০১. বিভীষিকা

আমার ডেঞ্জারাস মামী মুহম্মদ জাফর ইকবাল
প্রথম প্রকাশ : অক্টোবর ২০২১
Amar dangerous Mami by Muhammed Zafar Iqbal.

.

উৎসর্গ

লুকিয়ে গল্পবই পড়ার জন্য যে ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা-মায়ের কাছে শাস্তি পায়। আমি জানি, অনেক বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো বই পড়তে দেন না।

.

বিভীষিকা

হ্যাঁ, এক শব্দে যদি কেউ আমার জীবনটাকে ব্যাখ্যা করতে চায় তাহলে সেই শব্দটা হবে বিভীষিকা। কেউ যেন মনে না করে আমার চারপাশে যারা আছে তারা বুঝি সবাই মিলে আমার জীবনটাকে বিভীষিকাময় করে রেখেছে, মোটও সেরকম কিছু নয়। বরং উলটোটাই সত্যি–আমার বাসার সবাই, স্কুলের বন্ধু-বান্ধব (এক দুজন রাক্ষস টাইপ স্যার ম্যাডাম ছাড়া), অন্য সব স্যার ম্যাডাম সবাই খুবই ভালো মানুষ। সত্যি কথা বলতে কী, আমিই একটু পাজী টাইপের, ইচ্ছা না থাকলেও কীভাবে কীভাবে জানি একটার পর একটা ঝামেলা পাকিয়ে ফেলি। কিন্তু তারপরেও আমার নিজের কাছে মনে হয় আমার জীবনটা একটা মূর্তিমান বিভীষিকা।

আমাদের বাসায় আছেন আব্বু, আম্মু, বড়ো বোন মিলা, আমি টুলু আর ছোটো ভাই পিলু। আন্ধুকে দিয়ে শুরু করা যাক। আব্বু হচ্ছেন পৃথিবীর সবচেয়ে ভুলোভালা মানুষ। এরকম একজন মানুষ কেমন করে কলেজের প্রফেসর হতে পারেন আমি সেটা চিন্তা করেও পাই না। আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় আব্বু নিশ্চয়ই মাঝেমধ্যে ভুলভাল কলেজে গিয়ে ভুলভাল ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়ে চলে আসেন। পড়ানও নিশ্চয়ই ভুলভাল জিনিস কিন্তু আজকালকার ছাত্রছাত্রীরা সেটা মনে হয় বুঝতেও পারে না। আর কাজকর্ম দেখে আম্মু মাঝে মাঝেই মাথা নেড়ে বলেন, “আমার সাথে বিয়ে না হলে তোমার যে কী হতো!”

কথাটা মনে হয় সত্যি, তাই আব্বু কেমন যেন বাচ্চা মানুষের মতো মাথা নেড়ে হাসেন, তারপরে বলেন, “ঠিকই বলেছ। তুমি আমাকে বিয়ে করেছিলে বলেই টিকে আছি।”

আম্মু বলেন, “আমি তোমাকে বিয়ে না করলে অবশ্য তোমার কোনোদিন বিয়েই হতো না। কোন মেয়ের মাথা খারাপ হয়েছে যে তোমাকে বিয়ে করবে?”

“আব্বু কোনো কথা না বলে আবার মাথা নাড়েন আর হাসেন। আমার সন্দেহ হয় যে আম্মু কী বলেছেন আব্বু এর মাঝে সেটাও নিশ্চয়ই ভুলে গেছেন। যাই হোক, এখন কথা হচ্ছে এরকম ভুলোভালা একজন মানুষ আমার জীবনে বিভীষিকা হয় কেমন করে?

সেটার অনেক কারণ আছে–একটা হচ্ছে আমার স্কুল। আমার নতুন স্কুলটা একটা ঢংয়ের স্কুল, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েই তাদের শান্তি নাই, টং করার জন্য তাদের মাঝে মাঝেই ছেলেমেয়েদের বাবা-মায়েদের সাথে কথা বলতে হয়। যারা নেকু নেকু টাইপের আঠা আঠা ভালো ছেলেমেয়ে, তাদের কোনো সমস্যা নাই, বাবা-মায়েরা যখন জানতে পারেন স্কুলে তাদের ছেলেমেয়েরা কত ভালো করছে তখন তারা মহাখুশী হয়ে ফিরে আসেন। ঝামেলাটা হয় আমার মতো দুই চারজনের যাদের লেখাপড়ার কোনো ইচ্ছা নাই, ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সাথেও যারা মাঝেমধ্যে একটু মারামারি করে, যাদের ক্রিকেট বল লেগে জানালার কাঁচ ভেঙে যায়, যারা লাইব্রেরির বই হারিয়ে ফেলে–এরকম ছেলেমেয়েদের। আমি চেষ্টা করি আব্বুকে নিয়ে যেতে, আম্মু যদি আমার সব অপকর্মের কথা জেনে যায় তাহলে পরে বিপদ হতে পারে।

শেষবার যখন আলুকে নিয়ে গেছি তখন জিনিয়া ম্যাডাম কাগজপত্র দেখে আব্বুকে বললেন, “আপনার ছেলের মনে হয় ডিসিপ্লিন নিয়ে একটু সমস্যা আছে।”

আব্বুর কথাটা বুঝতে একটু সময় লাগল, তারপর বুঝলেন ভুলভাবে। আব্বু হা হা করে হাসার চেষ্টা করে বললেন, “কার নাই? ইংরেজি ল্যাংগুয়েজটাই একটা সমস্যা। ডিসিপ্লিন শব্দটার মাঝে এস এর পর বাড়তি একটা সি দেওয়ার দরকার কী? মাঝে মাঝে আমারই প্যাঁচ লেগে যায়। তারপর ধরেন নিমোনিয়া শব্দটা—”

জিনিয়া ম্যাডাম মুখ শক্ত করে বললেন, “না, আমি বানান নিয়ে কথা বলছি না। আমি বলছি ডিসিপ্লিন ব্যাপারটা নিয়ে। আমার কাছে বিশাল লিস্ট।”

আব্বু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। মনে হয় বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে তার ছেলের ডিসিপ্লিন নিয়ে সমস্যা থাকতে পারে।

জিনিয়া ম্যাডাম মুখটাকে রাক্ষুসীর মতো করে বললেন, “মনে হয় লেখাপড়াতেও মন নেই। সব সাবজেক্টে টেনেটুনে পাশ। গণিতের অবস্থা ভয়াবহ।”

আমি না শোনার ভান করে গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার বাম হাতের কেনে আঙুলটা পরীক্ষা করতে লাগলাম। শুনলাম রাক্ষুসী ম্যাডাম বলছেন, “এই যে গণিত পরীক্ষার খাতাটা এখানে আছে। প্রশ্ন করা আছে যতজন শ্রমিক তত টাকা মজুরি হিসেবে এত টাকা দেওয়া হয়েছে, শ্রমিকদের মজুরি কত। আপনার ছেলে কী লিখেছে জানেন?”

আমি শুনলাম আব্বু দুর্বল গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কী লিখেছে?”

সে লিখেছে, “শ্রমিকদের যথেষ্ট মজুরি দেওয়া হয় নাই। এটি অন্যায় এবং অমানবিক। এটি একধরনের শোষণ।”

রাক্ষুসী ম্যাডাম একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “শোষণ বানানটা ভুল।”

আমি চোখের কোনা দিয়ে আব্বুর মুখের দিকে তাকালাম, দেখলাম তার ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি। আব্বু মনে হলো অনেক কষ্ট করে তার হাসিটা গোপন করে জিজ্ঞেস করলেন, “এই উত্তর লিখে সে কত পেয়েছে?”

রাক্ষুসী ম্যাডাম আবার একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, “মাইনাস টেন।”

আব্বু বললেন, “ভুল তো লিখে নাই, শূন্য দিলেই হতো।”

আমি মাথা নেড়ে আব্বুর কথা সমর্থন করব কিনা বুঝতে পারলাম না, শেষ পর্যন্ত না শোনার ভান করে পরের আঙুলটা পরীক্ষা করতে লাগলাম।

.

যখন বাসায় আসছি তখন আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম, “আব্বু তুমি কি আমার ওপর রাগ হয়েছ?”

“রাগ? কেন?” মনে হলো আব্বু এর মাঝে সবকিছু ভুলে গেছেন।

আমি বললাম, “এই যে পরীক্ষায় কম নম্বর পাচ্ছি। স্যার ম্যাডামরা রাগ। আমার ডিসিপ্লিন নিয়ে সমস্যা।”

আব্বু বললেন, “ও আচ্ছা! সেই ব্যাপার? বুঝতে পারছি না রাগ হব নাকি অবাক হব। কাঁদব না হাসব।”

আমি বড়ো মানুষের মতো বললাম, “আব্বু তোমার রাগ হওয়ারও দরকার নাই খুশী হওয়ারও দরকার নাই, হাসারও দরকার নাই কাদারও দরকার নাই।”

“তাহলে?”

“শুধু ভুলে যাও।”

“শুধু ভুলে যাব?”

“হ্যাঁ ভুলে যাও। এগুলো মনে রাখার দরকার কী? স্কুলের জিনিস স্কুলে থাকুক। কী বলো আব্বু?”

আব্বু বললেন, “ঠিক আছে। স্কুলের জিনিস স্কুলে থাকুক। কিন্তু—”

“কিন্তু কী?”

“অঙ্কে ফেল করলে তো ফেল।”

আমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললাম, “না আব্বু, ফেল করব কেন? ফেল করব না। খালি বুঝতে পারি না আমরা ক্লাস সেভেনে পড়ি আমাদের শ্রমিকদের বেতন নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে কেন?”

আব্বু কিছু বললেন না, আমি তখন আবার মনে করিয়ে দিলাম, “আব্বু, মনে থাকবে তো?”

“কী মনে থাকবে?”

“জিনিয়া ম্যাডাম আমাকে নিয়ে যে খারাপ খারাপ কথা বলেছে সেগুলো বাসায় বলবে না।”

“ঠিক আছে।”

“মনে থাকবে তো? তুমি তো আবার সব কথা ভুলে যাও।”

“ভুলব না।”

কিন্তু বাসায় এসে আব্বু ভুলে গেলেন। বাসায় ঢুকেই আব্বু চিৎকার করে সবাইকে ডেকে বললেন, “এই যে কে কোথায়, তোমরা সবাই এসে শুনে যাও। আমাদের টুলু তার অঙ্ক পরীক্ষার খাতায় কী লিখেছে-”

তারপর একেবারে দাঁড়ি কমা সেমিকোলনসহ আমাদের রাক্ষুসী জিনিয়া ম্যাডাম যে কথাগুলো বলেছেন সেগুলো হাত পা নেড়ে নেড়ে সবাইকে বললেন। আমার ভুলোভালা আব্বু কিছুই ভুললেন না, শুধু ভুলে গেলেন যে আমাকে কথা দিয়েছিলেন কাউকে বলবেন না।

তারপর কী হলো আমি সেটা বলতে চাই না। সত্যি কথা বলতে কী মনেও করতে চাই না। সেটা ছিল জীবনের চরম বিভীষিকা, সেই বিভীষিকা এখনো শেষ হয় নাই। বাসায় কেউ বেড়াতে এলে এখনো প্রথমেই আব্বু আম্মুকে জিজ্ঞেস করে, “আপনার সেই ছেলে কোথায়? যে অঙ্ক পরীক্ষায় শ্রমিকের শোষণের কথা লিখে এসেছিল?”

আমার তখন মাথা নিচু করে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়।

যাই হোক, এবারে বলি আম্মুর কথা। সারাজীবন শুধু শুনে এসেছি মা এবং সন্তানের ভালোবাসার কথা। তাদের ভেতরে আছে মায়া মমতা স্নেহের বন্ধন, সেই জন্য পৃথিবীটা নাকি টিকে আছে। কিন্তু কেউ আমাকে বলে নাই যে পৃথিবীর মায়েরা ছেলেমেয়ের চোখের দিকে তাকালেই তাদের যা কিছু আছে সবকিছু জেনে যায়, সবকিছু বুঝে ফেলে। আম্মু আমাকে দেখেই বুঝে ফেলেন স্কুলে মারপিট করে এসেছি কিনা, পরীক্ষায় গোল্লা পেয়েছি কিনা, হোমওয়ার্ক না করেই স্কুলে যাচ্ছি কিনা, ওপরে পরিষ্কার শার্ট কিন্তু নিচে ময়লা গেঞ্জি পরেই রওনা দিয়েছি কিনা কিংবা এই রকম আরও হাজারটা জিনিস।

সেই দিন বিকালবেলা খেলতে যাব, আম্মু আমাকে ডাকলেন, “টুলু, কাছে আয়।”

আমি আম্মুর কাছে গেলাম। আম্মু আমার হাতটা ধরে বললেন, “তোর শরীর খারাপ লাগছে?”

আমি বললাম, “নাহ। শরীর খারাপ লাগবে কেন?”

আম্মু বললেন, “আজ খেলতে না গেলি। বাসায় বিশ্রাম নে।”

আম্মু একইসাথে বাসার প্রধানমন্ত্রী আর সেনাবাহিনীর প্রধান, তার কথা না শুনে উপায় আছে? তাই খেলতে গেলাম না আর। ঠিক দশ মিনিট পর আপুর ওপর হড়হড় করে বমি করে দিলাম। বমিতেই শেষ হলো না, দেখতে দেখতে উথালপাথাল জ্বর। একজন মানুষ যদি শুধু একবার আমার দিকে তাকিয়েই শুধু ময়লা গেঞ্জি না, আমার ব্রেনের ভেতর কী হচ্ছে সেটা জেনেই শেষ করেন না, শরীরের ভেতর কী কী ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাস ঘুরঘুর করছে সেটাও দেখে ফেলেন তাহলে তো মুশকিল। আমার বয়স বাড়ছে, টের পাচ্ছি হরমোন কিক করা শুরু করছে। ক্লাসের যে মেয়েগুলোকে এতদিন ফাজিল বলে মনে হতো আজকাল দেখি এত ফাজিল মনে হয় না। ক্লাসের পাজী মেয়েটা সেদিন চেটে চেটে গোবরের মতো দেখতে কী একটা চাটনি খাচ্ছিল, আমাকে দেখে বলল, “খাবি একটু?” আমি জন্মেও এগুলো খাই না কিন্তু না করতে পারলাম না। একটু খেয়ে ফেললাম–এমন টক যে বলার মতো না কিন্তু সেটা আর বললাম না, মাথা নেড়ে বললাম যে খেতে খারাপ না। সুন্দর গান গাইতে পারে মেয়েটা সেদিন আমাদের ক্লাসের নামকরা ভালো ছাত্র রঞ্জুর সাথে হেসে হেসে কথা বলছিল দেখে আমার কেমন জানি হিংসা হলো! এই রকম ছোটো ছোটো ঘটনা ঘটছে যেগুলোর নিশানা ভালো না। আম্মু যদি আমার চোখের দিকে তাকিয়েই সব জেনে ফেলেন তাহলে তো মুশকিল।

একদিন আম্মুকে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম। আম্মুর মেজাজ মর্জি যখন একটু ঠান্ডা এবং আশেপাশে আর কেউ নাই তখন জিজ্ঞেস করলাম, “আম্মু, তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি?”

আম্মু বললেন, “কী জিনিস?”

আমি ইতস্তত করে বললাম, “আমি কী করি, কী চিন্তা করি তুমি সেটা বুঝে ফেল কেমন করে?”

আম্মু একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, তারপর কেমন যেন মুচকি হাসলেন, তারপর বললেন, “তুই কে?”

আমি অবাক হয়ে বুকে হাত দিয়ে বললাম, “আমি! মানে আমি টুলু।”

আম্মু বললেন, “তোর কি ধারণা তুই আলাদা একটা মানুষ?”

আমি আরও অবাক হয়ে বললাম, “আমি আলাদা মানুষ হব না কেন?”

আম্মু মাথা নাড়লেন, বললেন, “তুই আলাদা মানুষ না। তুই আমার পেটে ছিলি নয় মাস তুই আমার একটা অংশ।”

“কিন্তু—কিন্তু–” আমি বললাম, “এখন তো আমি তোমার পেটে নাই!”

“তাতে কী হয়েছে? জন্ম হওয়ার পর বহুদিন তুই জানতি না তুই আলাদা মানুষ। খিদে লাগলে আমার সাথে চিপসে লেগে থাকতি, দুধ খেয়ে ঘেউক করে একটা ঢেকুর তুলতি! তোর ধারণা ছিল আমি আর তুই এক মানুষ।”

আমি আবার চেষ্টা করলাম, “কিন্তু কিন্তু–এখন? এখন আমি তো আলাদা মানুষ!”

আম্মু কীভাবে জানি হাসলেন, বললেন, “তুই মনে করছিস তুই আলাদা। কিন্তু ছেলেমেয়েরা কখনো মায়ের থেকে আলাদা হতে পারে না।”

আমি প্রায় আর্তনাদ করে বললাম, “কখনো পারে না?”

আম্মু মাথা নাড়লেন, “নাহ। তোর মন খারাপ হলে আমি বুঝতে পারি। তোর মন খুশী হলে আমি বুঝতে পারি। মনে নাই স্কুলে পড়ে গিয়ে যখন তোর হাত ভাঙল আমি বাসা থেকে টের পেয়ে গেলাম। মনটা ছটফট করছিল তোর আব্বুকে ফোন করলাম—”

আমার মনে পড়ল। সত্যি সত্যি যখন স্কুলের দেওয়াল থেকে পড়ে আমার হাত ভেঙে গিয়েছিল আম্মু বাসায় বসে থেকে কেমন করে সেটা জানি টের পেয়ে গিয়েছিলেন। রীতিমতো রহস্য।

আমি হতাশ হয়ে বললাম, “তার মানে আমার মনের মাঝে কী আছে সব তুমি জানো?”

“মোটামুটি!”

আমি এখনো বুঝতে পারছি না এটা কীভাবে সম্ভব। কোনো বইয়ে এইগুলো কি লেখা আছে কীভাবে এটা হয়? আম্মু কি আমার সাথে ঠাট্টা করছেন? ঠাট্টা হোক আর যাই হোক, আসল কথা হচ্ছে আমার নিজস্ব জিনিস বলে কিছু নাই! আমি কী করব, কী চিন্তা করব সব আম্মু জানবে? আমাকে পুরো জীবন লেবন্দু হয়ে কাটাতে হবে? এটা যদি বিভীষিকা না হয় তাহলে বিভীষিকা আর কী হতে পারে?

.

এবার বলি আপুর কথা। আপুর নাম মিলা, সে আমার থেকে তিন বছর বড়ো, পড়ে ক্লাস টেনে। আপু হচ্ছে আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো বিভীষিকা। এটা শুনে কেউ যেন মনে না করে আপু ভয়ংকর পাজী এবং সবসময় আমাকে জ্বালাতন করছে। আমি আগেই বলেছি আমার আব্বু-আম্মু আর ভাই-বোন কেউ পাজী না, এদের মাঝে আমিই একমাত্র অল্প কিছু পাজী। আমার আপু যদি পাজী না হয় তাহলে সে কেমন করে আমার জীবনের বিভীষিকা হতে পারে?

আপু হচ্ছে একেবারে নিখুঁত ভালো মেয়ে, একজন মানুষ এর থেকে ভালো হতে পারে না। তার চেহারা পরীর মতন কিন্তু সে ভুলেও সেজেগুজে নায়িকার মতো হয়ে থাকে না। লেখাপড়ায় যেরকম ভালো, আচার ব্যবহার কাজকর্ম চালচলনেও সেরকম ভালো। লেখাপড়ায় ভালো বললেই চোখে ভারী চশমা এবং কুঁজো টাইপের একজনের চেহারা ভেসে উঠে, যে দিনরাত মাথা গুঁজে পড়ছে, এক কোচিং সেন্টার থেকে আরেক কোচিং সেন্টারে দৌড়াদৌড়ি করছে, পাঠ্যবই এবং গাইড বই মুখস্থ করে ফেলছে। কিন্তু আপু মোটেও সেরকম না। সে জীবনে কোনো কোচিং সেন্টারে যায় নাই, কোনো গাইড বই হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে নাই। কখনো প্রাইভেট পড়ে নাই। বাম হাত দিয়ে লিখে সে পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে যেতে পারে কিন্তু জীবনেও তার চেষ্টা করে নাই। সে যত পাঠ্যবই পড়ে তার থেকে অনেক বেশী গল্পের বই পড়ে–শুধু আমার মতন কমিক আর ভূতের বই না, সবরকম বই। এমনকি কবিতার বই, একটা কবিতা কয়েকবার পড়লেই তার মুখস্থ হয়ে যায়। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি যখন তার ঘরে কেউ থাকে না তখন আপু জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় একটার পর একটা কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে। বিকাল বেলা আপু মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে খেলে। শীতের সময় টাকা তুলে কম্বল কিনে গরিব মানুষদের দিয়ে আসে। কখনো কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার আনার চেষ্টা করে না। আমাকে দেখেশুনে রাখে। আমি যখনই একটা বড়ো ঝামেলায় পড়ি তখন আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে।

আপু কখনোই আমাকে পড়া ধরে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে না। কিন্তু আমি যদি কিছু একটা জিজ্ঞেস করি আপু সেটা সময় নিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আমি না বুঝলেও একটুও অধৈর্য হয় না। এককথায় বলা যায় আপু হচ্ছে একেবারে পুরোপুরি ভালো একটা মেয়ে এবং সেজন্যই সে হচ্ছে আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো বিভীষিকা।

তার কারণটা বোঝা কঠিন না, প্রতি সেকেন্ডে সবাই আমাকে আপুর সাথে তুলনা করে আমি যে কত অপদার্থ সেটা আমাকে বুঝিয়ে দেয়। আমার জীবনে আমি সবচেয়ে বেশীবার যে বাক্যটা শুনেছি, সেটা হচ্ছে, “তোমার আপু এত ভালো একটা মেয়ে, তার ভাই হয়ে তুমি এরকম হলে কেমন করে?” শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে মনে হয় মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে চিৎকার করে রাস্তায় বের হয়ে যাই।

আমি ব্যাপারটা একদিন আপুকে বলেছিলাম, শুনে সে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। আমার মাথায় চাটি দিয়ে বলল, “ছাগল টাইপের লোজন তোকে এসব বলে আর তুই সেগুলো শুনে মেজাজ খারাপ করিস?”

“মিথ্যা তো বলে না। ঠিকই তো বলে।”

আপু হঠাৎ মুখ গম্ভীর করে বলল, “কোন কথাটা ঠিক? তুই খারাপ আর আমি ভালো?”

“হ্যাঁ, এটা কি ভুল?”

আপু বলল, “তুই জানিস আমার পরিচিতরা আমাকে কী বলে?”

“কী বলে?”

“তারা বলে আমি একটা গাধা।”

“গাধা? কেন? তোমাকে গাধা বলে কেন?”

তার কারণ আমি কোচিং করি না, প্রাইভেট পড়ি না। আউট বই পড়ি, পরীক্ষায় কম নাম্বার পাই, ফার্স্ট হই না। কম্পিটিশনে অংশ নিই না, মেডেল আনি না, আলতু ফালতু জায়গায় ভলান্টারি কাজ করে সময় নষ্ট করি–”

আপু হাসল, তারপর বলল, “আরও শুনতে চাস?”

“আরও আছে?”

“হ্যাঁ, আছে।”

“কী?”

“আমি কেন লিপস্টিক দিই না। ফাস্টফুডের দোকানে কেন ছেলেবন্ধু নিয়ে আড্ডা মারি না।”

আমি মাথা নাড়লাম, মনে হচ্ছে মেয়েদের আলাদা কিছু সমস্যা আছে যেগুলো আমাদের নাই। আপু বলল, “যখন সবাই এগুলো বলে তখন আমি কী করি জানিস?”

“কী করো?”

“এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিই। বুঝলি?”

আমি মাথা নাড়লাম। আপু বলল, “এখন থেকে তুইও এই কাজ করবি। আলতু ফালুত যত কথা শুনবি সেগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিবি। বুঝেছিস?”

আমি আবার মাথা নাড়লাম, “বুঝেছি।”

কিন্তু আমি সেটা করতে পারি না। আলতু ফালতু কথা এক কান দিয়ে ঢুকে কিন্তু অন্য কান দিয়ে বের হয় না। ভেতরে জমা হতে থাকে। জমা হচ্ছে তো হচ্ছেই, এখন এমন অবস্থা ভালো কথা আর কান দিয়ে ঢুকতে পারে না। এটা যদি বিভীষিকা না হয় তাহলে বিভীষিকা আর কী হবে?

.

এখন বাকী থাকল আমাদের সবচেয়ে ছোটো ভাই পিলু। তার বয়স সাত, পড়ে ক্লাস টুতে কিন্তু একটু ভ্যাবলা টাইপের। ছোটো বলে আব্বু আম্মু আদর করে করে মনে হয় এরকম ভ্যাবলা বানিয়ে দিয়েছেন। তার সবকিছু করে দিতে হয়, গেঞ্জি পর্যন্ত সোজা করে পরতে পারে না। মাঝে মাঝেই তার প্যান্টের বোতাম খুলে দিতে হয়। বড়ো হয়ে এর কী অবস্থা হবে কে জানে!

তার প্রিয় খেলা ছিল লুডু, একটা লুডুর বোর্ড নিয়ে সে ঘুরে বেড়াত কিন্তু কে তার সাথে লুডু খেলবে? আমার পেছনে দিন রাত ঘ্যান ঘ্যান করত, বলত, “ভাইয়া, চলো লুডু খেলি। প্লিজ ভাইয়া, প্লিজ।”

আমি বলতাম, “ধুর গাধা। লুডু একটা খেলা হলো? আমি এই বোকা মানুষের খেলা খেলি না।”

“তাহলে তুমি কী খেলবে?”

আমি ভাব দেখিয়ে বললাম, “দাবা খেলতে চাইলে খেলতে পারি। দাবা হচ্ছে বুদ্ধির খেলা।”

“কিন্তু আমি তো দাবা খেলা জানি না।” আমি ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললাম, “সেটা তোর মাথাব্যথা।”

তখন পিলু নতুন একটা ঘ্যান ঘ্যান শুরু করল, “ভাইয়া আমাকে দাবা খেলা শিখিয়ে দাও। প্লিজ ভাইয়া, প্লিজ।”

আমি তাকে ধমক দিয়ে বিদায় করে দেওয়ার চেষ্টা করলাম, বললাম, “তুই খেলবি দাবা? সাপ লুডু খেলতেই তোর কালো ঘাম ছুটে যায়।”

পিলু বিদায় হলো না, ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগল। “প্লিজ ভাইয়া প্লিজ।”

ঘ্যান ঘ্যান করার মাঝে পিলুর মতো এক্সপার্ট আর কেউ নাই তাই একদিন আমার তাকে দাবা খেলা শিখিয়ে দিতে হলো। একটু ভ্যাবলা টাইপের হলেও সে দেখি বেশ মনোযোগ দিয়ে খেলাটা শিখল। দাবার গুটির মাঝে ঘোড়াটা দেখতে ঘোড়ার মতো হলেও হাতীটা কেন হাতীর মতো না সেটা নিয়ে সে অনেকক্ষণ আমার সাথে কথা বলল। রাজা থেকে মন্ত্রীর তেজ কেন বেশী সেটা নিয়েও পিলু অনেকক্ষণ আমার সাথে তর্ক করল।

আমি ধরে নিলাম যার লুডু খেলায় অভ্যাস, দুদিনে তার দাবা খেলায় উৎসাহ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা হলো না, দুদিন পর সে দাবার বোর্ড নিয়ে আমার পেছনে ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগল, “ভাইয়া চলো দাবা খেলি। তুমি বলেছিলে দাবা খেলবে আমার সাথে।”

তাকে বিদায় করা কঠিন, আমি তখন একটা ডিটেকটিভ বই পড়ছি। দুই নম্বর মার্ডারটা হয়ে গেছে, তিন নম্বরটা হবে হবে করছে, এখন পিলুর মতো ভ্যাবলা মানুষের সাথে কে দাবা খেলবে? কিন্তু সে যেহেতু বিদায় নিবে না তাই ভাবলাম দ্রুত এক দান দাবা খেলে তাকে বিদায় করে দিই। আমি বললাম, “এক দান খেলব, ঠিক আছে?”

পিলু রাজী হলো। আমি ডিটেকটিভ বইটা পড়তে পড়তে তার সাথে খেলছি, খেলা শেষ করতে দেরী হওয়ার কথা না। খানিকক্ষণ পর পিলু বলল, “ভাইয়া, তোমার খেলা শেষ।”

আমি বোর্ডের দিকে তাকিয়ে দেখি সত্যি সত্যি আমার সব গুটি খেয়ে গাধাটা খেলা শেষ করে দিয়েছে। পিলু সব দাঁত বের করে হেসে বলল, “তুমি হেরে গেছ।”

আমি মুখ খিঁচিয়ে বললাম, “আমি মন দিয়ে খেলি নাই, বই পড়ছিলাম।”

পিলু গাধাটা ভ্যাবলার মতো হাসতে হাসতে বলল, “হেরে গেছ, হেরে গেছ, হেরে গেছ।”

আমি বইটা বন্ধ করে মুখ শক্ত করে বললাম, “সাহস থাকলে আরেকবার খেল।”

পিলু সাথে সাথে বোর্ডে গুটি সাজিয়ে আবার ফেলতে বসে গেল আর কী আশ্চর্য আমি আবার হেরে গেলাম। পিলু দাঁত বের করে হাসল, বলল, “হারু পার্টি হারু পার্টি হারু পার্টি–”

আমার তখন রোখ চেপে আছে, দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, “আর একবার খেল।”

পিলু আরও একবার খেলে আমাকে আবার হারিয়ে দিল। কী আশ্চর্য! পিলু তখন বোর্ড গুটিয়ে তার গুটিগুলো বাক্সে ঢুকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “আর খেলার দরকার নাই।”

আমি বললাম, “কেন?”

ভ্যাবলাটা বলল, “তুমি খালি ভুল চাল দাও আর চাল ফিরিয়ে নাও তোমার সাথে খেলে আনন্দ নাই।”

কত বড়ো সাহস, ইচ্ছে হলো মাথাটা ভেঙে দিই, কিন্তু কথাটা তো সত্যি! পিলু সব দিক দিয়ে ভ্যাবলা কিন্তু দাবা খেলায় অসাধারণ।

.

দেখতে দেখতে পিলুর খেলা আরও ভালো হয়ে গেল। আব্বু তাকে কী একটা দাবার বই কিনে দিয়েছেন সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই বই খুলে বসে থাকে। দাবার বোর্ডে গুটি সাজিয়ে নিজে নিজে গুটি চালে আর বিড়বিড় করে কথা বলে। মাঝে মাঝে বোর্ড নিয়ে আমার কাছে এসে বলে, “ভাইয়া খেলবে এক দান?”

আমি ফ্যাকাশে মুখে বলি, “না, না!”

“আমি মন্ত্রী ছাড়া খেলব।”

“দরকার নাই।”

পিলু বাসায় সবার সাথে দাবা খেলে কিছু টাকা রোজগার করেছে, আমাকে সেই টাকার লোভ দেখায়। চোখ নাচিয়ে বলে, “ঠিক আছে তুমি যদি দশ দান টিকে থাক তাহলে দশ টাকা দিব।”

আমি রাজী হই না। এই পিলু এখন আমার জীবনের নতুন বিভীষিকা।

.

আমি অবশ্য মেনেই নিয়েছি আমার জীবনের এই বিভীষিকাগুলো নিয়েই আমার বেঁচে থাকতে হবে। মোটামুটি অভ্যাসই করে নিয়েছি কিন্তু তখন একদিন টের পেলাম আসলে আমি এতদিন যেগুলোকে বিভীষিকা মনে করে এসেছি সেগুলো মোটেও বিভীষিকা না–সেগুলো হচ্ছে ছোটোখাটো ঝামেলা।

সত্যিকারের বিভীষিকা কাকে বলে সেটা আমি হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম।

Leave a Reply to zahida jahan khanam Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *