০৬. দ্বিখণ্ডিত

দ্বিখণ্ডিত

আমি পরপর কয়েকটি ঘটনা বলব। একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কহীন মনে হতে পারে। তবু একটু ধৈর্য ধরে শুনবেন, প্লিজ। শুনলে এগুলোর মধ্যে একটা যোগসূত্র খুঁজে পেতে পারেন। পাবেনই। আর শেষে আমি আপনাকে বলব, কেন এখানে এসেছি।

হিলারি স্টেপস কী জিনিস জানেন? জানার কথা নয়। এভারেস্ট শৃঙ্গের ঠিক আগে আগে একটা বিরাট পাথরের চাঙড়। ১২ মিটার উঁচু খাড়া একটা দেয়ালের মতো। ধরুন জেলখানার দেয়াল কত উঁচু হয়? চৌদ্দ-পনেরো ফুট হবে। সেটাই কী দুর্লঙ্ঘ্য লাগে! আর এ তো পাক্কা ১২ মিটার! যারা এভারেস্টে চড়েন, পর্বতারোহীরা, তাঁদের চোখে এটা হলো সর্বশেষ বড় চ্যালেঞ্জ। সাড়ে আট হাজার মিটারের ওপরে, অত উঁচুতে, একটা দৈব নিষেধ যেন দাঁড়িয়ে আছে–বলছে, এসো না, উঠো না। কাব্য করছি না। বইপত্রে পড়ুন, এটার কথা বলা আছে, হিলারি স্টেপসের কথা। ওইটা পার হতে বিরাট কসরত। অনেকে ওখান থেকে ফিরে আসে। কী আফসোেস দেখুন! এভারেস্টের মাত্র ৫৮ মিটার নিচ থেকে ফিরে আসা। স্বর্গের দরজায় কড়া নেড়ে ফিরে আসা আরকি।

গত সপ্তাহে পত্রিকায় একটা খবর এসেছে, আপনার চোখে পড়ার কথা। টিম মোসেডেল নামে এক ব্রিটিশ পর্বতারোহী এভারেস্ট থেকে নেমে এসে প্রেস কনফারেন্স করে বললেন, হিলারি স্টেপস আর নেই। নেই মানে, যাওয়া-আসার পথে তিনি পাথরটা দেখতে পাননি। কোথায় গেল? সম্ভবত ধসে পড়েছে। দু বছর আগে নেপালে একটা ভয়ানক ভূমিকম্প হয়েছিল, আপনার মনে থাকার কথা। মোসেডেলের অনুমান, সেটার ঝাঁকিতে পড়ে গিয়ে থাকবে পাথরটা। হতেই পারে। এ রকম ভূকম্পনের আঁকাআঁকিতে কত কিছুই তো অদলবদল ঘটে। স্বয়ং হিমালয় পর্বতখানাই তো উঠে এসেছে এমন এক তুলাধোনা ঝাঁকুনিতে।

তো, হিলারি স্টেপস নেই, ভালো কথা। না থাকলে সমস্যা তো নেই। যারা এভারেস্টে চড়বেন, তাঁদের জন্য সুসংবাদ। কিন্তু গোল বাধল এর দুদিন পরে। অং শেরিং নামে এক শেরপা কাঠমান্ডুতে পাল্টা প্রেস কনফারেন্স করে বললেন, হিলারি স্টেপস ওখানেই আছে। বহাল তবিয়তে। অং শেরিং নিজে সেটা দেখেছেন। শুধু শেরিং নন, আরও অনেক শেরপাই দেখেছেন। মোসেডেলের আগে-পরে যারা এভারেস্টে উঠেছেন, তাঁরা সবাই সেটা দেখেছেন। এখনো দেখছেন।

তাহলে ঝামেলাটা কোথায়? অং শেরিং বললেন, মোসেডেলের দৃষ্টিবিভ্রম হয়েছে। অতিরিক্ত তুষারে পাথরটা হয়তো এমনভাবে ঢাকা পড়ে গেছে, চোখে দেখা যায় না। কিন্তু দেখা যাক না-যাক, পাথরটা আছে। তার জায়গাতেই আছে। সরে তো যায়ইনি, একটু টালও খায়নি। যারা এভারেস্টে চড়ছেন, তাদের আগের মতোই কষ্ট করে পাথরটা ডিঙাতে হচ্ছে।

ব্যাপারটা এখানেই মিটে যাওয়ার কথা। শেরপারা যুগ যুগ ধরে এই পথ বেয়ে উঠছেন, নামছেন। জায়গাটা তাদের হাতের তালুর মতো চেনাজানা। তারা যেটা বলবেন, সেটাই ধ্রুব সত্য। কিন্তু সমস্যা হয়েছে কী, মোসেডেলও ফেলনা কেউ নন। এ নিয়ে ষষ্ঠবার এভারেস্টে চড়েছেন তিনি। এই পথ তারও কম চেনা নয়। হিলারি স্টেপসের মতো অত বড় একটা পাথরখণ্ড থাকার পরও সেটাকে নেই ভাবার মতো আনাড়ি তিনি নন। আর তা ছাড়া মোসেডেল খাঁটি ব্রিটিশ চিজ। তিনি জায়গাটার একটা ছবিও তুলে এনেছেন। তাতে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, পাথরটা নেই। চার বছর আগে পঞ্চমবার যখন এভারেস্টে চড়েছিলেন, তখনকার ছবিও দেখালেন মোসেডেল। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে একই অ্যাঙ্গেলে ভোলা ছবি। তাতে দেখা যাচ্ছে পাথরটা আছে। তার মানে মধ্যবর্তী কোনো এক সময় তা নেই হয়ে গেছে। সেটা ২০১৫ সালের ভূমিকম্পের সময় ঘটেছে বলে অনুমান করলে খুব বেশি কষ্টকল্পনা মনে হয় কি?

এদিকে শেরপা অং শেরিংই বা ছাড়বেন কেন। ছবি তিনিও বের করলেন। একই জায়গার ছবি। একই অ্যাঙ্গেলে। সেখানে পাথরটা আছে।

ব্যাপার তো খুবই জটিল হয়ে গেল। একটা পাথর আছে, আবার নেই। কিংবা একজনের জন্য তাঁছে, আরেকজনের জন্য নেই। এই প্যাঁচ খুলবে কে?

আপনি শুনছেন তো? বিরক্ত লাগছে না তো? এবার তাহলে আরেকটা ঘটনা বলি। একটু অতীতের।

১৯৪৭ সালের জুলাই মাসের ঘটনা। ঘটনা বলা ঠিক হচ্ছে। আসলে একটা ছবি। ছবিটাই ঘটনা। একটা আলোকচিত্র। ছবিটা আমি পকেটে করে এনেছি। একটা পেপার কাটিং। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে কাটিং করেছি। ঢাকায় আনন্দবাজার একটা জায়গাতেই পাওয়া যায়। ধানমন্ডি দুইয়ে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারে। সেখানে রিডিং টেবিলে বসে কাঁচি দিয়ে কেটে পকেটে ভরেছি। কেউ দেখেনি।

এই যে ছবিটা আপনার টেবিলে বিছিয়ে দিলাম। একটু দেখুন। কী দেখছেন? একটা লোক বসে আছে। তার চারপাশে বইপত্রের স্থপ। লোকটার নাম কেশবন। বি এস কেশবন। দক্ষিণ ভারতের লোক। বোঝাই যাচ্ছে জায়গাটা একটা লাইব্রেরি। গ্রন্থাগার। আর কেশবন এটার লাইব্রেরিয়ান। কেশবন ভারতের প্রথম জাতীয় গ্রন্থাগারিক। ছবিতে তাঁকে গালে একটা হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। একটু যেন বিমর্ষ। চারপাশের স্তূপ করে রাখা বইগুলো তিনি দুই ভাগে ভাগ করছেন। কেন ভাগ করছেন? কারণ দেশ ভাগ হচ্ছে। তারিখটা লক্ষ করুন। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাস। এক মাস পরেই ইংরেজরা চলে যাবে। সবকিছু পাকাপাকি হয়ে গেছে। ভারত উপনিবেশ ভাগের প্রস্তুতি চলছে। যেখানে যা কিছু আছে, দুই ভাগ। হিসাব-কিতাব চলছে। কেশবন তার লাইব্রেরির বইপত্রও দুই ভাগ করছেন। ছবিতে দেখুন, এক পাশের বইয়ের ওপর প্ল্যাকার্ডে রোমান হরফে লেখা। ‘পাকিস্তান’। আরেক ভাগে ইন্ডিয়া।

ছবিটা তুলেছেন ডেভিড ডগলাস ডানকান নামে এক ব্রিটিশ সাংবাদিক। ১৯৪৭ সালের ১৮ আগস্ট আমেরিকার লাইফ ম্যাগাজিনে প্রথম ছাপা হয় এটা। পঞ্চাশ বছর পর ১৯৯৭ সালের আগস্টে টাইম ম্যাগাজিনে আবার ছাপা হয় এই ছবি। একেবারে প্রচ্ছদে। ভারত ভাগের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে তারা প্রচ্ছদ কাহিনি করেছিল। আগে-পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ছবিটা ছাপা হয়েছে।

দেশভাগের গ্রাউন্ড রিয়েলিটি ফুটে উঠেছে সামান্য একটা ছবিতে। বিখ্যাত ছবি। আইকনিক ছবি। কিন্তু ছবিটা খুবই কনফিউজিং। রহস্য দেখা দিয়েছে ছবিটার লোকেশন নিয়ে। কেশবন লাইব্রেরির বই ভাগ করছেন। কিন্তু কোন লাইব্রেরির বই?

লাইফ ম্যাগাজিনসহ প্রথম দিককার পত্রপত্রিকায় লেখা হলো, জায়গাটা দিল্লির ইমপেরিয়াল সেক্রেটারিয়েট লাইব্রেরি। কেশবন সেটারই লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন বাদে নব্বইয়ের দশকের পর থেকে কলকাতার ম্যাগাজিনগুলো দাবি করতে শুরু করল, জায়গাটা আসলে কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি। কেশবন ওই সময় নাকি ছিলেন ওই লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান। নানান তথ্য-প্রমাণ দিয়ে এই দাবি তোলা হলো। সেসব তথ্যপ্রমাণ এত অকাট্য, অস্বীকার করার জো নেই। এই যে আমি আনন্দবাজার থেকে কেটে এনেছি যে ছবিটা, সেটার ক্যাপশনেও দেখুন একই কথা দাবি করা হয়েছে।

তাহলে একটা ছবি। একটা ঘটনা। কিন্তু সেটার লোকেশন দুটা। প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব। অথচ একটা দৃশ্যের তো একটাই লোকেশন হবে, তা-ই না? দুটো লোকেশন তো হতে পারে না।

এই ছবির রহস্য ভেদ করতে নেমেছিলেন আনহাদ হুনদাল নামে এক ভারতীয় সাংবাদিক। ছবিটা নিয়ে নানান জনের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে শুরু করেন তিনি। এঁকে দেখান, তাঁকে দেখান। কেউ কিছু জানেন কিনা, জিজ্ঞেস করেন। এভাবে একদিন তিনি গেলেন অন্বেষা সেনগুপ্ত নামে এক মহিলার কাছে। অন্বেষা দেশভাগ-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। ছবি দেখে অন্বেষা বললেন, দেশভাগের সময় নানান কিছুই ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়েছিল বটে। কোনো সেন্ট্রাল লাইব্রেরি ভাগ হয়নি। প্রস্তাব উঠেছিল। কিন্তু কোনো পক্ষই সম্মত হয়নি। ফুলে কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিই হোক, আর যোক দিল্লির ইমপেরিয়াল সেক্রেটারিয়েট লাইব্রেরি, কোনোটাতেই এই দৃশ্যের অবতারণা হয়নি।

তাহলে বই ভাগাভাগির ছবিটা এল কোথা থেকে? এর জবাব দিতে পারবেন দুজন। এক, যিনি ছবিটা তুলেছেন, মানে ডেভিড ডগলাস ডানকান। দুই, যিনি ছবির বিষয়বস্তু, মানে কেশবন। ডগলাস কবে মরে ভূত হয়ে গেছেন! কেশবন এখনো বেঁচে আছেন বটে, কিন্তু স্মৃতি এমন ক্ষয়ে গেছে, ভরসা করা কঠিন। তবু নয়াদিল্লির এক শহরতলিতে তাঁর নিরিবিলি বাগানবাড়িতে গিয়ে অশীতিপর লাইব্রেরিয়ানের চোখের সামনে মেলে ধরা হলো ছবিটা। বারান্দায় ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে কেশবন ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘লোকটা আমিই বটে। কিন্তু ঘটনাটা কখনো ঘটেনি।’

কোন ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করছেন কেশবন? লাইব্রেরি ভাগ হওয়াটা? না, মোটেও তা নয়। কেশবনের ছেলে মুকুল কেশবন বললেন, ‘বাবা বোঝাতে চাচ্ছেন, দেশভাগের ঘটনাটাই আসলে ঘটেনি।

মানে? মানে হলো, ভারত ভাগ হয়েছে–এটাই কেশবন। বিশ্বাস করেন না। আজীবন করেননি। তিনি বরাবর মনে করে এসেছেন, একটা অখণ্ড ভারতে তিনি বসবাস করছেন। ইংরেজরা চলে গেছে বটে, তবে র‍্যাডক্লিফের মানচিত্রটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে। ওটার আর দরকার হয়নি। শেষ মুহূর্তে মুসলিম লীগ আর কংগ্রেস লিডারদের মধ্যে একটা রফা হয়েছিল। জিন্নাহকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছিল। তাতে কলকাতার দাঙ্গাও আর হয়নি। লাহোরেও কাউকে কচুকাটা করা হয়নি।

একটা লোকের পক্ষে সারা জীবন এ রকম বিরাট এক বিভ্রান্তির মধ্যে বসবাস করা কী করে সম্ভব, আমার মাথায় ঢোকে না। এটা স্রেফ পাগলামি। কিন্তু কেশবনের এই ছবিটার ব্যাখা কে দেবে? ছবিটা একটা বিরাট খটকাই থেকে গেল।

ভাবছেন এসব অপ্রাসঙ্গিক কথা কেন বলছি আপনাকে? আপনার সঙ্গে এগুলোর কী যোগ? আরেকটু ধৈর্য ধরুন। কিংবা এক কাপ চা খাওয়াতে পারেন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তার ওই পারে একটা হোটেল আছে। মালাই দেওয়া চা বানায়। ফ্লাস্ক হাতে কাউকে যদি পাঠিয়ে দিতেন। এক কাপ চা হলে মন্দ হতো না।

এবার বর্তমান সময়ে আসি। তিন বছর আগের কথা। ঢাকা থেকে প্রকাশিত দুটি দৈনিক পত্রিকায় দুটি খবর ছাপা হলো। খুব মামুলি খবর। এক মন্ত্রীর খবর। আমি তার নাম বলছি না। একটি খবরে বলা হলো, মন্ত্রী নেত্রকোনায় একটা সেতু উদ্বোধন করেছেন। আরেকটি খবরে বলা হলো, মন্ত্রী খুলনায় পার্টির একটি সভায় যোগ দিয়েছেন। দিতেই পারেন। মন্ত্রীরা এসব কাজই তো করবেন। সমস্যা হলো, পত্রিকা দুটি একই দিনে ছাপা হওয়া। এবং দুটি পত্রিকাই দাবি করছে, ছাপা হওয়ার আগের দিন মন্ত্রী এ কাজটি করেছেন। মানে একই দিনে। শুধু যে একই দিনে, তা-ই নয়, একই সময়ে বিকেলবেলা।

দুটি জায়গা লক্ষ করুন, একটা নেত্রকোনা, আরেকটা খুলনা। কীভাবে এটা সম্ভব হলো? হয় পত্রিকা দুটির কোনো একটি তারিখে ভুল করেছে। অথবা মন্ত্রী এক জায়গায় কাজ সেরে আসলেই আরেক জায়গায় গিয়েছেন। সমস্যা হলো, বাংলাদেশে নেত্রকোনায় বিকেলবেলা একটি সেতু উদ্বোধন করে বিকেলবেলাতেই খুলনায় গিয়ে পার্টির সভা করা সম্ভব নয়। বিমানে বা হেলিকপ্টারে করে গেলেও না। তার মানে পত্রিকা দুটির কোনো একটা ভুল নিউজ করেছে। না, পত্রিকা দুটির কোনোটিই ভুল নিউজ করেনি। আমি দুটি পত্রিকা অফিসে গিয়েছি। শুধু পত্রিকা অফিস নয়, নেত্রকোনা এবং খুলনাতেও গিয়েছি। মন্ত্রী আসলেই পত্রিকায় উল্লিখিত দিনে ওখানে গিয়েছিলেন। ওই সব কর্মসূচিতে তিনি অংশ নিয়েছেন।

মন্ত্রী আমাদের এলাকার লোক। একে-ওকে ধরে আমি একদিন তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। তার সঙ্গে দেখা করলাম। পত্রিকার কাটিং তুলে দিলাম তাঁর হাতে। তিনি দেখে গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছু বললেন না।

চা-টা এরা ভালোই বানিয়েছে। আপনাকে আর বিরক্ত করব না। বৃষ্টি কমে এসেছে। আমিও উঠব। আরেকটা ঘটনা বলেই আমি শেষ করব। তারপর আসল কথায় আসব।

এবার যেটা বলব, সেটার সঙ্গে আমি নিজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। আমি একটা সরকারি দপ্তরে ছোটখাটো পদে চাকরি করি। দপ্তরটা তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তো ফিল্ম সেন্সর বোর্ডেও কিছুদিন কাজ করতে হয়েছে আমাকে। সেন্সর বোর্ড কী করে, জানেন তো? যারা ছবি বানায়, চলচ্চিত্র, তারা একটা করে কপি জমা দেয়। সেন্সর বোর্ড সেটা স্ক্রিনিং করে। সবাই মিলে একসঙ্গে বসে ছবি দেখে। তারপর আলাদাভাবে রিপোর্ট করে। কোথাও কোনো আপত্তি আছে কি না, সরকারি গাইডলাইন ঠিকমতো মানা হয়েছে কি না–এসব বিষয়ে রিপোর্ট। আমার কাজ ছিল এসব রিপোর্ট কম্পাইল করা, সুপারিশগুলোর একটা তালিকা করে সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে জমা দেওয়া। নব্বইয়ের দশকে আমাদের দেশে চলচ্চিত্রের খুব দুর্দিন যাচ্ছিল, মনে আছে? অশ্লীলতাবিরোধী আন্দোলনের কারণে খুব মন্দা। বছরে দশ বারোটি ছবিও বানানো হয় কি হয় না। সেন্সর বোর্ডে কাজ নেই। বোর্ড মেম্বাররা কালেভদ্রে একত্রে বসে ছবি দেখার সুযোগ পান। এ রকম সময়ে একদিন তরুণ এক চলচ্চিত্র নির্মাতার একটা ছবি জমা পড়ল। লোকটা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গাঁটের পয়সা খরচ করে ছবিটা তৈরি করেছেন।

সেন্সর বোর্ডে একটা সাজ সাজ রব পড়ে গেল। কাজ পাওয়া গেছে। একদিন সন্ধ্যার পরপর ইস্কাটন গার্ডেন রোডে সেন্সর বোর্ডের অফিসে ফিল্ম স্ক্রিনিংয়ের বন্দোবস্ত হলো। আমিও তাতে উপস্থিত ছিলাম। সদস্য না হয়েও। ছবির কাহিনি বেশ জটিল। আর্ট ফিল্ম বলতে পারেন। বিষয়বস্তু এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ঢাকার একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েন। বিশ্বজুড়ে বামধারার রাজনীতির বিদায়ঘণ্টা বাজছে। নানান অস্তিত্ববাদী ক্রাইসিস। এ নিয়ে জটিল কাসুন্দি। ছবির প্রায় কিছুই বুঝলাম না। সমাপ্তিটা তো মাথার ওপর দিয়ে গেল।

এ রকম সিনেমা ঢাকার হলগুলোয় চলবে না। এগুলো ফেস্টিভ্যালে দেওয়ার জন্য। পুরস্কার-টুরস্কার পাবে। পত্রপত্রিকায় উচ্ছ্বসিত রিভিউ হবে।

ছবি শেষে বোর্ড মেম্বাররা গম্ভীর মুখে চলে গেলেন। তিন দিনের মধ্যে সবাই নিজ নিজ রিপোর্ট জমা দিলেন। সেগুলো সবই আমার টেবিলে এল। দাপ্তরিক দায়িত্ব হিসেবে আমাকে সেগুলো পড়তে হলো। পড়তে পড়তে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। রিপোর্টগুলো পড়ে বোঝার উপায় নেই, দশ বোর্ড মেম্বার আসলে একটি অভিন্ন ছবি দেখেছেন। দেখলাম, তারা আসলে দশটি আলাদা আলাদা ছবির কথা বলছেন। একেক জনের ছবি শেষ হয়েছে একেকভাবে। যেমন একজন বললেন, তাঁর আপত্তি ছবিটির অহেতুক বিয়োগান্তক সমাপ্তি নিয়ে। ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রধান চরিত্রের মৃত্যু অপ্রাসঙ্গিক। এটা দর্শকদের মধ্যে ভুল মেসেজ দেবে। কিন্তু আমি অবাক হলাম এটা ভেবে যে, ছবিতে তো প্রধান চরিত্রের মৃত্যুই হয়নি। ছুরিকাঘাতে মৃত্যুর কোনো দৃশ্যই কোথাও নেই। এভাবে একেকটা রিভিউ রিপোর্ট পড়ছি, আর আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

তাই বলে ভাববেন না, আমার জীবনে এই ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম। বলতে কি, অনেক ছোটবেলা থেকে আমি এ রকম অসংগতি দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। আমি লক্ষ করেছি, জগতে এ রকম অসংগতির ঘটনা মাঝে মাঝেই ঘটে। একটা ঘটনা দু-টুকরো হয়ে দুটি ঘটনায় পরিণত হয়। একটা লোক একই সময়ে দুই জায়গায় অবস্থান করে। খুব অল্প সময়ের জন্য করে। অধিকাংশ লোকেরই এগুলো নজর এড়িয়ে যায়। তবে কারও কারও চোখে পড়ে। তারা এটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না। চেপে যায়।

আমি চেপে গেলাম না। এ রকম ঘটনা আমি অনুসন্ধান শুরু করলাম। কড়া নজর রাখা। দেখলাম, যতটা বিরল ভেবেছিলাম, ততটা বিরল নয় এসব ঘটনা। সতর্ক থাকলে চোখে পড়ে। মাঝে মাঝেই পড়ে।

ব্যাখ্যা? না কোনো ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র নই। তবে এটুকু বুঝি, আমরা যতটা সরল মনে করি, জগৎটা তত সরল নয়। যেটাকে আমরা বাস্তবতা বলি, সেটা একটা বিছিয়ে রাখা চাদরের মতো। যুক্তির চাদর। কিন্তু সমস্যা কী জানেন, চাদরটার এখানে-সেখানে ছেঁড়াফাটা, কোথাও কোথাও সেলাই খুলে যাওয়া, কোথাও তাপ্পি মারা। ওই ছেঁড়া ফুটোগুলো দিয়ে আরেকটা জগৎ উঁকি দেয়। সূক্ষ্ম একটা আভাস পাওয়া যায়, বাস্তবতার এই চাদরের নিচে আরেকটা বৃহত্তর জমিন আছে। সেখানে দুইয়ে দুইয়ে সব সময় চার হয় না। সেখানে লজিক চলে তার নিজের নিয়মে।

সবচেয়ে অদ্ভুত কথা কী জানেন, এই বিশেষ ধরনের ঘটনা, এইসব অসংগতি খুঁজতে খুঁজতে আমি এগুলোর মধ্যে সূক্ষ্ম একটা প্যাটার্ন আবিষ্কার করতে শুরু করলাম। ব্যাখ্যা করতে পারব না, কিন্তু এটা ঠিক যে আমি আগাম আভাস পাই। আমি প্রেডিক্ট করতে পারি। টের পাই, কখন এ রকম ঘটনা আবার ঘটতে যাচ্ছে। এটা আমার একটা বাড়তি ক্ষমতাই বলতে পারেন। আমি আগাম বুঝতে পারি, চাদরটার কোথায় কোথায় ছেঁড়া।

আপনি যে বিরক্ত হচ্ছেন সেটা স্পষ্ট। হবেনই-বা না কেন! এতক্ষণ ধরে বকবক করছি। এভারেস্টের চূড়ার একটা পাথরখণ্ড, দেশভাগের সময়কার একটা লাইব্রেরি ভাগের ছবি, সেন্সর বোর্ডের সিনেমা নিয়ে গ্যাঞ্জাম–এসব হাবিজাবি কথা এ রকম বৃষ্টির দুপুরে মোহাম্মদপুর থানার ওসিকে বলার কী মানে? আপনি যে এতক্ষণ ধৈর্য ধরে শুনেছেন, এটাই অবাক বিষয়। আপনার ঘড়িতে এখন কটা বাজে? দুপুর দুটা সাঁইত্রিশ মিনিট, তাই তো? বেশ। এবার তাহলে কাজের কথায় আসি। আমি এসেছি একটা জিডি করতে। আপনি আমার নামে একটা জিডি রেকর্ড করবেন। হ্যাঁ, এখন। কী লিখবেন? লিখুন, একটা লোক আমাকে হুমকি দিচ্ছে। লোকটাকে আমি চিনি না। নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। টেলিফোনে দিচ্ছে, রাস্তায় দেখা করে দিচ্ছে। বলছে, আমাকে মেরে ফেলবে। লিখছেন? জিডি করার সময়টা ভালো করে লিখুন। দুইটা সাঁইত্রিশ মিনিট। পারলে সেকেন্ডটাও লিখুন। এবার কি সই দিতে হবে আমাকে? দিচ্ছি। এবার তাহলে উঠি। জানতে চান এসবের মানে কী? কেন এত বকবক করলাম? আরে, আমি তো ভেবেছিলাম আপনার কৌতূহল বলে কিছুই নেই। এতক্ষণ যেভাবে মুখ গোমড়া করে ফোনে গেম খেলছিলেন, ভেবেছি আপনি কিছুই শোনেননি। শুনুন, আপনাকে খোলাসা করেই বলি। আপনাকে বলাই যায়। ইনফ্যাক্ট আপনাকে বলাই ভালো। জিডির অভিযোগের তদন্ত করাটা আমার জন্য খুব দরকারি না। দরকারি হলো জিডি করাটা। এটাই আমার অ্যালিবাই। আমার দরকার এটা প্রমাণ করা যে এই দুপুর দুইটা সঁইত্রিশ মিনিটে আমি মোহাম্মদপুর থানায় বসে ছিলাম একেবারে ওসি সাহেবের সামনে। একবারও নড়িনি। কোথাও যাইনি। কারণ কী? কারণ, ঠিক এই মুহূর্তে এই দুটা সাঁইত্রিশ মিনিটে বনানী এগারো নম্বর রোডে একটা প্রাইভেট ব্যাংকে ডাকাতি হচ্ছে। ছয়জন ডাকাত ভয়ানক অস্ত্র তাক করে সবাইকে জিম্মি করে ভল্টের টাকাপয়সা সব নিয়ে যাচ্ছে। আজই সন্ধ্যাবেলা এটা নিয়ে থানায় মামলা হবে। আজ রাত থেকেই তদন্ত শুরু হবে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ছয় ডাকাতের দুজনকে চেনা যাবে। তাদের একজন আমি। হ্যাঁ, আমি। কোনো ভুল নেই। এই আমিই–তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক ক্লার্ক। কীভাবে সেটা সম্ভব, এতক্ষণ ধরে সেটাই তো বোঝানোর চেষ্টা করলাম আপনাকে।

আমার এখন একটাই ভরসা। আপনি। আপনার সাক্ষ্য। আর এই জিডি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *