৪. গোল্ডেন মুনে পৌঁছতে

গোল্ডেন মুনে পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা গড়িয়ে গেল। কিন্তু সোনালি চাঁদের দর্শনমাত্রই তিন অফিসারের চোখ ব্রহ্মতালুতে! এটা ক্লাব! না ফাইভ স্টার হোটেল! কিংবা রিসোর্ট! ক্লাবের গেটে সুসজ্জিত উর্দিধারী গেটকিপার সসম্ভ্রমে দরজা খুলে দিল। ক্লাবের সামনের মসৃণ বাঁধানো রাস্তার পাশে সবুজের দুরন্ত কারিকুরি। দুপাশে গাছের বর্ডার লাইনের পেছনেই বিরাট পান্না সবুজ মাঠ। সেখানে টেনিসকোর্ট আছে। কয়েকজন টেনিস খেলছেন। মাঠের পাশেই সারি সারি দামি দামি গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। একপাশে বিরাট সুইমিংপুলকে সামনে রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে গোল্ডেন মুন।

রাজারহাটে বেশ অনেকখানি ফাঁকা জমিকে ঘিরে বছর দেড়েক হলো গড়ে উঠেছে ঝাঁ চকচকে নতুন ক্লাব। পুরো এরিয়া জুড়ে বিরাট প্রাচীর! মেইন বিল্ডিঙের পেছনে অর্ধচন্দ্রাকারে ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট বাংলো টাইপের শৌখিন কটেজ। প্রত্যেকটি কটেজের সামনে সুন্দর ফুলের বাগান। চতুর্দিকে নানারকম গাছ দিয়ে এমন সাজিয়েছে যে তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যায়। তাদের। ঠিক কেন্দ্রেই দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক স্টাইলের মেইন বিল্ডিং। চারতলা বিল্ডিংটাই কাঁচের! তার ওপরে সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে সোনালি আলো ঠিকরে দিচ্ছে। নীল সুইমিংপুলে তখনও সুইমিং সুট পরে সাঁতার দিচ্ছে কয়েকজন সুন্দরী জলপরি! দেখেই বোঝা যায় যে সাঁতার কাটতে রীতিমতো পারদর্শী। আর একেকজনের কী ফিগার! সুন্দরীদের মসৃণ রেশমের মতো ত্বকের ওপরে অভ্রের গুঁড়োর মতো জলবিন্দু চিকমিক করে উঠছে। সুইমিং সুট পরা অর্ধনগ্ন দেহ জলের সঙ্গে রতিক্রিয়ায় উল্লাসে মেতেছে।

অর্ণব সেদিকে তাকিয়েই আঁতকে গিয়েছিল। অধিরাজ তার চোখের সামনে হাত দিয়ে আড়াল করে দিয়েছে–চাঁদ দেখতে এসে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি! ওদিকে নয় অর্ণব।

মিস্ ঘোষ হেসে ফেলল–নিসর্গশোভাও দেখা যাবে না স্যার?

আপনি মনের আনন্দে দেখুন। কিন্তু অর্ণব দেখবে না। সে ছদ্মরাগে বলে–আমার হিংসে হচ্ছে!

অর্ণব হেসে ফেলল। কোন্ কুক্ষণে যে কথাটা বলেছিল! এখন উঠতে বসতে খোঁচা খেতে হবে! অধিরাজ তার দিকে বক্র কটাক্ষে তাকিয়ে গুজগুজ করল-স্পেশ্যাল কেউ! স্পেশ্যাল কেউ!

সুইমিং পুলটা কাটিয়েই সামনে বিরাট কাঁচের দরজা পড়ল। দরজার ওপ্রান্তেই রিসেপশনে কমলা রঙের শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং কমলা রঙের লিপস্টিপ মেখে আরেক জান-নেওয়া সুন্দরী বসে আছেন। অর্ণবের আবার একই কথা মনে হয়। সম্ভবত খুনি নয়, তারা ব্রহ্মাণ্ডসুন্দরীর খোঁজই করছে।

মহিলা ডাকসাইটে সুন্দরী। মিস্ ঘোষ রিসেপশনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে।

আমার তো চমৎকার একগ্লাস অরেঞ্জ জুস্ মনে হচ্ছে! অধিরাজ দুষ্ট হাসল–টাটিক কমলালেবুর রস! বয়েস হচ্ছে তো! তাই ভুলভাল দেখছি।

টাটিক! অর্ণব সকৌতূহলে জানতে চায়।

টাটকার স্ত্রী লিঙ্গ। অভিধানে নেই। সে মসৃণ হাসল–আমি বানালাম।

অধিরাজ মুখে হাসলেও ভেতরে ভেতরে বেশ কষ্ট পাচ্ছিল। অর্ণবরা যখন লাঞ্চ করতে গিয়েছিল সেই ফাঁকে প্রচণ্ড বমি করেছে সে। তারপর কিছুক্ষণ নিজের পায়ে দাঁড়াতেই বেশ কষ্ট হচ্ছিল। মাথা চক্কর দিচ্ছে, সর্বশরীর যন্ত্রণায় ভেঙে আনছে। উপায়ান্তর না দেখে কোনোমতে ওষুধের দোকান থেকে প্যারাসিটামল কিনে খেয়ে নিয়েছে। এখন টেম্পারেচার নামলেও ক্রমাগতই ঘামছে। বুকের ভেতরটা অস্থির অস্থির করছে। অসম্ভব কাহিলও লাগছে। একটা সংবিৎ তন্দ্রা নেমে আসছিল চোখে। অথচ ঘুমানোর উপায় নেই। রবার্ট ফ্রস্টের মতো তাকেও এখন ঘুমানোর আগে অনেকদূর যেতে হবে। মাইলস টু গো। বিফোর আই স্লিপ। খুনি এখনও কয়েক যোজন এগিয়ে। তাকে ধরতে হবে।

এক্সকিউজ মি। সে সুন্দরী রিসেপশনিস্টের দিকে একটা নরম হাসি ছুঁড়ে দেয়–আমাদের কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল।

রিসেপশনিস্ট পূর্ণদৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকাল–আপনারা? মেম্বার? না হতে চান?

কোনোটাই না। অধিরাজ আইডি কার্ড বের করে এনেছে–সিআইডি, হোমিসাইড।

নিতান্তই দুটো শব্দ। কিন্তু রিসেপশনিস্টের মুখভঙ্গি যা হলো তা অবর্ণনীয়। একসঙ্গে ভয়, কৌতূহল, সতর্কতার ছাপ একসঙ্গে তার মুখে পড়ে মিলেমিশে যায়। দ্বিতীয়বার যখন সে মুখ খুলল তখন কণ্ঠস্বরে যথেষ্ট সাবধানতার আঁচ পাওয়া গেল–সিআইডি! কিন্তু কেন স্যার? আমরা তো এখানে ইললিগ্যাল কিছু করছি না।

অধিরাজ সে প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে ড. বিজয় জয়সওয়ালের ছবিটা তার নাকের সামনে তুলে ধরল–ইনি এখানকার মেম্বার ছিলেন?

মেয়েটি বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল–সরি স্যার, আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। আপনি আমাদের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলুন।

হুঁ। তার ভুরু কৌতুকে নেচে উঠল–তাঁদের এখন কোথায় পাওয়া যাবে?

তরুণীটি আর বিলম্ব না করে কাকে যেন ফোন করে। ফোনে ঠোঁট বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে এক মিনিট কথা বলেই অধিরাজের দিকে তাকাল–ওঁরা কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছেন স্যার। আপনারা ততক্ষণ একটু বসুন।

রিসেপশন কাউন্টারের উলটোদিকেই বসার ব্যবস্থা। লাল ভেলভেটে মোড়া সোফাগুলো এত নরম যে বসলেই প্রায় ডুবে যেতে হয়। মিস্ ঘোষ আর অর্ণব একটা সোফা ভাগাভাগি করেই বসল। অধিরাজ ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে একটু তফাতে। রিসেপশনিস্ট এসে জিজ্ঞেস করল যে চা কিংবা কফি দেবে কি না। বলাই বাহুল্য, তিনজনেই সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করল। মেয়েটি ওদের দিকে একটা সন্ত্রস্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে যায়।

লাঞ্চে কী খেলে? অধিরাজ অর্ণবের দিকে তাকিয়ে ফিচেল হাসছে–প্লিজ, বোলো না যে চাউমিন তথা হাক্কা নুডল্স্ খেয়েছ।

অর্ণব গোল গোল চোখ করে তার দিকে তাকায়। যা ব্বাবা! ধরে ফেলেছে!

বুঝলেন কী করে! মিস ঘোষ হাসলেন–তিনি ঠিক তাই খেয়েছেন! মাল্টিকুইজিন রেস্টুরেন্ট ছিল। বিরিয়ানি, কাবাব থেকে শুরু করে দোসা অবধি সবই ছিল। দারুণ দারুণ থালিও! তা সত্ত্বেও তিনি সব ফেলে হাক্কা নুডলসই খেলেন!

অধিরাজ উত্তর না দিয়ে মিটিমিটি হাসল। অর্ণব যেমন তাকে হাড়ে হাড়ে চেনে, তেমন সেও অর্ণবকে মজ্জায় মজ্জায় জানে। চাউমিন পেলে সে দুনিয়া ভুলে যায়। এমনকি এডিজি শিশির সেনের মেয়ের বিয়ের রিসেপশন পার্টিতে সে আরেকটু হলেই হায়াত রিজেন্সির হাক্কা নুডলেসর স্টক একাই শেষ করে ফেলছিল। শেষমেশ শিশির সেন স্বয়ং এসে গলা খাকারি দিয়ে বললেন– অর্ণব, এখানে নুডুলস্ ছাড়া আরও অনেক ডিশ আছে। প্লিজ সেগুলোও ট্রাই করে দেখো। নয়তো আর কেউ নুডলস্ পাবে না।

অর্ণব কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই যাচ্ছিল। তার আগেই অধিরাজ বলে উঠল–ঐ দ্যাখো–ক্লাবের কর্তৃপক্ষ আসছেন। নো ডেভিল। স্ট্রেট জেরা করা যাবে না। প্ল্যান বি। অর্ণব, সামলে।

অর্ণব সামনের দিকে তাকিয়েই প্রায় প্রস্তরীভূত হয়ে যায়। এর চেয়ে বোধহয় ডাইনোসোর তেড়ে এলেও ভালো হতো। সেই একইরকম স্লো মোশনে ক্যাট ওয়াক করতে করতেই এগিয়ে আসছেন মানসী জয়সওয়াল। সঙ্গে আরেকজন দিলতোড় সুন্দরী! লাল রঙের সিফন আর স্লিভলেস ব্লাউজে মানসী অপ্রতিরোধ্য। সঙ্গের সুন্দরী ম রঙের টপলেস গাউন পরেছেন। ক্লিভেজে আর উত্তুঙ্গ স্তনে যৌবন উপছে পড়ছে। উন্মুক্ত কাঁধ আর বাহু প্রায় স্বচ্ছই বলা চলে। মরাল গ্রীবা! চুলে প্ল্যাটিনাম ব্লন্ড কালার করিয়েছেন। ঠিকই করেছেন। কারণ ওঁর মধ্যে একটা বিদেশিনী মার্কা সৌন্দর্য আছে। চোখের তারা ঘন সবুজ। গোলাপি ঠোঁট। দুধে আলতা গায়ের রং। তাই প্ল্যাটিনাম ব্লন্ড চমৎকার মানিয়েছে। কিন্তু অন্যান্য সুন্দরীদের মতো ঢলঢলে নন। তাঁর সৌন্দর্যে একটা বুদ্ধিদীপ্ত ধারালো ভাব আছে। ঠিক যেন শান দেওয়া সোনালি রঙের তলোয়াল।

নিজেকে কেমন দেবরাজ ইন্দ্র মনে হচ্ছে। অধিরাজ উঠে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল–কেমন চারদিকে উর্বশী, মেনকা, তিলোত্তমা, রম্ভারা নৃত্য করছে দেখেছ?

সে অতিকষ্টে বলল–ইন্দ্র কিন্তু চূড়ান্ত মদ্যপ আর লম্পট ছিলেন স্যার!

চোখ টিপল অধিরাজ–আমিও এই মুহূর্তে ব্রহ্মচারী থাকার গ্যারান্টি দিতে পারছি না অর্ণব। তোমার হনুমান চালিসা লাগবে?

অর্ণব আড়চোখে তাকিয়ে হেঁচকি তুলে থেমে গেল। মানসী জয়সওয়াল ততক্ষণে সামনে এসে দাঁড়িয়ে সুমধুর অথচ বঙ্কিম কটাক্ষে তাদের দিকেই দেখছেন। অধিরাজকে দেখলেই কেমন যেন মাংসাশী প্রাণী মার্কা একটা লুক দেন মহিলা। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। লাল টুকটুকে ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন–আপনারা? স্পা করাতে এসেছেন বুঝি? না জেরা?  

অত্যন্ত বাজে রসিকতা! অর্ণবের মুখ ব্যাজার হয়ে যায়! মহিলা যতটা সুন্দরী ঠিক ততটাই বোকা! মুখ খুললেই সব সৌন্দর্য মাটি। ওঁকে মনে মনে খুনির লিস্ট থেকে বাদ দিল সে। এত মূর্খ মহিলা কিছুতেই খুনি হতে পারে না!

জেরার উদ্দেশ্যেই এসেছিলাম। তবে এখনই মাইন্ড চেঞ্জ করলাম। অধিরাজ ভারি মিষ্টি হেসে বলে–আপনি নিজের হাতে ম্যাসাজটা দিলে আপত্তি নেই! এমনিতেই একটু স্ট্রেসড আছি। ভাবছি একটা ম্যাসাজও নেব।

ফুলবডি?

সে চোখ সরু করে বলল–অফকোর্স।

এবার আর আকাশ নয়–হিমালয়টাই বোধহয় টেথিস সাগরে পরিণত হয়ে অর্ণবের মাথায় ঝুষ্ঠুস করে পড়ল! মনে হলো, একটা কোকিল বুঝি মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিস্‌অর্ডারে ভুগে কাও কাও করে ডাকছে! অথবা একটা জিরাফ হয়তো ঠ্যাং তুলে এক্কা-দোক্কা খেলছে। কিংবা সে নিজে একটা ব্ল্যাক হোলে ঢুকে গিয়েছে, সেখানে সোফিয়া লোরেন দোলনায় দুলে দুলে গান গাইছেন–পাখি পাখি পরদেসি-ই-ই…।

মানসী জয়সওয়াল একটা ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে অধিরাজের সুঠাম পুরুষালি দেহটাকে আপাদমস্তক মেপে নিলেন। অর্ণব একদম গরম হয়ে গেল। কী নির্লজ্জ মহিলা রে বাবা! অধিরাজ আবার তাঁকে হাওয়া দিচ্ছে!

ওয়েল, মিট মাই পার্টনার–অ্যাডেলিন বাজাজ। ভেরি গুড চেস প্লেয়ার! অ্যান্ড অ্যাডেলিন, হি ইজ দ্য মোস্ট হ্যান্ডসাম অ্যান্ড বিউটিফুল ম্যান আই হ্যাভ এভার সিন। অফিসার অধিরাজ ব্যানার্জী।

মানসী সঙ্গের মফসুন্দরীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। অ্যাডেলিন মনে হয় কম কথার মানুষ। মৃদু হাসলেন। তারও বয়েস বোঝা দায়। পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ অবধি সবই হতে পারে। তাঁর কাঁধের দিকে তাকিয়েই আঁতকে উঠল অর্ণব। সর্বনাশ! ইনি তো মাকড়সা সুন্দরী! একটা ভয়ংকর কালো ব্লোয়া ওঠা মাকড়সা কাঁধের কাছে ঘাল্টি মেরে বসে আছে। ট্যাটু! সুন্দরীদের চয়েস এমন খতরনাক কেন!

কিন্তু…। অধিরাজ একটু ন্যাকা সেজে বলল–একটা ক্লাবে চেস প্লেয়ার আর বটানিস্ট একসঙ্গে কী করছেন!

আপনাদের জন্যই আছি। মানসী বাঁকানো হাসি হাসলেন–ক্লাবটা মানুষের এনজয়মেন্ট আর রিফ্রেশমেন্টের জায়গা। তাই এখানে সবরকমের ফেসিলিটিস আছে। জিম, যোগা থেকে শুরু করে নানারকমের স্পোর্টস–সবই পাবেন। একদিকে স্যালুন আর স্পা আছে। ইংলিশ বার কাম মাল্টিকুইজিন রেস্টুরেন্ট আছে। কনফারেন্স রুম আছে। কিছুদিন নিরুপদ্রবে বা একা কাটাতে চাইলে কটেজে থাকতে পারেন। অন্যদিকে লন টেনিস, টেবল টেনিস, বিলিয়ার্ড, ইনডোর বাস্কেট বল, বলিং গেম–সব খেলা যায়। আর প্রতি সানডে ব্রিজ গেম আর চেস টুর্নামেন্ট হয়। সানডেতে চেস ক্লাবও বসে। আপনার কোনটা চাই?

অধিরাজ উত্তর না দিয়ে অদ্ভুত একটা হাসি হাসল। অর্ণবের প্রায় মাথা ঘোরার উপক্রম! এই হাসিটাকে বর্ণনা করতে গেলে একটা শব্দই বলতে হয়! মারকাটারি!

সে অবশ্য অর্ণবের দিকে দৃকপাতও না করে মানসী জয়সওয়ালের খুব কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল–আপাতত আপনার হাতে একটা কমপ্লিমেন্টারি ম্যাসাজের লোভ সামলাতে পারছি না।

মানসীও অদ্ভুত ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসলেন–শিওর। আপনার কী পছন্দ বলুন?

এইবার অধিরাজ থমকে যায়–মানে?

মানে অনেকেরই অনেকরকম পছন্দ। মানসী জানালেন–কেউ ম্যাশ পছন্দ করেন, কেউ বা ম্যাশ পছন্দ করেন। আই মিন মেল অ্যান্ড ফিমেল। পুরুষেরা সচরাচর মেয়েদেরই পছন্দ করেন। তবে তাদের মধ্যে অনেকে আবার মেয়েদের দক্ষতার চেয়ে সৌন্দর্যকেই বেশি প্রাধান্য দেন। অনেকে কালো মেয়ে পছন্দ করেন না। সেই নিয়ে বেশ কয়েকজন সদস্য অবজেকশনও দিয়েছিলেন। তাই জানতে চাইছি, আপনার কী পছন্দ?

সে উষ্ণ স্বরে জানায়–আমার তো আপনাকেই পছন্দ।

নটি বয়! অবিকল কিশোরীদের মতো খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন মানসী–বেশ, চলুন।

এক মিনিট। অধিরাজ স্মিত হাসল–আমার সঙ্গীরা কী করবেন? ওঁদেরও তো রিফ্রেশমেন্ট দরকার তাই না? অর্ণব খেতে খুব ভালোবাসে। আর। মিস্ ঘোষ দাবা খেলতে ভালোবাসেন।

অর্ণব তার ধরণধারণ দেখে খেপে লাল হয়েছিল। সে প্রায় খ্যাক করে ওঠে– মোটেও না। আমি দাবা খেলতে বেশি ভালোবাসি, আর মিস্ ঘোষ খেতে।

মিস্ ঘোষ তার রাগ দেখে হাঁ করে তাকিয়েছিল। অর্ণবকে এমন তুমুল চটতে সে কখনো দেখেনি।

ওকে। অর্ণব তবে মিস্ বাজাজের সঙ্গে দাবাই খেলো, আর মিস্ ঘোষ কিছু খেয়ে নিন।

অর্ণব অবাধ্য ঘোড়ার মতো ফোঁস ফোঁস করে বলে–আপনি এদিকে আসুন তো স্যার। কথা আছে।

অধিরাজ হাসতে হাসতে মানসীর দিকে তাকায়–কিছু মনে করবেন না। একটু স্মোক করে আসি। এটা বোধহয় নো-স্মোকিং জোন। জাস্ট গিভ মি আ সেকেন্ড।

অফকোর্স। মিসেস জয়সওয়াল মদির হাসলেন–তবে একদিনই কমপ্লিমেন্টারি। নয়তো আমরা মেম্বারদের ছাড়া অন্য কাউকে সার্ভ করি না। আমি নিজে কোনো ক্লায়েন্টকে অ্যাটেন্ড করি না। মেয়েরা করে।

মাই প্লেজার। সে মিষ্টি হাসল-চলো অর্ণব। একটু ধূমপান করে নেওয়া যাক।

অর্ণব হুম-হাম করতে করতে অধিরাজের পেছন পেছন চলল। সঙ্গে সঙ্গে মিস ঘোষও।

এটা কী হচ্ছে? কাঁচের দরজা ঠেলে বাইরে পা রাখতেই অর্ণব প্রায় ভিসুভিয়াসের মতো ফেটে পড়ল–আমরা এখানে জেরা করতে এসেছি, না ম্যাসাজ নিতে আর দাবা খেলতে! আপনি কি পাগল হলেন? ঐ মানসী জয়সওয়াল এক নম্বরের লুচ্চি বেগম! ওদিকে বর হসপিটালে, এদিকে তিনি পুরুষদের ম্যাসাজ দিয়ে বেড়াচ্ছেন! আপনাকে হাতে পেলে ছাড়বেন!

কে কাকে ছাড়ে? আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। কচি খোকা তো নই যে ইলোপ করবেন। যা করব নিজের মর্জিতেই করব। ঐ মহিলাকে উলটোপালটা বলছ কেন? তিনি কি আমার গলায় বকলস লাগিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন?

অধিরাজ একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল–আপাতত কাজের ওপর ফোকাস করো। অ্যাডেলিন বাজাজের সঙ্গে দয়া করে দাবাটা ভালো করে খেলো। গো হারা হেরে অন্তত নাকটা কাটিও না।

কিন্তু কেন? আমরা তো সরাসরিই জেরা করতে পারি!

উত্তেজিত অর্ণবকে থামিয়ে দিয়ে বলল সে–সরাসরি কেউ কিছুই বলবে না। অন্তত মানসী জয়সওয়াল এবং অ্যাডেলিন বাজাজ থাকতে। বিশেষ করে আমাদের টার্গেট ম্যাশজরা। অর্থাৎ ফিমেলরা। তাও সবাই নয়। মিস ঘোষ…!

স্যার?

এই কাজটা আপনি ছাড়া আর কেউ পারবে না। আমি এদিকে মিসেস জয়সওয়ালকে আটকে রাখছি, অর্ণব অন্যদিকে অ্যাডেলিন বাজাজকে আটকে রাখবে। আপনার পুরো ফাঁকা মাঠ। আপনি প্রথমে রেস্টুরেন্ট গিয়ে চমৎকার একটা ডার্ক ফ্যান্টাসি আইসক্রিম উইথ সস্ অ্যান্ড চকলেট চিপ্স খেতে চাইবেন। তারপর একটু খোঁজখবর করে জানবেন যে ম্যাজদের মধ্যে কয়জন কালো মেয়ে আছেন।

ওকে স্যার। মিস্ ঘোষ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়।

আপনি স্ট্রেট সেই সব মেয়েদের কাছে জানতে চাইবেন যে এদের মধ্যে কারা ক্লায়েন্টদের হাতে অপমানিত হয়েছে। কতজন তাদের কাছে ম্যাসাজ নিতে প্রত্যাখ্যান করেছিল। মেয়েরা আর কিছু মনে রাখুক না রাখুক, নিজেদের ইনসাল্ট খুব ভালো মনে রাখে। আমার ধারণা, একদম মনে করে বলে দেবে। এমনকি নামধাম বলে দিলেও আশ্চর্য হব না। পুলিশি কড়া ধরনের জেরা করবেন না। আপনার কমপ্লেক্সন ডার্ক। ওরা আপনাকে যাতে সমব্যথী ভাবে এমনভাবেই এগোবেন।

অর্ণব ততক্ষণে অধৈর্য হয়ে উঠেছে–এসবের দরকার কী? পাকড়াও করে জেরা করলেই তো হয়!

হবে না। অধিরাজ এক মুখ ধোয়া ছাড়ল–মালকিনরা সামনে থাকলে কেউ নিজের ব্যক্তিগত ক্ষোভের কথা বলবে না। দেখলে না, রিসেপশনিস্ট একটা কথাও বলল না! মানসী জয়সওয়ালের কথাও উপেক্ষা করা যায় না। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, কালো মেয়েদের নিয়ে অবজেকশন দিয়েছিলেন কিছু ক্লায়েন্ট। প্রশ্ন হলো, তারা কারা? আমাদের মক্কেলরা নয়তো? কালো মেয়েদের রিজেকশনটা মালকিনদের কাছে প্রফেশনাল। কিন্তু ওদের কাছে পার্সোনাল। আর মানসী জয়সওয়াল এবং ক্লাবটাকে দেখে আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে–সর্বনাশিনীর গল্পটা ঠিক এখান থেকেই শুরু হয়েছে। আমার দৃঢ় ধারণা, কেউ এই রিজেকশনটাকে পার্সোনালি নিয়ে নিয়েছে। আমি ড্যাম্ শিওর-সর্বনাশিনীর পেছনে কোনো কালো মেয়ের ব্যক্তিগত আঘাতের গল্প রয়েছেই। তাছাড়া ক্লাবে রিসোর্ট সিস্টেম আছে। সর্বনাশিনী ও তার ভিকটিমের প্রেম ও অভিসারপর্ব এখানে জমে ওঠার সম্পূর্ণ চান্স আছে। হয়তো তিন ভিকটিমের সঙ্গে এই রিসোর্টেই তিনি গোপনে ফুলশয্যা সেরেছেন! চান্সেস ফিফটি ফিফটি। তবু রিস্কটা নিতে হবে।

অর্ণব চুপ করে যায়। বসের সঙ্গে তো আর নাকে নাক বাজিয়ে ঝগড়া করা যায় না। তার অসন্তুষ্ট মুখ দেখে হেসে ফেলল অধিরাজওরকম হাঁড়ির মতো মুখ না করে দাবায় কনসেনট্রেট কোর। ভুলে যেও না, তুমি যার সঙ্গে খেলতে বসছ তার সারনেম বাজাজ! বাজাজ সারনেমটা মিস্ কোর না। একে বাজাজ–তায় দাবাড়ু।

ওঃ! এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝল অর্ণব। নিজের বোকামিতে নিজের গালেই একটা থাপ্পড় মারার ইচ্ছে করছিল। বাজাজ সারনেমটা কী করে মিস করল! তবু একটা ধন্দ কিছুতেই কাটছিল না। সে বলল–কিন্তু ওঁর নাম তো অ্যাডেলিন!

হ্যাঁ, ওটা তার খ্রিষ্টান নেম। কিন্তু তার আগে কী আছে সেটা কি জানো? রিয়ার ফুল নেম ছিল–রিয়া সামান্থা বাজাজ। কে বলতে পারে যে অ্যাডেলিনের পুরো নাম প্রিয়া অ্যাডেলিন বাজাজ নয়? প্রিয়ার ছবি আমাদের হাতে নেই। কিংবা তার পুরো নাম এখনও জানতে পারিনি আমরা।

অর্ণব এবার ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারে। কিন্তু তার জন্য সিংহীর গুহায় ঢোকা কি খুব জরুরি? মহিলা একনম্বরের পুরুষ শিকারি!

খেলতে খেলতে ওঁর সঙ্গে একটু খেজুর করবে। ক্লাবে কারা কারা চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু আছে জানতে চাইবে। উমঙ্গ অ্যান্ড্রু বাজাজের কথা একদম তুলবে না। আমরা জানাতে চাই না যে ঐ অ্যাঙ্গেলটার কথা আমরা জানতে পেরেছি। লক্ষ করবে তিনি কোন দিকের খুঁটি বাছেন। সাদা না কালো? নিজেই ধমাস করে নিজের কালার বেছে নিও না। ওঁকে আগে বেছে নিতে দেবে! আর যে করেই হোক, অন্তত ঘণ্টাখানেক আটকে রেখো।

অর্ণব সবটা না বুঝলেও সম্মত হলো। মনের আশঙ্কা তবু কাটছে না। আতঙ্কিত গলায় বলল–কিন্তু স্যার! আপনি একটু বেশি ঝুঁকি নিচ্ছেন না? মিসেস জয়সওয়াল কী প্রকৃতির মহিলা বোঝেননি!

খুব ভালোই বুঝেছি। অধিরাজ শেষ টানটা দিয়ে সিগারেটটা ডাস্টবিনে ফেলে দেয়–তবে আরও একটু ভালো করে বোঝা দরকার!

উনি আপনাকে বরবাদ করে ছাড়বেন।

ইন দ্যাট কেস…। সে উষ্ণ দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত অর্ণবের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মৃদু স্বরে বলল–

আমি বরবাদ হতেই চাই।

*

ঘরটা আলো-আঁধারি! একটা মিষ্টি নীল আলো মৃদু নেশার ঘোর নিয়ে ছলকে পড়ছে। রেশমি নরম আলো খানিকটা রহস্য নিয়ে ঝিমঝিমে তন্দ্রালু আবেশ মেদুর। ঘরটার চতুর্দিকে আয়না! কাঁচে নীলাভ রশ্মি পড়ে তেলের মতো পিচ্ছিল ভঙ্গিতে বুঁদ হয়ে আছে। একপাশে বিরাট সাদা ধবধবে বাথটব। সুগন্ধি রঙিন জল ফুলের পাপড়ি বুকে নিয়ে স্থির। গোটা ঘর সুন্দর ফুলে সাজানো। কোথা থেকে যেন একটা সুমধুর সুর ভেসে আসছে। সব মিলিয়ে রীতিমতো নেশা ধরানো পরিবেশ।

তার ঠিক মাঝখানেই সাদা ধবধবে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে ছিল অধিরাজ। একটা সাদা তোয়ালে শুধু কোমর থেকে হাঁটু আবৃত করেছে। বাকিটা অনাবৃত। এই মুহূর্তে তার নিজেকে আস্ত একটা ফুলের তোড়া মনে হচ্ছিল। তার ওপর চিলড় এসির হিমেল স্পর্শ। বেশ শীত করছে। মুখে প্রকাশ না করলেও বুকের মধ্যে একটা অস্থিরতা। যখন এই রুমে ঢুকেছিল তখনই মানসী বলেছিলেন–ধড়াচূড়ো এবার খুলতে হবে যে!

অধিরাজের হৎপিণ্ড তৎক্ষণাৎ হাইজাম্প মেরেছিল। কিন্তু সে জানে যে। জামাকাপড় পরে স্পা বা ম্যাসাজ হয় না। তাই স্মার্টলি নির্বিবাদে নারীটির সমস্ত কথা মেনে নিয়েছে। মানসী মোহিনী হেসে জিজ্ঞেস করেন–কী অয়েল দেব?

অধিরাজ যেন প্রশ্নটার জন্য তৈরিই ছিল–ল্যাভেন্ডার। কিন্তু যতই সাহসী হোক্, বুকের ভেতরটা যে ঢিপঢিপ করছে। এভাবে নগ্নদেহে আজ পর্যন্ত কোনো মহিলার সামনে আসেনি সে। এমনকি বড় হওয়ার পর মায়ের সামনেও শার্ট খোলেনি। অথচ…!

অধিরাজ একবার ভয়ে ভয়ে বাথটবের দিকে তাকায়। এরপর কি ওটাতেও স্নান করতে হবে। তাহলে পবিত্রর ভবিষ্যদ্বাণীর অব্যর্থ হওয়া থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। নিউমোনিয়াতেই মরবে সে! অবশ্য তার আগেই যদি মানসী জয়সওয়ালের কৃপায় হার্টফেল না করে!

বিউটি!

মানসী জয়সওয়ালের কড়কড়ে গলা এখন একদম মাখনের মতো মসৃণ। তার হাত এখন অধিরাজের দেহে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে প্রত্যেকটা প্রেশার পয়েন্টে এমনভাবে স্পর্শ করছে যে অস্বস্তির চেয়ে বেশি আরামই লাগছে তার। কখনো কখনো চোখ বুজেও আসছে। কিন্তু আপ্রাণ নিজেকে সতর্ক রাখার চেষ্টা করছে সে।

মানসী জয়সওয়াল মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। মসৃণ বাদামি রঙের খোদাই করা ভাস্কর্যের মতো শরীর! কোথাও এতটুকু ক্রটি নেই। ত্বক এককথায়–ফ্ল লেস! এরকম পারফেক্ট ভি শেপড় চেহারা বাঙালি ছেলেদের মধ্যে খুব কমই দেখা যায়। এরকম হাইটও সহজে পাওয়া যায় না। অনেকে স্টেরয়েড নিয়ে প্রচুর চর্বিওয়ালা মাস বানায় ঠিকই। কিন্তু সেগুলো দেখলেই বোঝা যায়–অস্বাভাবিক। কিন্তু এ চেহারার পেশিগুলো এতটাই স্বাভাবিক যে মনে হয়, এমনটাই হওয়া উচিত ছিল। কে বলে পুরুষের দেহে রহস্য নেই! সামনের পুরুষটি তো নিজেই আপাদমস্তক রহস্য! চেহারা গ্রিক ভাস্কর্যের মতো-অথচ মুখশ্রীটুকু ছেলেমানুষিতে ভরা। চোখ দুটো ভীষণ ভাষাময়, বুদ্ধিদীপ্ত! কিন্তু তার মধ্যে কোথাও যেন ভীষণ ইনোসেন্ট! অদ্ভুত!

তিনি আরেকবার তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–বিউটি! আপনার প্রেমিকা খুব লাকি!

প্রেমিকা নেই। তার সংক্ষিপ্ত উত্তর।

সে কী! মানসী বিস্মিত–আপনি ইয়ং, হ্যান্ডসাম। অথচ প্রেমিকা নেই!

না।

কেন? মেয়েদের পছন্দ নয়?

অধিরাজ এবার হেসেই ফেলল। মহিলা এবার অবিকল তার বাবার মতো কথা বলছেন। বাবা মাঝেমধ্যেই প্রশ্ন করেন–রাজা, তোর কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই তো! তোর মুখে তো শুধু অর্ণবের কথাই শুনি! অর্ণব না হয়ে অর্ণবী হলে তবু স্বস্তি পেতাম! মানসী সরাসরি প্রশ্নটা করেননি। কিন্তু হাবভাব তেমনই।

কলেজে মেয়েবন্ধু ছিল। তবে প্রেমিকা ছিল না। সে এবার একটু খেজুরই জুড়ে দিল–পরে তো আর সময়ই হলো না!

মানসীও অবশ্য খেজুর করতে কম ওস্তাদ নন্। কিছুক্ষণের মধ্যেই অধিরাজের বাবা কী করেন, মা কী করেন, কী ডায়েটে সে অভ্যস্ত, দিনে কত ঘণ্টা জিম করে থেকে শুরু করে তাদের বাড়ির বাসনমাজুনি কত টাকা নেয়–মোটামুটি সবই জেনে ফেললেন। নিজের কথাও কিছুটা বললেন। বাঙালি ঘরের মেয়ে। বিজয়ের সঙ্গে বিদেশেই দেখা এবং প্রেম। তারপরেই বিবাহ। অধিরাজ পরম ধৈর্য নিয়ে তার কথা শুনছে। মহিলা আপনমনেই বকছেন। তার মধ্যেই অবশ্য কী সব সযত্নে মাখিয়ে চলেছেন। প্রথম দিকে একটু অস্বস্তি বোধ করলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ সহজ বোধ করল সে। মেয়েদের স্পর্শ কখনই সেভাবে পায়নি। তার ওপর তিনি আবার ওস্তাদ লোক। এমন এমন প্রেশার পয়েন্টে এমনভাবে স্পর্শ করছেন যে প্রবলভাবে ইনস্টিটিংটের বৈদ্যুতিক ঝটকা খাচ্ছে। বিশেষ করে হাতটা যখন নাভির আশেপাশে আর উরুতে চলে যাচ্ছে তখন নিজেকেই সামলে রাখা কষ্ট! তবু মুখে হাসি রেখে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে।

এত স্টিফ হয়ে যাচ্ছেন কেন? মানসীর কুশুভ্র দন্তপংক্তি ঝিলিক মারল–রিল্যাক্স! আপনাকে আমি খেয়ে ফেলব না! ইজি-ই-জি!

তার কণ্ঠস্বর যেন নেশা ধরানোর মতো মধুর লাগল অধিরাজের। অদ্ভুত বিষয়! যে কড়কড়ে গলাটা প্রথম দিন শুনেছিল, এখন সেটাই অদ্ভুত শ্রুতিমধুর। তাহলে ঐ খড়খড়ানি বোধহয় বেচারি স্বামীর জন্য বরাদ্দ।

আসলে আপনার মতো সেলিব্রিটি মহিলা নিজের হাতে ম্যাসাজ করছেন কি না! তাই হয়তো…!

দাঁতে ঠোঁট কামড়ালেন মানসী–রিয়েলি? তবে একটা ঘটনা কোনো ক্লায়েন্টকে আমি নিজে অ্যাটেন্ড করি না। আমার এখানে অনেক গোয়ানিজ সুন্দরী মেয়ে আছে। তারাই করে। তবে আপনার কেসটা আলাদা। আপনি আবার ম্যাসাজের নামে মেয়েদের কী জেরা করতে শুরু করবেন ঠিক নেই। তিনি খিলখিল করে হেসে উঠলেন–আপনাকে বিশ্বাস নেই!

অধিরাজ ঠোঁট টিপে হাসে। সেজন্যই তো সে সেধে বাঁশটা ঘাড়ে নিয়েছে। ওদিকে মিস ঘোষ কতদূর এগোল কে জানে! সে সরলভাবেই প্রশ্ন করে– গোয়ানিজ মেয়ে কেন?

কারণ তারা এসবে ওস্তাদ। গোয়ানিজ মেয়েরা ম্যাসাজ খুব ভালো করে। গোয়া তো এসব বিজনেসের জন্য স্বর্গ। মানসী বললেন–ইনফ্যাক্ট, আমার পাশের ফ্ল্যাটেই একটি গোয়ানিজ মহিলা থাকে। আমি নিজের ম্যাসাজ আর স্পা ওকে দিয়েই করাই। নিজেরটা তো আর নিজেই করা যায় না। আই মাস্ট অ্যাডমিট, ও আমার থেকেও বেটার অপশন। এত সুন্দর ম্যাসাজ করে যে ঘুম এসে যায়।

আপনার ক্লাবও যে আছে, সেটা তো আগে বলেননি।

অধিরাজ প্রসঙ্গ পালটাল। মানসী জয়সওয়াল ফের হাসলেন–কারণ ক্লাবটা আমার নয়। আমার স্বামীর। আর ঐ যে অ্যাডেলিনকে দেখলেন না? ওর স্বামী দুবাইতে থাকে। মি. এ বাজাজ। বিজয় আর মি. বাজাজের পার্টনারশিপেই ক্লাবটা হয়েছে। মি. বাজাজ স্লিপিং পার্টনার। তিনি এ দেশে খুব একটা আসেন। বিজয়েরও বিশেষ সময় নেই। তাই আমাদের ঘাড়েই দায়িত্ব চাপিয়েছে।

মি. এ বাজাজের ফুল নেম কী? সে সকৌতূহলে জানতে চায়।

আমি জানি না। তিনি আস্তে আস্তে বলেন–আসলে অ্যাডেলিন ব্যক্তিগত কথা খুব একটা বলে না। এমনিতেই খুব কম কথা বলে। ও কিন্তু ভারতীয় নয়। তবে কয়েক জেনারেশন ধরে এখানেই আছে। স্বামীর সঙ্গে খুব ভালো কেমিস্ট্রি নেই বলেই মনে হয়। কিন্তু দুর্ধর্ষ দাবা খেলে। চেস ক্লাবটা ও-ই সামলায়। আপনার বন্ধুর কপালে দুঃখ আছে। অ্যাডেলিন হারতে ভালোবাসে না।

কপালে দুঃখ তো আমারও আছে।

অধিরাজ মুখে কথাটা না বললেও মনে মনে ঠিক এই বাক্যটাই বলল। মুখে অবশ্য অন্য বাক্য উচ্চারণ করে–আপনি হারতে ভালোবাসেন?

আলো-আঁধারিতে মিসেস জয়সওয়ালের হাসিটা যেন একটু বিষণ্ণ ঠেকল-দাবার কথা বলছেন? না–আমিও হারতে ভালোবাসি না। তবে দাবার বাইরে অনেক হেরেছি মি. ব্যানার্জী।

অধিরাজ বিহ্বল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এ তো পরিচিত মানসী জয়সওয়ালের কথা বলে মনে হচ্ছে না! সে মহিলাকে একটু খোঁচা দেয়–এরকম কেন বলছেন ম্যাডাম? আপনি কলকাতার অন্যতম সফল বিজনেস-ওম্যান! স্পা আর স্যালুন বিজনেসকে আপনার মতো এমন শিল্পের

পর্যায়ে কেউ নিয়ে যেতে পারেনি! মানসী জয়সওয়াল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর মৃদু হেসে গম্ভীর গলায় বললেন–আপনার কথায় মনে হলো আপনি খুব সুখী একটা ফ্যামিলি থেকে বিলং করেন! বয়েসটাও কম। তাই এসব বুঝবেন না! সবসময়ই টাকা, সাকসেস আর বিজনেসটা বড় কথা নয়। এই ক্লাবের রিসোর্টগুলোয় একদিন ঘুরে দেখে আসুন। বুঝবেন মানুষ কতটা একা আর কী ভীষণ অসুখী!

অধিরাজ এইবার মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে–কেন? কী এমন হয় রিসোর্টগুলোয়? আই মিন, কোনো সেক্স র‍্যাকেট…?

এ বাবা! না…না! তিনি জিভ কাটছেন–ইললিগ্যাল কিছু নয়। কিন্তু আমাদের ক্লায়েন্টরা সব পয়সাওয়ালা লোক। ধরুন আপনি দেখলেন যে মি. অমুক সঙ্গে একটি মেয়েকে নিয়ে দশ-বারো দিন মহানন্দে রিসোর্টে কাটিয়ে গেলেন। তার ঠিক কয়েকদিন পরেই দেখলেন, মি. অমুকের গিন্নী আরেকজন পুরুষকে নিয়ে এসে হাজির! মি, তমুক সুজানের সঙ্গে মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছেন তো মিসেস তমুক সুজয়ের সঙ্গে ইভনিং ওয়াকে! অনেক পুরুষ আবার বয়ফ্রেন্ড নিয়ে আসে। আবার অনেক মহিলা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে। এখানে কিছুদিন থাকলেই বিবাহ সম্পর্কে মোহ উড়ে যাবে আপনার। কিন্তু কাকে কী বলবেন? এখন তো সবই লিগ্যাল!

অধিরাজ মনে মনে একটা হিসাব কষে নিয়ে বলল–ক্লাবের সঙ্গে এই রিসোর্টের ব্যাপারটা ইউনিক। কার মাথা থেকে বেরিয়েছে এই আইডিয়া?

বিজয় ছাড়া এসব আইডিয়া আর কার মাথা থেকে বেরোবে! মহিলার চোখ জ্বলছে–মানুষের সম্পর্ক, দুর্বলতা বেচে নিজের ব্যাংক ব্যালান্স বাড়ানোর কথা একমাত্র ওই ভাবতে পারে। তিনি চিড়বিড় করে ওঠেন–বিজয়ের মানুষের সম্পর্ক, অনুভূতি নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। আমার বিজনেস, আমার ডিগ্রিতে কোনো ইন্টারেস্ট নেই ওর। ও আমার পেছনে টাকা ঢালে আমায় অ্যাপ্রিশিয়েট করার জন্য নয়, শুধুমাত্র আমায় বিজি রাখার জন্য। ও আমার সময় বেচতে চায়, কারণ ওর আমাকে দেওয়ার জন্য অনেক টাকা আছে, কিন্তু সময় নেই। ওর আমাকে দেওয়ার জন্য কিছু নেই! সময় নেই, শরীর নেই, সন্তান নেই! না-থিং! সেখানে আমি একটা বিশ্রি বাঁজা বুড়ি ছাড়া আর কিছু নই। আ লুজার!

অধিরাজ একদৃষ্টে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। বোধহয় ঢিলটা যথাস্থানেই পড়েছে। সম্ভবত মানসী জয়সওয়ালের দুর্বলতম স্থানে! ভদ্রমহিলা একটু চুপ করে থেকেই ফের মুখ খুললেন–আপনি আমায় ক্যারেক্টারলেস, শেমলেস, পার্ভার্টেড ভাববেন। কিন্তু সত্যি কথাটাই বলি। আপনার দেহ আমায় প্রথম থেকেই ভীষণ টানছে। কারণ বহু বছর আমি কোনো পুরুষের দেহ, স্পর্শ পাইনি। আমি নিজেকে সুন্দর করে সাজাই-কিন্তু কেউ দেখে না। সবাই আমাকে বাইরে খুব তোষামোদ করে–কিন্তু আসলে একটা গা রগড়ানি ঢলানি মাগি ভাবে! আই রিপিট–গা রগড়ানি ঢলানি মাগি!

কথাগুলোর মধ্যে এমন একটা জ্বালা ছিল, যা অ্যাসিডের মতো কান বেয়ে জ্বালাতে জ্বালাতে চলে গেল! অধিরাজ স্তম্ভিত, হতবাক। এ কোন্ মানসী জয়সওয়াল! কোথায় সেই লাস্যময়ী, ছলনাময়ী! মানসী যখন ফের মুখ তুলে তাকালেন তখন তার দুচোখে জল আর আগুন–দুই-ই পাশাপাশি ঝিলিক। মারল–আপনার সহযোগীদের চোখেও সেই একই ব্যঙ্গ দেখতে পেয়েছি। আমি। একমাত্র আপনিই আমায় আন্ডার এস্টিমেট করেননি। একমাত্র আপনিই…!

এবার তাঁর চোখের কাজল গলে লম্বা কালো দাগ নিয়ে অশ্রুবিন্দুর সঙ্গে ঝরে পড়ল। এই মুহূর্তে মহিলা নিজেকে আয়নায় দেখলে আঁতকে উঠতেন! ওয়াটার প্রুফ কাজল নয় হয়তো। তাই ধেবড়ে গিয়েছে। অদ্ভুত অসহায় অসুন্দর এবং আনসফিস্টিকেটেড ভঙ্গিতে বললেন–কেউ বোঝে না! কেউ বুঝবে না! আমারও মন আছে! আমারও শরীর আছে! সে শরীরেও আগুন জ্বলে! ড্যা-ম ই-ট!

অধিরাজ খুব শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এই মুহূর্তে মানসীকে কুৎসিত লাগছে। তাঁর মুখে বয়সের ভাঁজগুলো স্পষ্ট। উত্তেজনায় বুকের আঁচল খসে পড়েছে মহিলার। কিন্তু এই বিজনেস-ওম্যান কোটিপতির স্ত্রী কতটা ভিখারি তা সে খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। ইনি কোটি কোটি টাকার ওপরে শুয়ে আছেন! কিন্তু সে শয্যা শরশয্যা ছাড়া কিছুই নয়! মানসী জয়সওয়াল! এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্ব-রিক্ত মানুষ।

আপনি ম্যাচিওর! আপনার যৌবন আছে! সৌন্দর্য আছে। আপনার চোখ–দেবদূতের মতো! ইনোসেন্স অ্যাট ইটস বেস্ট। আমি নির্লজ্জের মতোই বলছি, ক্যান আই টাচ ইউ! অবিকল সর্বহারা ভিখিরির মতোই বললেন তিনি–আপনার সুন্দর শরীরটাকে একটু স্পর্শ করতে পারি? ক্যান আই কিস্ ইউ? ক্যান আই হাগ ইউ? প্লিজ…!

মাথায় যেন বাজ পড়ল। এরকম মুখের ওপর কেউ বলতে পারে! অধিরাজ বিহ্বলভাবে মানসীর দিকে তাকিয়ে থাকে। জীবনে অনেক প্রেমপত্র পেয়েছে। কিন্তু এমন ভয়ংকর প্রস্তাব আগে কখনো আসেনি। এই কিম্ভুতকিমাকার প্রস্তাব শুনে তার এখনই লাফ মেরে পালিয়ে যাওয়া উচিত। তিনি তো প্রেমপ্রার্থিনীও নন–সেফ শরীর চাইছেন! মহিলাকে স্বৈরিনী, ব্যভিচারিণী ভেবে ঘৃণা করা উচিত। কিন্তু কোনোটাই তার ভাবনায় এল না। মানসী ঠিকই বলেছেন–মানুষ বড় একা! বড় দুঃখী! নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছেন বলেই কথাটা এভাবে বলতে পারলেন। প্রেমের ভান না করে প্রস্তাবটা একদম স্পষ্টাস্পষ্টি রেখেছেন। মানসীকে সে ঘৃণা করতে পারছিল না। বরং তার প্রতি করুণা অনুভব করছিল।

মানসী জয়সওয়াল তার বলিষ্ঠ হাত দুটো নিজের নরম হাতে ব্যাকুলভাবে তুলে নিয়েছেন–বেশি কিছু চাইছি না আপনার কাছ থেকে। আপনি এখানে তদন্ত করতেই এসেছিলেন। কাজ শেষ হলেই চলে যাবেন। আর কিছু আপনার মনে থাকবে না। বাট জাস্ট ওয়ান কি…! আমি আপনাকে ছুঁ…ছুঁতে চাই…!

ভীষণ আবেগে থরথর করে কাঁপছেন মানসী। শেষ বাক্যটায় প্রবল আকুলতা ঝরে পড়ল। অধিরাজ আস্তে আস্তে উঠে বসল বিছানায়। মানসী তার একদম কাছে ঘনিয়ে এসেছেন। তার সুগন্ধি গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ল অধিরাজের মুখে। কাঁপা কাঁপা নরম আঙুল স্পর্শ করে যাচ্ছে ধারালো মুখ, নাক, চিবুক–ঠোঁট…! যেমন একটা বুভুক্ষু মানুষ একমুঠো ভাতের দিকে তাকিয়ে থাকে, তেমনই পরম কামনায় তাকিয়ে আছেন তিনি। অধিরাজ টের পেল তাঁর তর্জনী ঠোঁট থেকে আস্তে আস্তে গলার দিকে নামছে। ঘাড়ে, বুকে খেলা করে বেড়াচ্ছে। স্পর্শ নয়–কয়েক ভোল্টের ইলেক্ট্রিক শক্‌!

সে একটু ইতস্তত করছে দেখে মানসী যেন হতাশ হলেন। মুখ নিচু করে বললেন–সরি, আপনাকে এসব উলটো-পালটা বলা উচিত নয় আমার। আপনি বোধহয় অনডিউটি…!

অধিরাজ এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। নিজেকে কয়েক মুহূর্তের জন্য বহু বিভাজিত সত্তা বলে মনে হলো তার। একসঙ্গেই সে বিপন্ন এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়। একটা সিদ্ধান্ত কিছুতেই নিতে পারছিল না। কিন্তু তা কয়েক সেকেন্ডের দ্বিধা মাত্র। পরক্ষণেই একটা সজোর শ্বাস টেনে মনে মনে নিজেকেই বলল–ও কে! ডোন্ট বি আ কাওয়ার্ড!

মানসী জয়সওয়াল দেখলেন অধিরাজ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। দেবতার মতো উন্নত, ঋজু মানুষটা তাঁর দিকে অদ্ভুত ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বুকের খসে পড়া আঁচলটা সযত্নে তুলে নিয়ে তাঁকে ঢেকে দিল সে। মৃদু হেসে বলল–ওয়েল মিসেস জয়সওয়াল, আমি বোধহয় এখন উর্দিতে নেই!

মুহূর্তের ভগ্নাংশ সব স্থির! পরক্ষণেই বিস্ফোরণ! মানসী দু হাতের নাগপাশে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগলেন। এলোপাতাড়ি ভাবে এক সুঠাম যুবকের সুগঠিত গলা, বুক, কাঁধের ওম শুষে নিচ্ছে তার দস্যু ঠোঁট। অবশেষে কপাল, চোখ, নাক ছুঁয়ে নরম ঠোঁটজোড়া ঠিক ঠোঁটের ওপরে এসে থমকে দাঁড়ায়। অধিরাজ দেখল, আধখোলা একজোড়া নেশাচ্ছন্ন অথচ কাতর দুটো চোখ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আধখোলা ঠোঁট দুটো থির্থি করে কাঁপছে। অধীর আগ্রহে চুম্বনপ্রত্যাশী।

সে আস্তে আস্তে মানসীর নরম ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। তিনি একেবারে অজগরের মতো তাকে জাপ্টে ধরে চিত করে ফেলেছেন বিছানার ওপরে। পাগলের মতো শ্বাসরোধী চুম্বনে পাগল করে দিচ্ছেন। আদরে আদরে বিধ্বস্ত পুরুষ!

অধিরাজের চোখ আস্তে আস্তে বুজে এল।

*

ঠিক কাঁটায় কাঁটায় চারটে নাগাদ অর্ণব ব্যাজার মুখে ক্লাবের মেইন বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে আসে। বলাই বাহুল্য তার মেজাজ অত্যন্ত খারাপ। অ্যাডেলিন বাজাজের কাছে বারবার হেরে এখন নিজেকে সেন্ট্রয়ের ধ্বংসস্তূপ মনে হচ্ছে। মহিলা যতটা সুন্দরী, ঠিক ততটাই ধুরন্ধর! কোথা দিয়ে আক্রমণ করছে, কী স্ট্র্যাটেজিতে খেলছে বোঝার আগেই অর্ণব মত। এত দুঃখ হয়েছে যে ভাবছে সর্বনাশিনীকে ডেকে বলবে–এবার পরের পোস্টটায় আরআইপি অর্ণব সরকার লেখ মা আমার! যতবার হেরেছে, মাকড়সা সুন্দরী ততবারই হেসেছেন। বলেছেন–আপনি হাল ছাড়বেন না। তাই না?

অর্ণব রুমালে মুখের ঘাম মুছে মৃদু হেসেছে। কৌতুকে স্বর্ণকেশীর চোখের সবুজ তারা ঝিলমিল করছিল। একটা ছোট্ট হাই তুলে বলেছেন–বাঃ! দ্যাট রিয়েলি গ্রেট! আপনার ধৈর্য আর চেষ্টার জবাব নেই।

আর চেষ্টা! শুধু চেষ্টাই সার হলো। তবে মন্দের ভালো যে কথায় কথায় ইনফর্মেশনগুলো নিয়ে নিয়েছে। অ্যাডেলিন খুব বেশি কথা বলার লোক নন্। তবু অর্ণব কায়দা করে কথাগুলো তার পেট থেকে বের করতে সক্ষম হয়েছে। অ্যাডেলিন ভুল বলেননি। অর্ণবের আর কিছু না থাক, ধৈৰ্য্য আছে।

আপনার কাজ হলো?

কাজ সেরে ততক্ষণে মিস ঘোষও বেরিয়ে এসেছে। অর্ণবকে হুঁকোমুখো হয়ে থাকতে দেখে জানতে চাইল–ফেল মেরেছেন নাকি?

টোট্যাল পনেরোবার! সে স্যাডসং গাওয়ার মতো মিনমিন করে বলে– একবার তো তিন মিনিটেই কুপোকাত করে দিয়েছিল। অত্যন্ত পাজি মহিলা!

পাজি নয়। পেছন থেকে অধিরাজের গম্ভীর স্বর শোনা যায়। সে লম্বা লম্বা পা ফেলে এদিকেই এগিয়ে আসছে–জিনিয়াস মহিলা! মেল ইগোটা একটু কমাও।

অর্ণব টোক গেলে। অধিরাজ সামনে এসে দাঁড়াতেই মিষ্টি ফুলের গন্ধ ওদের দুজনের নাকে এসেই ঝাপ্টা মারল। ম্যাসাজটা তবে ভালোই হয়েছে। আর কী কী হয়েছে কে জানে! সে আড়চোখে একবার তাকে আপাদমস্তক দেখে নেয়। আস্ত আছে তো লোকটা!

চলো, আপাতত এখান থেকে বেরোনো যাক। অধিরাজ বলতে বলতেই ফের হেঁচে ফেলল–ওঃ! মহিলা পুরো বাথটবে চুবিয়ে ছেড়েছেন!

অর্ণব আর কথা না বাড়িয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে গেল। সামান্য তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে–মিসেস জয়সওয়াল আপনাকে এগিয়ে দিতে এলেন না তো!

কথার মধ্যে যে বঙ্কিম ভঙ্গিটা ছিল তা বুঝতে পেরে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসল সে-অ্যাকচুয়ালি তিনি তো আমায় বাড়িতেই ড্রপ করতে চেয়েছিলেন। তুমি রাগ করবে বলে আর চান্স নিলাম না!

বুমেরাং খেয়ে চুপ করে গেল অর্ণব। এই অভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলাই বৃথা! সে প্রায় ভামের মতো মুখ করে গাড়িতে স্টার্ট দেয়।

গাড়িটা হুশ করে ক্লাবের ক্যাম্পাস দিয়ে বেরিয়ে গেল। ওরা ভালো করে দেখলে টের পেত মিসেস জয়সওয়াল দোতলার জানলা দিয়ে ওদের গাড়ির দিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার চোখে অদ্ভুত আলো খেলা করছে।

প্রথমে অন্তত মিনিট পাঁচেক কেউ কোনো কথা বলল না। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর অধিরাজই ফের মুখ খোলে–বলো, কী কী জানতে পারলে। লেডিজ ফার্স্ট। মিস্ ঘোষ প্লিজ।

মিস ঘোষ বলল–আইসক্রিম পেলাম না স্যার! বাট ইনফর্মেশন পেয়েছি।

এক মিনিট। তার ভুরু কুঁচকে গিয়েছে–আইসক্রিম পেলেন না কেন?

কারণ গত দুদিন ধরে আইসক্রিম পার্লার বন্ধ। কীসব প্রবলেম হয়েছে যেন। মিস্ ঘোষ জানালেন–রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার ঠিক করে বলতেই পারল না। আইসক্রিম পার্লারের শাটারই বন্ধ।

দুদিন ধরে বন্ধ! সে কী! অধিরাজ চিন্তান্বিতভাবে অর্ণবের কাঁধে হাত রাখল–অর্ণব, একটু সাইড করে দাঁড় করাও তো! মিস্ ঘোষ, প্লিজ কন্টিনিউ…।

আইসক্রিম না পেয়ে শেষ পর্যন্ত একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক খেয়ে মিসেস জয়সওয়ালের মেয়েদের খোঁজে গেলাম। ওখানে একটি মেয়েই কালো স্যার। মারিয়া ডিসেনা। প্রথমে কিছুতেই মুখ খুলছিল না। বেটিকে বারে নিয়ে গিয়ে কয়েক গ্লাস ভদ্কা উইথ লাইম খাওয়ালাম। তারপর কানের কাছে রীতিমতো কান্নাকাটি জুড়ে নিজের দুঃখের কাহিনি ফলাও করে শোনালাম। বাড়িতে অসুস্থ বাবা, ছোট ছোট ভাই-বোনদের দায়িত্ব, এটস্ট্রো এটসেট্রা। ঐ বাংলা ফিল্মের প্লট আর কী! মিস্ ঘোষ ফিক করে হাসল–ওকে বললাম যে আমিও এখানে কাজ খুঁজছি। আজ মিসেস জয়সওয়াল আমায় দেখা করতে বলেছেন। পাঁচটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। সেই শুনে মারিয়া খচে লাল! আমায় স্ট্রেট বলল–এখানে তোমার আমার মতো মেয়েদের চাকরি করা মানে কাস্টমারের জুতো খাওয়া! নিজের মানসম্মান বোধ থাকলে ফোটো!

ব্রিলিয়ান্ট! অধিরাজ সপ্রশংস কণ্ঠে বলল–তারপর?

তারপরই তো ঝুলি থেকে বিড়াল বেরোল। মিস্ ঘোষ বললেন আমাকে আর কারোর নামই নিতে হয়নি। মারিয়া খেপে গিয়ে আরও কয়েকটা পেগ মেরে সব উগরে দিল। আপনার তীর একদম বুলস আই এ লেগেছে। স্যার। বেছে বেছে আপনার তিন মক্কেল, সঞ্জীব রায়চৌধুরী, অর্জুন শিকদার আর ড. বিজয় জয়সওয়ালের নামই নিল ও। সঙ্গে আরেকজনের নামও বলেছিল। কী সাম বাজাজও যেন। বলেছিল, এই ক্লাবের আরেক মালিক। ঐ লোকটাও নাকি ভীষণ অসভ্য। খুব খারাপ ব্যবহার করে। ওর ঐ তিন মক্কেলের নাম মনে আছে কারণ প্রথম দুজনের মরার খবর টিভিতে দেখেছে। আর ড. বিজয় জয়সওয়াল আর ওদের মালিকের একই নাম। সর্বনাশিনীর কেসটা ও রীতিমতো ফলো করে। স্পষ্ট বলল, দুজন মরে পৃথিবীর পাপের ভার কমিয়েছে। বাকি দুটোরও মরাই উচিত।

টেরিফিক!

মারিয়া আরও বলল, যে সঞ্জীব, অর্জুন আর বিজয়কে ও ম্যাসাজ দিতে গিয়েছিল। তিনজনেই ভয়ংকর হল্লা করেছিলেন। মানসী জয়সওয়ালকে রীতিমতো অসুবিধেয় পড়তে হয়েছিল। ওঁরা এমন সিনক্রিয়েট করেছিলেন সবার সামনে যে প্রায় গোটা ক্লাবই কেসটা জেনে গিয়েছে। আর মি. বাজাজ কয়েকদিনের জন্য দুবাই থেকে এসেছিলেন। মারিয়াকে দেখলেই নাকি গালিগালাজ করতেন। বলতেন–এই কালো বিড়ালটা এখানে কী করছে? মোমপালিশ নাও মানসী ভার্নিশ নিয়ে কী করব?

গ্রেট! অধিরাজ একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলে- তার মানে এই তিনজনই যে এই ক্লাবে আসতেন, এবং রীতিমতো সুন্দরীদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করতেন–সেটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। এবং এই তিনজনই কালো মেয়েদের ওপর বিতৃষ্ণা প্রকাশ করেছিলেন।

বিতৃষ্ণা মানে! প্রচণ্ড অপমান করেছিলেন ওঁরা মেয়েটিকে। মিস্ ঘোষ রীতিমতো উত্তেজিত-মারিয়ার কথা শুনে তো আমারই রাগ হয়ে গিয়েছিল। সামনে থাকলে তিনটেকেই কষিয়ে থাপ্পড় মারতাম।

চারটেকে। মি. বাজাজও আছেন যে! অধিরাজ সংযোজন করল।

ঠিক। মিস্ ঘোষ জানাল–মারিয়া এটাও বলল যে ঐ তিন পাবলিক প্রায়ই কোনো মুসলিম মেয়ের সঙ্গে রিসোর্টে এসে বেশ কিছুদিন থাকতেন। তবে মেয়ে বা মহিলা কে তা ও দেখেনি বা জানে না। কারণ তিনি বোরখা পরে আসতেন। আর রিসোর্টগুলো সব সেলফ হেল্প প্রসেসে চলে। নিজস্ব কিচেন আছে। ফ্রিজে সবরকমের খাদ্যই মজুত। ইচ্ছে করলে বোর্ডাররা নিজের রান্না নিজেরাই করে নিতে পারেন। মিনিবারও আছে। তা না করলে নিজেদের ক্লাবের ডিনার টাইমে এসে খেয়ে যেতে হবে। বিছানার দশটা ফ্রেশ চাদর বেডরুমের কাবার্ডে থাকে। সয়েলড চাদরটা ফেলার জন্য প্রত্যেকটা রিসোর্টেই লন্ড্রি বাস্কেট আছে। অথবা বোর্ডাররা নিজেরাই কেচে নিতে পারেন। সে ব্যবস্থাও আছে। এমনকি বোর্ডারদের নামও লেখা হয় না। অর্থাৎ বোর্ডারদের প্রাইভেসি রক্ষা করার জন্য একদম বজ্ৰ-আঁটুনি ব্যবস্থা স্যার। মারিয়া কেন, কোনো কর্মীর পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয় যে কার সঙ্গে কে আসছেন! বুঝতেই পারছেন রিসোর্টে কী চলছে!

তা পারছি। তার মসৃণ কপালে ভাঁজ পড়ে–দুই মৃত ব্যক্তির মাঝখানের এই লিঙ্কটা পুলিশ বুঝে ওঠেনি। হয়তো ভিকটিমদের স্ত্রীরা কর্তাদের সোনালি চন্দ্র অভিযানের কথা জানতেন না! অথবা জানলেও ক্লাবটা ঠিক কী জাতীয় সে সম্পর্কে একেবারেই ধারণা নেই। তবে এখন কোনো সন্দেহই নেই যে সর্বনাশিনীর বেস অব অপারেশন এই গোল্ডেন মুন ক্লাব অ্যান্ড রিসোর্টস। এখানেই তাদের পূর্বরাগ। এবং কোনো হোটেল বা রেস্টুরেন্ট নয়, এটাই তাদের মিলনের জায়গা। এবং সঞ্জীব ও অর্জুন মৃত্যুর আগে এখানেই ছিলেন। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ই ফোন অফ করে দিয়েছেন বলে এই লোকেশনটা শো করেনি ফোন ডিটেলসে। গ্রেট। অধিরাজ স্মিত হাসল–এবার অর্ণব বলো।

অর্ণব বিরসবদনে বলল–আমি আর কী বলব স্যার। পনেরোবার হেরেছি।

তুমি যে হারবে তা আমি আগেই জানতাম। ওটাও প্রতিষ্ঠিত সত্য। সে হাসছেবাকি খবর কী?

এখানে প্রতি সানডে-তে চেস ক্লাব বসে স্যার। অ্যাডেলিন বাজাজও কখনো সখনও খেলেন। তবে আমি মহিলাকে একটু খচিয়েই দিতে চেয়েছিলাম। বলেছিলাম, আপনার থেকেও ভালো খেলোয়াড় নিশ্চয়ই আছে। এখানে। তিনি রেগেমেগে বললেন–একমাত্র অহল্যা জয়সওয়াল আর অর্জুন শিকদার ছাড়া আর কেউ আজ পর্যন্ত তাকে চ্যালেঞ্জও করতে পারেনি, হারানো তো দূর। আমি বিশ্বাসই করছিলাম না। মহিলার যে ভয়ংকর ইগো, তা বুঝতে পেরেছিলাম বলে একটা ধাক্কা দিয়েছিলাম। তাতেই তিনি রেগে লাল হয়ে আমার মুখে প্রায় টুর্নামেন্টের স্কোরশিট ছুঁড়ে মারলেন। আমি সুযোগ বুঝে অহল্যা জয়সওয়াল আর অর্জুন শিকদারের খেলার বেশ কয়েকটা স্কোরশিট ঝেড়ে দিয়েছি। অ্যাডেলিনের সঙ্গে ঐ দুই প্লেয়ার জিততে পারেননি। ড্র করেছেন। তবে অর্জুন শিকদারকে অহল্যা জয়সওয়াল বেশ কয়েকবার বলে বলে হারিয়েছেন। অহল্যা গুরুদেব খেলোয়াড় স্যার।

ব্রাভো অর্ণব। অধিরাজ তার পিঠ চাপড়ে দেয়–পুরো বাঘের বাচ্চা। কাজ তো অনেকদূর এগিয়ে রেখেছ বস্।

অর্ণব প্রশংসা পেয়ে গদগদ হয়ে প্যান্টের পকেট থেকে চার-পাঁচটা স্কোরশিট বের করে এগিয়ে দেয় অধিরাজের দিকে। অধিরাজ স্কোরশিটগুলোয় নজর বোলাতে বোলাতেই বলে–অ্যাডেলিন কোন কালারে খেলছিলেন? ব্ল্যাক না হোয়াইট?

হোয়াইট স্যার।

প্রত্যেকবারই?

একদম। আপনার কথামতোই আমি ওঁকে বেছে নিতে দিয়েছি। এবং তিনি প্রত্যেকবারই সাদা বেছেছেন।

অধিরাজের দুচোখে গভীর আত্মমগ্নতা। সে সংক্ষেপে উত্তর দিল-হুঁম্। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ নিয়মমাফিক সাদাই প্রথম চাল দেয়। কালো তার পরে।  

আরও একটা অদ্ভুত খবর আছে স্যার, জানি না কতটা কাজে লাগবে। অর্ণব একটু আমতা আমতা করে–একটু পিকিউলিয়ার!

বলে ফেলো।

আমি অহল্যা জয়সওয়াল সম্পর্কে বলতেই অ্যাডেলিন বললেন–ন্যাস্টি ফ্যামিলি! মেয়েটা কালো কুৎসিত! পুরুষ না মহিলা বোঝাই যায় না। একটা বউ শ্বশুরের পেছন পেছন ঘোরে, আরেকটা লেসবিয়ান! একখানা মুসলিম মেয়েকে গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে ঘুরছে!

অ্যাডেলিনের জিভটা বেশ কড়া দেখছি! কায়দা করে তোমাকে কেচ্ছা শুনিয়েছেন। অধিরাজ গম্ভীরমুখে বলে–কিন্তু শিনা জয়সওয়াল যে লেসবিয়ান তা তিনি জানলেন কী করে? শিনা ওঁকেই প্রেম নিবেদন করেছেন নাকি?

ভগবান জানে। অর্ণব মৃদু হাসল-পনেরোবার হারার জন্য ফাউয়ে সংবাদ দিয়েছেন! তবে অহল্যার ওপর খার আছে।

সেটাই স্বাভাবিক। কারণ অহল্যা ওঁর থেকেও ভালো চেস্ প্লেয়ার। সে স্কোরশিটগুলো দেখতে দেখতেই বলে–অর্জুন শিকদারও কিন্তু মারাত্মক দাবাড়ু। যে দুটো খেলায় জিতেছেন, তার স্কোরশিট দেখলেই বুঝবে ব্রিলিয়ান্ট প্লেয়ার! অথচ যতবার অহল্যার সঙ্গে খেলেছেন-ততবারই গো হারান হেরেছেন। তিনি হোয়াইটে খেলছিলেন। অহল্যা ব্ল্যাক। মুভগুলো দেখো! পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে একটুও মন দিয়ে খেলেননি!

কেন?

হয়তো একটু বেশিই টেনেছিলেন। অধিরাজ আচ্ছন্ন স্বরে বলল–শুধু একটা প্রশ্নের উত্তরই পেলাম না। মিস ঘোষ আইসক্রিম কেন খেতে পারলেন না?

হাঃ!

বিস্ময়সূচক শব্দটা উচ্চারণ না করে পারল না অর্ণব। সর্বনাশিনী একা কি কম মগজমারি ছিল যে আইসক্রিম প্রবলেমও এসে জুটেছে! সে ইতস্তত করে বলে–হয়তো আইসক্রিম মেশিন খারাপ!

দুদিনের জন্য! এরকম একটা ক্লাবে দুদিনের জন্য মেশিন খারাপ– আর কেউ কোনো স্টেপ নেয়নি! আর তাছাড়া আইসক্রিম মেশিন কেন? এসব ক্লাবে আলাদা ডিপ ফ্রিজার থাকে আইসক্রিম রাখার জন্য। সেখান থেকে স্কুপে তুলে সার্ভ করা হয়। আমি মিস ঘোষকে ডার্ক ফ্যান্টাসি আইসক্রিম উইথ সস্ অ্যান্ড চকলেট চিপস খেতে বলেছিলাম। ওটা ফ্রিজার থেকে বের করেই দিতে হবে। সে ঠোঁট কামড়ে এক মিনিট ভাবল। তার ভুরুতে ফের চিন্তার ভাঁজ। একটু চুপ করে থেকে বলল–অর্ণব, তুমি গোল্ডেন মুন ক্লাবের ফোন নম্বরটা নোট করেছ?

ইয়েস স্যার। দাবার স্কোরশিটেই ছিল। আমি সেভ করে নিয়েছি।

গুড জব। ফোন মারো দেখি। একটা জিনিস একটু কনফার্ম করে নিই।

ও কে।

অর্ণব গোল্ডেন মুন ক্লাবের নম্বরে ফোন করে। সম্ভবত রিসেপশনের ফোন নম্বর। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পরেই ও প্রান্তে জাগ্রত হলো এক নারীর কণ্ঠস্বর–গুড ইভনিং, গোভেন মুন ক্লাব।

অর্ণব একটি শব্দও না করে তৎক্ষণাৎ ফোনটা হস্তান্তর করে দেয় অধিরাজের কাছে। সে ফোনটা নিয়ে অদ্ভুত একটা টোনে বলল–হ্যালো, হিন্দুস্থান রেফ্রিজারেশন প্রাইভেট লিমিটেড থেকে বলছি। আপনাদের ডিপ ফ্রিজার ফের খারাপ হয়েছে? এত ঘনঘন খারাপ হয় কেন আপনাদের ডিপ ফ্রিজার! এই তো কয়েকদিন আগেই ঠিক করে দেওয়া হলো! সাতদিনও হয়নি!

রিসেপশনের মেয়েটি জবাব দিল–না স্যার। আপনার ভুল হচ্ছে। সাতদিন তো দূর, গত নমাসের মধ্যে আমাদের ডিপ ফ্রিজার একবারও খারাপ হয়নি।

ন মাস আগে তো হয়েছিল? অধিরাজ প্রায় ধমক দিয়ে বলে–ঠিক কি না ম্যাডাম?

ও-প্রান্ত হকচকিয়ে গিয়ে বলল–হা স্যার। কিন্তু…।

হোয়াট কিন্তু? এক বছরের কমপ্রিহেন্সিভ ওয়ারান্টি পিরিয়ড! এর মধ্যে দুবার খারাপ হলো! ফ্রিজের মধ্যে ঢুকে কি চোর-পুলিশ খেলেন আপনারা! নাকি ওটাকে আলমারি হিসেবে ব্যবহার করছেন!

বিহেভ ইওরসেলফ। ওদিক থেকে মহিলাও কড়কে উঠলেন–ফর ইওর কাইন্ড ইনফর্মেশন, দুবার নয়, তিনবার খারাপ হয়েছে! আপনারাই বা এমন কী সারাচ্ছেন যে এক বছরের মধ্যে থার্ড টাইম ফ্রিজ খারাপ হলো! অথচ আগের দুবার আপনারাই বলে গেলেন যে ফ্রিজের কিস্যু হয়নি! এই আপনাদের সার্ভিস? ওদিকে আমাদেরই ধমকাচ্ছেন? লজ্জা করে না?

ঠিক আছে, ঠিক আছে। কাল ফার্স্ট আওয়ারেই লোক পাঠাচ্ছি।

অধিরাজ হেসে জিভ কাটল! এই রে! তিনবার খারাপ হয়েছে, দুবার নয়। সে আর কথা না বাড়িয়ে ফটাস্ করে ফোন কেটে দেয়। তার যা জানার ছিল, জানা হয়ে গিয়েছে।

কী হলো স্যার?

মিস্ ঘোষের প্রশ্নের উত্তরে অধিরাজ মুখ কাচুমাচু করেছে–রিসেপশনের অরেঞ্জ জুস সিমপ্ল ঝেড়ে দিল। তবে যা বলার বলে দিয়েছে। আইসক্রিম পার্লারের ডিপ ফ্রিজার এখনও পর্যন্ত দুবার নয়, তিনবার বিগড়েছে। আর কোম্পানির লোক আগের দুবার বলেছে ফ্রিজারের কিছু হয়নি।

তাতে কী হলো? অর্ণব অবাক–ক্লাবের আইসক্রিম পার্লারের সঙ্গে আমাদের কেসের সম্পর্ক কী?

অধিরাজের মুখ থেকে ছেলেমানুষি ভাবটা মুছে গিয়ে একটু চিন্তার ছাপ ফুটে ওঠে–কিছুই না। পুরো প্রব্যালিটির ওপর খেলছি অর্ণব। যেমন খুনি আমাদের স্টেপ বুঝে এগোচ্ছে, তেমন আমিও তার মাইন্ড রিড করার চেষ্টা করতে করতেই চেজ করছি। এ খেলাটা পুরো দাবার ছকের মতো হচ্ছে।

কিন্তু ক্লাবের ফ্রিজের খারাপ হওয়ার সঙ্গে খুনির কী রিলেশন? অর্ণব হতভম্ব।

ও কে। বুঝিয়েই বলছি। অধিরাজ সিগারেটের প্যাকেট থেকে ইন্ডিয়া কিংসের স্টিক বের করে আনে–আমরা এখনও পর্যন্ত যত প্রব্যাবিলিটি পেয়েছি তার একটা সাম-আপ করা যাক। আমরা বুঝতে পারছি যে আমাদের তিন মক্কেলের ভেতরের অন্যতম যোগসূত্র এই গোল্ডেন মুন ক্লাব অ্যান্ড রিসোর্টস। সম্ভবত এখানেই তারা অজ্ঞাত কোনো নারীর সঙ্গে ফুর্তি করতে আসতেন। এই রিসোর্টগুলো বানানোই হয়েছে এই কারণে। পুরো চান্স আছে পটল তোলার আগের মুহূর্তেও তারা হয়তো এখানেই ছিলেন। বিশ্বজিৎ বলছিল যে সর্বনাশিনী আনসিকিওরড হটস্পট ইউজ করছে। এখানেও কিন্তু আশেপাশেই আনসিকিওরড হটস্পট আছে। আমার মোবাইল অন্তত দুবার এরকম ওপেন কানেকশন ক্যাচ করেছে। আমার মনে হচ্ছে, যা ঘটছে–এখানেই ঘটছে। যদিও সেটা এখনও প্রতিষ্ঠিত সত্য নয়-এবং আরও কিছু প্রশ্ন রয়েছে যার উত্তর পাইনি। সত্য প্রতিষ্ঠা পেলে তখন প্রশ্নগুলো উঠতে পারে। কিন্তু চান্স তো আছেই। এই অবধি বোঝা গেল?

অর্ণব আর মিস্ ঘোেষ মাথা নাড়ল। অর্থাৎ তারা বুঝেছে।

এইবার আসি সঞ্জীব রায়চৌধুরী আর অর্জুন শিকদারের লাশের প্রসঙ্গে। শুরু থেকেই আমি ফরেনসিক রিপোর্টে একটা লাইন মিস করছি। টাকলুও কিন্তু লাইনটা বলেনি। অথচ বলা উচিত ছিল।

অর্ণব আর মিস্ ঘোষের মুণ্ডু পরস্পরের দিকে ঘুরে গেল। কী এমন জিনিস যা ফরেনসিক রিপোর্টে লেখা নেই!

সঞ্জীব রায়চৌধুরীর বডি ডাম্প করা হয়েছিল ঝোঁপের মধ্যে। অধিরাজ রিং বানাতে বানাতে বলে–অর্জুন শিকদারকে আবর্জনার স্তূপে। একজনের মৃত্যু হয়েছে চারদিন আগে, অন্যজনের পাঁচদিন। অথচ বডি একটুও ডিকম্পোজড় হলো না! চারদিন যদি কোনো বডিকে ফেলে রাখা হয় তবে সামান্য পচন ধরবে, দুর্গন্ধ হবে। কিন্তু দুজনের ক্ষেত্রে তা হয়নি। কেন? তবে খুনি এমন কোনো জায়গায় বডিটাকে রেখেছিল, যেখানে মৃতদেহ চট করে নষ্ট হয় না। সেটা কোনো মর্গ বা প্রাইভেট মরচুয়ারি হতে পারে না! মর্গে রাখতে হলে ডকুমেন্টস লাগে। মরচুয়ারিতে রাখলে বডি এম্বা করা হয়। কিন্তু বডিতে এম্বামিং লিকুইড বা ফ্লুইড পায়নি ফরেনসিক। তবে এতদিন বডিটা এমন কোথায় ছিল যাতে ডিকম্পোজই হলো না! ফরেনসিকের স্যাম্পল নিতে কোনো সমস্যাই হয়নি!

অর্ণবের চোখ বিস্ফারিত–ফ্রিজ!

যা তা ফ্রিজ নয়। এমন ফ্রিজ যেটা এয়ারটাইট! ময়েশ্চার নেই। বডিতে কোনোরকম বরফকুচি ছিল না। অর্থাৎ ভেতরে জল ছিল না। সচরাচর এই ধরনের ক্লাবে আইসক্রিম যে ফ্রিজগুলোয় রাখা হয় সেই ডিপ ফ্রিজগুলো আকারে বিরাট বড় হয়। আর সেখানে সিস্টেমটাই এমন যাতে আইসক্রিমগুলো গলে না যায়–অথবা বরফ না জমে। সচরাচর মাইনাস নাইন্টিন ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে আরও বেশি ঠান্ডা করতে পারে এই জাতীয় ডিপ ফ্রিজার। মৃতদেহ রাখার সবচেয়ে ভালো জায়গা। কী অবস্থা দেখো, গত দুদিন ধরে ক্লাবের রেস্টুরেন্টে আইসক্রিম পার্লার বন্ধ! শুধু তাই নয়–নয়মাস আগেও আইসক্রিম পার্লারের ডিপ ফ্রিজার কাজ করছিল না, আর ঠিক তখনই অর্জুন শিকদারের বডি পায় পুলিশ। এখানেই শেষ নয়–এক বছরে তিনবার বিগড়েছে গোল্ডেন মুন ক্লাবের ডিপ ফ্রিজার, আর একবছরে তিনটে লোকের ওপরই সর্বনাশিনীর কোপ পড়েছে। পুরোটাই কোইনসিডেন্স মনে হচ্ছে? আরও মজার কথা আগের দুবার কোম্পানির লোক বলেছে ফ্রিজে কোনো ডিফেক্ট নেই! আমার দৃঢ় বিশ্বাস এবারও তাই বলবে। সে একটা ভারি নিঃশ্বাস ফেলল–প্রথম গেমটা বোধহয় হারলাম আমরা। ড. বিজয় জয়সওয়ালকে জ্যান্ত পাওয়ার বোধহয় কোনো চান্স নেই!.

অর্ণব টের পেল তার শাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত যেন হিম হয়ে গেল। গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে গিয়েছে। কী সাংঘাতিক! কী সর্বনেশে কাণ্ড! একটা মানুষকে মেরে ডিপ ফ্রিজারে রেখে দিচ্ছে! এ শয়তান না রাক্ষসী!

স্যার, তাহলে এখনই আইসক্রিম পার্লার থেকে বের করে আনতে পারি না বডিটা? সে উত্তেজিত–রেড করলেই তো হয়!

অন হোয়াট গ্রাউন্ড?অধিরাজ বিষণ্ণ হাসল-এটা এখনও থিওরির পর্যায়ে আছে। এখনও পর্যন্ত কোনো আনএথিক্যাল জিনিস বা ইললিগ্যাল কাজের সন্ধান পাইনি। রেড কী করে করব? আর যদি রেডও করি–তবে লাশটা হয়তো পাবো। কিন্তু খুনির কোনো লিঙ্ক পাওয়া যাবে না।

তবে? মিস্ ঘোষ উত্তেজিত–কিছুই করতে পারব না?

অবশ্যই পারব। সে শান্তভাবে জবাব দেয়–তবে হাতে নাতে ধরতে হবে। সপ্রমাণ। আমার মনে হয় না এটা কোনো একজন লোকের কাজ। একজন নারী একটি লোককে ভালোবাসার নাটক করে বিষ দিয়ে মারতে পারে। টেক-এক্সপার্ট হলে হ্যাঁকিং ও করতে পারে। কিন্তু এরকম লম্বা-চওড়া পুরুষ মানুষগুলোকে ঘাড়ে করে ফ্রিজারে ঢোকানো, সেখান থেকে বের করা, তারপর অনেক দূরে গিয়ে ডাম্প করা–উঁহু, কোনো সুন্দরী তন্বীর কাজ নয়–যদি না সেই সুন্দরীর নাম করনাম মালেশ্বরী, মেরি-কম, গীতা-ববিতা ফোগাত বা সাক্ষী মালিক না হয়!

সঙ্গে কোনো পুরুষ আছে। অর্ণব স্বগতোক্তি করে।

ডেফিনিটলি। সে মিস্ ঘোষের দিকে তাকায়–রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের চেহারা কেমন?

রীতিমতো লম্বা-চওড়া স্যার। মিস ঘোষ জানাল–মুষকো বলা যায়।

অধিরাজ মিষ্টি হেসে অর্থপূর্ণভাবে শ্রাগ করে। অর্ণবের আর তর সয় না–লোকটাকে ধরে উলটো করে পেটালে হয় না?

একটু অপেক্ষা করো অর্ণব। সে স্মিত হাসল–সবসময় হুমহাম করলে চলে না। পকড়েঙ্গে জরুর, থোড়িসি নজাকত সে! ইনি তো রানির বোড়ে মাত্র। রানিকে ধরতে হবে না?

কীভাবে?

ইজি। আমরা যদিও এ যাত্রা ম্যাসাজ করে, দাবা খেলে ক্ষান্ত দিয়েছি, কিন্তু প্রতিপক্ষ এতক্ষণে জেনে গিয়েছে যে পুলিশের নজর পড়েছে এখানে। আজ কিছু করিনি। কিন্তু কাল করব না–তার গ্যারান্টি কী? পুলিশকে জনগণ অতটা বিশ্বাসও করে না। সে সুখটান মেরে খুব ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে বলল–অতএব রিস্ক নেবে না। বডি আজই ডাম্প করবে বলেই আমার ধারণা। এখন থেকে লাগাতার ফিল্ডিং দেব। ক্যাচ কট কট হতে বাধ্য। আজ যদি না ও করে, কাল তো করবেই!

কিন্তু যদি তা না হয়!

অধিরাজ কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে চুপ করে থেকে বলল–তাহলে বুঝব আমার থেকে সর্বনাশিনীর বুদ্ধি অনেক বেশি। নার্ভ আর মনের লড়াইয়ে হার স্বীকার করে এই কেস থেকে হাত তুলে নেব।

অর্ণব আর মিস্ ঘোষ ফের দৃষ্টি বিনিময় করল। তাদের দুজনের চোখে সংশয়। রাতে কি আদৌ কিছু ঘটবে? যদি না ঘটে? যদি খুনি অন্য কোনো দিক দিয়ে মাত দিয়ে বেরিয়ে যায়…!

আপাতত প্রথম কাজ…। গাড়ির সিটের তলা থেকে ফরেনসিক কিট বের করতে করতে বলল অধিরাজমিস ঘোষ, আপনি আমার স্কিনের কিছুটা স্যাম্পল নিয়ে নিন। এখান থেকে আপনাকে আমি ট্যাক্সিতে তুলে দিচ্ছি। আপনি স্ট্রেট ফরেনসিক ল্যাবে চলে যান। সেখানে আপনি ড. অসীম চ্যাটার্জীকে স্যাম্পলটা দিয়ে দেবেন…।

সে কথা শেষ করতে না করতেই তার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। আড়চোখে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েছে অধিরাজনাও। শয়তান কা নাম লিয়া, ঔর শয়তান হাজির! কী টাইমিং বুড়োর!

অর্ণব মুখ ঘুরিয়ে হাসি চাপে। ড. চ্যাটার্জীর যে কত নাম! দুর্বাসা, টাকলু, শয়তান, বুড়ো, ফুটবল, জাবুলানি, গ্লোব–আরও কত কী!

হ্যালো…!

অধিরাজ ফোনটা ধরতে না ধরতেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল বুড়োর চিৎকার–এতক্ষণ ধরে ফোনে ট্রাই করছি–কোন জাহান্নামে গিয়েছিলে শুনি?

গোল্লায় গিয়েছি ড.। সে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল–চতুর্দিকে কেশবতী কন্যে, মেঘবরণ চুল দেখে পাগল হয়ে গেলাম!

ড. চ্যাটার্জী রেগে লাল হয়ে প্রায় নাচতে নাচতে বললেন–খবরদার, আমার টাক নিয়ে কোনো কথা নয় বলছি।

অধিরাজ নিরীহ মুখ করেছে–যা ব্বাবা! টাকের কথা আবার কখন বললাম! আপনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই একই রেকর্ড বাজাবেন দেখছি।

সত্যি করে বলল, আমার নামটা স্ক্রিনে দেখে অর্ণবকে একবারও বলোনি যে টাকলু ফোন করেছে!

ইশশশ! দেবদাস ফিল্মের ঐশ্বর্য রাইয়ের মতো লজ্জা লজ্জা ভঙ্গিতে বলল সে–তাই কী বলতে পারি? ছি ছি! তওবা তওবা!

তুমি যে কী বলতে পারো, আর কী করতে পারো সে আমার ভালোই জানা আছে। বুড়ো খ্যাকখ্যাক করে উঠেছে–এখন জরুরি কথাটা শোনো। আহেলি একটা জিনিস বের করেছে…।

আমি কর্ণময়! বলুন।

আহেলির আবিষ্কারের কথা ড. চ্যাটার্জী সবিস্তারে অধিরাজকে বললেন। সে খুব মন দিয়ে প্রত্যেকটা কথা শুনল। বেশ কয়েকবার হুঁ হাঁ করল। তারপর শান্তভাবেই বলল–তার মানে চেরি রেড কালারের ভিনাইল স্যাটিন ফিনিশ ইমালশন্ ডোর পেইন্ট?

হ্যাঁ। ড. চ্যাটার্জী বললেন–ঐ চেরি রেড কালারের দরজার পেছনে কিছু কিছু রহস্য তো আছেই। খোঁজ করো। পেয়ে যাবে।

গ্রেট! গ্রেট জব ড.! সে গম্ভীর-আহেলির একটা চকলেট প্রাপ্য রইল। আর আপনার জন্য আদিদাস টেলস্টার এইটিন!

ড. চ্যাটার্জীর কণ্ঠস্বর সন্দিগ্ধ–সেটা কী! ওটা বিগত বিশ্বকাপের বিখ্যাত ফুটবল। অধিরাজ ঠোঁট টিপে হাসছে।

আদিদাস নয়, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চটে পুরো কালিদাস হয়ে লক্ষ মারলেন–ইঁদুর, বাদুড়, পাষণ্ড-পা-জি কোথাকার! তোমায় এরপর কোনোদিন আমি নিজের হাতেই খুন করব! বদমাশ ছোঁড়া…!

তিনি হাউমাউ করে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল সে–ওকে ড.। লাফালাফি না করে প্রয়োজনীয় কথাটা শুনুন।

তোমার একটা কথাও শুনছি না আমি! ব্ল্যাক মাম্বা, গডজিলা, কিংকং, কদাকার বুনিপ একটা!

ড. চ্যাটার্জী কোনো কথাই শুনবেন না। অর্ণব আর হাসি চাপতে পারছিল না। এই দুজনের চিরকালই হিন্দুস্তান-পাকিস্তান সম্পর্ক! সবসময়ই দাঙ্গা লেগেই আছে। অধিরাজ কিছুতেই ড. চ্যাটার্জীর পেছনে লাগা ছাড়বে না। আর ড. চ্যাটার্জী ফুটবলের নাম শুনলেই ক্ষেপে যাবেন। যদিও এ রাগ বেশিক্ষণ থাকার নয়। অর্ণব জানে, অধিরাজ ঠিক পটিয়ে পাটিয়ে বুড়োকে লাইনে এনেই ফেলবে। সে প্রচুর হাওয়া, তেল, মাখন মাখিয়ে বুড়োকে ঠিক ভেজাবেই।

আমার কথা শুনুন ড.। অধিরাজ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল–আপনাকে মিস্ কাটা মুণ্ডুর কসম!

অর্ণব হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। এই মিস্ কাটামুণ্ডুটা কে? ড. চ্যাটার্জীকে তার দিব্যিই বা দেওয়া হচ্ছে কেন? আর আশ্চর্যের ব্যাপার ড. চ্যাটার্জীও সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হয়ে গেলেন। একটু ঠান্ডা হয়ে বলেন–আচ্ছা, কী বলবে বলল।

আপনাকে একটা স্কিন স্যাম্পল পাঠাচ্ছি। অধিরাজ সিরিয়াস-তার মধ্যে ল্যাভেন্ডার অয়েল আছে। একটু মিলিয়ে দেখুন তো সেই অয়েলটা অর্জুন শিকদারের স্কিনে পাওয়া অয়েলটার সঙ্গে ম্যাচ করছে কি না। আমার জানা দরকার দুটো ল্যাভেন্ডার অ্যারোমা অয়েলই এক কি না।

ফাইন। পাঠিয়ে দাও।

রিপোর্টটা আজ রাতেই পেলে ভালো হয়। সে মাথা চুলকে বলল–একটু তাড়া আছে।

হয়ে যাবে। ড. চ্যাটার্জী ফোঁস ফোঁস করে বললেন–আর ওঁর নাম মোটেও মিস্ কাটা মুণ্ডু নয়..;মিস…।

জানি। অধিরাজ মুচকি হাসে–আপাতত এখানেই সমাচার সমাপ্ত। রাতে কথা হচ্ছে।

ড. চ্যাটার্জী লাইন কেটে দিলেন। অধিরাজ দ্রুত ও অভ্যস্ত হাতে নিজেই নিজের হাত থেকে খানিকটা স্কিন স্যাম্পল নিয়ে যত্ন করে এভিডেন্স ব্যাগে সিল করে রাখল। তারপর মিস ঘোষকে এভিডেন্স ব্যাগটা দিয়ে বলল-আপনার এখন দুটো কাজ মিস্ ঘোষ। প্রথমত, এই স্কিন স্যাম্পলটাকে ড. চ্যাটার্জীর হাতে পৌঁছে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, মেরিলিন প্ল্যাটিনাম হাউজিঙে তদন্তের নাম করে ঢোকা।

তদন্ত! কিন্তু একা একা অত বড় বিল্ডিং সার্চ করব কী করে? মিস্ ঘোষ বলল–তার জন্য একটা গোটা টিম লাগবে…।

উঁহু! সার্চ নয়। সে বুঝিয়ে দেয়–নিজের আইডিকার্ড দেখিয়েই ঢুকবেন। কিন্তু কোনো সার্চ অপারেশন করতে হবে না। বরং গোটা বিল্ডিংটা ভালো করে দেখবেন। শুধু এইটুকু খুঁজে বের করতে হবে যে মেরিলিন প্ল্যাটিনামে কোন কোন ফ্ল্যাটের দরজা রেড চেরি কালারের। আর পেইন্টটা সাধারণ নয়। স্যাটিন ফিনিশ ইমালশন পেইন্ট। একদম মখমলের মতো মসৃণ ঝকঝকে রং।

আমি স্যাটিন ফিনিশ পেইন্ট চিনি স্যার। কোনো অসুবিধে হবে না।

ফাইন। আপনি শুধু নোটিস করবেন যে কোন কোন ফ্ল্যাটের দরজায় রেড চেরি কালারের স্যাটিন ফিনিশ পেইন্ট আছে। এবং সেটা আমাদের ফোনে জানিয়ে দিয়ে চুপচাপ ওখান থেকে কেটে পড়বেন। আজকের জন্য এইটুকুই। আর কিছু করার আপাতত দরকার নেই।

ও কে।

নিজের দায়িত্ব বুঝে নিয়ে চলে গেল মিস ঘোষ। অধিরাজ নিজেই তাকে ট্যাক্সিতে তুলে দিল। অর্ণবের মাথায় তখনও অনেক কথা ঘুরঘুর করছে। সে ফিরে আসতেই জিজ্ঞেস করল–স্যার, এই মিস কাটা মুণ্ডুটা কে? কী বিটকেল সারনেম!

অ্যাকচুয়ালি…। ছেলেমানুষের মতো হাসল অধিরাজ–ওঁর পদবী কাটা মুন্ডু নয়। অন্য কিছুই। আমিই ভুলে গিয়েছি। তবে ইনি হচ্ছেন আমাদের টাকলুর পেহ্লা পো প্যায়ার!

অ্যাঁ! অর্ণব আরেকটু হলেই ফেইন্ট হয়ে যাচ্ছিল–কিন্তু সে তো দীপিকা পাড়ুকোন ছিলেন। বদলাল কখন?

দীপিকা পাড়ুকোন ক্রাশ। সে হাসছে–চোখে দেখেই শান্তি। কিন্তু ইনি বুড়টার হৃদয়েশ্বরী। ড. চ্যাটার্জীর হৃদয়ে এখন কাটা মুভুর নাচ চলছে।

তিনি কে? কী করেন? ড. চ্যাটার্জীর সঙ্গে দেখা হলো কোথায়? কবে হলো? কী করে…!

ধীরে বন্ধু ধীরে! অধিরাজ অর্ণবের অস্থিরতা দেখে মিটমিট করে হাসে–তিনি সাম্প্রতিক কালের একজন থ্রিলার রাইটার। আনম্যারেড। তার গল্পে যত ভুলভাল কাণ্ড ঘটে। থ্রি ডি ইমেজ দেখে লোকে ভূত ভূত করে চেঁচায়! এমনকি একজন লোকের মাথায় একটা চিপ বসিয়ে তাকে হিপনোটাইজড়ও করা হয়! ড্রাগন-ড্রাকুলা, ওয়্যার উলফ-কী নেই! ওসব থ্রিলার পড়তে হলে ব্রেনটা খুলে রেখে পড়তে হবে। যাই হোক, ড. চ্যাটার্জী সেই ভয়ংকর খ্রিলারের ধাক্কাতেই কুপোকাত! এমন নেশা হয়েছে যে এখন লেখিকার ফোন নম্বর খুঁজে বের করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। ভাগ্যিস বুড়ো ফেসবুক ব্যবহার করে না। নয়তো জানতে পারত যে যাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন, তিনি ফেসবুকে সগৌরবে বিরাজমান।

সে কী! অর্ণবের চক্ষু চড়কগাছ–দেখতে কেমন? আপনি দেখেছেন?

দেখেছি বইকি! টাকলুর প্রেম বলে কথা। দেখতে তো হবেই। সে বলল–সত্যি বলছি অর্ণব, একদম কার্পেথিয়ার দুর্গ থেকে আমদানি করা ব্র্যান্ড নিউ ভ্যাম্পায়ারনি মার্কা দেখতে। ঘচাং ফু, খাবো তোকে অ্যাটিটিউড। ফোনে সেভ করে ড. চ্যাটার্জীকেও দেখিয়েছিলাম। সেটা দেখে বুড়ো আরও মজেছে। স্বাভাবিক! ব্রহ্মপিশাচ লেডি ভ্যাম্পায়ারই পছন্দ করবে। বিটকেল লোকের চয়েস বিটকেলই হয়।

কিন্তু ভদ্রমহিলা?

আ ভেরি হার্ড নাট টু ক্র্যাক। একটু পাতা লাগিয়েছিলাম। শুনেছি, ছেলেদের বিশেষ পাত্তা দেন না। তাঁর মাথায় খুন, লাশ, ড্রাকুলাই অষ্টপ্রহর ঘোরে। প্রেম-ট্রেম নয়।

অর্ণব হতাশ হয়ে যায়। যা। লাভ স্টোরির শুরুতেই সব ভেস্তে গেল। তার মনের কথা বুঝতে পেরেই অধিরাজ বলল–হাল ছেড়ো না বন্ধু। মিস্ কাটমুণ্ডু হ্যান্ডসাম ছেলেদের পাত্তা দেন না। মানে তোমার আমার চান্স নেই। কিন্তু বিটকেল লোকদের পছন্দও তেমনই হয়। বলা যায় না, ড. চ্যাটার্জীর সেক্সি টাক দেখেই ম্যাডাম তাঁকে নিজের ওনলি অ্যাডাম বানিয়ে ফেললেন! খুন, বিষ নিয়ে যে সর্বক্ষণ প্লট বানাচ্ছে, মড়া কাটা ডাক্তার তার প্রিয়তম হতেই পারেন।

কিন্তু ড. চ্যাটার্জী…।

অধিরাজ হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয়–ড. চ্যাটার্জীর লাভ প্রবলেম পরে সলভ করব। আপাতত সর্বনাশিনীর ওপর কনসেনট্রেট করো। তুমি গাড়িটা ক্লাব থেকে একটু দূরে পার্ক করবে। তারপর সোজা ক্লাবের পেছন দিকের পাঁচিল টপকে ঢুকে গাছপালার ভিড়ে লুকিয়ে খেয়াল রাখবে। আমি একটু বাড়ি যাচ্ছি। এ কয়দিন বাড়ি ফিরিনি বলে বাবা-মা চিন্তায় আছেন। তাছাড়া শরীরটাও ভালো লাগছে না। একটু খেয়েদেয়ে, ওষুধ খেয়ে চাঙা হয়ে আসছি। তাছাড়া আমার বাইকটাও দরকার। যতক্ষণ না ফিরছি, এখান থেকে নড়বে না। কে আসছে, কে যাচ্ছে খেয়াল রেখো। তেমন সন্দেহজনক কিছু দেখলেই ফোন করবে। একটু থেমে সে আপনমনেই বলে–যদিও এখনই কিছু ঘটবে বলে মনে হয় না। হলে গভীর রাত বা ভোর রাতের দিকে হবে…!

রাতের দিকে?

আমার গা ফিলিংস বলছে রাতের দিকেই। সে চাপা স্বরে বলল–কিন্তু কিছু তো হবেই। কোনো ক্ল আজ পাবোই।

অর্ণব একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন আরও কিছু বলতে চায়। কিন্তু সংকোচ করছে। একবার, দুবার মুখ খুলেও থেমে গেল। সেটা লক্ষ করেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় অধিরাজ–কিছু বলবে?

স্যার…মিসেস জয়সওয়াল…আই মিন…।

ইউ মিন, তারপর পায়ের আঘো অন্ধকার রুমে কী হইল? সে হেসে ফেলেছে–আমি ভাবছিলাম, এই প্রশ্নটা এখনও আসছেনা কেন! তুমি বড় পজেসিভ অর্ণব।

অর্ণব লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়। একটু ইতস্তত করে বলল–উনি আপনাকে কিছু করেননি তো!

তিনি আমাকে কী করবেন! সে হো হো করে হেসে উঠেছে–আমি মাইনর তো নই যে মলেস্ট করবেন! তবে তোমায় কিছুই না বললে তোমার পেট গুড়গুড় করবে। আবার মিসেস জয়সওয়ালের প্রাইভেসিও নষ্ট করতে পারি। শুধু এইটুকু বলতে পারি–মিসেস জয়সওয়াল কোনো মঙ্গলগ্রহের প্রাণী নন্। একজন আপাদমস্তক স্বাভাবিক, স্ট্রেট ফরোয়ার্ড নারী। আমিও কিছু মুনি ঋষি নই। এক হাতে তালি কখনো বাজে? ওঁর কিছু প্রয়োজন ছিল যা আমি ওঁকে দিয়েছি। আবার আমার কিছু দরকার ছিল যা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি।

তবু…! এইভাবে স্যার! …

অধিরাজ মৃদু হেসে তার কাঁধে হাত রাখে–বিলিভ মি অর্ণব। এমন কিছু ঘটেনি যার জন্য লজ্জাবোধ করতে পারি। অন দ্য কারারি, যা হয়েছে বেশ হয়েছে। আই রিয়েলি এনজয়েড দ্য এক্সপেরিয়েন্স। ব্যাস।

অর্ণব বুঝল, অধিরাজ এর বেশি আর কিছু বলবে না। সে জোরে শ্বাস টানল–ও কে স্যার।

গেট রেডি। সেরহস্যপূর্ণ গম্ভীর গলায় বলল–আমার সিক্সথ সেন্স বলছে আজ রাতে মজারু ঘটবেই। প্রস্তুত থাকো।

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *