১৪. গণভিত্তিক সাহিত্যিক মোড়

পঞ্চম খণ্ড
সাহিত্যিক জীবন (গরমামুলি)

অধ্যায় চৌদ্দ – গণভিত্তিক সাহিত্যিক মোড়

১. উৎপ্রেরণা-জাত জাতীয় চিন্তা

সাহিত্যকে জীবন-ভিত্তিক হইতে হইবে এ ধারণাটা আমার ছিল একরকম সহজাত। এটাকে উৎপ্রেরণা-ভিত্তিকও বলা যাইতে পারে। তবে সে জীবন যে গণজীবন হইতে হইবে, এ উপলব্ধি আসে আরো পরে। কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হইবে যে, গোড়ায় এর মধ্যে কোনও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। সাম্প্রদায়িক চেতনা ত ছিলই না। ছাত্রজীবনের গোড়া হইতেই আমি বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, রমেশ দত্ত, শরৎচন্দ্র প্রভৃতি কবি ঔপন্যাসিককে বাংলা সাহিত্যের দিকপাল মনে করিতাম, এবং এঁদের অনুসারী আরো শত-শত হিন্দু সাহিত্যিককে আমার অনুকরণযোগ্য আদর্শ ভাবিতাম। শ্রদ্ধার সঙ্গে অথবা মনোযোগে পড়িতামও। এই সব মনীষীর লেখায় কোনও মুসলমান চরিত্র নাই। বঙ্কিম-রমেশচন্দ্রের মত দুই-একজনের লেখায় যাও আছে, তা-ও ঘৃণা ও বিদ্বেষপূর্ণ। এসব দেখিয়া মনে আফসোস হইত বটে, কিন্তু তাতেও কোনও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ দেখিতাম না। কাজেই আফসোস হইলেও রাগ হইত না।

বরঞ্চ মনে করিতাম, বলিতামও যে, মুসলমান সমাজে নাটক-নভেলের চরিত্র হইবার মত লোকই নাই। নারী-পুরুষের প্রেমই যখন নাটক নভেলের উপজীব্য তখন কড়া পর্দাপালক মুসলিম সমাজ লইয়া উপন্যাসই হইতে পারে না। শিশু-সুলভ এই সব চিন্তা-ধারণার যখন অবসান হইল, তখনও হিন্দু সাহিত্যিকদের মুসলিম-চরিত্রহীন বই-পুস্তককে ক্ষমার চক্ষেই দেখিয়া আসিতে থাকিলাম। লেখকদেরে কোনও দোষ দিতাম না। কারণ দোষটা ত আমাদের সমাজের, মানে আমাদের। নাহক অপরকে দোষ দিব কেন?

.

. সাহিত্য-জীবন

ছাত্র-জীবনের অবসানে এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির যে পরিবর্তন হয়, সেটা গোড়ায় ছিল রাজনৈতিক। সে রাজনীতিতেও সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। কারণ আমার রাজনৈতিক জীবনই শুরু হয় কংগ্রেসের মধ্য দিয়া। হিন্দু কংগ্রেস নেতাদের প্রশিক্ষণের অধীনে। রাজনৈতিক জীবনের প্রাইমারি স্তরেই ১৯২২ সালে আমি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও কবি মোজাম্মেল হক সাহেবদ্বয়ের সম্পাদকতায় প্রকাশিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় ‘গোলামী সাহিত্য শীর্ষক প্রবন্ধ লিখি। এই প্রবন্ধে গোটা বাংলা সাহিত্যকেই বিশেষত রবীন্দ্র শরৎচন্দ্রকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করি। সমালোচনা ত নয়, একেবারে নিন্দা। সে নিন্দায় অজ্ঞানতা, সাহিত্য সমালোচনায় অনধিকার, যতই থাকুক। তাতে সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। সাহিত্যিক সাম্প্রদায়িকতা মানে এখানে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার মত অবিচার বোধ নয়। এখানে সাম্প্রদায়িকতা মানে হিন্দু-মুসলিম স্বাতন্ত্র্য বোধ। গোলামী সাহিত্যে আমি গোটা বাঙ্গালী জাতির পক্ষ হইতেই কথা বলিবার চেষ্টা করিয়াছি। গোটা বাঙ্গালী জাতির স্বার্থের দিক হইতেই তৎকালীন সাহিত্যকে গোলামী সাহিত্য বলিয়াছি। বঙ্কিম-মাইকেল তত দিনে উনিশ শতকের ইউরোপীয় নব-জাগরণের বাণীই বাঙ্গালী জীবনে সাহিত্যের মাধ্যমে প্রচারের পথনির্দেশ করিয়াছেন। তাদেরই প্রদর্শিত পথে চলিয়া রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র বাংলা সাহিত্যকে সত্য-সত্যই আধুনিক সাহিত্যে রূপান্তরিত করিয়া চলিয়াছেন। বস্তুত বাংলা সাহিত্যের ‘স্বর্ণযুগ তখন আরম্ভ হইয়াছে।

কিন্তু আমার মত তরুণের মনে অতবড় উপলব্ধি কোনও নাড়া দেয় নাই। আমার চোখে পড়িয়াছিল শুধু এই একটা দিক : বঙ্কিম-মাইকেল যা লিখিয়া গিয়াছেন, রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্র যা লিখিতেছেন এবং এ দুই শক্তিধরের অনুকরণে বাঙ্গালী সাহিত্য-সাধকরা যা লিখিতেছেন, তার সাথে বাঙ্গলার বাস্তব জীবনের কোনও মিল নাই। ইংরাজ-ফরাসি সাহিত্যিকদের অনুকরণে আমাদের সাহিত্যিকরা বাংলা ভাষায় বাঙ্গালী নামে কতকগুলি ইংরাজ ফরাসি চরিত্রের কাহিনী লিখিতেছেন। আমার বিবেচনায় পৌনে দুইশ বছরের বিদেশি প্রভাবে রাজনীতির দিক হইতে আমরা যেমন ইংরাজের গোলাম হইয়া গিয়াছি, শিল্প-সাহিত্য-কৃষ্টির ক্ষেত্রে তেমনি আমরা ইংরাজের গোলাম হইয়া গিয়াছি। এটা অবশ্য অংশত আমার তকালীন রাজনৈতিক ভাবাবেগেরই ফল। কংগ্রেসের অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের দ্বারা ভারতের অন্যান্য তরুণদের মতই আমিও বিপুলভাবে প্রভাবিত হইয়াছিলাম। কিন্তু সে কারণে সাহিত্য সম্বন্ধে আমার ঐ মতবাদের মধ্যে কোনও সাম্প্রদায়িক বা আঞ্চলিক সংকীর্ণতা ছিল না। বরঞ্চ জাতীয় সাহিত্যের প্রাণ ও রূপ সম্পর্কে একটা ধারণা প্রকাশের প্রয়াস ছিল। কেউ-কেউ তা স্বীকারও করিয়াছিলেন দেখিয়া আমি উৎসাহিতও হইয়াছিলাম। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কলিকাতার সাহিত্যিক মহলে আমার এই প্রবন্ধে প্রকাশিত আমার মতবাদকে ধৃষ্টতা বলিয়া বিরূপ সমালোচনা করা হইলেও বরিশাল হিতৈষীর সম্পাদক খ্যাতনামা কংগ্রেস নেতা শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র ঘোষ তাঁর কাগজের সম্পাদকীয়তে আমার প্রবন্ধের সত্যভাষণের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়াছিলেন এবং একজন অখ্যাতনামা সাহিত্যে-নবাগত’কে অভিনন্দন জানাইয়াছিলেন। এই মতবাদ যে আমার ক্ষণস্থায়ী ভাবাবেগ ছিল না, তার প্রমাণ এই যে পরবর্তীকালের বিভিন্ন সময়ে আমি একাধিক লেখায় এই একই কথা বলিয়া ও লিখিয়াছিলাম। তার মধ্যে ১৯৩২-৩৩ সালের সওগাত-এ ‘সাহিত্য ও যুগ-ধর্ম ও ১৯৪১ ৪২ সালে অধ্যাপক হুমায়ুন কবির-সম্পাদিত চতুরঙ্গ-এ ‘সাহিত্যিকের দৃষ্টিতে রাজনীতি’ শীর্ষক দুইটি বিতণ্ডামূলক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখিয়াছিলাম। তাতে মোটামুটি ঐ একই কথা বলিয়াছিলাম বিভিন্ন যুক্তি-তর্কের অবতারণা করিয়া।

.

. খণ্ডতার সংগত কারণ

এই সব বিতর্কমূলক প্রবন্ধে আমি তৎকালীন সাহিত্যিক নেতৃত্বের সমালোচনামূলক অনেক কথা বলিয়াছি বটে, কিন্তু সে সব আপত্তিকর কথার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। ঐ সব সাহিত্যিক সমস্যার মধ্যে বাংলার হিন্দু-মুসলমানের স্বার্থের কোনও বিরোধ আছে, তেমন কোনও কথা আমি প্রকারান্তরেও বলি নাই। কারণ এ সম্পর্কে আমার কোনও চেতনাই তখনও জন্মে নাই। সামাজিক আচার-আচরণে মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের ব্যবহারে ছেলেবেলা হইতেই আমি ঘোরতর অসন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু ওটাকেই হিন্দুদের সামাজিক কুসংস্কার, তার মানে তাদের দুর্বলতা মনে করিতাম। ওতে আমার মনে মুসলমানদের কোনও ইনফিরিওরিটি বা হিন্দুদের কোনও সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স ছিল না। তবু সামাজিক ব্যবসায় হিন্দু ও মুসলমানের স্বাতন্ত্র সম্বন্ধে ছেলেবেলা হইতেই একটা ধারণা হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু হিন্দুদের প্রতি সাধারণভাবে আমার কোনও বিদ্বেষ বা ঘৃণা ছিল না। হিন্দু শিক্ষক-অধ্যাপকদের ও বহু গুরুজনের প্রতি আমার সীমাহীন ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালবাসা ছিল। আজও আছে। ঐ ধরনের স্বাতন্ত্রের চিন্তা ভাবনা আমার সামাজিক চিন্তা-ধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমার চিন্তা-ধারায় এই প্রকার কোনও ভাবনাই আমাকে স্পর্শ করিত না। রাজনীতিতে আমি ছিলাম জাতীয়তাবাদী ও কংগ্রেসি। সে কারণেও আমার সাহিত্য-চিন্তায় সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবেশ না করিয়া থাকিতে পারে। কিন্তু আশ্চর্য এই যে বয়স ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু-মুসলিম সামাজিক স্বাতন্ত্র-চিন্তা আমার মনে আসে রাজনীতি ক্ষেত্রের আগে সাহিত্যক্ষেত্রে। কংগ্রেসি হিসাবে আমি যখন প্রজা-আন্দোলনে প্রবেশ করি, তখন প্রায় সকল হিন্দু কংগ্রেস-নেতাই তার বিরুদ্ধাচরণ করেন। প্রজা-আন্দোলনের বহু মুসলিম সহকর্মী এটাকে হিন্দুদের সাম্প্রদায়িকতা বলিতেন। কিন্তু আমি তা বলিতাম না। সাম্প্রদায়িকতার বদলে এটাকে আমি ভেস্টেড ইন্টারেস্টের স্বার্থপরতা বলিতাম। হিন্দু-জমিদার মহাজনদের দ্বারা হিন্দু মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত সম্প্রদায় সাধারণভাবে উপকৃত হইতেছেন বলিয়া কৃষক-প্রজা-খাতক আন্দোলনে তারা সাধারণভাবে যোগ দিতেছেন না, এই যুক্তিতে এ ক্ষেত্রেও হিন্দুদের সাম্প্রদায়িকতা অভিযোগ হইতে রেহাই দিতাম।

.

. পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতা

কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে এমন কোনও যুক্তিতে হিন্দু সাহিত্যিকদেরে রেহাই দিতে পারিলাম না। সাহিত্য-ক্ষেত্রে কোনও প্রকারের ভেস্টেড ইন্টারেস্ট আমি কল্পনা করিতে পারিলাম না। কাজেই বাংলার অধিকাংশ অধিবাসী মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু সাহিত্যিকরা তাদেরে লইয়া কোনও বই-পুস্তক লেখেন না, এতে আমি দুঃখিত ছিলাম। কিন্তু এই অভিযোগ ভিত্তি করিয়া মুসলমানদের তরফে কোনও প্রকার লেখালেখি করাটাকে আমি মর্যাদা হানিকর মনে করিতাম। এ ধরনের অভিযোগ আন্দোলনকে আমি নারী জাতির, তফসিলি হিন্দু সম্প্রদায়ের, চাকুরিতে মুসলমানদের এবং কৃষক খাতকের অধিকার আদায়ের অভিযোগ–আন্দোলনের মতই শক্তিধরের বিরুদ্ধে অশক্তির, ক্ষমতাবানের বিরুদ্ধে অক্ষমের, উৎপীড়কের বিরুদ্ধে উৎপীড়িতের আন্দোলন মনে করিতাম। সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটা ছিল আমার চিন্তার অতীত। এই জন্য আমি সওগাত, নওরোজ ইত্যাদি মুসলিম সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ সমর্থন করিতাম এবং রাজনৈতিক কারণে দি মুসলমান, মোহাম্মদী, মুসলিম হিতৈষী ইত্যাদি সংবাদপত্র প্রকাশ সমর্থন করিলেও গোড়াতে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি প্রতিষ্ঠা ও মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের বিরোধী ছিলাম। কিন্তু বেশি দিন এই মনোভাব বাঁচাইয়া রাখিতে পারি নাই। বয়স ও অভিজ্ঞতা যত বাড়িতে লাগিল, জীবন ও সাহিত্যের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা সম্বন্ধে আমার মত ততই দৃঢ় হইতে লাগিল। আমি উপলব্ধি করিতে থাকিলাম, পরকীয়া প্রেম, নর-নারীর প্রতি আকর্ষণ-বিকর্ষণই সাহিত্যের একমাত্র বিষয়বস্তু নয়। পশ্চিমা সাহিত্যের তথাকথিত ‘ইটারন্যাল ট্রায়েঙ্গল’ই নর-নারীর প্রেমের সত্যিকার ও শাশ্বত রূপ নয়। আমার এই মতবাদ আরো দৃঢ় হইতে থাকিল যে অনর্জিত ধন সম্পদের অধিকারী কর্মহীন, শ্রমহীন, সুতরাং নিদ্রাহীন, অবসর-বহুল বহুভোগী বড়লোকদের কাছে নারী-প্রেম দুর্লভ ও নারী-হৃদয় দুয়ে রহস্যপুরী হইতে পারে, কিন্তু হৃদয়বান একভোগী সাধারণ পুরুষের কাছে নারী-প্রেম দুর্লভও নয়, নারী-হৃদয় রহস্যপুরীও নয়। কাজেই জীবন-শিল্প সাহিত্যের একমাত্র বিষয়বস্তুও এটা হইতে পারে না। বরঞ্চ গণ-মানুষের অসংখ্য দুঃখ-বেদনা, হাসি-কান্না, তাদের মহত্ত্ব-নীচতা, বীরত্ব-ভীরুতা, ক্ষমা-ঘৃণা, ত্যাগ-লোভ ইত্যাদি হৃদয়-বৃত্তি অবলম্বনে সাহিত্য রচিত হইলে সেটাই হইবে সত্যিকার শিল্প ও উপভোগ্য সাহিত্য।

এই মতবাদ জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন উপলব্ধিও উন্মোষিত হইতে লাগিল যে সমাজ-ব্যবস্থার দরুন হিন্দু-সাহিত্যিকরা মুসলমান চরিত্র লইয়া গল্প-উপন্যাস লিখিতে পারেন না বলিয়া আমি যে এতদিন তাঁদেরে ক্ষমা করিয়া আসিতেছিলাম, সে ধারণা আমার ঠিক নয়। আমাদের প্রতি ঘৃণা-অবজ্ঞাই এ অবহেলার কারণ। মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের অযোগ্যতার দরুনই হিন্দু মাসিকাদিতে মুসলমান লেখকদের লেখা ছাপা হয়, নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের পরে এ যুক্তিও আর টিকিল না। মরহুম আফ্যালুল হকের মুসলিম ভারত ও নওরোজ-এর এবং নাসিরউদ্দীন সাহেবের সওগাত-এর মাধ্যমে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জনের পরেই নজরুল ইসলাম হিন্দু-সাহিত্যিকদের দ্বারা স্বীকৃতি পান, তার আগে নয়।

.

. নূতন উপলব্ধি

রাজনীতির মত সাহিত্যেও হিন্দু-মুসলিমের এই স্বাতন্ত্র-বোধ দেখিয়া ক্রমে আমি নূতন জ্ঞান লাভ করিলাম। আমার ক্রমশ এই উপলব্ধি হইতে লাগিল যে নজরুল ইসলামের মত যুগ-প্রবর্তক প্রতিভাকেও যে দেশে স্বতন্ত্র সাম্প্রদায়িক সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিয়া পরিচিত ও স্বীকৃত হইতে হয়, সে দেশে এই স্বাতন্ত্রটাই বোধহয় বাস্তব সত্য। এর পর বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সেক্রেটারিগিরি গ্রহণ করিতে আমার আর কোনও আপত্তি থাকিল না। রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক উদারপন্থী কংগ্রেস-খিলাফতী সহকর্মী ও সাহিত্য-ক্ষেত্রে আমার অন্যতম মুরুব্বি ও পথপ্রদর্শক মৌ. মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী চৌধুরী সাহেবই বস্তুত আমাকে এই ‘সাম্প্রদায়িক সাহিত্য সমিতির সেক্রেটারিগিরি গ্রহণ করিতে বাধ্য করেন। ততদিনে প্রজাস্বত্ব আইনের ব্যাপারে সকল মতের ও সকল শ্রেণীর হিন্দুর ও সকল মতের ও সকল শ্রেণীর মুসলমানরা দুই পৃথক লাইনে কাতারবন্দী হইয়া উঠিয়াছেন। ভাষা ও শব্দের হিন্দু-মুসলমানিত্ব সম্বন্ধে মুসলমানী কথার অভিজ্ঞতার সাথে যোগ হইল নয়া পড়ার অভিজ্ঞতা। কঠোর বাস্তবতার কাছে ভাবাবেগ-সস্তৃত আদর্শবাদ পরাজিত হইল। জীবন-ক্ষুধানামক আমার যে নভেল কৃষক-প্রজা আন্দোলন। রূপায়ণের উদ্দেশ্যে শুরু হইয়াছিল, তা পর্যবসিত হইল পাকিস্তান আন্দোলনের বাস্তবতা চিত্রায়ণে। আমার সাহিত্যিক চিন্তাধারার এই ক্রমোন্নতি, অথবা বলিতে পারেন, ক্রমাবনতি, এমন স্তরে আসিল যে ১৯৪৩ সালে কলিকাতার প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মিলনীতে এক ভাষণে আমি লিখিয়াছিলাম : ভারতে রাজনৈতিক পাকিস্তান হইবে কি না জানি না, কিন্তু এটা নিশ্চিত যে বাংলার মেজরিটি সম্প্রদায় মুসলমানদের মুখের ভাষাকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লেখক-সাহিত্যিকরা এবং শিক্ষা বিভাগে যেভাবে সাহিত্য ও পাঠ্যপুস্তক হইতে পরিহার করিয়া চলিয়াছেন, তাতে বাংলায় সাহিত্যিক পাকিস্তান হইতে বাধ্য।

.

. জটিলতা বৃদ্ধি

এটা ত গেল লেখ্য বাংলা ভাষার সমস্যা। এর পরেও গোদের উপর একটা বিষফোঁড়া দেখা দিল। আঠার শতকের শেষ দিককার মার্কিন ও ফরাসি বিপ্লব ও বিশ শতকের গোড়ার রুশ বিপ্লবের ফলে ইউরোপ ও আমেরিকায় ভাষা ও সাহিত্য একটা গণমুখী মোড় গ্রহণ করিল প্রবল স্রোতের বেগেই। খুব স্বাভাবিক কারণেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এটা প্রতিফলিত হইল। কলিকাতা-কেন্দ্রিক বাংলাতে স্বভাবতই এই গণমুখিতা পশ্চিম বাংলায়। কেন্দ্রীভূত হইল। কলিকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের আঞ্চলিক কথ্য ভাষা সাহিত্যের ভাষার মর্যাদা লাভ করিয়া ইতিপূর্বে বাংলায় যেটা ছিল শুধু হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্র্য, তার সাথে যোগ হইল পশ্চিম ও পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র। এই ডাবল সমস্যার সমাধান স্পষ্টত দুঃসাধ্য ছিল। এমনি সময়ে ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক পাকিস্তান দাবি উঠিল। হিন্দুরা স্বভাবতই প্রবল বিরোধিতা করিল। পরিণামে হিন্দুদের দাবিতে বাংলা পশ্চিম ও পূর্ব বাংলায় বিভক্ত হইয়া গেল। কলিকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হইল। দুইশ বছরের কলিকাতার হিন্টারল্যান্ড পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হইল। ঢাকা পূর্ব-পাকিস্তানের রাজধানী হইল। আগে ছিল যেটা ভাষা-সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক ও আঞ্চলিক স্বাতন্ত্রের প্রশ্ন, সেটাই হইয়া গেল দুই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জাতীয় স্বকীয়তার প্রশ্ন।

.

. আমার উভয়সংকট

এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিটা আমাকে যতটা আঘাতিত ও বিভ্রান্ত করিল, আমার জানা কাউকে বা আমার বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদের ততটা আঘাতিত ও বিভ্রান্ত করিয়াছে বলিয়া মনে হইল না। আমার এই একাকিত্ব ও অনন্য সাধারণত্বের কারণ খুঁজিবার অনেক চেষ্ট করিয়াছি। দেশভাগের আগের প্রায় দশ-পনের বছর ও দেশভাগের পরের পঁচিশ বছর একুনে আমার সাহিত্যিক জীবনের এই চল্লিশটি বছর এই গবেষণায় না হোক, ধ্যান ধারণা ও চিন্তা-ভাবনায় কাটিয়াছে। আমি কোনও অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী নই। তবু আমার এই একাকিত্বের কারণ কী? এর একমাত্র উত্তর, আমার বিবেচনায়, এই যে বাংলার রাজনীতি ও সাহিত্যের উভয় ক্ষেত্রেই আমার বিশেষ একাকিত্ব বরাবরই ছিল। রাজনীতিতে আমি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী ও কংগ্রেসি ছিলাম আন্তরিকতার সাথেই। কিন্তু সেখানেও আমি গণমুখী, ভাষান্তরে ও কার্যান্তরে, কৃষক-প্রজা কংগ্রেসি ছিলাম। রাজনীতিতে আমার বাঙ্গালী জাতীয়তা ছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের প্যাটার্নের। এ জাতীয়তাবাদে বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অর্থ ছিল রাজনৈতিক ফেডারেশন, কৃষ্টিক ফিউশন ছিল না। ব্যবহারিক রাজনীতিতে এটা সম্ভব ও বাস্তব ছিল। কিন্তু সাহিত্য-ক্ষেত্রে এটা সম্ভব ছিল না। কারণ রাজনীতিতে মেজরিটি আধিপত্য, সাহিত্যে মাইনরিটির রাজত্ব। দেশবন্ধুর জাতীয়তাবাদ যখন বাঙ্গালী হিন্দুরা গ্রহণ করিল না তখনই বহুজাতিক উপমহাদেশ ইন্ডিয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজাতিক বেঙ্গলও ভাগ হইয়া গেল। বহু জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসি মুসলিম পাকিস্তান দাবির সমর্থন করিয়াছেন। বহু জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসি হিন্দু বেঙ্গল পার্টিশন-সমর্থন করিয়াছেন। এটা তাঁদের পক্ষে কঠিন ছিল। রাজনৈতিক পরিবেশ ও স্বাধিকার-বোধই জাতীয় চেতনায় বিবর্তন ঘটাইয়া এ কাজ সহজ করিয়া দেয়। কিন্তু কংগ্রেসি মুসলিম সাহিত্যিকের পক্ষে এটা তত সহজ ছিল না। বহু মুসলিম সাহিত্যিক পাকিস্তান দাবির সমর্থন করিয়াছেন। কিন্তু তাঁরা কংগ্রেসি জাতীয়তাবাদী ছিলেন না। পাকিস্তান দাবির সমর্থনের আগে তারা সক্রিয় রাজনীতি করিতেন না। মুসলিম-প্রধান একটা নয়া রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে তারা অতি সহজেই সমর্থন করিতে পারিলেন। আমার পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না। কাজেই আমাকে চিন্তা-ভাবনা করিয়া পাকিস্তানি হইতে হইয়াছিল। তাতে তিন-চার বছর লাগিয়াছিল। গোড়াতে আমি আমার সম্পাদিত দৈনিক কৃষক-এ কষিয়া পাকিস্তান দাবির নিন্দা করিয়াছি। মুসলিম স্বার্থ সম্বন্ধে আমি সচেতন ও মুখর ছিলাম না, তা নয়। বরঞ্চ কংগ্রেসে আমি মুসলিম স্বার্থ রক্ষার দাবি সবল ভাষায় করিয়াছি। কিন্তু সে কারণে দেশভাগ করার আমি প্রয়োজন বোধ করি নাই। বরঞ্চ আমি মনে করিয়াছি, দেশভাগে মুসলমানদের লাভের চেয়ে ক্ষতিই হইবে বেশি। পরে আমি যখন পাকিস্তানবাদী হইলাম, তখন এমন সর্বাত্মক পাকিস্তানি হইলাম যে মুসলিম লীগ নেতাদের চেয়েও গোড়া পাকিস্তানি হইলাম। কারণ আমার পাকিস্তানি চিন্তার মধ্যে কৃষক-প্রজা অর্থনৈতিক অধিকারের এবং মুসলমানদের কৃষ্টি সাহিত্যিক স্বকীয়তার প্রবল অনুভূতি ছিল। এই দুইটা দাবির মধ্যে প্রথমটা যেমন স্কুল ও দৃশ্যমান ছিল, দ্বিতীয়টা তত স্কুল ও দৃশ্যমান ছিল না। সে জন্য মুসলিম ইন্টেলিজেনশিয়া সাধারণত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র সম্বন্ধে যতটা সচেতন ছিলেন, কৃষ্টি-সাহিত্যের ব্যাপারে তত সচেতন ছিলেন না।

.

. পাকিস্তান সংগ্রামে মুসলিম সাহিত্যের দ্বিধাবিভক্তি

অধিকন্তু এটা স্মরণীয় যে বাংলার অধিকাংশ প্রতিভাধর মুসলিম সাহিত্যিকরাই পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। সেকালের সাহিত্যিকদের দৃষ্টি ছিল সাধারণত আসমানের দিকে মাটির দিকে নয়। পাকিস্তান দাবিকে তারা সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দাবি মনে করিতেন। সাহিত্যে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার স্থান নাই বলিয়া তারা বিশ্বাস করিতেন। এর দুইটা কারণ ছিল। প্রথমত, কৃষ্টি-সাহিত্যকে তাঁরা ক্লাসের (উচ্চবর্ণের) সম্পদ ভাবিতেন, মাসের’ (জনগণের) সম্পদ ভাবিতেন না। দ্বিতীয়ত, তাদের এই আত্মবিশ্বাস ছিল যে হিন্দু-মুসলিম মিশ্রিত জাতীয়তার ক্ষেত্রে তারা আপন আপন প্রতিভাবলেই নিজেদের স্থান করিয়া লইতে পারিবেন। একটি মাত্র দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। নজরুল ইসলাম তার মুসলিম-চৈতন্যে আকাশচুম্বী হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান দাবির তীব্র বিরোধিতা করিয়াছেন। সাহিত্য-ক্ষেত্রে হিন্দু প্রাধান্য তাঁর অসাধারণ যুগ-প্রবর্তক-প্রতিভাকে দাবাইয়া রাখিতে পারে নাই। এই অভিজ্ঞতার চূড়ায় বসিয়া তিনি বাঙ্গালী মুসলমানের প্রাণের প্রকাশ সোচ্চারে এবং সাফল্যজনকভাবেই করিয়াছেন। কিন্তু তাদের মুখের চিন্তা করা তখনও প্রয়োজন মনে করেন নাই। নিজের বিপুল আত্মবিশ্বাসের জোরে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের গোড়ার দিকে তার তীব্র বিরোধিতা করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু দেশভাগ হইয়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরেও তিনি সেই মতবাদে বিশ্বাসী থাকিতেন কি না, আজ তা বলা খুবই কঠিন। যতই কঠিন হোক, এটা অনুমান করা তত কঠিন নয় যে, তাঁর মুসলিম-চৈতন্যের তীব্রতা এবং মুসলিম ঐতিহ্যে আস্থার প্রাচুর্য তাঁকে শেষ পর্যন্ত ঢাকায় আনিত এবং এ দেশেরই কৃষ্টি-সাহিত্যের নবায়নের নেতৃত্ব গ্রহণে বাধ্য করিত। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে নাই। পাকিস্তান আন্দোলনের গোড়াতেই তিনি শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হন। আজ ত্রিশ বছর ধরিয়া তিনি সম্বিহারা হইয়াও বাঁচিয়া আছেন। দুই বছর আগে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ঢাকায় আনিয়া সুচিকিৎসার ব্যবস্থাদি করিয়াছেন।

পক্ষান্তরে অপর প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিক গোলাম মোস্তফা বাংলার মুসলমানদের মুসলিম সত্তায় তীব্রভাবে সচেতন ছিলেন বটে, কিন্তু তাদের বাঙ্গালী সত্তার দৈশিক জাতীয় ঐতিহ্য ও স্বকীয়তায় তেমন সচেতন ছিলেন না। এই জন্যই পরবর্তীকালে পাকিস্তান স্থাপনের পরে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে উর্দুর সমর্থন করিতে পারিয়াছিলেন। এই দুই প্রতিভাধরের দৃষ্টান্ত হইতে বুঝা গেল যে পাকিস্তান আন্দোলনের মুখে, পঞ্চম দশকের গোড়ার দিকে বাঙ্গালী মুসলিম লেখক-সাহিত্যিকরা মোটামুটি দুইটি দলে বিভক্ত ছিলেন। একদল ছিলেন পাকিস্তানের বিরোধী। তাঁরা বলিতেন, ধর্মের সাথে জাতীয়তা ও জাতীয় সাহিত্যের কোনও সংশ্রব নাই। শিল্প-সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতার কোনও স্থান নাই। অপর দলে ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক। তারা দৈশিক জাতীয়তা ও কৃষ্টি-সাহিত্যের স্বাতন্ত্রে বিশ্বাস করিতেন না। ধর্মকেই তারা মুসলমানদের রাজনীতি, কৃষ্টি ও সাহিত্যের একমাত্র নিয়ন্ত্রক মনে করিতেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরেও প্রথম দল বলিতে থাকিলেন, দেশভাগ হইলেও আমাদের কৃষ্টি-সাহিত্য ভাগ হয় নাই। কৃষ্টি সাহিত্য অবিভাজ্য। পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব বাংলা পৃথক-পৃথক ও স্বাধীন-স্বাধীন রাষ্ট্র হইলেও দুই বাংলার কৃষ্টি-সাহিত্য অবিভক্ত রহিয়া গিয়াছে। দ্বিতীয় দল বলিতে লাগিলেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দ্বারা এটাই প্রমাণিত ও স্বীকৃত হইল যে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের কৃষ্টি-সাহিত্য অভিন্ন।

আমি এই দুই দলের কোনটারই অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। পাকিস্তান সৃষ্টির আগেও ছিলাম না; পরেও নাই। এ সব কথাই আমি এই খণ্ডে বিস্তারিতভাবে বলিয়াছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *