০৪. ইয়েমেন ও ভারত যাবার উদ্দেশ্যে

চার

ইয়েমেন ও ভারত যাবার উদ্দেশ্যে হজের পরেই আমি জেদ্দায় এলাম জাহাজ ধরবার জন্য কিন্তু কোন সঙ্গী পেলাম না বলে আমার সে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হল। আমাকে চল্লিশ দিন কাটাতে হল জেদ্দায়। সেখানে তখন কসাইরগামী একখানা জাহাজ ছিল। জাহাজটির অবস্থা কি রকম দেখবার জন্য জাহাজে উঠে আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। খোদার ইচ্ছায় তা হয়েছিল, কারণ সে জাহাজটি যাত্রা করে গিয়ে সমুদ্রে ডুবে যায় এবং অতি অল্প লোকই প্রাণ রক্ষা করতে সমর্থ হয়। পরে আমি আয়বীব যাওয়ার জন্য জাহাজে উঠি কিন্তু জাহাজ গিয়ে পৌঁছে রাস দাওয়াইর নামক জাহাজ ভিড়াবার একটি জায়গায়। সেখান থেকে কয়েকজন বেজার সঙ্গে আমরা মরুভূমির পথে আয়বীব রওয়ানা হয়ে গেলাম। সেখান থেকে এডফু গিয়ে নীলনদের পথে কায়রো এলাম। কায়রোতে দিন কয়েক কাটিয়ে যাত্রা করলাম সিরিয়া। পথে যেতে দ্বিতীয় বারের জন্য গাঁজা, হেবরণ, জেরুজালেম, রামলা আকরে, ত্রিপলী এবং জাবালা হয়ে লাধিকিয়া দেখে এলাম।

লাধিকিয়ায় ছোট একটি জাহাজ পেলাম। জাহাজটি Genoeseদের, তার মালিকের নাম মারতালমিন। সে জাহাজে তুর্কীদের দেশ বলে পরিচিত বেলাদ-আর রোম (আনাতোলিয়া) রওয়ানা হলাম। আগে এ দেশটি তুর্কীদেরই ছিল। পরে এদেশ অধিকার করে মুসলমানেরা কিন্তু তবু এখনও তুর্কমেন মুসলমানদের শাসনাধীনে এখানে অনেক খ্রীষ্টান বসবাস করে। আমাদের দশ রাত্রি সমুদ্রে কাটাতে হয়েছে। সে সময়ে খ্রস্টানরা আমাদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করেছে এবং ভাড়া বাবদ কিছুই গ্রহণ করেনি। দশম দিনে আমরা আলায়া পৌঁছি। আলায়া থেকেই এ প্রদেশের শুরু। এ দেশটি পৃথিবীর অন্যতম উত্তম দেশ। অন্যান্য দেশের ভাল যা-কিছু খোদা এখানে এনে একত্র করে দিয়েছেন। এখানকার লোকেরা সবচেয়ে শান্ত প্রকৃতির। পোষাকে পরিচ্ছদেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, খাদ্যের ব্যাপারে অত্যন্ত সূক্ষদর্শী। সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে এরা সব চেয়ে দয়াল। এদেশের যেখানেই আমরা গেছি, মুসাফেরখানায় বা গৃহস্থ বাড়ীতে, সেখানেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই এসে আমাদের কুশলাদি জিজ্ঞাসা করেছে। এখানকার নারীরা নেকাব ব্যবহার করে না। যখন আমরা চলে এলাম তখন ঠিক আত্মীয় পরিজনের মতই আমাদের বিদায় দিল, নারীদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। সপ্তাহে মাত্র একবার তারা রুটী তৈরি করে। যে দিন রুটী তৈরি হত লোকেরা সেদিন গরম রুটী আমাদের দিয়ে বলত, “বাড়ীর বিবিরা আপনাদের উপহার পাঠিয়েছেন এবং দোয়া করতে বলেছেন।” এখানকার সমস্ত বাসিন্দাই গোঁড়া সুন্নী মতাবলম্বী কিন্তু এরা ভাঙ খায় এবং তা অনিষ্টকর মনে করে না।

সমুদ্রোপকূলে আলেয়া একটি বড় শহর। এ শহরের অধিবাসীরা তুর্কমেন। কায়রো, আলেকজেন্দ্রিয়া, সিরয়া থেকে সওদাগরের এ শহরে যাতায়াত করে। এ জেলায় যথেষ্ট কাঠ পাওয়া যায়। এখান থেকে আলেকজান্দ্রিয়া ও ডামিয়েট্টায় কাঠ চালান হয়ে যায়। সেখান থেকে বহন করে নেওয়া হয় মিসরের অন্যান্য শহরে। এখানে সুলতান আলাউদ্দিনের দ্বারা নির্মিত ইট প্রসিদ্ধ দূর্গ আছে। শহরের কাজী ঘোড়ায় চড়ে আমাকে আলেয়ার সুলতান ইউসুফ বেকের সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে গেলেন। সুলতানের। পিতার নাম ছিল কারামান। এখানকার লোকদের ভাষায় বেক অর্থ রাজা। তিনি শহর থেকে দশ মাইল দূরে বাস করেন। আমরা গিয়ে দেখলাম, তিনি সমুদ্র পারে একটি। টিলার উপর বসে আছেন, নীচে বসে আছেন আমীর ও উজিরগণ। সুলতানের ডাইনে ও বামে রয়েছে সৈনিকরা। তিনি তার চুলে কাল রং দিয়েছেন। আমি তাকে অভিবাদন। করলাম এবং আমার আগমনের কারণ সম্বন্ধে তিনি যে সব প্রশ্ন করলেন তার জবাব। দিলাম। আমি চলে আসার পর তিনি আমাকে কিছু অর্থ উপহার পাঠিয়েছিলেন।

আলেয়া থেকে আমরা এলাম অতি সুদৃশ্য শহর আস্তালিয়া (আদালিয়া)৩। শহরটি আয়তনে বিশাল। কিন্তু তা হলেও এমন আকর্ষণীয় শহর অন্যত্র দেখা যায় না। শহরের লোকসংখ্যা যথেষ্ট হলেও উত্তমরূপে সজ্জিত। এখানে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের লোকদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল বা মহল্লা রয়েছে। শহরের খৃষ্টান অধিবাসীরা প্রাচীরবেষ্টিত মিনা (বন্দর) নামক একটি মহল্লায় বাস করে। রাত্রে এবং শুক্রবার নামাজের ৪ সময় প্রাচীরের প্রবেশদ্বার ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখা হয়। এ শহরের আদি বাসিন্দা গ্রীকরাও পৃথক একটি মহল্লায় বাস করে, ইহুদীরা অপর একটিতে। সুলতান ও তার বিভিন্ন কর্মচারীরাও পৃথক একটি মহল্লায় বাস করেন। প্রত্যেক মহল্লাই প্রাচীরবেষ্টিত। বাকি মুসলমান অধিবাসীরা শহরের কেন্দ্রস্থলে বাস করে। সমস্ত শহর ও উল্লিখিত মহল্লাগুলির চতুর্দিক বেষ্টন করে আরও একটি বৃহৎ প্রাচীর আছে। এখানকার ফলের বাগানগুলিতে উক্তৃষ্ট শ্রেণীর এক প্রকার খুবানী বা অ্যাপ্রিকট পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকদের কাছে তা কামালউদ্দীন নামে পরিচিত। এ ফলের শাষের ভেতরে মিষ্ট বাদাম পাওয়া যায়। শুষ্ক খুবানী এখান থেকে মিশরে চালান হয়ে যায়। মিশরে এ ফলের যথেষ্ট কদর।

আমরা এখানকার কলেজের মসজিদে ছিলাম। কলেজের তখনকার অধ্যক্ষের নাম ছিল শেখ শিহাবউদ্দীন আল হামাবী। আনাতোলিয়ার প্রতি জেলায়, শহরে ও গ্রামে যে সব তুর্কমেন আছে, তাদের ভেতর সর্বত্রই আখিয়া (Akhiya) বা ‘যুব ভ্রাতৃত্ব’ (Young Brotherhood) নামক একটি প্রতিষ্ঠানের সভ্য দেখা যায়। মেহমানদের আদর আপ্যায়ন করতে সদাই ব্য, এদের মত এমন সম্প্রদায় আর কোথাও দেখা যায় না। মেহমানদের কাছে এরা যথাসম্ভব খাবার হাজির করে, অন্যের অভাব দূর করে, অন্যায় অত্যাচার দমন করে এবং পুলিসের অত্যাচারী চরদের বা তাদের সঙ্গে যে সব। দুষ্কৃতকারী যোগদান করে, তাদের হত্যা করে। যুবভাই বা স্থানীয় লোকদের ভাষায় আখি নির্বাচিত হয় সমব্যবসায়ী সকলের ভোটে, অবিবাহিত লোকদের দ্বারা অথবা কঠোর সংযমী ধর্মপরায়ণ কোন ব্যক্তি দ্বারা। নির্বাচিত যুবই স্ব-সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব। করে। এই প্রতিষ্ঠান ফতুয়া’ (বা Order of youth) নামেও পরিচিত। নেতা একটি মুসাফেরখানা প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাতে কম্বল, বাতি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিষ এনে দেন। প্রতিষ্ঠানের সভ্যরা সারাদিন নিজ-নিজ জীবিকার জন্য উপার্জন করে, দিনের শেষে বিকালে বা উপার্জন করে সবই এনে দেয় নেতার কাছে। এভাবে যে অর্থ সঞ্চিত হয় তা দিয়ে ফল, খাদ্য এবং মুসাফেরখানার অন্যান্য দরকারী জিনিষ ক্রয় করা হয়। সেদিন যদি কোন মুসাফের শহরে আসে তবে তাকে মুসাফেরখানায় রেখে ঐ দিনের সংগৃহিত খাদ্য দেওয়া হয়। এভাবে যতদিন খুশী সে সেখানে থাকতে পারে। যদি কোনদিন কোন মুসাফের না আসে তবে নিজেরা একত্র হয়ে সে সব খাবার খায় এবং খাওয়ার পরে নৃত্য-গীত-বাদ্যের দ্বারা আমোদ প্রমোদ করে। পরের দিন আবার যে যার কাজে চলে যায় এবং শেষ বেলায় উপার্জিত অর্থ এনে নেতার কাছে যথারীতি জমা দেয়। প্রতিষ্ঠানের সভ্যদের বলা হয় ফিতায়ানা (Fityan) Youth)। নেতাকে বলা হয় ‘আখি’৫ আগেই তা বলেছি।

আমাদের আন্তালিয়ায় পৌঁছবার পরের দিন এমনি একটি যুবক শেখ শিহাবউদ্দিনের কাছে এসে তুর্কী ভাষায় কথাবার্তা বল্লেন। আমি তখন তার কথা বুঝতে পারিনি। লোকটির পরিধানে ছিল পুরাতন কাপড়, মাথায়ও একটি টুপি ছিল। শেখ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এ লোকটি কি বলছে বুঝতে পারলে?”

আমি বল্লাম, “না, কিছুই বুঝতে পারলাম না।”

শেখ তখন বললেন, “তোমাকে এবং তোমার দলের আর সবাইকে তার ওখানে খাওয়ার দাওয়াত করতে এসেছে।”

আমি মনে মনে বিস্মিত হলাম কিন্তু মুখে বল্লাম, “বেশ তো।”

লোকটি চলে গেলে শেখকে বললাম, “লোকটি গরীব। আমাদের খাওয়াতে গেলে তার কষ্ট হবে। লোকটির উপর আমাদের বোঝা চাপাতে চাই না।”

শেখ হেসে বললেন, “সে যুব ভ্রাতৃত্বের একজন শেখ। মূচির কাজ করে কিন্তু খুব দয়ালু। তার দলে রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসায়ে লিপ্ত প্রায় দু’শ লোক। তারা একে নেতা নির্বাচিত করে একটি মুসাফেরখানা তৈরী করেছে। সেখানে মুসাফেরদের খাওয়ানো হয়। সারা দিনে এরা যা উপায় করে রাত্রে তাই খরচ করে।”

আমার মাগরেবের নামাজ পড়া হয়েছে এমন সময় আবার সেই লোকটি এসে হাজির। সে এসে আমাদের মুসাফেরখানায় নিয়ে গেল। আমরা অতি চমৎকার একটি অট্টালিকায় এসে হাজির হলাম। ঘরের মেঝে তুর্কী কার্পেটে মোড়া, অসংখ্য বাতি জ্বলছে ইরাকী কাঁচের ঝাড় লণ্ঠনের। কিছু সংখ্যক যুবক সার বেঁধে হল-কামরায় দাঁড়িয়ে আছে। পরণে তাদের লম্বা কোর্তা, পায়ে জুতা, কোমরবন্ধের সঙ্গে ঝুলছে প্রায় দুহাত করে লম্বা একটি করে ছুরি। তাদের মাথায় সাদা উলের টুপি, টুপির চুড়ায় বাধা এক হাত লম্বা দু আঙ্গুল চওড়া এক টুকরা কাপড়। যখন তারা বসল তখন সবাই টুপি খুলে নিজের সামনে রেখে দিল। তারপর আরেকটি করে কারুকার্যময় রেশমের বা ঐ জাতীয় টুপি মাথায় দিল। তাদের হলটির মধ্যস্থলে মুসাফেরদের জন্য রক্ষিত একটি দেবী। আমরা গিয়ে আসন গ্রহণ করার পর ফল মিষ্টি ইত্যাদি খাওয়া হ’ল এবং তার পরে শুরু হ’ল নৃত্য গীত। আমরা তাদের মুক্ত হস্তের দয়া দাক্ষিণ্য দেখে মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়ে গেলাম। আমরা রাত্রির শেষ দিকে বিদায় নিয়ে এলাম। আমরা যখন এ শহরে গিয়েছি তখন ইউনুস বেকের পুত্র খিদর বেক ছিলেন সুলতান। তিনি তখন অসুস্থ। তবু আমরা তার সঙ্গে দেখা করেছি তার রুগ্ন শয্যায়। তিনি অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বললেন এবং বিদায় নেওয়ার সময় কিছু অর্থ আমাদের উপহার। দিলেন।

সেখান থেকে আমলা এলাম বরদুল (Buldur) জায়গাটি ছোট কিন্তু অনেক ফলের বাগান এবং নদী নালা আছে আর আছে পাহাড়ের উপর একটি দূর্গ। আমরা সেখানে বাস করলাম ইমামের (peacher) মেহমান হয়ে। সেখানকার যুব ভ্রাতৃত্ব একটি সভা ডাকল এবং তাদের সঙ্গে থাকতে আমাদের অনুরোধ জানাল। কিন্তু আমাদের মেজবান ইমাম তাতে রাজী হলেন না। কাজেই যুব ভ্রাতৃত্ব তাদের এক সভ্যের একটি বাগানে ভোজের আয়োজন করে আমাদের সেখানে নিয়ে গেল। তারা যে রকম আনন্দের সঙ্গে আমাদের অভ্যর্থনা করল তা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল যদিও আমরা কেউ পরস্পরের ভাষা বুঝতে পারিনি এবং বুঝিয়ে দেবারও কেউ সেখানে ছিল না। আমরা সেখানে একদিন তাদের সঙ্গে কাটিয়ে বিদায় নিয়ে এলাম।

বারদুর থেকে আমরা এলাম সাবারতা (Isarta), সেখানে থেকে আকরিদুর (Egirdir)। আকরিদুর জনবহুল একটি বড় শহর। এখানে মিঠা পানির একটি হ্রদ আছে। এদ থেকে নৌকায় দু’দিনে আকশর ও বাকশর এবং অন্যান্য শহর ও গ্রামে ৬ যাওয়া যায়। আকারদুরের সুলতান এ দেশের একজন খ্যাতনামা শাসনকর্তা। তিনি একজন সৎ প্রকৃতির লোক। প্রতিদিন তিনি শহরের প্রধান মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করেন। আমাদের সেখানে থাকাকালে তার একটি পুত্র মারা যায়। তার দাফনে পরে সুলতান এবং ছাত্রেরা তিনদিন অবধি খালি পায়ে কবরস্থানে যান। দ্বিতীয় দিন আমি তাদের সঙ্গে গিয়েছিলাম। আমাকে হেঁটে যেতে দেখে তিনি একটি ঘোড়া পাঠিয়ে দেন। মাদ্রাসায় পৌঁছে আমি সেই ঘোড়াটি ফেরত পাঠিয়ে দেই। কিন্তু তিনি সে ঘোড়া পুনরায় ফেরত পাঠিয়ে বলেন, “আমি উপহার হিসাবে ঘোড়াটি আপনাকে দিয়েছি, ধার হিসাবে নয়।” তিনি আমাকে জামা কাপড় ও কিছু অর্থও উপহার দেন।

অতঃপর আমরা কুল হিসার (Laka Fortress) শহরে পৌঁছলাম। নল খাগড়াপূর্ণ জলায় সম্পূর্ণভাবে বেষ্টিত কুল হিসার একটি ছোট শহর।৭ নল খাগড়া ও পানির উপরে তৈরী একটি সেতু এ শহরের একমাত্র প্রবেশ পথ। পথটি এত সরু যে একেবারে একটি মাত্র ঘোড়সওয়ার সে পথে যেতে পারে। একটি হ্রদের মধ্যে একটি পাহাড়। সেই পাহাড়ের উপরে রয়েছে দুর্ভেদ্য এ শহরটি। এখানকার সুলতান আকরিদুরের সুলতানের ভাই। আমরা যখন এখানে পৌঁছি তিনি তখন অনুপস্থিত ছিলেন। আমরা সেখানে কয়েকদিন কাটাবার পর তিনি এলেন। তিনি আমাদের খাদ্য ও ঘোড়া সরবরাহ করে অত্যন্ত সহৃদয়তার পরিচয় দেন। জারমিয়ান (Kermian) নামে পরিচিত একদল দস্য সেখানে আছে। কুতাহিয়া নামে একটি শহরও তাদের দখলে আছে। এজন্য সুলতান আমাদের সঙ্গে একদল অশ্বারোহী দেন লাধিক (Denizli) পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দেবার জন্য। সাতটি বড় মসজিদবিশিষ্ট সাধিক একটি প্রসিদ্ধ শহর। চারপাশে সোনালী জরির কাজ করা এ ধরণের অতুলনীয় সূতী কাপড় তৈরী হয় লাধিক শহরে। উত্তম বুনট ও উৎকৃষ্ট শ্রেণীর সূতার তৈরী বলে সে কাপড় খুব টেকসই হয়। কারিগরদের মধ্যে অধিকাংশই গ্ৰী নারী, কারণ, এখানে বহু সংখ্যক গ্রীকের বাস। তারা সুলতানের প্রজা এবং তাঁকে জিজিয়া কর দেয়। গ্রীকদের একটি বিশেষ চিহ্ন হল তাদের মাথার লম্বা চুড়াবিশিষ্ট সাদা বা লাল টুপি। এখানকার গ্রীক নারীরা মাথায় ব্যবহার করে বড় পাগড়ী। শহরে প্রবেশ করেই আমরা একটি বাজারের মধ্য দিয়া যেতে ছিলাম, কয়েকজন দোকানদার তাড়াতাড়ি তাদের দোকান ছেড়ে এসে আমাদের ঘোড়ার লাগাম ধরল। এ ব্যাপারে অন্যান্য দোকানদাররা আপত্তি উত্থাপন করল। তারপরে এমন বাদানুবাদ চলতে আরম্ভ করল যে কয়েকজন ছুরি বের করে ফেলল। আমরা অবশ্য তাদের বক্তব্য কিছুই বুঝতে পারিনি কিন্তু মনে ভয় হল যে, এরাই বোধ হয় সেই ডাকাত এবং এটাই তাদের শহর। অবশেষে খোদা আমাদের এমন একজন লোক সেখানে এনে হাজির করলেন যিনি আরবী জানতেন। তিনি আমাদের বুঝিয়ে বললেন, বিবদমান লোকগুলি দুটি যুব ভ্রাতৃত্বের সভ্য। দু’দলই আমাদের মেহমান হিসাবে পেতে চাইছে। তাদের এ ব্যাপার দেখে আমরা অবাক হয়ে গেলাম। পরে স্থির হল, তারা লটারী করবে এবং যারা তাতে জিবে তাদের সঙ্গেই প্রথমে আমরা গিয়ে বাস করব। তদনুসারে কাজ হলে প্রথমে আমরা ভ্রাতা সিনানের সঙ্গে গেলাম। তিনি আমাদের গোসলখানায় নিয়ে গেলেন এবং নিজে আমার দেখাশুনা করলেন। অবশেষে আমাদের জন্য তারা মিষ্টি ও বহু রকম ফল এনে একটি ভোজের আয়োজন করেন। ভোজনের পর কোরান পাঠ হয় এবং তারপর তারা সুর করে দরুদ পড়ে ও নৃত্য করে। পরের দিন আমরা সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাই। তিনি আনাতোলিয়ার একজন প্রসিদ্ধ সুলতান। সেখান থেকে ফিরে এলে আমাদের সঙ্গে দেখা হয় অপর মুসাফেরখানার ভ্রাতা তুমানের সঙ্গে। তিনি আমাদের আরও বেশী সমাদর করেন এবং গোসলখানা থেকে বের হয়ে আসার পর আমাদের উপর গোলাপ পানি সিঞ্চন করেন।

রাস্তার বিপদের ভয়ে আমরা লাধিকে কিছুদিন কাটাই। পরে একটি কাফেলার সংবাদ পেয়ে আমরা একদিন এবং পরবর্তী রাত্রের কিছু অংশ তাদের সঙ্গে গিয়ে তাবাস (Davas) দূর্গে পৌঁছি। দূর্গের বাইরেই আমাদের সে রাত্রি কাটাতে হয়। পরের দিন ভোরে দেওয়ালের উপর দিয়ে আমাদের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করে খোঁজ খবর দেওয়া হয়। অতঃপর তাদের সেনাপতি তার সৈন্যদল নিয়ে বেরিয়ে আসেন এবং কোথাও দরা আছে কিনা চারদিকে ঘুরে তা দেখেন। দেখার পরে পশুগুলি ছেড়ে দেওয়া হয় বিচরণের জন্য। এই সেখানকার নিত্য প্রচলিত রীতি। সেখান থেকে আমরা এলাম। মুঘলা এবং মুলা থেকে মিলাস। মিলাস দেশের অন্যতম সুন্দর ও প্রসিদ্ধ শহর। আমরা এখানেও একটি যুব ভ্রাতৃত্বের মুসাফেরখানায় বাস করি। এখানে তারা আমাদের নানাভাবে যে রকম সমাদর করেন সে সমাদর আগের চেয়েও বেশী। শাসনকর্তা হিসাবে এখানকার সুলতান একজন খ্যাতনামা ব্যক্তি। তিনি সর্বদা ধর্মশাস্ত্রবিদৃদের সঙ্গে দিন কাটান। তিনি আমাদের খাদ্য ও অর্থ উপহার দিয়েছিলেন। সুলতানের উপহার গ্রহণ করে আমরা কুনিয়া (Konia) শহরের উদ্দেশ্য যাত্রা করি। কুনিয়া সুন্দর অট্টালিকাবিশিষ্ট একটি বড় শহর। এ শহরে অনেক নদীনালা ও ফলের বাগান আছে। শহরের রাস্তাগুলি যথেষ্ট প্রশস্ত এবং প্রত্যেক পণ্যের জন্য এখানে পৃথক বাজার আছে। কথিত আছে এ শহর স্থাপিত হয় বাদশাহ সেকান্দারের দ্বারা। বর্তমানে এ শহরটি সুলতান বদরউদ্দিন ইব্‌নে কারামানের রাজত্বের অন্তর্গত। একটু পরেই আমরা তাঁর বিষয়ে উল্লেখ করব। শহরটি কিছুদিনের জন্য ইরাকের রাজা দখল করেছিলেন কারণ এ শহর তার রাজ্যের অতি নিকটে। আমরা মেহমান হয়েছিলাম কাজীর মুসাফেরখানায়। কাজীর নাম ইব্‌নে কালাম শাহ। তিনি ফতুয়ার একজন সভ্য। তার মুসাফেরখানাটি বড় এবং শিষ্য সংখ্যাও যথেষ্ট। খলিফা হজরত আলীর সময় থেকে তাদের এ ফতুয়া চলে এসেছে বলে তারা দাবী করে। সূফী মতাবলম্বীরা যেমন তালি দেওয়া বস্ত্র পরিধান করে তাদেরও তেমনি বিশেষ পরিধেয় ছিল পায়জামা। এই কাজী অন্যান্য ফতুয়ার চেয়ে অনেক বেশী সমাদর আমাদের করেছেন এবং নিজের পরিবর্তে ছেলেকে আমাদের সঙ্গে গোসল খানায় পাঠিয়েছেন।

এ শহরেই বিখ্যাত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি জালালউদ্দিন রুমীর মাজার শরীফ অবস্থিত। রুমী এখানে মাওলানা (আমাদের প্রভু) নামে পরিচিত। তিনি অশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। আনাতোলিয়ায় এক ভ্রাতৃত্ব আছে তারা মাওলানা রুমীর সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংযোগ দাবী করে। তাঁর নামানুসারে এ ভ্রাতৃত্বকে বলা হয় জালালিয়া। কাহিনী প্রচলিত আছে যে, জালালউদ্দিন প্রথম জীবনে একজন ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ ও অধ্যাপক ছিলেন। একদিন এক মিঠাই বিক্রেতা কলেজের মসজিদে এল এক খাঞ্চা মিঠাই মাথায় নিয়ে। তাঁকে এক টুকরা মিঠাই দিয়ে সে বেরিয়ে গেল। শেখ তখন তার অধ্যাপনার কাজ ফেলে মিঠাইওয়ালার পেছনে চলে গেলেন এবং কয়েক বছর অবধি নিরুদ্দিষ্ট রইলেন। তারপরে তিনি ফিরে এলেন সত্য কিন্তু ফিরে এলেন মানসিক সুস্থতা হারিয়ে। তখন। তিনি ফারসী কবিতা আবৃত্তি করা ছাড়া আর কোন কথাই বলতেন না। তাঁর ফারসী কবিতার অর্থও তখন কেউ বুঝতে পারত না। তিনি তখন যা রচনা করেছেন তার শিষ্যরা সে সব লিখে রেখেছেন। পুস্তকাকারে সে সব রচনার সমষ্টিই বিখ্যাত গ্রন্থ মসনবি। এ গ্রন্থকে এ দেশের লোকেরা বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখে। এ গ্রন্থের বিষয় নিয়ে তারা গভীরভাবে চিন্তা করে, শিক্ষা দেয় এবং প্রতি বৃহস্পতিবার রাত্রে তাদের ধর্মশালায় এ গ্রন্থ পাঠ করে।

কুনিয়া থেকে আমরা এলাম লারান্দা (কারামান)। লারান্দা কারামানের সুলতানের রাজধানী। সুলতানের সঙ্গে আমার দেখা হল শহরের বাইরে। তিনি তখন শিকার করে ফিরছিলেন। আমি ঘোড়া থেকে নেমে তাকে অভ্যর্থনা করায় তিনিও ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন। এ দেশের সুলতানদের যদি কোন বিদেশী সফরকারী ঘোড় থেকে নেমে সম্মান প্রদর্শন করে তবে তারাও তাঁর চেয়ে বেশী সম্মান তাদের করেন। পক্ষান্তরে যদি কেউ ঘোড়া থেকে না নামেন তবে তারা অসন্তুষ্ট হন। ফলে তিনি তাদের সদেস্থা থেকে বঞ্চিত হন। একবার এ ধরণের কোন এক রাজার আমরা অনুরূপ একটি ব্যাপার ঘটেছিল। সুলতানকে এভাবে সম্মান করার পরে তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে শহরে এলেন। এবং বিশেষ আতিথেয়তা দেখালেন।

আমরা অবশেষে ইরাক রাজ্যের অন্তর্গত আকসারা (আকসেরাই) এসে পৌঁছলাম। এখানে ভেড়ার লোমের কার্পেট তৈরী হয় এবং সে সব কার্পেট সুদূর ভারত, চীন ও তুর্কী দেশগুলিতে চালান হয়ে যায়। আকসারা থেকে নাকদা এবং সেখান থেকে এলাম কায়সারিয়া। কায়সারিয়া দেশের অন্যতম বড় শহর। এ শহরে একজন শাসনকর্তার বেগম (Khatun) বাস করেন। তিনি সুলতানের আত্মীয়, এবং সুলতানের সকল আত্মীয়ের মতই তিনি আগা পদবী ব্যবহার করেন। আগার অর্থ বিখ্যাত। আমরা তাঁর। সঙ্গে দেখা করলে তিনি অত্যন্ত বিনীত ব্যবহার করলেন এবং আমাদের আহারের ব্যবস্থা করলেন। বিদায়ের সময় তিনি জাজিম ও লাগাম সহ একটি ঘোড়া এবং কিছু অর্থ উপহার দিলেন। এ শহরগুলির সর্বত্রই আমরা যুব ভ্রাতৃত্বের মুসাফেরখানায় বাস করেছি। সুলতান যে শহরে বসবাস না করেন, এখানকার প্রচলিত রীতি অনুসারে সে। শহরের শাসন ভার থাকে একজন যুব ভাইয়ের উপর। তিনি সুলতানের সমমর্যাদায় সবকিছু কার্য পরিচালনা করেন।

অবশেষে আমরা দেশের আরেকটি বড় শহর সিওয়াসে এসে পৌঁছলাম। ইরাকের সুলতানের নিয়োজিত একজন শাসনকর্তা সিওয়াসে বাস করেন। তার নাম আলাউদ্দিন আরতানা। শহরের কাছে যেতে প্রথমে আমাদের সঙ্গে দেখা হ’ল যুব ভ্রাতা আহমদ-এর অন্তর্ভুক্ত একটি দলের সঙ্গে, তারপরে দেখা হ’ল যুবভ্রাতা সেলেবী দলের সঙ্গে। তারা। আমাদের অনুরোধ জানাল তাদের আতিথ্য গ্রহণ করতে কিন্তু আমরা আগের দলকে কথা দিয়েছিলাম বলে সে অনুরোধ রক্ষা করতে পারলাম না। তাদের মুসাফেরখানায় হাজীর হলে আমাদের মেজবানরা অত্যন্ত খুশী হলেন এবং বিশেষ সমাদরের সঙ্গে আমাদের মেহমানদারী করলেন। আমরা আলাউদ্দিন আরতানার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বিশুদ্ধ আরবীতে আমার সঙ্গে কথার্বাতা বললেন, যে সব দেশ সফর করেছি, যে সব রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে সে সব জানতে চাইলেন এবং আমাদের উপহার দিয়ে বিদায় দিলেন। বিদায়ের আগে চিঠি লিখে দিলেন অন্যান্য শহরস্থ তার সহকারীদের কাছে আমাদের সমাদর করবার জন্য এবং খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরবরাহের জন্য।

সেখান থেকে আমরা পৌঁছলাম আমাসিয়া। প্রশস্ত রাস্তাওয়ালা এ শহরটি যেমন সুন্দর তেমনি বড়। সেখান থেকে এলাম কুমিশ(মুশখানা)। কুমিশ একটি জনবহুল শহর। এখানে একটি রৌপ্য খনি আছে। ইরাক ও সিরিয়ার সওদাগরেরা এ শহরে অহরহ যাতায়াত করে। কুমিশ ছেড়ে পৌঁছলাম এসে আরজানজান। আরজানজানের অধিকাংশ বাসিন্দা আর্মেনিয়ান। আরজানজানের পর আমরা এলাম আরজাররাম। শহরটি বড় কিন্তু দু’দল তুর্কমেনদের ভেতর গৃহযুদ্ধের ফলে শহরটি আজ ধ্বংসের মুখে এসে পড়েছে। আমরা এখানে যুবভ্রাতা তুমানের মুসাফের খানায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। শুনলাম তুমানের বয়স একশ ত্রিশ বছর। তিনি একখানা লাঠি ভর করে হেঁটে বেড়ান। তিনি এখনও কার্যক্ষম আছেন এবং নিয়মিত নির্দিষ্ট সময়ে নামাজ আদায় করেন।

অতঃপর আমরা পৌঁছলাম বিরগী১০। সেখানে এসে শুনলাম মহিউদ্দিন নামক একজন নামকরা অধ্যাপক সেখানে বাস করেন। মাদ্রাসায় পৌঁছে আমরা দেখলাম, তিনি একটি তেজী গাধায় আরোহণ করে সবেমাত্র আসছেন। তার পরিধানে রয়েছে সোনালী জরির কাজ করা প্রচুর কাপড় জামা। দু’পাশে আসছে গোলাম ও ভূত্যের দল, পিছনে ছাত্রেরা। তিনি আমাদের সদয় অভ্যর্থনা জানালেন এবং মাগরেবের নামাজের পর আমাকে দেখা করতে আমন্ত্রণ জানালেন।

যথা সময়ে গিয়ে আমি তার দেখা পেলাম তার বাগানে একটি অভ্যর্থনা কক্ষে। বাগানে একটি নহর আছে। মারবেল পাথরের চৌবাচ্চার সঙ্গে সেটি যুক্ত। কারুকার্যময় বক্সে আবৃত একটি উচ্চ আসনে তিনি বসেছেন, ডাইনে ও বামে দাঁড়িয়ে আছে গোলাম, ভৃত্য ও ছাত্রের দল। আমি তাকে প্রথম দেখে কোন রাজা বলেই ভুল করেছিলাম। তিনি উঠে আমাকে অর্ভ্যথনা করে বেদীর উপর পাশে আমাকে বসালেন। খাওয়ার পরে আমরা মাদ্রাসায় ফিরে এলাম। বিরগীর সুলতান তখন নিকটেই পাহাড়ের উপর তার গ্রীষ্মবাসে বাস করছিলেন। অধ্যাপকের কাছে খবর পেয়ে তিনি আমাকে ডেকে পাঠান। অধ্যাপকের সঙ্গে আমি গিয়ে যখন হাজির হলাম, তিনি তখন তার দু’ পুত্রকে পাঠালেন আমাদের কুশল প্রশ্নাদি জিজ্ঞাসার জন্য। আমাকে তিনি একটি তাবুও পাঠালেন। এ শ্রেণীর তাবুকে এখানে খরগ বলে। কাঠের কতকগুলি বাতা গুম্বজাকারে একত্র করে এটি তৈরী করা হয়েছে। বাতার ফাঁকে পশমী কাপড়-উপরের দিক আলো-হাওয়া প্রবেশের জন্য খোলা। দরকার মত তা বন্ধও করা যায়। পরের দিন সুলতান আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং আমি যে সব দেশে সফর করেছি সে সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। আহারের পরে আমি বিদায় নিয়ে এলাম। কয়েক দিন এভাবেই চলল। সুলতান প্রত্যেক দিনই তাঁর সঙ্গে আহারের জন্য আমাদের ডেকে পাঠান। তুর্কীরা ধর্মশাস্ত্রবিদদের প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করে তার নিদর্শন স্বরূপ তিনি নিজেই একদিন বিকেলে এসে আমাদের তাবুতে হাজির হলেন। অবশেষে অধ্যাপক ও আমি উভয়েই এ পাহাড়ে বাস করে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। কাজেই অধ্যাপক একদিন সুলতানকে বলে পাঠালেন যে। আমি পুনরায় আমার সফর শুরু করতে চাইছি। জবাবে সুলতান জানালেন, তিনি পরের দিন আমাদের সঙ্গে নিয়ে শহরে তার প্রাসাদে ফিরে যাবেন। পরের দিন আমাদের জন্য একটি চমৎকার ঘোড়া পাঠিয়ে তিনিও আমাদের সঙ্গে শহরে ফিরে এলেন। প্রাসাদে ফিরে এসে প্রকাণ্ড একটি সিঁড়ি বেয়ে দরবার কক্ষে এসে পৌঁছলাম। কক্ষের মধ্যস্থলে পানির একটি চৌবাচ্চা। চৌবাচ্চার প্রত্যেক কোণে একটি করে ব্রঞ্জনির্মিত সিংহ। সিংহের মুখ থেকে চৌবাচ্চায় অনবরত পানি পড়ছে। কক্ষের চারদিকে বেষ্টন করে। কার্পেট মোড়া বেদী–এক জায়গায় বেদীর উপরে সুলতানের জন্য গদি আঁটা আসন। আমরা এখানে পৌঁছলে সুলতান গদি সরিয়ে আমাদের সঙ্গে কার্পেটের উপর আসন গ্রহণ করলেন। কোর-আন পাঠকগণ সর্বদাই দরবারে হাজির থাকেন। তারা বসেন বেদীর নীচে। কিছু শরবৎ ও বিস্কুট খাওয়ার পরে আমি সুলতানকে ধন্যবাদ জানালাম ও অধ্যাপকের প্রশংসা করলাম। তাতে সুলতান অত্যন্ত খুশী হলেন।

আমরা সে অবস্থায় বসা থাকতেই সুলতান হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, “আসমান থেকে পড়েছে এমন কোন পাথর আপনি কখনও দেখেছেন কি?”

আমি বললাম, “না, তেমন কোন পাথরের কথা আজ অবধি শুনি নি।”

“হ্যাঁ, এ শহরের বাইরে একবার একটি পাথর পড়েছিল।” এই বলে তিনি সেই পাথরটি আনতে হুকুম করলেন। প্রকাও একটা কাল পাথর আনা হল আমাদের সামনে। পাথরটি শক্ত এবং চঞ্চকে। মনে হল তার ওজন এক হন্দরের কম হবে না। অতঃপর সুলতান ডেকে পাঠালেন পাথর-ভাঙ্গা মজুরদের। চারজন মজুর এক সঙ্গে লোহার হাতুড়ী দিয়ে পাথরের উপর ঘা মারল কিন্তু পাথরের গায়ে কোন দাগও পড়ল না। আমি বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলাম। সুলতান তখন পাথরের টুকরাটি যথাস্থানে নিয়ে রাখতে হুকুম দিলেন। আমরা চৌদ্দদিন অবধি এ সুলতানের সঙ্গে একত্রে বাস করেছি। প্রতি রাত্রেই তিনি আমাদের জন্য ফল, মিষ্টি ও অন্যান্য খাদ্য পাঠাতেন, আর পাঠাতেন মোমবাতি। তা ছাড়াও তিনি আমাকে এক শ’ স্বর্ণমুদ্রা, এক হাজার দেরহাম, এক প্রস্থ পরিচ্ছদ এবং মাইকেল নামে একজন গোলাম উপহার দেন। আমার সঙ্গীদের প্রত্যেককে দেন একটি করে পোষাক ও কিছু অর্থ। এসব কিছুর জন্যই আমরা অধ্যাপক মহিউদ্দিনের কাছে ঋণী। খোদা তার মঙ্গল করুন।

আমরা সেখান থেকে পুনরায় যাত্রা শুরু করে সুলতানের এলাকার মধ্যেই তিরা শহরে এলাম। সেখান থেকে এলাম গ্রীকদের শহর আয়ামূলক (Ephesus)। গ্রীকরা এ প্রাচীন বড় শহরটিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে। পাথরের দ্বারা সুন্দরভাবে নির্মিত প্রকাও একটি গীর্জা এখানে আছে। প্রত্যেকটি পাথর খণ্ড দশ হাত বা তার চেয়েও বেশী লম্বা। এখানকার বড় মসজিদটি অত্যন্ত সুদৃশ্য। এক সময়ে এটি গ্রীকদের একটি গীর্জা ছিল। আমি চল্লিশ দিনারে এখানে একটি গ্রীক বাদী ক্রয় করেছিলাম।

সেখান থেকে আমরা এলাম ইয়াজমীর (স্বার্থা)। সমুদ্রোপকূলে ধ্বংসপ্রায় একটি বড় শহর। আয়দীনের সুলতানের পুত্র ওমর এখানে শাসনকর্তা। আমার কথা শুনে তিনি সরাইখানায় দেখা করতে এসেছিলেন এবং আমাকে উপহার পাঠিয়েছিলেন। পরে তিনি আমাকে নিকোলাস নামক একজন গ্রীক ক্রীতদাসও দেন। তিনি একজন দয়ালু ও ধর্মপ্রাণ শাহজাদা এবং সর্বদা খৃষ্টানদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন। তার কতকগুলি নৌকা ছিল। সেগুলির সাহায্যে তিনি বিখ্যাত কস্টান্টিনোপলের আশে-পাশে আক্রমণ করে’ লোকদের বন্দী করে আনতেন ও লুটের মাল আনতেন। সে সব দান খয়রাত ও উপহারে ব্যয় করে আবার গিয়ে আক্রমণ চালাতেন। অবশেষে এ আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে। গ্রীকরা আবেদন জানান পোপের কাছে। পোপ জেনোয়া ও ফ্রান্সের খৃষ্টানদের আদেশ করলেন প্রতি-আক্রমণ চালাতে। তারা তাই করল। পোপও রোম থেকে একদল সৈন্য। পাঠালেন। পোপের সৈন্যরা রাত্রে আক্রমণ চালিয়ে বন্দর ও শহর দখল করে ফেলল। আমীর ওমর দূর্গ থেকে বেরিয়ে তাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে কিছু সংখ্যক সৈন্যসহ শহীদ হলেন। খৃস্টানরা শহরে আধিপত্য বিস্তার করলেও দূর্গটি সুরক্ষিত ও শক্তিশালী থাকায় তা দখল করতে পারল না।

সেখান থেকে আমরা মাগনিসিয়া (এখন Manisa) এসে হজের নামাজ পড়লাম। আমাদের জামাতে ছিলেন সুলতান সারুখান। এখানে আমার গোলামটি ঘোড়াকে পানি খাওয়াবার জন্য গিয়ে আমার সঙ্গীর আরেকটি গোলামের সঙ্গে পালাবার চেষ্টা করে। সুলতান পলাতকদের খুঁজে বের করতে পাঠালেন কিন্তু সবাই তখন ঈদের উৎসবে ব্যস্ত বলে তাদের খুঁজে বের করা সম্ভব হল না। তারা ফুজা নামে উপকুলবর্তী একটি শহরের দিকে পলায়ন করে। এ শহরটি বিধর্মীদের অধিকারে।১২ বিধর্মীরা প্রতি বছর সুলতানকে কিছু উপহার পাঠায়। ফলে সুলতান তাদের উপর সন্তুষ্ট থাকেন। পরের দিন। দুপুর বেলা কয়েকজন তুর্কী ঘোড়াসহ গোলামদের এনে আমাদের কাছে হাজির করে। আগের দিন বিকালে পলাতকরা তুর্কীদের কাছ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। তাদের দেখে সন্দেহের উদ্রেক হওয়ায় অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পরে পলাতকরা পলায়নের ব্যাপার। স্বীকার করতে বাধ্য হয়।

অতঃপর আমরা বারখামা পৌঁছলাম। বারখামা একটি ধ্বংস প্রায় শহর কিন্তু এখানে পাহাড়ের চূড়ায় একটি সুরক্ষিত দূর্গ রয়েছে। এখানে আমরা একজন গাইড নিযুক্ত করে পাহাড়ের পথে সফর করে বালিকাসরি এসে পৌঁছলাম। এখানকার দুমুর খাঁ নামক সুলতান একজন অপদার্থ ব্যক্তি। তার পিতা এ শহর নির্মাণ করেন এবং পুত্রের আমলে সে শহর একদল প্রতারকের বাসস্থানে পরিণত হয়। যেমন রাজা, তেমনি তার। প্রজা।” আমি তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে একটি জামা উপহার দেন। এ শহর থেকে আমি মার্গেরাইট নাম্নী একটি গ্রীক বালিকা বাদী রূপে খরিদ করি।

বারখামা থেকে আমরা এলাম বাবু (Brusa)। চমৎকার বাজার, প্রশস্ত রাস্তা চারিদিক ফলের বাগবাগিচা ও নদীনালা সহ বারসা একটি বড় শহর। এখানে শহরের বাইরে দু’টি চিকিৎসাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার একটি পুরুষদের জন্য, অপরটি। নারীদের জন্য। দূর দূরাঞ্চল থেকে রোগীরা এখানে চিকিৎসার জন্য আসে। তারা এসে একজন তুর্কী সুলতানের দ্বারা নির্মিত একটি মুসাফেরখানায় তিনদিন বসবাস করতে পারে। এ শহরে এসে আমি শেখ আবদুল্লাহ্ নামক একজন মিশরী ভ্রমণকারীর দেখা পাই। তিনি চীন, সিংহল, পাশ্চাত্য, স্পেন, নিগ্রোল্যাণ্ড ছাড়া দুনিয়ার সব দেশ সফর করেছেন। কাজেই এসব দেশ সফর করে এ ব্যাপারে আমি তাকে ছাড়িয়ে গেছি। বারসার বর্তমান সুলতান ওখান বেক। তিনি ওসমান চাকের পুত্র। তিনি তুর্কমেন সুলতানদের সর্বপ্রধান। অর্থ, জমি, সৈন্যবল প্রভৃতিতে তিনি সবচেয়ে বেশী সম্পদশালী। তার প্রায় এক শ’টি দূর্গ তিনি নিজে ঘুরে ঘুরে দেখাশুনা করেন। তিনি বিধর্মীদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং তাদের দেশ অবরোধ করেন। তাঁর পিতাই বারসা। শহর গ্রীকদের থেকে দখল করেন। কথিত আছে তিনি প্রায় বিশ বৎসরকাল ইয়াজনিক (Nicea) অবরোধ করে রাখেন কিন্তু শহরটি দখলের পূর্বেই এন্তেকাল করেন। এ জায়গাটি দখল করবার আগে তাঁর পুত্র ওখান বেকও প্রায় বার বৎসর কাল এটি অবরোধ করে রাখেন। আমি বাসায় এসে এখানেই তার দেখা পাই।১৩ একটি হ্রদের মধ্যস্থলে অবস্থিত ইয়াজনিক শহরে ঢুকতে হয় সরু পুলের মত একটি রাস্তা পার হয়ে। এ রাস্তাটি এত সরু যে এক সঙ্গে একজন মাত্র ঘোড়সওয়ার অগ্রসর হতে পারে। শহরের চারদিক দেওয়াল দ্বারা বেষ্টিত। দুটি দেওয়ালের মধ্যে একটি করে পরিখা। পরিখা পার হতে হয় কাঠের টানা সকোর সাহায্যে। দেওয়ালের মধ্যে ফলের বাগান, ঘরবাড়ী, ও মাঠ আছে। পানি তুলতে হয় কুপ থেকে। আমার একটি ঘোড়া অসুস্থ হয়ে পড়ে বলে আমাদের এখানে চল্লিশ দিন থাকতে হয়। কিন্তু অনেক বিলম্ব হতে থাকায় অতিষ্ঠ হয়ে আমি তিনজন সঙ্গী একটি বালিকা বাদী ও দু’জন বালক গোলাম নিয়ে ঘোড়াটি ফেলেই রওয়ানা হয়ে এলাম। ভাল তুর্কী ভাষা জানে এবং দোভাষীর কাজ করতে পারে তখন এমন কেউ আমাদের সঙ্গে ছিল না। আমাদের দোভাষীকে আমরা ছেড়ে এসেছি ইয়াজনিকে। এ শহর ছেড়ে আমরা সাকারী (Sangarius) নামে প্রকাণ্ড একটি নদী খেয়ার সাহায্যে পার হয়ে এলাম। খেয়া বলতে চারটি কাঠের বিম দড়ি দিয়ে একত্রে বাধা। তার উপরে মালপত্র চাপিয়ে যাত্রীরা উঠলে তা অপর পারে নেওয়া হয় দড়ির সাহায্যে টেনে। ঘোড়াগুলি সাতরে যায় তার পেছনে।

সেই রাত্রেই আমরা কাবিয়া (Gheiva) পৌঁছে একটি ভ্রাতৃত্বের আশ্রয়ে থাকি। কিন্তু তিনি আরবী ভাষা বুঝতেন না, আমরা বুঝতাম না তুর্কী। কাজেই তিনি একজন ধর্মশাস্ত্রজ্ঞকে ডেকে নিয়ে এলেন। ইনি আমাদের সঙ্গে কথা বললেন ফারসীতে। আমাদের আরবী বুঝতে না পেরে তিনি ভ্রাতাকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন, Ishan ‘arabi kuhna miguyand waman ‘arabi naw midanam, pate as প্রাচীন আরবী বলছেন এবং আমি জানি শুধু আধুনিক আরবী। তিনি নিজের লজ্জা ঢাকবার জন্যই একথা বলেছেন, কারণ সবাই জান্ত তিনি আরবী জানেন কিন্তু আসলে তিনি আরবী জানতেন না। কিন্তু তাতে বরং আমাদের যথেষ্ট উপকারই হয়েছিল। আমাদের সেই ভ্রাতা ঐ ব্যক্তিকে বিশ্বাস করে আমাদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা দেখিয়ে বললেন, “এদের যথেষ্ট সম্মান করতে হবে কারণ এরা আরবীতে কথা বলেন। আমাদের। প্রিয় পয়গম্বর ও তাঁর সাহাবাগণের ভাষাও ছিল প্রাচীন আরবী।”

ধর্মশাস্ত্রবিদ সে লোকটি কি বলেছিলেন প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি কিন্তু কথাগুলি আমি মনে করে রেখেছিলাম। পরে আমি যখন ফারসী ভাষা শিখলাম তথনই শুধু অর্থ বুঝতে পারলাম।

আমরা মুসাফেরখানায় সে রাত কাটালাম। ভ্রাতা আমাদের একজন চালক সঙ্গে দিয়ে ইয়ানিজা(Tarakli) নামক বড় একটি শহরে পাঠালেন। আমরা আখির মুসাফেরখানা খুজতে গিয়ে দেখা পেলাম একজন পাগলা দরবেশের। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “এটাই কি আখির মুসাফেরখানা?”

তিনি বললেন “না-আম” (হাঁ)।

তার জবাব শুনে আমি এই ভেবে খুশী হলাম যে এতদিনে অন্ততঃ আরবী-জানা একজন লোকের দেখা পেলাম। কিন্তু তাকে বেশী করে পরখ করতে গিয়ে সব গুমর ফাঁক হয়ে গেল। তিনি আরবী বলতে শুধু ঐ “না-আম” শব্দটিই জানতেন। আমরা তাই মুসাফেরখানায় আশ্রয় গ্রহণ করলে একজন ছাত্র এসে আমাদের খাবার দিয়ে গেল। আমি নিজে তখন অনুপস্থিত ছিলাম কিন্তু এ ছাত্রটির সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব ভাব হয়ে উঠল। যদিও সে আরবী জাত না তবু আমাদের সঙ্গে খুবই সদয় ব্যবহার করত। সে আমাদের বিষয় শাসনকর্তার কাছে বলায় তিনি তার একজন ঘোড়সওয়ার পাঠিয়ে দেন। আমাদের কেনু (Kevnik) পৌঁছে দেবার জন্য। ওরধান বেকের এলাকার ভেতর কেনুক একটি ছোট শহর। মুসলমান শাসনাধীনে শহরে বাস করে বিধর্মী গ্রীকরা। এখানে মুসলমান বাড়ি শুধুই একটি এবং সেটির মালিক গ্রীকদের শাসনকর্তা। কাজেই আমাদের থাকতে হল একজন বৃদ্ধা বিধর্মীয় গৃহে। তখন ছিল তুষার ও বৃষ্টিপাতের সময়। বৃদ্ধা আমাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে১৪ এবং আমরা তার গৃহেই রাত কাটাই। এ শহরের কোন গাছগাছড়া বা আঙ্গুর বাগান নাই। এখানে একমাত্র জাফরানের চাষ হয়। আমাদের সওদাগর মনে করে বৃদ্ধা আমাদের কাছে বিক্রির জন্য। অনেকটা জাফরান এনে হাজির করেছিল।

ভোরে আমরা ঘোড়ায় চড়ে রওয়ানা হলে আমাদের ঘোড়সওয়ার চালক আরেকজন চালক এনে হাজির করল আমাদের মুতুরনি অবধি পৌঁছে দিতে। আগের দিন রাত্রে এত অধিক তুষার পাত হয়েছে যে রাস্তার চিহ্ন লুপ্ত হয়ে গেছে। কাজেই আমাদের চালক আগে-আগে যেতে লাগল, আমরা তার পদচিহ্ন অনুসরণ করে চললাম। প্রায় দুপুরের সময় আমরা তুর্কমেনদের একটি গ্রামে এসে পৌঁছলাম। তারা আমাদের আহারের বন্দোবস্ত করলো। আমাদের ঘোড়সওয়ারের অনুরোধে তাদের একজন এসে আমাদের। সঙ্গী হল। বন্ধুর পাবর্ত্য পথের ভেতর দিয়ে সে আমাদের নিয়ে চলল। একটি খালে আমাদের ত্রিশবারের বেশী পার হতে হল। সে সব ছাড়িয়ে গেলে চালক আমাদের কাছে কিছু অর্থ চাইল। আমরা বললাম, “আমরা শহরে পৌঁছে তোমাকে যথেষ্ট অর্থ দেব।”

আমাদের কথায় সে সন্তুষ্ট হল না অথবা বুঝতেই পারল না। সে আমাদের এক সঙ্গীর একটি ধনুক চেয়ে নিয়ে একদিকে কিছু দূর গিয়ে আবার ফিরে এল। আমি সে। সময় তাকে কিছু অর্থ দিলাম। সে তখন আমাদের ফেলেই চলে গেল। কোন্ দিকে যেতে হবে কিছুই আমরা জানি না, আমাদের সামনে কোন রাস্তাও নেই। সূর্য ডুবে যাচ্ছে প্রায় এমন সময় আমরা একটা পাহাড়ে এসে পৌঁছলাম। সেখানে আমরা পথ চিনতে পারলাম কতকগুলি পাথর পথে ছড়ানো দেখে। আরও বেশী তুষারপাত হতে পারে এবং জায়গাটা জনমানবহীন আশঙ্কা করে আমার ভয় হ’ল হয়ত সঙ্গীদেরসহ এখানেই আমাদের শেষ। ঘোড়া থেকে নামলে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য এবং পথ চলব তাও জানা। নেই। আমার ঘোড়াটা ছিল ভাল। তখন মনে মনে ভাবলাম, আমি যদি নিরাপদে কোথাও পৌঁছতে পারি তবে সঙ্গীদের রক্ষার চেষ্টা করতে পারি। এই ভেবে আমি তাদের। খোদার উপর সোপর্দ করে রওয়ানা হয়ে গেলাম। সন্ধ্যার অনেক পরে এক জায়গায় কতকগুলি বাড়ীঘর দেখে বলে উঠলাম, আল্লাহু বাড়িগুলিতে যেনো লোকজনের দেখা পাই। লোকজনের দেখা সত্যিই পেলাম। খোদা মেহেরবানী করে আমাকে কয়েকজন দরবেশের এক বাসস্থানে এনে হাজির করেছেন। দরজায় আমাকে কথা বলতে শুনে তাদের একজন বেরিয়ে এলেন। আমি লোকটিকে আগে থেকেই চিনতাম। দরবেশদের সঙ্গে নিয়ে আমি তাকে আমার সঙ্গীদের রক্ষার জন্য যেতে অনুরোধ করলাম। আমাকে। সঙ্গে নিয়েই তারা সেখানে গেলেন এবং পরম দয়ালু খোদাকে অশেষ ধন্যবাদ যে আমরা সবাই নিরাপদে ফিরে এলাম। দরবেশদের সবাই সাধ্যমত খাদ্যবস্ত্র দিয়ে আমাদের বিপদ দূর করলেন।

পরেরদিন ভোরে যাত্রা করে আমরা মুতুরলি (Mudurlu) পৌঁছলাম। সেখানে আরবী জানে এমন একজন হজযাত্রীর দেখা পেলাম। তাকে আমরা অনুরোধ করলাম আমাদের সঙ্গী হয়ে কাস্তামুনিয়া অবধি যেতে। সেখান থেকে কাস্তামুনিয়া দশ দিনের পথ। আমার একটি মিশরীয় জামা, সাময়িক খরচের জন্য কিছু অর্থ, একটি ঘোড়া তাকে দিলাম এবং বিশেষ পারিতোষিকের প্রতিশ্রুতি দিলাম। জামা ও অর্থ সে। পরিবারের লোকদের দিয়ে গেলো। দেখা গেল, সে একজন ধনবান ব্যক্তি কিন্তু চরিত্র তার নীচ প্রকৃতির। আমরা আমাদের খরচ পত্রের জন্য তার হাতে টাকা পয়সা দিতাম। আমাদের উচ্ছিষ্ট রুটি সে নিয়ে যেত এবং তাই দিয়ে আমাদের জন্য মসলা শাকও লবণ কিনে আনতো অথচ সে দরুণ আমাদের পয়সা কেটে নিত। আমি এ কথা ও শুনেছি যে আমরা আমাদের খরচের জন্য তাকে যা দিতাম তারও কিছুটা অংশ সে চুরি করত। আমরা তুর্কী ভাষা জানতাম না বলেই তাকে আমাদের সঙ্গে রাখতে হয়েছিল। তারপর ব্যাপার এতদূর গড়াল যে, সন্ধ্যায় আমরা তাকে বলতাম “কেমন হাজী, আজকে কত চুরি করলে?”

সে তার জবাবে কত নিয়েছে তা প্রকাশ করত, আমরা হাসতাম ও তাই নিয়ে আমোদ করতাম।

সেখান থেকে আমরা বুলি শহরে এসে এক যুব ভ্রাতৃত্বের মুসাফেরখানায় আশ্রয় নিলাম। কী যে চমৎকার লোক এখানে মুসাফেরখানায় তা তারা যেমন উচ্চমনা আর নিঃস্বার্থ, তেমনি মুসাফেরদের প্রতি সদয়, স্নেহশীল। কী আন্তরিকতাপূর্ণ তাদের অভ্যর্থনা! কোন মুসাফের এলে তাদের ব্যবহারে তাকে ভাবতে হবে যে সে তাদেরই একজন অতি প্রিয় আপনজন।

পরেরদিন ভোরে রওয়ানা হয়ে আমরা গারাদি বুলি শহরে পৌঁছলাম। সমতল ভূমিতে অবস্থিত এ শহরটি সুন্দর ও বড় কিন্তু মনে হয় এটি পৃথিবীর অন্যতম শীতপ্রধান শহর। গারাদি বুলি শহর কয়েকটি মহল্লায় বিভক্ত এবং এক-এক মহল্লায় এক-এক সম্প্রদায়ের লোক বাস করে। এক মহল্লার লোক অপর মহল্লার লোকদের সঙ্গে কখনও মেলামেশা করে না। এখানকার সুলতান দেশের একজন খ্যাতি সম্পন্ন শাসক। তিনি সুদর্শন ও সৎ, কিন্তু অনুদার। তিনি মুসাফেরখানায় এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করেন এবং এক ঘন্টাকাল আমাদের সঙ্গে আলাপ করেন। পরে আমাকে জিন্ লাগানো একটি ঘোড়া ও একটি পোক উপহার দেন।

আমরা বারলু ১৫ নামক একটি ছোট শহর ছাড়িয়ে কাস্তামুনিয়া এসে পৌঁছলাম। কাস্তামুনিয়া একটি সুন্দর বড় শহর। এখানে জিনিসপত্র পাওয়া যায় প্রচুর এবং দামও এত সস্তা যে আমি কোথাও তেমন দেখিনি। আমরা এখানে অন্ধ কালা একজন শেখের সরাইখানায় ছিলাম। তার একটি আশ্চর্য গুণ দেখলাম। তার ছাত্রদের ভেতর একজন। নিজের আঙুল দিয়া মাটিতে বা শূন্যে যা লিখে দিত তিনি অনায়াসে তা বুঝতেন ও জবাব দিতেন। কখনো কখনো এভাবে বড় বড় গল্প পর্যন্ত তাকে বলা হয়। আমরা প্রায় চল্লিশদিন এখানে কাটাই। বিখ্যাত সুলায়মান বাদশাহ কাস্তামুনিয়ার সুলতান। দীর্ঘ শ্মশোভিত রাজোচিত সৌম্যকান্তি বিশিষ্ট সত্তর বছরের বৃদ্ধ তিনি। আমি তাঁর অভ্যর্থনা কক্ষে দেখা করতে গেলে তিনি আমাকে পাশে বসিয়ে আমার সফর সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। পরে তিনি আমাকে তার কাছেই থাকতে হুকুম করে। সেই দিনই আমার ব্যয় নির্বাহের ও ঘোড়ার খাদ্যের জন্য টাকা পয়সা ছাড়াও একটি সাদা ঘোড়া ও একটি পোষাক দিলেন। এরপর অর্ধদিনের পথ দূরের এক গ্রাম থেকে তিনি আমাকে কিছু গম ও বার্লি দেন। কিন্তু খাদ্যশস্য সেখানে খুবই সস্তা বলে তা বিক্রি করা সম্ভব হল না। কাজেই সেগুলি আমার সঙ্গী হজযাত্রীদের দিয়ে দিলাম। প্রতিদিন অপরাহ্নে দরবারে বসা এখানকার সুলতানদের একটি রীতি। তখন সেখানে খাদ্য পরিবেশন করা হয় এবং দরজা খুলে রাখা হয়। শহরের বাসিন্দা, যাযাবর বিদেশী মুসাফের বা সফরকারী–কারও জন্যই সে খাদ্য গ্রহণে বাধা নেই।

কাস্তামুনিয়া থেকে আমরা সানুব (Sinope) এসে পৌঁছলাম। শক্তি ও সৌন্দর্যের সমাবেশ হয়েছে এ জনবহুল শহরটিতে। একমাত্র পূর্ব দিক ব্যতীত শহরটি সমুদ্রদ্বারা বেষ্টিত। পূর্ব দিকের একটি মাত্র প্রবেশপথ দিয়ে শাসনকর্তা ইব্রাহিম বেকের অনুমতি ছাড়া কেউ শহরে প্রবেশ করতে পারে না। ইব্রাহিম বেক্‌ সুলতান সুলায়মান বাদশাহর ছেলে। শহরের বাইরে এগারটি গ্রাম গ্রীক বিধর্মীদের বাস। সানুবের প্রধান মসজিদটি অত্যন্ত সুন্দর। সুলতান পারওয়ানাহ্ এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। তার পরে সুলতান হন তার ছেলে গাজী চেলেবি। গাজী চেলেবির মৃত্যুর পর শহরটি দখল করেন সুলতান সুলায়মান। গাজী চেলেবি সাহসী কিন্তু দাম্ভিক ছিলেন। তাঁর অদ্ভূত দক্ষতা ছিল পানির নীচে সঁতরাবার। তিনি তার যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে গ্রীকদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যেতেন। যখন দুই দলে যুদ্ধ আরম্ভ হতো এবং সবাই ব্যস্ত থাকত যুদ্ধে তখন তিনি লোহার একটি যন্ত্র। দিয়ে পানিতে ডুব দিতেন এবং যন্ত্রের সাহায্যে শত্রুর জাহাজ ফুটো করে দিয়ে। আসতেন। জাহাজ ডুবে যাবার আগে শত্রুরা কিছুই বুঝতে পারত না।

আমরা জাহাজে কিরাম১৬ যাব বলে অনুকুল আবহাওয়ার অপেক্ষায় চল্লিশ দিন কাটালাম কাস্তামুনিয়া। তারপর গ্রীকদের একটি জাহাজ ভাড়া করেও আমাদের এগার। দিন অপেক্ষা করতে হল অনুকুল বাতাসের অপেক্ষায়। অবশেষে আমাদের জাহাজ পাল তুলে দিল কিন্তু তিন রাত্রি চলবার পরই আমরা মধ্য সমুদ্রে আটকা পড়ে গেলাম উয়াবহ। ঝড়ে। দেখতে দেখতে তুমুল ঝড় আরম্ভ হল এবং বায়ুর পরিবর্তিত গতি আমাদের পুনরায় সানুবের কাছে নিয়ে হাজির করল। তারপরে আকাশ পরিষ্কার হলে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম এবং অনুরূপ আরও একটি ঝড়ের পরে সমুদ্রের পারে পাহাড় দেখতে পেলাম। তখন কার্শ(Kerch) নামক একটি পোতাশ্রয়ের দিকে আমরা অগ্রসর হলাম। যেই পোতাশ্রয়ে ঢুকতে যাচ্ছি এমন সময় দেখতে পেলাম পাহাড়ের উপর থেকে কয়েকজন লোক সঙ্কেতে আমাদের সেখানে ঢুকতে বারণ করছে। বন্দরে কোন শত্রুর জাহাজ আছে মনে করে আমরা ফিরে এসে উপকুল ঘেঁষে চলতে লাগলাম। জাহাজ যখন পারের দিকে যাচ্ছিল তখন আমি কাপ্তেনকে বললাম, আমি এখানে নামতে ইচ্ছা করি। তিনি আমাকে নামিয়ে দিলেন। কিপচ মরুভূমির ভেতর এ স্থানটি সবুজ তৃণাছন্ন কিন্তু বৃক্ষহীন। এখানে জ্বালানী কাঠ দুষ্প্রাপ্য বলে সবাই খুঁটে ব্যবহার করে। কাজেই, সেখানে উচ্চ স্তরের লোকদেরও জামার আঁচলে করে খুঁটে কুড়াতে দেখা যায়। এ মরুভূমিতে যাতায়াতের একমাত্র বাহন চার চাকার গাড়ী। মরুভূমির একদিক থেকে অপরদিক অবধি যেতে ছ’মাস লাগে। ছ’মাসের তিন মাস যেতে হয় সুলতান মোহাম্মদ উজবেগের১৭ রাজ্যের মধ্যে দিয়ে। আমরা এখানে পৌঁছবার পরের দিন আমাদের সঙ্গী একজন সওদাগর কিপচকের এক খৃষ্টান বাসিন্দার কাছ থেকে কয়েকটি গাড়ী ভাড়া করলেন এবং আমরা কাফা এসে পৌঁছলাম। খৃষ্টান অধ্যুষিত কাফা সমুদ্রের তীরে একটি বড় শহর। শহরের খৃষ্টান শাসনকর্তার নাম ডামড়ির (Dennetrio)১৮।

কাফায় এসে আমরা মসজিদে বাস করি। এখানে এসে পৌঁছার এক ঘন্টা পরেই। শুনতে পেলাম চারদিকে ঘন্টা বাজছে। এর আগে কোথাও এ রকম ঘন্টা বাজতে শুনি নাই১৯ বলে ভয় পেয়ে আমি সঙ্গীদের মিনারে উঠে কোরআন পাঠ করতে ও আজান দিতে বললাম। তারা তাই করতেই হঠাৎ অস্ত্র ও বর্মধারী লোক এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি সেখানকার মুসলমানদের কাজী বলে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আপনাদের কোরআন পড়া আর আজান শুনে ভয় হলো আপনাদের কোনো বিপদ ঘটেছে কি না, তাই ছুটে এলাম। তারপর তিনি বলে গেলেন এবং আমাদেরও কোনো বিপদ ঘটল না। পরেরদিন শাসনকর্তা এসে আমাদের এক ভোজে আপ্যায়িত করলেন। পরে আমরা ঘুরে দেখলাম শহরে অনেক বাজার রয়েছে। সমস্ত বাসিন্দাই বিধর্মী। বন্দরে গিয়ে দেখলাম, যুদ্ধ জাহাজ, সওদাগরী জাহাজ মিলিয়ে ছোট-বড় প্রায় দু’শ জাহাজ রয়েছে পোতাশ্রয়ে। এ পোতাশ্রয়টি পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত পোতাশ্রয়।

একটি চার চাকার গাড়ী ভাড়া করে আমরা কিরাম শহরে এলাম। কিরাম সুলতান উজবেগ খানের রাজ্যের অন্তর্গত। এখানকার শাসনকর্তার নাম তালাকতুমুর। আমাদের কথা শুনে তিনি একটি ঘোড়াসহ ইমামকে আমাদের কাছে পাঠান, কারণ তিনি নিজে তখন অসুস্থ ছিলেন। পরে আমরা তার সঙ্গে দেখা করলে তিনি আমাদের যথেষ্ট সম্মান করেন ও উপহার দেন। শাসনকর্তা খানের রাজধানী সারা যাত্রার আয়োজন করছিলেন। কাজেই আমরাও তার সঙ্গে যাবার জন্য গাড়ি ভাড়া করে নিলাম। এসব গাড়ির চারটি বড় চাকা থাকে এবং ভারের তারতম্য হিসেবে দুটি বা তার বেশী সংখ্যক ঘোড়া, বলদ বা উটে টানে। ঘোড়াগুলির একটিতে চড়ে চালক হাতে চাবুক বা কাঠের লাঠি নিয়ে বসে। কাঠের বাতার সঙ্গে বনাত বা কম্বলের কাপড় চামড়ার ফালি দিয়ে বেঁধে তৈরী এক ধরনের হাল্কা তাবু গাড়ীর উপর দেওয়া হয়। তবু ঝা দেওয়া জানালার সাহায্যে বাইরের সবকিছুই দেখা যায় কিন্তু বাইরে থেকে ভিতরের কিছু দেখা যায় না। চলন্ত গাড়ীর এসব তাবুর ভিতরে বসে খাওয়া, ঘুমানো, লেখাপড়া প্রভৃতি সবই করা চলে। যে গাড়ীতে মালপত্র এবং রসদ রাখা হয় সে গাড়ীতে এক রকম একটি তাবু থাকে এবং তা তালা দিয়ে রাখা হয়।

আমীর তালাকতুমুর তার ভাই ও দুটি ছেলে সহ আমরা একত্র যাত্রা করলাম। যেসব জায়গায় আমরা বিশ্রামের জন্য থেমেছি তার সব জায়গায়ই তুকরা তাদের ঘোড়াগুলিকে রাত্রে বা দিনে যথেচ্ছভাবে চড়ে বেড়াবার জন্য ছেড়ে দেয়, সঙ্গে কোন সহিস বা রক্ষক থাকে না। চুরির ব্যাপারে তাদের আইনের কড়াকড়ির জন্যই এ রকম করা সম্ভব হয়েছে। কোনো চুরি যাওয়া ঘোড়াসহ কাউকে পেলে তাকে সেটি ফেরৎ দিতে বাধ্য করা হয় আরও নয়টি ঘোড়া সঙ্গে দিয়ে। যদি সে তা দিতে অক্ষম হয় তবে ঘোড়ার পরিবর্তে তার ছেলেদের নেওয়া হয়। যদি তার ছেলেও না থাকে তবে তাকেই। জবাই করা হয় ভেড়ার মত। তারা রুটী বা অপর কোনো শক্ত খাদ্য গ্রহণ করে না। মিলেট বা জোয়ারের সঙ্গে কুচি কুচি করে কাটা মাংসের সুরুয়া রান্না করে তারা তাই খায়। থালায় করে দইয়ের সঙ্গে সুরুয়া পরিবেশন করলে তারা তাই পান করে এবং পরে গাধার দুধে তৈরী কুমিজ নামক দই খায়। জোয়ার দিয়ে তারা একপ্রকার চোলাই। করা পানীয় তৈরী করে। এ পানীয় তাদের কাছে বুজা (Beer) নামে পরিচিত। তাদের। মতে বুজা অবৈধ পানীয় নয়। বুজা দেখতে শাদা। আমি একবার খেয়ে দেখেছিলাম জিনিসটা তেতো। কাজেই, আর কোনোদিন খাইনি। মিষ্টি খাওয়াকে এরা অপমানজনক মনে করে। একবার রমজানের সময় আমার এক সঙ্গীর হাতে তৈরী কিছু মিষ্টি সুলতান উজবেগকে দিয়েছিলাম। তিনি কোন রকমে আঙুল দিয়ে সেগুলি ধরেই মুখে পুরে দিলেন।

কিরাম থেকে যাত্রা করে আঠারটি স্টেশন পার হয়ে আমরা একটি জলাশয়ের কাছে পৌঁছলাম। সেটি হেঁটে২০ পার হতে একদিন লেগে গেলো। অনেক গরু, ঘোড়া ও গাড়ী পার হয়ে যাবার পরে জায়গাটি অত্যন্ত কর্দমাক্ত হয় এবং পার হওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। সুতরাং আমীর আমার একটু আরাম হবে ভেবে তার একজন পরিষদ সঙ্গে দিয়ে আমাকে আগেই পাঠিয়ে দিলেন। আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবার আদেশ দিয়ে আজাকের শাসনকর্তাকে একটা চিঠিও লিখে দিলেন তিনি। তারপরে আমরা দ্বিতীয় এক জলাশয়ে এলাম। সেটি পার হতেও আধা দিন লেগে গেলে সেখান থেকে যাত্রা করার তৃতীয় দিন আমরা সমুদ্রের পারে আজাক (Azov) শহরে এসে পৌঁছলাম। এ সুগঠিত শহরটিতে Genoese এবং অন্যান্য সওদাগরেরা বরাবর যাতায়াত করে। আমীর তালাকতুমুরের পত্র পেয়েই শাসনকর্তার শহরের কাজী ও কয়েকজন ছাত্র সঙ্গে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন এবং খাদ্যও পাঠালেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে আমরা আহারের পর শহরে গেলাম। কারণ, শহরের বাইরে আমরা তাবু ফেলেছিলাম। দুদিন পরে আমীর তালাকতুমুর এলে বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে তাকে অভ্যর্থনা করা হলো। রঙীন রেশমী কাপড়ে তৈরী বিশেষ একটি তাবুতে তার জন্য ভোজের আয়োজন হল। তিনি ঘোড়া থেকে নামলে রেশমী কাপড়ের টুকরা বিছিয়ে দেওয়া হল তার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য। তিনি দয়া পরবশ হয়ে আমাকে আগে আগে যেতে দিলেন, যাতে শাসনকর্তা বুঝতে পারেন যে তিনি আমাকে কতটা সম্মানের চোখে দেখেন। আমাকে নিয়ে প্রকাণ্ড একটি চেয়ারে বসিয়ে নিজে বসলেন পাশে একটি আসনে। তার ছেলেরা, ভাই ও ভাইপোরা দাঁড়িয়ে রইলেন বিনীতভাবে। প্রকাণ্ড এ চেয়ারখানা তার। নিজের জন্যই রক্ষিত ছিল। ভোজ শেষ হলে আমীরকে, তার পরিবারের প্রত্যেককে এবং আমাকে একটি করে জামা উপহার দেওয়া হল। তারপরে আমীরও তার ভাইকে দশটি করে ঘোড়া, দু’ ছেলেকে ছয়টি ঘোড়া এবং আমাকে একটি ঘোড়া উপহার দিলেন।

এদেশে ঘোড়র সংখ্যা অত্যন্ত বেশী এবং মূল্য খুবই কম। একটি ভাল ঘোড়ার মূল্য আমাদের চলতি এক দিনারের বেশী নয়। এখানকার লোকের জীবিকা ঘোড়ার উপর নির্ভর করে। আমাদের দেশে যেমন ঘোড়ার সংখ্যা বেশী, তাদের দেশে তেমনি ঘোড়ার সংখ্যা অথবা ভেড়ার সংখ্যার চেয়েও তাদের ঘোড়ার সংখ্যা বেশী। একজন মাত্র তুকা হাজার হাজার ঘোড়ার মালিক। এক সঙ্গে ছয় হাজার বা সে রকম সংখ্যক। ঘোড় ভারতে চালান হয়ে যায়। তার মধ্যে প্রত্যেক সওদাগরই হয়তো ১শত বা ২শত করে ঘোড়া একবারে পাঠায়। প্রত্যেক পঞ্চাশটি ঘোড়ার জন্য তারা একজন করে রক্ষক বা সহিস ভাড়া করে। তারাই ঘোড়াগুলিকে খাওয়াবার ব্যবস্থা করে। লম্বা একটি লাঠির মাথায় দড়ি বাঁধা থাকে। সহিস সেই লাঠি হাতে একটি ঘোড়ায় চড়ে এবং যখনই আরেকটি ঘোড়াকে ধরতে চায় তখন নিজের ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যায় দ্বিতীয় ঘোড়াটির কাছে। এগিয়ে গিয়ে লাঠির সাহায্যে দড়িটি ঘোড়ার ঘাড়ের উপর ছুঁড়ে দিয়ে তাকে টেনে আনে। তারপর তার পিঠে চড়ে প্রথমটি চারণভূমিতে ছেড়ে দেয়। সিন্ধুদেশে পৌঁছবার পরে ঘোড়াগুলিকে ঘাস খাওয়ানো হয়। সিন্ধুদেশের ঘাসপাতা বালির সমকক্ষ নয় বলে অধিকাংশ ঘোড়া মরে যায় অথবা চুরি হয়ে যায়। সিন্ধু পৌঁছে ঘোড়ার মালিককে সাত রৌপ্য দিনার শুল্ক দিতে হয় এবং মুলতান গিয়ে আরও একবার শুল্ক আদায় দিতে হয়। পূর্বে মালিককে তার আমদানীকৃত ঘোড়ার দামের এক চতুর্থাংশ শুল্ক বাবদ দিতে হয়েছে কিন্তু সুলতান মোহাম্মদ তা রদ করে দেন এবং আয়ের দশমাংশ শুল্ক ধার্য করেন। তা সত্বেও ঘোড়র মালীক যথেষ্ট লাভ করে। প্রতি ঘোড়া কমপক্ষে একশত দিনার (মরক্কো মুদ্রায় পঁচিশ দিনার) বিক্রি হয়। অনেক সময় তার দ্বিগুণ বা তিনগুণ মুল্যেও ঘোড় বিক্রি হয়। একটি ভাল ঘোড় পাঁচশ দিনার বা তার চেয়েও বেশী মূল্যে বিক্রি হয়। ভারতীয়েরা ঘোড়দৌড়ের জন্য এসব ঘোড়া কিনে না। তারা যুদ্ধে ঘোড়া ব্যবহার করে এবং যুদ্ধের সময় নিজেরা বর্ম পরে এবং ঘোড়াকেও বর্ম পরিয়ে দেয়। ইয়মেন, ওমান ও ফারস থেকে তারা ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া খরিদ করে। সেখানকার ঘোড়ার দাম এক হাজার থেকে চার হাজার দিনার অবধি।

আমীর তালাকতুমুরের সঙ্গে আমি আজাক থেকে মাজার অবধি যাই। তুরুস্কে যে সব সুন্দর শহর আছে তার মধ্যে এটি একটি। এ শহরটি একটি সুন্দর নদীর পারে অবস্থিত।২২ শহরের বাজারে একজন য়িহুদী আমাকে আরবীয় ভাষায় শুভেচ্ছা জানালো। সে থেকে এখানে এসেছে। য়িহুদীটি বলল, সে স্থলপথে কনস্টান্টিনোপল, আনাতোলিয়া এবং সিরকাসিয়ানদের দেশ(Transcaucasla) হয়ে এখানে এসেছে। তাতে চার মাস সময় লেগেছে। সফররত সওদাগরেরাও এপথ চিনে। তারাও তার কথা। সবাই সমর্থন করল।

এদেশে এসে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় লক্ষ্য করলাম, নারীর প্রতি তুর্কী জাতির সম্মান। এখানে পুরুষদের চেয়ে সমাজে নারীর মর্যাদা বেশী। কিরাম থেকে রওয়ানা হয়ে আসবার পরে আমীরের বেগমকে আমার দেখবার সুযোগ হয়। তিনিই প্রথম শাহজাদী, যাকে আমি এখানে দেখলাম। তাঁর সম্পূর্ণ গাড়ীটি ছিল নীল রঙের দামী পশমী কাপড়ে ঢাকা। তাবুর দরজা জানালা খোলা। শাহজাদীর সঙ্গে রয়েছে পরমা সুন্দরী ও মূল্যবান বস্ত্রালঙ্কারে সজ্জিতা চারজন পরিচারিকা। তার পিছনে আরও কতকগুলি গাড়ী। তাতেও রয়েছে তার মহলের পরিচারিকারা। আমীরের তাবুর কাছে এসে তিনি যখন গাড়ী থেকে নামলেন তখন ত্রিশ জন পরিচারিকা এলো তার বাঞ্চল বহন করতে। আমি সওদাগর এবং সাধারণ পরিবারের মহিলাদেরও দেখেছি। তাঁরা। প্রত্যেকে একটি গাড়ীতে যাতায়াত করে। সে গাড়ী ঘোড়ায় টানে। তার বাঞ্চল বহন করবার জন্য তিন চারজন পরিচারিকা থাকে। মহিলারা মুক্তার কাজ করা সরু মাথাওয়ালা টুপি ব্যবহার করে। টুপির চূড়ায় ময়ুরের পালক লাগানো থাকে। তাবুর জানালা খোলা রাখা হয় বলে জানালা দিয়ে তাদের মুখ দেখা যায়। কারণ তুর্কী রমণীরা মুখে নেকাব ব্যবহার করে না।

অনেক সময় স্বামীর সঙ্গেও তারা বাইরে বের হন। তখন অনেকে তাদের পরিচারক মনে করে, কারণ মেষের লোমে তৈরী পোশাক আর উঁচু টুপি ছাড়া আর কিছুই তারা পরিধান করে না।

অতঃপর আমরা সুলতানের শিবিরে যাত্রার আয়োজন করলাম। সুলতানের শিবির। ছিল তখন বিশদাগ নামক স্থানে। বিশদাগ অর্থ পাঁচ পাহাড়’২৩। মাজার থেকে বিশদাগ চারদিনের পথ। এ পাহাড়গুলির মধ্যে একটি উষ্ণপ্রস্রবন আছে। তুর্কীরা এখানে এসে গোসল করে এবং তাতে রোগ প্রতিরোধ হয় বলে এরা দাবী করে। রমজান মাসে পয়লা তারিখে আমরা শিবিরে এসে পৌঁছলাম। এসে শুনলাম, আমরা যেখান থেকে এইমাত্র এসেছি তারই ধারে কাছে কোথাও শিবির উঠে যাচ্ছে। কাজেই আমাদের আবার ফিরে আসতে হল। সেখানে একটি পাহাড়ের উপরে আমার তাবু খাটালাম। তাবুর সামনে একটি নিশান পুতে ঘোড়া ও গাড়ীগুলিকে তাবুর পেছনে রাখলাম। তখন মহল্পা অগ্রসর হয়ে এল। মহল্লার নাম রেখেছে তারা ‘অরদু’। আমরা দেখলাম একটা। প্রকাণ্ড শহর যেনো এগিয়ে আসছে তার বাসিন্দা, মসজিদ, বাজার প্রভৃতি সব কিছু নিয়ে। চলমান রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া উঠছে কারণ সফরের সময়েও তারা পথে রান্না করে আহার করে। ঘোড়ায় টানা গাড়ীতে এসব আছে। তাবুর জায়গায় পৌঁছে তারা গাড়ী থেকে নামিয়ে তাবুগুলি সেখানে খাটাল। সে সব তাবু ওজনে খুব হালকা। মসজিদ এবং দোকানপাটও এনে সেখানে স্থাপন করা হল। সুলতানের খাতুনরাও নিজ নিজ দলবল সহ আমাদের পাশ দিয়ে গেলেন। চতুর্থ খাতুন যেতে-যেতে নিশানওয়ালা আমাদের। তবুটি পাহাড়ের উপর দেখতে পেলেন। আমরা যে সদ্য এখানে এসেছি নিশানটি তারই চিহ্ন। তাবুটি দেখতে পেয়ে তিনি আমাদের অর্ভ্যথনা করতে পাঠালেন তার সখীদের এবং বালক ভৃত্যদের। আমার একজন সঙ্গীও তালাকতুমুরের একজন পরিষদের সাহায্যে আমি তাকে কিছু উপহার পাঠালাম। তিনি তা সাদরে গ্রহণ করলেন এবং আমাদের তার হেফাজতে রাখবার হুকুম দিয়ে চলে গেলেন। পরে সুলতান এলেন এবং নিজের ‘মহল্লা’ নিয়ে পৃথকভাবে শবির স্থাপন করলেন।

বিখ্যাত সুলতান মুহাম্মদ উজবেক খ একটি বিশাল রাজ্যের শাসনকর্তা। তিনি আল্লাহর শত্ৰু কনস্টান্টিনোপলের অধিবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন। আমাদের আমির-উ-মমামেনি (খোদা তার শক্তি বৃদ্ধি করুক এবং তাকে জয়যুক্ত করুক) মিশর ও সিরিয়ার সুলতান (মরক্কার সুলতান) ইরাকের সুলতান, তুর্কীস্তানের সুলতান, অসের পরে যে দেশ আছে সেখানকার সুলতান, ভারতের সুলতান ও চীনের সুলতান প্রভৃতি পৃথিবীর সাতটি রাজ্যের একটির মতই বৃহৎ সুলতান উজবেকের রাজ্য। আমার আগমনের পরের দিন বিকেলে এক আনুষ্ঠানিক দরবারে তার সঙ্গে আমি দেখা করলাম। সেখানে একটি বিরাট ভোজের আয়োজন হয়েছিল। আমরা সুলতানের উপস্থিতিতে এফতার করলাম। এখানকার তুর্কীরা মুসাফেরদের আহার ও বাসস্থান দেবার অথবা অর্থ সাহায্যে করবার রীতি পালন করে না কিন্তু তারা জবাই করার জন্য। তাদের ভেড়া ও ঘোড়া দেয় এবং কুমিজ খেতে দেয়। এসব তাদের দান বলে গণ্য। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের পরে সুলতান সোনালী মণ্ডপ নামে অতি সুসজ্জিত একটি মণ্ডপে দরবারে বসেন। মণ্ডপের মধ্যস্থলে কাষ্ঠনির্মিত একটি সিংহাসন। সিংহাসনটি রূপালী পাতে মোড়া এবং পায়াগুলি রূপায় নির্মিত ও উপরিভাগ মণিমুক্তা খচিত। সুলতান মসনদে বসলে ডান পাশে বসেন খাতুন তায়তুঘলিন, তার ডানদিকে বসেন খাতুন কেবেক, সুলতানের বামে বসেন খাতুন বায়ালুন আর তার বামে খাতুন উদুর্জা। মনদের নিম্নে দাঁড়ান সুলতানের দুই পুত্র–বড়টি ডানে ছোটটি বামে। কন্যা বসেন। সুলতানের সামনে। প্রত্যেক খাতুন এলেই সুলতান উঠে হাত ধরে তাকে মসনদে উঠতে সাহায্যে করেন। দরবারের সামনেই এসব ঘটে, কোন পর্দার দরকার হয় না।

সুলতানদের সঙ্গে দেখা করার পরের দিনই আমি প্রধান খাতুন তায়তুঘলির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনিই বেগম এবং দুই সুলতান জাদার মাতা। তিনি দশজন বর্ষীয়সী মহিলার সঙ্গে বসেছিলেন। তারা সম্ভবতঃ বেগমের পরিচারিকা হবে। বেগমের সামনে বসেছিল প্রায় পঞ্চাশজন সখী। তাদের সামনের থালায় চেরীফল নিয়ে তারা পরিষ্কার করছিল। বেগম নিজেও একটি সোনালী ট্রেতে চেরীফল নিয়ে পরিষ্কার করছিলেন। তিনি কুমিজ আনতে হুকুম করলেন এবং নিজহাতে একটি পেয়লা ভর্তি করে আমার হাতে দিলেন। তাদের বিবেচনায় এভাবে নিজহাতে কুমিজ পরিবেশন খুব সম্মানজনক। আমি আগে কখনও কুমিজ পান করি নাই। তবু পেয়ালাটি হাতে না নেবার কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। কুমিজ খেয়ে দেখলাম এবং আদৌ সুস্বাদু মনে হল না বলে আমার এক সঙ্গীকে খেতে দিলাম। পরের দিন গেলাম দ্বিতীয় খাতুন কেবেকের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি তখন কোরআন শরীফ পাঠ করছিলেন। তিনিও আমাকে কুমিজ পান করতে দিলেন। তৃতীয় ধাতুন বায়ালুন কনস্টান্টিনোপলের ম্রাটের কন্যা।২৪ তাকে দেখলাম মণিমুক্তাখচিত একটি মসনদে তিনি বসে আছেন। তার সামনে গ্রীক, তুর্কী ও লুবিয়ান জাতীয় প্রায় শতেক সখী বসে বা দাঁড়িয়ে আছে। তার পিছনে রয়েছে খোঁজারা এবং পার্শ্বে গ্রীক পরিচারক। তিনি আমাদের সফরের কথা, গৃহের কথা জিজ্ঞাসাবাদ করলেন এবং রুমালের সাহায্যে নিজের সজল চক্ষু মুছলেন। পরে তার হুকুমে খাবার এলে আমরা তাঁর সামনে বসেই খেলাম। আমরা বিদায় হতে চাইলে তিনি বললেন, আমাদের সম্পর্ক যেন এখানেই শেষ না হয়। সর্বদা আসবেন এবং কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবেন। তিনি আমাদের প্রতি বিশেষ অনুকম্পা প্রদর্শন করেন। আমরা চলে আসবার পরে তিনি আমাদের খাদ্য, প্রচুর রুটী, মাখন, ভেড়া, অর্থ ও দামী পোষাক এবং তেরোটি ঘোড়া দান করেছিলেন। তার তিনটি ঘোড়া বেশ ভাল ছিল এবং দশটি ছিল সাধারণ ঘোড়া। এই খাতুনের সঙ্গে আমি কনস্টান্টিনোপল অবধি যাই। সে বর্ণনা পরে দেওয়া হবে। চতুর্থ খাতুন রাণীদের মধ্যে সর্বোত্তম। তিনি যেমন অমায়িক তেমনি সহানুভূতিশীলা। আমরা দেখা করলে তিনি আমাদের প্রতি যে দয়া প্রদর্শন করেন তার তুলনা হয় না। সুলতানের কন্যাও আমাদের প্রতি যে দয়াদাক্ষিণ্য প্রদর্শন করেন তেমন আর কোনো খাতুনই করতে পারেন নাই। তিনি বহুভাবে আমাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন। খোদা যেনো তাকে পুরস্কৃত করেন।

আমি বুলগার ২৫ শহরের কথা শুনেছিলাম। সেখানে সবচেয়ে স্বল্পস্থায়ী রাত এবং পাল্টা মৌসুমে সবচেয়ে স্বল্পস্থায়ী দিন হয়। আমার ইচ্ছে হয়েছিল স্বচক্ষে তা দেখতে হবে। সুলতানের শিবির থেকে দশ রাতের পথ বুলগার শহর। আমি সুলতানকে অনুরোধ করেছিলাম আমার সঙ্গে একজন চালক দিতে এবং তিনি সে অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। রমজান মাসে আমরা সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম। সন্ধ্যায় এফতারের পরে মগরেবের নামাজ পড়ে ভোর হবার আগে শুধু রাত্রের নামাজ পড়বার মতো সময় হাতে। পেলাম। সেখানে তিন দিন কাটালাম।

বুলগার থেকে চল্লিশ দিন লাগে অন্ধকারের দেশে যেতে। সেখানেও যাবার ইচ্ছা আমার ছিল কিন্তু পথকষ্টের কথা ভেবে এবং বিশেষ লাভবান হতে পারব না মনে করে সে ইচ্ছা ত্যাগ করলাম। সেখানে যাবার একমাত্র বাহন কুকুরে-টানা শ্লেজ। সেখানকার মরুভূমি বরফে আজ্ঞ বলে মানুষ বা পশু পা পিছলে পড়ে যাওয়া ছাড়া হেঁটে যেতে পারে না। কিন্তু কুকুর তার পায়ের নখ দিয়ে বরফ আটকে ধরতে পারে। ধনী সওদাগরেরা নিজেদের শত শত শ্রেজে খাদ্য, পানী, জ্বালানী বোঝাই করে এসব রাস্তায় চলতে পারেন কারণ মরুভূমির এ রাস্তায় গাছপালা বা মানুষের বস্তি নাই। এ-সব পথের একমাত্র চালক এমন সব কুকুর যারা একাধিক বার এ পথে যাতায়াত করেছে। এমন একটি কুকুরের মূল্যও প্রায় হাজার দিনার অবধি ওঠে। এমনি একটি কুকুরের ঘাড়ে জে বেঁধে দিয়ে সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় আরও তিনটি কুকুর। এই কুকুরটি চালক এবং অন্যান্য কুকুর স্লেজ নিয়ে তাকেই অনুসরণ করে। যখন চালক কোথাও থামে তখন এরাও থামে। চালক কুকুরের মালিক কথননা তার কুকুরকে মারে না বা গালাগালি দেয় না। খাবার তৈরি হলে মানুষের আগে খেতে দেওয়া হয় কুকুরকে। নতুবা কুকুর রাগান্বিত হয়ে সবাইকে ধ্বংসের মুখে ফেলে পালিয়ে যায়। সফরকারীরা চল্লিশ মঞ্জিল পার হয়ে এসে অন্ধকার দেশে পৌঁছে। তখন যে যা পণ্যদ্রব্য এনেছে সবই সেখানে রেখে ফিরে আসে নিজের নিজের তাবুতে। পরের দিন গিয়ে দেখতে পায় সে সব জিনিষের পাশে-পাশে রাখা আছে মেরুদেশের বেজী জাতীয় জীবের চামড়া। সওদাগর যদি তার পণ্যের বিনিময়ে সে সব পেয়ে সন্তুষ্ট হয় তবে তা’গ্রহণ করে নতুবা সেখানেই রেখে পুনরায় চলে আসে। তখন স্থানীয় লোকেরা আরও কিছু বেশী চামড়া রেখে যায় অথবা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সওদাগরের পণ্য ফেলে নিজেদের দেওয়া চামড়া ফেরত নিয়ে যায়। এ নিয়মেই সেখানে তেজারতী চলে। সেখানে যারা সওদাগরী করতে যায় তারা জিনের সঙ্গে না মানুষের সঙ্গে কারবার করছে তার কিছুই জানতে পারে না, কারণ তারা কেউ কাউকে দেখে না।

যে আমীরকে সুলতান আমার সাথী হিসাবে সঙ্গে দিয়েছিলেন তার সঙ্গেই বুলগার থেকে ফিরে এলাম এবং ২৮শে রমজান বিশদাগে এসে মহল্লা দেখতে পেলাম। ঈদ পর্ব উদ্যাপনের পর সুলতানের সঙ্গে মহল্প সহ আমরা হজতরখান (আম্রাখান) এসে পৌঁছলাম। চমৎকার শহর হজতরখান। পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত নদী ইতিল (গা) এর পারে শহরটি অবস্থিত। শীতকালে নদীটি বরফে পরিণত হয়। তখন লোকেরা শ্লেজের সাহায্যে নদীর উপর দিয়া যাতায়াত করে। কোনো-কোনো সময় কাফেলা শীতের শেষে এ নদী পার হতে এসে ডুবে মরে। এ শহরে এসে খাতুন বায়ালুন তাঁর পিতার সঙ্গে দেখা করবার জন্য সুলতানের অনুমতি চাইলেন। তার ইচ্ছা ছিল পিতৃগৃহে সন্তান প্রসব করে তিনি পুনরায় সুলতানের কাছে ফিরে যাবেন। তিনি খাতুনকে অনুমতি দিলেন। তখন আমিও বিখ্যাত কনস্টান্টিনোপলস শহর দেখবার আশায় খাতুনের সঙ্গে যাবার অনুমতি চাইলাম। তিনি আমার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অনুমতি দিতে সম্মত হলেন না। আমি তখন বললাম, আমি আপনার পৃষ্ঠপোষকতা ও রক্ষণাধীনে গেলে আমার ভয়ের কিছুই নেই। তারপরে তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন এবং আমরা পরস্পর বিদায় নিলাম। তিনি আমাকে দেড় হাজার দিনার, একটি পোষাক, বেশ কিছু ঘোড়া উপহার দিলেন। প্রত্যেক খাতুন দিলেন রৌপ্যের তাল। সুলতানের কন্যা দিলেন তাঁদের চেয়েও বেশী। সেই সঙ্গে দিলেন এক প্রস্থ পোষাক পরিচ্ছদ ও বহু বেজী জাতীয় জীবের চামড়ার মালিক হলাম।

খাতুন বায়ালুনের সঙ্গে ১০ই শওয়াল আমরা রওয়ানা হয়ে গেলাম। সুলতান, বেগম ও মসনদের উত্তরাধিকারী শাহ্জাদা এক মঞ্জিল অবধি খাতুন বায়ানের সঙ্গে গিয়ে ফিরে এলেন। অন্যান্য খাতুনরা গেলেন দ্বিতীয় মঞ্জিল অবধি। তারপর তারাও ফিরে এলেন। আমীর বায়দারা পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে তার সহগামী হলেন। খাতুনের নিজেরও ছিল প্রায় পাঁচশ’ ঘোড়সওয়ার, তার মধ্যে দু’শ তার নিজস্ব ক্রীতদাস ও গ্রীক, বাকি সব তুর্কী এছাড়া তাঁর সঙ্গে পরিচারিকা ছিল দুশ। তাদের অধিকাংশই ছিল গ্রীক। দু’হাজার ভারবাহী ও আরোহণোপযোগী ঘোড়া ছিল তাঁর সঙ্গে। চারশ’ ছিল গাড়ী। এছাড়াও ছিল তিন শ’ বলদ ও দু’শ উট। এ সব ছাড়া ছিল দশজন গ্রীক যুবক ও সমসংখ্যক ভারতীয় যুবক। ভারতীয় যুবকদের যে প্রধান তাকে বলা হতো ভারতীয় ‘সানবুল। গ্রীক যুবকদের নেতার নাম ছিল মাইকেল। কিন্তু তুর্কীরা তার নাম রেখে ছিল লুলু (মুক্তা)। খাতুন তার অধিকাংশ পরিচারিকা ও মালপত্র সুলতানের শিবিরেই রেখে এসেছেন, কারণ তিনি মাত্র পিতার সঙ্গে দেখা করতে চলেছেন। আমরা উকাক২৭ রওয়ানা হলাম। উকাক মাঝারী আকারের একটি শহর হলেও এখানে সুন্দর-সুন্দর অট্টালিকা এবং প্রচুর প্রাকৃতিক উৎপন্নদ্ৰব্য আছে। শহরটি শীতপ্রধান। এ শহর থেকে, একদিন হেঁটে গেলে রুশদেশের পর্বত। রুশরা খৃষ্টান, তাদের মাথায় লাল চুল, চোখ নীলবর্ণ, মুখচ্ছবি কদাকার। লোকগুলি বিশ্বাসঘাতক। এদের দেশে রৌপ্য খনি আছে। সেখান থেকে রৌপ্যের তাল এনে তার সাহায্যে এখানে কেনা বেচা চলে। প্রতিটি রৌপ্য তালের ওজন পাঁচ আউন্স।

এখান থেকে দশ রাত্রি সফরের পরে আমরা কিপচাপ মরুভূমির সমুদ্রোপকুলস্থ সারদা শহরে এসে পৌঁছলাম। এখানে এমন একটি পোতায় আছে যা সবচেয়ে বড় ও সুন্দর পোতাশ্রয়গুলির অন্যতম। শহরের বাইরে অনেক ফলের বাগান, ঝরণা আছে। এ অঞ্চলে তুর্কী এবং তাদের অধীনে কিছুসংখ্যক গ্রীকের বাস। এসব গ্রীকের অধিকাংশই শিল্পজীবি। তাদের বাসগৃহগুলি কাঠের তৈরি। এক সময়ে এ শহরটি বেশ বড়ই ছিল। কিন্তু গ্রীক ও তুর্কীদের ভেতর ঝগড়ার ফলে শহরের অধিকাংশই আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রথমে গ্রীকরাই জয়ী হয়ে প্রভাব বিস্তার করেছিল কিন্তু তুর্কীরা প্রতিবেশীদেশের সাহায্যে পেয়ে গ্রীকদের হত্যা করে ও দেশ থেকে বিতাড়িত করে। গ্রীকদের অনেকে তুর্কীদের প্রজা হিসেবে এখনও সেখানে বসবাস করছে। এ দেশের প্রত্যেক মঞ্জিলে এসেই খাতুন ঘোড়া, ভেড়া, গরুমহিষ, যব, কুমিজ, গরু ও মেষের দুধ উপহার পেয়েছেন। এখানে দ্বিপ্রহরের পূর্বে ও বিকেলে পথ চলা হয়। প্রত্যেক শাসনকর্তাই তার এলাকার সীমান্ত অবধি খাতুনকে এগিয়ে দিতে আসেন। তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যই এরূপ করা হয়, খাতুনের নিরাপত্তার জন্য নয়, কারণ এদেশগুলি সম্পূর্ণ নিরাপদ। অতঃপর আমরা যে শহরে পৌঁছলাম সে শহরটি ‘বাবা। সালতাফ’২৯-এর নামে পরিচিত। বাবা সালতাফ ছিলেন একজন ecstatic mystic, কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে যে সব গল্প প্রচলিত ছিল তাতে মনে হয় তিনি শরিয়ত বিরোধী কাজ করতেন। তুর্কীদের রাজ্যের শেষ সীমায় অবস্থিত এ শহরটি। এখান থেকে গ্রীকদের রাজ্য পর্যন্ত জনহীন মরুভূমির ভেতর দিয়ে আঠার দিনের পথ। এ পথের আট দিন পর্যন্ত পানি দুষ্প্রাপ্য। কাজেই ছোট মশকে গাড়ী বোঝাই করে পানি নিয়ে এ পথে যাত্রা করতে হয়। আমরা যাত্রা করেছিলাম শীতকালে। কাজেই আমরা পানির অভাব বোধ করিনি। খোদাকে অশেষ ধন্যবাদ যে আমাদের যাত্রাপথ নিরাপদই ছিল।

এ যাত্রাপথের শেষে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম গ্রীক রাজ্যের৩০ সীমান্তে মাহটুলী দূর্গে। খাতুনের আগমনের সংবাদ গ্রীকরা পূর্বেই অবগত ছিল। কাজেই গ্রীকদের প্রধান ব্যক্তি নিকোলাস একদল সৈন্য ও অনেক উপহার দ্রব্যসহ রাজকুমারীদের এবং শুশ্রূষাকারিণীদের সঙ্গে নিয়ে এখানে দেখা করতে আসেন কনস্টান্টিনোপল থেকে। মহাটুলী থেকে কনস্টান্টিনোপল বাইশ দিনের পথ। মাহটুলী থেকে খাল অবধি যেতে লাগে মোল দিন, পরে সেখান থেকে কনস্টান্টিনোপল ছয় দিন। এ দূর্গ থেকে যাত্রা করতে ঘোড়া বা খচ্চরের সাহায্য নিতে হয়। পথ বন্ধুর ও পর্বতসঙ্কুল বলে গাড়ী। এখানেই রেখে যেতে হয়। গ্রীক-প্রধান অনেক খচ্চর সঙ্গে এনেছিলেন। তার ভেতর থেকে ছয়টি খচ্চর খাতুন আমার জন্য পাঠান। আমার গাড়ী ও মালপত্রের। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে সব সঙ্গী ও ক্রীতদাসদের রেখে এসেছিলাম খাতুন তাদের দেখাশুনার ভার দেন দূর্গরক্ষকের উপর। তিনি তাদের বাসোপযোগী একটি ঘরের। ব্যবস্থা করে দেন। কমাণ্ডার বায়দারা তার সৈন্যদল নিয়ে এখান থেকেই ফিরে যান এবং আজান দেওয়ার রীতিও রহিত হয়। তার উপহার সামগ্রীর সঙ্গে কিছু মদ্যও ছিল। তিনি তা পান করেন। শুকরের মাংস ছিল। তার জনৈক কর্মচারীর কাছে শুনেছি খাতুন তা। আহার করেন। একজন তুর্কী ছাড়া নামাজী কেউ তার সঙ্গে রইল না। এ তুকীটি আমাদের সঙ্গে এসে নামাজ আদায় করত। আমাদের সম্বন্ধে যে মনোভাব এতদিন লুক্কায়িত ছিল, আমরা বিধর্মীদের দেশে প্রবেশ করবার সঙ্গে-সঙ্গে তা আবার সজাগ হয়ে উঠল। কিন্তু খাতুন গ্রীক-প্রধানকে আমাদের সঙ্গে সম্মানজনক ব্যবহার করতে বলে দিলেন। তার ফলে একজন পাহারাদারকে তিনি প্রহার করেন। কারণ, এ পাহারাদার আমাদের নামাজের প্রতি উপহাস করেছিল।

এরপর আমরা মাসলামা ইব্‌নে আবদুল মালেকের দূর্গে পৌঁছলাম। একটি পর্বতের পাদদেশে ইসতাফিলি নামক বেগবতী নদীর পাড়ে এ দূর্গটি অবস্থিত। এ দুর্গের। ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই নেই। দূর্গের বাইরে একটি প্রকাণ্ড গ্রাম। আমরা যখন গেলাম তখন খালে জোয়ার এসেছে প্রায় দু’মাইল চওড়া ও খালটি হেঁটে পার হতে হবে। বলে আমরা ভাটার জন্য অপেক্ষা করে রইলাম। অতঃপর বালুকাময় পথে চার মাইল হেঁটে আমরা পেলাম দ্বিতীয় খাল। চার মাইল চওড়া এ খালটিও আমরা হেঁটে পার হলাম। তারপর প্রস্তর ও বালুকাময় পথে দু’মাইল হেঁটে তৃতীয় খালের কাছে এলাম। তখন খালে সবেমাত্র জোয়ার আসতে শুরু হয়েছে। কাজেই এক মাইল চওড়া এ খালটি হেঁটে পার হতে আমাদের বেশ খানিকটা বেগ পেতে হল। সুতরাং সমস্ত খালের প্রস্থ অর্থাৎ খাল ও শুকনা জায়গা সহ প্রায় বার মাইল। বর্ষার সময়ে এ স্থানের সবটাই ডুবে যায় বলে নৌকা ছাড়া পার হবার উপায় থাকে না। তৃতীয় খালটির পারে ফানিকা নামে ছোট একটি সুন্দর শহর আছে। এখানকার গীর্জাও ঘরবাড়ীগুলি বেশ সুন্দর। শহরের চারদিকে খাল ও ফলের বাগান আছে। এসব বাগানে সারা বছরই আঙুর, আপেল নাশপাতি, খুবানী প্রভৃতি ফল থাকে। এ শহরে আমাদের তিন রাত্রি কাটাতে হল। খাতুন ছিলেন তাঁর পিতার একটি ছোট দূর্গে।

‘অতঃপর কিফালী কারাস নামে খাতুনের এক ভাই সেখানে এলেন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাঁচ হাজার ঘোড়সওয়ার নিয়ে। খাতুনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সাদা পোষাক পরিহিত তার ভাই ছাই রংয়ের একটি ঘোড়ায় আরোহন করলেন। তার মাথার উপরে মণিমুক্তা খচিত ছত্র। তার ডাইনে ছয় জন যুবরাজ বামেও সমসংখ্যক, সবারই পোষাক সাদা, মাথায় সোনালী জরির কাজ করা ছত্র। তার সামনে একশত জন পদাতিক সৈন্য ও একশত জন ঘোড়সওয়ার। তাদের গায়ে লম্বা কোট ও ঘোড়ার পীঠও বক্সে আচ্ছাদিত। তাদের প্রত্যেকের সামনেই জীন লাগানো এক সুসজ্জিত ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে একজন ঘোড়সওয়ারের উপযোগী মণিমুক্তা খচিত শিরস্ত্রাণ, কর্ম, ধনুক এবং একটি তরবারী, প্রত্যেকের হাতেই একটি-একটি বর্শা, বর্শার মাথায় ক্ষুদ্র নিশান। অধিকাংশ বর্শাই হর্ণ বা রৌপ্যের পাতে মোড়া। এগুলি সুলতানের পুত্রের আরোহণের ঘোড়া। তাঁর ঘোড়াসওয়ার সৈন্যরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত। এক একটি দলে দুশ ঘোড়সওয়ার। তাদের, উপরে আছে একজন করে অধিনায়ক। তার সামনে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দশজন ঘোড়সওয়ার। তারাও একটি করে ঘোড় চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অধিনায়কের পিছনেও দশজন ঘোড়সওয়ার রঙীন পতাকা বহন করে চলেছে। আরও দশজনে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে চলেছে দশটি জয়ঢাক। তাদের সঙ্গে রয়েছে রণভেরী, শিঙ্গা ও বাঁশী বাজাবার জন্য ছয় জন। খাতুন একটি ঘোড়ায় চড়ে বের হলেন রক্ষী, পরিচারিকা, ক্রীতদাস বালক এবং ভৃত্য সহ প্রায় পাঁচ শত লোকলস্কর নিয়ে। তাদের প্রত্যেকের পরিধানে সোনালী জরি ও জড়োয়ার কাজ করা মূল্যবান রেশমী পোষাক। তিনি নিজে পরেছেন। সোনালী বুটিদার মণিমুক্তাভূষিত রেশমী পোষাক, মাথায় মূল্যবান জড়োয়ার কাজ করা মুকুট। তার ঘোড়াটির আচ্ছাদনও তৈরী হয়েছে সোনালী কাজ করা রেশমী কাপড়ে। ঘোড়র পায়ে সোনার তৈরী ব্রেসলেট, গলায় পাথর বসানো হার। ঘোড়ার পায়ে সোনার তৈরী ব্রেসলেট, গলায় পাথর বসানো হয়। ঘোড়র জীনের ফ্রেমটি স্বর্ণমণ্ডিত ও মণিমাণিক্যখচিত। শহরের থেকে প্রায় এক মাইল দূরে একখন্ড সমতলভূমিতে ভাই। বোনে দেখা হল। তার ভাই বয়সে ছোট বলে প্রথমে ঘোড়া থেকে নেমে বোনের ঘোড়ার রেকাবে চুম্বন দিলেন, বোন চুম্বন দিলেন ভাইয়ের মাথায়। সেনানায়ক এবং যুবরাজরাও সবাই ঘোড়া থেকে নেমে খাতুনের ঘোড়ার রেকাবে চুম্বন দিলেন। তারপর ভাইকে নিয়ে তিনি রওয়ানা হলেন।

পরদিন আমরা সমুদ্রোপকূলে একটি বড় শহরে হাজির হলাম। নদীনালা ও বৃক্ষ শোভিত এ শহরটির নাম আমার স্মরণ নেই। শহরের উপকণ্ঠে আমাদের তাবু ফেলা হল। খাতুনের যে ভাইটি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী তিনি দেখা করতে এলেন অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত দশ হাজার ঘোড়সওয়ার সিপাহীর এক মিছিল নিয়ে। তার মাথায় একটি মুকুট, ডান দিকে বিশ জন এবং বাঁ দিকে বিশ জন যুবরাজ (Prince)। তাঁর ঘোড়াগুলোকেও সাজানো হয়েছে তার ভাইয়ের ঘোড়ার মতই, কিন্তু জাকজমক এবার অনেক বেশী এবং ঘোড়ার সংখ্যাও বেশী। ভগ্নি আগের বারে যে পোষাক পরেছিলেন। এবারেও সে পোষাকেই এসেছেন। সামনাসামনি হলে দু’জনই এক সঙ্গে ঘোড় থেকে নামলেন। কাছেই একটি রেশমী তাবু খাটানো ছিল। দুজনেই তারা সে তাবুতে প্রবেশ করলেন। কাজেই কি ভাবে তারা পরস্পরকে অভ্যর্থনা করলেন তা জানা সম্ভব হল না। আমাদের তাবু ছিল কষ্টান্টিনোপলস থেকে দশ মাইল দূরে। পরের দিন মূল্যবান পোষাকে সজ্জিত নারী পুরুষ ও শিশু নির্বিশেষে শহরের অধিবাসীরা কেউ ঘোড়ায় চড়ে কেউ বা পায়ে হেঁটে সেখানে এসে হাজির হল। ভোরে ঢাক ঢোল ও ভেরী বাজানো। হ’ল। সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী রাজপরিষদের কর্মচারীসহ খাতুনের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। সম্রাটের মাথার ওপর একটি চন্দ্রাতপ ধরে আছে বেশ কিছু সংখ্যক ঘোড়সওয়ার ও পদাতিক মিলে। তাদের প্রত্যেকের হাতে কাঠের লম্বা লাঠি। লাঠির মাথায় একটি করে চামড়ার বলের মত বস্তু। তারই সাহায্যে তারা চন্দ্রাতপটি উঁচু করে রয়েছে। চন্দ্রাতপের। মধ্যস্থলে বেদীর মত একটি বস্তু রয়েছে। সেটির অবলম্বনও ঘোড়সওয়ারদের লাঠি। সম্রাট যখন সামনের দিকে অগ্রসর হলেন তখন সৈনিকদের ভেতর কেমন একটা। জড়াজড়ি রু হয়ে গেল। ফলে সেখানে ধূলি উড়তে লাগল। আমি তাদের মধ্যে প্রবেশ করতে না পেরে জীবনের ভয়ে খাতুনের মালপত্র ও লোকলস্করের সঙ্গে রয়ে গেলাম। শুনেছি, খাতুন তার পিতামাতার কাছে গিয়ে প্রথমে তাদের সম্মুখস্থ মাটী চুম্বন করেন ও পরে তাদের ঘোড়ার খুরে চুম্বন করেন। খাতুনের প্রধান প্রধান কর্মচারীরাও তাই করে।

আমরা দুপুর বেলা অথবা দুপুরের একটু পরে কনস্টান্টিনোপলে প্রবেশ করলাম। শহরের লোকেরা আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ঘন্টা বাজাতে আরম্ভ করে। রাজপ্রাসাদের প্রথম প্রবেশদ্বারে পৌঁছে দেখতে পেলাম প্রায় শতেক লোক সেখানে দাঁড়িয়ে। তাদের সঙ্গে মঞ্চে দাঁড়িয়ে একজন সর্দার। তাদের বলতে শুনলাম সারাকি সারাকিনু অর্থাৎ মুসলিম মুসলিম। তারা আমাদের ভিতরে প্রবেশ করতে দেবে না। খাতুনের সঙ্গীরা। তখন বুঝিয়ে দিল যে আমারও তাদের সঙ্গী। কিন্তু উত্তরে তারা বলল “বিনানুমতিতে এদের ঢুকতে দেওয়া নিষেধ। কাজেই আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। খাতুনের একজন সঙ্গী গিয়ে খাতুনকে এ সংবাদ জানাল। ধাতুন তখনও পিতার কাছেই ছিলেন। তিনি পিতাকে আমাদের বিষয় জানাতেই আমরা ভিতরে প্রবেশের অনুমতি পেলাম এবং বাসস্থানের কাছে একটি বাসগৃহও পেলাম। এ ছাড়া তিনি হুকুম দিলেন, শহরের কোথাও যেতে আমাদের যেনো বাধা দেওয়া না হয়। তার এ হুকুম বাজারে ঘোষণা। করে দেওয়া হল। আমরা তিন দিন প্রাসাদের ভেতরেই রইলাম। খাতুন আমাদের জন্য ময়দা, রুটী, গোশত, মুরগী, মাখন, মাছ, ফল, টাকা-পয়সা, ও শয্যদ্রব্য পাঠিয়ে দিলেন। চতুর্থ দিনে আমরা সুলতানের দরবারে যাবার সুযোগ পেলাম।

কনস্টন্টিনোপলের ম্রাটের নাম তাকফুর। পিতার নাম সম্রাট জিরজিস (জর্জ)৩২। তাঁর পিতা ম্রাট জর্জ তখনও জীবিত কিন্তু তিনি ছেলের হাতে রাজত্ব দিয়ে নিজে গীর্জায় থেকে সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করছেন ও ধর্মচর্চা করেছেন। তার কথা আমরা পরে বলব। আমাদের কনস্টান্টিনোপলে পৌঁছবার চতুর্থ দিনে খাতুন তার ভারতীয় ক্রীতদাস সানবুলকে আমাদের কাছে পাঠালেন। সে আমার হাত ধরে প্রাসাদের ভেতরে নিয়ে গেল। আমরা পর-পর চারটি দেউড়ী পার হয়ে গেলাম। প্রত্যেক দেউড়ীতে খিলানের নীচে সশস্ত্র পদাতিক সৈন্যরা রয়েছে। তাদের অধিনায়ক রয়েছে কার্পেট মোড়া মঞ্চের উপর। পঞ্চম দেউড়ীতে পৌঁছতেই সানবুল আমাকে সেখানে রেখে অন্যত্র চলে গেল এবং ফিরে এল চারজন গ্রীক যুবক সঙ্গে নিয়ে। আমার সঙ্গে কোন ছুরি আছে কিনা দেহ তল্লাসী করে তারা দেখে নিল। একজন কর্মচারী আমাকে বললেন, “এটা এদের রীতি। যিনি রাজার নিকট যাবেন তিনি আমীর ফকির বা দেশী বিদেশী যাই হন না কেন তার দেহ তল্লাসী করা হবেই হবে।” এ রকম রীতি ভারতেও প্রচলিত আছে। দেহ তল্লাসীর পরে দেউড়ীর ভারপ্রাপ্ত লোকটি উঠে আমাকে হাত ধরে নিয়ে দরজা খুললেন। তখন চারজন লোক আমাকে ঘিরে ধরল। তাদের দু’জন ধরল আমার জামার আস্তিন আর দু’জন দাঁড়াল পিছনে। তারপরে আমাকে নিয়ে এল প্রকাণ্ড একটি হলে। হলের দেওয়ালগুলি কারুকার্যখচিত। তাতে রয়েছে বিভিন্ন প্রাণী ও প্রাণহীন বর চিত্র। মধ্যস্থলে একটি নহর, নহরের দু’পাশে গাছ। ডানে ও বামে লোক দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই। হলে আরও তিনজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে তাদের হাতে দিয়ে আগের চারজন চলে গেল। আগের লোকদের মত এরাও আমার জামা ধরল এবং অপর একজনের ইঙ্গিতে আমাকে সামনের দিকে নিয়ে চলল৩৩। তাদের ভেতর একজন ছিল ইহুদী। তিনি আমাকে আরবীতে বললেন, “ভয় পাবেন না। ভিতরে যারা যান তাদের সঙ্গে এ রকম ব্যবহারই এরা করে। আমি এখানকার দোভাষী। আমি সিরিয়ার অধিবাসী।” এ কথা শুনে সুলতানকে কিভাবে অভিবাদন করতে হবে আমি জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আমাকে “আচ্ছালামু আলাইকুম” বলতে পরামর্শ দিলেন। আমরা প্রকাণ্ড একটি চন্দ্রাতপের নীচে এসে হাজির হলাম। সেখানে সম্রাট তাঁর সিংহাসনে বসে ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তার মাহিষী, খাতুনে মাতা। সিংহাসনের পাদদেশে বসেছেন খাতুন ও তার ভাইয়েরা। সিংহাসনের ডান দিকে ছ’জন, বাঁ দিকে চারজন এবং পছনে চারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। সবাই তারা সশস্ত্র। আমি সম্রাটের কাছে গিয়ে তাকে অভিবাদন করবার আগেই তিনি আমাকে অভয় দেওয়ার জন্য একটু বসতে ইঙ্গিত করলেন। একটু বসে আমি তার কাছে এগিয়ে গিয়ে তাকে অভিবাদন জানাতে তিনি আমাকে বসতে বললেন, কিন্তু আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। তিনি আমাকে জেরুজালেম, পবিত্র পাহাড়, পবিত্র সমাধির গীর্জা, ঈসার দোলনা এবং বেলেহেম সম্বন্ধে নানান কথা জিজ্ঞেস করলেন। তারপরে জিজ্ঞেস করলেন, হজরত ইব্রাহিমের (Hebron) শহর, দামাস্কাস, কায়রো, ইরাক ও আনাতোলিয়ার কথা। আমি তার সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিলে সঙ্গে-সঙ্গে ইহুদী দোভাষী তা বুঝিয়ে দিলেন। তিনি আমার জবাবে সন্তুষ্ট হয়ে নিজের ছেলেদের বললেন, “এর সঙ্গে সম্মানজনক ব্যবহার করবে এবং কোনো রকম বিপদ-আপদে না পড়েন সে দিকে লক্ষ্য রাখবে।”

অতঃপর তিনি আমাকে সম্মানসূচক একটি পোষাক জীন ও লাগামসহ একটি ঘোড়া, সম্রাটের নিজের ব্যবহারের ছাতার মত একটি ছাতা উপহার দিলেন। ছাতাটি হল নিরাপত্তার চিহ্ন। আমার সঙ্গে থেকে প্রত্যহ শহরের নানা দ্রষ্টব্য জিনিষ দেখাবার জন্য একটি লোক আমার জন্য নিযুক্ত করে দিতে সম্রাটকে অনুরোধ জনালাম। তাহলে যা-কিছু সুন্দর ও অভিনব আমার চোখে পড়বে তার কথা দেশে গিয়ে বলতে পারব। আমার অনুরোধ রক্ষা করে একজন লোক নিযুক্ত করে দিলেন। তাদের দেশের রীতি হলো, কেউ যদি সম্রাটের সম্মানসূচক পোষাক ও ঘোড় উপহার পায় তবে জয়ঢাক, ঢোল, বাঁশী বাজিয়ে এমনভাবে তাকে শহর প্রদক্ষিণ করানো হয় যাতে সবাই তাকে দেখতে পায়। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এ রীতি তারা পালন করে চলে তুর্কীদের বেলা, যাতে কেউ তাদের কোন রকম অত্যাচার না করে। এভাবে আমাকে নিয়েও শহর প্রদক্ষিণ করা হল।

শহরটি বেশ বড় এবং একটি প্রকাও নদীর দ্বারা দু’ভাগে বিভক্ত। এ নদীটিতে জোয়ার ভাটা হয়। আগে এ নদীর উপর পাথরের একটি সেতু ছিল। এখন তা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নৌকার সাহায্যে পারাপার করা হয়। নদীর পূর্ব পারে শহরটির যে অংশ পড়েছে সে অংশের নাম ইস্তাম্বুল। বাদশাহ, আমীর ওমরাহ এবং অন্যান্য সবারই বাসস্থান এ অংশের অন্তর্ভুক্ত। এ শহরের বাজার ও রাস্তাঘাট বেশ প্রশস্ত এবং শান্ বাঁধানো। প্রতিটি বাজারেরই প্রবেশদ্বার আছে, রাত্রে তা বন্ধ করে রাখা হয়। বাজারের বিক্রেতা ও শ্রমশিল্পীদের বেশীর ভাগই নারী। একটি পাহাড়ের পাদদেশে এ শহর। অবস্থিত। পাহাড়টি সমুদ্রের দিকে প্রায় নয় মাইল বেড়ে গেছে। পাহাড়টির প্রস্থও তদনুরূপ তা ততোধিক হবে। পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে ছোট্ট একটি দূর্গ এবং শাহী প্রাসাদ। শহর-প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে পাহাড়টি আবেষ্টন করে। এ প্রাচীরটি এতো সুদৃঢ় যে সমুদ্রের দিক থেকে আক্রমণ করবার আশঙ্কা নেই। এ আবেষ্টনীর মধ্যে রয়েছে তেরোটি গ্রাম। এখানকার প্রধান গীর্জাটি শহরের এ অংশের মধ্যস্থলে অবস্থিত। নদীর পশ্চিম তীরস্থ শহরের অপরাংশ গালাটা নামে পরিচিত এবং ফরাসী (Frankish)। খৃষ্টানদের বাসের জন্য নির্দিষ্ট। এ অংশে তারাই বসবাস করে। ফরাসী ছাড়াও এদের ভেতর রয়েছে জেনেভা, ভেনিস ও রোমের লোকজন। কনস্টান্টিনোপলের রাজার কর্তৃত্ব। তারা মেনে চলে এবং তাদের অনুমোদনক্রমে রাজা তাদের ভেতর থেকে একজনকে কর্তৃত্বের ভার দেন। এদের কাছে সে ব্যক্তি (Comes) কোসেম্ নামে পরিচিত। তারা প্রতি বছরই রাজাকে একটা কর দিতে বাধ্য। অনেক সময় তারা বিদ্রোহও করে এবং রাজা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তখন পোপ এসে উভয় দলের ভেতর শান্তি স্থাপন করেন। তারা সবাই ব্যবসায়ী। পৃথিবীর অন্যতম প্রসিদ্ধ পোতাশ্রয়ের তারা অধিকারী। আমি সেখানে একসঙ্গে শতেক গালিও বড় জাহাজ দেখেছি। ছোট জাহাজ সেখানে এতো বেশী যে গুণে শেষ করা যায় না। শহরের এ অংশের বাজারগুলিও ভাল কিন্তু অত্যন্ত নোংরা। বাজারগুলির ভেতর দিয়ে ক্ষুদ্র একটি নদী বয়ে গেছে। সে নদীটিও অত্যন্ত নোংরা। এমন কি তাদের গীর্জাগুলিও নিম্নস্তরের এবং ময়লাযুক্ত।

প্রসিদ্ধ গীর্জাটির বাইরের বর্ণনাই আমি দিতে সক্ষম। কারণ, এ গীর্জার অভ্যন্তর দেখবার সুযোগ আমার হয়নি। তারা এ গীর্জার নাম দিয়েছে আয়া সোফিয়া (St. Sophia)। কিংবদন্তী প্রচলিত আছে, গীর্জাটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বেরেচিয়ার পুত্র আসা। বেরেচিয়া সলোমনের Cousin (জ্ঞাতি ভাই)। গ্রীসদের প্রসিদ্ধ গীর্জাগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। গীর্জাটি দেওয়াল দ্বারা এভাবে বেষ্টিত যে দেখে একটি শহর বলেই মনে হয়। এর তেরটি প্রবেশপথ আছে এবং ঘেরাও করা একটি পবিত্র স্থান আছে। স্থানটি এক মাইল লম্বা এবং একটি মাত্র প্রবেশদ্বার। কারও এ আবেষ্টনীর ভেতর প্রবেশ করতে বাধা নিষেধ নেই। বস্তুতঃ আমি প্রবেশ করেছিলাম রাজার পিতার সঙ্গে। মার্বেল পাথরে মোড়া এ স্থানটি একটি দরবার গৃহের মত। গীর্জা থেকে বেরিয়ে একটি নহর এখান দিয়ে বয়ে চলেছে। এ চত্বরের প্রবেশদ্বারের বাইরে রয়েছে বেদী ও দোকানপাট। অধিকাংশই কাঠের তৈরী। এখানে তাদের বিচারকগণ এবং দপ্তর-রক্ষকগণ বসেন। গীর্জার দরজার বাইরে বারান্দার নীচে থাকে গীর্জার তত্বাবধানকারীরা। তারা রাস্তায় ঝাট দেয়, গীর্জার আলো জ্বালে ও দরজা বন্ধ করে। সেখানে যে প্রকাণ্ড একটি কুশ রক্ষিত আছে, তার সামনে প্রণত না হলে তারা কাউকে গীর্জায় ঢুকতে দেয় না। তারা দাবী করে, কাঠের এ স্মরণ চিহ্নটির উপরে কৃত্রিম যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল৩৪। দশ হাত উপরে গীর্জার প্রবেশদ্বারের মাথায় একটি সোনলী বাক্সের মধ্যে এটি রাখা হয়েছে। একটি ক্রুশ তৈরি করার উদ্দেশ্যে আরেকটি সোনালী বাক্স রাখা হয়েছে। আড়াআড়ি ভাবে। প্রবেশদ্বারটি সোনা ও রূপার পাতে মোড়া; রিং দুটি খাঁটি সোনার তৈরী। শুনেছি এ গীর্জার পাদ্রী ও সন্যাসীদের সংখ্যা হাজার হাজার। তাদের অনেকে নাকি যীশুখৃষ্টের দ্বাদশ শিষ্যের বংশধর। এ গীর্জার ভেতরে আরও একটি গীর্জা রয়েছে শুধু স্ত্রীলোকদের জন্য। তাদের ভেতর প্রায় এক হাজার হবে কুমারী। বয়স্থা নারীর সংখ্যা আরও বেশী। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির জন্য তারা নিজেদের উৎসর্গ করেছে। রীতি অনুসারে প্রতিদিন ভোরে রাজা, তাঁর অমাত্যগণ ও অন্যান্য লোকজন এ গীর্জায় আগমন করেন। পোপ ও গীর্জায় আসেন বছরে একবার। তিনি চার দিনের রাস্তা দূরে থাকতেই রাজা তাকে অভ্যর্থনা করতে যান। তার সামনে হাজির হয়ে ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ান। গোপ যখন এসে নগরে প্রবেশ করেন তখন রাজা তার আগে নগ্নপদে যেতে থাকেন। যতদিন পোপ কনস্টান্টিনোপলে অবস্থান করেন, প্রতিদিন সকালে বিকালে রাজা এসে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

মুসলমানদের যেমন Religious house বা Conventখৃষ্টানদের তেমনি Monastery. কনস্টান্টিনোপলে এ ধরনের অনেক monastery রয়েছে। তার ভেতর রাজ জর্জ যেটি তৈরী করিয়েছেন সেটি ইস্তাম্বুলের বাইরে গাটালার উল্টা দিকে। আরও দু’টি monastery আছে প্রধান গীর্জার বাইরে, গীর্জার প্রবেশ পথের দক্ষিণে। এ monastery দু’টি তৈরী হয়েছে একটি বাগানের মধ্যে। বাগনটিকে দু’ভাগ করেছে একটি নহর। monastery–র একটি পুরুষদের জন্য অপরটি নারীদের। প্রত্যেক monastery–র ভেতরেই একটি করে গীর্জা। গীর্জার চার পাশ ঘিরে রয়েছে ছোট ছোট কুঠরী বা কামরা। ধর্মের নামে উৎসর্গ কৃত নারী পুরুষরা। সেখানে বাস করে ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করে। প্রত্যেক monastery-র বাসিন্দাদের খোরপোষের ব্যয় নির্বাহ হয় ধর্ম প্রাণ লোকদের দানে। যে রাজা monastery তৈরী করেছেন তার। সন্ন্যাসজীবন যাপনের জন্য প্রত্যেক monastery-র ভেতরেই একটি করে ছোট Convent রয়েছে। কারণ, রাজাদের মধ্যে অনেকেই ষাট সত্তর বৎসর বয়স হলে একটি nonastery তৈরী করে ছেলেদের উপর রাজ্য চালনার ভার ন্যস্ত করে বাকী জীবন Convent–এ এসে ধর্মচর্চায় কাটান। কারুকার্যখচিত মর্মর প্রস্তর দ্বারা এসব জাঁকজমকশালী monastery তৈরী করা হয়। রাজার দেওয়া একজন গ্রীক পরিচালকের সঙ্গে আমি একটি monastery-তে প্রবেশের সুযোগ পেলাম। তার ভেতরে একটি গীর্জায় দেখলাম পশমী কাপড় পরিহিত প্রায় পাঁচশ কুমারী। তাদের সবারই মুণ্ডিত মস্তক পশমী টুপীতে ঢাকা। কুমারীদের সবাই অন্ততঃ সুন্দরী কিন্তু কৃসাধনের সুস্পষ্ট ছাপ তাদের মধ্যে রয়েছে। তাদের সামনে বেদীর উপর বসে এক যুবক অতি সুললিত সুরে তাদের বাইবেল (Gospel) পড়ে শুনাচ্ছিলো। তেমন সুললিত স্বর আমি কমই শুনছি। তাকে ঘিরে আরও আটজন যুবক তাদের পুরোহিতের সংগে নিজ-নিজ বেদীর উপর বসে আছে। প্রথম যুবকের পড়া শেষ হতেই আরেকজন পড়তে আরম্ভ করে। পরিচালক গ্রীক আমাকে বললো, “এসব কুমারীরা রাজার কন্যা। গীর্জার কাজের জন্য এরা জীবন উৎসর্গ করেছে। তেমনি যুবকরাও রাজার ছেলে।” যে সব গীর্জায় মন্ত্রী, শাসনকর্তা এবং প্রসিদ্ধ অপরাপর ব্যক্তিদের কন্যারা রয়েছে আমি সে সব গীর্জায়ও তার সংগে প্রবেশ করেছি। এছাড়া সেখানে বয়স্থা নারীরা এবং সন্ন্যাসীরাও রয়েছে। প্রত্যেক গীর্জায় প্রায় শতেক লোক বাস করে। শহরের অধিকাংশ বাসিন্দাই সন্ন্যাসী, কাঠোর সংযমী তাপস অথবা পুরোহিত।৩৫ সৈনিক থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক অবধি এ শহরের ছোট বড় সবাই শীত ও গ্রীষ্মে মাথায় প্রকাণ্ড ছাতা ব্যবহার করে। মেয়েরা ব্যবহার করে প্রকাণ্ড পাগড়ী। একদিন আমার গ্রীক পরিচালকের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে বের হয়ে ভূতপূর্ব রাজা জর্জের দেখা পেলাম পথে। তিনিও এখন সন্ন্যাভ্রত পালন করেছেন। পশমী বস্ত্র পরিহিত মাথায় পশমী টুপি দিয়ে পায়ে হেঁটে তিনি যাচ্ছিলেন। লম্বা সাদা দাড়ি র মুখে। দেখলেই কঠোর সংযমী বলে চেনা যায়। তার সামনে ও পেছনে রয়েছে একদল ন্ন্যাসী। তার হাতে একটি যষ্ঠী, গলায় তসবী। তাকে দেখেই ঘোড়া থেকে নেমে গ্রীক আমাকে বলল, “নেমে পড়ন, ইনি আমাদের রাজার পিতা। পরিচালক তাকে অভিবাদন করার পরে তিনি তাকে আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। তারপর একটু থেমে আমাকে কাছে ডাকলেন। তিনি আমার হাত ধরে আরবী জানা সেই গ্রীক পরিচালককে বললেন, “এই মুসলিমকে বুঝিয়ে বলল, যে হাত জেরুজালেমে প্রবেশ করেছে এবং যে পদদ্বয় Dome of the Rock এবং Holy sepulchreও বেথেলহামের পবিত্র গীর্জায় প্রবেশ করেছে আমি তাই ধারণা করছি।” এই বলে তিনি আমার পা ছুঁয়ে হাত বুলালেন নিজের মুখে। বিধর্মী হয়েও এসব পুণ্যস্থান যারা দর্শন করেন তাঁদের প্রতি এদের অগাধ ভক্তি দেখে আমি বিস্মিত হলাম। তিনি আবার আমার হাত ধরে এক সঙ্গে চলতে লাগলেন। চলতে চলতে বহুক্ষণ অবধি অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন- জেরুজালেম এবং সেখানকার খৃষ্টানদের সম্বন্ধে। গীর্জায় ঘেরাও করা যে পবিত্রস্থানের বর্ণনা আমি উপরে দিয়েছি সেখানেও আমি তার সঙ্গে প্রবেশ করেছি। তিনি যখন প্রধান প্রবেশদ্বারের দিকে যাচ্ছিলেন তখন একদল পুরোহিত ও সন্ন্যাসী এগিয়ে এলে তাকে অভিবাদন করতে, কারণ অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। তাদের অগ্রসর হতে দেখে তিনি আমার হাত ছেড়ে দিলেন। আমি তখন তাকে বললাম, “আমারও ইচ্ছে হয় আপনার সঙ্গে গীর্জার ভেতরে ঢুকতে।” তখন তিনি দোভাষীর। দিকে ফিরে বললেন,”যে এ গীর্জায় ঢুকতে চাইবে তাকে প্রথম ঐ বিখ্যাত ক্রুশের সামনে সেজদা করতে হবে। এ রীতি আমাদের পূর্বপুরুষের সময় থেকে প্রচলিত রয়েছে। এবং তা রদ করবার উপায় নেই। কাজেই আমাকে ফিরে আসতে হলো। তিনি একাই গিয়ে গীর্জায় ঢুকলেন। এরপর তার আর দেখা পাইনি। রাজাকে ছেড়ে আমরা এসে বাজারে দালাল লোকদের কাছে এলাম। সেখানে Judge আমাকে দেখতে পেয়ে তার। একজন সহকারীকে পাঠালেন পরিচালকের কাছে আমার পরিচয় জানতে। আমি একজন মুসলিম পণ্ডিত শুনে তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি সুদর্শন একজন বৃদ্ধি ব্যক্তি, তাঁর পরিধানে সন্ন্যাসীর কাল পোক। জন দশেক লোক তার সামনে বসে লিখছে। আমাকে দেখে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর সঙ্গীরাও উঠল। তিনি বললেন “আপনি আমাদের রাজার মেহমান, সিরিয়া ও মিশরের অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন। বহুক্ষণ অবধি আমরা কথাবার্তা বললাম। অনেক লোক এসে জড়ো হলো তার চারপাশে। তিনি বললেন, “একদিন আমার বাড়িতে নিশ্চয়ই আসবেন যাতে আপনার মেহমানদারী করবার সুযোগ পাই।” বিদায় নিয়ে আমি চলে এলাম। তারপরে আর তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি।

খাতুনের সঙ্গী তুর্কীরা বুঝতে পারলো, খাতুন তার পিতার ধর্মে বিশ্বাসী এবং পিতার সঙ্গেই তিনি থাকতে চান। তখন তারা স্বদেশে ফিরে যাবার অনুমতি চাইলো। তিনি তাদের মূল্যবান উপহার সামগ্রী দিয়ে বিদায় দিলেন। তাছাড়া পাঁচশ ঘোড়াসওয়ারসহ সারুজা নামক একজন আমীরকে সঙ্গে দিলেন তাদের দেশে পৌঁছে দিতে। তিনি আমাকেও ডেকে পাঠালেন। আমাকে দিলেন বারবারা নামক তাদের দেশে। প্রচলিত তিন’শ স্বর্ণমুদ্রা। মুদ্রা হিসাবে বারবার ৩৬ ভাল নয়। আর দিলেন এক হাজার ভেনিসের রৌপ্যমুদ্রা, সে সঙ্গে বস্ত্র ও পোষাক পরিচ্ছদ এবং তার পিতার দেওয়া দুটি ঘোড়া। তার পর আমাকে সারুজার হাওলা করে দিলেন। তাদের শহরে একমাস ছ’ দিন কাটিয়ে বিদায় নিয়ে এলাম। সীমান্ত পৌঁছে আমাদের সঙ্গীদের এবং মালপত্রসহ গাড়ী নিয়ে মরুভূমির পথে ফিরে এলাম। বাবা সালটাক অবধি সাজা আমাদের সঙ্গে এলেন। তারপর তিনদিন সেখানে মেহমান থেকে দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।

তখন ছিল শীতকাল। আমি পশম-দেওয়া তিনটি কোট গায়ে ব্যবহার করি। সে সঙ্গে দুটি পাজামা, তার একটিতে আস্তর লাগানো। পায়ে প্রথমে উলের মোজা তার উপর আস্তর লাগানো সূতী মোজা, তার উপর ভল্লুকের পশম-লাগানো ঘোড়র চামড়ার জুতা। আগুনের কাছে বসে গরম পানি দিয়ে আমি ওজু করি। কিন্তু প্রত্যেক ফোঁটা পানি সঙ্গে-সঙ্গে জমে বরফ হয়ে যায়। যখন মুখ ধুই তখন দাড়ী বেয়ে পানি পড়েই জমে যায়। বরফ হয়ে। সে শুলো ঝেড়ে ফেলে তুষারের মতো ছড়িয়ে পড়ে। নাক বেয়ে পানি পড়ে গোঁফের উপর এসেই জমে যায়। গায়ে যে-সব কাপড়-চোপড়ের বহর চাপিয়ে ছিলাম তা নিয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠতে আমার অসুবিধা হচ্ছিলো। সঙ্গীরা তখন ধরে আমাকে জিনের উপর চাপিয়ে দিলো।

আমরা সুলতান উজবেগকে হতারখানে (আস্ত্রাখান) রেখে এসেছিলাম। ফিরে গিয়ে দেখলাম তিনি তার রাজধানীতে চলে গেছেন। আমরা ইটিল (ভগা) নদী ও আশেপাশের জলাশয়ে ভ্রমণ করলাম। সে-সবই জমে তখন বরফ হয়ে গেছে। রান্না খাওয়ার জন্যে পানির দরকার হলেই আমরা বরফ ভেঙ্গে একটি পাতে টুকরা রেখে দিতাম। তাই গলে পানি হতো। এমনি করে চলে চতুর্থ দিনে আমরা সুলতানের রাজধানী৩৭ সারা গিয়ে পৌঁছলাম। তাঁর সঙ্গে দেখা করে আমাদের সফরের কথা, গ্রীকদের রাজার কথা এবং তাদের শহরের কথা সুলতানকে বললাম। সব শুনে সুলতান আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হুকুম দিলেন। চমৎকার বাজার ও প্রশস্ত রাস্তাঘাটযুক্ত সারা একটি সুন্দর ও বড় শহর। একদিন আমরা স্থানীয় একজন প্রসিদ্ধ লোকের সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে শহরটি কতো বড় তাই জরিপ করতে বের হলাম। শহরের একপাশে আমরা বাস করতাম। একদিন ভোরে বেরিয়ে শহরের অপর পাশ অবধি পৌঁছতে অপরাহ্ন হয়ে গেলো। আরেক দিন হেঁটে বের হলাম শহর কতটা চওড়া তাই দেখতে। যাওয়া এবং আসায় আধা দিন লেগে গেলো তাও গেলাম দু’পাশে শুধু বাড়ি দেখে, সেখানে কোনো ভগ্নাবশেষ বা বাগান চোখে পড়লো না। এখানে তেরোটি গীর্জা এবং অনেকগুলো মসজিদ আছে। এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে রয়েছে নানা জাতীয় লোক। তাদের মধ্যে মঙ্গলরাই দেশের শাসনকর্তা। তারা অংশতঃ মুসলিম। আর রয়েছে মুলিম আস্ (Ossetes) এবং কিপচা সারকাসিয়ানস (Circassians) রুশ ও গ্রীক। এদের সবাই খ্রীষ্টান। প্রত্যেক দলেরই পৃথক মহল্লা, পৃথক বাজার। ইরাক, মিশর ও সিরিয়ার সওদাগর ও বিদেশী লোকেরা নিজ নিজ ধনসম্পত্তি রক্ষার সুবিধার জন্যে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা একটি মহল্লায় বাস করে।

টিকা

পরিচ্ছেদ ৪

১। বিলাদ আর্‌-রুম প্রকৃতপক্ষে “গ্রীদের দেশ” যদিও সাধারণতঃ ব্যবহৃত হয় বাইজান্টাইন প্রদেশ সম্বন্ধে-স্বভাবতঃই এটাকে প্রয়োগ করা হয়েছিল বিশেষভাবে আনাতোলিয়ার সীমান্ত প্রদেশ সম্পর্কে। প্রথম শতাব্দগুলির দিকে কতকগুলি অস্থায়ী অধিকারের পরে এ দেশটি শেষবার অধ্যুষিত হয়েছিল ১০৭১ এবং ১০৮১-এর মাঝামাঝি সাজুক তুর্কিদের দ্বারা। তেরো শতাব্দীর শেষ দিকে খ্ৰীষ্টানদের (বাইজেটিয়ার, ত্রেবিজণ্ড এবং আর্মেনিয়া) অধিকৃত কিম্বা ইরানের শাসকদের অধিকৃত কতগুলি জায়গা ছাড়া সমস্ত পেনিনসোলাটি কোনিয়ার সাজুক সুলতানের পক্ষ নিয়েছিল। কিন্তু তেরো শতাব্দীর কিছু পূর্ব থেকে স্থানীয় প্রধানদের মধ্যে দেশটি ভাগ হয়ে গিয়েছিল। এদের প্রদেশগুলি ক্রমে অটোম্যান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়ছিল।

২। আলেয়া বন্দর নির্মাণ করেছিলেন রোমের শ্রেষ্ঠতম সালজুক সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ ১ম (১২১৯-৩৭), এবং তার নামানুসারে স্থানটির নাম দেওয়া হয় পশ্চিমী সওদাগরদের নিকট আরোস থেকে)। মিশরে কাঠের অভাব হেতু সেখানে বৃহৎ পরিমাণ কাঠ। আমদানী করা হতো তার নৌ-বহর ইত্যাদি নির্মাণের কাজে।

৩। আদোলিয়া’ পশ্চিমী সওদাগরদের নিকট স্যাটালিয়া বলে পরিচিত। আনাতোলিয়ার দক্ষিণ সমুদ্র-উপকুলে এটা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ঘাঁটি। এখানে মিশরীয় এবং সাইপ্রিয়ট বাণিজ্য বেশ প্রবল ছিল। লেবুকে মিশরে এখনো আদালিয়া বলা হয়।

৪। রাতের বেলা এবং শুক্রবারের নামাজের সময় নগরের গেটগুলি বন্ধ করে দেওয়ার এবং খ্রীষ্টানদের বাইরে রাখার নিয়ম আধুনিক কাল পর্যন্ত ও ভূমধ্যসাগরীয় বহু স্থানে প্রচলিত ছিল; যেমন সাফাক্সে। সম্ভবতঃ এরূপ করা হতো অকস্মাৎ আক্রমণের আশঙ্কায়।

৫। ফুতুয়া’ নামীয় প্রতিষ্ঠানগুলির ইতিহাস এখনো প্রচ্ছন্ন রয়েছে। বিন্নি আকারে এদের প্রথম দেখতে পাওয়া যায় বারো শতাব্দীতে-এর উৎপত্তি বলা যেতে পারে সূফী কি দরবেশ সম্প্রদায়। ফুতুয়া”পৌরুষেয় শব্দটি বহুকাল ধরে প্রয়োগ করা হয়েছে দরবেশদের ব্যাপারে। এর নৈতিক অর্থ হচ্ছে ক্ষতি থেকে নিরস্ত থাকা-বিনা দ্বিধায় দান করা এবং কোনো অভিযোগ না করা। আর সূফীর নিদর্শন তালীযুক্ত জামাকে তারা লেবাস আল-ফুতুয়া পৌরুষেয় পোশাক। এটা খুব কড়াভাবে প্রয়োজিত করা হতো “ধর্মযোদ্ধা” দলের ব্যাপারে। বিশেষ করে এ “ধর্মযোদ্ধাগণ যখন অধপতিত হয়ে পড়েন, নিদর্শন দ্বারা এবং হজরত আলী থেকে এবং উৎপত্তির দাবীর দ্বারা সেটা সম্ভবতঃ সেই দলের নির্দশন যেটা কল্পণাপ্রবণ খলিফার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আনাতোলিয়ার অবশিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলি মনে হয় স্থানীয় ব্যবসায়ী দল। এতে ছিল সূফিবাদের খুব একটি প্রবল সংমিশ্রণ। আর এতে ছিল স্থানীয় স্ব-শাসনের এবং তুর্কি সুলতানদের অত্যাচার প্রতিরোধের একটি প্রবণতা (সাধারণভাবে বর্ণিং, তুর্কি বিরলিওথেক, ব্যাও ১৬, বার্লিন ১৯২৩)। এবং ওয়াসিফ বাওট্রস মালী ল্য ট্রেডিশন শেভালেরেস্ কদা আরাবিস্ (প্যারিস্ ১৯৯১ সন পৃঃ ১-৩৩)।

৬। এ অংশটির মানে হচ্ছে এই যে এসারদিরগু এবং কিরিলি-গুল পাড়ী দিয়ে নৌকা যোগে (বেশাহরের হ্রদ, এটা এগারদিরগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বলে ইনে বতুতা মনে করেন) আকশাহর এবং বেশাহর-এ পৌঁছানো যায় দু দিনে। ডেফ্রিসেরি মনে করেন যে এই আকাশাহর আশাহর নয়, এটা হচ্ছে আওশার শহর বা আশার এগারদিরগুলোর নিকটবর্তী।

৭। ডেফ্রিমেরির মতে গুল-হিসার ছিল একটি ক্ষুদ্র দূর্গ। পরে এটা ধ্বংস করা হয়। বুলছুর হ্রদের প্রাণে এটা অবস্থিত ছিল। অন্যদিকে লা ষ্ট্রেজ এর অবস্থান স্থল নির্দিষ্ট করেছেন ইষ্টনোজের পশ্চিমে সগু-গুলের ধারে।

৮। উপরে উল্লেখিত ৫ টীকা দ্রষ্টব্য

৯। এটা হচ্ছে সুপরিচিত মেলেডি ভ্রাতৃত্ব বা “নৃত্যপর দরবেশের দল”। এটা সংস্থাপন। করেছিলেন জালালউদ্দীন তার গুরু শাসি তাবুরিজের (ইব্‌নে বতুতার গল্পের মিষ্টি বিক্রেতা) স্মৃতির উদ্দেশ্যে। জালালউদ্দীনের মৃত্যু হয় ১২২৩ খ্রীষ্টাব্দে কোনিয়াতে। সাধারণতঃ তাকে ডাকাত দলে তখন এদের বেলায়ও এটা ব্যবহার করা হয়েছে। বারো শতাব্দীর মাঝামাঝি বাগদাদের এমনি একটি ডাকাত দলে ভর্তি হওয়ার অনুষ্ঠানে পায়জামার উল্লেখ করা হয়েছে। “লেবাসে আল ফুতুয়া” বলে (ইব্‌নে আখির ১১,৪১)। কিছু বছর পরে দামাস্কাসে ইব্‌নে জুবেইর নুবুইয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এ প্রতিষ্ঠানটি সিরিয়ার শিয়া সম্প্রদায়ের গোড়ামীর বিরুদ্ধে সগ্রাম করেছে। এই যোদ্ধাদলের নিয়ম ছিল যে, এর কোনো সদস্য যে কোনো প্রকার বিপদেই পতিত হোক না কেন তিনি কারো সাহায্যে নেবেন না। দলের মধ্যে উপযুক্ত লোক নেওয়া হতো এবং ভর্তি হওয়ার সময় দেওয়া হতো পায়জামা।

১১৮২ সালে একজন সূফি শেখ খলিফা আল নাসিরকে লেবাস বা পয়েতবম প্রদান করেন। সাহসী বীর ব্যক্তিদের একটি দল গঠনের ব্যাপারে তিনি ফুতুয়া সংগঠন করার ধারণা গ্রহণ করেন। (সম্ভবতঃ ফ্রাঙ্কিস আদর্শের উপরে)। তিনি নিজেকে স্থাপন করেন এ দলের প্রধান নায়ক এবং তার সময়ের শাসনকারী নরপতি এবং অন্য সব ব্যক্তিদের লেবাস প্রদান করতো দলের নির্দশন রূপে। এর সংস্থাপন অনুষ্ঠানে এই পবিত্র পায়জামা পরা হতো এবং “পৌরুষ পান পাত্রে” করা হতো “কাস্ আল-ফুতুয়া-এতে কোনো শারাব থাকতো না-থাকতো নিমক মিশানো পানি। এ দলটি তার সূফি পূর্ববর্তীদের কাল্পনিক বংশধারা গ্রহণ করেছিলেন যার প্রথম পুরুষ হিসেবে ধরা হয় খলিফা হজরত আলীকে (২ পরিচ্ছেদ ৪ টীকা দ্রষ্টব্য) এবং নাসিরের রাজত্বের কিছুকাল পর পর্যন্ত তারা টিকে থাকেন একটি অবসন্নকর অবস্থাতে। (কানিয়োতে ইব্‌নে বতুতা যে ভ্রাতৃসংঘ দেখেছিলেন যেটা আনাতোলিয়ার অন্য দল থেকে পৃথক করে দেখা। হয়েছে তার পায়জামার বিশেষ পার্শিয়ান সরজী কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবি বলা হয়। (আর, এ নিকলসন সঙ্কলিত “সিলেটেড পোয়েস্ অব ফ্রম্ দিওয়ানই শামসি তাবরিজের ভূমিকা দ্রষ্টব্য)।

১০। বিরগী হচ্ছে পুরাকাহিনী পিজিয়ন। এটা কেষ্টার উপত্যকার অন্তর্গত। এখানে ইব্‌নে বতুতার বর্ণনার একটি সুস্পষ্ট ফাঁক রয়েছে। কতকগুলি শহর–পরিদর্শন ব্যতীত তিনি রচিত সমগ্র আনাতোলিয়া অতিক্রম করতে পেরেছেন–এমন কি যদি তিনি মধ্য মালভূমির ভিতর দিয়ে সিভাস থেকে সোজা পথ ধরেও চলতেন। খুব সম্ভব তিনি তার গতিপথ গ্রহণ করেন কিছু কোনিয়ার দিকে এবং সেখান থেকে এগারাদর ভিতর দিয়ে।

১১। এখানে ১৩৪৪ খ্রীষ্টাব্দে স্বার্ণা দখলের উল্লেখ করা হয়েছে (ইব্‌নে বতুতার পর্যটনের অনেক বছর পরে)। স্মার্ণা দখল করে ছিলেন ক্রুসেড সৈন্যগণ নাইটস্ অব্ সেন্ট জনের সাহায্যে।

১২। ফুজা (ফুগিয়া, পুরাকালীন ফুগিয়া) স্থানটি প্যালায় ব্রজিগণ জাকারিয়ার জিনোইজ পরিবারকে ছেড়ে দিয়েছিল। এটা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ঘাঁটি। সেখানকার য়্যালুমিলস্ এবং কিয়োজের মাষ্টিক ব্যবসাতে জাকারিয়া পরিবারের পূর্ণ অধিকার কায়েস ছিল (এটা তারা দখল করেছিল ১৩০৪ খ্রীষ্টাব্দে)। এ সময়ের ফুজা পুরানো ফোসিয়া (এসৃকি ফুজা) ছিল কিম্বা নতুন ফোসিয়া (ইয়েনি ফোজা) ছিল সেটা সম্পূর্ণ নিশ্চিত নয়।

১৩। অটোম্যান সাম্রাজ্যের যে সব বিবরণ আমরা পেয়েছি তন্মধ্যে ইনে বতুতার বিবরণ হচ্ছে প্রথম শ্রেণীর। ১৩২৬ খ্রীষ্টাব্দে ক্ৰসা তুর্কিদের হাতে সমর্পিত হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা ছিল হজরত ওসমানের মৃত্যুর বহুর-এবং নাইসিয়ার পতন ঘটে ১৩২৯ খ্রষ্টাব্দে। কিন্তু উভয় নগরের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয় আরো অনেক আগে (এইচ, এ, গিবসের ফাউন্ডেশন অব দি অটোম্যান এম্পায়ার, ৪৬-৮ দ্রষ্টব্য)। ওসমানকে ওসমান চুক নাম দেওয়া হয়েছে এ সম্বন্ধে প্রফেসর ক্রেমার্স বলেছেন যে এটা আরবী নাম ওসমান থেকে আসেনি–এসেছে কিজিল আরমাক তীরে অবস্থিত ওসমানজি দূর্গের নাম থেকে (জে ডি, এস, জি, ৮১, LXI f.)।

১৪। মূল গ্রন্থে যে বাক্যটি নেওয়া হয়েছে, যেমন আমরা তার প্রতি সদয় ব্যবহার করেছি” এর স্থানে আমি শ্রেষ্ঠ পাণ্ডুলিপির এ লেখাটি পছন্দ করি।

১৫। ডেফ্রিমেরী বালুকে কাষ্টামুনির দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বয়ালুর সঙ্গে একত্র করছেন।

১৬। অধিক সাধারণভাবে বলা হয় সলঘট, এখন ক্রিমিয়ার অভ্যন্তরে ষ্টারিক্রিম। এ সময়ে এটা ছিল ক্রিমিয়ার মোঙ্গল শাসনকর্তার আবাসস্থান। এর পরে এটা হয়েছিল স্বাধীন বানাতের বাসস্থান।

১৭। কিপচাকের কিম্বা গোল্ডেন হোর্ডের খানাত ছিল চারটি প্রধান খানাতের সর্ব পশ্চিমে অবস্থিত। স্থাপিত হয়েছিল তেরো শতাব্দীতে-এবং এ সময়ে এটা ভাগ হয়েছিল র হোর্ড এবং হোয়াইট হোর্ড নাম দুই ভাগে। যদিও পরবর্তী ব্লু হোর্ড প্রকৃতপক্ষে অধিক শক্তিশালী ছিল এবং এদের অধিকার বিস্তৃত ছিল কি এবং ককেশাস থেকে আরাল সমুদ্র খিতা পর্যন্ত। সুলতান মোহাম্মদ উজবেগ যিনি ১৩১২ থেকে ১৩৪০ পর্যন্ত রাজত্ব করেছেন তিনি ছিলেন বু হোর্ডের খানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।

১৮। কাফা এখন ফিও ডোসিয়া নামে পরিচিত। তেরো শতাব্দীর শেষ দিকে জিওনিগণ কৃষ্ণ সাগরের উত্তর তীরবর্তী প্রধান বাণিজ্য ঘাঁটি রূপে পুননির্মাণ করেছিল।

১৯। মুসলিমগণ ঘণ্টাধ্বনিকে মহাপাপ কার্য বলে ঘৃণা করেন। এবং এ কথা পয়গম্বরের উপদেশ বলে মনে করেন যেঃ “যে গৃহে ঘন্টা বাজে সেথানে ফিশতাগণ প্রবেশ করেন না।”

২০। এটাকে আমি গ্রহণ করছি মিয়া নদীর মোহনা বলে। এটা ত্যাগানরগের পশ্চিমে। ২১। ধর্মীয় খয়রাত্ বা জাকাত হচ্ছে শতকরা আড়াই টাকা।

২২। মাজারের ধ্বংসাবশেষ (এখন বার্গোমাজ ডারি) কুমা নদীর তীরে অবস্থিত, আখানের দক্ষিণ-পশ্চিমে, জার্জওয়াস্কের ১১০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে ৪৪.৫০ উত্তরে, ৪৪.২৭ পূর্বে।

২৩। বেশতো হচ্ছে ককেশাশের অন্যতম পাদ-পবর্ত। এটা একটি অরণ্যময় পর্বত, ১৪০০ মিটার উঁচু পিয়াতিগরকের ঠিক উত্তরে, জর্জিয়কির প্রায় ৩৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে।

২৪। বাইজেন্টাইন ঐতিহাসিকদের বিবরণে তৃতীয় এড্রোনিকাসের (১৩৩১ সালে এর বয়েস ছিল পঁয়ত্রিশ বছর) মেয়েকে গোল্ডেন হোর্ডের একজন খানের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার ঘটনার কোন উল্লেখ নেই। তবে এর পূর্বের অন্ততঃ দুটি দৃষ্টান্ত রয়েছে। সন্তানের অবৈধ কন্যাদেরকে তারত্তার প্রধানদের কাছে বিয়ে দেওয়া হতো।

২৫। বুলঘারের ধ্বংসাবশেষ অবস্থিত রয়েছে ভলগা নদীর বাস তীরে কামা জংশনের ঠিক নিম্নে। এটা ছিল মধ্যযুগের গ্রেট বুলগেরিয়া রাজ্যের রাজধানী। তেরো শতাব্দীতে মোঙ্গলগণ এটা নিজেদের অধিকারে সংযোজিত করে নেয়। রাশিয়ান এবং সাইবেরিয়ান উৎপন্ন দ্রব্য নিয়ন্ত্রণের জন্য এ স্থানটির যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। এ কথা বুঝা খুব শক্ত যে মাজার থেকে বুগার। পর্যন্ত ইব্‌নে বতুতা কি করে দশদিন সময়ে পর্যটন করেছিলেন-কারণ এ দুটি স্থানের মাঝখানের পথ ৮০০ শত মাইল।

২৬। এ শব্দটি উত্তর সাইবেরিয়া সম্বন্ধে ব্যবহৃত হয়। ইউসের মার্কোপলোর ২য় খণ্ড, ৪৮৪-৬ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।

২৭। ইউসের মার্কোপলোর (২ খণ্ড, ৪৮৮) একটি টীকায় বলা হয়েছে যে মধ্যযুগীয় লেখকগণ যে প্রসিদ্ধ শহরের নামটি বারংবার উল্লেখ করেছেন সেটা এই ইউকাক শহর নয়। এটা ভগার তীরে সারাটোভের ছয় মাইল নিয়ে অবস্থিত ছিল। কিন্তু এটা লোকাচি কিম্বা লোেকাক রূপে উল্লেখিত আজব সমুদ্র তীরে একটি ক্ষুদ্র স্থান। এখানকার রূপার খনি সম্বন্ধে ইব্‌নে বতুতা বলেছেনঃ “মিয়াস নদীর নিকটে বিশেষ নকল রূপার খনি (আজব সমুদ্রে পতিত একটি নদী। এটা টেগানরগের ২২ মাইল পশ্চিমে)….এই খনি থেকে তোলা রূপায় রাশিয়ার রুব প্রস্তুত হতো।

২৮। ক্রিমিয়ার অন্তর্গত সুরদা সুরদা বা সুলদায়া, এখন সুদাক। এ স্থানটি কাফার (টীকা ১৮ দ্রষ্টব্য) অভ্যুত্থান কাল পর্যন্ত ইউসিনের উত্তর উপকুলের প্রধান বাণিজ্য বন্দর ছিল। দলটি “কেন যে ক্রিমিয়ার ভিতর দিয়ে ঘুর পথে গিয়েছিল সেটা পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে না। খুব সম্ভব ইব্‌নে বতুতা তার পথের বিবরণে গোলমাল করে ফেলেছেন এবং স্ট্যারি ক্রিমে অবস্থানকালে সুরদাকে গিয়েছিলেন।

২৯। মন্দিরটির অবস্থান স্থলের কোনো সুনির্দিষ্ট আভাস নেই। ইব্‌নে বতুতার বর্ণনা অনুসারে স্থানটি ছিল নিপার এবং ক্রিমিয়ার মাঝখানে কোনো এক জায়গায়। বলা হয়েছে এই বাবা সালতুক (১৩৮৯ সালে মার্জিয়ার অন্তর্গত বাবা দাঘে নির্বাসিত হয়েছিলেন) থেকে সারি সাতিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল। বেশী সম্প্রদায়ের সঙ্গে এর সংযোগ ছিল (এফ, ডরিও, হ্যাঁলাকের Ann. Brit. Sch. Athens XIX, ২০৩-৬; XX, ১০৭, টীকা ১ দ্রষ্টব্য)।

৩০। প্রেসের ভিতর দিয়ে কনস্টান্টিনেপলের যে পথের বিবরণ ইব্‌নে বতুতা দিয়েছেন সেটা তার বর্ণনায় একেবারেই বুঝা যায় না।

এখানে, যেমন চীনের ব্যাপারে নামগুলির অপরিচিতি আশ্চর্য রকম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে বিশেষ করে কুড়ি বছর কালের পরে যখন স্মৃতি থেকে তাদেরকে বের করা হয়েছে। ১৩৩১-৩২ খ্রীষ্টাব্দে সাম্রাজ্যের সীমান্ত শহর (এ নামটি ইব্‌নে বতুতার ইতিহাস অপেক্ষা তার এই ভ্রমণই প্রযুক্ত হওয়া উচিত) ছিল দিয়ামপোলিস, অন্যথায় ক্যাভুলি (এখন জ্যাবুলি)। এর স্থানে হয়তো “মাতুলি” বসতে পারে। “খোলটি” মনে হচ্ছে নদী কিম্বা মোহনা। লোকে স্বভাবতঃই মনে করতে পারে এটা দানিউব-যদিও এটাকে ভুলভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে।

ফ্যানিকা হচ্ছে সম্ভবতঃ আগাথনিকা যেখানে দিয়ামপোলিস্ থেকে প্রধান রাস্তা তুজা (তজস) নদী অতিক্রম করেছে কিজিল আগাচরে বা এর নিকটে। মাসলামা ইব্‌নে আবদুল মানিকের দূর্গ ৭১৬-৭ খ্রীষ্টাব্দে কনষ্টান্টিনেপলের বিরুদ্ধে আরব অভিযানের ইতিহাসের গল্পীয় পরিবৃদ্ধির অন্তর্গত। এ অভিযানের প্রধান অধিনায়ক ছিলেন মালামা।

৩১। কিফালি হচ্ছে গ্রীক কিফে শব্দের অক্ষরান্তরিত শব্দ। এর অর্থ, উপরওয়ালা প্রধান।

৩২। এ সময়ে সম্রাট ছিলেন এড্রোনিকাস, তৃতীয়; দ্বিতীয় এড্রোনিকাসের পৌত্র। তাফুর পদবী (আর্মেনিয়ান তাগাডর=রাজ) মুসলিম লেখকগণ ম্রাটের প্রতি এবং এশিয়ামাইনরের অন্য খ্রীষ্টান রাজাদের প্রতি প্রয়োগ করতেন, সম্ভবতঃ চীন সম্রাটের প্রতি প্রদত্ত পদবীর কাব্যময় সুর ফাগফুর (বাঘপুরের স্থানে, চীনে পদবীর পার্শিয়ান অনুবাদ “স্বর্গের পুত্র”) পদবী রূপে। এ কথার ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন যে ইব্‌নে বতুতা কেমন করে ম্রাট দ্বিতীয় এন্তোনিকাসকে (ইনি ১৩২৮ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসন ত্যাগ করেন, সন্নাসী হন,এবং তার মৃত্যু হয় ১৩ই ফেব্রুয়ারি ১৩৩২ খ্রীষ্টাব্দে)জর্জ নামে অভিহিত করেছেন।

৩৩। এখানে যে অনুষ্ঠানে কথা বিবৃত করা হয়েছে সেটার মিল রয়েছে বাইজেন্টাইন দরবারের আনুষ্ঠানিক আচারের সঙ্গে। কনষ্টান্টিনেপল দখলের পরে অটোম্যান সুলতাগণ এটা গ্রহণ করেছিলেন।

৩৪। মুসলিমগণের বিশ্বাস যে যিশুকে শূলে হত্যা করা হয়নি। তাকে স্বর্গলোকে তুলে নেওয়া হয় এবং তার পরিবর্তে তারি অনুরূপ এক ব্যক্তিকে শূলে বিদ্ধ করা হয়।

৩৫। কনষ্টান্টিনেপলের সন্ন্যাসী এবং গীর্জার সংখ্যা মনে হয় এ সময়ে অধিকাংশ পর্যটকের বিষয় উৎপাদন করেছিল। বারট্রা দা লা ব্লোকুইয়ার সেখানে ১৪৩২-৩ সালের শীওক কাটিয়েছিলেন। তার হিসেবে সেখানে গির্জার সংখ্যা ছিল ৩,০০০ এবং তিনি বলেছেন, অধিকাংশ অধিবাসী আশ্রমে বাস করতেন। ক্লাভিজো, ৮৮ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।

৩৬। বারবার হচ্ছে হাইপারপাইরণের প্রতিবেশী। প্যালোনসের দিনারের খাদমিশ্রণ।

৩৭। তারপর দেশের সুরে অঞ্চলে দুটি শহর ছিল। এ দুটিই পর্যায়ক্রমে গোল্ডেন হোর্ডের খানদের রাজধানী ছিল। পুরানো সারাই অবস্থিত ছিল আধুনিক সেলিট্রেগ্রামের নিকটে, আখানে ৭৪ মাইল উপরে–আর নতুন সারাই যা আধুনিক পাবে, শহরে মিলিত সেটা ছিল আখানের ২২৫মাইল উপরে। সুলতান মুহম্মদ উজবে পুরানো সারাই থেকে এ সময় রাজধানী স্থানান্তরিত করেন নতুন সারাইয়ে-সম্ভবতঃ কিছু বছর পূর্বে। ইব্‌নে বতুতার বিবরণ নতুন সারাইয়ের সঙ্গে বেশ মিলে যায়। এর ধ্বংসাবশেষ চল্লিশ মাইলের উপর স্থান ব্যাপী। ছড়িয়ে আছে। এবং কুড়ি স্কোয়ার মাইল স্থানে ইহা ব্যাপ্ত। (এ, বেলোডিজের, ইন্ ল্যাটভিজাস্ ইউনিভারসিটেটিস্ রাস্তি আক টা ইউনিভারসিটেটিস ল্যাভিয়েনসিজ,১৩খণ্ড (রিগা, ১৯২৬, ৩-৮২পৃঃ)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *