০৭. গোঁড়ামির পরিবেশ

তৃতীয় খণ্ড – ধর্ম-জীবন

অধ্যায় সাত – গোঁড়ামির পরিবেশ

১. নফলিয়াতের পাবন্দি

ফরাযী পরিবারের আনুষ্ঠানিক ধার্মিকতার পরিবেশে আমার জন্ম। বুদ্ধি হওয়ার সাথে সাথেই দেখিয়াছি নামাজ-রোযার ধুম। সুরুজ উঠার দুই ঘণ্টা আগেই দাদাজী খোশ ইলহানে বুলন্দ আওয়াজে আযান দিতেন। তাঁর আযান আশেপাশের দু-চার গ্রামের লোক শুনিতে পাইত। লোকেরা বলাবলি করিত : ফরাযী সাবের আযানই আমাগর ঘড়ি। দাদাজীর আযানে আমাদের বাড়ির সকলেই জাগিয়া উঠিতেন। পুরুষরা সকলে বাহির বাড়ির মসজিদে (তকালে কাঁচা ভিটি টিনের ঘর) জমাতে নামাজ পড়িতেন। প্রতিবেশীদের মধ্যে যারা সকালে উঠিতেন, তাঁরাও এই জমাতে শামিল হইতেন। আমাদের চাকরদের মধ্যে যারা রাত্রে আমাদের বাড়িতে থাকিত তারাও নামাজ পড়িতে বাধ্য ছিল এবং ফযরের নামাজে জমাতে শামিল হইত। মোট কথা আল্লার ভয়ে না হউক, দাদাজীর ভয়ে আমাদের বাড়ির সবাই নামাজি ছিলেন।

বাড়ির ভিতরের মেয়েরা সকলে পাক্কা নামাজি ছিলেন। মেয়েলোক অর্থে দাদি, ফুফু, মা ও চাচি। এ ছাড়া গুলের মা নাম্নী এক চাকরানি ও তার মেয়ে গুলজান। এরাও সকলেই আওয়াল-ওয়াকতে ফযরের নামাজ পড়িত।

এ অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে আমার পূর্বপুরুষেরাই সকলের আগে শিরা কবুল’ করিয়াছিলেন, এ কথা আমি এই পুস্তকের পয়লা অধ্যায়েই বলিয়াছি। ‘পয়লা শরা কবুল করার মধ্যে যেমন একটা গৌরব বোধ আছে, তেমনি একটা দায়িত্ববোধও আছে। আমি ছেলেবেলায় দেখিয়াছি, আমার মুরুব্বিদের মধ্যে এই গৌরববোধটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল; কিন্তু দায়িত্ব বোধটা প্রতিবেশীরা এবং বাইরের লোকেরা স্মরণ করাইয়া দিতেন। প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যারা রোযা-নামাজে নিজেরা গাফেল ছিলেন, তাঁরাও ফরাযী পরিবারের লোকদের নামাজ-রোযার গাফলতি সহ্য করিতেন না। যেসব আমোদ-প্রমোদ, গান-বাজনা, যাত্রাপার্টি ও পূজা-মেলায় আমার সহপাঠী ও সমবয়সীরা অবাধে যাইত, সে সবে আমি ও আমার ভাইয়েরা গেলে তারাই আপত্তি করিত। এমনকি ঐ সব গান-বাজনার আয়োজনকারী হিন্দুরা ও আমাদের শিক্ষকেরাও আর সকলকে বাদ দিয়া শুধু আমাদেরে বলিতেন : “তোমরা ফরাযী বাড়ির লোক। তোমাদের এসবে আসা উচিৎ নয়।

এই পরিবেশে আমাদের মুরুব্বিদের বাড়ির বাহিরের পুরুষদের, অন্দরের মেয়েলোকদের এবং আমরা মকতব-পাঠশালার পড়ুয়াদের কারো পক্ষে নামাজ-রোযায় ও শরিয়তের অপরাপর আইকাম-আরকানে গাফলতি করার উপায় ছিল না। এ অবস্থায় আমাদের অজ্ঞাতসারেই আমরা বাধ্য হইয়াই মুসল্লি-মুত্তাকি অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক ধার্মিকরূপে গড়িয়া উঠিয়াছিলাম।

কাজেই জ্ঞান হইয়াছে অবধি আমি আমাদের বাড়িতে নামাজের ধুম দেখিতেছি। আর রোযা? পুরুষরা সবাই বছরে একবার রমযানের এক মাস মাত্র রোযা রাখিতেন। এ ছাড়া দাদাজীকে মাঝে মাঝে কোনও বিশেষ উপলক্ষে রোযা রাখিতে দেখিয়াছি। কিন্তু বাড়ির মেয়েদের যেন রোযার আর শেষ নাই। রমযানের পরে শওয়ালের ছয়টি সাক্ষী রোযা’ মাসে মাসে আইয়াম-বাজের রোযা, আশুরার রোযা, শবে বরাত ও শবে মেরাযের রোযা ইত্যাদি কত কী? মেয়েদের মধ্যে আবার মা সকলকে ছাড়াইয়া যাইতেন। বরকত ও ফজিলতের যতগুলি নফল রোযা আছে সেগুলি ত তিনি রাখিতেনই, তার উপর তিনি প্রায় সারা বছরই সদুকার রোযা ও কাফুরার রোযা রাখিতেন। শ্বশুর-শাশুড়ি, বাপ-মা, স্বামী-পুত্র, ভাই-ভগিনী অথবা নিকট আত্মীয় কারো অসুখ-বিসুখ হইলে, অমনি মা তার রোগমুক্তির জন্য তিনটা রোযা, সদকা মানিয়া বসিতেন। খোদার ফজলে মার উপরোক্ত শ্রেণীর লোকের অভাব ছিল না তাদের কারো না কারো অসুখ-বিসুখ একটু-না-একটু হইতই। সুতরাং মার সদকার রোযা যোগাড় করিতে হইত না। যদি সৌভাগ্যবশত কোনো বছর এতগুলি আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কারোই কোনও অসুখ-বিসুখ না হইত এবং তার ফলে মার সদকার রোযার অভাব হইত, তবু তাঁকে রোযা রাখা হইতে মহরুম করিবার উপায় ছিল না। সে অবস্থায় তিনি কাফফারার রোযা রাখিতেন। আমি খুব ত্যক্ত-বিরক্ত হইতাম। কারণ দিনের বেলা মাকে খাইতে দেখা এবং তাঁর হাতের ‘লুকমা’ বা ‘নওলা’ খাওয়া আমার ভারি শখের জিনিস ছিল। তাই মাকে প্রশ্ন করিতাম : এটা আবার কিসের রোযা? তিনি বলিতেন, আমরা দিন-রাত অজানাভাবে কত আয়েব কসুর গোনা-খাতা করিতেছি, তার হিসাব নাই। আমাদের বরাতে যে বালা মুসিবত হইয়া থাকে, তা এইসব গোনা-খাতার জন্যই হইয়া থাকে। তিনি রোযা করিয়া সেইসব গোনা-খাতা আল্লার দরগায় মাফ নিতেছেন এবং ঐ সব বালা-মুসিবতের রাস্তা বন্ধ করিতেছেন। মোট কথা রোযা রাখা মার একটা নেশা ছিল এবং শেষ পর্যন্ত ওটা তার স্বভাবে পরিণত হইয়াছিল। দিনের বেলা কিছু খাওয়া তার সহ্য হইত না। জীবনের শেষ পনের-বিশ বছর তিনি বছরের নিষিদ্ধ ছয় দিন বাদে সারা বছরই রোযা রাখিতেন।

যা হোক রোযা-নামাজের এই ধুম ছাড়া বাহির বাড়ির আটচালা টিনের ঘরে চাচাজীর মাদ্রাসা বসিত। তাতে সকাল-সন্ধ্যায় আরবি-ফারসি পড়া হইত। তাছাড়া বার মাসই মুনশী-মৌলবী, আত্মীয়-স্বজন এবং বিদেশি আলেম-মুসাফিরের সমাগম থাকিত। এঁরা প্রায় সব সময় মসলা-মসায়েলের আলোচনা ও বাহাস-মুবাহেসা করিতেন। প্রায় মাসে মাসেই বাহির বাড়ির উঠানে ওয়াযের মজলিস বসিত।

.

. শৈশবের বাড়াবাড়ি

এই পরিবেশে অন্য সহোদরদের সাথে আমিও খুব মুসল্লি-মোত্তাকি হইয়া উঠিলাম। বরঞ্চ আমি সকলের চেয়ে বেশিই হইলাম। পাঁচ বছর বয়সে মতন কোরআন শরিফ খতম করিলাম। ঐ বয়সেই পাঁচ ওয়াকত নামাজ নিয়মিত পড়িতে লাগিলাম। এ ছাড়া মার জায়নামাজে তার পাশে বসিয়া তার দেখাদেখি এবাদত করিতাম। কী এবাদত করিতাম, তা নিজেই জানিতাম না। কখনও মার তসবিহ ছড়া নাড়িয়া, কখনও ডান হাতের আঙুল টিপিয়া এবং কখনো সিন্দা করিয়া মার অনুকরণ করিতাম। এতে মা অসন্তুষ্ট হইতেন না। বরঞ্চ দোওয়া তসবিহ শিখাইবার চেষ্টা করিতেন।

সাত বছর বয়সে সর্বপ্রথম পুরা ত্রিশটা রমযানের রোযা রাখিলাম। নয় বছর বয়সে বাড়ির মাদ্রাসায় জমাতে নহম ও পাঠশালায় দ্বিতীয় শ্রেণী পাশ করিয়া ফেলিলাম। তাতে উর্দু ফেকায়ে-মোহাম্মদী, রাহে-নাজাত, মেফতাহুল জান্নাত ও বাংলা নিয়ামতে-দুনিয়া ও আখেরাত এবং নক্‌শে-সুলেমানী পড়িয়া একরূপ মুখস্থ করিয়া ফেলিলাম। এইসব কেতাবের উপদেশসমূহের শিশুসুলভ আজগুবি অর্থ করিয়া সেসব উপদেশ গোপনে আমল করিতে লাগিলাম। এই সব আমলের দুই-একটা এইরূপ : প্রতি রেকাতে একবার সুরা ফাতেহার পর তিনবার সুরা কওসর অথবা সুরা এখলাস পড়িয়া একশ রেকাত নামাজ পড়িতাম। প্রতি দুই রেকাত অন্তর সালাম ফিরাইতাম এবং একশ বার সোবহানাল্লা পড়িতাম। প্রায় প্রতি রাত্রেই এই নামাজ শুরু করিতাম বটে কিন্তু খুব কম রাত্রেই পুরা করিতে পারিতাম। দশা বিশ রেকাত পড়িতেই মা বা বাপজী জাগিয়া উঠিতেন। আমিও নামাজ বন্ধ করিতাম। কিন্তু তারা কোনো দিন আমাকে তষিহ করিতেন না। বরঞ্চ মা এটা পছন্দই করিতেন। পড়ার জন্য বাড়ি ছাড়ার পূর্ব পর্যন্ত আমি বাবা-মার সঙ্গেই থাকিতাম। তাঁদেরে গোপন করিতে গিয়া আমাকে বেশি রাত্রে এ নামাজ পড়িতে হইত। আমি তাদের আগেই শুইয়া পড়িতাম এবং ঘুমের ভঙ্গিতে পড়িয়া থাকিতাম। তারা দুজনে শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িলেই আমি চট করিয়া উঠিয়া পড়িতাম। অযুর দরকার হইত না; কারণ অযু করিয়াই বিছানায় আসিতাম। মার জায়নামাজটা বিছাইয়া এবাদতে লাগিয়া যাইতাম। অন্ধকারেই এটা করিতাম। কারণ বাতি জ্বালাইলে বাবা-মা টের পাইবেন, ভয় ছিল। নফল নামাজে কেরাত জোরে পড়িতে হয় না। কাজেই সেদিকে কোনও চিন্তার কারণ ছিল না।

কিন্তু আসল কথা এই যে বাবা-মা উভয়েই আমার এই গোপন এবাদতের নেশার কথা জানিতেন। যদিও আমি মনে করিতাম, তারা ঘুমাইয়া আছেন। আসলে কিন্তু তারা সজাগই থাকিতেন এবং অন্ধকারে আমার এবাদত লক্ষ করিতেন। প্রথম প্রথম উভয়েই কৌতুক বোধ করিতেন। মা পছন্দ করিতেন। কিন্তু আমার কতকগুলি জটিল রোগ দেখা দেওয়ায় তারা চিন্তিত হইলেন। শরীর আমার কোনও দিনই পুষ্ট ছিল না। এইসব রোগে আমি শুকাইয়া একেবারে কঙ্কাল হইয়া গেলাম। আমার এই এবাদতের সঙ্গে আমার রোগের সম্পর্ক আছে বলিয়া বাবা-মারও সন্দেহ হইয়াছিল। কাজেই দাদাজীর কাছে এবং আমার চিকিৎসকদের কাছে তারা আমার এই গোপন কথা প্রকাশ করিয়া দেন।

এর পর শুধু বাবা-মা নন, সমস্ত মুরুব্বিরা মিলিয়া আমাকে বুঝাইতে লাগেন, এই অল্প বয়সে নফল এবাদতের দরকার নাই। চাচাজী এক ধাপ আগাইয়া গিয়া বলিলেন : এ অবস্থায় এই বয়সে নফল এবাদতে কোনও সওয়াব ত হইবেই না, বরঞ্চ গোনা হইবে।

কিন্তু এসব কথায় আমি টলিলাম না। মুরুব্বিরা ত শুধু উপদেশ দিয়াই ক্ষান্ত হইলেন। কোনও প্রকার যবরদস্তি করিলেন না। আমার গোপন এবাদত এখন হইতে প্রকাশ্যভাবে চলিতে থাকিল।

আমার এই নফল এবাদতের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হযরত পয়গম্বর। সাহেবকে খাবে দেখা। অন্তত খাজে-খেযেরের সাক্ষাৎ পাওয়া আমার নফল এবাদতের অপর প্রধান মকসুদ ছিল। পয়গম্বর সাহেবকে খাবে দেখার জন্য নশে-সুলেমানী’ ও ‘নিয়ামতে-দুনিয়া ও আখেরাতে যতগুলি তরকিব বাতলান হইয়াছিল একটা-একটা করিয়া তার সবগুলি আমি এস্তেমাল করিতাম। কাগজের ছোট টুকরায় আরবি হরফে একশ একবার আল্লাহ লিখিয়া সেই টুকরা বালিশের নিচে লইয়া শুইতাম। যাফরানের কালিতে শাহাদত আঙুলে আরবি হরফে মোহাম্মদ লিখিয়া শুইতাম। ঘুম আসিবার আগ পর্যন্ত মনে মনে ইয়া রাহিম’ জপিতাম। এত করিয়াও কিন্তু পয়গম্বর সাহেবকে কখনো খাবে দেখিতে পাই নাই। ঐ আমলের ফলে খাজে-খেযেরের মোলাকাত পাইবার আশায় নদীর পাড় বা অন্যান্য সম্ভাব্য স্থানে একা একা ঘুরিয়া বেড়াইতাম। কিন্তু খাজে খেযেরের সাক্ষাৎ পাইলাম না। তবে খাবে খাজে-খেযেরের আনুমানিক চেহারার অর্থাৎ সাদা দাড়ি, সফেদ পোশাকের গৌরবর্ণ একজন সুফি-দরবেশকে পুনঃপুন স্বপ্নে দেখিতাম। তিনি স্বপ্নে আমাকে আরবি মুখরেজ ও তালায় শিখাইয়াছিলেন। এসব কথা আমি অন্য অধ্যায়ে বিস্তারিত বর্ণনা করিয়াছি।

.

. টুপি নিষ্ঠা

এবাদত-বন্দেগিতে আমার এই ধার্মিকতা আমার পোশাক-পাতিতে প্রকট হয়। টুপি ছাড়া আমি কোথাও যাইতাম না, স্কুলে-মকতবে ত নয়ই। ক্লাসে কখনও মাথা হইতে টুপি নামাইতাম না। আমার টুপিটা ছিল লাল তুর্কি টুপি। ঐ ধরনের টুপিতে মাথায় বাতাস যাতায়াতের কোনো রাস্তা ছিল না। গরমের দিনে ঘামে মাথা ভিজিয়া যাইত। কপাল, গাল, চিপ ও ঘাড় বাইয়া ঘাম পড়িত। তবু টুপি খুলিতাম না। গ্রামের পাঠশালায় পড়িবার সময় আমাদের শিক্ষক জগদীশ বাবু কোনও দিন টুপি খুলিতে বলেন নাই। আলিমুদ্দিন মাস্টার সাহেব ত এ জন্য দস্তুরমত আমাদের দুই ভাইয়ের তারিফই করিতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে দরিরামপুর স্কুলে ও আরো পরে শহরে মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে পড়িবার সময় হিন্দু শিক্ষক ও সহপাঠীরা অন্তত গরমের সময় টুপিটা খুলিয়া রাখিতে। পরামর্শ দিতেন। কিন্তু আমি তাদের কথা রাখিতাম না। শুধু হাসিয়া বলিতাম: ‘আমার কোনও অসুবিধা হইতেছে না। দরিরামপুর স্কুলে পড়িবার সময় স্কুলসংলগ্ন মাদ্রাসার ছাত্রদের অনেকে সর্বদা টুপি পরিত না। তা দেখাইয়া অনেক শিক্ষক ও সহপাঠী টুপি খুলিয়া মাথা ঠাণ্ডা করিতে উপদেশ দিতেন। তাদেরও আমি বলিতাম : আমার মাথা বেশ ঠাণ্ডাই আছে। আমিও আসলে ঠাণ্ডা। টুপির জন্য আমি কখনও মাথায় গরম বোধ করিতাম না।

.

. মযহাবী-বিরোধ

আমার এই ধর্মপ্রীতি অনেকবার আমাকে খুব বিপদেও ফেলিয়াছে। আমাদের পরিবার খুব গোঁড়া মোহাম্মদী। আমাদের ধনীখোলা গ্রামের বেশির ভাগ লোকই তাই। ছাত্ররাও। কিন্তু আমি ছাড়া আমাদের অঞ্চলের ছাত্রদের কোনও অসুবিধা বা বিপদ ছিল না। কারণ এরা কেউ নিজেদের মোহাম্মদীগিরি প্রদর্শন করিত না। নামাজের আহকাম-আরকানে হানাফী ও মোহাম্মদীদের মধ্যে যেসব প্রভেদ আছে, তার মধ্যে মোহাম্মদীদের বুকের উপর তহরিমা বান্ধা ও রুকুতে-রুকুতে রফাদায়েন করাই প্রধান কারণ এই দুইটাই সহনামাজিদের এবং বাহিরের দর্শকদের চোখে পড়ে। অন্যসব প্রভেদ সাধারণ। দর্শকের চোখে পড়ে না। আরেকটি বড় তফাত যা চোখে পড়ে না কানে লাগে, সেটি হইল জোরে ‘আমিন’ বলা। কেরাত জোরে না পড়িলে জোরে আমি বলিত হয় না। সুতরাং জুম্মা ও রাতের নামাজ ছাড়া এ পার্থক্য ধরা পড়ে না। আমাদের জিলায় এবং পরে জানিতে পারি, সারা দেশেই, হানাফীর অনুপাতে মোহাম্মদীর সংখ্যা অনেক কম। আমাদের ছাত্রজীবনেই আমি হানাফী মোহাম্মদীতে অনেক বাহাস-মুবাহেসা ও ঝগড়া-বিবাদ দেখিয়াছি। সুতরাং উভয় সম্প্রদায়ে বিরোধ ছিল প্রচুর। এমন বিরোধ থাকিলে ছোট দলের লোক সাধারণত একটু আত্মগোপন করিয়া চলে। বড় জমাতে বা যেখানে-সেখানে তারা ধরা দেয় না। ধরা না দেওয়ার উপায়ও খুব কঠিন ছিল না। তহরিমা বাধার সময় হাত দুইটা ঠেলিয়া একেবারে বুকের উপর না তুলিয়া সামান্য নামাইয়া বাঁধিলেই গোলমাল চুকিয়া যায়। হানাফীদের নিয়ম দুই হাত নাভির নিচে বাঁধা। কিন্তু নাভির নিচে কি উপরে, সেটা কেউ আঙুলে মাপিয়া দেখে না। কাজেই পেটের উপর বা ভুড়িতে হাত দুইটা ফেলিয়া রাখিলেই হানাফী মতে তহরিমা বাধা হইল। আর রফাদায়েনটা হাতের কবজি ভাঙ্গিয়া ইশারায় করিলে অথবা একদম না করিলেই বা কী হইল? শান্তিপ্রিয় মোহাম্মদীদের তাই করা উচিৎ। সেকালে অনেকেই তা করিত। আমি নিজে অনেক মোহাম্মদীকে হানাফীদের জমাতে ঐভাবে আত্মগোপন করিতে দেখিয়াছি। ওরা যে শুধু আমার বয়সী শিশু ছিল, তা নয়। আমাদের জমাতের দুই-একজন মুনশী মৌলবীকেও ঐভাবে আত্মগোপন করিতে দেখিয়াছি। তারা যে উদার ছিলেন, তারা যে উভয় প্রকারের আহকাম-আরকানকে জায়েজ মনে করিতেন, তা নয়। নিজেদের মধ্যে জুম্মায় বা ঈদের জমাতে এবং সভা-সমিতিতে তাদের কেউ কেউ হানাফীদিগকে হিন্দু-সে বদতর’ বলিয়া গালিও দিতেন। এরাই যখন হানাফীদের মধ্যে পড়িয়া হানাফী মতে নামাজ পড়িয়া আত্মগোপন করিতেন, তখন আমার শিশুমনও বিদ্রোহী হইয়া উঠিত। আমি বুঝিতাম, ইনারা ভয়ে আত্মগোপন করিতেছেন। এটাকে আমি কাপুরুষ বলিয়া ঘৃণা করিতাম। এই ধরনের কোনও আলেমকে যখন আমাদের বাড়িতে হানাফীদেরে নিন্দা করিতে শুনিতাম, তখন প্রকাশ্যভাবে মৌলবী সাহেবের কুকীর্তির কথা বলিয়া দিতাম।

.

. আমার একগুঁয়েমি

কাজেই কোনও অবস্থাতেই কোনো জায়গাতেই আমি নিজের মোহাম্মদীগিরি গোপন করিতাম না। বরঞ্চ ওটা যাহির করাকে আমি গৌরবের বিষয় মনে করিতাম। নামাজে বুকের উপর তহরিমা বাঁধা, তহরিমা বাঁধার আগে কান পর্যন্ত হাত না তুলিয়া কাঁধ পর্যন্ত তোলা, জোরে ‘আমিন’ কওয়া, রুকুতে যাইতে-উঠিতে রফাদায়েন করা, প্রথম রেকাত হইতে দ্বিতীয় রেকাতে উঠিবার সময় সিজদা হইতে সোজা না উঠিয়া বসিয়া উঠা, চতুর্থ বা শেষ রেকাতে আত্তাহিয়াত পড়িবার সময় বাম পা ডান পায়ের নিচে দিয়া বাহির করিয়া দেওয়া, আত্তাহিয়াত পড়িবার সময় সারাক্ষণ শাহাদত আঙুল উঁচা করিয়া রাখা ইত্যাদি কোনও খুঁটিনাটিও বাদ দিতাম না। বরঞ্চ হানাফী সহনামাজিদেরে দেখাইবার জন্য তহরিমাটা অনাবশ্যকরূপে বুকের উপরের দিকে ঠেলিয়া দিতাম। ভাবটা যেন এই : দেখ ও হানাফীগণ, আমি মোহাম্মদী, তোমাদেরে আমি ডরাই না। যা করিতে পার কর। নিজের বাড়ির জমাতে আমি যতটা জোরে ‘আমিন’ বলিতাম, হানাফীদের জমাতে তার থনে জোরে বলিতাম। উদ্দেশ্য যেন হানাফীদের কানতালি লাগাইয়া দেওয়া।

এমন যখন আমার মোহাম্মদী তেজ, ঠিক সেই সময় আমি দরিরামপুর মাইনর স্কুলে ভর্তি হইলাম এবং দুই-একদিন বাদেই জুম্মার নামাজ পড়িতে মসজিদে গেলাম। ময়মনসিংহ ত্রিশালের পাকা রাস্তায় ত্রিশাল থানা বা দরিরামপুর হাই স্কুলে পৌঁছিবার একটু আগেই রাস্তার ডান দিকে যে পাকা এক গুম্বুজের মসজিদ দেখা যায় এইটিতেই তকালেও আমরা স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র জুম্মার নামাজ এমনকি অনেকে ওয়াকতিয়া নামাজও পড়িতাম। আসল মসজিদটি আকারে তেমন বড় না হইলেও সামনের সেহানটি খুবই কুশাদা। মসজিদের ভিতরে যত মুসল্লি ধরে, বারান্দায় ধরে তার তিন ডবল। স্কুলের হেডমৌলবী জনাব জহুরুল হক ও অন্যান্য শিক্ষক-মুদাররেসদের পিছনে পিছনে আমরা অনেক ছাত্র দল বাঁধিয়া মসজিদে আসিলাম। সামনের পুকুরে অযু করিয়া ছাত্ররা সকলে বারান্দায় দাঁড়াইলাম। শুধু মৌলবী সাহেবরা মসজিদের ভিতরে গেলেন। আর আর সাথীরা কে কোথায় দাঁড়াইল মনে নাই। কিন্তু আমরা দুই ভাই একসঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়াইলাম।

.

. প্রথম সংঘর্ষ

আমরা দুই ভাই পাক্কা মোহাম্মদী। সুতরাং বুকের উপর রাখিয়া তহরিমা বাঁধিয়াছি। এক-আধ রেকাত দাখিলুল-মসজিদ বা কাবলুল-জুম্মা বোধ হয় পড়িয়াও ফেলিয়াছি। এমন সময় একজন মোটা গলায় চিৎকার করিয়া বলিলেন : “এই বাচ্চারা, তোমরা কেমনে নামাজ পড়তেছ? তোমরা লা-মাযহাবী নাকি?’ কাকে কে এ কথা বলিতেছে, তা ভাবিবার সময় পাইলাম না। একটা লোক আসিয়া আমাদের দুই ভাইয়ের বুকে বাঁধা হাত টানিয়া নাভির নিচে নামাইয়া দিলেন। নামাজে দাঁড়াইয়া কথা বলিতে নাই। কাজেই আমরা কিছু বলিলাম না। কিন্তু লোকটি আমাদের হাত ছাড়িয়া দেওয়া মাত্র আমাদের দুই জোড়া হাত স্প্রিংয়ের মত পূর্বস্থানে বুকের উপরে উঠিয়া আসিল। লোকটি আবার আমাদের হাত নামাইয়া দিলেন। আবার আমাদের হাত উঠিয়া পড়িল।

শুনিলাম অপর দুই-একজন বলিল : ‘আহা, আপনে এটা কি করতেছেন? আমাদের আক্রমণকারী ভদ্রলোক বলিলেন : এরা লা-মযহাবী যে।

প্রতিবাদকারী বলিলেন : হোক না। ওদেরে দাখিলী সুন্নতটা শেষ করতে দেন। তারপর যা হয় বলেন।

আমরা বিনা বাধায় সুন্নত শেষ করিতে পারিলাম। কিন্তু সালাম ফেরান মাত্র লোকটি আমাদের সামনে আবার কুঁদিয়া আসিলেন। মনে হইল তিনি আমাদের দুই রেকাত দাখিলী নামাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ওত পাতিয়া পাশেই দাঁড়াইয়া ছিলেন। চিল্লাইয়া আমাদের মুখের সামনে মুষ্টিবদ্ধ হাত নাড়িয়া বলিতে লাগিলেন : তোমরা লা-মাযহাবী। তোমরা খারেজি। আমাদের মসজিদে ঢুকিয়া মসজিদ নাপাক করিয়াছ।

আমরা ভড়কাইয়া গিয়াছিলাম। কিন্তু আশেপাশের কিছু লোক আমাদের পক্ষে থাকিলেন। পক্ষে থাকিলেন মানে আমাদেরে সমর্থন করিলেন, তা নয়। ঐ লোকটি যাতে তাঁর মুষ্টিবদ্ধ হাত আমাদের গায়ে বসাইয়া দিতে না পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তারা আমাদের ঘিরিয়া রাখিলেন। হৈ-চৈয়ে নামাজের কাতার ভাঙ্গিয়া নামাজের জমাত জনতায় পরিণত হইল। মসজিদের ভিতর হইতে স্কুলের হেডমৌলবী ও মাদ্রাসার মুদাররেসরাও বাহির হইয়া আসিলেন। জনতার মধ্যেও আলেমে-আলেমে অনেক কথা কাটাকাটি হইল। আমাদের পরিচয় জানাজানি হইয়া গেল। দাদাজীর নাম অনেকেই জানিতেন। হেডমৌলবী সাহেবের মধ্যস্থতায় আমাদের বিনা বাধায় নামাজ পড়িতে দেওয়া হইল। আক্রমণকারী ভদ্রলোক ও তার সমর্থকেরা গোঁ গোঁৎ করিতে লাগিলেন। নামাজ শেষে হেডমৌলবী সাহেব ও অন্য মৌলবী সাহেবেরা আমাদেরে সাহস দিলেন এবং বরাবর নির্ভয়ে এই মসজিদে নামাজ পড়িতে আসিতে বলিলেন। আমরাও নির্ভয়েই সেখানে জুম্মার নামাজ পড়িতে লাগিলাম। এর পরেও আরো দুই-একবার আমাদেরে আক্রমণ করা হইয়াছে কিন্তু প্রতিবারই আক্রমণকারী ছিলেন নবাগত।

.

. মযহাবী-বিরোধের তকালীন রূপ

যে যুগের কথা আমি বলিতেছি, সে যুগে এমন ব্যবহার অন্যায়ও ছিল না। ব্যতিক্রম ছিল না। বরঞ্চ ঐটাই ছিল নিয়ম। তৎকালে হানাফী মোহাম্মদীর বিরোধ, বাহাসের সভা, সভা শেষে মারামারি এবং পরিণামে মামলা মোকদ্দমা ও জেল-জরিমানা ছিল সাধারণ ব্যাপার। আমার আয়না পুস্তকের ‘মোজাহিদিন’ গল্পটা নেহাত কাল্পনিক গল্প নয়। ঐ ধরনের বহু সভায় আমি নিজে গিয়াছি। চাচাজী এরই ধরনের বাহাসের নামে নাচিয়া উঠিতেন। উদ্যোগ-আয়োজন করিতেন। বাহাসের সভায় গিয়া আগের কাতারে বসিতেন। হানাফীদিগকে তর্কে হারাইবার উদ্দেশ্যে তিনি এ সম্পর্কে বেশ কিছু পুস্তকাদি কিনিয়াছিলেন। তার মধ্যে মওলানা আব্বাছ আলীর ফেফায়ে মোহাম্মদী ও মৌলবী এলাহী বখশের রদ্দে মোকাল্লেদিন ও দুরারায়ে মোহাম্মদী ইত্যাদির নাম আজও আমার মনে আছে। পক্ষান্তরে হানাফীদের বক্তব্য সম্বন্ধে ওয়াকেফহাল হইবার জন্য মওলানা রুহুল আমিন ও মৌলবী নঈমউদ্দিন সাহেবের রদ্দে গায়ের মোকাল্লেদিন ও রদ্দে লা-মযহাবী নামক পুস্তকও তিনি কিনিয়াছিলেন। তিনি হানাফীদের উপর এত বিরূপ ছিলেন যে তাঁদেরে বুঝাইতে গিয়া রাগের চোটে উর্দু বলিয়া ফেলিতেন। তিনি বলিতেন ‘হানাফীরা হিন্দো-সে বদতর হ্যায়। আমার মোজাহেদিন’ গল্পে উভয় পক্ষের যে সব তথাকথিত যুক্তির অবতারণা করিয়াছি, ও-সবই ঐ সময়কার বাহাসে দুই পক্ষের দেওয়া যুক্তি। যুক্তিগুলি খুবই লজিক্যাল এবং আমার এখনও মনে হয় উভয় পক্ষের কথার মধ্যেই আন্তরিকতা ছিল।

কাজেই দরিরামপুর মসজিদের কতিপয় মাতব্বর-মুসল্লি যে আমাকে হামলা করিয়াছিলেন এতে বিস্ময়েরও কিছু নাই, অন্যায়ও তারা করেন নাই। আমার মত লা-মযহাবীরা ঐ মসজিদে ঢুকিয়া উহা নাপাক করিয়াছি, এ কথা তারা ঈমানদার সাচ্চা হানাফী মুসলমান হিসাবেই বলিয়া ছিলেন। তাদের বিচারে হানাফীরাই একমাত্র খাঁটি মুসলমান। অ-হানাফীরা মুসলমানই নয়। হানাফী আলেমরা অবশ্য বলিতেন, চার মযহাবই বরহক, চারটার একটা মানিলেই সে মুসলমান হইল। কিন্তু হানাফী জনসাধারণ অতশত সূক্ষ্ম বিচারে যাইত না। অন্যতম মযহাবী দল শাফীরাও নামাজের খুঁটিনাটি আরকানে অবিকল মোহাম্মদীদের মত চলিলেও জনসাধারণ সে কথা বিচার করে না। মোট কথা, লা-মযহাবীদের নামাজ পড়া না-পড়া সমান। শুধু তা-ই নয় চাচাজীর বিচারে হানাফীরা হিন্দুদের আগেই দুযখে যাইবে। অনেক হানাফীর চোখে মোহাম্মদীদের কপালেও তাই আছে। অতএব নামাজ না পড়ো তাও ভাল, তবু অপর দলের মত পড়িও না। এ কথাটাও আমার কাল্পনিক কথা নয়। এমন ঘটনা অনেক ঘটিয়াছে। আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ সাহেবের মুখে শোনা গল্পটাই এখন নজিরস্বরূপ উল্লেখ করিতেছি। গল্পটা এই :

.

. করটিয়ার কাহিনী

বাংলার হাতেমতায়ী করটিয়ার স্বনামধন্য জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চান মিয়া) সাহেবের পিতা হাফেয মোহাম্মদ আলী সাহেব খুব কট্টর হানাফী ছিলেন। একদা তিনি খবর পাইলেন, তাঁর প্রজাদের মধ্যে একজন লা মহাবী আছেন। তাঁর নাম ইসমাইল মুনশী। তাঁর জমিদারির পুণ্য ভূমিতে লা-মযহাবী! অমনি ইসমাইল মুনশীর তলব হইল। ইসমাইল মুনশী আসিলেন। নকিব ফুকারিল : আসামি ইসমাইল মুনশী হাজির। মুনশী সাহেব দরবারে হাজির হইয়া কুর্নিশ করিলেন। হাফেয সাহেব সিংহাসন হইতে গর্জিয়া উঠিলেন : তোমার নাম ইসমাইল?

মুনশী সাহেব আরেকটা কুর্নিশ করিয়া বলিলেন : হাঁ হুযুর।

হফেয সাহেব : তুমি আমার প্রজা?

মুনশী : জি, হুযুর।

হাফেয সাহেব : তুমি নাকি লা-মাযহাবী?

মুনশী সাহেব চোখ কপালে তুলিয়া বলিলেন : লা-মযহাবী, ওটা কি চিজ, হুযুর?

হাফেয সাহেব লোকটার অজ্ঞতায় বিস্মিত হইয়া বলিলেন : লা-মযহাবী কারে কয় তাও জান না? আরে এই যে যারগো কয় মোহাম্মদী, তুমি কি মোহাম্মদী?

মুনশী সাহেব আরো বেআক্কেল বনিয়া গেলেন। বলিলেন : মোহাম্মদী কারে কয়, তা ত জানি না হুযুর।

হাফেয সাহেব এত বড় মূর্খকে লইয়া বিপদে পড়িলেন। বলিলেন : মোহাম্মদীও জান না? আহা এই যে যারগগা রফাদানী কওয়া হয়। তুমি কি রফাদানী?

মুনশী সাহেব কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন: রফাদানী? সে আবার কে? আমি জীবনে এর নামও ত শুনছি না, হুযুর।

হাফেয সাহেবের ধৈর্যচ্যুতি ঘটিল। তিনি বিরক্ত হইয়া শেষ চেষ্টা করিলেন। বলিলেন : রফাদানী চিন না? অই যে নামাজের মধ্যে দুই হাত এমন এমন কৈরা যারা মশা খেদায়।

হাফেয সাহেব নিজের দুহাত কাঁধ পর্যন্ত ঘন ঘন উঠাইয়া-নামাইয়া দেখাইলেন এবং বলিলেন : তুমি নামাজের মধ্যে এমন কৈরা হাত উঠাও নামাও?

মুনশী সাহেব যেন এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝিলেন। তিনি বলিলেন : নামাজের কথা কইতেছেন হুযুর। আমার চৌদ্দপুরুষে নামাজই পড়ি না হাত উঠামু কি?

হাফেয সাহেবের গম্ভীর রাগত মুখে এইবার হাসি ফুটিল। তিনি হাসি মুখে বলিলেন : ও তুমি নামাজই পড় না? ঠিক ত? কোনো দিন নামাজ পড় নাই?

মুনশী সাহেব মুখ পুছিয়া বলিলেন : না, হুযুর। হাফেয সাহেব : যাও, তুমি, খালাস।

কাহিনীটার কতখানি সত্য, আর কতখানি রং-ঢং লাগানো, তা জানিবার উপায় নাই। কিন্তু মোটামুটি সত্য এই যে হানাফী-মোহাম্মদী বিরোধ তৎকালে ঐ রকমই ছিল।

দরিরামপুরে ঐ ঘটনা ঘটার পর আমি সাবধান ত হইলামই না, বরঞ্চ আমার জিদ আরো বাড়িয়া গেল। মোহাম্মদী মতে নামাজ পড়া সহী হাদিস সেহা-সেত্তার হুকুম। সহী হাদিস মানেই পয়গম্বর সাহেবের কথা। সুতরাং ওটাই আল্লার কথা। মানুষের ডরে আল্লা-রসুলের হুকুম অমান্য করিব? আল্লাকে না ডরাইয়া মানুষকে ডরাইব? কিছুতেই না। এই মনোভাব লইয়া নিরাপদে দরিরামপুর ছাত্রজীবন কাটাইয়া দিলাম। কারণ গোড়াতে বাপ দাদার পরিচয় এবং শেষ পর্যন্ত নিজের জনপ্রিয়তা ছিল সেখানে আমার জোর। ঐ অঞ্চলের মাতব্বররা ও স্কুল কমিটির মেম্বররা সকলেই আমাকে পুত্রের স্নেহাদর দিয়াছিলেন। আমিও ওঁদের নিজের লোক হইয়া গিয়াছিলাম। কিন্তু ময়মনসিংহ শহরে সে সুবিধা ছিল না।

.

. ময়মনসিংহ শহরে সংঘর্ষ

১৯১৩ সালে ময়মনসিংহে আসিয়া আবার সেই বিপদে পড়িলাম। মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের আশেপাশে কোনো মসজিদ ছিল না। কাঁচারি মসজিদ এখনও হয় নাই। কাজেই ওয়াকতিয়া নামাজ পড়িতাম আমরা কাঁচারির শানবান্ধা ঘাটে। ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল রোড যেখানে আসিয়া ব্রহ্মপুত্র নদীর পাড়ে পড়িয়াছে ঠিক এইখানে নদীতে একটা বিশাল বাধান ঘাট ছিল। পাশে যেমন বড়; গভীরও তেমনি। একেবারে নদীর তলায় চলিয়া গিয়াছিল। ঘাটলাটি ছিল দুতলা। অর্থাৎ রাস্তা হইতে সাত-আট ধাপ নিচে নামিয়া সিঁড়ি অপেক্ষা পাশে ডবল বিশাল পাকা চত্বরে আসিতে হইত। এই চত্বরের দুই পাশে পুরাটা এবং অপর দুই পাশে সিঁড়ি বাদে বাকিটা পোড়াপিট ছিল। ঠিক যেন হেলানিয়া বেঞ্চি। এই চত্বর হইতে মূল ঘাট শুরু। অসংখ্য সিঁড়ির ধাপ পানির ভিতর ঢুকিয়া পড়িয়াছে। ঘাটের উপরেই একটা বিশাল বটগাছ। এই গাছটা ঘাটলা ঢাকা দিয়া বেশির ভাগই ছায়া-শীতল রাখিত। আজ সে ঘাটও নাই, বটগাছও নাই। যা হোক কাঁচারির লোকজন এ মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের নামাজি ছাত্ররা এখানেই যোহরের নামাজ পড়িতাম। কিন্তু জুম্মার নামাজ পড়িতে যাইতাম জিলা স্কুল মসজিদে। পরিচয়ের সুবিধার জন্য একে ঐ নামে ডাকা হইলেও জিলা স্কুলের সাথে এর কোনও সম্পর্ক নাই। জনগণের অর্থ সাহায্যে আজ এখানে তিন গুম্বুজের মসজিদ উঠিয়াছে বটে কিন্তু আমি যখনকার কথা বলিতেছি তখন এটি ছিল একটি ছোট্ট টিনের ঘর।

এই মসজিদে জুম্মা পড়িতে গিয়া প্রথম দিনই আমি বিপদে পড়িলাম। দাখিলুল মসজিদের দুই রেকাত নামাজও শেষ করিতে পারিলাম না। হৈ হৈ করিয়া দুই-তিন জন লোক আসিয়া আমাকে ঘেরিয়া একদম হেঁচকা টানে আমার তহরিমা বান্ধা হাত নামাইয়া দিল। চিল্লাইয়া বলিল : তুমি লা মাযহাবী? তোমার বাড়ি কই? কই থাক?

চার বছর আগের দরিরামপুরের ঘটনা মনে পড়িল। কিন্তু দুই-এর মধ্যে কত তফাত। সেটা ছিল বাড়ির কাছে। দুই ভাই ছিলাম। মৌলবী যহুরুল হক ছিলেন, আর বাপ-দাদাকে ওরা চিনিতেন। আর আজ? আমি একা বিদেশ বিভুই। চিনা-জানা কেউ নাই। ঘাবড়াইলাম। আল্লাকে ডাকিতে লাগিলাম।

আল্লাহ সাড়া দিলেন। একদল ছাত্রসহ একজন মাস্টার গোছের লোক ঢুকিলেন। ঢুকিয়াই ব্যাপার কী জিজ্ঞাসা করিলেন। আমার কিছু বলিতে হইল না। ওদের মুখের কথা শুনিয়াই লোকগুলিকে তিনি তম্বিহ করিতে লাগিলেন। ওদের মত সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক মনোভাবের লোকই মযহাবী বিবাদ বাধাইয়া মুসলমানদের ঐক্য নষ্ট করিতেছে; আসলে সব মযহাবই ঠিক ইত্যাদি বক্তৃতা করিলেন। কাতার ভাঙ্গিয়া মুসল্লিরা জনতায় পরিণত হইল। ভিতর হইতে মৌলবী গোছের অনেকে বাহির হইয়া আসিলেন। দেখিলাম, এই ভদ্রলোককে সবাই চিনেন। সবাই খাতির করেন। তাঁর কথায় প্রায় সবাই সায় দিলেন। আমার আততায়ী তিনজনকে এতক্ষণ যাঁরা সমর্থন করিতেছিলেন, তাঁরাও ঘুরিয়া দাঁড়াইলেন। সবাই মিলিয়া ওদেরে বকিতে লাগিলেন। ভদ্রলোকের কত প্রভাব! এক মুহূর্তে সব ওলট-পালট করিয়া দিলেন।

এতক্ষণে ভদ্রলোক আমার দিকে স্নেহ-ভরা দৃষ্টিতে চাহিলেন। হাত ধরিয়া টানিয়া আমাকে নিজের পাশে দাঁড় করাইলেন। নিজের নামাজ শুরু করিলেন। তার নিরাপদ পাশে দাঁড়াইয়া আমি নির্ভয়ে স্বাধীনভাবে নামাজ পড়িলাম। ইচ্ছার বিরুদ্ধে মনে মনে সারাক্ষণ আমি আল্লার চেয়ে বেশি কৃতজ্ঞতা জানাইলাম এই ভদ্রলোককে।

নামাজ শেষে ভদ্রলোক আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি পরম বিনয়ের সাথে পরিচয় দিলাম। তারও পরিচয় পাইলাম। তিনি জিলা স্কুলের শিক্ষক মৌ. শেখ আবদুল মজিদ। তার নাম আমি আগে হইতেই জানিতাম। তিনি সাহিত্যিক। শিক্ষা প্রচার বা এই গোছের নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করিতেন তিনি। সারা শহরের মুসলিম ছাত্রদের তিনি ছিলেন প্রিয় ‘মজিদ সার’। মুসল্লিদের উপর প্রভাবের কারণও বুঝিলাম। সারা জিলার মুসলমানদের একচ্ছত্র নেতা উকিল পাবলিক প্রসিকিউটর (পরে খান বাহাদুর) মৌ. মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেবের প্রিয় সহচর ছিলেন এই মজিদ স্যার। যে স্কুলেরই ছাত্র হউক, মুসলমান ছেলেরা তাঁকে এক ডাকে চিনিত। সবাই তাকে মান্য করিত এবং ভালবাসিত।

অল্পদিন মধ্যেই আমিও তার একজন ভক্ত অনুচর হইলাম। সাহিত্য সেবায় তাঁর প্রেরণা পাইয়াছিলাম অনেকখানি ত বটেই মযহাবী উদারতাও শিখিয়াছিলাম নিশ্চয়ই। কারণ কিছুদিন মধ্যেই আমি বুঝিতে পারিলাম মজিদ সারের উদারতা ও মহানুভবতার খাতিরেই বোধ হয় তহরিমা বাঁধিবার সময় হাত দুইটা বুকের উপর অতিরিক্ত মাত্রায় ঠেলিয়া উঁচায় তুলিতে গিয়া কেমন যেন বাধ-বাধ ঠেকিত। মজিদ সারের উদার হাসিমাখা মুখ আমার চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিত। হাত দুইটা যেন অবশ হইয়া বুক হইতে ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামিয়া আসিত।

.

১০. দাদাজীর উদারতা

এর পরেও মজিদ সারের উদারতা ও তার কথাগুলি আমার বুকে খোঁচাইয়া চলিল। এই মযহাবী কলহ মুসলমানদের আত্মঘাতী অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং এটাতে মুসলমানরা দুর্বল হইতেছে; মজিদ সারের এই কথাটা কি সত্য নয়? চিন্তা করিতে লাগিলাম। এত দিনে মনে পড়িল দাদাজীর মুখেও যেন এই ধরনের কথা শুনিয়াছি। দাদাজী উম্মী মানুষ, লেখা-পড়া জানিতেন না। কিন্তু তিনি জ্ঞানী ছিলেন। অনেক আলেম-ওলামা ও শিক্ষিত লোকও দাদাজীর জ্ঞান বুদ্ধির তারিফ করিতেন এবং জটিল-জটিল প্রশ্নে দাদাজীর উপদেশ মানিয়া চলিতেন। মজিদ সারের মত শিক্ষিতের ভাষায় ঐ সব কথা তিনি নিশ্চিয়ই বলেন নাই। কিন্তু তিনি যা বলিতেন মজিদ সারের কথার সাথে অর্থের দিক দিয়া তার আশ্চর্য মিল আছে। কথা ছাড়াও কাজে-কর্মে দাদাজী আশ্চর্য রকম উদার ছিলেন। দাদাজীও পাক্কা মোহাম্মদী ছিলেন বটে, কিন্তু আমাদের বাড়িতে হানাফী মযহাবের বড় কোনও আলেম আসিলে তাকে জুম্মার বা ঈদের নামাজে এমামতি করিতে দিতেন। চাচাজী এতে ঘোরতর অসন্তুষ্ট হইতেন। কিন্তু দাদাজী তাঁর মত অগ্রাহ্য করিতেন। শুধু শর্ত করিতেন, হানাফী মওলানা সাহেবকে কয়েকটি ব্যাপারে মোহাম্মদী মতে নামাজ পড়াইতে হইবে শুধু মুকতাদীদের সুবিধার জন্য। যথা : সুরা ফাতেহার শেষে কেরাত শুরু করিবার আগে মুকতাদীদেরে ‘আমিন’ বলিবার সময় দিয়া অল্প দম নিতে হইবে। প্রথম রেকাত হইতে দ্বিতীয় রেকাতে উঠিবার সময় বসিয়া লইতে হইবে। ঈদের জমাতে মোহাম্মদীদের মত সাত ও পাঁচ তকবির পড়িতে হইবে। ব্যস আর কিছু না। দাদাজী স্পষ্টই বলিতেন, ঐরূপ না করিলে মুকতাদীরা অসুবিধায় পড়িবে। মুকতাদীদের অসুবিধা না হয় এমনভাবে উক্ত হানাফী মওলানা সাহেব সব আরকান হানাফী মতেই পালন করিতে পারেন। যথা : বুকের উপর হাত না বাধিয়া নাভির নিচে বাঁধা এবং রফাদায়েন না করা। এমাম এটা করিলেন কিনা, তাতে মুকতাদীদের কিছু আসে যায় না।

দাদাজীর এই উদারতার জন্য হানাফী আলেমরাও দেশে-বিদেশে দাদাজীর নাম করিতেন। অবশ্য গোঁড়া মোহাম্মদীদের কেউ কেউ বলিতেন যে দাদাজী তাঁর এক হানাফী ভাগিনা মৌলবী লোকমান আলী সাহেবের খাতিরে ও প্রভাবে এইরূপ উদারতা দেখাইতেন।

সেটা ঠিক কিনা বলা যায় না। কিন্তু মৌলবী লোকমান আলী সাহেবও, যখন আমাদের জুম্মার এমামতি করিতেন, তখন মোহাম্মদী আরকানই মানিয়া চলিতেন। এমনকি, কট্টর হানাফী হইয়াও মৌ. লোকমান আলী আমাদের ঈদের মাঠে এমামতি করিতে গিয়া বার তকবিরে নামাজ পড়াইতেন।

.

১১. গোঁড়ামি ও আদব-লেহায

আরেকটা ব্যাপারে দাদাজীর উদারতা দেখিয়া ছেলেবেলা রাগ করিতাম, একটু বড় হইয়া গৌরব করিতাম ও অনুসরণ করিতাম। ভিন গাঁয়ে একদিন হানাফী আত্মীয় বাড়িতে আমাদের বাড়ির সকলেই দাওয়াত খাইতে গিয়াছিলাম। যিয়াফতটা বোধ হয় লিল্লার যিয়াফত ছিল। বোধ হয় সেই জন্যই খাওয়ার আগে মিলাদের মহফিল হইল। যথারীতি মিলাদ পড়া হইল। যথাসময়ে সকলে কেয়ামে দাঁড়াইয়া উঠিলেন। কেয়াম করাকে মোহাম্মদীরা কবিরা গোনাহ, অনেক শেরক মনে করিয়া থাকেন। প্রধানত এই কেয়ামের জন্যই মোহাম্মদীরা মিলাদের বিরোধী। অথচ দাদাজী সকলের সাথে সাথে কেয়ামে দাঁড়াইলেন এবং পাশে বসা আমাকেও হাত ধরিয়া টানিয়া খাড়া করিলেন। অদূরে বসা চাচাজী নিরুদ্বেগে বসিয়া রহিলেন।

যিয়াফত হইতে ফিরিবার পথে এই লইয়া দাদাজী ও চাচাজীর মধ্যে কথা-কাটাকাটি হইয়াছিল। তার সব কথা আমার মনে নাই। কিন্তু দাদাজীর একটা কথা আজও আমার কানে বাজিতেছে। দাদাজী বলিয়াছিলেন : অন্য কারণে না হউক, আদবের খাতিরে দাঁড়ান উচিৎ। কোনও মজলিসে সবাই যখন দাঁড়াইল তখন এক-আধজনের বসিয়া থাকা বেয়াদবি।

দাদাজীর এই ধরনের উদারতার অর্থ মজিদ সারের সাথে মিশিবার পর আমার কাছে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হইয়া উঠিল। আমি দ্বিধা-সন্দেহের মাঝে কাল কাটাইতে লাগিলাম। মজিদ সারের সংসর্গ ও আমাদের হোস্টেলের পরিবেশ আমাকে ক্রমে উদার করিয়া তুলিল। আমাদের হোস্টেলে সুপার ছিলেন তৎসময়ের জিলা স্কুলের হেডমৌলবী মৌ. আলী নেওয়াজ সাহেব। তিনি মযহাবী কলহের বিরোধী ছিলেন। তা ছাড়া আঞ্জুমনে ওলামায়ে বাঙ্গলার দুইজন খ্যাতনামা আলেম আমাদের হোস্টেলে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করিয়াছিলেন। একজন মওলানা খোন্দকার আহমদ আলী আকালুবী, অপরজন মওলানা মযাফফর উদ্দিন আহমদ। মওলানা মাফর উদ্দিনের বাড়ি ছিল ঢাকায়। তিনি আঞ্জুমনের প্রচার উপলক্ষে ময়মনসিংহ আসিলে আমাদের হোস্টেলে মেহমান হইতেন। আর মওলানা আকালুবী সাহেব ময়মনসিংহ জিলার লোক। তার সাতটি শ্যালক এক সঙ্গে এই হোস্টেলে থাকিতেন। তার মধ্যে একজন পরবর্তীকালে হাইকোর্টের জজ হইয়াছিলেন। তিনি ছিলেন জাসটিস বদিউজ্জামান। যা হোক সাত শালার খাতিরেই হউক আর আঞ্জুমনের প্রচার উপলক্ষেই হউক তিনি প্রায়ই আমাদের হোস্টেলে আসিতেন। মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও মওলানা মো. আকরম খাঁ প্রভৃতি যারা আঞ্জুমনে ওলামার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন, মওলানা আকালুবী ছিলেন তাঁদের অন্যতম। হানাফী-মোহাম্মদী মযহাবী কলহ দূর করা ছিল এই আঞ্জুমনের অন্যতম উদ্দেশ্য। মওলানা আকালুবী সাহেবের নাম আমরা অনেকেই আগে হইতে জানিতাম। তাঁর শুভ জাগরণ নামক কাব্যগ্রন্থ রাজদ্রোহ অপরাধে বাযেয়াফত হওয়ায় ইতিমধ্যেই তার নাম দেশময় ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। সুবক্তা হিসাবেও তাঁর খুবই খ্যাতি ছিল। তাকে চোখে দেখিয়া আরো খুশি হইলাম। দুধে আলতা গৌরবর্ণ সুডৌল চেহারা মুখ ভরা বিরাট চাপ দাড়ি, হাসি-মুখ, মিষ্ট ভাষা আমাদের সবাইকে মুগ্ধ করিল। তিনি ইসলামের সৌন্দর্য বুঝাইতে গিয়া প্রসঙ্গক্রমে মযহাবী বিরোধের অযৌক্তিকতা আমাদেরে বুঝাইয়া দিলেন। তিনি নিজে মোহাম্মদী। কিন্তু তার শ্যালকরা হানাফী এই খাতিরে তিনি উদারতা প্রচার করিতেছেন বলিয়া আড়ালে সিনিয়র ছাত্ররা হাসি-তামাশা করিলেও তার যুক্তিগুলির অকাট্যতা সকলেই স্বীকার করিতেন। ফলে আমাদের হোস্টেলের ভিতরে হানাফী-মোহাম্মদী মত-বিরোধটা আস্তে আস্তে নিভিয়া গেল। তার ফলে আমার মনেও উদারতা দেখা দিল। না দিলে চলে না। কারণ সবাই উদার। আমি একা অনুদার থাকিলে কেমন দেখায়?

.

১২. মযহাবী সংকীর্ণতা মরিয়াও মরে না

আমাদের জিলায় এই মযহাবী সংকীর্ণতা কতটা কায়েমী মোকরররী হইয়াছিল, তার প্রমাণ পাইয়াছিলাম উপরোক্ত ঘটনার পঁচিশ বছর পরে ১৯৩৭ সালে। তখন কৃষক-প্রজা আন্দোলন খুব জনপ্রিয়। ময়মনসিংহ জিলা কৃষক-প্রজা সমিতি সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। আমি এই সমিতির সেক্রেটারি। জিলার প্রজা আন্দোলনের আমি নেতা। বাংলা আইন পরিষদের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ মার্টির বিরুদ্ধে নির্বাচন যুদ্ধ করিতেছি। খান বাহাদুর শরফুদ্দীন, খান বাহাদুর নূরুল আমিন প্রভৃতি বড় বড় নেতা আমাদের বিরুদ্ধ পক্ষ। গরীব কৃষক প্রজা-কর্মী লইয়া এই সব ধনী ও ক্ষমতাশালী লোকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতেছি। আমি জিলার কৃষক প্রজা পার্টির নেতা বলিয়া লীগ পার্টির সোজাসুজি আক্রমণটা আমারই বিরুদ্ধে। আমার আয়নার অনেক কপি লীগ পার্টি হইতে ক্রয় করিয়া মুসলমানদের মধ্যে বিশেষত আলেম ও পীরদের মধ্যে বিতরণ করিয়া আমাকে মুসলমান ভোটারদের কাছে অপ্রিয় করা এবং তাতে পরোক্ষভাবে কৃষক প্রজা পার্টিকে দুর্বল করাই উদ্দেশ্য। কৃষক প্রজা পার্টির কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে বহু আলেম-ওলামা ছিলেন। তাহারা স্বভাবত আমার জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ রাখিবার চেষ্টা করিতেন। এটা করিতে গিয়া আমাকে তারা পাক্কা মুসলমান বলিয়া চিত্রিত করিতেন এবং আয়নার লেখাগুলির ব্যাখ্যা করিয়া নির্দোষ প্রমাণ করিতেন। কিন্তু একটা ব্যাপারে তারা লা-জবাব হইতেন। আমি তখন ঘোরতর বেনামাজি ছিলাম। ঘোরতর বেনামাজি মানে আমি সভা সমিতিতেও নামাজ পড়িতাম না। বাড়িতে নামাজ পড় আর না পড় সভা সমিতিতে বিশেষত ইলেকশনী সভায় পলিটিক্যাল নামাজ পড়া পলিটিশিয়ানদের চিরদিনের নীতি। অন্তত এই কাজ করিতে আলেম বন্ধুরা অনেক দিন আমাকে পীড়াপীড়ি করিয়াছেন। আল্লার ডরেই যখন পড়ি না, তখন মানুষের ডরে পড়িব? এই বলিয়া অনেকবার মৌলবী সাহেবদেরে নিরস্ত করিলাম।

কিন্তু নান্দাইল থানার এক সভায় তা পারিলাম না। এখানে সংগ্রাম বড় কঠিন। মুসলিম লীগ প্রার্থী ডিবি চেয়ারম্যান খান বাহাদুর নূরুল আমিন। আর তার মোকাবিলায় আমাদের প্রার্থী গরীব প্রাইমারী মকতবের শিক্ষক আবদুল ওয়াহেদ বোকাইনগরী। সেদিনকার মিটিংটা হইবে নূরুল আমিন সাহেবের হোম থানা নান্দাইলের আলেম-প্রধান জায়গা শাহগঞ্জে। এই অঞ্চলের কৃষক প্রজা আন্দোলনের প্রধান নেতা মওলানা বোরহান উদ্দিন কামালপুরী আমাকে আগেই জানাইয়াছিলেন, এই একটি গ্রামেই ত্রিশজনের বেশি মাদ্রাসা-পাশ ও দেওবন্দ-পাশ মওলানা আছেন। এঁরা যেদিক সমর্থন করিবেন, নির্বাচনে তাদের জিত অবধারিত। এই মিটিংয়ের উদ্যোক্তারাও সকলেই মৌলবী-মওলানা। কাজেই এঁরা আগেই আমাকে বলিয়া রাখিয়াছিলেন, এখানকার সভায় আমাকে নামাজ পড়িতেই হইবে। নইলে নির্বাচনে আমাদের চান্স অন্ধকার।

উদ্যোক্তা মওলানা সাহেবরা আমার সম্মতির অপেক্ষা করা নিরাপদ মনে করেন নাই। আমার শাসনভার তাঁরা নিজেদের হাতেই নিয়াছিলেন। সভাস্থলে আসরের আওয়াল ওয়াকতে পৌঁছিলাম। গিয়াই দেখিলাম সভামঞ্চের অদূরে আমার অযুর জন্য এক বদনা পানি, একটা জলচৌকি ও একখানা তোয়ালিয়া রাখা হইয়াছে। প্রধান উদ্যোক্তা মওলানা সাহেবের দিকে চাহিলাম। তিনিও হাসিলেন, আমিও হাসিলাম। চোখ ইশারায় জানাজানি হইয়া গেল, আজ আর ছাড়াছাড়ি নাই। কোনও অজুহাতেরই সম্ভাবনা বা ঘেঁদা রাখা হয় নাই। তখন মোটামুটি জনতা বেশ বড় হইয়াছে। কজন আযান দিতে লাগিলেন। তিনজন মওলানা আমাকে অযু করিতে বলিয়া ঘাড়ের উপর দাঁড়াইয়া থাকিলেন যেন আমি ফাঁক পাইলেই পালাইব। আমি মোহাম্মদী কায়দায় ধীরে ধীরে অযু করিতে লাগিলাম। তাতে বেশ দেরি হইতে লাগিল। ওদিকে নামাজের কাতার খাড়া হইয়া গেল। ঐ অঞ্চলের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বজ্যেষ্ঠ আলেম এমামরূপে দাঁড়াইয়া গেলেন। আমার পাহারা-বন্ধুদের তিন-চারটা তাগাদায় আমি অবশেষে যখন অযু শেষ করিলাম, তখন নামাজ শুরু হইয়া গিয়াছে। আমরা সকলের পিছনের কাতারে দাঁড়াইলাম। মওলানা বন্ধুরা আমার দুই পাশে দাঁড়াইলেন আমি যাতে কাতার হইতে ভাগিয়া না যাই। আমি পাক্কা মোহাম্মদী কায়দায় দুই পা ফাঁক করিয়া দাঁড়াইলাম। দুই হাত চিৎ করিয়া কাঁধ পর্যন্ত তুলিলাম এবং সিনা টান। করিয়া বুকের উপর তহরিমা বাধিলাম। আর কথা নাই! দুই পাশের দুই আলেম বন্ধু নিজেরা নিয়ত ছাড়িয়া দিলেন। আমার তহরিমা বাঁধা হাত দুইটা সজোরে টানিয়া খুলিয়া ফেলিলেন এবং আমাকে টানিয়া পার্শ্ববর্তী ঝোঁপের একটা গাছতলায় নিয়া আসিলেন। হাঁপাইতে-হপাইতে বলিলেন : আপনে যে ও জিনিস, তা জানিতাম না। আপনার আর নামাজ পড়িবার দরকার নাই। এইখানে বসিয়া আপনি বিড়ি খাইতে থাকেন। আমরা একটা অজুহাত দিয়া দিব।

তাঁরা নিশ্চয়ই ভাল অজুহাত দিয়াছিলেন। কেউ আমার নামাজ না পড়ার খোঁজও করিলেন না। খুব ভাল ও সফল মিটিং হইল। আমার বক্তৃতা খুব জমিল। মগরেবের পরেও অনেকক্ষণ বক্তৃতা করিলাম। মগরেবের নামাজও আমার পড়িতে হইল না।

.

১৩. আমার জবাব

সভা তুখার জমিয়াছিল। আমার বক্তৃতাও খুব জোরদার হইয়াছিল। প্রমাণ, নির্বাচনে ঐ অঞ্চলে ভোট অনেক বেশি পাইয়াছিলাম। যা হোক, সভা শেষে মওলানা সাহেবরা আমাকে স্টেশন পর্যন্ত আগাইয়া দিতে আসিলেন এবং আমার টিকেটসহ নিজেদেরও টিকেট কাটিলেন। ময়মনসিংহ শহরে আমার বাসা পর্যন্ত আসিলেন। সারা রাস্তায় একটা কথাও বলিলেন না।

অত রাত্রে চারজন মেহমানের খানা বাসায় ছিল না। কাজেই বিবি সাহেব আমাদেরে চা দিয়া রান্নায় লাগিলেন। চা খাওয়া শেষ হইল। আমি হুঁক্কা টানিতে লাগিলাম। মওলানা সাহেবরা যেন কত বড় গোপন কথা বলিতেছেন, এমনিভাবে অত রাত্রেও একবার দরজার দিকে একবার জানালার দিকে চাহিলেন। তারপর একাধিকবার গলা কাশিয়া একজন বলিলেন : উকিল সাহেব, আমাদের বে-আদবি মাফ করিবেন, কিছু মনে করিবেন না। আপনার মত এক বড় জ্ঞানী-গুণী, এত বড় সাহিত্যিক, জনসাধারণের এত বড় নেতা লা-মযহাবী, এটা যে আমরা কিছুতেই বিশ্বাস করিতে পারিতেছি না।

আমি এক-এক করিয়া সকলের মুখের দিকেই তাকাইলাম। সত্যই ভদ্রলোকদের মুখে বিষাদের ছায়া। কত বড় ব্যথাই না তাঁরা পাইয়াছেন। আমিও তাদের বিষাদের অনুকরণে মুখ বিষণ্ণ করিয়া বলিলাম : আপনাদের চোখকে অবিশ্বাস করিবার কোনও কারণ নাই। আমি সত্যই লা-মযহাবী। এতে কি আমার প্রতি আপনাদের আস্থা কমিয়া গেল? আমার কথা বাদ দেন, কৃষক-প্রজা আন্দোলনের প্রতি আপনাদের দরদ এর পরেও থাকিবে ত? আমার অপরাধে আপনারা কৃষক প্রজা পার্টি ছাড়িবেন না ত?

ভদ্রলোকেরা তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে পারিলেন না। প্রায় মিনিটখানেক পরে তাঁদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় জন খুব গোছাইয়া মিষ্টি ভাষায় বলিলেন : আমাদের জন্য চিন্তা করিবেন না। আমরা অতটা ফ্যানাটিক নই। কিন্তু এটা জানাজানি হইয়া গেলে ত আর রক্ষা থাকিবে না।

আমিও সমান উদ্বেগ দেখাইয়া বলিলাম : এখন উপায় কী?

ভদ্রলোকেরা কোনও জবাব দিলেন না। একদৃষ্টে করুণ চোখে আমার দিকে চাহিয়া রহিলেন। অগত্যা আমি বলিলাম : এর মাত্র দুইটা উপায় আছে। একটা, আমার মোহাম্মদী মযহাব ছাড়িয়া হানাফী মাযহাব এখতিয়ার করা। এটা আমি পারি না। কারণ আমি বিশ্বাস করি, পৈতৃক ধর্মই মানুষের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ধর্মের খুঁটি। এটাকে নৌকার নঙ্গর বলিতে পারেন। ইংরাজিতে এটাকে মুরিং বলা হয়। এই খুঁটি একবার ফসকাইলে কোনও ধর্মের ঘাটেই আপনি স্থায়ী হইতে পারিবেন না। যে পৈতৃক হানাফী মত ছাড়িয়া মোহাম্মদী বা মোহাম্মদী মত ছাড়িয়া হানাফী হইতে পারে সে ইসলাম ছাড়িয়া খৃষ্টধর্ম, খৃষ্টধর্ম ছাড়িয়া বৌদ্ধধর্ম এবং সব ধর্ম ছাড়িয়া মানবধর্মও গ্রহণ করিতে পারেন। তার চেয়ে বরঞ্চ আল্লা আপনারে যে ধর্মে সৃষ্টি করিয়াছেন, সেই ধর্মে থাকিয়াই ধর্ম সাধনা করুন না। আল্লা আপনাকে খারাপ জায়গায় পয়দা করিয়াছেন, আল্লার প্রতি এই অবিশ্বাস কেন হইবে আপনার? তিনি কি ভুল করিতে পারেন? তিনি যে আলেম-উল-গায়েব, তিনি যে অন্তর্যামী। তিনি যে দেশে যে ধর্মে আপনারে পয়দা করিয়াছেন, সেখানেই আপনার কর্তব্যও রাখিয়াছেন। এটা আমি বিশ্বাস করি। কাজেই ভাই সাহেবান, আপনারা বুঝতেছেন, আমার পক্ষে বাপের মযহাব ছাড়া সম্ভব নয়। কাজেই আমি দ্বিতীয় উপায় অবলম্বন করিয়াছি। এই জিলার পঞ্চাশ লক্ষ মুসলমান কৃষক-প্রজার মধ্যে চল্লিশ লক্ষই হানাফী। আপনারা বলিয়াছেন, কৃষক-প্রজা আন্দোলনের নেতা লা-মযহাবী, এটা জানাজানি হইয়া গেলে আর রক্ষা থাকিবে না। তাই আল্লার সাথে আমার একটা ফয়সলা হইয়া গিয়াছে। আমি নামাজ পড়িলে কৃষক-প্রজা আন্দোলনের, তার মানে এ জিলার পঞ্চাশ লক্ষ, তথা বাংলার চার কোটি কৃষক-প্রজার মুক্তির আন্দোলনে ব্যাঘাত হইবে। অতএব আল্লার অনুমতি লইয়া আমি ঠিক করছি আমি নামাজ না পড়িয়া দুখেই যাব। নিজের একার বেহেশতের জন্য কোটি কোটি লোকের অনিষ্ট হইতে দিব না।

মওলানা সাহেবদের সবারই চোখ পানিতে ছলছল করিয়া উঠিল, আমারও। একজন চেয়ার ছাড়িয়া আমার দিকে আগাইলেন। আমার পায়ের দিকে হাত বাড়াইলেন। আমি পা সরাইয়া নিলাম। তিনি কদমবুছির ভঙ্গিতে নিজের মুখে বুকে হাত লাগাইয়া বলিলেন : আপনে পীর-মুর্শেদ, আপনের বাতেনি নামাজ আল্লার দরবারে কবুল হইয়া গিয়াছে। যাহেরি নামাজের আপনের দরকার নাই।

আমি সবিনয়ে বলিলাম : আমার সম্বন্ধে মুবালেগা করিয়া আমারে আরো বেশি গোনাগার করিবেন না। শুধু দোওয়া করিবেন, আল্লাহ যেন আমার ঈমান শক্ত রাখেন।

মওলানা সাহেবরা সত্য-সত্যই হাত উঠাইয়া দোওয়া করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *