১৫. স্বাতন্ত্রের স্বীকৃতি

অধ্যায় পনের – স্বাতন্ত্রের স্বীকৃতি

১. সোজা পথ সহজ না

পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায় এক যুগ পূর্ব হইতে আমার সাহিত্যিক মতবাদে যে ধীর অথচ দৃঢ় পরিবর্তন আসিতেছিল, তাতে আমার আশা হইয়াছিল অখণ্ড বাংলার কৃষ্টিবোধের ও সাহিত্যিক-স্বাতন্ত্রের জটিলতা বাংলা বাটোয়ারায় সহজ হইয়া গেল। রাজনীতিতে ‘স্পিরিট-অব-পার্টিশন’-এর ব্যাখ্যা করিয়া আমি ভারত বাটোয়ারাকে যেমন হিন্দু-মুসলিম সমস্যার সর্বাঙ্গীণ সুন্দর সমাধান বলিয়াছিলাম ও বিশ্বাসও করিয়াছিলাম, পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার স্বতন্ত্রীকরণকে আমি তেমনি আমাদের কৃষ্টিক, ভাষিক ও সাহিত্যিক জটিলতার সহজ সমাধানের পন্থা বলিয়া অভিনন্দিত করিয়াছিলাম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে আমি এই মতবাদের সমর্থক খাড়া করিয়াছিলাম। মৃত্যুর মাত্র দুই বছর আগে বোধ হয় দূরদর্শিতা বলেই তিনি লিখিয়াছিলেন : বাংলা আসলে দুইটা। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা শুধু দেহে নয়, অন্তরেও দুই। কলিকাতা-কেন্দ্রিক পশ্চিম বাংলা হইতে পৃথক হইয়া পূর্ব বাংলা রাজনৈতিক। ও অর্থনৈতিক দিকে স্বাধীনতা পাইল, রাজনৈতিক নেতারা অবশ্যই তা উপলব্ধি করিয়াছিলেন। কিন্তু আমার দৃষ্টি ছিল অন্য দিকে। আমি ভাবিয়াছিলাম, কৃষ্টিক-ভাষিক ও সাহিত্যিক দিকে পূর্ব বাংলা পশ্চিম বাংলার সবল দুচ্ছেদ্য বাহু-ডোর হইতে মুক্ত হইয়া স্বকীয়তা আত্মস্থ ও বিকশিত হইবার সুযোগ লাভ করিল। এটা অচিন্তনীয় অপূর্ব সুযোগ। অন্যথায় কলিকাতার পাটকেলের হাত হইতে পূর্ব বাংলার কৃষকদের মুক্তির যেমন কোনও সম্ভাবনা ছিল না, বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরশ্চন্দ্রের দুর্ভেদ্য বৃত্ত হইতে পূর্ব বাংলার শিল্পী-সাহিত্যিকদের মুক্তিরও কোনও আশা ছিল না। এ অবস্থায় কলিকাতা ছাড়িয়া সকলের আগে ঢাকা আসা আমার প্রথম কর্তব্য ছিল লেখক-সাহিত্যিকদের জন্য টেবিল-চেয়ার সাজাইতে, অভাবে সিলেটের শীতল পাটি বিছাইতে; আর, নারী-সাহিত্যিকদের জন্য কলিকাতার শিফন কাথানের বদলে ঢাকাইয়া জামদানি যোগাড় করিতে। কিন্তু ইত্তেহাদ-এর ঢাকা আসার পথে সরকারি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হওয়ায় উহার সম্পাদনার দায়িত্ব পালনের দরুন আমারও ঢাকা আসিতে তিন বছর দেরি হইয়া গেল। তাই কলিকাতায় বসিয়া পূর্ব পাকিস্তানের সামান্য খেদমত করিবার চেষ্টা করিলাম। পূর্ব পাকিস্তানের শিশুদের জন্য ছোটদের কাছাছুল আম্বিয়া নামক দুই খণ্ডের একটি শিশু-পাঠ্য-পুস্তক লিখিলাম। এই প্রথম চেষ্টায় সরকার পক্ষ হইতে যে বাধা পাইয়াছিলাম, তৎকালে সেটা খুবই কঠোর মনে হইয়াছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে স্বয়ং সাহিত্যিকদের নিকট হইতে প্রাপ্ত বাধার কাছে সে সরকারি বাধাটা ছিল নিতান্তই তুচ্ছ। শিল্পী-সাহিত্যিকদের বিরোধিকার কথা পরে ক্রমে-ক্রমে বলিতেছি। সরকারি বাধাটার কথাটা আগে কহিয়া লই।

.

. প্রথম তিক্ত অভিজ্ঞতা

আমি চিত্র-শিল্পকে শিল্প-সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মনে করি। এ বিষয়ে আমি আমাদের ওলামা-সমাজের একাংশের সহিত একমত কোনও দিন ছিলাম না। সাধারণ শিল্প-সাহিত্য ছাড়াও শিক্ষাক্ষেত্রেও চিত্রকে অত্যাবশ্যক মনে করিতাম। বিশেষত শিশুশিক্ষায় ‘পিকটরিয়েল রিপ্রেয়েন্টশন’-কে অপরিহার্য বিবেচনা করিতাম। এই বিশ্বাসকে পাকিস্তানের শিক্ষা-বিভাগে চালু করিবার আশায় ১৯৪৭ সালে কলিকাতা বসিয়াই ছোটদের কাছাছুল আম্বিয়া নামে দুই খণ্ডের একটি সচিত্র শিশুপাঠ্য বই লিখিলাম। তাতে শেষ পয়গম্বর হযরত রসুলুল্লাহ ছাড়া কতিপয় প্রধান নবীর ও সেই সঙ্গে ইবলিস, নমরুদ ও কারুনের কাহিনী লিখিলাম। এই বইয়ে কাহিনীর সাথে সংগতি রাখিয়া কিছু কিছু কাল্পনিক ছবি দিলাম। ছবিগুলি তৎকালীন শ্রেষ্ঠ মুসলিম আর্টিস্টদের অন্যতম কাজী আবুল কাসেমের হাতে আঁকাইলাম। মানুষের, বিশেষত, পীর-পয়গম্বরদের, ছবি সম্বন্ধে মুসলিম সংস্কারের প্রতি নজর রাখিয়া এই সব কাল্পনিক ছবি আঁকিতেও বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হইল। কোনও ছবিতেই সংশ্লিষ্ট নবীর মুখ দেখান হইল না। শিশুদের পক্ষে কাহিনী বুঝিবার জন্য যেভাবে যতটুকু দরকার সেইভাবে ও ভঙ্গিতে একজন কল্পিত মানুষের ছবি আঁকা হইল মাত্র। আমার প্রিয় বন্ধু আয়নুল হক খ ও মোহাম্মদ নাসির আলীর ঢাকায় সদ্য-প্রতিষ্ঠিত নওরোজ কিতাবিস্তান এই বই ছাপিয়া বাজারে ছাড়িলেন। বইটি তৎকালীন জনপ্রিয়তা লাভ করিল। কোনও কোনও শিক্ষাবিদ বইখানাকে ক্লাস থ্রি-ফোরের ‘র‍্যাপিডরিডার’ করিবার সুপারিশ করিলেন। এমন সময় পূর্ব বাংলা শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারি জনাব এফ। করিমের একটি শোক’ নোটিস ও ঢাকা হইতে প্রকাশিত একমাত্র দৈনিক আজাদ-এর সম্পাদকীয় রূপে একটি হুঁশিয়ারি পাইলাম। সরকারি নোটিসে আমার এ বই কেন বাযেয়াফত হইবে না, তার কারণ দর্শাইতে বলা হইল। আর আজাদ-এর সম্পাদকীয়তে আমাকে ভোলানাথের কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়া হইল। উল্লেখ্য যে, কিছুদিন আগে হযরত পয়গম্বর সাহেবের ছবিসহ একটি বই বিক্রির অপরাধে ভোলানাথ সেন নামক কলিকাতার এক পুস্তক বিক্রেতাকে জনৈক মুসলমান আততায়ী হত্যা করিয়াছিল। এই উপলক্ষে আজাদ আমার এই পুস্তকের প্রকাশক ও বিক্রেতাদিগকেও হুঁশিয়ার করিয়া দিলেন। মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের আজাদএর কথার জবাবে শহীদ সুহরাওয়ার্দীর ইত্তেহাদ-এর কিছু বলিবার উপায় ছিল না। তাই আমি পূর্ব বাংলা সরকারের শিক্ষা-দফতরের সেক্রেটারি সাহেবের জবাব দিলাম। মি. এফ করিম ছিলেন উর্দু সাহিত্যিক। তাঁর সাথে আমার পরিচয় ছিল। তাই আমার ক্য শশা করিবার কৈফিয়তটি শুধু সরকারি অভিযুক্ত আসামির কাঠখোট্টা লিগ্যাল স্টেটমেন্ট ছিল না। একজন সাহিত্যিকের কাছে অপর একজন সাহিত্যিকের পত্রও ছিল সেটা। পয়গম্বর সাহেবরাও দেহী মানুষ ‘বাশার আল-কোরআনের এই শিক্ষার দিকে এবং পিকটরিয়েল রিপ্রেযেন্টেশন ছাড়া শিশুশিক্ষা হয় না বলিয়া আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানীদের অভিমতের দিকে সেক্রেটারি সাহেবের মনোযোগ আকর্ষণ ত করিলামই, তাছাড়া সদ্য-প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান সরকারের শিক্ষানীতি সম্বন্ধে কতিপয় প্রশ্ন পেশ করিলাম। শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর সরকারের অভিমত কী সে প্রশ্নও তুলিলাম। নয়া রাষ্ট্রের নয়া সরকার পাকিস্তানে সিনেমা-থিয়েটার করিতে দিবেন কি না, দিলে সে সবে আউলিয়া-দরবেশ পীর-পয়গম্বদের মত আদর্শ ও অনুকরণীয় চরিত্রসমূহ রূপায়ণ ও চিত্রায়ণ করিতে দেওয়া হইবে? না প্রচলিত নাটক-সিনেমার মত শুধু অমুসলমানদের দেব-দেবী ও মহাপুরুষদেরে লইয়াই পাকিস্তানি ছায়াছবি ও ড্রামা-নাটক হইতে থাকিবে? যদি মুসলিম মহাপুরুষদের জীবনালেখ্য নাটকে-সিনেমায় আঁকিতে হয়, তবে ছবি ত ছবি জিন্দা মানুষকে পীর-পয়গম্বর সাজিতে হইবে কি না? যদি, পক্ষান্তরে, মুসলিম মহাপুরুষদের জীবন লইয়া কোনও নাটক সিনেমা করিতে না দেওয়া হয় তবে, পাকিস্তানের জনগণ নাটক-সিনেমার মারফত একটা বিপুল সম্ভাবনাময় মহৎ শিক্ষার মাধ্যম হইতে বঞ্চিত থাকিবে কি না? যদি পাকিস্তানের নাটক-সিনেমায় শুধু অমুসলমান দেব-দেবী ও মহাপুরুষদের জীবনালেখ্য প্রদর্শিত হয়; তবে পাকিস্তানি মুসলমানদের ধর্মীয় ও কৃষ্টিক পরিস্থিতি ও পরিবেশ কী দাঁড়াইবে, পাকিস্তানের বর্তমান শাসকরা কি চিন্তা করিয়া দেখিয়াছেন? ইত্যাদি ইত্যাদি।

মি. এফ করিম আমার এই পত্রের প্রাপ্তি স্বীকার করিলেন মাত্র দু-চার লাইনে। কোনও জবাবও দিলেন না। আমার বইটা ফর্মালি বাযেয়াফতও করিলেন না। কিন্তু তার দরকারও হইল না। আজাদ-এর হুমকিতে পূর্ব বাংলার পুস্তক বিক্রেতাদের মধ্যে এমন সন্ত্রাস সৃষ্টি হইল যে তার এই বই আর বিক্রয় করিলেন না। যার-তার মওজুদ কপি হয় পাবলিশারকে ফিরাইয়া দিলেন, অথবা পোড়াইয়া ফেলিয়াছেন বলিলেন। পাবলিশার নিজেও তাই করিলেন। ছবিগুলি বাদ দিয়া নূতন করিয়া বইখানি আবার ছাপাইলেন। ছবি ছাড়া শিশুপাঠ্য বই স্বভাবতই ছবিওয়ালা বইয়ের মত চলিল না। এ ঘটনার বেশকিছু দিন পরে শিক্ষা দফতর ছোটদের কাছাছুল আম্বিয়াকে সত্য-সত্যই র‍্যাপিডরিডার করিয়াছিলেন। কিন্তু সেটা ছবিওয়ালা না ছবিহীন তার উল্লেখ না থাকায় সরকারি আদেশের চেয়ে আজাদ-এর আদেশই পাবলিশার ও বিক্রেতার নিকট বেশি মর্যাদা পাইল।

.

৩. পশ্চিমাদের অদূরদর্শিতা

১৯৫০ সালের মে মাসে আমি কলিকাতা ত্যাগ করিয়া দেশে ফিরিলাম। কলিকাতা বসিয়া পূর্ব বাংলার লেখক-সাহিত্যিকদের কৃষ্টিক-সাহিত্যিক স্বকীয়তা-বোধ সম্বন্ধে আমি যে আশা ও ধারণা করিয়াছিলাম, ঢাকায় তার কিছুই দেখিলাম না। বরঞ্চ তার উল্টাটাই দেখিলাম। অবশ্য এর রাজনৈতিক কারণও ছিল। স্বয়ং কায়েদে আযম হইতে শুরু করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বাংলার বিরুদ্ধে ও উর্দুর পক্ষে যে অভিযান চালাইয়াছিলেন, পূর্ব বাংলার মুসলিম নেতারা সে অভিযানে যেরূপ আত্মমর্যাদাবোধহীন অদূরদর্শী জি-হুঁযুর বৃত্তি চালাইয়া যাইতেছিলেন, তাতে পূর্ব বাংলার ইনটেলিজেনশিয়া ও ছাত্রসমাজ স্বভাবতই উর্দু ও পশ্চিমা নেতাদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছিলেন। ভাষা-সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই উর্দু-বিরোধিতা বোধগম্য কারণেই পশ্চিম বাংলামুখিতার রূপ নিল। ‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিপুল সাফল্যও নয়া রাষ্ট্র পূর্ব বাংলার কৃষ্টিক স্বকীয়তা লাভের কোনও কাজে লাগিল না। পূর্ব বাংলার ছাত্র তরুণ ও শিক্ষিত সম্প্রদায় নিতান্ত আত্মরক্ষার দায়ে যে পরিমাণ ও অনুপাতে উর্দু-বিরোধী সংগ্রাম চালাইলেন, সেই পরিমাণ ও অনুপাতে নিজেদের অজ্ঞাতসারেই এবং যুদ্ধের নিয়ম অনুসারেই তাঁরা পশ্চিম বাংলার কৃষ্টি-সাহিত্যিক দুর্গের শক্তিশালী প্রচারের অন্তরালে ঢুকিতে লাগিলেন। দুই যুগ পরে সত্তরের দশকে রাজনৈতিক অধিকারের সংগ্রামে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-তরুণ ও শিক্ষিক সম্প্রদায় পাঞ্জাবি সৈন্যের পিটুনিতে যেমন ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সামরিক ছায়ায় আশ্রয় লইতে বাধ্য হইয়াছিল, পঞ্চাশের দশকের উর্দুর হামলা হইতে ভাষা-কৃষ্টি রক্ষার জন্য ঠিক তেমনি তারা কলিকাতার কৃষ্টি-সাহিত্যিক দুর্গে আশ্রয় লইয়াছিল। ভাষা-আন্দোলনে আমি সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছি। বস্তুত কলিকাতা হইতেই ইত্তেহাদ-এর লেখায় ও সংবাদ সরবরাহের মাধ্যমে ভাষা-আন্দোলনের সমর্থন শুরু করিয়াছিলাম। কিন্তু ভাষা-আন্দোলনকে নয়া রাষ্ট্রের কৃষ্টিক স্বকীয়তাবোধ স্ফুরণের কাজে লাগাইতে পারি নাই। পাকিস্তান আন্দোলনের বন্যা-স্রোতের সামনে দাঁড়াইয়া কলিকাতা হইতে চল্লিশের দশকে আমরা কতিপয় সাহিত্যিক পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের যে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, কৃষ্টিক স্বকীয়তা ও জাতীয় স্বাতন্ত্রের কথা সগর্বে বুলন্দ আওয়াজে বলিতে পারিয়াছিলাম, পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় বসিয়া তার কিছুই বলিতে পারিলাম না। পশ্চিম পাকিস্তান ও পশ্চিম বাংলার মধ্যে লাহোর ও কলিকাতার মধ্যে এবং ইকবাল ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে একটা পূর্ব বাংলা, একটা ঢাকা, একটা নজরুল ইসলাম আছে, তা আমরা কেউ বুঝিলাম না। এই না বুঝারও একটা সংগত কারণ আছে। সেটা পাকিস্তান সৃষ্টির আগের উর্দু ও বাংলা-সাহিত্যের একশ বছরের ইতিহাস। এই মুদ্দতে উর্দু-সাহিত্যের নেতৃত্ব ছিল মুসলমানদের হাতে। বাংলা-সাহিত্যের নেতৃত্ব ছিল হিন্দুদের হাতে। শুধু ফর্ম ও কনটেন্টেই নয়, প্রাণরূপ ও আঙ্গিকেও উর্দু-সাহিত্য ছিল মুসলিম কৃষ্টির বাহন, সুতরাং মুসলিম সাহিত্য। পক্ষান্তরে, ঐ সব ব্যাপারে বাংলা সাহিত্য ছিল হিন্দু কৃষ্টির বাহন, অতএব হিন্দু সাহিত্য। এটা অবশ্য স্কুল ও সুপারফিশিয়াল দৃষ্টি। কিন্তু বাস্তব দৃষ্টি। কারণ ভারত বাটোয়ারার সমগ্র ব্যাপারটাই তৎকালে এই দৃষ্টিকোণ হইতে বিচার করা হইতেছিল। রাজনীতি ক্ষেত্রে যেমন স্পিরিট-অব পার্টিশনটা দুই নয়া জাতি-রাষ্ট্রের দুই ফাদারের মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গেই আমরা ভুলিয়া গিয়াছিলাম, কৃষ্টি-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অবিকল তাই ঘটিয়াছিল।

.

. পূর্ব বাংলার দুধারী বিপদ

পূর্ব বাংলার ভাগ্যে এই বিভ্রান্তির কুফল হইতেছিল বিষময়। একদিকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী প্রথমে একমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করিবার অপচেষ্টা করিলেন এবং পরে আরবি হরফে বাংলা লিখিবার প্রয়াস পাইলেন। অপরদিকে পূর্ব বাংলার লেখক-সাহিত্যিকরা উর্দু-আরবি-ফারসির সাথে বাংলা ভাষার কোনও মিল নাই দেখাইবার উদ্দেশ্যে বহু যুগ-প্রচলিত বাঙ্গালী মুসলিমদের মুখের ভাষা হইতে আরবি-ফারসি সব শব্দ তাড়াইবার অভিযান শুরু করিলেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অবিভাজ্য, এই যুক্তিতে স্বভাবতই তারা হিন্দু মনীষীদের অনুকরণ করিলেন। ঐ মনীষীরা ইতিমধ্যে গণমুখী সাহিত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যে পশ্চিম-বাংলার আঞ্চলিক কথ্য ভাষাকে সাহিত্যে স্থান দিয়াছিলেন, আমাদের লেখক-সাহিত্যিকরাও না বুঝিয়া তাই করিতে লাগিলেন। ক্রমে পশ্চিম-বাংলার কথ্য ভাষা পূর্ব বাংলার সাহিত্যের ভাষা হইয়া গেল। পূর্ব বাংলার ভাষিক-সাহিত্যিক, সুতরাং কৃষ্টিক, স্বকীয়তার পথ দ্রুতগতিতে অবরুদ্ধ হইতে লাগিল। আমি আমাদের ভাষা আন্দোলনের মর্ম ব্যাখ্যায় বাংলা একাডেমির বিভিন্ন বৈঠকে, ছাত্র-তরুণদের সভায়, বিভিন্ন সাহিত্য সম্মিলনীতে এবং সংবাদপত্রের বিশেষ সংখ্যায় প্রবন্ধ লিখিয়া আমাদের সাহিত্যকদেরে হুঁশিয়ার করিতে লাগিলাম। বাংলা একাডেমি আমাকে অ্যাওয়ার্ড দিলেন, ফেলো নির্বাচিত করিলেন, জীবন-সদস্য করিলেন, সম্মান দিলেন খুবই। কিন্তু কথা শুনিলেন না।

.

. বাংলা সাহিত্যের মুসলমানি রূপ

দেশভাগ হওয়ার আগেকার প্রায় গোটা ত্রিশ বছরের লেখক-জীবনে আমার সাহিত্য-কর্মের প্রধান দাবি ছিল এই : বাংলার মেজরিটি মুসলমানের মুখের ভাষাকে বাংলা-সাহিত্যে সম্মানের স্থান দিতে আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ হওয়ার অজুহাতে মুসলমানদের নিত্য-ব্যবহৃত বহু শব্দকে শুধু ঐ কারণে বাংলা সাহিত্যে স্থান দেওয়া হয় না। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নেতা হিন্দু লেখকরাই। তাঁদের লেখাতেই যে শুধু মুসলমান বাঙ্গালীর মুখের ভাষা বর্জিত হইত তা নয়, সরকারি শিক্ষা কর্তৃপক্ষ তা-ই করিতেন। অপেক্ষাকৃত অল্প বয়স হইতেই এটা আমার মনে পীড়া দিত। আমার আত্মসম্মানে আঘাত লাগিত। আমার মনে হইত, হিন্দু লেখকদের এই মনোভাব আসলে মুসলমান সমাজের প্রতি উপেক্ষার এমনকি অবজ্ঞার শামিল। এ সম্পর্কে আমার অভিমত ক্রমে এত দৃঢ় হইয়া উঠে বলিয়াই উনিশশ তেতাল্লিশ সালে কলিকাতার ‘প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশনের সাহিত্য সম্মিলনীতে ভাষণ দিতে গিয়া আমি ভারতে রাজনৈতিক পাকিস্তান হওয়ার চেয়ে বাংলায় সাহিত্যিক পাকিস্তান হওয়ার সম্ভাবনাকে অধিকতর নিশ্চিত বলিয়াছিলাম।

দেশভাগ হওয়ার পর আমার সাহিত্যিক অ্যাপ্রোচে মৌলিক পরিবর্তন আসিল। মুসলমান’ শব্দটার স্থান দখল করিল ‘পূর্ব বাংলা। পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হয় শুধু রাষ্ট্রীয় অর্থে। কৃষ্টিক অর্থে পূর্ব বাংলা ছিল বরাবর একটি স্বাধীন স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। এর কৃষ্টিক স্বকীয়তা এক দিকে যেমন পাকিস্তানের অপর অঞ্চল পশ্চিম পাকিস্তান হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল, অপরদিকে তেমনি ঐতিহাসিক বাংলার অপর অঞ্চল পশ্চিম বাংলা হইতে ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। কিন্তু আমাদের কবি-সাহিত্যিক চিন্তা-নায়কদের বিপুল মেজরিটির মধ্যে এই উপলব্ধির অভাব দেখিয়া আমি শুধু দুঃখিত হইলাম না, বিস্মিতও হইলাম। এঁদের মধ্যে একদল বলিতে লাগিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানি কৃষ্টি হইতে আমাদের কৃষ্টি স্বতন্ত্র নয়; কারণ উভয়টাই ইসলামি বৃষ্টি। অপর দল সমান জোরে বলিতে থাকিলেন, আমাদের কৃষ্টি পশ্চিম বাংলার কৃষ্টি হইতে স্বতন্ত্র নয়; কারণ উভয়টাই এক বাঙ্গালী কৃষ্টি। ইসলামি কৃষ্টি-ওয়ালারা বলিতে থাকিলেন, ইসলামি বিশ্বকবি ইকবাল আমাদের জাতীয় কবি; বাঙ্গালী কৃষ্টি-ওয়ালারা বলিতে চলিলেন, বাঙ্গালী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় কবি। বিস্ময়ের কথা, এই পরস্পরবিরোধী দ্বিমুখী দল দুইটি আশ্চর্যরূপে একমত যে আমরা পূর্ব বাঙ্গালী বা পূর্ব পাকিস্তানিদের নিজস্ব কোনও কৃষ্টিক স্বকীয়তা নাই। আমাদের স্বতন্ত্র ভাষা-সাহিত্যের কোনও অস্তিত্ব নাই। থাকার প্রয়োজনও নাই।

এ ব্যাপারে আমি দুই-এর কোনও দলের মিছিলেই শামিল হইতে পারিলাম না। কলিকাতার সাহিত্যিক মহলে আমি ত্রিশ-ত্রিশটা বছর ভাষায় মুসলমান’ রহিয়া গিয়াছিলাম, ঢাকার সাহিত্যিক মহলে আমি তেমনি বাঙ্গাল থাকিয়া গেলাম। কলিকাতায় বরঞ্চ নজরুল ইসলামের মত প্রতিভাধর মনীষী আমার কতকটা পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কতকটা’ বলিলাম এই জন্য যে, আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ ব্যবহারে নজরুল ইসলাম ও আমার মধ্যে একটা মূলগত পার্থক্য আছে। আমি আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করি ওগুলি আরবি ফারসি বা মুসলমানি শব্দ বলিয়া নয়, শব্দগুলি বাঙ্গালীর দৈনন্দিন ব্যবহারে চালু বলিয়া। সে কারণে এগুলি বাংলা শব্দ হইয়া গিয়াছে বলিয়া। বানানে ও উচ্চারণে অনেকগুলির রূপান্তরও ঘটিয়াছে। ঐ রূপান্তরিত অবস্থাতেই আমি ও-সব শব্দ ব্যবহার করি। শুধু বাঙ্গালী মুসলমানরাই ব্যবহার করে, হিন্দুরা করে না, এমন আরবি-ফারসি-মূল শব্দকেও আমি বাংলা শব্দ মনে করি এবং আমার লেখায় বাংলা শব্দ হিসাবেই ব্যবহার করি। যে শব্দ এমনভাবে চালু নাই, তেমন শব্দ শুধু আরবি-ফারসি বা মুসলমানি হওয়ার যুক্তিতে ব্যবহার করি না। এই কারণে অজানা ও অপ্রচলিত নূতন আরবি-ফারসি শব্দ আমদানি আমি করি না। এই কারণে আমার সকল বিষয়ের প্রবন্ধে বা গল্পে-উপন্যাসে মোটামুটি একই ধরনের ভাষার ব্যবহার দেখা যাইবে।

কিন্তু নজরুল ইসলাম ঠিক তা করেন নাই। তিনি মুসলমানি বা ইসলামি বিষয়ে কবিতা রচনায় এমন সব সুন্দর-সুন্দর মিঠা-মিঠা ও কঠিন-কঠিন আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন যেগুলি বাংলার মুসলিম জনসাধারণের কাছেও সুপরিচিত নয়। তাঁর অসাধারণ প্রতিভাবলে শব্দচয়নে। ও সুপ্রয়োগে তিনি এমন কারিগরি দেখাইয়াছেন যে, মনে হইবে ওখানে ঐ শব্দটি না বসাইলে কবিতাটি অমন সুন্দর হইত না। এসবই সত্য কথা। কিন্তু এটাও স্বীকার করিতে হইবে যে নজরুল ইসলাম তার বিস্ময়কর মনীষার বলে এমন অনেক আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় ঢুকাইয়াছেন, যা আর কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। পক্ষান্তরে এটা লক্ষণীয় যে, মুসলমানি’ বিষয় ছাড়া আর কোনও লেখায় তিনি এমন করেন নাই। তিনি তার সাধারণ গদ্য-পদ্য লেখায় হিন্দু কবি-সাহিত্যিকদের প্রচলিত ধারাই বজায় রাখিয়াছেন। যেহেতু আমি কবি নই, কাজী সাহেবের কাব্যিক ভাষা আমার লেখা প্রভাবিত করার প্রশ্নই উঠে না। গদ্য লেখাকে মুসলমানি করার উদ্দেশ্যে আমি চেষ্টা করিয়া বা অভিধান খুঁজিয়া কোনও আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করি নাই। মুসলমান বাঙ্গালীর মুখে যেসব শব্দ প্রচলিত আছে, সেগুলিই আমি অবাধে ও নির্দ্বিধায় ব্যবহার করিয়াছি। মোটকথা, বাংলা ভাষার কাব্য-সাহিত্যিকে নজরুল ইসলাম মুসলমানি, মানে সত্যিকার বাঙ্গলার জাতীয় কাব্য করিয়াছেন। কিন্তু গদ্য সাহিত্যকে মুসলমানি করিবার চেষ্টা করেন নাই।

.

. বাংলা সাহিত্যের বাঙ্গাল রূপ

দেশত্যাগের পরে এ বিষয়ে আমার শব্দচয়নের মাপকাঠি রূপান্তরিত হইল মুসলমানি’ হইতে ‘বাঙ্গালে। পূর্ব বাঙ্গালীর শব্দ প্রয়োগ ও বাচনভঙ্গিই আমার রচনার উপজীব্য হইল। অখণ্ড ভারতে ব্যাপারটা ছিল মাইনরিটির সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা রক্ষার ব্যাপার। অবিভক্ত বাংলায় ছিল অধিকতর অগ্রসর মাইনরিটির দ্বারা অনগ্রসর মেজরিটির সাংস্কৃতিক অবদমনের ব্যাপার। কিন্তু পূর্ব বাংলা বা পূর্ব-পাকিস্তানে (বর্তমানের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ) এটা হইয়া উঠিল একটা স্বাধীন দেশ ও রাষ্ট্রের কৃষ্টিক ও রাষ্ট্রীয় পরিচিতি, ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্রের প্রশ্ন। অবিভক্ত বাংলায় কলিকাতা ছিল গোটা বাংলার রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক, ভাষিক ও সাহিত্যিক কেন্দ্রবিন্দু। সারা বাংলার শিল্প-বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমিও ছিল কলিকাতা। কলিকাতা প্রায় দুইশ বছর বাংলার রাজধানী থাকায় এ সব ঘটিয়াছিল নিতান্ত স্বাভাবিকভাবেই। বাংলা বিভাগের ফলে এই অবস্থার মৌল ও সার্বিক পরিবর্তন ঘটে। কলিকাতার পরে ঢাকা হয় পূর্ব বাংলা, পূর্ব-পাকিস্তান, ও (পরে) বাংলাদেশের রাজধানী। এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে শাসনতান্ত্রিক, শাসনযান্ত্রিক, প্রশাসনিক সকল ব্যাপারে পূর্ব বাংলা স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা লাভ করিল রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের অমোঘ ও দুর্নিবার চাপেই। শিল্প-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনও স্বাভাবিকভাবেই নিজস্বতা লাভ করিল আপনা-আপনি, কারো চিন্তা-ভাবনার ফল ছাড়াই। কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌমত্ব সত্তার সাথে-সাথে কৃষ্টিক, সাহিত্যিক ও ভাষিক স্বাতন্ত্রটা অমন সুস্পষ্ট, দুর্নিবার ও অটোমেটিক হইয়া যায় না। কৃষ্টিক, সাহিত্যিক ও ভাষিক ঔপনিবেশিকতটা রাষ্ট্রীয় ও আর্থিক শ্ৰেণীভেদের মত দৈহিক ও বাহ্যিক প্রাধান্যের ব্যাপার না হওয়ায় এবং প্রধানত মানসিক ব্যাপার হওয়ায় সহজে সাধারণের দৃষ্টিগোচর নয়। কৃষ্টি-সাহিত্যের ব্যাপারটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপারের মত সাধারণ ও প্রাত্যহিক ব্যক্তি বা জাতীয় স্বাতন্ত্রের স্থল স্বার্থের ব্যাপারও নয়। এটা আসলে সূক্ষ্ম জাতীয় স্বকীয়তার আধ্যাত্মিক স্বার্থের ব্যাপার। রাষ্ট্র-নেতাদের অতিব্যস্ত চোখে এসব ব্যাপার সহজে ধরা পড়িবার কথা নয়; নয়া রাষ্ট্রের ফর্মেটিভ স্তরের নেতাদের ত নয়ই। সে কারণে শিল্পী-সাহিত্যিক প্রভৃতি চিন্তা-নায়কদের উপরই ন্যস্ত হয় এদিককার প্রাথমিক দায়িত্ব। কিন্তু সাধারণ অবস্থায় শিল্পী-সাহিত্যিকরা নিজেদের মন মস্তিষ্ক ও কলমকে রাজনীতির উর্ধ্বে ও বাহিরে রাখায় অভ্যস্ত। এটাকে তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র, বৈশিষ্ট্য ও কর্তব্য মনে করেন। রাখিতে পারাকে তারা গৌরবের বিষয় মনে করেন। উনিশ শতকের ইউরোপীয় শিল্পী-সাহিত্যিকদের অনুকরণে বিশ শতকের প্রথমার্ধের কলিকাতা-কেন্দ্রিক বাঙ্গালী শিল্পী সাহিত্যিকরাও বাংলা সাহিত্যকে যথাসম্ভব রাজনীতির ‘ধুলা-মাটি হইতে বাঁচাইয়া রাখিবার চেষ্টা করিতেন। এ সময়কার বাংলা সাহিত্য মানেই হিন্দু বাংলা সাহিত্য। নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের আগেতক বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের কোনও উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল না। এ অবস্থায় বাঙ্গালী মুসলমানদের সাহিত্য-সাধনার সাফল্যের মাপকাঠি ছিল হিন্দু কবি সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের অনুকরণ-অনুসরণে সাফল্যের কৃতিত্ব। এই বিচারে ও কারণে বাংলার মুসলমান শিল্পী-সাহিত্যিকদের বিপুল মেজরিটি দেশ বিভাগের বিরোধী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেশ যখন ভাগ হইয়াই গেল তখন অপর সকলের মত তারাও কলিকাতা ছাড়িয়া ঢাকায় আশ্রয় নিলেন। কিন্তু মনের দিক হইতে তারা কলিকাতায়ই থাকিয়া গেলেন। তারা বলিতে লাগিলেন : শিল্প-সাহিত্য অবিভাজ্য। রাজনৈতিক কারণে বাংলা ভাগ হইলেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ভাগ হয় নাই।’ এসব কথা যারা বলেন, বিশ্বাস করেন, পূর্ব বাংলার সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্রের দাবি বা উপলব্ধি তাদের নিকট আশা করা যায় না। তারা স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীতে বসিয়া কলিকাতার ভাষায় পশ্চিম-বাংলার সাহিত্যিক ঐতিহ্য বহন করিয়া চলিলেন। তারা রবীন্দ্রনাথকে পূর্ব-পাকিস্তানের জাতীয় কবি, কলিকাতার কৃষ্টিকে পূর্ব-পাকিস্তানের কৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলিয়া গৌরববোধ করিতে লাগিলেন। এটা করিলেন তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই, অভ্যাসবশতই। তাদের বিশ্বাসও অনেকখানি আন্তরিক। নয়া রাষ্ট্র, নয়া জাতি, নয়া কৃষ্টি ও নয়া সাহিত্য যে পরস্পরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, এটা বুঝিতে একটু সময় লাগেই। এই কারণে এটা উপলব্ধি করিবার প্রাথমিক দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতাদের। শুধু প্রয়োগ করিবার দায়িত্বটাই শিল্পী। সাহিত্যিকদের। এক পক্ষ তাদের দায়িত্ব পালন না করায় অপর পক্ষ তাদের দায়িত্ব পালন করেন নাই। অথচ উভয় পক্ষেরই দিবার মত কৈফিয়ত আছে। মুখে ও কলমে দিতেছেনও সেসব কৈফিয়ত। আপাতদৃষ্টিতে তারা জিতিতেছেনও। স্কুল দৃষ্টিতে দেখা যাইবে, দেশের লেখক গোষ্ঠী ও পাঠক সাধারণের মেজরিটি তাদের কথা ও কাজ মানিয়া লইয়াছেন।

.

. বিভ্রান্তির হেতু

কিন্তু ভাষা-সাহিত্য ও শিল্প-কৃষ্টির ইতিহাস একটু তলাইয়া বিচার করিলেই বুঝা যাইবে তাঁদের ধারণাটা ভ্রান্ত ও তাদের কার্যকলাপ অবাস্তব। এটা আজকাল সকলেই জানেন যে, শিল্প সাহিত্য, সুতরাং ভাষাও, এককালে ভদ্রলোক ও পণ্ডিতদের একচেটিয়া সম্পদ ছিল। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের বেলাও ছিল তাই। ইংরাজ শাসনের প্রভাবে বাংলা সাহিত্য যখন পশ্চিমী অর্থে উন্নতির পথ ধরে উনিশ শতকের মাঝামাঝি, তখন এটা সংস্কৃত-ঘেঁষা পণ্ডিতি বাংলা হওয়ার দিকে ধাবিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র প্রভৃতি মনীষীর নেতৃত্বে তার এই গতির পরিবর্তন হয়। বাংলা ভাষা হয় অতঃপর মধ্যবিত্ত শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের, তৎকালীন কথায় ভদ্রলোকের, সাহিত্যের মাধ্যম। ইউরোপ মার্কিন সাংস্কৃতিক বিপ্লবে বিশ শতকের গোড়া হইতেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য গণমুখী হয়। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র ও তাদের অনুসারীরা এই প্রগতির পথে বিরাট অবদান রাখেন। স্বাভাবিক ক্রমোন্নতি, ভদ্রলোকের ভাষায় ক্রমাবনতি ও ভাষা-সাহিত্যের এই গণমুখিতা, ভদ্রলোকের ভাষায় নিম্নমুখিতা, সাহিত্যের ভাষাকে পরিমণ্ডলীয় চাপেই কলিকাতার পার্শ্ববর্তী ভাগীরথী-তীরবর্তী আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় (কনভার্সেশনাল ল্যাংগুয়েজে) পরিণত করে। রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্রের অসাধারণ প্রতিভার স্পর্শ পাইয়া ভাগীরথী তীরের ‘গ্রাম্যতা’ (রাসটিসিটি), তার জিভের অশালীন মোচড়সহ (ইন্ডিসেন্ট টাং টুইসৃটিং) সভ্য ও শালীন সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত হইল। এটা স্বাভাবিক। ভাষার নিজস্ব অভদ্রতা ও অশালীনতা বলিয়া কিছু নাই। যা ভদ্রলোকের মুখের ভাষা, তাই ভদ্রভাষা। ভদ্রসাহিত্যে যে ভাষা ব্যবহৃত ও প্রযুক্ত হয়, সেটাই ভদ্র, শালীন সাহিত্যের ভাষা। আসলে ভাষা সাহিত্যকে ভদ্র করে না। সাহিত্যই ভাষাকে ভদ্র করে। বস্তুত, ভাষায় স্ল্যাং বা অপভাষা ও অশালীন শব্দ বলিয়া কিছু নাই। সব সভ্য, শালীন ও সাহিত্যের ভাষাই গোড়ায়, সাহিত্যে স্থান পাওয়ার আগ পর্যন্ত, স্ল্যাং থাকে। সভ্য জাতসমূহের সব উন্নত ভাষাই গোড়ায় স্ল্যাং ছিল।

রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্রের মনীষার যাদুর কাঠিস্পর্শে ভাগীরথী অঞ্চলের অসাধু কথ্য ভালগার ভাষা যেদিন উন্নত বাংলা সাহিত্যের ভাষা হইতে শুরু করিল, সেদিন অনেক ভদ্র ও শালীনতাবাদী লেখক-সাহিত্যিক ও ভাষাবিজ্ঞানী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইয়া ইহার প্রতিবাদ করিলেন। কিন্তু সে প্রতিবাদ বন্যার স্রোতে বাধা দেওয়ার শামিল হইল। তবু সেই প্রতিবাদীদের উদ্দেশ্য মহৎ ছিল, এটা স্বীকার করিতেই হইবে। সে মহৎ উদ্দেশ্যের দুইটা বড় দিক ছিল। এক দল ছিলেন বাংলা ভাষার মার্জিত রূপের পক্ষে। অপর দল ছিলেন বাংলা ভাষার অখণ্ডতার পক্ষে। আমি এখানে দ্বিতীয় দলের কথাই বলিব। কারণ এঁদের মতের সাথেই আমরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এদের নেতা ছিলেন স্বনামধন্য সর্বজনমান্য ভাষাবিজ্ঞানী ডা. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। তার প্রতিপাদ্য ছিল ভাগীরথী-তীরের আঞ্চলিক কথ্য ভাষাকে (কনভার্সেশনাল ল্যাংগুয়েজকে) সাহিত্যের ভাষা করিয়া বাংলার কবি-ঔপন্যাসিকরা বাংলা ভাষাকে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার দুই ভাষায় বিভক্ত করিতেছেন। কথাটা তিনি বলিয়াছিলেন মুসলমানদের পাকিস্তান দাবির ও বাংলা বাটোয়ারার অনেক আগে ১৯৩৭ সালে। তিনি তার এক সারগর্ভ ভাষণে বলিয়াছিলেন : ‘ভালর জন্যই হউক আর মন্দের জন্যই হউক, উচিতই হউক, আর অনুচিতই হউক, ভাগীরথী নদীর সংলগ্ন স্থানের বিশেষত কলিকাতা অঞ্চলের ভদ্রসমাজের কথ্য ভাষা আজকাল সাহিত্যে ব্যবহৃত হইতেছে। এই ভাষা অঞ্চল-বিশেষের মৌখিক ভাষা। ইহার ব্যাকরণ ও উচ্চারণ-রীতি সমগ্র বাংলার শিক্ষিত ব্যক্তিগণ ব্যবহারিকভাবে স্বীকার করিয়া লইলেও নিজ মাতৃভাষার রিথ হিসাবে উহার বিশেষত্বের অধিকারী হয় নাই সে জন্য অবিসংবাদিতার্থ সাধু বাংলা ভাষার রাজপথ ছাড়িয়া যারা কলিকাতার আঞ্চলিক ভাষার পথে চলিতেছেন, অচেনা পথে চলার জন্য তাঁদের অনেকে এমন অনেক বিভ্রাট ঘটাইয়া থাকেন, যাহা লেখক ও পাঠক উভয়ের পক্ষেই কষ্টকর। আজকালকার যে কোনও বাংলা দৈনিক সাপ্তাহিক মাসিকপত্রে অনেক লেখকের লেখা পড়িলেই এ কথা বেশ বুঝিতে পারা যায়।

ডা. সুনীতি কুমার চ্যাটার্জি ভাষাবিজ্ঞানী। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নন। কিম্বা সমাজবিজ্ঞানীও নন। তিনি অখণ্ড বাংলার এগার কোটি মানুষের ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা লইয়া গর্ব করিতেন। কাজেই আঞ্চলিকতার অভিশাপে বাংলা ভাষার দ্বিধাবিভক্তির আশঙ্কায় তিনি ঐ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করিয়াছিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানী না হওয়ায় তিনি বুঝিতে পারেন নাই, দুর্বার গতি গণতন্ত্রের চাপে শিল্প-সাহিত্য ও ভাষাকে যে গণমুখী হইতে হইতেছে, বাংলা ভাষার অখণ্ডতা ও সাধুতার দোহাই দিয়া সে দুর্বার গতিরোধ করা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রক্ষমতা ও জাতীয় সম্পদ ভোগের অধিকার যেমন করিয়া সমাজের উপরতলা হইতে মধ্যবিত্ত পার হইয়া সমাজের তথা জাতির একেবারে নিচের তলায় আসিতে বাধ্য ছিল, শিল্প-সাহিত্য ও ভাষার বেলাও তাই ঘটা অপ্রতিরোধ্য হইয়া পড়িয়াছিল। ভাষা ও সাহিত্যের এই গণমুখী গতি স্বভাবতই তকালীন রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রস্থল কলিকাতার পার্শ্ববর্তী জনগণের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হইল।

.

. আমাদের কথ্য ভাষার শক্তির উৎস

এটা বুঝিয়াছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি শুধু বিশ্বকবি ছিলেন না। তিনি শুধু বাংলা ভাষাকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে উন্নীতই করেন নাই। তিনি শুধু শিল্পী সাহিত্যিক-কবি-সংগীতজ্ঞই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একাধারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও স্বপ্নদ্রষ্টা। রাজনীতিতে ছিলেন তিনি মহাভারত বিশ্বভারতীয় প্রবক্তা। সমাজবিজ্ঞানে ছিলেন তিনি আর্য-অনার্য-হিন্দু-মুসলিম-শক-হুঁন মোগল-পাঠানের সংমিশ্রণে ভারত-তীর্থের’, মহামিলনের কুম্ভমেলার স্বাপ্নিক। যিনি বিশাল দেখেন, তিনি ক্ষুদ্রও দেখেন। কারণ বিশাল ত খণ্ডেরই সংমিশ্রণ। তাই মহাভারতের স্বপ্ন দেখার সময়ও তার বিশাল চিন্তা-রাজ্যে খণ্ডিত বাংলার দৃশ্যও তার চোখ এড়াইয়া যাইত না। মৃত্যুর মাত্র দুই বছর আগে তিনি তাই বুঝিতে ও বলিতে পারিয়াছিলেন : বাংলা শুধু দেহে দুই নয়, অন্তরেও দুই। বাংলা সাহিত্যে কলিকাতা-কেন্দ্রিক আঞ্চলিকতার প্রাধান্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দ্বিখণ্ডিত হইবার আশঙ্কায় সুনীতি বাবুর মত তাই রবীন্দ্রনাথ ভীত হন নাই। এটা স্বাভাবিক বলিয়া তিনি মানিয়া লইয়াছিলেন। ডা. সুনীতি চ্যাটার্জিকে সান্ত্বনা দিবার উদ্দেশ্যেই বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ ঐ সময় লিখিয়াছিলেন যে, বাংলা সাহিত্যের ভাষায় কলিকাতা-কেন্দ্রিক আঞ্চলিক প্রাধান্য দোষেরও নয়, অস্বাভাবিকও নয়। কলিকাতার বদলে ঢাকা যদি বাংলার রাজধানী হইত, তবে তথাকার আঞ্চলিকতা “ঢাকাইয়া-বাংলাই” বাংলা সাহিত্যের ভাষা হইত। তাতে পশ্চিম-বাংলা মুখ বাঁকা করিলে সে বক্রতা আপনি সিদা হইয়া যাইত।

খুবই খাঁটি সত্য কথা। স্বাভাবিক ঘটনা। বাস্তব সত্য কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এটা বুঝিয়াছিলেন জীবন-সায়াহ্নে। এটা বুঝিতে তার মহাসাগরের মত বিশাল মনীষার দরকার হইয়াছিল। কারণ এটা ছিল তাঁর জন্য অপরের ব্যাপার। নিজের ব্যাপার এটা তাঁর ছিল না। অপর পক্ষে তাঁর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভক্ত অনুসারী হইয়াও আমি এটা বুঝিয়াছিলাম তরুণ বয়সেই। আমার জন্য মনীষার বিশাল মহাসাগর ত দরকার ছিলই না, বড় রকমের জলাশয়েরও আবশ্যকতা ছিল না। একটি অগভীর ডোবাই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। কারণ এটা আমার ছিল নিজস্ব ব্যাপার। একজন সাধারণ দেশপ্রেমিক আত্মসম্মানী, ‘বাঙ্গালের’ মনই ছিল এটা বুঝার জন্য যথেষ্ট।

বাংলা সাহিত্যের একজন নগণ্য লেখক হিসাবে আমি যথাসময়ে বুঝিয়াছিলাম, সাহিত্যকে জনগণের মনের কথা মুখের ভাষায় প্রকাশের মাধ্যম হইতেই হইবে। কলিকাতা বসিয়াই এই উপলব্ধি ঘটিল বলিয়া এটাও বুঝিলাম, কলিকাতা-কেন্দ্রিক ঐ আঞ্চলিকতাটা আকস্মিক ও পরিবেশিক। ওটা প্রকৃতির দেওয়া স্বাভাবিকতা নয়। রবীন্দ্রনাথের মত দূরদর্শী ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নিশ্চয়ই ছিলাম না। কাজেই ঢাকা বাংলার রাজধানী হওয়ার কল্পনা আমার মাথায় ঢোকে নাই। কিন্তু এটা অতিসহজেই বুঝিয়াছিলাম যে, পশ্চিম-বাংলার কনভার্সেশনাল ল্যাংগুয়েজে সাহিত্য রচিত হইতেছে হউক, কিন্তু ঐ সঙ্গে পূর্ব বাংলার কনভার্সেশনাল ল্যাংগুয়েজেও সাহিত্য রচিত হইবে। হইতে পারে এবং হওয়া উচিৎ। লেখা শুরুও করিলাম। এটা মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা-বোধও ছিল না। পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্য বোধও ছিল না। এটা পাকিস্তান হওয়ার বার বছর আগের কথা। এই সময়ে আমি আমার জীবন ক্ষুধা নামক একটা বড় আকারের নভেল লিখিতে শুরু করি। শ্রদ্ধেয় বন্ধু মৌ. নাসিরউদ্দীন সাহেব তার সওগাত-এ ধারাবাহিক ছাপিতে থাকেন। অনেক দিন লাগে শেষ হইতে। নভেল হিসাবে এর বাহাদুরি বা মূল্যায়ন এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার বক্তব্য এই যে, এই পুস্তকে আমি পাত্র-পাত্রীর ডায়লগ পূর্ব বাংলার কথ্যভাষায় লিখিয়াছি তখনকার দিনেই। আরো কেউ-কেউ পূর্ব বাংলার কথ্যভাষা তাদের নাটক-নভেলে স্থানে-স্থানে ব্যবহার করিয়াছেন।

.

. ‘মনিব’ ও ‘চাকরের’ ভাষা

কিন্তু অহংকার না করিয়াও আমি বলিতে পারি এবং এখানে সে কথাটাই বলিতেছি যে, আমার মধ্যে ও তাদের মধ্যে মৌল পার্থক্য রহিয়াছে। তারা পূর্ব বাংলার কথ্যভাষা দেন নাই বইয়ের চাকরবাকর শ্ৰেণীর চরিত্রের মুখে। ভদ্রলোক চরিত্রের সবাই বিশুদ্ধ আর্য উচ্চারণে কলিকাতার কথ্যভাষাই ব্যবহার করিয়া থাকেন। পশ্চিম-বাংলার কথ্যভাষা যে ভদ্র, শালীন ও শ্রুতিমধুর এটা এমফাসাইয করিবার মতলবেই যেন চাকরবাকরের মুখেও যতটুকু পূর্ব বাংলার কথ্যভাষা ঢোকান তা-ও বিকৃত উচ্চারণে ও বিশ্রীমুখ ও অঙ্গ-ভঙ্গিতে। পূর্ব বাংলার কনভার্সেশনাল বাংলাকে বিদ্রূপ করার সুচিন্তিত মতলবেই যেন ঐটুকু করা হয়। পশ্চিম-বাংলার ভদ্রতা’ ও পূর্ব বাংলার ‘অভদ্রতা’ আন্ডারলাইন করার জন্য আরো উপায় ইতিমধ্যে বাহির হইয়াছে। অশিক্ষিত কৃষক, অর্ধশিক্ষিত ইংরাজি না-জানা ব্যবসায়ী, কারবারী ও আরবি ফারসি-জানা-মৌলবী বাপ-দাদারা ও ইংরাজি-শিক্ষিত কলেজ-পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী ও দারোগা-ডিপুটিদের মধ্যকার ডায়লগের বেলাও ওঁদের মুখ দিয়া পূর্ব বাংলা ও এদের মুখ দিয়া পশ্চিম-বাংলা অসংকোচে বলাইতেছেন। এই নাট্যকার-ঔপন্যাসিকরা ভাল করিয়াই সমঝাইতেছেন যে খোদ পূর্ব বাংলায় (বাংলাদেশে) ও পূর্ব বাংলার কথ্যভাষাটা অসভ্য লোকের ও পশ্চিম-বাংলার কথ্যভাষাটাই ভদ্রলোকের ভাষা। বৈঠকখানা, আফিস-আদালত ও সভা সমিতি সর্বত্রই এটা সত্য। মনে পড়িতেছে, এর মধ্যে এক সিনেমায় বাংলাদেশের মেন্টাল হসপিটালের একটি ছবি দেখিয়াছিলাম। সে হাসপাতালে সব পাগলও কী সুন্দর কলিকাতার কথ্যভাষা বলিয়াছিল! এ সবই টাওয়ার বাংলা ও খামার বাংলার মধ্যে দুইশ বছরের মনিব-চাকর সম্বন্ধ বজায় রাখিবার অপচেষ্টা। পরিভাষা সৃষ্টির নামে ‘বিদেশি শব্দ’ হওয়ার অজুহাতে ‘আদালত’, ‘কলেজ ইত্যাদি চলতি সহজ বাংলা শব্দের জায়গায় ন্যায়পীঠ’ ও ‘মহাবিদ্যালয় ইত্যাদি দুর্বোধ্য-দুরুচ্চার সংস্কৃত শব্দ প্রবর্তন এবং তুলা-মুলা ইত্যাদি চেনা শব্দকে তুলো-মুলো ইত্যাদি অচেনা ভদ্র উচ্চারণ ঐ একই অপচেষ্টার অংশমাত্র। এঁদের মধ্যে কেউ-কেউ পাড়া গাঁয়ের কৃষক-শ্রমিক লইয়া নাটক-নভেল লিখিয়াছেন। ঐ সব বইয়ের পাত্র পাত্রীর মুখে পূর্ব বাংলার কথ্যভাষা দিয়াছেন। লোকাল কালার দানে ও স্বাভাবিকতা ও বাস্তবতা অঙ্কনের তার অনেকগুলিই সুন্দর-সফল-সজীব আর্ট হইয়াছে। কিন্তু যেই ঘটনার মধ্যে কোনও দারোগা-মাস্টার বা অন্য কোনও শিক্ষিত লোকের আমদানি হইয়াছে, অমনি তার মুখে পশ্চিম-বাংলার কথ্যভাষা দেওয়া হইয়াছে। যেন পূর্ব বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায়ের নিজস্ব কোনও সফিসটিকেটেড কথ্যভাষা নাই।

এইখানেই তাঁদের সাথে আমার বিরোধ। আমি জানি, এবং সেটাই বলিতে এবং বই-পুস্তকে দেখাইতে চাই যে, পূর্ব বাংলার বিপুল শিক্ষিত সমাজের মধ্যে স্মরণাতীত কাল হইতে তাঁদের একটা নিজস্ব সুসভ্য, শালীন শ্রুতিমধুর সফিসটিকেটেড কথ্য বাংলা বিদ্যমান আছে। এই ভাষা পূর্ব বাংলার হিন্দু মুসলিম ভদ্রলোক ও শিক্ষিত সম্প্রদায় দেশ বাঁটোয়ারা হইবার আগে হইতে ব্যবহার করিয়া আসিতেছেন, এবং আজও ব্যবহার করিতেছেন। চিরকাল ব্যবহার করিবেন। আমাদের লেখক-সাহিত্যিকরা হাজার পশ্চিম-বাংলার কথ্যভাষাকে আমাদের সাহিত্যের এবং সরকারি কাগজপত্রের ভাষা করিলেও আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়সহ জনগণের মুখের ভাষা করিতে পারিবেন না। কারণ ব্যক্তির ভাষা বদলান সম্ভব হইলেও জাতির ভাষা বদলান যায় না।

এটা ভাষাবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য হইলেও আমি ঐ সব বিজ্ঞান না পড়িয়াই সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান হইতেই তা বুঝিতে পারিয়াছিলাম। বাংলা বাটোয়ারা হওয়ার আগে পূর্ব বাংলার মুখের ভাষার প্রতি আমার এই দরদ ছিল আঞ্চলিক আত্মসম্মানের প্রশ্ন। কলিকাতা রাজধানী রাখিয়াও এবং বাংলাদেশ অখণ্ড রাখিয়াও যে বাংলা-সাহিত্য থাকিত, তাতে পূর্ব বাংলার মুখের ভাষা উপেক্ষিত হইবে, এতে আমি অপমান বোধ করিতাম। সেজন্য আমার জীবনক্ষুধায় এবং তারও আগে ছোটগল্পে পূর্ব বাংলার কথ্যভাষাকে স্থান দিবার চেষ্টা করিতাম। দেশ ভাগ হইয়া পূর্ব বাংলা প্রথমে পূর্ব-পাকিস্তান ও পরে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ হওয়ার পর এই আঞ্চলিক আত্মমর্যাদাবোধই জাতীয় মর্যাদায় উন্নীত হইয়াছে। কাজেই দেশভাগের পরে আমি আমার কোনও বইয়েই গ্রন্থকার বা গল্পকারে ভাষায় ত নয়ই, অপশ্চিম বাঙ্গালী পাত্র-পাত্রীর ডায়লগেও পশ্চিম-বাংলার কথ্যভাষা প্রয়োগ করি নাই। তার বদলে পূর্ব বাংলার শিক্ষিত সমাজের সফিসটিকেটেড ও পরিমার্জিত কথ্য বাংলা ব্যবহার করিয়াছি। এই সব গ্রন্থে মন্ত্রী, মেম্বর, অধ্যাপক, প্রিন্সিপাল, ডাক্তার, বিচারক, উকিল, মোখতার সবার মুখে এই ভাষা দিয়াছি। আমার সত্য মিথ্যা ও আবে হায়াত নামের নভেল, গালিভারের সফরনামা ও আসমানী পদানামক গল্পের বইয়ে এই নিয়ম মানিয়া চলিয়াছি। কর্তব্য যে কঠিন, সে সম্বন্ধে আমিও যে সম্পূর্ণ সচেতন পরবর্তী পৃষ্ঠাসমূহে পাঠক তা বুঝিতে পারিবেন।

.

১০. আমার ‘একাকিত্ব’

নিজের অক্ষমতার দরুন গল্প-উপন্যাসে যা পারিলাম না, প্রবন্ধে-নিবন্ধে তা সমাধা করতে উদ্যত হইলাম। আমাদের রাষ্ট্রীয় রূপ ‘পূর্ব-পাকিস্তান বা স্বাধীন বাংলাদেশ’ যা-ই হউক ভাষা-সাহিত্য, কালচার-সংস্কৃতিতে যে আমরা একদিকে পশ্চিম পাকিস্তান ও অপর দিকে ভারত হইতে সম্পূর্ণ পৃথক, এ সব ব্যাপারেই যে আমাদের নিজস্বতা ও স্বকীয়তা আছে, এটা আমার অনড় দৃঢ় মত। দেশের লেখক-সাহিত্যিকদেরে তা বুঝাইবার জন্য আমি ইংরাজি বাংলা মাসিক-দৈনিক কাগজে প্রবন্ধ লিখিতে লাগিলাম। একাধিক সাহিত্য সম্মিলনীতে, বাংলা একাডেমির ও একইশা ফেব্রুয়ারির ছাত্রদের সভায় ভাষণ পড়িতে লাগিলাম। এর সবগুলিই হয় দৈনিক কাগজ নয় ত একাডেমি পত্রিকায় তৎকালে প্রকাশিত হইয়াছিল। এইসব ভাষণ-নিবন্ধের অনেকগুলি যাইটের দশকে প্রকাশিত আমার পাক-বাংলার কালচার নামক পুস্তক ছাপা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই বইয়ের নাম বদলাইয়া বাংলাদেশের কালচার রাখা হইয়াছে। সত্তরের দশকে এন্ড অব এ বিট্রেয়াল নামক ইংরেজি বইয়ে এবং শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু নামক বাংলা বইয়ে রাজনৈতিক প্রবন্ধসমূহের সঙ্গে-সঙ্গে অনেকগুলি কালচারেল নিবন্ধও সংযোজিত হইয়াছে। রাজনৈতিক প্রবন্ধের সাথে কালচারেল প্রবন্ধগুলি একত্র করিবার কারণ ছিল। আমার প্রতিপাদ্য ছিল এই যে রাজনৈতিক কারণে ১৯৪৭ সালে যে দেশ ভাগ হইয়াছিল, কালচারেল দিক হইতেও ওটা ঠিকই হইয়াছিল। পাকিস্তানি আমলে একই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত থাকিয়াও পূর্ব-পাকিস্তান শুধু ভাষায় নয়, আর্ট-কালচারের ব্যাপারেও, অবশিষ্ট পাকিস্তান হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল। স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশ তেমনি তার কৃষ্টি-সাহিত্যের ব্যাপারে পশ্চিম-বাংলা-ভারত হইতে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্রই আছে। চিরকাল থাকিবে।

কিন্তু আমার এ মতবাদ অন্তত কাগজে-কলমে কেউ মানেন নাই। একদল পাকিস্তানি আমলে পূর্ব-পাকিস্তানের কৃষ্টিক স্বাতন্ত্র্য মানিতেন না। পূর্ব পাকিস্তানের কৃষ্টিকে তারা অখণ্ড পাকিস্তানি কৃষ্টির অংশ মনে করিতেন। অপর দল যারা পাকিস্তানি আমলেও পূর্ব-পাকিস্তানের কৃষ্টি-সাহিত্যকে পশ্চিম-বাংলার কৃষ্টি-সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলিতেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের গলার আওয়াজ ও কলমের জোর বাড়িয়াছে। আমি যতই বলি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক পাকিস্তান বাস্তবায়িত হইয়াছে, তাঁরা তত জোর গলায় বলেন : এতে বেঙ্গলী কালচার-আর্টের অবিভাজ্যতা চূড়ান্তরূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। আমি যত বলি, ইংরাজ-আমলের পৌনে দুইশ বছরের বাংলার শিল্প-সাহিত্য আসলে গোটা বাংলা তথা হিন্দু মুসলমানদের আর্ট-কালচার ছিল না ও নাই, তারা তত বলেন, কলিকাতা কেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গের ঐ কালচার-সাহিত্যই গোটা বাংলার তথা হিন্দু মুসলিমের যুক্ত জাতীয় সাহিত্য ও আর্ট-কালচার। আমি যত বলি, ভাগীরথী তীরের ইংরাজ-সৃষ্ট ঐ বেঙ্গল আসলে ‘টাওয়ার বাংলা’ আসল বাংলা পূর্ব বাংলায়, তাদের বিচারের খামার বাংলায়, আমার কথায় তাঁদের ‘বিদগ্ধ’ মনে ও প্রস্তরীভূত মস্তকে কোনও আসর হয় না। শুধু আমার কথাই বা কেন? টাওয়ার বাংলা হইতেও বলা হয় : ‘তোমাদের আবার কালচার কী? তোমাদের ত একটিমাত্র কালচার : সেটা এগ্রিকালচার। কাজেই ওটা নিয়াই থাক, ভদ্রলোকের হেঁসেলে ঢুকিবার চেষ্টা করিও না। তবু আমাদের বিদগ্ধদের হুশ হয় না। কারণ তাদের মন-মস্তিষ্ক সত্যই টাওয়ারের কালচারের অগ্নিতাপে বিদগ্ধ হইয়া গিয়াছে। এঁরা মুসলমান’ হইলেও ভদ্রলোক।

শুধু ‘বাঙ্গালী সংস্কৃতির’ ও বাংলা সাহিত্যের অবিভাজ্যতাবাদী এই ভদ্রলোক মুসলমানরাই টাওয়ার বাংলার ‘কথ্য ভাষা-শৈলী’ ব্যবহার করেন তা নয়, যে সব ইসলামী রাষ্ট্রনীতিবাদী, মুসলিম নেশনহুড’-বিশ্বাসী, শরিয়তী আইনের প্রবক্তা’, যারা সাধারণভাবে অমুসলমানদের সাথে বিশেষভাবে হিন্দুদের সাথে পলিটিক্যাল নেশন’ গড়িতেও রাজি নন, তাঁরাও তাঁদের

ইসলামি রাষ্ট্রনীতি’ পশ্চিম-বাংলার তথা হিন্দু-বাংলার কথ্যভাষাতেই প্রচার করিয়া থাকেন। পাকিস্তান আমলে এঁরা আমাদের ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করিয়াছিলেন উর্দুর সমর্থনে। এখন এঁরা নিজেদের সাহিত্যিক। আচরণে যেন আমাদেরে আজও ‘উইথ ভেনজ্যান্স’ বলিতেছেন : ইকবালের উর্দু যখন বর্জন করিয়াছ, তখন রবীন্দ্রনাথের বাংলা তোমাদেরে ধরাইয়াই ছাড়িব। যদি এতে তোমাদের আবার হুঁশ হয়।

সুতরাং এই সুস্পষ্ট বিরুদ্ধ মতবাদী দুই দলের কেউ আমার সমর্থন করেন না। তবে কি আমি একা? দৃশ্যত আপাতত তাই মনে হইবে। দুই-একটি মাত্র দৈনিক খবরের কাগজ ছাড়া বাংলাদেশের নগর-শহরের সব কাগজই এমনকি মফস্বল শহরের সাপ্তাহিকগুলি পর্যন্ত কলিকাতার কথ্যভাষায় লেখার চেষ্টা হইয়া থাকে। কাজেই মনে হইবে, বাংলাদেশের শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত, পণ্ডিত অপণ্ডিত লেখক সাহিত্যিক সাংবাদিকদের কেউই বাংলাদেশের কৃষ্টিক-ভাষিক সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র স্বকীয়তার সমর্থক নয়। এঁরা সবাই বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিম-বাংলার ভাষিক-কৃষ্টিক-সাহিত্যিক হিন্টারল্যান্ড, কলনি বা মার্কেটরূপেই বজায় রাখিবার পক্ষপাতী। কিন্তু এটা হইতে পারে না। সত্যও হইতে পারে না, বাস্তবও হইতে পারে না। সত্যও না, রিয়ালিটিও না। বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষী আট কোটি মানুষের একটা স্বাধীন সার্বভৌম জাতি অপর রাষ্ট্রের অঙ্গ চার কোটি বাংলা ভাষাভাষীর কালচারেল উপনিবেশ থাকিতে পারে না।

কাজেই আমি একা নই। এই আট কোটি বাঙ্গালীর শতকরা নিরানব্বইজনই আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার মতই কৃষ্টিক স্বকীয়তারও দৃঢ় সমর্থক। আর লেখক-সাহিত্যিকদের কথা? তারা কত জন? এঁদের পাঠকই বা কয়জন? জনতার শতকরা মাত্র কুড়িজন লেখা-পড়া জানেন। এঁদের কত ডেসিমেল পয়েন্ট পার্সেন্ট লেখেন, আর কত ডেসিমেল পার্সেন্ট পড়েন? বলা যায়, এঁরা যতই মুষ্টির ভগ্নাংশ হউন, এঁরাই দেশের কৃষ্টি-সাহিত্যের নিয়ামক। কথাটা ঠিক। কিন্তু এঁদের কতজন সজ্ঞানে অপর রাষ্ট্রের ভাষিক কৃষ্টিক উপনিবেশের দালালি করিতেছেন? খুবই নগণ্য অংশ। আর সকলে পশ্চিম-বাংলার কথ্যভাষাকেই বাংলা-সাহিত্যের চলতি মাধ্যম বলিয়া জানেন। তারা ভাবেন, এটাই উন্নত বাংলা। সাহিত্যের উন্নত সর্বাধুনিক ভাষা। এটা যে পশ্চিম বাংলারই কথ্য ডায়লেক্ট তা-ও অনেকে জানেন না। তারা এটাকে সর্বাধুনিক সাহিত্যের ভাষা হিসাবেই চিনেন। যদিও তারা এ ভাষায় শুধু লেখেন, কথা বলেন না। কিন্তু এটাতে তারা কোনও অসংগতি দেখিতে পান না। আমরা কেতাবি ভাষায় কবে কথা বলিয়াছি? যেদিন এঁরা জানিবেন, কেতাবি ভাষা কেতাবি ভাষাই, ওটা অপর কোনও বিদেশের বা অঞ্চলের কথ্যভাষা নয়, সেদিন তারা আত্মমর্যাদার খাতিরেই নিজেদের কথ্যভাষায় যেমন কথা বলিবেন, তেমনি নিজস্ব সফিসটিকেটেড মার্জিত সাহিত্যের ভাষা নিজেরাই করিয়া লইবেন। এত বড় জাতির জনতা যেদিন সংকল্প করিবে : আমরা কারো থনে নিচু থাকিব না, কারো কাছে নীচ হইব না, সেদিনই আমরা মুক্ত হইব।

তবু আমি বুঝি ও সরলভাবে স্বীকার করি যে, আমি বর্তমানে বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রে যুগ-ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলিতেছি। স্রোতের বিরুদ্ধে চলিবার চেষ্টা করিতেছি। এ ব্যাপারে আমি ডা. ইয়ুং ইমার্সনের কথাও ভুলি নাই। বরঞ্চ তাদের জীবন হইতে প্রেরণা লাভ করিয়াছি। ডা. ইয়ুং তার পশুচলেটস অব এনালিটিক্যাল সাইকলজিতে লিখিয়াছেন : স্পিরিট অব দি এজ, মানে যুগধর্ম, ধর্মোন্মাদনার চেয়েও শক্তিশালী। এটা কোনও যুক্তির ধার ধারে না। ওটা একটা প্রবণতা। অবচেতনার মধ্য দিয়া দুর্বল মনে তা প্রভাব বিস্তার করে দুর্বার গতিতে। এই যুগ-ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়া শুধু নিষ্ফল নয়, পাগলামিও। ওটা অবৈধ, অশালীন কুফরি ব্যক্তির জন্য বিপজ্জনক। তবু আমি এই যুগ-ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়াইছি এই সত্য উপলব্ধি করিয়া যে এটা ‘যুগে’র হইলেও ধর্মে’র শক্তি এর মধ্যে নাই। এটা ফ্যাশন মাত্র। মার্কিন জাতির পথ প্রদর্শক ইমার্সন যে তথাকথিত যুগ-ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া ছিলেন তা পরবর্তী অধ্যায়ে বর্ণনা করিয়াছি। তা ছাড়া এঁদের কেউ কেউ যুক্তি দেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন জিলা ও অঞ্চলের কথ্যভাষা এতই ভিন্ন ও পৃথক যে, এদেশে বাংলাভাষাকে সর্বাঞ্চলীয় সর্বজনগ্রাহ্য কোনও বাংলাদেশি জাতীয় রূপ দেওয়া সম্ভব নয়।

কথাটা যে কত অসার, অসত্য ও ভ্রান্ত, তা ভাষাবিজ্ঞানীমাত্রেই জানেন। সব রাষ্ট্রের, সব জাতির, সব দেশের বেলাতেই গোড়াতে এই আঞ্চলিক বিভিন্নতা থাকে ও ছিল। দেশ, রাষ্ট্র ও জাতির স্বার্থেই সে বিভিন্নতা ডিঙ্গাইয়া জাতীয় ভাষা ও সাহিত্য সৃষ্টি হইয়াছে। কলিকাতার যে ভাষাকে এঁরা এত সহজে চলতি বাংলা’ বলেন, তারও জন্ম এইভাবেই হইয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *