১.৫ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ

স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ

নিউক্লিয়াস কিংবা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের কার্যক্রমের কোনো দালিলিক সূত্র পাওয়া যায় না। যারা ‘বিপ্লবী বাংলা’ নামের মুখপত্রটির কথা বলেন, তারা কেউ আজ পর্যন্ত এর কোনো কপি দেখাতে পারেননি। গোপনীয়তার স্বার্থে এগুলো সংরক্ষণ করা বিপজ্জনক, এটা মেনে নিয়েও বলা যায়, এর কনটেন্ট কী ছিল, তা-ও জানা যায়নি।

আমি এর গোড়ায় যেতে চাইলাম। সিরাজুল আলম খান বিষয়টি বারবার এড়িয়ে গেছেন। আবার যাদের ডিকটেশন দিয়ে তিনি লেখান, সেগুলো বেশির ভাগই অগোছালো। আমি লেগে থাকলাম।

রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে আমি ধারাবাহিকভাবে গবেষণার কাজ করছি ২০১২ সাল থেকে। তখন থেকে মাঝেমধ্যে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে দেখা ও কথা হতো। প্রশ্ন করলে তিনি সরাসরি জবাব দেন না। এ ধরনের আচরণ বা স্টাইলের কারণে ‘রাজনীতির রহস্যপুরুষ’ হিসেবে তার একটি পরিচিতি দাঁড়িয়ে গেছে। ‘কাপালিক’ নামটি চলে গেছে আড়ালে।

২০১৪-১৮ সালে আমি তার সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় কাটাই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলি। কথাগুলো রেকর্ড করি। তার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের গোড়ার দিকের কিছু কথাবার্তা এখানে তুলে ধরলাম :

মহিউদ্দিন আহমদ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন কোন বছর?

সিরাজুল আলম খান : ১৯৫৮ সালে। ম্যাথমেটিকসে। ফজলুল হক হলে রেসিডেন্ট হলাম। যে রুমে গেলাম, সেটা ছিল ছাত্রলীগের জেনারেল সেক্রেটারির রুম। রফিকুল্লাহ চৌধুরী হলেন প্রেসিডেন্ট, আজহার আলী জেনারেল সেক্রেটারি। বুঝতেই পারো। একজন জেনারেল সেক্রেটারির রুমে–একটা অভাগা ঢুকলেও তো অনেক দিক দিয়ে একটা…

মহি: ভিআইপি!

সিরাজ: হ্যাঁ। রফিকুল্লাহ চৌধুরী আসতেন। আজহার ভাই তো ছিলেনই। উনি পরে ব্যারিস্টারি পড়তে গেছেন। পরে আবার বাংলাদেশবিরোধী হয়ে গিয়েছিলেন। হি ডাইড অ্যাজ আ পাকিস্তানি। বছর পাঁচ-ছয় আগে লন্ডনে মারা গেছেন। ছাত্রলীগের অফিস সেক্রেটারি ছিলেন সৈয়দ রেজা কাদের। উনিও ওই রুমে।

মহি : এটা কি থ্রি-সিটেড রুম?

সিরাজ : থ্রি-সিটেড রুম। পরে হয়ে গেছে ফোর-সিটেড।

মহি: রুম নম্বর মনে আছে?

সিরাজ : টি ই ফোর। টপ ইস্ট ফোর। পরে আবার টি বাদ দিয়ে দিয়েছে। শুধু ইস্ট ফোর।

তখন তো রাজনীতি বন্ধ। ছাত্রসংগঠনগুলো সব বন্ধ। আজহার ভাই চলে গেলেন। রফিকুল্লাহ ভাই প্রেসিডেন্ট। মোয়াজ্জেম ভাই সেক্রেটারি হবেন। পুরোনো আর্টর্স বিল্ডিংয়ে ইফতার পার্টি করে ৬০ ৭০ জন জোগাড় করে, গোপনে সন্ধ্যার পরে আমাদের একটা কমিটি করা হলো। দুই বছরের জন্য। পরের বছর রেজা কাদের ভাই আমার নাম এক্সিকিউটিভ কমিটিতে মেম্বার হিসেবে দিলেন। পরের বছর রফিকুল্লাহ ভাই চলে গেলেন।

মহি: তাহলে ‘৫৯ সালে আপনাকে কমিটিতে নেওয়া হলো। সিরাজ : ‘৬০ সালের শুরুর দিকে। ওই রোজার টাইমে। পরের বছর মোয়াজ্জেম ভাই হলেন প্রেসিডেন্ট, শেখ মনি সেক্রেটারি। আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি। অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি হওয়ারও একটা গল্প আছে। যে ছেলেটা অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ছিল, নাজমুল হক, সে আবার রেডিও পাকিস্তানে চাকরি পেয়ে গেছে। সরকারি চাকরি হওয়াতে সে তো আর সংগঠন করবে না। রিজাইন দিয়েছে। আমাকে এক্সিকিউটিভ মেম্বার থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি বানিয়েছে।

মাঝেমধ্যে রুমের মধ্যে দেখি যে সৈয়দ রেজা কাদের ভাইয়ের কাছে লোকজন আসে, কথাবার্তা বলে। সবাই ছাত্রলীগের। আমাকে বলে, থাকো তুমি। অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি হওয়ার পরে, মনির গলা থেকে হঠাৎ করে রক্ত বের হলো। ডাক্তার টিবি সাসপেক্ট করে। বললেন, ‘তুমি কমপ্লিট রেস্টে যাও।’ তখন আমি অ্যাক্টিং জেনারেল সেক্রেটারি হলাম। অ্যাক্টিং জেনারেল সেক্রেটারি হওয়ার ফলে সারা ইস্ট পাকিস্তানে চিঠি লিখে লিখে যোগাযোগ হতো। রেজা কাদের ভাই আছেন তখনো।

মহি: উনি তখন কী?

সিরাজ : উনি আউটগোয়িং। কিন্তু তখনো হলে থাকেন।

মহি: তাস খেলতেন?

সিরাজ : ব্রিজ খেলতাম।

মহি: আপনি কি কলেজে থাকতে ছাত্রলীগের সঙ্গে ছিলেন?

সিরাজ : তখন ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন ছিল না। পাইওনিয়ার্স পার্টি আর ডেমোক্রেটিক পার্টি। আমরা ছিলাম পাইওনিয়ার্স পার্টিতে। এখানেও ছাত্রলীগাররা ছিল, আবার ডেমোক্রেটিক পার্টিতেও ছাত্রলীগাররা ছিল। আবার এই দুটোতেই ছাত্র ইউনিয়ন ছিল। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ডেমোক্রেটিক পার্টিতে ছিলেন। তখন যোগাযোগ ও দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। কিন্তু কোনো রিলেশন গড়ে ওঠেনি।

মহি: তাহলে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, এগুলো ঢাকা কলেজে অ্যালাউড ছিল না।

সিরাজ : গভর্নমেন্ট কলেজে খুব স্ট্রিক্ট ছিল। এর মধ্যে এসে গেল ‘৬২ সালের মুভমেন্ট।

মহি: রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে আপনার পরিচয়ের ইতিহাসটা বলুন।

সিরাজ : সে তো আমার এক বছর-দুই বছরের জুনিয়র। একই হলে এল। ফজলুল হক হলে ভর্তি হলো। সে ছিল আবার কুস্তিগির, জিমনেসিয়ামে যেত। আমিও জিমনেসিয়ামে যেতাম। সেখানে দেখা।

মহি: রাজ্জাক ভাইয়ের কোন দিকটা আপনাকে আকর্ষণ করেছে?

সিরাজ : হি কুড অর্গানাইজ। খুব সহজে মিশতে পারে।

মহি: কোন ডিপার্টমেন্টে পড়তেন তিনি?

সিরাজ : পলিটিক্যাল সায়েন্স। মহি: তখন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কারা? ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে?

সিরাজ : নেতা অরিজিনালি হলো ফরহাদ ভাই। পরবর্তীকালে এসেছে কাজী জাফর।

শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট এল। হামুদুর রহমান কমিশন, শরিফ

কমিশন ইত্যাদি।

মহি: তখন শরিফ কমিশন। একটা কথা বলি, শরিফ কমিশনের রিপোর্ট আপনারা কেউ পড়েছেন?

সিরাজ : পড়েছি মানে, আউটলাইনগুলো জানি।

মহি : ওটাতে এমন কিছু ছিল না। যা ছিল, তা এখন এ দেশে ইমপ্লিমেন্ট হচ্ছে। মানে আইয়ুববিরোধী একটা আন্দোলন করতে চেয়েছিলেন আপনারা?

সিরাজ : না না, ওই যে তিন বছরের পাস কোর্স? আমরা এটার পক্ষে ছিলাম না।

মহি: কিন্তু তিন বছর হলে অনার্স আর পাস কোর্সের মধ্যে যে। একটা ফারাক ছিল, ওটা বন্ধ হতো।

সিরাজ : না। পাস কোর্স দুই বছরেরই হবে। অনার্স হবে তিন বছরের। পাস কোর্স তিন বছরের হবে কেন, এই ছিল কথাটা। কিন্তু ওখানে সেমিস্টার সিস্টেমটা ছিল। এটা বাদ দিতে গিয়ে সেমিস্টার সিস্টেমও বাদ গেল। যে কারণে আমরা পিছিয়ে পড়লাম। সেমিস্টার সিস্টেমটা তো খুবই ইফেকটিভ সিস্টেম।

তো সারা বছর স্ট্রাইক হচ্ছে। আন্দোলন, মিটিং, মিছিল, এসব হচ্ছে, পুলিশের দাবড়াদাবড়ি হচ্ছে। এর মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের ওপর অত্যাচার করছে, আমাদের শোষণ করছে, এসব ধারণা আস্তে আস্তে আসা শুরু হলো।

মহি: আরেফ ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ হলো কীভাবে?

সিরাজ : তখন আমরা সিক্সটি টুতে…শিক্ষা আন্দোলনে। বিভিন্ন কলেজে গিয়ে আমরা যখন ছোট ছোট গ্রুপে আলোচনা করতাম, তখন দেখি যে একটা ছেলে বসে থাকে। বাট হি ইজ ভেরি অ্যাটেনটিভ অ্যান্ড হি ইজ ভেরি রেগুলার। জগন্নাথ কলেজে পড়ত।

ধীরস্থির ছেলেটা। আন্দোলনগুলোয় আছে। কিন্তু হইচই করার মধ্যে নাই। একটা ব্যাপোর্ট–প্রথম র‍্যাপোর্টটা হলো আমি আর রাজ্জাক, এর পরের ব্যাপোর্টটা হলো আমি আর আরেফ। এর পরে হলো আবুল কালাম আজাদ। পরে প্রাইমারি শিক্ষকদের নেতা হয়েছিল। হতে হতে আমরা একসময় তিনজন, আবার একসময় চারজন বসা শুরু করলাম–ছাত্রলীগকে কীভাবে আরও বেশি অর্গানাইজ করা যায়। এই করার মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার কথাটা আস্তে আস্তে এল। বাট নট ইন আ কংক্রিট টার্ম।

‘৬২-এর শেষের দিকে আমরা–এখনকার দিনে যাকে ককাস বলে–ঠিক করলাম আমরা সেন্ট্রাল সেল টাইপের কিছু একটা করব। আউটার স্টেডিয়ামে পাঁচ-সাতটা মিটিং দেওয়ার পর আমরা ইকবাল হলের মাঠে বসতাম, টেনিস গ্রাউন্ডে। এটা অবশ্য আরও পরে। বললাম, আমরা এই কাজটা শুরু করি।

মহি : চারজনে?

সিরাজ: হ্যাঁ। চারজন থেকে তিনজন এসে গেল কীভাবে, তা একটু বলে রাখি। আমি জেলে গেলাম। আজাদও জেলে গেল। রাজ্জাকও জেলে। আরেফ কিন্তু জেলে যায় নাই। আজাদ বলল যে সিরাজ ভাই, আমি বোধ হয় এটার সঙ্গে থাকতে পারব না। আমাকে। বাদ দিয়ে আপনারা কাজ করেন। তবে এটার প্রতি আই উইল রিমেইন সিনসিয়ার।

মহি: জেলে এই আলাপ হলো?

সিরাজ : জেলে। জেলে তো আমরা ২০-২৫ জন একসঙ্গে থাকতাম। মনি, ওবায়দুর রহমান, আমি, রাজ্জাক, আজাদ, ছাত্র ইউনিয়নের অল লিডার্স, বদরুল হক বাচ্চু, পরে জাস্টিস হয়েছিল, হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, রেজা আলী। আজাদ বলল, আমি গরিবঘরের ছেলে। আমার ভাইদের পড়াতে হবে।

আমরা জেলে যাওয়ার পর সিটিতে আরেফ কাজ করতে থাকল। জেলে যাওয়ার আগে আমি জেনারেল সেক্রেটারি হলাম। জেল থেকে বেরিয়ে কনফারেন্স করলাম। মনে আছে, কনফারেন্স হলো ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। রাজ্জাক জেনারেল সেক্রেটারি হলো।

.

১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বড়সড় আন্দোলন শুরু হয়। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এই প্রথমবারের মতো প্রধান দুই ছাত্র সংগঠন–ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে আন্দোলন করে।

১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী করাচিতে গ্রেপ্তার হলে ঢাকায় এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। ঢাকার ছাত্রসমাজ তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের অধীনে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। সোহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তার ছাত্র আন্দোলনের একটি বড় সুযোগ তৈরি করে দেয়। এই আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হলো ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কাছাকাছি চলে আসা। সাবেক কূটনীতিক-লেখক কামরুদ্দীন আহমদের ভাষ্যে বিষয়টি উঠে এসেছে এভাবে :

ঢাকায় খবর এল ৩১ জানুয়ারি যে, শহীদ সাহেব ৩০ জানুয়ারি তারিখে গ্রেপ্তার হয়েছেন। ছাত্ররা, বিশেষ করে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে তারা সোহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ধর্মঘট করবে পয়লা ফেব্রুয়ারি। ছাত্র ইউনিয়ন, যারা শহীদ সাহেবের মার্কিনঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করেছে বহুদিন, তারা কেন এ আন্দোলনে যোগ দিল, তা আমি প্রথমটায় বুঝতে পারিনি। পরে অবশ্যই শুনেছিলাম যে তারা বহুদিন আগে থেকে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলায় এক বড় আন্দোলন করতে চেয়েছিল, কিন্তু ছাত্রলীগের তেমন সমর্থন না পাওয়ায় তারা সে আন্দোলনকে সক্রিয় করে তুলতে পারেনি। ছাত্রলীগের ধারণা, যে আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন, সে আন্দোলনে তারা বক্তৃতামঞ্চে সমর্থন দিতে পারে, কিন্তু সক্রিয় সমর্থন দিতে পারে না। এবারকার আন্দোলন জোরদার হলো, কারণ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির দাবির সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই সামরিক আইন প্রত্যাহার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান এসে গেল।

পাঁচ দিন পর্যন্ত ধর্মঘট-বিক্ষোভ ফেটে পড়তে লাগল, ক্রমাগত বেশি করে। অবস্থা সরকারের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছিল। তাই বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হলো। ছাত্রদের হল ছেড়ে যেতে আদেশ দেওয়া হলো। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসকে শহরের বিভিন্ন স্থানে ‘পজিশন’ নিতে বলা হলো।…

পরের দিন অবস্থা আরও গুরুতর হলো। সেনাবাহিনীও তলব করা হলো। ৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের হল থেকে জোর করে বের করে। দেওয়া হলো। কিন্তু ইতিমধ্যে ৭ তারিখে ছাত্র-জনতা নবাবপুর রোড পার হয়ে জেলা কোর্টের সম্মুখে আসার পর ইপিআরের জওয়ানরা প্রথম টিয়ার গ্যাস ও পরে বেয়নেট চার্জ করে।…কাঁদানে গ্যাস ছাড়া হলো। সঙ্গে সঙ্গে গুলির আওয়াজ শোনা গেল। ছাত্র-জনতা শাঁখারীপট্টির ভেতর দিয়ে, তাঁতীবাজার দিয়ে পালিয়ে গিয়ে ছত্রভঙ্গ হলো। একটি ছেলে রাস্তায় তখনো পড়ে আছে, যার ভুঁড়ি ছিদ্র হয়ে পেটের অন্ত্রনালি বেরিয়ে পড়েছে। ছেলেরা পালানোর সময় চিৎকার করে উঠল, গুলিতে একজন মারা গেছে–সে রাস্তায় পড়ে আছে। মৃতদেহ কালেক্টরের বাংলোর সম্মুখে পুলিশ নিয়ে এল। দেখা গেল, মৃত্যু হয়েছে বেয়নেটের চার্জে।

কামরুদ্দীন আহমদের ভাষ্যটি হলো একজন সংবেদনশীল পর্যবেক্ষকের। যারা বিষয়টি ভেতর থেকে দেখেছেন, তাঁদের একজন হলেন ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠক হায়দার আকবর খান রনো। ছাত্র আন্দোলন, ছাত্রসংগঠনগুলোর আন্তসম্পর্ক এবং আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে একটি অন্তরঙ্গ বিবরণ পাওয়া যায় তার কাছ থেকে। রনোর ভাষ্যটি এ রকম :

৩১ জানুয়ারি ১৯৬২ সাল। মধুর ক্যানটিনে আমরা চারটি ছাত্রসংগঠনের প্রতিনিধিরা মিলিত হলাম। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, এনএসএফ ও ছাত্রশক্তি। ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে মোহাম্মদ ফরহাদ, বদরুল হক, মহিউদ্দিন আহমেদ ও আমি ছিলাম। ছাত্রলীগ ছিল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন। ছাত্রলীগকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনে। ছাত্রশক্তির পক্ষে মিয়া মোহাম্মদ নুরুজ্জামান এবং এনএসএফ-এর পক্ষে আবুল হাসনাত। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের। মধ্যে আগেই কথা হয়েছে, আমরা সোহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ছাত্র ধর্মঘটের প্রস্তাব দেব। সিদ্ধান্তমতো ছাত্র ধর্মঘটের প্রস্তাব দেওয়া হলো। আপত্তি করল এনএসএফ ও ছাত্রশক্তি। রাত বারোটা পর্যন্ত মধুর ক্যানটিনে এই আলোচনা চলল। একপর্যায়ে মোহাম্মদ ফরহাদ বললেন, ঠিক আছে আজ আর আলোচনা বাড়িয়ে লাভ নেই, আগামীকাল আমরা আবার বসব। কোথায় কখন বসা হবে। তা ঠিক হলো। সভা এইভাবে শেষ হলো। ছাত্রলীগের শেখ ফজলুল হক মনি এবং আমরা মোহাম্মদ ফরহাদের এমন ভূমিকায় বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হলাম। কিন্তু এনএসএফ ও ছাত্রশক্তির প্রতিনিধিরা চলে গেলে ফরহাদ বললেন, আগামীকালই ধর্মঘট হবে। ওদেরকে ফাঁকি দিলাম। ওরা এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাবে, আইবিকে খবর দিতে পারবে না। কিন্তু আমরা আগামীকালই স্ট্রাইক করব।’ আমরা ফরহাদের বুদ্ধির তারিফ না করে পারিনি।

সেই মধ্যরাতে ধর্মঘটের পোস্টার লিখলাম। তখনকার দিনে হাতে লেখা পোস্টারের চল ছিল। তাও আবার খবরের কাগজের ওপর লেখা হতো পোস্টার। ধর্মঘটের ডাক দিয়ে পোস্টার লিখে প্রত্যেকটা হলে ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সেঁটে দেওয়া হলো।…বেলা এগারোটার দিকে আমতলায় ছাত্ররা জমা হলেন, খুব বেশি না, শ পাঁচেক হবে। একটা ছোটখাটো সভা হলো। আমি একক বক্তা ছিলাম। এই সভায় কোনো সভাপতি ছিল না। সামরিক শাসনকে অমান্য করে এটাই প্রথম সামরিক শাসনবিরোধী সভা ও বক্তৃতা।…

পরদিন ২ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মঘটের খবর কোনো কাগজে ছাপা হয়নি। আমরা শ দেড়েক ছাত্রের এক মিছিলসহকারে। তোপখানা রোডের প্রেসক্লাবের সামনে উপস্থিত হয়ে সব কটি খবরের কাগজ পোড়ালাম। সেখানে আবদুর রহিম আজাদ জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য রাস্তায় বক্তৃতা এই প্রথম।

পরদিন ৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের মন্ত্রী মনজুর কাদের এসেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি। তিনি বক্তৃতা করবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর্টস বিল্ডিংয়ের দোতলায় এক নির্ধারিত রুমে তিনি এলেন এবং যথারীতি বক্তৃতা শুরু করেছেন বা করতে যাচ্ছেন, এমন সময় শ্রোতাদের কাছ থেকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে থাকেন। প্রধানত জিয়াউদ্দিন মাহমুদ প্রশ্ন করতে শুরু করেন। ‘গণতন্ত্র নাই। কেন?’ ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কেন?’ এইসব ছিল প্রশ্ন। বস্তুত মনজুর কাদেরকে প্রশ্নের জবাবও ভালোভাবে দিতে দেওয়া হয়নি। জিয়াউদ্দিন মাহমুদ এগিয়ে এসে তাকে ধাক্কা মারেন এবং চলে যেতে বলেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁকে আগলিয়ে ধরে নিয়ে গেল। কিন্তু তার ওপর থুতু বর্ষিত হতে লাগল। মুখে, গায়ে, কাপড়ে থুতু গিয়ে পড়ল। বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে মন্ত্রীর যে গাড়িটি রাখা ছিল, তা অগ্নিদগ্ধ হলো। পুলিশের গাড়িতে করে মন্ত্রীকে সরিয়ে নেওয়া হলো। এরপর আমতলার ছাত্রসভায় জিয়াউদ্দিন মাহমুদ খুব গরম বক্তৃতা দিলেন। আর্টস বিল্ডিংয়ে যত ছাত্র ছিল, সবাই জমায়েত হয়েছিল সেই সভায়।

এই তিন দিনের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ বেশ তেতে উঠেছে। খবরের কাগজে কোনো রিপোর্ট না থাকলেও মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সরাসরি মার্শাল লকে চ্যালেঞ্জ করেছে।

পরের দু-তিনদিন তেমন কিছু ঘটেনি। একদিন ছিল রবিবার। ছুটির দিন। আরেক দিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সরকারি গোয়েন্দা বিভাগের জনৈক কর্মচারী ধরা পড়ে। তাকে ছাত্ররা বেদম প্রহার করে। এই ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন বদরুল হক।

৬ ফেব্রুয়ারি কার্জন হলের মাঠে প্রায় হাজার তিনেক ছাত্র জমা হয়েছিল সকালবেলায়। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম মিছিল বের করতে হবে। প্রথমে হাইকোর্টের মোড়েই পুলিশ বাধা দেয়। আবু তালেব ও দিলীপ দত্ত গ্রেপ্তার হলেন।

‘৬২-র সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে তাঁরাই প্রথম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পুলিশের প্রতি ইট নিক্ষেপ করা হলো। একপর্যায়ে পুলিশ বহনকারী একটি বাসে আগুন লাগানো হয়। হাইকোর্ট ও কার্জন হলের মাঝখানের রাস্তাটা হয়ে উঠল লড়াইয়ের জায়গা। ওই রাস্তায় সেনাবাহিনীর জিওসির গাড়ির ওপরও পাথর ছোঁড়া হয়েছিল। পুলিশের সঙ্গে যখন সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, তখন আমরা কজন ঠিক করলাম মেডিকেল কলেজের পাশ দিয়ে পুরান ঢাকায় মিছিল নিয়ে যাওয়া হোক। এ পথে তখন পুলিশ ছিল না। সেই পথে আমরা মিছিল বের করলাম। একটু যেতেই সাধারণ মানুষও যোগ দিয়েছিল। প্রায় দশ হাজার মানুষের মিছিল পরিণত হয় সামরিক শাসনবিরোধী স্লোগানে মুখরিত মিছিলে। খুবই জঙ্গি। বিশাল মিছিল পুরান ঢাকা প্রদক্ষিণ করে নবাবপুর রোড, গুলিস্তান হয়ে কার্জন হলে ফিরে আসে। গোটা পথ প্রদক্ষিণ করতে তিন ঘণ্টার মতো লেগেছিল। মিছিল চলার পথে যেসব দোকান, অফিসে আইয়ুব খানের ছবি ছিল, সেসব জায়গা থেকে ছবি নামিয়ে ভেঙে ফেলা হলো।…

পরদিন ৭ ফেব্রুয়ারি আবার একই পথে মিছিল বের হলো কার্জন হল থেকে মেডিকেল কলেজের পাশ দিয়ে পুরান ঢাকার দিকে। সেদিন মিছিল বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল নবাবপুরের রথখোলার মোড়ে। সামনের দিক থেকে পুলিশ বাধা দিল এবং টিয়ার গ্যাস ছুড়ল।…এরপর পুলিশের বদলে মিলিটারি এসে দাঁড়াল। আমাদের দিকে মেশিনগান তাক করে পজিশন নিয়েছে।…

৭ ফেব্রুয়ারি সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম পর্যায় শেষ হলো। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি পরবর্তী পর্যায়ের জন্য। অপেক্ষা করছি কবে ইউনিভার্সিটি খোলে। কিন্তু এর মধ্যে ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি জনগণের অন্য কোনো অংশকে মাঠে নামানো গেল না। এমনকি অন্যান্য কলেজের ছাত্রদেরও কোনো সভা বা মিছিল হয়নি। রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে একটা হরতালের ডাক দেওয়া যেতে পারত। না, তেমন কিছুই হয়নি।

১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের অ্যাকটিভিস্টদের একজন ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠক পঙ্কজ ভট্টাচার্য। তিনি ছিলেন জগন্নাথ হল শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। ১৯৬৩ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি হন। ওই সময় সভাপতি বদরুল হক গ্রেপ্তার হয়ে গেলে তিনি ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সহযাত্রী হওয়ার পটভূমি জানতে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে আমার কথোপকথন ছিল এ রকম:

মহিউদ্দিন আহমদ : ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন একসঙ্গে আন্দোলন করবে, এটা তো একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। কীভাবে এটা হলো?

পঙ্কজ ভট্টাচার্য : ১৯৬১ সালের মে মাসের শুরুর দিকে মানিক মিয়ার দূতিয়ালিতে তাঁর কাকরাইলের বাসায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা

মণি সিংহ এবং খোকা রায়ের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বৈঠক হয়। বৈঠকে শেখ মুজিব বলেছিলেন, এখন থেকে স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব তুলতে হবে।’ এই পটভূমিতে ছাত্রলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনি এবং ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মোহাম্মদ ফরহাদের মধ্যে বেশ কয়েকবার বৈঠক হয় এবং তারা দুই সংগঠনের যৌথ আন্দোলনের ব্যাপারে একমত হন। এ রকম একটা বৈঠকে আমি উপস্থিত ছিলাম। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি রেজা আলীর। ইস্কাটনের বাসায় দুই সংগঠনের প্রায় ৩০ জনের একটা বর্ধিত সভা হয়। দুই দলের অ্যাকটিভিস্টরা উপস্থিত ছিলেন। এঁরা এসেছিলেন শেখ মনি এবং মোহাম্মদ ফরহাদের পছন্দের ভিত্তিতে।

৩১ জানুয়ারি খবর আসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রেপ্তার হয়েছেন। ওই দিন মধুর ক্যানটিনে ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ সভা ছিল। এ সময় হঠাৎ এনএসএফের নেতারা এসে হাজির। যেহেতু তারা সরকারি দল, আমরা তাদের সামনে আলাপ-আলোচনা করতে চাইনি। চোখের ইশারায় আমরা প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলি। ঠিক হয় রাতে আবার সভা হবে।

রাত দুটোর সময় ইকবাল হলে আবার সভা বসে। ঠিক হয়, পরদিন সকাল দশটায় আমতলায় ছাত্রসভা হবে। আগেই সিদ্ধান্ত ছিল পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে আন্দোলন হবে। সোহরাওয়ার্দী গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি পাল্টে যায়। আন্দোলনের ফোকাস তখন গিয়ে বন্দিমুক্তির দাবিতে দাঁড়ায়। একটানা কয়েক দিন বিক্ষোভ মিছিল হয়। ৩ তারিখে মিছিলে দুপাশের বাড়ির বারান্দা ও ছাদ থেকে আমাদের ওপর ফুল ছিটানো হয়েছিল। ৫ তারিখ দিলীপ দত্ত গ্রেপ্তার হন। আমাকেও পুলিশের গাড়িতে তোলা হয়েছিল। আমি গাড়ি থেকে লাফিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাই এবং ওয়াইজঘাটে এক ব্যাংক কর্মচারী আমাকে আশ্রয় দেয়। ওই দিন মিছিলটি সদরঘাট হয়ে শহীদ মিনার পর্যন্ত যায়। বিভিন্ন দোকানে রাখা আইয়ুব খানের ফটো আমাদের কাছে দিলে আমরা তা বাঁশের ডগায় উঁচিয়ে আগুন ধরিয়ে দিই। অনেক স্কুলের ছাত্র ইউনিফর্ম পরে মিছিলে যোগ দিয়েছিল। এটা ছিল অভিনব। ঢাকা কলেজ, কায়েদে আজম কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে শরিক হয়েছিল।

মহি : কত দিন চলেছিল আন্দোলন?

পঙ্কজ : আমাদের বিক্ষোভ মিছিল চলেছিল ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। কিন্তু বন্দিমুক্তি ও শিক্ষার দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত ছিল। আগস্ট মাসে শরিফ কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত স্থগিত ঘোষণা করা হলে আমাদের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে এটা ছিল আমাদের বিজয়। তারপর আমরা কমিশনের রিপোর্ট পুরোপুরি বাতিলের দাবি জানাতে থাকি।

.

১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন রিপোর্টকে কেন্দ্র করে আইয়ুব খান সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল বেশ জোরেশোরেই। ওই সময়েই ছাত্রনেতা হিসেবে সিরাজুল আলম খানের উত্থান। সাধারণ কর্মী থেকেই তিনি হয়েছিলেন একজন সংগঠক। ওই সময়ের একটি বিবরণ আমি পেয়েছি মোস্তফা মোহসীন মন্টুর কাছ থেকে। ষাটের দশকের শেষ দিকে ছাত্র আন্দোলনে মন্টু খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ‘৬২ সালে তিনি নিতান্তই একজন কিশোর। তার এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় আলাপ হলো :

মোস্তফা মোহসীন মন্টু : ১৯৬২ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় আমি স্কুলে পড়ি, নবকুমার ইনস্টিটিউশন। আমাদের ওপর দায়িত্ব পড়ল কারওয়ান বাজারের মোড়ে রেলগেটে। ওখানে একটা গেট বানানো হয়েছিল। আমরা ১৫-২০ জন গেলাম সেখানে। পলিটেকনিক স্কুলের কিছু ছেলেও এসেছে। আমরা ওই গেটে আগুন লাগিয়ে দিলাম। এর মধ্যে আর্মি এসে গেল।

মহিউদ্দিন আহমদ : আপনাদের অর্গানাইজ করেছিলেন কে?

মন্টু : সিরাজ ভাই। উনি তখন ছাত্রলীগের সেক্রেটারি না, মনি ভাই সেক্রেটারি। আর্মি এসে আমাদের ঘিরে ফেলল। এর মধ্যে দু তিনজন দৌড়ে পালিয়ে গেল। একজন সৈন্য এসে বলল, বাচ্চালোগ, ইয়ে কাম তোম আচ্ছা নেহি কিয়া। তোমকো ইয়ে করনা নেহি। চাহিয়ে। তোমকো কোন ভেজা?

আমি ভাঙা ভাঙা উর্দুতে উত্তর দিলাম, আইয়ুব খান কো নেহি মাংতা।

–ও মেরা সদর (প্রেসিডেন্ট) হ্যায়। ঠিক হ্যায়, জিসকে জিসকে। ঘর যানা হায়, ঘর যাও। আর জিসকো পুলিশ চৌকিকে মে যানা হ্যায়, উনলোগ ট্রাক মে ওঠ যাও।

আমরা ১০-১২ জন ট্রাকে উঠে পড়লাম। আমাদের নিয়ে গেল ক্যান্টনমেন্টে। একটা ব্যারাকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। শীতের দিন। বিকেল হচ্ছে, আমরা শীতে কাঁপছি। পরে দুবার করে কম্বল দিল, মোটা পশমের কম্বল। সন্ধ্যা সাতটার দিকে আমরা চিৎকার শুরু করলাম। পরে চাদর এনে দিল। এক চাদরে হয় না। একটা বিছাব, আরেকটা কম্বলের নিচে দিতে হবে। দুইটাই দিল। পরে খাবার রুটি, খাসির মাংস আর ডাল। ঠেসে খেলাম। পরদিন সকালে ভালো নাশতা দিয়েছে। ওদের একজন মহিলা ডাক্তার ছিল। সে আমাদের পরীক্ষা-টরিক্ষা করল।

মহি: বাঙালি?

মন্টু : না, পাঞ্জাবি। ওর সঙ্গে আরেকজন জুনিয়র পুরুষ ডাক্তার ছিল, বাঙালি। বলল, তোমরা বাবা এ অবস্থায় কেন এগুলো করতে যাও। এখন তো মার্শাল ল চলছে। তোমরা এগুলো করবা না। তোমাদের ক্ষতি হয়ে যাবে। মিলিটারির তো নিয়ম-টিয়ম আছে। তারা মানুষ মারলে কোনো বিচার-টিচার হয় না।

তারপর গাড়িতে করে রমনা থানায় পাঠিয়ে দিল। থানা থেকে আমার বড় ভাইকে খবর পাঠানো হলো। উনি থানায় এসে বন্ড দিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেলেন। এটাই আমার জীবনে প্রথম ধরা পড়া।

আমতলাতে আমরা মোয়াজ্জেম ভাইয়ের (শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন) বক্তৃতা শুনতে যেতাম। মোয়াজ্জেম ভাই আধা মিনিট থেকে এক মিনিট বাংলায় বলতেন। তারপর ইংলিশ। কথাবার্তা যেন কামানের গোলার মতো বের হতো তার মুখ দিয়ে। গলাটাও ছিল ওই রকম। তার গলা শুনে মনে হতো, এখনই যুদ্ধে চলে যাই। গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যেত। [৫]

.

ফিরে আসি নিউক্লিয়াস প্রসঙ্গে। সিরাজুল আলম খান তখন ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। শেখ মুজিবুর রহমান তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং মূল সংগঠক ও নেতা। রাজনৈতিক দলগুলো তখন অতটা সক্রিয় নয়। ওই সময় শেখ মুজিবের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা। হয় সিরাজুল আলম খানের। এটা ১৯৬২ সালের শেষের দিকে বা ১৯৬৩ সালের শুরুর দিকের কথা।

মোয়াজ্জেম ভাই আমাকে প্রথম নিয়ে যায় মুজিব ভাইয়ের কাছে–উনি আলফা ইনস্যুরেন্স ইস্ট পাকিস্তানের জেনারেল ম্যানেজার। তৎকালীন জিন্নাহ অ্যাভিনিউ-এখনকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে অফিস। সামনে একটা সাদা কাগজ। সেখানে কিছু লিখলেন। মোয়াজ্জেম ভাইকে বললেন, তুই তো থাকছিস না। মনি। প্রেসিডেন্ট, ওবায়দুর রহমান জেনারেল সেক্রেটারি, অর্গানাইজিং সেক্রেটারি সিরাজুল আলম খান। তারপর অন্য প্রসঙ্গে তিনি চলে। গেলেন। বললেন, ভালো করে কাজ কর ইত্যাদি।

আমার কাছে কেন যেন ভালো লাগেনি। প্রথম কথা হলো, ওই যে দুই নম্বর হব না। অর্গানাইজিং সেক্রেটারি মানেই তো দুই নম্বর। আগেই মোয়াজ্জেম ভাইয়ের কাছ থেকে আমি জেনে নিয়েছি ছাত্রলীগ কী। উনি বললেন, এটা জেনারেল সেক্রেটারি বেজড অর্গানাইজেশন। হি ইজ দ্য এক্সিকিউটিভ চিফ। প্রেসিডেন্ট তো প্রেসিডেন্টই। ওখানে কোনো কথা বলার তো দরকার নাই। আমি চলে এসেছি। বললাম, হাউ আই কেম ইন কনট্যাক্ট উইথ মুজিব ভাই।

রেজা কাদের ভাই এমএ পাস করে গেলেন। চাকরি হচ্ছে না। বাই দিস টাইম আমিও হলে থাকতে পারি না। ওনাকে বললাম। বললেন, নিম ভিলায় চলে আসেন। দুজনে এক বিছানায় থাকি। আলাদা থাকলে তো মাসে ৩০ টাকা দিতে হয় সিটভাড়া।

মহি: এটা কোন জায়গাটা? সিরাজ : নিমতলী। আগে যে জাদুঘরটা ছিল, পুলিশ হসপিটাল, ওখানে একটা রেলক্রসিংয়ের মতো ছিল, তার ডান দিকে গেলে নাজিমউদ্দিন রোডে বেরিয়ে যাওয়া যায়।

মহি : ওখানে মেস?

সিরাজ : অ্যারিস্টোক্রেটিক মেস। ওখানে নন-সিএসপি ছিল মোয়াজ্জেম ভাই, রেজা কাদের ভাই আর আমি। আর সবাই ওখান থেকে সিএসপি হতো।

মহি: ডেইলি এক টাকা ভাড়া?

সিরাজ : মাসে ৩০ টাকা। আর এক টাকার খাবার।

মহি : সারা দিনের খাওয়া এক টাকা?

সিরাজ : হ্যাঁ। আমি তো একটু বেশি খানেওয়ালা! রেজা কাদের ভাই থাকলে ভাগ করে খেতাম। উনি প্রাইভেট পড়াতেন। তাতে যা টাকা-টুকা পেতেন, তা দিয়ে খাওয়াদাওয়া। আর তো শুধু হাঁটা। সিগারেট খেতাম তখন। [৬]

.

সিরাজুল আলম খান ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে পুরান ঢাকার পাকিস্তান মাঠে ছাত্রলীগের সম্মেলনের আয়োজন হলো। এই অধিবেশনে তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কে এম ওবায়দুর রহমানকে করা হয় সভাপতি। ওই সময়ের একজন সাক্ষী হলেন মাহবুব তালুকদার। তাঁর বয়ানে উঠে এসেছে নানান কথা।

মাহবুব তালুকদার : আমি ওই পিরিয়ডে ইত্তেফাক-এ বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা ছিলাম। যারা ছাত্ররাজনীতি করে, তারা সবাই আমার বন্ধু হয়ে গেল। কারণ, ইত্তেফাক তখন একটা দুর্ধর্ষ পত্রিকা। ওইটাতে যদি নাম ছাপানো যায়, এটা একটা বিরাট প্রাপ্তি হলো বলে তারা মনে করে। নাম ছাপাটা অনেক ক্ষেত্রে আমার ওপরই নির্ভর করত। আর আমি ছিলাম একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার। পরে অবশ্য পাকিস্তান অবজারভার-এ মিজানুর রহমান শেলী বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে ছয় মাস কাজ করেছিল।

মহিউদ্দিন আহমদ : সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ বা সম্পর্ক কেমন ছিল?

তালুকদার : সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আমার একটা অদ্ভুত বন্ধুত্ব। শেখ ফজলুল হক মনি, ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, এনায়েতুর রহমান, সিরাজুল আলম খান–এদের মধ্যে দুজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেশি হয়। একজন হলো শেখ ফজলুল হক মনি, আরেকজন হলো সিরাজুল আলম খান। সম্পর্কটা তুমি পর্যায়ের না। এটা তুই’ পর্যায়ের। খুব ঘনিষ্ঠ না হলে তো আমরা কাউকে তুই বলি না।

একবার সিরাজ হাসপাতালে। খবর পাঠাল, আমাকে দেখতে চায়। গেলাম। অনেক লোকজন ছিল। বলল যে, তোমরা সরে যাও। আমি এখন আমার বন্ধুর সঙ্গে থাকব। সবাই চলে গেল। আমরা বসে বসে কত রাজ্যের গল্প করলাম। নো পলিটিকস।

আমার অনেক সময় মনে হতো, সরকারের সঙ্গে এই লোকটার সম্পর্ক আছে কি না। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। মনির ব্যাপারে তো মনে হয় নাই। ওবায়দুর রহমানের ব্যাপারে তো মনে হয় নাই। তার কারণ হলো…

মহি : এটা কি ওই সময় মনে হয়েছে? ছাত্রজীবনে?

তালুকদার : হ্যাঁ, হ্যাঁ। মনে হয়েছে কেন? তার একটা বড় কারণ হলো, ওর মধ্যে যে রহস্যময়তা এসে দানা বাঁধছিল–লোকে বলে না, সে রহস্যময়? ওটা তখন থেকেই ছিল। আমার মনে হতো, ব্যাপারটা কী? ওর সঙ্গে কি কোনো এজেন্সির সম্পর্ক আছে? কী সব বলে, কী করে, না করে? এটা নিয়ে আমি কনসার্নড় ছিলাম না। ছাত্রলীগের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল দুইটা বিষয়ে। সম্ভবত ১৯৬৪ সালে একটা মহাসম্মেলন হয়। সারা দেশ থেকে ১০-১৫ হাজার ছাত্রলীগ সদস্য পাকিস্তান মাঠে এসেছিল।

মহি : এটা ১৯৬৩ সালে।

তালুকদার : পাকিস্তান মাঠে আবদুল লতিফের পরিচালনায় আমার লেখা একটা গীতিনকশা মঞ্চস্থ হয়েছিল, যেখানে বায়ান্ন থেকে ধারাবাহিকভাবে ওই সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরেছিলাম। এটা খুব সাকসেসফুল হয়েছিল। ইত্তেফাক-এর প্রথম পাতায় বিরাট করে ছাপা হয়েছিল। এই হলো একটা। আরেকটা এর আগে। ছাত্রলীগের প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারির ম্যাগাজিন আমি এবং আমার বন্ধু সৈয়দ আহমদ–মারা গেছে–আমরা দুজন যৌথভাবে সম্পাদনা করেছিলাম, সম্ভবত ১৯৫৮ সালে।

মহি: আপনি কখনো ছাত্রলীগ করেননি?

তালুকদার : আমি তো সাংবাদিক। আমি ছাত্রলীগ করব কেন? আমার যত দূর মনে আছে, কিছুদিন ছাত্রলীগের কালচারাল ফ্রন্টের প্রধান ছিলাম, কেন্দ্রীয়। [৭]

.

১৯৬৩ সালের ছাত্রলীগ সম্মেলন ছিল সিরাজুল আলম খানের উত্থানপর্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ওই সম্মেলনে তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক পদের একজন দাবিদার। তার পেছনে দারুণ সমর্থন জুগিয়েছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। বিরোধিতা করেছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি আমি।

মহি: মোয়াজ্জেম ভাই তো যাবেন ‘৬৩ সালে। আপনি তো ‘৬৩ সালে সেক্রেটারি হলেন।

সিরাজ : হ্যাঁ। ওখানে দেখলাম, যারা ফরিদপুর আর বরিশাল থেকে এসেছে, ওরা আমার বিরুদ্ধে। আর সবাই আমার পক্ষে, ইনকুডিং ঢাকা সিটি। হোল হাউস ঢাকা সিটির নেতৃত্বে আমার পক্ষে। অন্য পক্ষে ওবায়দুর রহমান প্রেসিডেন্ট। চিটাগাং থেকে সামবডি অথবা অন্য জায়গা থেকে সেক্রেটারি হিসেবে কার কার নাম এসেছে। বাট নট মি। আমি তো সাপোর্টেড বাই শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। কী কারণে আমাকে নিয়ে দুই পক্ষ হলো, আমি আজও বুঝি না।

মহি: ফেরদৌস কোরেশীর সঙ্গেই বোধ হয় এটা হয়েছিল? সিরাজ : ফেরদৌস কোরেশী, আর পরে শুনেছি আবদুল হাই সাচ্চু। ওই যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। ফেরদৌস কোরেশী তো শেখ মুজিবের পক্ষে বা মনির পক্ষে না। এটা হলো চিটাগাংওয়ালাদের কাজ। ফেরদৌস কোরেশীর একটা সুনামও ছিল। তখন যে বন্যা। হয়েছিল, বন্যার জন্য সারা দেশে আমরা সাহায্য নিয়ে গিয়েছিলাম। উনি চিটাগাংয়ের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। তার নামটা সবাই জেনে গিয়েছিল। আমাকে জেনেছিল অ্যাক্টিং সেক্রেটারি হওয়ার কারণে, সবার সঙ্গে আমার যোগাযোগ, সেই কারণে। আমি তো সেক্রেটারি হয়ে গেলাম।

তারপর তো কাজের ধারা আমরা স্পিডআপ করলাম। আমরা বিপ্লবী বাংলা নামে একটা পেপার বের করলাম। হাতে লিখে। কয়েকটা সংখ্যা করেছিলাম। এগুলো খুব গোপন। কারণ, ধরা পড়লেই, মানে বেত মারা। আর জেল তো আছেই। রাজশাহীতে একটা স্কুলের ছেলে একটা গোপন দলের পোস্টার লাগাতে গিয়েছিল। তাকে আটটা বেত মারা হয়েছে। সে যখন জেল থেকে বের হলো, তাকে এক্সিবিট করা হলো। ছাত্র ইউনিয়ন ওটা করল। আমরা পক্ষে ছিলাম। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন ওই ছেলেকে তাদের পকেটে নিয়ে গেল।

মহি: এই যে আপনারা ক্ল্যানডেসটাইন কাজ করছিলেন, ওই সময় যারা আপনাদের সিনিয়র বা কনটেম্পোরারি ছিল, বিশেষ করে মোয়াজ্জেম ভাই বা মনি ভাই, এঁদের কনফিডেন্সে নিলেন না কেন?

সিরাজ : মোয়াজ্জেম ভাই হঠাৎ আমাকে আর মনিকে ডাকলেন। হসপিটালে ব্রাদার-সিস্টাররা যেখানে থাকেন, তাদের চিফের বাসায়। ছিলেন। আজিমপুর কলোনিতে। পেপারে নাম দিয়েছে সারেন্ডার করার জন্য। তাদের নামে তখন হুলিয়া। বললেন, সারেন্ডার করব।

মহি : এটা মোয়াজ্জেম ভাই বললেন?

সিরাজ : হ্যাঁ। বললেন, দেশ থেকে একটু ঘুরে আসি। মুন্সিগঞ্জ থেকে। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করায় বললেন, পরে জানাব। বের হয়ে এসে মনি বলল যে তোরা ঢোকার আগে উনি আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, উনি এটার সঙ্গে থাকবেন না।

মহি: মোয়াজ্জেম ভাই থাকবেন না? এটা মনি ভাইকে আগেই বলেছিলেন?

সিরাজ : আগে মানে ওই বৈঠকের আগে। এই ওনার ডিসঅ্যাসোসিয়েশন হয়ে গেল। আর মনির ডিসঅ্যাসোসিয়েশন হলো তার গলায় রক্ত। আর সে বিয়ে করে ফেলল। সেরনিয়াবাত সাহেবের মেয়ে। ওদের একই বংশের মধ্যে বিয়ে হয়, জানো তো? আমি পড়ে গেলাম একা। কিন্তু মাথায় তো পোকাটা ঢুকে গেছে। ওইটার সঙ্গে আর ওরা নাই। আমরা যেটা শুরু করলাম, একেবারে লিংকবিহীন। আমাদের নিউক্লিয়াসটা শুরু করলাম। [৮]

সিরাজুল আলম খানের কথায় বোঝা যায়, শাহ মোয়াজ্জেম, শেখ মনি ও তিনি–তিনজনই একটা গোপন প্রক্রিয়ায় শেখ ফজলুল হক মনি ছিলে। পরে তাঁদের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের সংযোগ কেটে যায়। শেখ মনিকে তাঁদের চক্র থেকে বাদ রাখার যে কারণ সিরাজুল আলম খান দেখিয়েছেন, তা পুরোপুরি সত্য নয়। শেখ মনি বিয়ে করেন অনেক বছর পর, উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের পর। অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। এর পরপর তিনি গ্রেপ্তার হয়ে যান।

.

শেখ মনি ও সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন ছিলেন শামসুজ্জামান খান (বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক)। তাঁরা প্রায় একই বয়সের। শামসুজ্জামান খানের কাছ থেকে ওই সময়ের একটি বিবরণ পাওয়া যায়। তার সঙ্গে আমার কথোপকথন ছিল এ রকম:

শামসুজ্জামান খান : ১৯৫৯ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, বাংলা বিভাগে। আমার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, কোনো মুসলিম হলে ভর্তি হব না। তখন ঢাকা হল (পরে নাম হয় শহীদুল্লাহ্ হল) ছিল একমাত্র। কসমোপলিটান হল। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই থাকতে পারত।

১৯৬০ সালের শেষ দিকে আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড একটু শুরু হলো। জগন্নাথ কলেজে আমার ক্লাসেই ছিল শেখ ফজলুল হক মনি। সে খুব সক্রিয়। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে পরিচয় হলো। যেহেতু আমি ছাত্রলীগ করি, আমি আর আসমত আলী শিকদার, আমাদের দুজনের রুম ছাত্রলীগের রাজনীতির কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ছিল। এখানে ওবায়দুর রহমান আসতেন। তখন তাকে আমরা জঙ্গিনেতা বলতাম। বরিশালে অশ্বিনীকুমার হলের নাম বদলে আইয়ুব হল করেছিল। তখন যারা নেতৃত্ব দিয়ে ওটা তুলে ফেলেছিল, ওবায়েদ সেখানে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিল।

মহিউদ্দিন আহমদ : মানে আইয়ুব হল বদলে আবার অশ্বিনীকুমার হল।

শামসুজ্জামান : হ্যাঁ। তখন আমরা একটু পেকে গেছি মনে হয়। ওবায়েদ এসেছেন মফস্বল থেকে। একটু কাঁচা ধরনের। হলের ইলেকশন হবে। ওবায়েদকে পাঠাতাম, যান, কনট্যাক্ট করে আসেন। পরে তো নেতা হলেন। ভালো বক্তৃতা করতেন। প্রথমে ঢাকা হলের হোয়াইট হাউসে ৩১ নম্বর রুমে থাকতাম। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদও রেসিডেন্ট হিসেবে ঢুকলেন।

মহি: আপনারা কি একই ব্যাচের?

শামসুজ্জামান : না। উনি আমার তিন বছরের সিনিয়র। ওনারা ছাত্র ইউনিয়ন করেন। আবদুল্লাহ আল আমিন, মোফাজ্জল করিম ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। ছাত্রলীগে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা কম ছিল। আমাদের হলে আগে আহমেদুর রহমান ছিলেন। তিনিও ছাত্র ইউনিয়নপন্থী। নির্মল সেন, আবদুল গাফফার চৌধুরী ছাত্রলীগ করতেন।

সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়ন খুবই অ্যাকটিভ। আমরা তো সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে খুব দুর্বল। মনির সঙ্গে আলাপ হলো, মোয়াজ্জেম সাহেবের সঙ্গে আলাপ হলো। বললেন, আমাদের মধ্যে তো এ রকম কেউ নেই। তোমরা করো।

১৯৬৩ সালে ছাত্রলীগের কনফারেন্স হলো। তখন পাকিস্তান মাঠ, এখন বোধ হয় বাংলাদেশ মাঠ নাম দিয়েছে। নিমতলীর পাশে, আগা সাদেক রোড। আমি ১০ জন বুদ্ধিজীবীকে আনলাম। আমাকে চিফ ইলেকশন কমিশনার করা হয়ছিল।

তখন এনএসএফও সামনে এসে গেছে। মেননকে ডাকসু অফিসের সামনে ফেলে বেশ মারপিট করল। ছাত্রলীগের গায়ে তেমন হাত পড়েনি। তখন ছাত্রলীগ মূলধারার দিকে একটা শক্তিশালী অবস্থানে গেছে। তার আগে কিন্তু ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র ইউনিয়ন শক্তিশালী। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারা মাত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তখন ওই সম্মেলনটা করলাম। ওই সময় থেকে। ছাত্রলীগে সংস্কৃতির দিকে একটু চোখ পড়ল।

অনার্সের পর আমি ৫২ নম্বর রুমে গেলাম–সিঙ্গেল সিটেড রুম। আমার পাশে থাকতেন মোফাজ্জেরুল হক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়তেন। আমরা পত্রিকা বের। করেছি। ঢাকা হলের পত্রিকার নাম ছিল শতদল। আমি সম্পাদক। ভবতোষ দত্ত এখানে ছাত্র ছিলেন। তিনি কলকাতা থেকে লেখা পাঠালেন। মুনীর। চৌধুরী স্যারের লেখা ছাপলাম। আর্কিটেকচারের ওপর ইংরেজিতে একটা লেখা মোফাজ্জেরুল হক অনুবাদ করলেন।

আমাদের সময় প্রিফেক্ট সিস্টেম ছিল। সিনিয়র ছাত্রদের প্রিফেক্ট করা হতো। প্রিফেক্টের কাজ ছিল রাতের বেলা রেজিস্টার বই নিয়ে ১০টার সময় সবাই উপস্থিত আছে কি না, সেটা চেক করা। এমএ ক্লাসের ছাত্র হয়ে এমএ ক্লাসের ছাত্রদের পরীক্ষা করছি। এখন হলে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রও রোলকল করা বুঝিয়ে দিত!

তখন আমি ২৪ নম্বর রুমে থাকি। রাতে কমনরুমে আকাশবাণীর গান শুনি। সিরাজুল আলম খান এলেন এবং আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো। উনি ম্যাথমেটিকস পড়তেন। আমার রুমে ফ্লোরে থাকতেন। দেখতাম, সকাল ১০টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে আছেন, কিন্তু পা নাড়ছেন। সেবার আমি ইলেকশনে দাঁড়ালাম, হলের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে।

মহি : এটা কোন সালে?

শামসুজ্জামান : ‘৬৩ সালে। আমি মোটামুটি জনপ্রিয়ই ছিলাম। তখন ছাত্রলীগ কোয়ালিশন করল এনএসএফের সঙ্গে। আমি বললাম, হেরে গেলেও আমি এনএসএফের সঙ্গে কোয়ালিশন করব না। ড. মুশফিকুর রহমান ছিলেন প্রভোস্ট। আমাকে বললেন, একটা পোস্ট ওদের দিয়ে দাও।

আমি বললাম, স্যার, ক্ষমা চাই। আমার পক্ষে এটা করা সম্ভব না। যাহোক, ইলেকশন হলো। আমি ১৫১ ভোট পেলাম। ছাত্র ইউনিয়নের বজলুর রহমান জিতল। পরে এক পর্যালোচনা মিটিংয়ে সিরাজুল আলম খান বললেন, ‘এত ভালো ক্যান্ডিডেট দিয়েও আমরা হেরে গেলাম। তবে উনি যে স্ট্যান্ডটা নিয়েছেন, সেটা বোধ হয় ঠিকই আছে।’

আমি যে ইলেকশনে দাঁড়িয়েছি, সিরাজুল আলম খান প্রতিদিন বক্তৃতা করতেন। মোয়াজ্জেম সাহেব, শেখ ফজলুল হক মনি আসত। বক্তৃতা করত।

আমাদের কাছে সরাসরি নিউক্লিয়াসের কথা বলা হয়নি। কিন্তু আমরা একটা সুগন্ধ পাচ্ছিলাম যে আমরা স্বাধীনতাসংগ্রামের দিকে যাচ্ছি। এটা বোঝা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

ওই সময় হলে তো মোয়াজ্জেম ভাই, শেখ মনি, এনায়েতুর রহমান থাকত না। সিরাজুল আলম খানই ছিলেন। আমাদের চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন অগ্রগামী নেতা। তখনই তিনি আমাদের নেতা ও দার্শনিক। এমনিতে তিনি সিম্পল, একটু ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ, চিন্তাশীল–এ বিষয়গুলো তাঁর মধ্যে আছে। ওই সময়…সামরিক শাসন, কাজটা কত কঠিন। [৯]

.

ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন সমীকরণ সহজ ছিল না। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে তারা কাছাকাছি এসেছিল। আবার দুই সংগঠনে ছিল প্রবল প্রতিযোগিতা। ছাত্র ইউনিয়ন ছিল গোপন কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গসংগঠন। অন্যদিকে ছাত্রলীগ ছিল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন। আদর্শগত দ্বন্দ্ব ও বিরোধ ছিল

বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী ছাত্ররা ছাত্র ইউনিয়নের দিকেই ঝুঁকতেন বেশি। তাদের চালচলন, কথাবার্তা ছিল তুলনামূলকভাবে অসাম্প্রদায়িক ও উদারবাদী। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভালো ছাত্র’ না হলে জেতা মুশকিল ছিল এবং ছাত্র ইউনিয়ন এ ব্যাপারে এগিয়ে ছিল। বিশেষ করে নারী ও অমুসলমানদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের সংযোগ ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল বেশি। ছাত্রলীগে যাঁদের সমাবেশ ঘটত, তারা বেশির ভাগই ছিলেন মধ্য কিংবা নিম্নমানের। ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিলেন কেউ কেউ। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে জীবন গড়ার যে দৌড়, তাতে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য বা সমর্থকেরা ছিলেন এগিয়ে। শুধু মিটিং-মিছিল বা হইহুল্লোড় করে তো আর ‘সিএসপি’ হওয়া যায় না!

নানা ইস্যুতে একসঙ্গে আন্দোলন করলেও আদর্শগত মতপার্থক্য ছিল। চোখে পড়ার মতো। এ প্রসঙ্গে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আমার যে। কথাবার্তা হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে, দলীয় ইগো অনেক সময় ঐক্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াত।

মহি: কী নিয়ে আপনাদের মধ্যে গোলমাল হতো? দু-একটা উদাহরণ দিন না।

সিরাজ : তখন তো আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান নেতা হলেন মওলানা ভাসানী। ছাত্র ইউনিয়ন তো ন্যাপের অনুসারী। আমরা স্লোগান দেওয়ার কিংবা লিফলেট লেখার সময় বলতাম বা লিখতাম সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী–এরপর জিন্দাবাদ বা মুক্তি চাই–এই সব। ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা বলত ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী। অর্থাৎ আমরা যার যার দলের নেতার নাম আগে বসিয়ে ভাবতাম এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

মহি: আপনাদের মধ্যে হাতাহাতি-মারামারি হতো না?

সিরাজ : একটা ঘটনার কথা বলি। আমি তখন ছাত্রলীগের কার্যকরী সাধারণ সম্পাদক। ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে তখন মন কষাকষি চলছে। ঢাকা হলে সন্ধ্যার পর হ্যাঁজাক লাইট জ্বালিয়ে হাউস টিউটরের উপস্থিতিতে দুই দলের নেতারা বৈঠকে বসলেন। ছাত্রলীগের পক্ষে নাজমুল ও আমি। ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে এনায়েত ভাই (এনায়েতউল্লাহ খান) এবং আরেকজন। পাঁচ-সাত। গজ দূরে জনা তিরিশেক সাধারণ ছাত্র। আলোচনার একপর্যায়ে তর্ক শুরু হলো। আমরা একে অপরকে দুষছিলাম। নাজমুল হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে এনায়েত ভাইয়ের মুখে একটা চড় মারল। এই ঘটনায় সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। মিটিং অসমাপ্ত রেখে হাউস টিউটর চলে। যান।

মহি: ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?

সিরাজ : তখন থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে আই হাড় আ। কর্ডিয়াল রিলেশন। এমনিতেই সবার সঙ্গে আমার কর্ডিয়াল রিলেশন ছিল।

মহি : ফরহাদ ভাই তো অন বিহাফ অব কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের কাজ কো-অর্ডিনেট করতেন।

সিরাজ : করত এবং হি ওয়াজ দ্য গাইড।

মহি : ওনার সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা হলো কীভাবে?

সিরাজ : আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতেন উনি। আর এরা জানত যে আই অ্যাম দ্য মেইন ম্যান ইন ছাত্রলীগ। ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি হিসেবে যারা ছিল, ওরা মাধ্যম হিসেবে কাজ করত। কোথায় দেখা হবে–ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির আহসানউল্লাহ হলে। তার কাছ থেকে সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা পেতাম। গুছিয়ে কীভাবে লিফলেট লিখতে হয়, এটাও তিনি দেখিয়ে দিতেন।

মহি : আপনি অনেক দিন আগে আমাকে একটা স্টোরি বলেছিলেন। চিকা মারার গল্পটা।

সিরাজ : হয়েছে কি, ছাত্রলীগের দু-তিনজন, আমিসহ, আর ছাত্র ইউনিয়নের সাইফুদ্দিন মানিক আর আলী রেজা।

মহি: আলী রেজা না রেজা আলী? সিরাজ : আলী রেজা। রেজা আলীও থাকত। কিন্তু আমি বলছি আলী রেজার কথা। জার্মানিতে ছিল। মারা গেছে কয়েক বছর আগে। আমরা একে অপরকে খুব পছন্দ করতাম।

আমরা ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়ন একসঙ্গে যেতাম। খুব ফ্রেন্ডলি ছিলাম। হাতে থাকত রঙের বালতি আর ব্রাশ। দুই পার্টির জন্য দুইটা। আর পুলিশের গাড়ি আসে কি না, অবজারভেশন পোস্ট থাকত। একবার আমরা ইকবাল হল থেকে বেরিয়ে এস এম হলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। লক্ষ্য হলো আর্কিটেকচার বিল্ডিং। এখানে বিরাট একটা পুকুর ছিল। নতুন আর্কিটেকচার বিল্ডিং হবে। এ জন্য দেড়-দুই বছর ধরে ইট আনা হচ্ছে। ইট জমা হচ্ছে। দেয়ালে লেখা শুরু হয়। হঠাৎ একটা ইঁদুর যায়। ইঁদুরজাতীয় কিছু–চিকা। সামনে দিয়ে চলে গেল। বললাম, এটারে মারি। তো এটা তো ইটের মধ্যে ঢুকে গেছে। চারদিকে ঘিরে দাঁড়ালাম, হুস হুস করছি। এইটা তো আর বের হয় না। ভোর সোয়া পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। আচ্ছা, বাদ দাও, আজ আর করব না। আবার হয়তো দুদিন পরে প্রোগ্রাম হলো। প্রোগ্রামটা হতো বিকেলবেলা, ইকবাল হলের ক্যানটিনে। আমরা তো বলতে পারব না, গোপনে রাতে দেয়ালে রং দিয়ে লিখতে যাচ্ছি। বলতাম, ওই যে, ওই যে, চিকাটাকে মারতে হবে না? এরপর যেদিনই যেতাম–কী কাজ, চিকা মারা। চিকা মারতে বের হব ওই টাইমটায়। ইট ওয়াজ সো পপুলার! ইনস্পায়ার্ড ফিল করত সবাই। ওখান থেকেই চিকামারা কথাটা এসেছে।

মহি: এটা কোন সময়? আপনি অ্যারেস্ট হওয়ার আগে?

সিরাজ : হ্যাঁ। ১৯৬৩ সালে।

মহি : আপনার সঙ্গে কি বাদশা ভাই (আমিনুল হক বাদশা) ছিলেন?

সিরাজ: হ্যাঁ, ও লিখে দিত। আমাদের মধ্যে লেখার একমাত্র লোক ছিল বাদশা। আমরা ডিপেন্ড করতাম ছাত্র ইউনিয়নের ওপর। সাইফুদ্দিন মানিকও লিখতে পারত। আর আর্ট কলেজ থেকে তিন চারজন নিয়ে আসত।

মহি: ছয় দফা দেওয়ার সময়টার কথা বলুন।

সিরাজ : ‘৬৫-এর যুদ্ধ একটা বিষয় শো করেছে। ইস্ট পাকিস্তানকে ভারত আক্রমণ করল না, এটা দখলও করল না।

মহি : ভারতের মার্সির ওপর থাকল।

সিরাজ : না। মানে হলো, পূর্ব পাকিস্তান একা থাকতে পারে। এই একটা ধারণা। পূর্ব পাকিস্তানকে যদি একা থাকতে হয়, ইন্ডিয়া তো কিছু করবে না? এই একটা বিষয় মাথার মধ্যে ঢুকে গেল। কিন্তু খুব একটা ফাইনাল সিদ্ধান্ত আকারে, তা না।

ছেষট্টিতে যখন ছয় দফা দিল, একদিন দেখলাম ইত্তেফাক থার্ড কলামের মাঝে সাত-আটটা লাইনে–শেখ মুজিবের ছয় দফা। মানে একটা ইম্পরট্যান্ট নিউজকে নেগলেক্ট করে যেভাবে দিতে হয়। ফার্স্ট পেজে দিতে হবে কিন্তু নেগলেক্ট করে। নিউজটা পড়লাম। মনি ডেকে নিয়ে বলল, দোস্ত, চল, এক জায়গায় যাব। গেলাম মুজিব ভাইয়ের অফিসে, আলফা ইনস্যুরেন্সে। বলল, তুই বস, আমি আসছি। সে ফিরে এসে একটা কাগজ দিল আমাকে। টাইপ করা। ওটা পড়ে–আমি জানি না আমার কী হয়েছে, আমি চলে এলাম।

মহি: শেখ মুজিব তখন অফিসে নেই?

সিরাজ : অফিসে আছে।

মহি : লাহোর যাওয়ার আগে তাহলে?

সিরাজ : না, লাহোর থেকে আসার পরে। আমি কীভাবে যে ইকবাল হলে চলে এলাম, কীভাবে যে রাজ্জাককে খবর দিলাম, আরেফকে কীভাবে খবর দিলাম, আর হুঁশ নাই। বললাম, পড়ো। রাজ্জাক বলল, এই তো পাইয়া গেছি।’

ছাত্রলীগ কনফারেন্সগুলোকে রিকুটের কাজে ব্যবহার করতাম। রাজ্জাককে সারা দেশে টুরে পাঠাতাম। সেন্ট্রাল কনফারেন্সের আগে বিভিন্ন জেলায় কনফারেন্স হয় না? আর সিটিতে কাজী আরেফ। প্রতিটি ডিস্ট্রিক্টে প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারির মধ্যে কমপক্ষে একজনকে আমাদের রিক্রুট হিসেবে। তারা বুঝে যেত যে একটা ভালো কাজের সঙ্গে, কঠিন কাজের সঙ্গে তারা যুক্ত হচ্ছে।

আমরা তো সব সময় খুঁজতাম কোথায় কোথায় পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ডিফারেন্স বা পার্থক্য। ছয় দফা পাওয়ার পর আমরা তিনজন কতবার যে পড়েছি। মনে হলো একটা স্বপ্ন দেখার মতো। এটাই তো হলো একমাত্র ডকুমেন্ট, যেটা দেশকে স্বাধীন করার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। আওয়ামী লীগ এটাকে নিয়ে এগোতে পারল না। কোনো বিবৃতি দিল না আওয়ামী লীগ।

এদিকে আইয়ুব খান একটা ট্যাকটিকস নিয়েছে। তখন একটা প্রো-চায়নিজ এক্সিস ঘটানোর চেষ্টা করছে। করতে গেলে ইন্টারনালিও তো এটা খাওয়াতে হবে। সে মওলানা ভাসানীকে চুজ করল। আইয়ুব খান ছয় দফার বিরুদ্ধে কঠিন একটা বক্তব্য দিয়েছিল–প্রয়োজনে অস্ত্রের ভাষা দিয়ে এটা মোকাবিলা করা হবে। পলিটিক্যালি হি ইউজড মওলানা ভাসানী। মওলানা ভাসানী বলল, একটা শর্ত। আমার সব নেতা, যারা আন্ডারগ্রাউন্ডে আছে, তাদের মুক্তি দিতে হবে। ছয়জনকে–আসহাবউদ্দিন চিটাগাংয়ের, মোহাম্মদ তোয়াহাসহ আরও দু-তিনজন যারা আছে, আর ভুলক্রমে হলো প্রফেসর মুজাফফর আহমদ। তার নামটাও উনি দিয়েছিলেন। এরা জেলে ছিল। রিলিজ হলো।

তখন ছাত্র ইউনিয়ন ব্রেক হয়ে গেছে। মেনন গ্রুপ তো আরও বেশি খ্যাপা ছিল। মওলানা ভাসানীর কারণে তখন তারা অ্যান্টি মুজিব স্টেপটা নিচ্ছে। যেহেতু ভাসানী বলেছে। তাদের এই স্ট্যান্ড, আর আমাদের হলো এর পক্ষে স্ট্যান্ড। তাদের এটা গুরুত্ব পেল কালচারাল ফ্রন্টে। তখন বিএনআর ছিল–ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন। যারা প্রতিষ্ঠিত, তারা সবাই এটার নেতা। প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকেরা পাকিস্তানভিত্তিক সমাজতন্ত্র করবে। আর শেখ মুজিব দেশটাকে ইন্ডিয়ার হাতে তুলে দিতে চাচ্ছে–এই প্রচার। এ জন্য লব্ধপ্রতিষ্ঠ কোনো শিল্পী-সাহিত্যিককে আমরা পাইনি। যাদের পেলাম, তারা হলো আল মুজাহিদী, মাহবুব তালুকদার, নাসিরুল ইসলাম বাচ্চু, আমিনুল হক বাদশা।

বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আমরা কামরুদ্দীন আহমদ আর আহমদ শরীফের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতাম। আর ইউনিভার্সিটিতে পলিটিক্যাল সায়েন্সের নূর মোহাম্মদ মিয়া।

আওয়ামী লীগও দুই ভাগে ভাগ। আতাউর রহমান খান থাকলেন এনডিএফে। আর এদিকে হলো শেখ মুজিব। ছিটেফোঁটা ছিল চিটাগাংয়ের এম এ আজিজ, খুলনায় শেখ আজিজ, ফরিদউদ্দিন, সোহরাব হোসেন–ডিস্ট্রিক্ট নেতা বলা হতো এদের। সবাই চলে গেছে, হয় সালাম খানের সঙ্গে অথবা আতাউর রহমান খানের সঙ্গে। আর শক্তি হলো ছাত্রলীগ। আমরা ছাত্রলীগকে কন্ট্রোল করতাম।

এভাবে গড়াতে গড়াতে, আমাদের শক্তি বেশ। রাজ্জাকের সেক্রেটারিশিপে আমাদের শক্তি তখন। ঢাকায় ৪০০-৫০০ পর্যন্ত মেম্বারশিপ।

মহি: ফেরদৌস কোরেশী আপনাদের সঙ্গে থাকলেন না কেন? সিরাজ : উই ডিড নট ফিল, তার থাকা, না থাকা। একজনের একটা মাইন্ড থাকে তো? তার ছিল না। ওবায়দুর রহমানের ছিল না। আর এটা গোপন সংগঠন তো। যে এটা না জানবে, সে কিছুই জানবে না। অনেকে বলে না, আমরা জানতাম না। গোপন সংগঠন, তুমি জানবা কেমন করে? নূরে আলম সিদ্দিকী বলে না অনেক সময়? গোপন জিনিস সে জানবে কী করে?

ছয় দফা মুভমেন্টকে আমরা কোনো অবস্থায় দাঁড় করাতে পারছিলাম না। আমাদের চিন্তা হলো, ছয় দফা যদি পেতে হয়, তাহলে এটাকে একটা পিপলস ক্যারেক্টর দিতে হবে। কীভাবে সম্ভব? ক্রস-সেকশন অব পিপলকে যদি দাবিদাওয়াভিত্তিক একটা পলিটিক্যাল সাইডে নিয়ে আসতে চাই, তাহলে ইট ক্যান ব্রিং সাম রেজাল্ট। আমাদের মধ্যে এ আলোচনাটা হলো। আমরা ছাত্র ইউনিয়নকে এটা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। ফরহাদ ভাই তখন কমিউনিস্ট পার্টি অর্গানাইজ করছেন। আন্ডারগ্রাউন্ডে। উনি তো খুবই ভালো মানুষ। এত উঁচু পর্যায়ের চিন্তার মানুষ খুব পাওয়া যায় না। সো পোলাইট, সো কনভিন্সিং! হা হা, প্রো-পিপল হতে পারে।’ বললাম ঠিক আছে, আমরা স্বায়ত্তশাসনের দাবিটা দিই? স্বায়ত্তশাসন বলাতে ওরা খুব খুশি হয়ে গেল। এক নম্বরেই স্বায়ত্তশাসন। এটা। ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে। এই হ্যান্ডলিংটা আমি করাচ্ছি। ছাত্রলীগকে দিয়ে। রউফ প্রেসিডেন্ট, খালেদ মোহাম্মদ আলী। সেক্রেটারি। যখন স্বায়ত্তশাসনের কংক্রিট প্রস্তাব এল, ওরা বেঁকে বসল। না, হবে না, ছয় দফা দিয়ে হবে না। এটা আমেরিকান প্রোগ্রাম। বহু সময় যায়। আলোচনা হয়। কোনো অবস্থাতেই তাদের মানানো যায় না। ঠিক আছে, ছয় দফার কথা না দিয়ে আমরা টার্মগুলো ব্যবহার করি?

হ্যাঁ, এসব টার্মিনোলজিতে এমন সব কথা আছে, তখন এটা তো আর স্বায়ত্তশাসন থাকে না। অন্য কিছু হয়ে যায়। তাহলে যে জায়গাটায় অন্য কিছু হয়ে যাবে, সেটা বাদ। তাহলে তিন নম্বরটা–দুই মুদ্রা?

আমি বললাম, দুই মুদ্রা বাদ। আমি উদাহরণ দিলাম। যদি একটা পরীক্ষায়–অনেক সময় প্রশ্ন থাকে–এইটা অথবা ওইটা। আমি যদি ‘অথবা’টা নিই, আমার অসুবিধা কিসের? আমি তো উত্তর দিচ্ছি। প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা না হয় দিলাম না। আলাদা মুদ্রা বা এখানকার টাকা ওখানে যেতে পারবে না। এখানকার হিসাব এখানে থাকবে। রাজি হয়ে গেল। ছয় দফা শব্দটা না থাকলেও এক-দুই-তিন-চার পাঁচ-ছয় করে রেখেছি। ছাত্রলীগেরও বলতে সুবিধা হবে, ছয় দফাভিত্তিক এগারো দফা। পরে বিভিন্ন দাবিদাওয়া মিলিয়ে হলো এগারো দফা। এগুলো আবার পাস-টাস করাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।

মুজিব ভাই তো জেলে। অল লিডারস আর ইন জেল।

মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আই ওয়াজ ক্লোজ। খুবই ক্লোজ। আমিও লাইক করতাম। উনিও লাইক করতেন।

তাঁর অফিসে যাওয়া-আসা করতাম। অফিস ছিল ১৫ নম্বরে, ৫১ তে না।

মহি: ১৫ পুরানা পল্টন।

সিরাজ : হ্যাঁ। তিন রুম। তিনি বক্তৃতা দিচ্ছেন বিভিন্ন জায়গায়। অ্যারেস্ট হচ্ছেন। আবার জামিন নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। একদিন আমাকে গাড়িতে করে ধানমন্ডিতে নিয়ে এলেন। বললেন, কালকে নারায়ণগঞ্জে মিটিং।

আমি কি যাব সেখানে?

না, যাইস না। আমাকে অ্যারেস্ট করবে। আর আমাকে বেইল দেবে না। কারণ, ওখানে বেইল করার লোক নাই। আমাকে ১১০০ ১২০০ টাকা দিলেন। কাজ করবি। যোগাযোগ থাকবে।

কার মাধ্যমে যোগাযোগ?

এছলাম। তোর ভাবির কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে নিস।

ইসলাম আরকি। উনি বলতেন এছলাম।

এ রকম আরও কয়েকবার গাড়িতে উনি আমাকে হলে নামিয়ে দিতেন। আমি তখন এস এম হলে থাকি।

সিক্সটি সিক্সের ৭ জুন। তাজউদ্দীন ভাইকে তো জেলে নিয়ে গেল। মিজান চৌধুরী হলেন অ্যাক্টিং সেক্রেটারি। হরতাল হবে ৭ জুন। মনি এসে জয়েন করল। আদমজীতে অ্যারোমা টি একটা সেকশন খুলেছিল। সে এটার দায়িত্বে। গাড়িতে করে, গাড়ি মানে সাইকেলে ভ্যান লাগিয়ে ঘোরে না?

মহি : যেভাবে আইসক্রিম বিক্রি করে?

সিরাজ: হ্যাঁ। এটার পেছনে চড়ে আর সাইকেল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চা দিয়ে আসত। মধুর ক্যানটিনে, বিভিন্ন হলের ক্যানটিনে,

মহি : ডিস্ট্রিবিউটর?

সিরাজ : হ্যাঁ। কমার্শিয়াল সাইড দেখত। ১০০ না ২০০ টাকার চাকরি। এসে বলল, দোস্ত, কাজ করে নিই।

কী বলবি বল?

আমি কীভাবে করব। আমার যোগাযোগ নাই।

তখন আমার একটা ৫০ সিসি হোন্ডা আছে। এর আগে একটা ডিসিশন ছিল, শ্রমিকদের মধ্যে আমাদের কাজ করতে হবে। তো যোগাযোগটা কীভাবে হবে? আমি তো কিছুই চিনি না। অনলি কানেকশন হতে পারে নোয়াখালী কানেকশন। মানুষ যেমন বিভিন্ন কানেকশনকে গুরুত্ব দিয়ে ঢোকে, এই সেন্সে। তেজগাঁওয়ে পেয়ে গেলাম। রুহুল আমিন ভূঁইয়া না। অন্য একজন। আদমজীতে পেয়ে গেলাম আজিজুল হক, আওয়ামী লীগের ভক্ত। আমার দুই বছরের সিনিয়র। আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া হিসেবে তখন আছে ডেমরা, আর শাহজাহান ভাইয়ের পোস্তগোলা। সামান্য কিছু চটকল, ম্যাচ ফ্যাক্টরি এই। নোয়াখালী কানেকশন। বলল যে আমরা তো এটা করতে। পারব না। আমাদের বড় নেতাদের বলতে হবে। কে বড় নেতা? রুহুল আমিন ভূঁইয়া, আবদুল মান্নান। এখানে পোস্তগোলায় পেলাম। মেসবাকে (মেসবাউদ্দীন আহমেদ)। সে বলল, তারও কিছু কানেকশন আছে। তার কানেকশন নিয়ে মুভ করে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বললাম। আওয়ামী লীগ অফিসে তাদের নিয়ে এলাম। মিজান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললাম। তারা মিজান ভাইকে বলল, কিছু টাকা খরচ করতে হবে। কত টাকা খরচ করতে হবে? ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। তখন তো এটা অনেক টাকা। মিজান ভাই বললেন, আপনারা কাজ শুরু করেন। সিরাজ তো যোগাযোগ রাখবে। সিরাজ, তুমি এদের পেছনে লাগো। টাকা আমি জোগাড় করব। যেভাবেই হোক।’

টাকা সংগ্রহ হলো। কেউ ১০০, কেউ ২০০। আদমজীতে সাদুকে পেয়ে গেলাম। সাইদুল হক সাদু, গাঁট্টাগোট্টা। চেহারাসুরতও সে রকম। বলিষ্ঠ, পেটানো শরীর। কী কারণে আমি তাকে লাইক করে ফেলেছি। আজিজ ভাইকে বললাম। গুন্ডামার্কা, প্রস্টিটিউশনে পড়ে থাকে, এটাকে নিয়ে কী করবেন?’ বললাম, কাজ হলেই তো হলো।

একটা ভিন্ন ধরনের প্রচার-প্রপাগান্ডায় আমরা নেমে গেলাম। প্রথম যেদিন নামলাম, মোয়াজ্জেম ভাই বাইরে, মিজান ভাই বাইরে। হরতালের প্রচার হবে কীভাবে? বায়তুল মোকাররমের ওখানটা, মোয়াজ্জেম ভাই বলে, ‘সিরাজ, তুই বক্তৃতা কর। আমার তখন গা কাঁপতেছে। বললাম, কী বলব? বল, বল?’ তখন আমি তো বক্তৃতা উক্তৃতা দিই। একটা দোকান থেকে টুল নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বললাম, এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে, পূর্ব পাকিস্তানের দাবির পক্ষে, রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে ৭ জুন হরতাল। লোক ছিল ৭-৮ জন। ১৫-২০ জন হলো এসবির লোক।

তখনো বায়তুল মোকাররম মসজিদের সিঁড়িগুলো হয়নি। মোয়াজ্জেম ভাই বললেন, ‘ভাগ। আর একটু হলে অ্যারেস্ট করে ফেলবে।’ ভেগে চলে এলাম। আমরা স্টুডেন্টদের মধ্যে প্রচার শুরু করলাম। তেজগাঁওয়ে তো স্কুল আছে। স্টুডেন্টদের বললাম, কোথায় কোথায় শ্রমিক আছে, আমাদের খোঁজ দাও। আদমজীতে কলেজ আছে। তাদের খোঁজ দাও। সেভাবেই আমরা যোগাযোগ করেছি। নোয়াখাইল্যা আর ছাত্রলীগের কানেকশনে।

ডিস্ট্রিক্টেও ছড়িয়ে গেল। যে হরতাল হলো, আনপ্রিসিডেন্টেড। মনে হলো, যেন একটা পাখিও ওড়েনি। আর সারা ঢাকার রাস্তায় ইট পেতে দেওয়া হয়েছে। তখন তো গাছ কাটার অভ্যাস হয়নি। আদমজীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে–সাদু, তোমাদের ওপর নির্ভর করছে ঢাকার হরতাল।’ বলল, ‘মুসলমান হিসাবে কথা দিলাম–হবে। আপনাকে কোথায় খুঁজব।’ বললাম, আওয়ামী লীগ অফিসে। রাতে থাকলাম মঞ্জুদের (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু) বাসায়। তখন বেশির ভাগ সময় মঞ্জুদের বাসায় থাকতাম। ওর একটা প্রিন্স গাড়ি ছিল। ওটায় চড়ে আমরা ঘুরতাম।

রাস্তায় এমনভাবে ইট ছিটানো। ইট সরিয়ে সরিয়ে গেলাম, হরতাল কেমন হয়েছে জানার জন্য। কাছে কী আছে? তেজগাঁও। যেভাবে ইট ছড়ানো, বহু কষ্টে–সোনারগাঁও হোটেল তো তখন ছিল না, ওই পর্যন্ত আসতে দেখলাম, ছাত্ররা মিছিল বের করার চেষ্টা করছে। তেজগাঁওয়ে গুলিতে শ্রমিক মারা গেছে, মনু মিয়া নাম। পরে পেপারে ছাপা হওয়ায় নাম জেনেছি।

তারপর আওয়ামী লীগ অফিসে গেলাম। হঠাৎ পুলিশের একটা জিপ এল। আমরা তো কোনো অবস্থায় অ্যারেস্ট হব না। ভেতরে এসে বলল, সিরাজুল আলম খান কার নাম?’ বললাম, আমার নাম। ওখানে দেখলাম তার সঙ্গে জিপে এসেছে সাদুর সঙ্গের এক লোক। পুলিশ বলল, এই শ্রমিক এসেছে আপনার সঙ্গে কথা বলতে। দেখলাম, তার নাম শফি। বলে যে, আমরা মিছিল নিয়ে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত এসেছি। সাদু ভাই বলেছে, আপনাকে নিয়ে যেতে।’

পুলিশ অফিসারটা বলছে, আমরা বলেছি হরতাল হয়ে গেছে। ওরা বলে যে উনি না বললে আমরা যাব না।’

২০ থেকে ২২ হাজার লোকের মিছিল। হাতে হলো আগুনের লুয়া। তখন তো মশাল বলত না।

আদমজী এমনিতেই তো জুট মিল। পাটের কোনো অভাব নেই। কাঠের কোনো অভাব নেই। পেট্রলপাম্প আছে। তেলের কোনো অভাব নেই। তিন থেকে চার হাজার লোকের হাতে লাঠি। মাথায় পাট, তাতে আগুন। একটু অন্যমনস্ক হলেই সারা ঢাকায় আগুন জ্বলে যাবে। এই রকম অবস্থা। পুলিশ অফিসার আমাকে এটা বলেছে, ‘আমি চিনি না আপনাকে, যে-ই হোন, ওখানে গিয়ে তাদের থামান।’

গেলাম। সবাই সেখানে বসে আছে। কিছু লেবু দেওয়া হয়েছে। লেবুর শরবত খাচ্ছে, ১৩ মাইল হেঁটে আসার পর। বললাম, মিছিল হয়েছে। এখন তোমরা যাও। সবাই জিন্দাবাদ দিয়ে দিয়ে আবার চলে গেল। মোট খরচ হয়েছে দেড় শ টাকা। লেবুর শরবত। আর তো কিছু দেওয়া যায় না। অনেক পত্রিকা বাধ্য হলো হরতালের খবর দিতে, কীভাবে ডিভাস্টেটিং হরতাল হলো।

তখনই আমাদের ধারণা হলো, ইয়েস, শ্রমিকদের অর্গানাইজ করতে পারলে ইট ক্যান বি ডান। আত্মবিশ্বাস এসে গেল। শ্রমিক সংগঠন থাকলে, ইট ক্যান বি ডান। এটা তো বলতে গেলে একেবারে ওয়ানম্যান শো, আমার দ্বারা। আর আমার মোটরসাইকেল আর মেসবা। আর পেয়ে গেলাম সিনিয়র লোকগুলোকে। মান্নান ভাই তো সমাজবাদী দলের। তাঁকে বললাম, শ্রমিকনেতা থাকবেন। শ্রমিকনেতা থেকে যদি একজন পার্লামেন্ট মেম্বার হতে পারেন, আপনি কত কথা সামনাসামনি বলতে পারবেন? সারা দেশের লোক জানবে? এ কথাগুলো উনি অ্যাপ্রিশিয়েট করলেন। এই তো হলো শ্রমিক সংগঠন করার গোড়ার কথা। নাম না দিয়ে, সেল সেল সেল। একেকটা ইন্ডাস্ট্রিতে পাঁচটা, সাতটা, দশটা পর্যন্ত সেল। আদমজীতে তো ২০-২৫টা সেল বানিয়ে ফেলেছি।

আর এদিকে হলো ছয় দফাঁকে এগারো দফায় পরিণত করা। একদিকে আন্দোলন, আরেক দিকে সংগঠন। এই জায়গাটায় আসতে ১৯৬৯ এসে গেল।

মহি : শেখ মুজিব যে টাকা দিলেন, কত টাকা?

সিরাজ : ১১০০-১২০০, তাদের খরচের জন্য। ওই কথা, তোর ভাবির সঙ্গে যোগাযোগ রাখিস। আর ইসলাম হলো মূলত পোস্টার লেখার লোক। মাঝেমধ্যে ১০০-২০০ পোস্টার লিখে দিত সে। আমরা আমাদের লোকের মাধ্যমে এটা লাগাতাম।

মহি : ওনার পুরো নাম নুরুল ইসলাম নাকি? নাম শুনেছি।

সিরাজ : হ্যাঁ। একটা বইও লিখেছে। আমার একটা নিক নেম ব্যবহার করা হতো। ভাবির কাছে ফোন করার জন্য ইটালা–মানে ইটওয়ালা। তখন বাড়ির কনস্ট্রাকশন হচ্ছে তো। ইট সাপ্লাই হতো। তো ফোনে কে বলছেন আপনি? ইটালা বলতেছি। ও আচ্ছা, ঠিক আছে আসেন। কোনো জরুরি খবরটবর থাকলে, ওয়ানস ইন আ মান্থ।

ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে আমরা একটা ফরমেশনে চলে গেলাম। ছাত্রলীগ হলো মেইন অর্গানাইজেশন। তারপর আন্ডারগ্রাউন্ড বা ব্যাকআপ নিউক্লিয়াস। শ্রমিক সংগঠনের ওপর জোর দেওয়া হলো। আওয়ামী লীগের স্ট্রাকচার তো নাথিং।

মহি: আপনাদের নিউক্লিয়াসের এক্সপানশনটা কখন শুরু হলো?

সিরাজ : তখন থেকেই। পার্টিকুলারলি সিক্সটি ফাইভে, যখন জেল থেকে বের হলাম।

তুমি বুঝতে যে আমার সঙ্গে তোমার চলাফেরার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। আর আমিও তোমাকে চুজ করছি। বাট আই অ্যাম নট টেলিং ইউ এভরিথিং যে এটা একটা গোপন সংগঠন। তুমি তো বুঝেই ফেলবে যে হাউ ইমপরট্যান্ট ইট ইজ। একটা সময় বোঝা যাবে যে উই আর ওয়ার্কিং ফর আ কজ। [১০]

৭ জুনের হরতাল সফল করার একক কৃতিত্ব দাবি করেছেন সিরাজুল আলম খান। এ বিষয়ে ভিন্নমত আছে তোফায়েল আহমেদের। তাঁর মতে, এটি ছিল একটি যৌথ প্রয়াস। আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন :

অনেস্টলি যদি বলি, আমি খুব নিরপেক্ষ ছিলাম। আমি তো ইকবাল হলের ভিপি। ইকবাল হল ছাত্র সংসদের ভিপি হয়েছি ১৯৬৬-৬৭ সালে। ওই সময় বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দিলেন। ৭ জুন মূলত সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই, মনি ভাই, আমি-ইকবাল হলে আমার ৩১৩ নম্বর রুম থেকেই কিন্তু কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। আমার রুমে বসেই সব প্ল্যান-প্রোগ্রাম হতো।

আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না। ৭ জুনের মূল ভূমিকা আসলে পালন করেছে মনি ভাই। এটা ফ্যাক্ট। সে জন্য মনি ভাইকে গ্রেপ্তার করল। সম্ভবত ১৮ তারিখ। লিফলেটগুলো মনি ভাই লিখতেন। সিরাজ ভাই, মনি ভাই, রাজ্জাক ভাই, আমি–ঢাকা মেডিকেল কলেজে যখন বসেছি ৭ জুন সফল করার জন্য, আমু ভাইও ছিলেন। নূরে আলম সিদ্দিকীও ছিল। আমরা এরিয়া ভাগ ভাগ করে…কে কোন জায়গায় যাবে।

আমি তখন অত বড় নেতা না। সত্যি কথা বলতে কি, তখন আমি কর্মী। রাজ্জাক ভাই হলো ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, মাজহারুল হক বাকী হলো সভাপতি। বাকী ভাই, রাজ্জাক ভাই দুজনই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। মনি ভাই, সিরাজ ভাই আউটগোয়িং। তারাও এই প্রসেসের মধ্যে ছিল। আমি হলাম অনেকের মধ্যে একজন।

বঙ্গবন্ধু অ্যারেস্ট হলেন মে মাসের ৮ তারিখ (১৯৬৬)। তারপর ৭ জুন পালন করার জন্য আমরা বিভিন্নভাবে কাজ করলাম। আন্দোলন হয়েছে ইকবাল হলভিত্তিক। এখানে প্রত্যেকেরই। ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে।

.

আওয়ামী লীগের মধ্যে সিরাজুল আলম খানের যে একটি ভিন্ন ধরনের কর্মতৎপরতা ছিল, তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ১৯৬৬ সালের ছয় দফা ঘোষণার পর। সিরাজ বলেছেন, তিনি কামরুদ্দীন আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং তার পরামর্শ নিতেন। কামরুদ্দীন আহমদ তখন আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু অনেক আওয়ামী লীগ নেতার কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সবাই তাকে শ্রদ্ধা করতেন। ছয় দফার পক্ষে। আন্দোলন গড়ে তোলা এবং ৭ জুনের (১৯৬৬) হরতাল সফল করার ক্ষেত্রে সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা তার অজানা ছিল না। এ প্রসঙ্গে কামরুদ্দীন আহমদের খোলামেলা পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য উল্লেখ করা হলো :

তখন থেকেই আওয়ামী লীগ সংগঠনের মধ্যে দুটো ধারা দেখা গিয়েছিল। একটি ধারায় শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কেন্দ্রে কেবল দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণক্ষমতা ব্যতীত অন্য সকল ক্ষমতা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন। আর এক ধারায় সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে একটি সেল গঠিত হয়েছিল, যারা পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করার পক্ষপাতী ছিলেন। ওই সেলের সদস্যরা শেখ মুজিবকে তাদের নেতা বলে গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর আদেশ নির্দেশ অনুসারে কাজও করতেন। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে সিরাজুল আলম খান নিজস্ব দল গঠন করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। ১৯৬৬ সালেও সিরাজুল আলম খান সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাস করতেন বলেই আমার ধারণা। সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আবদুর। রাজ্জাকও তখন একই ধারণা পোষণ করতেন। আবদুর রাজ্জাক তাঁদের সেলের গোপনীয়তা রক্ষা করলেও নিজেকে আওয়ামী লীগের শৃঙ্খলার অধীন বলেই মনে করতেন। অন্যদিকে সিরাজুল আলম খান নিজের জীবনেও গোপনীয়তা রক্ষা করে চলতেন। তিনি সর্বদা তাঁর নিজের চারদিকে এক রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। তুলতে সচেষ্ট থাকতেন। তিনি কখন কোথায় থাকতেন বা কখন কোথায় যেতেন, তা রহস্যে ঢাকা থাকত। যেখানে যা পেতেন, তা। খেয়েই তাঁর দিন চলত। তাঁর দলের কর্মীদের জন্য যতটা দরদ ছিল, বস্তিবাসীদের জন্যও ততটাই দরদে ভরা ছিল তার মন। গোড়াতে সূর্য সেন-প্রীতিলতা ছিলেন তাঁর স্বপ্নের নায়ক-নায়িকা। আওয়ামী লীগের কর্মীরা সিরাজুল আলমকে শ্রদ্ধা করতেন। কারণ, তাঁদের সুখ-দুঃখের কথা সিরাজুল আলম খান অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।

১৯৬৬ সালের আওয়ামী লীগের আন্দোলনের পেছনে সিরাজুল আলম খানের দান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন এটা প্রমাণিত হয়ে গেল যে আন্দোলন আর পূর্বেকার মতো ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। শ্রমিকদের মধ্যেও আন্দোলনের ঢেউ বিস্তার লাভ করেছে। ৭ জুন তারিখে নারায়ণগঞ্জ, তেজগাঁও, টঙ্গী ও চট্টগ্রামের শিল্প এলাকায় আন্দোলনের তীব্রতা এত বৃদ্ধি পেল যে পুলিশকে গুলি চালাতে হয়েছিল। আদমজী ও অন্যান্য মিল থেকে। হাজার হাজার শ্রমিক পায়ে হেঁটে পল্টনের সভায় যোগ দেওয়ার

জন্য ঢাকা এসেছিল।১২ সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আবার শুরু হলো আলাপ। ছয় দফা আন্দোলনের পর কীভাবে এগোলেন তিনি, কীভাবে বিস্তৃত হলো তার নিউক্লিয়াস, এ নিয়ে মেলে ধরলেন স্মৃতির ঝাঁপি।

মহি: আপনাদের কাজের অনেক ডাইমেনশন, অনেক ডিটেইলস।

সিরাজ : আমাদের এই বয়সে, আমি তো বুঝি, আমাকে কী কষ্ট করতে হয়েছে। আমি তো অনেক সুঠাম দেহের, অনেক তেজি মানুষ। অনেক কষ্ট সহ্য করার মানুষ, যেটা খুব কম লোকের মধ্যে আছে। মাইলকে মাইল হাঁটা, ফর নো রিজন। শাজাহান সিরাজ তো প্রায়ই বলে, দাদার সঙ্গে চার-পাঁচ মাইল হাঁটা, আবার ফিরলাম, বুঝলাম না যে হাঁটছি। পরে বুঝেছি, এই হাঁটার কারণে আমার যে ইন্টারেস্ট এবং ক্ষমতা, এগুলোর প্রমাণ পেয়ে গেছে সে। দেন হি ওয়াজ আসকড টু জয়েন আ সিক্রেট মুভমেন্ট-স্বাধীনতা। ডিস্ট্রিক্টে ডিস্ট্রিক্টে একজন করে, তারা তখনো জানে না নিউক্লিয়াস কী। পরে জেনেছে।

মহি : জাস্ট কন্ট্যাক্ট পারসন?

সিরাজ : কন্ট্যাক্ট পারসন।

যশোরে হলো মনি, আরেক মনি। রবিউল সেকেন্ড ম্যান মনে হয়। রাজশাহীতে হলো ডা. করিম।

বগুড়ায় হলো পটল। সিলেটে আখতার আহমদ। ময়মনসিংহে ডা. নুরুল ইসলাম (চঞ্চল)। রংপুরে গোলাপ বা গোলাপের ভাই একজন। দিনাজপুরে দরকারও পড়েনি, সে রকম গড়েও ওঠেনি। বরিশালে হলো জহিরুল ইসলাম খান (পান্না) আর বাকের, দুজন। আর মাতব্বরি দেখাত আমির হোসেন আমু। আমরা অ্যাগ্রি করতাম। আমু ওয়াজ নট আ সেন্ট্রাল লিডার। হি ইউজড টু সিট অলওয়েজ অ্যাট দ্য সেন্টার। আর শেখ সাহেবের আত্মীয় তো, ওকে আমরা নিউক্লিয়াসে নিতে পারিনি। বাট হি ওয়াজ আ ভেরি মাচ অ্যাসপিরেন্ট ক্যান্ডিডেড ফর নিউক্লিয়াস মেম্বারশিপ। নিউক্লিয়াসের তিনজনের পরে ছিল আবুল কালাম আজাদ। ফিফথ মেম্বার হলো আমাদের মেসবা। অঙ্কুর প্রকাশনীর। এত সুন্দর মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারপর হলো। মনিরুল ইসলাম, মানে মার্শাল মনি। তারপর আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, এরা।

মহি: মার্শালের সঙ্গে আপনার পরিচয় কোন ইয়ারে?

সিরাজ : একই সময়ে। আমরা তখন সংগঠন হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছি। ও বিকেলে আসত, আলোচনাগুলো শুনত। এভাবে সেন্টারকে আমরা গড়ে তুললাম। সেন্টার এটাই থাকবে। তারপর কোথাও করপোরেট লাইন, কোথাও ইউনিভার্সিটির একটা সেল, দুইটা সেল, কলেজ লেভেলের সেল, কোথাও পাড়া কমিটি, এভাবে বা ইনডিভিজুয়ালি–যা আমাদের নলেজে থাকবে। ঢাকা ইউনিভার্সিটি আর ঢাকা সিটি–মুভমেন্টটা তো তাদের হাতে গড়া। যদি কেউ প্রশ্ন তোলে যে এগুলো তো আমরা পাইনি কোনো দিন। আরে ব্যাটা, তুমি পাইবা কীভাবে? তুমি কি মুভমেন্টের ওই। জায়গাতে ছিলা? ভোর রাতে কে উঠে যেয়ে বাস পোড়াত? কে মাইকিংটা দিত? কে রাতে চিকামারার জন্য যেত? অন্য কেউ জানবে না তো? যে যাচ্ছে, সে জানে। আর যারা নেওয়াচ্ছে, তারা জানে। এসব নিয়ে ফেরদৌস আহমদ কোরেশী বা নূরে আলম। সিদ্দিকী প্রশ্ন তুলেছে। মাজহারুল হক বাকী কিন্তু কোনো দিন বলেনি। হি নিউ। সে বলেছে, সিরাজ ভাই আছে ওখানে? ব্যস। আমাকে সিরাজ সাহেব বলত। আমি বাকী সাহেব বলতাম। সে এসেছে রাজশাহী থেকে। সে জানত, এটা এমন একটা শক্তি। আছে না, গ্রিক মিথলজিতে, কাটলে রক্ত বের হয়, মৃত্যু হয় না। এই রকম। এই যে আমাদের লিটল কমরেড রফিক। বয়সে ছোট। বাট এত তার তীক্ষ্ণতা। [১৩]

.

১০

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের সম্পর্ক ছিল গুরু শিষ্যের মতো। সিরাজ নানাভাবে শেখ মুজিবের ওপর নির্ভর করতেন এবং সিরাজের ওপর শেখ মুজিবের অগাধ আস্থা ছিল। মনে হতো তাঁরা বুঝি একই পরিবারের সদস্য। এ সম্পর্কে একটি বিবরণ পাওয়া যায় এস এম ইউসুফের কাছ থেকে।

১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় ইকবাল হলের ক্যানটিনের ওপরতলায় ছাত্র সংসদ অফিসে ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় যোগ দিতে ইউসুফ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। বর্ধিত সভায় নির্ধারিত প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে তিনি এসেছিলেন অবজারভার হিসেবে। তিনি বলেন :

ছাত্রলীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ (পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক) বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য নামে দুটি পুস্তিকা লিখেছিলেন। বর্ধিত সভায় যোগ দিতে আসা প্রতিনিধিদের ওরিয়েন্টেশন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পুস্তিকা দুটি পাঠ করা হয়। আমি ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর রুমে শাজাহান সিরাজের সঙ্গে ডাবলিং করতাম। একটা সিটে রব থাকত, আর একটায় লোকমান হোসেন। তারাও এসেছিলেন বর্ধিত সভায় যোগ দিতে। সিরাজ ভাই (সিরাজুল আলম খান) ফ্লোরে ঘুমাতেন। আসতেন শেষ রাতে। একটা চৌকির নিচে তার বিছানা থাকত। একটা ছেঁড়া মাদুর, ছেঁড়া তোশক, ভেঁড়া বালিশ। রাত দুইটা-তিনটার দিকে ইকবাল হলের পুকুরপাড়ে নিয়ে সিরাজ ভাই আমার আঙুলের রক্ত, স্বাধীনতার শপথ, এই সব করিয়েছে।

থার্ড ডে সকালবেলা উনি আমাকে বললেন, আজকে তুমি কোথাও যাইয়ো না, আমার সঙ্গে থাকো। ওনার সঙ্গে রিকশায় ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় গেলাম। দেখলাম আরদালি-চাপরাসি সবাই সিরাজ ভাইকে জানে। ঘরের লোক মনে হলো ওনাকে। একজনকে বললেন, মুজিব ভাই আছেন?

হ্যাঁ, আছেন, দোতলায়।

গিয়ে বললো আমি আসছি।

ড্রয়িংরুমে বসলাম। দেখা গেল শেখ সাহেব নামতেছে। নাইমাই বললেন, কোন স্কুলে পড়ো? সিরাজ, তোরা চা খা, আমি তোর জন্য ওইটা নিয়া আসি। কিছুক্ষণ পর আবার উনি নাইমা আসলেন।

সিরাজ, তোর জন্য তিন হাজার টাকা রাখছিলাম।

মুজিব ভাই, এখান থেকে টাকা বাঁচবে। আপনাকে কিছু টাকা ফেরত দিতে পারব।

না, ফেরত দিতে হবে না। যদি বাঁচে, ছেলেদের ১০-২০ টাকা গাড়িভাড়া দিয়া দিস।

এই টাকা হচ্ছে নীলক্ষেতে আনোয়ারা হোটেল আর পলাশীতে খাওয়া খরচের জন্য, যারা বর্ধিত সভায় যোগ দিতে বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছিল। এরপর তারা দুজন দোতলায় গিয়ে আধা ঘণ্টার মতো কথা বললেন। নিচে নেমে এসে সিরাজ ভাইকে টাকা দেওয়ার সময় শেখ সাহেব বললেন, হ্যাঁ, মনে রাখিস কিন্তু, যেন ঠিকঠিকমতো হয়। [১৪]

শেখ মুজিব দলের জন্য টাকা জোগাড় করতেন, অনেক সময় সংসারের প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখতেন না। ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় যোগ দিতে বিভিন্ন জেলা থেকে যারা ঢাকায় এসেছিলেন, তাঁদের থাকা-খাওয়ার দায়িত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আর খরচ জোগানোর জন্য তাকে নির্ভর করতে হয়েছিল শেখ মুজিবের ওপর। শেখ মুজিবের কাছে কাড়ি কাড়ি টাকা থাকত না। অনেক কষ্ট করেই তাঁকে দল চালাতে হতো। ছাত্রলীগের কর্মীদের জন্য তাঁর দরজা ছিল সব সময় খোলা। এর একটি অন্তরঙ্গ বিবরণ দিয়েছেন সিরাজুল আলম খান :

একদিন মুজিব ভাইকে বললাম, ১০০ টাকা লাগবে। অবাক হয়ে গেলেন। আমি তো কখনো টাকা চাইতাম না।

এখন তো নাই। কখন লাগবে?

কালকে। বগুড়ার পটল আছে আমাদের, ওর হার্নিয়ার অসুখ হয়েছে হাইড্রোসিল। অপারেশন লাগবে। ডা. ফজলে রাব্বীর ওখানে হবে। তখন এত ক্লিনিক ছিল না। অনেক ডাক্তার তাদের বাসায় দু-চারটা বেড রেখে রোগী দেখতেন।

আচ্ছা দেব আমি।

উনি মিটিং-টিটিং করে চলে গেলেন। অন্য সময় হলে ডেকে বলতেন, ওদিকে যাবি? চল।

কিন্তু উনি উঠে চলে গেলেন। চিন্তায় পড়লাম। আমার কাছে তো ১০০ টাকা নাই। ভীষণ চিন্তা। আমি বলে দেব’–এ-জাতীয় কিছু একটা কথা বলেছিলেন।

পটলকে ইকবাল হলে রাখলাম। ও তো হাঁটতেই পারে না। সকালবেলা রিকশা করে…পটলকে মনে আছে না? মন্ত্রী পটল না। খুব টল ফিগার, হ্যান্ডসাম। একটু তোতলাত।

সকাল সাতটায় অপারেশন হওয়ার কথা। টাকা তো জোগাড় হয়নি। পটলকে বললাম, চল যাই। রিকশা থেকে নেমে গেট দিয়ে ঢুকলাম। দেখি আমাদের আসার আগেই মুজিব ভাই এসে বসে আছেন। বললেন, আমি বলে দিছি, যা। ক্যান ইউ থিঙ্ক অব ইট? উনি ভোর পাঁচটায় উঠে এসে বসে আছেন। অপেক্ষা করছেন।

ডা. রাব্বী আর উনি সমবয়সী।

এটা তো শুধু আন্তরিকতার বিষয় না। একজন রোগী, পার্টির লোক, তার জন্য সকালে এসে…এমনও হতে পারে ওনার পকেটে ওই দিন ১০০ টাকাও নাই। [১৫]

.

১১

সিরাজুল আলম খানের জীবনযাপন একটু খাপছাড়া। এটা সবার নজরেই পড়ত। হয়তো দেখা গেল তিনি কয়েক দিন ভাত না খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন। হয়তো মুড়ি কিংবা চা খেয়ে দিন কেটেছে। আবার কখনো সখনো গোগ্রাসে এক বেলাতেই খেয়েছেন তিন দিনের খাবার। এ প্রসঙ্গে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন তার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন :

আমি তখন ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট। পুরান ঢাকায় পালোয়ানের হোটেলে খেতে যেতাম মাঝেমধ্যে। ওদের ওখানে ভালো মোরগ পোলাও পাওয়া যেত। এক প্লেট খেলেই উদরপূর্তি হতো। একদিন গেলাম সেখানে। সঙ্গে সিরাজুল আলম খান এবং আরও একজন। খাওয়ার পর ওয়েটার বিল নিয়ে এল, ছয় টাকা। আমার তো আক্কেলগুড়ুম। আমরা তিনজনে তিন প্লেট খেলে তো দুই টাকা হবে। কেউ একজন যদি দুই প্লেট খায়, তাহলে আড়াই টাকা। ছয় টাকা কী করে হয়? আমি চেঁচিয়ে বললাম, ম্যানেজার, হিসাবে ভুল আছে। ম্যানেজার ওয়েটারের সঙ্গে কথা বলল। তারপর সিরাজের দিকে আঙুল দিয়ে বলল, “ওই স্যার একাই ছয় প্লেট খাইছে।’ আমার অবাক হওয়ার পালা। ম্যানেজার কাছে এসে বলল, ‘আপনেরা দুইজনের বিল দেন, ওই স্যারেরটা ফ্রি। আমার হোটেলের খাওন যে লোক এত পছন্দ কইরা খাইছে, ওর কাছ থিকা আমি ট্যাকা নিমু না। এরপর এই স্যার যতবার আইব, খাওয়া ফ্রি। (সমবেত ওয়েটারদের উদ্দেশে) এই, তোরা সব ওনারে দেইখা চিন্যা রাখ। যখনই আইব, খাইব, টাকা নিবি’। [১৬]

কেরানীগঞ্জের কলাতিয়ার বোরহানউদ্দিন গগন, কাজী আরেফ আহমদ আর সিরাজুল আলম খান প্রায়ই একসঙ্গে চলতেন, খাওয়াদাওয়া করতেন। তিনজনই খুব খেতে পারতেন। সিরাজুল আলম খান কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন একদিনের অভিজ্ঞতার কথা :

সিরাজ : একবার আমরা একটা রেস্তোরাঁয় পাল্লা দিয়ে খেলাম, কে কত খেতে পারে। গগন খেল ২২টা পরোটা, আমি ২৬টা। আরেফ কয়টা খেল, জানো?

মহি : ওনার যে শরীর, কয়টা আর খেতে পারবেন? বড়জোর পাঁচ-ছয়টা?

সিরাজ : ও খেল ৩২টা।

মহি: উনি তো লিকলিকে। এত খাবেন কী করে? অসম্ভব?

সিরাজ : না খেয়ে থাকার যেমন অভ্যাস ছিল, আবার খুব বেশিও খেতে পারত।

মহি : কথায় আছে, সরু পেটে গরু সয়।

সিরাজ : হা হা হা। [১৭]

তোফায়েল আহমেদ তখন ইকবাল হলের ভিপি। হলে তাঁর কামরায় এসে মাঝেমধ্যে থাকতেন সিরাজুল আলম খান। আসতেন অনেক রাতে। তোফায়েল তার জন্য খাবার রেখে দিতেন টেবিলে। হয়তো দেখা গেছে খেয়েদেয়ে উনি ঘুমালেন, একনাগাড়ে দুদিন। [১৮]

.

১২

সত্তরের দশকে যে কয়জন তরুণ সংগঠক ভিন্ন ধারার রাজনীতি করে সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন, সিরাজুল হক সিকদার তাঁদের অন্যতম। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় তার নাম প্রথম চাউর হয়। সিরাজ সিকদারের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের পরিচয় কিংবা কথাবার্তা হয়েছিল কি না, এ নিয়ে আমার মনে কৌতূহল ছিল। সিরাজুল আলম খান এ ব্যাপারে কখনো মুখ খোলেননি। আমি তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাদের দুজনের মধ্যে কি কখনো দেখা হয়েছে? কথা হয়েছে? তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিলেন এমনভাবে, যেন তাদের মধ্যে কোনো রকম দেখাসাক্ষাৎ ছিল না।

সিরাজুল আলম খানের যে স্বভাব, কাউকে প্রাসঙ্গিক বা গুরুত্বপূর্ণ মনে করলে তিনি তার খোঁজ নেবেন না, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। অনেক কিছুই ছিল তাঁর জানার বাইরে। আর তিনি সব জানবেন, এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। সিরাজ সিকদার একেবারেই একজন গুরুত্বহীন ব্যক্তি ছিলেন, এমনটি ভাববার কারণ দেখি না। অনেক গুরুত্বহীন, অকর্মণ্য ও অপদার্থ। লোককে নিয়ে চলাফেরা এবং তাদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলার অভ্যাস ছিল সিরাজুল আলম খানের, এ আমার নিজের চোখে দেখা। এ ব্যাপারে আমি তার দীর্ঘদিনের সাথি মোস্তফা মোহসীন মন্টুর সঙ্গে কথা বলেছি। জেনেছি, সিরাজ সিকদারের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের দেখা ও কথা হয়েছে। আমার সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি একটি ঘটনার উল্লেখ করলেন :

মহিউদ্দিন আহমদ: একটা কথা বলুন তো, সিরাজ সিকদারের সম্পর্কে…

মোস্তফা মোহসীন মন্টু : সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে সিরাজ সিকদারের একটা সম্পর্ক ছিল।

মহি : এটা আমি জানতাম না।

মন্টু : আমি এর নীরব সাক্ষী।

মহি: তাদের কি কখনো দেখা হয়েছে?

মন্টু : ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির মাঠে দেখা হয়েছে, নজরুল হলের সামনে।

মহি: কোন সালে?

মন্টু : ১৯৬৭ সালে। খুব ক্রুসিয়াল টাইম। সিরাজ ভাইয়ের একটা লামব্রেটা মোটরবাইক ছিল। উনি এটা নিয়া চলতেন। আবার আমার মোটরসাইকেলেও যেতেন। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনের রাস্তাটা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতাম। এটা খুব নিরাপদ রাস্তা ছিল। আর রেললাইনের বস্তিতে সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে যে কত রাত কাটিয়েছি!

মহি: সিরাজ সিকদারের বিষয়টা বলুন।

মন্টু : একবার মোটরসাইকেলে সিরাজ ভাইসহ আমরা তিনজন মেডিকেল কলেজের পাশ দিয়ে বকশীবাজার হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলাম। নজরুল হলের কাছে এসে একটা গাছের নিচে দাঁড়ালাম। রাতের বেলা। সিরাজ ভাই বললেন, ‘আমার দিকে খেয়াল রাখিস।’ আমাদের দুজনের কাছেই পিস্তল আছে। দুজন লোক এল। আমরা একটু এগিয়ে গেলাম। ওই দুজনের মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে থাকল। একজন এগিয়ে এল। সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলল। দেখছি, কিন্তু শুনতে পাচ্ছি না। সিরাজ ভাই আমাদের বললেন, এই, তোরা পিছে যা। যেখানে ছিলি, সেখানে যা। আমরা একটু এগিয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, ওরা দুজন এসেছে কেন? আসার কথা তো একজনের? দুই ঘণ্টার মতো কথা বললেন তাঁরা।

মহি: দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?

মন্টু : না, বসে।

মহি: মাঠে বসে?

মন্টু : হ্যাঁ, গাছতলায়, চাদর বিছিয়ে। কৃষ্ণচূড়াগাছ ছিল।

মহি: সিরাজ সিকদারকে কি আগে থেকে চিনতেন? তাঁর চেহারা?

মন্টু : না। ডেসক্রিপশনটা হলো চারকোনা মুখ।

মহি: উনি তো ছাত্র ইউনিয়ন-মেনন গ্রুপে ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন?

মন্টু : প্রমিন্যান্ট ছিলেন না। এই যে দেয়ালে ছবিটা, এ ছবিটা কিন্তু সিরাজ সিকদারের বোন শামীমের করা।

মহি: তো তাদের মধ্যে কী আলাপ হলো?

মন্টু : পরে জিজ্ঞেস করেছি। সিরাজ ভাই বললেন, এরা তো বিপ্লব করতেছে। সামনে আমাদেরও তো বিপ্লবই করতে হবে। বিপ্লব করলে তো একই জায়গায় থাকতে হবে। একই জায়গায় দেখা হবে। ওদের চিন্তাচেতনা এক রকম, আমাদেরটা এক রকম। স্বাধীনতা আমরা দুজনেই চাই। পদ্ধতি কী হবে, এটা পরে দেখা যাবে।

মহি : ইনি যে সিরাজ সিকদার, এটা সিরাজ ভাই বললেন?

মন্টু : হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কে ইনি? খবরদার, কাউকে বলবি না, সিরাজ সিকদার।’ বলতে চাননি। অনেক জোর করে। কথাটা আদায় করেছি।

মহি : সিরাজ সিকদারের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, এটা আজই প্রথম জানলাম।

মন্টু : মনি ভাই আর সিরাজ ভাইয়ের মধ্যে একটা বিষয়ে মিল ছিল–ডেস্টিনেশনে যাওয়ার পথে যারা একমত হবে, সেই লোকগুলোকে সাথে নিয়া যাও। আমরা তো এক রাস্তায় যাব। রাস্তা। বাক না নেওয়া পর্যন্ত একসঙ্গে চলি না? [১৯]

.

১৩

সংগঠন করা সহজ কাজ ছিল না। সংগঠকদের আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিল। না। সিরাজুল আলম খানের কাছে শুনেছি, আবদুর রাজ্জাক কেরানীগঞ্জে আঁটি স্কুলে ছাত্র পড়াতেন। কাজী আরেফ আহমদ পোগোজ স্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষকের চাকরি নিয়েছিলেন। সিরাজুল আলম খান আঁটি স্কুলের একটা কামরা ব্যবহার করে ওখানে মেট্রিক পরীক্ষার্থীদের কোচিং করাতেন। এসব করে যা পেতেন, তা দিয়ে খাওয়া, চলাফেরা ও সংগঠনের কাজ। পরে সিরাজ ও রাজ্জাক কাজ। ছেড়ে দেন। আরেফ একাই শিক্ষকতা চালিয়ে যান এবং অন্য দুজনকে যত। দূর পারেন সাহায্য করতেন। সময় ছিল বৈরী। সিরাজুল আলম খান ওই সময়ের একটা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া বিবরণ দিয়েছেন, যেখানে ফুটে উঠেছে তাদের কষ্টের কথা, কৃচ্ছ্বসাধনের কথা :

সিরাজ : তোমাকে ক্ষুধার একটা স্টোরি বলি। বড় আকারে শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার আগে আমরা ২০-২২ জন ঢাকা-বেজড কাজ করতাম। আর ১০-১২ জন শ্রমিক। পয়সাকড়ির এত অভাব? বাড়ি থেকে যা পায়–আমারটা পেলে সবাই, সবারটা পেলে আমি, এ রকম তো? কোনো রকমে সকালে নাশতা করার পর হয়তো সেটা ভালোভাবেই করা হতো। তারপর সারা দিন না খাওয়া। হেঁটে সব জায়গায় যাওয়া, কাজ করা। দুই আনা-চার আনা খরচ করে যে বাসে যাবে, সেটাও খাওয়ার জন্য রাখা হতো। বিকেলে দেখা গেল, এক। টাকা বা দুই আনা-চার আনা জোগাড় হয়েছে। যার পকেটে যা। আছে। মনি নামে আমাদের সঙ্গে একটা ছেলে ছিল। এখন বেশ। পয়সাকড়ি হয়েছে। খুব সিনসিয়ার। টাকাগুলো সাধারণত রাজ্জাক কালেক্ট করত। আমি নিজে ধরতাম না। হঠাৎ দেখা গেল দূর থেকে একজন আসছে। মনি। শেখ মনি না, অন্য এক মনি। আলী হোসেন মনি। গেঞ্জিটাকে বিড়া বানিয়েছে। মাথার ওপর এত বড় একটা…

মহি: টুকরি?

সিরাজ : না, কাঁঠাল। মিরপুর থেকে এটা কিনে নিয়ে এসেছে। হেঁটে গিয়ে। আট আনা-দশ আনা দাম। এটা রাখেন সিরাজ ভাই। তারপর দুই সের মুড়ি। এইটা দিয়ে ২০-২২ জনের খাওয়া। বহুদিন এভাবে চলেছে।

একদিন শেখ মনির সঙ্গে পালিয়ে আছি বাড্ডায়, দক্ষিণখান। তখন তো এগুলো চষা খেত, খাল-বিল। আওয়ামী লীগ কানেকশনে এক লোক একটা ঘর উঠিয়েছিল। টিনের বেড়া, কাঁচা ফ্লোর। রান্নাবান্নার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু করতে হতো না। গ্রামের লোকেরাই রান্না করে দিত।

একবার একটা পলিসি মিটিংয়ে সে বলল, তুই বেশি তর্ক করিস কেন? বললাম, আমি যা বুঝি, তা-ই করব।

আর একবার বললে কিন্তু বের করে দেব।

মহি: আপনি বললেন?

সিরাজ : না, সে বলল। আমাকে এ রকম বলা? হোয়াট?

বল।

দে বের করে। আমি আবারও বললাম। সে বের করে দিল আমাকে। বলল, গেট আউট। তখন রাত একটা।

মহি : দক্ষিণখান থেকে?

সিরাজ : হ্যাঁ। বেরিয়ে হেঁটে চলে এলাম ঢাকা হলে। দিনে তো বের হতে পারি না। পরদিন সন্ধ্যায় গেলাম ওখানে। মনি বলল, তুই চলে গেলি? আমি বলাতে?

থাকলে হয়তো আরও ঝগড়া হতো। তার চেয়ে চলে যাওয়াটাই ছিল ভালো।

হার্ট খুব ভালো ছিল মনির। সবাই তো বলে, পরে কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। খুব ফরমাল হয়ে গিয়েছিল।

এখন যেটা ভাবি…। ওবায়দুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মনি, ফেরদৌস কোরেশী–এদের কাছে বললে আমার মনে হয় ক্ষতি হতো। ছাত্রলীগের মাধ্যমে এটা আউট হয়ে যেত।

অনেক সময় রাতে থাকার জন্য এর কাছে, ওর কাছে গেছি। কোথাও শেল্টার পেয়েছি, কোথাও পাইনি। এই যে মন্ত্রী আনিসুল হকের বাবা সিরাজুল হক সাহেব। ফোন-টোন করে গেলাম। বলছে, রাতে খাইয়া আসবা?

না, আপনি খাওয়ালে খাব।

ঠিক আছে, আসো।

উনি মক্কেল-টক্কেল বিদায় দিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা শুরু করলেন। আমার সঙ্গে কলিমুর রহমান, একজন স্টুডেন্ট-ডাক্তার। রাত নয়টা-সাড়ে নয়টায় কথা শুরু হলো। দশটা-সাড়ে দশটায় বলে যে সিরাজ, তুমি চলে যাও। আর একবারও যদি কথা বললো, আমি কিন্তু তোমাকে পুলিশে দিয়ে দেব। মানে এসব স্বাধীনতার কথাটথা বললে।

মহি : এটা কোন ইয়ারের কথা?

সিরাজ : সিক্সটি সিক্স। [২০]

.

১৪

১৯৬৫ সালের শেষ দিকে সিরাজুল আলম খান তাঁর কাজের ধরন ও পরিধি পাল্টাচ্ছিলেন। কামরুদ্দীন আহমদের সঙ্গে তিনি ওই সময় বেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতো। এ প্রসঙ্গে কামরুদ্দীন আহমদ বলেন :

১৯৬৭ সালের এপ্রিল মাসে আমার দ্য সোশ্যাল হিস্ট্রি অব ইষ্ট পাকিস্তান প্রকাশিত হয়। বইটি হঠাৎ এত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে ছয় মাসের মধ্যেই প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। ওই বছর ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই দ্বিতীয় সংস্করণ বের করতে হয়। ওই পুস্তকখানি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতার রূপ নেয়। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ওরা দুজন আমার অফিসে যেত, আমার সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে আলোচনা করার জন্য। সিরাজুল আলম খান। তখন মুখে বাংলার স্বাধীনতার কথা না বললেও স্বাধীনতা লাভের জন্য শেখ মুজিবের অজ্ঞাতে আওয়ামী লীগের কিছু কর্মী নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় গুপ্ত সংগঠন করেছিলেন। ওই সংগঠনসমূহের জন্য প্রচারপত্র লেখা হতো ও তাদের মধ্যে বিতরণ করা হতো। এই সংগঠনের কথা আওয়ামী লীগ নির্বাহী কমিটির কেউ, এমনকি শেখ সাহেবও জানতেন না। সিরাজুল আলম খান তার

ওই গুপ্ত সংস্থার জন্য তখন একটি প্রেস কেনার চেষ্টা করেছিলেন। [২১]

সিরাজুল আলম খান কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, খবরের কাগজগুলো তাদের কথা তেমন ছাপাত না। সাংবাদিকেরা অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিত। এ নিয়ে তাঁর মনে ছিল প্রচণ্ড ক্ষোভ। এ নিয়ে কিছু কথা হলো।

মহি: সাংবাদিকদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ কেমন ছিল?

সিরাজ : একটা জার্নালিস্টও জানতে চায়নি, কখন, কীভাবে এসব হলো। সব পাকিস্তান-মার্কা জার্নালিস্ট। শুধু আমাদের নূরুল ইসলাম ভাই, পরে বাসসে গিয়েছিলেন, উনি জানতেন। আর আমাকে ভালো জানতেন, বুঝতেন কী একটা কাজ হচ্ছে, সিরাজুদ্দীন হোসেন। আর আউয়াল সাহেব ছিলেন। সিনিয়র জার্নালিস্ট, মারা গেছেন। আজাদ-এর তখনকার নিউজ এডিটর। আর ছিল আবুল বাশার মৃধা, আজাদএ কাজ করত।

মহি : ওই সময় কিছু লোক তো আপনাদের নিশ্চয়ই ফিন্যান্সিয়াল হেল্প করত? অল্প হলেও।

সিরাজ : ফিন্যান্সিয়াল হেল্প করত সাইদ ভাই।

মহি : সাইদ ভাই মানে সাইদুর রহমান? উনি তো আরও পরে, ১৯৬৯-৭০ সালে। আর কোনো ফিন্যান্সিয়াল হেল্প? এই যে রংটং কিনতে হবে, এটা-ওটা কিনতে হবে।

সিরাজ : এটা চাঁদা তুলে। রেজা আলী কনট্রিবিউট করত। লিফলেট আমরা বিনা পয়সায় ছাপায়া ফেলতাম। পাইওনিয়ার প্রেসের মোহাইমেন সাহেবের কী যে কনট্রিবিউশন? হাজার হাজার লিফলেট ওখান থেকে ছাপিয়ে এনেছি। অনেক টাকা দিয়েছেন আমাদের। ১০ টাকা, ১৫ টাকা, ২০ টাকা। থাকতেন সদরঘাটে। ওখানে বাসা ছিল।

আরেকজন ছিলেন, নবাবগঞ্জ রোডে বইয়ের ব্যবসা করতেন। নাম হলো নুরুল ইসলাম বিএসসি। গেলেই উনি ১০ টাকা দিতেন।

মহি :নুরুল ইসলাম বিএসসি? চিটাগাংয়ে একজন আছেন, উনি নাকি?

সিরাজ : না না।

আবদুল বাশার মৃধাও বেশ পয়সা খরচ করতেন। ওনার বাবা ছিলেন ট্রেন ড্রাইভার।

মুজিব ভাই নিজের যোগাযোগের মাধ্যমে ইস্পাহানি গ্রুপ থেকে বড় অঙ্কের চাঁদা পেতেন। উনি আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মালিক হারুন গ্রুপের কাছ থেকে নিয়মিত বেতন পেতেন। এই কোম্পানির পূর্ব পাকিস্তান শাখার প্রধান ছিলেন স্বয়ং মুজিব ভাই। তাজউদ্দীন ভাই, গাজী গোলাম মোস্তফাসহ বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা আলফা ইনস্যুরেন্সে কাজ করতেন। আমরা ছাত্রলীগের কাজে টাকার দরকার হলে প্রয়োজনমতো তিনি টাকা দিতেন। আমিও দরকার পড়লে টাকার জন্য তাকে বলতাম। পরিমাণে বেশি না হলেও দু-তিনবার টাকা নিয়েছি। ছয় দফা দেওয়ার পর মুজিব ভাই গ্রেপ্তার হয়ে গেলে আলফা ইনস্যুরেন্স থেকে টাকা সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কেন্দ্রীয়ভাবে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ময়মনসিংহ থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং পাবনা থেকে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ঢাকায় আনা হয়। তাঁদের দুজনসহ আরও কয়েকজনকে মাসিক হারে টাকা দেওয়া হতো। সৈয়দ নজরুল পেতেন এক হাজার টাকা এবং মনসুর আলী পেতেন পাঁচ শ টাকা।

টাকার অভাবে অন্যান্য খরচ, যোগাযোগ, কষ্টকর ছিল। ১৫ নম্বর পুরানা পল্টনে অফিসভাড়া মাসে ২৫ টাকা, বিদ্যুৎ বিল মাসে ৫ টাকা দিতে হতো। আমি, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমদ, আওয়ামী লীগের আলী হোসেন ও শাহাবুদ্দিন অফিসে নিয়মিত যেতাম। মুহম্মদুল্লাহ ভাই অফিসে আসা বন্ধ করলেন। তাজউদ্দীন ভাই অ্যারেস্ট হওয়ার কারণে প্রথমে মিজান ভাই (মিজানুর রহমান চৌধুরী) এবং তারপর আমেনা বেগমকে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়। তখন সৈয়দ নজরুল ও মনসুর আলী সভা-সমিতি উপলক্ষে ঢাকায় আসতেন। ঢাকার গাজীপুরের ময়েজউদ্দিন, নেত্রকোনার মোমেন ভাই সপ্তাহে এক দিন অফিসে আসতেন। মাঝেমধ্যে টাঙ্গাইলের মান্নান ভাইও আসতেন। মোয়াজ্জেম ভাই প্রায়ই আসতেন। এ ছাড়া ঢাকা শহর বা জেলার কেউ ছয় মাসেও একবার আসতেন না। [২২

 শেখ মুজিব জেলে থাকা অবস্থায়ও সিরাজুল আলম খান তাঁর কাছ থেকে নিয়মিত টাকা পেতেন বেগম মুজিবের মাধ্যমে। সিরাজুল আলম খান এ ব্যাপারে বলেন :

মুজিব ভাই তখন জেলে। ভাবি (বেগম মুজিব) ১৫ দিন বা এক মাস পরপর তার সঙ্গে জেলে দেখা করতে যেতেন। মাঝেমধ্যে আমি গিয়ে ভাবির সঙ্গে দেখা করতাম মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে তার আলোচনার বিষয় জানার জন্য। একবার ভাবির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম দুপুরের দিকে। ভাবি বললেন, ‘ভাই, আসেন, খেয়ে যান।’ সারা দিন খাইনি। সাগ্রহেই খেলাম। ভাবি পান খেতেন। আমার হাতেও এক খিলি পান তুলে দিলেন। ঘণ্টাখানেক পর বাসা থেকে বেরিয়ে আসছি। হঠাৎ ভাবি বললেন, ভাই, দাঁড়ান। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে বললেন, ‘এখানে দুই শ টাকা আছে, রাখেন।’ দুটি এক শ টাকার নোট। বললেন, ‘ফোনও তো করতে পারেন। আমাকে ফোন করবেন। আমি বেরিয়ে এসে গেট পার না হতেই ভাবি আবার বললেন, মাসের প্রথম দিকে ফোন করবেন, ভাই।’ প্রতি মাসে আমি ফোন করতাম। আমাকে তিনি যেতে বলতেন। একটা খাম দিতেন। ভেতরে কখনো দুই শ এক টাকা বা দুই শ দশ টাকা। প্রতি মাসের শুরুতেই আমি ফোন করতাম। দু-তিন মাস বাদ ছিল। ‘৬৯ সালে মুজিব ভাই জেল থেকে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত একই পরিমাণ টাকার একটা খাম আমাকে দিতেন। [২৩]

.

১৫

পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার একটি উদ্যোগে জড়িয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তানে সশস্ত্র বাহিনীর কতিপয় সদস্য। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, লিডিং সি-ম্যান সুলতান উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। ১৯৬২-৬৩ সালের দিকে করাচিতে এই উদ্যোগের সূত্রপাত। পরে তারা সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে ও বাইরে আরও কয়েকজনকে সম্পৃক্ত করেন। তারা দেশের জন্য একটি পতাকাও তৈরি করছিলেন এবং নতুন দেশের নাম রেখেছিলেন ‘বাংলাদেশ। দলের একজনের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে এই গোপন উদ্যোগের বিষয়টি পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের কাছে ফাঁস হয়ে যায়। শুরু হয় ধরপাকড়। ১৯৬৮ সালের জুন মাসে শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামি করে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ভারতের সাহায্যে তারা পাকিস্তান ভেঙে পূর্ব। পাকিস্তানকে আলাদা করতে চেয়েছেন; আগরতলায় বসে এ ষড়যন্ত্র করা। হয়। মামলাটির নাম ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য। গণমাধ্যমে এবং জন-আলোচনায় এটি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিতি পায়।

ওই সময় পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) নামে একটি জোট তৈরির চেষ্টা চালায়। উদ্দেশ্য হলো, ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিতে সরকারবিরোধী জনমত ও আন্দোলন গড়ে তোলা। এ সময় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একধরনের আপসকামিতা দেখা যায়। ওই সময় সিরাজুল আলম খানের একটা চেষ্টা ছিল আওয়ামী লীগ যাতে রাজনীতির মাঠে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে এবং একই সঙ্গে শেখ মুজিব ও মামলার অন্য অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিটি হারিয়ে না যায়। এ প্রসঙ্গে কামরুদ্দীন আহমদের ভাষ্য বেশ চমকপ্রদ ও প্রাসঙ্গিক। এখানে তা উদ্ধৃত করা হলো :

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন রাজসাক্ষীদের জেরা চলছিল, তখন আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী দল কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি পাঞ্জাবের নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের পরামর্শে পাকিস্তান। ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টে (পিডিএম) যোগ দেওয়া সাব্যস্ত করে। সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, আমেনা বেগম ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম সালাম খানের পিডিএমে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব আলোচনা করার জন্য আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁদের নিকট থেকে শুনতে পেলাম যে নবাব নসরুল্লাহ নেতাদের বোঝাতে সক্ষম। হয়েছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের ফাঁসি, না হয় ১৪ বছরের জেল অবধারিত। ওই পটভূমিতে সব দলের সব নেতা একত্রে মিলে পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য আন্দোলন করা ছাড়া পথ নেই। সেই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট সংঘটিত হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ যদি এই আন্দোলনে যোগ না দেয়, তবে তাদের পক্ষে একা আন্দোলন করা সম্ভব হবে না। বিশেষ করে শেখ মুজিব উপস্থিত নেই এবং অদূর ভবিষ্যতে সে সম্ভাবনাও নেই।

আবদুস সালাম খান এবং জহিরুদ্দীন আগরতলা মামলায় শেখের পক্ষে প্রধান উকিল। সুতরাং তাদের দুজনকে নবাবজাদা নসরুল্লাহ অনুরোধ করলেন শেখ মুজিবকে বোঝাতে, যাতে তিনি যেন আওয়ামী লীগকে পিডিএমের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। কারণ, ওই যোগদানের ফলে কেবল দেশের মঙ্গলই হবে না, আওয়ামী লীগও সংগঠন হিসেবে বেঁচে থাকবে। নবাবজাদা নিশ্চিত ছিলেন যে শেখ সাহেব আবদুস সালাম খান ও জহিরুদ্দীনের অনুরোধ রক্ষা না করে পারবেন না।

পরের দিন ক্যান্টনমেন্টে আসামিরা যখন হাজির হলো, তখন আবদুস সালাম খান ও জহিরুদ্দীন শেখ মুজিবের নিকট নবাবজাদা নসরুল্লাহর প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। শেখ সাহেব আবদুস সালাম খানকে একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করতে বলেন এবং আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটিকে সংগঠনের কাজ সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য টাকাপয়সার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেন। নবাবজাদার প্রস্তাবের প্রসঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগ কার্যকরী সংসদের যেসব সদস্য বাইরে আছে, তাদের মতামত গ্রহণের নির্দেশ দিলেন এবং ওই সদস্যদের সভায় প্রস্তাবটি উত্থাপন করে ওই সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপদেশ দেন। তিনি স্টিয়ারিং কমিটির কয়েকজন সদস্যের নামও বিবেচনা করতে বললেন ও স্টিয়ারিং কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে আবদুস সালাম খানকে মনোনীত করলেন। আওয়ামী লীগের সদস্য অন্য যেসব উকিল ওই মামলা পরিচালনার জন্য ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের তিনি ওই সমস্ত ঘটনা এবং আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আমেনা বেগমকে তাঁর নির্দেশ ও উপদেশসমূহ জানানোর জন্য বলেন। এ ছাড়া সালাম খানের সঙ্গে তার আলোচনার কথাও জানাতে বলেন। পরদিন আবদুস সালাম খান ও জহিরুদ্দীন আমেনা বেগমকে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের সভা আহ্বান করতে অনুরোধ জানালেন। অন্যান্য জেলার প্রতিনিধিরা যাতে এই সভায় উপস্থিত হতে পারেন, সে জন্য সাত দিনের নোটিশ দিয়ে এই জরুরি সভা ডাকা হলো। সভায় মোটামুটিভাবে যেসব সদস্য গ্রেপ্তার হননি, তারা প্রায় সবাই উপস্থিত হয়েছিলেন।

সভায় আবদুস সালাম খান প্রথমে সদস্যদের মামলার ভালো মন্দ দিক বিশ্লেষণ করে শোনান। তিনি ইঙ্গিতে জানালেন যে যদিও রাজসাক্ষীর মধ্যে অনেকেই সরকারকে সমর্থন করেনি, তবু যেসব দলিল ও পুলিশ রিপোর্ট এসেছে ও ভারতীয় মিশনের ভূতপূর্ব বাণিজ্যসচিব সম্বন্ধে যেসব তথ্য সংগ্রহ ও প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করা হয়েছে, তাতে শেখ সাহেব এবং অন্যদের মুক্তি সম্ভব না-ও হতে পারে। আর যেহেতু সরকারি উকিল মনজুর কাদের যথেষ্ট পরিশ্রম করে মামলাটা সাজিয়েছেন, তাতে ট্রাইব্যুনাল হয়তো বিশ্বাস করবেন যে মামলা সঠিক, তবে শেখ মুজিব ও তাঁর দলের ভয়ে সাক্ষীরা সত্যি কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। সে অবস্থায় ট্রাইব্যুনাল শেখ মুজিবকে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলতে পারেন। বিপদ হচ্ছে যে ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার কোনো সুযোগ থাকবে না। সুতরাং ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, ট্রাইব্যুনালের রায় মেনে নিতে হবে। অথচ দেশে গণতন্ত্র থাকলে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যেত। সুতরাং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগকে সব দলের সঙ্গে একত্র হয়ে আন্দোলন চালাতে হবে।

মামলা সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনার পর আবদুস সালাম খান পিডিএমের ম্যানিফেস্টোর একটা করে কপি প্রত্যেক সদস্যকে দিলেন। সবাই যখন তাদের কপি পড়ে ফেললেন, তখন আবদুস সালাম খান প্রতিটি দফার ওপর তাদের মতামত দিয়ে সদস্যদের বক্তৃতা করতে বললেন। সিরাজুল আলম খান বললেন যে প্রতিটি দফা ভালো করে পরীক্ষা করার জন্য দু-এক দিন সময়ের প্রয়োজন। সুতরাং সভা আপাতত ২৪ ঘন্টার জন্য মুলতবি রাখা হোক। সিরাজুল আলমকে সমর্থন করল আবদুর রাজ্জাক, আমেনা বেগম ও নজরুল ইসলাম। সভা মুলতবি করা হলো রাত্রে সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক আমার বাসায় এলেন দফাগুলো আলোচনা করার জন্য। আমি দফাওয়ারি মতামত দেওয়ার আগে তাঁদের সতর্ক করে বললাম, এটা নবাবজাদা নসরুল্লাহর ষড়যন্ত্রও হতে পারে। শেখ সাহেব ১৯৬৬ সালে লাহোরে বিরোধী সর্বদলীয় সম্মেলনে যখন ছয় দফা উপস্থাপন করেছিলেন, তখন নসরুল্লাহ বলেছিলেন যে ছয় দফা বিবেচনা করা যায় না, কারণ, ছয় দফা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মস্তিষ্কপ্রসূত। ওই কথার ওপরই শেখ মুজিব লাহোর সম্মেলন থেকে বেরিয়ে আসেন। সেই থেকে অদ্যাবধি পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ছয় দফা দাবির কোনো দফা প্রত্যাহার করেনি বা পুনর্বিবেচনা করেনি। অথচ নবাবজাদা এখন সেই ছয় দফার প্রবক্তা এবং তাঁর ভাষায় বিচ্ছিন্নতাবাদী আওয়ামী লীগকে পিডিএমে টানার জন্য ঢাকায় এসেছেন। উপরন্তু আবদুস সালাম খান ও জহিরুদ্দীন এ প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন, অথচ তারাও ছয় দফা আন্দোলনের সমর্থক নন। তাই স্বভাবতই ধরে নেওয়া দোষের হবে না যে এর পেছনে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র আছেই। হতে পারে পূর্ব পাকিস্তানে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছে, তা ভন্ডুল করাই এদের উদ্দেশ্য। আমি বলি যে ব্যক্তিগতভাবে আবদুস। সালাম খান আগরতলা মামলা সম্বন্ধে যে বিশ্লেষণী দিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে আমি একমত হতে পারছি না। আমি মনে করি, বিশ্লেষণটি উদ্দেশ্যমূলক। আওয়ামী লীগ যাতে তার প্রস্তাব মেনে নেয়, সে জন্যই এভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কারণ, প্রথমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে পরে সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টে আপিলের মাধ্যমে শেখ সাহেবকে মুক্ত করা হবে একটা বাতুল চিন্তা। কারণ, এ ধরনের পদক্ষেপ যথাযথভাবে গ্রহণ করার মতো পরিবেশ বা পরিস্থিতি কখন তৈরি হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। জেল বা ফাঁসি থেকে তাকে রক্ষা করতে হলে জেলের তালাই ভাঙতে হবে, আর তা করতে হবে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই।

এরপর আমি প্রতিটি দফার ওপর আমার মতামত দিতে আরম্ভ করি। সিরাজুল আলম খান কাগজ-কলম নিয়ে প্রতিটি দফার ওপর আমার বিশ্লেষণমূলক আলোচনা ও মতামত লিখে নেয়। সম্ভবত এর জন্যই পরদিন আবদুস সালাম খান ও জহিরুদ্দীন যথেষ্ট বিতর্কের পরও আওয়ামী লীগকে পিডিএমে যোগ দেওয়ার প্রস্তাবে সম্মত করাতে ব্যর্থ হন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে শেখ সাহেব ১৯৬৬ সালের পর থেকে জেলে থাকার সময় সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাকের চেষ্টায় আওয়ামী লীগের কর্মসূচির ভেতর দুটো দফা সংযোজন করা হয়। একটি দফা হলো দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট ব্যবস্থা ভেঙে ফেলা।। [২৪]

.

১৬

কামাল উদ্দিন আহমেদ পড়ে মোহাম্মদপুর গভ. হাইস্কুলে। বাড়ি কাঁপাসিয়া। থাকে ঢাকার মণিপুরিপাড়ায়। তার পরিবারে রীতিমতো একটা ঝড় বয়ে গেছে। তার বড় ভাই পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবেক লিডিং সি ম্যান সুলতান উদ্দিন আহমেদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৪ নম্বর আসামি। কামালের ভগ্নিপতির নামও কামালউদ্দিন। তিনি ব্যবসা করতেন। আগে নৌবাহিনীতে ছিলেন। তিনি এই মামলার ২ নম্বর সাক্ষী। দুজনই তখন গ্রেপ্তার অবস্থায় আছেন ঢাকা সেনানিবাসে। কামাল বুঝে উঠতে পারছিল না কী করবে।

কামাল জানে, এই মামলার ১ নম্বর অভিযুক্ত হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কী মনে করে কামাল একদিন গিয়ে উপস্থিত হলো ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবের বাসায়। দেখা করল বেগম মুজিবের সঙ্গে। বলল, এখন সে কী করবে। বেগম মুজিবের অবস্থাও তখন ভালো নয়। দলের লোকেরা তাঁর বাড়ির ছায়া মাড়ায় না। শেখ মুজিবের পক্ষে মামলা লড়ার জন্য উকিল পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি কামালকে বললেন, তুমি সিরাজুল আলম খানের কাছে যাও।’ কামাল বলল, তাকে তো চিনি না। কোথায় পাব তাকে।’ বেগম মুজিব বললেন, তুমি ইকবাল হলে যাও। সেখানে দেখবে একজন লোক, লম্বা চুল, দাড়ি-গোফ। তাকে খুঁজে বের কর। সে-ই সিরাজুল আলম খান।

কামাল ইকবাল হলে গেল। খুঁজে বের করল সিরাজুল আলম খানকে। তিনি কামালকে নানান পরামর্শ দিলেন। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী কামালদের পরিবারের খোঁজখবর রাখতেন। [২৫]

বদিউল আলম ছিলেন ছাত্রলীগের তুঘোড় কর্মী। তাঁর ভাষ্যে জানা যায়, ছাত্রলীগের মধ্যে একটি ঘরানা তৈরি হচ্ছে ষাটের দশকের মাঝামাঝি। একপর্যায়ে তিনিও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। তার সঙ্গে আমার কথোপকথন ছিল এ রকম :

বদিউল আলম : আমি তখন সচিবালয়ে স্বাস্থ্য দপ্তরের কেরানি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি। থাকতাম আজিমপুরে ছাপরা মসজিদের পেছনে একটা মেসে। ওখানে আসত আখতারুল হক আর রফিক। আখতারুল ছাত্র ইউনিয়ন করত। রফিক ছাত্রলীগ।

মহিউদ্দিন আহমদ : রফিক মানে লিটল কমরেড?

বদিউল : হ্যাঁ। আমরা মাঝেমধ্যে আড্ডা দিতাম, স্বাধীনতা নিয়ে কথাবার্তা বলতাম। আমরা একটা দেয়ালপত্রিকা বের করে ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলের দেয়ালে লাগিয়েছিলাম। ওখানে আমরা স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার–এ-জাতীয় কবিতা, লেখা ব্যবহার করেছি। স্বাধীনতা শব্দটি সরাসরি ব্যবহার করিনি।

তারপর শুরু হলো ইকবাল হলে যাওয়া-আসা। রফিকের মাধ্যমে কাজী আরেফ আহমদের সঙ্গে প্রথমে পরিচয় হলো। তারপর পরিচয় হলো সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে।

মহি : এটা কি ছয় দফা-৭ জুন (১৯৬৬)-এর আগে না পরে?

বদিউল : আগে। ৭ জুনের হরতালের সময় আমি তো অ্যাকটিভ ওয়ার্কার। ইকবাল হলে এসে ওনাদের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে আমি ছাত্রলীগার হয়ে গেলাম। তখন জগন্নাথ কলেজে নাইট শিফটে ভর্তি হলাম। ক্লাস-ট্রাস করতাম না। ইকবাল হলে তখন মার্শাল মনির সঙ্গেও কথা হয়। উনি আসতেন।

মহি : এদের মধ্যে কার সঙ্গে আগে পরিচয় হয়েছে?

বদিউল : কাজী আরেফ আহমদ।

মহি : উনি তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র?

বদিউল : হ্যাঁ। তখন তাঁদের সঙ্গে কাজে জড়িত হয়ে একপর্যায়ে চাকরি ছেড়ে দিই। চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় আমার সারভাইভালের আর কোনো পথ খোলা থাকল না। আমি মেস ছেড়ে দিয়ে ইকবাল হলে এসে থাকতাম। তখন কাজী আরেফ আহমদের সঙ্গে আমার একটা অ্যাসোসিয়েশন ডেভেলপ করে। তাঁর বাসায় যেতাম। তখন ছয় দফা, স্বায়ত্তশাসন, স্বাধীনতার কথা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতো।

মহি: নিউক্লিয়াস সম্পর্কে ধারণা হলো কখন?

বদিউল : এ সম্পর্কে আমি জানতে পারি ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে।

মহি: নিউক্লিয়াস শব্দটি কি ব্যবহার করা হয়েছিল?

বদিউল : না। ছাত্রলীগের যে গ্রুপিং আমাদের, এটা ছিল সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক আর কাজী আরেফ আহমদকে কেন্দ্র করে। এরা আমাদের গাইড করত।

কাজী আরেফ আহমদ ঢাকা সিটির সাংগঠনিক কাজ দেখাশোনা করতেন। শেখ মুজিবকে যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানো হলো, আমার তারিখ সঠিক মনে নাই, রাতে আমরা এর প্রতিবাদে পোস্টার লাগিয়েছিলাম। ইকবাল হল, সলিমুল্লাহ হল, আজাদ অফিসের দেয়ালে–কিল কিল আইয়ুব কিল, কনডেম লন্ডন কন্সপিরেসি।

মহি : লন্ডন কন্সপিরেসি কেন?

বদিউল : আইয়ুব খান লন্ডন ভিজিটে গিয়েছিল। সেখান থেকে এসেই সে এটা করেছে।

তখন জানলাম, সিরাজুল আলম খান হচ্ছে আমাদের লিডার। আমাদের ধারণা ছিল, তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে লিয়াজো মেইনটেইন করেন। কেউ এটা আমাদের বলে দেয়নি।

এ সময় আমাকে শ্রমিকনেতা আবদুল মান্নানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো। আমি ঢাকা জুট মিলে থাকতাম এবং শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে কথাবার্তা বলতাম। তেজগাঁওয়ের শ্রমিকনেতা রুহুল আমিন ভূঁইয়ার ওখানেও যেতাম, কাজ করতাম। পরে রফিক। আর আমাকে রুহুল আমিন ভূইয়ার সঙ্গে ট্যাগ করে দেওয়া হলো।

কাজী আরেফ আহমদ আমাকে একদিন বললেন, আমাদের দেশের বাইরে যেতে হবে। ট্রেনিংয়ের জন্য। [২৬]

.

১৭

১৯৬৬-৬৮ সাল ছিল আওয়ামী লীগের জন্য দুঃসময়। নেতারা বেশির ভাগ জেলে আটক। যুবনেতাদের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি, কে এম ওবায়দুর রহমান ও আবদুর রাজ্জাকও কারাগারে। বলা চলে, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আমেনা বেগম রীতিমতো হারিকেন জ্বালিয়ে আওয়ামী লীগ অফিস পাহারা দিতেন, আর বাইরে থেকে আন্দোলনের জোয়ার তৈরির চেষ্টায় ছিলেন সিরাজুল আলম খান। মূল ভরসা ছিল ছাত্রলীগ। তারাই কোনোমতে দলের নিবুনিবু সলতেটাকে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। এ সময় তাদের পাশে দাঁড়ান সাইদুর রহমান নামের এক তরুণ ব্যবসায়ী। ওই সময়ের একটা ছবি পাওয়া যায় তার বর্ণনা থেকে। প্রথমে ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রউফের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। রউফ তাকে ইকবাল হলে নিয়ে আসেন। সেখানে পরিচয় হয় সিরাজুল আলম খান এবং তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাজের তখন সবে শুরু। ছাত্র আন্দোলনের একপর্যায়ে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শেখ ফজলুল হক মনি ও আবদুর রাজ্জাক জেল থেকে ছাড়া পান। তাদের সঙ্গেও সাইদুর রহমানের ঘনিষ্ঠতা হয়। সাইদুর রহমানের ভাষ্য অনুযায়ী :

ওই সময় শেখ সাহেবকে সাপোর্ট করার মতো আই ওয়াজ দ্য লোন ম্যান। সমস্ত ইন্টেলিজেন্স উপেক্ষা কইরা এদের হাইডআউটের জন্য দুইটা বাড়ি ভাড়া করছিলাম আমি। একটা করেছিলাম বাসাবোতে, আরেকটা আদাবরে। এদের রাত্রিবেলা নিয়া যাওয়ার জন্য আমার ঢাকা-ক ৩১৫৫ ভক্সওয়াগন–দ্যাট ওয়াজ দ্য ওনলি কার, তাদের জন্য ইউজ করছি। অন্য কেউ তাদের কাছে আসত না। মিটিংগুলো আমার বাসায় হইত। ১১ দফার প্রথম দিকের লিফলেটটা ছাপানোর টাকা আমি দিছি। মুজিব কোট যে এরা গায়ে দেয়, এদের চার পাঁচজনকে কোট প্রথম আমিই বানায়া দেই। এরা আমার বাসায় থাকত। পরে ইন্টেলিজেন্স যখন এদের পেছনে লাগল, তখন গাড়িতে–আমার ওয়াইফ থাকত পেছনের সিটে, সিরাজ, মনি, তোফায়েল, রাজ্জাক, রউফ, যেকোনো একজন বা দুইজন পেছনের সিটে আমার ওয়াইফের লগে বইত। আমি তাদের ড্রাইভার। এইভাবে রাতের বেলা তাদের নিয়া নিয়া যাইতাম। [২৭]

ক্রিমিনাল অ্যামেন্ডমেন্ট (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডিন্যান্স-৬ ১৯৬৮ অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যদের বিচার চলছিল। আইয়ুব সরকার এই আইন বাতিলের ঘোষণা দেন এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেন। এর আগে শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে আইয়ুব খানের ডাকা গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। প্যারোলে ছাড়া পেয়ে বৈঠকে যোগ দেওয়ার বিষয়টি একটি আপস হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ ছিল। শেখ মুজিব যাতে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে না যান, সে জন্য সিরাজুল আলম খানের একটা চেষ্টা ছিল। এ প্রসঙ্গে কামরুদ্দীন আহমদ বলেন :

এ কে ব্রোহি, খাজা সাহাবুদ্দীন ও আইনমন্ত্রী জাফর সাহেব শেখ মুজিবকে জামিনে অথবা প্যারোলে বের হয়ে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের পরামর্শ দেন। স্পষ্টত এটা ছিল ষড়যন্ত্র মামলাকে জিইয়ে রাখার আরেক ষড়যন্ত্র। শেখ মুজিব যাতে ওই ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁদে পা না দেন, তার জন্য সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক বেগম মুজিবকে সতর্ক করে দেন। বেগম মুজিবকে তারা ক্যান্টনমেন্টে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করে দিতে অনুরোধ করেন। বেগম মুজিবের মাধ্যমে তারা ব্রোহি ও খাজা সাহাবুদ্দীনের প্রস্তাব অনুযায়ী শেখ মুজিবকে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করেন। যাক, শেখ মুজিব শেষ পর্যন্ত ওই ফাঁদে পা দেননি। ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয়। [২৮]

.

১৮

১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কার্যক্রম বাতিল হয়ে যায়। ২২ ফেব্রুয়ারি মামলায় অভিযুক্ত সবাই জেল থেকে মুক্ত হন। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী নিজেই গাড়ি চালিয়ে শেখ মুজিবকে তাঁর ধানমন্ডির বাসায় পৌঁছে দেন। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। বিকেলে অনুষ্ঠিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ। তিনি ‘জনগণের পক্ষ থেকে’ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ঘোষণা করেন। এর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সিরাজুল আলম খান আমাকে বলেন :

সিরাজ : এই প্রথম রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব ভাষণ দেবেন। ধানমন্ডির বাসা থেকে আমরা রওনা হলাম। গাড়িতে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে একদিকে আমি, অন্যদিকে তোফায়েল। পেছনে দুটো গাড়িতে খসরু এবং তাঁর টিম। সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে এসে লিডার (মুজিব) কানের কাছে মুখ এনে বললেন, কী বলবে-টলবে। আমি বললাম, ছাত্র ইউনিয়ন যা বলবে, ইট ডাজ নট ম্যাটার। আমাদের সব ঠিক আছে। কিন্তু কেউ জানে না এখনো। তোফায়েল বলল, ‘কী বলব?’ আমি বললাম যে তুমি একটা টাইটেল দেবা, বঙ্গবন্ধু, আজ থেকে আমরা তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করলাম। তারপর দুবার স্লোগান দেবা। আমি বাঁয়ে ঝুঁকলাম লিডারকে বলার জন্য। তোফায়েল একটা জিনিস দেবে আপনাকে। ওনার ওপর আমার একটা বিরাট কনফিডেন্স ছিল। উনি এটা বুঝলেন। জিজ্ঞেস করলেন না। তোফায়েলকে বললাম, বক্তৃতা শর্ট হবে। এই জায়গায় এটা বলবা, রিসেপশনটা ভালো হবে। মুজিব ভাই অপোজ করলেন না। তার অর্থ হলো, উনি এটা অ্যাকসেপ্ট করলেন। এই তো ‘বঙ্গবন্ধু’ বলার ইতিহাস। এটা আমরা আনলাম ইঞ্জিনিয়ারিং করে।

শব্দটা এল কোথা থেকে? আমাদের রেজাউল হক মুশতাক আর শেখ কামাল একটা পোস্টার বের করেছে। আহসানউল্লাহ হলে ৩১৪ নম্বর রুমে থাকতাম আমি। ওরা আমার কাছে এল। দেখি যে একটা পোস্টার, ‘বঙ্গবন্ধু’ লেখা। এটা লাগাবে, পরামর্শ চাচ্ছে।

কাগজটা মুড়ি দিয়ে বললাম, কাউকে কিছু বোলো না। বঙ্গবন্ধু নামটি আওয়ামী বৃত্তে নতুন যোগ হলেও শব্দটি আগে থেকেই ছিল। ১৩০৮ বঙ্গাব্দে (খ্রিষ্টীয় ১৯০১) বঙ্গবন্ধু নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয়। পত্রিকাটি বঙ্গ নামের দেশটির হিতৈষী–এ অর্থেই ব্যবহৃত হতো। এর সম্পাদক ছিলেন দুর্গাদাস রায়। তখন বঙ্গবন্ধু ছিল একটি পত্রিকা, এখন এটি একজন রাজনৈতিক নেতার বিশেষণ। শিগগিরই এটি তাঁর নামের অংশ হয়ে যায়।

তবে ব্যক্তির ভূষণ হিসেবে বঙ্গবন্ধু’ নাম এর আগেও দেওয়া হয়েছিল স্কটিশ সমাজসেবক ডেভিড হেয়ারকে। রাজা রামমোহন রায়, স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট, রাজা রাধাকান্ত দেব প্রমুখকে নিয়ে ১৮১৭ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হিন্দু কলেজ (পরে নাম হয় প্রেসিডেন্সি কলেজ)। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা প্রসারে তাঁর অবদানে মুগ্ধ হয়ে রামমোহন রায় তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে অভিহিত করেছিলেন। [২৯]

মা-বাবার দেওয়া নামের সঙ্গে একটি বিশেষণ বা উপমা জুড়ে দেওয়ার রেওয়াজ আছে প্রাচীনকাল থেকেই। একসময় সিরাজুল আলম খানের ভক্তরা তাঁকে বাংলার ক্যাস্ট্রো বলা শুরু করেন। এই নামের উৎপত্তি-রহস্য জানাতে গিয়ে তিনি বলেন :

মহি : শেখ মুজিব আপনাকে নাকি ‘ক্যাস্ট্রো’ বলেছিলেন? কখন?

সিরাজ : এটা উনসত্তরের আন্দোলনের পরের ঘটনা।

একদিন মুজিব ভাইয়ের বাসায়। দুপুরবেলা। আফটার লাঞ্চ। সদলবলে সাংবাদিকেরা আসছে। আট-দশজন। ওরা আসার দুই মিনিট আগে আমিও পৌঁছালাম। নাজমুল বলল, দোস্ত, তুই এখানে? এত খাইটা কোনো লাভ আছে? তুই তো কর্মী আর সংগঠক। কোনো দিন নেতা হইতে পারবি না। নেতা হতে হলে তুই ভাব দেখাবি। কাজ কম করবি। দেখিস না আমাদের? তুই দুই ঘণ্টা বসে আছিস না? আমরা ফোন করছি, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আসতে বলছে।

আসলে আমি এসেছি দুই মিনিট আগে। মুজিব ভাই বলছেন, কাজ আছে। ব্যারিস্টার মওদুদ ভাই এসেছে। এই কথাগুলো অন্য জার্নালিস্টরাও শুনেছে। সবাই বসেছে। মুজিব ভাই আমাকে বললেন, ‘আমার পাশে বস।’ আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। মুজিব ভাই বললেন, ‘ওকে চিনিস? চেনো ওরে?’

এমনিতে তো চেহারায় চেনে আমাকে।

চিনে রাখো। আমার ক্যাস্ট্রো কিন্তু।

সবাই এটা ইয়ার্কি-ফাজলামো হিসেবে নিয়েছে। কেউ কারও ক্যাস্ট্রো হয় নাকি? এ রকম একটা ভাব নিয়েছে। ও আমার ফাইল টাইল নাড়াচাড়া করে–একটা নেগলিজেন্সের ভাব না? ওরা বুঝল এ রকম একটা কিছু।

আলাপ-আলোচনা শেষে সালাম-টালাম দিয়ে যাওয়ার সময় মুজিব ভাই ওদের বললেন, ‘দেখো, আমি তো তোমাদের সঙ্গে সব সময় কথা বলতে পারব না। সিরাজের সঙ্গে তোমরা যোগাযোগ রাখবা। হি ইজ দ্য ম্যান। সিরাজ, ওরা যে কী বলতে আসছিল? ওটা করে দে। প্রেসে চলে যাক।’

নাজমুলের তো আক্কেলগুড়ুম। বলে, দোস্ত, আমি তোর কাছে মাফ চাই।

ড. ওয়াজেদ। হাসিনার হাজব্যান্ড। ভালো ছাত্র ছিল। বলত, দোস্ত, জীবনটা নষ্ট করলি। বিয়ে-থা করলি না। চাকরি-বাকরি না, ব্যবসা-বাণিজ্য না। কত বড় হতে পারতি। কিছুই হলি না। ওই টোনের কথা আরকি। নাজমুলের মতোই। তবে এটা হলো। সিমপ্যাথেটিক।

এই ওয়াজেদ, শামসুজ্জামান খান এই মানুষেরা মুভমেন্টের টাইমে সবাই চলে এল দেশে, ছুটিতে। এরা পিএইচডি করছিল। একজন জার্মানিতে ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। আবার কেউ কেউ সিএসপি হয়ে পড়তে গেছে। ‘দোস্ত, তুই যে এত বড় কাজ করছিস।’ ভালো ছাত্র তো? বোঝে। ‘এত বড় কাজ তুই করতেছিস? কিছুই আমরা বুঝতাম না। তুই যে অনেক রাতে। ফিরতি। আমরা তো বলতাম তুই বুঝি কোথাও এমন আড্ডা-টা। দিস, যেটা লেট নাইটে, মুখ দেখানো যায় না।’ [৩০]

.

১৯

‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামটি ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে। কিন্তু ছাত্রলীগের মধ্যে একটা ঘরানা তৈরি হচ্ছিল, যারা স্বাধীনতার কথা বলে, সমাজতন্ত্রের কথা বলে। এটাকে একটা গ্রুপ, উপদল, প্রবণতা–যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তার উপস্থিতি ছিল। সিরাজুল আলম খান ছিলেন এই তরুণদের নেতা। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের পর এই প্রবণতা আরও বেগবান হয়। এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার জন্য আমি শরীফ নুরুল আম্বিয়ার শরণাপন্ন হলাম। আমাদের কথা হলো তার জিগাতলার বাসায় :

মহিউদ্দিন আহমদ; আমি এখন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সুলুকসন্ধান করছি। আদতে কি এর অস্তিত্ব ছিল? নাকি নামটি পরে দেওয়া হয়েছে?

শরীফ নুরুল আম্বিয়া : আমি তখনো ছাত্রলীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট হই নাই। তখনো আমি বুয়েটের একজন অর্গানাইজার। বুয়েট আর ঢাকা সিটির বিভিন্ন জায়গায় ফোরামের কাজ করতাম। তখন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামটা এল। আমি এর সদস্য হইলাম।

মহি : এটা কি ১৯৭০ সালের ছাত্রলীগের কাউন্সিল সভার আগে?

আম্বিয়া : হ্যাঁ, কাউন্সিলের আগে।

মহি: ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের পরে?

আম্বিয়া : হ্যাঁ। তারপর ১৯৭০ সালের মার্চে ছাত্রলীগ সেন্ট্রাল কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হইলাম। বুয়েটের কোটা থেকে। কোটা ঠিক না। বুয়েট থেকে একজন হয় আরকি। আগে ইসহাক ভাই ছিল। অন্যরা অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি হইছিল। তখন ভাইস প্রেসিডেন্ট কেবল আমিই। আমাকে বলা হয়েছে, ছাত্রলীগ সেন্ট্রাল কমিটিকে কন্ট্রোল করতে হবে টুওয়ার্ডস লিবারেশন। অতশত বুঝতাম না। এগুলো বুঝত মার্শাল (মনিরুল ইসলাম)। কোথায় ভোট দিতে হবে, কোথায় কী করতে হবে, কমিটি ভাগ করে কে কারে ম্যানেজ করবে, এগুলোইট ওয়াজ আ স্কিম, ভেরি ইফেকটিভ। সে অনুযায়ী কাজ করতাম।

স্বাধীনতার প্রস্তাবের সময়, আমার মনে আছে, আমি তো পরীক্ষার প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম। তখন পড়া থেকে মন উঠে গেছে। এখন কী করব? ভাবলাম পরীক্ষা-টরিক্ষা দেব না। বিপ্লবের পথে চইলা যাই। বাঁচি কি মরি, স্বাধীনতা…। সিরাজ ভাইকে বললাম, পড়ব না।

না, পরীক্ষাটা দাও।

তখন তো তাঁর কথা বেদবাক্যের মতো। বললাম, ঠিক আছে। পরীক্ষার জন্য পড়ব। দরকার হইলে ডাইকেন। আমি আসব।

আমার ফিলিং হইল, আমি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের মেম্বার হিসেবে রিক্রুটেড হইছি এবং সে অনুযায়ী ছাত্ররাজনীতিতে কাজ করতেছি। আমি ঢাকা সিটিতে কাজ করছি, বুয়েটের ভেতরে কাজ করছি। এটার রেজাল্ট দেখা গেছে একাত্তরের ২৫ মার্চের পর।

মহি : শেখ মুজিবের সঙ্গে সিরাজ ভাইয়ের যোগাযোগের পুরো ইতিহাসটা আপনি জানেন?

আম্বিয়া : সিরাজ ভাই যেটুকু বলছে, শুধু সেটুকুই জানি।

মহি : উনি তো কখনো পুরোটা বলেন না।

আম্বিয়া : এখন ওনার অনেক কিছু মনে না-ও থাকতে পারে। ১৯৭০ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। ঢাকায় হাতে লেইখা ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলো’-রাতভর এই পোস্টারিং আমরা করছিলাম এবং সিরাজ ভাই নিজে থেকে…আমি ছিলাম, ইনু (হাসানুল হক ইনু) ছিল, জগন্নাথ কলেজের নজরুল ছিল, আর সম্ভবত সালাউদ্দিন ইউসুফ বা আবদুল্লাহ সানি ছিল। ইনুর একটা ভক্সওয়াগন গাড়ি ছিল। ওইটা নিয়া আসছিল। শ্রমিক লীগের অফিস ছিল পল্টনে। নজরুল ওইখানে বসে পোস্টার লিখছে। আমরা গাড়ি নিয়া ওইখানে গিয়া ওই সব পোস্টার আইনা আঠা-উঠা বানায়া নিয়া আহসানউল্লাহ হলে নিয়া আসলাম। বললাম, চলেন দেশ স্বাধীন কইরা আসি। সারা রাত পোস্টার লাগাইলাম। ভোর ছয়টায় হলে আসছি, ক্যানটিনে নাশতা খাইছি। এইটা এক্সকুসিভ একটা রোমান্টিক কাজ।

সিরাজ ভাই হাতে-কলমে সবাইকে শিখাইছে। এমনি এমনি বইলা দিলে আমরা কি যাইতাম? ডাউট আছে। বা ওনার ডাউট ছিল, আমরা পারি কি পারি না, করি কি করি না। উনি নিজে ছিল আমাদের সঙ্গে।

‘৬৯ সালের পর আমাদের মধ্যে ওনার যে জনপ্রিয়তা, দেবতার মতো। শেখ সাহেব জেল থিকা বাইর হওয়ার পর সবাই তো তাঁর কাছে যাইত না। ইকবাল হলে আসত নির্দেশনার জন্য, বিশেষ করে যারা মুভমেন্টের লোক।

ওনাদের মেকানিজম ছিল। যে গ্রুপ যে কাজ করবে, আরেক গ্রুপ তা জানবে না। জিজ্ঞেস করতে পারবে না। [৩১]

.

২০

সত্তর দশকের শুরুতেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে কেঁপে উঠেছিল দেশ। প্রথম প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানার মধ্যেই এটা উচ্চারিত হতো। খুব দ্রুতই তা প্রকাশ্য জনসভায় ঠাই করে নেয়। এ নিয়ে কথা হলো সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে। তিনি বললেন :

জয় বাংলা স্লোগানটা খুব ক্রিটিক্যাল ছিল। এটার বিরোধিতা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি। এটা হিন্দুদের, এটা নন-আওয়ামী লীগ স্লোগান, এটা ইন্ডিয়া বেইজড–এই সব কথা। সে জন্য আমাকে ইনিশিয়েটিভ নিতে হয়েছে। এর আগে যে যে জায়গায় ঢোকানো হয়েছে, বাধা হয়েছে। দেন উই ডিসাইডেড, ১১ জানুয়ারি (১৯৭০) পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের যে মিটিংটা হবে, ওখানে এটা ইঞ্জিনিয়ারিং করা হবে, খুব প্ল্যানড ওয়েতে। ওয়ার্ক করতে ফরোয়ার্ড খেলার জন্য গাজী গোলাম মোস্তফাঁকে চুজ করলাম। গাজী আমাকে বস বলত। যেকোনো কাজে আমাকে সাপোর্ট দিত। ওই দিনও দিয়েছে।

মাজহারুল হক বাকীর ‘বিজ্ঞাপন’ অফিস। সেখানে আর্টিস্ট কামাল ভাই (কামাল আহমেদ)। বললাম, কামাল ভাই, আমার একটা কাজ।

আপনি বললে তো করবই।

বাকীকে বললাম, আপনার অফিসটা দুইটার পর আমার কাছে ছেড়ে দেন।

আমার এখানে গোপন মিটিং করে কি সব শেষ করে দেবেন?

ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ছিল তো? সেন্সগুলো তো থাকে তার। আমি ওনাকে বললাম, আমার একটা লেখা দরকার। কালারটা একটু চুজ করে দিতে হবে। জয় বাংলা’–দুইটা শব্দ হবে। একটা ‘জয়’, আরেকটা বাংলা’। কাঠের ওপর হবে। কালার ইজ ইয়োরস।

কিসের জন্য, বলেন না?

তাকে বললাম। কার থেকে নিয়ে যেন আমি তার পকেটে ২০ বা ৩০ টাকা ঢুকিয়ে দিয়েছি।

আফতাবরা (আফতাব আহমাদ) এটা (এই স্লোগান) এখানে সেখানে বলছে। আমাদের একেবারে হার্ডকোর যারা, তারা এই স্লোগান দেবে। এই দায়িত্বটা দিলাম মার্শাল মনিকে। চিরকুট দিয়ে দিয়ে, পল্টনে কোন কোন জায়গায় কে থাকবে। রাতে একবার শুধু ঘুরে দেখলাম।

এসব সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে করেছি। এখন দেখি যে কত সায়েন্টিফিক ছিল। আগের লোক জানে না পরে কী হবে। পরের লোক জানে না আগে কে করে গেছে। এই ধরনের একটা মেকানিজম, হাইলি সফিস্টিকেটেড বলা যায়।

সেদিন শেখ সাহেবকে আমি স্কট করলাম না। পথের মধ্যে গাজী গোলাম মোস্তফার হাত ধরে বললাম, মোস্তফা ভাই, আজকে আমাকে

একটা কাজ করে দিতে হবে। উনিও লজ্জা পেলেন।

কী বলেন আপনি?

লিডারকে বলবেন, একটা স্লোগান হবে।

আচ্ছা ঠিক আছে। যান, আপনি করেন।

এদিকে ডায়াসটা অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক উঁচু করে বানানো হয়েছে। দুইটা কাঠের তক্তায়, বড় সাইজ, লেখা হয়েছে। একটাতে ‘জয়’, অন্যটাতে বাংলা’। যেন দূর থেকে চোখে পড়ে। কামাল আহমেদের আঁকা। শেখ সাহেবের এই ব্যাপারগুলো এত ভালো! আমি আর বক্তারা ছাড়া আর কাউকে ডায়াসে উঠতে দিলেন না। বললেন, কে কে যাবে, গাজী, নজরুল সাহেব তো যাবেন, তাজউদ্দীন তো যাবেন, মোশতাক তো থাকবে, আর কেউ না। আর শুধু সিরাজ থাকবে।

তক্তা দুইটা ওঠানো হলো ১০-১২ মিনিট আগে। পেরেক দিয়ে ডায়াসে লাগানো হলো। দুজনের বক্তৃতার পর লিডার বলল, ‘সিরাজ, স্লোগান দে।’ আমি বুঝলাম, গাজী গোলাম মোস্তফা কাম করায়া দিছে। আমি তো উঠলাম। আকাশ, সাগরের ঢেউ, গর্জন এই সব বললাম। ইট ওয়াজ জাস্ট লাইক ডেলিভারি পেইন। আমি এক্সাইটেড। দেড়-দুই মিনিট কথা বলেছি। আমার সমস্ত শরীর ঘেমে গেছে। বললাম, ওপরে আপনারা দুইটা শব্দ দেখছেন, আমার সঙ্গে আপনারা কণ্ঠ মিলায়া ধরেন–জয় বাংলা। আর কী–বাব্বা! কিসের কামানের গর্জন-টর্জন। স্টাম্বলড হয়ে গেল সব। আমি যখন পেছনে তাকালাম, শেখ সাহেবকে দেখলাম–হি ওয়াজ হ্যাপি। আমাকে বললেন, ‘পাশে বয়।’ আমি ওনার পাশে না বসে খন্দকার মোশতাকের পাশে গেলাম। মোশতাক আমার হাত ধরে বলল, ‘ভাইডি, কামডা আজকে সাইরে দিছ, না?’ হি ওয়াজ নট হ্যাপি। [৩২]

অ্যাট দ্য সেম টাইম, হি ওয়াজ নট আনহ্যাপি অলসো।৩২ জয় বাংলা স্লোগানটি মধুর ক্যানটিন চত্বরে ছাত্রলীগের এক কর্মিসভায় প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন সূর্য সেন হলের (আগের নাম জিন্নাহ হল) ছাত্রলীগের সংগঠক আফতাব আহমাদ। এরপর এটা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে। সিরাজুল আলম খানের অনুসারীদের মধ্যেই এটা চালু ছিল। ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার প্রকাশ্য রাজনীতির অনুমতি দেওয়ার পর আওয়ামী লীগ প্রথম জনসভা করে পল্টন ময়দানে ১১ জানুয়ারি। একটি জনসভায় প্রথমবারের মতো ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি উচ্চারিত হয়েছিল ওই দিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিজে ওই স্লোগান ওই দিন দেননি। তবে বোঝা যায়, এটি তিনি গ্রহণ করেছেন। তিনি প্রকাশ্য জনসভায় নিজ কণ্ঠে প্রথমবার এই স্লোগান দিয়েছেন ৭ জুন ১৯৭০, রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায়। ওই দিন বক্তৃতার একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি নেতা নই, আমি কর্মী। ওই যে নেতা ঘুমিয়ে আছেন–শেরেবাংলা আর সোহরাওয়ার্দী। আজ থেকে আপনারা আইয়ুব নগর বলবেন না, বলবেন শেরেবাংলা নগর। আর রেসকোর্সকে বলবেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। [৩৩]

উল্লেখ্য যে পাকিস্তান সরকার ঢাকার আগারগাঁও এলাকায় জাতীয় পরিষদ ভবন কমপ্লেক্স নির্মাণ করছিল। ওই এলাকাকে বলা হতো সেকেন্ড ক্যাপিটাল বা দ্বিতীয় রাজধানী। প্রথম রাজধানী ছিল ইসলামাবাদ। সেকেন্ড ক্যাপিটালের নামকরণ হয়েছিল ‘আইয়ুব নগর’। সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আমার কথোপকথন জারি থাকল।

মহি : ওই সভায় গণমাধ্যমের সাপোর্ট কেমন পেয়েছিলেন?

সিরাজ : এটা চিন্তায় ছিল, হাউ টু ক্যারি আউট। সব পেপারে কীভাবে ওয়ার্ক করাব। সব পেপারেই নিউজ দিয়েছে, বাট নট দ্যাট, বিস্তারিত দেয় নাই। একটা পেপারও তো কো-অপারেট করে নাই। সে জন্য আমি তোফায়েলকে দিয়ে বলিয়েছি। যদি এখন থেকে কোনো নিউজ করা না হয়, তাহলে প্রতিটা পেপার অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হবে। যেমন মর্নিং নিউজ অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল (১৯৬৯ সালে)। তা-ও কভার করে না। কিন্তু কী করব? জার্নালিস্টরা প্রস্তাব নিল, এটা নাকি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হুমকি। এই যে আবদুল গাফফার চৌধুরী একমাত্র লোক, শেষ পর্যন্ত বিরোধিতা করে গেছে। যেহেতু আমাকে শেখ সাহেবের রাইট হ্যান্ড হিসেবে দেখত। পূর্বদেশ-এ পরে লিখত, চ্যাংড়া পোলাপানরা নাকি লাফালাফি করতেছে। সিরাজুদ্দীন হোসেন আমাকে ভীষণ লাইক করতেন। মুজিব ভাইয়ের ক্লাসমেট তো।

মহি: বঙ্গবন্ধু ওই মিটিংয়ের পর আপনাকে কিছু বলেননি?

সিরাজ : আসার সময় লিডার বলল, আজ তো তুই আমাকে আনতে যাস নাই? চল, আমার সঙ্গে চল। খুশি হইছস তো? আর ইউ হ্যাপি?

তুমি হয়তো এক লাইনেই বলতে পারো, এটা অমুকের চেষ্টায় হয়েছে। কিন্তু সিনেমায় যদি দেখাও, তাহলে সিকোয়েন্সগুলো উইথ কারেক্ট গ্রামার অ্যান্ড উইথ অল আদার অ্যাডজাস্টমেন্টস–এগুলো দিয়ে জয় বাংলাকে এবং বঙ্গবন্ধুকে প্লেস করা। আরও আছে, পদ্ম মেঘনা-যমুনা/ তোমার আমার ঠিকানা, পিন্ডি না ঢাকা। আরও তো গ্রুপ ছিল। তারা সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিত। স্লোগান কী কী হতে পারে। একটা জাতীয়তাবাদী, আরেকটা হলো ক্লাস। এইখানে ডিফিট দিয়ে এটা করা, দ্যাট ওয়াজ নট দ্যাট ইজি। আমাদেরটা কারেক্ট হয়েছে। তাদেরটা ঢাকা পড়ে গেছে।

মহি : ওটাও কারেক্ট স্লোগান।

সিরাজ : না না, কেমন করে কারেক্ট স্লোগান?

মহি : ওটাও কারেক্ট। বাট ইয়োর স্লোগান ডিসাইডস প্রাইমারি অ্যাটেনশন।

সিরাজ : না না, ওটা কীভাবে কারেক্ট হলো? তুমি যে মুহূর্তে ওটাকে কারেক্ট বলো, আদার সেকশনস অব দ্য পিপলকে এক্সক্লড করে দিচ্ছ। আমাদেরটা ইনফ্লুসিভ, তাদেরটা এক্সক্লসিভ। আকাশ পাতাল তফাত।

মহি : একটা ন্যাশনাল কোশ্চেন, আর একটা হলো ক্লাস কোশ্চেন।

সিরাজ : তখন আর ওটাকে ক্লাস কোশ্চেন বলা হবে না। এগুলো কনস্পিরেটরিয়াল। না বুঝে আমরা কনস্পিরেসি করি না? ক্ষতি তো মানুষ জেনেশুনে করে না? খুব কম।

মহি : ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে জয় বাংলা স্লোগানকে পপুলারাইজ করেছে আ ফ ম মাহবুবুল হক।

সিরাজ : আর আফতাব।

মহি : আফতাব ওয়াজ নট আ পপুলার পারসন। মাহবুব তো খুব পপুলার। মাহবুব দশটা ছেলেকে ছাত্রলীগে আনে। আফতাব এর মধ্যে ছয়টাকে হোস্টাইল করে ভাগায়। বিহেভিয়ারটা তো অন্য রকম।

সিরাজ: তোমাকে তো মাহবুবই আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। প্রথম যেদিন পরিচয় করিয়ে দিল, স্লোগান দিতে এসে, মধুর ক্যানটিনে পাঁচ-ছয়জনসহ, বলল, এই যে আমাদের…খুব ভালো ছাত্র ইত্যাদি।

মহি : ইকোনমিকস ডিপার্টমেন্টে মাহবুব ভিপি পদে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর অপোনেন্টরা সাংঘাতিক। ইকবাল আহমেদ আর রিজওয়ানুল ইসলাম। রিজওয়ান তো জীবনে কোনো পরীক্ষায় সেকেন্ড হন নাই। এত ভালো ছাত্র। ওই সময় ইকোনমিকস ডিপার্টমেন্টে ছাত্রলীগের পক্ষে হার্ডলি পাঁচ-ছয়জন। মোস্টলি ছাত্র ইউনিয়ন আর নন-পার্টিজান। সেখানে আমি গলা ফাটিয়ে ফেলছি জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে ওখানেও সবাই বিস্মিত-কী বলে? এটা আবার কী স্লোগান।

সিরাজ : ওই সময় একটা পোস্টার ছিল। একটা সাপ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কাশ্মীরের ওপর দিয়ে এখানে এসে ছোবল দিচ্ছে। মাঝখানে ইন্ডিয়া। ওটা সেনসেশন ক্রিয়েট করল। না হলে তো রবকে ডাকসুতে জেতানো যায় না। ফার্স্ট টাইম ডাইরেক্ট ইলেকশন। কত কষ্টে।

মহি : ডাকসু ইলেকশন আসতে আসতে জয় বাংলা তখন মোটামুটি একটা পপুলার স্লোগান হয়ে গেছে।

সিরাজ : তারপরও আমি ইলেকশনটা নিজে কনডাক্ট করেছি। বলেছি, রব জিতবে। জিতেছে।

মহি: রব ভাইয়ের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের আরেকজন পঁড়িয়েছিল। সে অনেক ভোট কাটল। তিন শ-সাড়ে তিন শ ভোট পেয়েছিল। মাহবুবুল হুদা ভূঁইয়া। ওটাও একটা কনস্পিরেসি ছিল।

সিরাজ : রবকে ভিপি করতে না পারলে…। কয়েকটা জিনিস না ঘটলে হিস্ট্রি উড হ্যাভ বিন ডিফারেন্ট। বঙ্গবন্ধুর লিডারশিপকে কনফার্ম করা, আমাদের নিউক্লিয়াস আর বিএলএফকে মেইন ইঞ্জিনিয়ারিং রোলটা, ড্রাইভিং রোলটা প্লে করা। থার্ড হলো ইলেকশনে যাওয়াটা। ফোর্থ হলো কোনোভাবে কমপ্রোমাইজ না। করা। কথা হবে, কিন্তু কমপ্রোমাইজ করা হবে না। সে জায়গাটা নিয়ে আর্মস স্ট্রাগলে যাওয়া।

একটা লোকই শুধু শেখ সাহেবকে সমর্থন করেছে। মওলানা ভাসানী। যা গালাগালি আমাকে দিত সবাই! মাহমুদ আলী তো সিরাজ, যদি এইটা করো, আমি ইস্ট পাকিস্তান ছাইড়া চলে যাব, ওয়েস্ট পাকিস্তানে চলে যাব। গেছেও সে। মন্ত্রীও হয়েছে। অথচ কত শিক্ষিত!

মহি : ন্যাপের ফাউন্ডার জেনারেল সেক্রেটারি না? পরে পলিটিকস চেঞ্জ করল। সেভেনটি ওয়ানে ইউএনওতে গেল অ্যাজ লিডার অব দ্য ডেলিগেশন ফ্রম পাকিস্তান। সঙ্গে শাহ আজিজুর রহমান গেল।

সিরাজ : আর্টফিল্ম করলে এগুলো বলা যায়।

মহি: বাজারি ফিল্ম করলে তো হবে না। ওই যে ওরা। এগারোজন–এ রকম ধুম-ধাড়াক্কা ছবি হবে।

সিরাজ; কিন্তু যদি আর্টফিল্ম করা যায়, যেকোনো একটা ভালো সিকোয়েন্স নিয়ে। একটা সিকোয়েন্সকেই মোটামুটি দেড় ঘণ্টা।

মহি: আমাদের দেশে যদি একটা মৃণাল সেন বা ঋত্বিক ঘটক টাইপ পরিচালক থাকত, তার হাত দিয়ে এ ধরনের ছবি হতো। আরেকজন ছিল। উনিও পারত। ভালো ছবি করছিল।

সিরাজ : কে?

মহি: ফখরুল আলম সাহেব। ওই যে বিন্দু থেকে বৃত্ত সিনেমা প্রযোজনা করেছিল।

সিরাজ: পারল না। সাউন্ডটা একটু প্রবলেম হয়ে গিয়েছিল।

মহি : এ ধরনের ছবিতে মেসেজ দেওয়া যায়।

সিরাজ : সত্যজিৎ রায়ের কাছে কামাল ভাই (কামাল আহমেদ) গিয়েছিলেন। উনি নিজেই গেলেন। বাংলাদেশে এত বড় একটা ঘটনা ঘটল, আপনি ছবি করবেন না?

না না, ওটা তো একটা মহাভারত! এটা আমার পক্ষে সম্ভব না।

অনেক রিকোয়েস্ট করলেন। উনি বললেন, কিছু মেটেরিয়াল দেন। আমি বইটই পড়ি।

কামাল ভাই ৩০-৩৫টা বই নিয়ে গেছেন–সব মুকুল সাহেব, গাফফার চৌধুরীর–কী সব লেখা। উনি বললেন, আমাকে সব বই পড়তে হয়েছে। শুধু শুধু সময় নষ্ট করলেন।

আমি বললাম, কামাল ভাই, আপনি আহমদ ছফার ওঙ্কার নিয়ে যান। পড়েছ? ওই যে বোবা মেয়েটা। ওরও কথা বলার অধিকার আছে।

মহি : সিক্সটি নাইনের মুভমেন্টের ব্যাকগ্রাউন্ডে। ছফা ভাই আমাকে বলেছেন, হুমায়ূন আহমেদের ছোট বোন ছিল বোবা, তার কথা মাথায় রেখে লিখেছে। [৩৪]

ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। সিরাজুল আলম খান ব্যাপারটি খুলে বলেননি। বিষয়টি আমি কিছুটা জানতাম। তবে সবটা নয়।

ডাকসু নির্বাচনে সহসভাপতি পদে সিরাজুল আলম খানের পছন্দের প্রার্থী ছিলেন আ স ম আবদুর রব। অপর একজন প্রার্থী হলেন শেখ শহীদুল ইসলাম। শেখ শহীদ ছাত্রলীগের দীর্ঘদিনের নেতা। সম্পর্কে বেগম মুজিবের বড় বোনের ছেলে। সিরাজপন্থীরা ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে চাইছিলেন ছাত্রলীগের আরেক নেতা স্বপন কুমার চৌধুরীকে।

সহসভাপতি পদে দুজন শক্ত প্রার্থীকে নিয়ে ছাত্রলীগের মনোনয়ন বোর্ড মুশকিলে পড়ে যায়। মনোনয়ন বোর্ড তৈরি করা হয় ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে। কমিটির সভাপতি হলেন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মো. কামালউদ্দিন। একই সঙ্গে তিনি ছাত্রলীগের মুহসীন হল শাখারও সভাপতি। সিরাজুল আলম খান বললেন ৩২ নম্বরে গিয়ে কথা বলতে, বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ নিতে। কামালউদ্দিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন :

সিরাজ ভাই বললেন সকাল সকাল যেতে। তখন নাকি লিডারের মুড ভালো থাকে। সকাল আটটার দিকে গেলাম বঙ্গবন্ধুর বাসায়। আমার সঙ্গে আরও পাঁচ-ছয়জন। এদের মধ্যে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিস এবং দপ্তর সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানও আছে। বঙ্গবন্ধু জানতেন আমরা আসব। হয়তো সিরাজ ভাই আগেভাগেই জানিয়ে রেখেছিলেন। আমরা তো কিছু জানাইনি।

বঙ্গবন্ধুকে রব আর শেখ শহীদের কথা বলতেই ঘরে ঢুকলেন বেগম মুজিব। দরজার আড়াল থেকে উনি হয়তো আমার কথা শুনছিলেন। বললেন, আমাদের মাইয়া-পোলারা যেন ইলেকশনে না দাঁড়ায়। নামের সঙ্গে শেখ আছে, এমন কেউ যেন ডাকসু ইলেকশন না করে।

ওনার কথায় মনে হলো বঙ্গবন্ধু কনভিন্সড। বললেন, ‘ডাকসু ইলেকশন আমার জন্য একটা মাইলস্টোন। যে-ই দাঁড়াক, তাকে জিততে হবে। সামনে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ইলেকশন। ডাকসু ইলেকশনের দিকে সবাই তাকায়া আছে। আমি চাই ভিক্টোরি।’

আমরা যা বোঝার বুঝে নিলাম। ফিরে এসে আমরা ঠিক করলাম, রব হবে আমাদের ক্যান্ডিডেট। কিন্তু জিএস ক্যান্ডিডেট স্বপনকে নিয়ে অনেকের আপত্তি। ইকবাল হলের ক্যানটিনে বসে আছি। এমন সময় ওখানে হাজির হলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। মঞ্জু ভাই ফজলুল হক হলের ভিপি ছিলেন। ডাকসাইটে নেতা। বললেন, “দেখো, আমার হলের একটা ছেলে আছে, মাখন। তাকে জিএস নমিনেশন দাও। ও ভালো ক্যান্ডিডেট হবে।’ এভাবেই আবদুল কুদুস মাখন চলে আসে লাইমলাইটে। মাখন ক্যান্ডিডেট হওয়ায় মনি ভাইও খুশি। [৩৫]

.

২১

১৯৭০ সালে প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু হওয়ার পর প্রায় প্রতি রোববার ছুটির দিনে পল্টনে জনসভা হতো। প্রথম রোববার পড়েছিল ৪ জানুয়ারি। ওই দিন আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ সভা করেছিল। পরের রোববার ১১ জানুয়ারি ছিল আওয়ামী লীগের জনসভা। তার পরের রোববার ১৮ জানুয়ারি ছিল জামায়াতে ইসলামীর জনসভা। ওই দিন পল্টনে তুলকালাম হয়। সিরাজুল আলম খান আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন, জামায়াতের সভা পণ্ড করে দিতে হবে। হয়েছিলও তাই। পরের রোববার ২৫ জানুয়ারি ছিল পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সভা। সভাপতিত্ব করবেন নুরুল আমিন। ওই মিটিংয়েও হামলা করে তা বানচাল করে দেওয়া হয়েছিল। এসবের নাটের গুরু ছিলেন সিরাজুল আলম খান। পরে তিনি এ ব্যাপারে কথা বলেছিলেন ছাত্রলীগের সংগঠক আবু করিমের সঙ্গে। তার কাছ থেকেই বিষয়টি শোনা। সিরাজুল আলম খানের অবশ্য এ ব্যাপারে রাখঢাক ছিল না। ঢাকায় জামায়াতকে আর নুরুল আমিনকে মিটিং করতে দেব না–এটাই ছিল তার কথা। তিনি এককথার মানুষ। আবু করিমের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম :

আবু করিম: সিরাজ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, ১৯৭০ সালে জামায়াতকে মিটিং করতে দিলেন না কেন? আসলেই কি জামায়াতের মিটিং ভেঙেছিলেন?

‘হে, ইট ইজ মি। সিরাজ ভাই নিজে এটা আমাকে বলেছে।

মহিউদ্দিন আহমদ : আমিও তো ছিলাম ওই মিটিংয়ে।

করিম : সিরাজ ভাই বলেছেন, ইট ইজ মি।’ ইট ইজ মি’ মানে পার্টি ডিসিশন না।

মহি: তাঁর ডিসিশনই তো?

করিম: উনি এটা কীভাবে অর্গানাইজ করেছেন, সেটাও বলেছেন আমাকে। ওনার কিছু পরিচিত লাকড়ি বিক্রেতাকে ভাড়া করেছেন। জামায়াত তো পল্টনে প্যান্ডেল-ট্যান্ডেল করেছে। এর বাইরে যে সলিমাবাদ রেস্টুরেন্ট, এর কর্মচারীরা সবাই হচ্ছে সিরাজুল আলম খানের চামচা। এরা পরে আমাদের বিনা পয়সায় খাওয়াত।

এই রেস্টুরেন্টে লাকড়ি লাগে দৈনিক দুই মণ বা তিন মণ। উনি অর্ডার দিয়েছেন ৩০০ মণ। ঘটনাটা কি আপনি বুঝতে পেরেছেন? লাকড়ির একটা পাহাড় হয়ে গেছে সেখানে। তখন ছোট চিরকুটের। মাধ্যমে ওনার যত ক্যাডার, যেমন আফতাব, মধু, বুলবুল, বদিউল, মাহবুব থেকে আরম্ভ করে, মানে তখনকার দিনে যারা যারা ছিল।

মহি : মানে গ্রুপের লোকজন।

করিম : মানে লাকড়ির অভাব নাই। জামায়াত মিটিং আরম্ভ করেছে। মিটিংয়ের একপর্যায়ে ওরা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কী একটা সেন্টেন্স বলছে…জিব্বা টাইনা ছিড়া ফেল। এই যে পেটানো আরম্ভ করল। মুহূর্তের মধ্যে মিটিং রণক্ষেত্র।

মহি : ওই দিন দুজন নিহত, ৫০০ আহত।

করিম : মানে নিহত তো পত্রিকায় ওভাবে আসে নাই।

মহি : পত্রিকায় এভাবেই এসেছে, ১৯ জানুয়ারি ১৯৭০। [৩৬]
.

২২

ছাত্রলীগের মধ্যে যে মেরুকরণ ঘটেছিল, তার একটা বিস্ফোরণ হয় ১৯৭০ সালের নভেম্বরে। ওই সময় ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে হইচই বেধে যায়। নিউমার্কেটের কাছে বলাকা বিল্ডিংয়ের তিনতলায় ছাত্রলীগ অফিসে তখন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভা চলছিল। সব জেলা থেকে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। সভা। চলাকালে একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য স্বপন কুমার চৌধুরী প্রস্তাবটি তোলেন। প্রস্তাব সমর্থন করেন রাজশাহী নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এম এ করিম। অধিকাংশ সদস্য এ প্রস্তাব সমর্থন করেন। ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল। ইসলাম প্রস্তাবের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন। এরপর বসে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক। বৈঠকে প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক আ ফ ম মাহবুবুল হক। প্রস্তাবটি ছিল এ রকম :

ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবিকে স্বাধীনতার পথে একটি পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করে ‘৭০-এর নির্বাচনকে ক্ষমতা দখলের পর্যায়ভুক্ত না করে আন্দোলনের পর্যায়ভুক্ত করার জন্য এবং বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের মাধ্যমে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি অর্জনই বাংলাদেশ

ছাত্রলীগের লক্ষ্য। প্রস্তাবটি তোলার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় কমিটির বেশির ভাগ সদস্য এটি সমর্থন করলেও মাত্র ১৩ জন এর বিরোধিতা করে। তাদের যুক্তি হলো, এ প্রস্তাব অবাস্তব ও গঠনতন্ত্রবিরোধী। বিরোধিতাকারী সদস্যদের মধ্যে ছিলেন। সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী স্বয়ং। বিরোধিতাকারীদের মধ্যে আরও ছিলেন শেখ শহিদুল ইসলাম, সৈয়দ রেজাউর রহমান, আবদুল কুদুস মাখন, ইসমত কাদির গামা, মনিরুল হক চৌধুরী, ওবায়দুল মুক্তাদির, শফিউল আলম প্রধান প্রমুখ। নূরে আলম সিদ্দিকী সভা মুলতবি করে সভাকক্ষ ছেড়ে চলে যান। আরও কয়েকজন তার সঙ্গে বেরিয়ে যান। মনিরুল ইসলামের (মার্শাল) সভাপতিত্বে সভা আবার শুরু হলে প্রস্তাবটি পাস হয়। [৩৭]

এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সিরাজুল আলম খানের অনুসারীরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তাঁদের মুখপাত্র ছিলেন স্বপন কুমার চৌধুরী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বপন শহীদ হন। তাঁর সম্মানে তখন স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ প্রস্তাবের উত্থাপক হিসেবে তার নাম প্রচার করা হয়। বিষয়টি সবাই মেনে নেন। [৩৮]

একটি সিদ্ধান্ত পাওয়ার আশায় সবাই মিলে তখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাসায় যান। উত্তেজিত ছাত্রনেতাদের শান্ত করেন তিনি। বলেন, প্রস্তাব পাস করে স্বাধীনতা হয় না। গ্রামে যা, কাজ কর। [৩৯]

প্রস্তাবের বিরোধিতাকারীরা যুক্তি হিসেবে ডিসেম্বরে (১৯৭০) অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচন ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা জানিয়েছিলেন এবং এই প্রস্তাবের পেছনে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছিলেন। তাঁদের আরেকটি বক্তব্য ছিল, ‘স্বাধীনতার প্রশ্ন তখনই আসবে, যখন লিডার (শেখ মুজিব) আহ্বান জানাবেন। [৪০]

উনসত্তরের আন্দোলনের সময় শেখ ফজলুল হক মনি জেল থেকে ছাড়া পান। তিনি ছাত্রলীগের মধ্যে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তখন থেকেই ছাত্রলীগের মধ্যে দুটি ধারা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। একটির কেন্দ্রে শেখ মনি এবং অন্যটির কেন্দ্রে সিরাজুল আলম খান। তাদের দুজনের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল খুবই চমৎকার, হৃদ্যতাপূর্ণ। কিন্তু তাঁদের অনুসারীরা মাঝেমধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ত। এর প্রভাব পড়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে। বিভিন্ন কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দুই ধারার অনুসারীরা দুটি প্যানেল দিয়ে নির্বাচন করতে শুরু করে। কোথাও কোথাও সমঝোতা হতো, কোথাও-বা আলাদা করেই তারা নির্বাচনে যেত।

‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ প্রস্তাব নিয়ে ছাত্রলীগের মধ্যকার আদর্শগত বিভক্তি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর প্রকাশ ঘটে ১৯৭০ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ঢাকার জিন্নাহ কলেজের (পরে নাম হয় তিতুমীর কলেজ) ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ছাত্রলীগের দুটি প্যানেল হয়। সিরাজপন্থীদের প্যানেলে কুতুবউদ্দিন চৌধুরী ও আনিসুজ্জামান খোনকে সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়। অন্য উপদলটি আলী হোসেন ও মনজুর কাদেরকে সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনয়ন দেয়। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও নগর শাখার নেতাদের মধ্যে রাফিয়া আক্তার ডলি, শেখ কামাল, তাজুল ইসলাম প্রমুখ আলী-মনজুর প্যানেলকে সমর্থন দেন। অন্যদিকে কুতুব-আনিস প্যানেলের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজউদ্দৌলা। এ নিয়ে দুটি গ্রুপ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। [৪১]

একপর্যায়ে সিরাজউদ্দৌলা ট্রাকবোঝাই কর্মীসহ ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবের বাসায় আসেন এবং নালিশ জানিয়ে বলেন, শেখ কামাল জিন্নাহ কলেজে এবং আমাদের এলাকায় বাড়াবাড়ি করছে। এটা শুনে শেখ মুজিব ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘আমি কলেজে একটা প্যানেলই দেখতে চাই।’ একটা আপসরফার জন্য তিনি শেখ মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও শাজাহান সিরাজকে দায়িত্ব দেন। দুই পক্ষের প্রতিনিধিরা রাতে এই চার নেতার সঙ্গে বৈঠকে বসে। এক পক্ষে শেখ কামাল, অন্য পক্ষে সিরাজউদ্দৌলা এবং জিন্নাহ কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন আহমেদ। আবদুর রাজ্জাক সিরাজউদ্দৌলাকে বলেন, ‘প্যানেল একটাই হবে। তোমরা সংসদের নয়টা পোস্টের আটটা নাও, ওদের একটা ছেড়ে দাও, মনজুর কাদেরকে রাখো।’ এভাবে একটা আপসের চেষ্টা হয়। তবে শেখ কামাল এটা মেনে নেননি। কুতুব-আনিস পরিষদের অনেক পোস্টার প্রতিপক্ষ পরিষদের ছেলেরা ছিঁড়ে ফেলে। কামাল উদ্দিন আহমেদের ভাষ্যমতে :

আমি এবং তাদের পক্ষের ঢাকা নগর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাহাবুদ্দিন রাতে নীলক্ষেতে আনোয়ারা রেস্তোরাঁয় যাই। ওখানে তখন সিরাজুল আলম খান কাঁচা মরিচ মেখে ভাত খাচ্ছিলেন। ওই সময় এসে হাজির হন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক আ ফ ম মাহবুবুল হক এবং জিন্নাহ হলের (এখন সূর্য সেন হল) ছাত্রলীগ নেতা আফতাব আহমাদ। আফতাবের হাতে একটা হকিস্টিক। সেটা দোলাতে দোলাতে তিনি বললেন, ‘দেয়ার ইজ নো কমপ্রোমাইজ ইন পলিটিকস।’

পরদিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন। আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনয়ন প্রত্যাহারের আর সুযোগ ছিল না। আমি পুরানা পল্টনে বাংলার বাণী অফিসে মনি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাই। আমি বলি, পোস্টার লিফলেট নষ্ট করে ফেলার কারণে অনেক বাড়তি খরচ হয়েছে। এটা দিতে হবে। মনি ভাই আমাকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘জিতে আয়, টাকা আমি দেব।’

নির্বাচনে সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ আটটি পদে কুতুব-আনিস পরিষদের প্রার্থীরা জয়ী হয়। অন্য পক্ষের একমাত্র জয়ী প্রার্থী ছিল মাকসুদ। পরে সে-ও আমাদের এই পক্ষে চলে আসে। রাতে আমি আবারও বাংলার বাণী অফিসে গিয়ে মনি ভাইয়ের কাছে টাকা চাই। মনি ভাই জানতে চান, ‘জিতছস?’ আমি হা-সূচক জবাব দিলে মনি ভাই বলেন, ‘দোস্তরে ডাক।’ আমি ওপরতলায় আওয়ামী লীগ অফিস থেকে ‘দোস্ত’, অর্থাৎ সিরাজুল আলম খানকে ডেকে আনি। মনি ভাই সিরাজ ভাইকে বললেন, ‘এরা কী বলে?’ সিরাজ ভাইয়ের সোজা জবাব, ‘তুমি বলছ টাকা দিবা, এখন দ্যাও।’ মনি ভাই আমাকে পাঁচ শ টাকা দিলেন। [৪২]

.

২৩

১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে শেখ মুজিবের সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। শেখ মুজিব সংবিধানসম্পর্কিত বিষয়ে তার সঙ্গে পরামর্শ করতেন, তাঁর মতামতের ওপর নির্ভর করতেন। সিরাজুল আলম খান সম্পর্কে তার ধারণা বেশ ইতিবাচক। বিষয়টি বোঝার জন্য ২০১৯ সালের ৯ জুন আমি হাজির হলাম মতিঝিলে তার চেম্বারে। নানা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হলো। সিরাজুল আলম খান প্রসঙ্গও বাদ পড়েনি।

মহিউদ্দিন আহমদ : সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আপনার কখনো ওয়ান টু ওয়ান আলাপ হয়েছে?

কামাল হোসেন : ইদানীং হয়নি। দু-একবার বলেছি, ওর সঙ্গে তো একটু দেখা হওয়া দরকার।

মহি : আগে তো কথা হতো?

কামাল : অবশ্যই হতো। আপনি কারেক্ট লোকের নাম নিচ্ছেন। এখনো মনে করি, রিয়েলি যে রাজনীতি বোঝে, বাংলাদেশের যে রাজনীতি, হি ইজ পারহ্যাপস দ্য ওনলি ওয়ান। দ্বিতীয় কাউকে আমি মনে করি না। আমার নিজেরও আগ্রহ থাকে তার সঙ্গে কথা বলার, এই কারণে।

মহি: উনি তো অনেক কিছুর মাস্টারমাইন্ড।

কামাল : অফ কোর্স। এটা হানড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট।

মহি: উনি বলেন, আমি কখনো আওয়ামী লীগ করি নাই। বাট বঙ্গবন্ধু ইজ নট আওয়ামী লীগ। ওনার অবস্থান আলাদা, অনেক উঁচুতে।

কামাল : ওয়ান্ডারফুল। এটা আমারও অবস্থান, হানড্রেড পার্সেন্ট।

মহি : ওনাকে কেমন দেখেছেন?

কামাল : উনি তো বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। অনেক কাজ করতেন। সমন্বয়ের কাজ করতেন। ছাত্রদের মধ্যে ওনার অনেক প্রভাব ছিল। পাকিস্তানিদের সঙ্গে তারা কোনো রকম আপস করার ঘোর বিরোধী ছিলেন। [৪৩]

অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন সিরাজুল আলম খান। এঁরা অনেকেই ছিলেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে। আবার কেউ কেউ ছিটকে পড়েছিলেন আওয়ামী বৃত্ত থেকে। সাংগঠনিক কাজে তিনি ছিলেন একরোখা। পেশিশক্তির ব্যবহারে কার্পণ্য করতেন না। তাঁকে ঘিরে তৈরি। হয়েছিল অদ্ভুত ধরনের একটি বলয়। এ নিয়ে আমরা কথা বলেছি। তিনি বলেছেন তার কথা।

মহি: অনেক সময় মনে হয়, আপনি খুব অ্যাগ্রেসিভ পলিটিকস করেছেন। আবার ঠান্ডা মাথার লোকদের সঙ্গেও আপনার বেশ ওঠবস। কীভাবে ব্যালান্স করেন?

সিরাজ : অলি আহাদ আমাকে ভীষণ পছন্দ করতেন। ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্টে তো হি ওয়াজ দ্য মেইন ম্যান। ‘৯২ সালে আমি যখন অসুস্থ, অপারেশন হলো স্পাইনাল কর্ডে, অলি আহাদ ভাই দেখতে এসেছিলেন। আউট অব দ্য ওয়ে। শেখ সাহেবের জন্য এঁরা রাজনীতিতে থাকতে পারলেন না। এটা কি তাঁর নিজস্ব কারণে, নাকি সুদূরপ্রসারী একটা চিন্তা আছে তার মাথায়, সে কারণে; সেটা আমি এখনো বের করতে পারিনি। আমি ‘৪৮, ৫৪, ‘৫৫ সালের কথা বলছি।

আমরাও অ্যাগ্রেসিভ ছিলাম। স্বাধীনতার প্রশ্নে আমরা যে কাজ করেছি, এ কাজে যদি কেউ হ্যাঁম্পার করে, নির্মম হতে পারতাম, মারপিট করে কেউ দাঁড়াতে পারত না। এ রকম একটা শক্তি ছিল। বিশেষ করে, মিছিলগুলোতে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। ওদের স্লোগান ছিল জয় সর্বহারা, আমাদের হলো জয় বাংলা। ওদের হলো শ্রমিক কৃষক অস্ত্র ধরো, আমাদের হলো বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো। একটা হলো ক্ল্যাসিক মুভমেন্ট অব সমাজতন্ত্র, আরেকটা হলো ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট। এগুলো এস্টাবলিশ করতে কত-কী যে করেছি! এবং (কামরুল আলম খান) খসরু আর (মোস্তফা মোহসীন) মন্টুর অবদান অসম্ভব! এরা তো ১৯৬২ সাল থেকে আমার সঙ্গে। আর এই মুভমেন্টগুলোর সুযোগে ছাত্রলীগ থেকে বিরাট বাহিনী বের করে নেওয়া হয়েছিল আন্ডার দেয়ার কমান্ড।

কামালউদ্দিন ফিরু। কী ডেয়ারিং! খসরুর সামনে কেউ দাঁড়াবে! আনথিংকেবল! যেভাবে তার গ্যাংগুলোকে সে অর্গানাইজ করত! তার আন্ডারে ঢাকায় আমাদের মিনিমাম একেবারে হেলেফেলে হলেও ৬০ জন-আপ টু ওয়ান হানড্রেড স্ট্যান্ডবাই থাকত। হল-বেসিস, কলেজ-বেসিস, পাড়া-বেসিস। আমাদের খুব বেশি পয়সা খরচ করতে হতো না। মিনিমাম কস্ট। সবাই তো যার যার বাড়িতে থাকত। হলে যারা আছে, তাদের বাপ তো বাড়ি থেকে টাকা পাঠায়। সে জন্য বেশি পয়সা লাগত না। খসরু একজনই। মহিউদ্দিন একটু ভীরু ছিল। ফিরু ছিল খুব সাহসী। ও প্রথমে এনএসএফের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

মহি : পরে নিউট্রাল করেছেন।

সিরাজ : পরে তো খসরু-মন্টু-ফিরু-মহিউদ্দিন। [৪৪]

.

২৪

ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকায় জন্ম নেওয়া পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ১৪ সদস্যের প্রথম যে আহ্বায়ক কমিটি তৈরি হয়েছিল, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন শেখ মুজিব। নঈমুদ্দীন আহমদ ছিলেন আহ্বায়ক। ১৯৫১ সালে। অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিব আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে ছাত্ররাজনীতি থেকে সরে যান। ইতিমধ্যে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

ছাত্রলীগকে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে দেখা হলেও এর সঙ্গে শেখ মুজিবের সব সময় ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ছাত্রলীগ নেতারা আলোচনা-পরামর্শের জন্য শেখ মুজিবের কাছেই যেতেন। অন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের তেমন গুরুত্ব ছিল না ছাত্রলীগে। পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক উত্থান ও জাতীয় নেতা হওয়ার পেছনে ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বলা চলে, ছাত্রলীগ ছিল শেখ মুজিবের শক্তির ভিত্তি।

১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে ছাত্রলীগে যারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন, তাঁদের একজন হলেন আমির হোসেন আমু। ছাত্রলীগে শেখ মুজিবের ভূমিকা, ছাত্রলীগের মধ্যকার দলাদলি ও রসায়ন, মনি-সিরাজের দ্বন্দ্ব, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা ইত্যাদি বিষয়ে মন খুলে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি ২০১৯ সালের ৪ জুন। তাঁর সঙ্গে আমার কথোপকথন ছিল এ রকম :

মহিউদ্দিন আহমদ : কীভাবে এলেন ছাত্রলীগে?

আমির হোসেন আমু : ১৯৫৭ সালে ঢাকার মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট অডিটরিয়ামে ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলন হয়। আমি ছিলাম অন্য লাইনের লোক। অন্যভাবে আমার নামডাক ছিল। আমাদের তো পলিটিক্যাল ফ্যামিলি। যখন আওয়ামী লীগ হয় বরিশালে, এর অ্যাডহক কমিটির ১৯ জন ছিল আমাদের ফ্যামিলির। ওই সময় ন্যাপ হইতেছে। ন্যাপ ভাঙা, পিটাপিটি করা–ওই সময় আমি একটু ফোকাসে আসলাম। হঠাৎ মঞ্জু ভাই চিঠি লেখছে, তুমি তোমার পছন্দমতো ৩৫ জন কাউন্সিলর নিয়া সন্ধ্যাবেলা ঢাকায় হাজির হও।’

মহি : নুরুল ইসলাম মঞ্জ?

আমু : হ্যাঁ। আমি চিঠির অর্থ বুঝলাম। ছাত্রলীগ হব, কিন্তু মাকু হইতে হবে। আমার পছন্দমতো লোকজন না নিয়া গেলে গোলমাল হবে। তাঁর ভাই হিরু ছিল আমার ফ্রেন্ড। তারে বললাম, দোস্ত, তোমার ভাই যা লেখছে, তার অর্থ তো এই ৷ বলল, লইয়া লও। তো আমার পছন্দমতো ৩৫ জনকে পকেটে লইয়া ঢাকায় এলাম, লঞ্চে। যখন নামলাম, তহন দেহি দুইটা বাস। একদল কয় এইটায় ওঠেন, আরেক দল কয় এইটায় ওঠেন। মহা মুশকিল।

মহি : এটা কোন ইয়ারে?

আমু : ফিফটি সেভেন। বললাম, মঞ্জু ভাই পাঠাইছে।

এই বাসে ওঠেন।

উঠলাম। আগামসিহ লেনে একটা জমিদারবাড়ি ছিল, সাদা দালান দুইটা। আমাগো ওই জায়গায় রাখল। এহানে শুনলাম আউয়াল সাব (এম এ আউয়াল) প্রেসিডেন্ট, মঞ্জু ভাই (নুরুল ইসলাম মঞ্জু) সেক্রেটারি। এই হইল একটা প্যানেল। আরেকটা প্যানেল হইল রফিকুল্লাহ চৌধুরী প্রেসিডেন্ট, পাবনার আজহার আলী সেক্রেটারি। আমরা তো মঞ্জু ভাইয়ের লোক, মঞ্জু ভাই হইল বরিশালে আমাগো নেতা।

মাহবুব আলী ইনষ্টিটিউটে আমি একেবারে ফার্স্ট রোতে বসা। পাশে একটা ফোল্ডিং চেয়ারে পা তুইলা বইসা আছি। প্রথম থিকাই গুনগুন আন্দোলন, মানে গোলমাল-আউয়াল সাবকে বক্তৃতা দিতে দেওয়া যাবে না। কেন? আউয়াল সাব বক্তৃতা দিলে হাউস কন্ট্রোল হইয়া যাবে। উনি খুব ভালো বক্তা। পপুলার ছাত্রনেতা তখন, ছাত্রলীগের সেক্রেটারি তিনি। প্রেসিডেন্ট মোমিন তালুকদার, ভালো বক্তৃতা দিতে পারে না। আউয়াল সাব ছিল একক নেতা। এন্টায়ার। হাউস তার পক্ষে। চেয়ারটা টান দিয়া তুইলা ছুঁইড়া মারলাম। ওইটা গিয়া পড়ছে ময়মনসিংহের উপরে। আমার পেছনে ছিল ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ। স্লোগান উঠল–ঢাকা-নারায়ণগঞ্জওয়ালারা ময়মনসিংরে মারে, এইটা হইতে দেওয়া যাবে না। আমরা হইচই করতেছি। এর মধ্যে আউয়াল সাব বক্তৃতা দেওয়ার চেষ্টা করতেছে। কিন্তু পারে নাই। আমারে একটা টেবিলের ওপর দাঁড়া করায়া দিল–যা, বক্তৃতা দে। যহন বক্তৃতা শুরু করছি, হঠাৎ দেহি পেছনে একটা হাত–কাজী গোলাম মাহবুব, বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। আমারে কয় :

নাম।

নামলাম। সামনে দেহি একটা গাড়ি।

ওঠ।

উঠলাম। নিয়া গেল বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। সেহানে দেহি আরেকজন বসা। বলল, আউয়াল সাবের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করছি। বঙ্গবন্ধু বলল, তোর দোষ কী। তুই তো নিজের ইচ্ছায় আসছ নাই। ও তো মঞ্জুর দলের লোক। মঞ্জুকেই সাপোর্ট করবে।

আমি একটু কনফিউজড হইলাম। কী করব? এহানে লইয়া আইল। এরা কী আলাপ করে?

বঙ্গবন্ধু বলল, মাহবুব, ওর সঙ্গে কথা কও।

মাহবুব ভাই কইল, রফিকুল্লাহ চৌধুরী আর আজহার হইল আমাদের প্যানেল। এর পক্ষে থাকবি। ওরা যদি বাইর হইয়া যায়, যাক। মঞ্জুরে গিয়া বোঝ। আমরা তারে ভাইস প্রেসিডেন্ট করব।’

মঞ্জুরে আমি কী বোঝাব? আইলাম এক রকম, আর শুনলাম আরেক রকম। আমার তো মাথা খারাপ হইয়া গেছে। মঞ্জু হইল বরিশালের মূল।

বঙ্গবন্ধুর কথার বাইরে আমি যাব নাকি? আমারে তো আগে জানাইতে হবে। আমি তো মঞ্জু ভাইয়ের চিঠি পাইয়া আমার লোক লইয়া আইছি।

নোয়াখালীর কচি ভাই তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটি ছাত্রলীগের সেক্রেটারি। টিক্কিওয়ালা পাঞ্জাবি পরছে। কে যেন টিক্কি ধইরা টান দিছে। ছিড়া গেছে। সে ছিল খুব ঠান্ডা স্বভাবের। কয়, “দেখ দেখ। আমি তো অবাক।

যা-ই হোক, মূল প্যানেল হইল–রফিকুল্লাহ চৌধুরী প্রেসিডেন্ট, আজহার আলী সেক্রেটারি, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন অর্গানাইজিং সেক্রেটারি। এই প্যানেল পাস। এদের কথা ছিল, চাইর বছরের বেশি কেউ থাকতে পারবে না। মোমিন তালুকদার প্রেসিডেন্ট আর আউয়াল সাব সেক্রেটারি–এরা চাইর বছর ছিল।

তহন মঞ্জু ভাই এক্সপেলড হইল। আমি একটা পোলাপান মানুষ। আমারে একটা মেম্বার কইরা দিল, সেন্ট্রাল কমিটির। বরিশাল ঠিক রাখার জন্য–মঞ্জুর বদলে আমুরে ঢুকায়া দাও।

মহি: তাহলে সিরাজুল আলম খানের আগেই আপনি সেন্ট্রাল কমিটির মেম্বার?

আমু : হইছি তো।

মহি: শেখ ফজলুল হক মনিরও আগে?

আমু : হ। আমি মনিরে বরিশাল বিএম কলেজে লইয়া গেছি। সে তহন জগন্নাথ কলেজে আইএ পরীক্ষা দেয়। সেইখানে কী একটা ঝামেলা হইছিল। আমি কইলাম, তুমি বরিশালে আসো, বিএম কলেজে আসো। এই কথা কইয়া তারে লইয়া গেলাম বরিশালে। বিএম কলেজে ভর্তি করাইলাম। সেখান থিকা সে বিএ পাস করছে।

মহি: আপনি তো অনেক সিনিয়র? আপনি তো একেবারে ছায়ার মধ্যে পড়ে গেছেন?

আমু : ওই যে, বরিশালে থাকার কারণে।

বঙ্গবন্ধু ‘৬১ সালে আমাদের ডাইকা বলছিলেন, আরও অনেকরে ডাকছিলেন। বরিশাল থিকা আমারে দুইটা কারণে ডাকছে। একটা হইল, এন্টায়ার খুলনা-বরিশাল অঞ্চলটা-আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হইছিল। ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে গোলমাল। আমি ছাত্র ইউনিয়নের সাতজনকে পিটায়া বরিশাল থিকা বাইর কইরা দিছিলাম। উনি বললেন, ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে প্রবলেম মিটায়া ফেলতে হবে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ হইছে, ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন মিলায়া… গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের জন্য সোহরাওয়ার্দী একটা প্রেস কনফারেন্স করবে, ওইটার পক্ষে এবং রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু হবে। মানিক ভাই (তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া) ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস লেখবে।’

এইটা ফ্যাক্ট। বাষট্টি সালে যখন মুভমেন্ট আরম্ভ হয়, তখনই কিন্তু বিএলএফের লিফলেট–তোমরা পাইছ কি না, জানি না। দ্যাট ওয়াজ সাকুলেটেড ফ্রম এস এম হল বাই শেখ মনি।

মহি: মোয়াজ্জেম ভাই একটা লিফলেটের কথা বলেছেন। এটা কি একষট্টি সালে?

আমু : আই গট ইট ইন সিক্সটি টু।

মহি: পূর্ববঙ্গ মুক্তি ফ্রন্ট?

আমু : বিএলএফ। এই যে নিউক্লিয়াসের কথা কয়, এদের জন্ম হইছে কখন?

মহি: লিফলেটটা কি ইংরেজিতে ছিল?

আমু : না না, বাংলায়।

মহি : সিরাজ ভাইরা যে নিউক্লিয়াসের কথা বলেন…

আমু : এইটা ঠিক না। জিনিসটা হইল কি–যখন ছয় দফা দেয়, তার আগে। ছাত্রলীগে বাকী-রাজ্জাকের (মাজহারুল হক বাকী সভাপতি, আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক) ক্যাবিনেট হইল ব্ল্যাকআউটের মধ্যে। পরের দিন আমরা ঠিক করলাম, এই কমিটির বাকী, রাজ্জাক আর আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করব। আমি ছিলাম অর্গানাইজিং সেক্রেটারি ক্যান্ডিডেট। তখন নোয়াখালীর খালেদ মোহাম্মদ আলী অর্গানাইজিং সেক্রেটারি। হওয়ার জন্য ফিট পইড়া গেল। থাক তুই অর্গানাইজিং সেক্রেটারি, আমি পাবলিসিটি সেক্রেটারি। আমার কী। আমি তো বরিশালে থাহি। তহন অবশ্য ম্যাক্সিমাম টাইম ঢাকায় থাকতাম, ইকবাল হলে। এমএ ফার্স্ট পার্ট পর্যন্ত পড়ছি। যা-ই হোক, আমরা ঠিক করলাম, বঙ্গবন্ধুর কাছে যাব। সকালে আইসা দেহি, বাকী আর রাজ্জাক গাইল খাইতেছে। জমির আলী আর হায়দার আকবর খান রনো, এই দুই গ্রুপ, এনএসএফ আর আলট্রা লেফট। বলতেছে, ভারতের দালাল, আওয়ামী লীগ কোনো স্টেটমেন্ট দেয় না। ইত্তেফাক-এর কোনো ভূমিকা নাই, কোনো নিউজ নাই যুদ্ধের ব্যাপারে।

মহি: পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধের ব্যাপারে কোনো স্টেটমেন্ট দেয় নাই?

আমু : হ। আমার অ্যাডভানটেজটা হইল, এনএসএফের যারা মাকু, তারা বেশির ভাগই বরিশালের। সাইদুর-পাঁচপান্ডু–এরা। আমার শিষ্য। এরা বরিশালে যাইয়া ছাত্রলীগ করত, এহানে এনএসএফ করে। জমির আলীর সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল আলতাফের মাধ্যমে। আলতাফ বরিশালের স্পোর্টসম্যান। জমির। আলী আমারে কয় :

বস?

আরে যা ব্যাটা।

ওদের দুজনরে বাইর কইরা নিয়া আইলাম। গেলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার বলে নাই। তবে বলছে যে, ‘আইজকা তোমরা গালি খাও। কিছুদিনের মধ্যে আমি একটা জিনিস দেব, তোমরা ফুলের মালা পাবা।’ বললাম, ফুলের মালা পাওয়ার আগপর্যন্ত আমাদের যদি ইউনিভার্সিটিতে যাইতে হয়, তাইলে আপনাগো কিছু কইতে হবে, যুদ্ধের ব্যাপারে। কিছু লিখতে হবে।

অনেকক্ষণ কথা বলার পর বঙ্গবন্ধু বিরক্ত হইয়া গেল। ঠিক আছে। একটা পাকিস্তান আওয়ামী লীগ আছে, ওরে দিয়া একটা স্টেটমেন্ট দেওয়াই। উনি তহন শাহ আজিজুর রহমানরে ফোন করল। শাহ আজিজ হইল আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের উপনেতা। শাহ আজিজরে বলল, ‘তুমি একটা স্টেটমেন্ট দাও। একটা ফয়সালা করল বঙ্গবন্ধু। ইত্তেফাক-এর ব্যাপারে মানিক ভাইয়ের কাছে যাও।’ গেলাম মানিক ভাইয়ের কাছে। উনি তো হুঁকা খায় আর কথা কয়। আমি কিছু জানি না, মজিবর মিয়া জানে। উনি যেভাবে বলতে আছে, ‘৬২ সাল থিকা সেইভাবে লেখতে আছি।’

মানিক ভাইয়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললাম। উনি বঙ্গবন্ধুরে ফোন করলেন। কী কইছে, তা তো জানি না। আমাদের কইল, যান আপনারা। আমরা আইসা পড়লাম। পরের দিন ইত্তেফাক-এর প্রথম পৃষ্ঠায় লাস্টে এক কলামে একটা ছোট্ট নিউজ দিছিল, যুদ্ধের ব্যাপারে।

মহি : সিরাজ ভাইয়ের নিউক্লিয়াসের ব্যাপারটা সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

আমু : সে যেটা করত, সে ছাত্রলীগে একটা গ্রুপ করত। নিজস্ব একটা বাহিনী–ইনফ্লুয়েন্স রাখার জন্য। সে হলে থাকত। যাতে সে এইভাবে থাকতে পারে এবং ছাত্রলীগে তার একটা প্রভাব থাকে, এ জন্য সে একটা গ্রুপ মেইনটেইন করত।

মহি: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি তো তাঁর লয়্যালটি ছিল?

আমু : লয়্যালটি ছিল, এতে কোনো সন্দেহ নাই।

মহি: শেখ মুজিবের খুব কনফিডেন্সের লোকও তো ছিল?

আমু : ছিল। এখন ক্ল্যাশ যেটা হইছে, এটা ইন্টারনাল। কোল্ড ওয়ারের মতো, বহিঃপ্রকাশ নাই। মনি আর সিরাজ–দুজনে খুব বন্ধুত্ব। বাট ভেতরে-ভেতরে ভীষণ অমিল। সিরাজুল আলম খান। যখন সেক্রেটারি হয়, মনি কিন্তু লাস্ট পর্যন্ত অপোজ করছে–এটা পাকিস্তান মাঠে, ১৯৬৩ সালে। আমি মনিরে জিগাইলাম–ধুর মিয়া, তোমার এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রাখো। ও আমার বন্ধু। ও কেন মোয়াজ্জেম ভাইয়ের ক্যান্ডিডেট হইল? ওরে একটু নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছি। [৪৫]

.

২৫

ছাত্রলীগের মধ্যে দুটি গ্রুপ ছিল চোখে পড়ার মতো। অন্য সংগঠনগুলোর কাছেও এটা ধরা পড়ত। এটা কি শুধুই ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব, নাকি এর মধ্যে রাজনৈতিক কারণও ছিল, যা তাদের মধ্যে বিভাজনটি আরও স্পষ্ট করে তোলে? এ নিয়ে ২০১৯ সালের ১৫-১৬ সেপ্টেম্বর খোলামেলা কথা হয়। তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে। তিনি তখন ছাত্রলীগের মধ্যে উদীয়মান সূর্য। তার সঙ্গে আমার কথোপকথন এখানে তুলে ধরছি :

মহিউদ্দিন আহমদ : ছাত্রলীগের মধ্যে তো দুটি গ্রুপ ছিল?

তোফায়েল আহমেদ : সিরাজ ভাই যে নিউক্লিয়াসের কথা বলে, আমি তো এর মেম্বার না। আমি এ সম্পর্কে জানিও না। মনি ভাইও এর মেম্বার না। আমরা বাষট্টিতে যখন বিএম কলেজে পড়ি, তখন মনি ভাই একটা লিফলেট লেখছে, সাংঘাতিক! সেই লিফলেটের মধ্যে স্বাধীনতার কথা ছিল। এই লিফলেট জেলায় জেলায় পৌঁছছে। যে লোকটা স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ, তিনি নিউক্লিয়াসে নাই। আছে কাজী আরেফ। সে তো তখন কলেজে পড়ে, জগন্নাথে। হয়তো ইন্টারমিডিয়েট পড়ে বা কিছু একটা।

সিরাজ ভাইয়ের তো কাজ ছিল দিনে ঘুমানো আর রাতে কাজ করা। রাজ্জাক ভাই, সিরাজ ভাই বা আরেফ যা করছে, আমি তাদের অবদানকে অস্বীকার করি না। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, আমি এ সম্পর্কে কিছু জানি না। নর আই ওয়াজ মেম্বার অব দ্যাট।

মহিউদ্দিন : আপনি ডাকসুর ভিপি হলেন কোন ইয়ারে?

তোফায়েল : সিক্সটি এইটের ১৭ জানুয়ারি। ইকবাল হলের ভিপি থেকে ডাকসুর ভিপি। হলো কি, আমার ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না, ইকবাল হলের ভিপি। চাকরি করার জন্য বাড়ি থেকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে। ইন দ্য মিন টাইম, ইকবাল হলের কোটায় ভিপি আসল। আগে কিন্তু হলে হলে ডাকসু ভিপি আসত। এ বছর এই হলে।

মহিউদ্দিন : বাই রোটেশন।

তোফায়েল : বাই রোটেশন, ইনডাইরেক্ট ইলেকশন। আগে মেম্বার হয়ে তারপর ভিপি। ওইবার ছিল ইকবাল হলের টার্ম। আই অ্যাম দ্য লাকিয়েস্ট ম্যান অব দ্য কান্ট্রি!

আমি ওই দিন ভিপি হলাম, যেদিন বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা মামলায় পুনরায় গ্রেপ্তার করল। ১৭ জানুয়ারি রাত, ১৮ জানুয়ারি প্রথম প্রহরে। আমি ভিপি হওয়ার পর উনি আমাকে চিঠি দিল, স্নেহের তোফায়েল, তুই ডাকসুর ভিপি হয়েছিস। কারাগারে বসে খবর পেয়ে…। সামাদ নামে জেলখানার এক কনস্টেবল চিঠিটা আমাকে পৌঁছে দিল। ওই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে জেলগেটে আবার গ্রেপ্তার করে।

মহিউদ্দিন : তখন ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেল।

তোফায়েল : হ্যাঁ। প্রথম ছয় মাস আমরা জানতামও না উনি কোথায় আছেন। আটষট্টি সালের ১৯ জুন ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হলো। তখনই আমরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। আমার লাক আমাকে কীভাবে ফেবার করেছে? আটষট্টির শেষে ডাকসু ইলেকশন হবে। ডাকসুর মেয়াদ শেষ। ইলেকশনের ডেট হয়ে গেছে। ইন দ্য মিন টাইম, পাঁচপান্ডুকে এস এম হলে মার্ডার করল। সে থাকত এফ এইচ হলে। খোকা-পাঁচপান্ডু দুই নাম একসঙ্গে জড়িত, যেমন রাজ্জাক তোফায়েল, মনি-সিরাজ–এই রকম। পাঁচপান্ডু মার্ডার হওয়ার ফলে ইউনিভার্সিটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। ইলেকশন স্থগিত হয়ে গেল। আমি ডাকসুর ভিপি রয়ে গেলাম। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারির ১ তারিখ ইউনিভার্সিটিতে কালো পতাকা ওড়ালাম আমি এবং ডাকসুর জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী।

আটষট্টি সালে আমি হলাম ইকবাল হলের মেম্বার। এটারও একটা ইতিহাস আছে। আমি তো ছাত্র না। আমি তো মেম্বার হতে পারব না। আমি গেলাম ভিসি ওসমান গণির কাছে। ড. ওসমান গণির কারণেই আমি তোফায়েল আহমেদ হয়েছি। আমি গেলাম ওনার কাছে। স্যার, ইলেকশন আসছে। আমি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে চাই।

এখন তো ভর্তির সময় নাই। তোমাকে ভর্তি করলে তো পার্সেন্টেজ-উপস্থিতি কাউন্ট হবে না।

স্যার, এইবার ইকবাল হল থেকে ডাকসুর ভিপি হবে। আপনি যদি আমাকে ভর্তি করান, তাহলে আমি মেম্বার হয়ে পরে ডাকসুর ভিপি হতে পারি।

উনি আমার দিকে তাকিয়ে কাগজে সাইন দিয়ে আমাকে ভর্তি করে দিলেন লাইব্রেরি সায়েন্সে। তখন হল সংসদে আমি মেম্বার হলাম। আর হলো মাহবুবুল হুদা ভূঁইয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাড়ি। আমরা দুজন ক্যান্ডিডেট। ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ফেরদৌস কোরেশী আমাকে সাপোর্ট করল। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং অন্যান্য হলের যারা মেম্বার হয়েছে, আই ওয়াজ সাপোর্টেড বাই দেম। আমি ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৮ ভিপি হলাম। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে ইলেকশন না হওয়ায় আই কন্টিনিউড।

আমি ডাকসুর সহসভাপতি, পরের বছর ছাত্রলীগের সভাপতি। আমি নিউক্লিয়াসের মেম্বার না। আমি এটা সম্বন্ধে জানিও না।

মহিউদ্দিন : গ্রুপিং তো একটা ছিল। সত্তর সালে তো এটা আমি দেখেছি।

তোফায়েল : কী দেখেছ? আমি কখনো গ্রুপিং করি নাই। এখনো করি না। সিরাজ ভাইকে আমি যে চোখে দেখতাম…এই কথা সত্য, এটা আমি স্বীকার করি, আমি কবরে যাওয়ার সময়ও স্বীকার করব, সিক্সটি নাইনের আন্দোলনের সময় রাজ্জাক ভাই গ্রেপ্তার, মনি ভাই গ্রেপ্তার। সবাই বন্দী। সিরাজ ভাই গ্রেপ্তার না। তিনি আমাকে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে আন্দোলনের সময় আমাকে সাহায্য করেছেন। এটা আমি কোনো দিন অস্বীকার করব না।

মহিউদ্দিন : আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, আপনি কোন গ্রুপিংয়ে নাই, ওই সময় আমি যেটা দেখেছি–এই যে স্বপন চৌধুরী, রব, আ ফ ম মাহবুবুল হক, মার্শাল মনি, আম্বিয়া–এরা তো একসঙ্গে–ওই গ্রুপিংটা তো ছিল?

তোফায়েল : একটা হলো রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে গ্রুপিং। তোমার এক মত, আমার এক মত। আরেকটা হলো নেতৃত্বের জন্য গ্রুপিং। এটা তো ছাত্রলীগে সব সময় ছিল। রাজ্জাক ভাই যখন জেনারেল সেক্রেটারি হলো, আমরা তো রাজ্জাক ভাইকে প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেট করলাম। ফেরদৌস কোরেশীও প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেট। পরে কম্প্রোমাইজ হলো, ফেরদৌস কোরেশী প্রেসিডেন্ট, রাজ্জাক ভাই জেনারেল সেক্রেটারি। এ ধরনের গ্রুপিং তো সব সময় ছিল। যেমন আমার সঙ্গে নূরে আলম সিদ্দিকীর গ্রুপিং ছিল। আমি যে ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট হলাম ১৯৬৯ সালে, আমাদের সময় সিস্টেম ছিল প্রতিবছর ২১ মার্চ ছাত্রলীগের সম্মেলন করতে হবে। তুমি যদি করতে না পারো, তিন সদস্যবিশিষ্ট একটা কমিটির কাছে ছাত্রলীগের ক্ষমতা চলে যাবে। এই যে ড. মোশাররফ, এখন বিএনপি করে, সে-ও তিন সদস্যের একজন ছিল। সম্মেলন হলো জুন মাসে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে। তখন বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে যেতেন না। এইখানে তো মারাত্মক গ্রুপিং। নূরে আলম সিদ্দিকী হলো ফেরদৌস কোরেশীর লোক। আর আমি হলাম মনি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই, তাদের লোক। আমি ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য ইন্টারেস্টেড ছিলাম না। কিন্তু মনি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই–তারা ঠিক করছে–তোফায়েল প্রেসিডেন্ট। আমি কন্ডিশন দিলাম, আমাকে প্রেসিডেন্ট করলে রবকে সেক্রেটারি করতে হবে। নূরে আলম সিদ্দিকীর জিএস ক্যান্ডিডেট হলো নেত্রকোনার মান্নান। তখন সাবজেক্ট কমিটি বসল। এই কমিটিতে আছে প্রতিটি জেলার প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি আর ওয়ার্কিং কমিটির সব মেম্বার। আমি পেলাম ৯৬ ভোট, নূরে আলম সিদ্দিকী পেল ২৩ ভোট। অর্থাৎ আমার সঙ্গে ভোট করে নূরে আলম সিদ্দিকী পরাজিত হলো। ফেরদৌস কোরেশী ছাত্রলীগ ভেঙে দিল। আল মুজাহিদীকে প্রেসিডেন্ট আর মান্নানকে জেনারেল সেক্রেটারি করল। নূরে আলম সিদ্দিকী ওই দিকে গেল না। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৭০ সালে সে প্রেসিডেন্ট হলো। ইকবাল হলে ২১ মার্চ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত ছিলেন। ওইখানে সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার একটা ভুল-বোঝাবুঝি হলো। আমি মনিরুল হক চৌধুরীকে অর্গানাইজিং সেক্রেটারি করতে চাইলাম। সিরাজ ভাই চাইল স্বপনকে করতে। কিন্তু আমারটাই হলো। এই প্রথম সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার মনোমালিন্য হলো। সিরাজ ভাই অসন্তুষ্ট হলো। তুমি এইটাকে যদি গ্রুপিং ধরো, তাহলে ঠিক আছে।

মহি: ১৯৭০ সালে শেখ শহীদ কি ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেট ছিল? তার নামে কিন্তু স্লোগান হয়েছিল।

তোফায়েল : ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি কে হবে, এটা বঙ্গবন্ধু কোনো দিন বলে দিত না। এটা ফার্স্ট টাইম ইন হিজ লাইফ। নূরে আলম সিদ্দিকী প্রেসিডেন্ট হতে পারত না। যে কেউ দাঁড়ালে সে-ই হতো। বঙ্গবন্ধু বলছে, আমারে খুব ডিস্টার্ব করে। এইবার ওরে বানায়া দে। নূরে আলম সিদ্দিকী প্রেসিডেন্ট হলো, শাজাহান সিরাজ জেনারেল সেক্রেটারি হলো। মনিরুল হক চৌধুরী হলো অর্গানাইজিং সেক্রেটারি। এইটাকে যদি তুমি গ্রুপিং বলল, সেটা আলাদা। কিন্তু স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনো গ্রুপিং ছিল না। এটাকে অনেকে বলে গ্রুপিং, যে অমুকে অমুকে স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না–এইটা বেজলেস। ছাত্রলীগে গ্রুপিং তো ছিলই।[৪৬]

.

২৬

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের আছে একটি বিস্তৃত পটভূমি। বিভিন্ন সময়ে এ লক্ষ্যে নানান উদ্যোগের কথা জানা যায়। অনুসন্ধানী গবেষণা যত বেশি হবে, ততই এর গভীরে যাওয়া যাবে, জানা যাবে এর পেছনের মানুষগুলোর। স্বপ্ন, লড়াই আর তিতিক্ষার কথা।

আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের ওপর অনেক বাঙালির আস্থায় চিড় ধরেছিল। এমনকি যারা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে হাঁটতেন, তাঁদেরও কারও কারও মধ্যে। ঘটনাপরম্পরায় দেখা যায়, ওই সময় থেকেই আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নানামুখী উদ্যোগ ছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনুসারীরা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে থাকলেও সেখানে একাধিক স্রোতোধারার সন্ধান পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ তখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। স্বাধীনতার কথা প্রকাশ্যে প্রচার করার অনুকূল পরিবেশ ছিল না। এমনকি গোপন প্রচারের পক্ষেও জোরালো কোনো প্রবণতা দৃশ্যমান হয়নি। কিছু কিছু সাহসী তরুণ এ লক্ষ্যে কাজ করতেন গোপনে, সতর্কতার সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে কেবল একটি প্রক্রিয়া বহমান ছিল, এমনটি বলা যাবে না। এ হলো নদীর জলধারার মতো। একটির সঙ্গে আরেকটির সংযোগ নেই। যেমন তিতাস জানে না তিস্তার। কথা, কংস জানে না কুমারের কথা। জানাজানি হয় তখনই, যখন তারা এক মোহনায় মেশে।

দেখা যাচ্ছে, অনেক প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। অথবা তাকে অবলম্বন করেই আবর্তিত হয়েছে একাধিক ধারা। এই পরিক্রমার একটি সুনির্দিষ্ট মাইলফলক হলো ছয় দফা, যা ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঝোড়ো হাওয়ার সূচনা করেছিল। তারপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু পথটি সহজ ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য এ প্রক্রিয়াগুলোর সুলুকসন্ধান খুবই জরুরি। সিরাজুল আলম খানের ‘নিউক্লিয়াস’ তেমনই একটি উদ্যোগ। এখানে তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

.

তথ্যসূত্র

১. সিরাজুল আলম খান

২. আহমদ, কামরুদ্দীন (২০১৮), বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, পৃ. ৪২০-৪২১

৩. রনো, হায়দার আকবর খান (২০০৫), শতাব্দী পেরিয়ে, তরফদার প্রকাশনী, ঢাকা, পৃ. ৩৪-৩৮

৪. পঙ্কজ ভট্টাচার্য

৫. মোস্তফা মোহসীন মন্টু

৬. সিরাজুল আলম খান

৭. মাহবুব তালুকদার

৮. সিরাজুল আলম খান

৯. শামসুজ্জামান খান

১০. সিরাজুল আলম খান

১১. তোফায়েল আহমেদ

১২. আহমদ, কামরুদ্দীন (১৯৮২), স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা, পৃ. ৬৮-৬৯

১৩. সিরাজুল আলম খান

১৪. এস এম ইউসুফ

১৫. সিরাজুল আলম খান

১৬. শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন

১৭. সিরাজুল আলম খান

১৮. তোফায়েল আহমেদ

১৯. মোস্তফা মোহসীন মন্টু

২০. সিরাজুল আলম খান

২১. আহমদ (১৯৮২), পৃ. ১০৩-১০৪ ২২. সিরাজুল আলম খান

২৩. ওই

২৪. আহমদ (১৯৮২), পৃ. ৭১-৭৪

২৫. কামাল উদ্দিন আহমেদ

২৬. বদিউল আলম

২৭. সাইদুর রহমান

২৮. আহমদ (১৯৮২), পৃ. ৭৯

২৯. চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জীব (২০১৫), নবজাগরণের নায়করা, পত্ৰভারতী, কলকাতা, পৃ. ২৯৫

৩০. সিরাজুল আলম খান

৩১. শরীফ নুরুল আম্বিয়া

৩২. সিরাজুল আলম খান

৩৩. লেখকের স্মৃতি থেকে

৩৪. সিরাজুল আলম খান

৩৫. মো. কামালউদ্দিন

৩৬, আবু করিম

৩৭. বদিউল আলম

৩৮. ওই

৩৯. ওই

৪০. সৈয়দ রেজাউর রহমান

৪১. কামাল উদ্দিন আহমেদ

৪২. ওই

৪৩. ড. কামাল হোসেন

৪৪. সিরাজুল আলম খান

৪৫. আমির হোসেন আমু

৪৬. তোফায়েল আহমেদ

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *