৬৫. চড়ুইভাতি বনভোজনের আসর

৬৫.

চড়ুইভাতি বনভোজনের আসর জানি। নামেতেই তার পরিচয়। চড়ুইয়ের ভোজ লাগে, দল বেঁধে মাঠে মাঠে। তাদের মতো, মানুষেরা যায় দল বেঁধে বনে বনে, খোলা আকাশের তলায়। হেথায় দেখ, অন্যরকম। ঘরের পিছনে, উত্তর-পশ্চিম আড়াল করে মাটির দেওয়াল। পুব-দক্ষিণ খোলা। দর-দরওয়াজা কিছু নেই। মাথার ওপর দোচালা ছাঁদে খড়ের ঢাকা। এক কোণে দুই উনোন। এর নাম রান্নাঘর।

এক উনোনে কাঠের আগুন। তার ওপর হাঁড়ি। কাঠের আগুনে আর হ্যারিকেনের আলোয় যেন তরঙ্গ খেলছে। চার পাশে অপর্যাপ্ত জায়গা। মাদুর শতরঞ্জি পাতার দরকার হয়নি। কয়েক আঁটি খড় বিছিয়ে দিয়েছে নিতাই। যে যেমন পারো, বসো।

সেইরকমই বসা হয়েছে। উনোন ঘেঁষে বিন্দু। তার কাছাকাছি রাধা বৃদ্ধা। গোপীদাস কি যেমন-তেমন বুড়া! আগেভাগেই গিয়ে রাধার পাশ ঘেঁষে বসে। অমনি রাধার ভুরুতে বাঁক, চোখেতে কোপ। কুলা নিয়ে সরে বসতে যায় কিন্তু জায়গা নেই তো, যাবে কোথায়! গোপীদাস বসে আওয়াজ করে, ‘জয়গুরু!’

বিন্দু আমার দিকে চেয়ে একটু হাসে। এমনকী কুসুমও চোখে ঝিলিক হানে। মুখে আঁচল চাপা দেয়। সে আবার আইমার মুখোমুখি বসেছে কি না। চাল ডালের ধান কাঁকর বাছবে বলে। আঁচল না চাপলে আইমা যদি দেখতে পায়!

গোপীদাস চোখের কোণে একবার আমার দিকে দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘কই সোজন, হল?’

সুজন খড়ের বাইরে, মাটির ওপর বসে তখন ছিলিম বানাতে ব্যস্ত। যে উনোনে আগুন নেই তার পাশে বসে গোকুল। সে জবাব দেয়, ‘এখন রাগের কারণ হচ্ছে বাবা। তারপরে তো রূপ দরশন।’

‘জয়গুরু জয়গুরু!’

গোপীদাস চোখ বুজে বোল দেয়। গোকুল বিন্দু চোখাচোখি করে হাসে। যেঁন তারা কী এক ঘোরের মধ্যে আছে। গোকুলের কথার মধ্যে ঘোর। এরা সবাই যেন সব সময়েই এক ঘোরের মধ্যে আছে। যে ভাব-কথার অর্থ বোঝা দায়।

সুজন হাতে নিয়ে গাঁজা ডলতে ডলতে বলে, ‘তার মানেই রসের ভিয়েন হচ্ছে।’

ওদিকে নিতাই আরও কাঠের বোঝা এনে জড়ো করে উনোনের কাছে। তারপরে গোকুলের কাছ ঘেঁষে মাটির দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে। আমি গোপীদাসের কাছাকাছি। এ আসরের কী নাম দেব জানি না। শীতের বাতাস আটকানো। খড়ের শয্যা গরম হয়ে উঠবে। ওদিকে চুলোয় লাল শিখা সাপের মতো ফোঁসফুঁসিয়ে জ্বলে। সেই তাপটুকুও সকলের গায়ে এসে লাগে। তা ছাড়া এতটুকু ঠাঁই, এতগুলো মানুষ কাছাকাছি পাশাপাশি। তার উত্তাপ অনেকখানি। মানুষের দেহে মনে প্রাণে যত উত্তাপ তার জুড়ি নেই।

চালার বাইরে একটা আম গাছের গোড়া দেখা যায়। তারপর অস্পষ্ট মাটির দেওয়াল। দেওয়ালের গায়ে ছোট দরজা বন্ধ। বোধ হয় খিড়কির দরজা।

সব মিলিয়ে নিজেকে যেন নিজেই চিনতে পারি না। এমন এক আসরে যে আমি বসে আছি, যেন নিজের প্রত্যয় হয় না। এমন আসর যে হতে পারে, তা-ই কি জানা ছিল। কতটুকুই বা জানি, দেখেছি বা কতটুকু! কত যে মানুষ, কত যে ঠাঁই, কত যে রূপ, কত অপরূপ, বঙ্গের নানা অঙ্গে। বিস্ময়ের ঝিলিক লাগে চোখে। তারই মধ্যে চোখ জুড়িয়ে যাওয়া সুখশীতল কাজল লেপে যায়। প্রাণের ভিতর এক ভাবের তরঙ্গ দুলে ওঠে।

দেখ, শিউড়ি শহরের বাইরে নিরালা এক আখড়ায় বাউলদের সঙ্গে তাদের রান্নাঘরের চালায় বসে আছি। বাইরে নিঝুম শীতের রাত। রাতের হিসাব কে করে। তবু যদি এ যামিনীর প্রহর জানতে চাও, হাত তুলে ঘড়িতে দেখ রাত সাড়ে বারো। এদিকে যখন গাঁজায়, ‘রসের ভিয়েন’ হচ্ছে, তখন হাঁড়িতে টগবগ শব্দ। জল ফুটতে আরম্ভ করেছে।

বিন্দু জিজ্ঞেস করে, ‘অই লো কুস্‌মি, চাল ডাল বাছা হল? আমার হাঁড়ির জলে ফুট ধইরছে।’

কথা শুনেই গোকুল বিন্দুর দিকে চায়। বিন্দু কিন্তু মুখ তোলে না। হাঁড়ির দিকেই চেয়ে থাকে। তার স্নিগ্ধ কালো মুখের রেখায় হাসি কাঁপে, নাকি আগুনের আলো ঝলকায় বুঝতে পারি না। গোকুল মুখ ফিরিয়ে সুজনের দিকে চায়। চোখাচোখি করে দু’জনেই মুখ টিপে হাসে।

রাধা বৃদ্ধা বলে, ‘এই যে হইয়ে এলো মা।’

গোপীদাস তাড়াতাড়ি কুলার দিকে ঝুঁকে বলে, ‘দাও ক্যানে, আমিও বাছি।’

রাধা অমনি কুলা আড়াল করতে চেষ্টা করে। বলে, ‘ক্যানে, জম্‌মোকানা কি দেইখতে পারে?’

‘তা ক্যানে পাবে না গ। কানাটোর যে সব মনে মনে জানা।’

এ দুয়ের বচনে সকলের চোখে মুখে হাসির ঝিলিক। কুসুম আবার আমাকে চোখ টেপে। মুখে আঁচল চাপে।

রাধা বলে ওঠে, ‘ইস্‌! মনে মনে জানা থাইকলেই ধান কাঁকর বাইছবে বটে।’

‘তা ক্যানে লারব হে। আমি তো আর রাতকানা না। জয় গুরু।’

ভারী নির্দোষী সুরে বাজে গোপীদাস। কিন্তু ঝাঁজে বাজে বৃদ্ধা, ‘ক্যানে, আমি কি রাতকানা নাকি। এতগুলান বেইছেছে কে? আমি, না গোপীদাস ক্ষ্যাপা বাবাজি?’

গোপীদাস চোখ ঘুরিয়ে ভারী সন্ত্রস্ত হয়ে বলে, ‘অই গ ঠাকরুন, রাগ-মাগ ঝগড়া-বিবাদ করো না গ। বইললাম একটা কথা, মানে কানা কি আর বইলছি গ? রাতে লজর করা দায়, তাই বইলছি যে—।’

‘ল্যান বাবা ল্যান, এদিকে তৈয়ার।’

কথার মাঝখানেই সুজন তাড়াতাড়ি কলকেখানি বাড়িয়ে ধরে গোপীদাসের সামনে।

গোপীদাস বলে ওঠে, ‘হঁ হঁ, এই যে, দাও বাবা।’

হাত বাড়িয়ে কলকে নেয়। ভাগ্যিস কলকে তৈরি হয়ে গিয়েছে। নইলে এ রসিক বুড়া যে বুড়িকে কত দূরে তুলত, বলা যায় না। রাধা তখনও বিড়বিড় করছে। বাকি সকলের মুখেই হাসির ঝিলিক। রাধার ভয়ে কেউ আওয়াজ দিয়ে হাসতে পারে না।

গোপীদাস তখন কলকের আগুনে আঙুল দিয়ে একটু খুঁচিয়ে টিপে টিপে দেখছে। গুনগুন করে গান করে, ‘হইলে ক্ষ্যাপার রাগের করণ, রূপের ঘরে লাগায় দম।’

বলে কলকেটি সোজা আমার দিকে বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘একটুক হবে বাবাজি?’

চমকাই যত, অবাক তত। তাড়াতাড়ি বলি, ‘না না, ও আমার লাগবে না।’

বলেই তাড়াতাড়ি পকেট থেকে নিজের ধূমপান বের করি। গোপীদাস বলে, ‘আহা, উ তো বাবাজি, তুমার আছেই গ। ই বস্তু একবার চেখে দ্যাখ ক্যানে, কেমন মৌজ হয়। তখন আর উ সব ভাল লাইগবে না। লাও, ধরো।’

বিন্দু বাজে খিলখিলিয়ে। আর যে নিতাই বাবাজির সঙ্গে এখনও বাক্যালাপ হয়নি, সে বলে ওঠে, ‘ল্যান বাবাজি, ল্যান, একবার পরখ করেন।’

সঙ্গে সঙ্গে কুসুমের ধমক, ‘তুমি থামো ক্যানে লিতাইদা। দাদা যেমন হইয়েছে! ই বাবাজি তোমাদিগের মতন গাঁজা খায় যে, খেতে বইলছ?’

অবাক কেবল আমি না। কুসুমের ধমক শুনে, অবাক সবাই! বিন্দু চোখ বড় বড় করে বলে, ‘বাপ্‌পুরে! তা বাবাজি যে এখন আমাদিগের মানুষ। খাবে না?’

কুসুমের ঘাড় নাড়ার চোটে চুলের বিনুনি একেবারে এদিক ওদিক ঝাপটা। বলে, ‘না, খাবে না।’

আমার দিকে চেয়ে বলে, ‘খেয়ো না, লিশা হবে, তখন ভোম্ হইয়ে বইসে থাকবে, হ্যাঁ।’ বলে এমন ভাবে ঘাড় কাত করে যেন ভয় দেখায়। অবাক যত মানি, ভিতরে যেন হাসি ততই কলকলিয়ে উঠতে চায়। কিন্তু এমন নির্ভেজাল ফরসা মন আর কোথায় পাবে। দেহেও বালিকা, মনেও বালিকা। তাই বাজে অ-বিকল। মনে মুখে আলাদা নেই। তার ওপরে উদ্বেগ। বয়স দিয়ে তো তার বিচার চলে না। খাইয়ে কেন ভোম্ করে দেবে এমন মানুষকে। তারপরে যদি কিছু হয়?

বিন্দুর চোখে হাসির তরঙ্গ। ঠোঁট টিপে, হাসি চেপে সে ঠায় আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। গোপীদাস বলে, ‘শুন গ লাতিন, একটু আস্বাদ লিলে, লিশা হবে না। লাও চিতেবাবাজি, ধরো।’

এবার গোকুল সুজনও তাল দেয়, ‘হোক, একটু হোক, কিছু হবে না, ভয় নাই।’

জেদাজেদির কথা না। মনপ্রাণের সাধ। তাই মনে কোনও জেদ চাপে না। ভয়টাই আসল। যে বস্তুকে চিরদিন ভয়ের চোখে দেখেছি, তার চেয়ে বেশি সংস্কারে জড়ানো মন নিয়ে যে জিনিসকে নীতি-দুর্নীতির ভাবে ভেবেছি, এক কথাতেই তার স্বাদ নিতে ভরসা পাই না। কিন্তু মনের দিকে চেয়ে দেখ তো, পাপাপাপের বোধ আছে কি!

দেখি না তো। পাপ পুণ্য কি এতই ঠুনকো! এত যদি সকলের সাধ, তা-ই না-হয় পুরুক। জীবনে অনেক কিছুই ঘটেনি। এমন মানুষদের সঙ্গে এমন আসরেই বা আর কবে মিলেছি! এই রাত্রের স্মৃতিতে না-হয় এই সাধ মিটুক।

গোপীদাসকে বলি, ‘আপনি আগে নিন।’

সঙ্গে সঙ্গে গোকুল বলে ওঠে, ‘হঁ হঁ, ঠিক কথা। তুমি আগে সেবা করো, বাবাজির তাতে সুবিধা হবে। পেত্থম তো!’

গোপীদাস ‘জয় গুরু’ বলে কপালে কলকে ছুঁইয়ে দাড়ির ওপরেই কলকে চেপে ধরে। এবার দেখ কুসুমের চোখ! তাকাতে লারছি হে। তোমার জন্যে চুরি করি, তুমিই বলো চোর। কেবল যে আশাহতের অভিমান, তাই না। ডাগর চোখ দুটিতে কী অবিশ্বাস আর কোপ কটাক্ষ। আমি প্রায় অপরাধের দায়ে একটু হাসি।

কুসুম ঝটিতি মুখ ফিরিয়ে নেয়। তারপরেই তৎক্ষণাৎ আবার চোখ পাকিয়ে বলে, ‘খাও , দেইখবে তা’পর কী হয়। মাথা যখন ঘুরাবে তখন বুইঝবে।’

বলেই কুলাটা তুলে বিন্দুর দিকে বলে, ‘লাও, ঢেইলে দাও।’

গোপীদাস সুদীর্ঘ টান দিয়ে স্থির চোখে আমার দিকে চায়। দাড়ির ভাঁজে হাসি, চোখ লাল। কোনও কথা না বলে কলকেটা বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে।

ভাল করে ধরতেও পারি না। লজ্জা করে, হাসি পায়। কেমন একটা উত্তেজনাও। ভয়ে ভয়ে কোনওরকমে একটু টান দিই। একটু ধোঁয়া বেরোয় সেই যথেষ্ট। হাত বাড়িয়ে দিই গোকুলের দিকে। সবাই ‘জয়গুরু’ বলে হেসে আওয়াজ দেয়।

গোকুল বলে, ‘কিছুই যে হল না বাবাজি। একটু দম দেন।’

ঘাড় নেড়ে বলি, ‘আর না।’

গোকুল কলকে নেয়। কিন্তু আমি পরিবর্তন কিছুই বুঝতে পারি না। গন্ধটা ভাল লাগে না, এই পর্যন্তই। নিজের ধূমপানে যেটুকু অনুভব করি, তাও করি না। ভোম্ হওয়া মাথা ঘোরা তো দূরের কথা।

ওদিকে গোকুল সুজনে সাধাসাধি হয়। শেষ পর্যন্ত সুজনকেই আগে নিতে হয়। তারপরে গোকুলের হাত ঘুরে যায় নিতাইয়ের হাতে। এদিকে, কুসুমের চোখের যেন পলক পড়ে না। চোখ বড় বড় করে ঠায় চেয়ে আছে আমার দিকে। আমি হাসতে জিজ্ঞেস করে, ‘মাথা ঘুইরছে?’

মাথা নেড়ে বলি, ‘না।’

‘লিশা হয় নাই?’

‘কিছু তো বুঝি না।’

একটু বোধ হয় প্রত্যয় হয় কুসুমের। চোখে বিশ্বাস ফিরে আসে। তবু ভুরু কুঁচকে বয়স্কার মতো ঘাড় নেড়ে বলে, ‘আমি লিশা ভাং দু’চক্ষে দেইখতে পারি না। আখড়ায় যে আসে, সেই গাঁজা খায়। এই দ্যাখ ক্যানে, দাদাকে একবার দ্যাখ, কেমন ভোম্ হইয়ে যেইছে।’

গোপীদাস চোখ বুজে অনেকক্ষণ চুপচাপ। এবার বলে, ‘ভোম্ হবো ক্যানে গ লাতিন। এই দ্যাখ কেমন কথা বইলছি।’

কুসুম বলে, ‘চখ্‌ মেল তো দেখি।’

গোপীদাস ভুরু টান করে চোখ তাকায়। লাল বর্ণ চোখ। না তাকাতে হলেই যেন ভাল। বলে, ‘এই দ্যাখ, চখ্ মেইলতে লারব ক্যানে। একটুক মৌজ খেতে দিবি তো!’

অন্যান্য সব পুরুষেরই তখন মৌজ খাওয়া চলেছে। সকলেই চুপচাপ। বিন্দু থেকে থেকে হাঁড়িতে কাঠের হাতা নাড়ে। এদিকে চেয়ে হাসে। হাঁড়ির মুখের সরা খুললেই ডালে চালে মেশানোর সেদ্ধ গন্ধ ছড়ায়। তারপর হঠাৎ বিন্দু বলে, ‘তা বলে, সবাই কি আর কাশীর মতন গ্যাঁজা খায়?’

গোপীদাস অমনি বলে ওঠে, ‘অই অই, তাই বল্ ক্যানে গ মা। লাতিনের আমার এত রাগবিরাগের কারণ বুইঝতে পাইচ্ছিলেম না।’

কুসুম চকিতে একবার বিন্দুর দিকে চায়। বিন্দু ততক্ষণে হাঁড়ির দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারপরেই কুসুম ফিরে চায় গোপীদাসের দিকে। তার চোখে গভীর সন্দেহ। টেপা ঠোঁটে রাগের লক্ষণ।

ঠিক এ সময়েই নিতাই সারা শরীর দুলিয়ে খল খল করে হেসে ওঠে। কুসুম তৎক্ষণাৎ ঝংকার দিয়ে ওঠে, ‘এই দেখ লিতাইদা, তুমি হেসো না, আমার গা জ্বলে যায়।’

নিতাই তাড়াতাড়ি গম্ভীর হয়ে বলে, ‘দ্যাখ ক্যানে, আমি কী কইরলাম। একটুক হাইসছি বই তো না।’

‘ক্যানে, হাসবে ক্যানে? হাসির কথা কী হয়েছে, শুনি?’

কথা আর ধমকের চোট শুনলে মনে হবে, ডাগর যুবতী কামিনী ঝংকার দেয়। অথচ সামনে দেখ সবুজ পানপাতা চকচকে মুখখানি। অসীম প্রকৃতি জুড়ে যেন এক শীর্ণ নদী। প্রতীক্ষায় থমকানো, অসীম প্রকৃতি জুড়ে ভাসবার একটু সংকেত চিহ্নমাত্র যেন। তবু দেহে কুলুকুলু, ভাবে ঢলঢল। চোপায় পাঁচমুখ, কথার ঝিরকুটি।

নিতাইটিও কম না। বলে, ‘না, তাই বইলছি, অই কাশীনাথের কথা বইললে কি না। বোষ্টমদের বিটাটো পনেরো ষোলো বচ্ছরের হল্যে কী হবে। কী গ্যাঁজা খেতে পারে, বাপ্ রে বাপ্!’

ইতিমধ্যে কুসুম একবার আমার দিকে দেখে নেয়। আসন্ন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে তার চোখ তখন দপদপে। কাশীনাথ নামের মধ্যে কিছু একটা রহস্য আছে বুঝতে পারি। আর সেই রহস্যে কুসুম জড়ানো। বিন্দুর টিপে টিপে হাসি, আড় চোখে চোখে চাওয়া দেখেও সেই অনুমান হয়। ধরতাইটা তো সে-ই দিয়েছে।

কুসুম ঝেঁজে ওঠে, ‘উ মুখপোড়া গ্যাঁজা খেতে পারে তো আমার কী।’

বোঝা যায়, নিতাই হল নরম মাটি। বিন্দু আর গোপীদাসকে ছেড়ে তাই তার ওপরেই কুসুমের আক্রমণ বেশি। নিতাই বলে, ‘অই দ্যাখ, আমি কি তোকে কিছু বইলছি।’

কিন্তু অবুঝ মনের রাগ তখন এসব শুনতে বুঝতে নারাজ। বলে, ‘বইললেই বা আমার কী।’

বিন্দু তাড়াতাড়ি বলে, ‘তবে তো মিটেই গেল।’

কুসুম তাতেও থামে না। বলে, ‘ও গ্যাঁজা খেয়ে মরুক গা, যা খুশি তাই হক গা। ই আখড়ায় এইসে খাক ক্যানে, মুখে নুড়ো জ্বেইলে দেবো।’

একবার ফোঁসানি দেখা কথা শোনো। নগরে থাকলে এ মেয়ে বই বগলে ফ্রক গায়ে দিয়ে ধিতিং ধিতিং নেচে ইস্কুলে যেত। কিন্তু ভিন জগতের, ভিন সংসারে সে আর এক মেয়ে।

বিন্দু তাড়াতাড়ি মিষ্টি করে তরাসে বলে, ‘তা হা ছি, উ কি রে কুস্‌মি, কী বইলছিস। অমন কইরে বলিস না।’

কুসুমের অমনি মাথা নত। কিন্তু স্বর বন্ধ না। যেন নিচু স্বরে গর্জায়, ‘না, বইলবে না!’

তারপরে বিন্দুর দিকে চেয়ে বলে, ‘তুমিই তো বইললে। ওর কথা কে শুনতে চায়?’

‘আচ্ছা আচ্ছা, আর বইলব না!’

বিন্দু সান্ত্বনা দেয়। সকলের দিকে চেয়ে টিপে টিপে হাসে। আর আসলে যে লোক চটিয়েছে, যার কথাতে নিতাই হেসে উঠেছিল, সেই গোপীদাস এতক্ষণে শব্দ করে ঘাড় নাড়ে। গম্ভীর মুখে বলে, ‘হঁ, ইটো তো ভাল কথা না। কাশীর এত লিশা টিসা ভাল না। ওকে বইলতে লাইগবে!’

কুসুম মুখ তুলে সন্দিগ্ধ চোখে একবার দেখে। আবার মুখ নামায়। আর গোপীদাস গুনগুন করে। আমি এবার জিজ্ঞেস করি, ‘কাশীনাথ কে?’

গোপীদাস খুবই যেন নিরুৎসাহিত স্বরে বলে, ‘কে আবার! কাছেই থাকে, বোষ্টমদের এক বিটা। লাতিনের তার উপরে খুব রাগ। ছোঁড়া বেজায় গ্যাঁজা খায়। ই আখড়াতে তার যাতাত আছে।’

তারপরে আর বুঝতে বিশেষ বাকি থাকে না। ওদিক থেকে বিন্দু আমার দিকে চেয়ে বলে, ‘এখন কাশী বোষ্টম ছেড়ে বাউল হতে চায়। কুস্‌মির দাদাকে গুরু কইরতে চায়।’

বক্তব্য পরিষ্কার। ঘটনাও স্বচ্ছ। কাশীনাথের বোষ্টম ধর্ম, বাউল ধর্ম, যত ধর্ম আছে সব ধর্মের সার কুসুম ধর্ম। তাই এখানে যাতায়াত। তাই গোকুলকে গুরু করার ইচ্ছা। আমি নিজেই মনে মনে বলি, ‘জয়গুরু জয়গুরু।’ নগরে সংসারে হলে এ মেয়ের সামনে এ বিষয়ে এমন করে কথা বলতে পারতাম না। কিন্তু এখানে অন্য দরিয়ায় ভাসি। এ দরিয়ার টান স্রোত সবই আলাদা। তার দিক ফেরাতে পারি না। তব নগরে সংসারে বলো, গ্রামে আখড়ায় বলল, তার ধরন-ধারণ চালচলন আলাদা হতে পারে। সহজ মন সেই এক। একটাই। ইস্কুলে পড়া আর না পড়া, মনের তার এক জায়গাতে বাঁধা। যা ভাল তা ভাল, যা মন্দ তা মন্দ। তাই মুখে বলি, ‘সে তো ভাল কথা।’

কুসুম অমনি ফোঁস করে ওঠে, ‘আর কাঁড়ি কাঁড়ি গ্যাঁজা খায় যে!’

তাতে কুসুমের কী, জিজ্ঞেস করা যায়। সে তো হবে গোকুলের শিষ্য। কিন্তু সে কথা জিজ্ঞেস করার সাহস আমার হয় না। বরং গম্ভীর হয়ে বলি, ‘সেটা অবিশ্যি ভাল না। ছেলেমানুষে অত গাঁজা খাওয়া কীসের!’

কুসুম একেবারে গিন্নির স্বরে বাজে, ‘অই বলে কে।’

যত গম্ভীর কুসুম, তত আমি। আসলে কুসুমের তত বেশি কিছু বলার নেই। কাশী যেন গাঁজা না খায়। কুসুম আর একবার আওয়াজ দেয়, ‘লজ্জা আছে নাকি!’

এইটুকুতেই আমার মনে বিস্ময়ের ঢেউ লেগে যায়। এই তো এক ফোঁটা মেয়ে। তার আচার আচরণ দেখলে মনে হয়, সংসার তাকে কোথায় উঠিয়ে দিয়েছে। নগরে যারা এই বয়সে লিখে-পড়ে হেসে-খেলে কাটায়, এ মেয়ে তখন যেন দায়-দায়িত্বের ভার নিতে তার কচি অপুষ্ট কাঁধ পেতে দেয়। মানুষ আর পরিবেশ, তাকে এই শিক্ষাই দিয়েছে।

ইতিমধ্যে নিতাই উঠে যায় কোথায়। গোপীদাস গুনগুন করেই চলে। বিন্দু বলে ওঠে, ‘অই লোক কুস্‌মি, কড়া আর তেল লিয়ে আসতে হবে। লঙ্কা ভেজে একটুক ঢেইলে দিতে হবে। লিতাইয়ের বোধ হয় এতক্ষণে খেয়াল হইয়েছে, হলুদ আদা, কিছু বাটা হয় নাই।’

গোপীদাস বলে, ‘পাকায় কী দরকার, কাঁচাতেই হোক না।’

বিন্দু বলে, ‘না, চিতেবাবাজি খাবে। একেবারে এমনি কইরতে পারব না।’

আমার দিকে চেয়ে হাসে। আমিও বলি, ‘থাক না।’

কুসুম চুপ করে থাকতে পারে না। সে উঠতে উঠতে বলে, ‘থাইকবে ক্যানে, আমি লিয়ে আসছি। চিতেবাবাজি বাতিটো লিয়ে এইস।’

গোকুল বলে ওঠে, ‘শুন শুন, মেয়্যার কথা শুন। উনি বাতি লিয়ে যাবেন ক্যানে, আমি যেইছি।’

অতঃপর আমার শিরদাঁড়াতে ধাক্কা। কুসুম যদি এমন অনায়াসে আমাকে ডাকতে পারে, আমি বা বসে থাকি কোন লজ্জায়! তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে হ্যারিকেন নিয়ে বলি, ‘চলো, চলো।’

গোকুল বিরত হয়ে বলে, ‘আমার বোনটি এইরকম বাবাজি, ওর মুখে কথা আটকায় না।’

কুসুমকে অনুসরণ করতে করতে বলি, ‘ভালই তো।’

চালা ছেড়ে যাবার আগে, বিন্দু কী যেন ইশারা করে, বুঝতে পারি না। উঠোন পেরিয়ে কুসুমের সঙ্গে আবার সেই ঘরে আসি। কোথায় যেন শিলনোড়ার ঘটং ঘটং শব্দ হয়। কুসুম কুলুঙ্গি থেকে তেলের ছোট বৈয়াম পাড়ে। বাসনপত্রের ডাঁই থেকে, ছোট একটা কড়াই তুলে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাকে কুথা থিক্যা লিয়ে এল? দাদার সঙ্গে আগে চেনাশুনা ছিল বুঝি?’

দাদা অর্থে গোপীদাস। বলি, ‘চেনাশোনা ছিল না। শান্তিনিকেতনে দেখা হল, সেখান থেকেই এলাম।’

‘অ।’

কুসুম কড়াই বের করেও ওঠে না। তেমন যেন তাড়া নেই। মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কি সত্যি দীক্ষা লিবে?’

একটু অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। কুসুমের কথা বুঝতে পারি না। তারপরে হঠাৎ মনে পড়ে যায় বিন্দুর কথা। সে বলেছিল কুসুম আর আমাকে একসঙ্গে দীক্ষা দেওয়া হবে। কিন্তু সে কথা হঠাৎ এখন কুসুমের মনে পড়ে গেল কেন? আমি ওর অপলক উৎসুক চোখের দিকে চেয়ে দেখি। কী ভেবে জিজ্ঞেস করছে কুসুম? ও কি বিন্দুকে বিশ্বাস করেছে নাকি? এমন অসংশয়িত সরলতায় তাও অসম্ভব না। বলি, ‘এখনও কিছু ঠিক করিনি। কেন বলো তো?’

কুসুম গ্রীবায় দোলা দিয়ে বলে, ‘তোমাদিগের মতন কেউ তো ল্যায় না, তাই বইলছি।’

বলে, এক হাতে তৈলের মাটি-পোড়ানো বৈয়াম, আর এক হাতে কড়াই ঝুলিয়ে নেয়। কিন্তু ঘরের বাইরে যায় না। হঠাৎ বলে, ‘রাগ কইরলে মানুষ কত কী বলে, না কি, না?’

এ প্রশ্নের জবাব সহসা ধরতে পারি না। তা-ই চেয়েই থাকি। কুসুম আবার বলে, ‘বোষ্টমদের বিটাটো এত গ্যাঁজা খায় ক্যানে? তা-ই ত নুড়ো জ্বেলে দেব বইলছি, উতে কি পাপ হয়?’

মুহূর্তের মধ্যে যেন অন্ধকার সরে গিয়ে আমার চোখের সামনে আলো ঝলকে ওঠে। সেই আলোতে দেখি গভীর অনুশোচনায় উৎকণ্ঠিত জিজ্ঞাসু একটু মুখ। আমার দীক্ষা, আগমন মূলে কিছু না। হয়তো আমাকে ডেকে নিয়ে আসার কারণও এইটুকুই। এই একটি জিজ্ঞাসা।

এই এক আশ্চর্য আলো-আঁধারি মুখ। কাঁচায় পাকায় মেশানো, তবু যেন সব কিছুরই ঊর্ধ্বে। এই ব্যাকুল উৎকণ্ঠা দেখে, কোথায় একটা ব্যথা ধরে যায়। মনে মনে বলি, তুমি হাজারবার নুড়ো জ্বেলে দিলেও বোষ্টমদের বিটা সেই কাশীনাথের মুখে সেই আগুন হাজার বছরের পরমায়ুর অমৃতে ঝরবে। তাড়াতাড়ি বলি, ‘কখনও না। তুমি বললে কোনও পাপ হয় না।’

কুসুম আমার চোখের দিকে একটু চেয়ে থাকে। তারপরে আস্তে আস্তে হাসে। হাসি ফোটে তার ঠোঁটে, চোখের তারায়। বলে, ‘কাল তাকে দেইখতে পাবে। এইসব।’

আমি আলো নিয়ে ওর সঙ্গে যাই। কিন্তু আমার বুকের মধ্যে কোথায় কোন এক প্রস্রবণ যেন ভেসে যেতে থাকে।

.

৬৬.

মনে করি, ঘুম আসবে। ঘুম আসে না। অথচ যেন এক ঘোর-লাগা ভাব। এ ঘোর আমার মনে লাগায় গোপীদাস। যেন আমার চিন্তার সীমায়, সীমান্তে সীমান্তে, এক দূর কালের চির রহস্যের, বাণী বন্ধনে বেঁধে বেঁধে যায়। আমি শুনি। আমার সমস্ত অনুভূতির মধ্যে এক আলো-অন্ধকারের দোলা। সেখানে বিস্ময় জাগে। জিজ্ঞাসার তরঙ্গ দোলে। কৌতূহলের অশেষে ভেসে যাই। গোপীদাসের নিচু ঘড়ঘড়ে মোটা গলার স্বর যেন বাতাসের গোঙানি। সেই গলার তত্ত্বকথা যেন, আমার সকল অনুভূতির পাথার বিথারে এক দীপশিখায় ভেসে ভেসে যায়।

কিছুক্ষণ আগেই, রান্নার সেই চালাঘরেই, ভোজের আসর শেষ হয়েছে। নিতাই যখন ধোয়া কলাপাতা নিয়ে এসেছিল, বিন্দু বড় বিচলিত হয়ে উঠেছিল। এই নিশিরাত্রে কী বলে, নিতাই কলাপাতা কেটে নিয়ে এল! নিতাই হেসে তাকিয়েছিল গোকুলের দিকে। জানা গিয়েছিল, গোকুল সন্ধ্যার আগেই কলাপাতা কেটে রেখেছিল। কেন যেন তার মনে হয়েছিল, রাত্রে কলাপাতার দরকার হতে পারে। তাই নিয়ে কুসুম বেজায় চোপাও করেছিল। কথা নাই বাত্তা নাই, কলাপাতাগুলান মুড়াল্‌ছ ক্যানে গ?…

কত স্বাদের, কত সাধের, নানা খানে, কত খিচুড়িই তো খাওয়া হয়। তবু মনে হয়েছিল, এমন স্বাদ পাইনি কোথাও। এক রকমের ডাল না, নানা রকমের। পাকা হল সম্বরা দেওয়া। কাঁচা বিনা সম্বরাতে। প্রকৃতির রীতি বুঝি এই। সে যেখানে হাত দেয়, সেখানেই রসের আস্বাদ। বিন্দুর হাতখানিও পাকা। এমন কিছু মালমশলা ছিল না। প্রকৃতির হাতেতে তুক ছিল। তার ওপরে, চিতেবাবাজি নতুন মানুষ। তাই একটু আলু বেগুন ভাজার বিলাসিতা। সব শেষে, খেজুর রসে বানানো লবাত। অমন মিষ্টিমুখ আর হয় না।

শোয়ার প্রশ্নে অতিথিদের জন্যে বিছানা-পাতা ঘরটি ছেড়ে দেবার কথা হয়েছিল। আমি বেছে নিয়েছি, ঘরের বাইরে এই দাওয়ার কোণের তক্তপোশ। ঠান্ডা এখানে ঢুকতে পায় না। কেবল যে খড়ের চাল নীচে নেমে এসেছে, তা-ই না। দাওয়ার এদিকটায় মাটির দেওয়াল খাড়া। তার ওপাশেই রান্নাঘরের চালা। এখনও যেন আখা থেকে কাঠকয়লার উত্তাপ আসছে।

তক্তপোশের এখানে এখনও গাঁজার গন্ধ। এখানে বসেই, সকলের একপ্রস্ত হয়েছে। তারপরে সবাই শুতে গিয়েছে। ঘরে গিয়েছে বিন্দু রাধা কুসুম। গোকুল সুজন নিতাই গিয়েছে অন্য ঘরে। সে ঘরের বাইরে দেখেছি, ভিতর দেখিনি।

বিন্দুর আগে, কুসুম একখানি মোটা কাঁথা আমার গায়ে ফেলে দিয়েছিল, ‘লাও, ইটো গায়ে দিয়ে শোও।’ বিন্দু হেসে বলেছিল, ‘এটি কুসুমের কাঁথা। চিতেবাবাজি যেন জুতজাত করে গায়ে দিয়ে শোয়। তবে বাবাজির গঞ্জিকাসেবন যতক্ষণ চলেছিল, কুসুম একটুও নড়েনি। চিতেবাবাজি আবার কল্‌কে ধরে কিনা, ঠায় দাঁড়িয়ে দেখেছিল। ধরিনি। নিজের বস্তুতেই ধূমপান করেছিলাম। কিন্তু মন পাথারে পাড়ি দিয়ো না। তার রং বাহারে, রং চিনতে যেয়ো না। কূল পাবে না। কেবল, মনে হয়েছিল, সহজে যে প্রকাশ করে, সহজ সে তো নয়। কোথায় এক কাশীনাথের বৃন্ত ধরে। বৃত্ত করে আমাকে। মেয়ের চপল চাঞ্চল্যে মায়ের উদ্বেগ কোথায় মিশে থাকে, তার হদিস মেলে এমনি করে। সে যে হাত বাড়িয়ে, বুক দিয়ে সব আগলে রাখতে চেয়েছে। তবে কুসুমের এ মনে, সেই মন কেমন করে লীলায়িত, তা আমি জানি না। এত অনায়াস মাধুর্যে কেমন করে গলে, সে রহস্যও বুঝি না। কুসুমের দিকে চেয়ে, একটা হাসি উছলে উঠেছিল। কিন্তু চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে উঠতে যাচ্ছিল।

সবাই চলে যাবার পর, আমি আর গোপীদাস। তক্তপোশ তেমন সরু না যে, দু’জনের পাশাপাশি শোয়া হয় না। সারাদিনের অগাধ ক্লান্তি। শরীর মন, ঘুমে ডুবে যাবারই কথা। অথচ যায়নি। তার জন্যে কোনও কষ্টও হচ্ছে না। সব মিলিয়ে, এই নতুন পরিবেশে, নতুন মানুষদের নেশা লেগেছে আমার। চোখে ঢুলুঢুলু আমেজ লাগে। মুখ গুঁজে শুইয়ে দেয় না। আমি কনুইয়ে ভর দিয়ে, আধশোয়া। গোপীদাস দেওয়ালে ঠেস দিয়ে আলস্যে এলানো। এইটুকু অনুমান। দেখতে পাচ্ছি না কিছুই। চারপাশে গভীর অন্ধকার। নিঝুম রাঢ়ের প্রাণ বাজে ঝিঁঝির স্বরে। চালের খড়, মাটির দেওয়াল, কাঁথা মাদুর, আশেপাশের গাছপালা, সব মিলিয়ে এক বিচিত্র গন্ধ।

এক সময়ে গোপীদাসের গলা শোনা যায়, ‘বাবাজি কি ঘুমাও?’

‘না।’

গোপীদাস একটু নড়াচড়া করে। তক্তপোশে শব্দ হয়। নিচু ঘড়ঘড়ে স্বরে বলে, ‘নানুরে চিঁড়া মুড়ি লিবার সোমায় বইলছিলে যে, গুরুসেবা কইরবে। না বাবাজি, সি কারণে কিছু বলি না। তবে বাবাজি, ক’দিন তোমার মনটো দেইখলাম, চখের লজর দেইখলাম, তা-ই দুটো কথা বইলছি। বয়স তো হল। মানুষ দেইখলাম মেলা। তা, তোমাকে দেইখে মনে হল, লদীর মতন ভেইসে নাও। মনখানি টানা, যা পাও, তাই লিচ্ছ। তাই লিয়ে চইলে যাচ্ছ। এ বড় ভাল, তা-ই দুটো কথা বইলতে ইচ্ছা কইরছে। গুরু-চিন্তে করো না বাবাজি, উতে তুমি ঠইকবে, আমি ঠইকব, বুইঝলে।’

বলতে বলতে বৃদ্ধ গোপীদাসের দীর্ঘশ্বাস পড়ে। কিন্তু আমার নিজের কথা তার মুখে শুনে, নিজেই অবাক হই। নদীর মতো ভেসে যাই, যা পাই, তাই নিয়ে চলি, এমন অনিবার দুরন্ত প্রাণ আমার না। তবু, এই নিশীথে, গোপীদাসের এমন আশ্চর্য কথায় নিজেরই যেন আবেশ লেগে যায়। কথা বলতে পারি না।

‘বাবাজি।’

‘বলুন।’

‘ঘুম পাইচ্ছে?’

‘না।’

একটু চুপচাপ। যেন তেপান্তরের দূরে বাতাসের শব্দে গোঙানি ওঠে, তেমনি স্বর শোনা যায়, ‘বইলছি কি বাবাজি, আমি বাউল না। আমরা কেউ বাউল না। বইলতে পারো, গোকুল-বিন্দু বাউল। উয়ারা এখনও ধ্যানে মনে আছে। তা যদি না থাইকত, তবে এ আখড়া, বিটাবিটি ঘর-সোম্সারে ভরা-ভরতি হয়ে যেত। সিটি হল, পতন। তা, আমরা হলাম পতিত। কী কইরব বলল, এই চুলদাড়ি আলখাল্লা ধরা চূড়া ছাইড়তে পারি না। গুপীযন্তর আর বাঁয়া হইয়েছে কেবল হাতের শোভা। কিন্তু বাউল কেউ লই বাবাজি। বাউলের কখনও বিটাবিটি হবে না, এই জাইনবে। তা আমাদিগের খালি তত্ত্ব জানা সার। কাজের কাজি হলাম না।’…

গোপীদাসের গলা ডুবে যায়। যেন এই গভীর অন্ধকার এক বিশাল গহ্বর। তার মধ্যে ডুবে যায়। আমার মনে পড়ে যায়, দক্ষিণের দরিয়ার কূলে গাজির কথা। পুরুষ-প্রকৃতি বচন তার মুখেও শুনেছিলাম। তত্ত্বের মূল তখনও জানতাম না। এখনও জানি না। তার মুখেও শুনেছিলাম, ফকির দরবেশের, পুরুষ-প্রকৃতির মিলনে, জন্ম বলে কিছু নেই। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জেনেছিলাম, ঘরে তার ক্ষুধার্ত সন্তানেরা বাবার পথ চেয়ে বসে আছে। সেই মুহূর্তে দেখেছিলাম, গাজি না, দরবেশে ফকির না, মুরশেদের নাম নিয়ে এক দরিদ্র বাঙালি। তার অন্তরে বাস করে এক স্বামী এক পিতা।

গোপীদাসের কথাতেও যেন সেই ধ্বনি শুনি। কিন্তু একটু ভিন্ন সুরে বাজে।

গোপীদাস বলে, ‘রাঁধবার জন্যে তোমার কাছে আনাজপাতি মশলা দিলাম। পাত্তর ধইরে দিলাম। চুলায় আগুন জ্বলে খা খা। কীসেতে কী দিলে কী হয়, সব তুমি জাইনলে। কিন্তু, রাঁধতে যেইয়ে, পুড়িয়ে সব ছাই কইরলে। আগুন লাগাল তোমার গায়ে। পোড়া অঙ্গ লিয়ে দৌড় দিলে। তুমি পাচক লও হে, তুমি পাচক লও। আমাদিগের হল সি গোত্তর। আমরা কেউ বাউল না বাবাজি। গোটা দেশ ঢুঁইল্ল্যে বাউল পাবা দু-চার জনা। আর সব জাইনবে খালি চুল্য আলখাল্লা সার। হাঁ বাবাজি, অনেক নেকাপড়া তো কইরেছ, চণ্ডীদাস জয়দেব বিদ্যাপতির কোনও বিটাবিটি ছিল, শুইনেছ?’

কথাটা যেন নতুন সুরে বেজে ওঠে কানে। কখনও তা ভাবিনি। কখনও তো শুনিনি। একটু অবাক হয়েই বলি, ‘না তো।’

‘তবে? ওঁয়াদের তো পিকিতি ছিলেন। রানি পদ্মাবতী লছমী। সি কারণে ওঁয়ারা হলেন রসের রসিক। “যে জন অনুরাগী হয়, সে রাগের দেশে যায়, রাগের তালা খুলে সে রূপ দেখতে পায়।” লালন ফকিরের কথা বাবাজি। তা, ওঁয়ারা তালা খুইলতে জানেন। আমরা জানি না। মনে ল্যায়, গোকুল-বিন্দু পাইরবে। উয়াদের আট বছর একত্তর বাস। ই দুটোতে তালা খুইলবে। আমরা পাইরলাম না।’…

গোপীদাসের কথা শেষ হয় না। তার আগেই নিশ্বাসের ঢেউ এসে কথা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। দাওয়ার অন্ধকার কোণে সেই নিশ্বাসের বাতাস যেন পাক দিয়ে ফেরে। অ-মুক্ত বন্ধন বাঁধা হাহাকার বাজে। তবু যেন আমার মনে অন্ধকার ভাব। আমার ভিতরের জিজ্ঞাসা বাইরের শব্দে বাজে, ‘এ কেমন ভজন, কীসের ভজন।’

গোপীদাস যেন সহসা জেগে ওঠা স্বরে বলে, ‘আঁ? বইলব, বাবাজি সি কথাটা বইলব।’

তবু আমার জিজ্ঞাসা বাজে, ‘চণ্ডীদাস-রামী, জয়দেব-পদ্মাবতী, তাঁদের সঙ্গে এই সাধনার সম্পর্ক কী?’

তাও বইলব বাবাজি। আগেই বইলছি তোমাকে, আবার বইলব, ভেঙেচুরে বইলব তবে বুইঝবে। তোমাকে বইলব। ক্যানে? না, অই কথা, তুমি বাবাজি সাধু চোরে মিশামিশি। তুমি বাদী পিতিবাদী, রাগী বিরাগী। মানো বা না মানো, আপনার বাবা-মাকে যেইয়ে জিগেসা করো, তোমার জম্‌মের মধ্যে কিছু একটা চমক আছে। কম্‌মের মধ্যে মেলা ফাড় ফোড় আছে। নিজে ভেইবে দেখ।’

গোপীদাসের কথা সহসা হৃদয়ঙ্গম হয় না। সে কি জ্যোতিষী শোনায় নাকি? তাতে বালাই, সে চিন্তা আমি করি না। কিন্তু জন্মের মধ্যে চমক মানে কী? জিজ্ঞেস করি, ‘ঠিক বুঝলাম না। জন্মের মধ্যে চমক আবার কি?’

অন্ধকারে একটা হাত এসে আমার গায়ে পড়ে। গোপীদাসের হাত। গায়ে হাতড়ে সে হাত আমার মধ্যে স্পর্শ করে। বলে, ‘মন্দ কিছু না বাবাজি। এই যেমন ধরো, কেউ জম্‌মায় ভাদ্দর মাসে জম্‌মাষ্টমীর দিনে, আবার কেউ দোল পুন্নিমার দিনে। কেউ জম্‌মায় মায়ের বাসন মাজার ঘাটে। কেউ পথের গাছতলায়। এই চমকের কথা বলি। তোমার তেমন কিছু আছে।’

নিজের কথায় সাত কাহন, ভাবতে লজ্জা করে। তবু যেন সহসা মায়ের গলার স্বর আমার কানে বেজে ওঠে। আমি আমার জন্মবৃত্তান্তের কাহিনী শুনি। অবাক লাগে তাই। গোপীদাসের কথার সঙ্গে যেন কোথায় মিলে যায়। জন্মবৃত্তান্তের ঘটনায় তার চমকের মিল দেখতে পাই। জিজ্ঞেস করি, ‘কী করে বললেন?’

গোপীদাস মাথায় একটু হাত বুলিয়ে বলে, ‘মন্তর-তন্তর না বাবাজি। বাউলের মন্তর-তন্তর বেদ বেরাহ্মণ নাই। তোমাকে দেইখে মনে হয়, তাই বলি। আপন কম্‌মের কথা ভাবো। ইদিকে যাও তো উদিকে ধাক্কা, উদিকে যাও তো ইদিকে। ঠেকাঠেকি বাঁকা-বাঁকি নদীর মতন। বাঁধালে পইড়বার লোক তুমি লয়। তাই তোমাকে বইলব। তুমি শুইনলে বুইঝবে। বিকার হবে না।’

কিন্তু এমন করে আমার কর্মের কথা গোপীদাস বলে কেমন করে। শুধু চোখের দেখায়, এই মানুষের কর্মের সর্পিল গতি সে চিনতে পারে? অথচ, নিজে তো জানি, কর্ম আমাকে কখনও সোজা পথ দেখায়নি। কঠিন যত, বাঁকা তত। মুখ তোলবার আগে জীবনস্রোতের ঝাপটায় ভেসে গিয়েছি অন্য দিকে।

গোপীদাসের হাত সরে যায় আমার মাথা থেকে। তারপরে তার গলার স্বর যেন, নিরবধি কালের স্রোতে গুনগুনিয়ে বাজে, ‘বাউলের মোদ্দা কথাটো শুইনছ তো, যা নাই ভাণ্ডে, তা নাই বেহ্মাণ্ডে। অই অই গ বাবাজি, উটি হল আসল কথা। তোমার শরীলে যা নাই, তা জগৎ-সোম্সারে নাই। ভজন করো, পূজন করো, সবই শরীলের মধ্যে। পুরুষের শরীলে, আর নারীজাতির শরীলে। ই দুয়েতে মিলন হলে, তবে সব মিলে।’

আমি সেই নিরবধি স্রোতের গায়ে। জিজ্ঞেস করি, ‘মিলন?’

‘হঁ, হঁ, হঁ গ বাবাজি, মিলন। তবে হঁ, ই তোমার বিয়ে নিকার পরে, আঁতুড় ঘরের কারবার লয়। চিতায় যেমন আঁধার রেতে, পাকে পাকে ঘোরা, ইখ্যান থেকে উখ্যানে, জঙ্গল থেকে জঙ্গলে, তা’পরেতে একেবারে অবাধ শিকার, তেমনি। চিতা যেমন খালি শিকারের ঘোরে থাকে, ভাবে থাকে, চখের লজরে শিকার ঘোরে, তেমনি। লক্ষ্যভেদের কথা জানো তো বাবাজি, অর্জুনের লক্ষ্যভেদ। দ্রৌপদীকে পাবার আগে যেমন মীন লক্ষ্যভেদ কইরেছিল, তেমনি। কী কইরে কইরেছিল বাবাজি, মনে আছে?’

বলি, ‘আছে। নীচে মাছের ছায়া দেখে, ওপরে—’

আমার কথা শেষ হবার আগেই, গোপীদাসের গলায় শব্দ ওঠে, ‘অই অই অই।’

সঙ্গে সঙ্গে তক্তপোশ দুলে ওঠে। গোপীদাস নিজেই হাত পা নাড়িয়ে দোলে। বলে, ‘অই, নীচেতে জলে মীনের ছায়া দেইখে, ঊদ্‌ধে মারে তির, তার নাম লক্ষ্যভেদ। জয় গুরু জয় গুরু! বাবাজি, এর নাম পুরুষ-পিকিতি মিলন। রতি আর রসের খেলা। নীচের জলের ছায়ায় খেলা করে, আসল মিলন উপরে। সিখ্যানে জম্‌মো মিত্যু নাই। সিখ্যানে, “বিষামর্তে আছে মিলন, জাইনতে হয় তার কিরূপ সাধন, দেইখ যেন গরল ভক্ষণ করো না হায় রে।” হাঁস যেমন জল থেকে দুধ খেয়ে ল্যায়, এ মিলন তেমনি। বুইঝলে বাবাজি।’

আমার চারপাশের অন্ধকার দুয়ার ভেদ করে, সহসা যেন একটা ঝলক লেগে যায়। বাউল পুরুষ-প্রকৃতির মিলন রহস্য, একটা চকিত ঝংকারের মতো আমার অবোধ অনুভূতির মধ্যে বেজে ওঠে। কিন্তু আমি কথা বলতে পারি না।

গোপীদাস বলে যায় বাউল তত্ত্ব। সে বলে, দুই দিকে দুই নদী বহে যায়। তার এক নাম কাম, আর নাম রতি। এই দুই নদী যখন বহে, তখন সে এক টানাতে চলে। কিন্তু মাঝখানে তার অমৃত নদী। কাম রতির মিলনে, সেই অমৃত নদী উজান বহে চলে। সেই অমৃতের যে নদী তাতে ডুবতে পারলেই সুখ। মহাসুখ। কামেতেই তাই প্রেম। প্রেমেতেই উত্তরণ। সেখানে মানুষ জীবের জন্মলীলা নেই। পতন পাতন ত্যাগ করে, সেই যে নিরন্তর মহাভাবের অনুভূতি, তাই জানবে বাউলের সাধনা।

কিন্তু, উজান চলতে পারে কয়জন। উজান চলার সাধন যে সাধেনি, ভেসে যায় সে স্রোতের টানে। তখন সে বিষয়ে পোড়া। আগুন কেবল ভস্মস্তূপ। সাধতে জানা চাই। কেমন সাধন? যোগসাধন। তখন দমের ঘরে দম। সেই জন্যে বলেছে, ‘ব্রহ্মাণ্ডের পরপারে আছে মূলাধার মূলে। নাহি দিবা নাহি রাতি, মন, মানুষের মহলে। চন্দ্র সূর্য যেতে নারে সে দলকমলে।’ তার জন্যে সেই সাধন, ‘যে কারণে যোগী ঋষি, রেচক, পূরক, কুম্ভক কেন করে অনিবার।’

এই সঙ্গে জানবে, তুমি বাইরে যারে তত্ত্ব করো, অবিরত সে আছে আজ্ঞাচক্রের ওপরে। কুলকুণ্ডলিনী শক্তি আছে মূলাধারে। প্রণয়ের যোগে জাগাও তাহারে। তোমার বামে ইড়া, ডাইনে পিঙ্গলা, মধ্যে সুষুম্না। রজঃ, তমঃ গুণে খেলা খেলছে। সেই জন্যেই, নিশ্বাসে বিশ্বাসে দম। যার নাম রেচক পূরক কুম্ভক।

শুরুতে চাই পুরুষ-প্রকৃতির আপন শরীরবস্তুর নানা পান-ভোজন। সেসব সকলই গঙ্গা-যমুনা-বারি, অমৃত স্বাদ। উভয়ে উভয়ে পিয়ে, তাইতে সুন্দর। সে জন্যে চাই, রূপবতী রসবতী যুবতী প্রকৃতি। যে প্রকৃতির মন সাধিকার মতো একাগ্র। আপন ভজনে যে সতী, শক্তিধারিণী। বাহ্যিক জীবনে সে যাই হোক, ব্রাহ্মণী-শূদ্রাণী, রজকিনি-নরসুন্দরী, যবনী-কপালী-বেশ্যা-নর্তকী। মোচন বচন কিছু নেই তার। আছে প্রেম সাধনের এক মন, এক দেহ।

একেই বলে, পরকীয় সাধন। পরকীয় সাধন মানে, পরস্ত্রীর সঙ্গে না। ‘উটি লোকে ভুল জানে গ বাবাজি। বলে রাধাকিষ্টের লীলা যেমন, পরকীয় তেমন। না, উটি ল্যায্য কথা লয় জাইনবে।’ পরকিতি পিরিতিই হল পরকীয় সাধন। তবে কিনা প্রকৃত রসের রসিক কৃষ্ণা-রাধা। বাউল সাধন সময়ে আপনার মধ্যে তাঁদেরই অনুভব করে। নিজেদের রাধা কৃষ্ণা কল্পনা করে। ‘ক্যানে কিনা’, নিরন্তর শৃঙ্গার লীলাময় রূপের মধ্যেই প্রেম প্রকাশিত। রজকিনি রামী পরের ঝি বটে, স্ত্রী না। পদ্মাবতীও তা-ই। যে সাধকের কাছে যেমন সাধিকার আবির্ভাব। দুয়ের মধ্যে প্রেম না থাকলে সাধন হয় না। যত আকর্ষণ, তত বিকর্ষণ। শেষ পর্যন্ত যা থাকে তা অন্য অনুভূতি, যখন আকর্ষণের বালাই নেই। তখন উভয় শক্তির স্তম্ভিত সাম্যে এক চিরমিলনের আনন্দ। সেই আনন্দের মধ্যে ‘মনের মানুষের’ অনুভব। ‘ভাবের মানুষের’ সঙ্গে সাক্ষাৎ। এই অনুভূতির আর এক নাম, ‘সহজ মানুষ’। তখনই জানবে ‘আমার কাম নদীতে টান ধরেছে, প্রেম নদীতে জল ধরে না।’…

এই ‘সহজ মানুষের’, ‘অধর মানুষের’ আবির্ভাব কোথায় হয়? প্রকৃতির রজেঃ। তাই বাউল বলে, ‘মীনের আবির্ভাব হয়েছে। সাধক হে, এবার বাঁধাল বাঁধা জলে।’ যে তিন রসেতে তাঁর আবির্ভাব, সে ঠাঁইয়ের নাম ত্রিবেণী। এবার ত্রিবেণীতে ডুব দাও। মীন রূপী সেই ‘অধর’ ধরো। কিন্তু সাবধান, এই ত্রিবেণীতে ডুব দিয়ে সাধিকার অঙ্গ না ভেজে। তার যেমন বেণী তেমনি থাকবে, চুল ভিজবে না। সাধক ডুব দিয়ে মীন তুলে আনবে, গায়ে একটু জল লাগবে না। সেই যে বলে, রাঁধবে বাড়বে খাবে সুখে, স্বামীর ঘর তো করবে না, তার অর্থ, ‘স্বামী’র ভজন সে করে না। সে ‘সহজ মানুষ’ ভজে। হেথায় স্বামী-স্ত্রী নেই। এই ‘সহজ মানুষ’কে ধরে সাধক সাধিকা উল্টাকলে উজান বেয়ে নিয়ে যায়। তিনি তাই অনুভূতিগম্য নিবিড়, অচঞ্চল মিথুনানন্দস্বরূপ। বাউলের পরমাত্মা শৃঙ্গার রস লীলাময়। ইনিই ‘অটল’। যদি টলে, তবে ‘জীবাচার’। ‘প্রেমাচার’ আর হল না।

গোপীদাস বলে, আমি শুনি। আমার মনের নিবিড় অন্ধকারের গহিন বিস্তারে তার কথা যেন এক দীপশিখার মতো ভেসে চলে। আমার কল্পনার চক্ষে নানা দৃশ্য, নানা ছবি, বিচিত্র অনুভূতি খেলে।

তারপরেও প্রশ্ন জাগে, এই সাধনের লক্ষ্য কী? কোন ঈশ্বরের আরাধন?

সেই এক লক্ষ্য অচঞ্চল মিথুনানন্দের মধ্যে ‘মনের মানুষে’র অনুভব। ‘সহজ মানুষ’কে অনুভূতিগম্য করে তোলা। ইনিই ঈশ্বর। বাউলের আর কোনও ঈশ্বর নেই। এই ‘অনুভব’-ই ঈশ্বর। সে জন্যেই গান, ‘টলিলে জীব, অটলে ঈশ্বর। এর মাঝে ক্রীড়া করে রসিক শেখর।’ জগৎজোড়া মীন সেই গাঙে, খেলছে খেলা পরম রঙ্গে। ‘সোনার মানুষ ভাসছে রসে।’ ইনিই সেই ঈশ্বর। রূপের মধ্যে অরূপ। আকারের মধ্যে নিরাকার।

এক মহা সুখবাদেরই কথা শুনি। বৌদ্ধ সহজিয়া, হিন্দু তন্ত্র সাধনার সঙ্গে এর তফাত বুঝতে পারি না। পরস্পরের যোগসূত্র কোথায় জানি না। তবু, সব মিলিয়ে আমার মনের মধ্যে এক বিশাল ভারত, যেন রহস্যকুয়াশাবেষ্টিত, জেগে ওঠে। কিছু তার দেখতে পাই, কিছু পাই না। নিরন্তরের পথে সে চলেছে, বিচিত্র তার ভাঙাগড়া। মুগ্ধ হই, আবার ভয় পাই। আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠতে গিয়ে ব্যথা বেজে ওঠে। বিস্মিত হতে গিয়ে হেসে বেজে উঠি।

এই একটি লোক গোপীদাস। এক গ্রামীণ বাঙালি। তার মুখ থেকে শুনি এক ভিন জগতের কথা। আমারই আর এক পরিচয়। যে-পরিচয়ের লিখন আমার সমাজে পরিবেশে কোথাও নেই। কিন্তু আমারই চারপাশে ছড়িয়ে আছে।

অথচ এই পরিচয়ের কোথাও ভারতের সেই অধ্যাত্মবাদের চিহ্ন দেখি না। এই দেহবাদের মধ্যে কেবল বস্তুবাদের লীলা। ঈশ্বর নেই, ব্রাহ্মণ্যবাদের কথা নেই। বেদ-বিধিবহির্ভূত এ আর-এক জগতের সংবাদ। আর-এক ভারতের সংবাদ। সেই ভারত আগে কতখানি ছিল, জানি না। দেখছি, আজও তার কিছু কিছু আছে। হয়তো ভবিষ্যতে থাকবে না।

গোপীদাস তখনও বলে, ‘তাই জাইনবে বাউলের কোনও জাত নাই। মানুষের কোনও জাত নাই। সি কথা বইলছেন রসিক চণ্ডীদাসে। আর জপ-তপ মন্তর-তন্তর, তাও বাউলের না। দেখ নাই ক্যানে, বামুনে তপ্‌পন করে, বলে, স্বগ্‌গে পিত্‌রি পুরুষকে জল দেয়। ই হবার লয় বাবাজি। বাউলের গান আছে,

‘বামুন বলে, তপ্‌পনে জল স্বগ্‌গেতে যায়।

হায়, অনাবিষ্টির মাঠে চাষা কাঁদে হে

ঠাকুর, তোমার তপ্‌পনের জল হোথা ক্যানে না যায়?’

গোপীদাসের ঘড়ঘড়ে গলায় একটু হাসি বাজে। বলে, ‘ই হল কথা বাবাজি। সোম্সারখানি সোম্সার বটে, উয়ার মধ্যে মানুষ লীলা করে। কেউ ভজে ‘সহজ মানুষ’। কেউ ভজে “জীবপ্রেম”। আর কিছু না।’

সে চুপ করে। সহসা একটা ঠান্ডা হাওয়ার ঝলক লাগে গায়ে। কোথায় যেন একটা নাম-না-জানা পাখি ডেকে ওঠে। রাত্রিশেষের সংকেত।

.

৬৭.

গোপীদাসের আর কোনও সাড়াশব্দ পাই না। কী একটা গানের কলি গুনগুন করতে করতে সে নৈঃশব্দ্যে ডুবে গিয়েছে। অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছে। হয়তো চোখে তার ঘুম নেমেছে। কিংবা তত্ত্বকথা বলতে গিয়ে নিজের ব্যর্থ সাধনের ব্যথায় মুখ গুঁজে আছে। কারণ, বাউল তত্ত্বের পরে আরও কয়েকবার সে সেই কথা বলেছিল, ‘আমরা কেউ সাধক লই বাবাজি। যে যোনিতে জম্‌মো, সেই যোনিতেই মিত্যু আমাদিগের। আমরা বাউল না।’…তারপরে কী যেন গুনগুন করছিল। এখন নিশ্চুপ।

থেকে থেকেই ঠান্ডা হাওয়ার ঝলক আসে। তার দংশন তেমন ভয়ংকর না। তবু কুসুমের দেওয়া কাঁথাটিকে আর হেলাফেলা করা গেল না। পা থেকে গলা অবধি ঢাকতে হল, একটু আগেই এক নাম-না-জানা পাখির ডাক শুনেছি। সে ডাক যেন অবাক প্রাণের চকিত স্খলিত শব্দ। এখন আবার থেকে থেকে সেই ডাক বাজছে। এখন আর অবাক স্খলিত না। পাখির প্রথম ডাক ছিল অবাক জিজ্ঞাসা, ‘এ কীসের বাতাস আসে? রাত কি পোহায়?’ যত সময় যায় ততই তার গলায় আগন্তুক দিনের আলোর অসংশয় ধ্বনি বেজে ওঠে, ‘ওই আসে, দিন আসে।’

বালিশে মাথা পেতে দিই। তন্দ্রার আবেশ লাগে। অঘোর ঘুম নামে না। এই রাত্রিশেষে আর বোধ হয় নামবে না। গোপীদাসের বাউল তত্ত্ব আমার মস্তিষ্কের চারি সীমায় ফিরতে থাকে। আর বাউল গানের কথা দুর্বোধ্য রহস্যময় মনে হয় না। এখন আর অস্পষ্ট আবছা আলো-আঁধারি মাখামাখি লাগে না। এখন যেন প্রতিটি কথা দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ দেখি। গহিন জলের তলায় সকলই আমার চোখে সুস্পষ্ট।

বাউলের গান আসলে গান না। সকলই তার সাধনমার্গের ঠিকঠিকানার কথা। গানই তার যন্ত্র। সে সদাই থাকে আপন ঘোরে। সদাই জপে আপন সাধন। সেই রসের রসিক যে, সে বোঝে। অরসিকের লাভ কেবল বিচিত্র বাণীর ছন্দে, লয়ে মানে তালে গানের ডালি। নানা ভাবে বাউল তার গানে সাধন পথের প্রতীক খোঁজে। এই প্রতীক দিয়ে যখন সে গান বাঁধে তখন সে শিল্পী। কত যে তার প্রতীক। যুগে যুগে যুগ-বদলের হাওয়ায় তার প্রতীক বদলে যায়। বলে তার বাড়ির কাছে আরশিনগর, তবু পড়শির দেখা পেল না। এখন জানি, আরশিনগর আপনারই ‘দেহভাণ্ড’। পড়শি সেই ‘অধর মানুষ’। রেলগাড়ি দেখেও বাউলের কবি-কল্পনা জাগে। কয়লায় আর জলে এই যে এঞ্জিন চলে, তার সঙ্গে মানুষের শরীর কল্পনা, ‘মানুষ চলছে আজব কলে’। অন্যত্র বলে, ‘গাড়ির প্রথম লক্ষ্য রাধা জংশনের দিকে। তিন লাইন পেরিয়ে (ত্রিবেণী) রাধা নামের জংশনে এসে গাড়ি উজান পথে চলে।’ এই কারণে তার নিজেকে বারেবারে সাবধান,

ভাল কইরে পড় গা ইস্কুলে

নইলে দুঃখু পাবি শেষকালে।

গুরুর কাছে সাধনপদ্ধতির ঠিক পথ চিনে নিতে হবে। নইলে কপালে দুঃখ। সেজন্যে বাউল কেবল জয় গুরু ধ্বনি দেয়। গুরু তার ঈশ্বরের তুল্য। কেন না, পথের সন্ধান তিনি দেন। সে পথে আছে বিষধর কালনাগ, দংশন করবে। দংশনে মৃত্যু। গুরু চিনিয়ে দেবেন পথের দিশা। কালনাগকে জয় করে কেমন করে সাধক যাবে? বাউল এতই বিনয়ী, সে সকলের কাছেই কিছু শিখতে চায়। হাটে মাঠে, ঘরে সংসারে, মঠে আখড়ায়, সকলের সব কথার মধ্যেই সে তার সাধন-পথের সংকেত খোঁজে। সংকেত পায়। তাই তার অঠিক বেঠিক, অথিক পথিক, গুরু অগণন। গুরু বলে কাকেই বা সে বিশেষ করে প্রণাম করবে! সেই কারণে বাউলের গানে সামান্য মানুষের, সামান্য কথায় সুর বাজে। ভিতরে তার অসামান্যের খোঁজাখুঁজি। সেই একমাত্র জানে, সে নেই বৃন্দাবনে। ‘বেরথা তারে খুঁজে মরা মাটির এই বেন্দাবনে, ভুঁয়ে নি সে বসবারই ধন, বসবে হিয়ের মাঝখানে।’

হাজার বছর আগে চর্যাপদের দোহায় এ কথা আগেই ধ্বনিত হয়েছে। সেখানেও সেই কথার খেলা। চর্যাপদের গানও তখন হয়তো মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। সাধকের মুখে গান শুনে সাধারণে গেয়েছে। কিন্তু তার ভিতরে ঢুকতে পারেনি। সেখানেও অরসিকের গান, রসিকের সাধনতত্ত্ব। পণ্ডিতেরা তাই চর্যাপদের দোহাকে নাম দিয়েছেন সন্ধ্যাভাষা। যা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট না। রাতের অন্ধকারের মতো কালোতে ঢাকা না। অস্পষ্ট আবছায়ায় থেকে যায় আসল কথা। দেখা যায়, তবু দেখা যায় না। ধরি ধরি করেও ধরা দেয় না। সেখানে সাধন-সংকেতের প্রতীক হয়েছে চঞ্চলা হরিণী, শিকারি ব্যাধ। শবরী বালা বা ডোম্বিনী নারী অবস্থান করেছে সাধকের বজ্র-সাধনের পদ্মমণ্ডলে। গভীর বিশাল নদী দুর্যোগে পার হয় সাধক সেই নারীর আশ্রয় নিয়ে।

বাউল গানের মতোই কথা শোনায় এক। আসল সুর বাজে অন্যখানে। হিন্দু তন্ত্রেও তাই। নানা ভাষা, নানা সংকেত, নানা প্রতীক। কিন্তু কথা সেই এক, লক্ষ্য এক, উজানে চলো সাধক। সেই তোমার শক্তি। নিম্নে রাখো দৃষ্টি, লক্ষ্যভেদ করো ঊর্ধ্বে। কেউ সাধে, জন্মান্তরে আর যেন জীবাকার না ঘটে, জন্মান্তর না হয়। কেউ সাধে শক্তি। শক্তিই মুক্তি, মানব-জীবন সার্থক।

ফললাভের বিচার আমি করি না। আমি বুঝি না। আমি জানি না। আমার চোখের দুয়ারে দেশের, কাল-কালান্তরের, রূপ-অরূপের এক তরঙ্গ দোলে। আর ভাবি, কত স্রোতে মেশামেশি, তবু এক স্রোতেই যেন ভারতবর্ষ চলমান। এক স্রোতের হেথায় এক রং, হোথায় আর রঙের ঝলক। তারই সঙ্গে বিবিধ বিচিত্র মানবগোষ্ঠী। কত যে তার ধ্যান-ধারণা, কত বিভিন্ন মন! কত বিচিত্র রূপ! নানা ভাবে, নানা রূপে, যাত্রা যেন সেই একই অরূপের দ্বারে।

তবু একটা মন যখন এমনি ভাবের স্রোতে ভাসে, আর একটা মন ঠেক খেয়ে খেয়ে থমকায়। তন্ত্র, বজ্রযান, বাউল, বেদবিরুদ্ধ এই দেহবাদ, কোথায় তার আদি? অন্তেই বা কী? এ যেন ভাবে আর বস্তুতে বিরোধ। সেই দূরে, দূরকালের, কৃষি উৎপাদনের প্রতীক ধরে মানুষ যে খেলা খেলেছে, এই দেহতত্ত্বের সঙ্গে কি তার কোনও সুতো-বাঁধাবাঁধি আছে? অস্পষ্ট আবছায়ার ধন্দ আমার চোখে। স্পষ্ট দেখতে পাই না। শুধু এইটুকু দেখি, পিছনের সেই দূরান্তের কালে দমনের নামগন্ধ নেই। সেখানে উজান, ঊর্ধ্বগমন, গূঢ় সাধনপদ্ধতি নেই। সেখানে সৃষ্টির বাসনায়, বিশ্বাসে, নানা বিচিত্র রীতি-পদ্ধতিতে পৃথিবীর অনুকরণ। মানুষ মাটি কেটেছে, বীজ বুনেছে। আর বালিকা যবে প্রথম সৃষ্টির সংকেতে ঝলকে উঠেছে, তখন পুরুষ তার সঙ্গে কর্ষিত ক্ষেত্রে সৃষ্টির সহজ আচরণে নিবিড় মিলনে মিলেছে। বলেছে, ‘হে পৃথিবী, তুমি যা করো, আমরাও তা-ই করি। তুমি উৎপাদন করো, আমরাও উৎপাদন করি। আমার দেহের সৃষ্টির সকল কণা তোমার মৃত্তিকায় রেখে যাই। বীজের ভাঁজে ভাঁজে দিয়ে যাই। তোমার গর্ভ ভরে উঠুক। বীজ আহরণ করে আমি গর্ভবতী হই।’

এই বিশ্বাসে মানুষ কত বিচিত্র আচরণ করেছে। কত রহস্য, গূঢ় গুপ্ত ভাবে গানে নাচে কথায় মিলনে লীলা করেছে। মলুটির সাঁওতালদের গণ-মিলনের মধ্যে আসলে সেই আকাঙক্ষা ফুটেছে। শান্তিনিকেতনের সাঁওতালদের উৎসবকে তাই এই সভ্যতার চোখ দিয়ে চেনা যায়নি।

এ সব-কিছুর মধ্যেই বস্তুর সংকেত। তাই ভাবি, দেহতত্ত্বের মধ্যে কি সেই কৃষি-লীলার কোনও যোগ আছে? যে যোগাযোগ পরে ধর্মতত্ত্বের আঙিনায় এসে উজান, ঊর্ধ্বগমন, দমন হয়ে উঠেছে?

জানি না। বুঝিও না। আমার মস্তিষ্কের সীমায় সীমায় এক বৃহৎ দেশ এক বিস্ময়কর অর্থবহ ছবির মতো ভেসে ভেসে চলে। অবশ্য পর্বত নদী, নগর পুরী জনপদ, বিভিন্ন বিচিত্র কোটি কোটি মানুষ। আমি তাদেরই মধ্যে ফিরি, আর নানা রূপে নিজেকেই যেন খুঁজি। যত দেখি, বিস্ময়ে আনন্দে আমার কথা ফুরিয়ে যায়। কেবল নতমস্তকে, সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাতে শীতল মৃত্তিকায় বুক চেপে যেন স্তব্ধ হয়ে থাকি। আমার সকল চেতনা কী এক গভীরতায় ডুবে যেতে থাকে!

সহসা একটি মেয়ে-গলার ঝংকারে প্রথমে শ্রবণ বিদ্ধ, অতঃপর চমকিত নিদ্রাভঙ্গ। যেন এক স্বপ্নাবেশে ছিলাম। চোখে তাকিয়ে প্রথমেই দেখি দিনের আলো দাওয়ায়। আমার গায়ে কাঁথা। মুহূর্তেই মনে পড়ে যায়, কোথায় আছি। কাঁথা সরিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে বসি। পাশে গোপীদাস নেই। তক্তপোশ থেকে যতটুকু উঠোন দেখা যায়, সেখানে কোনও মানুষ দেখতে পাই না। কিন্তু কথা শুনতে পাই। শুধু শুনতে পাই না, বুঝতেও পারি, যার গলার ঝংকারে আমার নিদ্রিত শ্রবণ বিদ্ধ হয়েছে, সে কুসুম। সেইজন্যেই বিন্দুর গলায় সামাল সামাল রবও শুনি, ‘আ ছি ছি কুস্‌মি, তোর জ্ঞানগম্যি কিছু নাই ক্যানে? এই শুইনলি বাবার মুখে, চিতেবাবাজি সারাটা রাত জাগা ছিল, এই মাত্তর একটুকু চখ বুজেছে! তুই হাঁকড় পাড়ছিস?’

একটু চুপচাপ। তারপরে কুসুমের কিঞ্চিৎ নিচু গলার ফোঁসানি শোনা গেল, ‘তা সাতসকালে এইসে ওকে কে উসব কথা বইলতে বইলছে। ক্যানে বইলবে।’

উত্তরে বিন্দুর গলা, ‘ক্যানে, কাশী তো মন্দ কিছু বলে নাই। বইলছে, আগে জাইনলে উ-ও রাতে আইসত, সকলের সাথে খেতো, বইসত।’

অই হরি! আবার সেই কাশীনাথ! তাই কুসুমের অত চোপা! আবার এই কাশীনাথের অমঙ্গল ভাবনাতেই গত রাত্রে কুসুমের অন্য মূর্তিও দেখেছি। কিমাশ্চর্যম্ ভোলা মন, সংসারে সকলই সম্ভব, বিচিত্র বাহারে। কিন্তু আমার ভাবনাতে বালাই। কুসুমের গলা আবার শোনা গেল, ‘তাই খালি বইলছে বুঝিন ও? এই যে বইললে, “কাল রেতের বেলায় এলে দম চড়ানো যেত।” উ কথা বইলবে ক্যানে? ইটো কি দম চড়াবার আখড়া?’

এবারে আর বিন্দুর গলা হঠাৎ শোনা যায় না। একটু পরে দমে যাওয়া স্বরে শোনা যায়, ‘বইলছে বুঝিন?’

কুসুমের গলা, ‘বলে নাই? সামনেই তো দাঁড়িয়ে রইলছে, আবার দাঁত বের করে হাইসছে, লজ্জাও করে না। জিজ্ঞেস করো ক্যানে।’

এবার একটি বেপরোয়া কাঁচামিঠে ছেলের গলা শোনা যায়, ‘বইলছি তো, হঁ বইলছি, বেশ কইরছি। লিতাইদা বইললে, কাল খুব দম হয়েছে। আমি থাইকলেও দম দিতাম। তাতে হয়েছে কী?’

কুসুম আবার ভুলে গেল চিতেবাবাজির নিদ্রার কথা। আগের মতোই ফোঁস করে ঝংকার দিয়ে ওঠে, ‘ইস্, দম দিতাম! মুখে নুড়ো জ্বেলে দিতাম না তা’লে।’

আবার নুড়ো জ্বালা! কুসুমের প্রাণে কি ভয় নেই! তার কি বুক ধুকধুক করছে না!

সঙ্গে সঙ্গে ছেলে-গলা ঝেঁজে ওঠে, ‘এঃ, কুথাকার মা গোঁসাই এইলেন র‍্যা, নুড়ো জ্বেইলে দেবে। তোর মুখে নুড়ো জ্বেইলে দেব।’

পরবর্তী দৃশ্য যে কী ঘটতে যাচ্ছে, দাওয়ার এক কোণে বসে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কেবল বিন্দুর উৎকণ্ঠিত গলা। শুনতে পাই, ‘এই, তোদের দুটোকে লিয়ে আমি আর পারি না। কাশী, তুই যা, তুই যা তো ভাই এখন। নইলে এই হাঁকাহাঁকি থাইমবে না।’

কাশীনাথের গলা শোনা যায়, ‘যেছি যেছি, উয়ার মুখ দেখবার নেগে ইখানে থাইকব না।’

কুসুমের মুখ দেখবার জন্যে এখানে থাকবে না। সে যাচ্ছে। আমি ভাবি, কুসুমও তা-ই চায়। তার বুঝি হাড় জুড়ায়। রাগারাগির ব্যাপার তো। রাগের নাম চণ্ডাল। কিন্তু শেষরাত্রের সেই নাম-না-জানা পাখিটার মতোই যেন কুসুমের গলায় ভিন্ন সুরে স্খলিত ডাক বাজে। সে একবারে অন্য সুরে বলে ওঠে, ‘চলে যাবে ক্যানে! বইললাম— ক্যানে, চিতেবাবাজি উকে দেইখতে চেয়েছে।’

অর্থাৎ কাশীনাথকে আমি দেখতে চেয়েছি। চেয়েছি বলে কিছু মনে করতে পারি না। তবে কুসুম রাত্রে বলেছিল, সকালে তাকে দেখতে পাব। কুসুম কথাটা বোধ হয় বিন্দুকেই বলে। কিন্তু জবাব আসে কাশীর ব্যঙ্গভরা ঝাঁজালো স্বরে, ‘অত শখ খায় না। তোর চিতেবাবাজিকে লিয়ে তুই থাক গা যা। আমার দরকার নাই।’

দুমদাম পায়ের শব্দ পাই না। তবে বিন্দুর কথা শুনে বুঝতে পারি, কাশীনাথ চলে গেল। বিন্দু একটু গলা তুলে বলে ওঠে, ‘পরে আবার আসিস কাশী, নক্‌কী ভাই আমার।’

তার আর কোনও জবাব পাওয়া যায় না। উঠোনও স্তব্ধ। দু’জনেই কাশীনাথের পিছু পিছু চলে গেল কিনা বুঝতে পারি না। কিন্তু সে ধন্দ বেশিক্ষণ থাকে না। আবার বিন্দুর গলা শুনতে পাই, ‘নে, এখন প্যাঁচার মতন মুখ করে দাঁড়িয়ে থাক। বইলছে তো বইলছে, মুখের কথা বই তো না। তুই অমন করে চোপা কইরতে ক্যানে গেলি?’

‘আর উ য্যে কইরলে!’

‘উ তো পরে কইরেছে। অন্য সোমায় তো বইলতে পারতিস।’

‘ক্যানে, উ কথা বইলবে ক্যানে? গ্যাঁজার নাম শুইনলেই নোলা ছোঁক ছোঁক করে ওঠে।’

‘সিটো আলাদা কথা। সোমায় বুঝে বইলতে নাগে। এখন আর মুখ ভার কইরতে হবে না, যা গরুটো আতুর পোড়োয় বেঁধে দিয়ে আয় গা।’

একটু চুপচাপ। আবার বিন্দুর গলা, ‘দাঁড়িয়ে রইলি ক্যানে, যা।’

কুসুমের গলা শোনা যায়। ‘আর উ কথা ক্যানে বইললে, “তোর চিতেবাবাজিকে লিয়ে তুই থাক গা যা”?’

বিন্দু বলে, ‘উটো রাগের কথা।’

কুসুম আবার বলে, ‘চিতেবাবাজির সঙ্গে দেখা হবে না।’

এবার বিরক্তিতেই বুঝি বিন্দুর গলায় হাসি বাজে। বলে, ‘অই লো কুস্‌মি, আর বকাস নাই আমাকে। আমি নেয়ে এসেছি, গুরু পেন্নাম হয় নাই। তা’পরেতে দুধ জ্বাল দিতে নাগবে, আমি যাই।’

বিন্দুর হাসিটা আমার মুখেও যেন ঝলকে ওঠে। এই নাবালক-নাবালিকাদের খুনসুটির সাক্ষী হয়ে তার কি থাকা চলে। কিন্তু কুসুমের জন্যেও আমার মন খারাপ লাগে। কাশীনাথের গাঁজা খাওয়া বা কটু ভাষাটাও তেমন কিছু না, যদি আমার সঙ্গে কাশীনাথের সাক্ষাৎটা হয়ে যায়। তার নিজে মনের ইচ্ছাটা যে আমার বয়ানে বলেছে সে। আমি কাশীনাথকে দেখতে চেয়েছি। আসলে সেইটুকু কুসুমের সাধ, আমি যেন কাশীনাথকে দেখি। কিন্তু কাশীনাথ সেইখানে বাদ সেধেছে, চিতেবাবাজিকে নিয়ে তার কোনও দরকার নেই।

রাগের কথা বটে। কুসুমের প্রাণেও তো বাজে। ঝগড়া বিবাদ, মুখে নুড়ো জ্বেলে দেবার পরেও খেদোক্তি তবু থেকেই যায়। সেই রহস্যের কথা কি কেউ বুঝবে!

বিন্দু নিচু হয়ে খড়ের চালে মাথা বাঁচিয়ে দাওয়ায় ওঠে। আমাকে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘অই গ, উঠে পড়েছ বাবাজি?’

‘হ্যাঁ।’

‘শুইনছ তো সব?’

আমার মুখে তখনও হাসির রেশ। আমার দিকে চেয়ে বিন্দু নিজেই হাসির শব্দে বাজে। তার সারা শরীরেই যেন হাসির তরঙ্গ লেগে যায়। আবার বলে, ‘তাতেই বুঝি ঘুম ভেঙে গেল? তা কী বইলব বলো, ইসব পাগলা-পাগলী নিয়ে আমাকে থাইকতে হয়। যত ঝগড়া, তত ভাব। থাইকতেও পারে না, ছাইড়তেও পারে না। তবু তো বয়স পাকে নাই।’

কথার শেষে বিন্দুর চোখের তারায় একটি ঝিলিক খেলে যায়। আর আমি ভাবি, বয়সের ভারে যেদিন ফাঁকা জায়গা ভরাট হবে, সেদিন তো অন্য সুরে বাজবে। সে সুর কেউ শুনতে পাবে না। তখন দুহুঁ দোহাঁ নিবিড় গভীরে পূর্ণ, নিঃশব্দ নিশ্চুপ। তখন তো স্বরে বাজবে না, প্রাণে বাজবে। এখন তো কেবল অপূর্ণ পাত্রের ঝনঝনা।

কিন্তু তার চেয়েও আমার দুই চোখের আলোর পূর্ণতায় যেন বিন্দু ভাসে। তার দিক থেকে আমি সহসা চোখ ফেরাতে পারি না। গায়ে তার জামা নেই। একটি মাত্র গেরুয়া রঙের লালপাড় শাড়িতে সর্বাঙ্গ জড়ানো। অল্প করে একটুখানি ঘোমটা টানা। ডান পাশের খোলা কাঁধের ওপর দিয়ে সদ্য জল নিংড়ানো, আঁচড়ানো চুলের গোছা স্বাস্থ্যোজ্জ্বল বুকের এক দিক ঢেকে দিয়েছে। টকটকে লাল সিঁদুরের ফোঁটা তার কপালে। মাঝখানের সরু সিঁথেয় সিঁদুরের উজ্জ্বল রেখা। একটি লোহার বালা ছাড়া হাতে দুটি মোটা শাঁখা। আয়ত চোখে কাজল নেই। তবু যেন কাজলের রেখায় কালো। কালো দুটি ভুরু, টিকলো নাক।

সব মিলিয়ে এই কি বাউল প্রকৃতির বেশ নাকি জানি না। আমি দেখি সেই এক চিরসধবা নারী। যে যতই চলকায়, ছলকায়, ঝলকায়, চোখের তারা নাচায়, তবু যেন কী এক গভীরতায় বিরাজিত। নম্র-অনম্রের, কোমলে-কঠিনে, কী এক পবিত্রতায় যেন গলে, অমৃত বিন্দু বিন্দু।

বিন্দু কখন যেন পায়ে পায়ে কাছে আসে। ঘাড় কাত করে জিজ্ঞেস করে, ‘কী দেইখছ বাবাজি?’

একটু লজ্জা পাই। হেসে বলি, ‘তোমাকেই। স্নান হয়ে গেল বুঝি?’

বিন্দু একেবারে তক্তপোশ ঘেঁষে বলে, ‘হ্যাঁ।’

তারপরেই ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করে, ‘আমার কী দেইখলে?’

এ বিন্দু সেই আবার রংবাহার প্রকৃতি। বলি, ‘তুমি সুন্দর, তাই দেখলাম।’

‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ।’

‘ঝিন্‌দিদির চাইতে?’

এ আবার কেমন প্রশ্ন? ঝিনির প্রসঙ্গ আসে কেন? বলি, ‘তুমি এক, সে আর এক।’

বিন্দু ঠোঁটের কোণে হাসি টিপে বলে, ‘তা হলেও আমরা এক।’

এ কথার কোনও জবাব দিতে পারি না। বিন্দুই আবার বলে, ‘তবে ঝিন্‌দিদি যখন লিয়ে যেতে পাইরল না, আমিই রেখ্যা দিই বাবাজিকে। ক’দিন থেকে যাও আমার কাছে।’

বিন্দুকে চেনা হয়তো অনেক বাকি। তবু, একটুখানি তো চিনেছি। ওর মধ্যে প্রকৃতিলীলা সহজ ভাবে সদাই খেলে। ওর আসল উদ্দেশ্যটা বুঝতে সময় লাগে না। আখড়ায় থাকতে বলার রীতিটা ওর এইরকম। বাকি সবই ওর আচরণের বৈশিষ্ট্য। গতিক সুবিধার নয়। তাড়াতাড়ি তক্তপোশ থেকে নেমে বলি, ‘আমার আর দেরি করার সময় নেই, এখুনি বেরোতে হবে। গোঁসাই বাবা কোথায় তোমাদের?’

বিন্দু যেন চমকে থতিয়ে যায়। চোখ বড় বড় করে চেয়ে বলে, ‘উ বাবা, উ বাবা! ই কী গ, কথা নাই বাত্তা নাই, ই যে একেবারে লাফ দিয়ে ওঠে। কুথা যাবে?’

‘বক্রেশ্বর।’

‘তা বেশ তো, হাত-মুখ ধোয়া লাইগবে না? একটু গোছগাছ কইরবে তো, না কী গ?’

আমি ততোধিক ব্যস্ত গলায় বলি, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, কোথায় একটু জল-টল পাওয়া যায় বলো। অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

বিন্দু তেমনি চোখ বড় বড় করে আমার দিকে চেয়ে থাকে। কোনও কথা বলে না। তারপরে আস্তে আস্তে তার চোখে কৌতুক ঘনিয়ে আসে। হাসির নিবিড়ে ঝিলিক দেয়। খিলখিল করে হেসে ওঠে। এ হাসিটা আমার মধ্যেও সংক্রামিত হয়। বিন্দু বলে ওঠে, ‘বাব্বা! সত্যি তুমি চিতে বাপু! রঙ্গ জানো বটে! আমি ভাবি কী যে, অই গ মা, থাইকতে বলেও ফ্যাসাদ কইরলাম য্যা! কুথা বিষ্টি তার দেখা নাই, মেঘের ডাক শুনেই চাষা লাঙল লিয়ে দৌড়াল্‌ছে!’

এবার আমার দ্বিগুণ হাসির পালা। বিন্দু ডাক দিয়ে বাইরে নিয়ে যায়, ‘এসো।’

তার সঙ্গে বাইরে যাই। হাতের ঘড়ি হাতেই বাঁধা। সময় কম না, সকাল আটটা বাজে। চারদিকে রোদের ঝিলিমিলি। বাইরে এসে মনে হয়, যেন রোদে ডুব দিলাম। রাতের অন্ধকারে কিছু দেখতে পাইনি। এখন দেখি, উঠোনের অন্য দিকে আর একখানি মাত্র ঘর। বাইরে থেকে শিকল টানা। উত্তর দিকে মাটির দেওয়ালে বাড়ির সীমা। তার ওপাশে আরও কয়েকটি ঘরের খড়ের চাল দেখা যায়। আম-কাঁঠালের গাছ আশেপাশে। শাল-সেগুনও আছে গুটিকয়।

বিন্দুর সঙ্গে সেই রান্নাঘরের দিকে যাই। খিড়কি দরজাটা যেখানে, সেখানে দু’ বালতি জল রয়েছে। একটুখানি জায়গা শান বাঁধানো। বিন্দু খিড়কি দরজা খুলে দেয়। সেখানে আম-কাঁঠাল ছাড়াও কয়েকটি কলাগাছ। চারপাশে মনসার বেড়া ডিঙিয়ে উঁচু-নিচু জমি দেখা যায়। কোথাও তার সবুজ ঘাস। কোথাও বাবলার ঝাড়। তার ওপারে রোদে পিঠ দিয়ে পড়ে আছে আদিগন্ত ধানকাটা মাঠ।

বিন্দু বাগানে গিয়ে মনসার বেড়ার কাছে ডিঙি দিয়ে পোড়ো জমির দিকে কী যেন দেখে। ফিরে বলে, ‘গরু বেঁধে দিয়ে কুসুম আবার কুথা গেল্‌ছে, কে জানে।’

মনসার বেড়ার গায়ে কঞ্চির তৈরি আগল করা আছে। সেই আগল খুলে দিয়ে আমার দিকে ফিরে বলে, ‘মাঠের দিকে ইচ্ছে হলে যেয়ো। জল বাড়িতে আছে, উখানে হাত-মুখ ধোয়া কইরবে। আমি যেছি, হাঁ? তোমার গামছা লিয়ে আসি।’

মাঠে যেতে বলার উদ্দেশ্য কী, তা আমার জানা। রাঢ় বলে কথা না, বাংলা দেশের অনেক পাড়াগাঁয়েই প্রাতঃকৃত্যের জন্যে প্রথম যাত্রা মাঠে। নগরের চাল হেথায় অচল। আমি বলি, ‘আমার ঝোলায় গামছা আছে।’

‘সিটিই পাবে।’

বিন্দু একটু হেসে চলে যায়।

মাঠ থেকে ফেরার পথে পোড়োর উঁচু জমিতে যখন উঠি, তখন দেখি বাবলাবনের একটেরেতে কুসুম দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার দিকে ওর লক্ষ নেই। অন্য দিকে মুখ তুলে কী যেন দেখছে। ডাকতে গিয়ে চুপ করে রইলাম। কী দেখছিল কুসুম কে জানে। হঠাৎ সে মাটিতে বসে পড়ে। বসে কী যেন ভাবে, আর মাটিতে আঙুল দিয়ে দাগ কাটতে থাকে।

হয়তো সে কাশীনাথকে দেখতে পেয়েছে। কিংবা কাশীনাথ এই পথে আসবে, তারই প্রতীক্ষা। কিছু না বলে আমি বাগান পেরিয়ে খিড়কিতে যাই। সেখানে ছোট পিঁড়ের ওপর আমার তোয়ালে। বালতির পাশে ঝকঝকে ঘটি, আর একটি মাজনের শিশি।

মুখ ধোয়া শেষ হবার আগেই বিন্দুর আবির্ভাব। জিজ্ঞেস করে, ‘নেয়ে লিবে বাবাজি?’

বলি, ‘না। বক্রেশ্বরে গিয়ে স্নান করব।’

‘উ বাবা ধনুকভাঙা পণ দেইখছি য্যা, আঁ?’

ততক্ষণে আমার ধোয়ামোছা শেষ। ফিরে বলি, ‘কুণ্ডের গরম জলে স্নান করব আজ।’

ঘরে এসে দেখি, গোপীদাস গোকুল সুজন সবাই রয়েছে। বিন্দু জিজ্ঞেস করে, একটুক দুধ এনে দিই বাবাজি, কেমন?’

দুধ! বিন্দুর কথার সুরে ও স্বরে কেমন যেন ভিন্ন স্বাদের আমেজ লেগে যায়। নেশা ধরে যায়। কিন্তু রাত পোহালে চা চা করে মরি। দুধের স্বাদ কি মনে আছে আর! তাও সকালবেলাতে! বলি, ‘না, একটু চা পেলেই হয়।’

‘তাও দেব, একটু দুধ খেয়ে লাও ক্যানে?’

গোপীদাস বলে, ‘আমার বিন্দু মায়ের শ্যামা গাইয়ের দুধ বড় মিঠা বাবাজি। একটুক খাও। চাট্টি মুড়ি দুধে ভিজিয়ে লবাত চিবিয়ে খেয়ে লাও!’

তারপরে আর বিন্দু অনুমতির অপেক্ষা করে না। সে বেরিয়ে যায়। গোকুলদাস থাকবার জন্যে অনুরোধ করে। গোপীদাস তাতে তাল দেয়। আমি বলি, ‘বক্রেশ্বরের টান লেগেছে, আগে সেখানেই যাই, তারপরে দেখা যাবে।’

খাওয়ার পালা চুকলে যখন বিদায় নিতে যাই, তখন সব হাসিমুখের আলোয় যেন একটি বন্ধু-বিদায়ের ছায়াও ঘনায়। গোপীদাসই আমার একমাত্র সঙ্গী। সে বক্রেশ্বর থেকে আবার এখানেই ফিরবে।

কিন্তু পা বাড়িয়েও যেতে পারি না। কুসুম কোথায়? কাশীনাথকে কি আমার দেখা হবে না? নিতাই তাড়াতাড়ি ছুটে যায় সামনের দরজা দিয়ে। একটু পরেই ফিরে আসে একটি সতেরো-আঠারো বছরের ছেলেকে নিয়ে। এখনও গোঁফদাড়ি কিছু গজায়নি। কিশোরী মেয়ের মতোই প্রায় মুখ। মাথায় তেলহীন রুক্ষ চুল। রোগা রোগা, লম্বা। ডাগর চোখ দুটি দেখে একবারও ভাবতে পারি না, এ ছেলে গাঁজা খায়। চোখ দু’টিতে এমনি একটি আবেশ, দেখে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না, এ ছেলে অমন করে ঝগড়া করতে পারে। মুখখানি যেন কুসুমের থেকেও সুন্দর। একটু শীতও তার নেই। গা একেবারে খালি। পরনে ছোট একখানি ধুতি। আমার সামনে এসে সলজ্জ হেসে মাথা নিচু করে রইল।

আমি তাকেই জিজ্ঞেস করি, ‘কুসুম কোথায়?’

‘জানি না।’

কেমন করে জানবে! আমি জানি, তোমাকে নিয়ে সে আমার কাছে আসবে। তাই তোমারই অপেক্ষায় বনের নিরালায় বসে আছে। কিন্তু সে কথা আমি বলি না। মনে মনে জানি, কুসুমের সাধ পূর্ণ হল। চিতেবাবাজির সঙ্গে কাশীনাথের দেখা হয়ে গেল।

আমি কাশীনাথের ঘাড়ে হাত দিয়ে এগিয়ে চলি। বিন্দুকে বলি, ‘কুসুমকে বলো।’ বিন্দু হেসে ঘাড় নাড়ে। কিন্তু ওর চোখের কোণ দুটি যেন চিকচিক করে।

.

৬৮.

দু’পাশে ঘর। মাঝখানে সরু পথ। লাল মাটি আর বালি কাঁকরে মেশানো। গোকুল সুজন নিতাই আমাদের পিছনে পিছনে আসে। গোপীদাস সকলের আগে। জয় গুরু ধ্বনি দিয়ে বেরিয়েছে। এখন একতারাটা বাজায় বংবঙিয়ে। কাশীনাথের কাঁধে এখনও আমার হাত। রাস্তার বাঁক নেবার আগে আর একবার পিছন ফিরে তাকাই। রাধা বৃদ্ধার পাশে বিন্দু তখনও মাটির দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথাখানি হেলানো। বৈরাগিণী, তবু শাঁখায় সিঁদুরে আমার অপরূপ দেখাটা ঘোচে না। মনে মনে বলি, এই প্রকৃতিতে সেই প্রকৃতি আছে। সহজ মানুষ যার অঙ্গের নীরে ভেসে ওঠে। সময় বুঝে যে নীরেতে বাউল বাঁধাল বাঁধে।

বাঁক নিতেই পাড়াটা শেষ হয়ে যায়। তারপরে মাঠ। মাঠের ধারে রেললাইন। লাইনের ওপারে শহর। শিউড়ি দেখা যায়। কিন্তু কুসুমকে সত্যি দেখা গেল না। আতুর পোড়ো যে কোনটা, এখান থেকে ঠিক বুঝতে পারি না। সেখানে কি সে এখনও বসে আছে! সেখান থেকে কি সে আমাদের দেখতে পাচ্ছে!

কাশীনাথকে বলি, ‘তা গোঁসাই, গাঁজাটা একটু কমসম খেলে হয় না।’

দেখ এবার ছেলেকে। লাজে লাজানো মুখখানি দেখে মনে হবে যুবতীর ব্রীড়া। চোখের তারায় যেন অষ্টাদশীর বিস্ময়-হানা হাসি। মুখ নামিয়ে বলে, ‘একটু-আধটুক খেয়াছি। রোজ খাই না। এদের জিগেঁস করেন ক্যানে।’

‘কুসুম যে বলে, গাঁজা দেখলে তোমার নোলা ছোঁক ছোঁক করে।’

‘উ তো মিছা কথা বলে।’

আর কাশীনাথ সাচা কথা বলে। আমি পিছন ফিরে গোকুলের দিকে তাকাই। গোকুল বলে, ‘সিটো কথা বটে। কুস্‌মি যত বলে, অত না।’

কাশীনাথ বলে ওঠে, ‘কুসি তো খালি আমাকে গ্যাঁজা খেতেই দ্যাখে। ন’ মাসে ছ’ মাসে একদিন খেলে নিত্যি তিরিশ দিন খোটা দেবে। পাকামি দেইখলে গা জ্বালা দেয়।’

সত্যিই তো। বলছে কে দেখতে হবে তো। হতে পারে সতেরো-আঠারো বছরের ছেলে। তা বলে, কুসুমের পাকামি সহ্য করবে কেন। তাও আবার, কুসুমের দাদার সামনেই বলছে। দাদাটিও শুনে হাসছে।

আমিই ভিন কথায় বেকায়দা করে ফেলি, ‘তা ন’ মাসে, ছ’ মাসে এক-আধটু না খেলেই নয়?’

আহ্, ক্যানে এমন লজ্জা দেন গা। কাশীনাথের রুক্ষুচুলের মাথাটা একেবারে তার আদুড় বুকের কাছে নুয়ে পড়ে। কোনও জবাব দেয় না। আর কুসুমের বেলায় যেমন, কাশীনাথের বেলাতেও, আমার সেই কথাই মনে হয়।

ওর দিকে চেয়ে মনে হয়, বই বগলে এখন ওর ইস্কুল কলেজে যাবার কথা। কিন্তু তার কোনও ছাপ-ছোপ ওর কোথাও নেই। বরং, কথা বলতে হচ্ছে গাঁজা খাওয়ার প্রসঙ্গে। বাঁধা গৎ-এ মানুষ নেই। মানুষ মেলে না এক ছাঁদে। রূপেতে তার সীমা নেই। সেইখানে সে অসীম। জিজ্ঞেস করি, ‘সারা দিন কী করো?’

‘কাজ করি।’

‘কী কাজ?’

‘আমাদিগের চাষ-আবাদ আছে। মাঠে গরু রেখ্যা আইসছি। গরু আমাকে দেইখতে হয়।’

অন্য ইস্কুলের মানুষ। কাশীনাথ কৃষক। কাশীনাথ রাখাল। তার ওপরে, বোষ্টমের ঘরের ছেলে। গোকুলের কাছে বাউলের দীক্ষা নিতে চায়। ইস্কুল কলেজের কথা এখানে আসে কেমন করে! সবই কি তোমার শহরের ভদ্রলোকের চালে চলে! বাংলাদেশের দিশে, দেশান্তরে! সে আর কতটুকু! ঘাটে মাঠে খেটে খাবার মানুষ তো বেশি!

ইতিমধ্যে রেল লাইন পেরিয়ে আমরা শহরের সীমায় এসে পড়ি। এখানকার চেহারা আলাদা। তিন চাকার রিকশা আর মোটরগাড়ির ভেঁপু সমান। আপাতত আমাদেরও রিকশা নিতে হয়। কাছারির কাছে গিয়ে বক্রেশ্বরের মোটর ধরতে হবে।

গোপীদাস বাঁয়াটা কোলের ওপর টেনে নিয়ে রিকশায় বসে। কাশীনাথকে ছেড়ে দিয়ে আমিও উঠে বসি। গোকুল সুজন নিতাই জয় গুরু ধ্বনি দেয়। গোকুল বলে, ‘দিনকালের কথা বইলতে লারছি। তবে যদি উৎরানের দিন কেঁদুলিতে আসেন, দেখা হতে পারে।’

দিনকালের কথাটা আমারও। তাই বলি, ‘দেখি। আশা তো করি যাব।’

কাশীনাথ আমার দিকেই চেয়েছিল। একবারও চোখ নামায়নি। কিছুটা অবাক, একটু বা কৌতূহল, তার মধ্যেই একটু ভাল লাগার হাসি, সলজ্জভাব। চোখাচোখি হতেই কিশোরীর মতোই হেসে চোখ নামিয়ে নেয়। বলি, ‘তা হলে যাওয়া যাক কাশীনাথ।’

‘আবার আইসবেন।’

সে কথার জবাব না দিয়ে বলি, ‘আমার কথাটা একটু বিবেচনা করে দেখো।’

আবার লজ্জা, মাথা নত। জানি না, এর চোট আবার কুসুমের ওপর গিয়ে পড়বে কী না। রিকশা চলবার আগে গোকুলকে কী যেন বলে কাশী। গোকুল বলে ওঠে, ‘তবে যা ক্যানে।’

গোপীদাস বলে, ‘কী?’

‘কাশী বইলছে, বক্কেশ্বরে যেতে মন কইরছে।’

আমি ডেকে বলি, ‘এস।’

কাশীনাথ সলজ্জ হেসে মাথা নাড়ে। বলে, ‘উপায় নাই। মাঠে আলু রইয়েছে।’

কৃষকের কাজ আছে। তা ছাড়া, রাখালের গরু দেখবে কে। আমাদের রিকশা ছেড়ে চলে যায়। নতুন ছবি ভেসে ওঠে। রাঢ়ের শহর। বাংলাদেশের দূর মফস্বল শহর যেমন হয়, তেমনই। তবে, প্রকৃতিতে কিছু ভেদাভেদ আছে। শহরের ধারেও রাঙা মাটি, পাথুরে প্রান্তর, উঁচু-নিচুতে ধু ধু করে যেন। শহরে যত ঢোকা যায়, তত ঘিঞ্জি। দোকানপাট বাজার, সব মিলিয়ে একটা গোছানো শহর যেন তবু হয়ে উঠতে পারে না। খড়ের চাল মাটির দেওয়াল, পাকা ইমারতের পাশেও পাবে। এদিকে-ওদিকে, ফাঁকে-ফোকে একটু মাঠ-ঘাট চোখে পড়বে। গাছপালায় নিবিড় কোনও বাগান বা পোড়ো। উঁচু ঢিবির ওপরে তাল গাছের জটলা চিনিয়ে দেয় জলাশয়। তাল গাছের ভিড় একটু বেশি।

তারপরে, পুরনো শিউড়ি শহরে, সরু রাস্তায় যত যানবাহনের ভিড় তত মানুষের। তাও প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। ধুতি-কুর্তা চোগা-চাপকানে মানুষ চেনা দায়। জনপদের খেটে খাওয়া মানুষদের দেখলে জানবে, কোন দেশেতে চল। তাদের মুখের ছাপে, গায়ের রঙে, পায়ের ধুলায় রাঢ়ের লিখন। তাদের চলন চালে, কথার ছন্দে দেশের পরিচয়। তার সঙ্গে তুমি যেটা পাচ্ছ সেটা হল একটু কৌতূহলী দৃষ্টি। ইটো আবার কে হ্যা, আলখাল্লা পরা চুল-দাড়িওয়ালা ডুগি একতারার সঙ্গে কোঁচাওয়ালা ভদ্দরলোক চইলছে! কাছারিতে সাক্ষী দিতে যায় নাকি!

তা না হলেও কাছারির সামনেই নামতে হয়। প্রচুর মোটরগাড়ি। মোটর বাস বলো, ছোট গাড়ি বলো, সব আছে। যাতে খুশি চলো। শিউড়ি রাজনগর। রাজনগর দুবরাজপুর লাইনের মোটর বাসে বক্রেশ্বর যাওয়া যায়। একখানি ছোট গাড়ি ভাড়া করেও যাওয়া যায়। টাকা একটু বেশি লাগে। গোপীদাসের তাতেই আপত্তি। ক্যানে বাবাজি, এত খরচের কী প্রয়োজন। আগের দিনে তো বনের আর মাঠের পথ হেঁটেই যেত গোপীদাসেরা। এখনই যত গাড়ি-ঘোড়ার দিনকাল এসেছে। আর সেই যে বলে, ঘোড়া দেখলেই খোঁড়া, এখনকার মানুষেরা তা-ই হয়েছে। গোপীদাস হেঁটে যেতেও রাজি।

তা জানি, সে হেঁটে যেতে রাজি। কিন্তু আমার এতটা সইবে না। বারো-চোদ্দো মাইল হেঁটে পাড়ি দেওয়া বড় কঠিন। তা ছাড়া, গতকাল নানুর থেকে যেভাবে এসেছি, আজ আর কোনও ধকল নিতে ইচ্ছা করে না। তা-ই দু’জনে একটি আলাদা গাড়িই ভাড়া করি।

গোপীদাস গাড়িতে উঠে হাত পা ছড়িয়ে বসে। ড্রাইভারের সঙ্গে দু’ একটা কথা বলে। তারপরে একটি শব্দ করে বলে, ‘বড় আরাম লাগে।’

চেয়ে দেখি, তার দৃষ্টি গাড়ির জানলা দিয়ে দূরে নিবদ্ধ। আরামের আমেজী ছাপটা তার মুখে দেখি না। যেন অন্য এক লোকে চলে গিয়েছে। দাড়ির ভাঁজে ভাঁজে মুখে একটু হাসির আভাস আছে। কিন্তু তাতে যেন কেমন একটু ব্যথা জড়ানো।

তার গতকালের রাত্রের কথা আমি ভুলিনি। এমনি এক ধুলামলিন আলখাল্লা পরা, একতারা বাঁয়াওয়ালা ঝোলা কাঁধে পথে পথে ফেরা মানুষ যে, এমন তত্ত্ব ভাষতে পারে, না শুনলে তা জানা যায় না। এই সব মানুষে যে আর এক মানুষ আছে, তা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু ভারতবর্ষের হর্ম্যতলে, রম্যকক্ষে কবে তত্ত্ব শোনা গিয়েছে। কেবল তত্ত্ব কেন। শিল্প বল, সঙ্গীত বল, সবই তো বনে পথে পাহাড়ে বন্দরে গাছতলায়। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে যে মানুষেরা মোহন হেসে পথ চলে যায়, ভারততত্ত্বের তত্ত্ব যে তারই ঝুলিতে। ভাবেই থাকো, আর বস্তুতেই থাকো, ভারত রীতির এইটুকুই বিস্ময়, ধুলা পায়ে যে-মানুষ পথের প্রান্তে গাছতলায় বসে, গভীর বাণী সেখানে বেজেছে।

অবাক যতই লাগুক, জানি আমার অচেনাতে চিনেছি গোপীদাসকে। তত্ত্ব রাজে তাদের কাছেই, ভাষেও তারাই। নগর আর আধুনিকতার ঘোরে যতই তাদের দীন ভাবি না কেন। তা-ই এমন মানুষকে যদি একটু আরাম দিয়ে থাকতে পারি, তা আমারই সন্তুষ্টি। সেই জন্যই জিজ্ঞেস করি, ‘ভাল লাগছে?’

গোপীদাস ফিরে তাকায় না। তেমনি দূরে চোখ রেখে বলে, ‘হঁ বাবাজি, জীবনে এই পেখম তোমার সাথে এমন আরাম কইরে বক্কেশ্বর যেইচ্ছি। তাই বইলছি বাবাজি, তুমি কিছু মনে করো না, নিজের কথাটো খালি মনে লেয়। আরাম কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না, ক্যানে কিনা, অ্যাঁ? তা উতেও কোনও দোষ নাই, যদি ধম্‌মে থাইকতে পাইরতাম। না পাইরলাম ধম্‌মে থাইকতে, না পাইরলাম খোলস ছাইড়তে। তবে বেঁচে ক্যানে রইলাম হে।’

গোপীদাস যেন আপনাকে করুণা করে হাসে। অথচ তার চোখ দু’খানি কেমন টলটলিয়ে ওঠে। গতকাল রাত্রের সেই আক্ষেপ, সেই বিলাপ। সেই ভাবেরই স্রোত যে মনের গহনে চলছে, বুঝতে পারিনি। এ কথার জবাব আমার জানা নেই। আমার সন্তুষ্টি যেন এক চকিত কষ্টে থমকে যায়।

গোপীদাস নিজেই আবার বলে, ‘বড় সোখ পেলাম, তাই কথাটো মনে হল। সোখেতেই পতিত হলাম যে বাবাজি। দুঃখের দান না দিয়ে সোখের ঘর কইরতে গেলে এই হাল হয়। সেই সোখেতেই পতিত হলাম।’

গতকাল রাত্রে যেন ঠিক এ কথা এমন ভাবে শুনিনি, সুখেতেই পতিত হলাম। জিজ্ঞেস করি, ‘দুঃখের দান কী?’

‘শিক্ষে।’

‘শিক্ষা?’

‘হঁ বাবাজি। তোমরা যেমন নেকাপড়া শিখে পরীক্ষা দাও, তেমনি শিক্ষে। নেকাপড়া না শিখে পরীক্ষায় যেইয়ে বইসলে পতন তো হবেই। তাই পরীক্ষায় ফেল কইরলাম বাবাজি।’

‘আবার তো পরীক্ষা দেওয়া যায়।’

‘না বাবাজি, উইখ্যানেতে তফাত। পরীক্ষা একবার। সারাজীবন ধইরে গুরুর কাছে শিক্ষে লাও, তা’পরেতে পরীক্ষেয় বসো। ফেল মাইরলে তো গেলে। সি কথাটো কাল বইলেছি তো তোমাকে, জীবাচার বারবার, প্রেমাচার একবার। তাই শরীলে সোখ পেইলেই নিজের কথাটো মনে পইড়ে যায়। আর তো বাবাজি, ই জীবনে কিছু হবার লয়। সব শেষ হয়ে গেছে।’

গোপীদাস কথা থামায়। দেখি টলটলানো চোখের দরিয়া গাল বেয়ে দাড়ি ভিজিয়ে দেয়।

মনে মনে এত আতুর হয়ে উঠি, ইচ্ছে থাকলেও একটু হাত বাড়িয়ে গোপীদাসের হাত ধরতে পারি না। এ জীবনে সবই শেষ হয়ে গেছে। সেই ব্যর্থতা তার ভাষায় ভাবে এমন গভীর করে বাজে, কথা বলতেও পারি না।

কিন্ত গোপীদাস আপন ঘোরেই বাজে। কেন সব শেষ হয়ে যায়? জরা এসে যে সব পথ বন্ধ করে দিলে। যৌবন থাকতে যে সাধন সাধেনি, জরাতে সে পথ রুদ্ধ। যার কাম গিয়েছে, তার প্রেমও গিয়েছে। বিশ্বপ্রকৃতিতে দেখনি, ঋতুর বদল আছে বলে, ধরিত্রী যুবতী। প্রকৃতিও তেমনি, তারও জরা এলে চলবে না। এই কাম-রতির মেশামিশিতেই কামগন্ধহীন প্রেম সাধন। নইলে হবার নয়। শব সাধনা শ্মশানে বসে। প্রেম সাধনা কামের ঘরে বসে। তবে তো সাধন। চোখ যদি নেই তো দেখবে কী দিয়ে। পা নেই তো চলবে কেমন করে।

এ সাধন সম্ভব কি না সে প্রশ্ন ভুল। ডুব দিতে যে শিখেছে, সে ডুব সাঁতারে পার হয়। সেই তো একই কথা, লক্ষ্যভেদ যে শেখে, সে নীচে তাকিয়ে উঁচুতে তির গাঁথে। তার মধ্যে অনেক কথা। নিজেকে তৈরি করতে হবে। পুরুষ প্রকৃতির শরীরে নীর ক্ষীর সবই আছে। সবের আস্বাদ নিতে হবে। শরীরের কোনও কিছুই অখাদ্য না। অপেয় না। সেজন্যে বলেছে, বাউল সাধকের লজ্জা ঘৃণা ভয় তিন থাকিতে নয়। কেন না তাকে যোগ্য হতে হবে। সেইজন্যে দ্রব্যগুণের কথা। শুধু পাতা চিবোও, লাল হবে না। শুধু খয়ের, শুধু চুনে, সুপুরিতেও না। সব মিলিয়ে চিবোলে তবে লাল। সেইরকম এই শরীরেই বহে গঙ্গা যমুনা। কামরতির নীর ক্ষীর। একে বলে,

বিনে জলে হয় চরণামৃত

যা খেলে যায় জরা-মৃত।

এ না হলে সাধক তৈরি হয় না। ‘স্ব স্ব বিন্দু পান কর আপনার করি। নহিলে সাধন সিদ্ধি নাই, নিত্যে যাইতে নারি।’ এর নাম আত্মরক্ষা। আত্মরক্ষার শক্তি। ‘গুরুর কাছে জেনে বুইঝে ঠিক মতন যদি লিতে পার তো তরে যাবে। ইও বাবাজি, “কেবল ইস্তিরি পুরুষে রমণ করা লয়! আত্মায় আত্মায় রমণ হল্যে রসিক তারে কয়”।’

গুরুর নির্দেশে সব যদি ঠিক ঠিক মতো করতে পারো তবে এ সাধন সম্ভব। সব মিশিয়ে যাও তবে লাল হবে। পাকা হবে। কাঁচায় ডাঁসায় চলবে না। যদি ধাপে ধাপে পাকা হতে পারো, তবে সাধন করো। গোপীদাস বলে, ‘ধন্দের কিছু নাই বাবাজি। আমি তো ফাঁকি, আমাকে দেইখে ধন্দে পড়ো না। জাইনবে, যে সাইধতে জানে, তার অসম্ভব কিছু না। আমি তো পতিত বাবাজি।’…

কখন যেন শহর পেরিয়ে গ্রাম ছাড়িয়ে গাড়ি এসে পড়ে নিরালা বনের ছায়ায়। সহসা মনে হয় অরণ্যের সীমায় এসেছি। ঋজু শাল কন রাস্তার ধারে। গহন বিথার ছায়ায়। রোদ ঝিলিমিলি। শুকনো পাতার ছড়াছড়ি। কাঠকুড়ানিদের দু-একজনকে দেখা যায় এখানে সেখানে।

আমি গোপীদাসের কথা শুনি। সম্ভব-অসম্ভবের সকল ধন্দ নিরসন করে সে বাজে। আর কিছু না, এইটুকু ভাবি, তত্ত্বের এই বিচিত্র বিস্ময়কর গুণ ভেদাভেদ বিষয় একদা অতীতে মানুষের মনে কেমন করে এসেছিল। আধুনিক বিদ্যাশিক্ষায় যার নাম ‘কেমিষ্ট্রি’, দ্রব্যের সেই গুণাগুণের বিচার কেমন করে আয়ত্ত করেছিল, সে যুগের ঝোলা কাঁধে ছেঁড়া আলখাল্লা ক্ষ্যাপা বাউল কাপালিকেরা। তাদের ইস্কুলের নাম কী। তাদের বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় ছিল।

গায়ে স্পর্শ লাগতে সংবিৎ পাই। ফিরে চাই। গোপীদাস আমার দিকে চেয়ে। এখন তার চোখ টলটলানো না। সুখেতে পতিত বাউল এখন আমার চোখের দিকে চেয়ে যেন কেমন এক নিবিড় রহস্যে হাসে। কিন্তু আমার একবারও মনে হয় না, এ মানুষ পতিত। এ মানুষ যে কেবল জীবাচারেই ডুবেছে, বিশ্বাস হয় না। এ মানুষ প্রেমাচারেও ভেসেছে। না হলে অমন কেঁদে ভাসে কেন। তার মুখের দিকে তাকিয়ে তো একবারও পতিতের পাপ দেখি না!’

গোপীদাস জিজ্ঞেস করে, ‘কী ভাবো বাবাজি?’

‘আপনার কথা।’

‘কেমন লাগে?’

‘আশ্চর্য লাগে।’

গোপীদাস এক মুহূর্ত চেয়ে থাকে আমার দিকে। তারপরে হঠাৎ বলে, ‘সাইধবে বাবাজি?’

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কী সাধব?’

‘বাউল সাধন?’

আমার গায়ের মধ্যে সহসা যেন এক শিহরন লেগে যায়। আমার বুকের কাছে কেমন একটা তোলপাড় ভাব। তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলি, ‘না, না, ও সাধন আমার নয়।’

‘ক্যানে বাবাজি?’

‘আমি বাউল নই।’

‘কে বা বাউল, বাবাজি! যে ভজে, সাধে, সেই বাউল হয়।’

আমি গোপীদাসের চোখের দিকে চেয়ে দেখি। তারপরে হেসে বলি, ‘জগতে সব কিছু সকলের জন্য নয়।’

‘তুমি বাবাজি লদীর মতন ভেইস্যে চলো, তুমি পাইরবে।’

‘না, এ কথা বলবেন না। আমি যে আপনার চেয়ে বেশি সুখেতে পতিত।

‘জয়গুরু!’

গোপীদাস যেন সহসা অস্ফুট কান্নায় ভেঙে পড়ে। আচমকা সে আমার পায়ের দিকে নুয়ে পড়ে। আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে! তাড়াতাড়ি তার দু’হাত চেপে ধরি, টেনে নিই। গোপীদাস মাথা নাড়ে, নিচু ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে, ‘তুমি পতিত লও, আমি জানি, আমি জানি গ।’

এ সব কথার জবাব দিতে পারি না। কিন্তু আমার বুকের কাছে যেন কীসের ভার চাপে। আমি ঠোঁটে ঠোঁটে টিপে থাকি। তবু আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে ওঠে। চোখ শুকনো রাখতে পারি না। আমার কোথায় যেন কলকল ধারা বহে যায়। কেবল একটি ধ্বনি শুনতে পাই, ‘পতিত পতিত পতিত।’

অথচ যা জানি না, বুঝি না, মানি না, বিশ্বাস করি না, তারই মধ্যে টেনে এনে গোপীদাস আমাকে এমনি ভাবে আতুর করে। এমনি ভাবে প্রাণমনের তরঙ্গে, এক অচিন আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তারপরে, আমার মনের মধ্যে, কেবল একটি কথাই বাজে। এই মুহূর্তে যেন নতুন করে বুঝতে পারি, এ গোপীদাস পতিত নয়।…

জমি ক্রমে উঁচু-নিচু। ছোটখাটো চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, গাড়ি এসে দাঁড়ায় বক্রেশ্বর নদীর ধারে। এখানে ওখানে পাথরের বড় বড় চাংড়া। মৃত্তিকায় কাঁকর বালি। মনে হয়, তার নীচেই পাথর। নদীতে জল নেই। নতুন সাঁকোর কাজ সবে শুরু হয়েছে। শেষ হলে তবে যাতায়াত। আমাদের যেতে হবে নদী পেরিয়ে ওপারে।

ওপারে বক্রেশ্বর। পাপহরা নাম উষ্ণ কুণ্ডবাহী, শিবক্ষেত্র। ওপারের পাথুরে জমির উঁচুতে দেখি কেবল মন্দির। মন্দির মন্দির মন্দির, সকলই শিব মন্দির। সব থেকে উচ্চ মন্দিরের চূড়াও এখান থেকে চোখে পড়ে। যেখানে উঁচু গাছের ডালে ডালে পাতায় পাতায় রৌদ্র ঝিলিমিলি।

গাড়ি থেকে নামতে চালক জিজ্ঞেস করে, আমরা আজই ফিরব কী না। তা হলে, সে-ই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তার জন্যে টাকাও সামান্য লাগবে। কেন না, তাকে তো ফিরতেই হবে।

গোপীদাস এক কথাতেই নাকচ করে। ‘না বাবা, তা-ই কী হয়। পথে বেরিয়ে, পিছ টান, উ ভাল লয়। তখন তোমার মুখ চেইয়ে আর সোমায় বুইঝে, আমাকে চইলতে হবে। তুমি বাবা যাও গা।’ অতএব চালককে বিদায় করতে হয়। গোপীদাসের বক্তব্য, একেবারে জলে পড়ে নেই তো। যে পথে আসা, সেই পথেই ফিরতে হবে কেন। না-হয় মোটর বাসে দুবরাজপুর দিয়ে রেলগাড়িতে করে যাওয়া যাবে। আর আমি যদি বর্ধমানের বড় রেল রাস্তা ধরতে চাই, তাতেও কোনও অসুবিধা হবে না।

নদীর একেবারে নীচে এসে, সামান্য একটু জলের ধারা চোখে পড়ে। পার হয়ে ওপারে যখন উঠি, তখন চারদিকে চেয়ে অবাক লাগে, এত শিবমন্দির করল কে!

গোপীদাস জানায়, জনে জনে করেছে। শিবক্ষেত্রে মানুষ নানা মানসে বাসনায় বিশ্বাসে এক এক মন্দির করেছে। সংখ্যা কত হবে? তা তিন শো-র ওপরে বটে!

অবাক লাগে, মুগ্ধও হই। এর নাম ভারতবর্ষ। তার মাঝে এক দেশ, বাংলাদেশ। যেখানে যাবে, নানা খানে নানা বৈচিত্র্য। এলাম যেন এক মন্দিরের রাজ্যে। কারুকার্যখচিত শিল্পের মেলা নেই মন্দিরে মন্দিরে। এর রূপ আলাদা। ইট গেঁথে গেঁথে, দোচালা চারচালা সটান সোজা মন্দির কেবল। পথ বেঁধে দেওয়া, নিয়মতান্ত্রিক সারি সারি না। এখানে ওখানে, যেখানে সেখানে, মন্দির মন্দির মন্দির। রাজা মহারাজা নামী ব্যক্তিদের স্মৃতি গাঁথা বিশাল দেবমন্দির না। সাধারণ শিবভক্তদের সামান্য নিবেদন, সামান্য প্রতিষ্ঠা। আশেপাশে জঙ্গল, বাবলা মনসা আসশেওড়া। কিছু প্রাচীন মহীরুহ বট অশ্বত্থ। আরও নানা গাছগাছালি। কোথাও বা বেড়ার কুটির, মাটির দাওয়া। কঞ্চির বেড়ায় ঘেরা, সামান্য একটু পালং মুলো, লাউয়ের মাচা।

তবু যেন সব মিলিয়ে, একটা সবুজ নিবিড় ভাব নেই। জমির উঁচু-নিচু পাথুরে বিস্তার, নতুন পুরনো, ভাঙা আস্ত মন্দির। কিছু গাছপালা। সব মিলিয়ে শিব বক্রেশ্বরের মতোই জটাজুটবিস্তৃত রুক্ষতা। যেন একটা সন্ন্যাসের বৈরাগ্যের ছাপ সর্বত্র। যেন এক উদাস, বৈরাগী আপনাকে ছড়িয়ে পড়ে আছে। তার দৃষ্টি যেন কোন সেই দূর আকাশলোকে, একটু ভ্রূকুটি ভাব। অথচ কপাল কপোল ঘিরে এক ধ্যানের প্রসন্নতা। তার মধ্যে, বাজে ঝিল্লিস্বর। পাখির পিক্-পিক্-চিক্-চিক্ শিস ডেকে ওঠে। নদীর পাড়েতেই থমকে দাঁড়িয়ে থাকি। পা চলে না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। মনে হয়, এখানে যেন পৃথিবীর এক শেষ প্রান্ত। এখান থেকে আর কোথাও যাবার নেই।

গোপীদাস আমার কাঁধে হাত দিয়ে ডাকে, ‘চলো বাবাজি। ইখ্যানে দাঁড়িয়ে থাইকলে কী হবে। কুণ্ডের দিকে চলো, আরও ভাল লাইগবে। তারপরে আসল বক্কেশ্বর বাবাকে দশ্শন কইরবে। চলো এগিয়ে যাই।’

তার সঙ্গে কয়েক পা চলতেই, কোথা থেকে সামনাসামনি একজন এসে দাঁড়ায়। রোগা, লম্বা, মাঝবয়সী লোক। মাথায় কাঁচা-পাকা খোঁচা খোঁচা চুল, আঁচড়ানো নেই! কিন্তু টিকিতে একটি ফুল বাঁধা। পরনের কাপড়েই গা ঢাকা। বুকের কাছে খোলা জায়গায় একগাছি পৈতা দেখা যায়। চোখের কোলে কালি, দৃষ্টি যেন, মর্মভেদী। আমার দিকে চেয়ে, প্রথম প্রশ্ন, ‘কুথা থেকে আইসছেন, কী নাম?’

থমকে দাঁড়াতে হয়। অবাক হয়ে তার দিকে দেখে, গোপীদাসের দিকে ফিরে চাই। গোপীদাস আমার হাত ধরে টেনে অন্য দিকে জবাব দেয়, ‘এ বাবাজি পূজা-টুজা দেবেন না গ ঠাকুর, ওঁয়ার পাণ্ডার দরকার নাই। একটুক বাবাকে দশ্শন কইরবেন, ঘুরে বেড়িয়ে দেইখবেন, চইলে যাবেন।’

তার কথা শেষ হবার আগেই আর একজনের আবির্ভাব। বয়স একটু কম বটে, তবে চেহারায় যেন মিল আছে। সে বলে ওঠে, ‘সি কথাটো তুমি বইলছ ক্যানে। উনি কি বইলছেন, পূজা দেবেন না?’

আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠি, ‘পুজো দেবার কথা কিছু ভাবিনি। একটু দেখতেই এসেছি।’

প্রথম পাণ্ডা চোখ শিবনেত্র করে। মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘তা বইললে কি হয় মোশায়! তীত্থক্ষেত্রে এইসেছেন, হিন্দুর ছেলে। জাগ্রত ক্যানে। কুথা থেকে আইসছেন?’

গোপীদাস সরাসরি বলে দেয়, ‘কলকেতা।’

‘অ। নাম কী?’

আমি নাম বলি। পাণ্ডা ঠাকুর একটু কী ভেবে যেন বলে, ‘তা বেশ তো। চলেন, আমার বাড়ি চলেন। কুণ্ডে নেয়ে-টেয়ে, পূজা দিয়ে আমার ওখানেই দুটি পেসাদ পাবেন।’

আমি ঘাড় নেড়ে বিনীত ভাবে বলি, ‘তার কোনও প্রয়োজন নেই।’

কথাটা মনঃপূত হল না, তা বুঝতে পারি। মুখের ভাব কেবল ব্যাজার না। ঠাকুরমশায়দের একটু যেন গোঁসাও হয়েছে। দ্বিতীয়জন আওয়াজ দেয়, ‘সে আপনার ইচ্ছা। কলকেতা থেকে এত দূরে এইসে পূজা না দিয়ে যাবেন, ইটো ঠিক লয়।’

এবার গোপীদাস একটু যেন ঝেঁজেই ওঠে, আ রে দূর, ক্যানে এত কথা বইলছ ঠাকুর! বাবাজি যদি পূজা দেন, তো দেবেন। পলায়ে যেছেন না তো গ। তব্‌ব্যা? হইল্‌ছে হইল্‌ছে, বাবাজি এখন আছেন।’

গোপীদাস আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে। কিন্তু যদি ভেবে থাকো, ঠাকুরমশায়রা তাতে তোমার পিছন ছাড়বেন, তা হলে ভুল করবে। তবে ঠাকুরমশায়রা নেইয়াকুঁড়ে না। সঙ্গে সঙ্গে চলে, বলে, ‘শ্বেত গঙ্গা দেখেন আগে। চান করে ল্যান। গামছা-টামছা আছে তো?’

‘আছে।’

‘তবে আর কী। চান করে মন্দিরে যান। বাবার মন্দির এখনও খোলা আছে, যেইয়ে দর্শন কইরে আসেন।’

বলে, গোপীদাসকে জিজ্ঞেস করে, ‘তা, হ্যাঁ হে বাবাজি, বাবুর খাবার ব্যবস্থা কী কইরছ?’

গোপীদাস নিস্পৃহ গলায় বলে, ‘দেখি।’

‘বাবুকে কুণ্ডগুলোন সব দেখাবে ঠিক করে।’

একেবারে নির্দেশ-আদেশের সুর ঠিক না। তবে, ‘বাবু’ কথাটা কানে লাগে। গোপীদাসের বাবু না আমি। আমি তার পথিক বন্ধু, পরস্পরে মজেছি। আমি তার বাবাজি।

গোপীদাস বলে, ‘দেখাব গ ঠাকুর দেখাব। না হল্যে আর লিয়ে আসছি ক্যানে।’

পথিমধ্যে আরও দু-চার পাণ্ডার দেখা পাওয়া যায়। তারাও আমার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। তারপরে এক জায়গায় সবাই দাঁড়িয়ে, কী যেন বলাবলি করতে থাকে। আমি গোপীদাসের সঙ্গে এগিয়ে যাই।

.

৬৯.

শীতের এই সকাল-দুপুরের মাঝামাঝি বেলায় খোলা জায়গার ঠান্ডা হাওয়ায় গোপীদাস আমাকে নিয়ে এল এক উষ্ণ পরিবেশে। এক না, একাধিক উষ্ণ কুণ্ড হেথা হোথা। এই জলাশয়ের পাশে দাঁড়ালে, সারা গায়ে উত্তাপ লাগে। জল ছুঁয়ে দেখবার আগেই মনে হয়, সারা শরীরের রক্তে রক্তে যেন উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে।

ছোট ছোট বিভিন্ন কুণ্ডের বিভিন্ন নাম। পাকা গাঁথনি দিয়ে বাঁধানো, আলাদা আলাদা জলাশয়। সিঁড়ি নেমে গিয়েছে কুণ্ডের জল পর্যন্ত। কিন্তু দাঁড়াও হে বক্রেশ্বরযাত্রী। সাত-তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে জলে হাত দিয়ো না। জলেতে আগুন আছে। আলসে দিয়ে ঘেরা জায়গায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিলে, মুখে এসে তাপ লাগে। বড় বড় বুদবুদে, জল যেন টগবগিয়ে ফুটছে। শব্দ করে, নিরন্তর বুদবুদ ফাটছে।

জলে একটু ঘোলানি নেই। একেবারে তলা অবধি দেখা যায়। ঘ্রাণে লাগে এক নানা মিশালী ধাতব গন্ধ। কুণ্ডের এখানে ওখানে, নানা গাছের ঝুপসি ঝাড়। ধরিত্রীর কোন কোল থেকে, পাতালের কোন শিরা বেয়ে আসে এই উষ্ণ স্রোত, কে জানে। আমি ভাবি। যার পাতাল রন্ধ্রে, ঠান্ডা মিষ্টি জলস্রোত বহে, তারি আর এক রন্ধ্রে এই ভয়ংকর তপ্ত স্রোত পাশাপাশি চলে। কেমন করে? নোনতা মিঠে, ঠান্ডা গরম, একের মধ্যেই, সকলের পাশাপাশি বাস। এক ধরিত্রীর দেহের কূল, নানা রূপে রসে অকূল।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে, ছোট এক কুণ্ডের জলের দিকে হাত বাড়াই। আর তখনই, নতুন গলায় আওয়াজ পাই, ‘এই কুণ্ডের জল বেজায় গরম বাবু, হাত দিবেন না।’

থমকে দাঁড়িয়ে মানুষ খুঁজি। কে বলে, কার গলা? পিছন ফিরে দেখি, গোপীদাস ঘাড় নিচু করে ডাইনের জংলা ঝোপের দিকে লক্ষ করছে। সেদিকে চেয়েই সে জিজ্ঞেস করে, ‘ই য্যা এলেকাটা বাবাজি দেইখছি গ। এখনও তুমি আছ?’

ততক্ষণে, মাঝখানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, ঝোপঝাড়ের আড়ালে, একটি মুখ আমিও দেখতে পেয়েছি। মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। একমুখ গোঁফদাড়ি। গায়ে একটা ময়লা কাঁথার মতো কিছু জড়ানো। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতে, চোখমুখ ভরে গোঁফদাড়িতে ছড়িয়ে একখানি হাসির ঝিলিক লাগে। তারপরে, গোপীদাসের দিকে ফিরে বলে, ‘থাইকব না তো যাব কুথা। যদ্দিন যার জিনিস সে না লিচ্ছে, তদ্দিন থাইকতে হবে।’

গোপীদাস বলে, ‘আহ্, দূর, সি কথা হইচ্ছে না। বইলছি, বক্কেশরে এখনও আছ?’

ঝোপের মানুষ বলে, ‘আর কুথা যাব গ। ই তো শেষ জায়গা। হিঃ হিঃ হিঃ।’…

শোনো হাসি! যেন একেবারে খিকখিকিয়ে বাজে, হিক্কা তুলে গড়িয়ে যায়। গোপীদাস বলে, ‘তা বটে। কেমন আছ এলেকাটা বাবাজি।’

এলেকাটা বাবাজি! এমন নাম কখনও শুনিনি। আর ঝোপের মধ্যে, কেউ যে অমন করে কাঁথা জড়িয়ে বসে থাকে, তাও দেখিনি। জবাব দেয়, ‘অই আছি, ভাল আছি। পেটে একটুকু গোলমাল, তা না হলে—।’

কথা শেষ না করে, আবার সেই খিকখিক হাসি। সেই বেজায় হাসি যে একেবারে নাভিস্থল থেকে আসছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু পেটের গোলমালের কথায়, হাসির কী আছে, বুঝতে পারি না। আমি একবার গোপীদাসের চোখের দিকে চাই। সেও যেন একটু ধন্দেই পড়েছে।

এলেকাটা বাবাজির হাসি একটু থামলে, আবার বলে, ‘তা না হলে, খুব ভাল আছি। এত সোখ আর কুথা মিলবে। মাটি গরম, জল গরম। ঠান্ডাতে বড় আরাম।’

গোপীদাস জিজ্ঞেস করে, ‘পেটে কী হল?’

‘জ্বালা!’

বলে, এলেকাটা ঝোপের আড়াল থেকে, আমার দিকে চেয়ে হাসে, আর একটি চোখ বুজে যেন কী ইশারা করে। আবার বলে, ‘মহামাঁস তো খেতে শিখি নাই। পেট ভরাব কী দিয়ে। খিদের জ্বালা গ, বুইঝলে?’

গোপীদাস আওয়াজ করে, ‘জয়গুরু।’

কিন্তু মহামাঁস কী। গোপীদাসই জিজ্ঞেস করে, ‘তা মহামাঁস খেল্যে কি পেট ভইরবে হে?’

এলেকাটা বলে, ‘খেতে পাইরলে, ভইরত। মহামাঁসের তো অভাব নাই গ।’

গোপীদাস আবার ‘জয়গুরু’ বলে। এলেকাটা বাবাজি তেমনি খিকখিক করে হাসে। হাতছানি দিয়ে আমাকে ডেকে বলে, ‘ইদিকে আসেন বাবু, একটো কথা বলি।’

আমি মাঝখানের সিঁড়ি থেকে উঠে আসি। কিন্তু মহামাঁস মানে কী? মহামাংস? মানুষের মাংসকেই তো মহামাংস বলে জানি। এলেকাটা বাবাজি কী তাই দিয়ে ক্ষুধা নিবৃত্তির আশা করেছিল নাকি?

সামনে এসে দেখি, হাঁটু মুড়ে পায়ের ওপর বসে আছে বাবাজি। ঝোপঝাড়ের মাঝখানে এমন ভাবে বসে আছে, আওয়াজ না দিলে সাধ্য নেই, সেখানে কেউ জীবের সন্ধান পাবে। সামনে এসে দাঁড়াতে তেমনি হেসে বলে, এই ক’দিন আগেই, ‘অই কুণ্ডে এক বাবাজি দেহ রক্ষা হইরেছেন। ফুটন্ত জল কি না, তাই বইলছি, থাক আর নাইমবেন না, উখান থেকে দ্যাখেন।’

গোপীদাস তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করে, ‘কে গ?’

‘সি তুমি চিনবে না। লতুন এইসেছিল। শ্মশানের উইপারে থাইকত। চ্যালা চামুণ্ডা জুইটতে দেরি হয় নাই। বাবাজি একেবারে ঘোর তান্ত্রিক। গ্যাঁজা মদ, দুয়েতেই খুব টান। তা এই ক’দিন আগে কারণ খেঁইয়ে, তা’পরে আবার খুব কইরে গ্যাঁজায় দম দিয়ে এই কুণ্ডের সিঁড়িতে এইসে শুইয়েছিল। কখন যে গড়িয়ে পইড়েছে কেউ জানে না। জাইনবার কথাও না। রাতবিরেতে কে আর অত খোঁজ রাখে। যখন তোলা হল, তখন বেবাক সেদ্ধ। ই তো আর তুমার চাল ডাল লয় যে, কুণ্ডের জলে ফুইটবে না। মানুষ ঠিক ফোটে।’

বলে আবার খিকখিক হাসি। গোপীদাস আওয়াজ করে ‘জয়গুরু’। কিন্তু আমার গায়ের মধ্যে যেন শিউরে ওঠে। একটা গোটা মানুষ গরম জলে সেদ্ধ হয়েছে! এ যেন সেই রূপকথার ফুটন্ত তেলে ফেলে দেওয়া! নরকের শাস্তি তৈল কটাহে নিক্ষেপ! আমি জলের দিকে ফিরে চাই। এই কুণ্ডে বুদবুদ উঠছে না, ফাটছে না। টগবগ করে ফুটে ফুটে শব্দ করছে না। কিন্তু দূর থেকে কেবল উত্তাপ লাগে না। খরতাপে যেমন মরীচিকা কাঁপে জলের ওপরে উত্তাপের তীব্রতায় তেমনি মরীচিকার মতো কাঁপছে। এলেকাটা বাবাজির কথার সত্যি-মিথ্যে জানি না। তবে মানুষ পড়লে সেদ্ধ হবে সন্দেহ নেই।

আমি বলে উঠি, ‘কী দরকার ছিল এখানে এসে শোবার?’

এলেকাটার আবার সেই হাসি। বলে, ‘বাবুর কথা শুইনে হেস্যে মরি গ। নিজের দরকারের জন্যে ক্যানে শুতে আইসবে বাবু। যার দরকার সেই ডেক্যে নিয়ে আইসছে।’

‘সে আবার কে?’

‘মরণ! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!…মরণ বইললে, আয় ইখানে এইসে শো। তাই এইসে শুল, আর মইল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।’…

বিচ্ছিরি! মৃত্যু, নিয়তি, যাই বলো, এই তত্ত্বরহস্যের কথায় ও হাসিতে গায়ের মধ্যে যেন কেমন করে ওঠে। গোপীদাসের দিকে চেয়ে ফিরতে যাই। তখন শুনি, ‘তা বাবু, কি কারণে, ডেক্যে লিয়ে আইসলাম আপনাকে, এলেকাটা বাবাজিকে কিছু দিয়ে যান।’

গোপীদাস দাড়ি কাঁপিয়ে চোখ পাকায়। ঠোঁট গুটিয়ে ঘাড় নাড়ে। বলে, ‘অইটি বলো ক্যানে। মরণ কুণ্ডের ইজারা লিয়ে বইসে আছ, পাওয়ানা দিয়ে যেতে হবে।’

এলেকাটা বাবাজি জিভ কেটে মাথা নাড়ে। বলে, ছি ছি ছি, মরণ কুণ্ডের ইজারা লিব আমি। বলে শালো, আমার ইজারা লিয়ে কে বস্যে রইয়েছে তার ঠিক নাই। আমি থাইকব মরণ কুণ্ডের ইজারা লিয়ে। দেন বাবু, এলেকাটা বাবাজিকে কিছু দিয়ে যান।’

আবার আমার দিকে চেয়ে হাত বাড়ায়। এমন কিছু জটিল ব্যাপার না। নতুন মানুষ, বাবু বলে মনে হয়েছে, তাই কিছু প্রাপ্তিযোগের আশা। তা না হয় হল। কিন্তু ঝোপের আড়াল থেকে ওরকম তাক দিয়ে খিকখিক করে হেসে এত কথা শোনাবার কারণ কী? ভয় দেখাবার জন্য নাকি? তখন তো মনে হচ্ছিল, ব্যাপার গুরুতর। মূলে তো কিছু আশা। জিজ্ঞেস করলাম, এলেকাটা নামের মানে কী? এমন তো কখনও শুনিনি।’

আবার সেই হাসি। সঙ্গে সঙ্গে হাতের ওপর ভর দিয়ে সামনে পা এগিয়ে বসে। দেখি একটা পা আছে, আর একটা পা হাঁটুর কাছ থেকে নেই। হাসতে হাসতে বলে, ‘এই জন্যে!’

একপদবিহীন মানুষের নাম এলেকাটা হয় নাকি! জিজ্ঞেস করবার আগেই জবাব শুনি, ‘এল গাড়ি’, মানে রেলগাড়ি জানেন তো?’

যে রকম শুনছি, তাতে রেলগাড়ি নামে শকট আছে, সেটাও হয়তো জানতে হবে এবার, বলি, ‘জানি।’

‘তা রেলে এ পা’খানি কাটা পইড়েছিল বুইঝলেন ক্যানে বাবু। সি থেকে এলেকাটা বলে সবাই।’

অর্থাৎ রেলেকাটাই হল এলেকাটা। ভাল ভাল। তার সঙ্গে বাবাজি কেন, সে কথা আর জিজ্ঞেস কারার প্রয়োজন বোধ করি না। যে কারণেই হোক, ইনি বাবাজি। তারপরে অন্য নাম যাই থাক, রেলে কাটা পড়ার খ্যাতিতেই বাবাজির নামের গৌরব। খুবই সোজাসুজি সহজ ব্যাপার। অথচ শুনলে মনে হয়, না জানি কী ভজকট জটিল রহস্যই রয়েছে নামের মধ্যে।

ক্ষমতায় যেটুকু হয় পকেট থেকে তাই তুলে এলেকাটার হাতে দিই। সঙ্গে সঙ্গেই জয়জয়কার ‘জয় বাবা বক্কেশ্বর। জয় বাবা অঘোর।’

কপালে হাত ঠেকিয়ে আবার বলে, ‘তবে আমার আসল নাম মানিকলাল। বাবার থানে আছি বটে, তবে জাইনবেন, আমি শৈব না বাবু, শাক্ত। যদি পুজো দেন তা হলে একটুক পেসাদ যেন পাই।’

গোপীদাস ততক্ষণে আমাকে ডাক দেয়, ‘এইস বাবাজি, এইস। তা অই গ এলেকাটা বাবাজি, আমাদিগের ক্ষ্যাপা অবধূতের খবর কী? ইখানে আছে?’

এলেকাটা এমন ঠোঁট বাঁকায় যে, দাড়ি সুদ্ধ উলটে যায়। বলে, ‘থাইকতে পারে। উয়ার কথা আমাকে জিগেস করো নাই বাবা, বইলতে লারব।’

গোপীদাস একটু অবাক হয়ে বলে, ‘ক্যানে, তুমি অবধূতের চেলা না?’

সঙ্গে সঙ্গে এলেকাটার বিদ্রোহ, ‘আমি শালা কোনও শালার চেলা নই। উসব আমাকে জিগেস করো নাই।’

গোপীদাসের চোখে সেই বিটলে ছোঁড়ার বিটলেমি ঝিলিক দেয়। বলে, ‘অ, আচ্ছা বাবাজি। ভৈরবী ঠাকরুনের খবর জান?’

‘নাঃ।’

এক কথায় নাকচ। কেবল নাকচ না, বিরক্তি যত বিক্ষোভ তত। গোপীদাস তবু জিজ্ঞেস করে, ‘ইখানে আছে কী না, তাও বইলতে লাইরছ?’

‘তা থাইকতে পারে, খুঁজে দ্যাখ গা।’

গোপীদাসের দাড়ির ভাঁজে হাসি। ফিরতে ফিরতে চোখের ইশারায় আমাকে চলতে বলে। আমি চলতে চলতে শুনি, এলেকাটা বাবাজি বিড়বিড় করে, ‘দ্যাগ গা তোমার অবধূতের কীত্তিকলাপ, শালা সাধনা কইরতে এইসেছে।’

কথায় কথায় এত যার চোখে মুখে গোঁফদাড়িতে হাসি, পিকপিকিয়ে বাজে নাভিস্থল থেকে, হঠাৎ একজনের নামোচ্চারণেই একেবারে যেন তার আগুনে ঘিয়ের ছিটা। ব্যাপার কী?

গোপীদাস আমার চোখের দিকে চেয়ে বলে, ‘বইলব বাবাজি, পরে বইলব।’

সে বিষয়ে সন্দেহ কিছু আছে। পরে জানা যাবে।

আপাতত পাপহরা জলাশয়ে যাবার আগে মাঝখানের কুণ্ডের দিকে আর একবার চোখ পড়ে। প্রথমবারে লক্ষ করিনি। এখন দেখছি কাচের মতো স্বচ্ছ জলের তলায় গোটা গোটা চাল ডাল পড়ে আছে। ফুটন্ত উষ্ণ জল দেখে অনেকে হয়তো আশা করেছিল চাল ডাল ফেললে ফুটবে।

গোপীদাস বলে, ‘আবার কী দেখ বাবাজি?’

‘চাল ডাল।’

গোপীদাসও চেয়ে দেখে আর হাসে। বলে, ‘আমার গুরুর কথা মনে পইড়ছে বাবাজি। জয় গুরু জয় গুরু!’

সে কপালে হাত ঠেকিয়ে গুরু স্মরণ করে। তারপরে বলে, ‘আমার গুরুর নাম ছিল নয়ন ক্ষ্যাপা। তা সি ক্ষ্যাপার সাথেই পেখম এই তীত্থে এইসেছিলাম। আমারও বাবাজি পেখম এই কুণ্ড দেইখে মনে হইয়েছিল, এত গরম, এত টগবগানি, ই জলে চাল ডাল ফুইটবে। ঝোলা থেকে এক মুঠা চাল লিয়ে ই কুণ্ডেতেই ফেইলেছিলাম। সি দেইখে ক্ষ্যাপার কী হাসি। বললেন, “অই র‍্যা ভোলা, ই জল সি জল লয় রে। ই জল পাকা জল। ই জলও জল বটে, গরম বটে, ফুইটছেও বটে। কিন্তুক চাল দিবি, ডাল দিবি, দিব্বি ফুইটবে, মুখের মতো গেলবার গরাসটি হবে, উটি হবার লয়। ই থেকে বুঝে লে নিজের সাধন তত্ত্ব। সাধন সাইধবি এমনি কইরে। জলও থাইকবে, গরমও থাইকবে, ফুইটবেও বটে, কিন্তুক আদত মালে ফুট খাবে না”।’

কথার শেষে গোপীদাসের দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বক্রেশ্বরের দূর বিস্তৃত শিবমন্দিরের দিগন্তে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তার গুরু নয়ন ক্ষ্যাপাকে কখনও চোখে দেখিনি। কিন্তু যেন গোপীদাসের মতোই একটি চুলদাড়ি আলখাল্লাওয়ালা মানুষের ছবি ভেসে ওঠে। আর ভাবি, বাউলের সেই এক তত্ত্ব কথা। কিন্তু কত বিচিত্র তার প্রতীক। কুণ্ডের উষ্ণ জলের কথায়ও তার তত্ত্বের প্রতীক জেগে ওঠে।

একটু পরে গোপীদাস ‘গুরু সত্য’ বলে আমাকে ডাক দেয়, ‘এইস বাবাজি।’

তার সঙ্গে একটুখানি গিয়েই নতুন দিগন্তে এসে পড়ি। দেখি বাঁধানো বড় ঘাট। এদিকে ওদিকে মেয়ে-পুরুষ কয়েকজন স্নান করছে। ঘাটের সিঁড়ির এখানে-ওখানে দু-একটা ছেঁড়া কাঁথা-মাদুর।

গোপীদাস বলে, ‘পাপহরা।’

আমার মনে হয়, জলের এমন গাঢ় রং দেখিনি। পৌষের নীল আকাশের ছায়া যেন এই জলে কেমন গাঢ় কৃষ্ণ হয়ে উঠেছে। খাঁটি আয়নার কাচে যেমন গভীরতা, এ জলেও যেন তেমনি। এখনই যেন উঁকি দিলে পাতালরাজ্যের সব কিছু দেখা যাবে।

এ নদী নয়! এমনকী বড় দিঘিও নয়। মাপজোক করে কাটাকাটি নেই। রোদ দেখে মনে হয়, পুবে-পশ্চিমে লম্বা আপন খেয়ালে টলমল এক জলাশয়। জলাশয়ের ওপারে চোখ পড়তে হঠাৎ চমকে উঠি। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। দেখে মনে হয় যেন এক বিশাল সাপের ফণা তোলা কেওড়ার ঝাড়। তার পাশে লকলকে আগুনের শিখা। বাতাস নেই, আগুনের জিভ যেন শূন্যে মেলে আকাশ চাটতে চায়। আগুনের পাশ ঘেঁষে সুঠাম শক্ত কালো এক পুরুষ। পরনে এক চিলতে কাপড়, মাথায় গামছা। মোটা বাঁশে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

দেখা মাত্র সেই মুহূর্তেই যেন সব বুঝতে পারি। তবু মুখে কথা ফোটে, ‘ওখানে কী?’

গোপীদাস বলে, ‘শ্মশান বাবাজি। আসলে বক্কেশর হল মহাশ্মশান। যে শ্মশানের কোনও নিবিত্তি নাই, তারে বলে মহাশ্মশান। বক্কেশ্বরের চিতা কখনও নিবে না বাবাজি। যিদিনে আইসবে, যখনই আইসবে, যখনই আইসবে দেইখবে, চিতা জ্বইলছে।’

মহাশ্মশান। চির সংস্কারের মনে কোথায় যেন শ্মশানের নামে এক ভয় জড়িয়ে আছে। মৃত আর শবের সান্নিধ্যে মন কখনওই যেন অনায়াস হয়ে ওঠে না। কিন্তু উষ্ণ কুণ্ড, এই জলাশয়, এত শিবমন্দির, এই গাছপালা ঝোপঝাড় প্রান্তর, গেরুয়া রঙের পাথর, মাটির সন্ন্যাসী-প্রকৃতি, আর গোপীদাসের কথা শুনতে শুনতে একবারও যেন অন্ধকার জাগে না। বরং সমস্ত মন জুড়ে যেন কী এক বিস্ময় জাগে। কী এক অচেনা গভীরতা, অদৃশ্য অচিন দূরত্ব আমাকে ডাক দিয়ে ডুবিয়ে নিয়ে যায়।

এত মন্দির দেবদেবী দেখি, নমস্কারের কথা মনে আসে না। পাপহরার ঘাটে দাঁড়িয়ে সহসা মনে হয়, ওই চিতার আগুনকে নমস্কার করি। কেন আমার এমন মনে হল, আমি জানি না। অথচ আমার চারপাশ সম্পর্কে আমি অচেতন নই। তাই হাত তুলে চিতার আগুনের দিকে চেয়ে নমস্কার করতে পারি না। কিন্তু মনে মনে করি।

কেন করি, কেন করি, কিছুই জানি না। কার চিতা তাও জানি না। তবু দেখি, আগুনের বিশাল বুকে আগুনের ব্যাকুল আলিঙ্গনে কে যেন মহাশান্তিতে নিবিড় ঘুমে অচেতন। কেন দেখি তাও জানি না। কেন প্রাণ বারংবার নমস্কারে নত, আমি জানি না।…

হঠাৎ মোটা গলার চড়া হাসিতে চমক লাগে। দেখি, এক খালি গা, প্রকাণ্ড কালো পুরুষ, সিঁড়ি দিয়ে জলে নেমে আসে। একমাথা ঝাঁকড়া চুল, কানে রুপার মাকড়ি। চোখ দুটি লাল টুকটুকে। মুখে জ্বলন্ত বিড়ি। শরীর যেন একটু টলমল। হাত মটকা দিয়ে বলে, ‘তু যা ক্যানে, আমি আইসছি।’

তার জবাবে ওপরের সিঁড়ি থেকে মেয়ে গলায় ঝংকার বেজে ওঠে, ‘না, তুমি এইস। কেমন তুমার স্সত্যি কথা, আমি বিটি শুনতে চাই। এইস বইলছি।’

ই বাবা দেখে মনে হয়, মেয়ে লয় বটে, বিষহরির বিটি! পায়রার মতো বুক ফোলানো যুবতী, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছে যেন ছিলা-টানা ধনুকের মতো বেঁকে। একবার যদি তির ছিটকে আসে, তবে অব্যর্থ শিকার জানবে। মাথাতে নেই ঘোমটা, বাসি খোঁপা এলোমেলো। ময়লা রঙিন শাড়িটাও শরীর জড়িয়ে এমন কিছু ঢাকাঢাকিতে নেই। চোখের রং কোকিলের চোখের মতোই লাল। বচন তো শুনলেই। এর পরেও কি কারুর এই মুখের ওপরে কথা বলতে সাহস হয়।

হয়। কেবল কথা বলার সাহস না, হেঁড়ে গলায় হো হো করে হাসতেও সাহস পায়। পুরুষটি হেসে বলে, ‘তু যা না বইলছি। আমি ডুব দিয়ে আইসছি।’

বলে ঘাটের শানে বসে, জলে পা ডুবিয়ে দেয়। বিড়ি টানে ঘন ঘন। ওপর থেকে তেমনি স্বরে শোনা যায়, ‘ক্যানে, একবার ঘুরে যেঁইয়ে লাঁইতে লাইরছ?’

‘হুঁ, লাইরছি, যা!’

এক মুহূর্ত চুপচাপ। নারীর চোখে তিরের ফলায় অঙ্গারের বিন্দু জ্বলে। কিন্তু আর কথা না। ঝটিতি ঘাড় ফিরিয়ে পিছন ফিরে চলে যায়। যেদিকে যায় সেদিকে কয়েকটি ঘরের ইশারা দেখা যায়। একজন স্নানার্থী জিজ্ঞেস করে, ‘কী হলা র‍্যা মদন?’

মদনের জবাব, ‘শিল লোড়াতে দিনে-এতে যা হচ্ছে, তাই। আব্বার কী ঘট-টং ঘসড় ঘসড়। লে বাবা, ঘা।’

তারপরেই কথা নেই, বার্তা নেই, হাত দুটো পিছনে ভর দিয়ে শরীর আর মুখটাকে আকাশমুখী করে মদনের প্রচণ্ড গলায় গান বেজে ওঠে, ‘হারালিদি পেইলেম বইলে হিদেতে লইলে তুলি…।’

কে একজন বলে ওঠে, ‘উঃ উঃ, উ বাবা র‍্যা!’

ছোটখাটো একটা হাসির ঢেউ লাগে। আমিও গোপীদাসের দিকে চেয়ে হেসে ফেলি।

গোপীদাস হেসে বলে, ‘শ্মশানের ডোম।’

আর যে চলে গেল, সে নিশ্চয় ডোম্বের ডোম্বিনী। চর্যাপদের ডোম্বিনীর মতোই যেন যুবতী নায়িকা লক্ষণাক্রান্তা।

গোপীদাস জিজ্ঞেস করে, ‘নেয়ে লিবে বাবাজি? এ জলে নাইতে খুব ভাল লাইগবে। উ পাটটো মিটিয়েই লাও।’

জিজ্ঞেস করি, ‘খুব গরম না তো?’

লেমেই দ্যাখ ক্যানে বাবাজি, এই ঠান্ডাতে উইঠতে ইচ্ছা কইরবে না। তা’পরে চলো, বাবাকে এবেলা একবার দশ্শন কইরবে।’

সেই ভাল। দর্শন মানে দেখাই। দর্শনের গুণ আমার নেই। মন্দিরের থেকে বাইরে যা দেখি তাতেই আমার মন মজে, ঘোর লাগে। ঝোলা খুলে সামান্য এক বস্ত্র পরে নিই চানের জন্য। আর গা মোছার ভোয়ালে। গোপীদাসও তৈরি হয়।

জলে নামতে গিয়ে আবার চমক। আবার ঠেক খাই। ঘাট বরাবর ওপারে এতক্ষণ শুধু এক পাকা বাড়িই দেখছিলাম। ওপারে জলাশয়ের কাছাকাছি সামনের দিকে সব খোলা এক কুঁড়েঘর দেখতে পাই। তার সামনে নিকানো ঝাঁটানো উঠোন। উঠোনের এক পাশে বড় এক গাছের গোড়ায় ভুর করা রয়েছে, নরমুণ্ডের কঙ্কাল। আবার যেন হঠাৎ সব কিছুর মধ্যে এক নতুন জগৎ জেগে ওঠে। গোপীদাসের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘ওখানে কী আছে?’

গোপীদাস ওপারের দিকে চেয়ে বলে, ‘উটি অঘোরী বাবার থান। মস্ত বড় তান্ত্রিক সাধু ছিলেন। উনি আর নাই, দেহ রেইখেছেন অনেককাল।’

‘কতকাল?’

‘তা বইলতে লাইরব। অ্যাই ধরণা, আমি ওঁয়ারে শেষ দেইখেছি পেরায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগে। আর দেখি নাই। সি বাবাজি, ওঁয়ারে দেইখলে বুকের মধ্যে কেমন কইরত!

‘কেন?’

‘অ্যাই দশাসই মুত্তি, তায় একেবারে দিগম্বর। চখ কী। অই বাপরে বাপ্! চখে চখ পইড়লে মনে হত, তোমার ভিতর-বার বলে কিছু নাই। আলখাল্লা আর কপ্‌নি দিয়ে নিজেকে কত ঢাইকবে, আর কী ঢাইকবে। ওঁয়ার যা দেখার তাই দেইখতেন। ভিতরের যত কালাকালি, সব ওঁয়ার নজরে পইড়ত। ফাঁকি দিবার উপায় নাই। অই জন্যেই কেউ কাছে গেলে বাঁশ লিয়ে তাড়া কইরতেন। আর মুখে বাবাজি শ-কার ব-কার লেইগেই ছিল।’

আমি অবাক হয়ে ওপারের কুটিরের দিকে চাই। শূন্য কুটির, কাউকে দেখতে পাই না। কুটিরের পিছনের বেড়ার কাছে একটা কী যেন রয়েছে। হয়তো তাঁরই স্মৃতি স্তূপ। উঠানেও কেউ নেই। পাকা ইমারতের জানালা দরজা, সবই বন্ধ। কেবল বটের গোড়ায় রাশিকৃত নরমুণ্ড কঙ্কালের চোখের অন্ধকার ছিদ্রে ছিদ্রে যেন তিনি নিষ্পলক দৃষ্টির মতোই নিরীক্ষণ করছেন।

স্নানের কথা ভুলে যাই। জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি কাছে গেছেন কখনও?’

‘যেইছি বই কী বাবাজি। উনি যে গুরুর গুরু। নামে কামে, উনিশ-বিশ তফাত। লইলে বাবাজি বাউলের সাধনার সাথে ওঁয়ার সাধনার তো তফাত কিছু না। কেউ শ্মশানে, কেউ আখড়ায়। যেথাকার যেমন আয়োজন, সেই মতো। ইখানে এইসে ওঁয়াকে দশ্শন না কইরে কি কেউ যায়!’

আমার চোখের সামনে এক বিশাল নগ্ন ক্ষ্যাপা মূর্তি ভেসে ওঠে। কিন্তু কেবল উন্মাদ ভাবতে পারি না সেই মূর্তিকে। ভাবনা চিন্তার যে লৌকিকতার মধ্যে থেকেও মন কখনও কখনও কোনও এক অলৌকিক ভাবের মধ্যে ডুবে যায় সেইরকম লাগে। সেই মূর্তির মধ্যে কী যেন এক অলৌকিকতা দেখি। হয়তো কেবল কল্পনা। কিন্তু সম্যক কোনও কিছুই জানি না। জিজ্ঞেস করি, ‘আপনাকে কী বলেছিলেন?’

গোপীদাস সব খুলে এক চিলতে কাপড় জড়িয়ে খালি গায়ে সিঁড়িতে বসে। বলে, ‘অই বাবা, আমার গুরুর সাথে পেখম সিবারে এইলেম, সিবারেতেই দেখা। আমার ক্ষ্যাপা বাবাকে একটা মন্দ কথা বলেন নাই। কুঁড়েতে যেঁইয়ে দাঁড়াতে লয়ন ক্ষ্যাপাকে বইললে, “কীরে শালো, এতদিনে সময় হল তোর?” ক্ষ্যাপা হেসে বইললেন, “তুমি যখন ডাইকলে তখনই এলাম। আগে তো ডাকো নাই, কেমন কইরে আইসব।” উ বাবা, কী বইলব বাবাজি, দেখি কিনা দুই ক্ষ্যাপা চখে চখে চেইয়ে হাসে। যেন কতকালের পিরিত। অথচ আমার ক্ষ্যাপা বইলেছিলেন, সিই জীবনে দুজনার পেখম দেখা। আমি বইসেছিলাম আমার গুরুর কাছে। তা কি বইলব বাবা, হাঁক কইরে উঠে ঘুষি পাকিয়ে তুইলে আমাকে দেখিয়ে লয়ন ক্ষ্যাপাকে বইললেন, “দে তো, উ শালোকে দু ঘা দে তো। শালোর মনে আমি পেচ্ছাব করি।’ ই কথা না বইলেই অ্যাক্কেবারে নিজের পুরুষাঙ্গখানি দেখিয়ে আবার বইললেন, “আমারটা দেখ্যা কী করবি শালো, লিজেরটাকে ঠিক করগা যা”।’

বলতে বলতে গোপীদাসের ভাবান্তর হয়। সে ওপারের কুঁড়ের দিকে যেন অবাক শোকের চোখে চেয়ে থাকে।

এসব তত্ত্ব ধর্ম আমি কিছুই জানি না। কিছুই বুঝি না। কেবল অবাক হয়ে শুনি। আর সব মিলিয়ে আমাকে যেন কোন এক রহস্যের ঘূর্ণিপাকে টেনে নিয়ে যায়। এক অবুঝ বিস্ময়ের ঘোর লেগে থাকে। একটা অলৌকিক ভাবনা আমাকে ঘিরে থাকে।

গোপীদাস সেদিকে চেয়েই মাথা নেড়ে বলে, ‘মিছা বইলতে লাইরব বাবাজি। তখন বয়স কম। অঘোরী ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাঙ দিয়ে বইসেছিলেন, আমি মনে মনে ওঁয়ার অঙ্গের কথা ভেইবেছিলাম। যাই ভাবনা অমনি হাঁক! আমার বুকে যেন বাজ পইড়ল। আমি দু’হাত দিয়ে লয়ন ক্ষ্যাপার পা জড়িয়ে উপুড় হইয়ে রইলাম। গুরু আমার গায়ে মাথায় হাত বুলাতে লাইগলেন। বইললেন, “ঠিক কইরবে গ, ঠিক কইরবে।” অঘোরী সি কথার জবাব দিলেন না। খালি বইতে লাইগলেন, “শালোর আদিখ্যেতা দেইখলে গা জ্বালা করে! শালোকে ভাল কইরে ধোয়াবি, লইলে দাগ যাবেক নাই”।’

গোপীদাসের আবার দীর্ঘশ্বাস পড়ে। শুধু উচ্চারণ করে, ‘লইলে দাগ যাবেক নাই।’…

মনে হয় স্বপ্নের মতো, বিস্ময়কর, বিচিত্র, অথচ অস্পষ্ট ঝাপসা। কিন্তু বক্রেশ্বর মহাশ্মশানের কোনও এক দুর্নিরীক্ষ্য সংসারের আলো অন্ধকারে আমি যেন বসে আছি। যা শুনি তার গুণ ব্যাখ্যা করতে পারি না, মর্মে যেতে পারি না। ভাষা যেন দুর্বোধ্য। যা দেখি তা অচেনা।

আমিও ওপারের দিকে চেয়ে থাকি। আবার একবার এই দেশের কথা নতুন করে মনে হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *