০৯. সার্কাডিয়ান ছন্দ

সার্কাডিয়ান ছন্দ

আজও লোকটাকে দেখলাম। রাস্তার উল্টো দিকে অচেনা ঝাঁকড়া গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকল লোকটা। একটানা। পায়ের ভর একবারও বদল করল না। এ থেকে বোঝা যায়, এ লোক কেমন প্রশিক্ষিত। C

লোকটার মধ্যে একটা অলস অন্যমনস্ক ভাব। একবারও আমার দোতলার জানালার দিকে তাকাল না। উল্টো দিকে খেলার মাঠে ছেলের দল ক্রিকেট খেলছে। সেদিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকল, যেন খেলা দেখছে।

চার ঘণ্টা পর লোকটা চলে গেল।

জানালার পর্দা সামান্য ফাঁক করে দেখি, তার জায়গায় আরেকটা লোক এসে দাঁড়িয়েছে। একই রকম উদাস ভঙ্গি। বুঝলাম, ডিউটি বদল। এরা এখন চব্বিশ ঘণ্টাই নজর রাখছে আমার ওপর। এরা টের পেয়ে গেছে, আমি মরিয়া হয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছি। কীভাবে টের পেয়েছে, আমি জানি না।

বাইরে বাইরে আমি তো একই রকম নিরীহ ভাব বজায় রাখছি। প্রতিদিনের মতো মোড়ের দোকানটায় পাউরুটি আর মাখন কিনতে যাচ্ছি। পোষা কুকুরটাকে হটিয়ে আনছি। বিকেলবেলা। আর পেনশনের টাকা তুলতে মাসে একবার করে যাচ্ছি সদর রাস্তার ব্যাংকটাতে। আর তো কোথাও যাচ্ছি না। কারও সঙ্গে দেখা করছি না। আমার কাছেও কেউ আসছে না। কাউকে টেলিফোন করছি না। করতে চাইলেও লাভ নেই। ফোন তুললেই যেভাবে একটা খট করে আওয়াজ হয়, বুঝতে পারি, আড়ি পাতা হয়েছে।

ওরা অবশ্য আঁচ করতে পারছে, আমি সবকিছু লিখে রাখতে শুরু করেছি। কিন্তু কোথায় লিখে রাখছি, কীভাবে লিখছি, কিছুতেই বুঝতে পারছে না। আমি বাইরে বেরোলে ওরা সারা ঘর আঁতিপাঁতি করে তল্লাশি চালায়, আমার লেখার টেবিল, দেরাজ তছনছ করে, বিছানার তোশক, বালিশের তুলা বের করে ফেলে, কিন্তু কোথাও কিছু খুঁজে পায় না।

ওরা কিছুই খুঁজে পাবে না। কেননা আমি এমন এক অভিনব পদ্ধতি ব্যবহার করে লিখছি, যা ওদের পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব নয়। সবার চোখের সামনে আমি প্রতিদিন একটু একটু করে লিখে রাখছি আমার প্রতিবেদন। ওরা দেখছে, কিন্তু টের পাচ্ছে না। এই নিচ্ছিদ্র নজরদারির মধ্যেও কীভাবে বোকা বনছে ওরা, ভেবে আনন্দ পাচ্ছি। নিজেদের যত চালাক ভাবুক, ওরা তো বোকাই। নাহলে আমার ডাইনিং টেবিলে লবণ আর মরিচদানিগুলোর দিকে কেন ওরা একবারও সন্দেহের চোখে তাকাবে না? কেন বুঝতে পারবে না, প্রতিদিন ওগুলোর সজ্জা বদলের মধ্যে প্যাটার্ন লুকিয়ে আছে? টরে টক্কা, টরে টক্কা, টক্কা টরে টরে। মোর্স কোড! গর্দভেরা, এ অতি মামুলি মোর্স কোড। আদি অকৃত্রিম মোর্স কোড।

লবণদানি-মরিচদানি; লবণদানি-লবণদানি, মরিচদানি লবণদানি, মরিচদানি-মরিচদানি।

হা-হা-হা-হা।

আমার ক্যামেরায় প্রতিদিন একবার করে তুলে রাখছি আমার ডিনার করার ছবি। বিশেষ কায়দা করে সেলফি তুলছি, যাতে লবণদানি-মরিচদানিগুলো দেখা যায়, আবার সেগুলো ছবিতে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ফুটে না ওঠে। ছবিগুলো প্রিন্ট দিয়ে তারিখ লিখে সাজিয়ে রাখছি আমার ব্যক্তিগত অ্যালবামে।

ওরা সেই অ্যালবামের পাতায় চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকছে, ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ছবির সামনে-পেছনে যাচাই করে দেখছে, কোনো জলছাপ আছে কি না। তারপর হতাশ হয়ে রেখে দিচ্ছে।

আমি জানি, আমাকে বেশি দিন সময় দেওয়া হবে না। খুব শিগগিরই সেই বিশেষ দিনটি আসবে, যেদিন বিকেলে আমি আমার কুকুরটাকে নিয়ে হাঁটতে বেরোলে একটা সাদা মাইক্রোবাস আমাকে অনুসরণ করবে। রাস্তার নির্জন অংশে দুটি ল্যাম্পপোস্টের মাঝখানে ওরা মাইক্রোবাস থামাবে। তারপর দরজা খুলে দুজন লোক এসে আমাকে দুদিক থেকে ধরে ঝট করে টেনে তুলবে মাইক্রোবাসে। আমার কুকুরটা ভীষণ ঘেউঘেউ করতে থাকবে। কিছুক্ষণ ছুটবে সেটা মাইক্রোবাসটার পেছন পেছন। তারপর একসময় দাঁড়িয়ে পড়বে বড় রাস্তার মোড়ে। তাকিয়ে থাকবে অপসৃয়মাণ সাদা মাইক্রোবাসটার দিকে।

সেই বিকেলবেলা আসার আগেই আমি পুরোটা লিখে ফেলতে পারব আশা করছি। আমি জানি, আমি নিশ্চিতভাবে জানি, আমার অন্তর্ধানের খবর জানাজানি হওয়ার পর যে লোকগুলো এই বাসায় পা রাখবেন, তাঁদের মধ্যে ইস্যুরেন্স ক্লেইমের সেই তরুণ পরিদর্শকও থাকবেন, যার অনুসন্ধানী দৃষ্টির ওপর ভরসা করে আমি এত কিছু সাজিয়েছি। আমি জানি, ওই তরুণ পেশাদার পরিদর্শক আমার ব্যক্তিগত ছবির অ্যালবামটি হাতে তুলে নেবেন এবং সেটার পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে তাঁর ভ্রু কুঁচকে যাবে। একই লোকের প্রতিদিনের নৈশাহারের ছবি যত্নে সাজিয়ে রাখার মধ্যে তিনি মানসিক অসুস্থতার বাইরে আরও কিছুর গন্ধ খুঁজে পাবেন এবং এই অ্যালবামটি তিনি তাঁর কাছে রেখে দেওয়ার অনুমতি জোগাড় করে ফেলবেন পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কাছ থেকে। নিজ বাসায় পড়ার টেবিলে রাতের পর রাত তিনি আমার অ্যালবামের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকবেন–এটা আমি একপ্রকার নিশ্চিত। তারপর কোনো এক ভোররাতের দিকে যখন আমার পোষা কুকুরের ডাকাডাকির শব্দে তাঁর ঘুম ভেঙে যাবে, আর তিনি উঠে পড়ার টেবিলে বসে টেবিলবাতি জ্বালিয়ে আরেকবার অ্যালবামটায় চোখ বোলাতে শুরু করবেন, সেই মুহূর্তে ছবির ডাইনিং টেবিলের লবণদানি আর মরিচদানিগুলোর দিকে তাঁর চোখ আটকে যাবে।

এই সামান্য কয়েকটা দৈব ঘটনার শিকল আশা করা কি এতই বাতুলতা?

.

বাইরে কুকুরটা একটানা ডাকাডাকি করছে। আমি জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিলাম। লাইটপোস্টের আলোয় দেখি একটা কুকুর। আমারই জানালার দিকে তাকিয়ে ডাক ছাড়ছে।

অস্বাভাবিক আচরণ। কুকুরেরা সাধারণত এ রকম করে না। এই কুকুরটাকে চেনা চেনা লাগল। কয়েক দিন ধরে এ রকম ডেজা-ভ্য হচ্ছে। রাস্তাঘাটে এমন কিছু লোক দেখছি, যাদের আগেও দেখেছি বলে আবছা মনে পড়ছে। কিছু লোক যেন ঘুরে ঘুরে আসছে আমার চলার পথে।

আমাকে কি অনুসরণ করা হচ্ছে?

আমার যা পেশা, তাতে এ ধরনের অভিজ্ঞতা নতুন কিছু নয়। বহু লোকের বড় বড় অঙ্কের টাকাপয়সার ভাগ্য ঝুলে থাকে আমার সিদ্ধান্তের ওপর। পেশাটা ঝুঁকিপূর্ণ, এমন বলব না, তবে দুয়েকবার টেলিফোনে হুমকি যে পাইনি, তা তো নয়। কিন্তু এবার পুরো ব্যাপারটায় কী যেন একটা ঝামেলা আছে। চরাচরজুড়ে যেন একটা বিরাট ফিসফাস। কেউ যেন কিছু একটা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিছুই স্পষ্ট নয়। সবই ধোঁয়াশা।

এখন আর ঘুম আসবে না। টেবিলে এসে বসলাম। বাতি জ্বালোম। টেবিলে সেই ক্রোনোবায়োলজিস্টের অ্যালবামটা পড়ে আছে। এটা নিয়ে কয়েক দিন ধরে দারুণ কসরত করছি।

ভদ্রলোক হঠাৎ করে হারিয়ে গেছেন। এ রকম অন্তর্ধান নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে এই সময়। তবে প্রৌঢ় বয়স পেরিয়ে যাওয়া একটা নির্ঝঞ্ঝাট লোকের এই পরিণতি বরণ করার কথা নয়। শুরু থেকে কোথাও একটা ঘাপলার গন্ধ পাচ্ছি। অ্যালবামটা তো আরও সন্দেহজনক। একই টেবিলের একই অ্যাঙ্গেলের ছবি প্রতিদিন তুলেছেন ভদ্রলোক। এমনকি প্লেটের খাবারটা পর্যন্ত হুবহু এক। পেছনে দেয়ালঘড়িতেও একই সময় দেখা যাচ্ছে। রাত সাড়ে নয়টা। একটা লোক প্রতিদিন রাত সাড়ে নয়টায় হুবহু একই দৃশ্যের ছবি কেন….এক মিনিট! হুবহু একই দৃশ্য তো নয়। সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন আছে।

টেবিলের লবণদানিগুলো প্রতিটি ছবিতে আলাদাভাবে সাজানো। কেন? তা ছাড়া একটা ডাইনিং টেবিলে এত লবণদানি আর মরিচদানি থাকে নাকি? ব্যাপারটা কী?

.

চার দিনের চেষ্টায় পুরো সংকেতটা পাঠোদ্ধার করা গেল। সেটার জন্য অবশ্য ধন্যবাদ দিতে হবে আমার হ্যাম রেডিও স্টেশনের বন্ধুকে।

হ্যাম রেডিও হচ্ছে একধরনের শৌখিন রেডিও স্টেশন। এগুলো যারা চালায়, মোর্স কোডের ওপর তাদের একটা দখল থাকে। বাতিল হয়ে যাওয়া একটা সংকেতলিপি যে আজও এভাবে টিকে আছে, সেটা জানা ছিল না।

ক্রোনোবায়োলজিস্টের বুদ্ধির তারিফ না করে পারা যায় না। ভদ্রলোক বার্তা পাঠাতে যে কৌশল অবলম্বন করেছেন, সেটা বড়জোর ঠান্ডাযুদ্ধের যুগের গুপ্তচরদের মাথায় আসতে পারে, কোনো বিজ্ঞানীর মাথায় নয়। এত ঢাক-ঢাক গুড়-গুড়ের কারণ এখন অনুমান করা যাচ্ছে। তার অন্তর্ধান আর আমার চারপাশে রাস্তাঘাটে কয়েকটা আধচেনা লোকের বারবার ফিরে আসা থেকে সেটা পরিষ্কার।

গুপ্তসংকেত ভেঙে যে বার্তা পাওয়া গেল, তা পড়ে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়লাম। কী জানতে পেরেছি, সেটাই এবার লিখে রাখছি। এটাও মোর্স কোডে। তবে একই পদ্ধতি নয়। আমাকে আরেকটা অভিনব পদ্ধতি বের করে নিতে হয়েছে। লাইব্রেরির সব বই আমি বাঁধাই করে নিয়েছি সাদা আর কালো মলাট দিয়ে। তারপর শেলফে বইগুলো সাজিয়ে রাখছি মোর্স কোড মেনে। আমার এই বার্তা ভবিষ্যতের অজানা কোনো বুদ্ধিমান পাঠকের উদ্দেশে।

.

ক্রোনোবায়োলজিস্টের বক্তব্যের কেন্দ্রে আছে সার্কাডিয়ান রিদম। এই জিনিসটা কী, শুরুতেই তা তিনি সরল ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

সার্কাডিয়ান রিদম হলো এই পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর, প্রতিটি জীবের দেহে ক্রিয়াশীল এক অদৃশ্য ছন্দ। একটা জীবদৈহিক ঘড়ি যেন সবার মধ্যে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই ঘড়ির বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। ২৪ ঘণ্টার একটা অমোঘ পেন্ডুলাম দুলছে সবার ভেতরে। শুধু মানুষ আর স্তন্যপায়ী প্রাণী নয়, একই ছন্দে দুলছে গাছপালা, সমুদ্রের মাছ, এমনকি ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া পর্যন্ত।

এই ছন্দ যে শুধু ঘুম আর জাগরণের চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে, তা-ই নয়, এই ছন্দ মেনে বৃক্ষ ডালপালা মেলছে, বহুঁকোষী জটিল প্রাণীর দেহে হরমোনের সংকেত ছুটছে কোষ থেকে কোষে।

কিন্তু ছন্দটা ঠিক ২৪ ঘণ্টার ঘড়িতেই বাধা কেন? কারণ, পৃথিবী নিজের চারপাশে একবার পাক খেতে ২৪ ঘন্টা সময় নেয়। দিন-রাতের পালাবদলের এই ছন্দই বহু কোটি বছর ধরে একটু একটু করে জীবদেহে ঢুকে পড়েছে।

বিজ্ঞানীরা প্রথম প্রথম ভাবতেন, এই ছন্দের পেছনে বোধ হয় দিনের আলো আর রাতের অন্ধকারের কোনো যোগ আছে। কিন্তু নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, ব্যাপারটার সঙ্গে আলোর ওঠানামার সরাসরি যোগ নেই। কিছু প্রাণীকে মাটির কয়েক শ ফুট গভীরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিনের পর দিন রেখে দেওয়া হয়েছে, যেখানে আলোর সামান্য রেশও প্রবেশ করতে পারে না। তবু তাদের মধ্যে সেই একই সার্কাডিয়ান রিদম সচল পাওয়া গেছে। যাবতীয় কায়দা-কানুন করেও এই ঘড়ি বন্ধ করা যায়নি। এই ছন্দ মুছে ফেলার কোনো উপায় নেই। তার মানে ঘড়িটা জীবনের আরও গভীরে কোথাও প্রোথিত। হয়তো জীবদেহের ডিএনএ কাঠামোর মধ্যে সেটা গেঁথে দেওয়া আছে।

সার্কাডিয়ান রিদমের এই জ্ঞান সবার আগে লুফে নিয়েছে ওষুধ কোম্পানিগুলো। কেননা মানবদেহে ওষুধ সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করে, যদি সার্কাডিয়ান রিদমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওষুধ প্রয়োগ করা যায়। এ কারণে সার্কাডিয়ান রিদম নিয়ে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় ওষুধ কোম্পানিগুলোর গবেষণাগারে।

আমাদের এই ক্রোনোবায়োলজিস্টও সে রকমই এক গবেষণাগারে কাজ করতেন। তবে সেটা ছিল সরকারি ওষুধ কোম্পানির গবেষণাগার। আর তিনি যুক্ত ছিলেন এক বিশেষ ধরনের গবেষণায়। তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল সার্কাডিয়ান স্লিপ ডিজর্ডার।

সেটা আবার কী?

কারও কারও দেহে সার্কাডিয়ান রিদমের এই ছন্দ কিছুটা গড়বড় হয়ে যায়। আর সেটা সবার আগে প্রকাশ পায় তাদের ঘুমের চক্রে। এই চক্র এলোমেলো হয়ে যায়। সার্কাডিয়ান স্লিপ ডিজর্ডারের রোগী অসময়ে ঘুমান, আর অসময়ে জেগে থাকেন। ক্রোনোবায়োলজিস্টরা লক্ষ করলেন, যাদের ক্ষেত্রে এ রকম স্লিপ ডিজর্ডার হয়, তাদের জীবনযাত্রার ধরনে কিছু মিল আছে। এদের বেশির ভাগই বিজনেস এক্সিকিউটিভ। এবং প্রায় সবাই ঘন ঘন বিমানযাত্রায় অভ্যস্ত। গবেষণার একপর্যায়ে আমাদের ক্রোনোবায়োলজিস্ট একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করলেন। তিনি দেখলেন, শুধু ঘন ঘন বিমানযাত্রা করলেই হবে না, বিমানযাত্রার একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন অনুসরণ করলেই কেবল এই ডিজর্ডার দেখা দেবে। সব রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ক্রোনোবায়োলজিস্ট নিশ্চিত হলেন, বিমানযাত্রার এ রকম কেবল একটিই প্যাটার্ন সম্ভব। সেই অশুভ প্যাটার্ন বা পথটি অত্যন্ত জটিল আর শর্তযুক্ত। যেমন ২৩ ডিগ্রি অক্ষাংশ ও ১৭০ ডিগ্রি দ্রাঘিমা থেকে প্রথমে বিমানে চেপে পশ্চিমে ৭৮ ডিগ্রি অক্ষাংশে যেতে হবে। এই যাত্রায় মাত্র ২ ডিগ্রি দ্রাঘিমা বিচ্যুতি থাকা যাবে। তারপর সেখানে দুই দিন অবস্থানের পর (অবস্থানের দৈর্ঘ্য বেশি বা কম হলে চলবে না) বিমানে চেপে পুব দিকে সরে যেতে হবে ৪৪ ডিগ্রি অক্ষাংশ ও ৭৮ ডিগ্রি দ্রাঘিমায়। এভাবে অন্তত ৩৫টি সুনির্দিষ্ট যাত্রাপথ ও গন্তব্য পেরোলে ৭৭ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে সার্কাডিয়ান স্লিপ ডিজর্ডার দেখা দেওয়ার। মানচিত্রে আঁকলে এই যাত্রাপথটি এমন জটিল হিজিবিজি দেখায়, কোনো মাথামুণ্ডু পাওয়া যায় না।

এই গবেষণা চলার সময় আমাদের ক্রোনোবায়োলজিস্ট গোপনে আরেক ধরনের পরীক্ষা চালালেন। তিনি দেখলেন, এই বিশেষ যাত্রাপথ অনুসরণ করার কারণে শুধু যে মানুষের সার্কাডিয়ান রিদমের তাল-লয় কেটে যাচ্ছে, তা নয়, একই প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে মানুষের অন্ত্রে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী কৃমিকুলে। এমনকি অন্ত্রে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসগুলোরও ছন্দে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এভাবে এগোতে গিয়ে ক্রোনোবায়োলজিস্টের মাথায় একটা বিশেষ চিন্তা উঁকি দিতে শুরু করে, সার্কাডিয়ান রিদম তাহলে অমোঘ নয়। এটা ভেঙে ফেলা সম্ভব।

শুরু হয় সার্কাডিয়ান রিদম নিয়ে আরেক ধরনের গবেষণা। আর সেটা গোপনে। আমাদের ক্রোনোবায়োলজিস্ট এই নতুন। গবেষণা চালাতে শুরু করেন পুরোনো গবেষণার সমান্তরালে। সার্কাডিয়ান রিদম মুছে ফেলার বিকল্প পদ্ধতি খুঁজতে থাকেন তিনি। বিমানযাত্রার মতো অত জটিল পথ অনুসরণ নয়। আরও সরল কোনো উপায়। সেটা তিনি পেয়েও যান একসময়। তারপর মানুষ থেকে শুরু করে নানা পশুপাখির সার্কাডিয়ান রিদম মুছে দিতে থাকেন তিনি। আর সেটা করতে গিয়ে নতুন আরেকটা ব্যাপার তার চোখে পড়ে। তিনি লক্ষ করেন, সার্কাডিয়ান ছন্দ মুছে ফেলা মানেই এক ছন্দহীন বিশৃঙ্খলা নয়। বরং প্রাণিদেহে তখন ধীরে ধীরে আরেক ধরনের ছন্দ উঁকি দেয়। সেটা আরেকটু বৃহৎ পরিসরের সার্কাডিয়ান ছন্দ। কিন্তু সেটার চলন-বলন ভিন্ন। আর সেটার ফ্রিকোয়েন্সি বা ছন্দের বিস্তারকাল ২৭ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট। সবার ক্ষেত্রে। এ যেন সব জীবের মধ্যে লুকিয়ে রাখা আদি ছন্দ। কেন? ঠিক ২৭ ঘণ্টা ৩৬ মিনিটই কেন? এর চেয়ে বেশি বা কম কেন নয়?

ক্রোনোবায়োলজিস্টের মনে হলো, তিনি যেন রক অ্যান্ড রোলের আড়ালে লুকানো কোনো জ্যাজসংগীত খুঁজে পেয়েছেন।

এই নতুন সার্কাডিয়ান ছন্দের উৎস নিয়ে গবেষণায় আমাদের ক্রোনোবায়োলজিস্ট এতই নিবিষ্ট ছিলেন যে তাঁর চারপাশে অপরিচিত কিছু লোকের আনাগোনা তিনি লক্ষই করলেন না। নিজের গবেষণা নিয়ে তিনি যদি অত বেশি মত্ত না থাকতেন, তাহলে অবশ্যই তার চোখে পড়ত, মধ্যরাতে গবেষণাগার থেকে বেরিয়ে হেঁটে মেট্রো স্টেশনে যাওয়ার পথে কয়েকজন লোক নিয়মিত তার পিছু নিচ্ছে। এমনকি মেট্রোর কামরা ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও তারা ঠিক তার চারপাশ ঘেঁষে বসছে।

নতুন গবেষণা শুরুর দ্বিতীয় সপ্তাহে ক্রোনোবায়োলজিস্টের চাকরি চলে গেল। গবেষণাগারের পরিচালক তাঁর হাতে সাদা খাম ধরিয়ে দিলেন। তার অপরাধ কী, সেটার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হলো না। চিঠি হাতে তিনি বেশ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে পঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর গবেষণাগার থেকে বেরিয়ে শহরের কেন্দ্রীয় পার্কে একটা চেরিগাছের নিচে বেঞ্চে বসে থাকলেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত। স্ট্রিটলাইটগুলো জ্বলে উঠলে তিনি হেঁটে বাসায় ফিরলেন। সদর দরজায় চাবি ঘোরানোর সময় প্রথমবারের মতো তার খটকা লাগল। তিনি ফিরে তাকালেন এবং রাস্তার উল্টো দিকে ফুটপাতে একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। পরের কয়েকটা দিন আরও কিছু খোঁজখবরের পর তিনি নিশ্চিত হলেন, তাঁর জীবনের এই আকস্মিক ট্র্যাজেডির পেছনে সার্কাডিয়ান

রিদমসংক্রান্ত গবেষণার যোগ আছে। এই গবেষণা বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই যে তার চাকরি খেয়ে ফেলা হয়েছে, এটা বুঝে যাওয়ার পর তিনি আঁচ করতে শুরু করলেন, তার চারপাশে কোথাও গভীর একটা ষড়যন্ত্র পাক খেয়ে উঠছে।

কেন? কেন? কেন?

একই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকল তার মাথায়।

প্রাণিদেহে ২৪ ঘণ্টার সার্কাডিয়ান ছন্দের তলায় ২৭ ঘণ্টা ৩৬ মিনিটের আরেকটি ছন্দ লুকানো আছে, এই নিরীহ সত্য ধামাচাপা দেওয়ার পেছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? কেন এই তথ্য বিপজ্জনক?

চাকরি যাওয়ার ১৭ বছর পর একদিন দুপুরবেলা ক্রোনোবায়োলজিস্ট তাঁর ইউরেকা মুহূর্তটি পেয়ে গেলেন। তিনি তখন পোষা কুকুরকে শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করিয়ে রোদে বসিয়ে রেখে পাশে মোড়ায় বসে তার কাছে আসা বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিনগুলোর পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছিলেন। একটি ম্যাগাজিনের ৪৮ নম্বর পৃষ্ঠায় একটা ছোট্ট আবিষ্কারের খবরের ওপর তার চোখ আটকে গেল। আমাদের গ্যালাক্সির উল্টো প্রান্তে প্রায় সাত হাজার আলোকবর্ষ দূরে এমন একটি গ্রহ পাওয়া গেছে, যে গ্রহের আহ্নিক গতি ২৭ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট। মানে গ্রহটা ঠিক ২৭ ঘণ্টা ৩৬ মিনিটে নিজের চারপাশে একবার পাক খায়।

এ দিয়ে হয়তো বিশেষ কিছুই বোঝায় না। একটা বিদঘুঁটে অনুমান আর সামান্য কিছ দৈব মিলের ওপর ভর করে কিছই দাঁড় করানো সম্ভব নয়। কিন্তু পত্রিকার পাতায় শিল্পীর তুলিতে আঁকা ওই গ্রহটির কাল্পনিক ল্যান্ডস্কেপের দিকে মায়াময় চোখে তাকিয়ে থাকলেন আমাদের ক্রোনোবায়োলজিস্ট।

জীবনসায়াহ্নে নিজেদের ফেলে আসা ভূমির ছবির দিকে এভাবেই তাকিয়ে থাকেন শরণার্থীরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *