০৮. চলে এলাম কালিকট

আট

সান্দাবুরের যে বিধর্মী সুলতানকে পরাজিত করে আমরা শহরটি দখল করেছিলাম তিনি সে শহর পুনর্দখলের জন্য অগ্রসর হলেন। বিধর্মীরা সবাই পালিয়ে গিয়ে তাঁর দলে যোগ দিলো। আমাদের সৈন্যদের থাকতে দেওয়া হয়েছিলো আশেপাশের গ্রামগুলোতে। তারাও আমাদের ছেড়ে চলে গেলো। বিধর্মীদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে আমরা মহাবিপদে পড়লাম। দুরবস্থা যখন চরমে পৌচেছে তখন আমি অবরুদ্ধ শহর ছেড়ে চলে এলাম কালিকট। কালিকটে এসে দিবাত-আল-মহল (মালদ্বীপ) সফরে যাবো স্থির করলাম। মালদ্বীপ থেকে জাহাজে উঠে দশ দিনের পরে আমরা মালদ্বীপ নামক দ্বীপপুঞ্জে এসে পৌঁছলাম। পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য এই দ্বীপপুঞ্জে দ্বীপের সংখ্যা হবে প্রায় দু’হাজার। একশ’ বা তার কম সংখ্যক দ্বীপ নিয়ে একটি বৃত্ত তৈরী হয়েছে। এ বৃত্তে প্রবেশের একটি করে পথ বা প্রবেশ দ্বার এবং শুধু দ্বার দিয়ে জাহাজ দ্বীপে গিয়ে পৌঁছলে সেখান থেকে একজনকে তুলে নিতে হয় অন্য দ্বীপে যাবার পথ দেখাবার জন্য। দ্বীপগুলো এতো কাছাকাছি অবস্থিত যে একটি দ্বীপ ছাড়লেই অন্য দ্বীপের তাল গাছের ডগার নজরে পড়ে। যদি কোনো জাহাজ পথ হারায় তবে আর দ্বীপে পৌঁছতে পারে না। বায়ু স্রোত সে জাহাজকে করমণ্ডল উপকুলে বা সিংহলে নিয়ে ঠেকায়।

মালদ্বীপের অধিবাসীরা সবাই ধার্মিক ও সম্মুসলমান। দ্বীপগুলো বারোটি জেলায় বিভক্ত। তার প্রত্যেকটি একজন শাসনকর্তার অধীনে। শাসনকর্তার উপাধি ‘কারদুই’। মহল নামক যে জেলার নামানুসারে এ দ্বীপপুঞ্জের নামকরণ হয়েছে সেখানে সুলতানদের বাসস্থান। কোনো দ্বীপেই কোনো রকম ফসলের আবাদ নেই। একটী মাত্র জেলায় যবের মতো এক প্রকার শষ্য জন্মে। তাই আমদানী করা হয় মহলে। কবলমাস নামক এক রকম মাছ, এখানকার অধিবাসীদের খাদ্য। ছাগমাংসের গন্ধযুক্ত এ মাছ চর্বিহীন এবং দেখতে লাল। ধরার পরে মাছগুলো চার টুকরো করে কাটা হয় এবং হাল্কাভাবে রান্না করার পরে তালপাতার ঝুড়িতে করে শুকানো (Smoked) হয়। ভালভাবে শুকিয়ে নিয়ে তারা সেগুলো আহার করে। এ মাছের কিছু কিছু রপ্তানী হয় ভারত, চীন ও ইয়েমেনে। এসব দ্বীপে গাছ বলতে অধিকাংশই নারকেল গাছ। উপরোক্ত মাছের সঙ্গে নারকেল এখানকার বাসিন্দাদের প্রধান খাদ্য। নারকেল গাছ এক বিচিত্র বস্তু। প্রতিমাসে একটি হিসেবে বছরে বারোটি ফলের ছড়ি এ সব গাছে বের হয়। তার ফল কতক বড়, কতক ছোট, কতক সবুজ, কতক আবার শুষ্ক। এখানকার লোকে নারকেল দিয়ে দুধ, তেল ও মধু তৈরী করে- সে কথা আগেই বলেছি। মালদ্বীপের অধিবাসীরা ইমানদার, ধার্মিক এবং সরলপ্রাণ। কিন্তু তারা শারীরিক দুর্বল এবং যুদ্ধে অপটু। প্রার্থনাই তাদের ধর্ম। একবার আমি যখন একটি চোরের হাত কেটে ফেলতে হুকুম দিয়েছিলাম, তখন সেখানে উপস্থিত কয়েকজন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। ভারতীয় জলদস্যুরা সে দ্বীপে কখনো চড়াও করে না বা দ্বীপবাসীদের উপর অত্যাচার করে না। কারণ, তারা অভিজ্ঞতায় বুঝতে পেরেছে, কেউ সে দ্বীপের কিছুতে হস্তক্ষেপ করলে অচিরেই তার দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। এদের প্রত্যেক দ্বীপেই সুন্দর মসজিদ আছে। এখানকার লোকের অধিকাংশ বাসগৃহই কাটের তৈরী। এরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে এবং ময়লা আবর্জনা এড়িয়ে চলে। নিজেদের গাত্র পরিষ্কার রাখবার জন্য এদের অধিকাংশই দিনে দু’বার করে গোসল করে। তাছাড়া এখানে অত্যাধিক গরম এবং শরীরে ঘাম ঝরে। তারা চন্দনতৈল বা ঐ জাতীয় প্রচুর গন্ধ তৈল ব্যবহার করে। পোশাক বলতে ব্যবহার করে শুধু চাদর Aেpron)। পাজামার পরিবর্তে একখানা চাদর তারা কোমরে জড়ায়, আরেকখানা পিঠের উপর দেয় হাজীদের মতো। কেউ-কেউ পাগড়ী ব্যবহার করে। অনেকে তার পরিবর্তে শুধু একখানা রুমাল মাথায় জড়িয়ে রাখে। কোনো কাজী বা এমামের সঙ্গে দেখা হলে তারা পিঠের কাপড় সরিয়ে অনাবৃত পিঠে তাকে অনুসরণ করে তার বাড়ি অবধি গমণ করে। এখানকার উচ্চ-নীচ সবাই নগ্নপদে চলাফেরা করে। গাছের ছায়াবৃত পথঘাটগুলো তারা সর্বদাই ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার। রাখে। সে সব পথে হাঁটতে বাগানের ভেতরে হাঁটার মতোই মনে হয়। তা সত্ত্বেও প্রত্যেকেই ঘরে ঢুকবার সময় তারা পা ধুয়ে ঢোকে। ধোয়ার পানি বারান্দায় রাখাই থাকে। পা ধোয়ার পরে তা মুছবার জন্য থাকে নারিকেল পাতায় তৈরী মোট এক রকম গামছা। মসজিদে ঢুকতে হলেও একই রীতি অনুসরণ করা হয়।

আগেই উল্লেখ করেছি, এখান থেকে মাছ রপ্তানী হয়। তা ছাড়া রপ্তানী হয় নারকেল, কাপড়, সূতী পাগড়ী, বহু প্রকার পিতল নির্মিত তৈজসপত্র, কড়ি এবং নারকেলের ছোবড়া। নারকেলের উপরের অংশ এরা গর্তে জড়ো করে রাখে এবং পরে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ছোবড়া বের করে। মেয়েরা পরে এগুলো দিয়ে দড়ি তৈরী করে। সে সব দড়ির সাহায্যে জাহাজের তক্তা বেঁধে জোড়া লাগানো হয়। সে সব দড়ি ভারত, চীন ও ইয়েমেনে রপ্তানী হয়। এগুলো শনের দড়ি থেকে উত্তম। ভারতীয় ও ইয়েমেনের জাহাজ নারকেলের দড়ি দিয়েই বাধা হয়। কারণ ভারত মহাসাগরে পর্বতের বহু চড়া আছে। তারকাঁটা দিয়ে তৈরী জাহাজ পবর্ত চুড়ার সঙ্গে সংঘর্ষে ভেঙ্গে যায়। নারকেলের এ দড়ি দিয়ে বাঁধা জাহাজ কখনো ভেঙ্গে টুকরো-টুকরো হয় না। এ দ্বীপের বাসিন্দারা টাকা পয়সা হিসাবে কড়ি ব্যবহার করে। কড়ি সমুদ্র থেকে সংগ্রহ করা এক প্রকার জীব। এ গুলোকে গর্তে রেখে দিলে ভিতরের মাংস পচে যায় এবং শাদা খোলস অবশিষ্ট থাকে। কেনা-বেচায় এ সব ব্যবহৃত হয় চার লক্ষ কড়ির পরিবর্তে এক স্বর্ণ দীনার হারে। অনেক সময় এর মূল্য কমে বারো অবধি বিনিময় হার হয়। তারা বাংলার অধিবাসীদের কাছে চাউলের পরিবর্তে কড়ি বিক্রি করে। বাংলায়ও এ জিনিস অর্থ হিসাবে ব্যবহার হয়। ইয়েমেনের লোকদের পণ্যের সঙ্গেও কড়ি বিনিময় হয়। তারা খালি জাহাজ সমুদ্রে স্থির রাখবার জন্য বালি বোঝাই না-করে কড়ি বোঝাই করে নেয়। কাফ্রীদের দেশেও মুদ্রা হিসাবে কড়ি ব্যবহৃত হয়। মালি ও গওগও-তে আমি ১,১৫০ কড়ি এক স্বর্ণ-দীনারের সঙ্গে বিনিময় হতে দেখেছি।

এখানকার নারীরা, এমন কি তাদের রাণীও, হাত আবৃত রাখে না। তারা চিরুণীর সাহায্যে মাথায় চুল আঁছড়ে এক পাশে রাখে। তাদের অধিকাংশই কোমর থেকে পা অবধি একখণ্ড কাপড় ব্যবহার করে। ফলে শরীরের অন্যান্য অংশ অনাবৃত থাকে। আমি যখন এখানে কাজীর পদে কাজ করেছিলাম তখন এ রীতি তুলে দিতে চেয়েছিলাম এবং কাপড় পরতে তাদের আদেশ করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি এ ব্যাপারে কৃতকার্য হতে পারিনি। মামলার সময় কোনো মেয়ে লোকেরই অনাবৃত অবস্থায় আমার সম্মুখে হাজির হবার হুকুম ছিলো না। এ ছাড়া আমি আর কিছু করতে পারিনি। আমার কয়েকজন ক্রীতদাসী ছিলো। তারা দিল্লীর অনুকরণে কাপড় পরতো এবং মাথায় ঘোমটা দিতো। কিন্তু কাপড় পরতে তারা অভ্যস্ত ছিলো না বলে তাদের সৌন্দর্য না বাড়িয়ে বরং কিভূতকিমাকার করে তুলতো। খাস করে তাদের একটি রীতি হলো পাঁচ দীনার বা

তারও কম বেতনে কোনো গৃহে ভূত্যের কাজ করা। সে ক্ষেত্রে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব মনিবের। তারা এ কাজকে অবমাননাকর মনে করে না। তাদের অধিকাংশ বালিকাই এ কাজ করে। কোনো ধনীলোকের গৃহে দশ থেকে বিশ জন অবধি এ রকম বালিকা দেখতে পাওয়া যায়। কোনো বালিকা একটি পাত্র ভাঙলে তার দাম তাকেই দিতে হয়। এর বাড়ির কাজ ছেড়ে সে যদি অন্য বাড়িতে যেতে চায় তবে তার নতুন মনিব পুরানো মনিবের পাওনা শোধ করে দেয়। পুরানো মনিবের দেনা শোধ করে সে। তখন নতুন মনিবের কাছে ঋণী হয়।

এ সব মেয়েদের আসল কাজ হলো নারকেলের ছোবড়ার দড়ি পাকানো। এখানকার যৌতুক খুব কম বলে এবং নারীসঙ্গ আনন্দদায়ক বলে এখানে বিয়ে করা খুবই সহজ। এখানে জাহাজ এসে পৌঁছলে খালাসীরা বিয়ে করে এবং অন্যত্র যাওয়ার প্রাক্কালে তাদের তালাক দেয়। বস্তুতঃ এ এক ধরনের সামরিক বিবাহ। এখানকার নারীরা কখনো নিজের দেশ ছেড়ে অন্যত্র যেতে রাজী হয় না।

এ দ্বীপপুঞ্জ সম্বন্ধে একটি আশ্চর্যজনক ব্যাপারে এই যে, এখানকার শাসনকর্তা খাদিজা নাম্নী একজন মহিলা। এক সময় তার পিতামহ ছিলেন শাসনকর্তা, তারপরে। ছিলেন তার পিতা। তার মৃত্যুর পরে শাসনভার ন্যস্ত হয় মহিলার ভাই শাহাবউদ্দিনের উপর। কিন্তু শাহাবউদ্দিন ছিলেন তখন নাবালক। পরে তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করে হত্যা করা হলে খাদিজা এবং তার কনিষ্ঠ দুটি সহোদরা ছাড়া বংশের আর কেউ অবশিষ্ট থাকে না। কাজেই খাদিজাই তখন সিংহাসনের অধিকারিনী হন। খাদিজার বিয়ে হয় তাদের ইমাম জামালউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি উজিরের পদে উন্নীত হন এবং প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার অধিকারীও তিনিই হন। কিন্তু হুকুমজারী হয় খাদিজার নামে। ছুরির মত বাঁকা একটি লোহার যন্ত্রদ্বারা তালপাতার উপরে এখানে হুকুম লেখা হয়। একমাত্র কোরাণ ও ধর্মসম্বন্ধীয় পুস্তকাদি ছাড়া আর কিছুই এখানে কাগজে লেখা হয় না! যখন কোনো বিদেশী এ দ্বীপপুঞ্জে আসে এবং দরবারে যায় তখন রীতি অনুসারে তাকে দু’খানা কাপড় সঙ্গে নিতে হয়। সুলতানাকে অভিবাদন করে একখানা কাপড় সে ছুঁড়ে দেয় পরে তার স্বামী উজির জামালউদ্দিনের প্রতিও দ্রুপ করে। তার সৈন্যসংখ্যা প্রায় এক হাজার। বিদেশ থেকে তাদের বহাল করা হয়। কিছু সংখ্যক দেশী সৈনিকও অবশ্য তার আছে। প্রত্যেক দিন প্রাসাদে এসে তারা সুলতানাকে অভিবাদন করে যায়। চাউল দিয়ে তাদের মাসিক বেতন পরিশোধ করা হয়। প্রত্যেক মাসের শেষে তারা দরবারে আসে, অভিবাদন করে এবং উজিরকে বলে, “আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন ও বলবেন যে আমরা বেতনের জন্য এসেছি।” তখন তাদের বেতন দেবার হুকুম হয়। কাজী এবং অন্যান্য পদস্থ কর্মচারীরাও যাদের উজিরই বলা হয়, প্রাসাদে এসে শ্রদ্ধা জানায় এবং খোঁজারা তাদের আগমনের সংবাদ পৌঁছে দিলে তারা প্রস্থান করে। অন্য যে কোনো রাজকর্মচারীর চেয়ে সাধারণের ভেতর কাজীর সমান সবচেয়ে বেশী। কাজীর আদেশ পালন করা হয় শাসনকর্তার বা তার চেয়েও গুরুত্ব সহকারে। তিনি প্রাসাদে কাপের্ট আসন গ্রহণ করেন। প্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত রীতি অনুসারে কাজী তিনটি দ্বীপের উপস্বত্ব ভোগ করবার অধিকারী। এ দ্বীপপুঞ্জে কোন কারাগার নেই। কাঠের তৈরী মাল গুদামে অপরাধীদের বন্দী করে রাখা হয়। আমাদের মরক্কো দেশে যেমন খ্রীষ্টান কয়েদীদের রাখা হয় তেমনি এখানেও প্রত্যেক কয়েদীকে এক টুকরো কাঠের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়।

এ দ্বীপপুঞ্জে এসে প্রথমে যে দ্বীপে আমি অবতরণ করি তার নাম কান্নালুস। সুন্দর এ দ্বীপে অনেকগুলো মসজিদ। সেখানকার একজন ধর্মপ্রাণ লোকের বাড়ীতে আমি আশ্রয় গ্রহণ করলাম। মোহাম্মদ নামক দাফারের একজন লোকের সাক্ষাৎ পেলাম এ দ্বীপে। সে বলল, মহল দ্বীপে কাজী নেই। সেখানে গিয়ে উজিরের সঙ্গে দেখা হলে তিনি আমাকে আর আসতে দেবেন না। আমার ইচ্ছা ছিল, এখান থেকে মা’বার (করমণ্ডল), সিংহল, বাংলা এবং সেখান থেকেই চীনে রওয়ানা হব। কান্নালুসে পনেরো দিন কাটাবার পর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে আবার যাত্রা করলাম। পথে অপর যে কয়টি দ্বীপে যাবার সুযোগ হলো, সব জায়গায়ই আমরা যথেষ্ট সমাদর ও আতিথেয়তা পেলাম। এমনি করে দশ দিন পরে আমরা সুলতানা ও তার স্বামীর বাসস্থান মহালে পৌঁছে নোঙ্গর করলাম। এ দেশের নিয়মানুসারে বিদেশী কেউ এসে বিনা অনুমতিতে তীরে যেতে পারে না। তীরে যাবার অনুমতি পেয়ে আমি একটি মসজিদে ঢুকতে চাইলাম কিন্তু মসজিদের পরিচারক আমাকে উজিরের সঙ্গে প্রথম দেখা করা উচিৎ বলে জানালো। জাহাজের কাপ্তেনকে আগেই আমি বলে রেখেছিলাম, আমার কথা জিজ্ঞেস করলে, চিনি না’ বলতে। কারণ আমার ভয় ছিল, উজির আমার পরিচয় পেলেই আমাকে কাজীর পদে বহাল করে আটক রাখবেন। কিন্তু আমি জানতাম না যে, কে একজন যেনো আগেই আমার কথা লিখে

জানিয়েছে এবং আমি যে দিল্লীতে কাজী ছিলাম তাও বলেছে। প্রাসাদে পৌঁছে তৃতীয়। প্রবেশ পথের ধারে এক খোলা বারান্দায় এসে আমরা দাঁড়ালাম। ইয়েমেনের কাজী ঈসা এগিয়ে এসে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। আমি উজিরকে অভিবাদন জানালাম। কাপ্তেন দশ টুকরো কাপড় এনেছিলেন। এক টুকরো কাপড় ছুঁড়ে দিয়ে তিনি সুলতানকে অভিবাদন করলেন। তারপর আরেক টুকরো একই ভাবে ছুঁড়ে দিয়ে উজিরকে অভিবাদন করলেন। এভাবে সব কটি টুকরো শেষ হবার পর তাকে আমার কথা জিজ্ঞাসা করা হলো। তিনি বললেন আমি একে চিনি না। অতঃপর তারা আমাদের কাছে পান ও গোলাব জল নিয়ে এলো। তাদের দেশে এসব সম্মানের চিহ্ন। একটি বাড়িতে আমরা থাকবার জায়গা পেলাম। একটি খোঞ্চ ভরতি ভাতের চারপাশে থালায় মাংস, মুরগী, ঘি এবং মাছ সহ আমাদের খাবার এসে পৌঁছল। দু’দিন পরে উজির আমাকে একটি পোষাক এবং আমার ব্যয় নির্বাহের জন্য এক লাখ কড়ি পাঠালেন।

দশ দিন পরে আরব ও পারস্যের কয়েকজন দরবেশ নিয়ে সিংহল থেকে একখানা জাহাজ এসে পৌঁছল। তারা আমাকে চিনতে পারলেন এবং উজিরের পরিচালকদের। কাছে আমার পরিচয় দিলেন। তাতে উজির আমাকে সেখানে রাখবার জন্য আরও উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। রমজানের শুরুতে তিনি উজির ও আমীরদের এক ভোজসভায় আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। পরে আমিও দরবেশদের সম্মানে একটি ভোজ দিতে ইচ্ছুক হয়ে উজিরের অনুমতি চাইলাম। কারণ দরবেশরা সিংহলে আদমের কদম জেয়ারত করে এসেছেন। তিনি অনুমতি দিয়ে আমাকে পাঁচটি ভেড়া, চাউল, মুরগী, ঘি ও মসলা পাঠিয়ে দিলেন।

ভেড়া সেখানে মা’বার, মালাবার ও মামা থেকে আমদানী হয় বলে খুবই দুষ্প্রাপ্য। আমি এসব সামগ্রী উজির সুলেমানের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলাম। তিনি এর সঙ্গে আরও কিছু যোগ করে সুন্দরভাবে রান্না করিয়ে দিলেন। অধিকন্তু পিতলের থালাবাসন ও কাপের্ট সরবরাহ করলেন। আমার ভোজসভায় যাতে কয়েকজন মন্ত্রী (Ministers) যোগদান করতে পারেন সেজন্য উজিরের অনুমতি চাইলাম। তিনি বললেন, এবং আমিও কিন্তু আসবো। তবে আমি তাকে ধন্যবাদ জানালাম। বাড়ী ফিরে দেখলাম, তিনি মন্ত্রী ও অন্যান্য গণ্যমান্য লোকদের নিয়ে আগেই সেখানে পৌঁছে গেছেন। উজির কাঠের একটি উঁচু বেদীর উপর আসন গ্রহণ করলেন। যে সব মন্ত্রী ও আমীররা সেখানে হাজির হয়েছেন তাঁদের সবাই কাপড় ছুঁড়ে দিয়ে উজিরকে সম্বর্ধনা জানাতে লাগলেন। এমনি করে সেখানে প্রায় একশ কাপড় জড়ো হলো এবং দরবেশরা সে সব নিয়ে গেলেন। অতঃপর খাদ্য পরিবেশন করা হলো। অতিথিদের খাওয়া শেষ হলে চমৎকার সুরে কোরাণ পাঠ হলো। দরবেশরা তখন তাদের শাস্ত্রানুসারে গান ও নৃত্য শুরু করলেন। আমি একটি আগুনের কুণ্ড জ্বালিয়ে রেখেছিলাম। তারা সেই আগুনের উপর হাঁটতে লাগলেন। মিষ্টি খাওয়ার মতো তাদের ভেতর কেউ-কেউ আগুন মুখে দিয়ে খেতে লাগলেন। আগুন নিবে না-যাওয়া অবধি এমনি চললো। রাত্রি শেষ হয়ে এলে উজির চলে গেলেন, আমিও তার অনুসরণ করলাম। সরকারী একটি বাগানের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে উজির আমাকে বললেন, এ বাগানটি আপনার। আমি আপনার বাসের জন্য এর ভেতর একটি ঘর তৈরী করে দেবো। আমি তাকে ধন্যবাদ জানালাম এবং তাঁর সুখ-শান্তির জন্য মোনাজাত করলাম। পরে তিনি আমাকে দু’জন ক্রীতদাসী, কয়েক টুকরো রেশমী কাপড় এবং এক কৌটা জহরত পাঠিয়েছিলেন।

কিছুকাল পরে নিম্নবর্ণিত কারণে আমার প্রতি উজিরের ব্যবহার শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠলো। উজির সুলেমান আমার সঙ্গে তার কন্যার বিবাহের প্রস্তাব করে পাঠালেন। এ ব্যাপারে আমি উজির জামালউদ্দিনের অনুমতি চাইলাম। অনুমতি চাইতে যাকে পাঠালাম সে এসে বললো, এ প্রস্তাবে তিনি নারাজ, কারণ তার নিজের কন্যার ইদ্দতের কাল ফুরালে তাকেই তিনি আপনার কাছে বিয়ে দিতে চান। কিন্তু তাঁর কন্যা ভাল নয় আশঙ্কায় আমি তাকে বিয়ে করতে সম্মত নই। কারণ, এর আগেই তার দু’বার বিয়ে হয়েছে এবং রোসমতের আগেই দু’স্বামীই মারা গেছে। ইত্যবসরে আমিও ভয়ানক জ্বরে আক্রান্ত হলাম। এ দ্বীপে যে আসবে তার জ্বর হবেই হবে। কাজেই এ দ্বীপে ছেড়ে চলে যাবার সংকল্প করে কিছু জহরত কড়ির পরিবর্তে বিক্রি করে ফেললাম। বাংলা দেশে যাবার জন্য একখানা জাহাজও ভাড়া করা হলো। তারপরে যখন আমি উজিরের কাছে বিদায় নিতে গেলাম তখন কাজী বেরিয়ে এসে বললেন, উজির বলছেন যদি আপনি যেতে চান তবে যা-কিছু আপনাকে দেওয়া হয়েছে তা ফেরত দিতে হবে। আমি জবাবে বললাম, আমি তা দিয়ে কড়ি কিনে ফেলেছি। কাজেই সে সব নিয়ে যা-খুশী আপনারা। করুন। তিনি আবার এসে বললেন, আপনাকে উজির সোনা দিয়েছেন, কড়ি তো দেননি। আমি বললাম, আমি সে সব বিক্রি করে সোনাই দেবো। কাজেই আমি সওদাগরদের কাছে কড়ি ফেরৎ দেবার জন্য গেলাম। কিন্তু উজির তাদের সে কড়ি ফেরত নিতে বারণ করে দিলেন। তার উদ্দেশ্য, যে কোনো রকমে আমার যাত্রা বন্ধ রাখা। অবশেষে তাঁর পাঠানো একজন সভাসদ এসে বললেন, উজির বলছেন, আপনি আমাদের কাছেই থেকে যান। তাতে আপনি যা চাইবেন তাই পাবেন। আমি বুঝতে পারলাম আমি এখন তাদের ক্ষমতার ভেতরে রয়েছি। আমি স্বেচ্ছায় না-থাকলে আমাকে রাখবার জন্য এরা বলপ্রয়োগ করবে। কাজেই, নিজের ইচ্ছায় থেকে যাওয়াই ভাল। আমি তখন তার লোককে বললাম, বেশ, আমি তার এখানেই থাকবো। লোকটি ফিরে গেলে উজির অত্যন্ত খুশী হলেন এবং আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি তার ঘরে। ঢুকতেই তিনি আমাকে আলিঙ্গন করে বললেন, আমরা চাই আপনাকে আমাদের ভেতর রাখতে আর আপনি কিনা আমাদের ছেড়ে চলে যেতে চান। আমি তাকে অজুহাত দেখালাম, তিনি তা মেনে নিলেন। পরে বললাম, যদি আমাকে থাকতেই বলেন তবে আমার কিছু শর্ত আছে। তিনি বলে উঠলেন শর্ত মঞ্জুর হলো। কি সে শর্ত বলুন। আমি তখন বললাম, আমি পায়ে হেঁটে চলতে পারি না। (সেখানে রীতি হলো, উজির ছাড়া কেউ ঘোড়ায় চড়তে পারবে না। আমাকে একটা ঘোড়া দেবার পরে আমি যখন কোথাও ঘোড়ায় চড়ে যেতাম তখন কৌতূহলী লোকজন ছেলে বুড়ো নির্বিশেষে আমার পিছু ধাওয়া করতো। অবশেষে আমাকে উজিরের কাছে নালিশ করতে হলো। ফলে তিনি ‘ডান্ধুরা’ পিটিয়ে জানিয়ে দিলেন যাতে কেউ আমার পিছু ধাওয়া না করে। ডান্ধুরা’ পিতলের তৈরী বাটীর মতো। লোহার ডাণ্ডা দিয়ে তা বাজানো হয়। অনেক দূর থেকে সে বাজনা শুনা যায়। সর্বসাধারণের মধ্যে কোনো প্রকার ঘোষণা করতে হলে তা। ‘ডান্ধুরা’ বাজিয়ে করতে হয়। উজির বললেন, আপনি যদি পাকী চড়তে চান তবে তাই করুন। তা না হলে আমাদের একটা ঘোড়া আছে, ঘটকীও আছে একটা। আপনি যেটা খুশী নিতে পারেন। আমি ঘটকী পছন্দ করলাম। তখনই সেটা আমার কাছে আনা হলো। সেই সঙ্গে এলো পোষাক। তখন আমি বললাম, যে কড়িগুলো কিনেছিলাম তা দিয়ে কি করবো? তিনি বললেন, আপনার কোনো সঙ্গীকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন সেগুলো বিক্রি করে দেবার জন্য। আমি বললাম, পাঠাতে পারি যদি আপনিও আপনার একজন লোক দেন তাকে সাহায্য করতে। তিনি তাতে রাজী হলেন। তখন আমি পাঠালাম আমার সঙ্গী আবু মোহাম্মদকে এবং তারা পাঠালো আল-হাজ্ব আলী নামক। একজন লোককে।

রমজান শেষ হবার পরেই আমি উজির সোলেমানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলাম তার কন্যাকে বিয়ে করবো বলে। উজির জামালউদ্দিনকে অনুরোধ জানালাম যাতে বিয়েটা তার সাক্ষাতে প্রাসাদেই সমাধা হয়। তিনি তাতে সম্মত হলেন এবং রীতি অনুযায়ী পান। ও চন্দনকাঠ পাঠিয়ে দিলেন। সব মেহমানরা এলেন কিন্তু উজির সোলমান বিলম্ব করতে লাগলেন। তাঁকে আনতে লোক পাঠানো হলো কিন্তু তবু তিনি এলেন না। দ্বিতীয়বার ডেকে পাঠাবার পরে তিনি তার কন্যা অসুস্থ বলে অজুহাত দেখালেন। পরে উজির আমাকে গোপনে বলেছিলেন। তার কন্যা এ বিয়েতে নারাজ, সে নিজেই নিজের কত্রী। লোকজন এসে গেছে, কাজেই সুলতানার শাশুড়ীকে বিয়ে করার বিষয়ে আপনার মতামত কি? (তার মেয়ের সঙ্গেই উজিরের ছেলের বিয়ে হয়েছে। আমি বললাম, বেশ ভালই। তখন কাজী ও সাক্ষী সাবুদ ডাকা হলো। বিয়ে পড়ানো হলো। উজির তাকে। মোহরানা দিলেন। কয়েকদিন পরে তাকে আমার কাছে পাঠানো হলো। তিনি একজন উত্তম নারী ছিলেন।

এই বিয়ের পরে উজির আমাকে জোর করেই কাজী পদে বহাল করলেন। তার কারণ, ওয়ারিশানের ভেতর কোনো সম্পত্তি ভাগ করে দেবার সময় কাজী সে সম্পত্তির দশ ভাগের এক ভাগ নিজের পারিশ্রমিক বলে গ্রহণ করতেন। তার এ প্রথার জন্য আমি তাকে তিরস্কার করেছিলাম। বলেছিলাম ওয়ারিশানের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে আপনি শুধু। ফি ছাড়া আর কিছুই পেতে পারেন না। এ ছাড়া কোনো কাজই তিনি ঠিকভাবে সমাধা। করতেন না। আমাকে যখন নিযুক্ত করা হলো তখন থেকে আমি সব-কিছুই পবিত্র শরিয়ত অনুসারে করতে চেষ্টিত হলাম। সেখানে আমাদের দেশের মতো মামলা। মোকদ্দমা নেই। তাদের মধ্যে প্রচলিত যে দুষনীয় রীতিটি প্রথম আমি সংশোধন করি তা ছিলো তালাক প্রাপ্ত স্ত্রীর পূর্ব-স্বামীর গৃহে অবস্থান। পুনরায় অন্যত্র বিবাহ না-হওয়া অবধি তারা পূর্ব-স্বামীর গৃহেই বাস করতো। অচিরেই আমি এ প্রথা রদ করি। এ অপরাধে অপরাধী প্রায় পঁচিশজন লোককে আমার কাছে হাজির করা হয়। আমি তাদের প্রহার করে বাজারের ভিতর হাঁটিয়ে নিয়ে যাই এবং তাদের কবল থেকে মেয়েদের মুক্ত করে দেই। অতঃপর নামাজ পড়ার জন্যও আমি কঠোর আদেশ দেই। লোকদের উপর হুকুম ছিলো শুক্রবার নামাজের পরেই তারা রাস্তায় ও বাজারে দ্রুত বেরিয়ে যাবে এবং কারা নামাজে যোগদান করেনি তা দেখবে। আমি তাদের এসে অনুরূপভাবে প্রহার করে রাস্তায় মিছিল করাতাম। বেতনভুক এমাম ও মোয়াজ্জিনদের প্রতিও আমি তাদের। কর্তব্যে তৎপর হতে বাধ্য করি। সে মতে সকল দ্বীপে চিঠি পাঠানো হয়। আমি মেয়েদের কাপড় পরাতেও চেষ্টা করেছি কিন্তু সে চেষ্টায় কৃতকার্য হতে পারিনি।

ইত্যবসরে আমি আরও তিনটি বিয়ে করেছি। তাদের একজন এক উজিরের কন্যা। তাকে এরা যথেষ্ট সম্মান করতো, কারণ এর পিতামহ একজন সুলতান ছিলেন। শাহাবউদ্দিনের পূর্ব-স্ত্রী ছিলেন আমার অন্যতমা স্ত্রী। এসব বিয়ের কারণে দুর্বল দ্বীপবাসীরা আমাকে ভয় করতে লাগলো এবং উজিরের কাছে আমার কুৎসা রটিয়ে আমাদের সম্পর্ক তিক্ত করে তুললো। একবার সুলতান শাহাবউদ্দিনের একজন ক্রীতদাসকে আমার নিকট হাজির করা হলো ব্যভিচারের অভিযোগে। প্রহারের পর আমি তাকে কারাগারে বন্দী করি। তাকে মুক্তি দেবার অনুরোধ করে উজির তার প্রধান সভাসদদের কয়েকজনকে আমার কাছে পাঠান। আমি তাদের বললাম, আপনারা কি এমন একজন নিগ্রো গোলামের পক্ষ সমর্থন করতে চান যে তার মনিবের ইজ্জতের হানি। করেছে। অথচ শাহাবউদ্দিন তার একজন ক্রীতদাসের গৃহে প্রবেশ করেছিলেন বলে তাকে সিংহাসনচ্যুত করেন এবং পরে তাকে হত্যা করেন। তৎপর আমি সেই গোলামকে ডাকিয়ে এনে বাঁশের লাঠি দিয়ে পিটালাম এবং তার গলায় দড়ি বেঁধে দ্বীপে টহল দেওয়ালাম। চাবুকের চেয়ে বাঁশের লাঠির প্রহার অপেক্ষাকৃত শক্ত। এ খবর। শুনতে পেয়ে উজির ভয়ানক রেগে গেলেন। তিনি তার উজিরদের এবং সেনাপতিদের একত্র করে আমাকেও ডাকলেন। আমি তার কাছে গিয়ে হাজির হলাম। যদিও সাধারণতঃ আমি তাকে কুর্নিশ করে থাকি, সেদিন কুর্নিশ না-করে সেদিন শুধু আচ্ছালাম আলাইকম বললাম। তারপর উপস্থিত সবাইকে সম্বোধন করে বললাম আপনারা সাক্ষী। থাকুন, আমি আমার কর্তব্য পালনে অক্ষম বলে পদত্যাগ করছি। উজির আমাকে লক্ষ্য করে কথা বলতে লাগলেন। আমি মঞ্চের উপর উঠে তার সামনে গিয়ে বসলাম এবং অনমনীয় মনোভাব নিয়ে তাঁর কথার উত্তর দিতে লাগলাম। ঠিক এমনি সময়ে মোয়াজ্জিন মাগরিবের নামাজের আজান দিয়ে উঠলেন আর উজিরও উঠে প্রাসাদের ভেতর চলে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, সবাই বলে আমি সুলতান। এ লোকটিকে ডেকে আনলাম আমার রাগ দেখাতে অথচ সেই আমাকে তার রাগ দেখাচ্ছে। আমি সেখানে যে সম্মান পেয়েছি তা শুধু ভারতের সুলতানের জন্য। কারণ তিনি আমাকে কতটা শ্রদ্ধা করতেন তা তারা জানতো। তারা যদিও অনেক দূরে বাস করতো তবু তাদের মনে সুলতানের ভয় কম ছিলো না।

উজির প্রাসাদে প্রবেশ করেই পদচ্যুত আগের কাজীকে ডেকে পাঠালেন। এ লোকটি ছিলেন দুর্মুখ। এসেই তিনি আমাকে বললেন আমাদের মনিব জিজ্ঞেস করেছিলেন আপনি তাকে কুর্নিশ না করে এতো লোকের সামনে তার মর্যাদাহানি করলেন কেনো। আমি জবাবে বললাম, তার সঙ্গে আমার সদ্ভাব ছিলো বলেই আমি তাকে কুর্নিশ করতাম কিন্তু তার মনোভাবের পরিবর্তন দেখে আমি সে অভ্যাস ত্যাগ করেছি। মুসলমানের অভিবাদন হলো সালাম। আমি তাকে যথারীতি সালাম করেছি। উজির তাকে দিয়ে দ্বিতীয়বার আমাকে বলে পাঠালেন, আপনি শুধু চলে যেতে চাইছেন। কাজেই যাওয়ার আগে আপনার বিবিদের এবং যা যৌতুক পেয়েছেন সব ফিরিয়ে দিতে হবে। তা ছাড়া দেনাও শোধ করতে হবে। আমি তাঁকে কুর্নিশ করে গৃহে ফিরে এলাম এবং সমস্ত দেনা পরিশোধ করে দিলাম। উজির এসব জানতে পেরে এবং আমি তখনও চলে যেতে চাইছি বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হলেন এবং আমাকে চলে যাওয়ার যে অনুমতি দিয়েছিলেন তাও প্রত্যাখ্যান করলেন। আমি তখন প্রতিজ্ঞা করলাম যে, চলে যাওয়া ছাড়া আমার অন্য পথ নেই। আমার সবকিছু জিনিষপত্র সমুদ্রতীরে এক মসজিদে নিয়ে রাখলাম। তারপর উজিরের মন্ত্রীদের দু’জনের সঙ্গে একটা চুক্তি করা হলো। আমার এক বিবির ভগ্নীর স্বামী হলেন মা’বারের (করমল) রাজা। এ দ্বীপপুঞ্জ তার অধিকারে নিবার জন্য আমি সেখান থেকে সৈন্য নিয়ে আসবো এবং আমি এখানে তার প্রতিনিধি হয়ে থাকবো। স্থির করা হলো, আমাদের সঙ্কেত হবে সাদা নিশান। যখন তারা সাদা নিশান। দেখবেন তখন তীরে বিদ্রোহ ঘোষণা করবেন উজিরের বিরুদ্ধে। উজির আমার সম্বন্ধে যতদিন না বিরূপভাব পোষণ করেছেন ততদিন আমি নিজে কখনো এরকম প্রস্তাব করিনি। তিনি ভীত হয়ে আমার সম্বন্ধে বলতে লাগলেন, আমার জীবিত কালেই হোক বা মৃত্যুর পরেই হোক এ লোকটি একদিন ওজারত দখল করবেই করবে। তিনি সব সময়েই আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন এবং বলতেন, আমি শুনেছি আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবার জন্য ভারতের সুলতান তাকে অর্থ পাঠিয়েছেন। আমি সৈন্য নিয়ে ফিরে আসবো মনে করে আমার যাওয়ার নামেই তিনি ভয় পেতেন। তাই একখানা জাহাজ ঠিকঠাক করে না দেওয়া অবধি তিনি আমাকে থেকে যেতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু আমি তা প্রত্যাখ্যান করলাম। তার মন্ত্রীরা এবং গণ্যমান্য লোকেরা মসজিদে এসে আমাকে ফিরে যেতে অনুরোধ করলেন। আমি তাদের বললাম প্রতিজ্ঞা না করে ফেললে আমি আপনাদের সঙ্গে ফিরেই যেতাম। তারা তখন প্রস্তাব করলেন, আবার প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে আমি অন্য কোন দ্বীপে গিয়ে ফিরে আসতে পারি। তখন তাঁদের সন্তুষ্ট করতে আমি বললাম, বেশ তাই হবে। রাত্রে যখন আমার যাত্রার সময় ঘনিয়ে এলো তখন উজিরের কাছে বিদায় নিতে গেলাম। তিনি আমাকে আলিঙ্গন করে এভাবে কাঁদতে লাগলেন যে তার চোখের পানি আমার পায়ের উপর পড়লো। আমার বৈবাহিক আত্মীয়েরা এবং বন্ধুরা বিদ্রোহ করবে আশঙ্কায় উজীর পরের রাত্রি নিজে দ্বীপ পাহারা দিয়ে কাটালেন।

আমি যাত্রা করে উজির আলীর দ্বীপে গিয়ে পৌঁছলাম। এখানে এসে আমার স্ত্রী ভয়ানক ব্যথায় আক্রান্ত হলেন এবং ফিরে যেতে চাইলেন। কাজেই আমি তাকে তালাক দিয়ে সেখানেই রেখে এলাম এবং উজিরকেও একথা লিখে দিলাম কারণ আমার স্ত্রী ছিলেন তার পুত্র-বধুর মাতা। আমার দ্বীপপুলোর বিভিন্ন জেলায় ঘুরতে-ঘুরতে এমন একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে এলাম যেখানে মাত্র একটি বাড়ি। তার মালীক একজন তাঁতী। তার স্ত্রী, পরিবারস্থ অন্যলোক, কয়েকটি নারকেল গাছ এবং মাছমারা ও অন্য দ্বীপে যাতায়াতের জন্য একখান ক্ষুদ্র নৌকা ছিলো। তার এ দ্বীপে কয়েকটি কলাগাছও আমরা দেখেছি কিন্তু দুটি দাঁড়কাক ছাড়া আর কোন পাখী সেখানে আমাদের নজরে পড়েনি। আমরা পৌঁছতে দাঁড়কাক দুটি এসে জাহাজের উপর উড়ে-উড়ে ঘুরপাক খেতে। লাগলো। আমি হলপ করে বলতে পারি, আমি ঐ লোকটিকে হিংসা করেছি এবং মনে মনে ইচ্ছা করেছি, আহা এমন একটি দ্বীপ যদি আমার থাকতো তবে এখানেই আমার বাসস্থান করতাম এবং জীবনে শেষ দিন অবধি এখানেই কাটাতাম। অতঃপর আমরা মুলুক দ্বীপে এলাম। ক্যান্টেন ইব্রাহিমের জাহাজটি এখানেই পড়ে ছিলো। এ জাহাজে করেই আমি মা’বার যাবার সঙ্কল্প করেছিলাম। ইব্রাহিম ও তার সঙ্গীরা আমার সঙ্গে দেখা করে আমাকে যথেষ্ট সমাদর দেখালেন। উজির এ দ্বীপ থেকে প্রত্যহ আমাকে ত্রিশ দীনারের কড়ি, কিছু নারকেল, মধু, পান, সুপারী ও মাছ দিবার আদেশ দিয়েছিলেন। আমি মুলুকে সত্তর দিন ছিলাম এবং দুটি বিয়ে করেছিলাম। দ্বীপের বাসিন্দারা আশঙ্কা। করেছিলো যে, যাবার দিন ইব্রাহিম তাদের দ্বীপ লুট করে যাবেন। কাজেই তারা প্রস্তাব করলো, ইব্রাহিমের সমস্ত অস্ত্রপাতি তারা শেষ দিন অবধি নিজেদের কাছে রেখে দেবে। এ নিয়ে মনাস্তর উপস্থিত হলো। আমরা মহলে ফিরে এলাম কিন্তু পোতাশ্রয়ের ভেতরে ঢুকলাম না। তারপর সমস্ত ঘটনা উজিরকে লিখে জানালে তিনি জবাব দিলেন অস্ত্রপাতি আটক করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। আমরা মুলুকে ফিরে এসে ৭৪৫ হিজরীর রবিউস সানি মাসের মাঝামাঝি (22nd. August 1344) সেখান থেকে যাত্রা করলাম। চার মাস পরে উজির জামালউদ্দিন এন্তেকাল করলেন-খোদা তার রুহের উপর দয়া বর্ষণ করুন!

জাহাজে কোনো আভিজ্ঞ পরিচালক ছাড়াই আমরা যাত্রা করেছিলাম। এ দ্বীপ থেকে মা’বারের দুরত্ব তিন দিনের। কিন্তু আমরা নয় দিন চলার পরে নবম দিনে সেলান (Ceylon) দ্বীপে এসে পৌঁছলাম। এখানে এসে দেখতে পেলাম সারান দ্বীপের পাহাড় আকাশে মাথা তুলে আছে ধূম্রের স্তম্ভের ৩ মতো। আমরা সে দ্বীপে এলেই নাবিকেরা। বললো, যে সুলতানের রাজ্যে সওদাগরেরা নির্ভয়ে যাতায়াত করতে পারে এ দ্বীপ সে রাজ্যের অন্তর্গত নয়। দ্বীপটি আয়রি শাকারবতী নামক একজন রাজার। তিনি অত্যাচারী এবং তার বোম্বেটে জাহাজ আছে। আমরা এ দ্বীপের পোতাশ্রয়ে আশ্রয় নিতে ভয় পেয়েছিলাম কিন্তু পর মূহুর্তে ঝড় উঠায় জাহাজ ডুবির ভয়ে আমি কাপ্তেনকে বললাম, আমাকে তীরে নামিয়ে দিন। আমি সুলতানের সঙ্গে এমন ব্যবস্থা করবো যাতে তিনি কোনো রকম দুর্ব্যবহার না করেন। আমার কথা মতো তিনি আমাকে তীরে নামিয়ে দিলেন। তাতে বিধর্মীরা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কে? আমি বললাম যে, আমি মা’বারের সুলতানের বন্ধু ও ভায়রাভাই। তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। জাহাজের মালপত্র তার জন্য উপহার। তারা সুলতানের কাছে ফিরে গিয়ে সংবাদ পৌঁছালো। তিনি খবর পেয়ে আমাকে ডেকে পাঠালেন। তার রাজধানী বাটালা (পুটালাম) শহরে গিয়ে আমি তার সঙ্গে দেখা করলাম। কাঠের দেওয়াল ও কাঠের মিনার দিয়ে ঘেরা বাটালা একটি ছোট শহর। এ শহরের সমস্ত উপকূল ছেয়ে পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে পড়ে আছে দারুচিনির গাছ। স্রোতে এসব গাছ ভেসে এসেছে। মা’বার ও মালাবারের লোকে বিনামূল্যে এসব সগ্রহ করে নিয়ে যায়। কিন্তু এজন্য সুলতানকে তারা বোনা কাপড় বা ঐ রকম সব জিনিস উপহার দিয়ে থাকে। এ দ্বীপ থেকে মা’বার একদিন ও এক রাতের পথ।

আমি বিধর্মী রাজা আয়রি শাকারবতীর সামনে হাজির হতেই তিনি উঠে এসে আমাকে নিয়ে তার পাশে বসালেন। এবং অত্যন্ত সদয়ভাবে কথাবার্তা বলতে লাগলেন। তিনি বললেন, আমার সঙ্গীরা সচ্ছন্দে নেমে এসে আমার আতিথ্য গ্রহণ করতে পারেন। কারণ, মা’বারের সুলতান আমার বন্ধু। তারপর তিনি আমাকে সেখানে থাকতে আমন্ত্রণ। জানালেন। আমি তিনদিন তার সেখানে ছিলাম। এ তিন দিনে আমার প্রতি তার আদর যত্ন ক্রমশঃ বেড়েছে। তিনি পার্শী ভাষা জানেন। আমার কাছে বিভিন্ন রাজা ও দেশের। গল্প শুনে তিনি খুব আনন্দ পেতেন। একদিন আমাকে কিছু মূল্যবান মুক্তা উপহার দিয়ে তিনি বললেন, লজ্জিত হবেন না, আপনার যা-কিছু মন চায় আমাকে বলুন। আমি বললাম, এ দ্বীপে এসে অবধি মনে একটা বাসনাই হয়েছে। এবং সে বাসনা হলো। আদমের কদম মোবারক জেয়ারত করা। (তারা বলে আদম বাবা এবং হাওয়াকে বলে মামা)। তিনি বললেন, সে তো সহজ ব্যাপার। একজন লোক সঙ্গে নিয়ে আপনাকে সেখানে পাঠিয়ে দেবো। আমি বললাম, তাই আমি চাই। আর যে জাহাজে আমি এলাম সে জাহাজখানা যেনো নিরাপদে মা’বার রওয়ানা হয়ে যেতে পারে। আমি যখন ফিরে যাবো তখন আপনার নিজের জাহাজে আমাকে পাঠাবেন। তিনি তাতে বলে উঠলেন, নিশ্চয়ই। আমি পরে যখন কাপ্তেনকে এ সব কথা বললাম, তখন তিনি বললেন, আপনি ফিরে না গেলে আমিও যাবো না। দরকার হলে আপনার জন্য এক বছর এখানে অপেক্ষা করবো।

সুলতানকে সে কথা বললাম। তিনি বললেন, আপনি ফিরে না আসা অবধি কাপ্তেন আমার মেহমান হিসাবে এখানেই থাকবেন।

তৎপর সুলতান আমাকে একখানা পালকী দিলেন। পাল্কীর বাহকেরা তাঁরই গোলাম। এ ছাড়া আমার সঙ্গে দিলেন চারজন যোগী–যাদের রীতি প্রতি বছর সেখানে গিয়ে তীর্থ করা, তিনজন ব্রাহ্মণ,৫ তার কর্মচারীদের দশজন এবং খাদ্যসম্ভার বহনের জন্য আরও পনেরো জন লোক। সে রাস্তায় পানির কোনো অভাব নেই। প্রথম দিন একটি নদীর ধারে গিয়ে আমরা তাবু ফেলি। সে নদীটি পার হয়েছিলাম বাঁশের ভেলার। সাহায্যে। সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে আমরা রাজার রাজ্যের শেষ-সীমান্তে মনার মণ্ডলি( মিনারী মালে) নামক সুন্দর একটি শহরে যাই। শহরের বাসিন্দারা আমাদিগকে একটি চমৎকার ভোজের আয়োজন করে আপ্যায়িত করেন। সে ভোজে উপাদেয় ভোজ্য ছিলো মহিষের বাচ্চার গোশত। মহিষের বাচ্চা তারা জীবন্ত অবস্থায় জঙ্গল থেকে ধরে আনে। বন্দর সালাওয়াট (Chilaw) নামক হোট শহর ছাড়িয়ে যাওয়ার পরে আমাদের রাস্তা শুরু হলো নদী-নালাবহুল অসমান ভূমির মধ্য দিয়ে। দেশের এ অংশে যথেষ্ট হাতি আছে, কিন্তু শেখ আবু আবদুল্লার দোয়ার বরকতে তারা বিদেশীদের বা তীর্থযাত্রীদের কোনো অনিষ্ট করে না। তিনিই আদমের কদম মোবারকে যাওয়ার জন্য সর্বপ্রথম এ রাস্তাটি নির্মাণ করেন। এখানকার বিধমরা পূর্বে মুসলমানদের কদম মোবারকে তীর্থ করবার অনুমতি দিতো না এবং তাদের উপর অত্যাচার করতো। এমন কি তাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া বা ব্যবসা-বাণিজ্য পর্যন্ত করতো না। কিন্তু শেখের সময়ে যে ঘটনা ঘটে তারপর থেকে তারা মুসলমানদের সম্মান করতে থাকে, গৃহে প্রবেশের অনুমতি দেয়, তাদের সঙ্গে পানাহার করে এবং তাদের স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে মেলামেশাকেও সন্দেহের চোখে দেখে না। আজ অবধি তারা এ শেখকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে এবং তাকে বিখ্যাত শেখ বলে।

তৎপর আমরা এখানকার প্রধান সুলতানের রাজধানী কুনাকর শহরে পৌঁছলাম ৬। দুটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী সঙ্কীর্ণ একটি উপত্যকায় এ শহরটি অবস্থিত। নিকটেই Lake of Rubles নামে একটি হ্রদ আছে। এ হ্রদে মণি-মুক্তা পাওয়া যায়। শহরের বাইরে শাবুশ নামে পরিচিত শিরাজের শেখ ওসমানের একটি সমজিদ আছে। সুলতানও এখানকার বাসিন্দারা তার কবর জেয়ারত করে ও সম্মানের চোখে দেখে। তিনি কদম মোবারকের একজন প্রদর্শক বা গাইড ছিলেন। পরে যখন তাঁর হাত ও পা কেটে ফেলা হয় তখন থেকে প্রদর্শকের কাজ করেন তার পুত্রগণ এবং গোলামগণ। তাঁর হাত পা কাটার কারণ, তিনি একটি গরু হত্যা করেছিলেন। বিধর্মী হিন্দুদের একটি আইন আছে, কেউ গোহত্যা করলে তাকেও ঠিক সেই ভাবে কেটে হত্যা করা হবে অথবা গরুর চামড়ায় পুরে দগ্ধ করা হবে। শেখ ওসমানকে তারা যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতো বলেই শুধু তাঁর হাত পা কেটে ছেড়ে দেন এবং একটি বাজারের আয় তাকে দান করেন। কুনাকরের সুলতানকে কুনার বলা হয়। তার একটি শ্বেতহস্তী আছে। সারা পৃথিবীতে আমি সেই একটি শ্বেতহস্তীই দেখেছি। উৎসবাদি উপলক্ষে তিনি শ্বেতহস্তীতে আরোহণ করেন। তখন এর কপালে বড় বড় মণি-মুক্তা দিয়ে সজ্জিত করা হয়। বাহরামান (Carbuncles) নামক চমৎকার মণি শুধু এ শহরেই পাওয়া যায়। তার কিছু সংখ্যক পাওয়া যায় হ্রদে এবং কিছু সংখ্যক মাটী খুঁড়ে হ্রদ থেকে যেগুলো পাওয়া যায় এদের কাছে সেগুলো বিশেষ মূল্যবান। সিংহল দ্বীপের সর্বত্রই জহরত বা মণি পাওয়া যায়। এখানকার জমি ব্যক্তিগত সম্পত্তি। যে কেউ একটি অংশ কিনে নিয়ে মণির জন্য খনন করতে থাকে। কোনো কোনো মণি লাল, কোনো কোনোটা হলদে (পোখরাজ) কতগুলো নীল (নীলকান্তমণি)। তাদের ভেতর প্রচলিত রীতি অনুসারে এক শ’ ফানাম মূল্যের মণি হলেই তা সুলতানের সম্পত্তি। তিনি সেগুলোর মূল্য দিয়ে নিজে গ্রহণ করেন। কম দামের মণি যারা পায় সেগুলো তাদেরই সম্পত্তি বলে গণ্য হয়। এক শ’। ফানাম ছয় স্বর্ণ দীনারের সমতূল্য।

কুনাকর থেকে রওয়ানা হয়ে আমরা উসতা মাহমুদ পুরী নামক এক গুহার কাছে এসে রইলাম। উস্তা মাহমুদ নামক একজন ধার্মিক লোক একটি পাহাড়ের পাদদেশে হ্রদের ধারে এ গুহাটি খনন করেন। সেখান থেকে আমরা বানরের হ্রদে (Lake of Monkeys) এলাম। এসব পাহাড়ে বহু সংখ্যক বানর আছে। এখানকার বানরগুলোর রং কালো এবং লেজ লম্বা। মানুষের মতো পুরুষ বানরের দাড়ী আছে। শেখ ওসমান, তার ছেলেরা এবং অপর অনেকে বলেছেন, এসব বানরের একজন প্রধান আছে। তাকে অন্যান্য বানর রাজার মতই মান্য করে। প্রধান বানর মাথায় গাছের পাতা দিয়ে তৈরী একটা ফিতের মতো জড়ায় এবং লাঠিতে ভর করে দাঁড়ায়। চারটি বানর লাঠি হাতে দাঁড়ায় তার ডাইনে বাঁয়ে। প্রধান বানর আসন গ্রহণ করলে অপর বানর চারটি তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায় এবং প্রধান বানরের স্ত্রীবানর ও বাচ্চারা তার সামনে এসে প্রত্যেক দিন বসে। অন্যান্য বানররা তখন এসে দুরে দুরে বসে। এবার পূর্বের চারটি বানরের একটি উঠে অপর বানরদের উদ্দেশ্য কিছু বলতেই তারা চলে যায়। তৎপর ফিরে আসে হাতে কলা, লেবু বা তেমনি কোনো ফলমুল নিয়ে। প্রধান বানর, তার বাচ্চারা এবং সঙ্গী চারজন সে সব ফল খায়। একজন যোগী আমাকে বলেছেন যে, প্রধান বানরের সামনে একটি বানরকে উক্ত চার বানর লাঠি দিয়ে প্রহার করছে এবং প্রহারের পরে চুল ছিঁড়ছে বলে তিনি দেখেছেন। সেখান থেকে চলতে চলতে আমরা যে জায়গায় গেলাম তার নাম বুড়ীর কুঁড়ে। এখানেই লোকালয়ের শেষ। সেখান থেকে কতকগুলো গুহার পাশ দিয়ে আমাদের আসতে হয়। এখানে এসেই আমরা উড়ন্ত সেঁক দেখতে পাই। সেগুলো জলার ধারে গাছে বা লতাপাতার মধ্যে বসে থাকে। মানুষ কাছে গেলে এরা তার উপর লাফ দিয়ে পড়ে। শরীরের যেখানে এরা পড়ে সেখানেই অবাধে রক্তপাত হতে থাকে। এজন্য এখানকার লোকেরা সর্বদা একটি লেবু সঙ্গে রাখে। লেবু রগড়ে তার রস জেঁকের উপর ফেললেই জোক পড়ে যায়। তখন তারা একটা কাঠের ছুরির মত চটা দিয়ে জায়গাটা চেঁছে দেয়। এজন্য তারা কাটের ছুরিও সঙ্গে রাখে।

সরণদ্বীপের একটি পর্বত (Adam’s Peak) পৃথিবীর অন্যতম উচ্চ পর্বত। নয়দিনের পথ দূরে থাকতেই সমুদ্রের বুক থেকে আমরা এ পর্বত দেখেছি। আমরা যখন। এ পর্বতে আরোহণ করেছিলাম। তখন দেখা যাচ্ছিলো আমাদের নীচে। সেজন্য নীচের কিছুই আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না। এ পাহাড়ের বুকে সবুজ বনানী ও নানা রংয়ের। ফুল রয়েছে। ফুলের মধ্যে হাতের তালুর মতো বড় বড় গোলাপও আছে। পাহাড়ের উপর কদম (Foot) পর্যন্ত পৌঁছবার দুটি পথ। তার একটির নাম ‘বাবা পথ’ অপরটির নাম মামা পথ’ অর্থাৎ আদম ও হাওয়ার পথ। মামা পথটি সহজ এবং সেই পথেই তীর্থযাত্রীরা নেমে আসে। কিন্তু কেউ যদি সে পথে উপরে যায় তবে সে আদৌ তীর্থভ্রমণ করেছে বলে গণ্য হয় না। বাবা পথটি দূরারোহ। পূর্ব পুরুষের লোকেরা এ পর্বতের গায়ে একটি সিঁড়ি কাটে এবং লোহার খুঁটি পুতে শিকল লাগিয়ে আরোহীদের ধরতে সুবিধা করে দেয়। এ রকম দশটি শিকল আছে। তার দুটি পাদদেশে প্রবেশ পথে তারপর পর পর সাতটি। দশম শিকলটিকে বলা হয় ইমানের শিকল। এ রকম নাম হবার কারণ এই যে, এ অবধি উঠে কেউ নীচের দিকে চাইলে পড়ে যাবার ভয়ে খোদার নাম স্মরণ করে। এই শিকলটি ছাড়িয়ে গেলে বন্ধুর একটি পথ। দশম শিকল থেকে খিজিরের গুহার দুরত্ব সাত মাইল। গুহাটি প্রশস্ত একটি মালভূমির মধ্যে অবস্থিত। কাছেই মাছে পরিপূর্ণ একটি ঝরণা আছে। কিন্তু কেউ সেসব মাছ ধরে না। কাছেই পথের দু’পাশে পাথর কেটে দু’টি পুষ্করিণী খনন করা হয়েছে। খিজিরের গুহায় পৌঁছে যাত্রীরা তাদের মালপত্র সেখানে রেখে দু’মাইল উপরে কদম মোবারকে পৌঁছে।

হজরত আদমের সেই পবিত্র কদম মোবারক একটি প্রশস্ত মালভূমিতে উচ্চ কালো প্রস্তরখণ্ডে অঙ্কিত। পবিত্র পদটি এতো গভীরভাবে বসেছে যে ছাপটি স্পষ্ট বসেছে। লম্বায় এ পদচিহ্ন এগারো বিঘৎ। পুরাকালে চীনের লোকেরা এখানে এসে বুড়ো আঙুলের ছাপসহ পাথরের কিছু অংশ কেটে নিয়ে যায়। সেটি জয়তুনের একটি মন্দিরে রক্ষিত আছে। দেশের দূরাঞ্চলের লোকেরা অবধি এখানে তা জেয়ারত করতে আসে। যে পাহাড়ে কদম মোবারক রয়েছে সেখানে নয়টি গর্ত করা হয়েছে। এ সব গর্তে বিধর্মী তীর্থযাত্রীরা স্বর্ণ, মূল্যবান মণিমুক্তা ও অলঙ্কারাদি দিয়ে যায়। দরবেশদের দেখা যায়, খিজিরের গুহায় পৌঁছবার পর এ সব গর্তে যা রক্ষিত আছে তা নিবার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা আরম্ভ করেছে। আমাদের বেলা কিছু পাথর ও সামান্য সোনা ছাড়া সেখানে কিছুই পাইনি। সে সব আমরা গাইডকে দিয়েছি। খিজিরের গুহায় তিনদিন কাটিয়ে সকালে ও বিকালে তীর্থযাত্রীদের কদম মোবারক জেয়ারত করতে হয়, এই-ই এখানে প্রচলিত নিয়ম। আমরাও এ নিয়ম পালন করেছি। তিনদিন এখানে কাটাবার পর আমরা মামা পথে নেমে এলাম। আসবার সময় পথে পাহাড়ের উপর কয়েকটি গ্রামে আমরা থেমেছি। পাহাড়ের পাদদেশে এমন একটি প্রাচীন গাছ আছে যার পাতা কখনো ঝরে পড়ে না। গাছটি যেখানে আছে সেখানে যাওয়া কারও সম্ভবপর নয়। এ গাছের পাতা চোখে দেখেছে এমন কোনো লোকের দেখা আমি পাইনি। এ পাহাড়ের পাদদেশে কয়েকজন যোগী দেখেছি। তারা গাছের পাতা পড়বার প্রতীক্ষায় কখনো এ জায়গা ছেড়ে যান না। এ সম্বন্ধে নোকমুখে নানা অলীক গল্প শুনা যায়। তার একটি হলো, এ গাছের পাতা যে খাবে সে বুড়ো হলেও যৌবন ফিরিয়ে পায়। কিন্তু তা সত্য হতে পারে না। এ পাহাড়ের তলায়ই রয়েছে সেই হ্রদ যেখানে জহরত পাওয়া যায়। এ হ্রদের। পানির বর্ণ উজ্জ্বল নীল।

সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে সমুদ্রোপকুলে দিনাওয়ার একটি বড় শহরে এসে পৌঁছলাম। এ শহরে ব্যবসায়ীদের বাস। এ শহরের বড় একটি মন্দিরে দিনাওয়ার নামে একটি মূর্তি রক্ষিত আছে। এ মন্দিরে প্রায় এক হাজার ব্রাহ্মণ ও যোগী বাস করে। এ ছাড়া স্ত্রীলোক, বিধর্মীদের কন্যা আছে প্রায় পাঁচশ। তারা প্রতিদিন রাত্রে মূর্তির সামনে নৃত্যগীত করে। এ শহর এবং তাঁর সর্বপ্রকার আয় মন্দিরের মূর্তির জন্য বরাদ্দ করা আছে। সেইখান থেকে মন্দিরবাসী ও তীর্থযাত্রীদের খাদ্য সরবরাহ করা হয়। প্রায় মানুষের সমান উচ্চ এ মূর্তিটি স্বর্ণ নির্মিত। মূর্তির চোখের স্থানে দুটি প্রকাণ্ড মণি আছে। রাত্রে তা বাতির মতই জ্বল জ্বল করে বলে শুনেছি।

এখান থেকে রওয়ানা হয়ে আঠারো মাইল দূরে কালি (Point-de-Galle) শহর। সেখান থেকে আমরা পৌঁছি কালানবো (Colombo), সিংহলে এটি অতি সুন্দর এবং বড় একটি শহর। এখানে উজির ও জলস্তি সাগরের শাসনকর্তা বাস করেন। তাঁর সঙ্গে এক হাজার হাবসী থাকে। কালাবো থেকে রওয়ানা হয়ে তিন দিন পর আমরা আবার বাটালা এসে আমরা পূর্বোক্ত সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। কাপ্তেন ইব্রাহীম তখনও আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সেখান থেকে একসঙ্গে আমরা মা’বার রওয়ানা হলাম।

***

টিকা

পরিচ্ছেদ ৮

১। মালদ্বীপ যদিও বহুকাল পূর্ব থেকে নাবিক এবং পর্যটকদের কাছে পরিচিত ছিল এবং বারো শতাব্দীতে মুসলিম অধ্যুসিত হয়ে পড়েছিল-তবু ইব্‌নে বতুতার বর্ণনা হচ্ছে অনেক আগের ব্যাপার, এর অধিবাসী এবং দ্বীপটি সম্বন্ধে এ বিবরণ আমাদের জানা আছে। তার প্রদত্ত অনেক নাম এখনো মানচিত্রে দেখা যায়।

২। মালদ্বীপ কালু-বিলি-মাস’, কালো বোনিতো মাছ আগুনে পুড়ানোর পর কালো হয়ে যায় বলে এর নাম কালো রাখা হয়েছে।

৩। “সন্দ্বীপের পাহাড়” হচ্ছে আদমের পর্বত চূড়া। সন্দ্বীপ হচ্ছে সিলনের পুরাতন আরবী এবং পার্শিয়ান নাম। (এর উদ্ভব হয়েছে সংস্কৃত ‘সিংহল দ্বীপ থেকে মানে সিংহের আবাস দ্বীপ)। ইহা পরে পালি ভাষায় সিহালাম= সেল্যান=সেলনে রূপান্তরিত হয়।

৪। সিলনের পুরাতন সিনহালিজ রাজ্য ১৩১৪ খ্রীষ্টাব্দের দিকে পাণ্ডিয়াজগণ আক্রমণ করে-এদের নিজেদের রাজ্য ছিল মাবারের অন্তর্গত মাদুরায়–এটা অন্ততঃ খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত বর্তমান ছিল-তারপর তখন সেটা ছিল মুসলিমদের হাতে। আক্রমণকারীদের নেতা ছিলেন আরিয়া চক্রবর্তী। কিন্তু ইব্‌নে বতুতার মুরব্বী সম্ভবতঃ সেই একই নামের কোনো পরবর্তী সেনাপতি। ইনি ১৩৭১ সালে কলম্বো এবং অন্যত্র দূর্গ নির্মাণ করেছিলেন। পাণ্ডিয়াদের বসতস্থান ছিল জান্না দ্বীপে।

৫। আদম পর্বত চূড়ার গর্তটিকে মুসলিমগণ আদমের পায়ের চিহ্ন বলে সম্মান করে থাকেন। ব্রাহ্মণ এবং বৌদ্ধগণও এটাকে সমভাবে ভক্তি করে থাকেন। তারা মনে করেন এটা শিবের এবং বুদ্ধের পদচিহ্ন।

৬। কুনাকার নিশ্চয়ই কর্ণেগ্যালি (কুরুনাগালা)। এটা পুরাতন সিংহলী রাজবংশের সেই সময়ের আবাস স্থল। কুনার নামটি সংস্কৃত কুনওয়ার “রাজকুমার” বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

৭। এ শিকলগুলি এখনো বর্তমান রয়েছে।

৮। দিনওয়ার (এটা ঠিকভাবে কুর্দিস্তান অন্তর্গত মধ্যযুগীয় একটি শহরের নাম কিরমানশার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত) এখানে দিওয়ানদারার জায়গায় বসেছে। বিষ্ণুর প্রসিদ্ধ মন্দিরের স্থান এটা (১৫৮৭ খ্রীষ্টাব্দে পুর্তুগীজগণ এটা ধ্বংস করেন)। স্থানটি দা হেডের নিকটে। সিলনের সর্বশেষ দক্ষিণে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *