১৫. নারাণঠাকুরের কথা

১৫.

নারাণঠাকুরের কথা শুনে আর মুখের ভাব দেখে আঙ্‌রি হাসে খিলখিলিয়ে। এখনও বুঝি চোখের জল শুকোয়নি। অথচ দেখ, প্রাণের যত বন্ধ দরজা যেন হঠাৎ হাওয়ায় খুলে যায় ঠাসঠাসিয়ে। অন্ধকার যায়, আলো বিরাজ করে। যত জলে ভেজা স্যাঁতস্যাঁতানি সব শুকু শুকু, ঝরঝরিয়ে ওঠে। কিন্তু আমি কেবল গাজির দিকেই দেখি। লোকটা গুণ জানে, না তুক জানে, কে জানে। এই দাওয়ার হাওয়ায় যেরকম মেঘ ছেয়ে এসেছিল, গুমোট ঘনিয়েছিল, সব সাফ-সুরতের কারিগরি যে লোকটার ঝোলা ভরে ছিল, এতটা বুঝতে পারিনি। কেবল যে গানে গানেই এই ডুবুরি মুক্তা তোলে, তা নয়। আবার বলে, ‘ভুঁয়েতে গাছ দুইখান, ফল ফলবে একখান, মনের বুঝ করো।’ অর্থাৎ, কোথায় করো ছুটোছুটি, কার কাছে বা মানত মানসিক। তোমার সব যে ঘরের কোণে বাঁধা। তুমি দিনকানা, রাতদেওয়ানা, চেয়ে দেখ না। এবার বলো, বিজ্ঞানের কী যুক্তি দেবে তোমরা। কেন, এর কি ভগবান নেই। তা সে আল্লা, খোদাতাল্লা, যে নামেই হোক। মানত মানসিক দোর-ধরা সব তো সেখানেই হয়। এ যে অন্যরকম গায়। শুধু গায় না, এই ভিয়েনে জ্বাল দেয় রহস্যের রস দিয়ে। তাইতে বন্ধ্যা নারীর কান্না যায়, অপুত্রকের সান্ত্বনা হয়। তবু, এই যে মাহাতো, যাকে বলি বাদার এক লক্ষপতি, তার কাছে ওর কোনও চাটুকারের চাওয়া নেই। যা বলে, যা করে, সবই স্ব-ভাবের বশে। তার ধন-মানের প্রার্থনা নেই। একটি বিড়ি পেয়েই ধন্য।

কেন, এই যুগের বাতাস কি ওর প্রাণে তুফান তোলে না! আমরা যখন পদে পদে মরি, বাঁচি, তখন এই আলখাল্লা উড়িয়ে এমন নিটুট হেসে ঝলকায় কেমন করে। ওর কি যুগোত্তরের প্রাণ নাকি? ধরা-ছোঁয়ার বাইরে যদিও, তবু যেন কীসের এক স্পর্ধা-অহংকারে একেবারে ডগমগিয়ে আছে। কীসের নেশা করেছে গাজি? আমাদের জীবনস্রোতের আঁকাবাঁকায় যেন কিছুই যায় আসে না ওর। আবার এখন দেখ, কথা একেবারে ঠোঁটের ডগায়। হাতজোড় করে এমন কথা বলে নারাণঠাকুরকে, ঠাকুর সন্দেহে ভুরু কুঁচকে থাকে। আর গাজি নিজে মিটিমিটি হাসে। কেবল আঙ্‌রি খিলখিলিয়ে ঝরে। এবার মাহাতোও তাল দেয়। ঘাড় দুলিয়ে হাসতে হাসতে বলে, ‘তা সে কথাখানি মিছে নয় ঠাকুর, তোমার হাতখানি ভাল। অনেক মেয়েমানুষের অমন পাকের হাত হয় না।’

এ আর গাজির প্রশংসা নয়, স্বয়ং মাহাতোর। নারাণও এবার আসর নিয়ে মাটিতে বসে বলে, ‘তা তোমাদের দশজনে খেয়ে যেমন বলবে, সেইরকমই হবে।’

ঠাকুর যেন একটু থতিয়েই পড়ে। মাহাতো ততক্ষণে গিন্নির দিকে চোখ ফিরিয়েছে। নজরে ভুল করিনি, আঙ্‌রির চোখের কোণও যেন একবার স্বামীকে ছুঁয়ে যায়। মাহাতো তাড়াতাড়ি বলে, ‘অই গ, দেখিস বাপু, তা বলি আমি তোর কথা বলি নাই। তোর হাতের খ্যাটন না হলি আমার দিন চলে না, সব্বাই জানে।’

আঙ্‌রি অমনি ঝামটা দেয়, ‘আহ্‌ ছি, কী কথার ছিরি, দ্যাখ দিকি। আমি কি তা বলেছি নাকি!’

গাজির হাসি বাজে চড়া সুরে। মাহাতো বলে, ‘না, অই বললাম আর কী।’

বলে সে পোড়া বিড়ি আবার ধরায়। ঝুঁকে পড়ে আগুন দেয় গিন্নিকে। গিন্নি যতটা সম্ভব আমাকে আড়াল করে ধরিয়ে নেয়। গাজিও তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে মাহাতোর দিকে। মাহাতোর হাতের কাঠির শেষ আগুনটুকু কাজে লেগে যায়। কিন্তু দু’পা পিছিয়ে বসে নারাণঠাকুর। আর একটু হলেই গাজির সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যেত। গাজি চেয়ে দেখে না, আপন মনে বিড়ি টেনে চলে।

তখনই আবার এসে দেখা দেয় ফোঁচা। কিন্তু বলে না কিছু, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে। তৎক্ষণাৎ নারাণের মুখে বিরক্তি দেখা দেয়। ডিগডিগে শরীরটাকে টান করে কোমরের কোথা থেকে বের করে একটা বিড়ি। সেটা ছুড়ে দেয় ফোঁচার দিকে। ফোঁচা সেটা কুড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। কোনও দিকেই তাকায় না। এবার যা বোঝবার তা বুঝে নাও। বলতে গেলে অনেক কথা। মোদ্দা কথা, ফোঁচার খাওয়া হয়ে গিয়েছে। মনিবের কাছ থেকে পাওনা নিয়ে সে চলে গেল।

কোথায় গেল। সেই কালো-কুলো আঁটো-খাটো বউটির কাছে নাকি। তা সে যেখানেই যাক, এখানে এই দেশেতে, এই মানুষদের কী যেন একটা ছন্দ আছে। আমার চোখে যা ছন্দোহীন বাজে, এখানে তা নয়। তাই ফোঁচার আসা ও চলে যাওয়ায় কেউ কিছু বলে না। সবাই আপন মনে বিড়ি টানে। তবু, কেন জানি না, আঙ্‌রির চোখে একটা ঝিলিক খেলে যায়।

মাহাতো হাই তুলে বলে, ‘বেলা গেল, এবার ওঠা দরকার।’

তার কথাতেই নিজের কথা মনে পড়ে যায়। তাড়াতাড়ি নারাণকে জিজ্ঞেস করি, ‘আমার কত হল?’

নারাণঠাকুর প্রস্তুত ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘আপনার হয়েছে দু’টাকা দু’আনা।’

বলে কী লোকটা! সেই যে কী বলে এক দল মানুষকে, যাদের নাম ড্যান্‌চিবাবু, আমি তা নই। এ যুগের বাংলায় বাস করে ড্যাম চীফ উচ্চারণ আমার সাজে না। ড্যাম্ চীফওয়ালা হতেও পারিনি। তবু দুটো মানুষের পেট ভরা খাওয়া যদি দু’টাকা দু’আনায় হয়, তবে তো না বলে পারি না, এ বঙ্গে যে আসে, কপাল তার সঙ্গেই থাকে।

ওদিকে নারাণঠাকুর তখন হিসাব দিতে শুরু করেছে, ‘আপনার হলো গে ভাত ডাল তরকারি আট আনা, মাছ চার আনা, দই চার আনা—এক টাকা।’

হাতের কড় গুনে সে হিসাব দেয়। তার কোনও দরকার ছিল না। বোধ হয় আমার অবাক হওয়া দেখে সে কড়া ক্রান্তির হিসাব বলে। কিন্তু মাছ দই খেলাম আমি, আমার হল এক টাকা। গাজির কেন এক টাকা দু’ আনা।

সে হিসাবের রহস্যও নারাণ ফরসা করে দেয়, ‘আর এর হল গে আপনার আট আনার ডাল ভাত তরকারি, তার সঙ্গে আরও দশ আনার ভাত।’

‘বুঝেছি।’ বলে আমি টাকা বাড়িয়ে দিই।

গাজি বলে ওঠে, ‘অত হিসাব বাবু চায় না। আপনি কি আর ঠকাবেন?’

ঠাকুর বলে, ‘তুমি থাম তো। সেই বলে না, কী করে চলে? না, বামুনের ভাতে আছি। তোমার আর কী। হিসাব দেওয়া আমার কাজ, লোক ভোলানো না।’

বলতে বলতে ঠাকুর পয়সা গোঁজে কষিতে। মাহাতো পয়সা বের করে জামার ভিতরে জামার পকেট থেকে। তার মধ্যেই গাজি বলে, ‘তা যদি বলেন ঠাকুরমশায়, অমন একখানি হাত থাকলি, লোককে আমি গাছের পাতা খাওয়াতাম। হাতের গুণে তাইতিই লোকে ভুলি যেত।’

বলে হেঁ হেঁ করে টেনে টেনে হাসে। আবার বলে, ‘তয় বলেন, লোক ভুলনো সবার কাম কিনা। তয় হ্যাঁ, কাম দিয়ি ভোলাতি হয়, আমার মতন খালি ফক্কিকারি নয়।’

দেখ, কোথায় লাগি মারে। কথা বহে কোন স্রোতে। নারাণঠাকুর যেন খোঁচা খেয়ে ফুঁসে ওঠে, ‘কেন, আমি কি বলেছি তুমি ফক্কিকারি করছ? ভারী খচ্চর তো লোকটা।’

ঠাকুরের মুখখানি বেশ পালিশ দেওয়া। শ্রীমুখের বচনে কোনও রাখ-ঢাক নেই। গাজিটা নিতান্তই পাজি। এমন একটা রুষ্ট গলায় গালাগাল শুনে আমার হাসি সামলানো দায় হল। কিন্তু আঙ্‌রির সে দায় নেই। সে গাজির দিকে চেয়ে গলা ছেড়ে হেসে ওঠে। এ সময়ে কেমন যেন রঙ্গিনী রঙ্গিনী লাগে এই আঙুরকে। মধ্যঋতু আশ্বিনেও শরীরের বাঁধুনিটি কোথাও টাল খায়নি। এখনও যত টান, তত অধরা অকূল। লাল শাড়ির বাঁধনে তাকে ধরে রাখা যায় না যেন। অনাবাদী জমি কিনা, এ দেহ এখনও বন। দেখলে ঠাহর হয়, এ মৃত্তিকা ভেদ করে ফসল ফলেনি, ছাঁদ-ছন্দ গড়েনি, তাই সে বন্য। একটু বাতাস লাগলেই এমন দুলে ওঠে, না জানি কত প্রাণে তুফান লেগে যায়। তখন টের পাওয়া যায় না, এ শরীরে এক মেয়ে কাঁদে মা হবার জন্যে। তার ওপরে, ধূমপানের নেশা থাকলেও গলাখানি মেয়েলি মিষ্টতা হারায়নি। বরং আঙ্‌রির খিলখিল হাসি যেন কেমন এক মোহ ছড়িয়ে দেয়।

সন্দেহ হয়, গাজিও গলা খুলে হাসতে চায়। ঠাকুরের রোষ দেখে থমকে যায়। বলে, ‘আহা, আপনি বলবেন কেন, আমিই তো বলছি। তয় চুপ দিয়ি থাকি, আর কিছু বলব না।’

বলে গাজি অন্য দিকে তাকায়। মাহাতো বলে, ‘তুমিও যেমন হয়িছ ঠাকুর। ওর কথায় এত রাগ করলি হয়। নাও, আমাদের হয়েছে আড়াই টাকা, না কী?’

নারাণের রাগ তখনও যায়নি। বলে, ‘না, দেখ তো মাহাতোদা, এমন এক একটা কথা বলে, আমার পিত্তি জ্বলে যায়। যত সব বাজে প্যাচাল পাড়ে।’

গাজির গলায় তখন সেই গাওয়া গানের গুনগুনানি, ‘যেজন প্রেমের ভাব জানে না, তার সঙ্গে কীসের লেনাদেনা…।’

মাহাতোর হাত থেকে ঠাকুর তখন পয়সা নিতে নিতে বলছিল, ‘তোমার কি আর হিসাবে ভুল হবে মাহাতোদা। আড়াই টাকাই হয়েছে।’

কিন্তু সে কথা শেষ হবার আগেই গাজিকে সে আবার খেঁকিয়ে ওঠে, ‘আরে রাখো তোমার লেনাদেনা। তোমার সঙ্গে প্রেম করার জন্যে আমি একেবারে মরে যাচ্ছি কি না।’

গাজি বলে, ‘এইটা আবার কী বলেন ঠাকুরমশায়। আমার সঙ্গে প্রেম করার জন্যি আপনি মরবেন কেন। তা বলি না। তয়, “প্রেম আছে কোনখানে? প্রেম তোমার মনে মনে।” প্রেম আপনার আমার সকলের মধ্যি আছে। আপনি প্রেমের ভাব জানেন না, তাই কি আমি বলতি পারি। ছি মুরশেদ! ছি!’

মাহাতোর দেওয়া টাকাও কষিতে গুঁজতে গুঁজতে ঠাকুর রুষ্ট চোখে ঠোঁট উলটায়। কোনও জবাব দেয় না। কিন্তু আঙ্‌রির হাসি যে অধরা। সে হাসতে হাসতে বলে, ‘গানটা শোনাও না।’

গাজি গান ধরবার আগেই আসে ফোঁচার বউ। কোলে সেই ছেলেটি আছে। তবে বৎসের জন্য বুকখানি মাঠের মতো ভোলা নয়। ডুরে শাড়ির ঢাকা আছে সেখানে। সে দু’খিলি পান বাড়িয়ে ধরে নারাণঠাকুরের দিকে। ঠাকুর পান নিয়ে বলে, ‘দোক্তা আননি?’

ফোঁচাকে বলে তুই, তার বউকে বলে তুমি। বলতেই হয়, স্ত্রীলোক তো। বউ বাঁ হাত থেকে, ডান হাতে দোক্তা নিয়ে ঢেলে দেয় ঠাকুরের বাড়ানো হাতে। বউটির মুখেও পান, পিকের ধারা চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঠোঁটে তার রক্তাভা লেগেছে। এ সময়ে আঙ্‌রি তার দিকে তাকায়। বউটি পান সামলে, ঠোঁট টিপে একটু হাসে। মাহাতো চোখ ঘুরিয়ে বলে, ‘বাঃ, খালি ঠাকুরই পান খাবে, আমরা খাব না?’

বউ তাড়াতাড়ি ঠোঁটে আঁচল তুলে বলে, ‘খাবেন, সেজে নিয়ে আসব?’

মাহাতো হেসে বলে, ‘এমনি বললাম, এই তো খেলাম।’

গাজি তখন গান ধরেছে,

‘কানা চোরে চুরি করে

ঘর থাকতে সিঁদ কাটে পগারে

শুধু বেগার খেটে মরে

কানার ভাগ্যে ধন মিলে না।

তার সঙ্গে কীসের লেনাদেনা।’

গান থামিয়ে গাজি ডুপ্‌কিতে আস্তে আস্তে তাল দেয়। আঙ্‌রির দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে হাসে। আঙ্‌রি তো হেসেই আছে। আমি দেখি, নারাণঠাকুরের মুখ। সে মাথা নামিয়ে, কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে, পান চিবুতে থাকে। সন্দেহ লাগে, গাজিটা আবার দুষ্টামি করে। এবার ডুপ্‌কি না থামিয়ে, তাল দিতে দিতেই গায়,

‘নিমগাছ করিয়ে রোপণ

শত ভার দুগ্ধ সিঞ্চন—

তবু কী তার স্বভাব যায় দূরে

ভিতরে মিঠা ঢুকতে পায় না।

যেজন প্রেমের ভাব জানে না।…

ওরে, উল্লুকের হয় উদ্‌দ্ধ নয়ান

সে দ্যাখে না সুয্যিকিরণ

(অথচ) দ্যাখ, পিঁপড়েতে পায় চিনির মর্ম

রসিক হলে যাবে জানা।

যেজন প্রেমের ভাব জানে না…।’

গান তখনও শেষ হয়নি, নারাণঠাকুর উঠে দাঁড়ায় খাড়া। ডিগডিগে শরীরে, পেটটি এখন একটু আগে বেড়ে এসেছে। তার ওপরে পৈতাগাছি। নইলে বলা যেত, তলোয়ার খাড়া হল। ডান হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলে, ‘তোমার ওই ছাতার গানের মর্মও কেউ বুঝবে না। গান না শালা বাচলামি।’

বলে সে দরজা দিয়ে ভিতরে চলে যায়। আর একটু হলে ধাক্কা লেগে যেত ফোঁচার বউয়ের সঙ্গে। বউ একটু অবাক হয়ে সকলের দিকে তাকায়। তারপর সেও ঠাকুরের পিছু পিছু চলে যায়। ইতিমধ্যে আঙ্‌রি হাসিতে,ঢলে পড়ে।

গাজির চোখে দেখি ঝলক, অথচ যেন বড় মনোকষ্টে বলে, ‘ঠাকুরমশায় আমাকে দু’ চোখি দেখতে পারেন না।’

মাহাতোও হাসে। হেসে বলে, ‘তুইও বড় ব্যাদ্‌ড়া গাজি। ঠাকুর চটেই বা কেন।’

মাহাতোর গলায় যেন কেমন স্নেহ ঝরে পড়ে। গাজি বলে, ‘ওই যে দ্যাখ, উনি ভাবেন কি যে, আমি বুঝি ওঁয়ারে শুনয়ে গাচ্ছি।’

মাহাতো বলে, ‘তাই তো গাস।’

গাজি হাতজোড় করে, ‘মুরশেদের নাম করি বলছি চাচা, তা গাই না। একটা কথা জানবে চাচা, যা গাই তা নিজির জন্যি, নিজিকে শুনয়ে গাই। তয় হ্যাঁ, বলতি পার কি যে, ঠাকুরমশায়কে দেখলি অনেক গান মনে পড়ি যায়।’

আঙ্‌রি তৎক্ষণাৎ হেসে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘আর একখানা গাও।’

মাহাতো তৎক্ষণাৎ হাত তুলে বলে, ‘না, আর না। উদিকি দ্যাখ, রোদ কখন চলি গেছে, এবার হাঁটা দেব।’

বলতে বলতে সে একেবারে উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছে ঘরের ভিতরেই তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ আর চাদর ছিল। এগিয়ে গিয়ে চাদরটাকে আগের মতোই কোমরে বাঁধে। ব্যাগ হাতে তুলে নেয়। বলে, ‘নেহাত জ্যোছনা ফুটবি, সেই আশা। নইলি অন্ধকারে চলা দায় হত।’

গাজি বলে, ‘তা চাচা, হাঁটা ধরবে কেন। গাড়ি আসতি বলো নাই?’

‘না তা আর বলতি পেরিচি কই। আসবার দিনক্ষণ ঠিক ছিল না। তারকেশ্বরে তিন দিন কেটি গেছে। তারপরে ভেবিছিলাম, কালীঘাটে যাব। এ যাত্রা আর তা হলি না। কাজ কম্‌মো অগাধ পড়ি রয়িছে।’

যত ভাবনা, সব যেন গাজির। বলে, ‘যেতি পারবে জানি, তা হলিও ভোলাখালি তক যাওয়া, দু’ কোশ রাস্তা।’

মাহাতো বলে, ‘চলি যাব ঠিক। তবে মাজাটা আজকাল একটু একটু ব্যথা করে।’

এ গাড়ির প্রসঙ্গ নিশ্চয় গরুরগাড়িই বোঝায়। কিন্তু এই প্রথম যেন টের পাওয়া গেল, মাহাতোর বয়স হয়েছে। চুলে তেমন পাক ধরেনি। মস্ত কালো মুখখানি, লাল চোখ, শরীরের বাঁধুনি দেখলে এমনি হঠাৎ টের পাওয়া যায় না। তবে এ রোদ এখন পশ্চিমে ঢলে গিয়েছে। মাহাতোর কথাটাই আবার মনে পড়ে, ‘এদিকে বেলা যে যায়।’

ইতিমধ্যে আমিও উঠে দাঁড়িয়েছি। অজানা গাছের ছায়া কখন চারদিকেই দিনশেষের ছায়ায় নিবিড় হয়ে এসেছে, খেয়াল করিনি। যদিও সন্ধ্যা বলা যাবে না, তবে আসন্ন সন্ধ্যা। রোদের চিহ্ন নেই। এই দাওয়াতেও ছায়া ঘন হয়ে এসেছে। হাত তুলে ঘড়ি দেখি, পাঁচটা বাজতে দেরি নেই।

মাহাতো আমার দিকে ফিরে বলে, ‘আপনিও উঠলেন? যাক, আপনার সঙ্গেও দেখা হয়ি গেল। তা, আজ আপনার থাকা হবি কমনে?’

থাকব কেন। নিজের কাপড়ের ঝুলি সামলাতে সামলাতে বলি, ‘থাকব না, এবার ফিরব।’

মাহাতো তার কোকিল চোখে একটু যেন অবাক হয়ে তাকায়। বলে, ‘কোথায় কমনে ফিরবেন।’

জবাব দেয় গাজি। ‘বসিরহাট। বসিরহাট থেকি বাবুকে কলকাতার মোটর ধরিয়ি দেব।’

মাহাতো বিস্ময়ের ঝোঁকে তার কাঁধের শহুরে ঝোলাটাই নামিয়ে ফেলে। আঙ্‌রির দিকে চেয়ে বলে, ‘অই দ্যাখ্‌ আঙ্‌রি শোন্‌, মাকড়াটা বলে কী। বসিরহাট যাবি কেমন করি তুই?’

আমার বুকটা ধক করে ওঠে। গাজি নির্বিকারে বলে, ‘কেন, ওপারে ন্যাজাটের মোটরে করি যাব।’

মাহাতো শরীর দুলিয়ে, মুখ বাঁকিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, ন্যাজার্টের মোটর তোমার মুরশেদের গাড়ি কি না, সে এখনও বসি আছে। তার তো চারটেয় চলি যাবার কথা। তাও—।’

কথা শেষ হয় না তার। গাজির আরশি-চোখে এই প্রথম দেখি ঝলক খেলে না। গোঁফদাড়ি সহ গোটা মুখখানি চুপসে যায়। কেবল মুখ দিয়ে আওয়াজ আসে, ‘অ্যাঁ?’

কিন্তু আমার শুধু বুক ধড়াসে যায় না। হঠাৎ যেন অগাধ জলে পড়ে যাই। দুশ্চিন্তায় আর উদ্বেগে বুকের কাছে নিশ্বাস আটকে যায়। সহসা নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। ভুলে যাই কোথায় এসেছিলাম, কেন এসেছিলাম। আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে এই অচেনা দিগন্ত। আর মনে হয়, কেউ যেন আমাকে স্বজনহারা করে নির্বাসনে ফেলে দিয়ে যায়। আমি গাজির দিকে তাকাই।

মাহাতো আরও বলে, ‘তাও কি, ন্যাজাট থেকি বসিরহাটের রাস্তা তোমার জন্যি একেবারে পাতা হয়ি পড়ি আছে নাকি?তবে আমি মরতি হাসনাবাদ থেকি লঞ্চে এলাম কেন?’

গাজি চোপসানো গলায় বলে, ‘কেন?’

মাহাতোর সাক্ষী সেই আবার আঙ্‌রি। বলে, ‘অই শোন আঙ্‌রি। গাজি গুয়োটার কথা শোন। রাস্তা ভাঙাভাঙি হচ্ছে আজ দু’ হপ্তা ধরি। সারা দিনি দু’তিনবার যাতাত্ হয় কিনা ঠিক নাই, উনি এখন বাবুকে নিয়ি বসিরহাট রওনা দিচ্ছেন।’

মাহাতো যত বলে, তত আমার বুক শুকোয়। বিদেশ বলে ভয় নেই। কিন্তু এই ভেড়ি বাঁধের সীমানায়, মানুষখেকো কামটের আবাস নোনা গাঙের কূলে, বাদার গঞ্জে, কোথায় বা আশ্রয়, কোথায় রাত্রিবাসের ঠাঁই। দূরের চেয়ে অচেনাকেই ভয় বেশি। আমি দিশেহারা চোখে একবার গাজির দিকে চাই, আর একবার মাহাতোর দিকে।

গাজির আরশি-চোখ যেন কাচের মতো ধোয়া, তাতে ছায়া খেলে না। বলে, ‘তা হলি?’

হঠাৎ দেখি, আঙ্‌রি হেসে ওঠে। একবার চোখ তুলে তাকায় আমার মুখের দিকে। তারপর গাজিকে বলে, ‘তা হলি আবার কী গো, এ দেশে কি মানুষ থাকে না?’

এ হাসির একটা গুণ আছে। উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তার মধ্যে, কেমন যেন ভরসা হয়ে বাজে। কথার মধ্যেও তাই। মন না মানুক, তবু ভুলে যাই কেন, এ দেশেও মানুষ বাস করে।

ঘোমটার ফাঁক থেকে আর একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আঙ্‌রি বলে, তোমার বাবুকে নিয়ে না হয় ভোলাখালি চলো।’

ভোলাখালি! দুই কোশ দূরে! তার চেয়ে তবু জানি, গাঙের কূলে আছি, যখনই হোক লঞ্চ পেয়ে যাব। কিংবা, খেয়া পার হলে ন্যাজাট। মোটর না যাক, রাস্তা তো আছে। আমি বলে উঠি, ‘তার চেয়ে বরং ওপারে যাই, গিয়ে দেখি যদি বাস থেকে থাকে।’

যেন অসহায়ের তৃণকুটার আশ্রয়। বাস্তবের খেয়াল থাকে না। মাহাতো আর তার বউ দু’জনেই হেসে ওঠে। মাহাতো বলে, ‘পাগল হলেন নাকি মশায়। বাস চললিও চারটের সময় বেরিয়ে গিয়েছে। তবে যদি গরিবির বাড়ি যেতি চান, চলেন। গোলপাতার ঘরে দুটো ডাল ভাত খেয়ি থাকবেন।’

শুনে আমার উদ্বেগ আরও বাড়ে। আমি যেন দেখি, আমার ডিঙা চলে যায় বুড়িগঙ্গার দিকে, আমি তাকে ধরে রাখতে পারি না। আমি যাত্রা করেছি, যে যাত্রা আমার অচিন কূলে আছে। ফেরা আমার হাতে নেই। সেই ছেলেবেলার বুড়িগঙ্গা আমাকে সারা জীবনে কখনও ছেড়ে যায়নি।

.

১৬.

যখন আশা যায়, তখন আচ্ছন্নতা আসে। ভুলে যাই পাত্র পরিবেশ। কয়েক মুহূর্ত যেন কোনও এক অচৈতন্যের অন্ধকারে ডুবে যাই। আমার যাত্রা নিরুদ্দেশের পথে নয়। তবু যেন নিরুদ্দেশের পথ আমাকে টেনে নিয়ে যায়।

গায়ে হাতের স্পর্শে সংবিৎ ফিরে পাই। মাহাতো আমার কাঁধে হাত রেখেছে। ফিরে তাকাতেই সে বলে, ‘অ মশায়, আপনি যে সত্যি সত্যি জলে পড়ি গেছেন বলি মনে হচ্ছে গো। এত উতলা কেন। ফিরতি না পারলি কি অনেক ক্ষতি হয়ি যাবে!’

ক্ষতি? কই, তেমন কোনও ক্ষতির দায় তো রেখে আসিনি পিছনে। সময়ের হিসাবে একটা রাত্রি, কত আর ক্ষতি করতে পারে। তবে, সেই যে কথা, মন গুণেই ধন, তাকে নিয়ে বিড়ম্বনা। মনে মনে গড়ছি এক, ঘটনা ঘটে অন্যরকম। তাতেই ঠেক খেতে হয়। কিন্তু, তিনজনেরই মুখের ভাব এমন হয়েছে, যেন সবাই আমার কাছে কী ধার ঠেরে বসে আছে। গাজির দাড়ির গোছা মুঠি পাকিয়ে ধরা, মুখখানি নত। মাহাতো-বউ আঙ্‌রি আমার দিকে তাকিয়ে। নজর করে দেখ, সেই হাসিটুকু নেই এখন মুখে। বরং কাজল-কালো ডাগর চোখ দুটিতে একটু যেন উদ্বেগের ছায়া। তার সঙ্গে কৌতূহল আর জিজ্ঞাসা। মাহাতোর লাল চোখেরও সেই ভাব। তাড়াতাড়ি বলি, ‘না, ক্ষতি আর কী ফিরে যেতে পারব বলেই ভেবেছিলাম কিনা। যাই হোক…।’

কথা শেষ করতে পারি না। মাহাতো বলে ওঠে, ‘না, আপনার অবস্থা দেখি আমরা চিন্তায় পড়ি গেছি। ভাবি, কী বলে, কী জানি, ফিরতি না পারলি ভদ্দরলোকের আবার ক্ষতি-টতি হয়ি যাবে কিনা।’

আঙ্‌রি আওয়াজ দেয়, ‘আহা, ফিরে যাবার উপায় নেই, ও কথা ভেবে কী হবে।’

‘সে কথা ঠিক।’ মাহাতো বলে, ‘তা হলি, শোনেন বলি, আমার বউও বলছে, আপনি ভোলাখালিতিই চলেন।’

আমার জবাবের আগেই আঙ্‌রি তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘তবে, শহরে মানুষ, হাঁটা অভ্যাস নেই। কষ্ট হবে কিন্তু।’

এর থেকে কী বোঝা যায়, বুঝি না। আঙ্‌রি যেতে বলে, আবার কষ্টের কথাও স্মরণ করায়। যদিও দূর বলে হাঁটার ভয় পাই না। কিন্তু কূল ছেড়ে যেতে আমি নারাজ। সময়ের হিসাবে যখন এক রাত্রিকে আমি অকূলে ছেড়ে দিতে পেরেছি, তখন নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের সন্ধান আর আমার নেই। এই হাটে যে ভেড়ি বাঁধে, কোথাও এক রাত্রি কেটে যাবে। জানি, আসন্ন এ রাত্রি চিররাত্রি নয়। সে আঁধার নিয়ে নামে আবার দিনের আলোয় হারাবে বলেই। সূর্য কেবল ছায়াকে আলিঙ্গন করে থাকে না। উষায় তাদের ছাড়াছাড়ি। ছায়া তখন বিরহিণী। মন একবার পিছন ফিরে দেখুক, এমন কত রাত্রি কত অকূলে ভেসে গিয়েছে। জীবনে এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। এবার আমি সোজাসুজি আঙ্‌রির দিকে তাকাই। বলি ‘দু’ ক্রোশ হাঁটতে পারি, তাতে ভয় পাই না। কিন্তু রাত পোহালে আবার তো ফিরতে হবে এখানেই।’

জবাব দেয় মাহাতো, ‘হ্যাঁ, তা ফিরতি হবে। তবে যদি আপনি সন্দেশখালির ওদিক দিয়ি ফিরতি চান, তা হলি আর…।’

মনে মনে বলি, ‘না, ভোলা বা সন্দেশ, আর কোনও “খালি”-ই দরকার নেই। তার চেয়ে এই কালীনগর থেকে ফেরাই ভাল। এ যাত্রায় আর কোনও অজানাতে নয়। বলি, ‘না, থাক মাহাতো মশাই, এখানেই রাতটা কোনও রকমে কাটিয়ে দেব।’

কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখি, মাহাতোর ঘোমটা-টানা বউটির মুখে একটু ছায়া তবু হাসতে চায়। বলে, ‘রাত তো ভোলাখালিতেও কাটানো যায়।’

মনেতে যে অবাক মানি না, তা বলব না। আলাপ-পরিচয়ের চৌহদ্দি বাদ দাও, সোজাসুজি কথা যার সঙ্গে নেই, সেই এক মাহাতো-গিন্নি এমন অবলীলায় ডাকে কেমন করে। মাহাতোর সামাজিক প্রতিষ্ঠা, আর্থিক অবস্থা জানতে বাকি নেই। এমন কর্তার কর্ত্রীকে যে স্বাধীন জেনানা ভাবব, তা পারি না। স্বৈরিণী বলার সাহস করো না। এইমাত্র জানা গিয়েছে, স্বামী-স্ত্রী মানত করে ফিরছে তারকেশ্বর থেকে। অথচ ঝিলিক ঝলক যা-ই থাক, আঙুরের চোখে কোথাও ছলনার ‘ছ’ নেই, চাতুরির ‘চ’ নেই। যেন এক ছোট অবুঝ মেয়ে আবদার করে, যার সমাজ-সংসারে দায়-দায়িত্বের বোধ নেই।

মাহাতো হেসে উঠে আমার দিকে তাকায়। বলে, ‘অই এক ওর দোষ, বুইলেন, লোকজনের হাল-হদিস বোঝে না, সবাইকি নিয়ি টানাটানি। বাড়ি যেয়ি দ্যাখেন, আজ এই, কাল সেই, লেগিই আছে। তা হলিই কি তোমার সব ফাঁক ঘুচি যায় ?’

বলেও মাহাতো টেনে টেনে হাসে। কিন্তু স্ত্রীর দিকে তাকায় না। আর সহসা আমার মনে পড়ে যায়, এ অনাবাদী জমি, এ দেহ বন, একটু বাতাসেই বড় দোলা লেগে যায়। পিছনে আছে এক শূন্যতা, সেখানে আছে কান্না। তোমাকে যে ডাক দিয়ে নিয়ে যেতে চায়, সেই ডাক আসে শূন্যতা থেকে। তা বলে কি অজানা অচেনা ভাল-মন্দ নেই। হেসে বলি মাহাতোকে, ‘কিন্তু আমাকে আর কতটুকু চেনেন যে, বাড়ি নিয়ে যেতে চান।’

মাহাতো মুখ খোলবার আগেই দেখি, আঙ্‌রি তার স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে চোখ নাচিয়ে হাসে। বলে, ‘কেন, আমরা কি মানুষ চিনি না। আমাদের আবার ভয় কি! গাজির বাবুর যেমন ভয় দেখলাম, তাতে বাবুকে আর ভয় পাই না। আমরাও মানুষ চিনি।’

বলে আঙ্‌রি একবার ফেরে গাজির দিকে, আবার দেখে আমার দিকে। সারল্যেও যে কেমন রঙের ঝিলিক হানে, তা এই আঙ্‌রিকে না দেখলে সবটুকু জানা যায় না। তোমার মনে আঁধার যত থাকুক, তার দায় তোমার। যে হবে যায় অনাবিল স্রোতে, সে যায় আপন প্রাণের টানে। তাতে তুমি যা-ই ছুড়ে দাও, সে থামে না। তার ঝলক হারায় না। তাই, ওই চোখ দু’টির দিকে চেয়ে যে কেবল কৃতজ্ঞতা মানি, তা নয়। প্রাণের সাহস দেখে এই বিড়ি-খাওয়া মাহাতো-বউটিকে কেমন যেন শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে। শুধু তা-ই বা কেন, অকূলে হারানো আমার প্রাণে কী এক সুর যেন বাজে। সুরের উৎস যেখানে, সেই চোখ দু’টিতে দেখি, বন্ধুত্ব বাজে কালো তারায় তারায়। তার নিরালা মনে অজস্র বন্ধুর ডাক। সে কেবল আপনাকে ভরে না। যেন বলে, ‘যদি কিছু থাকে, এস, তা দিয়ে তোমাকেও ভরিয়ে দিই।’ সে কেবলই ফাঁক ভরাতে চায়। সে নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দিতে চায়, অকূলের মানুষকে কূল দিতে চায়। যদি তার ঘরে গিয়ে দেখ, ঘর ভেঙে যাওয়া, ডানা-ভাঙা পাখিকে সে কোলে বসিয়ে দানা খাওয়ায়, কোথাকার হারিয়ে যাওয়া ছাগল-ছানা তার ঘরে বৃদ্ধি পায়, স্বজন-ছাড়া কূল-হারানো ছেলেমেয়ে যত্নে মানুষ হয়, তবে অবাক হয়ো না।

আঙ্‌রির চোখের দিকে চেয়ে, হেসে অপরাধ ভঞ্জন করি। বলি, ‘বুঝেছি। কিন্তু সে কথা থাক, দেরি হয়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে ভোলাখালির পথে হেঁটে সঙ্গে যাই, একটু এগিয়ে দিয়ে আসি।’

এবার আঙ্‌রি ঘোমটা টানে। তার চেয়ে বেয়াজ দেখ, তার মুখ ভার হয়ে আসে। বলে, ‘ঘরের লোকেরা ঘরে যাবে, তাদের আবার এগিয়ে দেবার কী দরকার। পথ আমাদের চেনা।’

গাজি এতক্ষণ হাসতে ভরসা পায়নি। তবু না হেসে যে পারে না। বলে, ‘না চাচি, বাবু সে কথা বলেন না।’

‘তুমি আর বাবুর কথা বুঝিয়ো না গো।’

কথাটা বলে ভারী মুখে। তারপরে হঠাৎ হেসে বলে, ‘নিয়ে যেতে পারতে বাবুকে, তা হলে সারা রাত বসে বসে তোমার গান শুনতাম। তোমার বাবুকে বলো, কাল সকালবেলা জোয়ান মোষের গাড়িতে করে পাঠিয়ে দেব, ভয় নেই।’

যে অবস্থায় ঠেকেছি, ভয় বলো, দ্বিধা বলো, সেই অবস্থাকে। মন যেন অনেকক্ষণ আগেই চলে গিয়েছে মাহাতো দম্পতির সঙ্গে। মনের এই গতিতে কোথায় যেন নিজেকেই অপরাধী বোধ হয়। আঙ্‌রির চোখে এখনও আশা ঝিলিক দেয়। এতই দুর্ভাগ্য, পথের ধারে পড়ে পাওয়া এমন নিমন্ত্রণ মাথা পেতে নিতে পারি না। সহজ হওয়া এত সহজ নয়। প্রাণে কত শক্তি থাকলে এমন সহজ হওয়া যায়, অল্পক্ষণের দু-চার কথার আলাপেও, রাগের দাবি করে। আঙ্‌রি যেন সত্যি আঙুর। তেমনি করেই সে সহজ। এখন তার প্রাণে যে সুধা আছে, তার মধুর গন্ধ, তা চাও কি না, পাও কি না, সে খবর সে চায় না। সে তার আপন রূপে, আপন ধর্মে, দোলদোলায়, টস্‌টসায়। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বলতে পারি না।

মাহাতো বলে ওঠে, ‘নে, তুই আর মানুষকে ত্যক্ত করিস না। কিন্তু, যাবার আগে তা হলি একটা ব্যবস্থা করি যেতে হয়।’

এবার গাজি উৎসুক চোখে তাকায় মাহাতোর দিকে। মাহাতো আমার দিকে চেয়ে বলে, ‘আমি বলি কি, আপনি এখেনেই থাকেন। কাজে কম্‌মে আটকি গেলে অনেকদিন নারাণঠাকুরের এ ঘরে থেকিচি। বিছানাপত্তর, দড়ির খাট, সবই আছে। মশারিও পাবেন। কোনও ভয় নাই, মেলাই টাকা-পয়সা নিয়ি এখেনে থেকিচি আমি। রাত্তিরি দুটো গরম ভাতও জুটবি খনে। একটা রাত্তির তো মামলা।’

আমাকে গাজির দিকে ফিরে তাকাতেই হয়। মিথ্যে বলব না, লোকটার ওপর কখন থেকে যেন বিরক্তি বোধ করতে আরম্ভ করেছিলাম। না জেনে সে কেন এমন জায়গায় এনে ঠেকালে। কিন্তু, ইচ্ছে করে নয়। সে তার জানামতেই মতলব দিয়েছিল। তবে মুরশেদ যদি গোলমাল করে তার কী উপায় আছে। তার অপরাধের ভাব দেখে বুঝেছি, এতক্ষণ ধরে সে তার মুরশেদের কাছে মনে মনে কপাল কুটে মরেছে।

গাজি মাহাতোর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এর চেয়ে আর ভাল কিছু হয় না।’

না, নারাণঠাকুরের ঘরের দিকে চেয়ে দেখব না। গর্ত দিয়ে ইঁদুর ওঠে কিংবা ডেয়ো পিঁপড়ে রাতভোর গায়ের মাংস চিবিয়ে খাবে সে ভাবনা ভেবে লাভ নেই। তবু লোকটাকে একটু-আধটু বোঝা গিয়েছে। ক্ষণেকের হলেও তার ঘরে খেয়েছি, তার সঙ্গে একটা সম্পর্ক বুঝতে পারি। নতুনের থেকে এই পুরনোই ভাল। আর কোথাও নয়।

মাহাতো একটু হেসে আবার বলে, ‘তবে এই হাটে-গঞ্জে রাত কাটাবার জায়গায় অভাব হবি না। সে জায়হাতি হাটুরে বাটুরে জন মহাজনরা আপনা থেকিই চলি যায়। তা বলি আপনাকে তো সে পথ দেখাতে পারি না।’

বলেই হাঁক দিয়ে ডাকে, ‘কই হে ঠাকুর, গেলে কম্‌নে?’

মহাতোর কথার মধ্যে যে কথা, হঠাৎ তা ধরতে পারি না। কেবল গাজি বলে ওঠে, ‘তোবা তোবা।’

এদিকে দেখি আঙ্‌রি যেন চোখ পাকিয়ে তাকায় মাহাতোর দিকে। অনেকটা নিঃশব্দে মুখ ঝামটা দেবার মতো মুখ ফিরিয়ে ভুরু কুঁচকে চোখ ফেরায় গাজির দিকে। গাজি যেন বড় লজ্জা পায়, বলে, ‘চাচার কী কথা বলো দিকিনি।’

আঙ্‌রির পান খাওয়া লাল ঠোঁট দু’টি একবার বেঁকে যায়। নীচের ঠোঁটটি তারপরেই উলটে যায়। দৃষ্টি উদাস। যেন এসবে তার কিছুই যায় আসে না। তাই সে চুপচাপ৷

‘দেখি, ঠাকুরটা আবার গেলে কম্‌নে৷’ বলতে বলতে মাহাতো যায় ঘরের ভিতর। কিন্তু তার প্রকাণ্ড কালো মুখে, মোটা মোটা ঠোঁটে হাসি একটু লেগে থাকে। ততক্ষণে আমি যেন মাহাতোর কথার মধ্যে কথাটির ইশারা পেয়ে গিয়েছি। আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুকুরধারে দুলিদের ঘরগুলো। হাটুরে বাটুরে জন মহাজনেরা যে কোথায় রাত কাটাতে যায়, তারপরে আর স্পষ্ট করে না বললেও চলে। অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মাহাতোর হাসিতে, গাজির তোবা তোবা আওয়াজে, আঙ্‌রির ভ্রুকুটি বিরক্তিতে। মাহাতো রসিকতা করে বলেছে বটে, তাতে চেনাজানার বাস্তব অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে। বিশ্ব-সংসারের এই কালের এই নিয়ম। তাকে নির্দয় বলো, রুচিহীন বলো, মানুষের নিজের হাতে গড়া নিয়ম। ভোজনাগার পান্থশালার সঙ্গে সঙ্গে সে বারোবাসর ছড়িয়ে রেখেছে। তাতে আপনাকে সুখী করতে চেয়ে আমরা কোথায় কালি মেখেছি, তা দেখা যাবে নিজের মধ্যে এক অচিন আয়নাতে। মাহাতোর কাছে কৃতজ্ঞতা বোধ করি। আর যা-ই করুক, সে আমাকে সে পথ দেখাতে পারে না। এইটুকু তার বিশ্বাস।

কিন্তু মনটা বিমর্ষ হয়ে ওঠে আঙ্‌রির দিকে চেয়ে। হয়তো তার মতো একটি আত্মীয়া থাকা অসমীচীন ছিল না আমার। বউদি কিংবা অন্য কোনওরকম। সেরকম কিছুই নয় সে। অথচ দেখ, মানুষের প্রাণের টান তাকে কোথায় নিয়ে যায়। কেবল সম্পর্কের কথা মেনেছি। কিন্তু সম্পর্ক গড়ে ওঠার কত যে বিচিত্র বিস্ময় রহস্য, সময়ের আশ্চর্য মাপজোক, তা যেন এমন করে জানা ছিল না। এখন মনে হয়, আঙ্‌রির সঙ্গে আমার কোথায় একটা চেনাচেনি হয়ে গিয়েছে। আমার সঙ্গে তার যেন কী এক সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গিয়েছে। সে সম্পর্কের কোনও নাম নেই, শুরু নেই, শেষ নেই। যে সম্পর্কের খোঁজ পাবে না এই সমাজের শাস্ত্রে বিধানে। এতে তুমি যে রং-ই মাখাতে চাও, রং ধরবে না। এই পরিচয় আছে অচিনে বিচিত্রে।

কিন্তু আঙ্‌রি এমন মুখ ভার করে থাকলে ভাল লাগে না। তার চোখের ঝিলিক আর খিলখিল হাসি এতক্ষণ সব কিছুকে সজীব করে রেখেছিল। তার পিছন ফেরানো মুখের দিকে চেয়ে বলি, ‘যেতে পারলে সত্যি বেশ ভাল লাগত।’

আঙ্‌রি আমার দিকে তাকায় না। তাকায় গাজির দিকে। যেন সে তাকে কিছু বলেছে। গাজির দিকে চেয়ে যে গাজিকেই বলে, ‘পথের মানুষকে ঘরে ডেকে নিয়ে যাওয়া তো আমার কাজ নয়। তবে এই কেমন যেন মনে হল, তাই।’

গাজি যেন কেমন অসহায় হয়ে পড়ে। আমার দিকে একবার চোরা চোখে দেখে নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, সেই তো কথা।’

কথা যে কোনদিকে মোড় নেয় ধরতে পারি না। তবে এটা বুঝতে পারি, আর মুখোমুখি কথা নেই। যা বলা-কওয়া আছে, এখন তার সাক্ষীগোপাল গাজি। সে হচ্ছে মধ্যবর্তী মানুষ। কিন্তু পথের মানুষ ঘরে ডেকে নেওয়া যে মাহাতো বউয়ের কাজ নয়, সে কথা এমন করে শোনায় কেন। এতক্ষণ তাকে কি সেটুকুও বুঝতে পারিনি? বলে উঠি, ‘আমি সে সব কিছু ভাবিনি।’

কিন্তু আঙ্‌রি যেন আমার কথা শুনতেই পেল না। সে গাজির দিকে চেয়ে আগের মতোই বলে, ‘তোমার বাবু, তখন থেকে দেখছি কি না কেমন যেন মনে হলো। তাই ভাবলাম, এখানে কোথায় কী ভাবে থাকবে, সেইজন্যে বলা। তা বলে তোমার বাবু যা ভাবছে, তা নয়।’

বলে, এমন ভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয় আঙ্‌রি, যেন আমার বুকে বিঁধিয়ে যায়। আমাকে খাটো করে দেয়। তার কথার ইঙ্গিতটা আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি। অথচ অন্তর্যামী ছাড়া আর কেউ জানে না, সে ভুল ভেবেছে। আমি কিছু বলবার আগেই গাজি বলে ওঠে, ‘না, চাচি, আমার বাবু তা কিছু ভাবে নাই, সেটা হলফ করি বলতি পারি।’

আঙ্‌রি মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘মিছা কথা বলো না।’

হয়তো বিশ্ব-সংসারের এটাই নিয়ম। মন যখন অবুঝ হয়, তখন সে আর অপরকে বুঝতে চায় না। আঙ্‌রির নিমন্ত্রণে সৌভাগ্য মেনেছি। এখন সে আমাকে অভিযুক্ত করে, কাঠগড়াতে দাঁড় করায়। যে অভিযোগে আছে একটা অসম্মানের ছোঁয়া। আমার রুচি নিয়ে টানাটানি। কিন্তু সব কিছুই আমার মনের মতন হবে, তাই বা কেন ভাবি। সব কিছুই হাসি কথায় টলটলিয়ে যাবে, এমন আশা কেন। তবে একটুখানি বেঁধে। বেঁধে বিঁধুক। মন যে সবার সমান নয়, মানবজীবনের সেই তো এক সৌন্দর্য। কাল সকালের জোয়ারে অনেক কিছুই ভেসে যাবে। হয়তো পলির নীচে থেকে যাবে কিছু। তবু পথের দেখা পথেই শেষ হবে। যেটুকু আমার, সেটুকু আর কেউ নেবে না। আঙ্‌রি আমার কাছে যা, তাই থাকবে। কিন্তু না বলে পারি না, ‘গাজি কিন্তু মিথ্যে বলেনি। তবে জোর করে তো কাউকে কিছু বিশ্বাস করানো যায় না। আমিও একটু-আধটু মানুষ চিনি।’

গাজি অমনি বলে ওঠে, ‘শোনো চাচি শোনো, বাবুকে আমার চিনতি পারো নাই। একবার চোক তুলে দ্যাখ দি’নি।’

আঙ্‌রি চোখ তুলে দেখে না। সে আশা আমি করি না। বরং ফিরে তাকাই ঘরের দিকে, নারাণঠাকুরের আশায়।

গাজি কিন্তু বলো যায়, ‘আর তুমি হলি মা দুগ্‌গা, তোমাকে কি আন্ ভাবা যায়!’

বলে আমাকে ডেকে বলে, ‘জানেন বাবু, চাচি আমার ডাকাত হত্যে করিছে।’

হত্যা করেছে! ফিরে তাকাই গাজির দিকে। গাজির আরশি-চোখে আলোর ঝলক, ফাঁদ বড় হয়ে ওঠে। বলে, ‘তিন বছর মামলা চলিছিল বাবু, জানেন। তা হবি পেরায় আট ন’ বছর আগের কথা। মাহাতো চাচার ঘরে ডাকাত পড়িছিল। তা, খালি যে টাকা লোটার মতলবে তারা এসেছিল, তা নয়। চাচিকেও ধরি নিয়ে যেতি চেয়িছিল। চাচির হাতে তখন কাটারি। একেবারে এক কোপেতে বলো হরি হরি বোল্‌। একটার মুন্ডু গিয়িছিল আধখানা, আর একটার গোটা হাত। চাচির সেই মূর্তি দেখি বাছাধনদের আর কুক্ পাড়তি হয় নাই। টাকা-পয়সাসুদ্ধ মরা আর আধমরাগুলোকে ফেলি দে দৌড়।’…

গাজিকে বাধা দিয়ে মুখ না ফিরিয়েই যেন লজ্জা পেয়ে আঙ্‌রি বলে ওঠে, ‘আহ্‌, চুপ করো দিকিনি।’

গাজির কথা শুনতে শুনতে চোখ পড়ে গিয়েছিল রক্তাম্বরীর দিকে। এ কালো মেয়ে যে সত্যিই শ্যামা সর্বনাশী, তা একবারও ভাবিনি। দেবীকাহিনী শুনেছি, কালী দুর্গার প্রতিমা দেখেছি। তাতে আমার কাজ-অকাজের জীবনে তেমন ঢেউ লাগেনি। কিন্তু আমি যেন চর্মচক্ষে সেই কাহিনীর নায়িকাকে দেখি। রূপান্তরের সেই প্রতিমা আমার সামনে। মনে থাকে না, বন্ধ্যা নারী মানসিক করে ফেরে তারকেশ্বর থেকে, একে দেখেছিলাম হাসনাবাদের পথে, বাসের মধ্যে ঘোমটার আড়ালে বিড়ি খেতে। এ যে সত্যি রক্তাম্বরী! সহজ প্রাণের পিছনে যে পথ, এবার যেন তার সঠিক হদিস পাই। অথচ দেখ, নিচু মুখ ফিরিয়ে কেমন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আবার লজ্জা পেয়ে লজ্জাবতী গাজিকে চুপ করতে বলে। যেন এ মেয়ে সে মেয়ে নয়, রক্তে ধোয়া প্রাণ যার নারীত্বে জ্বলজ্বলানো। রক্তে যার গঙ্গাস্নানের পবিত্রতা।

গাজি বলে, ‘না, তাই বলি আর কী, চাচি তোমাকে কি আন্‌ ভাবা যায়।’

অবাক হয়ে ভাবি, শক্তি কোথায় বসত করে, এই আঙুরকে দেখে যেন তার ঠিকানা পাই না। অথচ সে এমন ভুল করে। করে বলেই বোধ হয় এ নায়িকা মানবী। এইটুকু প্রবোধ মেনে চোখ ফেরাতে যাই। হঠাৎ আঙ্‌রি আমার দিকে ফিরে তাকায়। তাকিয়ে ফিক্‌ করে একটু হাসে। দেখি, তার কাজলকালো চোখে আবার সেই হাসির ঝিকিমিকি। গাজির দিকে ফিরে বলে ‘আর সেই মামলাতে যদি খুনি বলে আমাকে চালান দিত তা হলে তো রাক্‌কুসী বলতে।’

গাজি দাড়ি দুলিয়ে বলে, ‘না চাচি, হাজার চালান দিলিও তুমি আমাদের মা দুগ্‌গা থাকতে।’

বলে ঘাড় কাত করে চোখ নাচিয়ে হঠাৎ সুর করে বলে ওঠে, ‘আমি কি আটাশে ছেলে? ভয়ে ভুলব নাকো চোখ রাঙালে।’

সুর করে গেয়ে গাজি হাত নেড়ে দেয়। আঙ্‌রি হাসে খিলখিল করে। বলে, ‘কী বলে দ্যাখ, দুর অ।’

আঙ্‌রি চকিতে একবার আমার দিকে তাকায়। একটু আগের গুম্‌সোনি গুমোটে আবার হাওয়া লেগে যায়। হায়, কে বা করে মনের বিচার। কোথা দিয়ে হাওয়া আসে, কে জানে!

গাজি আঙ্‌রির দিকে চেয়ে ততক্ষণে অন্য সুরে গুনগুন করে ওঠে, ‘দুগ্‌গা নাম তরী, মস্তকেতে ধরি, যতন করিয়ে রাখব। আমার অন্তে শমন এলে, অজপা ফুরোলে, দুগ্‌গা দুগ্‌গা বলে ডাকব।’…

এবার আর সাঁই দরবেশের দেহতত্ত্ব নয়, দাড়িওয়ালা গাজি শাক্ত পদাবলী গায়। এতও জানা আছে লোকটার! কিন্তু আঙ্‌রি হাসতে হাসতে ভুরু কোঁচকায়। বলে, ‘আহ্‌ না, ছি। আমাকে নিয়ে ওরকম ঠাকুর-দেবতার গান করো না। কী এক পাপ এসেছিল কোনকালে। ভাবলে এখনও রাতে ঘুমোতে পারি না। ওসব আর বলো না।’

গাজি হেসে কী বলতে যায়। মাহাতো ফিরে আসে নারাণঠাকুরকে নিয়ে। আসতে আসতেই ঠাকুর বলে, ‘এর আর বলাবলির কী আছে। কোনও অসুবিধা হবে না।’

আমার দিকে তাকিয়ে ঠাকুর অভয় হাসি হাসে। বলে, ‘আমিও তো তখন থেকে ভাবছি। শুনতে পাচ্ছি বেড়াতে এসেছেন, ভাবলাম, কোনও ব্যবস্থা-ট্যবস্থা করে এসেছেন।’

বলেই গাজির দিকে ফিরে মুখ বিকৃত করে সে। প্রায় খেঁকিয়ে ওঠে, ‘কেন, বড় যে ফড়ফড়ানি। বিদেশি ভদ্দরলোককে মিঠে মিঠে কথা বলে নিয়ে তো এসেছ, এখন যাও, ফিরিয়ে নিয়ে যাও। আবার বলে, বসিরহাটে নিয়ে যাবে। কত ওস্তাদি!’

গাজি একেবারে জোড়হাত। বলে, ‘আর বলবেন না ঠাকুরমশায়, মুরশেদের পয়জার আমার মুখে।’

একেই বোধ হয় ‘খোসামুদে রামপেসাদে’ বলে। কোনও রকমেই ঠেক খাওয়াতে পারবে না। কিন্তু ঠাকুর সে কথা শুনলে তো! বলেই চলে, ‘তাই তো বলি, এমন হুজ্জোত কে বাঁধাবে। দুটো গান গাইতে পারে বলে উনি একেবারে সব জেনে বসে আছেন।’

গাজি তাড়াতাড়ি বলে, ‘না, ঠাকুরমশায়, কিরা কেটি বলতি পারি, আমি দিনকানা, রাত দেওয়ানা। তয়, একটা কথা বলে রাখি, আজ রাত্তিরি কিন্তু আপনার এই দাওয়াতি আমাকে শুতি দিতি হবে।

ঠাকুরের জবাবের আগেই আঙ্‌রির গলায় হাসি ঝরে পড়ে। ঠাকুর রেগে কিছু বলতে যায়। মাহাতো বলে ওঠে, ‘তা শোবে, তাতি আর কী। ঘরে গিয়ি তো শুচ্ছে না। এবার আমরা যাই। চল্ গো আঙ্‌রি, যাই।’

নারাণঠাকুরের যে কথাটা মুখে আটকে গিয়েছিল সে কথাটাই রূপান্তরে শোনায়, ‘খালি বাজে—’

আঙ্‌রি বলে ওঠে, ‘প্যাচাল পাড়ে।’

বলেই, হাসির ঝড়ে ঝরে পড়ে। গাজি মুখ ফিরিয়ে আওয়াজ দেয়, ‘জয় মুরশেদ!’

তারপর নিজেই আগে দাওয়া থেকে নেমে হাঁটা ধরে। আমি মাহাতোর সঙ্গ ধরে বলি, ‘চলুন, আপনাদের সঙ্গে একটু যাই।’

কথাটা কেবল মাহাতোকে বলিনি। আর যার উদ্দেশে, সেই আঙ্‌রি একবার চোখ তুলে চায়। এখন তার ঠোঁটে একটি প্রীতির হাসি ঝলকায়।

.

১৭.

আঙ্‌রির ঠোঁটে যে কেবল প্রীতির হাসি ঝলকায়, তা নয়। আবার পিছন ফিরে নারাণঠাকুরের দিকে দেখে। ঠাকুরের মুখের বুলি কেড়ে নিয়ে, সে যে বুলি পূরণ করে দিয়েছে, সেই থেকে ঠাকুরের বাত্ গায়েব। মুখের হাঁ বন্ধ হয়নি। জর্দা গুণ্ডি বিড়ির ধোঁয়ায় কালো হয়ে যাওয়া জিভটা পর্যন্ত দেখা যায়, নড়েচড়ে না। ভুরু গিয়েছে কুঁচকে, দৃষ্টিতে ভাব নেই। আমার সঙ্গ নেওয়া দেখে আঙ্‌রি আসলে শালীন হেসে অনুমতি করে। কিন্তু পিছন ফিরে ঠাকুরের দিকে চেয়ে আবার খিলখিলিয়ে ঝরে।

কেবল যে ঝরে, তা নয়। কেমন ঝোঁকতা লাগে শরীরে। ঘোমটা রয় না মাথায়, রক্তাম্বরীর আঁচল খসে পড়ে। এবার বলো, এ শরীর কি কেবল মধ্যঋতু আশ্বিনে টুইটুম্বুর। তার চেয়ে বেশি দেখ, অধরা উদ্ধত। জামার ছাঁটেকাটে, সাজেগোজে, খাঁজে-খাঁজে ঠেকা দিয়ে সাজানো বানানো নয়। এ বনে বন্যতা, প্রকৃতি নিজের হাতে সাজিয়েছে। এ আর এখন মাহাতো-গিন্নি নয়, যেন এক ডাগরী যুবতী, তাতে রঙ্গিনী। যে-ডাকাতের মুণ্ডু ঘুরেছিল আর মুণ্ডু বলি গিয়েছিল, সে বেচারির দোষ কতটুকু। মরণ কী আর এমনি ধরে! তবে অসুর বেশে এলে বলি যাওয়া ছাড়া উপায় কী!

এতক্ষণে নারাণঠাকুরের মুখের হাঁ বন্ধ হয়, দাঁত দেখা যায়। তারপর দাওয়া থেকেই বলে, ‘আচ্ছা গো মাহাতো-বোঠান, খুব একখানা দিয়ে গেলে।’

আঙ্‌রি দাঁড়িয়ে পড়ে ঘাড় নাচিয়ে বলে, ‘কেন কী দিয়ে গেলাম।’

ঠাকুরও ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলে, ‘বুঝতে পেরেছি গো, বুঝতে পেরেছি।’

আঙ্‌রি ভুরু কাঁপিয়ে খানিকটা ধমকের সুরে বলে, ‘কী যে খালি বাজে প্যাচাল পাড়ে।’

বলেই আবার খিলখিলিয়ে হাসি। হাসির তালে শরীরে যেন নাচের ছন্দ লাগে। এবার দাওয়া থেকে ঠাকুরের হাসিও ভেসে আসে। তার ডিগডিগে শরীরে পাঁজরাগুলো পর্যন্ত তালে তালে নাচে। বলতে থাকে ‘বুঝেছি গো বোঠান, বুঝেছি।’

মাহাতো রঙ্গ বোঝে। তবে জীবনযাপনের একটা ভার আছে। বয়সেরও আছে বোধ হয়। বউয়ের সঙ্গে তেমন তাল দিতে পারে না। কিন্তু মুখ টিপে হাসে। ডাক দেয়, ‘আয় গো বউ তাড়াতাড়ি আয়। বেলা একেবারে চলি গেল।’

আঙ্‌রি ফিরে আবার সঙ্গ ধরে। মাহাতো আমার দিকে চেয়ে বলে, ‘নারাণঠাকুর বড় মজার লোক।’

আমি বলি, ‘গাজির ওপরে একটু রাগ আছে।’

আমার কথার জবাব দেয় আঙ্‌রি, ‘তা নয়, ঠাকুরের ওইটাই ভাব।’

মাহাতো বলে, ‘ঠিক বলিছ। লোকটাই ওরকম।’

আঙ্‌রি বলে, ‘এঁড়ে লাগা ছাওয়ালের মতন। ও যা বলবে, তাই শুনতে হবে। না শুনলেই হম্বিতম্বি। দেখ না, ফোঁচার বউয়ের সঙ্গে কেমন করে কথা বলে।’

বলে আঙ্‌রি হাসে। আমার দিকে চায়। বলতে চায়, মানুষ চিনি। এ আর কথা সাজিয়ে চরিত্র ব্যাখ্যা নয়, যেমন কেতাবে হয়। যেমন দেখা বোঝা, তেমনি বলা। আমার কানে লেগে থাকে, ‘এঁড়ে লাগা ছেলের মতন’ ব্যাখ্যাখানি। যার কোনও কিছু মনের মতন নয়। যে হাত-পা ছুড়েই আছে। আর এঁড়ে লাগা ছেলের যত বায়নাক্কা, সবই আপন ভাইয়ের সঙ্গে। আর কারুর সঙ্গে নয়। তাতে বোঝা গেল, নারাণঠাকুর আর গাজি আসলে পরস্পরে অনেক বেশি কাছাকাছি। কিন্তু মা হওয়া যা ভাগ্যে ঘটেনি সেই আঙ্‌রি তুলনা দিতে গিয়ে কেমন করে এঁড়ে লাগা ছেলের কথা বলে! মনটা বুঝি কেবল মাতৃভাবের স্রোতে আনাগোনা করে।

আঙ্‌রি আবার বলে ‘তাই দেখ না, গাজি যেমন করে ফোঁচার বউও সেরকম করে। ঝগড়া বিবাদ করে না, মুখ ফিরিয়ে হাসে। ও লোকের সঙ্গে আবার কেউ ঝগড়া করে নাকি।’

মাহাতো তার লাল চোখ বড় করে বলে, ‘উ বাবা, ন’ মাসে ছ’ মাসে তো আসিস। তোর নজর দেখি সব দিকি যায়।’

আঙ্‌রি বলে, ‘যাবে না কেন। কানা নাকি আমি?’

‘না, তা বলি না। তা হলি, আমি যখন বকিঝকি, তুইও মুখ ফিরিয়ে হাসিস।’

‘আহ্ দূর অ, তুমি কি ঠাকুরের মত করো নাকি যে, আমি ওরকম করব। দেখ দিকিনি।’

বলে আঙ্‌রি আমার দিকে চেয়ে হাসে। এই প্রথম সোজাসুজি সম্বোধনে সোজাসুজি কথা। মাহাতোও আমার দিকে চেয়ে হাসে। বলে, ‘তা কী জানি। বলা তো যায় না। ফোঁচার বউয়ির কথা যে রকম বললি।’

আঙ্‌রি তার ডাগর চোখের কোণ দিয়ে তাকিয়ে পরিষ্কার জিভ ভেংচে দেয়, শব্দ করে ‘অ্যা হ্যা হ্যা।’

মাহাতো যেন নেশা করে হাসে হ্যা হ্যা শব্দে।

ইতিমধ্যে পেরিয়ে যাই হাটের সীমানা। সামনে খানিকটা ধানকাটা মাঠ। মাঠ পেরিয়ে রাস্তা। এতক্ষণে গাজির দেখা মেলে। দেখি, ধানকাটা মাঠের একটা সবুজ উঁচু আলপথের ওপর সে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ ফেরানো তার আমাদের দিকে। গাছপালা নেই। আকাশের তলায় পাগড়ি বাঁধা আলখাল্লা পরা গাজিকে দেখায় যেন আদ্যিকালের পথ-চলা মানুষটা আকাশের ধ্যান করে। একটু একটু বাতাসে তার বাবরি আর দাড়ি কাঁপে। তার সঙ্গে কাঁপে পাগড়ির ল্যাজ।

এতক্ষণ ধরে পাখির ডাক চাপা পড়েছিল আঙ্‌রির হাসির আড়ালে। কিংবা পাখিগুলোই কান পেতে ভোলাখালির বউয়ের হাসি শুনছিল। এখন হঠাৎ পিছন থেকে হাটের গাছে তাদের ডাক শোনা যায়। ওপারে ন্যাজাটের আকাশের এক কোণে বুঝি সূর্য অস্ত গিয়েছে। প্রথম শীতের নীল আকাশে পশ্চিমের কোণটা রাঙিয়ে গিয়েছে। কোথা থেকে দু-চারটি হালকা মেঘের টুকরো এসেছে। যেন তাদের সকল টান টকটকিয়ে যাওয়া পশ্চিমের রাঙা থানে। তাতে লালের ঝলক দেখায় যেন লম্বা লম্বা পেঁচড়ার মতো। আর সেই লালেরই ঝলক দেখ সবার গায়ে মুখে। কেবল মানুষের নর, ধানকাটা মাঠের ধুলায়, না-কাটা পাকা ধানের মাঠে আর ওই যে দূরান্তে পথ চলে যায়, সে তো যেন এয়োস্ত্রীর সিঁথির মতো টকটকিয়ে উঠেছে।

গাজির কাছাকাছি হতেই সে বলে, ‘আমি ভাবি কী যে, আবার কী হলি। ঠাকুর আবার কিছু বলে নাকি।’

আঙ্‌রি বলে ওঠে, ‘বলছিল তো। তুমি চলে এলে, তোমাকেই তো ডাকছিল।’

ফিরতে গিয়ে দাঁড়ায় গাজি। বলে, ‘আমাকে?’

আলের পথে, পাশাপাশি কেউ নয়। আমি সকলের পিছনে। আঙ্‌রি আমার আগে। আমি তার মুখ দেখতে পাই না। তার গলা শুনতে পাই, ‘তবে কি আমাকে? তুমি ফিরে যাও না, তারপর তোমাকে দেখাবে বলেছে।’

গাজি যেন সত্যি দুশ্চিন্তায় পড়ে। বলে, ‘কেন চাচি, আমি তো কিছু বলি নাই।’

আঙ্‌রির গলা শোনা যায়, ‘বলনি তো কী, খালি বাজে প্যাচাল পাড়ো।’

গাজি তখনও তাকিয়েছিল আঙ্‌রির দিকে। দেখি, দেখতে দেখতে তার চোখের ছায়া সরে। তারপরে তার আর আঙ্‌রির মিলিত গলার হাসি বেজে ওঠে মাঠের মাঝখানে। কোনখানে যেন তখনও কয়েকটা পাখি, কৃষকের ফাঁকি পড়া চোখের দানা খুঁটছিল মাঠে। তারা তরাসে ডাক দিয়ে উড়ে যায় কয়েক হাত দূর থেকে। আর সেই হাসির ঢল সামলাতে আঙ্‌রির পা হয়ে যায় বেসামাল। সে ঢল খেয়ে নেমে যায় মাঠে।

মাহাতো হেঁকে ওঠে, ‘দেখ, করে কী, আছাড়-পিছাড় খাবি নাকি।’

বলে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। আঙ্‌রি হাসতে হাসতে বলে, ‘না, পড়ব না।’

কথা শেষ না করেই আবার দৌড়ে ওঠে আলের ওপর। তাতে কেবল যে ঠিনঠিনিয়ে চুড়ি বেজে যায়, তা নয়। ঘোমটা-খসা খোঁপায় গোঁজা ঝুমকো কাঁটাগুলোও ঝুনঝুনিয়ে বাজে।

মাহাতোর গলায় বিরক্তিতে স্নেহ ঝরে। বলে, ‘পড়বি যখন, তখন বুঝবি। লোকি বলবি, মাহাতোর দজ্জাল বউটা মাঠ দিয়ি দৌড়য়।’

আঙ্‌রির শাড়ি তখন মাহাতোর আগে, গাজির কাছে। বলে, ‘বলুক গে, তোমাদের লোকগুলোকে চিনি।’

বলে সে একবার মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে চায়। দেখে নিতে চায়, আমিও সেই লোক কি না, যে লোকগুলোকে সে চেনে।

কিন্তু আমি তখন দেখছিলাম মাহাতো-গিন্নিকে নয়, কোনও দজ্জাল বউকেও নয়। আমি দেখছিলাম, খুশিতে ডগমগ একটি কিশোরীকে। যাকে দেখে মধ্যঋতুর কথা আর মনে থাকে না। সামনে যার হেমন্তের শুকু শুকু টানের দিন। আলতা পরা তেলতেলে কালো পায়ের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, যাত্রা তো শুরু কেবল। কঠিনের চড়াই উৎরাই ভেঙে এ পায়ে শেষ দাগ পড়তে দেরি আছে।

আমার দিকে তাকিয়ে বিচার কী হল, বুঝতে পারি না। বোঝা গেল, মুখ ফিরিয়ে কী যেন বলে গাজিকে। গাজি হা হা করে হেসে তাকায় আমার দিকে। তারপর মুখ ফিরিয়ে চলতে চলতে বলে, ‘নইলি কি আর অমন বাবুর সঙ্গ ধরি চাচি। অই চোক দেখিই ধরিছি, কালা এখন গোকুল ছেড়ি, নদের ধুলোয় ধুলোট খেলে।’

কথা কোন বায়ে বহে, ধরতে পারি না। প্রসঙ্গ আমাকে নিয়ে, সেটা অনুমান করতে পারি। কিন্তু চোখ দেখে কী ধরা গেল, তাতে কালা ছাড়ে গোকুল কিংবা নদিয়ায় ধুলট খেলে, সে হাস্যের অর্থ কী, বুঝতে পারি না।

আঙ্‌রি আবার একবার ফিরে চায়। তারপরে আবার যেন কী বলে, কানে শুনতে পাই না। যে বলে, সে শোনাতেও চায় না। অমনি গাজি গান ধরে দেয়:

‘ওগো, যে কালা সে কালাই আছে, তারে কি চিনতি পেলে।

কালা এখন গোকুল ছেড়ি, নদের ধুলায় ধুলোট খেলে।’…

গান থামিয়ে বলে, ‘জানলে চাচি, বাবুকি পেত্থম যখন জিগেস করলাম, কী যে, “বাবু আপনাকে তো চিনতি পারলাম না। ইদিকে দেখি-টেখি নাই। তা যাবেন কম্‌নে?” বাবু বললেন, “তা তো জানি না।” কথা শুনি ভারী মজা লাগে, ভাবি, এ তো বড় মজার বাবু। কম্‌নে কোথায় যাবেন, তাই জানেন না। তারপরে বললেন, “এই একটু বের হয়ে পড়েছি!” তা হলিই বোঝো, এ মানুষ কেমনতর। অই তুমি যা বললে, আমারও তাই মনে হয়েছিল।’

কী মনে হয়েছিল গাজির। কথা বলে আমাকে নিয়ে, অথচ আমি জানতে পারি না। বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে কেতাবি সভ্যতা যে এদের বোঝাবো, সে উপায় নেই। এ মানষেরা সব আপন বায়ে চলে। মনে যেমন জাগে, তেমনি ভাবে। তা চলুক, ভাবুক, আপত্তি নেই। কিন্তু আমাকে নিয়ে কেন। এমনি করে বললে কৌতূহল সূচ্যগ্র হয়। দেবতা তো নই। অথচ জিজ্ঞেস করতে পারি না কোনও মতেই।

আঙ্‌রি আবার ফিরে চায়। মাহাতো বলে ওঠে, ‘দেখ্‌, আবার পড়ে যাবি।’

যেন সে এক পাল ছেলেমানুষ নিয়ে চলেছে। সে সব কথা শোনে না, শোনবার কৌতূহলও নেই। বাচ্চাগুলো কী নিয়ে ক্যালোর-ব্যাপোর করে, ধাড়িটা যেন শুনেও শোনে না, কেবল হুঁশিয়ার করে নিয়ে যায়।

গাজি তখনও কথার জের টেনে চলেছে, ‘চোক দেখি মনে হলো, এই সবে সোম্‌সারে পা পড়িছে। কোলের ছাওয়ালের মতন যে দেখে, তাই মন টেনি নিয়ে যায়। যেন জগৎ আর দেখা হয় নাই। আমি ভাবি, বাহ্‌ মুরশেদ, এ মানুষটা তো ভারী মজার। আবার বলেন, কোথায় কম্‌নে যাবো জানি না।’

বলে আকাশ ফাটিয়ে হাসে। মুখ নিচু করে আমাকে চলতে হচ্ছিল। একবার মুখ তুলে দেখি গাজির দিকে। না, সে পিছন ফিরে তাকায় না। মাহাতো বলে ওঠে, ‘কী খালি তোরা বলিস আর মাকড়ার মতন হাসিস।’

গাজি বলে ‘না, বলি, চাচি বলে কি না, বাবু নাকি ছোট ছাওয়ালের মতো চায়। যেন হাঁ করে খেলা দেখে আর মনে মনে হাসে। তাই বলি, হাসে এক, দেখে আর এক। বাবুকে পেয়ি বড় মজার লেগেছে। তয় মনে মনে ভাবি কি যে, বাবু কি খেলতি বের হয়িছেন, ছোট ছাওয়াল যেমন ঘর থেকি পলায়। না কি পথে বের হয়ি হারিয়ে গেছেন।’

এই বলে সে পিছন ফিরে তাকায়। আমি চোখ ফিরিয়ে নিই। কিন্তু গাজির শেষের কথাগুলো আমার ভিতরে কোথায় বাজতে থাকে। এই যে মুহূর্ত, এই রাঙা সন্ধ্যা, ধানকাটা মাঠ, দূর দিগন্তে ঠেকে থাকা আকাশ, আর এইসব নরনারী, যাদের মাঝখানে, আমার মনে পড়ে না, কোথা থেকে এলাম, কে আমি! কোথায় যাই, কীসের সন্ধানে। সেই ছেলেবেলার কথাই মনে পড়ে যায়। যখন আমার আমিত্বে আজকের কোনও পরিচয় লেখা হয়নি। অথচ বারে বারে মনে হয়, সেই আমিকে কোনওদিনের তরে ছাড়িয়ে যেতে পারিনি। যে আমি ঘর থেকে পালিয়েছি খেলতে, খেলতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছি কোন এক অচিনে। যেখানে সকলই বিস্ময়, অথচ চোখের জল মুছতে হয়েছে।

আমাকে নিয়ে কথা বলুক, তা চাই না। কিন্তু গাজিটা কে। ও যেন সবই ভিতর থেকে দেখে। ও কি আমার জন্মলগ্নের সাক্ষী। ও কি চিরদিন ধরে চেনে আমাকে। ও কি সেই মাঝি নাকি, যে আমাকে নিয়ে এসেছিল বুড়িগঙ্গার মোহনা থেকে। ও কি ধলেশ্বরী তীরের লতব্‌দী গ্রামের সেই রামকৃষ্ণ আশ্রমের সাধু, যিনি একবার আমার চিবুক তুলে ধরে মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। গায়ের গেরুয়া দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়েছিলেন, পারেননি কেবল চোখের কূলের বিস্ময় আর কৌতূহল মুছিয়ে দিতে। তারপর হাত ধরে দাড়ির ভাঁজে হেসে বলেছিলেন, ‘চলো, তোমারে দিয়া আসি তোমার আত্মীয়ের কাছে।’…

আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে পূব দেশের ধলেশ্বরীর তীর থেকে তিন মাইল দূরে এক গ্রাম। নাম তার চারগ্রাম। দেখি, এক ছেলে তার দিদিমার আঁচল ধরে টানে আর কাঁদে। বলে, ‘ইন্দিরের লগে আইজ যাইতে দাও বেজেরহাট।’

দিদিমা ধমক দিয়ে বলে, ‘না, বেজেরহাটের ভিড়ে তুই হারাইয়া যাবি। সেখানে পোলা চুরি যায়।’

সেখানে পোলা চুরি হয় এই ভয় দেখায় দিদিমা। কিন্তু নাতি না শোনে বুড়ি দিদিমার কথা। তাঁর থানের আঁচল নিয়ে টানাটানি করে। এদিকে বাড়ির চাকর, নমঃশূদ্র ইন্দির ধামা মাথায় পা বাড়ায় বাড়ির বাইরে। তখন সেই ছেলে ডাক ছেড়ে চিৎকার করে, দিদিমার কোমর জড়িয়ে ধরে কাঁদে। দিদিমার প্রাণ তাতে না গলে পারে না, ডাক দেন, ‘ইন্দর, শোন্‌। অরে লইয়া যা, দেখিস্‌ না হারায়। যখন হাট করবি, কুতুর চাউলের গদিতে পোলারে বসাইয়া রাখিস। দুপুরের আগে ফিরিস, নাতি কিন্তু না খাইয়া যায়।’

ছেলেটি ভাবে, ইন্দির আর একটু হলেই বিশ্বাসঘাতকতা করে চলে যাচ্ছিল। কারণ, বেজেরহাট, ব্ৰজের হাট যার নাম, সেই পৃথিবীর পরম বিস্ময় বাজারের গল্প ইন্দির তাকে শুনিয়েছিল। বলেছিল, দিদিমাকে বলে সে-ই তাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ব্যাপার ঘটছিল আলাদা। এখন ইন্দির হাত বাড়ায় ছেলের হাত ধরবার জন্যে, ছেলে শোনে না। সে এসেছে ঢাকা শহর থেকে চারগ্রামে, দিদিমার কাছে বেড়াতে। প্রাণে তার সেই সাধ, একদিন যাবে সে পশ্চিম দিকে দু’মাইল দূরে ব্রজেরহাটের হাট দেখতে। ইন্দির হাত ধরবার আগেই ছেলে দৌড় দেয়। যেন বাঁধা বাছুর ছাড়া পেয়ে ছোটে গাভীর স্তনের তৃষ্ণায়। যে স্তন ছড়ানো সবুজ রবিশস্যের মাঠে মাঠে, আর লাল পথে। যে স্তন ছড়ানো সকালের রোদে, মাথা তুলে রোদ পোহানো বিশাল হিজলের বনে, বেতঝোপের মাথা দোলানো ডগায় ডগায়। এক দৌড়ে সে মাঠ পেরিয়ে বাঁক নেয়, কুলইচণ্ডীতলা থেকে। বুড়ো হিজলের জটায়, আঁধার আঁধার ছায়ায়। ছেলেটি এক মুহূর্ত দাঁড়ায়। গাটা একটু ছম্‌ ছম্‌ করে, মনে একটা ভয়ের দুরুদুরু। কিম্ভূতাকৃতি এক সিঁদুর মাখানো হিজলের গুঁড়ির দিক চেয়ে দেখে। সবাই বলে, ওইখানে প্রথম দেবী কুলইচণ্ডীর বাস। এখান দিয়ে যে যায়, সে-ই নমস্কার করে। কুলইচণ্ডীর মূর্তি কেমন, তা সে জানে না। হয়তো কোনও প্রতিমা আছে। কিন্তু ছেলেটির চোখে কুলইচণ্ডী চিরদিনই দলামোচড়া পাকানো সাপের মতো, যেমন সেই হিজলের সিঁদুর মাখানো গুঁড়িটা। ছেলেটিও হাত তুলে নমস্কার করে। তারপরে আবার দৌড় দেয়। ইতিমধ্যে ইন্দিরও তার বড় বড় পায়ে দৌড়ে এসে গৃহকর্ত্রীর নাতিকে ধরে ফেলে। ধমক দিয়ে বলে, ‘শহরের পোলা তুমি, গেরামের রাস্তা যদি হারাইয়া ফালাও, তারপরে? তখন কী হইবো?’

তারপরে কী হবে, শহরের ছেলেটির জানা ছিল না। সে কেবল ইন্দিরের মুখের দিকে তাকায়। তখন ইন্দির তাকে শোনাতে থাকে, এইসব মাঠের পথে, বড় বড় গাছে, খালের ধারে কত সব ছায়ারা ঘুরে বেড়ায়। তারপরে সেই গল্পটা বলে, যে গল্পের নায়কের পরিচয় আর নেই। স্থান কাল পাত্র, সকলই ইতিহাসের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। গ্রামের উত্তর পাড়ার স্বয়ং গোরাই দত্তের নাম দিয়ে কাহিনী বলে। বলে, ‘গোরাই দত্ত সিরাজদিঘির থেইক্যা বাড়ি ফিরতে আছিল, রাইত তখন নয়টা। বড় জবর আন্ধাইরা রাইত। গোরাই দত্তের হাতে প্রকাণ্ড এক রুইমাছ। আসার রাস্তায় পড়ে কাদিশালের খাল।…’

… তারপরে, গোরাই দত্ত যখন কাদিশালের খালের ধার দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলেন, তখন তাঁর মনে হয়, পিছনে শুকনো পাতায় পা ফেলে ফেলে আর একজন যেন কে আসে। তখন গোরাই দত্ত কী করেন, শহরের পোলাটি বলতে পারেনি। গোরাই দত্ত পিছন ফিরে তাকাবেন? সর্বনাশ, তাই কখনও হয় নাকি। তা হলেই তো মট্‌ করে ঘাড় মটকে ধরবে। অতএব শহরের ছেলেটি জেনে রাখুক, এমনি অন্ধকার রাত্রে একলা খালের ধার দিয়ে চলতে চলতে বা যে-কোনওখানেই হোক, পিছনে যদি কারুর শব্দ পাওয়া যায়, খবরদার, যেন ফিরে না তাকায়। তাই গোরাই দত্তও সেটা বুঝতে পেরেছিলেন, কে তাঁর পিছন আসে। তাই তিনি ফিরে তাকাননি।

কিন্তু যে পিছনে পিছনে আসছিল, সে যখন দেখে যে, গোরাই দত্ত ফিরেও চান না, তখন হঠাৎ শোনা গেল, কে যেন তাঁর আগে আগে যায়। পায়ের শব্দ শোনা যায়। অথচ তাকে চোখে দেখা যায় না। কিন্তু গোরাই দত্ত থামেন না, সামনে চলতে থাকেন। কেন? না, তখন থামলেই ঘাড়টি মট্‌ করে ভেঙে পড়বে। তখন হঠাৎ গোরাই দত্ত দেখেন, খালের জল থেকে, একটা লম্বা হাত উঠে আসে। হাতে এক চিমটি মাংসের বালাই নেই, কেবল সাদা ধবধবে হাড়। অথচ সেই হাতে মেলাই সোনা-রুপোর চুড়ি। হাড়ের সঙ্গে চুড়িগুলো ঠকঠকিয়ে বাজে। আর শোনা গেল, মেয়েমানুষের নাকি-নাকি গলা, ‘এত বঁড় রুঁই মাঁছ দেঁইখ্যাঁ নোঁলা দিয়াঁ জঁলঁ পঁড়েঁ। অঁ দঁত্তঁমঁশাঁই, মাঁছখান খাঁইতেঁ দিঁয়াঁ যাঁন।’

তখন দত্তমশাই কী করেন, কিছুই না, আরও শক্ত হাতে মাছখানি ধরে জোরে জোরে হাঁটেন। না তাকান ডাইনে, না বাঁয়ে, না পিছনে। তাঁর নজর সামনের দিকে, যে পথে যেতে হবে। এদিকে সেই এক কথা জল থেকে বারে বারে ডেকে বলে। আর অন্ধকারের মধ্যে সেই হাড়ের হাতখানি, সোনারুপোর চুড়ি যে হাতে ঠকঠকিয়ে বাজে।

তারপর খালপারের রাস্তা শেষ হয়ে যখন ডাইনে মোড় নিয়ে গ্রামের দিকে চলেন, তখন শুনতে পান, খালের জলে যেন হাতি দাপাতে থাকে। মনে হয়, এই বুঝি একটা প্রকাণ্ড দৈত্য জল থেকে ঝাঁপিয়ে এসে পড়ে। অথচ কিছুই পড়ে না। গোরাই দও বেশ খানিকটা চলে যাবার পর হঠাৎ সব শব্দ থেমে যায়। আর মেয়েমানুষের সরু চড়া নাকি গলা শোনা যায়, ‘আঁইচ্ছা, আঁইজ তঁর ডাঁইনেঁর দিঁন, তাঁই বাঁইচা গেঁলি, আঁর এঁকদিঁন তাঁর ঘাঁড় মঁটকাঁমু।’

কাদিশালের খালের ধারে পশ্চিমপাড়ার গোরাই দত্তের এই বিস্ময়কর কাহিনী শুনিয়ে ইন্দির জানতে চায়, শহরের পোলা কি বলতে পারে, কে গোরাই দত্তর পিছু নিয়েছিল? শহরের ছেলেটি তখন সকাল বেলার শীতের রোদে ইন্দিরের মোটা বড় হাতটি কষে ধরে আছে। জানাল, না, সে জানে না।

ইন্দির জানাল, ‘ওইটা হল মাউচ্ছা পেত্নী।’

অর্থাৎ মেছো পেত্নী। তার পরেই ইন্দিরের প্রশ্ন হল, ‘আইচ্ছা, কও তো, গোরাই দত্ত তখন মনে মনে কী কইছিল?’

ছেলেটি বলে, ‘জানি না।’

ইন্দির বলে, ‘ক্যান্‌, এইটা তো সবাই জানে।’

বলে ছড়া কাটে,

‘ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি,

রাম লক্ষ্মণ লগে আছে, করবি আমার কী।’

ইন্দিরের হাত ধরে-থাকা ছেলেটি ঠোঁট নেড়ে নেড়ে মুখস্থ করবার চেষ্টা করে। কিন্তু সে একবার ভেবে দেখেনি, তার ছুট খাওয়া অবাধ্যতা কখন পোষ মেনে গিয়েছে। ইন্দির কখন যে কেমন করে কী বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছে, সে টের পায়নি। বাঁশির গুণে ছেলে কখন মন্ত্রমুগ্ধ সাপের মতো ইন্দিরের সুরে আর তালে তালে চলে। সেদিন টের পাওয়া যায়নি। টের পাওয়া গিয়েছে পরে, চারগ্রামের ইন্দির এক মস্ত বড় শিল্পী।’

.

১৮.

ইন্দির নামে সেই শিল্পী যেন জাদুকর। সকালবেলায় শীতের রোদে যখন দিকদিগন্তের কলাই-মটরের ক্ষেত শিশিরে ঝিকিমিকি করে, ঝোপে ঝোপে বেত গাছের কালো সবুজের পাতা চিকচিক করে, বিশাল হিজল-জিয়লের ঝুপ্‌সিতে পাখিরা ডাকে, খেজুর গাছের চাঁছা কপালে কঞ্চির ঠিলির কাছে মৌমাছিরা গুনগুনায়, তখন ইন্দির তাকে তৈরি করে তোলে এক মস্ত ব্ৰহ্মদৈত্যের রাজ্য, প্রেতিনীর তেপান্তর, যত অশরীরী আত্মাদের ঘাড় মটকানো তাণ্ডবের প্রকাণ্ড কারখানা। ছেলেটি অনুভব করে, চারদিকে ভূত-পেত্‌নীতে গিজগিজ করছে। কেন না, ইন্দিরই তাকে জানিয়েছে, ‘অই যে দ্যাখ খুঁটায় বান্দা গরুটা ঘাস খাইতে আছে, অইটাই হয়তো পেত্নী। যেই তুমি কাছে যাইবা, দ্যাখ্‌বা, গরু-টরু কিছু নাই, ভুঁইয়াগো বাড়ির এক সোন্দর বউ খাড়াইয়া রইছে।’

শহরের ছেলেটি ইন্দিরের লম্বা লম্বা শক্ত হাত আরও জোরে কষে ধরে। আর বুক ধুকুধুকু আশা ও কৌতূহলে খুঁটোয় বাঁধা গরুটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, এই বুঝি গরুটা সত্যি সত্যি ভূঁইয়াদের বাড়ির সুন্দর বউ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তার কোনও লক্ষণ দেখা যায় না। রোদে পিঠ দিয়ে, ল্যাজ নেড়ে মাছি তাড়িয়ে তাড়িয়ে সে যেমন ঘাস খাচ্ছিল, তেমনি খেতে থাকে। তবু সে জিজ্ঞেস করে যায়, ‘তারপর?’

‘তারপর?’… তারপর যত তুমি কাছে যাইবা, দ্যাখবা, সোন্দর বউটা কান্দে। কান্দে, আর কান্দে। দেইখ্যা তোমার মন গইলা যাইব। তুমি গিয়া কইবা, “কোন বাড়ির বউ তুমি, কোন গেরামে বাড়ি, তুমি কান্দো ক্যান?” তখন সেই বউ কইব, অমুক গেরামে বাড়ি তার, অমুক বাড়ির বউ। ডাকাইতে তারে চুরি করছে, এইখানে ফালাইয়া গেছে। অখন তারে পৌঁছাইয়া দিতে হইব।’

‘তারপর?’

তারপর… তারপর… তারপর? এই ‘তারপরের’ আর শেষ নেই। জাদুকরের গল্পও আর তাই ফুরোয় না। ইন্দির জানায়, যে মানুষ সে বউকে দেখে ভুলবে, তারই মরণ। কারণ আসলে তো সে বউ না, সে পেত্‌নী। সে পথ ভুলিয়ে নিয়ে যাবে কোন শ্যাওড়ার জঙ্গলে, নিশিন্দার বনে, বেতের ঝোপে, হিজলের জটায়। তারপর ঘাড় মটকে রক্ত শুষে খেয়ে ফেলবে। তবুও ‘তারপরে’ থাকে। আর জাদুকরের বাঁশি ভিন্ন ভিন্ন সুরে বাজতে থাকে। যে সুরে কাল-মহাকাল সবই হারিয়ে যায়, তাল মান তো কোন ছার।

ছেলেটি যে শুধু শোনে, তা নয়। ইন্দিরের মুখের দিকেও হাঁ করে দেখে। হতে পারে, ইন্দিরের সবে তখন গোঁফ উঠেছে। তবু সেই ইন্দির যেন ছেলেটির চোখে তখন হাজার বছরের সবকিছু দেখা-শোনা-জানা এক আদ্যিকালের লোক। যদিও ইন্দিরের ঘাড়-কামানো লম্বা লম্বা কালো চুল, বড় বড় চোখ দেখেও সে মুগ্ধ। ইন্দির আর তার কাছে ইহজগতের লোক থাকে না। সে যেন অন্য এক জগতের আগন্তুক। অন্য জগতের কথা শুনিয়ে নিয়ে যায়।

চুম্বক যেমন লোহা টানে, তেমনি করে ছেলেটিকে নিয়ে ইন্দির পৌঁছে যায় ব্রজেরহাটে। সে জায়গার নাম কেন ব্রজেরহাট, ছেলেটি তার খবর জানত না। আজও জানে না। ব্রজের হাট নয়, বেজেরহাট। দূরে দূরান্তে গ্রাম, চারদিকে মাঠ। মাঠের মাঝখানে হঠাৎ গুটিকয় বড় বড় বট আর হিজল গাছ। তাকে ঘিরে অনেকগুলো ঘর। ছেঁচা বাঁশের বেড়া, টিনের চাল। হাটের দিনে এত লোক, যেন ঠাঁই নেই কোথাও।

ইন্দিরের সঙ্গে গোটা হাটে চক্র দেবার পর গৃহকর্ত্রীর হুকুম অনুযায়ী ছেলেটিকে গিয়ে বসতে হয় কুতুদাসের চালের গদিতে। স্বয়ং কুতুদাস নিচু চৌকির ওপরে শীতলপাটির ওপর বসে। কাছে তার কাঠের বাক্স। সামনে লম্বা খতিয়ান, খতিয়ে লেখা হিসাবের অজস্র অঙ্কে ভরা। আর চুন-সুরকির মতো ভূর করা চাল। ওজন-দাঁড়িতে চাল মাপা আর বিক্রি চলছে। রামে রাম, রামে দুই, রামে তিন। যতই হোক, রাম ছাড়া কথা নেই। ইন্দির দাস মশাইকে দণ্ডবৎ করে জানিয়ে যায়, ভুঁইয়াদের নাতি রইল, ঠাকরুন বলে দিয়েছেন। সে বাজার করে আবার সঙ্গে করে নিয়ে যাবে।

দাস মশাইয়ের টাকে যত ঝলক দাঁতেও তেমনি ঝলক। গদির ওপর জায়গা নির্দেশ করে ভুঁইয়াদের নাতিকে বলেন, ‘বইয়ো, বইয়ো বাসী। কী খাইবা কও… অ্যাঁ, হ’কও, বরিশাইল্যা চিকন বালাম, এক নম্বইরা দুই মণ সাঁইতিরিশ সের…।’

এক কথা বলতে গিয়ে, অন্য দিকেও তাল সামলান। হিসাব লেখেন, টাকা গোনেন, আবার ভূঁইয়াদের নাতিকে আপ্যায়নও করেন। তার সঙ্গে নানান বাতপুছ—শহর, ইস্কুল, পড়াশুনো…। তার মধ্যেই, কে যেন ঠোঙায় করে এনে দেয় জিলিপি আর জিভেগজা। ছেলেটির লজ্জা করে, সঙ্কোচ হয়, জানায়, তার খিদে পায়নি। কুতুদাস ভুঁড়ি কাঁপিয়ে হেসে বলেন, ‘খাইতে খাইতে খিদা লাগবো, খাইয়া দ্যাখ কেমুন বেজেরহাটির জিলাপি।’

বলতে বলতেই আবার অন্যমনস্ক, হিসাব লেখা আর টাকা গোনা চলে। আর ছেলেটি দেখে, খেতে খেতে সত্যি খিদে পায়। খেতে খেতে ঠোঙাও শূন্য হয়ে যায়। গদির এক কর্মচারী তাড়াতাড়ি কাঁসার গেলাসে জল দেয়। ছেলেটি জল খেতে খেতে সিরাজদিঘার কথা শোনে। দোকানে ক্রেতাদের ভিড়ে দু’জন বলাবলি করে, তারা এখান থেকে বেরিয়ে সিরাজদিঘা যাবে। সিরাজদিঘা! ধলেশ্বরী নদীর ধারে মস্ত এক গঞ্জ, নাম তার সিরাজদিঘা। ছেলেটি সিরাজদিঘার লঞ্চঘাট দেখেছে, আর দূর থেকে দেখেছে সেই গঞ্জ, যার কোনও শেষ নেই। ঘরের শেষ নেই, নৌকার শেষ নেই, মানুষের শেষ নেই। আর ধলেশ্বরী, তার যেন পার নেই, কূল নেই। তার অনেক দিনের সাধ, একদিন সে সিরাজদিঘায় যাবে।

লোক দুটোর কথা শুনে ছেলেটির বুকের রক্ত চলকে ওঠে। মনেতে ঝড় ওঠে, যেন তাকে ঠেলে নিয়ে যেতে চায়। প্রাণে প্রাণে বলে, ‘আমি সিরাজদিঘায় যাবো।’… তারপরে সে আরও শোনে, লোক দু’টি বলাবলি করে, বিকেল হতে না হতে আবার তারা ব্রজেরহাটে ফিরবে। তৎক্ষণাৎ ছেলেটি উঠে দাঁড়ায়। কুতুদাসের কালো মুখে সাদা দাঁতের ঝিলিক হানে। জিজ্ঞেস করেন, ‘কই যাও গো বাসী?’

ধরা পড়ার ভয়ে ছেলেটির বুক ধড়াসে যায়। মুখ দিয়ে রা সরে না। কেবল ঘাড় নেড়ে জানায়, সে কোথাও যায় না। কুতুদাসের মনে ভেজাল নেই। কী ভেবে যেন সে হেসে বলে, ‘বাজার দেখতে ইচ্ছে করে? বাজারের ভিতরে গেলে তো তুমি হারাইয়া যাইবা। বারিন্দায় গিয়া বইসা দেখ।’

বারিন্দায় অর্থাৎ গদিঘরের বাইরে দাওয়ায় বসে দেখতে বলেন। দাসের মনে কোনও অবিশ্বাস নেই, সন্দেহ নেই। আহা, এমন মানুষকে ঠকায় ছেলেটা।

ছেলেটা কি ঠকায়। ধলেশ্বরীর স্রোত যে তাকে টেনে নিয়ে যায়। সিরাজদিঘার তুফান যে তার প্রাণে। সেই তুফানে উড়িয়ে নিয়ে যায়। সে গিয়ে বাইরের দাওয়ায় দাঁড়ায়। সবাই কাজে ব্যস্ত, ছেলেটির দিকে কেউ তেমন নজর করে না। ছেলেটি ভাবে, লোক দুটো বেরিয়ে আসবে কখন।

ভাবতে হয় না, লোক দুটো বেরিয়ে আসে তখনই। সিরাজদিঘার পথ জানা নেই। দাওয়া থেকে নেমে ছেলেটি তাদের পিছু পিছু যায়। …ওরে ভোলা, আত্মহারা, ধলেশ্বরীর নিশিপাওয়া, সিরাজদিঘার হাতছানি দেখা, বুড়ি দিদিমার কথা কি তোর মনে নেই? আহা, ভুঁইয়াদের নাতি হারিয়ে ইন্দির যে চারগ্রামে গিয়ে আর মুখ দেখাতে পারবে না, সে কথা কি তোর মনে নেই? সে যে ব্রজেরহাটের মাটিতে মাথা কুটে দাপাবে, তা কি একটু ভাবিস না! এই অচেনা গ্রামের রাজ্যে, বিদেশের ছেলে তুই, আত্মীয়রা যে বুক চাপড়ে মরবে।

না, সে খেয়াল আর তখন ছেলেটির নেই।

সে খেয়াল না থাকুক, গোরাই দত্তর কথা কি তার মনে নেই? তার কি মনে নেই, পথের ধারে খুঁটোয় বাঁধা গরুটাও ছদ্মবেশী পেত্‌নী হতে পারে? এই তামাম দেশ জুড়ে যে ঘাড় মটকাবার জন্যে কারা অদেখায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, সে কথা কি সে ভুলে গিয়েছে?

ভুলে গিয়েছে। অশরীরী আত্মাদের থেকেও ধলেশ্বরী সিরাজদিঘার মায়াডাক যে আরও তীব্র। তাকে সব ভুলিয়ে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু ওরে অস্নাত, অভুক্ত, সিরাজদিঘার পথ কত দূর, তাও তোর জানা নেই। কোন সাহসে যাস্‌।

যে টানে ভেসে যায়, তার ভয়-ডর থাকে না। ছেলেটি তখন ব্রজেরহাট ছাড়িয়ে অনেক দূর। গ্রাম্য লোক দুটো ফিরেও চায় না, কে একটা ছেলে আসে তাদের পিছু পিছু। তারা এক হাটে সওদা করে, আর এক হাটে বেচে দেয়। তারা বেচাকেনার কথায় মশগুল হয়ে চলে। ছেলেটি ধরা পড়ার ভয়ে তাদের কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারে না। কেবল পিছু পিছু চলে, আর চোখ তুলে ব্যগ্র হয়ে দেখে, কোথায় ধলেশ্বরী, কোথায় সিরাজদিঘা।…

কতক্ষণ চলে ছেলেটি, তার হিসাব করতে পারে না। সূর্য যখন মাথার ওপরে, তখন সে দেখতে পায়, ধলেশ্বরী রুপোর মতো ধারায় বহে যায়। ধলেশ্বরী, ধলেশ্বরী! হুই ওপারে দেখা যায় এক কালো রেখা। একটুখানি বাঁক নিয়ে, কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। কেবল ধলেশ্বরী ঢেউয়ে ঢেউয়ে চলকায়। রোদে ঝলক দেয়। এত ঝলক দেয়, মাঝ নদীতে চোখ রাখাই দায়। নদীতে কত ডিঙ্গা, কত নৌকা যায়। দেখতে দেখতে ব্ৰজেরহাটের লোক দুটো কখন হারিয়ে যায়, তার খেয়াল থাকে না। সে সিরাজদিঘার বন্দরের দিকে চায়। কত ঘর, কত বাড়ি, তার শেষ নেই। উঁচু পাড় ধরে সেই যেন দূরের আকাশে গিয়ে ঠেকেছে। কত নৌকো মাল তোলে, কত নৌকো খালাস করে, তার যেন লেখাজোখা নেই। এখানে,আবার আকাশের গায়ে এখানে-ওখানে চোঙা, তাতে ধোঁয়া ওড়ে। মানুষের পায়ে ওড়ে ধুলা। হাট নয়, গঞ্জ নয়, ছেলেটির মনে পড়ে, এ সিরাজদিঘার বন্দর। বন্দরের মধ্যে ঢুকে পড়ে সে। এত দোকান, এত পসার কেবল যে বেচাকেনাই হয়, তা নয়। কত কি তৈরি হয়। বিস্কুট রুটি বাতাসা মিষ্টি, পাটি মাদুর হোগলা, যা বলবে।

ছেলেটি এক দিক দিয়ে যায়, আর এক দিক হারায়। হারিয়ে আবার আর একদিকে যায়। না মেটে কৌতূহল, না সাধ। ঘুরতে ঘুরতে আবার আসে ধলেশ্বরীর ধারে। শোনে, সেখানে খেয়াঘাটের মাঝি হাঁকে, ‘নাও যায় লতব্‌দীর চর, যাওনের লোক আছেন!’

লতব্‌দীর চর। ছেলেটির মনে পড়ে যায়। লতব্‌দী গ্রামে পিসিমার বাড়ি। তাড়াতাড়ি জামার পকেটে হাত দিয়ে দেখে, দেড়খানি পয়সা, পঞ্চম জর্জের ছাপ মারা। চেয়ে দেখে, যাত্রীরা অনেকেই ছইবিহীন খেয়া নৌকায় জায়গা নিয়েছে। সে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘পার করতে কয় পয়সা।’

মাঝি একবার চেয়ে দেখে। বলে, ‘পোলাপানের আধ পয়সা।’

ছেলেমানুষের আধ পয়সা, বড় মানুষের এক পয়সা। ছেলেটি আর কিছু ভাবে না। নৌকায় গিয়ে উঠে বসে। কেবল নাম শুনেছে, সিরাজদিঘার ওপারে লতব্‌দীর চরগ্রাম, সেই গ্রামে পিসিমার বাড়ি। চোখের সামনে ভাসে শুধু পিসিমার ঝাপসা মুখখানি। ফরসা মুখ, ঝক্‌ঝকে চোখ, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা। কিন্তু মুখখানি বড় গম্ভীর। মাঝি নৌকা ভাসিয়ে দেয়।

কেন, এ ছেলে কি নোঙর ছেঁড়া নৌকা? কে তাকে টেনে নিয়ে যায়, কীসের টানে? পিছনে যারা রয়ে গিয়েছে, তাদের কথা কি তার একবারও মনে পড়ে না। সে যে এমন করে অচিন দেশে হারিয়ে যায়, তার কি একটুও বুক কাঁপে না।

কাঁপে। যখন ঢল খেয়ে যায় রোদ, তবুও লতব্‌দীর কালো রেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে না, ধলেশ্বরীর পাড়ি শেষ হয় না, আর ক্ষুধা তার স্বভাববশে হাঁক দিয়ে ওঠে, তখন বুক কেঁপে যায়। যদি অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, তবে সে পিসিমার বাড়ি খুঁজে পাবে কেমন করে। এ পাড়ি শেষ হবে কখন।

যাত্রীরা যারা বেচাকেনা সেরে ফেরে, তারা নিজেদের মধ্যে নানান কথা বলাবলি করে। ছেলেটির দিকে কেউ ফিরে চায় না, জিজ্ঞেস করে না কিছু। তারা কেমন করে জানবে, এ ছেলে অকূলে ভাসছে। কেউ-ই জানে না, এতক্ষণে ব্রজেরহাটে কী ধুম লেগে গিয়েছে।

সূর্য যখন পশ্চিমের কোলে গিয়ে ঠেকে, তখন খেয়া নৌকা নোঙর করে লতব্‌দীর চরে। ছেলেটি চেয়ে দেখে, ধারেকাছে কোনও গ্রাম নেই। সামনে ধু-ধু মাঠ, মাঠের ওপারে গ্রাম, তখন ছেলেটির চোখে ভয় আর হতাশা। চোখে ভাসে জল। কোথায় পিসিমার বাড়ি, সে জানে না। যাত্রীদের এবার নজর পড়ে তার ওপর। একজন জিজ্ঞেস করে, সে কোথায় যাবে, কাদের বাড়ি। ছেলেটি তার পিসেমশায়ের নাম করে।

লোকটি হাত ধরে বলে, ‘কান্দ ক্যান্‌, চলো আমার লগে। মহারাজের কাছে দিয়া আসি তোমারে।’

ছেলেটি ভয় পেয়ে বলে, সে মহারাজের কাছে যেতে চায় না। সে পিসেমশায়ের কাছে যেতে চায়। তার কথা শুনে হাট থেকে ফেরা যাত্রীরা হাসাহাসি করে। যে-জন নিয়ে যাবে বলে, সে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার পিসেমশায়রে চিন না?’

ছেলেটিকে স্বীকার করতে হয়, সে পিসিমাকে দু-একবার দেখেছে, কিন্তু পিসেমশায়কে না। তখন সবাই আরও হাসাহাসি করে। লোকটি বলে, ‘আইচ্ছা চলো, তোমার পিসার কাছে লইয়া যাই।’

ছেলেটির হাত ধরে লোকটি হাঁটা দেয়। দু’পাশে রবিশস্য, মাঝে মাঝে কুমড়োর হলুদ ফুলে ভরা কাঠা কাঠা জমি। তার মাঝখান দিয়ে সরু পথ। সূর্য যখন ডুবুডুবু, তার ছটায় যখন সারা আকাশ লাল, তখন ছেলেটি এসে পৌঁছয় গ্রামের এক প্রান্তে। বড় এক বটের জটায় ঝাড়ে অজস্র পাখি ডাকাডাকি করে। তার পাশেই আগল খোলা এক গোবর নিকানো উঠোন। উঠোনের তিন দিকে তিন ঘর। ঘরের ধারে ধারে অজস্র গাঁদা ফুল। সামনের ঘরটির দরজার দু’পাশে মাধবীলতা। লতা দিয়ে মাথার ওপরে গোল করে তোরণের মতো করা হয়েছে। তাতে মাধবী ফুল ফুটে আছে। সেই ঘরের মাথার ওপরে টিনের চালে একটি নিশান উড়ছে। সবই যেন নিশ্চুপ, শান্ত, গম্ভীর। কী এক গভীরতা যেন সেখানে বিরাজ করছিল। খোলা আগলের সামনে দু’টি বাঁশের মাঝখানে, টিনের ওপরে পরিচ্ছন্ন করে লেখা রয়েছে, ‘রামকৃষ্ণ আশ্রম।’

অভুক্ত অস্নাত ছেলেটির ধুলা-মুখে চোখের জলের দাগ আঁকা। সে টিনের ওপর লেখা পড়ে, লোকটির দিকে অবাক হয়ে চায়। লোকটি তখন তার ফিতে বাঁধা, তালি মারা জুতো জোড়া খুলতে খুলতে বলে, ‘চলো, ভিতরে যাই।’ কেন? ছেলেটি ভাবে, সে তো কোনও আশ্রমে আশ্রয় চায়নি। লোকটা কি তাকে আশ্রমে দিয়ে যেতে চায় নাকি।

লোকটিই ছেলেটির হাত ধরে উঠোনে ঢোকে। ঢুকতে ঢুকতে ডাকে, ‘সাধু মহারাজ আছেন নাকি?’

ডাকতে ডাকতেই পাশের ঘর থেকে একজন বেরিয়ে এলেন। শ্যামলা রং, শান্ত গভীর দু’টি চোখ। বয়স পঞ্চাশ হবে। মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি। মাথার কাঁচা-পাকা চুল বড় বড়, ঘাড়ের কাছে যেন জট পাকিয়ে গিয়েছে। পরনে গেরুয়া, গায়ে গেরুয়া কাপড়, গায়ে একটু মেদ নেই। দীর্ঘ শরীর, হাত দুটি যেন একটু বেশি লম্বা। বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। একবার লোকটির দিকে, আর একবার ছেলেটির দিকে। কোনও কথা না বলে আরও কাছে এলেন।

লোকটি নিচু হয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করে। বলে, ‘এই পোলা আপনার নাম কয়— কয় যে, আপনি নাকি তার পিসামশায়।’

ছেলেটি মনে মনে মাথা নাড়ে। ভাবে, একজন সাধু তার পিসেমশায় হতে পারেন না। কিন্তু গেরুয়াধারী যেন অবাক হন। আরও কাছে এসে ছেলেটিকে তার নাম জিজ্ঞেস করেন। ছেলেটি নাম বলে। কিন্তু তার চোখে তখন আবার জল এসে পড়ে।

সাধু তখন ছেলেটির বাবার নাম জিজ্ঞেস করেন। বাবার নাম শুনেই বাড়ি কোথায় জানতে চান। জবাবের আগেই ছেলেটির হাত ধরে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কার সঙ্গে আইলা তুমি, কোইথেইকা আইলা?’

ছেলেটি তখন চারগ্রামের নাম বলে। সাধু বলে ওঠেন, ‘হ হ, সে তো তোমার মামার বাড়ির গ্রাম।’

তারপরেই তিনি ছেলেটির আপাদমস্তক দেখে ঘরে ডেকে নিয়ে যান। লোকটিকে বলেন, ‘এই পোলা এইখানে কেমনে আইল জানি না। তবে আমার কাছে দিয়া খুবই ভাল কাজ করলেন। ভগবান আপনারে সুখী করবেন।’

লোকটি নমস্কার করে চলে যায়। সাধু ছেলেটিকে ঘরে নিয়ে আবার তার মুখের দিকে তাকান। তারপরে মুখ ফিরিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরের এক পাশ থেকে একটি পেতলের রেকাবিতে কয়েকটি নারকেলের নাড় আর দুটি লাড্ডু খেতে দেন। নিজের হাতে গেলাসে জল গড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘এইবার খাইতে খাইতে কও তো বাবা, লতব্‌দীতে কেমনে আইছ?’

উদ্বেগে তখন ছেলেটির গলায় খাবার যেতে চায় না। তবু খাবার পেয়ে জিভে জল এসে পড়ে। সেই সঙ্গে চোখেও। একটু একটু খায়। আর ব্রজেরহাট থেকে কেমন করে চলে এসেছে, সেই বার্তা চলে। যদিও বার্তা বলতে তার ঠেক খেতে হয় বারে বারে। লজ্জা করে, সঙ্কোচ হয়। তবু সিরাজদিঘার বন্দর আর ধলেশ্বরী নদী দেখার কথা না বলে পারে না।

সাধু শোনেন, আর একটু একটু ঘাড় নাড়েন। ছেলেটির মনে হয়, তাঁর বড় বড় চোখ দু’টিতে যেন হাসি। দাড়ির জটায়ও যেন হাসি চিকচিক করে। ছেলেটির যে চোখে জল, গলা ডুবে যায় কান্নায়, তা যেন দেখেন না, শোনেন না। খালি একবার বলেন, ‘খাইয়া লও।’

ছেলেটির উদ্বেগে মন অস্থির, কিন্তু খাবার শেষ হয়ে যায় নিমেষেই। ঢকঢক করে জল খায়। এক তৃষ্ণা, কষ বেয়ে জল পড়ে যায়। ছেলেটি হাতের চেটোয় তা মুছে নেয়। কিন্তু চোখের জল সমান ধারায় বহে। চোখ তার লাল হয়ে ওঠে।

সাধু শুধু শোনেন, একটি কথা জিজ্ঞেস করেন না। চুপচাপ খানিকক্ষণ ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। থাকতে থাকতে তাঁর চোখ দু’টি যেন আরও ঝলক দিয়ে ওঠে। হাসিতে তাঁর দাঁত দেখা যায়। তেমনি ভাবেই হঠাৎ উঠে দাঁড়ান। একটা কুলুঙ্গির কাছে গিয়ে দেশলাই জ্বেলে প্রদীপ ধরান। মাথা নামিয়ে ছোট একটি নমস্কার করেন। তারপরে ছেলেটির সামনে এসে গায়ের গেরুয়া কাপড়ের টুকরো দিয়ে তার চোখের জল মুছিয়ে দেন। চিবুক ধরে বলেন, ‘চলো, তোমারে দিয়া আসি তোমার আত্মীয়ের কাছে।’

ছেলেটির হাত ধরে বাইরে এসে ঘরের শিকল তুলে দেন। একবার মাধবীলতায় ঘেরা সামনের ঘরটির দিকে তাকান। তারপরে আগল ঠেলে গ্রামের পথে এগিয়ে যান।

ইতিমধ্যে অন্ত্যচ্ছটায় সারা আকাশের রক্তিমায় কালির ছোপ লেগেছে। ঈষৎ রক্তাভ পশ্চিমের আকাশের গাছের আড়ালে-আবডালে চোখে পড়ে। সন্ধ্যা নেমেছে। পাখিদের ডাকাডাকি শেষ হয়েছে। চারদিকেই একটা স্তব্ধতা। কেবল ঝিঁঝির ডাক শোনা যায়। তার মধ্যেই দু’একটা পাখির চকিত ডাক যেন ভীরু জিজ্ঞাসার মতো বেজে ওঠে।

সাধু এঁকেবেঁকে গ্রামের নানান পথ ধরে প্রায় আর এক প্রান্তে আসেন। এসে একবার দাঁড়ান একটি বড় পাকা কোঠার সামনে। বড় কোঠা একতলা। উঁচু বারান্দা, কয়েক ধাপ লম্বা সিঁড়ি। সেইখানে সাধু একবার কপালে হাত ঠেকান। তারপর সেই কোঠার শেষে টিনের চাল দেওয়া কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো টিনের বেড়া এক ঘরের সামনেই দাঁড়ান। ঘরের দরজা এদিকে নয়। সামনেই একটা উঠোন দেখা যায়। উঠোনে তুলসী মঞ্চে প্রদীপ জ্বলছে। একটু আগেই সন্ধ্যা দেখানো হয়েছে। উঠোনের এক পাশে একটা লাউমাচা দেখা যায়। সাধু আর অগ্রসর না হয়ে সেখানেই দাঁড়ান। ডাক দেন, ‘সুরবালা! সুরবালা!’…

ছেলেটির মনে পড়ে যায়, এই তার পিসিমার নাম। বাবার মুখে সে অনেকবার শুনেছে। কোনও সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। কিন্তু একটু পরেই পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। আলোর রেশ চোখে পড়ে। হ্যারিকেন হাতে কপাল অবধি ঘোমটা ঢাকা এক বউ দাঁড়ায়। বউটির কপালে সিঁদুর, সিঁথেয় সিঁদুরের রক্তাভা, পরনে লালপাড় শাড়ি, হাতে শাঁখা ও নোয়া। ফরসা রং, ঝকঝকে চোখ। ছেলেটির বুকের ভিতর নিঃশব্দে বেজে ওঠে, ‘পিসিমা, পিসিমা!’…

কিন্তু এ পিসিমা যেন সেরকম নন, যেমন তাঁকে অন্য সময় দেখা গিয়েছিল। এ মুখ যেন অন্যরকম। গম্ভীর নয়, অথচ গম্ভীর। সন্ধ্যাবেলার মতোই ছায়া-ছায়া, নিশ্চুপ, স্তব্ধ। তিনি এসে একবারও ছেলেটির দিকে তাকান না। সাধুর দিকে চোখ তুলে দেখেন।

সাধু বলেন, ‘এই তোমার দাদার পোলা, একজন দিয়া গেল, চারগ্রাম থেইকা আইছে। এর মুখেই সব শোনবা।’

পিসিমা যেন চকিত হয়ে ছেলেটির দিকে তাকান। তার নাম ধরে ডেকে ওঠেন, ‘এ কি, তুই?’

ছেলেটির চোখেও তখন আবার জল এসে পড়েছে। সে সাধুর হাত ছাড়িয়ে ছুটে গিয়ে পিসিমাকে জড়িয়ে ধরে। পিসিমা তাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে সাধুর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী ব্যাপার, কিছুই তো বুঝি না?’

গলায় তাঁর উদ্বেগ। সাধু কিন্তু হাসেন। বলেন, ‘পোলাপানের মন, স্বপ্নের মধ্যে ডাক শুইনা দৌড় দেয়। সব কথাই ওর মুখে শোনবা। আইজ রাত্রে আর হইব না, কাইল সকালেই আমি তোক পাঠাইয়া চারগ্রামে খবর দিয়া দিমু।’

বলেও তিনি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। পিসিমাও নীরব। ছেলেটি পিসিমার কোলের কাছে থেকে মুখ ফিরিয়ে একবার সাধুর দিকে দেখে। দেখে, সাধু তাকিয়ে আছেন পিসিমার দিকে। তাঁর চোখে যেন সেইরকম একটু হাসি। হ্যারিকেনের আলোয় তাঁর চোখের মণি দুটো আকাশের তারার মতো দেখায়। পিসিমা মাথা নামিয়ে মাটির দিকে চেয়েছিলেন। সাধু বললেন, ‘সুরবালা, আমি তা হইলে যাই?’

পিসিমা কোনও কথা বলেন না। হাত থেকে হ্যারিকেনটা নামিয়ে রাখেন। ছেলেটিকে হাত ধরে কোলের কাছে সরিয়ে আঁচল টেনে গলবস্ত্র হন। সাধু বলে ওঠেন, ‘না, তোমারে তো কতদিন কইছি, এইরকম কইরো না। আমি যাই।’

তারপরেই প্রসঙ্গ বদলান। জিজ্ঞেস করেন, ‘পোলা-মাইয়ারা সব ভাল আছে তো?’

পিসিমা বলেন, ‘আছে।’

শুধু এই একটি কথা। তারপরে মাটিতে জানু পেতে কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করেন। কিন্তু সাধু তখন পিছন ফিরে চলতে আরম্ভ করেছেন। পিসিমা মাথা তুলে দেখেন না। সেই অবস্থাতেই কিছুক্ষণ থাকেন।

ইতিমধ্যেই ছেলেটির লক্ষ পড়ে, ঘরের কোণে তিনটি ছায়া এসে দাঁড়িয়েছে। একটি বছর তেরোর মেয়ে। বেড়া-বেনুনি বাঁধা, একটা শাড়ি জড়ানো তার রোগা গায়ে। তার চেয়ে ছোট একটি ছেলে। আর একজন মেয়েটির থেকে বড়। তারা সবাই ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি ফিস্‌ফিস্‌ করে ছেলেটির নাম ধরে ডেকে বলে, ‘তুই অমুক না?’

ছেলেটি তৎক্ষণাৎ তার পিসতুতো দাদা এবং ভাইবোনদের চিনতে পারে। সে তাদের দিকে এগিয়ে যায়। তারা সবাই তাকে জড়িয়ে ধরে। ছেলেটি প্রথমেই জিজ্ঞেস করে, ‘ওই সাধুটা কে?’

ছোট পিসতুতো ভাইটি বলে ওঠে, ‘আমাগো বাবা।’

ছেলেটি অবাক হয়ে ভাবে, কেন, তার পিসেমশাই সাধু কেন? তিনি কেন গ্রামের এক প্রান্তে আশ্রমে সাধু হয়ে থাকেন।… কিন্তু ছেলেটি তার সারা জীবনেও কখনও জানতে পারেনি, কেন তার পিসেমশাই সাধু হয়েছিলেন— সংসার ছেড়ে আশ্রমে বাস করতেন। সারা জীবনে সে পিসেমশাইকে দু-একবার দেখেছে। পিসিমাকে অনেকবার। পিসিমার শান্ত স্বল্পবাক উজ্জ্বল গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে তার চিরদিনই মনে হয়েছে, বিশ্বসংসারের সব কিছুকে হয়তো চেনা যায় না। দেখা যায় না, কিন্তু কী একটা সেই নামহীন ব্যাখ্যাহীন অনুভূতি দিয়ে শুধু এইটুকু সে বুঝেছে, লতব্‌দীর সেই দম্পতির মাঝখানে যে বিচ্ছিন্নতা, তার মধ্যে কোথাও যেন একটা সেতু আছে। যে সেতুতে, মনে হয়, চোখের জল এবং হাসি দুই-ই আছে, আর আছে এক অনাবিষ্কৃত রহস্যের সম্পর্ক।

এই ঘটনার সাত দিন পরে পিসিমার বাড়িতে একদিন ঠিক দুপুরে এল একদল লোক। যে দলের মধ্যে ছিল ছেলেটির বাবা মা দিদি মেজদা আর দিদিমা, সঙ্গে ইন্দির। তারা এল যেন একদল ক্রুদ্ধ ব্যাধের মতো। যে পাখিটা খাঁচায় বাঁধা পড়েছে তাকে ধরবার জন্যে। চোখে তাদের ব্যগ্র জিজ্ঞাসা, অথচ শিকার পাবার কঠিন উল্লাস। ছেলেটির এইরকমই মনে হয়েছিল। তাই সে তখন দৌড়ে গিয়ে পিসিমার খাটের তলায় অন্ধকার কোণে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কেবল মেজদার তীব্র গলা শোনা যায়, ‘ওই যে, খাটের তলায় গেছে।’….

.

১৯.

ছেলেটিকে খাটের তলা থেকে গাদাখানেক ঝুল-কালি-ধুলো মেখে শেষ পর্যন্ত বেরোতেই হয়েছিল। আর বেরিয়েই, সামনে সারবন্দি দাঁড়িয়ে বাবা, মা, দিদিমা, দিদি, মেজদা। তার সঙ্গে আর এক পাশে পিসিমা, তাঁর ছেলেমেয়েরা। ইন্দির নিশ্চয়ই বাইরের উঠোনে ছিল, কারণ ঘরে ঢোকবার অধিকার ওর ছিল না। ছেলেটি চোখ তুলে তাকায়নি। কেবল তার গাল দুটো আর পিঠটা সুড়সুড় করছিল। কখন শাস্তি নেমে আসবে।

কিন্তু তার বদলে প্রথমেই বাবার হুঙ্কার শোনা গিয়েছিল, ‘দেখ, গরু-চোরটাকে দেখ।’

গরু-চোর! ছেলেটি একবার চকিতে সকলের দিকে না তাকিয়ে পারে না। তার মধ্যেই সে দেখতে পায় পিসিমার গম্ভীর বিষণ্ণ মুখেও একটু হাসির ঝিলিক খেলে যায়। তিনি আঁচল চেপে দেন মুখে। তাঁর ছেলেমেয়েদের মুখও হাসি হাসি। এমনকী, মায়ের চোখে জল থাকা সত্ত্বেও ঠোঁটের কোণ দুটো টিপে ধরেন। যেন তাঁর হাসি পেয়ে যাচ্ছিল। তার চেয়ে অবাক, দিদির ঝলসানো চোখ পাকানো থাকলেও মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু শব্দ পাওয়া যায় না। শরীরটা কাঁপতে থাকে। কেবল মেজদার ডগলাস ফেয়ার-ব্যাংকস-এর ক্ষ্যাপাচণ্ডী মুখে হঠাৎ একটা অবাক জিজ্ঞাসা দেখা দেয়। সেও বাবার দিকে তাকায়। কারণ, ছোট ভাইয়ের জিজ্ঞাসাটা তার মনেও ঝলক দেয়, বাবার গরুচোর বলার অর্থ কী। ছেলেটি ভাবে, সে আবার গরু চুরি করল কবে। কখন, কাদের গরু। আর গরু চুরি করে সে করবেই বা কী। কিন্তু দশ বছরের ছেলেটি প্রতিবাদ করতে সাহস করে না। আবহাওয়া মোটেই সুবিধার নয়। এমনিতেই কী শাস্তি তার কপালে আছে, সে আন্দাজ করতে পারছিল না। তার ওপরে গরু চুরি করেনি, এ কথা বলতে গিয়ে বাবাকে ক্ষ্যাপাতে সাহস পায় না। তবে পিসিমা, সাধু পিসেমশাই, সবাই জানেন, গরু সে চুরি করেনি।

তারপর শুরু হয় জেরা। কিন্তু আশ্চর্য, বাবার দিক থেকে নয়। জেরা শুরু করে দিদি। বাকিরা সব শোনেন। কেবল মেজদারই হাত নিসপিস, একটা ‘ফাইট’ না ঝাড়তে পারলে ওর শান্তি হচ্ছিল না। তবে বড়দের সামনে সে স্বাধীনতা ওর ছিল না। কিন্তু জেরার জবাবে ছেলেটি যা বলছিল, তার কার্যকারণ মাথামুন্ডু কেউই বুঝতে পারছিল না। ‘কেন সে ওরকম করে চলে এসেছিল’ এর জবাবে ছেলেটির সেই এক কথা, ‘এমনি ইচ্ছা হয়েছিল। কেন, তা সে জানে না।’

মায়ের আর ধৈর্য থাকেনি৷ তিনি ঠাস্ করে এক চড় কষিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘জানবি কেমনে, তরে যে ভূতে ধরছিল।’

বলে আর একটি চপেটাঘাত, আর তার সঙ্গে শপথ, ‘তর ঘাড়ের থেইক্যা আমি ভূত ঝাড়াইয়া দিমু।’

আর একটি চপেটাঘাতের আগেই, পিসিমা মায়ের হাত ধরে ফেলেন। আর মা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলেন, ‘না ঠাকুরঝি, হুতাশে আইজ চার দিন আমার গলা দিয়া ভাত নামে নাই, চক্ষের পাতা বুজি নাই।’

পিসিমা মাকে প্রবোধ দিতে আরম্ভ করেন। দিদিমা ছেলেটির গায়ের ঝুল-কালি পরিষ্কার করেন, আবার তার মধ্যে দু-চার ঠোনাও লাগান। দাঁতহীন মাড়িতে মাড়ি ঘষে গালাগাল দেন, ‘শহইরা বান্দর!’

অর্থাৎ ‘শহুরে বাঁদর’। আবার থান কাপড়ের ঘোমটা খসে যায় বলে সেটাও তাড়াতাড়ি টেনে দেন। জামাই যে কাছেই দাঁড়িয়ে। আশ্চর্য এই, বাবা তখন একেবারেই নিস্পৃহ, জামা ছাড়তে ব্যস্ত হন। ওদিকে পিসিমা তাঁর কন্যাকে নির্দেশ দেন, মামার জন্য একটু তামাক সাজতে। তারপরেই এক হ্যাঁচকায় দিদি টেনে নিয়ে যায় ছেলেটিকে। উদ্দেশ্য নাকি, ছেলেটিকে স্নান করিয়ে পরিষ্কার করবে। যার অর্থ, আরও কয়েক প্ৰস্ত ঠোনা ও চুল টানা। মেদজা ওত পেতেই ছিল। কিন্তু সুযোগ পেতে পেতে সেই বিকেলে, দল বেঁধে খেলতে বেরিয়ে একখানি মোক্ষম ‘ফাইট’ না দিয়ে ও ছাড়েনি। অথচ, মা বাবা দিদিমা, সবাইকে পিসিমা বলেছিল, ‘যাউক, তবু ছ্যামড়াটা পলাইয়া আইছিল, তাই সকলের লগে একটু দেখা হইল।’… কেবল গরুচুরির অভিযোগটা আর ওঠেনি।

গাজির কথায় আমি সেই ছেলেটিকেই দেখতে পাই। যাকে আমি কোনওদিন ছাড়িয়ে যেতে পারিনি। সেই যে অবুঝ, অচিনের টানে কোথায় চলে যায় জানে না। যে ঘর পালিয়ে খেলতে যায়, খেলতে গিয়ে হারায় অকূলে। জানে না, কার টানে, কীসের সন্ধানে। কেবল অবাক লাগে গাজির কথা শুনে। চোখে ওর দুষ্টামি, ও গাজি না পাজি। কিন্তু ও কি অন্তর্যামীও ? ও কি আমার পিছু পিছু আসে সেই জন্মলগ্ন থেকেই? আর এই আঙ্‌রি-আঙুর মাহাতো বউটি; তার কাজলকালো হাসি চলকানো ডাগর চোখেও কি সেই ছেলেটিকে দেখতে পায়? যার চোখে সকলই খেলা, সকলই বিস্ময়। কেন, কে আমাকে এমন অবাক কাজল পরিয়েছে। যা দেখি, সবই বিচিত্র, সবই অসামান্য।

‘অ গাজি, তোমার বাবুর ভর হলো নাকি?’

কথার সঙ্গে হাসির ঝঙ্কার। পাশে তাকিয়ে দেখি, আঙ্‌রির মুখ। ধানকাটা মাঠের আল পথ পেরিয়ে কখন উঠে এসেছি বড় সড়কে। এখন আমার এক পাশে আঙ্‌রি, আর এক পাশে গাজি। মাহাতো চলে আগে আগে ব্যাগ ঝুলিয়ে। ন্যাজাটের আকাশের পশ্চিম কোণে রক্তাভায় কালি পড়তে আরম্ভ করেছে। যে দূরগামী পথকে অস্তচ্ছটায় সধবার সিঁথির মতো লাল, সেই নাক বরাবর পথকে এখন ছায়ামাখা ধূসর দেখি। বনচড়াইয়ের ঝাঁক চোখে পড়ে না আর। পাখিগুলোর ডাক থেমে এসেছে। আঙ্‌রির কথায় সংবিৎ ফিরে পাই। তার দিকে ফিরে চাই। সে চোখের এক কোণে চেয়ে কালো তারা সরিয়ে নিয়ে যায় অন্য কোণে। গাজি বলে, ‘ভয় তো বাবুর হয়িই আছে, চাচি। এ যে ঘোরের মানুষ।’

আঙ্‌রি কথা চালায় গাজির সঙ্গে, নজর চালে অন্য দিকে। ঘাড় বাঁকিয়ে একবার আমার দিকে দেখে বলে, ‘কেন, মানুষ তো কাঁচা, তার এত ভর ঘোর কীসের?

‘তা বললি কি হয়, চাচি। ভর যাঁনাদের হয়, তাঁদের কাঁচা-পাকা নাই।’

আঙ্‌রি ঘাড় দুলিয়ে বলে, ‘তা নয় বুঝলাম, কাঁচা-পাকা নাই। তোমার বাবুর হয় কেন?’

মাহাতো ঘাড় নেড়ে বলে ওঠে, ‘দ্যাও, এখন জব দ্যাও, হয় কেন, নইলি ছাড়ান নাই।’

গাজি হাসে, আমি হাসি। স্বামীর ঠাট্টায় আঙ্‌রি জিভ দেখিয়ে ভেংচি কাটে। ‘অ্যা হ্যা হ্যা, তোমাকে বলেছে ছাড়ান নাই। তুমি চুপ করো দিকিনি।’

মাহাতো মুখ ফেরায় না। চলতে চলতে সামনের দিকে মুখ রেখেই বলে, ‘অই দেখ, আমি তোর হয়েই তো বলি। কথার জব চাই না? এমনি এমনিই কথা নাকি?’

বুঝতে পারি। মাহাতো মশাইয়ের উলটো দিকে ফেরানো কালো প্রকাণ্ড মুখে বিটলে হাসি ঝলকায়। সাহস করে ফিরে তাকাতে পারে না। পাছে গিন্নির চোখে হাসি ধরা পড়ে যায়।

আঙ্‌রি বলে, ‘এমনি হোক অমনি হোক, তোমাকে কথা বলতে বলেছে কে?’

মাহাতোর সেই এক ভাব। মুখ ফেরাবার নাম নেই। ঘাড়ের কাছে মাংসের চাপে ঘাড় গর্দান প্রায় এক। যেন জাম্বুবান চলেছে। আওয়াজ আসে, ‘তা কেউ বলে নাই। তা অই কথা শুনলি কথা কইতি ইচ্ছা করে কি না, তাই। আচ্ছা চুপ করলাম।’

ভেবেছিলাম, আঙ্‌রি বুঝি আবার ঝামটে উঠবে। মাহাতোর কথার মধ্যে হাসি রহস্যের সুরটুকু তো ছিল। কিন্তু আঙ্‌রি নিশ্চুপে হাসে গাজির দিকে চেয়ে। আবার কর্তার দিকেও তাকায়। তাকিয়ে ইশারা দেয় গাজিকে। যেন বলতে চায়, ‘তোমার মাহাতো চাচাটি ভারী পাজি, খুব চিনি।’ তারপরে একবার নজর চালিয়ে দেখে নেয় আমাকে।

গাজি বলে, ‘বাবুকে তুমি নিজিই পুছ করো তয়, ভর ঘোর কেন হয়।’

কীসের ভর, কীসের ঘোর, তাই বুঝি না। কী মনে হয়, আঙ্‌রির, কী বলতে চায় সে। কী কথা বা বলাবলি করে তারা, কে জানে। দেখি আঙ্‌রি হাসে। হাসে আর দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে হাসি চাপে। আর ঘন ঘন দৃষ্টি চালে। তারপরেও হঠাৎ শুনি, ‘কই গো বাবু, বলো না কেন?’

এবার সরাসরি, সোজাসুজি। ঘাড় কাত করে কয়েক মুহূর্ত চোখে চোখ রেখে মুখোমুখি কথা। অবাক লাগে, চমক খাই। হেসে বলি, ‘কী বলব, তাই তো বুঝি না। কীসের ভর, কীসের ঘোর।’

আঙ্‌রির বিশ্বাস হয় না, ধন্দ লাগে। তাই অবিশ্বাসে ঘাড় বাঁকায়। ঝিলিক হানা চোখ দুটো কেমন করে যেন পাকায়। পান রাঙানো ঠোঁট ফুলিয়ে গাজিকে বলে, ‘শুনলে তো কথা। তোমার বাবু ঘোর ভর বোঝে না।’

গাজির ফাটা ঠোঁট হাসিতে এ গাল ও গাল ছড়িয়ে যায়। লাল দাঁত দেখিয়ে বলে, ‘বুইতি পারলেন না বাবু! চাচি জিগ্যেস করে, বাবু আমার এমন কাঁচা, তয় কেন দেওয়ানা হয়ি ঘোরেন।’

‘দেওয়ানা কোথায় দেখলে? আমি ঘুরতে বেরিয়েছি।’

গাজি তাড়াতাড়ি বলে, ‘তাই দেখি কি কথা বাবু। ভাব দেখি কথা হয়, কথা শুনি কথা হয়।’

আঙ্‌রিও তার সঙ্গে জোড়ে, ‘দেখে বিবাগী বিবাগী লাগে।’

গাজি আরও জোগান দেয়, ‘চোখ-মুখগুলোন তো আর রেখি আসতে পারেন নাই।’

আঙ্‌রি বলে, ‘যেন ঠাঁইনাড়া মানুষ, ঠাঁই কোথায় জানে না। কেন?’

এত কথা তো ভেবে দেখিনি। এমন জিজ্ঞাসাবাদের জবাবও তাই জানা নেই। কী এক টানে যেন চলি, যে টানের নাম জানা নেই। সেই চলার নির্দেশ কী, তার খবরও পাইনি। তবে দেওয়ানা নই, এইটুকু জানি। বিবাগী নই, তাও জানি৷ ঠাঁইনাড়া হয়ে ঠাঁই খুঁজে ফেরার মানুষও আমি নই। সংসারেতে দানা খুঁটে অন্ন পাই। জীবনযাপনের ভাবনা আমার পাকে পাকে জড়ানো। নিরাপত্তার চিন্তা আমাকে কখনও ছেড়ে যায় না। জগজ্জনের সকলের সঙ্গে আমি একাকার, সকলের সঙ্গে আমার পা পড়ে। দেওয়ানী বিবাগী আমি নই। তবু, সেই যে এক নাম-না-জানা টান, যার নাম হদিস কিছুই জানা নেই, তার ব্যাখ্যা করি, সে ভাষা আমার অজানা। অতএব, এদের কথার কী জবাব দেব, বুঝতে পারি না।

আঙ্‌রি তখনও বলে, ‘লোকে বলে, “জানাও মনে মনে জানা।” তা, তোমার তো দেখি, চোখ দু’খানি ঠিক আছে, মনের যেন ঠিক-ঠিকানা নাই। কেন, ঘর গিরস্তি বসত সঙ্গত নাই নাকি?’

বলে আঙ্‌রি একটু চোখ ঘুরিয়ে ভুরু নাচায়। আমি যেন দেখি, সব মিলিয়ে আঙ্‌রির শরীর ঘিরে অপরূপ এক নাচের ছন্দ। কিন্তু কথা বলবার আগেই ওদিক থেকে মাহাতোর আওয়াজ আসে, ‘হ্যাঁ জব দিতি হবে, জব চাই।’

শুনে আমার হাসি সামলানো দায় হলো। দেখি, মাহাতোর কাঁধের ব্যাগটা পর্যন্ত কাঁপে। হাসিতে সেও ফুলছে। এদিকে ভুরু কুঁচকে আঙ্‌রি চায় গাজির দিকে। গাজিও হাসি চাপতে পারে না। বলে, ‘চাচার যে কথা।’

আঙ্‌রি বলে, ‘অ, সবাই মিলে আমাকে ঠাট্টা করছ?’

মাহাতো এবার ফেরে। যদিও হাসিতে তার কালো মস্ত মুখখানি ঝকমকিয়ে রয়েছে। হাসি চাপতে চাপতে বলে, ‘কেন, মন্দ কী বলিছি। অ মশাই, জব দেন না।’

আঙ্‌রি অমনি ঝামটা দিয়ে ওঠে, ‘ফের তুমি কথা বলছ?’

মাহাতো তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে কয়েক পা এগিয়ে যায়। যেতে যেতে বলে, “আচ্ছা আচ্ছা, আমি আর কিছু বলব না।’

মাহাতোর মধ্যে যে এমন একটি দুষ্টু রসিক রগুড়ে আছে, এতক্ষণ বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম, বংশধরের ক্ষুধায় একটা লোক, দশে মিলে চলে। আসলে কোথায় যেন একটা ক্লান্তিতে সে নত, বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন। কিন্তু সে যে এমন রসের ধারায় টগবগানো, ধরতে পারিনি। আঙ্‌রির সামনে গলা খুলে হাসতে পারি না। নিঃশব্দে ফুলে ফুলে উঠি। গাজির অবস্থাও সেই প্রকার। হাসি চাপতে গিয়ে সে দাড়ি ঝাড়া দিয়ে ডাক দিয়ে ওঠে, ‘জয় মুরশেদ!’

আঙ্‌রি যেন রেগে বলে, ‘দু’চোখে দেখতে পারি না।’

অথচ দেখতে না পেরেও ব্যাগ কাঁধে, কোমরে চাদর বাঁধা, আগে আগে চলা, ঘাড়ে গর্দানে মাংসল কালো লোকটার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকে। তারপরে আমার দিকে ফিরে ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ছিটিয়ে দেয়। কপট রাগ, বিষ নেই, এই কথাটা জানতে পারি। এবার আমার জবাবটা তার পাওয়া উচিত। তাই বলি, ‘সে সব কিছু নয়, আমার সবই আছে।’

‘আঙ্‌রি অমনি বলে ওঠে, ‘তাই কি মানি নাকি! মিছে কথা।’

‘না, সত্যি বলছি।’

‘তবে কি আমরা চোখের মাথা খেয়েছি নাকি?’

অবাক হয়ে বলি ‘কেন?’

আঙ্‌রি বলে, ‘সব থাকলে কাউকে এরকম দেখায় নাকি। যেন দিশা-দিশা নাই, ঘরছাড়া, মানুষের ঠিক নাই।’

এতটা মেনে নেব না। কিন্তু এই যে আঙ্‌রি, এর চোখ আর মন আমার নয়। ওর দেখা বোঝাটাকে আমি সহসা বদলাতে পারি না। তাই যুক্তি তর্কে যাব না। হেসে বলি, ‘সেটা তা হলে আমার কপালের দোষ।’

অমনি গাজি আওয়াজ দেয়, ‘অই শোনো, কথা কাকে বলে।’

আঙ্‌রি ঘাড় ফিরিয়ে চায়, হঠাৎ কিছু বলতে পারে না। বলতে পারে না, কিন্তু চোখ সরিয়ে নেয় না। তার কালো ডাগর চোখে যেন কুলুপকাঠি। আমার মুখের দরজায় তালা খুঁজে ফেরে। দৃষ্টি দিয়ে, বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে খোঁজে। খুলবে, ধন্দ ঘুচিয়ে দেখবে।

ওদিকে মাহাতো দাঁড়িয়ে পড়েছে। দূরত্ব কমিয়ে সকলের সঙ্গ ধরে আমাকে বলে, ‘উইটি মশাই আপনার ঠিক কথা নয়। তখন থেকি আমারও মন বলছে, এ লোকের ছাঁদন বাঁধন নাই।’

ভেবেছিলাম, আর একবার হাসির জোয়ার লাগবে। কিন্তু মাহাতো মশাইয়ের ভাবভঙ্গিতে তার হদিস নেই। আমার থেকে সেটা আঙ্‌রি বেশি বোঝে। তাই সে স্বামীর সঙ্গে তাল দিয়ে বলে ওঠে, ‘আমি তো সে কথাই বলছি গো। বয়সের বেলা দেখলে বোঝা যায় না। তা, এই বেলাতে কেউ ঠিকেনা ছাড়া ঘোরে!’

বলে আঙ্‌রি হাসে। নিছক হাসি নয়, তাতে সপ্রশ্ন গাম্ভীর্যেরও ছোঁয়া আছে। কী বলবে বলো। বলার কিছু নেই। সকলেরই নিজের নিজের মন আর স্বভাব বলে কথা আছে।

মাহাতো বলে, ‘তবে অই যে শুনলি, সব নাকি ওনার কপাল দোষ।’

আঙ্‌রি বলে, ‘সে দোষ তা হলে কাটিয়ে দিই আমরা।’

সে ওষুধ জানা আছে নাকি আঙুরলতার? অবাক হয়ে চেয়ে দেখি, তার ডাগর চোখের কালো তারায় কী এক গুপ্ত কথা চিকচিক করে।

মাহাতো বলে, ‘কী করি?’

‘ঘরে নিয়ে ধরে রাখব।’

সর্বনাশ। ভেড়ি-বাঁধের নোনা কূলে এইটুকু কি বাকি নাকি আমার! মাহাতোর লাল চোখ দুটো বড় হয়ে ওঠে। বলে, ‘অই বাবা, ঘরে নিয়ি ছোঁড়া ধরি রাখবার মন তোর?’

কথা শুনে আঙ্‌রি হঠাৎ লজ্জা পায়। হাসতে গিয়ে ভুরু কোঁচকায়। ঘাড়ে দোলা দিয়ে ঘোমটা টেনে ধমক দেয়, ‘আহ্‌ ছি, কী মুখ গ! আমি ধরে রাখব বলেছি নাকি?’

মাহাতো যেন অসহায় হয়ে একবার গাজির দিকে চায়। বলে, ‘তয় ?’

‘কেন, আমার মেয়ে নাই? আমার চাঁপা নাই ঘরে?’

শুনে মাহাতো আর গাজি একযোগে অট্টহেসে মাঠ কাঁপায়। আমি ভাবি, ছোঁড়া ধরবার ফাঁদ যে মেয়ে, সে বিষয়ে আঙ্‌রির নিজস্ব মতে ভুল নেই। কিন্তু সন্তানের মানত করে যে ফেরে সেই রাঢ়ের তারকেশ্বর থেকে, তার আবার চাঁপা নামের মেয়ে কোথায় থাকে।

হাসি শুনে আঙ্‌রি বলে, ‘তা অত হাসবার কী আছে। মেয়ে কি আমার ফ্যাল্‌না নাকি। এমন একটা ছেলে কি পাওয়া যাবে না?’

যাক, সে মেয়ে যেই হোক, এটা জানা গেল, আঙ্‌রি শাশুড়ি হয়ে আমাকে ধরে রাখতে চায়। এমন নির্যস ঠাট্টা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখব, ভাবতে পারি না। মাহাতোও সেই কথাই বলে, ‘তাই বল্‌, তোর চম্পাবতীকে দিয়ি ছেলে ধরবি। তা, মেয়েকে আমাদের কেউ ফ্যাল্‌না বলতি পারবে না।’

আঙ্‌রি আবার বলে, ‘আর আজকাল জাতের কথা অত কেউ ভাবে না।’

এতখানিও আঙ্‌রির জানা আছে। সে আরও বলে, ‘ঘর দেবো, জমি দেবো, মেয়ে দেবো, কোনও কিছুতে ফাঁক রাখব না। দেখ, রাজি আছ?’

আমাকেই জিজ্ঞেস করে। এমন দুর্দিনে এরকম ঘর-জামাই ব্যবস্থা মন্দ কী। হাসতে হাসতে বলি, ‘আর আমি চোর না ডাকাত, সে ভাবনা নেই?’

আঙ্‌রি বলে, ‘তা আমরা বুঝব।’

তাও তো বটে। আঙ্‌রির তাতে থোড়াই ডর। ডাকাতের রক্ত আছে তার হাতে। বেশি এদিক ওদিক করলে তার ব্যবস্থা সে নিজেই করতে পারবে। জিজ্ঞেস করি, ‘কিন্তু মেয়ে এল কোত্থেকে?’

আঙ্‌রি জবাব দেয়, ‘যেখান থেকে আসে। বাপ-মায়ের মেয়ে। দু’ বছরের মেয়ে যখন, বাপ-মা দুটোই গেল ওলাওঠায়, সেই থেকে আমার কাছে। এখন বয়স, তেরো বছর।’

তা কম নয়, উপযুক্ত বয়স বটে। আজ ও বেলাতেই তার নমুনা দেখেছি। লঞ্চে উঠতে গিয়ে সাঁকো থেকে পাঁকে পড়ে-যাওয়া সেই ভোট জড়ানো বউ। কিন্তু এদিকে সন্ধ্যার ছায়া কখন অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছে। কতক্ষণ চলেছি, তার হিসাব নেই। খেয়াল হল, মাটিতে ছায়ার নড়াচড়া দেখে। দেখি, মাথার ওপর প্রায় আধখানা চাঁদ, অন্ধকারের সঙ্গে লড়ে। তাতে আলোও আছে, অন্ধকার দূর হয় না। দুয়ের এ ভাগাভাগিতে সকলই স্পষ্ট-অস্পষ্টের মাঝামাঝি খেলা করে। দূরে গাছের অস্পষ্ট অবয়ব দেখা যায়। চেনা যায় কেবল মাঠের মধ্যে দু-একটি নারকেল-সুপারি গাছ। ঝিঁঝির ডাক সহসা যেন চড়া সুরে বেজে ওঠে।

আঙ্‌রি কখনও বলে, ‘মেয়েও আমাদের দেখতে সুন্দর, তাই না? কি বলো গো?’

মাহাতোর জবাবে আবার একটা হাসির জোয়ার লাগবে, সেই আশাতে থাকি। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে শুনি, মাহাতোর গলায় কেবল শব্দ বাজে, ‘হুম্‌।’

এতক্ষণে সহসা আমার সন্দেহ হয়, আঙ্‌রি ঠাট্টা করে না। একে সারল্য বলে, না অজ্ঞানতা বলে, বলতে পারি না। কিন্তু নিজের ভাগ্যের দিকে চেয়ে মনে মনে না হেসে পারি না। কোনও এক মাহাতো-বউয়ের কল্পনাকে যে আমি এতখানি উস্‌কে দিতে পারি, ধারণা ছিল না। আঙ্‌রি কথা বলে না, প্রস্তাব করে। বলে চলে, ‘ফরসা, রং, একপিঠ চুল। এত বড় চোখের ফাঁদ…।’

আঙ্‌রি কথা শেষ করতে পারে না। মাহাতো বলে ওঠে, ‘এই দেখ্‌ আঙ্‌রি, এবার থাম। পাগল হলি নাকি।’

অস্পষ্ট আলোয় দেখি, আঙ্‌রি আমার দিকে একবার চায়, আবার স্বামীর দিকে। মাহাতো তখন তার স্ত্রীর পাশে। আবার বলে, ‘সোম্‌সারটা ভগমান তোর মতন গড়ে নাই। যাকে তোর ভাল লাগবে, তাকেই তুই ধরি রাখতি চাইবি, তাই কি হয় নাকি। উনি এলেন কোত্থেকি, যাবেন কম্‌নে, তুই চাঁপা দিয়ি ধরবি ওনাকে।’

বলে একটু থামে। তারপরে আবার বলে, ‘অনেক দূর আসা হয়িছে, আর না। এবার এরা ফিরে যাক। ফিরতি হবি তো আবার।’

বলে সে নিজেই দাঁড়িয়ে পড়ে। আমরা সবাই দাঁড়াই। আমাদের পাশেই একটা নাম-না-জানা ঝাড়ালো বেঁটে গাছ। এমন ঝাড়ালো, একেবারে নিশ্ছিদ্র। তাকে ঘিরে ঝিকিমিকি জোনাকি জ্বলে। আকাশে জ্বলে মিটি মিটি তারা। অস্পষ্ট আলোয় তাকাই আঙ্‌রির দিকে। আঙ্‌রি আমার দিকেই চেয়ে রয়েছে। যদি ঠিক দেখে থাকি, তবে তার চেয়ে থাকার মধ্যে তখনও জিজ্ঞাসা। আমি বলি, ‘এবার তবে ফেরা যাক।’

তবু একবার আমার বলতে ইচ্ছা করে, আমি যে তার ফরসা রং, একপিঠ চুল, বড় চোখের ফাঁদ চম্পাবতীকে নিয়ে ধরা দিয়ে থাকতে পারব না তার জন্যে দুঃখিত। বলতে গেলে পাছে এই নিরর্থক প্রসঙ্গ আরও দীর্ঘতর হয়, তাই বলতে পারি না। কিন্তু আঙ্‌রিও আর তা বলে না। আসলে ভর আর ঘোর, আমার নয়, আঙ্‌রির। তার মধ্যে কোনও বাস্তব-অবাস্তবের প্রশ্ন নেই। স্বামীর কথায় তার সংবিৎ ফেরে। কেবল বলে, ‘তবে বাপু, এ বেলাতে এমন ঠিক-ঠিকানা ছাড়া ভাল নয়, এই বলে দিলাম। আমাদের ভোলাখালিতে আসবে কবে?’

বলি, ‘সময়ের কথা ঠিক করে বলতে পারি না। এক সময়ে ঠিক এসে পড়ব।’

আঙ্‌রি বলে, ‘যার নিজের কোনও ঠিকানা নাই, সে কি ঠিক করে কিছু বলতে পারে?’ এ কথার কোনও জবাব দিতে পারি না। কেন না, জানি, একথা দেওয়াও অবাস্তব। আজ, এই মুহূর্তে যে আমি এখানে, তাও যেমন হিসাবের বাইরে, কথা দেওয়াটাও তেমনি হবে। কিন্তু মনে মনে বলি, ভোলাখালিতে একদিন আমি আসব। যেন আসতে পারি।

এই সময়ে মাহাতো ফস করে একটা বিড়ি ধরায়। আঙ্‌রি সেদিকে তাকিয়ে বলে, ‘অ মা, একটা বিড়ি ধরালে? আমাকে একটা দিলে না?’

মাহাতো প্রায় ধমক দিয়ে বলে, ‘না। বিড়ি খাওয়া না তোর বারণ! ডাক্তার ইস্তক বলিছে, তবু নেশা ছাড়তি পারে না।’

বলেই আমার দিকে ফিরে বলে, ‘অ মশাই, আপনাকে তো জামাই করতি চায়। আপনি একটু বারণ করেন তো।’

অমনি আঙ্‌রি ঝামটা দেয়, ‘দেখ, মিছা কথা বলো না। এখন কি দু-তিনটার বেশি খাই নাকি। তাই বা বলো আমাকে নিশা ধরালে কে? রোজ একটু একটু করে খাইয়ে তুমিই তো ধরিয়েছ।’

গাঙ চলছিল ডাইনে। একবার মোড় ফিরে বাঁকা স্রোতে বাঁয়ে। কথা ছিল কোথায়, আসে কোথায়! ভাবলাম বুঝি, এই নিয়ে লাগে। কিন্তু মাহাতো তাড়াতাড়ি সুর নরম করে বলে, ‘আচ্ছা, এটাই খাস। চল, আর দেরি করিস না।’

আঙ্‌রির রোষটা তখনই যায় না। বলে, ‘দেখ না, অমনি দুষতে আরম্ভ করেছে।’

মাহাতো আমাদের উদ্দেশে এবার হাত তোলে। বলে, ‘চলি। সময় করতি পারলি ভোলাখালি আসবেন।’

খোলা প্রাণের নিমন্ত্রণ। জবাবের প্রত্যাশা নেই। সে পিছন ফিরে চলতে আরম্ভ করে। আঙ্‌রি আর একবার তাকায়। বলে, ‘কথাটা মনে রেখো গো, গাজির বাবু। একবার এসো।’

গাজির দিকে ফিরে বলে, ‘তুমি তাড়াতাড়ি একদিন এসো।’

বলে সে চলে যায়। গাজি বলে, ‘আসব, চাচি।’

আমি আর গাজিও ফিরি। কয়েক পা গিয়ে দু’জনেই ফিরে চাই। অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায়, মনে হয়, আঙ্‌রিও যেন ফিরে দাঁড়িয়েছে। তার হাত ওঠে, না আঁচল ওড়ে, বুঝতে পারি না। একটা অস্পষ্ট গলার ডাকও যেন শুনতে পাই, ‘আয় গো বউ, দেরি করিস না।’ তারপর দু’টি ছায়া ক্রমে মিলিয়ে যায়। আমরা আবার ফিরতে থাকি। গাজির গলায় একবার শোনা যায়, ‘চাচি বড় ভাল লোক।’

সে কথার কোনও জবাব দিই না। আমার কথা বলতে ইচ্ছা করে না। কেবল আঙ্‌রির মুখখানিই চোখের সামনে ভাসতে থাকে। সে ভাল না মন্দ, সে ভাবনা আসে না মনে। ভাবি, সাহিত্যের থেকে জীবন কত বড়। তুমি যখন কলম নিয়ে ভাবো, কলম নিয়ে রচো, তখন তোমার বিধিবিধান সামঞ্জস্য যুক্তি কলমের চালে চলে। জীবন তার চেয়ে অনেক বিস্ময়কর, বিচিত্রতর। সে এমনি অমানিত, যুক্তিতে অথই। সে কোনও কিছুর অধীন নয়। এই অধর অথইকে সাধনা করো কলমের হিজিবিজি কেটে। হিজিবিজির নানান ছক, নানান ছাঁদন বাঁধন। আঙ্‌রি সেখানে নেই। সে তোমার মন ভুলানো নিটোল গল্পে বাঁধা নয়। কিছুতে সে বাস্তব নয়। কীসেই বা তার যুক্তি। কেবল তার সেই মুখখানির সঙ্গে মাহাতোর কথাগুলো কানে বাজে, ‘ভগমান তোর মনের মতন করি সোম্‌সার গড়ে নাই। যাকে তোর ভাল লাগে, তাকেই তুই ধরি রাখতি চাস…।’ যেন, ‘কেন রে তুই যেথা সেথা পরিস্ প্রেমের ফাঁদ।’ এ কী রেয়াজ, বলো। যুক্তি কী দেবে হে!

যুক্তি কেবল সেখানে, যেখানে আঙ্‌রি এখনও শুধুই মেয়ে। আপন রক্ত সঞ্চারে আজিও যার ফল ফলেনি। তবু দেখ, কত না ফুল যেন তাকে ঘিরে ফুটেছে। যেন গন্ধ পাই। দেখ, কত না ফলে যেন সে ফলবতী। ক্ষুধা যেন মিটে যায়। অতএব, বুঝে দেখ মন, সংসার যার নিজের মতো গড়া নয়, তবু হাত বাড়িয়ে ফেরে, কত আঘাত তাকে সইতে হয়। তাই সে মানুষ দেখে চিনতে পারে।

আর একবার পিছন ফিরি। কিছুই দেখা যায় না। নোনা গাঙের কূলে, অস্পষ্ট কুহেলি জ্যোৎস্নার অবাধ নিঝুম প্রকৃতি। মনে মনে বলি, যা খুঁজে ফিরি নিরুদ্দেশে, সেই চলাতে, একবার আসব। এমন ‘নেমন্তন্ন’ কি কখনও ভুলি।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *