১৬. রাষ্ট্রিক বনাম কৃষ্টিক স্বাধীনতা

অধ্যায় ষোল – রাষ্ট্রিক বনাম কৃষ্টিক স্বাধীনতা

. মার্কিন নজির

আমাদের জাতীয় মর্যাদা, কৃষ্টিক স্বকীয়তা ও রাষ্ট্রিক সার্বভৌম-স্বাধীনতার জন্য যে দুইশ বছরের আমাদের কালচারের টাওয়ার কলিকাতার প্রভাবমুক্ত হইতে হইবে, এটা আমি উপলব্ধি করি জার্মান, ইটালি, আয়ারল্যান্ড ও মার্কিন মুল্লুকের ভাষিক-সাহিত্যিক কৃষ্টিক-উদ্বর্তনের ইতিহাস পড়িয়া। এইসব আন্দোলনের ইতিহাসই আমার মনে গভীর রেখাপাত করিয়াছে সত্য কিন্তু মার্কিন মুল্লুকের সর্বগ্রামটা আমার মন ও মস্তিষ্ককে উদ্বেলিত করিয়াছে সবচেয়ে বেশি। এ দাগ সৃষ্টি করেন ইমার্সন। ১৯৬২ সালে আমি বাংলা একাডেমিতে ‘সাহিত্যের প্রাণ, রূপ ও আঙ্গিক’ নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ পড়ি। তাতে পাক-বাংলার ভাষা-সাহিত্যের স্বাতন্ত্র্য ও কৃষ্টিক স্বকীয়তার কথা বলি এবং বৃটেনের ভাষা-সাহিত্য হইতে মার্কিন ভাষা-সাহিত্যের স্বাতন্ত্রের নজির দেই। সমবেত সাহিত্যিকদের অধিকাংশ আমার প্রতিবাদ করেন। আমার কথাকে তারা অবিভাজ্য বাংলা কৃষ্টি-সাহিত্যকে দ্বিখণ্ডিত করার ষড়যন্ত্র আখ্যা দেন। জবাবে আমি বলি ইমার্সনের মত পণ্ডিত ব্যক্তির কথা বুঝিতে মার্কিনবাসীর পঞ্চাশ বছর লাগিয়াছিল, আমার মত অপণ্ডিত ব্যক্তির কথা বুঝিতে আপনাদের একশ বছর লাগিলেও আমি তাতে বিস্মিত হইব না। পাঠকদের সুবিধার জন্য আমি এখানে মার্কিন জাতির সেই সংগ্রামী উদ্বর্তনের কথাটারই পুনরুল্লেখ করিতেছি।

মার্কিনীরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করে ১৭৭৬ সালে। কিন্তু ভাষিক ও সাহিত্যিক স্বাধীনতা লাভ করিতে তাদের আরো দেড়শ বছর লাগিয়াছিল। এ সব ব্যাপারে স্বকীয়তার আবশ্যকতা উপলব্ধি করিতেই তাদের প্রায় একশ বছর লাগিয়াছিল। একবার জাতীয় স্তরে সে উপলব্ধি ঘটিয়া গেলে প্রয়োগের স্তরে আর বেশি সময় লাগে না। মার্কিনীদেরও লাগে নাই। মাত্র পঞ্চাশ বছরেই মার্কিন জাতি জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইংরাজ জাতির থনে পৃথক স্বতন্ত্র-স্বাধীন-স্বকীয় ব্যক্তিত্ব হাসিল করিয়া ফেলে। উপলব্ধির মুদ্দতটা যেমন ছিল দীর্ঘ, প্রসেসটাও ছিল তেমনি কণ্টকাকীর্ণ। রাজনৈতিক সিভিল ওয়ারের মতই এটাও ছিল কৃষ্টিক-সাহিত্যিক সিভিল ওয়ার। রাজনৈতিক যুদ্ধে জিতার চেয়ে কৃষ্টিক যুদ্ধে জিতা আরো বেশি কঠিন। রাজনীতিক পরাধীনতাটা দৈহিক ও দৃশ্যমান। কিন্তু কৃষ্টিক পরাধীনতাটা মানসিক ও অদৃশ্য। দীর্ঘদিনের পরাধীনতা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যেমন অভ্যাসে পরিণত হয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ততটা হয় না। কৃষ্টিক-ভাষিক-সাহিত্যিক পরাধীনতাটা যেমন একটা এলিটিমের পোশাকি ভব্যতায় পরিণত হইতে পারে, রাজনৈতিক পরাধীনতা তেমন হইতে পারে না। ফলে রাজনীতিক চেতনার বিস্ফোরণটা যত সহজে গণভিত্তিক হইতে পারে কৃষ্টিক চেতনাটা তেমন গণভিত্তিক হইতে পারে না। এই কারণে আমাদের দেশের বর্তমান লেখক-সাহিত্যিকরা কলিকাতার ভাষা কৃষ্টির মোকাবিলায় যেমন হীনম্মন্যতায় ভুগিতেছেন, পুরা উনিশ শতকের মার্কিন সাহিত্যিকরা তেমনি হীনম্মন্যতায় ভুগিতেছিলেন লন্ডনের ভাষা সাহিত্যের মোকাবিলায়। আমাদের লেখক-সাহিত্যিকরা বর্তমানে যেমন আমাদের নিজস্ব ভাষার বাক-রীতি ও উচ্চারণ-ভঙ্গিতে কলিকাতা শান্তিনিকেতনের বাক-রীতির মোকাবিলায় হেয় ভালগার ও অভব্য মনে করেন, ঐ যুগের মার্কিন লেখক-সাহিত্যিকরাও তেমনি লন্ডন-অক্সফোর্ডের বাক-রীতি ও উচ্চারণ-ভঙ্গির মোকাবিলায় মার্কিনী বাক-রীতি ও উচ্চারণ ভঙ্গিকে ভালগার ও অসভ্য মনে করিতেন।

.

. স্বাতন্ত্র-বোধের উন্মেষ

মার্কিনীদের ভাষিক-সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র্য লাভে দেড়শ বছরের বেশি সময় লাগিলেও দু-চারজন মার্কিনীর মধ্যে সে চৈতন্য-স্ফুরণ ঘটিয়াছিল খুব দ্রুতগতিতেই। এঁদের মধ্যে সকলের আগে নাম করিতে হয় বিশ্ববিখ্যাত ওয়েবস্টারস ডিকশনারির রচয়িতা নোআ ওয়েবস্টারের। যদিও তিনি তাঁর রচিত ডিকশনারি প্রকাশ করেন ১৮২৮ সালে; কিন্তু তাঁর চল্লিশ বছর আগেই ১৭৮৯ সালে তাঁর ইংরাজি ভাষা সম্বন্ধে বিশেষ বক্তব্য ‘ডিসার্টেশন অন ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ’ নামক নিবন্ধে বহু তথ্যপূর্ণ যুক্তি দিয়া এই উপসংহার টানিয়াছিলেন : কতিপয় অবস্থা-গতিক ভবিষ্যতে ইংরাজি ভাষা হইতে মার্কিন ভাষার পৃথকীকরণ আবশ্যক ও অনিবার্য করিয়া তুলিবে।’ এই নিবন্ধ প্রকাশের চল্লিশ বছর পরে ওয়েবস্টার ১৯২৮ সালে তাঁর বিশ্ববিখ্যাত অভিধান প্রকাশ করেন। এই অভিধানে তিনি ইংরাজি ভাষায় অপ্রচলিত বহু মার্কিন শব্দ অন্তর্ভুক্ত করেন।

.

. ওয়েবস্টারের দৃঢ়তা

কিন্তু তার আগেই ১৮০৬ সালেই নোআ ওয়েবস্টারের প্রতিবাদে বেশ কিছু মার্কিন সাহিত্যিক কলম ধরেন। তার মধ্যে ডেভিড ব্যাসনে ওয়েবস্টারকে লেখেন : দুর্ভাগ্যবশত যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের ভাষার মধ্যে এমন কোনও মিল ও মিলন নাই যাতে একটা ঐক্যবদ্ধ মার্কিন ভাষা হইতে পারে। মার্কিন জাতির নিজস্ব ভাষা সৃষ্টির নব উদ্যমকে অঙ্কুরে বিনাশ করিবার এমন চেষ্টা অনেকে করিয়াছিলেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও জিলার ভাষিক বৈচিত্র্যকে ঐক্যবদ্ধ ‘ঢাকাইয়া বাংলা সৃষ্টির দূরপনেয় প্রতিবন্ধক আখ্যা দিয়া ‘কোলকেতেয়ে বাংলাকেই আমাদের সাহিত্যের ভাষা রাখিবার যুক্তি যারা দেন, তাঁদের জুড়ি উনিশ শতকের আমেরিকাতে অনেক ছিলেন। এঁদেরে লক্ষ্য করিয়াই ১৮১৭ সালে জেমস পলভিং লিখিয়াছিলেন : ‘এঁদের হাতে মার্কিনী ছাপা কোনও পুস্তক পড়িলেই তার ভাল দিক চাপিয়া গিয়া এঁরা শুধু খারাপ দিকই করিয়া দেখাইয়া থাকেন।’

এ সব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নোআ ওয়েবস্টার ১৮২৮ সালে তার বিপ্লব সৃষ্টিকারী ডিকশনারি প্রকাশ করেন। এই সালেই এন্ড্রু জ্যাকসন যুক্তরাজ্যের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। জ্যাকশন ছিলেন গোড়া মার্কিন স্বকীয়তাবাদী। স্বাধীন মার্কিন যুক্তরাজ্যের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও রাষ্ট্র-দার্শনিক তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফার্সন তাঁর জীবন-সায়াহ্নে ১৮২১ সালে লেখেন : ইংরাজি ও মার্কিন কালচার সম্পূর্ণ পৃথক। আমাদের কালচার বিকশিত হইতে পারে কেবলমাত্র আমাদের নিজস্ব ভাষাতেই। এই সময় ইমার্সন তার অসাধারণ সৃজনশীল ও উর্বর কলম লইয়া মার্কিনী স্বকীয়তার পক্ষে মাঠে নামেন। বৃটিশ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেনস মার্কিনী ইংরাজির বিদ্রূপ করিয়া। কতিপয় চরিত্র সৃষ্টি করেন। আর বলেন যে আমেরিকানরা ঐ রূপ অমার্জিত ভালগারিযমকেই ইডিয়ম মনে করে। ১৮৪২ সালের জার্নালে ইমার্সন ডিকেনসের রচনার ও মন্তব্যের প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন : যদিও আমেরিকানরা বাস্তব জীবনে তাদের কথাবার্তায় অমন ভাষা ব্যবহার করে না, তথাপি মি. ডিকেনস এখান-ওখান হইতে দু-চারটা অমার্জিত শব্দ যোগাড় করিয়া উহাই মার্কিন চরিত্রগুলির মুখে ঢুকাইয়া দিয়া মার্কিনীদের ভাষার ক্যারিকেচার করিয়া থাকেন।

.

. দেশি শত্রুতা বনাম বিদেশি শত্রুতা

ইমার্সন-বর্ণিত ঘটনার নজির আমাদের দেশেও আছে। তবে সেটা করেন আমাদের বিখ্যাত পশ্চিম বাংলার লেখকরা না-খোদ আমাদের দেশের ঔপন্যাসিক-নাট্যকাররাই। তাঁদের রচিত নাটক-উপন্যাসের ডায়লগে বাংলাদেশি ‘ভদ্রলোক’ চরিত্রেরা পশ্চিম-বাংলার সাধু কথ্যভাষাই ব্যবহার করেন (যদিও বাস্তব জীবনে তা ঘটে না)। কিন্তু ঐ সঙ্গে চাকরবাকর, কুলি ও মজুরদের মুখে বাংলাদেশের কথ্যভাষার ব্যবহার করা হয় বিকৃতরূপে ও ভঙ্গিতে যেন শুধু ক্যারিকেচার করিবার উদ্দেশ্যেই।

যা হোক মার্কিনী জনগণের মধ্যে নিজেদের ভাষার প্রতি মমতা ততদিনে বেশ সচেতন ও মুখর হইয়া উঠিলেও নামযাদা শিল্পী-সাহিত্যিকরা তখনও বিলাতী ইংরাজির প্রতি তাঁদের মোহ কাটাইয়া উঠিতে পারেন নাই। তাদের মধ্যে হেনরি জেমস, কুপার, হথর্ন ও ওয়াশিংটন আর্ভিংসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কুপার ও ওয়াশিংটন জনগণের ভয়ে প্রথম-প্রথম ছদ্মনামে লিখিতেন। শিল্পী হিসাবে খ্যাতি লাভ করার পরে নিজ নামে লেখা শুরু করার পরেও তারা বিলাতী ইংরাজিতেই লিখিতেন। সেজন্য তাঁরা তাঁদের উপন্যাসের চরিত্রগুলিকে ইংরাজ ও ঘটনাস্থলগুলি ইংলন্ডের শহর নগর-পল্লী বাছিয়া লইতেন। ঘটনাকালকেও তারা স্বাধীনতা লাভের আগের দিনে লইয়া যাইতেন। এঁরা সকলেই যার-তার সময়ে নামযাদা শিল্পী হইলেও তাঁরা বলিতেন, মার্কিনীদের জীবনে নাটক-নভেলের উপকরণ খুব দুর্লভ।

বাংলাদেশেও এঁদের জুড়ির সংখ্যাই বেশি। আমাদের লেখক সাহিত্যিকদেরও অভিমত মনে হয় এই যে বাঙ্গালদের, বিশেষত মুসলমান বাঙ্গালদের, জীবনে নাটক-নভেলের উপকরণের খুবই অভাব। তাই তাঁদের গল্প-উপন্যাসের ঘটনাস্থলের নাম থাকে না। দেশহীন এই সব চরিত্রের নামগুলি বেশির ভাগ মুসলমান হইলেও তাদের কথাবার্তা আচার-আচরণে তাঁদেরে পশ্চিম-বাংলায় ভদ্রলোক’ বলিয়াই মনে হইবে।

ঐ যুগের মার্কিনী ঔপন্যাসিকদের মধ্যে এইরূপ হীনম্মন্যতাকে তাই হুইটম্যান-মাৰ্কটুইন, ফকনার কষিয়া গাল দিয়াছেন। মাৰ্কটুইন সগৌরবে। ঘোষণা করিয়াছেন : আমাদের জনগণের মুখের ভাষাই আসলে শালীন ভাষা। কতিপয় শিক্ষিত লোকের ভাষাই আসল ভাষা নয়। মুষ্টিমেয় ভদ্রলোকের আচার-আচরণই ভদ্রতা নয়। বিপুলসংখ্যক নিরক্ষর লোকের ভাষাই প্রকৃত জাতীয় ভাষা। এই দিক হইতে মার্কিনী ইংরাজি ও ইংলন্ডের ইংরাজি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দুইটা ভাষা। হুইটম্যানও প্রায় একই কথা বলিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন : ‘ভালগারিযম বলিয়া কিছু নাই। সব জীবন্ত ভাষাই গোড়াতে ভালগার ছিল। জনগণের মুখের তথাকথিত অমার্জিত ভাষা জীবনের প্রয়োজনে সাহিত্যে গৃহীত হয়; তাতেই তা সাহিত্যের ভাষা হইয়া যায়। অবশেষে বৈয়াকরণদের প্রাণহীন শব্দতালিকাতেই সেই সব শব্দ স্থান। পায়। হুইটম্যান তার রচনায় বহুল ব্যবহারে প্রমাণ করিয়াছেন যে কথাকথিত ভালগার শব্দ ও শব্দসমষ্টিই বিপুল প্রাণবন্ত ও জীবন্ত ভাষার প্রকৃত সম্পদ। শিক্ষিত ভদ্রলোকদের মুখের ভাষার চেয়ে অশিক্ষিত জনতার তথাকথিত অশ্লীল শব্দগুলিই জীবন্ত কাব্য ও সাহিত্যকে প্রাণবন্ত করিয়া থাকে।

.

. দূরদর্শী বিদেশির সদুপদেশ

শুধু দূরদর্শী দেশপ্রেমিক আমেরিকান লেখকরাই নন, ইউরোপীয় কোনও কোনও মনীষীও মার্কিন জাতিকে ভাষা-সাহিত্যে স্বকীয়তা অর্জনের উপদেশ দিয়াছেন। বিখ্যাত ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পণ্ডিত এলেক্সি-ডি-তোকভিল ১৮৩১ সালে আমেরিকা ভ্রমণ করিয়া লিখিয়াছিলেন : আমেরিকান সাহিত্যিকরা নিজেদের দেশে বাস করেন না। তারা মনের দিক হইতে ইংলন্ডে বাস করেন। ইংরাজ সাহিত্যিকরাই আজও আমেরিকান সাহিত্যিকদের মডেল। কিন্তু এটা বেশি দিন চলিবে না। মার্কিনী জনগণের ভাষাই হইবে মার্কিন সাহিত্যের ভাষা। মার্কিন জনগণ ইংলন্ডের ভাষায় নয়, তাদের নিজস্ব ভাষাতেই সাহিত্য সৃষ্টি চায়। আমেরিকা একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সে গণতন্ত্রের সম্যক বিকাশ হইতে পারে মার্কিন জনগণের ভাষাতেই।

প্রায় একশ বছর পরে আরেকজন ফরাসি পণ্ডিত প্রায় একই কথা বলিয়াছিলেন। তিনি ছিলেন অধ্যাপক এ জি সুলেয়ার। তিনি ছিলেন ইয়েল ইউনিভার্সিটির ফরাসি ভাষার অধ্যাপক। ১৯২৯ সালে তিনি ইয়েল রিভিউ পত্রিকায় লিখিয়াছিলেন : মার্কিন সভ্যতা যেদিন ইংরাজি সভ্যতার আবেষ্টনী হইতে মুক্ত হইয়া স্বকীয়তা লাভ করিবে, এবং এটা ঘটিতে আর বেশি বিলম্বও নাই, তখন মার্কিন ভাষা ও ভাষার নিজস্ব জীবনের প্রয়োজনেই, মার্কিন জাতি জাতীয় ভাষার রূপ প্রদানে মার্কিন বাচনভঙ্গিই গ্রহণ করিবে।

এ ভবিষ্যদ্বাণী সফল হইতে সত্যই বেশি সময় লাগে নাই। কারণ ততদিনে মার্কিনবাসীর কৃষ্টিক-ভাষিক ও সাহিত্যিক স্বকীয়তার বাণী খুব জোরদার হইয়া উঠিয়াছে। ইমার্সন, মাৰ্কটুইন, হেনরি ক্যাবটলজ, ফাউলার, জর্জ মেইশ, হুইটম্যান প্রভৃতি উনিশ শতকের শেষার্ধের শক্তিশালী লেখকদের প্রচারের ফলে মার্কিন গণ-মনে ততদিনে শুধু মার্কিন ভাষাপ্রীতি নয়, ইংরাজি বিদ্বেষও জাগ্রত হইয়া গিয়াছে। ভাষা-বিদ্বেষ ক্রমে জাতি-বিদ্বেষে রূপান্তরিত হইয়াছে। আমাদের বেলা ঘটি’ ও ‘বাঙ্গালের মত ইংরাজকে ‘জনবুল ও মার্কিনকে ‘ব্রাদার জনাথন’ বলাও ততদিনে গালিতে পরিণত হইয়া গিয়াছে। মার্কিন জাতির নিজস্ব ভাষার পক্ষে জনমত ততদিনে এতই তীব্র হইয়া উঠিয়াছে যে ১৯২৩ সালে ইলিনিওস অঙ্গরাজ্যের রাজধানী শিকাগোর আইন পরিষদে এই মর্মে একটা বিল পাশ হয় যে ইলিনিওস অঙ্গরাজ্যের সরকারি ভাষা (অফিশিয়াল ল্যাংগুয়েজ) এর নাম ইংরাজি ভাষার বদলে আমেরিকান ভাষা রাখা হউক। এই সময়ে আমেরিকান তরুণ ভাষাবিজ্ঞানী হেনরি লুই মেনকেন (যিনি এর কিছু দিন পরেই আমেরিকান ল্যাংগুয়েজ’ এই নামে একটি বিশাল আকারের পুস্তক প্রকাশ করেন) প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করেন। যে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোঘণার দলিলটিকে ইংরাজি হইতে আমেরিকান ভাষায় অনুবাদ করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন। এরই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ১৯২৩ সালেই কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে বৃটিশ আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালসমূহের ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপকরা এক সম্মিলনীতে মিলিত হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইংরাজি হইতে স্বতন্ত্র একটি নয়া ভাষা সৃষ্টির আন্দোলনকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করিয়া এই সভায় একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই উদ্যোগকে অধ্যাপকরা মার্কিনী বিকট রসিকতা অথবা ঘোরতর অপরাধ (এ ডিপ এ্যামিরিকান জোক অর এ গ্রেট ক্রাইম) বলিয়া আখ্যায়িত করেন। ঐ সম্মিলনীতে কলাম্বিয়া সুট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হেনরি ভ্যান ডাইক ও মিশিগান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফ্রেড নিউটন স্কট হেনরি লুই মেনকেনের উদ্যোগকে মানবতা ও সভ্যতা-বিরোধী জংলি অপরাধ বলেন এবং তাঁকে পশমের চট পরাইয়া শাস্তি দিবার প্রস্তাব করেন। এঁরা মার্কিনবাদের তীব্র নিন্দা করেন এবং ইংরাজি ভাষার পবিত্রতা রক্ষার জন্য কঠোরভাবে ব্যাকরণের নিয়মাদি পালনের নির্দেশ জারি করেন।

কিন্তু ততদিনে মার্কিন জাতির স্বকীয়তার দাবি ও উন্মাদনা দুর্বার হইয়া উঠিয়াছে। ইমার্সনের স্বকীয়তা বাণীতে উদ্বুদ্ধ, মিস জারট্রড স্টেইন, এযরা পাউন্ড ও টি এস ইলিয়টের কৃষ্টি-সাহিত্যিক নবজাগরণের বাণী ততদিনে মার্কিন জাতির মধ্যে কৃষ্টি-সাহিত্যের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী করিয়া তুলিয়াছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কায়যারের হাতে মার-খাওয়া ইংরাজ জাতিকে বিপন্মুক্ত করার দায়িত্ব পালনে আগাইয়া আসেন যে প্রেসিডেন্ট উড্র উইলসন, তিনিও নীতিতে ইংরাজি ভাষার পবিত্রতা রক্ষার পক্ষপাতী হইয়াও ততদিনে ‘বিশুদ্ধ ইংরাজি’ শব্দের মাঝে-মাঝে ‘অশালীন ও অমার্জিত মার্কিনী’ শব্দও ব্যবহার করিতে শুরু করিয়াছেন। এতে ইংলন্ডের ভাষিক কায়েমি স্বার্থবাদীরা এতই বিচলিত হইয়াছিলেন যে স্যার সিডনি বেপা প্রস্তাব দিয়াছিলেন যে মার্কিনী ছাত্রদের ইংরাজ অধ্যাপকদের নিকট ইংরাজি পড়িতে বাধ্য করা উচিৎ।

.

. উপলব্ধির বাস্তবায়ন

কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। মার্কিন জাতির কৃষ্টিক-ভাষিক স্বকীয়তা লাভের আন্দোলন সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রচারমাধ্যম রেডিও-সিনেমায় হামলা চালাইল। হলিউডের সিনেমা পরিচালক-প্রযোজকরা ইংরাজি সিনেমার নাম বদলাইয়া মার্কিনী নাম রাখিলেন মুভি। মুভির এ্যাকটার-একট্ৰেসরা বিশুদ্ধ ইংরাজি উচ্চারণ করিবার জন্য বিলাত হইতে প্রশিক্ষক আমদানি করা ছাড়িয়া দিলেন। কলাম্বিয়া, ন্যাশনাল ও আমেরিকান নামক তিনটা ব্রডকাসটিং কোম্পানিই তাদের সংবাদপাঠক ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জন্য ওয়েস্ট এন্ড-অক্সনিয়ার ইংরাজি উচ্চারণ প্রশিক্ষণের বিশেষ স্কুলগুলি উঠাইয়া দিলেন। মার্কিনীরা মার্কিনী ইংরাজি মার্কিন উচ্চারণ-ভঙ্গিতেই বলিতে লাগিলেন। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের অর্থনৈতিক নিউডিলের উদ্দীপনা মার্কিন জাতিকে ভাষিক নিউডিলেও উদ্দীপিত করিয়া ফেলিল। ইংলন্ডের ভাষিক কায়েমি স্বার্থীরা, মানে শিক্ষক-লেখক ও পুস্তক-প্রকাশকরা, সবাই আগে হইতেই বিপদ গনিতেছিলেন। ১৯২৭ সালে এঁদের সমবেত উদ্যোগে লন্ডনে ইংরাজি ভাষা সাহিত্য সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মিলনীর অধিবেশন করিলেন। প্রধানত মার্কিন সাহিত্যিকদের উৎসাহ-উদ্যোগেই এই সম্মিলনী হইয়াছিল। কারণ মার্কিন মুল্লুকের সাহিত্যিক সনাতনীরা খোদ ইংলন্ডের সাহিত্যিকদের চেয়েও বেশি ইংরাজিপ্রীতি দেখাইতেছিলেন। এটা স্বাভাবিকও। আমাদের দেশের বাঙ্গাল’ কবি-সাহিত্যিকদের পশ্চিম বাংলাভাষা প্রীতি পশ্চিম বাঙ্গালীদের চেয়েও বেশি। যা হোক লন্ডনের এই আন্তর্জাতিক সম্মিলনীতে এই মর্মে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, ইংরাজি ভাষার পবিত্র কুয়া অপবিত্রকরণের মার্কিনী (ডিফাইলিং পিওর অয়েল অব ইংলিশ বাই দি আমেরিকানস) অপচেষ্টা যে কোনও উপায়ে ঠেকাইতে হইবে। নিউ স্টেটসম্যান এ সম্পর্কে ১৯২৭ সালের ২৫ জুনের সম্পাদকীয়তে লিখিয়াছিল : আমরা আমাদের মাতৃভাষা ইংরাজি সম্পর্কে আমেরিকানদের সাথে আলোচনায় বসিব না? কারণ ইংরাজি ভাষাকে যারা প্রাণ দিয়া ভালবাসে, তাদের মোকাবিলা আমেরিকানরাই সর্বাপেক্ষা ঘোরতর শত্রু। ঐ প্রস্তাবের ব্যাখ্যা করিয়া বিখ্যাত ব্যঙ্গ পত্রিকা পাঞ্চ সম্পাদকীয় লেখেন : ইংরাজি ভাষায় কুয়া পবিত্র রাখিতে হইলে আমেরিকানরা যাতে ঐ কুয়ায় কাদা না ফেলিতে পারে তার বিধান করিতে হইবে। ইয়াংকিরা যে ভাষায় কথা বলে, তাকে শুধু কাদা-মাটি বলিলেও ঠিক হইবে না। তারা কথা ত বলে না, দস্তুরমত থুথু ফেলে। অতএব তাদের ভাষা আসলে শাব্দিক নিষ্ঠীবন মাত্র।’

এ সব স্পষ্টতই রাগের কথা; কটুক্তি ও গালাগালি। লোক রাগ করে যখন তাদের আর কোনও উপায় থাকে না। গাল দেয় যখন যুক্তি থাকে না। ১৭৭৬ সালে মার্কিনীদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ঠেকাইবার জন্য ইংলন্ড অস্ত্র ধরিয়াছিল। দেড়শ বছর পরে তাদের ভাষিক-সাহিত্যিক স্বাধীনতা ঠেকাইবার কাজে অস্ত্রের বদলে ইংরাজরা জিভ ও কলম ধরিয়াছিল। কিন্তু কৃষ্টিক-ভাষিক স্বকীয়তার বাসনা রাজনৈতিক স্বরাজের বাসনার চেয়ে কম শক্তিশালী নয়।

.

. জনগণের জয়

ইংরাজরা নাহক ভয় পাইয়াছিল। না বুঝিয়া যুদ্ধ করিয়াছিল। ভ্রান্ত ধারণায় মার্কিনীদের ভাষিক-কৃষ্টিক স্বকীয়তায় বাধা দিয়াছিল। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা লাভ করিয়াও মার্কিনীরা আজও ইংরাজের সাথে একই আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী হইয়াই আছে। ভাষিক-সাহিত্যিক স্বকীয়তা হাসিল করিয়াও আজও তারা ইংরাজি ভাষা গোষ্ঠীর সদস্যই আছে। মিসেস জারট্রডস্টেইনের ভাষায় মার্কিনবাসী ইংরাজি ভাষা ও তার হরফ কিছুই ছাড়ে নাই। শুধু ইংরাজি ভাষা ও সাহিত্যে মার্কিনী শব্দ ও বাচনভঙ্গি আমদানি করিয়া ঐ সাহিত্যে মার্কিনী প্রাণ প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। তাই অতবড় বিশ্বশক্তি হইয়াও বৃটিশ সরকার প্রায় নিরস্ত্র মার্কিনীদেরে হারাইতে পারে নাই। ইংরাজি ভাষা ও সাহিত্য অতবড় বিশ্ব সাহিত্য হইয়াও কয়েদির বুলি’ ও অশালীন শাব্দিক নিষ্ঠীবন’কে ইংরাজি সাহিত্যের পবিত্র হেঁসেল হইতে দূরে রাখিতে পারে নাই। এইভাবে ভাষা সাহিত্যের লড়াই-এ শেকসপিয়ার-স্কট-মিলটনের উত্তরাধিকারী জন বুল ভাষা-সাহিত্যের ঐতিহ্যহীন ব্রাদার জনথনের কাছে হারিয়া গিয়াছিল। ইতিহাসের তাকিদেই তেমনি বঙ্কিম, মাইকেল-রবীন্দ্রের উত্তরাধিকারী ভদ্রলোকেরা ভাষা-ঐতিহ্যহীন’ বাঙ্গালদের কাছে একদিন হারিয়া যাইবেন। কারণ বাঙ্গালরা বাংলাভাষা ও হরফ ছাড়িতে চায় না। তারা বাংলা সাহিত্যে বাংলাদেশের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করিতে চায় মাত্র।

উপরে আমেরিকাবাসীর ভাষিক স্বকীয়তার সংগ্রামের অতিসংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হইল। এতে পাঠক নিশ্চয়ই দেখিতেছেন, মার্কিনীদের ভাষিক স্বকীয়তার সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হইয়াছিল। দীর্ঘস্থায়ী হইয়াছিল এইজন্য যে সংগ্রামটা ছিল কঠিন। সংগ্রামটা কঠিন ছিল এই জন্য যে সংগ্রামের অভীষ্টটা জনগণের নিকট সুস্পষ্ট ছিল না। সুস্পষ্ট ছিল না এই জন্য যে মার্কিনী ও ইংরাজরা ধর্ম-সমাজ কৃষ্টি ও ঐতিহ্যে মূলত একই ছিল। এই দিক হইতে কৃষ্টি-সাহিত্যের ব্যাপারে মার্কিনীদের স্বাতন্ত্র-স্বকীয়তা অপরিহার্য ছিল না। এই অপরিহার্যতা সৃষ্টি হইয়াছিল তাদের রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে। মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক প্রয়োজন বিষয়ী তাকিদ; সুতরাং মস্তিষ্কের ব্যাপার। পক্ষান্তরে সৃষ্টি-ঐতিহ্যের তাকিদটা তাদের আবেগের তাকিদ; সুতরাং হৃদয়ের ব্যাপার। কৃষ্টিক-ভাষিক সাহিত্যিক স্বকীয়তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় আর্থিক স্বকীয়তার রক্ষা বিকাশ ও বিস্তৃতি অসম্ভব। এ সত্য উপলব্ধি করার পরই কেবল এটা তাদের আবেগের মানে হৃদয়ের ব্যাপারে উন্নত হইল। এটা ঘটিতেই তাদের সময় লাগিয়াছিল।

আমাদের বেলা এত দীর্ঘ সময় লাগিবার কোনও হেতু বা কারণ নাই। রাষ্ট্রীয় সত্তার সঙ্গে আমরা ধর্ম-সমাজ-কৃষ্টি-ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সকল ব্যাপার ও স্তরে আমরা স্বতন্ত্র। ভাষিক-সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র ছাড়া বাংলাদেশ তার রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা রক্ষা করিতে পারিবে। এই কারণেই মার্কিন পক্ষের আমার ভাষাবাদের উৎস। মার্কিনীদের জাতীয় ভাষা সাহিত্য বিকাশে নোআ ওয়েবস্টারের আমেরিকান ইংলিশ ডিকশনারি যে অবদান রাখিয়াছিল, বাংলাদেশের ভাষা-সাহিত্য বিকাশে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-সম্পাদিত পূর্ব পাকিস্তানি আঞ্চলিক ভাষার অভিধান-এর অবদান হইবে ঠিক তাই। ১৯৬৫ সালে ড. শহীদুল্লাহ ঐ অভিধান বাহির করিয়াছিলেন বলিয়া কেউ নিরাশ হইবেন না। মনে রাখিবেন, ওয়েবস্টার তার অভিধান বাহির করিয়া ছিলেন ১৮২৮ সালে। আর আমেরিকার ভাষার সাহিত্যের মার্কিনী রূপায়ণ চুড়ান্ত হইয়াছিল একশ বছর পরে বিশ শতকের ত্রিশের দশকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *