৪৫. নীল আকাশে রোদের ঝলক

৪৫.

ঝিনির মুখের নীল আকাশে রোদের ঝলক দেখলেও আমার ভিতরটা ঝলকায় না। সেখানে তখনও বিনা মেঘে ঝড়ে বাড়ি-খাওয়া ঠেক চমক। মুখ থুবড়ে পড়া হকচকানি। দিকে দিকে আঁধার, নজর চলে না, শ্রবণও অবশ। কী ঘটে গেল কিছু বুঝতে পারি না যেন। কেবল চোখের সামনে একটি মেয়ে, এখনও যেন পুরো চেনা না। যেন দূরকালের চেনা-চেনা। তার স্বভাব থেকে উপচে-পড়া কিছু আচরণ। আর কিছু কথা। যে কথার সম্যক উপলব্ধি এই মুহূর্তে নেই।

সরাইখানার লোক এসে খালি কফির পাত্র তুলে নিয়ে যায়। সেটুকু বাহ্যজ্ঞান ছিল। পয়সা মিটিয়ে বাইরে এসে মেলার মধ্য দিয়ে বন্ধুর বাড়ির দিকে এগোই। কিন্তু কিছু কিছু কথা নিঃশব্দে আমার শ্রবণে বাজতেই থাকে। ‘হয়তো ফিলজফি পড়তে গিয়ে আপনার মতো লোককে…।’ কেমন করে মানবে হে। এমন কথা কি মেনে নেওয়া যায়। বিশ্ব-সংসারে চলতে গিয়ে রীতির কাছা অনেক এঁটেছি। তাতে আসল রূপের খোলতাই কিছু হয়নি। ভিতরখানি ভরা তো এক আটপৌরে প্রাণে। বিদুষীর কথা মানব কেমন করে।

আরও কথা বাজে, ‘বাবা-মায়ের মতো তাঁদের মেয়েটিও হয়তো—হয়তো মুগ্ধ হয়েছিল, তাই কী লিখতে কী লিখেছি, না জেনে কাব্য করেছি।’ না, না, বড় ব্যাজ, বড় অস্বস্তি, ভারী বাধা লাগে। বিদুষী বহুত দূর, কারুকেই এমন অসম্মানের অহঙ্কার নেই। তার চেয়েও বেশি ঝিনির গলার স্বর ডুবে যাওয়া বুকের ভিতরে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা।

না, না, নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বাঁচি না। ধিক্কার পথ-চলাকে। ধিক্কার মনকে। ঝিনির কাছে এমন অপরাধ কখন, কবে থেকে করে বসে আছি। তারপরে, ‘…সত্যি অলকা চক্রবর্তী নই। আমি ঝিনি-ই।’ নিশ্চয়ই। সে অলকা চক্রবর্তীর মতো দাঁড়ায়নি এসে। যায়নি। ঝিনির মতো সব কিছু। সে ঝিনি, সন্দেহ নেই। তবু সব মিলিয়ে আমার মনের কোথায় ঠেক খেয়ে যায়। এক অবাক অবুঝ সুর বেজে যায়। তার সঙ্গে নিজের অন্যায়বোধের কাঁটাটা খচখচিয়ে ওঠে। ছাতিমতলার মেলায় এ কী লাগে বিষম গোল!

কিন্তু দৃষ্টিতে, স্বরে, কথায় এত যে নালিশ, সব কি সত্যি? মেলার লোক দেখি না, মেলা দিয়ে হেঁটে যাই। এক বিদুষীর মুখ ভাসে, তার ওপর দিয়ে খেলে যায় অনেক হিজিবিজি অক্ষর। অক্ষরগুলো পড়তে চেষ্টা করি, তাই স্মৃতি দিয়ে নজর করি। তবু স্মৃতির নজরে সব দেখতে পাই এমন না। স্মৃতির চোখে তত ধার নেই। কালির লেখা মাঝে মাঝে ঢেউ দিয়ে ওঠে।

‘…দেখছি, দৈব বলে একটা জিনিস সত্যি সত্যি আছে। নইলে আপনাকে তো নতুন করে বলার কিছু নেই, দক্ষিণের নদীনালায় ছড়ানো সেই অঞ্চলটা প্রাচীনকালে আর্যরা বরাবরই পরিহার করেছেন। মুঘল সরকারের কাছে সুন্দরবনের এলাকা ছিল “দোজাখ্‌”। মানে— নরক। কাউকে নির্বাসন দিতে হলে সেখানে পাঠানো হত। এখন অবশ্যি সোনা ফলছে। তবু আমাদের যমের দ্বারও তো দক্ষিণেই শুনতে পাই। আর সে-ই পথে দক্ষিণে লঞ্চে করে গোসাবায় যেতে যেতে যে আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি। সেইজন্যেই অবাক লেগেছে বেশি।… আপনার সঙ্গে দেখা হবার কথা কোনও পত্রিকার অফিসে। কোনও প্রকাশকের ঘরে। আর আপনিও সেইরকম। একটা কাপড়ের ঝোলা কোলের কাছে নিয়ে কথা বলতে বলতে চলেছেন এক ফকির দরবেশের সঙ্গে। তার সঙ্গে হাসছেন, কথা বলছেন, গান শুনছেন। আমি তো প্রথমটায় ভেবেছিলাম, আপনিও বোধ হয় আমাদের মতো আত্মীয়-বাড়ির যাত্রী, নয় তো—বিদেশ থেকে গৃহগামী।… আশা করি ভুল বোঝবার কোনও কারণ নেই, সত্যি কিন্তু ভেবেছিলাম আপনি সেই অঞ্চলেরই অধিবাসী। হয়তো কলকাতায় চাকরি করেন, দেশের বাড়িতে একটু দেখা করতে যাচ্ছেন। কিংবা, সেই অঞ্চলের কোনও ইস্কুল-মাস্টার হবেন। নিদেন কোনও মনোহারি দোকানের মালিক। ধান-চালের কারবারিদের সঙ্গে ঠিক মেলানো যায় না, তা নইলে বোধ হয় তাও ভাবতাম।…

‘তারপরে যখন জানাজানি হল, আ ছি ছি, আমি তো মনে মনেই জিব কেটেছিলাম। কী যে লজ্জা করছিল না। তার ওপরে বাবার ওইরকম কথাবার্তা।… আচ্ছা, বাবাকে আপনার কেমন লেগেছে? ও-রকম মানুষ হয়? আপনি তো সংসারে কত লোক দেখেছেন, আমার বাবার মতো একটা লোক দেখেছেন?’…

আচ্ছা, সেসব কথা থাক এখন, যতই অবাক হই আর লজ্জা পাই, মনে মনে এত খুশি হয়েছিলাম। আমি মনে মনে কল্পনা করতাম, গোঁফ-দাড়ি না থাক, আপনি একটা মস্ত দশাসই বয়স্ক লোক! তার পরিবর্তে দেখলাম একেবারে অন্য মানুষ! যাই বলুন, অতটা তা বলে ভাবিনি। আপনার লেখার সঙ্গে চেহারার একটুও মিল নেই। পরে মায়ের সঙ্গে এই নিয়ে আমার কথা হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা মা-মেয়ে একমত। মাও তো আপনার বই পড়েছেন। মায়ের ভাষায় আপনি হলেন, “ও তো একরত্তি ছেলে!”…

‘…আর ওভাবে আপনাকে দেখতে পেয়ে ভালই হয়েছিল। আপনি যেন একেবারে হাতে-নাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন।’…

কী বিড়ম্বনা হে, এমনি অনেক কথা ঝিনি লিখেছিল। এই যে চোখের কুলায় ভাসে নাগরিকাটির মুখ। অথচ যেন নাগরিকা না, বড় আটপৌরে কথায় ভাষে, হাসে সটান সটান, সোজা সোজা, চাপা-স্মৃতির চোখে আরও দেখি অনেক অক্ষর চাপা নেই। যা মনে আসে তা-ই ভাষে। তরঙ্গিয়া ওঠে এই মুখের ওপর।

‘ভাগ্যিস, একটু নমস্কার, দুটো কথা, একটি নামসই, এইটুকুর মধ্য দিয়েই পরিচয়ের শুরু, আর আলাপের শেষ হয়নি। তা হলে কী বিশ্রী হত বলুন তো? সেখানে আপনি তখন অন্য মানুষ। আপনি বুঝি প্রায়ই এরকম বেরিয়ে পড়েন? আপনার কী মজা! আমিও যদি পারতাম! আমার খুব ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে এমনি বেরিয়ে পড়ি। আপনাকে দেখে যেমন মনে হচ্ছিল, সেই নদী, ভেড়ী, বাঁধ, দিগ্‌বিসারি ধান ক্ষেত, মিঠে রোদ-ঝরা আকাশ, সবকিছুর মধ্যে আপনি যেন ডুবে গিয়েছেন, অন্য এক রাজ্যে চলে গিয়েছেন, কোথাও আপনার কোনও বাধা নেই, আমারও খুব ইচ্ছে করে সবকিছু থেকে এমনি করে ছুটে যাই। কিন্তু সংসারটা আমাদের সে অধিকার দেয়নি… বাবা তো খালি সেই কথাটাই বলেন, “অচেনা অজানা জায়গায় ওরকম একটা মুসলমান ফকিরের সঙ্গে ছেলেটা বয়ে গেল কী করে? প্রাণে একটু ভয় ডর নেই?” সত্যি, আমিও ভাবি, আপনার কী একটু ভয় হল না? বিশেষ করে বাদা অঞ্চলকে লোকে এমনিতেই ভয় পায়। খুন-ডাকাতি তো ওসব জায়গায় লেগেই আছে।…এসব কি কেবল লেখার রসদ সংগ্রহের জন্যে? নাকি মন মানে না তা-ই? আমার কিন্তু মনে হয়েছিল, আপনি মনের তাগিদেই গিয়েছিলেন।’

‘…রাগ করছেন না তো, এত কথা লিখছি বলে। আপনার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে আপনি রাগ করবেন না। তা-ই এত কথা লিখছি। ওভাবে আপনাকে দেখে আলাপ হয়ে মনে হল, আপনাকে আসল রূপে দেখা গেল। সব থেকে ভাল লেগেছে আরও আপনার সঙ্গীটির জন্যে। ভারী আশ্চর্য, অমন তো কতই আমরা পথে-ঘাটে দেখি, তা বলে কি সঙ্গী করে নিই নাকি! ওটাই বোধ হয় আপনাদের বিশেষত্ব। আপনার গাজিকে আমার খুব ভাল লেগেছে। গান আরও ভাল লেগেছে, ওইরকম গান আমি আর কখনও শুনিনি। আপনার জন্যেই সেটা সম্ভব হয়েছিল।…

‘…বাবার তো সবটাতেই বাড়াবাড়ি। আসলে কী জানেন, গাজির গান বাবারও খুব ভাল লেগেছিল। গাজি লোকটাকেও বাবার খুব ভাল লেগেছিল। ভাল না লাগলে বাবা কারুর সঙ্গে ওরকম করে কথা বলেন না। তবে, আমার বাবার সহজে কিছু ভাল লাগে না। তা-ই ভাবি, আপনি কি জাদু জানেন, জানি না, আমার বাবা তো একেবারে মুগ্ধ। নইলে, আমার দাদার কথা ভুলেও যখন তিনি উচ্চারণ করেন না, আপনাকে অবলীলায় সব বলে ফেললেন। বাইরের কোনও লোকের কাছে বাবাকে অতটা আর্ত আর করুণ হয়ে উঠতে কখনও দেখিনি। আর আমরা মা-মেয়েই বা কম কী। আপনার সামনে চোখের জলটুকু চাপতে পারলাম না। আপনি দেখছি, লোক সুবিধের নন।’…

তাইতে বড় অবাক মানি এখন। ঝিনির সঙ্গে আমার দু’বার দেখা। সেই দক্ষিণের গাঙের বুকে, আর এই রাঢ়ের ছাতিমতলার মেলায়। দু’বারেই চোখের জল দেখতে হল। কেন হে, বিদুষীর বুক আকাশে কেবল কি মেঘ ছড়ানো নাকি। খালি যে ঝরে। তবু মনের বচন, লিখনে দেখি, নাগরিকার বয়ানে ভাষে।

‘…সত্যি, আপনাকে এখন হিংসেই হচ্ছে। বাবা-মা দু’জনেই, দেখছি, আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাবার কোনও বন্ধুবান্ধব এলেই, আপনার প্রসঙ্গ একবার উঠবেই। বলেন, ‘ভারী ভাল ছেলে’ শুনে হাসবেন না যেন, বাবা বলেন, ‘একেই বলে কবি আর শিল্পী।’ আমি যদি বলি, ‘বাবা, উনি কবি নন, গদ্য-লেখক।’ তা হলেই বাবা বলবেন, ‘ওই হল, কবি আর লেখক একই কথা। দেখেই বোঝা যায়, রসিক ছেলে, সব বোঝে-টোঝে। তোদের ওই ছোকরাদের মতো মাথায় একরাশ উড়ু উড়ু চুল, ঘরের মধ্যে ম্যানম্যান প্যানপ্যান করছে, তা নয়।’ বাবাকে কিছু বোঝানো যায় না। বাবার কথাবার্তা এইরকম। এর থেকেই বুঝে নিতে হবে। তবে, সেই এক কথা, অচেনা-অজানা বাদার হাটে গঞ্জে ওভাবে রাত কাটিয়ে দেওয়াটা কিছুতেই ওঁর ভাল লাগছে না। আমার মায়েরও সেই কথা। জানি না, আপনার মা-বাবা দু’জনেই আছেন কি না, আছেন বলেই মনে করি। তাঁরা হয়তো আপনাকে চেনেন, বোঝেন, তা-ই ভয় পান না। আমার মা-বাবার খুব ভয়। আপনি বলে নয়, অন্য কোনও ছেলেকে ভাল লেগে গেলে, ওঁরা তাকেও এভাবেই বলতেন। আমার মা তো বলছেন, আপনি নাকি খুব মিশুকে মিষ্টি ছেলে, একটুও গুমোর অহংকার নেই। বুঝতেই পারছেন, আপনি আর এখন এঁদের কাছে বাইরের পোশাকি পরিচয়ে নেই।…

‘…হ্যাঁ, আমিও তাই বলতে চাই। ব্যক্তিগত অধিকার যদি নাও থাকে, না-হয় একজন বাঙালি সাধারণ মেয়ে হিসাবেই বলছি, রাত-বিরেতে অমন দূরে অজানা জায়গায় না-হয় না-ই কাটালেন। বিপদ-আপদের কথা কিছুই তো বলা যায় না।…

‘…রোজই জিজ্ঞেস করছেন, আপনাকে কোনও চিঠিপত্র দিয়েছি কিনা। বাবা-মা দু’জনেই। সাধ করে কি আর এতদিনে লিখতে বসেছি! দেখছেন তো, কত বড় চিঠি হয়ে গেল। হয়তো আপনার পড়বার ধৈর্যও থাকবে না। তবু, একটু কষ্ট করে পড়বেন। আপনার প্রতি অবিশ্বাস আমার একটুও নেই, তবু বাবা-মাকে বললাম না যে, আপনাকে চিঠি লিখছি। ধরুন, কোনও কারণে আপনি হয়তো জবাব দিলেন না, বা আপনি হয়তো বাইরে কোথাও চলে গিয়েছেন। তা হলে আমি এঁদের কাছে বড় বেকায়দায় পড়ে যাব। আর কিছুই না, এঁদের বয়স হয়ে গিয়েছে, আর আপনাকে খুব ভাল লেগেছে। জবাব না পেলে মনে মনে কষ্ট পাবেন। তাই ভাবছি, আপনার জবাব এলে, সেটাই এঁদের হাতে তুলে দেব।

‘…না, আমন্ত্রণটা কেবল মায়ের নয়, বাবার এবং আমারও। একদিন আসুন না আমাদের বাড়িতে। কলকাতা থেকে খুব বেশি দূরে তো থাকেন না। যাতায়াতও আপনার নিয়মিত। এলে সবাই খুব খুশি হবেন। আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে আদি গঙ্গা দেখা যায়। সব মিলিয়ে আমাদের এখানকার ছবিটা আপনার খুব শহুরে লাগবে না। আপনি যেখানে থাকেন, বোধ হয় সেখানকার সঙ্গে কিছু মিল খুঁজে পাবেন।…

‘…না, আর বিরক্ত করব না। জবাবের প্রত্যাশায় রইলাম। ইতিতে পোশাকি নামটা লিখতে চাইনে, এখন সেটা অর্থহীন লাগছে। নমস্কার দেবেন। ইতি—ঝিনি’

কখন যেন মোড় নিয়ে আশ্রমের সীমানায় ঢুকেছি। মেলা পেরিয়ে এসেছি নিরালায়। কিন্তু চলতে গিয়ে যেন ঠেক খেয়ে যাই। স্মৃতির চোখে এত লেখা স্পষ্ট দেখতে পাই, তবু তার জবাব কেন দিইনি। একে কেবল অবিচার বলো না। বলো, অন্যায়। বলো, অসহবত। বলো অশালীনতা।

তবু, এই কি তোমার জবাব হে?

নিজেকে পুছ করে বাঁদিকে মোড় নিতে যাই বন্ধুর বাড়ির পথে। আমার মন টানে ডাইনে। দৃষ্টি চলে যায় আমলকীর সারি পেরিয়ে ছাতিমের ঝাড়ে। আর দেখ, সহসা যেন আমার মনের এত জিজ্ঞাসাবাদের অনুকারে একটি আলোর ঝিলিক হেনে যায়। জবাব আমার ভিতরে ভাষে, এক উদাসী হাসিতে। অবিচার অন্যায় অসহবত অশালীন কিছু না। জানি, ব্রহ্মনারায়ণ চক্রবর্তী একজন স্নেহে উপচানো বাবা। চোখের ওপারে অগাধ কান্না থমকে থাকা, দিশেহারা চোখে চেয়ে থাকা এক মা তাঁরই গৃহিণী। বড় ভাগ্য হে, তাঁদের ভালবাসা পেয়েছিলাম। আর কিছু প্রীতি, এক যুবতী বিদুষীর।

জীবনে জোয়ার কত আসে, ভাঁটায় কত নামে। পলির স্তর থেকে যায় অনেক কিছু। হারায় না। সেখানে প্রকৃতি তার আপন হাতে কাজ করে যায়। এই যাওয়া-আসার কূলে পলি ছানব না। হাত দিয়ে ঘাঁটব না। যা কিছু সব আমার দুই কূলের মৃত্তিকায় থাকা সেই তো জীবনের নিয়ম। নিরন্তরে চলি হে, যাওয়া-আসার অশেষে। যা পেয়েছি, তাই নিয়েছি। যা গিয়েছে, তা যাবে। চলাচলের এই নিয়মে কেউ যেন ঠেক না খেয়ে থাকি।

একদিন ব্ৰহ্মনারায়ণ আর তদীয় গৃহিণীর মন চলাচলের পলিতে তুমিও ঢাকা পড়ে যাবে। ঝিনিরও তাই। আজকের রাগ অভিমান কান্নাটা কিছু না। চলাচলের খেয়ার মোড় বাঁকাবাঁকি নেই। এখন যে জোয়ারের ভরাভরি, তা-ই উপচায়। যদি নিষ্ঠুরতা মনে হয় তবে বলো, তবু এই-ই তো সত্যি।

জীবনের পুছ-জবাব অন্যখানে অন্য সুরে ব্রহ্মাণ্ডের তালে বাজছে। সেথায় লেখালেখির কারণ অকারণ। অতএব আপনা বাঁয়ে চলো।

বাগানের দরজায় হাত দিয়েছি কি না দিয়েছি, বন্ধুর উদ্বিগ্ন সুর বেজে ওঠে, ‘এখুনি যাচ্ছিলাম মেলায় হারানো মানুষের খোঁজ করা অফিসে। সেখানে কিছু না হলে সোজা থানায়। ব্যাপার কী?’

লজ্জিত হয়ে পড়ি। বিব্রত হয়ে বলি, ‘একটু দেরি হয়ে গেল।’

‘একটু? সর্বনাশ! আপনার একটু আর বেশি কাকে বলে জানি না। বেলা চারটে বেজে গেল!’

তাড়াতাড়ি অচিনবাবুর নাম করি। বন্ধু তৎক্ষণাৎ উদ্বেগে হেসে বলেন, ‘আরও সর্বনাশ। অচিনদার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে যে এর মধ্যে আসতে পেরেছেন, তা-ই যথেষ্ট। তা হলে, “একটু দেরি’ই বলতে হবে।’

কিন্তু বন্ধুর বাড়ি নিঝুম। গৃহিণী অতিথি কাউকেই দেখি না। জিজ্ঞেস করতে বলেন, ‘বেবাক মেলায় চলে গেছেন। গৃহিণী আপনার দায়িত্ব আমাকে দিয়ে গেছেন। তাঁরাও বোধ হয় আপনাকে খুঁজছেন।’

আরও লজ্জিত হয়ে পড়ি। বন্ধু সেদিকে তাকিয়েই দেখেন না। বলেন, ‘আসুন, খাওয়াটা সেরে নিন। দক্ষিণ হস্তের ব্যাপারটা নিশ্চয়ই চোকেনি।’

‘তা চোকেনি, তবে একটু স্নানটা সেরে আসি।’

‘মাথা খারাপ নাকি আপনার! এই শীতের অবেলায় এখন চান? আর এই দেশে? একটু হাতে মুখে জল দিয়ে আসুন, তার বেশি নয়।’

মিছে নির্দেশ পরামর্শ না। শীতের স্থানে যেটুকু সুখ তার সময় চলে গিয়েছে সূর্যের ঢল খাওয়া আকাশের ঢালুতে। অতএব হাতে মুখে জল দেওয়াই সাব্যস্ত।

বন্ধু বললেন, ‘কপাল আপনার খারাপ। একে খিচুড়ি, তরকারি আর মাত্র লবাত। তাও এখন ঠান্ডা।

তা হোক, ক্ষতি নেই। কিন্তু লবাত আবার কী। জিজ্ঞেস করি, ‘লবাতটা কী?’

‘মিঠাই। খেজুরি গুড়ের পাটালি, তার নাম লবাত।’

চোখে দেখা হল। নলেন কিনা জানি না, তবে পাটালি। রংটা একটু যা কালো মানুষের গায়ের মতো। কিন্তু তার আগে অবাক মানি মহাপ্রাণীটির কাতরতায়। ই কী দ্যাখ হে, ঠান্ডা খিচুড়ি তরকারি পেয়েও মহাপ্রাণীটির রসনায় কী সুখ! কোথায় ছিল জঠরের এত বুভুক্ষা, জানতে পারিনি। বন্ধুর দুঃখ প্রকাশ মিছে। এর নামই মহাপ্রাণী, তাকে তৃপ্ত করি পরম পরিতোষে।

বন্ধুকে দেখে মনে হয়, বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুত। তাঁকে বলি, ‘আপনি গিয়ে দলে যোগ দিন।’

‘আর আপনি? এখন বেরোবেন না?’

‘একটু বিশ্রাম করতে চাই।’

‘উচিত। অচিনদার কাছ থেকে এসে এবার সেটা খুবই উচিত। তা হলে বিশ্রামের পর এখানেই চা খেয়ে আপনি বেরোবেন। আমরা তা হলে কোথায় থাকব আপনার জন্যে?’

‘যেখানেই হোক, মেলাতেই। খুঁজে বের করে নেব।’

বন্ধু মনে মনে পা বাড়িয়ে ছিলেন। ভৃত্যকে আমার ভার দিয়ে মেলায় দৌড় দিলেন। আর তাঁকে আটকে রাখার জন্যে মনে মনে নিজেকেই হানি।

খাওয়া শেষ হতে না হতেই, মনে হয়, রাঢ়ের আকাশে আঁধার নেমে আসে। বিশ্রাম করতে গিয়ে একটু তন্দ্রার ঘোর লাগে। সেটুকু ভেঙে যাবার পর দেখি, ঘরে আলো, বাইরে অন্ধকার। ঘরের কোণে ঝিঝি ডাকে, দূরে মেলার মানুষ। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরোই। বাউল আসর আমার গন্তব্য।

সেখানে যখন পৌঁছুই দেখতে পাই, স্বয়ং গোপীদাস আসরে। একতারা হাতে, আর কিছু নেই। ভাঙা-ভাঙা গলায় গাইছে,

‘যেজন প্রেমের ভাব জানে না,

তার সঙ্গে কীসের লেনাদেনা।’…

হঠাৎ মনে হয়, গানটা যেন জানা-জানা। শোনা-শোনা। কোথায় শুনেছি। ভাবতে ভাবতেই চোখের সামনে গাজির মুখ ভেসে ওঠে। আর দেখি, গোপীদাস আমাকে দেখে ঘাড় দুলিয়ে ডাকে। চোখের ইশারা করে একদিকে। ইশারার লক্ষ্যে লক্ষ করে দেখি, কী অবাক হে, অচিনবাবু বসে আছেন আসরের সামনে। তাঁর পাশে শ্ৰীমতী অলকা—না, ঝিনি চক্রবর্তী।

.

৪৬.

একা ঝিনি না, তাদের গোটা দলটাই অচিনবাবুকে ঘিরে বসে আছে। কী ভাবে, কোন পন্থায় আলাপ পরিচয়, সে চিন্তা বৃথা। মেলার মানুষ, মেলায় আলাপ, সেটা এক কথা। এখানে সবাই সবার চেনা। আলাপ করে নিলেই হল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আসল কথা আলাদা। এখানে অচিনবাবুর খেলা। ও-বেলা বিদায় নেবার আগে ঝিনি আর ঝিনির দলকে এক লহমায় দেখে রেখেছিলেন। আসরে তাদের দেখতে পেয়ে কাছে ডেকে নিতে তাঁর দেরি হয়নি।

দেখছি, তাঁর এক পাশেতে ঝিনি, আর এক পাশেতে রাধা। পিছন ঘেঁষে মাস্টারমশাই নীরেনদা। সুপর্ণাদি লিলি শুভেন্দু কাছাকাছি, সামনাসামনি, ঘিরে বসে আছে। গোপীদাসের চোখের ঘূর্ণিতে অনেকেরই নজর পড়ে আমার দিকে। নীরেনদাই হাত তোলেন আগে। তারপরেই রাধা। ঝিনির সঙ্গে চোখাচোখির অবকাশেই দেখি অচিনবাবুর মুখ এগিয়ে যায় তার কানের কাছে। কী যেন বলেন। তৎক্ষণাৎ ঝিনির মুখ লাজে লাজানো। দৃষ্টি নামিয়ে মুখ ফেরায়। গোপীদাস তখন একতারাটা তুলেই আমাকে ডাকে। আর তার রাধা বৃদ্ধা প্রকৃতিটি ভাঙা ভাঙা চড়া সুরে গাইছে,

‘দ্যাখ, উল্লুকের হয় উরধো লয়ান।

সে দ্যাখে না সূয্যের কিরাণ।’

গোপীদাস তখনই তার বুড়া শরীর চকিতে পাক দিয়ে কাশি-ভরা মোটা গলায় জোগান দেয়,

‘আর পিপড়েতে পায় চিনির মর্ম,

রসিক হয়িলে যাবে জানা

যেজন প্রেমের ভাব জানে না

তার সঙ্গে কীসের লেনাদেনা।’

ওদিকে, আসরে, গোকুলের পাশে বিন্দু, তাদের পাশে সুজন। কেউ চুপ করে বসে নেই। গোপীদাসের গানের সঙ্গে গোকুল তার ভুগিতে আর ঘুংগুরে তাল দিয়ে চলেছে। বিন্দু বাজায় প্রেমজুরি। সুজনের দোতারার তারে তরঙ্গ খেলে যায়।

আমি ততক্ষণে আসরের দাওয়ায় উঠে জায়গা নেবার ফিকির করি। অচিনবাবু এতক্ষণে হাত তুলে ডাকেন, ‘ইদিকে এসো হে৷ পথ চেয়ে আর কাল গুনে এতক্ষণে দেখা পাওয়া গেল।’

ইতিমধ্যে গানটা শেষ হয়। গোপীদাস আসরের মাঝখান থেকেই বলে, ‘একটু ঠাই করে দাও, বাবাজি বইসবে কুথা?’

অচিনবাবু ধমকের সুরে বলেন, ‘বড় যে দরদ দেখি বাবাজির ওপর।’

গোপীদাস তেমনি বড় বড় লাল চোখ দুটি ঘুরিয়ে বলে, ‘তুমার থেকে বেশি লয়।’

বলে আমার দিকে ফিরে চোখের পাতা নাচায়। অচিনবাবু আর সে কথার জবাব না দিয়ে সরে বসে জায়গা করবার চেষ্টা করেন। বলেন, ‘দেখি ভাই অলকা, সবাই একটু সরে সরে বসি।’

অই হে, এর মধ্যে ‘ভাই অলকা’ হয়ে গিয়েছে। তা নইলে আর অচিনবাবু কেন। কিন্তু আমার সংকোচ লাগে। বলি, ‘আপনারা বসুন, আমি এদিকেই বসছি।’

‘আজ্ঞে না। মজিয়ে মজিয়ে এখন ফারাকে ফারাকে থাকবে, তা হবে না। গুটি গুটি চলে এসসা দিকিনি এখানে।’

এই হল অচিনবাবুর কথা। আরও দশজনা আছেন। এ মানুষকে ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। বচন কোথা থেকে কোথায় যাবে, বলা যায় না। ওদিকে নীরেনদা, সুপর্ণাদি, রাধা, লিলি, ঝিনিতেও হাসাহাসি লেগেছে। শুভেন্দুর মুখেও হাসি। তার চেয়েও সকৌতুক চোখে যেন অবাক ভাবটাই বেশি। কয়েকজনকে পেরিয়ে কোনওরকমে অচিনবাবুর পাশে গিয়ে বসি। আমার এক পাশে রাধা, এক পাশে অচিনবাবু। অচিনবাবুর অন্য পাশে ঝিনি।

বসতে না বসতেই অচিনবাবু বলেন, ‘খুব দেরি করে আসেনি, কী বলল অলকা?’

ঝিনি বলে, ‘আমি তো ভেবেছিলাম, এত দেরিতে ফিরেছেন, বোধ হয় আজ আর আসতেই পারবেন না।’

‘তবু সবাই মিলে গুটি গুটি বাউল আসরে এসে পড়েছ।’

অচিনবাবুও চোখ ঘোরাল। রাধা বলল, ‘বাউল গান শুনতে।’

‘সেই তো। কী যেন বলে না, সেই “কথা পড়ল সবার মাঝে, যার কথা তার গায়ে বাজে।” ভাই রাধে, বাউল সভায় তো লোকে বাউল গান শুনতেই আসে, এর আর বলাবলির কী আছে?’

বলে ঝিনির দিকে ফিরে সাক্ষী মানেন, ‘না কী বলো অলকা।’

ঝিনি তাড়াতাড়ি বলে, ‘বটেই তো।’

কিন্তু বলতে যেন গলায় লাগে ঝিনির। হঠাৎ লজ্জা পেয়ে মুখে একটু রঙের ছোপ লেগে যায়। ঠোঁটের কোণে টিপুনি লাগে, বাঁক খায়। মুখ ফিরিয়ে নেয় একেবারে অন্য দিকে। দেখে চেনা যায় না, এ মেয়ে বিদ্যাবতী নাগরিকা। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয় রাধার। সে হেসে আবার ঝিনির দিকেই চায়।

পিছন থেকে নীরেনদা বলে ওঠেন, ‘খালি গান শুনতে আসিনি। আপনাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের জন্যেও এসেছি।’

অচিনবাবু তাঁর দিকে ফিরে বলেন, ‘তা-ই নাকি? সেও খুব ভাল কথা।’

ওঁর বলার ভঙ্গিতেই কেমন যেন হাসির ঘরে চাবির দম দেওয়া। সবাই হেসে ওঠে। ইতিমধ্যে আবার একতারা বাঁয়া প্রেমজুরি আর দোতারায় বাজনা বেজে ওঠে। গান শুরু হবার আগেই অচিনবাবু হঠাৎ আমার দিকে ফেরেন। মুখখানি গম্ভীর করে ভুরু কুঁচকে প্রায় ধিক্কার দিয়ে বলে ওঠেন, ‘কিন্তু ছি ছি ছি, তুমি যে এরকম, তা জানতাম না।’

বলেই এমন ভাবে মুখ ঘুরিয়ে নেন, আমার বুক ধড়াসে যায়। উদ্বেগে বলে উঠি, ‘কেন বলুন তো? কী হয়েছে?’

‘ছি ছি ছি, সে কি বলবার কথা? নাঃ, তুমি লোক সুবিধের নও।’

হঠাৎ কী অন্যায় ঘটেছে, বুঝতে পারি না। অবাক উদ্বেগে অচিনবাবুর মুখের দিকে চাই। তিনি তখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। জিজ্ঞেস করতে যাব, তার আগেই গোপীদাস ভাঙা ভাঙা গলায় গেয়ে ওঠে,

‘হেঁ হেঁ হেঁ, যে ভাব গোপীর ভাবনা।’…

কথায় বলে, নিজের বুকে আঙুল দেখিয়ে, ‘মানে, গোপী। এই গোপী—গোপীদাসের ভাবনা।’

বলে হাসতে হাসতে, কাশতে কাশতে একটু সামলে নিয়ে আবার ধরে,

‘যে ভাব গোপীর ভাবনা,

সামান্যের কাজ লয়, সে ভাব জানা।’

রাধা বৃদ্ধা ধরে,

‘বৈরাগ্যভাব বেদের বিধি।

গোপিকাভাব প্রেমের নিধি।’

দু’জনে একসঙ্গে গায়,

‘ডুইবে থাকে নিরবধি।

তাতে রসিক জনা।

যে ভাব গোপীর ভাবনা।’

জয়গুরু জয়গুরু আওয়াজ বাজে। বিন্দুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়। সে হাসে। কিন্তু আমার মনটা থমকে থাকে। যদি বা দেখ, অচিনবাবুর মুখ তেমন রাগে ভারী নয়, বরং মিটিমিটি হাসি, গানের সুরে ঘাড় দোলে, তথাপি তাঁর ধিক্কার ভুলতে পারি না। ধিক্কারের কারণ বুঝি না। অপরাধের বৃত্তান্ত জানা নেই। সবাই যেন গানে মজে আছে। আমার মনটাই আঁকুপাঁকু করে।

এক সময়ে গোপীদাসের গান শেষ হয়। সে বসে পড়ে। লক্ষ করে দেখি, তাদের সামনে বড় এক মালসায় আগুন রয়েছে। গোকুল সেই আগুন থেকে আগুন তুলে কলকে সাজাতে উদ্যোগী।

অচিনবাবু বলে ওঠেন, ‘নাও, এবার প্রেমের গাঁজায় বিশ্রাম। তবে আমরাও উঠি।’

গোপীদাস বলে, ‘রাগ করো ক্যানে। দম না দিলে কি দমের মানুষ চইলতে পারে? তুমিও দম দাও।’

গান থামতে আসর একটু আলগা হয়ে যায়। ঝিনি বলে ওঠে, ‘আমরাও একটু চা খেয়ে আসি।’

নীরেনদা বলেন, ‘তা-ই চলো।’

আমি অচিনবাবুকে জিজ্ঞেস করি, ‘আপনিও যাচ্ছেন?’

জবাব আসে ঝিনির কাছ থেকে, হ্যাঁ। আপনিও তো যাচ্ছেন আমাদের সঙ্গে।’

এক পলকের জন্যে ঝিনির ও-বেলার মুখ আমার মনে পড়ে যায়। আর মনে পড়ে যায় ওর কথা, ‘ও-বেলা আসব।’ ও তা হলে বাউল আসরে আসবার কথাই বলেছিল। এখন ওর চোখে ক্ষোভের ছাপ নেই। অভিযোগের ছায়া নেই। চোখ-ভাসানো জলের বদলে যে হাসিটি ফুটে আছে, তাতে একটা লজ্জা-মাখানো লুকোচুরি ভাব। বোধ হয় ও-বেলাতে ওর নিজের কথা ভেবেই ভাবান্তর।

এদিকে অচিনবাবু, ঝিনির কথায় আওয়াজ দেন, ‘সে কথা আবার বলতে হবে নাকি! আমাদের সঙ্গে ছাড়া ও যাবে কোথায়।’

লিলি বলে ওঠে, ‘বলা যায় না। অন্যত্র যাবার কথা থাকতে পারে।’

‘আছে নাকি হে?’

অচিনবাবু যেন ধমকে বাজেন। বলি, ‘না, কোথাও যাবার নেই।’

এ সময়ে হঠাৎ সবাইকে যেন একটু সচকিত করে দিয়ে শুভেন্দু তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়। সুপর্ণাদি ডেকে ওঠেন, ‘শুভেন্দু।’

শুভেন্দু যেন শুনতে পায় না। দাওয়া থেকে নেমে পড়ে সে। সুপর্ণাদি যেন অবাক হয়ে তাকান ঝিনির দিকে। রাধা লিলি চোখাচোখি করে। ঝিনিই এবার ডাক দিয়ে ওঠে, ‘শুভেন্দু।’

শুভেন্দু ফিরে দাঁড়ায়। তার মুখ গম্ভীর, কেমন একটা অনিচ্ছার বিরাগ ভাব। ফিরে বলে, ‘বলো।’

ঝিনি জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

‘বাড়ি।’

‘কেন?’

‘ভাল লাগছে না।’

নীরেনদা তাড়াতাড়ি উদ্বেগে জিজ্ঞেস করেন, ‘শরীর খারাপ করেছে নাকি?’

‘হ্যাঁ, শরীরটা তেমন ভাল লাগছে না। আমি চলি।’

বিশেষ কারুর দিকেই না তাকিয়ে কোনওরকমে একবার ঝিনির সঙ্গে চোখাচোখি করেই সে ফিরে যায়। কয়েক মুহূর্ত সকলেই একটু ঠেক খায়। সকলেই একবার ঝিনির মুখের দিকে চায়। ঝিনিও যেন একটু গম্ভীর হয়ে ওঠে। উচ্চারণ করে, ‘আশ্চর্য!’

নীরেনদা বলেন, ‘একটু মেজাজি ছেলে তো।’

ঝিনি বলে, ‘কিন্তু সেটা এখানে কেন?’

অচিনবাবু এতক্ষণ হাতের চুরুটটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলেন। হঠাৎ বলেন, ‘আমি অবিশ্যি কিছুই জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, সংসারটাই এরকম। সে যে কেবল সুরে বাজে, তা নয়। বেসুরেও বাজে।’

তার বলার ধরনে সকলের মুখেই কিঞ্চিৎ হাসি দেখা দেয়। ঝিনির মুখে একটু রাঙা ছোপের আভাস লাগে। নীরেনদা বলে ওঠেন, ‘ঠিক, খুব ঠিক কথা।’

অচিনবাবু আবার বলেন, ‘বেঠিকের তো কিছু নেই নীরেনবাবু, এ আমরা সবাই জানি। আরও জানি, সুরে আর কতটুকু বাজে। বেসুরের মধ্যেই তো বেশি চলছি। তা আমি বলছিলাম, শুভেন্দুবাবুর এ ব্যাপারে যদি কিছু বিহিত করা যায়, সেটা করা যেতে পারে।’

আবার সবাই চুপ। বিহিতের সন্ধান যেন কারুর জানা নেই। আমি ঝিনির দিকে তাকাই। কেন জানি না, আমার মনে একটু সন্দেহ, বিহিতের খোঁজ ওর জানা আছে। ঝিনির ডাকে শুভেন্দুর ফিরে দাঁড়ানো, যাবার আগে, একবার তাকিয়ে যাওয়া, কোথায় যেন একটা খেই ধরিয়ে দেয়। ঝিনিও হঠাৎ চোখ তোলে। চোখাচোখি হতে আবার ওর মুখে একটু ছোপ ধরে যায়। দূরের দিকে চেয়ে বলে, ‘বিহিত করার কিছু আছে বলে মনে হয় না আমার। লিলি একবার যাবি নাকি?’

লিলি অবাক হয়ে বলে, ‘কোথায়? শুভেন্দুদাকে ডাকতে? অসম্ভব, আমি পারব না ভাই।’

রাধা বলে, ‘তোর তো সম্পর্কে দাদা।’

‘তা হোক। তোদের তো বন্ধু।’

ঝিনি বলে ওঠে, ‘এত কথার কী দরকার। আমরা যেমন যাচ্ছিলাম, তেমনি যাই না কেন।’

নীরেনদা বলেন, ‘হ্যাঁ, সেই ভাল। চলো আমরা যাই। আমি বরং একবার ঘুরে আসি-বাড়ি থেকে। তোমরা কাছেপিঠেই থেকো।’

নীরেনদা চলে যান। অচিনবাবু হাত বাড়িয়ে সবাইকে সামনে এগোবার ইঙ্গিত করে বলেন, ‘অগত্যা। মাস্টারমশাই যা ভাল বুঝেছেন, ঠিকই বুঝেছেন।’

ঝিনি রাধা লিলি আর সুপর্ণাদিদের দলটা একটু এগিয়ে এগিয়ে চলে। বুঝতে পারি, তাদের মধ্যে শুভেন্দুর বিষয়ে আলোচনা চলছে। আমি অচিনবাবুর সঙ্গে একটু পিছনে পিছনে। বলতে ইচ্ছা করে, মন গুণে ধন না, পথ গুণে ধন। পথের কোথায় যে কোন মোড় কোন বাঁকে ফেরে, কোথায় তার কতখানি আঁকাবাঁকা বন্ধুর, কত ভাঙাচোরা কোনখানে, কে জানে! তার কোন কোন সীমানায় অন্ধকার জমাট, কোথায় আলো কতটুকু, না চললে তার হদিস মেলে না। তবু বলতে গেলে এই ভাবি, ঠেক না খেয়ে চলে যাব। স্বচ্ছ জলে ডুব দেব, ঘোলায় পড়ব না। ভাঙাচোরা এড়িয়ে যাব, আঁকাবাঁকায় যাব না। আলো দেখে নিশেন করব, অন্ধকারে যাব না।

এইটি তোমার বাসনা। সংসারে সহজ পথ দেখলে কবে। তোমার মন, আর পথের মেজাজ আলাদা। পথ তো কেবল মৃত্তিকার বুকে দাগ-কাটা জায়গা না। এ পথের আর-এক নাম জীবন-চলাচলের সড়ক। তাই মেঘ এসে চুপি দেয় মনে। বিমর্ষ লাগে, ভার বোধ হয়। আর এই হাওয়া-বন্ধ গুমোটের মধ্যে দূর চিকুরে যেন জিজ্ঞাসায় ঝিলিক হানে, ‘কেন, কেন।’

তার চেয়ে নিজেকে নিয়ে মোড় ফিরি। এবার না-হয় সঙ্গ বদলাই। এত লোক, এত কথা, এত হাসি, এত বাতি। ওই সীমানায় যাই। এ পথে গুমোট। পথের গুমোট পথেই থাক। আমি ভাসি গিয়ে অন্য তরঙ্গে, অন্য মানুষদের ঠিকানায়।

ভাবতে ভাবতেই দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। অচিনবাবুও দাড়ান। অবাক না হয়ে সহজ গলাতেই বলেন, ‘ভুল করো না হে। সংসারে সব রকমেই চলতে হয়, এটা তোমাকে বোঝাবার কিছু নেই। চলো, চলো।’

.

৪৭.

আবার বলতে হয়, এঁর নাম অচিনবাবু। অবাক হয়ে তাকাই ওঁর মুখের দিকে। এ মানুষ অন্তর্যামী নাকি। না কী, থামতে দেখেই মনের কথা টের পেয়েছেন! অথচ আমি যখন বিমর্ষ, মন ভার ভার লাগে, ওঁর মুখে তখনও মিটিমিটি হাসি। হিজিবিজি রেখা গোরা মুখখানিতে যেন রহস্যের নানা সুতোয় ঝিকিমিকি করে। আমাকে চেয়ে থাকতে দেখে বলেন, ‘কী, ঠিক বলেছি? সরে পড়তে চাইছিলে তো?’

দ্বিধায় জড়িয়ে জবাব দিতে যাই, ‘মানে—।’

‘আহা, সে কথা বলতে হবে কেন হে। পালানোই তো আমাদের অভ্যাস। তার মধ্যে আবার তোমাকে দেখেই বুঝেছি, তুমি একটা সেরা পলাতক।’

তাড়াতাড়ি বোঝাতে যাই, ‘না, না, মানে—।’

‘আবার মানে দেখায়, এ ছোকরাকে নিয়ে তো পারা যাবে না দেখছি।’

অচিনবাবু ধমকে বাজেন, কিন্তু সুরেতে হাসি। বলেন, ‘তোমার সাহিত্যিকের ভাষায় কী বলবে তা জানি না। তোমার মনের আসল কথা তো হল, “ধেওরি তোর নিকুচি করেছে, এদের কাছ থেকে কেটে পড়ি।” তাই তো, না কী?’

এমন নির্যস সত্যি বললে অস্বীকার করি, জিভে এত পালিশ নেই। তা সেই সত্যিটাকে নিজের ভাষায় যেমন করেই বলি। অন্য তরঙ্গে ভেসে যাবার আসল কথা তো এটাই। তাতে আমি ‘পলাতক’ হয়ে যাই কিনা জানি না। মনে মনে পথ চলার গতি চেয়েছি। ঠেক খেতে চাই না। বলি, ‘আসলে কী জানেন, ওঁদের নিজেদের ব্যাপারের মধ্যে থেকে হয়তো ওঁদেরই বিরক্ত করব।’

‘সাব্বাস!’

বলেই অচিনবাবু আমার কাঁধে হাত রাখেন। বলেন, ‘একেই বলে কথাকার। তা না হলে আর এমন যুক্তি জোগাতে পারো? কিন্তু দেখ, আমিও কথা বলতে পারি। মুখ যখন খুলিয়েই দিলে, তা হলে বলি, এদের ব্যাপারটা তো তোমাকে বাদ দিয়ে নয়।’

আমি কিছু বলতে যাবার আগেই হাত তুলে থামিয়ে দেন। আবার বলেন, ‘দৃষ্টি থাকলে, নিশ্চয়ই বুঝেছ শুভেন্দুর হঠাৎ এত শরীর খারাপ হল কেন, বাড়ি যাবার তাড়া কেন। মেয়েদের খালি ভাল লাগলেই চলে, ভালবাসলেই চলে? মন বোঝাবুঝির দায় নেই? তা যদি নেই, বাছা এঁড়ে লাগা ছেলের মতো চলে যাও যেথায় খুশি। মন জয়ের মজদুরি যদি না করতে পারো, তবে এখানে কিলিয়ে কাঁটাল পাকাতে পারবে না।’

বলেই মুখ নামিয়ে নিচু স্বরে বলেন, ‘আর শুভেন্দু যাকে কিলিয়ে পাকাতে চাইছে, সে যে অলকা, সেটাও আশা করি বুঝতে পেরেছ।’

অস্বীকারের উপায় নেই। স্বীকার করার দায় নিতে চাই না। শুভেন্দুর চলে যাবার মুহূর্তের ঘটনাই সে কথা বুঝিয়ে দিয়েছিল। তবে আমার জবাবের প্রত্যাশা অচিনবাবুর নেই। তিনি তেমনি স্বরেই বেজে চলেন, ‘তার ওপরে, কাঁটালটি যদি পাকা হয়, তবে তো কথাই নেই। কিল দিলেই সে ছটকে ছিটকে যাবে। না কী বলো হে ভায়া?’

প্রশ্ন শুনে চমকাই। জবাব দিতে গিয়ে থমকাই। এ প্রসঙ্গে যেতে চাই না। কোথায় যেন সংকোচে আড়ষ্ট লাগে। অকারণে অচেনার গায়ে হাত দেওয়া।

তোমার তা মনে হতে পারে, অচিনবাবুর হয় না। বলেন, ‘অতএব দেখতেই পাচ্ছ, শুভেন্দুর জন্যে আসল জায়গায় কোথাও একটু থমকায়নি। সবাই ঠিক আছে। এর পরে তোমার কথার জবাব হল, যে মেয়েটিকে দুপুরবেলা কাঁদিয়ে গেছ, সে যে এখন একটু হাসতে চাইবে, এটাই তো স্বাভাবিক।’

প্রায় বিষম খেয়ে চমকে তাকাই। অচিনবাবুর চোখে যেন কেমন এক উদাস হাসি। অথচ উদাস না। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন ঢুলুঢুলু ভাব করেন। আমি ভাবি, এত খবর এর মধ্যেই পেলেন কেমন করে। অন্তত এ ক্ষেত্রে একজন মুখ না খুললে জানবার উপায় ছিল না।

অচিনবাবুর চোখ থেকে চোখ সরাবার আগেই তিনি আবার বলেন, ‘তা হলেই বুঝতে পারছ, তুমি এদের ব্যাপারে নেই, সেটা ঠিক নয়। বরং আমি তো বলি, তুমিই কাণ্ডটা ঘটালে।’

‘আমি?’

‘তবে কি আমি? এই বুড়ো অচিন মজুমদার?’

বলে এমন ভাবে ভুরু টানেন, চোখের কোণে তাকান, আর গালের ভাঁজে দুষ্টু হাসি হাসেন, হাসি সামলানো দায় হয়। তবু হাসতে গিয়ে কোথায় যেন ঠেক লেগে যায়। বিব্রত বিস্ময়ে বলি, ‘কিন্তু দেখুন, তা তো আমি চাইনি।’

‘তোমার চাওয়াতেই কি সব হবে?’

‘না, তা—।’

আমার কথা থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তুমি পালালেই কি সব মিটে যায়?’

এ কথার হঠাৎ কোনও জবাব দিতে পারি না। অচিনবাবু আবার বলেন, ‘সবাই সবার ভাবে চলে, কাউকে দোষ দিতে পারি না। পালাবে কেন, তুমি তোমার ভাবে চলো। পালানোটাই সহজ এখানে, না পালিয়ে সহজে চলো, সেটাই ভাল। একটা মুখে অন্ধকার দেখেছ। বাকি মুখের আলো কি কিছুই নয়?ֹ’

অচিনবাবুর চোখের দিকে চেয়ে মনে হয়, দৃষ্টির ওপারে যেন এক না-বলা কথার ইশারা। যে ইশারা আলোকে ঝিলিকে দেখা যায় না। যে ইশারা গভীর, গম্ভীর, নিশ্চপ, অথচ নিরন্তর চলে। বুঝতে পারি, সহজের কথা যত সহজে বলেন, সহজে চলা তত সহজ না। পালানোটা ভুল, সে কথা বুঝি। তবু মনটা কেমন খচখচিয়ে মরে। সহজের পথে অসহজের ঘূর্ণি লাগবে না তো? পালাব না, হে সহজ, তোমার অলক্ষ্যের জটিল ধাঁধায় টেনে নিয়ো না। পথ চলাতে অন্ধকারের বিড়ম্বনা, সে বড় ব্যাজ।

ঝিনিদের দলটা আমাদের আগে আগে চলেছে। আমরা তেমনি পিছনে। আমাদের চার পাশে নানা পসারের বিকিকিনি। নানা মানুষের নানা দিকে যাওয়া-আসা, কলকলানি। লক্ষ করেছি, রাধা আর লিলি কয়েকবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখেছে। ওদের চোখেমুখের হাসি বলে দেয়, এখন আর শুভেন্দুর কথায় ওরা নেই। ওরা তিন সখীতে কী যেন বলাবলি করে। চুড়ির রিনিঠিনির মতো হাসিতে বাজে। ওদের চলার ভঙ্গিতে, ছাঁদেও যেন সেই হাসির তালে দোল দোলানো। থেকে থেকে রাধা লিলি ফিরে ফিরে চায়। ঝিনি একবারও ফেরে না। তবু মনে হয়, রাধা লিলির চাহনি আর হাসি ঝিনির চোখে মুখেও ঝলকাচ্ছে। কেবল সুপর্ণাদি চলেছেন দোকান পসার আর মানুষ দেখতে দেখতে। বয়স আর মন নিয়ে তিন সখী থেকে তিনি এখন সঙ্গে থেকেও আলাদা।

অচিনবাবুর দৃষ্টি সামনে। কিন্তু বিশেষ ভাবে কোনও কিছুর ওপরে না। তাই মনে হয়, তাঁর দৃষ্টি মনের ভিতরে। সেইদিকে চোখ রেখেই হঠাৎ বলে ওঠেন, ‘মেয়েটি বড় ভাল। ভারী মিষ্টি আর সহজ। এত সহজ যে, ওকে ভুল বোঝার পথ করে রেখেছে হাজারটা। ওর বাইরের পোশাকটা আর ডিগ্রির কথা শুনলে কেউ ভাবতে পারবে না, ও এত সহজ। নইলে—।’

বলতে বলতে হঠাৎ থমকে যান। আমার দিকে ভুরু কুঁচকে অবাক হয়ে তাকান। তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, ‘ইস্‌, ছি ছি ছি, একেবারে ভুলে গেছি। তোমার সঙ্গে যে আমার কথাই নেই হে। আমি যে তোমার ওপর ভীষণ রাগ করেছি।’

সেই প্রসঙ্গটা এবার হঠাৎ আমারও মনে পড়ে যায়। বাউল আসরে তিনি আমাকে ছিছিক্কার দিয়ে উঠেছিলেন। কেন, তা জানা হয়নি। অসহায় বোধ করি, অবাক হয়ে বলি, ‘হ্যাঁ, তখনও বলছিলেন। কিন্তু কী করেছি, বলুন তো?’

অচিনবাবুর এখনকার মুখ আলাদা। ওঁর হিজিবিজি মুখের রেখায় হঠাৎ যেন ভারী রাগ দেখা দেয়। কিন্তু মন দিয়ে দেখ, এ রাগ কপট। রাগের ওপারে যেন কেমন একটু অনুরাগের রং লাগানো। রুক্ষু স্বরে বলেন, ‘কী করনি, তাই বলো। তোমার সম্পর্কে আমার একটা অন্যরকম ধারণা ছিল। কিন্তু তুমি যে এরকম, এহ্‌, ছি ছি ছি।’

আসল কথায় বাজেন না। আন কথাতেই, কথা শেষ করে চোখ পাকিয়ে তাকান। আবার তিন সখীর দিকে একবার তাকিয়ে বলেন, ‘এতক্ষণে বুঝলাম, কেন ওরা বারে বারে ফিরে ফিরে চাইছে।’

আমি কেবল ধাঁধার জটায় পাক খেয়ে যাই। অপরাধ কী, প্রসঙ্গ কী, তার নাগাল পাই না। তবু জিজ্ঞেস করি, ‘কেন চাইছেন ওঁরা বলুন তো? কী বলাবলি করছেন ওঁরা?’

‘ওরা বলাবলি করছে, আড়ি দিয়েও আবার তোমার সঙ্গে কথা বলছি কেন। না না, তোমার সঙ্গে আমার আর কথা নেই।’

প্রায় ওঁর পায়ে ধরতে ইচ্ছা করে। এ কী অসহায়তা দেখ। জিজ্ঞেস করি, ‘কিন্তু কী অপরাধ করেছি, তা বলুন।’

অচিনবাবু চোখ পাকিয়ে বলেন, ‘তোমার অপরাধ, তুমি অহংকারী।’

অহংকারী! এ অপবাদ তো শত্রুতেও দেয় না আমাকে। বলি, ‘অহংকারী?’

‘হ্যাঁ, আর মিথ্যুক।’

‘মিথ্যুক?’

‘হ্যাঁ। ভাগ্যিস জানতে পেরেছি, তাই। আমি তোমার ঠিকানাও নেব না, তোমাকে কোনওদিন চিঠিও লিখব না।’

আর বলবার দরকার হয় না। কোথাকার কথা কোথায় এসেছে, এবার বুঝতে পারি। চিঠির প্রসঙ্গ অচিনবাবুর কানে উঠেছে। আমার মনে কেবল এই ধাঁধা, ওঁর সঙ্গে ঝিনির এত কথাবার্তা কখন হল। দু’জনাতে এত বলাবলি কেমন করে হল। কয়েক ঘণ্টার তফাতে দেখছি, আমার মানুষ আর আমার নেই। তিনি এখন ভিন দলের দলী। আমিই পর। তিনি এখন ঝিনিদের শরিক। এখন মনে পড়ে, ঝিনির কান্নার কথাও তাঁর গোচরে এসেছে। আর এই তো একটু আগেই শুনলাম; অমন মিষ্টি আর সহজ মেয়ে তিনি আর দেখেননি। এ যে দেখি, আমে দুধে মাখামাখি, আঁটি গড়াগড়ি যায়।

তবে এক বেলাতে এটুকুও বুঝেছি, ভাবের এমন ইন্দ্রজাল অচিনবাবুর অচিন লীলাতেই আছে। সহজেই সহজ আনে। সহজেই সহজ ধরে। ঝিনি সেই সহজে ধরা দিয়েছে। দিয়ে দু’জনে দু’জনের ভাবের ভাবী হয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি বিব্রত লজ্জায় বলি, ‘আসলে কী জানেন—।’

‘আরে রাখ হে তোমার আসল নকল। তুমি মানুষ চেন না।’

সে কথা শিরোধার্য। তেমন অহংকার যেন কোনওদিন না করি। যে আপনাকে চেনে না, সে কেমন করে মানুষ চিনবে। যার আপন পথের ঠিকানা জানা নেই, আপন খোঁজার রূপ চেনে না, সে ভিন মানুষের কী চিনবে। বলি, ‘তা ঠিক।’

তাতে অচিনবাবু শান্ত হন না। রুমে বলেন, ‘হাজার বার ঠিক। আমি বলব, তুমি ওকে শুধু অসম্মান করনি, ওকে মিথ্যেবাদী করেছ, ওর অহংকার চুর্ণবিচুর্ণ করেছ।’

অচিনবাবুর মুখের গাম্ভীর্যে এখন আর কপটতা নেই। কিন্তু চিঠির জবাব না দিয়ে অসম্মানিত করতে চাইনি। কী অহংকার যে চুর্ণ করেছি, তাও জানি না। অবাক হয়ে বলি, ‘উনি কি তাই বলেছেন আপনাকে?’

‘উনি বলবেন কেন। ওঁর কথা থেকেই বোঝা যায়।’

‘কিন্তু ওঁর অহংকারের কথাটা বুঝলাম না।’

‘কেন, এত মানুষ দেখেছ, এটুকু বোঝনি, একটি মেয়ের একটা মেয়েত্বর অহংকার থাকে। তোমার কথা সে তার বন্ধুদের বলেছে। তোমার জন্যে সে তার বাবা-মাকে মিথ্যে কথা বলেছে।’

সে অপরাধ মনে মনে আগেই স্বীকার করেছি। অস্ফুটে বলি, ‘জানি।’

অচিনবাবু আমার দিকে একবার তাকান। তারপরে মুখ ফিরিয়ে বলেন, ‘তার চেয়ে বড় কথা, তুমি ওকে দুঃখ দিয়েছ।’

সে কথাও অনস্বীকার্য। তাঁই চুপ করে থাকি। অচিনবাবু আমার কাঁধে হাত দেন। আমার চোখের দিকে তাকান। দেখি ঈষৎ লাল চোখ দুটি প্রীতি-স্নেহে চিকচিক করে। বলেন, ‘একটা ভাল মেয়েকে দুঃখ দিলে একটু লাগে, তাই এত কথা বললাম। ওর মনটা ভাবো, যেমনি প্রথম আলাপে বুঝেছে, তোমাকে আমার একটু ভাল লেগেছে, অমনি আমাকে সব বলে দিয়েছে। তাতে বোঝা গেল, বিদ্যা বুদ্ধি যা-ই বলো, একটি সুন্দর হৃদয় তার চেয়ে অনেক বড়। সে আর যাই হোক, ছলনা জানে না।’

বলে আবার আমার চোখের দিকে তাকান। ওঁর চোখে যেন কীসের এক অস্পষ্ট জিজ্ঞাসা। যে জিজ্ঞাসায় জড়ানো একটি অচেনা হাসি। আমি বলি, ‘অন্যায় হয়ে গেছে।’

অচিনবাবু বলেন, ‘আর সেটা হয়েছে, তুমি ওকে চিনতে পারনি।’

অবাক হয়ে তাকাই। কী চেনার কথা বলছেন উনি। তার কোনও জবাব নেই, কেবল একটু হাসেন আমার চোখের দিকে চেয়ে। তারপর মুখ ফিরিয়ে নেন। আমার ঠেক লেগে যায় মনে মনে। কোন সংকেত, কোন দিকেতে কী দেখান এই বয়স্ক অভিজ্ঞ রসিক প্রাণের মানুষ! পথ চলি আপন খোঁজার ফেরে। সেখানে সেই চেনাটাই দায়, যে চেনাতে পথের গতি হারিয়ে যায়।

অচিনবাবু হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘আর যেয়ো না, সামনের ঘরেই ঢোকো।’

মেয়েরা দাঁড়ায়। তাদের সামনেই এক চা-কফির ঘর। তেমন ভিড় নেই। মেয়েরা ভিতরে ঢুকেও বসে না। অচিনবাবুর দিকে তাকায়। আমরা এগিয়ে যেতে ঝিনি বলে, ‘বসুন অচিনদা।’

এই শোনো, এর মধ্যে আমার অচিনবাবু এদের অচিনদাও হয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বসছি। তোমরা বসো। সুপর্ণাদি বসুন।’

বলেই রাধা আর লিলির দিকে চেয়ে মুখখানা গম্ভীর করেন। বলেন, ‘তোমরা ভাবছিলে আড়ি দিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলছিলাম? মোটেই না। যা-তা শুনিয়ে দিচ্ছিলাম।’

রাধা লিলি হেসে ওঠেন। সুপর্ণাদি নিঃশব্দে হাসেন। কিন্তু ঝিনির অবাক চোখে একটু উদ্বেগের ছায়া। সেদিকে চেয়ে অচিনবাবু হাত তুলে বলেন, ‘আরে না না, তোমার ভয় পাবার কিছু নেই। মিথ্যুককে মিথ্যুক বলেছি, এই যা।’

তাঁর কথার ভাবে রাধা লিলি আবার হেসে ওঠে। ঝিনির মুখে একটু রং ধরে যায়। ও আমার দিকে একবার চেয়ে তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নেয়। বলে, ‘অচিনদা, আমি কিন্তু আপনাকে দক্ষিণের গল্প বলেছি, নালিশ কিছু করিনি।’

‘তুমি নালিশ করবে কেন। একে আমার যা বলার ছিল, বলেছি। এখন বসো৷’

আমাকে ডেকে বললেন, ‘বসো হে।’

বসতে গিয়েও একেবারে চুপ করে থাকতে পারি না। প্রায় কারুর দিকে না তাকিয়ে বলি, হ্যাঁ, অন্যায় তো একটা হয়েই গেছে।’

অচিনদা বলে ওঠেন, ‘কবুল?’

আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাই। তিনি বলেন, ‘বেশ, ক্ষমা চাওয়ার পাঠ এখন থাক, ওটা অন্য সময় হবে।’

রাধা লিলি আমার দিকে চেয়ে হাসে। সুপর্ণাদি আমাকে বলেন, ‘আমাদের মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে আপনিও রেহাই পেলেন না।’

ঝিনি বলে ওঠে, ‘আহা, কষ্ট আবার কী। এ প্রসঙ্গ থাক, আর নয়।’

ঝিনি লজ্জা পাচ্ছে, বোঝা যায়। প্রসঙ্গান্তরে যেতে চায়। মনে মনে আমারও সেই প্রার্থনা। তবু রাধা চোখে ঝিলিক হেনে বলে ওঠে, ‘মিটমাট যাই হোক, সেই পুরনো চিঠির জবাব দিতে হবে।’

আমি বলি, ‘তাও দেব।’

ঝিনি হেসে ওঠে। ওর সঙ্গে চোখাচোখি করে রাধা লিলিও হাসে। অচিনদা জিজ্ঞেস করেন, ‘কী হল?’

জবাব দেয় ঝিনি, ‘না—মানে ওঁর কথা শুনলে একটু অবিশ্বাস করা যায় না কিনা, তাই।’

সকলের হাসির মধ্যেই অচিনদা বলে ওঠেন, ‘চিতা, চিতা ভাই, চিতা বাঘের চলাফেরা টের পাবে না। তখন বললাম না, গোপীদাস ওর নাম দিয়েছে, কালো চিতা।’

লিলি বলে ওঠে, ‘আর আপনি দিয়েছেন, কালো বিড়াল।’

সকলের হাসিতে কফিখানাটাই খিলখিলিয়ে বেজে ওঠে। আমিও বঞ্চিত হই না। কফির কাপ এসে পড়ে সামনে। চুমুক দিতে গিয়ে ঠেক খাই। হঠাৎ এক সাঁওতাল পুরুষ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে হেঁকে ওঠে, ‘অই, তু অচিনবাবু কী না, অ্যাঁ?’

অচিনদা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন এক মুহূর্ত। কাঁচা-পাকা ঝাঁকড়াচুলো, গায়ে ধোকড়া একটা কম্বল সাঁওতাল পুরুষটির দিকে একটু তাকিয়ে থেকে অচিনদা বলে ওঠেন, ‘আরে তুই বরহম না?’

‘হঁ রে হঁ, তো চিনতে পারলি? আমাদের উদিক্‌খে যাবি না?’

‘যাব। তুই আয় না এখানে?’

‘না, ভিতরে যাব না। তু আয় কেনে।’

অচিনদা উঠে দাঁড়ান। এমন ব্যাকুল, এমন হাসির ঝলক মুখে, মনে হয় কতদিন পরে যেন প্রাণের বন্ধুর দেখা পেয়েছেন। আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখি, তিনি দোকানের বাইরে গিয়ে সাঁওতাল পুরুষটিকে জড়িয়ে ধরেন।

.

৪৮.

আবার না, বারে বারে ফিরে ফিরে বলতে হয়, এর নাম অচিনবাবু। নইলে এমন দৃশ্য দেখতে পেতে না ছাতিমতলার মেলায়। এক গোরা বয়স্ককে জড়িয়ে ধরে কালো সাঁওতালি। তাও কি, দেখ একবার, দামি পশমি জামা আলোয়ানের সঙ্গে কি না ধুলায় মাখা ছেড়া কম্বলের জড়াজড়ি। এর সঙ্গে আরও খবর যোগ করো, গোরা বয়স্ক অচিনবাবু লখ্‌নৌ থেকে সোজা এসেছেন নিজের বিলাতি হাওয়া গাড়িতে। চাকরির বিনিময়ে তাঁর মাসিক মূল্য বত্রিশ শো টাকা। যাকে জড়িয়ে ধরেছেন, তাকে দেখলে বোঝা যায়, বিহান থেকে তার দিন কাটে মাঠে। সাঁঝবেলাতে ঘাটে পা ধুয়ে যে ঘরে ফেরে।

বলবে, এমন বহিরাঙ্গনের দামাদামির বিচার কেন হে। কারণ ঘর নিয়ে যে মন। নিচুতে না, উঁচুতে না, মাঝখানে যে মধ্যবিত্তের মন, তার সেই ছোট জায়গাটাই আগে নাড়া খেয়ে যায়। তাই অবাক লাগে। তারপরে উঁচু নিচু মাঝখানের ঘর না, তার বাইরে, সে-ই এক, যার দ্বিতীয় নেই, প্রাণে প্রাণে জড়ানো দেখে, নিজের প্রাণের ভিন স্রোতের বাঁধ খুলে যায়। তখন কেবল অবাক লাগে না। টলটলিয়ে ওঠে মুগ্ধ রসের ঢেউয়ে।

একবার মুখ ফিরিয়ে সঙ্গীদের দিকে ফিরতে যাই। প্রথমেই চোখ পড়ে যায় ঝিনির দিকে। চোখ পড়তে চোখাচোখি হয়ে যায়। সে তখন আমার দিকে চেয়ে কেন, কে জানে। একটু যেন লজ্জা পেয়ে যায়। বলে ওঠে, ‘অদ্ভুত।’

অবাক খুশিতে বেজে ওঠে রাধা, ‘কে, অচিনদা তো? সত্যি।’

লিলি বলে, ‘দেখেছ, ওঁর খাতিরের লোক সব আলাদা।’

আমি আবার চোখ ফিরিয়ে অচিনদাকে দেখি। দেখি, তখন আর বরহম সাঁওতাল একলা না। পাশে দাঁড়িয়ে তার কাছাকাছি বয়সের এক সাঁওতালনী। সেও যেন হেসে হেসে অচিনদাকে কী বলে। আর উনি হেসে হেসে জবাব দেন। তারপর পকেট থেকে কী নিয়ে বরহমের হাতে গুঁজে দিতে যান। সে হাত ফিরিয়ে নেয়। শুনতে পাই, বলে, ‘না রে না, তুই চল ক্যানে৷ উ আমি চাই না।’

অচিনদা বলেন, ‘তুই চল না। সব নিয়ে-টিয়ে গিয়ে বোস, আমি যাচ্ছি।’

রাধা বলে, ‘কী দিচ্ছেন?’

লিলি বলে, ‘মনে হচ্ছে টাকা দিচ্ছেন যেন।’

আমি আবার এদিকে চোখ ফেরাই। ঝিনিও সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে চায়। তার চোখেও জিজ্ঞাসা। যার জবাব আমার জানা ছিল না। তারপরে হঠাৎ ঝিনি যেন কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না। চোখ নামিয়ে নেয়।

জিজ্ঞেস করি, ‘কিছু বলছেন?’

ঝিনি চোখ তুলে বলে, ‘আপনার মুগ্ধতা দেখছি।’

বলি, ‘আমিও আপনাদেরটা দেখছি।’

‘আপনার সঙ্গে আমাদের একটু তফাত আছে।’

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘যথা?’

ঝিনি বলে, ‘বুঝিয়ে বলতে পারছি না। কেবল মনে হল, আপনি একবারে আত্মহারা।’

তবু অবুঝের মতো চেয়ে থাকি। কথার ঠিক জায়গা ধরতে পারি না। ঝিনি আবার বলে, ‘ছেলেমানুষের মতো। যেন আপনিও পারলে, লোকটাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরতেন।’

দার্শনিকেরা কল্পনা করে কি না জানি না। দার্শনিকারা করে, ঝিনি তার প্রমাণ। নইলে এত বাড়িয়ে বলবে কেন। অচিনদার বন্ধু আর বন্ধুত্ব দেখে মুগ্ধ হয়েছি বটে। বরহম সাঁওতালকে জড়িয়ে ধরতে চাইব কেন। বন্ধু হলে ধরতাম। অমন খোলা প্রাণের আকাঙ্ক্ষায় আর মুগ্ধতায় আমার মন ভেপেছে।

আমরা যখন কথা বলি, তখন বাকিদের ধেয়ান অচিনদার দিকে। ঝিনি আবার বলে, ‘আপনার সেই গাজির কথা আমার মনে পড়ছে।’

জিজ্ঞেস করবার অবকাশ পাই না, অচিনদা আর বরহমকে দেখে কেন গাজির কথা তার মনে পড়ে। অচিনদার ধমক শোনা যায়, ‘নিবি না তা হলে?’

ফিরে চেয়ে দেখি, বরহম তখন পেছিয়ে গিয়েছে অনেকখানি। তার বোঁচা নাক, কালো মুখে দুষ্টু দুষ্টু হাসি। সাঁওতালনীরও সেই রকম। বরহম নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে জানায়, নেবে না। বলে, ‘তুই আয়, আমরা যেয়ে বসি।’

অচিনদা বলেন, ‘ঠিক থাকবি তো?’

‘হঁ রে হঁ, মিছা ক্যানে বইলব?’

‘তো যা, তোরা যা, আমি একটু বাদে যাচ্ছি।’

বরহম ঘাড় কাত করে, সাঁওতালনীকে নিয়ে চলে যায়। অচিনদা আসেন। মুখে তাঁর টেপা টেপা হাসি। এসে বসতে না বসতেই রাধা জিজ্ঞেস করে, ‘ও কে, অচিনদা!’

সুপর্ণাদি বলে ওঠেন, ‘আগে কফিতে চুমুক দিতে দাও, ওটা ঠান্ডা হয়ে গেল।’

যাঁর যেদিকে নজর। কফির পাত্রে চুমুক দেবার আগে অচিনদা বলেন, ‘ছেলেবেলার বন্ধু।’

এক চুমুকে কফির পাত্র শেষ করে, চোখ ঘুরিয়ে হেসে বলেন, ‘দেখছ তো কীরকম বন্ধু? এখনও ভেবে দেখ, আমার সঙ্গ করা চলবে কি না।’

তাঁর কথায় সবাই হেসে বাজে। তিনি চুরুটে আগুন জ্বালেন।

লিলি জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার ছেলেবেলার বন্ধু মানে? আপনি কি এদের সঙ্গে ছিলেন নাকি ছেলেবেলায়?’

‘তা, একরকম তা-ই বলতে পারো। সঙ্গে না থাকলেও কাছাকাছি তো ছিলাম। আমরা ছিলাম আশ্রমে, ওরা ছিল কোপাইয়ের ধারে। ওরা যখন কোপাইয়ের ধারে গরু চরাত, আমরা তখন ছেলেবেলায় অনেকবার সেখানে গিয়েছি। তবে এইটুকু বলতে পারো, সব ছেলেরাই কি আর কোপাইয়ের সাঁওতাল ছেলেদের সঙ্গে ভাব করত? তা করত না, আমার মতো দু’ একজনের সে রোগ ছিল। রোগটা যে কেমন, বুঝতেই পারছ, এখনও দেখা হলে আগের মতোই ছেলেমানুষি করতে ইচ্ছে করে।’

কথা বলতে বলতে ওঁর চুরুট নিবে যায়। আবার আগুন জ্বালেন। আর সেই আগুনের আলোয় দেখি, ওঁর মুখের হিজিবিজি রেখায় তরঙ্গের দোলা। রাধা বলে, ‘আপনারা বেশ মজায় ছিলেন।’

অচিনদা বলেন, ‘মজা? তা একরকম বলতে পারো। আমাদের যুগের শান্তিনিকেতনের সঙ্গে এ যুগের অনেক তফাত। তুমি যাকে মজা বলছ, আমাদের কাছে সেটাই ছিল খাঁটি চেহারা, ওরিজিনাল। তবে তর্ক আসতে পারে, সে কথা থাক, সময় তার কাজ করে যায়। তার ওপরে কারুর হাত চলে না। তবে কি না, “ওর অন্তর্ধান পটে হেরি তব রূপ চিরন্তন। অন্তরে অলক্ষ্যলোকে তোমার পরম আগমন।” হারিয়ে যাওয়ার পিছনেও কিছু জেগে থাকে। সময় চলে যায় ঠিকই, তার ওপারেও কিছু থেকে যায়। কেবল যে চোখ বুজলেই তা দেখতে পাই, তা নয়। মাঝে মাঝে বরহমের মতো কেউ কেউ পুরনো সুরে ডেকে ওঠে, সামনে এসে দেখা দেয়।’

সবাই এমন নিবিষ্ট হয়ে শুনি, কখন যেন, মেলার এই কফি ঘরে স্তব্ধতা নেমে আসে। আমি আবার দেখি, সেই মানুষকে। যে মানুষ হাবাগোবা ছেলেটির মতো অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছেন। ইতিমধ্যে আমরা সবাই চোখাচোখি করি। সকলেরই যেন এক উৎসুক বিস্ময়। সকলেরই চোখে যেন রূপকথা শোনার আবেশ।

কিন্তু নৈঃশব্দ্যই চমক দিল অচিনদাকে। হঠাৎ বলেন, ‘এই দেখ, বকে চলেছি। এবার ভাই, আমি তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নেব। আবার কাল—।’

তাঁর কথা শেষ হবার আগেই ঝিনি যেন ব্যাকুল উদ্বেগে বলে ওঠে, ‘এত তাড়াতাড়ি?’

অচিনদা অমনি চোখ ঘুরিয়ে বলেন, ‘খুব তাড়াতাড়ি বুঝি?’

ওঁর ভুরু তলে, চোখ ঘোরানোর মধ্যে যেন কী এক ইশারা খেলে যায়। এমন করে বলেন, বাকিরা যখন হাসে, ঝিনির ডাগর চোখ দুটি তখন হঠাৎ লাজে লাজিয়ে যায়। মুখ নত করে। কিন্তু রাধা ওর ঘাড় অবধি ফাঁপানো চুলে ঝটকা দিয়ে বলে, ‘খুব তাড়াতাড়িই তো হচ্ছে। আপনি এখুনি চলে যাচ্ছেন কেন। সেরকম কথা তো ছিল না।’

লিলি বলে, ‘তা ছাড়া, আমাদের তো আবার বাউল গান শুনতে যাবার কথা।’

অচিনদা বলেন, ‘আহা, সবাই তো আর চলে যাচ্ছে না। তোমরা রয়েছ, একেও রেখে যাচ্ছি।’

বলে, আমার দিকে একবার চোখের ইশারা করে দেখান। তারপরে ঝিনির দিকে তাকান। আমার চোখাচোখি হয় রাধা লিলির সঙ্গে। সবাই হাসি। কিন্তু মনে মনে ভাবি, অচিনদা পথ চলার কোন দিকেতে ইশারা দেন। নিত্য উধাও পথের ধারে, কোন বাগিচা রচেন। কী ফুল ফোটান।

রাধা ওর ছেলেমানুষি মিঠে মুখখানি গ্রীবার বৃন্তে দুলিয়ে বলে, ‘তা জানি, তবু একটু থাকুন।’

সঙ্গে সঙ্গে ঝিনি বলে ওঠে, ‘আর তা নইলে আমরাও আপনার সঙ্গে যাই।’

অচিনদা প্রায় চমকে উঠে বলেন, ‘অ্যাঁ বল কী? নাঃ, এ মেয়েটা দেখছি সত্যি সেই “যোগিনী হয়ে যাবো সেই দেশে, যেথায় নিঠুর হরি”।’

আবার হাসি বেজে ওঠে। কিন্তু লিলি বলে ওঠে, ‘না না, সত্যি, আমরা সবাই মিলে আপনার সঙ্গে যাবো।’

অচিনদা খলখলিয়ে হেসে বলেন, ‘সর্বনাশ, এ কাদের নিয়ে বেরিয়েছেন সুপর্ণাদি? এ তো সব দেখছি বাউল বৈরাগিণী। কাল মানে না, লোক মানে না, স্থান মানে না, বলে সঙ্গে চলে যাবে?’

লক্ষ করেছিলাম, সুপর্ণাদি বারে বারেই বাইরের দিকে তাকাচ্ছিলেন। হেসে বলেন, ‘আমি ওদের নিয়ে বেরোইনি। ওরাই আমাকে নিয়ে বেরিয়েছে।’

বলে, সস্নেহে তাকাল তিন সখীর দিকে। অচিনদা বলেন, ‘কিন্তু আমি যেখানে যাচ্ছি, সেখানে এ সময়ে তো তোমাদের নিয়ে যেতে পারব না ভাই। তা হলে এসো, সবাই মিলে আর এক পাত্র করে কফি খাই, গল্প করি।’

ইচ্ছা নেই, তবে অগত্যা। আবার কফির অনুমতি হয়। ঝিনি জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় যাবেন?’

বরহমদের আড্ডায়।

‘কোপাইয়ের ধারে?’

শুনেই রাধা উচ্ছ্বাসে আর উল্লাসে বেজে ওঠে, ‘ইস্‌, কী সুন্দর! আমাদেরও নিয়ে চলুন না।’

অচিনদা ততক্ষণে হাসতে আরম্ভ করেছেন। বলেন, ‘উঃ, এ কী কলকাত্তাইয়া পাগলীদের পাল্লায় পড়েছি দেখ। আরে বোকা, কোপাই কি এখানে নাকি? আমি কি বরহমদের আস্তানার কথা বলেছি? আমি বলেছি, ওদের আড্ডায় যাবো একটু। এখন অন্ধকার হয়ে গিয়েছে, সেখানে তোমাদের নিয়ে যেতে পারব না।’

সকলেরই মুখে ছায়া ঘনায়। জমাটি আসর হঠাৎ ভাঙার হতাশা। ভাঙবার আগেই গরম কফির উষ্ণতা যেন জুড়িয়ে যায়।

ঝিনি আবার জিজ্ঞেস করে, ‘এই মেলার মধ্যেই তো?’

‘না। তা হলে আর তোমাদের নিয়ে যেতে বাধা কী ছিল। আমি যাবো উত্তরের খাল পেরিয়ে?’

বলে, চুপচাপ কয়েকবার কফির পাত্রে চুমুক দিয়ে আবার বলেন, অথচ এককালে পৌষ মেলায় বরহমরা ছিল অনেক বড় শরিক। মেলাটা ছিল, ওদেরই অনেকখানি।’

এবার আমার বেজে ওঠার পালা। বলি, ‘হ্যাঁ, ওরা তো শুনেছি দল বেঁধে আসে, নাচে, গান করে।’

আমার কথায় অচিনদা ঘাড় দুলিয়ে সমর্থন জানাতে জানাতে, তারপরে উলটো দিকে নাড়াতে থাকেন। বলেন, ‘কিন্তু আর ওদের এ মেলায় দেখতে পাবে না। স্বয়ং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের দলিলেও ওদের উৎসবে আমন্ত্রণের নির্দেশ ছিল। কিন্তু ওরা আসে না, আসবে না কোনওদিন।’

কেন, তা জিজ্ঞেস করবার দরকার হয় না। অচিনদা নিজেই বলেন, ‘বোধ হয়, বছর আট-দশ আগেও এসেছে। উত্তরায়ণের সামনে নয়া পোস্টাফিসের রাস্তার ধারে যে মাঠ, সেখানে ওরা নিজেরা নাচে গানে মেতে থাকত, সবাইকে মাতিয়ে রাখত। কিন্তু সেই চিরন্তন ট্র্যাজেডি, শহরের মানুষেরা কোনওদিন তাদের চোখ থেকে শহরের ফুলিটা খুলতে পারেনি।’

সকলেই উৎসুক জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে। অচিনদা ঝিনির দিকে চেয়ে বলেন, ‘তোমার দর্শন পড়া আছে, তুমি জানো নিশ্চয়ই, আমরা যাদের আদিবাসী বলি, তাদের কতগুলো আদিম বিশ্বাস আছে। ছেলেমেয়েদের খোলাখুলি মেলামেশাটা ওদের বিশ্বাসেরই অঙ্গ। অথচ দেখ, আমরা সভ্য শহুরে লোকেরা তার জন্যে আন্দোলন করি। আমরা সমানাধিকারের কথা বলি, ওদের বলতে হয় না, কারণ ওটা ওদের জীবনধারণ, সমাজ-সামাজিকতার মধ্যে পড়ে। অতএব উৎসবে অনুষ্ঠানে, ওরা মেয়েপুরুষেরা, একসঙ্গে হাত ধরে নাচে, গান করে, পান করে। কিন্তু আমাদের শহুরে সভ্য মানুষের মুশকিল হল, তারা পয়সা দিয়ে নাচ দেখে। একটু হয়তো শুনতে কটু লাগবে, তারা বাঈজীর বাড়ি যায়, মুজরো দেয়, টাকা ছোড়ে। আকাশের তলায়, প্রকৃতির সাজে সাজানো মাতঙ্গ মাতঙ্গিনীর নাচ দেখেনি কোনওদিন। তাই মেলা দেখতে আসা, ছিঁচকে শহুরে লোকদের চোখের সেই নোংরা চশমাতে কেবল লোভ। সহজলভ্য ভেবে তারা সাঁওতাল মেয়েদের গায়ে হাত বাড়াতে গেল। তার পরিণতি যা হয়, তাই হয়েছিল। প্রতিবাদ আর সংঘর্ষ। সেই থেকে মেলার উৎসব থেকে ওরা বিদায় নিয়েছে।’

কথা শেষ করে, অচিনদা কফির পাত্রে চুমুক দেয়। অপরেরা তাও ভুলে যায়। সকলেরই মুখে ক্ষুব্ধ বিষণ্ণতা। আমার চোখে ভেসে ওঠে মলুটি গ্রামের মৌলীক্ষার মাঠ। কালীপূজার ভাসানে যেখানে দেখেছিলাম, আমি বিশ্বাসের অপরূপ লীলা। হয়তো এই ছাতিমতলার মেলায়, মৌলীক্ষার মাঠের মতো, নিরাবরণ পুরুষ প্রকৃতির গণমিল হত না, কিন্তু সহস্রের নাচের দোলায় তরঙ্গায়িত মাঠ ভেসে ওঠে চোখে।

ঝিনি যেন ইংরেজিতে কী বলে ওঠে, খেয়াল করি না। অচিনদা বলেন, ‘ঠিক বলেছ, আমরা সবাই পিতৃতান্ত্রিক নগর সভ্যতার চোখে দেখি।’

রাধা তো অল্পেতেই বাজে। বলে ওঠে, ‘কতগুলো নোংরা লোকের জন্য আমরা বঞ্চিত হয়েছি। লোকগুলোকে তির ধনুক দিয়ে ওরা মেরে ফেলতে পারেনি?’

অচিনদা বলে ওঠেন, ‘আরে তা হলে আমরাই যে আবার কাঁদতে বসতাম গো। যাদের মারত, তারা তো সব আমাদেরই ভাই ছেলে স্বামী।’

নাগরিকা রাধা ওর ঘাড়ে ছাঁটা চুলে ঝাপটা মারে। বলে, ‘ভাই ছেলে স্বামী না ছাই।’

রূপে বেশবাসে বোঝা যায় না, রাধা এমনি ভাষণ করতে পারে। ওর কথা শুনে ফোঁসানি দেখে সবাই হাসে। অচিনদা আমাকে বলেন, ‘কী হে, তুমি যে বড় উদাস হয়ে পড়লে।’

বলি, ‘উদাস না। আপনার কথা শুনে, দৃশ্য মনে পড়ে গেল।’

‘সাঁওতাল নাচের? কোথায়?’

‘মলুটি গ্রামে। রামপুরহাট থেকে যেতে হয়।’

বিসর্জনের সেই সন্ধ্যাবেলার কথা বলি। সেই নাচের অনুষ্ঠানের শেষ মুহূর্তের কথা যখন বলি সকলের চোখে যেন একটা দ্বিধার বিস্ময়। কেবল অচিনদা ছাড়া। আর ঝিনি যেন চোখের দিকে তাকাতে গিয়ে হঠাৎ লজ্জা পেয়ে যায়।

রাধা বলে ওঠে, ‘সত্যি?’

ওর বিস্ময়ের তীব্রতায়, দৃষ্টির জিজ্ঞাসায় আমিও প্রায় লজ্জা পেয়ে যাই। লিলি বলে, ‘সত্যি নয় তো মিথ্যে বলছেন নাকি?’

রাধা যেন হঠাৎ কেঁপে উঠে বলে, ‘না, আমি বোধ হয় দেখতে পারতাম না।’

সবাই হাসে। ঝিনি চোখ তুলতে গিয়ে আবার লজ্জা পায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বলে, ‘আশ্চর্য!’

অচিনদা বলে ওঠেন, ‘আর একেই বলে তক্ষক।’

বলে, আমার দিকে ইশারা করে দেখান। বলেন, ‘এদিকে শব্দাশব্দি নেই, ওদিকে সব দেখে শুনে তক্ষকটি হয়ে বসে আছেন।’

সবাই খিলখিলিয়ে বাজে। অচিনদা আবার একটু গলা নামিয়ে বলেন, ‘তা, সেখানে ওসব দেখে, ভায়ার কোনও গোলমাল হয়নি তো?’

তাঁর প্রশ্নের ঢঙে, সবাই আরো জোরে বেজে ওঠে। আমি বলি, ‘না। তবে এত অবাক কখনও হইনি। মনে হয়েছিল হাজার হাজার বছর আগের ভারতবর্ষের এক রূপ দেখলাম। এমন সৌভাগ্য ক’জনের হয়?’

অচিনদা পিঠে হাত দিয়ে বলেন, ‘ঠিক, ঠিক বলেছ।’

সুপর্ণাদি হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা, আপনার মনে কোনও বিকার আসেনি?’

আমি বলি, ‘না সুপর্ণাদি। মনে প্রশ্ন এসেছিল। তার জবাবও আমি পেয়েছি। শুনেছি কোনারকের মন্দিরের মূর্তি দেখে নাকি অনেক রুচিবাগীশ ভদ্রলোকের রুচিতে আঘাত লাগে। আমার লাগেনি। আমি দেখেছিলাম, বিশ্বসংসারের এক চিরন্তন রথ, স্বাস্থ্য আর আয়ুর আকাঙ্ক্ষায় সৃষ্টির লীলা করে চলেছে। আর মলুটির সাঁওতালদের সেই গণ-মিলনের ছবি যেন, কোনারকের মন্দিরের গায়ের জীবন্ত রূপ।’

‘অপূর্ব!’

অচিনদা আমার পিঠে চাপ দেন। বলেন, ‘তোমার কথার জন্যে বলছি না, তোমার দেখার নজরের কথা বলছি। বুঝলে অলকা, এ হলো অন্য চোখের কথা। তোমার ফিলজফিতে, তুমি একমত তো?’

ঝিনি বলে, ‘ফিলজফির কথা জানি না, কিন্তু একমত।’

অচিনদা তৎক্ষণাৎ বলে ওঠেন, ‘অতএব আর নয়। ওহে, পয়সাটা নিয়ে যাও।’

বলে, তিনি পকেটে হাত দেন। আমিও দিই। আর একই সঙ্গে ওরা তিন সখীতে কুটুস কুটুস ব্যাগ খুলে ফেলে। অচিনদা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলেন, ‘কী হল? সবাই যেন একেবারে মুখিয়ে ছিলে মনে হল। দেখুন তো সুপর্ণাদি, এদের ডেঁপোমি দেখলে আমার গা জ্বলে যায়।’

তারপরেও আর হাত তোলার সাহস কারুর থাকে না। সুপর্ণাদি স্নিগ্ধ হেসে বলেন, ‘ছেলেমানুষ তো৷’

পয়সা দিয়ে তিনি উঠে দাঁড়াতেই আমিও দাঁড়াই। অচিনদা বলেন, ‘কী হল?’

সঙ্কোচে জিজ্ঞেস করি, ‘আমি গেলে আপনার অসুবিধে হবে?’

অচিনদা তাঁর কোঁচকানো ভুরুর তলা থেকে একটু লাল লাল চোখের ঝলকে একবার সবাইকে দেখে নেন। তারপরে বলেন, ‘তুমি যাবে মানে, এঁদের—।’

তাঁর কথা শেষ হয় না। হঠাৎ ঝিনি উঠে দাঁড়ায়। দেখি কখন সহসা বায়ু কোণে মেঘ জমে গিয়েছে। ঘন গর্জনের আভাস, ঝঞ্ঝার ঝিকিমিকি। বলে, ‘না না, উনি কেন মিছিমিছি ওঁর অসুবিধে করে থাকবেন। আমাদের কোনও দরকার নেই ওঁকে।’

আমিই যেন বিব্রত লজ্জায় অধোবদন। অচিনদাকে কী বলব, বুঝতে না পেরে, তাড়াতাড়ি ঝিনির দিকে ফিরি। এই তো, এত কথা, এত হাসি। এই তো মুহূর্ত আগেও ঝিনি এত ‘একমত’।

তবু—তবু কখন, কোন মুহূর্তে চিকুর হেনে গেল বায়ু কোণে।

আমি কিছু বলবার আগেই ঝিনি আবার বলে ওঠে, ‘বুঝতেই তো পারছেন অচিনদা, আমাদের সঙ্গে থাকতে ওঁর ভাল লাগছে না। তা ছাড়া নীরেনদা অনেকক্ষণ গেছেন, এখনও এলেন না। শুভেন্দুর জন্যে আমার একটু ভাবনা হচ্ছে। আমিও আর থাকতে পারব না, চলি। আবার দেখা হবে।’

‘বলেই, পা বাড়িয়ে দেয়। দিয়ে পিছন ফিরে ডাকে, ‘আসুন সুপর্ণাদি। রাধা লিলি আয়।’

কী বা বলিহারি দেখ, ঝিনির ডাকে সবাই দেখি, সুড়সুড়িয়ে উঠে যায়। রাধা লিলি, এমনকী সুপর্ণাদির ঠোঁটের কোণেও একটু হাসি দেখা দেয়। তবে বড় সন্তর্পণে। ‘যাচ্ছি’ বলে সবাই বিদায় নেয়। কেবল সুপর্ণাদি অচিনদাকে বলেন, ‘আজ বড় বেগতিক দেখছি।’

অচিনদা গলা নামিয়ে বলেন, ‘কিংবা এটাই হয়তো গতিক।’

সুপর্ণাদি হেসে চলে যান। আর অচিনদা আমার দিকে প্রায় দুর্গা প্রতিমার অসুরের মতো চোখ পাকিয়ে রুক্ষে তাকান। প্রথম কেবল উচ্চারণ করতে পারেন, ‘বদ ছোকরা!’

আমি কিছু বলতে যেতেই হুমকে ডাকেন, ‘চোপ। দেখাচ্ছি তোমাকে, চলো।’

.

৪৯.

অচিনদা এমন ভাবে হুমকে ‘চোপ’ বলেন, মনে হয়, হাত বাড়িয়ে মারতে আসেন বুঝি। কিন্তু মারেন না, হাত বাড়িয়ে পিছু ধাওয়ার ইশারা করে, নিজেই রেগে ধেয়ে যান। যেভাবে শাসালেন, এর পরে কী দেখাবেন, কে জানে। তবে পিছু ধাওয়ার ইশারা তো না, হুকুম। অতএব হুকুমবরদারের মতো পিছু পিছু চলি।

তবু, ঝিনির মুখটা মনে পড়ে বারে বারে। কানে লেগে থাকে ওর কথাগুলো। অচিনদার সঙ্গে যাবার ইচ্ছা হয়েছিল, তা-ই বলেছিলাম। বরহমদের ভাবনা আমার মাথায়। মনেতে কৌতুহলের ঝিকিমিকি, যাবো তাদের আড্ডায়। আর কিছু না। আর কিছু ভাবিনি। কিন্তু একমাত্র কথায় যে ঝিনির মুখে মেঘ ডেকে এনেছি, তা জানিনি। পূর্বাভাসেও এমন বার্তা ছিল না, অচিনদাকে ছেড়ে, অন্য দলে থাকব। এ যে দেখি, পুরনো অপরাধ ভঞ্জন করতে গিয়ে, নতুন অপরাধের কলঙ্ক মিলে যায়। অথচ উপায় কী করি।

তবে, কেন, সেই জবাব কে দেবে। কেন অপরাধী হই, ঝিনি কেন অপরাধী করে। পথ চলার এই বিহঙ্গের কিচির-মিচিরে, যখন পাখায় লাগে রঙের ঝলক, হাসিতে ঝরে ফুলঝুরির রংবাহার, তখন আলো কেন নেবে। মুখের হাসি নিবিয়ে, এই অন্ধকারের দুঃখ কেন। দুঃখে এমন বিরাগ দিয়ে, এমন তীব্র দাহে বেঁধা কেন। এমন কথা কখন ভেবেছি, আমাকে ঝিনিদের দরকার আছে, যে-কথাটা ওকে সরোষে জানাতে হয়, আমাকে ওদের দরকার নেই। ওদের সঙ্গ আমার ভাল লাগে না, সে কথা বা কখন ভেবেছি। শুভেন্দুর জন্যে ওর ভাবনার উদ্বেগে বাধা দেবার কথা তো ভাবিনি কখনও। ঝিনি আর থাকতে পারবে না, এমন ভাবে বলে গেল, যেন পথ আটকে দাঁড়িয়েছিলাম।

ছাতিমতলার মেলায়, এই জনারণ্যের মাঝখানে চলতে চলতে, একটু না হেসে পারি না। মন-টাটানো হাসি। ভুলি কেন, কেবল অমৃত পান করে যাব। আমার কূলে কূলে কেবল অমৃত। তিক্ত রসের স্রোত কি কেবল তোমার ছোঁয়া বাঁচিয়ে বহে যায়। আপন না জেনে, অলক্ষ্যে কখন সে-পাত্র তুলে নাও, অমৃতের আমেজে তা খেয়াল থাকে না। একটু যদি জ্বালা ধরে, ধরুক। “জ্বলিস্‌ যদি দিবা নিশি, তবেই আলো দেখবি।” এমন গানের মতো ভাববো না। তবু পিছন ফিরে, পথের যে-আলোতে টান লাগে, সেই আলোতেই চলে যাবো হেথা, এই পথ চলাতে মানের কথা মনে রাখব না। অপমান গায়ে মাখব না। ঝিনির ওপরে রাগ আসে না, ওকে নিয়ে আমার বৈরাগ্যের কথাই বা কী। অতএব, সেই ভাল, সেই ভাল।

ঝিনিকে বুঝতে পারি না, বলব না। বিদুষী বলে একটু অবাক লাগে। সংসার আমার মনের অবাক দিয়ে বানানো না। যেমন ‘যা নাই ভাণ্ডে, তা নাই ব্রহ্মাণ্ডে’ তেমনি সংসারের স্ব-ভাবেতেই অবাক বিরাজ করে। যা অসম্ভব ভাবি, জগতে তার সবই সম্ভব। অসম্ভব ভাবি কেবল, আপনার মনের ছক দিয়ে।

বেশ, সেই ভাল, সেই ভাল। ঝিনি বাজে, ঝিনির মতোই। বাজবেও। ওর মনের তারে তারে হয়তো এমনি সুরেই বাঁধা আছে, হাত লাগলে তা এমনি করেই বাজে। তার কার্যকারণ অতীত জানি না। খুঁজতে যাওয়া আরও বিড়ম্বনা। অতএব, আপন পথে, আপনাতে চলি। তিক্ত ঝাঁজের রস ছিটিয়ে, ঝিনির যেথায় মন, সেথায় থাক।

কিন্তু, অচিনদা কি থামবেন না। একবার ফিরেও দেখবেন না, তাঁর পিছু ধাওয়ার হুকুম পালন হচ্ছে কি না! কাঁধ ঝুঁকিয়ে সেই যে চলেছেন আর থামবার নামটি নেই। রেগে আছেন জানি। না হয়, একবার রেগেই তাকিয়ে দেখুন। সার্কাস ম্যাজিক নাগর-দোলা, গ্রামীণ মেলার সীমানা পেরিয়ে, নাগরিকদের নগর ঝলকানো মেলাও পেরিয়ে যান। কারা যেন অচিনদার নাম ধরে ডাকাডাকি করে। সবাইকেই, হাত তুলে, ঘাড় দুলিয়ে, কথা না বলে, ব্যস্ত মানুষ এগিয়ে চলে যান। যেন, থামবার উপায় নেই।

মেলা পেরিয়ে দেখি, পশ্চিমে হাঁটা দেন। কেন জানি না, মনে করেছিলাম, বরহমদের আড্ডা বুঝি পুব দিকে। একেবারে বাঁধানো সড়কের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে ভাবি, ঘরে ফিরে যান নাকি? আমার ওপর গোসা করে, আসল যাত্রাই নাস্তি না তো!

বড় সড়কে পড়ে, আশ্রম সীমানার দিকে যান না। উত্তরে হাঁটেন। আমার উপায় নেই, জেলের পিছনে কেলে হাঁড়ি। লোক চলাচলের ভিড় সবখানেই, সব পথেতেই। তার মধ্যেই দেখি, ডান দিকে, হাসপাতালের পথের ধারে, এক বিলাতি মোটরগাড়ির কাছে থমকে দাঁড়ান। ডাক দেন, ‘বিরিজ!’

ডাক দিতে না দিতেই, রাস্তার পাশ থেকে একজন ছুটে এসে আওয়াজ দেয়, ‘জি হুজুর।’ বিরিজ যার নাম, তাকে দেখে সন্দেহ হয়, সে গাড়ির চালক। ছুটে এসে গাড়ির দরজা খুলে ধরে। অচিনদা বলেন, ‘না, উঠব না। গাড়ির ভিতর থেকে বড় ঝোলাটা দাও তো।’

আমি যে কাছেই দাঁড়িয়ে আছি, তা যেন দেখতেই পান না। মুখের ভাব সেই দুর্গাপ্রতিমার অসুরের মতোই। তবে, বিরিজের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে, একটু অন্যরকম। বিরিজ প্রায় কলের পুতুলের মতো হুকুম পালন করে। ভিতর থেকে একটা কাপড়ের ঝোলা বের করে দেয়। কী আছে, কে জানে, তবে খালি ঝোলা না। সেটা হাতে নিয়ে, অচিনদা বলেন, ‘তুমি বাড়িতে চলে যাও। আজ রাত্রে আর কোথাও যাব না। গাড়ি তুলে দিয়ে, তুমি খেয়েদেয়ে, শুয়ে পড়গে।’

বিরিজ শিরোধার্য করে জবাব দেয়, ‘জি।’

কিন্তু সেদিকে আর তখন অচিনদার ধ্যান নেই। হঠাৎ দখিনমুখো একটা খালি সাইকেলরিকশা দেখে, হাত তুলে ডাক দেন, ‘এই দাঁড়া দাঁড়া, এদিকে আয়।’

ব্যাপারের কিছু সুলুক সন্ধান পাই না। নিজের যন্ত্রযান থাকতে কেন মানুষের টানা তিন চাকা ডাক দেন, কে জানে। রিকশাওয়ালা রিকশা নিয়ে কাছে আসতে, মুখ এগিয়ে নিয়ে তার মুখ দেখেন। উস্কোখুস্কো চুল কালো লোকটা দাঁত দেখিয়ে হাসে। বলে, ‘ভাল আছেন বাবু।’

‘তা আছি। তুই কে?’

‘আমি তো লরোত্তম, বোলপুরের সাঁকোর ধাঁরে—।’

অচিনদা বলে ওঠেন, ‘গদাধরের বিটা।’

‘হুঁ হুঁ, চিনতে পাইরলেন?’

‘তা পেরেছি। এখন চল্ তো।’

বলেই, সেই লাল লাল চোখে, ঘুরন দিয়ে, আমার দিকে তাকান। হাত তুলে বলেন, ‘ওঠো।’

যথা আজ্ঞা। এখানে পুছপাছ চলবে না জানি। রিকশায় উঠে বসি। লরোত্তম, অর্থাৎ নরোত্তম জিজ্ঞেস করে, ‘কুথা যাবেন?’

‘যমের বাড়ি।’

বলে রিকশায় উঠে নির্দেশ দেন, ‘ঘুরিয়ে নে খালের দিকে চল্‌।’

নরোত্তম হাসতে হাসতে গাড়ি ঘোরায় উত্তরে। উত্তর-পশ্চিমা হাওয়ার ঝাপটা খেয়ে চলতে থাকে। সে ঝাপটা মুখে এসে লাগতে মনে হয়, চামড়া চড়চড়িয়ে যায়। যেন ছুরি দিয়ে কাটে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, কোথায় চলেছেন। কেবল যে ভরসা পাই না, তা-ই না। কৌতূহলের মজাটা মনে মনেই চাখি। দেখি, কোথায় গন্তব্য। কিন্তু একটি কথা না। অচিনদার দৃষ্টি সামনের দিকে। ভুরু দিয়ে যেন চোখ ঢাকা।

খালের সাঁকোতেই শেষ বাতি। তারপরে নিবিড় অন্ধকার। খালের জলের ধারা একবার চিকচিকিয়ে উঠতে না উঠতেই, রিকশা গড়িয়ে নেমে যায়, আর ঝনঝনিয়ে বাজে। শান্তিনিকেতনের পাকা মসৃণ রাস্তা আর নেই। এ সেই রাঢ় বীরভূমের খোয়াইয়ের বুক চিরে রাস্তা। যে রাস্তায় মাটি বালি কাঁকর পাথর ছড়ানো। পদে পদে উঁচু-নিচু। তিনটে মানুষকে নিয়েও যেন, রিকশাটাকে ধরে লোফালুফি নাচানাচি করে।

আলোর সীমানা পেরিয়ে আসতেই, ঘুটঘুটে অন্ধকারের গ্রাসে যেন অন্ধ হয়ে যাই। সামনে, আশেপাশে, কিছুই চোখে পড়ে না। কেবল, দু’পাশের খোলা মাঠ থেকে ঠান্ডা হাওয়ার ধারালো নখে ছিন্নভিন্ন হই। দাঁতে দাঁত চাপতে হয়। অথচ বয়স্ক প্রৌঢ় আমার পাশে বসে, স্থির নিশ্চল, কোনও বিকার টের পাই না।

জানি না, দু’পাশের এই খোলা তেপান্তরকে খোয়াই বলব কি না। কে জানে, কোপাই কত দূরে। মলুটির পথে দেখেছি, বর্ষার জলে ক্ষয়ে যাওয়া, কাঁকর ছড়ানো নদীখাতের নাম খোয়াই। যে-নদীখাতে বর্ষার পরে আর জল থাকে না। কেবল, দিকে দিকে উঁচু-নিচু ছোট বড় কাঁকর ছড়ানো গিরিমালার মতো দিগন্ত বিস্তৃত। লাল তার রং, বৈরাগ্যের গেরুয়ার প্রলেপ লাগানো, আর বালির বিস্তৃতি। থেকে থেকে, হেথা হোথা, হঠাৎ জলের রেখা চিক চিক করে।

কোপাই, বর্ষাতে বড় ভয়ংকর শুনেছি। ভয়ংকরী না, সে-ই তার যৌবনের কাল। তার খোয়াইয়ের বিস্তৃতি যে কতদূর, কে জানে। রিকশা যে-ভাবে নেমে, লাফিয়ে লাফিয়ে চলে, তাতেই ভাবি, এ হয়তো খোয়াইয়ের বুক চিরে রাস্তা। ডাইনে, বাঁয়ে, সবই শূন্য লাগে। কোথায় যে আকাশ নেমেছে, কোথায় এ বিস্তৃতির সীমা বুঝতে পারি না। কেবল, কুয়াশাহীন আকাশে দেখি, তারায় ভরা।

কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎ অচিনদা চমকে উঠে বলেন, ‘এহ্‌, বড় ভুল হয়ে গেছে, টর্চ লাইট আনা হয়নি।’

নরোত্তম জিজ্ঞেস করে, ‘যাবেন কুথা?’

‘বাঁশঝাড়ে।‘

শোনো এবার কথা! এ হচ্ছে, অচিনবাবুর কথা। আলোর সীমানা ফেলে এসে এই শীতের থাবায় আঁচড়ানো অন্ধকারে তেপান্তরে, এখন আওয়াজ দিচ্ছেন, গন্তব্য বাঁশঝাড়ে। কে জানে, সেই বাঁশঝাড় কোথায়, এ মুল্লুকের কোনখানে। আমার মনটা যেন কেমন একটু উথালি-পাথালি করে। এবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, সে বেণুবন কোথায়, কেনই বা সেখানে।

নরোত্তম কিন্তু বেশ সহজেই আওয়াজ দেয়, ‘অ। অই উইটা তো?’

বলে ডান হাত তুলে পুবদিকে দেখায়। তখন অন্ধকারে একটু নজর সরেছে, সয়ে এসেছে। তাকিয়ে মনে হল, আকাশের নীচে, তেপান্তরের বুকে, দ্বীপের মতো কালো এক ঝুপসি। অন্ধকারের বুকে, আর এক প্রস্ত যেন কালো পোছড়া। আর কিছু যখন চোখে পড়ে না, তখন ওটাই বোধ হয় বাঁশঝাড়।

অচিনদা বলেন, ‘হ্যাঁ, ওটাই। কিন্তু এত অন্ধকারে তো অসুবিধা হবে। তুই দাঁড়া নরোত্তম, আর যাসনে। এখান থেকেই হাঁটতে হবে।’

নরোত্তম রিকশা দাঁড় করায়। কাছে-পিঠে কোথাও একটা আলো নেই। ছাতিমতলায় মেলার যাত্রীও চোখে পড়ে না এ-পথে। তার ওপরে, এই মাঠের বুকে, অন্ধকার বাঁশঝাড়ে গমন, ই কী কথা হে!

নরোত্তম রিকশা থেকে নেমে বলে, ‘এক কাজ কইরতে পারি বাবু। আমার গাড়ির বাতিটা লিয়ে, আপনাদের পথ দেখিয়ে লিয়ে যাই। না হলে, যেতে লারবেন।’

অচিনদা তৎক্ষণাৎ আওয়াজ দেন, ‘ঠিক বলেছিস। তোর গাড়ির বাতিটাই খোল্‌। তা ছাড়া তু-ই আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবি, তোকে থাকতেও হবে। কিন্তু তোর রিকশা রাখবি কোথায়!’

‘সে হবে বাবু, রাস্তার ধারে লামিয়ে রেখে দিচ্ছি। গরুর গাড়িটাড়ি এসে পড়তে পারে।’

‘কিন্তু গাড়ি চুরি করবে না তো কেউ।’

নরোত্তম হাসে। বলে, ‘না বাবু। এখান থেকে আর রিকশা কে চুরি করবে।’

বাতিটা খুলে সে অচিনদার হাতে দেয়, বলে, ‘ধরেন একটু, গাড়িটা লামাই।’

বাতি তো না, একটু লালের আভাস মাত্র। তাও বাতাসে তিরতির করে। তবে কি না, এ ঘোর আঁধারে। তাও একটু-আধটু, খাল রাস্তা দেখা যায়। উঁচু-নিচু মালুম দেয়। নরোত্তম রিকশাটা রাস্তার ধারে, একটা গর্তের মতো জায়গায় নামিয়ে দেয়। অচিনদা বাতি হাতে, রাস্তা থেকে নামতে নামতে, একবার আমার দিকে ফিরে তাকান। তখন সেই অসুরের মতো বিকট ভাব নেই বটে, তবে গম্ভীর। কিন্তু চোখে যেন একটু রহস্যের ঝিকিমিকি। ডাক দেন, ‘এসো হে। সাবধানে এসো, পড়ে-টড়ে যেয়ো না, ঢালু আছে।’

সেটা লক্ষ করেছি। সাবধান না হয়েও উপায় নেই। পড়লে যে কোমল ধরিত্রীর বুকে পড়ব, সে আশা নেই। পদক্ষেপেই জানা যাচ্ছে, কাঁকরে পাথরে, এ মৃত্তিকা বড় কঠিন। নরোত্তম রিকশা রেখে অচিনদার হাত থেকে আলোটা নিয়ে, আগে আগে যায়। অচিনদা আমার পাশে পাশে। পথ বলে ঠিক কিছু আছে মনে হয় না। উঁচু-নিচু ঢেউ খেলানো পাথুরে মাটির এখানে ওখানে ঘাস গজানো। তার মাঝখানে, পায়ে চলা পথের একটা চিহ্ন চোখে পড়ে।

অচিনদার মুখের দিকে বারেক তাকাই। বিশেষ কিছু দেখা যায় না। শেষ পর্যন্ত যেন আমি না, আমার ভিতর থেকে অন্য কেউ জিজ্ঞেস করে ওঠে, ‘আমরা ওই বাঁশঝাড়ে যাচ্ছি, না?’

‘হ্যাঁ।’

ছোট জবাব। তবু জিজ্ঞেস করি, ‘কিন্তু এখানে এ সময়ে—?’

কথা শেষ করতে না দিয়েই বলে ওঠেন, ‘ভয় হচ্ছে?’

‘না, তা নয়, তবে এই অন্ধকারে, লোকজন কেউ নেই, তা-ই।’

‘দেখা যাক, কী আছে না আছে। গেলেই দেখতে পাবে।’

অতএব, কথা থাক, চলো অন্ধকারের পাথার পারে। অচিনদার এক হাতে সেই ঝোলা। গায়ে ভারী পশমি চাদর। তবু, চলেন যেন অনায়াসে। শীতের হাওয়া কিছু না, উঁচু-নিচু আর একটি ক্ষীণ লাল বলয়ের আলো তাতেই বেশ স্বচ্ছন্দ। আবার পরিষ্কার কথায়, নিচু স্বরে গান ভাজেন, ‘চোরা যায় চুরি করতে গায়ে দিয়ে প্রেমাবলি।’ প্রেমাবলি সম্ভবত নামাবলির শব্দের ফের। গুনগুন করতে করতে, হঠাৎ থেমে বলেন, ‘এদের কী বলে জানো তো?’

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কাদের বলুন তো?’

প্রায় খেঁকিয়ে বলেন, ‘বুঝলে না? ওই যে সব চোরারা প্রেমাবলি গায়ে দিয়ে চুরি করতে যায়। এদের বলে শঠ, প্রবঞ্চক।’

এখন এই শীতের দারুণ পথে, প্রেমাবলি গায়ে দেওয়া চোরের ভাবনা তেমন মনে আসে না। তবু সায় দিয়ে বলি, ‘তা ঠিক।’

‘তা ঠিক মানে?’

আবার সেই হুমকোনি, ‘তা ঠিক মানে কী। তুমিও তো তা-ই।’

‘আমি?’

‘নয়?’

অন্ধকারেও টের পাই তিনি আমার দিকে ফিরে চান। বলেন, ‘প্রেম না জেনে প্রেমের হাটের বুলবুলা! তুমি কী রকম লেখক।’

খেয়াল করতে সময় পাই না, এ গানের কলি কোথায় যেন শোনা ছিল। তবু না জেনে বুলি দিয়েছি কোথায়, জানি না। ছাতিমতলার এই সীমানায়, আমি তো লেখকের পরিচয়ে চলি না। তার ওপরে রকম কেমন, কবে বা তা জানতে পেরেছি।

অচিনবাবু থামেন না। বলেন, ‘অত করে বললাম তোমাকে তখন। তবু জেনেশুনে মেয়েটাকে কষ্ট দিলে।’

‘কষ্ট?’

‘না, খুব আনন্দ দিয়েছ, তাই ফরফরিয়ে চলে গেল। আমার সঙ্গে না আসতে চাইলে তোমার কী হত?’

তাড়াতাড়ি বলি, ‘না, আসলে আমি—।’

‘আরে দূর তোমার আসল। তোমার আসল-নকল রাখো। তুমি ওদের সঙ্গেই থাকলে না কেন?’

‘সে কথাটা ভাবিইনি।’

‘চমৎকার। এত দেখেশুনেও ভাবতে পারলে না।’

প্রায় অসহায়ের মতো অচিনদার দিকে ফিরে তাকাই। তাঁর অবয়বটা শুধু দেখতে পাই। মুখের ভাব দেখতে পাই না। কথা মনে আসে অথচ বলতে পারি না।

অচিনদাই আবার বলেন, ‘এ কি তোমার নীতিবাগীশ মনের বিচার নাকি?’

মনে মনে বলি, তা-ই যদি হয় দোষ কোথায়। পথ চলার নীতি না হয় থাকুক। সংসারের নিজেরও তো কিছু নীতি আছে। তাকে লঙঘন করি কেমন করে।

নিজের কথার জবাব তিনি নিজেই দেন, ‘তা-ই যদি বলো তোমার থেকে ওর নীতিবোধ কম নাকি!’

সে কথা ভাবতে দ্বিধা লাগে। ঝিনি যে সমাজ পরিবার পরিবেশের মেয়ে, সেখানে নীতিবোধ কমের কথা নেই। তার ওপরে ঝিনির নিজের একটা পরিচয় আছে। বলি, ‘সেটা কী করে বলি বলুন।’

অচিনদা বলেন, ‘তা যদি বলো, তা-ই বা মানব কেন, বলতে পারো?’

হঠাৎ যেন অচিনদার গলার ঝাঁজ চলে যায়। এই খোয়াইয়ের বুকে, অন্ধকারের পাথারে, আকাশের নীচে তাঁর গলায় বাজে যেন এক নৈরাশ্যের বিধুরতা। বলেন, ‘মন বলে কি কিছু নেই?’

বলি, ‘নিশ্চয়ই আছে।’

মনে মনে বলি, মন আছে চিরন্তনে। কিন্তু অচিনদা যেন আমার কথা শোনেন না, নিজের কথারই খেই টেনে চলেন। বলেন, ‘তোমরা কী বলো, ভাবো, সব হয়তো জানি না। কিন্তু নীতি দিয়ে কোনওদিন ব্রজের বাঁশি থামানো যায়নি। যার মন নিয়ে যমুনার জল উজানে গিয়েছে, তাও কখনও থামানো যায়নি। নীতি দুর্নীতি পাপ সব সেখানে তুচ্ছ।’

অবাক অসহায় হয়ে বলি, ‘আর সমাজ-সংসার!’

অচিনদা হঠাৎ আমার কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘তার মধ্যেই সে নিত্যকাল বহে। সমাজ-সংসারকে বাদ দিতে চেয়েছে কে! সমাজ-সংসার আছে বলে কি আর সব বাদ! যমুনা কি আকাশে না মাটিতে? আর এ কথাই বা ভাবলে কেন, ঝিনির মতো মেয়ে সমাজ-সংসার ভুলে যাবে। ওর কি কোনও রুচি নেই, বোধবুদ্ধি নেই!’

কিন্তু অচিনদা কেন এমন করে বলেন। জীবনের অনেকখানি যিনি দেখেছেন, যাঁকে দেখে মনে হয়েছে, মুখের হিজিবিজি রেখায় এ সংসারের অনেক নিষ্ঠুর আঁচড় লেগেছে, যাঁর চোখের ওপারে হাসিকে দেখেছি যেন কাঁদন ভরা, তিনি কেন এমন করে বলেন। বলি, ‘কিন্তু অচিনদা—।’

অচিনদা বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, ‘ভয় পাও, না? পাছে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ো, তা-ই না?’

এ কথার জবাব দিতে পারি না হঠাৎ। হয়তো নানা আলো-আঁধারে সে-ই আমার ভাবনা। অচিনদা নিজেই বলেন, ‘সেটাও তোমার ভুল। ওকে চিনতে পারনি বলে ভয় পেয়েছ। মেয়েটার মধ্যে কোথায় একটা গোলকধাঁধার যন্ত্রণা আছে। হয়তো চাঁদের মতো অনেক দাগও আছে। কিন্তু বেঁধে অপমান করার মতো মন আর রুচি নয়, এটুকু জানি।’

বলতে বলতে আমাকে আর একটু নিবিড় করে জড়িয়ে বলেন, ‘ওকে যদি একটু কাছে আসতে দাও, প্রীতির লেন-দেন করো, ঠকবে না, বুঝলে। আমাকে ভুল বোঝার কোনও কারণ নেই তোমার।

আমি অবাক নির্বাক হয়ে অচিনদার দিকে তাকাই। অচিনদা হঠাৎ আমার কানের কাছে মুখ এনে যেন চুপি চুপি বলেন, ‘জেনো, নারী নর সকলেরই একটাই মন, রূপে আলাদা। কিন্তু তাকে ছোট করে দেখো না। হয়তো দেখবে অলকাও তোমাকে কোন মন্ত্র দিয়ে যাবে, একদিন সে তোমার কাছে গুরুর মতো জেগে উঠবে। তোমার তো অজানা থাকবার কথা নয়, “ও তোর অথিক গুরু পথিক গুরু গুরু অগণন।” ওকে শুধু শুধু কষ্ট দিয়ো না।’

অচিনদা চুপ করে যান। আমি যেন কেমন আবিষ্ট হয়ে পড়ি। অচিনদার কথাগুলো যেন আর কথা নয় কেবল। তার মধ্যে এই সংসারের সীমায় বসে যে অসীমে মন দোলা চলা করে, সেখানকার বার্তা বহে আনে। এখন অচিনদা আমার কাছ থেকে একটু সরে চলেন। আর গুনগুনিয়ে বাজেন, ‘ও মন, ফিরি করে যা আপনারে। নগদ হিসাব পরে করিস, ধ্যানের হিসাব কর না রে।’…

শুনি আর মন যেন কোন অলক্ষ্যের স্রোতে ভেসে যায়। তবু বারে বারে ঠেক খায় এই পথ চলাতে। কীসের সন্ধানে ফিরি জানি না। কিন্তু অন্ধকারের সীমায় যেতে চাই না এইটুকু জানি।

এই সময়ে সহসা বাঁশঝাড়ের ফাঁকে যেন আলোর বিন্দু দেখতে পাই। আর তারই সঙ্গে মানুষের অস্পষ্ট গলা। সামনে তাকিয়ে দেখি, বাঁশঝাড়ের মাটি ঢিবির মতো উঁচুতে উঠে গিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *