২২. উকালতি জীবন

অধ্যায় বাইশ – উকালতি জীবন

১. শুরুতে নৈরাশ্য

১৯২৯ সালের নভেম্বর মাসে উকালতির সনদ লই ময়মনসিংহ জজকোর্টে প্র্যাকটিস করিবার জন্য। কিন্তু কলিকাতার সাংবাদিক জীবন গুটাইয়া আসিতে-আসিতে ১৯৩০ সালের জানুয়ারি হইয়া যায়। পঁচাশি টাকা মাহিয়ানার সাংবাদিকতা ছাড়িয়া উকালতি ধরিতে সাধ্যমত সাবধানতা অবলম্বন করিয়াছিলাম। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন যারা উকালতি করিতেছিলেন, চিঠি-পত্র লিখিয়া আগে হইতেই তাদের মতামত লইয়াছিলাম। প্রায় সকলেই জানাইয়াছিলেন যে আমার পক্ষে গোড়া হইতেই মোটামুটি দুই হইতে তিনশ টাকা মাসে রোযগার করা মোটেই কঠিন হইবে না।

তিনশ টাকা? তবে আর চিন্তাটা কী? স্নেহময় মৌলবী মুজিবর রহমান সাহেবকে যামিন দিয়া বাটারওয়ার্থ কোং হইতে দুই হাজার টাকার আইন বই লইয়া ময়মনসিংহে পৌঁছিলাম। আটাশ টাকা মাসের এক নূতন দালান ভাড়া করিলাম। উকিলের বাসার উপযোগী নয়া ফার্নিচার কিনিলাম। সাইনবোর্ড লটকাইলাম। নয়া বই-বোঝাই নয়া আলমারি-টেবিল চেয়ারে চেম্বার সাজাইয়া বসিলাম। আস দেখি এইবার কত মওক্কেল আসিতে পার।

কিন্তু মওক্কেল আসিল না। এক মাস-দুই মাস-তিন মাস গেল। শেষে চার মাসও যায়। নূতন উকিলকে কোর্ট গার্ডিয়ান করা হয়। এই গার্ডিয়ান গিরির ফিস বাবত প্রথম মাসে সাড়ে চার টাকা, দ্বিতীয় মাসে ন’টাকা, তৃতীয় মাসে ফের সাড়ে চার, চতুর্থ মাসে একদম শূন্য। বাড়ি ভাড়া বকেয়া পড়িয়াছে চার মাসে সোওয়াশ। বাটারওয়ার্থের কিস্তি খেলাফ চার মাসে দুইশ। চাচা উকিল, তার বাসায় খাই। তাই উপাস থাকি নাই।

ঘাবড়াইয়া গেলাম। স্ত্রী-পুত্র লইয়া নূতন দালানে ধুম-ধামে থাকিবার যে রঙ্গিন স্বপ্ন দেখিতেছিলাম, প্রবল ধাক্কায় সে স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া গেল; চোখে অন্ধকার দেখিতেছিলাম। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করিলাম না। বাইরে ভড়ক ঠিক রাখিলাম।

এমন সময় দি মুসলমান-এর শেয়ার বিক্রয় সফলে মৌ. মুজিবর রহমান সাহেব ময়মনসিংহে আসিলেন। তিনি আমার দুরবস্থার কথা জানিতে পারিয়া আমাকে তার কাছে ফিরাইয়া নিতে চাইলেন। আমি রাজি না হওয়ায় তিনি নিজে খোঁজ-তালাশ করিয়া আট টাকা ভাড়ার ছোট বাসায় রাখিয়া গেলেন। আর নগদ চারশ টাকা দিয়া গেলেন। বাটারওয়ার্থের নিকট আরো সময় নিবেন, আশ্বাস দিয়া গেলেন। মৌলবী সাহেবকে বিদায় দিয়া স্টেশন হইতে সোজা বাসায় আসিলাম। কৃতজ্ঞতায় অঝোরে চোখের পানি ফেলিলাম।

এরপর আস্তে-আস্তে দু-একজন করিয়া মওক্কেল আসিতে লাগিল। তারা বড় গরীব। যা দিত চোখ বুঝিয়া তাই লইতাম। বন্ধু পরামর্শ দিলেন, অভিজ্ঞ মুহরি না রাখিলে কেস পাওয়া যাইবে না। তা ত বুঝি। কিন্তু মুহরি রাখি কেমনে? ছোট বাসা। অন্যলোক রাখিবার জায়গা নাই। স্টোভে নিজ হাতে পাক করিয়া খাই। মুহরিকে খাওয়াইব কেমনে?

জ্ঞানী-অভিজ্ঞ পুরান উকিলরা বলিলেন : যদি ঝর-ঝরা কাঁচা টাকা চাও ফৌজদারি প্র্যাকটিস কর। আর যদি মরিবার দিন পর্যন্ত রোযগার করিতে চাও, তবে দেওয়ানি প্র্যাকটিস কর। আমার যা অবস্থা, তাতে আমি আগে ঝর-ঝরা কাঁচা টাকার সন্ধানে ফৌজদারি কোর্টেই গেলাম। কিন্তু টাকা ধরা দিল না। বুঝিলাম, আয়ের বেশির ভাগ টাকা টাউটকে না দিলে সেখানে কেস পাওয়া যাইবে না। অনেক হিতৈষী বন্ধু যুক্তি দিলেন : একদম না পাওয়ার অপেক্ষা অর্ধেক পাওয়া ভাল। যুক্তি অকাট্য। কিন্তু মনকে প্রবোধ দিতে পারিলাম না।

দেওয়ানিতেই মনোযোগ দিলাম। দেওয়ানি প্র্যাকটিসে যারা হাত পাকাইয়াছেন, তাঁরা হুঁশিয়ার করিলেন : কমসেকম পাঁচ বৎসর পেটে-ভাতে থাকিতে হইবে।

তাই রাজি। পেটে-ভাতেই থাকিলাম।

বরাবরের মত স্টোভে আন্ডাভাজি ও চাউল সিদ্ধ করিতেছি, এমন সময় খান সাহেব সাহেব আলী ‘উকিল সাব’ ‘উকিল সাব’ চিৎকার করিতে করিতে আমার বৈঠকখানায় ঢুকিলেন। দুইটি মাত্র কামরা। সামনেরটি চেম্বার, পিছনেরটি শোবার ঘর। শোবার ঘরেই স্টোভ ধরাইয়াছি। চিল্লাইয়া ডাকিলাম : ভিতরে আসুন।

.

. খান সাহেব সাহেব আলী

খান সাহেব ছিলেন পিতৃতুল্য ব্যক্তি। প্রবীণ মোখতার। আমার স্কুলজীবন হইতেই তাকে চিনি। স্কুল-কলেজের কোনও সভা-সমিতি হইতেই তিনি বাদ যাইতেন না। তিনি আমার লেখা ও বক্তৃতার খুব তারিফ করিতেন। আমাকে তিনি তখন হইতেই খুব স্নেহ করিতেন। পরবর্তীকালে আমি কংগ্রেসি হইয়া যাওয়ায় তিনি মর্মাহত হইয়াছিলেন। বলিতেন : মুসলমান সমাজের একটা জুয়েল হিন্দুদের পাল্লায় পড়িয়া নষ্ট হইল। তা সত্ত্বেও তিনি আমার হিত-চিন্তা করিতেন। আমাকে মুক্তি দিবার জন্য আল্লার কাছে দোওয়া করিতেন। পথে-ঘাটে, সময়ে-অসময়ে কংগ্রেস ছাড়িবার উপদেশ দিতেন।

এমন মুরুব্বি খান সাহেবের কাছে আমার কিছুই গোপনীয় নাই। কাজেই ভিতরে ডাকিলাম। তিনি আমাকে রান্না-রত দেখিয়া হাসিয়া বলিলেন : নিজ হাতে রান্না করিয়া খাওয়া খুবই সওয়াবের কাজ। কিন্তু সেটা ফকির-দরবেশ, সাধু-সন্ন্যাসীর কাজ; উকিল-মোখতারের কাজ নয়। রান্না-বান্নায় আমি যে সময় নষ্ট করিতেছি, ঐ সময় আইন বই পড়ায় নিয়োজিত করিলে খুবই উপকার হইবে।

আমি যখন বলিলাম যে আমি সওয়াবের আশায় নিজ হাতে পাকাই না। চাকর রাখিতে পারি না বলিয়াই এটা করি, তখন তিনি অতি সহজ গলায় বলিলেন : চাকরের দরকার নাই, বউ-মাকে নিয়া আসেন।

আমিও সরলভাবে বলিলাম : ওদেরে আনিয়া খাওয়াইব কী? প্র্যাকটিসের কথা ত আপনি জানেনই।

খান সাহেব গম্ভীরভাবেই বলিলেন : জানিয়াই এ কথা বলিতেছি। রেযেকের মালিক আপনি নন, আল্লাহ। বউ-মা ও ছেলেদেরে ধানীখোলা রাখিয়াছেন বলিয়া আল্লাহ তাদের রেযেক সেখানে পাঠাইতেছেন। শুধু আপনার একার রেযেক এখানে পাঠাইতেছেন। আপনি ওদেরে নিয়া আসেন। দেখিবেন, ওদের খোরাকি আল্লাহ এখানে পাঠাইতেছেন। আমার কথা বিশ্বাস করুন।

আশি-বৎসরের এই বৃদ্ধের এই কথার আন্তরিকতা তাঁর চোখে-মুখে ফুটিয়া উঠিল। আমি বলিলাম: আপনার কথা আমি বিশ্বাস করি; কিন্তু এই বাড়িতে ওদেরে আনি কেমন করিয়া?

উত্তরে খান সাহেব যা বলিলেন তাতে বুঝিলাম তাঁর আজিকার এ আগমন আকস্মিক নয়। তিনি আমার সপরিবারে থাকিবার বাড়ি ঠিক করিয়াই আসিয়াছেন। সামনের বাড়িটা দুই-একদিনের মধ্যে খালি হইতেছে। ও-বাড়ি তিনি আমার জন্য ঠিক করিয়া বাড়িওয়ালার সঙ্গে চূড়ান্ত কথা ঠিক করিয়া আসিয়াছেন। পরের রবিবারে যেন বউমাকে লইয়া আসি। ঐ বাড়ি যেদিন খালি হইবে, সেইদিনই যেন আমি উক্ত বাড়িতে প্রবেশ করিয়া বিছানা-পত্র, আসবাব-পাতি ঠিক-ঠাক করিয়া রাখি। বাড়িওয়ালার সাথে আমার কথা বলিবার দরকার নাই। আমার মঙ্গল চিন্তায় এই অনাত্মীয় বৃদ্ধের নিঃস্বার্থ আগ্রহ ও তৎপরতা দেখিয়া কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরিয়া উঠিল। আমি এই নূতন ব্যবস্থার আর্থিক দিকটার কথা ভাবিয়া শুধু বলিলাম : কিন্তু ও-বাড়ির ভাড়া যে অনেক বেশি।

তিনি হাসিয়া জবাব দিলেন : বউমা ও ছেলেদের খোরাকিটা যিনি পাঠাইতে পারিবেন, তিনি তাদের থাকার বাড়িটার ভাড়াও পাঠাইতে পারিবেন।

.

. নূতন অভিজ্ঞতা

আমি তাঁর পরামর্শ-মত কাজ করিলাম। দিনে-দিনে বুঝিলাম, খান সাহেবের কথা একেবারে মিথ্যা নয়। রোযগার বাড়িতে লাগিল। কায়ক্লেশে নয় বেশ স্বচ্ছন্দে ও সুখেই দিন যাইতে লাগিল। মওক্কেল বেশ বাড়িল। অবশ্য মওক্কেল যত বাড়িল, মেহমান বাড়িল তার চেয়ে অনেক বেশি। মওক্কেল যা আসিলেন, তাঁদের অধিকাংশেই আত্মীয় অথবা চিনাজানা ‘দেশের লোক’। লজ্জায় তাদের কাছে ফিস চাইতে পারিতাম না। নিতান্ত বাধ্য হইয়া চোখ-কান বুজিয়া যখন চাহিতাম তখন অসামান্য সরলতার সাথে তারা জবাব দিতেন : ‘বাবাজি, টাকাই যদি দিতে পারি, তবে আর আপনার কাছে আসিব কেন?’ কথাটার তাৎপর্য না বুঝিয়াই হয়ত এমন কথা তাঁরা বলিতেন। কিন্তু অর্থ যাই হোক, আমি ফিস পাইতাম না। আর ফিস তারা আমাকে দেন বা না দেন আত্মীয়তা হইতে তাঁরা আমাকে বঞ্চিত করিতেন না। অন্য উকিলকে ফিস দিয়া তারা রাত্রে আমার মেহমান হইতে বিন্দুমাত্র লজ্জা পাইতেন না। শহরে থাকিবেন অথচ আমার মত নিকট আত্মীয়ের বাসায় না উঠিয়া অন্যত্র উঠিলে আমিই বা কী মনে করিব, আর লোকেই বা কী বলিবে? এইভাবে মক্কেলের চেয়ে মেহমান বেশি হওয়ায়ও খোদার ফযলে একরকমে চলিয়া যাইত। এইখানেই খান সাহেবের কথার সত্যতা আরো বেশি করিয়া ঠিক প্রমাণিত হইল। খান সাহেব মাঝে-মাঝেই আমার খোঁজখবর করিতে আসিতেন। আমার বৈঠকখানা ভর্তি লোক দেখিয়া পরিতৃপ্তির হাসি-হাসিয়া বিদায় হইতেন। বৈঠকখানার লোকের শতকরা নব্বই জন যে মওক্কেল নয়, বাকি দশের অর্ধেক যে বিনা-পয়সার মওক্কেল তা-ও তিনি জানিতেন। কারণ কোর্টে সে কথা বলিতেন এবং সাহস দিতেন। বলিতেন, আগে ভিড় হউক। এই ভিড় হইতেই মওক্কেল বাহির হইবে।

আমার বিদ্যা-বুদ্ধি ও বাগ্মিতার প্রতি বাপজীর আস্থা ছিল অসীম। কাজেই উকিল হওয়ামাত্র আমার চারপাশে মওক্কেল মৌমাছির মত ভেনভেন করিয়া ঘুরিতে শুরু করিবে, এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। কিন্তু বউমার নিকট ও লোক মুখে আমার অবস্থার কথা শুনিয়া তিনিও ঘাবড়াইয়া উঠিলেন। তাঁর মত নিরীহ সরল মানুষও বাড়ি বসিয়া থাকিতে পারিলেন না। আমাকে কেস দিবার জন্য তিনি আত্মীয়-বন্ধুর বাড়ি-বাড়ি ক্যানভাস করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। এই আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে একজনের কথা আমি ভুলিতে পারি নাই। তখন তার উপর রাগ করিয়াছিলাম। এখন ব্যাপার বুঝিতে পারিয়াছি বলিয়া সে রাগ আর নাই।

এই আত্মীয়টি একজন মৌলবী সাহেব। তিনি অনেক জমি-জমা-ওয়ালা অবস্থাশালী বলিয়া তাঁর নিজেরও অনেক মামলা-মোকদ্দমা ছিল। তার চেয়ে বেশি তিনি আশ-পাশের মামলাবাজ লোকদের মামলারও তদবিরাদি করিতেন। ফলে সপ্তাহে ছয় দিনই তিনি কোর্টে হাজির থাকিতেন। বাপজী এঁকেই আমার মুরুব্বি ধরিলেন। আমাকে কেস দিবার জন্য তাকে জোর করিয়া পাকড়াইলেন। মৌলবী সাহেব কেস ত দিলেনই না, কোরআন হাদিস আওড়াইয়া বাপজীকে বুঝাইয়া দিলেন যে, উকালতি পেশা মুসলমানের নয়; ওটা পেশাকারের ব্যবসার মতই হারাম। আমার মত একটা ভাল ছেলেকে ঐ হারাম ব্যবসায়ে দিয়া আমার বাপ গোনাহ্ করিয়াছেন। মৌলবী সাহেব নিজে ঐ পাপ কাজের সহায়তা করেন কেন, বাপজীর এই কৌতূহলের উপরে তিনি বাপজানকে এই জ্ঞানের নূর দান করেন : মুসলমানের জন্য নাপাক দুনিয়ায় দুনিয়াবি কাজের জন্য মামলা-মোকদ্দমার মত গোনার কাজ করিতেই যখন হয়, তখন সেটা মালাউন-কাফের-হিন্দুদের দিয়া করাই ভাল। বাপজীর মত ধার্মিক আত্মীয়ের প্রিয় পুত্রকে দিয়া তিনি এই পাপ করাইতে পারেন না।

মৌলবী সাহেবের কথিত উদ্দেশ্যে না হইলেও অন্য কারণে তৎকালে অধিকাংশ অবস্থাশালী মুসলমান হিন্দু উকিলদেরই কেস দিতেন। তৎকালে এই ধারণা খুব প্রবল ছিল যে, হিন্দুরাই ভাল উকিল; মুসলমানরা ভাল উকিল নয়। ধারণাটা নিতান্ত মিথ্যা ছিল না। মুসলমান উকিলদের অধিকাংশই ফৌজদারি কেস নিতেন। কয়েক দিন হাত-মুখ পাকাইয়াই তারা এসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকিউটর হইবার আশায় অফিসারদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ আরম্ভ করিতেন। এর ফলে আরেকটা ধারণা মক্কেলদের মধ্যে হইয়াছিল যে মুসলমান উকিলরা দেওয়ানি মোকদ্দমা বুঝেন না। এই ধারণার বিরুদ্ধে লড়াই করিয়াই আমাকে উকালতি, তা-ও দেওয়ানি উকালতি চালাইয়া যাইতে হইল। কোনও মতে বাসা খরচ যখন চলিয়া যাইতেছে তখন শনৈঃ শনৈঃ অগ্রসর হইতেও আমার কোনও আপত্তি ছিল না।

.

. ‘অনুকিলী’-সততা

এই সময়ে উকিল হিসাবে আমি দুইটি কাজ করিলাম, যার ফলে উকিলরা যেমন আমার উপর খাফা হইলেন, মওক্কেল সাধারণ বিশেষত মুসলমান মওক্কেলরা আমার উপর তেমনি সন্তুষ্ট হইলেন।

প্রথমটি উকিলের বৈঠকখানায় মওক্কেলদের বসিবার ব্যবস্থা। তৎকালে ময়মনসিংহ শহরে প্রায় দুই-আড়াইশ উকিল। তার মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা মাত্র জন ত্রিশেক। বাকি সকলেই হিন্দু। তাদের মধ্যে দুই-তিনজন ব্যারিস্টার ছিলেন। হিন্দু উকিলদের চেম্বারে সাধারণ মুসলমান মওক্কেলরা চেয়ারে বসিতে পারিতেন না। তাঁদের জন্য ছিল টুল। প্রত্যেক হিন্দু উকিলের বৈঠকখানায় এককোণে মুসলমান মক্কেলদের জন্য একটি পানি-ছাড়া ডাবা (নারিকেলী হুক্কা), কতকটা ভুষি তামাক এবং কিছু টিক্কা থাকিত। মওক্কেলরা নিজ হাতে তামাক সাজিয়া খাইতেন। নিতান্ত শিক্ষিত ভদ্রবেশী ছাড়া আর সব মুসলমান মক্কেলকেই উকিলরা ‘তুমি’ বলিতেন। ময়মনসিংহ হিন্দু জমিদার-প্রধান জিলা। এখানে জমিদার ও তাদের কর্মচারী-আমলা সবাই মুসলমান প্রজাদেরে ছোট-বড়-ধনী-নির্ধন-নির্বিশেষে ‘তুমি’ বলিয়া থাকেন। উকিলরা তাদেরই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব। কাজেই জমিদার কাছারির এই আদব-কায়দা খুব স্বাভাবিকভাবেই উকিলের শেরেস্তায় ঢুকিয়াছে। এই জন্য হিন্দু উকিলের শেরেস্তায় মুসলমানদের অমর্যাদার, এই অবমাননার, এই নীচুতার, এই অছুৎ-অছুৎ ভাবটা বিশেষ কারো চোখে দৃষ্টিকটু লাগিত না। আমার কাছেও না।

কিন্তু আমি উকালতি করিতে আসিয়া দেখিলাম যে, শুধু হিন্দু উকিলদের নয়, মুসলমান উকিলদের বাসাতেও এই ব্যবস্থা। মুসলমান উকিলদের অধিকাংশেই আমারই মত কৃষক-সম্প্রদায়ের লোক। তাদের আত্মীয়স্বজন যারা মামলা করিতে আসেন, তাঁরাও অধিকাংশ শিক্ষাদীক্ষায় পোশাকে পরিচ্ছদে নিতান্ত সাধারণ লোক। মুসলমান উকিলের বাসাতে আসিয়াও তাঁরা বরাবরের অভ্যাস-মত টুলেই বসিতেন, চেয়ারে বসিতেন না।

হুঁক্কার অবস্থাও প্রায় তাই। এই ব্যবস্থা আমার মনে পীড়া দিল। দুই একজন ঘনিষ্ঠ মুসলিম বন্ধুর কাছে কথাটা তুলিলাম। তাদের এই ব্যবহারের প্রতিবাদ করিলাম। তারা আমার ভাবালুতার নিন্দা করিলেন। ব্যবসা করিতে গেলে ওসব সেন্টিমেন্টালগিরি চলিবে না। মামলায় মুসলমান মওক্কেলদেরে চেয়ারে বসিতে দিলে তারা মাথায় উঠিবে। হিন্দু উকিলরা আমাদের বৈঠকখানায় আসিবেন না। হিন্দু-মুসলিম উকিলদের মধ্যে পরস্পরের বৈঠকখানায় আড্ডা মারার যে একটা ভ্রাতৃত্ব গড়িয়া উঠিয়াছে, এটা নষ্ট হইবে। এতে মুসলমান উকিলদেরই ক্ষতি হইবে। বন্ধুরা নিজেদের অভিজ্ঞতা হইতেই এসব কথা বলিলেন। দুই-তিনজন গোড়ার দিকে নাকি আমার মতই চিন্তা করিতেন এবং কাজও এইরূপ শুরু করিয়াছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেদের স্বার্থেই ঐ ভাবালুতা ত্যাগ করিয়াছেন।

বন্ধুদের কথা আমার পছন্দ হইল না তাই তাদের অভিজ্ঞতার খুঁটি-নাটি জানিতে চাহিলাম। কে কবে কোন মুসলিম মওক্কেলকে চেয়ারে বসিতে দেখিয়াছিলেন, কোন হিন্দু বন্ধু তার প্রতিবাদ করিয়াছিলেন, ইত্যাদি জানিবার চেষ্টা করিলাম। বুঝিলাম, এঁরা কেউ কিছুই করেন নাই। কোনও হিন্দু বন্ধুও প্রতিবাদ করেন নাই। কাজেই অমন কোনও ঘটনাই ঘটে নাই। ঘটিয়া থাকিলেও এঁরা দেখেন নাই। অনুমানেই এঁরা এই চিত্র আঁকিয়া লইয়াছিলেন। যা হইতে পারে, হওয়া খুব সম্ভব, তাই হইয়াছে বলিয়া ইহারা চালাইয়া দিয়াছেন।

কাজেই এই ব্যবস্থা আমি মানিলাম না। আমার বৈঠকখানায় চেয়ারের সংখ্যা বাড়াইলাম। যে কোনও মওক্কেল আসিলেই আমি হাতের ইশারায় চেয়ারে বসিতে বলিতাম।

অনেক মওক্কেল আনন্দে আসন গ্রহণ করিতেন। কিন্তু অধিকাংশেই আমার কথা অগ্রাহ্য করিয়া টুলেই বসিতেন। আমি তাঁদেরে চেষ্টা করিয়া আনিয়া চেয়ারে বসাইতাম। তারা জড়-সড় হইয়া চেয়ারের কিনারায় বসিতেন। স্পষ্টই দেখিতাম তারা চেয়ারে বসিয়া অস্বস্তি বোধ করিতেছেন। তখন মামলার আলোচনা ফেলিয়া বসার ব্যবস্থা মান-সম্মান এবং মওক্কেলের অধিকার ইত্যাদি সম্বন্ধে বক্তৃতা শুরু করিতাম। উকিল-মোখতারদের সমস্ত বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠা, টেবিল-চেয়ার ও খাট-পালং-এর প্রতিটি ইট-কাঠ মওক্কেলদের টাকায় হইয়াছে, এদিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতাম। মওক্কেলরা উকিলদের অন্নদাতা মনিব, উকিলরা মওক্কেলদের দিন চুক্তির কামলা, এই সব কথা বলিতাম। কে কোথায় কবে শুনিয়াছেন যে মনিবকে চাকর তুই-তুংকার করে? কে কোথায় দেখিয়াছেন যে চাকর চেয়ারে বসিয়া থাকে আর মনিব তার সামনে চেয়ারে না বসিয়া টুলে বসিয়া থাকে? দস্তুরমত কৃষক-প্রজার পাবলিক মিটিং-এর বক্তৃতা।

আমার বক্তৃতায় ক্রিয়া শুরু হইল। আমার চেম্বারে লুঙ্গি-পরা, খালি গা, গামছা-কাঁধে মওক্কেলদেরে চেয়ারে বসিয়া থাকিতে রাস্তার লোকেরা দেখিতে পাইল। নিতান্ত অল্প-বয়স্ক ছেলেদেরে ছাড়া আর সকল শ্রেণীর মক্কেলদেরে আমি আপনি সম্বোধন করিতে লাগিলাম। এমনকি, দেশের বাড়িতে, রাস্তা ঘাটে ও হাটে-বাজারে, যাদেরে আমি ‘তুমি’ বলিয়া নাম ধরিয়া ডাকিতাম, কোর্টে-কাছারিতে-এজলাসে-কাঠগড়াতে, বার লাইব্রেরিতে তাঁদেরই ‘আপনি’ ‘অমুক সাহেব’ বলিয়া ডাকিতে লাগিলাম। মাতবর শ্রেণীর মওক্কেলরা আমার বৈঠকখানায় বসিয়া আমার ফরসি হুঁক্কা আর গড়গড়ায় তামাক খাইতে লাগিলেন। আমি নিজে হুক্কা টানিবার পর নিজ হাতে টেবিলের উপর দিয়া গড়গড়ার নল মওক্কেলের দিকে বাড়াইয়া বলিতাম : হুক্কা মরজী করেন।

কথাটা বনের আগুনের মতই শহর-সুদ্ধা ছড়াইয়া পড়িল। আমার নিকট প্রতিবেশী উকিল বন্ধু ছিলেন একজন জমিদার। তার সাথে আমার খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি সাহিত্যামোদী ছিলেন। তা ছাড়া তিনি আমার সাথে ক্রসওয়ার্ড ও দাবা খেলিতেন। আমার বৈঠকখানায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠান তিনিই প্রতিবাদ করিলেন সকলের আগে। আমার মক্কেলদের মধ্যে তারা নিজের প্রজার সংখ্যাও কম ছিল না। যদিও তিনি বরাবর শহরে থাকিতেন বলিয়া প্রজাদের অনেকেই তাকে চিনিত না, এবং তিনি নিজেও কোনও প্রজাকেই চিনিতেন না, তবু প্রজা ত? তাদের সাথে তিনি একত্রে চেয়ারে বসেন কী করিয়া? কাজেই তিনি আমার বাসায় আসা বন্ধ করিলেন। ঐ সব কাজের জন্য এবং দাবা খেলিতে অতঃপর তিনি তাঁর বৈঠকখানায় আমাকে ডাকিয়া নিতেন।

যা হোক আমার বাসায় এই সুবিধার কথা শুনিয়া মওক্কেল সাধারণের অধিকার বোধ ও আত্মমর্যাদা জ্ঞান বাড়িল। তারা প্রায় সব উকিলের বাসায় অমন ব্যবহার পাইবার আশা করিতে লাগিলেন। অনেকেই কাজে-কর্মে তাঁদের দাবি প্রতিষ্ঠা করিতে লাগিলেন। উকিলদের অনেকেই আমার নিন্দা করিলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে না হইলেও কথাটাও বার লাইব্রেরিতে উঠিল। এই সময় বার লাইব্রেরিতে কনসালটেশানের জন্য অর্থাৎ মওক্কেলদেরে লইয়া কথাবার্তা বলিবার জন্য কোনও নির্দিষ্ট কামরা ছিল না। আমার প্রবর্তিত নয়া অধিকার খাটাইতে গিয়া অনেক মওকেল বার লাইব্রেরিতে উকিলদের জন্য নির্দিষ্ট চেয়ার খালি পাইলেই বসিয়া পড়িতে লাগিলেন। আমার প্রবর্তিত নয়া ব্যবস্থারই এটা কুফল বলিয়া সকলে আমার ভুল চোখে আঙুল দিয়া দেখাইতে লাগিলেন। কিন্তু আমি তাতেও পরাজয় স্বীকার না করায় অবশেষে মওক্কেলদের আক্রমণ হইতে উকিলদের চেয়ার রক্ষার উদ্দেশ্যে কনসালটেশনের জন্য অর্থাৎ মওক্কেলদের জন্য একটি কামরা আলাদা বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইল।

দ্বিতীয়টি এই : তৎকালে কোর্ট ফি আইন অনুসারে পঞ্চাশ টাকার বেশি মূল্যের মামলার দরখাস্তে লাগিত বার আনার কোর্ট ফি; এর কম মূল্যের মামলার দরখাস্তে লাগিত দুই আনার কোর্ট ফি। এই দরখাস্ত বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষেই লাগে। অধিকাংশ মামলার বিশেষত বকেয়া খাযনা মামলার দাবি প্রায়ই পঞ্চাশের কম থাকিত। আমি নয়া উকিল হিসাবে দেখিলাম যে পঞ্চাশ টাকার উপর-নিচ-নির্বিশেষে সমস্ত মামলার দরখাস্ত কোর্ট ফি খরচা বার আনা আদায় করা হইতেছে। আমি অনেক পুরাতন মামলাবাজ লোকের সঙ্গে আলাপ করিয়া দেখিলাম : দুই আনা কোর্ট ফির কমেও দরখাস্ত হইতে পারে, এ কথা তারা জানেন না। এমন অদ্ভুত কথা তারা কোনওদিন শুনেনও নাই। আমি দুই-একজন প্রবীণ উকিলকে এ কথা জিজ্ঞাসা করিলাম; তারা বলিলেন : ওটা উকিলদের ‘ট্রেড-সিক্রেট’। মক্কেলদেরে ও-কথা জানাইতে নাই। আমি আমার মুহরিকে এ কথা বলিলাম। তিনিও অপর উকিলদের কথা সমর্থন করিলেন। সকলেই বলিলেন : বেশির ভাগ মওক্কেলই বড় পাজি। তাঁরা উকিল-মুহরির ন্যায্য পাওনা দিতে চান না। তাঁদের নিকট হইতে কোর্ট ফি, পেশকার, শেরেস্তাদার, দাখিলি-রেজিস্ট্রারি ইত্যাদির বাজে দোহাই দিয়া টাকা আদায় করিতে হয়। আমি তাদের যুক্তি গ্রহণ করিলাম না। চিনা পরিচিত মওক্কেলদেরে এই ‘ট্রেড সিক্রেট’ বলিয়া দিলাম। তৎকালে কোর্ট ফি আইনের সংক্ষিপ্তসার বাংলায় দু-চার আনা দামের পুস্তিকাকারে কলিকাতায় পাওয়া যাইত। আমি অনেক মামলাবাজ লোককে দিয়া ঐ পুস্তিকার এক-এক কপি কিনাইলাম। ইহাতে উকিল-মুহরিদের অনেকেই আমার উপর ভয়ানক খাফা হইলেন। কিন্তু মক্কেলদের নিকট আমি খুব জনপ্রিয় হইয়া উঠিলাম। আমার পসার বাড়িয়া গেল।

.

. ফিস আদায়

কিন্তু ক্রমে বুঝিতে পারিলাম যে, আমাদের দেশের মফস্বলের মক্কেলরা বাস্তবিকই উকিলের ন্যায্য ফিস দিতে কৃপণতা করেন। এঁরাই আবার হাকিম, পেশকার, দারোগা, শেরেস্তাদার বাবত মুক্তহস্তে টাকা খরচ করেন। আমার নিজের বেলাতে এমন অনেক ঘটনা ঘটিয়াছে। মওক্কেল আমার ফিস বাবত দুটা টাকা দিলেন না। পকেট ঝাড়িয়া দেখাইলেন, বাড়ি ফিরিবার ট্রেন ভাড়া বাবত মাত্র চারি আনা পয়সা আছে। আজ দিতে পারিবেন না। দুই-এক দিনের মধ্যেই আমার ফিস লইয়া আসিতেছেন। আমার নিজের নিষ্ফলতা দেখিয়া আমার মুহরি আমাকে গোপনে বলিলেন : আপনি যদি ফিস আদায়ের ক্ষমতা আমাকে দেন এবং পরে কিছু না বলেন, তবে আমি চেষ্টা করিয়া দেখিতে পারি। আমি অনুমতি দিয়া বার লাইব্রেরিতে বসিয়া আড্ডা মারিতে লাগিলাম। আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরিয়া আসিয়া মুহরি সাহেব আমাকে পাঁচটা টাকা দিয়া বলিলেন : আজকার দুই টাকা, আগের পাওনা তিন টাকা। আমি বিস্ময় ও কৃতজ্ঞতার সাথে বলিলাম : এটা কিরূপে সম্ভব হইল? মুহরি সাহেব বলিলেন : সে কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না।

জিজ্ঞাসা করিলামও না। অতঃপর আমার ফিস আদায়ের ভার মুহরি সাহেবের উপরই ছাড়িয়া দিলাম। আস্তে-আস্তে আমার ফিসসহ মামলা খরচের টাকা-পয়সা আদায় আমি একদম ছাড়িয়া দিলাম। মওক্কেলরা উপযাজক হইয়া আমার হাতে দিতে চাহিলেও আমি নিতাম না। বলিতাম : মুহরি সাবের হাতে দেন। অনেক বড়-বড় মওক্কেল এতে চটিতেন। এটাকে অপমান মনে করিতেন। কিন্তু আমি বুঝাইতাম : হিসাবের সুবিধার জন্য খাতায় তারিখ-মত টাকা-পয়সা জমা করিবার সুবিধার জন্যই এটা দরকার। কারণ পয়সা-কড়ির ব্যাপারে আমি একেবারে ছেলেমানুষ।তখন তারা নিরস্ত হইতেন। ফলে আমার উকালতি জীবনের শেষ পর্যন্ত মক্কেলদের সঙ্গে টাকা-পয়সার ব্যাপারে আমার সোজাসুজি সম্পর্ক ছিল না। মুহরিই আমার পক্ষ হইতে সকল টাকা-কড়ি আদায় করিতেন।

কিন্তু এই ব্যবস্থার একটা খারাপ দিকও ছিল। উকিল নিজ হাতে টাকা নিতে না পারেন, কিন্তু তাঁর ফিস কত, মুহরির পাওনা কত, কোর্ট ফি-আদি বাবত খরচ কত, এসব কথা মক্কেলের জানা উচিৎ। তা না করিয়া মওক্কেলকে অন্ধকারে রাখিয়া মুহরির উপর টাকা-পয়সা আদায়ের ভার দিলে টাকা-পয়সা আদায়ের যে সুবিধা হয়, সে কথা আগে বলিলাম। কিন্তু এর দোষের দিকটাও আমাদের দেখা উচিৎ। সাধারণ মওক্কেলরা উকিল-মুহরির ন্যায্য পাওনা দিতে চায় না বলিয়াই মুহরিরা পেশকার-শেরেস্তাদারের নামে টাকা আদায় করিতে বাধ্য হয়, এই হইল সাধারণ মত। কিন্তু কথাটা পুরাপুরি ঠিক নয়। শুধু মওক্কেলদেরে একতরফাভাবে দোষ দেওয়া চলে না। উকিল-মুহরিরাও এতে সমানভাবে দোষী। মওক্কেলরা উকিল-মুহরির নামে টাকা না দিয়া পেশকার-শেরেস্তাদারের নামে টাকা দেন, এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, মওক্কেলরা তাদের কেসের ব্যাপারে উকিলের চেয়ে পেশকার-শেরেস্তাদারকেই বেশি গুরুত্ব দিয়া থাকেন। ভাবটা এই : পেশকার-শেরেস্তাদার পক্ষে থাকিলে উকিল না হইলেও চলে। অজ্ঞ সাধারণ মওক্কেলের মনে এ ধারণা সৃষ্টি করিয়াছে কে? উকিল-মুহরিরাই। একদিনে এই ধারণার সৃষ্টি হয় নাই। আস্তে আস্তে অনেক দিনে এই ধারণার জন্ম হইয়াছে। উকিল-মুহরিরাই নিজেদের কাজে-কর্মে ও কথাবার্তায় এই ধারণার জন্ম দিয়াছেন। আয় ও মর্যাদা উভয় দিক হইতেই এতে আইন ব্যবসায়ীর লোকসান হইয়াছে।

.

৬. টাউট প্রথা এই ভ্রান্ত ধারণা হইতে যে আরেকটা কুপ্রথা আইন ব্যবসায়ে ঢুকিয়াছে তার নাম টাউট প্রথা। অবস্থা এমন দাঁড়িইয়াছে, টাউট না ধরিয়া আইন ব্যবসা, বিশেষত ফৌজদারি আইন ব্যবসা করা একরূপ অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে। গোড়াতে এই প্রথার পক্ষেও একটা নৈতিক ও আইন-সম্মত যুক্তি দেওয়া হইত, তাঁদেরে টাউট না বলিয়া এক শ্রেণীর ‘প্রাইমারি-লিগ্যাল এডভাইয়ার’ বলা যাইতে পারে। সুদূর পাড়াগাঁয়ের অজ্ঞ মামলা-ওয়ালাদের পথ-ঘাট চিনাইয়া ঠক-রাহাজান-পকেট-মারের হাত হইতে বাঁচাইয়া নির্ভরযোগ্য উকিল-মোখতারের শেরেস্তায় পৌঁছাইয়া দেওয়াও এডমিনিস্ট্রেশন-অব জাসটিসের একটা অঙ্গ। সুতরাং উকিল-মোখতারের মত তাদেরও একটা ফিস পাওয়া উচিৎ। এ ফিসটা ন্যায়ত মওক্কেলরই দেওয়া উচিৎ। কিন্তু নানা কারণে ওঁরা মক্কেলের কাছে তা সোজাসুজি চাইতে পারেন না। কাজেই উকিল-মোখতাররাই ঐ পাওনাটা আদায় করিয়া দেন। তাহা আদায় করিতে গিয়া কেউ নিজের ফিসটাই প্রয়োজন-মাফিক বাড়াইয়া আদায় করেন, কেউ পেশকার-শেরেস্তাদার এবং কোর্ট-এর নামে আদায় করিয়া থাকেন। কোর্ট শব্দ দ্বারা তারা অবশ্য মিন করেন কোর্ট ইন্সপেক্টর বা কোর্ট সাব-ইন্সপেক্টর। কিন্তু ঐ সংক্ষিপ্ত শব্দ ব্যবহারের মধ্যে উচ্চারণ-সুবিধা ছাড়াও আরেকটা উদ্দেশ্য লুক্কাইত থাকে। কোর্ট অর্থে যে কেউ-কেউ হাকিম-ম্যাজিস্ট্রেট বুঝেন তাতে টাকা আদায় সহজও হয়। অথচ হাকিমের নামে ঘুষ আদায়ের রিস্কও থাকে না। এইভাবে গোড়াতে টাউট প্রথার সৃষ্টি হইয়াছিল। কিন্তু কালক্রমে আজ এ প্রথা আফিস-আদালতের করাপশন প্রথার মতই অকটোপাসের শক্তি অর্জন করিয়াছে।

আমি যখন উকালতিতে ঢুকি, তখন অনেক হিতৈষী মুরুব্বি প্রবীণ উকিল আমাকে এই প্রথার উপকারিতা বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছেন। এঁদের বিরুদ্ধতার বিপদ সম্বন্ধেও আমাকে সজাগ করিয়াছেন। এক মুরুব্বি প্রবীণ উকিল নিজের সময়ের অভাবহেতু একটি দায়রা মামলা আমার কাছে পাঠাইয়াছিলেন। মামলায় জিতিয়াছিলাম। কাজেই মুরুব্বির প্রশংসা। পাইয়াছিলাম। কিন্তু এক কারণে তিরস্কৃতও হইয়াছিলাম। তদবিরকারককে আদায়ী ফিসের অংশ না দেওয়ায় তিনি উক্ত প্রবীণ উকিলের কাছে নালিশ করেন। মুরুব্বি আমার ঐ কাজকে ‘প্রফেশন্যাল মিসকন্ডাক্ট’ বলিয়াছেন। আরেকজন সিনিয়র ফৌজদারি উকিলের এই সুনাম ছিল যে তিনি আদায়ী ফিসের শতকরা পঁচাত্তর টাকা টাউটকে দিয়া থাকেন। আমি এ সম্বন্ধে তাঁকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি টাউট প্রথার উপকারিতা সম্বন্ধে ওজস্বিনী ভাষায় বক্তৃতা করিলেন। তাঁর মধ্যে মুদ্দা কথা ছিল দুইটা : (১) তুমি এক দিনে একটা কেস করিয়া পাইবে দশ টাকা; আর আমি একদিন দশটা কেস করিয়া পাইব দশদশং একশ। টাউটদের পঁচাত্তর বাদ দিয়াও আমার থাকিবে নেট পঁচিশ। (২) টাউট ছাড়া কেস করিয়া হারিলে মওক্কেলের গাল খাইতে হয়। উকিলের; আর টাউটদের মাধ্যমে কেস করিয়া হারিলে উকিলের গাল খাইতে হয় না, সে গাল খায় হাকিম। টাউট একশ একটা যুক্তি প্রমাণ দিয়া মওক্কেলকে চোখে আঙুল দিয়া বুঝাইয়া দিবেন এই উকিলের মত সুন্দর করিয়া কেস কেউ করিতে পারিত না। কিন্তু অপর পক্ষ হাকিমকে মোটা ঘুষ দিয়া মামলা জিতিয়াছে।

উভয় প্রবীণ মুরুব্বির কথার কঠোর সত্যতা পরে বুঝিয়াছিলাম। কিন্তু তাদের উপদেশ মানিয়া চলিতে মনকে কিছুতেই রাজি করিতে পারি নাই।

.

. ‘নোবল প্রফেশন’

উকালতি ব্যবসাকে আমি উঁচু দরের মহান বৃত্তি ‘নোবল প্রফেশন’ মনে করিতাম। এখনও করি। আমাদের দেশের বড়-বড় উকিল-ব্যারিস্টারের মতামত এবং বই-পুস্তক পড়িয়াই আমার এই বিশ্বাস হইয়াছে। অবশ্য এর বিরুদ্ধ কথাও শুনিয়াছি পরম শ্রদ্ধেয় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় একদা প্রকাশ্য সভায় বলিয়াছিলেন : ‘উকিল ও বেশ্যা একই শ্রেণীর ব্যবসায়ী; একদল সতীত্ব বিক্রয় করিয়া খায়, অপর দল সততা বিক্রয় করিয়া খায়।’ আচার্য রায় ছাড়াও আরো অনেক বিজ্ঞানী ও শিক্ষক উকিলদেরে লইয়ার’ না বলিয়া ‘লায়ার’ বলিয়াছেন।

তলাইয়া বিচার করিলে শেষ পর্যন্ত দেখা যাইবে যে, উভয় মতের মধ্যেই সত্য আছে। এডমিনিস্ট্রেশন-অব-জাসটিস’কে যদি মহৎ কাজ বলিতে হয়, কোর্ট-আদালত, হাকিম-হুঁকামাকে যদি সভ্যতার অলংকার বলিতে হয়, মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার রক্ষাকে যদি মহান দায়িত্ব ও কর্তব্য বলিতে হয়, তবে উকিল সম্প্রদায়কে অমন উচ্চ মর্যাদার আসন না দিয়া উপায় নাই। উকিলরা যে এই এডমিনিস্ট্রেশন-অব-জাসটিসের অপরিহার্য অঙ্গ, সেটা যুক্তি ও দৃষ্টান্ত দিয়া বুঝাইবার দরকার নাই।

বলা যাইতে পারে উকালতি মানুষের মন ও চরিত্রকে ‘এনোবল’ করে। মানুষের হৃদয়কে উদার, চিন্তাকে উন্নত ও দৃষ্টিকে প্রসারিত করে না। কারণ আসলে উকিলরা নিজেদের মক্কেলকে জিতাইতেই চান, সুবিচার চান না। মামলা জিতিবার জন্য তারা মওক্কেল ও সাক্ষীকে মিথ্যা কথা শিখান। ধর্মের নামে হলফ করিয়া মানুষ যে আদালতের কাঠগড়ায় ডাহা মিথ্যা কথা বলিয়া আসে, তা কেবল এই বিদ্বান-বুদ্ধিমান উকিলদের পরামর্শেই।

অভিযোগ মিথ্যা নয়। একটু পরেই নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নজির দিতেছি। কিন্তু তার আগে একটু ভূমিকা করিয়া লইতে চাই।

আমাদের মনে রাখিতে হইবে কোনও ব্যবসা বা রোযগারের পথই মানুষকে পুরাপুরি এনোবল করে না। সব রোযগারের পথেই কিছু না কিছু দোষ-ত্রুটি আছেই। সব ব্যবসাতেই মানুষ নিজের স্বার্থের দিকটা সকলের আগে দেখিয়া থাকে। দৃশ্যত সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবসা যে মসজিদের এমামতি, মন্দিরের পৌরাহিত্য, গির্জার ক্লার্জিম্যানগিরি, তবলিগ বা মিশনারিগিরি, এমনকি মাস্টার-প্রফেসারগিরি, এ সব ব্যবসাও স্বতই মানুষের আত্মাকে উন্নত করে না। অন্যান্য ব্যবসার কথা ত উঠেই না। সব ব্যবসা ও রোযগারের ব্যাপারেই ভাল-মন্দ দুই দিক আছে। একজন চরিত্রহীন পাষণ্ড লোককে সৎপথে আনিয়া একজন মুবাল্লেগ বা মিশনারি, একটা বখাটে বাউণ্ডেল ছেলেকে পরীক্ষা পাশ করাইয়া একজন শিক্ষক যে আনন্দ পাইবেন, একজন কঠিন-পীড়াগ্রস্ত মৃতপ্রায় রোগীকে আরোগ্য করিয়া একজন ডাক্তার যে আনন্দ পাইবেন, একজন নিরপরাধ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড হইতে খালাস করিয়া একজন উকিলও ঠিক তেমনি আনন্দ পাইবেন। কাজেই মিশনারি শিক্ষক, ডাক্তার ও উকিলরা সমান মর্যাদার অধিকারী। পক্ষান্তরে বেহেশতের টিকিট বিক্রয় করিয়া মুবাল্লেগ-মিশনারি, পরীক্ষার প্রশ্ন অগ্রিম বিক্রয় করিয়া শিক্ষক, কায়দায় পাইয়া রোগীর নিকট হইতে গলা-কাটা ভিজিট আদায় করিয়া ডাক্তার যে পাপ করিয়া থাকেন, উকিলদের এই শ্রেণীর পাপও ওঁদের পাপের সমান, কিছুমাত্র বেশি নয়।

.

. মিথ্যাই সত্য

উকিলরা নিজেরা মিছা কথা কন, মওক্কেল ও সাক্ষীদেরও মিছা কথা কওয়ান। আগে তাঁদের নিজেদের মিথ্যা ভাষণেরই বিচার করা যাউক। উকিল যদি মওক্কেলের ক্ষতি না করেন; মওক্কেলের ভালর জন্য যদি দু চারটা মিছা কথা বলান এবং বলেন, তবে সেটা দোষের হইবে কেন? এমনকি খোদ মওক্কেলকেও যদি ফাঁকি দেন, তবে সব-সময় তা দোষের হইবে না। ধরুন একটি লোক বাড়িতে শরিকদের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া হলফ করিয়া আসিয়াছেন, পরদিনই তিনি বাটোয়ারা মামলা দায়ের করিবেন। সমস্ত টাকা-পয়সা ও প্রয়োজনীয় দলিলপত্র আপনাকে বুঝাইয়া দিয়া তিনি পরদিনই মামলা দায়ের করিতে বলিলেন। আপনি তার সহিত তর্ক করিলেন না। তাঁর কথামত কাজ করিতে রাজি হইয়াই মামলা গ্রহণ করিলেন। আপনি যদি বলিতেন অত তাড়াতাড়ি করিবার মত সময় আপনার নাই, কিম্বা যদি বলিতেন অত তাড়াতাড়ি করিলে আরজিতে ভুল-ভ্রান্তি থাকিয়া। যাইতে পারে, যদি তাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিতেন যে, মামলাতে তামাদির কোনও প্রশ্ন নাই, তাড়াহুড়ার কোনও দরকারও নাই, ধীরে-সুস্থে মামলা দায়ের করিলেই চলিবে, তবে তিনি আর আপনার মক্কেল থাকিতেন না। কারণ তিনি ক্রুদ্ধ মানুষ। তিনি পরদিনই মামলা দায়ের করিতেই আসিয়াছেন। পরেও মামলা দায়ের করা যাইতে পারে–এই যুক্তি শুনিতে তিনি আসেন নাই। সেই যুক্তি তাঁর আগে হইতেই জানা আছে। কাজেই আপনি অভিজ্ঞ বুদ্ধিমান লোকের মতই বিনা-তর্কে মামলা গ্রহণ করিলেন। তাঁর কথামতই মামলা দায়ের হইবে বলিয়া তাকে বিদায় দিলেন। কিন্তু বাড়ি ফিরিয়াও ভদ্রলোকের শান্তি নাই। একদিন পরেই তিনি আপনার কাছে আসিয়া খোঁজ করিলেন, মামলা দায়ের হইয়াছে কিনা? আপনি তার কাগজ পত্র পড়িয়াছেন। আরজিও মুসাবিদা করিয়াছেন। ফারায়েযটা আবার রিভাইয করিতে হইবে। আর একদিনে মুসাবিদাটা ঠিক হইয়া যাইবে। আপনি সাধ্যমত তাড়াতাড়ি করিয়াছেন। গত দুই রাত্র একটু বেশি রাত্র পর্যন্ত জাগিয়াছেন। কাজেই আপনার মুহরি এবং আপনি নিজেও মওক্কেলকে বলিয়া দিলেন তার মামলা দায়ের হইয়া গিয়াছে। মিথ্যা কথা। কিন্তু এ মিথ্যা কথা আপনি মওক্কেলের অনিষ্ট করিবার জন্য বলেন নাই; এ মিথ্যার ফলে মওক্কেলের কোনও ক্ষতিও হইবে না। বরঞ্চ মওক্কেলের মনটা প্রফুল্ল এবং তার এলাকায় তাঁর মস্তক উন্নত রাখিবার উদ্দেশ্যেই এই মিথ্যা কথা বলিয়াছেন। এই মিথ্যার ফলে মওক্কেলের ভালই হইবে, কারণ আপনি তাড়াহুড়া না করিয়া ধীরে-সুস্থে আরজি মুসাবিদা করায় তাতে ভুল-ভ্রান্তি থাকিবে না।

এটা ত গেল উকিলদের নিজের মিছা কথা কওয়ার আবশ্যকতার নজির। মওক্কেলদেরে দিয়াও যে মিছা কথা বলান কত দরকার, কিভাবে দরকার, তাও আমাদের বিচার করিয়া দেখা দরকার। সরলভাবে স্বীকার করা দরকার যে, মওক্কেলকে ও সাক্ষীগণকে দিয়া মিছা কথা না বলাইয়া মামলা জিতা যায় না। কিন্তু সেগুলি আসলে মিছা কথা নয়, সত্য কথাই একটু গোছাইয়া সাজাইয়া বলা। মাটি, কাঠ ও পাথর দিয়া শিল্পী যেমন সুন্দর মূর্তি গড়েন, একই ঘটনাকে তেমনি বিভিন্ন রূপে ও আকারে সাজাইয়া হাকিমের সামনে উপস্থিত করিতে হয়; তবেই হাকিমরা বিচার করিতে পারেন। শিল্পীর নৈপুণ্যে অনেক সময় নকল জিনিসও আসল বলিয়া ভুল হয়। হাকিমরাও তাই কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভুল বিচার করেন। কিন্তু ঐরূপ না সাজাইয়া শুধু সত্যের ও তথ্যের ঢেলা হাকিমের নাক বরাবর ছুড়িয়া মারিলে হাকিমরা ভুল করিতেন আরো বেশি। এইজন্য আইনও সে ব্যবস্থা করিয়াছে। পুলিশের কাছে যবানবন্দিকে আইন সাক্ষ্য বলিয়া স্বীকার করে না। অপরাধের স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করিবার অধিকার আসামিকে দেওয়া হইয়াছে। এইজন্য দেওয়ানি মামলার বাদী-বিবাদীর আরজি-জবাব উকিলরা মুসাবিদা করিয়া কোর্টে দাখিল করেন; পক্ষগণকে সোজাসুজি আদালতের সামনে দাঁড়াইয়া নিজের কথা বলিবার জন্য পাঠাইয়া দেন না। অর্থাৎ হাকিমের কাছে মক্কেলদের কথা উকিল বলেন আগে, মওক্কেল নিজে বলেন তার পরে। কাজেই মওক্কেলের কথা উকিল মানিয়া চলেন না, মওক্কেলই উকিলের কথামত চলেন। এ বিষয়ে একটি মজার ঘটনা উল্লেখ না করিয়া পারিতেছি না।

.

. সত্যের জন্যে মিথ্যার ভূমিকা

একদিন এক বুড়ো হাজী সাহেব মামলা লাগাইতে আসেন। একজন তাঁর নিকট হইতে প্রায় দেড় হাজার টাকা দামের ধান-সরিষা নিয়াছে। তলব তাগাদায় দেনা শোধ করে নাই। আমি হাজী সাহেবের সঙ্গে খানিক আলাপ করিয়া মুহরির হাওলা করিয়া অন্য কাজে ব্যস্ত হইলাম। কোর্ট ফি, উকিলের ফিস, মুহরির তহুরি ইত্যাদি সব খরচাদি আদায় করিয়া মুহরি খানিক পরে হাজী সাহেবকে আমার সামনে উপস্থিত করেন। আমি এক খণ্ড সাদা কাগজ টানিয়া লইয়া আরজির পয়েন্টস লিখিয়া লইতে লাগিলাম। হাজী সাহেব বলিয়া যাইতে লাগিলেন। বাদী-বিবাদীর নাম, তাদের পিতার নাম, গ্রাম, থানা, ধান-সরিষার পরিমাণ ও দাম লিখিলাম। কিন্তু ঋণ নিবার সময়-তারিখ লিখিতে গিয়া কলম ছাড়িয়া সোজা হইয়া বসিলাম এবং হাজী সাহেবের নিকট চাহিলাম। বলিলাম : হাজী সাহেব, সন-তারিখ ঠিকমত বলিতেছেন ত? কোনও ভুল করেন নাই ত?

হাজী সাহেব মাথা নাড়িয়া জোরের সঙ্গেই বলিলেন : আমার ভুল হইবার উপায় নাই। সব আমার মুখস্থ। কত তাগাদা করিয়াছি। শালার বেটা কি আমারে কম ঘুরাইয়াছে।

আমি বিষণ্ণ মুখে বলিলাম: বড়ই আফসোসের কথা হাজী সাহেব; আপনার মামলা চলিবে না; দাবি আপনার তামাদি হইয়া গিয়াছে।

হাজী সাহেব আসমান হইতে পড়িলেন। বলিলেন : তামাদি হইয়াছে? কেন হইয়াছে? কেন মামলা চলিবে না? হক টাকার আবার তামাদি? আমি হাজী সাহেবকে বুঝাইলাম, আইনের বিধান। তিন বছরের একদিন বেশি হইলেই দাবি পচিয়া গেল। পাওনা যতই হক হোক, আর মামলা চলে না। হাজী সাহেব চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। এখন তবে উপায় কী? আমি বলিলাম, উপায় একটা আছে। আপনার দাবি মাত্র তিন মাসের জন্য তামাদি হইয়া গিয়াছে। আপনি যদি ধান-সরিষার নেওয়ার তারিখ তিন মাস পিছাইয়া বলেন অর্থাৎ যদি পৌষের বদলে ফাল্গুন মাস বলেন, তবেই আপনার তামাদি রক্ষা হয়।

হাজী সাহেব কানে হাত দিয়া তাওবা-আসতাগফারুল্লাহ পড়িলেন। কী! মিথ্যা কথা বলিব? দেড় হাজার টাকার জন্য? মাফ করিবেন উকিল সাহেব। আমি আল্লার ঘর যিয়ারত করিয়া আসিয়াছি। দেড় হাজার ত দূরের কথা, দেড় লাখের জন্যও মিছা কথা বলিতে পারিব না।

হাজী সাহেবের ইমানদারিতে যেমন খুশি হইলাম, তার হক টাকাটা মারা যাইতেছে দেখিয়া তেমনি দুঃখিতও হইলাম। বোধহয় আমার মনের অগোচরে কেসটা হারাইবার আশঙ্কাও কাজ করিতেছিল। তাই হাজী সাহেবকে বুঝাইবার চেষ্ট করিলাম : এটা আসলে মিথ্যা নয়, সত্যের খাতিরে কথা একটু ঘুরাইয়া বলা মাত্র। ঐ লোকটা যে হাজী সাহেবের ধান-সরিষা নিয়াছে, এটা সত্য কথা। সে যে টাকা দেয় নাই, এটাও সত্য কথা। হাজী সাহেব যে লোকটার কাছে দেড় হাজার টাকা পাইবেন, এটাও সত্য কথা। এই হক টাকা ঐ নিমকহারাম লোকটা শোধ করিতেছে না। কাজেই নিরীহ হাজী সাহেবকে কোর্ট করিতে হইতেছে। আল্লার আইনে হক টাকার তামাদি নাই। অথচ গবর্নমেন্ট একটা আইন করিয়াছেন যে পাওনা সত্যই হক হোক, তিন বছর পর হইয়া গেলেই সেটা নাহক হইয়া যায়। আইনটা যে আল্লার নয়, গবর্নমেন্টের, গবর্নমেন্ট যে খৃষ্টান, হাজী সাহেবকে তা-ও বলিলাম। সুতরাং ঐ আইনের সাথে মিল রাখিবার জন্য যদি হাজী সাহেব লেন-দেনের মাসটা সনও নয় তারিখও নয়–একটু নড়চড় করেন, তবে কোনও গোনাহ হইবে না। কারণ সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি এটা করিতেছেন। ফতোয়াটা আরো মযবুত করিবার জন্য বলিলাম : হক পাওনা শোধ করা আল্লার আইন, আর তিন বছরে তামাদিটা খৃষ্টানদের আইন। খৃষ্টানের আইন আল্লার আইনের উপরে যাইতে পারে না।

কিন্তু প্রায় ঘণ্টাখানেকের এই ওজস্বিনী বক্তৃতায়ও কোনো কাজ হইল না। হাজী সাহেব এর পরেও বলিলেন : ‘না উকিল সাহেব, বুড়ো বয়সে এই কয়টা টাকার জন্য মিছা কথা বলিয়া ঈমান নষ্ট করিব না। মামলা আর করিব না, যদি হক্কে থাকে টাকা পাইব, না থাকিলে পাইব না।’

বলিয়া হাজী সাহেব উঠিলেন। আমি মুহরি সাহেবকে বলিলাম : হাজী সাহেবের টাকা ফেরত দাও।

মুহরি সাহেব একতাড়া নোট আনিয়া এমন জোরে টেবিলের উপর রাখিলেন যাতে আমার মনে হইল ঐ নোটের তাড়া দিয়া তিনি আমার মাথায় বাড়ি মারিলেন।

হাজী সাহেব চলিয়া গেলে আমাকে নিরালা পাইয়া মুহরি সাহেব রাগ কম্পিত কণ্ঠে বলিলেন : এই রকমে উকালতি চলিবে না, সার। দেখলেনও ত একটা সামান্য কথায় কতগুলি টাকা হারাইলাম?

মুহরি সাহেব আমার একদিনের ফিস বত্রিশ টাকা ও নিজের তহুরি বাবত পাঁচ টাকা আদায় করিয়াছিলেন। এ ছাড়া দাখিলি, শেরেস্তা, পেশকার, আমলা, নম্বর ইত্যাদি বাবতও আরো দশ টাকা আদায় করিয়াছিলেন। তার উপর আরজির কোর্ট ফি দেড় হাজার টাকা দাবির উপর যা আদায় করিয়াছিলেন তাতেও লাভ থাকিত। পরের টাকা হাতাইয়াও আরাম আছে। কথায় বলে : পরের হলদি বাটিলেও হাতে রং লাগে। কাজেই মুহরি। সাহেবের রাগের কারণ বুঝিলাম। ঠাণ্ডা হাসি হাসিয়া বলিলাম : কি দোষ করিলাম?

মুহরি : তামাদির কথা বলিতে গেলেন কেন?

আমি বিরক্ত-মাখা চোখে চাহিয়া বলিলাম : বলো কী? দাবি তামাদি হইয়া গিয়াছে, মক্কেলকে তা বলিব না? মিথ্যা করিয়া বলা উচিৎ ছিল সব ঠিক আছে?

মুহরি গম্ভীর সুরে বলিলেন : মিথ্যা বলিবেন কেন? কিছু না বলিলেই হইত। আরজি লিখিবার সময় আমরা ঠিক ফালগুন মাসের লেন-দেন লিখিয়া দিতাম। হাজী সাহেবকে পরে বুঝাইলেই তিনি তা মানিয়া নিতেন।

আমি যখন দৃঢ়স্বরে জানাইলাম যে, মুহরি সাহেবের সহিত আমি একমত নই, তখন তিনি বলিলেন, অন্য যে কোনও উকিল তার মত-মতেই কাজ করিতেন। করিবেনও তাই। হাজী সাহেব অন্য উকিলের হাতে পড়িবেন। মামলা দায়েরও হইবে। মাঝখান হইতে আমার ফিসটা মারা গেল। মামলাটা খুবই কনটেটেড হইবে। আরো অনেক ফিস পাওয়া যাইত। আমাদের টাকাও গেল। বদনামও হইল। অন্য উকিল হাজী সাহেবকে বুঝাইবেন, তাঁর মামলা মোটেই তামাদি হয় নাই। যে উকিল তামাদির কথা বলিয়াছে, সে কিছু আইন জানে না। হাজী সাহেব সে কথা বিশ্বাস করিবেন। নাহক আমাদের ফিসটা মারা গেল।

আমি মুহরি সাহেবকে সান্ত্বনা দিলাম, ঐ টাকা আমাদের হক্কে ছিল না বলিয়াই পাইলাম না। যদি ওটা কিসমতে থাকে, তবে ঘুরিয়া-ফিরিয়া তা আসিবেই।

মুহরি সাহেব বিনয়ের নিচে রাগ গোপন করিয়া বলিলেন : ‘টাকা পকেটে পাইয়াও যদি আমরা ফেলিয়া দেই, তবে তা আবার আমাদের পকেটে ফিরিয়া আসিবে টাকার এমন হাত-পা নাই।

মুহরি সাহেব নামাজি মানুষ। খুব সকালে উঠিয়া তিনি কালামুল্লাহ তেলাওত করিতেন। আমি রাগ করিয়া বলিলাম : তুমি নামাজি মানুষ। তাই আল্লার উপর তাওয়াক্কুল না রাখিলেও বোধ হয় তোমার চলে। কিন্তু আমার যে তাওয়াক্কুল ছাড়া চলে না। তুমি দেখিয়া লইও কিসমতে থাকিলে এই মামলা আবার আসিবেই।

সপ্তাহ না যাইতেই হাজী সাহেব আসিয়া হাজির। সেদিন তিনি তার বড় ছেলেকে সঙ্গে আনিয়াছেন। ছেলেও প্রৌঢ়। হাজী সাহেব যা বলিলেন তার মর্ম এই : তিনি সকলের সঙ্গে বুদ্ধি-পরামর্শ করিয়া দেখিয়াছেন। আমার কথাই ঠিক। হক পাওয়ার জন্য আইনের বিধান মানিতে গিয়া কথা একটু ঘুরাইয়া ফিরাইয়া বলা যাইতে পারে। অতএব তিনি মামলা করিবেন। ইতিমধ্যে দুই

একজন উকিল এবং অনেক মুহরি এই মোকদ্দমা হাত করিবার জন্য হাজী সাহেবের বাড়ি পর্যন্ত গিয়াছেন। আমার চেয়ে কম ফিসে ও কম খরচে মামলা জিতাইয়া দিবেন বলিয়াছেন। কিন্তু হাজী সাহেব তাঁদের কাছে মামলা দেন নাই। আমারই কাছে আসিয়াছেন। উপসংহারে তিনি বলিলেন : ‘আমার ছেলেরা ও বিবি সাব বলিলেন, মামলা যদি করিতেই হয়, তবে প্রথমে যে উকিলের কাছে গিয়াছেন, তার কাছে যান। আমার নিজেরও ইচ্ছাও তাই। কিন্তু বিবি সাহেব আমার কথায় বিশ্বাস না করিয়া বড় ছেলেকে সঙ্গে পাঠাইয়াছেন।

আমি হাজী সাহেবের কথা শুনিতে-শুনিতে মাঝে-মাঝে মুহরি সাহেবের দিকে তাকাইতেছিলাম। তিনি একবার আমার চোখে-চোখে চাহিয়াই মাথা হেঁট করিলেন।

হাজী সাহেব কোমর-প্যাঁচা থলি খুলিতে-খুলিতে বলিলেন : আইনের যখন বিধান, তখন হক টাকার জন্য লেনদেনের সময়টা বদলাইতে রাজি আছি তবে তিন-তিনটা মাসের অতবড় মিছা কথাটা না বলিয়া মাস খানেকের কথা বলিলে হয় না?

আমি হাসিয়া বলিলাম : তিন মাসেও যে মিছা হইবে, এক মাসেও সেই মিছাই হইবে।

অবিশ্বাসের মাথা নাড়াইয়া হাজী সাহেব বলিলেন : উকিল সাহেব, আমি উম্মী মানুষ, কিন্তু একেবারে নাদান নই। তিন মাসের মিছা আর এক মাসের মিছার গোনা সমান হইতেই পারে না। এক টাকার চুরি আর একশ টাকার চুরির গোনাও সমান হইতে পারে না।

আমি হাজী সাহেবের সঙ্গে তর্ক বাড়াইলাম না। বলিলাম : আপনার কথাই বোধ হয় ঠিক। কিন্তু তিন মাসের কমে আপনার মামলার তামাদি রক্ষা হয় না। এখন কী করিবেন?

হাজী সাহেব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া অর্ধ সমর্থনের সুরে বলিলেন : দেন তবে আল্লার নামে মামলা দায়ের করিয়া। তিনি মাসই পিছাইয়া দেন। কী করি? হক টাকার জন্য মিছা কথা বলিতে হইবে। আয় খোদা তুমি সাক্ষী থাকিও।

যথাসময়ে মামলার শুনানির দিনে হাজী সাহেব নিজে সাক্ষী দিতে আসিলেন এবং সঙ্গে আরো দুইজন হাজী সাক্ষী ও একজন ইউনিয়ন মেম্বর সাক্ষী হইয়া আসিলেন। সকলে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া ধৰ্মত হলফ করিয়া ফাল্গুন মাসের লেন-দেনের কথা, জুম্মার মসজিদে তলব-তাগাদার কথা এবং বিবাদীর দাবি স্বীকার করার কথা বেদেরেগ বলিয়া গেলেন। বিবাদীর উকিলের জেরার মুখে অগ্রহায়ণ মাসে লেনদেনের কথা খুব জোরের সঙ্গে অস্বীকার করিয়া গেলেন। হাজী সাহেবের মামলা পুরাপুরি ডিক্রি হইল। এবং আপিল পর্যন্ত সে ডিক্রি বহাল রহিল।

.

১০. আলীপুরে

উকিল হিসাবে আমি খুব বড় কেউকেটা ছিলাম না। সাংবাদিকতা ও রাজনীতি করার দরুনই হোক আর আমার অযোগ্যতার দরুনই হোক কথাটা সত্য। কাজেই উকিল হিসাবে আইন-ঘটিত ব্যাপারে কোনও চাঞ্চল্যকর ঘটনা আমার বলিবার নাই। তবু আলীপুর জজকোর্টের অভিজ্ঞতা কিছুটা না বলিলে আমার উকিল জীবনের কাহিনী অপূর্ণ থাকিয়া যাইবে।

আলীপুরের কথা বলিবার আগে বলিতে হয় যিনি আমাকে আলীপুরে নিলেন, তাঁর কথা। ইনি খান বাহাদুর মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম। এর সঙ্গে আগের পরিচয় থাকিলেও ঘনিষ্ঠতা হয় তিনি যখন ময়মনসিংহের মুনসেফ। ঘটনার সময় তিনি বাংলা সরকারের এসিস্ট্যান্ট জুডিশিয়াল সেক্রেটারি। সেক্রেটারি না থাকায় তিনিই তখন অফিশিয়েটিং জুডিশিয়াল সেক্রেটারি। নিতান্ত অকস্মাৎ নবযুগএর চাকুরি যাওয়ায় আমি যখন কী করি, কী করি করিতেছিলাম, তখন সেই বন্ধু ফেরেশতার মত আমার জীবনে উদয় হইলেন। নিজের আইনের বই-পুস্তক দিলেন। বাপের পরিত্যক্ত গাউনটা আমার কাঁধে তুলিয়া দিয়া বলিলেন : উপযুক্ত উত্তরাধিকারীর কাঁধে উঠিল এটা। তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত জিলা ও সেশন জজ মৌ, আবদুল খালেক। শুধু বই-পুস্তক ও গাউনই দিলেন না। তিনি আমাকে নিয়া আলীপুরের সমস্ত জজ-মুনসেফ ও কলিকাতা স্মল ক্যু কোর্টের জজদের সঙ্গে পরিচিত করিয়া দিলেন।

এর ফল হাতে-হাতে পাইলাম। উকালতির শুরুতে হাকিমদের সহায়তা, সুনজরের পৃষ্ঠপোষকতা যে কত মূল্যবান, সে কথা বুঝাইয়া বলা অনাবশ্যক। মামলা পরিচালনার সময় জেরা-বানবন্দির সময় যদি হাকিম বলেন, ‘চমঙ্কার’, ‘বেশ করিতেছেন’, ‘ওয়েল ডান ফর এ বিগিনার’, তবে নূতন। উকিলের শুধু আত্মবিশ্বাস ও সাহসই বাড়ে না, জনপ্রিয়তা ও পসারও সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়া যায়। পক্ষান্তরে ঐ সময় হাকিম যদি বলেন, ‘তৈয়ার হইয়া আসেন নাই’, ‘আইন-কানুন কিছু জানেন না’, ‘মওক্কেলের সর্বনাশ করিতেছেন’ তবে সে নূতন উকিলের প্র্যাকটিসের বারটা বাজিয়া যায়। সিনিয়রদের জন্য অবশ্য হাকিমের ভাব-গতিকে বেশি কিছু আসে যায় না; কিন্তু নবাগতের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধুবর সিরাজুল ইসলাম। এইভাবে আমাকে প্র্যাকটিসের পাকা সড়কে তুলিয়া দিয়াছিলেন। আমি সারাজীবনেও তাঁর এ দেনা শোধ করিতে পারিব না।

আলীপুরের মর্যাদার অভিজ্ঞতাও তেমনি আমার মনে থাকিবে। প্রথমত, উকিল-মুহরির সম্পর্ক। আলীপুরের মুহরিদিগকে আমি সলিসিটর উপাধি দিয়াছিলাম। কার্যত হাইকোর্টের সলিসিটর যা আলীপুরের মুহরিও তাই। অন্যান্য স্থানে মুহরিকে জিজ্ঞাসা করা হয় : ‘আপনি কোন উকিলের শেরেস্তায় কাজ করেন? আর আলীপুরের উকিলদেরে জিজ্ঞাসা করা হয় : ‘আপনি কোন মুহরির শেরেস্তায় কাজ করেন? বস্তুত ‘শেরেস্তা মুহরিদেরই। উকিলদের প্রায় কারুরই শেরেস্তা নাই। সেখানে মওক্কেল আসে মুহরিদের কাছে। তারাই কেস নেন; কাগজ-পত্র, দলিল-দস্তাবেজ বুঝিয়া লন। টাকা পয়সা লন। উকিলের ফি আদায় করেন তারাই। কেসের শ্রেণী ও গুরুত্ব হিসাবে উকিল নিযুক্ত করেন তাঁরাই। উকিলকে ফিসও দেন তাঁরাই। এ কাজের জন্য তাদের প্রত্যেকের নিকট বিস্তারিত ও বড় নোট বই আছে। সে নোট বইয়ে বর্ণানুক্রমিক সূচিপত্রও আছে। এসব কাজ করিতে গেলে যে আইন জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও বিদ্যা-বুদ্ধির দরকার, আলীপুরের মুহরিদের অধিকাংশের মধ্যেই তা আছে অন্তত আমার আমলে ছিল। আমার মুহরির নাম ছিল মোহাম্মদ আমজাদ আলী মিয়া। অর্থাৎ আমি তাঁরই শেরেস্তার উকিল ছিলাম। লেখক সাহিত্যিক হিসাবে আমার নাম জানিতেন বলিয়াই। গোড়াতে তিনি দয়া করিয়া আমাকে তাঁর শেরেস্তার জুনিয়র উকিলের তালিকাযুক্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু অল্পদিনেই তিনি আমাকে সিনিয়র লিটিতে নেন এবং আরো কিছুদিন পরে তিনি আমাকে তাঁর শেরেস্তার প্রধান করেন। তার কাছে আমি উকালতির অনেক প্যাঁচ-মোচড় ও মামলার প্রধান ইঞ্জিনিয়ারের কাজকর্ম অনেক কিছু শিখিয়াছি। ভদ্রলোক ত মুহরি নন, পাশ-না-করা সনদহীন একজন উকিল।

মোকদ্দমার তদারককারীদের সকলেই যে টাউট নয়, এ অভিজ্ঞতাও হয় আমার আলীপুরেই। সেখানেই আমি প্রথম জানিতে পারি শিক্ষিত অবস্থাশালী ও অবসর-প্রচুর দুই-একজন গ্রাম্য মাতব্বরের এটা শখ, এটা তাদের অবসর বিনোদনের একটা স্পোর্টস। আলীপুরে কয়েক মাস কাটিবার পর আমজাদ মিয়া এক ভদ্রলোককে আমার সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দেন। বলেন : ভদ্রলোক আমার বই-পুস্তক বিশেষত আয়নার একজন সমঝদার। আমার একজন ভক্ত। ভদ্রলোকের নাম সিদ্ধেশ্বর প্রামাণিক। পাড়াগাঁয়ের একজন হিন্দু ভদ্রলোক আমার লেখার ভক্ত শুনিয়া খুশি হইলাম। আমি যতদিন আলীপুরে ছিলাম, এই ভদ্রলোক ততদিনই মাসে গড়ে দুই-তিনটা বড়-বড় কেস আমাকে দিতেন। প্রথম দিন যখন কেস আমাকে দেন, সেদিন তাঁকে আমি বড় রকমের টাউট মনে করিয়াছিলাম। আমার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা এবং মোকদ্দমার ইনস্ট্রাকশনে তার উৎসাহপূর্ণ অংশগ্রহণ হইতেই আমার এই ধারণা হইয়াছিল। ভদ্রলোক চলিয়া গেলে আমজাদ মিয়ার নিকট আমার মনোভাব ব্যক্ত করিলে তিনি জিভ কাটিয়া বলেন : উনি তেমন লোক নন। রোদ বৃষ্টি-ঝড়-তুফান তিনি অগ্রাহ্য করিয়া ভদ্রলোক অমন নিঃস্বার্থভাবে মাসে দুই-তিন বা তার চেয়েও বেশি বার আমার কাছে পরের কেস নিয়া আসেন দেখিয়া নিজের খাইয়া বনের মহিষ তাড়াইবার’ তার শখে আমি সত্যই আশ্চর্য হইয়াছিলাম। তার প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জন্মিয়াছিল। কিন্তু এর পরে আরো বিস্মিত হইয়াছিলাম, যখন জানিতে পারিলাম তিনি হিন্দু নন, মুসলমান। ঘটনাচক্রেই এটা জানিতে পারিলাম। আমার সামনে একটা কাগজে নিজের নাম দস্তখত করিতে গিয়া পিতার নাম লিখিলেন আইনুদ্দীন প্রামাণিক। সিদ্ধেশ্বর প্রামাণিকের পিতার নাম আইনুদ্দীন প্রামাণিক? বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলিলাম; ভদ্রলোক আর্য সমাজীর পাল্লায় পড়িয়া শুদ্ধি হইয়াছেন নাকি?

ভদ্রলোক আমার বিস্ময় বুঝিতে পারিয়া সব বলিলেন। তাঁর আসল নাম সিদ্দিকুর রহমান প্রামাণিক। শৈশবে বাবা মারা যান। হিন্দু-প্রধান এলাকা। প্রতিবেশীরা তাঁকে সিদ্ধেশ্বর’ বলিয়া ডাকিত। হিন্দু বাড়িতে হাইস্কুল। সব শিক্ষক হিন্দু। কাজেই স্কুলের রেজিস্ট্রারিতেও তাঁর নাম উঠিল সিদ্ধেশ্বর প্রামাণিক। সেটেলমেন্ট-পর্চায়, সাবরেজিস্টারি আফিসে, জমিদারের শেরেস্তায় এবং ইউনিয়ন বোর্ডের খাতায় তিনি এখন সিদ্ধেশ্বর প্রামাণিক। নাম-সংশোধন করা কঠিন ও ব্যয়সাধ্য ব্যাপার।

নিজের গ্রামের কথা মনে পড়িল। সেখানে দুইজন প্রতাপশালী সম্মানী হিন্দু মাতব্বর ছিলেন। একজন ইনছান দাস (ঈশ্বান চন্দ্র দাস), অপরজন ওমর সরকার (উমাচরণ সরকার)। এঁরা নিজ মুখেই ইনছাস দাস’ ও ‘ওমর সরকার’ বলিতেন। কারণ আসল নাম বলিলে রাতের অন্ধকারে কেউ চিনিতও না; হয়ত তাদের প্রাপ্য সম্মানও দিত না। কিন্তু তাঁদেরও নাম খাতা পত্রে ঠিক ছিল সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের মত এমন ‘ঢাকী-শুদ্ধা বিসর্জন’ তাঁদের দিতে হয় নাই।

কলিকাতা হইতে ফিরিয়া আসিয়া ১৯৫০ হইতে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহেই উকালতি করিলাম। আমার আগেকার মুহরি আখতারুদ্দীন খা আমার সাহচর্যে পেটি-ফগিং ঘৃণা করিতে শিখিয়াছিলেন। কাজেই আমি ময়মনসিংহ ছাড়ার পরে তিনিও মুহরিগিরি ছাড়িয়া বাড়িতে অবসর জীবন যাপন করিতেছিলেন। কারণ তাঁর অবস্থা ভাল। আমি পুনরায় উকালতি শুরু করায় তিনি আসিয়া আমার মুহরিগিরি নিলেন।

কিন্তু বার বছর আগে ময়মনসিংহ ছাড়িবার সময় আমি যা ছিলাম তা আর নাই। এখন বয়স হইয়াছে, স্টাইল বাড়িয়াছে, আমিরি শিখিয়াছি; পরিবার বড় হইয়াছে, সুতরাং খরচও বাড়িয়াছে। তাই আয়ও অনুপাতে বাড়া দরকার। শুধু দেওয়ানিতে তাড়াতাড়ি অত টাকা আসিবে না। কাজেই ফৌজদারিতে যাওয়া দরকার। আখতার মিয়ার সঙ্গে গভীর পরামর্শ করিলাম। ফৌজদারির প্রতি তাঁরও ঘৃণা ছিল খুব বেশি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফৌজদারিতে যাওয়া ঠিক হইল। নিম্ন আদালতে বেল-টেলের ব্যাপারে দুই-একদিন গেলামও।

অমনি টাউট মহলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হইল। তাঁদের পক্ষে এক দল প্রতিনিধি বেশি রাতে আমার সঙ্গে দেখা করিলেন। তাঁরা নিতান্ত ভদ্রভাবে মিষ্টি ভাষায় যা বলিলেন, তার সারমর্ম এই : আমি ফৌজদারি লাইনে আসায় তারা আনন্দিত। কিন্তু তাদের সহানুভূতি ছাড়া আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। ইতিপূর্বে আমি উদ্যোগী হইয়া তাদের অনেককে জিলা জজ ও জিলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়া টাউটনোটিফাই করাইয়াছিলাম, সে কথা তারা মনে রাখিবেন না। পুরাপুরিই আমাকে সাহায্য করিবেন। তাদের সহায়তা নিলে আমি কেস করিয়া দম ফেলিতে পারিব না। টাকা রাখিবার স্থান পাইব না। তাঁরা এখন এসোসিয়েশন ফার্ম করিয়াছেন। ইচ্ছা করিলে তাঁরা একজনকে আসমানেও তুলিতে পারেন, পাতালেও নামাইতে পারেন। তাঁদের সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখিলে মামলায় খুব বেশি খাঁটিবার দরকার নাই। সব মামলা জিতিবারও দরকার নাই। হারি আর জিতি মওক্কেল আমার হাতছাড়া হইবে না। কারণ জিতিলেও জিৎ হারিলেও জিৎ। যদি মামলায় জিতি, তবে আমার সেটা কৃতিত্ব। তখন আমার তারিফে তারা দেশের আকাশ-পাতাল মুখরিত করিবেন। আর যদি হারি, তবে দোষ হইবে হাকিমের জুরির। হাকিম ও জুরিরা অপর পক্ষের মোটা টাকা খাইয়া আমার জিতা মামলাটার বিরুদ্ধে রায় দিয়াছেন। আপিলে ও হাইকোর্টে সব ঠিক হইয়া যাইবে। স্থানীয় আপিল হইলে আবার ফিস পাইব। আর হাইকোর্ট হইলে নিজের লোককে কেস দিয়া সেখানেও অংশ পাইব। এত সুবিধা। আর যদি তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখি, তবে মামলা হারিলে হার, জিতিলেও হার। যদি জিতি তবে তারা প্রচার করিবেন, অমন সহজ মামলায় উকিলের দরকারই ছিল না। যে কোনও জুনিয়র অথবা একজন মোখতার দিয়া ওর দশভাগের একভাগ খরচে মামলা হইয়া যাইত। সরল মওক্কেল পাইয়া আমি অমন। গলাকাটা ফিস নিয়াছি। আর যদি হারি, তবে ওরা বলিয়া বেড়াইবে এটা হারিবার মামলাই নয়। আমি ভুল জেরা করিয়া বাদী পক্ষের কেস প্রমাণ করিয়া দিয়াছি। মানুষ বুঝিয়া কারো কাছে তাঁরা বলিবেন, কবি-সাহিত্যিক মানুষ রাতদিন বই লিখিয়া কাটান, আইনের বই পড়ার সময় কই? সব আইন ভুলিয়া গিয়াছেন। আর কারো কাছে বলিবেন, অপর পক্ষের কাছে টাকা খাইয়া মওক্কেলের এই সর্বনাশ করিয়াছেন। শুধু এই মওক্কেল না, আরো অনেকেরই এইরূপ সর্বনাশ করিয়াছেন। আমাকে কেস দেওয়া মানেই ফাঁসির দড়ি নিজ গলায় দেওয়া ও জেলের দরজা নিজ হাতে খুলিয়া দেওয়া।

বার বছর আগে হইলে এঁদেরে যুদ্ধে আহ্বান করিয়া গলাধাক্কা দিয়া বাহির করিয়া দিতাম। কিন্তু এবার দিলাম না। কারণ স্পষ্টই দেখিলাম, এঁদের কথায় অতিশয়োক্তি থাকিলেও মোটামুটি সত্য। কাজেই তাঁদেরে চা-পান খাওয়াইয়া এবং চিন্তা করিয়া দেখিবার ওয়াদা করিয়া বিদায় করিলাম।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত এদের নিকট মাথা নত করিলাম না। অন্য উপায় অবলম্বন করিলাম। মোখতারদের সঙ্গেই অর্থনৈতিক সম্বন্ধ স্থাপন করিলাম। ফিসের অংশ যখন দিতেই হইবে, তখন মোখতারদেরেই দিব, টাউটকে দিব না। মোখতাররা আমাদের ‘সহব্যবসায়ী। তাঁরাও সনদধারী। তারাও উকিলদের মতই আদালতের অফিসার। কিন্তু ব্যাপারটাকে সুষ্ঠু ও বিবেক সংগত করিবার জন্য মোখতারের অংশটার নাম দিলাম ‘জুনিয়র ফিস’। আমার ফিস আদায়ের ক্ষমতাও ছাড়িয়া দিলাম তাদেরই হাতে। অতঃপর ফৌজদারি প্র্যাকটিসেও আমার অসুবিধা থাকিল না। বলা হয়, উকালতি রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কথাটা সত্য শুধু আইন সভার মেম্বর হওয়া পর্যন্ত। মন্ত্রী হইলেন ত উকালতি গেল। মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পর এক্স-মিনিস্টার হিসাবেও সুবিধা হয়; কিন্তু সেটা শুধু ক্রিমিন্যাল প্র্যাকটিসে। দেওয়ানি প্র্যাকটিসে একবার কনটিনিউটি ভাঙ্গিলে আর সহজে জোড়া লাগে না। আমারও লাগে নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *