1 of 2

১.১৩ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে

এই ভারতের মহামাবের সাগরতীরে

আমার এক অধ্যাপক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি নিজে জনসঙ্ঘের সমর্থক; জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কেন ওঁদের নীতি সমর্থন করি না। মতের পার্থক্য সত্ত্বেও আলোচনা করবার সদিচ্ছা ওঁর আছে, এই দেখে আনন্দিত হয়েছিলাম। সংক্ষেপে আমার। জবাব লিখছি।

জনসঙ্ঘ ভারতীয় সংস্কৃতির ঐক্যে বিশ্বাসী। ভারতীয় সংস্কৃতি এক ও অবিভাজ্য এবং এর একটা মূল ধারা আছে। এই ধারা থেকে যিনি বিচাৎ তিনি প্রকৃত ভারতীয় নন। সংস্কৃতির এই মৌল ঐক্য হবে আমাদের রাজনীতির ধারক ও নিয়ন্তা। এই ঐক্যকে খণ্ডিত করে পাকিস্তানের জন্ম কাজেই ভারত বিভাগ মেনে নেওয়া চলে না। জনসংঘের চিন্তার এটাই মূল কথা।

ভারতীয় সংস্কৃতির স্বরূপ ও ঐক্য সম্বন্ধে আমার ধারণা ভিন্ন। আর রাজনীতি ও সংস্কৃতির সম্পর্ক নিয়ে জনসঙ্ঘের চিন্তাটাও ভ্রান্তিপূর্ণ।

ভারতীয় সংস্কৃতির দুটি ভিন্ন ধারণা আছে; একটি বৃহৎ ও গ্রহণধর্মী অপরটি ক্ষুদ্র এবং ছোট ছোট নিষেধের বেড়ায় খণ্ডিত। ভারতে দীর্ঘ ইতিহাস ধরে বার বারই দেখি যে বাইরে থেকে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, শিল্প, চিন্তাধারা এদেশে প্রবেশ করেছে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐক্যকে সাময়িকভাবে খণ্ডিত করে; তারপর দেশের বৃহৎ ঐতিহ্য এই বিদেশাগত, বিচিত্র উপাদানকে ধীরে ধীরে নিজের অংশ করে নিয়েছে। আমাদের মন যতদিন সৃষ্টিশীল ছিল, যে পরিমাণে সৃষ্টিশীল ছিল, ততদিন সে-পরিমাণে সমম্বয়ধর্মী কালের এই প্রক্রিয়ায় আমাদের ঐতিহ্য বিত্তবান হয়েছে। ভারতের সংস্কৃতিতে কার স্থান হবে অথবা হবে না, প্রতি পদে পদে তার নিয়ন্ত্রণের ভার যদি না থাকত কালের হাতে, যদি থাকত কোনো শক্তিমান রাজপুরুষ অথবা ভারত সম্রাটের হাতে, তাহলে এদেশ মহামানবের সাগরতীরের পরিবর্তে হয়ে উঠত এক অতি প্রাচীন, অনড়, আত্মসঙ্কুচিত এবং অবশেষে আত্মরক্ষারও শক্তিরহিত, বন্ধ্যা সংস্কৃতির বাসভূমি। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও অবশ্য সংস্কৃতির এই অবক্ষয় সম্ভব যখন আমরা নিজের মনে নিজেই ভয় এবং অহমিকার মিশ্রণে গঠিত একটা অদৃশ্য প্রাচীর গড়ে তুলি, যার উদাহরণও আমাদের দেশে আছে। কিন্তু সংস্কৃতির উপর রাষ্ট্রের কড়া শাসনে যখন ভিতরের এই নিষেধটাই সমর্থন খোঁজে তখন বিপদটা হয়ে ওঠে আরও বিষম।

রাষ্ট্রনেতাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় সাময়িক ঘটনার চাপে, ক্ষুদ্রকালের সীমায়। সুস্থ সংস্কৃতির দৃষ্টি বৃহৎকালে বিস্তৃত, তার আকাঙ্ক্ষা অজ্ঞাতকে জ্ঞানের ভিতর ডাকা, অনাত্মীয়কে আত্মার বন্ধনে বাঁধা। যাঁরা রাজনীতিকে সংস্কৃতির মাপে কাটতে চান, ভয় হয় যে, তাঁরা সংস্কৃতিকেই অবশেষে কাটবেন রাজনীতির ছোট মাপে। দেশের মান এতে সংকীর্ণ হবে। সংস্কৃতিকে আমি যথাসম্ভব মুক্তি দেবারই পক্ষপাতী; রাজনীতির সীমানা টেনে তাকে খণ্ডিত করা ভুল।

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক সম্বন্ধেও আমার একই কথা। গায়ের জোরে রাষ্ট্রের সীমানা বাড়ানো যদি-বা সম্ভব, সংস্কৃতির সীমা তাতে বদলায় না; জোরজবরদস্তিতে ওটা আরও। সঙ্কুচিত হয়। ভারত এবং পাকিস্তানের ভিতর যদি হৃদয়ের যোগ ক্রমশ দৃঢ় হয়, নানা। কাজে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা যদি আমরা ধীরে ধীরে বাড়াতে পারি, তারই শেষ পরিণতি হিসাবে কোনো এক দূর ভবিষ্যতে যদি এই উপমহাদেশের মানুষেরা রাজনীতিক সীমানা মুছে দিতে চায় তো সেটাই হবে রাজনীতির উপর সংস্কৃতির জয়। শুধু বালে আর যাই প্রমাণ করা যাক, সম্প্রীতিভ্রষ্ট দুই দলের সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রমাণ করা। যায় না। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা বক্তৃতায় যতটা গ্রহণধর্মী দৈনন্দিন জীবনের আচারে বিচারে ততটা নই। এই জাতীয় দুর্বলতাটাই জনসঙ্ঘেরও দুর্বলতা। হিন্দুধর্মের জায়গায় ভারতীয় সংস্কৃতি শব্দটা বসালেই তাতে ধর্ম অথবা সংস্কৃতি কোনোটাই প্রশস্ত হয় না। দ্বন্দ্ব তো শব্দ নিয়ে নয়; বিস্তৃত করতে হবে বুদ্ধি এবং হৃদয়। পাকিস্তান অথবা অন্য। যে-কোনো দেশ যদি ভারত আক্রমণ করে তো সে আক্রমণ সর্বশক্তি দিয়ে ঠেকানোই আমাদের কর্তব্য; কারণ দুর্বলতা দিয়ে প্রতিবেশীকে প্রলুব্ধ করাটা অপরাধ নিজের প্রতিও অপরের প্রতিও। কিন্তু অবিভাজ্য সংস্কৃতির অহমিকার পতাকা তুলে হিংসা এবং অসহিষ্ণুতার আঘাতে সংস্কৃতিকে খণ্ড খণ্ড করাটা শোচনীয় হঠকারিতা।

জনসঙ্ঘের রাজনীতি ছেড়ে এবার প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া যাক। আমাদের আজ বিশেষভাবে প্রয়োজন দেশে বৈজ্ঞানিক চিন্তার প্রসার। তথ্যকে তত্ত্ব দিয়ে বাঁধবার আর তত্ত্বকে তথ্য দিয়ে যাচাই করবার অভ্যাস আমাদের আয়ত্ত করতে হবে। শিখতে হবে এবং শেখাতে হবে যে, তত্ত্ব শুধু শব্দসর্ব মন্ত্রবিশেষ নয়, বরং ব্যবহারে তার পরীক্ষা। এই নতুন দৃষ্টিকোণের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পুরনো চিন্তাকে বিচার করতে হবে—সেই চিন্তায় যেটুকু ভুল সেটুকু ছাড়তে হবে, যেটুকু সত্য তা নতুন করে ধরতে হবে।

চিন্তার এই দিকপরিবর্তনের যুগে আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতিকে অবহেলা করা প্রয়োজন একথা বলছি না। নতুনকে যদি আমরা গভীরভাবে পেতে চাই তো ঐতিহ্যের সূত্রে প্রাপ্ত পুরাতন চিন্তার প্রতি আমাদের নতুন করে মনোযোগী হতে হবে। প্রাচীনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নতুনকে তেমন গভীরভাবে পাওয়া যায় না, যেমন পাওয়া যায় প্রাচীনের নিষ্ঠাপূর্ণ সমালোচনার ভিতর দিয়ে।

কোনো দেশই তার পুরনো ঐতিহ্যকে সহসা সামগ্রিকভাবে ত্যাগ করে না; আমরাও করব না। ঐতিহ্যের বিচারে কতটুকু রাখা অথবা ছাড়া আবশ্যক, সে বিষয়েও আমাদের। ভিতর ক্রমাগতই নানা মত দেখা দেবে। এটাই স্বাভাবিক; এটাই সুস্থ মনের প্রমাণ। বহু। মতের এই দ্বন্দ্বটাই প্রয়োজন। ভারতীয়ত্বের একটা মূল সংজ্ঞা ধরে নিয়ে দেশের উপর সেটা চাপাবার চেষ্টা করাটা শুধু নিষ্প্রয়োজন নয়, বিপজ্জনক। কোনো রাজনৈতিক দল। অথবা সরকার যদি একাজ করতে উদ্যোগী হন, তাতে আমাদের গণতন্ত্র এবং প্রগতি দুই-ই বিপন্ন হবে। যে কোনো নতুন চিন্তা সাধারণ্যে গৃহীত না-হওয়া পর্যন্ত সেটাকে বিজাতীয়। মনে হওয়া স্বাভাবিক। অভারতীয় চিন্তা ও বাক্য দমন করবার তোড়জোড় শুরু হলে সেই উৎপীড়নে আমাদের চেতনা সংকুচিত হবে এবং আমাদের ক্ষুদ্র মন নিয়ে আমরা বিশ্ব-বিজ্ঞানের প্রসারিত ধারা থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব।

কথাটা আর এক দিক থেকে রাখি। আমাদের একটা অশিক্ষিত অভ্যাস আমরা ব্যক্তিগত চরিত্রের মহত্ত্ব অথবা কলঙ্কের আলোচনায় অত্যধিক উৎসাহী। অভ্যাসটা জাতীয়, দলবিশেষের নয়। কিন্তু এটা দূর করা দরকার। মধ্যযুগের প্রধান চিন্তা ছিল ভগবচ্চিন্তা; সেখানে ধ্যান-ধারণার মূল্য চরিত্রের মূল্যে নিরূপণ করাটা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এবং সামাজিক আলোচনায় বিচারের একটা ভিন্ন মান প্রয়োজন। সেই মান এদেশে এখনও সৃষ্টি হয়নি। আমাদের চিন্তায় এই উপলব্ধিটা এখনও ভালভাবে প্রবেশ করেনি যে, কোনো মত ভ্রান্ত হলে ব্যক্তিগত চরিত্রপ্রসঙ্গ বাদ দিয়ে শুধু যুক্তির সাহায্যেই সেমতের ভ্রান্তি প্রমাণ করা সম্ভব এবং সেটাই প্রয়োজন। আধুনিক চিন্তার প্রবক্তারা সবাই ব্যক্তিগত চরিত্রে মহৎ নন। ফ্রাসিস বেকনের কাছে আধুনিক যুগ অশেষ ঋণী; নতুন বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিশেষ চরিত্রটি তিনি সতের শতকের প্রারম্ভে স্মরণীয় ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগত চরিত্রের দিক থেকে বেকন সম্ভবত পূজনীয় পুরুষ ছিলেন না। আবার নতুন চিন্তার প্রবক্তা যেখানে প্রকৃতপক্ষে মানুষ হিসাবে মন্দ নন, সেখানেও তাঁর মতকে তুচ্ছ প্রতিপন্ন করবার জন্য তাঁর চরিত্রে মিথ্যা কালিমা আরোপ করা প্রাচীন সমাজের নেতাদের পক্ষে অসম্ভব নয়। শুদ্ধ হিন্দুয়ানীর প্রচারে এই প্রবৃত্তিটা প্রশ্রয় পায়।

আধুনিক বামপন্থীরাও অবশ্য এ বিদ্যায় আজ কারও চেয়ে পিছিয়ে নেই। অপর মতের যুক্তিনিষ্ঠ সমালোচনার চেয়ে সেই মতাবলম্বীর ব্যক্তিগত চরিত্র সম্বন্ধে ইতর কুৎসা রটনায় এদের উৎসাহ বেশী। দক্ষিণপন্থী গোঁড়ামির সঙ্গে উগ্র বামপন্থীদের সাদৃশ্য এখানে উল্লেখযোগ্য। এর একটা মৌলিক কারণ সহজেই অনুমেয়। সব রকম গোঁড়ামির চোখেই নিজ নিজ মতের সত্যতা প্রশ্নাতীত, কাজেই মতবিরোধ ঘটলেই সত্যের তন্নিষ্ঠ আলোচনা ছেড়ে বিপক্ষের অভিসন্ধির প্রতি ক্রুদ্ধ আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। আমাদের এই কঙ্কপিপাসু দেশে খানিকটা কলঙ্ক কাহিনীর অবতারণা করে বিচারকে যুক্তিভ্রষ্ট করা মারাত্মক রকম সহজ। এই গ্রাম্য কুৎসাপ্রিয়তা থেকে দেশের মনকে উদ্ধার করে বিচারনিষ্ঠায় তাকে প্রতিষ্ঠিত না-করা পর্যন্ত এদেশে স্বাধীন চিন্তার ভদ্র ঐতিহ্য সৃষ্টি করা যাবে না।

রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত উদার যুক্তিবাদী, মানবপ্রেমিক একটি চিন্তার স্রোত দেশের উপর দিককার শিক্ষিত মানুষের মনে ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়েছিল। দেশের তলের দিকে সাধারণ মানুষের মনকে এই নতুন ধারা বড় স্পর্শ করতে পারেনি; শতাব্দীসঞ্চিত সংস্কার অক্ষুণ্ণ মহিমায় সেখানে বিরাজ করে গিয়েছে। স্বাধীনতার পর গণতন্ত্রের বর্তমান যুগে যুক্তি ও মানবতাবাদী চিন্তা ধারাকে কী করে রক্ষা করা যায় ও প্রসারিত করা যায়, এটাই আজকের এক প্রধান সমস্যা। জনসাধারণের সংস্কারকে উপেক্ষা করে গণপ্রতিনিধিত্ব করা কঠিন। শুধু রাজনীতি দিয়ে দেশের মনকে মুক্ত করা যাবে না। নতুন চিন্তার ধারাকে প্রসারিত করা, তাকে গণমানসে প্রবাহিত করা রাজনীতিক চালাকি দ্বারা সম্ভব নয়। এদেশে গণতন্ত্রকে সফল করতে হলে গণনির্বাচন ও দলীয় রাজনীতির পাশাপাশি চাই শিক্ষার প্রসার ও পুনর্গঠন, আর দেশব্যাপী নতুন চিন্তা ও বিচারের আলোড়ন। ভারতীয়ত্ব নিয়ে যাঁরা ভাবিত তাঁদের কাছে অতএব আমার আবেদন এই যে, ভারতীয়ত্বের সংজ্ঞাটা অন্তত এতটা প্রশস্ত রাখুন যাতে নতুন বিচারের ধারা স্বচ্ছন্দে বইবার পথ পায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *