৬. সিআইডি অফিসে

সিআইডি অফিসে থমথমে একটা বুক ভার করা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। সকলেই কাজ করে চলেছে। কিন্তু সবটাই যেন যান্ত্রিক। সবসময়ই একটা ভীষণ আশঙ্কা গ্রাস করতে আসছে। কারোর মোবাইল বা ল্যান্ডলাইন বেজে উঠলেই গোটা অফিস সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছে। কী জানি কী খবর আসে! এমনকী স্বয়ং এডিজি শিশির সেনও অস্থির! কারণ তাঁর সেরা অফিসারটি হসপিটালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে শুয়ে আছে। কাল যেতে পারেননি। আজ বিকেলে হয়তো যাবেন। ইতোমধ্যে যে কতবার অর্ণবকে ফোন করেছেন তার হিসাব নেই। একটাই প্রশ্ন তাঁর–কোনো খবর আছে?

এখনও পর্যন্ত কোনো খবর নেই। একটাই আশার কথা যে বুলেটটা হার্টে লাগেনি। তাহলে আর কিছু করার থাকত না ডাক্তারদের। ডাক্তাররা বুলেটটাকে বের করতে পেরেছেন। আপাতত সেটা ফরেনসিকের জিম্মায় চলে গিয়েছে। ব্যালিস্টিক রিপোর্টের অপেক্ষায় আছে।

কাল রাতে যখন কথা বলতে বলতেই থেমে গিয়েছিল অধিরাজ তখনই প্রমাদ গুনেছিল অর্ণব! ফায়ারিংয়ের শব্দ অবশ্য শোনা সম্ভব ছিল না। শুধু শুনেছিল মেয়ে গলার ক্রুদ্ধ চিৎকার। আর পরিষ্কার শুনতে পেয়েছিল রিয়া নামটা। আর তারপরেই লাইন ডিসকানেক্টেড! পবিত্র আশঙ্কায় চেঁচিয়ে উঠেছিল–রাজ…! কী হলো!

স্যার…!

অর্ণব লাইন কেটে দিয়ে পাগলের মতো অধিরাজের ফোনে বারবার ফোন করছিল। ফোন বেজেই যাচ্ছে কিন্তু কেউ তুলছে না। প্রত্যেকবারই বাজতে বাজতে নিরুত্তর হয়ে যাচ্ছে। কোনোবারই ওপাশ থেকে পরিচিত গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো না।

শি–ট!

অর্ণব লাশটাকে ফরেনসিক টিমের অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়েই ছুটল মেরিলিন প্ল্যাটিনামের দিকে। লাশ নিতে ড. চ্যাটার্জী নিজেই এসেছিলেন। অর্ণবকে অমন টেনড় দেখে তাঁরও সন্দেহ হয়। তিনি ভুরু কুঁচকে জানতে চেয়েছিলেন– এনি প্রবলেম অর্ণব?।

অর্ণব চিন্তিত মুখে বলে–জানি না। স্যার গেট কীপারকে চেজ করতে করতে মেরিলিন প্ল্যাটিনামে গিয়েছেন। কিন্তু এখন ওঁকে আর ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না!

রাজা ফোন তুলছে না! ড. চ্যাটার্জীও যেন একটু ঘাবড়ে গেলেন–সে কী! দাঁড়াও তো!

তিনিও বেশ কয়েকবার ফোন করলেন। কিন্তু ঘটনা একই। বাজতে বাজতেই কেটে যাচ্ছে ফোন। কোনো রিপ্লাই নেই। ড. চ্যাটার্জী আর কোনো কথা না বাড়িয়ে অর্ণবের গাড়িতেই গাট হয়ে বসে পড়লেন। অর্ণব বুঝল তিনিও তাঁর সঙ্গেই যাবেন। সে গাড়িতে স্টার্ট দিয়েই শুনল তিনি ফোনে আহেলির সঙ্গে কথা বলছেন–লাশটা যাচ্ছে। প্রিলিমিনারি টেস্টগুলো করো। আমি একটু পরেই আসছি।

মেরিলিন প্ল্যাটিনামে ঢুকতে না ঢুকতেই গেটের সামনে একটা অ্যাম্বুলেন্স দেখে বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে উঠল অর্ণবের। এর মধ্যে পবিত্র আচার্যর ফোনে অসংখ্যবার ফোন করেছে। কিন্তু প্রত্যেকবারই লাইন বিজি। এবার স্বয়ং তাকেই দেখতে পেল অর্ণব। পবিত্র আর ওয়ার্ডবয়রা যে রক্তমাখা বেহুশ মানুষটাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের দিকে দৌড়াচ্ছিল, তাকেও চিনতে কোনো অসুবিধে হলো না! অর্ণবও প্রায় সর্বহারার মতো দৌড়ায় সেদিকেই–স্যার!

মাই গড!

তার পেছন পেছন ড. চ্যাটার্জীও। পবিত্র আর ওয়ার্ডবয়রা ততক্ষণে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়েছে অধিরাজকে। একজন ওয়ার্ডবয় অভ্যস্ত ও নিপুণ হাতে অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দিল তার মুখে। ড. চ্যাটার্জী অ্যাম্বুলেন্সে উঠে অধিরাজের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন–কী হয়েছে? বেঁচে আছে তো?।

এখনও আছে। পবিত্র নিচু স্বরে বলল–তবে বুকে গুলি লেগেছে।

সে কী! তিনি কেঁপে উঠলেন–কোথায় লেগেছে? হার্টে নয় তো!

কে মারল? অর্ণবের প্রশ্নও ধেয়ে আসে। সে উন্মত্ত রাগে ফুঁসছে–কে শুট করেছে?

রিয়া সামান্থা বাজাজ। পবিত্র যত দ্রুত সম্ভব বলল–উনি রাজার বডির পাশেই বসেছিলেন। এবং মার্ডার ওয়েপনটা তখনও ওঁর হাতেই ছিল! ওঁকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। লেডি অফিসাররা নিয়ে আসছেন।

অফিসার আচার্য! ড. চ্যাটার্জী প্রায় গর্জন করে ওঠেন–মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গোয়েজ! রাজার বডি মানে? ও এখনও বেঁচে আছে। বডি হয়নি! মার্ডার ওয়েপন আবার কী!

পবিত্র অনুতপ্তভাবে মাথা নিচু করেই বলল–সরি! তবে বডিও আছে। গেট কীপার গগনের বডি ছাদে পড়েছিল। স্পট ডেড। রিয়ার হাতে যেটা ছিল সেটা প্ৰব্যাবৃলি মার্ডার ওয়েপনই। লাশ আর মার্ডার ওয়েপন ল্যাবে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ড. চ্যাটার্জী আর কথা না বাড়িয়ে অধিরাজের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিয়ে তার অসাড় হাতটা শক্ত করে ধরে বসলেন। অর্ণব পবিত্রর দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়। পবিত্র তার অনুচ্চারিত প্রশ্নটা বুঝে নিয়ে বলল–তোমরা যাও। আমি টিম ডেকে রিয়া যে ফ্ল্যাটে থাকে সেটা সার্চ করছি। যে ফ্ল্যাটের কথা মিস্ ঘোষ জানিয়েছিলেন, মানে চেরি রেড দরজাওয়ালা সেভেন ও বি ফ্ল্যাটটা রিয়ার মাসি অহনা ভট্টাচার্যেরই। ওখানেই রিয়া থাকে। এটাকেও কো ইনসিডেন্স বলা যাচ্ছে না।

স্যারের বাবা-মাকে…।

অলরেডি জানিয়ে দিয়েছি। ওঁরা ডাইরেক্ট হসপিটালেই যাবেন। পবিত্র একটু চুপ করে থেকে বলল- তোমরা যাও। আমি এদিকটা দেখেই আসছি। ইনভেস্টিগেশন তো চালাতেই হবে।

অর্ণব একদৃষ্টে তাকিয়েছিল অধিরাজের দিকে। তার মাথায় যেন আর কিছু ঢুকছে না। অধিরাজের রক্তহীন বিবর্ণ মুখের আধখানা ঢেকে গিয়েছে অক্সিজেন মাস্কে! বুকের ওঠা-নামা এত ক্ষীণ যে বোঝাই যায় না। এই মানুষটাই একটু আগে কথা বলছিল, হাসছিল, বাইক নিয়ে চেজ করছিল! প্রচণ্ড আফসোসে তার নিজেকেই ঠাস ঠাস করে চড় মারতে ইচ্ছে করে। অধিরাজের গায়ে জ্বর ছিল! হয়তো সেটাই বাড়াবাড়ির পর্যায়ে যাওয়ার ফলে রিফ্লেক্স অ্যাকশন ঠিকমতো কাজ করেনি। নয়তো এইরকম একজন চতুর শাশুটারকে রিয়া বাজাজ একগুলিতেই কাত করে ফেলল! অবিশ্বাস্য! যে হিস্ট্রি শু্যটারদের সঙ্গে নিয়মিত এনকাউন্টার করে অভ্যস্ত, একটা গুলি তাকেই মেরে দিয়ে গেল! রিয়া বাজাজ আর যাই হোক–প্রোফেশনাল শ্যটার নয়! অধিরাজ ব্যানার্জীর হাতে বন্দুক থাকলে বাঘা বাঘা প্রতিপক্ষও ফায়ার করার সুযোগ পায় না! অথচ শেষে কিনা রিয়া বাজাজের হাতেই…!

সে পরম অপরাধবোধে চোখ বোঁজে। জ্বরটাই সর্বনাশ করেছে। আর তার যে জ্বর ছিল তা একমাত্র অর্ণব ছাড়া আর কেউ জানত না। এ লোকটা তো রিস্ক নিতেই ভালোবাসে। কিন্তু অর্ণব আরেকটু সতর্ক হতেই পারত। কেন একা ছাড়ল অধিরাজকে! সারাজীবন পাশাপাশি থেকে এসেছে। অথচ যখন তার অর্ণবের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, তখনই সে পাশে ছিল না!

হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা মিনিট আতঙ্কে কাটছিল ওদের। অধিরাজকে যখন অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলেন ডাক্তাররা তার পর থেকেই অর্ণব প্রাণপণে ঈশ্বরকে ডাকছিল। ড. চ্যাটার্জী ওটির বাইরে, চুপ করে পায়চারি করছিলেন। একটা কথাও বলেননি। এত শান্ত হয়ে থাকতে তাঁকে আগে কখনো দেখেনি অর্ণব। আর অধিরাজের মা-বাবার মুখের দিকে তাকানোর সাহসই হয়নি।

অপারেশন চলাকালীন ডাক্তার ও সিস্টারদের মধ্যে একটা ভীষণ ব্যস্ততা চলছিল। ড. চ্যাটার্জী একজন ডাক্তারের সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বলছিলেন। তার মুখ ক্রমশই গম্ভীর হয়ে উঠছে দেখে অর্ণব এগিয়ে গেল। তার দিকে তাকিয়ে। আপনমনেই বিড়বিড় করে বললেন ড. চ্যাটার্জী–চিন্তার কিছু নেই। হেভি ব্লাড লস্ হয়েছে। ব্লাড দিতে হবে। তবে নিউমোথোরাক্সটা না হলেই বোধহয় ভালো হতো।

মানে?

মানে গুলিটা লাংসকে পাংচার করেছে। তিনি অন্যমনস্ক–তবে পাংচার লাংসের পেশেন্টও বেঁচে যায়। রিস্ক ফ্যাক্টর আছে। তবে রাজার বয়েস অল্প, হেলথও খুব ভালো। লড়বে। হিও হবে।

কথাগুলো যে কাকে সান্ত্বনা দিতে বললেন ড. চ্যাটার্জী, ঈশ্বরই জানেন। অর্ণব একটুও স্বস্তি পেল না। বরং সারারাত উদ্বেগেই কাটল। চতুর্দিক নিস্তব্ধ। শুধু অধিরাজের মায়ের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

অবশেষে বহু প্রতীক্ষার পর ওটির দরজা খুলল। সার্জেন স্পষ্ট জানালেন–গুলিটা বের করতে পেরেছি। তবে এখনই কিছু বলতে পারছি না। সেম্পোরিয়াম নেই। যতক্ষণ না সেটা আসছে, ততক্ষণ কিছু বলা মুশকিল। আইসিইউতে দিতে হবে। আপাতত ভেন্টিলেটরে রাখা জরুরি। বলতে বলতেই হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন–বাই দ্য ওয়ে, গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গেই কেউ ওঁকে সিপিআর দিয়েছে কী?

সিপিআর! ড. চ্যাটার্জী অর্ণবের দিকে তাকালেন–পবিত্র দিয়েছে?

নো। মে বি ফিমেল ওয়ান! সার্জেন বললেন–অফিসার ব্যানার্জী নিশ্চয়ই স্ট্রবেরি লিপ-বাম মাখেন না? বা অন্য কোনো পুরুষ অফিসার?

হোয়াট! ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ অবাকস্ট্রবেরি লিপবাম!

ইয়েস। সার্জন মাথা ঝাঁকালেন–যদিও এসব এভিডেন্স আমাদের দেখার কথা নয়। কিন্তু এটা সিআইডি অফিসারের কেস বলেই দেখেছি। ইনফ্যাক্ট আমাদের সিস্টার নোটিস করেছেন। ওঁর ঠোঁটে স্ট্রবেরি লিপবাম্ ছিল। বুকের ওপরেও সামান্য সোয়েলিং নজরে এসেছে। খুব জোরে একদম হার্টের ওপরে দুমদা মারলে যেমন হয় আর কী। নিউমোথোরাক্সের ক্ষেত্রে অনেক সময় সাডেন শকে কার্ডিয়াক প্রবলেম হয়–হ্যাঁর্ট পাম্পিং থামিয়ে দেয়। সেক্ষেত্রে সিপিআর না দিলে পেশেন্ট ওখানেই মরে যেতে পারে। অফিসার ব্যানার্জীকে কেউ সিপিআর দিয়েছিল বলেই আমার ধারণা।

কথাগুলো বলেই তিনি গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন। অর্ণব আর ড. চ্যাটার্জী স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে। দুজনের মুখে কোনো ভাষা নেই! অর্ণবের মাথায় প্রায় কিছুই ঢোকেনি। ড. চ্যাটার্জী অধিরাজের লজটাই বললেন–

স্ট্রেঞ্জ!

সেই থেকেই অধিরাজ আইসিইউতে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত অগুনতি নল নিয়ে শুয়ে আছে। চোখদুটো যেন চরম ক্লান্তিতে বোজা। মুখ বিবর্ণ। ব্লাড এখনও দেওয়া হচ্ছে। থেকে থেকেই ব্লাড প্রেশার নেমে যাচ্ছে। ভীষণভাবে ফ্লাকচুয়েট করছে। অক্সিজেন মাস্কে মুখ প্রায় দেখাই যায় না। টান টান ঋজু দেহটা সাদা চাদরে আবৃত। শুধু লম্বা সুন্দর গ্রীবা, তামাটে রঙের সুগঠিত কাধটুকু আর বুকের ওপর জড়ো করা হাতদুটো দেখা যায়। হাতের আঙুলগুলো স্থির! এখন তার ধারে কাছে কাউকেই ঘেঁষতে দিচ্ছেন না ডাক্তাররা। দরজার বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে কাঁচে মুখ ঠেকিয়ে অক্লান্ত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন মা-বাবা! অর্ণব, ড. চ্যাটার্জী, আজকে সকালে পবিত্র এবং অন্যান্য অফিসাররাও তাদের বুঝিয়ে উঠতে পারেনি। কিছুতেই সরানো যাচ্ছে না বন্ধ। দরজার সামনে থেকে। অধিরাজের বাবা বারবার বলছেন–চিরদিনই শান্তিতে থাকতে বলেছি। এত শান্ত হতে বলিনি বাবা!

দৃশ্যটা মনে পড়তেই চোখে জল চলে এলো অর্ণবের। সত্যিই তো! অমন দাপুটে লোকটা কী অসহায়ের মতো পড়ে আছে। কখনো অধিরাজকে স্থির হয়ে বসতে দেখেনি সে। সবসময়ই কিছু না কিছু করে যাচ্ছে। ব্যস্ততাই বোধহয় সবচেয়ে পছন্দ তার। আর ডিপার্টমেন্টও এই লোকটার চওড়া কাঁধের ওপর একের পর এক কেসফাইল চাপাতে ভালোবাসে। তা নিয়ে কখনো ক্লান্তি নেই, কোনো অভিযোগ, অনুযোগ নেই–শুধু ফ্রেশ একটা ছেলেমানুষী হাসি। সে হবে না শব্দটা সহ্যই করতে পারে না। ইমপসিবল শব্দটা ওর অভিধানেই নেই।

অর্ণব।

অফিসার পবিত্র আচার্য তার কাঁধে হাত রাখতেই সচকিত হয়ে উঠল অর্ণব। মনে পড়ল এই মুহূর্তে হসপিটালে নয়, সে সিআইডি ব্যুরোতেই বসে আছে। আর এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। তার চোখের পাতা ভিজে এসেছিল। কোনোরকমে সামলে নিয়ে বলল–হ্যাঁ?

রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার শালা কিছুতেই মুখ খুলছে না। পবিত্রর চোখ জ্বলে ওঠে–কাল রাত থেকে তুলোধোনা করছি। কিন্তু একই গান গাইছে– কিছু জানি না। তুমি একবার দেখবে? রাজা থাকলে কিছু করত হয়তো…।

দেখছি। সে পবিত্রর দিকে তাকিয়ে খুব শান্তভাবে বলল–রিয়া বাজাজ নতুন কিছু বলল?

নাথিং। পবিত্র হতাশভাবে মাথা নাড়ে–সে তো শুরুতেই বলে দিয়েছে যে সব খুন ও নিজেই করেছে। বলছে ঠিকই, কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না। দেখি ফার্দার ইনভেস্টিগেশনে কী বেরোয়।

অধিরাজের লড়াইটা এখন লড়ছে গোটা সিআইডি ব্যুরো। তার ঘটনাটা হোমিসাইডের রক্ত গরম করে দিয়েছে। ফলে এই কয়েক ঘণ্টায় সব তোলপাড় করে ঝড়ের বেগে চলছে ইনভেস্টিগেশন। অর্ণবের নেতৃত্বে অফিসাররা যাকেই পাচ্ছে তার দিকেই তেড়ে যাচ্ছে। তারা গোটা গোল্ডেন মুন ক্লাবকেই রেড করে সিল করে দিয়েছে। হাতের কাছে যা যা ফাইল পেয়েছে, তুলে এনেছে। সিড হয়েছে ডিপফ্রিজার। সেটাও ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। মানসী জয়সওয়াল আর অ্যাডেলিন বাজাজকে জেরার জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছে। অ্যাডেলিন প্রায় মুখ খিস্তি করতে বাকি রেখেছেন। দাঁত খিঁচিয়ে বলেছেন–আপনাদের কাছে আমাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই। আসল অপরাধীকে ধরতে পারছেন না বলে আমাদের হ্যারাস করছেন। যাব না। ফুটুন।

অর্ণবের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে অক্সিজেন মাস্ক পরা অধিরাজের অসহায় চেহারাটা। চিরদিনের শান্ত অর্ণব হঠাৎ হিংস্রভাবে হিসিহিসিয়ে ওঠে–আপাতত আমি ফুটছি ঠিকই। কিন্তু ম্যাডাম, আপনি যদি আজই ব্যুরোয় না আসেন, আর একটা প্রমাণও যদি আপনাদের বিরুদ্ধে পাই তবে প্রমিস-আপনাকে জেলের ফুটন্ত কড়াইয়ে ফেলে ফোঁটাবো! ওখানে একটা চেসবোর্ডও পাবেন না।

পবিত্র অর্ণবের এমন বিধ্বংসী মূর্তি কখনো দেখেনি। সে স্তম্ভিত! অ্যাডেলিনও হতবাক। যে লোকটিকে প্রায় বলে বলে দাবায় হারিয়েছেন সেই শান্ত ছেলেটা এমনভাবে রি-অ্যাক্ট করবে তা স্বপ্নেও ভাবেননি। কোনোমতে ঢোক গিলে বললেন–ওকে।

রিয়া বাজাজের ফ্ল্যাট তন্নতন্ন করে খুঁজে একগাদা সাইবার ক্রাইম সম্পর্কিত বই পাওয়া গিয়েছে। রয়েছে ভৌতিক এবং রহস্যের গল্পের গুচ্ছ গুচ্ছ সংকলন। সব বইতেই রিয়া বাজাজের নামের স্টিকার লাগানো। পাওয়া গেল নানা ধরনের চেসবোর্ডও। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়–পাওয়া যায়নি কোনো ডেস্কটপ, ল্যাপটপ বা ট্যাব। আরও অদ্ভুত ব্যাপার, তাদের হলঘরে একটা সোফায় পাওয়া গেল একটা আস্ত ম্যানিকুইন! ম্যানিকুইনটার বুকে একটা ছুরি বসানো! শুধু তাই নয়, ম্যানিকুইনটা প্রায় ছুরির আঘাতে ঝাঁঝরা!

রিয়াকে এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলেই সে কাঁপতে কাঁপতে একটা কথাই বলছে–আমি সবাইকে মেরেছি, কিন্তু কাউকে মারতে চাইনি। ওদের কেন মেরেছি, জানি না। আমি শুধু মি. বাজাজকে মারতে চেয়েছিলাম! কিন্তু ও মরেনি! ও এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে…আমায় ভয় দেখাচ্ছে!

রিয়ার সঙ্গে তার মাসি অহনা ভট্টাচার্য এবং গভর্নেস অ্যালিসও উপস্থিত ছিল। অহনাকে রিয়া মাউ বলে ডাকে। অহল্যার বোনের নাম যে অহনা হবে তাতে আর আশ্চর্য কী! তিনিই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন–ম্যানিকুইনটা পেয়েছেন আপনারা? ঐ ম্যানিকুইনটাকেই রিয়া মি. বাজাজ ভাবে। ওর প্যারানয়েড স্কিজোফ্রেনিয়া আছে। সুযোগ পেলেই ঐ ম্যানিকুইনটাকে ছুরি মারে। বারবার লাশ ফেলার মতো ওটাকে বস্তাবন্দি করে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে ফেলে দেয়। সিকিউরিটি গার্ডদের বলাই আছে। ওরা ওটাকে খুঁজে পেতে ফের ফেরত দিয়ে যায়। রিয়া ঐ ম্যানিকুইনটাকে কখনো ভয় পায়, কখনো হিংস্র হয়ে ওঠে। আমি সামলাতে পারি না। একমাত্র ওর গভর্নেস অ্যালিসই ওকে বাগে আনতে পারে।

রিয়ার গভর্নেস অ্যালিসও তাঁর কথাকেই সমর্থন করল। সে জানায়–মি. উমঙ্গ অ্যান্ড্রু বাজাজ দুই মেয়ের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করতেন স্যার। স্পেশ্যালি রিয়ার সঙ্গে। সে কালো বলে যা তা বলতেন। উঠতে-বসতে মারধোরও করতেন। রিয়ার ওপর অনেক অত্যাচার করেছেন। সবচেয়ে ভয়ংকর টর্চার ছিল তার সঙ্গে দাবা খেলা। খেলতে হবেই। অথচ রিয়া বেবি খুব শার্প ছিল। কখনো যদি সে জিতে যেত তবে বেল্ট দিয়ে জানোয়ারের মতো মারতেন। গরম ইস্ত্রির ছ্যাকা থেকে শুরু করে লাঠি পেটা–সবরকম টর্চারই ছিল লিস্টে। রিয়া বেবি এমনি এমনি এমন হয়নি।

আর প্রিয়া? অর্ণব জানতে চায়–তার ওপরও টর্চার করতেন মি, বাজাজ?

অহনা একটু চুপ করে থেকে বললেন–টর্চার করাটাই মি. অ্যান্ড্রু বাজাজের স্বভাব। দিদির ওপর কম অত্যাচার করেছেন? তবে যদি দুই মেয়ের মধ্যে যদি কেউ সামান্য ছাড় পেয়ে থাকে তবে সে প্রিয়া। কারণ প্রিয়া ওঁর মতোই ফরসা ছিল।

সে এখন কোথায় কিছু জানেন?

সঠিক জানি না। মি. বাজাজ বলেছিলেন সে নাকি কোন এক অপদার্থ ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছে। অহনা ঠোঁট কামড়ে ধরে বললেন–তবে আমার বিশ্বাস হয় না। প্রিয়া এত বোকাও নয় যেকোনো ওয়ার্থলেস ভ্যাগাবন্ডের সঙ্গে প্রেম করবে। সে বোনকে খুব ভালোবাসত। তাকে ঐরকম পাষণ্ডের কাছে ফেলে রেখে চলে যাওয়ার পাত্রী নয়। আমার সন্দেহ হয় যে…।

কী? এবার দুই অফিসারই একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল।

আমার ধারণা প্রিয়া বেঁচেই নেই। তাকে মি, বাজাজ খুন করে কোথাও গুম করে দিয়েছেন।

হোয়াট! অর্ণব উত্তেজনায় প্রায় লাফিয়েই ওঠে–কী!

কারণ সে বেঁচে থাকলে এতদিনে মি. বাজাজকেই খুন করত। তাই আগেই তাকে সরিয়ে দিয়েছেন। প্রিয়া নিজের চোখে ওর মায়ের যন্ত্রণা দেখেছে। বাজাজ দিদিকে কুত্তি বলে ডাকতেন। ঘরে বৌ-বাচ্চা থাকতেই একেকদিন একেকটা কলগার্লকে এনে বেডরুমে তুলত লোকটা। শেষপর্যন্ত তো আরেকটা মেয়েকেই পার্মানেন্টলি ঘরে তুলে আনলেন। এমন ক্রুয়েল লোক আমি আর দেখিনি! অহনার কণ্ঠে প্রচণ্ড তিক্ততা ও বিদ্বেষআমার দিদি কালো ছিল–এটাই তার অপরাধ। আর সেই অপরাধের শাস্তি সে পেয়েছে। অহল্যা দিদির মৃত্যুটা সবার চোখে স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা জানি, ওটাও মার্ডারই ছিল। অসম্ভব মানসিক যন্ত্রণা পেয়ে তিলে তিলে মরেছে সে!

অহল্যা বাজাজ কীভাবে মারা গিয়েছিলেন?

অহনার চোখ সজল হয়ে ওঠে–রিয়ার জন্ম দিতে গিয়েই মারা গিয়েছিল দিদি। প্রেগন্যান্সির আগে থেকেই সে রক্তশূন্যতায় ভুগছিল। স্বাভাবিক। ওকে ঠিকমতো খেতেও দিতেন না বাজাজ। প্রেগন্যান্ট অবস্থাতেই বেশ কয়েকবার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। এমনকি শেষদিন পেটে একাধিকবার লাথিও মেরেছিলেন। তাতেই ব্লান্ডারটা হলো। মা আর বাচ্চা দুজনেরই প্রাণ সংশয় হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তাররা কোনো একজনকে বাঁচাতে পারতেন। অ্যান্ড্রু বাজাজের কাছে অনুমতি চাওয়া হলে তিনি স্ট্রেট বলে দিলেন–আই জাস্ট ডোন্ট কেয়ার। দিদি বাঁচল না। কিন্তু ডাক্তাররা রিয়াকে বাঁচাতে পেরেছিলেন। তার চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ল–এখন মনে হয়, ও মরলেই বোধহয় ভালো হতো। এটা কী বাঁচা!

প্রিয়া কোনোরকম প্রতিবাদ করেনি?

ভদ্রমহিলা আঁচলে চোখ মুছে বললেন-করেছিল। অহল্যা দিদিকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত সে। দিদি যে এত টর্চার সত্ত্বেও বাজাজকে ছেড়ে যায়নি, তার একটাই কারণ। বড়ো মেয়ে প্রিয়া। নয়তো সে যখন খুশি চলে যেতে পারত। তার নিজস্ব প্রচুর টাকা ছিল। সেই টাকাই দু হাতে ওড়াচ্ছিল অ্যান্ড্রু। বাজাজ হুমকি দিত যে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে বা ডিভোর্স চাইলে প্রিয়াকে মেরে ফেলবে। এবং শুধু হুমকি নয়-বাজাজের মতো লোকের পক্ষে সেটা সম্ভবও ছিল। সেই ভয়েই দিদি ওর সঙ্গে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু প্রিয়া সব স্বচক্ষে দেখেছে। মায়ের মৃত্যুর পর সে শুশান থেকে ফিরেই সোজা পুলিশ স্টেশনে গিয়ে বাপের নামে নালিশ করেছিল। প্রিয়া মাইনর ছিল। তখন ওর মাত্র দশ বছর বয়েস। ওর কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। প্রিয়াই একমাত্র মানুষ যে বারবারই চিৎকার বলেছিল–ইটস আ মার্ডার! এবং যেদিন ও নিখোঁজ হয়ে যায়, ঠিক সেদিনই প্রিয়া অ্যান্ড্রুর গলা টিপে ধরেছিল। অ্যান্ড্রু ওকে ছেড়ে দেবেন?

সে কী! অর্ণব অবাক–আপনি জানলেন কী করে? আপনি ওদের সঙ্গে থাকতেন?

না। তিনি বললেন–অ্যালিস বলেছে। অ্যালিস একদম ছোটবেলা থেকে রিয়াকে মায়ের মতো মানুষ করেছে। অহল্যা দিদি যখন মারা যায় তখন প্রিয়া খুবই ছোট। রিয়াকে কে দেখত? অ্যান্ড্রু যে ফাদারের কাছে মানুষ, অ্যালিসও সেই ফাদারের কাছেই থাকত। ও অনাথ। সেই ফাদারই অ্যালিসকে রিয়ার দেখাশুনা করার ভার দিয়েছিলেন। অ্যান্ড্রু ফাদারের কথা অমান্য করতে পারতেন না। তাছাড়া সন্তান তার কাছে একটা ঝামেলা! তাই অ্যালিসকে মেনে নিয়েছিলেন।

অর্ণব আড়চোখে একবার অ্যালিসকে দেখে নেয়। এই কেসের একমাত্র হতকুচ্ছিত চেহারার নারী! কুচকুচে কালো! ভয়ংকর মোটা! সম্ভবত অধিরাজ, অর্ণব এবং পবিত্রকে একসঙ্গে পাশাপাশি দাঁড় করালে তবেই অ্যালিসের বহরটা বোঝা সম্ভব! কালো ফোলা ফোলা মুখ অদ্ভুত নিস্পৃহ! চোখদুটো এত ছোট যে প্রায় দেখাই যায় না! ঠোঁট ফুলো ফুলো-মোটা। কাঁচাপাকা চুলগুলো বিস্রস্ত হয়ে মুখের ওপরে পড়েছে। অথচ সে যে পরম স্নেহময়ী তা তার সেই কুতকুতে চোখের দৃষ্টিতেই বোঝা যায়।

অন্যদিকে অহনা ভট্টাচার্য কালো হলেও চরম সুন্দরী। এক কথায় ব্ল্যাক বিউটি! সোফিয়া লোরেনও বোধহয় তার সৌন্দর্যের পাশে ফেল পড়বেন। তাঁকে অহল্যার বোন বলে মেনে নেওয়া কষ্টকর! কত বছরের ছোট কে জানে! কারণ অহল্যার বড়ো মেয়ে প্রিয়া যদি আদৌ বেঁচে থাকে তবে তার বয়স এখন বত্রিশ হওয়া উচিত। অথচ অহনাকে পঁয়ত্রিশের বেশি বলে মনেই হয় না! তার চেহারা অবশ্য নিগ্রোবটু ধরনের নয়। রীতিমতো পানপাতার মতো মুখ। টানা টানা চোখে মিশরীয় সৌন্দর্য! চুল কিঞ্চিত ঢেউখেলানো। শাড়ি পরলেও অনিন্দ্যসুন্দর সুললিত চেহারাটির দিকে তাকালে চোখ ফেরানো মুশকিল। মুখের আদলটা ভীষণ যৌন আবেদনময়। কবজিতে একটি কিং কোবরা ফণা তুলে আছে– মানে ট্যাটু আর কী! অর্ণবের মনে হলো, হেলেন অব ট্রয়, মুমতাজমহলদের পর এবার ক্লিওপেট্রীও এলেন!

রিয়ার মেন্টাল প্রবলেমের মূলেও মি. বাজাজ। অ্যালিস মৃদুস্বরে জানায়–বেবির প্যারানয়েড স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগটা মি. অ্যান্ড্রু বাজাজের কারণেই। হি ইজ দ্য ডেভিল!

রিয়া প্যারানয়েড স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগী! অর্ণব আর পবিত্র পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। তার মানে মেয়েটাকে সরাসরি জেরা করা সম্ভব নয়। কাউন্সিলর এনে জেরা করতে হবে। পবিত্র শুধু বলল–আপনার কাছে প্রিয়া আর অহল্যা বাজাজের ছবি আছে?

আছে। অহনা বললেন–অ্যালবাম থেকে দিতে হবে। অ্যালবামটা আপনারা আনেননি বোধহয়।

না।

ঠিক আছে। নিয়ে আসছি।

আচ্ছা, রিয়ার ক্রিশ্চান নেম সামান্থা। প্রিয়ার পুরো নাম কী ছিল?

প্রিয়া এস্থার বাজাজ।

অহনা চলে গেলেন। অ্যালিস রয়ে গেল। সে রিয়ার মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে চুপ করে রইল। পবিত্র একবার সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দুজনকে দেখে নিল। তারপর বাইরে বেরিয়ে অর্ণবকে বলল–আমার ব্যাপারটা খুব সহজ মনে হচ্ছে না। গোলমাল আছে। এই রিয়া বাজাজ কী সত্যিই পাগল? না অ্যাকটিং করছে?

কেন?

একটা জিনিস ওঁদের ফ্ল্যাটে পেয়েছি। তুমি দৌড়োদৌড়ি করছিলে বলে বলিনি। আমার টেবিলে আছে। এক কথায় হাইলি সাস্পিশাস। চলো তোমায় দেখাচ্ছি।

পবিত্র নিজের টেবিল থেকে একটা সবুজ রঙের ফাইল তুলে নিয়ে অর্ণবের হাতে ধরিয়ে দিল–দেখো।

অর্ণব ফাইলটা খুলেই হাঁ। ভেতরে থরে থরে অধিরাজের ছবি সাজানো। বেশিরভাগই নিউজ পেপার থেকে সগ্রহ করা। কিছু ক্যামেরায় তোলা। খবরের। কাটিং, যে সব কেস এখনও পর্যন্ত তারা সল্ভ করেছে সে সবের ডিটেলস্। অধিরাজের ইন্টারভিউ। তার সম্পর্কে যত খবর আজ পর্যন্ত বেরিয়েছে সবই সযত্নে সাজানো।

রাজার ওপর প্রায় থিসিসই বলতে পারো। এ পাবলিক অনেকদিন ধরেই ফলো করছে। আর ইন্টারভিউটা কোন ক্রাইম রিপোর্টার নিয়েছে দেখেছ?

সুপর্ণা জয়সওয়াল!

অর্ণবের মনে হয়েছিল এবার তার মাথা ফেটে যাবে। যখন গেট কীপারটা বেছে বেছে এই মেরিলিন প্ল্যাটিনামেই এলো, তখন ভেবেছিল– তদন্তের ক্ষেত্র একটা সীমিত জায়গায় অন্তত এলো। কিন্তু না! আবার সন্দেহের তীর ঘুরে গেল জয়সওয়ালদের দিকে। কিন্তু জয়সওয়ালদের মধ্যে কেউ মেরিলিন প্ল্যাটিনামে বিনা বাধায় ঢুকে গেল কী করে? সিকিউরিটি গার্ডরা আটকালো না! তাও আবার রিয়া বাজাজদের ফ্ল্যাটে! কোনো কানেকশনই তো নেই!

শেষ আশা ছিল ক্লাবের রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারটার বয়ান। কিন্তু সে ব্যাটাও মুখ খুলছে না! অর্ণব চোখ বুজল। এরকম পরিস্থিতির সামনে পড়লে অধিরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় কী কতেন? কিছু তো করতেন। এত মার খাওয়ার পরও যখন মুখ খুলছে না তখন মোটা চামড়ার লোক। কী করা যায়…? স্যার কী করতেন…?

সে কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়–চলুন তো।

পবিত্র মাথা ঝাঁকিয়ে নির্বিবাদে তার সঙ্গে সঙ্গেই চলল।

ম্যানেজারটা এতক্ষণ সিআইডি স্পেশ্যাল লাঠির বাড়ি খেয়ে প্রায় বেঁকেই গিয়েছে। তার দেহে বোধহয় এমন একটা জায়গাও বাকি নেই যেখানে মারা হয়নি। তবু দাতে দাঁত চেপে বসে আছে।

অর্ণব তার দিকে একটু বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে পবিত্রর দিকে তাকায়–এটাকে সাইজ করতে হবে?

পবিত্র মনে মনে হাসল। অর্ণব অধিরাজের স্টাইলটাই ধরেছে। শুধু গলার আওয়াজ আর ভঙ্গিটা আলাদা। ক্লেভার বয়! অধিরাজের ছায়ায় থাকে বলে সবসময় তাকে ঠিকমতো বোঝা যায় না। নয়তো অর্ণবও কিছু কিছু ক্ষেত্রে রীতিমতো ভালো খেলে। যেমন এখন খেলছে।

অর্ণব শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে লাঠি হাতে দাঁড়ানো কনস্টেবলদের দিকে দেখল–কী দেখছ? আমার ড্রয়ারে একটা আনলাইসেন্সড় গান আছে। নিয়ে এসো। সার্ভিস রিভলবারে হবে না। আর রেকর্ডে লেখো কোনোরকম প্রমাণ না পাওয়ার জন্য ওকে আজ সকাল দশটায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অ্যাই, তোর নাম কী রে?

ম্যানেজারটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে সে। কোনোমতে বলল–স্যার…!

তোর নাম স্যার?

অর্ণব ভ্রুকুটি করেছে। পবিত্র পেছন থেকে বলল–বিমান সাঁপুই!

ফাইন। সে কনস্টেবলদের দিকে তাকিয়েছে–রেকর্ডে লিখে ফেলো। আর আনলাইসেন্সড গানটা নিয়ে এসো। নট সার্ভিস রিভলবার। গট ইট?  

ওকে স্যার।

কনস্টেবলরা দ্রুত বেরিয়ে যায়। বিমান সাঁপুই ঠোঁট চেটে বলল–আমি কিছু জানি না স্যার!

কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোকে? অর্ণব বিরক্তি তিক্ত স্বরেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে–চুপ থাক্।

কিছুক্ষণ পরেই কনস্টেবলরা আগ্নেয়াস্ত্রটা নিয়ে এসে হাজির। অর্ণব ভালো করে অস্ত্রটাকে ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে বলল–লোডেড তো?

একদম।

ফাইন। সে ম্যানেজারের দিকে তাকায় এবার দয়া করে উঠে দাঁড়া। আমার হাতে অনেক কাজ আছে। তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে।

বিমান সাঁপুইয়ের গলার হাড়টা ওঠা-নামা করল। কী সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি কী শেষ করবে? এনকাউন্টার করবে নাকি? তেমনই তো মনে হচ্ছে। সামনের অফিসারের চোখের দিকে তাকাল সে। সেখানে শুধু প্রতিহিংসা আগুনের মতো জ্বলছে! সত্যিই ঠুকে দেবে…!

আবে! সোজা কথা বুঝতে অসুবিধে হয়? সে ধমেক ওঠে–উঠে দাঁড়া।

শেষ কথাটা এত জোরে বলল অর্ণব যে লোকটা কেঁপে উঠল। মার খেয়ে সারা শরীরে ব্যথা। তবু কোনোমতে উঠে দাঁড়াল। সভয়ে বলল–কী করছেন স্যার?

সমাজসেবা!

অর্ণব কনস্টেবলদের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যেতে ইঙ্গিত করে। তারাও তাড়াতাড়ি বুট খটখটিয়ে বেরিয়ে গেল। এখন সে আর পবিত্র ছাড়া আর কেউ নেই। ম্যানেজার ভয়ে ভয়ে বলল–সমাজসেবা?

সোশ্যাল সার্ভিস। অর্ণব তার মাথার দিকে বন্দুক তাক করেছে–এই ডিস্ট্যান্সটা ঠিক আছে?

আরেকটু পিছিয়ে এসো অর্ণব। পবিত্র বলল–ঘিলু ছিটকে যাবে। তোমার আমার শার্টের বারোটা বাজবে।

লোকটার দুশো ছটা হাড়ে তখন খটখটানি শুরু হয়ে গিয়েছে। ঠিকই ধরেছে সে। এনকাউন্টারের মুডেই আছে এরা!

স্যার…!

শশশ! পবিত্র দাবড়ে ওঠে-চুপ কর। কনসেনট্রেট করতে অসুবিধে হচ্ছে। গুলিটা একটু এদিক-ওদিক হলে তোরই কষ্ট হবে।

স্যার! শুনুন…!

শোনার সময় নেই। অর্ণব বলল–তুই কিছুই জানিস না। তাই তোকে আমাদের আর দরকার নেই। অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখতে নেই, ফেলে দিতে হয়। স্বচ্ছ ভারত অভিযানের নাম শুনেছিস? আনঅফিশিয়ালি হিস্ট্রিশিটারদের সরানোও স্বচ্ছ ভারত অভিযানের একটা পার্ট।

পবিত্র পেছন থেকে বলল–ওকে। অর্ণব, শট।

স্যার! লোকটা ঝুপ করে বসে পড়ে চিৎকার করে ওঠে-প্লিজ মারবেন না! বলছি…বলছি।

বলার দরকারই নেই! অর্ণব ট্রিগারে আঙুল রেখে খুব ঠান্ডা কণ্ঠস্বরে বলল–টাইম আউট! তোকেও আমরা একটা ফ্রিজারে পাঠাবো। সরকারি ফ্রিজার। চ-বাই!

স্যার! আমি সত্যিই কিছু জানি না। সব ঐ গগনের কথায় করেছি। সে হাউমাউ করে অর্ণবের পা জড়িয়ে ধরেছে–প্লিজ শুনুন! গগন আমায় টাকা। দিয়েছিল। তিনটে লাশের জন্য দেড় লাখ…!

অর্ণব তখনও বন্দুক সরায়নি। তাকে গানপয়েন্টে রেখে চুপ করে তাকিয়ে। আছে। তার দৃষ্টি জ্বর, নিষ্ঠুর!

বলতে থাক। পবিত্র পেছন থেকে বলল–নয়তো…।

না। বলছি। লোকটা গড়গড়িয়ে বলতে থাকে–গগন বলেছিল কোন এক ম্যাডামের কথায় সে নাকি কাজ করে। ম্যাডাম খুব সুন্দরী। তিনি টাকা দেবেন। বেশি কিছু করতে হবে না। শুধু একটা লাশ কিছুদিনের জন্য ফ্রিজারে রেখে দিতে হবে। আমি ছাপোষা মানুষ। টাকার লোভে কাজটা করেছি স্যার।

ছাপোষা মানুষেরা ফ্রিজারে লাশ রাখে? অর্ণব গর্জন করে। ওঠে–ফাজলামি মারার জায়গা পাসনি! শালা চুতিয়া! তোকে তো…!

সে ফের অর্ণবের পায়ের ওপর পড়েছে–আমি এর বেশি কিছু জানি না। গগন রিসোর্ট থেকে চুপিচুপি লাশ বের করে আনত। এমনকি লাশগুলো কোন্ কটেজে থাকত তাও জানি না। গগন আগেই রাতের অন্ধকারে লাশগুলোকে বের করে ভেতরের বাগানে লুকিয়ে রাখত। ও ফোন করলেই আমি সুযোগ বুঝে চলে যেতাম। তারপর ফ্রিজারে রেখে দিতাম কিছুদিনের জন্য। গগন ফের এসে লাশ নিয়ে যেত। ততদিন আইসক্রিম পার্লার বন্ধ রাখতাম।

টাকা কে দিত তোকে?

গগনই দিত। পবিত্রর প্রশ্নের উত্তরে জানাল বিমান সাঁপুই–নগদে টাকা দিয়ে যেত।

ম্যাডামকে দেখিসনি? গগন তাঁর সম্পর্কে কিছু বলেনি?

একদিনও দেখিনি। তবে গগন বলেছিল কড়ক মাল। আর বলেছিল ম্যাডাম গায়ে হাবিজাবি ছবি আঁকাতে ভালোবাসেন। সে অর্ণবের পায়ের ওপরই কাঁপতে কাঁপতেই শুয়ে পড়েছে–আমি আর কিছু জানি না। আমি প্রত্যেকবারই কাজ হয়ে যাওয়ার পর ফ্রিজ সারাই কোম্পানির লোককে ফোন করতাম। এবার যে কে ওদের আগেই খবর দিয়ে দিল তাও জানি না! তার ওপর আপনারাও এসেছিলেন। আমি শুধু এইটুকুই গগনকে জানিয়েছিলাম। ও শালা হারামখোের আমাকেই ফাঁসিয়ে দিয়েছে!

অর্ণব তার দিকে একটা অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিপাত করে রিভলবারটা সরিয়ে নিল। তারপর গটগট করে বেরিয়ে গেল। পেছন পেছন পবিত্রও।

সু-পা-র্ব! পবিত্র বাইরে বেরিয়েই জোরে হেসে উঠল–কী অ্যাটিটিউড মামা! কিছুক্ষণের জন্য আমার তো মনেই হচ্ছিল যে অর্ণব সরকার নয়–অধিরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় কথা বলছে! শুধু হাইট আর ভয়েসটা অন্যরকম। রাজা হলে আরও একটু ভয়ংকর স্টাইলে কথা বলত। তবে তোমার স্টাইলটাও ঝিন-চ্যাক।

অর্ণব একটু বিষণ্ণ হাসল–এসব স্যারকে দেখেই শিখেছি। কে জানে কেমন আছেন এখন!

আজ বিকেলে কে গেল?

এডিজি শিশির সেন আর আহেলি।

ও। পবিত্র বলল–আমি কাল সকালে যাব তবে। আজ বরং গোল্ডেন মুনে ফরেনসিক টিমকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাই। প্রত্যেকটা রিসোর্ট খুঁজে দেখব। দেখি, যদি কিছু পাওয়া যায়।

ওকে।

অর্ণব নিজের টেবিলের দিকেই হেঁটে চলে যাচ্ছিল। মনটা ভারি হয়ে আছে। আজ একবার হসপিটালে যেতে পারলে বোধহয় ভালো হতো। কে জানে, ওদিকে কী অবস্থা। আহেলি আর এডিজি সেন গেছেন অবশ্য…।

হঠাই বুকপকেটে তার মোবাইলটা ভাইব্রেট করে উঠল। অর্ণব তাড়াতাড়ি ফোনটা বের করে দেখল স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে আহেলির নাম।

আশঙ্কায় তার হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠে।

*

অন্যদিকে ড. অসীম চ্যাটার্জী ফরেনসিক ল্যাবে অস্থিরভাবে পায়চারি করছিলেন। গেট কীপারের লাশ থেকে বলার কিছুই নেই। একদম পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে কেউ গুলি মেরেছে। এক গুলিতেই শেষ। তার গায়ে কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্টও নেই। বেসিক্যালি, তার দেহ থেকে কিছুই তেমন পাওয়া যায়নি। বাকি রইল বুলেট ও রিভলবারের বিষয়। রিভলবারে একমাত্র রিয়া বাজাজের আঙুলের ছাপে পাওয়া গিয়েছে। ঐ রিভলবার থেকেই দুটো গুলি বেরিয়েছে কিনা সেটা ব্যালিস্টিক এক্সপার্টরা বলবে।

দুই বিজয় জয়সওয়ালের গাড়িতে এভিডেন্সের জোরদার খোঁজ চলছে। এখনও পর্যন্ত তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি। তবু ফরেনসিক টিমের সদস্যরা হাল ছাড়েনি। তাঁর সহকারীরা প্রাণপণ তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু ড. বিজয় জয়সওয়ালের দেহটা যেন আপাদমস্তক রহস্য! লোকটা আন্দাজ প্রায় আশি ঘন্টা আগে মারা গিয়েছে। অথচ পাওয়া যাচ্ছে না কিছুই। আশ্চর্য! তার ধারণা ছিল পুলিশের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা কিছু বের করতে না পারলেও তিনি অন্তত কিছু পাবেন। ব্লাড থেকে পাকস্থলি, মাথার চুল থেকে নখ অবধি সবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন। অথচ কিছুই পাওয়া যায়নি। এখন তো তারও সন্দেহ হচ্ছে যে এগুলো সত্যিই খুন কি না! নয়তো এখনও মার্ডার ওয়েপনের কোনো খোঁজ মেলে না! নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিচ্ছেন। চিরদিনই নিজের বুদ্ধি নিয়ে জাক করে গেলেন! অথচ এই মুহূর্তে যখন তার একটা কথা কেসের অভিমুখ বদলে দিতে পারে, তখনই তিনি ব্যর্থ?

আপনমনেই ভ্রুকুটি করলেন অসীম চ্যাটার্জী–ব্যর্থ হব না আমি! কেউ পারেনি। কিন্তু আমি উ. অসীম চ্যাটার্জী। কলকাতার সবচেয়ে অভিজ্ঞ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ! কেন ফেল মারব?

কিন্তু ব্যাপারটা আদতে হচ্ছে কী! ড. বিজয় জয়সওয়ালের দেহে লাভ বাইটের দাগ স্পষ্ট। মৃত্যুর আগে তিনিও অর্জুন শিকদারের মতই সেক্স করেছিলেন। তারপরই মরে গেল লোকটা! আগের দু বার ভিকটিম ছয় থেকে সাতদিন বেঁচে ছিল। এবার অতদিন বাঁচেইনি! খুনির এত তাড়া কেন? তাছাড়া কী করেই বা মরল! গায়ে লাভ-বাইট ছাড়া আর কোনো দাগ নেই! পাকস্থলি খাদ্যহীন। বিষ যদি হয়–সেটা শরীরে গেল কী করে? উত্তর নেই। মৃত্যুর কারণ যথারীতি সেই অ্যাকিউট হেপাটিক ও রেনাল ফেইলিওর! আশ্চর্য! আজকাল কী লিভার ড্যামেজ আর রেনাল ফেইলিওর নামক জিনিসগুলো থালায় কিনতে পাওয়া যাচ্ছে? নাকি দুনিয়ার সব মাতাল ও দুশ্চরিত্ররা ঠিক করেছে লিভার বরবাদ করেই মরবে। হাউ? হাউ?

অধিরাজের জামাকাপড় ও মোবাইলও পরীক্ষা করে দেখেছেন তিনি। মোবাইলটা খুব সযত্নে মুছে দেওয়া হয়েছে। কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই। তবে তার জ্যাকেটে ফিঙ্গারপ্রিন্ট খোঁজা শক্ত। এত লোকে ছুঁয়েছে যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট তোলাই মুশকিল। গান পাউডারের ট্রেস অবশ্য আছে। সেটা রিয়া বাজাজের আঙুল থেকে আসাও সম্ভব। কিন্তু যে জিনিসটা দেখে চমকে গেছেন তা হলো তার টি-শার্টেও স্ট্রবেরি লিপবামের ট্রেস রয়েছে! সেই স্ট্রবেরি লিপবাম যা অধিরাজের ঠোঁটেও লেগেছিল। তিনি পবিত্র আচার্যর কাছ থেকে জেনেছেন ওরা কেউ তাকে সিপি আর দেয়নি। তবে দিল কে? যে দিয়েছিল সম্ভবত সেই টি-শার্টটা দাঁত দিয়ে ছিড়বার চেষ্টা করেছিল। সে রিয়া বাজাজ হতে পারে না! মানসী জয়সওয়াল হতেই পারেন না! তিনি অধিরাজকে কামড়ে দিতে পারেন, চুমুও খেতে পারেন–কিন্তু কিস্ অব্ লাইফ দেওয়া তাঁর কর্ম নয়! এ জিনিস সে-ই পারে যে সিপিআর দিতে জানে। মেডিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড যার আছে।

ফের বিড়বিড় করে উঠলেন তিনি–রাজা, কী করছ তুমি! মালি তো একটাই! প্রশ্ন হলো ফুল কী দুটো? একটা মানসী জয়সওয়াল হলে দ্বিতীয়টা কে ভাই!

হয়তো আরও কিছুক্ষণ নিজের মনে বকে যেতেন ড. চ্যাটার্জী। তার আগেই মোবাইল বেজে উঠেছে। তিনি আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন আহেলি ফোন করছে।

হ্যালো!

ফোনটা ধরতে না ধরতেই ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এল আহেলির ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর–স্যার, এখনই হসপিটালের আইসিইউ তে চলে আসুন। অফিসার ব্যানার্জী যেন কেমন করছেন!

কেমন করছে মানে? তাঁর হৃৎপিণ্ড যেন ট্র্যাপিজ প্লেয়ারের মতো ভল্ট খেল–কী হয়েছে? সেন্স এসেছে?

না। চোখ বোজা। ওঁর ডেলিরিয়াম হচ্ছে। আহেলি প্রায় কেঁদেই ফেলে–উনি অক্সিজেন মাস্ক, চ্যানেলগুলো আরেকটু হলেই টানাটানি করে খুলে ফেলছিলেন। কেমন যেন পাগল পাগল হাবভাব। একজন ওয়ার্ডবয়কে এমন ধাক্কা মেরেছেন যে আরেকটু হলেই পড়ে গিয়ে মাথাটা ফাটতো। ওয়ার্ডবয়রা সামলাতে না পেরে হাত বেঁধে দিয়েছে। তার ওপর কীসব ভুল বকছেন। বডি টেম্পারেচার ওয়ান ও ফোর ফারেনহাইটেরও বেশি। স্যাচুরেশন। লেভেল কম। ব্লাড প্রেশার ক্রমাগতই ফ্লাকচুয়েট করছে। এডিজি সেন, ওঁর পেরেন্টস কী করবেন বুঝতে পারছেন না।

তাতে কী হয়েছে। তিনি যেন আহেলিকে বোঝানোর বদলে নিজেকেই বোঝাচ্ছেন–হাই ফিভার হলে ডেলিরিয়াম হতেই পারে। ভুল বকতেই পারে। আর ও যে লাফালাফি করবে সেটাই তো স্বাভাবিক। যেরকম শান্ত ছেলে তাতে অতগুলো নল চুপচাপ সহ্য করলেই বরং আশ্চর্য হতাম! ডাক্তাররা হাত বেঁধে দিয়ে ঠিকই করেছেন। যদিও সে দড়ি কতক্ষণ টিকবে বলা মুশকিল।

কিন্তু অফিসার ব্যানার্জী কিছু একটা বলার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। একবার অক্সিজেন মাস্ক টান মেরে খুলে ফেলেছিলেন। তখনই বারবার আপনার নাম নিয়েছিলেন। অর্ণব সরকারকেও ডাকছেন! আপনাদের দুজনকেই খুব হেল্পলেসভাবে ডাকছেন তিনি, স্যার। কী বলছেন, অক্সিজেন মাস্কের জন্য বোঝা যাচ্ছে না। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।

ড. চ্যাটার্জী আর একমুহূর্তও দেরি না করে বললেন–ওকে। আসছি।

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের কাজ মাথায় উঠল। তিনি ল্যাবের দায়িত্ব অন্য একজনকে দিয়ে সবেগে বেরিয়ে গেলেন। নিজের গাড়ির দিকে দৌড়াতে দৌড়াতেই অর্ণবকে ফোন করলেন। অর্ণবও ততক্ষণে সংবাদ পেয়েছে। সেও হসপিটালের দিকেই যাচ্ছে।

গিয়ে আবার কোনোরকম হুলস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে বোসো না। ড. চ্যাটার্জী তাকে সাবধান করেন–রাজা প্রলাপ বকছে ঠিকই, কিন্তু প্রলাপের মধ্যেও কাজের কথা কিছু থাকতে পারে। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করবে ঠিক কী বলছে। আর ওকে ডাকাডাকি করবে না–শুধু শুনবে।

ঠিক আছে।

তাড়াহুড়ো করে, যানজট ঠেলে যতক্ষণে হসপিটালে পৌঁছলেন ড. চ্যাটার্জী ততক্ষণে সেখানে রীতিমতো দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়ে গিয়েছে। অধিরাজের বাবা-মা, আহেলি, অর্ণব, এডিজি শিশির সেন বাইরেই চিন্তিত গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ড. চ্যাটার্জী এডিজি সেনকে দেখে সসম্ভ্রমে বললেন–আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন স্যার? ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না?

না! তিনি খুব শান্তভাবেই বলেন–দিয়েছিল। কিন্তু এভাবে কখনো রাজাকে দেখিনি। ভালো লাগছে না। আপনি প্লিজ ডাক্তারদের দেখুন। ওঁরা ওকে সামলাতে পারছে না। ক্রমশ রেস্টলেস হয়ে যাচ্ছে।

স্বাভাবিক! পেশেন্ট যদি এত অস্থির হয় তবে ডাক্তারদের পক্ষেও তাকে সামলানো কষ্ট। অধিরাজের মারপিট করার ক্ষমতা এই মুহূর্তে নেই। কিন্তু যেটুকু আছে, তা সবাইকে ঘোল খাইয়ে ছাড়ার পক্ষে যথেষ্ট। ড. চ্যাটার্জী দেখলেন–সে রীতিমতো ছটফট করছে। ভীষণ অস্থির, অশান্ত। যতবার তার হাত বাঁধা হচ্ছে, ততবারই দড়ি ছিঁড়ে ফেলছে। অক্সিজেন মাস্ক, চ্যানেল সমেত যাবতীয় নল পছন্দ হচ্ছে না বলে টান মেরে খোলার উপক্রম করছে। ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসক রীতিমতো বিপন্ন। ড. চ্যাটার্জীকে দেখেই বলে উঠলেন- কী করি বলুন তো। অফিসার যা শুরু করেছেন তাতে কী করব বুঝতে পারছি না। একজন ওয়ার্ডবয়কে ঠেলে ফেলে দিয়েছেন। হাত বেঁধেছিলাম। কিন্তু তিনি ছিঁড়ে ফেলেছেন। এত ছটফট করছেন যে একবার বেড থেকে পড়েই গিয়েছিলেন! এখন তো আমিও এগোতে ভয় পাচ্ছি। ঐ হাতের ঘুষি খেলে আর দেখতে হবে না! ওদিকে আইজি, সিআইডি! গায়ে হাত দিতেও ভয় করছে। কিন্তু এরকম হলে ওঁকে বাঁচানো অসম্ভব!

কী দড়ি দিয়ে বেঁধেছিলেন?

প্রথমে সাধারণ দড়ি দিয়েছিলাম। তাতেও কিছু হচ্ছে না দেখে শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধেছিলাম। ড. রীতিমতো নার্ভাস–কিন্তু সেটাও একটু আগেই ছিঁড়ে গেল।

ড. চ্যাটার্জী এক মুহূর্ত ভাবলেন–মোটা নাইলনের দড়ি আছে?

নাইলনের দড়ি!

হা। থাকলে নিয়ে আসুন। অবাধ্য পেশেন্ট হলে আসুরিক ব্যবস্থাই করতে হবে। আর শুধু হাত বাঁধবেন না। ও একজন অত্যন্ত দক্ষ সিআইডি অফিসার। সজ্ঞানে থাকলে এরকম করত না। কিন্তু এখন যেটা করছে, সেটা রিফ্লেক্স অ্যাকশন! হাত বাঁধলে সেটা কী করে খুলতে হয়–খুব ভালোভাবেই জানে। এক্সপার্ট লোক। আপনি যতই কায়দা করে বাঁধুন ঠিক খুলে ফেলবে। এভাবে আটকানো যাবে না।

ডাক্তারবাবু রুমালে মুখ মুছে বললেন–তবে?

মাথা থেকে পা অবধি এমনভাবে টাইট করে বাঁধুন যাতে নড়াচড়াই না করতে পারে। আপনি দড়ির ব্যবস্থা করুন। আমি দেখছি।

যদি মেরে ধরে দেন!

ড. চ্যাটার্জী হেসে ফেললেন। একটা অজ্ঞান, অসহায় লোককে কী ভয়ই না পাচ্ছে এরা! ওঁদেরও দোষ নেই। আজকাল লোকে কথায় কথায় ডাক্তারদের গায়ে হাত তোলে। কিছুদিন আগেই এক পুলিশ অফিসার এক ডাক্তারকে থাপ্পড় মারায় প্রচুর ঝামেলা হয়েছিল। এই চিকিৎসকও সেই ভয়টাই পাচ্ছেন।

আপনি শুধু দড়িটা আনুন। বাকিটা আমরাই দেখে নিচ্ছি।

ড. চ্যাটার্জী এবার বাইরে বেরিয়ে অধিরাজের মা-বাবাকে ডেকে নিলেন। অধিরাজের মায়ের চোখ দুটো লাল। ফুলো ফুলো। তাঁকে ভেতরে ডেকে নিয়ে বুঝিয়ে বললেন–দেখুন, ছেলে যতই ডেলিরিয়ামে থাকুক, মায়ের স্পর্শ সে ঠিকই চিনবে। আমাদের কথা ও শুনতেও পাবে নাবুঝতেও পারবে না। কিন্তু মায়ের কণ্ঠস্বর মানুষ এমন স্টেজ থেকে শুনে আসে যখন সে সম্পূর্ণ অচেতন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে থেকেই যে স্বর শুনে এসেছে, তাকে চিনতে ভুল হবে না। এমনও কেস আছে, যেখানে কোমায় থাকা সন্তানও মায়ের ডাক শুনে সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছে। অশান্ত ছেলেকে একমাত্র তার মা শান্ত করতে পারেন। আপনি একটু দেখুন ম্যাডাম।

অধিরাজের মা কোনো কথা না বলে এগিয়ে গেলেন ছেলের দিকে। তার বেডের পাশের টুলটায় বসে জ্বরতপ্ত কপালে হাত রেখে আস্তে আস্তে ডাকলেন–রাজা!

উঁ..উঁ?

অধিরাজের দেহটা কেঁপে উঠল। অশান্ত মানুষটা এবার যেন খণ্ড মুহূর্তের জন্য একটু স্থির হলো। তার হাত দুটো এবার অন্ধ মানুষের মতো হাতড়ে হাতড়ে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে। মা তার হাত ধরে ফেললেন–এই তো আমি! কী কষ্ট হচ্ছে?

অধিরাজ বিড়বিড় করে কিছু বলল। মুখে অক্সিজেন মাস্ক থাকার ফলে কথাগুলো স্পষ্ট নয়। কিন্তু ড. চ্যাটার্জীর অভ্যস্ত কানে ধরা পড়ল কথাটা আসছি মা! আর দু মিনিট!

রেসপন্স করছে। ভুল রেসপন্স। কিন্তু চিনতে পেরেছে। ড. চ্যাটার্জী বললেন–আপনি ওর দু হাত ধরে কথা বলতে থাকুন। আমরা সেই ফাঁকেই কাজ সেরে ফেলি।

যেমন কথা তেমনই কাজ। মা ছেলের মাথায়, বুকে হাত বুলিয়ে, আদরে কথায় ভুলিয়ে রাখলেন। সেই সুযোগেই দুজন ওয়ার্ডবয়সহ ড. চ্যাটার্জী ও অর্ণব তাকে বিছানার সঙ্গে টাইট করে বাধল। এমনকি স্বয়ং এডিজি শিশির সেনও হাত লাগালেন। এখন লাফালাফি তো দূর, সে সামান্য নড়াচড়াও করতে পারবে না। কাজ শেষ করে বেডের চারপাশের রেলিংগুলো তুলে দিয়ে বললেন ড. চ্যাটার্জী-এবার দেখি যাদু, তোমার গায়ে কত জোর ক্ষমতা থাকলে এই দড়িটা ছিঁড়ে বেড় থেকে পড়ে দেখাও।

অর্ণব…অর্ণব…!

ড. চ্যাটার্জী অর্ণবের দিকে তাকালেন। অর্ণব এগিয়ে গেল–স্যার!

আরও একটা…আরও একটা…!

শুধু এই দুটো শব্দই শোনা গেল। বাকি কথাগুলো ফের অক্সিজেন মাস্কে আটকে গিয়েছে। ড. চ্যাটার্জী নিরুপায়ের মতো তাকালেন ডাক্তারবাবুর দিকে কিছুক্ষণের জন্য অক্সিজেন মাস্কটা সরানো যাবে? জাস্ট ফর আ সেকেন্ড।

ডাক্তারবাবু একবার তাঁদের সবার দিকে তাকালেন। তারপর শ্রাগ। করলেন–ওকে। তবে বেশিক্ষণের জন্য নয় কিন্তু!

অক্সিজেন মাস্ক খুলে গেল। অধিরাজ ফের বিড়বিড় করে ওঠে। কণ্ঠস্বর স্খলিত, ক্ষীণ–আরও একটা… আরও একজন…বাজাজ…বাজাজ এখনও আছে। আবার…আর আইপি পোস্ট…বেশি সময় নেই…সময় নেই। প্রিয়া…জয়সওয়াল! অহল্যা…অহল্যা…!

অর্ণব বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। কী বলছে? আবার আর আইপি পোস্ট পড়বে! এ তো সাধারণ প্রলাপ মনে হচ্ছে না!

অর্ণব-অর্ণব স-র-কা-র! এবার সে যেন একটু জোরেই বলল কোথায়?

অর্ণব উত্তর দিতেই যাচ্ছিল। ড. চ্যাটার্জী ইশারা করে তাকে চুপ থাকতে বললেন। অর্ণব উত্তর দিলেও সে চিনতে পারবে না। বুঝতেও পারবে না। তার যা বলার সে এমনিই বলবে।

শীত…শীত করছে…শীত…ঠান্ডা…বরফ!

এবার অর্থহীন কথাবার্তা! অক্সিজেন মাস্ক সরে যাওয়ায় তার নিঃশ্বাস নিতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে। একটু দম নিয়েই কোনোমতে হাঁফাতে হাঁফাতে ফের বলে উঠল সেড-ক! হোয়াই! হোয়াই! হোয়াই নাইন্টি সিক্স? হোয়াই ওয়ান টুয়েন্টি? হোয়াই নট টুয়েলভ অর টুয়েন্টি ফোর? ফ্রিজ… কেন?… হোয়াই?

ড. চ্যাটার্জী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন অধিরাজের দিকে। ঠিক কী বলছে?

এবার হয়নি…নাইন্টি সিক্স হয়নি..ব্লান্ডার…হোয়াই ড.? সে ফের জোরে চেঁচিয়ে উঠল–উত্তরটা কী? আর মি ড!

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ বিস্মিত, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছেন। কোন প্রশ্নের উত্তর অবচেতনে খুঁজে বেড়াচ্ছে অধিরাজ? তিনি যেন এখন একটু একটু বুঝতে পারছেন। বোধহয় ধরতে পারছেন, কী বলতে চাইছে সে!

মা…আমায় মারছ কেন?…আমার বুকে…বুকে…!

বলতে বলতেই ফের ছটফট করে উঠেছে। যেভাবে শ্বাস নিচ্ছে তাতে স্পষ্ট, আর টানতে পারছে না। ডাক্তার দ্রুতহাতে তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক পরাতে পরাতে বললেন–সরি। আর অ্যালাউ করতে পারছি না। তিনি নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। আপনারা প্লিজ এবার বাইরে যান।

অর্ণব লক্ষ্য করল ড. চ্যাটার্জীর জ্বরু দুটো ফের শুয়োপোকা মূর্তি ধারণ করেছে। অধিরাজের মা ছেলের মাথায় হাত বোলাচ্ছিলেন। তিনি একটু অপ্রতিভ দৃষ্টিতে তাকালেন। বোধহয় এখনই ছেলেকে ছেড়ে ওঠার ইচ্ছে নেই।

এক মিনিট ড.। ড. চ্যাটার্জী এগিয়ে গেলেন অধিরাজের দিকে একটা জিনিস একটু দেখি।

শিওর।

অধিরাজ এখন অনেকটাই শান্ত। তবে এখনও খুব ক্ষীণস্বরে কী যেন বিড়বিড় করছে। ড. অসীম চ্যাটার্জী চাদরটা সরিয়ে তার অনাবৃত ঘাড়, গলা, কাঁধ, বুক খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিলেন। হঠাই কী দেখে যেন তার চোখ দ করে উঠল। দাঁতে দাঁত পিষে বললেন–ব্লাডি বিচ্যু!

অর্ণব কৌতূহল সামলাতে না পেরে ড. চ্যাটার্জীর প্রায় ঘাড়ের ওপর দিয়েই ঝুঁকে পড়ল। যা দেখল তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ! অধিরাজের গলা এবং ডান কাঁধের সঙ্গমস্থলে জ্বলজ্বল করছে খুব সামান্য একটা রক্তাভ চিহ্ন! লাভ বাইট!

সর্বনাশ! সে বলতেই যাচ্ছিল–হি…!

হিকি! ড. চ্যাটার্জী ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে ইশারায় তাকে থামালেন। সেটাই স্বাভাবিক। কোনো মায়ের সামনে এসব কথা না বলাই ভালো। কিন্তু অর্ণবের মনে হল–এবার তার মাথা ঘুরছে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে খুব নিচু গলায় কিছু বলে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেলেন। এডিজি সেন অধিরাজের বাবার সঙ্গে কথা বলছিলেন। ওদের বেরিয়ে আসতে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।

আমার মনে হয় রাজার ব্লাড থেকে শুরু করে টিস্যু, পা থেকে মাথা পর্যন্ত ইনভেস্টিগেট করা দরকার। এমনকি যদি কিছু খেয়ে থাকে–দরকার পড়লে সেগুলোও টেস্ট করা দরকার। ড. চ্যাটার্জী গম্ভীর মুখে বললেন–যদি কোনোরকম এভিডেন্স থাকে।

ইউ মিন্…! এডিজি সেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন–পয়জন?

শিয়োর নই। ড.কে বলে এসেছি। তিনি টেস্ট করবেন বলেছেন। দেখা যাক। তাঁর চোখে অদ্ভুত একটা কুটিল দৃষ্টি–আসছি স্যার।

হসপিটালের বাইরে বেরিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ ধূমপান করলেন অসীম চ্যাটার্জী। অর্ণব আর আহেলিকে চা অফারও করলেন। তাঁর মাথায় কিছু যে ঘুরছে তা মুখভঙ্গিতেই স্পষ্ট। অর্ণব কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। তার এখনও সন্দেহ যে হিকিজের মাধ্যমে কিছু না কিছু তো হচ্ছেই। অধিরাজের সঙ্গে যে সর্বনাশিনীর দেখা হয়েছে তা ঐ ছোট্ট দাগটাই স্পষ্ট বলে দেয়। আসলে তবে হয়েছিলটা কী?

সে একটু আমতা আমতা করে বলে–স্যার কী বললেন কিছু বুঝেছেন?

কিছুটা তো ভুলভাল! অত ফিভার থাকলে তো ভুল বকবেই। ড. চ্যাটার্জী সিগারেটটাকে ফেলে দিয়ে বললেন–কিন্তু প্রশ্ন হলো, যেটা অর্থহীন নয় সেটা ঠিক কী?

মানে?

মানে আসল প্রশ্নটা ও ঠিকই করেছে। আমরা ভাবছিলাম–হোয়াট? হাউ? ও সঠিক অ্যাঙ্গেলটাই ধরেছে। প্রশ্নটা হোয়াট বা হাউ নয়–হোয়াই! এই প্রশ্নটাই ওর মাথায় স্ট্রাইক করেছে।

হোয়াই!

হ্যাঁ। আমি যা বুঝেছি তা তোমায় বলছি। ড. চ্যাটার্জী একটু চুপ করে থেকে বললেন–রাজার প্রশ্নটা ছিল হোয়াই নাইন্টি সিক্স? হোয়াই ওয়ান টুয়েন্টি? হোয়াই নট টুয়েলভ অর টুয়েন্টি ফোর? হোয়াই? ফ্রিজ… কেন? তাই তো? আসলে এই নাইন্টি সিক্স, ওয়ান টুয়েন্টি, টুয়েল আর টুয়েন্টি ফোর সংখ্যাগুলো ও আনতাবড়ি বলেনি। এগুলো আওয়ার্স। মানে ঘন্টা। ও লাশগুলো ডাম্প করার প্যাটার্নটা বোঝাতে চাইছিল আমাকে। কেন লাশগুলো ঠিক ছিয়ানব্বই ঘণ্টা বা একশো কুড়ি ঘন্টার পরে পাওয়া গিয়েছিল? চব্বিশ ঘণ্টা বা বারো ঘণ্টা পরে সুযোগ বুঝে ডাম্প করা হয়নি? ফ্রিজার ইউজ করতে হলো কেন? এই প্রশ্নেরই উত্তর চাইছিল ও। তার কপালে গভীর ভজ–জাতে মাতাল তালে ঠিক। ভুল বকার মধ্যেও সঠিক কথাটাই বলেছে।

অর্ণবের মনে পড়ল–ঐ ম্যানেজারও বলেছিল, তারা ভাবতেই পারেনি যে রেফ্রিজারেটর সারাই করার লোক এত তাড়াতাড়ি খবর পাবে! তার মানে এবারও ওরা দেরিতেই ডাম্প করার তালে ছিল। অধিরাজের একটা ফোনেই সব ভেস্তে গিয়েছে।

সে কথা বলতেই ড. চ্যাটার্জী প্রায় লাফিয়েই উঠলেন–রাইট ইউ আর। রাজাও সেটাই বলছিল। ও বলছিল–এবার ছিয়ানব্বই হয়নি! ব্লান্ডার! রাজার হুড়ো খেয়ে সত্যিই ব্লান্ডার করেছে! এইবার আশি ঘণ্টার সামান্য বেশি হয়েছে কিন্তু ছিয়ানব্বই হয়নি। এইবার ভুল করেছে অর্ণব! আর এইবার আমি ছাড়ছি না। আহেলি…কুইক! ই-উ-রে-কা!

আহেলিকে প্রায় বগলদাবা করেই গাড়ির দিকে ছুটলেন ড. অসীম চ্যাটার্জী।

*

আমি সাগরের বেলা, তুমি দূরন্ত ঢেউ
বারে বারে শুধু আঘাত করিয়া যাও।
ধরা দেবে বলে আশা করে রই, তবু ধরা নাহি দাও
বারে বারে শুধু আঘাত করিয়া যাও।

আবার একটা নিঃশব্দ রাত। চতুর্দিক নিস্তব্ধ, নিঝুম। তার মধ্যেই ভেসে আসছে গানের সুর। ঘরে খুব স্তিমিত আলো জ্বলছে। সে আলো এমনই যে টর্চ মেরে দেখতে হবে আদৌ আলোটা জ্বলছে কিনা! সেই আলো-আঁধারিতে ঠিকভাবে কাউকেই দেখা সম্ভব নয়। অবশ্য খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে আধো অন্ধকারে মিশে একটা অস্থির ছায়া বিক্ষিপ্তভাবে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে।

গানটা ডিভিডি প্লেয়ারে বাজছিল। মান্না দের দরদী কষ্ঠ পরম আকুলতায় কোনো এক নিষ্ঠুর প্রেমিকের উদ্দেশ্যে প্রেমে উপচে পড়ছে। গানটা শুনলেই বুকের মধ্যে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা পাক মারে। মনে হয়, যেন সত্যিই কাউকে ভালোবাসার কথা ছিল। কিন্তু আজও হলো না। যা হতে পারত, তা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। এক বিশাল সমুদ্রতটের মতো শূন্য-তৃষিত বুক নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। কেউ তরঙ্গ হয়ে বারবার ঝাঁপিয়ে পড়ছে সেই বুকে। অথচ নিমেষের মধ্যেই সরে যাচ্ছে। তাকে ধরার উপায় নেই। চোখের সামনেই জল ছলছল করছে, অথচ তার বুকে শুধু বালি। তরঙ্গের পর তরঙ্গ শুধু ব্যথাই দিয়ে চলেছে। আর কোনো প্রাপ্তি হলো না।

মা-ও এই গানটা খুব গাইতেন। পুরনো দিনের গান গাইতে ভালোবাসতেন খুব। গলাটা অপূর্ব ছিল তার। এত মিষ্টি আর সুরেলা কণ্ঠস্বর আর কখনো শোনেনি সে। মায়ের মুখে কতবার যে এই গানটা শুনেছে সে! যখন গাইতেন বারে বারে শুধু আঘাত করিয়া যাও–তখন মনে হতো সত্যিই আহত বুকের পাঁজর থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। চোখ দুটো কাতর এক প্রত্যাশায় তাকিয়ে থাকত বাইরের দিকে। মেঘের মতো চুল পিঠ ছাপিয়ে পড়ত। কণ্ঠস্বরে আবেগ পাখির পালকের মতো তিরতিরিয়ে কাঁপত। মা গাইতেন। আর সে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। ভাবত মানুষটা কী এতই কালো যে তার বাকি গুণগুলোকেও সেই কালি ভেদ করে দেখা যায় না! কোকিলকণ্ঠীর কণ্ঠের চেয়েও তার কালো রঙটাই বেশি গুরুত্ব কেন পায়? গান শুনেও কী একবারও ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না মানুষটাকে!

জানি না তোমার এ কি অকরুশ খেলা,
তব প্রেমে কেন মিশে রয় অবহেলা
পাওয়ার বাহিরে চলে গিয়ে কেন আমারে কাঁদাতে চাও।
বারে বারে শুধু আঘাত করিয়া যাও…!

অবহেলা, কান্না আর আঘাত–এই তিনটে নিজের জীবনে অনেক দেখেছে ও। অবহেলার চূড়ান্ত প্রকাশ কতটা জঘন্য এবং তার ফলাফল কী হতে পারে তা তার মতো ভালো কেউ জানে না! এক কৃষ্ণবর্ণা নারী নিজের পরাজয়ের ইতিহাস রক্তাক্ষরে লিখে গিয়েছে তার সামনেই। একটু একটু করে সে চলে গিয়েছিল মৃত্যুর খুব কাছে। মেয়েটা শুধু দেখেছে! অসহায়ের মতো নিজের সবচেয়ে বড় অবলম্বনকে ধুঁকতে ধুঁকতে মরতে দেখেছে সে। কিছু করতে পারেনি। কিছু না! …

ভাবতে ভাবতেই তার হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ওঠে। লোকটা কীভাবে মেরে ফেলল একটা আস্ত মানুষকে! এর চেয়ে তো গর্দান নিলেই ভালো হতো! বড়োজোর কয়েক সেকেন্ডের জন্য ধড়ফড় করত, কষ্ট পেত। কিন্তু এইভাবে চরম অবহেলায়, আঘাতে আঘাতে একটু একটু করে যে মৃত্যু দেওয়া হয় তার চেয়ে কঠিন শাস্তি আর কিছু নেই। সে চোখ গোল গোল করে সবিস্ময়ে দেখত মাকে একধাক্কা মেরে ঘর থেকে বের করে দিল লোকটা। সেই ধাক্কা সামলাতে

পেরে মা পড়ে গিয়েছে! কপাল থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে নাকের ওপর। নাকের ডগায় ঝলমলে চুনীর নাকছাবির মতো রক্তবিন্দু! সে দু হাত বাড়িয়ে দৌড়ে যেত তার কাছে–মা…!

কিছু হয়নি। মা অপ্রস্তুত হয়ে সব যন্ত্রণা মুহূর্তের মধ্যে ঢেকে ফেলেন। তাড়াতাড়ি তাকে গভীর স্নেহে, মমতায় বুকে টেনে নিয়েছেন তিনি–আমি আর বাবা খেলা করছি। যেমন তুমি আর তোমার বন্ধুরা খেলা করো–তেমন আমরাও খেলছি।

ছোট্ট মেয়েটার বিশ্বাস হয় না। তারা যখন খেলা করে তখন পড়ে গেলেও কারো মাথা ফাটে না। তাছাড়া বেডরুমের ভেতর থেকে কীরকম অদ্ভুত আওয়াজ আসছে! বেডরুমে কে আছে? কে ভেতরে?

সে মায়ের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়াল বেডরুমের দিকে। দরজাটা ভেজানো ছিল। ধাক্কা মারতেই…!

মা…! কী করছিস! ওদিকে যাস না! তার মা ঝাঁকিয়ে উঠলেন–দাঁড়া…!

কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। নিষিদ্ধ দরজায় দাঁড়িয়ে নিষ্পাপ শৈশব! বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে। বাবা অন্য একটা মেয়েকে বিছানায় নিয়ে খেলা করছে কেন? এইমাত্র মায়ের সঙ্গে খেলছিল না? মাকে মারল! আর এই মেয়েটাকে কী করছে! এই মেয়েটাই বা কে!

লোকটা তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে গর্জে উঠল–হোয়াট? এখানে কী চাই?

সে ধমক খেয়ে একটু কেঁপে উঠল। কিন্তু বাচ্চাটা কিছু করার আগেই মা শশব্যস্তে কোলে তুলে নিয়েছেন তাকে। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে একরকম দৌড়েই চলে গেলেন সেখান থেকে! তাঁর অপমানে, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া মুখটা আজও মনে পড়ে…।

তখন সে কিছু বুঝতে পারেনি। কিন্তু এখন? তার মায়ের অবহেলিত, অপমানিত দিনগুলো যতবার মনে পড়ে ততবার যেন ধমনীর মধ্যে রক্ত টগবগিয়ে ফুটতে থাকে। কত রাত যে অভুক্ত থেকেছেন মা তার খবর কেউ রাখত না। ধূম জ্বর গায়ে নিয়ে নিত্যনৈমিত্তিক কাজ মুখ বুজে করে গিয়েছেন। আসলে মা তো ঐ নোংরা মেয়েটার আসার সঙ্গে সঙ্গেই মরে গিয়েছিলেন! দেহটাই শুধু বাকি ছিল। অনাহারে, অসুখে-বিসুখে ক্রমশ জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হয়ে চলেছিলেন। তাঁর ফ্যাকাশে ঠোঁট, নিষ্প্রভ চোখ রক্তশূন্যতায় কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। ঠিক যেন ব্ল্যাকবোর্ডে আঁকা কোনো ছবিকে একটু একটু করে মুছে দিচ্ছে একটা হাত। মা ক্ষীণতর হতে হতে কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছিলেন। তার ভয় হতো–হয়তো কোনোদিন মিলিয়েই যাবেন তিনি! সেই ভয়ে রাতে মাকে দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে ঘুমোত সে। ভয় পেত, চোখ খুললেই যদি দেখে মানুষটা নেই! অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে!

শেষ পর্যন্ত তার ভয়টাই সত্যি হলো! মা একদিন সত্যিই মিলিয়ে গেলেন। সে চোখের সামনে তাকে একটু একটু করে সম্পূর্ণ রক্তশূন্য হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছিল। একটা মানুষের অবহেলাই শেষ করে দিল সবকিছু…।

অবহেলা! …অবহেলা! …মেয়েটার গোটা মস্তিষ্কে শব্দটা ছোট ছোট আলপিনের মতো ফুটেই চলেছে। সে নিজে অবহেলা বরদাস্ত করতে পারে না! তার আফ্রোদিতির মতো অপূর্ব মুখশ্রী মেডুসার মতো ক্রুর হয়ে ওঠে। চোখ দুটোয় বাঘিনীর দৃষ্টি। অবহেলা নয়! কেউ তাকে অবহেলা করতে পারবে না! কেউ না! করুণা, অবহেলা–কোনোটাই না! কোনো পুরুষের সাধ্য নেই তাকে প্রত্যাখ্যান করে! নীরব উদাসীনতায় তাকে অবজ্ঞা করার ক্ষমতা সে কাউকে দেবে না! কখনো না!

তার চোখের খরদৃষ্টি কী মনে পড়তেই আস্তে আস্তে ফের কোমল হয়ে আসে। হঠাৎ মনে পড়ে যায় সেই গাঢ় চন্দন রঙের মুখ! নিমীলিত চোখের দীর্ঘ অক্ষিপল্লব। সারা মুখে ঘাম অভ্রের মতো চিকচিক করছিল। ঘামে ভেজা অবাধ্য চুলগুলো কপাল ছুঁয়ে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিল। কী ধারালো মুখের আদল! সেই মুহূর্তটা কী অদ্ভুত! সারাজীবনে হয়তো আর কখনো ঐ মুহূর্তটা আর ফেরত পাওয়া যাবে না! ঐ সময়টুকু শুধু লোকটা একান্তভাবে তারই ছিল। সে নিচু হয়ে ঘাম, পারফিউম আর সিগারেটের সম্মিলিত পুরুষালি গন্ধটা বুক ভরে নিয়েছিল। উত্তপ্ত কপালে আঙুল বুলিয়ে সিক্ত কুন্তলচুর্ণ সরিয়ে দিতে দিতে মনে মনে ভেবেছিল–সারাজীবন চুলোয় যাক। যতক্ষণ না তোমার সাঙ্গপাঙ্গ এসে না পৌঁছচ্ছে, ততক্ষণ তুমি আমার! এই যে শ্বাস নিচ্ছ এটা আমারই দেওয়া! এই অক্সিজেনটা কে দিয়েছে সেটাও তোমাকে জানতেই হবে। যতদিন শ্বাস নেবে-ততদিন তোমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে সর্বনাশিনীও থাকবে। আমায় অবহেলা করার সাধ্য তোমার নেই।

ভাবতে ভাবতেই কৌতুকময়ী মৃদু হাসল। ঝকঝক করে উঠল তার দাঁত। লোকটা যখন লাভ বাইটটা দেখবে তখন ওর মুখটা ঠিক কেমন হতে পারে! কী মজা! ভারি মজার ব্যাপার! ভীষণ কৌতুকে সে সজোরে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই বালিশে মুখ গুঁজে ফেলল। থরথর করে কেঁপে উঠল তার শখের মতো সাদা পিঠ।

দুরন্ত হাসিতে? না অদম্য কান্নায়!

মান্না দে গেয়েই চললেন—

আসে আর যায় কত চৈতালি বেলা,
এ জীবনে শুধু মালা গেঁথে ছিঁড়ে ফেলা।
কোন্ সে বিরহী কাঁদে মোর বুকে, তুমি কি শুনিতে পাও?
বারে বারে শুধু আঘাত…!

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *