০৩. পণ্ডিত-মুর্খ

পণ্ডিত-মূর্খ

আমি জানি, সকলেই আমাকে খারাপ ভাববেন। সকলেই বলবেন, আমি নিতান্ত নীচ মনের মানুষ। আজকের প্রগতিশীলতার মোড়ক, আজকের এই মেকি ভদ্রতার পরিশীলন, তার মধ্যে যেখানে নীচকে নীচ বলতে নেই, মুখকে মূর্খ বলতে নেই, এমনকী চালাককে চালাক বলতেও নেই, বুদ্ধিমানকে বুদ্ধিমান বলতেও নেই–সেখানে মূর্খ লোকের মূর্খতা বিচার করতে বসলে লোকে আমাকে দুয়ো দেবে বইকি। সেকালের প্রাচীন কর্তারা আমাদের উপদেশ দিয়েছিলেন যে, কানাকে কানা বলিয়ো না, খোঁড়াকে খোঁড়া বলিয়ো না। আমরা বহু চেষ্টায় এসব ব্যাপারে পরিশীলিত হয়েছি, অঙ্গবিকারগ্রস্ত মানুষ যে-কোনো অপাঙক্তেয় মর্যাদাহীন মানুষ নন, সে ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট বোধধাদয় হয়েছে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে অন্ধ-খঞ্জ-বধিরদের বিচিত্র কর্মরাশি দেখে এখন রীতিমতো লজ্জিত বোধ করি, তথাচ পুরাতন পৈতামহ-পাপের শাব্দিক প্রায়শ্চিত্তও করে থাকি।

কিন্তু আমরা মহা বিপদে পড়েছি মূর্খদের নিয়ে। বিশেষত সেই মূর্খদের নিয়ে আরও বেশি বিপদে পড়েছি, যাঁরা মূর্খ, অথচ সরল নন, যদি বা কিছু সরল তবু অযৌক্তিকতার চরম স্বর্গ থেকে মুখে-মুখে কথা বলেন। বিপদ আছে আরও–আপনি কাকে মূর্খ বলবেন, মূর্খত্ব নির্ধারণের মাপকাঠিই বা কী হবে? সত্যি কথা বলতে কি, মূর্খদের, বিশেষত স্বল্পবিদ্য চালাক মূর্খদের মূর্খ বলা পরম বিপদ। নিরক্ষর মূর্খকে মূর্খ বললে সেই মহলের আত্মীয়স্বজন অত্যন্ত কৃপাবিষ্ট হয়ে পড়েন, আর চালাকি-সফল। মূর্খদের মূর্খ বললে, তাদের পরিত্রাতার ভূমিকায় এত-শত মূর্খের আবির্ভাব ঘটে যে, তাতে প্রমাদ আরও বাড়বে।

আমি অবশ্য মূর্খত্বের অনেক উপকারিতা খুঁজে পেয়েছি এবং সেই কারণে একটি সরল মূর্খজীবনই যাপন করতে চাই। এক অসাধারণ কবিই এই মূর্খজীবনের সুবিধাগুলি উল্লেখ করে আমাকে উদ্দীপিত করেছেন। তিনি লিখেছেন–সবচেয়ে বড়ো সুবিধে হল এই যে, মূর্খত্ব লাভের জন্য কোনো পরিশ্রম করতে হয় না এবং এই সুলভ মূর্খত্ববোধের আরও অন্তত আটটা গুণ আছে ভালো-ভালো। প্রথমত, মূর্খ মানুষের কোনো ঘটনা নিয়ে কোনো টেনশন নেই এবং তা নেই বলেই সে বড় নিশ্চিন্ত। দ্বিতীয় গুণ হল খাওয়া। মূর্খ লোকেরা প্রচুর খেতে পারে, আসলে শারীরিক ভালো-মন্দের বুদ্ধিও ততটা থাকে না বলে মূর্খ লোকের খিদেও বেশি। খাওয়াও বেশি। কথা বলার ব্যাপারেও মূর্খ লোকের কোনো বিরাম নেই, দিন-রাত বিষয়-ভাবনাহীন কথা বলে যেতে পারে মূর্খ লোক। আর ঘুমোতেও পারে সেই রকম, দিন-রাত–নিশ্চিন্তো বহুভোজনোতিমুখরো রাত্রিন্দিবং স্বল্পভাক। মূর্খ মানুষ কার্য এবং অকার্যের কোনো বিচার করতে পারে না, ফলে সমস্ত বিপন্ন-বিক্ষুব্ধ মুহূর্তেও সে অন্ধ এবং বধিরের মতো থাকে। মূর্খের মানও নেই, কোনো অপমানও নেই, সব সমান। সবচেয়ে বড়ো কথা, মূর্খ লোকের খুব একটা রোগ-ভোগও নেই, শরীরটাও তার যথাসম্ভব মজবুতই থাকে। সত্যি কথা বলতে কি, মূর্খ হবার মতো সুখ আর কিছুতে নেই–প্রায়েন আময়-বর্জিতো দৃঢ়বপুঃ মূখঃ সুখং জীবতি।

এই কারণেই আমি নিরক্ষর সুখী মূর্খদের আমাদের লিস্টি থেকে বাদ দিচ্ছি। কেননা এই নিরভিমান দৃঢ়বপু সুখী মূর্খদের ওপরে আমাদের মায়া আছে, করুণা আছে, তারা কষ্ট দেয় না। যদিও এটা আমরা খুব ভালোভাবে জানি যে, পুরাকালে যখন বিদ্যাচর্চার সুবিধে সবচেয়ে কম ছিল, তখনও একটি মূর্খ পুত্রের জন্য পিতা-মাতার ক্ষোভের অন্ত ছিল না। যে পুত্র এখনও জন্মায়নি অথবা জন্মেও যে মারা গেছে–এই দুই জাতীয় পুত্রকেই তারা মূর্খ পুত্রের চেয়ে শ্রেয় মনে করতেন–অজাত-মৃত-মূখেভ্যো মৃতাজাতৌ সুতৌ বর। এ রকম আরও হাজারও নীতিশ্লোক আছে, যাতে বুঝি মূর্খত্বের জন্য সেকালে অনেক যন্ত্রণা ছিল এবং যন্ত্রণার জন্যই বহুল মূর্খতার জন্য আমাদের এখনও মায়া হয়, আমরা কষ্ট পাই। কিন্তু এমন নিরক্ষরতার অভিশাপ বাদ দিয়ে যদি সাক্ষরতার দিকে তাকাই তাহলে যন্ত্রণা আরও বাড়ে। লেখাপড়া এতটুকু না করেও যে মানুষ বিদ্বান লোকের মতো কথা বলে, চালাকি করে এবং উত্তাল বদমায়েশি করে, তাদের নিয়ে আমরা মহা-দুর্ভাবনায় পড়েছি। এমন মানুষ দেখি রাস্তাঘাটে, যারা সচিন তেন্ডুলকরের ‘টেনিস এলবো’-র আয়ুর্বেদিক উপশম-পদ্ধতি থেকে আরম্ভ করে সিয়াচেন নিয়ে চৈনিক অধ্যবসায় এবং ড, নন্দী যে কার্ডিয়োলজির কিছুই বোঝেন না–সেটা একেবারে হাতে-কলমে প্রমাণ করে দিতে পারেন। কী কী করলে আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হতে পারতেন এবং কী কী না করলে আজ জ্যোতি বসু ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন–এসব ব্যাপারে এঁদের চুড়ান্ত মতামত আছে।

এঁদের আপনি মূর্খ বলতে পারবেন না। কেননা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি–সব এঁদের হস্তামলকবৎ। তাহলে আপনি কী বলবেন এঁদের–এঁদের তো বিদ্বানও বলতে পারবেন না। এইখানেই জানানো দরকার যে, আমাদের প্রাচীনেরা নিরক্ষর মানুষকে তেমন করে মূর্খ বলেননি, বরঞ্চ আরও কয়েক প্রকার মুখের কথা বলেছেন, যাঁরা ঠিক প্রথাগত মূর্খ নন। তাদের পুঁথিগত বিদ্যা থাকতেও পারে, আবার নাও পারে। এমনকী সামাজিক আচার-আচরণও এই মূর্খতার নিদান হতে পারে। মহাভারতের উদ্যোগপর্বে ধৃতরাষ্ট্রের নিজের দোষে যখন যুদ্ধ বাধার উপক্রম হয়েছে, তখন স্বকৃত অন্যায়গুলির কথা স্মরণে না রেখে, কেন পাণ্ডবরা যুদ্ধের কথা ভাবছেন সেই চিন্তায় তার রাতের ঘুম নষ্ট হয়ে গেছে। এই অবস্থায় মহামতি বিদুরকে ডেকে তিনি যখন নিজের বিনিদ্রতার কথা বলছেন বিদুর তখন বললেন–চার ধরনের মানুষ রাতে ঘুমোতে পারে না মহারাজ! এক, যে মানুষ সহায়শূন্য দুর্বল, অথচ প্রবলতর ব্যক্তির দ্বারা আক্রান্ত, রাতে তার ঘুম আসে না। দুই, যার টাকা-পয়সা সব চুরি গেছে, তার ঘুম আসে না। তিন নম্বর বিনিদ্র মানুষ হল চোর, কার বাড়িতে চুরি করবে, নির্বিঘ্নে কী করে পালাবে, সেই চিন্তায় তার ঘুম আসে না। আর চতুর্থ হল কামুক। স্ত্রী চিন্তায় ঘুম আসে না তার–হৃতস্বং কামিনং চৌরমাবিশন্তি প্রজাগরাঃ।

এই চারজনের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্র কোনো কক্ষেই যেন পড়েন না, অথচ বিদুর কথাটা বলে দিলেন। তার মানেই, তিনি কোনো কক্ষে অবশ্যই আছেন, অথচ দাদা বলেই বিদুর তা স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না; একইভাবে ধৃতরাষ্ট্র নিরক্ষর মুখ নন, অথচ বিদুর তার কাছে কয়েক কিসিমের মূর্খের সংবাদ দিয়েছেন এবং অবশ্যই ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যে সেই মূর্খত্ব আছে, যে মূর্খত্বের কথা দাদা ধৃতরাষ্ট্রকে বলা যায় না।

বিদুর বলেছিলেন–যে মানুষ পড়াশুনো কিছুই করেনি, বিদ্যাস্থানের একটি বিষয়ও যে জানে না, অথচ তার স্বভাবটা বেশ উদ্ধত–অতশ্চ সমুন্নদ্ধঃ–সেই মানুষটা কিন্তু মূর্খ। আপনারা ভাবছেন–এমনটা হয় নাকি। আমরা বলব–এই মূর্খতার জন্য এখন কলকাতা এবং কলকাতার আশেপাশে বিভিন্ন কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে প্রবেশ করলেই হবে। প্রত্যেক বিভাগে আপনারা দুটি-তিনটি করে স্যাম্পল পাবেন, যাঁরা নিজেদের শাস্ত্র কিছুই জানেন না, কিন্তু তাদের ঠাট-বাট, কথাবার্তা শুনবেন–মনে হবে এমন হয় নাই আর হবার নয়। এঁদের ঔদ্ধত্য দেখলে বুঝতে পারবেন বিদুর-কথিত মুখ কাকে বলে। বিদুর বলেছেন-দরিদ্র লোক, যার দু’পয়সার মুরোদ নেই, সে যদি হঠাৎ বদান্য দাতা হয়ে ওঠে, তবে সেও এক ধরনের মুখতা। বিদুরনীতির তৃতীয় চিহ্নিত মূর্খ হলেন তারাই, যাঁরা কর্ম না করেই ধন উপার্জন করতে চান–অর্থাংশ্চাকর্মণা প্রেম্পূঃ। শব্দটা ছিল–অকর্মণা–এখানে কর্ম না করা মানে কিন্তু কোনো কর্ম না করা নয়, এখানে অকর্ম বলতে বোঝায় বিনা পরিশ্রমে ফোকটে পয়সা করা। যেমন ধরুন-জুয়ো খেলে, রেস খেলে অথবা লটারি খেলে যাঁরা পয়সা উপায় করতে চাইছেন, বিদুর তাদের এক ধরনের মূর্খ বলবেন।

বিদুর কিন্তু মহাভারতীয় পণ্ডিত হলেও প্রখর বাস্তববাদী। কেউ যদি নিজের সমস্ত কাজ জলাঞ্জলি দিয়ে পরের কাজ করতে যায়, তবে সে বিদুরের মতে মূর্খ। আমরা এরকম লোক বহু দেখেছি। আপনারা বলবেন–পরার্থপরতা তো খুব ভালো, বিশেষ করে আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ ধরণী-’পরে’–এই নিরিখে। সত্যি বলতে কি, এই মহানুভব আচরণের বিরুদ্ধে এটা স্বার্থপরতার কোনো প্রসঙ্গই নয়। এ হল সেই আচার যখন পড়াশুনোর প্রয়োজন ফেলে পাড়ার লোকজনের সঙ্গে লরিতে করে শবদাহ করতে যাওয়া। অথবা তদ্ভাব-ভাবিত হয়ে পার্টির মিছিল করা অথবা নিজের বাড়ির রেশন না এনে পাড়ার রকে রোদ-চশমার আড়ালে ক্যারাম খেলা। এমনকী বিদুর এটাও মুখতা বলবেন–যদি কেউ বন্ধুর জন্য মিথ্যে কথা বলে, বন্ধুর জন্য মিথ্যা আচরণ করে। শেষ কথাটা বুঝতে অসুবিধে হতে পারে, তবে উদাহরণ দিলে বুঝবেন। শকুনিমামা দুর্যোধনের জন্য কপট পাশা খেলেছিলেন, বন্ধুর স্বার্থে কর্ণ দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ সমর্থন করেছিলেন। এমন বন্ধুত্বপূর্ণ মিথ্যাচরণ মূর্খর্তই বটে।

মূর্খ সংজ্ঞা পরিহারের সবচেয়ে বড়ো উপায় নিজের ক্ষমতা, নিজের ‘লিমিটেশন’ বোঝা। সেটা না বুঝে যেটা পাবার নয়, সেইটা যদি মানুষ পেতে চায়, ধরাছোঁয়ার বাইরের জিনিসটাকে যে মানুষ ধরতে চায়, এবং তার জন্য ভালোবাসার মানুষকে, অনুকূল জনকে যে ত্যাগ করে–মহাভারতের মতে সেটা মূখামি–অকামান্ কাময়তি য়ঃ কাময়ানা পরিত্যজেৎ। নিজের পরিমিতি বোঝার ওপরে এতটাই জোর আছে এখানে যে, নিজের আখের না বুঝে নিজের চেয়ে বলবত্তর মানুষের পিছনে লাগাটাও মূর্খতা বলেই গণ্য হয়েছে একটা মাত্র লাইনে-বলবন্তঞ্চ যো দ্বেষ্টি তমাহুঢ়চেতসম্। বলবান’ বলতে তখনকার রাজতন্ত্র শুধুমাত্র পেশিশক্তিসম্পন্ন গুন্ডাকেই বোঝাত না, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষমতাশালী মানুষও বলবান বলেই গণ্য হতেন। ভারতবর্ষের গণতন্ত্রে–লোকে বলে, কথা বলার স্বাধীনতা, ভোট দেবার স্বাধীনতা–এসব নাকি আমাদের গণতন্ত্রে আছে। কিন্তু আমাদের পাড়ার রাজনৈতিক ‘কেলে পাঁচু’র যে শক্তি অথবা গ্রাম-গঞ্জে বিপক্ষে ভোট দিলেও যেখানে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ধোপা-নাপিত-পুকুর বন্ধ করে, তাতে সর্বার্থে নিজের চেয়ে বলবত্তর মানুষকে বিদ্বেষ করাটা এখনও মূর্খতাই বটে–চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।

মহামতি বিদুর যদি আজকের দিনে ভারতবর্ষের যে-কোনো প্রদেশে যে-কোনো সরকারি দপ্তরে যেতেন, তাহলে সরকারের পলিসি-মেকার’ থেকে আরম্ভ করে করণিক, দপ্তরি, পিয়ন পর্যন্ত সকলকেই মূর্খ বলতেন। বিদুর বলেছেন–যে কাজটা সংক্ষেপে করা যায়, সেই কাজটাই যদি লোক বিস্তৃতভাবে করে, তবে তাকে তো মূর্খ বলতে হবেই; তা ছাড়াও যে। লোক সব সময়েই সন্দেহ করছে এবং যে কাজটা তাড়াতাড়ি করা যায়, সেটাকে যদি কেউ অযথা বিলম্বিত করে দেয়, তবে তাকে মুখ বলতে হবে–চিরং করোতি ক্ষিপ্রার্থে স মূঢ়ো ভরতষভ। বিদুর তো জানতেন না যে, সংক্ষিপ্ত কর্ম বিস্তৃত করা, সন্দেহ করা অথবা ক্ষিপ্র করণীয়কে বিলম্বিত করার আরও গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে। আজকের দিনের সদা-চালাকির বুদ্ধিতে আপনারা অবশ্য বিদুরকেই মূর্খ ভাববেন, কিন্তু বিদুর যে আজকের দিনের রাজনীতি এবং ব্যক্তিচরিত্রও খুব ভালো বুঝতেন, সেটা ধরা পড়ে তার চাঁছাছোলা কথায়। বিদুর বলেছেন–যে মানুষটা নিজেই যে দোষে দুষ্ট, সেই মানুষ যদি সেই দোষ দিয়েই পরের নিন্দা করে–পরং ক্ষিপতি দোষেণ বর্তমানঃ স্বয়ং তথা–তবে তার চেয়ে মূর্খ আর কেউ নেই। বিদুর প্রাচীন মানুষ, তিনি জানেন না, আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটি মূখামি নয়, এটাই বড়ো গুণ। ম্যানেজমেন্ট মিটিং অথবা রাজনৈতিক মিটিং-বড়ো ব্যক্তি, বড়ো নেতা নিজেই যে দোষে দোষী, তিনি সেই দোষ দিয়েই অন্যতরের নিন্দা করেন।

মহাভারত অবশ্য সাধারণ মানুষের নাচার অবস্থাটা বোঝে এবং সেই কারণেই উপদেশ দিয়ে বলেছে–যার ওপরে তোমার রাগ করার ক্ষমতাই নেই বাপু, তার ওপরে রাগও করতে যেয়ো না, তাকে শাসনও করতে যেয়ো না, সেটা মূর্খামি হবে–অশিষ্যংশাস্তি যে রাজন্…তমাহুমূঢ়চেতসম্। এখানে ক্ষমতা’ কথাটা অবশ্যই শারীরিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অর্থে বুঝতে হবে। আবার এরই উলটো দিকে বিদুর বলেছেন–যাদের শাসন করা উচিত যারা শাসনের যোগ্য তাদের যদি শাসন না করো, তবে সেটাও পরম মূখামিযশ্চ শিষ্যং ন শাস্তি চ। আধুনিক কালে বিদুরের এই কথার গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদ আছে সুকুমার রায়ের ছড়ায়–কাউকে বেশি লাই দিতে নেই অমনি চড়ে মাথায়। বস্তুত আধুনিক কালের প্রগতিশীলতা এবং শ্রম-সমন্বয়ের ভাবনায় নিম্নবর্গের কর্মচারী থেকে করণিক, শিক্ষক, অধ্যাপক–সকল ক্ষেত্রেই অনেক স্বাধীনতা, অনেক শিথিলতা ছিল। ফলত শুধু নিম্নবর্গের কর্মচারী নয়, উচ্চস্তরের কর্মচারীরাও–যারা পূর্বে শাসনের যোগ্য ছিলেন, এখন তারা সব রকম শাসনের বাইরে। ফলত পিতৃ-পিতামহের পাপের দায় বহন করছেন এখনকার প্রজন্ম, যাঁরা অগ্রজদের উদ্দেশে গালাগালি দিতে না পেরেশাসক নেতাদের গালাগালি দিয়ে বলবেন–শাসনের যোগ্য মানুষকে তোমরা শাসন করোনি, তোমরাও মূর্খ।

মহাভারতে বিদুর মূর্খ সম্বন্ধে যত কথা বলেছেন, তাতে এ কথা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, লেখাপড়া না-জানা নিরক্ষর মানুষ মূর্খের সংজ্ঞার মধ্যেই আসেন না। বরঞ্চ মহাভারত তাদেরই মূর্খ বলতে চায়–যাঁরা লেখাপড়া করেছেন এবং স্বল্পবিদ্যাতেই যাঁদের মধ্যে ভয়ংকরী শক্তি জন্মেছে।

প্রাচীন ব্যক্তিরা বলেছেন, পেটে বিদ্যে না থাকা সত্ত্বেও যদি নিজেকে পণ্ডিত বলে জাহির করতে চাও, যদি কবি-সাহিত্যিক হিসেবে নামও কিনতে চাওযদ্যভ্যর্থয়সে শুতেন রহিতঃ পাণ্ডিত্যমাণ্ডুং বলাৎ–তাহলে তার একটা ভালো এবং সহজ উপায় আছে বলি–তুমি অতিপ্রসিদ্ধ স্মরণীয় ব্যক্তিদের ধরে-ধরে গালাগাল দাও আগে। যেমন ধরো-ব্যাস-বাল্মীকি এই সব মহাকবিদের সম্পর্কে উলটোপালটা কথা বলে নিশ্চিন্তে গালাগাল করো–ব্যাসাদী কবি-পুঙ্গবান্ অনুচিতৈর্বাক্যৈঃ সলীলং ক্ষিপ। তারপর নিজের লেখা শ্লোক, কবিতা সোচ্চারে সবার সামনে সগর্বে পাঠ করো, কিন্তু চোখ বুজে পাঠ করো সেগুলো। অন্যেরা যেসব কাব্য-কবিতা লিখছে, সেগুলোর যথাসাধ্য নিন্দা করো বিনা প্ররোচনাতেই, আর সভা-সমিতিতে, বিদ্বৎসভায় বড়ো বড়ো পণ্ডিত মানুষের বিভিন্ন কথার প্রতিবাদ করে যাও নিরন্তর–কাব্যং ধিক্কুরু যৎ-পরৈ-বিরচিতং স্পর্ধস্ব সার্ধং বুধৈঃ–এইভাবে চললে সুস্থ বিদ্যা না থাকলেও খুব তাড়াতাড়ি পাণ্ডিত্য লাভ করা যায়।

“নতুন কিছু করো দাদা নতুন কিছু করো। যদি কিছু না পারো তো বউকে ধরে মারো।” প্রাচীনেরা বলেছেন–যেভাবে তোক যদি প্রসিদ্ধ পুরুষ হতে চাও তবে নতুন কিছু তোমায় করতেই হবে। হয় তুমি বাড়িতে মাঝে-মাঝেই বাসনপত্র মাটিতে ফেলে ভাঙো, নয়তো কাপড়-জামা ঘেঁড়ো কুচিকুচি করে, অথবা এমনও করতে পারো রাস্তায় গাধার পিঠে চড়ে যাতায়াত শুরু করো। এইরকম নতুন নতুন কাজ করলে তুমি খ্যাতিমান পুরুষ হবে–যেন কেপায়েন প্রসিদ্ধঃ পুরুষো ভবেৎ। তবে এ তো গেল সাধারণ মানুষের সাধারণ উপায়ে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠা। ভয়ংকরী অল্পবিদ্যা পেটে নিয়ে বড়ো হয়ে ওঠার উপায় বলেছেন অন্য এক প্রাচীন কবি। বলেছেন–কিছু কিছু লোক আছেন, যাঁরা সভাস্থলে, বিদ্বৎসভায় অনেক বিবাদ করেন, কেননা অন্যের যশের কথা শুনলেই তাদের মাথা ধরে–যে সংসৎসু বিবাদিনঃ পরযশঃশূলেন শল্যাকুলাঃ। সাপের মাথার মণির একটা মিথ ব্যবহার করে কবি বোঝাতে চেয়েছেন–এঁদের কিন্তু একটা আলগা চটক আছে, চোখটায় সব সময়ই যেন একটা রাগ-রাগ ভাব, পণ্ডিত-সজ্জনের গুণ এঁরা অসাধারণ দক্ষতায় নিরাবরণ করে দিতে পারেন, অথবা আচ্ছাদন করতে পারেন আত্মস্তুতির গরিমায়–কুন্তি স্বগুণস্তবেন গুণিনাং যত্ন গুণাচ্ছাদন। কবি মনে করেন এই ধরনের বিদ্যা সাপের মাথার মণিটির মতো শুধু পরের উদ্বেগ সৃষ্টি করে, এটাকে বিদ্যা বলে না।

তবে কি এটা মূর্খতা? না, আপনি একে সোজাসুজি মূর্খামি বলতে পারবেন না, কারণ এর পেটে কিছু বিদ্যে আছে। প্রাচীনেরা এই বিদ্যেটাকে কী চোখে দেখেছেন, সেটা বোঝা যায় আর এক মহাকবির কথায়। আত্মস্তুতি এবং আত্মপ্রশংসার নানা কিসিম আছে এবং তাতে যে বুদ্ধিমান মানুষেরও মন ভোলানো যায়, সেটা আজকের দিনের অঙ্গ। কিন্তু পুরাতনকালে আত্মস্তুতি ব্যাপারটা ভীষণ রকমের দুগুণ এবং মূর্খামি মনে করা হত। সেই মহাকবি লিখেছেন–কেন যে মানুষ আত্মস্তুতি করে বুঝে পাই না। এতে নিজের সুখও হয় না, নতুন কোনো সৌভাগ্যও আসে না। এখানে কবির উপমাটি ভয়ংকর। তিনি বলেছেন–নিজেই নিজের স্তন-মর্দন করে কুলকামিনী স্ত্রী কোন্ সুখ পায়! তাতে সুখও নেই, সৌভাগ্যও নেই–যথৈব চ কুলস্ত্ৰীণাং স্বয়ং স্বকুচমর্দনে। আজকাল অবশ্য আত্মস্তুতি করে এই স্বমর্দন-সুখ অনেকেই লাভ করছেন।

পুরাতন কবি একে যতই মূর্খামি মনে করুন, আসলে এটা এখন বিদ্যা। চতুরতার বিদ্যা। বর্তমান কালচারে যদি নিজেকে উত্তরোত্তর উন্নতির দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে হয়, সঠিক বিদ্যে না থাকলেও যদি ওপরে উঠতে হয়, তাহলে গাইতে হবে, নিজের গুণ নিজে গাইতে হবে এমন ভাবেই, যার মধ্যে কথা, শব্দ কিছু নাও থাকতে পারে। নিজেকে জলে তৈলবিন্দুবৎ প্রসারিত করে মেলে ধরা–আমরা একেই আত্মস্তুতি বলতে চাই, অথচ প্রাচীন পণ্ডিতেরা এইরকম বিকীর্ণ আত্মপ্রশংসাকে রীতিমতো ঘৃণা করতেন। বলতেন–আত্মশক্তি না থাকলেই এই মূখামি করতে হয়। তাঁরা বলতেন–কাদের জন্য খেটে মরছি আমরা, কাদের শিক্ষা দিচ্ছি, আঁ! একদল হল উদ্ধত মানুষ, যারা পরের উন্নতি দেখলে নিজেরা পাগল হয়ে যায়–কতিচিদুদ্ধত-নির্ভর-মসরাঃ। আর একদল আছে তারা সব সময়েই নিজের এবং নিজের কথার প্রশংসা করে চলেছে–কতিচি আত্মবচঃস্তুতিশালিনঃ। আর আরেক দল তো আছে নিরক্ষর মূর্খ, তাদের কথা আর কী বলব। সত্যি বলতে কী, কাদের জন্য এত খেটে মরছি দিনরাত–তদিহ সম্প্রতি কং প্রতি মে শ্রমঃ!

নিরক্ষর মূর্খের সঙ্গে পরশ্রীকাতর উদ্ধত ব্যক্তি এবং আত্মশংসী মানুষটি এক নিশ্বাসে উচ্চারিত হলেও বুঝতে পারি–এদের তিন জনের চরিত্র একরকম নয়। নিরক্ষর মুখের মধ্যে চারিত্রিক দিক থেকে যদি কোনো গোঁয়ার্তুমি না থাকে, তবে তাকে যা বোঝানো যায়, তাই বোঝে–এটা হলে আমাদের দেশে কোনো রাজনৈতিক দূর্তেরা গদিতে বসতে পারতেন না। আর যদি গোঁয়ার্তুমি থাকে, তাহলে তাকে উপদেশ দিলে সে প্রচণ্ড খেপে যাবে এবং অবশেষে উচ্চতর, বলবত্তর তথা গোষ্ঠীবৃহত্তর মানুষের হাতে ধোপা-নাপিতসহ রসাতলে যাবে। এঁদের নিয়ে অবশ্য আমার চিন্তা নেই। কিন্তু কথঞ্চিৎ বিদ্যা এবং বেশির ভাগ অবিদ্যায় যিনি উদ্ধত হয়ে ওঠেন, তাঁকে সামাল দেবার কোনো উপায় কিছু নেই, যতক্ষণ সভায়, সমিতিতে বিদ্যাগোষ্ঠীতে যোগ্যতর ব্যক্তিত্বের প্রতি তিনি নিজের বিষোদগার করতে না পারছেন।

আসলে যোগ্যতরের ধীশক্তিকে পরাস্ত করার যে বৌদ্ধিক অক্ষমতা, তা থেকেই মাৎসর্য জন্মায় এবং সেই মাৎসর্যই ঔদ্ধত্যের রূপ নেয়। বুদ্ধিমান ব্যক্তি কোনো মৎসরী ব্যক্তির সঙ্গে তর্ক করে পারবেন না বলেই তাকে বুদ্ধি দেওয়া হয়েছে–তাকে সায় দিয়ে চলতে হবে। উদ্ধত মূর্খ মানুষকে যথাসম্ভব সায় দিয়ে চলতে-চলতে নিজের কথা বলা যায়–মূখং ছন্দানুবৃত্তা চ। মূর্খ অথচ উদ্ধত–এমন লোকের কাজই হল বিনা কারণে বিবাদ বাধানো। সভা-সমিতিতে মূল বক্তার বক্তব্য শোনার পর যদি কোনোভাবে প্রশ্নের সুযোগ থাকে, তবে এমন হতেই পারে যে বক্তা সময়াভাবে কতক খাঁটি কথা বলতে পারলেন না, অথবা যা বললেন, তার প্রসঙ্গান্তর অপেক্ষিত ছিল। সেখানে প্রশ্নও অনেক সুস্থিত হতে পারে। কিন্তু এমন প্রাগ্নিক আমি দেখেছি, যিনি অপ্রসঙ্গে, অপেক্ষায় এমন বিহ্বল প্রশ্ন করেন, যা শোনার পর বক্তা-বেচারা চেয়ারপারসনের চাদরের তলায় আশ্রয় খোঁজেন। আর মূল বক্তা যদি তখন উদ্ধত মূর্খের উত্তরে নিজের ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেন, তাহলে যা অবস্থা হতে পারে তার একটা নমুনা দিয়েছেন এক কবি। কবি বলেছেন–একটি বানর যদি হঠাৎ মদ্যপান করে বসে এবং তার পরে যদি বানরটিকে একটি কাকড়াবিছে কামড়ায়–মর্কটস্য সুরাপানং তস্য বৃশ্চিকদংশন–তার ওপরে যদি আমার মূল বক্তাটি তার প্রশ্নের উদ্ধত প্রত্যুত্তর দেন, তবে সেটা হবে সেই সুরাপীত, বৃশ্চিক-দষ্ট বানরের ওপর ভূতের আবেশ–এরপর যা ইচ্ছে তাই ঘটে যেতে পারে–যা তা ভবিষ্যতি।

আর বাকি রইলেন সেই অবিবেকী আত্মশংসী মানুষটি, নিজের কথা বলতে যাঁর গণ্ডদেশ স্ফীত হয়, পরের উৎকর্ষে যাঁর মাথা ধরে যায়, এমন মানুষকে সামলানো বড় কঠিন। দেখিয়ে-দেখিয়ে কাজ করা যার অভ্যেস, নিজের কথা বলে-বলে যাকে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়, উপযুক্ত এবং চোখ-কান-খোলা কর্তৃপক্ষই তাকে আপন ঔদাসীন্যে পর্যদস্ত করতে পারেন, না হলে এঁদেরই চিরকালীন বাজার। রাজসভায় এঁদের কদর, মন্ত্রীর কাছে এঁরাই তাড়াতাড়ি পৌঁছান, এবং এঁরাই কর্তৃপক্ষের নজর কাড়েন সবার আগে। তারপর যেদিন রাজার বোধোদয় হয়, মন্ত্রীর নজর পড়ে আরও উন্নততর আত্মশংসীর দিকে এবং কর্তৃপক্ষ যখন বোঝেন যে, তিনি কথা যত শুনেছেন, কাজ তত পাননি, তখনই আত্মশ্লাঘী মুখ মানুষের খানিক শিক্ষা হয়।

মুর্খের অনেক কিসিম শুনলাম, আরও অনেক কিসিম আছে, যা বলবার সময় আসবে পরে। অন্য কোনো অবসরে। আজকের এই মোহকলিল আত্মরতির দিনে বিদ্বান, বুদ্ধিমান হওয়াটাও খুব জটিলতা বলে মনে করি। বিশেষত পণ্ডিত-সজ্জনদের যত দেখছি, ততই আমার পুরাতন কালের কতিপয় বিষয়-রসিক অধ্যাপকদের ওপর শ্রদ্ধা আরও বাড়ছে। তাতে নিজেকেও যেমন ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে, অপরদেরও তাই। অবশ্য বিদ্যার প্রথমোন্মেষ যৌবনোদ্দীপ্ত বয়সে খানিকটা তাড়িয়ে নিয়ে যায় বটে, তাতে ঔদ্ধত্যও খানিকটা আসতে পারে আহার্য রূপসজ্জার মতো, কিন্তু প্রকৃত বিদ্যাই এই সময় তাকে আরও অভিনিবিষ্ট করে গভীর নির্জন বিদ্যারসে, তখন নিজেকেই একটা আস্ত মুখ ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। এক কবি লিখেছেন–আমি যখন খানিকটা পড়াশুনা করে বেশ তৃপ্ত হলাম, তখন নিজেকে মদমত্ত হাতির মতো মনে হত। আরও খানিকটা জানার পর নিজেকে প্রায় সর্বজ্ঞই মনে হত, মনে হত–আমি বুঝি সবাই জানি–তদা সর্বজ্ঞো’হস্মীতি-অভব অবলিপ্তং মম মনঃ। তারপর যখন বড়ো বড়ো পণ্ডিতের কাছে উপনিষগ্ন হলাম, বুঝতে পারলাম অনন্ত বিদ্যাচর্যার ব্যাপ্তি কত হতে পারে, তখন থেকে নিজেকেও মূর্খ ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না, গর্ব-অহঙ্কারের জ্বরটাও শরীর থেকে তদবধি নেমেছে–তদা মূখোশ্মীতি জ্বর ইব মদো মে ব্যপগতঃ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *