২৪. শেষ কথা

শেষ কথা

আমার এ আত্মজীবনীর ‘শেষ কথা’ আমার জীবনের মুদ্দা কথা। সে কথাটা এই যে, আমি জীবনে সুখী হইয়াছি। আর দশজনের মত জীবনে আমি সুখ চাহিয়াছিলাম। সুখ আমি পাইয়াছি। এ সুখ মনের শান্তি। আত্মার তৃপ্তি। অন্তরের সন্তোষ। চাওয়া-পাওয়া লইয়াই মানবজীবন। আমি যা চাহিয়াছি, তাই পাইয়াছি। জীবনের কাছে আমার আর কোনও পাওনা নাই। কোনও দেনাও নাই। দুনিয়ার বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ নাই। সমাজের বিরুদ্ধে আমার কোনও অসন্তোষ নাই। মানুষের বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিমান নাই। আশি বছর বয়সে আমার মন তৃপ্ত। আমার দেহ শান্ত। আমার অযোগ্যতা, অসম্পূর্ণতা, আমার অনধিকার ও অসংখ্য ভুল-ত্রুটি সত্ত্বেও এই সুখ, তুপ্তি ও মর্যাদা আমাকে দেওয়া হইয়াছে বলিয়া আমার বন্ধু-বান্ধব, আমার আত্মীয়-স্বজন, আমার প্রতিবেশী, আমার সহকর্মী, আমার নেতা-মুরুব্বি, আমার সমাজ, আমার দেশ, সর্বোপরি আমার আল্লার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এ কথা বলিবার জন্যই আমার এই আত্মজীবনী লেখা।

কিন্তু এটা আমার ব্যক্তিগত জীবন। এই ব্যক্তিগত জীবনেই আমি সুখ, শান্তি, তৃপ্তি, সন্তোষ ইত্যাদি মানবিক সম্পদের অধিকারী হইয়াছি। এমনকি ব্যক্তিগত জীবনের যেটুকু বাহিরে প্রসারিত সেখানেও আমি সাফল্য, সুখ, শান্তি ও তৃপ্তি ভোগ করিয়াছি। যশ ও পদ-মর্যাদাও লাভ করিয়াছি। শিক্ষা ও জ্ঞান লাভ করিতে চাহিয়াছি, উচ্চশিক্ষা পাইয়াছি। জ্ঞানলাভের জন্য অসংখ্য বই-পুস্তক পড়িবার সুযোগ পাইয়াছি। রোযগারের তালাশে উকালতিতে গিয়াছিলাম, সফল উকিল হইয়াছি। সাংবাদিক হইতে গিয়াছিলাম, তিন-তিনটা দৈনিকের সম্পাদক হইয়াছি। সাহিত্যিক হইতে চাহিয়াছিলাম, বই-পুস্তক লিখিয়া অর্থ, যশ, প্রশংসা, এওয়ার্ড ও স্বর্ণপদক পাইয়াছি। রাজনীতি করিতে চাহিয়াছিলাম, মেম্বর মন্ত্রী হইতে, এমনকি প্রধানমন্ত্রিত্ব করিতে পারিয়াছি। কাজেই বলা যায়, ভিতর ও বাহির সর্বত্র আমি ব্যক্তিগত জীবনে সাফল্য, সুখ ও সন্তোষ লাভ করিতে পারিয়াছি। নিজের বুদ্ধিতে যেখানে কুলায় নাই, তকদির সেখানে সহায়তা করিয়াছে।

.

২.

কিন্তু প্রশ্ন থাকিয়া যায়, দেশ ও সমাজের তাতে কী লাভ হইয়াছে? জনগণের জন্য কোন ভাল কাজটা সমাধা করিতে পারিয়াছি? স্পষ্টতই পারি নাই। কাজেই বলা চলে আমার ব্যক্তিগত জীবনে আমার স্বপ্ন-সাধ পূর্ণ হইলেও দেশ-সমাজের ক্ষেত্রে আমার স্বপ্ন-সাধ সফল হয় নাই। দেশ, সমাজ ও জনগণ সম্বন্ধে আমার উচ্চ আদর্শ ও রঙ্গিন স্বপ্ন ছিল। তার একটাও সম্যক সফল হয় নাই। জনগণের দারিদ্র্য, অশিক্ষা, তাদের উপর শোষণ-নির্যাতন, যুলুম-নিপীড়ন, অত্যাচার-অবিচারের প্রতিকারের স্বপ্ন দেখিয়াছি। যুদ্ধ বিগ্রহ, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-শাসনের অবসান চাহিয়াছি। দেশের সকল প্রকার আন্দোলনের শরিক হইয়াছি। সাধ্যমত ত্যাগ স্বীকার করিয়াছি। জেল-যুলুম-দুর্নাম সহিয়াছি। মনে হইয়াছে, সবটাতেই সফল হইয়াছি। আসলে তা হয় নাই। নিচের তলার জনগণের দারিদ্র্য-নিরক্ষরতা, শোষণ নির্যাতন আগের মতই আছে। উপরের তলার কতিপয় আগের মতই বিলাসের প্রাচুর্যে গড়াগড়ি দিতেছে, আমার ছেলেবেলা এদের, মানে শোষক-শোষিতের ও নিপীড়ক-নিপীড়িতের, যারে যেখানে যে অবস্থায়। দেখিয়াছি, আজও ঠিক সেখানেই দেখিতেছি। এ সবই আমার সামাজিক, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের স্বপ্নের অসাফল্য। রাজনীতিতেও তাই। স্বাধীন ভারত, স্বাধীন পাকিস্তান, স্বাধীন বাংলাদেশ কোনওটাই আমার স্বপ্ন কল্পনামত হয় নাই। দেশের মাটি স্বাধীন হইয়াছে, কিন্তু মাটির মালিকরা স্বাধীন হয় নাই। ফলে আমার রাজনৈতিক স্বপ্নও পুরাপুরি সফল হয় নাই। এক কথায় আমার পাবলিক লাইফ, সামাজিক-রাষ্ট্রীয় জীবন, অতৃপ্ত অসুখী।

.

৩.

এ কথার তাৎপর্য এই যে আমি প্রাইভেট লাইফে, ব্যক্তি-জীবনে তৃপ্ত, সন্তুষ্ট ও সুখী; আর পাবলিক লাইফে সমাজ-জীবনে অতৃপ্ত, অসন্তুষ্ট ও অসুখী। এটা কি করিয়া সত্য হইল, সম্ভব হইল? সত্য ও সম্ভব হইয়াছে বলিয়া এটাই আমার জীবনের বৈশিষ্ট্য। দম্ভ-অহংকার না করিয়াও আমি বলিতে পারি, এটাই আমার জীবনের শিক্ষা। আজকার তরুণরা অন্তত এইটুকুর জন্য আমার জীবন হইতে শিক্ষা গ্রহণ করিতে পারেন।

.

৪.

শিক্ষণীয় বিষয়টা এই : মানুষ সামাজিক জীব হইলেও তার একটা ব্যক্তিত্ব আছে। ঐ ব্যক্তিত্বে সে একা ও স্বাধীন। এই বইয়ের ভূমিকাতেও আমি ইশারায় এই কথাটাই বলিয়াছি। তার এই ব্যক্তিগত ব্যাপারে তার কর্তব্য, দায়িত্ব, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদ, আপদ-সম্পদ সম্পূর্ণ তার একার।

কিন্তু এই ব্যক্তি-জীবনের বাইরে সে সমষ্টির অংশ। সেখানে সে একাও নয়, স্বাধীনও নয়। তথায় সে একার ইচ্ছায় একা কিছু করিতে পারে না। সেখানকার ভাল-মন্দ, সফলতা-নিষ্ফলতা, আপদ-সম্পদ, সুখ-দুঃখ, আনন্দ বিষাদ তার একার নয়, সমষ্টির। সেখানকার দায়িত্ব-কর্তব্যও কাজেই তার একার নয়। ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখের নিন্দা-প্রশংসাটা তার নিজের একার। কিন্তু সমাজ-জীবনের ভাল-মন্দের নিন্দা-প্রশংসার অধিকারী সে একা নয়। সুফল-কুফলও সে একা ভোগ করে না।

মানুষের প্রাইভেট ও পাবলিক এই যে দুইটা জীবন সে দুইটা আলাদা ভাবে যাপন করিবার কায়দা যারা জানিতে পারিয়াছে, তারাই এক জীবনে অতৃপ্ত থাকিয়াও অপর জীবনে তৃপ্ত হইতে পারিয়াছে। খোদাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আমি এদের মধ্যে একজন।

.

৫.

প্রাইভেট লাইফে আমি সবুরী। পাবলিক লাইফে আমি গণতন্ত্রী। উভয় জীবনেই উচ্চাশা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর দশজনের মতই আমার ছিল। কিন্তু তার যতটুকু আমার পূর্ণ হইয়াছে, তাতেই আমি তৃপ্ত। আমার পাওয়ার যতটুকু আমি পাইয়াছি, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। আমার প্রাপ্যের পরিমাণ, আমার যোগ্যতার পরিমাপ ও আমার অধিকারের সীমানা উপরের কোনও অদৃশ্য শক্তির অসীম জ্ঞান যে-যেখানে নির্ধারণ করিয়াছেন, সেটাই নিশ্চয় ঠিক। এই উপলব্ধি হইতে আমার বেশি সময় লাগে নাই এটা বোধহয় আমার সহজাত। আমার বাপ-মা ও দাদা-দাদিকে আমি এমনি সবুরী পাইয়াছিলাম। আমাদের এটা নাই, ওটা হইল না, এ ধরনের কথা তাদের মুখে শুনি নাই। যৌবনে স্ত্রীর মুখে এবং বার্ধক্যে ছেলেদের মুখেও ঐ ধরনের কথা শুনি নাই। আমার ব্যক্তিগত তৃপ্তি ও সন্তুষ্টিই যেন আমার সংসারের আবহাওয়া।

কিন্তু পাবলিক লাইফে ব্যক্তিগত সবুরে চলে নাই। গণতান্ত্রিক উপলব্ধির দরকার হইয়াছে। সে জীবনেও আমার ব্যক্তিগত মর্যাদা প্রাপ্যাধিকই পাইয়াছি। কিন্তু পাবলিকের জন্য কী পাইয়াছি? দেশ, জাতি ও কৃষক শ্রমিকদের মুক্তির জন্য যে সব কথা বলিয়াছি ও লিখিয়াছি, ওয়াদা করিয়া মেম্বর-মন্ত্রী হইয়াছি, সেগুলি ত আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। ও-সবে ত আপোস করিবার, অল্পে তুষ্ট হইবার কোনও অধিকার আমার ছিল না। তবু তৃপ্ত হইলাম এই উপলব্ধিতে যে ও-সব প্রচারেই আমার অধিকার। প্রয়োগে নয়। এটাই গণতন্ত্র। আমার নির্দেশিত পথটা যতই ঠিক হউক, জোর করিয়া তা প্রয়োগ করা যাইবে না। করিলে সেটা হইবে ডিক্টেটরশিপ। ডিক্টেটররা পরিণামে জনগণের কল্যাণ করেন না। ক্ষমতার লোভেই তারা ক্ষমতা খাটান। জনতার জিন্দাবাদ-ধ্বনির লোভ বড় লোভ।

ব্যক্তিজীবনে ধন-লোভের তৃপ্তি নাই। রাষ্ট্র-জীবনে ক্ষমতা-লোভেরও তৃপ্তি নাই। ডিক্টেটররা ক্ষমতা ছাড়িতে এবং রাষ্ট্র-নেতারা রিটায়ার করিতে পারেন না, এই কারণে। সব জীবনের এটাই চরম শিক্ষা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *