০৫. প্রতিদ্বন্দ্বী

প্রতিদ্বন্দ্বী

১৯৬৮ সালের এক শরতের দুপুরে লাহোর জংশন রেলস্টেশনে পা রেখে আমার মনে হয়েছিল, কবিরা বড় বজ্জাত প্রজাতির। তাদের হৃদয় পঙ্কিল, অস্থিমজ্জা অসুয়াদুষ্ট। এই ধারণা আমি। আজও ত্যাগ করতে পারিনি।

রেলস্টেশনের দুর্গ আকৃতির লাল ইটের ভবনের বাইরে আমাকে স্বাগত জানাতে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে নামকরা কবিদের একজন–সুলতান চুঘতাই। একটা ধূসররঙা মাজদা কাপেলার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো পঞ্চাশোর্ধ্ব লোকটিকে দেখে অবশ্য বিশ্বাস করা কঠিন ছিল, ইনি উর্দু কবিতায় নতুন যুগের সূচনা ঘটিয়েছেন। লোকটি মোটেও সৌম্যকান্তি নন, চেহারা বিশেষত্বহীন। দেখে বোঝার উপায় নেই, এ লোক পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে বনেদি পরিবারগুলোর একটির সন্তান।

সুলতান চুঘতাই আমার দিকে হাত বাড়িয়ে ইংরেজিতে বললেন, ‘ওয়েলকাম টু দ্য সিটি অব পোয়েটস।’

কথাটা উনি সম্ভবত বাড়িয়েই বলেছিলেন। ষাটের দশকের শেষের দিকে লাহোরে উর্দু কবিতার এমন কোনো জোয়ার বইছিল না।

কবিতার সমঝদার আমি কখনো ছিলাম না। আইনকানুন, মামলা-মোকদ্দমা আমার কর্মক্ষেত্র। ঢাকা হাইকোর্টের একজন জাঁদরেল আইনবিদের চেম্বারে নবিশ হিসেবে আমি সবে যোগ দিয়েছি। আমি লাহোরে পা রেখেছি তার সহকারী হিসেবে। সুলতান চুঘতাই চুরির মামলা ঠুকেছেন তাঁর ঘোরতর প্রতিদ্বন্দ্বী কবি তালাল লুধিয়ানির বিরুদ্ধে।

লাহোরের হাকিম আদালতে চুঘতাই যে অভিযোগ এনেছেন, তা এতই বিস্ফোরক, তখনকার দিনের লাহোর শহর কেঁপে উঠেছিল। অভিযোগ প্লেজিয়ারিজম বা কুম্ভিলকবৃত্তির। লুধিয়ানি চুরি করেছেন চুঘতাইয়ের লেখা।

ওই রাতে পূর্ব লাহোরের সোদিয়াল এলাকায় ভিক্টোরিয়ান কায়দায় বানানো চুঘতাই পরিবারের প্রাসাদোপম বসতবাড়ির ছাদ পর্যন্ত বইয়ে ঠাসা লাইব্রেরি কক্ষে বসে আমি বললাম, ‘শুনেছি আপনার হাতে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। আদালতে আপনি কিছুই দাঁড় করাতে পারেননি। হাকিম আদালত আপনার বিরুদ্ধে রায় দিয়ে দিয়েছেন। জজকোর্টও।’

কিছুক্ষণ আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে চুঘতাই বললেন, ‘হ্যাঁ, দিয়েছেন। তো?’

‘আপনি লাহোর হাইকোর্টে মামলা করেছেন। শুনছি, সেখানেও হারতে যাচ্ছেন। অর্থাৎ আপনার অভিযোগ একেবারে কাঁচা।’

সে জন্যই তো সুদূর ঢাকা থেকে আইনজীবী আনিয়েছি। আপনার সিনিয়র ব্যারিস্টার আরশাদ আজিজ আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। উনি এত জাদরেল উকিল, পুরো পাকিস্তানে সবাই ওনাকে একনামে চেনে। আমি চেয়েছিলাম উনি নিজে আসুন। এখন যেহেতু উনি আপনাকে পাঠিয়েছেন, ধরে নিচ্ছি বয়সে তরুণ দেখালেও আপনার মধ্যে গুণপনার কমতি নেই। আপনি নিজে প্রমাণ জোগাড় করুন। যে পদক্ষেপ নিতে হয়, নিন।

আপনার কোন কবিতা উনি চুরি করেছেন বলছেন?

‘একটি বা দুটি কবিতা নয়, উনি একের পর এক আমার তিনটি কিতাব মেরে দিয়েছেন।’

পরদিন নাশতার টেবিলে বসে আমি বললাম, ‘লুধিয়ানি আপনার যেসব বই নকল করেছেন বলে আপনি অভিযোগ করেছেন, সেসব বই আপনি আদালতে দাখিল করতে পারেননি, চুঘতাইজি।’

চুঘতাই উদাস গলায় বললেন, ‘পারিনি।’

‘কেন?’

‘কারণ, আমার বই ছাপাই হয়নি।’

‘যে বই ছাপা হয়নি, সেই বই নকল করা হয়েছে–এই অভিযোগ টিকবে?’

‘আমার কাছে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি আছে। নিজ হাতে লেখা।’

‘তাতে কী! ডিফেন্স বলবে, লুধিয়ানির ছাপানো বই থেকে আপনি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন।’

‘তা-ই তো বলেছে।’

‘তাহলে আর কী, কেস ফিনিশড। কিছুই করার নেই।’

এই প্রথম ভদ্রতার খোলস খসে গিয়ে চুঘতাইয়ের চোখে ক্রোধের ছাপ। বললেন, ‘কিছুই করার নেই মানে! এই বেইনসাফির কোনো বিচার নেই! একটা চোর, একটা ভিখারির সন্তান দিনের পর দিন আমার সব কবিতা, সব ছন্দ, সব অক্ষর চুরি করে নিয়ে যাবে, আমার তৈরি উপমা, শব্দে শব্দে ঠোক্কর খাওয়া ধ্বনিমাধুর্য দখল করে আমারই প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠবে, তাঁকে বলা হতে থাকবে উর্দু কবিতার নয়া সিতারা, আর তা মেনে নিতে হবে আমাকে? শুনে রাখুন, সাহিত্যের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় জোচ্চুরি, বড় বেইনসাফি কোনো দিন হয়নি।’

আমি বললাম, ‘আপনি আপনার পরবর্তী পাণ্ডুলিপি সুরক্ষিত রাখুন, চুঘতাইজি। পাণ্ডুলিপি যাতে কেউ চুরি করতে না পারে।’

চুঘতাই তাঁর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘পরেরটাও চুরি হবে। আমি নিশ্চিত।’

‘আপনি লিখে সিন্দুকে ভরে রাখুন।’

‘পৃথিবীর কোনো সিন্দুক ওই ছুঁচোকে আটকাতে পারবে না।’

‘আপনি বাড়ির লোকজনকে সন্দেহ করছেন, বা প্রেসের লোকজনকে?’

‘না।’

‘তাহলে?’

‘পুরোটা বুঝতে হলে উকিল সাহেব, আপনাকে উর্দু কবিতার ইতিহাস জানতে হবে। বুঝতে হবে এর সাম্প্রতিক প্রবণতা। এবং বুঝতে হবে চুঘতাই আর লুধিয়ানির দ্বন্দ্বের স্বরূপ। একমাত্র তাহলেই আপনি পারবেন পুরো বিষয়টি আদালতের সামনে তুলে ধরতে। আমি চাই, আপনি আদালতে বিষয়টা বিস্তারিত তুলে ধরুন শুধু। জিতি না-জিতি, কথাগুলো অন্তত বলা তো হোক।’

.

তো, এইভাবে কবিতাবিমুখ এক আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও শুধু মক্কেলের ফেরে আমাকে উর্দু কবিতার গোলকধাঁধার মধ্যে প্রবেশ করতে হয়েছিল। পরবর্তী কয়েকটি দিন রসুল পার্কের ছায়াঢাকা তরুবীথি বেয়ে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে চুঘতাই আমার সামনে উর্দু কবিতার বিশাল ভূখণ্ডের দরজা উন্মোচন করতে শুরু করেন। সেই দরজায় উঁকি দিয়ে আমি ভেতরে অদ্ভুত এক মোহনীয় বাগিচা দেখতে শুরু করি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি চুঘতাইয়ের কথার জাদুতে ঝুঁদ হয়ে থাকতাম। পঞ্চম দিন থেকে টের পেতে শুরু করি, আমার মক্কেলের মামলার সুরাহা কবিতার এই গোলকধাঁধাময় গলিপথের ভেতরেই কোথাও লুকিয়ে আছে, আইনের ধারা-উপধারার মধ্যে তা খুঁজতে যাওয়া বৃথা। সে ক্ষেত্রে একজন পরিপূর্ণ কবি-বিচারকই কেবল আমার মক্কেলকে ইনসাফ দিতে পারেন। আর কেউ নন।

.

পঞ্চাশের দশকের শেষ দিক থেকে শুরু করে পরবর্তী দশটি বছরের উর্দু কবিতার ইতিহাস চুঘতাই আর লুধিয়ানির দ্বন্দ্বযুদ্ধের ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁদের কলম ও ঠোঁটের মধ্য দিয়ে উর্দু কবিতার দুটি শক্তিশালী স্রোতোধারা প্রবহমান হয়েছে। এই দুই সমবয়সী কবি কী করে ঘনিষ্ঠ বন্ধু থেকে ঘোরতর শত্রু হয়ে উঠলেন, সেই গল্প লাহোরের সাহিত্য আড্ডার মুখরোচক কিংবদন্তি। তাতে সত্যের পাশাপাশি অনেক মিথ্যার খাদও মিশে আছে। যেমন কেউ কেউ বলেন, দেশভাগের পর লুধিয়ানা থেকে লাহোরে আসা মোহাজির, কপর্দকহীন কিশোর লুধিয়ানি বেশ কিছুদিন চুঘতাই পরিবারে আশ্রিত ছিলেন। সে বয়সে দুজনই ওই পরিবারের এক বয়োজ্যেষ্ঠ নারীর প্রেমে পড়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত সেখান থেকে।

কিংবদন্তি যা-ই চালু থাক, লাহোরের উত্তর অংশের বনেদি এলাকায় বেড়ে ওঠা চুঘতাই আর দক্ষিণ অংশের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মহল্লায় বসবাসকারী লুধিয়ানির কবিতার জগৎ যে ভিন্ন হবে, এটাই স্বাভাবিক ছিল। তরুণ বয়সে লুধিয়ানি হকিকত পসন্দ বা বাস্তববাদ নামক একটি নতুন কাব্য-আন্দোলনের জন্ম দেন। এটির দুর্বিনীত অনুসারীরা উর্দু কবিতায় চল্লিশের দশক থেকে চালু রুহানী বা মরমি ধারার কবিদের নির্দয় সমালোচনা করতেন। বলতে কি, চুঘতাই ছিলেন এই আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। তিক্ত বিদিষ্ট চুঘতাই একপর্যায়ে ফরাসি প্রতীকবাদী কবিদের প্রভাববলয়ে আসেন, তাতে ষাটের দশকের মাঝামাঝি তাঁর কবিতা নতুন দিকে বাঁক নেয়। উর্দু কবিতায় প্রতীকবাদী ধারা যে দ্রুত বিকাশ লাভ করতে শুরু করে, সেটার একক কৃতিত্ব চুঘতাইকেই দিতে হবে। পরবর্তীকালে পরাবাস্তববাদী উপকরণও মিশে যেতে থাকে তাঁর কবিতায়। এ সময় চুঘতাইয়ের জনপ্রিয়তা এত বেড়ে যায় যে তিনি একপ্রকার গার্হস্থ্য নামে পরিণত হন। তাঁর কবিতার বই নেই, পুরো পশ্চিম পাকিস্তানে এমন মধ্যবিত্তের বাড়ি খুঁজে পাওয়া যেত না।

চুঘতাইয়ের জনপ্রিয়তার চাপে লুধিয়ানির বাস্তববাদী ধারাটি শুকিয়ে যেতে শুরু করে। একটা পর্যায়ে লুধিয়ানির কলম থেমে যায়। বেশ কিছুদিন তিনি নিরুদ্দেশ থাকেন। এ সময় তাঁকে ঘিরে নানা রকম গুজব ডালপালা ছড়াতে শুরু করে। বছর দুয়েক পর তিনি ফিরে আসেন এবং গুলো কি মহেক নামে তাঁর একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়। সমালোচকেরা সবাই স্বীকার করেন, এই বইয়ের কবিতাগুলো লুধিয়ানির এত দিনকার প্রবণতা ও ভঙ্গিমার অনেকটাই বিপরীত। তিনি এক নতুন পথে হাঁটতে শুরু করেছেন।

কিন্তু বইটি প্রকাশের পরপরই হইচই শুরু করে দেন চুঘতাই। লাহোর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে তিনি যে অভিযোগ করেন, তা উর্দু সাহিত্যের ইতিহাসের সবচেয়ে কেলেঙ্কারিময় ইলজাম। লুধিয়ানির বিরুদ্ধে তিনি কুম্ভিলকবৃত্তির অভিযোগ আনেন। প্রমাণ হিসেবে নিজের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি হাজির করেন। ওই দিনের পর থেকে অনেককেই বলতে শোনা গেছে, ঈর্ষাকাতর চুঘতাই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছেন।

পরবর্তী দুই বছরে লুধিয়ানির আরও দুটি কবিতার বই বের হয় এবং দুবারই একইভাবে পাণ্ডুলিপি চুরির অভিযোগ আনেন চুঘতাই। দুবারই তিনি হাস্যরসের জন্ম দেন। এর পরপরই আদালতে মামলা।

.

‘লোকটা জোচ্চোর, উকিল সাহেব। এ নিয়ে মনে কোনো সন্দেহ রাখবেন না’, বললেন চুঘতাই।

আমি তার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘কিন্তু প্রমাণ তো লাগবে।’

‘ওর কবিতাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। ও লিখেছে, ‘লৌট আও বো চমনমে/ যাহা গুলাবোঁ কি পারি নিশাবাজ হো কে/শোয়ে হ্যায় ঘাস কি গালিচে পে৷’ (ফিরে এসো সেই বাগানে/যেখানে গোলাপের পাপড়ি শুকিয়ে/লুটিয়ে আছে ঘাসের গালিচায়)। এই চিত্রকল্প তৈরি করা ওর বাবার পক্ষেও সম্ভব নয়। এই ভাষা ওর নয়। আরও প্রমাণ দেব? গত দেড় বছরে আমি একটাও নতুন কবিতা লিখিনি। এই দেড় বছরে ওর নতুন বই বের হওয়াও বন্ধ। বলে কিনা রাইটার্স ব্লক।’

আমি বললাম, ‘আপনার পাণ্ডুলিপির কবিতাগুলো লেখার পর নিচে তারিখ দেওয়া থাকে না?’

প্রশ্ন শুনে চুঘতাই বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর যা বললেন, সে রকম অদ্ভুত কথা আমি জীবনে শুনিনি। তিনি বললেন, ‘ওর কবিতার বই বের হচ্ছে আমার কবিতাগুলো লেখারও আগে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ও আমার কবিতাই চুরি করছে।’

স্তম্ভিত হয়ে চুঘতাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি আমি।

চুঘতাই বলেন, ‘আপনি বিশ্বাস করছেন না আমার কথা, তা-ই না?’

‘আপনি ব্যাখ্যা করে বলুন।’

‘আমার পাণ্ডুলিপি লেখার অন্তত ছয় মাস থেকে দেড় বছর আগে বের হচ্ছে ওর কবিতার বই। তবু বলব, ও আমার পাণ্ডুলিপিই চুরি করছে।’

‘যে পাণ্ডুলিপি লেখাই হয়নি, সেই পাণ্ডুলিপি চুরি হয় কী করে?’

চুঘতাইয়ের চোখে অসহায় চাহনি। তাঁকে নিয়ে আমার মনের মধ্যে কী চিন্তা দানা বাঁধছে, তিনি বোধ হয় টের পেতে শুরু করেছেন।

.

চুঘতাইদের বাগানবাড়ির দোতলার বারান্দায় সারা রাত বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবলাম আমি। ভোরের দিকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।

নাশতার টেবিলে চুঘতাইয়ের মুখোমুখি বসে বললাম, ‘উপমা-উৎপ্রেক্ষা, কবিতার শব্দচয়ন প্রবণতা, চিত্রকল্প তৈরির কৌশল–যা-ই বলুন, এগুলো কিছুই এজলাসে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে কাজে লাগবে না।’

‘আপনি কি ঢাকায় ফিরে যাচ্ছেন?’

‘না। একটু আগে টেলিগ্রাম করে এলাম, ফিরতে আরও এক মাস দেরি হবে।’

‘কী করবেন আপনি?’

‘চোরকে হাতেনাতে ধরব।’

‘কীভাবে?’

‘ফাঁদ পেতে। ঢাকায় আমার এক কবিবন্ধু আছে। আরিফ হাসান। ব্যর্থ কবি। বছর পাঁচেক আগে তাঁর একটি কবিতার বই বেরিয়েছে। এখানে আপনার এই বাগানবাড়িতে বসে বসে আমি ওই বাংলা কবিতার বইটি এখন উর্দুতে অনুবাদ করব। গোপনে। আপনি সেগুলো আবার কপি করবেন। হুবহু। তারপর আপনার নামে ওই কবিতার পাণ্ডুলিপি ছাপতে জমা দেবেন প্রকাশকের কাছে। ছাপবেন না। ছাপতে দেবেন শুধু।’

চুঘতাই তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। তার চোখ চকচক করছে।

.

১৯৬৮ সালের ৭ নভেম্বর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হয়ে গেল। বাংলা কবিতার বইয়ের নাম ছিল সময়চক্র। উর্দুতে সেটা দাঁড়াল ওঅক্ত কা সিলসিলা। প্রকাশককে দেওয়া হলো ৯ নভেম্বর। আর তখনই খবর পেলাম, ১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ কবি তালাল লুধিয়ানির নতুন বই বেরিয়ে গেছে, নাম ওঅক্ত কা সিলসিলা। সেই বইয়ের জন্য তিনি অল পাকিস্তান উর্দু একাডেমির পুরস্কারও পেয়ে গেছেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমার লাহোরে পা রাখারও দেড় বছর আগে এসব ঘটে গেছে।

আমি আশ্চর্য হলাম না। আমার কাছে সবই পরিষ্কার হয়ে গেছে। লুধিয়ানি চুরি করছেন পৃথিবীর তাজ্জবতম উপায়ে। এই চুরি ঠেকানোর কোনো পথ নেই।

কিন্তু আমার পাতা ফাঁদে তাকে পড়তেই হলো।

ঢাকার কবির বাংলা কবিতা মেরে দেওয়ার অভিযোগে মামলা হলো লুধিয়ানির বিরুদ্ধে। তার চেয়েও বড় অভিযোগ, উর্দু একাডেমির সঙ্গে প্রতারণা করে পুরস্কার বাগানো। দ্বিতীয় অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো।

লুধিয়ানিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। পারার কথা নয়। সময়ের জটিল গলিপথে লুকিয়ে পড়ার কৌশল তিনি জেনে গেছেন। তার লেখার কক্ষের দরজা ভেঙে পুলিশ ঢুকে দেখে, ঘর খালি। লুধিয়ানির স্ত্রীর দাবি, পুলিশ দরজা ভাঙার সময়ও ভেতরে স্বামীর গলার আওয়াজ তিনি শুনেছেন।

ওই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অন্য কোনো পথ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *