ-ফ্রাই খাব না। আমি বললাম– যাঃ এরকম করতে নেই। এ তো অনেক ভাল জিনিস, দোকানে যা খাস সে কহিবার নহে সখি।

আমি এই গপ্পোটাই কেঁদেছিলাম কৌরব-পাণ্ডব বংশের প্রথমাকে বোঝানোর জন্য। বলেছিলাম- এই যে আপনারা বলেন না আমি হচ্ছি লাহিড়ী বাড়ির ছেলে, আমাদের বংশে এসব… ইত্যাদি ইত্যাদি এরকম লাহিড়ীবংশ, বসুপরিবার, রায়পরিবার, সান্যালবংশ আমি অনেক দেখেছি, কার যে কোথায় কী লুকিয়ে আছে, কে যে কোথায় বাঁধা পড়েছিলেন, তারপর কত যুগ আগে কী ঘটে গেছে, আমরা কিন্তু কিছুই জানি না। আর বৃদ্ধ চানক্য শোলোক বেঁধে বলেছিলেন, আর চানক্য বলছি কেন- খোদ গরুড় পুরাণে আছে– এমন কোনও বংশ পৃথিবীতে নেই যার মধ্যে দোষ নেই। এই পৃথিবীতে মেয়েরা আছে এবং কোন মেয়ে যে কার মাথায় কোথায় গিয়ে পড়বে, তা কেউ জানে না, নদীর মতো কুল-ভাসানো গতি তাদের নারীনাঞ্চ নদীনাঞ্চ স্বচ্ছন্দা ললিতা গতিঃ- অতএব বংশ নিয়ে বড় বড় কথা বোলো না, মনে রেখো কিন্তু এই পৃথিবীতে মেয়েরা জন্মেছেন কুলং নির্মলস্তত্র স্ত্রীজনো যত্র জায়তে।

পৌরাণিক কণ্বক-ঠাকুর মেয়েদের ওপর খুব শ্রদ্ধাবশত এ কথা বলেছেন, তা নিশ্চয়ই নয়। হয়তো-বা সম-সামাজিক পৌরুষেয়তায় তালি দেবার জন্য যেন অন্য হাতটি নেই এমনভাবেই কথা বলেন তারা। কিন্তু আমরা তো জানি তাদের গান্ধর্ব, রাক্ষস, পৈশাচ ইত্যাদি প্রায়-বিধিসম্মত বৈবাহিকতার মধ্যেই তো অন্য কুলের মেয়েদের বিধিসম্মত সংক্রমণ ঘটে যায়। সেখানে পরবর্তীকালে লাহিড়ী-মুখার্জি-বসুদের সমস্ত মহাবংশের প্রতি আমার প্রণাম রইল। মৎস্যগন্ধা সত্যবতী ধীবর রাজার মেয়ে তাকে মহাকাব্যিক মাহাত্ম দেবার জন্য কোথায় সেই মগধরাজা উপরিচর বসুর শুক্রসংক্রান্তি কল্পনা করা হয়েছে মৎস্য-গর্ভে। ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর বীজ এল দ্বৈপায়ন ঋষি থেকে, আর পাণ্ডবরা তো সব দেবতার ছেলে। স্বয়ং দুর্যোধন ক্ষত্রিয় রাজাদের জন্মরহস্যের কথা তুলে জ্ঞাতিভাই পাণ্ডবদের দুষেছিলেন সেই অস্ত্রপরীক্ষার সময়ে, যখন অধিরথসূতপুত্র রাধাগৰ্ভজাত কর্ণকে ভীমসেন যা নয় তাই বলছিলেন। তখন দুর্যোধন সাক্ষেপে বলেছিলেন, ওরে আর কথা বাড়াস না। তোদের নিজেদের জন্ম কোথায় কীভাবে হয়েছে, তা কিন্তু আমার ভালরকম জানা আছে– ভবতাঞ্চ যথা জন্ম তদপ্যাগমিতং ময়া। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা এত তর্ক কীসের? বলছি তো, পৃথিবীতে মহা-মহাবীরদের জন্মের উৎস খুঁজতে যাসনে, চেষ্টা করিসনে নদীর উৎস খোঁজার– শূরাণাঞ্চ নদীনাঞ্চ দুর্বিদা প্রভবা কিল। দুর্যোধনের কথাটা তো প্রায় গরুড় পুরাণের মতো হয়ে গেল। দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য– এঁদেরও ছাড়লেন না দুর্যোধন, তাদের জন্ম ঋষিদের ঔরসে হয়েছিল বটে, কিন্তু স্বৰ্গবেশ্যা অপ্সরারাই যে তাদের জন্মের নিমিত্ত হয়ে আছেন, সে-কথা তির্যকভাবে উল্লেখ করতে ভোলেননি দুর্যোধন। আমাদের ধারণা, মহাভারতের বড় বড় অনেক মানুষের জন্ম-মাহাত্ম্যে প্রথাগত বৈবাহিক সংকেত না থাকায়– এইরকম একটা মৌখিক শ্লোকও তৈরি হয়ে গিয়েছিল, যার মর্ম হল– ঋষিদের আর নদীদের আর প্রসিদ্ধ ভরত বংশের মূল খুঁজতে যেয়ো না বাপু– নদীনাঞ্চ ঋষীণাঞ্চ ভারতস্য কুলস্য চ। মূলান্বেষো ন কর্তব্যঃ… ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই ভণিতা থেকে পরিষ্কার যে, এই কথাগুলির একটা ভাল দিকও আছে। অন্তত মহাভারতের কালে মহাভারতের ‘কোর স্টোরি-লাইন’-এর মধ্যে জাতি-বর্ণের ব্রাহ্মণ্য-বিদ্বেষ তৈরি হয়নি এবং এই দৃষ্টি থেকেই আমাদের ভরত-কুরু-কৌরব-পাণ্ডবদের প্রথমাকে খুঁজতে হবে। কিন্তু মুশকিল কী জানেন, মহাভারতের কালের এই কৌলীন্যহীন তথা প্রথাবিরুদ্ধ উদারতা সকলের সহ্য হয়নি এবং প্রসিদ্ধ ভরত-কুরুবংশের মধ্যে এই জন্ম বিষয়ক উদারতা মহাভারতের প্রমাণে সিদ্ধ হলেও ভরতবংশ সম্বন্ধে এই বিসংবাদী কথাগুলিকে অন্য অর্থ দিয়ে শব্দের অভিধা শক্তিকে আবরণ করতে চেয়েছেন অনেকে। আমরা যে একটু আগেই মৌখিকতার ধারায় ভেসে-আসা শ্লোকে নদী, ঋষি আর ভরতবংশের মূল নিয়ে জল্পনা বন্ধ করতে বলেছিলাম, এই শ্লোকের অপর একটি পাঠ গরুড় পুরাণের মধ্যে পাওয়া যায়। সেখানে একটিমাত্র শব্দই শুধু অন্যরকম। এখানে বলা হয়েছে– নদী-সকলের মূল উদ্ভব কোথা থেকে হয়েছে জানার চেষ্টা কোরো না। চেষ্টা কোরো না অগ্নিহোত্রী ঋষিদের মূল অন্বেষণ করতে অথবা ভরত-বংশের মূল অন্বেষণ করতে– নদীনাম অগ্নিহোত্রাণাং ভারতস্য কুলস্য চ।

এখানে পঞ্চানন তর্করত্নমশাই অনুবাদ করেছেন- নদী, অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, ভারত ও কুল ইহাদের মূল অনুসন্ধান করিবে না, যেহেতু মূল অন্বেষণ করিলে দোষ হইতে পারে। আমরা শুধু বলব– ‘অগ্নিহোত্র যজ্ঞে’র মূল ‘ভারতে’র মূল–এই অনুবাদে অর্থটা কি বোকা বোকা অর্থহীন হয়ে গেল না? তবে তর্করত্নের মতো বিশালবুদ্ধি ব্যক্তি এই অনুবাদ নিজে করেননি, জনৈক কৃষ্ণদাস শাস্ত্রীর অনুবাদ তিনি প্রকাশনা সম্পাদনা করেছেন বলেই শাস্ত্রীমশায়ের বেখেয়াল অনুবাদ তিনি খেয়ালই করেননি। খেয়াল করলে বুঝতেন– গরুড় পুরাণের এই অধ্যায়ে অনেক শ্লোকই লোকমুখে প্রচলিত ছিল এবং এগুলি নীতিশ্লোক হিসেবেই চিরকাল চিহ্নিত হয়েছে। অনেক শ্লোকের ঈষৎ-পরিবর্তিত পাঠ আমাদের নীতিশাস্ত্রগুলির মধ্যেও পাওয়া যাবে, আর নৈতিক এই শ্লোকগুলি যেহেতু লোকস্তর থেকে উঠে আসে, তাই এগুলির মধ্যে সামাজিক সমালোচনা, রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি ধিক্কার এবং জাতি বর্ণের চতুর ব্যবস্থার প্রতি বিষোদগারও উঠে আসে। আমরা তাই কৃষ্ণদাস শাস্ত্রীর মতো সংকুচিত অনুবাদ গ্রহণ করব না। বরঞ্চ মহাভারত নিজের মধ্যেই নিজ-সমাজসৃষ্টির যে উদারতা দেখিয়েছে সেটাই মেনে নেব। আমরা মূলান্বেষও করব আমাদের মহাভারতীয় সত্তায় এবং শ্রদ্ধায়।

আপনারা অবহিত আছেন নিশ্চয় যে, পুরাণের বিবরণ অনুযায়ী চন্দ্রবংশের সূচনাতেই একটা গণ্ডগোল হয়েছিল। ভগবান ব্রহ্মা চন্দ্রকে সৃষ্টি করে তাকে অশেষ গ্রহ-নক্ষত্রের এবং সমস্ত ওষধিকুলের আধিপত্য দিলেন। তিনিও রাজসূয় যজ্ঞ-টজ্ঞ করে নিজেকে উচ্চস্থানে প্রতিষ্ঠা করায় মনে মনে একটু অহংকারীও হয়ে পড়লেন। ঠিক এইরকম অবস্থায় তিনি দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে হরণ করে নিজ ভবনে নিয়ে এলেন। ভগবান ব্রহ্মা এবং দেবর্ষিরা অনেকে অনুরোধ করলেও তিনি তারাকে ছাড়লেন না। এতে শেষপর্যন্ত একটা বিশাল যুদ্ধই বেধে গেল এবং প্রৌঢ় দেবতাদের সহায়তায় তারাকে ফেরানো হল বৃহস্পতির কাছে, কিন্তু তখন তারা গর্ভবতী। বৃহস্পতি তারার এই অবস্থা দেখে তাকে ‘অ্যাবর্শনে’র পথ বাতলে দিলেন। তারা গৰ্ভত্যাগ করার পর দেখা গেল বাচ্চাটি অসম্ভব সুন্দর চন্দ্র তো সেই বাচ্চার দিকে সাভিলাষে তাকালেনই, এমনকী বৃহস্পতিও তাকে বেশ পছন্দ করে ফেললেন। এবারে প্রশ্ন উঠতে আরম্ভ করল- বালকটি কার? দেবতারাও বার বার জিজ্ঞাসা করতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু তারা একেবারে নিরুত্তরা। মায়ের এই নিরুত্তর স্বভাব দেখে ছেলে পর্যন্ত রেগে উঠছে। অবশেষে সেই ব্রহ্মার অনুরোধে তারা স্বীকার করলেন– ছেলেটি চন্দ্রের। ব্রহ্মা সানন্দে শৈশব-প্রাজ্ঞ ছেলের নামকরণ করলেন বুধ। এক্ষেত্রে আমাদের ছোট্ট একটু টিপ্পনী এই যে, আপনারা দেখছেন তো নামগুলি– বৃহস্পতি, চন্দ্র, তারা, বুধ– এগুলি সবই তো আমাদের গ্রহ-নক্ষত্রের নাম। হয়তো-বা জন্মমূলে খানিক অলৌকিকতা এবং দেবমাহাত্ম খ্যাপন করে চন্দ্রবংশকে একটা মর্যাদার আসন দেওয়াটা এখানে জরুরি ছিল, একই সঙ্গে তারাহরণ, গর্ভপাত ইত্যাদির মাধ্যমে একটা মনুষ্যোচিত ব্যবহারও এখানে অনুষ্যত হল। চন্দ্রের পরে বুধের জীবন-সঙ্গিনীর মধ্যে তো রীতিমতো আধুনিক বিতর্কের ছায়া পড়েছে। বিষ্ণু পুরাণ জানিয়েছে– মনুর স্ত্রী ইচ্ছা করেছিলেন তার একটি মেয়ে হোক। তাতে যাজ্ঞিকের যজ্ঞপ্রভাবে তার একটি মেয়ে হল। মেয়েটির নাম ইলা। এই ইলা মৈত্রাবরুণের প্রভাবে মনুর পুত্র হয়ে উঠলেন এবং তার একটি পুরুষ-নামও হল, তার নাম সুদ্যুম্ন। এই লিঙ্গপরিবর্তনের ঘটনাটাকে trans-sexualism বলব কিনা জানি না, তবে মহাভারত সেইকালে এমন একটা জীবনোদাহরণ দিয়েছে, এটাই ভীষণ আধুনিক লাগে। পুরাণ বলেছে– সুদুম্ন মনুপুত্রের ওপর আবার নাকি দেবতার অভিশাপ নেমে এল, তিনি আবারও ইলা হলেন। এমন কন্যা অবস্থায় ইলা যখন চন্দ্রপুত্র বুধের আশ্রমের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছেন, তখনই পারস্পরিক আকর্ষণে তাদের মিলন হল এবং ইলার গর্ভে বুধের পুত্র হল– তাঁর নাম পুরূরবা। ইলা নাকি আবারও পুরুষ হয়েছিলেন এবং আগে মেয়ে ছিলেন বলে রাজ্য পাননি। তাকে প্রতিষ্ঠান বলে একটা জায়গা দেওয়া হয়েছিল এবং ইলা সুদ্যুম্ন পুত্র পুরূরবাকেই সেই রাজ্য দান করেন। পুরূরবা কিন্তু বুধের পুত্র হওয়া সত্ত্বেও প্রধানত ইলার ছেলে ঐল পুরূরবা হিসেবেই বেশি বিখ্যাত ছিলেন; হয়তো মা ইলার জীবনে trans-scxualism-এর ব্যাপারটা বেশি প্রথিত হওয়ায় পিতার নামের চেয়েও পুরূরবা ইলার নামেই বেশি বিখ্যাত হয়েছিলেন।

পুরূরবা যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনই তেজস্বী। তৎকালীন দিনের ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে রাজা হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠান নগরকে যথেষ্ট পরিমাণ উন্নত করেছিলেন এবং সেটা এতটাই যে হস্তিনাপুরী প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত এই বংশের বড় বড় রাজা যযাতি, পুরু, দুষ্যন্ত, ভরত সকলেই এই প্রতিষ্ঠানে রাজত্ব করে গেছেন। প্রতিষ্ঠান নগরের অবস্থিতি ছিল এলাহাবাদের উলটো দিকে ঝুসি নামে একটা জায়গায়। গঙ্গার ধার-বরাবর এই জায়গাটাকে এখনও প্রতিষ্ঠানপুর বলেন অনেকে। পুরূরবা এখানেই রাজত্ব করতেন। চন্দ্রবংশে পুরূরবাই বোধহয় সেই প্রধান মৌল পুরুষ, যাঁর সময় থেকে ঈষৎ অলৌকিক যে পিতৃ-পরিচয় আকাশের চাঁদ, বুধ গ্রহ এবং ইলার মতো দ্বৈত-যৌনতার বিষয় থেকে সরে গিয়ে প্রথম একটা পার্থিব মানুষকে দেখতে পাচ্ছি। এই বংশে পরবর্তী কালে বহুবিখ্যাত রাজারা অনেকেই জন্মেছেন- একেবারে নহুষ-যযাতি থেকে আরম্ভ করে দুষ্যন্ত-ভরত-কুরু এবং সর্বশেষে কৃষ্ণ-পাণ্ডব-কৌরব- সকলের বংশমূল পুরূরবা এবং তারা হয়তো পুরূরবার চেয়েও হাজার গুণ বেশি বিখ্যাত। কিন্তু তাই বলে পুরূরবার বিখ্যাতি কিছু কমে না। তিনিই বোধহয় সেই প্রথম পার্থিব পুরুষ যার জন্য পার্থিব প্রেমকল্প প্রথম বুঝতে পেরেছি আমরা। তিনিই বোধহয় প্রথম সেই পুরুষ, যাঁর কামনায় স্বর্গসুন্দরী উর্বশী স্বর্গ ছেড়ে নেমে আসেন ভুয়ে এবং তিনিই বোধহয় প্রথম সেই পার্থিব পুরুষ, যার জন্য আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলা ‘নাটকে’র উৎপত্তি ঘটেছে। কালিদাসের ‘বিক্ৰমোবশীয়’ নাটকের নায়ক বিক্রম আদিপুরুষ পুরূরবার ছায়ামাত্র। পুরূরবা এমনই এক পুরুষ যে, পুরুষমানুষ হওয়া সত্ত্বেও পৌরাণিকেরা তার সুরূপের কথা না বলে পারেননি সগুণশ্চ সুরূপশ্চ প্রজারঞ্জনতৎপরঃ।

মনের মধ্যে তার রাজোচিত উৎসাহ-উদ্যমের কোনও অভাব ছিল না, ফলে শত্রুরাজ্যের কাছে তিনি ছিলেন কৃতান্তের মতো। অন্যদিকে তাঁর আদেশ-নির্দেশের মধ্যে এমনই এক ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠত যে, মাথা নুইয়ে তাঁর আদেশ-নির্দেশ পালন করা ছাড়া গত্যন্তর থাকত না– সদৈবোৎসাহশক্তিশ্চ প্রভুশক্তিস্তথোত্তমা। মর্ত্যলোকে এই গুণী রাজাকে উর্বশী আগে থেকেই চিনতেন। পুরাণগুলিতে যেমন আছে, তাতে দেখছি– মিত্রাবরুণের শাপ (দেবীভাগবত পুরাণে কিন্তু প্রজাপতি ব্রহ্মার দ্বারা শাপগ্রস্ত হয়েছেন উর্বশী ব্রহ্মশাপাভিতা সা) লাভ করেই উর্বশী স্বর্গ ছেড়ে নেমে আসলেন ভুয়ে আর স্বামী হিসাবে বরণ করে নিলেন পুরূরবাকে। উর্বশী নাকি তার নাম-ধাম আর গুণ-গান শুনেই মুগ্ধ হয়েছিলেন শ্রুত্বোৰ্বশী বশীভূতা। কিন্তু বিভিন্ন পুরাণের অন্য জায়গাগুলো ঘাঁটলে বোঝা যাবে– উর্বশী পুরূরবাকে পূর্বে দেখে থাকবেন।

সেকালে মর্ত্যভূমিতে যাঁরা বড় বড় রাজা হতেন তারা তাদের জ্ঞান, বলবত্তা এবং ঐশ্বর্যের মহিমায় শুধু যে দেবরাজের সঙ্গে তুলনীয় হতেন– তাই নয়, অপিচ স্বর্গে তারা নিয়মিত যাতায়াত করতেন। মাঝে মাঝে দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গেও মর্ত্যরাজাদের এমন বন্ধুত্ব জমে উঠত যে, স্বর্গের ইন্দ্র তাদের খাতির করে নিজের অর্ধাসন ছেড়ে দিতেন তাদের আপ্যায়ন করার জন্য। পুরূরবাও ছিলেন এই ধরনের এক রাজা। মৎস্যপুরাণ লিখেছে– কীর্তি চামরগ্রাহিণী দাসীর মতো তার অঙ্গসংবাহিকা হয়েছিলেন। ভগবান বিষ্ণু এতই প্রসন্ন ছিলেন পুরূরবার উপর যে, সেই সু-দৃষ্টির ফলে দেবরাজ ইন্দ্রও তাঁর অর্ধাসন ত্যাগ করতেন মর্ত্য রাজার সম্মানে। এই পুরূরবা যখন সসাগরা পৃথিবীর রাজা, সেই সময় ইন্দ্রের প্রতিপক্ষ দানব রাজা কেশী তার অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছিলেন সর্বত্র। পুরূরবা বহুবার কেশীকে পরাজিত করেছেন এবং আরও একবার কেশী দানবের সঙ্গে তার সংঘাত হল। কিন্তু এইবার সংঘর্ষের কারণ ছিলেন উর্বশী।

রাজা পুরূরবা একদিন বেড়াতে বেরিয়েছেন তার দক্ষিণ-আকাশবাহী রথে চড়ে। হঠাৎ তিনি দেখলেন– দানবেন্দ্র কেশী স্বর্গের সেরা নর্তকী উর্বশী এবং চিত্রলেখা নামে দুই অপ্সরাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন– কেশিনা দানবেন্দ্রেণ চিত্রলেখা অথোর্বশীম।

পুরূরবা চিত্রলেখাকে না চিনলেও উর্বশীকে নিশ্চয়ই চিনতেন। স্বর্গসুন্দরী উর্বশীর এই বিপদে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিলেন কেশীকে। কেশী যে উর্বশীকে তুলে নিয়ে আসছিলেন স্বর্গ থেকে, সে কিন্তু ইন্দ্রকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েই শক্রোহপি সমরে যেন চৈবং বিনির্জিতঃ। কিন্তু পুরূরবাকে কেশী ভয় পান। পুরূরবা সঙ্গে সঙ্গে বায়ব্যাস্ত্রে কেশী দানবের পথ রুদ্ধ করে উর্বশীকে তুলে নিলেন নিজের রথে। আহা! বেচারা চিত্রলেখা। পৌরাণিক তাঁর কথা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করলেন না। পুরূরবা শুধু উর্বশীকে নিজের রথে তুলে নিয়ে তাকে পৌঁছে দিলেন দেবরাজের আস্তানায়। কৃতজ্ঞতার কারণে সমস্ত দেবতাদের সঙ্গে তার গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেল– মিত্রত্বমগমদ দৈবৈৰ্দদাবেন্দ্রায় চোবশীম।

তাই বলছিলাম, অন্তত উর্বশীকে পুরূরবা চিনতেন এবং অবশ্যই উর্বশীও পুরূরবাকে। এবারে আরও একটা ঘটনা বলি। পুরূরবা যেভাবে ইন্দ্রজয়ী কেশীকে পরাস্ত করে উর্বশীকে উদ্ধার করেছিলেন, তাতে তারও একটা ‘হিরো-ওয়ারশিপ’ তৈরি হয়েছিল রাজার উপর।

উর্বশীকে ফিরে পাওয়ার ফলে স্বর্গে একেবারে উৎসবের আবহাওয়া চলে এল। নৃত্যগুরু ভরত মুনিকে তলব করে ইন্দ্র বললেন নাটক দেখানোর ব্যবস্থা করতে। ভরত মুনি বললেন, কোনও ব্যাপারই নয়। আমাদের লক্ষ্মী-স্বয়ংবর’ নাটক একেবারে তৈরিই আছে, আর তাতে ‘হিরোইন’ হলেন স্বয়ং উর্বশী।

নাটক আরম্ভ হল। ভরত মুনি মেনকা উর্বশী এবং রম্ভাকে নাচার ইঙ্গিত করলেন– মেনকাম উর্বশীং রম্ভাং নৃত্যতেতি তদাদিশৎ। উর্বশী অভিনয় করছিলেন স্বয়ং লক্ষ্মীর ভূমিকায়। তিনিই প্রধান নায়িকা। কিন্তু পুরূরবাকে দেখা ইস্তক তার এমনই মনের অবস্থা যে, তিনি শুধুই মুখে পুরূরবার নাম নিয়ে গান করেন। কিন্তু মনের মধ্যে যাই থাক, অভিনয়ের সময় তো আর পুরূরবার কথা বললে চলবে না, লক্ষ্মী-স্বয়ংবর’ নাটকে তার লক্ষ্মীর পার্ট বলার কথা। উর্বশী নাচতে নাচতে শুধুই পুরূরবার দিকে তাকান, মনেও তিনি পুরূরবার কথা ভাবেন এবং এক সময় লক্ষ্মীর পার্টটাই ভুলে যান– বিস্মৃতাভিনয়ং সর্বং যৎ পুরা ভরতোদিতম। ভরত মুনির রাগ হয়ে গেল ভীষণ। তিনি অভিশাপ দিলেন– তোকে মর্ত্যভূমিতে লতা হয়ে জন্মাতে হবে আর ওই পুরূরবা হবে একটা পিশাচ।

আমরা দু-দুটো শাপের কথা শুনলাম। একটা মিত্রাবরুণ, যুগল-ঋষির শাপ, দ্বিতীয়টা ভরতমুনির শাপ। প্রথম শাপের কথা আছে দেবীভাগবতপুরাণে, দ্বিতীয় শাপের কথা পেলাম মৎসপুরাণে। এবারে এই দুই শাপের শেষে আমাদের উপজীব্য হল শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ। শুকদেব জানাচ্ছেন– মিত্রাবরুণের শাপের কথা উর্বশীর মনে ছিল। কিন্তু ‘মর্ত্যলোকে যাও’ বললেই তো আর হল না। উর্বশীর মতো এক অসামান্যা রূপসি মর্ত্যলোকে বাস করবেন। তা তিনি তো আর যার তার ঘরে গিয়ে বেঁটে-খাটো-মোটা-কালো একটা লোককে নিজের প্রেম উপহার দিতে পারেন না। তিনি বিদগ্ধা রসিকা বটে, মর্ত্যভূমিতে নেমে এলেও তিনি এমনই একজনকে স্বামীত্বে বরণ করতে চাইবেন, যাকে তার ভাল লাগবে। উর্বশী তাই ভাবছিলেন। হয়তো এই ভাবার সময়টুকু মিত্রাবরুণ দিয়েছিলেন।

ভাগবত পুরাণ বলছে– নারদ মুনিও নাকি ইন্দ্রসভায় বারবার তাঁর বীণার ঝংকারে পুরূরবার সম্বন্ধেই গান গাইছিলেন। গান শুনে উর্বশীর প্রাণ-মন আকুল হয়ে গেল। ভাবলেন- এই তো সেই মানুষ, যে তার প্রেমের মর্ম বুঝবে। আর শুধু প্রেমই তো নয়, এ হল লক্ষ্মী-স্বয়ংবর নাটকের সবচেয়ে দামি তারকার প্রেম। এ প্রেম বিনা পয়সায় হয় না। উর্বশী যে পুরূরবাকেই নিজের প্রেমের যোগ্য বলে ভাবলেন তার কারণ আগেই জানিয়ে দিয়েছে অন্যান্য পুরাণগুলি। পুরূরবার শুধু প্রেম নয়, আর কী আছে? উর্বশী শুনেছেন– সে রাজার রূপ-গুণ-চরিত্র যেমন, তেমনই আছে আধুনিকের উদারতা! তার অতুল ঐশ্বর্য এবং ক্ষমতার কথাও উর্বশী শুনেছেন- তস্য রূপ-গুণৌদার্য-শীল-দ্রবিণ বিক্রমান। এসব খবর পেয়েই উর্বশী এসেছেন পুরূরবার কাছে।

এ পুরাণ, সে পুরাণ যাই বলুক, পুরূরবার ব্যাপারে উর্বশীর কিন্তু ভালবাসাও ছিল। বেদের মন্ত্রগুলি পড়লে আমার অন্তত সেইরকমই লাগে এবং বেদের সেই প্রেমের সুরটুকু একমাত্র ধরে রেখেছে বিষ্ণু পুরাণ। এই পুরাণে বলা আছে– পুরূরবাকে দেখামাত্রই স্বর্গসুন্দরীর অভিমান-মঞ্চ থেকে নেমে এসে, স্বর্গসুখের সমস্ত অভিলাষ ত্যাগ করে– অপহায় মানম্ অশেষ অপাস্য স্বর্গসুখাভিলাষ উর্বশী একেবারে তন্মনা হয়ে রাজার কাছে উপস্থিত হলেন। স্বর্গসুন্দরী আজ মাটির ধুলোয় নেমে এসে পুরূরবার কাছে কী চাইছেন? রাজা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। বললেন, সুন্দরী আমার! দাঁড়িয়ে কেন? বোসো। কী করতে পারি তোমার জন্য আস্যতাং করবাম কিম? উর্বশী কাছে এলেন। তারপর ইনি দেখলেন ওঁকে আর উনি দেখলেন এঁকে। দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে তন্ময় হয়ে গেলেন। দু’জনেই চাইলেন দু’জনকে।

রাজা বললেন– সুভ্রু! আমি তোমাকে চাই। তুমি খুশি হয়ে আমাকে ভালবাসবে এই আমি চাই। আমাদের ভালবাসা হোক চিরকালের–রতির্নো শাশ্বতীঃ সমাঃ। মর্ত্যভূমিতে নেমে স্বর্গের অপ্সরাও রাজার কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেন– লজ্জাবখণ্ডিতমুখী। উর্বশী বললেন– সুন্দর আমার। তোমাকে দেখার পরেও তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে না, তোমাকে মন দেবে না, এমন মেয়ে আছে নাকি তিন ভুবনে কস্যাস্তয়ি ন মজ্জেত মনো দৃষ্টি সুন্দর। হৃদয়ের সমস্ত উচ্ছ্বাস দিয়ে পুরূরবার কাছে আত্মনিবেদন করার পরেও উর্বশী কিন্তু নিজেকে সম্পূর্ণ উজাড় করে দিতে পারলেন না। বললেন– রাজা, তোমাকে দেখা অবধি আমার মন জ্বলছে রিরংসায়। কিন্তু তবু আমার একটা শর্ত আছে, রাজ।

সুরলোকের শ্রেষ্ঠতমা রূপসির রিরংসার কথা জেনেও পৃথিবীতে এমন কোনও পুরুষমানুষ আছে যে তার শর্তে রাজি না হবে? পুরূরবা বললেন, বলো তোমার শর্ত। উর্বশী দুটি মেষ শাবকের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, মহারাজ, এই দুটিকে আমি পুত্রস্নেহে লালন করেছি। এই দুটি আমার শয্যার দুই পাশে বাঁধা থাকবে, এদের সরানো চলবে না। উর্বশী এবার বললেন, আমি তোমাকে মৈথুনের সময় ছাড়া অন্য কোনও সময় নগ্ন দেখতে চাই না, রাজা। এবং আমাকে অন্য কিছু খাবার জন্য অনুরোধ করবে না তুমি, আমি শুধুই ঘি খেয়ে থাকব– ঘৃতং মে বীর ভক্ষ্যং স্যান্নেক্ষে ত্বান্যত্র মৈথুনাৎ।

পুরূরবা রাজি হলেন উর্বশীর শর্তে। তারপর উর্বশীর রমণ-সুখে তার দিনরাত কোথা দিয়ে যেতে লাগল তা টেরও পেলেন না রাজা। উর্বশীকে নিয়ে কখনও তিনি চৈত্ররথের বনে, কামনার মোক্ষম অলকাপুরীতে বেড়াচ্ছেন, কখনও-বা মানসসরোবরে কমল-কলির মধ্যে জলক্রীড়া করছেন, কখনও বা স্বর্গসুন্দরীর সঙ্গে বিজন রহস্যালাপ চলছে বহুক্ষণ ধরে। রাজার ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে উর্বশীও তাকে ভালবাসা দিলেন অনেক, এমনকী আর কখনও স্বর্গে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছাও তার হত না– প্রতিদিন-প্রবর্ধমানানুরাগা অমরলোকবাসেহপি ন স্পৃহাং চকার।

এদিকে কতকাল উর্বশী স্বর্গে নেই– দেবতা, গন্ধর্ব এমনকী অপ্সরাদেরও আর ভাল লাগে না। দেবরাজ ইন্দ্রের বৈজয়ন্ত প্রাসাদে নাচের আসর আর সেভাবে জমেই না। দিনের পর দিন উর্বশীহীন রঙ্গমঞ্চ দেখে ইন্দ্রের মনে রীতিমতো কষ্টের সঞ্চার হল। একদিন তো নর্তক গন্ধর্বদের ডেকে তিনি মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন আমার আর ভাল লাগে না, উর্বশী নেই এমন সভা মানায় নাকি উর্বশীরহিতং মহ্যমাস্থানং নাতিশোভতে। ইন্দ্রের মনোভাব বুঝে স্বর্গের সিদ্ধ-চারণ-গন্ধর্বেরা ঠিক করল- যে করেই হোক উর্বশীকে ফিরিয়ে আনতে হবে ধরাধাম থেকে।

কিন্তু সোজা পথে তো আর এ কাজ করা যাবে না। পুরূরবা প্রকৃষ্ট গব্যঘৃতের সরবরাহ ঠিক রেখেছেন, অতএব উর্বশীর খাবার কোনও কষ্টই নেই। শয্যার পার্শ্ববর্তী মেষদুটি এখন রাজারও স্নেহধন্য, আর রুচিশীল মর্ত্যরাজার বিনা কারণে উলঙ্গ হওয়ারও কোনও প্রশ্ন আসে না। উর্বশী স্বর্গের কথা ভুলে গিয়েছেন, বরঞ্চ মর্তের প্রেমে এখন তিনি গভীরভাবে লালায়িত। এতসব দেখে গন্ধর্ব বিভাবসু আরও সব গন্ধর্বদের নিয়ে উর্বশীকে রাজার হৃদয় থেকে সরিয়ে আনার চক্রান্ত করলেন। একদিন গভীর রাতে, অন্ধকার যখন প্রায় গ্রাস করে ফেলছে প্রতিষ্ঠানপুরের রাজপ্রাসাদ, সেইসময় গন্ধর্ব বিভাবসু অন্য গন্ধর্বদের সঙ্গে এসে সবার অলক্ষিতে রাজার অন্তঃপুরে ঢুকলেন।

রাজা তখন বিবস্ত্র অবস্থায় উর্বশীর সঙ্গে শুয়ে আছেন। গন্ধর্বরা উর্বশীর শয্যার পাশ থেকে একটি মেষশাবক তুলে নিয়ে চলে গেল। মেষের ডাক শুনে মাঝরাতেই উর্বশীর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি বলে উঠলেন– আমি নিশ্চয়ই অনাথ, নইলে আমার ছেলের মতো মেষশাবকটিকে হরণ করবে কে? হায় হায় কী করি, কার কাছেই বা যাই!

পুরূরবা সব শুনলেন, কিন্তু উর্বশী তাকে নগ্ন অবস্থায় দেখে ফেলবেন– এই ভয়ে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন না– নগ্নং মাং দেবী দ্রক্ষ্যতীতি ন যযৌ। রাজাকে নির্বিকার দেখে গন্ধর্বরা এবার দ্বিতীয় মেষটিকেও হরণ করল। উর্বশী আবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন– এক রত্তি ক্ষমতা নেই, অথচ দেখায় যেন ওঁর কত ক্ষমতা। আসলে একটা নপুংসক স্বামীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আমার কুনাথেন নপুংসসা বীরমানিনা। নইলে আমার ছেলে নিয়ে যাচ্ছে চোরে, আর উনি! পুরুষমানুষ বাইরে গেলে মেয়েছেলে যেমন দরজা বন্ধ করে দিনের বেলা ঘুমায়, সেইরকম ঘুমোচ্ছেন– যঃ শেতে নিশি সন্ত্ৰস্তো যথা নারী দিবা পুমান।

পুরূরবা আর থাকতে পারলেন না। সেই বিবস্ত্র অবস্থাতেই বিছানা ছেড়ে উঠে খঙ্গ হাতে নিয়ে বেরোলেন উর্বশীর মেষশাবক ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু যেই না তিনি বেরোতে যাবেন, এই সময় গন্ধর্বরা বিদ্যুতের স্ফুরণ ঘটাল আকাশে। চকিত ক্ষণপ্রভায় উর্বশী দেখলেন– রাজা উলঙ্গ। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজবাড়ি থেকে চলে গেলেন অন্যত্র– তৎপ্রভয়া চোৰ্বশী রাজান অপগম্বরং দৃষ্টা অপবৃত্তসময়া তৎক্ষণাদেব অপক্রান্তা। রাজা তো এই মারি কি সেই মারি করে বেরিয়েছিলেন, এদিকে গন্ধর্বরা কাজ হয়ে গিয়েছে দেখে মেষশাবক ফেলে রেখে পালাল। রাজা পরম পুলকে মেষদুটি কোলে করে বাড়ি ফিরে দেখলেন উর্বশী নেই। উর্বশীর প্রেমে আকুল পুরূরবা সেই নগ্ন অবস্থাতেই উন্মত্তের মতো বেরিয়ে পড়লেন উর্বশীকে খুঁজতে– তাঞ্চ অপশ্যন অপগতাম্বর এব উন্মত্তরূপো বভ্রাম। এখানে-সেখানে পরিচিত-অপরিচিত নানা জায়গায় খুঁজে পুরূরবা উপস্থিত হলেন কুরুক্ষেত্রে। দেখলেন এক কমল-সরোবরে অন্যান্য অনেক অপ্সরাদের সঙ্গে জলক্রীড়ায় মত্ত উর্বশী।

এই যেটুকু বললাম এ হল ঋগবেদে বলা পুরূরবা-উর্বশী সংলাপ-সূক্তের অগ্রভাগ যা বেদে নেই, অথচ নানা পুরাণে বর্ণিত আছে। এইবার আমরা খোদ ঋগবেদের সংলাপ-সূক্তে দেখব– উর্বশী বোধহয় রাজাকে দেখেই নানা বিভঙ্গে চলে যেতে চাইছিলেন, আর অমনি পুরূরবার বারণ শুরু হল বৈদিক ভাষায়– হয়ে জায়ে মনসা তিষ্ঠ ঘোরে প্রিয়া আমার। জায়া আমার। এত নিষ্ঠুর তোমার মন! দাঁড়াও, এত তাড়াতাড়ি চলে যেয়ো না। তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। মনের কথা এখনই যদি পরিষ্কার করে না বলি, তা হলে অনেক অসুবিধা হবে পরে। উর্বশী নির্বিকারচিত্তে বলে উঠলেন– তোমার সঙ্গে থা বলে আমার কী হবে– কিমেতা বাঁচা কৃণবা তবাহং– আমি প্রথম ঊষার আলোর মতো মুছে গিয়েছি তোমার জীবন থেকে। হাওয়াকে যেমন ধরে রাখা যায় না আলিঙ্গনের মুদ্রায়, না বাহুতে, তেমনই তুমিও আমাকে ধরে রাখতে পারবে না। তুমি ঘরে ফিরে যাও– পুরূরবঃ পুনরস্তং পরেহি।

পুরাবিদ পণ্ডিতেরা আধুনিক দৃষ্টিতে বলেন– পুরূরবা হলেন সূর্যের প্রতীক, তিনি সৌর নায়ক। আর উর্বশী হলেন ঊষা, “উর্বশী’ শব্দের একটা অর্থও তাই। সূর্যের উদয় হলে শুধু যে অন্ধকার দূরে যায় তাই নয়, রক্তিম বসনে সাজা সুন্দরী ঊষাও আর থাকে না। আলোয় আলোয় জ্বলে ওঠা নগ্ন সূর্যকে উর্বশী ঊষা ছেড়ে চলে যায়, আর সেই নগ্ন-তেজের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে তার সারাদিনের হাহাকার। অল্পক্ষণের মিলনে সে শুধু বলে না, এত তাড়াতাড়ি যেয়ো না, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে কত!

সূর্য-ঊষার এই রূপক-সংলাপের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিলেও বৈদিক ঋষির প্রেমের ভাবনাটা ব্যর্থ হয় না কিছু। উর্বশীর কথা শুনে পুরূরবা বললেন তুমি নেই, তাই আমার তুণীর থেকে বাণ বেরোয়নি একটাও, যুদ্ধে গিয়ে ধরে আনতে পারিনি শত্রুর গোধন। রাজকার্য বীরশূন্য, শোভাহীন, সৈন্যেরা সিংহনাদ করা ছেড়ে দিয়েছে। অর্থাৎ উর্বশী ছাড়া পুরূরবার সমস্ত দৈনন্দিন কাজ আটকে গিয়েছে। এখনও তিনি সরোমাঞ্চে স্মরণ করেন- কীভাবে উর্বশী শ্বশুরের ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়েই পুরূরবার ঘরে আসতেন রমণ-সুখ অনুভব করার জন্য। উর্বশীও বলেন- রাজা আমার। প্রতিদিন তিনবার তুমি আমায় আলিঙ্গন করতে– ত্রিঃ স্ম মাহ্নঃ শ্লথয়ো বৈতসেন। কোনও সপত্নীর সঙ্গে আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না, তুমি শুধু আমাকেই সুখী করতে। তুমি আমার রাজা, তুমি আমায় সমস্ত সুখ দিয়েছ।

কিন্তু এত সুখ পেয়েও উর্বশী রাজাকে চিরতরে ছেড়ে এসেছেন। এখন তার বক্তব্য–তুমি ফিরে যাও এখান থেকে, আমাকে আর তুমি পাবে না পরে হি অস্তং নহি মূরমাপঃ।

উর্বশীর কথা শুনে পুরূরবার হৃদয় ভেঙে গেল। নৈরাশ্যের যন্ত্রণায় তিনি শেষ ঋক মন্ত্র উচ্চারণ করলেন এবং সে মন্ত্রই বোধহয় সমস্ত বিরহ-পদাবলীর প্রথম সংজ্ঞা। পুরূরবা বললেন– তুমি যখন আর ফিরে আসবে না, তবে পতন হোক তোমার প্রণয়ীর। সে যেন আর কোনওদিন দাঁড়ানোর শক্তি না খুঁজে পায়– সুদেবো অদ্য প্রপতেদনাবৃৎ। পরাবতং পরমাং গন্তবা উ। সে যেন কালরাত্রির কোলে ঘুমিয়ে পড়ে, ক্ষুধার্ত নেকড়েরা যেন খেয়ে নেয় তাকে। উর্বশী এতকালের সহবাস-চেতনায় সান্ত্বনা দিলেন রাজাকে। বললেন– পুরূরবা! অমন করে বোলো না তুমি এমন করে মরণ চেয়ো না। তুমি কি জানো না– মেয়েদের হৃদয়টাই নেকড়ের হৃদয়ের মতো, মেয়েদের ভালবাসা স্থায়ী হয় না– ন বৈ স্ত্রৈণাণি সখ্যানি সন্তি। সালাবৃকাণাং হৃদয়ান্যেতা।

আমি সত্যিই ভাবতে পারি না যে, খ্রিস্টজন্মের দুই আড়াই বছর আগে আমরা এইরকম অসামান্য কবিতা লিখেছি। পৃথিবীর অন্যাংশের মানুষ যখন কঁচা মাংস খাচ্ছে, তখন আমরা মিলন-বিরহের জীবন-নাটকের কথা লিপিবদ্ধ করছি এই নাটকীয় ভাবনায়।

বিষয়বস্তু হিসেবে আরও লক্ষণীয় হল- একজন স্বর্গসুন্দরী অপ্সরার এই মানসিক সংশ্লেষ। একজন মর্ত মানুষের জন্য তার হৃদয় এতটাই ভগ্ন হয় যে, তিনি নিজেও আড়াল খোঁজেন সমগ্র স্ত্রীজাতির প্রণয়স্বভাবের অন্তরালে। ফ্রেইলটি! দাই নেম ইজ উওম্যান’ এ কথা তো সেদিন লিখলেন শেক্সপীয়র এবং তাও তিনি সেটা পুরুষের মুখে বসিয়ে দিয়ে স্ত্রীজাতির উদ্দেশে পৌরুষেয় আক্রোশ প্রচার করে দিলেন সাধারণী ব্যঞ্জনায়। কিন্তু যে-রমণী নিজের মুখে নিজের ক্রুরতা প্রকট করে তোলে প্রণয়ীর কাছে, প্রেমিকা হিসেবে সে কিন্তু নিজের অসহায়তার জায়গাটাই শুধু প্রমাণসহ করে তোলে না, একই সঙ্গে সে স্বর্গসুন্দরীর অভিমান-মঞ্চ থেকে মাটির ধূলিতে নেমে আসে; প্রণয়ী পুরূরবার সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করতে না পারার যন্ত্রণাটা তাঁকে বিরহিণীর ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করে।

উর্বশী ফেরেননি। স্বর্গের আগ্রাসনে ফেরার উপায় ছিল না তার। পুরূরবা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন। এই বুক ভাসানো বিরহ দিয়েই রচিত হয়েছে কবি কালিদাসের ‘বিক্রমোর্বশীয়’ নাটকের অন্তরভাগ। পুরাণে বর্ণিত ভরত মুনির যে অভিশাপে লতা হয়ে থাকবেন উর্বশী তাও কালিদাস কাজে লাগিয়েছেন কবিজনোচিত সমব্যথা নিয়ে। আমাদের পুরাণকারের হৃদয় অবশ্য বড়ই দয়াপ্রবণ। তারা পুরূরবাকে একেবারে নিরাশ করেননি। রাজা যখন পদ্ম সরোবরের তীরে দাঁড়িয়ে উর্বশীকে বারবার ফিরে আসার অনুরোধ জানাচ্ছেন, তখন উর্বশী বললেন– কেন এমন অবিবেচক পাগলের মতো করছ! আমার গর্ভে তোমারই ছেলে আছে। তুমি ঠিক এক বছর পরে আবার এইখানে ফিরে এসো। তখন তোমার ছেলেকে তোমারই কোলে দেব, আর সম্পূর্ণ এক রাত্রি ধরে তোমার সঙ্গে মিলন সঙ্গম উপভোগ করব আমি– সংবৎসরান্তে হি ভবানেকরাত্রং ময়েশ্বরঃ রংস্যতি।

পুরূরবা বড় খুশি হয়ে রাজধানীতে ফিরলেন– তবু তো এক রাত্রির জন্য তিনি পাবেন উর্বশীকে। পুরূরবা ফিরে চলে গেলে কমলসরোবরের যত স্নান-সহচরী অপ্সরারা ঘিরে ধরল উর্বশীকে। উর্বশী বললেন, ইনিই আমার সেই পুরুষ-রত্ন পুরূরবা, যাঁর ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে এতকাল তারই সহবাসে দিন কেটেছে আমার। অপ্সরারা বলল– কী সুন্দর! কী সুন্দর! ইচ্ছা হয় ভাই, আমরাও এমন পুরুষের সঙ্গে রসে-রমণে সারা জীবন কাটিয়ে দিই– অনেন সহাস্মকমপি সর্বকালমভিরন্তুং স্পৃহা ভবেদিতি।

পুরূরবা কিন্তু এমনটি চান না। উর্বশী ছাড়া দ্বিতীয় কোনও সত্তা তার হৃদয় অধিকার করে না। এক বছর পরে তিনি আবার এসেছেন উর্বশীর সংকেতিত স্থানে। একটি দুর্লভ রাত্রি উর্বশীর সহবাসে ক্ষণিকের মধ্যে কেটে গেল। অবশ্য রাজা তার প্রথম পুত্র ‘আয়ু’-কে লাভ করলেন এরমধ্যে এবং দ্বিতীয় পুত্রের গর্ভাধান করে এলেন। উর্বশীর সঙ্গে মাত্র পাঁচ রাত্রির আঙ্গিক মিলনের অধিকারে পুরূরবা আরও পাঁচটি পুত্রের জনক হওয়ার সুযোগ। পেয়েছিলেন, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, পাঁচ বছরে পাঁচটি রাত্রি মাত্র ভিক্ষা পেয়েও পুরূরবা উর্বশীকে স্মরণ করেছেন আরও গভীরভাবে। এই স্মরণের অনন্যতার মধ্যেই উর্বশী বুঝেছেন পুরূরবা তাকে ছাড়া জানেন না। পুরূরবাকে তিনি বলেছেন– আমাকে তুমি এত ভালবাস, তাই আমার সন্ধতায় গন্ধর্বরা তোমার উপর খুশি হয়েছেন। তুমি বর চাও তাঁদের কাছে। রাজা বর চাইলেন এবং তাদেরই করুণায় হোম করে তিনি একাত্ম হলেন উর্বশীর সঙ্গে উর্বশীলোকে।

বেদ-পুরাণের এই কাহিনির শেষে এসে সেই ডি. এইচ. লরেন্স-এর কথাটা বড় সার্থক মনে হয় আমার And most harlots had somewhere a streak of womanly generos ity…plenty of harlots gave themselves, when they felt like it, for nothing. 76517 নন্দনকানন ছেড়ে আসাটা কোনও অভিশাপই ছিল না উর্বশীর কাছে, এমন কোনও স্ফীত বোধও কাজ করে না তার মনে যে, তার নৃত্য-গীত, তার বৈদগ্ধ্য একমাত্র দেবরাজ ভোগ্য কোনও পণ্য বস্তু। বরঞ্চ সুরলোকের প্রয়োজন সাধক যান্ত্রিক আগ্রাসন তাকে বিপ্রতীপভাবে এক অযান্ত্রিক মর্ত্যপ্রেমের সন্ধান দিয়েছে, যেখানে এক স্বর্গবেশ্যা সুরসুন্দরী জননী হবার আস্বাদন চেয়েছেন মর্ত মানুষের কাছে। উর্বশীর সূত্র ধরেই বলি– এটা বোধহয় ভারতীয় সভ্যতার একটা ট্রেইট’-ই বটে যে, আমরা মহাভারত-রামায়ণ বা পুরাণগুলিতে যত মেনকা-রম্ভা, ঘৃতাচী-বিশ্বাচীদের নাম শুনেছি, তারা বহুল সময়েই মুনি-ঋষিদের ধ্যানভঙ্গ করার জন্য নিয়োজিত হলেও তারা কিন্তু অনেক সময়েই সেই সব শুষ্ক-রুক্ষ মুনি-ঋষিদের সন্তান ধারিকা জননী। এমনকী অনেক অভ্যুদয়শালী তপঃপরাক্রান্ত ঋষি-মুনিও আছেন, যাদের জননী আসলে স্বর্গসুন্দরী এই স্বৰ্গবেশ্যা অপ্সরারা।

অশেষ যৌবনোন্মাদনার অন্তরালে অপ্সরাদের এই জননীত্বের পরিসরটুকু কিন্তু কম নয় ভারতীয় সংস্কৃতিতে এবং ভেবে দেখা দরকার যে, অনেক ক্ষেত্রেই এই স্বর্গবেশ্যারা পুত্র কন্যার প্রতি তেমন মায়া-মোহ প্রকটভাবে দেখাননি, কখনও বা সন্তানদের পরিত্যাগও করেছেন, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা সন্তান ধারণ করার ক্ষেত্রে অস্বীকৃত হননি, এবং উৎকট ঋষি-মুনিদের সন্তান আপন গর্ভে ধারণ করার কারণে বিরাগও প্রদর্শন করেননি কখনও। তাতে এটা বুঝি যে, আপন স্বর্গীয় যৌবন নিয়ে তারা যতই আকুল থাকুন, অপ্সরাকুলের অনেকেই কিন্তু বহুতর বিরাট মহাপুরুষের জননী। এই মহাপুরুষ-কুলে বশিষ্ঠ কিংবা অগস্ত্যের মতো ঋষিরা যেমন আছেন, তেমনই আছেন দ্রোণাচার্য-কৃপাচার্যের মতো নমস্য ব্যক্তিরা। আবার ঘৃতাচী-মেনকাদের মতো অপ্সরারা না থাকলে আমরা রুরুর স্ত্রী প্রমদ্বরাকেও পেতাম না আর ভারতখ্যাত ভরতের জননী শকুন্তলাকেও পেতাম না দুষ্যন্তের স্ত্রী বলে। আরও শতেক বিখ্যাত অপ্সরা-প্রসূতির বিবরণ না দিয়ে বরঞ্চ এটা বলাই ভাল যে, মাতৃত্ব কিন্তু ভারতীয় স্বর্গসুন্দরীদের অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য এবং এখানে উর্বশী এমনই একটা নাম, যিনি ভবিষ্যবিখ্যাত পুরু-ভরত-কুরুবংশের আদিজননী। তিনি তার পুত্র আয়ুকে সযত্নে গর্ভে ধারণ করে ফিরিয়ে দিয়ে গেছেন প্রেমিক রাজার তত্ত্বাবধানে। আর উর্বশীর এই বংশ-মাতৃত্বের মহিমাটুকু ভুলতে পারা যায় না বলেই আমরা পাণ্ডব অর্জুনকে দেখেছি– তিনি স্বর্গসুন্দরীর যৌন আকর্ষণের মধ্যেও আগে স্মরণ করেছেন তার জননীত্বের কথা। কথাটা অবশ্য একটু বুঝিয়ে বলতে হবে।

আসলে এটা একটা জটিল প্রশ্নও বটে এবং সে প্রশ্ন ভারতবর্ষের সুরসুন্দরীদের সম্বন্ধে যেমন প্রযোজ্য, তেমনই প্রযোজ্য ঋষি-মুনিদের ক্ষেত্রেও। লক্ষণীয়, আমরা ঋষি বশিষ্ঠকে দশরথ-রামচন্দ্রের কুলপুরোহিত হিসেবে যেমন পেয়েছি, তেমনই তাদের অতিবৃদ্ধ-প্রপিতামহ দিলীপেরও কুলপুরোহিত হিসেবে বশিষ্ঠকেই দেখেছি। যে-নারদকে আমরা সত্য-ত্রেতাযুগে বীণা বাজিয়ে হরিনাম করতে শুনেছি, তাকেই দেখেছি দ্বাপর কলির সন্ধিতে কতবার, কত ঘটনায়, তার ঠিক নেই। আবার অপ্সরাদের ক্ষেত্রে দেখুন, মেনকা-ঘৃতাচী– যাঁদের আমরা কুরু-ভরতবংশের প্রথম-যুগীয় রাজত্বকালে ঋষিদের মন ভোলাতে দেখেছি, তারাই তাদের অধস্তন-কালে অন্য অর্বাচীন ঋষি-মুনির ধ্যান ভাঙাচ্ছেন। আমরা শুধু বলব– এই নামগুলিকে একটা ব্যক্তিনাম হিসেবে না দেখাই ভাল, আসলে এঁরা এক-একটা ইনস্টিটিউশন’, এবং প্রথম-বিখ্যাত ব্যক্তিনামেই তাদের সম্প্রদায় গড়ে উঠত। তাদের তপস্যা কিংবা সৌন্দর্যের পরম্পরাটা এমনই, যাতে পরবর্তী শিষ্য-শিষ্যের ওপর মূল ঋষির নাম অধিরূঢ় হত, অথবা অপরূপা কোনও সুন্দরীর ওপরে অধিরূঢ় প্রতীকটি হত উর্বশী-মেনকা-রম্ভার। এবারে আমরা পাণ্ডব অর্জুনের কথায় আসি।

কত কষ্টের তপস্যায় মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে অর্জুন স্বর্গে পৌঁছেছেন ইন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে। কচি-কাঁচা ছেলে স্বর্গে গিয়েছে তার জন্মদাতা বাবার সঙ্গে দেখা করতে। সুন্দরী স্ত্রীলোকের ব্যাপারে এমনিতে অর্জুনের কিছু দুর্বলতা আছে; সে আমরা উলূপী, চিত্রাঙ্গদাকে দিয়েই বেশ বুঝেছি। কিন্তু পাড়ার মেয়ে এক কথা, আর স্বর্গের মতো বিদেশ-বিভুই, সে বড় ভয়ানক কথা। আমাদের বন্ধু-বান্ধব দু-একজনা– অরুণ-বরুণ এই শ্যাম বঙ্গদেশে শ্যামলা কমলাদের সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়েছিল, তাদের কয়েকজনকে দেখলাম মেমসাহেবদের দেশে গিয়ে, একেবারে থম মেরে গেল। ছেলেমেয়ের নির্বিচার ‘ডেটিং-ফেটিং’ দেখে তারা কোথায় সুযোগ নেবে, না একেবারে অতিরিক্ত সচেতন হয়ে গর্তে ঢুকে পড়ল। আমাদের অর্জুনেরও ওইরকম থম-মারা অবস্থা হল স্বর্গসুন্দরীদের দেখে। বাবা ইন্দ্র ছেলেকে দেখে অর্ধাসন ত্যাগ করে সানন্দে তাকে বসতে দিলেন বটে, কিন্তু বাবার বৈজয়ন্ত প্রাসাদের সভায় অর্জুন যা দেখলেন, তাতে তিনি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলেন। অর্জুন দেখলেন উর্বশী মেনকারা সব নাচ জুড়েছেন দেবসভায় এবং তাদের নাচের ঠমক-গমক দেখলে একেবারে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হবে। অর্জুনের মনোভাব বুঝে মহাভারতের কবি নাচনিদের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন– এঁরা হলেন সব বরাঙ্গনা। তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করা মহাপুরুষরা পর্যন্ত এঁদের দেখলে পরে পাগল হয়ে যান। আর এখানে তাদের অঙ্গভঙ্গি কেমন? বিশাল নিতম্বে তরঙ্গ তুলে মহাকটিতটশ্রোণ্যঃ কম্পমানৈঃ পয়োধরৈঃ- পয়োধরের ঈষৎ-চকিত কম্পনে মাতাল করে দিয়ে ইন্দ্রসভার অপ্সরারা হাবে-ভাবে, কটাক্ষে মানুষের বুদ্ধিটাই মোহিত করে দিচ্ছে সম্পূর্ণ।

অর্জুন সব দেখলেন বটে, তবে দেখেশুনে একটু গুটিয়ে থাকলেন। একে বাবার সামনে, তার মধ্যে অপ্সরাদের ওই দুঃসাহসিক শিথিল ব্যবহার, অর্জুন নিজেকে খুব সংযত করে রাখলেন। তবে জায়গাটা স্বর্গ বলে কথা, এবং ইন্দ্ৰ-বাবার মতো অতি-প্রগতিশীল মানুষ আর হয় না। ইন্দ্রসভায় উর্বশী-মেনকার নাচগান যখন চলছিল, তখন অর্জুন একবার সবিস্ময়ে খানিকক্ষণ তাকিয়েছিলেন উর্বশীর দিকে। ছেলের চাপা-চাউনি ইন্দ্র খেয়াল করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে গন্ধর্ব চিত্রসেনকে বলে দিয়েছেন– ছেলেটাকে উর্বশীর দিকে চেয়ে থাকতে দেখলাম। মনে মনে তাকে পছন্দই নাকি, কে জানে? যা হোক, তুমি উর্বশীকে বলো, যেন সে একবার অর্জুনের ঘরে যায়– সোপতিতু ফাল্গুনম।

চিত্রসেন অবসর বুঝে উর্বশীর কাছে গিয়ে অর্জুনের সম্বন্ধে বলতে আরম্ভ করলেন। মর্ত্যলোকে অর্জুনের সমান বীর যে আর নেই, তার মতো উদার চরিত্র, তার মতো সৎ, বুদ্ধিমান এবং রূপবান মানুষ যে আর দ্বিতীয় হয় না এমন সব নানা সুখ্যাতি করে চিত্রসেন আসল কথা পাড়লেন। বললেন- তুমি তো অৰ্জুনকে দেখলেও। তোমার পরিচিত মানুষ। তা এমন মানুষ স্বর্গে এলেন, তো তিনি স্বর্গের আসল মজাটা না পেয়েই চলে যাবেন, তা তো হয় না। তিনি স্বর্গে আসার ফল লাভ করে যান একটু– স স্বর্গফলমাপুয়াৎ।

চিত্রসেনের কথা শুনে উর্বশী বেশ তৈলোদ্রিক্ত হলেন। মুচকি হেসে তিনি বললেন– অর্জুনের যত গুণের কথা তোমার কাছে শুনলাম, তাতে কোন মেয়ে তাকে না চাইবে বলো? একে তো দেবরাজ বলেছেন, তাতে আবার তুমি যেমন তার গুণপনা বলছ– সেসব শুনেই তো অর্জুনের উপর আমার কামনার উদ্রেক হচ্ছে- তস্য চাহং গুণেীঘেন ফাল্গুনে জাতমন্মথা। উর্বশী চিত্রসেনকে কথা দিয়ে দিলেন– তুমি ভেব না। আমি ঠিক সময়মতো চলে যাব তার কাছে।

গন্ধর্ব চিত্রসেনকে বিদায় দিয়ে উর্বশী ভাল করে স্নান করলেন। অর্জুনকে তিনি ইন্দ্রসভায় দেখেছেন। তাঁর কথা ভাবলেই এখন তার মন কামনায় পীড়িত হচ্ছে–মন্মথেন প্রপীড়িতা। উর্বশী খুব সাজলেন। গলায় সাতনরি হার পরে, গায়ে সুগন্ধ মেখে মনে মনে তিনি এতটাই অর্জুনের কাছে চলে গেলেন যে, তার মনে হল যেন অর্জুন উর্বশীর মহার্ঘ শয্যাতেই এসে পড়েছেন এবং তিনি যেন রমণে প্রবৃত্ত হয়েছেন অর্জুনের সঙ্গে মনোরথেন সংপ্রাপ্তং রময়তেব হি ফাল্গুনম।

উর্বশী অর্জুনের ঘরের দিকে চললেন। আকাশে চাঁদের আলো এবং রজনির অন্ধকার। দুই-ই গাঢ় হল। বেণিতে টাটকা ফুলের মালা গুঁজে, স্তনের উপর কুঙ্কুম-চন্দনের অলকা তিলকা এঁকে, সূক্ষ্মবস্ত্রের স্কুটাস্ফুট ব্যঞ্জনায় জঘন দেশে ঢেউ তুলে উর্বশী চললেন– সূক্ষ্মবস্ত্রধরং রেজে জঘনং নিরবদ্যবৎ। যাওয়ার সময় কামোদ্রেকের জন্য একটু মদ্যও পান করে নিলেন উর্বশী– সীধুপানেন চাপ্লেন। জনহীন স্বর্গপথে চাঁদের জ্যোৎস্নাকে সাথি করে, মিহি সুরে গান করতে করতে উর্বশী যখন চলতে আরম্ভ করলেন, তখন তার সূক্ষ্মবস্ত্রের অন্তরালেও পীন পয়োধরের উল্লম্ফনটুকু দৃশ্যত রোধ করা গেল না।– গচ্ছন্ত্যা হাররুচিরৌ স্তনৌ তস্যা ববল্পতুঃ।

উর্বশী এসে পড়েছেন অর্জুনের বাড়িতে। দারোয়ান খবর দিল স্বর্গসুন্দরী উর্বশী আপনার সেবায় উপস্থিত। অর্জুন কিন্তু এতটা ভাবেননি। এগিয়ে এসে স্বাগতভাষণ করে ঘরে নিয়ে যাবেন কী, তার আগে উর্বশীর সাজগোজ দেখে অর্জুন চক্ষু মুদে রইলেন। তারপর তার উচ্ছ্বাসে জল ঢেলে দিয়ে বললেন মা! আপনি অপ্সরাদের মধ্যে প্রধান, আপনাকে প্রণাম। বলুন, কী আদেশ? স্বর্গসুন্দরীর সমস্ত সম্মান ধুলোয় মিশে গেল যেন। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হল উর্বশীর।

বললেন– কী যা-তা বলছ? ওই যে ইন্দ্রসভায় নাচবার সময় আমার দিকেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলে তুমি– অনিমিষং পার্থ মামেকাং তত্র দৃষ্টবান– এমনকী তোমার বাবা ইন্দ্র পর্যন্ত সেই বেহায়া চাউনি দেখে গন্ধর্ব চিত্রসেনকে দিয়ে আমায় খবর পাঠালেন যে, তোমার কাছে যেতে হবে আমায় সেসব কী তা হলে মিথ্যা?

একটা প্রশ্ন এখানে উঠবেই। আপনারা বলতেই পারেন কোথায় সেই পুরূরবা, অর্জুনের কতকাল আগের পুরুষ, আর কোথায় অর্জুন? এ উর্বশী কি সেই উর্বশী? পুরাতনেরা বলবেন- স্বর্গের অপ্সরা বলে কথা। তাঁদের বয়স বাড়ে না, তাঁরা চিরযৌবনা। আমি তা বলি না। ইতিহাস পুরাণ পড়ে আমি যা বুঝেছি, তাতে স্বর্গ নামের জায়গাটা পৃথিবীর বাইরের কোনও জায়গা নয়। আর ইন্দ্র যে একটা উপাধি মাত্র, দেবতা-মনুষ্য রাক্ষস যে কেউ যে ক্ষমতা অথবা মহাপুণ্যের ফলে ইন্দ্ৰত্ব পেতে পারেন, সে উদাহরণও আছে ভূরিভূরি। এই কথাগুলো বলে আমি যেটা বোঝাতে চাই, সেটা হল উর্বশীও একটা উপাধি। স্বর্গের শ্রেষ্ঠতমা সুন্দরী অপ্সরা যিনি, তারই নাম উর্বশী। এক উর্বশী বিদায় নিয়ে চলে যান, তারপর আরও এক সুন্দরী প্রধান নির্বাচিত হন উর্বশীর সিংহাসনে। এইরকমটি না হলে স্বর্গের দেবতারাও যেখানে দার্শনিক দৃষ্টিতে জরা-মরণ বর্জিত নন, সেখানে উর্বশী শুধু অপ্সরা বলেই চিরযৌবনা থাকবেন সে কথা ঠিক নয়।

বস্তুত উর্বশী-মেনকারা এক সময় আপন আপন ব্যক্তি নামেই বিরাজ করতেন, কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁদের সৌন্দৰ্য বৈদগ্ধ্যের কারণে এই নামগুলো উপাধি বা একটি বিশেষ পদের মর্যাদা লাভ করে। পুরাণে ইতিহাসে অপ্সরারা কেউ একা নন। তাদের দল এবং উপদলও ছিল। উর্বশীর সঙ্গে তাঁর দলের অপ্সরারা থাকেন, মেনকার সঙ্গে তার দলের মেয়েরা অথবা রম্ভার সঙ্গে তাঁর দলের সুন্দরীরা। এইরকম এক-একটি অপ্সরা দলের সুন্দরীমুখ্যার উপাধি হত উর্বশী, মেনকা অথবা রম্ভা। কাজেই অর্জুন যে উর্বশীর দিকে চেয়েছিলেন, ইনি কোনওভাবেই পুরূরবার কণ্ঠলগ্না উর্বশী নন। কিন্তু এইরকমই কোনও এক উর্বশী তার বহু পূর্বপুরুষের বক্ষলগ্না হয়ে বিশাল পুরু-বংশের জননী হয়েছিলেন– এই মর্যাদাই হয়তো অৰ্জুনকে কেমন যেন লজ্জিত করে তুলল।

অতএব উর্বশী যখন সানুরাগে যাচিৎকার অনুনয়ে বললেন– না অর্জুন, তোমার পিতা কিংবা চিত্রসেনের কথাতেই শুধু নয়, আমিই তোমাকে চেয়েছি। তুমি আমারও আকাঙ্ক্ষিত পুরুষ, আমি নিজেই তোমার কাছে এসেছি– মমাপ্যেষ মনোরথঃ– তখনও কিন্তু অর্জুন কানে আঙুল দিলেন। বললেন– আপনি যা বললেন, আমার সে কথা না শুনলেই ভাল হত– দুঃস্ফুতং মেহস্তু সুভগে। সম্মানের প্রশ্নে আপনি আমার কাছে জননী কুন্তীর মতো, অথবা ইন্দ্রপত্নী শচীর মতো। আমি যে আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম তার কারণ আমার বিস্ময়। ভাবছিলাম, এই উর্বশী আমাদের পুরুবংশের জননী! উর্বশী এই মাতৃ সম্বোধনে মোটেই সুখী হলেন না। বললেন– দেখো, আমরা হলাম গিয়ে অপ্সরা। আমাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই যে, আমরা কুলবধূদের মতো একটি স্বামী নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেব–অনাবৃতাশ্চ সর্বা স্মঃ- আমরা সবার কাছেই মুক্ত। তোমার ওই পুরুবংশের কত পুরুষ, এমনকী তাদের পুত্র-প্রপৌত্ররা পর্যন্ত যারাই আপন পুণ্যবলে এই স্বর্গলোকে এসেছেন, তারাই আমাদের সঙ্গে রমণসুখ অনুভব করে গেছেন, কেউ বাদ যাননি–তপসা রময়ন্ত্যস্মান ন চ তেষাং ব্যতিক্রমঃ। আর এতসব তুমি যদি নাও বোঝো, তা হলে শেষ কথাটা বলি শোনো তোমাকে দেখার পর থেকে কামনায় শরীর জ্বলছে আমার, আমি তোমাকে চাইছি, অতএব তুমিও আমাকে চাইবে, এটাই কথা– এমন করে চাইলে তুমি কিছুতেই ধৰ্মত আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না– তৎ প্রসীদ ন মামার্তাং ন বিসর্জয়িতুমহসি।

অর্জুন বললেন- এবার আমার অন্তরের সত্য কথাটাও শুনুন। আমি এই স্বর্গের দেব দেবীদের শপথ নিয়ে আবারও বলছি– আমার কাছে আমার মা কুন্তী-মাদ্রী যেমন সম্মানিত, যেমন সম্মানিত ইন্দ্রপত্নী শচীদেবী, আপনিও আমার কাছে তেমনই মায়ের মতো, এমনকী তার চেয়েও বেশি, কেননা আপনি আমার এই বংশেরই আদি জননী তথা চ বংশজননী ত্বং হি মেহদ্য গরীয়সী। আপনার সৌন্দর্যের কোনও তুলনা নেই, আপনি বরবৰ্ণিনী, কিন্তু তবুও আপনি চলে যান এখান থেকে, আমি মাথা নুইয়ে চরণে পড়ছি আপনার। আমি আমার এই দৃষ্টি পালটাতে পারব না। আপনি সত্যিই আমার পূজনীয়া মায়ের মতো, আমি আশা করব– আপনিও আমাকে পুত্রের মতো রক্ষা করবেন– তুং হি মে মাতৃবৎ পূজ্যা রক্ষ্যোহহং মাতৃবত্ ত্বয়া।

কামার্তা এবং স্বয়মাগতা রমণীর সকাম নিবেদনের মধ্যে এমন সম্পর্কশুদ্ধির গঙ্গাজল ঢেলে দিলে তার রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। স্বর্গের অধুনাতনী সুন্দরীতমারও রাগ হল। উর্বশী বললেন– তোমার পিতা চেয়েছিলেন– আমি তোমার কাছে আসি, তাই তোমার ঘরে এসেছিলাম আমি; আর আমিও তোমাকে দেখে মুগ্ধা কামিনী হয়েছিলাম। কিন্তু তুমি এমনটা দেখেও যেভাবে অনভিনন্দনে মুখ ফিরিয়ে নিলে– যস্মান্মাং নাভিনন্দেথাঃ স্বয়ঞ্চ গৃহমাগতাম- তাই আমিও তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি– তুমি মেয়েদের মধ্যে বাস করবে নপুংসকের মতে, কেউ তোমাকে আর পুরুষ বলবে না– অপুমানিতি বিখ্যাতঃ ষণ্ডবদ বিচরিষ্যসি।

খুব রাগ হল উর্বশীর। উষ্ণ নিঃশ্বাসে, ক্রোধ-ফুরিত অধরে তিনি বেরিয়ে গেলেন অর্জুনের ঘর থেকে। অভিশাপ শুনে ধনুর্ধর মহাবীর অর্জুনেরও ভাল লাগল না– রাত্রে ভাল করে ঘুমও এল না তার। পরের দিন সকাল হতেই গন্ধর্ব-বন্ধু চিত্রসেনের সঙ্গে দেখা করে আদ্যোপান্ত বললেন সব কিছু। সব শুনে গন্ধর্ব চিত্রসেন বললেন- শাপে বর হয়েছে। তোমার। গন্ধর্ব চিত্রসেন প্রথমে অর্জুনের প্রশংসা করে বললেন- ধন্যি তোমার মা, যিনি এমন সুপুত্রের জননী। স্বর্গসুন্দরী উর্বশী এসেছিলেন তোমার কাছে, অথচ তুমি ধৈর্য দেখিয়েছ ঋষিদের মতো। আর উর্বশী যে শাপ দিয়েছেন, তাতে তোমার ভালই হবে। তোমাদের বনবাসের কাল শেষ হলে তোমাদের অজ্ঞাতবাসে যেতে হবে, তখনই তুমি তোমার ওই অভিশাপটা ক্ষইয়ে দেবে। তুমি নপুংসকের ভাবে থাকবে, আর নাচ-গান করে দিন কাটিয়ে দেবে মেয়েদের মধ্যে তেন নর্তনবেশেন অপুংস্বেন তথৈব চ। অতএব চিন্তা কোরো না, উর্বশীর এই অভিশাপ তোমার কাছে আসবে সময়মতো– অর্থকৃত্তাত সাধশ্চ ভবিষ্যতি।

সুরসুন্দরী উর্বশীর জীবন-চিত্র বর্ণনায় তার রূপ-বৈদগ্ধ্যের যে বিশাল চমৎকার মহাভারত পুরাণে ফুটে উঠেছে, সেটা একটা চরম বৈশিষ্ট্য বটে, কিন্তু অপ্সরা-সুন্দরীদের এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যের চেয়েও উর্বশী বোধহয় এইখানেই একান্তভাবে পৃথক যে, বৈদিক ঋকমন্ত্র থেকে মহাভারত-পুরাণ পর্যন্ত তাঁর সম্ভোগ-বিরহের সুর চিরন্তনী এক প্রেমিকা-সত্তার বিস্তার ঘটায় এবং অবশেষে বিশ্রান্তি লাভ করে জননীত্বের পরিসরে। সে পরিসর এমনই উদার বিশদ এবং মহান যে, বহু অতীত বৎসরের পরেও মহাবীর অর্জুন তার মাথা নত করেছেন শুধু এক নাম-প্রতাঁকের কাছে। তিনি বলেছিলেন সেই নৃত্যসভার আসরে আপনার দিকে উৎফুল্ল নয়নে তাকিয়ে দেখেছি আর ভেবেছি– এই তো সেই পরম্পরাবাহিতা উর্বশী, যিনি এই প্রসিদ্ধ পৌরব-বংশের আদিজননী, আপনি আমার মাতৃসমা গুরু, যেমন আমার জননী কুন্তী, যেমন ইন্দ্রাণী শচী আমার মা, তেমনই আপনিও; অথবা তার চেয়েও অনেক বেশি উর্বশী আমাদের বংশ-বিবর্ধিনী আদিজননী–

গুরোর্থরুতরা মে ত্বং মম বংশবিবর্ধিনী।
ইয়ং পৌরববংশস্য জননী বিদিতেতি হ ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *