১৩. ব্রাহ্মণ : মহাভারত এবং সাধারণের উদ্গার

ব্রাহ্মণ : মহাভারত এবং সাধারণের উদ্গার

শারীরিক কারণেই আমি অসময়ে খাওয়া-দাওয়া করি না বলে নেমন্তন্ন বাড়িগুলিতে আমার খুব দুর্নাম হয়েছে এবং ততোধিক দুর্নাম রটেছে আর একটি কারণে যে, আমি প্রায় নেমন্তন্ন-বাড়িতেই বলি–আমার খাবারটা প্যাকেটে দিয়ে দাও, বাড়ি গিয়ে খাব। এই প্রতিক্রিয়ায় কেউ অবাক হলে বা অস্বচ্ছন্দ বোধ করলে, আমি সান্ত্বনা দিয়ে বলি–দ্যাখো, বামুনমানুষ। ছাঁদাবাঁধার অভ্যাস তো আজকের নয়। তুমি লজ্জা পেয়ো না, দিয়ে দাও যা দিতে চাইছ। আমি যে এই কাজটা করলাম, সভ্য-জগতে এটা একটু লজ্জাজনকই বটে। তো সেই লজ্জা মাথায় নিয়ে, সেই কলঙ্কে নিন্দাপঙ্কে তিলক টানি/ এলেম রানি বলে যেই ঘরে ঢুকলাম, সঙ্গে-সঙ্গে গিন্নি আকুল তিরস্কারে বলতে থাকেন–আবার তুমি লোকের কাছে চেয়ে-চিন্তে খাবার নিয়ে বাড়ি ঢুকেছ, তোমার এই বামুনের অভ্যাসটা আর গেল না। এমনভাবেই তিনি খানিকক্ষণ গালি দিলেন, যেন আমি খুব নীচুজাতের মানুষ এবং এককালে আমায় চেয়ে-চিন্তেই খেতে হত। আমি অবশ্য কথাটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাইনি, কেননা চেয়ে-চিন্তে না আনলেও যদি কেউ কিছু দেয়, তাতে বেশ আনন্দই হয় এবং ছোটোবেলায় আমরা যেহেতু অনেকেই খুব অর্থকৃচ্ছুতার মধ্যে মানুষ হয়েছি তাই পরদ্রব্যের প্রতি লোভ, এবং কোনোভাবে সেই দ্রব্যলাভ হলে প্রভূত হর্ষ কোনোটাই খুব চেপে রাখতে পারিনি। আমার বিরুদ্ধবাদী মানুষেরা অবশ্য এটাকেই ব্রাহ্মণ্য বলে বিমলানন্দ লাভ করেছেন।

তবে কিনা, আমি দেখেছি, সভ্যতার পথে চলতে-চলতে ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণগোষ্ঠী যখন একদিকে চরম সম্মানলাভ করছিলেন–সেটা বিদ্যাবুদ্ধির ক্ষেত্রেই হোক, অথবা রাজনীতি, ধর্মনীতি, সমাজনীতির ক্ষেত্রেই হোক, এই সম্মান যখন চরমে উঠেছে, তখনও কিন্তু তলায়-তলায় পাশে-পাশে একটা বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই চলে এসেছে। বিশেষত ব্রাহ্মণ বলেই সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে সুবিধে পেতে পেতে একটা সময়ে যখন তারা সবকিছুই সমাজের কাছে তাদের প্রাপ্য অধিকার বলে মনে করতে থাকেন, তখন তাদের ঔদ্ধত্যটাও চরমে গিয়ে পৌঁছোয়। যে সামাজিক অবস্থিতিতে ব্রাহ্মণ একটা বিশেষ জাতি হিসেবে চূড়ান্ত সামাজিক সম্মানের জায়গায় পৌঁছেছিল, তার একটা বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া এখানে সম্ভব নয়। তবে খুব সংক্ষেপে এটা বলতেই হবে যে, সেই চরম সম্মানের জায়গাটা তাদের নির্ভুল বেদমন্ত্র উচ্চারণের মাহাত্ম্য থেকেও আসেনি, যাগযজ্ঞের আড়ম্বরে একটা মহান গম্ভীরতা তৈরি করে সমাজকে ম্যাজিক দেখিয়েও এই সম্মান আসেনি। এই সম্মান এবং এই ব্রাহ্মণ্য ভারতবর্ষের সর্বোত্তম শিক্ষালাভের মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল এবং সেই শিক্ষাও এসেছে ত্যাগ-বৈরাগ্য-তপস্যার চরম অনুশীলন থেকে।

মহাভারতে ব্যাস তার ছেলেকে প্রারম্ভিক ব্রহ্মচর্যের উপদেশ দেবার সময় বলেছিলেন–অর্থের মোহ, কামনার মোহ এবং আরও যত মোহজাল আছে, সেই সমস্ত ত্যাগ করে ক্কচিৎ-কদাচিৎ ব্রাহ্মণ্য লাভ করা যায়। তাই সেটাকে যত্ন করে রক্ষা করতে হয়। তার পরেই ব্যাস একটু ধমক দিয়েইবললেন দ্যাখো বাছা! বামুনের শরীরটা ব্যক্তিগত কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য নয়। বামুন হয়ে যখন জন্মেছ, তখন মনে রেখো, এই শরীর শুধুই কৃচ্ছ্বসাধনের জন্য আর কষ্ট সহ্য করার জন্য এবং তাতেই তোমার পরকালের সুখইহ ক্লেশায় তপসে প্ৰেত্য চানুত্তমং সুখম। আর এই ক্লেশ এবং তপস্যা দিয়ে ব্রাহ্মণকে কী আয়ত্ত করতে হবে? না, সত্যকে জানতে হবে, শিখতে হবে ঋজুতা, ক্রোধহীনতা, অসূয়াবর্জন, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ এবং কৃচ্ছুতা। সর্বশেষ কথাটা হল অহিংসা এবং অনৃশংসতা–যা পূর্বোক্ত সাধনগুলির মাধ্যমে আসে।

ব্রাহ্মণ্যের এই উচ্চ আদর্শের পালনীয়তা সমাজে সমুজ্জ্বল থাকায় বহুমুখী বিদ্যাশিক্ষার সঙ্গে যেখানে ত্যাগ-বৈরাগ্যের মহত্ত্ব মিশ্রিত, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই লৌকিক সম্মানের শ্রেষ্ঠ আসনটি জুটে যেত ব্রাহ্মণের। শুধু লৌকিক কেন, বিদ্যালাভ এবং নিলুব্ধতা একত্র সমবায়ী হওয়ায় ভারতবর্ষের রাজশক্তিও কোনোদিন ব্রাহ্মণের সম্মান লঙ্ঘন করেনি। ভাবতে পারেন কী, যে বৌদ্ধরা প্রধানত ব্রাহ্মণ্য-বিরোধী বলে অতিসরল কিছু পণ্ডিতের কাছে বিখ্যাত হয়েছেন, তাঁরাও প্রকৃত ব্রাহ্মণের মাহাত্ম্য লঙ্ঘন করেননি। এমনকী তাদের ধর্ম, আচার এবং সত্যের পরিশীলনে এই সদাশয় ব্রাহ্মণত্বই তারা লাভ করতে চেয়েছেন। বিশ্বাস না হয়ন জটাহি ন গোত্তেন ইত্যাদি ধম্মপদের মন্ত্র দেখে নিন। সেখানে ধ্রুবপদে তবেই না তাকে ব্রাহ্মণ বলা যাবে, এমনটাই আছে।

কিন্তু ব্রাহ্মণের এই সম্মান, আমরা বলব–মহাভারতের সময় থেকেই নষ্ট হতে আরম্ভ করেছে এবং এই নাশারম্ভের কারণ হয়তো রাজসংস্রব এবং অর্থপুষ্টি। সে-কথায় পরে আসছি। আমাদের দেশে এই সেদিন রবীন্দ্রনাথের কালে এক মহারাষ্ট্রী ব্রাহ্মণকে এক ইংরেজ প্রভু জুতো মেরেছিলেন। ব্যাপারটা উচ্চতম ন্যায়ালয় পর্যন্ত গড়ায় এবং বিচারক এই জুতো মারার ঘটনাটাকে অতি তুচ্ছ ‘কে’ বলে খারিজ করে দেন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু এই সাহেব কিংবা সেই বিচারককেও একহাত নিয়ে বসেননি। তিনি লিখেছিলেন ব্রাহ্মণও যখন আপন কর্তব্য পরিত্যাগ করিয়াছে, তখন কেবল গায়ের জোরে পরলোকের ভয় দেখাইয়া সমাজের উচ্চতম আসনে আপনাকে রক্ষা করিতে পারে না। কোনো সম্মান বিনা মূল্যের নহে। যথেচ্ছ কাজ করিয়া সম্মান রাখা যায় না। …তাহারা জীবনযাত্রাকে সরল ও বিশুদ্ধ করিয়া, অভাবকে সংক্ষিপ্ত করিয়া, অধ্যয়ন-অধ্যাপন যজন-যাজনকেই ব্রত করিয়া, দেশের উচ্চতম আদর্শকে সমস্ত দোকানদারির কলুষস্পর্শ হইতে রক্ষা করিয়া, সামাজিক যে সম্মান প্রাপ্ত হইতেছেন, তাহার যথার্থ অধিকারী হইবেন–এইরূপ আশা করা যায়।…ইহা না হইলে আত্মম্ভরিতার উপর কর্তৃত্বকে দীর্ঘকাল রক্ষা করা যায় না। সম্মানও পাইবে, অথচ তাহার কোনো মূল্য দিবে না, ইহা চিরদিন সহ্য হয় না।

কবির কথা থেকে বোঝা যায় যে, ত্যাগ-বৈরাগ্য-কৃচ্ছুতা নেই, ঋজুতা নেই, তপস্যা নেই, অথচ অর্থগৃধুতা আছে, আত্মম্ভরিতা আছে, মাতব্বরি আছে, ভয় দেখানো আছে, এমন ব্রাহ্মণ্য সামাজিক মানুষের সম্মান লাভ করতে পারে না। ঠিক এই জায়গায় এসে আমি জানাতে চাই যে, প্রথাগত ব্রাহ্মণ্যের বিরুদ্ধে, জন্মব্রাহ্মণ্যের বিরুদ্ধে অথবা ব্রাহ্মণ্য-প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থোপার্জন করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং গুপ্ত সমালোচনা কিন্তু অনেক দিনই আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল এবং সেটা ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের মধ্যেই হয়েছিল। শুধুমাত্র শুষ্ক আচার দেখিয়ে, গুরুর গৌরব দেখিয়ে, পিতার গৌরব দেখিয়ে অধস্তন বর্ণকে অপমান করার একটা আদত ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের মধ্যে এমনভাবেই নিহিত হয়ে গিয়েছিল যে, গৌরবযুক্ত পিতামাতার পুত্র-কন্যারাও এবং অনুপযুক্ত শিষ্যরাও সমাজভুক্ত অধর বর্ণকে কথায় কথায় অপমান করে বসত। কিন্তু এই সব সময়ে প্রতিবাদ এসেছে এবং গৌরবযুক্ত ব্রাহ্মণের সম্বন্ধেও অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা কী ভাবছে, তার কিছু উপাদান আছে মহাভারতে, পুরাণে এবং লোকমুখে।

আমরা বলব কী এমন ঘটেছিল দুই বন্ধুর মধ্যে, তারা তো খেলার সাথি ছিলেন, সখী ছিলেন কথালাপে। দৈত্যাসুরগুরু শুক্রাচার্যের মেয়ে দেবযানী আর অসুররাজ বৃষপর্বার মেয়ে শর্মিষ্ঠা। এঁরা অন্যান্য মেয়েবন্ধুদের সঙ্গে একটি উদ্যান-সরোবরে স্নান করতে নেমেছিলেন। এদিকে প্রবল হাওয়ায় সরোবরের তীরে ছেড়ে-রাখা তাদের বস্ত্রগুলি এলোমেলো হয়ে এক জায়গায় মিশে গেল। এই অবস্থায় অসুররাজ বৃষপর্বার মেয়ে শর্মিষ্ঠা স্নান সেরে উঠে বিমিশ্র বস্ত্ররাশির মধ্য থেকে গুরুকন্যা দেবযানীর কাপড় খানি পরে ফেললেন ভুলক্রমে, একেবারেই না বুঝে ব্যতিমিশ্রমজানন্তী দুহিতা বৃষপর্বণঃ। এটা তো ভুলই শুধু এবং যাঁরা এতক্ষণ একসঙ্গে সখীত্বের পরিসরে সরোবরে ক্রীড়া করছিলেন, তাদেরই একজন এই ভুল করলে সেটা তো যথেষ্ট সহনীয়ই বটে। কিন্তু দেবযানী গুরুর মেয়ে ব্রাহ্মণ-কন্যা এবং তাঁর পিতা যেহেতু অসুররাজের গুরু, অতএব তিনিও নিজেকে রাজার পুত্রকন্যাদের গুরু বলে মনে করেন। ফলত একই সরোবরের জলক্রীড়ার বান্ধবী হওয়া সত্ত্বেও দেবযানী শর্মিষ্ঠাকে বলে ফেললেন–হ্যাঁরে অসুরের মেয়ে! তুই আমার শিষ্যা হয়ে আমার কাপড় পরে ফেললি। কোনো আচার-বিচারের জ্ঞান আছে তোর? যে কাজটা করেছিস, তার ফল মোটে ভালো হবে না–সমুদাচারহীনায়া ন তে সাধু ভবিষ্যতি।

শর্মিষ্ঠা কোন মন্ত্রে দেবযানীর কাছে দীক্ষিত হয়ে দেবযানীর শিষ্যা হয়েছিলেন, জানি না। কিন্তু রাজগৃহের জাতিকা বলে কথাটা তার সহ্য হল না। তিনি বললেন–দ্যাখ দেবযানী! আমার বাবা হলেন রাজা। তিনি বসে থাকুন বা শুয়ে থাকুন, এমন কোনো পরিস্থিতি নেই, যখন তোর বাবা আমার বাবাকে নীচে দাঁড়িয়ে স্তুতি করে–আসীনঞ্চ শয়ানঞ্চ পিতা তে পিতরং মম স্তৌতি। অতএব দেবানী! তুই হলি তার মেয়ে, যিনি রাজার কাছে যাচনা করেন, রাজার স্তব করেন এবং রাজার দেওয়া দান গ্রহণ করেন–চতত্ত্বং হি দুহিতা স্তবতঃ প্রতিগৃহ্নতঃ। আর আমি হলাম তাঁর মেয়ে যাঁর স্তুতি করা হয়, যিনি দান করেন, কিন্তু কারও দেওয়া দান তিনি গ্রহণ করেন না। তুই কপাল কুটে মর, মাটিতে মাথা ঠুকতে থাক, ভিখারি কোথাকার! আরও আরও তুই রেগে যা বরং, কিন্তু আমার কিছুই করতে পারবি না তুই, আমি তোর একফেঁটা কেয়ার করি না। হি ত্বাং গণয়াম্যহং…হ্য কুপ্যস্ব যাচকি..রিক্তা ক্ষুভ্যসি ভিক্ষুকি।

শর্মিষ্ঠার এইসব কথার কোনো উপযুক্ত জবাব দিতে পারেননি দেবযানী, কিন্তু তাই বলে তার অহঙ্কার, আত্মম্ভরিতার যুক্তি লুপ্ত হয়ে যায়নি। সেটা বোঝা যায় যখন নিরপেক্ষ কথকঠাকুর বৈশম্পায়ন পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করছেন। তিনি বলেছেন–আত্মম্ভরিতার যুক্তি দিয়ে, আপন প্রাধান্যের যুক্তি দিয়ে তবুও যখন দেবযানী নিজের গর্ব প্রকাশ করছেন এবং শর্মিষ্ঠার পরিহিত বস্ত্রখানি ধরেও টানাটানি করছেন সমুজ্জ্বয়ং দেবযানীং গতাং সক্তাঞ্চ বাসসি–তখন আর শর্মিষ্ঠা তাকে সহ্য করতে না পেরে একটা মজা কুয়োর মধ্যে দেবযানীকে ফেলে দিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। এর ফল ভালো হয়নি আমরা জানি। মহারাজ যযাতি মৃগয়ায় এসে দেবযানীর কান্না শুনে তাকে কুয়ো থেকে তুলেছেন বটে, কিন্তু দেবযানী মুহূর্তের মধ্যে পিতার কাছে গেছেন এবং শর্মিষ্ঠা যা যা বলেছেন, তা সক্রোধে উগরে দিয়েছেন শুক্রাচার্যের সামনে। শুক্রাচার্য তাঁকে নিজের অবস্থাটা বুঝিয়েছেন প্রথমে। বলেছেন, এটা কখনও ঠিক নয় যে, তিনি যাচক, ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের মতো বৃষপর্বার রাজধানীতে আছেন, বরঞ্চ উলটোই, রাজাই তাকে যাচনা করে ঘরে রেখেছেন তার সঞ্জীবনী মন্ত্রে অসুরদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য।

আমরা জানাতে চাই–শুক্রাচার্য এতটুকুও মিথ্যা বলেননি নিজের সম্বন্ধে এবং তিনি নিতান্ত ব্রাহ্মণোচিত ভাবেই এটা বুঝেছিলেন যে, এখানে দেবযানীরও কিছু দোষ আছে। নিতান্ত ব্রাহ্মণোচিত গুণেই তিনি দেবযানীকে শর্মিষ্ঠার অতিবাদ সহ্য করে ক্ষমা করে নিতে বলেছিলেনঃ সন্ধারয়তে মনুং যযাতিবাদাংস্তিতিক্ষতে। কিন্তু দেবযানী কিছুই শোনেননি, শর্মিষ্ঠার ওপরে ব্রাহ্মণ্যের শাস্তি নেমে এসেছিল। আমরা শুধু জানাতে চাই–শুক্রাচার্য তেমনটা না হওয়া সত্ত্বেও যেভাবে যাচকভিক্ষুক অথবা লোভীর নিন্দা-অতিবাদ শুনেছিলেন, এই তিরস্কারটা সাধারণ মানুষের মনেও ছিল। তারা অন্তরে অন্তরে ব্রাহ্মণকে এমন হীন দৃষ্টিতেই দেখতেন অথচ বেশি কিছু যে বিরুদ্ধে বলতে পারতেন না, তার কারণ ব্রাহ্মণেরা রাজার সমর্থন পেতেন। ব্রাহ্মণের যেহেতু দান-পরিগ্রহ ছাড়া অর্থোপার্জনের অন্য কোনো ধর্মসম্মত উপায় ছিল না, তাই যজ্ঞকারী রাজার দান-গ্রহণের সূত্র ধরে অতিশিক্ষিত বুদ্ধিমান ব্রাহ্মণদের রাজমন্ত্রকে স্থান পাওয়াটা মোটেই কঠিন হয়নি। আর মনু-মহারাজ রাজার সমস্ত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সিদ্ধান্ত-গ্রহণের ক্ষেত্রে মন্ত্রী, অমাত্য, সেনাপতি–সবার সঙ্গে আলোচনার পরেও একজন বিশিষ্ট প্রাজ্ঞ ব্রাহ্মণের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনাটা করতে বলেছেন সর্বেষাং তু বিশিষ্টেন ব্রাহ্মণেন বিপশ্চিতা। মন্ত্রয়েৎ পরমং মন্ত্রম…।

ব্রাহ্মণের সঙ্গে রাজা-রাষ্ট্র-রাজনীতির এই যে সংস্রব ঘটল, তাতে যেমন এই ঘনিষ্ঠ সংস্রবের দোহাই দিয়ে দেবযানীর মতো বামুন-মেয়ের সঙ্গে ক্ষত্রিয় যযাতির প্রতিলোেম অসবর্ণ বিবাহ সিদ্ধ হয়েছে, তেমনই এই রাজসংসবের জন্য সাধারণ মানুষের মনে ব্রাহ্মণের সম্বন্ধে লোভের প্রতিক্রিয়া এসেছে এবং স্বয়ং রাজারাও মাঝে মাঝে উত্যক্ত হয়ে সেটা বলে ফেলছেন–এমন উদাহরণ আছে মহাভারতে। ক্ষত্রিয় রাজা যযাতি ব্রাহ্মণ-কন্যা দেবযানীর অনেক অনুরোধ-উপরোধ সত্ত্বেও যখন তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হলেন না, তখন দেবযানী তাকে বলেছিলেন ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় এই দুই বর্ণই পরস্পরের পরিপূরক ক্ষত্রিয়ের ক্ষাত্রবৃত্তি যেমন ব্রাহ্মণকে আশ্রয় করে সজীব আছে, তেমনই ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণ্যও ক্ষত্রিয়কে আশ্রয় করে বেঁচে আছে–সংসৃষ্টং ব্ৰহ্মণা ক্ষত্রং ক্ষত্রেণ ব্ৰহ্ম সংহিতম। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের এমন মাখামাখি বর্ণনা দিয়ে দেবযানী শেষ পর্যন্ত ক্ষত্রিয় যযাতিকে বিয়ে করলেন বটে, কিন্তু মহাভারতের প্রায় অন্ত্যভাগে এসে ক্ষত্রিয় রাজাকার্তবীর্য-অর্জুন এই কথার প্রতিবাদ করে বলছেন–ক্ষত্রিয়দের থেকে ব্রাহ্মণরা শ্রেষ্ঠ–এই কথাই চলছিল এত দিন, কিন্তু আসল সিদ্ধান্তের কথা এইটাই যে, ক্ষত্রিয়রাই ব্রাহ্মণদের থেকে শ্রেষ্ঠ পূর্বো ব্রহ্মোত্তরো বাদো দ্বিতীয়ঃ ক্ষত্রিয়োরঃ। এ বারে প্রতিবাদ করে বলছেন কার্তবীর্য অর্জুন–এবং সেটা পূর্বে দেবযানীর বলা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মাখামাখির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অথবা এত কালের স্বীকৃতি ‘পূর্বো ব্রহ্মোত্তরো বাদঃ–তার প্রতিবাদ। কার্তবীর্য বলছেন ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়দের আশ্রয় করে আছেন, এটাই ঠিক। কিন্তু কোনোভাবেই ক্ষত্রিয়রা ব্রাহ্মণদের আশ্রয় করে নেই ব্রাহ্মণাঃ সংশ্ৰিতাঃ ক্ষত্রং নক্ষত্রং ব্রাহ্মণাশ্রিতম।

ক্ষত্রিয় রাজপুরুষ এবং রাজাদের যাজন-যাজন করে, তাদের দেওয়া দান প্রতিগ্রহ করে ব্রাহ্মণদের জীবিকা চলছে, পুত্র-পরিবার নিয়ে তাদের জীবনও চলছে ক্ষত্রিয়দের ভরণে এবং পোষণে, এমন একটা আপন গরিমার বোধই শুধু নয়, আসলে মনে মনে ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধে এমন একটা নিম্ন ধারণাই পোষণ করতে আরম্ভ করেছিলেন যে,–এরা আমাদেরই খায়-পরে আর আমাদেরই জ্ঞান দেয়, তাহলে এরা আমাদের চাইতে বড়ো কীসে–ক্ষত্রাবৃত্তি-ব্রাহ্মণানাং তৈঃকথংব্রাহ্মণো বরঃ?ব্রাহ্মণরা রাজবাড়িতে যেসব যাগযজ্ঞ করাতেন, তাতে নিয়ম, আচার, সংযমের সঙ্গে বিস্তীর্ণ মন্ত্রবর্ণের উচ্চারণ এবং যজ্ঞান্তে ভূরি-দক্ষিণার ব্যবস্থা থাকার ফলেই কিন্তু রাজপুরুষদের এইরকম ধারণা হত–এবং সেটা এখনও একই রকম হয় যে, ঘরে এসে কতকগুলো দুর্বোধ্য উচ্চারণে কীই-না-কী বলে গেল আর কতকগুলি অর্থ নিয়ে গেল। এটা মনে রাখতে হবে যে, তখনকার রাজা-রাজড়া-রাজপুরুষরাও কিন্তু গুরুর কাছে বেদ পড়তে যেতেন এবং অনেক সময়েই ব্রাহ্মণ-শিষ্যদের সঙ্গে একসঙ্গেই থাকতেন, যেমন দ্রোণাচার্য এবং পাঞ্চাল দ্রুপদ। তাঁরা জানতেনও যথেষ্ট সচেতনভাবে যে, ব্রাহ্মণরা বেদমন্ত্রের উচ্চারণ করেই প্রস্তুত যজ্ঞে আহুতি দেন, তাঁরা নিয়মাচারের বিধান দেন যজ্ঞকালে, শেষে দক্ষিণাও নেন এবং সবচেয়ে বড়ো কথাযাজক ব্রাহ্মণদের রাজারাও অন্তরায় দূর করার জন্যই তো নিজেরাই ডেকে আনতেন এবং এখনও আমরা তাই আনি। অথচ সম্পূর্ণ এই প্রক্রিয়ার মধ্যে যজ্ঞ-যাজনের পরিশ্রম ছাড়া রাজকীয় পরিশ্রম অথবা বাণিজ্য-ব্যবসায়ী ব্যক্তির পরিশ্রম বহিরঙ্গ দেখা যায় না বলেই–অথচ যাজনের দক্ষিণা দিতেই হয়–তাই বোধহয় এমন একটা মানসিকতা বহুকাল আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল, যা কার্তবীর্য-অর্জুন বলছেন। তিনি বলেছেন ব্রাহ্মণরা অধীত বেদবিদ্যার ছলনায় বেদপাঠ শোনাচ্ছেন, ব্রহ্মজ্ঞান উপদেশ দিচ্ছেন আর খেয়ে যাচ্ছেন ক্ষত্রিয়দের শ্রিতা ব্রহ্মেপধা বিপ্রাঃ খাদন্তি ক্ষত্রিয়া ভুবি।

কীর্তবীর্য-অর্জুন শেষ পর্যন্ত এই মনোভাবে স্থিত হতে পারেননি, দেবতারা তাকে ব্রাহ্মণদের বৌদ্ধিক শক্তি এবং অতিজাগতিক ক্ষমতা সম্বন্ধে অবহিত করেছেন এবং তিনি সাময়িকভাবে শুধরেও নিয়েছেন নিজেকে। কিন্তু আমরা শুধু বলতে চাই, বহিরঙ্গে ব্রাহ্মণের এই মাহাত্ম্য স্বীকৃতি লাভ করলেও তাদের সম্বন্ধে অন্তরে অন্তরে অন্য অধস্তন জাতিবর্ণের মানুষেরা এক ধরনের বিদ্বেষ পোষণ করত, যা বেরিয়ে আসত রাগের সময়। আমাদের মনে আছে–কৌরব দুর্যোধন ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণদের নিয়ে বিরাট-রাজার গোধন হরণ করতে গিয়েছিলেন। পাণ্ডবরা তখন বিরাট-রাজ্যে অজ্ঞাতবাসের কাল কাটাচ্ছিলেন ছদ্মবেশে এবং অজ্ঞাতবাসের কাল শেষ হয়ে যাওয়ায় বৃহন্নলাবেশী অর্জুন নিজেই যুদ্ধে এসেছেন। অর্জুনের রথনির্ঘোষ এবং তার ধনুকের টংকারে যে মিশ্রশব্দ ভেসে আসছিল তাতে আচার্য দ্রোণ আকস্মিকভাবে বলেই ফেললেন যে, যা দেখছি, যা শুনছি, তাতে এটা অর্জুন না হয়ে যায় না।

কথাটা শুনেই কর্ণ খুব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। প্রথম দিকে একটু রাখঢাক করে বললেও পরের দিকে ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে তার অন্তহৃদয়ের কথা বেরিয়ে এল। কর্ণ বললেন–একটা ঘোড়ার ডাক শুনেই যেভাবে আচার্য দ্রোণ অর্জুনের প্রশংসা করতে আরম্ভ করেছেন, তাতে আমাদের সৈন্যরা মানসিক বল হারিয়ে ফেলবে। আরে ঘোড়ারা কত সময়েই ডাকে, স্থানে, অস্থানে কতই ডাকে, কিন্তু একটা ঘোড়ার ডাক শুনেই ওনার সব তালগোল পাকিয়ে গেল–হূেষিতংস্থপথানে দ্রোণে সর্বং বিঘট্রিত।কর্ণের ধারণা দ্রোণের মতো ব্রাহ্মণদের যুদ্ধক্ষেত্রে থাকাটাই উচিত না, কোথায় এইসব বামুন-পণ্ডিতদের থাকা উচিত, সে সম্বন্ধে এবার সাধারণী ব্রাহ্মণ্য-কুৎসা বেরিয়ে আসছে কর্ণের মুখ দিয়ে। কর্ণ বলছেন–আচার্য ব্রাহ্মণেরা সব বড়ো দয়ালু এবং সব সময়েই ভাবছেন–এই বুঝি বিপদ হল। অতএব এসব লোককে কর্তব্য-বিষয়ে কোনো প্রশ্নই করা উচিত নয়। তো এঁদের মানায় কোথায় জানোবড়োলোকের বড়ো বাড়িতে বক্তৃতা মারতে দাও, দেখবে, কেমন বক্তৃতা দেবে। বিচিত্র মানুষের ততোধিক বিচিত্র গুষ্টির মধ্যে বক্তৃতা মারতে দাও, দেখবে কেমন দেবে। আবার যেখানে যজ্ঞকার্য হচ্ছে, নানান নিয়ম-কানুন আচার নিয়ে কথা হচ্ছে, সেখানে দেখবে এঁদের কত কথা–প্রাসাদে বিচিত্রে গোষ্ঠীযূপাসনেষু চ। আবার দ্যাখো, যেখানে বিভিন্ন মানুষ একত্রে সভা করে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলছে, সেখানে এঁদের মুখে খই ফুটবে। আবার দ্যাখো, যজ্ঞের প্রক্রিয়ায় যে হাজার রকম নিয়ম আছে, যজ্ঞের অঙ্গ হিসেবে যেসব বস্তু লাগে, আগে-পরে কোন মন্ত্র বলতে হবে–এসব নিয়ে যেখানে চর্চা হচ্ছে, সেখানে নানান আশ্চর্য কথা বলেন বলে, সেখানেই এঁরা শোভা পান-ইজ্যাস্ত্রে চোপসন্ধানে পণ্ডিতাস্তুত্র শোভনাঃ।

শেষ কথাটায় কর্ণ একেবারে ধুয়ে দিচ্ছেন ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের। বলছেন–অন্য লোকের কোথায় কী খুঁত আছে বার করতে দাও, কোন মানুষটা কেমন, তার চরিত্রবর্ণনা করতে বলল, আর খাবার-দাবার, অন্নপান–তার গুণ-দোষ, ঘঁত্সর্গ নিয়ে কিছু বলতে দাও, দেখবে, সেইসব জায়গায় আমাদের এই আচার্য ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা কত ভালো–পরেষাং বিবর-জ্ঞানে মনুষ্য চরিতেষু চ। অন্নসংস্কার-দোষেষু… আমরা বলতে চাই, সাধারণ লোকের মনেও এই ছিল এবং এই আছে, এবং তার পরবর্তী সময়ের মানুষেরা যেহেতু আর পণ্ডিত দেখছেন না, শুধু বামুন পুরোহিত দেখছেন, ফলে এই সমস্ত দোষের সঙ্গে দক্ষিণার যোগ হওয়ায় এক্কেবারে নিম্নস্তরের সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে, তা কিন্তু আধুনিক কোনো কলিযুগীয় ঘটনা নয়, তারও পরম্পরা বহু কালের। আমি বোঝাতে চাই, এই পরম্পরার মধ্যে কোনো শাস্ত্রীয়তা নেই, এই পরম্পরা তৈরি হয়েছে সাধারণ অধোবর্ণ মানুষের ঈর্ষা, অসূয়া এবং ঘৃণা দিয়ে–যে-কারণে ভারী কোনো দার্শনিক বা স্মার্ত শ্লোক নয়, অথবা ব্রাহ্মণকে ধরেই ব্রাহ্মণ্য-বর্ণনা হয়, নিরপেক্ষ সমাজ-দ্রষ্টা কবি যাঁরা ছিলেন, তারা জীবনের অনন্ত বিষয়ান্তরের মধ্যে হঠাৎ-হঠাৎ করে ব্রাহ্মণের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে দিয়েছেন ব্রাহ্মণেতরের ঘৃণা, ঈর্ষা, অসূয়া দিয়ে।

আমার মনে পড়ে–তখন পূর্ববঙ্গ থেকে সবে কলকাতায় এসেছি। এক বাড়িতে সান্ধ্যকালীন নেমন্তন্নে উপস্থিত হয়েছি। সেখানে ঘোষ-বোস-সাহা-মণ্ডলদের সঙ্গে ব্রাহ্মণরাও পঙক্তি-ভোজন করছেন চেয়ার পেতে–এই উদারতা কবেই তৈরি হয়ে গেছে। তৈরি হয়ে গেছে কত আচার, আদব-কায়দা যা পূর্ববঙ্গীয়রা একেবারেই জানত না। বিশেষত এই কলকাতা শহর, যেখানে ঔপনিবেশিক গানের রেশ তখনও বহুল বিয়েবাড়ি, নেমন্তন্ন-বাড়িতে তখনও গরমকালেও বাঙালি কোট-প্যান্টটাই পরে আসতেন, সেইরকম এক নেমন্তন্ন খেতে বসেছি, বাঙাল। সেই কমলা রঙের ছোটো ছোটো চেয়ার, কাঠের তক্তায় কাগজের রোল, মাটির গ্লাস–আমার তো বসতে গিয়েই আগে গেলাস পড়ে জল গড়াল। গৃহকর্তার তত্ত্বাবধায়কদের আতিথেয়তায় আমার মলিন লজ্জা আবৃত হল। ঝুড়ি থেকে লুচি পড়ছে পাতে, অনুবর্তনী লম্বা বেগুনভাজা এবং ছোলার ডাল। আমি তৎক্ষণাৎ খেতে আরম্ভ করলাম, কারও দিকে না তাকিয়ে। আসলে বাঙালরা গাঁয়ে-গঞ্জে কোনোদিন ফুলকো লুচি দ্যাখেনি, সকালবেলায় মা-ও লোভ দেখিয়ে বলেছিলেন–দুপুরবেলায় একগাদা গিলে বসে থাকিস না, সন্ধ্যাবেলায় লুচি খেতে পারবি না। আমিও সেই দ্বিপ্রহরিক সংক্রান্ত লোভেই সঙ্গে-সঙ্গে খেতে আরম্ভ করেছি। এই অবস্থায় আমার মামার এক বন্ধু, তিনি মিস্টার দত্তই হবেন হয়তো–সামনের টেবিল থেকেই বলে ফেললেন–মজা করেই বললেন–জানিস তো, একেই বলে লুচির ওপর পড়ল ডাল, বামুন নাচে তালে তাল। ওরে আমাদের দিকে একটু তাকিয়ে দ্যাখ। খেতে আরম্ভ করেছি না, তবে তো খাবি। মিস্টার দত্ত কিন্তু আমাদের যথেষ্ট চিনতেন এবং ভালোও বাসতেন।

তখন সত্যিই এটা বোঝার বয়স ছিল না যে, এই অধিক্ষেপ আমার ব্রাহ্মণ্যের প্রতি কিংবা লুচি-না-দেখা বাঙালত্বের প্রতি, নাকি ক্ষুধাতাড়িত বালকত্বের প্রতি? বস্তুত এটা শহুরে আদব-কায়দা না-জানা বাঙালের প্রতিই হওয়া উচিত ছিল, কিংবা খাবার দেখলে বালকের অসহনীয়তার প্রতিই এই নিন্দা-মন্দ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা না হয়ে যে সেটা ব্রাহ্মণ্য-স্বভাবের প্রতিই হল–সেটা কিন্তু একটা সামাজিক সংকেত তৈরি করে। বহুকাল, কালান্তরের ঘৃণা-ঈর্ষা-অসূয়া কতকগুলি প্রবাদ-শ্লোক তৈরি করেছে লঘু-চাণক্য, বৃদ্ধ-চাণক্যের নীতি শ্লোকের মতো, কিন্তু সেগুলি তির্যকভাবে নির্দেশ করে ব্রাহ্মণের স্বভাব–এবং এই শ্লোকটা কার্যক্ষেত্রে ব্রাহ্মণরা নিজেরাও উচ্চারণ করেন মেনে নিয়ে একটা শ্লোকে আছে ময়ুরেরা মেঘের ডাক শুনলেই স্বভাবত খুশি হয়, পরের খুশি দেখলে পরে প্রকৃত সাধু মানুষ খুশি হন, খল-কপট মানুষেরা যেমন পরের বিপদ-বিড়ম্বনা দেখলে খুশি হয়, বামুনেরা তেমনই খাবার পেলেই খুশি হন–তুষ্যন্তি ভোজনৈৰ্বিপ্ৰা ময়ূরাঃ ঘনগর্জিতেঃ।

এত সব কিছু ছেড়ে ব্রাহ্মণরা কেন খাবার পেলেই খুশি হন–জানবেন পূর্বোক্ত শ্লোকটির ক্রিয়াপদের পাঠান্তরে খুশি হওয়ার জায়গায় নাচতে থাকেন’ আছেনৃত্যন্তি ভোজনৈর্বিপ্রাঃ) কিন্তু খাবার পেলেই এমনটা ব্রাহ্মণদেরই হয় কেন, তার হয়তো সামাজিক কারণ আছে–অতিরিক্ত ব্রত-উপবাসের সঙ্গে দারিদ্রও সেখানে একটা পরম্পরা-বাহিত কারণ, এটা এখনকার মানুষেরা বুঝতে পারবেন না। ব্রাহ্মণ যজন-যাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা নিয়ে থাকবে, পরের চাকরি করবে না, কৃষিকার্য করবে না এবং রাজবাড়িতে অথবা ধনী-জনের খিদমদগারি করে অর্থ উপার্জন করবে এমনটাও চলবে না–এটাই নীতিগতভাবে ব্রাহ্মণের নীতি ছিল। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ হয়ে অন্যোপায়ে টাকাপয়সা উপার্জন করে বড়োলোক হয়েছে, এটাও সামাজিক মানুষেরা ব্রাহ্মণের পতন বলেই মনে করতেন এবং এ-বিষয়েও একটি প্রাবাদিক নীতি-শ্লোক তৈরি হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের মানসলোক থেকে উচ্চারিত। বলা হচ্ছে–অতিরিক্ত রূপ-যৌবন যদি বেশি থাকে এবং সে যদি বিবাহিতাও হয়, তবে সে মেয়ের নষ্ট হবার সম্ভাবনা যেমন বেশি, তেমনই বামুন নষ্ট হয়ে যায় রাজার সেবা করে স্ত্রী বিনশ্যতি রূপেণ ব্রাহ্মণো রাজসেবয়া।

অন্যের চাকরি করা ব্রাহ্মণের বারণ ছিল, কৃষিজীবিতা তো নয়ই, কিন্তু সবচেয়ে ঘৃণা করা হত বোধহয় রাজবাড়ির অর্থপুষ্ট ব্রাহ্মণকে। এই ঘৃণা আমরা শর্মিষ্ঠার মুখে আঁচ পেয়েছি, আরও স্পষ্ট দেখেছি দ্রোণাচার্যের ক্ষেত্রে, যিনি ব্রাহ্মণের বৃত্তি ত্যাগ করে ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন। বলে গ্রামে-গ্রামান্তরে ঘুরেও ছেলেকে দুধ খাওয়ানোর জন্য একটা গোরু পর্যন্ত দান পাননি ব্রাহ্মণদের জ্বালায়–অন্তা অন্তং পরিক্রম্য নাধ্যগচ্ছং পয়স্বিনীম্। আর দ্রোণাচার্য যখন রাজবাড়িতে অর্থলাভের আশায় কুরুবাড়ির রাজনীতির মধ্যেই প্রবেশ করে ফেলেছেন, তখন মাঝে-মাঝেই তাকে তিরস্কার-বাক্য শুনতে হয়েছে কর্ণ, দুর্যোধন কিংবা দুঃশাসনের কাছ থেকে। আমরা বিস্তারে যাচ্ছি না, কিন্তু রাজবাড়ির যাগযজ্ঞে নৈমিত্তিক দক্ষিণা ছাড়াও যারা রাজার রাজকার্যে সহায়তা করতেন, যাঁরা তাঁর ধী-সচিবের কাজ করতেন তাদের প্রতি সমগোত্রীয় ব্রাহ্মণদের ঈর্ষা ছিল, অধোবর্ণ পুরুষদের ছিল ঘৃণা।

এক ব্রাহ্মণ আর এক ব্রাহ্মণের প্রতি ঈর্ষা পোষণ করতেন এই কারণেই যে, অপর জন রাজার বাড়িতে কত সম্মানদক্ষিণা পাচ্ছেন এই ভেবে। মহাভারত-বিষ্ণুপুরাণে একটা কাহিনি আছে। সেখানে সূর্যবংশীয় ইক্ষাকুর পুত্র নিমি এক বিরাট যজ্ঞ করার কথা ভেবে বশিষ্ঠ-মুনিকে যজ্ঞের হোতা হিসেবে বরণ করলে, বশিষ্ট নিমি-রাজাকে বললেন–এখন তো হবে না। আমাকে স্বর্গের দেবরাজ ইন্দ্র পূর্বাহেই বরণ করেছেন হোতা হিসেবে এবং সেটাও বিরাট যজ্ঞ। তুমি কিছু কাল অপেক্ষা করো, আমি ফিরে এসে তোমার কাজ করে দেব। নিমি এ-কথার কোনো উত্তর দিলেন না এবং তার মৌনতাকে সম্মতি ভেবে চলে গেলেন সুরযজ্ঞের যাজন করতে। এদিকে নিমি-রাজা আর দেরি করতে চাইলেন না। তিনি মহর্ষি গৌতমকে হোতা রূপে বরণ করে যজ্ঞ আরম্ভ করে দিলেন। সুরযজ্ঞ সমাপন করে বশিষ্ঠ ত্বরিতে এলেন নিমির রাজ্যে। এসে দেখলেন–ঋষি গৌতম যজ্ঞের সমস্ত কর্তৃত্বভার গ্রহণ করে যজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন। বশিষ্ঠের এত রাগ হল যে, তিনি চরম অভিশাপ দিলেন নিমিকে। লক্ষণীয়, এর প্রত্যুত্তরে নিমিও কিন্তু ছেড়ে দেননি। তিনি যে অভিশাপ দিয়েছিলেন সেটাও ভালোরকম ফলেছে, কারণ তিনি তো নির্দোষ ছিলেন।

আমরা বলতে চাই রাজবাড়িতে বৃত্তি গ্রহণের ব্যাপারটাই কিন্তু বশিষ্ঠের ক্রোধ ঘটিয়েছে–অর্থলিঙ্গুতাই কিন্তু সেখানে একক কারণ যাতে অন্যতর মহর্ষি গৌতমকে দেখে তার রাগ হচ্ছে অথবা রাগ হচ্ছে তার সম্মান এবং কর্তৃত্ব দেখে। সাধারণ মানুষও এই প্রবণতাগুলি লক্ষ করেছে এবং তাদের দৃষ্টি এত গভীর এবং তা সামগ্রিকভাবে ব্রাহ্মণ-সমাজ, বিশেষত যাঁরা অন্যের যজন-যাজন করে সাধারণভাবে অর্থোপার্জন করতেন, তাদেরও এমনভাবেই জড়িয়ে নিয়েছে, তাতে অদ্ভুত একটা প্রাবাদিক শ্লোক লিখেছেন এক কবি। তিনি লিখেছেন–ব্রাহ্মণ, জ্যোতিষী গণক-ঠাকুর, বেশ্যা, কুকুর এবং মুরগি–এদের সবার চরিত্রের একটা সমান-সাধারণ দিক আছে। অভীষ্ট বস্তুগুলির ওপরে এদের একজনের নজর পড়লে অন্যেরা অতিঘনিষ্ঠ সমগোত্রীয় হওয়া সত্ত্বেও তার ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে–ইষ্টেষু-অন্যেষু কুপ্যন্তি ন জানে তস্য কারণম্। কবি যতই বলুন কী যে তার কারণ, বুঝতে পারি না বাপু। কিন্তু আমরা জানি–মহল্লায় শাসালো খদ্দের এলে প্রত্যেক বেশ্যাই ভাবে–এ আমার ঘরেই ঢুকবে, কুকুর-কিংবা কুকুট-কুলের একজনের সামনে খাবার পড়লেই অন্য সকলেই চিৎকার করতে থাকে। বস্তুত কুকুর, কুকুট এবং বেশ্যাদের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের একত্রে সংগত করার মধ্যে যে লোভর তাৎপর্য আছে, তার থেকেও বেশি ইঙ্গিতবহ–একটি খাদ্যবস্তুকে কেন্দ্র করে একই মানসিকতার মানুষগুলির মধ্যে বৃত্তিসংকোচের বোধ।

একজন সাধারণ অর্থহীন গৃহস্থ ব্রাহ্মণের মুখে মহাভারতীয় উক্তি শুনেছি। তিনি বলেছিলেন ব্রাহ্মণরা কার অধীনে আছেন? কারও নয়। কোন লোকের ইচ্ছানুসারে তিনি চলেন? কারও নয় ব্রাহ্মণাঃ কস্য বাস্তব্যাকস্য বা ছন্দচারিণঃ।তারা নিজেদের যজন-যাজন অধ্যয়ন-অধ্যাপনা নিয়ে থাকবেন, যেখানে আহার জোটে সেখানেই খাবেন পাখিদের মতো। এই শ্লোকের মধ্যে ব্রাহ্মণের যে পক্ষিবৃত্তির কথা বলা হয়েছে, এটাই ভগবদগীতার যদৃচ্ছালাভসন্তুষ্ট অথবা নীতিকথায় সেই ব্রাহ্মণই শুদ্ধ, যিনি সদা-সন্তুষ্টসন্তোষী ব্রাহ্মণঃ শুচিঃ। মহাভারত কিন্তু এতদূর গেছে যে, এই বিশাল উদার গুণগুলির লক্ষণ দিয়েই ব্রাহ্মণত্ব এবং শূদ্রত্বের ‘সোয়াপ’ তৈরি করে দিয়েছে। বলেছে–এইসব পরমোদার গুণ যদি শূদ্রের মধ্যে দেখা যায় তবে তাঁকেই ব্রাহ্মণ বলতে হবে, আর এসব গুণের অভাবে সেই ব্রাহ্মণকে শূদ্র বলতে হবে।

কিন্তু কার্যক্ষেত্র এবং জীবনের বাস্তব এমনই যে, খাবার যেখানে জুটবে সেখানে খাবো’–এই মহাশয় এবং অন্য সমস্ত বৃত্তির নিষেধ অর্থনৈতিকভাবে ক্লিষ্ট ব্রাহ্মণকে এতটাই ক্লিষ্ট করেছে যে, ব্রহ্মদর্শনের চরম জায়গায় পৌঁছেও ব্রহ্মদর্শী ঋষি ব্রাহ্মণ যাজ্ঞবল্ক্যকে সরহস্যে বলতে হয়েছে ব্ৰহ্মজ্ঞানীদের প্রতি আমার নমস্কার থাকল। বরঞ্চ ব্ৰহ্মবিষয়িনী আলোচনার শেষে যে পুরস্কার আছে, সেই সোনা বাঁধানো শিঙওয়ালা গোরুগুলিই আমাদের দরকারনমো বয়ং ব্রহ্মষ্ঠায় কূর্মঃ, গোকামা এব বয়ম্। অতএব ত্যাগ-বৈরাগ্যের আদর্শ সাধারণ্যে চলেনি। পক্ষিবৃত্তিতা, ভিক্ষাটনের বড়ো বড়ো আদর্শ সাধারণ্যে এই বৃত্তি পুষ্ট করেছে যে, অন্যের ওপরেই ব্রাহ্মণকে খেতে হবে, তার লোভ বেড়েছে, বেড়েছে পরপীড়ন। তাতে ব্রাহ্মণেতর নিম্নবর্ণের লোকেরা অথবা স্বয়ং ব্রাহ্মণেরাই ব্রাহ্মণের লোভ নিয়ে গান বেঁধেছে। প্রথম নীতিশ্লোকটি একটু ভদ্র। বলা হচ্ছে–সাতটা ফোকর আছে এই পৃথিবীতে যে জায়গাগুলিতে যতই ঢালো, যতই পূরণ করার চেষ্টা করো, কোনোদিন সে-সব ফোকর বোজানো যাবে না। এর মধ্যে প্রথম হল ব্রাহ্মণ, দ্বিতীয় আগুন, তৃতীয় যম, চতুর্থ হলেন রাজা, পঞ্চম সাগর, ষষ্ঠ হল মানুষের পেট এবং সপ্তম হল নিজের বাড়ি–এই সাত জায়গায় শুধু ঢালতে হয়।

একেবারে লোকস্তর থেকে উঠে আসা মানুষের কথ্য পরম্পরায় তৈরি এই শ্লোকগুলি কিন্তু ব্রাহ্মণের অভিশাপ নিয়ে মাথা ঘামায় না। বরঞ্চ বৃত্তিহীনতায় অছিলায় শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের ধুয়ো তুলে ব্রাহ্মণ যে সামাজিক শোষণ করেছে, তাকে নিন্দেমন্দ করে নিকৃষ্ট ভাষায়। একটি শ্লোক বলেছেধন-সম্পত্তি চলে গেলে লোকে গণক-জ্যোতিষীদের দোষ দেয়, রোগী মারা গেলে লোকে ডাক্তার-বদ্যির দোষ দেয়। কিন্তু ধন-সম্পত্তি গেলেও লোকে বামুনকে দোষে আবার লোকে মারা গেলেও লোকে সেই বামুনকেই দুযে যায়। ধন-সম্পত্তি গেলে লোকে বলে কত বামুনদের খাইয়ে পুণ্যলোভে আমি কত টাকা নষ্ট করেছি, আর লোকে মারা গেলে ভাবে–আবার শ্রাদ্ধ করতে হবে, আবার বামুনঠাকুর! দান-দক্ষিণা, কলাডা, মুলাডা–গতশ্রীশ্চ গতায়ুশ্চ ব্রাহ্মণান্ দ্বেষ্টি ভারত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *