৫. স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না

ওটাও স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না! তবু ডাক্তাররা ন্যাচারাল ডেথের সার্টিফিকেটই দিয়েছিলেন। কিন্তু সে জানে ওটা খুন ছিল! একদম ঠান্ডা মাথায় প্রি-প্ল্যানড মার্ডার! একটু একটু করে! তিলে তিলে…!

তার চোখের সামনে নির্বিবাদে পুড়ে গেল একটা মানুষ! চিরদিনের জন্য কালো ছাই হয়ে গেল! কালো ছাই! …

কালো ছাই? মেয়েটির দুচোখে আগুন জ্বলে ওঠে। ফরসা অনিন্দ্যসুন্দর মুখ অদ্ভুত সংকল্পে দৃঢ়! তার সজল দুচোখে আগুনের প্রতিবিম্ব। চিতার নয়, মোমবাতির। মোমবাতির স্নিগ্ধ শিখা তার জলভরা চোখের তারায় পড়ে যেন অনির্বাণ বহ্নিরূপে লকলকিয়ে উঠল। না–এখনও ছাই হয়নি। এখনও সে জ্বলছে। বুকের মধ্যে অনন্ত জ্বালা নিয়ে জ্বলছে। আজও চিড়বিড়িয়ে উঠছে যন্ত্রণায়। সে জ্বালা কাউকে বলার নয়। কাউকে বোঝানোর নয়। ততদিন সে জ্বলবে, যতক্ষণ না এ খেলা শেষ হয়।

সে সামনের আয়নার দিকে তাকায়। আচমকা মনে হলো, সেই বিশ্বাসঘাতক পুরুষটা ওর ঠিক পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছে। ওর পেছনে তারই ছায়া! সুন্দর কোমল মুখটা শক্ত হয়ে ওঠে। এখনও তাকে ছেড়ে যায়নি সে! আজও ঠিক তেমনই আছে। সেই ঘৃণিত লোকটা…!

সুন্দরী বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়ায়। হাতের সামনে একটা ওড়না পড়ে ছিল। সেটা দিয়েই পাগলের মতো আয়নাটা মুছতে শুরু করে। মুছে দিতে হবে। লোকটাকে একদম মুছে দিতে হবে। ওর বিন্দুমাত্র অস্তিত্বও রাখা যাবে না। ওকে পুড়িয়ে ছারখার করতে হবে। নয়তো বারবার জিতে যাবে সাদা রাজা! কালো রানির হার নিশ্চিত! হেরে যাবে ওর সমস্ত শুভাকাঙ্খ। হেরে যাবে শুভবুদ্ধি। যেটুকু মমতা বুকে এখনও লুকিয়ে আছে, সেটুকুও হারিয়ে যাবে। হৃদয় নিংড়ে শুধু ঘৃণাই দিয়ে যাবে ও আজীবন! ভালোবাসবে না? কাউকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরতে পারবে না! একটা মানুষ কি শুধু ঘৃণার জোরেই বাঁচতে পারে!

মেয়েটি এত জোরে আয়নাটাকে মুছছে যে আয়নাটা প্রায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল। তার বিক্ষিপ্ততা ক্রমাগতই বাড়ছে। উন্মাদনা বাড়ছে! কই? লোকটা মুছে যাচ্ছে না তো! তার অস্তিত্ব এতটাই প্রবল যে এখনও সে কাঁচের মধ্যেই উপস্থিত! ঠিক তার পেছনেই…!

কাচ মুছতে মুছতেই থম্কে গেল সে। কানের কাছে কতগুলো শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে! এত আওয়াজ যেকোনোটাই সঠিকভাবে শ্রুতিগোচর হচ্ছে না। খানিকটা কর্ণেন্দ্রিয়ের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। একসঙ্গে অনেকগুলো গলার আওয়াজ। সে ইতস্তত দৃষ্টিক্ষেপ করে। কোনো তীক্ষ্ণ শ্রবণশক্তি সম্পন্ন জীবের মতো চকিতে অস্থিরভাবে এদিক-ওদিক দেখছে। কার যেন পায়ের শব্দ! কেউ আসছে? খড়খড় করে আরশোলা উড়ে গেল। একটা এলোমেলো পায়ের শব্দ না? একটা চাপা কান্নার আওয়াজ! কেউ বুঝি প্রবল যন্ত্রণায় কাঁদছে। এক এলোকেশীর বিধ্বস্ত চেহারা মুহূর্তের জন্য আয়নায়ছায়া ফেলে সৎ করে সরে গেল। সে ঝাঁপিয়ে পড়ে দু হাতে সেই যন্ত্রণাকাতর রমণীকে জড়িয়ে ধরার আগেই তার ছবি মুছে গিয়ে কাঁচে ভেসে উঠল এক ভীতু ভীতু কিশোরীর নিষ্পাপ মুখ!

মেয়েটার চোখ দিয়ে অব্যক্ত যন্ত্রণায় একবিন্দু জল গড়িয়ে পড়ে। সে অস্কুট একটা শব্দ করে সেই কিশোরীর মুখ স্পর্শ করতে চায়। কী নিষ্পাপ চোখে মেয়েটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। স্কুরিত ওষ্ঠাধরে অভিমান! যেন ওর ঠোঁট স্পর্শ করলেই অভিমান টস্ টস্ করে গলে পড়বে চোখ থেকে…!

কিন্তু মেয়েটাকে স্পর্শ করতে গিয়েও পারল না! সেই কিশোরীও মুছে গিয়েছে। এখন সেই লোকটার চেহারাটা আরও স্পষ্ট। লোকটা আঙুল উঁচিয়ে বলছে–ইউ ডার্টি অ্যানিমল! নিজের চেহারাটা দেখেছিস! চাকরাণীও তোর থেকে দেখতে ভালো। যখন বিছানায় এসে বসিস, মনে হয় একটা কালো কুতিয়া এসে বসেছে! বেরো এখান থেকে! …নয়তো কুতিয়াকে বেল্ট পেটা করে সোজাও করতে পারি… ব্লাডি বিচ!

চো-ও-প!

আর সহ্য হলো না! হাতের কাছে ফুলদানিটা ছিল। সেটাকেই আয়না লক্ষ করে ছুঁড়ে মারল! সজোরে ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ল আয়নার কাঁচ! চতুর্দিকে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে পড়েছে। সে বিস্ময়বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল সমস্ত কাঁচের টুকরোয় সেই লোকটারই প্রতিবিম্ব! লোকটা হাসছে! হো হো করে হাসছে। নির্লজ্জ! পাষণ্ড! …

আচ্ছা? তুই আমায় হারাবি! হ্যাঁ? দেখাচ্ছি!

মেয়েটা অসম্ভব রাগে উন্মত্ত হয়ে ঘর থেকে চলে গেল টয়লেটের দিকে। দমাস করে দরজা বন্ধ করার শব্দ। কলকল করে প্রবল ধারায় জল পড়ছে। তারপরই সব চুপ। শুধু একটানা ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়ার আওয়াজ–টুপ টুপ টুপ…।

একটা প্যাঁচা বিপন্ন চিৎকার করে উঠে ঝটপটিয়ে উড়ে গেল। জানলার চতুষ্কোণ পরিসরে গোল থালার মতো রুপালি চাঁদ ধরা পড়েছে। কিন্তু চাঁদের নীলাভ জ্যোৎস্না হালকা মেঘের হস্তক্ষেপে অস্বচ্ছ। প্যাচাটা ঠিক যেন প্রেতছায়ার মতোই চাঁদের বুক ছুঁয়ে চলে গেল। এখন আকাশ বেশ কালো। মেঘ জমেছে। নারকেল পাতা হাওয়ায় শিরশির করে ওঠে। হাওয়ার গতিবিধিও যেন বেশ সতর্ক। সন্ত্রস্ত হয়ে দুর্বোধ্য ইশারায় বয়ে চলেছে। ঘড়ির কাঁটা কোনো এক অমোঘ পরিণামের দিকনির্দেশ করে প্রতিটা প্রহর গুনছে। কিছু যেন হবে। কিছু যেন ঘটতে চলেছে…!

বেশ কিছুক্ষণ পরে সেই অসহ্য নৈঃশব্দ্যের ভেতরে ছোট্ট একটা শব্দ তরঙ্গ তুলল। টয়লেটের দরজা খুলে গিয়েছে। মেয়েটি ভূতে পাওয়া মানুষের মতো টলতে টলতে বেরিয়ে এল। তার মুখ অবনত। মেঘের মতো কুন্তলরাশি তার মুখ ছুঁয়ে আছে। আর খানিকটা অন্ধকার জমে আছে তার সুডৌল মুখের চারদিকে। আস্তে আস্তে এসে সে বসে পড়ল আয়নার টুকরো টুকরো কাঁচের সামনে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আঁতিপাতি করে খোঁজে সেই শয়তানটাকে। কোথায় সে! এখনও আছে কি? এখনও তার মুখে সেই ব্যঙ্গের হাসি রয়েছে?

কিন্তু এই মুহূর্তে লোকটার প্রতিবিম্ব পড়ছে না আয়নার কাঁচে! মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠল। যেন ভারি মজা পেয়েছে এমন করে হাসছে সে। হাসির ধমক সামলাতে না পেরে লুটোপুটি খাচ্ছে মেঝেতে! উচ্চকিত হাস্যে ফেটে পড়ে বলল–গন? কাওয়ার্ড!

বলতে বলতেই মুখ তুলল সুন্দরী! কিন্তু…!

এ কী! এ কে!

একটু আগে যে শ্বেতবর্ণা সুন্দরী বসেছিল এ তার মুখ নয়! এ মুখ কালো কুচকুচে! কালো চকচকে চামড়া দেখলেই চিক্কণ কালো রঙের সাপের কথা মনে। পড়ে। দুচোখে খরদৃষ্টি! যেন একটা কালো সাপ! অথবা মানবীর দেহে বুঝি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে এক কালো বিড়ালের ভয়াবহ মুখ!

অবিকল প্রাচীন মিশরীয় দেবী বাস্ট বা বাস্টেট-এর মতো!

*

গোল্ডেন মুন ক্লাবের আলো অনেকক্ষণ আগেই নিভে গিয়েছে।

ঘড়িতে এখন রাত বারোটা। একটু আগেও ক্লাবের মধ্যে নানারকমের শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। একের পর এক গাড়ি এসে ভিড় বাড়াচ্ছিল। গাড়ির হর্ন, মেয়েদের খিলি খিল হাসি, পুরুষদের উচ্চকণ্ঠে কথাবার্তার সঙ্গে মাতাল মানুষের প্রলাপও ভেসে আসছিল। কিন্তু রাত বাড়তে না বাড়তেই আস্তে আস্তে ছবিটা বদলাতে শুরু করল। টলোমলো পায়ে বিদায় নিচ্ছিলেন অভ্যাগতরা। দুই একজন নিশাচর অবশ্য ইতোমধ্যেই রিসোর্টে সঙ্গী বা সঙ্গিনী সহ নাইট ওয়াকে চলে এসেছেন। খুব সন্তর্পণে তাদের এন্ট্রি হলো। তারপর আবার সব চুপচাপ।

অর্ণব একদৃষ্টে সেদিকেই তাকিয়েছিল। সে এই মুহূর্তে লম্বা-চওড়া একটা ঝাঁকড়াচুলা গাছের পেছনে অন্ধকারের সঙ্গে মিশে লুকিয়ে আছে। গাছগুলোকে এখন দীর্ঘতর মনে হচ্ছে। অন্ধকারের সমার্থক শব্দ হয়ে চুপ করে ওত পেতে আছে গুল্মের ঝোঁপগুলো। প্রতিটা সেকেন্ড যে কী অধীরভাবে কাটছে তার ঠিক নেই। এক মুহূর্তের জন্যও পাহারায় ছেদ দেয়নি। অক্লান্ত ভাবে বসের কথাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে। যদিও বুকের মধ্যে একটা আলোড়ন হচ্ছিল। সত্যিই কি অধিরাজের আন্দাজ সঠিক প্রমাণিত হবে? এটা যে কী হচ্ছে তা এখনও তার বোধগম্য হয়নি। এটা কেস না দাবাখেলা? অধিরাজ কতদূর গিয়েছিল মানসী জয়সওয়ালের সঙ্গে? সে কোনো কাজ কারণ ছাড়া করে না। কিন্তু মানসী জয়সওয়ালের সঙ্গে ফ্লার্টিং-এর মধ্যে কী কারণ থাকতে পারে। ঠিক কী ঘটছে এই রিসোর্টে!

কী ভাবছ বস্?

কাঁধের ওপরে আলতো চাপ আর পরিচিত কণ্ঠস্বরে সচকিত হয়ে পেছনে ফিরল–স্যার!

আলতো করে মোবাইলটা জ্বেলেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল অর্ণবের। অধিরাজ কালো লেদার জ্যাকেটে! এ কেমন হুলিয়া! আর যাই হোক, পুলিশি ড্রেস কোড নয়।

আলোটা নেভাও অর্ণব, কেউ আমাদের দেখে ফেলতে পারে। সে একটু অনুতপ্ত স্বরে বলল–সরি, আসতে দেরি হলো। সমস্ত বন্দোবস্ত করতে একটু টাইম লাগল। এদিকে কোনো আপডেট?।

হ্যাঁ। অর্ণব জবাব দিল–ড. চ্যাটার্জী কয়েকমিনিট আগেই ফোন করেছিলেন। আপনার স্কিন স্যাম্পেলর ল্যাভেন্ডারের সঙ্গে অর্জুন শিকদারের ল্যাভেন্ডার অয়েল পারফেক্টলি ম্যাচ করেছে। দুটো নিঃসন্দেহে একই প্রোডাক্ট।

বেশ! বেশ! অন্ধকারে মৃদু হাসির শব্দ ভেসে আসে মিস ছোষ কিছু বলেছেন? লাল দরজাটা পাওয়া গেল?

হ্যাঁ। তিনি পেয়েছেন। মেরিলিন প্ল্যাটিনামের একটি ফ্ল্যাটের দরজাই চেরি রেড। আটতলায় বিজয় জয়সওয়ালের ঠিক অপোজিট ফ্ল্যাটটা। সেভেন ও বি। জনৈক অহনা ভট্টাচার্যের।

থ্যাঙ্ক গড। তবু একজন ভট্টাচার্য এল। এতক্ষণ তো জয়সওয়াল আর বাজাজের মধ্যেই ডাব্লুস চলছিল। দু-দুটো জয়সওয়াল পরিবার। কতজন বাজাজ তাই বা কে জানে!।

অর্ণব চাপা স্বরে বলে–সত্যি! এখন তো মনে হচ্ছে কলকাতায় শুধু জয়সওয়াল আর বাজাজ ফ্যামিলিই থাকে। আর কোনো সারনেমই নেই।

শুধু সারনেমই নয়–নামের মিলটা লক্ষ করোনি? রিয়া বাজাজের মায়ের নাম ছিল অহল্যা। আবার ড. জয়সওয়ালের মিসেসের নামও অহল্যা! অহল্যা বাজাজ আপাতদৃষ্টিতে কালো ও অসুন্দর ছিলেন। অহল্যা জয়সওয়ালও ঠিক তাই। অধিরাজ বিড়বিড় করে-এ দুটো নাম এক হওয়া এবং দুটো মানুষের একরকমই বর্ণনা হওয়া মোটেই ভালো লক্ষণ নয় অর্ণব। অহল্যা বাজাজের একটা ছবি দরকার ছিল।

অর্ণব যেন শ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছে–তবে কি দুটো লোকই এক!

দুটো লোকই এক কি না জানি না। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল–তবে আমার ধারণা অহল্যা বাজাজের সঙ্গে অহল্যা জয়সওয়ালের কিছু তো সম্পর্ক আছে। কিছু একটা মিসিং লিঙ্ক। কিন্তু সেটা এখনও ধরা যাচ্ছে না।

ওদিকে ল্যাভেন্ডারের স্যাম্পল ও তো মিলল। অর্ণব কৌতূহলী–তবে কি মানসী জয়সওয়াল…?

সন্দেহ করাটা অন্যায় নয়। কারণ নিশান অ্যারোমা ইন্ডাস্ট্রির অয়েল বাইরে কোথাও কিনতে পাওয়া যায় না। নিজেদের ল্যাবে তৈরি করে নিশানের

স্পা আর স্যালুনগুলোতেই পাঠানো হয়। আবার এখানে স্বয়ং মালকিনই এসে বসে আছেন!

তবে কি তিনিই সর্বনাশিনী! অর্ণব চোখ কপালে তুলে বলল-এই লেভেলের অ্যাকটিং করে চলেছেন! মা-ই-গ-ড!

আজ সকালেও এ কথাটা বললে আমার সন্দেহ থাকত। মানসী জয়সওয়াল রীতিমতো সুন্দরী ও আকর্ষণীয়া। বয়েসই বোঝা দায়। আপাতদৃষ্টিতে বোকা মনে হলেও, ওটা ওঁর সম্ভাব্য অস্কারজয়ী রিয়েল লাইফ অ্যাকটিং ও হতে পারত। নিস্পৃহ স্বরে উত্তর এল–কিন্তু আফটার ম্যাসাজ আমি ওঁকে তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছি। মানসী জয়সওয়ালের সঙ্গেও কোনো লিঙ্ক হয়তো আছে। কিন্তু সর্বনাশিনী তিনি নন্।

কেন? অর্ণব সন্দিগ্ধতিনি যে এখনও চমৎকার অভিনয় করছেন না তার প্রমাণ কী?

অধিরাজ অন্ধকারেই স্মিত হাসল–প্রোফেসর রিভার সং-এর একটা কোট শুনেছ? আই লাভ বাইটিং। ইটস লাইক কিসিং, বাট দেয়ার্স আ উইনার! আমাদের সর্বনাশিনীর মনস্তত্ব ঠিক তেমনই। তিনিও ডমিনেট করতেই ভালোবাসেন। সব খেলাতেই জিততে চান।

রিভার সং মানে ড. হু সিরিজের রিভার সং?

জানতাম তুমি ঠিক ধরে ফেলবে। তুমি তো আবার যত রাজ্যের কমিকস, সায়েন্সফিকশন পড়তে ভালোবাস। সে শান্ত ভঙ্গিতে বলল–হ্যাঁ, সেই রিভার সং ই বটে।

অর্ণব চুপ করে যায়। প্রোফেসর রিভার সং-এর মধ্যে কোথা থেকে এলেন?

তার মন যেন পড়ে ফেলল অধিরাজ–প্রোফেসর রিভার সং-এর ঐ ডায়লগটা আমাদের কেসের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। অর্জুন শিকদারের ফরেনসিক রিপোর্টটা মনে আছে? ওখানে স্পষ্ট একটা কথা ছিল। অর্জুন শিকদার মৃত্যুর আগে সেক্স করেছিলেন। সেটা বোঝা গেল কী করে?

লাভ বাইট স্যার। সে সপ্রতিভভাবে বলল–লাভ বাইট দেখেই তো…!

শুধু লাভ বাইট নয়, মোক্ষম লাভ বাইট! অধিরাজ একটা অঙ্ক মেলাচ্ছে–সেটা শোনার পর আমি সঞ্জীব রায়চৌধুরীর লাশের ফটোও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। তার লাশেও গলায়, ঘাড়ে, কাঁধে লাভ বাইট ছিল। সেবার পুলিশ গুরুত্ব দেয়নি বলে ঐ ব্যাপারটা লক্ষ করেনি। আমাদের কন্যে কামড়াতে ভালোবাসেন অর্ণব। শি ইজ আ ভেরি স্ট্রং কিসার! স্ট্রং কিসার বললেও পুরোটা বলা হয় না–চূড়ান্ত প্যাশনেট, অ্যাগ্রেসিভ অ্যান্ড ডমিনেটিং। শুধু তাই নয়–তিনি বিছানাতেও বিজয়িনী হতে চান। এই মনোভাবটা তার এতই প্রবল যে রীতিমতো বিধ্বংসী বলা যায়। তিনি যে ইচ্ছে করে এটা করেন তা নয়। এটা অটোম্যাটিক্যালি হয়ে যায়। সেক্স ইজ আ ইনস্টিটিংক্ট। সেখানে বিচার বুদ্ধি-ক্যামোফ্লেজ সব মাথায় ওঠে। ইনস্টিংক্টের কাছে সব মানুষই অসহায়। সো, এইখানে তিনি একটি জব্বর ভুল করে ফেলেছেন। এইসান প্যাশনেট স্ট্রং কিস করেছেন যে হিকিজ, আই মিন লাভ বাইটস্ চলে এসেছে। সচরাচর মেয়েরা সেক্সে এতখানি ডমিনেটিং হয় না। বাট শি ইজ…।

অর্ণবের ভুরু কুঁচকে গেল–কিন্তু আপনার গলায় বা ঘাড়ে তো কোনো দাগ নেই! মিসেস জয়সওয়াল প্যাশনেট বা অ্যাগ্রেসিভ নন?

যথেষ্টই। কিন্তু তার স্টাইলটা অন্যরকম। দাঁতের ব্যবহার করেন না বা স্ট্রংলি সা করেন না। ওঁর ট্র্যাজেড়িটা আলাদা। ওঁকে খরচের খাতায় ফেলতেই পারো। তিনি লাভ বাইট দেন না।

এইজন্যই তার মানে…!অর্ণব হাঁ করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। কোনোমতে ধরা গলায় বলল–তাহলে তো এখন আপনাকে সব সাসপেক্টের সঙ্গে…।

অধিরাজ সজোরে হেসে উঠতে গিয়েও চেপে গেছে–কী? শুতে হবে?

তার কান গরম হয়ে যায়। লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করল অর্ণব। ফের বোস কথা বলে ফেলেছে। অধিরাজ ঠোঁট টিপে হাসল-এগেইন গুড ওয়ান।

অর্ণব মনে মনে নিজেরই চৌদ্দগুষ্টিকে গাল দেয়। লাভ বাইটের কথা তো। তার মনেই আসেনি। অথচ মনে আসা উচিত ছিল। সে একসময়ে ডাক্তারি পড়ত। কিন্তু পরে লাইন চেঞ্জ করে নেয়। ডাক্তারি প্রায় ভুলেই মেরে দিয়েছে। তবে লাভ বাইট বা হিকিজ সম্বন্ধে জানে। অধিরাজ যা বলছে সেটাই সঠিক। সচরাচর যারা হিকিজ দেয়, তারা নিজের অজান্তে, অবচেতনেই এ কাজটা করে। স্ট্রং কিস, সাক, বা বাইট করলে এরকম হেমাটোমা হওয়া সম্ভব। কিন্তু এটা যেকোনো ক্লও হতে পারে তা তার মাথাতেই আসেনি।

স্যার, অনেকসময়ে কিন্তু একটা হিকিই ডেঞ্জারাস হতে পারে। খুব স্ট্রং বা অ্যাগ্রেসিভ হিকির ফলে কিন্তু মৃত্যুও হয়েছে। আচমকা অর্ণবের মাথায় একটা সম্ভাবনা আসে-লাভ বাইট বা হিকি ব্লাড ভেসেলের ওপরে এফেক্ট করে মূলত। অনেকসময় ব্লাড ক্লট হয়ে গিয়ে স্ট্রোক, বা প্যারালাইসিসও হতে পারে। এমনকি মৃত্যুর রেকর্ডও আছে। আমরা এদিকে হয়তো ঝোপে ঝোপে বাঘ খুঁজে বেড়াচ্ছি, ওদিকে বিড়াল বিষাক্ত থাবা নিয়ে বসে আছে! এই হিকিই মার্ডার ওয়েপন নয়তো?

অর্ণব আরও কিছু বলতেই যাচ্ছিল। তার আগেই অধিরাজ ঘড়ির দিকে একঝলক তাকিয়ে ইশারা করল–ব্রিলিয়ান্ট। কিন্তু এখন আর কথা নয় অর্ণব। আপাতত রাতের অতিথিকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিতে হবে। তুমি এখানে। ফিল্ডিংটা দাও। আমি বাইরে দিচ্ছি।

আপনি বাইরে থাকবেন?

হ্যাঁ, একটু দূরে। ব্লু টুথ পরে থাকো। আমি আমার বাইকে বসে আছি। আর যা যা দেখবে আমায় রিলে করতে থাকবে। নিজে থেকে কিছু করতে যেও না।

ও কে স্যার।

অধিরাজ মৃদু হেসে পাঁচিলের দিকে দৌড়ে চলে গেল। যেভাবে অনায়াসেই পাঁচিল টপকাল সে, তাতে হয়তো হনুমানও লজ্জা পাবে। অর্ণব দ্রুতহাতে ব্লুটুথ পরে নিল। এখন থেকে ব্ল টুথেই কথাবার্তা হবে। তার সতর্ক দৃষ্টি আবার ক্লাব হাউসের দিকে ফিরল।

ক্লাবের বাইরে তখন ল্যাম্পপোস্টের পিঙ্গল আলো পিচের কালো রাস্তায় পড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। দুদিকে শুধু ধূধূ করছে মাঠ। বেশ অনেকখানি দূরে কিছু হাইরাইজের মাথা অভ্রভেদী অহংকারে ছুঁয়ে আছে আকাশ। অন্ধকারে ঘুমন্ত প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর বিরাট কলেবরের মতো দেখতে লাগছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়–এই বুঝি দপ্ করে জ্বলে উঠবে তাদের হিংস্র সবুজ চোখ! দুই-একটা বেওয়ারিশ কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। অধিরাজের পায়ের শব্দে চোখটা একটু টেরচা করে খুলে দেখে নিল। চোখে জিজ্ঞেস–কে রে তুই ডিস্টার্ব কচ্ছিস?

সে এবং তার ছায়া পায়ে পা মিলিয়ে গেল অন্ধকার মাঠের দিকে। এখানেই দাঁড় করানো আছে বাইকটা। বাইকটারও রং গাঢ় হওয়ার দরুণ অন্ধকারে চমঙ্কার মিশে গিয়েছে। বাইকটার চেহারা দেখলেই ভয় করে। এ জাতীয় বাইক সচরাচর বাইক র‍্যালি, রেসিঙে ব্যবহৃত হয়। সাধারণ বাইকাররা এই সব বাইক ধরার সাহস পাবে না। কিন্তু অধিরাজের চিরকালই যত রাজ্যের ভয়াবহ কাণ্ডকীর্তি করতে ভালো লাগে। সে অসম্ভব ডেয়ার ডেভিল। মাউন্টেনিয়ারিং তার প্যাশন। আর বাইক! কলেজে পড়াকালীন তুঘোড় বাইকার ছিল। বাইকের নানারকম স্টান্ট করতে ওস্তাদ। এখনও তার নিজস্ব একটা বাইকার গ্যাং আছে। সুযোগ পেলেই গ্যাং নিয়ে লং জার্নিতে বেরিয়ে পড়বে। গতবছরই বাইকে চেপে সিকিম ট্রিপ মেরেছিল। তার বাবা সুযোগ পেলেই বলেন–বুড়ো বয়সেও নিস্তার নেই! অশান্তির ট্যাবলেট বাড়িতেই বসে আছে। এই পাহাড়ে চড়ছে, এই বাইকে চেপেস্টান্ট মারছে! সর্বক্ষণ প্রাণ হাতে! কবে কী ঘটিয়ে বসবে সেই ভয়েই কাঁটা হয়ে আছি। কেন বাপু? তোর একটু শান্তভাবে বসে থাকতে ভালো লাগে না?

ভেবেই সে ফিক করে আপনমনেই হেসে ফেলে। বাবা যদি জানতেন যে এখন সে এখানে অন্ধকারে খুনিকে ধরার জন্য একশ দুই জ্বর গায়ে নিয়ে ওঁৎ পেতে বসে আছে তবে যে কী করতেন কে জানে! হ্যাঁ, গায়ে এখন একশ দুইয়ের কাছাকাছিই জ্বর। প্যারাসিটামলের কাজ শেষ হতে না হতেই ফের জ্বর উঠতে শুরু করেছে। মাথার শিরা-উপশিরাগুলো যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। গলা জ্বালা করছে। মাঝেমধ্যেই চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, তবু আর ওষুধ খায়নি। জ্বরের ওষুধ খেলেই ঘুম পায়। শরীর ছেড়ে দেয়। এই মুহূর্তে কোনোরকম চান্স নিতে চায় না। আজ তাকে সজাগ, সতর্ক থাকতে হবেই। যেকোনো মূল্যেই হোক…!

একটা পরিচিত ভাইব্রেশনে সজাগ হয়ে উঠল অধিরাজ। ফোন এসেছে। সে হেডসেট অ্যাকটিভ করল–হ্যালো।

এনি আপডেট রাজা? অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। কী হলো?

অফিসার পবিত্র আচার্য। সে ও ক্লাব থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। সঙ্গে আরও একটা গাড়িতে ব্যাক আপ। আজ পুরো প্রস্তুতি নিয়েছে সিআইডি, হোমিসাইড। প্রতীক্ষা শুধু প্রতিপক্ষের একটা ভুল স্টেপের।

নাথিং মামা! সে হাসল–সবে তো কলির সন্ধে। এখনই অধৈর্য হচ্ছ কেন?

মশাকে গণহারে ব্লাড ডোনেট করতে হলে বুঝতে! গজগজ করে পবিত্র–আজ সত্যিই কি পাখি পড়বে? না ফালতু জাল পেতে বসে আছি?

আমার ধারণা পাখি পড়বে। দেখো, সুকুমার রায়ের মতো ফসকে গেল কেস না হয়!

গুড় গুড় গুড় গুঁড়িয়ে হামা খাপ পেতেছেন গোষ্ঠমামা এগিয়ে আছেন বাগিয়ে ধামা, এইবারে বাণ চিড়িয়া নামা-চট্ট। অধিরাজ দুষ্ট হেসে বলে–ছোটবেলায় পড়েছি। ডোন্ট ওরি! কড়া ফিল্ডিং এমনি এমনিই দেওয়া হয়নি।

তুমি এত কনফিডেন্ট কী করে হচ্ছ?

আসতে হবেই। গুগলি দিয়েছি তো। সে আত্মবিশ্বাসী–একেই আজ সিআইডির পায়ের ধুলো পড়েছে। কোম্পানি থেকেও ফোন গিয়েছে। কাল সিআইডি রেড করতে পারে। তার ওপর কোম্পানির লোক আজ ঝগড়া করেছে। বলেছে কাল আসবে। রেগেমেগে যদি লেট আসার রেকর্ড ব্রেক করে সত্যিই কাল সকালেই চলে আসে–তবে দিনের বেলায় লাশ ডাম্প করা সম্ভব নয়। আজ রাতটুকুই সময় আছে। যা করতে হবে, আজই করতে হবে। যেখানে ডাব্লু অ্যাটাক ধেয়ে আসার সম্ভাবনা, সেখানে ফ্রিজারে লাশ ফেলে রাখার মতো এত বড় চান্স নেবেন কী করে তিনি? শিওর আন্দাজ করেছেন যে বুবি ট্র্যাপ কোথাও একটা আছে, কিন্তু তারও উপায় নেই। সেকেন্ড কোনো রাস্তাই রাখিনি।

তুমি যখন জানো যে লাশটা ডিপ ফ্রিজারেই আছে তখন বের করে আনলেই তো হতো। পবিত্র ফের বিরক্ত–তা না করে পাশ দিয়ে হেঁটে চলে এলে!

তোমার মানহানির মামলা খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে? অধিরাজ শান্তভাবেই বলল-ধরো লাশটা বের করলাম কিন্তু ধরব কাকে? ম্যানেজারকে? মানসী জয়সওয়ালকে? কী প্রমাণ যে ওঁদের মধ্যেই কেউ রেখেছেন? আমায় যদি ডিফেন্স জিজ্ঞেস করেন–আপনি কি স্বচক্ষে ওদের কাউকে লাশটা রাখতে বা বের করতে দেখেছেন?–কী জবাব দেব? ওঁরা তো দুজনেই কোর্টে দাঁড়িয়ে বলবেন–আমরা কিছুটি জানি না হুজুর–সিআইডি, হোমিসাইড আর কাউকে

পেয়ে আমাদেরই বলির পাঠা বানিয়েছে। ঐ লাশটাও ওঁরাই প্ল্যান্ট করেছেন–তখন তুমি কী বলবে? কারোর বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে? সেই জন্যই এত রাতে তুমি, আমি, অর্ণব–সবাই জেগে বসে আছি। তবে তোমার থেকে অর্ণব সঙ্গী হিসেবে অনেক বেটার। আই থিঙ্ক হি ইজ দ্য বেস্ট। কোনো প্রশ্ন না করে কাজ করে যায়। একটুও অধৈর্য হয় না। তুমি বকে বকেই আমার মাথা খারাপ করছ।

কী করব! পবিত্র বলল–যত রাজ্যের পাগল ক্রিমিন্যাল তোমার কপালেই জোটে! তারপর তোমার সঙ্গে আমাদের সবার নাভিশ্বাস ওঠে।

পাগল নয়–জিনিয়াস! তবে স্বয়ং তিনি আসবেন না।

শ্যাঃ… পবিত্র অদ্ভুত একটা শব্দ উচ্চারণ করে–মানেটা কী? এত কষ্ট করে শেষে চুনোপুঁটি ধরব?

চুনোপুঁটি ধরতে হবে না। শুধু…! বলতে বলতেই কিছু একটা দেখে সে থেমে গেল। একটা সাদা রঙের বোলেরো হুশ করে তার চোখের সামনে দিয়ে ক্লাবের দিকেই চলে গেল। গাড়িটার কাঁচগুলো কালো। জানলা বন্ধ। চাপা স্বরে পবিত্রকে বলল অধিরাজ–এখন পেটে বোম মেরে চুপ করে থাকো। মনে হয় তেনারা এলেন।

ও কে বস।

পবিত্রর লাইনটা কেটে দিয়ে অর্ণবকে ফোনে ধরল সে। অর্ণব খুব সতর্ক ছিল। একবার রিং হতে না হতেই ওপ্রান্তে জাগ্রত হলো তার কণ্ঠস্বর–হ্যাঁ স্যার।

একটা সাদা রঙের বোলেরো ঠিক ক্লাবের দিকেই যাচ্ছে। একটু গাড়িটার ওপরে নজর রাখো।

ধরব?

না, শুধু দেখো–ঠিক কী হচ্ছে। এখন কিছু করবে না।

ডান্।

এবার আর ফোন না কেটেই পবিত্ৰকে চটজলদি কনফারেন্সে নিয়ে নিল সে। তার কণ্ঠে কম্যান্ডিং টোন–এখন একটা কথাও নয়। অর্ণবও লাইনে আছে। যতক্ষণ না বলছি–নো অ্যাকশন। কেউ জায়গা ছেড়ে নড়বে না।

ঠিক আছে।

এরপর মিনিটখানেক শুধু রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা। অর্ণব দেখল বোলেরোটা ঠিক এসে থামল ক্লাবের সামনে। ক্লাবের আলো নিভে গেলেও এন্ট্রান্সে একটা বেশ জোরালো আলো সামনের বাঁধানো রাস্তাকে আলোকিত করেছে। বোলেরো থেকে যে লোকটা নেমে এল তাকে দেখেই সে বিস্মিত! এ কী! এ তো মেরিলিন প্ল্যাটিনামের গেটকিপারটা! এই লোকটাই জুয়েলার বিজয় জয়সওয়ালের গাড়িটাকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিল! অন্তত বয়ানে তেমনই বলেছিল।

সে অধিরাজকে সে কথা ফিসফিস করে বলতেই উত্তর এল–আমি এমনকিছুই আশা করেছিলাম। বিজয় জয়সওয়ালের গাড়ি কে চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবার বুঝলে? এই ব্যাটার ওপরে আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল। চুপচাপ দেখে যাও, কী করছে।

গেটকিপার গাড়ি থেকে নেমে এসে ডাইনে বাঁয়ে না তাকিয়ে সোজা গটগটিয়ে চলে গেল ক্লাবের ভেতরে। উত্তেজনায় অর্ণব তখন রীতিমতো ঘেমে নেয়ে একসা। হৃৎপিণ্ডটাই না পাঁজর ফাটিয়ে বেরিয়ে আসে! তার ভয় হচ্ছিল যে হার্টটা যেরকম শব্দ করছে, তাতে লোকটা তার উপস্থিতি টের না পেয়ে যায়! তার ইচ্ছে ছিল এখনই গিয়ে ব্যাটার কলার চেপে ধরে। কিন্তু সে উপায় নেই।

আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল! চতুর্দিকে সম্পূর্ণ নৈঃশব্দ্য। সে নিস্তব্ধতা এতই গভীর যে গাছের পাতা খসার সামান্য আওয়াজটুকুও পাচ্ছিল অর্ণব। সে দমবন্ধ করে পরের ঘটনার জন্য অপেক্ষা করছে। অথচ গেটকিপারটা সেই যে ভেতরে গিয়েছে, আর বেরোবার নামই নেই। এতক্ষণ ধরে করছেটা কী! অর্ণব মনে মনে গরগর করে। একটা লাশ নিয়েই তো বেরোবি রে ব্যাটা! নাকি গোটা ফ্রিজটাই ঘাড়ে করে আনছিস?

সে আবার ফিসফিস করে-স্যার, একবার ভেতরে গিয়ে দেখব? বড় দেরি করছে।

একদম না। ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় উত্তর এল–ড, বিজয় জয়সওয়ালের চেহারাটা দেখেছ? পুরো জলহস্তী। তার ওপর মরে গিয়ে আরও ভারী হয়ে গিয়েছেন। একটু সময় তো লাগবেই।

পবিত্র ওপাশ থেকে ফোড়ন কাটে-এর চেয়ে অর্ণবই গিয়ে একটু হাত লাগাক না। দেখছ না, বেচারি কেমন ব্যাকুল হয়ে পড়েছে।

অধিরাজ ঠাট্টাটাকে পাত্তা না দিয়ে বলে–পবিত্র, তোমরাও এবার আস্তে আস্তে এগিয়ে এসো। গোল্ডেন মুন থেকে অর্ণব বেরোলেই তুমি ঢুকবে। তোমার কাছে ওয়ারেন্ট আছে তো?

আছে। কিন্তু ধরব কাকে?

যিনি গেটকিপারের সঙ্গে হাত লাগাচ্ছেন। মোস্ট প্রব্যাব্লি ক্লাবের রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার। আগে রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে যাক। তারপর তোমাদের এন্ট্রি। লোকটাকে একটা কথাও বলতে দেবে না। কোনো কথা শুনবেও না। স্রেফ তোমার ব্যাক-আপ টিমের অফিসারদের হাতে তুলে দেবে। আর দুই একজন লেডি অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে নিজের গাড়িতে অর্ণবকে ফলো করবে।

ঠিক আছে।

ক্লাবের সামনে এসেই হুটারটা বাজিয়ে দাও। আমি চাই, শুধু ম্যানেজার নয় গেটকিপারটাও টের পাক যে ক্লাবে পুলিশের রেড পড়েছে।

অর্ণব এর মধ্যে কিছু বলবে কি না ভাবছিল। তার আগেই সামনের দৃশ্যটা দেখে তার মাথার চুল আর গায়ের রোম খাড়া হয়ে যায়! সত্যিই গেটকিপারটার সঙ্গে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার বেরিয়ে এসেছে। দুজনে ধরাধরি করে একটা বস্তা টেনে আনছে। ওদের দেখেই মনে হচ্ছে বস্তাটা চূড়ান্ত ভারি। বস্তাটাকে কোনোরকমে গাড়িতে তুলে দিয়ে ম্যানেজার গেটকিপারের সঙ্গে নিচু স্বরে কী যেন কথা বলল! তারপরই দুজন দুদিকে। গেটকিপারটি বোলেরোর ড্রাইভিং সিটে উঠে বসেছে! পরমুহূর্তেই চাপা গর্জন করে উঠল সাদা রঙের বোলেরো।

স্যার। ও গাড়িতে উঠে বসে স্টার্ট দিয়েছে।

ফ্যান্টাস্টিক! তুমি বাইরে চলে এসো ইমিডিয়েটলি। অধিরাজ নির্দেশ দিল–পবিত্র। স্টার্ট!

অর্ণব সবেগে পাঁচিলের দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে শুনতে পেল নিস্তব্ধতার বুক চিরে চেঁচিয়ে উঠেছে পুলিশি সাইরেনের প্রবল আওয়াজ! পবিত্র আচার্যর এন্ট্রি হয়ে গিয়েছে। অ্যাকশন শুরু!

লোক দুটো বোধহয় দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে এত তাড়াতাড়ি ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে হাজির হবে। হুটার শুনে দুজনেই সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। পরের মুহূর্তেই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার প্রাণপণে ক্লাবের ভেতরে দৌড়াছে। আর সাদা বোলেরো তিরবেগে বেরিয়ে গেল বাইরের দিকে।

অর্ণব নিজের গাড়িতে উঠে বসতে বসতেই শুনতে পেল অধিরাজের নির্দেশ–হুটার অন্। ফলো দ্য হোয়াইট বোলেরো। যতক্ষণ না লাশ ডাম্প করছে ততক্ষণ আঠার মতো লেগে থাকবে।

ততক্ষণে ক্লাবের ভেতরে ঢুকে পড়েছে দু-দুটো পুলিশের গাড়ি। অফিসার পবিত্র আচার্য প্রায় চলন্ত গাড়ি থেকেই লাফিয়ে নামল। মাটিতে ল্যান্ড করেই শিকারি নেকড়ের মতো বিদ্যুৎ বেগে দৌড়াচ্ছে ক্লাবের ভেতরের দিকে। তার পেছন পেছন আরও কয়েকজন অফিসার!

ক্লাবের ভেতরটা বেশ অন্ধকার। তা সত্ত্বে সামনের ধাবমান লোকটিকে দেখতে অসুবিধে হচ্ছে না তার। সম্ভবত পলায়নরত ব্যক্তিটি বিশেষ দৌড়ঝাঁপে অভ্যস্ত নয়। তার জোরে জোরে শ্বাস ফেলার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তা সত্ত্বেও আপ্রাণ দৌড়াচ্ছে। পবিত্র দাঁতে দাঁত পেষে। এখন সে মোটেই দৌড়োদৌড়ি করার মুডে নেই। এখানের কাজ শেষ করেই অর্ণবকে ফলো করতে হবে। বেশি ইঁদুর-বিড়াল খেলার সময় নেই। আধা অন্ধকারেই তার পুলিশি নজর বুঝে নিল ঠিক কতটা দূরত্বে আছে শিকার। সে দৌড়াতে দৌড়তেই দেহটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দেয়। পরক্ষণেই একদম নিখুঁত হিসাবে গিয়ে হুড়মুড় করে পড়ল লোকটার একেবারে ঘাড়ের ওপর! এরকম উদ্ভট আক্রমণ আদৌ আশা করেনি লোকটি। দুজনেই জড়াজড়ি করে পড়ে গিয়েছে! পবিত্র তাকে আর কোনোরকম সুযোগ না দিয়েই ক্ষিপ্রবেগে তার বুকের ওপর চড়ে বসে ঠাটিয়ে এক থাপ্পড় মারল-ম্যারাথন রেসে নেমেছিস নাকি শালা? এখানে সোনার মেডেল কে দেবে তোকে?

ওপাশ থেকে অধিরাজের হাসি ভেসে এল-ও কে সিআইডির স্পেশ্যাল লোহার বালা দিয়ে দাও।

হুঁ! লোকটাকে এক ঘুসি মেরে অজ্ঞান করে দিয়ে বলল পবিত্র–অ্যানাস্থেশিয়া দিয়ে দিয়েছি। পিস্ অ আ কেক!

গ্রেট।

*

অন্যদিকে আরেক প্রস্থ চেজ চলছে।

দু পাশে শুধু সার সার ল্যাম্পপোস্ট এই অদ্ভুত জীবন-মরণ সগ্রামের সাক্ষী। খাঁ খাঁ শূন্য মাঠ অন্ধছায়া বুকে নিয়ে স্যাঁত স্যাঁত করে সরে যাচ্ছে। রাস্তায় এই মুহূর্তে একটি মানুষও নেই! একটা-দুটো রাতচরা পাখি শুধু উড়ে যাচ্ছে ডানা ঝটপটিয়ে। তার মধ্যেই এক সর্বনেশে অশনি সঙ্কেতের মতো হুটারের কর্ণভেদী আওয়াজ। তীব্রগতিতে ফাঁকা মসৃণ রাস্তা বেয়ে দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে দুটো গাড়ি। একটা সাদা রঙের বোলেরো। তার পেছনে ধেয়ে আসছে পুলিশের গাড়ি।

সামনের গাড়িটা গতিবেগ বাড়িয়েছে। ঠান্ডা হাওয়া হু হু করে নাক, চোখ, মুখে এসে ঝাঁপটা মারছে। অর্ণব দৃঢ়হাতে স্টিয়ারিং ধরে অ্যাসিলেটরে চাপ বাড়িয়ে দেয়। গাড়ির গতিবেগ প্রায় একশো কুড়ি ছুঁই ছুঁই। দুটো গাড়ির মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ গজের সামান্য বেশি দূরত্ব। বোলেরোটার কাছে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে অর্ণব। কিন্তু বোলেরোর মালিক সহজে ধরা দেবার পাত্র নয়। সেও সম্ভবত দাঁতে দাঁত চেপে গাড়ি চালাচ্ছে। এদিকে যত গতিবেগ বাড়ছে, ওদিকেও তাল মিলিয়ে ততটাই বাড়ছে।

গুড জব। তার হেডসেট কড়কড় করে ওঠে–একবার এগোও, একবার পিছনে যাও।

অর্ণব প্রায় আকাশ থেকে পড়ে। এ তো পুরো উলটো গল্প। সে বিস্মিত–ওকে আমরা ধরব না স্যার?

অধিরাজ হাসল–ওকে, ধরলে কিছুই হাতে আসবে না। পোষা কুত্তা! বরং ওকে এমন ভয় দেখাও যাতে ও সেই ভুলটাই করে যেটা আমি চাইছি।

স্যার!

আমি এই লিডটা জাম্প করে পরের লিডে যেতে চাই। ওকে এমন ভয় দেখাও যাতে টেনশনের চোটে বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পায়। লাশটা যাতে ডাম্প করে সেই সুযোগটা ওকে অবশ্যই দেবে। সচরাচর কুকুরেরা ভয় পেলে সবচেয়ে আগে মালিকের কাছেই দৌড়ায়।

গট ইট। অর্ণব অ্যাকসিলেটরের ওপর চাপ কমালকিন্তু আপনি কোথায়?

বাঁ দিকে তাকাও। তোমার ঠিক পাশেই আছি।

সে বাঁ দিকে তাকাতেই দেখতে পেল শুনশান মাঠের ওপর দিয়ে একটা আলো তীব্রবেগে ছুটে চলেছে তার গাড়ির সমান্তরালে।

আপনি…মাঠের ওপর দিয়ে বাইক চালাচ্ছেন!

নয়তো কি হাইরাইজের ওপর দিয়ে চালাবো? অধিরাজ সিরিয়াস মুণ্ডুটা সামনে ঘোরাও। তুমি যেখানে থামবে, সেখান থেকেই আমার দৌড় শুরু! আগেই কেঁচিও না। যতটা পারো তেড়ে যাও। বুঝতে যেন না পারে গোটা কেসটাই গট-আপ। আমরা এখন পুরো দাবা খেলছি। তুমি কুইন হয়ে তেড়ে যাচ্ছ। পবিত্রও গজ হয়ে ধেয়ে এলো বলে। ও চেকমেট বাঁচানোর জন্য তোমার দিকে কনসেনট্রেট করতে গিয়ে ভাবতেই পারবে না যে তৃতীয় দিক দিয়ে বোড়ে এগিয়ে আসছে। এটাই স্ট্রাটেজি।

ওকে।

অর্ণব ড্রাইভিংয়ে মন দেয়। তার সঙ্গে ঠিক সমান্তরালে একটু দূরেই তাল মিলিয়ে তীব্রবেগে ছুটে চলেছে বাইক। অধিরাজের মাথায় কালো রঙের হেলমেট। লেদার জ্যাকেটের চেইন গলা অবধি টানা। তবুও শীত শীত করছে। এবড়ো-খেবড়ো মাঠের ওপর দিয়ে বাইক চালানো মোটেই সহজ কাজ নয়। থেকে থেকেই লাফিয়ে লাফিয়ে উঠেছে। কিন্তু সে হাল ছাড়ার লোক নয়। যতক্ষণ পাশ থেকে অনুসরণ করা যায় ততক্ষণই করবে। মাঠ শেষ হয়ে গেলে তখন অর্ণবের গাড়ির পেছনে যেতে হবে।

অর্ণব এবার আবার অ্যাসিলেটরের ওপর চাপ মারে। একটু না এগোলে খেলাটা জমবে না। ভয় যখন দেখানোর অর্ডার আছে তখন ভয়ের কোটা শেষ করেই ছাড়বে। তার গাড়িটা আস্তে আস্তে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে। দুটো ছুটন্ত গাড়ির মধ্যে ব্যবধান আগে থেকে অনেকটাই কম। সে একহাতে স্টিয়ারিং চেপে ধরে আরেক হাতে তুলে নেয় রিভলবার। আপনমনেই হেসে বলল–টেক দিস ডিয়ার।

পরপর দুটো ফায়ারিংয়ের আওয়াজ। শুনশান রাস্তা মুহূর্তে সচকিত হয়ে উঠল। যে কুকুরগুলো শুয়েছিল, তারা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে শোরগোল ফেলে দিল। কেউ লেজ গুটিয়ে কুঁইকুঁই করছে। কেউ-বা গর্জন করে উঠে অর্ণবের গাড়ির পেছনে দৌড়াল। কিন্তু যে স্পিডে গাড়ি চলছে, তার সঙ্গে ছুটে পারবে না। অগত্যা তাদের ব্যর্থ আস্ফালন শোনা গেল।

ওপ্রান্তে অধিরাজের হাসির শব্দ–জিনিয়াস গুরু

বোলেরোটা এক মুহূর্তের জন্য যেন শ্লথ হয়ে গেল। সম্ভবত ড্রাইভার ঘাবড়ে গিয়েছে। একটু বুঝি থতমতও খেল। পরক্ষণেই অবশ্য ফের গতি ধরে নিল। সেই ফাঁকেই বেশ খানিকটা কভার করে নিয়েছে সে।

ও নিউটাউনের দিকে যাচ্ছে। অর্ণব বলল–মনে হয় ন্যাশনাল হাইওয়ে টুয়েলভ ধরবে।

এন এইচ টুয়েলভ ধরার সম্ভাবনাই বেশি। অনেকক্ষণ পরে পবিত্রর গলা শোনা গেল–সম্ভবত নিউটাউন টু বিধাননগরের মাঝখানেই বডিটা ডাম্প করবে। ওখানে অ্যাকোয়াটিকার আশেপাশে প্রচুর ফাঁকা জায়গা।

রাইট ইউ আর। অধিরাজ উত্তর দিল–অর্ণব, লিড় করো। আমরা পেছনে আছি।

ইয়েস স্যার।

অর্ণব বুঝে গেল এবার কী করতে হবে। দাবা খেলতে না পারলেও কার রেসিং এবং চোর-পুলিশ খেলায় সে ওস্তাদ। নিজের কেরিয়ারে কম চেজ করেনি। এখন তো রীতিমতো মজাই লাগে। সে মুচকি হেসে সর্বশক্তি দিয়ে অ্যাসিলেটরে চাপ দিল। এবার হুড়মুড়িয়ে ওর ঘাড়ে গিয়ে পড়বে। তারপর যা থাকে কপালে!

আস্তে আস্তে দুটো গাড়ির মধ্যে ব্যবধান কমছে। সাদা বোলেরোর পেছনের পুলিশ-কার এঁটে আছে নাছোড়বান্দার মতো। তীব্র হুটারের শব্দে আকাশ কাঁপছে। আলো-আঁধারি রাস্তার ওপর দিয়ে হুশ হুশ করে ছুটে চলেছে দুটো গাড়ি। তাদের ডিপারের আলো দানবের চোখের মতো জ্বলজ্বল করে। অর্ণবের গাড়ির ঠিক পাশাপাশিই বুলেটের গতিতে ছুটছে রেসিং বাইক। সব মিলিয়ে রীতিমতো উত্তেজনাময় পরিস্থিতি।

প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দ! ধাতব আওয়াজে আবার সচকিত হয়ে উঠল রাত্রি। অর্ণব চেজ করতে করতেই অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। সুযোগ পেয়ে বোলেরোর পেছনটা জোরদার ঠুকে দিয়েছে! বোলেরোটা একটু কেঁপে উঠেই সামাল দিল। স্পিড আরও বাড়িয়েছে। সম্ভবত এই মুহূর্তে দুটো গাড়িই স্পিড লিমিটের চূড়ান্ত পর্যায়ে!

সামনের বোলেরোর ড্রাইভার বোধহয় বিপন্ন বোধ করে। পুলিশের গাড়ি ইতোমধ্যেই একবার ঠুকে দিয়েছে। সে সাইড মিররে দেখতে পেল, ফের যমদূতের মতো তেড়ে আসছে গাড়িটা! সে দাঁতে দাঁত চেপে খিস্তি দেয়–শুয়োরের বাচ্চা!

আরও কিছু বোঝার আগেই আরেকটা চরম ধাক্কা! হারামিরা ইচ্ছে করেই ধাক্কা মারছে! এত স্পিডে এসে গোত্তা মারলে অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা। আরেকটু হলেই বেসামাল হয়ে যাচ্ছিল গাড়িটা। শুধু বোলেরোর মতো বিশালবপু গাড়ি বলে এখনও টিকে আছে। গেট-কীপারটি প্রাণপণে স্টিয়ারিং আঁকড়ে ধরে। ম্যাডামকে যে ফোন করে বিপদের কথা জানাবে সে উপায়ও নেই। এতক্ষণে বোধহয় ম্যানেজারও পুলিশের হেফাজতে। যেভাবে তাড়া করেছে খানকির ছেলেরা যে, ফোন করার ফুরসটুকুও পাচ্ছে না। তার ওপর ফায়ারও করছে। সে অসহায়ভাবে একবার পেছনের সিটের লম্বা বস্তাটার দিকে তাকায়। এটাকে এবার কোথায় ফেলবে! আফসোসে ঠোঁট কামড়ায় লোকটা ম্যাডামকে একটা ফোন করতে পারলে ভালো হত। কিন্তু…।

আর কিছু ভাবার সময় পেল না সে। ঠং করে আবার সেই ভয়ংকর ধাতব শব্দ। এবার আর গাড়ি নয়, সে নিজেই কেঁপে উঠল। ওরা গুলি ছুড়ছে। গুলিটা টায়ারে না লাগলেও গাড়ির গায়ে লেগেছে। এনকাউন্টার করে দেবে না তো! এরকম বিপদে পড়তে হবে জানলে কে এই কাজ করত! ম্যাডাম বলেছিলেন–কিছু হবে না। পুলিশ তোর টিকিটিও ছুঁতে পারবে না। প্রত্যেকবার কড়কড়ে দু লাখ! ভেবে দ্যাখ।

ম্যাডামের কথার মধ্যে অদ্ভুত একটা নেশা ছিল। মহিলার সম্মোহিনী শক্তির আবর্তে পড়ে গিয়েছিল। অমন রূপবতী নারী যদি এভাবে কোনো অনুরোধ করে, তবে তার মতো পুরুষের সাধ্য নেই তাকে প্রত্যাখ্যান করার। তার ওপর আবার টাকার অঙ্কটা! এত টাকা সে একসঙ্গে কখনো দেখেনি। কিন্তু তখন কে জানত…!

এই নাও, এন এইচ টুয়েলভ ধরল। পবিত্রর কণ্ঠস্বর ব্লুটুথের মাধ্যমে দুই অফিসারের কানে বেজে উঠল–এবার ও কোনোদিকে যাবে তা নিয়ে বেটিং করবে কেউ?

অনেক অপশন আছে। অধিরাজ বাইক নিয়ে এবার রাস্তায় উঠে এসেছে। একটা স্পিড ব্রেকারের ধাক্কায় বাইক লাফিয়ে উঠেছিল। ঝাঁকুনিটা সামলে নিয়ে বলল–মা ফ্লাইওভার ধরবে, কিংবা রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। আবার কালিকাপুর রোডও ধরতে পারে। দুটো চান্সই প্রবল।

মানে আইদার বালিগঞ্জ ফাঁড়ি অর নিউ আলিপুর! অর্ণব আস্তে আস্তে বলল।

আমার সিক্সথ সেন্স তাই বলছে। লেটু সি। সে উত্তর দেয়–অর্ণব, তোমার পেছনেই পবিত্র আসছে। প্রায় ধরেই ফেলেছে আমাদের। ওকে সাইড দাও। গেট-কীপারকে এবার হিচকক থ্রিলার দেখিয়ে দিই।

অর্ণব পাশের আয়নায় দেখল অফিসার পবিত্র আচার্যের গাড়িটা প্রবল বিক্রমে হু হু করে এগিয়ে আসছে এদিকেই। সে গাড়ির গতিবেগ কমিয়ে একটু পিছিয়ে পড়ে। পবিত্রর গাড়িটা হুশ করে বেরিয়ে গেল। অর্ণবকে দেখে পবিত্র হেসে মাথা ঝাঁকাল। হেডসেটে শোনা গেল তার কণ্ঠস্বর-লেটস প্লে ব্রো।

পবিত্র আচার্যর এই কথার অর্থ সে খুব ভালোভাবেই জানে। অর্থাৎ সেই পুরোনো খেলাটাই খেলতে হবে। এ খেলা ওরা আগেও বেশ কয়েকবার খেলেছে। অর্ণবের মুখে একটা দুষ্ট হাসি ভেসে ওঠে।

গাইজ, ওকে যতদূর তাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব নিয়ে যাও। ফের অধিরাজের গলা শোনা যায়–আমি চাই না ও কিছু ভাবার সময় বা সুযোগ পাক?

দেয় কে!।

পবিত্র তখন বোলেরোর পাশে পৌঁছে গিয়েছে। প্রাণপণে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়িটাকে একদম বোলেয়োর প্রায় ওপরে নিয়ে ফেলল। প্রচণ্ড জোরে শব্দ। জবরদস্ত ধাক্কা! গাড়ি এবং চালক–দুজনেই কেঁপে উঠেছে। সামলে উঠতে না উঠতেই পাশ থেকে আবার আক্রমণ! পবিত্র ঠান্ডা গলায় উচ্চারণ কল–অর্ণব।

অর্ণব তৈরিই ছিল। চালক কিছু বোঝার আগেই সে পেছন দিক দিয়ে ধড়াম করে মারল! তবে ওরা এমনভাবে ঠুকছে যাতে অ্যাক্সিডেন্ট না হয়। এ কৌশল অধিরাজের কাছ থেকেই শেখা। কত স্পীডে কতটা জোরে ঠুকলে গাড়িটা উলটে যাবে না-এই গোটা ক্যালকুলেশন তারই। অপরাধীর রক্তহিম করার জন্য যথেষ্ট।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে এই ঠোকাঠুকি চলল। বোলেরোর ড্রাইভার অসহায় বোধ করে। একটা গাড়ি পাশ থেকে এসে গোত্তা মারছে, তো আরেকটা পেছন থেকে! সে স্পষ্ট বুঝতে পারল–এরা আজ তাকে মারার মুডেই আছে। গাড়িটাকে উলটে দিতেই চায়। বুঝতে পেরেছে গ্রেফতার করে লাভ হবে না। তাই…!

ভাবতেই তার জ্বরু কুটিল ভঙ্গি ধারণ করে। কুকুরগুলো মাংস না পেলে তাড়া করা ছাড়বে না। ওদের যে করেই হোক ডাইভার্ট করে দিতে হবে। লাশটা ডাম্প। করতে পারলে বোধহয় ভালো হত! কিন্তু কবে কী ভাবে! সুযোগই দিচ্ছে না। দু। দিক থেকে রে রে করে তেড়ে আসছে। ড্রাইভ করবে, না লাশটাকে ফেলবে!

পবিত্র বোধহয় তার মনোভাব বুঝতে পেরে কিছুটা ঢিলে দিল। আস্তে আস্তে বলল-ওকে বয়েজ। ডিনার ব্রেক।

অর্ণব মনে মনে হেসে ইচ্ছে করেই একটু পিছিয়ে পড়তে থাকে। তার পেছনেই বাইকে অধিরাজ। অর্ণব তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল–ঢিল দাও।

ওকে বস্। পবিত্রর গাড়ির স্পীডোমিটারের কাঁটা ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকে। অর্ণবও পিছিয়ে পড়ছে। এখন পবিত্র আর অর্ণবের গাড়ি পাশাপাশি। ঠিক তাদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ছুটে চলেছে বাইক। রাস্তায় এই মুহূর্তে এই রুদ্ধশ্বাস রেস দেখার জন্য কোনো দর্শক নেই। শুধু সার সার ল্যাম্পপোস্ট এই অদ্ভুত প্রতিযোগিতা দেখে যাচ্ছে। পিঙ্গল আভার রেশ চিরে দিয়ে বিদ্যুৎবেগে ছুটে চলেছে সাদা বোলেরো। তার থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে ধাওয়া করছে দু-দুটো পুলিশ-কার। ঠিক তাদের পেছনেই নিজেকে লুকিয়ে তুমুল স্পীডে এগোচ্ছে বাইক।

ঠান্ডা হাওয়া এবার অর্ণবের কানের পাশ দিয়ে হু হু করে বেরিয়ে যাচ্ছে। মাথার চুল এলোমেলো। চোখে হাওয়ার ঝাঁপটা লাগলেও খুব অসুবিধে হচ্ছে না। সে এসবে অভ্যস্ত। আস্তে আস্তে অ্যাকুসিলেটরের ওপর চাপ কমাতে থাকে। পবিত্র তার আগে চলে এসেছে। হেডসেটে তার গলা–বোলেরোর স্পীড বাড়ছে। কী করব?

আরও একটু পিছিয়ে এসো। অধিরাজ বলল–ওকে এবার একটু স্পেস দাও। ড. বিজয় জয়সওয়ালের আত্মার শান্তির জন্য তিরিশ সেকেন্ড মৌনতা পালন করা যাক। ডাম্প করার জন্য এনাফ।

বেশ।

বোলেরোর ড্রাইভার এবার ওদের একটু পিছিয়ে পড়তে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বাপ রে! কী চেপেটাই না ধরেছিল! তার স্পীডোমিটারের কাঁটা একশো কুড়ি ছুঁয়ে ফেলেছে। নিকুচি করেছে ট্র্যাফিকের। আজকে বাঁচলে, কালকে ট্রাফিক পুলিশের কথা ভাববে। কিন্তু এখনই লাশটাকে না ফেললে যে চলছে না! কিন্তু তার জন্য সময় চাই। গাড়ি থামিয়ে, পেছনের দরজা খুলে বস্তাটাকে টেনে নামাতে হবে। খুব দ্রুত কাজটা করলেও মিনিমাম কুড়ি সেকেন্ড লাগবেই। অত সময় কী হাতে আছে?

সে সামনের আয়নার দিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেল! এ কী, গাড়িগুলো গেল কোথায়! একটু আগেই তো পেছন পেছন আসছিল। এখন প্রায় দেখাই যায় না। অনেক দূরে বিন্দুর মতো হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। ওরা এতটা পিছিয়ে পড়ল কী করে! এরকম আশাতীত সৌভাগ্যে খুশি হওয়া উচিত না সন্দেহ করা উচিত–কোনোটাই সে ভেবে উঠতে পারল না। টেনশনে ঘেমে নেয়ে জল হয়ে গিয়েছে। মাথাটাও ঠিকমতো কাজ করছে না। শুধু একটাই চিন্তা মনে এলো–লাশটা ফেলতে হবে। হয়তো বডি দেখলে ওরা ওখানেই থেমে যাবে।

লোকটা সশব্দে গাড়িতে ব্রেক মারল। গাড়ি থামতে না থামতেই দরজা খুলে দৌড়ে গেল পেছনের দরজার দিকে। দ্রুতহাতে বস্তাটাকে নামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। উঃ! কী ভারি মাইরি! ওদিকে ওরা যে ক্রমাগতই এগিয়ে আসছে…।

সে দাঁতে দাঁত চেপে সর্বশক্তি দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে বস্তাটাকে নামিয়ে আনল। উত্তেজনায়, দুশ্চিন্তায়, পরিশ্রমে ক্রমাগতই ঘামছে। তার কপাল, মুখ বেয়ে টস টস্ করে ঘাম পড়ছে। কোনোমতে লাশটাকে নামিয়ে এনেই লোকটা ফের দৌড়াল সামনের দিকে। দরজা খুলেই বিদ্যুৎগতিতে উঠে বসল ড্রাইভিং সিটে। ওদিকে পুলিশের গাড়ির আলো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে।

বডি ডাম্পড। পবিত্র বলল–সাদা বস্তাটাকে দেখতে পাচ্ছি।

বেশ। অধিরাজ ডাকল–অর্ণব!

ইয়েস স্যার।

তোমার দৌড় ওখানেই শেষ। তুমি লাশটাকে পাহারা দেবে। ফরেনসিক টিমকে খবর দেবে। ওরা যেন ইমিডিয়েটলি এসে বডি নিয়ে যায়। গট ইট?

স্যার!

পবিত্র বলল–আমি কী করব? আমার সঙ্গে দু-একজন সুন্দরী লেডি অফিসার আছেন। তাদের সঙ্গে প্রেম করতে পারি?

মিনিট পাঁচেক প্রেম চলবে। সে হাসল–কিন্তু তার বেশি না। এখন হুটার বন্ধ করো। মিনিট পাঁচেক ব্রেক নিয়ে তুমি আমার পেছনে আসবে। একদম চুপচাপ। আমি তোমায় বলে দেব কোথায় আসতে হবে।

তুমি শিওর যে ও সঠিক জায়গাতেই যাবে?পবিত্রর সন্দেহ যায়নি।

চান্স নিয়ে দেখা যাক। নয়তো ও ব্যাটা তো রাডারের মধ্যেই আছে।

রাস্তার একপাশে বস্তাটা পড়েছিল। অর্ণব ঠিক তার সামনেই গাড়ি থামাল। তাড়াহুড়োয় লাশটা ঠিকভাবে ফেলতে পারেনি। সে গাড়ি থেকে নেমে ধীরেসুস্থে এগিয়ে গেল বস্তার দিকে। ইতোমধ্যেই ডিপারের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে বস্তা থেকে একটা মানুষের হাত বেরিয়ে এসে এলিয়ে পড়েছে রাস্তার ওপরে। অর্ণব হাতে গ্লাভস পরতে পরতেই ঠিক তার পেছনে আরেকটা গাড়ির ব্রেক কষার আওয়াজ শুনতে পায়। পবিত্র আচার্য এসে হাজির। সে এবং সঙ্গের লেডি অফিসাররা হাতে গ্লাভস পরে গাড়ি থেকে ঝুপঝুপ করে নামছে। পবিত্র তার দিকে তাকিয়ে জ্বরু নাচিয়ে বলল–চলো, হিপোপটেমাসকে বের করা যাক।

সবাই মিলে টেনেটুনে বস্তার ভেতর থেকে লাশটাকে বের করে। কোনো সন্দেহ নেই–ড. বিজয় জয়সওয়ালই বটে! অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এত চেষ্টার পরেও লোকটাকে বাঁচানো গেল না! সর্বনাশিনী ফের মাত দিয়ে বেরিয়ে গেল।

গট হিম রাজা।

গ্রেট। ফরেনসিককে খবর দাও। দুর্বাসা যদি বেরিয়ে গিয়ে না থাকে তবে তাঁকেও আসতে বলে। এই লোকটার পোস্টমর্টেম রিপোের্ট তাড়াতাড়ি চাই।

অর্ণব দেখল বাইক আরোহী একেবারে আলোর গতিবেগে তাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। যেভাবে হেলে গিয়ে তাদের গাড়িটাকে কাটাল তা বোধহয় কোনো স্টান্টম্যানের পক্ষেই সম্ভব! পবিত্র হৈ হৈ করে উঠল–উফফ রাজা! সেক্সি… সেক্সি! ড্যাম সেক্সি মুভ ডুড!

বাইক আরোহী তাদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে হাত তুলে থাম্বস আপ দেখাল! তাকে এখন সাদা বোলেরোর পেছনে যেতে হবে। বোড়ে যদি রাণীর কাছে নিয়ে যায় তবেই কেল্লা ফতে। বোড়ে ভয় পেয়ে যদি রানিকেও একটু নার্ভাস করে দেয়, তাহলে তো কথাই নেই।

অনেক বুদ্ধিমান লোকও নার্ভাস হয়ে গেলে ভুল করে বসে। বাকিটা…!

*

মেরিলিন প্ল্যাটিনাম সোসাইটির সামনে এসেই থামল সাদা বোলেরো।

গেট-কীপার একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। পুলিশ কারের আর নাম গন্ধ নেই। হয়তো ওরা লাশটাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তার দিকে আর খেয়াল করেনি। বাপ রে! কী তাড়াটাই না করেছিল। এখনও তার বুক কাঁপছে। একসময় তো মনেই হচ্ছিল যে তাকে ঠুকেই ছাড়বে! শেষপর্যন্ত যে ছেড়ে দিয়েছে এই তার চোদ্দপুরুষের ভাগ্য!

এখন রাত প্রায় দেড়টা বাজতে চলল। মা ফ্লাইওভার ধরলে আরও তাড়াতাড়ি আসা যেত। কিন্তু ইচ্ছে করেই একটু ঘুরপথে এসেছে। কে বলতে পারে, হয়তো পুলিশ ইতোমধ্যেই অ্যালার্ট জারি করে দিয়েছে! সোজা রাস্তাতে গেলেই ধরে ফেলবে। তাই অন্য পথেই আসতে হয়েছে।

সে গাড়িটাকে কোনোমতে দাঁড় করিয়ে ছুটে গেল মেরিলিন প্ল্যাটিনামের দিকে। ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতেই হবে তাকে। এবারের টাকাটা পেয়ে গেলে গা ঢাকা দেবে। যতদিন না সব ঠান্ডা হচ্ছে ততদিন গর্ত থেকে আর বেরোচ্ছে না! যদি মহিলা টাকা দিতে তেড়িবেড়ি করে, তবে ব্ল্যাকমেলিং ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই। সে যদি ডোবে তবে ম্যাডামকে নিয়েই ডুববে।

লোকটা তাড়াহুড়োর চোটে খেয়ালই করেনি যে উলটোদিকেই একটা বাইক দাঁড়িয়ে আছে। এবং দীর্ঘদেহী হেলমেট পরা বাইক আরোহী ঠিক বাইকের গায়েই ঠেস দিয়ে কারোর অপেক্ষা করছে। তার সেদিকে তাকানোর সময়ই নেই। সে তড়িঘড়ি গেটের দিকে ছুটে গেল। আজ সম্ভবত অন্য একজন গেট-কীপার নাইটশিফট করছে। তাকে কিছু একটা বলেই লোকটা কমপ্লেক্সের মধ্যে ঢুকে গেল।

অধিরাজ একটুও তাড়াহুড়ো করল না। লোকটাকে কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না যে পুলিশ পেছনেই আছে। অতএব সে ধীরে সুস্থে হেলমেট খুলল। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যায় সেদিকেই।

আপনি…?

এই গেট-কীপারটিকে এর আগে দেখেনি অধিরাজ। সে চোখ কুঁচকে ছেলেটির মুখ একঝলক দেখে নিল। তারপর আইডি কার্ডটা বের করে নীরবে দেখাল।

সিআইডি! বেচারির চোখ কপালে! অধিরাজ ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারায় তৗকে চুপ থাকতে বলে দৌড়ে চলে গেল ভেতরের দিকে। মেরিলিন প্ল্যাটিনামের অন্যান্য সিকিউরিটি গার্ডরা সকৌতূহলে তার দিকে তাকালেও বাধা দিল না। তারা ওকে সিআইডি অফিসার হিসাবে চেনে। বিজয় জয়সওয়ালের ব্যাপারে এতবার ওদের ধমকেছে আর জেরা করেছে যে সহজে ভোলার কথাও নয়।

মেরিলিন প্ল্যাটিনামের বিল্ডিংঙে দুটো লিফট থাকলেও একটা আবার আউট অব অর্ডার। অন্যটা অবশ্য চলছে। অধিরাজ যতক্ষণে হুড়মুড়িয়ে সেখানে পৌঁছল, ততক্ষণে লিফটটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সে দেখল লিট্টা ওপরের দিকে উঠছে…! ফার্স্ট ফ্লোর…সেকেন্ড ফ্লোর…!

সে বিন্দুমাত্রও দেরিনা করে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করল। লিটটা থামবে কোথায়? কোন ফ্লোরে যাচ্ছে? পাগলের মতো প্রতিটি ফ্লোরে লিফটের নির্দেশের দিকে তাকাচ্ছে। লিফট এখনও উঠছে।

অধিরাজের কোনোদিনই সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হয় না। কিন্তু আজ চারটে ফ্লোরের সিঁড়ি ভেঙেই মনে হলো, দম বন্ধ হয়ে আসছে। জ্বরে গোটা দেহ যেন পুড়ে যাচ্ছে। জ্যাকেটটা খুলে ফেলতে পারলে বোধহয় ভালো হতো। দরদরিয়ে ঘামছে। অথচ সময় নেই। সে লিফটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছুটছে। একটার পর একটা ফ্লোর চলে যাচ্ছে! অথচ লিফটের থামার নামই নেই! এখনও উঠে চলেছে। সাত…আট, নয়!

অধিরাজের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। আর কত ওপরে উঠবে! ও কি কারোর ফ্ল্যাটে যাচ্ছে? নাকি…! ছাদে নয়তো? সে কোনোমতে সজোরে শ্বাস নিয়ে ফের দুড়দাড় করে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করল। চোখের সামনে সার সার সিঁড়ি। একের পর এক লাফিয়ে টপকে যাচ্ছে। ওদিকে লিফট উঠছে…! দশ…এগারো…বারো…!

শেষপর্যন্ত টুয়েলভথ ফ্লোরে গিয়ে থামল লিফট! স্বাভাবিক। কারণ তার ওপরে ছাদ ছাড়া আর কিছু নেই। অধিরাজ তখনও তিনটে তলা নিচে। এতক্ষণ গাড়ি চেজ করেছে। এবার লিট চেজ করছে। নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে…গায়ে আগুন জ্বলছে…ঘামে ভিজে গিয়েছে আপাদমস্তক…! তবু…!

পবিত্র–কতদূর? সে হাঁফাতে হাঁফাতেই প্রশ্ন করে।

ব্যাড লাক বস্। পবিত্র জানাল–একটা টায়ার পাংচার হয়ে গিয়েছে। এক দু মিনিট লেট হতে পারে। মেরিলিন প্ল্যাটিনাম তো?

হ্যাঁ। ছাছে যাচ্ছে সম্ভবত…! কাম শার্প…!

এক্ষুনি যাচ্ছি…।

অধিরাজ ওপরের দিকে প্রাণপণে দৌড়তে থাকে। গতি তীব্র থেকে তীব্রতর! আঃ! এত কষ্ট হচ্ছে কেন! বারবার মনে হচ্ছে পারবে না। পবিত্রদের গাড়িটাও এখনই পাংচার হতে হলো!

সে সবেগে টুয়েলভস্ ফ্লোর ক্রস করল। এর ওপরে শুধু ছাত। দৌড়াতে দৌড়াতেই দেখতে পেল ছাদের দরজা খোলা। মেরিলিন প্ল্যাটিনামের ছাদেও সুন্দর রং-বেরঙের আলো কারুকাজ। সামনের অংশটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এখান থেকে লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না। ও নিশ্চয়ই ওপরে একা নেই। একটা মানুষের ছুটে আসার শব্দও যেন পাওয়া যাচ্ছে। ছুটতে ছুটতেই কোমরের বেল্টে হাত চলে গিয়েছে তার…!

কিন্তু কোমর থেকে যন্ত্রটাকে বের করে আনার আগেই অতর্কিতেই সামনে এসে দাঁড়াল কেউ! কিছু বোঝার আগেই থপ করে একটা আওয়াজ! অধিরাজ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো কেঁপে উঠল। সে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে সামনের দিকে দেখার চেষ্টা করল একবার। মর্মান্তিক সে দৃষ্টি! দুনিয়ার ব্যথা, অবিশ্বাস আর বিস্ময় মিলেমিশে একাকার! সামনে ওটা কে! বুকের মধ্যে একটা তীব্র যন্ত্রণা! শরীর থেকে গরম কিছু একটা গলগল করে বেরিয়ে যাচ্ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। বুকের ওপর চরম ভার! কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই বাবার গলা শুনতে পেল সে–কবে কী ঘটিয়ে বসবে সেই ভয়েই…! আবার তার মধ্যেই যেন ড. চ্যাটার্জী চেঁচিয়ে উঠলেন–খুন করে ফেলব…একদম খু-উ-ন করে ফেলব…!

শেষ মুহূর্তের জন্য একঝলক চেতনা বিদ্যুৎচমকের মতো চমকে উঠল! সামনের বন্দুকধারীকে দেখে একবারের জন্য ঠোঁট কেঁপে উঠল তার। আততায়ীকে চিনতে পেরেছে! শ্বাস নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে অস্ফুটে উচ্চারণ করার চেষ্টা করল তার নাম–রি…রি…

রিয়া…! অধিরাজের ঠিক সামনেই তখন দাঁড়িয়ে আছে এক কৃষ্ণাঙ্গী! অবিকল যেন জামাকাপড়ের শোরুমে সাজানো কালো রঙের ম্যানিকুইন! তার হাতে উদ্যত রিভলবার। সাইলেন্সর লাগানো। আঙুল ট্রিগারে। ভয় পেয়ে মেয়েটি কেঁদে উঠল সরি! সরি! আমি তোমাকে মারতে চাইনি…মারতে চাইনি…আই অ্যাম সরি।

রিয়া সামান্থা বাজাজ! অধিরাজের মস্তিষ্ক শুধু এইটুকুই জানাতে পেরেছিল তাকে। তারপরই সব অন্ধকার! তার ছফুট চার ইঞ্চির দীর্ঘ দেহটা সংজ্ঞাহীন হয়ে টলে পড়েই যাচ্ছিল। তার আগেই পেছন থেকে দুটো কোমল হাত ধরে ফেলল তাকে। একটি নারীকণ্ঠ প্রচণ্ড রাগে বলল–রিয়া!

আমি কিছু করিনি! রিয়া সজোরে কেঁদে ওঠে…ওপরে ঐ লোকটা মরে পড়ে আছে। আমি ওকেও মারতে চাইনি। আমি শুধু ভেবেছিলাম মি. বাজাজ আসছে! …আমি মি. বাজাজকেই তো মারতে চেয়েছি…কী করে বুঝব এ অন্য লোক!

ইউ শট হিম লাইক দিস!

অপর নারীকণ্ঠ চরম আক্রোশে হিসহিসিয়ে বলল–ইউ ইডিয়ট! স্টুপিড গার্ল! হেল্প মি!

ইজ হি ডেড?

অন্য নারীটি ধমকে উঠল-আই সেইড, হেল্প মি!

ওকে।

ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে রিয়া বাজাজ হাত লাগায়। ছফুট চার ইঞ্চি লম্বা একটি বলিষ্ঠ পুরুষকে ধরে রাখা একা মেয়ের কাজ নয়। দুজনে মিলে ধরাধরি করে কোনোমতে তাকে চিৎ করে শুইয়ে দিল মেঝের ওপরে। দ্বিতীয় মেয়েটি তার প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে লাইন কেটে দেয়। কান থেকে সযত্নে ব্লুটুথ ওয়্যারলেস ইয়ার ফোন খুলে নিতে নিতে রিয়াকে বলল–

নাউ লিভ! এখনই এখান থেকে চলে যা।

রিয়া ভয়ার্তভাবে দুড়দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে নেমে যায়। দ্বিতীয় মেয়েটি অধিরাজের বুকের ওপরে মাথা রাখে। প্রাণপণে হার্টবিট শোনার চেষ্টা করছে। তাকে উন্মত্তের মতো লাগছিল। কী প্রচণ্ড রক্তপাত হচ্ছে! হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ নেই! রিয়া–চরম বোকা একটা মেয়ে!

সে পাগলের মতো নিথর দেহটাকে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে থাকে সামান্যতম জীবনের চিহ্ন। নেই? নিঃশ্বাস পড়ছে না! একদম শেষ! অসম্ভব! হতে পারে না। এত সহজে ও যেতে পারে না। এখনও অনেক খেলা বাকি। আজ পর্যন্ত এই মানুষটার মতো ভালো কেউ বোঝেনি তাকে! তার মন আর কারোর কাছে এত সহজবোধ্য নয়। এভাবে তাকে বিপদে ফেলতে আর কেউ পারবে না। এইভাবে তাকে ভুল চাল খেলতে বাধ্য করতে পারেনি কেউ। ওকে কী প্রচণ্ড মরিয়াই না করে তুলেছিল এই লোকটা! তার একটা ভুলের জন্যও গেট-কীপার অবধি পৌঁছেই গিয়েছিল। ইডিয়টটাকে না মারলে হয়তো তাকেও ধরে ফেলত। কিন্তু রিয়া…!

মেয়েটা অধিরাজের হাত ধরে পালস্ বোঝার চেষ্টা করছে। তাতেও যখন কিছু বোঝা গেল না তখন জ্যাকেট ধরে ঝাঁকুনি দিল বেশ কয়েকবার! মনে মনে বলল… কাম অন! ওয়েক আপ! আমরা দুজন চেসবোর্ডের দুদিকে আছি। দুজন শত্রু। কিন্তু তাও তুমি আমার সবচেয়ে কাছাকাছি। অনেক পুরুষ আমার পেছনে ছুটেছে, কিন্তু তোমার মতো এমন একনিষ্ঠভাবে কেউ আমায় ধাওয়া করেনি। তোমার মস্তিষ্কে, তোমার বুকে, চেতনায়-অবচেতনে, স্বপ্নে-জাগরণে শুধু আমিই আছি! প্রত্যেক নারীর মধ্যে পাগল প্রেমিকের মতো আমাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছ তুমি! আমাকে এখন প্রত্যাখ্যান করতে পারো না। এভাবে খেলা শেষ করতে পারো না। ওয়েক আপ!

নিথর দেহে তাও কোনোরকম জীবনের লক্ষণ নেই। এইবার তার সমস্ত অনুভূতি, সমস্ত প্রচেষ্টা হিংস্র রূপ ধারণ করল। সে অধিরাজের গালে ঠাস্ ঠাস করে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিয়ে নিরুপায়ের মতো কেঁদে ফেলল। দু হাতে মুখ ঢেকে অসহায় কান্নামাখা কণ্ঠে বলল–নিষ্ঠুর! …

ওঃ!

একটা কাতর শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে মেয়েটা। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল নিস্পন্দ দীর্ঘ শরীরটা যেন একটু কেঁপে উঠল! ভুল! নাকি ঠিকই দেখছে! বেঁচে আছে? নাকি সবটাই ভ্রম…!

এই!…এই! এ-ই!

সে চোখের জল তাড়াতাড়ি মুছে ফেলল। ব্যাকুল, উদগ্রভাবে দু হাতে তার গালে আলতো চাপড় মারছে। দু সেকেন্ড সব চুপচাপ! তারপরই এতক্ষণের নিথর দেহ আবার কেঁপে উঠল। ঠোঁটজোড়া একটু খুলে গেল! যেন আপ্রাণ নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে…!

কা-ম অ-নৃ!

মেয়েটা বুঝে গেল কী করতে হবে। এখনও মানুষটার দেহ লড়াই ছাড়েনি। সে এখনও চেষ্টা করছে। মেয়েটা দ্রুতহাতে জ্যাকেটটার চেইন খুলে ফেলল। জ্যাকেট ততক্ষণে ভিজে গিয়েছে। রক্তে ভিজে গিয়েছে টি-শার্টটাও। সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে টি-শার্টটা ছিঁড়ে ফেলার। কিন্তু ছিঁড়ছে না। ওদিকে অধিরাজ ফের নিথর হয়ে যাচ্ছে! …

ড্যাম ইট!

সেটি শার্টটাকে টান মেরে তুলে দিল ওপরে। এখন অধিরাজের বক্ষদেশ এবং ক্ষতস্থান প্রকট! মেয়েটি আর কোনো ভাবনা-চিন্তা না করেই তার ওপর চেপে বসে হাতের তালু দিয়ে বুকে চাপ মারছে। মুখে মুখ ঠেকিয়ে আর্টিফিশিয়াল ব্রিদিং দেওয়ার চেষ্টাও করছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হওয়ার নয়। মানুষটা ক্রমশই নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ…!

হোল্ড অনু! প্লিজ বেবি! ব্রিদ…ব্রি…।

ফিসফিস করে করুণ অনুনয় করল সে। চোখের জলে মেয়েটার ঠোঁট ভিজে গিয়েছিল। সেই ভিজে ঠোঁটই এখন একটু প্রাণের উত্তাপ সঞ্চার করার চেষ্টা করছে এক মৃতপ্রায় মানুষের দেহে। একটু উষ্ণ নিঃশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই প্রক্রিয়াটিকে ছোট করে বলা হয় সিপিআর। কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন! কৃত্রিম উপায়ে হৃৎপিণ্ডকে সচল করার প্রক্রিয়া।

কিন্তু সিপিআরেও কিছু হলো না! মেয়েটি তার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে আর্টিফিশিয়াল ব্রিদিং দিতে দিতেই এবার পাগলের মতো গুমগুম করে এলোপাথাড়ি কিল মারতে থাকে বুকের ওপর–কাম্ অহ্ ইউ ব্রট! ও-য়ে-ক আ–প! আই সেইড ওয়েক আ…প!

এতক্ষণ যে দেহে কোনোরকম প্রাণের অস্তিত্ব ছিল না, দুমদাম কিল খেয়ে সেই শরীরটাই হঠাৎ একটা জোরালো ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো সামান্য লাফিয়েও উঠল। একটা প্রবল হেঁচকির মতো শ্বাস টানল অধিরাজের অচেতন দেহ! যেন প্রচণ্ড শক্তিশালী একটা ইঞ্জিন অনেকক্ষণ থেমে থাকার পর আচমকা চলতে শুরু করল! মেয়েটা তার নাকের সামনে আঙুল রাখল। নিঃশ্বাস পড়ছে।

গুড বয়! সে হেসে পরম মমতায় তার কপালে হাত রাখে। উসকোখুশকো চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বলল–ওয়েলকাম ব্যাক টাইগার।

টাইগারই বটে। বাঘিনীর উপযুক্ত বাঘ!

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *