০৮. গোঁড়ামির প্রতিক্রিয়া

অধ্যায় আট – গোঁড়ামির প্রতিক্রিয়া

১. উদারতার ক্রমপ্রসার

আগের অধ্যায়ের শেষ দিকে যেসব ঘটনার কথা বলা হইয়াছে, সেগুলি ছাত্রজীবনের পরে কর্মজীবনের কথা। এখন ছাত্রজীবনেই আবার ফিরিয়া যাই। মজিদ সারের সংশ্রব আমার গোঁড়ামির বরফে উদারতার উত্তাপ লাগাইয়া দিল। আমার গোঁড়ামি প্রথমে আস্তে আস্তে ও পরে দ্রুত গলিতে লাগিল। অবশেষে গোঁড়ামির জায়গা উদারতা দখল করিল।

উদারতার বুক প্রশস্ত ও বাহু লম্বা। সে বুকে একজনকে নিতে পারিলে আরেকজনকেও নিতে হয়। সে বাহু একজনকে জড়াইয়া সন্তুষ্ট থাকে না। দশজনকে ধরিতে চায়। মজিদ সারের উদারতার ছোঁয়াচে আমার মন যখন আমার এতদিনের দুশমন হানাফীকে ভালবাসিতে পারিল, তখন উদারতা ও ভালবাসার পরিধি আর একটু বাড়িয়া অন্যান্য ধর্ম-সম্প্রদায়কেও ভালবাসিতে পারিবেন না কেন?

আমার মনও তা পারিল। প্রথমে ব্রাহ্ম, তারপর খৃষ্টান ও তারও পরে হিন্দুকে সে উদারতার পরিধির মধ্যে জায়গা দিল। উক্ত ক্রমে পরিধি বাড়িল কেন, সে কথাই এখন বলিতেছি। ব্রাহ্মরা এক খোদা মানে, লোকমুখে এই কথা শুনিয়া ব্রাহ্মদের সভায় বক্তৃতা শুনিতে যাইতে লাগিলাম। ময়মনসিংহ স্টেশন রোডে গাঙ্গিনার পাড়ে এখন ব্রাহ্মমন্দির নামে যে দালানটি আছে এবং যাতে বর্তমানে ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুল চলিতেছে, এটি তখনও ছিল এবং সত্যই ব্রাহ্মমন্দির ছিল। সেখানে প্রতি সপ্তাহেই সভা হইত। বিশেষ করিয়া মহোৎসবের সময় কলিকাতা হইতে বড় বড় নামকরা বক্তা আসিতেন। এঁদের বক্তৃতা কখনও আমি বাদ দিতাম না। এঁদের মধ্যে সঞ্জীবনী সম্পাদক শ্রীযুক্ত কৃষ্ণকুমার মিত্র ও প্রবাসী সম্পাদক শ্রীযুক্ত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কথা আমার মনে আছে। কৃষ্ণকুমার বাবুর বক্তৃতা আমার খুব পছন্দ হইয়াছিল। বোধ হয় এই সময়েই কৃষ্ণকুমার বাবুর মোহাম্মদ চরিত পড়িয়াছিলাম।

.

. ডা. বিপিন বিহারী সেন

ডা. বিপিন বিহারী সেন ও শ্রীযুক্ত মনোরঞ্জন ব্যানার্জী তখন ব্রাহ্ম সমাজের দুই প্রধান ছিলেন। ক্লাস সেভেনে পড়িবার সময় যখন সেহড়া কাঁঠাল লজে’ থাকিতাম তখন এই দুই ভদ্রলোকের সাথে প্রায়ই দেখা হইত। তাঁদের বাড়ির সামনে দিয়াই আমাদের স্কুলে যাতায়াতের পথ ছিল। ডা. বিপিন সেন বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। মনোরঞ্জন বাবু সিটি স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার ছিলেন। ডাক্তার বাবুর বাগানওয়ালা বিরাট বাড়ি ছিল। সেই বাগানে ডা. সেন ও মিসেস সেনকে প্রায়ই দেখিতাম। রাস্তার পাশের ডুয়ার্ক ওয়ালের উপর দিয়া তাঁদেরে দেখা যাইত। বাগানে দাঁড়াইয়া ডাক্তার বাবু স্কুলে-গমনরত আমাদের কুশল-মঙ্গল জিজ্ঞাসা করিতেন। তাঁর মুখ সব সময় হাসি-হাসি থাকিত। কাজেই রোজ দেখা হইলেই আদাব দিতাম। তিনি ত আদাব লইতেনই। মিসেস সেনও আমাদের আদাব লইতেন। প্রথম প্রথম অবশ্য আমি ডাক্তার বাবুকে উদ্দেশ্যে করিয়াই আদাব দিতাম। বেগানা আওরতকে আদাব দেওয়া বা তার দিকে চোখ তুলিয়া চাওয়া আমাদের কল্পনার বাহিরে ছিল। বিশেষত ঐ সময়ে মিসেস সেন ছাড়া আর কোনও মেয়েলোককে বাহিরে দেখি নাই। কাজেই মিসেস সেনের দিকে চোখ তুলিয়া চাইতে শরম লাগিত। কিন্তু ডাক্তার সেনকে আদাব দেওয়ার সময় তিনিও যেভাবে আমাদের আদাব নিতেন, তাতে আস্তে আস্তে আমার লজ্জা কাটিয়া গেল। তখন মিসেস সেনকে একা দেখিলেও আদাব দিতাম। তিনি হাসি মুখে হাত তুলিয়া আদাব নিতেন। কিন্তু কথা বলিতেন না। সে সময় ব্রাহ্ম মেয়েরাও ব্রাহ্মমন্দিরের সভায় যাইতেন। মিসেস সেনও যাইতেন। মেয়েদের বসিবার জন্য পৃথক ব্যবস্থা ছিল। মিসেস সেনও সেখানে বসিতেন। তবু গেটে বা রাস্তায় মিসেস সেনের সঙ্গে দেখা হইয়া গেলে, সেখানেও তাঁকে আদাব দিতাম। এইটুকু পরিচয়েই মহিলাকে আমার এত ভাল লাগিয়া ছিল যে, এর পর মাত্র কয়েক মাস পরে যখন মিসেস সেনের মৃত্যুসংবাদ পাইলাম, তখন নিজের অজ্ঞাতে আমার চোখে পানি আসিয়া পড়িয়াছিল। ডা. ও মিসেস সেনের প্রতি শ্রদ্ধাহেতুই হউক, আর কৃষ্ণবাবুর বক্তৃতা শুনিয়াই হউক, অথবা কৃষ্ণবাবুর মোহাম্মদ চরিত পড়িয়াই হউক, আমি ব্রাহ্মদের প্রতি বেশ আকৃষ্ট হইয়া পড়িলাম। এই সময় গিরিশ সেনের বঙ্গানুবাদ কোরআন ও অপসমালা পড়িয়া সে আকর্ষণ আরো বাড়িল। হোস্টেলেও স্কুলে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে তর্ক করিতে গিয়া আমি ব্রাহ্মগণকে মুসলমান বলিয়া দাবি করিতাম। নিজের মতে নিঃসন্দেহ হইবার জন্য চাচাজীকে জিজ্ঞাসা করিলাম। চাচাজী হানাফীদের প্রতি নিষ্ঠুর হইলেও অমুসলমানদের প্রতি খুবই উদার ছিলেন। আমার প্রশ্নের জবাবে তিনি বলিলেন : শুধু ব্রাহ্ম বৈলা নয়, যেকোনো লোক আল্লার ওয়াহাদানিয়াত (একত্ব) স্বীকার করে, সেই মুসলমান। চাচাজীর মত পাইয়া আমি এ বিষয়ে আরো শক্তিশালী হইলাম।

.

. খৃষ্টান

হযরত ঈসা পয়গাম্বরের উম্মত বলিয়া এই সময় খৃষ্টানদের সম্বন্ধে আমার কৌতূহল বাড়ে। ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের গেটের পাশে এখনও যে ‘গসপেল হল’ আছে সেখানে প্রতি রবিবার প্রার্থনা ও বক্তৃতা হইত। প্রতি সন্ধ্যায় হলের সামনে টুলের উপর দাঁড়াইয়া মিশনারীরা বক্তৃতা করিতেন। রোজ এঁদের বক্তৃতা শুনিবার জন্য আসিতাম কিন্তু এঁদের বক্তৃতা ভাল লাগিত না বলিয়া বেশিক্ষণ থাকিতাম না। কিন্তু যেদিন ইংরাজ পাদরি বক্তৃতা করিতেন, সেদিন বেশ অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিতাম। বক্তৃতা ভাল লাগিত বলিয়া নয়। ইংরাজ সাহেব বাংলায় বক্তৃতা করিতেছেন, তাই শুনিবার জন্য। ওদের মুখে বাংলা কথা আমার বড় ভাল লাগিত।

কিন্তু একবার এক খৃষ্টান পাদরির বক্তৃতা সত্যই ভাল লাগিয়াছিল। ইনি ছিলেন রেভারেন্ড ফাদার এ ডি খা। ইনার বক্তৃতার ব্যবস্থা হইয়াছিল টাউন হলে। এই উপলক্ষে টাউন হল বিশেষভাবে সাজান হইয়াছিল। জিলা ম্যাজিস্ট্রেট, জিলা জজ ও পুলিশ সাহেব প্রভৃতি সমস্ত ইংরাজ কর্মচারী এই সভায় যোগ দিয়াছিলেন। তা ছাড়া শহরের সমস্ত গণ্যমান্য লোকও উপস্থিত ছিলেন। রেভারেন্ড ফাদার এ ডি খা টাঙ্গাইল মহকুমার এক মুসলমান ভদ্র পরিবারের লোক। তাঁর নাম আলাউদ্দিন খাঁ। তিনি ছেলেবেলায় খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন এবং স্বীয় প্রতিভা বলে খৃষ্টান ধর্মযাজক সমাজে এত উন্নতি করেন। গসপেল হল হইতে বিজ্ঞাপন আকারে আগেই এ সব খবর প্রচার করা হইয়াছিল বলিয়া আমি প্রবল আগ্রহে এই সভায় যোগদান করি। হলে তিল ধারণের স্থান ছিল না। ছাত্রদের দাঁড়াইয়া বক্তৃতা শুনিতে হইল। আমিও দাঁড়াইয়াই শুনিলাম। তিনি অবশ্য বেশিক্ষণ বক্তৃতা করিলেন ইংরাজিতে। ইংরাজি বক্তৃতা আমি তেমন ভাল বুঝিলাম না। কিন্তু বাংলায় তিনি যতটুকু বলিলেন, তা আমার খুব ভাল লাগিল। তিনি অন্যান্য মিশনারীর মত অন্যান্য ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু না বলিয়াই শুধু খৃষ্টান ধর্মের গুণাবলি বয়ান করিলেন।

এই সব নাম করা লোকের বক্তৃতা শুনিয়া শুনিয়া আমার ক্রমেই মনে হইতে লাগিল সব ধর্মের মধ্যেই অল্প-বিস্তর সত্য ও সৌন্দর্য রহিয়াছে। এই ধারণা পল্লবিত হইয়া শেষ পর্যন্ত আমার মধ্যে পরস্পর-বিরোধী মত দেখা দিল। সব ধর্মের সত্য আছে, সব ধর্মই মানুষের কল্যাণ চায়। তবু কেন এক ধর্ম আরেক ধর্মের নিন্দা করে? তবু কেন এক ধর্ম আরেক ধর্মকে মিথ্যা বলে? ধর্মে ধর্মে কেন এই বিরোধ? মানুষের কল্যাণ করার মত পবিত্র কাজ করিতে গিয়াও এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেন? এটা ত নিতান্ত ব্যবসাদারের মত কাজ।

.

. নামাজ-রোযার শিথিলতা

যখন আমার মনে ধর্ম সম্পর্কে এই আলোড়ন চলিল, তখন নামাজ-বন্দেগিতে আমার আর উৎসাহ থাকিল না। আস্তে আস্তে নামাজ-রোযা ছাড়িয়া দিলাম। টুপি ফেলিয়া দিলাম। যাত্রা-থিয়েটার দেখিতে লাগিলাম। গান-বাজনা শুনিতে থাকিলাম। এই পরিবর্তন আমার মধ্যে এত তাড়াতাড়ি হইয়া গেল যে, আমার সহপাঠী ও বন্ধু-বান্ধবরা অবাক হইয়া গেল। কিন্তু বাড়িতে মুরুব্বিরা। আমার এই পরিবর্তন টের পাইলেন না। দাদাজী তখন এন্তেকাল করিয়াছেন। সুতরাং তাঁর ভয় নাই। বাপজীও দাদাজীর মতই উদার, তাঁকেও ভয় নাই। শুধু চাচাজীকেই সবচেয়ে ভয় পাইতাম। কিন্তু ভয়ে নয়, মুরুব্বিদের প্রতি বিশেষত বাপ-মার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধায় আমি বাড়িতে আমার মুসল্লী মুত্তাকিগিরি পুরামাত্রায় বজায় রাখিলাম। বাপজী-মার, বিশেষ করিয়া মার মনে কষ্ট দেওয়া আমার কল্পনারও বাহিরে ছিল। আমি এটা কিছুতেই বরদাশত করিতে পারিতাম না। তারা মনে কষ্ট পাইবেন, শুধু এ ভয়েই আমি বাড়িতে এসব করিতাম। শহরে যে আমি নামাজ-রোযা করিতাম না, এ খবর যাতে বাপজী ও মার কানে না যায়, সেদিকে সতর্ক থাকিতাম। গ্রীষ্ম ও পূজার লম্বা ছুটিতে সহপাঠী ও অন্যান্য বন্ধুদের বাড়িতে দল বাঁধিয়া বেড়ান তৎকালে ছাত্রদের মধ্যে রেওয়াজ ছিল। এই উপলক্ষে আমাদের বাড়িতে যেসব ছাত্র বন্ধু বেড়াইতে আসিত তাদেরে আগে হইতে আমি সাবধান করিয়া দিতাম।

এইভাবে কিছুকাল চলিবার পর আমি যখন আইএ পড়িবার জন্য ঢাকায়। আসিলাম, তখন আমি পুরামাত্রায় বে-নামাজি হইয়া গিয়াছি। আইএ পড়াকালে আমি যখন হাকিম আরশাদ সাহেবের বাড়িতে যায়গীর থাকিতাম, তখন রাতে শুইতাম চুড়িহাট্টা মসজিদে। মসজিদের একটি কামরায় আমার বিছানাপত্র ও বাক্স-আদি থাকিত। বই-পুস্তক যদিও থাকিত হাকিম সাহেবের বাড়িতে, কিন্তু কার্যত আমি মসজিদেরই একজন বাসিন্দা। তবু আমি এক ফযর ছাড়া অন্য ওয়াকতের নামাজ পড়িতাম না। ফযরটা না পড়িয়া উপায় ছিল না।

জগন্নাথ কলেজের দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন বাবু উমেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। তিনি আইএতে আমাদের লজিক পড়াইতেন। তাঁর বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ জিলার নেত্রকোনা মহকুমায়। এই খাতিরে আমি তার কাছে ভিড়িয়া পড়িলাম। তাঁর ক্লাসে ভাল করিলাম। তিনি সাহিত্যিক ছিলেন। তাঁর লেখা দার্শনিক প্রবন্ধটি মাসিক কাগজে ছাপা হইতে আগেই দেখিয়াছি। আমার কয়েকটা লেখা ইতিপূর্বেই মাসিক কাগজে বাহির হইয়াছে। আমি কলেজে শুধু ‘আহমদ’ বলিয়া উমেশ বাবু অবশ্য সে খবর রাখিতেন না। আমি নিজেই একদিন তাঁকে জানাইয়াছিলাম। এই সব কারণে উমেশ বাবু আমাকে একটু বিশেষ খাতির করিতেন। আমি লজিকের পাঠ্যবই ডিঙ্গাইয়া দর্শনের বই পড়িতে শুরু করি। জন স্টুয়ার্ট মিল, রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী, হীরেন দত্ত, ব্ৰজেন শীল, এ্যানি বেসান্ত প্রভৃতি দার্শনিক লেখকের লেখা এই সময় আমি খুব পড়িতাম এবং মাঝে মাঝে উমেশবাবুর কাছে বুঝিতে যাইতাম। এইভাবে উমেশ বাবু আমার মধ্যে স্বাধীন চিন্তার উন্মেষ করেন এবং আমার মনকে সংস্কারমুক্ত করিয়া তুলেন।

.

. কবর-পূজা

‘নামাজ পড় আর না পড়, পীর মানিতেই হইবে’ এই ধরনের মতবাদ তখন হানাফী সম্প্রদায়ের এক অংশে খুবই চালু ছিল। আমরা মোহাম্মদীরা এমনিতেই পীর মানি না, তার উপর আমি সম্প্রতি ধর্মের সত্যতায়ই সন্দিহান হইয়া পড়িয়াছি। কাজেই এই সময়কার আমার মতবাদ হানাফী জনসাধারণের, এমনকি শিক্ষিত সম্প্রদায়েরও সহ্য করিবার কথা নয়। আমার এই মতবাদ কাজেই একবার আমাকে বিপদে ফেলিয়াছিল। আমি হাকিম আরশাদ সাহেবের বাড়িতে যায়গীর থাকাকালে আলিমুদ্দীন সাহেব নামক জনৈক শিক্ষকের নেতৃত্বে একবার নৌকাভ্রমণে যাই। ছাত্র-বন্ধুদের মধ্যে মি. রেজাই করিম তার এক ভাই আবদুল করিম, মি. ইউসুফ সালাহউদ্দিন তার ভাই সালেহউদ্দিন প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নৌকাভ্রমণ উপলক্ষে নদীর ধারে অবস্থিত মিরপুরে পীরের দরগা যিয়ারত করা হয়। আমি যিয়ারত করি। যিয়ারত শেষ করিয়া নৌকায় ফিরিয়া বন্ধুরা পীর সাহেবের কাছে কে কী মুকসেদ চাহিয়াছেন, তার খবর-পুরসি শুরু করেন। সকলেই যার-তার মুকসেদের কথা বলেন। কিন্তু আমি কিছু বলি না। কাজেই আমাকে সবাই ধরেন, আমি কি চাহিয়াছি বলিতে হইবে। সকলের পীড়াপীড়িতে আমি বলিলাম : ‘পীর সাহেবের গোনা-খাতা মাফ করবার লাগি আল্লাহর দরগায় মুনাজাত করছি। আমার এই কথা শুনিয়া সকলে ত আমাকে মারে আর কি? পীর সাহেবের শানে এত বড় কথা! তাঁর গোনা-খাতা? সকলেই ভদ্র বংশের ভদ্রলোকের ছেলেপিলে। কাজেই সত্য-সত্যই আমাকে মারপিট করিলেন না। কিন্তু ঐ বেতমি কথা প্রত্যাহার করিবার জন্য জিদ করিলেন। আমি প্রত্যাহার করিলাম না। বরঞ্চ নিজের উক্তির সমর্থনে বলিলাম : এই যে আপনারা আল্লার কাছে মকসুদ চাইয়া পীর সাহেবের নিকট চাইলেন, এই যে পীর সাহেবের মাজারে মাথা কুটিয়া দৈনিক হাজার লোক শেরক করিতেছে, এই যে পীর সাহেবের কবর যিয়ারতের ওসিলায় হররোজ আল্লার হুকুমের বরখেলাফ করিতেছে, তাতে লোকেরার ত গোনাহ হইতেছেই, পীর সাহেবেরও হইতেছে। যার কবরে এমন শেরেকি হয়, আল্লার দরগায়ে তিনিও নিশ্চয়ই গোনাগার। তাই আমি পীর সাহেবের মাগফেরাত চাহিয়া মোনাজাত করিয়াছি।

আমার জবাবে বন্ধুরা স্তম্ভিত হইলেন। মেহেরবানি করিয়া তাঁরা আমাকে নৌকা হইতে ফেলিয়া দিলেন না। কালবিলম্ব না করিয়া নৌকা ফিরাইতে মাল্লাকে আদেশ দিলেন। আমার সাহচর্যে তারা যেন আর এক মুহূর্ত থাকিতে রাজি ছিলেন না। বাকি পথ তারা আমার সাথে কোনও কথা বলিলেন না। হাকিম সাহেবের কাছে আমার এই ধর্মবিরোধী বতমিজির খবর পৌঁছিল। আমার যায়গীর উঠাইয়া দিবার চাপ তার উপর পড়িল।

কিন্তু হাকিম সাহেব জানিতেন আমরা মোহাম্মদী। তিনি বহুদিন আগে হইতেই আমাদের গ্রামে যাতায়াত করিতেন। আমাদের গ্রামের অনেকেরই তিনি চিকিৎসা করিয়াছেন। গ্রামের বিভিন্ন মাতব্বরের বাড়িতে তিনি। একনাগাড়ে সপ্তাহের বেশি সময় থাকিয়াছেন। কাজেই তার কাছে এটা জানাই ছিল যে আমি ও আমার আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশী সকলেই গোড়া মোহাম্মদী এবং আমরা পীর-পূজা, গোর-পূজার ভয়ানক বিরোধী। কাজেই হাকিম সাহেব ঐ চাপে টলিলেন না। তিনি শুধু গোপনে আমাকে উপদেশ দিলেন একটু সাবধানে কথাবার্তা বলিতে।

.

. পীর-পূজা

একশ্রেণীর মুসলমানের পীরভক্তি এই সময় এমন চরম সীমায় উঠিয়া ছিল যে, উহা স্পষ্টতই ইসলামের মৌলিক শিক্ষার বিরোধী। এই শ্রেণীর মুসলমানের কথাবার্তায়, কাজে-কর্মে আল্লার পানা না চাহিয়া পীর সাহেবদের পানা চাহিতেন। যেমন তারা ‘ইনশাহ আল্লাহ এই কাজ করিব’, ‘খোদার ফযলে ভালই আছি’, ‘আল্লার মর্জিতে এটা হইয়াছে, ইত্যাদি না বলিয়া হুযুর পাকের ইচ্ছা হইলে এ কাজ করিব’, ‘হুযুর কেবলার মেহেরবানিতে ভালই আছি’, ‘খাজাবাবার দোওয়াতে এটা হইয়াছে’ ইত্যাদি বলিতেন। মোট কথা, এঁরা যার-তার পীর সাহেবদেরে দিয়া আল্লার জায়গা দখল করাইয়াছিলেন। এই পীর-পূজার চরম দৃষ্টান্ত দেখিয়াছিলাম, এস এম হোস্টেলে থাকিবার সময়। আমার পাশের রুমেই চাঁদপুরের একজন ছাত্র থাকিতেন। আইএ সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। বয়স আঠার-উনিশ। চেহারা-ছবিতে এবং চাল-চলনে ভদ্র পরিবারের ছেলে। রোজ সকালে তার খোশ-ইলহানের কোরআন তেলাওয়াত শুনিয়া আমাদের ঘুম ভাঙ্গিত। কোনও কারণেই তার এই কোরআন তেলাওয়াত কামাই হইত না। অথচ এই ভদ্রলোক নামাজ পড়িতেন না। নামাজ আমিও পড়িতাম না। আলসামি করিয়া পড়িতাম না, তা নয়। নামাজ পড়ার আমি বিরোধীই ছিলাম। ছাত্র-বন্ধুদের মধ্যে নামাজের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করিতাম। সে জন্য কলেজের আরবির প্রফেসার এবং হোস্টেল সুপার অধ্যাপক এ এম আসাদ সাহেবের কাছে কয়েকবার ধমক খাইয়াছি। কিন্তু নামাজবিরোধী প্রচার বন্ধ করি নাই। কাজেই কথিত ভদ্রলোকের নামাজ না পড়ায় আমার খুশি হইবার কথা। কিন্তু খুশি হওয়ার বদলে আমি দুঃখিত হইলাম। যিনি কোরআন তেলাওয়াত করিবেন, তিনি নামাজ পড়িবেন না কেন? রোজ নিয়মিতভাবে কোরআন তেলাওয়াত করার মত দৃঢ় ধর্ম-বিশ্বাস যার, আলসামি করিয়া তিনি নামাজ তরক করিবেন, এটা আমার বরদাশত হইল না। আলসামিকে আমি দুচক্ষে দেখিতে পারিতাম না।

কাজেই আমি তাঁকে তাঁর এই আলস্যের কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম। এবং তাঁর জবাবের অপেক্ষা না করিয়া আলসামির নৈতিক ও দৈহিক কুফল বর্ণনা করিয়া বক্তৃতা শুরু করিয়া দিলাম। বক্তা, সাহিত্যিক উপরের ক্লাসের ছাত্র বলিয়া ভদ্রলোক আমাকে সম্মান করিতেন। কাজেই আমার কথায় তিনি চোখে-মুখে বাধা দিলেন না। আমি আমার কথার মাঝে একটু দম নিতেই তিনি বলিলেন : কিন্তু আমি ত আলসামি কইরা নামাজ তরক করি না। নামাজ আমার লাগি ফরযই হৈছে না।

আমার কানকে আমি বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। এই আঠার-উনিশ বছরের যুবকের জন্য নামাজ ফরয হয় নাই? আমি কি ভুল শুনিলাম? সন্দেহ নিরসনের জন্য আবার বলিলাম : কী কইলেন?’ যুবক তার কথার পুনরাবৃত্তি করিলেন। আমি বলিলাম, সাত বছর বয়স হোতেই যে নামাজ ফরয হয়।

যুবক কিছুমাত্র অপ্রস্তুত না হইয়া বলিলেন : জি হাঁ সে কথা ঠিক। কিন্তু আমার নামাজ যে আল্লার দরগায় কবুল হৈব না।

আমি আরো বিস্মিত হইয়া বলিলাম : কেন? আপনার অপরাধ?

যুবক বিনা-সংকোচে বলিলেন : আমি যে আজও পীরের মুরিদ হৈতে পারি নাই।

আমি স্তম্ভিত হইলাম। মুরিদ না হইতে পারার কারণ সম্বন্ধেও যুবক আরো কিছু বলিয়াছিলেন। কিন্তু সে সব কথা আমার কানে ঢুকিল না। আমি নিজের কাজে চলিয়া গেলাম। অনেক দিন আমার মন হইতে এই চিন্তা দূর হইল না। হায়, পুতুল-ভাঙ্গা ইসলামের এই দুর্দশা মুসলমানেরই হাতে?

.

. ধর্ম-মত বনাম চরিত্র

কিছুদিন আগে হইতেই আল-ইসলাম নামক বাংলা মাসিক ও ইসলামিক রিভিউ ও রিভিউ-অব-রিলিজিয়ন নামক ইংরাজি মাসিক কাগজ নিয়মিত পড়িতে শুরু করিয়াছি। এই সব কাগজে বড় বড় পণ্ডিত ও আলেম লেখকের লেখার মধ্যে একটি কথা আমার খুব পছন্দ হইয়াছিল। সেটা এই যে সব ইসলাম ধর্মের অনুসারীরাই ইসলামের আসল শিক্ষা হইতে দূরে সরিয়া পড়িয়াছে। মুসলমানদের কাজকর্ম, চাল-চলন, স্বভাব-চরিত্র যে আমাদের ভাল লাগে না, তার জন্য ইসলাম দায়ী নয়, দায়ী আমাদের ভুল ব্যাখ্যা।

কিন্তু বেশিদিন এই কৈফিয়তে সন্তুষ্ট থাকিতে পারিলাম না। প্রথমত সব ধর্মের পক্ষ হইতেই এ ধরনের কথা বলা হইতেছে। দ্বিতীয়ত ভয়ানক ধার্মিক, ভয়ানক শরিয়তের পা-বন্ধ, সাংঘাতিক নামাজি লোককেও আদর্শ চরিত্রবান, সত্যবাদী ও পরোপকারী হইতে দেখি না কেন? তৃতীয়ত হিন্দু, ব্রাহ্ম ও খৃষ্টানদের মধ্যে এমন আদর্শ চরিত্রবান সত্যবাদী ও স্বার্থত্যাগী লোক দেখিয়াই শুধু মুসলমান নন বলিয়াই তারা বেহেশতের বদলে দোযখে যাইবেন, এই কথাটা কিছুতেই আমার মন মানিত না। ময়মনসিংহের ডা. বিপিন সেনের মত ত্যাগী ও পরোপকারী ব্রাহ্ম, আমার অধ্যাপক উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের মত হিন্দু ও আমার অধ্যাপক মি. ল্যাংলির মত খৃষ্টান দোযখে যাইবেন। আর আমার চিনা-জানা দু-একজন মওলানা-মৌলবী সাহেবের মত মিথ্যাবাদী, মামলাবাজ ও নাবালক ভাতিজাদের সম্পত্তি অপহারক মুসলমান বেহেশতে যাইবে, এটা আমার বিবেকে বাধিত। চতুর্থত, সব ধর্মই যার-তার মতে মানুষের কল্যাণের জন্য একযোগে চেষ্টা না করিয়া যার-তার শ্রেষ্ঠত্ব, যাহির করিবার জন্য এত চেষ্টা-তদবির, এত প্রচার-প্রচারণা, এত অর্থ ব্যয় করিতেছে কেন? ইসলামিক রিভিউ ও আল-ইসলাম-এর পাশে পাশে এই সময় আমি খৃষ্টান মিশনারীদের প্রকাশিত এপিফেনি নামক কাগজ পড়িতাম এবং সদরঘাটে অবস্থিত ব্যাপটিস্ট মিশন হলে বক্তৃতা শুনিতে ও বই সংগ্রহ করিতে যাইতাম। সময়ের মধ্যেই ম্যাট্রিক পাশ করিবার সময় একবার ও আইএ পাশ করিবার সময় আরেকবার চামড়ার বাধানো সুন্দর কাগজে ছাপা দুইখানা বাইবেল এই মিশন হইতে উপহার পাইয়াছিলাম। এই প্রচারণার সমস্ত ব্যাপারটাই আমার কাছে ব্যবসাদারি বলিয়া মনে হইল। এই সময় হাকিমী চিকিৎসা ভাল কি কবিরাজী চিকিৎসা ভাল, এই বিষয়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ও হ্যান্ডবিলে খুব বাদ-বিতণ্ডা চলিতেছিল। ‘জিস্তান’, ‘সুশীল মালতী’ প্রভৃতি সুগন্ধি পানের মসল্লা চা’র ছোট ছোট প্যাকেটও এই সময় বিনা মূল্যে বিতরণ করা হইত। ধর্মপ্রচার ও এই সব ঔষধপত্রের প্রচারের মধ্যে আমি কোনও পার্থক্য দেখিতে পাইলাম না।

.

. সব ধর্ম সত্য, না সব ধর্ম মিথ্যা?

দুই-তিন বছর আগে ভাবিতাম, সব ধর্মই সত্য হইতে পারে। এখন ভাবিতে শুরু করিলাম সব ধর্মই মিথ্যাও হইতে পারে। সিদ্ধান্তে পৌঁছিতে বেশি দিন লাগিল না। দর্শনের অনার্স ক্লাসে বড় বড় দার্শনিকের নাম শুনিয়া কলেজ লাইব্রেরিতে তাঁদের বই-পুস্তক পড়িতে লাগিলাম। গভীর অধ্যয়নের সময়ও ছিল না, সম্ভবও ছিল না। ভাসা-ভাসা পড়িয়াই বড় দার্শনিক তত্ত্ব সম্বন্ধে নিজস্ব অর্থ করিয়া বসিলাম। লৌকিক ধর্ম ও আসল ধর্মের পার্থক্য আমার সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল। আমি বুঝিলাম আল্লার গুণাবলির অনুকরণে সদগুণের অধিকারী হওয়ার নামই ধর্ম। সেটা করিতে গিয়া কোনও লৌকিক ধর্মের নিয়মাবলি মানিয়া চলার দরকার নাই। মানুষ নীতিমান হইলেই ধার্মিক হইল। যেসব লৌকিক ধর্ম মানুষের মধ্যে প্রচলিত আছে, এগুলি ব্যবসাদারী ডগমা মাত্র। খোদাকে মূলধন করিয়া এরা এক-একটা ব্যবসা ফাঁদিয়াছে মাত্র। সৃষ্টিকর্তার নিজের মুখের বাক্য বলিয়াও যে সব কিতাব চালু আছে, সেগুলির মধ্যে যুগোপযোগী ভাল-মন্দ কথা আছে বটে কিন্তু ওগুলি আসলে খোদার মুখের কথাও নয় এবং সে কারণেই ওগুলি চিরকালের উপযোগীও নয়। সৃষ্টিকর্তার অবতার পুত্র বন্ধু বলিয়া যেসব ধর্ম প্রবর্তক দাবি করিতেছেন, তাদের দাবি ঠিক নয়। এই সব সিদ্ধান্ত করিয়া সমস্ত লৌকিক ধর্মের বিরুদ্ধে পাইকারি হারে কঠোর কঠোর উক্তি করিতে লাগিলাম। সহপাঠী ও বন্ধুরা আমার কথা শুনিয়া কেউ কানে আঙুল দিল, কেউ শিহরিয়া উঠিল, কেউ মারমুখী হইল। মারিল না কেউ। কিন্তু সবাই আমারে নাস্তিক আখ্যা দিল। হিতৈষীরা আমার আখেরাতের চিন্তায় আকুল হইল। বক ধার্মিকেরা আমাকে হোস্টেল হইতে বাহির করিয়া দিবার জন্য সুপার আসাদ সাহেবকে চাপ দিতে লাগিল। আসাদ সাহেব কি ভাবিয়া আমাকে তাড়াইলেন না, প্রিন্সিপালের কাছে আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করিলেন না। কিন্তু মিলাদ প্রভৃতি বার্ষিক অনুষ্ঠান হইতে আমাকে বাদ দিলেন।

.

. খোদা-বিশ্বাস বনাম ধর্ম-বিশ্বাস

কিন্তু আসল কথা এই যে আমি তখনও নাস্তিক হই নাই। ধর্মবিরোধী অর্থাৎ লৌকিক ধর্মবিরোধী হইয়াছি মাত্র। তৎকালে ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলিলেই লোকেরা তাকে নাস্তিক বলিত। ধর্ম ও আল্লাকে তারা একই বস্তু মনে করিত। সুতরাং যে ধর্ম মানে না, সে আল্লাকেও মানে না। এই ছিল সাধারণ জনমত। কিন্তু কৌতুকের বিষয় এই যে, ধর্ম মানে এখানে তারা শুধু নিজেদের ধর্ম মনে করিত। আল্লা ও ধর্ম যে এক, সেটা অন্য কারো ধর্ম নয়, আমাদের ধর্ম। কাজেই মুসলমান যদি হিন্দু ও খৃষ্টানের, হিন্দু যদি মুসলমান খৃষ্টানের অথবা খৃষ্টান যদি হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মের নিন্দা করে, তবে সেটা নাস্তিকতা হইবে না। এ কথার সোজা অর্থ এই যে আমার ধর্ম ছাড়া আর গুলি আসলে ধর্মই নয়। কাজেই ওগুলিতে অবিশ্বাস করিলে বা ওদের নিন্দা করিলে তাতে সৃষ্টিকর্তা অসন্তুষ্ট হইবেন না। বরঞ্চ উল্টা ঐগুলিকে নিন্দা না করিলেই তিনি অসন্তুষ্ট হইবেন। তার মানে আমারটাই আল্লার একমাত্র ধর্ম। আর গুলি সব জাল। ধার্মিকেরা একবার ভুলক্রমেও বলেন না, নাস্তিকের চেয়ে খোদা-বিশ্বাসী ভাল, অতএব আমার ধর্মে বিশ্বাস না হয়, অন্য ধর্মে বিশ্বাস কর; তবু সৃষ্টিকর্তার প্রতি ঈমান আন। না, না, এ কথা বলা চলিবে না। বরঞ্চ নাস্তিক থাক তা-ও ভাল। তবু আমার ধর্ম ছাড়া অপরের ধর্মে বিশ্বাস করিও না। ছেলেবেলা চাচাজীর কাছে যা শুনিয়াছিলাম তা আজও সত্য। তিনি বলিতেন: হানাফীরা হিন্দুর চেয়ে বদতর। হানাফীরা যে আল্লা, রসুল, নামাজ, রোযা, হজ, যাকাত ইত্যাদি ইসলামের সবগুলি মূলনীতিতে বিশ্বাসী তাতেও চাচাজী সন্তুষ্ট নন। তাঁরা যে বুকের উপর তহরিমা বাধিয়া জোরে ‘আমিন’ কয় না, এতেই তারা প্রতীক পূজক বহু ঈশ্বরবাদী হিন্দুর চেয়ে বদতর হইয়া গেল। চাচাজীর কথা : ‘যদি মুসলমান হইতে চাও তবে আমাদের মত মোহাম্মদী হও; যদি মোহাম্মদী না হও তবে তোমার মুসলমান হওয়ার কোনো সার্থকতা নাই; তুমি বরঞ্চ হিন্দুই থাক।’ এটা করটিয়ার জমিদার হাফেয মোহাম্মদ আলী সাহেবেরও কথা। অবশ্য প্রচলিত গল্পটি যদি সত্য হইয়া থাকে।

ঠিক তেমনি ধার্মিকেরা বলে, আমার ধর্মে যারা বিশ্বাস করে না, তারা। ‘নাস্তিকোঁসে বদ্‌তর হ্যায়’। চাচাজীর কথা অনুসরণ করিয়াই তারা বলে : যদি ধর্মবিশ্বাসী অর্থাৎ খোদা-বিশ্বাসী হইতে চাও, তবে আমার ধর্মে ঈমান আন। যদি তা নাই পার, তবে নাস্তিকই থাক।

.

১০. নাস্তিকতা

ধার্মিকদের চিন্তায় ও কথায় এই স্ববিরোধিতা দেখিয়া আমি নিজের মনেই হাসিতাম। স্বল্প বুদ্ধিতার জন্য ওদের উপর কৃপা হইত। কিন্তু তাদের কথা সত্য হইতে বেশি দিন লাগিল না। ধর্মে অবিশ্বাসী হইয়া আমি বেশি দিন। খোদার উপর ঈমান রাখিতে পারিলাম না। তখন দর্শনের ক্লাসে পড়া দেকার্তে, স্পিনোযা, মিল, বেনথাম, কোতে, লক, হিউম, কেন্ট, হেগেল আমার মাথায় গজগজ করিতেছে। আমি প্রথমে পার্সিমনি-অব-লজিক বা ন্যায়শাস্ত্রের বখিলির সূত্র দিয়া আল্লার সর্বজ্ঞতা, সর্বশক্তিমানত্ব ও সর্বব্যাপিতা খণ্ডন করিতে লাগিলাম। তর্কশাস্ত্রের বখিলি ব্যাপারটা এই যে আপনি কোনও কিছুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত করিবার সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু অনুমান করিতে পারিবেন না। ধরুন লংক্লথের একটা পায়জামার দাম আপনি আজকালের বাজারেও দশ টাকার বেশি অনুমান করিতে পারেন না। সে জায়গায় আপনার পরনের পাজামাটি দেখিয়া যদি আমি বলি : আমি অনুমান করি, এটা বানাইতে দশ হাজার টাকা খরচ পড়িয়াছে; কিম্বা যদি বলি : আমার মনে হয় কলিকাতার মাস্টার টেইলার বরকতুল্লা এই পাজামাটা সিলাই করিয়াছে তবে এই দুইটা কথাই পার্সিমনি-অব-লজিক-এর খেলাফ হইবে। কারণ ঐ পাজামা বানাইতে প্রথম শ্রেণীর লংক্লথেও দশ টাকার বেশি খরচ পড়িতে পারে না; এবং ইসলামপুর-নবাবপুরের যে কোনও সাধারণ দর্জি এই পায়জামা সেলাই করিতে পারে। তেমনি, একটি কাঁচা-ভিটির বাঁশ ছনে দুচালা ঘর দেখিয়া যদি আমি বলি : তাজমহলের কারিকর বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি ইসমাইল খাই নিশ্চয় এই ঘরটি বানাইয়াছে, তবে এটাও পার্সিমনি অব-লজিক সূত্রের খেলাফ হইবে।

চিন্তার এই সূত্র ধরিয়া ধর্ম বিরোধ হইতে অতি সহজেই খোদা বিরোধে পৌঁছিলাম। মুসলমান হিসাবে এক আল্লা-বিশ্বাসী। সে আল্লা-বিশ্বাসী, সে আল্লা নিরাকার, নিরঞ্জন, সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান। এমন সর্বব্যাপী এক আল্লা হইতে প্রথমে সুফিবাদের দিকে মন ধাবিত হইল। মনসুর হাল্লাজের ‘আনাল হক’ (আমি’ই হক), উপনিষদের ‘অহংব্রহ্ম’ খুবই আকর্ষণীয় মনে হইল। স্পিনোযা ও লাইবনিজের নিয়ম (অদ্বৈতবাদ) ও প্যাথিযম (সর্বেশ্বরবাদ, মায়াবাদ) আমার চোখে খুব উঁচুদরের তত্ত্বদর্শন ছিল। এর সঙ্গে সুফীবাদ, অদ্বৈতবাদের মিল দেখিয়া আমি খুবই চমৎকৃত হইলাম। এইভাবে নিরাকার সৃষ্টিকর্তা হইতে ‘আনাল এক’-এ ‘অহংব্রহ্মবাদের ভিতর দিয়া প্রথম মায়াবাদ বা প্যাথিযম ও পরে মনিযম এবং আরো পরে নিরীশ্বরবাদের দুর্নিবার যুক্তির খাদে পড়িতে আমার বেশি সময় লাগিল না।

সূত্রের এই দৃষ্টান্ত হইতে আমি বলিতে লাগিলাম : রোগ, শোক, ঝড়, ভুইকাপ, বন্যা, মহামারি ও দুঃখ-দারিদ্র্যপূর্ণ অসুন্দর এই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তারূপে সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ ও কল্যাণময় একজন আল্লা-ভগবান অনুমান করা যুক্তিসহ ও ন্যায়সম্মত নয়। আমি বন্ধুদেরে চোখে আঙ্গুল দিয়া কলেজ প্রাঙ্গণের আমগাছগুলি দেখাইয়া দিতাম। দেখ, দেখ, ফায়ুন মাসে এইসব গাছ বউলে ঝুঁকিয়া পড়ে, মনে হয় লক্ষ কোটি আম হইবে। কিন্তু চৈত্র-বৈশাখে সেইসব বউল ঝরিয়া পড়ে, থাকে মাত্র এক কুড়ি আম। পাড়াগাঁয়ের খালে-বিলে-পুকুরে গিয়া দেখ একটা মাছ কমসে কম লক্ষ পোনা ছাড়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাচ্চা মাছ থাকে মাত্র কুড়ি-পঁচিশ, বড় বড় হয় মাত্র দশ-পনেরটা। এসব কাজ দক্ষ নিপুণ সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার কাজ হইতে পারে? একটা পাকা মালি এক সাজি ফুল দিয়া কুড়ি মালা গাঁথিবে। কোনও আনাড়ির হাতে পড়িলে একটি মালা গাঁথিতেই সাজির ফুল খতম। প্রকৃতির এই অপব্যয় অনিয়ম ও অশৃঙ্খলা কদাচ সর্বজ্ঞ ও অন্তর্যামী আল্লার অস্তিত্ব প্রমাণ করে না। জ্ঞানের দিক দিয়া যা, শক্তির দিকেও তাই। আল্লার সর্বশক্তিমানত্ব চ্যালেঞ্জ করিয়া বলিতে লাগিলাম : খোদা কি এক সঙ্গে এই দরজাটা খোলা ও বন্ধ রাখিতে পারেন।

.

১১. মি. ল্যাংলির সহনশীলতা

এ সব কথা অধ্যাপকদের সামনেই বলিতাম। তাদের সঙ্গেও তর্ক করিতাম। অনার্স ক্লাসে অধ্যাপক ল্যাংলি ও ভট্টাচার্যের সঙ্গেই হইত বেশি। ল্যাংলি সাহেব খুব বড় ধার্মিক মানুষ ছিলেন। কিন্তু সহনশীল দার্শনিক মনোভাবও তার ছিল যথেষ্ট। তিনি প্রথম প্রথম আমাকে বুঝাইবার খুব চেষ্টা করিতেন। আমার যুক্তির দুর্বলতা কোথায়, দেখাইয়া দিতেন। কখনও চটিতেন না। কখনও কড়া কথা বলিতেন না। ছাত্রদের নির্বুদ্ধিতার জন্য কস্মিনকালেও তাদেরে মনে কষ্ট দিয়া কথা বলিতেন না। তারা যে নির্বোধ, তাদের মাথায় যে ঘিলু নাই, এমন ধরনের কথা যেত তার মুখ দিয়া আসিতই না। তার প্রশ্নের হাজার ভুল উত্তর দিলেও তিনি বলিতেন না : ‘তোমার উত্তর ঠিক হয় নাই। বরঞ্চ তিনি বলিতেন : ‘তোমার উত্তর যথাস্থানে ঠিকই আছে : কিন্তু আমার প্রশ্ন ওটা ছিল না। ল্যাংলি সাহেবের এই ভদ্রতার নজিররূপে আমরার ছাত্রদের মধ্যে যে উপমাটি প্রচলিত ছিল সেইটিই নমুনাস্বরূপ উল্লেখ করিতেছি। ধরুন, তিনি কোনও ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন : ‘বলো ত একটা মুরগির কতটা পা আছে? জবাবে ছাত্রটি বলিল : একটা ঘোড়ার চারটা পা আছে, স্যার’। ছাত্রদের এই নিরেট মূর্খের মত জবাবে যে কোনও শিক্ষক চটিয়া যাইতেন। কিন্তু ল্যাংলি সাহেব চটিতেন না। তবে কী করিতেন? তিনি বলিতেন : ‘ঘোড়ার পা সম্পর্কে তুমি ঠিকই বলিয়াছ। কিন্তু আমার প্রশ্ন ছিল মুরগির কয়টা পা।

এমন শরিফ ভদ্রলোকের সাথে গরম তর্ক করার উপায় ছিল না। তমিযে লেহাযে তাঁর মত ভদ্র, যবানে তাঁর মত মিষ্টভাষী না হইলে তার সাথে স্বভাবতই তর্ক জমান যাইত না। কিন্তু ল্যাংলি সাহেব শুধু আমাদের দর্শনের শিক্ষক ছিলেন না, ভদ্রতা ও তমিয-লেহাযেরও শিক্ষক ছিলেন। আমার নাস্তিক্য যতই বেপরওয়া ও বেলাগাম হইতে লাগিল, ল্যাংলি সাহেবের স্নেহ আমার প্রতি তত যেন বাড়িতে লাগিল। ডা. মার্টিনোর স্টাডি-অব-রিলিজিয়ন নামে একটা বড় দামি পুস্তক আমাদের অনার্সের পাঠ্য ছিল। এই পুস্তকের পঠিতব্য অংশ ছাড়াও সবটা বই পড়িয়া ফেলিতে তিনি আমাকে উপদেশ দিতেন এবং সত্য-সত্যই পড়িয়াছি কিনা, নানা রকম প্রশ্ন করিয়া তা পরীক্ষা করিতেন। ডা. মার্টিনোকে মি. ল্যাংলি পীরের মত মান্য করিতেন। এটা জানিয়াও আমি ল্যাংলি সাহেবের এক প্রশ্নের জবাবে বলিয়াছিলাম : ডা. মার্টিনো দার্শনিক নন, তিনি আসলে খৃষ্টান পাদরি। এতে ল্যাংলি সাহেব নিশ্চয়ই মনে খুব ব্যথা পাইয়াছিলেন। যিনি জীবনে কাকেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেও কড়া কথা বলেন নাই তিনিই আমাকে শুনাইয়া একদিন বলিলেন : ‘বেকন ঠিকই বলিয়াছেন লিটল লার্নিং ইজ ড্যানজারাস অ্যান্ড লিটল ফিলসফি লিডস টু এথিযম’ অর্থাৎ অল্পবিদ্যা বিপজ্জনক, অল্পদর্শন নাস্তিক্য-জনক।’ কথাটায় আমি মনে কষ্ট পাইব আশঙ্কা করিয়াই বোধ হয় উহার ধার মারিবার উদ্দেশ্যে সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বলিলেন : ‘ডোন্ট ওয়ারি অল অ্যাকটিভ মাইন্ডস মাস্ট অব নেসেসিটি পাশ থু দ্যাট স্কেপটিসিযম ইন দেয়ার ইয়ুথ’ অর্থাৎ এর জন্য চিন্তা করিও না। সক্রিয় তরুণ মনে অমন সন্দেহবাদ একবার আসিয়াই থাকে।

যেন নাস্তিক্য একটা রোগ। এই রোগাক্রান্ত হইয়া আমি যেন বাঁচিবার আশা ত্যাগ করিয়াছি। তিনি যেন বড় ডাক্তাররূপে আমাকে সান্ত্বনা দিলেন : কোনও চিন্তা করিও না। তোমার রোগ সারিয়া যাইবে। বছরের এই ঋতুতে সবারই এই রোগ হইয়া থাকে।

কিন্তু ল্যাংলি সাহেবের চিকিৎসায় আমি ভাল হইলাম না। ডা. মার্টিনোর স্টাডি-অব-রিলিজিয়ন পড়িয়া ধর্মের প্রতি আমার বিরূপ ভাব কমিল না। আল্লার প্রতি আমার মতিগতি বদলাইল না। নাস্তিক্যের প্রতি আমার ঈমান এতটুকু ক্ষুণ্ণ হইল না। বরঞ্চ ডা. মার্টিনোর কোনও কোনও যুক্তি আমাকে সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে আরো শক্ত করিয়া তুলিল।

.

১২. অধ্যাপক ভট্টাচার্য

ল্যাংলি সাহেব যা পারিলেন না; অধ্যাপক উমেশ ভট্টাচার্য তা পারিলেন। তিনি সক্রেটিসের ডায়লেকটিক ম্যাথডে আমার সঙ্গে তর্ক করিয়া অর্থাৎ আমার প্রায় সব কথার সমর্থন করিতে করিতে এক বেকায়দা জায়গায় আনিয়া ফেলিলেন। উমেশ বাবু ডগমা রিলিজিয়ন, এমনকি খোদার সর্বজ্ঞতা ও সর্বশক্তিমানত্বের প্রশ্নেও আমার সহিত একমত হইবার পর অবশেষে অত্যন্ত অকস্মাৎ তিনি বলিয়া বসিলেন : খোদা আছেন এটারও যেমন কোনও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রমাণ নাই, খোদা যে নাই তারও কোনও প্রমাণ নাই, কি বল?

আমি হঠাৎ চমকিয়া উঠিলাম। তাই ত। কিসের জোরে আমি খোদা নাই বলিয়া কুঁদিয়া বেড়াইতেছি? আমার পকেটে টাকা বা সিগারেট নাই; ঘরে খাবার নাই, টেবিলে পুস্তক নাই, এসব কথা যেমন নিজের জ্ঞানে বলিতে পারি। সৌরজগতে আল্লাহ নাই, এ কথা কি তেমনি নিজের জ্ঞানে বলিতে পারি? আমাকে চিন্তা করিতে দেখিয়া উমেশ বাবু হাসিলেন। তিনি কান্টের বই হইতে খানিকটা পড়িয়া শুনাইলেন। ওতে লেখা ছিল : আল্লাহ অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। তিনি মানুষের সমস্ত ইন্দ্রিয়ের বাহিরে ও উর্ধ্বে বলিয়া কেউ তাঁকে জানেও নাই, জানিতে পারিবেও না। কান্টের উক্তি শেষ করিয়া উমেশ বাবু বলিলেন : তবু কান্ট খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। সব খোদা-বিশ্বাসীরাই না জানিয়া খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে তোমার মত এই না জানিয়া ‘খোদা আছেন’ বলার দরুন এঁদের মতকে যদি যুক্তিহীন ডগমা বলিতে চাও, তবে তুমি যে না জানিয়া ‘খোদা নাই’ বলিতেছ, এটা ত সেই কারণেই যুক্তিহীন ডগমা।

.

১৩. এ্যাগনস্‌টিক

উমেশ বাবুর ঐদিনকার কথায় আমার চিন্তা-স্রোতের মোড় ঘুরিয়া গেল। আমি বুঝিলাম নাস্তিক্যবাদের পক্ষে আমি এতদিন যত কথা বলিয়াছি, যত যুক্তি দিয়াছি, সব ভুল। তার একটারও ভিত্তি নাই। তা যদি না থাকে তবে কী? আল্লাহ আছেন কি নাই, তা আমরা জানি না। জানিতে পারিও না। এই মতে, মানে সন্দেহে, যখন দৃঢ় হইলাম, তখন নূতন চিন্তার সম্মুখীন হইলাম। আচ্ছা না হয়, আল্লাহ আছেন কি নাই, তা লইয়া মাথা ঘামাইলাম না; কারণ মাথা ঘামাইয়া কোনও লাভ হইবে না, বুঝিলাম। কিন্তু চিন্তা যে এখানে আসিয়াই থামিয়া যায় না। আল্লাহ থাকিলেও যখন দূরে আছেন, নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনে যখন তাঁকে পাইতেছি না, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় যখন তাঁর সাক্ষাৎ পাইতেছি না, কাজেই তার কথা না হয় নাই ভাবিলাম। যদিও চিন্তক মন এই নৈরাশ্যবাদকে মানিয়া লইতে চায় না; কোনও একটা বিষয় চিরকাল মানবমনের অগোচরে থাকিয়া যাইবে যদিও মন এটা মানিয়া নিতে চায় না; তবু না হয় ধরিয়া নিলাম, খোদার চিন্তা নাই করিলাম মনকে এ ব্যাপারে চোখ বুজিয়া থাকিতে রাজি করিলাম। কিন্তু আমার নিজের সম্বন্ধে চিন্তা না করিয়া ত পারি না। আল্লাহ নাই না হয় মানিলাম, কিন্তু আমার মন ও আত্মা নাই, এ কথাটা অত সহজে মানিয়া লওয়া যায় না। হিউমের বইয়ে পড়িয়াছি, মন বা আত্মা বলিয়া আমাদের কোনও স্বতন্ত্র সত্তা বা অস্তিত্ব নাই। ডেকার্তে বলিয়াছেন, আমাদের মন ও দেহ দুইটা স্বতন্ত্র বস্তু। দুইটার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই আমাদের জীবন। এই মত লইয়া কোনও রকমে বাঁচা যাইত। কিন্তু হিউম আসিয়া স্পষ্টই বলিয়া দিলেন যে, মন বা আত্মা বলিয়া আমাদের স্বতন্ত্র কোনও অঙ্গ নাই। আমাদের দেহে যে সব ইন্দ্রিয় বা প্রত্যঙ্গ আছে, তাদের অভিজ্ঞতার সমষ্টিকেই আমরা মন বলিয়া জানি। ডেকার্তে বলিয়াছেন : কব্জিটো আরগো সাম আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি। হিউম বলিলেন : আমি বলিয়া কোনও স্বতন্ত্র সত্তা নাই; আমি নামক দেহটির মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, হাত-পা, নাসিকা, জিভ ও চামড়ার বোধ বা অভিজ্ঞতার যোগফলকেই আমরা আমার সত্তা, আমার মন বা আমার আত্মা বলিয়া ভান করিতেছি। আমার দেহের ঐ সব অঙ্গ একটা একটা করিয়া হাঁটিয়া ফেলিলেই বুঝিতে পারিব যে ঐ সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা ইন্দ্রিয়ের বাইরে মন বা আত্মা বলিয়া কোনও বস্তু নাই।

এটা বড় সাংঘাতিক কথা। আমার প্রেম-হিংসা, স্নেহ-ক্রোধ, মহত্ত্ব নীচতা, দয়া-প্রতিশোধ, সুখ-দুঃখ, আশা-নৈরাশ্য সবই কি তবে ইন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতামাত্র। ধর্ম না থাকায় আমি বুদ্ধির মুক্তি লাভ করিয়াছিলাম, ভালই হইয়াছিল। আল্লাহ না থাকায় আমার বিশেষ কিছু আসে যায় নাই। কিন্তু এখন যে সব গেল! আমার মন, অন্তর, আত্মা, কিছু যদি না থাকিল, তবে আমার জীবনের সার্থকতা কি? আমার জ্ঞান-বিদ্যা-চৰ্চ্চার অর্থাৎ আমাদের শিল্প-সাহিত্য, দর্শন-বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য কি? এক কথায় মানুষের জীবনই ব্যর্থ ও নিরর্থক হইয়া যায়। মানুষও এক প্রকার জন্তু বটে। কিন্তু তাই বলিয়া তারা কি গরু-বকরির চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়? মন-অন্তর-আত্মাই যদি মানুষের না থাকিল তবে সে শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়?

ইম্যানুয়েল কান্টের মত হইতে সান্ত্বনা পাইবার চেষ্টা করিলাম। তিনি লিখিয়াছেন, মানুষের মন ও আত্মা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু আল্লাহকে যেমন আমরা জানিতে পারি না, পারিবও না, তেমনি আমাদের মন ও আত্মাকে আমরা জানিতে পারি না।

ফলে চারি বছরের ঘোরতর নাস্তিক আমি চারি মাসের মধ্যে নাস্তিক্যকে যুক্তিহীন ও ভিত্তিহীন ডগমা বলিয়া বর্জন করিলাম। ফলে আস্তিকও থাকিলাম না। নাস্তিকও থাকিলাম না। যা হইলাম তাকে ইংরাজিতে বলা যায় এ্যাগনস্‌টিক। বাংলাতে তাকে অজ্ঞেয়বাদী বলা যাইতে পারে। ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার বুঝাইতে হইলে বলিতে হয় চিন্তারাজ্যের ত্রিশঙ্কু অবস্থা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *