৬০. সবুরে চলো মন

৬০.

সবুরে চলো মন। সবুরে ধন মিলবে।

নিজেকে বলি। নিজেকে বুঝসুঝ করাই। কিন্তু কী বা আমার ধনের প্রত্যাশা! আমার বুকে বাজে, আমি সেই মামুদ গাজি না। আমি গোপীদাস সুজন গোকুল বাউল না। আমার ঝোলা ধুলার না। পরম পাওয়ার রতন নেই আমার ঝুলিতে।

তবু আমার পথ চলার যে ধন, সে সোনাদানা না। মনের ঝোলা ফাঁক করে রেখেছি। বড় গহিন, আঁধারের আঁকাবাঁকা ঝুলি। যদি সেথায় মন মোহরে ভরতি হয়ে, টুকুস জেল্লা লাগে, সেই এক প্রত্যাশা।

কিন্তু ভরে কই? ভরি ভরি করে, মন দোল দুলিয়ে ওঠে। তারপরেই দেখ, নানা ব্যাজ। ভারী ঠেক। কাউকে কিছু বোঝানো গেল না। দশই পৌষের এই সকালে চলেছি নানুরের পথে। চণ্ডীদাস নানুরে। এক কথাতে বলি, মন চলো যাই চণ্ডীদাসে। চলো যাই রজকিনির পাটে। সেই রামা, নাম যার রামী, তার প্রেম-শ্রীপাটে। যেথায় বাশুলি দেবীর থানে বসে, কবি রচে রাধাকৃষ্ণ প্ৰেমবিরহ গান। তত্ত্ব যার রসের প্লাবনে ভাসে, মোহ রস বোঝে সেই রসিকা রজকিনি।

কী রহস্য দেখ, পরমা শক্তি দেবী বাগুলি ভজে দ্বিজ। অথচ শিল্পীরূপে গাহে গান, হাসে কাঁদে মরমিয়া ধ্যানে, রাই কালা নামে। তাই শুনে, অবশ বিবশ হৈয়া থাকে রজকিনি। কী রহস্য, কী রহস্য! রসের রসিক না হলে পরে, অরসিকের ধন্দ সার। আমি সেই অরসিক। আমার ভারী ধন্দ। তাই চলি চণ্ডীদাসে। ছুটি রজকিনি পাটে।

কিন্তু সেই যাওয়ার পথে মনে বড় ঠেক। আর এক ধন্দ। ভেবেছিলাম একলা ছেড়ে সঙ্গী ধরব। গোকুল বিন্দুদের সঙ্গে যাব। তবে কিনা, তুমি করো থিতু। আলামাটি চাল করে আর একজনে। তাঁর নাম অচিনদা। এ বড় ভারী মোগল। সঙ্গে খানা না খাইয়ে ছাড়বেন না। নানুরের যাত্রায়, আমাকেই তিনি সঙ্গী করেছেন। নিজের গাড়ি, নিজেই চালিয়ে নিয়ে চলেন। বেতনভোগী চালক পড়ে থাকে ছাতিমতলায়। উনি যন্ত্রের লাগাম ধরে বলেন, ‘আরে দূর, অমন পনেরো-বিশ মাইল নিজেই চালিয়ে যাব।’

তা যাবেন, কিন্তু ঝিনি রাধা লিলিকেও সঙ্গে না নিয়ে যান কেমন করে। তার ওপরে ইনি আবার অচিনবাবু তো! গোপীদাসেরাই বা কেন মোটর- বাসে যাবে? ওরা মোটে তো পাঁচজন। যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় ন’জন। একেবারে অব্যর্থ কথা। গাড়িতে একেবারে ঠাসাঠাসি ন’জন। এমন কিছু একেবারে ঘাড়ে মাথায় গোঁজাখুঁজি না। এ বিলাতি গাড়ির খোল ফাঁদ, সবই বেশ বড়। জায়গার অকুলান হয়নি।

অচিনদা চেয়েছিলেন, সামনের আসনে গোপীদাসদের নিয়ে বসবেন। সেটা হাতজোড় করে, নিরস্ত করা গিয়েছে। তাঁর সঙ্গে বসেছে, ঝিনি রাধা লিলি। পিছনে বাউলকুলের সঙ্গে আমি। সুজনের কোল চেপে গোপীদাস। রাধার কোলে বিন্দু। গোকুল আমার পাশে, বড় আড়ষ্ট। ওরা আমার আরাম দেখতে গিয়ে নিজেরা নিজেদের কোলে চেপেছে। তার দরকার ছিল না। গাড়ি বেশ বড়। তবুও। বললে বলে, ‘আমাদের এরকম অভ্যাস আছে বাবাজি, কিছু ভাববেন না।’

ওদিকে দেখ, একখানি প্রকাণ্ড চুরুট মুখে দিয়ে শিঙে বাজিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলেন অচিনদা। শহর পেরিয়ে কখন গ্রামের পথে এসে পড়ি। যাত্রা পুবে, একটু উত্তরে পাক দিয়ে। গাড়ির সামনে, চারজনের গায়ে মোহর-রং রোদ। রোদের জেল্লা, ধানকাটা মাঠে, তাল শালের পাতায়। মাঝে মাঝে গ্রাম আসে। কখনও যাই গ্রামের ওপর দিয়ে। কখনও গ্রাম পড়ে থাকে দূরে, মাঠের ওপারে। ত্বরায় যাই চণ্ডীদাসে।

কিন্তু যেমন করে যেতে মন চেয়েছিল, তেমন যাওয়া হয় না। পাখা ঝাড়া দিয়ে, উড়ে যাব সেই ছিল সাধ। এখন দেখ ডানায় যেন কীসের এক টান লাগে। মনের ডানা তার নাম। টানের ফেরে, ফিরে ফিরে দেখি, কেবল ঝিনি। ওকে দুষি না। আপন করম দোষ। ঝিনি যায় আপন ভাগ্যে। আমার যদি ডানায় টান লাগে, সে আমার ভাগ্য। অচিনদা সুদ্ধ নেচে উঠলেন। আর, বোঝাব কাকে! অতএব, তা-ই চলো।

আমার তো যাত্রা! আমার ফেরা নেই। অচিনদাদের যাত্রা, ফেরার কথা জেনে মেনে। নিজেকে তাই বুঝ-সুঝ করাই, মন ব্যাজারে লাভ নেই। সবুরে ধন মিলবে। না জানি, কীসের সন্ধানে ফিরি। না জানা যে ধনের আশায় পথ চলা, তা মেলে না সবুর বিহনে। এখন তো ভাবি, এ যাত্রাই বা মন্দ কী। এখন তো যেন, এই চলাতেই কী এক সুর বেজে যায়, তাল লেগে যায়। মন ওঠে দোল দুলিয়ে। এমনি করে, সবাই মিলে যাওয়াও এক ভাগ্য। এখন দেখি, পথ চলাতে এটুকুই আনন্দ।

অচিনদার সামনে, গতকাল মুখের কথা খসাতে পারিনি। বলবার আগেই তাঁর ধরতাই, ‘শুনেছি, শুনেছি, তুমি নানুর যাচ্ছ কাল। তবে তুমি একলা যাচ্ছ না, আমরাও যাচ্ছি।’

‘আমরা’ শুনেই হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। প্রশ্নের আগেই, অচিনদা বলেছিলেন, ‘আমি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে ঝিনি রাধা লিলি। তুমিও আমাদের সঙ্গে।’

আর কিছু কি শুনতে চাও? যাও, ফতোয়া পেয়ে গেছ, এবার গিয়ে তলপি-তলপা বাঁধো। তা না হয় হল। কিন্তু মতলবটি তৈরি হল কখন?

বুঝে নাও মনে মনে। এক সময়ে নিশ্চয় তৈরি হয়েছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, দলের বাকিরা বাদ থাকছেন কেন? ওঁর জবাবও পরিষ্কার। শুভেন্দুর তো এমনিতেই বক্ৰগতি! দল বেঁধে ঘোরাঘুরিতে তার অরুচি। নীরেনদা আর সুপর্ণাদি, এ যাত্রায় নিজেরাই নিজেদের বাতিল করেছেন।

কিন্তু আমার মনে ঠেক ঠেকা। ইতিমধ্যে আমার মতলব যে তৈরি হয়ে গিয়েছিল গোপীদাসের সঙ্গে! রাত পোহালে বোলপুর থেকে প্রথম মোটর-বাস ধরে তাদের সঙ্গী হব। সে কথা বলতেই, অচিনদার প্রস্তাব, তাদেরও সঙ্গে নেওয়া হবে।

অগত্যা উপায় কী? সেই কথাই শিরোধার্য, রাত্রে একবার যাত্রার আসরে ঝিনি বলেছিল, ‘নানুর যাচ্ছি বলে আপত্তি আছে?’

অবাক হয়ে বলেছিলাম, ‘আপত্তি থাকবে কেন?’

‘একসঙ্গে যাওয়া তো, তা-ই।’

‘তাতে কী হয়েছে?’

ঝিনি জবাব না দিয়ে চোখের দিকে তাকিয়েছিল। আমি হেসে চোখ ফেরাবার আগেই, বলে উঠেছিল, ‘কিছু না, না?’

সে কথা আর নতুন করে ঝিনিকে কী বোঝাব! যে যার আপন ফেরায় ফেরে। কোনও জবাব দিতে পারিনি। ঝিনি আবার বলেছিল, ‘নানুর পর্যন্ত তো? আর তো নয়। সেখান থেকে আমরা ফিরে আসব, আর আপনি—।’

ও কথা শেষ করেনি। চেয়ে দেখেছিলাম ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আসরে তখন লুৎফা বেগমের বিলাপ চলেছে।

এই সেই যাত্রা। এখন আর সে ভাবনা মনে আসে না। এখন, নিখিলের এ আনন্দধারায় ধুইয়ে দাও, মনের কোণের মলিনতা সব দীনতা ধুইয়ে দাও। মন চলো যাই চণ্ডীদাসে। এক কবির ঠাঁই ছেড়ে, আর এক কবির থানে।

ছাতিমতলার গতকালের অনুষ্ঠানে, তার আর এক পরিচয়। গতকাল ছিল, হবিষ্যান্ন গ্রহণের দিন। শান্তিনিকেতনের জ্ঞানী গুণী সংগঠক কর্মচারী, সকল মৃতদের স্মরণে, হবিষ্যান্ন। এমন আর কোথাও দেখিনি। কেবল মনে হয়েছিল, এই তো ভারত, এই তো ভারতরীতি। আত্মীয়-আত্মজনে ছেড়ে যায়, তার স্মরণে হবিষ্যান্ন। পৃথিবীর এক দেশেতেই এই রীতি। এই রীতিতে তার আত্মপরিচয়।

ব্যক্তির মৃত্যুর বিশেষ দিনের, দিনক্ষণ নেই। নয়ই পৌষ, সবাইকে স্মরণ। ঘরে ঘরে যদি হবিষ্যান্ন না হয়, চলে এসো শান্তিনিকেতনের পাকশালায়। এ অনুষ্ঠান বহিরাগতদের জন্য না। শান্তিনিকেতনের নিজের সীমায় বাঁধা। আমার আশ্রয়দাতা বন্ধু, সঙ্গী করে নিয়ে গিয়েছিলেন।

হবিষ্যান্নের আসরে গিয়ে প্রথম মনে পড়েছিল তাঁকে, যার দীক্ষাদিনের স্মৃতি সাতুই পৌষ। দেখ, কঠিন সংসারের এই বাস্তবে বাস করি। তথাপি চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল, এক ধ্যানী প্রসন্ন মুখ। যেন নিবিড় স্নিগ্ধ দুই চোখ মেলে, জীবিতদের দেখেন। যেন আম ছাতিমের পাতায় পাতায়, অজস্র সেই চক্ষু। আমলকীর রোদ লাগা ঝিলিকে যেন নেই চোখের হাসি৷ ঝিরিঝিরি পাতার বাতাসে, ঋষির নিশ্বাস। সকল প্রাচীন প্রবীণ মহীরুহে, তাঁরই দেহের আকার।

এই স্মরণ-ভোজনে, বুক দুলিয়ে, চোখে জল আসেনি। মনে পড়েছিল, আত্মানুসন্ধানের কথা। এক যাত্রীকে দেখতে পেয়েছিলাম, ভারতের প্রান্তে প্রান্তে যিনি ফেরেন, বলেন, ‘আমার আঁধার হৃদয় আলো করো।’ যিনি ভাষান্তরে ডাক দিয়ে ওঠেন, ‘অ যাঁ ন শুদ, কে চেরা আমদম, কুজা বূদম; দর্দ ও দরেল্‌, কে গা ফিল্‌ জে কারে খে শতনম।… প্রকাশ হল না যে, কোথায় ছিলেম, এখানে কেন এলেম; দুঃখ ও পরিতাপ যে, আপনার কাজ আপনিই ভুলে রয়েছি।’ যাঁর চোখে ধারা বিগলিত, বুকের মধ্যে আতুর ধ্বনি, ‘কতদিন, আর কতদিন, আমি সেই দিনের নিমিত্ত অপেক্ষা করিব, যে দিন তোমার সম্মুখে আমি পরিপূর্ণ আনন্দময় হইব…।’

ভারতের পথে পথে, পাহাড়ে কন্দরে নদীতে, লোকালয়ে মন্দিরে মন্দিরে, যিনি পরিপূর্ণ আনন্দময় হয়ে এসে বসেছিলেন এই রাঢ়ের ছাতিমতলায়। তখন আপন মন্দিরে ভরা। জ্ঞান বুদ্ধি যুক্তির কাটাকাটিতে কেবল রক্তই ঝরেছে। তারপর সেই রক্তে ফুটেছিল এক ফুল, নাম তার প্রেম। ‘জিন প্রেম রস চাখা নঁহী, অমৃতরস পিয়া তো ক্যা হুয়া?’… আর সেই জন্যেই ‘মতলুব হাসিল ন হুয়া, রো রো মুয়া তো ক্যা হুয়া?’ ছাতিমতলায় এসে, সেই ডাক শেষ হয়েছিল,

য়া রব, আঁ শমে শব-অফরোজ

জে কাশানা-এ-কীস্ত?

জানে-মা সোখৎ, বে-পূর্সীদ্‌

কে জানানা-এ-কীস্ত?

‘যে দীপ রাত্রিকে দিন করে, সে দীপ কার ঘরে? আমার তো প্রাণ দগ্ধ হল, জিজ্ঞেস করি, তা প্রিয় হল কার?’ তারপরে। রাঢ়ের এই লাল মৃত্তিকার নিবিড় সবুজের ছায়ায়, পাখি ডাকার সুরে উচ্চারিত হয়েছিল,

বেদাহমেতং পুরুষং মহান্ত

আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।

গতকাল হবিষ্যান্নে বসে সেই সন্ধানীর কথা মনে পড়েছিল। মহর্ষিকে যেন কী এক অলক্ষ্যের লক্ষ্যে, স্পর্শহীনের স্পর্শে, অনুভব করেছিলাম।

জীবন মন কী বিচিত্র দেখ। মহর্ষির সঙ্গে তাঁর পুত্রের স্মৃতি না কেবল, আপন মৃত আত্মজনদের কথাও মনে পড়েছিল। যেন, মৃত আপন জন্মদাতার উপস্থিতি আমার হবিষ্যান্নকে এক অমৃতের স্বাদ দিয়েছিল।

তখন মনে হয়েছিল, স্থানের সীমায় না হে, অসীম বিশ্বের সকল মৃত আত্মার স্মরণে্‌ এই হবিষ্যান্ন গ্রহণ করি। মহামানবের সাগরতীরে বসে এই আর এক ভারতপ্রাণ প্রকাশ।

গতকালের শেষ অনুষ্ঠান ছিল আমার, বাংলার মসনদ যাত্রা। ছাতিমতলার পথে আমার সহযাত্রী লোকো শেডের ‘কিলিনার’ অতুলের গুণ রসের আস্বাদন।

সন্ধ্যাবেলা, বাউল আসর থেকে বিদায় নেবার কালে জিজ্ঞাসা শুধু একজনের চোখেই ছিল। ঝিনি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘রাত্রে কী করবেন?’

যাত্রার কথাটা বলতে চাইনি। হাসি ঠাট্টার ভয় ছিল। তারপরে অচিনদার সামনে সাহসও ঠিক পাচ্ছিলাম না। হয়তো এক কথাতেই নাকচ করে দেবেন। আইন-কানুনের নিষেধ না। ইচ্ছা করলে অচিনদাকেও তুমি নাকচ করতে পারো। কিন্তু অচিনদা প্রেমে বাজেন। জেনেশুনে তাঁকে নাকচ করি, মন তেমন শুকনো খাতে বহে না। তাই বলেছিলাম, ‘কাল সকালেই বেরতে হবে কিনা। তাই ভাবছি আর বেরবো না।’

অচিনদা হুমকে উঠেছিলেন, ‘কাল সকালে কোথায়?’

কথাটা যে জেনেশুনেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, পরের কথাতেই তা বোঝা গিয়েছিল। তখনই তাঁর আপন মতলব ঘোষণা করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গের পরেও কথা শেষ হয়নি। বলেছিলেন, ‘কাল সকালে বেরোতে হবে বলে এই সন্ধেবেলাতেই ঘরে গিয়ে ঢুকতে হবে কেন। চলো, এখন সবাই মিলে দক্ষিণপল্লিতে যাই।’

বলে লোমশ ভুরুর তলায় একবার ঝটিতি দৃষ্টিপাত করেছিলেন ঝিনির দিকে। রাধা আওয়াজ দিয়ে উঠেছিল, ‘সেই ভাল।’

কিন্তু আমার ভাল না। আমার ভাবনা, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে যাত্রার আসরের সামনে গিয়ে বসতে হবে। বলেছিলাম, ‘না, মানে আসলে—।’

অচিনদার সেই এক ধমক, ‘অনেক আসল-নকল তো চেনালে। একবার ঝেড়ে কাশো দেখি। এই রাত করে কোপাই-খোপাইয়ের ধারে যাবে নাকি?’

স্তকর দেবার আগে অবাক হয়ে দেখেছিলাম, ঝিনির চোখে যেন আলোর ঝিলিক খেলে যায়। চকিত উত্তেজনা আর কৌতূহলে মুখের রং বদলে গিয়েছিল। কোপাইয়ের ধারে যাবার কথা শুনে ওর মন নেচে উঠেছিল।

আমিই ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠেছিলাম, ‘না, না, সেখানে যাব না।’

‘তবে কোথায়?’

দারোগার জেরা চোরকে। অতএব স্বীকারোক্তি, ‘আজ একটু যাত্রা দেখব ভাবছিলাম।’

লিলি একেবারে ছোট মেয়ের মতো হাততালি দিয়ে উঠেছিল, ‘ইস, কী মজা। আমরাও যাব।’ রাধারও তা-ই। ঝিনির চোখ একবার অবাকে ঝলকেছিল। তারপরে ওর চোখেও নতুন কৌতুহল আর উত্তেজনার রং লেগেছিল।

অচিনদা হতাশায় মাথা নেড়েছিলেন। আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা একেবারেই বাউন্ডুলে। শান্তিনিকেতনে এসেও যাত্রা দেখতে চায়। তাও যদি কোনও ভাল দলের যাত্রা হত।’

বলেছিলাম, ‘না, সেজন্যে নয়, একটা—।’

অচিমদা বলে উঠেছিলেন, ‘নতুনত্বের স্বাদ, কেমন? যার অর্থ সেখান থেকে যতটুকু রস পাওয়া যায়, সবটুকু একেবারে শুষে নিয়ে যাবে।’

ঝিনি চোখের কোণে চেয়েছিল। ঠোঁটের কোণে হাসি টিপে রেখেছিল।

অচিনদা আবার বলেছিলেন, ‘তবে, এ যাত্রা কি ভাল লাগবে? শুনেছি, বোলপুরেরই কারা নাকি করবে।’

আমি বলেছিলাম, ‘সেজন্যও নয়। আজকের পালায় যে সিরাজ সাজবে, তাকে কথা দিয়েছি কিনা।’

অচিনদা যেন একেবারে বাকরহিত হয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় অবাক রাগে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপরে তিন সখীর দিকে ফিরে বলেছিলেন, ‘শুনেছ? উনি সিরাজকে কথা দিয়ে বসে আছেন। কে সিরাজ, কোথায় আলাপ হল এর মধ্যেই, আমরা তার কিছুই জানিনে। উনি দিব্যি সব ঠিক করে রেখেছেন।’

ওরা তিন সখীতে হেসে উঠেছিল। ওরকম করে বললে, কিছু বলা যায় না। অচিনদা আমার দিকে ফিরে আবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি কি মন্ত্র জানো?’

বলেছিলাম, ‘না, আসবার সময় ট্রেনে আলাপ হয়েছিল। যে সিরাজ করবে, সে অন্ডালে চাকরি করে। একসঙ্গেই এসেছি, তাইতেই জানাশোনা।’

অচিনদা আবার ওদের দিকে ফিরে বলেছিলেন, ‘বোঝো এবার।’

ঝিনি ঝটিতি একবার আমার দিকে চেয়ে অচিনদাকে বলেছিল, ‘যাত্রার ব্যাপারটা কিন্তু আমাদের কাছে চেপে যাওয়া হয়েছিল।’

অচিনদা তৎক্ষণাৎ বেজে উঠেছিলেন, ‘চাপবেই তো ভাই। মজা যা লোটবার তা উনি একলাই লুটবেন। আমরা কে?’

বলেছিলাম, ‘তার জন্যে নয়। আপনাদের ভাল লাগবে কিনা, জানি না তো, তাই।’

রাধা বলে উঠেছিল, ‘না হয় মশাই, একবার বলেই দেখতেন। চেপে যাচ্ছিলেন কেন?’

বটেই তো। মনে মনে বলেছিলাম, ‘ঘাট হয়েছে।’

অচিনদা বলেছিলেন, ‘সিরাজদৌল্লার নেমন্তন্ন যখন, তখন তো যেতেই হবে। আমরা সবাই ওর পিছু পিছু গিয়ে বসব। এবার তাহলে সবাই তৈরি হয়ে আসা যাক।’

যাত্রার আসর নিয়ে মনের মধ্যে চিরদিনের এক সংশয় ভয়। দেখেছিলাম এ বয়সেও সেটা যায়নি। ভয় ছিল, ঠিক জায়গায় গিয়ে বসতে পারব তো? তাই কোনওরকমে খাওয়া সেরে অনেক আগেই চলে গিয়েছিলাম। বাউল আসরের অদূরেই যাত্রার আসর বসেছিল। কিন্তু গিয়েই চমকে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখেছিলাম, আমার রেলগাড়ির সহযাত্রী অতুলদাস, বাংলার মসনদের সিরাজ, স্বয়ং আসরে শতরঞ্জি পাতছে। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন।

দেখেই মনে হয়েছিল, ঝাঁকড়াচুলো অত বড় মাথাটা বোধ হয় ক্ষারে কাচা হয়েছে। চুলের ভারেই মুখখানি শীর্ণ। চোখের কোল বসা। পরনে একটা লুঙ্গি, গায়ে একটা ময়লা সুতির চাদর। একটু পরেই যে লোক কিনা বাংলার মসনদে নবাব হয়ে বসবে।

মনে মনে হাসতে গিয়েও ঠেক খেয়েছিলাম। শিল্পীকে এ দু’দিন অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে নিশ্চয়। তারপরে ঘরেতে দানাপানির কি হাল, কে জানে। চেহারাকে দোষ দিতে পারিনি। অতুলদাস শিল্পীকে দেখে কেমন একটা মন-টাটানো মুগ্ধ বোধে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম।

ইতিমধ্যেই ভিড় জমতে শুরু করেছিল। সেই আসরে চোখে পড়ার মতো দেখেছিলাম স্থানীয় বাসিন্দাদের, নরনারীর আগমন। গিন্নির কোলে কাঁখে ছেলে, তবু যম ঘোমটা সরে না। কর্তা বিড়ি কামড়ে ধরে আগেই এক হাতের হ্যারিকেনটি নিবিয়ে দিয়েছিল। আর এক হাতের চটের থলিটা কোথায় পেতে বসা যায়, নজরে সেই ঘোঁতঘোঁতের লক্ষণ। সকলের জন্য তো আর শতরঞ্জির আসন না। পালার আসরের জন্য আর বাদকদের জন্য শতরঞ্জি। বাদবাকি সব বসে যাও ভায়া দাওয়া জুড়ে।

তার মধ্যেই চোখ পড়েছিল রঙিন সুতোয় ফুলতোলা সুতোর চাদর জড়ানো একটি রোগা রোগা বউ, এক পাশে দাঁড়িয়ে। তার কোলে এক শিশু। আর এক শিশু তার কোমর জড়িয়ে ধরে পা দাপাচ্ছে। চিৎকার করে ডাক দিচ্ছে, ‘অই বাবা, বাবা গ!’

বাবা যে কে, তা বুঝতে পারিনি। কেউ জবাব দিচ্ছিল না। তারপরে একবার স্বয়ং সিরাজ হুমকে উঠেছিল, ‘দুত্তোরি তোর বাপের নিকুচি করেছে। বইলছি যে, দাঁড়া, সব পাতা-টাতা হক, তা পরে বইসবি। তা লয়, খালি বাবা বাবা!’

বটে, স্বয়ং সিরাজেরই ছেলে! অই হে, উনি কি তবে সিরাজপত্নী নাকি? দেখেছিলাম, বউটি তখন ছেলের হাত ধরে চোখ পাকিয়েছিল। রোগা-রোগা মুখখানি, তাতে একটু হিমানী পাউডারের স্পষ্ট ছোপ। কপালে সিঁদুর, ঠোঁটে পানের দাগ। সধবার যেমন বেশবাস হয়। সেই তো কথা, তোমরা সবাই শিল্পীকে দেখবে। ঘরের মানুষ দেখবে না? তোমরা তো নগদ হাততালি বা দুয়ো দিয়ে যাবে। তারপরেও কোন এক নির্জনে নিশীথে ঘরের কোণে বসে এক দম্পতি কথা বলবে। পুরনো দিনের কথা। তখনও এই রাত্রের স্মৃতি হয়তো কথা হয়ে বাজবে, ‘অই গ, তোমার মনে আছে, সেই একবার মেলাতে সিরাজ সেইজ্জেছিলাম!’

.

৬১.

‘এই যে বড়দা।’

মোটা কিন্তু মিহি ভরাট গলা বেজে উঠেছিল একেবারে কানের কাছে। এক মুহূর্তের আন্ চিন্তায় লক্ষ করিনি, অতুলদাস কখন আমাকে দেখতে পেয়েছে। চিনতে পেরেছে। তবে নতুন সম্বোধন কি না। তা-ই চমক। আজ পর্যন্ত কারুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হবার সৌভাগ্য হয়নি। অতুলদাসও এর আগে বড়দা বলে ডেকেছিল কি না, মনে করতে পারিনি।

কথা বলতে এক পলকের দেরি। তার মধ্যেই আবার বেজে উঠেছিল, ‘সেই গাড়ির দাদা তো?’

মোট কথা, যে কোনও একটা দাদা হতেই হবে। বলেছিলাম, ‘এই যে।’

তৎক্ষণাৎ হাত ধরে বলেছিল, ‘মনে আছে তবে? আসেন আসেন, বসেন। দ্যাখেন না, কারুর পাত্তা নাই। ইদিকে সময় হয়ে এল।’

বলে হাত ধরে টেনেই নিয়ে গিয়েছিল। আসরের সীমা বরাবর, শতরঞ্জি দেখিয়ে বলেছিল, ‘এখানে বসেন।’

বলেই সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে এক ধমক, ‘অ্যাই দ্যাখ, কোথায় বইসতে আইসল। আয়, এই এখানে বস। এইস, তুমিও এইস, বস।’

আমার থেকে হাত দুয়েক পিছনে শতরঞ্জির ওপরেই স্ত্রী-পুত্রকে জায়গা নির্দেশ করেছিল। নির্দেশ মাত্র স্ত্রী সেখানে গিয়ে বসেছিল। কোলেরটিকে বাগিয়ে ধরেছিল। বড়টির বোধ হয় মনঃপূত হয়নি। মায়ের কাছ ঘেঁষে দাড়িয়েছিল গোমরা মুখে। কিন্তু সেদিকে তখন অতুলদাসের নজর দিতে গেলে চলছিল না। আমার সামনে এসে ঠোঁট টিপে একটু হেসেছিল। তার মধ্যে লজ্জা গাম্ভীর্য, সবই ছিল। জানিয়ে দিয়েছিল, ‘মানে পরিবার।’

তা বুঝেছিলাম, পরিবার মানে গিন্নি। আর একবার তাকিয়ে দেখেছিলাম সিরাজপত্নীকে। বেচারি আন্ পুরুষের চোখ পড়তে লজ্জায় পড়ে, একটু ঘোমটা টেনেছিল। আমি আমতা আমতা করে বলেছিলাম, ‘আমার সঙ্গে আরও দু-চার জন আছে। এখানে বসলে অসুবিধে হবে না তো।’

‘কিচ্ছু না। আমি বলছি, আপনি বসেন। যারা আসবেন, তারাও বসবেন। একটা হারমনিয়া, পাখোয়াজ, ডুগি-তবলা, ফুলুট, পাইপ বাঁশি আর ব্যায়লা, পাঁচটা লোক। খুব হয়ে যাবে, বসেন।’

সম্ভবত স্বয়ং সিরাজের খাতিরেই কেউ কেউ অধমকে তাকিয়ে দেখেছিল। আর বাদকদের পুরো হিসেবের পরে সে যখন আমাকে বসতে বলেছিল, তার ওপরে কথা থাকতে পারে না। অনেকের যে চক্ষুশূল হয়নি তা নয়। যাত্রার আসরে অমন জায়গায় বসবার সৌভাগ্য ক’জনার হয়!

কিন্তু অতুলদাসের দাঁড়াবার ফুরসত কোথা হে। এদিক থেকে কারা ডাকে। ওদিক থেকে সাজঘরের ডাক। অতএব ব্যস্ততার মধ্যেও একটি বিনীত হাসি ফুটেছিল, চোখের কোলে, গালের ভাঁজে ভাঁজে।

‘হেঁ হেঁ হেঁ, দেখেছেন তো, কোনদিকে যাই। ইদিকে সময় হয়ে এল। পালা যা হবে তা বুঝতেই পারছি, ক্ষমা ঘেন্না করে নেবেন। এখন তা হলে চলি।’

আমিই তখন বিব্রত, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি যান।’

ঠিক যেন কুর্নিশের ভঙ্গিতে একটা হাত উঠেছিল কপালে। কোমরে একটা ঢেউ। প্রায় নাটকীয় প্রস্থানের মতো দাওয়ার নীচে চলে গিয়েছিল। নীচেই এক কোণে চট ঘিরে সাজঘর। সেখানেই চটের আড়ালে অন্তর্ধান। তারপরে বাদকেরা বাদ্য নিয়ে এসে বসেছিলেন। জনসমাগম হতেও দেরি হয়নি। অচিনদা এসেছিলেন তাঁর বাহিনী নিয়ে। যে বাহিনীতে ঝিনি রাধা লিলি ছাড়াও, নীরেনদা আর সুপর্ণাদি ছিলেন। যাকে বলে, আসর জমানো লোক, অচিনদা তা-ই। তিনি এসে বসতে না বসতেই, আমার দিকে আর কেউ ফিরে চায়নি। এমনকী বাদকেরাও সমীহ করে তাকিয়েছিল। সরে বসে জায়গা দিতে গিয়ে দেখেছিলাম, ঝিনি পাশে এসে বসেছিল। পরপর তিন সখী।

প্রথম বাজনা বেজে উঠতেই, সেই ছেলেবেলার ধকধকে উত্তেজনায় থরথরিয়ে উঠেছিলাম। সে বাজনা কেবল শ্রবণে মনে বাজেনি। রক্তে বেজেছিল। তিন ঘণ্টির পর, প্রথম আবির্ভাবেই নর্তকী। ধিন ধিন করে, কোমর বাঁকিয়ে নেচে নেচে গান করেছিল। গানটা যেন শোনা শোনা। মনে হয়েছিল, শহরের পাড়ায় পাড়ায়, কলের গানে শুনেছি। তারপরেই সিরাজদৌল্লার আবির্ভাব। আমার চেনা মানুষ, অতুলদাস। তবে ওসব চেনাশোনা ছাড়ো। সামনে তখন নবাব সিরাজদৌল্লা। টকটকে রং করা মুখ, লাল গাল, লাল ঠোঁট, কাজল টানা চোখ। বাঁকা সিঁথির ঝাঁকড়া চুল তখন আর ক্ষারে কাচা কাকের বাসা না। রীতিমতো পাট করা। গোঁফের ঠাট দেখে মনে হয়েছিল, তার চেয়ে নবাবি কিছু হয় না। সেই সঙ্গে ন্যাপথলিনের গন্ধে আসর ভরে গিয়েছিল। নিশ্চয়ই পোশাক থেকে আসছিল। যাকে বলে, খাঁটি নবাবি পোশাক। কী তার জেল্লা ঝলক!

আসরে প্রবেশ মাত্রই সে আমার দিকে তাকিয়েছিল। ভেবেছিলাম, তখুনি চোখ ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু তা-ই যদি বুঝে থাকো, তা হলে ভুল। সে আমার দিকে ঠায় তাকিয়ে বলে যাচ্ছিল, ‘মাতামহ আমাকে এত্তেলা দিয়েছেন। জানি না, নবাব আলিবর্দী এখনও হয়তো ভাবছেন, আমাকে মসনদে বসালে আমি তা রক্ষা করতে পারব কী না। কিংবা আরও কোনও গূঢ় চক্রান্ত এর মধ্যে থাকতে পারে। এই প্রাসাদের প্রতি কক্ষে কক্ষে এখন ষড়যন্ত্র চলেছে, লক্ষ্য সেই মসনদ, বাংলা বিহার ওড়িশ্যার মসনদ…।’

কিন্তু কী বিপদ, আমি অস্বস্তিতে মরছিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে কেন। যতবারই চোখ ফিরিয়ে চোখ তুলতে যাচ্ছিলাম, ততবারই সেই চোখাচোখি। নবাবের স্বগতোক্তি করার লক্ষ্য কি আর কেউ হতে পারত না। তখন আমার আরও লজ্জা, নবাবের ঠায় তাকানো দেখে, ঝিনি লিলিরাও আমার দিকে তাকাচ্ছিল৷ এমনকী, অন্য দর্শকেরাও। অন্যদিকে চোখ ফিরিয়েও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। উঠে যাব কি না ভাবতে ভাবতেই আলিবর্দীর আবির্ভাব হয়েছিল। তবে রেহাই। তার আগেই অচিনদার নিচু স্বরের মন্তব্য, ‘লেখকের দিকে চেয়ে সিরাজ বোধ হয় প্রেরণা সংগ্রহ করছে।’

ফলে রাধা বেজে উঠেছিল খিলখিল করে। ওরকম একটা গম্ভীর পরিবেশ প্রায় মাটি হবার জোগাড় হয়েছিল। আর লজ্জা অস্বস্তিতে মরেছিলাম আমি। তবে পালা জমাতে দেরি হয়নি। আর কসম খেয়ে যদি বলো, তা হলে বলতে হবে, অতুলদাস একাই একশো। তার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারেনি। হাততালি যত সব তার কপালেই। হোঁতকা মোটা মীরজাফর কিংবা ক্লাইভ সাহেব বা গজচোখো লুৎফা, কেউ সিরাজের মতো না। তবে যদি কথাবাত্তার একটু-আধটু ভুল ভেরান্তি পেয়ে থাকে, সেটা নিজ গুণে ক্ষমা করে নিয়ো। কিন্তু লোকো শেডের কিলিনারকে সে একবারও মনে করতে দেয়নি। অচিনদার মতো লোকও মাঝে মাঝে বাহবা দিয়ে উঠছিলেন। আর সিরাজের পরাজয়ের পরে লুৎফাকে নিয়ে চলে যাবার সময়ে পিছন ফিরে দেখেছিলাম অতুলগিন্নিকে। দেখেছিলাম, ঘোমটা টেনে দেবার কথা তার মনে নেই। গায়ের চাদর খুলে গিয়ে রোগা শরীরটি দেখা যাচ্ছিল। দুই ছেলেই কোলের কাছে ঘুমে অচেতন। তাদের দু’জনের গায়ে মায়ের দু’হাত। চোখের ধারার জল গলছিল গাল বেয়ে। নবাবের দুঃখে না স্বামীর কষ্টে, কে জানে। সে যেন আর এক লুৎফা। তারপরে সিরাজের হত্যার দৃশ্যের তো কথাই নেই। অতুল-গিন্নি তখন আঁচলে মুখ ঢেকে বসেছিল। এত বড় অকল্যাণ সে চেয়ে দেখবে কেমন করে।

ভারী একটা খুশির মধ্যেও মন টাটিয়ে উঠেছিল। কেন কে জানে। সিরাজের মরণে কি অতুল কিলিনারের আর্তনাদ শোনা গিয়েছিল, ‘আর না, আর মেরো না, খোদার দোহাই, মহম্মদী বেগ, আমাকে আর আঘাত করো না…!’ তখন মনে হয়েছিল, সত্যি সিরাজের মৃত্যু দেখছি। অতুলদাস খাঁটি শিল্পী।

পালার শেষে তার সঙ্গে একবার দেখা না করে ফিরতে পারিনি। যদি মেডেল দিতে পারতাম, ভাল হত। উপায় ছিল না। আড়ালে ডেকে, সংকোচে লজ্জায় একটা দশ টাকার নোট দিয়েছিলাম হাতে। সে কি হাত টানাটানি। ভাল লেগেছে, সেই যথেষ্ট। তবে একটা মেডেল পেলে, ঘরে রেখে দিতে পারত। চোখে পড়লে, দাদার কথা মনে পড়ে যেত। বলেছিলাম, ‘তার যখন উপায় নেই, আপনি একটু মিষ্টি কিনে খেলে খুশি হব।’

তখন দশ টাকার নোটটা ভাঁজে ভাঁজে একটুখানি করে পকেটে রেখেছিল। বলেছিল, ‘ভাগ্যে এই লোকের দেখা পেয়েছিলাম। তবে কেবল মিষ্টি খাব না, ভাত তরকারি সব খাব।’

বলে, মুখের অজস্র ভাঁজে হেসেছিল।

পথ চলি, খুঁজে ফেরার তত্ত্ব নাম কিছুই জানি না। কিছু পাই, যে-পাওয়ানা কখনও খুশিতে ভরা। কখনও অবাকে ঝলকানো। কখনও চোখের জলে ভেজানো। কখনও কষ্টে টনটনানো। কখনও বিষাদের নিশ্বাসে ভরা। কখনও বা এইসব দিয়ে মাখামাখি। তারই এক পাওয়ানা অতুলদাস। ঝোলায় ভরে এই পাওয়া নিয়ে যাই। এখন তার শেষ কথা কয়টি কেবল মনে পড়ে, ‘আর কি কখনও এই মানুষের দেখা পাব।’

আমারও তো সেই কথা। আর কি কখনও এই মানুষের দেখা পাব। আমার যে সেই গানের মতন লাগে, ‘এই মানুষে, সেই মানুষ আছে, যেথায় গোঁসাই বিরাজে।’…

হাসিতে চমক লাগে। সবাই প্রায় একসঙ্গেই হাসে। তার মধ্যে গোপীদাস বেশি বাজে। ফিরে তাকাতে বলে, ‘সত্যি নাকি চিতেবাবাজি, ধ্যানেতে আছেন?’

সামনের আসন থেকে ওরা তিন সখীতে ফিরে ফিরে চায়। আমি অবাক হয়ে বলি, ‘কীসের ধ্যান?’

গোপীদাস বলে, ‘তা যদি বুইঝতে পারব, তবে আর ভাবনা কী ছিল। দেখছি কি না, চিতেবাবাজির কথাবাত্তা নাই। এক মনে চুপচাপ।’

বলি, ‘ভাবছিলাম।’

অচিনদা গাড়ি চালাতে চালাতে বলেন, ‘কী ভাবছিল সে কথা আর জিজ্ঞেস করো না।’

এ কথা শুনেও সবার হাসি। গোকুলদাস তার ডুপ্‌কির বুকে এক আঙুলেই বোতলের ছিপি খোলার মতন শব্দ করতে থাকে। তার মধ্যেও তাল আছে। তবে পাপের মন বলে কি না জানি না, সুজন বিন্দুর চোখাচোখি মিটিমিটি হাসিতে যেন কেমন এক রঙের খেলা। ওরা যেন, দুয়েতে অন্য কোথাও আলাদা। এটা ওদের কী খেলা, কে জানে। গোকুলদাস বা এমন নিস্পৃহ কেন। না হয় তারা স্বামী-স্ত্রী না। দু’জন, দু’জনের পুরুষ প্রকৃতি তো। এই উদাসী উদার মনের তল বিথার কে জানে।

গোপীদাস বলে, ‘তবে নানুর বুল্যে কথা, গুরুর তীত্থে যাওয়া। তায় আবার আমাদিগের চিতেবাবাজি নেকেন পড়েন। ওঁয়ার তো ধ্যান হবেই।’

সে ধ্যানে ছিলাম না। কিন্তু বলা বৃথা। রাধা বৃদ্ধা আওয়াজ করে, ‘জয়গুরু।’

গোপীদাস গুনগুনায়, ‘বাউলের গুরু চণ্ডীদাস, আমি তাঁর দাসানুদাস।’

এবার গোকুল আওয়াজ করে, ‘জয়গুরু।’

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘চণ্ডীদাস কি বাউলদের গুরু নাকি?’

গোপীদাসের দাড়ির ভাঁজে, চোখ ভরে, যেন এক মুগ্ধ রহস্যের হাসির ঝলক। কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে, ‘যেমন তমন গুরু লয় বাবাজি, পরম গুরু। সহজের পাঁচ রসিক। রসিক সবাই হয় না। বাউল কয়, ভবেতে আছেন পাঁচ রসিক, বিল্বমঙ্গল, জয়দেব, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি আর শ্যাখর রায়।’

বলে, আর প্রতি নামে নামে, বারে বারে কপালে হাত ছোঁয়ায়। কেবল যে, সে-ই ছোঁয়ায়, তা না। রাধা বৃদ্ধা, গোকুল বিন্দু সুজন, সবাই কপালে হাত ছোঁয়ায়। সকলেই একবার উচ্চারণ করে, ‘জয়গুরু।’

ভক্তি কাকে বলে, জানি না। এদের সকলের মুখ দেখে মনে হয়, কী এক ভাবের খেলায় টলটলানো। যেন স্থান কালের দিশায় নেই। এমন যে একটা বিলিতি গাড়ির খোলে বসে যায়, তাও যেন মনে নেই। বাউল-বৈষ্ণবের তফাত কোথায় কতখানি জানি না। তফাত আছে শুনেছি। কিন্তু গোপীদাস পরম গুরু রসিক বলে যাঁদের নাম করে, তাঁরা সবাই কৃষ্ণপ্রেমিক শুনি। রাধা কৃষ্ণ নামের কবি। বাউল ঘরানায় তাঁদের মেলবন্ধন কোথায় জানি না। গোপীদাসের শ্যাখর রায় বোধ হয় বৈষ্ণব পদকর্তা রায় শেখর। সকলেরই তো গাঁথা কথা এক। বাউল যেমন রহস্যে ভাসে, মনের মানুষ ডেকে বেড়ায়, এঁদের গানে তা শুনি না।

না শুনি, না-ই শুনি। আমি কেন ফাঁপরে পড়ি। কার সাধনের কোথায় কী মেলবন্ধন, তা জেনে আমার লাভ কী। তার চেয়ে শুনে যাই।

গোপীদাস তখন আমার দিকে চেয়ে, ঘাড় নেড়ে নেড়ে, ঘড়ঘড়ে গলায় সুর দিয়ে বলে,

‘অই রে ভজা, ভজবি যদি,

ভজ্‌গা রসিকে।

রসিক থাকে রসের ঘরে।

অলখে ঝলকে।

বলে, বিটলে একটা ছোঁড়ার মতো, গোপীদাস চোখ পিটপিট করে। দাড়ির ভাঁজে হাসে। আবার বারেক চোখ ফিরিয়ে সকলের দিকে চায়। ঝিনির দিকে চোখ পড়তে, ইশারায় আমাকে দেখায়। ঝিনির দৃষ্টি চকিতে একবার আমার দিকে ঘুরে যায়। মুখে রঙের ছোপ লাগে। কিন্তু আসনের পিঠে ঝুঁকে পড়ে, গোপীদাসের দিকেই চেয়ে থাকে। ওর সখীরাও তা-ই।

ওদিক থেকে অচিনদা বলে ওঠেন,

‘বিজোড়ে নাই, জোড়ে রসিক

রসের আস্বাদ করে

রাধা বিনে কৃষ্ণ নাই।

অধরা ধরে।’

‘অই শুন, অই শুন’

গোপীদাস আমার দিকে চেয়ে, আঙুল দিয়ে অচিনদাকে দেখায়। খকর খকর কেশে, আবার তেমনি চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, ঘড়ঘড়ে গলায়, সুর দিয়ে গায়,

‘বিল্বমঙ্গলের রসের চিনি

দেয় চিন্তামণি

চণ্ডীদাসের রসের ধ্যানে

রামী রজকিনি।’

অচিনদাসহ, বাউলজনেরা সবাই যখন ‘জয়গুরু’ বোলে আওয়াজ তোলে, গোপীদাস তখনও গায়,

‘জয়দেবে দেয় রসের সিন্ধু।

পরকিতি পদ্মাবতী

লছিমা দেয় রসের সন্ধান।

জানেন বিদ্যাপতি।’

আবার যখন জয়গুরু আওয়াজ ওঠে, তার মধ্যেই অচিনদা বেজে ওঠেন, ‘আর রাধা দেয় রসের সন্ধান, পায় গোপীদাস।’

যেমনি বলা, অমনি শুনি গোপীদাস হেঁকে ওঠে, ‘মরে যাই হে, মরে যাই।’

বলতে বলতেই তার শরীর যেন কেঁপে ওঠে। সুজনের কোলের ওপর থেকে, সহসা ঝুঁকে পড়ে একেবারে রাধা বৃদ্ধার পায়ে ধরে। সে-ই হাত কপালে ছোঁয়ায়। জিভ বের করে জিভে ছোঁয়ায়। তার চোখমুখ আরক্ত হয়। চোখ ছলছলিয়ে ওঠে।

রাধা বৃদ্ধারও সেই দশা। দেখি, তারও চোখ ভেসে যায়। কথা বলতে পারে না, ফাটা ফাটা শীতার্ত ঠোট কাঁপে থরথরিয়ে। সে তাড়াহুড়ো করে না। ধীরে সুস্থে, নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে গোপীদাসের পায়ে ছোঁয়। জিভে মাথায় ঠেকায়।।

পরমুহূর্তেই দেখি, গোকুল বিন্দুর পায়ে হাত দেয়। ওদিক থেকে, সুজনের হাতও বিন্দুর পায়ে স্পর্শ করে। গোকুল সুজন নিজেদের দিকে চেয়ে, যেন সম্মোহিতের মতো হাসে। বিন্দু তাড়াতাড়ি দু’জনের দুই হাত তুলে নিজের কপালে ছোঁয়ায়। ওদের হাতে নিজের পায়ের ধুলা সে নিজের জিভেই ছোঁয়ায়। তার চোখ বুজে যায়। চোখের কোণে জল চিকচিক করে।

গোপীদাস নিচু স্বরে উচ্চারণ করতে থাকে, ‘কিরপা কর হে গুরু। তুমি বাপ্‌ মা, তুমি স্বামী, তুমি পত্নী। তুমি পুরুষ, তুমি পরকিতি…।’

তার দুই হাত বুকের কাছে। সে যেন মন্ত্র ভাষে। কেউ কোনও কথা বলে না। সকলেই চুপচাপ। অচিনদা সামনের দিকে অপলক চেয়ে, চালিয়ে চলেন। তাঁর মুখের ভাব দেখতে পাই না। ঝিনির চোখও বুঝি ভেসে যাবে, এই সন্দেহ লাগে। তার চেয়ে বেশি, ওর চোখমুখ যেন মুগ্ধ বিস্ময়ে আচ্ছন্ন। রাধা আর লিলি বিস্ময় কৌতূহলে সকলের মুখের দিকেই চায়।

আমার মনের সুর কাটে না। নতুন সুরে বাজে। নাম-না-জানা সেই সুরে, কেমন এক আলো-কালোর ধন্দে দোলে। যা ঘটে যায় তার অর্থ বুঝি না। কিন্তু এমনি করে পায়ের ধুলা কাড়াকাড়ি, চোখের জলে ভাসাভাসি, তারপরে নীরব নিশ্ৰুপ সব মিলিয়ে কোথায় কীসের তরঙ্গ বহে যায়। ভিন দুনিয়ার মানুষ আমি, ভিন ভাবেতে থাকি। এই মানুষদের বুঝি না। এদের ভজন পূজন রীতি প্রকরণ, কিছুই জানি না। তবু দেখ, এরা কেবল যে বিশ্বাসেই আছে তা না। যেন মন ভরে এক কীসের তরঙ্গ। সেই তরঙ্গে ভাসে। এরা পরস্পরের পায়ে ধরে, পরস্পরের জিভে ঠেকায়। তারপরে চোখের জলে হাসে। বুঝি না বুঝি, মানি না মানি, মিথ্যার ঘরে এমন ভাবের খেলা খেলে না। এ সত্যের স্বরূপ কী, কে জানে।

হঠাৎ স্পর্শে চমক লাগে। দেখি গোপীদাস হাত বাড়িয়ে আমার কাঁধ ছোঁয়। বলে, ‘বাবাজি, কিছু বুইঝতে পারলেন গ?’

ঘাড় নেড়ে বলি, ‘না।’

বুড়া কেশো গলায় হাসে। বলে, ‘অই, বুইঝবেন কেমন করে। চিতেবাবাজি কি গুরু ধইরেছেন?’

অবাক হয়ে বলি, ‘গুরু?’

‘হাঁ, গুরু। গুরু তো বাবাজি অনেক। ইথে গুরু, বিথে গুরু, প্রাণের গুরু অন্যথায়। আসল গুরু পেতে হলে আগের গুরু ধরতে হয়, বুইঝলেন না?’

দেখি আবার তার চোখে সেই রহস্যের হাসি। ভুরু নাচিয়ে নাচিয়ে কথা বলে। বুঝতে পারি না, তা-ই চেয়ে থাকি চুপ করে। আর গোপীদাস যেন কোন এক জগৎ থেকে ভিন সুরে বাজে, ‘বাবাজি, পদ্মাবতীর চরণে বইস্যে, জয়দেব ছিচরণ চারণ চক্কোত্তি। রজকিনির পাটে বইস্যে, চণ্ডীদাসে ভজেন, “তুমি রজকিনি, আমার রমণী, তুমি হও মাত্‌রি পিত্‌রি। তিসন্ধে যাজন, তোমারি ভজন, তুমি বেদমাতা গায়ত্তিরি।” বুইঝলেন ক্যানে বাবাজি, গুরু কেমন হয়। কালাচাঁদের বয়ান শোনেন নাই গ, “রাধে তুমি সি আমার গতি। তোমার কারণে, রসতত্ব লাগি, গোকুলে আমার স্থিতি।” সেই গুরুর কথা বলছি বাবাজি।’

বলতে বলতে ভুরু তুলে একবার ঝিনির দিকে চায়। ঝিনির মুখে রং লাগে। কিন্তু তার আয়ত চোখের দৃষ্টি গোপীদাসের দিকে।

.

৬২.

গোপীদাসের কথা শুনে, কী বুঝি না বুঝি, তাই কী জানি? এইটুকু শুধু শুনি, চণ্ডীদাস রামীর পূজা করেছিলেন। রাধা, কৃষ্ণের গতি। কিন্তু ঘরছাড়া এই চলার পথে গুরুতত্ত্বের ধরতাই পাই না। কেবল দেখি, গোপীদাসের ভুরু নাচে, ঝিনির দিকে চেয়ে চেয়ে। ঝিনির মুখে শুধু রং লাগে না। চোখে যেন নানা আলোর খেলা। গোপীদাসের দিকে চেয়ে যেন কী খোঁজে। কী যেন দেখে। আর রাধা লিলি বা কী বোঝে কী জানে। ওরা ঠোঁট টিপে হাসে।

গোপীদাস আবার আমার কাঁধে ঠুকুস ঠুকুস চাপড়ায়। প্রায় যেন চুপি চুপি জিজ্ঞেস করে, ‘হাঁ বাবাজি, বুইঝতে পারলেন?’

না বুঝলেই বা ক্ষতি কী। সংসারে বাহিরে সব জানা, সকলের না। না হয়, এই তত্ত্ব না-জানা থাক। তবু ঘাড় নাড়তে হয়। আর গোপীদাস কেশো গলায় টিটকিরি দিয়ে হাসে। বলে, ‘বাপ্‌ গুরু, তার এক শিক্ষা, মা গুরু, তার এক শিক্ষা, লয় ক্যানে বাবাজি, আঁ? আর ইস্কুলের মাস্টরবাবু আর এক গুরু, তারও আর এক শিক্ষা। রসের শিক্ষা, কে দেবে গ বাবাজি, সিটি বলেন ক্যানে।’

চোখের জিজ্ঞাসা চোখেই থাকে। কথা বলতে পারি না। বিন্দু ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে চায়। লাল পাড়ের ঘোমটা খসিয়ে তার রুক্ষু চুলের গোছা গাল ঢেকে দেয়। ছড়ার মতন করে ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে বলে,

‘গুরু করব শত শত, মন্তর করব সার

যার সঙ্গে মন মিলবে, দায় দিব তার।’

বলে গোকুলদাসের দিকে চেয়ে হাসে। গোকুলদাস ঘাড় নাড়িয়ে সায় দেয়। বিন্দু মুখ ফিরিয়ে চায় সুজনের দিকে। বিন্দুর দিকে চেয়ে সুজনের চোখের পলক পড়ে না। যেন চোখের আলোয় দেবীর আরতি করে। বিন্দুর চোখও যেন আবেশে ভরে যায়।

গোপীদাস আওয়াজ দেয়, ‘অই অই, যথাত্থ বইলছে বিন্দু। “ঘরে গুরু, বাইরে গুরু, গুরু পাথারে। গইনচি কত, আগোনা সি, হিয়ায় বাস করে।” তার মধ্যে যে রসের গুরু, তারে কই প্রেমের গুরু। বুইঝলেন তো বাবাজি, প্রেমের গুরু। পিরিতি যার নাম। উটি না হলে বেবাক বুজরুক। পিরিতি বইলে, ই তিন আখর, বিদিত ভোবন মাঝে।’

ওদিক থেকে অচিনদা বেজে ওঠে, ‘সেই সঙ্গে তোমাদের সেই গানের কলিটাও বাতলে দাও, যে জন প্রেমের ভাব জানে না, তার সঙ্গে কীসের লেনাদেনা?’

গোপীদাস বলে ওঠে, ‘আহা, সি জন্যেই তো, বাবাজি গুরু ধইরতে বইলছি। নইলে ভাব বুইঝবেন কেমন করে।’

অচিনদা বলেন, ‘চিতায় তো ধরে না, গুরু শিকার করে।’

সবাই হেসে ওঠে। গোপীদাস চায় ঝিনির দিকে। ঝিনির চোখ আমার দিকে। আমি ভাবি, দরিয়ার স্রোত চলে, সে-ই এক টানে। সে-ই এক বর্গার একদিকে। আমি চোখ তুলে রাখতে পারি না। যা সরিয়ে রাখতে চাই দূরে, তা-ই সবাই নিয়ে আসে কাছে। সবাই এক সুরেতে বাজে। আমি বাজি কুল লাজ মান ভয়ে। কিন্তু সে কথা বোঝানো যাবে না কাউকে।

তবে আমার মনের মধ্যে নানান জিজ্ঞাসার চমক। গোপীদাসের কথায় লাগে গোল। এদের তত্ত্ব আমি বুঝতে পারি না। জয়দেব চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি, বৈষ্ণব পদকর্তারা কেন তাদের গুরু, ধরতে পারি না। কৃষ্ণকে ঈশ্বর বলে না। কেবল গুরু গুরু করে। প্রেম প্রেম বলে। যার সন্ধানের দান থাকে, পদ্মবতী, রামী রজকিনি, রানি লছমীর হাতে। যেন ঘটনাচক্রের, ঘর-সংসারের প্রেমের বার্তা না। প্রেম সাধনে, গুরুর আসন নারীর জন্যে পাতা।

সে প্রেমের তত্ত্ব বুঝি না। প্রেম কী, তাই বা কী জানি। তবু যেন মনের মধ্যে কেমন একটা দোলা লেগে যায়। কীসের একটা ধারা যেন উপছে পড়তে চায়। তাতে এক আনন্দের বোধ যতটুকু, তার চেয়ে বেশি যেন এক হাহাকারের কষ্ট বাজে। মন দুখানো ব্যথায় যেন কোন শূন্যতায় বাতাসে মাথা কোটে। এ অনুভবের ব্যাখ্যা জানি না। ব্যক্ত করতে পারি না।

এই সময়ে গোকুলদাস সরু গলায় গেয়ে ওঠে,

‘সখী, হিয়া মোর ক্যানে কাঁপে।

নয়ানে ঝরায়ে বারি,

ই পরাণ থরথরি।

সি বাঁশির মধুর আলাপে।’

টেনে টেনে, কীর্তনের সুরে, যেন আর্তস্বরে বাজে। গোকুলের দিকে চেয়ে দেখি, দৃষ্টি তার সামনের দিকে। কারুর দিকে চেয়ে নেই। সে যেন আপনাতে আপনি বিভোর। মুখে ভাবের খেলা নেই। সুরের মধ্যে যেন হিয়া কাঁপানো বিষাদ সংশয়। গাড়ির মধ্যে নতুন সুর বেজে ওঠে। অন্য আবেশ লাগে।

ঝিনির সঙ্গে দুই সখী, এদিকে ফিরে চায়। গোপীদাস বলে, ‘সেই তো, পিরিতি পরকিতি, ফাঁদের ধরা।’

গাড়ি তখন বাঁ দিকে বাঁক নেয়। অচিনদা ঘোষণা করেন, ‘নানুর এল।’

নানুর! নান্নুর! যা-ই বললা, সে-ই এক কথা, নাম চণ্ডীদাস। ইতিহাস লিখি না, ইতিহাস জানি না। যদি বলো আর এক দেশে, আর একজন এই নামে আছেন, তবে তাও সেই নামের মহিমা। দুই বলো, চার বলো, লাখোও বলো, তবু জানি, সে-ই এক নাম, চণ্ডীদাস। এক কথা, এক গান, একই সুরে বাজে। নামের, স্থানের, মহাফেজখানার যে দলিল-দস্তাবেজ ঘাঁটতে যায়, সে যাক। তার কাজ তার। আমার নাম সার। এখানে আমি তর্কেতে নেই। ছাতনা-নান্নুরের লড়াইয়ে নেই। যেমন কিনা একান্ন পীঠের যেখানে যাও, এক শরীরের নানা রূপ। আমার কাছে নানুর যা, ছাতনাও তাই। যেখানে তাঁর নাম, সেখানেই আমার কবিতীর্থ। শিল্পীর সাধন ক্ষেত্র।

এখন আমার সেই কবিতা মনে পড়ে,

নান্নুরের মাঠে গ্রামের নিকটে

বাশুলি আছয়ে যথা

তাহার আদেশে কহে চণ্ডীদাসে

সুখ সে পাইবে কোথা।

যেখানে বাশুলি অধিষ্ঠাত্রী, সেখানে দুঃখকষ্ট অপমান সকলই সুখ। কারণ,

‘চণ্ডীদাস কহে সে এক বাশুলি

প্রেম প্রচারের গুরু।

তাহারই চাপড়ে নিদ্রা ভাঙ্গিল

পিরিত হইল শুরু।’

সেই নানুরে পদার্পণ। আগমন চণ্ডীদাসে। অচিনদা চেনা মানুষের মতো, এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করায়। চোখ মেলে তো দেখি, বীরভূমের এক গ্রাম। প্রথমেই লক্ষ পড়ে, মাটির বেড়া, খড়ের চাল। গাড়ির পথ যেখানে শেষ, গ্রামে ঢোকার পথের মোড়ে চায়ের দোকান একদিকে। আর একদিকে ভিন জিনিসের বিপণি। কালো মানুষটা শুকনো গামছা গায়ে। রোদে গা দিয়ে চায়ের অপেক্ষায়। সঙ্গে আরও দুই-চারি জন। হৃদয় মন শরীর সকল দিয়ে ধূমায়িত পানীয় দর্শন। ওদিকে মুড়ি মুড়কি ডাল তেল ইত্যাদির সামনে নানুরের মানুষদের অলস শ্লথ কেনাকাটা। তার মধ্যেই কারা এল হে? একবার চোখ তুলে অচিন লোকদের দেখা। একটু বা অবাক কৌতূহল, গাড়িওয়ালা শহুরেদের সঙ্গে একতারা-দোতারা-বাঁয়া আলখাল্লার দল জুটল কেমন করে। তারপরে আর তেমন উৎসাহ নেই। চণ্ডীদাস বলে কথা। এমন কত মানুষ আসছে যাচ্ছে। তাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলে কী আর ঘর গেরস্থালি চলে।

পাকা রাস্তা আবার ডাইনে মোড় নিয়ে চলে গিয়েছে। অচিনদা আমাদের ডেকে নিয়ে যান গ্রামের মধ্যে। তার আগে পরম রসিকের লীলাভূমিতে নেমে ভূমির ধুলা নিয়ে মাথায় ছোঁয়ায় গোপীদাসের দল। মুখে শব্দ জয়গুরু। আর গ্রামের পথে পা দিয়ে আমার বুকের মধ্যে ধ্বক করে ওঠে। দেখি এক বড় জলাশয়। তার পাড়ে ধোপার পাট রয়েছে। কাপড় কাচছে না কেউ। ওপারের গাছের ছায়ায় ছায়ায় মাথায় ঘোমটা এক বধূ সদ্য জল সইয়ে কলসি কাঁখে চলে যায়।

ভাবি, এই কি সেই রজকিনির পাট নাকি। আর কোথায় বসে ছিপ দিয়ে মাছ ধরত বাশুলির পূজারী ব্রাহ্মণ। যেথায় ‘পিরিতি করিল, জগতে ভাসিল, ধোপানি দ্বিজের সনে। জগতে জানিল, কলঙ্কে ভাসিল, কানাকানি লোকে জনে।’ কোথায় সেই তেহাই গ্রাম, তিন ক্রোশ দূরে। যেখান থেকে রজকনন্দিনী আসত নানুরের বাশুলির জলাশয়ে কাপড় কাচতে।

ডাইনে দেখি, উঁচু পাড়, আরও এক পুকুর। পথের দু’পাশে বন্ধুর ভূমি। হয়তো এই সেই মাঠ, ‘নান্নুরের মাঠে, গ্রামের নিকটে।’ এখানে ওখানে তাল, ছেউটি বাবলার ঝাড়। এ প্রান্তর গ্রামের নিকটে বটে। ধানকাটা রিক্ত মাঠ। যেন সব দিয়ে-থুয়ে, উদাস বৈরাগী ধূলি আলখাল্লায় জড়ানো। তার বুকের ওপর দিয়ে চলে যায় গরুর গাড়ি। হেথা হোথা, পলাশের ডালে এখনও ফুল আসেনি। কিন্তু ন্যাড়া শিমুলের ডালে ডালে ইতিমধ্যেই পাগলা মাতামাতি। লালের ছড়াছড়ি।

ছাতিমতলা পেরিয়ে এলাম বাশুলির থানে। এক মরমিয়া ধ্যানের দেশ থেকে আর একজনের লীলাভূমে। হয়তো এই পথে হেঁটে গিয়েছেন তিনি মাঠে গ্রামান্তরে। ছেলেবেলার ধূলি খেলা থেকে যৌবনের পিরিতি আখর তিনের গানে গানে ফিরেছেন। মন শিহরে যায়, তরঙ্গে দোলে। এই ধূলিতে সেই পায়ের ধুলা আছে। এই বাতাসে সেই মানুষের নিশ্বাস। কেমন দেখতে ছিলেন! কেমন করে কথা বলতেন, হাসতেন। নিরালা নিরিবিলি কোনখানে বসে ছন্দের ভাবে মগ্ন থাকতেন।

গায়ে স্পর্শ লাগতে ফিরে তাকাই। লিলি জামা ধরে টানে, ‘ও মশাই, আসুন। সবাই যে চলে যাচ্ছে।’

দেখি, বাঁয়ে ফিরে পুষ্করিণীর ধার দিয়ে সবাই গ্রামের ভিতরে যান। অচিনদা সকলের আগে। তাঁর পিছে গোপীদাসেরা। তিন সখী সকলের পিছনে। তারা এখনও দাঁড়িয়ে। ঝিনির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। জলের ধারে, পথের ওপর দাঁড়িয়ে সে। তার পাশে রাধা।

শুনতে পাই, অচিনদার গলা, ‘ওকে নিয়ে এসো। বলো, ওদিকে কিছু নেই, এদিকেই সব।’

তার সঙ্গে গোপীদাসের তালের ঠেকা, ‘হুঁ, চিতেবাবাজি আবার দিক ভুল না করে।’

ঝিনির পাশ থেকে রাধা আমাকে বলে, ‘একেবারে তন্ময় হয়ে গেলেন যে। আগে মন্দিরটি দেখে আসি চলুন।’

তাড়াতাড়ি সকলের পিছন ধরি। পুকুরের সীমা পেরিয়ে দু’ পাশে মাটির ঘর। মাঝখানে গলি পথ। একটুখানি গিয়েই চোখে পড়ে উঁচু ঢিবি। ঢিবির ওপারে মন্দিরের চূড়া। টিবির পাশ দিয়ে এগিয়ে উঁচুতে মন্দিরের চত্বরে যাই। আমরা ছাড়া আর কোনও প্রাণী দেখি না। নিঝুম নিশ্চুপ চারদিক। ঘুঘুর অলস ডাক, ঝিঁঝির টানা স্বর। গাছের ছায়ায় নিবিড়, উঠোনে শুকনো পাতা ওড়ে। বাশুলির মন্দির একদিকে। উঠোনের ওপারে বাশলির মুখোমুখি আর এক মন্দির। এই মুহূর্তে স্মরণে আসে না, কোন বিগ্রহ এই মন্দিরে। বাশুলিকেই প্রথম দর্শন করি। ছোট এক কালো পাথরের মূর্তি। কে বাশুলি, বাসলী কে, কে বা বিশালাক্ষী, কে জানে। এঁকে নিয়ে নানা মত, নানা কথা। কেউ বলে বৌদ্ধ, ইনি নিত্যার সহচরী। ‘ডাকিনী বাশুলি, নিত্যা সহচরী, বসতি করয়ে তথা।’ ‘নিত্যের আদেশে, বাশুলি চলিল, সহজ জানাবার ওরে।’ স্বয়ং চণ্ডীদাসের এই বার্তা। ‘বাশুলি কহায় বলে চণ্ডীদাস গীত। আপনি আপনি চিত করহ সম্বিত।’ কিন্তু দেখি, ইনি, চতুর্ভুজা বাগীশ্বরী। পাষাণের দেবী মূর্তি, বীণা পুস্তক জপমালাধারিণী। এ দেবী আমাদের পরিচিতা। ইনি বিদ্যাদেবী ‘ব্রজেশ্বরী।’

বাশলি যাঁর নাম, তিনি রুধিরপায়িনী চামুণ্ডা। ইনি যে তিনি নন, সন্দেহ নেই। বিশালাক্ষী বা কে। ধর্মঠাকুরের যাঁরা আবরণ দেবতা, তাঁদের কেউ কি। কে জানে। বাশুলির নমস্কারের শ্লোকে তাঁকে মঙ্গলচণ্ডীও বলা হয়েছে। যিনি সেই চণ্ডীকে সেবেন, তিনি চণ্ডীদাস। কত যে কথা। তাই লোকে বলে, নানা মুনির নানা মত।

থাকুক। আমি মুনি না। আমার মুনির মতন মত নেই। চণ্ডীদাসের বচনে শুনি, ইনি তাঁর ‘প্রেম প্রচারের গুরু।’ ‘বাশুলি আসিয়া চাপড় মারিয়া চণ্ডীদাসে কিছু কয়।’ বাশুলির আদেশেই চণ্ডীদাস প্রেম সাধেন, পিরিতি গান করেন। ‘বাশুলি আদেশে কহে চণ্ডীদাসে, ধোপানি চরণ সার।’ তবু ভয় ছিল প্রাণে। সমাজের ভয়ে, লোকভয়ে, অত্যাচারে পীড়নে শ্লেষে ঠাট্টায় তিক্তবিরক্ত চণ্ডীদাস যখন আত্মীয়দের মুখ চেয়ে প্রেমিকাকে ছাড়তে চেয়েছিলেন, তখন রামীর বিলাপ, ‘নাথ আমি সে রজবালা।… কহেন রামিনি, শুন গুণমণি, জানিলাঙ তোমার রীতি। বাশুলি বচন করিলে লঙ্ঘন, সুনহ রসিকপতি।’

কিন্তু বাশুলির বচন লঙ্ঘন করেননি। রামী ত্যাগ করে ঘরে ফিরে যাননি। প্রেম ছেড়ে অ-প্রেম সাধনে যাননি। কারণ শিরে বন্দী বাশুলি আদেশ। ‘রামীর বচন, করহ শ্রবণ, দাসীরে করহ সাথ।’ সাথেই করেছিলেন, কিন্তু তার আগে অনেক যাতনা, পীড়ন, অপমান। ইনি সেই বাশুলি। ইনি যে-ই হোন, নিত্যা সহচরী বা রুধিরপায়িনী, মঙ্গলচণ্ডী বা বিদ্যাদেবী, ইনি সেই কবির পূজ্যা। ইনি তাই সকল মানবের পূজ্যা। সকল শিল্পীর পূজ্যা। এঁরই নির্দেশে প্রেম সাধন, প্রেমপদাবলি রচনা। ছাতিমতলার কবির বচন মনে পড়ে। ভবিষ্যতের সে-ই দিনের মুখ চেয়ে যিনি চণ্ডীদাসের কথা বলেছেন, ‘…যখন হৃদয়ের দ্বার দিবারাত্রি উদ্ঘাটিত থাকিবে, ও কোন অতিথি রুদ্ধদ্বারে আঘাত করিয়া বিফল মনোরথ হইয়া ফিরিয়া না যাইবে, তখন কবিরা গাইবেন, “পিরিতি নগরে বসত করিব, পিরিতে বান্ধিব ঘর। পিরিতি দেখিয়া পড়শি করিব, তা বিনু সকলি পর”।’

কোন দূরে না জানি আছে সে প্রেমজগৎ। আর সেই প্রেমজগতের কবিতা সকলই, সৃষ্টির নির্বন্ধ ছিল, কবির এই দেবীর হাতে। জানি, সামান্য ধনে গরিব বলি অসামান্য সৃষ্টির আকাঙক্ষায়। মনো আশ বাস পুরুক না পুরুক, বাশুলিকে নমস্কার। প্রণাম, শত কোটি।

তবু ভাবি মনে, তবে রাধাকৃষ্ণ গান কেন। বৌদ্ধ হিন্দু মেলামেলি জড়াজড়ি যদি বা দেখি, বৈষ্ণবের রূপ কোথায়। চোখ ফেরাতে গিয়ে দেখি, পাশে অচিনদা। মন্দিরের খোলা দরজার কাছে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঝিনি দাঁড়িয়ে আছে। গোপীদাসের দল কখন মন্দিরের দাওয়া থেকে, দর্শন করে নেমে গিয়েছে। কে যেন একতারা বাজায়। সঙ্গে বাঁয়ার বুকে আলতো চাঁটির আওয়াজ। রাধা লিলি যেন কোথায় নিরুদ্দেশ। হয়তো ডাইনে যে পুরনো পাকা বাড়ি দেখা যায়, সেখানেই ঢুকেছে। কিংবা আশেপাশে, মন্দির প্রদক্ষিণে।

হয়তো এই মন্দিরে যা কিছু এই-ই সব না। কেতাবে পড়েছি, পাঁচশো বছরের সেই আদি মন্দির, কালের ধুলায় মিশিয়েছে। এ মন্দির অনেক পরে। হয়তো সে-ই প্রাচীন মন্দিরে কালাচাঁদ রাইকিশোরী ছিল। অন্যথায় পদাবলির যা কিছু, সবের নায়ক-নায়িকা তো সেই দু’জনেই।

অচিনদাকে জিজ্ঞেস করব ভেবে মুখ তুলি। দেখি, বাশুলির প্রতি নিবিড় দৃষ্টিপাতে নিশ্চল মগ্ন। কী ভাবেন অচিনদা। এই পিরিতি গুরুদেবীর সামনে দাঁড়িয়ে, বসন্তোৎসবের রাত্রে আম্রকুঞ্জের নীরজাকে মনে পড়ে নাকি। কোন ধ্যানেতে এমন মগ্ন!

তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি না। মুখ ফেরাতে গিয়ে ঝিনির দিকে চোখ পড়ে। বাশুলির দরজায় দাঁড়িয়ে ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। আসবার পথে যেটুকু চঞ্চলতা ছিল, সকলই গিয়েছে। চোখের নানা রঙের ঝলক গিয়েছে। ঠোঁটের হাসি গিয়েছে। শীতের সকালে কোনও প্রসাধনই সারতে পারেনি। রুক্ষু চুলে, আলগা বাঁধনে, একটা খোঁপা করা। বাসন্তী রঙের শাড়ি, লাল পাড়। ফুলতোলা পশমি চাদর, লম্বা ভাঁজে গলায় ঝোলানো। চুলে আর শাড়িতেই যেন, কেমন একটু বৈরাগিণী ভাব এনে দিয়েছে। ওর মুখে এখন ছায়া নিবিড়। চোখের কোলে যেন কীসের এক অস্পষ্ট উদ্বেগ, আর জিজ্ঞাসা। যেন কিছু জিজ্ঞেস করতে চায়।

চোখে চোখ পড়তে এক মুহূর্তের জন্যে চোখ সরাতে পারি না। তারপরে মুখ ফিরিয়ে বাশুলির দাওয়া থেকে নেমে আসি। অন্য মন্দির যাই। আশেপাশে দেখি। কোথায়, রাধাকৃষ্ণ তো দেখি না। ইতিমধ্যে কোথা থেকে গান বেজে ওঠে,

পিরিতি অনল ছুঁইলে মরণ।

শুন গ কুলের বধূ

আমার বচন না শুন এখন

জানিবে কেমন মধু।

সই, পিরিতের বলি বলিস না মোকে

পিরিতি অনলে পুড়িয়া মরিবে।

জনম যাবে গ দুঃখে।…

কোথায় গান বাজে। মনে হয়, গোকুলদাসের গলা। হয়তো মন্দিরের সীমা ছাড়িয়ে নীচে কোনও গৃহস্থের উঠোনে, ওরা দল বেঁধে আসর জমিয়ে বসেছে। ভাবতে ভাবতে ভিন মন্দিরের পিছন থেকে যখন উঠোনের দিকে আসি, দেখি সেখানে কেউ নেই। চার পাশের, বেষ্টিত চত্বরে, এই ভিন মন্দিরের দাওয়ায় আমি একলা। স্তব্ধ, নিশ্চুপ। মুখোমুখি, ওপারে বাশুলির শির মাত্র দেখি। শুধু গানের আখর ভেসে আসে, ‘সই বলিস না গ, বলিস না গ, বলিস না মোকে।’..

কোথায় গেল সবাই। ধীরে ধীরে নেমে আসি নীচে। দেখি, দরজা দিয়ে চত্বরে ঢোকে গোপীদাস। বলে, ‘তাই ভাবি, চিতেবাবাজিরা গেলেন কুথা!’

পিছনে পায়ের শব্দে চেয়ে দেখি, যে-দাওয়া থেকে আমি নেমে আসি, সেই দাওয়াতে ঝিনি দাঁড়িয়ে। অবাক লাগে, কখন এল, কোথায় ছিল সে। ও কি আমাকে কিছু বলতে চায়। এমন করে চেয়ে কেন! অথচ বলে না কিছুই। জানি না, কী দেখে আমার মুখে। গোপীদাসকে জিজ্ঞেস করি, ‘অচিনদা কোথায় গেলেন।’

গোপীদাস ভুরু নারিয়ে হেসে ভাষে, ‘সবাই যে যার নিজের মনে, আপনাদের মতনই।’

আপনাদের! হয়তো তা-ই ভাবে গোপীদাস। আমি অন্য কথা জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি এখানে আগে এসেছেন!’

গোপীদাস দাড়ি নাচিয়ে চোখ বড় করে বলে, ‘আগে কী গ বাবাজি! পিতি বচ্ছর একবারটি না এইসে কি পারি। হেথাতে আসি, আর পিতি বছরে একবার যাই কিরণহারে। সেথাতেই ওঁয়াদের দুইজনার সমাধি আছে।’

এ কথা জানা ছিল না। জিজ্ঞেস করি, ‘দু’জনের মানে, চণ্ডীদাস আর রামীর?’

‘এঁজ্ঞে। সবাই কয়, সেথাতে এক মন্দির ছিল, পুরনো লাটমন্দির। বইসে, দু’জনে গান কইরছিলেন। মন্দির ভেঙে পড়েছিল।’

আমার মনে পড়ে যায়, ভিন কাহিনী। গৌড়ের রাজা ডেকেছিলেন চণ্ডীদাসকে পদাবলি গান শোনাতে। সঙ্গিনী রজকিনিকে নিয়ে গিয়েছিলেন গান শোনাতে। কিন্তু ‘রুপিলে বিষের গাছ হৃদয় মাঝারে। গরলে জারল অঙ্গ দোষ দিব কারে।’ গৌড়ের রানি চণ্ডীদাসকে দেখে, গান শুনে ‘ঘরে রৈতে নারে, করে অভিসার।’ অতএব রাজার আদেশ, হাতির পিঠে শিকল দিয়ে বেঁধে মারো কবিকে। ‘চণ্ডীদাসে করি ধ্যান; বেগম তেজল প্রাণ। শুনিয়া ধবিনি ধায়, পড়িল বেগম পায়।’ চণ্ডীদাসের সঙ্গে বেগমের প্রাণ যায়। তার পায়ে প্রাণত্যাগ করে রজকিনি।

কত কথা, কত কাহিনী। সত্যি-মিথ্যার বিচারে কে যায়। তবে এইটুকু শুধু মনে হয়, দুহুঁ করে ধরাধরি করে দুইয়ের মরণ হয়েছিল। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কখনও ছাড়াছাড়ি হয়নি।

গোপীদাসকে জিজ্ঞেস করি, ‘কিন্তু এখানে রাধাকৃষ্ণের কিছুই দেখি না কেন।’

গোপীদাস দাড়ি উড়িয়ে হাসে। বলে, ‘অই চিতেবাবাজি, তুমাকে আর বুঝাব কত। হেথা রাধা কৃষ্ট থাইকবে ক্যানে? পদাবলির জন্যে বুইলছ?’

এই প্রথম গোপীদাস আমাকে তুমি বলে। যেন এতক্ষণে সহজের হাওয়া লাগে। দূরত্ব যায় দূরে। বলি, ‘হ্যাঁ।’ গোপীদাস কাছে এসে, মুঠো করে দাড়ি ধরে। যেন কী এক পরম বার্তা বলে, এমনি করে। ধীরে ধীরে বলে, ‘রাধাকিষ্টের লীলা কোথায়, নিজের কথা বাজে, বুইঝলে ত? রজকের বিটির কথা ভাব, আর চণ্ডীঠাকুরের কথা ভাব। এ দুয়েতে যে লীলা, তারই মিলেমিশে রাধা-কেষ্ট। নিজের কথা পরকে দিয়ে, হাঁ, বুইঝলে? যে দুঃখে রাধা কাঁদে, রামীও সেই দুঃখে কাঁদে, না কী বাবাজি, আঁ? হল ত? ইবারে দেখ, রসতত্ত্বের লেগে কেষ্ট থাকেন রাধার পায়ে। উনি থাকে রামীর পায়ে। তবে কি না বাবাজি, খালি পদাবলি শুইনলে, রসিকের আদত কথা শুন নাই।’

তার কথার মাঝেই, বিন্দু আর সুজন আসে। কাছে এসে কথা শোনে। জিজ্ঞেস করি, ‘কী সে কথা?’

চোখ বড় করে মাথা দুলিয়ে বলে, ‘অই সেই এক তত্ত্ব। রাধা-কেষ্ট যা সাধে, এ পুরুষ পিকিতিও তাই সাধে। রসিকের গান শুন নাই,

সই, সহজ মানুষ নিত্যের দ্যাশে

মনের ভিতর কেমনে আইসে।

ব্যাসের আচার করিবে যেই

বিরজা উপরে কেমনে আইসে।

সহজ ভজন বিষম হয়

অনুগত কিনা কেহ না পায়।

চণ্ডীদাস বলে ই সার কথা

বুঝিলে যাইবে মনের বেথা।’

গোপীদাস যেন গোপন কথা বলে, এমনি তার সুর স্বর মুখের ভাব। চণ্ডীদাসের এ গান আমার শোনা নেই। মনে হয় যেন, বাউলের গান শুনি। এদিকে বিন্দু আর সুজন কপালে হাত ঠেকিয়ে শব্দ করে ‘জয়গুরু।’ তারপরে বিন্দু গুনগুন করে গেয়ে ওঠে,

সখি, যাইবি দক্ষিণে

থাকিবি পচ্চিমে

বলিবি পুবের মুখে।

গোপন পিরিতি

গোপন রাখিবি

থাকিবি মনের সুখে।

সাধিবি মনের কাজ—

সাপের মুখেতে

ভেকেরে নাচাবি

তবে ত রসিকরাজ।

কুলটা হইবি

কুল না ছাড়িবি

কলঙ্কে ভাসিবি নিতি

পেয়ে কামরতি

হয়ে অন্য পতি

তাইতে বলাবি সতী।

সিনান করিবি

জল না ছুঁইবি

আলায়ে মাথার কেশ

জলেতে পশিবি

জলে না তিতিবি

নাই সুখ দুখ কেলেশ

আনের ছোঁয়াতে

সিনান করিবি

তবে ত সে রীতি সাজে

কহে চণ্ডীদাস

ই বড় ওল্লাস

থাকিব যোবতী মাঝে।

গানের শুরুতেই সুজনের দোতারায় সুর বেজে উঠেছে। গান শেষ হতে না হতেই, গোপীদাস চোখ বুজে, যেন হেসে কেঁদে, আওয়াজ দেয়, ‘জয় গুরু, জয় গুরু!’ তাড়াতাড়ি বিন্দুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। গালে চিবুকে হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, ‘বেঁচে থাক মা, গুরু তোকে দয়া কইরবেন গ বিটি। তুই দয়া পাবি।’

আমার মন ফেরে অন্ধকারে মাথা কুটে। চণ্ডীদাসের পদাবলিতে এমন বাউল হেঁয়ালি শোনা ছিল না। এই তত্ত্ব বুঝি না, অর্থ জানি না। নির্বাক, অবাক চোখে চেয়ে থাকি। সুজনের তো থামবার নাম নেই। তার শরীরে সাপের পাক তরঙ্গ। দোতারা বাজিয়ে চলে বিন্দুর দিকে চেয়ে। গান গেয়ে বিন্দুরও যেন কীসের ঘোর লেগেছে।

গোপীদাস আমার দিকে ফিরে বলে, ‘যা সাধেন রাধা কেষ্ট, তাই সাধেন রামী চণ্ডীদাস, বুইঝলে বাবাজি?’

কেবল ঘাড় নেড়ে নিঃশব্দে জানাই, ‘না।’

গোপীদাস দাড়ির ভাঁজে রহস্য হেসে বলে, ‘ক্যানে গ বাবাজি, শুন নাই, “শৃঙ্গার রস বুঝিবে কে? সব রস সার শৃঙ্গার-এ। শৃঙ্গার রসের মরম বুঝে। মরম বুঝিয়া ধরম যজে।” শুন নাই?’

যত শুনি, অবাক মানি তত। কিন্তু বুঝি না কিছুই। তাই মাথা নাড়াই সার। গোপীদাস তেমনি বলে চলে, “স্বরূপে আরোপ যার, রসিক নাগর তার, পাওয়া যাবে মদনমোহন। যেইয়ে দেবী বাশুলিরে, শুধায় করজোড়ে, রামী কহে শৃঙ্গার সাধন।” আর চণ্ডীদাস যেইয়ে বলেন, “তুমি ত হে রমণের গুরু, রসের কল্পতরু, তার সনে দাস অভিমান। চণ্ডীদাস কহে, মাতা, বইললে সাধন কথা, রামী সত্য প্রাণপ্রিয়া হইল।”

বলে, বলতে বলতে গোপীদাসের চোখ ছলছলিয়ে ওঠে। সে যেন কীসের এক ঘোরের মধ্যে ডুবে যায়। আর বিন্দু তার নিজের ঘোরেই, আবার গুনগুনিয়ে ওঠে,

আমার পরাণ পুতুল লইয়া

নাগর করে হে পূজা

নাগর পরাণ পুতুল আমার

হিদয় মাঝেতে রাজা।…

গোপীদাসের চোখ ভেসে যায়। আবার বিন্দুর মাথায় হাত দিয়ে বলে, ‘বা বিটি, বাহ্‌ বাহ্‌।’ আমার দিকে ফিরে বলে, ‘বুইঝলে তো বাবাজি। আদতে চণ্ডীদাস হলেন বাউল, রসের রসিক।’

তারপরে হঠাৎ আমার চিবুকে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘বুঝবা তুমি?’

বলি, ‘ইচ্ছা করে।’

গোপীদাস ঘড়ঘড়ে গলায়, হা হা করে হাসে। বিন্দু যেন ঢুলু ঢুলু চোখে, আমার দিকে চেয়ে হাসে। সুজন তেমনি বাজিয়ে চলে।

গোপীদাস আমার কপালে হাত রেখে চোখের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসে। বলে, ‘এই জানবা বাবাজি, মোট কথা, পুরুষ পিকিতি মিলন চাই, আবার যখন মিলন, তখনই বিচ্ছেদ। জীবন্তে যে মরা থাকে, টানেতে যে উজান চলে, তার সাধন হয়। বড় কঠিন, বড় কঠিন। পিরিতে সাধন, সাধনে পিরিত, এই কথা। চণ্ডীদাস হলেন এই সাধক।’

মাথা নেড়ে বলে, যেমন নিরালা নিভৃতে, শ্রবণ উৎকর্ণ হয়ে শোনে, দূরের অস্পষ্ট ধ্বনি, তেমনি যেন আওয়াজ দেয় গোপীদাসের কথা। অন্ধকারে যেমন জাগে ঝাপসা আলোর ইশারা, তেমনি বোধ হয় তার কথা। দেহতত্ত্বের সহজ সাধন, যেন এক অরূপের রূপে জেগে ওঠে। তার ধর্ম কী, মর্ম কী, জানি না। মনে বাজে, প্রেম ভজে যেই জন, সেই জন সেবিছে মানব। প্রেম, দুঃখের লাগিয়া শুধু। যবে সুখের আগমন, তখন সুখ দুঃখ অতীত। তখন এক ভিন জগতের দোলা। তখন রূপ ছেড়ে, অরূপের খেলা। তখন চোখের জলে, হাসির ধারা ঝরে। সে অনুভূতি কেমন, কে জানে। কেবল দেখি, নিজের বুকে কেমন এক বাষ্প জমে ওঠে। কথা ফুরিয়ে যায়। কী চাই, কী পাই না। সেই এক শূন্যতায় বাতাসের ঘূর্ণি লেগে যায়।

গোপীদাস ডেকে বলে, ‘চল গ বিন্দু, বাশুলির কাছে যেইয়ে আর একটুক বসি।’

চলতে গিয়ে আমার দিকে ফিরে একবার সুর করে বলে, ‘রসের মানুষ ধরবি যদি, রসের খোঁজে যা।’

যার নাম-ঠিকানা জানি না, আলাপ-সুবাদ নেই, তাকে কোথায় খুঁজব। তার চেয়ে যাই, কবির লীলাভূমির পথে পথে। ধুলায় ধুলায় ফিরি গিয়ে। শুনেছিলাম, এখানে নাকি রামী রজকিনির ভিটাও আছে। দেখে আসি গিয়ে।

কিন্তু পিছনের মন্দিরের দাওয়ায় ঝিনি দাঁড়িয়ে। একবার না তাকিয়ে যাই কেমন করে। ফিরে দেখি, দাওয়া শূন্য। ঝিনি নেই। সেই ভাল, সেই ভাল। মন্দিরের সীমা থেকে বেরিয়ে টিবির পাশ দিয়ে গ্রামের পথে নেমে যাই। কে জানে, পাঁচশো বছর আগে, এ পথই ছিল কি না। এই যে সব নানুরবাসীরা মুখের দিকে তাকিয়ে চলে যায়, কুটিরে কুটিরে গৃহস্থালির নানা রব, উঠোনে মরাই, দরজার কাছে গরুটা বাঁধা, সবই হয়তো এমনি ছিল। এই পথেই, রজকনন্দিনী বাশুলির মন্দিরে যেত হয়তো। মন্দিরের সে ছিল পরিচারিকা। ঝাঁট পাট ধুলা পরিষ্কার তার কাজ। পূজার দায় চণ্ডীঠাকুরের। হয়তো, এই পথেই, গাছতলায় দাঁড়িয়ে পড়শিরা কানাকানি করেছে, কলঙ্ক দিয়েছে। কিন্তু বাশুলির আদেশ লঙ্ঘিত হয়নি। ‘ধোপানি চরণ সার’ হয়েছিল। কেবল প্রেম সাধনে না। প্রেম সাধনের ফুল ফুটেছিল রামিনীর কবিতায়। চণ্ডীদাস একা নন, রজকঝিয়ারিও কবি ছিলেন। ‘কোথা যাও ওহে, প্রাণবঁধু মোর, দাসীরে উপেক্ষা করি। না দেখিয়া মুখ, ফাটে মোর বুক, ধৈরয ধরিত নারি। বাল্যকাল হতে, এ দেহ সঁপিনু, মনে আন নাহি জানি। কি দোষ পাইয়া, মথুরা যাইবে, বল হে সে কথা শুনি।’ ব্যথার ফুলের নাম কবিতা। প্রেম মৃত্তিকায়, বিরহের বৃক্ষে তার জন্ম।

এই তো সেই গ্রাম। এই সেই পথ। আমি সেই পথে চলি। ভুলে যাই কোন কালে আছি। কালের ঘূর্ণিতে পাক খেয়ে যাই। আমি যুগল গলার গান শুনি। মৃদঙ্গে শব্দ, প্রেমজুরির ঠিনি ঠিনি।

কোথায় এসে পড়ি, খেয়াল থাকে না। নিরালা জঙ্গল, বাঁশঝাড়ের ছায়া, সামনে মাঠ। যেন কার পায়ের শব্দ পাই। কার গলায় যেন কীসের শব্দ। থমকে দাঁড়াই। সামনের মূর্তিকে ভাল করে চেয়ে দেখি। দেখি ঝিনি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। বলে, ‘গ্রামের বাইরে চলে যাচ্ছেন যে।’

‘তাই বুঝি। তুমি কোথা থেকে এলে?’

‘আপনার পিছনে পিছনে।’

সহসা সংবিৎ ফেরে আমার। দেখি, ঝিনির চোখের কোলে স্পষ্ট উদ্বেগ, মুখে ছায়া ভার। তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করি, ‘আর সব কোথায়?’

‘মন্দিরের কাছে-পিঠেই আছেন।’

‘চলো তা হলে সেদিকেই যাই।’

বলে, ফিরতে যাই, ঝিনি নিশ্চল থাকে। পলকহীন চোখ সরায় না। আবার ডাকতে যাই। তার আগেই জিজ্ঞেস করে, ‘এখান থেকে কোথায় যাবেন?’

বলি, ‘ইচ্ছে আছে, বক্রেশ্বর যাব।’

‘এখান থেকেই?’

‘হ্যাঁ, তাই তো কথা হয়েছে গোপীদাসের সঙ্গে।’

‘স্নান খাওয়ার কী হবে এই দুপুরে?’

কী অবাক কথা বলে ঝিনি। হেঁসে বলি, ‘সে কথা তো ভাবিনি। সঙ্গীদের যা হবে, আমারও তাই।’

ঝিনি চুপ করে চেয়ে থাকে এক মুহূর্ত। তারপরে বলে, ‘বক্রেশ্বর থেকে কোথায়?’

‘যেখান থেকে শান্তিনিকেতনে এসেছিলাম, সাঁওতাল পরগনার সেই জায়গাতে।’

‘তারপর?’

‘কেঁদুলি যাবার ইচ্ছা, মকর সংক্রান্তির মেলায়।’

‘তারপর?’

‘তারপর কিছু ভাবিনি।’

‘ঘরে ফেরার দিনক্ষণও জানা নেই?

জবাব দিতে পারি না। দিনক্ষণ না জানি, পথ তো সার করিনি। ঘরে ফেরার পথেই তো পা বাড়িয়ে আছি।

ঝিনি বলে, ‘জবাব দিতে ভয় লাগছে, না?’

‘কেন?’

‘পাছে সেই ঠিকানায় চিঠি দিই।’

তাড়াতাড়ি বলি, ‘না, না, চিঠি দেবে বই কী।’

‘জবাবের প্রত্যাশা না করে।’

ওর নিচু স্বরে যেন কী এক তরঙ্গের দোলা। বলি, ‘তা কেন।’

ও আবার চুপ করে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকে। তারপরে জিজ্ঞেস করে, ‘আবার কি কখনও দেখা হবে?’

সহজেই বলি, ‘কেন হবে না।’

ঝিনি বলে, ‘শুনলে মনে হয়, কতই সত্যি। ভয় নেই, জানতে চাইব না, কোথায় কবে। দেখা হবে, এইটুকু জানলাম, তা-ই যথেষ্ট।’

কথা শেষ হবার আগেই, ওর অপলক চোখের রং বদলে যায়। যেন জলের মতো চিকচিক করে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে। হঠাৎ নিচু হয়ে হাত বাড়ায়।

এ যেন বড় বেশি। আমার মনে ভাবনায় সবকিছুতেই বাধে। বলে উঠি, ‘থাক না।’

বলি আমি, শোনার দায় তো ঝিনিরই। ও কথা শোনে না। আমি আবার বলে উঠি, ‘এটা ভারী সেকেলে ব্যাপার।’

ঝিনি উঠে দাঁড়ায়। ওর গলা ভেঙে যায়, তবু বলে, ‘হতে পারে। আমার সেকাল-একাল নেই। সে সব তোমারই থাক। শিক্ষা শহর আধুনিকতা ওসব ভাবনা তোমার থাক। আমার কোনও দরকার নেই। আমার যা দরকার, আমি তাই করি।’

এত বড় কথাটা, এমনি করে বলে ঝিনি। কত সহজে ওর সম্বোধন বদলে যায়। আমার বুকের মধ্যে নানান কথা বেজে ওঠে। গলার কাছে, যেন রুদ্ধশ্বাসে চেপে থাকে। কথা বলতে পারি না। ওকে আমি কী বলব, তা জানি না। কিন্তু একটা কষ্ট বিঁধে থাকে কোথায়। যেন নড়তে চড়তে পারি না।

ঝিনি চোখ মোছে। তাকাতে গিয়ে, চোখ নামায়। ওর মুখে আবার রঙের ছোপ লাগে, বলে, ‘ক’টা দিন খুব যাতনা পেলে। এবার সুখে ঘুরে বেড়াবে।’

বলি, ‘না, যাতনা তো পাইনি।’

কথা শেষ করতে পারি না। ও বলে ওঠে, ‘কত মিথ্যে যে বলতে পারো। সেটাই বুঝি তোমার শক্তি। এ সময়ে মুখখানিকে এমন সুন্দর করে রাখো কেমন করে।’

কথার জবাব খুঁজি। জবাব খুঁজে পাবার আগেই, শুনতে পাই, ‘বলেছিলাম কি না, কোথাও দুটোতে ঘুষটে মুষটে আছে।’

পিছন ফিরে দেখি, অচিনদা, রাধা লিলিসহ। অচিনদা ঝিনিকে হাতের ঘড়ি দেখিয়ে বলেন, ‘আমাদের যে এবার ফিরতে হবে ভাই।’

ঝিনি বলে, ‘চলুন। এই ভদ্রলোকের একটু তত্ত্বতল্লাশ করছিলাম, কোথা থেকে কোথায় যাবেন।’

অচিনদা যেন ঝেঁজে বাজেন, ‘ওর কথা ছাড়। ও আছে ওর নিজের তালে। আমাদের সঙ্গে ওর বনবে না। দেখছ না, উনি এখন বাউল বাবাজিদের দলে ভিড়েছেন। চলো চলো, আমরা ফিরি।’

ইতিমধ্যে দুই সখী, ঝিনির গায়ের কাছে দাঁড়ায়। রাধা ঝিনির একটা হাত ধরে। সবাই মিলে এগিয়ে যাই। গ্রামের বাইরে, গাড়ির কাছে এসে দাঁড়াই। গোপীদাসেরা হয়তো মন্দির চত্বরেই আছে। আমি গাড়ি থেকে আমার ঝোলাটা নিই। বাকিরা সব গাড়িতে উঠে বসে। সেখান থেকেই রাধা লিলি, কলকাতায় নিমন্ত্রণ করে। আর অচিনদা বলেন, ‘শালুক চিনেছে গোপাল ঠাকুর। ওকে আবার নেমন্তন্ন। দেখছ, আমি একটা কথাও বলছি না।’

আমি বলি উঠি, ‘অচিনদা, আপনার কাছে লখনৌয়ে যাব।’

‘এই দ্যাখ, আমাকে পর্যন্ত মিথ্যে বলতে আরম্ভ করেছে। তবে তুই আমাকে মজাতে পারবি না।’

বলতে বলতেই এঞ্জিনে গর্জন তোলেন। অচিনদার কথায় হাসতে যাই, হাসতে পারি না। ওঁর পাশে বসে ঝিনি। পিছনে দুই সখী। ঝিনি এক পলকের জন্যেও চোখ সরায় না।

হঠাৎ এঞ্জিনের শব্দ থেমে যায়। অচিনদা আমার দিকে চেয়ে, কোমল স্বরে বলে ওঠেন, ‘সবটা মিথ্যে করিস না। সময় পেলে একবার আসিস।’

তারপরে ঝিনির কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘এবার যাওয়া যাক কেমন।’

ঝিনি ঘাড় কাত করে সম্মতি জানায়। এঞ্জিন আবার গর্জন করে। গাড়ি ঘুরে যায়। ঝিনির মুখ আড়ালে পড়ে যায়। চকিতে দেখি, রাধার চোখের কোণে জল। লিলি হাত তোলে। ওরা যেন ওদের সখীর হয়ে বিদায় জানায়। এক রাশ ধুলায় আমি ঢাকা পড়ে যাই। চোখ বুজে থাকি।

.

৬৩.

ধুলা সরে যায়। তবু আমার চোখ খুলতে একটু সময় লাগে। জগৎ-সংসারে, আমিও কি জগৎ-জন নই? বন্ধুবিদায় কি আমাকেও একটু বাজে না? না বাজবে তো, সব মুখ ক’টি এমন করে চোখের সামনে ভাসে কেন?

এখন তো দেখি, পথ আমার সামনে। চলায় কোনও বাধা নেই। অথচ, পথ চলার পাওয়ানায় ঝুলি আমার উপচানো। হৃদ্কলসি টলটলানো। এখন মনে হচ্ছে, অচিনদার চোখ দুটি যেন রক্তাভ হয়ে উঠেছিল। মুখখানিও তাই। বিদায়ের প্রথম পাটে কত ঝাঁজ, বিরাগ। শেষ মুহূর্তে গোপন সুধার পাত্র ফেটে গেল। প্রাণের ধারা গড়িয়ে এল। ‘তুইতোকারি’ তো অনেক শুনেছি। এমন মন-বীণাতে ঝঙ্কার তুলতে পারে কে? এমন সহজ স্বরে, ছোট কথায় ডাক দিতে পারে ক’জন? মুখখানি যতই মনে পড়ে, পাশে আর একটি মুখ কিছুতেই সরতে চায় না। সে মুখ আমার কল্পনায়। নাম তাঁর নীরজা। সব মিলিয়ে এক দুঃসহ যন্ত্রণা, যেন খুলতে গেলে লাগে, পরতে গেলে বাজে। ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে-জন আছে মাঝখানে। তারপরে শুধু একটি কথা জাগে, ওহে, মানুষ কী বিচিত্র! আমার প্রাণে নমস্কারের নতি। এই ভুঁয়েতে দাঁড়িয়ে বলি, সবার উপরে মানুষ বিচিত্র, তাহার উপরে নাই।…

সেই সঙ্গে মানবীর কথাও বলো। মানুষজগতে সে আলাদা কিছু না। রূপে রূপে মিলে যেমন অপরূপ, তেমনি এক রূপের ফের মাত্র। মিল-অমিলের একটা সে, তাইতেই ছন্দ। বিদায়ের পর মন এখন থিতু হয়েছে। তাই যেন মনে পড়ে যায়, গাড়ি ঘুরে যাবার মুহূর্তে, ঝিনির ঠোঁট দুটি একবার নড়ে উঠল। ও যেন বলল, ‘আসি।’

এই মুহূর্তে আমার পথ চলার আর সংশয় নেই। কিন্তু নিঃসংশয়ে বুঝতে পারি, কোথায় যেন একটা কষ্টের কাঁটা বিঁধে রইল। চলার পথে খচ্খচ্ করে নানা ভাবে সে জানান দেবে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি, আমাকে ঘিরে যেন নানা ফুলের বর্ণবাহার, নানা গন্ধের মদিরতা। সেই সকলি একটি মেয়ের সহজ প্রকাশ। সেসব সকলিই তার কথা। তার হাসি, চোখের জল। হতাশা নৈরাশ্যের অন্ধকারে কেউ আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে যায়নি। রেখে গিয়েছে তার প্রাণের কুসুমকলি বিকশিত সমারোহে। কোথাও তার কাঁটা থাকবে, আশ্চর্য কী! তবু কেবল খচখচানি না। বিচিত্রের পরম বিস্ময়, কী অপরূপ যেন সে রেখে গেল। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু’হাত আমার বুকে এসে ঠেকে। পুলকিত প্রণাম শুধু বিচিত্রকে। না পথ চলার প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতায়ও।

দেখলাম, একটি মন যখন দ্বিধাহীন সুরে বাজে, অন্য প্রাণে তার তাল লাগে। তাই চকিতে দেখেছি, রাধার চোখের জল। লিলির হাত তুলে বিদায় জানানো। এমনকী ঝিনির অনুমতি নিয়ে অচিনদার গাড়ি ঘুরিয়ে নেওয়া। মানুষ থাকে না বেশবাসে পোশাকে। তাই মনবিচিত্রার ভরা ডালি আমার প্রাণপুটে নিয়ে চলি এবার ভিন পথে।

‘কী দ্যাখেন গ গোঁসাই?’

পাশ ফিরে দেখি বাউল-প্রকৃতি বিন্দু। ভুরু টেনে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখে আমার চোখের দিকে। বলি, ‘ওঁরা সবাই চলে গেলেন!’

বিন্দু সনিশ্বাসে, প্রায় গানের সুরে বলে, ‘সোম্সারের কী গতি গ! সামনে থাইকলে নজরে পড়ে না। দূরে যেইলে মন টাটায়।’

যে যেমন বোঝে, তেমনই ভাষে। আমার কিছু বলার নেই। সে আবার বলে, ‘যাবার সময় দেখা হল না। তা না হোক, আবার হবে, না কী বলেন বাবাজি?’

বিন্দুর তেমনই চোখের নিবিড়ে হাসির ঝিলিকখানি বাঁকা বাঁকা। লালপাড় গেরুয়া রঙের শাড়ির ঘোমটা ভেঙে পড়েছে রুক্ষু চুলের খোঁপায়। বাউল-প্রকৃতি যেন রঙ্গিণী। চণ্ডীদাসের ভনিতায়, তার ধন্দ ধরানো গানের কথা মনে পড়ে যায়। সে কুলটা হবে, তবু কুল ছাড়বে না। এর মর্ম সঠিক বুঝি না। গেরুয়ায় ঢাকা, এই নিটুট অধরা যৌবন। বৈরাগিণী কোন সাধনে সাধে, তাও জানি না। আবার বলে, ‘চলেন, যাই বাবাজি। এ-কূল গেল, ও-কূলে চলেন। সবাই সাতরানির দিঘির ধারে আছে।’

সাতরানির দিঘি আবার কোথায়? জিজ্ঞেস করবার আগেই প্রকৃতি হাত টেনে ধরে। দু-এক গ্রামবাসী একটু নজর ঘুরিয়ে দেখে। কিন্তু যার কারণে দেখা, সেই বিন্দুর কোনও খেয়াল নেই। সঙ্কোচের বালাই যা তা আমার। জিজ্ঞেস করি, ‘সাতরানির দিঘি আবার কোথায়?’

‘পচ্চিমে। বাশুলির মন্দিরের কাছ দিয়েই যাব চলেন।’

হাত টেনে, পথ ধরিয়ে দিয়ে আবার হাত ছাড়ে বিন্দু। চলতে চলতে বলে, ‘নলরাজের রাজ্যি ছিল ইখ্যানে। রাজা রানি দিঘি কেট্যাছিল, তার নাম সাতরানির দিঘি।’

জিজ্ঞেস করি, ‘সাতরানি কেন?’

‘সাত রাজার সাত রানি। সাত রাজা রাজত্ব কইরেছিল যে, তা-ই। নলরাজাদের নাম শুনেন নাই ক্যানে?’

সে তো এক পৌরাণিক রাজারই নাম জানি, নলরাজা। রানি যার দময়ন্তী। সে উপাখ্যানের সঙ্গে নানুরের কী সম্পর্ক তা জানি না, বলি, ‘মহাভারতে নলরাজার কথা পড়েছি।’

বিন্দু ঘাড় দুলিয়ে বলে, ‘তা কী জানি বাবাজি, ই নল রাজাটো সেই কিনা, জানি না। নলহাটির নাম শুইনেছেন তো?’

‘তা শুনেছি।’

অই, অই নল রাজাদের রাজ্যি ছিল। নান্নুরেও তাদের রাজ্যি ছিল। গোঁসাইবাবা সব জানে, বইলতে পারবে। রাজাদের অনেক গাড়ি ছিল ই গাঁয়ে। ‘পখুরের নাম শুনেন নাই, নলগড়ে পখুর তেলগড়ে, ফুলগড়ে, ঘিগড়ে। গড়ের নাম পখুর।’

বিন্দুর কথায়, আর এক নানুরের নাম শুনি। মনে মনে অবাকও মানি। গেরুয়াধারিণী এক বাউল-প্রকৃতি কেমন ইতিহাসের খবর দেয়। এমন বলতে পারবে না যে, দেশপরিচয়ের খবর রাখি না। কিন্তু বিন্দুকে একটু অন্যমনস্ক লাগে। পথ চলতে, গৃহস্থদের ঘরের এদিকে ওদিকে ইতিউতি চায়। উৎকর্ণ হয়ে, যেন কিছু শুনতে চায়। আমার পাশে পাশে চলে। চোখাচোখি হলে হাসে।।

একবার জিজ্ঞেস করি, ‘হাসছেন কেন?’

বিন্দু খিলখিলিয়ে হেসে মরে। শরীরে বাঁক লেগে যায়। কী এমন কথা বলেছি যে, এত হাসি! অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। বিন্দু হাসি সামলে বলে, ‘বাবাজির তনজ্ঞান নাই দেখি। “আপনি” বইলছেন কী গ?’

তা বটে। কিন্তু এক কথাতেই তুমি বলতে এ জিভের আড় ভাঙে না। ঘর পরিবেশের একটা টান আছে তো। বিন্দু নিজেই আবার বলে: ‘হাসি না, বাবাজিকে দেখি।’

আমাকে দেখার কী আছে, কে জানে। বিন্দু আবার তেমনই চোখেই চায়। আমার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে চেয়ে মুখখানি এগিয়ে নিয়ে আসে। নিচুস্বরে বলে, ‘দেখি বাবাজি পাষাণ, নাকি মাকড়া পাথর।’ সে আবার কী! পাষাণ বা কী, মাকড়া পাথর বা কী, আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? এদের সকলের সব কথাতেই হেঁয়ালি। বলি, ‘বুঝলাম না।’

বিন্দু আবার হাসে। প্রকৃতি তার শরীরের অধরা তরঙ্গে আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। বলে, ‘বাবাজির মনের কথা বইলছি। জানেন তো বাবাজি, পুন্নিমেতেও অমাবস্যা হয়। পাষাণও গলে। ঝিন্‌দিদির লেগে কি মন পুইড়ছে না একটু?’

কথা কত ধারায় বহে। ঘুরে ফিরে সেই ঝিনির প্রসঙ্গ। কথার ধরনে বুঝতে পারিনি। বলি, ‘পোড়াপুড়ির কী আছে!’

বিন্দু ঘাড় কাত করে বলে, ‘নাই বাবাজি? তবে যে একজনকে পুইড়তে দেখলাম, সিটো কি কিছু না?’

গম্ভীর হয়ে বলি, ‘সংসারে চলতে গেলে তার নিয়মে চলতে হয়।’

বিন্দুর হাসিতেও এবার গাম্ভীর্য দেখা দেয়। বলে, ‘অই গ বাবাজি, মন ছাড়া কি সোম্সার! সোম্সারখানা কি সোম্সার ছাড়া! যে সোম্সারে ঝিন্‌দিদির মতন মানুষ নাই, তা আবার কেমন সোম্সার!’

দেখি, বলতে বলতে, বিন্দুর স্বর বদলে যায়। তার নিশ্বাস পড়ে। কপালে হাত ছোঁয়ায়। কার উদ্দেশে, কে জানে। তারপরে হঠাৎ আমার একটা হাত টেনে ধরে। বলে, ‘আমার একটা কথা রাখবেন বাবাজি?’

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কী কথা।’

‘আবার যদি কুন দিন ঝিন্‌দিদির দেখা পান তাকে কাঁদাবেন না। হেনস্থা কইরবেন না।’ যাকে কাঁদাতে চাইনি, হেনস্থা করতে চাইনি, তার সম্পর্কে কী কথা দেব। তবু কথা বাড়াতে চাই না, বলি, ‘তাই হবে।’

বিন্দু বলে, ‘সোম্সারে কত রকমের পাপ আছে। আপনি ক্যানে পাপের ভাগ নিবেন। ধম্‌মে থাইকবেন বাবাজি, কথা রাইখবেন।’ বলে বিন্দু আমার হাতে একটু চাপ দেয়। বড় বড় কালো চোখ দুটো মেলে আমার চোখের দিকে চেয়ে হাসে। লাজানো হাসি না। যেন কী ইশারা দেয়, কালো মণির ঝিলিকে।

বিন্দুর সঙ্গে আমার তর্কের কিছু নেই। সে যে জগৎ থেকে কথা বলে, তার ঠিকানা আমি জানি না। তার পাপ পুণ্য ধর্মবোধের থেকে আমি থাকি অনেক দূরে। আমার চারপাশের বিধিনিষেধের বেড়া ডিঙিয়ে সেই পুণ্যের সীমায় যেতে আমার বাধা। অন্ধকারের ভয় আমাকে দূরে সরিয়ে রাখে। অন্য পথে চালায়।

বিন্দু আমার হাত ছেড়ে দেয়। তারপর এদিক ওদিক চেয়ে আপন মনেই বলে ওঠে, ‘আমার গোঁসাইয়ের গান কুথাও শুনি না।’

গোকুলের কথা বলে বিন্দু। তাই কি সে এত উৎকর্ণ, এত ইতিউতি চাওয়া! আমি তার দিকে তাকাই। সে আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘দেইখেছেন নাকি?’

বলি, ‘গোকুলদাসকে? না তো।’

বিন্দু হেসে ঘাড় দোলায়। বলে, ‘কী জানি, কুথা যেইয়ে বইসে আছে। অনেকক্ষণ দেখি না।’

বিন্দুর হাসিতে আর ঘাড় দোলানিতে সব মেটে না। কোথায় যেন চোখের বালির মতন একটু মন করকরিয়ে যায়। কোথায় যেন একটু বেসুরের ধন্দ লেগে যায়। বিন্দু কি গোকুলকে খুঁজতে বেরিয়েছে? সে মানুষটি গেল কোথায়? বিন্দুর দিক থেকে আমার চোখ সরে না। ভাবি, এতক্ষণে আপন গোঁসাইয়ের খোঁজ! পাষাণ কেবল আমি, এ প্রকৃতি-পাষাণ ঠাকরুন কী পাষাণী নয়?

বিন্দু আমার দিকে চেয়ে আবার হেসে বাজে। জিজ্ঞেস করি, ‘গোঁসাই হারিয়ে গেল নাকি?’

বিন্দু বলে, ‘হারাবার লয়। তবে গোঁসাই আমার ক্ষ্যাপা গোঁসাই ত! মন কইরল ত, একতারাখানা নিয়ে হাঁটা দিল।’

‘তা হলে কী হবে?’

‘খুইজে লিব। যাবে কুথা, আমার গোঁসাই না?’

গরবিনী ঘাড় কাত করে ভুরু টেনে হাসে। আমি ছাড়ি না, জিজ্ঞেস করি, ‘কিন্তু না বলে যাবে কেন?’ বিন্দু ঠোঁট টিপে হেসে, চোখে ঝিলিক হানে। বলে, ‘মন যাওয়ায় আবার মন ফেরায়।’

বলতে বলতে আমরা গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিমের সীমায় আসি। দিঘির ধারে না, দেখি প্রাচীন এক ছড়ানো ভগ্নস্তূপের মধ্যে গাছতলাতে গোপীদাস আর রাধা বৃদ্ধা। আমাকে দেখে গোপীদাস ডেকে ওঠে, ‘এইস বাবাজি। অচিনবাবু আর দিদিমণিরা চইলে গেছে?’

জবাব দেয় বিন্দু, ‘হিঁ গ বাবা, যেইয়ে দেখি, চিতেবাবাজি পথের দিকে চেইয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইয়েছেন।’

‘অই হে, জয় গুরু, জয় গুরু। মন বইলে না কথা!’

আমার দৃষ্টি তখন চারদিকের ধ্বংসস্তূপের দিকে। আস্ত কিছুই নেই, কালের দাগে দাগানো, বিবর্ণ ভাঙা ইটের ছড়াছড়ি। হেথা হোথা ভিতরে দাগ, প্রাসাদের চিহ্ন। কোথাও ভাঙা স্তূপ ঢেকে দূর্বা গজিয়েছে। নল রাজার প্রাসাদ। আমাকে দেখতে দেখে গোপীদাস রাজবার্তা শোনায়। তার থেকে বুঝতে পারি, নল রাজার বংশ বীরভূমে কোন এককালে রাজত্ব করেছিলেন। সময়ের হিসাব সে দিতে পারে না। কিন্তু নলহাটিতে আর সন্ধিগড়া বাজারেও রাজাদের অনেক পুরনো চিহ্ন আছে।

জানি না, কোন সে রাজবংশ। কোথা থেকে তাদের আগমন। নাম শুনে মনে হয় হিন্দু। আর এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে যেন জেগে উঠতে দেখি বিশাল রাজপ্রাসাদ, লোকলস্কর। তার হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, গড়প্রাকারে প্রহরী। সকালে সন্ধ্যায় বাদ্য সংগীত, দুন্দুভি বাজে। প্রহরে প্রহরে বাজে ঘণ্টা। পূজা, উৎসব, আলো, নৃত্যগীত। অন্তঃপুরে অবগুণ্ঠনময়ীর আয়ত চোখে হাসি, বাজে কিঙ্কিণী। সাত রাজা সাত রানি, চিহ্ন তার রেখে চলে যায়। তারপরে, আর এক উৎসবের ঘণ্টা বাজে বাশুলির মন্দিরে। নানুরের ইতিহাসে, নতুন পায়ের ধ্বনি বেজে ওঠে। কবির পায়ের ধ্বনি। মৃদঙ্গ বেজে ওঠে। রজকিনির হাতে বুঝি প্রেমজুরি বাজে, দুহুঁক স্বরে ওঠে গান, পিরিতি আখর তিন।

এখন স্মৃতি কেবল ধ্বংসস্তুপে, গ্রামের পথের ধুলায়, নিঃশব্দ নিঝুম ঝিঁঝি-ডাকা গ্রাম নানুর। পতঙ্গের নিরন্তর ডাকে, এ-কালের যাত্রী আমরা, কান পেতে শুনি এক দুর্বোধ্য বাণী। অর্থ বুঝি না, তবু যেন কী এক অর্থময় রহসেই পতঙ্গের পাখা বেজে চলে।

গোপীদাসের গলা শুনে ফিরি। দেখি, এক দিক থেকে সুজন আসে একলা। গোপীদাস জিজ্ঞেস করে, ‘কুথাও দেখতে পেইলে না?’

সুজন ঘাড় নাড়ে। গোপীদাস রাধার দিকে চেয়ে মাথা দুলিয়ে একটু হাসে। বিন্দুকে জিজ্ঞেস করে, ‘কী কইরবি গ বিটি?’

বিন্দু তার গেরুয়া রঙের ঝোলা হাতড়াতে হাতড়াতে বলে, ‘তোমরা যা কইরবে, তাই কইরব। তবে আমি বলি সে চলে গেইছে।’

‘কুথা?’

‘আখড়ায়।’

বিন্দু কথা বলে, কিন্তু কারুর দিকে চায় না। গোপীদাস আর রাধা আবার চোখাচোখি করে। এই সময়ে বিন্দু হঠাৎ সুজনের দিকে চায়। চেয়ে হাসে। বলে, ‘লাও, ঝোলাটোলা লিয়ে রওনা দিই।’

সুজন যেন একটু চিন্তিত। তবু হেসে মিনতি করে বলে, ‘বলছিলাম কি, আমি এবার ফিরি।’

গোপীদাস জিজ্ঞেস করে, ‘কুথা যাবে?’

‘বোলপুর হয়ে ঘুরে ফিরে তোমার কাছে যাব।’

বিন্দু ঘাড় কাত করে, অপাঙ্গে চেয়ে বলে, ‘ইস্! কে যেতে দিচ্ছে! তুমি যাবে আমাদিগের আখড়ায়, মনে নাই? তুমি যাবে আমার সাথে।’

সুজনের তবু দোমনা। সে কেবলই বিন্দুর চোখের দিকে চায়। বিন্দু কিন্তু হাসে। যেমন করে আগে হেসেছে, এখন তেমনি গলায় ঢেউ দিয়ে আবার বলে, ‘গোঁসাই তুমাকে নিমন্তন্ন কইরেছে। তুমি না আমাদিগের অতিথি!’

সুজনের গলায় দোতারা ঠিক ঝোলানো আছে। তারের গায়ে আঙুল দিয়ে টং টং শব্দ তোলে। বলে, ‘তা ঠিক কথা বটে। তবে গোঁসাই নিজেই চলে গেল।’

বিন্দু বলে, ‘তা যাক গা না, আমাকে ত রেইখে গেইছে। আমার সাথে যাবে।’

গোপীদাস কী বোঝে কে জানে। সে সুজনের দিকে চেয়ে বলে, ‘হঁ হঁ, বিন্দু যা বইলছে, তাই করো বাবা।’ এমন সময়ে বিন্দু ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে চায়। চেয়ে হাসে। গোপীদাসকে বলে, ‘চিতেবাবাজিকে কী বইলবে, বলো।’

গোপীদাসের যেন হঠাৎ খেয়াল হয়। তাড়াতাড়ি আমার দিকে ফিরে বলে, ‘অই অই, ভুলে যেইছি গ। শুন বাবাজি, হেথাতেই চালে ডালে ফুটিয়ে খেয়ে লিবে, নাকি অন্য কিছু খাবে? বেলা তো হল মেলা।’

আমার কোনওটাতেই আপত্তি নেই। কিন্তু কোথা থেকে কোথায়, কীভাবে যাচ্ছি, সেটা জানা দরকার। আমার গন্তব্য বক্রেশ্বর। যানবাহন কোথায় কেমন, কিছু জানি না। জানবার চেষ্টাও করিনি। গোপীদাস বলেছে, বক্রেশ্বরে পৌঁছনোর দায় তার। বলি, ‘যা সুবিধে তাই হোক। যাওয়া হবে কীভাবে, কখন গাড়ি, কিছুই তো জানি না।’

গোপীদাস বলে, ‘অই তাইতেই বলছিলাম বাবাজি, সময় বিশেষ হাতে নেই। ইখ্যান থেকে মোটরগাড়িতে যাব লাভপুর। লাভপুর থেকে কাটোয়া আদমপুরের রেল ধইরে যাব আদমপুর। তা তো ছোট রেলগাড়ি। আদমপুর থেকে বড় গাড়ি ধইরে যেতে নাগবে সাঁইথে। তুমি তো চিতেবাবাজি বুঝ সবই, পথ বড় ঘুরপাক।’

বলে একবার দাড়ি কাঁপিয়ে চোখ ঘুরায়, ‘তা’পরেতে সাঁইথে থেকে আবার গাড়ি বদল কইরে শিউড়ি যেতে হবে। সিখ্যান থেকে মোটরে কইরে বক্রেশ্বর। তা বাবাজি, ধর ধর কইরে, এখন রওনা দিয়ে, আজ রাত্রে শিউড়িতক যাওয়া যাবে।’

আমি ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘বক্রেশ্বর যাব কখন?’

‘কাল সক্কালবেলাতেই যেতে পারবে।’

‘রাত্রে থাকব কোথায়?’

যেন কত হাসির কথাই বলেছি, এমনি ভাবে সবাই হেসে ওঠে। বিন্দুর হাসিটাই সব থেকে চড়া। গোপীদাস বলে, ‘চিতেবাবাজি, তুমাকে কি চিনি না? থাকবার জাগার লেগে তুমার ভাবনা? তুমি পথেঘাটে ঘোরা মানুষ।’

বলি, ‘কিন্তু, জায়গাটা তো চেনা না।’

বিন্দু ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। সে ঝোলাটা কাঁধে ফেলে, আমার কাছে আসে। বলে, ‘গেলেই চেনা হইয়ে যাবে। কিছু না থাক, গোকুল বিন্দুর আখড়া তো আছে।’

এতক্ষণে জানা গেল, গোকুল বিন্দুর আখড়া আছে শিউড়িতে। বিন্দু আবার বলে, ‘চিতেবাবাজিরও আজ আমাদিগের আখড়ায় নিমন্তন্ন।’

বলে হাত টেনে ধরে, ‘চলেন চলেন, আর দেরি না।’

গোপীদাসও উঠে পড়ে বলে, ‘হঁ হঁ, রওনা হওয়া যাক। চলো গ রাধা।’

চলতে চলতেই রাধা জিজ্ঞেস করে, ‘আর হেরুক কবে যাবে?’

গোপীদাস বলে, ‘যাব গ যাব, চিতেবাবাজির সাথে, বক্রেশ্বর ঘুইরে এইসেই, হেরুকে যাব।’

হেরুক নামের সঙ্গে যেন বৌদ্ধজগতের গাঁটছড়া বাঁধা। হেরুক বজ্রের কথা কোন বৌদ্ধ শাখায় মেলে। তার সঙ্গে কি গ্রামের নামের কোনও যোগসূত্র আছে? জিজ্ঞেস করি, ‘হেরুক কোথায়।’

গোপীদাস জানায়, ‘আমাদিগের আখড়া বাবাজি। গদাধরপুর থেকে লেইমে যাওয়া যায়, সাঁইথে থেকেও যাওয়া যায়। শিউড়ি থেকে মটরে করেই চইলে যাব। দ্বারকা লদীর নাম শুইনেছ বাবাজি?’

শুনেছি বলে মনে হয়, কিন্তু স্মরণ করতে পারি না। এক দ্বারকার কথাই জানি, মথুরা বৃন্দাবনের সঙ্গে যার চিন পরিচয়। নদীর কথা মনে নেই, অকপটেই বলি, ‘না।’

‘অই গ বাবাজি, তুমি ক্যানে জাইনবা না। বড় লদী, বাঁকুড়াতক চইলে গেইছে। দ্বারকার ধারে হেরুক।’

দ্বারকার ধারে হেরুক। কানে বাজে যেন, কত দূর কালের এক ভূগোল পরিচয়ের মতো। চুপ করে থাকি। মনে মনে ভাবি, কতটুকু জানি এই বঙ্গদেশ। রঙ্গ করতেই আধখানায় ওপরে পাঁচিল গিয়েছে। বাকিটুকুর সীমায় জলস্থলের কত বৈচিত্র্য, কত বিচিত্র মানুষ, এই পথ চলাতে তার কতটুকু মেলে! বাঁধানো সড়ক ভেঙে চলে যাই। পরশপাথরের মতো, ক্ষ্যাপার সকল খোঁজা কোথায় হয়তো পড়ে থাকবে, জানতেও পারি না। কত দ্বারকার তীরে কতই হেরুক। কত না জানি কালের চিহ্ন নিয়ে, কোন এক বনস্থলীর টলটলে জলাশয়ে আপনার প্রতিবিম্ব দেখে। কিছুই জানতে পারি না।

তবু মানুষ নিশ্চল না, চলে নিরন্তরে, পথে জনপদে। দ্বারকা তীরের, হেরুকের মানুষের সঙ্গে চলি। এই যে তার সঙ্গ পাই, গান কথা শুনি, এই আমার হেরুক পরিচয়। আমার এই দেখাতেই, সব দেখা। মানুষের মাঝেই, দেশকালের পরিচয়।

বিন্দু তখনও আমার পাশে পাশেই। তার পিছে পিছে সুজন। দোতারার তারে তার অন্যমনস্ক টং টং চলেছে।

বিন্দু জিজ্ঞেস করে, ‘হেরুক যাবেন নাকি বাবাজি?’

বলি, ‘যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এ যাত্রায় হবে না।’

গ্রামের বাইরে এসে পথের মোড়ে চিঁড়ে মুড়কির বিপণি। গোপীদাস সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই, তার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। বলি, ‘ওটি হবে না। কতখানি কী কিনতে হবে বলুন, নিয়ে নিচ্ছি।’

‘অই অই, চিতেবাবাজির কথা শুন গ তোরা। তা বেশ লাও, কিন্তু ক্যানে বাবাজি, যাবৎ খরচ তুমি ক্যানে কইরবে?’

বলি, ‘সেই যে বললেন, তত্ত্ব বোঝাবেন। না-হয় গুরুসেবাই করি।’

ঠাট্টা করে বলে কি না জানি না। গোপীদাস সহসা ধুলা আলখাল্লাসহ জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে, ‘জয়গুরু, জয়গুরু, এমন কথা বইল না গ চিতেবাবাজি, কেঁদে মইরে যাব।’

বলতে বলতেই দেখি, তার চোখ রক্তাভ, জল উপচে পড়ে। হঠাৎ কথা বলতে পারি না। গোপীদাসের আলিঙ্গনে চুপ করে থাকি। ধর্মাধর্মের আবেগ বুঝি না। কিন্তু, কেমন এক প্রেম-স্নেহের ধারায় যেন, আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সুখে দুঃখে মেশানো এক বোধে, নিশ্চল হয়ে থাকি। নিজেকে নিজে মনে মনে বলি, ‘যদি কিছু ঠাট্টা করে বলে থাকি, তবে অপরাধ, বড় অপরাধ।’

গোপীদাস নিজেকে নিজেই সামলায়। বলে, ‘লাও বাবাজি, লাও। চিঁড়ে মুড়কি মিশুয়ে, বাতাসার টাকনা দিয়ে, যেতে যেতে খাওয়া যাবে।’

দোকানিকে সে নিজেই পরিমাণ বলে দেয়। মাপজোক শেষ হতে না-হতেই মোটর বাস এসে পড়ে। হাত তুলে চেঁচিয়ে যন্ত্র-ঘোড়াকে থামিয়ে রাখতে হয়। গাড়িতে জায়গা পাবে, সে আশা কম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে যেতে হয়। তারপরে, যার যেখানে জায়গা মেলে, সে সেখানেই বসে। বিন্দু আর সুজন পাশাপাশি জায়গা পায়। সেখান থেকে উঠে বিন্দু আমার জামার কোঁচড়ে চিঁড়ে মুড়কি দিয়ে যায়। চোখাচোখি হলে হাসে। একটু দূরে হলেও বুঝতে পারি, সুজনের কানের কাছে সে কী যেন সুর দিয়ে গুন গুন করে। সুজন বাউল পাগড়ি ঝুঁকিয়ে নিষ্পলক চেয়ে থাকে।

তবু, যদি ঠিক দেখে থাকি, বিন্দুর হাসির ঝিলিকে, কোথায় যেন মেঘ থমথম ছায়া। ঠোঁটের কোণের চকিত চমকে, থেকে থেকে যেন কেমন এক বিষাদ আড়ষ্টতা।

লাভপুরে পৌঁছেও, সময় বিশেষ হাতে থাকে না। ছুটোছুটি করেই টিকেট কাটতে হয়। তখন বেলা শেষে, বাতি জ্বলে উঠেছে। কয়লার ধোঁয়া উড়িয়ে, ছোট গাড়িটি যখন এসে দাঁড়ায়, তখন একটু সৌভাগ্য, গাড়ি ভরাভরতি ঠাসাঠাসি কলরবে জমজমাট না।

গাড়ির কামরায় বাতি নেই বললে চলে। এক কোণে একটি বাতি টিমটিম করে। তাতে অসুবিধা নেই। পাশাপাশি জায়গা মেলে। কিন্তু বিন্দুর কোনও কথা শুনি না। অথচ সে আমার পাশে বসে। আলস্যে হেলানো শরীর, মুখ কাত করে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। মাথায় ঘোমটা নেই। রুক্ষু খোঁপাটা আধ-ভাঙা বিস্রস্ত। তার মুখের এক পাশে টিমটিমে আলো। অস্পষ্ট মুখের কিছুই দেখতে পাই না। কেবল মনে হয়, ভিতর বাহিরের অন্ধকারে সে যেন নিজেকে মিশিয়ে রেখেছে।

চুপ করে থাকতে পারি না। গাড়ির শব্দের সুযোগ নিয়ে, তার কানের কাছে জিজ্ঞেস করি, ‘গোঁসাইয়ের জন্য মন কেমন করছে?’

বিন্দু চমকে তাকায়। চকিত হেসে, তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে দেয়। সেও গাড়ির শব্দে গলা ডুবিয়ে বলে, ‘মানুষ তো বাবাজি!’

কথাটা যেন ঠিক বুঝতে পারি না, তাই চেয়ে থাকি। বিন্দু আবার বলে, ‘মন কেমন না করলে কি তত্ত্ব সাধা যায়! মানুষের সব কিছুই থাকে। মন বড় অধৈর্য হয়েছে আমার।’

বলে, আবার তেমনই করেই, ঘাড় কাত করে পেতে দেয় জানালায়। আমি যেন আর সেই গেরুয়াধারিণী বাউল-প্রকৃতিটিকে চিনতে পারি না। আমি দেখি, বিরহ বিবশ রাই, দহনে না যায়। সব মিলিয়ে, এ যেন এক গৃহস্থ প্রেমিকা বধূ। ঘোমটা টেনে দেয়, নিশ্বাসে ভারী হয়ে থাকে।

আমদপুর থেকে সাঁইথিয়াতে গাড়ি বদলে যখন শিউড়িতে নামি, তখন এই শহরটি নিঝুম।

শীতের রাত্রি, যাত্রী অল্প। তবু তিন চাকার রিকশাওয়ালারা যাত্রী খুঁজতে আসে। গোপীদাস ডাক দিয়ে নিয়ে যায়, শহরের উলটোদিকে, রেল লাইনের অন্য পারে। রিকশায় উঠতে হয় না, সবাই হেঁটে যায়। সকলের আগে এবার বিন্দু। আমার মনে পড়ে যায়, বিন্দুর বিশ্বাস, গোকুলদাস আখড়াতেই ফিরে এসেছে।

এসেছে তো? এই ব্যাকুল উৎকণ্ঠা আমার। বিন্দুর মনে কী ঘটছে কে জানে। আমাদের সকলের পিছনে সুজন।

খানিক দূর এসেই, গুটিকয় গাছ। দুই চারি নিঝুম কুটির, কোথাও সাড়াশব্দ, বাতি নেই। তারই পাশ দিয়ে গিয়ে মাটির দেওয়ালের সীমানা। দরজা খোলা, উঠোন অন্ধকার। কোথাও আলো নেই।

বিন্দু আগে গিয়ে ঢোকে। দূর থেকেও বুঝতে পারি, সে উঠোনের মাঝখানে থমকে দাঁড়ায়। তার গলায় একবার উচ্চারিত হয়, ‘নিতাই আছ?’

একটু পরেই, খুট করে কোথায় যেন শব্দ পাই। একটা বাতি এগিয়ে আসে উঠোনে। তারপরেই দেখি, বাতি হাতে স্বয়ং গোকুলদাস। সে একবার বিন্দুর দিকে তাকায়। তাড়াতাড়ি বাতিটা এক পাশে রেখে, হঠাৎ একেবারে বিন্দুর পায়ের কাছে নিচু হয়ে বসে।

গোপীদাস বলে ওঠে, ‘জয়গুরু, জয়গুরু।’

ততক্ষণে বিন্দুও নত হয়ে, মাটিতে বসে, গোকুলের পায়ে হাত রাখে। কাছে যেতে যেতে দেখি দুজনের চোখেই জল। আমাদের সাড়া পেয়েই, গোকুল চোখ তোলে। কাকে যেন খোঁজে। তাড়াতাড়ি উঠে সুজনের কাছে ছুটে যায়। বিন্দুর মতো, তারও পায়ে হাত দেয়। সুজন গোকুলকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে।

গোপীদাস ভাঙা ভাঙা গলায় আবার বাজে, ‘জয়গুরু, জয়গুরু!’

আমি কী দেখি, কী বুঝি, কিছুই জানি না। আমি কোন কালের সীমানায়, কোন মানুষদের কাছে দাঁড়িয়ে, বুঝতে পারি না। কেবল আমার বুকের কাছে যেন কী এক প্রস্রবণের উথালি-পাথালি। বুকের কাছে হাত রেখে, নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার কানে বাজতে থাকে শুধু, হাসি-কান্নার এক অস্পষ্ট, শ্বাস-প্রশ্বাসের আবেগমন্থিত ধ্বনি।

.

৬৪.

বাউল বলো বৈষ্ণব বলো, সকলই মানব-মানবী লীলা। এই আলো-আঁধারি উঠোনে সকলের ছায়ায় হারিয়ে আমি একলা একলা তা-ই দেখি। থাকি নির্বাক স্তব্ধ, কিন্তু আমার ভিতরেও হাসিকান্নার দোলা লেগে যায়। তার সঙ্গে পরম বিস্ময়ে এক ভুলভঞ্জনের, অপরাধভঞ্জনের, মানুষলীলার অরূপসায়রে যেন ডুবে যায়। সেই যে আমার মনে একসময়ে প্রশ্ন জেগেছিল, সুজন বিন্দুর বংবিচ্ছুরিত হাসাহাসি চোখাচোখি দেখে সেই কথা মনে পড়ে যায়। ভেবেছিলাম, গোকুল বিন্দু না-ই বা হল ঘর-করণের স্বামী-স্ত্রী। সাধন সাধবার পুরুষ-প্রকৃতি তো। গোকুলের প্রাণে কোথাও কি আঁধার ঘনায় না! মনের কোথাও কি যাতনা বেঁধে না!

এখন চোখ ভরে দেখ, শ্রবণ ভরে শোনো, সেই জবাবের ছবি ও কথন। গায়েতে আলখাল্লা, মাথায় চূড়ো করে বাঁধা চুলে পাগড়ি, হাতেতে একতারা, এই মানুষেও সেই মানুষেরই খেলা। এই মানুষেও সেই মানুষেরই ব্যথা বেজেছে। সেই ‘হারাই হারাই সদা ভয় হয়, হারাইয়া ফিরি চকিতে।’…ব্যথার উদাস প্রাণের বল্গায় ঢিল পড়ে যায়। এই মানুষকেও হারাবার হাহাকার সঙ্গছাড়া করে, নিঃসঙ্গের কান্নায় নিয়ে যায়। ভেক দাও, ভেলকি দাও, মানুষ সে-ই মানুষ। সেই তার সব থেকে বড় চেনাচিনি।

আমার চোখ যদি ভিজে থাকে, তার চেয়ে খুশি বাজে বেশি। পরম বিস্ময়ে আমার নমস্কারে নতি অন্য কারণে। সে কারণ শুধু মানুষ পরিচয়ের সুখে নয়। মানবমহত্ত্বের বিস্ময়ে। ভাবি, প্রাণধর্মের এত সাহস, এমন সহজ মন কোথা থেকে পেয়েছে গোকুল বিন্দুরা। ঈর্ষা যেখানে ব্যথা হয়ে বাজে, বাধা যেখানে হীনমন্যতার অন্ধকারে বাঁধা পড়ে না, নিঃসঙ্গ মানুষটিকে একলা ছুটিয়ে দেয়, যেন ত্যাগেতেই প্রেম জাগায়। একবারও তো ওদের মুখে অন্ধকারের কালি দেখিনি। কথার ঘৃণায় অপমান করতে দেখিনি। বিতৃষ্ণায় বিরাগে রাগে একবারও তো হাসাহাসি দেখিনি। অথচ প্রাণের এক জায়গায় বিঁধেছিল ঠিক। সেই তিরবেঁধা পাখি একবারও কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে ওঠেনি। কখন নিঃশব্দে বুকের পালকে রক্ত . চাপা দিয়ে চলে এসেছিল আপন ঝোপের কোটরে।

কিন্তু পক্ষিণীর প্রাণে বেজেছিল ঠিক। তাই দেখেছিলাম, তার বিজলি চোখের ওপারে মেঘের ছায়া। তার হাসির তরঙ্গে উদাসিনীর বিষাদ। শুধু ‘সে জানত, তাই বলেছিল, সে আখড়ায় চলে গেছে।’

তারপরে দেখ, প্রাণের সাহস কত! কী সহজ আবেগে বাজে। আপন ভুল-ভঞ্জনের দায়ে মনের কলুষ যত, সকলই প্রকৃতির পায়ে ঢেলে দেয়। সুজনকে বুকে আগলে ধরে। কথা কিছু বলে না, ঘন নিশ্বাসে আর হাসি-কান্নায় বাজে। আমি যেন শুনতে পাই, ‘আমার প্রাণের অন্ধকার ঘুচাও, ক্ষমা করো। আমি অতি হীন। তোমাদের পায়ে রাখো। আমার দীনতা ঘুচাও।’…

কিন্তু অন্ধকার, দীনতা, হীনতা গোকুলের একলার নয়। বিন্দু আর সুজনও যেন সেই সুরেই বাজে। ব্যথা দিয়েছে তাই ব্যথা বাজে। তাদেরও যেন সেই কথা, ‘ক্ষমা করো, ক্ষমা করো।’…

আমি তা-ই দেখি। আমি ভুল-ভঞ্জনের সহজ লীলা দেখি। আমি এসে দাঁড়িয়েছি যেন এক অপরাধভঞ্জনের পাটে। এখন গোকুলের এক হাতের আলিঙ্গনে বিন্দু। আর হাতে সুজন। গোপীদাসের ঘড়ঘড়ে গলায় খুশির গোঙানি। তার সঙ্গে এক কথা, ‘জয় গুরু, জয় গুরু!’

আমি বলি, ‘জয় মানুষ, জয় মানুষ!’ দেখ দেখি কোথা থেকে কোথায় এলাম। সেখানে এসে কী দেখি! কী অপরূপ! আমি যেন, এমনি করে চলতে পারি, এমনি করে দেখতে পাই, আর পাওনা নিয়ে চলে যাই। পথ চলাতে এই আমার পরম পাওয়া যেন। আমি তীর্থ অতীর্থ জানি না। মন্ত্রতন্ত্র সাধনপূজন সন্ন্যাস-বৈরাগ্য, কিছু আমার নেই। কীসের সন্ধানে ফিরি তাও জানি না। তবু যেন সব ভরে ওঠে।

উঠোনের অন্ধকার থেকে আরও দু’জনের আবির্ভাব হয়। দেখি, বয়স্ক এক কালো পুরুষ। শক্ত সমর্থ বটে, গায়ে একখানি মোটা জোড়াতালি কাপড় জড়ানো। চুল দাড়ি উসকোখুসকো। আর একজন এসে দাঁড়ায়। বছর তেরো চোদ্দোর মেয়ে, সেইরকম আমার অনুমান। এমনি একটা সাধারণ শাড়িতে জড়ানো শ্যামাঙ্গিনী বালা। ডাগর চোখের বিস্ময়ে এখনও ঘুম জড়ানো। কিশোরীর মাথার সিঁদুর আছে কিনা ঠাহর করতে পারি না। তবে শীতে যে সে কাতর, বোঝা যায়, শাড়ির আঁচল দিয়ে নাক অবধি ঢাকা দেওয়া দেখে।

গোপীদাসের বুঝি আচমকা ধ্যান ভাঙে। তাড়াতাড়ি এ পাশে ও পাশে চেয়ে পিছন ফিরে আমার কাঁধে হাত রাখে। বলে, ‘তা-ই বলি, বাবাজি কুথা গেল।’

বলে তার আলখাল্লা-জড়ানো বুকের একটু কাছে টেনে নেয়। ছোটখাটো মানুষটি তো না। দশাসই গোপীদাস আমার থেকে লম্বা। এমন আজানুলম্বিত বাহু, এমন খাড়া নাক, টানা চোখের ফাঁদ ক’জনের থাকে! মুখ নিচু করে সে আমার মুখের দিকে চায়। চোখের দিকে চায়। তারপরে ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে নিঃশব্দে হাসে। বলে, ‘বাবাজি, ই দ্যাখ, দেইখছ তো, সাধন কেবল তত্ত্বে হয় না।’

তারপরেই সুর করে গায়,

‘অনুরাগ না থাইকলে কি সাধন সাধা যায়?

অনুরাগেই পিরিত মন্থর,

রাগের কারণ হয়।’…

গেয়ে আবার বলে, ‘দুঃখে বাড়ে অনুরাগ। অনুরাগে প্রেম। তবে সহজ ভজন বুইঝলে ত বাবাজি।’

সাধন ভজন জানি না। জানি শুধু বেশেবাসে, সম্প্রদায়ে, মন্ত্রে তন্ত্র মানুষের চিন পরিচয় না। মানুষের পরিচয় নিতান্ত মনুষ্যত্বে। সেইখানেতেই যত আবিষ্কারের বিস্ময়, রং ছড়াছড়ি। আমি সুখে বিস্ময়ে তা-ই দেখি। তত্ত্বের মূল দেখি।

ইতিমধ্যে বিন্দু যেন ত্রস্ত চকিতে বেজে ওঠে, ‘আই গ গোঁসাই, চিতেবাবাজিও যে আজ আমাদিগের অতিথি। ওঁয়াকে যে আমি ডেইকে লিয়ে এসেছি।’

বলতে বলতে গোকুলের আলিঙ্গন ছাড়িয়ে সে আমার কাছে আসে৷ তার আগে গোকুল ছুটে এসে আমার হাত ধরে। বলে, ‘ই দ্যাখ ক্যানে, বইলতে লাগে, চিতেবাবাজি এসেছে। আসেন বাবাজি, আসেন, কী ভাগ্যি গ বিন্দু আমাদিগের।’

শহর-নগরের হিসাব খতানো মানুষ আমি। তবু আমারও যেন ইচ্ছা করে, গোকুলকে একটু বুকে জড়িয়ে ধরি। পারি না, লজ্জা করে। এই মানুষদের এত আবেগ সহজ ধারায় কেমন করে বহে তাও জানি না। বরং নিজের মনের হিসাব কষি। রাত্রিবেলা এক বাউল যদি আমার অতিথি হত, তাকে কি এমনি করে ডেকে নিতে পারতাম? এমন করে কি সৌভাগ্য মানতাম?

বিন্দু আবার বলে, ‘বাবাজির যে কী চিন্তে। বলে কিনা, রাতে থাকা জুইটবে কুথা।’

অমনি সবাই হেসে ওঠে। গোকুল এখন আর সেই চুপচাপ কম কথার গোকুল না। বলে, ‘তা বটে। বাবাজি আমাদিগের চিতে যে! বন-জঙ্গলের হালচাল কেমন, জাইনতে হবে তো।’

আবার সবাই হেসে বাজে। গোকুল আবার আমাকে ডেকে গোপীদাস আর রাধা বৃদ্ধাকে ডাকে, ‘আসেন, বাবা গোঁসাই আসেন। মা আসেন গ। চলো চলো সোজন গোঁসাই, ঘরেতে চলো, আর ঠান্ডায় থাকে না।’

বিন্দু ততক্ষণে সেই কিশোরীর কাছে। তার গালে গলায় হাত দেয়। কাপড় সরিয়ে গায়ের তাপ দেখতে দেখতে বলে, ‘অই লো কুস্‌মি, খোলামেলা ঠান্ডাতে এইসে দাঁড়ালি, জ্বর নাই তো?’

গোকুল জবাব দেয়, ‘না, আমি দেইখেছি, জ্বর নাই তবে ঠান্ডায় আর থাকিস না গ, ঘরে যা, ঘরে যা।’

কুস্‌মি নিশ্চয় কুসুম। গোপীদাস তাড়াতাড়ি কুসুমের চিবুক ধরে, কলি মুখখানি তুলে পুছ করে, ‘লাতিনের আমার আর রাগ বিরাগ নাই তো?’

কুসুম অমনি মুখখানি সরিয়ে নিয়ে বলে, ‘লিয়ে তো যাও নাই, এখন আর জিগেঁস করা ক্যানে?’

কটাক্ষে তার কোপ। মুখখানি অমনি ভার। গোপীদাস চোখ গোল করে বলে, ‘উই উই, উ র‍্যা বাব্বারে বাব্বা, এখনও গোসা যায় নাই।’

বিন্দু বলে, ‘গোসা ক্যানে করিস কুস্‌মি। জ্বর শরীলে বিদেশ বিভুঁয়ে লিয়ে যাব, তা’পরে একটা ভারী ব্যামো-স্যামো হইয়ে গেলে কী হত বল দিকিনি।’

কুসুমের কোপকটাক্ষ একটু সরল হয়। সকলের দিকে একবার তাকাতে গিয়ে হঠাৎ অচেনা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা লোকটার দিকে নজর পড়ে যায়। চোখাচোখি হতেই, আহ্ কী লজ্জা! অমনি মুখ নত।

তাই দেখেই বিন্দু চোখে ঝিলিক দিয়ে বলে, ‘তা’ পরেতে এই দ্যাখ ক্যানে, কী সোন্দর একটা চিতেবাবাজি ধরে লিয়ে এসেছি। চেইয়ে দ্যাখ একবার।’

বলছে যখন দেখতেই হয়। একেবারে ডাগর চোখ দুটি তুলে কুসুম আমার দিকে চায়। বিন্দু আবার জিজ্ঞেস করে, ‘ভাল না?’

কুসুম সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। অমনি হাসির রোল পড়ে যায়। আমিও না হেসে পারি না। বেচারি।

বেচারি? ওই শোনো, অমনি হাসির মুখে বেজে ওঠে, ‘আহা, হাসবার কী আছে, সত্যি তো ভাল।’

বিন্দু অমনি চোখ ঘুরিয়ে হাসে, বলে, ‘উ বাব্বা! আচ্ছা লো আচ্ছা, বাবাকে গুরু করে তোদের দুজনাকে দীক্ষা দেওয়া হবে, রাজি আছিস তো?’

ভেবেছিলাম, এবার বুঝি কুসুম লাজে লাজিয়ে যাবে। সে আশা করো না। ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, ‘খালি মিছা কথা।’

বলে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। আর বিন্দু বলে, ‘আচ্ছা, মিছা না সাচা, পরে দেখিস। এখন বাবাজিদের খাওয়ার ফিকির দ্যাখ।’

বলে বিন্দু আমার দিকে চেয়ে হাসে। সবাই মিলেই হাসে। আমি ভাবি, তেরো চোদ্দো না, তার চেয়েও কম। এ কুসুম-কলি এখনও কলির রূপ পেয়েছে মাত্র। এখনও লজ্জা পেতে শেখেনি, নিতান্ত শিশু। শরীরের আড়ায় একটু লম্বা, তায় শাড়ি জড়ানো। তাতেই একটু ধন্দ লাগে। জিজ্ঞেস করি, ‘ও কে?’

বিন্দু বলে, ‘আমার ননদ।’

গোপীদাস বলে, ‘আমি বলি, আমার সতীন।’

আবার হেসে চোখ ঘুরিয়ে বলে, ‘গোকুলের বোন বটে, আমি বলি লাতিন।’

শুনি, আর মনে হয় আখড়া কোথায়। আমি তো যেন কোনও গৃহস্থের আঙিনায় ননদ-ভাজের কথা শুনি। দাদা-নাতনির বাক্যালাপ শুনি। হেথায় আখড়া গেরুয়া আলখাল্লা, একতারার সংসার-বৈরাগ্যের আসর কোথায়।

বিন্দু ততক্ষণে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘অই অ লিতাই, আর দাঁড়িয়ো না। চলো চলো, তাড়াতাড়ি যাই। তুমি যেইয়ে চুলায় কাঠ ধরাও। আমি দেখি, চাল ডাল কুথা কী আছে।’

সে যেদিকে যায়, গোকুল হাত ধরে সেদিকেই নিয়ে যায় আমাকে। নিতাই আসে সঙ্গে হ্যারিকেন নিয়ে। খড়ের চালের ঘর। ঘরের সামনে দাওয়া। দাওয়াও খড়ের চাল দিয়ে ঢাকা। মাথা নিচু করে উঠতে হয়। তারপরে ঘরের দরজা। খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পাই, কুসুম আর একখানি হ্যারিকেন ইতিমধ্যে জ্বালিয়েছে। দাওয়ার এক পাশে তক্তপোশের মতো কী একটা রয়েছে। তাতে মাদুর কাঁথা ছড়ানো। গোপীদাসকে সেদিকে যেতে দেখে আমিও ফিরতে যাই। গোকুল বলে, ‘ঘরে চলেন বাবাজি, দাওয়ায় শীত কইরবে। বাবা গোঁসাই ঘরে আসেন। সোজন এইস।’

ঘরের দরজার পাশে বিন্দু এসে দাঁড়ায়। যেন অভ্যর্থনা করছে। বাইরে শীত করছিল সত্যি। ঘরের ভিতরে বেশ গরম। আসবাবপত্র তেমন কিছু চোখে পড়ে না। এক পাশে কিছু বাসনপত্র। তার মধ্যে কাঁসা পিতল অ্যালুমিনিয়াম কলাই মাটির পাত্রও আছে। এক পাশের মাটির দেওয়ালে দড়িতে ঝোলানো গেরুয়া জামাকাপড়। লালপাড় শাড়িই একটি বিশেষ করে চোখে পড়ে। সঙ্গে ভাঁজ করা কাঁথাও আছে। এক পাশে কাঠের একখানি বাক্স। ঘরের বেশ খানিকটা জুড়ে মাদুর আর শতরঞ্জির ওপরে গেরুয়ায় ছাপানো চাদর পাতা। মোটা মোটা কাঁথা ভাঁজ করা রয়েছে। গুটিকয় ময়লা ময়লা বালিশ। সব মিলিয়ে কোথাও ধূলি-মলিন মনে হয় না। সযত্ন হাতের ছোঁয়ায় যেন বেশ পরিপাটি পরিচ্ছন্ন।

গোকুল আমাকে সেই বিছানায় বসতে বলে, ‘বসেন ইখ্যানে। বাবা মা বসেন। সোজন বইস।’

সবাই মিলে বসি, কেবল রাধা বৃদ্ধা ছাড়া। সে তার কাঁধের ঝোলাটা আগে রাখে কাঠের বাক্সের ওপরে। আর বিন্দু এসে আমার কাঁধের ঝোলা ধরে টান দেয়। বলে, ‘দেন, কাঁধের বোঝা লামিয়ে বসেন বাবাজি।’

ঝোলাটা নিয়ে সে দেয়ালের গায়ে পেরেকে ঝুলিয়ে দেয়। আবার বিছানার কাছে এসে একটা কাঁথার পাট ভেঙে আমার কোলে বিছিয়ে দেয়। আমি সঙ্কুচিত হয়ে তাড়াতাড়ি বলি, ‘আহা, থাক না, আমি নিচ্ছি।’

বিন্দু বলে, ‘আমিই দেই ক্যানে বাবাজি। কত কষ্ট দিয়ে লিয়ে এইসেছি।’

আর একখানি কাঁথা খুলে পাশাপাশি গোপীদাস আর সুজনের কোলে ছড়িয়ে দেয়। গোপীদাস আরামের শব্দ করে। বিন্দু সুজনকে বলে, ‘একটুক গরম হইয়ে লাও।’

গোকুল তাড়াতাড়ি বলে, ‘তবে দেখ গোঁসাই, ওম্ পেইয়ে মুরগির মতন ডিম পাড়তে লেইগ না, তা হলে আর তুইলতে লারব।’

সবাই হাসে। ডিম পাড়ার রহস্য কী, বুঝি না। বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়ার কথা বলে। সুজনও পিছোয় না। বলে, ‘বসে থাকব বটে। তুমি কোথায় যাচ্ছ।’

‘যাই, বিন্দুর সাথে একটুক আয়োজন দেখি গা।’

‘তুমি একলা দেখবে কেন৷ আমিও দেখব।’

বিন্দু গোকুল দু’জনেই হাসে। গোকুল বলে, ‘তবে এইস।’

গোপীদাস তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘তবে বাবা সোজন, তুমিও আয়োজন কইরবা তো, ছেঁদোয় একবার ঠিকরে গোঁজা দাও।’

বলেই কাঁধ থেকে নিজের ছোট ঝোলাটি নামিয়ে তার থেকে হাতড়ে বের করে ন্যাকড়া জড়ানো কলকে। তার সঙ্গে ছোট একটি পুরিয়া। অর্থাৎ গাঁজা সাজতে বলছে। শুধু গাঁজা তো না, আয় ভাই, প্রেমের গাঁজা খাবি কে। ছেঁদোয় ঠিকরে মানে, কলকেতে ঠিকরে দেওয়া।

গোকুল বলে, ‘বাবা, গোঁসাই রাখেন ক্যানে, আমার কাছে তো জিনিস আছে।’

‘তা থাক বাবা, পরে তো আবার লাইগবে। এখন উতেই হোক।’

সুজন কলকে আর পুরিয়া নিয়ে গোকুলের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। বিন্দু ডেকে বলে, ‘অ কুস্‌মি, কুলোখান লিয়ে আয় ভাই।’

কুসুম তাড়াতাড়ি ঘরের এক কোণ থেকে একখানি কুলো বের করে নিয়ে আসে। বিন্দু ততক্ষণে সরা ঢাকা এক এক হাঁড়ির মুখ খোলে। বড় একটা হাঁড়ি থেকে কুনকে দিয়ে চাল তোলে। আর বাকি হাঁড়িগুলো থেকে হাতের মুঠোয় মুঠোয় ডাল তোলে। কুলোয় কুসুম আর রাধা বৃদ্ধা হাত দিয়ে ছড়িয়ে দেয়। ধান কাঁকর বাছতে আরম্ভ করে। কুসুম বলে ওঠে, ‘অই গ আই মা, কী কইরছ গ? ডাল ফেলে দিচ্ছ য্যা।’

রাধা বৃদ্ধা বিব্রত হয়ে ভুরু কোঁচকায়। তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে বলে, ‘তাই নিকি?’

‘হঁ গ!’

চোখের বাতিতে আর কতকাল তেল থাকে বল। এদিকে তেল বাড়ন্ত, ওদিকে নজর নিবু-নিবু। বয়স কত কে জানে। দেখে মনে হয়, গোপীদাসের চেয়েও জরা তাকে বেশি ধরেছে।

গোপীদাস বলে ওঠে, ‘আর কি রাতে চাল ডাল বাছার লজর আছে তুমার?’

‘তুমার আছে তো?’

বৃদ্ধা প্রকৃতি একটু যেন ফোঁস করে। গোপীদাস আমার দিকে চেয়ে একটু চোখ মটকে হাসে। বলে, ‘আমি তো জম্‌মোকানা।’

এই বাউল যে বিটলে বুড়ো, তা জানা ছিল। কিন্তু বৃদ্ধা প্রকৃতিটির পিছনে লাগার রস যে এখনও আছে, তা জানতাম না।

রাধা জবাব দেয়, ‘সি তো আমিও বটে, জম্‌মোকানা।’

‘না, না, জম্‌মোকানা ক্যানে। গোটা জেবন ধইরে চাল ডাল বাইছলে। এখন তুমি রাতকানা হইয়েছ। রাতে আর লজর খেলে না।’

অই বাপ্, বৃদ্ধার কোপ দেখ একবার। ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে বলে, ‘ক্যানে, রাতকানা হবো ক্যানে। একটা তো ডাল ফেইলেছি। আমি কি ধান কাঁকর বাইছতে লারছি? একবার দেইখে যাও ক্যানে।’

বিন্দুর সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়। কৌটোবাটা থেকে কী যেন সে বের করে। হলুদ লঙ্কা বের করে বোধ হয়। পরমুহূর্তেই মুখখানি গম্ভীর করে বলে, ‘চুপ করো ক্যানে বাবা।’

‘আচ্ছা গ আচ্ছা, জয়গুরু।’

ওদিকে ততক্ষণে রাধা কুলোসুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়েছে। কুসুমকে বলে, ‘চলো গ লাতিন, আমরা চুলোর ধারে যেইয়ে বসি। আগুনও পাওয়া যাবে, বাতিও পাওয়া যাবে।’

বলে নিজেই আগে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বিন্দু পিছন থেকে বলে, ‘আধারে যাইচ্ছ, পড়ে যাবে যে। ও লিতাই, বাতি লিয়ে কুথা গেইলে, মাকে দেখাও।’

শেষের দিকে তার গলা ওঠে। বাইরে কোথাও থেকে নিতাইয়ের জবাব আসে, ‘এই যে দেখাই। আমি কিন্তুক কাঠ জ্বেলে হাঁড়িতে জল বসিয়ে দিইছি গ।’

বিন্দুও গলা তুলে বলে, ‘বেশ কইরেছ।’

তারপরে গোপীদাসের দিকে চেয়ে কপট কোপে ভুরু কুঁচকে বলে, ‘বাবা গোঁসাই খালি মায়ের পেছুতে লাগে।’

গোপীদাস গলা নিচু করে প্রায় চুপিচুপি স্বরে বলে, ‘লজর যে ওঁয়ার এখন খাটো হয়্যা যেইছে, সিটো বইলতে গেলেই রাগ। তা হলে যাকগা, তোরই চালডালগুলান বেবাক লষ্ট হবে, আর ধান কাঁকরগুলান পইড়ে থাইকবে।’

ভুরু কোঁচকাতে গিয়ে বিন্দু হেসে ফেলে। কুসুমকে বলে, ‘এগুলান লে ভাই, লিয়ে চল তাড়াতাড়ি যাই। পেটে কারুর কিচ্ছু নাই।’

কুসুম আঁচল পেতে ধরে। বিন্দু তার আঁচল কোঁচড়ে মুঠো করে রাখা হলুদ-লঙ্কা দেয়। কিছু তেজপাতা, চুপড়ি ঘেঁটে গুটিকয় আলু বেগুন, মায় পালং শাকের গোছাও ঢেলে দেয়। তারপরে দু’জনে যখন বেরুতে যায়, তখন কুসুম গোপীদাসের দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে চেয়ে বলে, ‘আইমার নামেতে যা বইললে, সব যেইয়ে লাগাল্‌ছি আমি।’

অমনি বুড়োর কপট আঁতকানি দেখ। বলে, ‘ইস্‌ ইস্‌, অই গ কুস্‌মি ডেকরি চামুণ্ডি।’

কুসুম থমকে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আবার গালি পাইড়ছ। বলি যেইয়ে।’

বিন্দু হাসতে থাকে। আমিও সামলাতে পারি না। একেই লোকেরা বিচ্ছু বলে কিনা, কে জানে। আমার যেন সেইরকম লাগে। তবে, যেমন দেবতা, তার তেমনি পুজো। বিটলে বাউল একেবারে ঢিট। তাড়াতাড়ি বলে, ‘অই শুন গ লাতিন, ই বারে যিখ্যানেই যাই, তোকে ছাড়া যাব না। জ্বর হলে ক্যাঁতা ঢাকা দিয়ে লিয়ে যাব।’

‘ঠিক তো?’

‘অব্যত্থ।’

বিন্দু আওয়াজ দেয়, ‘বাব্বারে বাবা, মেয়্যা তো না, কেউটের ছানা।’

দুজনেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়। তার আগেই কুসুমই আবার দরজার কাছে থমকে দাঁড়ায়। ঘাড় ফিরিয়ে বলে, ‘তা, হাঁই দাদা, উয়াকে লিয়ে ইখ্যানে বইসে থাইকবে ক্যানে। চুলার কাছে চলো, আগুন পোয়াতে পাইরবা।’

উয়াকে মানে আমি। বিন্দু চোখ বড় করে বলে, ‘উ বাবা, চিতেবাবাজিকে ছেড়ে কুসি যেইতে লাইরছে গ।’

যাকে বলা, তার তেমন প্রতিক্রিয়া নেই। বলে, ‘ঘরে বইসে কী কইরবে। তার চে উখানেই তো ভাল৷ এইস ক্যানে, এইস।’

অবাক হয়ে দেখি, কুসুম অবলীলাক্রমে আমার দিকে, আমাকেই ডাকছে। জিজ্ঞেস করি, ‘আমাকে বলছ?’

‘হুঁ।’

বিন্দু হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে। আর গোপীদাস বলে, ‘তাই চলো চিতেবাবাজি, আগুনের ধারেই জইমবে ভাল। লাতিন আমার ঠিক বইলছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *