1 of 2

১.০৫ সাধারণ নির্বাচন ও গণতন্ত্র

সাধারণ নির্বাচন ও গণতন্ত্র

১৯৫০ সালে আমরা ভারতের মানুষেরা, গণতান্ত্রিক সংবিধান গ্রহণ করেছিলাম। তারপর বারবারই সময় এসেছে নতুন করে নিজেকে দুটি প্রশ্ন করবার। আমরা গণতন্ত্রের পথ বেছে নিয়ে ঠিক করেছি তো? যদি ঠিক করে থাকি তবে গণতন্ত্রকে ভবিষ্যতে বিপদ থেকে মুক্ত রাখবার জন্য আজ আমাদের কী করণীয় ও চতুর্থ সাধারণ নিবাচনের পর এই দুটি প্রশ্নই আবার আমাদের সম্মুখেভবিষ্যতেরউদ্যত তর্জনীর মত উপস্থিত।

এই সাধারণ নির্বাচনে বহু স্থানে বিশ বৎসরের নিরবচ্ছিন্ন কংগ্রেসী রাজত্বের অবসান ঘটেছে। দোর্দন্ডপ্রতাপ নেতারা পরাস্ত হয়েছেন, বহু মুখ্যমন্ত্রী আসনচত। ভোটের অধিকার শুধুই একটা মামুলী অধিকার, ভোটের সাহায্যে ক্ষমতাবানকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায় না, অর্থলের কাছে ভোটদাতার স্বাধীনতা সর্বদাই পরাস্ত, এমন একটা হতাশ ভাবনা গত কয়েক বৎসর ধরে গণতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে ক্রমশ দুর্বল করে আনছিল। চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনের ফলে গণতান্ত্রিক বিশ্বাসের পুনরুজ্জীবন ঘটল।

কথাটা আরও একটু তলিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন। এমন কোনো আর্থিক, সামাজিক অথবা রাজনৈতিক ব্যবস্থা নেই যাতে জীবন থেকে সব অভাব-অভিযোগ অন্তর্হিত হয়। বাস্তুবাদী মানুষের এই কথাটা মনে মনে ধরে রাখাই ভাল। বিক্ষোভ সমাজে থাকবেই; কিন্তু এই বিক্ষোভকে সভ্যভাবে প্রকাশ করবার উপায় থাকা চাই। ক্ষমতার প্রভাবে শাসক অবিনীত এবং অত্যাচারী হয়ে উঠবেন এ-ভয় সব দেশেই থাকবে; তবে সেই শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করবার একটা শান্তিপূর্ণ পথ খোলা থাকা বাঞ্ছনীয়। আমাদের প্রতিবেশী নানা দেশে, যেমন ইন্দোনেশিয়া ও চীনে, আমরা ইদানীং গণবিক্ষোভের অন্য এক চেহারা। দেখেছি। অত্যাচারী শাসককে সরাবার নামে সেখানে গণশক্তি উন্মত্ত তাণ্ডবে মেতেছে। সেই তুলনায় ভারতের গণতান্ত্রিক নির্বাচন সংযত সুসভ্য। গণতান্ত্রিক হিসাবে এজন্য। আমরা গর্বিত।

.

নির্বাচনের পর কেন্দ্রে কংগ্রেসী দলের গরিষ্ঠতা এখনও অব্যাহত আছে, কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন দলের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সম্পর্ক এর ফলে একটা নতুন গুরুত্ব লাভ করেছে। এখানে সংকট দেখা দিলে দেশময় তোলপাড়ে গণতন্ত্র বিপন্ন হতে পারে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের পারস্পরিক সম্পর্কে সুবিচার ও বন্ধুভাব অক্ষুণ্ণ রাখা তাই আজ বিশেষ প্রয়োজন।

নতুন পরিস্থিতিতে কোনো কোনো ব্যাপারে বিভিন্ন রাজ্য বিভিন্ন নীতি অনুসরণ করতে চাইতে পারে। কোনো রাজ্য হয়ত মাদকতা নিবারণ নীতি রাখতে চাইবেন, কোনো রাজ্য। চাইবেন না। কোথাও ভূমিরাজস্ব তুলে দেওয়া হবে, কোথাও হবে না। এই ধরনের কিছু পার্থক্য আগেও ছিল; এখন সম্ভবত আরও বেশী করে দেখা দেবে। ভারতের মতো বড়। দেশে ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে নীতি ও কার্যক্রমের কিছুটা বিভিন্নতা ঘটাই স্বাভাবিক। কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই শাসন যখন অটুট ছিল তখন কর্মসূচীর যতটা সাম্য লক্ষিত হত আজ যদি ততটা না হয় তাতে ক্ষতি নেই; বরং কোনো কোনো ব্যাপারে ক্সর একটু বৈচিত্র্যই ভাল।

তাই বলে রাজ্য __ __ __ __ __ অবশ্য নয়। রাজ্য সরকার নিজের ব্যর্থতা ঢাকবার জন্য কোনো অসঙ্গত দাবি তুলে কেন্দ্রের উপর সব দোষ চাপাতে চেষ্টা করবেন, এটা একেবারে অসম্ভব নয় সারা দেশের দিক থেকে, গণতন্ত্রে। সাফল্যের দিক থেকে, এটা হবে অত্যন্ত ক্ষতিকর। কাজেই কেন্দ্রের কাছ থেকে কোনো রাজ্য সরকার যখন কিছু দাবি করেন তখন সেই দাবি সঙ্গত কি না দেশহিতৈষীমাত্রেরই সেটা দায়িত্বশীল মন নিয়ে বিচার করা প্রয়োজন। এসব বিষয়ে বিচার করবার সাধারণ নীতি হল এই যে, কোনো রাজ্য কেন্দ্রের কাছে যে-অধিকার দাবি করছেন অনুরূপ অধিকার সব রাজ্যকে দিলে তাতে সারা দেশের মঙ্গল কি না। উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যাক। কেরল সরকার দাবি করছেন যে, ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার একটি অংশ আলাদা করে কেরলকে দিয়ে দিতে হবে, কারণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ব্যাপারে ঐ রাজ্যের। বিশেষ অবদান আছে। এখন বিচার্য হল যে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা যদি এইভাবে বিভিন্ন রাজ্যের ভিতর ভাগ করে দেওয়া যায় তাহলে ভারতের আর্থিক পরিকল্পনা ও বাঙ্গীন উন্নতির দিক থেকে সেটা ভাল কি মন্দ।

সর্বোপরি যে-কথাটা মনে রাখা দরকার তা হল এই : এ দেশে বিভিন্ন রাজ্যে সরকারী মত ও কার্যক্রমের খানিকটা পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক; কিন্তু সমস্ত দেশের হয়ে যে-গণতান্ত্রিক সংবিধান আমরা গ্রহণ করেছি, নাগরিকের যে-সব মৌল অধিকার তাতে স্বীকৃত আছে, কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রতিটি রাজ্য সরকারকেই সেই সংবিধান ও মৌল অধিকারগুলি মান্য করে চলতে হবে। এক অর্থে এই সংবিধান-স্বীকৃত অধিকারগুলির প্রতিষ্ঠা সাময়িক জনমতের ঊর্ধ্বে। কথাটা কারও অদ্ভুত মনে হতে পারে কাজেই সামান্য ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

.

প্রাচীন যুগে রাজাই ছিলেন সব কর্তৃত্বের অধিকারী। কিন্তু সেই শাসকের স্বেচ্ছাচার যখন চরমে উঠত তখন তাঁকেও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হত যে রাজার ইচ্ছারও ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা ধর্মের। গণতন্ত্রে জনগণকে বসানো হয়েছে রাজার আসনে। কিন্তু গণতন্ত্রেরও একটা ধর্ম আছে; বিরুদ্ধ মত শান্তিপূর্ণভাবে প্রকাশের ও সংগঠনের অধিকার, আইন অনুযায়ী বিচার এই সব মৌল নীতি সেই গণতান্ত্রিক ধর্মেরই অংশ। জনগণের চঞ্চল, উম্মত্ত ইচ্ছা যদি কখনও এই মৌলিক অধিকারগুলিকে আঘাত করে তো স্বৈরাচারী রাজার মতোই নিন্দনীয় হয় বিপথগামী গণপ্রবৃত্তি। জনগণের প্রতিনিধিদের অবশ্য অধিকার আছে। ঐসব মৌল নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে আবশ্যকমতো আইনের পরিবর্তন সাধন। করার। তবু আইন অনুযায়ী বিচারই চাই; ‘গণ-আদালতে’র স্বৈরাচার গণতন্ত্রের প্রহসন মাত্র।

এ সব কথা শুধু নীতিগতভাবেই সত্য নয়, আজকের পরিস্থিতিতে এর একটা অত্যন্ত জরুরী ব্যবহারিক তাৎপর্যও আছে। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস দল নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে, বিভিন্ন দলের একটি বিকল্প সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আরও একাধিক রাজ্যে অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। সংবিধানের শর্ত পালন করেই এই সব সরকারকে টিকে থাকতে হবে। এ দেশের সকল দল গণতন্ত্রে সমান বিশ্বাসী নয়। কিন্তু কয়েকটা বাস্তব সত্য সকলেরই মনে রাখা ভালো। কোনো রাজ্যে আইন ও নিরাপত্তা বিপন্ন হলে অনিবার্যভাবেই শিল্প ও মূলধন সে স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় খুঁজবে এবং আশ্রয় জুটবেও। পুরনো শিল্প যদি স্থান ত্যাগ নাও করে তবু নতুন মূলধন সুস্থান খুঁজবে। যে-রাজ্য রাজনীতিক দুযোগে ক্লিষ্ট সেখানে বেকার ও আর্থিক দুর্দশা বৃদ্ধি পাবে। কোনো বৈপ্লবিক আওয়াজেই এই

সংকট আটকানো যাবে না। যেমন শহরে তেমনই গ্রামে। গ্রামে গ্রামে গৃহযুদ্ধের বীজ ছড়িয়ে সংকট ডেকে আনা কঠিন নয়; কিন্তু সংকট থেকে মুক্তির পথ তাতে উন্মুক্ত হবে না। সংবিধানকে অচল করা যাবে; কিন্তু সেই অচল সংবিধানও আমাদের বুকের উপর পাথরের মতো চেপে বসবে।

চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনের ফলে আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটা নতুন অধ্যায় যোগ হয়েছে। কংগ্রেসের অবিসংবাদী দক্ষতার অবসান হয়েছে। এখন প্রয়োজন দায়িত্বশীল, গণতান্ত্রিক বিকল্প দল সংগঠন। পশ্চিমবঙ্গে বিকল্প সরকার আমরা পেয়েছি। বহু দলের ঐক্যে প্রতিষ্ঠিত এই নতুন সরকারের মাধ্যমে কংগ্রেসের সমকক্ষ ঐক্যবদ্ধ, গণতান্ত্রিক, বিকল্প দল গঠনের কাজ যদি সহজ হয় তবেই ভাল। কোন উপদল এই বাঞ্ছিত বিবর্তনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালে দায়িত্বশীল গণমতের তিরস্কার তার প্রাপ্য। প্রধান কথা, গণতন্ত্রকে সফল করে তুলতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টা এ দেশে ব্যর্থ হলে তার ফলাফল হবে ভয়াবহ।

গত কয়েক বছরে দেশ নানা দুঃখ-দুর্দশার ভিতর দিয়ে গিয়েছে। এর জন্য দলবিশেষকে সম্পূর্ণ দোষী করাটা ভুল। কংগ্রেসের পরাজয়ের প্রয়োজন ছিল, কারণ ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভাল নয়। কিন্তু কোনো বিকল্প সরকারের কাছ থেকেই আমাদের অত্যন্ত কিছু প্রত্যাশা করা উচিত নয়। দেশের সামনে আরও দুঃখকষ্ট আছে, এর ভিতর দিয়েই আমাদের সাবধানে নিজ নিজ কর্তব্যে রত থেকে এগোতে হবে। প্রতিশ্রুতি অথবা প্রত্যাশার আতিশয্যে বিপদ আছে, কারণ এই আতিশয্যকে আশ্রয় করেই মানুষ সামান্য ভালোটাকে হারায় কল্পিত অতিভালোর দূরাশায়।

গণযুগ ও গণতন্ত্র (১৯৬৭)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *