২. হাউজিং কমপ্লেক্সের দিকে তাকিয়ে

মেরিলিন প্ল্যাটিনাম হাউজিং কমপ্লেক্সের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য চোখ ধাঁধিয়ে গেল অর্ণবের!

এটা কলকাতা না ইন্দ্রপ্রস্থ! আর্কিটেক্টরা সম্ভবত বিশ্বকর্মা আর ময়দানবকেও টেক্কা দিয়েছেন। বালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে যে এরকম হাউজিং কমপ্লেক্স গড়ে উঠতে পারে, তা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না ওর। গোটা কমপ্লেক্সটাই জলের ওপরে গড়ে উঠেছে! যেন জলের ওপরে ভাসমান মিনার! নিচে কাঁচের মতো স্বচ্ছ জলটাকেও নীল বলেই মনে হয়! এক টুকরো আকাশ বুঝে নিচে নেমে এসেছে। একঝলক দেখলেই বোঝা যায় এখানে লাখের নয়, কোটির খেলা চলে! টাওয়ারগুলো সম্পূর্ণ এসি! পুরো স্বর্গ!

তার বুকের ভেতরটা রীতিমতো ঢিপঢিপ করছে। আকাশচুম্বী উজ্জ্বল টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে এখন একটা কথাই ভাবছে সে। এখানেই বিজয় জয়সওয়াল থাকেন! এর আগেও তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে একবার এখানে এসেছিল অর্ণব। তখন পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। কিন্তু এখন অবস্থা আরও সংশয়জনক। একটু আগেই খবর পাওয়া গিয়েছে যে মি. জয়সওয়াল বাড়ি ফিরে এসেছেন। বলাইবাহুল্য সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত খবর। কিন্তু কিছু কি পাওয়া যাবে তাঁর কাছ থেকে? নাকি ফের আবার নতুন কোনো জটে জড়িয়ে পড়তে হবে। বিশ্বাস নেই! এই কেসটা যেন ক্রমশই পদে পদে জটিল হচ্ছে।

কাল অধিরাজ বলামাত্রই কাজে নেমে পড়েছিল অর্ণব। তৎক্ষণাত্র বিজয় জয়সওয়ালের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিল সে। তিনি শুধু দুটো তথ্যই দিতে পারলেন। প্রথমত, তিনি সন্দেহ করেন যে তাঁর স্বামীর কোনো মেয়ের সঙ্গে অ্যাফেয়ার চলছে। দ্বিতীয়ত, প্রায়ই মি, জয়সওয়াল এরকম সন্দেহজনক ট্যুরে চলে যান। তখন তাঁকে ফোনে পাওয়া যায় না। এবার দশদিন আগেই ফের হাওয়া হয়েছেন। মি. জয়সওয়ালের প্রপার্টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই এমন করে ঠোঁট ওলটালেন যেন তাঁকে ধর্মঘটের সমাস বলতে বলা হয়েছে! মি. জয়সওয়াল নিজের বিজনেস, প্রপার্টি বা লেনদেনের কথা স্ত্রীকে কখনই বলেন না। তিনি কোথায় যেতে পারেন সে বিষয়ে ভদ্রমহিলার কোনো ধারণা নেই, তবে হাবেভাবে মনে হলো যে স্বামী মায়ের ভোগে গেলেই তিনি সবচেয়ে। বেশি খুশি হবেন।

অধিরাজের নির্দেশমতো ভদ্রলোকের ঘর, অফিস ভালো করে খুঁজে দেখেছিল সে। নিতান্তই ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু কাগজ আর ফাইল ছাড়া তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছুই নেই। কাগজপত্র থেকেই জানা গেল যে লোকটার প্রপার্টি আছে প্রচুর। মুম্বাইয়ের পালি হিলসে আর গোয়ায় নিজস্ব বাংলো আছে। কলকাতায় অন্য কোনো ফ্ল্যাট বা বাড়ি নেই, তবে জমি কিনে রেখেছেন প্রচুর। ব্যাংক ডিটেলসও স্বাভাবিক। ফোন রেকর্ডে কোনো সন্দেহজনক নম্বরও পাওয়া যায়নি। তাঁর লাস্ট ফোন লোকেশন বাড়িই শো করছে! অর্থাৎ বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ই তিনি ফোন সুইচ অফ করেছিলেন। আর অন্ করেননি।

ভাবতেই একটা দারুণ হতাশা ঘিরে ধরল অর্ণবকে। কোনো কেসে এভিডেন্সের এমন আকাল আর এত টুইস্ট আজ পর্যন্ত দেখেনি সে! কেসটা। আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সর্বনাশিনী ও বিজয় জয়সওয়ালের ছবি ফ্যাক্স করে দেওয়া হয়েছিল দীঘা ও মন্দারমণি সমেত পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি পুলিশ স্টেশনে। খবরিদের হাতে হাতে তার ফটো ঘুরছে। জিপনেট, অর্থাৎ জোনাল ইন্টিগ্রেটেড পুলিশ নেটওয়ার্কেও দুজনের ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তখনও কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে যে সাইবার সেলের দক্ষতার ওপর সবচেয়ে বেশি ভরসা, তারাও সর্বনাশিনীর আইপি অ্যাড্রেস ট্র্যাক করতে গিয়ে আতান্তরে পড়েছে। শুধু আর আইপি পোস্ট আরনিজের ছবি ছাড়া স্টেটাস আপডেটে আর কিছুই নেই। ঐ প্রোফাইলটি কারোর সঙ্গে চ্যাট করেনি। সাইবার সেল আপ্রাণ খুঁজেছে যদি একটাও চ্যাট হিস্ট্রি পাওয়া যায়। কিন্তু সে সব কিছুই নেই। তার প্রত্যেকটি পোস্টের আইপি অ্যাড্রেস আলাদা। বেশিরভাগই কিছু অখ্যাত সাইবার কাফের, কয়েকটা কারোর পার্সোনাল কম্পিউটারের, মোবাইলের। সম্প্রতি যে পোস্টটি করেছে সেটার আইপি অ্যাড্রেস ট্র্যাক করে দেখা গেল সেটি একজনের ল্যাপটপের আইপি।

অর্ণব নিজেই দলবল সমেত সর্বপ্রথমেই সেই ভদ্রলোকের কাছে হাজির হলো, যার ল্যাপটপের আইপি অ্যাড্রেস থেকে বিজয় জয়সওয়ালের আর আইপি পোস্টটি করা হয়েছে। কিন্তু ভদ্রলোককে দেখে প্রায় আকাশ থেকে পড়ল ওরা। লোকটি ইনভ্যালিড! সাইবার সেলের লোকেরা তাঁর ল্যাপটপ, লগ ইন হিস্ট্রি ইত্যাদি সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘেঁটে দেখেও কিছুই বের করতে পারল না। সর্বনাশিনীর সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্কই নেই!

অর্ণব শুধু সেখানেই থামেনি। সে সেইসব সাইবার কাফেতে ঢু মেরেছে যাদের আইপি অ্যাড্রেস সর্বনাশিনী ব্যবহার করেছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, যে সেখানেও কিছুই পাওয়া যায়নি। কিছু সাইবার কাফের রেজিস্টার এবং সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে, প্রত্যেকবার ঠিক যে সময়ে সর্বনাশিনী অনলাইন হয়েছিল সেই সময়ে সাইবার কাফের উক্ত আইপি অ্যাড্রেসের কম্পিউটারটি হয় ব্যবহৃতই হয়নি, নয় রীতিমতো আইডি প্রুফ দিয়ে কেউ ব্যবহার করেছে। তাদের খুঁজেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ওরা। কিন্তু তারাও ক্লিনচিট পেয়েছে, কারণ সাইবার সেল বিশেষজ্ঞ সেই কম্পিউটারগুলোও আঁতিপাতি করে খুঁজেও তেমন আপত্তিকর কিছুই পাননি! মোবাইলের ক্ষেত্রেও সেই একই ঘটনা! এই প্রোফাইলের পোস্টে যে আইপি অ্যাড্রেসের পার্সোনাল কম্পিউটারটি ব্যবহৃত হয়েছে তার মালিককে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে অর্ণব নিজেই প্রায় বেকুব বনে গেল। কম্পিউটারের মালিক চটে গিয়ে জানালেন যে তার কম্পিউটার থেকে কখনোই ফেসবুক ব্যবহার করা হয় না। ওটা সম্পূর্ণ তার অফিসিয়াল কাজে ব্যবহার করা হয়। এমনকি ফেসবুকে তার নিজের অ্যাকাউন্টই নেই। ওরাও ভেরিফাই করে দেখল, ঘটনাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি!

এত কাণ্ড করতে করতে প্রায় রাত বারোটা বাজল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যতখানি করা যায়, তার থেকেও বেশি তৎপরতায় কাজ করছিল ওরা। কিন্তু প্রাথমিক তদন্তে কিছুই পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত বুনোহঁসের পেছনে তাড়া করতে করতে ওদের যখন দম বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম, তখনই অধিরাজ বিরক্ত হয়ে সাইবার সেলের সবচেয়ে দক্ষ কর্মী বিশ্বজিৎকে ডেকে পাঠাল। অত্যন্ত বিরক্তিমাখা সুরে বলল–এটা কী হচ্ছে বিশ্বজিৎ? কী সব ভুলভাল লিড দিচ্ছ! একটা আইপি অ্যাড্রেসও সঠিকভাবে বলতে পারলে না!

ততক্ষণে অবশ্য বিশ্বজিতেরও গলদঘর্ম অবস্থা। সে ঘাম মুছতে মুছতে বলল–স্যার, এভাবে হবে না। এটা সিম্পল কেস অব আইপি অ্যাড্রেস স্পুফিং।

অধিরাজ নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিল। কথাটা শুনেই সোজা হয়ে বসল–আইপি অ্যাড্রেস স্কুফ করছে?

হ্যাঁ স্যার। যে এটা করছে, সে নিজের আইডেন্টিটি হাইড করে অন্যের আইডেন্টিটি র‍্যান্ডমলি মিমিক করছে। একাধিক ফলস আইপি অ্যাড্রেস তৈরি করেছে। ফলস্বরূপ আমরা তাকে ধরতেই পারছি না।

অধিরাজের দৃষ্টি শানিত হয়ে ওঠে–কিন্তু আইপি অ্যাড্রেস স্পুফিং করলেও তো আসল আইপি ট্র্যাক করা যায়।

করা যায়। বিশ্বজিতের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে–আমাকে আজকের রাতটা দিন স্যার। কাল সকালের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু বলতে পারব।

সেদিন রাতে অধিরাজ আর বাড়ি ফিরল না। অগত্যা অর্ণবও অফিসেই থেকে গেল। তার মধ্যেই ট্র্যাফিক পুলিশ ফোন করে জানিয়েছিল, তারাগত দশদিনের ফুটেজ তন্নতন্ন করে ঘেঁটেও বিজয় জয়সওয়ালের গাড়িকে ট্র্যাক করতে পারেনি। ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সে গাড়ি কোথায় হাপিশ হলো, কেউ কিছুই জানে না। অন্তত তার বাড়ির আশেপাশের কোনো সিগন্যালের সামনে দিয়ে যায়নি তা নিশ্চিত। তবু তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এক কাজ করুন। অধিরাজ বলল–আমাদের ফুটেজগুলো পাঠিয়ে দিন তো। আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন। তবু আমরাও একবার দেখে নিই।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেস। ফলে আধঘণ্টার মধ্যেই সব সিসিটিভি ফুটেজ এসে হাজির হলো। ওরা তৎক্ষণাৎ দুজনে মিলে সেই সমস্ত ফুটেজ দেখতে বসে পড়ে। অর্ণবের মনে আশা ছিল যে অতিরিক্ত তাড়াহুড়োর ফলে হয়তো পুলিশের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে গাড়িটা। ভালো করে দেখলে হয়তো পাওয়া যাবে। একটা আস্ত এসইউভি গাড়ি নিশ্চয়ই হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না।

কিন্তু চারজোড়া চোখ সমস্ত রাত ধরে গুচ্ছ গুছ ফুটেজ দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। কাপের পর কাপ কফি শেষ। সিগারেটের পর সিগারেট পুড়ল। তবু গাড়িটাকে শনাক্ত করতে পারল না। সাদা এসইউভি অনেক আছে। কিন্তু উক্ত নম্বর প্লেটের গাড়িটিই নেই! অধিরাজের কপালে চিন্তার কুঞ্চন। এসব আদতে হচ্ছেটা কী! এরকম অদ্ভুতুড়ে ঘটনা আদৌ ঘটতে পারে! বিজয় জয়সওয়াল গাড়ি করে বেরিয়ে গেলেন, অথচ গাড়িটা কোথায়! এ কি জেমস বন্ডের ফিল্মের ইনভিজিবল কার নাকি!

ধুত্তোর।

ফুটেজ দেখা শেষ হলে বিরক্ত হয়ে অধিরাজ কম্পিউটার অফ করে দেয়। অর্ণব দেখল তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা। কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে টেবিলের দিকে তাকিয়ে থেকে অবশেষে একটু ক্লান্ত ভাবে বলেছিল–অর্ণব, বাইরে তো ভোর হলো, কিন্তু এখনও যে ভেতরে অন্ধকার! একটু একটু করে সময় কাটছে, আর বিজয় জয়সওয়ালের মরণ ঘনাচ্ছে। অথচ আমাদের হাতে কি নেই! …নাথিং!

অর্ণব কী বলে সান্ত্বনা দেবে ভেবে পায় না। সেও রীতিমতো ফ্রাস্ট্রেটেড। দুজনেই নীরব। অধিরাজের অস্থির আঙুলগুলো টেবিলের ওপরে এলোমেলো আঁকিবুকি কাটছে। বেশ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ফের স্বভাববিরুদ্ধ অধৈর্য স্বরে বলে ওঠে–এই লোকগুলোর এভাবেই মরা উচিত! কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে বাড়ির বউকে বলে যায় না কেন এরা! বাড়িতে বউ আছে, বাচ্চাও আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কাউকে কিছু না বলে তেনারা চললেন প্রেম করতে! এত গোপনীয়তার কী আছে? প্রেম করছিস্ কর সেলফোনটা তো অন্ রাখবি!

অর্ণব ভারি গলায় জানায়–অর্জুন শিকদারের একটা পাঁচ বছরের মেয়ে আছে স্যার। সঞ্জীব রায়চৌধুরীর দুই ছেলে। বড়টার বয়েস তিন বছর। আরেকটা নেহাতই কোলের শিশু!

বাচ্চাগুলোই হলো আসল ভিকটিম! তার কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা–কিছু বোঝার আগেই পিতৃহীন! বড় হওয়ার পরে যখন বাবার কীর্তি জানতে পারবে তখন মনের অবস্থা কী দাঁড়াবে একবার ভাবো। বিজয় জয়সওয়ালের ছেলে পুলে কিছু আছে?

না।

বাঁচা গেছে! বলতে বলতেই চোখ বুজল অধিরাজ। চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে ক্লান্তভাবে বলল–আমাকে একটু একা থাকতে দাও অর্ণব। এখন সবে কাক ডাকছে! এই মুহূর্তে আর কিছু করার নেই। দেখা যাক, বিশ্বজিত কী বলে। যদি কিছু লিড দিতে পারে…।

বিশ্বজিত কিন্তু বেলা দশটার আগে দেখা দিল না। অর্ণব দেখল, তার চুল উশকোখুশকো। চোখ দুটো রক্তজবার মতো লাল। সারারাত ধরে বেচারি সর্বনাশিনীর পেছনে দৌড়েছে। যতভাবে পারা যায়, যতরকম সফটওয়্যার ব্যবহার করা যায়, প্রায় সবই করে ফেলেছে। কিন্তু যখন সে অধিরাজের কেবিনে ঢুকল, তখন তাকে পুরো ভগ্নদূতের মতো দেখাচ্ছিল। অধিরাজ তার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতেই ক্ষীণস্বরে বলল–আমি সারারাত আপ্রাণ চেষ্টা করেছি প্রোফাইলটার অ্যাকচুয়াল আইপি অ্যাড্রেস ট্র্যাক করার। কিন্তু স্যার, এখন প্রায় অসম্ভব লাগছে!

অধিরাজ কোনো কথা বলল না। কিন্তু তার ভুরু ভঙ্গিই অনুচ্চারিত শব্দটা প্রকাশ করে দেয়–কেন?

এ পাবলিক মহাধড়িবাজ স্যার! প্রায় অসহায়ের মতো বলল বিশ্বজিৎ–যতবার অ্যাকচুয়াল আইপি ট্র্যাক করার চেষ্টা করছি, প্রত্যেকবারই সার্ভিস প্রোভাইড়র পালটে পালটে যাচ্ছে!

এ বার প্রশ্নটা মুখেই করল সে–মানে?

মানে এই লোকটি বা মহিলাটি নিজের নেটওয়ার্ক ইউজই করছে না। প্রত্যেকবার কোনো আনসিকিওর্ড হটস্পট থেকে অনলাইন হচ্ছে। যেমন ধরুন পার্ক স্ট্রিট, নিউটাউনে বা ইত্যাদি কিছু জায়গায় এরকম আনসিকিওর্ড হটস্পট আছে যেখান থেকে অনায়াসেই নেট কানেকশন পাওয়া যায়। সে সেখান থেকে অনলাইন হয়ে তারপর আইপি অ্যাড্রেস সুফিং করছে। জাস্ট জিনিয়াস মাপের শয়তান!

উপস্থিত দুই অফিসারের মাথাতেই যেন সূর্য সমেত সবকয়টা গ্রহ, উপগ্রহ ভেঙে পড়ল! কী সর্বনেশে কাণ্ড! অর্ণব মনে মনে স্বীকার করল–নামটা সার্থক বটে! সত্যিই সর্বনাশিনী!

অধিরাজ কিছুক্ষণ বিশ্বজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিশ্বজিতের মুখে ব্যর্থতা স্পষ্ট। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–আই সি! এবার বুঝতে পারছি যে পুলিশ কেন এই প্রোফাইলটাকে ট্র্যাক করতে পারেনি!

বিশ্বজিৎ কোনো কথা বলল না। সে মাথা হেঁট করে নীরবে বেরিয়েই যাচ্ছিল। তাকে কী ভেবে যেন হঠাৎই পেছন থেকে ডাকল সে–এক মিনিট! আরেকটা কাজ করো তো।

ইয়েস স্যার? ছেলেটা থমকে দাঁড়ায়।

সরাসরি না হলেও অজান্তেই তুমি একটা লিড দিয়ে ফেলেছ বস্। অধিরাজ মৃদু হাসছে–যিনি এই জাতীয় হাইটেক বদমাশ, তিনি নির্ঘাৎ হ্যাঁকিঙে এক্সপার্ট! এবং আমি নিশ্চিত, এর আগে নিশ্চয়ই তিনি পুলিশি হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, যেখান থেকে অভিজ্ঞতা আরও জোরদার হয়েছে। সম্ভবত এর আগেও আইপি অ্যাড্রেস স্পুফিং করেই কোনো বদমায়েশি করেছিলেন। কিন্তু সেবার ধরা পড়ার খারাপ অভিজ্ঞতা আছে বলেই এবার নতুন পদ্ধতি আমদানি করেছেন। নতুন হ্যাকারের মাখা হলে শুধু সুফিঙের কথাই ভাবত! এবং অবশ্যই ধরা পড়ত। তিনি সাইবার সেলের তদন্ত পদ্ধতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করে বসে আছেন। অগত্যা শুধু সুফিঙেই ক্ষান্ত দেননি। নিজেকে আপগ্রেড করে আনসিকিওরড হটস্পটে বসে আইপি সুফিং করার মতো ফুলফ ডাবল লকওয়ালা ভয়ংকর প্ল্যান ছকেছেন। এ পুরানো পাপী না হয়েই যায় না!

বিশ্বজিতের চোখ চকচক করে ওঠে–তার মানে…?

অধিরাজ শান্তভাবে বলে–এখনও পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে যত আইপি অ্যাড্রেস সুফিঙের মাধ্যমে সাইবার ক্রাইম হয়েছে, সমস্ত কেস ফাইল পাঠিয়ে দাও। অ্যাসাপ!

ও কে স্যার।

অর্ণব বিস্মিত দৃষ্টিতে অধিরাজের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই সম্ভাবনাটা তার মাথাতে আসেনি। সত্যিই তো। লোকটি বা মেয়েটি যখন এত আটঘাট বেঁধে নেমেছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার হ্যাকার হওয়ার প্রবল চান্স! এবং অধিরাজের যুক্তিটাও অকাট্য। নির্ঘাৎ প্রথমবার অপকর্মটি করে পুলিশের কাছে ধরা পড়েছিল সে। তাতে তার অভিজ্ঞতা বেড়েছে বলেই দ্বিতীয়বার ওয়াটার টাইট প্ল্যান বানিয়েছে। কাজটাকে প্রায় পারফেক্ট ক্রাইমের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু নিজের অজান্তেই একটা হালকা লিড দিয়ে দিয়েছে!

যখন টেকনোলজি জবাব দিয়ে দেয়, তখন একটা অস্ত্রই কাজে আসে অর্ণব। আদি ও সনাতন মগজের ধূসর বস্তু। অধিরাজ টেবিলের ওপরে পেপারওয়েটটাকে নিয়ে খেলতে খেলতে বলল–যদি আমার খুব ভুল না হয় তবে ইনি একজন মহিলা। পুরুষ হলে বিষ দিতে যাবে কোন দুঃখে! পুরুষেরা এরকম সূক্ষ্ম কাজই করে না। দুমদাম গুলি, বা ঘপাঘপ চাকু থাকতে বিষ কেন! তিনি মহিলাই! যুবতি। অত্যন্ত সুন্দরী। এবং সম্ভবত ফুটফুটে ফরসা।

যুবতী ও সুন্দরী তো বটেই। নয়তো দুজন পুরুষ তাকে দেখে এমন পাগল হয়ে ওঠে। কিন্তু একটা প্রশ্ন তখনও অর্ণবের মাথায় ঘুরছিল ফুটফুটে ফরসা স্যার? কিন্তু ছবিতে তো কুচকুচে কালো!

ফেসবুকে নিজের ছোবড়াটাই দেখাতে হবে এমন কোনো আইন আছে কি? অধিরাজের মুখে সেই পেটেন্ট বদমায়েশি হাসি–আমার ফেসবুক প্রোফাইলে তো আমি টাকলুর ছবি দিয়ে রেখেছি। কে জানতে যাচ্ছে প্রোফাইলের মালিক সত্যিই অবাক পৃথিবী, না তার মাথায় ঝাকড়া ঝাঁকড়া চুল!

অর্ণবের চক্ষু চড়কগাছ–আপনার ফেসবুক প্রোফাইলে ড. চ্যাটার্জীর ডিপি! ড. চ্যাটার্জী জানেন?

দুর্বাসা জানতে পারলে কি ছেড়ে কথা বলত? অধিরাজ ফিক করে হাসল–তবে চিন্তা নেই, বুড়ো তখনই জানতে পারবেন, যখন তিনি ফেসবুকে থাকবেন। যে লোক ইউ টিউবকে টিউব লাইট ভাবে, আর ব্রাউজার খুলতে বললে দাঁত খিঁচিয়ে বলে–আমি কি মহিলা যে ব্লাউজ খুলব!– তার কাছে জুকারবার্গ আর জুরাসিক পার্ক একই বস্তু!

অর্ণব একটু ভেবে বলে–কিন্তু ধরুন আপনার ডিপিতে যদি ড. চ্যাটার্জীর ছবিও থাকে, তবু তো পুলিশ অন্তত ড. চ্যাটার্জীকে খুঁজে বের করতে পারবে।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পারবে। সে রিভলভিং চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসেছে–সময় লাগবে। কিন্তু লোকটাকে কখনো না কখনো ঠিকই পাওয়া যাবে।

তবে সর্বনাশিনীর ডিপিতে যে মেয়েটার ছবিটা আছে, তাকে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? পুলিশ তো চেষ্টা করছে কমদিন হয়নি।

হ্যাঁ। পুলিশ প্রচুর চেষ্টা করেছে। ওদের নানারকম ডেটাবেসে সার্চ করেছে। গুগল ইমেজ সার্চ করেছে। খবরিদের মাধ্যমে ঘুরিয়েছে, প্রত্যেকটা পুলিশ স্টেশনে ঘুরিয়েছে। এখন তো জিপনেটেও আছে। অধিরাজের দৃষ্টি অন্যমনস্ক। সে সর্বনাশিনীর ছবিটা ড্রয়ার থেকে বের করে টেবিলে রাখেমেয়েটার ছবিটা দেখেছ? যে মাপের সুন্দরী ও যে ধরনের বোন্ড পোশাক পরে আছে, তাতে প্রথমেই মনে হয় মডেল! মডেল হলে এতদিনে তাকে খুঁজেও পাওয়া উচিত ছিল। কোনো সেলিব্রিটির ছবি হলেও গুগলই বলে দিত। তাছাড়া এমন মারকাটারি সুন্দরীকে কখনো কারোর চোখে পড়েনি তা হতেই পারে না। সেক্ষেত্রে খবরি নেটওয়ার্ক ঠিকই বলতে পারত। কিন্তু কোনোটাই হয়নি। আমিও বুঝতে পারছি না যে কেন এই মেয়েটাকে এতদিনেও পাওয়া গেল না! পুলিশ চাইলে কবর থেকেও মরা লোককে খুঁজে বের করে আনতে পারে! অথচ এই মেয়েটা পুরো ভ্যানিশ! তবে আমার দৃঢ় ধারণা, এ পাবলিক সে পাবলিক নয়। অন্য কারোর ফটো দিয়েছে। আর ছবির মেয়েটা কালো হলেও আসল মক্কেল ফরসা।

কাটা ঘুরেফিরে আবার সেই ফরসাতেই আটকাল! অর্ণব সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে সে স্মিত হাসলভেরি ইজি। একবার অপরাধীর দিক থেকে ভাবো। যেকোনো লিডই দেয় না, সে কখনো নিজের সম্পর্কে একটাও কু দেবে? সে তো আপ্রাণ চেষ্টা করবে আমাদের বিভ্রান্ত করার। প্রত্যেকটা তথ্য ভুল দেবে। আমার যেমন নিজের চেহারা প্রকাশ করার ইচ্ছে নেই, তেমনই সেও নিজেকে প্রকাশিত করার জন্য ব্যাকুল নয়। আমি পাবলিককে কনফিউজ করার জন্য টাকলুর ছবি দিয়েছি, যাঁর চেহারা সম্পূর্ণ আমার বিপরীত-সেও সেটাই করেছে। আমার ধারণা এ-ও সম্পূর্ণ বিপরীত। স্রেফ মিসলিড করছে। তার কপালে ভাঁজ পড়ে–কিন্তু মেয়েটাকে এখনও আমার চেনা চেনা লাগছে… কোথায় যে দেখেছি! এইরকম চুল…একদম এই চোখ…চাউনি…হাসি! দেখেছি শিওর! কিন্তু কোথায়…!

অর্ণব লক্ষ করেছিল অধিরাজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছবিটাকে খুঁটিয়ে দেখছে। বেশ কয়েক মিনিট চুপ করে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। তারপর খুব নিচু গলায় বলল–গোলমাল আছে অর্ণব! ছবিটাতে একটা বিরাট অসংগতি আছে। লক্ষ করেছ?

সে ছবিটার দিকে দেখল। এখনও পর্যন্ত কয়েকশো বার দেখেও কোনো অসংগতি তার চোখে পড়েনি। প্রশ্নটা করতেই যাচ্ছিল তার আগেই উত্তর দিয়ে দিল অধিরাজমেয়েটার রঙ গাঢ় কালো, চুল কোঁকড়া, কপাল উঁচু, নাকও মোটা-টিপিক্যাল নিগ্রোবটু চেহারা… স্ট্রেঞ্জ!

এতে স্ট্রেঞ্জের কী হলো! নিগ্রোবটু চেহারা হলে তো এমনই হবে। কিন্তু . এবারও প্রশ্নটা করার সুযোগ পেল না অর্ণব। প্রশ্নের আগেই ফের চলে এল উত্তর–নিগ্রোবটু চেহারায় ঠোঁট এত পাতলা হয় কী করে?

তাই তো! এটা আগে ভাবেনি সে। সত্যিই ছবির মেয়েটির ঠোঁট নিগ্রোদের তুলনায় পাতলা! যেটা হওয়া খুব স্বাভাবিক নয়। এই ধরনের মেয়েদের ঠোঁট অত্যন্ত মোটা হয়।

দাঁড়াও! দাঁড়াও…ওয়েট!

অধিরাজ ছবি দেখতে দেখতেই যেন একটা ঘোরে চলে গেল। অদ্ভুত আলো-ছায়া তার চোখে খেলা করছিল। কখনো যেন একটু উত্তেজনা, কখনো ফের সংশয়! দৃষ্টি কখনো তীব্র হয়ে উঠছে, কখনো বা সপ্রশ্ন! মস্তিষ্কের প্রত্যেকটি কোষে ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অমোঘ জিজ্ঞেস-কে?… কে?… কে?

খুব চেনা, অথচ চেনা নয়! হাসিটা যেন কোথাও দেখেছে! আগে কখনো…! কিন্তু কোথায়? কোথায়?

ওঃ…!

ছবিটা চোখ কুঁচকে দেখতে দেখতেই লাফিয়ে উঠল সে–আমি একটা গর্দভ! মাই গুডনেস!

স্যার! কখনো হাসি দিয়ে কোনো মানুষকে চিনতে পেরেছ অর্ণব?

বলতে বলতেই সে এক হাত দিয়ে মেয়েটার চোখ, নাক ঢেকে দিয়েছে। এখন শুধু তার হাসিটাই দেখা যাচ্ছে। অর্ণব দেখামাত্রই রীতিমতো শিউরে উঠল–স্যার…এ তো…!

ইয়েস! হ্যাঁলি বেরি! শুধু তাই নয়, বাকি পার্টসগুলোও অন্য কারোর। চোখ দুটো দেখো…। অধিরাজ এবার নাক, ঠোঁট ঢেকে দিয়েছে- কৃষ্ণসুন্দরীদের ফ্যান হলে এই কপাল, ভুরু আর সেক্সি আইজ চিনতে বাধ্য তুমি।

ধরা গলায় বলল অর্ণবলুপিতা নঙিয়ে!

এগজ্যাক্টলি! চুলটা আমার মনে হচ্ছে জ্যানেট জ্যাকসনের, নাকটা যে কার কে জানে। বডিটাও আই থিঙ্ক মেগান গুডের। এই ড্রেসে ওর ছবি দেখেছি! অধিরাজ স্থলিত স্বরে বলে–শুধু পুলিশ, সিআইডি, সিবিআই কেন! তাদের চৌদ্দ গুষ্টি, এমনকি স্বয়ং ভগবানও এ মেয়েকে খুঁজে পাবেন না! এ সুন্দরী বাস্তবে এক্সিস্টই করে না! সব কৃষ্ণসুন্দরীকে চমৎকারভাবে ফটোশপে পাঞ্চ করে, দুর্ধর্ষ এডিটিং করে আমাদের নাকে মোক্ষম পাঞ্চ বসিয়ে দিয়েছে! কী মারাত্মক ব্রেন!

দুই অফিসার কতক্ষণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে ছিল তা হয়তো নিজেরাই জানে না! অসম্ভব শকড হয়েছিল ওরা। কারণ আকাশ পাতাল খুঁড়ে যাকে খোঁজা হচ্ছে তার কোনো অস্তিত্বই নেই!

এই অবধি কি কম চমক ছিল যে এরপর একের পর এক শক আসতে শুরু করল! ড. চ্যাটার্জীর কনফিউশন! অ্যারোমা থেরাপি! এখন আবার বিজয় জয়সওয়ালের প্রত্যাবর্তন! ঠিক হচ্ছেটা কী!

অর্ণব টেনশন কমানোর জন্য বেশ কয়েকবার জোরে জোরে শ্বাস টানল। তারপর মেরিলিন প্ল্যাটিনাম টাওয়ারের দিকে এগিয়ে গেল দ্রুতবেগে। গন্তব্য বিজয় জয়সওয়ালের ফ্ল্যাট! কোথায় গিয়েছিলেন তিনি, এতদিন কোথায় ছিলেন, তাঁর গাড়িটাই বা কেন হাওয়া হলো, তার অজ্ঞাত প্রেমিকাই বা কে–সব প্রশ্নের জবাব একমাত্র তিনিই দিতে পারেন।

সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন–সর্বনাশিনী তাঁর নামেই বা আরআইপি পোস্ট দিল কেন?

সম্ভবত স্বয়ং বিজয় জয়সওয়ালও এর উত্তর দিতে পারবেন না!

*

ওঃ! আই অ্যাম ডাইং!

কুৎসিত লোকটা কাতর শব্দ করে ওঠে। তার সারা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। অবস্থা দেখলে বোঝা যায় তার শরীর যথেষ্টই খারাপ। বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। পেটটা থেকে থেকে চেপে ধরছে। গত কয়েক ঘণ্টায় খাবার তত দূর একফোঁটা জলও খেতে পারেনি। খেলেই পেটে একটা প্রবল যন্ত্রণা খিচ ধরাচ্ছে। কখনো বমি করছে, কখনো বা টয়লেটে দৌড়াচ্ছে। এখন অবশ্য সে শক্তিও আর নেই! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমাগতই দুর্বল হয়ে পড়ছে সে।

তার সামনে সিল্কের লাল টকটকে গাউন পরে বসে আছে সেই অনিন্দ্যসুন্দরী যুবতী। এই মুহূর্তে তাকে অপ্রতিরোধ্য ম্রাজ্ঞীর মতো দেখাচ্ছে! উদ্ধত, গর্বিত ভঙ্গিতে এমনভাবে বসে আছে যেন সমস্ত পৃথিবী অবিকল কার্পেটটার মতোই তার পদানত। সে মৃদু হাসল। তার কুশুভ্র দন্তপংক্তিতে সামান্য হিংস্রতা! কিন্তু ঠোঁটে সম্ভবত দুনিয়ার মধুরতম হাসিটি লেগে আছে। মিষ্টি রিনরিনে গলায় বলল–সামান্য স্টমাক আপসেটেই বাবুর এত কষ্ট!

এটা সামান্য! লোকটা অত্যন্ত কষ্টে বলল–পেটে অসম্ভব যন্ত্রণা! সুন্দরী খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে–এখন একটু হুইস্কি দিই? সঙ্গে কাবাব?

অসহায় মানুষটার চোখ বেয়ে জল পড়ে। এটা কি রসিকতা? না ব্যঙ্গ? এ কী ধরনের খেলা!

কী করতে পারি বলো তোমার জন্য? সে আবার মধুর কণ্ঠে বলল–একটা সুন্দর ম্যাসাজ দেব?

পুরুষটি কোনোমতে মাথা নাড়ে। মেয়েটি সকৌতুকে তাকে একঝলক দেখে নিয়ে রহস্যঘন কণ্ঠস্বরে বলল–সেক্স করবে?

মানুষটা কোনো উত্তর দিতে গিয়েও পারল না। বরং আবার কাতরে উঠল! যন্ত্রণা ক্রমাগতই বাড়ছে। বিবমিষার বেগ ফের পেট থেকে বুকে এসে চাপ মারছে! কে জানে ফুড পয়জনিং হলো কি না! এখন তার ম্যাসাজ বা সেক্সের দরকার নেই। বরং ওষুধ চাই। ডাক্তার দেখাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সে উপায় নেই। এখন তার পায়ে হেঁটে টয়লেটে যাওয়ার ক্ষমতাটুকুও নেই, ক্লিনিকে বা হসপিটালে যাবে কী করে? হাতের কাছে মোবাইলটা থাকলে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকা যেত। কিন্তু মোবাইল তো সঙ্গিনীর হেফাজতে। যেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল, তখনই ফোনটা নানাবিধ ছলা-কলায় নিয়ে নিয়েছিল সে। প্রেমে অন্ধ পুরুষ তাকে ফোনটা নির্বিবাদে দিয়েও দিয়েছিল। কিন্তু এখন শত অনুনয়েও ফোনটা ফেরত দিচ্ছে না ছলনাময়ী! স্রেফ মুচকি মুচকি হাসছে। অথচ সে নিজের স্ত্রী, সংসার ত্যাগ করে চলে এসেছিল তার টানে। সে আকর্ষণ যে কী অমোঘ তা আর কেউ বুঝবে না। মনে হতো, ওর জন্য স্ত্রী-সংসার কেন, সবকিছু ফেলে চলে যাওয়া যায়। আর সেই মেয়ে কি না বসে বসে তার যন্ত্রণা দেখছে!

লোকটার চোখ জলে ঝাপ্সা হয়ে যায়। এখন বুঝতে পারছে যে প্রাণের দায়, বড় দায়! সংসারে সব মানুষই আসলে নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। সে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে যেতে ভাবছিল, তার সঙ্গে ঠিক কী হচ্ছে! এই নারী তাকে নিয়ে ঠিক কী করতে চায়! আজ সকাল থেকেই তার প্রচণ্ড পেট ব্যথা–সঙ্গে বীভৎস বমি ও ডায়রিয়া। প্রথমে ব্যাপারটাকে নিতান্তই বদহজম ভেবেছিল। বিশেষ পাত্তা দেয়নি। কিন্তু যত সময় যেতে লাগল, ততই ব্যথাটা বাড়তে থাকল। ওষুধ খেতেই পারছে না। যা খাচ্ছে স্রেফ বমি হয়ে উঠে যাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে নির্ঘাৎ মরে যাবে!

মেয়েটা বোধ হয় তার মনের কথাটা বুঝতে পারল। ঠোঁট টিপে হেসে বলল সে–সে কি! মরতে ভয় লাগছে? কিন্তু তুমি যে বলেছিলে আমার জন্য প্রাণও দিতে পারো!

কথাটার মধ্যে অদ্ভুত এক ভয় এবং ভীষণ সারল্য যুগপৎ মিশে আছে। যেন চাইল্ডস প্লের সেই নিষ্পাপ পুতুলটা সরল অথচ নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে বলছে–হাই, আই অ্যাম টমি, অ্যান্ড আই অ্যাম ইওর ফ্রেন্ড টু দ্য এন্ড! কথাটা আপাত নিষ্পাপ, কিন্তু ভয়ংকর! তেমনই একটা হাড় কনকনে শীতলতা লুকিয়ে আছে মেয়েটির কথার মধ্যে।

লোকটার এবার সত্যিই ভয় করতে শুরু করল! মেয়েটা কী বলতে চাইছে? সত্যি সত্যিই মরে যাবে নাকি? নাঃ, নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছে। সে তো তাকে ভালোবাসে। তার জন্যই সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে এসেছে। এই সুন্দরীই তাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল অন্য কোথাও ঘর বাঁধার সেই স্বপ্নের টানে সমাজ, সংসারের তোয়াক্কা না করেই চলে এসেছে। বয়স্ক অসুন্দর স্ত্রী, ছকে বাঁধা একঘেয়ে জীবনযাপন কতদিনই বা ভালো লাগে তার মতো রঙিন মেজাজের মানুষের! তাই যখন ও জীবনে এল, তখন অনেক রঙিন স্বপ্নের জাল বুনেছিল সে। মনে হয়েছিল, মূর্তিমতী রোমাঞ্চ এসে গিয়েছে। মনে হয়েছিল, ওর জন্য প্রাণও বোধহয় দেওয়া যায়! আবেশে, আবেগে সেই কথাটা অনেকবার বলেছে। ওকে।

কিন্তু সত্যিই কি প্রাণ দিতে হবে! ভাবতেই মানুষটা কেঁপে ওঠে। কথাটা রসিকতা? না সত্যি! নয়তো অসহায় প্রেমিককে একটু সাহায্যও কেন করছে না এই নারী! সকাল থেকেই এমন কষ্ট হচ্ছে, অথচ সে শুধু স্থির দৃষ্টিতে মৃদু হাসতে হাসতে তার অবস্থা দেখে যাচ্ছে।

আবার একটা বমির দমক! আর সামলাতে পারল না মানুষটা! অসহ্য যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠেছে তার পাকস্থলী! কিছু বোঝার আগেই সে হড়হড়িয়ে অনেকটা বমি করে ফেলল দামি কার্পেটটার ওপরেই।

সুন্দরী তখনও একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে। খুব শান্ত কণ্ঠে বলল–নো প্রবলেম। আমি কয়েকদিন পরেই কেচে দেব। তুমি মহানন্দে ওটাকে নোংরা করতে পারো। প্রেমের জন্য এটুকু কষ্ট তো করতেই পারি।

প্লিজ…আমার ফোনটা…ড….অ্যাম্বুলেন্স…!

অতিকষ্টে কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারল লোকটি। এখন আস্তে আস্তে তার জীবনীশক্তি কমে আসছে। চোখের সামনে অস্বচ্ছ অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। শরীরটা যেন অবশ…!

মৃত্যুর রং কী জানো? কালো!

মেয়েটি অল্প অল্প দুলছে। তার দুচোখে খরদৃষ্টি। ভীষণ অস্বাভাবিক কণ্ঠে বলল–মরে গেলে লোকে চোখে অন্ধকার দেখে। অন্ধকার কালো। মরার পর পুড়ে গেলে সবাই ছাই হয়ে যায়। ছাইয়ের রঙও কালো…।

বলতে বলতেই তার দুচোখ দপ করে জ্বলে ওঠে। ভীষণ নিষ্ঠুর কণ্ঠে একরাশ জ্বালা এবং আক্রোশ উগরে দিয়ে বলে সে

তবে কালো রং নিয়ে তোমাদের এত প্রবলেম কেন?

এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। লোকটি সামান্য কেঁপে ওঠে। কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরোয় না। মেয়েটি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চাউনি অপলক, অথচ নিষ্প্রাণ। সে চোখে কোনো দুর্বলতা, কোনো প্রেম নেই। বরং যেন আগুন জ্বলছে ধকধক করে। সে জানে, পুরুষটি এখনই মরবে না। আরও অন্তত কয়েকঘণ্টা বাঁচবে সে। তবে আগের দুজনের চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি মরবে। পুলিশ এখন অনেক বেশি সতর্ক হয়ে গিয়েছে। তাই আর চান্স নেওয়া ঠিক হবে না।

ভাবতেই তার মুখে ফের একটা রহস্যময় হাসি উঠে আসে। পুলিশ ভাবছে এবার হয়তো লোকটাকে বাঁচানো গেল। ওরা বিজয় জয়সওয়ালকে ফিরে পেয়ে নিশ্চয়ই হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। কিন্তু বেচারারা জানে না যে…!

সে অলস দৃষ্টিতে দাবার ছকটার দিকে তাকায়। শেষ দানটা এখনও দেওয়া হয়নি।

*

এটাই বাকি ছিল?

হসপিটালের মার্বেল বাঁধানো করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই অধিরাজ হতাশভাবে মাথা ঝাঁকায়-ফের সব ঘেঁটে গেল! এখনও কিছুই বুঝতে পারছি না। শেষ আশা ছিল বিজয় জয়সওয়ালের বয়ান। সেটাও গেল!

অর্ণবও দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সত্যিই মাঝখানের দুদিন নেহাতই বিফলে গেল। ব্যক্তিগতভাবে তার মনে হয়েছিল যে হয়তো কিছু প্রশ্নের জবাব বিজয় জয়সওয়াল নিজেই দিতে পারবেন না। কিন্তু তিনি যেকোনো প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারবেন না তা কে জানত! যখন অর্ণব তাঁর বাড়িতে গিয়েছিল তখন ভদ্রলোক রীতিমতো ঝিমোচ্ছিলেন। প্রাথমিকভাবে সে একটু বিস্মিত হয়। মি. জয়সওয়ালসাত সকালেই মদ্যপান করে বসে আছেন নাকি?

মিসেস মানসী জয়সওয়ালও মুখভঙ্গি করে বলেছিলেন–কীসে কুঁদ হয়ে আছে কে জানে! কোনো প্রশ্নেরই জবাব দিচ্ছে না। আজ সকালে টলতে টলতে বাড়ি ফিরল। তারপর থেকেই এই অবস্থা।

অর্ণব লক্ষ্য করে সত্যিই বিজয় কেমন থম্ মেরে বসে আছেন। তাঁর চোখদুটো খোলা। কিন্তু চাউনিটা অস্বাভাবিক। যেন কিছুই দেখছেন না। সম্পূর্ণ বোধহীন একটা পুতুলের মতো চুপ করে লক্ষ্যহীনভাবে তাকিয়ে আছেন। অর্ণব দুই-চারটে প্রশ্ন করলেও কোনো জবাব দিলেন না। তিনি কিছুই শুনছেন না, কিছুই বলছেন না। তাঁর স্ত্রী মানসী খনখন করে ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন–ফিরে আসার পর থেকে এই একই ড্রামা চলছে! কোন্ দুনিয়ায় আছে জানি না। আমাকে তো কিছু বললই না! এখন আপনাকেও উত্তর দিচ্ছে না। যদি দেয় তবে জিজ্ঞেস করবেন যে এতদিন কোন চুলোয় ছিল! আর গিয়েছিলই যখন, তখন ফের কোথা থেকে টপকে পড়ল!

বাপ রে! কী জাদরেল মহিলা! কথাটা ছুঁড়ে দিয়েই তিনি রেগেমেগে গটগটিয়ে চলে গেলেন। অবস্থা দেখে চাকর-বাকর-বাটলাররাও কেটে পড়ল। অর্ণব মহা আতান্তরে পড়ে। এখন এই ল্যাম্পপোস্টটিকে নিয়ে কী করবে! মি, জয়সওয়াল তখনও স্ট্রেট উর্দু চক্ষু হয়ে আছেন। বোধহয় তুরীয় দশা প্রাপ্ত হয়েছেন! অর্ণবের মনে হলো, হয়তো স্ত্রীর জ্বালায় বিরক্ত হয়ে তিনি সব ছেড়েছুঁড়ে হিমালয়েই চলে গিয়েছিলেন। অন্তত ভাবসাব তো তেমনই। তাঁর গালের অযত্ন লালিত দাড়ি, পরনের মলিন পরিচ্ছদও প্রায় বৈরাগ্যেরই সাক্ষ্য দেয়। সে বেশ কড়া পুলিশি ভঙ্গিতে আবার র‍্যান্ডম কিছু প্রশ্ন করে গেল। কোথায় গিয়েছিলেন? এতদিন কোথায় ছিলেন? আপনার সেলফোন বন্ধ করেছিলেন কেন? গাড়িটা কোথায়? ইত্যাদি ইত্যাদি। মাঝখানে আবার মিসেস জয়সওয়াল হাউমাউ করে টর্নেডো এন্ট্রি মেরে খাঁচাচে স্বরে বললেন–এসব পরে জিজ্ঞেস করবেন। তার আগে জিজ্ঞেস করুন কোন্ কুত্তিটার সঙ্গে গিয়েছিল, হ্যাঁ?

সর্বনাশ! অর্ণব মনশ্চক্ষে দেখল মানসী জয়সওয়াল নন, তার জায়গায় ড. চ্যাটার্জী এসে দাঁত খিচোচ্ছেন! এই জাতীয় ক্যারক্যারে গলায় কথা বললে মড়া মানুষও বোধহয় লাফ মেরে উঠে বসবে। অথচ ভদ্রলোক যেন পাত্তাই দিলেন না! কথা বলা তো দূর–সে মাল নট নড়ন চড়ন, নট কিচ্ছু!

ঘাবড়ে গিয়ে সে অধিরাজকেই ফোন করেছিল। প্রায় নিরূপায়ের মতোই বলল–স্যার, বিজয় জয়সওয়াল তো কোনো কথারই উত্তর দিচ্ছেন না!

অধিরাজ বিস্মিত–উত্তর দিচ্ছেন না মানে? উত্তর দিতে অস্বীকার করছেন?

 তাও না! অস্বীকার করতে হলেও তো কথা বলতে হবে। ইনফ্যাক্ট তিনি কথাই বলছেন না! ও চাপাস্বরে বলে–হাবভাবও কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। পুরো চুপচণ্ডী। কোনো কথাতেই কোনো রি-অ্যাকশন নেই। বোধহয় আপনমনেই সেফ ভাবছেন এবং ভেবেই চলেছেন।

অধিরাজ প্রায় আকাশ থেকে পড়ে যাচ্ছিল! এর মানেটা কী! মৌব্রত নিয়েছেন? না জুয়েলারির ব্যবসা ছেড়ে কবি হওয়ার তাল করছেন!

আমি জানি না স্যার। অর্ণব জানায়–কেমন যেন গুম মেরে বসে আছেন।

ও প্রান্তে কিছুক্ষণ নীরবতা। সম্ভবত অধিরাজও এমন খবরের জন্য প্রস্তুত ছিল না! কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল–অর্ণব, আমার লক্ষণ ভালো ঠেকছে না। বিজয় জয়সওয়াল বাড়ি ফিরে এসেছেন মানে এই নয় যে তিনি সম্পূর্ণ বিপন্মুক্ত! আপাতদৃষ্টিতে কোনোরকম দৈহিক অসুস্থতা বুঝতে পারছ?

অসুস্থ নন্, অস্বাভাবিক!

অস্বাভাবিকতাও ঠিক নয়। আমরা এখনও জানি না যে কী বিষ দেওয়া হচ্ছে, বা মার্ডারারের মোডাস অপারেন্ডি কী! সেটা সবকিছু হতে পারে! এমনকি কোনো স্লো পয়জন হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। হয়তো বিষটা অলরেডি দেওয়া হয়ে গিয়েছে। আর এটা হয়তো তারই প্রিলিমিনারি এফেক্ট। চান্স নেওয়া উচিত হবে না! বলতে বলতেই অধিরাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে–আমি এখনই টাকলুর সঙ্গে আসছি অ্যাম্বুলেন্স সমেত। মি. জয়সওয়ালকে ইমিডিয়েটলি হসপিটালাইজড করতে হবে। তার আগে ড. চ্যাটার্জী একটু স্যাম্পল নিয়ে নেবেন। তারপরই ওঁকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হবে। তুমি এখন ওখান থেকে কোথাও নড়বে না। লক্ষ রাখবে এর মধ্যে আর কোনোরকম পরিবর্তন বা সিম্পটম দেখা যায় কি না। কোনোরকম বেগতিক দেখলেই জানাবে। আর কেউ যেন মি. জয়সওয়ালকে এর মধ্যে কোনো ড্রিঙ্ক বা খাবার না দেয়, সেদিকে সতর্ক নজর রেখো। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছচ্ছি।

ও কে স্যার।

ফোনটা নামিয়ে রেখে অর্ণব ফের মি. জয়সওয়ালের দিকে তাকায়। তিনি এখনও রাত জাগা পাচার মতো গোল গোল চোখ করে বসে আছেন। স্বাভাবিকতার বিন্দুমাত্রও লক্ষণ নেই। মিসেস জয়সওয়াল তাঁর দিকে তাকিয়ে মুখ ভেটকে আছেন। বিড়বিড় করে একবার বললেন–ফিল্মে নামলে অস্কার বাঁধা ছিল। কিন্তু কার উদ্দেশ্যে বললেন কে জানে!

অর্ণব আড়চোখে ভদ্রমহিলাকে জরিপ করতে থাকে। আগেরবার তার যে কথাটা মনে হয়েছিল, আজও তাই হলো। মানসী জয়সওয়াল যতক্ষণ মুখ না খোলেন ততক্ষণ সত্যিই মারকাটারি সুন্দরী! যেমন ডালিমের মতো রং, শ্বেতপাথরের মতো মসৃণ ত্বক, তেমন চোখা চোখা মুখ, তেমনই দুরন্ত ফিগার! মেহগনি রঙের লম্বা চুল! প্রায় পাঁচ ফুট সাত কি আট ইঞ্চি লম্বা। নির্মেদ শরীর। ওঁকে দেখলে যে কেউ প্রেমে পাগল হবে। তার ওপর স্লিভলেস নাইটির ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে শ্বেতপাথরের মতো বাহুযুগল। ডান বাহুতে আবার একখানা ট্যাটু করিয়েছেন! ট্যাটুটা কাঁকড়াবিছের! প্রথম দর্শনে ট্যাটুটা দেখে অবাক হয়েছিল সে। এরকম সুন্দরীর বাহুমূলে কাঁকড়াবিছে কেন? মুখ খোলার পর অবশ্য কারণটা বুঝেছে। যতই সুন্দরী হোন, ভদ্রমহিলা ভালোই হুল দিতে জানেন!

তিনি ঠিক কবে বেরিয়েছিলেন মনে আছে আপনার?

বহুবার করা প্রশ্নটা আবার রিপিট করল অর্ণব।

বারবার একই কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন? এই দেখুন। ভদ্রমহিলা এবার রেগে গিয়ে নিজের অত্যন্ত দামি মোবাইলটা এগিয়ে দিলেন তার দিকে। অর্ণব দেখল, তাতে একটি মেসেজে পরিষ্কার করে লেখা আছে–মানসী, আমি জরুরি একটা ট্যুরে বেরোচ্ছি। তুমি ঘুমাচ্ছ বলে ডিস্টার্ব করলাম না–বিজয়। মেসেজটা এসেছে এগারো তারিখ ভোর চারটে বাজতে পাঁচে।

এখনও কি আপনার মাথাতে ব্যাপারটা ঢোকেনি? মানসী এক গঙ্গা কথা বলতে শুরু করলেন–দেখুন, আপনাকে অলরেডি এই কয়েকঘণ্টায় পাঁচশ পঁয়ষট্টি বার বলেছি যে তিনি কখন যান, কোথায় যান, কার কাছে যান–আমায় কখনই কিছু বলেন না। তিনিও বলার প্রয়োজন বোধ করেন না। আমিও জিজ্ঞেস করি না। তিনিও বিজি। আমিও বিজি। আমার হার্বাল বিউটি প্রোডাক্টের বিজনেস। ওঁর পায়ে পায়ে ঘুরে গোয়েন্দাগিরি করার সময় নেই। আন্দাজ এই মাসের এগারো তারিখ ভোর রাতেই তিনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আমি ঘুমিয়েছিলাম। আমার ফোনে এই মেসেজটা করে জানান যে জরুরি ট্যুরে যাচ্ছেন। বিজয় এরকম প্রায়ই করে থাকেন। তাই আমি আদৌ ওরিড় হইনি! তাছাড়া ওঁকে নিয়ে ভাবার সময়ও নেই। আমার নিজস্ব বিজনেস আছে।

হার্বাল বিউটি প্রোডাক্ট? অর্ণব বেচারা তোপের লাগাতার গর্জনের মুখে কী করবে বুঝে পাচ্ছিল না। অসহায়ের মতো মিনমিনিয়ে কোনোমতে প্রশ্নটা করল সে।

হ্যাঁ। নানারকমের বিউটি প্রোডাক্ট। জেনারেল ক্রিম, লোশন, ফেশিয়াল, স্পায়ের নানান কিটস ছাড়াও অ্যারোমা প্রোডাক্টের বিজনেসও করি।

অ্যারোমা শব্দটা শুনেই সচকিত হয়ে ওঠে সে। ড. চ্যাটার্জী অ্যারোমা অয়েলের কথা বলেছিলেন! আবার তিনিও অ্যারোমা প্রোডাক্টের ব্যবসা করেন! ব্যাপারটা কী!

আপনার অ্যারোমা প্রোডাক্টের বিজনেসও আছে?

মানসী প্রশ্নটা শুনে এমন মুখভঙ্গি করেছেন যেন পারলে এখনই ফুটন্ত অ্যারোমা অয়েলের কড়াইয়ে ফেলে দেন অর্ণবকে। কটমট করে তাকিয়ে বললেন–শুধু বিজনেস নয়, আমি নিজের ল্যাবে প্রোডাক্টগুলো তৈরি করি। নিশান অ্যারোমা ইন্ডাস্ট্রির নাম শোনেননি? পাশাপাশি আমাদের বিউটি ক্লিনিক, স্পাও আছে।

কথা তো নয়, যেন কাঁকড়াবিছের হুল! অর্ণব ঢোক গিলল! নিশান অ্যারোমা ইন্ডাস্ট্রির নাম না শুনে সে যে ভয়ংকর পাপ করেছে তাতে সন্দেহ নেই। তারও দোষ নেই। এসব স্পা, স্যালুন বা অ্যারোমা জাতীয় রূপচর্চার বিষয় তার মাথার ওপর দিয়েই যায়। এতদিন ধারণা ছিল, শুধু মেয়েরাই এসব করে। এখন তো দেখছে, পুরুষরাও কিছু কম যায় না। এই কেসটা না এলে এতকিছু জানাই হতো না।

আপনি পারলে একবার একটা ম্যাসাজ নিয়ে নিন। এতক্ষণে মিসেস জয়সওয়ালের কণ্ঠস্বর একটু নরম হলো–আপনার অরিজিনাল কমপ্লেক্সন ফেয়ার। কিন্তু কিছুটা ট্যানড় হয়ে গিয়েছে। ম্যাসাজ আর স্পা করালে খানিকটা ডি-ট্যানড হয়ে যাবেন। স্কিনও একদম স্মথ হয়ে যাবে। নিজের স্কিনকে নিজেরই ভালোবাসতে ইচ্ছে করবে। তাছাড়া আপনাদের চাকরিতে স্ট্রেসটাও ফ্যাক্টর। সেটাও অনেকটা কমবে।

সেরেছে! মহিলা যে এবার ম্যাসাজ আর স্পা নিয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন। অর্ণব মনে মনে বিরক্ত হয়। নিজের স্বামীকে নিয়ে চিন্তা নেই, সিআইডি অফিসারের ত্বক নিয়ে যত মাথাব্যথা! এ ধরনের খেজুরে পিরিতের কোনো মানে হয়! কী পাঞ্চাইন! নিজের স্কিনকে নিজেরই ভালোবাসতে ইচ্ছে করবে! ইনি যে আদতে একজন বিজনেস ও-ম্যান হবেন তাতে আর আশ্চর্য কী!

সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিজয় জয়সওয়ালের দিকে তাকিয়েছিল। লোকটা এখনও সেই একই ভঙ্গিতে বসে আছে! একটুও হেলদোল নেই। কী রে বাবা! এ যে পুরো জড়ভরত! অর্ণবের মনে মিসেস জয়সওয়ালের সন্দেহটাই ঘনিয়ে আসে। সত্যি সত্যিই কি তিনি সজ্ঞানে নেই? নাকি অ্যাকটিং করছেন!

অবশ্য তাকে আর বেশি কিছু ভাবতে হলো না। মিনিট দশেকের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স এবং ড. চ্যাটার্জীকে নিয়ে অধিরাজ উপস্থিত। বিজয় জয়সওয়ালের অবস্থা দেখে ড. চ্যাটার্জীর চক্ষু চড়কগাছ! কুটি করে বললেন–এ কী! এ তো পুরো স্ট্যাচু! কখন থেকে এই অবস্থা?

মিসেস জয়সওয়াল ড. চ্যাটার্জীর থেকেও ভয়ংকরভাবে ভুরু কুঁচকে বললেন–সকাল থেকেই এই অ্যাকটিং চলছে!

ড. চ্যাটার্জী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত ভদ্রলোকের অবস্থা জরিপ করেন। কিছুক্ষণ তার চোখে জোরালো টর্চ মেরে দেখলেন। ব্লাডপ্রেশার আর পালস রেট চেক করলেন! তারপরই কথা নেই বার্তা নেই বিদ্যুৎবেগে সপাটে এক বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়…!

অধিরাজ হাঁ হাঁ করে ওঠে–আরে! কী করছেন, কী করছেন…! অর্ণবও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই মিসেস জয়সওয়াল বলে। উঠলেন–বেশ হয়েছে। পারলে আমার তরফ থেকে আরও একটা।

স্বয়ং ড. চ্যাটার্জিও তাঁর কথা শুনে ঘাবড়ে গিয়েছেন। মহিলাদের মধ্যেও যে তাঁর মতো এক পিস থাকতে পারে, তা হয়তো আশা করেননি। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন–কী!

কিছু না! শেষ পর্যন্ত অধিরাজই তাঁকে উদ্ধার করে–কী বুঝলেন আপনি?

ড. চ্যাটার্জীর মুখ চিন্তান্বিত–ভেবেছিলাম হিপনোটাইজড কি না। কিন্তু একটা সজোর থাপ্পড় খেয়েও এ পাবলিক নট আউট! ভালো বুঝছি না। হসপিটালাইজড করাই ভালো।

মানে! অধিরাজের চোখে বিপন্নতা–হিপনোটাইজড ন? তবে কী?

ড. চ্যাটার্জী সিরিঞ্জ আর ব্লাড স্যামপ্লের শিশি বের করে স্যাম্পল নিতে নিতে বলেন–এখনই হাতে সেরকম কোনো প্রমাণ নেই। ব্লাড রিপোর্ট এলে পরিষ্কার বলতে পারব। কিন্তু মাথায় এই টাকটা তো এমনি এমনিই পড়েনি। এই তেলো হাঁড়ির মধ্যে প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে। সিম্পটমগুলো দেখে রিপোর্টে কী আসবে তা এখনই বলতে পারি। কোনো বিষ থাকলে অবশ্য সেটা বলতে পারব না। কিন্তু তার সঙ্গে যা আসবে তা খানিকটা বুঝে গিয়েছি।

কী?

আ ভেরি স্ট্রং ডোজ অব ডেট-রেপ ড্রাগ। ড. চ্যাটার্জী ব্লাড স্যাম্পল এভিডেন্স ব্যাগে পুরে টাকটাকে ফের আদর করতে শুরু করেছেন- ওঁর এই অবস্থা এমনি এমনিই হয়নি। চোখের তারা একদম স্থির। টর্চের আলোয় পিউপিলস একটু কুঁকড়ে গেল ঠিকই কিন্তু তিনি চোখের পাতাটুকুও ফেললেন না! ব্লাডপ্রেশার আর পালস রেটও লো। এই লেভেলের অ্যাকটিং কোনো অস্কার বিজয়ী অভিনেতাও করতে পারবেন না। আমার ধারণা ব্লাডে এবং ইউরিনে এইরকম একটা ড্রাগই পাওয়া যাবে। মোস্ট ব্যাবলি, রোহিপ্ন! মোস্ট নটোরিয়াস ডেট-রেপ ড্রাগ।

অধিরাজের মুখে চিন্তার ছাপ। লোকটাকে শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গুল দেওয়া হলো! রোহিপ্ন বা ডেট-রেপ ড্রাগের কেস সে বেশ কয়েকটা স্বচক্ষেই দেখেছে। সচরাচর এগুলো সেক্ট্রয়াল অ্যাসল্ট বা রেপ কেসের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এর বিশেষত্বই হলো যে ভিকটিম ঘটনার পরে কিছুই মনে করতে পারে না! সে কোথায় গিয়েছিল, কী করেছিল, কার সঙ্গে দেখা করেছে–বিগত দিনগুলোর কিছুই তার স্মরণে থাকে না। হ্যালুসিনেট করে, ব্ল্যাক-আউট হয়, কনফিউজড হয়ে যায়, কখনো বা এরকমই স্তব্ধ-জড়ভরত হয়ে বসে থাকে। অতীত তার কাছে অন্ধকার! এমনকি বর্তমানও আবছা! বিজয় জয়সওয়ালও এখন তেমনই কোনো ড্রাগের ঘোরে আছেন।

সে উ, চ্যাটার্জীর দিকে তাকায়–তার মানে…?।

তার মানে পণ্ডশ্রম। তিনি তোমার একটি প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারবেন। কারণ যে ওঁকে লোপাট করেছিল সে সম্ভবত এতদিন ধরে ড্রাগের ডোজ। অল্প অল্প করে দিয়ে গিয়েছে। নয়তো এত খারাপ অবস্থাও হওয়ার কথা নয়। আমার আশঙ্কা তিনি কোথা থেকে লোপাট হয়েছিলেন, কীভাবে ফিরলেন, কোথায় ছিলেন–ব্লা…ব্লা…ব্লা… তোমাদের একটি প্রশ্নের উত্তরও ওঁর কাছে নেই। হি ইজ জাস্ট লাইক আ ব্ল্যাঙ্ক পেজ।

অধিরাজ বুঝতে পারল সে আবার একটা ডেড এন্ডের সামনে এসে পড়েছে! এটা কি শেষমেষ ব্লাইন্ড কেস হতেই চলেছে? একমাত্র একটাই ক্ষীণ আশা ছিল যে বিজয় জয়সওয়াল হয়তো কিছু বলবেন। কিন্তু সে সম্ভাবনাও এখন বিশ বাঁও জলে! মি. জয়সওয়াল তো এটাও বলতে পারবেন না যে এগারো তারিখ ভোরে তিনি কোথায় গিয়েছিলেন! সিকিউরিটি গার্ড ও গেটকিপারের বয়ান অনুযায়ী মি. জয়সওয়ালের গাড়িটা মেইন গেট দিয়ে ঠিক ভোর চারটে নাগাদ বেরিয়েছিল। কিন্তু তারপর? গাড়িটাই বা গেল কোথায়!

লোকটাকে আগে বাঁচানো দরকার? ড. চ্যাটার্জী বললেন হসপিটালাইজড করে ডাক্তারদের সমস্ত ইনভেস্টিগেশন করতে বলল। হয়তো ওঁকে বিষটাও দেওয়া হয়েছে যেটার প্রতিক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি। বিষ যদি

দেওয়াও হয়, ড্রাগের ওভার ডোসেজও সুবিধার বিষয় নয়। আর এক মুহূর্তও দেরি করা ঠিক হবে না রাজা।

ড. চ্যাটার্জীর মতামতকে কখনই উপেক্ষা করে না অধিরাজ। সঙ্গে সঙ্গেই বাইরে অপেক্ষারত অ্যাম্বুলেন্স বিজয় জয়সওয়ালকে নিয়ে গেল। মিসেস জয়সওয়ালও কোনো সমস্যা করলেন না। বরং লক্ষ্মী মেয়ের মতোই কো অপারেট করছিলেন। অর্ণব অবশ্য তার ভয়েই কাঁটা হয়ে ছিল। মানসী জয়সওয়াল যেভাবে অধিরাজকে দেখছিলেন, মনে হচ্ছিল এখনই এক গ্লাস জল দিয়ে গিলে খাবেন। অর্ণব ভাবছিল, এই বুঝি তিনি স্যারকে ম্যাসাজের জন্য টেনেই নিয়ে গেলেন! একবার তো বলেই বসেছিলেন–আপনি রেগুলার বডি স্পা, হেয়ার স্পা করেন–তাই না? চোখের পাতায় কী লাগান? ক্যাস্টর অয়েল!

আজ্ঞে না। অধিরাজ ড. চ্যাটার্জীর সঙ্গে নিচু স্বরে কিছু একটা আলোচনা করছিল। কথাটা শুনে মিসেস জয়সওয়ালের দিকে তাকিয়ে শিশুসুলভ হাসল–ওসব করি না। সময় নেই।

সে কী! মানসী বিস্মিত–বোঝা যায় না তো!

ড. চ্যাটার্জী হেয়ার স্পা শুনেই বোধহয় গরম হয়ে গিয়েছিলেন। কড়কড় করে উঠে বললেন–এসব ম্যান মেড নয়। ওপরওয়ালাই সব স্পা-রে-গা-মা করেই ওকে পাঠিয়েছেন। বুঝেছেন?

মিসেস জয়সওয়াল তাঁর দিকে তাকিয়েছেন–তবে আপনিই ম্যান মেড হেয়ার গ্রোয়িং সলিউশন টেস্ট করে দেখুন না। আমাদের বিউটি ক্লিনিকে অ্যালোপেশিয়ারও ট্রিটমেন্ট হয়। আপনাকে তো আর ওপরওয়ালা দেননি। আমরাই নয় চুল বসিয়ে দেব। ম্যানমেড।

অর্ণব আর অধিরাজ দুজনেই এবার প্রমাদ গুনল। ড. অসীম চ্যাটার্জী খেপে খাঞ্জা খা হয়ে কিছু একটা চরম কথা বলতেই যাচ্ছিলেন। তার আগেই লাফ মেরে তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে অধিরাজ। ড. চ্যাটার্জীকে পিঠের আড়ালে রেখে বলে উঠল–অফকোর্স তিনি ট্রাই করবেন ম্যাম্। আপনার কার্ড পাওয়া যাবে? পার্সোনাল নম্বর?

মানসী রক্তিম ঠোঁট মুচড়ে রহস্যমাখা হাসলেন–শিওর। তারপরই কেমন যেন সখী ধরো ধরো স্টাইলে চলে গেলেন। অধিরাজের পেছনে দাঁড়িয়ে রাগে হুমহাম করছিলেন ফরেনসিক এক্সপার্ট। ভদ্রমহিলা চলে যেতেই রেগেমেগে বললেন–এটা কী হলো?

অধিরাজ নিরীহ মুখভঙ্গি করেছে–কেন? মাথায় চুল গজানোর একটা স্কোপ পেয়েছেন, চান্স নেবেন না?

চান্স তো তিনি মারছেন! রাগে, অপমানে ওঁর মুখ বেগুনি-চুল নয়, অন্য কিছুর চান্স! তাও তোমার সঙ্গে! লজ্জা করে না? মহিলা তোমার মায়ের বয়সি!

সে মাথা চুলকাতে চুলকাতে লাজুক হাসল–না না। অত নয়। আপনি একটু বাড়িয়েই বলছেন।

মহিলা বিবাহিত!

তাতে কী? দারুণ সুন্দরী। নিরুত্তাপ উত্তর– আমি একটু সুন্দরী মেয়েদের কার্ড চাইতে পারি না?

না! পারো না! হুমহুম করে বললেন তিনি–এই কেসটায় পড়ে তুমি বিগড়ে যাচ্ছ!

কী মুশকিল! অধিরাজ হেসে ফেলল–এদিকে আপনি সুন্দরী মেয়ে দেখে বিগড়ে যাওয়ার কথা বলছেন। ওদিকে অর্ণব বলছে, ওর স্পেশাল কেউ নাকি আমি! দুজনে মিলে শুরুটা করেছেন কী?

অর্ণবের কান লজ্জায় লাল হয়ে যায়। কী কুক্ষণে যে মুখ ফস্কে কথাটা বলে ফেলেছিল! অসীম চ্যাটার্জী কিছু বলতে গিয়েও চেপে গেলেন। মিসেস জয়সওয়াল এদিকেই ক্যাটওয়াক করতে করতে আসছেন। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চাপা গলায় স্বগতোক্তি করেন–পুরো ঘেমে নেয়ে গেলাম যে! এই ভ্যাম্পটা কি র‍্যাম্পে হাঁটছে?

এই নিন। কার্ডটা সযত্নে অধিরাজের হাতে তুলে দিলেন মানসী। এই সুযোগে হাতে হাত, আঙুলে আঙুল স্পর্শ করল। অধিরাজ মিষ্টি হেসে বলল–থ্যাঙ্ক ইউ।

অলওয়েজ ওয়েলকাম।

মি, জয়সওয়ালের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে ড. চ্যাটার্জী যেন হাঁফ ছাড়লেন। অধিরাজ ভদ্রমহিলার কার্ডটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। তার ভুরুর মাঝখানে ফের চিন্তার ভাঁজ। সেটা লক্ষ করেই ড. চ্যাটার্জী বলে ওঠেন–কী দেখে এত চিন্তিত হয়ে পড়লে? কার্ডটাতে কি মহিলার ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স লেখা আছে?

সে ব্যঙ্গটাকে উড়িয়ে দিয়ে চিন্তিত স্বরে বলল–না, ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স নয়, ওঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা লেখা আছে। মিসেস মানসী জয়সওয়ালএকজন স্কলার মহিলা। পিএইচডি ইন বটানি। ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ড থেকে ডিগ্রি আর সোনার মেডেল এনেছেন। এককথায় তিনি একজন অত্যন্ত প্রতিভাময়ী উদ্ভিদবিশারদ!

হোয়াট! ড. চ্যাটার্জী প্রায় লাফিয়েই ওঠেন–এটার জন্যই কার্ড চেয়েছিলে?

আজ্ঞে। সে নম্রভাবেই জানায়–কাউকে তো আর মুখের ওপরে জিজ্ঞেস করা যায় না, আপনি কী নিয়ে পড়াশোনা করেছেন! সন্দেহ করবে। সেজন্যই কার্ড চেয়েছিলাম। সবাই অবশ্য শিক্ষাগত যোগ্যতা কার্ডে লেখে না। কিন্তু তিনি একটু অন্যরকম চরিত্রের। নিজেকে জাহির করার মানসিকতা আছে

ওঁর। সেজন্যই চান্স নিয়েছিলাম। আর ঢিলটা ঠিকই লেগেছে।

তার মানে তিনি একাই চান্স নিচ্ছিলেন না, তুমিও নিচ্ছিলে! কী পাজি ছেলে রে বাবা!

ড. চ্যাটার্জীর কথার উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসল অধিরাজ। অর্ণবের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল–ওঁর চারপাশে ফিল্ডিং বসিয়ে দাও অর্ণব। আমাদের ইপ্সিত নারীটির সঙ্গে ভদ্রমহিলার প্রোফাইল খাপ খাচ্ছে। বয়স একটু বেশি হলেও বোঝা যায় না।

তার কথামতো সেদিন থেকেই নিয়ম করে মিসেস জয়সওয়ালের ওপর নজর রাখছে প্লেন ড্রেসের মহিলা অফিসাররা। মি. জয়সওয়াল ফিরে আসার পর আটচল্লিশ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। কিন্তু কোনোদিকেই কোনো সূত্র পাওয়া যাচ্ছে না। মানসী জয়সওয়ালের গতিবিধির মধ্যে তেমন কোনো অস্বাভাবিকতা পাওয়া যায়নি। নিয়মিত অফিস, বাড়ি, কনফারেন্স করে বেড়াচ্ছেন। হসপিটালে স্বামীকে ভিজিটিং আওয়ারে দেখতেও এসেছেন। এছাড়া তাঁর আর কোনো মুভমেন্ট বিশেষ নেই। ফোন রেকর্ডও ক্লিন।

গত আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে অবশ্য তিনটে জিনিস হয়েছে। প্রথমতঃ মি. জয়সওয়ালের রক্ত পরীক্ষা করে ফলাফল জানিয়েছেন ড. চ্যাটার্জী। যথারীতি মি. জয়সওয়ালের ব্লাডে কোনো বিষের অস্তিত্ব নেই, তবে খুব বেশি মাত্রায় রোহিপ্নলের ট্রেস পাওয়া গিয়েছে। ওঁর ব্লাডে অত্যন্ত বেশি মাত্রায় অ্যালকোহলও আছে। সম্ভবত অ্যালকোহলের সঙ্গেই রোহিপ্ন দেওয়া হয়েছে তাঁকে। বিজয় জয়সওয়াল ডাক্তারদের পরিচর্যায় এখন খানিকটা সুস্থ। অত্যন্ত স্বস্তির কথা যে তার লিভার ঠিকঠাকই আছে। রেনাল ফাংশনও যথেষ্ট ভালো। অর্থাৎ কোনোরকম অঘটন ঘটার সম্ভাবনা নেই।

দ্বিতীয়ত, সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্ট আইপি সুফিঙের যত কেস রেকর্ডে ছিল, সব পাঠিয়েছে। প্রাথমিকভাবে প্রায় দুশো হ্যাকারের প্রোফাইল এসেছিল ওদের কাছে। তার মধ্যে বেশ কিছু প্রতিভাবান হ্যাকারদের গোয়েন্দা বিভাগ নিজেদের কাজে লাগিয়েছে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এখন সাইবার সেলের কর্মী। বাকিদের মধ্যে অনেকেই বর্তমানে বিদেশে বা কলকাতার বাইরে প্রতিষ্ঠিত। তারা এ জাতীয় বদমায়েশি করে নিজেদের দুর্দান্ত ক্যারিয়ার বরবাদ করবে বলে মনে হয় না। অতএব, তাদের বাদ দিয়ে এখন বাকি প্রোফাইলগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি হচ্ছে। যদিও এখনও তাদের মধ্যে ছুপা রুস্তমটিকে পাওয়া যায়নি। মেয়ে হ্যাকারের সংখ্যা অবশ্য তুলনামূলক কম। কিন্তু সাবধানের মার নেই। অধিরাজের সন্দেহ, এই খুনগুলোর মধ্যে একাধিক মাথা রয়েছে। তাই ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সব হ্যাকারের স্ক্যানিংই চলছে। এখন তারা কোথায় আছে, কী করছে, সে সব খবরই নেওয়া চলছে।

তৃতীয়ত, মি, জয়সওয়ালের মোবাইল ফোনটা অনেক খোঁজাখুঁজি করে শেষ পর্যন্ত মেরিলিন প্ল্যাটিনাম হাউজিং কমপ্লেক্সের বাগানেই পাওয়া গিয়েছে। ফোনটা অক্ষত অবস্থাতেই আছে। তবে সুইচড অফ ছিল। সেটাকে এভিডেন্স হিসেবে জমা করা হয়েছে। সিকিউরিটি গার্ডদের দফায় দফায় জেরা করেও নতুন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তারা মি, জয়সওয়ালের গাড়িকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে, কিন্তু ভেতরে স্বয়ং তিনিই ছিলেন কি না, তা বলতে পারছে। মেরিলিন প্ল্যাটিনাম হাউজিঙের গ্যারাজে সিসিটিভি আছে, কিন্তু একটা ক্যামেরাও চলে না। তাই গাড়িটা নিয়ে কে বেরিয়েছিল তা দেখা সম্ভব নয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, মি. জয়সওয়ালকে ফিরে আসতেও কেউ দেখেনি! তিনি নিজে এসেছেন, না কেউ তাকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে কিছুই জানে না।

অধিরাজ তখন পারলে গেটকিপারকে এক হাত নেয়–আস্ত একটা মানুষ ভ্যানিশ হয়ে গেল, আবার ফিরে এল–তুই কিছুই দেখিসনি? তিনি কি মি. ইন্ডিয়া? না তুই ব্যাটা পাউয়া মেরে বসেছিলি!

গেটকিপার অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মুখ দেখে বোঝা গেল, হয়তো দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাই সঠিক। সে সম্ভবত মদ্যপান করেই বসেছিল। কিন্তু বাকি সিকিউরিটি গার্ডরা নিজেদের বক্তব্যে অটল। তারা কেউ মি. জয়সওয়ালকে ফিরে আসতে দেখেনি, এবং তিনি কী করে একেবারে বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছলেন তা জানে না।

অর্ণব লক্ষ করল অধিরাজের চোয়াল কঠিন হয়ে উঠছে। সে আস্তে আস্তে বলল–এমনও তো হতে পারে যে মি. জয়সওয়ালকে কেউ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল, তাই সিকিউরিটি গার্ডরা লক্ষই করেনি?

সেই কেউটা কে অর্ণব? অধিরাজ একটু অধৈর্য–তেমন কেউ হলেও তো কারোর না কারোর চোখে পড়বে! জয়সওয়াল খুব ভোরে হাপিশ হয়েছিলেন। যদি ধরেও নিই ঐ আধা অন্ধকারে সেবারে ঠিকমতো কেউ লক্ষ করেনি, কিন্তু এবার কী হলো! তিনি ফিরেছেন তো দিন-দুপুরে! আর যাঁর ড্রাগের প্রভাবে মস্তিষ্কই কাজ করছে না, তিনি একেবারে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে, লিফটে বা সিঁড়ি বেয়ে আটতলায় একেবারে নিজের ফ্ল্যাটের সামনেই পৌঁছলেন! এটা কী করে সম্ভব?

হতে পারে ওঁকে কেউ মেক আপ দিয়ে নিয়ে এসেছিল, তাই গার্ডরা চিনতে পারেনি…!

মেক আপ! তবে মিসেস জয়সওয়াল চিনলেন কী করে? মেক-আপটা মুছলই বা কখন? কোথায়? দিনের বেলায় সিকিউরিটি গার্ডরা কি ব্ল্যাকের রানি মুখার্জির রোলে অভিনয় করছিল? অধিরাজের আয়ত চোখে রাগে ঝিলিক দিয়ে ওঠে–তাছাড়া মি. জয়সওয়ালের চেহারাটা দেখেছ? এই দশাসই লম্বা-চওড়া মার্কা মারা চেহারা। ঐ খানদানি খোবড়া লুকানোর জন্য একমাত্র জাম্বুবানের মেক-আপই দিতে হবে। আর এরকম চেহারা দেখলে কেউ সন্দেহ করবে না? কারোর চোখে পড়বে না যে বিউটির রাজ্যে বিস্ট ঢুকেছে!

বলতে বলতেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল–এবার দয়া করে বলে বোসো না, মি, জয়সওয়ালকে নিচ থেকে কেউ তার ফ্ল্যাটের সামনে ছুঁড়ে মেরেছে! তিনি মি. বিজয় জয়সওয়াল, মিসাইল নন্ যে একেবারে সঠিক জায়গায় উড়ে এসে পড়বেন।

অর্ণব হাসতে গিয়েও চেপে যায়। এই পরিস্থিতিতে হাসা উচিত নয়।

এর অর্থ একটাই হতে পারে। সবচেয়ে সহজ দুটো সম্ভাবনা। অধিরাজের চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল–হয় সিকিউরিটি গার্ডরা সবাই একসঙ্গে মিথ্যে কথা বলছে, নয়তো বিজয় জয়সওয়াল কখনো কমপ্লেক্সের বাইরেই যাননি। তিনি ভেতরেই ছিলেন।

কিন্তু তা কী করে সম্ভব! আমি ওঁর ফ্ল্যাট তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছি। অর্ণব হা-তাছাড়া ওঁর গাড়িটাই বা বাইরে নিয়ে গেল কে?

বিস্মিত অর্ণবের পিঠে হাত রেখে হাসল অধিরাজ–আমি কখন বললাম যে বিজয় জয়সওয়াল তাঁর ফ্ল্যাটেই ছিলেন! আমি বলেছি–কমপ্লেক্সের বাইরে যাননি। আর গাড়িটার ব্যাপারটা এখনও বুঝতে পারছি না। কিন্তু এটা তো ঠিক, যে ওটা কেউ বের করে নিয়ে গিয়েছিল।

তবে গোটা কমপ্লেক্সের সমস্ত ফ্ল্যাটগুলো সার্চ করে দেখব?

এখন নয় অর্ণব। অধিরাজ রে ব্যানের গগলস্টা চোখে চাপিয়ে বলল–ড. চ্যাটার্জী এখন বিজয় জয়সওয়ালের জামাকাপড় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস বুড়ো ঠিক কিছু না কিছু বের করবেই। তখন দেখা যাবে।

এই অবধি কিছুটা এগোনো গেলেও বাকি খবর বেশ আশঙ্কাজনক। ড. চ্যাটার্জীর কথাই সঠিক। এগারো তারিখ থেকে বিজয় জয়সওয়াল একটা দিনের কথাও মনে করতে পারছেন না। এমনকি তিনি এগারো তারিখ কোথায় গিয়েছিলেন, আদৌ কোথাও যাওয়ার কথা ছিল কি না–তাও তাঁর মনে নেই। শুধু এইটুকু কোনোমতে বলতে পারলেন যে তাঁর আদৌ কোনো এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার নেই। মানসী মি. জয়সওয়ালের মা-কে একদমই পছন্দ করেন না। ঐ যা হয় আর কী! সাস-বহু সংঘাত। তিক্ততা এত দূর পৌঁছেছে। যে বাধ্য হয়েই বিজয়কে স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা হতে হলো। বিজয়ের বিধবা মা সল্টলেকের নিজস্ব বাড়িতে একাই থাকেন, আর ওঁরা মেরিলিন প্ল্যাটিনাম হাউজিঙে। ইদানিং মায়ের শরীর-স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছে না বলে বিজয় মাঝে মাঝেই তাঁর কাছে গিয়ে থাকেন। কিন্তু স্ত্রীকে কিছুই জানান না। কারণ তিনি জানলেই অশান্তি করবেন। কিছুতেই তাঁকে মায়ের কাছে যেতে দেবেন না। আর এই গোপনীয়তার কারণেই মানসীর ধারণা যে বিজয় অন্য কোনো মহিলার সঙ্গে প্রেম করছেন।

বিজয়ের কথা যে সঠিক তা ওঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করেই জানা গেল। সত্যিই বিজয় ওঁর কাছে মাঝেমধ্যেই আসেন। মায়ের খেয়াল রাখেন, ডাক্তার দেখান, চেক-আপ করান। যতদিন থাকেন, বউয়ের ভয়ে ততদিন অবধি ফোন অফ করে রাখেন।

কিন্তু এর বেশি আর কিছু জানা গেল না। বিজয় ঠিকমতো কথা বলতেই পারছেন না। কথা বলতে বলতেই কখনো কখনো এমন কনফিউজড হয়ে যাচ্ছেন যে দুই অফিসারই ঘাবড়ে যাচ্ছে। ডাক্তাররা তাঁর ওপর বেশি চাপ দিতে বারণ করছেন। অগত্যা অধিরাজের অবস্থা প্রায় পরাজিত সৈনিকের মতোই।

অবশ্য তোমাকে একটা কথা গ্যারান্টি দিয়েই বলতে পারি। সে হাসপিটালের লিফটে উঠে ফের চিন্তান্বিতভাবে বলল–মিসেস জয়সওয়ালকে এগারো তারিখ চারটে বাজতে পাঁচ মিনিটে যে মেসেজ পাঠানো হয়েছিল, সেটা আর যেই হোক, বিজয় জয়সওয়াল নিজে পাঠাননি।

অর্ণবের মাথায় যেন বাজ পড়ল। সে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে।

আমি বিজয় জয়সওয়ালের ফোনের মেসেজগুলো দেখছিলাম। ভদ্রলোকের পূর্বপুরুষ কলকাতাতেই ছিলেন। ওঁর জন্মও কলকাতাতেই। দারুণ ভালো বাংলা বলেন। ইনফ্যাক্ট বাঙালিই হয়ে গিয়েছেন। তিনি সবসময়ই নিজের নাম বিজয়-এর আদ্যাক্ষর বি লেখেন। প্রত্যেকটা মেসেজেই তাই লিখেছেন। অথচ ওঁর শেষ মেসেজটায় বিজয় নামের আদ্যাক্ষর ভি! বিজয় নয়–ভিজয়।

তার মানে…! বিস্ময়ে কথা হারিয়ে ফেলে অর্ণব।

তার মানে যিনি শেষ মেসেজটি করেছেন তিনি জানতেন না যে বিজয় নিজের নামের আদ্যাক্ষরটি ভি নয় বি লেখেন। ওদিকে সর্বনাশিনীর আর আইপি পোস্টে বিজয়ের স্পেলিঙেও প্রথমে ভি আছে! অতএব, বিজয় জয়সওয়াল নিজে তো মেসেজটি করতেই পারেন না, এমনকি মিসেস জয়সওয়ালও পারেন না। কারণ স্বামী নিজের নামের স্পেলিং কী লেখেন তা তিনি জানেন। পরদিন হসপিটালের ফর্মালিটিগুলো সারার সময়ে তিনিও পেশেন্টের নামের জায়গায় বিজয় বি দিয়েই লিখেছেন, ভি দিয়ে নয়। সেজন্যই ব্যাপারটা আরও ঘেঁটে গেল।

মিসেস জয়সওয়াল তবে ক্লিন?

সে মাথা নাড়েনা। ক্লিনচিট একেবারেই দেওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে মিসেস জয়সওয়াল মেসেজটা করতে পারেন না, ঠিক সেই একই কারণে মেসেজ পাওয়া মাত্রই তাঁর সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল। তিনি কি দেখেননি যে ঐ মেসেজটায় বিজয়ের নামের আদ্যাক্ষর ভি? যা বিজয় জয়সওয়াল কখনই করেন না। স্ট্রেঞ্জ!

তবে কি তিনিই…!

অসম্ভব নয়। লিফট থেকে বেরিয়ে বাইরের দিকে যেতে যেতে বলল সে–আমার ধারণা সব প্রশ্নের উত্তর মেরিলিন প্ল্যাটিনাম হাউজিঙেই আছে। খুনি আছে কি না জানি না–কিন্তু কোনো না কোনো লিঙ্ক তো অবশ্যই আছে। দরকার শুধু একটা জোরদার প্রমাণের।

কথা বলতে বলতেই বাইরে চলে এসেছিল ওরা। হসপিটালের বাইরে বেরিয়ে আসতেই অর্ণব আর অধিরাজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সাংবাদিকের দল। তারা এতক্ষণ বুম আর ক্যামেরা নিয়ে বাইরে ওত পেতে বসেছিল। দুই অফিসারকে দেখেই একগাদা প্রশ্ন নিয়ে লাফিয়ে পড়েছে

স্যার, এই সর্বনাশিনীটা কে?

কোনো কু পেলেন আপনারা?

একের পর এক ডেথ ফোরকাস্ট হয়ে চলেছে, মানুষ মারা পড়ছে, অথচ পুলিশ কেন কিছু করতে পারল না?

অফিসার ব্যানার্জী, আপনার একটা বাইট স্যার…!

বিজয় জয়সওয়ালের ডেথ ফোরকাস্টটা কি তবে প্র্যাঙ্ক ছিল?

অধিরাজ পুলিশি স্মার্ট ভঙ্গিতে ভিড় ঠেলে অপ্রতিহত ভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। শেষ প্রশ্নটা শুনে থমকে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্নকর্তাকে মেপে নিল। প্রশ্নকর্তা নয় প্রশ্নকত্রী। একটু উষ্ণদৃষ্টিতে কৃষ্ণাঙ্গী মহিলা রিপোর্টারকে দেখে নিয়ে সান্দ্র স্বরে উত্তর দিল–নো কমেন্টস্।

কথাটা বলেই সে দ্রুত ছন্দে এগিয়ে গেল নিজের গাড়ির দিকে। নাছোড়বান্দা সাংবাদিকরা তার পেছন পেছন দৌড়াছে। অর্ণব তাদের সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অধিরাজের এসবই অত্যন্ত বিরক্তিকর ঠেকছিল। মিডিয়ার আর কী! তারা তো আঙুল তুলেই ক্ষান্ত। এদিকে যে কী দমবন্ধ অবস্থা তা শুধু পুলিশ আর সিআইডিই টের পাচ্ছে।

অধিরাজ সজোরে নাক টানে। অনেকক্ষণ ধরেই নাক সুড়সুড় করছিল তার। গলাও খুশখুশ করছে। কে জানে সর্দি হবে কি না। কয়েকদিন ধরে ভীষণ অনিয়ম হচ্ছে। স্নান করার সময়ের মাথা-মুণ্ডু নেই। তার ওপর চিল্ড এসি। অধিরাজ অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছিল হাঁচিটাকে কন্ট্রোল করার। কিন্তু আর থামানোগেল না। সর্বসমক্ষে একেবারে অসভ্যের মতো হেঁচেই ফেলল সে।

ব্লেস ইউ।

বাইরে থেকে একটা মিষ্টি নরম মেয়েলি স্বরে ভেসে এল শব্দ দুটো। অধিরাজ অন্যমনস্ক চোখ তুলে তার অজ্ঞাত শুভাকাঙ্ক্ষীকে খুঁজল। তার সামনেই সেই কৃষ্ণাঙ্গী পুরুষালি চেহারার রিপোর্টার সাদা ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসছে। সে মেয়েটির দিকে কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসল–থ্যাঙ্কস।

আস্তে আস্তে গাড়ির কাঁচ উঠে গেল। অর্ণব ড্রাইভিং সিটে বসে পড়েছে। কয়েক সেকেন্ডের নিস্তব্ধতা। পরক্ষণেই গাড়ি সশব্দে স্টার্ট নিল। একরাশ ধুলো উড়িয়ে মুহূর্তের মধ্যে তীব্র বেগে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে গেল রিপোর্টারদের পেছনে রেখে।

সাংবাদিকদের ভিড়ে একজোড়া কাজলটানা অপূর্ব চোখ অনিমেষে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। সিআইডি অফিসার অধিরাজ ব্যানার্জীকে আগে টিভিতে, খবরের কাগজে দেখেছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকদিন ধরেই টিভিতে দেখছে। আজ একবার স্বচক্ষে দেখতে এসেছিল। উন্নত দেহ, ঋজু মানুষটার চোখ দুটো কী অদ্ভুত! আজ পর্যন্ত অনেক পুরুষ দেখেছে সে, তাদের দৃষ্টিও দেখেছে। কিন্তু এই পুরুষটির দৃষ্টি কী ভীষণ স্বচ্ছু! স্বচ্ছ অথচ গভীর! অজান্তেই চোখ দিয়ে হৃদয়ের গভীরে চলে যায় সে চাউনি। যে কালো কুচকুচে মেয়েটিকে দেখে সে হাসল, সেই হতকুচ্ছিত মেয়েটির দিকে কোনো পুরুষ তাকাবেও না, হাসা তত দূর। অথচ…!

সে বুঝতে পারল এ পুরুষ অন্য ধাতুর! তার সৌন্দর্য একদিকে যেমন আগুন জ্বালায়, তেমনই অপরিসীম মমতাও ডেকে আনে।

বুকের ভেতরে একটা তীক্ষ্ণ ব্যথা টের পেল সে। কানের কাছে এখনও বাজছে একটা গম্ভীর কোমল গলা–থ্যাঙ্কস! শব্দটা অন্য কাউকে বলেছে ঠিকই, কিন্তু তার ব্লেস ইউর উত্তরেই তো বলা!

বন্ধু হলে ভালো হতো! কিন্তু তা সম্ভব নয়। তাই শত্রুতাই সই! অন্তত কোনো সম্পর্ক তো হলো।

*

সিআইডি ব্যুরো ততক্ষণে সরগরম। প্রায় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সেখানে তদন্ত চলছে।

একদিকে অধিরাজের আরেক সহযোগী অফিসার পবিত্র আচার্য গুচ্ছ গুচ্ছ হ্যাকারের প্রোফাইল নিয়ে বসে আছে। সে আর তার টিম মিলে প্রাক্তন হাইটেক বদমায়েশদের খোঁজ করছে। অর্থাৎ হ্যাকারদের রাউন্ড আপ করছে। প্রত্যেককে ফোন করে ব্যুরোতে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছে। সন্দেহজনক হ্যাকারদের লিস্ট তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে শহরের প্রখ্যাত গাড়ি চোর, চোরাই গাড়ি বিক্রেতা, কার স্মাগলার, হিস্ট্রিশিটারদের লাইন লেগে গিয়েছে গারদে। কনস্টেবলরা মনের সুখে হাত সাফ করছে তাদের ওপরে। কিন্তু কেউ মুখ খুলছে না। সবারই মুখে এক কথা–আমি কিছু জানি না হুজুর।

অধিরাজ নিজের কেবিনে ঢুকতে না ঢুকতেই পবিত্র একখানা ফাইল বগলদাবা করে হুড়মুড়িয়ে এসে হাজির–রাজা, কয়েকটা প্রোফাইল পাওয়া গিয়েছে যেগুলো বেশ সন্দেহজনক।

সে আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল–এখন দয়া করে বলল না যে বেশি নয়, মাত্র শ খানেক প্রোফাইল তোমার বেশ সন্দেহজনক লাগছে।

পবিত্র হাসল-না, অত বেশি নয়। বেশিরভাগ হ্যাকারকেই ট্র্যাক করতে পেরেছি। কিন্তু তাদের ধরন-ধারণ ঠিক এই কেসের সঙ্গে মিলছে না। শুধু তিনজন মিসিং। তাদের প্রোফাইল বেশ এই কেসের জন্য একদম পারফেক্ট। কোয়াইট ইন্টারেস্টিং ও।

অধিরাজ চেয়ারে বসে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বলে–আই অ্যাম অল্ ইয়ার্স।

পবিত্র অম্লানবদনেতার সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা লম্বা স্টিক তুলে নিয়ে বলল–আই লাভ ইন্ডিয়া কিংস।

অ্যান্ড আই লাভ ইউ সো…। সে লাইটার দিয়ে একটু ঝুঁকে পবিত্রর স্টিকটা ধরিয়ে দিয়েছে–এই কথাটা বলব কি না, তা নির্ভর করছে তোমার ডেটার ওপরে।

এলভিসের গান একটু বেশিই শুনছ। পবিত্র একটা সুখটান দিয়ে বলল- বেশ, তোমায় তোমার তিনজন প্রেমিকার বিবরণ দিয়েই দিই।

প্রেমিকা! নিজের সিগারেটটা ধরিয়ে বলল অধিরাজ-প্রেমিক নয়? মানে তিনজনই ফিমেল?

নিঃসন্দেহে। যদি না ইতোমধ্যেই সেক্স পালটে থাকে। সে ফাইল খুলে বেশ কিছু কাগজপত্র বের করে। ওগুলো সব সাইবার হিস্ট্রি শিটারদের রেকর্ড। অধিরাজ কাগজগুলো তুলে নিয়ে মন দিয়ে দেখছে। পবিত্র বলল প্রথম রত্নটির নাম সোহিনী ভট্টাচার্য। ২০০৯ সালে সাইবার ক্রাইম ওয়ার্ল্ডে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি একের পর এক ই-মেল করে গোয়েন্দা দফতরকে রীতিমতো ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিলেন। প্রত্যেকটি ই মেলের বিষয়বস্তু একই। শহরের বিভিন্ন জায়গায় নাকি বম্বিং হতে চলেছে। সাইবার সেল যখন অ্যাকশনে নামল, তখন আইপি ট্র্যাক করতে গিয়ে জান কয়লা হয়ে গিয়েছিল তাদের। কোনোটা দুবাইয়ের, তো কোনোটা বাংলাদেশের আইপি! চমৎকার আইপি স্পুফিং করে চলেছিলেন লাগাতার। যদিও দুদিনের মাথায় সাইবার সেল এই ছদ্মবেশী শয়তানিটিকে ধরে। নিজের জবানবন্দিতে তিনি বলেছিলেন যে ব্যাপারটা নিছকই মজা করার জন্য করেছেন। একটি থ্রিলার পড়েই নাকি তার মাথায় এই ফিঙের কনসেপ্ট আসে। সেটাই প্র্যাক্টিক্যালি করে দেখতে গিয়েছিলেন। ওদিকে তার মজার চোটে পুলিশ আর সাইবার সেলের লোকেরা চোখে সরষে ফুল দেখছিল।

হুম। অধিরাজ সোহিনী ভট্টাচার্যর ছবি ও ডিটেলস দেখতে দেখতেই বলল–যখন এই দুষ্কর্মটি করেন তখন তিনি টিন বাজাচ্ছিলেন! আই মিন, টিন এজার ছিলেন। মাত্র ষোলো বছর বয়েস। ছবিতে তো দেখছি একেবারে শান্তশিষ্ট-টিকি বিশিষ্ট। হর্সটেল বাঁধা স্কুলগার্ল লুক, চোখে একখানা ভারি পাওয়ারের চশমা। কালো, কিন্তু মিষ্টি।

হ্যাঁ। তবে তখন বয়েসটা খুব অল্প ছিল। সেজন্যই তাকে শুধু একটু ধমক-ধামক দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে তিনি তাতেই থেমে থাকেননি। দ্বিতীয়বার রীতিমতো একটি সাইট খুলে চাইল্ড পর্নোগ্রাফি স্প্রেড করছিলেন। এটা যখন করেন, তখনও তিনি টিনই বাজাচ্ছিলেন। অর্থাৎ, শি ওয়াজ এইট্টিন প্লাস।

গ্রেট! সে একমুখ ধোয়া ছাড়ে– এবারও তো শ্রীঘরে যাননি দেখছি।

না। বড়লোকের বেটি। বাবা নামি উকিল দিয়ে বাঁচিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও তার শিক্ষা হয়নি। থার্ডবার…!

ব্যাঙ্কের সিস্টেমে ঢুকে পড়ে পঞ্চাশ লাখ টাকার অনলাইন ট্রানজাকশন গুলিয়ে দিয়েছিলেন। এবারও আইপি সুফিং করেছিলেন। অন্য একজনের ওয়াই ফাঁই রাউটারকে হ্যাঁক করে কীর্তিটি করেছিলেন। তবু ধরা পড়লেন। অধিরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলল–এবার টিন নয়, ব্যান্ড বেজে গেল! এটা তিনি তেইশ বছর বয়েসে করেছিলেন। এবং তারপর থেকেই নিখোঁজ!

আজ পর্যন্ত তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধরা পড়ার আগেই হাওয়া! পবিত্র বলতে থাকে যে পাব্লিকের মাথায় অন্যের ওয়াই ফাঁই রাউটার হ্যাঁক করার বুদ্ধি আসতে পারে, তার পরবর্তী ধাপ–ওপেন আনসিকিওর্ড হটস্পট ইউজ করার মতো খচরামিও তার মাথায় আসা আশ্চর্য কিছু নয়!

ইন্টারেস্টিং। সে সোহিনী ভট্টাচার্যর ছবির ওপরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল- নেক্সট কে?

শান্তিপ্রিয়া চক্রবর্তী। এর মতো অশান্তিপ্রিয়া আর কেউ আছেন কি না কে জানে! তিনি খাতা খোলেন মাত্র পনেরো বছর বয়সে। অনলাইন ফ্রডে প্রায় মাস্টার ডিগ্রি হাসিল করেছেন। আইডি স্পুফিং তার মতো ভালো আর কেউ পেরেছে কি না সন্দেহ। তিনিও একসময় একটি ফেক ফেসবুক প্রোফাইল খুলে সেলিব্রিটিদের ফেকডেথ পোস্ট দিতেন। আই মিন ডেথ হোক্স আর কী। আইডি স্পুফিংকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তবু পুলিশ তাকে ধরেছিল। কিন্তু পনেরো বছর বয়েস হওয়ার দরুণ ইনভেস্টিগেটিং অফিসার একেও সামান্য ধমক-ধামক দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন। শান্তিপ্রিয়া ধমকটা তখন হজম করলেও তার ইগোয় হেভি লেগেছিল। রিভেঞ্জটা ভালোই নিয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরই খোদ কলকাতা পুলিশের ওয়েবসাইটের ওপরেই অ্যাটাক হলো। ওয়ান ফাইন মর্নিং, কলকাতা পুলিশের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে সানি লিওনের সেক্সি নৃত্য দেখে সবারই চক্ষু চড়কগাছ!

সানি লিওনের নাচ তোমরা সবাই দেখলে–শুধু আমিই বাদ গেলাম! অধিরাজ কাঁচুমাচু মুখ করেছে সানিকে…সরি…সরি…শান্তি প্রিয়াকে কোথায় পাব?

এখানেই গোলমাল। পবিত্রর মুখে চিন্তার ভাঁজ-এই মেয়েটির খোঁজও পাওয়া যাচ্ছে না। একবছর আগেও তিনি জুভেনাইল হোমে ছিলেন। ছাড়া পাওয়ার পর আর বাড়ি ফেরেননি। অর্থাৎ পুরো কপুরের মতো ভ্যানিশ!

যাঃ! সানি লিওনও গেলেন!

পবিত্র হাসছে–বেটার, তুমি সানি লিওনের বদলে শান্তিপ্রিয়াকেই দেখো। কালো কুচকুচে। এ-ও তোমার সর্বনাশিনীর আদলেরই প্রোফাইল। মেয়েটা দেখতে নিরীহ-কিন্তু ভয়ংকর রিভেঞ্জফুল! আর ফেক ফেসবুক প্রোফাইল, ডেথ হোক্সের ব্যাপারটা কিন্তু সর্বনাশিনীর স্টাইলের সঙ্গেই মিলছে।

ঠিক। অধিরাজ শান্তিপ্রিয়ার ছবির ওপরে চোখ বোলাতে বোলাতে বলল- নেক্সট?

রিয়া বাজাজ। বিখ্যাত দাবা খেলোয়াড় উমঙ্গ অ্যান্ড্রু বাজাজের ছোট কন্যে। মিস্ বাজাজের কাণ্ড দেখে পুলিশেরই চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। তিনি একখানা ফেক ফেসবুক প্রোফাইল বানিয়ে সেখান থেকে নানান সেলিব্রিটি, প্রভাবশালী মহিলাদের অশ্লীল মেসেজ ও ভিডিও পাঠাচ্ছিলেন। এমনকি তারা প্রতিবাদ জানালেও আপত্তিকর ভাষায় হুমকিও দেন। তার শিকারের মধ্যে কেউ নামকরা নায়িকা, কেউ মডেল, কেউ গায়িকা, কেউ বা নেত্রী অথবা সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট। তার উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে সেলিব্রিটিরা সাইবার সেলে অভিযোগ জানান। সাইবার সেল যে আইপি অ্যাড্রেসটি খুঁজে পেল সেটি কিন্তু রিয়া বাজাজের ল্যাপটপের নয়, মি. বাজাজের ল্যাপটপের। বেচারি দাবাড়ু মি. বাজাজ ফেঁসে গেলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল মি. বাজাজ নন, আসল কীর্তিমতী তাঁর কন্যা রিয়া। তিনি যত বদমায়েশি সব বাপের আইপি অ্যাড্রেস নকল করে করছিলেন।

ইনিও টিন!

হা, বছর চারেক আগে আঠারো ছিলেন। এখন বাইশ হওয়ার কথা। কিন্তু বয়সে টিন হলেও জাতে ইস্পাত। মেয়েটা বোধহয় সামান্য মেন্টাল পেশেন্ট। কিন্তু বজ্জাতি বুদ্ধি মারাত্মক। জন্মের সময়ই মা কে হারিয়েছে। মি. বাজাজের দ্বিতীয় স্ত্রী খুব একটা সুবিধের ছিলেন না। সৎ-মায়ের জ্বালায় ছোট মেয়েটার মানসিক দিকটা ভেঙে গিয়েছিল। মেয়েটা আবার ড্রাগ অ্যাডিক্টও ছিল। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কী জানো রাজা?… পবিত্র একটু থেমে ফের বলল–রিয়া বাজাজ কাজটা করেছিল ঠিকই, কিন্তু সবার মনে হয়েছিল এই বুদ্ধিটা অন্য কারোর মাথা থেকে বেরিয়েছে। মাস্টারমাইন্ড অন্য কেউ। কিন্তু মেয়েটা এমন ঠ্যাটা যে স্বীকারই করল না! সব আমিই করেছি বলে সেই যে বসে রইল, আর নিজের বয়ান থেকে নড়লই না।

এই খবরটা আমি জানি। বেশ কিছুদিন ধরে খবরের কাগজের হেডলাইন ছিল। অধিরাজ নড়েচড়ে বসে–মি. উমঙ্গ অ্যান্ড্রু বাজাজের হিস্ট্রি সত্যিই ইন্টারেস্টিং। মি. বাজাজ নিজেও খুব রঙিন মেজাজের লোক ছিলেন। জামা কাপড়ের মতো গার্লফ্রেন্ড পালটাতেন। তিনি শৈশবেই অনাথ। এক চার্চের ফাদারের কাছে থেকে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু ভদ্রলোক মারকাটারি হ্যান্ডসাম। যৌবনের প্রারম্ভেই এক হিন্দু কোটিপতির কুদর্শনা মেয়ে অহল্যাকে পটিয়ে পাটিয়ে বিয়ে করেছিলেন। শ্বশুরের দাক্ষিণ্যেই তার উন্নতি ঘটল। দাবাড়ু হিসেবে প্রতিষ্ঠাও পেলেন। কিন্তু লম্পট হলে যা হয় আর কী! স্ত্রীর বদলে অন্য মেয়েদের সঙ্গেই বেশি থাকতেন। অনেক ঘাটের জল খেয়ে শেষ পর্যন্ত প্রথম স্ত্রী অহল্যা বেঁচে থাকতেই অন্য এক সুন্দরীকে এনে সটান ঘরে তুললেন। বউয়ের ওপর শারীরীক অত্যাচারও করতেন। সেই নিয়ে বিস্তর হইচই হয়েছিল। অহল্যা বাজাজ রিয়ার জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। তাতে ভদ্রলোক একটুও দুঃখিত না হয়ে প্রেমিকাকেই বিয়ে করে বসলেন।

হ্যাঁ। পবিত্র মুচকি হাসে–তাতেও অবশ্য তিনি ক্ষান্ত হননি। আজ থেকে বছর তিনেক আগেই মি. বাজাজ হাওয়া হয়ে গেলেন। তাঁর ল্যাপটপ ঘেঁটে বোঝা গেল যে, তিনি এবার আরেক সুন্দরীর প্রেমে পড়ে দেশ ছাড়া হয়েছেন। কারণ তাঁর ই-মেল অ্যাড্রেসে এক অজ্ঞাত সুন্দরীর প্রচুর প্রেমপত্র ছিল। এবং তিনি খালি হাতে হাওয়া হননি। সঙ্গে পাসপোর্ট–প্রচুর টাকা পয়সা-বহুমূল্য গয়নাগাটি ইত্যাদিও হাওয়া হয়েছিল। তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রায় নব্বই লক্ষ টাকা ছিল। সেটাও তুলে নেওয়া হয়েছে। পুলিশ তার মিসিং কেস নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি। লম্পট পাবলিকরা যদি থেকে থেকে প্রেম। করে আর প্রেমিকাকে নিয়ে ভেগে গিয়ে পাটায়ার সি বিচে বসে হাওয়া খায়, তবে পুলিশ কী করবে?

কেন? পুলিশদের কি পাটায়া যেতে নেই? গিয়ে একবার দেখ তো যে মি. বাজাজ কোন টাটকা তাজা বুলবুল ভাজা খাচ্ছেন। এনিওয়ে… অধিরাজ একটু চিন্তা করে বলে–রিয়া বাজাজকে যথেষ্টই ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে আমার। এত অপশন থাকতে বিদ্যেধরী নিজের বাপের আইপি অ্যাড্রেস কপি করলেন কেন? বাপকে গণধোলাই খাওয়ানোর ইচ্ছে ছিল নাকি?

পুলিশেরও তেমন কিছুই সন্দেহ হয়েছিল। বাবার ওপরে অবদমিত রাগ আর প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই এরকম একটা কাজ করেছিল মেয়েটা। কিন্তু মেয়েটা স্বীকারই করল না। বলল–আমার ইচ্ছে করেছে, তাই করেছি–ব্যাস্। পবিত্র আপনমনেই বলে–বড় শক্ত মেয়ে! একেবারে মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিল। ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের ওকে একটুও নর্মাল মনে হয়নি।

শেষ পর্যন্ত কী হলো?

শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। মি. উমঙ্গ অ্যান্ড্রু বাজাজ রীতিমতো খ্যাতনামা দাবাড়ু ছিলেন। তার অনুরোধে সেলিব্রিটিরা কেস তুলে নিলেন। রিয়া ছাড়া পেল। কিন্তু তারপর তার কী যে হলো তা শ্যামলালও জানে না! মি. বাজাজ তাকে কোথায় পাচার করলেন কে জানে। তারপর তো তিনি নিজেও ফুড়ুৎ! বাপ-মেয়ের কী হলো–কেউ জানে না। মি. বাজাজের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী অবশ্য আছেন। তিনি সিঙ্গাপুরে আরেকজন ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে সেট। এ কেসের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।

অধিরাজ রিয়া বাজাজের ছবিটা দেখে নিল। তিনিও কৃষ্ণাঙ্গী। কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, মোটা নাক-ঠোঁট, উঁচু কপাল। তবে আলগা একটা চটক আছে। পুরো নাম রিয়া সামান্থা বাজাজ। সে সিগারেটের অবশিষ্টাংশ অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিতে দিতে বলল–যাক, তবু তো কিছু পাওয়া গেল!

পাওয়া আর গেল কই! পবিত্র ঠোঁট উলটে বলল–এদের কাউকেই তো পাওয়া যাচ্ছে না। বললাম নামিসিং!

পাওয়া যাবে। সে মৃদু হাসে–অবশ্য বিদেশে রপ্তানি হলে পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমার মনে হয় এদের মধ্যে অন্তত একজন এখন এখানেই আছেন। সর্বনাশিনীর প্রোফাইলটা কলকাতার আনসিকিওরড হট স্পট থেকেই যখন অনলাইন হচ্ছে, তখন শ্রীমতীও এখানেই আছেন! আর এখন আমাদের হাতে অন্তত সঠিক একটা ছবি আছে।

পবিত্র ভুরু নাচাল-এবার কি আমাকে এলভিসের গানটা শোনানো যাবে? অ্যান্ড আই লাভ ইউ সো, দ্যাট পিপু আস্ক মি হাউ…!

অধিরাজ উত্তরে কিছু বলার আগেই কেবিনের দরজা খুলে অর্ণব উঁকি মারল–আসব স্যার?

সে পবিত্রর দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসছে–অর্ণব আমার ক্ষেত্রে খুব পজেসিভ। যখনই আমি কাউকে আই লাভ ইউ বলতে যাই, তখনই ও চলে আসে। অতএব, ঐ গান তোমায় শোনানো যাবে না। বলতে বলতেই অর্ণবের দিকে তাকায়–আসতে আজ্ঞা হোক।

অফিসার পবিত্র আচার্য সকৌতুকে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলল–এ কী অর্ণব! কী শুনছি! রাজা নাকি তোমার ভয়ে কাউকে আই লাভ ইউ বলতেই পারছে না!

অর্ণব মহা ফাঁপরে পড়ে। দুজনই তার সিনিয়র। সুতরাং এই ফাজলামির উত্তর আর কী দেবে! তাছাড়া খাল কেটে কুমিরটা সে নিজেই এনেছে। অধিরাজ ব্যানার্জী কোন লেভেলের পাজি, সেটা জানা সত্ত্বেও লুজ কমেন্ট করে ফেলেছে। সুতরাং উপায় নেই। সে ফের কেবলুশের মতো দন্তকান্তি দেখিয়ে দিল।

বলল কী সমাচার? হিস্ট্রিশিটাররা কেউ মুখ খুলল?

অর্ণব জানায়–না স্যার। সব তোতারাম হয়ে বসে আছে। তোতাকে গুচ্ছ কাঁচা লঙ্কাও খাওয়ালাম। কিন্তু তারপরও কিছু বলছে না।

কী বেইমান! কাঁচা লঙ্কা খেয়েও তোতা মুখ খুলল না! অধিরাজ দুঃখিত ভাব করে বলল–কয় কেজি খাওয়ালে?

গুনিনি স্যার। কম করে মাথা পিছু এক কেজি তো হবেই!

তার সঙ্গে ড্রিঙ্কস হিসেবে কী দিয়েছ?

দিইনি স্যার। জল খেতে চাইছে। ঝালে মরে যাচ্ছে।

ঝালে মরে যাচ্ছে, তবু মুখ খুলছে না! হু! মানুষ ক্রমাগতই নেমকহারাম হয়ে যাচ্ছে। সে কয়েকমুহূর্ত কী যেন ভাবল। পরক্ষণেই চূড়ান্ত বদমায়েশি মাখা একটা হাসি ভেসে ওঠে তার মুখে–এক কাজ করো। এত ঝাল খেয়ে গলা জ্বলছে নিশ্চয়ই। একদম গরম দুধ খেতে দাও। গরম দুধ মানে গরম দুধ! বুঝেছ?

অর্ণব মৃদু হাসল। সে ইদানীং এসবে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে–গট ইট।

দুধে চিনিটা বেশি দিতে বলবে। অধিরাজ ঠান্ডা, শান্ত স্বরে বলল-বাট নো ওয়াটার। জল দেবে না। দরকার পড়লে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজে ঢকঢক করে পেট ভরে জল খাবে। কিন্তু ওদের জল খেতে দেবে না।

ওকে স্যার।

ট্রাই করে দেখো। কিছুক্ষণের মধ্যে এপার ওপার হয়ে যাবে আশা করি।

অর্ণব মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল। অধিরাজ আবার পবিত্রর দিকে মনোনিবেশ করে–পবিত্র, এই তিনজনের মধ্যে কোনো একজন এ কেসে যুক্ত থাকতেই পারে। কিন্তু আসল পাবলিক এরা নয়। যে সুন্দরী আমাদের নাজেহাল করে রেখেছেন, তিনি মোস্ট প্ৰব্যাবলি ফরসা।

কীভাবে বলছ? অন হোয়াট বেসিস?

কালো হলে তিনি কালো মেয়ের ছবি দিতেনই না। অধিরাজ আরেকটা সিগারেট ধরানোর উপক্রম করতে করতে বলল–যেভাবে মিস লিড করছেন, তাতে এত সহজ একটা কু আমাদের হাতে তুলে দেওয়ার পাত্রী তিনি নন। তবে কালোর সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক তো আছেই। শুধু কালোই নয়, নিগ্রোবটু চেহারা।

পবিত্র একটু কনফিউজডমেয়েটি ফরসা বলছ, আবার বলছ নিগ্রোবটু চেহারার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে! একটু এক্সপ্লেইন করবে?

অবচেতন মন বলে সাদা বাংলায় একটা কথা আছে জানো? অথবা ইংরেজিতে সাব-কনশাস মাইন্ড নামক বস্তু? সে নিজের সিগারেটটা ধরিয়ে প্যাকেটটা পবিত্রর দিকে এগিয়ে দেয়–জিনিসটা খুব গোলমেলে। তাকে যতই চেপে রাখার চেষ্টা করো, সে বেরিয়ে আসতেই চাইবে। পারফেক্ট ক্রাইম বলে কিছু হয় না। সব ক্রাইমের মধ্যেই ক্রিমিন্যালের সাবকনশাস মাইন্ড কিছু না কিছু ক্ল রাখবেই। আমাদের সর্বনাশিনীর কনশাস মাইন্ড তাঁকে কালো মেয়ের ছবি পোস্ট করতে বলে। অর্থাৎ, তিনি যা তার একদম উলটোটা। কিন্তু অবচেতন মনে হ্যাঁলি বেরি, জ্যানেট জ্যাকসন, লুপিতা নঙিয়ো, মেগান গুড আসেন! কেন? কালোই তো দরকার। তবে কাজল, শিল্পা শেঠি, বিপাশা বসু বা সুস্মিতা সেন নয় কেন? ওঁরাও তো কালো। তবে? এখানেই খুনির অবচেতন মনের কারিকুরি। সে চিৎকার করে বলতে চাইছে–নিগ্রোবটু চেহারা আমার প্রিয়। সর্বনাশিনী নিজে অমন নয়। তবে, একটাই সম্ভাবনা। তার প্রিয়তম মানুষটি নিগ্লোবটু চেহারার। কোঁকড়ানো চুল, সাদা ঝকঝকে চোখ, মোটা নাকের মানুষ।

এটা তোমার ওয়াইল্ড গেস। পবিত্র এই যুক্তিতে সন্তুষ্ট নয়–আমার তো মনে হচ্ছে সর্বনাশিনী এই তিনজনের মধ্যে যে কেউ হতে পারে। অন্য কেউ নয়।

অধিরাজ অপূর্ব হাসি হাসল। তার চোখে কৌতুকের ঝিকিমিকি তাই? তোমার মনে হচ্ছে এই তিনজনের মধ্যে যে-কেউ হতে পারে। কিন্তু যদি বলি, আমার মনে হচ্ছে সম্ভবত রিয়া বাজাজের সঙ্গেই এই খুনগুলোর সম্পর্ক আছে, তবে তুমি কী বলবে? যদি বলি, সোহিনী, শান্তিপ্রিয়ার থেকেও আমি রিয়ার ওপরেই বেশি জোর দিতে চাই, তবে?

কেন? রিয়াই কেন?

প্রথমত, বাকি দুজন কালো হলেও নিগ্রোবটু চেহারা নয়। একমাত্র রিয়া বাজাজের চেহারাই ওরকম।

পবিত্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অধিরাজের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটার বয়েস কম। কিন্তু তার বুদ্ধির ধার কিছু কম নয়। নিশ্চয়ই সে কিছু আন্দাজ করেছে।

দ্বিতীয়ত?

রিয়া বাজাজের অতীত। মোডাস অপারেন্ডিটা বুঝতে এখনও হয়তো পারিনি। কিন্তু একটা ব্যাব্ল মোটিভকে বোধহয় আর নজর আন্দাজ করা যাচ্ছে না। অধিরাজের দৃষ্টি আত্মমগ্ন। সামান্য বিষণ্ণতাও লেগে আছে দৃষ্টিতে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–রিয়ার মা অহল্যা বাজাজ দেখতে ভালো ছিলেন না এটা সবাই জানে। কিন্তু ভালো দেখতে নয় বললে ঠিক কেমন দেখতে সেটা বোঝা যায় না। রিয়ার মধ্যে নিগ্রোবটু স্টাইল থাকলেও তাকে সুন্দরী বলা যায়। মি. উমঙ্গ অ্যান্ড্রু বাজাজ অত্যন্ত ফরসা, সুদর্শন পুরুষ ছিলেন। সুতরাং রিয়ার চেহারা তার মায়ের মতো হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অহল্যা বাজাজের একটা ছবি জোগাড় করো তো বস। জানা দরকার যে তার চেহারা নিগ্রোবটু স্টাইলের ছিল কি না।

পবিত্র স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে তার মানে রিয়াই…?

উঁহু…উঁহু। সে মাথা নাড়ছে–সে বড়জোর বোড়ে। কিন্তু খুনির যা বুদ্ধির ধার দেখছি, তাতে একটা ড্রাগ অ্যাডিক্টের মাথা থেকে এই বুদ্ধি বেরোনো সম্ভব নয়। বড়জোর এই পোস্টগুলো সে করেছে। মাস্টারমাইন্ড রিয়া নয়। এর পেছনে অন্য কেউ আছে। যে ফরসা, অসম্ভব বুদ্ধিমতী এবং পুলিশের থেকে বুদ্ধিতে অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছে, ঠান্ডা মাথার লোক, বাংলা সাহিত্যপ্রেমী। সে আর যেই হোক রিয়া নয়!

তুমি তো শ্রীশ্রী জ্যোতিষার্ণবের মতো বুলি আউড়ে যাচ্ছ দেখছি! পবিত্র চোখ কপালে তুলে ফেলেছে-কী করে এত জোর দিয়ে বলছ! ফরসা, বুদ্ধিমতী বুঝলাম। কিন্তু সাহিত্যপ্রেমী! কোনো লজিকই নেই…!

লজিক ভীষণভাবেই আছে। অধিরাজ মুচকি হাসল–শুধু তুমি সেটা বুঝতে পারছ না। খুনির অবচেতন মন সম্পর্কে বলছিলাম না? সাব-কনশাস মাইন্ড সবসময়েই খুনির চরিত্র বলে দেয়। তুমি তো বাঙালির বাচ্চা। বাংলা বই-টই পড়তে খুব ভালোবাস। সাহিত্যে রুচি আছে। তুমিই বলো, এই কেসটার আগে সর্বনাশিনী শব্দটা কতবার শুনেছ?

সে একটু ভেবে উত্তর দিল–সর্বনাশী, সর্বনেশে শুনেছি। বাট, আই মাস্ট অ্যাডমিট–সর্বনাশিনী শুনিনি।

তাহলে দেখো! শব্দটা হিব্রু নয়, ফরাসি নয়, ইজিপ্সিয়ান এমনকি জুলুও নয়–খাঁটি বাংলা শব্দ। কিন্তু শব্দটা একটু পুরনো ধাঁচের। অর্থাৎ পুরনো বাংলায় বেশি ব্যবহৃত হওয়া শব্দ। তুমিও এই শব্দটা শোনননি। স্বাভাবিক। কারণ আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সর্বনাশী, সর্বনেশে, সর্বনাশা শব্দগুলোই বেশি ইউজ হয়। সর্বনাশিনীর দেখা বেশিরভাগই বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্রের লেখায়, বা রবীন্দ্র সাহিত্যে পাওয়া যায়। যেমন ফর এগজাপু, মুসলমানীর গল্পে আছে–সর্বনাশিনী, বেজাতের ঘর থেকে ফিরে এসেছিস, আবার তোর লজ্জা নেই! অল্পবয়েসেই হ্যাঁকিং এক্সপার্ট, সামান্য অ্যাবনর্মাল, ড্রাগ অ্যাডিক্ট, হাইটেক বেব রিয়া বাজাজ শরৎ-বঙ্কিম বা রবীন্দ্ররচনাবলি পড়ে বলে মনে হয়? আজকের প্রজন্ম হরর স্টোরি বা ইংরেজি থ্রিলার পড়তে অভ্যস্ত। হ্যাকাররাও কম্পিউটার টেকনোলজি, হ্যাঁকিং সম্পর্কিত পড়াশোনার বাইরে যদি কিছু পড়ে, তবে তা থ্রিলার। যদি প্রোফাইলটার নাম দ্য গার্ল উইথ দ্য ড্রাগন টাটু, ব্লাডি মেরি, ভালাক, দ্য নান হতো, বা নিদেন পক্ষে কাউন্টেস ড্রাকুলাতাও বুঝতাম। কিন্তু সর্বনাশিনী! শব্দটাই অদ্ভুত নয়? কোনো সাধারণ মানুষ এই শব্দটা কখনো ব্যবহার করবে? তাও অ্যাজ এ ফেসবুক নেম?

পবিত্র বুঝতে পারল যে যুক্তিটা যথেষ্ট জোরদার। রিয়া সামান্থা বাজাজের মতো মেয়ে শরৎ-বঙ্কিম বা রবীন্দ্র রচনাবলি পড়ছে, তা ভাবাই যায় না। সে গলা খাঁকারি দেয়–বুঝলাম। কিন্তু সবাইকে ছেড়ে রিয়া বাজাজই কেন? শুধুমাত্র তার চেহারা নিগ্লোবটু ধরনের বলে!

সেটাও একটা কারণ। দ্বিতীয় কারণ তার অতীত। অধিরাজের চোখ দুটো ফের আত্মমগ্ন হয়ে যায়। সে আত্মমগ্নভাবে বলে–আমরা এতক্ষণ ধরে অনেক রকম অ্যাঙ্গেল ভেবে ফেলেছি। সুপারি মার্কেটে খুঁজেছি, নিহত মানুষদের পারিবারিক অ্যাঙ্গেল খুঁজছি, স্ত্রীদের অসন্তোষের দিকটা দেখেছি–কিন্তু একটা দিক ভাবিনি যেটা শুরুতেই ভাবা উচিত ছিল।

কী?

কিডজ–সন্তান! একবার কথা প্রসঙ্গে অর্ণবকে বলেছিলাম, যে লোকগুলো খুন হচ্ছে–ভিকটিম তারা নয়, ভিকটিম আসলে তাদের সন্তানেরা। যখন জানবে যে তাদের বাবা, মাকে ছেড়ে অন্য মেয়ের কাছে যেত–তখন মনের অবস্থা কী দাঁড়াবে একবার ভাবো! এই অ্যাঙ্গেলটা তখনই ধরা উচিত ছিল। কিন্তু বিজয় জয়সওয়ালকে খোঁজার তাড়াহুড়োয় তখন ব্যাপারটা স্ট্রাইক করেনি। আজ রিয়া বাজাজের কেস হিস্ট্রিটা দেখে ঠিক সেই কথাটাই মনে হলো!

কী হেঁয়ালি করছ!

হেঁয়ালি নয়–মনস্তত্ত্ব। অধিরাজ সজোরে নাক টানল–রিয়া বাজাজের কেসটাই ধরো। বেচারি জন্মমুহূর্তেই মাকে হারিয়েছে। বিমাতা নিশ্চয়ই তাকে আদর করে বুকে টেনে নেননি। যদি নিতেন তবে সে অমন বিপথে যেত না। ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে ড্রাগ ধরত না। বাবার যা চরিত্র সে আর বলার নয়। জ্ঞান হওয়ার পরে নিজের মায়ের ছবি নিশ্চয়ই দেখেছে। মনে মনে ভেবেছে, এই আমার মা! বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার উশৃঙ্খলতা যত দেখেছে ততই না দেখা মায়ের প্রতি তার ভালোবাসা, সমবেদনা বেড়েছে। জানতে পেরেছে তার জন্মদাত্রীকে কী প্রচণ্ড উপেক্ষা করে লোকটা তার উপস্থিতিতেই অন্য একজন সুন্দরী মহিলাকে ঘরে এনে তুলেছিল। তার মায়ের নারীত্বের কী ভয়ংকর অপমান করেছিল সে! একটা অযত্নলালিত, অবহেলিত নিষ্পাপ মন বিষিয়ে যাওয়ার পক্ষে এইটুকুই যথেষ্ট। তার লম্পট বাবার ওপর এই প্রচণ্ড ঘৃণা, প্রচণ্ড রাগ থেকেই সে ওরকম একটা পদক্ষেপ নিয়েছিল। রিয়া নিজের বাবাকে আইনের হাত দিয়েই শাস্তি দিতে চেয়েছিল। তার আসল লক্ষ্য সেলিব্রিটিরা ছিলেন না, ছিলেন মি. উমঙ্গ অ্যান্ড্রু বাজাজ।

কিন্তু তাই বলে শহরের সমস্ত লম্পটকে মারতে শুরু করবে? এরকম সমাজসেবা করার মানেটা কী?

আমি কখনই বলিনি যে রিয়া বাজাজ লোকগুলোকে ধরে ধরে মারছে। আমি বলছি প্ৰব্যাব্লি…। অধিরাজ সজোরে একবার হেঁচে নিয়ে রুমাল বের করতে করতে বলল–সরি… বোধহয় ঠান্ডা লেগেছে!

ইটস্ ও কে। পবিত্রর কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। সে প্রসঙ্গে ফিরে আসে–রিয়া যদি না করে থাকে, তবে কে?

রিয়া অপরাধ করেছিল ঠিকই। কিন্তু খুন করেনি। সে সাইবার ক্রাইম করতে পারে। কিন্তু খুন করার হলে তখনই করত। কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গিটা দেখো। সে অপরাধ করলেও লম্পট বাবাকে আইনি শাস্তিই দিতে চেয়েছিল। ঠান্ডা মাথায় রীতিমতো অঙ্ক করে খুন করাটা তার মেন্টালিটিতে খাপ খাচ্ছে না। অধিরাজ রুমালে নাক মুছতে মুছতে বলল–সে হ্যাকার হিসাবে জিনিয়াস হতে পারে। তবে এরকম প্রায় পারফেক্ট ক্রাইম করতে পারবে বলে মনে হয় না। লক্ষ করে দেখো, খুনি যেভাবে কাজ করছে তাতে স্পষ্ট, পুলিশের তদন্ত পদ্ধতি সে খুব ভালোভাবেই জানে। পুলিশ কোন্ রাস্তায় যেতে পারে, সেগুলো সে আগে থেকেই জেনে বসে আছে। পুলিশের ইনভেস্টিগেশনের স্টাইল জানে বলে রীতিমতো অঙ্ক কষেই চালগুলো দিচ্ছে। সাইবার সেল যে সর্বনাশিনীর প্রোফাইলের পেছনে দৌড়াবে, ট্রাফিকের সিসিটিভি ফুটেজ দেখবে, ফরেনসিক প্রমাণের জন্য উঠে পড়ে খুঁজবে–সবটাই ভালোভাবে জানে। তাই একটাও লুজ বল খেলেনি।

আমাদের ডিপার্টমেন্টের কেউ…?

হওয়া অসম্ভব নয়। আমি কোনো সম্ভাবনাকেই বাদ দিচ্ছি না। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ–তবে পুলিশি ইনভেস্টিগেশন জানার জন্য ডিপার্টমেন্টের কেউ হওয়ার দরকার নেই। আজকাল টিভিতে যে পরিমাণ ক্রাইম শো দেখানো হয়–ক্রাইম প্যাট্রল, সাবধান ইন্ডিয়া, পুলিশ ফাইলস এটট্রো, সেগুলো রেগুলার ফলো করলেই পুলিশের প্রসিডিওর জানতে বাকি থাকে না। আমার ধারণা, হয় তিনি ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে যুক্ত, নয় ক্রাইম নিউজ, ক্রাইম শোটিভি সিরিজগুলো খুব খুঁটিয়ে দেখেন। সেগুলোর কল্যাণেই ঘুঘু হয়ে বসে আছেন।

কিন্তু আমার প্রশ্নটা যেখানে ছিল, সেখানেই থেকে গেল যে! রিয়া যদি না হয়, তবে খুনগুলো কে করছে?

রিয়ার চেয়েও যার মি. উমঙ্গ বাজাজের ওপর রাগ বেশি থাকা উচিত। নিগ্লোবটু চেহারার রিয়া, অহল্যা যার প্রিয়তম মানুষ। মি. বাজাজের অহল্যার ওপরে অত্যাচারের ইতিহাসটা যে রিয়ার থেকেও বেশি জানে। যে নিজের চোখে অহল্যাকে প্রতিনিয়ত অপমানিত হতে দেখেছে। রিয়া যেটা দেখেনি তা সে দেখেছে। রিয়া নিজের মা-কে দেখেনি, তাঁর স্নেহ পায়নি–তা সত্ত্বেও সে নিজের বাপকে আরও একটু হলেই জেলের ভাত খাওয়াচ্ছিল! তবে একবার তার কথা ভাবো যে অহল্যার স্নেহ, মমতা, দুঃখ, কান্না সব স্বচক্ষে দেখেছে। স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতিশোধস্পৃহা আরও অনেক বেশি।

সেটা কে?

অধিরাজ রহস্যময় হাসল–রিয়ার কথা বলতে গিয়ে তুমি একটা কথা বলেছিলে। ওর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিলে–উমঙ্গ অ্যান্ড্রু বাজাজের ছোট কন্যে।

ছোট কন্যে, ছোট সন্তান নয়। এখন প্রশ্ন হলো রিয়া যদি ছোট কন্যে হয়, তবে বড় কন্যেটি কে? কী করেন তিনি? এখন কোথায় আছেন? তার কথা তো বললে না?

প্রিয়া বাজাজ! সে তো…! দাঁড়াও দাঁড়াও…!পবিত্র থমকে গিয়েছে। তার চোখ বিস্ফারিত–তার মানে…?

মানে কিছুই নয়। অপরাধী যেমন পুলিশের সমস্ত রুটিন এনকোয়ারি, ইনভেস্টিগেশনের বাইরে গিয়ে খেলছে, আমিও তেমনই পুরো আউট অফ বক্স খেলছি। পুরোটাই এখনও থিওরি। যুক্তিযুক্ত অনুমানমাত্র। অধিরাজের মুখ গম্ভীর–এই প্রিয়া বাজাজের গল্প কিছু জানো? রিয়া যখন এই কাণ্ডটা করে তখন এল্ডার সিস্টার কোথায় ছিলেন সেটা তো বলেনি।

কারণএল্ডার মিস বাজাজ সিনেই ছিলেন না। মি. বাজাজ জানিয়েছিলেন যে প্রিয়া অল্প বয়েসেই নাকি কোন্ হতভাগা অপোগণ্ডকে বিয়ে করবে বলে বাড়ি থেকে অনেক আগেই পালিয়ে গিয়েছিল।

প্রিয়া রিয়ার থেকে কত বড়?

দশ বছরের বড়।

দশ বছর! অধিরাজের চোখে কেমন যেন বিষণ্ণতা। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে–অভিশপ্ত শৈশব! রিয়ার থেকেও এর কপাল খারাপ। বাবার লাম্পট্য, মায়ের হতাশা-অপমান-মৃত্যু বোঝার জন্য দশ বছর বয়স যথেষ্ট। সে বুঝেছিল–এবং গুনে গুনে বদলাও নেওয়ার সম্ভাবনাটাও ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না।

কিন্তু সঞ্জীব রায়চৌধুরী, অর্জুন শিকদারই কেন? বাপের ওপর রাগ যখন বাপকেই মারলে পারে!

বাপকেই তো মারছে! বারবার তাকেই তো খুন করে যাচ্ছে সে। শুধু তার দৃষ্টিকোণটা বুঝতে পারছি না আমরা। তার কণ্ঠে একটু যেন ব্যথার আভাস-বাবাকে এত ঘৃণা করে যে যার মধ্যেই বাবার গুণগুলো দেখছে, তাকেই খুন করছে। যেসব বেইমান পুরুষেরা নিজের স্ত্রী-সন্তানকে ভাসিয়ে দিয়ে তার কাছে চলে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে নিজের বাপকেই দেখছে ও। নিজের নাম সর্বনাশিনী রেখেছে ঠিকই–তবে হতভাগিনী নামটাও সঠিক হতো বোধহয়! নিজের বাপকেও ছাড়ার চান্স কম। তার চোখে যেন দুনিয়ার রহস্য এসে জমেছে–আমি খুব আশ্চর্য হবো না যদি কিছুদিন পরেই সর্বনাশিনীর আরআইপি পোস্টে উমঙ্গ অ্যান্ড্রু বাজাজের ডেথ ফোরকাস্ট হয়। কিন্তু সেটা তো পরের কথা। আপাতত বিজয় জয়সওয়াল…।

কিন্তু বিজয় জয়সওয়াল তো সুস্থই আছেন। পবিত্র অবাক-তাকে নিয়ে ভাবার কী আছে?

অধিরাজ যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিল। তার মনের মধ্যে অদ্ভুত এক আশঙ্কার মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। এমন হওয়ার তো কথা নয়! যতটুকু খুনির মনকে পড়ে উঠতে পেরেছে, তাতে এরকম ফাজলামি সে করবে না। কথা দিয়ে কথার খেলাপ করার লোক সে নয়। তার বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণাঙ্গী রিপোর্টারের প্রশ্নটা- বিজয় জয়সওয়ালের ডেথ ফোরকাস্টটা কি তবে প্র্যাঙ্ক ছিল?

অধিরাজের ভুরুতে ভাঁজ পড়ল। সর্বনাশিনীকে যতটুকু চিনেছে, তাতে বিজয় জয়সওয়ালের বাঁচার কথাই নয়! কিন্তু বিজয় জয়সওয়াল দিব্যি বেঁচে বর্তে আছেন। ডাক্তাররা আজই ফাইনালি জানিয়েছেন যেকোনোরকম বিষ তাঁর দেহে নেই। তবু আরও কিছুদিন তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখতে চাইছেন তাঁরা। তাছাড়া সঞ্জীব রায়চৌধুরী আর অর্জুন শিকদারের প্রোফাইলের সঙ্গে ঠিক বিজয়ের প্রোফাইল মিলছে না। বিজয় লম্পট নন্। স্ত্রীর সঙ্গে অসন্তোষ থাকলেও সেটার কারণ সম্পূর্ণ আলাদা। অন্য দুজনের স্ত্রী কালো এবং অসুন্দর ছিলেন। কিন্তু মানসী জয়সওয়াল ডানাকাটা পরি! সুন্দরী ও সুতনুকা। মহিলার বয়েস প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি হওয়া উচিত। অথচ দেখলে ত্রিশ-বত্রিশের বেশি মনে হয় না। অন্য দুজনের সন্তানও ছিল। বিজয় জয়সওয়াল নিঃসন্তান!

এতখানি পার্থক্য! দুজন ভিকটিমের সঙ্গে বিজয়ের কোনো মিলই নেই! সর্বনাশিনী শিকার নির্বাচনে এত বড় ভুল কী করে করে বসল! সে তো এতবড় ভুল করার লোক নয়! নিজে ভুল করেছে না অন্যদের ভুল করাতে চায়…!

অধিরাজ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো কেঁপে উঠল। একটা হাড় হিম করা ভয় তাকে স্পর্শ করেছে। সে ফিসফিস করে বলল–কলকাতায় বিজয় জয়সওয়াল নামের শুধু একটা লোক নেই পবিত্র! এই বিজয় জয়সওয়াল যদি বেঁচে থাকেন তবে…।

তবে…। রুদ্ধশ্বাসে বলল অফিসার পবিত্র আচার্য।

অন্য কোনো বিজয় জয়সওয়াল মারা যাবেন! অধিরাজ প্রায় লাফিয়ে ওঠে-পবিত্র…! শহরে কতজন বিজয় জয়সওয়াল আছেন? ফাইন্ড আউট ইমিডিয়েটলি। তারা ঠিকঠাক আছেন? আরআইপি পোস্টটা পড়েছে বাহাত্তর ঘণ্টার বেশি হয়ে গিয়েছে। বেশি সময় নেই।

ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল পবিত্র। আর একটিও কথা না বলে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *