০৪. নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা–দরিরামপুর

অধ্যায় চার – নিম্নমাধ্যমিক শিক্ষা–দরিরামপুরে

. ত্রিশাল-দরিরামপুর–বনাম ও বেনাম

১৯০৯ সালের জানুয়ারি মাসে আমি ও আমার বড় ভাই মোহাম্মদ মকিম আলী দরিরামপুর মাইনর স্কুলের ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হই। শামসুদ্দিন ও সদরুদ্দিন দুই ভাইও আমাদের সাথে নিম্ন-প্রাথমিক পাশ করিয়া ময়মনসিংহ শহরে গিয়া জিলা স্কুলে ভর্তি হয়।

দরিরামপুর মাইনর স্কুল ছিল একেবারে নূতন। আমরা যে বৎসর সেখানে ভর্তি হইলাম, সেই বারই উহা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম প্রতিষ্ঠিত হইলেও সে নয়া স্কুলে আমাদের উপরের ক্লাসে অর্থাৎ ক্লাস ফোর-ফাইভে এবং সম্ভবত সিক্সেও ছাত্র ভর্তি হইয়াছিল। কাজেই এক মাইনর স্কুলেই ছাত্রসংখ্যা ছিল দেড় শর কাছাকাছি। তার উপর স্কুলঘরের লাগাই ছিল মাদ্রাসা। মাদ্রাসাটি ছিল পুরান নেসাবের। তাতে ছাত্র ছিল পঞ্চাশের উপর। ফলে মোট প্রায় দুই শ ছাত্র একই জায়গায় পড়াশোনা করিতাম।

স্কুল-মাদ্রাসার সামনেই ত্রিশাল থানা। ত্রিশাল গ্রাম আসলে সুতোয়া নদীর পশ্চিম পারে। থানাটি অবস্থিত নদীর পূর্ব পারের দরিরামপুর গ্রামে। এর কারণ, থানার অবস্থিতি লইয়া দুই গ্রামের মধ্যে বিরোধ হইয়াছিল। নেতৃবৃন্দ ও সরকারি কর্মচারীদের মধ্যস্থতায় এই আপস হইয়াছিল যে, থানার অবস্থান হইবে দরিরামপুর গ্রামে, কিন্তু থানার নাম হইবে ত্রিশাল। ইহার ফল এই হইয়াছিল যে থানা প্রতিষ্ঠিত হইবার অল্পদিন পরই সাবরেজিস্টারি অফিসও স্থাপিত হইয়াছে। থানার অনুকরণে সাবরেজিস্টারি অফিসেরও নাম হইয়াছে। ত্রিশাল। কিন্তু তার অবস্থান হইয়াছে দরিরামপুরে। এই নিয়ম আজও চলিতেছে। এর কয়েক বছর পরে পোস্টাফিস হইয়াছে দরিরামপুরে। নাম তার ত্রিশাল। সম্প্রতি রেভিনিউ, কৃষি, পল্লি উন্নয়ন ও টেলিগ্রাফ অফিস ইত্যাদি যতগুলি সরকারি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান হইয়াছে; সবগুলির অবস্থান হইয়াছে দরিরামপুরে কিন্তু নাম হইয়াছে ত্রিশাল। সুতরাং এত দিনে দেখা যাইতেছে যে গোড়ার এ আপসরফায় ত্রিশালেরই জয় হইয়াছিল। সব প্রতিষ্ঠানই ত্রিশালের নাম বহন করিতেছে; কিন্তু সন্তান উদরে ধরিতেছে দরিরামপুর। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এই নিয়ম চলে নাই। হাইস্কুলের অবস্থান ও নাম দরিরামপুরই রহিয়াছে। সম্প্রতি যে কলেজ স্থাপিত হইয়াছে তারও নাম দরিরামপুর। আমি যখন দরিরামপুর মাইনর স্কুলে ভর্তি হইলাম, তখন সাবরেজিস্টারি অফিসও মাত্র কয়েক দিন আগে স্থাপিত হইয়াছে। থানা ও সাবরেজিস্টারি অফিসে কার্যোপলক্ষে প্রতিদিন বহু লোক যাতায়াত করিতেছে। দুই শ ছাত্র, প্রায় পনের জন মাস্টার-মোদাররেস। ছাত্রদের অভিভাবকদেরও অনেকে যাতায়াত করিতেন। এই সব লোকজনের নিত্যপ্রয়োজন মিটাইবার জন্য ডিবি রোডের পার্শ্বে বেশ কয়েকটি দোকানপাট খোলা হইয়াছে। কাপড় সিলাই করিবার জন্য একখানা খলিফার দোকান বসিয়াছে। এখানে বলিয়া রাখা দরকার, ময়মনসিংহ হইতে ডিবি রাস্তা থানা ও সাবরেজিস্টারি অফিসের সামনে দিয়া সুতোয়া নদী পার হইয়াছে এবং ত্রিশাল বাজার ভেদ করিয়া পুড়াবাড়ি পর্যন্ত গিয়াছে। বর্তমানে এই রাস্তা পাকা হইয়াছে এবং সুতোয়া নদীর উপর পাকা পোলও হইয়াছে। কিন্তু তৎকালে নদীতে পোল হয় নাই। রাস্তাটি ছিল কাঁচা।

যা হোক দুই শ ছাত্রের স্কুলেও পার্শ্ববর্তী স্থানে এত লোক সমাগমে আমি সম্পূর্ণ নূতন জীবনের স্বাদ পাইলাম। এত বড় স্কুল। এত সব ছাত্র। এত সব মাস্টার-মৌলবী। সারা দিন এত লোকের আসা-যাওয়া। দারোগা সাহেব পরেন খাকি হাফপ্যান্ট ও সাবরেজিস্টার বাবু সাদা কোট প্যান্টালুন। তাঁদের যাতায়াত সাইকেলে। অবাক বিস্ময়ে এসবের দিকে চাহিয়া থাকিতাম। রাস্তা ঘাটে অনবরত লোকজনের ডাক-চিৎকার তো শুনিতামই। খোদ স্কুলের মধ্যেও যেন পড়ুয়াদের আওয়াজ গমগম করিত। এই নয়া পরিবেশ আমার কাছে স্বপ্নের মত লাগিত। আমি যেন স্বপ্নে কোনো অজানা রাজ্যে আসিয়াছি। যেন শীঘ্রই স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া যাইবে।

কিন্তু স্বপ্ন ভাঙ্গিল না। আস্তে আস্তে পরিবেশে মিলিয়া গেলাম। সবই বাস্তব হইয়া আসিল। এবং ভালও লাগিল। স্কুলের মাস্টার ছিলেন মোট সাতজন। বাবু বসন্তকুমার সেন ছিলেন হেডমাস্টার। তার বাড়ি ছিল নেত্রকোনা। বাবু কৈলাস চন্দ্র দে ছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার। তাঁর বাড়ি ত্রিশাল থানার কাঁঠাল গ্রামে। হেডপণ্ডিত ছিলেন বাবু ঈশান চন্দ্র রায় তর্কালঙ্কার। তাঁর বাড়ির ঠিকানা মনে নাই। সেকেন্ড পণ্ডিত ছিলেন জনাব খিদির উদ্দিন খাঁ। বাড়ি ছিল ফুলবাড়িয়া থানার মাগুরজোড়া গ্রামে। হেডমৌলবী ছিলেন মৌ. যহুরুল হক। বাড়ি আমাদেরই পার্শ্ববর্তী গ্রাম বৈলরের কানহর নামক মৌযায়। এ ছাড়া আরো দুইজন শিক্ষক ছিলেন। একজনের নাম মোহাম্মদ শাহজাহান মিঞা। আরেকজনের নাম ছিল জনাব আব্বাস আলী।

শিক্ষকদের মধ্যে হেডমৌলবী মৌ, যহুরুল হক সাহেব আমার এক মামুর সম্বন্ধী। কাজেই তিনি আমাকে আগে হইতেই চিনিতেন। তা ছাড়া তিনি প্রতি শনিবার অবশ্যই এবং সপ্তাহের আরো দুই-এক দিন আমাদের সঙ্গেই বাড়ি আসিতেন। এবং ফিরিবার কালে প্রায় সবদিনই একই সঙ্গেই যাইতেন। কাজেই তার সঙ্গে স্বভাবতই ঘনিষ্ঠতা হয়। সেকেন্ড পণ্ডিত জনাব খিদির উদ্দিন খাঁ সাহেবের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়। সেকেন্ড পণ্ডিত জনাব খিদির উদ্দিন খাঁ সাহেবের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয় অন্য কারণে। আমার চাচা জাফর সাহেব ছিলেন পণ্ডিত সাহেবের নিকট প্রতিবেশী। চাচাজীর প্রতি পণ্ডিত সাহেবের পরিবারের উচ্চ ধারণা ছিল। গাজী সাহেবের পুত্র বলিয়া চাচাজীকে তারা সম্মান করিতেন। প্রায়ই তিনি জাফর চাচার তারিফ করিতেন। সে জন্য মনে মনে পণ্ডিত সাহেবের প্রতি আমি একটা আত্মীয়তা অনুভব করিতাম।

.

. হেডমাস্টারের নজরে সত্যবাদিতা

হেডমাস্টার বসন্ত বাবুর প্রিয় ছাত্র হই আমি এক আকস্মিক ঘটনায়। সেদিন আমাদের ক্লাসটিচার ছিলেন অনুপস্থিত। আমাদের ক্লাসের ছাত্রসংখ্যা ছিল চল্লিশের মত। এত বড় ক্লাসে ক্লাসটিচার না থাকিলে যা হওয়ার কথা তাই হইল। তুমুল হট্টগোল চলিতে লাগিল। হঠাৎ হেডমাস্টার বাবু আসিয়া ক্লাসের দরজায় দাঁড়াইলেন। ক্লাসের উপর যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হইল। হেডমাস্টার বাবুকে ছাত্ররা যমের মত ভয় করিত। কাজেই সারা ক্লাস একদম চুপ। নিঃশব্দে সকলে যার-তার সিটে দাঁড়াইয়া রহিলাম। হেডমাস্টার বাবু গম্ভীর মুখে একপা-দুপা করিয়া ক্লাসে ঢুকিলেন। ভাটার মত চোখ দুইটা সারা ক্লানের উপর দিয়া একবার ঘুরাইয়া নিয়া কঠোর আদেশের সুরে বলিলেন : “তোমরা সকলেই বসো। যন্ত্রচালিত-মত আমরা নিঃশব্দে বসিলাম। তিনি এইবার বজ্রনির্ঘোষে বলিলেন : “এইবার কও, গোলমাল করিয়াছে কে?’ ভয়ে সব ছাত্রেরই হাঁটু ঠকঠক করিতেছে। জিভ শুকাইয়া গিয়াছে। কেউ জবাব দিল না। হেডমাস্টার বাবু আবার গর্জন করিলেন : ‘কথার জবাব দাও। বলো, কে গোলমাল করিয়াছ?’

নিথর নিঃশব্দে ক্লাসের মধ্যে আমি অতি কষ্টে দাঁড়াইলাম। আমার হাঁটু ঠকঠক করিতেছিল। সারা গায় ঘাম ছুটিয়া গিয়াছিল। আমার জিভ শুকাইয়া গিয়াছিল। কোনো কথা বলিলাম না। শুধু, ফ্যালফ্যাল করিয়া হেডমাস্টার বাবুর দিকে তাকাইয়া রহিলাম। হেডমাস্টার বাবু আমার দিকে তাকাইলেন এবং বলিলেন : তুমি গোলমাল করিয়াছ?

আমার গলা দিয়া কথা আসিতে চাহিল না। কাজেই মাথা ঝুকাইলাম এবং ধরা গলায় বলিলাম : ‘জি, সার। হেডমাস্টার বাবুর মুখের গাম্ভীর্য বিস্ময় কৌতূহলে রূপান্তরিত হইল। তিনি কৌতূহলের সুরে বলিলেন : তুমি একাই গোলমাল করিয়াছ?

আমি আবার শির ঝুকাইয়া ধরা গলায় বলিলাম : ‘জি, সার।

এবার হেডমাস্টার বাবু লম্বা মোচের নিচে মুচকি হাসিলেন। বলিলেন : ‘এত বড় গোলমালটা তুমি একাই করিয়াছ? আর কেউ করে নাই?

আমি মাথা হেঁট করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম।

হেডমাস্টার বাবু আবার গম্ভীর সুরে বলিলেন : ‘এক জনে গোলমাল করা যায় না। এই ছেলে সত্য কথা কহিয়াছে। আর তোমার কেউ সত্য কথা কও নাই। এই ছেলে সত্য কথা বলার পুরস্কার পাইবে। সে একা বসিবে। আর তোমরা সকলে স্কুল ছুটি না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়াইয়া থাকিবা।

বলিয়া হাসিমুখে আমার দিকে চাহিয়া স্নেহমাখা সুরে বলিলেন : তুমি বসো। তোমার নাম কী?

আমি নাম বলিলাম। তিনি আবার বলিলেন : তুমি বসো।’ আমি বসিলাম। হেডমাস্টার বাবু আর সকলের দিকে চাহিয়া বলিলেন : তোমরা দাঁড়াইয়া থাকো। সকলে দাঁড়াইল। হেডমাস্টার বাবু ক্লাস থনে বাহির হইয়া গেলেন।

হেডমাস্টার বাবুর এই শাস্তিতে সারা ক্লাস শান্তই ছিল। আর কেউ কোনও গোলমাল করে নাই। তবু কিছুক্ষণ পরে চুপে চুপে পা ফেলিয়া হেডমাস্টার বাবু আমাদের ক্লাসে উঁকি দিলেন। ছাত্ররা তার আদেশ পালন করিতেছে কি না, তা দেখিবার জন্যই বোধ হয় তিনি আসিয়াছিলেন। তিনি ক্লাসের দরজায় দাঁড়াইয়া দেখিলেন, সকলে তো দাঁড়াইয়া আছেই, আমিও দাঁড়াইয়া আছি।

তিনি তখন ক্লাসে ঢুকিলেন। আমার দিকে চাহিয়া তিরস্কারের সুরে বলিলেন : “তোমাকে ত আমি বসিতে বলিয়াছিলাম। তুমি দাঁড়াইয়া আছ। কেন?

আমি মাথা হেঁট করিয়া রহিলাম। কোনও জবাব দিলাম না। হেডমাস্টার বাবু এবার কঠোর হইয়া বলিলেন : ‘কেন তুমি বসো নাই? কেন আমার আদেশ অমান্য করিলা?’

আমি ফোৎ ফোৎ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিলাম। হেডমাস্টার বাবু অবাক হইয়া আগ বাড়িলেন। আমার মাথায় হাত রাখিয়া বলিলেন : ‘কাঁদো কেন? কী হইয়াছে?’

হেডমাস্টার বাবুর স্নেহমাখা সুরে আমার সাহস বাড়িল। তখন কান্না রুখিয়া অতি কষ্টে বলিলাম : আমার মিঞা ভাই এই ক্লাসেই আছে। তারে খাড়া রাইখা আমি বসি কেমনে?

হেডমাস্টার বাবু হাসিমুখে বলিলেন : ‘তোমার মিঞা ভাই কে?’

আমি আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিলাম। হেডমাস্টার বাবু তাঁকে বলিলেন : ‘তোমার ছোট ভাই-এর খাতিরে তোমাকেও বসিতে দিলাম। তোমরা দুই ভাই বসো। আর সকলে দাঁড়াইয়া থাকো।’

আমরা দুই ভাই এতক্ষণ দুই জায়গায় ছিলাম। এইবার দুজন একত্র হইয়া আরামসে বসিয়া রহিলাম। আর দাঁড়ানো সহপাঠীদের দুর্দশা হাসিমুখে উপভোগ করিতে লাগিলাম।

এতে আমরা দুই ভাই কিছুদিনের জন্য সহপাঠীদের চক্ষুশূল হইলাম বটে, কিন্তু অল্পদিনেই সে ভাব কাটিয়া গিয়াছিল। তবে এই ঘটনায় আমি হেডমাস্টার বাবুর সুনজরে পড়িলাম। তিনি ঐ গল্প সারা স্কুলে ছড়াইয়া। দেওয়ায় অন্য মাস্টাররা এবং অপর ক্লাসের ছাত্ররা আমাকে খুব ভালবাসিতে লাগিলেন। আমি ছাত্রও ভাল ছিলাম। ষান্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষায় প্রায় সকল সাবজেকটেই ফার্স্ট হইতাম। এটাও আমার জনপ্রিয়তার কারণ ছিল।

এইভাবে হেডমাস্টার বাবুর স্নেহাদরের মধ্যে ক্লাস ফোরে উঠিবার পর হেডমাস্টার বাবুর সাথে আবার আরেকটা দুর্ঘটনা ঘটিয়া যায়। সে ঘটনাটি ঘটে এইভাবে :

.

. হেডমাস্টারের ডাক-হরকরা

তখনও ত্রিশাল পোস্টাফিস হয় নাই। বৈলরের পোস্টাফিস মারফতই তখনও এই স্কুলের চিঠিপত্র যাতায়াত হয়। বৈলর পোস্টাফিস আমাদের বাড়ির কাছে। স্কুলে যাতায়াত করিতে আমাদের এই পোস্টাফিসের সামনে দিয়াই যাইতে হয়। দরিরামপুর অঞ্চলে সপ্তাহে একবার মাত্র চিঠিপত্র বিলি হইত। বৃহস্পতিবার দিন ত্রিশাল বাজারের হাট বার। বিরাট হাট। পঞ্চাশ হাজার হইতে প্রায় এক লক্ষ লোক এই হাটে জমায়েত হইত। বৈলর পোস্টাফিসের পিয়ন ত্রিশালের বাজারে এই হাটের দিন এক নির্দিষ্ট জায়গায় বসিতেন। স্কুল, মাদ্রাসা, থানা, সাবরেজিস্টারি আফিস ও এতদঞ্চলের সমস্ত চিঠিপত্র এইখান থনেই বিলি হইত। পিয়ন ঐ দিন প্রচুর পোস্টকার্ড, স্ট্যাম্প, ইনভেলাপ নিয়া আসিতেন। ওখানে বসিয়াই বিক্রি করিতেন। বাজারের এক দোকানের বারান্দায় একটি চিঠির বাক্স টানানো ছিল। ঐ দিন পিয়ন ঐ বাক্স খুলিয়া চিঠিপত্র লইয়া যাইতেন। তা ছাড়া পিয়নের হাতে হাতে চিঠি দিয়া দিলেও ডাকে দেওয়া হইয়া যাইত। অবশ্য ত্রিশাল বাজারে প্রবেশ করিবার আগে পিয়নকে দরিরামপুর হইয়া আসিতে হইত। সে জন্য থানা সাবরেজিস্টারি আফিস ও স্কুল-মাদ্রাসার পত্রগুলি অনেক সময় তিনি যার-তার আফিসেই দিয়া আসিতেন। তবু এদের সকলের অসুবিধা হইত।

হেডমাস্টার বাবু যখন জানিতে পারিলেন যে, স্কুলে যাতায়াত করিতে আমরা কয়জন বৈলর পোস্টাফিসের সামনে দিয়াই যাওয়া-আসা করিয়া থাকি, তখন তিনি এক সহজ উপায় বাহির করিলেন। তিনি স্কুলের সমস্ত চিঠিপত্র আমাকে দিয়া পোস্ট করাইতে লাগিলেন। তাতে আমার কোনোই অসুবিধা হইত না। স্কুল হইতে ফিরিবার পথে চিঠিগুলি পোস্টাফিস ঘরের বেড়ায় মুখ হাঁ-করা ডাকবাক্সে ফেলিয়া দিয়া যাইতাম।

ফলে যেদিন হেডমাস্টার বাবুর চিঠি থাকিত, সেদিন পোস্টাফিস হইয়া যাওয়া আমার উপর বাধ্যতামূলক হইয়া পড়িত। আমাদের বাড়ি হইতে দরিরামপুর যাতায়াত করিবার একাধিক রাস্তা ছিল। পোস্টাফিসের সামনের রাস্তা তার মধ্যে একটি। কবে কোন রাস্তায় যাইব, সেটা নির্ভর করিত সাথীদের উপর। স্কুল হইতে বাহির হইবার সময় এক রাস্তার একই দিকে অনেক ছাত্র চলিতাম। তারপর আগ বাড়িতে-বাড়িতে সাথীসংখ্যা কমিতে থাকিত। একজন-দুইজন করিয়া ভিন্ন রাস্তায় আমরা ভাগ হইয়া পড়িতাম। পোস্টাফিসের কাছে আসিতে আসিতে আমরা চার-পাঁচজনে পরিণত হইতাম। এদের অধিকাংশের মত অন্য রাস্তায় যাইবার পক্ষে হইলে সাধারণত আমি ও মিঞা ভাই তা মানিয়া লইতাম। কিন্তু হেডমাস্টার বাবুর চিঠি ডাকে দেওয়া থাকিলে কিছুতেই আমি অন্য রাস্তায় যাইতে পারিতাম না। সাথীরা রাগ করিয়া আমাকে একা ত্যাগ করিও না। সে অবস্থায় আমার বড় ভাইই আমার একমাত্র সাথী হইতেন। এইটুকু অসুবিধা আমি সহজেই অগ্রাহ্য করিতাম। কারণ হেডমাস্টার বাবু জরুরি চিঠিপত্র আমার হাতে দিয়া বিশ্বাস করেন, এটা কম গৌরবের কথা নয়। বস্তুত এ জন্য আমার অনেক বন্ধু ঈর্ষাপরায়ণ হইয়াছে। আমার উপরের ক্লাসের কয়েকজন বয়স্ক ছাত্র হেডমাস্টার বাবুর চিঠি ডাকে দেওয়ার ভার লইতে চাহিয়াছেন, কিন্তু হেডমাস্টার বাবু রাজি হন নাই।

নিয়মিতভাবে পরম বিশ্বস্ততার সঙ্গে আমি এই দায়িত্ব পালন করিয়া চলিলাম। ছয় মাস চলিয়া গেল। কোনও ত্রুটি বা অসুবিধা হইল না। কিন্তু ছয় মাস পরে একটা গোলমাল হইয়া গেল।

ব্যাপারটা এই :

.

. হেডমাস্টারের ‘ভুল’

তৎকালে দরিরামপুর স্কুল লোকাল বোর্ড হইতে মাসিক অর্থ সাহায্য পাইত। সে জন্য আইন অনুসারে স্কুলের হেডমাস্টারকে লোকাল বোর্ড অফিসে একটি ষান্মাসিক রিপোর্ট পাঠাইতে হইত। এ বছরের ষান্মাসিক রিপোর্টও যথারীতি তিনি আমাকেই পোস্ট করিতে দিলেন। এটা ছিল একটা লম্বা ইনভেলাপ। অত বড় চিঠি এর আগে আমরা কেউ দেখি নাই। কাজেই পথে আসিতে সাথীরা সবাই এটা দেখিতে চাইল। আমি এক্সারসাইয বুকের মলাটের ফাঁক হইতে বাহির করিয়া সকলকেই দেখাইলাম। কিন্তু কাউকে ছুঁইতে দিলাম না। সাথীদের দেখাইতে গিয়া আমারও কৌতূহল হইল। আমি নিজে পথ চলিতে চলিতে চিঠিটা দেখিতে থাকিলাম। স্পেলিং করিয়া করিয়া ঠিকানাটা পড়িবার চেষ্টাও করিলাম। চিঠিটার ঠিকানা ছিল ‘টু দি ভাইস চেয়ারম্যান লোকাল বোর্ড সদর ময়মনসিংহ।’ কারণ তৎকালে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটরা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের এবং এসডিওরা মহকুমার লোকাল বোর্ডের এক্স-অফিশিও চেয়ারম্যান থাকিতেন। ঐ সব প্রতিষ্ঠানেই নির্বাচিত মেম্বরদের মধ্য হইতে একজন ভাইস চেয়ারম্যান হইতেন। কার্যত এই ভাইস চেয়ারম্যানই ঐ প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন। সে জন্য সাধারণত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের লেখা সমস্ত চিঠিপত্র ভাইস চেয়ারম্যানের নামেই পাঠাইবার নিয়ম ছিল। কিন্তু আমি দশ বছরের শিশু। অতশত কি জানি? আমি ক্লাস ফোরের ভাল ছাত্র। ওয়ার্ডবুক আমার মুখস্থ। ম্যান’ মানে মানুষ, চেয়ার’ মানে কুরসি, এটা তো সোজা কথা। কাজেই চেয়ারম্যান। মানে কুরসি বানাইবার সুতারমিস্ত্রী, এটাও আমার মত ভাল ছাত্রের পক্ষে বুঝা কঠিন হইল না। কিন্তু চিন্তায় পড়িলাম আগের শব্দটা লইয়া। এটা কী? একটা খাড়া টান দিয়া তার গোড়া হইতে ডান দিকে একটা তেরছা টান বেশ লম্বা করিয়া যে হরফটা লেখা হইয়াছে তাতে শব্দটা হয় ভাইস’। কিন্তু এখানে সে শব্দের কোনও মানে হয় না। ভাইস মানে পাপ’। পাপের সাথে চেয়ার বা সুতারমিস্ত্রীর কোনও সম্পর্ক থাকিতে পারে না। কাজেই একটা কিছু ভুল এখানেই হইয়াছে। তাতে সন্দেহ নাই। হেডমাস্টার বাবুকে আমি শুধু শ্রদ্ধা করিতাম না, ভালবাসিতাম। তার মত পণ্ডিত লোক খুব কমই আছে। এই ছিল আমার বিশ্বাস। তাঁরই নিজ হাতে লেখা একটা চিঠি এমন বড় একটা ভুল লইয়া শহরে চলিয়া যাইবে, আর শহরের সরকারি লোকের নিকট আমার প্রিয় হেডমাস্টারের দুর্নাম হইবে, এটা আমার কিছুতেই সহ্য হইতেছিল না। আমি আমার সমস্ত বিদ্যা-বুদ্ধি খাটাইয়া এই ভুল সংশোধনের উপায় চিন্তা করিতে লাগিলাম। অনেক গবেষণা করিলাম। আমাকে চিন্তিত দেখিয়া এবং সাথীদের হৈ হল্লা ও অট্টহাসিতে বরাবরের মত যোগ দিতেছি না দেখিয়া অনেকেই কারণ জিজ্ঞাসা করিল। আমি সবচেয়ে ভাল ছাত্র। এ ব্যাপারে তাদেরে জিগাইবার কী আছে? আমি কিছু না বলিয়া তাদেরে এড়াইয়া চলিলাম এবং চিন্তা ও গবেষণা চালাইয়া গেলাম। ক্রমে সাথী-সংখ্যা কমিতে লাগিল। আমিও অধিকতর সূক্ষ্মভাবে ভাইস কথাটার উপর চোখ বুলাইতে লাগিলাম। এই সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে একটা বস্তু আমার নজরে পড়িল। দেখিলাম, “ভি’র খাড়া টান-টান মাথার পিছন দিকে অর্থাৎ বাম দিকে সূক্ষ্ম ও অতি ক্ষুদ্র একটি টান নিচ মুখে হেলিয়া রহিয়াছে। এই টানটি আরো একটু লম্বা হইলেই হরফটা ভি’ না হইয়া এন’ হইয়া যাইত। বিদ্যুতের বেগে আমার মাথায় একটা অনুপ্রেরণা নাজিল হইল। হাঁ, এটা ‘এন’-ই বটে। শব্দটা তবে ভাইস’ নয় নাইস’। এবার ব্যাপারটা আমার কাছে দিনের আলোর মত পরিষ্কার হইয়া গেল। নাইস’ মানে সুন্দর। ঠিক, হেডমাস্টার বাবুর সুন্দর চেয়ারের জন্য শহরে অর্ডার দিয়াছেন। চিঠিতে চেয়ারের সাইয মাপ ও কাঠ ইত্যাদির বিশদ বর্ণনা দিয়াছেন নিশ্চয়ই। কাজেই অত বড় চিঠি। এইবার আমার মনে পড়িয়া গেল, মাত্র কয়েক দিন আগে হেডমাস্টার বাবু সেক্রেটারি জনাব মানিক হাজী সাহেবের সঙ্গে স্কুলের এবং টিচারদের কমনরুমের চেয়ারের অভাবের কথা এবং শীঘ্রই কতকগুলি ভাল চেয়ার আনিবার কথা আলোচনা করিয়াছিলেন। সেই আলোচনায় হেডমাস্টার বাবু স্কুলের সেক্রেটারি মানিক হাজী সাহেবকে এমন কথাও বলিয়াছিলেন যে ভাঙা চেয়ারে বসিতে গিয়া অনেক শিক্ষকের জামাকাপড়ও দু-একবার ছিঁড়িয়া গিয়াছে।

আর কোনও সন্দেহ থাকিল না। হেডমাস্টার বাবু ব্যস্ত মানুষ। তাঁর অবসর খুবই কম। সেই ব্যস্ততার মধ্যে তিনি তাড়াতাড়িতে এই পত্র লিখিয়াছিলেন। বস্তুত ব্যাপারটা আমার চক্ষের সামনে এখন স্পষ্ট ভাসিয়া উঠিল। আমাকে দাঁড়াইতে বলিয়া তিনি এই চিঠিটা লিখিয়াছিলেন। তাড়াতাড়িতে লিখিবার ফলে নিশ্চয় নূতন সরু নিবেরই দোষে ‘এন’-এর বাম। দিকটার টানটা পুরাপুরি পড়ে নাই। আমি লেফাফাটা আরো চোখের কাছে আনিয়া দেখিতে পাইলাম যে, ‘এন’-এর বাম দিকটার টানটা না পড়িলেও নিবের একটা আঁচড় ওখানে স্পষ্টই দেখা যাইতেছে।

.

. ‘ভুল’ সংশোধন

সুতরাং আমি স্থির করিয়া ফেলিলাম, চিঠিটা ডাকে দিবার আগে ওটা সংশোধন করিতে হইবে। সাথীদেরে, এমনকি আমার বড় ভাইকে কিছু। বলিলাম না। তাদের সাথে কেন পরামর্শ করিব? আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয়। ইংরাজিতে আমি এক শ নম্বরের মধ্যে পঁচানব্বইর কম কখনও পাই না। আর আমার সাথীরা পঞ্চাশ-ষাটের বেশি কেউ কখনও পান নাই। ইংরাজি শব্দ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিতে যাইব ওদেরে? একটা ফন্দি করিয়া সাথীদের নিকট হইতে আমি আলগা হইয়া পড়িলাম।

বাজারে গেলাম, ঢুকিলাম এক পরিচিত বড় দোকানে। দোকানের ফরাশের কলমদানে দুইটা দোয়াত ও চার-পাঁচটা কলম রাখা ছিল। পরীক্ষা করিয়া তারই একটা বাছিয়া লইলাম। কালি মিলাইয়া অতি সাবধানে ‘এন’ এর বাম দিককার টানটা লম্বা করিয়া ভাইস চেয়ারম্যানকে ‘নাইস’ চেয়ারম্যান করিয়া ফেলিলাম। চুষ কাগজ দিয়া ওটাকে নিপিস করিয়া শুখাইলাম। দৌড়াইয়া পোস্টাফিসে গেলাম। বরাবরের চেয়ে অনেক বেশি সাবধানে চিঠিটা বাক্সে ফেলিলাম। সে উদ্দেশ্যে বাক্সের হাঁ-করা মুখে হাত যতটা ঢুকে ততটা ঢুকাইলাম। চিঠিটা সশব্দে যখন বাক্সের তলায় পড়িল, তখন নিশ্চিত হইয়া আরামের নিশ্বাস ফেলিলাম। আল্লার দরগায় হাজার হাজার শোকর। আমার প্রাণপ্রিয় গর্বের ব্যক্তি হেডমাস্টার বাবুকে নিশ্চিত অপমানের ও বদনামের হাত হইতে রক্ষা করিতে পারিলাম!

এর দিন দশেক পরে একদিন হেডমাস্টার বাবু আমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। তাঁর কামরায় গিয়া দেখিলাম, তিনি একা গম্ভীর মুখে বসিয়া আছেন। আমি ‘আদাব’ দিয়া সামনে দাঁড়াইলাম। তিনি বিষণ্ণ মুখে বলিলেন : ‘কিছুদিন আগে তোমারে একটা বড় লেফাফা ডাকে দিতে দিছিলাম মনে আছে?’

আমি : মনে আছে, সার।

হেডমাস্টার : তুমি সেটা নিজ হাতে ডাকবাক্সে দিছিলা? না, আর কারো হাতে দিছিলা?

আমি : আমি নিজ হাতেই বাক্সে দিছিলাম সার। সেই দিনই স্কুল থনে ফিরবার পথেই দিছিলাম। কেন সার? কী হইছে?

হেডমাস্টার বাবু আমার প্রশ্ন অগ্রাহ্য করিয়া নিজেই প্রশ্ন করিলেন : ডাকবাক্সে ফেলবার আগে চিঠিটা বরাবর তোমারই কাছে আছিল? না, আর কারো কাছে দিছিলা?

আমি সোৎসাহে বলিলাম : না সার, আর কারো হাতে দেই নাই। অনেকেই অত বড় চিঠিটা দেখতে চাইছিল। কিন্তু চিঠিটা আমি হাতছাড়া করছি না। আমার হাতে রাইখাই সকলরে দেখাইছি। কেউরেই ছুঁইবার ধরবার দেই নাই।’

হেডমাস্টার বাবু কী যেন চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন : তুমি চিঠিটা ডাকে দিবার আগে লেফাফার ঠিকানা লেখাটা পড়ছিলা?

এতক্ষণে সব ব্যাপারটা আমার চক্ষের সামনে পরিষ্কার হইয়া আসিয়া উঠিল। একটা অজানা অশুভ চিন্তায় আমার বুক কাঁপিয়া উঠিল। আমি বলিলাম : ‘জি সার, পড়ছিলাম।’

হেডমাস্টার বাবু আড়চক্ষে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন : ‘ওতে কোনো রকম ভুল তোমার নজরে পড়ছিল কি?

আমার মনে অশুভ চিন্তা মুহূর্তে কাটিয়া গেল। আমি উৎসাহভরে বলিলাম : ‘হ সার। আপনার তাড়াতাড়ির জন্য একটা টান অস্পষ্ট হৈয়া গেছিল। তাতে ‘নাইস’ শব্দটা ভাইস’ হৈয়া গেছিল। আমি ওটা ঠিক কৈরা দিছিলাম।

মোচের নিচে অতিকষ্টে হাসি গোপন করিয়া গম্ভীর মুখে হেডমাস্টার বাবু বলিলেন : এ ভুল সংশোধনের জন্য স্কুলের সাহায্য কাটা যাবার এবং আমার চাকরি যাবার সম্ভাবনা হইছে। অমন সংশোধন আর কখনও কইর না। ময় মুরুব্বি গুরুজনের ভুল সংশোধন করবার আগে চিন্তাভাবনা কইর।

বলিয়া তিনি আরেকটা লম্বা লেফাফা দেখাইলেন। বলিলেন যে লোকাল বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান রাগ করিয়া ঐ পত্রটা পাঠাইয়াছেন। তিনি মনে করিয়াছেন হেডমাস্টার বাবু তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা-মশকরা করিয়াছেন। অতঃপর হেডমাস্টার বাবু আমাকে ভাইস চেয়ারম্যান শব্দের অর্থ বুঝাইয়া দিলেন। আমি লজ্জায় মাটির সাথে মিশিয়া যাইতে থাকিলাম। হেডমাস্টার বাবু আমার দুর্দশা দেখিয়া দয়াপরবশ হইলেন। আমাকে সান্ত্বনা ও উৎসাহ দিয়া ক্লাসে ফিরিয়া যাইতে বলিলেন।

হেডমাস্টার বাবুর কাছে অত সহজে রেহাই পাইয়া তাঁর প্রতি আমার ভক্তি আরো বাড়িয়া গেল। তিনি আমার এই এই লজ্জাজনক ব্যাপারটা কারো কাছে প্রকাশ করিলেন না। হেডপণ্ডিত ঈশান চন্দ্র রায় মশায়ের নিকট এই ব্যাপারটা ঘটিলে কী যে ঘটিত বলা যায় না। সারা গা কাঁটা দিয়া উঠিল। মাত্র কয়েক মাস আগের ঘটনা মনে পড়িয়া গেল। ঘটনাটা এই:

.

. মহিষ ও মহিষী

আমাদের বাংলা সাহিত্যের বইয়ে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড ও রানী আলেকজান্দ্রার দুইটা ছবি ছিল। দুইটা ছবিই সমান সাইযের আন্ডার মত গোলাকার। দুইটা ছবিই একই পৃষ্ঠায় পাশাপাশি ছাপা। রাজার ছবির নিচে লেখা ছিল : সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড। আর রানীর ছবির নিচে লেখা ছিল মহিষী আলেকান্দ্রা’। সপ্তম এডওয়ার্ড তখন আমাদের রাজা। সকলেই তাঁর নাম জানিতাম। রাজা-সম্রাটদের ‘বউ’ থাকে, এ জ্ঞানও আমার ছিল। সুতরাং রাজার পাশের ছবির মেয়ে লোকটা রাজার বউ হইবেন, তাতে আমার সন্দেহ থাকিল না। কিন্তু তাঁকে মহিষী বলা হইবে কেন, এটা আমি বুঝিতে পারিলাম না। চাচাজীকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, বড় বড় রাজা-বাদশার স্ত্রীকে সম্মান করিয়া মহিষী বলা হয়। চাচাজীর জবাবে সন্তুষ্ট না হইয়া হেডপণ্ডিত মশায়ের কাছে জিজ্ঞাসা করিলাম। বুঝিলাম, চাচাজী ঠিকই বলিয়াছেন। পণ্ডিত মহাশয় কিছু কিছু অবোধ্য সংস্কৃত আওড়াইয়া ধাতু প্রত্যয় বুঝাইবার। চেষ্টা করিয়া বলিলেন যে সংস্কৃত মহ+ইষ=মহিষ হইতে মহিষী হইয়াছে। আমি যাহা বুঝিবার বুঝিলাম।

এরপর আমার সিদ্ধান্ত দুর্নিবার হইয়া উঠিল। রানীকে সম্মান দেখাইয়া যদি মহিষী বলা যায়, তবে রাজাকে সম্মান দেখাইয়া নিশ্চয়ই মহিষ বলা যায়। যাহা চিন্তা, তাহা কাজ। পাঠ্যপুস্তকের ঐ পাতাটি বাহির করিয়া সপ্তম এডওয়ার্ডের ছবির নিচের লেখাটা বাম দিকে ‘সম্রাট’ কথাটা সাফ কাটিয়া সে স্থলে যথাসাধ্য ছাপার হরফের মত সুন্দর করিয়া গুট-গুট হরফে মহিষ লিখিয়া রাখিলাম। সহপাঠী ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছে, এমনকি বড় ভাইয়ের কাছে, খুব জোরের সঙ্গে বলিয়া বেড়াইতে লাগিলাম, বড় বড় রাজাকে মহিষ বলা হয়। আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয় বলিয়া কেউ আমার কথায় সন্দেহ করিল না। এসব ব্যাপারে আমার মত কেউ মাথা ঘামাইতেন না। আধুনিক ভাষায়, গবেষণা করিতেন না।

পণ্ডিত মশায়ের একটা বরাবরের অভ্যাস ছিল তিনি ক্লাসে ঘুরিয়া ঘুরিয়া পড়াইতেন। তিনি চেয়ারে বসিলেই তার ঘুম পায়। ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইবার সময় তিনি এক-এক সময় যাকে সামনে পাইতেন, তার হাত হইতেই খপ করিয়া পড়ার বইটা টানিয়া নিতেন এবং বই দেখিয়াই তিনি ছাত্রদেরে প্রশ্ন করিতেন। তিনি বলিতেন, এতে তার দুইটা উদ্দেশ্য সাধিত হইত। অনেকে দুষ্ট ছেলে আসল পড়ার বইটা হাতে না লইয়া যে কোনও একটা বই খুলিয়া মুখের সামনে ধরিয়া রাখিত এবং পাঠ্যবই পড়িতেছে বলিয়া মাস্টার মশায়কে ফাঁকি দিত। হেডপণ্ডিত মশায়ের ক্লাসে অমন চালাকি করিবার উপায় ছিল না। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল, কোন ছেলে তার পড়ার বই কত পরিচ্ছন্ন রাখিয়াছে, তা দেখা। সেদিন তিনি এমন করিয়া আমার সাহিত্য বইটা টানিয়া নিলেন। পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে তাঁর নজর পড়বি-ত-পড় একেবারে রাজা-রানীর পৃষ্ঠায়। তিনি চোখ বড় করিয়াই কপালে তুলিলেন। তারপর আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন : “এটা কে করেছে?

বলিয়া তিনি আমার সামনে আঙুল দিয়া ছবিটার কাটা জায়গা দেখাইলেন।

আমি ব্যাপার বুঝিলাম। নির্ভয়ে বলিলাম : আমি।’

পণ্ডিত মহাশয় আমার স্থিরভাব দেখিয়া রুষ্ট হইলেন। কঠোর সুরে বলিলেন : “এটা তোমারে কে শিখাইছে?”

আমি সপ্রতিভভাবে বলিলাম : আপনে সার।’

পণ্ডিত মহাশয় বিস্ময়-ক্রোধে গর্জিয়া উঠিলেন। বলিলেন : আমি?

তাঁর বাঁ হাতটা আমার ডান কানের দিকে আসিতে আসিতে ফিরিয়া গেল। বলিলেন : তুমিও শেষ পর্যন্ত “বাজাইরা” হৈতছ?

‘বাজাইরা’ হেডপণ্ডিত মহাশয়ের মুখে সবচেয়ে অপমানকর গাল। যেসব দুষ্ট ছাত্র স্কুল ছুটির পর সোজা বাড়ি মুখে রওয়ানা না হইয়া বাজারের দোকানে দোকানে আড্ডা মারিয়া বেড়ায়, তাদেরই হেডপণ্ডিত মশায় ‘বাজাইরা’ বলিতেন। তাঁর মতে, এ ধরনের ছেলে জীবনে উন্নতি করিতে পারিবে না। লেখাপড়া তাদের হইবে না। পিতা-মাতার অবাধ্য হইবে এবং শেষ জীবনে তাদের অনেক কষ্ট-লাঞ্ছনা হইবে। হেডপণ্ডিত মহাশয়ের এক ‘বাজাইরা’ কথার মধ্যে এত এত সুদূরপ্রসারী অর্থ নিহিত ছিল। কাজেই খুব অপমান বোধ করিলাম। ঘাড় হেঁট করিয়া বলিলাম : রানী মহিষী হৈলে রাজা মহিষ হইব না কেন, সার?

আমার এই অকাট্য যুক্তির কোনও জবাব পণ্ডিত মহাশয় দিতে পারিলেন। তাই তিনি আরো বেশি রাগিয়া বলিলেন: ফের ‘যদি’ ‘বাজাইরার মত তর্ক করো তবে তোমারেও একদিন নারিকেলের ঝোকা’ বানাইয়া ছাড়ম। ক্লাসের ফার্স্ট বয় বৈলা খাতির করুম না।’

.

. পণ্ডিত মশায়ের অভিনব দণ্ড

নারিকেলের ঝোকার কথা শুনিয়া আমার পিলা চমকিয়া গেল। কারণ হেডপণ্ডিত মশায়ের এটা নিজস্ব মৌলিক আবিষ্কার। পণ্ডিত মশায় ছিলেন বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ। খুবই শুচিবাইগ্রস্ত লোক। ছাত্রদের কানের ময়লায় তার হাত ময়লা হয় বলিয়া বেশ কিছুদিন ধরিয়া কান মলা ছাড়িয়া দিয়াছেন। কিন্তু বাধ্য হইয়া কোনও ভয়ানক দুষ্ট ছাত্রের কান যদি তাকে মলিতেই হয়, তবে হাতে কাপড় লইয়া কান ধরিয়া থাকেন। সে কাপড়টাও ঐ দুষ্ট ছেলেরই গায়ের চাদর। অথবা শার্টের আঁচল। পারতপক্ষে তিনি আজকাল কারো কান মলেন না। তবু বরাবরের অভ্যাসমত রাগ হইলেই তাঁর বাঁ হাতটা ছাত্রদের কানের দিকে ছোটে। খানিক আগে আমারই কানের দিকে তার হাত ছুটিয়াছিল। আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয় বলিয়াই তার হাতটা ফিরিয়া গিয়াছে, তা নয়। তার আঙুলে আমার কানের ফিটের ময়লা লাগিবে বলিয়া। কানমলা ছাড়িয়া তিনি। ইদানীং ছিটকি অর্থাৎ লকলকা বাঁশের কঞ্চি ধরিয়াছেন। কিন্তু কিছুদিন আগে এক দুষ্ট ছেলেকে ছিটকির বাড়ি কশিতেই সে এমন গলা ফাটাইয়া ও মাগো, বাবাগো বলিয়া চিৎকার করে যে সারা স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র দৌড়াদৌড়ি করিয়া সেই ক্লাসের সামনে ভিড় করেন। এমনকি থানা হইতে ছোট বা বড় কোনো দারোগা বাবুও আসিয়া পড়েন।

এরপর হইতে হেডপণ্ডিত মহাশয় ছিটকি ফেলিয়া নারিকেলের ঝোকা’র প্রবর্তন করেন। এই দণ্ডের কৌশলটা এই : তিনজন হইতে পাঁচ-ছয়-সাতজন ছেলেকে একত্রে দাঁড় করানো হইত। তাদের সকলের গলা বেড়িয়া একটা চাদরে দুই মাথা একত্র করিয়া পণ্ডিত মহাশয় নিজ হাতে লইতেন। তারপর দড়ির গিরো কশার মত করিয়া চাদরের দুই মাথায় আতেক্কা হেঁচকা টান মারিতেন। তাতে চাদর-বেড়া সব ছাত্রের মাথা ঠুকঠাক ঠুসঠাস ও ঘটাঘট শব্দ করিয়া পরস্পরের সঙ্গে ঘাত-প্রতিঘাত করিত। তাতে নারিকেলের ঝোকার আওয়াজ পাওয়া যাইত। তিন-চারবার এরূপ করিলেই ছাত্ররা কান্নাকাটি ও কাকুতি-মিনতি শুরু করিত আর দুষ্টামি করিব না সার, কাল পড়া শিখিয়া আসিব, আজ মাফ করিয়া দেন স্যার ইত্যাদি।

পাঁচ-সাতটা মাথা একটানে একখানে করা কম শক্তির কাম নয়। কাজেই পণ্ডিত মহাশয় নিজেও নিশ্চয়ই ক্লান্ত হইয়া পড়িতেন। কিন্তু সেভাব না দেখাইয়া শুধু ছাত্রদের উপর দয়া পরবশ হইয়াই’ সেদিনকার মত ছাড়িয়া দিতেন।

এমন শাস্তি পণ্ডিত মশায় প্রায়ই দিতেন। আমাদের ক্লাসেও হইত। একত্রে অন্তত তিনটা অপরাধী পাওয়া না গেলে নারিকেলের ঝোকা ভাল জমে না বলিয়াই যা কয়েক দিন বাদ পড়িত। এমন শাস্তির প্রতি আমার একটা ভয়ানক ভীতি ছিল। কাজেই রাজার মহিষ না হওয়ার কোনও কারণ খুঁজিয়া না পাইলেও শুধু নারিকেলের ঝোকা হওয়ার ভয়ে রাজাকে মহিষ বলা হইতে বিরত হইলাম।

.

৮. স্কুলে যাতায়াত

দরিরামপুর স্কুলে আমি চার বছর পড়িয়াছি। এই চার বছরে আমার অনেক জ্ঞান লাভ হইয়াছিল। তার মধ্যে বিপজ্জনক কায়িক পরিশ্রমই ছিল প্রধান। আমাদের বাড়ি হইতে বৈলর-ধানীখোলা বাজার-ঘাট আঁকাবাঁকা পথে এক মাইল। নদী পার হইয়া ডিবি রোডে আসিতে আরো এক মাইল। ডিবি রোড স্কুল পর্যন্ত তিন মাইল। এই পাঁচ মাইল রাস্তা চার বছর ধরিয়া দৈনিক দুইবার হাঁটিয়াছি। এই দূরত্ব পাঁচ মাইল শুকনা দিনে। বর্ষাকালে এই দূরত্ব অনেক বাড়িয়া যাইত। কারণ ধান-পাট ক্ষেতের আইল-বিল-বাতর ও খাল-বিলে কিনার ঘুরিয়া যাইতে হইত। শুকনা দিনের মত ক্ষেত-পাথালি বা বিল পাথালি চলিবার উপায় ছিল না। ঝড়-বৃষ্টির দিনেও স্কুল কামাই করার সাধ্য ছিল না। তবে বৃষ্টিতে কাপড়চোপড় নিতান্তই ভিজিয়া ডুবডুবা হইয়া গেলে ‘রেইনি ডে’ পাওয়া যাইত। অর্থাৎ নাম ডাকিয়া হাজিরা বইয়ে হাজির গরহাজির লিখিয়া স্কুল ছুটি দেওয়া হইত। এমন ‘সৌভাগ্য’ বছরে দুই দিনের বেশি আমার দরিরামপুর জীবনে হয় নাই।

বর্ষাকালে আরেকটা বড় অসুবিধা ছিল। সুতোয়া নদীতে কোনও পোল তো ছিলই না, গোদারাও ছিল না। ধানীখোলা-বৈলর ঘাটে হাটুরিয়াদের পারাপারের সুবিধার জন্য জমিদার পক্ষ হইতে যে নৌকার ব্যবস্থা ছিল, তা সব দিন বা সব সময় পাওয়া যাইত না। পুরা বর্ষাতে থমথমা ভরা নদী সাঁতরাইয়া পার হইবার সাহস বা মুরুব্বিদের অনুমতি ছিল না। অবশ্য অন্যান্য সময় নদী কম-ভরা অবস্থায় কোনও কোনও দিন সাতরাইয়া পার হইয়াছি। এতেও বই-পুস্তক, কালি-কলম, পেনসিল লইয়া আমাদের কোনও অসুবিধা হইত না। তবে এত দূরের রাস্তায় অতগুলি বই-পুস্তক ও খাতাপত্র লইয়া যাতায়াত বাস্তবিকই কঠিন হইত।

.

. বই-পুস্তকের থলি

কিন্তু দরিরামপুর ভর্তি হইবার পর মা আমাদের দুই ভাইকে দুটি জুযদানের মত থলি সিলাই করিয়া দিয়াছিলেন। প্রথমে এটা পুরাতন কাপড়ের মযবুত, পরে নয়া মার্কিনের টুকরা দিয়া তৈরি হইত। দশীর তাগা দিয়া জুযদানের মত এসব বড় থলি সিলাই করিতেন। দশী’ ও ‘তাগা’ শব্দ দুইটা আমাদের ছেলেবেলায় খুব চালু ছিল। আজকালের তরুণরা হয়তো এদের কথা শোনেই নাই। তাই এ সম্পর্কে কিছু বলা ভাল। তাগা’ মানে সুতা। মোটা সুতাকেই তাগা’ বলা হইত। ‘দশী’ হইল কাপড় বুনিবার সুতার (ইয়ান) ছোট ঘোট বান্ডিল। তৎকালে সুতার বান্ডিল আসিত বিলাত হইতে। এক এক বান্ডিল এক পাউন্ডের (আধসের) হইত। তাঁতি ও জোলারা বাজার হইতে এই বান্ডিল কিনিয়া গামছা, মেয়েদের মোটা রঙ্গিন শাড়ি ও পুরুষদের মোটা লুঙ্গি বুনিত। এক-এক বান্ডিল সুতার দাম ছিল দশ-বার আনা। সুতার দোকানদাররা এক পাউন্ডের বান্ডিল ভাঙ্গিয়া আধপোয়ার (এক আউন্স) ছোট ছোট বান্ডিল বানাইয়া বিক্রয় করিত। গিরস্তরা এই ছোট ছোট বান্ডিলকেই দশী’ বলিত। গিরস্তরা বাড়ির মেয়েদের জন্য এই ‘দশী কিনিত। মেয়েরা এই ‘দশী’র দুই-তিন নাল সুতায় তাগা পাকাইত। এই তাগায় মেয়েরা কথা সিলাই করিত। ছেলেবেলায় মা, ফুফু ও চাচিজানকে এই তাগা দিয়া কাঁথা সিলাই করিতে দেখিয়াছি। দশী’র সুতাগুলি ছিল সাদা। কথায় নকশি করিবার জন্য তাঁরা লাল-নীল-কালো রঙের সুতা ব্যবহার করিতেন। এই রঙ্গিন সুতা কিনিতে হইত না। মেয়েরা চওড়া পাড়ের যেসব বিলাতী শাড়ি পরিতেন, সেসব পাড়ের রং ছিল যেমন পাকা, সুতাও ছিল তেমনি মযবুত। ‘দশীর’ মোটা তাগায় সিলাই করিবার সময় মেয়েরা দুই নম্বর সুই ব্যবহার করিতেন। আর নকশি তুলিবার, তহবন্দ সিলাই করিবার এবং জামা-কোর্তা রিপু করিবার সময় পাঁচ নম্বর সুই ব্যবহার করিতেন। ফলে মেয়েদের কাছে দুই নম্বর ও পাঁচ নম্বর সুইই আমি দেখিয়াছি। আমাদের বাড়িতে শুধু চাচিজিকে দশ নম্বর সুই ব্যবহার করিতে দেখিয়াছি। এই দশ নম্বর সুই ও আলেকান্দ্রা মার্কা গুটি সুতা দিয়া তিনি নিজের জন্য কল্লিদার লম্বা কোর্তা সিলাই করিতেন।

.

১০. থলির সুবিধা

যা হোক, এই দশী তাগা দিয়াই মা আমাদের জন্য থলি তৈয়ার করিতেন। এই থলি বগলেও নেওয়া যাইত, আবার কাঁধে ঝুলাইয়াও নেওয়া যাইত। কাঁধে ঝুলাইবার জন্য কাপড়ের শক্ত পাড় দিয়া কাঁধ-প্যাচা বনাত লাগানো হইত। এই থলিতে পেনসিল, রবার ও কলম-তারাশের (ছোট চাকু) জন্য পৃথক পৃথক জেব থাকিত। প্রথম প্রথম আমরা কাঁধ-পঁাচা থলিতে করিয়া বই-পুস্তক নিতে আপত্তি করিতাম। কারণ এটা দেখিতে আদালত পোস্টাফিসের পিয়ন-পিয়াদার মত দেখাইত। কিন্তু কিছুদিনেই আমাদের এই শরম কাটিয়া গেল। দূরের রাস্তায় এইভাবে বই-পুস্তক বহনের সুবিধাও আমরা বুঝিলাম। দু-একজন শিক্ষক আমাদের তারিফও করিলেন। কোনও ছাত্র কিছু একটা হারাইবার অজুহাত দিলেই মাস্টার সাহেবেরা আমাদের নজির দিতেন। এই থলির দরুনই দরিরামপুরে আমরা ছাত্রজীবনের চারটা বছরে আমি কোনও দিন বই-পুস্তক, খাতা-দোয়াত, কলম-পেনসিল, রবার চুষকাগজ-কলম-তারাশ, কিছুই হারাই নাই। যখন যেটার দরকার হাত দিয়াই পাইয়াছি। অথচ অনেক বেশি বইয়ের ভারী বোঝা বহন করিতে আমাদের কোনও কষ্ট হইত না। কাধ-প্যাচা বনাতটা সাধারণত ডান কাঁধের উপর থাকিত এবং থলিটা বাম কাকালে ঝুলিয়া থাকিত। ক্কচিৎ-কদাচিৎ কাঁধ বদলাইয়া বনাতটা ডান কাঁধ হইতে বাম কাঁধে আনিতাম। তাতে থলিটা বাম কাকাল হইতে ডান কাকালে আসিত।

.

১১. বিপজ্জনক রাস্তা

এই থলি কাঁধে করিয়া আমরা বাড়ি হইতে বাহির হইতাম স্কুলের নির্ধারিত সময়ের দুই আড়াই ঘণ্টা আগে। অর্থাৎ দশটার সময় ক্লাস বসিলে আমরা সাড়ে সাতটায় বাড়ি হইতে বাহির হইয়া উঁচা-উঁচা পাটের ক্ষেতের সরু-সরু আইল-বাতর দিয়া পানিতে-ডুবা ধান ক্ষেতের আইল হাঁটিয়া নদী পার হইতাম এবং আরো মাইলখানেক হাঁটিয়া বড়দিঘির’ নিকটে আসিয়া ডিবি রাস্তায় উঠিতাম। বৈলর, কানহর, কাঁঠাল, ভরাডুবা ইত্যাদি গ্রামের সহপাঠীরা এই বড়দিঘির পাড়ে আসিয়া জমা হইত। ক্লাস আওয়ারের এক ঘণ্টা বাকি থাকিতে এখান হইতে সকলে মিলিয়া রওয়ানা হইতাম। রাস্তার দুই পাশে আরো ছাত্ররা অপেক্ষা করিতে থাকিত। তারা আমাদের সাথে শামিল হইত।

কিন্তু যদি নৌকার অভাবে আমরা সুতোয়া নদী পার হইতে না পারিতাম তবে নদীর কূল বাহিয়া দক্ষিণ দিকে যাইতে থাকিতাম। বর্তমানে ধানীখোলা বাজার হইতে ত্রিশাল বাজার পর্যন্ত গাড়ি, ঘোড়া মটর চলিবার উপযোগী যে ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা আছে, এমন কোনও রাস্তা তৎকালে ছিল না। তবে দুপায়া একটি রাস্তা ছিল। কিন্তু সে রাস্তা ছিল প্রায় অন্ধকার বিশাল জঙ্গলের ভিতর দিয়া। তাতে আবার কিছু দূর পরপর পনের-বিশ হাত গভীর নদীর ভাঙতি ছিল। দিনের বেলায়ও ঐ রাস্তায় কেউ একা চলিতে সাহস পাইত না। আমাদের মত আট-দশ বছরের শিশুর তো কথাই নাই। কিন্তু আমরা সাহস করিতাম। আমরা দুই ভাই ছাড়াও আমাদের প্রতিবেশী আরো দুইজন ছাত্র দরিরামপুর স্কুলে পড়িত। আমরা এই চারিজন নদীর পাড়ের এই পথে। দক্ষিণ দিকে চলিতাম। নদীর পাড়ে বহু অবস্থাশালী গৃহস্থের বাড়ি ছিল। তাদের বাড়ির ঘাটে পারাপারের সুবিধার জন্য কলাগাছের ভোরা (ভেলা) থাকিত। আমরা বহুদিন এই রকম ভোরায় নদী পার হইয়াছি। নদী পার হইয়া একবার বৈলর গ্রামে যে কোনও মৌযায় পৌঁছিতে পারিলেই আমরা নিশ্চিন্ত হইতাম। আইল-বাতর ভাঙ্গিয়া কোনও এক উপায়ে আমরা ডিবি রাস্তা ধরিতে পারিতামই।

এত করিয়াও আমরা প্রায় ঠিক সময়েই স্কুলে পৌঁছিতাম। চার বছরে আমরা দুই এক দিনের বেশি লেইট হইয়াছি বলিয়া মনে পড়ে না।

রাস্তাঘাটের এই বিপজ্জনক অবস্থার জন্য আমার মুরুব্বিরা সারা দিন উদ্বিগ্ন থাকিতেন। আমার মা সারা দিন আমাদের নিরাপদে ফিরিয়া আসিবার জন্য দমে-দমে আল্লা-আল্লা করিতেন। আসরের নামাজ পড়িয়াই দেউড়ির কাছে। আসিয়া উঁকিঝুঁকি শুরু করিতেন। বাপজী ও চাচাজী সাংসারিক কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকিতেন বটে, কিন্তু দাদাজী তৎকালে সব কাজ হইতে অবসর নিয়াছেন। কাজেই আসরের নামাজ পড়িয়াই তিনি বাড়ি হইতে বাহির হইতেন এবং নদীর ঘাটের কাছে কোনও দোকান ঘরে বা কাঁচারিতে বসিয়া ঘাটের দিকে চাহিয়া থাকিতেন। আমরা ফিরিয়া আসিলে আমাদেরে সঙ্গে নিয়া বাড়ি ফিরিতেন। কোনও কোনও দিন ফিরিতে আমাদের এত দেরি হইত যে নদীর পাড়েই দাদাজীকে মগরেবের নামাজ পড়িতে হইয়াছে। লোকজনের মুখে শুনিয়াছি সেদিন দাদাজী নদীর পাড় দিয়া প্রায় এক মাইল রাস্তায় উত্তর-দক্ষিণ করিয়া টহল দিয়াছেন। এবং রাস্তায় যাকে পাইয়াছেন তাকেই জিজ্ঞাসা করিয়াছেন।

.

১২. দুইটি ব্যক্তিত্বের প্রভাব

দরিরামপুর স্কুলে ছাত্রজীবনে আমি দুইটি লোকের দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হইয়াছিলাম। তার একজন আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার কৈলাস বাবু। আরেকজন স্কুল-সংলগ্ন মাদ্রাসার ছাত্র মোহাম্মদ আতিকুল্লাহ। কৈলাস বাবু আমাকে সাহিত্য সাধনার অনুপ্রেরণা দিয়াছিলেন। সে কথা আমি অন্য অধ্যায়ে বর্ণনা করিব। এখানে শুধু এইটুকু বলা দরকার যে কৈলাস বাবু আমার মনে উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগাইয়াছিলেন। পড়া-শোনায়, আদব-কায়দায়, স্বভাব-চরিত্রে আমার মত ছেলে তিনি জীবনে আর দুইটি দেখেন নাই, সব সময় সবার কাছে তিনি এই কথা বলিয়া বেড়াইতেন। তিনি ছাত্রদের উপযোগী শিক্ষামূলক নাটক লিখিয়া ছাত্রদের দিয়া অভিনয় করাইতেন। তাতে সব সময় আমাকে নায়কের পাট দিতেন। সব সময় নায়কটি আদর্শ চরিত্রবান যুবক থাকিত। উপসংহারে তার জয় দেখানো হইত। আমি আগে সত্য সত্যই ভাল ছিলাম কিনা দ্বিমত হইতে পারিত। কিন্তু কৈলাস বাবু ভাল বলিতে-বলিতে আমি সত্যই ভাল হইয়া গেলাম।

আতিকুল্লাহ মাদ্রাসার ছাত্র হইলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, গায়ক ও চিত্রকর। জীব-জন্তুর ছবি আঁকা নিষেধ আছে বলিয়া আতিকুল্লাহ শুধু লতা পাতা-গাছ-বৃক্ষ ও নদী-নালার ছবি আঁকিতেন। গান না গাহিয়া তিনি বাংলা গজল গাইতেন। লতা-পাতা আঁকা ছাড়া তিনি আরবি ও বাংলা হরফে অতি চমৎকার ‘তুগরা’ আঁকিতেন। আরবি হরফের তুগরা অনেক কেতাবে পাওয়া যাইত, কাজেই আতিকুল্লাহর আরবি তুগরাতে বড় কেউ আশ্চর্য হইতেন না। কিন্তু বাংলা হরফে তিনি যে তুগরা আঁকিতেন সেটা ছিল সত্যই মৌলিক। চিত্র করা ও তুগরা লেখার কাজে যে সব বিভিন্ন রঙের কালি লাগিত, আতিকুল্লাহ সবই নিজের হাতে তৈয়ার করিতেন। চিত্র ও তুগরা ছাড়াও তিনি সাধারণ চিঠিপত্র ও খাতার কাগজেও এমন সুন্দর হরফে সব লেখা লিখিতেন যে ছাপার হরফ বলিয়া ভুল হইত। তিনি একদিকে তেরছাকাটা খাগের কলম দিয়া বড়-বড় হরফে বহু পোস্টার লিখিয়া ঘরের বেড়ায়, মসজিদের দেওয়ালে লটকাইয়া দিতেন। না বলিয়া দিলে কেউ এগুলিকে হাতের লেখা বলিয়া ধরিতে পারিতেন না। পক্ষান্তরে সরু মিহিন লেখাতেও তিনি উস্তাদ ছিলেন। একদা তিনি ছাপার হরফের মত গুট-গুট পরিচ্ছন্ন ও সুস্পষ্ট অক্ষরে একটি পোস্টকার্ডে একাশি লাইনের একটি পত্র লিখিয়াছিলেন। ছাপার হরফের মত প্রতিটি হরফ এমন স্পষ্ট ও আলগ ছিল যে কোনও অল্প শিক্ষিত লোকও তা পড়িতে পারিত।

এই সব গুণে আমি অল্পদিনেই আতিকুল্লাহর শাগরিদ হইয়া গেলাম। তিনিও আমাকে অকাতরে তার বিদ্যা শিখাইলেন। আমি নিজ হাতে বিভিন্ন রঙের কালি বানাইয়া চিত্র ও তুগরা আঁকায় লাগিয়া গেলাম। অবশ্য এসব গুণে আমি আতিকুল্লাহ সাহেবের ধারে-কাছেও যাইতে পারিলাম না। কিন্তু এতে আমার হাতের লেখার অনেক উন্নতি হইল। আমার ছেলেবেলার উস্তাদ চাচাজী, জগদীশ বাবু ও আলিমুদ্দিন মাস্টার সকলেরই হাতের লেখা ভাল ছিল। বিশেষত চাচাজীর আরবি ও বাংলা লেখা তাঁর পাঠ্যজীবনের খাতা-পত্র আমরা অনেক দেখিয়াছি। হাতে-তৈরি মিসমিসা কালিতে তেরছাকাটা কলমে এসব লেখা অবিকল ছাপা হরফের মত দেখা যাইত। ত্রিশ-চল্লিশ বছরেও কালির চকচকাভাব কমে নাই। বাল্য শিক্ষকের হাতের লেখাই অধিকাংশ ছাত্রের হস্তাক্ষরে প্রভাবিত করে। আমারও করিয়াছিল। কিন্তু নকশি লেখায় আমাকে একমাত্র আতিকুল্লাহ সাহেবই যে প্রভাবিত করিয়াছিলেন, তাতে কোনও সন্দেহ নাই। আতিকুল্লাহ সাহেব আমাকে সাহিত্য সাধনায়ও উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলেন, এ কথা আমি অন্য অধ্যায়ে বলিব। এখানে শুধু এইটুকু বলিতে চাই যে প্রায় সমবয়সী সহপাঠীও যে মানুষের জীবনে কত প্রভাব বিস্তার করিতে পারে, আতিকুল্লাহ আমার জীবনে তার একটা উজ্জ্বল প্রমাণ।

.

১৩. করোনেশনের পুরস্কার

১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি ক্লাস ফাইভ হইতে ক্লাস সিক্সে প্রমোশন পাই। ঠিক সেই সময়ে আমাদের সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড মারা যান। সে জন্য এক সপ্তাহ কাল আমরা ছাত্ররা হাতের বাহুতে কালো ফিতা বাধিয়া চলিতাম। সরকারি হুকুমে হেডমাস্টার বাবুই আমাদেরে এই কালো ফিতা পরিতে বাধ্য করিয়াছেন। কিন্তু ফিতা ও সেফটিপিন স্কুল হইতেই সরবরাহ করা হইয়াছিল বলিয়া এতে আমাদের কোনও আপত্তি হয় নাই। বরঞ্চ একটা নয়া অভিজ্ঞতা হিসাবে এটা আমি উপভোগ করিয়াছিলাম।

ঐ সালের ১২ ডিসেম্বর তারিখে সম্রাট পঞ্চম জর্জের অভিষেক উৎসব দিল্লি দরবার উপলক্ষে সরকারি টাকায় আমাদের স্কুলে উৎসব হয় এবং পুরস্কার বিতরণ করা হয়। স্কুলের সবচেয়ে ভাল ছাত্র হিসাবে, সত্যবাদী ছাত্র হিসাবে এবং নিয়মিতভাবে স্কুলে হাজির থাকার দরুন আমি তিন দফা পুরস্কার পাই। তিন দফায় বাংলা-ইংরাজি মিলাইয়া আমি দশ কি বারখানা ভাল ভাল বাঁধানো বই পুরস্কার পাইয়াছিলাম। ইংরাজি বইয়ের মধ্যে রবিনসন ক্রুসো, আইভানহো, ইভনিংস অ্যাট হোম, গ্রিমস ফেয়ারি টেলস এর নাম এবং বাংলা বইয়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী ও নৌকাডুবি এবং জলধর সেনের বিশু দাদার নাম মনে আছে। এই সব বইয়ের দুই-একটি বাদে আর সবগুলিই লাল-নীল-সবুজ রঙের কাপড়ে বাঁধাই ছিল। অনেকগুলিতেই সুন্দর ছবি ছিল। এই সব পুস্তক বগলে লইয়া যেদিন বাড়ি ফিরিলাম এবং আমার বড় ভাই সগর্বে আমার সবচেয়ে বেশি ও সবচেয়ে দামি বই পুরস্কার পাওয়ার কথা বর্ণনা করিতে লাগিলেন, তখন বাড়ির সকলে আনন্দ-উল্লাস করিতে লাগিলেন। আমি লজ্জা-শরমে খানিকক্ষণ লুকাইয়া থাকিলাম। তারপর পুস্তকের মধ্যে মানুষের ছবি দেখিয়া কেউ কেউ আপত্তি তুলিলেন বটে কিন্তু কিছুদিন আগে চাচাজীর নিজের কেনা আমির হামযা ও জংগনামার মধ্যেও ঘোড়সওয়ার আমির হামযা ও হানিফার পাতা-জোড়া ছবি আছে বলিয়া ছবির আপত্তি বেশি দিন টিকিল না। ১৯১২ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি দরিরামপুর মাইনর স্কুলের বিদ্যা শেষ করিয়া ময়মনসিংহ শহরে আসিলাম। এই বছরই দরিরামপুর মাইনর স্কুলকে হাইস্কুলে উন্নীত করা হয়। কাজেই স্কুল কমিটির মেম্বর-সেক্রেটারি সকলে আমাদের দুই ভাইকেই ঐ স্কুলে থাকিয়া যাইতে বলেন এবং দাদাজীকে ধরেন। দাদাজী কিছুটা নরম হইলেন বটে কিন্তু আমি শহরে যাইবার জন্য জিদ ধরিলাম। শেষে আপসরফা হিসাবে অন্তত এক ভাই ঐ স্কুলে থাকা ঠিক হইল। ফলে মিঞা ভাই দরিরামপুর নয়া হাইস্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হইলেন। আমি ময়মনসিংহ চলিয়া আসিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *