১২. কৌরবদের সেনাপতি ভীষ্ম

॥ ১২ ॥

এই সাংঘাতিক যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে কৌরবদের সেনাপতি ভীষ্ম বারবার অপমান করেছেন কর্ণকে। সকলের সামনে তিনি কর্ণ সম্পর্কে এমন কথাও বললেন, যোদ্ধা হিসেবে কর্ণ এমন কিছু বড় নয়, বড় বড় বীরদের তুলনায় কর্ণর ক্ষমতা অর্ধেকের মতন।

বারবার এ রকম কথা শুনে একসময় খেপে উঠলেন কর্ণ। উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, “ভীষ্ম যতদিন সেনাপতি থাকবেন, ততদিন আমি এই যুদ্ধে অস্ত্র ধরব না, এ রকম সভাতেও আসব না। এঁর মৃত্যুর পর আমি যুদ্ধ করতে আসব, তখন সবাই দেখবে আমার পরাক্রম।”

ভীষ্ম মোটেই সত্যি কথা বলেননি। সারা দেশেই অনেকে কর্ণকে একজন প্রধান, বীর বলে মনে করে। কেউ-কেউ মনে করে, এমনকী অর্জুনও তাঁর সমকক্ষ নন।

কর্ণ দুর্যোধনের বন্ধু আর পাণ্ডবদের সঙ্গে লড়াই করার চিন্তায় দুর্যোধন সব সময় নির্ভর করেছেন কর্ণের উপর। এখন এই নিদারুণ যুদ্ধের সময় কর্ণ থাকবেন না তাঁর পাশে? এ আবার হয় নাকি? এ রকম সময় দুর্যোধন ও আরও অনেকে দৌড়ে গিয়ে কর্ণকে ধরে ফেলে, তাঁকে ভাল-ভাল কথা শুনিয়ে ফিরিয়ে আনাই কি উচিত ছিল না?

কিন্তু ভীষ্ম আর কর্ণর ঝগড়া এমন এক পর্যায়ে এসেছে, কর্ণকে ফিরিয়ে আনলে ভীষ্মও হয়তো বলে উঠবেন যে, কর্ণ দলে এলে তিনিও যুদ্ধ না করে অস্ত্র ত্যাগ করবেন! তখন তো মহাগোলমাল শুরু হয়ে যাবে। তাই পিতামহ ভীষ্মর সম্মানরক্ষার জন্য দুর্যোধন তাঁকেই মান্য করলেন।

তারপর তো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, কর্ণকে বাদ দিয়ে। এ জন্য কৌরবদের যে কতখানি ক্ষতি হল, তা বুঝল না কেউ? কর্ণ যদি প্রথম থেকেই কৌরবদের পক্ষ নিয়ে লড়াই করতেন, তা হলে গোটা যুদ্ধটারই গতি অন্যদিকে ঘুরে যেতে পারত। তা তো হলই না, এর মধ্যে যুদ্ধ চলল দশ দিন। এই দশ দিনে দু’পক্ষেরই ক্ষতি হল অনেক। এই দশদিন কর্ণ ঘুরেছেন যুদ্ধক্ষেত্রের আশপাশে, সব খবর শুনেছেন, কিন্তু নিজে অস্ত্র ধরেননি।

এখন ভীষ্মর পতন হয়েছে, এখন তো যুদ্ধে অংশ নিতে কর্ণর কোনও বাধাই রইল না। অনেক কৌরবসৈন্য কর্ণের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন। এখন তাঁদের কাছে কর্ণই সবচেয়ে বড় ভরসা। পাণ্ডবরাও তাঁকে ভয় পান।

কর্ণ যুদ্ধে যোগ দিতে রাজি হয়েছেন। যুদ্ধের পোশাকে সজ্জিত হয়ে কর্ণ প্রথম যে কাজটা করলেন, তাতে আশ্চর্য হতেই হয়। তিনি গেলেন শরশয্যায় শায়িত ভীষ্মর কাছে। তখন আর কাছাকাছি কেউ নেই। ভীষ্ম তখন ঝিমিয়ে রয়েছেন। কর্ণ তাঁর পায়ে হাত দিয়ে বললেন, “হে কুরুশ্রেষ্ঠ, আমি রাধা ও অধিরথের পুত্র কর্ণ। আমি কোনও দোষ করিনি, তবু আপনি আমার উপর সব সময় বিদ্বেষ করেছেন। তবু আমি যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য অনুমতি চাইতে এসেছি।”

অতিকষ্টে চোখ মেলে ভীষ্ম দেখলেন কর্ণকে। তাঁকে আরও কাছে ডেকে এনে ভীষ্ম সস্নেহে বললেন, “তুমি তো রাধা আর অধিরথ নামে শূদ্রদের পুত্র নও। আমি নারদের কাছে শুনেছি, তুমি কুন্তীর সন্তান, তুমি ক্ষত্রিয়। তুমি পাণ্ডবদের বড় ভাই।”

কর্ণ বললেন, “আমার এই শূদ্র মা-বাবাকেই আমি মানি। এঁরা খুব শিশুকাল থেকেই সব রকম যত্নে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, আমার আর অন্য পরিচয় দরকার নেই।”

ভীষ্ম বললেন, “আমি আরও জেনেছি, তুমি একজন অসাধারণ যোদ্ধা, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তোমার তুলনা করা যায়, তুমি বেদ পাঠ করেছ, প্রচুর দান-ধ্যান করে থাকো। তবু আমি মাঝে-মাঝেই তোমাকে অপমান করেছি। তা তোমার তেজ কমিয়ে দেওয়ার জন্য। তুমি দুর্যোধনের সঙ্গে যোগ দিয়ে তার অনেক অন্যায়কে সমর্থন করেছ। কিন্তু তুমি যে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ, তার জন্য আমি খুশি হয়েছি। তোমার উপর এখন আমার আর রাগ নেই। তুমি যুদ্ধে যোগ দিতে যাচ্ছ, যাও৷ মনে রেখো, পাণ্ডবরা তোমার মায়ের পেটের ভাই, তুমি কৌরবপক্ষে থেকেও ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করো, দু’পক্ষকেই এক জায়গায় মিলিয়ে দাও, ভাইয়ে-ভাইয়ে এই নিদারুণ অর্থহীন যুদ্ধ দু’টি পরিবারেরই যে ধ্বংস ডেকে আনবে। আমার পতনেই এই যুদ্ধের অবসান হোক। অনেক রাজা আর প্রচুর সাধারণ মানুষ এ জন্য প্রাণে বেঁচে যাবে।”

কর্ণ বললেন, “আপনি যা বললেন, তা একেবারে ঠিক। আমিও আপনার সঙ্গে একমত। কিন্তু পিতামহ, এই যুদ্ধ থামাবার ক্ষমতা আমার নেই। দুর্যোধন যেন নিয়তির টানে ছুটে চলেছে সর্বনাশের দিকে। এই যুদ্ধে দু’ পক্ষই ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি মোটেই জয়ী হওয়ার আশা করি না। তবে, বিছানায় শুয়ে-শুয়ে মৃত্যু বরণ করার বদলে আমাদের মতন যোদ্ধারা যদি সংগ্রাম করতে-করতেই মৃত্যু বরণ করে, সেটাই আমাদের পক্ষে সত্যিকার গৌরবের ব্যাপার। আমি সে জন্যই এসেছি। আমার অস্থির স্বভাবের জন্য হঠাৎ-হঠাৎ আপনাকে কিছু কটু কথা বলেছি, সে জন্য আমায় ক্ষমা করুন।”

ভীষ্ম বললেন, “এ যুদ্ধ থামাবার সাধ্য এখন আর কারও নেই। আমিও তো আগে কত চেষ্টা করেছি, একটুও সফল হতে পারিনি। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধ থামাবার জন্য যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা খুবই যুক্তিযুক্ত। তবু কেউ তা মানেনি। তুমি যুদ্ধে যোগ দিতে যাচ্ছ, যাও। নিয়ম নীতি মেনে যুদ্ধ করো, শিগগিরই যাতে তুমি স্বর্গে যেতে পারো, আমি তোমায় সেই আশীর্বাদ করছি।”

ভীষ্মকে আবার প্রণাম করে কর্ণ ছলছল চোখে নিজের রথে উঠে চলে গেলেন দুর্যোধনের কাছে।

কৌরবপক্ষের অনেকেই আশা করেছিলেন, ভীষ্মর পর কর্ণই হবেন সেনাপতি। কিন্তু কর্ণ তাতে রাজি নন। দুর্যোধন এ ব্যাপারে কর্ণর পরামর্শ চাইলে তিনি বললেন, “আমাদের পক্ষে এমন বেশ কয়েকজন আছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই সেনাপতি হওয়ার যোগ্য। তবে, তাঁদের একজনকে সেনাপতি হিসেবে বরণ করলে অন্যরা ক্ষুব্ধ হবেন, কিংবা দুঃখিত হবেন। তাই আমার মতে, অস্ত্রগুরু দ্রোণই হোন সেনাপতি। তাঁর বয়স সকলের চেয়ে বেশি, আর এখানে অনেকেই তাঁর শিষ্য। কেউ এতে আপত্তি করবে না।”

দ্রোণ রাজি হলেন। তিনিই হলেন কৌরবদের দ্বিতীয় সেনাপতি।

আবার যথারীতি যুদ্ধ শুরু হবে, তার আগে দ্রোণ দুর্যোধনকে বললেন, “তুমি মহামতি ভীষ্মর পতনের পর আমাকে সেনাপতিত্ব দিয়ে সম্মান জানিয়েছ। এ জন্য আমি খুশি হয়েছি তো বটেই। এখন তুমি আমার কাছে একটা বর চাও।”

দুর্যোধন বললেন, “হে গুরুশ্রেষ্ঠ, আপনি যদি আমাকে বর দিতেই চান, তা হলে যুধিষ্ঠিরকে জ্যান্ত অবস্থায় আমার কাছে ধরে এনে দিন।”

এ-কথা শুনে দ্রোণ খুব অবাক হলেন, খুশিও হলেন। ধন্য যুধিষ্ঠির। তিনি এমনই একজন মহৎ মানুষ যে, তাঁর প্রধান শত্রুও তাঁকে হত্যা করতে চায় না। বাঁচিয়ে রেখে শুধু ধরে আনতে চায়।

আসল ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম কিছুই নয়। যুধিষ্ঠির কতটা মহৎ চরিত্র, তা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাতে চান না দুর্যোধন। আসলে তিনি একটা মতলব এঁটেছেন। দুর্যোধন বেশ ভাল করেই জানেন যে, কোনও ক্রমে যুধিষ্ঠিরকে হত্যা করতে পারলে তাঁদের বিপদ আরও বেড়ে যাবে। পাণ্ডবদের অন্য চার ভাই তাঁদের দাদাকে এতই ভক্তি-শ্রদ্ধা করে যে, যুধিষ্ঠিরের মৃত্যু-সংবাদ পেলে তাঁরা সর্বশক্তি নিয়ে কৌরবদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। আর সেই পাণ্ডবদের মধ্যেই রয়েছেন ভীম ও অর্জুনের মতন অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধা! তার চেয়ে অনেক সহজ হবে যুধিষ্ঠিরকে ছিনিয়ে আনা। তাঁর উপর কোনও অত্যাচার করা হবে না। বরং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও বিনয় দেখানো হবে। তারপর তাঁকে অনুরোধ করা হবে, আর একবার পাশা খেলার জন্য। যুধিষ্ঠির এই প্রস্তাবে কখনও “না” বলেন না। তিনি খেলতে বসবেন, আর আগের বারের মতনই হারতে থাকবেন। প্রত্যেকটা খেলায় হেরে গিয়ে যুধিষ্ঠির সর্বস্বান্ত হবেন। তখন খেলার শর্ত অনুযায়ী চার ভাই ও দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে বাধ্য হবেন বারো বছরের জন্য বনবাসে যেতে। তারপরেও এক বছর অজ্ঞাতবাস। অত বছর পর আর তাঁদের যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসা সম্ভব হবে না। আর এ জন্য কৌরব পক্ষকেও কেউ দোষ দিতে পারবে না, যুধিষ্ঠির নিজেই খেলতে রাজি হবেন আর হারবেন, আর এসবের দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে।

দুর্যোধন তাঁর এই মতলবের কথা চেপে রাখতে পারলেন না। বলে ফেললেন দ্রোণের সামনে। দ্রোণ এখন কী করবেন, তিনি যে দুর্যোধনকে একটা বর দেওয়ার কথা দিয়ে ফেলেছেন? এখন তা আর ফেরানো যায় না।

দ্রোণ তখন বললেন, “রাজা, তুমি চাও যুধিষ্ঠিরকে জীবন্ত অবস্থায় ধরে আনি। সে দায়িত্ব আমি অবশ্যই পালন করব, তবে আমার কিছু অক্ষমতার কথাও তোমাদের জানিয়ে রাখি। অর্জুন যদি সর্বক্ষণ যুধিষ্ঠিরের পাশে-পাশে থাকে, তা হলে সেই অবস্থা থেকে যুধিষ্ঠিরকে উঠিয়ে আনার সাধ্য আমারও নেই। অর্জুন আমার শিষ্য ছিল ঠিকই, কিন্তু তারপরও সে ইন্দ্র আর অন্য অনেক দেবতার কাছ থেকে প্রচুর নতুন অস্ত্র পেয়েছে। তার সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করলে আমি কিছুতেই তাকে হারাতে পারব না। বরং তোমরা এক কাজ করো, অনেকে মিলে যে-কোনও ছুতোয় তোমরা অর্জুনকে যুদ্ধক্ষেত্রে অন্যদিকে নিয়ে যাও, যুধিষ্ঠির যদি একটুক্ষণের জন্যও ফাঁকা থাকেন, তাঁকে অন্য বীররাও ঘিরে থাকলেও আমি তাদের গ্রাহ্য করি না। আমি ঠিক যুধিষ্ঠিরকে তুলে এনে তোমার হাতে দেব। তোমাদের কাছ থেকে আমি শুধু এইটুকু সাহায্য চাই।”

দুর্যোধন ভাবলেন, কিছুক্ষণের জন্য অর্জুনকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়। গুরু দ্রোণ যখন কথা দিয়েছেন, তাতে মনে হচ্ছে, যুধিষ্ঠির এবার সত্যি-সত্যি ধরা পড়বেন।

যে-কোনও বড় যুদ্ধের সময় দু’পক্ষেই অনেক গুপ্তচর ঘোরাঘুরি করে। তারা অন্যরকম সেজে অন্য পক্ষের অনেক গোপন খবর জেনে নেয়। সেই রকমই এক গুপ্তচর কৌরবশিবির থেকে বেরিয়ে এসে দৌড়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে জানিয়ে দিল সব।

যুধিষ্ঠির তখন অর্জুনকে বললেন, “তুমি তো শুনলে গুরু দ্রোণের শপথের কথা। একমাত্র তুমি ছাড়া তিনি অন্য কোনও যোদ্ধাকে গ্রাহ্যই করেন না। সেই জন্য, আজ সারাদিন তুমি আমার পাশে-পাশেই থাকো। গুরু দ্রোণকে কোনও সুযোগ দিয়ো না।”

অর্জুন বললেন, “গুরু দ্রোণকে আমি কিছুতেই হত্যা করতে পারব না, আবার আপনার পাশ ছেড়েও কোথাও যাব না। আমি আমার অস্ত্রগুরুর সঙ্গে লড়াই করব ঠিকই, আর আপনাকে কেউ এখান থেকে তুলে নিয়ে যাবে, সে প্রশ্নই ওঠে না।”

সুতরাং দু’পক্ষেরই এই মনের ভাব নিয়ে শুরু হল যুদ্ধ। আজ এগারো দিন।

এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার। দুই পক্ষেই যেসব বড়-বড় বীর যোদ্ধা রয়েছেন, তাঁদের বয়স কিন্তু কম নয়। ষাট কিংবা তারও বেশি হতে পারে। দ্রোণের বয়স ছিয়াশি। ভীম, অর্জুন, দুর্যোধন, কর্ণেরও বড়-বড় ছেলে আছে, তাদের কেউ-কেউ এই যুদ্ধে অংশ নিতে নেমে পড়েছে। তাদের মধ্যে অর্জুনের প্রিয় সন্তান অভিমন্যু বেশ বিখ্যাত।

এদিনের যুদ্ধে কৌরবরা অনেক চেষ্টা করেও যুধিষ্ঠিরের কাছাকাছি পোঁছতে পারলেন না। অর্জুন ছাড়াও ভীম, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও আরও অনেকে ঘিরে রাখলেন যুধিষ্ঠিরকে। সন্ধের সময় যুদ্ধ শেষ হলে দুই দলই নিজেদের শিবিরে ফিরে গেলেন গোমড়া মুখে। কৌরবপক্ষের অনেকেই আশা করেছিলেন যে, সেদিনই যুধিষ্ঠির সম্পর্কে একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলবেন দ্রোণ। আর পাণ্ডবদের পক্ষে অনেকেই ভাবছিলেন, সবাই মিলে যুধিষ্ঠিরকে ঘিরে থাকলে অন্যদিকে ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে অনেক।

সন্ধের পর দু’দিকের শিবিরেই প্রধান পুরুষরা আলাপ-আলোচনা করতে বসেন। দ্রোণ ম্লান মুখে দুর্যোধনকে বললেন, “আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, আজই যুধিষ্ঠিরকে ধরে নিয়ে আসব। কিন্তু আমি তা পারিনি। তবে তোমাকে তো আমি আগেই বলেছি, অর্জুন পাশে থাকলে দেবতাদেরও সাধ্য নেই যুধিষ্ঠিরকে স্পর্শ করার। তোমরা তো অর্জুনকে দূরে সরিয়ে দিতেও পারলে না!”

তখন ত্রিগর্ত নামে একটি দেশের রাজা এগিয়ে এসে বললেন, “কাল থেকে আমরা এ দায়িত্ব নিতে পারি। অর্জুন আমাদের রাজ্যের প্রতি অনেক অবিচার করেছেন, রাজা সুশর্মা ও তাঁর ভাইদের অপমান করেছেন বারবার, সেই সব কিছুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আজ তাঁরা জীবনপণ করতে চান। তাঁদের সঙ্গে থাকবেন সংসপ্তক আর নারায়ণী নামে অতি দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী, এঁরা যুদ্ধে নামার আগেই শপথ করেন, জয়ী হতে না পারলেও এঁরা কখনও রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান না, জীবন-মরণ সংগ্রাম করেন, সেখানেই প্রাণত্যাগ করেন।”

প্রশ্ন হল, এঁরা অর্জুনকে কীভাবে এখান থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবেন? অর্জুন এঁদের কথা শুনবেন কেন?

সুশর্মা তখন বললেন, “তার একটা সহজ উপায় আছে। অর্জুনের একটা শপথ আছে, কেউ যদি একেবারে অর্জুনের সামনে গিয়ে সরাসরি যুদ্ধে আহ্বান করে, অর্জুন তাকে অগ্রাহ্য করেন না। তার যুদ্ধ-সাধ মিটিয়ে দেওয়ার জন্য লড়ে যান। আমরাও কাল সকালে অর্জুনের কাছে গিয়ে এই আহ্বান জানাব। অর্জুন যুদ্ধ শুরু করলে আমরা বেশ কয়েকজন নানা দিক থেকে আক্রমণ করব তাঁকে। এতে অর্জুন খানিকটা বিভ্রান্ত তো হবেনই। কাকে ছেড়ে কাকে আক্রমণ করবেন? আমরা তাঁকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যাব, সেই অবসরে আপনারা যুধিষ্ঠিরকে ধরে নিতে পারবেন।”

গুপ্তচররা কৌরবশিবিরের এই সব গোপন কথাও জানিয়ে দিল পাণ্ডবদের।

পরদিন সকালেই ত্রিগর্তের রাজা ও অন্য কয়েকজন অর্জুনের শিবিরের সামনে শুরু করে দিলেন হইহল্লা।

অর্জুন যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে প্রথমেই গেলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে। তাঁকে প্রণাম করতে আর অনুমতি নিতে।

যুধিষ্ঠির বললেন, “আচার্য দ্রোণ চান আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কৌরবশিবিরে বন্দি করে রাখবেন। সেটা যাতে ওঁরা না পারেন, সেই ব্যবস্থা করার ভারও তোমারই উপরে। এখন তুমি কী করবে, তা নিজেই ঠিক করো।”

অর্জুন বললেন, “আমি যে প্রতিজ্ঞা করে বসে আছি, যে-কেউ আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইলে তাকে ফেরাব না। তবে, আমি কিছুক্ষণ না থাকলেও পাঞ্চাল রাজ্যের বীর সত্যজিৎ সব সময় আপনার গায়ে সেঁটে থাকবে। সত্যজিৎ নিজেও বড় যোদ্ধা, আরও অনেকে তো তাকে সাহায্য করবে। যদি সত্যজিৎ হঠাৎ নিহত হয়, তখন আমার বিশেষ অনুরোধ, আপনি তখন রণক্ষেত্র ছেড়ে আপনার শিবিরে বিশ্রাম নিতে যাবেন। এর মধ্যে তো আমি এসেই পড়ছি।”

যুদ্ধের সময়, কোথায় কারা মুখোমুখি হয়ে লড়ছে, কে নিহত হল, কে নিজেকে জয়ী মনে করল, কে কোন অস্ত্র ব্যবহার করছে, এই সবই সঞ্জয় শোনাতে লাগল অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে। কিন্তু আমাদের অত খুঁটিনাটি জানার দরকার নেই। অনেক যুদ্ধ তো একই রকম, সব নামও আমরা মনে রাখতে পারব না, বড়-বড় ঘটনাগুলো জানলেই হল।

যুদ্ধের ইতিহাস যখন লেখা হয়, তাতে সাধারণ পদাতিক সৈন্যদের কারও নামই থাকে না। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই এই পদাতিক সৈন্যরাই যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে দেয়। এখানেই সংসপ্তক আর নারায়ণী সৈন্যরা এত হিংস্রভাবে আক্রমণ চালাচ্ছেন, যাতে মনে হয়, আর দু’-এক দিনের মধ্যেই পাণ্ডবদের সৈন্যবাহিনী হয় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, অথবা প্রাণভয়ে পালাবে।

সেই জন্যই অর্জুন প্রথমে ত্রিগর্তের রাজা ও তাঁর ভাই-টাইদের যমের বাড়ি পাঠালেন, তারপর প্রবল বিক্রমে সংহার করতে লাগলেন ওই দুই বাহিনীর সৈন্যদের।

মোট কথা, আজ সারাদিন যুদ্ধে কী ফলাফল পাওয়া গেল? দু’পক্ষেরই কয়েকজন বীর সংগ্রামে নিহত হয়েছে, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, সারাদিনের মধ্যে কৌরবদলের কেউই যুধিষ্ঠিরের গায়ে একটি আঁচড়ও কাটতে পারলেন না।

একসময় সমস্ত আকাশ নানা রঙে রাঙিয়ে সূর্যাস্ত হতে লাগল। নিঃশব্দে নেমে এল সন্ধে। শেষ হল আর একটা দিন।

পরের দিনটাই তেরো দিনের দিন। সকাল থেকেই দ্রোণ তাঁর সৈন্যদের বিশেষ ভাবে সাজাতে লাগলেন। এর নাম ব্যূহ। এই ব্যূহও নানারকম হয়, নামও হয় অনেক রকম। দ্রোণ যেটি বানালেন, তার নাম চক্রব্যুহ। বাইরে থেকে এর মধ্যে প্রবেশ করা খুবই কঠিন; কিন্তু ভিতরে যারা রয়েছে, তারা অনায়াসে সেখান থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে। সেটাই খুব বিপদের কথা।

যুধিষ্ঠির অর্জুনের ছেলে অভিমন্যুকে বললেন, “বৎস, এই যে ওরা চক্রব্যুহ বানিয়েছে, এর মধ্যে ঢোকার কোনও কৌশল আমরা অনেকেই জানি না। শুধু জানে অর্জুন, শ্রীকৃষ্ণ, প্রদ্যুম্ন আর তুমি। বাবার কাছ থেকে তুমিই তা শিখেছ। এখন তুমি আমাদের পথ দেখাও, আমরা তোমার পিছু-পিছু যাব।”

অভিমন্যু তো যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। সে বলল, “আমি অবশ্যই আপনাদের জন্য পথ বলে দেব। তবে, একটা কথা আছে। বাবা আমাকে এর ভিতরে ঢোকার কৌশলটাই শিখিয়েছেন, কিন্তু এর থেকে বেরিয়ে আসার পদ্ধতিটা তিনি এখনও আমাকে শেখাবার সময় পাননি। আপনাদের ভিতরে নিয়ে গিয়ে যদি কোনও বিপদ হয়…”

ভীম বললেন, “বৎস, তুমি শুধু আমাদের জন্য এই ব্যূহের দ্বার খুলে দাও। আমি, সাত্যকি, আরও যাঁরা রয়েছেন, সবাই তোমার সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ব। তারপর ওদের যাকে পাব তাকেই খতম করব, আর এই ব্যূহটাই ভেঙে-চুরে লন্ডভন্ড করে দেব। তখন আর ফেরার পথ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”

অভিমন্যু তখন আনন্দে ঝলমল মুখে একটা হাত তুলে বলল, “চলুন তবে, আর দেরি করার কোনও দরকার নেই। শুরু হোক, শুরু হোক, আসুন!”

অভিমন্যু তার রথ চালিয়ে দিল সেই ব্যূহের প্রবেশপথের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *