৩.১ বিদ্রোহ

পর্ব ৩ জাসদ

বিদ্রোহ

সিরাজুল আলম খান আরও অনেকের মতো ভেবেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরীক্ষিত নেতারা বেরিয়ে আসবেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি তার ভালোবাসা, আস্থা, আনুগত্য ও পক্ষপাত ছিল। আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের তিনি আমলে নিতেন না। যুদ্ধের সময় তাঁদের অনেকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি আমাকে খোলামেলাভাবে কিছু কথা বলেছেন :

জামায়াতে ইসলামী তো পাকিস্তানি ফোর্স। তারা পাকিস্তান রাখতে চেয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ কী চেয়েছে? ইলেকশন পর্যন্ত তো এক রকম ছিল। যখন এটা সশস্ত্র যুদ্ধের দিকে টার্ন নিল, দে অপোজড ইট। তখন তো মিয়াভাইদের অবস্থা এমন হয়েছে–যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। যে ফোর্স বের হবে, তখন তো আমরা নাই।’ এসব নিয়ে আমাদের সঙ্গে তো তাদের কথাবার্তা হয়েছে। কোনো কারণ নেই, তবু বলি, কোনো কারণে যুদ্ধ যদি আরও এক বছর চলে, তাহলে ওরা তো বাদ পড়ে যায়। রিয়েল ফাইটিং ফোর্স চলে আসত সামনে। এটা ইন্ডিয়ান গভমেন্টও বুঝত। তারাও চাইত, যে করেই হোক ওই শক্তিটা যেন গ্রো না করে। দেশ তো স্বাধীন হয়ে গেল। এখন তো বলা যাবে না স্বাধীন হোয়ো না। সাড়ে আট মাসের বাচ্চা। বলা যাবে না যে এই বাচ্চা চাই না। ইট নিডস নার্সিং। [১]

সিরাজুল আলম খানের কথা হলো, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শুরুটা ভালো হয়নি। যেভাবে এটি গড়ে তোলা দরকার ছিল, তা হয়নি। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে এ জন্য তৈরি ছিল না। এ যেন পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা। হঠাৎ পেয়ে যাওয়া এক বিশাল সম্পদ, যার ব্যবহার তারা জানেন না। এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এলেন।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতি। ১১ জানুয়ারি তিনি ‘বাংলাদেশ অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। এই আদেশে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে বিজয়ী এবং আইনের দ্বারা অন্য কোনো দিক দিয়ে অযোগ্য বিবেচিত নন, এমন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গণপরিষদ গঠনের কথা বলা হয়। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারব্যবস্থার কথা বলা হলো। ১২ জানুয়ারি শেখ। মুজিব রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ পান। একই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সিরাজুল আলম খান মনে করতেন, বঙ্গবন্ধুর নামেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতা ছিলেন তাজউদ্দীন। তিনিই হলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ক্যাজুয়ালটি। [২]

প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে তাজউদ্দীনের বাদ পড়া কি অনিবার্য ছিল, নাকি এর পেছনে অন্য কিছু কাজ করেছে? এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। বিশিষ্ট লেখক কামরুদ্দীন আহমদ এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এতে মনে হয় সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ মুজিবের কোনো বিকল্প ছিল না।

ঢাকায় যেদিন মুজিব ফিরে এলেন, সেদিন তাঁর প্রথম কর্তব্যকাজ মনে হলো ড. কামাল হোসেনকে বাংলাদেশের বিরোধিতার অভিযোগ ও মুক্তিবাহিনীর সন্দেহ থেকে মুক্ত করা, যা তিনি প্রথম দিনকার জনসভায় বিচক্ষণতার সঙ্গেই করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারপর সারা দিন ধরে হাজার হাজার লোকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার চলল। পরের দিনই তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে তাঁর নিকট নানা অভিযোগ আসতে আরম্ভ করল। বিশেষ করে তার ভাগনে ফজলুল হক মনি ও দলের অন্যদের পক্ষ থেকে। সব কথায় কান না দিলেও তাজউদ্দীনের নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে সরকার গঠন করা তাঁর মনঃপূত হয়নি। খন্দকার মোশতাক আহমদ আওয়ামী লীগে সবার চেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তার দাবি কেন বিবেচনা করা হয়নি, তা শেখের পক্ষে বোধগম্য হলো না। তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৫৩ সালে। নজরুল ইসলাম তার চেয়ে পুরোনো। মনসুর আলী একমাত্র সংসদ সদস্য, যিনি ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী না করে নিজে প্রধানমন্ত্রী হওয়া শেখ সাহেবের খুব ভালো লাগেনি।

তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে তাঁর মন্ত্রিসভার সবারই নালিশ ছিল। খন্দকার মোশতাকের নালিশ ছিল যে তাজউদ্দীন বরাবরই সমাজতন্ত্রবাদী–সংসদীয় গণতন্ত্রে তার আস্থা খুবই কম। অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগ সংগঠনে তিনি ছিলেন পুরোপুরি আবুল হাশিম সাহেবের দলের লোক। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রতি তাঁর কোনো আনুগত্য ছিল না। অন্যদিকে তাজউদ্দীনের দাবি ছিল যে যদিও তিনি ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছিলেন, কিন্তু অন্য সব প্রতিদ্বন্দ্বীর মতো পার্টির প্রতি তাঁর আনুগত্য নড়বড়ে ছিল না। ১৯৫৪ সালে খন্দকার মোশতাক চিফ হুইপ পদের জন্য আবু হোসেন। সরকারের দলে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে মনসুর আলী সাহেব দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে পড়েন এবং সেই মামলা উঠিয়ে না নিলে মামলায় তার মুক্তি পাওয়া শক্ত ছিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনের সময় নিজেকে আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন–ওই কাজটা আওয়ামী লীগের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রমাণ করে না। সুতরাং ওই সব নেতার সঙ্গে তার তুলনা করা তাকে অপমান করারই শামিল।

শেখ মুজিব সব দিক বিবেচনা করে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে তিনি নিজেই হবেন প্রধানমন্ত্রী ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী হবেন রাষ্ট্রপতি। খন্দকার মোশতাক, মনসুর আলী, তাজউদ্দীন ও অন্যরা তার মন্ত্রিসভার সদস্য হবেন, যাতে তাদের একে অন্যের প্রতি ঈর্ষা বা দ্বন্দ্ব না থাকে। [৩]

.

১৯৬০-এর দশকে সিরাজুল আলম খান যে চক্র বা সেল তৈরি করেছিলেন, যেটাকে তিনি পরে ‘নিউক্লিয়াস’ নামে প্রচার করেছেন, তা ছিল একটি রাজনৈতিক দলের জ্বণ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই জ্বণটি আকারে ও প্রকারে বাড়তে থাকে। যেভাবেই হোক, তিনি একদল তরুণকে সঙ্গে পেয়েছিলেন, যাদের আন্তরিকতা ও আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। এটি তাঁকে শক্তি জুগিয়েছিল। তিনি ভাবলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে তিনি দর কষাকষির স্তরে পৌঁছে গেছেন। তিনি তলিয়ে দেখেননি বঙ্গবন্ধু তাঁকে কী চোখে দেখতে অভ্যস্ত। বঙ্গবন্ধুর কাছে তিনি একজন কর্মী। কর্মঠ, অনুগত, আস্থাভাজন শিষ্য। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল ম্যান্ডেটের বলে শেখ মুজিব যে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থেকে একজন রাজনীতিবিদের পক্ষে এ ধরনের অর্জন পৃথিবীতে বিরল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও দেশ তাঁর হাতে সমর্পিত হয়েছে। তিনি এখন অনেক উঁচুতে, একেবারেই শিখরে। সিরাজুল আলম খানকে তিনি তখনো একজন। কর্মী মনে করেন।

সিরাজুল আলম খান ভেবেছিলেন, শেখ মুজিব জাতির পিতা। তিনি দল এবং সরকারের প্রধান হবেন না। বাইরে থেকে তিনি নির্দেশনা দেবেন, নৈতিক শক্তি জোগাবেন। দেশটি কীভাবে পরিচালিত হবে, এ বিষয়ে সিরাজ পয়েন্ট আকারে দফাওয়ারি কিছু সুপারিশ তৈরি করলেন। তাঁর অন্যতম শিষ্য ছিলেন। মনিরুল ইসলাম, যিনি একাত্তরে তার সেক্টরে মুজিববাহিনীর উপ-অধিনায়ক ছিলেন। মনিরুল ইসলাম পরে একটি বই লিখেছেন, যেখানে শেখ মুজিবকে দেওয়া সিরাজুল আলম খানের চার দফা সুপারিশের কথা উল্লেখ আছে। এ নিয়ে আমি একদিন কথা বললাম সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে :

মহিউদ্দিন আহমদ : মনিরুল ইসলামের বইতে আপনার দেওয়া চার দফার কথা আছে। এটাই কি সব?

সিরাজুল আলম খান : চার দফা কেন হবে? দফা তো ছিল ১৫টা। গণকণ্ঠএ তো ছাপা হয়েছিল–পড়ো নাই?

মহি: পড়েছি। ওটা তো ছাপা হয়েছিল। আপনারা জাতীয় সরকারের কথা বলেছিলেন।

সিরাজ : হ্যাঁ, আরও অনেক কিছুই বলেছিলাম। কাগজ-কলম আনো, লিখে নাও।

আমি কাগজ-কলম নিয়ে বসলাম। তিনি পয়েন্টগুলো বললেন, আমি টুকে নিলাম। তারপর সেগুলো সাজিয়ে-গুছিয়ে দাঁড় করালাম ১৫ দফা। তাঁকে খসড়াটি দেখালাম। তিনি অল্প পরিমার্জন করলেন। আমি এটি আমার লেখা ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ বইয়ে উদ্ধৃত করেছি। পরে অবশ্য তিনি আমার বইয়ের ওই অংশটুকু হুবহু তুলে নিয়ে একটি চটি বই বের করেছেন। নাম দিয়েছেন ‘সিরাজুল আলম খানের ১৫ দফা’। কিন্তু ওই দফাগুলোর কী হলো? এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার কথোপকথন ছিল এ রকম :

মহি: আপনি কি ১৫ দফা লিখিত আকারে বঙ্গবন্ধুকে দিলেন?

সিরাজ : আমি যখন তাঁর কাছে গেলাম, তিনি বললেন, এটা তোফায়েলকে দাও। তোফায়েল তখন তাঁর পলিটিক্যাল সেক্রেটারি। আমি কী করে তোফায়েলকে দিই? এটা তো আমার জন্য বিব্রতকর। আমি তার হাতেই দিতে চাইলাম। আমি চেয়েছিলাম, তিনি এটা পড়ে দেখবেন, আলোচনা করবেন।

মহি : তারপর কী হলো?

সিরাজ : তিনি এটা নিলেন, তারপর ড্রয়ারে রেখে দিলেন। ওখান থেকে ওটা সম্ভবত আর বের হয়নি। [৪]

কী ছিল ওই ১৫ দফায়? বাহাত্তরের ২৫ মে ডাকসুর সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ এবং ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নামে একটি বিবৃতি প্রচার করা হয়েছিল। সিরাজুল আলম খানের দেওয়া প্রস্তাবগুলোর ভিত্তিতেই এই বিবৃতি তৈরি হয়েছিল। বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের পরিস্থিতি খুবই জটিল এবং কেবল বঙ্গবন্ধুই দেশকে নৈরাজ্যের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। বিবৃতিতে উল্লেখ করা দাবিগুলোর মধ্যে ছিল :

১. জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সকল ক্ষমতার উৎস বলে ঘোষণা করতে হবে।

২. বর্তমান মন্ত্রিসভা ও গণপরিষদ বাতিল করে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বোত্তম সদস্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করতে হবে।

৩. বিপ্লবী সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে পূর্ণ সমাজতান্ত্রিক নীতিসমূহ সন্নিবিষ্ট করে অন্তর্বর্তীকালীন একটি খসড়া সংবিধান তৈরি করতে হবে।

৪. গণ-আদালতে দুর্নীতিপরায়ণ গণপরিষদ সদস্যদের প্রকাশ্য বিচার করতে হবে।

৫. পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দালাল, রাজাকার, আলবদর, চোরাচালানি, কালোবাজারি ও সশস্ত্র দুষ্কৃতকারীদের প্রকাশ্যে গুলি করে মারতে হবে।

৬. অসৎ ব্যবসায়ী এবং নৈরাজ্যপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে সাহায্য করার পূর্ণ ক্ষমতা ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী, লাল বাহিনী ও আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে দিতে হবে।

৭. সব রাজনৈতিক নেতা ও উচ্চপদস্থ আমলার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও ব্যাংকে রক্ষিত অর্থের পরিমাণ জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করতে হবে। [৫]

বাহাত্তরের জানুয়ারিতে জাতীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল লাল বাহিনী। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নাম ১৯৭০ সাল থেকেই শোনা গেছে। এর প্রধান ছিলেন আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা আবদুর রাজ্জাক। দুজনই একসময় সিরাজুল আলম খানের আস্থাভাজন ছিলেন। কিন্তু এই বিবৃতি তৈরি করল অ্যান্টি-ক্লাইমেক্স। একই তারিখে (২৫ মে) জাতীয় শ্রমিক লীগের তিন নেতা-মো. শাহজাহান, আবদুল মান্নান ও রুহুল আমিন ভূঁইয়া একটি যৌথ বিবৃতিতে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা, মন্ত্রিপরিষদ ও গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী সরকার গঠনের দাবি জানালেও পরে আবদুল মান্নান বিবৃতি থেকে তার নাম প্রত্যাহার করে নেন। [৬]

বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। ২৬ মে আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কোরবান আলী, সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান এবং সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক এক বিবৃতিতে ‘প্রতিক্রিয়াশীল ও অতিবিপ্লবীদের মোকাবিলা করার জন্য’ জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। [৭]

ব্যাপারটি বেশ গোলমেলে। একদিকে সিরাজুল আলম খান ও তাঁর অনুসারীরা চাচ্ছেন ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ কায়েম করতে, অন্যদিকে তারা দেশে ‘নৈরাজ্যপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টিকারীদের’ বিরুদ্ধে ‘লাল বাহিনী’ এবং ‘আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’কে আরও ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন। আবার ‘লাল বাহিনী’ এবং ‘স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’র নেতারা সিরাজুল আলম খানদের উল্টো ‘দুষ্কৃতকারী’ বলেছেন। তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, তাঁরা এক ছাদের তলায় আর কখনোই আসবেন না। মজার ব্যাপার হলো, উভয় গ্রুপই বঙ্গবন্ধুর ওপর আস্থাশীল এবং তাঁকেই নেতা মানেন। শেখ মুজিব তখন পর্যন্ত তার নিরপেক্ষ অবস্থানটি বজায় রেখেছেন।

নানা কারণে ওই সময়ে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল। তার মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে কী কথা হয়েছিল সিরাজুল আলম খানের? এ প্রসঙ্গে তিনি আমাকে যা বলেছেন, তা এখানে তুলে ধরছি।

মুজিব ভাই আমাকে বললেন, ‘আমি তো কমিউনিস্ট হতে পারব না। এ দেশটা সোনার দেশ হতো। ১৫ দফাতে যা আছে, তিনটা বছর যদি এভাবে চালানো যেত, থিংস উড হ্যাভ বিন ডিফারেন্ট।

নিউমার্কেটে যত অবাঙালি ছিল, সবাই তো চলে গেছে। যারা বাঙালি ছিল, তাদের নিয়ে একটা কো-অপারেটিভ করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে চলছে। একদিন দুপুরে এস এম হলে খেতে বসেছি। হঠাৎ নিউমার্কেটের জহির এসে হাজির। বলল, মন্ত্রী এম আর সিদ্দিকী তো সব প্রাইভেটে দিয়া দিছে।’

মুজিব ভাইয়ের বাসায় চলে গেলাম। উনি মাত্র খাওয়া শেষ করে একটু শুয়েছেন।

মুজিব ভাই, আপনি বলেছিলেন কো-অপারেটিভের মাধ্যমে সবকিছু ডেভেলপ করা হবে।

হ্যাঁ হ্যাঁ, কী হয়েছে?

জহির, তুমি বলো।

স্যার, আজকে তো এখানে মিনিস্টারের মিটিং ছিল। উনি বলতেছেন, এগুলি আমরা প্রাইভেটে দিয়ে দিচ্ছি। আপনারা কেউ যদি নিতে চান, কিনে নিতে পারেন। এই কথাটা আপনাকে জানানো দরকার বলে মনে করতেছি।

মুজিব ভাই সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। টেলিফোনে বললেন, “সিদ্দিকী সাহেব, এটা কী? এটা তো সিদ্ধান্ত না। এটা তো কো অপারেটিভ হবে। প্রাইভেট ওনারশিপ হবে না। আমাদের বললেন, ‘তোরা যা। যা করার আমি করছি।’

পরদিন বা তার পরদিন এম আর সিদ্দিকী আমার সঙ্গে যেভাবে কথা বলল, “সিরাজ সাহেব, আপনাদের এগুলো হবে না। শেখ সাহেবের মাথায় ভর করে তো লাভ নেই। এভাবে ইন্ডাস্ট্রি-বিজনেস চলবে না। কো-অপারেটিভ দিয়ে কোথাও কিছু হয়েছে, শুনেছেন? প্রাইভেট ওনারশিপে দেন। দেখবেন, ভালো চলবে। আর কো-অপারেটিভে দিলে যার যার পকেট ভরবে। এটা করবেন না। আমি এটা পারব না।’

বিকেলবেলা নোটিশ দিয়ে সকালে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সাকুলার নিগেট করে দিচ্ছে। পরে মুজিব ভাইকে বললাম। বললেন, সব কি আমি দেখতে পারব রে?’ এ কথাতেই বোঝা যায় যে এটা তো উনি ব্যক্তিগত দেখার কথা বলছেন।

পারসোনালি হি ওয়াজ কেয়ারিং। [৮]

.

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সম্পর্কে সিরাজুল আলম খানের সম্পর্কটি এক দিনে বা একটি ঘটনায় নষ্ট হয়নি। তবে বোঝা যাচ্ছিল গুরুর সঙ্গে শিষ্যের ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে।

গণভবন ছিল প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন। তিনি থাকতেন ধানমন্ডিতে তাঁর নিজ বাড়িতে। গণভবনে তিনি অফিস করতেন। সারা দিন সেখানে নানা। ধরনের লোকের যাতায়াত হতো। গণভবন হয়ে উঠল ক্ষমতার কেন্দ্র। মধু থাকলেই মৌ-লোভীদের ভিড় জমে। তারা আসে নানা উদ্দেশ্যে। এ বিষয়ে। কামরুদ্দীন আহমদের ভাষ্য বেশ প্রাসঙ্গিক :

শেখ সাহেব সম্বন্ধে যা-ই বলা হোক না কেন, এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে তার সময় গণভবন একটা পুরোদস্তুর আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছিল। শেখ সাহেবকে সাহায্য করতে তাঁর পাশে যারা অবস্থান করত, তারা প্রত্যেকেই মনে করত যে তারা অজীবন গণভবনের অধিবাসীই থাকবে। নানা রকম নির্দেশ যেত ওই গণভবন থেকে। থানার দারোগা থেকে সচিবালয়ের কর্মকর্তারা পর্যন্ত সবাই তটস্থ থাকতেন গণভবনের নির্দেশের ভয়ে। তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহে এটা প্রায়ই দেখা গেছে যে স্বাধীনতার পরপরই নেতারা তাদের দলের লোকজন দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকেন। দলের লোকজনের জন্য। সেক্রেটারিয়েটে থাকে অবাধ যাতায়াতের অধিকার। ভারতে একসময় মাথায় খদ্দরের টুপি দেখলেই লোকে তাকে পারমিটশিকারি বা মাল পাচারকারী ভাবত। পাকিস্তান হওয়ার পর করাচিতে ওই অবস্থা কিছুটা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু জিন্নাহ সাহেব বা লিয়াকত আলী খান রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ছিলেন না, তাই সেক্রেটারিয়েটে ভিড়টা হতো ব্যবসায়ীদের। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মীরা যেহেতু নব্য ব্যবসায়ী হয়ে উঠল, তাই তাদের ব্যস্ত থাকতে হতো শেখ সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। মন্ত্রীদের ঘরে পারমিটশিকারিদের ভিড় লেগেই থাকত। ফলে মন্ত্রীদের পক্ষে কাজকর্ম করা ছিল সাধ্যের বাইরে। মন্ত্রীদের ঘরে চলত একে অন্যের ব্যাপারে কুৎসা রটনা। ফলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমে গেল এবং দুর্নীতি বৃদ্ধি পেতে লাগল। [৯]

সিরাজুল আলম খান নিজেই বলেছেন, কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী। ষাটের দশকে নানান কাজকর্মে পরামর্শের জন্য তিনি তাঁর কাছে। যেতেন। তাঁকে সবকিছু জানাতেন। ওই সময় দুই যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খান ক্ষমতার এক অদৃশ্য দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বিষয়টি কামরুদ্দীন আহমদের নজর এড়ায়নি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :

ছাত্রলীগের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সিরাজুল আলম খান ও শেখ মনি। দুজনার মধ্যে আদর্শগত ও সংগঠনগত মতানৈক্য ছিল আগেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় মতানৈক্য আরও বৃদ্ধি পায়। দুঃখের বিষয় যে শেখ মুজিবও এর মধ্যে জড়িয়ে পড়লেন।

১৯৭২ সালে তিনি আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটিতে এই দুই নেতার মধ্যে শেখ মনিকে মনোনয়ন দিলেন। এর পরপরই একই সঙ্গে যখন ছাত্রলীগ দুই জায়গায় সম্মেলন করছিল, তখন তিনি শেখ মনির সমর্থিত ছাত্রলীগ সম্মেলনে যোগ দিলেন। ফলত তিনি শেখ মনির দিকেই ঝুঁকে পড়লেন। সেই থেকে শেখ সাহেব ও সিরাজুল আলম খানের মধ্যে মতের আপস-নিষ্পত্তি হয়নি কোনো দিন।

মুক্তিযুদ্ধের পর আমার সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের বার তিনেক সাক্ষাৎ হয়েছে। শেখ সাহেব একবার বিদেশে চিকিৎসা করতে যাওয়ার পূর্বে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আপসরফা করার জন্য আলোচনায় বসেছিলেন। সিরাজুল আলম খান এসেছিলেন সেই আলোচনার বিবরণ আমাকে জানানোর জন্য। বাকি দুবার এসেছিলেন দেশের রাজনৈতিক অবস্থার ওপর তার নিজস্ব মতামতের বিশ্লেষণ জানাতে। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে ফিরে বেশ কয়েক মাস আমার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি। তখন শুনেছিলাম যে সিরাজুল আলম খান। জাতীয়তাবাদের আদর্শ ত্যাগ করে সন্ত্রাসবাদে দীক্ষিত হয়েছেন। আবার কেউ বলেছিল যে মুক্তিযুদ্ধের সময় তারিক আলীর সংস্পর্শে এসে তিনি ট্রটস্কিপন্থী হয়েছেন। [১০]

ছাত্রলীগের ‘মুজিববাদ’ ও ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ গ্রুপের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের পরপরই, বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি মাসে, যখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সভায় সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় কমিটিতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রপন্থীদের একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল। ওই সময় মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রলীগের কাছাকাছি আসার এবং ঐক্য গড়ে তোলার জন্য আগ্রহী হয়ে পড়ে। একদিকে ছাত্রলীগে ভাঙনের আওয়াজ, অন্যদিকে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়নের ‘এসো মোরা দেশ গড়ি’ স্লোগান ভিন্ন মাত্রা তৈরি করে।

বাহাত্তরের ৯ এপ্রিল ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুরু হয় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় সম্মেলন। সম্মেলন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। প্যান্ডেলের পাশে খোলা জায়গায় হার্ডবোর্ড দিয়ে দুটো ঢাউস সাইজের মিসাইল বানিয়ে প্রদর্শন করা হয়। একটা মিসাইলের গায়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং অন্যটাতে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের ছবি এঁকে রাখা হয়েছিল। এ ছাড়া শেখ মুজিবের একটা বড় এবং মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ ও মোজাফফর আহমদের অপেক্ষাকৃত ছোট প্রতিকৃতি রাখা হয়েছিল।

উদ্বোধনী ভাষণে শেখ মুজিব ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। সভাপতির ভাষণে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল ইসলাম ‘ছাত্রলীগ ও সংগ্রামী ছাত্রসমাজে’র প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আসুন, আমরা একই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ ও লড়াই করি। আমি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আমার সংগঠনের বিলুপ্তি ঘোষণা করতে রাজি আছি। আসুন আমরা একটি দলে সমাজতন্ত্রের পক্ষে দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে যাই।’[১১] নুরুল ইসলামের ঘোষণায় তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত ছিল। তিন বছর পর দুটি ছাত্রসংগঠন একীভূত হয়েছিল।

.

শেখ মনি ও সিরাজুল আলম খানকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের মধ্যে যে মেরুকরণ হচ্ছিল, তার প্রকাশ ঘটে ১৯৭২ সালের ৬ মে বটতলায় অনুষ্ঠিত আসন্ন ডাকসু নির্বাচন উপলক্ষে আয়োজিত একটি সভায়। ওই নির্বাচনে ছাত্রলীগের বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং ছাত্রলীগ দুটো আলাদা প্যানেল নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। তাদের মধ্যকার বিভক্তির সুযোগে ছাত্র ইউনিয়ন ডাকসু নির্বাচনে একটি ছাড়া সব কটি পদে জয় পায়। রোকেয়া হলের প্রতিনিধি হিসেবে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ গ্রুপের একমাত্র মমতাজ বেগম ডাকসুর সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

ছাত্রলীগ যে ভাঙছে, এটা যে আর জোড়া লাগবে না, বাহাত্তরের মে মাসেই তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তখনই শুরু হয়েছিল দুই গ্রুপে বহিষ্কার আর পাল্টা বহিষ্কার। একাত্তরের ডিসেম্বর থেকেই ছাত্রলীগের তরুণেরা ‘মুজিববাদ’ প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়ে আসছিল। সিরাজুল আলম খান এই স্লোগানের জন্মদাতা হলেও তাঁর অনুসারীরা পরে এটি বলা বন্ধ করে দেয় এবং সমালোচনা করে বলতে থাকে যে এ রকম একটি মতবাদ হতে পারে না।

বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, এ বছর জুলাই মাসের ২১, ২২, ২৩ তারিখ কাউন্সিল অধিবেশন হবে। উভয় গ্রুপই তারিখ ঠিক রেখে সম্মেলনের আয়োজন করেছিল–একই দিন দুই জায়গায়। দুটো প্যান্ডেলই তৈরি করেছিল হাজি মো, চান মিয়া ডেকোরেটরস।

২১, ২২ ও ২৩ জুলাই পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের সম্মেলনে সিরাজপন্থীরা সবাই জড়ো হন। দ্বিতীয় দিন শাজাহান সিরাজের নামে সাধারণ সম্পাদকের কার্যবিবরণী শিরোনামে ৪০ পৃষ্ঠার একটি ছাপানো পুস্তিকা বিলি করা হয়। হুটহাট করে তো কিছু ছাপানো যায় না। অনেক দিন ধরেই এটির খসড়া তৈরি হচ্ছিল। এই পুস্তিকায় ‘মুজিববাদ’ সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা ও মন্তব্য দেওয়া হয়, তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্য খুব স্বস্তিকর ছিল না। এটি লেখার সময় এই গ্রুপের প্রধান নেতা সিরাজুল আলম খান নিশ্চিত ছিলেন যে শেখ মুজিব তাঁদের সম্মেলন উদ্বোধন করতে পল্টন ময়দানে আসবেন না, তিনি তাঁদের সঙ্গে থাকবেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যদি নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতেন। এবং সবাই যদি তাঁর কাছ থেকে একটা মীমাংসা আশা করতেন, তাহলে শাজাহান সিরাজের রিপোর্টের ভাষা এত আক্রমণাত্মক হতো না। বঙ্গবন্ধুর। এই অবস্থানের কথা কি তিনি আগে থেকেই জানতেন? সাধারণ সম্পাদকের কার্যবিবরণীর ভাষা এই ইঙ্গিত দেয় :

জেলা শহরগুলো, এমনকি থানা ও গ্রামপর্যায়ে একদল রাজনৈতিক টাউট প্রকৃতির লোক রয়েছে, যারা আইয়ুব আমলে আইয়ুবভক্ত, ইয়াহিয়া আমলে ইয়াহিয়াভক্ত; বর্তমানে তারাই মুজিববাদের প্রধান। প্রবক্তা। আরও দেখবেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের যারা বর্তমানে। লাইসেন্স, পারমিট শিকার, অসৎ ব্যবসা ও চোরাকারবারিতে লিপ্ত এবং লুটপাট ও বাড়ি-গাড়ি দখল করছে, তারাই মুজিববাদের ভক্ত। তা ছাড়া বর্তমান সমাজের বিত্তবান শ্রেণি, বড় বড় আমলারা। মুজিববাদের সমর্থক সেজে নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত। অল্প দিন হলেও মাত্র দু-আড়াই মাসে বাংলাদেশে সকল শ্রেণির মানুষের মুখে একটি অতি সুন্দর কথা শোনা যায়, তা হলো রাতে লুটপাট, দিনে প্রতিবাদ, তারই নাম মুজিববাদ।’…।

ইতিহাসের পাতা ওলটালেই দেখা যায় যে এ পর্যন্ত যে কয়টি ‘বাদের সৃষ্টি হয়েছে, তা রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে ভিত্তি করে নয়, বরং কোনো একটি তত্ত্বকে কেন্দ্র করে বাদের সৃষ্টি। যেকোনো বাদের সৃষ্টির জন্য তত্ত্বের যে ভিত্তির প্রয়োজন, মুজিববাদে তা কোথায়? মুজিববাদীরা হয়তো বলবেন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাই হলো মুজিববাদের তত্ত্বগত ভিত্তি। আমাদের প্রশ্ন–গণতন্ত্র যেখানে ব্যক্তিসম্পদ মালিকানায় বিশ্বাসী, সেখানে। সমাজতন্ত্রের স্থান কোথায়? আমাদের প্রশ্ন, জাতীয়তাবাদ বলতে যেখানে বাঙালির বাঙালিত্ব বোঝায়, সেখানে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের জন্য কী ব্যবস্থা? আমাদের প্রশ্ন, সমাজতন্ত্রের বক্তব্য রয়েছে যেখানে, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজন আছে কি? আরও প্রশ্ন, যে ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয়েছে, সে ভারতেও কংগ্রেস বহু। পূর্ব থেকেই গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার বক্তব্য রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে কার্যকরী করছে, সে চার নীতি ‘নেহরুবাদ’, ইন্দিরাবাদ’ বা ‘কংগ্রেসবাদ’ না হয়ে ‘মুজিববাদ হয় কীভাবে? আমাদের প্রশ্ন, গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নাম ‘গণতান্ত্রিক সমাজবাদ’ না হয়ে মুজিববাদ হয় কীভাবে। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে ভারতে, চিলিতে, ইউরোপের বহু দেশে ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে। আমাদের। প্রশ্ন, সেসব দেশে গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকে যদি কোনো ব্যক্তিবাদ’ নাম না দেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশে কেন তা মুজিববাদ হবে?

এসব প্রশ্নের বিচারে আজ এ কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে মুজিববাদ পুঁজিবাদের নামান্তর মাত্র। মুজিববাদের মোড়কে। পুঁজিবাদকে আমরা এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে দিতে পারি না। কারণ, কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য বা কোনো ব্যক্তি বা দলকে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার জন্য ৩০ লাখ লোক প্রাণ দেয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি আনয়নের মধ্যেই ৩০ লাখ মানুষের রক্তদানের সার্থকতা। খুঁজে পাওয়া যাবে। [১২]

এ তো গেল তত্ত্বের কথা। শেখ মুজিব তখন অবিসংবাদী নেতা, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু। দেশের রাজনীতিতে শেখ মুজিবের কাল্ট’ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ার মূল হোতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তিনি হঠাৎ করেই শেখ মুজিবের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। শাজাহান সিরাজের পাঠ করা কার্যবিবরণীতে শেখ মুজিবের নাম উল্লেখ না করে তাঁকে ইঙ্গিত করেই বলা হলো :

এ দেশের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, এ দেশে কোনো দিনও কোনো রাজনৈতিক দল কোনো আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়নি। বরং ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালনার মাধ্যমে ছাত্রসমাজ থেকে গড়ে ওঠা রাজনীতিবিদেরা এবং রাজনৈতিক দলগুলো শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। আজকে যে শিশু, ভবিষ্যতে তিনিই পিতা, এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও তা আবার প্রমাণিত হবে। আরও একটি কথা অপ্রিয় সত্য হলেও বলতে হচ্ছে যে, এ দেশে কোনো রাজনৈতিক নেতা কোনো আন্দোলনের জন্ম বা নেতৃত্ব দেয়নি। বরং জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ‘নেতা’ সৃষ্টি হয়েছে। [১৩]

সম্মেলন প্রস্তুতি পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন ছাত্রলীগের সহসভাপতি মনিরুল ইসলাম (মার্শাল)। তিনি এটা নিশ্চিত করেছেন যে সাধারণ সম্পাদকের কার্যবিবরণীটি সিরাজুল আলম খানের লেখা। এই প্রতিবেদনে ভবিষ্যৎ রাজনীতি সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, ছাত্রলীগ লড়ছে ‘শ্রেণিসংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে সামাজিক বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। [১৪] সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী অন্য রাজনৈতিক দলগুলো থেকে যে তারা আলাদা, এর ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিবেদনে :

এবারে আসুন আমাদের দেশের মস্কোপন্থী’ ও ‘পিকিংপন্থী দলগুলোর রাজনৈতিক চিন্তাধারার সঙ্গে আমাদের পার্থক্য কোথায় তা বিচার করি। এখানকার মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থীরাও বহুদিন ধরে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা প্রচার করে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে তাদের এই প্রচারের ফলেও তাদের বক্তব্য বা তাদের দল সাধারণ মানুষের মনে কোনো আঁচড় কাটতে পারেনি। তা থেকেই বোঝা যায় যে তাদের বক্তব্য বা দলীয় দুর্বলতা কোথাও না কোথাও রয়েছে। তাদের এ দুর্বলতাকে কয়েক অংশে ভাগ করা যায়।

১. বক্তব্য উত্থাপনে তাদের সময়জ্ঞানের অভাব মারাত্মকভাবে দেখা যায়। সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিক সচেতন করে তোলার পূর্বেই তাদের অসময়োচিত বক্তব্য সাধারণ মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য হয় না।

২. রাজনীতিতে পর্যায়ক্রমিক রাজনৈতিক আন্দোলনের স্তরে তারা বিশ্বাসী নয়। সে জন্যই তাদের কেউ মনেপ্রাণে এ দেশের ভাষা। আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, শাসনতন্ত্র দাবির আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা তথা ১১ দফা তথা স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনে হয় বিরোধিতা করতে দেখা গেছে, নয় দেরিতে উপায়ান্তর না দেখে সমর্থন করতে হয়েছে।

৩. যেহেতু তাদের মূল উৎস রাশিয়া বা চীন, সেহেতু যে পর্যন্ত রাশিয়া বা চীন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে না এসেছে, সে পর্যন্ত তারা আন্দোলনকে পুরোপুরি সমর্থন করেনি।

৪. এ পর্যন্ত তারা কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারেনি বা রাজনৈতিক আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মস্কোপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিবর্তে লেজুড় হিসেবে কাজ করছে। এবং পিকিংপন্থী বিভিন্ন উপদল গণজাগরণ সৃষ্টি একেবারেই না করে গুপ্তহত্যা, রাজনৈতিক হত্যা ও অসংগঠিত বিক্ষিপ্তভাবে রাজনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছে।

৫. এরা জাতীয় রাজনীতিকে রাজনীতির মূল নিয়ামক শক্তি হিসেবে বিবেচনা না করে আন্তর্জাতিকতাবাদকে জাতীয় রাজনীতির মূল চাবিকাঠি মনে করে। [১৫]

ওপরের কথাগুলোতে অন্যান্য সমাজতন্ত্রী দলের বিরুদ্ধে ঢালাও মন্তব্য ছিল। ফলে তারা শুধু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেই থেমে থাকেনি, অন্যান্য বাম দলের কঠোর সমালোচনা করে আরেকটি ফ্রন্ট খুলল।

পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের সম্মেলন ছিল জমজমাট। কলকাতা থেকে কয়েকজন সংগীতশিল্পী নিয়ে আসা হয়েছিল। তাঁরা মাঝরাত পর্যন্ত গান শোনাতেন। দর্শক-শ্রোতার ভিড় উপচে পড়ত। একাধিকবার ছাত্রলীগের কাউন্সিল সভা আয়োজনের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সিরাজুল আলম খান এবারের সম্মেলন অনুষ্ঠানে কোনো খুঁত রাখেননি। দ্বিতীয় দিন সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট আলোচনার পর বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাবেক নেতা এবং মুসলিম লীগের র‍্যাডিক্যাল ধারার প্রতিভূ আবুল হাশিম অতিথি আলোচক হিসেবে ভাষণ দেন। এরপর স্থানীয় শিল্পীরা গান শোনান। তরুণ গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর ঘণ্টাখানেক ধরে সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতাকে তার একটি দীর্ঘ গানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। [১৬]

সম্মেলনের সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ গ্রুপের একটি মিছিল এ সময় পল্টনের পথ দিয়ে গুলিস্তানের দিকে যাচ্ছিল। একেবারে ঘরের কাছ দিয়ে শত্রুপক্ষের লোকেরা বীরদর্পে হেঁটে যাবে, এটি পল্টনে সমবেত ছাত্রলীগ কর্মীদের কাছে উসকানিমূলক মনে হলো। তাঁরা বেরিয়ে এলেন। প্রথমে একটু চেঁচামেচি, স্লোগান-পাল্টা স্লোগান, তারপর ধাক্কাধাক্কি। মিছিলের সামনে ছিলেন সিরাজুল আলম খানের নিউক্লিয়াসের একদা সদস্য আবদুর রাজ্জাক। তিনি কিছু কিলঘুষি হজম করলেন। পরে ওই মিছিলটি দ্রুত সরে পড়ে।

সৈয়দ রেজাউর রহমান ছিলেন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি। ছাত্রলীগের মধ্যে এই বিদ্রোহ’ তাঁর ভালো লাগেনি। আমাকে দেওয়া এক। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন :

৩২ নম্বর এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে একটা ব্রিফিং ছিল। ওখান থেকে ডিকটেশন এলে ছাত্রলীগ পরিচালিত হবে কি না? তবে এটা ঠিক, সিরাজ ভাই কিন্তু ছাত্রলীগের একটা ভালো অংশকে নিতে পেরেছিল। কর্মী হিসেবে এরা কর্মঠ ছিল, অগ্রণী ছিল। এদের সিরাজ ভাই যেভাবেই হোক প্রভাবিত করতে সক্ষম হইছে। [১৭]

ছাত্রলীগের ঘর যখন ভাঙছে, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কোন দিকে যাবেন, এ নিয়ে কিছুদিন আগে থেকেই ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ গ্রুপের সদস্যরা কল্পনাও করতে পারেননি যে তিনি ইতিমধ্যে তাঁদের ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিষয়টি এই গ্রুপের শীর্ষ নেতা সিরাজুল আলম খানেরও কি অজানা ছিল? আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সিরাজুল আলম খান বলেছেন :

আগের রাতে একটা-দেড়টা পর্যন্ত আমি মুজিব ভাইয়ের বাসায় ছিলাম। তিনি বলেছিলেন, তিনি কোথাও যাবেন না। একপর্যায়ে বললেন, সিরাজ, আমি তো কমিউনিস্ট হতে পারব না?’ তারপর আমি চলে আসি। শুনেছিলাম, মনি এসেছিল রাত দুইটার দিকে। সে মুজিব ভাইকে সরাসরি বলেছিল, ‘আপনি যদি সিরাজের সঙ্গে যান, রাজনীতির উত্তরাধিকারের প্রশ্নে তা ঠিক আছে। যদি আমাকে সমর্থন দেন, তাহলে রাজনীতির উত্তরাধিকার তো আছেই, রক্তের উত্তরাধিকারও থাকছে। এখন আপনি ঠিক করেন, আপনি কোন দিকে যাবেন। [১৮]

আমি সিরাজুল আলম খানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, শেখ মুজিবকে শেখ মনি কী বলেছেন, এটা আপনি জানলেন কীভাবে? তিনি এ ধরনের প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। বললেন, ‘ফ্রম হর্সেস মাউথ। [১৯]

২১ জুলাই সকালে পল্টনের প্যান্ডেলে ছাত্রলীগ কর্মীদের ভিড় ছিল দেখার মতো। সাধারণ কর্মীরা অনেকেই আশা করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু এই সম্মেলন উদ্বোধন করবেন। অথচ শেখ মুজিব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মেলনে যোগ দিয়ে তার অবস্থানটি স্পষ্ট করবেন। এ সম্পর্কে ছাত্রলীগ নেতা শেখ শহীদুল ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। এখানে আমাদের মধ্যকার কথোপকথন তুলে ধরা হলো, যার মাধ্যমে বাহাত্তরের রাজনৈতিক বিভক্তির একটা ছবি পাওয়া যায় :

শেখ শহীদুল ইসলাম : মূল গোলমালটা তো বাধালেন মনি ভাই। মনি ভাই ছিলেন হাইলি অ্যাসপারেন্ট। উনি চাচ্ছিলেন, আফটার বঙ্গবন্ধু, উনি সাকসিড করবেন। উনি এ জন্য তাজউদ্দীনকেও টলারেট করতেন না। আলোচনার সময় সিরাজ ভাই বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘রেভল্যুশন হলে পুরোনো কিছু রাখা হয় না। আপনি এই আইনকানুনের মধ্যে যাইয়েন না। আপনি দেশের নাম বদলায়া ফেলেন। এটাকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ না বলে সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অব বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বলেন এবং ওয়ান পার্টি সিস্টেমে চইলা যান।’

মনি ভাই এইটা ডিজঅ্যাগ্রি করলেন। মনি ভাই বললেন, ‘এই মুহূর্তে করা যাবে না। এটা করার দরকারও নাই। আমরা কমিটেড টু পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি। পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি আপাতত চলুক।’

মনি ভাইয়ের কথা পার্শিয়ালি ট্র। আমাদের ক্যাডার তো সমাজতান্ত্রিক না। এরা গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে বেরিয়ে এসেছে। এরা প্রিপেয়ার্ডও না। সিরাজ ভাইকে এই কথাটাই বললেন মনি ভাই! ‘সিরাজ, তোমার ওই কয়েকজন লোক নিয়া তো সমাজতন্ত্র কায়েম করা যাবে না। তোমার সেই প্রিপারেশন কই?’ সিরাজ ভাই বললেন, কর্মক্ষেত্রে গেলে প্রস্তুতি হয়ে যাবে তাদের।

মহিউদ্দিন আহমদ : এই যে দুই জায়গায় দুইটা সম্মেলন হলো, বঙ্গবন্ধু কি আপসেট হন নাই একটুও?

শহীদ: সত্যি কথা বলতে কি, আমি কোনো আপসেট দেখি নাই ওনাকে। ওনার একটা ধারণা ছিল যে উনি যেখানে থাকবেন, সেটাই মূল ছাত্রলীগ।

মহি : এই ডিসিশনটা উনি কত দিন আগে নিয়েছেন?

শহীদ : কনফারেন্সের ডেট হওয়ার পরপরই।

মহি : তাহলে এই কথা হয়েছে অ্যাট লিস্ট দুই-তিন সপ্তাহ আগে?

শহীদ: না না, তারও আগে।

মহি : বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করলে একটা প্যাঁচআপ করতে পারতেন না?

শহীদ : উনি চেষ্টা করছেন। মনি ভাই অ্যারোগেন্ট টাইপের লোক ছিলেন। সিরাজ ভাই ছিলেন, অ্যারোগেন্ট বলব না, হার্ডলাইনার। তার মূল পয়েন্ট থেকে কখনো সরতে চায় না। [২০]

ছাত্রলীগের ভাঙন নিয়ে নানা রকম ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল। বেশির ভাগ নেতা-কর্মী ছিলেন অন্ধকারে। সিরাজুল আলম খানের প্রতি তার অনুসারীদের ছিল অন্ধ ভক্তি, প্রশ্নাতীত আনুগত্য। তিনি যেভাবে বুঝিয়েছেন, অনুসারীরা সেভাবেই বুঝেছেন। এমনকি প্রতিপক্ষ গ্রুপে, অর্থাৎ সরকারি ছাত্রলীগে থেকে যাওয়া কয়েকজন নেতাও সিরাজুল আলম খানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এই বিভক্তি এমনভাবে আসবে, এটি তাঁরা ভাবেননি। তারা সবাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনুসারী। এখানে রাজনীতির চেয়ে নেতার নির্দেশ ছিল বেশি কার্যকর। তারা কখনোই শেখ মুজিবকে ছেড়ে আসতে চাননি। এঁদের একজন ছিলেন কুমিল্লার মনিরুল হক চৌধুরী। তিনি অবিভক্ত ছাত্রলীগের (১৯৭০ ৭২) সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রলীগ ভাগ হয়ে যাওয়ার পর তিনি ১৯৭৩ সালে সরকার সমর্থক ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার কিছু কথা হয়। এখানে তা তুলে ধরা হলো :

মনিরুল হক চৌধুরী : মুক্তিযুদ্ধের যে জেনারেশনটা, তার শতকরা ৮০ ভাগ আপনারা নিয়া গেছেন। আমরা অবশিষ্ট কিছু পাইছি, ম্যাক্সিমাম টোয়েন্টি পার্সেন্ট। এই টোয়েন্টি পার্সেন্টের অনেকেই লুণ্ঠনকারী হইল। চ্যালেঞ্জিং কিছু না থাকলে যা হয়। আপনারা যে ৮০ পার্সেন্ট, জীবন-যৌবন দিয়া শেষ হইছেন। আপনারা যদি সেদিন অ্যামবিশাস না হইতেন, দেশ ৯ মাসে স্বাধীন হইছে, আমরা ৯ মাসেই সমাজতন্ত্র কইরা ফেলব’–এমন একটা ভাব!

মহিউদ্দিন আহমদ : আমাদের কীই-বা করার ছিল। আমরা কীই বা বুঝি। বঙ্গবন্ধু তখন একটা ইনিশিয়েটিভ নিলেই হতো।

মনিরুল : এইটা বইলেন না। এইটা বললে অন্যায় হবে। বিভিন্ন সভায় নেতাদের বক্তৃতা, বিশেষ কইরা রব ভাইয়ের। ছোট ছোট কর্মীদের কথা বাদ দেন, তাদের বাজে বাজে বক্তৃতা…। বঙ্গবন্ধু একদিন দুঃখ কইরা বলতেছিল, ‘দেখো, এরা যদি আওয়ামী লীগের বিকল্প হইতে পারে, এর চেয়ে মঙ্গলজনক কিছু হবে না। না হইলে আমাকে স্বাধীনতাবিরোধীদের কাছে ক্ষমতা ছাড়তে হবে।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় তো আমাদের মধ্যে পার্থক্য হয় নাই। হ্যাঁ, আগে একটু পার্থক্য ছিল। তারা একটু এক্সট্রিম ছিল। আমি মনে করি, স্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের বক্তব্য এক্সট্রিম ছিল। এইটা হইছে বইলাই তো হইছে। আবার এখনই করা যাবে না, এইটা বলছে বইলাই তো ব্যালেন্স হইছে।

মহি: যে বিভক্তিটা হলো, তার ইমিডিয়েট কারণ কী ছিল? প্রধান কারণ?

মনিরুল : ইন্ডিয়া। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে একটা ফোর্স বানাইতে চাইছিল। কারণ, বঙ্গবন্ধুকে হজম করতে পারতেছিল না। বঙ্গবন্ধু তখন বিশ্বব্যাপী একটা হটকেক।

মহি: আমার প্রশ্ন হলো, বাহাত্তর সালে যে গোলমালটা হলো, ডাকসু ইলেকশন, তারপর আলাদা সম্মেলন, এটা কি কোনোভাবে এড়ানো যেত না?

মনিরুল : বঙ্গবন্ধু শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করছে। আমাদের কর্মীরা, র্যাংক অ্যান্ড ফাইল, যেভাবে তাদের পক্ষে ঝুইলা পড়ছে, তারা মনে করছে সবটা লইয়া তারা চইলা যাবে। আমরা তো টের পাইছি। আমরা তো মাঠেই মোকাবিলা করছি। বঙ্গবন্ধু সেই দিন স্ট্যান্ড না নিলে আমরা কিছুই পাইতাম না। এই যে এইটি পার্সেন্ট শক্তি অপচয় হইছে, এইটা হানড্রেড পার্সেন্ট হইত। সমঝোতার জন্য সিরাজ ভাই রাজি ছিল।

মহি : রাজি ছিল?

মনিরুল : হ্যাঁ, আমি সিরাজ ভাইকে ব্লেম করব না। বঙ্গবন্ধু সিরাজ ভাইকে ব্লেম করে নাই। [২১]

ছাত্রলীগের বিভক্তি এবং নেপথ্যের অনেক কিছু দেখেছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আমির হোসেন আমু। তিনি শেখ মনি ও সিরাজুল আলম খানের বন্ধু। ছাত্রলীগের বিভক্তি প্রসঙ্গে তিনি আমাকে যা বলেছিলেন, তা এ রকম :

মহি : বাহাত্তর সালে ছাত্রলীগের ভাঙন কি এড়ানো যেত না?

আমু : না। তার কারণ, ইন্টারনালি তখন তো লিডারশিপ ক্ল্যাশ আইসা গেছে। ওইটা ভাগ না হইলে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্ব তো আরও বেশি শক্তিশালী হয় না।

মহি : বঙ্গবন্ধু যদি একটা ইনিশিয়েটিভ নিতেন?

আমু : নিতে দেয় নাই তো। এই ব্যাপারে তখন রাজ্জাক-মনি তোফায়েল সব এক। আমারে কোট করিয়া কিন্তু সব কথা লেহা যাবে না।

মহি : শোনেন, ইতিহাস এ জন্যই বিকৃত হয়। আপনারা কেউ কিছু বলে যান না। সবাই তো মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখে। আমার ধারণা, বঙ্গবন্ধুর যে ব্যক্তিত্ব, উনি ডাইকা দুই-তিনটা ধমক দিয়া–ঠিক আছে, আমি প্যানেল বানায়া দেব, দুই গ্রুপ থেকে। একটা প্যাঁচআপ কি করা যেত না?

আমু : যাইত। ঠিকভাবে বললে বঙ্গবন্ধু শোনত। কিন্তু যারা বলবে, তারাই তো তারে উল্টা বুঝাইছে।

মহি: আমি যেটা রব ভাইয়ের কাছে শুনেছি, সিরাজ ভাইয়ের কাছে শুনেছি, মনি ভাই তো জীবিত নাই, রাজ্জাক ভাইও নাই।

আমু : তারা কী বলছে?

মহি: তারা যেটা বলছে, আগের দিন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত ছিল, বঙ্গবন্ধু কোথাও যাবেন না।

আমু : এটা ঠিক। মহি: কিন্তু রাতে এটা ঘুরে গেছে।

আমু : এইটা যে সিদ্ধান্ত ছিল, এইটা ঠিক। সিরাজুল আলম খান তো কিছুটা ডিটাচড। যাদের হাতে বঙ্গবন্ধু, এরা তো তখন সার্বক্ষণিক তার সঙ্গে। এরা বুঝাইছে, আপনি একটা জায়গায় গেলে। বাধ্য হইয়া ওরা আসবে। আপনে কোনো জায়গায় যাবেন না, এইটা তো হয় না। আপনার লিডারশিপ তো থাকে না। আপনি যাবেন। আলটিমেটলি তারা আসবে। তারা আসতে বাধ্য। আপনার লোক হইলে তারা আসবে। এইটা বুঝাইছে।

মহি: আমার মনে হয়, এটা একটা ডিজাস্টার হইছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এইটাই সবচেয়ে বড় ডিজাস্টার।

আমু : আমার বক্তব্য তো এইটা। আফটার লিবারেশন এইটা হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হইছে আওয়ামী লীগের। [২২]

একটা প্রশ্ন অবশ্য থেকেই যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যদি মনি গ্রুপকে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই থাকেন, তাহলে সেটা সাধারণ ছাত্রলীগ কর্মীদের কাছে গোপন করা হয়েছিল কেন? তিনি যদি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাবেন, এটা সাধারণ কর্মীদের কাছে কি ইচ্ছাকৃতভাবেই গোপন রাখা হয়েছিল?

আগেই ঠিক করা হয়েছিল যে একাত্তরের শহীদ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরীর বাবাকে দিয়ে পল্টনের সম্মেলন উদ্বোধন করা হবে। বঙ্গবন্ধু পল্টনে আসবেন না, এই তথ্য গোপন করার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। যে কর্মীরা এটা জানলে হতাশায় ভেঙে পড়বে এবং এদের অনেকেই হয়তো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মেলনে যোগ দিতে চলে যাবে। এটা হলে তো শেখ মুজিবের লাভ ছাড়া ক্ষতি হতো না। তিনি নিজে কেন তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করে আগেই জানান দিলেন না? তিনি কি ভিন্নমতাবলম্বীদের দল থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন? তিনি কি ভেবেছিলেন, এতে করে তার নিজস্ব বলয় আরও সংহত হবে? অথবা তিনি কি চেয়েছিলেন যে তাঁর অনুগত মুক্তিযোদ্ধারা নতুন একটা প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলুক, যাতে করে চরম ডানপন্থী ইসলামি দলগুলা বা উগ্র বাম দলগুলো প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠতে না পারে? এটা কি একটা পাতানো খেলা ছিল? বাহাত্তরের বিভাজনের কারণে রাজনীতিতে পরে যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল, তার একটি বিশ্লেষণের জন্য এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাওয়া দরকার।

ছাত্রলীগের আনুষ্ঠানিক বিভক্তির পর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রপন্থী গ্রুপটি সব বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা বলা বন্ধ করে দেয়।

.

এটা বোঝা যাচ্ছিল যে ছাত্রলীগের বিদ্রোহীরা সংগঠিত হয়ে নতুন একটি রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দেবে। প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে কৌতূহল যেমন ছিল, সন্দেহও ছিল। কেউ কেউ এর মধ্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধও পেয়েছেন। রাজনীতিবিদ ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিদ্বন্দ্বীর উদ্ভব হতে যাচ্ছে। ১ অক্টোবর ১৯৭২ সাপ্তাহিক স্বাধিকারএ তিনি লেখেন :

আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসা অংশটি হয়তো ইতিমধ্যেই নিজেদের অপ্রকাশ্যে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে সংগঠিত করেছে। তা না করে থাকলেও ভবিষ্যতে তাদেরকে সেটা করতেই হবে। ছাত্রলীগের রব-সিরাজ গ্রুপের ভাঙন পরিণতিতে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দলের জন্ম দান করতে বাধ্য এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পরিচালিত ন্যাপ নয়, এই নতুন পার্টিই বাংলাদেশের রাজনীতিক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক সংগঠন। [২৩]

সিরাজুল আলম খান একটি নতুন রাজনৈতিক দল তৈরির চেষ্টা চালাতে থাকেন। ডাকসুর সাবেক সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব নতুন দলের সাধারণ সম্পাদক হবেন, এটা মোটামুটি স্থির করাই ছিল। সিরাজুল আলম খান একজনকে খুঁজছিলেন, যিনি এই দলের সভাপতি হবেন। তিনি তাঁর একসময়ের রাজনৈতিক গুরু শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গেও এ ব্যাপারে কথা বলেছিলেন। শাহ মোয়াজ্জেম ওই প্রস্তাব সম্পর্কে আমাকে সাক্ষাৎকারে বলেছেন :

একদিন সিরাজ হঠাৎ এসে হাজির আমার বাসায়। সরাসরি রান্নাঘরে ঢুকে আমার স্ত্রীকে বলল, ভাবি, এক সের চালের ভাত রান্ধেন। সে গোসল-টোসল সেরে খেতে বসল। গরুর মাংস দিয়ে এক সের চালের ভাত, সবটা খেল। তারপর ঘুম, একটানা তিন দিন। চতুর্থ দিন আমাকে বলল, নতুন দল বানাচ্ছি, আপনি প্রেসিডেন্ট। বললাম, ‘তোমরা তো মার্ক্সবাদী। আমি একজন ডেমোক্র্যাট। আমি তোমাদের সঙ্গে যাব না।’ [২৪]

নতুন দল তৈরির ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গেও যোগাযোগ হয়েছিল। [২৫]

ছাত্রলীগের বিভক্তি সত্ত্বেও সিরাজুল আলম খান গণভবনে যাওয়া-আসা বন্ধ করেননি। ওই সময়ের একটি বিবরণ দিলেন তিনিঃ

হঠাৎ একদিন শুনি, মনির শ্বশুর, সে হলো কৃষক লীগের প্রেসিডেন্ট। আর কাকে যেন সেক্রেটারি করেছে। এটা সম্ভবত বাহাত্তরের এপ্রিলে। মুজিব ভাই বললেন :

সবই তো তুই করেছিস। সবাই বলল ভালো ভালো লোক আছে। ওপরের দিকেও একটা ভালো কমিটি করা দরকার। মনি তো সেভাবেই বলল।

আমার অবস্থা তখন–না পারি নিজের কামড় খেতে, না পারি অন্যকে আক্রমণ করতে, শরীরের এমন অবস্থা হয় না? বললাম :

আমি কিন্তু এটা অ্যাগ্রি করছি না।

যা হবার হয়ে গেছে রে কাজ কর।

আমি বেরিয়ে আসলাম। আবদুল মালেক শহীদুল্লাহকে প্রেসিডেন্ট করে, ইনুকে সেক্রেটারি করে জাতীয় কৃষক লীগ নাম দিয়ে আরেকটা কমিটি করলাম।

উনি বললেন, সংগঠন তো দুই ভাগ হয়ে গেল। বললাম :

এটা তো আমি করিনি।

এটা কে করেছে?

মনি করেছে।

মনি কী করে, না করে, সেটাও তো বুঝি না।

আরেকটা ভালো কাজ উনি করেছেন। ক্যাবিনেট মিটিং হবে। বললেন, চারটা-সাড়ে চারটার দিকে আসিস তো?

ক্যাবিনেট মিটিংয়ের অ্যাজেন্ডা দেখালেন আমাকে। এ রকম তিন-চারবার উনি আমাকে ডেকেছেন।

একবার ক্যাবিনেট মিটিং চলতেছে। হঠাৎ একজন বললেন, আচ্ছা, সিরাজের সঙ্গে আপনার এত খাতির কেন?

ক্যাবিনেট মিটিংয়ের বিষয় নিয়ে তাঁর সামনে…। উনি তো আবার এসব জায়গায় দুই পক্ষের কথা শুনতেন। হি ওয়াজ গুড আপ টু দ্যাট পয়েন্ট।

তাঁর গলব্লাডার অপারেশন হবে। উনি প্রতিদিন একটা প্রেসনোট দিতে বলতেন। মিনিস্টার, পার্টির লোক অ্যান্ড সিরাজুল আলম খান। এখানে আওয়ামী লীগের সবাই বলত–কেন তার কাছে এটা পাঠাও?

এর মধ্যে জাসদ হবে হবে। আমি বললাম, আমি একটা পার্টি ফরমেশন দেব।

হ্যাঁ, বাইরে কথা হচ্ছে, তুই কর্নেল ওসমানীর কাছে গেছিলি। আরও কোথায় কোথায় কথা বলছিলি। এগুলো করলে ইউনিটি থাকে কী করে?

তাজউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে, এটা আর উনি বলেন না। [২৬]

পরে সেনাবাহিনী থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া মেজর মোহাম্মদ আবদুল জলিল ও আ স ম আবদুর রবকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ৩১ অক্টোবর ১৯৭২ এই প্রক্রিয়া থেকে জন্ম নেয় জাতীয়। সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নামের নতুন একটি রাজনৈতিক দল। জন্মলগ্নেই জাসদ সরকার উৎখাতের ঘোষণা দেয়। [২৭]

ছাত্রলীগের যে অংশটি পরবর্তী সময়ে জাসদ প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা রেখেছে, একসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি তাদের অতিভক্তি ছিল। লক্ষণীয়। বাহাত্তরের ২৫ মে এক বিবৃতিতে এই অংশটি শেখ মুজিবকে একচ্ছত্র নেতা ঘোষণা করে দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে প্রশাসন চালানোর আহ্বান জানিয়েছিল। তাদের এই অবস্থান ২০ জুলাই পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। এক রাতের মধ্যে তাদের অবস্থা একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে যায়।

ছাত্রলীগের কর্মী মহলে এবং জন-আলোচনায় মেজর জলিল ভালোভাবেই ছিলেন। ড. আলীম-আল রাজী সম্পর্কেও কানাঘুষা ছিল। অনেকের ধারণা ছিল, ড. রাজী জাসদে যোগ দেবেন, প্রেসিডেন্ট হবেন এবং জলিল যোগ দেবেন ভাসানীপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ)। পরে দেখা গেল, ড. রাজী ন্যাপকে (ভাসানী) এবং জলিল জাসদকে বেছে নিয়েছেন।

জলিলের জাসদে যোগদানের ব্যাপারটায় নাটকীয়তা ছিল। আগের দিন। পর্যন্ত ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকেই জানতেন না যে তিনি জাসদে যুক্ত হবেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে বেশ কয়েক মাস ধরেই দেখা করছিলেন এবং কথাবার্তা বলছিলেন। তাঁর সম্পর্কে ভিন্ন ধরনের একটি বয়ান পাওয়া গেল আওয়ামী লীগের সে সময়ের তরুণ নেতা ও গণপরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমুর কাছ থেকে। তাঁর সঙ্গে আমার কথোপকথন ছিল এ রকম :

আমির হোসেন আমু : আমারে কিন্তু সিরাজুল আলম খান সব সময় বিশ্বাস করত। ইউ আস্ক হিম। আমারে সে পরিষ্কার বলছে, আপনার ওপর আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে। কিন্তু আমি জানি, একটা জায়গায় গিয়া আপনি ঠেইকা যান। আত্মীয়তার কারণে আসতে পারেন না। অনেক কথা বলতে পারেন না, বলবেন না।

মহিউদ্দিন আহমদ : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার রিলেশনশিপটা কী?

আমু : বঙ্গবন্ধুর মা আমার নানির ফার্স্ট কাজিন আমার মা আর বঙ্গবন্ধু হইল একই স্টেপের ব্রাদার-সিস্টার।

মহি: তাহলে সম্পর্কে আপনার মামা।

আমু : আগে মামা। এরপরে ভায়রা। বঙ্গবন্ধুর ওয়াইফ আর আমার ওয়াইফ আপন মামাতো-ফুফাতো বোন। আমার শ্বশুর হইল বেগম মুজিবের আপন নানা। বঙ্গবন্ধু আমার তিন-চাইর রকমের আত্মীয়।

মহি: আচ্ছা, মেজর জলিল জাসদে গেল কেন? আপনার কী ধারণা?

আমু : এইটা একটা অবাক ব্যাপার। মেজর জলিল যেদিন জাসদে যাবে, তার আগের দিন বঙ্গবন্ধু তারে ১৫ হাজার টাকা দিছে, সে বিডিআরের প্রধান হবে। তারে ডিজি-বিডিআর করার কথা।

মহি : ১৫ হাজার টাকা আনছে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে?

আমু : হ্যাঁ, সন্ধ্যার সময়। পরের দিন তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট হবে বিডিআরে। সকালবেলা দেহি তার নাম জাসদে। জাসদে যাওয়ার কথা তো রাজ্জাকের। রাজ্জাক যায় নাই।

মহি: কর্নেল সি আর দত্তকে বিডিআরের চিফ করা হয়েছিল।

আমু : জলিলরে বুঝাইছে। ও অ্যারেস্ট হইছে তো একবার? ওরে বুঝাইছে, তোমারে বিডিআরে ঢুকাইতেছে। পরে চিফ করবে না। যেহেতু তুমি অ্যারেস্ট হইছ। তোমারে বিশ্বাস করবে না। থাইক্যা লাভ নাই। এই দিকে আসো। আমার মনে হয়, এইভাবে বুঝায়া-টুঝায়া নিছে।

মহি : জাসদের ব্যাপারে আপনার কী মনে হয়? এটা কি ইন্ডিয়ার কনসেন্ট ছাড়া হয়েছে?

আমু : ইন্ডিয়ার কনসেন্ট ফুল না। একটা সেকশনের।

মহি : আপনার কাছে কি কোনো এভিডেন্স আছে? নাকি অনুমান থেকে বলতেছেন?

আমু : আছে।

মহি : শোনেন, ইতিহাস হারায়া যাবে, যদি আপনারা না বলেন।

আমু : আমার ধারণাটা হইল, বঙ্গবন্ধু যখন ফেরে ১৯৭২ সালে, তখন তিনি ইন্দিরা গান্ধীরে বলছে, তোমার সৈন্য কখন ফেরত নেবা। অন দ্যাট ভেরি মোমেন্ট, দে আন্ডারস্ট্রড যে বঙ্গবন্ধু তাদের কন্ট্রোলের লোক না। বঙ্গবন্ধু তাদের রাইভাল হবে। তাদের পোষা লোক হবে না। সুতরাং তাকে সাইজে রাখতে হইলে, তাঁকে ঠিক রাখতে হইলে তাঁর ওপর প্রেশার রাখতে হবে। এই প্রেশার রাখার প্রশ্নে একটা গ্রুপ তখন ঠিক করছে–জাসদ। কিন্তু এর বাইরে সিরাজুল আলম খানের লাইন ছিল। ইন্ডিয়ার লাইনের ওপর ভরসা কইরা সে আগায় নাই। অত সাহস সে পাইত না। কারণ, বঙ্গবন্ধুরে সে চেনে। ইচ্ছা করলে তখন তারে ফাঁসিও দিয়া দিতে পারত। পারত না? গুলি কইরা মাইরা ফালাইতে পারত। পারত না? বঙ্গবন্ধু যে তখন কোনো অ্যাকশনে যায় নাই, নিশ্চয়ই কোননা ইন্টারন্যাশনাল ব্যাপার ছিল? বঙ্গবন্ধুরে যে ফাঁসি দিতে পারে নাই, সেটাও তো ইন্টারন্যাশনাল কারণে। নাকি?

মহি: কাজী আরেফ আহমদ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

আমু : কাজী আরেফ, এ তো বোগাস। বেশি কথা কয়। পরে তাত্ত্বিক টাইপ হইছিল। সিরাজুল আলম খানের খাস ট্যান্ডল ছিল।

মহি : বিএলএফের সঙ্গে তার কি কোনো অফিশিয়াল সম্পর্ক ছিল?

আমু : না। ওই পারে যাওয়ার পর দেখতাম খুটমুট খুটমুট করে। [২৮]

জাসদের সাত সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হলো ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর। মেজর জলিল আর আ স ম আবদুর রব হলেন যুগ্ম আহ্বায়ক। আহ্বায়ক কমিটির অন্য পাঁচজন সদস্য হলেন শাজাহান সিরাজ, বিধান কৃষ্ণ সেন, সুলতান উদ্দিন আহমেদ, নূর আলম জিকু ও রহমত আলী। এঁদের মধ্যে নূর আলম জিকু ও শাজাহান সিরাজ ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। সুলতান উদ্দিন ও বিধান সেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন। রহমত আলী আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা। তিনি ছিলেন জাসদে তাজউদ্দীন আহমদের ‘নমিনি’। রহমত আলী অবশ্য এক দিনও জাসদে থাকতে পারেননি। শেখ ফজলুল হক মনির লোকেরা তাকে অপহরণ করে তাঁর কাছ থেকে একটি বিবৃতি আদায় করে নেয়। বিবৃতিতে তিনি বলেন, জাসদের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। [২৯]

ছাত্রলীগে সিরাজুল আলম খানের অনুসারীরা জাসদে দলে দলে যোগ দিলেন। ছাত্রলীগের এই অংশটি হলো জাসদের মূল শক্তি। দলটি আওয়ামী লীগে ভাঙন ধরাতে পারেনি। গণপরিষদের মাত্র দুজন সদস্য জাসদে যোগ দেন। তাঁরা হলেন ময়মনসিংহের আবদুল মালেক শহীদুল্লাহ এবং সাতক্ষীরার স ম আলাউদ্দিন। তাঁদের আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

১৯৭২ সালের এপ্রিলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ ফজলুল হক মনিকে দলের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য বানানো হয়েছিল। কিন্তু নিজের শক্ত ভিত তৈরির জন্য তাঁর দরকার হলো আলাদা একটা প্ল্যাটফর্ম। জাসদ তৈরি হওয়ার পর এর যৌক্তিকতা আরও বেড়ে যায়। আওয়ামী লীগে নিজের প্রভাববলয় তৈরি করা এবং জাসদের অগ্রযাত্রা ঠেকানোর জন্য তিনি তৈরি করলেন আওয়ামী যুবলীগ ও যুবলীগ তৈরি হলো ভারতের যুব কংগ্রেসের আদলে। এর আগে বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে যুব সংগঠন ছিল না।

১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে যুবলীগ গঠনের ঘোষণা দেন শেখ ফজলুল হক মনি। সম্মেলনে তাঁর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী, আবদুল কুদুস মাখন ও রাজিউদ্দীন। শেখ মনি একটি আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। কমিটির সদস্যরা হলেন আহ্বায়ক : শেখ ফজলুল হক মনি; সম্পাদকমণ্ডলী : নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদুস মাখন, আবদুল কাদের সিদ্দিকী, ইব্রাহিম, খন্দকার আবদুল হান্নান, ডা. আলী হাফিজ (সেলিম), সৈয়দ রেজাউর রহমান, সুলতান শরীফ, আকবর আলী ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (মায়া)।

শেখ মনি আগে থেকেই সিরাজপন্থীদের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে ছিলেন। এ ব্যাপারে তার মধ্যে কোনো লুকোছাপা ছিল না। একদিন দৈনিক বাংলায় ফোন করে বললেন, রব ও শাজাহান সিরাজের কোনো সংবাদ যেন না ছাপানো হয়।

১৯৭৩ সালের মে মাসে যুবলীগের সম্মেলন হলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সম্মেলনে যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হলো। চেয়ারম্যান হলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সাধারণ সম্পাদক হলেন নূরে আলম সিদ্দিকী। প্রেসিডিয়ামের অন্যতম সদস্য হন গণপরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু। যুবলীগ তৈরির পটভূমি সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন আমির হোসেন আমু :

আমি জানতাম, আবদুর রাজ্জাক অনেক দিন থিকা সিরাজুল আলম খানের লোক। আমি তারে কইলাম, তুমি কি বঙ্গবন্ধুর বাইরে রাজনীতি করতে পারবা?

না।

তুমি কি মনে করো সিরাজুল আলম খান শেখ মনির চেয়ে বঙ্গবন্ধুর বেশি আপন?

না।

তাহলে? সব যখন এক জায়গায় যাইয়া মেলবা, তহন তো এক হইতে হইবে। আগে থাকতে গ্রুপিং না কইরা তুমি তাদের মিলায়া দাও, নইলে মনির লগে থাকো। তুমি যখন সিরাজুল আলম খানের কাছ থিকা ছুঁইটা আইবা, তখন সে মনে করবে একলা। তখন সে মিলতে রাজি হইতে পারে।

অনেক কওয়া-টওয়ার পর সে নিউট্রাল হইল। বাট পুরা আসল না। মোটামুটি নিউট্রাল করছি।

আমি যেটা মোটামুটি বুঝছিলাম, সিরাজুল আলম খান রাজ্জাকরে বুঝাইছে, তুই হইলি সংগঠনের লোক। মনি তো সংগঠন ছাইড়া দিছে। মনিরে নেতা বানায়া লাভ কী। নেতা তুই হবি। মনি পেপার নিয়া থাকবে। বঙ্গবন্ধু তারে মানিক মিয়া বানাবে। একটা ভাবসাব নিয়া থাকবে। যেইটা লিবারেশনের পরপর রাজ্জাক তোফায়েল একসঙ্গে করছিল। সিরাজুল আলম খান চইলা যাওয়ার পর বুঝাইয়া মনিরে নির্বাসনে পাঠায়া মানিক মিয়া বানায়া দিছিল।

বঙ্গবন্ধু তো পয়লা যুবলীগ করতে রাজি হয় নাই। যুবলীগ নেতা করাইছি আমি। মনি তো ফেল করছিল। মনি যখন প্রস্তাব দিছিল, বঙ্গবন্ধু তো রাজি হয় নাই। মনি যে প্রস্তাব দিছে আর বঙ্গবন্ধু যে রাজি হয় নাই, এইটা আমি জানতাম না। আমি তো পার্লামেন্ট সেশন ছাড়া ঢাকায় আসতাম না। বরিশালে থাকতাম।

আসলাম। মনিরে কইলাম, যুবলীগ ঠিক করতে হবে। ওইখানে (কলকাতায়) বইসা ঠিক করছিলাম, যুবলীগ করতে হবে, করবা না?

মামা রাজি হয় না।

মামারে রাজি করাইতে হবে।

সে তহন কয় নাই যে পারে নাই। কয়, পারলে তুমি করো।

আমি দেখলাম, বাসায় বইয়া আলাপ করলে হবে না। গণভবনে গেলাম। সন্ধ্যার সময়। বঙ্গবন্ধু কাজটাজ সাইরা বলে, কী?

কথা আছে। আগে ছিল হকিস্টিক। বড়জোর চেইন। হেইয়া ব্যবহার হইত মাইরপিটে। এহন কিন্তু কথায় কথায় ইয়া…এর বায়রা কিছু নাই। ঘুষি-মুষি কিছু নাই। এদের সবাইরে তো আপনি চাকরি দিতে পারবেন না। এরা তো বিরাট বাহিনী। পলিটিক্যালি অ্যাবজরব করতে হইলে আপনারে তো ফ্রন্ট খুলতে হবে। আপনি তো সবাইরে আওয়ামী লীগে নেতে পারতেছেন না। পাঁচটা মার্ডার হবে রোজ। এহন তো হবে অস্ত্রের গ্রুপিং। পলিটিক্যাল গ্রুপিং নাই। এদের তো বিভিন্ন জায়গায় ঢুকাইতে হবে।

কী করব?

একটা গ্রুপ, যারা নিডি, তাদের চাকরি দিতে হবে। যারা পলিটিকস করবে, তাদের জন্য ফ্রন্ট খুইলা দিতে হবে। আপনি ফ্রন্ট খুইলা দেন?

আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকায়া রইল। কয়, তুই কাইল আসিস। এই জায়গায় আসিস।

আমি বাসায় যাইতাম বোজ। কিন্তু কথা কইতাম এহানে। পরের দিন আবার গেলাম। যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু কয়, অনেক চিন্তা করছি। তুই ভালো কথা বলছস। কিন্তু মনিরে তো আমি মানা কইরা দিছি। একটা কাজ কর। তুই মনিরে নিয়া আয়।

তহন তো আমি বোঝলাম। মনিরে আইন্যা মনিরে দিয়া প্রস্তাব দেওয়াব। তহন রাজি হবে। তা না হইলে তো খারাপ দেহা যায়।

আমি মনিরে ভাইঙ্গা কইলাম না। বললাম, চলো। আইজ দুইজন একসঙ্গে যাই দেহি।

আমারে নিয়ো না, তুমি যাও।

না না, তোমার যাইতে হবে।

সে কিছুতেই যাইতে রাজি হয় না। বললাম, আমি বঙ্গবন্ধুর লগে কথা কইছি। সে তোমারে লইয়া যাইতে কইছে।

কী কও? চলো।

আইলাম। আসার পর, আমরা বসা, বঙ্গবন্ধু মনিরে কয় : কী বলবি?

আমি তো না, আমু মিয়া কী কইতে আইছে, আমি জানি না।

আমি বললাম যে এই যুবলীগের ব্যাপারটা আলোচনা করতেছিলাম।

মনি আমার সঙ্গে আলাপ করছিল। মনির সঙ্গে আলাপ কর। সে কী করতে চায়, করুক। আমি ‘না’ বলছিলাম। পরে চিন্তা করলাম, ঠিক আছে, তোমরা আলোচনা কইরা ঠিক করো! [৩২]

.

মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মুজিববাহিনীর দুই শীর্ষ নেতা এবং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী ও বন্ধু দুটি আলাদা দল তৈরি করলেন, জাসদ ও আওয়ামী যুবলীগ। যুবলীগের যৌক্তিকতা, সরকারের সঙ্গে এর সম্পর্ক, বিরোধী দল সম্পর্কে মন্তব্য–এসব উঠে এসেছে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ২৯ জুন ১৯৭৩ প্রকাশিত শেখ ফজলুল হক মনির এক সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন মাহফুজ উল্লাহ। এখানে তার কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হলো :

প্রশ্ন : আপনার রাজনৈতিক সংগঠন যুবলীগ কি যুব কংগ্রেসের প্রতিরূপ? এর রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে কিছু বলুন।

উত্তর : যুবলীগ যুব কংগ্রেসের অনুপ্রেরণায় সংগঠিত হয়নি। এ দেশে চিরদিনের অসংগঠিত যুবশক্তিকে সংগঠিত করাই যুবলীগের উদ্দেশ্য। যুবশক্তি সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ। যুবলীগের মাধ্যমে জাতীয় আদর্শের ভিত্তিতে আমি এই যুবশক্তিকে সংগঠিত করতে চাই। যুবলীগ ছাত্রলীগের মতোই আওয়ামী লীগের সংযুক্ত সংগঠন।

প্রশ্ন : আমাদের দেশের বিরোধী দল সম্পর্কে কিছু বলুন।

উত্তর : আমাদের দেশে বিরোধী দল নেই। আমরা চাই দেশে সুষ্ঠু বিরোধী দল গড়ে উঠুক। আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত ভাসানী, অলি আহাদ, আতাউর রহমান খান, মুজাফফর, জাসদ এরাই আজ বিরোধী দলের নেতৃত্ব করছে। এরা বিপ্লবের পতাকা বহন করেনি। যারা স্বাধীনতার পতাকা বহন করতে পারেনি, তাদের নিয়ে অন্য রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে।

প্রশ্ন : আপনি জাসদ নেতাদের আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত বলছেন। কিন্তু জাসদ নেতৃবৃন্দ কখনো আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন না। যেমন মেজর জলিল এবং আ স ম আবদুর রব।

উত্তর : জাসদে সব ফালতু লোক এসে জুটেছে। তাদের নেতৃত্ব করছে দুর্নীতির অভিযোগে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর জলিল।

প্রশ্ন : আমরা যত দূর জানি মেজর জলিলের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছে।

উত্তর : তার মায়ের কান্নার জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছে–তিনি প্রাণভিক্ষা পেয়েছেন। একদিন আমাদের সঙ্গে মহত্ত্বর কাজে জড়িত ছিলেন বলেই তা সম্ভব হয়েছে। আমাদের সহনশীলতা বেশি বলেই অনেককে ক্ষমা করে দিয়েছি।

প্রশ্ন : বর্তমানে যে হারে ভায়োলেন্সের সংখ্যা বাড়ছে, সে সম্পর্কে আপনার মত কী?

উত্তর : যে পরিমাণে ভায়োলেন্স হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। করার দরকার হয়নি। এখন শুধু আওয়ামী লীগ দলীয় লোকদের মারা হচ্ছে। দেশ এখন ক্রান্তিকালে অবস্থান করছে।

প্রশ্ন : আপনি কি রাজনীতিতে ভায়োলেন্সে বিশ্বাসী?

উত্তর : প্রয়োজন হলে রাজনীতিতে ভায়োলেন্সে বিশ্বাসী। তবে সে ভায়োলেন্সের ভিত্তি হবে গণতান্ত্রিকতা।

প্রশ্ন : আপনার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ কী?

উত্তর : আমার কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই।

প্রশ্ন : মুজিববাদ কি দেশে শান্তি আনবে?

উত্তর : মুজিববাদই শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে। কেননা, এটাই সর্বশেষ মতবাদ। [৩৩]

শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খানের মধ্যে দ্বৈরথ জারি থাকল। শেখ মনি ‘মুজিববাদ’ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষণা করলেন। সিরাজুল আলম খান ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ নিয়ে আগুয়ান হলেন। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক, সংঘাত কিংবা সমীকরণ মাও সে তুংয়ের বিখ্যাত উক্তিটি মনে করিয়ে দেয়–ঐক্য ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু দ্বন্দ্ব চিরস্থায়ী।

.

ছাত্রলীগ যদি না ভাঙত, জাসদ যদি আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ না হতো, তাহলে কী হতো? এ নিয়ে আছে নানা আলোচনা ও তর্ক। এ নিয়ে কথা বলেছিলাম সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে। অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ মানেন না, ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্বোধন করেন না। সূচনাটি হয়েছিল ছাত্রলীগের সিরাজপন্থীদের হাতে। এটি অনেক দূর গড়িয়েছে। সিরাজুল আলম খান তুলে ধরলেন তাঁর সাম্প্রতিক উপলব্ধির কথা :

শেখ মুজিব শুড বি প্লেইসড ইন আ রাইট প্লেস–তারপর যারা আছে, তারা আসবে।

সিরাজুল আলম খান যদি শেখ মুজিবের সঙ্গে থাকত, তাহলে বাংলাদেশ নাকি আরও ভালো হতো। কথা তো ঠিকই। বিরোধী দল থাকত না। পিটায়া…সমান হইয়া যাইত সব। সেটা ভালো রাজনীতি হতো? আজকে যেটুকু স্বাধীনতা আমরা গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে, সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পাচ্ছি, সেটুকুও তো থাকত না।

স্বাধীনতার কোশ্চেনটা মিসহ্যান্ডেলড হয়েছে, রাইট ফ্রম দ্য বিগিনিং। দেশে আসার দুদিন পর। ওই যে তিনি প্রাইম মিনিস্টার হবেন, ফ্রম দ্যাট ডে।

ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মতো দেশে বিরোধী দল মানেই সরকারি দলের লেজুড়। এটা কি ওয়েস্টমিনস্টার? এটা ইংল্যান্ড মনে হচ্ছে, আমেরিকা মনে হচ্ছে–সেখানে অপজিশনটাই গড়ে উঠেছে শত শত বছরের মধ্য দিয়ে। এখানে কে হবে বিরোধী দল? কয়েকটা লোক তো হতে হবে এবং সেটার গ্যারান্টি কে দিচ্ছে? আওয়ার কনস্টিটিউশন। ১৯৭২ সালের কনস্টিটিউশন।

গভমেন্টের বিরুদ্ধে কে থাকবে? আমি সরকারি দলে যাব না। তাহলে কে থাকবে? আমি বিরোধী দলে আসলাম। আমার বক্তব্য কী হবে? শেখ মুজিবকে বিরোধিতা করার অর্থ কী হবে? স্বাধীনতার বিরোধিতা করা? আচ্ছা, বাহাত্তর সালে সরকারের ভুলত্রুটিটা কী? সরকারটা কোথায় দেখলা তুমি? গভমেন্ট মানেই কি সরকার? একটা ইলেকশন হয়ে গেলেই কি গণতন্ত্র? [৩৪]

.

তথ্যসূত্র

১. সিরাজুল আলম খান

২. ওই

৩. আহমদ (১৯৮২), পৃ. ১৫৯-১৬০

৪. সিরাজুল আলম খান।

৫. গণকণ্ঠ, ২৫ মে ১৯৭২

৬. আহমদ, মহিউদ্দিন (২০১৪), জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, পৃ. ২৭-২৮

৭. বাংলার বাণী, ১৭ মে ১৯৭২

৮. সিরাজুল আলম খান

৯. আহমদ (১৯৮২), পৃ. ১৮৬

১০, ওই, পৃ. ১৭০-১৭১

১১. সংবাদ, ১০ এপ্রিল ১৯৭২

১২. বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (১৯৭২), সাধারণ সম্পাদকের কার্যবিবরণী, শাজাহান সিরাজ, পৃ. ৯-১০

১৩. ওই, পৃ. ১৩

১৪. ওই, পৃ. ৬।

১৫. ওই, পৃ. ২০-২১

১৬. লেখকের স্মৃতি থেকে

১৭. সৈয়দ রেজাউর রহমান

১৮. সিরাজুল আলম খান

১৯. ওই

২০. শেখ শহীদুল ইসলাম

২১. মনিরুল হক চৌধুরী

২২. আমির হোসেন আমু

২৩. উমর, বদরুদ্দীন (১০১২), রচনা সংগ্রহ-২, শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা, পৃ. ৫৯৫

২৪. শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন

২৫. আ স ম আবদুর রব

২৬. সিরাজুল আলম খান

২৭. গণকণ্ঠ, ১ নভেম্বর ১৯৭২

২৮. আমির হোসেন আমু

২৯. আহমদ (২০১৪), পৃ. ৮৯

৩০. বাংলার বাণী, ১২ নভেম্বর ১৯৭২

৩১. সেন, পৃ. ৫৪১

৩২. আমির হোসেন আমু

৩৩. বিচিত্রা, ২৯ জুন ১৯৭৩; উল্লাহ, মাহফুজ (২০১৮), স্বাধীনতার প্রথম দশকে বাংলাদেশ, দি ইউনিভার্সেল একাডেমি, ঢাকা, পৃ. ২৭-৩১

৩৪. সিরাজুল আলম খান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *