০২. জন্ম ও শৈশব

অধ্যায় দুই – জন্ম ও শৈশব

. জন্ম

বাংলা ১৩০৫ সালের ১৯ ভাদ্র (ইং ১৮৯৮, ৩ সেপ্টেম্বর) শনিবার ফযরের ওয়াতে আমার জন্ম। আমি বাপ-মার তৃতীয় সন্তান। আমাকে পেটে লইয়াই মা গুরুতর অসুখে পড়েন। সে রোগ দীঘস্থায়ী হয়। আমার জন্মের অনেক দিন পরে তিনি আরোগ্য লাভ করেন। কয়েক দিন স্থায়ী বেদনার পরে আমি ভূমিষ্ঠ হই এবং প্রসবের পরেই মা অজ্ঞান হইয়া পড়েন। আগের দুই প্রসবে মার কোনোই কষ্ট হয় নাই। কাজেই আমার প্রসবের সময়কার মার। এই কষ্ট ও এই অজ্ঞান হইয়া পড়াকে বাড়ির সকলে অশুভ লক্ষণ মনে। করেন। মা শ্বশুর-শাশুড়ির আদরের বউ ছিলেন। মার জন্য সকলে কান্নাকাটি জুড়িয়া দেন।

এদিকে দাই আমাকে প্রসব করাইয়া ঘোষণা করে যে মৃত সন্তান হইয়াছে। সাধারণ অবস্থায় দাইদের অমন কথায় কেউ বিশ্বাস করিতেন না। নিজ চক্ষে সন্তান দেখিবার জন্য সবাই উদ্বিগ্ন হইতেন। কিন্তু আদরের বড় বউয়ের মরা-বাঁচা লইয়া সবাই এত ব্যস্ত ছিলেন যে মরা সন্তান দেখিবার জন্য কেউ বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন নাই। কাজেই মরা সন্তানটিকে যথাসময়ে দাফন-কাফন করা সাপেক্ষে আমাকে একটি সুপারির খোলে ঢাকা হয় এবং বাইরে ফেলিয়া রাখিলে কাক-কুকুরে নিয়া যাইতে পারে বলিয়া ঘরের এক অন্ধকার কোণে রাখা হয়।

মেয়ের অন্তিম অবস্থায় খবর পাইয়া আমার নানা মেহের উল্লা ফরাযী আসেন মেয়েকে দেখিতে। নানাজী গৌরবর্ণ দীর্ঘাঙ্গ সুপুরুষ ছিলেন। তাঁর চাপদাড়ি ও সুউচ্চ বাঁশির মত নাকটা দেখিবার মত ছিল। নাকের আগাটা ময়না পাখির ঠোঁটের মত বাঁকা ছিল। নানার মুখে শুনিয়াছি তাঁর বাবা মহব্বত উল্লা ফরাযী আরো গৌরবর্ণ সুপুরুষ ছিলেন। তাঁর নাকটা নাকি আরো সুন্দর ছিল। যা হোক, নানাজী ছিলেন এ অঞ্চলে ডাকসাইটে ধানুরি (ধন্বন্তরি) কবিরাজ। তিনি মেয়েকে দেখিয়া-শুনিয়া এবং তয়-তদবিরের পরামর্শ দিয়া মরা নাতিটি দেখিতে চাহিলেন। তাঁকে ঘরের কোণে রাখা সুপারির খোলটি দেখাইয়া দেওয়া হইল। নানাজী সুপারির খোলটি খুলিয়া আমাকে দেখিলেন। নাড়ি ও বুক পরীক্ষা করিয়া ঘোষণা করিলেন, সন্তানের জান এখনও কবয হয় নাই, যত্ন-তালাফি করিলে এখনও বাঁচিবার আশা আছে। আমার দাদি নানাজীর কথায় দাইকে লইয়া তদবির-তালাফির কাজে লাগিলেন। নানাজীর কথামত কিছুক্ষণ তালাফি করিবার পরই আমি কাঁদিয়া উঠি। নানাজী আমার কানে কলেমা তৈয়ব বারবার আবৃত্তি করিতে লাগিলেন। বাড়িময় এবং শেষে পাড়াময় চাঞ্চল্য পড়িয়া যায়। নানাজীর প্রশংসায় দেশ ফাটিয়া যায়। তিনি জিন পালিতেন, এ ধারণা লোকের আগেই ছিল। এবার প্রমাণ হইল তিনি মরা মানুষও বাঁচাইতে পারেন। আমার জ্ঞান হইবার পরও বহুদিন দাদি-ফুফু-চাচি এই গল্প করিতেন। বলিবার সময় দাদির নিজের এবং আমার মারও চোখ পানিতে ছলছল করিয়া উঠিত। আমি নিজেও খুব পেট-কান্দুয়া ছিলাম, অর্থাৎ কথায়-কথায় কাঁদিয়া ফেলিতাম। আমিও ঐ গল্প শুনিয়া কাঁদিয়া ফেলিতাম। দাদি-ফুফু বা মা যাকে হাতের কাছে পাইতাম, তাঁরই কোলে মাথা লুকাইয়া ফ্যাক-ফ্যাক করিয়া কাঁদিতে থাকিতাম। মার কাছে ছিল এসবই শোনা কথা। কারণ, এসব ঘটনা ঘটিয়াছিল তাঁর অজ্ঞান অবস্থাতেই। তবু তিনি বহুবার ঐ শোনা কথা বহু মেয়েলোকের কাছে আবৃত্তি করিয়াছেন। আমি কাছে থাকিলে আমাকে বুকে জড়াইয়া বলিতেন, আল্লা আমার হারানো মানিক ফিরাইয়া দিয়াছে।

.

. স্বাস্থ্য ও ভাগ্য

আমার স্বাস্থ্য বরাবর খারাপ ছিল। প্রধান কারণ মার দুধ পাই নাই। আমার জন্মের পর পুরা এক বছর মা অসুস্থ থাকেন। গরুর দুধ ও ভিমটা কলাই ছিল আমার একমাত্র খাদ্য। বোধ হয় এ কারণেই আমার পেটের অসুখ সর্বদা লাগিয়াই থাকে। ফলে আমার শরীর স্বাভাবিক পুষ্টি লাভ করে নাই। দূর হইতে আমার বুকের ও পাঁজরার হাড়ি গোনা যাইত। হাত-পা লম্বা লম্বা শুকনা কাঠি আর মাথাটা ইয়া বড়। দাঁড়াইলে মনে হইত ঝাঁটার শলার আগায় একটা বেগুন গাঁথিয়া খাড়া করিয়া রাখা হইয়াছে। বস্তুত, এই উপমাটাও লোকজনের দেওয়া। এইরূপ স্বাস্থ্য ও জন্মের সময়কার ঐ অনৈসর্গিক ঘটনার জন্য আমার মুরুব্বিরা আমার জীবন সম্পর্কে সর্বদাই সন্ত্রস্ত থাকিতেন। তারা প্রায়ই বলিতেন, “এটা কি বাঁচিবে? মায়া বাড়াইয়া কোনো দিন না কোনো দিন আমাদেরে কান্দাইয়া চলিয়া যাইবে। মুরুব্বিদের এই সন্ত্রাস আরো বাড়াইবার জন্যই বোধ হয় আমার শরীরের উপর দিয়া ঘন ঘন দুর্ঘটনা ঘটিয়া যাইত। মরিতে-মরিতে বাঁচিয়া উঠিতাম।

আমাদের অঞ্চলেও তৎকালে অনেক গণক ঠাকুর ছিলেন। বাপ-মা আদরের ছেলেপিলে দেখিলেই গণক ঠাকুরেরা যা যা বলিয়া থাকেন, আমার বেলায়ও তা-ই বলিলেন। তারা আমার হাত দেখিয়া বলিলেন, ছেলের কপালে রাজটিকা আছে। বাঁচিয়া থাকিলে এ ছেলে কোনো দিন দেশের রাজা হইবে। কিন্তু এর ভাগ্যে বড় বড় ফাড়া আছে। শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করিলেই সেসব ফাড়া কাটিয়া যাইবে।

রাজভাগ্য ও ফাড়া গণকদের মুখে অবিচ্ছেদ্য। এটাই তাদের স্টক-ইন ট্রেড। কারণ, এ দুইটি কথায় কোনো বাপ-মার মন স্থির থাকিতে পারে? কোনো কৃপণ মা-বাবার টাকার থলির মুখ এর পরেও বন্ধ থাকিতে পারে? বলেন, গণক ঠাকুর ঐ যে কী বলিলেন ওটা করিতে কত খরচ লাগে? খরচ? খরচ আর এমন বেশি কী? একরূপ কিছুই লাগিবে না। কিন্তু ছেলেটার জন্ম শনিবারে কিনা। তাই শনি ও রাহু এই দুইজনে প্রতিযোগিতা করিয়া ছেলেটার অনিষ্ট করিবার চেষ্টা করিতেছে। কে কার আগে বেশি অনিষ্ট করিতে পারে? কাজেই দশ-বার টাকা লাগিয়া যাইবে। কঠিন স্বস্ত্যয়ন কিনা। আরেক গণক আসিয়া বলিলেন, দশ টাকা লাগিবে কেন? কোন গণক বলিয়াছে শনি এ ছেলের দুশমন? সে গণকই নয়। এ ছেলের জন্ম যখন শনিবারে তখন স্বয়ং শনিই এর রক্ষক: যেমন চোরের হেফাযতে ধন রাখা। যে চুরি করিবে সেই চোরই যদি হয় পাহারাদার, তবে সেটা চুরি হওয়ার সম্ভাবনা কোথায়? শনি এই ছেলের রক্ষক হওয়ায় স্বয়ং বৃহস্পতি এই ছেলের প্রতি অনুকম্পা করিবে। কাজেই এই ছেলে বিদ্যার সাগর ও বুদ্ধির রাজা হইবে। তবে যেসব ছোটখাটো গ্রহের কুদৃষ্টি আছে, সেগুলি কাটাইতে হইবেই। তাতে চার টাকার বেশি খরচ লাগিতে পারে না।

এই গণক ঠাকুরই ভাল। বুঝেও ভাল, অথচ সস্তাও। আমার দাদি, মা ও বাড়ির মেয়েদের সকলেরই ইচ্ছা হইত, সস্তায় আমার সব ফাড়া কাটাইয়া আমার রাজভাগ্যের আকাশটা একদম মেঘশূন্য করিয়া রাখিতে। তলে-তলে বাপজীরও সমর্থন ছিল। কিন্তু দাদাজী ও চাচাজীর জন্য কিছু করা সম্ভব ছিল না। তারা দুইজনই ছিলেন একদম পাক্কা ফরাযী। হাদিস-কোরআনের বাহিরে কোনো কথা বলা বা কাজ করা তাদের দ্বারা ত কল্পনাও করা যাইত না। অপরেও তাদের সামনে করিতে পারিতেন না। ফলে আমার জীবনের ফাড়াকাটাইবার জন্য গণকদের কথিত কোনো বেশরা কাজ হইল না বটে, তবে প্রচুর তাবিজ-কবচ দেওয়া হইতে লাগিল।

.

. রোগ ও চিকিৎসা

আমার দাদির মামু মফিজুদ্দিন আখন্দ ও খালাতো ভাই রমজান আলী শাহ ঝাড়-ফুঁক তুকতাক ও তাবিজ-কবচের ব্যবসা করিতেন। রমজান আলী শাহ জিন-পরি পালিতেন বলিয়া লোকের বিশ্বাস ছিল। এই দুইজনই একত্রে এবং পৃথক পৃথকভাবে আমাকে অনেক ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ-কবচ দিয়াছেন। ঐ সব তাবিজ-কবচে কোনো কুফরি কালাম ইস্তেমাল করা হয় নাই, এই সম্পর্কে আমার মুরুব্বিরা নিশ্চিত হইয়া লইতেন। আখন্দ সাহেব বলিতেন, তিনি তাঁর তাবিজে কালামুল্লার আয়াত ও আরবি হরফ ছাড়া কিছু ব্যবহার করেন না। আর শাহ সাহেব? তিনি আখন্দ সাহেবের এক ডিগ্রি উপরে যাইতেন। তিনি দেখাইতেন যে তিনি বোখারার কাগজের উপর যাফরানের কালিতে যইতুন কাঠের কলমে তাবিজ লিখিয়া থাকেন। এঁরা দুইজনই ছিলেন হানাফি। কাজেই এরা পীর-মুরিদির ব্যবসা করিতেন। আমার মুরুব্বিরা মোহাম্মদী। পীর-মুরিদির তারা ঘোর বিরোধী। কাজেই একজন দাদাজীর মামাশ্বশুর ও আরেকজন শালা হওয়া সত্ত্বেও তাদের দেওয়া তাবিজ-কবচ সম্পর্কে এত সাবধানতা অবলম্বন করা হইত। তবু এই দুইজন মিলিয়া আমাকে এত তাবিজ-কবচ দিয়াছিলেন যে আমার গলা, কোমর ও দুই বাহুতে তিল ধারণের জায়গা থাকে নাই।

পেটের পীড়া ও হাড্ডিসার দেহ ছাড়া আমার আরো দুইটা বড় রোগ ছিল। আমার উপরিউক্ত দুইজন চিকিৎসক এ বিষয়ে একমত ছিলেন যে, শেষোক্ত দুইটাই আমার আসল রোগ। প্রথমোক্ত দুইটা শেষোক্ত দুইটার কুফল মাত্র। আমার রোগ দুইটি ছিল এই : (১) আমি নিদ্ৰাচর বা সমনামবুলিস্ট ছিলাম। আমি ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া যাইতাম। বরাবর রাত্রেই এটা হইত। মাত্র দুইবার দিনের বেলা হইয়াছিল। ঘুমন্ত অবস্থায় আমি বাড়ির বাহিরে অনেক দূরে চলিয়া যাইতাম। আমি শৈশবের শেষ পর্যন্ত বাপ-মার সাথে একই বিছানায় শুইতাম। আমাদের বাড়ির নিয়ম ছিল শুধু নবজাত শিশুই বাপ-মার বিছানায় থাকিতে পারিত। তার বড়রা দাদির ঘরে তার বিছানায় যাইত। এই হিসাবে আমার ছোট ভাইয়ের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই আমার দাদির বিছানায় যাওয়ার কথা। কিন্তু আমার বেলা তা হয় নাই। আমার ছোট ভাই ও বহিন এক-এক করিয়া বছরখানেক বয়সেই মার বিছানা ছাড়িয়া দাদির বিছানায় চলিয়া গেল। কিন্তু আমি মার কাছেই থাকিয়া গেলাম।

.

. নিদ্ৰাচর

আমার বাপ-মা দুজনই ঘুমে খুব হুশিয়ার ছিলেন। অর্থাৎ ঘুম তাদের খুব পাতলা ছিল। সামান্য শব্দেই তাদের ঘুম ভাঙ্গিয়া যাইত। তাছাড়া মা প্রায় সারা রাতেই নফল নামাজ ও অন্যান্য এবাদত করিয়া কাটাইতেন। কাজেই তাদের নিকট হইতে রাতে উঠিয়া যাওয়া খুবই কঠিন ছিল। তবু কেমন করিয়া না জানি, আমি তাদের পাশ হইতেই ঘুমের ঘোরে উঠিয়া যাইতাম। অবশ্য অল্পক্ষণের মধ্যেই তাঁরা টের পাইতেন। আমার খোঁজে তারা যে হৈচৈ শুরু করিতেন, তাতে সারা বাড়ির এমনকি পাড়ার লোক জাগিয়া উঠিত। লণ্ঠন, পাট সোলার বুন্দা, বাঁশের মশাল ইত্যাদি লইয়া চারদিকে আমার তালাশ করা হইত। সাধারণত বাড়ির আশপাশেই আমাকে পাওয়া যাইত। মাত্র দুইবার আমাকে বাড়ি থনে দূরে মাঠে পাওয়া গিয়াছিল। তালাশকারীরা দেখিয়াছেন, আমি জাগ্রত লোকের মতই সাবধানে পথ চলিতেছি। আঁকা-বাঁকা, উঁচা-নিচা, আইল-বাতরের কোথাও আমি হোঁচট খাইতেছি না। পুকুরাদি, জলাশয়ে না পড়িয়া সাবধানে ও-গুলির পাড় বাহিয়া চলিতেছি। এই অবস্থায় আমাকে ধরিয়া কোলে তুলিবার পরই আবার ঘুম ভাঙ্গিত। তখনই আমি কান্নাকাটি শুরু করিতাম।

এইভাবে বেশ কিছুকাল যাওয়ার পর বাড়ির সকলের উপদেশে বাপজীর ঘরের কেওয়াড়ে ভিতর থেকে শিকল লাগানো হইল। আমি ছেলেমানুষ। খুব সকাল-সকাল ঘুমাইয়া পড়িতাম। বাবা-মা শোবার সময় দরজার শিকল লাগাইয়া শুইতেন। ঘুমন্ত অবস্থায় আমি শিকল খুলিয়া বাহির হইয়া যাইতাম। কপাটের উপরের চৌকাঠে লাগানো শিকল আমার মত শিশুর নাগালের বাহিরে। তবু সেটা আমি কীরূপে খুলিতাম, এটা সকলের বিস্ময় সৃষ্টি করিত। এ ঘটনায় আমার মুরুব্বিদের, আত্মীয়-স্বজনের ও পাড়া-প্রতিবেশীর মনে আর কিছুমাত্র সন্দেহ থাকিল না যে জিনের আছরেই আমি এসব কাজ করিতেছি। এরপর বাবা-মা পালা করিয়া রাত জাগিয়াছেন। তার মধ্যেও কোন ফাঁকে আমি বাহির হইয়া পড়িয়াছি। বাবা-মার কাছে পরে শুনিয়াছি, বসা অবস্থায়ও তারা যখনই এক-আধটু ঝিমাইয়াছেন, সেই ঝিমানের ফাঁকেই আমি আলগোছে বাহির হইয়া গিয়াছি।

দিনের বেলার একটি ঘটনা এইরূপ : সেদিন আমাদের বাড়িতে ছোটখাটো একটি মেহমানি। বাড়ির পুরুষেরা সবাই বাহির বাড়িতে মেহমানদেরে লইয়া ব্যস্ত। বাড়ির মেয়েরা সকলে রান্না-বাড়ায় অতিরিক্ত খাটুনির পর যোহরের প্রায় শেষ ওয়াতে কেউ গোসল করিতে, কেউ নামাজ পড়িতে ব্যস্ত। আমার খুবই ক্ষিধা পাওয়ায় মেহমানদের খাওয়ার আগেই মা আমাকে খাওয়াইয়া-দাওয়াইয়া ঘুম পাড়াইয়া ছিলেন। হঠাৎ দেখা গেল আমি ভিতর বাড়ির উঠানের কোণের নারিকেলগাছের অনেকখানি উঁচায় উঠিয়া দুই হাতে গাছটা জড়াইয়া ধরিয়া আছি। নারিকেল-সুপারিগাছে উঠিতে দুপায়ে জুড়োম দরকার হয়। কিন্তু আমি খালি পায়েই গাছে উঠিয়াছি। বিশ হাত উঁচা গাছের অর্ধেকের বেশি উঁচায় আমি উঠিয়াছি। সকলেই বুঝিলেন আমি ঘুমের ঘোরে গাছে উঠিয়াছি। এটাও তাঁরা বুঝিলেন হৈচৈ করিলেই আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া যাইবে এবং হুঁশ হওয়া মাত্র আমি ভয় পাইয়া মাটিতে পড়িয়া যাইব। এবং মারা যাইব। সারিসুরি করিয়া বাহির বাড়িতে খবর পাঠানো হইল। বাড়ির ও আত্মীয়-স্বজনের অনেক পুরুষ মানুষ আসিলেন। চাকর-বাকরেরাও সকলে আসিল। জাল, খেতা, ফরাস, চাদর, চট যা জুটিল সব আনিয়া লোকজনেরা নারিকেলগাছ ঘেরিয়া এসব পাতিয়া ধরিলেন। একজন দক্ষ গাছ-বাওয়ালোক গাছে উঠিলেন। আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় কোলে তুলিয়া লইলেন। আমার ঘুম ছুটিতেই চিৎকার শুরু করিলাম। কিন্তু লোকটি আমাকে সবলে চাপিয়া ধরিয়া নিচে নামিয়া আসিলেন। সকলে আরামের নিশ্বাস ফেলিলেন। মা-দাদি তাঁরা খুশিতে কাঁদিয়া ফেলিলেন।

.

. ঘুমে চিৎকার

আমার দ্বিতীয় রোগটা ছিল ঘুম হইতে চিৎকার করিয়া উঠা। এই চিৎকার অনেকক্ষণ ধরিয়া চলিত। তেমন শীতের মধ্যেও ঘামে আমার সারা গা ও কাপড়-চোপড় ভিজিয়া যাইত। স্বপ্নে আমি ভয়াবহ কিছু একটা দেখিয়া ভয়ে কাঁদিয়া উঠিতাম। কিন্তু সেটা কী, গোছাইয়া বলিতে পারিতাম না। তখনও বুঝিতাম, এই বৃদ্ধ বয়সে আজও বুঝি, ব্যাপারটা শুধু অনুভব করিবার, বর্ণনা করিবার নয়। অনুভব করাটাও নিতান্ত আবছা-আবছা। আজও যতদূর মনে পড়ে, তাতে এইটুকু বলা যায়, গরু-মহিষের গাড়ির চাকার মত বড় লোহার একটা খুব ভারী চাকা ভনভন করিয়া ঘুরিতে-ঘুরিতে আমার কাছে আসিয়া আমার চোখ-মুখ ঝলসাইয়া দিত। কে যেন সবলে আমাকে সেই চাকায় উঠাইয়া দিত। আমাকে লইয়া সেই চাকা ঊর্ধ্ব দিকে বন্দুকের গুলির বেগে ছুটিতে থাকিত। তাতেই আমার শ্বাস বন্ধ হইয়া আসিত। আমি চিৎকার করিয়া উঠিতাম। কিন্তু সহজে সে স্বপ্ন ছুটিত না।

এই দুইটা রোগ আমার দশ-এগার বছর বয়স পর্যন্ত ছিল। বয়স হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই আমার এই রোগ সারিয়া থাকুক, আর চিকিৎসার ফলেই সারিয়া থাকুক, কৃতিত্ব সবটুকু পাইয়াছিলেন আমার দাদার মামাশ্বশুর মফিযুদ্দিন আখন্দ সাহেব। কারণ শেষ চিকিৎসা করিয়াছিলেন তিনি একা, অনেকবারই তিনি আমাকে তাবিজ-কবচ ও পানি-পড়া দিয়াছেন বটে কিন্তু সেটা তখন ছিল এজমালি। রমজান আলী শাহ সাহেব ছাড়া মাঝখানে ‘পাবনার মৌলবী’ নামক এক আলেম একাদিক্রমে তিন মাস আমাদের বাড়ি থাকিয়া আমার চিকিৎসা করিয়াছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকিয়া থাকেন এই আখন্দ সাহেব। তার শেষ চিকিৎসাটা ছিল এইরূপ : চারটি তাজা রক্তজবা ফুল যোগাড় করা হইল। চারটি নয়া মাটির টোফা কিনা হইল। আখন্দ সাহেব চারটি রক্তজবায় আরবি আয়াত পড়িয়া-পড়িয়া দশ-দশ বার ফুঁ দিলেন এবং আমার মাথায়, চোখ, মুখে ও বুকে ঐ ফুল ছুঁয়াইয়া মাটির টোফায় ভরিলেন। নিজ হাতে টোফার মুখে ভাল করিয়া লেপিয়া-পুঁছিয়া আমাদের বাড়ির চার কোণে চারটি টোফা পুতিলেন। টোফা পপাতা জায়গা চারটি নিজে সযত্নে লেপিয়া পুঁছিয়া দিলেন। এই সব লেপা-পোছার কাজেও আখন্দ সাহেব প্রতিবার হাত চালাইবার সময় এক-একটি আরবি শব্দ উচ্চারণ করিলেন। সারাক্ষণ তিনি আমাকে সঙ্গে সঙ্গে রাখিলেন। তাতেই এই সব খুঁটিনাটি আমার স্পষ্ট মনে আছে। লেপা-পৌঁছার পর তিনি আদেশ করিলেন ঐ চারটি জায়গা যেন কেউ, বিশেষ করিয়া আমি, কখনও পায়ে না মাড়াই।

মুরুব্বিদের কাছে শুনিয়াছি, এরপর আমি আর কোনো দিন ঘুমের ঘোরে হাঁটি নাই বা ঘুম হইতে চিৎকার করিয়া উঠি নাই।

.

. আকস্মিক দুর্ঘটনা

কিন্তু ইতিমধ্যে আমার শরীরের উপর দিয়া সাংঘাতিক বহু দুর্ঘটনা ঘটিয়া গিয়াছে। তার মধ্যে বড়-বড় কয়টা এইরূপ :

(ক) প্রথম আঘাত পাইয়াছিলাম বাপজীর নিজের হাত হইতে। তিনি একদিন একটা কোদালের আছাড়ি লাগাইতেছিলেন। কোদাল-কুড়ালের আছাড়ি টাইট করিবার জন্য উল্টা দিক হইতে কাঠ বা বাঁশের কচি মারিতে হয়। বাবজি। এই কাজটিই করিতেছিলেন। আছাড়িটা লম্বা হওয়ায় তিনি দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া মুগুর পিটাইয়া কচি ঢুকাইতে ছিলেন। এক হাতে কোদাল ধরিয়া আরেক হাতে পিটাইতে ছিলেন। একটা বাড়ি বেকায়দায় পড়ায় হাত হইতে কোদালটা ছুটিয়া সবেগে উল্টা দিকে মাটিতে গিয়া পড়ে। আমি তখন মাত্র আড়াই বছরের শিশু। সবেমাত্র দৌড়িতে শিখিয়াছি। আমি হঠাৎ কোথা হইতে দৌড়িয়া বাপজীর কাছে আসিতেছিলাম। ঐ কোদাল আসিয়া পড়িল আমার মাথায়। আমি চিৎকার করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেলাম। লহুতে আমার মাথা লাল হইয়া গেল। বাপজী হায় কী করিলাম’ বলিয়া আমাকে কোলে করিয়া বাড়িতে ঢুকিলেন। ভাগ্যিস আমার মাথায় কোদালটার মুখ না লাগিয়া এক পাশ লাগিয়াছিল। মুখ লাগিলে আমার কচি মাথা দুই ফালা হইয়া যাইত। সেটা না হওয়ায় ঐ বিপদেও সকলে সান্ত্বনা পাইলেন এবং আল্লার দরগায় শোকরিয়া জানাইতে লাগিলেন। আমার দাদি ও মা উভয়ের কাটা-ছেঁড়ার ধন্বন্তরি ঔষধ জানিতেন। সেটা পাড়াগাঁয়ে সহজলভ্য একটি গাছড়ার রস। সেই ঔষধ লাগাইয়া আমার মাথায় গালপাট্টা বাধিয়া দেওয়া হইল। এটা সারিতে প্রায় এক মাস লাগিয়াছিল। এই আঘাতের দাগ আজও আমার তালুতে বিদ্যমান রহিয়াছে।

(খ) করাতিরা একবার আমাদের একটা খুব বড় কড়াইগাছ কাটিয়াছিল। সেটা মাটিতে পড়িবার পর কুড়াল দিয়া ওটার ডাল ছাঁটা হইতেছিল। বহু লোক ভিড় করিয়া তামাশা দেখিতেছিল। সে তামেশগিরদের মধ্যে আমিও ছিলাম। তামেশগিররা সকলেই আমার চেয়ে বড় ও লম্বা। কাজেই তামেশগিরের মধ্যে আমি ডুবিয়াছিলাম। অথচ করাতিদের কুড়ালের কোপে একটা ডালের বড় একটা ধারালো টুকরা ভনভন করিয়া উড়িয়া সকল তামেশগিরদেরে ডিঙ্গাইয়া আমার মাথায় বিধিয়া পড়ে। আমি গুরুতররূপে। আহত হইয়া বেহুঁশ হইয়া পড়ি। ধরাধরি করিয়া বাড়িতে আনার অনেকক্ষণ পরে আমার হুঁশ হয়। এটা ঘটে আমার ছয়-সাত বছর বয়সে। এর দাগ আজ পর্যন্ত আমার কপালের দিকে মাথায় আছে।

(গ) তখন আমার বয়স নয়-দশ বছর। সে সময় আমাদের অঞ্চলে অবস্থাপন্ন সব গৃহস্থের বাড়িতেই এক বা একাধিক দৌড়ের ঘোড়া ছিল। শুকনা দিনে মোহররম পর্ব পড়িলে সেই পরবের দিনে অথবা হিন্দুদের চড়কের মেলার সময় পাঁচ গ্রামে ঘোড়দৌড় হইত। আমাদেরও একটা ঘোড়া থাকিত। দুই-এক বছর পর-পর ঘোড়া বদল করা হইত। খুব ছেলেবেলা হইতেই আমার ঘোড়া দৌড়াইবার শখ ছিল। স্কুল হইতে ফিরিবার পর বিকালে মাঠে ব্যাটবল (ক্রিকেট), ডাংগুটি বা কপাটি খেলিতাম। খেলা শেষ করিবার পর এবং মগরেবের নামাজের আগ পর্যন্ত আধঘণ্টা খানেক ঘোড়া দৌড়াইতাম। গ্রামের ঘোড়াওয়ালারাও এই সময় যার তার ঘোড়া লইয়া বাহির হইত। মাঝে মাঝেই একত্রে বাজি রাখিয়া বা আড়াআড়ি করিয়া ঘোড়া দৌড়াইতাম। ঘোড়-সওয়ারদের মধ্যে কিন্তু আমার মত অল্প বয়সের কেউ ছিল না। আমার একটা বিশেষ অভ্যাস ছিল এই যে, মাঠে ঘোড়া দৌড় শেষ করিয়া বাড়ি ফিরিবার পথে আমাদের পুকুরপাড় হইতে তিন-চার রশি দূরে থাকিতেই লাগাম ছাড়িয়া দিয়া ঘোড়র পেটে গোড়াতালি দিতাম। ঘোড়া পবনের বেগে লম্বী দৌড় দিত। আমি লম্বীর সাথে তাল রাখিয়া দুই হাতে তালি বাজাইয়া ঘোড়াকে শাবাশ দিতাম। টাল সামলাইবার জন্য দরকার হইলে এক-আধবার বাম হাতে ঘোড়ার বাক বা গদির ইলট ধরিতাম। টাল সামলাইয়া আবার ছাড়িয়া দিতাম। এটা রোজই করিতাম।

সেদিন দেরিতে বাহির হইয়াছিলাম। কাজেই ফিরিতেও দেরি হইল। বরাবর মগরেবের আযান শুনিয়াই ঘোড়া ফিরাইতাম। এবং মগরেবের জমাতে শামিল হইতাম। আমাদের বাড়ির মসজিদে তৎকালে মগরেব ও এশা এই দুই ওয়াক্তিয়া নামাজেও পাড়ার লোকেরা জমাতে শামিল হইত। সেদিন কিন্তু আযান শুনিয়াই ঘোড়া ফিরাইলাম না। যাই যাচ্ছি করিয়া আও দুই একটি চক্কর দিলাম। অবশেষে ঘাটতি পূরণের আশায় ঘোড়াটিকে বরাবরের চেয়ে তেজের লম্বী দৌড় দেওয়াইলাম। আমার গোড়াতালির জবাবে ঘোড়াটা পিছনের পা দিয়া বাতাসে একটি লাথি মারিয়া বাতাসের আগে ছুট দিল।

আমাদের পুকুরের পুব পাশের প্রশস্ত পাড়াটায় পাট লাড়িবার জন্য সারি সারি বাঁশের আড় বাঁধা ছিল। পাটের মওসুম শেষ হইয়াছে। কাজেই আড়গুলি খোলার সময় হইয়াছে। দুই-এক দিনের মধ্যে খোলা হইবে এই অবস্থা। এই আড়ের সারির মধ্যে দিয়াই প্রশস্ত যাতায়াতের রাস্তা। এই রাস্তা দিয়াই আমি বরাবর অনায়াসে ঘোড়া চালাইয়া থাকি। বাহির হইবার সময়ও এই রাস্তা দিয়াই ঘোড়া দৌড়াইয়া গিয়াছি। বরাত মন্দ। ইতিমধ্যে কোনো কারণে একটা আড়ের বাঁশের গিরো খুলিয়া বাঁশের আগাটা রাস্তার দিকে গলা বাড়াইয়া ছিল। বাঁশের আগাটা ছিল একদম কলম কাটা। অন্ধের মত ঘোড়া ছুটাইয়া যখন এই জায়গায় আসিলাম, তখন হঠাৎ আমার নজরে পড়িল বাশের এই কলমকাটা আগাটা তির বেগে আমার ডান দিকের গলা সোজা আসিতেছে। চক্ষের নিমেষে ওটা আমার গলা ভেদ করিয়া ফেলিবে। লাগাম আমার হাতে ছিল না। কাজেই ঘোড়া থামাইবার প্রশ্ন উঠে না। জৈবিক উৎপ্রেরণা বশে ডাক হাতে ঘোড়ার বাঁক ধরিয়া বাম হাতে বাঁশের আগাটা ঠেকাইবার চেষ্টা করিলাম। কিসে যে কী হইল কিছুই জানিতে পারিলাম না। পরে শুনিয়াছি এবং অনুমান করিয়াছি যে ঘোড়ার গতিবেগে আমার হাতের চাপে বাশের গোড়ার দিকে দুই-একটা গিঁরো ছিঁড়িয়া যায় এবং তাতে বাঁশের আগাটা নুইয়া পড়ে। ফলে বাঁশটা আমার গলায় বা বুকে বিঁধিয়া বাম উরুতে গভীর খাদ করিয়া এক দলা গোশত উল্টাইয়া বাঁ দিকে বাহির হইয়া যায়।

তখন বাহির বাড়িতে কোনো লোকজন ছিলেন না। সবাই মগরেবের নামাজ জমাতে পড়িতে ছিলেন। ঘোড়াটা প্রথমে টাটু দৌড়ে পরে দুগামা গতিতে বাহির বাড়ির উঠান পার হইয়া দেউড়ির ভিতর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং সোজা উত্তরের ভিটির দাদাজীর ঘরের সামনে গিয়া দাঁড়ায়। দাদি তখন নামাজ শেষ করিয়া ওজিফা পড়িতেছিলেন। ঘোড়ার পায়ের আহট ও হ্রেষার আওয়াজ শুনিয়া তিনি তাড়াতাড়ি মোনাজাত সারিয়া বাইরে আসেন। তিনি দেখেন যে আমি ঘোড়ার পিঠে উপুড় হইয়া পড়িয়া আছি। আমার মাথা ঘোড়ার বাকের উপর শায়িত এবং দুই হাত দুই দিকে ঝুলিতেছে। আমার কাপড়-চোপড় ও ঘোড়ার শরীর বাহিয়া টপটপ করিয়া লহু পড়িতেছে। ঘোড়ার গদি লহুতে ভিজিয়া গিয়াছে। তিনি চিৎকার করিয়া বারান্দা হইতে নামিয়া আসিয়া আমাকে ধরেন। মা, ফুফু, চাচি সবাই যার-তার ঘরে নামাজ পড়িতেছিলেন। দাদির চিঙ্কারে আমার মা, চাচি, ফুফু ও চাকরানিরা দৌড়াদৌড়ি করিয়া আসেন। বাহির বাড়ি হইতে মুরুব্বিরা সকলে আসেন। আমাকে বেহুশ অবস্থায় ঘোড়া হইতে নামানো হয়। কান্নাকাটির মধ্যে আমার শুশ্রূষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়। আমার হুঁশ হইতে রাত দুপুরের বেশি হইয়া গিয়াছিল। ততক্ষণে আমার গায়ে হাত-পুড়িয়া-যাওয়া জ্বর উঠিয়াছে। এই ঘা শুকাইতে আমার মাসাধিককাল সময় লাগিয়াছিল। বাঁ হাতের তলায় তিন ইঞ্চি লম্বা এক ইঞ্চি গভীর ক্ষত হইয়াছিল। এই সত্তর বছরে সেটা ছোট হইয়া এখন এক ইঞ্চি পরিমাণ দাগ আছে। বা উরাতের ঘাটা হইয়াছিল লম্বায় চার ইঞ্চি পাশে দুই ইঞ্চি ও গভীরে দেড় ইঞ্চি। সে ক্ষত শুকাইয়া এই সত্তর বছরেও দীঘে দেড় ইঞ্চি পাশে এক হইয়াছে। গভীরতাটা গোশতে ভরিয়া উঠিয়াছে বটে কিন্তু সিকি ইঞ্চির মত খাদ বা ডিপ্রেশন আজও রহিয়াছে।

এমনি ধরনের অপেক্ষাকৃত কম সাংঘাতিক আকস্মিক আঘাত যে আমি কত পাইয়াছি, তার লেখাযযাখা নাই। আমার শরীরে অনেক দাগই মিশিয়া গিয়াছে। যেগুলি মিলিয়া যায় নাই এবং মিলিবেও না এমন কাটা দাগের সংখ্যাই সতেরটা। যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিকদের মত শরীরের কাটা-ছেঁড়া জখমের সংখ্যা গনিয়া যদি জীবনযুদ্ধের বীরত্বের পরিমাপ করা হইত, তবে আমি বার বছর বয়সের আগেই বীরত্বের মেডেল পাইতাম। পরবর্তী জীবনে আমি যে অহিংস সংগ্রামের একটা পক্ষপাতী হইয়াছি, তার সাথে ছেলেবেলায় এত বেশি খুন-জখমের কোনো সম্পর্ক থাকিতে পারে বলিয়াই এই তুচ্ছ ঘটনাগুলির উল্লেখ করিলাম।

.

. শৈশবের কড়াকড়ি

কতকগুলি ব্যাপারে শৈশবে আমাদের সর্বক্ষণ সবাইকে খুবই কড়াকড়ির মধ্যে জীবনযাপন করিতে হইত। কড়াকড়িগুলি যে বাপ-দাদার আরোপিত কড়াকড়ি তা নয়; সামাজিক পরিবেশেই এই কড়াকড়ি আরোপ করিত। এক আধ ওয়াক্ত নামাজ কাযা করিবার উপায় ছিল না। স্কুলে, মাদ্রাসায়, রাস্তা ঘাটে, আত্মীয় বাড়িতে মেহমানিতে, কোথাও আমাদের এক ওয়াক্ত নামাজ তরক হইলে বেনামাজিরাও আমাদেরে তম্বিহ করিতেন। বলিতেন, তুমি ফরাযী বাড়ির ছেলে হইয়াও নামাজ তরক করিয়াছ? কী লজ্জার কথা! যিনি এই তম্বিহটা করিলেন, তিনি জীবনেও পশ্চিম দিকে আছাড় পাড়েন নাই। কিন্তু সে কথা বলিবার উপায় নাই। কারণ সর্বসম্মত জনমত এই যে আর কেহ নামাজ তরক করিলে কিছু আসে যায় না। আমরা ফরাযী বাড়ির নাবালক শিশুরা নামাজ তরক করিলেই সেটা হয় নিতান্ত অন্যায় কাজ।

নামাজ-রোযা সম্বন্ধে যা, গান-বাজনা সম্বন্ধেও তা-ই। আমাদের গ্রামে হিন্দু তালুকদার বাড়িতে, জমিদারের কাছারিতে, পাশের গ্রামের জমিদারবাড়িতে প্রতিবছর কত গান-বাজনা যাত্রা-থিয়েটার হইত। গ্রামসুদ্ধা লোক তাতে ভাঙ্গিয়া পড়িত। কিন্তু আমাদের মুরুব্বিরা কেউ তাতে যাইতেন না। এমনকি আমাদের বাড়ির পুরাতন বছরিয়া চাকরেরা পর্যন্ত ঐ সব গান বাজনা দেখিতে যাইত না। গ্রামের সমবয়সী বন্ধু, স্কুলের সহপাঠী কারো প্ররোচনায় যদি আমাদের ভাইদের কেউ দিনের বেলাও এক-আধবার এসব দেখিতে গিয়াছি, তবে ঐ সব গান-বাজনার উদ্যোক্তারাই আপত্তি করিয়াছেন। মুসলমান দর্শকেরা বলিয়াছেন, সর্বনাশ, ফরাযী বাড়ির ছেলে হইয়া তুমি গান শুনিতে আসিয়াছ? শিগগির পালাও। হিন্দু উদ্যোক্তারা বলিতেন, তোমরা ফরাযী, গান শোনা তোমাদের নিষেধ। তোমার মুরুব্বিরা জানিতে পারিলে আমাদের দোষ হইবে। তোমরাও শাস্তি পাইবে। ফলে অবস্থা এমন দাঁড়াইয়াছিল যে গ্রামের সমবয়সীরা, স্কুলের সহপাঠীরা, এমনকি স্বয়ং মাস্টার সাহেব, যখন সদলবলে যাত্রা-থিয়েটার দেখিতে যাইতেন, তখন আমিও আমরা তিন ভাই তাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া থাকিতাম।

এটা ত গেল হিন্দুদের আয়োজিত যাত্রা-থিয়েটারের কথা। এমন যে, মুসলমানের আয়োজিত মোহররমের লাঠি খেলা,–ও আমাদের বাড়িতে হইতে পারি না। আমার ছেলেবেলায় মোহররমের লাঠি খেলার প্রচলন বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। মোহররমের দশ দিন ঢাক-ঢোল, কাড়া নাকাড়া, শানাই, ক্ল্যারিওনেটের আওয়াজ রাতদিন পাড়া-গাঁয়ের আকাশ মুখরিত ও মাটি কম্পিত থাকিত। একই গ্রামের বিভিন্ন পাড়া হইতে এক একটি আখড়া বাহির হইত। তারা লাঠি, তলওয়ার (তলওয়ারের বদলা পাজন), সড়কি, বল্লম, চরকি, রামদা লইয়া চমৎকার অনেক সময় বুক কাঁপানো বিস্ময়কর, উস্তাদি খেলা দেখাইত; একাধিক আখড়ার মধ্যে। মোকাবিলা হইয়া গেলে ঐ সব আখড়ার নেতাদের মধ্যে ডুয়েল প্রতিযোগিতা হইত। এসব প্রতিযোগিতা দেখিবার জন্য বিপুল জনতার ভিড় হইত। মোহররমের লাঠি খেলাকে আমাদের ছেলেবেলা ‘লাকড়ি-বাড়ি’ বলা হইত।

এই খেলা দেখিবার জন্য আমি গ্রামের অন্যান্য প্রতিবেশীর বাড়িতে যাইতাম। কারণ আমাদের বাড়িতে ঐ খেলা হওয়া নিষেধ ছিল। সব আখড়ার লোকেরাই ‘বার্ষিকীর’ (বছরিয়া বখশিশ) জন্য আমাদের বাড়িতেও আসিত। কিন্তু আমাদের বাড়িতে আসিবার সময় অনেক দূর হইতেই বাদ্য বন্ধ করিয়া দিত। এতে আমাদের মনে বড়ই কষ্ট হইত। পাশের বাড়িতে ধুমধামের সাথে লাকড়ি-বাড়ি খেলা হইতেছে। বাড়ির লোকেরা ও তাদের ছেলেমেয়েরা নিজেদের ঘরের উসারা-বারান্দায় বসিয়া নিজেদের উঠানের মধ্যে খেলা দেখিতেছে, তাদের বাড়ির মেয়েছেলেরা ঘরের খিড়কি, দেউড়ি, বেড়ার ফাঁক দিয়া ঐসব সুন্দর-সুন্দর এবং মজার-মজার খেলা দেখিতেছে, অথচ আমাদের পরের বাড়ি গিয়া সে তামাশা দেখিতে হইতেছে; আর আমাদের বাড়ির মেয়েছেলেরা অমন ভাল-ভাল খেলা দেখিতে পারিতেছেন না, এটা আমার খুবই অপমানকর মনে হইত। ছেলেবেলার এই অপমানবোধটা খেলা-তামাশা দেখার আনন্দের ক্ষুধার চেয়ে কম তীব্র ছিল না। তাই সাহসে বুক বাঁধিয়া দাদাজীর কাছে যাইতাম। তিনিই ছিলেন আমার আবদারের বড় জায়গা। তাই তার কাছে আবদার করিতাম। তর্ক করিতাম। তাদেরই মুখে শোনা হাদিসের দোহাই দিয়া বলিতাম, লাঠিখেলা সুন্নত। আমার মনে পড়ে, আমার অনেক জিদাজিদিতে দাদাজী একবার বিনা-বাজনায় লাঠিখেলার অনুমতি দিয়াছিলেন। কিন্তু বাজনা ছাড়া খেলা জমে নাই। খেলওয়াড়রাও বেশিক্ষণ খেলা চালাইতে পারে নাই। অতঃপর বাদ্যের পক্ষেও তাঁদেরই মুখে শোনা হাদিসের দোহাই দিতাম। একতারা বাজনা যুদ্ধ-জেহাদের বাজনা। এই যুক্তির কোনো জবাব ছিল না। শেষ পর্যন্ত দাদাজী বলেন, আমার বাপের আমল হইতেই এই রেওয়াজ চলিয়া আসিতেছে। আমি সে রেওয়াজ তুলিয়া দিতে পারি না। বাবার আমলে বরঞ্চ এর চেয়ে কড়াকড়ি ছিল। আমাদের বাড়ি হইতে শোনা না যায় এমন দূরে বাজনা বন্ধ করিতে হইত। এখন অনেক ঘন ঘন বসতবাড়ি হইয়া যাওয়ায় সে নিয়ম একটু ঢিলা হইয়াছে। তোমাদের আমলে যা হয় করিয়ো। আমি যত দিন আছি এটা বদলানো যাইবে না।

দাদাজীর কাছে নিরাশ হইয়া বাপ-চাচার নিকট গেলাম। দাদাজীর মতের বিরুদ্ধে কিছু করিতে তারা রাজি হইলেন না। মুরুব্বিদের এই মনোভাবের সমর্থনে আমি কোনোই যুক্তি খুঁজিয়া পাইলাম না। এই বংশ হইতেই গাজী আশেক উল্লা সাহেবের মত জেহাদি সৈনিকের জন্ম হইয়াছে। এই বাড়িতে বসিয়াই গাজী সাহেব গ্রামের যুবকদেরে লাঠি-তলওয়ার খেলা শিখাইয়াছেন। অথচ তাঁর অবর্তমানে সেই বাড়িতেই লাঠি খেলা ও যুদ্ধের একতারা বাজনা এমন কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ হইয়াছে। দাদাজীর কথা সত্য হইলে গাজী সাহেবের বিদ্যমানেও এ বাড়িতে মোহররমের লাঠি খেলা হয় নাই। কী আশ্চর্যের কথা!

.

. পারিবারিক প্রথা

আরেকটি বিস্ময়কর ব্যাপার আমাদের বাড়িতে ঘটিত। আমার জ্ঞান হইয়াছে। অবধি দেখিয়াছি প্রতিবছর মোহররমের সময় আমাদের বাড়িতে খুব বড় একটা যিয়াফত হইত। মোহররমের চাঁদ দেখিয়াই আমাদের বাড়ির মেয়ে পুরুষ সকলে নফল রোযা রাখিতে শুরু করিতেন। কাতলের দিন খুব বড় পাঁচগেরামি মেহমানি হইত। তাতে অনেক গরু-খাসি যবেহ হইত। বাড়ির সামনের উঠান ও ময়দান লোকে লোকারণ্য হইয়া যাইত। সাদা পোশাক পাগড়িপরা বহু মৌলবী-মওলানা তাতে যোগ দিতেন। লোক খাওয়ানো ছাড়া গরীব-মিসকিনের মধ্যে অনেক পয়সা-কড়ি বিতরণ করা হইত। ঐ মেহমানির ভগ্নাবশেষ পরদিবস ‘মনজিলের দিন পর্যন্ত চলিত। সেদিনও ছোটখাটো মেহমানি ও দান-দক্ষিণা চলিত। আলেম-ফাযেলরা সকাল হইতে যোহরের ওয়াক্ত পর্যন্ত কালামুল্লা খতম করিয়া বখশিয়া দিতেন। তারপর খাওয়া-দাওয়া সারিয়া আছরের নামাজ পড়িয়া বিদায় হইতেন। এই ধরনের যিয়াফতে লোক হইত বেশুমার। দাওয়াতি তোক ছাড়াও বিনা-দাওয়াতি গরীব-মিসকিন জমা হইত অনেক। আন্দাজ কমবেশি পাঁচ হাজার লোক খাইত। খরচ কিন্তু তেমন বেশি লাগিত না।

তারিখের পনের-বিশ দিন আগে হইতেই গাছ কাটিয়া লাকড়ি ফাড়া ও শুকানো শুরু হইত। শুধু যিয়াফত বাড়িতে নয়, পাড়ার প্রায় সকলের, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ত অবশ্যই। দুই-তিন দিন আগে হইতে কলাগাছের পাতা কাটা শুরু হইত। এটাও সারা গায়ের প্রায় সব বাড়িতেই। কলাগাছ। হইতে পাতা কাটিয়া সেগুলি আবার এক হাত লম্বা টুকরা করিয়া আঁটি বাধা হইত। এক এক আঁটিতে দশ-পনেরটা টুকরা পাতার এক-একটা বুন্দা থাকিত। দশটা বুন্দায় একটা আঁটি হইত। তার মানে এক-এক আঁটিতে কমবেশি দেড় শ কলাপাতার টুকরা থাকিত। যিয়াফতের দুই-এক দিন আগে হইতেই এ সব ফাড়া লাকড়ি ও এই সব আঁটি-বাঁধা কলাপাতা যিয়াফত বাড়িতে আসিয়া পৌঁছিত। তাতে যিয়াফত বাড়ির কোনো খরচ লাগিত না। দেনেওয়ালাদের অবস্থাভেদে ও সাধ্যমত নিজেরা অথবা চাকরের মাথায় এই সব যিয়াফত বাড়িতে পৌঁছাইয়া দিতেন। এটা ছিল তৎকালীন প্রথা ও একরকম বাধ্যকর রেওয়াজ। চাহিলে কেউ ‘না’ করিত না। না চাহিলেই বরঞ্চ মন-কষাকষির কারণ হইত। হাজার থনে বেশি লোকের যিয়াফতেই এই নিয়ম চালু ছিল। ছোটখাটো যিয়াফতে বাড়িওয়ালারা নিজেরাই লাকড়ি ও পাতার ব্যবস্থা করিয়া নিতেন।

লাকড়ি ও বাসন-বরতনের ব্যবস্থা ত এইভাবে হইয়া যাইত বিনা খরচায়। তার পরে ধরুন চাল-ডাল ও খাসি-গরুর কথা। একটা প্রমাণ সাইযের গরুতে পাঁচ শ ও একটা খাসিতে এক শ লোকের খাওয়া হইত। কারণ গোশতের সাথে গোল-আলু মাটিয়া আলু, ফেন কচু (চার-পাঁচ হাত লম্বা মানকচু) তরকারি দেওয়া হইত। গোশত ছাড়াও ডাইল এবং দই অথবা মিঠুরি থাকিত। দই গোয়ালারা দিত। আর মিঠুরিটা যিয়াফতের বাবুর্চিখানাতেই তৈরি হইত। বড় ডেগভর্তি পানির মধ্যে দরকারমত চালের গুঁড়া, চিনি, দুধ ও লবণ দিয়া জাল দিলেই মিঠুরি রান্না হইত।

এই হিসাবে দশটা গরু, দুইটা খাসি, পঁচিশ মণ চাল, পাঁচ মণ ডাল, পাঁচ মণ মিঠুরি বা দশ মণ দই দিয়া পাঁচ হাজার লোক খাওয়ানো যাইত। এতে মোটমাটে পাঁচ শ টাকার বেশি খরচ পড়িত না। গরুর দাম দশ-পনের, খাসির দাম চার-পাঁচ, চালের মণ দেড় টাকা-পাঁচসিকা। দুই-তিন টাকা মণ দই পাওয়া গেলে বরঞ্চ পাঁচ শ টাকার কিছু কমই লাগিত। চার-পাঁচ হাজার লোক বসিবার জায়গা করা খুব কঠিন ছিল না। ধান, সরিষা, কলাই মাড়াই শেষ হইবার পর এবং পাট বুনা শুরু হইবার আগে সকলের বাড়ির সামনে-পাশে বহু বিস্তৃত জমি খালি পড়িয়া থাকিত। নিম্ন-মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বাড়ি মাত্রেরই দুই একখানা বড় শামিয়ানা, ফরাশ ও শতরঞ্জি থাকিত। মাতব্বরদের বাড়িতেই দুই-তিনটা করিয়া বড় ডেগ থাকিত। প্রতি গ্রামে দুই-একজন করিয়া শখের বাবুর্চি ছিলেন; বড় বড় যিয়াফতে রান্না করা তাদের গৌরবের বিষয় ছিল। এই সব শখের বাবুর্চিরা বিনা পারিশ্রমিকে সহকারী লইয়া ভোর হইতে রান্না শুরু করিতেন, বাঁশের কোনোই অভাব ছিল না। ঘন ঘন খুঁটি গাড়িয়া গ্রামের পাঁচ দশটা শামিয়ানা টাঙানো হইত। জমি চাষ করা থাকিলে সামান্য মুগুরপেটা করিয়া তাতে ধারি-টাচাইর উপর ফরাশ-শতরঞ্জি ও চট বিছাইয়া সুন্দর বসার ব্যবস্থা হইত। এতে খরচ যা লাগিত, তা উল্লেখযোগ্য নয়। আমাদের বাড়ির মত নিম্ন-মধ্যবিত্ত গৃহস্থের পক্ষে বছরে একবার চার-পাঁচ শ টাকা খরচ করিয়া এমন যিয়াফতের আয়োজন করা দাদাজীর আমলে মোটেই কঠিন মনে করিতাম না। আমাদের ছেলেবেলা আমাদের অঞ্চলের অনেক মাতব্বর গৃহস্থের বাড়িতেই বছরে বছরে এমন যিয়াফত দেখিয়াছি এবং নিজেরা। খাইয়াছি। কখনও-কখনও এর চেয়েও বড় বিশাল যিয়াফতও খাইয়াছি। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, আবুল কালাম শামসুদ্দিন সাহেবের দাদা রিয়াত উল্লা মণ্ডল সাহেবের লিল্লায় যিয়াফতটা হইয়াছিল দস্তুরমত একটা মেলা। সে যিয়াফতে এক শ একটা গরু যবেহ হইয়াছিল বলিয়া শুনিয়াছিলাম।

.

. সমসাময়িক অবস্থা

প্রায় এক শ বিঘার জোতদার হইলেও দাদাজীর আমলে আমাদের কোনো বর্গাদার ছিল না। সব জমিই নিজের চাষে থাকিত। দাদাজীর আমলে দেখিয়াছি এইসব জমি আবাদ করিতে তিন-চার জোড়া হাল, দশ-বার জন কামলা খাঁটিত। হালের বলদগুলি ছিল বিশাল আকারের। উচ্চতায় পাঁচ ফুটের নিচে হইবে না। বলদ যেমন বড়, লাঙলগুলিও তেমনি দীঘে-পাশে আলিশান। এইসব হাল বাইবার মত কামলারাও ছিল ইয়া বড় জওয়ান। দাদার আমলের সাধু, ইদু, খিদিরদ্দি, খলবদ্দি, আইনদ্দি প্রভৃতি পাঁচ-ছয়জন বছরিয়া কামলার বিশাল আকারের কথা আজও মনে পড়ে। এরা কেউ উঁচায় প্রায় ছয় ফুট ও ঐ পরিমাণে মোটাতাজা ছিল। কাজে-কামে চলিতও এরা দেও-এর মত। এরা শুধু কাজেই বড় ছিল না, শক্তিতেও ছিল তেমনি অসাধারণ। সে শক্তি তারা শুধু এমনি দেখাইত না, আমাদের গিরস্থির কাজেও লাগাইত। বিভিন্ন রকমের ভারী ভারী বোঝা টানিতে, বিশেষত, মাঠ থনে ধানের আঁটির বোঝা আনিতে, সেই বিপুল শক্তি খাটাইত। ধান কাটিবার সময় যে আঁটি বাঁধা হয়, তারে আমাদের অঞ্চলে বলা হয় মুড়ি। এক-একটা মুড়ির ওজন পাঁচ সেরের বেশি ছাড়া কম হবে না। সাধারণ কামলারা এই ধরনের মুড়ির আটটাতে এক বোঝা বাধিয়া মাঠ হইতে বাড়ির খলায় আনিত। এই আটটা মুড়ি কেউ একটা আঁটি বাঁধিয়া মাথায় করিয়া আনিত। কেউ আবার চার-চারটা মুড়ির দুইটা আঁটি বাঁধিয়া বাহুক কাঁধে করিয়া আনিত। এই বাহুক সম্বন্ধেও সকলের এই ধারণা না-ও থাকিতে পারে। আমাদের অঞ্চলে ধান বাহিবার এই বাহুক গোয়ালা বা ফেরিওয়ালারা বাহুকের মত দুই পাশের দুইটা বোঝা ঝুলাইয়া আনা হয় না। তার বদলে বাহুকের দুই দিক ধানের দুই আঁটির ঠিক মাঝামাঝি ঢুকাইয়া দেওয়া হয়। সে উদ্দেশ্যে বাহুকের দুই দিকই ধারালো চোখা। এ চোখা মাথা দুইটি ধানের বোঝার ঠিক মাঝখানে এমনি কায়দায় ঢুকানো হইত যে, কোনো দিকে বেশি হইয়া তেছড়াভাবে হেলিয়া পড়িত না। পড়িলে আর বাহুক বওয়া সম্ভব হইত না। এই বাহুকের দুইটা আঁটি বাঁধার মধ্যেও বাংলাদেশের বিভিন্ন জিলায়। অন্তত দুই রকম কায়দা আছে। এক ধরনে ধানের সব মুড়ির ধানের মুখ নিচ দিকে ঝুলাইয়া বাঁধা হয়। আরেক ধরনে মুড়িগুলি উল্টা-পাল্টা দুই মুখ করিয়া বাধা হয়। তাতে ধানের দিক একদিকে থাকে না। সমান সংখ্যায় দুই দিকে থাকে। এই ধানের বাধার ফলে দুই দিককার বোঝা দুইটার বাহকের কাঁধের উপরের লেভেলে থাকে। এই ধরনের বাধাতেই বাহুক চুকানোতে খুবই উস্তাদি লাগে। মনে হয়, এতে বোঝাটাও কিছুটা পাতলা হয়। কারণ বাহকের চলার তালে-তালে উভয় দিককার বোঝাই ছন্দে ছন্দে নাচিতে থাকে।

এই ধরনের বাহুকেই হউক, আর এক বোঝার মাথায় করিয়াই হউক, অপর কামলারা যেখানে আটটা মুড়ি বহন করিত, সেখানে আমাদের বাড়ির ইদু-সাধুরা দশ-বার-চৌদ্দটা মুড়ি একবারে বহন করিত। এই লইয়া তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হইত। এটা সহজ ছিল না। কারণ, এতে প্রত্যেক বারের বোঝার ভার দেড় হইতে দুই মণ ওজনের হইত।

এছাড়া ইদু-সাধুরা আরেক কাজে তাদের শক্তির প্রতিযোগিতা করিত। আমাদের বাড়িতে তৎকালে প্রায় হাজার মণ ধান বিক্রি হইতে। এই বিক্রিটা প্রায়শই দুই-তিন দফার বেশিতে হইত না। তাতে প্রতি দফায় তিন শ হইতে পাঁচ শ মণ বিক্রয় হইত। যেদিন বিক্রিটা হইত, সেদিন আমাদের বাড়ির উত্তরের উঠান (এটাই আমাদের খলা ছিল বলা যাইতে পারে) লোক সমাগমে গমগম করিত। আমাদের কামলারা মাপিয়া দিত। ব্যাপারীদের ঘোড়াওয়ালারা এসব ধান সুতোয়া নদীতে দক্ষিণা ব্যাপারীদের পাঁচ শ মণি নৌকায় নিয়া যাইত। পাঁচসেরি পাথরের দাঁড়িপাল্লায় এই ধান মাপা হইতে। অনেক ধান। কাজেই বড় বড় কান্দি। এক কান্দি হইতে ধান মাপিয়া আরেক কান্দি করিতে স্বভাবতই বেশ দূরে করা যাইত। নইলে অতি শীঘ্রই দুই কান্দি লাগালাগি হইয়া যাইবার আশঙ্কা ছিল। কাজেই দাঁড়িপাল্লাওয়ালারা প্রতিবারের মাপা ধান খুব দূরে অন্তত চার-পাঁচ হাত দূরে মেলিয়া মারিত। এই লইয়াই আমাদের ইদু-সাধুদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করিতে দেখিয়াছি : কে কতদূর মেলিয়া মারিতে পারে। এটা সোজা কাজ নয়! কাজটা করিতে হয় বসা অবস্থা হইতে। পাঁচ সের ধান দুই একবার দশ হাত দূরে ফেলাও কঠিন নয়। কিন্তু চার-পাঁচ শ মণ ধান সারা দিন ধরিয়া মাপিতে হইবে। আগাগোড়া সমান দূরে ফেলিতে হইবে। কাজেই সমান জোরে মারিতে হইবে।

এমন বলবান জোয়ান-জোয়ান কামলারা যখন উঁচা উঁচা বলদ দিয়া হালচাষ করিত, তখন আমার বড় ভাই ও আমি স্কুল ছুটির দিনে হাল ধরিতে চাহিতাম। কামলাদের কেউ কেউ আমাদেরে লাঙল ধরিতে দিত, কিন্তু সাবধানতা হিসাবে আমাদের সাথে সাথে চলিত এবং লাঙলের কুটিতে আমাদের মুঠির কাছে হাত রাখিত। কিন্তু সর্দার কামলারা এতে আপত্তি করিত এবং আমাদেরে সরাইয়া দিত। বলিত, লেখাপড়া জানা লোকের লাঙল ধরিতে নাই। লেখাপড়া জানা লোক লাঙল ধরিলে লাঙলের রেখের নিচের জমি সত্তর হাত পর্যন্ত পুড়িয়া যায়। সে ক্ষেতে কোনো ফসল হয় না। আমাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে অনেক মুনশী-মৌলবী নিজের হাতে হালচাষ করেন। তাতে মাটি পুড়িয়া যায় না। সে নজিরের কথা বলিলে কামলারা জবাব দিত, তাঁরা আরবি-ফারসি পড়িয়াছেন, লেখাপড়া করেন নাই। লেখাপড়া মানে এখানে বাংলা লেখাপড়া। তৎকালে এ কথার গূঢ় মর্ম বুঝিতে পারি নাই। পরে বুঝিয়াছিলাম। লেখাপড়া জানা বাবু ভদ্রলোকেরা নিজ হাতে চাষ না করিবার কী চমৎকার যুক্তি জনপ্রিয় করিয়াছিলেন।

.

১০. প্রাচুর্য ও সরলতা

এরা ছাড়া আমাদের আরো তিন-চারজন বছরিয়া কামলা ছিল। ফসল। লাগানো-মাড়ানো এই দুই সময় এদেরে ছাড়াও মাসুরা (মাসোহারা) কামলাও রাখা হইত। এই সব গৃহস্থির কামলা ছাড়া তিন-চারজন রাখালও থাকিত। বলদা গরু বা হালের বলদের জন্য একজন ও পালের গরু বা ছেটুয়া গরুর জন্য দুইজন রাখাল থাকিত। হালের বলদ দশ-বারটা, আর ছেটুয়া গরু ছিল। প্রায় পঞ্চাশটা। হালের বলদের জন্য পৃথক একটা ও ছেটুয়া গরুর জন্য দুই তিনটা গোয়াল ছিল। পঞ্চাশটা ছেটুয়া গরুর মধ্যে আধাআধি বাছুর ও বাকি সব গাই থাকিত। গাইগুলির মধ্যে আট-দশটা দুধাল, বাকিগুলির কিছু গাভীন ও কিছু ছাড়ানিয়া (দুধ দেওয়া শেষ হইয়াছে কিন্তু আজও গাভীন হয় নাই এমন) গাই ছিল। দুধের বাছুরগুলিকে গোয়ালের এক কোণে খোয়াড়ের মধ্যে সারা রাত বাধিয়া রাখা হইত। ফযরের ওয়াকতে এক-একটা করিয়া বাছুর ছাড়িয়া তার মায়ের দুধ পানান হইত। দুধ পানান (দুয়ান) শেষ হইলেই গোয়ালের সব গরু ছাড়িয়া দেওয়া হইত। গুরুগুলিও বরাবরের অভ্যাসমত হালটে চলিতে শুরু করিত। আমাদের বাড়ির হালট গিয়া পড়িয়াছে সারা গাঁয়ের এজমালি হালটে। এই হালটের এক শাখা গিয়া পড়িয়াছে নদীর পাড়ে, অপর শাখা গ্রামের মাঠে। ক্ষেতে ফসল থাকার সময় হালটের এই শাখায় গরু যাইত না। সব যাইত নদীর ধারে। সেখানে গাঁয়ের সব গরুর সাথে মিলিয়া জঙ্গলের পাতা-পুতুড়ি ও ঘাস খাইত। বেশি গরুওয়ালাদের নিজস্ব চরাক্ষেত (গরু চরাইবার জন্য পতিত জমি) থাকিত। আমাদেরও কয়েকটা চরাক্ষেত ছিল। বরাবর একই ক্ষেতকে চরাক্ষেত রাখা হইত না। দুই-তিন বছর পরপর বদলানো হইত। এতে একদিক যেমন যথেষ্ট ঘাসে। গরু চরানোও চলিত, আবার কয়েক বছর পতিত পড়িয়া থাকায় এবং গরু বাছুর চরিবার সময় যে পরিমাণ লেদাইত, তাতে ক্ষেতের উর্বরতাও বাড়িত।

এত-এত কামলা ও বলদ গরুর বয়ান শুনিয়া আজকালকার তরুণেরা মনে করিবে, এটা ত একমত হালুয়া রাজার ব্যাপার, আসলে তা কিছু নয়। ঐ যে ছয় ফুট লম্বা জোয়ান কামলাদের কথা বলা হইল, তাদের বার্ষিক বেতন ছিল সর্বোচ্চ পঞ্চাশ-ষাট টাকা। আর রাখালদের বেতন ছিল বছরে দশ টাকা। চাকরি শুরু করিবার প্রথম দিনেই কিংবা দু’এক দিন আগে সব টাকা অগ্রিম দেওয়া-নেওয়া হইত। বয়স্ক কামলারা নিজেরা, আর ছোকরা চাকরদের বাপ-চাচা মুরুব্বিরা এই টাকা নিতেন। অগ্রিম বেতনের টাকা পাওয়ার পর সারা বছর তারা কাজ করিয়া দিত। টাকা মারিয়া দিবার কথা তৎকালে কারো মনেও পড়িত না। বছরের বেতন অগ্রিম আদায় করিয়া পরবর্তী তিন শ পঁয়ষট্টি দিন সে টাকার বদলা খাঁটিয়া দিতে বোধ হয় আজকাল কোনোও লোকই রাজি হইবে না। কেউ যদি রাজি হয়, তবে দু’চার দিনের মধ্যেই নির্বোধ বেওকুফ বেআক্কেল গাধা বলিয়া সর্বত্র তার বদনাম ছড়াইয়া পড়িবে। কিন্তু আগের লোকেরা এমন ছিলেন না। গৃহস্থরাও না, তাঁদের কামলারাও না। সকলেই সকলকে বিশ্বাস করিতেন। বিশ্বাসের সুযোগ-সুবিধাও ছিল। ধরুন কামলাদের কথাটাই। যে বছরে ষাট টাকা অগ্রিম পাইল, সে ঐ টাকার মধ্যে ত্রিশ-চল্লিশ টাকায় ষাট-আশি মণ ধান কিনিয়া ফেলিল। তার স্ত্রী-কন্যারা মিলিয়া ধান সিদ্ধ করিয়া বাড়া বানিয়া চাউল করিল। ষাট মণ ধানে চাল হইবে পঁয়তাল্লিশ মণ। আশি মণে হইবে প্রায় ষাট মণ। চাউলের দাম তখন দেড় টাকা মণ। অর্থাৎ ষাট টাকা বেতন পাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই কামলাটি শতাধিক টাকার মালিক হইয়া গেল। আর গৃহস্থের লাভ হইল যে, গাঁয়ের বাছা-বাছা সবল কর্মঠ কামলা তিনি বছরের নামে কিনিয়া ফেলিলেন। অন্যথায় বুনা-লাগানো ও দাওয়ামাড়ির সময় অমন কামলা পাওয়া যাইত না। পাওয়া গেলেও মাসিক বেতন দশ টাকার কম হইত না।

শুধু এই কারণেই যে লোকজন সৎ-সাধু থাকিত, তা নয়। শঠ-প্রবঞ্চক ও ঠক-ধড়িবায হইবার মত তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও চুরি-ডাকাতি করিবার মত সাহসই তখন জনসাধারণের মধ্যে হয় নাই। আরেকটা দৃষ্টান্ত দেই। প্রতিবছর ফাল্গুন চৈত্র মাসে বিহার হইতে বহু গরুর ব্যাপারী হাজার হাজার গরু লইয়া বাংলাদেশে ঢুকিত। আমাদের এলাকায়ও অনেকে আসিত। আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকে আগে বহুদূর বিস্তৃত ধানী জমি ছিল। একেবারে খোলা মাঠ। ধান কাটা হইয়া সবটাই একদম ময়দান। শুধু বাড়ির আশপাশে কিছু রবিশস্য সরিষা, কলাই করা হইত। এই ভোলা বিশাল মাঠে হাজার হাজার গরুসহ এই বিহারী ব্যাপারীরা আস্তানা ফেলিত। সুবিধা অনুসারে সাত দিন হইতে পনের দিন এক-এক আস্তানায় থাকিত। দৈনিক দশ-বিশটা গরু বিক্রি হইলে পাঁচ-সাত শ টাকা জমা হইত। সাত দিনে তিন-চার হাজার টাকা হইত। এই টাকা লইয়া ব্যাপারীরা মাঠের মধ্যে এত দিন রাত কাটাইত। কোনো একটা ডাকাতি-রাহাজানি হয় নাই।

.

১১. দাদাজীর এন্তেকালের পর

দাদাজী যত দিন বাঁচিয়া ছিলেন তত দিন উপরে কথিত মেহমানির ধুমধাম পুরা বজায় ছিল। কিন্তু রোযা রাখার নিয়মে শৈথিল্য আসিয়া পড়িয়াছিল। প্রথমে আমরা ভাইয়েরা রেহাই পাইলাম। কারণ অনেক দূরে হাঁটিয়া স্কুলে যাইতে হইত। মোহররমের ছুটি ছিল মাত্র এক দিন। আমাদের মত অপোগণ্ড শিশুর পক্ষে না খাইয়া স্কুলে যাওয়া কঠিন। কাজেই নফল রোযার জন্য অত কষ্ট করার দরকার নাই। আমরা যেই মাফ পাইলাম, অমনি আরো অনেকে নিজেদেরে মাফ করিয়া দিলেন। রোযা সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই যে, যত দিন বাড়িতে দিনের বেলা চুলায় আগুন না ধরে, তত দিন সে বাড়িতে রোযা রাখিতেও কারো কষ্ট হয় না। যেই মাত্র দুই-একজনের জন্য বিশেষ কারণে দিনের বেলা চুলায় রান্না চড়িল, অমনি প্রতিদিন এ বিশেষ কারণে হাজতির সংখ্যা বাড়িয়া চলিল। আমাদের বাড়িতে মোহররমের নফল রোযার বরাতে ঘটিল তা-ই। যত দিন দিনের বেলা পাকঘরের দরজা বন্ধ ছিল, তত দিন মোহররমের নফল রোযা প্রতাপ লইয়া আমাদের বাড়িতে রাজত্ব করিতেছিল। যেই ছাত্রত্বের হাজতে আমরা কয় ভাই হাজতি হইয়া রেহাই পাইলাম, অমনি গুরুতর অজুহাতের হাজতি দিন-দিন বাড়িয়া গেল। আমরা বড় হইয়া দেখিয়াছি, শেষ পর্যন্ত বাড়ির মুরুব্বি হিসাবে দাদাজী একাই রোযা রাখিতেন। আর মেয়েদের মধ্যে আমার মা এই নফল রোযা রাখিতেন।

দাদাজীর এন্তেকালের পর এই যিয়াফতের আচার ও ধুমধাম আস্তে আস্তে কমিয়া যায় এবং কয়েক বছর পরে একেবারে বন্ধ হইয়া যায়। কিন্তু এর কারণ আমার বাপ-চাচার কৃপণতা বা মত পরিবর্তন ছিল না। ছিল অর্থাভাব। দাদাজীর এন্তেকালের পর আট-দশ বছরের মধ্যে আমাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হইতে থাকে। একদিকে শরিকানা ভাগে চাষাবাদে ফসলের উৎপত্তি কমিয়া যায়, অপরদিকে আমাদের লেখাপড়ার খরচ বাড়িয়া যায়।

যা হোক, দাদাজীর আমলে মোহররম পর্বে আমাদের বাড়িতে এত ধুম ধড়ক্কি হইলেও দুই ঈদে কিন্তু অমন বিশেষ কিছু হইত না। বকরিদে প্রথম প্রথম দুই-তিনটা ও পরে মাত্র একটা গরু কোরবানি হইত। মোহররম লইয়া এত হৈচৈ করায় অনেক ছাত্র-বন্ধু ও শিক্ষক সন্দেহ প্রকাশ করিতেন আমরা আগে শিয়া ছিলাম। কিন্তু এটা ঠিক নয়। কারণ আমার বড় দাদা গাজী সাহেব এবং তারপর আমার চাচা মুনশী ছমিরুদ্দিন ফরাযী সাহেব ঘোরতর শিয়াবিরোধী ছিলেন। শিয়াদিগকে কাফের বলিতে চাচাজীকে আমি নিজ কানে শুনিয়াছি।

অথচ মোহররম লইয়া ধুম-ধড়কির কারণ দাদাজীও বলিতে পারিতেন না। তিনি বলিতেন, এটা বহুদিন হইতে এইভাবে পুরুষানুক্রমে চলিয়া আসিতেছিল।

.

১২. খেলাধুলার স্বাধীনতা

গান-বাজনা সম্বন্ধে আমার মুরুব্বিরা ঐরূপ কড়াকড়ি করিলেও খেলাধুলার ব্যাপারে তারা উদার ছিলেন। ঘোড়ায় চড়ার কথা আগেই লিখিয়াছি। এ ছাড়া আমরা শুকনার দিনে (অগ্রহায়ণ মাস হইতে জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত) মাঠে ব্যাটবল, ফুটবল, ডাংগুলি, কপাটি ইত্যাদি অনেক রকম খেলা খেলিতাম। ব্যাটবল মানে ক্রিকেট। আজকালের ছেলেদের মত আমরা ব্যাটবল কিনিতে পারিতাম না। নিজেরাই ব্যাট ও বল বানাইয়া লইতাম। দেবদারুগাছের চেলি অথবা ডাল কাটিয়া আগা চওড়া ও গোড়ায় হাতল করিয়া সুন্দর ব্যাট বানাইতাম। সুন্দর মানে তকালের জন্য সুন্দর। এটা ছিল প্রথম শ্রেণীর ব্যাট। সাধারণত এটাও জুটিত না। এক ফালি তক্তার একদিকে কাটিয়া ধরিবার মত একটা হাতল বানাইতে পারিলেই ব্যাট হইয়া গেল। আর বল? একটা শক্ত ভারী কাঠের গুলি বানাইয়া গাঁয়ের মুচেকে দিয়া তার উপর চামড়া সিলাই করাইয়া লইতাম। এটাই হইল আমাদের বল। এছাড়া কতগুলি লোহার চাকতি একত্রে করিয়া তার উপর খুব করিয়া নেকড়া জড়াইয়া গোল পিণ্ড বানাইতাম। এই গোল পিণ্ডের উপর মিহিন দড়ি দিয়া টাইপ করিয়া জাল বুনিতাম। তাতেও একরকম করিয়া শক্ত মযবুত ও টিকসই বল হইত। ত্রিকাঠি বা স্ট্যাম্প বানানো আরো সহজ ছিল। ত্রিকাঠি উচ্চারণে তিরিকাট ছিল আমাদের ক্রিকেটের বাংলা পরিভাষা। বাঁশের কাবারি বা ইঞ্চি অথবা সুপারিগাছের ফালা একদিকে চোখা করিয়া দুই জোড়া ত্ৰিকাঠি (তিন কাঠি) বানাইতাম। আমাদের আমলে পাড়াগাঁয়ে একদিক হইতে ওভারে-ওভারে বল করিবার নিয়ম ছিল না। দুই দিক হইতেই বল হইত। দুই দিকেই বৌলার, দুই দিকেই কিপার। খেলার গতিকে যেদিককার বৌলারের হাতে বল গিয়া পড়িত, সেদিক হইতেই বল চালনা হইত। আমাদের খেলার আরেকটা নিয়ম ছিল, আমরা মাথার উপর হইতে বল চালাইতাম না। বরঞ্চ হাত উঁচা করিয়া মাথা বা ঘাড়ের উপর হইতে বল মারিলে সেটা হইত ঢিল-মারা ‘নো বল’। আমাদের বল মারার কায়দা ছিল যাকে বলা যাইতে পারে আন্ডার হ্যান্ডবল মারা। ঝুলানো অবস্থায় হাতটা যতদূর সম্ভব পিছনে নিয়া ঐ ঝুলানোভাবেই অপরদিককার ত্ৰিকাঠি সই করিয়া বল নিক্ষেপ করা হইত।

ফুটবল সম্পর্কে কিন্তু অতটা আত্মনির্ভরশীল হওয়া সম্ভবও ছিল না, তার দরকারও হইত না। চামড়ার ফুটবল নিজ হাতে তৈয়ার করা কঠিন। কোনোমতে হারি-চাঁদা তুলিয়া তিন টাকা এক আনা জোগাড় করিতে পারিলেই তিন টাকার একটা তিন নম্বরের ফুটবল ও এক আনা দিয়া হুইসেল কেনা হইয়া যাইত। অনেক সময় হুইসেল ছাড়াও আমাদের খেলা হইত। রেফারি বুড়া ও শাহাদত এই দুই আঙুল মুখে ঢুকাইয়া জিভের চাপে সুন্দর হুইসেল মারিতে পারিত।

.

১৩. চুরুট-তামাকের কড়াকড়ি

তৎকালে পাড়াগাঁয়ে আমাদের সমবয়সীদের প্রায় সবাই তামাক খাইত। যারা চাষবাসের কাজ করিতেন, তাঁদের ছোট ছোট ছেলেরা বাপ-চাচার সামনেই তামাক খাইত। কাজে ব্যস্ত বাপ-চাচাঁদের তামাকটা ছেলেরাই সাজিয়া দিত। তামাক সাজিতে গিয়া নিজে দুই-এক টান খাইয়া লইত। ক্রমে এটা অনুমোদিত প্রথা হইয়া গিয়াছিল। একত্রে চাষবাস করিবার সময় এটা অপরিহার্য ছিল। একত্রে মাঠে কাজ করিবে, আর তামাক খাইবার সময় মুরুব্বিদের সম্মান দেখাইতে গিয়া গোপন করিবে, তার সময় ছিল না। সুবিধামত জায়গাও ছিল না। তবু অনেক ছেলে বাপ-চাচার সম্মানে একটু ঘুরিয়া বসিয়া হুঁক্কায় টান দিত। এই প্রথাই পরে নইচার আড়ালে তামাক খাওয়া’ বলিয়া সাহিত্যে স্থান পাইয়াছিল।

কিন্তু আমাদের বেলায় এটা হইবার ছিল না। কারণ আমাদের বাড়িতে তামাক খাওয়া একদম নিষিদ্ধ ছিল। দাদাজী তামাক খাওয়াকে একরূপ হারামই বলিতেন। কাজেকর্মে আচার-আচরণে তামাক খাওয়াকে তিনি হারামের থনে বেশি কড়া নজরে দেখিতেন। আমাদের দশ-পনের জন গৃহস্থির কামলার বেশির ভাগ ছিল তামাকখোর। তাদেরে তামাক না দিলে তারা কাজে জোর পাইত না। তাই বাপজী, চাচাজী ও গ্রামের মাতব্বরদের সুপারিশে কতকটা প্রয়োজনের তাগিদে দাদাজী কামলাদের বেলা তাঁর কড়াকড়ি শিথিল করিয়াছিলেন। কিন্তু আর সকলের বেলা খুব কড়া ছিলেন। ঘোরতর তামাকখোর বড় বড় আত্মীয়েরা আমাদের বাড়িতে আসিয়া তামাক ছাড়াই দিন কাটাইয়া যাইতেন। এ ব্যাপারে দাদাজীর কোনো পক্ষপাতিত্ব ছিল না। মুনশী-মৌলবী, আলেম-ফাযেল ও সরকার মাতব্বর সকলের প্রতি সমান নির্দয় ব্যবহার করিতেন। বিদেশাগত মৌলবী-মওলানাদের মধ্যে দু’একজন তামাকখোর, আর প্রায় সকলেই সাদা পাতাখোর থাকিতেন। পানের সাথে জর্দা-মশল্লার মত শুকনা তামাক পাতা খাওয়াকেই সাদা পাতা। খাওয়া বলা হইত। দাদাজী তাঁদেরে আমাদের বাড়িতে তামাক খাইতে ত দিতেনই না, তার জানামতে সাদা পাতা খাওয়াও সম্ভব ছিল না। তামাক চুরুট খাওয়াকে তিনি গু খাওয়া বলিতেন। হুক্কার তামাক খাওয়াকে তিনি কাঁচা গু ও সাদা পাতা চুরুট খাওয়াকে শুকনা গু খাওয়া বলিতেন। দাদাজীর কঠোরতায় তারা কেউ দাদাজীর সামনে সাদা পাতাও খাইতেন না। একটু আড়ালে সরিয়া গিয়া খাইতেন। তামাকের অভাব অসহ্য হইলে কেউ কেউ কামলাদের কাছে চাহিয়া তাদেরই সাজা হুক্কায় দুই-এক দম কষিতেন।

ছেলেবেলার একটি ঘটনার কথা মনে পড়িতেছে। একদিন নামাজের পরে এক মৌলবী সাহেব মসজিদে বসিয়াই ওয়ায করিতেছিলেন। ওয়ায করিতে করিতে তিনি মাঝে মাঝে পানের ডিবিয়া হইতে পানের খিলি বাহির করিয়া মুখে দিতেছিলেন। তিনি ছিলেন দিল্লি-ফেরতা বড় মওলানা। তিনি ছিলেন খুব ‘আম্বলী’ মানে তামাকের আদি। দাদাজীর মতামত তখনও তিনি জানিতেন না। দাদাজীর দিকে চাহিয়া তিনি বলিলেন, ‘ফরাযী সাহেব, আমার তামাক খাওয়ার আদত আছে। এক ছিলিম তামাকের হুকুম দিন। সমবেত মুসল্লিরা অবাক হইলেন। দাদাজীও বোধ হয় প্রথমে হকচকিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু মুসল্লিদের মধ্যে উপস্থিত আমাদের এক কামলাকে তিনি ভাল করিয়া তামাক সাজিয়া হুঁক্কাটা ধুইয়া-মুছিয়া আনিবার হুকুম দিলেন। কামলাটিও নিশ্চয়ই বিস্মিত হইয়াছিল। কিন্তু কিছু না বলিয়া তামাক সাজিয়া আনিতে বাহির হইয়া গেল। মওলানা সাহেব আবার ওয়ায শুরু করিলেন।

কিছুক্ষণ পরে কামলা হুক্কা হাতে মসজিদের দরজায় দাঁড়াইয়া উচ্চ স্বরে বলিল, “চাচা মিয়া, তামাক আনছি। ঐ কামলাটি ছিল বেশ বয়স্ক। সে দাদাজীরে চাচা মিয়া ডাকিত। দাদাজী তার দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘এইখানে। লৈয়া আয়।’

মওলানা সাহেব ঝটিতে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিলেন, না না, তুমি ভিতরে আইসো না। আমি বাইরে আইতেছি।’

দাদাজী পাশে বসা মওলানার চৌগার দামন ধরিয়া বলিলেন, না, না, মওলানা সাহেব, আপনি বাইরে যাইতে পারবেন না, এইভাবে বৈসাই তামাক খাইতে হৈব।’

এরপর দাদাজী ও মওলানা সাহেবের মধ্যে যে কথা-কাটাকাটি হইল তার শেষটায় মওলানা সাহেব তওবা করিয়া তামাক ছাড়িয়া দিয়াছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *