1 of 2

১.০৪ শ্রমিক ও গণতন্ত্র

শ্রমিক ও গণতন্ত্র

সাম্য ও স্বাধীনতার নীতিতে যখন আমরা আস্থা স্থাপন করেছি তখন শিল্পে শ্রমিকের স্বায়ত্তশাসনের আদর্শকেও অস্বীকার করা যাবে না। সাম্যবাদের পক্ষে যে-সব যুক্তি বিস্তার করা হয় তার সবই সমান গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু মনে রাখা ভালো যে শিল্পের পরিচালনায় শ্রমিকের অধিকারকে আদর্শ হিসাবে গণ্য করেছেন শুধু মার্ক্সই নয়। এর সুস্পষ্ট স্বীকৃতি আছে জন স্টুয়ার্ট মিলের চিন্তায়, সকল গণতান্ত্রিকের পক্ষেই যা শ্রদ্ধেয়। আবার মিলের চিন্তায় এই স্বীকৃতির মূলে আছে পূর্ববর্তী সাম্যবাদীদের ধ্যানধারণা। মিলের বার বৎসর পরে মার্কের জন্ম। সাম্যবাদী আন্দোলন তারপর প্রচণ্ড তাত্ত্বিক তর্কে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। কিন্তু এইসব তর্কের উর্ধে যে সব আদর্শের প্রতিষ্ঠা শিল্পের পরিচালনায় শ্রমিকের অধিকার তাদেরই একটি।

তর্ক চলবে। পৃথিবীর শ্রমিক এক হোক, এটা মহৎ আদর্শ। কিন্তু পৃথিবীর শ্রমিকের স্বার্থ এক ও অভিন্ন এমন কথা যদি কেউ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসাবে রাখতে চান তো তর্ক অবশ্যম্ভাবী। সাম্রাজ্য থেকে ইংল্যাণ্ড যদি কোনো আর্থিক ফল লাভ করে থাকে তো ইংরেজ শ্রমিকও তার অংশীদার হয়েছেন। ম্যানচেষ্টর ও আমেদাবাদের শ্রমিকের ভিতর স্বার্থের কোনো বাস্তব ঐক্য নেই। যে-সব কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক আজ দলে দলে ইংল্যান্ডে প্রবেশ করছেন তাঁদের সঙ্গে ইংরেজ শ্রমিক স্বার্থের কোনো কল্পিত ঐক্যও বোধ করেন না।

শুধু বিভিন্ন দেশের শ্রমিকদের ভিতরেই স্বার্থের দ্বন্দ্ব সম্ভব নয় একই দেশে সকল শ্রমিকের স্বার্থও অভিন্ন নয়। রুশ দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার কিছুদিন পরই এই সত্যটি অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠেছিল। বিল্পবের পর লেনিন মন্ত্রী থেকে শ্রমিক পর্যন্ত সকলেরই আয় প্রায় সমান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ-ব্যবস্থা বেশীদিন টেকেনি। শ্রমিকদের ভিতরও স্তরভেদ আছে। কেউ অভিজ্ঞ, কেউ বা অনভিজ্ঞ; কারও কর্মে দক্ষতা বেশী, কেউ বা দক্ষ নন। এঁদের ভিতর পারিশ্রমিকের পার্থক্য কতটা হবে? এক ধরনের কর্মী অপেক্ষাকৃত বেশী পেলে অন্যেরা তুলনায় কম পাবেন, এটা তো সহজ। কথা। যেহেতু শ্রমিকেরা বিভিন্ন গুণ ও কর্মে বিভক্ত, অতএব তাঁদের ভিতর বাস্তব স্বার্থের দ্বন্দ্ব সম্ভব। আবার ক্রেতা ও বিক্রেতার ভিতর যেমন স্বার্থের সংঘাত থাকে, কৃষক ও শ্রমিকের ভিতরও তেমনই আছে; কারণ যে-খাদ্য কৃষক উৎপন্ন করেন, শ্রমিক তার ক্রেতা। খাদ্যশস্যের দাম তুলনামূলকভাবে বেশী হলে কৃষক খুশি, কিন্তু শ্রমিক অসন্তুষ্ট। এসব নিয়ে সমাজতান্ত্রিক দেশেও দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে।

কাজেই শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থ এক ও অবিভাজ্য, একথাটা তথ্যের বিশ্লেষণে দাঁড়ায় না। এটাকে বিশ্বাস হিসাবে ধরে নিলে মজুরশ্রেণীর ভিতর সংগ্রামী ঐক্য সৃষ্টি করা সহজ হয়। এটা অন্য কথা। কিন্তু একে ‘বৈজ্ঞানিক’ আখ্যা দেওয়া বিপজ্জনক। যুদ্ধের সময় জাতীয় স্বার্থের ঐক্যটাকে বড় করে ধরা হয়; তাতে জাতীয় সংগ্রাম প্রচেষ্টা শক্তিশালী হয়। কিন্তু জাতীয় ঐক্যের উত্তেজনাপূর্ণ ধারণাকে আবার গণতন্ত্রের শত্রুরা ব্যবহার করেছেন সকল। বিরোধী শক্তিকে সংহার করবার জন্য। এরই নির্মম প্রকাশ আমরা দেখেছি হিটলার মুসোলিনির দেশে। শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্য সম্বন্ধে উত্তেজিত ধারণাকেও তেমনই গণতন্ত্রের সংহারের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে সাম্যবাদী দেশে। বাস্তব জীবনে স্বার্থের ঐক্য ও সংঘাত দুই-ই পরম্পর জড়িয়ে থাকে। প্রয়োজনে কখনও একটিকে একমাত্র সত্য ও সম্পূর্ণ সত্য বলে চালাতে চাইলে শুধু যে সত্যের অপলাপ হয় তাই নয়, সমাজের বুকে নতুন স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার বিপদও দেখা দেয়।

কিন্তু এ তর্ক মুলতুবী থাক। গোড়ার সেই আদর্শের প্রশ্নেই ফিরে আসা যাক। শিল্পে শ্রমিকের স্বায়ত্তশাসন সাম্যবাদী আদর্শের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। জাতীয় অথবা শ্রেণীগত স্বার্থের ঐক্যের ধারণা এখানে নিষ্প্রয়োজন। ধনিকের মুনাফা ও শ্রমিকের মজুরী ঐতিহাসিক সূত্রে পরস্পর বিরোধী, এই তত্ত্বেরও প্রয়োজন নেই। অস্বীকার করে লাভ নেই যে, শিল্পপতি যেখানেই উৎপাদন পদ্ধতির উন্নতিতে সহায়ক সেখানেই ধনিক ও শ্রমিকের স্বার্থ একই সঙ্গে হ্রস্বদৃষ্টিতে বিরোধী এবং দীর্ঘদৃষ্টিতে পরিপূরক। যে-বণিকগণ ও শিল্পনায়কেরা পৃথিবীময় বাণিজ্যবিস্তারে সহায়তা করেছেন ও উৎপাদনপদ্ধতির যুগান্তকারী উন্নতি ঘটিয়েছেন তাঁরা সমগ্র সমাজকেই আর্থিক উন্নতির একটা উচ্চতর স্তরে নিয়ে গেছেন। একথা অন্তত মার্ক্স অস্বীকার করেননি। এসব মেনে নিয়েও আমরা ধনতন্ত্রের উচ্ছেদ চাইতে পারি, অথবা বলতে পারি যে বৃহৎ শিল্পে স্বল্পসংখ্যক লোকের মালিকানা চিরকালের ব্যবস্থাও নয়, আদর্শ হিসাবে মান্যও নয়।

শিল্পে শ্রমিকের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে যুক্তিটাঐসব তাত্ত্বিক তর্কের বাইরে সহজেই স্থাপন করা যায়। মূল কথাটি সহজ। এমন একটা যুগ ছিল যখন সমাজের যাঁরা কর্তা তাঁদের কথা তলাকার মানুষেরা বিনা প্রশ্নে মেনে নিত। ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে শূদ্রের মনে সন্দেহ ছিল না। পুত্র পিতার, ভৃত্য প্রভুর, কনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠের আজ্ঞাবহ ছিল। সেযুগের সমাজে পরিবর্তনের চেয়ে ঐতিহ্যের প্রভাবই বড় ছিল। আজকের সমাজ গতিশীল। এই গতিশীলতার ফলে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে প্রশ্ন ও সংশয় প্রবল হয়েছে। সে যুগের পুরাতন ভৃত্যের আজ্ঞাবহতা আর আশা করা যায় না। আজকের বৃহৎ শিল্পে শ্রমিক ও পরিচালকের ভিতর সম্পর্কনির্ণয়ের প্রশ্নে সমাজের মানসিক পরিমণ্ডলের এই পরিবর্তন উপেক্ষা করা যায় না। যে-সব নিয়ম শিল্প প্রতিষ্ঠানে প্রযোজ্য তার যৌক্তিকতা শ্রমিকের কাছে স্পষ্ট না হলে নিয়ম কার্যকর করা প্রায়ই অসম্ভব! কাজেই শ্রমিক ও পরিচালকগোষ্ঠীর ভিতর চিন্তার একটা সেতুবন্ধ প্রয়োজন। এরই পরিণতি হিসাবে শিল্পের উপর শ্রমিকের কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে স্বীকার করে নেওয়া আবশ্যক। আর্থিক উন্নতির ইতিহাসে ধনতন্ত্রের অবদান যাই হোক না কেন, যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন অনিবার্য।

এই সঙ্গে আরও একটি কথা মনে রাখা বাঞ্ছনীয়। শিল্পে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেই শিল্পপরিচালনায় শ্রমিকের অধিকার কায়েম হয় এমন নয়। বরং রাষ্ট্রীয়করণের ফলে আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ধনতন্ত্রের উত্তরাধিকারী হিসাবে আজ দেখা দিয়েছে আমলাতান্ত্রিক আর্থিক ব্যবস্থা। ধনতন্ত্রের মতোই এটাও কোনো ব্যক্তিবিশেষের দুরভিসন্ধির ফল নয়। আধুনিক সমাজ ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের গঠন ও প্রকৃতিই এমন যে এর ভিতর ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ রোধ করা কঠিন।

অনুন্নত দেশগুলিতে এই বিপদ আরও গুরুতর। আমলাতন্ত্র শিল্পপরিচালনায় দক্ষ না হবার সম্ভাবনা; বহুক্ষেত্রে দেখা গেছে যে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে দক্ষতার মান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়েও নীচু। আবার যে-দেশে স্বৈরাচারের প্রতিরোধী ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি সেখানে একই দোষ আমলাতন্ত্রের আশ্রয়ে সর্বময় হয়ে উঠেছে। সরকারি মালিকানা কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজন। কিন্তু শিল্পের রাষ্ট্রীয়করণের ফলে যদি অকর্মণ্যতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতাই আরও সুদৃঢ় হয়ে বসে তবে সেই দুর্দশাকে সমাজতন্ত্রের নামে বরণ করা অর্থহীন দুভাগ্য। এই বিপদের কথা মনে রেখে আমাদের অগ্রসর হবার পথ নির্ধারণ করতে হবে।

শিল্পের পরিচালনায় শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হলে কয়েকটি শর্ত পূর্ণ হওয়া প্রয়োজন।

প্রথম প্রয়োজন শ্রমিক সমিতিকে সাংগঠনিক ভাবে শক্তিশালী করে তোলা। শিল্পপ্রতিষ্ঠান সরকারী হোক অথবা বেসরকারী হোক, শ্রমিক সমিতি যদি শক্তিমান হয় তো পরিচালকগণ শ্রমিকের কথায় কান পাততে বাধ্য। লাভের একটি অংশ শ্রমিকের প্রাপ্য হবে এই প্রস্তাবটিও সমর্থনযোগ্য। এর ফলে শিল্পের সঙ্গে শ্রমিকের মনের সংযোগ ঘনিষ্ঠতর হবে আশা করা যায়। শিল্পপতিদের পক্ষ থেকে একটা আপত্তি শোনা যায়। তাঁরা বলেন, ব্যবসায়ে ক্ষতি হলে তার কোনো অংশ কি শ্রমিকেরা বহন করতে রাজী হবেন? তা যদি না হয় তো লাভের অংশই বা তাঁদের দিতে হবে কেন? একথা ঠিক যে মজুরী কেটে ক্ষতির বোঝা শ্রমিকদের ওপর চাপানো যাবে না। তবে এক্ষেত্রে একটা। বিকল্প ব্যবস্থা শিল্পপতিরা বিবেচনা করে দেখতে পারেন। বাৎসরিক হিসাবের পরিবর্তে প্রতি বৎসরে পূর্ববর্তী পাঁচ বৎসরের লাভক্ষতির গড়পড়তা হিসাবে শ্রমিকের লভ্যাংশ নির্ণয় করা যেতে পারে। এ সবই শুধু প্রথম পদক্ষেপ। এরপর শ্রমিকের প্রতিনিধিকে পরিচালক সমিতির অন্তর্ভুক্ত করা বাঞ্ছনীয় হবে। আর শেষ লক্ষ্য হিসাবে থাকবে, সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কাঠামোর ভিতর সমবায়ের ভিত্তিতে শিল্পের পরিচালনা।

কিন্তু এর কিছু শর্ত আছে। আধুনিক শিল্পে যে-শৃঙ্খলাবোধ আবশ্যক, অনুন্নত দেশে তার খুবই অভাব। অথচ এছাড়া কোনো দেশই আজকের পৃথিবীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাঁড়াতে পারে না। জাপান, জার্মানি প্রভৃতি দেশের দ্রুত উন্নতির অন্যতম প্রধান কারণ। শৃঙ্খলাবোধ ও কঠিন পরিশ্রমের অভ্যাস। ধনতান্ত্রিক দেশে শ্রমিকদের ভিতর এইসব গুণ একভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। সোভিয়েত দেশে স্তালিনী শাসনে এটা সম্ভব হয়েছে অন্যভাবে। আমাদেরও যে-কোনো ভাবে এটা করতে হবে, নয় তো জাতি হিসাবে আমরা পরাজিত হব। শিল্পে স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে কর্মে দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলা ও নৈপুণ্যের যদি সংযোগ স্থাপন করা যায় তবেই সেই স্বায়ত্ত শাসন সফল হবে, নয় তো সেটা ব্যর্থ হতে বাধ্য।

তৃতীয় প্রয়োজন দেশময় বিজ্ঞানবোধ ও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রসার।

বৃহত্তর সমাজে গণতন্ত্র অব্যাহত না থাকলে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানেও গণতন্ত্রের প্রয়োেগ দুর্বল হতে বাধ্য। শিল্পের পরিচালনা আমরা যেভাবেই সংগঠন করি না কেন, শ্রমিক ও পরিচালকের দৃষ্টি অভিন্ন হয় না। এমন কি পরিচালক যদি শ্রমিকদের দ্বারা নির্বাচিত হন তবু নির্বাচনের পর দৃষ্টিভঙ্গীর এই পার্থক্যের সম্ভাবনা দূর হয় না; কারণ দায়িত্বের যেখানে বিভেদ আছে দৃষ্টিকোণের সেখানে পার্থক্য থাকাই স্বাভাবিক। এই অবস্থায় শ্রমিক ও পরিচালকের ভিতর বিরোধ নিষ্পত্তির একটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি একান্ত প্রয়োজন। একথা সকলেই স্বীকার করবেন যে, সাধারণ কতগুলি ব্যাপারে পরিচালকের কিছু বিশেষ ক্ষমতা না থাকলে কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন হতে পারে না। তার অতিরিক্ত কোনো প্রশ্নে বিরোধ দেখা দিলে তৃতীয়পক্ষের মধ্যস্থতাই গণতন্ত্রের অঙ্গ হিসাবে গ্রহণীয়। এর বিরুদ্ধে যুক্তি দেখানো হয় যে, মধ্যস্থ সব সময় নিরপেক্ষ হন না। কিন্তু গায়ের জোরকে মধ্যস্থ করলেও গণতন্ত্র বাঁচে না। কাজেই প্রশ্নটা এই যে, আদর্শ বিচারক আছেন কিনা? হিংসার চেয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো বিচারক পাওয়া যায় তবে তাঁর বিচারই শ্রেয়। বৃহত্তর সমাজে গণতান্ত্রিক চেতনা যদি জীবিত থাকে তো এমন বিচারক খুঁজে পাওয়া কঠিন হয় না। নয় তো শেষ সম্বল অহিংস অসহযোগের পথ তো আছেই।

গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে যোগ করা আবশ্যক বিজ্ঞানবোধ। উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যেখানে আমাদের কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই সেখানে অনেক বাদবিসম্বাদেরই যুক্তিসঙ্গত সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না। বিজ্ঞান ছাড়া আধুনিক শিল্পনীতির রূপায়ণে কোনো উদ্দেশ্যচেতনা অথবা দিগবোধ রক্ষা করাই সম্ভব নয়। এযুগে সাম্যবাদ সম্বন্ধে আলোচনা নিরর্থক যদি-না। সাম্যবাদকে সুদৃঢ় আর্থিক ভিত্তির ওপর স্থাপিত করা যায়। সেজন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানের প্রয়োগ। সাম্যের জন্য সংগ্রামে বিজ্ঞান ও গণতন্ত্রের মতো নির্ভরযোগ্য সহায় আর নেই।

যে কথাটা দিয়ে শুরু করা যেতো তাই দিয়ে শেষ করছি। শ্রমের মর্যাদায় শ্রমিকের মাদা। আমাদের সমাজে বিশ্বকমার আসন নীচু। কর্মের সংস্থানও আজ দেশে যথেষ্ট নয়। পঞ্জাবী ও গুজরাতীরা এদিক থেকে ভাগ্যবান। তাঁরা কর্মের সংস্থান করে নিয়েছেন। আর আমরা অভিমান করছি; হাত-পা ছুঁড়ছি। কিন্তু এটা এগোবার উপায় নয়। শ্রমনিষ্ঠা ও সংগঠনের গুণেই কর্মের সুযোগ সৃষ্টি হয়। মানুষের বিভিন্ন গুণের ভিতর কোনটাকে আমরা কত উঁচু আসন দেব এ নিয়ে যুগে যুগে দৃষ্টির পরিবর্তন ঘটেছে। যেহেতু মানুষ অসম্পূর্ণ এবং সবগুণ কারো ভিতর সমপরিমাণে আশা করা যায় না, অতএব এর ভিতর কয়েকটি গুণকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে ও বাড়িয়ে তুলে যুগের কাজ। সম্পন্ন করতে হয়। এদেশে শ্রমনিষ্ঠাকে আজ একটা বিশেষ সম্মানের আসন দেওয়া প্রয়োজন। গান্ধী ছোট কাজ নিজের হাতে তুলে নিয়ে তাকে বড় করতে চেয়েছিলেন; নিরলস পরিশ্রমের আদর্শ দেশের সামনে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু আমাদের স্বাভাবিক ঝোঁকটা আজও ভিন্নমুখী। আলস্যকে আমরা আজও বড় দোষ বলে মানি না। কর্মের চেয়ে এদেশে বংশের আভিজাত্য বড়। এই আভিজাত্যের পকে নত করে শ্রমিক আন্দোলন যদি শ্রমের মর্যাদাকে উন্নত করতে পারে তো সারা দেশেরই তাতে উন্নতি হবে।

কিন্তু আমাদের ভিতর যাঁরা বৈপ্লবিক ধ্বনি কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন তাঁরা এবিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনের কোনো দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। আমার একটি ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার কথা বলছি। যে-প্রতিষ্ঠানে আমি কাজ করি সেখানে একবার এমন একজন তরুণ শিক্ষককে ঘেরাও করা হল, যাঁর তুল্য কর্মনিষ্ঠ ব্যক্তি দেশে অথবা বিদেশে বড় চোখে পড়ে না। এর কর্তব্যনিষ্ঠার ভগ্নাংশও ঘেরাওকারীদের ভিতর ছিল না; তাঁদের সম্বল ছিল কিছু বৈষ্ণুবিক আওয়াজ। বন্ধুবর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী “উলঙ্গ রাজা” নামে একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা লিখেছেন। এদেশের রাজা ফাঁকিবাজ। বর্ণাঢ্য ধ্বনি দিয়ে তাঁকে আবৃত করার চেষ্টা বৃথা, যদিও এই হাস্যকর আড়ম্বরে হাততালি দেবার লোকের অভাব হয় না।

শ্রম ও বিজ্ঞানের সাহায্যে মানুষ নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করে। এই সৃষ্টির কাজে সামান্য দানেও অসীম গৌরব। শ্রমের সাহায্যে মানুষ সমাজ ও ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়। যে-শ্রমিক আন্দোলন এই মহৎ ধারণায় বিন্দুমাত্র উদ্বুদ্ধ নয়, সে তার ক্ষুদ্রতায় একদিন খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়; ইতিহাসে তার কোনো বড় পরিচয় থাকে না।

সমাজ ও ইতিহাস (১৯৭০)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *