৯৯. ধীরে ধীরে হাটছে ল্যাংডন

অধ্যায় ৯৯

ধীরে ধীরে হাটছে ল্যাংডন, অদ্ভুতভাবেই নিজেকে অশরীরি মনে হচ্ছে তার, যেনো নির্দিষ্ট একটি দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে। প্লেগের চেয়ে বিপজ্জনক আর কী হতে পারে?

বোট থেকে ডকে ওঠার পর সিয়েনা তাকে আর কিছু বলে নি। মেয়েটি তাকে শুধু ইশারা করেছিলো ডক থেকে নেমে নিরিবিলি একটি পথের দিকে চলে যেতে।

ল্যাংডন টের পাচ্ছে সিয়েনার চোখের জল থামলেও মেয়েটার ভেতরে এক ধরণের আবেগের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। দূরে সাইরেনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে কিন্তু সিয়েনাকে দেখে মনে হয় না এসব খুব একটা খেয়াল করছে। উদাসভাবে মাটির দিকে চেয়ে আছে, পায়ের নীচে যে কাঁকর বিছানো পথ আছে প্রতি পদক্ষেপে সেটার যে শব্দ তাতে যেনো সম্মোহিত হয়ে আছে সে।

তারা দু’জনে ছোট্ট একটি পার্কে ঢুকে পড়লে সিয়েনা তাকে গাছপালায় ঢাকা একটি জায়গায় নিয়ে গেলো, যেখানে তারা সারা দুনিয়া থেকে লুকিয়ে থাকতে পারবে। একটা বেঞ্চে বসে সামনের সমুদ্রের দিকে চেয়ে রইলো তারা। জলরাশির ওপারে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন গালাতা টাওয়ার, তার আশেপাশে জনবসতিগুলো ছোটো ছোটো বিন্দুর মতো দেখাচ্ছে। এখান থেকে খুবই প্রশান্তিময় মনে হচ্ছে চারপাশটা। কিন্তু ল্যাংডন জানে ভূ-গর্ভস্থ জলাধারে যা ঘটে গেছে তা কতোটা বিভীষিকা বয়ে আনতে পারবে। তার সন্দেহ, সিনস্কি আর এসআরএস টিম এরইমধ্যে বুঝে গেছে প্লেগটা থামানোর জন্য বেশ দেরি করে ফেলেছে তারা।

তার পাশে বসে থাকা সিয়েনা চেয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। “আমার হাতে বেশি সময় নেই, রবার্ট,” বললো সে। “পুলিশসহ বাকিরা জেনে যাবে আমি কোথায় গিয়েছি। তবে তারা সেটা করার আগে আমি চাই তুমি সত্যটা জানো…পুরো সত্যটা।”

নিঃশব্দে সায় দিলো ল্যাংডন।

চোখ মুছে তার দিকে মুখোমুখি বসলো সিয়েনা। “বারট্রান্ড জোবরিস্ট…ও আমার প্রথম প্রেম ছিলো। ও আমার একজন মেন্টর হয়ে উঠেছিলে।”

“এটা আমি জানি, সিয়েনা,” বললো ল্যাংডন।

একটু চমকে গেলেও কথা বলা অব্যাহত রাখলো সে। “তার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো মুগ্ধ করার মতো বয়সে। তার আইডিয়া, মেধা আমাকে বিমোহিত করে ফেলেছিলো। বারট্রান্ড বিশ্বাস করতো, যেমনটি আমিও করি, আমাদের মানুষের প্রজাতিটি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে…এক ভয়ঙ্কর সমাপ্তির মুখোমুখি আমরা, কারোর কোনো ধারণাই নেই ঐ বিপর্যয়ের ক্ষণটি কতো দ্রুত আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে।”

ল্যাংডন কোনো জবাব দিলো না।

“আমি আমার পুরো শৈশব জুড়ে এ বিশ্বকে রক্ষা করতে চেয়েছি,” বললো সিয়েনা। কিন্তু আমাকে শুধু বলা হতো : ‘তুমি এ বিশ্বকে রক্ষা করতে পারবে

, সুতরাং নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিও না। “ একটু থামলো সে, জোর করে কান্না আটকে রাখলো যেনো। তারপরই জোবরিস্টের সাথে আমার দেখা-চমৎকার সুন্দর আর মেধাবী একজন মানুষ, সে আমাকে বললো এ বিশ্বকে রক্ষা করা কেবল সম্ভবই নয়…বরং এটা করা আমাদের নৈতিক বাধ্যবাধকতা। সে আমাকে সমমনা বিশাল একটি সার্কেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়-ঐসব লোকজন বেশ বুদ্ধিমান আর সমাজে প্রতিষ্ঠিত…যারা আসলেই ভবিষ্যৎ পাল্টে দিতে পারবে। জীবনে প্রথম আমি নিজেকে আর একা মনে করলাম না, রবার্ট।”

নরম করে হাসলো ল্যাংডন, কথাটার মধ্যে যে যন্ত্রণা আছে সেটা টের পেলো।

“আমি আমার জীবনে অনেক ভয়ঙ্কর সব ব্যাপার সহ্য করেছি, কম্পিতকণ্ঠে বলতে লাগলো সিয়েনা। একটু থেমে ন্যাড়া মাথায় হাত বুলিয়ে গুছিয়ে নিলো নিজের চিন্তাভাবনা। “একটা কথা বিশ্বাস করেই আমি বেঁচে ছিলাম, আর সেটা হলো আমরা যেমনটি আছি তারচেয়েও ভালো থাকার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে…ভবিষ্যতের বিপর্যয় এড়িয়ে যাবার জন্য দরকারি পদক্ষেপ নেবার সক্ষমতা আমাদের আছে।”

“বারট্রান্ডও একই কথা বিশ্বাস করতো?” জানতে চাইলো ল্যাংডন।

“অবশ্যই। মানবজাতির ব্যাপারে বারট্রান্ডের সীমাহীন আশা ছিলো। ও একজ ট্রান্সহিউম্যানিস্ট ছিলো যে বিশ্বাস করতো আমরা আসলে পোস্টহিউম্যান যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি-যে যুগটা সত্যি সত্যি ভবিষ্যতে দেখা যাবে। ভবিষ্যৎ দেখার মতো চোখ ছিলো তার, সে এমনকিছু দেখতে পেতো যা সাধারণ মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। প্রযুক্তির বিস্ময়কর ক্ষমতা সম্পর্কেও তার আস্থা ছিলো, বিশ্বাস করতো এর সাহায্যে কয়েক জেনারেশনের পর আমাদের মানবজাতি একদম ভিন্ন একটি প্রজাতিতে উপনীত হতে পারবে-জেনেটিক্যালি তারা আরো বেশি উন্নত, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, স্মার্ট, শক্তিশালী এমন কি আরো বেশি সহমর্মি হয়ে উঠবে।” থামলো সে। “শুধু একটাই সমস্যা। সে মনে করতো না আমাদের প্রজাতিটি বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে। এসব সম্ভাবনার কথা বুঝতে পারবে।”

“বিপুল জনসংখ্যার কারণে…” ল্যাংডন বললো।

সায় দিলো সিয়েনা। “ম্যালথাসের বিপর্যয়। বারট্রান্ড আমাকে বলতো, তার নাকি মনে হতো সেন্ট জর্জ থানিক দানবকে হত্যা করার চেষ্টা করছে।”

ল্যাংডন তার কথাটার অর্থ ধরতে পারলো না। “মেডুসা?”

“রূপাকার্থে সেটাই। মেডুসাসহ থানিক দানবদের সবাই মাটির নীচে বাস করে কারণ তারা সরাসরি ধরিত্রির মার্তার সাথে সম্পর্কিত। অ্যালোগোরিতে, থানিকেরা সব সময়-”

“উর্বরতার প্রতীক,” বললো ল্যাংডন, এই সমান্তরাল ব্যাপারটি তার মাথায় আগে কেন আসে নি সেজন্য চমকে উঠলো সে। ফলদায়ক। জনসংখ্যা।

“হ্যাঁ, উর্বরতা,” জবাব দিলো সিয়েনা। “বারট্রান্ড ‘থানিক দানব’ শব্দটি ব্যবহার করতো আমাদের বৃদ্ধিমত্তার অশুভ হুমকিকে বোঝানোর জন্য। আমাদের বিপুল জনসংখ্যাকে দিগন্তের উপর ঝুঁকে থাকা দানবের সাথে তুলনা করতো সে…এমন একটি দানব আমাদের সবাইকে গিলে খাবার আগেই যাকে থামানোর দরকার। আর সেটা করতে হবে এক্ষুণি।”

আমাদের প্রজনন ক্ষমতাই আমাদেরকে ধাওয়া করছে, বুঝতে পারলো ল্যাংডন। খানিক দানব। “বাট্রান্ড সেই দানবের সাথে লড়াই করেছে…কিন্তু কিভাবে?”

“দয়া করে বোঝার চেষ্টা করো,” বললো সে। “এসব সমস্যা সমাধান করা সহজ কাজ নয়। কোন সমস্যাটি অগ্রাধিকার পাবে সেটা চিহ্নিত করা সব সময়ই জটিল একটি প্রক্রিয়া। তিন বছরের কোনো বাচ্চার পা কেটে ফেলে যে লোক সে মারাত্মক জঘন্য একটি কাজ করার অপরাধে অপরাধী…যদি না লোকটি একজন ডাক্তার হয় এবং বাচ্চাটিকে গ্যাংরিনের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কখনও কখনও আমাদেরকে দুটো খারাপের মধ্যে থেকে অপেক্ষাকৃত কম খারাপটিকে বেছে নিতে হয়।” আবারো তার চোখে অশ্রু। “আমি বিশ্বাস করি বারট্রান্ডের উদ্দেশ্য ছিলো খুবই মহৎ…কিন্তু তার পদ্ধতিটা…” মুখটা সরিয়ে নিলো সে, অন্ধকার আকাশের দিকে তাকালো।

“সিয়েনা,” নরমসুরে বললো ল্যাংডন। “এসব কিছু বোঝার দরকার আছে আমার। আমি চাই বারট্রান্ড কি করেছে সবকিছু তুমি আমাকে খুলে বলবে। সে আসলে কি ছড়িয়ে দিয়েছে, বলো তো?”

তার দিকে তাকালো সিয়েনা। তার গভীর কালো চোখে সুতীব্র আতঙ্ক। “ও একটা ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে,” ফিসফিসিয়ে বললো সে। “খুবই অন্যরকম একটি ভাইরাস।”

ল্যাংডনের দম আটকে গেলো। আমাকে বলো।

“বারট্রান্ড যেটা সৃষ্টি করেছে সেটাকে বলে ভাইরাল ভেক্টর। এটা এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যে কোষে এই ভাইরাস আক্রমণ করবে সেটাতে একটি জেনেটিক তথ্য ইন্সটল করে দেবে।” কথাটা যেনো প্রফেসর বুঝতে পারে সেজন্যে একটু থামলো সিয়েনা। “ভেক্টর ভাইরাস…কোনো কোষকে মেরে ফেলে না …বরং সেই কোষে আগে থেকে ঠিক দেয়া ডিএনএ প্রবেশ করিয়ে দেয়, এভাবে পুরো কোষটার জেনোম রূপান্তর করে ফেলে।”

কথাটার মানে বুঝতে কষ্টই হলো ল্যাংডনের। এই ভাইরাস আমাদের ডিএনএ বদলে দেয়?

“এই ভাইরাসটি এমনই যে,” সিয়েনা বলে যেতে লাগলো, “আমরা টেরই পাবো না ওটা আমাদেরকে সংক্রমিত করেছে। কেউ এরজন্য অসুস্থ হবে না। ওটা যে আমাদেরকে জেনেটিক্যালি বদলে দিচ্ছে সেটা বোঝার কোনো উপায়ই থাকবে না। কোনো সিমটম ধরা পড়বে না পরীক্ষা-নিরীক্ষায়।

ল্যাংডনের মনে হলো তার সমস্ত শরীরের রক্তপ্রবাহ বেড়ে গেছে। “এটা কি বদলে দেয়?”

কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে ফেললো সিয়েনা। রবার্ট, ফিসফিসিয়ে বললো সে, “ঐ জলাধারে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে একটি চেইন রি-অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। যারাই ওখানে গেছে তারা সবাই সংক্রমিত হয়ে পড়েছে। তারা এখন ঐ ভাইরাসের ‘হোস্ট হয়ে গেছে। নিজেদের শরীরে ভাইরাসের মতো অযাচিত মেহমানকে বয়ে বেড়াচ্ছে…নিজেদের অগোচরে এরকম মারাত্মক ছোঁয়াচে একটি ভাইরাস তারা মুহূর্তেই ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা দুনিয়ায়…অনেকটা বনে-বাদারে দাবানলের মতো তীব্র গতিতে। এতোক্ষণে এই ভাইরাসটি সমগ্র পৃথিবীর জনসংখ্যার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তুমি, আমি…সবার মধ্যে।”

বেঞ্চ থেকে উঠে উদভ্রান্তের মতো পায়চারি করতে লাগলো ল্যাংডন। “ভাইরাসটা আমাদের কি করে?” আবারো একই প্রশ্ন করলো সে।

দীর্ঘ সময় ধরে চুপ মেরে রইলো সিয়েনা। “এই ভাইরাসটি আমাদের শরীরে ঢুকে…আমাদের প্রজনন ক্ষমতাকে বিনষ্ট করে দেয়।” অস্বস্তি ভাব ফুটে উঠলো মেয়েটার চোখেমুখে। “বারট্রান্ড প্রজননবিনাশী একটি প্লেগ সৃষ্টি করেছে।”

কথাটা ল্যাংডনকে বজ্রাহত করলো যেনো। এই ভাইরাসটি আমাদের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করে ফেলবে? ল্যাংডন জানে এরকম কিছু ভাইরাস আছে যার কারণে আমাদের প্রজনন শক্তি অকেজো হয়ে পড়ে কিন্তু বাতাসবাহিত উচ্চমাত্রার সংক্রামক কোনো ভাইরাসের কথা শোনে নি যার ফলে আমরা জেনেটিক্যালি অনুর্বর হয়ে পড়বো। এটা তো অনেকটা অরওয়েলিয়ান কল্পকাহিনী হয়ে গেলো।

“এরকম ভাইরাসের কথা প্রায়শই বলতে বারট্রান্ড,” শান্তকণ্ঠে বললো সিয়েনা। “কিন্তু আমি কখনও ভাবি নি সে এটা সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে…কিংবা বলা যায় সৃষ্টি করতে সফল হবে। সে যখন আমাকে চিঠি লিখে জানালো এ কাজে সে সফল হয়েছে আমি প্রচণ্ড ভড়কে গেছিলাম। হন্যে হয়ে তাকে খুঁজে বেড়াতে শুরু করি, যেনো এই জিনিসটা ধ্বংস করে দেয়ার জন্য তাকে রাজি করাতে পারি। শেষে আমি তার নাগাল পেলেও ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়।”

“দাঁড়াও,” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললো ল্যাংডন। “এই ভাইরাস যদি আমাদের সবার প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করে দেয় তাহলে তো আর কোনো বংশধর জন্মাবে না। মানুষের প্রজাতিটি দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাবে।”

“ঠিক,” আস্তে করে বললো সে। “তবে মনে রেখো, মানুষের বিলুপ্তি কিন্তু বারট্রান্ডের উদ্দেশ্য নয়-বরং তার উদ্দেশ্য এর উল্টোটী-সেজন্যেই এমন একটি ভাইরাস সে সৃষ্টি করেছে যেটা দৈবচয়ন ভিত্তিতে সক্রিয় হয়ে উঠবে। এই ইনফার্নো আমাদের সবার শরীরে থাকার পরও, বংশপরম্পরায় এটা আমাদের মধ্যে বাহিত হলেও এটা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের মধ্যেই সক্রিয় হয়ে উঠবে। মানে, এটা সবার শরীরে থাকলেও সক্রিয়ভাবে কাজ করবে কেবলমাত্র কিছু মানুষের মধ্যে।”

“কিছু মানুষের মধ্যে মানে?” অবিশ্বাসে বলে উঠলো ল্যাংডন।

“বারট্রান্ড জানতো ব্ল্যাক ডেথ অর্থাৎ প্লেগ ইউরোপের এক তৃতীয়াংশের মতো জনসংখ্যা হ্রাস করেছিলো। ওর বিশ্বাস ছিলো প্রকৃতি জানে কিভাবে তার অযাচিত অংশ কমিয়ে আনতে হয়। বারট্রান্ড এটা সৃষ্টি করার সময় হিসেব করে দেখেছিলো প্লেগের আক্রমণে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের মৃত্যুর যে হিসেবটি আছে সেটা জনসংখ্যা কমিয়ে দেবার জন্য একেবারে যথার্থ একটি অনুপাত।”

এটা তো দানবীয় চিন্তাভাবনা, ভাবলো ল্যাংডন।

“ব্ল্যাক ডেথ এভাবে জনসংখ্যার ঘনত্ব কমিয়ে রেনেসাঁর পথ করে দেয়, বললো সে। “বারট্রান্ড এই ইনফার্নো সৃষ্টি করেছে আধুনিক পৃথিবীতে নতুন যুগের আবির্ভাবের সূচনা করার জন্য-এটা হলো ট্রান্সহিউম্যানিস্ট ব্ল্যাক ডেথ-পার্থক্য হলো এরফলে কোনো প্রাণহানি হবে না, শুধু প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। বারট্রান্ডের ভাইরাস এ মুহূর্তে বিশ্বের তিন ভাগের এক ভাগ মানুষের উপর ক্রিয়া করবে। বাকি দু’ভাগ আগের মতোই রয়ে যাবে। কিন্তু তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে আবার তিন ভাগের এক ভাগ জন্ম নেবে প্রজনন ক্ষমতাহীন হয়ে। এভাবেই এটা চলতে থাকবে।”

কথা বলতে গিয়ে সিয়েনার হাত কাঁপতে লাগলো। আমার কাছে লেখা বারট্রান্ডের চিঠি পড়ে মনে হয়েছে সে খুব গর্বিত এ নিয়ে। তার মতে এই ইনফার্নো মানবজাতির অনিবার্য সমস্যার খুবই মানবিক এবং অভিজাত একটি সমাধান।” তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়তে লাগলো আবার। সেই জল মুছে বলতে লাগলো সে, “প্লেগের ভয়াল ছোবলের কথা বিবেচনায় নিলে আমি স্বীকার করছি এটা অনেক বেশি সান্ত্বনাসূচক। কোনো মৃত্যু নেই। অসুস্থতা নেই। দুভোগ পর্যন্ত নেই। রাস্তাঘাটে মানুষের লাশ পড়ে থাকবে না। কবর দিতে দিতে শুকনো জায়গাও ফুরিয়ে আসবে না। চোখের সামনে কোনো প্রিয়জনকে ধুকে ধুকে মরতেও দেখা যাবে না। মানুষ কেবল তার প্রজনন শক্তি হারিয়ে ফেলবে, আগের চেয়ে কম জন্ম দিতে পারবে। এভাবে আমাদের জনসংখ্যা কমতে কমতে সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে একটা সময়।” থামলো সে। “প্লেগের চেয়ে এটার ফলাফল অনেক বেশি সম্ভাবনাময়। এটা শুধু আমাদের সংখ্যাকে কমিয়ে আনবে কিছুটা সময়ের জন্য। ইনফার্নোর সাহায্যে বারট্রান্ড একটি দীর্ঘমেয়াদী সমাধান দিয়েছে। স্থায়ী সমাধান…একটি ট্রান্সহিউম্যানিস্ট সমাধান। ও ছিলো জার্ম-লাইন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার। যেকোনো সমস্যা রুট লেভেল থেকে সমাধান করতো।”

“এটা তো জেনেটিক সন্ত্রাসবাদ…” বিড়বিড় করে বললো ল্যাংডন। “আমরা কে, সব সময় কি ছিলাম, এরকম মৌলিক বিষয়গুলোকে বদলে দেবে এটা।”

“বারট্রান্ড অবশ্য ব্যাপারটা এভাবে দেখে নি। মানুষের বির্বতনে যে মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে সেসব সারিয়ে তোলার স্বপ্ন দেখতো সে…ত্রুটিতা হলো আমাদের প্রজাতিটি খুব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। আমরা এমন একটি জীব যারা অসধারণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বিনামূল্যে যতো কনডম, জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল আর শিক্ষা দেয়া হোক না কেন আমরা জন্ম দিয়েই যাচ্ছি…সেটা আমরা চাই বা না চাই। তুমি কি জানো সিডিসি কিছুদিন আগে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গর্ভবতী মহিলাদের অর্ধেকই অনিচ্ছায় কিংবা অপরিকল্পিতভাবে সন্তান ধারণ করে? অনুন্নত দেশে এই হিসেবটা শতকরা সতুর ভাগেরও বেশি!”

এইসব পরিসংখ্যান ল্যাংডনও দেখেছে কিন্তু এটার কার্যকারীতা বুঝতে পারছে এখন।

বারট্রান্ড জোবরিস্ট আমাদের প্রজাতিটিকে নতুন করে ডিজাইন করেছে…আমাদেরকে রক্ষা করার জন্য…আমাদেরকে রূপান্তরিত করেছে কম প্রজনন শক্তিসম্পন্ন প্রজাতি হিসেবে।

গভীর করে দম নিয়ে বসফরাস প্রণালীর দিকে তাকালো ল্যাংডন। দূরে দেখা যাচ্ছে অনেকগুলো নৌযান। এখনও সাইরেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে এখান থেকে, সেটা আসছে ডক থেকে। ল্যাংডন বুঝতে পারলো সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

“সবচাইতে ভীতিকর ব্যাপারটি হলো,” সিয়েনা বললো, “ইনফার্নোর প্রজনন ক্ষমতা বিনষ্ট করা নয়, বরং এটার সক্ষমতা। একটি বাতাসবাহিত ভাইরাল ভেক্টর হলো বিরাট অগ্রগতি-সময়ের চেয়ে অনেক বছর এগিয়ে যাওয়া। বারট্রান্ড আচমকা আমাদের সবাইকে জেনিটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অন্ধকার যুগ থেকে এগিয়ে দিয়ে গেছে অনেক সামনের দিকে। বিবর্তনের প্রক্রিয়াটির তালা খুলে দিয়েছে সে, মানবজাতিকে নিজের প্রজাতিটি নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার সক্ষমতা দান করে গেছে। বাক্স থেকে প্যান্ডোরা বের হয়ে গেছে, ওটাকে আর বাক্সে ভরে রাখা যাবে না। মানুষের প্রজাতিটিকে আরো উন্নত করার চাবিকাঠি দিয়ে গেছে বারট্রান্ড…এই চাবি যদি ভুল কোনো হাতে পড়ে তাহলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই প্রযুক্তিটি সৃষ্টি করাই উচিত হয় নি। বারট্রান্ডের চিঠিতে যখন পড়লাম সে কিভাবে তার উদ্দেশ্য পূরণ করবে সঙ্গে সঙ্গে আমি চিঠিটি আগুনে পুড়িয়ে ফেলি। তারপর প্রতীজ্ঞা করি তার ভাইরাসটি খুঁজে বের করে ধ্বংস করে দেবো।”

“আমি বুঝতে পারছি না,” রাগেক্ষোভে বললো ল্যাংডন। “তুমি যদি ভাইরাসটি ধ্বংসই করতে চাইলে তাহলে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা আর ডা: সিনস্কির সাথে সহযোগীতা করলে না কেন? তোমার তো উচিত ছিলো সিডিসি কিংবা এরকম কাউকে জানানো।”

“তুমি কী বলছো! এই প্রযুক্তিটি কোনোভাবেই সরকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে পড়া ঠিক হবে না! ভেবে দেখো, রবার্ট। মানবসভ্যতার ইতিহাসে যতোগুলো যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয়েছে তার সবগুলোকেই আমরা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছি–আগুন থেকে শুরু করে পারমাণবিক শক্তি পর্যন্ত এ কথা বলা যায়-আর এ কাজটা করেছে শক্তিশালী সরকারগুলো। আমাদের বায়োলজিক্যাল অস্ত্র কোত্থেকে এসছে বলে মনে করো? বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং সিডিসি’র মতো প্রতিষ্ঠানের রিসার্চ থেকে এগুলোর উৎপত্তি। মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসকে জেনেটিক ভেক্টর হিসেবে ব্যবহার করলে সেটা হয়ে উঠবে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচাইতে শক্তিশালী মারণাস্ত্র। এটা যে পরিণতি বয়ে আনবে তার কথা আমরা কল্পনাও করতে পারবো না। এটা দিয়ে খুব সহজে টারগেটেড বায়োলজিক্যাল অস্ত্র বানানো সম্ভব। ভাবো এমন একটি প্যাথোজেনের কথা যা কেবল নির্দিষ্ট জাতিগ গোষ্ঠীর উপর আক্রমণ করবে কারণ ওটার মধ্যে ঐ জাতিগোষ্ঠীর জেনেটিক কোড মার্কার দেয়া আছে। এটা দিয়ে জেনিটিক স্তরে ব্যাপকহারে জাতিগত নিধন অর্থাৎ এথনিক ক্লেনজিং করা সম্ভব!”

“আমি তোমার দুর্ভাবনার ব্যাপারটা বুঝি, কিন্তু এই প্রযুক্তিটা ভালো কাজেও তো ব্যবহার করা যেতে পারে, পারে না? এই আবিষ্কারটি কি জেনেটিক মেডিসিনের মাধ্যমে আমাদের মঙ্গলের জন্য ঈশ্বর পাঠান নি? বিশ্বব্যাপী নতুন। ধরণের একটি রোগপ্রতিরোধক ভ্যাকসিন বানানোও তো যেতে পারে এটা দিয়ে।”

“সম্ভবত, কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যেসব লোকের হাতে ক্ষমতা আছে তাদেরকে থেকে আমি কেবল খারাপ কাজই করতে দেখেছি।”

বহুদূর থেকে হেলিকপ্টারের আওয়াজ ভেসে এলে ল্যাংডন সেটা শুনতে পেলো। গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে মসলার বাজারে উপরে চোখ যেতেই দেখতে পেলো রাতের আকাশে উপর থেকে একটি সার্চলাইট ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ মুহূর্তে ওটা আছে ডকের উপরে।

চিন্তিত হয়ে পড়লো সিয়েনা। “আমাকে যেতে হবে,” বললো সে। উঠে দাঁড়ালো, তাকালো পশ্চিমের আতাতুর্ক ব্রিজের দিকে। “আমার মনে হয় পায়ে। হেঁটেই আমি ঐ ব্রিজটা পার হতে পারবো। সেখান থেকে পৌঁছে যেতে পারবো।”

“তুমি কোথাও যাচ্ছে না, সিয়েনা, দৃঢ়ভাবে বললো সে।

“রবার্ট, আমি শুধু তোমার কাছে পুরো ব্যাপারটা খোলাসা করার জন্য ফিরে এসেছি। আমি মনে করেছি এটা তোমার জানা উচিত। তুমি তো এখন সব জেনে গেছে।”

“না, সিয়েনা,” বললো ল্যাংডন। “তুমি ফিরে এসেছে কারণ তুমি সারাটা জীবন পালিয়ে বেড়িয়েছে, অবশেষে তুমি বুঝতে পেরেছো তুমি আর পালিয়ে থাকতে পারবে না।”

তার সামনে সিয়েনা কুকড়ে গেলো। আমার আর কী করার আছে, বলো?” জলরাশির উপর ঘুরে বেড়ানো হেলিকপ্টারটির দিকে চকিতে তাকালো সে। “তারা আমাকে ধরতে পারলে জেলে ঢোকাবে।”

“তুমি তো কোনো অপরাধ করো নি, সিয়েনা। ঐ ভাইরাসটি তুমি সৃষ্টি করো নি…তুমি ওটা ছড়িয়েও দাও নি।”

“সত্যি, কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা যেনো ওটা খুঁজে না পায় সেজন্যে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে গেছি। আমি যদি তুরস্কের আদালতে দোষী নাও হই আমাকে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে অভিযুক্ত করা হবে জীবাণু অস্ত্রের সাথে জড়িত একজন সন্ত্রাসী হিসেবে।”

হেলিকপ্টারের আওয়াজটা বেড়ে গেলে ল্যাংডন ডকের উপর তাকালো। কপ্টারটি সেখানে স্থির হয়ে আশেপশে সার্চলাইট ফেলে তল্লাশী চালাচ্ছে।

যেকোনো সময় দৌড়ে পালানোর জন্য প্রস্তত হয়ে গেলো সিয়েনা।

“প্লিজ, আমার কথা শোনো,” নামকণ্ঠে বললো ল্যাংডন। “আমি জানি তুমি অনেক কষ্ট আর সঙ্কটের মধ্য দিয়ে গেছে, আমি এও জানি তুমি খুব ভয় পাচ্ছো, কিন্তু তোমার উচিত ভালো কিছু ভাবা। মঙ্গলজনক কিছু চিন্তা করা। জোবরিস্ট ভাইরাসটি সৃষ্টি করেছে আর তুমি সেটা থামানোর চেষ্টা করেছে।”

“কিন্তু আমি সেটা করতে পারি নি।”

“হ্যাঁ, এখন সেই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে, বৈজ্ঞানিক আর চিকিৎসক সমাজের এটা জানা দরকার, ভালোভাবে বোঝা দরকার। তুমি হলে একমাত্র ব্যক্তি যে এটার সম্পর্কে সবকিছু জানো। হয়তো এটা নিষ্ক্রিয় করার কোনো উপায় বের করা যাবে…” মেয়েটার চোখের দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকালো ল্যাংডন। “তুমি এভাবে উধাও হয়ে যেতে পারো না।”

সিয়েনার হালকা-পাতলা দেহটি কাঁপতে লাগলো, যেনো দুঃখ আর অনিশ্চয়তার প্লাবন বয়ে যাচ্ছে তার ভেতরে। “রবার্ট, আমি…আমি জানি না কী করবো। আমি এমনকি এও জানি না আমি কে। আমার দিকে তাকাও।” ন্যাড়া মাথায় হাত রাখলো সে। “আমি এক দানবে পরিণত হয়েছি। আমি কি করে এসব মোকাবেলা-”।

ল্যাংডন মেয়েটাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো। টের পেলো সিয়েনার সমস্ত শরীর কাঁপছে। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে কথা বললো।

“সিয়েনা, আমি জানি তুমি পালাতে চাইছে, কিন্তু আমি তোমাকে পালাতে দেবো না। আজ হোক কাল হোক কাউকে না কাউকে তোমার বিশ্বাস করতেই হবে।”

“আমি পারবো না…” ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো সে। “আমি জানিও না কিভাবে একজনকে বিশ্বাস করতে হয়।”

শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরলো ল্যাংডন। “ছোট্ট করে শুরু করো। ছোট্ট একটি পদক্ষেপ নাও। আমাকে বিশ্বাস করো।”

.

অধ্যায় ১০০

জানালাবিহীন সি-১৩০ বিমানের গায়ে জোরে জোরে আঘাতের শব্দ হলে প্রভোস্ট লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বাইরে কেউ পিস্তলের বাট দিয়ে প্লেনের দরজায় আঘাত করছে, দরজা খুলে তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়ার জন্য দাবি করছে জোরে জোরে।

“সবাই যার যার সিটে বসে থাকুন,” পাইলট আদেশের সুরে বলে দরজার দিকে এগোলো। “টার্কিশ পুলিশ এসেছে।”

প্রভোস্ট আর ফেরিস নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলো।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার যেসব কর্মচারী প্লেনের ভেতরে আছে তাদের ভাবসাব দেখে প্রভোস্ট বুঝতে পারছে কন্টেইনমেন্ট মিশনটি ব্যর্থ হয়েছে। জোবরিস্ট তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে ফেলেছে, ভাবলো সে। আর আমার কোম্পানি সেই কাজটা সম্ভব করতে সব ধরণের সাহায্য-সহযোগীতা দিয়েছে তাকে।

প্লেনের বাইরে কর্তৃত্বপরায়ন কণ্ঠটি এবার গর্জন করতে শুরু করলো তুর্কি ভাষায়।

“দরজা খুলবেন না!” পাইলটকে আদেশের সুরে বললো প্রভোস্ট।

থমকে দাঁড়িয়ে তার দিকে কটমট চোখে তাকালো পাইলট। “কেন খুলবো?”

“বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা একটি আন্তর্জাতিক রিলিফ সংগঠন, প্রভোস্ট জবাব দিলো, “আর এই প্লেনটা সার্বভৌম!”

মাথা ঝাঁকালো পাইলট। “স্যার, প্লেনটা টার্কিশ এয়ারপোর্টে পার্ক করা আছে। এখান থেকে প্লেনটা ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা এ দেশের আইন কানুনের অধীনেই থাকবো।” কথাটা বলে দরজা খুলতে চলে গেলো সে।

দু’জন ইউনিফর্ম পরা লোক চেয়ে আছে পাইলটের দিকে। তাদের শীতল চোখে কোনো ধরণের সৌজন্যতা নেই। “ক্যাপ্টেন কে?” ভারি কণ্ঠে একজন জিজ্ঞেস করলো পাইলটকে।

“আমি।”

অন্য অফিসার পইলটকে একটি কাগজ দেখালো। “গ্রেফতারের ডকুমেন্ট। এই দুজন প্যাসেঞ্জারকে আমরা নিয়ে যেতে এসেছি।”

কাগজটা পড়ে ভেতরে বসা ফেরিস আর প্রভোস্টের দিকে তাকালো পাইলট।

“ডা: সিনস্কিকে ডাকুন,” আদেশের সুরে বললো প্রভোস্ট। “আমরা একটি আন্তর্জাতিক ইমার্জেন্সি মিশনে এসেছি এখানে।”

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক কর্মচারি প্রভোস্টের দিকে চেয়ে নাক সিঁটকালো। “ডা: এলিজাবেথ সিনস্কি? বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালক? উনি নিজেই আপনাকে গ্রেফতার করার অর্ডার দিয়েছেন।”

“এটা হতে পারে না,” জবাবে বললো প্রভোস্ট। “মি: ফেরিস আর আমি এখানে এসেছি ডা: সিনস্কিকে সাহায্য করার জন্য।”

“তাহলে বলতে হচ্ছে আপনি ভালোমতো সাহায্য করতে পারেন নি,” দ্বিতীয় অফিসার বললো। “ডা: সিনস্কি নিজে আমাদের সাথে যোগাযোগ করে আপনাকে তুরস্কের মাটিতে বায়ো-সন্ত্রাস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন।” হ্যান্ডকাফ বের করলো সে। “আপনাদেরকে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হবে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য।”

“আমি একজন অ্যাটর্নি চাই!” চিৎকার করে বললো প্রভোস্ট।

.

ত্রিশ সেকেন্ড পর প্রভোস্ট আর ফেরিস হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় কালো রঙের একটি সিডানের পেছনে বসে আছে। তাদের গাড়িটা এয়ারপোর্ট থেকে বেশ দূরে কাটাতারের বেড়ার কাছে এসে আচমকা থেমে গেলো। কাটাতারের একটি জায়গা সুন্দর করে কেটে রাখা হয়েছে যেনো একটা গাড়ি ঢুকে যেতে পারে অনায়াসে। এরপর আস্তে করে সেখান দিয়ে গাড়িটা ঢুকে পড়লো। কিছুটা পথ এগোবার পর পরিত্যাক্ত একটি শিল্প এলাকায় এসে থামলো সেটা।

ইউনিফর্ম পরা দু’জন লোক গাড়ি থেকে বের হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিলো এবার। কেউ তাদেরকে ফলো করছে না দেখে সন্তুষ্ট হলো। দ্রুত নিজেদের পুলিশের ইউনিফর্মগুলো খুলে ফেলে পাশে রেখে ফেরিস আর প্রভোস্টকে গাড়ি থেকে বের করে আনলো তারা। হ্যান্ডকাফ দুটো খুলে ফেলতেই প্রভোস্ট কব্জি দুটো ঘষতে লাগলো। বুঝতে পারলো বন্দী অবস্থা তার মোটেও সহ্য হয় না।

“গাড়ির চাবিটা সিটের নীচে আছে,” একজন এজেন্ট বললো তাকে, কাছেই একটি সাদা রঙের ভ্যানের দিকে ইশারা করলো। “ওটার পেছনের সিটে একটা ডাফেলব্যাগ আছে, তারমধ্যে দরকারি সব জিনিস পাবেন-ট্রাভেল ডকুমেন্ট, নগদটাকা, প্রিপেইড ফোন, জামাকাপড়সহ আরো কিছু জিনিস।”

“ধন্যবাদ তোমাদেরকে,” বললো প্রভোস্ট। “বেশ ভালো কাজ করেছে।”

“আমাদেরকে এরকমই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, স্যার।”

এ কথা বলেই তুর্কি দু’জন সিডানটা নিয়ে চলে গেলো।

সিনস্কি আমাকে কখনই ছেড়ে দিতো না, নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিলো প্রভোস্ট। আর এ কথাটা সে বুঝতে পেরেছিলো বিমানে করে ইস্তাম্বুলে আসার পথে। তাই কনসোর্টিয়ামের এখানকার শাখায় ই-মেইল করে জানিয়ে দিয়েছিলো ফেরিস আর তাকে তুলে আনতে হবে প্লেন থেকে।

“আপনি কি মনে করছেন সিনস্কি আমাদের পেছনে লাগবে?” জানতে চাইলো ফেরিস।

“সিনস্কি?” মাথা নেড়ে সায় দিলো প্রভোস্ট। “অবশ্যই। যদিও বর্তমানে সে অন্য বিষয় নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত।”

তারা দু’জন গাড়িতে উঠে বসলে প্রভোস্ট ডাফেল ব্যাগ খুলে দেখে নিলো সব ঠিক আছে কিনা। একটা বেসবল ক্যাপ বের করে মাথায় পরে নিলো। হাইল্যান্ড পার্ক-এর ছোট্ট একটি বোতলও খুঁজে পেলো ব্যাগে।

ছেলেগুলো আসলেই ভালো।

বোতলটার দিকে চেয়ে প্রভোস্ট ভাবলো আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। তারপর জোবরিস্টের জীবাণুভর্তি ব্যাগ আর আগামীকালের তারিখটার কথা মনে পড়তেই মত বদলালো।

আমি আমার নিজের অলঙ্খনীয় নিয়ম ভঙ্গ করেছি, মনে মনে বললো সে। আমি আমার ক্লায়েন্টকে ছেড়ে দিয়েছি।

প্রভোস্টের কেমনজানি একটা অনুভূতি হলো, জানে আগামী দিনগুলোতে সারাবিশ্বের সংবাদে একটি মহাবিপর্যয়ের সংবাদ দখল করে থাকবে। সেই মহাবিপর্যয়ে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিলো। আমার সাহায্য ছাড়া এটা হতে পারতো না।

সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বোতলের মুখটা খুলে ফেললো সে।

উপভোগ করো এটা, নিজেকে সুধালো। যেভাবেই ভেবে দেখো না কেন তোমার দিন ফুরিয়ে আসছে।

বোতল থেকেই ঢকঢক করে অনেকটুকু পান করলো প্রভোস্ট। গলার ভেতরে উষ্ণতা টের পেলো।

আচমকা অন্ধকার বিদীর্ণ করে জ্বলে উঠলো তীব্র আলোর স্পটলাইট, আর নীল রঙের পুলিশের গাড়ির বাতি। তাদের চারপাশ ঘিরে ধরেছে তারা।

চারদিকে উদভ্রান্তের মতো তাকিয়ে দেখলো প্রভোস্ট…তারপর পাথরের মতো জমে রইলো নিজের সিটে।

পালানোর কোনো পথ নেই।

সশস্ত্র তুর্কি পুলিশের দল রাইফেল তাক করে তাদের ভ্যানের দিকে এগিয়ে আসতে থাকলে প্রভোস্ট শেষবারের মতো এক ঢোক পান করে আস্তে করে দু’হাত উপরে তুলে ধরলো।

ভালো করেই জানে এইসব অফিসার তার নিজের লোকজন নয়।

.

অধ্যায় ১০১

ইস্তাম্বুলের লিভেন্ট প্লাজার অত্যাধুনিক একটি সুউচ্চ ভবনে সুইস কনসুলেটটি অবস্থিত। প্রাচীন একটি মেট্রোপলিসের বুকে কাঁচেঘেরা এই ভবনটি সহজেই চোখে পড়ে।

প্রায় এক ঘণ্টা আগে জলাধার থেকে এখানে চলে এসেছে সিনস্কি, কনসুলেটের অফিসে স্থাপন করেছে ক্ষণস্থায়ী একটি কমান্ডপোস্ট। স্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলো জলাধারে পদপিষ্ঠ হবার খবরটি শোনার পর থেকে হামলে পড়েছে। তাদেরকে এখনও নির্দিষ্ট করে কোনো তথ্য দেয়া হয় নি তবে আন্তর্জাতিক একটি সংস্থার মেডিকেল সদস্যদের হ্যাঁজম্যাট সুট পরে ওখানে অবস্থান করার ঘটনাটি যথেষ্ট চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে, এ নিয়ে অনুমাণ করার লোকও কম নেই।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে শহরের বাতিগুলো দেখে নিজেকে খুব একা বোধ করলো। আনমনে গলার নেকলেসটায় হাত দিলো সে কিন্তু কিছু পেলো না। তার ভাঙা নেকলেসটির টুকরো এখন ডেস্কের উপর পড়ে আছে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালক কিছুক্ষণ আগে কয়েক ঘণ্টা পর জেনেভায় যে বেশ কয়েকটি ইমার্জেন্সি মিটিং হবে তার সমন্বয় করার ব্যবস্থা করেছে। বিভিন্ন সংস্থার স্পেশালিস্টরা ইতিমধ্যেই রওনা দিয়ে দিয়েছে। একটুপর সিনস্কি নিজেও প্লেন ধরবে তাদেরকে ব্রিফ করার জন্য। রাত্রিকালীন দায়িত্বে থাকা এক স্টাফ একটু আগে তার জন্য টার্কিশ কফি দিয়ে গেলে এক নিমেষেই সবটুকু পান করেছে।

কনসুলেটের এক তরুণ স্টাফ খোলা দরজা দিয়ে উঁকি মারলো। “ম্যাম? রবার্ট ল্যাংডন আপনার সাথে দেখা করতে চান।”

“ধন্যবাদ, উনাকে এক্ষুণি পাঠিয়ে দাও।”

বিশ মিনিট আগে ল্যাংডন তাকে ফোন করে জানায় সিয়েনা ব্রুকস তার চোখ ফাঁকি দিয়ে একটি স্পিডবোট চুরি করে পালিয়ে গেছে। সিনস্কি অবশ্য পুলিশের কাছ থেকে আগেই খবরটা পেয়ে গেছিলো। তারা সমুদ্রে তল্লাশী চালালেও খালি হাতে ফিরে আসে।

ল্যাংডনকে এখন দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে সিনস্কি অবাক হলো, তাকে দেখে চেনাই যাচ্ছে না। তার সুটটা নোংরা, ঘনকালো চুল এলোমেলো, চোখ দুটো ক্লান্ত আর বুজে আসছে যেনো।

“প্রফেসর, আপনি ঠিক আছেন তো?” উঠে দাঁড়ালো সিনস্কি।

ক্লান্তভঙ্গিতে হাসলো ল্যাংডন। “সারাটা রাত বেশ ভালোই গেছে আমার।”

“জোবরিস্টের ভাইরাসটি,” কোনো রকম ভূমিকা না করেই বসতে বসতে বললো ল্যাংডন। “মনে হয় এক সপ্তাহ আগেই ছড়িয়ে পড়েছে।”

ধৈর্যের সাথে সায় দিলো সিনস্কি। “হা, আমরাও এটা জানতে পেরেছি। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো সিমটমের রিপোর্ট পাই নি। আমরা নমুনাগুলো পরীক্ষা করার চেষ্টা করছি। কিন্তু সপ্তাহখানেকের আগে মনে হয় না সবটা জানা যাবে।”

“এটা ভেক্টর ভাইরাস, বললো ল্যাংডন।

সোজা হয়ে বসলো সিনস্কি। যারপরনাই অবাক সে। এই পদবাচ্যটি প্রফেসর জানে দেখে চমকে গেছে। “কী বললেন?”

“জোবরিস্ট এমন একটি বাতাসবাহিত ভেক্টর ভাইরাস সৃষ্টি করেছে যা আমাদের ডিএনএ বদলে দিতে পারে।”

এবার চেয়ার ছেড়ে উঠেই পড়লো ডাক্তার। এটা তো সম্ভবই না! “আপনার এ রকম দাবি করার কারণ কি?”

“সিয়েনা,” ল্যাংডন শান্তভাবে বললো। “ও-ই আমাকে এসব বলেছে। আধঘণ্টা আগে।”

ডেস্কের উপর দু’হাত রেখে সামনের দিকে ঝুঁকে এলো সিনস্কি। তার চোখেমুখে অবিশ্বাস। “মেয়েটা তাহলে পালিয়ে যায় নি?”

“অবশ্যই পালিয়েছিলো। বোটে করে সমুদ্রে চলে গেছিলো সে। খুব সহজেই চিরকালের জন্য পালিয়ে যেতে পারতো কিন্তু সে তা করে নি। স্বেচ্ছায় ফিরে এসে জানিয়েছ এই সঙ্কটেটায় সাহায্য করতে চায়।”

অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সিনস্কি। “ক্ষমা করবেন, ওই মেয়েকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ আমি দেখছি না। বিশেষ করে এরকম আজগুবি গল্প যখন বলেছে।”

“কিন্তু আমি তার কথা বিশ্বাস করি,” বললো ল্যাংডন। তার কণ্ঠে দৃঢ়তা। “সে যখন বলছে এটা ভেক্টর ভাইরাস তখন আপনার উচিত ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নেয়া।”

হঠাৎ করে সিনস্কির খুব ক্লান্ত বোধ হলো, ল্যাংডন কী বলছে সেটা বুঝে উঠতে হিমশিম খাচ্ছে। জানালার সামনে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। ডিএনএ বদলে দিতে পারে এমন একটি ভাইরাল ভেক্টর? কথাটা যেমন অবিশ্বাস্য তেমনি ভীতিকর। তবে সে জানে কথাটার মধ্যে যুক্তিও আছে। হাজার হোক, জোবরিস্ট একজন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার ছিলো, সে ভালো করেই জানতো একটি জিনে সামান্যতম পরিবর্তন দেহের মধ্যে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে-ক্যান্সার, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ফেইলিওর এবং রক্তে বিশৃঙ্খলা।

স্পেশালিস্টরা এখন এসব জেনেটিক অবস্থা মোকাবেলা করতে শুরু করেছে। অবিকশিত ভেক্টর ভাইরাসের সাহায্যে। এই ভাইরাস রোগীর শরীরে সরাসরি ইনজেক্ট করে দেয়া হয়। এসব ভাইরাস এমনভাবে প্রোগ্রাম করা হয় যেনো তারা রোগীর শরীরে ঢুকে ডিএনএ প্রতিস্থাপন করে ক্ষতিগ্রস্ত অংশকে মেরামত করতে পারে। আর সব বিজ্ঞানের মতো এই নতুন বিজ্ঞানেরও কিছু কারাপ দিক আছে। ভেক্টর ভাইরাসের ফলাফল হয় উপকারী নয়তো ধ্বংসাত্মক…এটা নির্ভর করে ইঞ্জিনিয়ারের মতিগতির উপরে। যদি কোনো ভাইরাসে ইচ্ছেকৃতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ প্রোগ্রাম করে সুস্থ কোষে ঢোকানো হয় তাহলে ফলাফল হবে খুবই ভয়াবহ। আর এই ধ্বংসাত্মক ভাইরাসকে যদি কোনোভাবে ইঞ্জিনিয়ার করে উচ্চমাত্রায় সংক্রমন আর বাতাসবাহিত করা যায়…

আর ভাবতে পারলো না সিনস্কি। জোবরিস্ট কি ধরণের জেনেটিক বিভীষিকা চিন্তা করেছে? জনসংখ্যার ঘনত্ব কিভাবে কমানোর পরিকল্পনা করেছে সে?

সিনস্কি জানে এর জবাব পেতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে। মানুষের জেনেটিক কোডে রয়েছে সীমাহীন রাসায়নিক পরিবর্তনের গোলকধাঁধা। জোবরিস্টের ভাইরাসের আসল কার্যকারীতা সম্পূর্নভাবে জানতে হলে কতোটা সময় লাগতে পারে সে ব্যাপারে সিনস্কির ভালো ধারণা আছে। খড়ের গাদায় সঁচ খোঁজার মতো ব্যাপার হবে না এটি, বরং ধরে নিতে হবে সেই খড়ের গাদাটি অজানা এক গ্রহে পড়ে আছে।

“এলিজাবেথ?” লাংডনের কণ্ঠটা তাকে বাস্তবে ফিরে আনলো।

জানালা থেকে ফিরে তাকালো সিনস্কি।

“আপনি কি আমার কথা শুনছেন?” জিজ্ঞেস করলো সে, এখনও শান্তভাবে চেয়ারে বসে আছে। “আপনি যেমনটি চেয়েছিলেন ঠিক তেমনি সিয়েনাও এই ভাইরাসটি ধ্বংস করতে চেয়েছিলো।”

“আমার তাতে গভীর সন্দেহ রয়েছে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো ল্যাংডন। “আমার মনে হয় আপনার উচিত আমার কথা শোনা। জোবরিস্ট মারা যাবার আগে সিয়েনার কাছে একটি চিঠি লিখে গেছিলো। তাকে বলেছিলো সে কি করেছে। এই ভাইরাসটি কি করবে সে ব্যাপারে তাকে বিস্তারিত বলেছে…কিভাবে এটা আক্রমণ করবে…কিভাবে এটা তার উদ্দেশ্য পূরণ করবে।”

বরফের মতো জমে গেলো সিনস্কি। একটা চিঠি আছে??

“সিয়েনা এই চিঠিটা পড়ে ভীষণ ভড়কে যায়। জোবরিস্টকে থামাতে চায়। সে। এই ভাইরাসকে সে এতোটাই মারাত্মক হিসেবে দেখে যে কেউ এটা সম্পর্কে জানুক তা চায় নি, এমনকি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ব্যাপারেও সে একই চিন্তা করেছে। বুঝতে পারছেন না? সিয়েনা ভাইরাসটি ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিলো…ওটা ছড়িয়ে দেয় নি।”

“একটা চিঠি আছে?” সিনস্কি জানতে চায়। “একেবারে বিস্তারিত জানিয়ে লিখেছে?”

“সিয়েনা আমাকে তাই বলেছে।”

“ঐ চিঠিটা আমাদের দরকার! ওটা থেকে আমরা বিস্তারিত জানতে পারলে অনেক সময় বেঁচে যাবে। আমরা খুব দ্রুত সব বুঝতে পেরে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য কাজে নেমে যেতে পারবো।”

মাথা ঝাঁকালো ল্যাংডন। “আপনি বুঝতে পারছেন না। জোবরিস্টের চিঠিটা পড়ার পর সিয়েনা খুবই ভড়কে গেছিলো। পড়ার পর পরই সে ওটা পুড়িয়ে ফেলে। সে চেয়েছিলো ওটা যেনো কারো হাতে

ডেস্কের উপর ঘুষি মারলো সিনস্কি। “ও আমাদের একমাত্র আশার আলোটি…মানে ওটা পুড়িয়ে ফেলেছে! ওটা থাকলে এই সঙ্কটে কতোটা সাহায্য হতো জানেন? আর আপনি ওকে বিশ্বাস করতে বলছেন এখন?”

“আমি জানি তার এই কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে অনেক প্রশ্ন তোলা যায়, কিন্তু আমি বলবো তাকে গালাগালি না করে বরং তার অসাধারণ মেধার সাহায্য নেয়াটাই বেশি ভালো হবে। মনে রাখবেন, তার রয়েছে বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তি।” ল্যাংডন একটু থামলো। “ও যদি জোবরিস্টের ঐ চিঠিটা পুণরায় তৈরি করে দিতে পারে তাহলে কি আপনার সুবিধা হবে?”

সিনস্কি চোখ কুচকে আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো। “তো প্রফেসর, আপনি আসলে আমাকে কি করতে বলছেন?”

ডেস্কের উপর খালি কফি কাপের দিকে ইঙ্গিত করলো ল্যাংডন। “আমি বলবো আপনি আরো কয়েক কাপ কফির অর্ডার দিন…আর সিয়েনা যে একটি অনুরোধ করেছে সেটা মন দিয়ে শুনুন।”

সিনস্কির নাড়িস্পন্দন বেড়ে গেলো, ফোনের দিকে তাকালো সে। “আপনি জানেন ওর সাথে কিভাবে যোগাযোগ করা যাবে?”

“হ্যাঁ।”

“আমাকে বলুন তার অনুরোধটি কি?”

ল্যাংডন তাকে কথাটা বললে সে চুপ মেরে প্রস্তাবটি বিবেচনা করে গেলো।

“আমার মনে হয় এটা করাই ঠিক হবে,” যোগ করলো ল্যাংডন। “আপনার আর কী হারানোর আছে, বলুন?”

“আপনি যা বলছেন তা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে।” ফোনটা তার দিকে ঠেলে দিলো সিনস্কি। “তাকে ফোন করুন।”

কিছুক্ষণ পর ত্রিশের কোঠায় এক মহিলাকে নিয়ে বের হয়ে এলো সে। এই মহিলা যে সিয়েনা এটা বুঝতে সিনস্কির কয়েক মুহূর্ত লেগে গেলো। পনিটেইলের সুন্দরী মেয়েটি যেনো পুরোপুরি বদলে গেছে। তার মাথা একদম ন্যাড়া।

তারা সবাই চুপচাপ অফিসে ঢুকে বসে পড়লো।

“আমাকে ক্ষমা করবেন,” বললো সিয়েনা। “আমি জানি অনেক কথা বলার আছে, তবে প্রথমেই বলি, আপনি আমাকে কিছু কথা বলতে দিন আগে।”

সিয়েনার কণ্ঠে যে যন্ত্রণা আছে সেটা খেয়াল করলো সিনস্কি। “অবশ্যই।”

“ম্যাম, আপনি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর। অন্য যে কারোর চেয়ে আপনি ভালো করেই জানেন আমাদের মানুষ প্রজাতিটি বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে…নিয়ন্ত্রণহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি। বিগত কয়েক বছর ধরেই বারট্রান্ড জোবরিস্ট এই সমস্যাটি নিয়ে অসংখ্য প্রভাশালী ব্যক্তিদের কাছে ধর্ণা দিয়েছে…এরমধ্যে আপনি নিজেও আছেন। অনেক সংস্থার কাছে সে এসব বিষয় খুলে বলেছে-ওয়ার্ল্ড ওয়াচ ইন্সটিটিউট, ক্লাব অব রোম, পপুলেশন ম্যাটার্স, কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স-কিন্তু এমন কাউকে সে পায় নি যার সাথে এই বাস্তব সমস্যাটির সমাধান নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করতে পারবে। আপনারা সবাই জন্মনিয়ন্ত্রণ, কন্ট্রাসেপটিভ, শিক্ষা, ছোটো পরিবারের জন্য কর সুবিধা এসব বিষয় অবতারনা করেছেন এই সমস্যাটি সমাধানের জন্য। এমনকি কেউ কেউ চাঁদে গিয়ে বসতি স্থাপন করার কথাও বলেছে! এসব শুনে বারট্রান্ডের মাথা বিগড়ে যায়।”

সিনস্কি স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলো, কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।

গভীর করে দম নিয়ে নিলো সিয়েনা। “আপনার সাথেও বারট্রান্ড একান্তে এ নিয়ে কথা বলেছে…কিন্তু আপনি তার কথা শুনে কোনো বিবেচনা না করেই, তার পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে না চেয়ে তাকে উন্মাদ বলে আখ্যায়িত করলেন। বায়োটেরর হিসেবে তার নাম ওয়াচলিস্টে তুলে দিলেন। ফলে বাধ্য হয়ে সে আত্মগোপনে চলে যায়।” আবেগে ভারি হয়ে উঠলো সিয়েনার কণ্ঠ। “আপনাদের মতো লোকজন তার কথাবার্তা না শুনেই, তার সমাধানটি যে অস্বস্তির কিছু না, এটা না বুঝেই তাকে পরিত্যাগ করেছেন, সেজন্যেই বরট্রান্ড একা একা মরেছে। বারট্রান্ড ভুল করেছে সত্য কথা বলে…আর সেই ভুলের শাস্তি দিয়েছেন তাকে সমাজচ্যুত করে।” চোখ মুছে সিনস্কির দিকে তাকালো সে। “বিশ্বাস করুন, আমি জানি সমাজচ্যুত হবার কি যন্ত্রণা…একা হয়ে যাবার কি কষ্ট। সবচেয়ে বাজে একাকীত্ব হলো ভুল বোঝার কারণে যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় সেটা। এরফলে আপনি বাস্তবকে বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবেন।”

কথা থামিয়ে চুপ মেরে গেলো সিয়েনা।

“এটাই বলতে চেয়েছিলাম আমি,” ফিসফিসিয়ে বললো সে।

দীর্ঘক্ষণ ধরে তাকে দেখে গেলো সিনস্কি। “মিস ব্রুকস,” অবশেষে শান্তকণ্ঠে বললো, “আপনার কথা ঠিক। আমি হয়তো এর আগে মনোযোগ দিয়ে এসব কথা শুনি নি…” একটু থেমে আবার বললো, “তবে এখন আমি শুনবো।”

.

অধ্যায় ১০২

রাত একটায় সুইস কনসুলেটের ঘড়িটা বেজে ওঠার পর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। সিনস্কির ডেস্কের নোটপ্যাডটি হাতেলেখা টেক্সট, প্রশ্ন আর চিত্রে ভরে উঠেছে এখন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালক প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে এক জায়গা বসে আছে, কোনো কথাও বলছে না। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে রাতের অন্ধকারের দিকে চেয়ে আছে সে। তার পেছনে উন্মুখ হয়ে বসে আছে ল্যাংডন। আর সিয়েনা। তারাও কোনো কথা বলছে না। কফির মগে শেষ চুমুক দিচ্ছে।

ঘরে একমাত্র গুঞ্জনটি আসছে মাথার উপরে থাকা ফুরোসেন্ট বাতি থেকে।

সিয়েনা নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে, সিনস্কি কী ভাবছে সেটা নিয়ে ভেবে যাচ্ছে সে। নির্মম বাস্তবতার পুরোটা এখন সে জেনে গেছে। বারট্রান্ডের ভাইরাসটি প্রজনন ক্ষমতা বিনষ্টকারী প্লেগ। এ পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে।

এসব ব্যাপর ব্যাখ্যা করার সময় সিনস্কির আবেগ টের পেয়েছে সিয়েনা। নিজের সেই আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেও হতবুদ্ধিকর অবস্থাটি লুকাতে পারে নি। জোবরিস্ট যে একটি বাতাসবাহিত ভেক্টর ভাইরাস সৃষ্টি করেছে এটা মেনে নিতেই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ে সে। তারপর যখন জানতে পারে ভাইরাসটি প্রাণঘাতি নয় তখন ক্ষণিকের জন্য তার চোখেমুখে আশার আলো দেখা গেছিলো। কিন্তু…ধীরে ধীরে যখন আসল সত্যটি বুঝতে পারলো, এ পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে, তখন স্তম্ভিত হয়ে পড়ে মহিলা। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে, মানুষের প্রজনন ক্ষমতা বিনষ্টকারী ভাইরাসের কথা মহিলার মনের গভীরে আলোড়ন তুলেছে।

সিয়েনা অবশ্য সবটা বলতে পেরে এক ধরণের স্বস্তি বোধ করছে এখন। বারট্রান্ড তার চিঠিতে যা যা বলেছে সবটাই স্মৃতি থেকে পুণরায় লিখে দিয়েছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালকের কাছে। আমার কাছে আর কোনো সিক্রেট নেই।

“এলিজাবেথ?” ল্যাংডন মুখ খুললো।

নিজের চিন্তার জগৎ থেকে ধীরে ধীরে ফিরে এলো সিনস্কি। তাদের দুজনের দিকে যখন তাকালো তখন তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। “সিয়েনা,” ম্রিয়মান কণ্ঠে বললো সে, “আপনি যে তথ্য দিলেন সেটা আমাদের অনেক কাজে লাগবে। এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আর প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করবে। আপনার এই সুবিবেচনাকে আমি সাধুবাদ জানাচ্ছি। আপনি তো জানেনই, মাহমারির আকারে ছড়িয়ে পড়া ভেক্টর ভাইরাসের সাহায্যে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের রোগপ্রতিরোধ করা সম্ভব বলে থিওরিটিক্যালি আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু সবাই বিশ্বাস করে এই টেকনোলজি এখনও দূরকল্পনা। ভবিষ্যতে হয়তো এটা বাস্তব হবে।”

নিজের ডেস্কে ফিরে এসে বসলো সিনস্কি।

“আমাকে ক্ষমা করবেন,” বলেই মাথা ঝাঁকালো। “এ মুহূর্তে এসব কথা শুনে আমার কাছে সায়েন্স-ফিকশন বলেই মনে হচ্ছে।”

এতে অবাক হবার কিছু নেই, ভাবলো সিয়েনা। চিকিৎসাজগতে প্রতিটি যুগান্তকারী আবিষ্কারই সায়েন্স-ফিকশন বলে মনে হয়-পেনিসিলিন, অ্যানেস্থেশিয়া, এক্স-রে, মাইক্রোস্কোপে প্রথমবারের মতো কোষের বিভাজন দেখা।

নোটপ্যাডের দিকে তাকালো সিনস্কি। “কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমি জেনেভায় গিয়ে তোপের মুখে পড়বো। কোনো সন্দেহ নেই প্রথম প্রশ্নটিই হবে এই ভাইরাসটি মোকাবেলা করার কোনো উপায় আছে কিনা।”

সিয়েনার সন্দেহ সে ঠিক বলছে কিনা।

“আর আমার মনে হয়,” সিনস্কি বলতে লাগলো, “এই সমস্যার সমাধানের জন্য প্রথমেই জোবরিস্টের ভাইরাসটি বিশ্লেষণ করে, সেটাকে পুরোপুরি বুঝতে হবে, তারপর ইঞ্জিনিয়াররা ওটা রি-প্রোগ্রাম করার চেষ্টা করবে যাতে করে আমাদের ডিএনএ আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে।” কথাগুলো বলার সময় সিনস্কিকে খুব একটা আশাবাদী বলে মনে হলো না। এবার সিয়েনার দিকে তাকালো সে। “এটার কাউন্টারভাইরাস সম্ভব কিনা সেটা দেখার আগে আমি জানতে চাইবো এ ব্যাপারে আপনার চিন্তাভাবনা কি।”

আমার চিন্তাভাবনা? ল্যাংডনের দিকে তাকালো সিয়েনা। প্রফেসর মাথা নেড়ে সায় দিলো। তার ভঙ্গিটা পরিস্কার : তুমি এতো দূর পর্যন্ত এসেছে। তোমার মনের সব কথা খুলে বলো। সত্যটা তুমি যেভাবে দেখো বলো।

গলা খাকারি দিয়ে কথা বলতে শুরু করলো সিয়েনা। “ম্যাম, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দুনিয়াটা আমি দীর্ঘদিন ধরে চিনি বারট্রান্ড জোবরিস্টের মাধ্যমে। আপনি অবশ্যই জানেন মানুষের জিনোম খুবই নাজুক একটি জিনিস…অনেকটা তাসের ঘরের মতো। আমরা যতো বেশি ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করবো, অ্যাডজাস্ট করতে যাবো ততো বেশি ভুল হবার সম্ভাবনা তৈরি হবে এবং আমরা ভুল কার্ড বদলে দিয়ে পুরো জিনিসটা ধ্বংস করে ফেলবো। আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, জোবরিস্ট যা করেছে সেটা পাল্টে দেয়াটা হবে মারাত্মক বিপজ্জনক একটি কাজ। বারট্রান্ড ছিলো অসাধারন একজন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার, তার মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ খুব কমই ছিলো। সমসাময়িকদের তুলনায় সে অনেক অনেক বছর এগিয়ে ছিলো। এই মুহূর্তে আমি ঠিক নিশ্চিত নই, এমন কাউকে বিশ্বাস করতে পারবো যে এই ব্যাপারটা পুরোপুরি জেনে সঠিকভাবে কাজটা করতে পারবে। এমন কি আপনারা যদি কার্যকরী একটি ডিজাইন করে পুরো ব্যাপারটা আবার আগের অবস্থায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করেন তাহলে সম্পূর্ণ নতুন একটি সংক্রমণ হবার আশংকা থেকেই যায়।”

“একেবারে সত্যি কথা,” বললো সিনস্কি। এসব কথা শুনে মোটেও অবাক হলো না সে। “তবে এটাও ঠিক, এরচেয়েও বড় ইসু আছে। আমরা হয়তো এটা পাল্টাতেও চাইবো না।”

কথাটা শুনে সিয়েনা বুঝতে পারলো না। “কী বললেন?”

“মিস ব্রুকস, আমি হয়তো বারট্রান্ডের পদ্ধতির ব্যাপারে একমত নই কিন্তু এ বিশ্ব সম্পর্কে তার যে মূল্যায়ন সেটা একদম সঠিক। এই গ্রহটি জনসংখ্যার সমস্যা নিয়ে মারাত্মক হুমকির মধ্যে আছে। আমরা যদি জোবরিস্টের ভাইরাসটিকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারি…তাহলে আমরা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবো।”

সিয়েনা হতভম্ব হয়ে গেলো মহিলার কথা শুনে। সিনস্কি মুচকি হেসে আরো বললো, “এরকম দৃষ্টিভঙ্গি আপনি আমার কাছ থেকে প্রত্যাশা করেন নি?”

মাথা ঝাঁকালো সিয়েনা। আমি বুঝতে পারছি না কার কাছ থেকে কি প্রত্যাশা করবো।”

“তাহলে আমি আপনাকে আবারো অবাক করে দিচ্ছি,” বলে গেলো সিনস্কি। “একটু আগেই বলেছি সারাবিশ্বের শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানেরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জেনেভাতে একটি মিটিং করবে। এই সঙ্কটটা কিভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করবে তারা। একটা অ্যাকশন প্ল্যান প্রস্তুত করা হবে হয়তো। এরকম একটি সম্মেলন কখনও হতে দেখেছি বলে আমার মনে পড়ছে না।” তরুণী ডাক্তারের দিকে তাকালো সে। “সিয়েনা, আমি চাই আপনি সেই মিটিংয়ে থাকবেন।”

“আমি?” আৎকে উঠলো সিয়েনা। “আমি কোনো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার নই। আমি যা জানি সবই তো আপনাকে বললাম।” নোটপ্যাডের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। “আমার যা বলার তা এই নোটপ্যাডে লিখে দিয়েছি।”

“যেভাবেই দেখা হোক না কেন, ল্যাংডন বলে উঠলো। “এই ভাইরাস নিয়ে অর্থবহ আলোচনা করতে হলে এর প্রেক্ষাপটটি জানা ভীষণ জরুরি। এই সঙ্কটটি মোকাবেলা করার জন্য একটি নৈতিক ফ্রেমওয়ার্কের প্রয়োজন পড়বে ডা: সিনস্কি এবং তার দলের। উনি অবশ্যই বিশ্বাস করেন এই আলোচনায় যোগ করার মতো তোমার একটি অনন্য অবস্থান রয়েছে।”

“আমার নৈতিক ফ্রেমওয়ার্ক মনে হয় না বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা পছন্দ করবে।”

“হয়তো করবে না,” জবাব দিলো ল্যাংডন। “আর সেজনেই ওখানে তোমার অংশগ্রহণ থাকা আরো বেশি দরকার। তুমি হলে নতুনধরণের চিন্তাভাবনা করে যারা সেই দলের একজন সদস্য। তুমি পাল্টা যুক্তি দাঁড় করাতে পারবে। বারট্রান্ড জোবরিস্টের মতো ভিশনারিদের মাইন্ড-সেটআপ বোঝার জন্য তুমি তাদেরকে সাহায্য করতে পারবে। তার মতো অসাধারণ একজন ব্যক্তির দৃঢ়বিশ্বাস এতোটাই মজবুত যে তারা পুরো ব্যাপারটা নিজের হাতে তুলে নেয়।”

“এক্ষেত্রে বারট্রান্ড কিন্তু প্রথম ব্যক্তি নয়।”

“ঠিক,” সিনস্কি বলে উঠলো। “কিন্তু সে শেষ ব্যক্তিও নয়। প্রতি মানে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা অনেক ল্যাব আবিষ্কার করে যেখানে বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের ধূসর এলাকা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে-মানবদেহের স্টেম সেল থেকে শুরু করে রূপকথার দানব চিমেরার উৎপাদন করা পর্যন্ত…প্রকৃতিতে অস্তিত্ব নেই এমন সব প্রজাতি তৈরি করার চেষ্টা করছে। এটা খুবই উদ্বেগজনক। বিজ্ঞান এতো দ্রুত এগোচ্ছে যে কোথায় এর সীমারেখা টানা হবে তা কেউ বুঝে উঠতে পারছে না।”

সিয়েনা একমত হলো। কয়েক দিন আগে দুজন শ্রদ্ধেয় ভাইরোলজিস্ট-ফুচিয়ে এবং কাওয়াকা-উচ্চমাত্রার সংক্রামক H5N1 ভাইরাস তৈরি করেছে। গবেষকদ্বয়ের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও এ কাজটি বায়ো-সিকিউরিটি স্পেশালিস্টদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। এ নিয়ে ব্যাপক তোলপার সৃষ্টি হয়েছে অনলাইনে।

“আমার আশংকা এটা আরো বেশি অপ্রীতিকর হয়ে উঠেবে,” বললো সিনস্কি। “আমরা এমন সব নতুন নতুন প্রযুক্তির দেখা পাচ্ছি যার কথা কল্পনাও করতে পারি নি।”

“নতুন দর্শণের কথাও বাদ দেবেন না,” সিয়েনা যোগ করলো। “মূলধারার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসছে ট্রান্সহিউম্যানিস্ট আন্দোলন। এর মূল প্রতিপাদ্যগুলোর একটি হলো, নিজেদের বিবর্তনে অংশগ্রহণ করা আমাদের মানব সম্প্রদায়ের একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা…প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের প্রজাতিটিকে উন্নত করা, আরো ভালো মানুষ সৃষ্টি করা-স্বাস্থ্যবান, শক্তিশালী এবং আরো বেশি কার্যকরী মস্তিষ্ক। এসবই খুব জলদি সম্ভব হয়ে উঠবে।”

“আপনি মনে করছেন না এ ধরণের বিশ্বাস বিবর্তনের প্রক্রিয়ার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ?”

“না,” কোনো রকম দ্বিধা না করেই বলে ফেললো সিয়েনা। “কয়েক হাজার বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবেই মানুষ বিবর্তিত হয়ে আসছে, এরসাথে সঙ্গতি রেখে নতুন কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কার করলে সেটা আরো কল্যাণকর হবে-কৃষিকাজ আরো উন্নত হয়ে উঠলে আমাদের খাদ্যসংস্থান হবে। নতুন নতুন ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হলে রোগবালাই থেকে মুক্ত হবো আমরা। আর এখন জেনেটিক কিছু হাতিয়ার তৈরি করে আমরা আমাদের নিজেদের শরীরকে বদলে নিতে পারবো যাতে করে পৃথিবীর পরিবর্তনের সাথে সাথে আমরা খাপ খেয়ে নিতে পারি।” থামলো সে। “আমার বিশ্বাস জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং হলো মানুষের অগ্রগতির একটি ধাপ।”।

সিনস্কি চুপচাপ ভেবে গেলো। “তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন এইসব টেকনোলজিকে আমাদের সাদরে গ্রহণ করা উচিত।”

“আমরা যদি সাদরে গ্রহণ না করি,” জবাব দিলো সিয়েনা, “তাহলে আমরা ঐসব গুহামানবের মতো আচরণ করবে যে কিনা শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য আগুন জ্বালাতে ভয় পাচ্ছে।”

তার কথাটা ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়ালো কয়েক মুহূর্ত পর্যন্ত। কেউ কোনো কথা বললো না।

নীরবতাটি ভাঙলো ল্যাংডন। “ভাববেন না আমি মান্ধাতা আমলের কথা বলছি। তবে আমি ডারউইনের তত্ত্বটার কথা বলবো, আমি এ প্রশ্নটা না তুলে পারছি না, আমরা কি তাহলে বিবর্তনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটিকে আরো দ্রুত করার চেষ্টা করবো?”

“রবার্ট,” সহমর্মিতার সাথে বলে উঠলো সিয়েনা, “জেনিটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কিন্তু বিবর্তন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে না। এটা প্রকৃতির স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড! তুমি কেবল ভুলে যাচ্ছো, বিবর্তনই বারট্রান্ড জোবরিস্টকে সৃষ্টি করেছে। তার অতি-উন্নত বুদ্ধিমত্তা বিবর্তনেরই ফল। ডারউইন এটাকে বলে গেছেন সময়ের পরিক্রমায় বিবর্তন। জেনেটিক ফিল্ডে বারট্রাভের বিরল দৃষ্টিভঙ্গি হুট করে স্বর্গীয় কোনো মহিমা থেকে আসে নি…এটা এসেছে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের মস্তিষ্কের যে উন্নয়ন সেখান থেকে।”

ল্যাংডন চুপচাপ কথাটা শুনে গেলো।

“একজন ডারউইনপন্থী হিসেবে তুমি ভালো করেই জানো,” বলতে লাগলো সে, “প্রকৃতি জনসংখ্যাকে সহনশীল পর্যায়ে রাখতে ঠিকই একটি পদ্ধতি খুঁজে নেয়-প্লেগ, দুর্ভিক্ষ, বন্যা। এবার আমাকে একটি প্রশ্ন করতে দাও, এটা কি সম্ভব নয়, প্রকৃতি এবার একটু ভিন্ন পদ্ধতি বেছে নিয়েছে? মহাদুর্যোগ কিংবা দুর্দশা বেছে না নিয়ে প্রকৃতি বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এমন একজন বিজ্ঞানীকে সৃষ্টি করেছে যে ভিন্নভাবে জনসংখ্যা কমিয়ে আনার পদ্ধতি আবিষ্কার করবে। প্লেগ নয়। মৃত্যুও নয়। এমন একটি প্রজাতি যে তার পরিবেশের সাথে আরো বেশি খাপ খেয়ে চলার ক্ষমতা রাখবে”

“সিয়েনা,” সিনস্কি বাধা দিয়ে বললো। “দেরি হয়ে গেছে। আমাদেরকে এখনই যেতে হবে। তবে যাওয়ার আগে আমি একটা বিষয় পরিস্কার করতে চাই। আজকে আপনি আমাকে বার বার বলেছেন বারট্রান্ড কোনো দানব নয়…সে মানুষকে ভালোবাসে। সে মানবজাতিকে রক্ষা করতে এতোটাই আন্তরিক আর বদ্ধপরিকর যে এরকম একটি পদক্ষেপকেও যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছে।”

সায় দিলো সিয়েনা। “ফলাফলই উদ্দেশ্যকে জায়েজ করে।” আলোচিত সমালোচিত ফ্লোরেন্তাইন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকিয়াভেলির বিখ্যাত একটি উদ্ধৃতি দিলো সে।

“তাহলে আমাকে বলুন,” সিনস্কি আবার বললো, “আপনি নিজেও কি বিশ্বাস করেন ফাল দিয়েই উদ্দেশ্যের বিচার করা ঠিক? আপনি এও বিশ্বাস করেন বারট্রান্ডের পৃথিবী রক্ষা করার উদ্দেশ্যটি এতোটাই মহৎ ছিলো যে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে দেয়া যুক্তিযুক্ত কাজ হয়েছে?”

ঘরে নেমে এলো সুকঠিন নীরবতা।

ডেস্কের দিকে ঝুঁকে এলো সিয়েনা। তার অভিব্যক্তিতে দেখা গেলো দৃঢ়তা। “ডা: সিনস্কি, আমি তো আপনাকে বলেছিই, বারট্রান্ড যা করেছে তা একেবারেই খামখেয়ালিপূর্ণ এবং অসম্ভব রকম বিপজ্জনক। তাকে যদি আমি থামাতে পারতাম তাহলে সেটা অনেক আগেই করতাম। আমি চাই আপনি আমার কথাটা বিশ্বাস করবেন।”

ডেস্কের উপর দিয়ে সিয়েনার হাত দুটো ধরলো এলিজাবেথ সিনস্কি। “আমি আপনাকে বিশ্বাস করেছি। আপনার বলা সবগুলো কথাই বিশ্বাস করেছি।”

.

অধ্যায় ১০৩

আতাতুর্ক এয়ারপোর্টে ভোরের প্রারম্ভে বাতাস খুবই শীতল আর কুয়াশায়চ্ছন্ন। টারমার্কে হালকা কুয়াশার চাদর ছড়িয়ে পড়েছে।

ল্যাংডন, সিয়েনা আর সিনস্কি একটি গাড়িতে করে এখানে এলে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার একজন কর্মকর্তা তাদেরকে অভ্যর্থনা জানিয়ে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করলো।

“আপনি যখন চাইবেন তখনই যেতে পারবো, আমরা প্রস্তুত আছি, ম্যাম,” বিনয়ের সঙ্গে বললো সে, তাদেরকে নিয়ে এলো টার্মিনাল ভবনে।

“আর মি: ল্যাংডনের কি ব্যবস্থা করলেন?” জানতে চাইলো সিনস্কি।

“উনাকে ফ্লোরেন্সে নিয়ে যাবার জন্য একটি প্রাইভেট প্লেনের ব্যবস্থা করেছি। উনার টেম্পোরারি ট্রাভেল ডকুমেন্ট প্লেনেই আছে।”

সন্তুষ্টচিত্তে মাথা নেড়ে সায় দিলো সিনস্কি। “আর যেসব বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি?”

‘কাজ শুরু হয়ে গেছে। যতো দ্রুত সম্ভব প্যাকেজটা শিপমেন্ট করে দেয়া হবে।”

লোকটাকে ধন্যবাদ জানালে সে টারমার্কে দাঁড়ানো প্লেনের দিকে এগিয়ে গেলো। ল্যাংডনের দিকে ফিরলো এবার। “আপনি নিশ্চিত আমাদের সাথে যাবেন না?” ক্লান্ত হাসি হেসে সাদাচুলগুলো কানের পাশ থেকে সরিয়ে দিলো

“পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমার মনে হচ্ছে না,” ঠাট্টারছলে বললো ল্যাংডন, “একজন আর্ট প্রফেসরের খুব বেশি কিছু করার আছে ওখানে।”

“আপনি অনেক কিছু করেছেন,” বললো সিনস্কি। কতোটা করেছেন। আপনি জানেনও না।” সিয়েনার দিকে ইঙ্গিত করলো। একটু দূরে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সি-১৩০ বিমানটি দেখছে সে।

“তাকে বিশ্বাস করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ,” শান্তকণ্ঠে বললো ল্যাংডন। “আমি বুঝতে পারছি এ জীবনে খুব বেশি মানুষ তাকে এভাবে বিশ্বাস করে নি।”

“আমার মনে হয় সিয়েনা আর আমি একে অনের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবো।” হাতের তালুটা মেলে ধরলো সিনস্কি। “ঈশ্বর আপনার সহায় হন, প্রফেসর।”

“আপনাকেও,” হাত মেলাতে মেলাতে বললো ল্যাংডন। “জেনেভাতে আপনার মিশন সফল হোক, এই কামনাই করি।”

“এরকম কামনা আমাদের খুব দরকার এখন,” কথাটা বলেই সিয়েনার দিকে মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করলো। “বিদায়ের আগে আপনারা দু’জন কিছুক্ষণ কথা বলেন। কথা বলা শেষ হলে ওকে পাঠিয়ে দিয়েন প্লেনে।”

সিনস্কি টার্মিনালের দিকে যেতে যেতে উদাসভাবে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দু’টুকরো ভাঙা নেকলেসটি বের করে আনলো।

“এই রড অব আসক্লিপসটি হাতছাড়া করবেন না,” পেছন থেকে বললো ল্যাংডন। “এটা মেরামত করা যাবে।”

“ধন্যবাদ আপনাকে,” হাত নেড়ে বললো সিনস্কি। “আশা করি সবকিছুই মেরামত করা যাবে।”

জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের রানওয়ের বাতিগুলো দেখছে সিয়েনা। কুয়াশার মধ্যে কেমন ভুতুরে দেখাচ্ছে ওগুলো। দূরের কন্ট্রোল টাওয়ারের উপরে তুরস্কের পতাকা দেখতে পেলো-লালের মধ্যে চাঁদ-তারার অটোমান সাম্রাজ্যের সিম্বলসহকারে-এই আধুনিক যুগেও সেটা উড়ছে।

“কি ভাবছো?” তার পেছন থেকে গম্ভীর একটা কণ্ঠ বলে উঠলো।

ঘুরে তাকালো সিয়েনা। “ঝড় আসবে মনে হচ্ছে।”

“আমি জানি,” শান্তভাবে বললো ল্যাংডন।

দীর্ঘক্ষণ ধরে তারা কোনো কথা বললো না। “তুমি আমাদের সাথে জেনেভাতে গেলে ভালো হতো।”

“আমারও ভালো লাগতো,” জবাবে বললো ল্যাংডন। “কিন্তু ওখানে তুমি খুব ব্যস্ত থাকবে। ভবিষ্যতে কি করতে না হবে সে নিয়ে অনেক আলোচনা করবে। আমার মতো বুড়ো প্রফেসরের সঙ্গ দরকার নেই তোমার। সে শুধু তোমার চলাফেরার গতি কমিয়ে দেবে।”

কথাটা সিয়েনা বুঝতে পারলো না বলেই মনে হলো। “তুমি মনে করো আমার জন্য তুমি একটু বেশি বয়স্ক হয়ে গেছো?”

জোরে হেসে উঠলো ল্যাংডন। “সিয়েনা, আমি অবশ্যই তোমার জন্য অনেক বেশি বুড়ো!”

একটু বিব্রত হলো সে। “ঠিক আছে…তবে তুমি জানবে আমাকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে।” অল্পবয়সী মেয়েদের মতো কাঁধ তুললো সিয়েনা। “মানে…তুমি যদি আমাকে কখনও দেখতে চাও আর কি।”

হেসে ফেললো সে। “আমার খুব ভালোই লাগবে।”

এরপর তারা দুজন আবারো চুপ মেরে গেলো। দু’জনের একজনও বুঝতে পারলো না কিভাবে বিদায় জানাবে।

আমেরিকান প্রফেসরের দিকে চেয়ে থেকে এমন একটি আবেগ অনুভব করলো সিয়েনা যেটার সাথে সে মোটেও অভ্যস্ত নয়। হুট করে সে পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে তার ঠোঁটে চুমু খেলো। একটু সরে যেতেই দেখা গেলো তার দু’চোখ ভেজা। “আমি তোমাকে অনেক মিস করবো,” ফিসফিসিয়ে বললো।

আন্তরিকভাইে হাসলো ল্যাংডন। জড়িয়ে ধরলো তাকে। “আমিও তোমাকে অনেক মিস করবো।”

তারা একে অন্যেকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত জড়িয়ে ধরে রাখলো, যেনো কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না।

অবশেষে ল্যাডন কথা বললো। “একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে…এটা দান্তে এটা প্রায়ই বলতেন…” একটু থামলো সে। “আজকের রাতটাকে মনে রেখো…কারণ এটাই চিরকালে সূচনা করবে।”

“ধন্যাবাদ, রবার্ট,” চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো এবার। “অবশেষে আমার মনে হচ্ছে এ জীবনের একটি লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছি।”

ল্যাংডন আবারো কাছে টেনে নিলো তাকে। “তুমি সব সময় বলতে এ পৃথিবীকে রক্ষা করতে চাও। মনে করো এটা তোমার সেই সুযোগ।”

আলতো করে হেসে ঘুরে দাঁড়ালো সিয়েনা। অপেক্ষমান সি-১৩০ বিমানের দিকে এগিয়ে যাবার সময় এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে…যা ঘটছে…এবং সম্ভাব্য যা ঘটতে পারে, সবকিছু বিবেচনা করে দেখলো সে।

আজকের রাতটাকে মনে রেখো, নিজেকে বললো সে। কারণ এটাই চিরকালে সূচনা করবে।

বিমানে ওঠার সময় সিয়েনা মনে মনে প্রার্থনা করলো, দান্তের কথাটা যেনো সত্যি হয়।

.

অধ্যায় ১০৪

বিকেলের ম্রিয়মান সূর্যটা হেলে পড়ছে পিয়াজ্জা দেল দুমো’র উপর, গিওত্তো’র বেল টাওয়ারের সাদা টাইলগুলো চকচক করছে, আর ফ্লোরেন্সের চমৎকার সান্তা মারিয়া দেল ফিওরি ক্যাথেড্রালের উপর ফেলেছে দীর্ঘ ছায়া।

ইগনাজিও বুসোনির শেষকৃত্য সবেমাত্র শুরু হয়েছে, রবার্ট ল্যাংডন আস্তে করে ক্যাথেড্রালের ভেতরে ঢুকে একটা সিটে বসে পড়লো। ইগনাজিও বুসোনিকে এরকম একটি ব্যাসিলিকায় স্মরণ করা হচ্ছে ভেবে খুশিই হলো সে। এই স্থাপনাটি দীর্ঘদিন ধরে তিনি দেখভাল করে গেছেন বিশ্বস্ততার সাথে।

বাইরের দিকটা জমকালো হলেও ফ্লোরেন্সের এই ক্যাথেড্রালটির ভেতরের সাজসজ্জা খুবই সাদামাটা আর জৌলুসহীন। তাসত্ত্বেও আজকে মনে হচ্ছে ভেতরের স্যাঙ্কচুয়ারিটি যেনো উৎসবমুখর।

ইটালি সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বন্ধুবান্ধব আর শিল্পকলা জগতের অনেকে এসেছে তাদের প্রিয় ইল দুমিনো’কে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।

মিডিয়াতে তার মৃত্যু সংবাদটি এসেছে অন্যভাবে। বুসোনির প্রিয় কাজ ছিলো গভীর রাতে দুমোর চারপাশে একটু হাটাহাটি করা, আর সেই কাজটি করার সময়ই তিনি মারা যান।

অবাক করা ব্যাপার হলো শেষকৃত্যের আবহটি শোকাবহ নয়। বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী আর পরিবারের লোকজন হাসি-ঠাট্টার সাথে বলাবলি করছে বুসোনি খুব ভালোবাসতেন রেনেসাঁর শিল্পকলা। আর তার নিজের জবানিতে প্রিয় জিনিস নাকি ছিলো বোলোনিস স্প্যাগোটি আর লালচে বুদিনো।

শেষকৃত্যের পর শোকার্ত ব্যক্তিবর্গ তার স্মৃতিচারণ করতে শুরু করলেও ল্যাংডন দুমোর ভেতরে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। ইগনাজিও যেসব চিত্রকর্ম দেখে মুগ্ধ হতেন সেগুলো দেখে গেলো সে…ডোম তথা গম্বুজের নীচে ভাসারির লাস্ট জাজমেন্ট, স্টেইন্ড-গ্লাসের জানালায় দোনাতেল্লো আর গিবাৰ্তির কর্ম। উচ্চেলো’র ঘড়ি, আর যে জিনিসটা প্রায় দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, মেঝের সেই মোজাইকের কারুকাজ।

এক সময় ল্যাংডন দেখতে পেলো সে দাঁড়িয়ে আছে খুবই পরিচিত একটি মুখের সামনে-এই মুখটি আর কারোর নয়, দান্তে অলিঘিয়েরির। মিচেলিনোর কিংবদন্তীতুল্য ফ্রেসকো, যেখানে কবি দাঁড়িয়ে আছেন পারগেটরির পর্বতের সামনে, দু’হাত বাড়িয়ে রেখেছেন তিনি, নিজের মাস্টারপিস দ্য ডিভাইন কমেডি নিবেদন করছেন।

ল্যাংডন না ভেবে পারলো না, দান্তে যদি জানতে পারতেন কয়েক শতাব্দী পর তার মহাকাব্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কেউ এমন ভয়ঙ্কর কাজ করবে তখন তার কেমন লাগতো। তিনি কখনও দুঃস্বপ্নেও এমনটি ভাবেন নি।

তিনি অমর জীবনের সন্ধান পেয়েছেন, ভাবলো ল্যাংডন। খ্যাতি নিয়ে প্রাচীন গ্রিকের এক দার্শনিকের মন্তব্যটি স্মরণ করলো সে। যতোদিন লোকজন তোমার কথা বলবে ততোদিন তুমি মরবে না।

সন্ধ্যার দিকে হোটেল ব্রুনেলেশিতে ফিরে এলো সে। রুমে ঢুকেই দেখতে পেলো বিশাল সাইজের একটি প্যাকেট।

অবশেষে প্যাকেজটা এসে পৌঁছেছে। সিনস্কিকে এটা পাঠাতে বলেছিলো সে।

বাক্সটা খুলে অবাক হলো ল্যাংডন। দারকারি জিনিসগুলো ছাড়াও আরো কিছু আছে তাতে। মনে হচ্ছে এলিজাবেথ সিনস্কি নিজের প্রভাব খাঁটিয়ে এটা করতে পেরেছে। ল্যাংডনের নিজের শার্ট, খাকি প্যান্ট আর হ্যারিস টুইড জ্যাকেট। সবগুলো পরিস্কার করে ইস্ত্রি করা। এমনকি তার জুতোটা পর্যন্ত পাঠানো হয়েছে। তার মানিব্যাগটাও দেখতে পেলো বাক্সের এককোণে। কিন্তু একটা জিনিস দেখে তার আনন্দের সীমা রইলো না।

আমার মিকি মাউস হাতঘড়ি।

ঘড়িটা হাতে পরে নিলো সে। তার কাছে মনে হলো এবার পুরোপুরি নিজেকে ফিরে পেয়েছে।

একটা ছোট্ট প্যাকেট হাতে নিয়ে হোটেল থেকে আবার বেরিয়ে গেলো। হেঁটে হেঁটে চলে এলো পালাজ্জো ভেচ্চিও’তে।

ওখানে এসে সিকিউরিটি অফিসে ঢু মেরে দেখলো মার্তা আলভারেজের সাথে দেখা করার জন্য একটা লিস্টে তার নাম আছে। তাকে সরাসরি হল অব ফাইভ হান্ড্রেড-এ নিয়ে যাওয়া হলো। এখনও প্রচুর সংখ্যক পর্যটক আছে। সেখানে। ল্যাংডন একেবারে ঠিক সময়েই এসেছে। প্রবেশপথের কাছেই মার্তার সাথে তার দেখা হবার কথা, কিন্তু সেখানে কাউকে দেখতে পেলো না।

পাশ দিয়ে যেতে থাকা এক ডোসেন্টকে ডাকলো।

“স্কুসি? দোভ পাসো এভারে মার্তা আলভারেজ?”

চওড়া হাসি দিলো ডোসেন্ট। “সিনোরা আলভারেজ?! উনি তো এখানে নেই! উনার একটা বাচ্চা হয়েছে! কাতালিনা! মলতো বেল্লা!”

মার্তার বাচ্চা হয়েছে শুনে খুশি হলো ল্যাংডন। “আহ…চে বেল্লো,” জবাব দিলো সে। “স্তূপেন্দো!”

ডোসেন্ট চলে যাবার পর ল্যাংডন ভাবলো যে প্যাকেজটা নিয়ে এসেছে সেটা এখন কী করবে।

চট করেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে, চলে গেলো দোতলায়, পালাজ্জোর জাদুঘরে। সতর্ক থাকলো সিকিউরিটি গার্ডরা যেনো তাকে দেখে না ফেলে।

জাদুঘরের একটি নির্দিষ্ট জাগায় এসে দাঁড়ালো ল্যাংডন। এটাকে বলে আন্দিতো। একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন, সাইনে লেখা আছে : কিউসো/ বন্ধ।

সাবধানে আশেপাশে তাকিয়ে প্যাকেটটার ভেতর থেকে প্রাস্টিকে মোড়ানো একটা জিনিস বের করে আনলো সে। পাস্টিকটা খুলে ফেলার পর দেখা গেলো দান্তের মৃত্যু-মুখোশটি তার দিকে আবারো চেয়ে আছে। ভেনিসের ট্রেনস্টেশনের লকারে রাখা ছিলো এটা। একেবারে অক্ষত আছে। শুধুমাত্র পেছনে সর্পিল বৃত্তাকারে একটি কবিতা লেখা আছে এখন।

অ্যান্টিক ডিসপ্লে কেসটার দিকে তাকালো ল্যাংডন। দান্তের মৃত্যু-মুখোশটি সামনের দিকে মুখ করে রাখা হয়…পেছনের কবিতাটা কেউ খেয়ালই করবে না।

সতর্কতার সাথে মুখোশটি কেসের ভেতরে আগের জায়গায় রেখে দিলো সে।

কেসটা বন্ধ করে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে দেখলো ল্যাংডন। অবশেষে আবার ফিরে এসেছে।

ওখান থেকে চলে আসার সময় বন্ধ লেখা সাইনটা নিজেই সরিয়ে দিলো। গ্যালারি দিয়ে যাবার সময় এক তরুণী ডোসেন্টের সাথে যেচে কথা বললো সে।

“সিনোরিনা?” বললো ল্যাংডন। “দান্তের মৃত্যু-মুখোশের উপরে যে বাতিটা আছে সেটা জ্বালানো দরকার। অন্ধকারে মুখোশটি দেখতে খুব সমস্যা হচ্ছে।”

 “আমি দুঃখিত, তরুণী বললো। “ওটা প্রদর্শন করা হচ্ছে না। ওখানে আর দান্তের মুখোশটি নেই।”

“আজব ব্যাপার,” অবাক হয়ে বললো ল্যাংডন। “আমি তো এখনই ওটা দেখে এলাম।”

তরুণী হতভম্ব হয়ে গেলো।

মেয়েটি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলে ল্যাংডন আস্তে করে জাদুঘর থেকে বের হয়ে গেলো।

.

উপসংহা

বিস্কে উপসাগরের চৌত্রিশ হাজার ফিট উপরে ভরা পূর্ণিমায় আলিতালিয়ার একটি বিমান বোস্টনের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিচ্ছে।

ভেতরে দ্য ডিভাইন কমেডি’র একটি পেপারব্যাক সংস্করণ নিয়ে বসে আছে রবার্ট ল্যাংডন। কাব্যগ্রন্থটির তেরজা রিমা ছন্দের সঙ্গি হয়েছে জেট ইঞ্জিনের গমগমে আওয়াজ, প্রায় সম্মোহিত করে ফেলছে তাকে। দান্তের শব্দগুলো যেনো পৃষ্ঠা থেকে উপচে পড়তে চাইছে।

ল্যাংডনের মনে হচ্ছে এ কথাগুলো যেনো তার জন্যই লিখেছেন কবি। সে বুঝতে পারছে দান্তের কবিতা নিছক নরকের দুর্দশার বিবরণ নয়, বরং এ যেনো সঙ্কট আর চ্যালেঞ্জ সহ্য করার মানুষের শক্তিশালী চেতনার এক অনবদ্য বিবরণ।

জানালার বাইরে পূর্ণিমার চাঁদটাকে দেখতে পেলো সে, চারপাশটা কেমন স্বর্গীয় বলে মনে হচ্ছে। সেদিকে চেয়ে থেকে বিগত কয়েকদিনের ঝঞ্ছবিক্ষুব্ধ সময়গুলো ভুলে গেলো ল্যাংডন।

নরকের সবচাইতে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গাটি তাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে যারা ভালো আর মন্দের সংঘাতের সময় নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখে। ল্যাংডনের কাছে কথাটার মানে আর কখনও এতো বেশি পরিস্কারভাবে উদ্ভাসিত হয় নিঃ বিপদের সময় হাতপা গুটিয়ে বসে থাকার মতো বড় পাপ আর নেই।

ল্যাংডন জানে লক্ষ-লক্ষ মানুষের মতো সে নিজেও এই অপরাধে অপরাধী। এরকম পরিস্থিতিতে অস্বীকৃতির বৈশ্বিক মহামারি শুরু হয়ে যায়। নিজের কাছে প্রতীজ্ঞা করলো সে, এ কথাটা কখনও ভুলে যাবে না।

বিমানটি পশ্চিম দিকে ছুটে চলতে শুরু করলে দু’জন মহিলার কথা ভাবলো সে। ওরা এখন জেনেভায় মিটিং করছে ভবিষ্যতের করনীয় নির্ধারণ করতে।

জানালার বাইরে সারি সারি মেঘের দল জমাট বাধতে শুরু করছে, ঢেকে দিচ্ছে আলোকিত চাঁদ।

নিজের সিটে আরাম করে বসলো রবার্ট ল্যাংডন, বুঝতে পারলো ঘুমানোর সময় হয়েছে। মাথার উপরের বাতিটা নিভিয়ে দেবার পর আবারো জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।

এইমাত্র নেমে আসা অন্ধকারে বদলে গেছে পৃথিবী। আকাশে চমকাচ্ছে অসংখ্য তারায় খচিত একটি নক্সীকাঁথা।

1 Comment
Collapse Comments
আমিনুল ইসলাম May 18, 2022 at 6:38 pm

অসংখ্য ধন্যবাদ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *