৫০. বাঁশঝাড়ের মাটি

৫০.

বাঁশঝাড়ের মাটি যেখানে ঢিবির মতো উঁচুতে উঠে গিয়েছে, নরোত্তম বাতি হাতে, সেই উঁচুতেই আরোহণ করে। আলোর ইশারা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। গলার স্বর আরো স্পষ্ট। অচিনদা আমার হাত টেনে ধরেন। একটু বাঁক নিয়ে ওপরে উঠতেই দেখি, জয় ভোলা মন। একেবারে তকতকে উঠোনের মতো পরিষ্কার জায়গা। চারদিকেতে বাঁশঝাড়ের ঘেরাও। মাঝখানে লাল মাটির পরিচ্ছন্ন বিস্তৃতি। ঝাড় ঘেঁষে, একদিকে এক পাতার ঘর। এর নামই বোধ হয় ঝোপড়ি। তার সামনে কিছু হাঁড়ি কলসি, একেই বলে কেঁড়ে। এক জায়গায় এক টিমটিমে লণ্ঠন, আর এক জায়গায় কেরোসিনের লম্ফ। মাঝখানে কাঠকুটোর স্বল্প আগুনের শিখা। তারই থরথরানো আলোয় যাদের কিম্ভুত ছায়া কাঁপে, তাদের সকলের সামনেই একটি করে কেঁড়ে। হাতে একটি করে মাটির ভাঁড়। গন্ধে যদি পেট ঘুলিয়ে ওঠে, তা হলেও জানবে, হেথায় রসের আসর জমেছে। বিলিতি কথায় সেই কী যেন বলে, ‘পাব্‌’ না আর কিছু, এও সেই প্রকারের যেন। রাস্তা থেকে খোয়াইয়ের মাঠ পেরিয়ে বাঁশঝাড়েতে পানশালা। তবে কি না এমন আর জন্মে দেখিনি। কেবল যে অবাক মানি, তা না। একটু অচিন অজানার, আঁধার রাতের শিউরোনি লাগে। ই কুথা লিয়ে এলেন গ অচিনদা। পরিচয়টা এখনও যে পেছনে ফেলে আসা ভদ্দরলোকের ছেলে। প্রাণটি অটুট নিয়ে ফেরা হবে তো!

আমরা গিয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই, অভ্যর্থনার উল্লাস বেজে ওঠে। বরহম দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে উঠে, হাত বাড়িয়ে বলে, ‘এস্যাছিস্‌?’

অচিনদা খেঁকিয়ে বলেন, ‘তুই কি ভেবেছিলি আসব না?’

‘হঁ হঁ, তু কি মিছা বুইলবি? ত, ক্যানে রাস্তা থেকে হাঁক দিলি না। বাতি লিয়ে যেতাম।’

অচিনদা সকলের মুখের দিকে দেখতে দেখতে বলেন, ‘হ্যাঁ, তাড়ি গিলে সব ভোম্‌ হয়ে বসে আছ, আমি অদ্দূর থেকে চেঁচিয়ে মরব, কেউ শুনতেও পাবে না। ওটা কে রে, শরত না?’

অমনি মাঝবয়সী সাঁওতাল একজন দাঁড়িয়ে উঠে বলে, ‘হ’রে, চিনতে পারলি?’

‘তুই চিনতে পারলি?’

অচিনদার কথা শুনে সবাই হাসে। শরত তার পাশের কালো স্ত্রীলোকটিকে দেখিয়ে বলে, ‘আর একে?’

স্ত্রীলোকটির বয়স অনুমান করা একটু শক্ত। লণ্ঠন লম্ফ আলোয় দেখি, শীতের বালাই নেই। একটি মাত্র সুতি জামায় আর মোটা শাড়িতে কালো শক্ত পুষ্ট শরীর। হাতে রসের ভাঁড়। চকচকে চোখে একটু লজ্জা লজ্জা ভাবের হাসি। অচিনদার দিকেই চেয়ে আছে।

অচিনদা বলেন, ‘তোর বউ তো।’

সে জবাব কেউ দেয় না। সবাই মিলে হাসাহাসি করে। তাও মানে বুঝতে হবে, ঠিক বলা হয়েছে। হাসির মানে এই না যে, ভুল হয়েছে। এ মানুষদের হালচালের ধরতাই একটু ভিন রকমের। অতএব বরহমও তার মেলায় দেখা বউটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তবে ইটো কে বল্‌ দেখি?’

অচিনদা বলেন, ‘তোর মুন্ডু।’

সকলেই হেসে বাজে। কেবল যে এই দু’জোড়া, তা না। জোড়াবিহীনও জনা চারেক আছে। তা ছাড়া আছে বুড়ো শুণ্ডি নিজে, পানশালার মালিক। কেবল একজনের জুটি কে, বুঝতে পারি না। যে বসে আছে বুড়ো শুণ্ডির কাছ ঘেঁষে। এ সেই কষ্টিপাথরে কাটা কালো যুবতী। মনে তো হয়, বুঝি সাঁওতালনীই হবে। এ যে কালোতে আলো, তা না। কালোতে আগুন। আগুন তার লাল ফুলফুল জামায়। যেথায় বুকের ঔদ্ধত্যকে সামনে দিয়ে বাঁক নিয়ে বসেছে মন্দিরের মূর্তির ভঙ্গিমায়। এক হাতে কলসির গলা জড়িয়ে ধরে, যেন বড় আদরে তুলে নিয়েছে বাঁ উরতের ওপর। ডান পা ছড়ানো। চুলে বাঁধন আছে, তবু কপালের এক পাশে ভেঙে পড়েছে। লম্ফর লাল আলোয় মনে হয়, টানা চোখে তরল আগুনের স্রোত বহে যায়। ডান হাতের ভাঁড়ে চুমুক দেয়, আর ফিক্‌-ফিক্‌ হাসে। এমন আসর আর কখনও দেখিনি।

সকলেরই একটু টলমল ঢুলুঢুলু ভাব। সবাই হাসে। সবাই অচিনদাকেই বেশি দেখে। কিন্তু ভাবি, অচিন্ত্য মজুমদার এই আসরে আসেন কেমন করে। এ মানুষের কি স্থান কাল পাত্র বলে কিছু নেই! সমাজের প্রতিষ্ঠার, বিত্তের যে সীমা থেকে তাঁর আবির্ভাব, সেই সীমার পথ কি এমন আশ্চর্য বাঁশঝাড়ে এসে ঠেকে!

বুনো শুণ্ডি উঠে বলে, ‘এস গ অচিনবাবু, আলোর কাছে এসে বসো।’

অচিনদা সেদিকে এগোতে এগোতে বলেন, ‘আসব তো, আমার জিনিস রেখেছ?’

বুড়ো ফোকলা দাঁতে হেসে বলে, ‘তা আর না রাখি। বরহম এসে বুইললে, তুমি আসছ। পুরো এক কলসি রেখে দিয়েছি।’

সর্বনাশ, অচিনদাও কি এখন এই আসরে, রসের কেঁড়ে নিয়ে বসবেন। তা হলে আমি কোথায় যাই। এখন বলতে ইচ্ছা করে— আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না। কেন, তখন যে বড় সাধ হয়েছিল, বরহমের আস্তানায় যাবো অচিনদার সঙ্গে। এখন এত হাঁসফাস আঁকুপাঁকু কীসের!’

অচিনদা বলেন, ‘ভাল জিনিস তো?’

বুড়ো বলে, ‘খারাপ কোনওদিন দিয়েছি? তুমি হলে পুরনো লোক।’

শোনো কথা। এর পরেও তুমি ভাববে, এ লোক বিলাতি গাড়িতে বেড়ায়। মাইনের কথায় লোকে বলে, তিন হাজারি মনসবদার! বাঁশঝাড়ের বুড়ো শুণ্ডি বলে কিনা পুরনো লোক। কত পুরনো! সেই পড়ুয়া বেলা থেকে নাকি। অচিনদা গিয়ে তার পাশ ঘেঁষে বসতেই বরহম শরতরাও এগিয়ে যায়। বউয়েরাও বাদ যায় না। বউ কলসি ভাঁড়, সব নিয়ে অচিনদাকে ঘিরে বসে। শুণ্ডি একটা কলসি এগিয়ে দেয় অচিনদার দিকে। আর আমি যেন এক হারিয়ে যাওয়া ছেলে। কার কাছে কোথায় যাই, ভেবে পাই না।

বরহম তাড়া দেয়, ‘কই, আমাদিগের পাওনাটো দে।’

অচিনদা বলেন, ‘দিচ্ছি রে দিচ্ছি।’

বলে এবার আমার দিকে ফিরে ডাকেন, ‘কই হে, এসো, তুমি যে অচেনা লোকের মতো দুরে দাঁড়িয়ে রইলে।’

বরহমই তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে আমাকে ডাকে, হঁ হঁ, আয় না রে ছোকরা বাবু, বিটিছাওয়ালের মতো দূরে দাঁড়িয়ে রইলি ক্যানে।’

মুরগি যেমন ভয়ে ভয়ে পা ফেলে এগোয়, তেমনি ত্রাসে ত্রাসে এগিয়ে যাই। জবাইয়ের ছুরি যেন চার পাশে ঝিলিক হানে। বরহমই জিজ্ঞেস করে, ‘ইটো কে?’

আমার কথাই বলে। অচিনদা বলেন, ‘বন্ধু।’

শরত বলে, ‘ছোকরা বন্ধু ধরেছিস।’

‘হ্যাঁ, নষ্ট করব বলে।’

কথা শুনে, আমিই সাজিয়ে যাই। বাকিরা হাসে। বরহম তার ওপরে তাল দেয়, ‘বিটা ছেলেকে আর তুই কি লষ্ট কইরবি। উয়াদের লষ্ট করবে বিটিছেলে।’

‘চুপ কর।’ ধমকের সুরে বাজেন অচিনদা। বলেন, ‘খালি ওই এক নষ্টই শিখেছ, না? কই হে, বসো না আমার কাছে।’

বরহমই সরে গিয়ে জায়গা করে দিয়ে বলে, ‘হঁ হঁ বস।’

অগত্যা, তবু একবার বলি, ‘এখানেই, মানে—।’

অচিনদার এখন অন্য রূপ। প্রায় ধমকে ওঠেন, ‘তবে কি অন্ধকার মাঠে গিয়ে বসবে? কেন, বরহমদের আড্ডায় আসতে চেয়েছিলে তো, এসো। আড্ডায় বসো। এবার বুঝতে পারছ তো, মেয়েদের কেন নিয়ে আসা যায়নি। ব্যাপারটা তো জানে না, খালি যাবো যাবো করে।’

তা বটে, মেয়ে তো দূরের কথা। জলজ্যান্ত ছেলে হয়ে, আমার বায়ু জন্মে যাচ্ছে। মেয়েদেরও নিয়ে আসার ভূত যে ওঁর মাথায় চাপেনি, তাই অনেক ভাগ্য। অচিনদার চোখের দিকে আর একবার তাকাই। চোখে একটু ইশারা করে পাশে ডাকেন। সেই ইশারায় ভরসা দিয়ে ঠোঁটের কোণে একটু হাসেন। ধুলার কথা ভাবতে গেলে চলে না। এখানে বাঁশঝাড়ের এই পানশালায় লাল ধুলাতেই ধুলোট জমেছে। অতএব, যতটা সম্ভব অচিনদার গা ঘেঁষে বসি। তবু গোটা দিনের পরিচয়। বাকিরা তো এই মুহূর্তের। অচিনদা রাখলে আছি, নইলে গিয়েছি। এখন তো আর একলা পারানির কোনও কথা নেই। আমার প্রাণের ভাঙা নৌকার মাঝি এখন অচিনদা।

অচিনদা জিজ্ঞেস করেন, ‘লোক বড় কম কম লাগছে। আর কেউ নেই?’

জোড়া-হীন চারজনও কাছে এসে বসেছে। বরহম বলে, ‘তুই আসবি, কেউ জানে নাই তো কী হবে। আর দু-চারজন আছে ইদিক-উদিক।’

অচিনদা বলেন, ‘তা, তাদেরও ডাক, আর বাকি থাকে কেন। আর ইটি কে, চিনতে পারছি না তো?’

বুড়ো শুণ্ডির অন্য পাশে আগুন-কালো মেয়েটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন। শুনে আবার সবাই হাসে। যেন হেসেই আছে, কারণ বোঝো না বোঝো— কারণ আছে বই কী। অকারণে এত হাসি, কারণের কারণেই। রক্তে যে কারণদেবীর খেলা। অচিনদার কথা শুনে কালো মেয়েটিও হাসে। শব্দ তার অল্পই, শরীর কাঁপে বেশি। চোখে যেন চিকুর হানাহানি, অবিশ্যি হাসিতে।

বরহমের বউ জবাব দেয়, ‘চিনতে লারলি? ই তো মাংরি রে, আমার বিটি।’

‘অ!’

বরহম তাড়াতাড়ি ঘাড় দুলিয়ে জানায়, ‘হঁয় হঁয় হঁয়।’

অচিনদা জিজ্ঞেস করেন, ‘জামাই কোথায়? বিয়ে হয়েছে তো?’

বরহম হাত ছুড়ে বলে, ‘সি কুথা যেইয়ে বসে রয়েছে, গোসা হয়েছে।’

স্বামী রাগ করে কোথায় গিয়ে বসে আছেন, গিন্নি এখানে রসের কলসি কোলে নিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। মাটির ভাঁড়ে ঢালছেন, ঢুকুঢুকু খাচ্ছেন। এ সব রীতি বুঝতে যেয়ো না। হেথায় গোঁসা-পিরিতের রং-রীতি আলাদা। মাংরির দিকে চেয়ে দেখি একবার। মুখ ফিরিয়ে ভাঁড়ে চুমুক দিচ্ছে। দিয়ে বার-কয়েক ঢোক গেলে। গিলতে গিলতে ভাঁড় এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘আমাকে টুকুস দে বাবু।’

অচিনদা বলেন, ‘দেবো দেবো। তারপরে আবার মারামারি দাঙ্গা বাধিয়ে দিস না বাপু।’

বলে অচিনদা তাঁর ঝোলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একেবারে লেবেল-আঁটা বোতল বের করেন। অমনি কার কার যেন জিভে ঝোল টানার শব্দ বাজে। শুনতে পাই, কে যেন বলে, ‘বেলাতি।’

রহস্য এবার একটু পরিষ্কার হয়। আসল উৎসবের উপকরণ তা হলে এ-ই! এক না, দুই দুই বোতল বেরোয় ঝোলা থেকে। যেন ঝাঁপি থেকে দু-দুটো কালনাগ ফণা তুলে ওঠে। অবাক হয়ে অচিনদার দিকে তাকাই। অচিনদা বলেন, ‘কী হে ভায়া, খুব খারাপ লাগছে তো এবার?’

খারাপ-ভাল বিচারের অবকাশ কোথায়। তার আগে যে মন আর চোখ ধাঁধিয়ে যায়। পথচলার এই সবুর বিহনে এমন বিচিত্র তো আর দেখিনি। বলি, ‘খুব অবাক লাগছে।’

‘এইসব দেখে তো?’

‘এ সবের থেকে আপনাকে দেখেই বেশি।’

‘নীতিবাগীশের মতো একথা ভাবছ না তো, অচিনদার মতো লোক টাকা দিয়ে এ লোকগুলোকে অন্য কিছু না দিয়ে এ সব খাওয়াচ্ছে?’

ভাবিনি। ওঁর কথা শুনে ভাবতে ইচ্ছা করে। যদি ভাবি, তার মধ্যে নীতিবাগীশতার কথাই বা আসবে কেন। যে কথা উনি বলেন, সে কথাটাই তো আগে মনে আসে। বোতলের মুখ খুলতে খুলতে নিজেই আবার বলেন, ‘আমার বন্ধুবান্ধবরাও দু-চারজন এরকম বলেন কিনা, তাই জিজ্ঞেস করছি।’

জবাবটা ঠিক আসে না, চুপ করে থাকি। অচিনদা নিজেই একটু হেসে বলেন, ‘তা যদি মনে হয় তোমাকে দোষ দেব না ভায়া। শুধু ক্ষমা চাইব।’

অবাক হয়ে তাড়াতাড়ি বলি, ‘না না, ক্ষমা চাইবেন কেন।’

‘নিজের এই প্রকৃতির জন্যে। এর চেয়ে ভাল আর হতে পারলাম না। এ সবের ওপরে আর যেতে পারলাম না। সংসারে কিছু কিছু অন্যায় আছে, যেগুলোকে একটু ক্ষমাঘেন্না করে চলতে হয়, সেই রকমই করো। কিন্তু এখন এই যে বছরে একবার আসি, ওদের সঙ্গে একটা রাত্রে খানিকক্ষণ থাকি, তখন আর মেঠাই-মন্ডার কথা মনে থাকে না। ওরাও আমার কাছে তা চায় না। একদা এই বাঁশঝাড়ে ওদের কাছে হাতেখড়ি হয়েছিল, এখনও ওদের কাছেই একটা দিনের এক সময়ে এখানে আসি।’…

অচিনদা কথা বলেন, আর তাঁর হিজিবিজি গোরা মুখের ছাঁদ যেন বদলাতে থাকে। যেন নিজের মধ্যে নিজেই ডুবে যান। সেই রূপকথা বলার স্বপ্ন যেন অন্য রূপে দেখা দেয়। আমার কথা ফুরিয়ে যায়। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে ভুলে যাই।

কথা থামিয়ে অচিনদা বোতল থেকে সবাইকে একটু একটু ঢেলে দেন। সবাই মাটির ভাঁড় এগিয়ে ধরে। এমনকী বুড়ো শুণ্ডি আর বরহমের মেয়ে মাংরিও। অচিনদা হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বলেন, ‘নাও হে, একটা পাত্র নাও।’

অবাক চমকে বলি, ‘আমি?’

‘নয় কেন? এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে?’

তাঁর কথা শেষ হবার আগেই বরহম চেঁচিয়ে ওঠে, ‘হঁয় হঁয়, আজ খেতে হয়। ই কি যে সে দব্য?’

সঙ্গে সঙ্গে মাংরি একটা মাটির ভাঁড়, আলগোছে ছুড়ে দেয় আমার কোলের ওপর। এ কি বিপদ দেখ হে। বিদেশ-বিভুঁই, অচিন অজানা, খোয়াইয়ের মাঠের ধারে বাঁশঝাড়ে খোয়ার দেখে যাও। যাতে পৃথক ফল না হয় তার জন্যে এখানেই বেতাল বেহুঁশ হয়ে থাকে। প্রায় করুণ আর্ত চোখে অচিনদার দিকে তাকাই।

অচিনদা পরম স্নেহে হাসেন। বলেন, ‘ভয় লাগছে? আচ্ছা, তা’ হলে থাক।’

বলেই হাঁক দেন, ‘কই রে, লরোত্তম কোথা গেলি।’

একেবারে পিছন থেকে উদ্বেগ-ব্যাকুল গলা যেন কঁকিয়ে ওঠে, ‘না না, উটি লারব বাবু। উ আমি খেতে লারব।’

অবাক হয়ে ফিরে দেখি, সত্যি সত্যি জোয়ান ছোঁড়া কালনাগ দেখছে যেন। এ যে দেখি আমার থেকেও এককাঠি সরেস। চোখ জুড়ে ভয়, ঘনঘন হাত নাড়ে। আমি মনে মনে ভাবি, আহা থাক না বেচারা। এ সবে অরুচি, ভয়-ডর পায় যখন থাক।

বুড়ো শুণ্ডি ভুরু কুঁচকে বলে, ‘ক্যানে রে, আঁ? তুই না একা বইসে এক লাগাড়ে দু’ কলসি খাস?’

নরোত্তম ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলে, ‘তা হক, উ বেলাতি আমি খেতে লারব, গা ঘুলায়।’

এবার বোঝো ভয় কোথায়! আমি ভাবি ছেলেমানুষ, ও-সব শেখে-টেখেনি। আসলে ওঁয়ার বেলাতিতে ভয়। মূলে উনি এক ঠাঁইয়েতেই দু’কলসির খদ্দের। অচিনদা বলেন, ‘তুমি একেবারে খাঁটি দিশি দেখছি, এতে তোমার গা ঘুলোয়।’

বলেই প্রায় হুমকে ওঠেন, ‘নিয়ে আয় একটা পাত্র।’

কাকে বলেন গ! তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘মাইরি বইলছি বাবু, হাতজোড় করে বইলছি, উ আমার হবে না।’

সত্যি প্রায় আতঙ্কে জোয়ানের চোখ ছলছল। এর থেকে আর বেচারি কেউ হয় না। এখন আবার মনে হয়, আহা, থাক না বেচারা। ময়ালের গ্রাস ভাল, তবু কেউটের ছোবল সইবে না। ভাবটা প্রায় সেইরকমেরই। দেখে মনে হয়, আর বেশি বললে দৌড় মারবে। সেটা কোনওদিক থেকেই সুবিধার হবে না। অচিনদাও সেটাই অনুমান করেন বোধ হয়। তা হলে বহুদূর হাঁটতে হবে। অতএব, অচিনদার শেষ বক্তব্য, ‘ব্যাটা, তোর দ্বারা কিস্‌স্যু হবে না। তবে তাড়ি খেয়েই মরো গে।’

এবার নরোত্তমের মুখে একটু স্বস্তির হাসি দেখা দেয়। বড় শান্তি বোধ করছে। অচিনদা একবার আমার দিকে চেয়ে ঠোঁটের কোণে হাসেন।

বুড়ো শুণ্ডি অচিনদাকে বলে, ‘তুমি লিলে না?’

‘হবে হবে, আমার দ্রব্য তো তুমিই রেখেছ। তোমরা খাও।’

সবাই এক এক চুমুকে রেচকের ঝাঁঝালো কাঁচা পানীয় গলায় ঢেলে দেয়। বরহম চাঁপা শব্দ করে ‘আহ্‌!’ আর শরতের বউ গিলেই মুখে কাপড় চেপে ধরে। সকলেরই বেশ ঝাঁজ লেগেছে বোঝা যায়। সকলেই একটু-আধটু শব্দ করে, মুখ কোঁচকায়। বুড়ো শুণ্ডি বলে, ‘বড় মজার জিনিস।’ মাংরি ঘনঘন ঢোক গিলছে, যেন তার মুখ রসে ভেসে যাচ্ছে। এবার রেচকের কাঁচা আরক, বোতলটা তুলে ধরে অচিনদাও গলায় ঢেলে দেন। প্রৌঢ় মানুষটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। কী আশ্চর্য, কোথায় এসে কোথায় বসে কী করছেন। এখনও এত ধকল সয়?

হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বলেন, ‘রাগ করছ না তো ভায়া?’

জবাব দিতে যাই, তার আগেই বলেন, ‘আমার এক বন্ধু বলে, “অচিন, বছরে একবার আসো, তা তোমার এসব সাঙ্গোপাঙ্গদের একদিন বেশ করে মাংস-ভাত খাইয়ে দিলেই পারো এ সব কেন”?’

কথা শুনতে খুব ভাল, কিন্তু কী জবাব দেবো বুঝতে পারি না। যেন বলতে চায়, ‘ভাল করতে পারি না মন্দ করতে কী দিবি তা দে।’ সেটাই আমার কলঙ্ক। ওদের সারা বছরের একটা দিনের কয়েক ঘণ্টায় কী মন্দ করতে পারি। বাড়ি-ঘরদোর পূজা-পার্বণের ব্যাপার নয় যে বসিয়ে খাওয়াব। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে একটু আড্ডা দিয়ে যাওয়া। তা এদের সঙ্গে তো ব্রিজ খেলে কফি খেয়ে আড্ডা দেবার অর্থ হয় না। যার যাতে মৌজ, তা ছাড়া নিজের কথাটাই মনে রাখতে হবে তো। যেমন রামকেষ্ট ঠাকুর বিরক্ত হয়ে বঙ্কিমচন্দ্রকে বলেছিলেন, ‘বাবা, যা খাচ্ছ তারই ঢেকুর তুলছ?’ তার মানে বঙ্কিমচন্দ্রের খাবারে গরহজম। যা ভাবেন তাই ওগরান। আমার রামকেষ্ট বন্ধুদেরও সেই কথাটাই বলি, ‘আমি যা, আমি তা-ই। নিজেকে আর হজম করতে পারলাম কই।’ সত্যি, আপন নিয়ে এমন ভাবে কাল কেটে গেল। পরের কথা আর ভাবতে পারলাম না।’…

অন্য দিকে বরহমরা হাত বাড়ায়, ‘দে বাবু।’

‘হ্যাঁ, এই যে।’

বলে অচিনদা আবার জনে জনে ঢেলে দেন। আমি দেখি হিজিবিজি গোরা মুখে সেই স্বপ্নের ভর। তবে, কেবল যেন রূপকথার না। এই স্বপ্নের ঘোরে যেন কী এক সুর বেজে যায়। সবাইকে দিয়ে আবার নিজের গলায় ঢালেন। তারপরে বলেন, ‘বিভূতি বাঁড়ুজ্জের আরণ্যক পড়েছ?’

‘পড়েছি।’

‘তা হলে জানো, এক জায়গায় লেখক আক্ষেপ করছেন, নিবিড় অরণ্য কেটে সেখানে কয়েক বিঘা ফসল বোনা দেখে। বলতে চেয়েছেন, এই অরণ্যের শরীর কেটে এই ফসলটুকু না ফলালে মানুষের এমন কী ক্ষতি হত। প্রথম যখন পড়েছিলাম, ভেবেছিলাম আন্‌সায়েন্টিফিক। খুবই অবৈজ্ঞানিক উক্তি। এখন কিন্তু ভাবি, প্রেমে কী না হয়। অরণ্যে যাঁর প্রেম, তিনি তো ওরকমই বলবেন। আমারও সেই রকম, আমি যে এমনি করে বসে এই আসর ভালবাসি।’…

বলতে বলতে থেমে আবার সকলের শূন্যপাত্রে ঢেলে দেন। যাদের দেন তারা এখন নিজেদের মধ্যে নানা কথায় নানান হাসিতে ব্যস্ত। বোঝা যায়, তাদের রক্তে নতুন জোয়ার লাগে। অচিনদা আবার আমাকে কী যেন বলতে যান। তার আগেই বরহম হেঁকে ওঠে, ‘অই, তু খেলি না?’

অচিনদাকে বলে, সেদিকে ঠিক নজর আছে। অচিনদাও ঢালেন। তারপরে বলেন, ‘সেবার এই শেষ বছরের পরীক্ষা সামনে। এই বাঁশঝাড় দূর থেকে দেখেছি। বরহমদের চিনতাম, ওদের যাতায়াত করতে দেখেছি। কেন, তাও জানতাম। আর পানের ব্যাপারটা যে নিজেদের কারুর মধ্যে তখন দেখিনি তা নয়। আমরা তখন বিদ্যাভবনের ছাত্র, কিছু পালক-টালক গজিয়েছে—অর্থাৎ তোমরা যাকে এম-এ ক্লাসের ছাত্র বলো, সেই রকম বয়স। পরীক্ষার শেষ বছরেই হঠাৎ একদিন বিকেলবেলায় এই বাঁশঝাড়ে এসে উঠেছিলাম। পান করতে নয়, তার জন্যে এখানে আসার দরকার ছিল না। সেদিন একটা নিশির ঘোর আমার। অনুভূতিগুলো যেন সব মরে গেছে। আশ্রম থেকে কখন হাঁটতে হাঁটতে কোপাইয়ের ধারে চলে গেছি, নিজেরও যেন সাড় ছিল না। শরৎকাল এসে গেছে। খোয়াইয়ের এখানে ওখানে কোপাইয়ের ধারে ধারে কাশের দোলানি। কোপাইয়ে তখনও জল কম না। কিন্তু সে-সব চেয়ে দেখেছিলাম বলে মনে পড়ে না। খালি পায়ে চলাফেরা করা অভ্যাস ছিল আমাদের, খালি পায়েই বেরিয়েছিলাম। ঠিক কী বললে তোমাকে বোঝাতে পারি জানি না। বোধ হয় অনেকটা সাপের কামড়ের মতো, বিষে অচৈতন্য।’

বলে একটু হাসেন। আবার বলেন, ‘অবিশ্যি সাপের কামড় কোনওদিন খাইনি, তা-ই জানি না। ওটা উপমা, তবে কামড় একটা খেয়েছিলাম।’…

বলতে বলতে আবার ঢেলে দেন। কখন দ্বিতীয় বোতল খোলা হয়ে যায় টের পাই না। বরহমদের অস্থিরতা বাড়ে। ইতিমধ্যে কখন আরো দু’টি জোড়া এসে ভিড়েছে। বোধ হয় কলসি আর ভাঁড় নিয়ে জুটি বসেছিল কোল-আঁধারে। সকলেরই কেমন যেন এক দোলা চঞ্চলতা। গলার স্বর চড়ে। তার মধ্যেই একটি মেয়ে-গলার গুনগুনানি শোনা যায়।

অচিনদা নিজের গলায় ঢেলে বলেন, ‘সেখান থেকে ফিরে হাঁটতে হাঁটতে কখন এই বাঁশঝাড়ে এসে উঠেছিলাম। তখন এই বরহম ওর বউকে নিয়ে এখানে বসেছিল। আমাকে দেখে হাত ধরে বসালো। ওদের সঙ্গে খেতে লাগলাম, যেন কোনও জ্ঞান নেই। ওই যে বললাম বিষে অচৈতন্য, সেই রকম। জীবনে যা ভাবিনি কোনওদিন, তাই করলাম। তারপরে সেই রাত্রে আর বাঁশঝাড় থেকে ফেরা হয়নি। আসলে বিষের পুরিয়াটা ছিল বুকেই—মানে বুক-পকেটে।’

বলে আমার ঘোর-লাগা কৌতূহলী অবাক মুখের দিকে চেয়ে হাসেন। মনে হয় ওঁর চোখ দুটো দেখতে পাই না। কোথায় যেন ঢাকা পড়ে গিয়েছে। কেবল অন্ধকারে ক্ষীণ স্রোতরেখার মতো কী যেন দেখা যায়। মুখটা একটু এগিয়ে নিয়ে এসে বলেন, তোমাকে একটা বস্তাপচা গল্প শোনাব, শুনবে?’

আমি স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো বলি, ‘শুনব।’

.

৫১.

ইতিমধ্যে বরহম শরতের দল কখন দাঁড়িয়ে পড়েছে খেয়াল করিনি। দেখি, ওদের পুরুষেরা একদিকে, মেয়েরা আর একদিকে, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছে। দাঁড়িয়ে না, ওদের দোলানি শুরু হয়ে গিয়েছে। উভয় পক্ষ সারি সারি। আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে মলুটির মৌলীক্ষার মাঠের ছবি। এখানে, এই বাঁশঝাড়ে তার আর এক রূপ। এখানে আগে থেকে কোনও আয়োজন ছিল না। কোনও বিশেষ উৎসবের অনুষ্ঠান নেই।

এখানে মেয়েদের গলায় গলায় গান বেজে ওঠে প্রাণের আপন ধ্বনিতে। পায়ে পায়ে নাচ লেগে যায়, প্রাণের দোলাতে। উৎসবের হেতু খোঁজায় নেই কেউ। এ আঙিনায়, উৎসবের প্রাণ আপনি এসে ধরা দেয়। এমন দিনে যাদের আসর জমে ওঠার কথা ছাতিমতলার মেলার আঙিনায়, আজ তারা সেখান থেকে দূরে। তাদের কয়েকজনের উৎসব লেগে যায় বিনা আয়োজনে। এখানে দূর ছড়ানো মাঠ নেই, বাঁশঝাড়ের ঘের। শুণ্ডি বুড়ো উসকে দেয় কাঠ-কুটোর আগুন। টিমটিমে লণ্ঠন আর লম্ফর লাল আলো। সেই আলোতে মানুষ কাপে, ছায়া কাঁপে। বাঁশঝাড়ের ঝুপসি ঝুপসি কালোতে, আগুনের আলোর ছিটায়, সকলই যেন কোন দূর কালে টেনে নিয়ে যায়।

ওদের গানের ভাষা বুঝি না। সুরের উত্থান-পতনে ঘুরে ফিরে একটা সুরই বাজে। যেন ঝিঁঝির ডাকের মতে, প্রকৃতির স্পন্দনে বাজে। কেবল একটা কথাই বুঝতে পারি। গানের মধ্যে, একবার করে ‘অচিনবাবু’ উচ্চারিত হয়। শুনে অচিনদা ঘাড় দুলিয়ে হাসেন। হাত তুলে বলেন, ‘আচ্ছা রে, আচ্ছা।’

আমার দিকে ফিরে বলেন, ‘ওরা বলছে, আমার মতো এমন মানুষ কোনওদিন দেখেনি। আমি মাটির পাত্র নই, ভেঙে যাই না, খাঁটি পিতলের জিনিস।’

বলে আবার হাসেন। কথা কন, হাসেন, কিন্তু সেই ঘোর লেগে থাকে মুখে। স্বপ্নঘোরের ওপার থেকে, এপারে আওয়াজ দেন। এদিকে শুণ্ডি বুড়ো একটি মাটির কলসি বসিয়ে দিয়েছে অচিনদার সামনে। সঙ্গে একটি ভাঁড়। বুড়ো ঢেলে ঢেলে দেয়, অচিনদা চুমুক দেন। এমন আজব পান দেখিনি কখনও।

একদিকে নাচ গান দোলা চলা। এখন আর বরহমের বউকে প্রৌঢ়া মনে হয় না। মেয়ের থেকে মা কম যায় না। সুরের দোলায় সকলেই এক, ফণা তোলা সাপিনীর আঁকাবাঁকা ঢেউ। নরোত্তম বসেছে একটু দূরে, অন্ধকার ঘেঁষে। একটা সহবত বলে কথা আছে তো। শত হলেও কলসি ভাঁড় নিয়ে বসেছে। একেবারে অচিনদার সামনাসামনি বসে কী করে। আর জোয়ানটি দু’চোখ ভরে নাচ দেখছে।

বরহম একবার অচিনদাকে হেঁকে ওঠে, ‘তুই লাচবি না?’

অচিনদা বলেন, ‘না বাবা, আমার কোমরে আর অত জোর নেই।’

তারপরে দূরের অন্ধকারে চোখ মেলে দেন। যে মানুষের যে মুখ দেখেছিল মা মেলার প্রাঙ্গণে এখন আর সে মুখ নেই। এ যেন অন্য এক মুখ। কেবল রক্তের লাল না, আগুনের আলোয় রাঙা হিজিবিজি মুখটা এখন যেন কেমন মসৃণ দেখি। আমার দিকে না তাকিয়েই বলেন, ‘বুক-পকেটের বিষের পুরিয়াটা আসলে যে চিঠি, সে কথা বোধ হয় তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না।’

বলে মুখ ফিরিয়ে তাকান। তাকান, কিন্তু আমি ভাবি, সেই ডাগর চোখ দু’খানি কোথায়। কেবল দুটি চিকচিকে বিন্দু ছাড়া কিছুই যেন দেখতে পাই না। নজরের ভাব বুঝি না। তবে বুক-পকেটের বিষের পুরিয়া যে চিঠি, তা বুঝতে পারিনি। সেই কৌতুহলের নিরসনে নতুন কৌতূহলে মন চকিত হয়।

অচিনদা বলেন, ‘চিঠিটা সেইদিনই এসে পৌঁছেছিল কলকাতা থেকে। চিঠির বক্তব্য ছিল, “তোমার প্রস্তাব নাকচ হয়েছে। তোমার বংশকৌলীন্য তেমন জোরালো নয়, পাশ করে বেরিয়ে অর্থকৌলীন্যেও যে তুমি খুব উঠতে পারবে, সে বিশ্বাস অভিভাবকদের নেই। তা ছাড়া, তুমি ভাল নও, তুমি যে প্রেম করো। আমাদের পরিবারে শিক্ষা-দীক্ষা আধুনিকতা যতই থাকুক, কিন্তু এ কথা কেউ ভুলবে না, তুমি আমাকে খারাপ করেছ। কেন না, আমার মধ্যেও যে তুমি প্রেমের বিষ ঢুকিয়েছ। তুমি খারাপ, তুমি খারাপ। তাই তো ওখানকার আত্মীয়দের ওপরেও ভরসা করা গেল না। কলেজের পড়া সাঙ্গ হবার আগেই আমাকে কলকাতায় নিয়ে আসতে হলো। তোমার আওতায় থাকলে আমার সর্বনাশ। তুমি খারাপ, তুমি যে বিষের মতো খারাপ। তোমার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করাও যায় না, কারণ কথা পাঁচ কান হবে, তাই যেখানে তুমি আছ, সেখান থেকে নিঃশব্দে আমাকে সরিয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে। আমার এতবড় ক্ষতি তাঁরা চোখ চেয়ে দেখবেন কেমন করে। আমার এতবড় অধঃপতন তাঁরা সইবেন কেমন করে। তাই আমার বিয়ে স্থির হয়ে গেছে। যার সঙ্গে স্থির হয়েছে, তিনি সাহেবদের কলেজ থেকে পাশ করেছেন, তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি পেয়েছেন, তিনি সব দিক থেকেই তোমার থেকে বড়। আমি ভাবি, বাহুবলেও কি তিনি তোমার থেকে বড়?”

অচিনদা একটু থামেন। একটু যেন হাসতে চেষ্টা করেন, ঠোঁট দুটো বাঁকা দেখায়। ওদিকে গানের রব উঁচুতে উঠেছে। নাচের তাল দ্রুত। আর আমার চোখের সামনে, সব ছাপিয়ে ভাসে এক অচেনা অজানা মুখ। কেন জানি না, দেখি তার অলকে কুসুম নেই, শিথিল কবরী। চোখেতে কাজল নেই, কিন্তু সজল দিঠি না। জল এসে থমকে আছে চোখের কূলের ওপারে। ব্যথার চেয়ে যেন বেশি দেখি ঠোটের কোণ বিদ্রুপ বাঁকা। অথচ সে যেন উদাসিনী। কখন বুঝি কেঁপে যায় ঠোঁটের কোণের বাঁকখানি।

অচিনদা যেন ঠেক খেয়েছিলেন। ঠেক কাটিয়ে আবার বলেন, ‘চিঠিতে আরো লেখা ছিল, যার মোদ্দা কথা, পুরুষের বাহুবলের কথা ছাড়া, আর কী ভাববো। সমাজ সংসার পারিবারিক সম্মান, সব কিছুর মাঝখানে, আমি সে-ই তো অবলা। বিষ যদি খেলাম, একেবারে মরণ হল না কেন। এখন যে জ্বলে যাচ্ছি, তাই মরণের কথা মনে আসছে, তাই পুরুষের বাহুবলের কথা মনে আসছে। সভ্যতা আধুনিকতা সংস্কারের ওপরে উঠতে পারল কোথায়। তাই বাহুবলের কথা বলতে ইচ্ছা করে। অথচ সভ্যতার এমনই ছলনা, বাহুবলকে নাকি তার বড় ঘৃণা। কিন্তু কী করি, অগ্রহায়ণের প্রথম সপ্তাহে সে-ই দিন, মাঝখানে শুধু কার্তিক মাসটুকু। সামনে তোমার পরীক্ষা, সে কথাও ভুলতে পারছি না। তা-ই এখন কেবল, এক জপ, এক তপ, তোমাকে খালি বলছি, অচিনদা, তুমি খারাপ, খুব খারাপ, বিষের মতো খারাপ। যে বিষেতে মরণ নেই, সে বিষ কেন দাও। এখন তুমি যা বুঝবে, তাই করবে। তবে তোমার কোনও ক্ষতি করো না। ইতি—’

অচিনদা চুপ করেন। আমি বলে উঠি, ‘ইতি—?’

অচিনদা যেন একটু অবাক হন। তারপরে হাসির মতো শব্দ করে বলেন, ‘ও, নামটা জিজ্ঞেস করছ? সেটাও আমাদের কালের মতোই, নীরজা।’

শুণ্ডি বুড়ো ভাঁড় এগিয়ে দেয়। অচিনদা হাত নাড়েন, আর চান না। এখন চেতন ব্রহ্মের আর কোনও রসের দরকার নেই। এখন সে রস প্রাণের ভিতর থেকে, স্মৃতির কলস গড়িয়ে মাতাল করেছে। এখন আর অন্য রসে দরকার নেই। ঝাঁজ তিক্ততা মাদকতা এর চেয়ে তীব্রতর আর কী দেবে।

নাচ গান তখনও চলে। যেন বরহমরা নিজেরা চালায় না। তাদের রক্তের মধ্যে কে যেন চালিয়ে যায়। অচিনদা একটা চুরুট ধরান। ধরিয়ে বলেন, ‘সেইজন্যেই বলছিলাম, একটা বস্তাপচা গল্প শোনাব তোমাকে।’

জিজ্ঞেস করি, ‘বস্তাপচা কেন?’

‘প্রেমের গল্প বলে। এমন প্রেমের গল্প তোমরা কত শুনেছ। তুমি সাহিত্যিক, কত লিখছ, কত রকমের বিচিত্র চমকপ্রদ প্রেমকাহিনী। তোমাদের যুগে হলে কী হত জানিনে, আমাদের যুগের কাহিনী নিতান্তই বস্তাপচা।’

শত মুখে শোনা কথার এই বিচার আমার জানা নেই। সমালোচক হওয়া যে আমার ভাগ্যে ঘটেনি। চিঠির কথা না, বিষের পুরিয়ার কথা যতটুকু শুনেছি, তাতে এ যুগ সে যুগের কথা মনে আসেনি। তাজা পচার বিচার আসেনি মনে। কেবল সেই দুটি চিরপ্রাণের কথা মনে হয়েছে, যাতে কোনওদিন পচন ধরে না। যার কোনও সেকাল-একাল নেই। তাই না বলে পারি না, ‘কেবল তো রূপের হেরফের।’

অচিনদা চুরুটে টান দিয়ে বলেন, ‘সেটাই কি কম নাকি হে। নইলে রূপ লাগি আঁখি ঝুরে কেন। নইলে, জনম অবধি হম রূপ নেহারলুঁ, নয়ন না তিরপিত ভেল, কেন? তোমরা তো তোমরা, দেখ স্বয়ং গুরুদেব পর্যন্ত, পঞ্চশরের শর বেঁধানো খেলা জমাতে শিলং-এর পাহাড়ের রাস্তায় নায়কের গাড়ি বিকল করে দেন, চমকে দেখি নায়িকাও সেখানে। আমার গল্পের শুরু থেকে শেষ অবধি সেরকম কোনও ঝলক চমক নেই।’

বিষের নীলে আর হুল ফোটে না। তবু দেখ, অচিনদা আপনার হুলে আপনাকে বিঁধতে চান আরও। হয়তো ব্যথা যেখানে গভীর, সেখানে একটু আত্মবিদ্রুপের হনন থাকে। আসলে, অচিন-নীরজার সহজের মধ্যেই গভীরতায় অনেক বেশি ডুবেছিল। বনে গিয়ে কাঁদার চেয়ে ঘর করার সহজে যে কাঁদে, সেটা দেখা যায় না। কিন্তু বনে গিয়ে কাঁদা থেকে এ কাঁদাটা অনেক গভীরে বেঁধানো। আটপৌরে ঘর-কন্নাতে সাজিয়ে কিছু দেখানো যায় না। কিন্তু সেখানে জীবনের লীলা চলেছে অহরহ। ঘটনার চমক যদি অচিনদার না থাকে, তাতে আসলের ক্ষতি হয় না। বরং বেশি গভীর মনে হয়। শুধু পত্রের বাচনিকে যতটুকু শুনেছি, তাতেই যেন মনের কোথায় একটা বন্ধ মুখের ধারা খুলে যায়। একটু যেন ব্যথা ধরার টনটনানি। কাঠের আগুনের আলোয় অচিনদার মুখ আর গলা শুনে আমিও কল্পনার ছবি দেখি।

তবু কথা থেমে যায়, তাই বলি, ‘কী আছে না-আছে তা জানব কেমন করে। গল্পটাই তো শোনা হল না এখনও।’

অচিনদা আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে আস্তে চাপড় মারেন। বলেন, ‘তা বটে। সেই চিঠিটাই জীবনে একটা পর্বের শেষ চিঠি। সেই চিঠি আসবার আগে মনের মধ্যে অনেক রকমের গুনগুনানি ছিল। মৌমাছির যেমন মধুর আশা, যেন অনেক আহরণ করে চাকে জমিয়ে রেখেছি। সেই পূর্ণিমার দিনের আশা, যেদিন মধুক্ষরায় জীবন ভেসে যাবে। তার আগে পর্যন্ত নীরজার যে ক’টি চিঠি পেয়েছি, কোনওটাতেই আমার নাকচ হয়ে যাবার সংবাদ ছিল না। বিয়ের পাত্র, দিনক্ষণ স্থির হয়ে যাবার কোনও কথা ছিল না। তখনও আশা, আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবার যোগ্যতাও এসে যাবে। তখন আমাকে আর নাকচ করে কে।’

বলে হাসেন না কি ঠোঁট উলটে একটু হাসির মতো শব্দ করেন, বুঝি না। বলেন, ‘আসলে কী জানো, তখন মস্তিষ্ক জুড়ে অনেক স্বপ্ন। আদর্শের ঠাসবুনোটে মাথা ভরা। বেশি জটিলতা মনে আসত না। ভয় করতে শিখিনি একটুও। কোনও বিষয়ে ভয় ধরলে তো আত্মরক্ষায় সাবধান হতে হয়। যে জন্যে মৌমাছির কথা বলছিলাম। সে কি আগে থেকে জানতে পারে, শুক্লপক্ষের শেষ দিনে তার চাক-ভরা মধুর দিকে কখন মানুষের হাতে আগুনের মশাল এগিয়ে আসছে। তাই ওর চিঠিটা আচমকা একেবারে বিষের তিরের মতো বিঁধেছিল। এমনই বিভ্রান্ত যে, কোপাইয়ের ধার ঘুরে কখন এই বাঁশঝাড়ে এসেছিলাম, জানতে পারিনি। এই যে দেখছ বরহম, ও তখন কাঁচা জোয়ান। ওর বউকে মনে হয়েছিল এই মাংরির থেকেও ঝলকানো। আলাপ ওদের সঙ্গে আগেই। সেই দিন সংলাপ-প্রলাপের পালা। ওরা খাচ্ছিল, আমাকে ডেকে বসালে, আমিও খেতে লাগলাম।’

একটু থামেন। আমি একবার বরহমের দিকে তাকাই। দেখি, তখন আর সে মুখোমুখি নয়, বউয়ের দুই কাঁধে দুই হাত রেখেছে। দু’জনেরই শরীর টলমল, পায়ে বেতাল লেগেছে। ওদের পুরনো বন্ধুর কথা আমি শুনছি। যে কথা ওরা হয়তো কোনওদিন জানতে পারেনি। জানতে পারেনি, একদা বিকালে ওদের বন্ধু কেন এখানে এসেছিল। বরহম এখনও বউকে নিয়ে নাচে। অচিনদা আজও যেন বাঁশঝাড়ের সেই মানুষটাই আছেন। আর আমি রাঢ়ের শীতে আঁচড়ানো রাত্রে বসে জগৎ-সংসারের অপরূপ দেখি। এই অপরূপের চাবিকাঠি কার হাতে, কে জানে। কে খোলে, কে দেখায়, জানি না। এখন যেন নিজেকে নতজানু মনে হয়। মনে হয়, বুকের কাছে দু’হাত আমার। এখন যেন আমার ভিতরে কে বলে, নমি নমি নমি, জীবন হে, নমি নমি নমি।

.

৫২.

অচিনদাও বোধ হয় বরহম দম্পতিকেই দেখছিলেন। হয়তো একই কথা ভাবছিলেন। আমি ওঁর দিকে তাকাতে যেন খুব সহজ ভাবেই বলেন, ‘পরের দিনই চলে গেলাম কলকাতা। কেন যে গিয়েছিলাম, তা ঠিক করে বলতে পারি না। চুপ করে থাকতে পারছিলাম না। এখানে বসে থাকতে পারছিলাম না। তখন মাথার মধ্যে একটা কথারই ঘুরপাক, বাহুবল। কী বলতে চেয়েছে নীরজা বাহুবলের কথা বলে! ওকে উদ্ধার করে নিয়ে আসব ওদের বাড়ি থেকে? ওকে হরণ করে নিয়ে আসব? পরীক্ষার চিন্তা মাথায় উঠে গিয়েছিল।

‘কলকাতায় আমার নিজের আত্মীয়ের বাড়ি ছিল। বাবা মা বরাবর দেশের বাড়িতেই থাকতেন। আত্মীয়দের অবাক করে দিয়ে সেখানে উঠলাম। কৈফিয়ত হল, একটু দরকারে হঠাৎ কয়েক দিনের জন্যে আসতে হয়েছে। কিন্তু কলকাতা গেলে কী হবে, কোনওদিন তো নীরজাদের বাড়ি যাইনি। ঠিকানা দেখে বাড়ি চিনে নিতে ভুল হয়নি। তারপর? নিজেকে যে কী রকম হতচ্ছাড়া মনে হয়েছিল, সে কথা এখন বলে বোঝাতে পারব না। বাড়িটাই না-হয় চিনলাম, ঢুকব কেমন করে, সেটাই তো ভাবনা। বাহুবলটা প্রকাশ করব কোথায়। বলে হঠাৎ হেসে ওঠেন অচিনদা। খানিকক্ষণ ধরে ফুলে ফুলে হাসেন। আমি যেন কেমন স্থির নিশ্চল হয়ে যাই। আমার বুকের মধ্যে দুরু দুরু করতে থাকে। হাসি যখন থামে, দু’হাত দিয়ে সারা মুখটা মোছেন। বলেন, ‘আসলে অপমানের ভয়ে ঢুকতে পারছিলাম না। নীরজার বাবার সঙ্গে শান্তিনিকেতনেই পরিচয় হয়েছিল, অতএব চেনা লোক। তবু তার কাছে গিয়ে আরজি পেশ করতে গেলেই যে একটা প্রচণ্ড গোলমাল লেগে যাবে, বুঝতে পারছিলাম। হয়তো তার ধাক্কা গিয়ে শান্তিনিকেতনেও লাগতে পারে। তাই কেবল, বাড়িটার আশেপাশে দু’দিন ধরে টহল দিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য, কোনওরকমে নীরজার সঙ্গে যদি একবার দেখা হয়ে যায়। সে কি একবার বাইরে বেরুতে পারে না! একবার কী ছাদেও উঠতে পারে না।

‘তখন তবু ওরকম ভাবতে পেরেছিলাম। এখন ভাবি, অমন পাগলের মতো সেদিন একটা বাড়ির দরজার কাছে কেমন করে দু’দিন দাঁড়িয়েছিলাম। ভেবে দেখেছিলাম, একমাত্র নাটকের নায়কের মতো বাড়িতে ঢুকে চেঁচিয়ে বলতে পারতাম, “নীরজা, আমি এসেছি।” তারপরেই ওর বাবার আবির্ভাব, বিতাড়ন, গর্জন, প্রতি-গর্জন, নীরজাকে আহ্বান, সে এক কাপড়ে বেরিয়ে এল। কিন্তু মুশকিল হল, জীবনে মনে কোথাও অমন নাটুকে রুচি ছিল না।

‘শেষ মুহূর্তে যখন স্থির করে ফেললাম, ওদের বাড়ি যাব, শান্তভাবে ওর বাবার সঙ্গে দেখা করব, তখনই মনে পড়ে গেল, ওদের বাড়িতে একটা টেলিফোন আছে। তোমাদের এখনকার মতো অটোমেটিক নয়, কলকাতার ম্যানুয়েল লাইন তুমি নিশ্চয়ই দেখেছ। গাইড দেখে, পি-কে দিয়ে ওদের নম্বরটা খুঁজে বের করেছিলাম। ওর বাবার নামেই ফোন ছিল। তবে কিনা ভায়া, তোমাদের যুগ নয়, আগেই বলেছি। অপারেটারের কাছে নাম্বার চেয়ে জিভটা একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। গলায় এক ফোঁটা স্বর ছিল না, দরদরিয়ে ঘাম ঝরছিল। “হ্যালো” বলে যিনি ফোন ধরেছিলেন, তিনি যে নীরজার বাবা, তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরেছিলাম। তিনি তিনবার জিজ্ঞেস করবার পরে আমি হঠাৎ বলে উঠেছিলাম, অমুক কথা বলছি, একটু নীরজাকে ডেকে দিতে হবে।

‘বলেই, একটা প্রচণ্ড চিৎকারের ভয়ে রিসিভারটা জোরে চেপে ধরেছিলাম। কিন্তু বুঝলে ভায়া, সংসারটা বড় ঘোরালো, মানুষ তার চেয়ে ঘোরালোতর। তিনি এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে, একটু অবাক হয়ে, ভারী মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কে, আমাদের শান্তিনিকেতনের অচিন্ত্য নাকি?” তখন আমারই যেন একটু বেকুব অবস্থা। বললাম, “হ্যাঁ।” তিনি তৎক্ষণাৎ অত্যন্ত শান্ত শালীন ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি কলকাতায় এসেছ নাকি? কবে এলে?” তার জবাব দিলাম। তিনি খুব চিন্তিত হয়ে জানতে চাইলেন, “এই পরীক্ষার সময় তুমি কলকাতায়, আপদ-বিপদ কিছু ঘটেনি তো?” বললাম, “সে রকম কিছু না, নীরজার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাইছিলাম।” তখন যেন কেমন একটু সাহস ফিরে আসছিল। তিনি বললেন, “ও, আচ্ছা তুমি একটু ধরো, আমি দেখছি খুকুনি কোথায়, একটু ধরো!”

‘খুকুনি হল নীরজার বাড়িতে ডাকা নাম। ও নামে ডাকবার অধিকারটা সে পরিবারের বাইরে আমাকেই দিয়েছিল। অনেক দিন পরে সেই নামটা শুনে যেমন মনটা টলমলিয়ে উঠছিল, তেমনি ওর বাবার ব্যবহারে বিস্ময়ে প্রায় অবশ হয়ে গিয়েছিলাম। সে যেন আগুনের ভয়ের কাছে জলের মতো মনে হয়েছিল। ঝড়ের বদলে শান্ত স্তব্ধতা। নীরজার চিঠির সঙ্গে যেন তাঁর কথা, গলার স্বরের কোনও মিল ছিল না। কিন্তু সময় চলে যাচ্ছিল, কতক্ষণ গিয়েছিল, খেয়াল করিনি। তবে বেশ খানিকক্ষণ। একসময়ে হঠাৎ মনে হয়েছিল, তাই তো, কেউ ধরে না যে। ছেড়ে দিল নাকি? যখন প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছি, তখন ওপারে খুট করে একটা শব্দ হল, আর আমার শরীরে মনে ঝঙ্কার দিয়ে বেজে উঠল, “হ্যালো।”

‘শুনেই চিনতে পারলাম, নীরু—নীরজা, কিন্তু গলার স্বরটা বড় নিচু, ভেজা ভেজা। যেন সেইমাত্র কেঁদেছে ও। বলে উঠলাম, “আমি অচিন, আমি এসেছি।”

বলতে বলতে অচিনদা আবার ফুলে ফুলে হেসে উঠলেন। যেন কী এক হাসির গল্প বলছেন। হাসতে হাসতেই আস্তে একটু কেশে নিয়ে বললেন, ‘আমার সেই বলার ভঙ্গিটা মনে করে তারপরে একলা একলা অনেক দিন হেসেছি। আমি আসলে ভুলেই গিয়েছিলাম, টেলিফোনের নিভৃতিটা আসলে নিভৃতি নয়। নীরু যেখান থেকে কথা বলছে, সেই ঘরে ওর বাবা মা দাদা ওকে ঘিরে আছেন। আমার কথা বলার যেমন স্বাধীনতা, ওর তা নেই। কিন্তু জবাবে ও কী বলেছিল জানো? যেন প্রায় অবাক হয়ে কোনওরকমে জিজ্ঞেস করেছিল, “কেন?” কেন? আমার হাত কেঁপে গেল, গলাও। মুহূর্তে যেন অন্ধকার দেখলাম। এ কোন নীরজা কথা বলছে আমার সঙ্গে? আমি আবার বলে উঠলাম, “আমি, আমি অচিন বলছি, আমি তোমার জন্যে কলকাতায় এসেছি।” কয়েক মুহূর্ত কোনও জবাব নেই। আমি আবার বলে উঠলাম, “নীরু, তুমি বাহুবলের কথা লিখেছ, আমি তাই এসেছি।” একটু পরে ওপার থেকে শব্দ এল, “ও!” যেন নীরজা বড় ক্লান্ত, অসুস্থ, দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারছে না। তারপরেই হঠাৎ বলে উঠল, “তুমি আমাদের বাড়িতে এস একবার।” বলেই লাইনটা ছেড়ে দিল। আমি রিসিভারটা ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কোন কথা থেকে যে কোন কথা হল, কিছুই বুঝতে পারলাম না। নীরজাকে যেন অচেনা লাগল একটু পরেই, হঠাৎ খেয়াল হল, ও আমাকে ওদের বাড়ি যেতে বলেছে। মনে হতেই রিসিভারটা নামিয়ে রেখে ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। মনে হল, নাকচ নয়, আমার আশা আছে। নিশ্চয়ই আছে, নইলে নীরু ওদের বাড়ি যেতে বলবে কেন। দেরি না করে তখনই আমি ওদের বাড়ি চলে গেলাম। এখনও চোখের সামনে ভাসছে, দু’দিকে দুটো গ্যারাজের মাঝখানে গেট। গেটটা খোলাই ছিল। ঠেলে ভিতরে ঢুকে সামনে বারান্দাওয়ালা একতলা বাড়ি। দরজা জানালা সবই ভিতর থেকে বন্ধ। বারান্দার দু’পাশে আরও দুটো ঘরের দরজা, সেগুলোও বন্ধ। সামনের দরজার গায়েই ঠকঠক করে টোকা দিলাম। তখন শুধু কানে বাজছে, “তুমি আমাদের বাড়িতে এস একবার।” নীরু ডেকেছে, আর আমার ভয় নেই, কাউকে আমার ভয় নেই। শুধু ভাবছি, দরজা খুলেই নীরজা আমাকে বলবে, “অচিনদা, আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল।” একবারও ভেবে দেখিনি, কোথায় নিয়ে যাব।

‘দরজা খুলছে না দেখে আবার টোকা দিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেল। নীরজা নয়, বুঝতে পারছ, ওর বাবা। আমাকে দেখেই সাদরে ভিতরে ডাকলেন, “এস, এস, অচিন, এস বসো।” চিনতেন তো আমাকে আগে থাকতেই। ব্রিটিশ আমলের সরকারি অফিসার, তাদের ব্যাপারই আলাদা। গায়ে গাউন, পরনে পায়জামা, ঢিলেঢালা আরামে সকাল কাটাচ্ছিলেন। আপ্যায়নটা একটু বেশি বেশি মনে হল, তার ওপরে, বুঝলে ভায়া, বাঙাল তো আমি। ঘরের সাজগোছের ঝকমকে কেতাকায়দা দেখে কেমন যেন মিইয়ে যেতে লাগলাম। আমি একটা সোফায় বসতে উনিও বসলেন। বললেন, “একটু চা দিতে বলি, কেমন?” আমি বললাম, “না, থাক। না।” আমার লক্ষ তখন বাড়ির ভিতরের দিকে দরজায়। কিন্তু সেখানে এত মোটা পর্দা যে, কিছুই দেখা যায় না। ভিতরের দিকে জানালাগুলো ভোলা, কিন্তু সেখানেও সেই মোটা পর্দা। সবই এত চুপচাপ, বাড়ির ভিতরে লোক আছে বলে মনে হয় না।

‘নীরজার বাবা বললেন, “না, না, থাকবে কেন, একটু চা খাও।” বলে চাকরকে ডাকলেন। চাকর এসে পর্দা সরিয়ে চায়ের হুকুম নিয়ে চলে গেল। এক পাশে পিয়ানোর ওপরে টাইমপিস ঘড়ি। সেখানে টিকটিক শব্দ ছাড়া কিছু নেই। আমি কিছুই বলি না। একটু পরে উনি জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, কলকাতায় কোথায় উঠেছি। পড়াশুনা কেমন চলছে। পাশ করলে কী করব, এইসব নানান সাতসতেরো, যার অর্থ হল সময় কাটানো। আসল কথায় কেউ নেই। ইতিমধ্যে চা এসে গেল, তার সঙ্গে কিছু টা-ও বটে, তবে খেতে ইচ্ছে করল না। চা-টাই কোনওরকমে শেষ করলাম। তারপরে দেখলাম, ভদ্রলোকের মুখের আকৃতি আর রং বদলাতে লাগল। হঠাৎ বললেন, “তোমার কথা আমি সব শুনেছি, মানে খুকুনিকে নিয়ে যেসব কথাবার্তা হয়েছে। দেখ, তুমি বোকা নও, বুদ্ধিমান, শিক্ষিত, আমাদের মনোভাব বুঝতে তোমার কোনও অসুবিধে হওয়া উচিত নয়। তোমাকে আমি সমবেদনা জানাচ্ছি, কেন না খুকুনিও একটু দোষ করে ফেলেছে, তোমাকে ভুল বোঝার অবকাশ দিয়েছে, আসলে ব্যাপারটা একেবারেই অসম্ভব।”

‘অসম্ভব শব্দটাকে এমন করে বললেন, যেন তারপরে আর কোনও কথাই থাকতে পারে না। আমি তখন ঘামতে আরম্ভ করেছি, কথা বলতে পারছি না। অপমান আর প্রত্যাখ্যানের ঠিক এ চেহারাটা আমার দেখা বা জানা ছিল না। চেঁচামেচি করলে, তাড়িয়ে-টাড়িয়ে দিলে, তবু যা হোক, তখুনি কিছু বলতে পারতাম। তিনি সেই সুযোগে আমাকে আরও বুঝিয়ে যেতে লাগলেন, এসব ভাবনা ছেড়ে, ভালভাবে লেখাপড়া শেষ করে নিজের কেরিয়ার গড়ে তুলি যেন। কত ভাল মেয়ে আমার জীবনে তখন আসবে, তখন নাকি আমি নিজেই এসব কথা মনে করে লজ্জা পাব, হাসব।’

বলতে বলতে সত্যি অচিনদা হেসে ওঠেন। কে যেন কাঠের আগুন উসকে দেয়। একটা বড় শিখা দপ করে জ্বলে ওঠে। পশ্চিমা বাতাসে কাঁপে থরথর। মনে হয়, নাচের আসর ঝিমিয়ে গিয়েছে। সবাই যেন নেই। কারা কোথায় নাচতে নাচতে হারিয়ে গিয়েছে বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে। আমি দেখি, আগুনের আলো কাঁপে অচিনদার মুখে। তিনি হাসেন আপন মনে। এখন বোধ হয় আর শ্রোতার কথা ওঁর মনে নেই। আর নিজে নিজেই যে বলেন, ‘তা হ্যাঁ, হাসি বই কী, এখন হাসি, খুব হাসি, তবে লজ্জা পাই কিনা, বুঝতে পারি না।’

হঠাৎ একটু থামেন, তারপরে ঘাড় নেড়ে বলেন, ‘না, লজ্জা পাই না। কী পাই, তা জানি না, তবে হাসি। তারপরে তিনি যখন কথার পাট একেবারে চুকিয়ে দিতে চাইলেন, “অতএব এটা সম্ভব নয়, বুঝতেই পারছ” তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?” তিনি শক্ত মুখে ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। কিন্তু রাগ করলেন না, হেসে ফেললেন, বললেন, “তা হলে। আর তোমাকে এতক্ষণ কী বললাম। যেসব কারণে সম্ভব নয়, সবই তোমাকে বলেছি।”

কিন্তু আমার যুক্তি অন্যরকম। তাই বললাম, “কিন্তু নীরজার তো আপত্তি নেই।”

‘তিনি আবার গম্ভীর হলেন, মুখ আরও শক্ত হল। আমার মনে হল, বাড়ির ভিতরের জানালা এবং দরজার পর্দার কাছে কে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে আড়ালে। অর্থাৎ কথাবার্তার শ্রোতা ছিল। নীরজার বাবা এবার কঠিন গলায় বললেন, “জানি, সে লজ্জার কথাটাও জানি। কী করে এরকম ঘটল, জানি না; তবে এ বাড়িতে ছেলেমেয়েদের আপত্তি-সম্মতিই বড় কথা নয়, অভিভাবকদের কথাই কথা। আর, খুকুনির বিয়ের কথাবার্তা অনেক আগে থেকেই অন্য জায়গায় পাকা হয়ে আছে, এখন এসব কথা নিরর্থক। আর…।” এই পর্যন্ত বলে তিনি থামলেন। শক্ত মুখে বারেবারেই মুঠি পাকাতে লাগলেন। আসলে তিনি রাগ চাপছিলেন। তারপরে মুখ খুললেন, “আর তারপরেও যদি এটা নিয়ে কোনওরকম বাড়াবাড়ি করো, তাতে আর কিছু লাভ হবে না। আমাদের পরিবারের কিছু দুর্নাম হবে, লোকে নানান কথা বলবে। তা হলে আমিও ব্যাপারটা ছেড়ে দেব না, বুঝতেই পারছ—ফ্যামিলি স্ক্যান্ডাল মেনে নিতে পারি না কিছুতেই। তবে তোমাকে এটুকু বলতে পারি, তোমার সঙ্গে খুকুনির বিয়ে কোনও মতেই হতে পারে না, এইটুকু ভেবে অন্তত তুমি গোলমাল করে কোনওরকম কেচ্ছাকেলেঙ্কারি করো না।” বলেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আবার বললেন, “তুমি বসো, আমি খুকুনিকে ডেকে দিচ্ছি।”

‘তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি অবিশ্যি তারপরেও নীরজাকে দেখতে পাব, আশা করিনি। এবার হয় যুদ্ধ নয় পশ্চাদপসরণ। কিন্তু উনি নিজেই খুকুনিকে ডেকে দিচ্ছেন বলায় আমার ক্ষোভ বেড়ে উঠতে পারল না। তিনি যেন আমাকে চমকে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন, আর আমি—আমি যেন এক অপরূপ দর্শনের আশায় দরজার দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। বুকটা ধড়ক-ধড়ক করতে লাগল। প্রতিটি পল যেন বিরাট, শেষ হতে চায় না। পর্দার নীচে দিয়ে, ওপাশে কেউ কেউ যাতায়াত করছে মনে হল।

‘সময়ের হিসাব দিতে পারি না, দেখলাম পর্দা উঠল, নীরজা ঢুকল। ঢুকে দরজার কাছেই দাঁড়াল। একবার আমার দিকে তাকাল, তৎক্ষণাৎ চোখ নামিয়ে নিল। দেখলাম, ওর চোখ তখনও লাল। নাকের ডগা লাল। সমস্ত মুখটা ভার, এই মাত্র চোখ মুছে এসেছে যেন। একটা বাসি বিনুনি পিঠে এলানো, জামা-কাপড় তেমন ফিটফাট নয়, বোধ হয় শুয়ে ছিল বা বসে ছিল। ওরকম অবস্থায় ওকে একবারই দেখেছিলাম, যেদিন ওকে শান্তিনিকেতন থেকে নিয়ে আসে, তার আগের দিনের শেষ দেখায়।

‘আমার চেতনা ছিল না যে, দরজা-জানালার পর্দার ওপারে অনেক শ্রোতা, অনেক সাক্ষী। আগেকার মতোই, কাছে যাবার জন্যে আমি ব্যগ্র। আমি উঠে দাঁড়ালাম, কোনওরকমে ওকে একবার ডাকতে পারলাম। তার জবাবে ও আমার দিকে না তাকিয়ে দরজা আর জানালার দিকেই চকিতে একবার দেখে নিল। তখনই আমি টের পেলাম, ওখানেই সবাই রয়েছে। নীরজা পায়ে পায়ে কাছে আসতে আসতে বলল, “বসো।”

‘বসতে বলল, কিন্তু ওর গলার স্বর খুব স্থির নয়। চোখও পরিষ্কার নয়, একটু যেন ঝাপসা মতোই। আমি যন্ত্রচালিতের মতো বসলাম। ও একটু দূরে বসল, বসেই রইল চুপ করে। আমি থাকতে পারলাম না, বলে উঠলাম, “তুমি আমাকে বাহুবলের কথা লিখেছিলে, আমি তাই এসেছি।”

‘তার জবাবে ও মুখ না তুলেই আস্তে আস্তে মাথা নাড়তে লাগল। সেইভাবেই বলল, লিখেছিলাম, কিন্তু তা সম্ভব নয়।” বলে ও আমার দিকে তাকাতেই ওর চোখে জল এসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁপতে লাগল।’

অচিনদা থামলেন। এখন আর হাসেন না। কোন দিকে তাকিয়ে আছেন, বুঝতে পারি না। ভুরুর ঢাকায় চোখ দেখতে পাই না। এখন যেন অনেকটা ভাবলেশহীন মুখে নিবে যাওয়া চুরুটে বার কয়েক টান দেন। ওদিকে মনে হয়, নাচের আসরটা আশেপাশের অন্ধকারে চলে গিয়েছে। জীবন কেন বিচিত্র, তার জবাবে শুনি, অচিনদা যখন নীরজার কান্নার কথা ভাবেন, তখন বাঁশঝাড়ের কোথায় যেন রঙ্গিণীর খিলখিল হাসি বেজে ওঠে। বুড়ো শুণ্ডি ঝিমোয়। মাংরি বা কোথায়! নরোত্তমকেও দেখি না। অথচ টের পাই, সবাই যেন আশেপাশেই আছে।

অচিনদা নেবানো চুরুট আর ধরাবার চেষ্টা করেন না। বলেন, ‘ইচ্ছে হল, উঠে নীরুর কাছে যাই। পারলাম না, কারণ মনে হল, অনেক চোখ আমাদের দেখছে। কোনওদিন তো কারুর সামনে ওর কাছে গিয়ে হাত ধরিনি। আর, সাহিত্যিক ভায়ার অজানা নেই, ছেলেরা কখনও কাঁদে না। তবে নীরুর ঘাড় নাড়া, কেঁদে ওঠা দেখে, কথা শুনে, হঠাৎ যেন বুঝতে পারলাম, ঝড়ে আমার দুয়ার ভাঙা, বুক-জোড়া অন্ধকার। তবু ডাক দিলাম, “নীরু।”

‘ডাক শুনে নীরজা একটু স্থির হল। আঁচলে চোখ মুখ মুছল। একবার কোনও রকমে আমার দিকে তাকাল। মুখ নিচু করেই বলল, “কথাটা লিখেছিলাম এক মন নিয়ে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, তার পরিণতি ভাল হবে না। তোমার ভীষণ ক্ষতি হবে।”

‘আমি যেন একেবারে অসহায় ছেলেমানুষের মতো বলে উঠলাম, “তা হলে কী হবে নীরু?” ও চুপ করে রইল। আমি আবার বললাম, “তুমি আমাকে আসতে বললে, মনে করেছিলাম, তবে বুঝি সব শুভ।”

নীরজা ঘাড় নেড়ে বলল, “না। ওরা টেলিফোনেই তোমাকে সব কথা বলতে চেয়েছিল। আমি তা পারিনি। আমি তোমাকে চলে আসতে বলেছি হঠাৎ, তাতে এরা খুশি হয়নি। কিন্তু আমি—আমি একবার না ডেকে পারলাম না।”

‘জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?” নীরজা একটু চুপ করে থেকে আমার দিকে তাকাল। আমার চোখের দিকে। তারপরে বলল, “আমার সুখ-দুঃখের কথা জিজ্ঞেস করো না, হয়তো এই শেষ কথা, এই শেষ দেখা।” কথাটা শোনা মাত্র বাতি যেন একেবারে নিবে গেল। এখন বলতে পারি ভায়া, তখন কথা শেষ, বেহাগের সুর বেজে উঠেছে, এবার বিদায়। কিন্তু ব্যাপারটা তো তেমন সোজা নয়। নীরজার চোখ ভেসে গিয়েছে, আমার যে কোথায় ভাসছে জানি না। কতখানি হারিয়েছি, তার হিসাবও জানি না। তখন ভাব অ-ভাবের মাঝে একটা আচ্ছন্নতা। কেবল এইটুকু বলতে পারি। নীরুর ওপর রাগ হয়নি, ওকে দোষ দিয়ে নালিশের কথা মনে আসেনি, ওর মন সম্পর্কে অন্যায় কিছু মনে হয়নি। কারণ ওর মন ছোট, এ আমি বিশ্বাস করি না। কেন জানি না, তখন গুরুদেবের মুখখানি একবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল।’…

অচিনদা চুপ করেন। ওঁর চোখ বোজা। ভুরু ওপর দিকে টেনে তোলা। আমি স্থান কাল পাত্র ভুলে যাই। চেয়ে থাকি নিমেষহারা চোখে। অচিনদার গলা বেজে ওঠে, ‘ভিতরের দরজার পর্দাটা একবার দুলে ওঠে। যেন কেউ ঢুকতে এসে ফিরে গেল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। আর একবার ইচ্ছে করল, ওর কাছে যাই, পারলাম না। মনের জোরের অভাবে নয়, দূষিত চোখগুলোকে করুণা আর উদারতা দেখাতে দিতে ইচ্ছে হল না। বললাম, “নীরু, হয়তো শেষ, তবু আছি, জেনো। চলি।”

‘আমার কথা শুনে ও যেন চমকে উঠল। ঝাপসা ভেজা চোখ নিয়েই চমকানো ভাব নিয়ে তাকাল। বলল, “চলে যাচ্ছ?”

‘আমি তখন উঠে দাঁড়িয়েছি। বললাম, ‘হ্যাঁ, যাই। দুপুরের গাড়িতেই ফিরব।” বলে দরজার কাছে যেতে যেতেও মনে হল, কী কথা যেন বলা হয়নি। পুরুষের মন তো, একটা কী যেন তার মনের মধ্যে থেকে যায়। তাই আর একবার ফিরে তাকিয়ে বললাম, “নীরু, চিঠিতে যে লিখেছ, ‘তুমি বড় খারাপ, বিষের মতো খারাপ,’ এখনও তা-ই আছি তো?”

‘কথাটা শুনে নীরু স্থির থাকতে পারল না। আবার দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল, ফুলে ফুলে উঠে চুপি চুপি গলায় বারে বারে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ।”… দরজা খুলে পথে বেরিয়ে এলাম, সবই একটু ঝাপসা লাগছিল। কিন্তু বুকের মধ্যে কোথায় যেন ভরে ভরে উঠল, হাসির ভরা নয়, কিন্তু সেও যেন এক সুখের ভরা। কানে বাজতে লাগল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ।” সেই দিন দুপুরেই ফিরে এসেছিলাম শান্তিনিকেতনে। কিন্তু ভায়া, এখন রাত্রি দুপুর, এর পরে আর বস্তাপচা গল্প জমবে না। নরোত্তমের খোঁজ করতে হয়।’

.

৫৩.

অচিনদা কথা শেষ করেই, ফস করে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালেন। নিবে যাওয়া চুরুটে দেন আগুন। দু’গালেতে ঢেউ তুলে জোরে জোরে টানেন। কিন্তু আমি যেন দিশাহারা বিভ্রান্ত। যেন কার হাত ধরে চলেছিলাম অচিনের অন্ধকারে। সহসা হাত ছেড়ে যায়। পথ হারিয়ে ঠেক খেয়ে যাই, ধন্দে পড়ি। পথের কোন সীমানায়, কোন দূরত্বে আছি, টের পাই না। তাই অচিনদার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।

রাত দুপুরের হিসাব কে মনে রেখেছে হে। অচিন-নীরজায়ন সংবাদ যেখানে এসে ঠেক খেয়ে গেল, সেখানে আমি পথহারা। সংবাদের শুরু শুনিনি। শেষ পেয়েছি বলেও মনে হয় না। অন্তরা শুনিয়ে গায়ক থামেন। শ্রোতা এখন আপন দায়ে অস্থায়ী আর আভোগের লাগি উৎকর্ণ। এখন তার স্থানকালের হিসাব নেই।

কিন্তু অচিনদার মুখে আবার সেই আগের মানুষ জাগেন। মিটি মিটি হেসে, হাত তুলে, কব্‌জির ঘড়ি দেখান। বলেন, “আর নয়, চলো এবার ফেরা যাক।’

আমি বলি, ‘কিন্তু শুরু আর শেষ পেলাম না।’

অচিনদা হাসেন। কেন যেন মনে হয়, উনি আমার কাছে এসেছেন আরও অনেক বেশি চেনা, অনেক অন্তরঙ্গ। সময়, তুমি তফাত যাও। বয়স, তোমার বিবেচনা নিয়ে বিদায় হও। অচিন প্রৌঢ়ের কোনও বয়স নেই। আমি দেখি, বহুদিনের চেনা এক বন্ধু আমার সামনে। বলেন, ‘গল্প-লিখিয়েদের নিয়ে এই মুশকিল। তাদের মাঝখান দিয়ে কিছু বোঝানো যাবে না, শুরু চাই, শেষও চাই। কিন্তু ভায়া, আমি তো গল্প-লিখিয়ে নই। ওসব ধরতাই আর শেষ জানি না।’

আমি বলি, ‘কিন্তু এদিকে যে মন মানে না।’

অচিনদা জোরে হেসে উঠে আমার পিঠে চাপড় দেন। আমার কথার জবাব না দিয়ে হাঁক দিয়ে ডাকেন, ‘কই রে, তোরা সব গেলি কোথায়।’

প্রথম জবাব দেয় বুড়ো শুণ্ডি। ঝিমুনি কাটিয়ে বলে, ‘এই তো আছি।’

বলে সে কাঠ খুঁচিয়ে আগুন উসকে দেয়। নরোত্তম অন্ধকার থেকে আলোয় উদয় হয়। দেখি, তার পিছু পিছু মাংরি। ক্যানে, ই দুটোতে কুথা ছিল হে। নরোত্তমের চোখে রসের ঝিকিমিকি। তবু রক্ষে, হাত পা টলোমলো না। সে-ই যে আমাদের সারথি।

মাংরি বলে নরোত্তমকে, ‘কী রে, লাচ শিখবি না!’

বলে, হাসে খিলখিল করে, আগুনের যেমন শিস কাঁপে তেমনি শরীর কাঁপিয়ে। নরোত্তম যেন জ্বরো স্বরে জবাব দেয়, ‘আর না, বাবুদের লিয়ে যেতে লাগবে না!’

অচিনদা বলেন, ‘ও বাব্বা, এর মধ্যে আবার লাচ শেখাশিখিও হচ্ছিল। তা বাবা, লিয়ে যেতে পারবে তো।’

নরোত্তম বলে, ‘অই কী বলেন গ বাবু, তা আর পারব না!’

মাংরি গিয়ে আবার বুড়ো শুণ্ডির পাশে বসে। আর একদিক থেকে এগিয়ে আসে বরহম। অচিনদাকে বলে ‘চললি?’

অচিনদা উঠতে উঠতে বলেন, ‘তবে কি সারা রাত এই জঙ্গলে বসে থাকব নাকি!’

বরহম বলে, ‘খালি তো উই খোকাবাবুটার সঙ্গে কথা বুইললি। টুকুস লাচ করলি না, গান করলি না।’

অচিনদা বলেন, ‘আবার হবে।’

আমিও উঠি। বরহমের তখন জিভ ভারী, তবু কথায় পেয়েছে। বলে, ‘আবার কবে হবে! আর কি তুই আসবি! বুইললি, ছেলেটাকে নষ্ট করবি, তাও করলি না, শুকনা মুখে লিয়ে যেইছিস।’

অচিনদা একবার আমার দিকে চেয়ে হাসেন। বলেন, ‘আরে, ওর কি কিছু আছে যে নষ্ট করব, এ ছেলেটা একেবারে পাক্কা নষ্ট।’

এবার আওয়াজ দেয় মাংরি, ‘অই, মিছা ক্যানে বুইলছিস, লষ্ট মানুষ অইরকম লাগে না।’

তার জবাব দেয় বুড়ো শুণ্ডি, ‘মাংরির হাতে দিলে দেখতে, কেমন লষ্ট করতে পারে।’

বলে সে হাসে। তার চেয়ে জোরে, খিলখিলিয়ে বাজে মাংরি। আর মাংরির বাবা স্বয়ং বরহম ঘাড় দুলিয়ে বলে ওঠে, ‘হঁয় হঁয় হঁয়।’

অচিনদা নকল কোপে ভুরু কুঁচকে তাকান মাংরির দিকে। আমি অবাক লজ্জা মানি। কেমন কথা, কত সহজে সবাই ভাবে। আবার বাপ্‌ বলে হঁয় হঁয়। অচিনদা মুখ ফিরিয়ে বরহমকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এরা সব কোথায় গেল? শরত, তোদের বউয়েরা?’

বরহমের শরীরে একটা দোলা লাগে। হাতের ঝাপটা দিয়ে মাতাল ভঙ্গিতে বলে, ‘আ দূর, অই উখানটোয় সব ঘুমাচ্ছে।’

‘তবে যা বাবা, তুইও গিয়ে ঘুমো, আমি চলি। এসো হে। চল রে নরোত্তম।’

অচিনদা পা বাড়ান। বরহম টলতে টলতে এগিয়ে আসে, ‘না, তুই অখন যাস না। বস ক্যানে, রস খাবো না তোর সাথে?’

অচিনদা না থেমেই বলেন, ‘খুব হয়েছে, আজ আর না।’

কিন্তু কে কার কথা শোনে। বরহমও সঙ্গে সঙ্গে এগোয়, বলে, ‘না না, অই অচিনবাবু, একটু থাক, যাস না। দুটো কথা হল না, তুই হাসলি না, কাঁন্দলি না। একবারটো কেঁন্দে যা, আমরাও কাঁন্দব, পিতি বছরের মতন।’

আমি অবাক হয়ে অচিনদার দিকে তাকাই। অচিনদা বলেন, ‘বাজে কথা, মাতালের প্রলাপ, ওসব শুনো না।’

তবু আমার মনে ধন্দ লাগে। প্রলাপ বটে, তবু কথার মধ্যে কেমন একটা ঘটনার সংকেত ফোটে যেন।

বরহম প্রতিবাদে গোটা শরীর নিয়ে ঢলে পড়ে, ‘অই, বাজে বুইলছিস ক্যানে। তুই কাঁন্দিস না? আমরা কাঁন্দি না?’

সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে অচিনদা বলেন, ‘যা এখন যা। মাতাল হলে সবাই সব করে।’

বরহম তেমনি বলতে থাকে, ‘তুই কত কথা বলিস, কত কাঁন্দিস, অই অচিনবাবু।’

বলতে বলতে সে অচিনদার একটা হাত টেনে ধরে। অচিনদাকে দাঁড়াতে হয়। নরোত্তম হুকুমমাত্রই বাতি জ্বালিয়ে গিয়েছিল। সে আমাদের আগে আগে। আমি দুই বন্ধুকে দেখি। দেখি, এখন আর অচিনদার হাসিটি তেমন এড়িয়ে যাবার ভোলানো হাসি না। বলেন, ‘আরে, খালি কাঁদলে কি কাঁদা হয়! মনে মনে কাঁদা হয় না?’

বরহম একটু ভাবে, তারপরে ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে বলে, ‘হঁয় হঁয়। মনে মনে হয়। তবে তুই চলে যেইছিস!’

‘হ্যাঁ।’

বলে অচিনদা একবার বরহমের হাতটা ধরেন। ওদিক থেকে বুড়া শুণ্ডি বলে, ‘আবার এস গ অচিনবাবু।’

‘আসব।’

বরহম অচিনদার হাতটা ছেড়ে দেয়। ঘাড় নাড়িয়ে বলে, ‘আচ্ছা, যা। আবার এক বছর পরে আসিস। ই বাবুটোকে লিয়ে আসিস।’

বলে সে আমার পিঠে একটু চাপড়ে দেয়। জিজ্ঞেস করি, ‘তোমরা বাড়ি যাবে না?’

‘না। কাল সক্কালে চলে যাব।’

অচিনদা এগিয়ে চলেন। আমার দিকে ফিরে আবার বলেন, ‘মাতালের কথা।’…

মনে মনে বলি, তা জানি না। অচিনদা কেবল বরহমকে মাতাল বলেন, না নিজেকেও, বুঝি না। কেবল এইটুকু বুঝতে পারি, অচিনদা ওদের সঙ্গে বসে কথা বলেন, হাসেন। ওরাও হাসে। অচিনদা কাঁদেন, ওরাও কাঁদে। ছবিটা মনে মনে আঁকি আর মনে মনে জিজ্ঞেস করি, কী বলে কাঁদেন অচিনদা। সেই ছবিটাও আমার একটু চাক্ষুষ করতে ইচ্ছা করে।

বাঁশঝাড়ের আড়াল ছাড়িয়ে টিবির নীচে নেমে আসতেই উত্তর-পশ্চিমা হিমেল হাওয়ার থাবা ঝাঁপিয়ে পড়ে। গালে গলায় আঁচড়ে দেয়। তবু অন্ধকার যেন অনেক সহনীয়। নরোত্তমের আলোর চেয়ে চোখের জ্যোতি কাজ করে অনায়াস।

অচিনদা যেন নতুন করে কিছু শুরু করেন না, এমনি সহজ গলায় বলেন, ‘শুরুটার মধ্যেও এমন কিছু নেই যে, তোমাকে চমকে দিয়ে অবাক করে দিতে পারি। আমরা সেকালের লোকেরা এখনও বলি, প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে। মেয়ে-পুরুষ নিজেরা পেতে রাখে বলে বিশ্বাস হয় না। কে পেতে রাখে তাও জানি না। বিষয়টাকে যদি প্রকৃতিঘটিত মনে করি, তা হলে বলতে হয়, ফাঁদ পাতা যার কাজ সেই পেতে রাখে। ধরা যাদের পড়বার, তারা ধরা পড়ে। তবে হ্যাঁ, ফাঁদের চেহারাটা নানাখানে নানারকম। আমাদের ফাঁদের রংটা ছিল সবটুকু লাল। কারণ, তখন হেমন্তকালের শেষ, শীতের প্রায় আরম্ভ। শান্তিনিকেতনের শীতের আরম্ভ যারা দেখেছে—দেখেছে বলতে শুধু চোখের দেখাই বলি না, যে দেখাটা মরমের ভেতর অবধি কাজ করে সেই দেখার কথা বলছি, সে আর জীবনে কখনও তা ভুলতে পারবে না।

‘যাই হোক, ফুল-ফলের কথা বলছি না, কিন্তু সব মিলিয়ে এত লাল অন্য সময়ে বোধ হয় দেখা যায় না। লাল মাটিতে তখন ধুলোর ছড়াছড়ি সবখানেই, মাঠে-ঘাটে-পথে, গাছের গায়ে গায়ে, পাতায় পাতায়, বাড়ি-ঘরের দেওয়ালে, বেড়ায়। তার ওপরে তখন খেলার মাঠের ওপারে পশ্চিমের কোণে সূর্য লাল টকটকে। বলতে পারো সময়টা বিকেল। একে তো লাল মাটির ধুলোয় সব রাঙা, তার ওপরে লাল সূর্যের ছটায় সবই আরও বেশি লাল। সেইজন্যেই বলছিলাম, ফাঁদটার রং ছিল লাল। রূপের সঙ্গে শব্দের কথাটাও আসে। বোধহয় একটু বেশি করেই আসে। যদিও রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর, তবু এ প্রসঙ্গে তোমাকে একটা কথা শুনিয়ে রাখি। তোমরা, হালের লেখকরা, কীভাবে ভাবো সবটা জানিনে, গুরুদেব একবার বলেছিলেন, যদি দৃষ্টি আর শ্রবণ, দু’টোর কোনও একটা আমাকে হারাতে হয়, তবে আমি দৃষ্টিটাকেই ছাড়তে রাজি আছি, কিন্তু শ্রবণকে নয়। তার মানেই বুঝতে পারছ, বাণীর জগতেই এ মানুষের কাব্যের সংসার পাতা ছিল, শব্দ যেখানে নিত্য-অনিত্যের খেলায় লীলা করেছে। এ মানুষ কখনও গান না বেঁধে পারেন? সুর দিয়ে গান না গেয়ে পারেন?

‘কিন্তু এসব কথা থাক। সামান্যের মধ্যে অকারণ এসব অসামান্যের আমদানি করা মিছে। এ আমার একটা দোষের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে। যা বলছিলাম, ফাঁদের লাল রঙে শব্দ যেগুলো ছিল, তার মধ্যে প্রথমেই মনে পড়ছে গলা খোলবার আগেই গলার আড় ভাঙবার জন্যে একটা কোকিলের অস্পষ্ট ভাঙা-ভাঙা ডাক। জানিনে, কখনও সেরকম ডাক শুনেছ কিনা, বলতে পারো, ভেতরের আবেগটা গলায় তখনও ভাল করে ফোটেনি। সবেরই একটা সময় আছে তো। পাখিদের তখন ঘরে ফেরার সময় হয়ে এসেছে, তবে দল বেঁধে ডাকাডাকি আরম্ভ হয়নি, দু’চারটে হঠাৎ হঠাৎ শিস, পিক্‌পিক্‌ কিচকিচ গাছের ঝুপনিতে, ঝাড়ে। একটু ভাল করে কান পাতলে ঝিঁঝির ডাক শোনা যায়।

‘ঘরে যাবার আগে একলা-একলা শেষ পাক দিয়ে ফিরছিলাম রেল-লাইনের দিক থেকে। তখন নতুন সিগারেট খাওয়া শিখেছি। তবে আশ্রমের বাইরে বিকেল-সন্ধেয় ঘুরে বেড়াবার সময়ে এক-আধটা। পকেটের মধ্যে সেটা খোঁচাচ্ছিল বলে খেয়ে ঢোকবার মনস্থ করলাম। আদি বাড়ির দক্ষিণে ফটকের কাছ থেকে খানিকটা বটতলার দিকে এগিয়ে ঠোটে সিগারেট চেপে যেমনি দেশলাই জ্বালতে যাব, পেছনে পায়ের শব্দ। চমকে সিগারেট নামিয়ে ফিরে তাকাতেই দেখলাম, ডোরাকাটা শাড়ি পরা এক মেয়ে। বিকেলে বাঁধা চুল, একটু লম্বা মুখে ডাগর দুটো চোখ। চোখ দুটিতে কৌতুকের ঝিকিমিকি, পাছে হাসি ছিটকে পড়ে তাই মুখে হাত চাপা। আমার মুখে তখনও ধরা পড়ে যাওয়া চমকের ভাবটা যায়নি। কয়েক মুহূর্ত সেই অবস্থায় থেকে মেয়েটি আমার সামনে দিয়েই এগিয়ে গেল। যাবার সময় কাছাকাছি আর একবার আমার মুখের দিকে তাকাতেই হাসি সে ধরে রাখতে পারল না, খিলখিল করে বেজে উঠল। তার ডোরা শাড়ি-পরা শরীর বেঁকে গেল হাসিতে। কয়েক হাত গিয়ে আবার ফিরে তাকাল, আবার হাসি, তারপরে বাঁয়ে মোড় নিয়ে অন্তর্ধান। ব্যাপারটা বোধগম্য হয়ে যখন নিজেকে ঠাট্টা করে হেসে ফেললাম, তখন পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হয়ে গেছে। চোখ আর মনের সবখানে জেগে রইল শুধু একটি মুখ।

‘তোমাদের ভাষায় এটাকে যদি একটা গল্পের শুরু বলা যায়, তবে সেটা যে বস্তাপচা, তাতে সন্দেহ নেই। আরও সন্দেহ নেই, কারণ প্রেম বলে একটা ব্যাপার, তার মধ্যে কত কিছু থাকে, কত কথা, কত বিচিত্র তার গতিবিধি, রীতি, কিন্তু আমাদের ফাঁদে পড়ার প্রাথমিক আচরণে দেখা গেল, চোখাচোখি হলেই কেবল হাসি। নীরজা তখন বোধ হয় নবম শ্রেণীর ছাত্রী—তোমাদের গল্পের আসরে যে মেয়েরা নায়িকার পোস্ট পাবার একেবারেই অযোগ্য। ম্যাট্রিক পাশ করে আমার তখন কলেজের শিক্ষা চলছে। দেখাদেখি চোখাচোখি হলেই কেবল হাসাহাসি। নীরজার মুখে রং লেগে যায়, লজ্জায় অন্য রকম হয়ে যেত, তার নামই জানাজানি। আমার মুখের রং কতখানি বদলাত জানিনে, তবে কান-টান গরম হয়ে উঠত, বুকের কাছটায় রক্ত যেন ছলাত ছলাত করে আছড়াত।

‘এ সব যে কেমন করে ঘটেছিল তা বলতে পারব না। প্রথম দিকে বলতে পারো, দেখাদেখি চোখাচোখি করাটা, লেখাপড়া করতে, চলা-ফেরায় আপনা-আপনি যতটুকু হত ততটাই সম্বল। তারপরে দেখা গেল দুই মন, দুই প্রাণ তাতে তৃপ্ত নয়, নিজেদের ইচ্ছে আর চেষ্টা এসে যোগ দিল, কেমন করে একটু নিরিবিলিতে বেশি দেখাদেখি চোখাচোখি হয়। সে ইচ্ছে আর চেষ্টাও সফল হল, কিন্তু কাছাকাছি যাওয়া নয়। একটু দূর দূর থেকেই, “নয়নে নয়ন দিয়া” তাতেই ভায়া, “যৌবনের বনে মন হারাইয়া’’ যায়, আর “গায়ে আমার পুলক জাগে, চোখে লাগে ঘোর; হৃদয়ে মোর কে বেঁধেছে রাঙা রাখির ডোর।” এমন একটা প্রেমোপাখ্যানকে তোমরা এক কথাতেই ঠোঁট উলটে নাকচ করে দেবে; এখন আমিও তাই দেব। কিন্তু আমার যে তখন, “আমি যে আর সইতে পারিনে, সুর বাজে মনের মাঝে গো, কথা দিয়ে কইতে পারিনে।”

‘তৃতীয় ধাপটা তোমাদের আধুনিকদের কাছে সব থেকে হাস্যকর মনে হবে, কিন্তু আমাদের সময়ে সেটাই অনেকখানি। শুরু হল পত্রালাপ। পত্রালাপের গতিবিধি এখনকার আমলের গোয়েন্দাদেরও হার মানায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অনেক লোমহর্ষক ঘটনায় দেখলাম, কবরখানায় দলিল রেখে পাচার হয়েছে, ফিল্‌মের রীল রেখে দিয়েছে পাচারের জন্য সামান্য একটা নিরীহ পার্কের রেলিং-এর ফুটোর মধ্যে, তেমনি করেই লক্ষ লক্ষ ডলার মার্ক পাউন্ড রুবল। কিন্তু তার বহু আগেই ছাতিমের গুঁড়ির গর্তে, অমুক জায়গায় শালের চিড়-খাওয়া ফাটলে, অমুক জায়গায় নিচু আমগাছের মাঝখানে, নয়তো নিতান্ত কোনও ঝোপেঝাড়ে আমরা অন্য দলিল পাচার করেছি, আর সে স্পষ্টও খুবই নিরীহ, নিতান্তই চোখের তৃষ্ণায় আর কাব্যের দৌলতে তার পরিচয়। অবিশ্যি আগের চিঠিতেই জানাজানি থাকত, পরবর্তী ডাকঘর কোথায় হবে, কোন গাছে, কোন ঝোপে, আর সেটা উভয় পক্ষ থেকেই। সেইজন্যেই বোধ হয়, যুদ্ধ আর প্রেম কোনও লিখিতকথিত রীতিনীতির মধ্যে নেই। সে পত্রালাপের বয়ান যদি শোনো, মাঝরাত্রে এ খোয়াইয়ের মাঠে পাগলের মতো হেসে উঠবে। প্রথম দিকে তো কেবল কবিতার ছড়াছড়ি, নিজের কথার চেয়ে উদ্ধৃতিতেই ঠাসা, প্রাণ খুলে নিজেদের মনের কথা বলতেও যে লজ্জা! তখন কেবল বন্দিদশার কান্নাকাটি, কাছে যাবার আকুলতা। তাতেই বছর ঘুরে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বছরও ঘুরে যেত, কিন্তু—।’

অচিনদা হঠাৎ থামেন। এক মুহূর্ত থেমেই আবার যেই শুরু করেন তখন ওঁর গলার সুর বদলে যায়। বাঁশঝাড়েও যে স্বর শুনিনি, সেই স্বর বেজে ওঠে। হঠাৎ যেন কেমন চুপিচুপি ভয়-পাওয়া ব্যগ্র গলায় বলে ওঠেন, ‘কিন্তু সে কথাটা বলতে এখনও কেমন যেন হয়ে যাই, গলার ঠিক থাকে না। এমনকী ওই বরহমের কথাই সত্যি হয়ে যাবে, ভেউ ভেউ করে কাঁদতে আরম্ভ করব। তখন তুমি এই বুড়োকে নিয়ে ভারী গোলমালে পড়ে যাবে ভায়া।’

বলেই সত্যি সত্যি কাঁদেন না, কাশি পাওয়া গলায় হা হা করে হেসে ওঠেন। শুনতে যতই ভারী লাগুক, এ হাসি যেন আমাকে বিঁধে যায়। অচিনদার দিকে ফিরে তাকাই। ওঁর মুখ দেখতে পাই না। কিন্তু যেখানে এসে থামেন, তার ওপারের অন্ধকারে তখন আমার আপন খোঁজাখুঁজি। আমার ব্যগ্র চোখের দৃষ্টি সেখানে আতুর হয়ে ফিরে মরে। তাই মুখ ফুটে আপনি বেরিয়ে যায়, ‘তবু?’

‘তবু?’

অচিনদা প্রায় হুমকে ওঠেন যেন। বলেন, ‘খুবই প্রাণঘাতী লাগছে যেন, অ্যাঁ? আমি কাঁদি-মরি যাই হোক, শুনতেই হবে, না? অলকা আর আমিই তোমাকে ঠিক বুঝেছি। কপট আর নিষ্ঠুর। আসলে নিজের তৃপ্তিটুকু নিয়ে সরে পড়া। আর লেখক যখন পাঠক হয়, সে পাঠকের জাত আলাদা, তাও জানি। এখন রস নিংড়ে না বের করলে শান্তি নেই।’

তাড়াতাড়ি বলি, ‘না, না অচিনদা, আমি—।’

‘তুমি থামো হে ছোকরা। তুমি নতুন কিছু নও।’

‘তা ঠিক।’

‘সত্যি?’

বলে হেসে আমার কাঁধে হাত রাখেন। বলেন, ‘বলব হে, তোমাকে বলব বলেই মুখ খোলা। আর এই মুখ খোলার মুখে—হ্যাঁ, এ একটা সুখ বলতে পারো, যদি একটু কাঁদিই, না-হয় কাঁদবই। তবে অতটা গড়াবে না। আসলে পত্রালাপের বন্দিদশা থেকে যেদিন প্রথম ছাড়া পেয়ে দু’জনে কাছাকাছি হয়েছিলাম, সেদিনটার স্মৃতি বড় বেশি উতলা করে তোলে। এমন উতলা আর কোনওদিনের স্মৃতিই করে না, কেন, তা বলতে পারিনে ভায়া।

‘শুরুর অঙ্কটা এই একটি দিনের কথাতেই শেষ করব, বাকিটা রেখো তোমার কল্পনার মধ্যে। দ্বিতীয় বছরটাও ঘুরে যেতে গিয়ে বসন্তোৎসব এসে গেল। সেবার নতুন গান, নতুন পালা। এই যদি তোমার প্রথম আগমন হয়, তবে বসন্তোৎসবের চেহারা তুমি জানো না। শান্তিনিকেতনের অধিকাংশ উৎসবই প্রকৃতির সঙ্গে মেলানো, সবগুলোকেই বলতে পারো ঋতুর উৎসব। আমবাগানের যেখানে সবাই আসে, সভা বসে, সেখানে আলপনা ছবি আবীরের ছড়াছড়ি। সন্ধে হতে-না-হতেই বাতির আয়োজন। আমাদের সকলের কাজ, সকলেই ব্যস্ত। নীরজা আলপনা দিয়েছিল মেয়েদের সঙ্গে। চুলে তেল দেয়নি, বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছিল। সন্ধেবেলা সকলের মাঝখানে ওকে একটু আবীর ছোঁয়াতে গিয়েই বন্দিশালার গারদে ভাঙন ধরেছিল। তারপরে সমস্ত ব্যাপারটা বলতে পারো নিশি পাওয়ার মতো। নীরু যেখানে বসেছিল, সেখান থেকে কেবলই আমাদের চোখে চোখ পড়ছিল। কিন্তু আশ্চর্য সেদিন লজ্জা আর হাসির চেয়ে যেন অন্য কিছু আমাদের মনের মধ্যে তোলপাড় করছিল।

‘ফাঁদের সেটা কত বড় কারসাজি, তুমি হয়তো কল্পনা করতে পারছ না। যে চাঁদ সেদিন আদি বাড়ির পাশ ঘেঁষে পুব কোণ ঘেঁষে উঠেছিল, তার বর্ণনা দিতে পারি সে ক্ষমতা আমার নেই। মনে হল, আমবাগান থেকে আমলকীবনে দুটো কোকিল ডাকাডাকি করছে। গান শুরু হবার আগেই দেখলাম, নীরু মেয়েদের কাছ থেকে উঠে চলে গেল। চোখের পাতা ফেলতে ভুলে গেলাম। বুকের কাছে যেন রক্তের উথালিপাথালি ঢেউ। দেখলাম, সে আস্তে আস্তে দক্ষিণের ছায়ায় ছায়ায় চলে যাচ্ছে। বলতে পারও চৌর্যবৃত্তি। কিন্তু স্থির থাকা দায়। নীরজা যদি এমন সাহসে বুক বাঁধতে পারে, আমি তবে কোন বসন্তোৎসবের শরিক। আমিও তবে চলি। বন্ধুদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছায়ায় ছায়ায় এগিয়ে গেলাম। একেবারে নির্জনে, সভার বাতির সীমানার বাইরে, কেবল আঁধারের ছায়ায় এক গাছতলায় আবিষ্কার করলাম ওকে। কাছে গিয়েও দাড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। গান তখন শুরু হয়েছে। একবার ডাকতে চাইলাম, দেখলাম গলার স্বর নেই। শরীরও প্রায় বিকল, তবু কাছে গিয়ে ওর একটা হাত ধরলাম। ঠান্ডা ভেজা-ভেজা হাত, কিন্তু নিশ্বাস পড়ছে ঘনঘন। আমি ওকে কাছে টেনে নিতেই বুকের কাছে নুয়ে পড়ল। সেবারে সেই আমার বসন্তোৎসব, “বসন্তে আজ ধরার চিত্ত হল উতলা।” এর বেশি আর কিছু বলতে পারিনে।’

অচিনদা চুপ করেন। আর আমি, আমার যুগের দূর-পারের কোন এক অন্যলোকে ডুবে যাই। আমার কাছে তখন আর জানাচেনা ব্যক্তির ঘটনা মূল্যহীন। তখন যেন সেকাল-একালের সময় ছাপিয়ে একটা চির সময়ের সুরে বেজে ওঠে,

আকাশ জুড়ে আজ লেগেছে

তোমার আমার মেলা,

দূরে কাছে ছড়িয়ে গেছে,

তোমার আমার খেলা।

অচিনদা আমাকে টেনে থামান। বলে, ‘দাঁড়াও হে, ওকে এখন গাড়িটা ঠেলে তুলতে দাও। এবার রাস্তায় উঠতে হবে।’

চমক লাগে না। টান লাগতেই দাঁড়িয়ে যাই। দেখি সামনে উঁচুতে রাস্তা। নরোত্তম ওপরে উঠে বাতি রেখে রিকশা টেনে তুলছে। অচিনদার দিকে তাকাই। তাঁর বুকের দিকে। সেই বুকে, এক বসন্তোৎসবের সন্ধ্যায়, আম গাছের ছায়ায় এক ফুল ফুটেছিল। এখন সেখানে শূন্য। সে কথা বলতে গিয়ে উনি কাঁদেননি জানি। কিন্তু এখনও বুকে গন্ধ, এখনও স্পর্শের অনুভূতি। এ মানুষের কাঁদবার সময় কোথায় এখন। এ মানুষ হয়তো এখনও কেবল খুঁজে খুঁজে ফেরে।

নরোত্তম রিকশা রাস্তায় তুলে ডাকে। ‘আসেন বাবু।’

.

৫৪.

অচিনদার সঙ্গে গিয়ে রিকশায় উঠে বসি। নরোত্তম নিজের জায়গায় বসে রিকশা চালাতে পারে না। তাকে দু’হাতে জোরে ঠেলে চালাতে হয়। ফেরবার পথ চড়াইয়ের মতো উঁচু। অচিনদাই জিজ্ঞেস করেন, ‘কী রে, নামব নাকি? ক্যানেলের ধার পর্যন্ত হেঁটে যাই চল।’

নরোত্তম বলে, ‘না বাবু, বসেন, লিয়ে যাব ঠিক।’

এখন সে হয়তো তা পারে। দ্রব্যভারে এখন রক্ত তার টগবগানো। রসের উত্তাপে উষ্ণ। তা না হলে এই খোয়াইয়ের খোলা দিগন্তে, নিশীথে, পৌষ বাতাসের ছোবলানিতে দুটো মানুষসুদ্ধ রিকশা চড়াইয়ে টেনে তোলা সহজ ছিল না। এখন তার বুকে পাঁজরায় জবর তেজ হে। ক্যানে কিনা, মাংরির কাছে যে লাচ শিখছিল, সে কথাটাও ভুললে চলবে না।

কিন্তু এসব হল বাহির দুয়ারের ঢেউ ছলছল। আমার ভিতর দুয়ারের খোলা স্রোতে জল চলন্তা। সেখানে টানের রীতি আলাদা, আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। অথচ ঘূর্ণিধাক্কায় ঠেক খেয়েছি। শুরুর অঙ্কটা একদিনের ছবিতেই অনেক কল্পনার লাগাম খুলে দিয়েছে। অনেক দুপুর-সন্ধ্যার নিরালা নির্জনে, পাখি-ডাকা ঝোপে-ঝাড়ে যেন দুটি ছেলেমেয়ের অনেক কূজন শুনেছি। হাসিতে কাঁদনে উদ্বেগে বেয়াকুল প্রাণের প্রেম থরথর। তারপর সন্দেহ, জিজ্ঞাসা, সাবধান, শাসন, বিচ্ছিন্নতা। তবু ভিতর দুয়ারের চলন্তায় ‘শেষ’ পাওয়ার টান লেগেছে। আর থাকতে পারি না। তাই জিজ্ঞেস করি, ‘আর শেষ?’

অচিনদা ঘাড় নেড়ে বলেন, ‘কী নেই-আঁকুড়ে তুই! এবার আভোগ চাই। কিন্তু “শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে”?’

বলে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলেন। দুঃখে না বিবাগে, বুঝতে পারি না। তাই অবাক হয়ে ফিরে দেখি। অচিনদার মুখ সামনের দিকে। মুখের ভাব বুঝি না। তবে ‘তুই’ ডাকেতে আমার যেমন মন তরতরিয়ে যায়, মনে হয় তেমনি ওঁরও কোথায় যেন চোখের জল-গলানো হাসির জোয়ার ভেসে যায়। মনে মনে ওঁর কথাই আওড়াই। কিন্তু অর্থ কী! কথা কোন ধারাতে বহে!

সেই বহমানতা থেকেই আপনি ভেসে ওঠে, ‘তা হলে তো আর এক কিস্যা বলতে হয়। সেটা তোমাদের সাহিত্যের ভাষায় বোধ হয় অ্যানটি-ক্লাইমেক্‌স বলে। এখনকার যুগে ওসব চলে কিনা জানিনে, তবে আমাদের যুগে ভাষা—সব কিছুতেই প্রচুর ক্লাইমেক্‌স অ্যানটি-ক্লাইমেক্‌স-এর ছড়াছড়ি। তোমার ভাল লাগবে কী?’

‘লাগবে।’

‘তা বটে। মাতালের যেমন একটু খেলেই আরও লাগে।’

এর পরে আর কথাকারের গৌরব করতে ইচ্ছা করে না। গৌরব দিই অচিনদাকে। বলেন, ‘তবে শোনো, মাতালের নেশাই জোগাই। আমার চাকরিটা যে একটু উঁচু, লম্বা ঘাড়ে গর্দানে, বুঝতেই পারছ। এর চাপে পড়লে অনেকেরই যমপেষ হয়ে মারা পড়ার ভয়। তবে আমি তো নেহাত অচিন্ত্য মজুমদার, আমার সবই সয়। এই ধরো, বছর তেরো আগের কথা বলছি, তখন আমি কলকাতায় পোস্টেড। পদাধিকার বলেই ছোট বড় মাঝারি, অনেক অফিসারেরই আমি প্রায় বিধাতা। আর আমি মনে করি, সাধারণ কেরানি কর্মচারী নিয়ে তবু একরকম চালিয়ে যাওয়া যায়; কিন্তু এই যে একটি পদ, “অফিসার”—এটা আমার কাছে প্রায় অভিশপ্ত বলে মনে হয়। এদের সঙ্গে ঠিকমতো চলা, যাকে বলে ট্যাকল করা, বড় ভয়ংকর ব্যাপার। কার যে কখন পান থেকে চুন খসে, বোঝবার উপায় নেই। তা সেসব কথা যাকগে, নানা কারণে একজন দ্বিতীয় শ্রেণীর অফিসার কয়েকদিন আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি আমার থেকে দু’চার বছরের বড় হবেন।’

বলতে বলতে একটু থামেন। ক্যানেলের ধারে আলোটা ক্রমে স্পষ্ট হয়। নরোত্তম তখনও হেঁটে হেঁটে ঠেলে চলে। অচিনদা হঠাৎ আরম্ভ করেন, ‘হ্যাঁ, ভদ্রলোকের চেহারাটি সুন্দর, কথাবার্তায় মনে হত রুচিসম্পন্ন, একটু বেশি গম্ভীর। অফিসের ব্যাপারে একটু অসন্তুষ্ট ভাব। কথা দিয়েছিলাম, সুরাহা হয়ে যাবে। ভদ্রলোকের নাম মৃন্ময় চৌধুরি। ছুটির পরে অফিস থেকে বেরোবার সময় এক-আধ দিন দেখেছি একটা কালো রঙের ভকলস্‌-এ করে বাড়ি যান। তখন আমি কলকাতায় মাত্র কয়েক মাস এসেছি। সব খবরাখবর নিয়ে উঠতে পারিনি।

‘একদিন অফিস থেকে বেরিয়ে দেখি, চৌধুরি বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, ওঁর গাড়ি আসেনি। জিজ্ঞেস করতে বললেন, ওঁর গাড়ি কারখানায় গেছে। একটু ভিড় কমলে ট্যাক্সিতে যাবেন। আমার তো জানো, বাড়ি ফেরার কোনও তাড়া নেই। অধিকাংশ দিনই আমার বেরোতে অনেক দেরি হয়ে যায়। প্রায়ই হোটেল থেকে খানাপিনা সেরে একেবারে গানবাজনা শেষ করে ফিরি। কোনও কোনও দিন দু-একজন বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা। চৌধুরিকে বললাম, আমি ওঁকে পৌছে দিতে পারি। শুনে ভদ্রলোক যত আপ্যায়িত, তত সঙ্কুচিত। বললেন, “আপনাকে আবার কষ্ট দেব, স্যার।”

‘আমি বললাম, “আপনি দিতে চাইলেই কষ্ট লাগবে, তার কোনও মানে নেই। প্রস্তাব তো আমার নিজের, আপনার কোনও অসুবিধে নেই তো?”

‘ভদ্রলোক অতিরিক্ত মাত্রায় বিব্রত আর ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, “না, না স্যার, মোটেই না। আমি আপনার জন্যেই বলছিলাম।”

বললাম, “তবে চলুন।” গাড়িতে উঠে বললাম, “ড্রাইভারকে আপনার ঠিকানাটা বলে দিন একটু।” তিনি ঠিকানা বললেন, শুনলাম আলিপুর। তোমাদের আজকালকার নিউ আলিপুর নয়, সেকালের সাহেবপাড়া। পথ চলতে যেটুকু কথাবার্তা হল, অধিকাংশই অফিসের। তবে তিনি যে মানুষ হিসেবে আমার সম্পর্কে একটা উচ্চ ধারণা পোষণ করেন, সেটাও জানিয়ে দিলেন। হয়তো আমার পদের জন্যেই ওরকম উচ্চ ধারণা, কেন না তা ছাড়া আর কোনও কারণ ছিল না। আমি একটু মাথা নাড়িয়ে না না বলে বিনয় করলাম। একসময়ে ওঁর বাগানওয়ালা ছোট সুন্দর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছুলাম। সব দিকেই বেশ ঝকঝকে চকচকে, একটু বেশি নিঝুম, চুপচাপ৷

‘চৌধুরি আমাকে কিছুতেই ছাড়লেন না, দয়া করে দু’মিনিটও যদি বসে যাই তবে নাকি তিনি কৃতার্থ হন। দু’মিনিট বসে কৃতার্থ করতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিল না। গাড়ি থেকে নেমে গাড়িবারান্দা থেকে উঠে ওঁর সঙ্গে ওঁর বাইরের ঘরে গেলাম। ঘরে ঢুকেই একটু থমকে যেতে হল, একজন মহিলা একটি সোফায় বসে উল বুনছিলেন। বিনা বিজ্ঞপ্তিতে প্রবেশ, মহিলাও একটু অবাক হয়ে তাকালেন। চৌধুরি তখন আমাকে ডাকলেন, “আসুন, স্যার। ইনি মিসেস চৌধুরি, আমার স্ত্রী। ইনি মি. মজুমদার, আমাদের ডিরেক্টর, নতুন এসেছেন।”

‘অতএব হাত তুলে নমস্কার। মহিলাও তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়েছেন। নমস্কারও করলেন। চৌধুরি যে খুবই ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন আমার আসাতে, মনে মনে উত্তেজনা বোধ করছেন, তা-বুঝতে পারছি। তিনি কোনও দিকে লক্ষ করবারই সময় পেলেন না। স্ত্রীকে বললেন, “নীরজা, এক মিনিট কথা বলো, আমি ভেতর থেকে আসছি।” আমাকেও বললেন, “কিছু মনে করবেন না, স্যার, এখুনি আসছি। আপনি বসুন।”

‘বলতে বলতেই ভদ্রলোক ভেতরের পর্দা সরিয়ে উধাও হলেন। আর আমি সেই যে জোড় হাত তুলেছি, তার জোড় ভাঙতে ভুলে গেলাম, চোখ ফেরাতেও ভুলে গেলাম। আমার মুখোমুখি যিনি তাঁর অবস্থাও প্রায় তথৈবচ।’

বলে অচিনদা থামলেন। আমি থাকতে না পেরে বলে উঠি, ‘তারপর?’

অচিনদা তবু চুপ। সামনের দিকে তাকিয়ে যেন ধ্যানে নিরীক্ষণ করেন সেই দৃশ্য। খালের ধারের আলো তখন অস্পষ্ট ভাবে পড়েছে তাঁর মুখে। আস্তে আস্তে ওঁর ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে। বলেন, ‘নামটা চৌধুরির মুখে আগেই শুনেছি। চেয়ে দেখলাম, প্রায় নিটোল, চিবুকের কাছে এসে পাতার মতো একটু লম্বা একখানি ফরসা মুখ। বয়স যদি চল্লিশের কাছাকাছি হয়, কেন না আমার বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ, সেই হিসেবেই বলতে হয়, সামনের মুখখানিতে বয়সের স্রোতটা যেন কোথায় থমকে রয়েছে। অথচ তরুণী যুবতী বলতে যেমন বোঝায় ঠিক তাও নয়। কী যে, তা ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। ওরকম কিছু বলে সেই মুখের ব্যাখ্যা আমি করতে পারি না, কেবল এইটুকু মনে হল, তার মুখে যেন এক বালিকার ভাব। চোখে একটু কাজলের আভাস। ঠোঁটে পানের রং নিঃসন্দেহে, ঠোঁট রাঙানোর রং দিয়ে ঠিক ওরকম রং করা যায় না। যাকে বলে বিদুষী, তা নয়। তার চেয়ে যেন বেশি, একটি চতুর বুদ্ধিমতী মুখ, যা তার টানা চোখের ফাঁদে ছিল। লম্বায় বেশি নয়, গড়নে একটু দোহারার ভাব। নিজের চোখের দেখায় বলতে ইচ্ছা করে, চোখে মুখে টলটলানো কেমন একটা রহস্যের ছায়া সেই মুখে। উক্তি যদি একটু বাড়াবাড়ি হয়, ক্ষমা করো ভায়া। বড় খোঁপাটির কাছে ঘোমটা ভাঙা। আমার মনে হল, যেন অনেক দিনের চেনা একটা ছায়া এখনও স্পষ্ট। নামটা তার আগেই আমার কোথায় যেন বিঁধে গেছে। কোথায় যে একটা উলটো স্রোতের টান লেগে গেছে বুঝতে পারলাম না। এত জোর টান যে, কেঁপে যাবার মতো।

‘একটু পরেই প্রায় অস্পষ্ট গলা শোনা গেল, “তুমি—মানে—আপনি…।”

‘আমি তখন ভাবছি, ম্যাজিস্ট্রেট কেন কলকাতায়, আমার বিভাগের চৌহদ্দিতে? তাই তো শুনেছিলাম, সে হয়েছিল ম্যাজিষ্ট্রেট-পত্নী। অবিশ্যি সরকারি চাকরিতেও জাতবদলের অনেক পালা চলে। তবু কলকাতার বুকে যাকে একবারও ভাবতে পারিনি, বরং প্রায়ই একটা ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠত, কোন এক মফস্বল শহরের ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলো, সেখানে এক গরবিনী পত্নী সংসারের কাজে ব্যস্ত, একটি মা, তার ছেলেমেয়েদের খাওয়াতে সাজাতে ছুটোছুটি করছে, সংসারের নিবিড়তায় এক গৃহিণী চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। আলিপুরের এক বিলিতি কটেজের কথা কল্পনায় আসেনি। তুমি-আপনির ধাঁধা দেখে আমাকেও মুখ খুলতে হল, “অচিন্ত্যকুমার মজুমদার। ভীষণ ভীষণ অবাক হয়েছি, এভাবে ঠিক—।”

‘চোখ থেকে চোখ সরাবার সময় কেউ পাইনি। জবাব এল, “আমি ঠিক ভেবে পাচ্ছি না। এখনও যেন—।” ওর কথা শেষ হল না। আমারও না। তার মাঝখানেই চৌধুরির আবির্ভাব হল। এতক্ষণে ভদ্রলোকের চোখে পড়ল, ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। একটা অন্য কিছুর গন্ধও যেন পেলেন। বললেন, “কী ব্যাপার, মনে হচ্ছে আপনারা পরিচিত।”

‘সেই প্রথম অবাক হওয়াটাকে এক লহমায় ভাসিয়ে দিয়ে নীরজা হেসে উঠল। বলল, “তাই তো। উনি তো শান্তিনিকেতনে ছিলেন, আমাদের পরিচয় অনেক দিনের। উনি তো আমাদের অচিনদা।”

‘আমি যেন কেমন একটু অস্বস্তি বোধ করলাম। নীরজার অচিনদা’র পরিচয়টা ওর স্বামীর কাছে তেমন ভাল লাগবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু পরমুহুর্তেই বুঝতে পারলাম, অচিনদার বিষয় চৌধুরি কিছুই জানেন না। তিনি নতুন খুশির উত্তেজনায় বলে উঠলেন, “তাই নাকি! আশ্চর্য যোগাযোগ তো! মি. মজুমদারকে নতুন পরিচয়ে পেলাম বলে মনে হচ্ছে।”

‘নীরজা ওর চোখের তারায় কেমন একটু ঝলক দিয়ে হেসে বলল, “বসো, অচিনদা। অবাক হয়ে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। এভাবে দেখা যখন হয়েই গেছে।”

‘ওর কথার ভাবে চৌধুরি হেসে উঠলেন। আর আমার মনে হল, এ যেন ঠিক সেই নীরজা নয়। এখন সে কথা বলে একটু ধীরে ধীরে। কিন্তু তার চোখে মুখে রঙে ছায়ায় কেমন একটা চকিত ভাব। ঠিক মেলানো যায় না। গলার স্বর বদলে গেছে। বদলানোর ভাবটা যে কেমন, তাও ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারিনে, কেমন একটা রহস্যের আমেজ-ধরানো মিঠে। একটু বোধ হয় প্রগল্‌ভ হয়ে উঠছি, কিন্তু কোনও উপায় নেই ভায়া। কনুই-ঢাকা জামায়, ঢাকাই শাড়িটা যে ভাবে সে ঘুরিয়ে পরেছে, তাতে কল্পনায় দেখা ম্যাজিস্ট্রেট-গিন্নি ছেলেমেয়েদের মা-কে কোথাও খুঁজে পেলাম না। বললাম, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বসব, কিন্তু অবাক হওয়ার ধাক্কাটাই সামলাতে পারছি না যে।”

‘বলতে বলতে বসলাম। চৌধুরি কেবল খুশি বা উত্তেজিত নন, আচমকা একটা বিশেষ উপরিপাওনা হয়ে গেলে লোকে যেমন একটু বেসামাল হয়ে পড়ে, সেইরকম অবস্থা ওঁর। তিনি তাঁর স্ত্রীকে বললেন, “কই, কখনও তো তুমি ওঁর কথা বলোনি। শান্তিনিকেতনের এত লোকের কথা বলেছ, এ নামটা কখনও শুনিনি।”

‘আমি আবার অবাক হয়ে নীরজার দিকে চোখ তুলতে গেলাম। নীরজা হেসে ওর স্বামীকে বললে, “কোনও কারণে ওঁর প্রসঙ্গ ওঠেনি, তাই বলা হয়নি। যদি জানতাম, ইনিই তোমাদের সেই বিধাতা মিঃ এ কে মজুমদার, তা হলে নিশ্চয়ই বলতাম।” বলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল। এই চোখ, এই হাসি, আমবাগানের বসন্তোৎসবের আলোয় দেখা সেই হাসি আর চোখ নয়। অথচ প্রৌঢ় বয়সে মনে হল, নদীতে ভাদ্রের কোটালের মতো টেনে নিয়ে যায়।

‘নীরজার কথা থেকে এও বুঝতে পারলাম, আমার কথা চৌধুরি কিছুই জানেন না। সম্ভবত বিশেষ যত্নেই সেসব গোপন রাখা হয়েছে, আর সেটা বোধ হয় ভালই হয়েছে। নইলে নীরজা আর মৃন্ময় চৌধুরির জীবন হয়তো সুখের হত না। ভুল বোঝাবুঝি হওয়াটা আশ্চর্যের কিছু ছিল না। চৌধুরি বলে উঠলেন, “স্যার, পুরনো একটা পরিচয় যখন পাওয়া গেছে, একটু সময় থাকতে অনুরোধ করি।”

‘নীরজা ভুরু বাঁকিয়ে একটু মিঠে শাসানির ভাব করে বললে, “অনুরোধ মানে? উনি এখন আর তোমার এক্তিয়ারে নন। আমি তো অনুরোধ করতে পারব না, আমি দাবি করব। আমি যেতে না দিলে অচিনদা যাবে কেমন করে!”

‘চৌধুরি খুশিতে ডগমগ হয়ে হেসে উঠলেন। চৌধুরির এত খুশির কারণ আশা করি বুঝতে পারছ?’

‘যদি চাকরি করতে তা হলে আরও ভাল বুঝতে পারতে। তবে সেসব কথা আমি ভাবছিলাম না, দেখছিলাম আর শুনছিলাম, কত সহজে নীরজা তার দাবি ঘোষণা করছে। তারপরেই, এত বড় একটা ডিরেক্টরের সামনে তার সাবর্ডিনেট অফিসারকে বলে উঠল “আর দেখ বাপু, অচিনদাকে তুমি অফিসে গিয়ে স্যার স্যার করো, আমার সামনে বাড়িতে অন্তত করো না।”

‘তখন আমাকেই তাড়াতাড়ি বলে উঠতে হল, “নিশ্চয়ই।”

‘চৌধুরি খুশি আর উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠলেন। তিনি তার স্ত্রীকে ঘাড় হেলিয়ে ধন্যবাদ জানালেন। নীরজা তখন শুধু কথায় নয়, সারা গায়ে, ভাবেভঙ্গিতে যেন ছেলেমানুষ হয়ে উঠেছে। বললে, “জানো অচিনদা, চৌধুরির মুখে তোমার কথা শুনেছি। তোমার রূপগুণের কত প্রশংসা, কয়েক দিনই এসে বলেছেন, দিল্লি থেকে আমাদের এক ছোকরা কর্তা এসেছেন, এখনও তাঁর বিয়ে হয়নি। সত্যি অচিনদা, এখনও তোমার বিয়ে হয়নি?”

‘নীরজার চোখের দিকে তাকাতে গেলাম, পারলাম না। বললাম, “না, সেটা এখনও হয়ে ওঠেনি। কিন্তু চুলে পাক ধরে যাবার পরেও যে আমি ছোকরা আছি, এটা বুঝতে পারিনি।” চৌধুরি সঙ্কোচে রাঙা হয়ে উঠলেন। তাড়াতাড়ি বললেন, “আপনি আমাদের থেকে অনেক জুনিয়র নিশ্চয়।” বললাম, “সামান্য দু-এক বছর হতে পারে।”

‘কিন্তু আমি দেখছিলাম, নীরজা যেন আমার প্রতিটি রন্ধ্রকে তার টানা চোখের কালো তারায় হাতড়ে দেখছে। ওর সেই দৃষ্টির সঙ্গে আমি চোখ মেলাতে পারছিলাম না। ও বলল, “ছেলেদের বিয়ে না হলে, তারা ছোকরাই থেকে যায়। চুলে তোমার পাক ধরেছে বটে, বিয়ের বয়স যায়নি।”

‘বললাম, “তাই নাকি। তা পঁয়তাল্লিশ বছরের ফোঁপরা ঢেঁকিকে দিয়েও যদি কাজ চালাবার কথা চিন্তা করো, তা হলে কিছু বলবার নেই। তবে, মরা গাছে আর ফুল ধরানো যাবে না।”

‘নীরজা সে কথা মানল না। হাসিঠাট্টার মধ্যে এক-আধটুকু বাদানুবাদের পর সে এমন ইচ্ছেও প্রকাশ করল, এবার আমার একটা বিয়ে না দিয়ে সে ছাড়বে না। আমি প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্যে জিজ্ঞেস করলাম, “বাড়িটা যেন ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে, তোমাদের ছেলেমেয়েরা কোথায়?”

‘কথাটা খুব স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করেছিলাম। নীরজা তাড়াতাড়ি বললে, “সে পাট এখনও তোলা আছে। তোমরা একটু বসো, আমি চায়ের ব্যবস্থা করি।” বলে ও তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেল। দেখলাম, চৌধুরির মুখে একটু বিষন্ন হাসি, একটু অস্বস্তিও। বললেন, “আমাদের ছেলেমেয়ে কিছু হয়নি।”

‘আবহাওয়াটা একটু ভারী হয়ে উঠল। আমি কথাটা ভাবতেই পারিনি। কিন্তু নীরজার কথাগুলোই আমার কানে বাজতে লাগল, “সে পাট এখনও তোলা আছে।” কথার মধ্যে কেমন একটু রহস্য আছে। যেন, হবে, কিন্তু হয়নি। হয়তো ব্যথা থেকেই এরকম ঠাট্টা। জানি না, তার মধ্যে আর কোনও বিদ্রুপ ছিল কি না।’

খালের সাঁকোর ওপর এসে অচিনদা থামেন। আলোয় এখন ওঁর মুখ পরিষ্কার দেখা যায়। আরক্ত ভাব আছে, কিন্তু দেখ, আবার যেন সেই অবুঝ, হাবাগোবা ছেলেটির ভাব এসেছে মুখে। একটু হেসে জিজ্ঞেস করেন, ‘বস্তাপচাতেই জমজমাটি, না কী বলো হে ভায়া। বেশ জমেছে তো?’

সে জবাব আর মুখ ফুটে দিতে ইচ্ছা করে না। মনে মনে বলি, ‘কী ছার গল্প লিখি। সংসারের আসল গল্পকারেরা কোথায় কী বেশে যে ঘুরে বেড়ান, দেখতে পাই না। অচিনদার কাছে কলম বন্ধক। চিরদিন যেন এমনি শুনে যেতে পারি। কিন্তু তেরো বছর আগে আলিপুরের কোনও এক গৃহের বসবার ঘরে মজুমদার আর চৌধুরির মাঝখানের নিঃশব্দে ঠেক খেয়ে থাকতে পারি না। জিজ্ঞেস করি, ‘তারপর?’

নরোত্তম এবার উঠে বসে রিকশা চালায়। অচিনদা বলেন, তারপর—“অনেক হল দেরি, আজও তবু দীর্ঘ পথের অন্ত নাই হেরি।”

ঝাপসায় দাঁড়িয়ে হাতড়ে ফিরি। তাই আবার জিজ্ঞেস করি, ‘কেন?’

অচিনদা যে কোথায় হারান, কোথায় ডোবেন, দেখতে জানি না। বুঝতে পারি না। সেই হারানো গভীর থেকে স্বর ভেসে ওঠে, ‘কারণ, “এখন এল অন্য সুরে অন্য গানের পালা, এখন গাঁথো অন্য ফুলে অন্য ছাঁদের মালা।” আগেই বলেছি ভায়া, শেষ নাহি যে…। আলিপুরে সেই সন্ধ্যায়, আর একটা শুরু বলতে পারো। চা পর্বের পরেই নীরজা ছেড়ে দেয়নি। চালচুলোহীন বাউন্ডুলে সাহেবকে সে তার কুঠিতে যেতে দিলে না। হোটেলের খানাপিনা নাচাগানায় ঠোঁট উলটে বললে, “অভক্তি!” ক্রমে চৌধুরি সাহস করে নিবেদন করলেন, আমার যদি আপত্তি না থাকে, তবে পানীয় নিয়ে বসা যেতে পারে। চৌধুরির পানাভ্যাস আছে। আমার তো সূর্য পাটে গেলেই ছোঁকছোঁকানি ধরে। অতএব, বসা গেল। নীরজা ঢাকাই শাড়িতে কোমরে বেড় দিয়ে মুখে গুঁজল পান, তার সঙ্গে সুগন্ধি জর্দা। একবার রান্নাঘরে, আর একবার আমাদের মাঝখানে, দু’দিকে সমান তাল দিয়ে চলল। কথা কমই বললে। কিন্তু কথা শোনায় এক, তার অর্থ আর এক। চোখের তারা ঘুরিয়ে চোখের কথাই বেশি বললে। তা শোনা যায় না বটে, কাজ এত বেশি, নেশাটা কিছুতেই জমতে চাইল না, কোথায় যেন কী একটা বিঁধেই রইল।

‘অনুমান করতে পারছ নিশ্চয়ই, একদিনেই এই পালা শেষ হল না, শুরু হল মাত্র। আর কলকাতার আমলাসমাজের ব্যাপারে, যে জানে, সে-ই জানে। ক্রমে ক্রমে রটি গেল বার্তা, বড় কর্তার সঙ্গে মিসেস চৌধুরির চলছে। এই “চলছে” শব্দ বড় মারাত্মক। কতরকমে যে তাকে চালানো যায়, তার ইয়ত্তা নেই। অবিশ্যি এটা সত্যি, নীরজাই তখন আমার পরিচালিকা। সে তখন আমার ঘরে-বাইরে। তার জন্যে চৌধুরির মুখে যে ছায়া ঘনাল, তা মোটেই নয়। তাঁর সংসারে আমার মতো একটি নতুন শরিক পেয়ে তিনি খুশিই হলেন যেন। সন্দেহ অবিশ্বাস এসে যে তাঁকে বিচলিত করেছে, আজ পর্যন্ত তা বুঝতে পারিনি। লোকের কথায় যে তিনি কখনও কান দিয়েছেন, তাও মনে হয়নি। বরং আমার সঙ্গে যে নীরজার একটা পুরনো ঘটনা ছিল, সেটাও জানতে পেরেছিলেন। তার জন্যে কখনও কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। চৌধুরি-মনের রহস্যের খোঁজ তুমি করো, ভায়া। আমি কিছুই জানিনে। কেবল জানি, এখন আমি আর চৌধুরি বসে গল্প করি—বরং বলা যাক, সুর ধরি, গান করি, আমাদের মাঝখানে নীরজা বসে তাল দেয়।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এখন মানে?’

‘এখন মানে, এখনও। চৌধুরি বদলি হয়ে এখন আছেন এলাহাবাদে। আমি লক্ষ্ণৌতে। অবিশ্যি, ওঁর বদলির বিষয়টা ওঁর ইচ্ছেতে আমার দ্বারাই হয়েছে। এখন ছুটিছাটায় আমি যাই এলাহাবাদে, নইলে ওরা আসে লক্ষ্ণৌতে। যদি বলতে পারতাম, এলাহাবাদ আর লক্ষৌয়ের দুটো সংসার নীরজা চালায়, তা হলেই বোধ হয় ঠিক বলা হয়। কিংবা বলা যায়, এখন তিনজনের একটাই সংসার…।’

হঠাৎ থেমে বলেন, ‘নরোত্তম, ডাইনে চল, বাবুকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’

তারপরে একটু ঠোঁট বাঁকিয়ে ভাষেন, ‘শেষ পেলে কি, ভায়া?’

জবাব দিতে পারি না। শীত নিশীথের ঝিঁঝি ডাকা নিঃশব্দে বন্ধুর ঘুমন্ত বাড়ির সামনে রিকশা এসে দাঁড়ায়। আমি চুপচাপ নামি। অচিনদার দিকে চোখ তুলতে গিয়ে চমকে যাই। দেখি, তাঁর হিজিবিজি মুখে রেখার কাঁপন লেগেছে। চুপিচুপি স্বরে বলেন, ‘এই অশেষের পালা আর সইতে পারি না, ভায়া।’

সঙ্গে সঙ্গে মোটা গলার আদেশ করেন, ‘চল রে, নরোত্তম। কাল দেখা হবে, ভায়া।’

নরোত্তম রিকশা ঘুরিয়ে চলে যায়।

.

আমি অন্ধকারেই দাঁড়িয়ে থাকি। যে গেয়ে যায়, সে গেয়ে যায়। নিশির ঘোর লাগে অন্যজনে। আমি সেই অন্যজন। ছাতিমতলার এই সীমানায়, ঝিঁঝি-ডাকা প্রহর বহে। কী যেন এক গন্ধ দিকে দিকে, যার নাম জানা নেই। দূরের মেলা এখন ণীষচুপ । আমার কানে বাজে শেষ কথা কয়টি, ‘এই অশেষের পালা আর সইতে পারি না ভায়া’।

অচিনদা আর্তনাদে বাজেননি। কিন্তু এক আর্তস্বরের ধ্বনি, আমার প্রাণে বাজে আখরের সুরে সুরে। একবারও বুঝতে পারিনি, সকাল থেকে যার সঙ্গে এত কথা, সকলই তির-বেঁধা পাখির ডাকাডাকি। সেই উপকথাটা মনে পড়ে যায়। পাখিটা যতই কাঁটার গায়ে বুক চাপে, রক্ত ঝরে, ততই ডাকে। সেই ডাক গান হয়ে যায়। শেষের পালায় এমন অ-শেষ একবারও ভাবিনি। চোখের সামনে ভাসে, পান খাওয়া ঠোঁট। রহস্যের আমেজ ধরানো চোখ। ঢাকাই শাড়ির আঁচল বিছিয়ে বসা এক নারী। কে জানে, কোন ঋতু লেগেছে এখন গায়ে। তাঁর দু’পাশে দুই পুরুষ। দুই চোখের তারায় দুই বাঁধা। সেই দুই তারাতে কী যে কথা, জানা যায়নি। নিঃশব্দ সেই কথার রহস্যে, কান পেতে চলে দুইজন। মুখে তাঁদের রেখা আঁকা পড়ে যায়। চুল বেবাক সাদা। তবু চলে নিরন্তর, উৎকর্ণ, কী কথা। কী যে কথা।

আমবাগানের বসন্তোৎসবের যাত্রা, ধায় নিরবধি। হাতছানি দিয়ে নিয়ে যায় কালান্তরে। আমি ভাবি, কোন নিয়তি, কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিল এ কে মজুমদারকে। কে নিয়ে গিয়েছিল হে, অ-দেখার দেখায়। না-পাওয়ার পাওয়ায়। অ-ধরার ধরায়। আজ অ-শেষের পালা সইতে পারা যায় না। শেষ করাও যায় কি? করতে গেলে টান লেগে যেখানটা ছিঁড়বে, সে-জ্বালা কি সইবে!

মানুষের এ অবস্থার নাম কী, কে জানে। কেবল, ভয়ে যেন শিউরে যায় বুক। সেই হিজিবিজি রেখায়, হঠাৎ কাঁপন লাগা মুখখানি আবার দেখতে ইচ্ছা করে।ফিরে তাকাই। কেউ নেই, ছাতিমতলার সীমানায় নিশীথের গাছপালা নীরব। অন্ধকারের পথ বিজন।

তবু যেন দেখতে পাই, কে চলে যায়, দূরের অস্পষ্ট আমবাগানের দিকে। দৃষ্টিতে তার বোধ নেই, বুদ্ধিও নেই যেন। সেই এক হাবাগোবা ছেলেটির মতো মুখ করে যে চেয়ে আছে, এপার থেকে ওপারে।

তোমার বুক যদি টনটনায়, তবু দেখ, সেথায় যেন কীসের এক হাসির জোয়ার লাগে। আমার পথ চলাতে, কী যে খুঁজি, ফিরি কীসের সন্ধানে, তার হদিস জানি না। তবু, এই অন্ধকারের নিরালায় দাঁড়িয়ে মনে হয়, কী এক রতন যেন আমার রূপ-সাগরে দোলা দেয়। খুঁজে পাবার জিনিস না সে। অ-খোঁজে দেখা দিয়ে যায়। যা পাইনি, তার নাম জানি না। যা পাই, তা-ই নিয়ে যাই পরম ধন বলে।

সহসা, এই অন্ধকার বিজন নিশীথে যেন কার আবির্ভাব ঘটে। আমি দেখতে পাই না, অনুভব করি। চোখের ঝাপসায়, হাতজোড় হয়ে আসে বুকে। নিজের কথা, নিজের বুকে কান পেতে শুনি, এই মানুষে, সেই মানুষ আছে। তাকে নমস্কার।

ঘুম ভাঙে, এক ঝাঁক পাখির ডাকাডাকিতে। তারপরে, কেবল চোখ না, মস্তিষ্ক থেকে ঘুম ছুটতে, বুঝতে পারি, পাখি না, ছেলেমেয়েদের হট্টগোল। কেবল তো চায়ের জল না। কী রক্ত জমানো ঠান্ডা হে। এই ভোরে একটু গরম জল না হলে কি চলে। অতএব, দাসদাসীর মুখ চেয়ে কী বসে থাকা যায়। হাত লাগাও সব আপন আপন।

সেই হাত লাগাবার আওয়াজ পাই গরম শয্যায় শুয়ে। বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর গলা শুনতে পাই। সকলেই ব্যস্ত, সকলেরই তাড়া। টের পাই, কেউ কাটে দাড়ি, কেউ মাজে দাঁত। শুনি, কেউ হাসে, কেউ করে গান।।

মনে পড়ে যায় কাল রাত্রে গেটে হাত দিতে শব্দ হয়েছিল। বাতি জ্বলে উঠেছিল সঙ্গে সঙ্গে। বন্ধুর আবির্ভাব অচিরাৎ। মুখে অবাক উৎকণ্ঠা। আবার অচিনদার নাম শুনেই সব অবাক উৎকণ্ঠার নিরসন। বন্ধুর পীড়াপীড়িতেও আহারে রুচি আসেনি। তখন দেহে মনে কেবল শয্যা শয্যা।

শুয়ে থাকা চলে না। বন্ধুর ডাক পড়ে, ‘এবার প্রস্তুত, আর দেরি নয়।’ ঘরে ঘরে ধোয়া-মোছা সাজসজ্জা। যার শেষ হয় সে-ই দৌড় দেয় ঘরের বাইরে। কেউ কারুর জন্যে বসে নেই। ডাক পড়েছে উপাসনার মন্দিরে।

লেট লতিফের দুর্গতি। তৈরি হয়ে আমি যখন মন্দিরের সীমায়, তখন স্তোত্র, প্রার্থনা শেষে সমবেত গান বেজে উঠেছে। ধরায় এখন আলো। পূর্বপল্লির গাছপালা ছাড়িয়ে রোদ এসেছে এই প্রাঙ্গণে।

তারপরে আমবাগানে সমাবর্তন উৎসব। গান বেজে ওঠে, ‘আমাদের শান্তিনিকেতন, আমাদের শান্তিনিকেতন।’…এবার দেখ, এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে। কেবল যে পাঞ্জাব সিন্ধু বোম্বাই গুজরাট দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ, তা না। কেমন কালা-ধলায় পাশাপাশি হাসাহাসি মিলমিশ। এর নাম, বিশ্বভারতীর প্রাঙ্গণ। আজ আটুই পৌষ। আজ বর্তমান আর প্রাক্তন আশ্রমিকদের কোলাকুলি। আজ কৃতীদের ডাকাডাকি, কৃতিত্বের ঘোষণা। তার প্রতীক স্বরূপ আচার্য তাঁদের হাতে তুলে দেন ছাতিমের পল্লব। শ্রীজওহরলাল এখন ভারতের প্রধান রাজপুরুষ নন। এখানে তার পরিচয়, আচার্য। পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের সংবর্ধিত করেন। ভারতীর অঙ্গনে ভাষেন ভিন্ন কথা, বিদ্যা শিক্ষা মানবধর্ম, বিপুল ভারত কথা। শুনে মনে হয় যেথাকার মানুষ সেথায় আছেন, অন্যখানে তাঁর লীলা নেই।

উৎসব শেষে জনসমুদ্রের স্রোত চলে নানা দিকে দিগন্তরে। সব থেকে বড় স্রোত ধায় মেলার প্রাঙ্গণে। আমিও সেই স্রোতে ভাসি। লক্ষ্য বাউল সমাবেশ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *