1 of 2

১.১০ জাতীয় সংহতি

জাতীয় সংহতি

জাতীয় সংহতি নিয়ে ইদানীং বহু আলোচনা হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। আমাদের। ইতিহাসে এক এক সময়ে এক একটি সমস্যা বড় হয়ে ওঠে, আমাদের মনের অনেকখানি জায়গা দখল করে বসে। দেশ যতদিন পরাধীন ছিল ততদিন পরাধীনতার সমস্যাটাই বড় ছিল, দেশকে কী করে স্বাধীন করা যায় এই প্রশ্নটাই আমাদের মনকে অধিকার করে ছিল। আজ দেশ স্বাধীন। এখন দেশের ঐক্য কী করে রক্ষা করা যায় সেটা বড় প্রশ্ন হয়ে উঠছে। স্বাধীনতা লাভের সময়ে দেশ একবার খণ্ডিত হয়েছে। সেটা আমাদের। কাছে একটা বেদনার কাহিনী। কিন্তু দেশ আবারও খণ্ডিত হতে পারে এই রকম আশংকা। অন্তত কিছুকাল আমাদের আলোড়িত করেনি। ঘটনা অবশ্য মাঝে মাঝেই অপ্রত্যাশিত মোড় নেয়। স্বাধীনতালাভের পর পঁচিশ বছর পূর্ণ হবার আগেই পাকিস্তান আবার দুই খণ্ড হল। এখন পাকিস্তান বলতে শুধু পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের জন্মান্তর হয়েছে, নতুন জন্মে সে বাংলাদেশ। অবশিষ্ট পাকিস্তানের ভিতরও ঐক্য রক্ষা করা সহজ হচ্ছে না। সেখানে নানা ভাষা, নানা সম্প্রদায়। ভাষা, ধর্ম এইসব নিয়ে ভারতীয় সমাজের বৈচিত্র আরো বেশি। বস্তুত এটাই এদেশীয় সমাজের একটা মেল বৈশিষ্ট্য।

অবশ্য বৃহৎ সমাজ মাত্রেরই একটা বৈশিষ্ট্য তার বৈচিত্র্য। কিন্তু ভারতে এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। চীনের সমাজও এক বৃহৎ সমাজ। কিন্তু সে দেশে এতো বিভিন্ন ভাষা নেই। সোভিয়েত দেশে নানা ভাষা আছে, কিন্তু ভারতের মতো এতো বিভিন্ন ধর্ম নেই। ভাষা ধর্ম সব মিলিয়ে ভারত যেন অতুলনীয়। ভারতের তুলনা চলে শুধু সারা পৃথিবীর সঙ্গে। ভারত একটি অপেক্ষাকৃত ছোট মাপের পৃথিবী। পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশের ভিতর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সমস্যার কথা আমরা শুনেছি। একই সমস্যা ভারতের অভ্যন্তরে। এখানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ যদি আমরা দেখাতে পারি তবে সারা বিশ্বের সামনে একটা উদাহরণ তুলে ধরা হবে।

এদেশের বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠি, সম্প্রদায়ের ভিতর সহযোগিতা ও সংঘাত সারাক্ষণই চলছে। খবরের কাগজ খুললেই সংঘর্ষের খবর চোখে পড়ে, কারণ সংঘর্ষটাই নাটকীয়, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যতিক্রম। আর যেটা ব্যতিক্রমী ও নাটকীয় সেটাই তো খবর। খবরের ইংরেজি প্রতিশব্দটি লক্ষ করলেই এটা স্পষ্ট হয়, যাতে নতুনত্ব আছে তারই নাম খবর। অতএব খবরের কাগজে আমরা বিভিন্ন জাতি ও উপজাতি, গোষ্ঠি ও সম্প্রদায়ের ভিতর সংঘাতের কথা বড় করে প্রত্যহ পাই। কিন্তু সে সবই হল সমাজের প্রাত্যহিক জীবনের ব্যতিক্রমী ঘটনা। এরই পাশে পাশে চলছে নিঃশব্দ সহযোগিতা।

তবু এই ব্যতিক্রমী ঘটনাগুলিকেও ভালোভাবে বুঝতে হবে। সংঘাতের চরিত্র যদি আমাদের অজানা থাকে তবে সংহতির পথও খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। সমাজের গঠন এবং সংঘাতের স্বরূপ নিয়ে তাত্ত্বিকেরা নানা কথা বলেছেন। কারো কারো মতে সমাজের আসল দ্বন্দ্বটা হল ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে, শাসকশ্রেণীর সঙ্গে শোষিত শ্রেণীর। শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রবক্তারা সমাজকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন একদিকে আছে সম্পত্তির মালিক অনাদিকে সর্বহারা। আধুনিক সমাজে দ্বন্দ্বটা মূলত ধনিকের সঙ্গে শ্রমিকের মূলধন অথবা উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানার প্রশ্নটা প্রধান প্রশ্ন। সমাজের গঠন এবং সামাজিক সংঘাতের চরিত্র বুঝতে হলে এইখানে দৃষ্টিপাত করাটাই সবচেয়ে জরুরী। অন্য এক দৃষ্টিভঙ্গীর কথা আমরা আগেই বলেছি। সেই দৃষ্টিতে দেখলে, বহুজাতি ও সম্প্রদায় নিয়ে ভারত এক মহাজাতি। প্রতিটি বৃহৎ সমাজ যেন একটি যুক্তরাজ্য, যার ভিত্তিতে আছে স্থানীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে বিবিধ লোকসমাজ। এই দুই দৃষ্টিভঙ্গীকে মেলানো যায় কিছুর পর্যন্ত, দুয়েতেই কিছু সত্য আছে। জাতিতে সম্প্রদায়ে বিভক্ত। আমাদের এই সমাজ আবার সমাজে শ্রেণীদ্বন্দ্বও আছে।

কিন্তু এদের মেলাবার আগে এই দুই দৃষ্টিভঙ্গীর চরিত্রগত গভীর পার্থক্যটা বুঝে নেওয়া ভালো। কোনো এককালে সমাজ বলতে প্রধান ছিল গ্রামসমাজ। সেখানে জাতি ধর্ম। এইসব ভিত্তি করেই ছিল মানুষের পরিচয়। বাণিজ্যের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠল অন্য এক জগৎ। তার কেন্দ্রে আছে নাগরিক সমাজ। নগরের অজানা বহু লোকের ভিড়ে মানুষের পরিচয় কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে যায়। ক্রেতা অথবা বিক্রেতা, মালিক কি মজুর হিসেবে সে চিহ্নিত হয়। মানুষের শ্রেণী পরিচয়ে তার জাতি অথবা ধর্ম প্রধান কথা নয়, আর্থিক সম্পর্কটাই প্রধান। নিছক শ্রেণীভিত্তিক বিশ্লেষণে আমরা যে দৃষ্টিভঙ্গী পাই সেটা মূলত নাগরিক। জাতি ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্যক্তির পরিচয় খোঁজাটা গ্রামীণ সংস্কৃতির চরিত্রের সঙ্গে মেলে না। নাগরিক সভ্যতার কিছুটা দাপট সত্ত্বেও এ দেশের সংস্কৃতি আজও গভীরভাবে গ্রামীণ। আমাদের সমাজে তাই সহযোগিতা অথবা সংঘর্ষের কাহিনী লেখা যায় না সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে। ভারতবর্ষের ইতিহাসচচা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ একদিন লিখেছিলেন, “আমাদের প্রাচীন ভারতে অসামঞ্জস্য রাজায় প্রজায় ছিল না, সে ছিল এক জাতিসম্প্রদায়ের সঙ্গে অন্য জাতিসম্প্রদায়ের।” কথাটা আজও সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়। বস্তুত শুধু ভারতই নয়, পৃথিবীর অন্যত্রও একই কথা অল্প বেশি সত্য। আরব ইহুদী সংঘর্ষ, শ্বেতবর্ণ কৃষ্ণবর্ণের ভিতর বিদ্বেষ, ইংরেজ ও আইরিশের কলহ, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ, এইসবের ভিতর মানুষের সম্প্রদায়ভিত্তিক পরিচয় অস্বীকার করা যায় না। পৃথিবীর কোথাও মানুষের চৈতন্য শুদ্ধ নাগরিকতার ছাঁচে গঠিত নয়।

অসামঞ্জস্যটা আমরা যেভাবে দেখি সামঞ্জস্য স্থাপনের উপায়টাও সেইভাবেই বুঝি। এদিক থেকেও দুই দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য আছে। যদি বলি যে, সমাজ সংগঠনের মূল কথাটা হল এই যে, সমাজ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত, শোষক শ্রেণী আর শোষিত শ্রেণী, তবে শোষক শ্রেণীকে উৎখাত করই সমাজে সামঞ্জস্য স্থাপনের পথ হিসেবে দেখা যায়। যদি ভাবি যে, এই বৃহৎ সমানে বহু জাতিসম্প্রদায়ের এক যুক্তরাজ্য, তবে সাম্প্রদায়িক কলহের ভিতরও দায়িত্বশীল যের চোখে সাম্প্রদায়িক ঐক্য স্থাপনের কথাটাই বড় হয়ে ওঠে। যুধ্যমান দুই সম্প্রদায়ের ভিতর একটিকে উৎখাত করে শান্তি স্থাপনের চিন্তাটা একটা অমানুষিক চিন্তা। রবীন্দ্রনাথের কাছে তাই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য রক্ষাই শান্তির বাণী।

যাঁরা শ্রেণীদ্বন্দ্বের তত্ত্বে বিশ্বাসী তাঁরা অন্তত তাত্ত্বিকভাবে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ফলে শ্রেণীদ্বন্দ্বের শক্তি বিপথগামী হয়। মানুষের সংগ্রামী শক্তিকে চালিত করতে হবে শ্রেণীসংগ্রামের পথে, নান্য পস্থা। কিন্তু এটা মূলত রণকৌশলের কথা! সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকে আমরা মূল্য দিই কি না, এটা হল মূল্যবোধের প্রশ্ন। মানবতাবাদের তত্ত্বের সঙ্গেও একে স্বতঃসিদ্ধভাবে একাকার করে দেওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ মানুষের ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু সব স্থানীয় সংস্কৃতিকে একাকার করে তিনি মানবসংস্কৃতি স্থাপন করতে চাননি। বৈচিত্র্যকে রক্ষা করে তিনি ঐক্য চেয়েছেন। আমাদের মেনে নিতে হয় যে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আছে; সামাজিক সংগঠনে এর একটা স্থান আছে; এর নিজস্ব মূল্য আছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে শ্রেণীদ্বন্দ্বের তত্ত্বের পরিপূরক হিসেবে গ্রহণ করা যায়, কিন্তু একটিকে অন্যটির অন্তর্গত করা যায় না। এর যে-কোনোটিই এককভাবে অসম্পূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ শোষণের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু এতে রাবীন্দ্রিক বাণী সম্পূর্ণ হয় না। তিনি বৈচিত্রের ভিতর ঐক্যের প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন, একথাটা যোগ করতে হয় তার নিজস্ব মূল্যে।

ভারতীয় সমাজের অভ্যন্তরে আধুনিককালে যে সংঘর্ষ দেখা গেছে তার কিছুটা কারণ ধর্মান্ধতা, অনেকটার মূলেই আছে ক্ষমতা অথবা সামাজিক প্রতিষ্ঠা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ইতিহাসের এই পর্বের সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। এদেশের ইংরেজ বণিকের কর্তৃত্ব স্থাপনের পর নতুন এক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠল। এই প্রশাসনযন্ত্রে প্রবেশ লাভের জন্য ভারতীয় মধ্যবিত্তের ভিতর একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হল। এই প্রবেশ লাভের জন্য প্রয়োজন ছিল ইংরেজিভিত্তিক কলেজী শিক্ষা। হিন্দু, বিশেষত বাঙ্গালী উচ্চবর্ণের মানুষ, সর্বপ্রথম এই নতুন শিক্ষালাভের জন্য এগিয়ে যায়। পরে মুসলমানেরাও এই শিক্ষায় আগ্রহী হয়। ততদিনে হিন্দু উচ্চবর্ণ সরকারী শাসনতন্ত্রে অনেকটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এইভাবে শুরু হল হিন্দু এবং মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের নতুন মধ্যবিত্তের ভিতর সংঘাত।

স্বাধীনতালাভের পর কলেজী শিক্ষার আরো সম্প্রসারণ ঘটেছে। এখন সংঘর্ষ দেখা দিয়েছে হিন্দু উচ্চবর্ণের সঙ্গে হিন্দু নিম্নবর্ণের। বর্ণ না বলে জাতি অথবা জাত বলাটাই। সঙ্গত, এ দুয়ের ভিতর অর্থভেদ আছে। যাই হোক, একটা কথা এখানে বিশেষভাবে লক্ষ করতে হবে। কলহটা যখন ছিল প্রধানত হিন্দু ও মুসলমান মধ্যবিত্তের ভিতর তখনও সেটা দুই সম্প্রদায়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতার আকার ধারণ করে, সেভাবেই ইতিহাসে তার প্রভাব আঁকা হয়ে গেছে। আজকের জাতিতে জাতিতে যে সংঘর্ষ সেখানেও ব্যাপারটা ঐ ধরনের হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাঁরা নতুন কলেজী শিক্ষা লাভ করেছেন, হিন্দুসমাজের পিছিয়ে পড়া জাতির ভিতর তাঁরা সংখ্যায় স্বল্প। তবু কলহটা হয়ে উঠেছে জাতিতে জাতিতে কলহ। এটাকে শুধু উচ্চশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী কৌশল বললে ঠিকভাবে বলা হয় না। আসলে সাধারণ মানুষের আত্মপরিচয় স্বাভাবিকভাবে জাতিভিত্তিক ও সম্প্রদায়সংলগ্ন, এ কথাটা অস্বীকার করে আমাদের সমাজকে বোঝা যাবে না।

এই গোড়ার কথাটা মেনে নিয়ে আমাদের আইনে ও সংবিধানে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অনুসূচিত জাতি এবং পিছিয়ে পড়া জাতিকে কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এই আইনকানুনের ধারায় এবং প্রয়োগে কিছু ত্রুটি আছে, সে কথা ভিন্ন। কিন্তু আমরা, বিশেষত অগ্রসর জাতের অনেকে, গোড়াতেই একটা আপত্তি তুলি। আমরা বলি, জাতের ভিত্তিতে কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়াটাই ভুল, দিতে হবে ব্যক্তি কিংবা পরিবারের আর্থিক আয়ের অর্থাৎ দারিদ্র্যের বিচারে। অর্থাৎ, আমরা ধনী দরিদ্রের পার্থক্য বুঝি, জাতের পার্থক্যটা লক্ষ করতে চাই না। কিন্তু আমাদের বৃহৎ সমাজে জাতিতে জাতিতে পার্থক্যটা উপেক্ষা করবার মতো নয়। সমগ্র মানবসমাজের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করলেও একই সিদ্ধান্তে আসতে হয়। দেশ তো একটা সমষ্টিগত ব্যাপার, প্রতি দেশের ভিতর ধনী দরিদ্রের পার্থক্য আছে, গরীব দেশেও কিছু ধনী আছে। দেশের ভিতরকার অসাম্য দূর করবার চেষ্টা আবশ্যক, কিন্তু উন্নত দেশ ও অনুন্নত দেশের ভিতর যে আর্থিক দূরত্ব সেটাও কমাবার জন্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। দেশের ভিতর জাতিতে জাতিতে যে আর্থিক বৈষম্য তার বেলায় একই কথা বলতে হবে। অনুসূচিত জাতির ভিতর যারা অর্থবান ও সম্পত্তিবান তাদের জন্য বিশেষ অর্থসাহায্য দেওয়া ঠিক হবে না, এ কথা মেনে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন জাতি এবং সম্প্রদায়ের ভিতর যেখানে উন্নতির মানে দূরত্ব আছে সেখানে সেই দূরত্ব কমাবার জন্য কিছু বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হবে, তা নইলে সমন্বয় সাধনের কোনো স্থায়ী ভিত্তিই প্রস্তুত হবে না।

অবশ্য চাকরীর ক্ষেত্রে সরকারী সংরক্ষণ নীতিও যথেষ্ট নয়। অন্তত দুদিক থেকে এর গুরুতর অসম্পূর্ণতা চোখে পড়ে। এই সংরক্ষণ নীতিকে আশ্রয় করে অনুন্নত জাতের ভিতর থেকে যাঁরা শিক্ষিত এবং সুবিধাভোগী হয়ে বেরিয়ে আসছেন তাঁদের অনেক সময়ই একটা ত্রিশঙ্কু অবস্থায় গিয়ে পড়তে হচ্ছে। তাঁরা নিজেদের জাত থেকেও বিচ্ছিন্ন আবার। শিক্ষা সত্ত্বেও উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজের সঙ্গে তাঁদের সুষ্ঠু কোনো সমন্বয় ঘটেনি। শুধু সরকারী আইন দিয়ে সমাজ সমন্বয়ের কাজ কখনও সম্পূর্ণ হয় না। এজন্য প্রয়োজন হয় বৃহত্তর এক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলন। এই হল প্রথম কথা।

এরপর আসে দ্বিতীয় কথা। আমাদের কলেজী শিক্ষার দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটছে। গ্রামের সমাজ থেকে আগে মুষ্টিমেয় ছেলেই কলেজে প্রবেশ করত। আজ তাদের সংখ্যা। অনেক বেড়েছে। আরো বাড়বে। এরা সবাই যদি সরকারী চাকরীর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে তবে সাধারণ গাণিতিক নিয়মেই একটা অসম্ভব অবস্থার সৃষ্টি হতে বাধ্য, হচ্ছেও। এই অবস্থায় পিছিয়ে পড়া জাতের শিক্ষিত ছেলেমেয়েদেরও চাকরী দেওয়া যাবে না, অগ্রসর জাতের কথা তো ছেড়েই দেওয়া গেল। এ পথে সামাজিক সংঘর্ষ বাড়বে, কমবে না। গ্রামীন অর্থনীতি এবং সেই সঙ্গে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার রূপান্তর অতএব আমাদের প্রাথমিক প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একদিকে গ্রামের সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সেবা ব্যবস্থার অভাব। আর অন্যদিকে গ্রামের শিক্ষিত ছেলেরা বেকার। এই অসঙ্গতি থাকতে দেবার অর্থ হয় না। আমাদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা এমন হওয়া সম্ভব যে গ্রাম থেকে ছেলে বেছে নিয়ে তাদেরই তৈরি করা যায় গ্রামে নিরক্ষতা দূরীকরণের কাজের জন্য, অথবা গ্রামের স্বাস্থ্য পরিকল্পনায় নিযুক্তির জন্য, অথবা গ্রামীণ ব্যাংকে কর্মনিবাহের উদ্দেশ্যে। আরো গোড়ার কথা এই যে অনুন্নত জাতি ও উপজাতির উন্নতি এবং গ্রামোন্নয়নের জন্য সরকারী তহবিল থেকে যে। টাকা আসে তার অনেকটাই আজকাল অর্ধপথে অন্তর্হিত হয় অনেক শহরবাসী মধ্যস্থের পকেটে। গ্রামীণ সংগঠনের কাজে গ্রামে মানুষদের যাতে প্রধান ভূমিকা থাকে, তারাই যাতে পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনার কাজে অগ্রসর হতে পারে, এই রকমই করতে হবে। নয় তো আমাদের সমাজ ও অর্থনীতি তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দেই বিধ্বস্ত হবে। গ্রামের সমাজে ব্যাধি জমে উঠবে আর শহরের হাসপাতালে তার সুষ্ঠু আরোগ্যের ব্যবস্থা হবে, এটা সম্ভব নয়। বহু জাতিতে ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত এই বৃহৎ সমাজে গ্রামের দিকে চোখ রেখেই সামাজিক নানা ব্যাধির আরোগ্যের আয়োজন করতে হবে।

জাতীয় সংহতির জন্য নানা পথে একই সঙ্গে চেষ্টা করা ছাড়া উপায় নেই। আর্থিক আয়োজনই যথেষ্ট নয়। প্রথমত আর্থিক উন্নয়ন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। দ্বিতীয় একটা কথাও আছে। সম্প্রতি যে সব দিক থেকে জাতীয় সংহতির উপর আক্রমণ এসেছে সেগুলি বিবেচনা করে দেখলে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে সব রাজ্য অথবা। সম্প্রদায় আর্থিক বিচারে সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত তারাই যে সংহতিবিরোধী কাজে সবচেয়ে সক্রিয় হয়েছে এমন মোটেই নয়। ভারতের দরিদ্রতম প্রধান রাজ্য বিহার, পঞ্জাব নয় প্রত্যেকটি রাজ্য ও সম্প্রদায়েরই নিজস্ব সমস্যা অথবা অসন্তোষের কিছু কারণ থাকে একথা ঠিক, কিন্তু জাতীয় সংহতির বিরোধী শক্তিগুলিকে যে সব সময়েই কিছু ন্যায্য আর্থিক সহায়তা দিয়ে সন্তুষ্ট করা যায় এমন ধরে নেওয়া ঠিক নয়। অতঃপর কী করা যায়?

জাতীয় সংহতির ওপর যখন আঘাত আসে তখন সরকার অনেক সময়েই সামরিক উপায়ে তাকে আটকাতে চেষ্টা করেন। তারই চরম দৃষ্টান্ত সামরিক ডিক্টেটরশিপ। নানা কারণে সামরিক শাসনে সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলির দিকে তাকালেই সেটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সামরিক শাসন জাতীয় সংহতিবিরোধী শক্তিগুলিকে নির্মূল করতে পারে না, তাদের কিছুকালের জন্য আত্মগোপন করতে বাধ্য করে মাত্র। বহুজাতিক সম্প্রদায়ে বিভক্ত বৃহৎ দেশকে বেশিদিন সামরিক স্বেচ্ছাচারিতায় ঐক্যবদ্ধ রাখা যায় না। অবশেষে কোনো একপ্রকার ঐকমত্যের দিকে অগ্রসর হতে হয়। বিভিন্ন জাতির স্বায়ত্তশাসনের অধিকার অনেকটা মেনে নিতে হয়। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ নয়, সমাধান খুঁজতে হয় বিকেন্দ্রীকরণের পথে।

তবে এখানেও সমস্যার অতি সরলীকরণের একটা ভয় আছে। রাজ্য সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিলে তাকে ক্ষমতার একপ্রকার বিকেন্দ্রীকরণ বলা যেতে পারে। বিকেন্দ্রীকরণের শেষ লক্ষ্য কিন্তু গ্রামসমাজ। দলীয় রাজনীতি যেহেতু ক্ষমতা নিয়ে লড়াই, রাজ্যগুলি যদি এই লড়াইয়ে মত্ত হয়ে ওঠে তবে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হতে পারে রাজ্যের স্তরে। তাতেই জাতীয় সংহতি নিরাপদ হবে এমন নয়। জঙ্গী শিখেরা রাজ্যের হাতে কতটা ক্ষমতা চাইবে? কিছু পাবার পর আরো ক্ষমতা পাবার তৃষ্ণা বেড়ে যাবারই সম্ভাবনা। কোনো এক রাজ্য বেশি পেলে অন্যান্য রাজ্য কি অল্পে সন্তুষ্ট থাকবে? আরো বেশি পাবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যদি সব রাজ্য জড়িয়ে পড়ে তবে এর শেষ কোথায়? এই রকম কিছু প্রশ্ন একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না।

কেউ কেউ সোবিয়েত দেশের উদাহরণ তুলে ধরেন। দেশ ভাগের ঠিক আগে মুসলমান সম্প্রদায়ের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে একটা বিতর্ক শুরু হয়েছিল। আমাদের কম্যুনিষ্ট বন্ধুদের মুখে আমরা তখন শুনেছিলাম যে, সোবিয়েত যুক্তরাজ্যে অঙ্গরাজ্যগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে। কিন্তু ঐ অধিকার সত্ত্বেও সোবিয়েত দেশ যে খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়নি তার কারণ সারা দেশে ক্ষমতার একচেটিয়া অধিকার নিয়ে আছে একটিমাত্র দল। সেই দলের শক্তিতে সংহতি রক্ষা হচ্ছে। সংবিধানে কী বলা আছে সেটা প্রধান কথা নয়, বাস্তব অবস্থাটা বিবেচ্য। সত্যি কি কোনো অঙ্গরাজ্যকে সোবিয়েত সরকারের ক্ষমতার নাগালের বাইরে যেতে দেওয়া হবে, যদি সে যেতে চায়? প্রশ্নটা আরো একটু বিস্তৃত করে জিজ্ঞেস করা যাক। পূর্ব ইউরোপের কোনো রাষ্ট্রকেই কি মস্কোর কর্তৃত্বের বাইরে যেতে দেওয়া হবে? এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, মস্কো যথাশক্তি এটা হতে দেবে না। এর সপক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের। অভিসন্ধিই সিদ্ধ হবে যদি সোবিয়েত দেশ অথবা পূর্ব ইউরোপ টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আমাদেরও সতর্ক হয়ে চলা প্রয়োজন। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে দেশ যদি খণ্ড খণ্ড হয়ে যায় তবে পূর্ব এবং পশ্চিমের বৃহৎ শক্তির যুদ্ধক্ষেত্র হয় না কি সেই বহুবিভক্ত ভারত?

ভারতে একদলীয় শাসনতন্ত্র নেই। আমাদের গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে ওটা মেলে না। কিন্তু আমরা জাতীয় সংস্কুতি রক্ষা করতে চাই। কী ভাবে সেটা সম্ভব? এটাই মূল প্রশ্ন। সঠিক আর্থিক নীতি যদিও জরুরী তবু কোনো আর্থিক কার্যক্রম দিয়েই জাতীয় সংহতিকে নিশ্চিত করে তোলা যাবে না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ বাঞ্ছনীয়, অথচ সেটাও যথেষ্ট নয়। জাতীয় সংহতির জন্য আরো যা চাই কোথায় তাকে পাব? প্রশ্নটা যদি আমাদের ধাক্কা দেয় তাতেও কিছু কাজ হয়।

সম্প্রতি এই প্রসঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। শিক্ষার ভিতর দিয়ে এমন কিছু আদর্শের কথা মানুষের চেতনায় জাগ্রত রাখতে হবে যার ফলে সংহতি রক্ষা পায়। কিন্তু কোন্ আদর্শের কথা? অনেকেরই আসলে মনে আছে জাতীয়তাবাদী আদর্শের কথা। অনেকেই ভাবছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যের প্রতি নতুন প্রজন্মকে অনুরক্ত করে তোলা আবশ্যক। এখানেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। জাতীয়তাবাদের আদর্শও দেখা দিয়েছে একাধিকরূপে। হিন্দু মহাসভারও একটা জাতীয়তাবাদ ছিল, যেটাকে আমরা অনেকেই গ্রহণ করি না। স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাখ্যা নিয়ে আছে নানা বিবাদ

জাতীয়তাবাদের কথা অনেকে বলবেন নিজের মতো করে। কিন্তু মতবাদের চেয়েও বড়, কিছু মূল্যবোধ। বহু আশা ও নৈরাশ্যের ইতিহাস, বহু মতবাদের ধ্বংসস্তূপ অতিক্রম। করেও থেকে যায় কিছু মূল্যবোধ। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষের কাছে আমরা। পাই সেই মূল্যের পরিচয়। জাতীয় সংহতি রক্ষার কোনো অনায়াসসিদ্ধ এবং সুনিশ্চিত পথ নেই। কিন্তু অন্য সব উপায়ের সঙ্গে যোগ করতে হবে মূল্যবোধেরও শিক্ষা। সে। শিক্ষার একটি প্রধান কথা এই আমরা যে কোনো জাতি অথবা সম্প্রদায়েরই অন্তর্ভুক্ত হই না কেন, তাকে উন্নত করে তোলা যাবে না আত্মসংকোচনের পথে। বৃহওর কিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তবেই সম্ভব তার বৃদ্ধি ও বিকাশ, তবেই তার সার্থকতা, শেষ অবধি, সব অর্থেই।

এটা একটা সহজ সত্য, বাস্তববুদ্ধি এবং আদর্শবাদ যেখানে একবিন্দুতে এসে মিলেছে। এদেশের বিভিন্ন জাতি সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পিছনে এটাকেই মূল যুক্তি বলে আজ গ্রহণ করা যায়। সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বলে দুটি শব্দ আমরা ব্যবহার করে থাকি। কোনো সম্প্রদায়েরই স্থায়ী উন্নতি সম্ভব নয় যদি সে নিজের ভিতর নিজেকে গুটিয়ে রাখে। এতে তার আর্থিক উপার্জনের সুযোগ সংকীর্ণ হয়, বুদ্ধির মুক্তি ঘটে না, নীতিরও দুর্গতি ঘটে। সাম্প্রদায়িক জীবনের এই আবদ্ধ অবস্থাকেই আমরা বলব সাম্প্রদায়িকতা। আর যখন কোনো সম্প্রদায় অন্যান্য সম্প্রদায়ের ধর্মকে সমান শ্রদ্ধা জানিয়ে সহযোগিতার উন্মুক্ত পথে এগিয়ে যেতে আগ্রহী হয় তাকেই আমরা বলি ধর্মনিরপেক্ষতা। অন্তত ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার এটাই প্রায়োগিক অর্থ। সব ধর্মকে সমান শ্রদ্ধা দেখাবার যুক্তি এখানে সরল। বৃহত্তর সহযোগিতার জন্য যে সব নৈতিক নিয়ম প্রয়োজন তাদের খুঁজে পাওয়া সম্ভব সব ধর্মের ভিতর। ধর্মবিশেষের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কাজটা প্রধানত সেই ধর্মাবলম্বীর হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। কোন ধর্ম বড় কোনটা ছোট, এই তর্কে শুধু সহযোগিতার পথে বাধা সৃষ্টি হয়।

নিজের সম্প্রদায়ের প্রতি মানুষের একটা স্বাভাবিক মমতা থাকে। তাতে দোষ নেই। প্রতিবেশীকে নিয়েই তো স্বাভাবিক নিয়মে সহযোগিতার শুরু। অন্যায় প্রতিবন্ধক থেকে নিজের সম্প্রদায়কে মুক্ত করবার চেষ্টাও সঙ্গত। কিন্তু শেষ লক্ষ্য হবে সহযোগিতার সম্প্রসারণ প্রকৃত দূরদৃষ্টি নিয়ে দেখলে এতেই স্বজাতিরও কল্যাণ।

এসব কিছুই নতুন কথা নয়। এ সবই বোঝা সহজ, বোঝানো যায়। শিক্ষিত উপজাতীয় যুবক একথাগুলি সহজেই বোঝে, এটা আমি নিজেই দেখেছি। সর্বভারতীয় কোনো দলের অন্তর্ভুক্ত হতে রাজি নন এমন উপজাতীয় নেতার সঙ্গে কথা বলেও দেখেছি, তিনি সোৎসাহে সহমত জানিয়েছেন।

আপত্তি তোলেন কিছু বিজ্ঞ সংশয়বাদী কিন্তু নীতিকথায় কি কাজ হয়? না, হয় না। শুধু রাজনীতির কৌশলেও কিন্তু বেশী কিছু হয় না। সবই চাই আর্থিক পরিকল্পনা, বিজ্ঞ রাজনীতি, মূল্যবোধ।

গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৮৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *