০৬. উচ্চশিক্ষা–ঢাকা শহরে

অধ্যায় ছয় – উচ্চশিক্ষা–ঢাকা শহরে

১. জগন্নাথ কলেজে

১৯১৭ সালে ম্যাট্রিক পাশ করিয়াই কলেজে পড়িবার জন্য ঢাকা আসিলাম। ইচ্ছা ছিল ঢাকা কলেজে পড়িব। কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হইল। ময়মনসিংহ আসিয়া যেমন জিলা স্কুলে সিট না পাইয়া মৃত্যুঞ্জয়ে ভর্তি হইয়াছিলাম, ঢাকায় আসিয়া তেমনি ঢাকা কলেজে সিট না পাইয়া জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হইলাম। তৎকালে প্রথম বিভাগ দ্বিতীয় বিভাগের কোনও মারামারি ছিল না। যে আগে আসিত, সেই ভর্তি হইতে পারিত। ময়মনসিংহের মত ঢাকা আসার সময়েও আমার দেরি হইয়া গিয়াছিল। কাজেই আমার বরাতে জুটিল জগন্নাথ কলেজ।

ছাত্রসংখ্যার দিক দিয়া মৃত্যুঞ্জয় স্কুল যেমন ছিল জিলা স্কুলের পাঁচ গুণ বড়, জগন্নাথ কলেজও তেমনি ঢাকা কলেজের তুলনায় পাঁচ না হইলেও তিন গুণ বড়। অধ্যাপকের দিক দিয়াও তৎকালে ঢাকা কলেজের তুলনায় জগন্নাথ কলেজ হীন ছিল না। ঢাকা কলেজে যদিও তৎকালে মি. টার্নারের মত ইংরাজ প্রিন্সিপাল ছিলেন তবু জগন্নাথ কলেজের প্রিন্সিপালও কম ছিলেন না। প্রফেসর ললিত কুমার চ্যাটার্জির মত দেশবিখ্যাত শিক্ষাবিদ জগন্নাথ কলেজের প্রিন্সিপাল। ইনি আবার স্যার আশুতোষের জামাই। এটাও জগন্নাথ কলেজের একটা গৌরবের বিষয়। তৎকালে স্যার আশুতোষ মুখার্জি কলিকাতা হাইকোর্টের জজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। আমি জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হইবার কয়েক মাস পরেই স্যাডলার কমিশন (মানে, ঢাকা ইউনিভার্সিটি কমিশন) ঢাকায় আসে। এই কমিশনের অন্যতম মেম্বর ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখার্জি। তিনি কমিশনের মেম্বর হিসাবে জগন্নাথ কলেজ পরিদর্শন করিলেন। আমাদের ক্লাসে গেলেন। জামাইর বাসায় খাওয়া-দাওয়া ও কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিলেন। এই সুযোগে আমরা স্যার আশুতোষের মত দেশবিখ্যাত বড়লোককে কাছে দাঁড়াইয়া দেখিবার সৌভাগ্য লাভ করিলাম। তা ছাড়া স্যার আশুতোষের পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি আমাদের সঙ্গে একই সময়ে ম্যাট্রিক পাশ করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিছুদিন পরে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ভগিনীর বাড়িতে বেড়াইতে আসেন এবং কয়েক দিন থাকেন। এই উপলক্ষে তিনি তার ভাগিনা মনোরঞ্জন চ্যাটার্জির সাথে আমাদের কলেজে মাঝে মাঝে বেড়াইতে আসিতেন। প্রিন্সিপাল ললিত চ্যাটার্জির ছেলে মনোরঞ্জন চ্যাটার্জিও আমাদের ক্লাসের নামকরা ছাত্র ছিলেন। তার দৌলতে আমরা এই সময় শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে পরিচিত হইবার সৌভাগ্য লাভ করি। আমাদের প্রিন্সিপালের শালা আর আশুতোষ মুখার্জির পুত্র এবং ম্যাট্রিকে ফার্স্ট স্ট্যান্ড করা ছাত্র শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং তার সাথে মুখোমুখি আলাপ করা তৎকালে পরম। সৌভাগ্যের বিষয় ছিল। ঢাকা কলেজের আমার যেসব বন্ধু তাদের কলেজের। তুলনায় জগন্নাথ কলেজকে হেয়প্রতিপন্ন করিতে চাহিত, তাদেরে এই সব দৃষ্টান্ত দিয়া জব্দ করিতাম। তা ছাড়া জগন্নাথ কলেজে ভাল ভাল প্রফেসারও পাইয়াছিলাম। তাঁদের মধ্যে ইংরাজির অধ্যাপক বাবু সতীশ চন্দ্র সরকার ও দর্শনের অধ্যাপক বাবু উমেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য আমার জীবনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করিয়াছিলেন। যথাস্থানে তাদের কথা বলিব।

.

. যায়গীর–হাকিম সাহেবের বাড়িতে

আগেই বলিয়াছি কিছুদিন আগে হইতেই আমাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ। হইয়া যায়। পনের-বিশ টাকা স্কলারশিপ পাইয়া আইএ পড়িব বলিয়া যে স্বপ্ন দেখিতেছিলাম পাঁচ টাকা স্কলারশিপ পাওয়ায় সে স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। কাজেই হোস্টেলে থাকিয়া লেখাপড়ার আশা ত্যাগ করিলাম। শামসুদ্দিনের পিতা জনাব সাহেদুল্লাহ মণ্ডল সাহেব ও গাঁয়ের অন্যতম প্রধান মাতব্বর জনাব ওসমান আলী সরকার সাহেবের মধ্যস্থতায় ঢাকা চকবাজার চুড়িহাট্টার হাকিম আরশাদ আলী সাহেবের বাড়িতে আমার যায়গীরের ব্যবস্থা হইল। হাকিম সাহেবের বাড়িতে আমার থাকিবার মত অতিরিক্ত ঘর ছিল না। কাজেই হাকিম সাহেবের বাড়ির কাছের চুড়িহাট্টা মসজিদের ইমাম সাহেবের হুজরা-সংলগ্ন রুমে আমার থাকার ব্যবস্থা হইল। তিনজনকে আমি পড়াইতাম। তিনটি ছেলেই অতিশয় ভদ্র, বিনয়ী ও ভাল ছাত্র ছিল। তাদেরে পড়াইতে আমার বিশেষ বেগ পাইতে হইত না। আমার নিজের পড়ারও কোনো অসুবিধা হইত না। ছেলেমেয়েরা আমার অতিশয় যত্ন নিত। বিবি সাহেব যদিও পর্দা করিতেন এবং কখনও আমার সামনে আসিতেন না, তথাপি আমার খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে সর্বদাই খবর নিতেন। ছেলেমেয়েরা না থাকিলে পর্দার আড়াল হইতে কথা বলিয়া আমার খোঁজখবর করিতেন। পরের বাড়িতে যায়গীর থাকার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম এবং এই শেষ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই বৃদ্ধ বয়সে ওদের কথা মনে পড়ে। খবর লইয়া জানিয়াছি, হাকিম সাহেব ও তাঁর বিবি সাহেবা এন্তেকাল করিয়াছেন। ছেলেদের একজন হাকিমি পাশ করিয়া হাকিম সাহেবের দাওয়াখানা চালাইতেছে। অন্যান্য ছেলেরা অন্য ব্যবসায় করে। অনেক ইচ্ছা সত্ত্বেও, ঢাকা থাকিয়াও, তাদের সাথে দেখা করিতে পারি নাই। সে জন্য মনে একটা ক্ষোভ আছে।

হাকিম সাহেবের বাড়ি চুড়িহাট্টা হইতে, আমি চকবাজার, মোগলটুলী, ইমামগঞ্জ, বাবুর বাজার, ইসলামপুর, পাটুয়াটুলী হইয়া কলেজে যাতায়াত করিতাম। রোজ এতটা পথ হাঁটিতে আমার মোটেই কষ্ট হইত না। কারণ এর চেয়ে অনেক লম্বা রাস্তা, এর চেয়ে হাজার গুণে খারাপ পথে, এর চেয়ে অনেক কম বয়সে হাঁটিয়া স্কুল করিবার অভ্যাস আমার ছিল দরিরামপুর স্কুলে পড়িবার সময়। তা ছাড়া শহরের রাস্তায় চলা আরো সোজা। বিভিন্ন রকমের নিত্য-নূতন দৃশ্য দেখিতে-দেখিতে কখন যে পথ ফুরাইয়া যাইত, তা টেরও পাইতাম না।

এই রাস্তায় কলেজে যাতায়াত করিবার সময় একটা ভারি মজার ঘটনা ঘটিয়াছিল। আমি কলেজ হইতে ফিরিবার পথে রাস্তায় একটি কাপড়ের টুকরার (ঠিক রুমাল নয়)। ছোট পুঁটলি পাইলাম। পুঁটলিটি তুলিয়া হাতে লইয়া পথ চলিতে-চলিতেই তার গিরো খুলিলাম। যে জায়গায় পুঁটলিটি পাইয়াছিলাম তা ইমামগঞ্জ-মৌলবী বাজারের মোড়ের কাছাকাছি হইবে। কিন্তু ওর গিরো খুলিতে খুলিতে আমি মোগলটুলী ছাড়াইয়া প্রায় চকে পৌঁছিলাম। দশ টাকার একটি, পাঁচ টাকার দুইটি ও দুই টাকার একটি নোটে মোট বাইশটি টাকা। যুদ্ধ মুদ্দতের জন্য ঐ সময় দুই টাকার নোট বাহির হইয়াছিল। তৎকালে ঐ বাইশ টাকার দাম আজকালকার দুই শ টাকারও বেশি। কারণ ঐ সময় দশ-বার টাকায় কলেজ হোস্টেলে স্বচ্ছন্দে থাকা চলিত। এক টাকা সিটরেন্ট, পাঁচ টাকা খোরাকি, এক টাকা টিফিন ও চার টাকা কলেজের বেতন, এই এগার টাকায় রাজপুত্রের হালে কলেজ হোস্টেলে অনেকেই থাকিত। আর আমার মত যায়গীর থাকা গরীব ছাত্রের জন্য বাইশ টাকা ছিল আলী বাবার মোহরের খনি। কাজেই টাকা গনিবার সময় আমার হাত কাপিতেছিল। এই টাকার কী করা যায়? যে ধরনের নেকড়ায় যেভাবে টাকাগুলি বাঁধা তাতে বুঝা যায়, মফস্বলের কোনও লোক কোনও জিনিস কিনিতেই শহরে আসিয়াছিল। ঐ টাকা হারাইয়া নিশ্চয়ই বেচারার খুবই ক্ষতি হইয়াছে। কিন্তু করা যায় কী? শহরে ঢোল-শহরত করিয়া দিলে ঐ লোকের সন্ধান পাওয়া যাইতে পারে। পয়সা খরচ করিয়া ঢোল-শহরত করিলে এই টাকা হইতেই কিছু টাকা খরচ হইয়া যাইবে। সুতরাং কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া ঠিক করিলাম থানায় এই টাকাটা জমা দিলে দারোগা বাবু সরকারি খরচেই ঢোল পিটাইয়া ঐ লোকের সন্ধান করিবেন। সামনেই চকবাজার থানা। তাতে ঢুকিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, ওসি আছেন কিনা? একজন বিহারি পুলিশ দাঁড়াইয়াছিল, সে বলিল : কুই নাহি হ্যায়।’

বাহির হইয়া আসিলাম। হঠাৎ একটু রিলিফ বোধ করিলাম। বুকের উপর হইতে একটা পাথর নামিয়া গেল। দারোগা বেটাদের যে বদনাম শুনি তাতে ওদের হাতে এ টাকাটা পড়িলে নির্ঘাত খাইয়া ফেলিবে। দারোগারা যে কেউ থানায় ছিলেন না এটা আল্লারই ইচ্ছা। তিনি যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। আল্লার এই মেহেরবানির কথা ভাবিয়া আসমানের দিকে চাইতেই দেখিলাম, সামনেই চকবাজার পোস্টাফিসের সাইনবোর্ড। আল্লার ইশারা এতক্ষণে বুঝিলাম। পোস্টাফিসে টাকাটা জমা দিয়া ঢোল-শহরতের কিম্বা ছাপা বিজ্ঞাপনের একটা কিছু ব্যবস্থা করা যাইবে। অতএব পোস্টাফিসে ঢুকিলাম। একটি কাউন্টার, বিকাল বেলা তাতেও খুব ভিড়। পোস্টাফিসে এ যাবকালে শুধু কার্ড ও স্ট্যাম্প কিনিয়াছি। টাকা জমাও দেই নাই, মনি অর্ডারও করি নাই। তবু এটা যে মনি অর্ডার হইবে না, তা বুঝিলাম। পোস্টাফিসের সেভিং ব্যাংকের নাম শুনিয়াছি। কিন্তু কীভাবে টাকা জমা দিতে হয়, তা জানি না। ভিড়ের পিছনে দাঁড়াইয়া এসব কথাই ভাবিতে লাগিলাম। যতক্ষণে সামনের ভিড় কমিল, ততক্ষণে আমার সন্দেহের উদ্রেক হইয়া গিয়াছে। পোস্টাফিসে টাকা জমা দিলে সেটাও থানার মতই গায়েব হইয়া যাইবে কিনা? একটু ভাবিয়া-চিন্তিয়া বন্ধু-বান্ধবের সাথে পরামর্শ করিয়াই কাজ করা উচিৎ। অতগুলি টাকা। আবার পরের টাকা। কাজেই সামনের ভিড় শূন্য হইয়া যাওয়ার পরও যখন আমি দাঁড়াইয়াই আছি, কিছু চাইতেছি না, তখন কাউন্টারের কর্মচারীই আমাকে বলিলেন: আপনি কি চান? আমি থতমত খাইলাম। তাড়াতাড়ি মুখ হইতে বাহির হইয়া গেল : একটা পোস্টকার্ড দেন।

সে সময় আমার পোস্টকার্ডের দরকার ছিল না। কিন্তু ওটা এমন জিনিস যার দরকার একদিন হইবেই। কাজেই ওটাকে অপব্যয় মনে না করিয়াই বাসায় ফিরিলাম। হাত-মুখ ধুইয়া নাশতা করিয়া ঢাকা কলেজের মুসলিম হোস্টেলে গেলাম। এটা আমার রোজকার অভ্যাস। বর্তমানে যেখানে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এটাই তখন ঢাকা কলেজের মুসলিম হোস্টেল। এর নাম ছিল তখন সেক্রেটারিয়েট মুসলিম হোস্টেল, সংক্ষেপে এসএম হোস্টেল। পূর্বপরিচিতদের মধ্যে শুধু শামসুদ্দিনই এই হোস্টেলে থাকিত। প্রথম-প্রথম তারই খাতিরে যাইতাম। কিছু দিনে অনেক বন্ধু জুটিয়া গেল। তাতে সেখানে যাওয়া আমার একটা বৈকালিক নেশা হইয়া গিয়াছিল।

.

. পথে-পাওয়া টাকার সদ্ব্যবহার

আমি হোস্টেলে পৌঁছিয়া দেখিলাম আমার বন্ধুরা সাজিয়া-গুঁজিয়া বাজারে যাইবার জন্য প্রস্তুত। অন্যদিন তাদেরে টেনিস বা ব্যাডমিন্টন খেলায় পাই। আমিও ওদের র‍্যাকেটে, ওদের বলে ও শাটলককে দুই-এক হাত খেলিতাম। কিন্তু সেই দিন ওরা বাজারে যাইবে বলিয়া অনেক আগেই খেলা ছাড়িয়া দিয়াছিল। সকলকে একত্রে পাইয়া খুশিই হইলাম। আমার টাকা পাওয়া, থানা-পোস্টাফিসে যাওয়া সব কথা বিস্তারিত বলিয়া তাদের উপদেশ চাইলাম। আমার কথা শুনিয়া সকলে একসঙ্গে হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। একজন বলিল : তুমি বিলাইর কাছে গোশতের পাহারাদারি দিতে চাইছিলা। যাক আল্লার মাল আল্লাই বাঁচাইছেন। আমিও মনে-মনে আল্লাকে ধন্যবাদ দিলাম। পরের টাকা লইয়া কী আহাম্মকিই না করিতে যাইতেছিলাম। নিজের এই গাধামির জন্য লজ্জা-ভারী চোখ তুলিয়া বলিলাম: এখন তবে করি কী?

এক বন্ধু হাত বাড়াইয়া বলিলেন : এমন আহাম্মক কি আর গাছে ধরে? ঐ টাকা যথাস্থানে পৌঁছানো ত সোজা ব্যাপার। দাও আমার কাছে টাকাটা।

আমি বন্ধুর কাছে টাকা দিলাম। একটা বড় বোঝা ঘাড় হইতে নামিয়া গেল। আরাম পাইলাম। বন্ধুদের সাথে হাসি-খুশিতে বাজারে গেলাম। গেলাম একদম পাটুয়াটুলীতে। প্রথমেই কালাচাঁদ গন্ধবণিকের দোকানে ঢুকিয়া বন্ধু এক টাকার মিঠাইর অর্ডার দিলেন। তৎকালে এক টাকার মিঠাইয়ে দশজনের পেট ভরিত। আমরা পাঁচ বন্ধুতে সে মিঠাই খাইয়া গলা পর্যন্ত ভরিলাম। ঢেকুর তুলিয়া কালাচাঁদের দোকান হইতে বাহির হইলাম এবং পান-সিগারেট খাইলাম। তারপর আমরা গেলাম মজিদ চশমাওয়ালার দোকানে। সেখানে আমাদের নেতা বন্ধু এগার টাকায় একটি সোনার ফ্রেমের জিরো পাওয়ারের চশমা কিনিলেন। সেখানে হইতে বাহির হইয়া লতিফ খলিফার দোকানে প্রবেশ করিয়া সেখানে এক বন্ধুর গায়ের ছয় টাকা দামের একটা কোটের মাপ দিয়া পুরা টাকা আগাম দিয়া দিলেন।

লতিফ খলিফার দোকান হইতে বাহির হইয়া বন্ধুরা আমার দিকে চাহিয়া হাসিয়া বলিলেন : দেখলা এইবার পাওয়া-টাকার সদ্ব্যবহার কেমনে করতে হয়?

সকলে প্রাণ খুলিয়া গলা ফাটাইয়া হাসিলেন। হাসি থামিলে আরেক বন্ধু বলিলেন : কিন্তু যে বেচারা টাকাটা পাইল, তারে ত কিছু দিলা না।

যে বন্ধুর পকেটে টাকা, তিনি বলিলেন : তার কথা আমার মনে আছে। তার কথা ভুইলা যাবার মত অবিবেচক আমি নই। চারটা টাকা এখনও রাইখা দিছি।

আমি এতক্ষণে ব্যাপার বুঝিলাম। বন্ধুরা ঐ পথে-পাওয়া টাকা দিয়াই আমাদেরে মিঠাই খাওয়াইয়াছেন এবং চশমা-কোট কিনিয়াছেন! বন্ধুরা কেন এটা করিলেন? হাওলাত স্বরূপই টাকা খরচ করিতেছেন, পরে ভরিয়া দিবেন। নিশ্চয়ই। কিন্তু ও-টাকা খরচ করিয়া কাজটা কি তারা ভাল করিলেন, বুঝিলাম না। তবে এটা বুঝিলাম যে টাকাটা খরচ হইয়া যাইতেছে। ভাবনা-চিন্তা শেষ হইবার আগেই দেখিলাম, আমরা এক রেডিমেড কাপড়ের দোকানে ঢুকিয়াছি। বন্ধুরা সকলে পছন্দ করিয়া চার টাকা দিয়া আমার জন্য খয়েরি হলুদ রঙের তসরেটের একটা কোট কিনিলেন। সব টাকা খরচ হইয়া যাওয়ার চেয়ে চার টাকা বাঁচা ভাল, বোধ হয় এই নীতিতে আমি ঐ কোট নিলাম। বন্ধুরা চকবাজার পর্যন্ত আমাকে পৌঁছাইয়া দিয়া সেন্ট্রাল জেলের সামনে দিয়া নিজেদের হোস্টেল মুখে রওয়ানা হইলেন। যাইবার সময় বলিয়া গেলেন : তোমার মত বোকারামের এ চার টাকাও পাওয়া উচিৎ ছিল না।

.

. কেতাবি সাধুতা বনাম বিষয়ী সাধুতা

এতক্ষণে পাঠকেরা নিশ্চয়ই বুঝিয়াছেন, কেন আমি বন্ধুদের নাম উল্লেখ করিলাম না। ঐ বন্ধুদের দুইজন ছাড়া আর সবাই বাঁচিয়া আছেন। তারা সকলেই আজ সম্মানিত ব্যক্তি। কিছুদিন আগে পর্যন্ত উচ্চপদস্থ ছিলেন। স্বভাব-চরিত্রে তারা সে সম্মানের যোগ্যও ছিলেন। নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি ও পদমর্যাদার সুযোগ লইয়া এঁরা কেউ কখনও অন্যায়-অসৎ উপায়ে অন্যের সম্পত্তি বা টাকা-পয়সা হস্তগত করিয়াছেন, এমন বদনাম এঁদের একজনেরও নাই। এঁরাই যৌবনে ঐ মনোভাবের পরিচয় দিয়াছিলেন। নিজের সাধুতার ফুটানি করিবার উদ্দেশ্যে অথবা বন্ধুদের নীতি-বোধকে হেয় করিবার মতলবেও এ ঘটনার উল্লেখ করিতেছি না। ঘটনা যেরূপ ঘটিয়াছে, অবিকল তাই বলিতেছি। বরঞ্চ সাধুতার ফুটানি করিবার মুখ আর আমার নিজেরই নাই। যখন এটা লিখিতেছি তখন আমার ঐ বন্ধুদের সকলেরই সুনাম অক্ষুণ্ণ ও চরিত্র নিষ্কলঙ্ক রহিয়াছে। আমি কয়েক মাস মন্ত্রিত্ব করিয়াই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ও নিম্ন আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হইয়াছিলাম। মাত্র উচ্চ আদালত হইতেই খালাস পাইয়াছিলাম। এ অবস্থায় নীতিবোধে আমি বন্ধুদের থনে শ্রেষ্ঠ, এ কথা বলিবার আমার অধিকারও নাই। বলিলে কেউ বিশ্বাসও করিবেন না। তবু এই ঘটনার উল্লেখের যদি কোনও মতলব ধরা যায় তবে সেটা সাধুতার ফুটানি করিবার জন্য নয়, বরং তেমন ফুটানির নিন্দা করিবার জন্যই।

পথে টাকা-পয়সা বা কোনও মূল্যবান চিজ পড়িয়া পাইলে এ ব্যাপারে আমাদের নাগরিক দায়িত্ব কী? পড়িয়া-পাওয়া টাকার পরিমাণ বা জিনিসের মূল্যভেদ, প্রাপকের অবস্থা বিশেষ, হারানো বস্তুর মালিকের আনুমানিক অবস্থা ইত্যাদিতে আমাদের নাগরিক কর্তব্যের ইতর-বিশেষ হইবে কিনা, এসব প্রশ্নের বিচার নিশ্চয়ই খুব সোজা নয়। অবস্থাভেদে ব্যক্তির ত বটেই, সমাজেরও নীতিবোধের প্রখরতার বেশ-কম হইতে পারে। ইউরোপ আমেরিকান দেশসমূহের লোকদের এদিককার নাগরিকতা-বোধ নাকি খুবই তীব্র। আমি শুনিয়াছি, সেখানে রাস্তার মোড়ে খবরের কাগজের স্তূপ ও একটা পাত্র পড়িয়া থাকে। বিক্রেতা থাকে না। খরিদ্দাররাই যার-তার ইচ্ছামত কাগজ নিয়া তার দাম ঐ পাত্রে ফেলিয়া যায়। কেউ এক পয়সা হেরফের করে না। দোকানেও নাকি জিনিসপত্রের গায় দাম লেখা থাকে। দরজায় বাক্স থাকে। খরিদ্দাররা ঐ বাক্সে দাম ফেলিয়া পছন্দমত জিনিস লইয়া যায়। কলেজজীবনে এক অধ্যাপকের মুখে শুনিয়াছিলাম, দ্রুতগামী চলন্ত বাসে জানালায় মুখ বাহির করায় তাঁর মাথার হ্যাট রাস্তায় পড়িয়া গিয়াছিল। মোটরসাইকেলওয়ালা পুলিশ দশ মাইল মোটর চালাইয়া পরবর্তী স্টেশনে সেই বাস ধরিয়াছিল এবং তার হ্যাট দিয়া গিয়াছিল। মন্ত্রিত্ব করিবার কালে এক রাষ্ট্রদূত বন্ধুর মুখে শুনিয়াছিলাম, এক বিমানবন্দরে তিনি রুমাল ফেলিয়া আসিয়াছিলেন। তিনটা দেশ ও দশটা বিমানবন্দর বাহিয়া হাওয়াই জাহাজে জাহাজে তাঁর রুমাল তার হাতে ফিরিয়া আসিয়াছিল। কিন্তু এটা ছবির একদিক মাত্র। ঐ দেশের অমন নাগরিক কর্তব্য-চেতন লোকেরাই আবার আফ্রো-এশিয়ান দেশসমূহের লোকদের ইনসানি হক ও মুখের বুলি কাড়িয়া লইতেছে। বাধা দিলে গুলির মুখে তাদের খুলি উড়াইয়া দিতেছে। মানুষের নীতিবোধ এত বিচিত্র।

আমাদের দেশের ও সমাজের অবস্থা তা নয়, এটাই বড় কথা নয়। আমার নিজেরই মধ্যে নৈতিক কাপুরুষতা ও দ্বিধা-সন্দেহ আছে। আমি আজ তা বেশ বুঝিতেছি। কলেজজীবনে এক হোস্টেল-মেট একবার আমার কাছ থনে পাঁচটা টাকা ধার নেন। কথা থাকে বাড়ি থনে মনি অর্ডার আসিলেই শোধ করিবেন। কতবার তার মনি অর্ডার আসিল। আমার টাকা শোধ করিলেন। যথেষ্ট তাগাদা করিলাম। বন্ধু-বান্ধব সালিস-সুপারিশ করিলেন। তবুও। বছর-দুই বছর কাটিয়া গেল। টাকা পাওয়ার আশা ছাড়িয়া দিলাম। এমন সময় একদিন দল বাঁধিয়া মার্কেটে যাইতেছি। আমার ঐ দেনাদার বন্ধুর পকেট থনে দশ টাকার একখানা নোট তার ও সকলের অজ্ঞাতে মেঝেয় পড়িয়া গেল। আমি সকলের অজ্ঞাতে আলগোছে তা তুলিয়া নিলাম। ভাবিলাম আল্লাহ সুদসহ আমার টাকা পাওয়াইয়া দিলেন। বাজারে গিয়া জিনিস পছন্দ করিয়া দাম দিতে গিয়া পকেটে হাত দিয়া বন্ধু বুঝিলেন তাঁর টাকা হারাইয়াছে। কত হায়-আফসোস করিলেন। আমি অন্যদের সাথে প্রচুর সহানুভূতি জানাইলাম। কিন্তু আসল কথা বলিলাম না।

ফাইনাল পরীক্ষার পর যেদিন সমপাঠীরা সকলে হোস্টেল হইতে বিদায় লইতেছিলাম, সেদিন ঐ বন্ধু পাঁচটা টাকা আমার হাতে জিয়া দিলেন এবং এতদিন দেনা শোধ না করার জন্য মাফ চাহিলেন। আমার হাত কাঁপিতেছিল। বুক ধড়ফড় করিতেছিল। কিন্তু মুখ ফুটিয়া সত্য কথা বলিতে এবং সে টাকা ফেরত দিতে সাহস পাইলাম না। বরং পরে মনকে প্রবোধ দিবার জন্য দুই বছরের অধিককাল আমাকে জ্বালাইবার প্রতিশোধের কথা এমনকি ইনসাফের মালিক আল্লাহর সুবিচারের কথাও ভাবিয়াছিলাম।

কেতাবি সাধুতা ও রাস্তার সাধুতায় সে পার্থক্য আছে এঁরা তার প্রমাণ। অথচ সাধারণ লোক এটা বুঝিতে পারে না। সাধুতার ভন্ডামি বা ফুটানিরিয়াকারীই যে আসল সাধুতা নয়, বিষয়ী সাধু লোকদের ধারণা তাই। এঁরা আসলে খারাপ লোক নন। সমাজের অবাঞ্ছিত অঙ্গ ও রাষ্ট্রের অবাঞ্ছিত নাগরিকও এঁরা নন। বরঞ্চ শুধু এই শ্রেণীর বিষয়ী ও বাস্তববাদী সাধু লোক যারা সাধুতাকে শুধু পলিসি মনে করেন, তাদের লইয়াই একটা দেশ একটা সমাজ সুখী-সমৃদ্ধিশালী হইতে পারে। পক্ষান্তরে পান হইতে চুন খসিয়া পড়িলেই যাঁরা হায়-হায় করিয়া উঠেন, কেতাবি সাধুতার সেই ভণ্ড ও রিয়াকারদেরে লইয়া একটা সমাজ বা দেশ সুখী হইতে পারে না। আজ পঁয়তাল্লিশ বছর পরেও আমি মনে করি, আমি ঐদিন আহাম্মকি করি নাই। কিন্তু যেসব বন্ধু ঐদিন আমাকে আহাম্মক বলিয়াছিলেন তাঁরা অসাধু, এ কথাও আমি বলিতে পারি না। বিশেষত এ কথাও আমি ভুলিতে পারি না যে বাইশ টাকা হজম করিতে আমার বিবেকে বাধিয়াছিল বটে কিন্তু ঐ টাকার ভগ্নাবশেষ চার টাকা হজম করিতে আমার আপত্তি হয় নাই। কিন্তু জনমত ব্যক্তির মতের বা যুক্তির তোয়াক্কা করে না। জনগণ ব্যক্তিগত সাধুতার খুব কমই মূল্য দিয়া থাকে। জনগণের বিশ্বাস, সুযোগ পাইলেই মানুষ চোর হয় ‘এভরিওয়ান হ্যাঁজ হিজ ভ্যালু, টাকা দিয়া সবাইকে কেনা যায়। জনগণের এই বিশ্বাস আছে বলিয়াই তাদের কথা : তৃণ হরণ করে না ব্রহ্মচারী; টাকা চুরি করে লক্ষ চারি। সারা জীবন যে লোকটা সাধুতার জন্য চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করিল, সেও যদি মওকামত ভাল সুযোগ পায় তবে টাকা মারিতে দ্বিধা করিবে না। যে সময়ে এ টাকাটা আমি রাস্তায় কুড়াইয়া পাইয়াছিলাম ঠিক সেই সময়ে কলেজের বকেয়া পাওনার জন্য আমার নাম কাটা যাওয়া আসন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। তবু এ টাকা দিয়া কলেজের বকেয়া বেতন শোধ করার কল্পনার একটা উঁকিতেই আমার বিবেক তার দিকে বাঘা কুত্তার মত ঘেউ-ঘেউ করিয়া উঠিয়াছিল। অথচ দুই ঘণ্টা পরে আমার বন্ধুরা যখন ঐ টাকার সব শেষ করিয়া বাকি চার টাকা দিয়া আমাকে একটা রেডিমেড কোট কিনিয়া দিলেন, তখন আমার সেই বিবেকই ক্লান্তি-অবসাদে অন্ধকার কোণে ঘুমাইতেছিল।

.

. হোস্টেল-জীবন বনাম যায়গীর-জীবন

হোস্টেল-জীবনের কথা শুরু করিবার আগে যায়গীর-জীবন সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। এই দেড় বছরের যায়গীর-জীবন একাধিক কারণে একাধিক দিক হইতে আমার নয়া অভিজ্ঞতার উৎস হইয়াছিল। ভবিষ্যৎ জীবনে সে অভিজ্ঞতা খুবই কাজে লাগিয়াছিল। প্রথম ও সর্বাপেক্ষা মূল্যবান যে শিক্ষালাভ করি, তা ছিল ছাত্র হিসাবে আভিজাত্য-বোধের অবসান। স্কুলজীবনের চার বছর হোস্টেলে কাটাইবার সময় নিজের অজ্ঞাতেই যায়গীরবাসী ও হোস্টেলবাসী ছাত্রদের মধ্যে একটা আভিজাত্যের সীমারেখা টানিতে শিখিয়াছিলাম। হোস্টেলবাসী ছাত্ররা সুপিরিয়র ও যায়গীরবাসী ছাত্ররা ইনফেরিয়র। হোস্টেলবাসীরা নিজের টাকায় খায় আর যায়গীরবাসীরা পরের খায়। এই কারণে হোস্টেলবাসীরা ধনী বাপের ছেলে আর যায়গীরবাসীরা গরীব বাপের ছেলে; পার্থক্যটা শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কারণ শহরতলী ও অদূরবর্তী পাড়াগাঁয়ে যেসব ছাত্র নিজের বাড়ি হইতে স্কুলে পড়িতে আসিত, আমরা হোস্টেলবাসীরা তাদেরেও কিছুটা অবজ্ঞা চোখে দেখিতাম। আমরা হোস্টেলবাসী ছাত্ররা অন্য সব ছাত্রের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর, কিছুটা অভিজাত শ্রেণীর মনে করিতাম। আজকালকার ক্যাডেট কলেজের ছাত্ররা যেমন সাধারণ স্কুল-কলেজের ছাত্রদের থনে নিজেদেরে কিছুটা শ্রেষ্ঠ মনে করিয়া থাকে, এমনি একটা মনোভাব আর কি?

আমার যায়গীর-জীবনে এই অহমিকা ভাঙ্গে। ভাঙ্গা কথাটা ব্যবহার করিলাম এই জন্য যে হোস্টেল-জীবন হইতে যায়গীর-জীবনে আমার এই পরিবর্তনটা প্রথম-প্রথম আমার মনঃপীড়ার কারণ হইয়াছিল। এটাকে একটা পতন মনে হইয়াছিল। বাপের দারিদ্র্যের ফলেই আমার এই পতন ঘটিয়াছিল। সুতরাং আমি আর অভিজাত শ্রেণীর ছাত্র নই। এটাই ছিল আমার মনঃপীড়ার কারণ।

এই মনঃপীড়ার যখন অবসান হইল, তখন নিজের দুর্ভাগ্যের সহিত আপস করার মত নিগেটিভ মনোভাব এটা ছিল না। যায়গীর-জীবনের একাধিক উপকারী দিকের সন্ধান লাভের মত পজিটিভ দিকও আমার চোখে উদ্ভাসিত হইল। প্রথমত, যায়গীর-জীবনে ছাত্ররা জনগণের মধ্যে বাস করিয়াই শিক্ষা লাভ করে; হোস্টেলবাসীর মত গণ-সমাজ-জীবন হইতে বিচ্ছিন্ন তারা হয় না। এই দিক হইতে যায়গীরবাসী ছাত্র হোস্টেলবাসীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। দ্বিতীয়ত যায়গীরবাসী ছাত্র পরের ভাত খায় এটাও ঠিক না। যায়গীর বাড়ির দু-চারজন ছেলেমেয়েকে তাদের পড়াইতে হয় বলিয়া তারা নিজের রোযগারী খানাই খায়। এই দিক হইতে শিক্ষাজীবনের আধুনিক বৈজ্ঞানিক নীতি আর্ন হোয়াইল ইউ লার্ন’, প্রয়োগ করিয়া থাকে এরাই। তৃতীয়ত, গণ সমাজ-জীবনে বাস করিয়া এরা শিক্ষা লাভ করে বলিয়া এরা সমাজের আচার-আচরণ সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করে এবং মানবজীবনের সহিত ব্যাপকতর ক্ষেত্রে পরিচিত হয়। হোস্টেলবাসীর চেয়ে এদের শিক্ষা অধিকতর বাস্তববাদী, অতএব পরিপূর্ণ হইয়া থাকে। হোস্টেলবাসীর মত অসামাজিক অবাস্তব ও অপূর্ণ থাকে না। চতুর্থত, যায়গীরবাসী ছাত্র হোস্টেলবাসীর চেয়ে আত্মবিশ্বাসী, স্বনির্ভর মিতব্যয়ী ও বিষয়জ্ঞানী হইতে শিখে। পরিস্থিতি ও পরিবেশই এমন হইতে তাদেরে শিক্ষা দেয়। পরবর্তী জীবনের জন্য এ সবই অত্যাবশ্যক গুণ।

.

. ঢাকার মহল্লা-জীবন

এটা ত গেল শিক্ষা-সুযোগের সাধারণ উপকারিতার দিক। দেড় বছরের যায়গীর-জীবনে চুড়িহাট্টা মহল্লা সাধারণভাবে এবং হাকিম সাহেব ও তার পরিবার-পরিজন হইতেও আমি ব্যক্তিগতভাবে যে জ্ঞান ও উপকার পাইয়াছি, তারও কিছু উল্লেখ করা প্রয়োজন।

চুড়িহাট্টা মহল্লাটি সে সময়ে ছিল একটি নিম্নমধ্যবিত্তের মহল্লা। ঢাকা শহরের অধিকাংশ গলিকুচার মহল্লাগুলি তখন এমনি ছিল। বাসেন্দাদের বেশির ভাগ ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর। তাদের অধিকাংশের বিশেষত তাদের মধ্যেকার আদি ঢাকাবাসীদের ভাষা ছিল ঢাকাইয়া উর্দু। এরা প্রায় সবাই ছিল স্বভাব-রসিক। সে রসিকতায় উপমা, শব্দবিন্যাস, বাক-রীতি, প্রকাশ ভঙ্গি ছিল অপূর্ব, মৌলিক ও প্রাসঙ্গিক। ঘটনা ও পরিস্থিতি যতই আকস্মিক ও অভাবনীয় হউক, তার উপযোগী মওকা-মাফিক অদ্ভুত কল্পনাপ্রসূত রসিকতা যেন তাদের ঠোঁটের আগায় সদা প্রস্তুত থাকিত। ঘটনার আকস্মিকতার মতই তাদের রসিকতার আকস্মিকতাও দর্শক ও শ্রোতাকে তাক লাগাইয়া দিত।

চুড়িহাট্টা মহল্লার জনসাধারণও ছিল এমন ঢাকাবাসীর এক অংশ। অন্যান্য মহল্লার মতই চুড়িহাট্টাতেও বাদ-মগরেব বিভিন্ন বাড়ির সেহানে আচ্ছা বসিত। এইসব আড্ডার রসে-ভরপুর বিতর্ক-আলোচনা ছিল বিচিত্র। আগে-আগে হাকিম সাহেবের সেহানেও ছিল আড্ডাখানা। কিন্তু হাকিম সাহেবের ছেলেমেয়েদের পড়ার ব্যাঘাত হয় বলিয়া ঐ আড্ডা ক্রমশ কমিয়া যায়। এবং আমি ছেলেমেয়েদের মাস্টার হওয়ার পর আজ্ঞা একদম উঠিয়া যায়। অবশ্য কিছু দূরের বাড়ি-সমূহের সেহানে আড্ডা চলিতে থাকে। আমার দরুন আড্ডা ভাঙ্গায় আড্ডাবাযরা অসন্তুষ্ট হইয়াছেন ভাবিয়া তাদেরে খুশি করিবার আশায় আমি মাঝে মাঝে তাঁদের আড্ডায় যাইতাম। কিন্তু লক্ষ্য করিতাম আমার উপস্থিতিতে আড্ডার স্বাভাবিক স্ফূর্তি বিঘ্নিত হইত। মন খুলিয়া তাঁরা হাসি-তামাশা করিতে পারিতেন না। ‘মাস্টার সাব’ বলিয়া তাঁরা আমাকে সম্বোধন করিতেন এবং উপযুক্ত সম্মান করিতেন বলিয়াই বোধ হয় এরূপ হইত। তাই আমিও আস্তে আস্তে তাঁদের আড্ডায় যাওয়া ছাড়িয়া দিলাম।

হাকিম সাহেব নিজে ছিলেন একজন স্বল্পভাষী গম্ভীর প্রকৃতির লোক। তিনি আরবি-ফারসিতে বেশ লিয়াকত রাখিতেন। নিজের বিদ্যার বড়াই তিনি কখনও করিতেন না। কিন্তু আমি অল্প দিনেই তাঁর পরিচয় পাইলাম। ফারসি আমার দ্বিতীয় ভাষা ছিল। আমি হাকিম সাহেবের ছেলেমেয়েদের পড়াইবার সময় সঙ্গে সঙ্গে নিজের পাঠ্যবইও পড়িতাম। আমি ফারসি টেক্সট বই পড়ার সময় হাকিম সাহেব দাওয়াখানা হইতে ফিরিয়া আসিলে প্রায়ই সাদী, হাফেয, রুমী, ফেরদৌসী ও জামী লইয়া আমার সহিত আলোচনায় বসিতেন। কবিদের সম্বন্ধে আমার অজানা অনেক তথ্য বর্ণনা করিতেন এবং আমার পাঠ্যবইয়ের বাইরের অনেক কবিতা আবৃত্তি করিতেন।

হাকিম সাহেব মোটামুটি খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসক ছিলেন। মৌলবী বাজারে তার দাওয়াখানা ছিল। বন্ধুবান্ধবসহ বাজারে সওদা করিতে বা বেড়াইতে গেলে হাকিম সাহেবের দোকানের সামনে দিয়া যাইতে হইত। সুযোগ পাইলেই দাওয়াখানায় ঢুকিতাম। দেখিতাম তার রোগী সংখ্যা অনেক। আমাদেরে দেখিলে তিনি বসিতে বলিতেন। সুবিধা হইলে বসিতামও। অবসর পাইলে তিনিও আমাদেরে আগের দিনের এবং হিন্দুস্থানে (মানে দিল্লি-লাখনৌসহ উত্তর-ভারতে) বর্তমানেও হাকিমি বিদ্যার আদর ও মর্যাদা বর্ণনা করিতেন। আমি তাতে এ বিষয়ে বেশ কিছু জ্ঞান লাভও করিয়াছিলাম।

হাকিম সাহেবের নিকট আমি উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতাও শিখিয়াছিলাম। তিনি অনেকবার আমাদের গ্রামে গিয়াছেন। কাজেই জানিতেন আমরা গোড়া মোহাম্মদী। গোর-পীর পূজার আমরা ভয়ানক বিরোধী। মহল্লার লোকেরা এবং সহপাঠী ছাত্ররা প্রায় সবাই ছিলেন হানাফী। এই লইয়া সহপাঠীদের সাথে আমার যে তর্ক ও বাদ-বিতণ্ডা হইত, তাতে অনেক সময় অপ্রিয়তারও সৃষ্টি হইত। এই ধরনের ঘটনায় হাকিম সাহেব প্রকাশ্যে আমার পক্ষ লইতেন, গোপনে আমাকে উদার হইতে উপদেশ দিতেন। এমন একটি ঘটনার কথাই বইয়ের অন্যত্র উল্লেখ করিয়াছি।

প্রায় দেড় বছর হাকিম সাহেবের বাড়িতে যায়গীর থাকিয়া আইএ ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বাদামতলী ঘাটের এক মেসে যাই। এটা ছিল ছাত্র ও অফিসারদের একটি মিশ্রিত মেস।

এই মেসে আমি মাত্র মাস কয়েক ছিলাম। এখান হইতেই আইএ ফাইনাল দেই। ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করি। কিন্তু কোনও স্কলারশিপ পাই না। এই মেসে আমিন সাহেব নামে একজন কেরানি থাকিতেন। তিনি খুব ভাল ফুট বাজাইতেন। আমার পরীক্ষার পড়ায় ব্যাঘাত হইবে বলিয়া তিনি বেশি রাত্রে মেসের খোলা সেহানে বসিয়া বাঁশি বাজাইতেন। বাঁশির সে মিঠা আওয়াজে আমার ও মেসের আরো অনেকের ঘুম ভাঙ্গিয়া যাইত। আমরা আর বিছানায় শুইয়া থাকিতে পারিতাম না। সেহানে আসিয়া আমি তার পা ঘেঁষিয়া বসিতাম। এই আমিন সাহেবের নিকট আমি ফুট বাজানো শিখিয়াছিলাম এবং পরবর্তী ছাত্রজীবনে বাঁশিবাদক হিসাবে নাম করিয়াছিলাম।

দুই বছরের জগন্নাথ কলেজ-জীবন আমার মোটামুটি সুখেই কাটিয়াছিল। ভাল-ভাল প্রফেসারের কাছে পড়িবার আনন্দ পাওয়া ছাড়াও জগন্নাথ কলেজে আমার একটা নূতন অভিজ্ঞতা লাভ হয়। স্কুল-কলেজের এত বড় লাইব্রেরি থাকিতে পারে, জগন্নাথ কলেজেই প্রথম এই জ্ঞান লাভ করি। লাইব্রেরির বিশালতায়, বইয়ের সংখ্যায় ও নাম না-শোনা ও চোখে না-দেখা বহু বড় বড় আকারের বই দেখিয়া আমি লাইব্রেরিটার প্রতি আসক্ত হইয়া পড়ি। ক্লাসে পড়া না থাকিলে অথবা অন্যভাবে অবসর পাইলেই আমি লাইব্রেরিতে ঢুকিতাম। অল্পক্ষণেই লাইব্রেরিতে ডুবিয়া পড়িতাম। সবচেয়ে বেশি ডুবিতাম ইতিহাসের বইয়ে। ইতিহাস মানে আরব জাতি ও মুসলিম দুনিয়ার ইতিহাস। খলিফা ওমরের আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিটি পোড়াইবার গল্পটি যে সম্পূর্ণ বানোয়াট, ঐতিহাসিক বাটলারের বই হইতে এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধসহ কয়েকটি ঐতিহাসিক প্রবন্ধ লিখি এই সময়ে। এগুলি আল-ইসলাম-এ ছাপা হয়। এইভাবে ইতিহাসের আউট বুকে এতটা মাতিয়া উঠি যে ইতিহাসের টেক্সট বুকগুলির প্রতি অবহেলা করি। ফলে অন্যান্য বিষয়ে ৮০-এর উপর নম্বর পাইয়াও ইতিহাসে মাত্র ৩৬ নম্বর পাইয়া কোনও মতে ফার্স্ট ডিভিশনে আইএ পাশ করি।

খেলাধুলায় শখ ছিল ছেলেবেলা হইতেই। কিন্তু জগন্নাথ কলেজের দুই বছর ফুটবল-ক্রিকেট হইতে বঞ্চিত থাকি। জগন্নাথ কলেজের নিজস্ব কোনও খেলার মাঠ ছিল না। কলেজের পিছন দিকে যে খানিকটা খোলা জায়গা ছিল, তাতে ফুটবল-ক্রিকেট খেলা চলিত না। তবু তার মধ্যে আমরা কোনো রকমে খেলা চালাইতাম। বল ক্যাচিং-এ অর্থাৎ গায়ের জোরে খুব উঁচায় ক্রিকেট বল ছুড়িয়া তা ধরায়, এই সময়ে আমার নাম ছিল। এমনি খেলায় একবার বল ধরিতে গিয়া আমি আহত হই। অসমান মাঠে উপর দিকে চাহিয়া দৌড়াইতে গিয়া হোঁচট খাইয়াছিলাম। ফলে বল পড়ার সম্ভাব্য স্থান হইতে বেশি আগাইয়া গিয়াছিলাম। তাই পিছন দিকে কাত হইয়া হাত বাড়াইয়া বল ধরিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম। বল হাত হইতে পিছল-ফসকিয়া চোখের নিচ দিকে গালে পড়ে। মুহূর্তে গাল-চোখ ফুলিয়া বাম চোখ একদম বন্ধ হইয়া যায়। এটা ছিল একটা অ্যানুয়েল স্পোর্টসের দিন। অধ্যাপকেরাও অনেকে দর্শকরূপে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের ও বন্ধুদের সমবেত উদ্যমে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা হইয়াছিল।

কলেজের অধ্যাপকদের মধ্যে প্রিন্সিপাল ললিত চ্যাটার্জি মহাশয় ছাড়াও আরো নামকরা অনেক অধ্যাপক ছিলেন। দর্শনের অধ্যাপক উমেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ইতিহাসের অধ্যাপক মি. পি গুপ্ত, ইংরাজির অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র সরকার, অধ্যাপক ফণীন্দ্র নাথ রায় প্রভৃতি অনেকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইতিহাসের অধ্যাপক মি. পি গুপ্ত অধ্যাপনায় ত ভাল ছিলেনই, চেহারা-ছবি ও পোশাকেও তিনি ছিলেন একেবারে ইংরাজ। বিশেষত, তিনি ছিলেন বিখ্যাত অধ্যাপিকা তটিনী গুপ্তার স্বামী। তৎকালে সারা ভারতে এবং ভারতের বাইরেও মিসেস তটিনী গুপ্তা ছিলেন জ্ঞানে প্রতিভায় বিস্ময় ও শ্রদ্ধার পাত্রী। অধ্যাপকদের মধ্যে শ্রীযুক্ত সতীশ চন্দ্র সরকার ছিলেন শুধু জগন্নাথ কলেজের নয়, সকল কলেজ-স্কুলের ছাত্রদের এবং ঢাকাবাসী সকলের ভক্তি শ্রদ্ধার পাত্র। অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করিয়া ইনি ন্যাশনাল কলেজ ও ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুল স্থাপন করেন। কলেজটি চলে নাই। কিন্তু মেডিকেল স্কুলটি আজও আছে।

.

. ঢাকা কলেজ–এস এম হোস্টেল

১৯১৯ সালে আইএ পাশ করিয়া আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। বিশ্বযুদ্ধের দরুন পাটের দাম কিছুটা বাড়িয়া যাওয়ায় সব পাটচাষির মতই আমার বাপের আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভাল হয়। এই সুযোগে আমি এস এম হোস্টেলেই উঠি। পরবর্তী জীবনে বড় হইয়াছিলেন এমন অনেক ভাল-ভাল ছাত্রের সাথে পরিচিত হই এই হোস্টেলে। এই হোস্টেলে তখন আসাম সরকারের অন্যতম মন্ত্রী কাছাড় হাইলাকান্দিবাসী মি. আবদুল মোত্তালেব মজুমদার, ডা. কাজী মোতাহার হোসেন, অধ্যাপক যহুরুল ইসলাম, হাইকোর্টের বিচারপতি মি. মোহাম্মদ ইব্রাহিম, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মি. মিজানুর রহমান, আইন পরিষদের ডি. স্পিকার মরহুম মোহাম্মদ শাহেদ আলী, আইজিআর মি. সাদেক খা, এককালীন গভর্নর রাষ্ট্রদূত মি. সুলতান উদ্দিন আহমদ, পুলিশের আইজি মি. শামসুদদোহা, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মি. আফতাঁবুদ্দিন আহমদ ও মোহাম্মদ হাসান আলী, ইনকাম ট্যাক্স অফিসার আবদুল আজীজ ডি. ম্যা. মি. আবদুল মজিদ মোল্লার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আজাদ সম্পাদক মি. আবুল কালাম শামসুদ্দিনও এই হোস্টেলের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু পরে তিনি কলিকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হইয়া কারমাইকেল হোস্টেলের বাসিন্দা হন।

আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হইবার অল্পদিন পরেই জগন্নাথ কলেজের দর্শনের অধ্যাপক বিখ্যাত দার্শনিক, সাহিত্যিক শ্রীযুক্ত উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয় ঢাকা কলেজের দর্শনের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। তিনি জগন্নাথ কলেজে আমাদিগকে তর্কশাস্ত্র পড়াইতেন। তর্কশাস্ত্রে আমার কৃতিত্বে সন্তুষ্ট হইয়া বিএতে দর্শনশাস্ত্রে অনার্স লইবার জন্য তিনি আমাকে তখনই উপদেশ দিয়াছিলেন। তাঁর উপদেশমতই আমি দর্শনশাস্ত্রে অনার্স লইয়াছিলাম। তিনি ঢাকা কলেজে যোগ দিয়া আমাকে দর্শনের অনার্স ক্লাসে দেখিয়া খুব সন্তুষ্ট হন। ঢাকা কলেজের দর্শনের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন তখন অধ্যাপক ল্যাংলি। তিনি পরবর্তীকলে দর্শনে পিএইচডি পাইয়াছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলার হইয়াছিলেন। অধ্যাপক ল্যাংলি ও অধ্যাপক উমেশ ভট্টাচার্য আমাদের দর্শনের অনার্স ক্লাস লইতেন। আমি জগন্নাথ কলেজ হইতেই উমেশবাবুর প্রিয় পাত্র ছিলাম। ক্লাসে ও পরীক্ষায় ভাল করিয়া আমি ল্যাংলি সাহেবের প্রিয় পাত্র হইয়া উঠিলাম।

.

. খেলাধুলা

জগন্নাথ কলেজে দুই বছর ধরিয়া খেলাধুলায় যে উপাস করিয়াছিলাম, ঢাকা কলেজে সে ক্ষুধা পুরাপুরি মিটাইলাম। খেলাধুলায় আমার বরাবরই খুব বেশি ঝোঁক ছিল। ঢাকা কলেজে ও হোস্টেলে খেলার সরঞ্জাম ও মাঠের সুবিধা প্রচুর পাওয়ায় খেলার ঝোঁকও আমার বাড়িল। ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন সব রকমের খেলাতেই অংশগ্রহণ করিতাম স্কুলজীবনেই। ঢাকা কলেজে আসিয়া টেনিস ও হকি খেলার সুযোগ পাইলাম। ফুটবল, ক্রিকেটে মোটামুটি ভাল খেলোয়াড় ছিলাম বটে, কিন্তু কলেজের এগার জনের একজন কখনো ছিলাম না। কিন্তু হোস্টেলে-হোস্টেলে কম্পিটিশনের অন্যতম খেলোয়াড় ছিলাম।

এই সব খেলায় মধ্যম শ্রেণীর খেলোয়াড় হইলেও লাফালাফি দৌড়াদৌড়িতে কিন্তু প্রধানদের মধ্যে একজন ছিলাম। বস্তুত, কলেজের বার্ষিক স্পোর্টসে লং জাম্প এবং হাই জাম্পে একবার প্রথম ও আরেকবার দ্বিতীয় হইয়াছিলাম। কাজী মোতাহার হোসেন, মি. আবদুল মোত্তালেব ও আমি এই তিনজনই ছিলাম এই লাফালাফিতে শ্রেষ্ঠ। লং জাম্পে আমার ও মোত্তালেব সাহেবের মধ্যে প্রতিযোগিতা হইত, আর হাই জাম্পে কাজী। সাহেব ও আমার মধ্যে প্রতিযোগিতা হইত। আমি যে বছর লং জাম্পে প্রথম হইয়াছিলাম সেইবার আমার লাফের দৈর্ঘ্য ছিল উনিশ ফুট দুই ইঞ্চি। পরে শুনিয়াছি আমার লাফের ঐ দৈর্ঘ্য বেশ কিছুকাল রেকর্ড ছিল। লম্বা লাফে আমার এই সাফল্যের কারণ সম্বন্ধে বন্ধুরা বলিতেন যে আমি লাফ দিয়া শূন্যে উঠিয়া দুই হাতে কাক-চিলের মত ডানা মারিয়া উড়িয়া যাইতাম। কথাটা ঠিক কিনা আমি জানিতাম না। কিন্তু আমি নিজে যেটা বুঝিতাম সেটা এই যে আমি জাম্পিং গ্রাউন্ড হইতে হাওয়ায় উড়িয়া ফলিং গ্রাউন্ডে পড়িয়া যাইতাম না। শূন্যে উঠিয়া হাত-পা ও কোমরের জোরে অন্তত দুইটা ঢেক্কর মারিতাম। আমি বুঝিতাম ঐ ঢেক্করে কমসে কম দুই ফুট জায়গা আমি আগাইয়া যাইতাম।

দ্বিতীয় বছর আমার লাফের দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় ফুট কমিয়া যায়। মোত্তালেব সাহেব সেইবার ফার্স্ট হন। আমার অধঃপতনের কারণ এই যে আমি সেইবার ফুটবল খেলিতে গিয়া হাঁটু মচকাইয়া ছিলাম। সে মচকানটা এত সাংঘাতিক হইয়াছিল যে আমাকে দুই-দুইবার হাসপাতালে ভর্তি হইতে হইয়াছিল। জীবনে আর তা সারে নাই। এই বৃদ্ধ বয়সেও সেই মচকানো হাঁটু নিয়া কষ্ট পাইতেছি।

.

. গলা সাধনা

বর্তমানে তরুণ বন্ধুরা শুনিয়া তাজ্জব হইবেন যে হোস্টেলের আনন্দমেলায় আমি শুধু ফুট বাজাইতাম না, গানও গাইতাম। ছেলেবেলা হইতেই আমার গলা ভাল ছিল। খোশ কুফী ও মিসরি ইলহানে আমি ছেলেবেলা যখন কোরআন তেলাওয়াত করিতাম, তখন অনেক কারী-মৌলবীও কান পাতিয়া শুনিতেন। আমি চাচাজীর নিকট এই ইলহান শিখিয়াছিলাম। আমার খোশ ইলহান শুনিয়া দরিরামপুর মাদ্রাসার কয়েক বন্ধু আমাকে গজল শিখান। জগন্নাথ কলেজে পড়িবার সময় আমি আমিন সাহেবের নিকট বাঁশি শিখি এবং হারমোনিয়ামে সারেগামা সাধি। আমিন সাহেব অবশ্য আমাকে হুঁশিয়ার করিয়া দিয়াছিলেন যে, গানের গলা রাখিতে গেলে আমাকে বাঁশি ছাড়িতে হইবে। আমি তা ছাড়ি নাই। ফুট, বাঁশি ও আড়বাঁশি বাজানো আমার একটা নেশা হইয়া গিয়াছিল। তাতে খুব দ্রুতগতিতে আমার গলা পড়িয়া যায়। বর্তমানে আমার গলা শুধু বেসুরা বা হোর্স হইয়াই যায় নাই; উদারার সপ্তগ্রামের প্রথম দুইটা ঘাট সা এবং রে একদম বন্ধ হইয়া গিয়াছে। ফলে বক্তৃতায়, এমনকি সাধারণ বৈঠকি আলাপেও নিম্ন গ্রামে আমার কথা মিলাইয়া বা ফেড আউট করিয়া যায়। ফলে জোর দিয়া কথা বাহির করিতে হয়। এক বন্ধুর এবং অনেকের ধারণা আমি চিল্লাইয়া কথা বলি। যারা জানেন না, তাঁরা ভাবেন আমি রাগ করিয়াছি।

.

১০. মধ্যম রকমের ভাল ছাত্র

ছাত্র হিসাবে আমি মধ্যম শ্রেণীর ভাল ছাত্র ছিলাম। প্রথম শ্রেণীর প্রতিভাধর ছিলাম না। ইউনিভার্সিটিতে নাম করিবার মত কিছু ছিল না। তবু যতটুকু পারিতাম সাহিত্য ও রাজনীতি আমাকে তা-ও করিতে দেয় নাই। আমি দিবারাত্র আউট বই লইয়া থাকিতাম। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা ছাত্রদের অনেকেই আউট বই পড়িয়াও পরীক্ষায় নাম করিয়াছেন। কাজেই শুধু আউট বই পড়াকেই আমার পরীক্ষার ভাল না করার জন্য দোষী করা যায় না। কিন্তু আমি ছিলাম একদম ‘হোল-হগার ওয়ান ট্র্যাক মাইন্ড’ যাকে বলে একরুখা। যখন যেটা ধরিতাম, সেটার শেষ না দেখিয়া ছাড়িতাম না। অনার্স নিয়াছি দর্শনে, কলেজ লাইব্রেরিতে রিসার্চ শুরু করিলাম ইতিহাসে। এক বই-এ আরেক বইয়ের রেফারেন্স পাইয়া সেই বই ধরিতাম। সেটা হইতে আরেকটা। এইভাবে দিনের পর দিন ও সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটাইয়া দিতাম। দর্শনে অনার্সের ছাত্রকে যদি রিসার্চ করিতে হয় তবে দর্শনেই করা দরকার। এ উপদেশ কেউ যদি দিতেন এবং সেটা যদি আমি পালন করিতে যাইতাম তবে সে পথেও শেষ দেখিতে চাইতাম। আমাদের পাঠ্যবইয়ে কান্ট, হেগেল, কোতে, ডেকার্টে, স্পিনোজা, মিলের কোটেশনে সন্তুষ্ট থাকিতাম না। তাদের মূল বই দেখিতে চাইতাম। এবং একটা খুলিয়া দশটায় জড়াইয়া পড়িতাম। ফলে আমি বোধ হয় পরীক্ষার পাশের দিক হইতে চিনিখোরের জায়গায় চিনির বলদ হইয়া গেলাম। সহপাঠীর নজরে পণ্ডিত হইয়া উঠিলাম; কিন্তু শিক্ষক ও পরীক্ষকদের কাছে মূর্খই রহিলাম।

.

১১. ল্যাংলি সাহেবের শেষ উপদেশ

এর উপর বিএ পরীক্ষার কয়েস মাস আগে হইতেই খিলাফত ও নন্‌কো আন্দোলনে মাতিয়া উঠিলাম। ইব্রাহিম সাহেব এই আন্দোলনে আমাদের নেতা। তার এবং বরিশালে আবুল কাসেম নামে এক সহপাঠীর প্রেরণায় খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিলাম। এবং বিএ পরীক্ষা দিব না বলিয়া হোস্টেল ছাড়িয়া বাড়ি চলিয়া গেলাম। ল্যাংলি সাহেব আমাকে সত্যই স্নেহ করিতেন। তিনি আমাকে তার সাথে দেখা করিবার জন্য বাড়ির ঠিকানায় পত্র দিলেন। আমি তাঁর আদেশ পালন করিলাম। তার সাথে দেখা করিলাম। তিনি আমাকে পরীক্ষাটা দিতে অনুরোধ করিলেন। আমি প্রস্তুতির অভাবের অজুহাত দিলাম। তিনি আমার সব কথা শুনিয়া বলিলেন : ‘পরীক্ষাটা তুমি দাও। অনার্স যদি নাও পাও পরীক্ষায় তুমি ফেল করিবে না। গ্র্যাজুয়েটটা ত হইয়া থাক, স্বরাজ হইলেও ওটা কাজে লাগিবে।’

আমি পরীক্ষা দিলাম। অনার্স পাইলাম না। পাশ করিলাম। পরীক্ষার ফল বাহির হইবার পর আবার ল্যাংলি সাহেব আমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। দেখা করিলাম। অনার্স না পাওয়ায় তিনি আমার জন্য দুঃখ প্রকাশ করিলেন। তিনি বলিলেন, অনার্স না পাওয়ার সম্ভাবনার কথা তিনি বলিয়াছিলেন বটে কিন্তু সত্য-সত্যই তাই ঘটিবে এটা তিনি বিশ্বাস করিতেন না। আমি অনার্স না পাওয়ায় তিনি বিস্মিত হইয়াছেন। এই বদনাম লইয়া আমার কলেজ ছাড়া উচিৎ হইবে না। আমার এমএ ক্লাসে ভর্তি হওয়া উচিৎ।

তখন নয়া ঢাকা ইউনিভার্সিটির কাজ শুরু হইয়াছে। নয়া ইউনিভার্সিটিতে অনেক সুবিধা পাওয়া যাইবে বলিয়াও ল্যাংলি সাহেব আমাকে অনেক আশা ভরসা দিলেন। আলীগড় হইতে কয়েকজন ভাল ছাত্র আসিয়া এখানে ভর্তি হইয়াছেন বলিয়া তিনি তাদের সাথে আমাকে দেখা করিতেও বলিলেন।

আমি এতদিনে কংগ্রেস-খিলাফত আন্দোলনে গলা পর্যন্ত ডুবিয়া গিয়াছি। মহাত্মাজীর এক বছরে স্বরাজ পাওয়া সম্বন্ধে পূর্ণ বিশ্বাসী। সুতরাং এই কয় মাসের জন্য ইংরাজের গোলামখানায় ঢুকিতে আমি রাজি হইলাম না।

কিন্তু হোস্টেলে গেলাম। দেখিলাম আমার যেসব বন্ধু কলেজ ছাড়িয়া খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়াছিলেন, তাঁদের অনেকেই হোস্টেলে ফিরিয়া আসিয়াছেন। নূতন নামকরা এমএ ক্লাসের ছাত্রদের মধ্যে মি. আলতাফ হোসেনকে (পরে ডন-এর এডিটর), মি. যাকির হোসেন (পরে আইজি ও গভর্নর), মো. সিরাজুল ইসলাম (পরে জুডিশিয়াল সার্ভিস ও খান বাহাদুর) প্রভৃতি অনেকের সাথে পরিচিত হইলাম। এঁরাও আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইতে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল রহিলাম।

‘গ্র্যাজুয়েট হইয়া থাক, স্বরাজ হইলেও ওটা কাজে লাগিবে’, ল্যাংলি সাহেবের এই কথাটা কাজে লাগিবার জন্য স্বরাজপ্রাপ্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে হয় নাই। মাত্র পাঁচ বছর পরেই কাজে লাগিয়াছিল। গান্ধীজির প্রতিশ্রুতিমত এক বছরে স্বরাজ না হওয়ায় এবং ইতিমধ্যে আন্দোলনে ভাটা পড়ায়, অধিকন্তু হিন্দু-মুসলিম বিরোধ জটিল হইয়া উঠায় স্বরাজের সম্ভাবনা আরো দূরে চলিয়া যায়। আমি ১৯২৬ সালে রিপন ল কলেজে ভর্তি হইলাম। ১৯২৯ সালে ফার্স্ট ক্লাস পাইয়া ফাইনাল পাশ করিলাম।

.

১২. সমকালীন শিক্ষা কারিকুলাম

আমাদের ছাত্রজীবনে উচ্চশিক্ষা মাত্র দুই প্রকারের ছিল : আর্ট ও সায়েন্স। ডিগ্রিও ছিল দুই প্রকারের : ব্যাচেলর অব আর্টস (বিএ), ব্যাচেলার অব সায়েন্স (বিএসসি) ও মাস্টার অব আর্টস (এমএ), মাস্টার অব সায়েন্স (এমএসসি)। আজকাল আর্টস’-এর বদলে বলা হয় হিম্যানিটিস’। আর উচ্চশিক্ষার শ্ৰেণীও দুইটার স্থলে তিনটা করা হইয়াছে, বাণিজ্য যোগ করা হইয়াছে। তার উপর মেয়েদের জন্য ‘হোম ইকনমিকস’ যোগ করিয়া চারটা করা হইয়াছে। মেয়েদের হোম ইকনমিকসের মত পুরুষদের জন্য ডিগ্রি ইন এগ্রিকালচারও যোগ করা হইয়াছে। এগ্রিকালচারের কলেজ অবশ্য আগেও ছিল। কিন্তু গোটা উপমহাদেশে ছিল মাত্র একটা। এখন বাংলাদেশেই একটা এগ্রিকালচারের ইউনিভার্সিটি করা হইয়াছে।

এসব সংস্কার, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ঠিকই হইয়াছে। যেসব দেশ শিক্ষা সভ্যতায় আমাদের দেশের চেয়ে অগ্রগামী, তাদের অভিজ্ঞতার আলোকেই এসব হইয়াছে এবং আমরা তাদের অনুসরণ করিয়াছি মাত্র। ধরুন, আর্টসের জায়গায় হিউম্যানিটিসের প্রবর্তন। আগেরটাও যেমন ঠিক ছিল না, পরেরটাও তেমনি ঠিক নয়। আর্ট’-কেও যেমন আমরা শিল্প, কারিগরি বা দক্ষতা ইত্যাদি রূপে বাংলায় তর্জমা করিতে পারিতাম না, এখনকারটাকেও আমার মানবিকতায় তর্জমা করিতে পারি না। তবু আমরা নিঃশঙ্কচিত্তে যেমন আগেরটা ব্যবহার করিয়াছি, এখনকারটাও তেমনি নিঃশঙ্কচিত্তেই ব্যবহার করিতেছি। ব্যাচেলার কথাটাকে ‘অবিবাহিত পুরুষ’ তর্জমা করিতে পারি নাই। আজও পারি না। তবু ডিগ্রিটার নাম ‘ব্যাচেলার আগেও বলিয়াছি এখনও বলিতেছি। বলিতেছি এইজন্য যে আসলে এসব শব্দের দ্বারা আমরা কী বুঝাইতে চাই, তা যতই আর্বিট্রারি বা অযৌক্তিক হউক, সকলে একই রকম বুঝিয়া থাকি। ব্যস, তাতেই কাজ হইল। উন্নততর, মানে অধিকতর স্পষ্ট অর্থজ্ঞাপক, শব্দের অনুসন্ধান করিতে গেলে অধিকতর জটিলতার সম্মুখীন হইব বলিয়াই আমরা অনুকরণযোগ্য ভদ্রলোকদের অনুকরণ করি। কিন্তু বিষয়-বস্তুর পরিবর্ধন বিস্তৃতিকরণ এবং তদনুসারে ডিগ্রির সংখ্যা বৃদ্ধিটা তেমন অযৌক্তিক বা অনাবশ্যক নয়। আমাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের এলাকা, আয়তনক্ষেত্র, অঞ্চল ও পরিমণ্ডল সম্বন্ধে আমাদের ধারণা ও জ্ঞান যতই অধিক ও ব্যাপক হইতেছে, উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি সংখ্যাও ততই বাড়িবে এটা খুবই স্বাভাবিক। একই শিক্ষার্থীর পক্ষে এই পরিমণ্ডলের সব জ্ঞানের বোঝা একই সঙ্গে একই মস্তকে বহন করা কঠিন বলিয়া জ্ঞানের ক্ষেত্রকে খণ্ড খণ্ড করিয়া এক এক বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন বিশেষজ্ঞ তৈয়ার করার ব্যবস্থার উদ্দেশ্যটাও সাধু ও বাস্তবধর্মী। সুখের বিষয় বর্তমানের শিক্ষা কর্তৃপক্ষ ক্রমে শিক্ষানীতি ও কারিকুলামে এই বাঞ্ছিত পরিবর্তন প্রবর্তন করিতেছেন।

.

১৩. শিক্ষাজীবনের শেষ নাই

এইভাবে প্রথমে ১৯২১ সালে এবং দ্বিতীয় বারে ১৯২৯ সালে আমার ছাত্রজীবন শেষ হয়। কিন্তু আমার শিক্ষাজীবনও কি ঐ সঙ্গে শেষ হইয়াছিল? এই অধ্যায়ের শিরোনাম, আমার শিক্ষাজীবন। কাজেই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় : কলেজ-ভার্সিটি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কি মানুষের শিক্ষাজীবন শেষ হয়? এটা বড় প্রশ্ন। শাশ্বত সনাতন প্রশ্ন। যুগে যুগে এ প্রশ্ন উঠিয়াছে। শিক্ষাবিদেরাও বলিয়াছেন, মানুষের শিক্ষাজীবন কখনও শেষ হয় না। কথাটা কি সত্য? সত্য হইলেও কত জনের জন্য, কার কার জন্য সত্য? কীভাবে সত্য? আমরা প্রায়শ দেখি, দর্শনশাস্ত্রে এমএ পাশ করিয়া আমাদের কত তরুণ ব্যাংকের কেরানি বা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টরি চাকরি গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁদের কি শিক্ষাজীবনের নিরবচ্ছিন্নতা বা ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রহিয়াছে। ব্যাংকের কেরানি প্রৌঢ় বয়সে যখন ম্যানেজার হইয়া সাব-ইন্সপেক্টর যখন ডিএসপি হইয়া রিটায়ার করেন, তখন তাদের দর্শনশাস্ত্রে না হউক, আর কোন শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি বাড়িয়াছে? বয়সের অভিজ্ঞতা লাভ তাঁরা করিয়াছেন নিশ্চয়ই এবং সেটা হইয়াও থাকিতে পারে বিপুল উভয়ের বেলাতেই। কিন্তু অধ্যয়নের শিক্ষাও হইয়াছে কি? ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে, তা হয় নাই। সত্য কথা এই যে কলেজজীবন শেষ করিয়া কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিবার পর শিক্ষাজীবনের নিরবচ্ছিন্নতা ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করা ঘটিয়া থাকে আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের খুব কম লোকের ভাগ্যেই। বরঞ্চ উল্টাটাই সত্য সংসার-জীবনে ঢুকিয়া কলেজে-ভার্সিটিতে অর্জিত বিদ্যা ভুলিয়া যাওয়াই আমাদের দেশের সাধারণ নিয়ম। জ্ঞান অর্জনের জন্য বই-পুস্তক পড়া ত দূরের কথা, আনন্দের জন্য বই পড়ার অভ্যাসও এদেশে খুবই কম।

সুখের বিষয় এর ব্যতিক্রম আছে। আমি গৌরবের সাথে ঘোষণা করিতেছি যে এই ব্যতিক্রমের মধ্যে আমিও একজন। পড়িবার আগ্রহ আমার ছেলেবেলার মতই তীব্র রহিয়াছে। শুধু তা-ই নয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে খিদা যেন আরো বাড়িয়াছে। ছাত্রজীবনের পনের-ষোল বছরে যত বই-পুস্তক পড়িয়াছি, পরবর্তী ষাট বছরে তার চার গুণেরও অনেক বেশি পড়িয়াছি। কাজেই আমি দাবি করিতে পারি যে আমার শিক্ষাজীবন। নিরবচ্ছিন্নভাবে আজও চলিতেছে। আমি আজও ছাত্র। গুরুতর অসুখ ছাড়া অন্য কোনও কারণেই আমার এই ছাত্রজীবনে ছেদ পড়ে নাই। এমনকি কঠিন অসুখেও রোগ মুক্তির পর স্বাস্থ্য লাভের মুদ্দতে বিছানায় শুইয়া বসিয়া কাটাইবার সময়টাও আমি বই-পুস্তক পড়িয়াই কাটাইয়াছি। জেল খাঁটিতে গিয়াও আমার অধ্যয়ন বন্ধ হয় নাই। বরঞ্চ এ সময় আরো বেশি পড়িয়াছি। আমার অধ্যয়নের এলাকা খুবই বিস্তৃত, এমনকি দেওয়ালহীন ছিল বটে এবং আমি সকল শ্রেণীর বই পড়িতাম সত্য, আমার পাঠ্য তালিকায় নাটক, নভেল, কাব্য-কবিতা, মিস্ত্রি-ডিটেকটিভ, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, ভাল-মন্দ, শ্লীল-অশ্লীল এমনকি স্কুল-কলেজের আধুনিক পাঠ্যপুস্তকও ছিল বটে, সব রকমের বই ছিল ঠিক, কিন্তু ফিলসফি, মেটাফিজিকস, পলিটিক্যাল সায়েন্স, ধর্মালোচনা (বিশেষত কোরআন, গীতা, বাইবেল সম্বন্ধে) প্রবন্ধই আমি বেশি পড়িয়াছি। ইতিহাসের প্রতিও আমার আকর্ষণ স্কুল-কলেজজীবন হইতেই ছিল। আজও আছে। টয়েনবি, রাসেল ও শ’র বহু বই পড়িয়াছি। কার্ল মার্ক্সের ক্যাপিটাল আমি একাধিকবার পড়িবার ও বুঝিবার চেষ্টা করিয়াছি। লেনিন ও মাও-এরও অনেকগুলি বই পড়িয়াছি। এসবের বেশির ভাগ পড়িয়াছি স্কুল কলেজজীবনের অবসানের পরে; পারিবারিক জীবনের ঝামেলার মধ্যে; রাজনৈতিক জীবনের হট্টগোলের মধ্যেও।

এসবই পড়িয়াছি জ্ঞান লাভের, মানে শিক্ষিত হইবার আশায়। জ্ঞান লাভও যথেষ্ট করিয়াছি। যথেষ্ট করিয়াছি বলিতেছি এইজন্য যে আমি নিজেই বুঝিতেছি প্রতিদিনই আমি কিছু না-কিছু নূতন জ্ঞান লাভ করিতেছি, নূতন সত্যের সন্ধান পাইতেছি। কাল যা জানিতাম না, আজ তা জানিয়াছি। এর যেন শেষ নাই। জ্ঞান লাভের যেন বিরতি বা বাউন্ডারি নাই। এমনকি নিছক আনন্দের জন্য শুধু সময় কাটাইবার জন্য যেসব মিস্ত্রি ও ডিটেকটিভ গল্প পড়িয়াছি, তাতেও প্রচুর জ্ঞান লাভ করিয়াছি। এসব বিষয়ে ইংলন্ড, আমেরিকার জনপ্রিয় যেসব গল্পকারের বই ও রুশ, ফরাসি যেসব বইয়ের ইংরাজি অনুবাদ পড়িয়াছি, তারও কোনও হিসাব নাই। সত্য-সত্যই অসংখ্য হইবে। অশ্লীল বলিয়া নিন্দিত যৌন-বিজ্ঞানের বই এবং সত্য-সত্যই নিন্দার যোগ্য এ সম্পর্কিত অবৈজ্ঞানিক বইও কম পড়ি নাই। কিন্তু শিক্ষা লাভ করিয়াছি আমি সবগুলি থনেই।

বই-পুস্তক কিনিয়াছি আমি অনেক। এ বিষয়ে সাধ্যানুসারে পয়সা খরচ। করিয়াছি ত নিশ্চয়ই। সাধ্যের অতীতও অনেক খরচ করিয়াছি। কিন্তু আমার মত রাক্ষস পাঠকের বই নিজে কিনিয়া পড়িবার সাধ্য খুব কম লোকেরই থাকে। আমার ত কোনও দিনই ছিল না। সেজন্য পরিচিত বন্ধুবান্ধবের নিকট ধার করিয়া অথবা কোনো লাইব্রেরিতে গিয়া পড়িতে হইয়াছে। বই পড়িয়া জ্ঞান লাভের একটা তৃপ্তি ত আছেই। তা ছাড়া বইয়ের মালিক হওয়ার আনন্দও কম নয়। কলিকাতা থাকিতে আমি ইমপেরিয়াল (বর্তমান ন্যাশনাল) লাইব্রেরিতে বসিয়া অনেক বই পড়িয়াছি। বর্তমানে ইউএসআইএসও বৃটিশ কাউন্সিল হইতে আনাইয়া অনেক বই পড়িয়াছি। বইয়ের মালিক হওয়ার জন্য কলিকাতায় প্রায় ত্রিশ বছরের জীবনে কলেজ স্কোয়ারের সেকেন্ড হ্যান্ড। পুস্তকের দোকানদার ও ফুটপাতের পুরান পুস্তক বিক্রেতাদেরও কম ঘাটাই নাই। বস্তুত আমার খরিদা পুস্তকগুলির মধ্যে অর্ধেকের বেশিই সেকেন্ড। হ্যান্ড। আমার ছেলেরা ও বউয়েরা সবাই পুস্তক কিনিয়া টাকা খরচ করিয়া থাকে। তারা অবশ্য নূতন পুস্তকই কিনিয়া থাকে। এদের কিনা বইয়ের রেঞ্জও খুব বিস্তৃত। বর্তমানে এদের কিনা বই-ই আমি বেশি পড়িয়া থাকি। আমার নিজের বই কিনার সামর্থও নাই, দরকারও পড়ে না।

কলিকাতায় কিনা বইগুলির অধিকাংশই ফেলিয়া আসিতে হইয়াছিল। তবু ছেলে ও বউদের বই-পুস্তক লইয়া আমার বাড়ির লাইব্রেরি মোটামুটি বেশ বড়। অবশ্য আমার সংগ্রহের মধ্যে আইন পুস্তকই বেশি।

আমার ছেলে-বউদের কিনা বই প্রায়ই অবশ্য তাদের নিজ নিজ সাবজেক্টের বই : কেউ ইকনমিকস, কেউ সাইকলযি, কেউ ফিলসফি, কেউ থিওলজি, আর কেউ বাংলা। সব বিষয়েই তারা ডিগ্রি লাভ করিয়াছে। কিন্তু ঐ সাবজেক্টের টেক্সট বুক ছাড়াও অনেকগুলি ইংরাজি নাটক, নভেল ও মিস্ত্রি বই তারা কিনিয়াছে ও কিনিয়া থাকে। ও সবই এখন আমার এই অবসরজীবনের প্রধান খোরাকি।

কেউ কেউ আছেন যারা বই পড়েন, কিন্তু কিনেন না। আবার কেউ কেউ আছেন বই কিনেন, পড়েন না। প্রথম শ্রেণীর লোকেরা পরের বই একবার হাতাইতে পারিলে আর ফেরত দেন না। দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা বৈঠকখানা সাজাইবার জন্য বুক কেস করেন। এই উভয় শ্রেণীর লোকই মন্দের ভাল। পরের বই নিয়া যদি পড়েন এবং পড়ার পরে যদি ফেরত নাও দেন তবু ভাল। পড়িলেন ত। দেশের জন্য এটাই লাভ আর যারা বই কিনিয়া লাইব্রেরি সাজান, পড়েন না, তাঁরাও ভাল যদি তারা অপরকে সে বই পড়িতে দেন। আগের দিন জমিদাররা বই কিনিয়া বড় বড় লাইব্রেরি সাজাইতেন, নিজেরা খুব কমই পড়িতেন। কিন্তু অপরকে তাঁরা পড়িতে দিতেন। ময়মনসিংহ জিলার জমিদারদের অনেকেরই ভাল ভাল লাইব্রেরি ছিল। সেখান হইতে আমি অনেক বই পড়িতে পাইয়াছি।

এতএব বই পড়ার সাধ, মানে জ্ঞান লাভের খিদা, আমার আজও মিটে নাই। কাজেই এই পঁচাত্তর বছর বয়সেও আমার শিক্ষাজীবন শেষ হয় নাই। ফলে আমার আত্মকথার এই অধ্যায় অসমাপ্তই রহিয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *