০৩. প্রাইমারি শিক্ষা–বাড়িতে

দ্বিতীয় খণ্ড শিক্ষাজীবন

অধ্যায় তিন প্রাইমারি শিক্ষা-বাড়িতে

. চাচাজীর নিকট

চাচাজী মুনশী ছমিরুদ্দিন ফরাযী সাহেব আমাদের বৈঠকখানায় একটি ফ্রি মাদ্রাসা চালাইতেন। এটাকে মাদ্রাসাও বলিতে পারেন, মক্তবও বলিতে পারেন। পাঁচ-সাত বৎসরের শিশুরা বগদাদি কায়দা, আম সেপারা ও কোরআন শরিফ পড়িত; অন্যদিকে দাড়ি-মোচওয়ালা যুবকেরা রাহে নাজাত, মেফতাহুল জান্নাত, ফেকায়ে মোহাম্মদী, শেখ সাদীর গুলিস্তাঁ, বুস্তাঁ এবং সাদীর ও ফরিদুদ্দিন আত্তারের পান্দেনামা, জামীর বাহার দানেশইত্যাদি উর্দু ফারসি কেতাবও পড়িত। মক্তবটি ফ্রি ছিল, মানে সকল দিকেই ফ্রি। বেতনও ছিল না, রেজিস্ট্রার হাজিরা বইও ছিল না। যার ইচ্ছা আসিয়া বসিয়া পড়িলেই হইত। যার যখন ইচ্ছা, উস্তাদজিকে বলিয়া চলিয়া যাইতে পারিত। বসিবার জন্য কোনো বেঞ্চির সারি ছিল না। আমাদের বাহির বাড়ির বিশাল আটচালা ঘরের মধ্যের কোঠায় চারটা হইতে ছয়টা চৌকি (তখতপোশ) লাগালাগি এক কাতারে পাতা ছিল। তার খানিকটায় পাটি ও খানিকটাতে চাটাই বিছানো থাকিত। এদের বেশির ভাগই অতি পুরান ও টুটাফাটা। এই ভাঙ্গা পাটি-চাটাইর উপর বসিয়াই তালেবিলিমরা মাথা ঝুকাইয়া-ঝুকাইয়া পড়া মুখস্থ করিত। চৌকির কাতারের সামনে একটা ডানা ভাঙ্গা কুরসিতে বসিয়া চাচাজী ছাত্রদেরে পড়াইতেন। আমার যতদূর মনে পড়ে, কোনো তালেবিলিমকেই নিজের আসন হইতে উঠিয়া আসিয়া পড়া দিতে হইত না। পড়ায় ভুল করিলে অথবা পুরান সবক শেষ করিয়া নূতন সবক নিতে হইলে চাচাজী নিজের আসনে বসিয়াই তা বলিয়া দিতেন। সব কেতাবই যেন তার মুখস্থ ছিল। চাচাজীর হাতে থাকিত একটা বাঁশের কঞ্চি অথবা ছিটকি লতার ডাল। ডালই হোক বা কঞ্চি হোক, ওটাকে ছিটকিই বলা হইত। ঐ ছিটকির উদ্দেশ্য ছিল, গাধা পিটাইয়া ঘোড়া করা অর্থাৎ অমনোযোগী ছাত্রকে পিটাইয়া মনোযাগী করা। সে উদ্দেশ্যে উদ্যত-ফণা সাপের মত সারা দিন ছিটকিটি অমনোযাগী ছাত্রের পিঠ বা হাতের তলা তালাশ করিয়া করিয়া উঁকিঝুঁকি পাড়িত। কিন্তু আমার জীবনে চাচাজীকে মাত্র তিনবার এ ছিটকিটি ব্যবহার করিতে দেখিয়াছি। আমাদের গ্রামের রেকাতুল্লাহ ও শহর আলী নামক দুইটি ছাত্রের পিঠে দুইবার এবং আমার নিজের পাছায় একবার; মোটমাট এই তিনবার মাত্র। আমার জন্য আর দরকারও ছিল না। ঐ একটি আঘাতের দাগই বহুদিন শুধু আমার শরীরে নয়, মনেও তাজা ছিল।

যা হোক, পাঁচ বছর বয়সে আমি চাচাজীর মক্তবে ভর্তি হইলাম, মানে অযু করিয়া পাকসাফ হইয়া তহবন্দ পরা অবস্থায় তালেবিলিমদের কাতারের এক কোণে বসিয়া পড়িলাম। আমার বড় দুই ভাই আগে হইতেই মক্তবের তালেবিলিম ছিলেন। কিন্তু আমি অল্প দিনেই তাঁদের সমান পড়া পড়িয়া ফেলিলাম। আমি প্রতিদিন একটার বদলে দুইটা নয়া সবক লইতাম। অল্প দিনেই আমি বগদাদি কায়দা শেষ করিয়া ফেলিলাম। তেলকা ও হালকা উভয় রকম ত্যদিকে আমি উত্তীর্ণ হইলাম। তেলকা মানে তীরের ফলার অর্ধেকের আকারে ভাঁজ করা চার পরত কাগজের একটি টুকরা। এর এক দিক মোটা, অপর দিক সুইয়ের মত ধারালো। ডান হাতের বুড়া ও শাহাদত আঙুলের ফাঁকে তেলকার মোটা অংশটা ধরিয়া চোখা অংশ দিয়া হরফ দেখানোই তেলকার কাজ। আরবি হরফ সংযুক্ত হইলে একটিমাত্র রেখার মধ্যে তিন চারটি হরফ লুকাইয়া থাকিতে পারে। শুধু নোকতা দেখিয়া সেই হরফগুলিকে চিনিতে হয়। আঙুলের মাথা দিয়া সে অক্ষর দেখানো যায় না। কারণ আঙুলের মাথা হরফের চেয়ে অনেক বেশি মোটা। এ কাজ করিতে হয় তেলকার সূচ্যগ্র মাথা দিয়া। এটা করিতে পারিলেই তালেবিলিম তেলকা পাশ করিয়াছে বলিতে হইবে। আর হালকা হইলে একটি কাগজের টুকরা, তার মাঝখানে একটা ছিদ্র। সকলেরই বোধ হয় মনে আছে, শিশুকালে বর্ণমালা পড়িবার সময় তারা আলিফ, বে, তে, ক-খ-গ বা এ-বি-সি গোড়া হইতে পড়িয়াও যাইতে পারিতেন। হরফও চিনিতেন। কিন্তু মাঝখান হইতে কোনো হরফ দেখাইয়া তার নাম পুছ করিলেই ঠেকিয়া যাইতেন। আগের পিছের হরফ না দেখিয়া যেকোনোও হরফ চিনিতে পারিলেই বুঝা গেল এইবার তালেবিলিমের অক্ষরজ্ঞান পাকা হইয়াছে। এই পরীক্ষাই হালকার কাজ। কেতাবের পৃষ্ঠায় হালকা নামক কাগজের টুকরাটি স্থাপন করিলে একটিমাত্র হরফ দেখা যাইত, ডাইনে বাঁয়ের উপর নিচের আর কোনও হরফ দেখা যাইত না। এ অবস্থায় যে এ হরফটি চিনিতে পারিত, কেবল সেই ছাত্রের হরফজ্ঞান পূর্ণ হইয়াছে।

আমি সমবয়সী এবং সহপাঠীদের সকলের আগে তেলকা ও হালকা পাশ করিয়া আম সেপারার সবক লইলাম। কয়েক মাসের মধ্যে আমি কোরআন শরিফে সবক লইলাম। আমপারাও কোরআন শরিফের অংশ বটে, কিন্তু ওটা কোরআন শরিফের সর্বশেষ পারা। উহার সুরাগুলি ছোট ছোট বলিয়া আলাদা করিয়া ছাপা হইয়াছে। এবং নাম দেওয়া হইয়াছে আমপারা। স্পষ্টতই এটা করা হইয়াছে কোরআন শরিফ পড়ার প্রথম পাঠ হিসাবে। কোরআন শরিফের ত্রিশটা পারার মধ্যে একমাত্র শেষ পারাটিরই বিশেষ নাম রাখা হইয়াছে। ‘আমপারা। অর্থ করা যায় সাধারণ পাঠ। ইংরাজিতে বলা যায় জেনারেল লেসন। অপর উনত্রিশটি পারার কোনোটারই বিশেষ নাম নাই। প্রথম পাঠ হিসাবে সুরাটির শুধু বিশেষ নামকরণই করা হয় নাই, তার সুরাগুলির স্থানিক মানও একদম পাল্টাইয়া দেওয়া হইয়াছে। কোরআন শরিফের শেষ পারা শুরু হইয়াছে সুরা নাবা’ দিয়া। শেষ হইয়াছে সুরা নাস দিয়া। কিন্তু আমপারা শুরু হইয়াছে সুরা নাস’ দিয়া। শেষ হইয়াছে সুরা নাবা’ দিয়া। কোরআন শরিফে সুরাসমূহের স্থানিক মান বড় হইতে ছোট। আমপারায় ছোট হইতে বড়। প্রাইমারি ছাত্রদের সুবিধার জন্যই এটা করা হইয়াছে। তারা ছোট ছোট সুরা পড়িয়া ক্রমে ক্রমে বড় বড় সুরা পড়িতে শুরু করিবে। আমপারার এই স্বাতন্ত্রের জন্যই এটি পড়া শুরু করাকেই কোরআন শরিফে সবক লওয়া বলা। হয় না। শুধু ‘আলিফ-লাম-মিম’, অর্থাৎ সুরা বাকারা পড়িতে শুরু করার নামই কোরআন শরিফ পড়া আরম্ভ করা। আমার বয়স সাত বছর পূর্ণ হইবার অনেক আগেই আমি কোরআন শরিফ মতন পড়া শেষ করিলাম। মতন পড়া’ মানে অর্থ না বুঝিয়া কোরআন পড়া। আমি যেদিন কোরআন শরিফে প্রথম সবক লইলাম এবং যেদিন খতম করিলাম, উভয় দিনই আমাদের বাড়িতে ছোটখাটো মেবানি হইয়াছিল। ভাইদের বেলাও তা-ই হইয়াছিল। মেহমান খাওয়ানোকেই মেবানি বলা হইত। তৎকালে অবস্থাপন্ন সকলেই তা করিতেন। আমার বড় দুই ভাইয়ের বেলা সেটা আগে হইয়াছিল। তৎকালে লেখা ও পড়া ছিল দুইটা আলাদা কাজ। বই-পুস্তক হাতে পড়ুয়ারারে পথেঘাটে দেখিলেই বুড়ারা পুছ করিতেন, ‘তুমি লেখো, না পড়ো? এ প্রশ্নের কারণ ছিল। মক্তবে শুধু পড়া হইত। লেখা হইত পাঠশালায়। তার মানে বাংলা পড়াইতে লেখার দরকার হইত। আরবি-ফারসি-উর্দু পড়ায় লেখার দরকার হইত না। মানে, লেখা কাজে লাগিত না অথচ মাদ্রাসায় আরবি ফারসি লেখা ও শিখানো হইত। মতন’ কোরআন শরিফ, মসলা-মাসায়েলের রাহে নাজাত বয়াতের গুলো-বুস্তা পড়িতে লেখার কোনো দরকার হয় না। তৎকালে আমাদের বাড়িতে ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে এমন পড়ুয়া অনেক ছিলেন, যারা লিখিতে জানিতেন না বাড়ির মেয়েলোকেরাও অনেকে কোরআন তেলাওয়াত করিতে পারিতেন। বস্তুত আমাদের বাড়ির মুরুব্বিদের মধ্যে একমাত্র চাচাজীই পড়া ও লেখা দুটোই জানিতেন। শুধু লেখা জানিতেন না, স্থানীয় মাদ্রাসায় আরবি-ফারসি পড়িয়া মুনশী’ হওয়া ছাড়াও চাচাজী তত্ত্বালের উচ্চ-প্রাইমারি পাশ করিয়াছিলেন। তাঁর বাংলা ও আরবি হাতের লেখা ছিল অতি চমৎকার, একদম ছাপার হরফ। চিঠিপত্র, জমা খরচ, বছরিয়া চাকররার হিসাবের খাতা তিনি সাধারণ ভাঙা হাতেই লিখিতেন। সে লেখাও তার খুবই সুন্দর ছিল। সে জন্য লোকেরা তাঁকে দিয়া জোরাজুরি করিয়া তমসুক ইত্যাদি লেখাইত। কিন্তু ওসব দলিলে সুদের কথা থাকে। বলিয়া তিনি পরে দলিল তমসুক লেখা ছাড়িয়া দেন।

তাঁর আরবি-ফারসি লেখা এমনকি বাংলা লেখাও ছিল দেখিবার মত। এমন লেখা আনেক কাগজপত্র, ফর্দ ও সিলাই করা জুজ-গাঁথা অনেক খাতা আমরা ছেলেবেলা চাচাজীর কিতাবের বস্তানি ও বাক্সে অনেক দেখিয়াছি। সেগুলি ছিল আরবি-ফারসি-উর্দু ও বাংলা বর্ণমালা, বয়েত-কবিতা অথবা অনেক গদ্য বাক্য। ওসবই তিনি লিখিয়াছিলেন বহু আগে। কিন্তু তখনও সেগুলি ছিল ঝলমলা চকচকা। তৎকালে আজকালের মত বুব্ল্যাকের বোতল বা বড়ি পাওয়া যাইত না। পড়ুয়ারার নিজের হাতে ‘ছিয়াই’ বা কালি বানাইয়া লইতে হইত। চাচাজীরে নিজ হাতে ‘ছিয়াই’ বানাইতে আমরা দেখিয়াছি। নিজেরাও চেষ্টা করিয়াছি। চাউল পুড়া-ভাজার গুড়া, ডেকচি-পাতিলের চুলার কালি ইত্যাদি একসাথে পিষিয়া লাউ-কুমড়ার পাতার রসের সঙ্গে মিশাইয়া এই কালি তৈয়ার করা হইত।

.

. ইয়াকুব মুনশীর নিকট

চাচাজীর এই সব গুণ ছিল বলিয়াই বোধ হয় তার মক্তবে পড়া ও লেখা দুইটাই ছিল। তবে লেখাটা বাধ্যতামূলক ছিল না। চাচাজীর মাদ্রাসার ছাত্ররাও ছিল যেমন অনিয়মিত, স্বয়ং চাচাজীও ছিলেন তেমনি অনিয়মিত। তিনি আত্মীয় বাড়িতে বা শহরে বেড়াইতে গেলে তিনি না ফিরা পর্যন্ত মাদ্রাসা বন্ধ থাকিত। তাতে অনেক সময় একনাগাড়ে দুই-তিন দিন পড়াশোনা হইত না। পড়াশোনায় আমার যেহান ভাল এ কথা সবাই বলিতেন। স্বয়ং চাচাজী। ত বলিতেনই। আমাদের বাড়িতে আগন্তুক আলেম-ফাযেলও সকলেই এক বাক্যে–ই বলিতেন। বোধ হয়, এতেই উৎসাহিত হইয়া দাদাজী চাচাজীর মাদ্রাসায় একজন বেতন করা মৌলবী রাখিবার ব্যবস্থা করিলেন। মুনশী ইয়াকুব আলী সুধারামী নামে একজন নোয়াখালীর মৌলবী সাহেব এই সময় আমাদের বাড়ির মাদ্রাসার শিক্ষক নিযুক্ত হন। আজকাল যেমন সবাইকে যাহা তাহা মৌলবী-মওলানা বলা হয়, তৎকালে তা হইত না। আরবি-ফারসিতে সর্বোচ্চ শিক্ষা লাভ করিয়া সনদ না পাইলে কাউকে মৌলবী বলা হইত না। তৎকালে আরবি-ফারসিতে এমন সব পণ্ডিত লোককে মুনশী বলা হইত, যাদের সমান জ্ঞান আজকাল অনেক তথাকথিত মওলানারও দেখা যায় না। এই কারণে মৌলবী ইয়াকুব আলী সুধারামী আমাদের অঞ্চলে ইয়াকুব মুনশী নামেই পরিচিত ছিলেন। উভয়েই মুনশী হইলেও সুধারামী সাহেব চাচাজীর চেয়ে সকল দিকেই লায়েক ছিলেন। তার মাহিনা নির্ধারিত হইল পাঁচ টাকা। এই পাঁচ টাকা বাড়াইয়া কোনো দিন ছয় টাকা করা হয় নাই। কিন্তু মৌলবী সাহেব ঐ বেতনেই তিন বছরকাল আমাদের মাদ্রাসায় পড়াইয়াছিলেন। কারণ তার মাসিক আয় ঐ পাঁচ টাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। অনেক বেশি ছিল। আমার এক নানা মুনশী ওয়ালি মাহমুদ মির‍্যা আমাদের বাড়ির মসজিদের স্থায়ী ইমাম ও সারা গায়ের মোল্লা ছিলেন। আঞ্চলিক মোল্লার কাজ ছিল বিয়া পড়ানো, সদকা-আকিকা-কোরবানির গরু-খাসি যবেহ করা, মউতার জানাযা পড়া এবং খতম পড়া। জানাযার মোল্লাকি ছাড়া সদকা-আকিকা-কোরবানির গরু-খাসির চামড়া মোল্লার প্রাপ্য ছিল। এতে মোল্লাজির বার্ষিক আয় খুব মোটা রকমের ছিল। আমার নানা মির‍্যা সাহেব অতিবৃদ্ধ হওয়ায় এক ইমামতি ছাড়া তার আর সব কাজ ও তাদের পাওনা মৌ. ইয়াকুব আলীর অনুকূলে ছাড়িয়া দেন। তাতে মৌলবী সাহেব যথেষ্ট রোযগার করিয়া মাসে মাসে বাড়িতে টাকা পাঠাইতে পারিতেন। একাদিক্রমে তিন বছর আমাদের বাড়িতে শিক্ষকতা করিয়া অবশেষে তিনি দেশে চলিয়া যান। শিক্ষকতা ছাড়িয়া দিলেও যত দিন তিনি বাঁচিয়াছিলেন, তত দিন প্রতিবছর রমযান মাসে তিনি আমাদের বাড়ি আসিতেন এবং মাসাবধি থাকিয়া গ্রামময় দাওয়াত খাইয়া বেশ টাকা পয়সা লইয়া দেশে ফিরিতেন। ফলত, এ গ্রামের শিক্ষিত লোকেরা প্রায় সকলেই সুধারামী মুনশী সাহেবের ছাত্র ছিলেন। কাজেই আমাদের গ্রামে তাঁর কদর ও দাওয়াতের কোনো অভাব ছিল না।

‘সুধারামী মুনশী’ সাহেব আমাদের মক্তবের ভার নেওয়ার পর সেখানে নিয়মমত হাজিরা বই করা হইল। দহম, নহম হাতম, হাতম এই চারিটি শ্রেণীর ছাত্রদের আলাদা করিয়া বসানো হইল। সুধারামী উপরের দুই ক্লাস এবং চাচাজী নিচের দুই ক্লাস পড়াইতেন। আমরা কাজেই উপরের শ্রেণীর ছাত্র হইলাম। সুধারামী সাহেব যত দিন আমাদেরে আরবি-ফারসি পড়াইয়াছেন, তত দিন চাচাজীর নিকট আর পড়ি নাই। কিন্তু ঐ সময় রাত্রে চাচাজীর কাছে বাংলা পড়িতাম। তিনি বর্ণ বানান শিক্ষানামক একখানি চটি বই আমাদের জন্য কিনিয়াছিলেন। চাচাজী মাদ্রাসার জমাতে চাহারম পড়ার পর উচ্চ প্রাইমারি পাশ করিয়াছিলেন। ছেলেবেলা তার বাক্সে পি ঘোষের পাটিগণিত, গোরীশংকরের বীজগণিত মলাটছেঁড়া ত্রিকোণমিতি বই দেখিয়াছি। পরে আমরা স্কুলে ইংরাজি পড়াশোনা শুরু করিলে চাচাজী নিজে রাজভাষা নামে একখানি বাংলা বই কিনিয়া কিছু কিছু ইংরাজি শিখাইয়াছিলেন। বাংলা ভাষার মাধ্যমে ইংরাজি শিক্ষার জন্য তৎকালে ইহা নামকরা পুস্তক ছিল।

সুধারামী সাহেবের পরে পরপর দুইজন মৌলবী আমাদের বাড়ির মাদ্রাসায় মুদাররেসি করিয়াছিলেন। কিন্তু এঁদের দুইজনের একজনও আমাদের বাড়িতে থাকিতেন না। এঁদের প্রথমজন ছিলেন মৌলবী মমতাযুদ্দিন। তিনি থাকিতেন আবুল কালাম শামসুদ্দিন সাহেবদের বাড়িতে। ভোরের বেলা তিনি শামসুদ্দিন, তাঁর ভাই সদরুদ্দিন ও পাড়ার সমস্ত তালেবিলিমসহ দল বাঁধিয়া আসিতেন এবং ছাত্রদের দশটার সময় পাঠশালায় পড়িতে যাওয়ার সুবিধার জন্য যথাসময়ে মাদ্রাসা ছুটি দিয়া দল-বলে চলিয়া যাইতেন। ইতিমধ্যে ধানীখোলা জমিদার কাছারিতে যে একটি পাঠশালা স্থাপিত হইয়াছিল, সে কথা একটু পরেই বলিতেছি।

বছরখানেকের বেশি মৌলবী মমতাযুদ্দিন আমাদের বাড়ির মাদ্রাসায় ছিলেন না। তিনি চলিয়া যাওয়ার পর আমাদের মাদ্রাসার শিক্ষক হন মৌলবী আবদুল আজিজ। এঁর আমলেই আমাদের বাড়ির মাদ্রাসা উঠিয়া যায়। এই সময় আমরা দুই ভাই ও শামসুদ্দিনরা দুই ভাই ধানীখোলা পাঠশালায় পড়া শেষ করি। শামসুদ্দিনরা চলিয়া যায় শহরে। আমরা চলিয়া যাই দরিরামপুর মাইনর স্কুলে। আমাদের অভাবে আমার মুরুব্বিরা মাদ্রাসা চালাইতে আর তেমন উৎসাহ বোধ করিলেন না। বোধ হয় প্রধানত সেই কারণেই আস্তে আস্তে শিক্ষক ও অভিভাবকদের অনুৎসাহে মাদ্রাসা উঠিয়া যায়।

.

. পাঠশালায়

ইতিপূর্বে সুধারামী সাহেবের আমলেই আমাদের গ্রামে জমিদার কাছারিতে একটি পাঠশালা স্থাপিত হয়। এই পাঠশালা স্থাপনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। আমাদের গ্রামের অন্যতম প্রধান মাতব্বর ওসমান আলী সরকার (পরবর্তীকালে খান সাহেব)। ইনি আমাদের দুই ভাইকেই এই পাঠশালায় দিতে দাদাজীকে ধরিয়া পড়েন। তখন আমরা তিন ভাই বাড়ির মাদ্রাসায় পড়িতাম। তার মধ্যে মাত্র একজনকে বাংলা লাইনে দিয়া অপর দুই ভাইকে দীনী লাইনে রাখার জন্য আমার মুরুব্বিরা জিদ করেন। কিন্তু ওসমান আলী সাহেবের পীড়াপীড়িতে এবং দাদাজীর সমর্থনে আমরা দুই ভাই (আমাদের সকলের জ্যেষ্ঠ মোহাম্মদ মকিম আলী ও আমি) পাঠশালায় ভর্তি হই। পাঠশালায় যাওয়ার সুবিধার জন্য আমাদের বাড়ির মাদ্রাসার সময় বদলাইয়া দুপুর হইতে সকালে আনা হয়। এই সময় আমরা ফারসি শেখ সাদী ও ফরিদুদ্দিন আত্তারের পান্দেনামা ও শেখ সাদীর গোলেস্ত-বুস্তা, উর্দু রাহেনাজাত, মেফতাহুল জান্নাত ও ফেকায়ে মোহাম্মদী পড়িতেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে মুযদার ফাইয়ুসনামে ব্যাকরণের বইও পড়িতেছিলাম!

জমিদার কাছারিরই একটি বাড়তি ঘরে আমাদের এই নয়া পাঠশালা শুরু হয়। প্রথমে কাছারির অন্যতম নায়েব বিক্রমপুর নিবাসী শ্ৰীযুক্ত মথুরা নাথ চক্রবর্তীর আত্মীয় শ্রীযুক্ত জগদীশ চন্দ্র চক্রবর্তী আমাদের পাঠশালার শিক্ষক হন। কিন্তু দু-মাস যাইতেই জগদীশ বাবু অন্যত্র চলিয়া যান। তখন আমাদের গ্রামের অন্যতম প্রধান মাতব্বর ও তালুকদার শ্রীযুক্ত উমাচরণ সরকারের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীযুক্ত জগদীশ চন্দ্র সরকার আমাদের শিক্ষক হইয়া আসেন। জগদীশ বাবু ছিলেন তৎকালের এন্ট্রান্স পড়া যুবক। তিনি উৎসাহী কর্মী, মিষ্টভাষী, সুপুরুষ, মধুর-কণ্ঠী গায়ক ছিলেন। অতি অল্প দিনে তিনি ছাত্রদের মন জয় করিলেন। পড়াশোনা ও খেলাধুলায় জগদীশবাবু আমাদের প্রাণে বিপুল সাড়া জাগাইলেন। বাংলা, অঙ্ক ও শুভঙ্করী শিক্ষাদান ছাড়া তিনি পাঠশালায় ড্রয়িং ও ড্রিলের আমদানি করিলেন। এর উপর তিনি সপ্তাহে দুই এক দিন ইংরাজি পড়াইতে লাগিলেন। তিনি আমাদের দিয়া ওয়ার্ডবুক অথবা স্পেলিং বুক নামে এক আনা দামের বই কিনাইলেন। ইংরাজি পড়া ও চিত্র অঙ্কন করা নিয়া আমাদের বাড়িতে কয়েক দিন মুরুব্বিদের দরবার হইল। শেষ পর্যন্ত ইংরাজি পড়ার এবং মানুষের মূর্তি ছাড়া অন্য রকম চিত্র আঁকিবার অনুমতি পাওয়া গেল।

.

. স্বদেশি ধুতি

এটা ছিল ইং ১৯০৬ সাল। এই সময় স্বদেশি আন্দোলন ও বিলাতী বয়কট শুরু হয়। কিন্তু আমরা অত শত জানিতাম না। যা জানিতাম তা এই যে, আমাদের মাস্টার মশায়, আমাদেরে স্বদেশি ধুতি পরিতে বাধ্য করিলেন। এখানে বলা আবশ্যক যে, তৎকালে মুসলমানদের মধ্যেও সাধারণ ভদ্রলোকের পোশাক ছিল ধুতি। মুনশী-মৌলবীরা অবশ্য গায়ে লম্বা কোর্তা ও পরনে পাজামা অথবা তহবন্দ ব্যবহার করিতেন। কিন্তু মুনশী-মৌলবী নন এমন সব মুসলমান ভদ্রলোকেরা ধুতি পাঞ্জাবি শার্ট এবং শার্ট পাঞ্জাবির উপর গরমের দিনে ঠাণ্ডা কোট ও শীতের দিনে গরম কোট পরিতেন। ধুতি শার্ট কোটের উপর দামি পশমি শাল পরিয়া তার উপর লাল তুর্কি টুপি পরিতে তৎকালে আমার অনেক মুরুব্বিকেই দেখিয়াছি। চাচাজী মুনশী ছিলেন বলিয়া তিনি সাধারণত তহবন্দের উপর লম্বা কোর্তা পরিতেন। কিন্তু দাদা ও বাপজী মুনশী বা মৌলবী ছিলেন না বলিয়া বাড়িতে যদিও তহবন্দ পরিয়াই থাকিতেন, কিন্তু হাটে-বাজারে ও বিবাহ-মজলিসে যাইবার কালে তারাও ধুতি পরিয়াই যাইতেন। তবে তাঁদেরে পাড়ওয়ালা ধুতি পরিতে খুব কমই দেখিয়াছি। সাধারণত তারা চুলপাড় ধুতি পরিতেন। তালের আঁশের টুপি, ইরানি টুপি বা সাদা গোল টুপিই তাঁদের শিরস্ত্রাণ ছিল।

কিন্তু আমরা মাদ্রাসার যাইবার সময় তহবন্দ ও পাঠশালায় যাইবার সময় ধুতি ও মাথায় লাল তুর্কি টুপি পরিয়া যাইতাম। এটা তঙ্কালের নিয়ম ছিল। তহবন্দ পরিয়া পাঠশালায় যাওয়ার কথা কেউ কল্পনাও করিতে পারিতেন না। আমাদের মাস্টার মশায় যখন জোর করিয়া আমাদেরে স্বদেশি ধুতি পরাইলেন, তখন আমরা মনে মনে মাস্টার মশায়ের উপর অসন্তুষ্ট হইলাম। আমাদের অসন্তোষের কারণ ছিল দুইটি। এক. স্বদেশি ধুতি ছিল বিলাতী ধুতির চেয়ে অনেক মোটা ঘবসা ও খসখসা। দুই. স্বদেশি ধুতির পাড়ের রং ছিল একেবারে কাঁচা। প্রথম ধাপেই পাড়ের রং উঠিয়া গোটা ধুতিটাতেই ছাকা ছাকা রং লাগিয়া যাইত। কাঁচা রঙের চিরন্তন বিশেষত্ব এই যে রং আসল জায়গা হইতে উঠিয়া অন্য জায়গায় লাগিলেই সেটা পাকা হইয়া যায়। সেখান হইতে তাকে আর হাজার চেষ্টায়ও তোলা যায় না। একশ্রেণির লোক আছে যারা ভাল কাজ করিতে পারে না, কিন্তু কুকার্যের উস্তাদ। কাঁচা রঙের স্বভাবও তা-ই। নিজের জায়গায় যে কাঁচা বটে, কিন্তু বেজায়গায় সে একদম পাকা। বিলাতী ধুতির পাড়ের রং এত পাকা ছিল যে, ধুতিটা পুরাতন হইয়া ফাটিয়া-ছিঁড়িয়া যাওয়ার পরও পাড়ের রংটা চকচক করিত। এই পাকা রঙের পাড় দিয়া অনেক কাজ হইত। পক্ষান্তরে বিলাতী ধুতি ছিল মিহিন ও মসৃণ। পরিতে কত আরাম। সে স্থলে দেশি ধুতিতে গায়ের চামড়া কুটকুট করিত।

এমন মোলায়েম মিহিন বিলাতী ধুতি ফেলিয়া যেদিন মাস্টার মশায়ের হুকুমে এবং একরকম যবরদস্তিতে ঘবসা স্বদেশি ধুতি পরিতে বাধ্য হইলাম, সেটা ছিল আমাদের একটা দুঃখের দিন। কিন্তু দুইটা কারণে আমরা বিনা প্রতিবাদে এই দুঃখ বরণ করিলাম। প্রথমত, মাস্টার মশায় অত বড় ফিটবাবু হইয়াও নিজেও ঐ মোটা ঘবসা স্বদেশি ধুতি পরিতেন। দ্বিতীয়ত, তৎকালে উস্তাদকে আমরা বাপ-মার মতই মুরুব্বির গুরুজন মনে করিতাম। তাদের কাজ না পছন্দ করা বা তাদের কথায় ‘না’ বলা আমাদের স্বপ্নেরও অগোচর ছিল।

.

. পাঠ্য বিষয়

আগেই বলিয়াছি, পাঠশালায় শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আমার মাদ্রাসার শিক্ষাও চলিতে লাগিল। সকালে উঠিয়া ফযরের নামাজ পড়িয়াই মাদ্রাসায় পড়িতে বসিতাম। ফাঁক পাইলে এই সময়ের মধ্যে তাড়াতাড়ি নাকে-মুখে চিড়া মুড়ি বা খই পিঠা পুঁজিয়া নাশতা করিয়া লইতাম। না হইলে বিনা নাশতাতেই মাদ্রাসায় বসিতাম। এক প্রহর বেলা হইতেই মাদ্রাসা ছুটি হইয়া যাইত। গোসল খাওয়া সারিয়া পাঠশালায় যাইতাম। বাড়িতে ঘড়ি ছিল না। কিন্তু বাড়ির মুরুব্বিদের সকলের, এমনকি মেয়েদেরও, এমন নিখুঁত সময়ের আন্দাজ ছিল যে ঠিক দশটার সময় পাঠশালায় হাজির হইতাম। অবশ্য পাঠশালাতেও ঘড়ি ছিল না। কিন্তু কাছারিতে বড় দেওয়াল ঘড়ি। ছিল। সেটা দেখিয়া দারওয়ান ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেল পিটাইয়া সারা গায়ে সময় ঘোষণা করিত। সাড়ে দশটা হইতে চারটা পর্যন্ত পাঠশালা বসিত। মাঝখানে আধঘণ্টা লেইজার বাদে মোট পাঁচ ঘণ্টা পড়া হইত। ১৯০৬ সালে যখন আমি প্রথম পাঠশালায় ভর্তি হই, তখন আমার বয়স আট বছর। বাড়ির মাদ্রাসায় আমি তখন মতন কোরআন শেষ করিয়া ফেকায়ে মোহাম্মদী, রাহেনাজাত, শেখ সাদীর পান্দেনামা ও গুলিস্তাঁ পড়িতেছি। যদিও আমাদের বাড়ির মাদ্রাসায় কোনো জমাত ছিল না, তথাপি চাচাজী ও মৌলবী সাহেবরা বলিতেন আমি জমাতে দহমের দরস পড়িতেছি। এই সময় পাঠশালায় ‘গ’ মিতি, ‘খ’-মিতি ও ‘ক’-মিতি এই তিনটা শিশু শ্রেণী ও তারপর ১ম ও ২য় শ্রেণী এই পাঁচ বছরের কোর্স ছিল। আমরা দুই ভাইকে প্রথমে ‘গ’-মিতিতে ভর্তি করা হইলেও বাড়িতে আমাদের বর্ণ পরিচয় হইয়াছিল বলিয়া তিন মাস পরে ‘খ’-মিতি এবং ছয় মাস পরে ‘ক’ মিতিতে আমাদের প্রমোশন দেওয়া হইল। ‘ক’-মিতিতে আমরা এক বছর পড়িলাম এবং এখানেই বাংলা সাহিত্য, অঙ্ক, শুভঙ্করী ও ‘ওয়ার্ডবুক’ পড়িলাম। সাহিত্য মানে বোধোদয় ও অঙ্কের নামতা, সরল যোগ-বিয়োগ এবং শুভঙ্করী আর‍্যা এই সব পড়িতাম। মাদ্রাসায় তিন ঘণ্টা সময়ে একটি হিন্দি মানে, উর্দু বই, দুইটা-দুইটা ফারসি বই পড়িতাম ও দুপুরে পাঠশালায় পাঁচ ঘণ্টা পড়া হইত। বাড়িতে পড়িবার সময় ছিল মগরেবের ও এশার নামাজের মধ্যেকার দুই ঘণ্টা সময়। এশার নামাজের পরই খাইয়া-দাইয়া ঘুমাইয়া পড়িতাম। পরের বছর যখন আমি পাঠশালায় ১ম শ্রেণীতে উঠিলাম, তখন মাদ্রাসায় জমাতে নহমে উঠিলাম। জমাতে নহমে সাদীর বুস্তা, ফরিদুদ্দিন আত্তারের পান্দেনামা ও ফেকায়ে মোহাম্মদীর বৃহত্তর অংশ ছাড়াও নহু সরফ ও মুসদার ফাইউস নামে দুইখানা আরবি ব্যাকরণের বই (উর্দুতে লেখা) পড়িতে হইত। পাঠশালায় প্রথম শ্রেণীতে কঠিনতম সাহিত্য, জটিলতর অঙ্ক ও শুভঙ্করী ছাড়া এই সময় বিজ্ঞান প্রবেশ নামক একখানা বিজ্ঞানের বই এবং শরীর পালন নামক একখানা স্বাস্থ্য বইও আমাদের পাঠ্য হয়। এর উপর ড্রিল-ড্রইং ত ছিলই। তৎকালে আমার মত আট-নয় বছরের শিশুর পক্ষে এতগুলি ভাষা ও বিষয় শিক্ষা খুব ভারী বোধ। হয় নাই।

আমি ‘ক’-মিতি হইতে প্রথম শ্রেণীতে উঠিবার অল্প দিন পরেই মাস্টার। মশায় জগদীশ বাবু ছুটি নেন। তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা দীনেশ চন্দ্র সরকার বড় ভাইর স্থলে একটিনি (এ্যাটিং) করিতে আসেন। জগদীশ বাবু তৎকালে আমাদের অঞ্চলে শ্রেষ্ঠ গায়ক ছিলেন। তাঁর গলা অপূর্ব রকম মিঠা ছিল। কলের গানে গান গাইবার জন্য (গ্রামোফোনে রেকর্ড করাইবার জন্য) তিনি কলিকাতা না কোথায় চলিয়া যান, আর মাস্টারিতে যোগ দেন নাই। দীনেশ বাবুও এন্ট্রেন্স ফেল করিয়া হোমিওপ্যাথিক পড়িতে যান। আমাদের গ্রামের যশস্বী শিক্ষক এতদঞ্চলে প্রায় সকল লোকের উস্তাদ আলিমুদ্দিন মাস্টার সাহেব এই সময় আমাদের শিক্ষক হইয়া আসেন। ইতিপূর্বে পাশের গ্রাম। বৈলরের পাঠশালায় তিনি বহুকাল ধরিয়া শিক্ষকতা করিয়া আসিতেছিলেন। নিচে লেখা ঘটনাসমূহের কারণে বাধ্য হইয়াই তিনি বৈলর পাঠশালা ছাড়িয়া ধানীখোলার শিক্ষক হইয়া আসেন।

.

. ধানীখোলা-বৈলর বিরোধ

বৈলর ও ধানীখোলা পাশাপাশি দুইটি বড় গ্রাম। মাঝখানে সুতোয়া নদী। নদীর একপারে বৈলরের জমিদারবাড়ি ও তৎসংলগ্ন বৈলরের বাজার। নদীর অপর পারে মুক্তগাছার জমিদারদের তিন হিস্যার কাছারি এবং তৎসংলগ্ন বাজার। দুই বাজারই যথেষ্ট সমৃদ্ধিশালী। তৎকালে সুতোয়া নদীর অবস্থা বর্তমানের মত শোচনীয় ছিল না। বার মাস নৌকা চলাচল করিত। বিশেষত, বর্ষাকালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বর্মী, ভৈরব ও চানপুর হইতে মালপত্র লইয়া বড় বড় নৌকা এই নদী দিয়া চলাচল করিত। আমরা ছেলেবেলা বৈলর ও ধানীখোলা বাজারের ঘাটে বড় বড় নৌকা বাঁধা দেখিয়াছি। বাজারের মহাজনদের দোকানের মাল : লোহা, টিন, ধান, চাউল, হাঁড়ি, পাতিল, কড়াই এই সমস্ত নৌকা হইতে ওঠা-নামা করিতে দেখিয়াছি।

মোটকথা, নদীর দুই পারের দুইটা বাজারই সরগরম অথচ নদী। পারাপারের ব্যবস্থা নাই। জিলা বোর্ডের বা লোক্যাল বোর্ডের তরফ হইতে কোনো পোল বা গোদারা নাই। জমিদারদের তরফ হইতেও না। শুধু হাটবারে জমিদারপক্ষ হইতে হাটুরিয়াদের পারাপারের জন্য সাময়িক ব্যবস্থা হইত। বৈলর বাজারের হাট বসিত শনি ও বুধবারে। ধানীখোলার হাট বসিত শুক্রবার ও মঙ্গলবারে। কাজেই সপ্তাহের মধ্যে চার দিনই জমিদারপক্ষ হইতে নৌকার ব্যবস্থা থাকিত। কিন্তু তাতেও পাবলিকের দুর্দশা দূর হইত না। কারণ অ-হাটের তিন দিন রবি, সোম ও বিষুদবার নদী পারাপারের কোনোই ব্যবস্থা। ছিল না। হাটবারের চার দিনও শুধু বিকাল ও সন্ধ্যাবেলা জমিদারদের নৌকা পারাপার হইত।

কিন্তু নৌকাগুলি ভাড়াটিয়া নৌকা ছিল না। জমিদারদের কিনা নিজস্ব। নৌকা। তাতে পারাপারে পয়সা-কড়ি লাগিত না। জমিদারদের নিজের নৌকা বলিয়া অ-হাটবারেও নৌকাগুলি ঘাটের আশেপাশেই বাঁধা থাকিত। কিন্তু মাল্লারা জমিদারদের লোক বলিয়া তারা নৌকায় থাকিত না। অন্য কাজে যাইত। তবে নদীর পাশের সমান লম্বা দুইটা মযবুত রশি নৌকার দুই গলুইর গোড়ায় বাঁধিয়া দুই পাড়ে দুইটা খুঁটিতে বাঁধিয়া রাখিত। রশি ধরিয়া টানিয়া লগি ছাড়াই এক পাড়ের নৌকা অপর পাড়ে নেওয়া চলিত। এই অবস্থা চলিবার সময় হাটবার লইয়া দুই বাজারের মালিকদের মধ্যে বিরোধ বাধে। এই বিরোধ ফৌজদারি কোর্টে পর্যন্ত গড়ায়। আগেকার জমিদাররা অতি সহজেই প্রজা-সাধারণকে দিয়া নিজেদের স্বার্থে ও পক্ষে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করাইতে পারিতেন। জমিদারদের সীমা ও চর জমির দখল লইয়া দুই জমিদারের বিরোধ প্রজাদের নিজেদের মধ্যে খুনাখুনি করিতে আমি ছেলেবেলা একাধিকবার দেখিয়াছি। তদুপরি এই বাজার-বিরোধটার মধ্যে প্রজা, সাধারণের স্বার্থ সোজাসুজি জড়িত ছিল। কাজেই জমিদারদের বিরোধ অতি সহজেই বৈলর-ধানীখোলাবাসীর বিরোধে পরিণত হইল। দুই গ্রামের লাঠিওয়ালারা নদীর পাড়ে দাঁড়াইয়া লাঠি ঘুরাইতে লাগিল। এক গ্রামের পক্ষে অন্য গ্রামের ভিতর দিয়া চলাচল বিপজ্জনক হইয়া উঠিল।

.

. আলিমুদ্দিন মাস্টার

এই বিপদ আলিমুদ্দিন মাস্টার সাহেবকেও ছাড়িল না। তিনি ধানীখোলার লোক। কাজেই বৈলর যাওয়া তার পক্ষে বিপজ্জনক হইল। তিনি একাই মাস্টারি করিতে যাইতেন না। তাঁর প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের কয়েকজন ছাত্রও স্বভাবতই তার পাঠশালায় যাইত। এই সময় আমাদের মাস্টারের অভাব হইয়াছিল। সুতরাং, আলিমুদ্দিন মাস্টার সাহেব অতি সহজেই ধানীখোলা পাঠশালার মাস্টারি পাইলেন। ছাত্ররা এবং তাহাদের অভিভাবকেরা আলিমুদ্দিন মাস্টার সাহেবকে পাইয়া খুশি। কারণ, তিনি দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক হিসাবে খুব নাম করিয়াছিলেন। তিনি আমাদের স্কুলের মাস্টারি নিবার পর আমাদের স্কুলের ছাত্রসংখ্যা বাড়িয়া গেল। বাজার লইয়া গন্ডগোল মিটিবার পরে বৈলর গ্রাম হইতেও অনেক অনেক ছাত্র আমাদের স্কুলে চলিয়া আসিল।

আলিমুদ্দিন মাস্টার সাহেব আমাদের পাঠশালার শিক্ষক হইবার পর তিনি এই স্কুলে কতকগুলি সংস্কার প্রবর্তন করিলেন। (এক) পাঠশালার বার্ষিক পুরস্কার-বিতরণী সভার আয়োজন হইল। গ্রামের ছুটির প্রাক্কালে সাধারণত জ্যৈষ্ঠ মাসে এই বার্ষিক সভা হইত। তাতে পর্দাঘেরা মঞ্চ করা হইত। মাস্টার সাহেব নিজে মঞ্চের ডিরেক্টর হইতেন। নিজ মুখে হুইসেল মারিয়া, নিজ হাতে রশি টানিয়া তিনি মঞ্চের পর্দা খুলিতেন ও বন্ধ করিতেন। ছাত্ররা এক মাস ধরিয়া শিখানো আবৃত্তি ঠিকমত করিতেছে কি না পর্দার পিছন হইতে তিনি দেখিতেন এবং প্রক্ট করিতেন। সভার শুরুতে তিনিই সমাগত অতিথিদিগকে স্বাগত জানাইতেন। সভা শেষে তিনিই সকলকে ধন্যবাদ দিতেন। মোটকথা, আলিমুদ্দিন মাস্টার সাহেব ছিলেন উৎসাহ-উদ্যমের প্রতিমূর্তি। (দুই) তিনি স্কুল গৃহ বদলাইলেন। আগে স্কুলঘর ছিল কাছারির পূর্ব প্রান্তে একেবারে বাজারসংলগ্ন। বাজারের এত নিকটে স্কুল থাকা ভাল নয় বলিয়া তিনি স্কুল সরাইয়া নিয়া গেলেন কাছারির অনেক পশ্চিমে পুকুরেরও পশ্চিম পাড়ে। আগের ঘরটি ছিল টিনের চৌচালা। নূতন ঘরটি হইল ছনের দুচালা। এতে বরঞ্চ ভাল হইল। গরমের দিনে টিনের ঘরে খুব অসুবিধা হইত। এখন ছনের ঘরে আরাম হইল। আরেক কারণে মাস্টার সাহেব বাজারের অত নিকট হইতে স্কুল সরাইয়া নিয়াছিলেন। সেটি তখন বুঝি নাই। বড় হইয়া। বুঝিয়াছিলাম। সে কারণ এই যে অন্যান্য বাজারের মত ধানীখোলা বাজারেও বেশ্যাপল্লি ছিল। তৎকালে বেশ্যাপাড়া ছাড়া বাজার করা যাইত না। (৩) আলিমুদ্দিন মাস্টার সাহেব স্কুলগৃহের মধ্যভাগকে তিন ক্লাসে বিভক্ত করিয়াছিলেন। কোনো পার্টিশন বা বেড়া-টাট্টি দিয়া নয়, শুধু বেঞ্চি পাতিয়া। একদিকে দ্বিতীয় শ্রেণী, মধ্যভাগে প্রথম শ্রেণী, আরেক পাশে ‘ক’-মিতি, ‘খ’ মিতি ইত্যাদি নিম্ন শ্ৰেণী। মাস্টার সাহেব একাই শিক্ষক ছিলেন এবং মাঝখানের ক্লাসে বসিয়া তিন ক্লাসই এক জায়গা হইতে পড়াইতেন। তবু দেখিতে স্কুলটির অভ্যন্তর ভাগ তিনটি আলাদা ক্লাস দেখাইত। (চার) মাস্টার সাহেব তত্ত্বালে ইংরাজি জানিতেন না বলিয়া জগদীশ বাবুর প্রচলিত নিয়ম বজায় রাখিবার জন্য কার্ত্তিক বাবু নামে কাছারির জনৈক আমলাকে সপ্তাহে দুই ঘণ্টা করিয়া ইংরাজি ক্লাস লইতে রাজি করেন। কার্তিক বাবু এ জন্য কোনো পয়সা-কড়ি নিতেন না। (পাঁচ) তিনি সব সময় টুপি পরিয়া স্কুলে আসিতেন। কখনও খালি মাথায় আসিতেন না। ছাত্রদেরেও টুপি পরিয়া আসিতে বলিতেন। তবে কেউ টুপি পরায় গাফলতি করিলে শাস্তি দিতেন না। তিনি নিজে ধুতি ও তহবন্দ উভয় পোশাকেই স্কুলে আসিতেন। তবে সাব ইন্সপেক্টর স্কুল পরিদর্শনে আসিবার দিন তিনি ধুতি পরিয়াই আসিতেন। তিনি নিজে তহবন্দ পরিলেও ছাত্রদের তিনি তহবন্দ পরিতে তাকিদ দিতেন না। স্কুলঘরের সামনে খানিকটা জায়গা বেড়া দিয়া তিনি নামাজের জায়গা করেন। এই বেড়ার চারদিকে পাতাবাহারের গাছ লাগাইয়া জায়গাটি সুন্দর রাখিতেন। নামাজের জায়গাটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখিবার জন্যে তিনি নিজে আমাদিগকে লইয়া ঝাড় দিতেন এবং ঘাস লম্বা হইয়া গেলে কাটিয়া ফেলিতেন। প্রতিদিন যোহরের ওয়াক্তে ছাত্রদের লইয়া তিনি নামাজ পড়িতেন। যারা অযু নামাজ জানিত না বা সুরা তকবির পড়িতে পারিত না, তাদেরেও তিনি তার সাথে সাথে উঠবসা করিতে হুকুম দিতেন। একটু একটু করিয়া সকলকেই তিনি নামাজ শিখাইতে চেষ্টা করিতেন। নামাজের জায়গায় বিছাইবার জন্য তিনি ছাত্রদের নিকট হইতে চাঁদা তুলিয়া চট কিনিয়াছিলেন। এই চট স্কুলের বাক্সে সযত্নে রাখিয়া দিতেন এবং তার চাবি নিজের কাছে রাখিতেন। এইসব চাদা ও ছাত্র-বেতন সম্পর্কে মাস্টার সাহেব সুবিচারি লোক ছিলেন। গরীব ছাত্রদের বেতন ছিল অবস্থাভেদে এক আনা, দুই আনা, চারি আনা। অনেকে ছিল ফ্রি। কিন্তু আমরা দুই ভাই, শামসুদ্দিনরা দুই ভাই ও ওসমান আলী সরকার সাহেবের এক ভাই সাদত আলী এই ধরনের অবস্থাশালী ছাত্রদের বেতন ছিল আট আনা করিয়া। এছাড়া তিনি অভিভাবকদের নিকট হইতে পাটের মওসুমে পাট ও ধানের মওসুমে ধান তুলিয়া স্কুলগৃহের সাজসরঞ্জাম, যথা টেবিল, চেয়ার, বেঞ্চি, ব্ল্যাকবোর্ড, ভূচিত্রাবলি, গ্লোব, ঘড়ি ও ঘণ্টা কিনিয়াছিলেন এবং এইসব রাখার জন্য প্রথমে বাক্স এবং শেষে আলমারি তৈয়ার করিয়াছিলেন। (ছয়) হাতে-কলমে। বিজ্ঞান পড়াইবার উদ্দেশ্যে তিনি আমাদের হাতে স্কুল ঘরের পাশে ও পিছনে নানাবিধ ফল-ফুলের গাছ লাগাইতেন। আমরা সকলেই ছিলাম কৃষকশ্রেণির লোক। কাজেই হাতে-কলমে কৃষি-কার্য শিখাইবার উদ্দেশ্যে তিনি একবার পানি-কাদার মধ্যে রোয়া ধান লাগাইতে আমাদের কামলা লইয়াছিলেন, অর্থাৎ স্কুলের সকল ছাত্রকে তিনি একদিন নিজের বাড়িতে দাওয়াত করিলেন। আমরা প্রায় সকলেই মাস্টার সাহেবের বাড়ি গেলাম। তিনি আমাদিগকে চিড়া ভাজা নাশতা খাওয়াইয়া ক্ষেতে নিয়া গেলেন। আমাদের সকলের হাতে এক এক মুঠা জালা (চারাধান গাছ) দিয়া এবং নিজে এক মুঠা লইয়া কাতার বাঁধিয়া রোয়া লাগাইতে শুরু করিলেন। আমাদের সহপাঠীরা প্রায় সকলেই নিজের হাতে কম-বেশি এ কাজ আগেই করিয়াছিল। আমরা দুই ভাই এবং শামসুদ্দিনরা দুই ভাই এবং সাদত আলী আমরা কেউ কোনো দিন নিজ হাতে রোয়া লাগাই নাই। কিন্তু সে কথা স্বীকার করিয়া বোকা বনিতে কেউ রাজি হইলাম না। আমরা মাস্টার সাহেবের এবং অন্য ছাত্রদের দেখাদেখি রোয়া লাগাইয়া পুরা ক্ষেত শেষ করিয়া ফেলিলাম। মাস্টার সাহেব আমাদের দক্ষতায় খুব খুশি হইলেন। বেলা পশ্চিম দিকে হেলিয়া পড়িলে সবাই মাস্টার সাহেবের বাড়ি ফিরিলাম। বাড়ির পাশের নদীতে গোসল করিয়া শরীরে মাস্টার সাহেবের দেওয়া প্রচুর সরিষার তেল মাখিয়া খাইতে বসিলাম। মাস্টার সাহেব আমাদের খাওয়ার জন্য মাছ-গোশত ও দুধ-কলা চিনিতে প্রচুর আয়োজন করিয়াছিলেন। আমরা তকালেই হিসাব করিয়া দেখিয়াছি, রোজানা বেতন দিয়া তিনি যদি কৃষিশ্রমিক নিযুক্ত করিতেন, তবে তাদের বেতন ও খোরাকিতে তার অত টাকা লাগিত না। দুই-তিন দিন পরে মাস্টার সাহেব আমাদেরে জানাইয়াছিলেন যে আমাদের রোয়া লাগানো ক্ষেতের বেশির ভাগ চারা মরিয়া গিয়াছে। তিনি চারাগুলি উখাড়িয়া দেখিয়াছেন যে আমরা অনেকেই জালার গোড়া ভাঙ্গিয়া মাটিতে পুঁতিয়া রাখিয়াছি। অতঃপর আর কোনো দিন মাস্টার সাহেব আমাদের নিয়া কোনো চাষের কাজ করান নাই।

(সাত) আলিমুদ্দিন মাস্টার সাহেব আমাদের স্কুলে আর একটি সংস্কার। প্রবর্তন করেন। সেটা হইল শুক্রবার মর্নিং স্কুল। স্কুলের আশপাশে প্রায় আধা মাইলের মধ্যে কোনো মসজিদ বা জুম্মাঘর ছিল না। কাজেই ছাত্রদের জুম্মার নামাজ পড়িবার সুবিধার জন্য তিনি শুক্রবারে সকাল ছয়টায় স্কুল বসাইবার ব্যবস্থা করিলেন। এর আগে পর্যন্ত আমরা দুই ভাই জগদীশ বাবুকে বলিয়াই শুক্রবারে অনুপস্থিত থাকিতাম। আলিমুদ্দিন মাস্টার সাহেব এই নয়া ব্যবস্থা করায় আমাদের জুম্মার নামাজের জন্য আর পাঠশালা কামাই করার দরকার থাকল না। শুক্রবার আমাদের বাড়ির মাদ্রাসা বন্ধ থাকিত। কাজেই সকালে স্কুল হওয়ায় সেদিকেও কোনো অসুবিধা হইল না। ছয়টা হইতে এগারটা পর্যন্ত রীতিমত ক্লাস হইত। ছুটির পর আমরা সাড়ে এগারটায় বাড়ি পৌঁছিতাম এবং গোসল করিয়া জুম্মার নামাজে যোগ দিতে পারিতাম।

.

. মাস্টার সাহেবের ছাত্রপ্রীতি

এ অঞ্চলে কোনো বড় মেহমানি হইলে এবং সে মেহমানিতে মাস্টার সাহেবকে দাওয়াত করিলে তিনি শর্ত করিতেন, তাঁর সব ছাত্রকে দাওয়াত করিলে তিনি যাইবেন। প্রায় সবাই ছাত্র-সুদ্ধাই মাস্টার সাহেবকে দাওয়াত দিতেন। দাওয়াতের দিন যথাসাধ্য পরিষ্কার জামা-কাপড় পরিয়া টুপি মাথায় দিয়া আসিতে সব ছাত্রকে তিনি বিশেষ তাগিদ দিতেন। সম্ভব হইলে ছাত্রদের অভিভাবকদেরেও বলিয়া দিতেন। নিকট প্রতিবেশী ছাত্রদের বাড়িতে গিয়া কাপড়-চোপড় ধুইল কি না খোঁজখবর করিতেন। নির্দিষ্ট দিনে বারটা-একটার সময় স্কুল ছুটি দিয়া সদলবলে মেহমানিতে যাইতেন। একত্রে এক কাতারে তাঁর সব ছাত্রকে বসাইবার জন্য তদবির করিতেন। এমনটি প্রয়োজন হইলে দাওয়াতের মালিকের সাথে দরবার করিতেন। সকল ছাত্রকে ঠিকমত বসাইয়া তিনি স্বয়ং তাদের সাথে বসিতেন। সাকিদারির সময় কোন ছাত্রের পাতে ভাত নাই, কার ভাগে গোশত কম পড়িল, এসব ব্যাপার লইয়া সাকিদারদের সাথে। দর-কষাকষি করিতেন। ফলে মাস্টার সাহেবের সাথে মেহমানিতে গেলে বেশি গোশত ও আদর-যত্ন পাওয়া যায়, ছাত্রদের মধ্যে এ কথা মশহুর হইয়া গিয়াছিল। খাওয়া-দাওয়ার পর মাস্টার সাহেব হুইসেল দিয়া সব ছাত্রকে আবার একত্রে জমা করিতেন। ফলইন’, ‘এটেনশন’, রাইট টার্ন’, ‘সেলিউট ওয়ান-টু-থ্রি’ মার্চ’ বলিয়া তিনি যিয়াফতের মজলিস হইতে ছাত্রদেরে লইয়া বাহির হইতেন। দর্শকেরা প্রশংসমান এক দৃষ্টিতে সেদিকে চাইয়া থাকিতেন এবং ছাত্রসহ মাস্টার সাহেব দূরে চলিয়া গেলে সকলে মাস্টার সাহেবের শিক্ষকতার তারিফ করিতেন। হাঁ, মাস্টার বটে। ছাত্রদেরে কী সুন্দর শায়ের করিয়াছেন।

ধানীখোলা পাঠশালায় আমার ছাত্রজীবনের শেষ বছর, অর্থাৎ ১৯০৮ সালের খুব সম্ভব ডিসেম্বর মাসে বৈলর বাজারে মুসলমানদের এক বিরাট সভা হয়। এত বড় সভা আমি জীবনের প্রথম এই দেখি। উভয় গ্রামের মাতব্বররা মিলিয়াই এই সভার আয়োজন করিয়াছিলেন। জিলা সদর হইতে এবং বিদেশ হইতে বড়-বড় বক্তা এই সভায় যোগ দিয়াছিলেন। তাদের মধ্যে সিরাজগঞ্জের মুনশী মেহেরুল্লাহ, মৌ. মোহাম্মদ ইসমাইল (পরে খান বাহাদুর) ও মৌ. আবদুর হাকিম নামে একজন স্কুল সাব-ইন্সপেক্টর আমার মনে স্থায়ী দাগ কাটিয়াছিলেন। এই বিরাট সভায় অনেক ভলান্টিয়ারের দরকার হইয়াছিল। উদ্যোক্তারা আশপাশের সমস্ত স্কুল-মাদ্রাসার কাছে ভলান্টিয়ার চাহিয়াছিলেন। কর্মবীর আলিমুদ্দিন মাস্টার এ ব্যাপারে সমস্ত স্কুল-মাদ্রাসাকে হারাইয়া দিয়াছিলেন। এক মাস ধরিয়া তিনি আমাদেরে ভলান্টিয়ারি কুচকাওয়াজ ও ফুট-ফরমাস সম্পর্কে এমন সুন্দর ট্রেনিং দিয়াছিলেন যে সম্মিলনীতে সমাগত মেহমানরা মাস্টার সাহেবকে ডাকিয়া নিয়া তারিফ করিয়াছিলেন। আমরা ছাত্ররাও এ সভা হইতে জীবনের খুব মূল্যবান জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছিলাম।

আলিমুদ্দিন মাস্টার সাহেবের কাছে মোটমাট দুই বছর পড়িয়াছিলাম। এই দুই বছরে আমার অনেক শিক্ষালাভ ঘটিয়াছিল। এই সময়ে আমি আট-নয় বছরের শিশু হইয়াও বুড়া প্রবীণের চেয়েও বেশি নফল এবাদত করিতাম। সে কথা আমি অন্যত্র বর্ণনা করিব। এখানে ঐ ব্যাপার উল্লেখ করা দরকার এই জন্য যে, হযরত পয়গম্বর সাহেবকে খাবে দেখা ঐ সময় আমার এবাদতের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু পয়গম্বর সাহেবকে খাবে কখনও দেখি নাই। তার বদলে সাদা জুব্বা-জাব্বা পাগড়ি-পরা খড়ম-পায়ে তসবি-হাতে একজন সুফি দরবেশকে খাবে দেখিতে পাইতাম। এই সুফি দরবেশের মুখের অবয়ব তখনও মনে পড়িত না। এখন ত পড়িবেই না কিন্তু এই দরবেশকে খাবে দেখিয়া আমার একটা অসাধারণ লাভ হইয়াছিল। তা এই :

.

. স্বপ্নে মুখরেজ-তালাফ্‌ফুয

চাচাজী ছমিরুদ্দিন মুনশী, ইয়াকুব, মৌলবী প্রভৃতি আমার শৈশবের উস্তাদরা কেই কারি ছিলেন না। তাঁদের মুখরেজ-তালাফুয সব আরবি হরফের বেলা নির্ভুল নিখুঁত ছিল না। মুখরেজ মানে হরফ উচ্চারণে অরগান-অব-স্পিচ ঠিক রাখা। হরফগুলির মধ্যে কতকগুলি মূর্ধা বা আলাজিভ হইতে, কতকগুলি তালু হইতে, কতকগুলি দাঁত হইতে, আর কতকগুলি ঠোঁট হইতে জিভের সংস্পর্শে বাহির হয়। অন্যান্য ভাষার চেয়ে আরবিতেই এই দিককার অর্থাৎ মুখরেজ উচ্চারণ খুব কড়াকড়িভাবে পালিত হয়। ইংরাজি একটা ‘এ’ ও বাংলা একটা স’ (ছ)-এর জায়গায় আরবিতে ‘সে’ ‘সিন’ ‘সোআদ’ এই তিনটা হরফ আছে। অথচ এই তিনটার মধ্যে দুইটা হরফই দন্ত্য হইলেও দুইটা উচ্চারণে দাঁত-জিভের দুইটা পৃথক জায়গা স্পর্শ করে এবং অপরটা ঠোঁট হইতে উচ্চারিত হয়। ঠিক তেমনি ইংরাজি একমাত্র ‘যেড’ হরফের স্থলে আরবিতে যাল, যে, যোআদ ও যোয়–এই চারিটি হরফ আছে। অথচ ঐ চারিটি হরফের নিজেদের মধ্যে প্রচুর উচ্চারণ-ভেদ রহিয়াছে। এই চারিটি হরফের প্রথম দুইটি হরফের মধ্যে যাল’-এর উচ্চারণের সময় দাঁত জিভের আগা স্পর্শ করে এবং যে উচ্চারণের সময় দাঁত জিভের মধ্যভাগ স্পর্শ করে। অর্থাৎ যে’র উচ্চারণ বাংলা য’র, উচ্চারণ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক। তেমনি বাংলা ‘হ’ বা ইংরাজি ‘এইচ’-এর উচ্চারণের সঙ্গে আরবি ‘হায়হুত্তি’র কোনও মিল নাই। বাংলা-ইংরাজি হ’ উচ্চারণের সঙ্গে আরবি ‘হায় হাওওয়াজ’-এর মিল রহিয়াছে।

কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য উচ্চারণগত এই সব সূক্ষ্ম পার্থক্যের কোনও মূল্য নাই। তাদের কাছে মাত্র দুইটি হরফে এই পার্থক্য পালন সীমাবদ্ধ হইয়াছে। ইংরাজি জে (‘জি’সহ) ও ‘যেডের পার্থক্য ও আরবি ‘জিম’ ও। ‘যে’র পার্থক্য। ইংরাজির ‘জে’ ও ‘জি’ (যে শব্দে ‘গ’ হয় না) এবং আরবির ‘জিম’ মূর্ধন্য বর্ণ। এগুলি আলাজিভের সঙ্গে জিভের স্পর্শ হইতে বাহির হয়। পক্ষান্তরে ইংরাজি ‘যেড’ ও আরবির ‘যে’ (যাল’সহ) দন্ত্য বর্ণ। আরবি যোয়াদ, যোয় যদিও দন্ত্য নয় ঔষ্ঠ্য, তবু তাদের নৈকট্য দন্ত্য ‘যে’ ‘যালের সাথে, মূর্ধন্য’ ‘জিমের সাথে নয়।

আরবিতে এই আঙ্গিক উৎপত্তিগত পার্থক্য মানিয়া চলাকেই মুখরেজ আদায় করা বলে। ইংরাজিতে এটাকে বলে ফনেটিকস।

পক্ষান্তরে তালাফুযও উচ্চারণ-ভঙ্গি বটে, কিন্তু সেটা হরফের আঙ্গিক বুৎপত্তির উপর নির্ভর করে না। শব্দকে হ্রস্ব, দীর্ঘ, লম্বা, খাটো করা, কোনও হরফ বা শব্দের উপর কম বা বেশি জোর একসেন্ট দেওয়া, বাক্যের কোন জায়গায় থামা বা না থামা, বেশি থামা বা কম থামা ইত্যাদি তালাফফুযের অন্তর্ভুক্ত। ইংরাজিতে যাকে একসেন্ট এ্যামফেসিস্ ও ফুলস্টপ বলা হয়, আরবিতে যাকে মদ্দ, তশদিদ, আয়াত, ওয়াকফা বলা হয়, বাংলায় যাকে পুত, বা দাড়ি বলা হয়, এই সবই তালাফুযের অংশ। একটা খুব সাধারণ দৃষ্টান্ত দিতেছি। ‘চ’ মূর্ধন্য হরফ। এটাকে দন্ত্য উচ্চারণ করিলে এটা হইবে মুখরেজের খেলাফ। কিন্তু ঠিকমত ‘চ’ মূর্ধন্য উচ্চারণ করিয়াও ‘চোর’ শব্দকে ‘চুর উচ্চারণ করিলে এটা হইবে তালাফুফের খেলাফ। সোজা কথায় ইংরাজিতে যাকে বলে ফনেটিকস, বাংলায় ধ্বনিতত্ত্ব, আরবিতে তাই মুখরেজ। তেমনি ইংরাজিতে যাকে বলে পাংচুয়েশন, বাংলায় যতি, আরবিতে তাই তালাফফুয। বিশেষ করিয়া কোরআন শরিফ তিলাওয়াতে পুরাপুরি মুখরেজ-তালাফুয আদায় করার দিকে বিশেষ তাগিদ আছে। কিন্তু আমার উস্তাদদের মধ্যে বা আত্মীয়স্বজনের মধ্যে এমনকি স্থানীয় আলেম-ওলামার মধ্যেও কারো এ বিষয়ের তীক্ষ্ণ জ্ঞান ছিল না। বিশেষত, মুখরেজের গুরুত্ব তারা মোটেই বুঝিতেন না। চাচাজীসহ আমার অন্য উস্তাদরা কোরআন তিলাওয়াতে এবং নামাজের কেরাতে মিঠা গলায় খোশ এলহানে সুরা পাঠ করিতেন। শুনিতে অতি মধুর লাগিত। বিশেষত, চাচাজী যখন নামাজে লম্বা কেরাত পাঠ করিতেন তখন ভদ্রার মধুর গুঞ্জন কাপিয়া-কাপিয়া আমার কানে বাজিতে থাকিত। এমন যে চাচাজী তিনিও জাহান্নামকে কখনও ‘যাহান্নাম’ ইযা জাআকে’ নির্বিচারে কখনও ইজা যাআ’। কখনও ইজা জাআ কখনও বা ইযা-যাআ পড়িতেন জিম’ ও ‘যে’র পার্থক্য যেন তারা বুঝিতেনই না। অন্তত উচ্চারণে তা মানিয়া চলিতেন না। শুধু সে কালে নয়, আজকালও আমি এমন অনেক পণ্ডিত লোক দেখিয়াছি, যারা জে’ ‘যেড’ ‘জিম’ ‘যের পার্থক্য বুঝেন না এবং বেদেরেগ একটার জায়গায় আরেকটা উচ্চারণ করিয়া থাকেন। বহু অধ্যাপককে ‘যিরো’র স্থলে ‘জিরো’, ‘যেনিথের’ জায়গায় ‘জেনিথ’, ‘এলিযাবেথের জায়গায় ‘এলিজাবেথ’, ‘জজ’-এর জায়গায় যর্জ’ এবং বহু উকিলকে জজকোর্টকে য কোর্ট উচ্চারণ করিতে শুনিয়াছি। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে পড়িতেছে। একবার নুরুযযামান নামক আরবিতে এমএ পাশ একটি যুবক চাকরিপ্রার্থী অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সহিত দেখা করিতে গিয়া নিজের নাম বলিয়াছিলেন, নুরুজ্জামান। সোহরাওয়ার্দী সাহেব প্রথমে ক্রুদ্ধ এবং শেষ পর্যন্ত বিস্মিত হইয়াছিলেন। কারণ দেখা গেল, নিজের নাম। আরবিতে এমলা করিবার সময় যে’কে ঠিক ‘যে’ই উচ্চারণ করেন, কিন্তু নামের উচ্চারণের সময় দুই ‘যে’কে সংযুক্ত করিয়া ‘জে’ করিয়া ফেলেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ও আমি অনেক চেষ্টা করিয়াও তাকে ঠিক করিতে পারি। নাই। আমাদের প্রিয় সহকর্মী তরুণ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ পর্যন্ত নিজের নাম মুযিবুর রহমান বলেন। অপর বন্ধু রাজশাহীর উলিক অধ্যাপক মুজিবুর রহমান নিজের নাম অসংকোচে যেড’ দিয়া লিখিয়া উচ্চারণ করিয়া থাকেন। বহুকাল সংশোধনের চেষ্টা করিয়াও ব্যর্থ হইয়া অবশেষে এই দুইজনকেই শহীদ সাহেব প্রকাশ্যভাবে খুব জোরে জোরে মুযিবুর রহমান ডাকিতেন। শৈশবে এই স্বরধ্বনিবোধ জাগ্রত না হইলে বয়সকালে যে এটা আর হইয়া উঠে না, তার প্রমাণ এই সেদিনও পাইয়াছি। আমার পরম স্নেহের পাত্রী এমএ পাশ একটি মেয়েকে এক ঘণ্টার বেশি সময় যেড’ ও ‘জে’র পার্থক্য বুঝাইতে ফনেটিকসের অনেক গূঢ় তত্ত্ব বুঝাইলাম। অবশেষে মহিলা সগৌরবে বলিলেন : ‘এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝিতে পারিলাম। ‘জেড’টার উচ্চারণটা সত্যই ঐরূপ। বাংলা বর্ণমালায় এই পার্থক্য নাই বলিয়াই বোধ হয় শিক্ষিত বাঙ্গালীদের জিভের এই অবস্থা।

যা হোক আমার ছেলেবেলায় দেশের অবস্থা এই রূপই ছিল। আমি নিজেও তেমনি শিক্ষা পাইতেছিলাম। এমন সময় স্বপ্নে-দেখা এই সুফি দরবেশ সাহেব আমাকে মুখরেজ-তালাফুয সম্পর্কে খাবেই সবক দিতে লাগিলেন। এক দিন নয়, দুই দিন নয়, পরপর কয়েক দিনই তিনি আমাকে মুখরেজ সম্বন্ধে সবক দিলেন। তিন দিনের খাবের কথা আমার আজিও স্পষ্ট মনে আছে। একদিন তিনি এক বড় জমাতে ইমামতি করিবার সময় সহি মুখরেজ আদায় করিয়া কেরাত পাঠ করিলেন এবং নামাজ শেষে আমাকে একা একদিকে লইয়া গিয়া তিনি কেরাতে কোন হরফ কীভাবে কোন উচ্চারণ করিয়াছেন আমাকে তা বুঝাইলেন। প্রত্যেক হরফের উচ্চারণ তিনি এমন স্পষ্ট ও সহজভাবে করিলেন যে, ঘুম ভাঙার পরেও ঐসব উচ্চারণ সুফি সাহেবের গলার সুরেই আমার কানে সারা দিন ঝংকৃত হইতে থাকিল। এই সুফি সাহেব নিজের পরিচয় দিতেন না। সে কথা তাঁকে পুছ করিতেও আমার মনে থাকিত না। তবু তার চেহারা সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা হইয়া গিয়াছিল। বরাবর যে একই লোক আসিতেন, সে কথা জোর করিয়াই বলা যায়। কারণ দিনের বেলা অনেক খুঁজিয়া-চিন্তিয়াও অমন সুন্দর চেহারার কোনও আলেম আমার মনে পড়িত না। উনার গলার আওয়াজও কারো সাথে মিলিত না। উনি আর যে-ই হোন, আমাদের আত্মীয় কারী ময়েযুদ্দিন সাহেব যে নন, তাতে কোনও সন্দেহ ছিল না। কারণ কারি সাহেব আমাদের বংশের আর সব মুরুব্বিদের মতই ঘোর কালো রঙের লোক ছিলেন। কাজেই এই সুফি সাহেবকে আবার স্বপ্নে দেখিবার জন্য সারা দিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করিতাম। দেখিতামও তাঁকে। একদিন খাবে দেখিলাম, তিনি আমাদের বাড়ির মসজিদেই খুব বুলন্দ আওয়াজে কোরআন তিলাওয়াত করিতেছেন। তিনি মসজিদের দরজার দিকে মুখ ফিরিয়া বসিয়া তিলাওয়াত করিতেছিলেন। আমি মসজিদের বাহিরের আঙিনায় খেলিতেছিলাম। হঠাৎ তার চিনা মিঠা গলা আমার কানে গেল। আমি কান পাতিয়া তাঁর গলা শুনিলাম। আমি তাঁকে দেখিতেছিলাম বটে, কিন্তু তিনি আমাকে দেখিতে পান নাই। তবু আমার মনে হইল, তিনি আমাকে শুনাইয়া প্রতি হরফের সহি মুখরেজ আদায় করিতেছেন। তিলাওয়াত শেষ করিয়া তিনি কোরআন শরিফ জুযদানে বাঁধিয়া রেহালের উপর রাখিয়া মাথা তুলিলেন এবং আমাকে দেখিতে পাইলেন। নিঃশব্দে হাত উঁচা করিয়া আমি তাকে সালাম করিলাম। তিনি হাত ইশারায় আমাকে ডাকিলেন। আমার অযু ছিল। খুব তাজিমের। সাথে তাঁর কাছে গিয়া বসিলাম। তিনি তখন আমাকে আলেফ-বে-তে-সে পড়াইতে শুরু করিলেন। তিনি অনেকক্ষণ ধরিয়া আমাকে জিম’ ‘যাল’ ‘যোআদ’ ‘যোয়’-এর উচ্চারণ শিখাইলেন। পাঠশালায় নামতা পড়িবার মত আমি সুফি সাহেবের প্রতি হরফ উচ্চারণে তার পুনরাবৃত্তি করিতে লাগিলাম। তৃতীয় দিনের স্বপ্নে আমি বাড়ির পশ্চিম দিকে নাগুয়া নদীর পাড় দিয়া বেড়াইতে ছিলাম। হঠাৎ ঐ সুফি সাহেব আমার সামনে পড়েন। আমি সালাম করি। তিনি কতদূর শিখিয়াছ?’ বলিলেন। আমি সবগুলি হরফ উচ্চারণ করিলাম। তিনি বলিলেন : শাবাশ, আর কয়েক দিন চেষ্টা করিলেই ঠিক হইয়া যাইবে।

এই সব স্বপ্নের বিস্ময়কর ফল হইল। আমি মুখরেজ ও তালাফুয এমন রত করিয়া ফেলিলাম যে মাদ্রাসায় সবক লইবার সময় উস্তাদজিদের ভুল ধরিতে লাগিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *