কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথ

কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথ

কালিদাসপ্রীতি রবীন্দ্রনাথ লাভ করেছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ‘আত্মচরিতে’ কালিদাসের ভাষা মাঝে মাঝে উঁকি দিয়েছে, বিশেষ করে যেখানে তিনি হিমালয়ের শোভা-সৌন্দর্যের বর্ণনার চেষ্টা করেছেন।

মহর্ষির কালিদাসপ্রীতি তাঁর বিখ্যাত পুত্রদের প্রায় প্রত্যেকেই সংক্রামিত হয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের শকুন্তলার অনুবাদ কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শকুন্তলা’ প্রবন্ধে উদ্ধৃত করেছেন, আর নবমেঘোদয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথের সানুরাগ ‘মেঘদূত’-আবৃত্তি কিশোর-রবীন্দ্রনাথের চিত্ত যে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল ‘জীবনস্মৃতি’র পাঠকরা তা জানেন।

কিন্তু প্রতিভার স্বধর্ম স্বীকরণ-অনুকরণ নয়। রবীন্দ্রনাথের গভীর কালিদাসপ্রীতিতে তাঁর সেই স্বীকরণ-বৃত্তি কার্যকরী হয়েছে। কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের বিচার এক উপাদেয় সাহিত্যিক বিষয়, কিন্তু সহজসাধ্য নয় আদৌ, কেননা কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথ দুই কালের দুই মহাভাবুক ও মহাশিল্পী। এ-বিষয়ে মাত্র কিছু কিছু ইঙ্গিত দিতে আমরা চেষ্টা করবো।

প্রথমেই চোখে পড়ে কালীদাসের সৌন্দর্য-বোধে ও রস-বোধে আর রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য-বোধে ও রস-বোধে পার্থক্য। এ বিষয়ে মিলও তাঁদের মধ্যে যথেষ্ট। এই দুই কবিই পৃথিবীর শোভা-সৌন্দর্যের একান্ত অনুরাগী: কালিদাস ইন্দ্র সারথি মাতলির মুখে বলেছেন–অহহ উদাররমণীয়া পৃথিবী; তার সঙ্গে আত্মিক যোগ রয়েছে রবীন্দ্রনাথের এই ধরনের অগণিত উক্তির :

শ্যামলা বিপুলা এ ধরার পানে,
চেয়ে দেখি আমি মুগ্ধ নয়ানে…………(কবির পুরস্কার)
মাটির সুরে আমার সাধন–
আমার মনকে বেঁধেছে রে
এই ধরণীর মাটির বাঁধন। (গান)

বিশেষ লক্ষ্য করার বিষয় এই যে দুই কবির চোখেই পৃথিবীর মহিমা যেন অন্যনিরপেক্ষ–পৃথিবীর যিনি স্রষ্টা ও নিয়ন্তা তাঁর কথা অনেকখানি বিস্মৃত হয়ে এরা উপভোগ করেছেন পৃথিবীর শোভা-সৌন্দর্য। এক্ষেত্রে জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকৃতপ্রেমিক ওয়ার্ডসোয়ার্থের সঙ্গে এঁদের পার্থক্য সুস্পষ্ট, কেননা, ওয়ার্ডসোয়ার্থ

প্রকৃতির অপরূপতার সঙ্গে অভিন্নভাবে দেখেছেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্তার মহিমা। মায়াবাদী হিন্দুর কুলে এই দুই কবির জন্ম যেন অদ্ভুত। কিন্তু হিন্দুর মায়াবাদকে হিন্দু অহিন্দু উভয়েই অসঙ্গত-রকমে বড় করে দেখেছেন। প্রাচীন হিন্দু যে শুধু–এমনকি মুখ্যত–মায়াবাদী ছিলেন না তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ বাৎস্যায়ন, চাণক্য আর বিশেষভাবে ব্যাস– তাঁর মহাভারতের সংখ্যাহীন নায়ক-নায়িকা দোষে গুণে এমন প্রাণবন্ত যে তেমন বিচিত্র প্রাণবন্ত নরনারী– সৃষ্টি জগতের খুব কম সাহিত্যেই সম্ভবপর হয়েছে। কিন্তু কালিদাসের ও রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য-বোধে ও রস-বোধে এতখানি মিল সত্ত্বেও খুব বড় পার্থক্য ফুটে উঠেছে এইখানে যে কালিদাস যথেষ্ট ভোগবাদী– অবশ্য সবল সেই ভোগ তাই অসুন্দর নয় কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আনন্দবাদী; কালিদাসের সৌন্দর্য-বোধ ও রস-বোধের চাইতে সূক্ষ্মতর রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য-বোধ ও রস-বোধে। এ সম্পর্কে কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করছিঃ

বালেন্দুবক্ৰাণ্যবিকাশভাবাদভুঃ পলাশান্যতিলোহিনি।
সদ্যো বসন্তেন সমাগতানাং নক্ষতানীব বনস্থলীনামা।। [১]

আসোদ মিথিলাং স বেষ্টয়ন পীড়িতোপবন- পাদপাং বলৈঃ।
প্রতিরোধমসহিষ্ট সা পুরী স্ত্রীব কান্তপরিভোগমায়তমা।। [২]

জলপ্রান্তে ক্ষুদ্ধ ক্ষুব্ধ কম্পন রাখিয়া,
সজল চরণচিহ্ন আঁকিয়া আঁকিয়া
সোপানে সোপানে, তীরে উঠিলা রূপসী;
স্রস্ত কেশভার পৃষ্ঠে পড়ি গেল খসি।
অঙ্গে অঙ্গে যৌবনের তরঙ্গ উচ্ছল
লাবণ্যের মায়ামন্ত্রে স্থির অচঞ্চল
বন্দী হয়ে আছে–তারি শিখরে শিখরে
পড়িল মধ্যাহ্ন রৌদ্র………..
ঘিরি তার চারিপাশ
নিখিল বাতাস আর অনন্ত আকাশ
যেন এক ঠাই এসে আগ্রহে সন্নত
সর্বাঙ্গ চুম্বিল তার; সেবকের মতো
সিক্ত তনু মুছি নিল আতপ্ত অঞ্চলে
সযতনে, ছায়াখানি রক্ত পদতলে
চ্যুত বসনের মতো রহিল পড়িয়া।
অরণ্য রহিল স্তব্দ, বিস্ময়ে মরিয়া।
ত্যজিয়া বকুলমুল মৃদুমন্দ হাসি
উঠিল অনঙ্গদেব
সম্মুখেতে আসি
থমকিয়া দাঁড়াল সহসা। মুখপানে
চাহিল নিমেষহীন নিশ্চল নয়ানে
ক্ষণকাল তরে। পরক্ষণে ভূমি ’পরে
জানুপাতি বসি, নির্বাক বিস্ময়ভরে
নতশিরে পুষ্পধনু, পুষ্পশরভার
সমর্পিল পদপ্রান্তে পূজা-উপাচার
তৃণ শূন্য করি। নিরস্ত্র মদন পানে
চাহিলা সুন্দরী শান্ত প্রসন্ন বয়ানো (বিজয়িনী)

কালিদাসের ভোগবাদ রবীন্দ্রনাথ যেন সজাগ ভাবেই ‘শোধিত’ করে’ নিয়েছেন। ‘কুমারসম্ভবে’র শেষের অনেকগুলো সর্গ কালিদাসের রচনা নয় এই প্রচলিত মত তিনি অতি মনোজ্ঞ ভাবে সমর্থন করেছেন এই সনেটে–

যখন শুনালে কবি দেবদম্পতিরে
কুমারসম্ভবগান,–চারি দিকে ঘিরে
দাঁড়াল প্রথমগণ,–শিখরের ’পর
নামিল মন্থর শান্ত সন্ধ্যামেঘস্তর,–
স্থগিত বিদ্যলীলা, গর্জন বিরত,
কুমারের শিখী করি পুচ্ছ অবনত,
স্থির হয়ে দাঁড়াইল পার্বতীর পাশে
বাঁকায়ে উন্নত গ্রীবা! কভু স্মিত হাসে
কাঁপিল দেবীর ওষ্ঠ,–কভু দীর্ঘশ্বাস
অলক্ষ্যে বহিল,–কভু অশ্রুজলোচ্ছ্বাস
দেখা দিল আঁখি প্রান্তে–যবে অবশেষে
ব্যাকুল শরমখানি নয়ন নিমেষে
নামিল নীরবে,–কবি, চাহি দেবী পানে
সহসা থামিলে তুমি অসমাপ্ত গানে। (চৈতালি)

“সহসা অসমাপ্ত গানে” থামবার ধরন যে সাধারণত কালিদাসের নয় তার পর্যাপ্ত প্রমাণ তাঁর রচনায় রয়েছে। তবে তিনি প্রকৃতই সৌন্দর্যরসিক, তাই এমন সুকুমার রুচি এক্ষেত্রে তাতে আরোপ করা সঙ্গত ও শোভন দুইই হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘ঋতুসংহার’ সনেটটিও এমন শোভন ‘শোধনে’র দৃষ্টান্ত, কেননা মূল ‘ঋতুসংহার প্রকৃতির আবেগপ্রাবল্যের স্তোত্রও বটে আনন্দস্তোত্রও বটে।

কিন্তু কালিদাসের ভোগবাদের এই উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে সত্যের অনুরোধে না উল্লেখ করে’ উপায় নেই যে অন্যান্য বড় প্রতিভার মতো কালিদাসকেও দুই একটি লক্ষণের দ্বারা বুঝে ফেলার চেষ্টা করা বিড়ম্বনা। এই ভোগবাদী কবি আশ্চর্যভাবে ত্যাগবাদীও। মহারাজ অজের রাজ্যভোগ আর দিগবিজয়ী রঘুর সন্ন্যাসের কৃচ্ছ সাধনা এই দুয়ের যে ছবি তিনি পাশাপাশি দাঁড় করিয়েছেন তা মনোরম। আমরা কয়েকটি শ্লোকের বাংলা অনুবাদ উদ্ধৃত করছি :

যুবা নৃপতি প্রজাদের পর্যবেক্ষণের জন্য আরোহণ করলেন ধর্মাসন। বর্ষীয়ান নৃপতি চিত্তের একাগ্রতা বিধানের জন্য নির্জনে পরিগ্রহ করলেন কুশাসন। একজন চারপাশের রাজাদের বশীভূত করলেন প্রভু-শক্তির দ্বারা। অপরজন সমাধিযোগের অভ্যাসের দ্বারা বশীভূত করলেন দেহস্থ পঞ্চ মরুৎ। তরুণ নৃপতি ভস্মসাৎ করলেন জগতের শত্রুদের সব আয়োজন। বর্ষীয়ান নৃপতি ভস্মসাৎ করতে প্রবৃত্ত হলেন স্বকর্মসমূহকে জ্ঞানময় বহ্নির দ্বারা।

প্রকৃত মহত্ত্বের ছবি আঁকতেও কালিদাসের অশেষ আগ্রহ; ভারত রাজ্যলোভী না হয়ে রামের অনুপস্থিতিকালে দীর্ঘকাল রাজ্য পরিচালনা করেন, এজন্য কবি তাকে বলেছেন, “অসিধারব্রত’ অভ্যাসকারী–শিয়ং ‘যুবাপ্যঙ্কগতামভোক্তা’ অঙ্কগতা স্ত্রীকে যুবক হয়েও তিনি ভোগ করেননি।’ [৩]

একই সঙ্গে ভোগ ও ত্যাগ রবীন্দ্রনাথেও বিদ্যমান, কিন্তু কালিদাসের সঙ্গে এক্ষেত্রে তাঁর পার্থক্য সূক্ষ্ম এবং গভীর। তরুণ নৃপতির রাজ্যশাসন আর প্রবীণ নৃপতির আত্মশাসনের যে ছবি কালিদাস এঁকেছেন তা থেকে এবং তার আরো বহু উক্তি থেকে এ সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে কালিদাসের চোখে সংসার ও সন্ন্যাস যেন দুই স্বতন্ত্র জগৎ, একটিকে সম্পূর্ণ বর্জন করে তবেই যেন অন্যটিতে প্রবেশ পথ পাওয়া যায়। যেন কালিদাস বলতে চান : যতদিন মানুষ সংসারে আছে ততদিন সে মুখ্যত ভোগধর্মী; অবশ্য মহৎদের জন্য এই ভোগ স্কুল চর্বচোষ্যাদি ভোগের সঙ্গে সঙ্গে–কখনো সে-সব অতিক্রম করে–কীর্তি-ভোগ বা যশ ভোগও বটে: ‘নন্দিনী’কে রক্ষার জন্য রাজা দিলীপ সিংহকে বলেছেন :

আমাকে যদি মনে কর তোমার অবধ্য তবে আমার যশ-শরীরের প্রতি দয়ালু হও, একান্তবিধ্বংসী পাঞ্চভৌতিক এই পিন্ডে আমার মতো লোকের একান্ত অনাস্থা। লোকোপবাদে সীতাকে বর্জন কালে রামের হয়ে কবি বলেছেন :

লোকোপবাদ নিবৃত্তির অন্য উপায় নেই দেখে রাম পত্নীত্যাগে বদ্ধপরিকর হলেন। যশ যাদের ধন তাঁরা নিজেদের দেহ থেকে যশকে অধিকতর মূল্যবান জ্ঞান করেন, ভোগসুখের সামগ্রীর (স্রক্‌চন্দনবনিতার) তো কথাই নেই।

কিন্তু এইসব কীর্তিমানদের জীবনেও কালে কালে এমন সময় উপস্থিত হয় যখন ভোগ যশ সবের কথা একেবারে বিসর্জন দিয়ে এরা রত হন যোগে-আত্মায় পরমাত্মা দর্শনের ব্রতে। এ আত্মায় পরমাত্মাদর্শনের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্তরূপে কালিদাস এঁকেছেন কৈলাসে ধ্যানরত মহাদেবের মূর্তি :

মনো নবদ্বারনিষিদ্ধবৃত্তি হৃদি ব্যবস্থাপ্য সমাধিবশ্যম্।
যমক্ষরং ক্ষেত্রবিদো বিদুস্তমাত্মানমাত্মন্যবলোকয়ন্তম।।[৪]

আত্মায় পরমাত্মা দর্শনের বা উপলব্ধির মাহাত্ম্য সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথও সচেতন, এ সম্পর্কে তাঁর নৈবেদ্যের এই কবিতা স্মরণ করা যেতে পারে :

হে রাজেন্দ্র তোমা-কাছে নত হতে গেলে
যে ঊর্ধ্বে উঠিতে হয়,সেথা বাহু মেলে
লহো ডাকি সুদুর্গম বন্ধুর কঠিন
শৈলপথে; অগ্রসর করো প্রতিদিন
যে মহান পথে তব বরপুত্রগণ
য়াছেন পদে পদে করিয়া অর্জন
মরণ-অধিক দুঃখ। ওগো অন্তরযামী,
অন্তরে যে রহিয়াছে অনির্বাণ আমি
দুঃখে তার লব আর দিব পরিচয়।
তারে যেন ম্লান নাহি করে কোনো ভয়,
তারে যেন কোনো লোভ না করে চঞ্চল।
সে যেন জ্ঞানের পথে রহে সমুজ্জ্বল,
জীবনের কর্মে যেন করে জ্যোতি দান,
মৃত্যুর বিশ্রাম যেন করে মহীয়ান।

কিন্তু তবু কালিদাসের আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতার বড় পার্থক্য এই যে রবীন্দ্রনাথ মুখ্যত গুহ্যসাধনাবাদী মরমী নন, ‘বিকাশধর্মী মানবতা’-পন্থী ভগবানে বা পরমাত্মায় তাঁর যতখানি আনন্দ তার চাইতে হয়ত তাঁর বেশি আনন্দ মানুষের জাগতিক জীবনের সর্বাঙ্গীন উল্কর্ষ সাধনায়। এ সম্বন্ধে তাঁর বহু উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে, কয়েকটি উদ্ধৃত করছি :

সেই তো আমি চাই।
সাধনা যে শেষ হবে মোর
সে ভাবনা তো নাই।
ফলের তরে নয়তো খোঁজা
কে বইবে সে বিষম বোঝা
যেই ফলে ফল ধুলায় ফেলে
আবার ফুল ফোঁটাই। (গীতালি)

পান্থ তুমি পান্থ জনের সখা হে
পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া
যাত্রাপথের আনন্দগান যে গাহে
তারি কণ্ঠে তোমারি গান গাওয়া। (গীতালি)

পতন-অত্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী,–
হে চির-সারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিন রাত্রী।

এই বিকাশধর্মী মানুষের পরিণামে নির্বাণলাভ বা ব্ৰহ্মপদ লাভ রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে অশ্রদ্ধেয় হয়ত নয় কিন্তু বেশি আনন্দ তার এই কথা ভাবায় যে মানুষ স্বীয় সৃষ্টিধর্মগুণে এই সংসার-ক্ষেত্রে ঈশ্বরের সাহায্যকারী :

তুমি তো গড়েছ শুধু এ মাটির ধরণী তোমার
মিলাইয়া আলোকে আঁধার।
শূন্য হাতে সেথা মোরে রেখে
হাসিছ আপনি সেই শূন্যের আড়ালে গুপ্ত থেকে।
দিয়েছ আমার পরে তার
তোমার স্বর্গটি রচিবার। (বলাকা)

‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থে সুপ্রাচীন সোহহম তত্ত্বের যে ব্যাখ্যা রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন তাও এই সম্পর্কে স্মরণীয়, তার মতে সোহহমের এ অর্থ নয় যে মানুষ ঈশ্বর, বরং এই অর্থ যে মানুষকে হতে হবে ঈশ্বরের মত সুন্দর ও শক্তিমান অর্থাৎ সৃষ্টিধর্মী। তাঁর এই বিখ্যাত বাণীও এই সম্পর্কে স্মরণীয় : যা শাস্ত্র তাই বিশ্বাস্য নয়, যা বিশ্বাস্য তাই শাস্ত্র। [৫]

কালিদাসের কালে, অথবা তার কিছু পূর্বে, ভারতবর্ষে প্রবল হয়েছিল বেদপন্থী ও বেদবিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ। কালিদাস বেদপন্থী-বর্ণাশ্রমধর্মের শক্তিমান সমর্থক, তার আদর্শ নৃপতিরা বর্ণাশ্রমধর্মের সজাগ প্রহরী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের যুগে ভারতবর্ষ যে সংঘর্ষ প্রত্যক্ষ করেছিল তা আরো ব্যাপক ও গভীর, তা হচ্ছে প্রাচ্য আর প্রতীচ্যের সংঘর্ষ। এই বিরাট সংঘর্ষ সমস্ত চেতনা দিয়ে অনুভব করবার শক্তি নিয়ে জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর চিন্তাধারার ও আদর্শের অপূর্ব মর্যাদা তাই থেকে।

রবীন্দ্রনাথ যেন সেকাল ও একালের মধ্যবর্তী সেতু। তার আদর্শ যে কালিদাসের আদর্শের চাইতে ব্যাপকতর, একালের মানুষের জন্য বেশি সত্য ও সার্থক, তা সহজেই বোঝা যায়, কেননা একালের মানুষের চিন্তায় বড় ব্যাপার কোনো ধরনের মরমী সাধনায় তেমন নয় যেমন বিকাশধমী মানবতা। কিন্তু জীবনাদর্শে রবীন্দ্রনাথ কালিদাসের চাইতে সমৃদ্ধতর বলেই তাকে যে কালিদাসের চাইতে স্বভাবত শ্রেষ্ঠতর কবি জ্ঞান করা হবে তা সত্য নয় কেননা কবির সত্যকার কৃতিত্ব অঙ্কনকুশলতায়। অবশ্য শ্রেষ্ঠ অঙ্কনকুশলতার সঙ্গে শ্রেষ্ঠ চিন্তাভাবনাও স্বভাবতই যুক্ত থাকে, কিন্তু কবির চিন্তাভাবনার মর্যাদা তার অঙ্কনকুশলতার মর্যাদা থেকেই। এর সুপরিচিত দৃষ্টান্ত দান্তে। ধর্মাদর্শে তিনি রোমান ক্যাথলিক, কিন্তু বিশিষ্ট আদর্শবাদী হয়েও মহত্ত্বঙ্খলিত জীবনের ছবি আঁকার কাজে তিনি এমন কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন যে সেজন্য জগতের কাব্যরসিকদের চিরশ্রদ্ধেয় হতে পেরেছেন। কালিদাসও জীবনের অর্থপূর্ণ আলেখ্য অঙ্কনে আশ্চর্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন বিশেষ করে তাঁর শকুন্তলায়– তাই তিনিও জগতের রসিকদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। কবি হিসাবে এমন শ্রদ্ধার্য যে রবীন্দ্রনাথও হয়েছেন সে বিষয়ে আমরা, তার একালের স্বভাষীরা, নিঃসন্দেহ। কিন্তু এই দাবির যথার্থতার বিচারক আমরা নই– কাল। কালিদাসের মতো সেই কালজয়ী কবি প্রতিষ্ঠা যে যে কারণে রবীন্দ্রনাথের লাভ হবে বলে আমাদের ধারণা তা সংক্ষেপে বিবৃত করা যায় এইভাবে :

কালিদাসের রচনায় রয়েছে অপূর্ব লালিত্য ও গাম্ভীর্য; রবীন্দ্রনাথের রচনাও তুল্যরূপে ললিত ও গম্ভীর। হয়তো এক্ষেত্রে কালিদাসই রবীন্দ্রনাথের বিশিষ্ট পথপ্রদর্শক। কিন্তু বিদ্যা এক্ষেত্রে যোগ্য শিষ্যে ন্যস্ত হয়েছিল।

কালিদাস আবির্ভূত হয়েছিলেন স্বাধীন ভারতবর্ষে, সেই স্বাধীন ভারতবর্ষে ছিলো মহাবিক্রম নৃপতিকুল। কালিদাসের শ্রেষ্ঠ নায়করা তাই শক্তিমান সৈনিক–অমিতপরাক্রম। রবীন্দ্রনাথের জন্ম পরাধীন ভারতবর্ষে। কিন্তু সেই হীন দশায়ও ভারতবর্ষের অন্তরে জেগেছিল নবশক্তির উল্লাস– বিরাট জগতে শ্রদ্ধেয় হবার স্বপ্ন। রবীন্দ্রনাথ সেই জাগরণের কবি, তাই তাঁর নায়করা ব্যবসায়ে বীর-সৈনিক না হলেও প্রকৃতপক্ষে বীরত্ব-ধর্মী, পরাজয় স্বীকার করা তাদের স্বভাব নয়, জীবনে নব নব মহিমার সম্ভাবনায় উদ্বোধিত হওয়া তাদের জন্মগত অধিকার।

কালিদাস সৃষ্টি করেছেন শকুন্তলাকে; অপূর্ব সেই নারী-মূর্তি–বোধ হয় শিল্পে নারীসৃষ্টির চরম– একাধারে সে উর্বশী আর লক্ষ্মী, মত আর স্বর্গ, বসন্ত আর হেমন্ত। রবীন্দ্রনাথও সৃষ্টি করেছেন এক চিরবন্দনীয় মাতৃমূতি– আনন্দময়ীকে–জগতের সাহিত্যে হয়ত অদ্বিতীয় মাতৃমূর্তি; কিন্তু শকুন্তলার মতো একই সঙ্গে মহিমা ও মোহনতা সেই মূর্তিতে নেই, তাই শিল্পসৃষ্টি হিসাবে শকুন্তলার গৌরব বেশি। কিন্তু এক পরমমোহন শিল্প-সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথও করেছেন, সেটি হচ্ছে তাঁর নিজের অন্তরাত্মা-প্রকৃতির অযুত লীলায় অপরূপভাবে চঞ্চল, অথচ এত যে লীলাচাঞ্চল্য, সৌন্দর্যের পরমসূক্ষ্ম অনুভূতি, সব অজানার উদ্দেশ্য স্তবনিবেদন :

আমর সব চেতনা সব বেদনা
রচিল এ যে কী আরাধনা…[৬]

 গম্ভীর ও অকুল স্তবনিবেদন জগতে ঢের হয়েছে, কিন্তু এমন মোহন স্তবনিবেদন হয়ত আর কোনো দ্বিতীয় কবির দ্বারা সম্ভবপর হয়নি।

———

১. বালচন্দ্রের মত বক্র অবিকশিত অতিলোহিত পলাশরাজি সদ্যঃ-বসন্তসমাগতা বনস্থলীরূপা নায়িকাদের অঙ্গে নক্ষত্রসমূহের মত শোভা পাইতে লাগিল। কুমারসম্ভব, তৃতীয় সর্গ।

২. তিনি (দশরথ) মিথিলায় উপনীত হইয়া সৈন্যদলসহ মিথিলা বেষ্টন করিয়া উহার উপবন ও পাদপরাজি পীড়িত করিতে লাগিলেন; মিথিলা তাহার প্রীতির অত্যাচার সহ্য করিল যুবতী যেমন সহ্য করে প্রগাঢ় প্রিয়-সম্ভোগ। রঘুবংশ, একাদশ সর্গ।

৩. রঘুবংশ, ত্রয়োদশ সর্গ

৪. (সংযমী মহাদেব) দেহের নবদ্বার হইতে নিবৃত্ত সমাধিনিয়ন্ত্রিত মন হৃদয়-অধিষ্ঠানে স্থাপিত করিয়া ক্ষেত্রজ্ঞ পুরুষগণ যাহাকে অবিনাশী বলিয়া জানেন সেই আত্মাকে স্বীয় আত্মার মধ্যে অবলোকন করিতেছেন। কুমারসম্ভব, তৃতীয় সর্গ

৫. সমাজ–অযোগ্য ভক্তি ৬. নটীর পূজা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *