রানি

রানি (ছোটোগল্প) – আব্দুর রউফ চৌধুরী

ড্রিগরোড স্টেশনের সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে কায়সার দেখল, ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে তার বন্ধু আফসার আহমদ — কোলে একটি শিশু আর বাহুলগ্নে প্রেম-অপরিবর্তন হরিণাক্ষী একটি নারী, সে এক শিশুর স্নিগ্ধপ্রজ্ঞাসম্পন্না জননী; তার অপরূপ সৌন্দর্য যেন— পঞ্চমহাভূত প্রকৃতির গর্ভজাত সৃষ্টি, জ্যোতিষ্কমণ্ডলের প্রথম সূর্যের স্বতঃস্ফূর্ত শিশিরসিক্ত আলো, তৃষিত পৃথিবীর একপশলা বারিসিক্ত বৃষ্টি, রাত্রি শেষে উদিত নক্ষত্রকুলের সুন্দরতম ধ্রুবতারা, ঊষালগ্নের স্থির উজ্জ্বল জ্যোতির দ্যোতিত, শাশ্বত অন্তবিরামহীন পূর্ণিমার চাঁদ; অপরূপ ও সৌন্দর্য সুষমামণ্ডিত একটি মূর্তি, তবে ভীতু মূর্তপ্রতীক। নারীটি ডানে-বাঁয়ে তাকাচ্ছে; তার নাকের পাতলা গড়ন, ঠোঁটের নিখুঁত বক্রতা, গায়ের নারিকেল-ভাঙা গন্ধ কায়সারকে দমিয়ে দিলো। নতুন কারও সঙ্গে পরিচিতি হওয়ার সম্ভাবনা কায়সারকে অস্বাভাবিকভাবেই ঘাবড়িয়ে দেয়, যেন নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হয়, ছেলেবেলায় মায়ের আঁচল ধরে বড়ো হওয়ার অভিজ্ঞতা কি এইজন্য দায়ী? আফসার কী যেন ভেবে পেছন ফিরে তাকাতেই তার আঁখিক্যামেরায় ধরা পড়ল কায়সারের ঝাপসা মূর্তিটি — বুঝি স্বপ্ন! না, স্বপ্ন নয়। চারদিকে বিমানবাহিনীর প্রান্তর আর দিগন্ত; এরই মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বিক্ষুব্ধপ্রকৃতির প্রতিশোধাত্মকরোষের একটি চিহ্ন — প্রকৃতির বিরুদ্ধে প্রতারণা ও ছলনামূলক সর্বগ্রাসী কংক্রিটের তৈরি রেলস্টেশনটি। কংক্রিটদানবটি ও স্টাফকোয়ার্টারস ছাড়া বাকি দিগন্ত জুড়ে বিশাল প্রান্তরের সঙ্গে আকাশের মিতালি চলছে, যেন একজন নারী দীর্ঘদিন দাম্পত্যযাপনের পর তার অনন্তকুমারীব্রত ঘুচে না যাওয়ার মোহে আপ্লুত-অভিমানী। হেমন্তের নবীন সূর্যের কোমল উত্তাপ নিয়ে যেন প্রকৃতির ওপর দিয়ে একটি প্রেমনির্ঝর বাতাস বইতে শুরু করেছে। আফসার ভিড় ঠেলে রাস্তার একপাশে এসে দাঁড়াল, বন্ধুর অপেক্ষায়। ধীরে, আস্তে, দুলে, ঝুলে একটু একটু করে কায়সার আবির্ভূত হলো তার বন্ধুর সজ্জিব, ঘনকালো, সজল, অবিচলিত দৃঢ়শান্ত দুটো চোখের সামনে। বন্ধুটি কাছে আসতেই নিরীহ হাসি হেসে আফসার বলল, কী-রে এতদিন কোথায় ছিলি?

আফসারের স্ত্রী তার খসে-পড়া ঘোমটা মাথায় তুলে স্বামীর আড়ালে আশ্রয় খুঁজে নিতে চাইছে, কিন্তু আফসারের আহ্বানে আস্ত মানুষটি — আগ্রহ ও উত্তেজনা সংযত রেখে — সামনে এগিয়ে আসতে বাধ্য হলো। আফসার তার স্ত্রী ও নিজের মাঝখানে কায়সারকে দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে অনেক প্রশ্ন করতে লাগল, ‘কবে এলি’; ‘কোথায় উঠলি’; ‘খবর দিলি না কেন’ ইত্যাদি, ইত্যাদি। প্রশ্নমালার দু-একটির উত্তর দিয়ে বন্ধুর বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিতেই বাকিসব উত্তর অবান্তর হয়ে গেল, শিশুর হাসির শব্দে আফসারও খুশি, তাই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেল কিনা সেদিকে আর খেয়াল রইল না, বরং তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু, এরকম মানুষের সঙ্গে পরিচয় থাকলে উপকৃত না হয়ে উপায় নেই।

কায়সার নিশ্চুপ, মৃতমানুষের নির্নিমেষ চাউনি যেন, রক্তও হিম হয়ে আসছে, তবে মনে তার শ্রান্তির আভাস। আফসারের কথাগুলো করাচির শীতল-গরম আবহাওয়ায় মাধুর্যবাষ্প হয়ে উড়ে যাক-বা-না-যাক, তার মন্তব্যের বাহারে কায়সারের মগজ যেন শীতলজলের শরবতের মতো জুড়িয়ে যাচ্ছে, তাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই! বন্ধুর দিকে দৃষ্টিস্থাপন করে আফসার বলল, আমার স্ত্রী রানি। মা-বাবা তাদের একমাত্র সন্তানের নাম রাখতে কার্পণ্য করেননি। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন আর কি!

স্ত্রীকে উৎফুল্ল করে তোলার জন্যই হয়তো সে হাসতে লাগল, রানি কিছুটা খুশি হলেও তার অন্তরে নিঃশব্দে পাথর নিঙড়ানো শান্ত অশ্রুবিন্দু ঝরছে, তাই পালটা উত্তর দিতে পারল না। রানির কাঁচুমাচু ভাব দেখে কায়সার বলল, বৌদি আমার অপূর্ব সুন্দরী, হুরিও হেরে যাবে তার সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতায়।

কিছুক্ষণের জন্য কায়সারের দৃষ্টি থমকে দাঁড়ায়, বন্ধুপত্নীর নীরব ক্রীড়াভঙ্গির প্রকাশই এই আকর্ষণের কারণ; সে সত্যিই বিশুদ্ধ আনন্দলাভ করছে; রানির দেহভঙ্গি ও মুগ্ধদৃষ্টি যেকোনও পুরুষের ভালোবাসা লুটে নেওয়ার যোগ্য, তাই হয়তো কায়সারের অন্তরে ভেসে উঠল — আমিও তোমাকে জীবন্তপ্রাণীর মুগ্ধ-অতৃপ্ত নয়নে অবলোকন করছি, ত্রিজগতের মধ্যে হয়তো তোমার মতো কোনও সুন্দরী নেই, প্রকৃতির অনুপম সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ তোমার দেহ।

ট্রেন চলে যাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোনও কিছুই শুনতে পাচ্ছে না কায়সার। এই শব্দের মাঝেই আফসার বলল, তোর সঙ্গে আমার ঢের ঝগড়া আছে, তবে এখানে দাঁড়িয়ে নয়। তাছাড়া তোর বৌদির প্রশংসা করতে হলে চল আমার বাসায়, সেই হবে উপযুক্ত স্থান।

কায়সার চমকে বলল, কেন?

রানি পলকহীন চোখে তাকাল, মুখ দেখে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না — একধরনের কৌতূহলের মধ্যেও একটি বেদনার আভাস ফুটে রয়েছে। আফসার একটু হেসে বলল, এখানে দাঁড়িয়ে তোর বৌদির প্রশংসা করলে টাংগাওয়ালার ঘোড়া যদি শুনতে পায় তাহলে সেও, হায়-রে বাবা, হেসে উঠবে।

রাস্তার দুপাশে কাত হয়ে শুয়ে থাকা বিদেশি বুনোঘাস, ফণিমনসার ঝোপ হঠাৎ বিদ্যুৎ-বাতির জাদু সোনালি রঙে রাঙিয়ে দিলো, বিস্তীর্ণ মাঠকেও; সেদিকে তাকিয়ে কায়সার কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, আজ নয়, অন্যদিন হবে।

কায়সারের মন যেন ক্ষীণধারা মরুনদী, অতিকষ্টে টিকে থাকা, শুকনো প্রায়, উৎসাহহীন, তবুও নিয়ম অনুসরণে চলতে হয় তাই চলা। আফসার এগুতে গিয়ে হোঁচট খেলো, জুতোর ফিতে সাপের মতো প্যাঁচিয়ে রয়েছে তার ডানপা, পথের পাশের কংক্রিটের রেলিংয়ের সঙ্গে হেলান দিয়ে, বাঁহাঁটু ভেঙে, ডানপা উঁচিয়ে জুতোর ফিতে লাগানোর চেষ্টা করল, কিন্তু ভুল প্রান্ত ধরে টান দিতেই ফিতের গিঁট বিষগেরোতে পরিণত হতে সময় নিল না, গিঁটজট খোলার জন্য টানাটানি করতে করতে বলল, আজ নয় কেন? আগামীকাল তো রোববার, একটু দেরি করে ঘুমে গেলে তোর কোনও অসুবিধে হবে না।

কায়সার তার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, বারোটার সময় গেট বন্ধ করে দেবে।

কিছুক্ষণ ফিতে ধরে টানাটানি করেও ফিতের বিষজট খুলতে না পেরে রাস্তার ওপর হাঁটুগেড়ে বসে নখ দিয়ে গেরোটি খুলে ঠিকমতো ফিতে বেঁধে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, সেনানিবাসে যে কয়েকটি নতুন কোয়ার্টারস তৈরি করা হয়েছে তারই একটিতে আমাদের বাস, কাজেই গেট বন্ধ হওয়া নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা নেই।

কায়সার আর কি করবে! কিছুই করার নেই। বিমানবাহিনীর কোয়ার্টারসের বিস্তীর্ণ মাঠে শিশির-ভেজা, ঝিমে-থাকা ফুলবাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলল তিনটি প্রাণী, সঙ্গে কোলে ধরে রাখা বাচ্চাটিও। সিন্ধুনদের কুয়াশাভেজা শীতের সোনালি রঙের বিদ্যুৎ-বাতির আলো ঈষৎ টেউ খেলছে রানির শাড়ির সঙ্গে, আর তার মুখে প্রকাশ পাচ্ছে ঘনায়মান বিষণ্ণতার একটি গভীর ছায়া; তার হৃদয় যেন স্বদেশ বিচ্ছেদের বেদনায় ভারাক্রান্ত — স্বদেশ, মা-বাবা, দাদা-বৌদি, বোন-ভগ্নীপতি, তাদের ছেলেমেয়েকে ছেড়ে চলে আসার ব্যথাই হয়তো-বা। সিন্ধুপাড়ে সুখের নীড় বাঁধলেও কি গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের কথা ভোলা যায়! হয়তো-বা তাও নয়, হয়তো-বা বিষাদ ফুটে উঠেছে অন্য কারণে — স্বামীর সঙ্গে একা একা সন্ধ্যাটি কাটিয়ে দেওয়ার আনন্দের শিহরন এবং অন্তরে জেগে থাকা বাসনা অকারণে ভেস্তে গেল বলে, কোথা থেকে এক বন্ধু এসে সুসময়টা নষ্ট করে দিলো। কায়সারের ইচ্ছে হচ্ছে একবার তাকে থামিয়ে বলবে, শুনি, কী হয়েছে! এত ম্লান কেন তোমার মুখ? কিন্তু সে তা বলতে পারল না, বরং মাথা চুলকোতে চুলকোতে, ঘাড় সামান্য কাত করে, কোনও কিছু না বলেই এগুতে থাকে, কোয়ার্টারসের প্রাঙ্গণ ঘেঁষে, মাথাভাঙা রাস্তা দিয়ে; উভয় পাশেই ফুলের সমাহার, সিন্ধি গোলাপের সুগন্ধে বাতাস মোহিত। কী মিষ্টি, কী স্নিগ্ধ! আকাশে চাঁদ উঠেছে, আলোও ছড়াচ্ছে, কিন্তু মাটির কাছাকাছি এসে যেন বিদ্যুৎ-বাতির আলোর কাছে হার মেনে নিচ্ছে, তবুও চাঁদস্নিগ্ধ আলো আপন মনেই পরিবেশকে মায়াময় করে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতেই কায়সারের নাকে একটি গন্ধ এসে ধাক্কা খেলো, রাস্তার পাশের ফুলের ঘ্রাণের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাসগৃহের সামনেই উন্মুক্ত জায়গায় ছোটো একটি বাগান করা যেত বা যত্ন করে একটি ছোটোখাটো বুনোগাছ লাগানো যেত কিংবা বিদেশি ঘাস, লতাপাতা-ঝোপঝাড় ফুলে ফেঁপে উঠার সুপরিকল্পিত বন্দোবস্ত করা যেত অথবা বারান্দার পাশ ঘিরে, দৃষ্টি আড়াল করে রাখার জন্য, নাম-না-জানা কোনু ঝাঁকড়াগাছ লাগানো যেত, যার ঝাঁকড়ামাথা এতদিনে ছাদ স্পর্শ করত, আর মাটির দিকে নুয়ে পড়া পাতাগুলো হিল্লোলিত হতো বাতাসের দুলনে; তা না করে এদিকের ওদিকের আবর্জনা, ঘর-ঝাড়-দেওয়া ময়লা, মাছের কাঁটা, মুরগির হাড় স্ত‚পিত করা হয়েছে। ওষুধভর্তি দুটো বোতলও নোংরা স্ত‚পের ওপর ভিড় জমিয়েছে। সমস্ত বিমানবাহিনীর সেনানিবাসের মুগ্ধকর পরিবেশ এখানে এসে যেন আত্মহত্যা করেছে। সুন্দরী এক নারী এমন অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

কায়সার বসারঘরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেল, দেয়ালে ঠেস দেওয়া একসেট আরাম চেয়ার, তারই ওপরের কালো চিহ্নগুলো যেন স্বামী-স্ত্রীর বিষণ্ণবিরস প্রহরগুলোর অনবরত ইতিহাস রচনা করে চলেছে, আর পেরেকের গর্তগুলোর মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে চলেছে দুঃখবিষাদগ্লানিই শুধু নয়, ক্লান্তিও। চুনরঙের চওড়া আস্তরণ, মেঝে থেকে একহাত পর্যন্ত উঁচু, শুকিয়ে বিরহ ধরা আবরণে পরিণত হয়েছে। চারদিকের অতিরিক্ত অপরিচ্ছন্ন ভাবটি সগৌরবে প্রকাশিত। ‘চা আনি’ — বলে পরদা সরিয়ে রানি চলে গেল রান্নাঘরে, আর তার পেছনে দুলতে লাগল পরদার প্রতিটি ভাঁজ; সেখানে ইস্ত্রির কোনও নিটোল চিহ্ন নেই, সেলাইয়ের পরতে পরতে শুধু জমে আছে ধুলোর তারকাঁটা, সুতোর মাঝেমধ্যে যেন দুর্বোধ্য ও দুঃস্বপ্নের ভগ্নস্ত‚পের ওপর জমে ওঠা বেদনার একরকম রহস্যময়ী জীবনগাথা — সবই সগর্বে আত্মপ্রকাশ করছে। রানি চা এনে দিলে, কাপে পূর্বকার চা-পানকারীর চুমুকের দাগ বাঁচিয়ে চুমুক বসানোর জায়গাটি খুঁজে পেল না কায়সার, বিমর্ষভাবে হাসলেও তার অন্তর ঘিনঘিন করতে থাকে। নিঃশব্দের প্রতীকের মতো কায়সার দেখতে থাকে ঘরের চারপাশ এবং এককোণে জড়ো করে রাখা ছেলের প্রস্রাবে ভেজা কাপড়গুলো। দেখতে পেল, এসবের মধ্যেও যেন অনুত্তেজিত বঞ্চিত আত্মার কিংবা অন্তরের যন্ত্রণাই স্তিমিত হতাশার মতো আনাগোনা করছে।

.

আফসারের সন্ধান নেই, তার অনুসন্ধানে এসে রানিকে প্রশ্ন করে বিব্রত করতে থাকে কায়সার, এরই সঙ্গে আবিষ্কার করল — রানি তার দূরসম্পর্কসূত্রে আত্মীয় হয়; এরকম সম্পর্ক সাধারণত বিস্মৃতির আড়ালে বিলুপ্ত হয়ে যায়, কিন্তু রানি এই সূত্র ধরেই কায়সারের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়। রানির এরকম ব্যবহার খুবই অপ্রত্যাশিত। কায়সার নিজেই জানে না এর মানে কী! তবুও সে মনে মনে খুশিই হলো, পর মুহূর্তে কষ্টও পেল বটে, যাকে বলে অকাল মৃত্যু — কী করে সে একজন সুন্দরীর সঙ্গে দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ হবে? সে ভেবে পাচ্ছে না! একথা রানিকে বলা যায় না, সে বুঝবেও না। কায়সার থেমে গেল। কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে রইল রানির আচমকা অপ্রস্তুত প্রস্তাবে, এখন থেকে আপনি আমাকে বোন বলে গ্রহণ করবেন।

কায়সারের বুকের ভেতর শিরশির করে উঠল, এই সম্পর্ক সে প্রাণপণ অস্বীকার করতে চায়, ঠেলে দিতে চায় মাথা থেকে, তারপর নিজেকে সংযত করে বলল, না মানলে কী করবে!

কায়সার সম্পর্কটিকে না মানলে রানির মনের অব্যক্ত কথাগুলো উচ্ছ্বসিত জলাশয়ের মতো ঢেউয়ের-পর-ঢেউ তুলে হৃৎপিণ্ডের গভীরে হারিয়ে যাবে; যেখানে বনোমোরগের ডাক চলছে — অনিয়মিত, বর্ণশূন্য, রুক্ষ; ঘরের বাতাসের মতো অনিশ্চিত; অনিশ্চিত ঘাসহীন, কাদাহীন রোদভেজা মরুবালুর মতো, অনিশ্চিত সিন্ধুনদের ওপর বয়ে চলা লবণাক্ত লু-হাওয়ার মতো — কখনও হিম, কখনও শীতল, কখনও বরফঠাণ্ডা, আবার কখনও রংচটা নি®প্রাণ বস্তুর মতো ফ্যাকাশে। কায়সার জানে, অব্যক্ত হৃদয়ের কথাগুলো কঠিন জটলায় ডুবে গেলে সেখানে জন্ম নেবে লালনীল রক্তের জটিল মোহনা, আস্তেধীরে ক্ষতস্থানটি শুকিয়ে উঠলেও বিবর্ণ মরা হৃদয়ের অব্যক্ত কথাগুলো বঞ্চিত ঘটঘটে হতে হতে একসময় বিলীন হয়ে যাবে, সঙ্গে হৃদয়ের শেষ আকাঙ্ক্ষাটিও; কিন্তু অব্যক্ত কথাগুলো ব্যক্ত করতে পারলে হৃদয়াঘাতপ্রাপ্ত জায়গাটি ছেঁড়া কাগজের মতো শুকোবে, জীবনবৃক্ষে সজীবতা লাভ করবে, শরীর প্রেমকামের তৈলাক্ত রসে ঋজু হবে।

রানির অবোধ দুটো চোখে অশ্রুচ্ছায়ার ক্ষীণরেখা ফুটে উঠেছে, কায়সার ঠিকই টের পাচ্ছে, সংসারে না পাওয়ার অভাবগুলো তার দৃষ্টিতে চকচক করছে, এ-যেন বঞ্চিত মনের একটি অতৃপ্ত পুঞ্জীভূত ছায়া। রানি জানে, একজন বিবাহিত স্ত্রীর পক্ষে আরেকজন পুরুষের কাছে মনের কথা প্রকাশ করা ভীষণ অন্যায়, তবুও চাপা গলায় বলল, আমি সবকিছু খুলে বলতে পারব না।

সমস্ত মহিমা, জীবনের সব ষোলোকটির ছক তার বাদামি উজ্জ্বল মুখে প্রকাশ পাচ্ছে, চোখদুটোও বেঁকে উঠেছে ধনুকের মতো, মনের অব্যক্ত কথাগুলো যেন সগর্বে উঁকি দিচ্ছে তেতুলবিচির মতো। ব্লাউজের বোতামে ঝকঝকে রুপালি বেদনার নুয়ে পড়া শাদা শাপলার ঝিলিকটিও প্রকাশ পাচ্ছে। ভারী নিশ্বাস বুকের মধ্যে সজোরে তরঙ্গ তুলছে; আকাশ, প্রান্তর, বদ্ধঘরের পরিবেশটিও যেন উলটোপালটে যাচ্ছে; হৃদয় যেন ডুবে যাচ্ছে গভীর বিষাদের অতলে, ঈর্ষান্বিত সৎমায়ের ঠোঁটের নিশ্চিত হাসির মতো; আর কায়সার ভেবে চলেছে — তুমি নারী : রূপওয়ালিনী, ছলনাময়ী, মনোমোহিনী, বিচিত্ররূপিণী; তুমি হেলেন : ট্রয় ধ্বংস করেছ; তুমি দ্রৌপদী : অষ্টাদশ অক্ষৌহিনীর বধ করেছ; তুমি সীতা : লঙ্কাপুরী জ্বলেপুড়ে খাক করে দিয়েছ; তুমি জয়নাব : কারবালা প্রান্তরে ইমামবংশকে খুন করেছ। নারী পারে না কী! আর প্রকাশ্যে একগাল হেসে বলল, আমি রাজি।

নীল-ফিতে-বাঁধা বেণিটি আঁচলে ঢেকে রানি নিশ্চুপ। চোখদুটো একটির চেয়ে অন্যটি নীরব, তবে ছাদের দিকে ধাবিত; গভীর অপরূপ দৃষ্টি; কায়সার মুগ্ধ না হয়ে পারে না, অন্যমনস্ক হয়ে বলল, আমাকে এক কাপ চা দেবে?

রানির মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল, তবে তার দুটো চোখে যেন জলে ঢাকা আগুন, মাঝেমধ্যে বিদ্যুতের ঝলক, অদ্ভুত! সে বলল, এই গরমে চায়ের কি কোনও প্রয়োজন আছে!

কায়সারের আদেশে নয়, তৃষিত অতিথির সেবাবৃত্তি রানির মনে জেগে উঠায় সে রান্নাঘরে চলে গেল, তবুও বুকের গোপন ব্যথাটি তাকে কঠিনভাবে পীড়া দিতে থাকে। তার অন্তরে ধরে রাখা হতাশাবেদনা আজ সত্যি সত্যিই ফেনিয়ে উঠেছে; চেনা-পরিচিত-জানা-একান্তকাম্য মানুষটি হঠাৎ কেমন যেন অচেনা-অপরিচিত-অজানা হয়ে উঠেছে, অকারণে বিস্ময়কর অন্যায় সে করছে। রানি এসবের কোনও সংগত কারণ আবিষ্কার করতে পারছে না, সমস্যার মীমাংসা করা যাবে কিনা সেই বিষয়েও অনিশ্চিত। নিঃসঙ্গ জীবনে, বিশেষ করে পরদেশে পরবাসী হয়ে কীভাবে সে এর সন্ধান করবে! রান্নাঘর থেকে ফিরে আসা রানির বাঁহাত এসে ঠেকাল কায়সারের কাঁধে, সামনে এক পেয়ালা শরবত। রানি বলল, সবটুকু কিন্তু খেতে হবে।

শরবতে চুমুক দিয়ে চোখ তুলে তাকাল কায়সার, আর তখনই তার চোখে ধরা পড়ল রানির চোখের কোণে চিকচিক করে উঠা ঝিলিকটি। সে ঝিলিকটি কি আফসার, না কায়সার! কায়সার ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে গেল। বরফঠাণ্ডা শরবতে আরেকবার গভীর চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করল, জিভ বোধ হয় বরফ হয়ে গেছে। সিনেমা হলের সামনে পরিচিত হওয়া ও ওদের বাসায় প্রথমবারের মতো চা খাওয়ার পর এই হচ্ছে তার দ্বিতীয় সাক্ষাৎ, প্রয়োজনীয় দু-চারটে কথাবার্তা, খুবই মামুলি — আর তো কিছু নয়। রানি আত্মীয়তার সম্পর্কস্থাপন করে, খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে আজ একটি বিপত্তিকর ঘটনা ঘটাবে নাকি! এতে কোনও সন্দেহ নেই। শরবতের পেয়ালায় ঘনঘন চুমুক দিয়ে কায়সার এসব কথাই ভেবে চলেছে, আর তার মনের অতল গহবর মন্থন করে চলেছে; স্বপ্নকাতর প্রাণ, সৌন্দর্যহর্ষে উদ্বেলিত সরল মেয়েটি সত্যিই রহস্যময়ী। দূর আকাশে, সাঁঝের মধ্যে রুপালি মেঘের বিচিত্র চিত্রকল্প ভেসে চলেছে, আর এরই মাঝে উড়ে বেড়াচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে মায়াবিনী শক্সখচিল আর তার স্তর ফুঁড়ে তীব্র কণ্ঠে যেন জেগে উঠছে সৈনিকনগরের ব্যস্ত বাস্তবতা। ঠিক তখনই আফসার দ্বারপ্রান্তে এসে থমকে দাঁড়াল, কায়সারের নজর এতক্ষণ দরজার ওপরই ছিল। কায়সার নীরব, আফসার স্থিরদৃষ্টিতে দেবমূর্তি, কিন্তু তার চোখ কপাল স্পর্শ করে, কপালের ভাঁজে-অভাঁজে যেন অকর্তব্যের দায়ই প্রকাশ পাচ্ছে। কুঞ্চিত ভুরুদুটো তার তীক্ষ্ণ, কিন্তু যুবকোচিত উজ্জ্বল মুখে উজ্জ্বলতার ম্লানঘন ছায়া, কণ্ঠ দিয়ে শুধু একটি অর্ধস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো, কিছুই বোঝা গেল না, আর্তনাদের মতোই শোনাল, কিন্তু এই শব্দের আঘাতে রানির গোলাপি মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল, বুকে দুরুদুরু ছক্কাপাঞ্জা চলছে, শুধু চোখদুটো নিঃশব্দে আফসারের দিকে লুকোচুরি খেলছে যেন। একমুহ‚র্তে সম্পূর্ণ পরিবেশ বদলে গেল। রানির অন্তরের অসহ্য বেদনা প্রকাশের জন্য একটি মানুষের প্রয়োজন ছিল, যেমনি ভেন্টিলেশন শূন্য ঘরের বায়ু দূষিত হয়ে ওঠে তেমনি বঞ্চিত মানব অন্তরে সঞ্চিত ব্যথা প্রকাশের সুযোগ না দিলে জীবন অসহনীয় হয়ে ওঠে; তাছাড়া উপায় কী! এরকম যন্ত্রণামূলক পরিবেশ বা অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনায় রানির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, কিছুক্ষণের জন্য, কিন্তু এখন, আফসারের আগমনে সব যেন থেমে গেল, কানের দুলগুলোও এপাশ ওপাশ দুলতে দুলতে অর্থহীন অসহায়ভাবে একসময় স্থির হয়ে যায়। আশ্চর্য, রানির টলন্ত দেহ নিজের অজান্তেই চেয়ারে নেতিয়ে পড়ে, কিন্তু বাতাসে তার হাড়গুলো খটখট শব্দে নড়তে থাকে। তার রক্তাভ মুখে অনেকগুলো অত্যন্ত অদ্ভুত পাঁঠাবলির নকশা ফুটে উঠেছে, যাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হতে থাকে স্বপ্ন আর জাগরণ।

.

রানির মুখে একটি বিষণ্ণ কিন্তু মহৎ ও আকর্ষণীয় ক্ষমাসুন্দর নিরুত্তাপ ভাব ফুটে রয়েছে; সে নিশ্চলভাবে, একান্তই অর্থহীন দৃষ্টিতে শূন্যপানে তাকিয়ে শুনছে কায়সারের ঘনঘন নিশ্বাস ও দ্রুততর পায়ের অসম পদধ্বনি; সহসাই তার মুখের পেশি ও রেখাগুলো কাঁপতে থাকে, কাঁপন বেড়েই চলেছে। রানির সুন্দর মুখটি একদিকে একটু বেঁকে গেছে আর সেই বিকৃত মুখের ভেতর থেকে কয়েকটি অস্পষ্ট কর্কশ শব্দ বেরিয়ে এলো — দাম্পত্যজীবনের অর্থাৎ শুকনো শাখায় পিঁপড়ের জীর্ণ বাসার ইতিবৃত্ত বিশদভাবে বলতে গিয়েও বলতে পারছে না, ইতস্তত করে স্পষ্ট-অস্পষ্ট মনের গোপন কথাগুলো প্রকাশের চেষ্টা করছে; ভেতরে ভেতরে তার অবুঝ সত্তাটিও কাঁপছে, সন্তর্পণে একটি আলপিন ফুটিয়ে অব্যক্ত কথাটি প্রকাশ করতে চাইছে, তা লক্ষ করে কায়সার বলল, দেখো রানি, সবকিছু খুলে না বললে আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারব না। রোগের বিস্তারিত বিবরণ না জেনে ডাক্তার কি পারে রোগীর জন্য সুব্যবস্থা করতে? অবশ্যই পারে না।

রানির দুর্বল মুখে একটি করুণ হাসি খেলে উঠল, যা তার গভীরগম্ভীর মুখে বেমানানই মনে হচ্ছে, তবুও এরই মধ্যে যেন আত্মপ্রকাশ করছে তার অসহায় অবস্থার রংবেরঙের সেলাইগুলো; চোখও ঝাপসা হয়ে উঠেছে। রানির দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে কায়সারের অন্তর অপ্রত্যাশিতভাবে কেঁপে উঠল। মা-মাতামহীর উপদেশ — বুক ভেঙে যাক, তবুও মুখ ভাঙবে না — ধন্বন্তরি বলে মান্য করে বাঙালি মেয়েরা, রানিকে তবুও সব খুলে বলতে হবে — সে তা বোঝে। বিদেশবিভুঁইয়ে আর কে আছে তার আপন? যে তার অতি আপন সে-ই তো পর হতে চলেছে। তাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। সে বুঝছে — কায়সারের মতো মানুষ এই বিদেশে পাওয়া কঠিন, মনে হয় ত্রাণকর্তারূপেই যেন তার আবির্ভাব ঘটেছে। বজ্রপাতের শব্দে উত্তেজিতভাবে যেমন ঘুম ভেঙে যায় তেমনই ব্যাকুলভাবে রানি বলল, সি-ব্লকের সাত নম্বর বাসার খানকিটা যে কয়েকটি স্ত্রীলোকের কপাল ভেঙেছে, আমিও তাদের একজন।

যেকোনও কারণেই হোক আফসার যে রানিকে এভাবে ঠকাচ্ছে তা কায়সার ভাবতেই পারেনি। রানির জীবনে প্রেম আছে, কিন্তু তা অনুপযুক্ত, ক্ষয়পূর্ণ হৃদয়ে অর্থহীন। আফসারের উল্লাসে ভাটা পড়েছে, রানি তা টেরও পাচ্ছে, স্ত্রীর আহ্বানে স্বামী আগের মতো আর সাড়া দিচ্ছে না, দিলেও দুর্বল, মনরক্ষা সাড়া যেন, কৃত্রিমতায় ভরপুর। স্ত্রীর জীর্ণাবিশিষ্ট যৌবনের সবকিছু ব্যয় করছে স্বামীকে জয় করার জন্য, কিন্তু ফল শূন্য। আফসার তার স্ত্রীর প্রেমের খোরাক দিতে পারছে না, শুধু তার স্ত্রীর অশান্তি-উদ্বেগ-সন্দেহ-ঈর্ষা-পীড়া দেওয়ার সমস্ত অনুভূতিগুলোকে বাড়িয়ে দিচ্ছে, তাই হয়তো রানির হৃদয় ভরে উঠেছে নিদারুণ কঠিন অব্যক্ত ব্যথায়।

চা পানের অপেক্ষা না করে উঠে পড়ল কায়সার।

সাত নম্বর বাসার দরজায় নক করতেই একটি মেয়ে দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়াল। দরজার ফাঁকে কায়সার দেখতে পেল দেয়ালে কাশ্মীরি কার্পেট ও জানালায় রাজস্তানি দর্পণের কারুকাজে সজ্জিত বিভিন্ন রকম পরদা ঝোলানো, যেন স্বর্গীয় আমেজ সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যদিকে, মেহগনির আলমারির ভেতর বিভিন্ন আঁকারের মূর্তিগুলো জ্বলন্ত মোমবাতির উজ্জ্বল শিখার মৃদু আলোয় লালচে হয়ে জ্বলছে। কায়সার দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে নরম কার্পেট মাড়িয়ে একটি ঘরের দিকে অগ্রসর হলো। ঘরের ভেতর থেকে খেয়ালের সুর ভেসে আসছে। ভেজানো দরজা একটু ফাঁক করতেই চোখে পড়ল, ছোটো একটি গোলটেবিলে ফল ও ঠাণ্ডা খাবারের এলোমেলো সমাবেশ। পা টিপে কায়সার জলসাঘরে ঢুকল। ঝকঝকে সিন্ধি চাদরের ওপর বসা একজন রমণী, সে খেয়াল গাইছে। সংগীত কী বিষম বস্তু! রাগরাগিণীর কী অসাধারণ ক্ষমতা! সংগীতস্রষ্টা খসরুর মতো কে পেরেছে — ইমন, ভৈরবি, পুরিয়া, ভূপালি, বিলাবল, বিহাগ, কল্যাণ, ঝিঝেট, বসন্ত, পূরবী, গৌরি, সরস্বতী, তড়ি — বিভিন্ন রকমের রাগরাগিণীর বিপুল বিস্তর সমুদ্রে ডুব দিয়ে খেলা করতে। রমণীর একপাশে হেলান দেওয়ার বালিশ, আর তার তিনপাশে জ্বলন্ত মোমবাতি ঘেরা পরিবেশে বসা পুরুষগুলো নীরবে মগ্ন — খেয়াল শুনছে। আধোমুখে দাঁড়িয়ে থাকে কায়সার। রমণীটি কুটিল, স্থির ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কায়সারের দিকে তাকালে, ভীরু চোখে আফসার বলল, ও আমার বন্ধু।

রমণীটি সুন্দর আস্তরণমোড়া মুখে অভ্যর্থনা জানাল, কিন্তু খেয়াল বন্ধ করল না। মদ্য ও মোমবাতি পোড়ার গন্ধ কায়সারকে যেন চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। গান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এক ভক্ত গুনে গুনে এক-একটি করে চার-চারটি আঙুরফল রূপবতীর মুখে ঢুকিয়ে দিলো, রমণীটি কোনও কথা বলল না, শুধু ঠোঁট ইশারায় নাড়ল, যেন আঙুরের রস অপচয় না হয়, কিন্তু হাসি ঠিকই স্থির হয়ে রইল আঁখিপাতে। যখন আফসারের হাত আঙুরসহ সাবধানে এগিয়ে এলো তখন তার চওড়া হাড় ও মাংসল হাতের ওপর রমণীটি ঠোঁট চেপে ধরল, কিন্তু তার দেহ একটুকুও কাঁপল না। ভালোবাসা ছাড়াই পুরুষকে বশীভূত করার বিদ্যা সে জানে। সত্যিই বীরভাগ্যা! সে হয়তো কোনওদিনই আফসারের বীরত্ব চায়নি, চেয়েছে একজন বঞ্চিত পুরুষের উষ্ণ হৃদয়ের ছোঁয়া, যা তার আত্মত্যাগের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। রমণীটি বলল, এই হবে আজকের আসরের শেষ গান।

ভক্তবৃন্দের করধ্বনির মধ্য দিয়ে গান একসময় শেষ হলো। পুরুষগুলোর গায়ে শুধু কামরূপিণীর নিশ্বাসের আঁচ। আলো-অন্ধকারে আচ্ছন্ন ঘরটিতে নেমে এসেছে অভূক্ত প্রেমিকদের কেয়ামত; বুকের মধ্যে শুরু হয়েছে শাদা বকের ডানা ঝাপটা, মন্থর গতিতে ডানা মেলার পাতলা ছায়াও, এরই সঙ্গে কয়েকটি ভক্তের কুচকুচে কালো ঝাঁকড়া চুলে ঢেউ উঠছে, অচেনা বিলে মাঝির মাছ ধরার ফন্দির মতো; আর দেয়ালে লেপটে রইল রমণীর গানের অন্যরকম ধ্বনিপ্রতিধ্বনির নকশা, আর তখনই নাটকের যেদৃশ্য শুরু হলো সেজন্য কায়সার একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। একে একে প্রত্যেক পুরুষ ওষ্ঠে ধারণ করল কড়কড়ে এক-একটি মোটা টাকার নোট। রমণী উপস্থিত মর্দজোয়ান সকলকে কামবাণে বিদ্ধ করে সব চেয়ে কাছের ভেড়াটির কোলে ঢলে পড়ল, স্রোতস্বিনীর মতো। হাত দিয়ে মুখ থেকে টাকার নোটটি আলতোভাবে সরিয়ে, অকস্মাৎ, ভেড়াটির ঠোঁটে নিজের ঠোঁট দাবিয়ে দিলো; দারুণ চুম্বন শক্তিতে চুষে নিল ওষ্ঠাধরের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত। রমণীটির ঠোঁটের ফাঁকে আটকে রইল লালাসিক্ত ভক্তের জিভের ডগা। রমণী তার দুই রম্ভোরুর সাহায্যে ভক্তের বক্ষে প্রবল চাপ দিলো, কামপ্রিয় অতৃপ্ত পুরুষকে রোমাঞ্চকর উন্মাদনায় মাতিয়ে তোলার সুফল প্রচেষ্টা যেন; দুর্বল মনের মানুষের পক্ষে এসব সহ্য করা কঠিন, তবুও রমণীটির সঙ্গসুখ আশ্চর্যভাবে ভক্তের মনকে ক্ষণিকের জন্য হলেও আনন্দ লুটতে সাহায্য করল। রমণীর আলিঙ্গন তাকে তার দুঃখময়, অতৃপ্তময় জীবন থেকে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও রেহাই দিলো। দুর্বল চিত্তের ভক্তরা, নিজের স্ত্রীর সঙ্গে মিলনখেলায় অপূর্ণবঞ্চিত হৃদয় নিয়ে, পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে রইল; পরস্ত্রীর সমস্ত দেহ উত্তেজিতভাবে ভক্ষণ করার আশায়। চোখ বোজে পুরুষগুলো যেন অনুভব করতে চাইল সুন্দরীর গভীরে অনুপ্রবেশ করে বীর্যস্খলনের আনন্দটি, আর যখন তারা একে একে চোখ খুলল তখন দেখা গেল রমণীটির সর্বস্ব লুটে খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাদের চোখে ঝিলিক মারছে। কায়সারের এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞতা না থাকায় সে ভক্তবৃন্দকে সমর্থন করতে পারল না, এমনকি পারল না রমণীর মহত্তর, মধুরতর, শ্রেয়তর ভালোবাসার সম্মান দিতে, শুধু তার মনে হলো, এইসব পুরুষের চোখ আকৃষ্ট করা রোমান্টিক প্রেমময়ী, মহৎ হৃদয়ের অধিকারী নারীটির অন্তরে যে অনুভূতি জেগে উঠেছে তার তুলনা কী? রমণীটি তার সামনে বসা এক ভক্তের গালে চারটি সফেদমসৃণ দাঁত দাবিয়ে ষোলোকটির দাগ কেটে পরবর্তী ভক্তের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল, অভুক্ত ভক্তকে কৃতার্থ করার বাসনায়; ভক্তরা যেন অভাবগ্রস্ত ভিক্ষুকের চেয়েও অভাবী। এমনভাবে সে তাকে ঘিরে বসা দশটি পুরুষের অন্তর জয় করতে করতে জয়ী মিষ্টিমধুর হাসি হাসতে থাকে। যে পুরুষগুলো একটু আগে একটি নারীর অর্চনায় আনন্দোপভোগ করছিল তারা বিজয়িনীর হাসির রেণু কুঁড়িয়ে নিয়ে ‘নারী হৃদয় কে বুঝে’ — আফসোস ধ্বনিটি সযত্নে বুকে ধারণ করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে লাগল; তারপর টাকার ছোটো থলেটি পকেটে রেখে, রংবেরং ও নানা রেখায় চিত্রিত কাঁধের ব্যাগটি কাঁধে তুলে নিয়ে, আস্তেধীরে, দরজাভিমুখে যাত্রা করল। পুরুষগুলোর পেছনে দরজাটি, সময়মতো, সশব্দে বন্ধ হতেই বর্ষাবিস্ফোরিত নদীর জল যেভাবে গ্রামগঞ্জকে উচ্ছ্বলিত স্রোতরাশিতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, সেইভাবে বেদনায় আপ্লুত তাদের অতৃপ্ত অন্তর ছলছল করতে লাগল, আর তাদের চোখে স্থান করে নিল স্তব্ধ, বঞ্চিত, মর্মাহত স্বীয় স্ত্রীদের করুণ মুখগুলো; তাই হয়তো ভাবছে স্বগৃহে ফিরে গিয়ে তার অবহেলিত স্ত্রীকে তর্জনগর্জন করবে কিনা; এই ভাবনায়ই তারা দ্রুত সিঁড়ি ভাঙতে থাকে, পায়ে যেন অসীম শক্তি, খরতর বেগে সেই শক্তি বয়ে চলে তাদের রক্ত ও পেশিতে; আর তাদের মনের মধ্যে জীবন্ত হয়ে ভেসে বেড়াতে থাকে নগরের শেষ সীমানায় অবস্থিত শ্মশানঘাটের চিত্রটি, শ্মশানঘাটের জলপ্রবাহে আত্মগোপন করে রয়েছে শুধুই মানুষপোড়া গন্ধ। জলসাঘরে তখনও ভেসে বেড়াচ্ছে আগরের গন্ধ, এই গন্ধঘেরা পরিবেশে আফসারের উদ্দেশে রমণীটি বলল, আগামী সন্ধ্যায় আপনার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এলে খুশি হবো, আসবেন তো, কেমন?

অবশ্যই।

জলসাঘরের বাইরে এসে আফসার বলল, দেখলে তো তোকে সুন্দরীর কেমন মনে ধরেছে!

তোর ঈর্ষা হচ্ছে বুঝি!

তা হবে কেন?

তোকে নিয়ে সবসময়ই গর্ব করি। যাক, এখন বাসায় চল?

না, এখন না। আগামীকাল ছুটি আছে। ব্রেকফাস্ট শেষ করেই তোর বাসায় আসব।

তোর অপেক্ষায় থাকব।

আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। তোর যেখানে প্রয়োজন চলে যাস। রানির জন্যও তোকে ভাবতে হবে না।

কেন?

ইতিমধ্যে আমাদের মধ্যে একটি স্প্যাশিয়েল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

খুশির কথা। তোর প্রতি আমার অগাধ আস্থা রয়েছে।

আমার প্রতি আস্থা অগাধ থাকা ভালো, তবে বন্ধু, সেইসঙ্গে আরেকটি কথাও অস্পষ্ট থাকে না।

কোন কথা?

রানির প্রতি তোর আকর্ষণ হ্রাস পেয়েছে।

সেজন্য কি আমি একা দায়ী!

না, তোকে বা রানিকে একা দায়ী করছি না, কেবল সত্যটি বললাম।

এতে লাভ?

সত্যকে যদি উপলব্ধি করি, তাহলে অসত্যকে বর্জন করতে সক্ষম হবো।

.

তীক্ষ্ণ ও ধাতব একটি শব্দ অনেকক্ষণ ধরে রানির কানে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। একটু সময়ের জন্য থামলেও আবার শুরু হতে সময় নেয়নি; কিন্তু কীসের শব্দ, ঠিক বোঝে উঠতে পারছে না। একটানা চলা শব্দটি যেন সবকিছুকে আড়াল করে দিচ্ছে। দূরপথে আসা-যাওয়া মোটরযানের বিকট হর্ণ বা বিমানবাহিনীর সেনানিবাসের অন্যকোনও যান্ত্রিক বিরক্তিকর আওয়াজও পারছে না এই শব্দটিকে হার মানাতে। শব্দটিকে কানে-মগজে ধারণ করে, দেয়াল ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে, রানি ভেবে চলেছে, অনেকক্ষণ ধরেই তো চলছে, এর অবসানই-বা কখন ঘটবে। সে ঠিকমতো আন্দাজ করতে পারছে না এই অত্যাচার কতক্ষণ ধরে চলছে, মনে হয়, আফসার বাজারে যাওয়ার আগেই শুরু হয়েছিল। ঘড়ির কাঁটাও ঠিক সন্ধান দিতে পারছে না কখন শুরু হয়েছিল, কিন্তু কাঁটাগুলো ঠিকই এগিয়ে চলেছে নিজমনে। এতক্ষণ ধরে তো আমি একটি নির্দিষ্ট চিন্তা নিয়েই ভেবে চলেছি, তাই ঘড়ির কাঁটার দিকে চোখ পড়েনি; এই ভাবনার সমস্ত জমি জুড়েই তো আমার স্বামী, তার বন্ধু, আর আমার ফেলে আসা স্মৃতির ওপর নির্ভর করা জীবনটি। তিনটি বিন্দুকে কেন্দ্র করে সংযোজকরেখা টানলে যে ত্রিভুজ সৃষ্টি হয় তার মধ্যমণি আমিই। আফসারের বাজারে যাওয়া আর বাজার থেকে ফিরে আসার এই সময়টুকুই নিজের মতো করে ব্যয় করতে পারি। আফসার বাজার থেকে ফিরে এলে, অনিচ্ছা থাকলেও আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে রান্নাবান্না। আমার চিন্তা রান্নাবান্না নিয়ে নয়। আমার সমস্যা খুব অপরিচিতও নয়। এর আগে এরকম সমস্যা হয়তো কেউ কেউ পেরিয়েও এসেছে। রানি পরদার ফাঁকে বাইরে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে তার সমস্যার সন্ধান করতে থাকে। বাইরটা একরকম ফাঁকা, যাদের বাজারে যাওয়ার কথা ছিল তারা চলে গেছে, গিন্নীরা হয়তো ইচ্ছেমতো নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে রানি নিজেকে নিঃসঙ্গ ভাবছে; অন্যদিন এমনটি হয় না, পরিবেশ এত ফাঁকাও থাকে না, ছেলেও অসময়ে ঘুমোয় না; এই নিঃসঙ্গ পরিবেশে তার অন্তরে একটি কথাই বারবার আঘাত করছে, কায়সারকে কেন সেদিন স্বামী সম্বন্ধে এত কথা বলতে গেল, যা একেবারেই তার উচিত হয়নি; খবরটি মুখরোচক, আর এই অবস্থায় যা হয়, নিজের জানা ঘটনাটি অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে না পারলে স্বস্তি পাওয়া যায় না; তবে অজানাকে জানার কৌতূহল যেমন তীব্র তেমনই ঘটনাকে রটনা করার প্রবণতাও পুরুষের বেলায় থাকে, হোক-না তা বন্ধুকে ঘিরে; আবির্ভূত এই চিন্তা রানিকে উত্তেজিত করছে। বাস্তবে আফসার তার কাছে সমস্যা নয়, কায়সারই যেন। স্বামীর বন্ধুকে নিয়ে যখন রানি ভাবছে তখনই সকালের নাস্তা শেষ করে কায়সার এসে হাজির হলো। রানি চমকে উঠল। চিন্তাটিকে মাটিচাপা দিয়ে তাড়াতাড়ি বলল, আপনার বন্ধু বাজারে গেছে। এখনই ফিরবে বোধ হয়!

কায়সারের মনে হলো আফসার ইচ্ছে করেই বাজার থেকে ফেরতে দেরি করছে। রানির সঙ্গে তার একান্ত কিছু কথা আছে, সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে সে কার্পণ্য করল না, বলল, গত সন্ধ্যায় আমি দেখেছি, সাত নম্বরের নারীটি বিনা কষ্টে দশটি পুরুষকে সেবাদাসে পরিণত করতে। তুমি তো তার চেয়ে অনেক সুন্দরী! একজন পুরুষকে বশে রাখতে পারছ না, এ কেমন কথা! তোমাকে আত্মবিশ্বাসে বলবতী হয়ে, নিজের দুর্বলতা দূর করে স্বামীকে জয় করতেই হবে।

রানির মিনতিভরা কণ্ঠ, কীভাবে! কী করতে হবে, আমাকে বলে দিন।

তোমাকে এখন থেকে সৌন্দর্যচর্চা করতে হবে। নিজেকে সৌন্দর্যচর্চায় সুন্দর করে বিদ্যুচ্চমকাতে হবে।

সন্তানের মা হয়ে সেজেগোজে থাকলে লোকে কী বলবে!

লোকে কী বলে তাতে তোমার কি? লোকের কথায় কিচ্ছু যায়-আসে না, আর যদি কেউ কিছু বলে তাহলে বলবে — মেয়েটি বড্ড সুন্দরী।

আমি এতশত বুঝি না। আমাকে কী করতে হবে তা সহজ ভাষায় বলে দিন!

ঠিক আছে। শোনো, আফসার বাড়ি ফিরে আসার আগেই তুমি ভালো শাড়ি পরে নেবে, সুগন্ধি আতর লাগাবে, ভালোভাবে চুল আঁচড়াবে, মুখে পাউডারের প্রলেপ দেবে, তারপর অলংকার পরে তার অপেক্ষা করবে। তোমার জন্য এসব করা অসম্ভব নয়, কল্পনাও নয়। সত্য ও স্পষ্ট বাস্তবতার প্রমাণ পাবে তখনই যখন সে বাড়ি ফিরে তোমাকে হাসিমুখে গ্রহণ করবে।

সে করবে? ও তো আমার দিকে ফিরেই তাকায় না।

কে বলেছে তাকায় না! তুমি একজন সুন্দরী নারী, একথা তোমার শত্রুও অস্বীকার করতে পারে না। করাচি জুড়ে তোমার মতো আকর্ষণীয় কত বাঙালি নারী আছে? শোনো, তোমার পরাজিত মনোভাব অবিলম্বে পরিত্যাগ করতে হবে। তুমি সুশ্রী হয়েও কি এমন বুদ্ধিহীনা হবে যে, অন্য-একটি নারীর কাছে সহজে হেরে যাবে! না, যাবে না। আমি তা হতে দিতে পারি না। তোমার সমস্ত বিদ্যাবুদ্ধি কাজে লাগাতে হবে। জয়ী হওয়ার জন্য উপযুক্ত সাজসজ্জায় তুমি যদি কোনও সুফিসন্ন্যাসীর সামনে গিয়ে দাঁড়াও তাহলে তার ধ্যানও ভেঙে যাবে। এই করাচিতে এমন কোনও পুরুষ নেই, যে তোমার চলনভঙ্গি দেখার জন্য পেছন ফিরে তাকাবে না, আফসার তো কোন ছার!

আফসার ফিরে আসায় তাদের কথা আর এগুলো না। সে কায়সারকে দেখে জিজ্ঞেস করল, কতক্ষণ হয়েছে এসেছিস?

স্মিতমুখে জবাব দিলো কায়সার, এই তো একটু আগে।

তাহলে চা খাওয়া হয়নি। চল চা খাওয়া যাক।

কথাগুলো সজোরে উচ্চারিত হলো যাতে রানি শুনতে পায়। সেই মুহূর্তে রানি তার স্বামীর হাত থেকে বাজারের ব্যাগটি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল। রানি জানাল, চিনি নেই।

বাজারে যাওয়ার সময় বলোনি কেন? বিরক্তসিক্ত কথা, তবুও বন্ধুর খাতিরে চিনির জন্য বেরিয়ে পড়ল আফসার।

কায়সার তার বন্ধু বেরিয়ে যাওয়ার পর রানিকে বলল, দেখো, আমি জানি তুমি তোমার স্বামীকে ভালোবাসো, কিন্তু তোমাকে এও স্মরণ রাখতে হবে যে, অন্তরের ভালোবাসাকে প্রতিটি কথায়, ব্যবহারে ও কাজে প্রকাশ করতে হয়। প্রীতি অর্জন করার জন্য অন্তরের গোপন বাসনাগুলো ফুটিয়ে তুলতে হয়। তার অভাবই দাম্পত্যকলহের মূল কারণ, আমি তা বিশ্বাস করি। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কলহ, মানাভিমান হতেই পারে, যা মিলনখেলার অঙ্গ, কিন্তু মিছে তর্কে কোনও লাভ হয় না, বরং অনুচিতই। তার চেয়ে নিজের ব্যবহার সুন্দর করে তোলাই উত্তম।

কীভাবে?

যেমন বাজারের ব্যাগটি আফসারের হাত থেকে নিতে নিতে তার চোখে চোখ রেখে মুচকি হেসে বলতে পারতে — বাহ্! ভালো বাজার এনেছ, সবজিগুলো বেশ তরতাজা ইত্যাদি, ইত্যাদি।

অবুঝ মেয়ের মতো প্রশ্ন করল রানি, কেন?

এরকম কথায় আফসারের মনকে প্রসন্নোৎফুল করত। সুযোগ হাতছাড়া করলে দোষ কাকে দেবে? এখন থেকে সর্বরকম সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। বাজার থেকে কী কী জিনিশ আনতে হবে তার তালিকা তৈরি করে দেবে। বাজার থেকে ফিরে এলে এ-নেই, সে-নেই বলা চলবে না। ঠিক তেমনই পরিবেশকে মলিন করে রাখাও উচিত হবে না। আবর্জনা মুক্ত পরিচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরি করা সকলেরই কর্তব্য।

চিনি নিয়ে আফসার ফিরে এসে জানাল, এক বাঙালি ও এক পাঞ্জাবির মধ্যে মারামারি, কিলঘুষি খুব হয়েছে। দুজনই বিমানসৈনিক, তবুও সিভিলিয়ান পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে।

বাংলার ভবিষ্যৎ যে বাঙালির স্বাধীনতার ওপর নির্ভরশীল — এই চেতনায় কায়সারের হৃদয়াকাশের অনেকাংশে কালোমেঘের ভেতর দিয়েও সূর্যালো যেন প্রকাশিত ও প্রসারিত হলো। হঠাৎ আফসারের শাদাকালো বিড়ালটি একটি ধূসরবর্ণের ইঁদুরকে মুখে নিয়ে ছাদ থেকে লাফিয়ে তাদের সামনে এসে পড়ল। কায়সার বলল, আমরা যদি সচেতন না হই তাহলে দেখবি বাঙালির অবস্থা হবে এই বিড়ালের মুখের ইঁদুরের মতো।

আফসার বলল, বাঙালির অবস্থা ইঁদুরের মতো হোক-বা-না-হোক আমার বাসায় কিন্তু ইঁদুর ও মাকড়সার অভাব নেই।

আফসারের কথায় তিক্ততা প্রকাশ পেলেও কায়সার নিরুত্তর, আর রানি জানালার ফাঁকে তীক্ষ্ণ ও ধাতব শব্দটির সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে উঠল। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে অনুমান করল, বিমানবাহিনীর সেনানিবাসের একপাশে যে সর্বগ্রাসী কংক্রিটের আরেকটি নতুন দালান উঠছে, শব্দের উৎস সেখানেই, এক নাগাড়ে ওয়েল্ডিং বা এই ধরনের কিছু চলছে; আর এসব নতুন নতুন গজিয়ে ওঠা সর্বগ্রাসী কংক্রিটের বাড়িঘরের জন্য এই শান্ত প্রান্তরটি দিন দিন বদলে যাচ্ছে, এরই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে এই অঞ্চলের অধিবাসীদের পরিচয়টুকুও। আবির্ভাব ঘটছে পাঞ্জাবি, গুজরাতি, পুস্তির; বৃদ্ধি পাচ্ছে গাড়ির, জ্যামের, দূষণের; একইসঙ্গে সুন্দরীর ও অন্যের স্বামীকে ভাগিয়ে নেওয়ার রংবেরঙের ভিন্ন পন্থা।

[লেখক পরিচিতি : জন্ম : ১ মার্চ ১৯২৯। মুকিমপুর, নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ।  মৃত্যু : ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬। মুক্ত স্কাউট ভবন, হবিগঞ্জ। ১৯৪৭। আউশকান্দি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু। ১৯৪৯। আউশকান্দি হাইস্কুলে শিক্ষকতার সময় পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগদান। তারপর সপরিবারে পাকিস্তানে বসবাস শুরু। ১৯৬১। বিমানবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ এবং সপরিবারে পূর্ব-বাংলায় প্রত্যাবর্তন। ১৯৬২। ব্রিটিশ সরকারের মিনিস্ট্রি-অফ-অ্যাভিয়েশনের গবেষণাকেন্দ্রে চাকরি গ্রহণ। ১৯৬৬—১৯৭১। ক্রমাগত পেশা বদল —  ম্যানেজার, ইলেকট্রিকমিস্ত্রি, ফিটার ইত্যাদি। ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধের একজন সক্রিয় সংগঠক। ১৯৭২। সিভিল সার্ভিসে যোগদান। ১৯৮৯। অবসর গ্রহণ এবং স্ত্রী সমেত বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন। সংগ্রাম-উন্মুখর বিচিত্র জীবনধারা থেকে সংগৃহিত হয় তাঁর অভিজ্ঞতা। দারিদ্র্যের প্রচণ্ড চাপ আর সামাজিক বিষমতা ও পীড়নে লেখালেখিতে প্ররোচিত। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬।  সকাল। ১১.৪০। তাঁর প্রিয় সংগঠন হবিগঞ্জ সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত হবিগঞ্জ মুক্ত স্কাউট ভবনে মহান একুশ স্মরণে আয়োজিত আলোচনা মঞ্চে বাংলা ভাষার পক্ষে উত্তেজিতমূলক বক্তৃতারত অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু জীবনের শাশ্বত সত্য জেনে তাকে গ্রহণ করেন। প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত অসংখ্য উপন্যাস, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ, গবেষণা সমেত রউফসৃষ্টিনিদর্শন বাংলাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী আগামী দিনেও বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃজনকর্মের গৌরবে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *