১১. হক্কুল এবাদ

অধ্যায় এগার — হক্কুল এবাদ

. বুদ্ধির মুক্তির সামাজিক দিক

মানব-মনের আযাদি, বুদ্ধির মুক্তি, স্বাধীন চিন্তা ইত্যাদি আজিকার তরুণ মনের স্বাভাবিক ক্ষুধা এবং সজীব সক্রিয় মনের লক্ষণ। কিন্তু এ সবেরই একটা ব্যক্তিগত ও একটা সামাজিক দিক আছে। পুরাকালের মুনি-ঋষি ও সুফি-দরবেশের আধ্যাত্মিক সাধনার মতই মানবমনের আযাদির একটা নিজস্ব মূল্য আজও আছে। কিন্তু সে মূল্য নিতান্তই ব্যক্তিগত যদি তা মানবসেবায় না লাগে। ব্যক্তিগত সীমার মধ্যে আধ্যাত্মিক উচ্চতা, বুদ্ধির পার্থক্য ও সাধারণ ধন-দৌলতের দাম একই। সমাজের কোনও কাজে লাগে না। আপনি যত মুক্তবুদ্ধির লোকই হউন, আপনার বুদ্ধি যদি সমাজের কাজে না লাগে, তবে সমাজের দিক হইতে আপনার বুদ্ধির দাম কানাকড়িও না। স্বার্থপর ধনী যেমন করিয়া নিজের বিলাসিতায় গড়াগড়ি করে, আপনিও তেমনি মুক্তবুদ্ধির বিলাসিতায় গড়াগড়ি পাড়েন। দুইটা একই জিনিস।

এই জন্যই মুক্ত-বুদ্ধিমান ও স্বাধীন চিন্তকরা পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্গে চিন্তা করিবেন ঠিকই, কিন্তু কথা বলিবেন খুব সাবধানে। কথা ও কাজের দ্বারা সুধী সমাজ যদি সমাজের ‘গোলাকার ঘেঁদার জন্য চার কোনা পেরেক’ হইয়া যান, তবে সমাজের কোনও কাজে তারা লাগিবেন না। কাজেই তাদের মুক্তবুদ্ধিকে জনগণের বুদ্ধির মুক্তির কাজে প্রয়োগ করিবার জন্যই তাঁদেরে সমাজের দেহে ‘ফিট-ইন করিতে হইবে, খাপ খাওয়াইতে হইবে। এটা করিতে হইলে মুক্তবুদ্ধির লোককে দরদি হইতে হইবে। যতই পতিত, বুদ্ধিহীন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন হউক না কেন, জনগণকে ভালবাসিতে হইবে। নিজের মুক্তবুদ্ধির অহংকারে ফাটিয়া পড়িলে চলিবে না। আস্তে আস্তে জ্বলিয়াই বাতি আলো দিতে পারে। ফাৎ করিয়া জ্বলিয়া উঠিলে আলো দেয়ার পরিবর্তে ঘর পুড়িয়া ফেলিবে।

.

. মুক্তবুদ্ধি বনাম চিন্তার অস্থিরতা

আমার ধর্মজীবন সম্বন্ধে এতক্ষণ যেসব কথা ও কাজের উল্লেখ করা হইল, তাতে পাঠকরা নিশ্চয় বুঝিয়াছেন যে, বিপুল ওঠা-নামা, উত্থান-পতন ও ওলট-পালটের মধ্যে দিয়াই আমার চিন্তা-ধারা প্রবাহিত হইয়াছে। কোনও এক স্তরে বেশি দিন স্থির থাকে নাই। অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা এটাকে আমার মানসিক অস্থিরতা, মেন্টাল ইনস্ট্যাবিলিটি বলিয়াছেন। কেউ বলিয়াছেন, এটা চিন্তার গভীরতার ও মতের স্থৈর্যের অভাব। কেউ সোজাসুজি এটাকে মতহীনতাও বলিয়াছেন।

আমি কিন্তু তাতে বিচলিত হই নাই। কারণ আমি জানিতাম, আমার চিন্তার গভীরতা আছে বলিয়াই তলার সন্ধান পাইতেছি না। যাদের চিন্তা অগভীর ও ভাসা-ভাসা তারাই প্রচলিত সত্যকে সত্য মানিয়া বসিয়া থাকেন। মনের দিক হইতে তাঁরা হয় অলস, নয় ত ভীরু। অলস এই জন্য যে তাঁরা মন ও মগজ খাটানোর শ্রমটুকু করিতে চান না। আর ভীরু এই জন্য যে চিন্তার জঙ্গলে প্রবেশ করাকে তারা নিরাপদ মনে করেন না। সকলেই জানেন বিপদ-আপদের ভয়ে যারা জঙ্গলে ঢুকিতে বা সামনে আগ বাড়িতে ভয় পান, তাঁরা জ্ঞানের অনেক সম্পদ ও মণি-মুক্তা হইতেই বঞ্চিত থাকে।

মুনশী-মৌলবী-মুরুব্বিরার কাছে বিশেষত চাচাজী মুনশী ছমিরুদ্দিন সাহেবের কাছে দর্শন-বিজ্ঞানের কঠোর নিন্দা শুনিতাম। চাচাজী ওগুলিকে ‘ফালসাফা’ বলিতেন। ‘ফালসাফা’ (ফিলোসফি) শয়তানের এলেম, ও এলেমে ঈমান নষ্ট হয়, এসব কথা প্রায়ই তিনি বলিতেন। ফালসাফাঁকে তিনি নজুমির (জ্যোতিষীর) মতই কুফরি বুদ্ধি বলিতেন। কলেজে দর্শন পড়িয়া এবং বিজ্ঞানের ছাত্র সহপাঠীদের সাথে আলোচনা করিয়া চাচাজীর কথার সত্যতার প্রমাণ পাইয়াছিলাম। সত্যই দর্শন-বিজ্ঞান আমাদের ঈমান নষ্ট, অন্তত শিথিল করিয়াছে। তখন হিন্দু মুরুব্বিদের অনেকের কথাও মনে পড়িয়াছে। তাদের মুখে প্রায়ই শুনিতাম : ‘বিশ্বাসে লভয়ে হরি, তর্কে বহুদূর’। তর্কশাস্ত্রে সত্য-সত্যই তত দিনে আমাদেরে ‘হরি’ হইতে অনেক দূরে নিয়া আসিয়াছে।

কিন্তু সে দূরত্ব বেশি দিন থাকে নাই। আস্তে-আস্তে ঢুকিবার, পানিতে নামিবার, অথবা তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ নদী পার হইবার সুফল আস্তে-আস্তে পাইতে লাগিলাম। স্তরে-স্তরে সেসব পরিবর্তনের কথা আগেই বলিয়াছি। শেষ বয়সে, এই আত্মকথা লিখিবার সময়ে, সেসব মানসিক চাঞ্চল্য আর নাই। চরম সত্য বা শেষ জ্ঞান লাভ করিয়া ফেলিয়াছি, নিশ্চয়ই এ কথা বলিতেছি না। জ্ঞানের শেষ নাই। চরম সত্য লাভও সম্ভব নয় মানবজীবনটাই জ্ঞানসাধনার একটা প্রসেসমাত্র। এটা অবশ্যই দার্শনিক দৃষ্টিকোণের কথা।

.

. বিজ্ঞান ধর্মবিরোধী নয়

দর্শন, বিজ্ঞান ও রাজনীতি সবাই মিলিয়া ধর্মের বিরুদ্ধে লাগিয়াছে বলিয়া মনে হইবে। এই কারণে আধুনিককালে একদিকে যেমন দর্শন বিজ্ঞানের মাপকাঠি দিয়া ধর্মকে সংস্কার বা আধুনিকীকরণের চেষ্টা চলিতেছে। অপরদিকে ধর্মকে দিয়া দর্শন, বিজ্ঞান ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলিতেছে। এসব চেষ্টার ঐতিহাসিক কারণ আছে। ঐ কারণেই ন্যায়, নীতি, ইনসাফ সুবিচার, এথিকস, মরালিটি, জাসটিস ও ফেয়ারপ্লেকে একাৰ্থবোধক একাঙ্গিকরণ করা হইয়া গিয়াছে। সত্য কথা বলিও, মিথ্যা বলিও না, ‘পরের দ্রব্য হরণ করিও না’, ‘এতিমে হেফাযত কর’, ‘কারো উপর যুলুম করিও না,’ এসব সকল ধর্মেরই উপদেশ। এই কারণেই ঐ সব উপদেশকে আমরা ধর্মের শিক্ষা বলিয়া মনে করি। ব্যাপক অর্থে এ সবই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত। ব্যাপক অর্থে যেমন সব জ্ঞানই বিজ্ঞান। কিন্তু নির্দিষ্ট সীমিত অর্থে যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ইত্যাদির স্বতন্ত্র ও নির্ধারিত এলাকা রহিয়াছে, তেমনি ন্যায়-নীতি, আচার-নীতি, বিচার-নীতি, এথিকস, মরালিটি, ধর্ম ও রিলিজিয়নের স্বতন্ত্র এলাকা আছে। এটা বুঝিতে জাতি-মানুষের যেমন সময় লাগিয়াছে, ব্যক্তি-মানুষেরও তেমনি সময় লাগে। মানবজাতি অনেক বয়সে, বহু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়া এই জ্ঞান লাভ করিয়াছে। ব্যক্তি-মানুষেরও এ জ্ঞান লাভ হয় বেশি বয়সে। আমার নিজের জীবনের বিভিন্ন বয়সে, বিভিন্ন পরিবেশে, ধর্ম সম্বন্ধে এমনকি খোদ আল্লার অস্তিত্ব সম্বন্ধে, বিভিন্ন ও পরস্পর-বিরোধী চিন্তা-ধারার মধ্য দিয়া এই বৃদ্ধ বয়সে এই অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছি যে, সজীব ও সক্রিয় মনের এটাই স্বাভাবিক ধর্ম। অমন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের আঁকাবাকা সংকীর্ণ পথেই মানুষের। মন বিকশিত হয়। আমার মত নগণ্য ব্যক্তি ত বটেই, দুনিয়ার সব বড়-বড় চিন্তাবিদ, পণ্ডিতদের জীবনেও এমনটাই ঘটিয়াছে। এমন যে মুসলিম দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, হুজ্জতুল ইসলাম (আরগুমেন্ট-অব-ইসলাম) উপাধিতে ভূষিত ইমাম গাযযালীকেও এই আঁকাবাকা সংকীর্ণ অন্ধকার গলিপথেই অগ্রসর হইতে হইয়াছে। সুফি আলেম পিতার ঔরসে জন্মলাভ করিয়াও, ধর্মীয় পরিবেশে প্রতিপালিত হইয়াও, এবং শৈশব হইতে ধর্মশাস্ত্রে শিক্ষা লাভ করিয়াও যৌবনে তিনি নাস্তিক হইয়া গিয়াছিলেন। দীর্ঘদিনের সাধনা, চিন্তা, মেডিটেশন, অধ্যয়ন দ্বারাই তিনি এই নাস্তিক্যের কবল হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন। এটাই স্বাভাবিক। সজীব ও সক্রিয় মনের বিকাশের ধারাই এই। কৌতূহল হইতে জিজ্ঞাসা, জিজ্ঞাসা হইতে সন্দেহ, সন্দেহ হইতে অবিশ্বাস, অবিশ্বাস হইতে অনুসন্ধান এবং সর্বশেষ অনুসন্ধান হইতে সত্য লাভ। বিশেষ সাধনা করিলে এটা মধ্যবয়সেও ঘটিতে পারে বটে, কিন্তু সাধারণত এটা অধিক বয়সেই ঘটিয়া থাকে।

.

. অন্ধভক্তি নয়, অর্জিত উপলব্ধি

ধর্ম সম্বন্ধে সারা জীবন চিন্তা-ভাবনা করিয়া মুক্তবুদ্ধির জোরে এদিক-ওদিক, ডাইনে-বামে, উপরে-নিচে, দশ দিক ঘুরিয়া-ফিরিয়া, বলিতে গেলে একেবারে আকাশ-পাতাল বেড়াইয়া, বৃদ্ধ বয়সে একরূপ ক্লান্ত হইয়াই এই স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, ধর্মে বিশ্বাস না করিয়া উপায় নাই। ধর্ম, আত্মা ও সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের ধারণা তিনটি এতই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, যে একটিতে বিশ্বাস করিলে অপরটিতে বিশ্বাস না করিয়া উপায় নাই। আবার এই তিনটি বিশ্বাসই মানবতা-বিশ্বাস হইতেই উদ্ভূত। অথচ খোদা-ধর্ম ও আত্ম-অবিশ্বাসীরা দার্শনিক নাস্তিকই হউন, আর কমিউনিস্ট নাস্তিকই হউন, সবাই কিন্তু মানবতা-বিশ্বাসী। বস্তুত মানবতার খাতিরেই তারা বর্ণ, শ্ৰেণী ও শোষণহীন সমাজব্যবস্থা চান। আনুষ্ঠানিক ও সংঘবদ্ধ ধর্ম তাঁদের অভীষ্ট লাভের প্রতিবন্ধক, এই অজুহাতেই তারা ধর্ম, খোদা ও আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করিয়া থাকেন। কিন্তু মানবতা একটা বিমূর্ত ধারণামাত্র নয়। ব্যক্তি মর্যাদার উপরই প্রকৃত মানবতা প্রতিষ্ঠিত। আত্মার ধারণা ব্যক্তি-মর্যাদারই প্রসারিত রূপ। ধর্ম ও সৃষ্টিকর্তার অনিবার্যতাও এইখানেই। ধর্মের দাবির এটা রক বটম। একদম হাড়ডি বা স্কেলিটন বলা যাইতে পারে। রাষ্ট্র, সমাজ, আইন-কানুন, শিল্প-বাণিজ্য আর্ট-সাহিত্য ধর্মের সনাতন এলাকার অনেকখানি দখল করিয়াছে। অভিজ্ঞ আত্মবিশ্বাসী মুরুব্বির মতই ধর্ম সে বেদখল মানিয়াও লইয়াছে। এখন ধর্মের এই সংকীর্ণ এলাকা এমন এক জায়গায় আসিয়া ঠেকিয়াছে, যেখানে বিজ্ঞানকেও ধর্মের আধিপত্য ও একক এলাকা মানিয়া লইতে হইবেই। মৃত্যুতেই মানবজীবনের অবসান, এটা যারা বলেন বা বিশ্বাস করেন, তাঁরা মানবজাতিকে অন্য সব স্পেশিসের সমপর্যায়ে ফেলেন। তাঁরা সঙ্গে-সঙ্গে ‘পাশবতার কথা না বলিয়া শুধু মানবতার কথা বলিতে পারেন না।

.

. শ্রেষ্ঠ মাবুদ

মহান সৃষ্টিকর্তা, পরকাল, আত্ম ও ধর্ম-বিশ্বাসের সহিত মানবীয় মর্যাদা এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, একটা ছাড়া অন্যটার কল্পনা করা যায় না। অবশ্য সৃষ্টিকর্তার ব্যক্তিত্বের, পরকালের পদার্থকতার ও ধর্মের আনুষ্ঠানিকতার স্কুল ধারণার বাহিরে ও উর্ধ্বে ঐসব ধারণা থাকিতে হইবে। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির ফলে মানুষ যতই কুসংস্কারমুক্ত হইবে, ঐসব ধারণাও ততই পরিচ্ছন্ন হইবে। মুক্তবুদ্ধি হওয়া মানে, লজিকের বন্দী হওয়া নয়। লজিকের এলাকা ইন্দ্রিয়ে সীমাবদ্ধ। ইন্দ্রিয়ের বাইরে কিছু নাই যারা মনে করেন, মানুষ হায়ওয়ান ছাড়া আর কিছু নয় যারা বলেন, মৃত্যুতেই মানব-জীবনের অবসান যারা বিশ্বাস করেন, তাঁদের জন্য ধর্ম, খোদা ও পরকালের অস্তিত্ব সত্যই অবান্তর। ব্যক্তিগত ব্যতিক্রম বাদে মানুষ সাধারণভাবে পরাশ্রয়ী। প্রকৃতিগতই হউক, আর শৈশবের পরিবেশের ফলে হউক, মানুষ নিরাপদ আশ্রয় চায়। সে আশ্রয়কে আশ্রয়প্রার্থীর চেয়ে শক্তিশালী ক্ষমতাবান ও বুদ্ধিমান হইতে হয়। মানবসভ্যতার শৈশবে এই আশ্রয় ছিল পেটার ফ্যামিলিয়া, গোষ্ঠী-নেতা, রাজা-বাদশাহ। এখন তা রূপ নিয়াছে ডিক্টেটর বা ফাদার-ইমেজের গণতান্ত্রিক নেতার। ব্যক্তিপূজা বা পার্সনালিটি কাল্ট যাদের অভিমানে বাধে তারাই প্রবর্তন করিয়াছেন রাষ্ট্রপূজা। এক রূপে না এক রূপে পূজাই যখন করিতে হইবে, তখন শরীরী মাবুদের চেয়ে নিরঞ্জন মাবুদই কি মানুষের আত্মমর্যাদার দিক হইতে উন্নততর নয়?

.

. বিজ্ঞানী-শ্ৰেষ্ঠ আইনস্টাইন

কিন্তু অন্ধবিশ্বাস কখনই অর্জিত আস্থার স্থলবর্তী হইতে পারে না। আমাদের মুরুব্বিরা যে নাস্তিকের ভয়ে ‘ফালসাফা বা দর্শনশাস্ত্র পড়ার বিরোধী ছিলেন, আসলে সে ভীতি ছিল অমূলক। প্রকৃত জ্ঞানপিপাসুর কাছে দর্শন-বিজ্ঞান নাস্তিক্যের শিক্ষা-দাতা হইতে পারে না। তার প্রমাণ আধুনিক যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি বলিয়াছেন : ‘আবেগের সাথে যার পরিচয় নাই, যে বিস্ময় ও ভক্তির আবেশে স্তব্ধ হয় না, সে মৃত। তার চোখ অন্ধ। সচেতন জীবন নিজেকে কেমন করিয়া অনন্তের মধ্য দিয়া চিরস্থায়ী করিতেছে তা ধ্যান করিতে, দুনিয়া জাহানের দুর্বোধ্য-গঠন-কৌশল সম্বন্ধে ধারণা করিতে এবং প্রকৃতিতে অভিব্যক্ত বুদ্ধিমত্তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রাংশ বিনয়াবনত অবস্থায় অনুভব করিবার চেষ্টা করিতে পারাই আমার জন্য যথেষ্ট।

রহস্যময়ের সামনে, গায়েবি কুদরতের কাছে, এমন বিনয়-নম্র ভক্তির স্তব্ধতা ও তাকওয়ার আত্মসমর্পণই জ্ঞানের পরিপক্ক পূর্ণতা। প্রকৃত জ্ঞান কখনও অহংকারী হইতে পারে না। বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীর এই বিনতিনম্রতা, এই আজিযী-এনকেসারিই প্রকৃত বিজ্ঞানীর আত্মোপলব্ধির প্রমাণ। আইনস্টাইনের এই অমূল্য উক্তিটি যদিও ১৯৩০ সালের ঘটনা, আমি কিন্তু ওটা পড়িয়াছিলাম তার বিশ-পঁচিশ বছর পরে। প্রবাদের ‘অল্পবিদ্যা। ভয়ংকরীর সত্যতা উপলব্ধি করিতে শুরু করি আমি তার বহু আগেই। ছাত্রজীবনে দর্শনশাস্ত্রে যখন ডারউইনের উদ্বর্তনবাদ বা থিওরি-অব ইভলিউশন পড়িলাম, তখন কোরআন-বাইবেলের সৃষ্টি-তত্ত্বের উপর আস্থা হারাইলাম। আদম-হাওয়ার কিস্সাকে সত্যই মাইথলজির কাহিনী মনে করিলাম। ধর্মে ও সৃষ্টিকর্তার সন্দেহ অবিশ্বাসে পরিণত হইল। নাস্তিক্যের ভিত্তি মযবুত হইল।

.

. ধর্মবোধের ভিত পাকা

কিন্তু বয়স ও জ্ঞান বৃদ্ধি সাথে সাথেই বুঝিতে শুরু করিলাম, ধর্মীয় সৃষ্টি তত্ত্ব ও থিওরি-অব-ইভলিউশন-এর পরস্পর-বিরোধিতা অত দৃঢ় ভিত্তিক নয়। ক্রমশ এই উপলব্ধি ঘটিল যে ইভলিউশন’ ক্রিয়েশন নয়; উদ্বর্তন সৃষ্টি নয়; পরিবর্তন মাত্র। পদার্থজগতে যেমন আমরা দেখিতে পাই কোনও বিজ্ঞানই সৃষ্টি করে না, রূপান্তর ঘটায়মাত্র, আদমের বেলা ডারউইনিযমও ঠিক তাই করিয়াছে। পদার্থবিজ্ঞান বিজলি, অণু-পরমাণু ও বোমা সৃষ্টি করে না। রসায়নবিজ্ঞানও তেমনি পানি বা অষুধ সৃষ্টি করে না। বিদ্যমান। বস্তুসমূহের পরিবর্তন, বিয়োজন ও সংযোজন করিয়া তাদের রূপান্তর ঘটায়মাত্র। বিজ্ঞান যেমন প্রকৃতির রহস্যের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ মাত্র ব্যাখ্যা করিতে পারিয়াছে, উদ্বর্তনবাদও তেমনি আদম-সৃষ্টি-রহস্যের সামান্য অতি সামান্য অংশই বুঝাইতে সমর্থ হইয়াছে। উদ্বর্তনবাদ মানুষের জীবন, আত্মা, মন, হৃদয়, ঘৃণা-ভালবাসা, বুদ্ধি-চেতনা কোনোটারই সৃষ্টির ব্যাখ্যা আজও দিতে পারে নাই।

বিজ্ঞান সম্পর্কে এই বিজ্ঞানী মনোভাবই পরিণামে ধর্মকে তথাকথিত বিজ্ঞানের হামলা হইতে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে। দর্শন সম্বন্ধেও এই কথাই সত্য। সাধারণ দৃষ্টিতে বিজ্ঞান যে ধর্মবিরোধী, তার আসল রূপ এই যে, ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা ও সে সম্বন্ধে ধর্মানুসারীদের ধ্যান-ধারণাকেই বিজ্ঞান ভ্রান্ত, অসত্য ও মিথ্যা প্রমাণ করিয়াছে। আসলে কোনও অনুষ্ঠানই ধর্মের প্রাণ-বস্তু নয়। ও-সব সামাজিকতা। পুরা ঈমান, পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাসই ধর্ম, অন্ধ অনুষ্ঠান ধর্ম নয়। ধর্মের এই রূপকেই বলা হয় স্পিরিচুয়াল বা রুহানি দিক ও এথিক্যাল, আখলাকি বা চারিত্র্য-নীতিক দিন। ইসলাম ধর্মে এই দুই ভাগের একটিকে বলা হয় হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক এবং হক্কুল এবাদ’ বা মানুষের হক। প্রথমটা সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানুষের কর্তব্য, দ্বিতীয়টা মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য। আল্লার প্রতি কর্তব্য-বিচ্যুতির অপরাধে কারো বিচার করিবার অধিকার মানুষের নাই। সে বিচারের মালিক খোদ আল্লাহ। এই কথাটাই কোরআনে বলা হইয়াছে : ধর্মের ব্যাপারে কোনও যবরদস্তি নাই। ধর্ম এখানে হক্কুল্লাহ রুহানি বা স্পিরিচুয়াল ধর্ম। ধর্মের হক্কুল এবাদ অংশে ত্রুটি-বিচ্যুতির ব্যাপারের বিচার মানুষ করিতে পারে, করা তার কর্তব্যও। এটা তার সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব। এই হল এবাদই ধর্মের সামাজিক রূপ।

.

. ধর্মের রুহানিয়াত অব্যয়

দৈহিক শৈশবের নফলিয়াত দিয়া আমার ধর্ম-জীবনের কাহিনী শুরু করিয়াছিলাম। আত্মিক শৈশবের রুহানিয়াত দিয়া তা শেষ করিতেছি। যেখান হইতে শুরু সেখানেই শেষ ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। কুল্লু শাইয়েন ইয়ারজুউ ইলা আসলেহি। আলিমুল-গায়েবের কাছে মানুষ সারা জীবনই শিশু। তরুণ শিশু ও বৃদ্ধ শিশু, এই যা পার্থক্য। সারা জীবন জ্ঞান আহরণ করিয়া এই জ্ঞান লাভ করিলাম যে এক পরমাণু জ্ঞানও লাভ করিতে পারি নাই। আইনস্টাইনের সাথে এই কথা বলিতে পারাই জ্ঞানীর লক্ষণ। এই জ্ঞানটুকুও আমরা লাভ করি সারা জীবনে ক্রমবিকাশের মাধ্যমে। জ্ঞানের যৌবনে আমরা পাঁচ ইন্দ্রিয় ছাড়া আর কারো সাক্ষ্য মানি না। বার্ধক্যে পৌঁছিয়া ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সত্তা উপলব্ধি করি। জ্ঞানের যৌবনে যারা মোরাকেবা, মোশাহেদা, তাসাওওয়াফ ও যোগাসনকে কুসংস্কার বলেন, জ্ঞানের বার্ধক্যে তারাই ‘ট্রানসেনডেন্টাল মেডিটেশন’ ও ‘এক্সটা-সেনসরি পারসেপশন’-কে বিজ্ঞান আখ্যা দেয়। ধ্যান ও নেসবতে বায়নান্নাসকে তারাই হিপনোটিযম ও অটোসাজেশন’ নামে বৈজ্ঞানিক সত্য এবং হাইপারটেনশনের ঔষধ রূপে গ্রহণ করেন। এ সবই তিন মাথাওয়ালা জ্ঞান-বৃদ্ধের সামনে জ্ঞান-যুবকের দাম্ভিক শক্তিমত্তার নতি স্বীকার। জ্ঞান জ্ঞানের সম্মান করিবেই।

বিজ্ঞানের বিস্ময়কর চরম উৎকর্ষে মানুষ আজ মহাশূন্যে অগণিত গ্রহ হইতে গ্রহান্তরে উড়িয়া বেড়াইতেছে মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর জীবের সন্ধানে। এ উদ্যম সফল হইলে এই ক্ষুদ্রতম গ্রহের মানুষ আর আশরাফুল মখলুকাত থাকিবে না। ফলে সব ধর্মের বুনিয়াদ ধসিয়া পড়িবে। ধর্মবিরোধীরা সে আশায় খুশি হইতেছেন। কিন্তু জীব পাইলেই ত হইবে না রুহও পাইতে হইবে। যদি তা না পাওয়া যায়, তবে কী হইবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *